৪০. ফাঁকা ডিসপ্লে কেবিনেট

অধ্যায় ৪০

ফাঁকা ডিসপ্লে কেবিনেটের দিকে তাকিয়ে মার্তা আলভারেজ কাঁপছে। মনে মনে এই প্রার্থনা করছে তার পেটে যে ব্যথাটা হচ্ছে সেটা যেনো প্রসব বেদনা না হয়।

দান্তের মৃত্যু-মুখোশ নেই!

সিকিউরিটি গার্ড দু’জন পুরোপুরি সতর্ক এখন, আন্দিতো’তে এসে ফাঁকা কেসটা দেখেই তারা উঠেপড়ে লেগেছে। একজন গতরাতের সিকিউরিটি ক্যামেরার ফুটেজ দেখার জন্য দ্রুত চলে গেছে ভিডিও কন্ট্রোল রুমে, অন্যজন পুলিশকে ফোন করে চুরির ঘটনা জানাচ্ছে।

“লা পোলিজিয়া অ্যারাইভেরা ত্ৰা ভেন্তি মিনিতি!” ফোনটা রেখেই গার্ড মার্তাকে জানালো।

“ভেন্তি মিনিতি?!” জানতে চাইলো সে। বিশ মিনিট?! “আমাদের এখানে। বড়সড় একটা চুরির ঘটনা ঘটে গেছে!”

গার্ড বলতে লাগলো, তাকে বলা হয়েছে শহরের বেশিরভাগ পুলিশ এ মুহূর্তে মারাত্মক একটি ক্রাইসিসে ব্যস্ত আছে। তারা চেষ্টা করবে কোনো এক এজেন্টকে যতো দ্রুত সম্ভব এখানে পাঠিয়ে দিতে।

“চে কসা পত্রিবৃবে এসারসি দি পিউ গ্রেভ?! চিৎকার করে বললো সে। এরচেয়ে বড় ক্রাইসিস আর কী হতে পারে?!

ল্যাংডন আর সিয়েনা উদ্বিগ্ন হয়ে একে অন্যের দিকে তাকালো। মার্তার কাছে মনে হলো এ দু’জন গেস্ট ভড়কে গেছে। এতে অবাক হবার কিছু নেই। ঘুরতে ঘুরতে এখানে এসে মুখোশটা দেখতে চেয়েছিলো তারা, অথচ দেখতে পেলো বিরাট একটি চুরির ঘটনা। গতরাতে কোনো না কোনোভাবে কেউ এই গ্যালারিতে ঢুকে দান্তের মৃত্যু-মুখোশটি চুরি করে নিয়ে গেছে।

মার্তা জানে এই জাদুঘরে এরচেয়ে অনেক বেশি দামি জিনিস রয়েছে, সেগুলোও চুরি হতে পারতো, সুতরাং এদিক থেকে সে কিছুটা সৌভাগ্যবতীও বটে। তারচেয়ে বড় কথা এটাই হলো এই মিউজিয়ামের ইতিহাসে প্রথম চুরির ঘটনা। আমি তো এমনকি প্রটোকলটাও জানি না!

নিজেকে আবারো বড় ক্লান্ত মনে হলো মার্তার। কাছের একটি পিলার ধরে দাঁড়িয়ে রইলো সে। মার্তাকে দু’জন সিকিউরিটি গার্ড যখন গতকাল রাত থেকে তাদের কর্মকাণ্ডের ব্যাখ্যা দিচ্ছে তখন খুবই হতভম্ব দেখালো তাদেরকে : গতকাল রাত দশটার দিকে ইল দুমিনো আর ল্যাংডনকে নিয়ে এখান থেকে বেরিয়ে যায় মার্তা। গার্ড তখন দরজাটা লক করে দিয়ে অ্যালার্মটা রিসেট করে দেয়। তার জানা মতো এরপর আর কেউ এখানে যেমন ঢোকে নি তেমনি বেরও হয় নি।

“অসম্ভব!” ইতালিতে রেগেমেগে বললো মার্তা। “রাতে আমরা তিনজন যখন এখান থেকে বের হয়ে যাই তখনও মুখোশটা কেবিনেটেই ছিলো। সুতরাং এটা স্পষ্ট, তখন থেকেই গ্যালারিতে কেউ একজন ছিলো!”

দুহাত তুলে গার্ড দু’জন তাদের বিস্ময় প্রকাশ করলো। “নোই নন আব্বিয়ামো ভিস্তো নেসুনো!”

এখন পুলিশ আসছে, এই গর্ভাবস্থায়ও যতো দ্রুত সম্ভব সিকিউরিটি কন্ট্রোল রুমের দিকে দ্রুত পদক্ষেপে এগিয়ে গেলো মার্তা। ল্যাংডন আর সিয়েনা ইতস্ত করলেও তার পিছু পিছু ছুটলো।

সিকিউরিটি ভিডিও, ভাবলো মার্তা। গতরাতে ওই সময় এখানে কে ছিলো সেটা ঠিকঠিকভাবে বলে দেবে!

.

তিন ব্লক দূরে পন্তে ভেচ্চিও’তে দাঁড়িয়ে ছিলো ভায়েন্থা, দু’জন পুলিশ লোকজনের ভীড়ের মধ্য দিয়ে ল্যাংডনের ছবি দেখাতে দেখাতে কাছে এগিয়ে আসায় অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি জায়গায় চলে এলো সে।

এক পুলিশ ভায়েন্থার খুব কাছে চলে আসতেই তার ওয়্যারলেস সেটটি ঘরঘর করে উঠলো। ইতালিয়ান ভাষায় ছোট্ট একটি তথ্য প্রচার করা হচ্ছে। পুলিশের ডিসপ্যাঁচ থেকে। ভায়েন্থা সবটা ধরতে না পারলেও আসল কথাটা বুঝতে পারলো : পালাজ্জো ভেচ্চিও’তে থাকা কোনো পুলিশ যেনো পালাজ্জোর জাদুঘরে গিয়ে একটি জবানবন্দী নিয়ে এসে রিপোর্ট করে।

অফিসার দু’জন নির্বিকার রইলো কিন্তু নড়েচড়ে উঠলো ভায়েন্থা।

ইল মিউজিও দি পালাজ্জো ভেচ্চিও?

গতরাতের চরম ব্যর্থতাটি-যে ঘটনা তার ক্যারিয়ারটাকে ধ্বংসের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে-পালাজ্জো ভেচ্চিও’র বাইরের অলিগলিতেই ঘটেছে।

পুলিশের বুলেটিন অব্যাহত রইলো, কিন্তু ওয়্যারলেসের ঘরঘর আওয়াজের কারণে দুটো শব্দ ছাড়া আর কিছুই বোঝা গেলো না : নামটা দান্তে অলিঘিয়েরি।

কথাটা শোনামাত্রই তার শরীরে কাটা দিয়ে উঠলো। দান্তে অলিঘিয়েরি?! এটা নিশ্চয় কাকতালীয় কোনো ঘটনা হতে পারে না। পালাজ্জো ভেচ্চিও’র দিকে ঘুরে তাকালো সে। সুদৃশ্য টাওয়ারটি চেখে পড়লো সবার আগে।

ঐ জাদুঘরে আসলে কী ঘটেছে? ভাবলো সে। কখন ঘটেছে??

দীর্ঘদিন একজন ফিল্ড এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছে ভায়েন্থা, সে জানে সবাই যেমনটা মনে করে, কাকতালীয় ব্যাপারগুলো আসলে ততো বেশি ঘটে না। পালাজ্জো ভেচ্চিও জাদুঘর…আর দান্তে? এটার সাথে নিশ্চয় ল্যাংডনের সম্পর্ক রয়েছে।

ভায়েন্থা অনেক আগে থেকেই সন্দেহ করেছিলো ল্যাংডন আবারো পুরনো শহরে ফিরে আসবে। এটা একেবারেই যৌক্তিক-এই পুরনো শহরেই গতরাতে ল্যাংডন ছিলো আর তখনই সব কিছু গুবলেট পাকাতে শুরু করে।

ভায়েন্থা আরো ভাবলো, এখন দিনের বেলায় হয়তো ল্যাংডন আবার ফিরে এসেছে পালাজ্জো ভেচ্চিও’তে যেটা খুঁজছিলো সেটা খুঁজে পেতে। তবে সে একদম নিশ্চিত ল্যাংডন সেতুটা পার হয়ে পুরনো শহরে ঢোকে নি। আর ববোলি গার্ডেনের ভেতর দিয়ে পায়ে হেঁটে ওখানে যাওয়াটাও প্রায় অসম্ভব।

নীচে তাকিয়ে দেখলো চারজন লোকের একটি দল ছোট্ট নৌকায় করে সেতু পার হচ্ছে। নৌকার গায়ে লেখা :

সোসিয়েতা কানোত্তিয়েরি ফিরেনজি/ফ্লোরেন্স রোয়িং ক্লাব।

নৌকাটা লাল-সাদা রঙে পেইন্ট করা।

ল্যাংডন এরকম কোনো নৌকায় করে পার হয় নি তো? এটা মনে হচ্ছে না, কিন্তু পুলিশ বুলেটিনটি শোনার পর তার মন বলছে পালাজ্জো ভেচ্চিও’তে যাওয়া দরকার তার।

“সব ক্যামেরা বের করুন, পার ফাভোরে!” ইংরেজিতে বলে উঠলো একটি নারীকণ্ঠ।

এক মহিলা গাইড কমলা রঙের পমপম একটা স্টিকের উপর রেখে দোলাচ্ছে আর পর্যটকদের বলে যাচ্ছে।

“আপনাদের মাথার উপরে ভাসারির সর্ববৃহৎ মাস্টারপিসটি রয়েছে!” বহুল চর্চিত একটি হাসি দিয়ে পমপমটা মাথার উপরে তুলে ধরলো এবার।

ভায়েন্থা এটা আগে খেয়াল করে নি। তবে মাথার উপর দিয়ে সঙ্কীর্ণ অ্যাপার্টমেন্টের মতো একটি স্থাপনা চলে গেছে এখানকার সারি সারি দোকানের উপর দিয়ে।

“ভাসারি করিডোর,” গাইড বলতে লাগলো। “এটা লম্বায় প্রায় এক কিলোমিটার। মেদিচি পরিবারের জন্য নির্মিত হয়েছিলো। তারা যাতে নিরাপদ

প্যাসেজওয়ে দিয়ে পিত্তি প্যালেস থেকে পালাজ্জো ভেওিতে যেতে পারে সেজন্যে।”

ভায়েন্থার চোখ দুটো গোল গোল হয়ে গেলো। মাথার উপরে টানেলের মতো স্থাপনাটি ভালো করে দেখলো এবার। করিডোরের কথাটা সে শুনেছে কিন্তু এ সম্পর্কে খুব একটা জানে না।

এটা দিয়ে পালাজ্জো ভেচ্চিও’তে যাওয়া যায়?

“বর্তমান সময়ে হাতেগোনা অল্প কিছু ভিআইপি ব্যক্তিবর্গ,” গাইড বলতে লাগলো নিজস্ব ঢঙে, “এটা দিয়ে যাতায়াত করতে পারে। এটা একই সাথে চমকপ্রদ একটি আর্ট গ্যালারিও, পালাজ্জো ভেচ্চিও থেকে ববোলি গার্ডেনের উত্তর-পূর্ব কোণ পর্যন্ত বিস্তৃত।”

এরপর গাইড যা বললো তার কিছুই ভায়েন্থার কানে গেলো না। ততোক্ষণে সে তার মোটরসাইকেলের দিকে পা বাড়িয়েছে।

.

অধ্যায় ৪১

মার্তা, সিয়েনা আর দু’জন গার্ডের সাথে ভিডিও কন্ট্রোল রুমে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই ল্যাংডনের মাথার যে জায়গায় সেলাই করা আছে সেখানটায় আগের সেই তীব্র ব্যথা ফিরে এলো আবার। জায়গাটা জামা বদলাবার ছোটোখাটো ঘরের মতোই। এক সারি কম্পিউটার মনিটর আর ড্রাইভ রাখা আছে সেখানে। ভেতরের বাতাস গুমোট, সিগারেটের ধোয়ার গন্ধও আছে।

লংডনের মনে হলো ঘরের দেয়ালগুলো যেনো তার দিকে চেপে আসছে।

একটা ভিডিও মনিটরের সামনে চেয়ার টেনে বসে পড়লো মার্তা। ইতিমধ্যেই মনিটরটি প্লেব্যাক মোডে চলে গেছে। পদায় দেখা যাচ্ছে আন্দিতোর ঝিরঝিরে সাদা-কালো ভিডিও ইমেজ। শটটা নেয়া হয়েছে দরজার উপর থেকে। পদায় যে সময়টা দেখা যাচ্ছে সেটা গতকালের সকালে-নির্দিষ্ট করে বললে এখন থেকে চব্বিশ ঘন্টা আগে-জাদুঘরটি খোলার ঠিক আগের সময়ে। ঐ দিন রাতে ল্যাংডন আর ইল দুমিনো আসার অনেক আগের ফুটেজ এটি।

গার্ড ভিডিওটা ফাস্ট-ফরোয়ার্ড করে দিলে ল্যাংডন দেখতে পেলো দলে দলে পর্যটক এসে ঢুকছে আন্দিতো’তে। তাদের সবার মোশন খুব দ্রুত। কেবিনেটে রাখা মুখোশটি অবশ্য এখান থেকে দেখা যাচ্ছে না তবে পর্যটক আর দর্শনার্থীদের ভাবভঙ্গি বলে দিচ্ছে ওটা তখনও জায়গামতো ছিলো। অনেকেই উঁকি মেরে দেখছে। কেউবা ক্যামেরা বের করে ছবি তুলে নিচ্ছে।

জলদি করো, মনে মনে বললো ল্যাংডন। ভালো করেই জানে পুলিশ চলে আসবে এখানে। সিয়েনাকে নিয়ে এখান থেকে সটকে পড়বে কিনা সেটাও ভাবলো কয়েক মুহূর্তের জন্য কিন্তু ভিডিওটা তাদের দেখা দরকার :

এই ভিডিও’তে যা-ই থাকুক না কেন যা কিছু ঘটছে তার অনেক প্রশ্নের জবাব এতে পাওয়া যাবে।

ফুটেজগুলো দ্রুত এগোতে লাগলো, সময় গড়িয়ে নেমে এলো বিকেল। দলে দলে দর্শনার্থী আসছে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে তাদের ভীড়টা পাতলা হতে শুরু করলো। তারপর এক সময় ফাঁকা হয়ে গেলো পুরোপুরি। পর্দায় দেখা যাচ্ছে সময়টা ১৭০০, জাদুঘরের সব বাতি নিভে গেলো এবার।

বিকেল পাঁচটায় বন্ধ হয়ে যায় জাদুঘর।

“অউমেন্তি লাভেলোসিতা, মার্তা আদেশের সুরে বললো। সামনের দিকে ঝুঁকে মনিটনের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো সে।

গার্ড ভিডিওটা আরো সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেলো। এবার যে সময়টা দেখা গেলো সেটা রাত ১০টার দিকে। জাদুঘরের বাতি জ্বলে উঠলো আবার।

সঙ্গে সঙ্গে গার্ড ভিডিওটার স্পিড স্বাভাবিক করে দিলো।

কয়েক মুহূর্ত পরেই গর্ভবতী মার্তা প্রবেশ করলো আন্দিতো’তে, তার পর পরই ল্যাংডন। তার পরনে অতিপরিচিত হ্যারিস টুইড ক্যাম্বার্লি জ্যাকেট, খাকি প্যান্ট আর কর্ডো লোফার। তার হাতে মিকি মাউস হাতঘড়িটাও দেখা গেলো এক ঝলক।

এই তো আমি…গুলিবিদ্ধ হবার আগে।

নিজেকে পর্দায় দেখে ল্যাংডনের মধ্যে অদ্ভুত এক অনুভূতি তৈরি হলো, কারণ এই মুহূর্তগুলোর কথা তার স্মৃতিতে নেই। গতরাতে আমি এখানে এসেছিলাম…মৃত্যু-মুখোশটি দেখতে? বিগত দু’দিনের কোনো স্মৃতি তার ভাণ্ডারে নেই।

ভিডিওটা আবার চলতে শুরু করলে সিয়েনা আর সে মার্তার পেছনে এসে দাঁড়ালো ভালো করে দেখার জন্য। নির্বাক ফুটেজে দেখা গেলো মার্তা আর ল্যাংডন মুখোশের কেসের সামনে এসে প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখছে। এমন সময় দরজার সামনে দেখা গেলো বিশালদেহী এক মোটাসোটা লোককে। সুট পরা, হাতে বৃফকেস। প্রায় দরজার সমান প্রস্থ। তার বিশাল বপুর সামনে মার্তার আটমাসের গর্ভাবস্থাও ম্রিয়মান।

দেখামাত্র লোকটাকে চিনতে পারলো ল্যাংডন। ইগনাজিও?!

“এ হলো ইগনাজিও বুসোনি,” সিয়েনার কানে কানে বললো সে। “মিউজিও দেল অপেরা দেল দুমো’র পরিচালক। অনেক বছর ধরেই তার সাথে আমার পরিচয়। তবে তাকে যে লোকে ইল দুমিনো নামে ডাকে সেটা জানতাম না।”

“তার জনে একেবারে উপযুক্ত একটি নাম,” আস্তে করে বললো সিয়েনা।

বিগত বছরগুলোতে তার দায়িত্বে থাকা ইল দুমো’র আর্টিফ্যাক্টস এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট ইতিহাস নিয়ে ইগনাজিওর সাথে ল্যাংডন কনসাল্টেড করেছে। তবে পালাজ্জো ভেচ্চিও’তে ভিজিট করতে আসাটা মনে হয় ইগনাজিও’র আওতার বাইরে। কিন্তু ইগনাজিও বুসোনি ফ্লোরেন্সের শিল্পকলা জগতে খুবই প্রভাবশালী একজন ব্যক্তি এবং সেই সঙ্গে দান্তে বিষয়ক একজন পণ্ডিতও বটে।

দান্তের মৃত্যু-মুখোশের ব্যাপারে তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে যোগ্য ব্যক্তি।

ল্যাংডন আবারো ভিডিও’র দিকে মনোযোগ দিলো। এখন দেখা যাচ্ছে সে আর ইগনাজিও মুখোশের কেবিনেটের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে, আর আন্দিতো’র দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে যাচ্ছে মার্তা। তারা দু’জন মিনিটের পর মিনিট ধরে কথা বলে যেতে লাগলে মার্তা বার বার তার হাতঘড়ির দিকে তাকাতে লাগলো।

ল্যাংডনের মনে হলো সিকিউরিটি টেপটার সাথে যদি অডিওটাও থাকতো তাহলে কতোই না ভালো হতো। আমি আর ইগনাজিও কি নিয়ে কথা বলছিলাম? কি খুঁজছিলাম আমরা?!

ঠিক এ সময় দেখা গেলো ল্যাংডন কেবিনেটের কাঁচের খুব কাছে মুখ নিয়ে মুখোশটি দেখতে গেলে মার্তা এসে কী যেনো বললো তাকে, সঙ্গে সঙ্গে প্রফেসর ক্ষমা প্রার্থনাসূচক ভঙ্গি করে একটু পিছিয়ে গেলো।

“দুঃখিত, আমি খুব কঠোর ছিলাম বলে,” পেছন ফিরে বললো মার্তা। তবে আপনাকে তো আগেই বলেছি, ডিসপ্লে কেসটি খুবই পুরনো, একেবারেই নাজুক অবস্থায় আছে। মুখোশের মালিক আমাদেরকে বার বার বলে দিয়েছেন আমরা যেনো দর্শনার্থীদেরকে নির্দিষ্ট দূরত্বে রাখি। তার অবর্তমানে আমাদের স্টাফরাও কেসটি খোলার অনুমতি পায় না।”

কথাটা বুঝতে একটু সময় লাগলো ল্যাংডনের। মুখোশের মালিক? তার। ধারণা ছিলো এই মুখোশটির মালিক জাদুঘর কর্তৃপক্ষ।

সিয়েনাও একইভাবে বিস্মিত হয়েছে কথাটা শুনে। “জাদুঘর এই মুখোশের মালিক নয়?”

মনিটরের পর্দায় চোখ রেখেই মার্তা মাথা ঝাঁকালো। “এক ধনী পৃষ্ঠপোষক দান্তের এই মুখোশটি আমাদের এখানে স্থায়ীভাবে ডিসপ্লে করার জন্য রেখেও এটা আমাদের সংগ্রহশালা থেকে কেনার প্রস্তাব দেয়। মোটা অঙ্কের টাকা ছিলো বলে আমরা হাসিমুখেই তার প্রস্তাবটা মেনে নেই।”

“দাঁড়ান,” বললো সিয়েনা। “উনি এই মুখোশের জন্য টাকা দিয়েছেন..আবার এটা এখানে রেখেও দিয়েছেন?”

“এটা খুবই প্রচলিত একটি ব্যবস্থা,” ল্যাংডন বললো। “দাতাদের অধিগ্রহণ-জাদুঘরে জন্য দান করার একটি নিয়ম আর কি। ধরে নেয়া হয় জিনিসটি উনি কিনে দান করে দিয়েছেন জাদুঘরের জন্য।”

“এই ডোনার লোকটি খুবই অন্য রকম ছিলো,” বললো মার্তা। “দান্তের উপর সত্যিকারের একজন পণ্ডিত…মানে বলতে পারেন…একেবারে ক্ষ্যাপা টাইপের।”

“লোকটা কে?” সিয়েনা জানতে চাইলো।

“কে?” পদার দিকে চেয়ে থেকেই ভুরু তুললো মার্তা। “তুমি হয়তো ইদানিংকালে তার সম্পর্কে পত্রপত্রিকায় পড়ে থাকবে-সুইস বিলিয়নেয়ার বারট্রান্ড জোবরিস্ট।”

ল্যাংডনের কাছে নামটা অল্পবিস্তর চেনা চেনা লাগলেও সিয়েনা তার হাতটা খপ করে ধরে রাখলো, যেনো চোখের সামনে ভূত দেখতে পাচ্ছে সে।

“ওহ্, হা…” কোনোমতে বললো সিয়েনা, তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে মুহূর্তে। “বারট্রান্ড জোবরিস্ট। প্রখ্যাত বায়োকেমিস্ট। তরুণ বয়স থেকেই অনেকগুলো বায়োলজিক্যাল পেটেন্ট করে প্রচুর ধনসম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন।” একটু থেমে ঢোক গিলে নিলো সে। ল্যাংডনের দিকে ঝুঁকে তার কানে কানে বললো চাপাস্বরে, “জোবরিস্টের সবচাইতে বড় কাজ হলো ফিল্ড অব জার্ম-লাইন ম্যানিপুলেশন।”

ল্যাংডনের কোনো ধারণাই নেই জার্ম-লাইন ম্যানিপুলেশন জিনিসটা কী, তবে এটার মধ্যে অশুভ একটা মতলব আছে বলে মনে হলো ত্ম বিশেষ করে এ সময় যখন প্লেগ আর মৃত্যুর ইমেজগুলো আবির্ভূত হচ্ছে তাদের সামনে। সে ভাবতে লাগলো সিয়েনা এই জোবরিস্টের ব্যাপারে হয়তো অনেক কিছু জানে, কেননা সে চিকিৎসাবিজ্ঞানের লোক…কিংবা তারা দু’জনেই হয়তো শৈশবে প্রোডিজি ছিলো। ওরকম মেধাবীরা কি একে অনের কাজ ফলো করে?

“কয়েক বছর আগে আমি প্রথম এই জোবরিস্টের কথা শুনি,” সিয়েনা বললো, “যখন তিনি মিডিয়াতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির উপরে খুবই আপত্তিজনক একটি ঘোষণা দিয়েছিলেন।” একটু থামলো সে, চেহারায় ফুটে উঠলো তিক্ত ভাব। “জোবরিস্ট জনসংখ্যার বৃদ্ধির ফলে যে বিপর্যয় নেমে আসবে সে ব্যাপারে একটি গাণিতিক তত্ত্ব দিয়েছিলেন।”

“কী বললে, বুঝলাম না?”

“পৃথিবীর জনসংখ্যা যে বৃদ্ধি পাচ্ছে সেটা গাণিতিকভাবেই স্বীকৃত, মানুষ আগের চেয়ে দীর্ঘজীবি হচ্ছে আর আমাদের প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক সম্পদ ক্রমাগতভাবেই হ্রাস পাচ্ছে। তার তত্ত্বটি ভবিষ্যত্বাণী করে যে, বর্তমান এই প্রবণতাটি মনুষ্যসমাজের কেয়ামততুল্য বিপর্যয় ছাড়া আর কোনো ফল বয়ে আনবে না। জোবরিস্ট প্রকাশ্যে বলে বেড়ান, মানবজাতি আর একশ’ বছরও টিকে থাকতে পারবে না…যদি না দ্রুতগতিতে ব্যাপকহারে এই জনসংখ্যা কমিয়ে আনা যায়।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ল্যাংডনের চোখের দিকে তাকালো সিয়েনা। “সত্যি বলতে কী, একবার জোবরিস্ট বলেছিলেন, ইউরোপের জন্য সবচেয়ে ভালো যে কাজটি হয়েছিলো সেটা ব্ল্যাক ডেথ।”

আৎকে উঠলো ল্যাংডন। টের পেলো তার ঘাড়ের পেছনের চুল দাঁড়িয়ে গেছে। আবারো তার মনের পর্দায় ভেসে উঠলো প্লেগ মুখোশটি। তার বর্তমান সমস্যাটির সাথে প্রাণঘাতী প্লেগের কোনো সম্পর্ক নেই, সকাল থেকেই এই চিন্তাটা জোর করে বাদ দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছিলো সে…কিন্তু সময় যতোই গড়াচ্ছে ততোই যেনো চিন্তাটা প্রকটভাবে তাকে গ্রাস করছে।

বরট্রান্ড জোবরিস্ট যে বলেছে, ইউরোপের জন্য সবচেয়ে মঙ্গলজনক ব্যাপার ছিলো ব্ল্যাক ডেথ, সে-কথাটি নিশ্চয় ভড়কে দেবার মতো। তবে এটাও ঠিক ল্যাংডন জানে অনেক ইতিহাসবিদ স্বীকার করে ১৩ শতকে দ্রুত এবং ব্যাপকহারে জনসংখ্যার বিলোপের ফলে দীর্ঘমেয়াদে ইউরোপের আর্থ-সামাজিক অবস্থার ব্যাপক উন্নতি হয়েছিলো। পেগ, বিপুল জনসংখ্যা, দুর্ভিক্ষ আর অর্থনৈতিক দুরাবস্থার কারণে ঐ সময়টাকে ‘অন্ধকার যুগ’ হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়। ব্ল্যাক ডেথের আচমকা আবির্ভাবের ফলে ইউরোপের জনসংখ্যা অবিশ্বাস্য গতিতে কমে যায়, ফলে খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের উপর চাপ কমে যায়, জনসংখ্যার তুলনায় ওগুলোর মজুদ যথেষ্ট পরিমাণে থাকায় বিরাট একটি সুবিধা বয়ে আনে ঐ ভূ-খণ্ডে, অনেক ইতিহাসবিদের মতে এর ফলে রেনেসাঁর আবির্ভাব ঘটে।

বায়োহ্যাজার্ড টিউবের সিম্বলটার কথা মনে পড়ে গেলো ল্যাংডনের, ওটার ভেতরে থাকা দান্তের ইনফার্নোর ম্যাপটি বদলে দেয়া হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে একটা ভীতিকর আশংকা উদয় হলো তার মনে : ঐ ভয়ঙ্কর প্রজেক্টরটি তৈরি করেছেন-বারট্রান্ড জোবরিস্ট-একজন বায়োকেমিস্ট এবং দান্তের অন্ধ অনুরাগী–এখন মনে হচ্ছে একেবারেই উপযুক্ত একজন প্রার্থী।

জেনেটিক জার্ম-লাইন ম্যানিপুলেশনের পিতা। ল্যাংডনের মনে হলো পাজলের টুকরোগুলো এবার খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে। তবে স্বীকার করতেই হচ্ছে, যে চিত্রটা ভেসে উঠছে চোখের সামনে সেটা খুবই ভয়াল একটি চিত্র।

“এই অংশটা ফাস্ট-ফরোয়ার্ড করো,” গার্ডকে বললো মার্তা। ল্যাংডন আর ইগনাজিও মৃত্যু-মুখোশটি স্টাডি করার সময়গুলো দ্রুত শেষ করতে চাইছে সে যাতে করে এরপর কে মুখোশটি চুরি করেছে সেটা দেখতে পায়।

গার্ড ফাস্ট ফরোয়ার্ড বাটনে চাপ দিতেই পদায় দ্রুতবেগে দৃশ্যগুলো এগোতে লাগলো।

তিন মিনিট….ছয় মিনিট…আট মিনিট।

পদায় তখনও ল্যাংডন আর ইগনাজিও…একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মার্তা বার বার এপাশ ওপাশ করে যাচ্ছে আর হাতঘড়ি দেখছে।

“আমি দুঃখিত, একটু সময় নিয়ে কথা বলেছিলাম,” বললো ল্যাংডন। “আপনাকে খুব ভুগিয়েছি মনে হয়।”

“এটা আমার নিজেরই দোষ,” জবাবে বললো মার্তা। “আপনারা দুজনেই আমাকে বার বার বলেছিলেন আমি যেনো বাসায় চলে যাই, গার্ডরা তো আছেই। তারাই যথেষ্ট, কিন্তু আমি ভেবেছিলাম এটা করা ঠিক হবে না। এক ধরণের অসৌজন্যতা হবে আর কি।”

হঠাৎ করে পর্দা থেকে মার্তা উধাও হয়ে গেলো। ভিডিওটা আবার স্বাভাবিক গতিতে ফিরিয়ে আনলো গার্ড।

“ঠিক আছে,” বললো মার্তা, “আমার মনে পড়েছে, আমি রেস্টরুমে গেছিলাম।”

গার্ড সায় দিয়ে ভিডিওটা আবার দ্রুতগতিতে চালানোর জন্য যে-ই না বাটনে চাপ দিতে যাবে সঙ্গে সঙ্গে তার হাতটা খপ করে ধরে ফেললো মার্তা। “এসপেত্তি!”

ঘাড় সোজা করে মনিটরের দিকে তাকালো সে।

ল্যাংডনও এটা দেখতে পেয়েছে। এটা আবার কি?!

পর্দায় দেখা যাচ্ছে ল্যাংডন তার জ্যাকেটের পকেট থেকে একজোড়া সার্জিক্যাল গ্লাভস বের করে হাতে পরে নিচ্ছে।

একই সঙ্গে ইল দুমিনো ল্যাংডনের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে, বার বার হলওয়ের দিকে তাকাচ্ছে সে, যেখান দিয়ে একটু আগে মার্তা রেস্টরুমে গেছে। কয়েক মুহূর্ত পর মোটাসোটা লোকটি ল্যাংডনের দিকে মাথা নেড়ে ইশারা করলো, যেনো বলতে চাইছে, ঠিক আছে। সব ক্লিয়ার।

আমরা কি করছিলাম?!

ল্যাংডন নিজেকে পর্দায় দেখতে পেলো গ্লাভস পরা হাত দিয়ে মুখোশ রাখার কেবিনেটের কাঁচের দরজাটা খোলার চেষ্টা করছে…তারপর আস্তে করে টান দিতেই দরজাটা খুলে গেলো।

এ দৃশ্য দেখে মুখে হাত চাপা দিলো মার্তা আলভারেজ।

অবিশ্বাসে দেখতে লাগলো ল্যাংডন। সে নিজে মুখোশটি হাতে তুলে নিচ্ছে।

“দিও মি সালভি!” রাগেক্ষোভে উঠে দাঁড়ালো মার্তা, চট করে ঘুরে দাঁড়ালো ল্যাংডনের দিকে। “কস’হা ফাত্তো? পারচে?”

ল্যাংডন কোনো কিছু বলার আগেই গার্ডদের একজন কোমর থেকে কালো রঙের বেরেটা পিস্তল বের করে তা করলো তার বুক বরাবর।

হায় ঈশ্বর!

পিস্তলের ব্যারেলের দিকে চেয়ে রইলো রবার্ট ল্যাংডন। তার কাছে মনে হলো ছোট্ট এই ঘরটার দেয়ালগুলো যেনো চারপাশ থেকে চেপে ধরছে তাকে। মার্তা এখন তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। অবিশ্বাস আর রাগে রীতিমতো কাঁপছে সে। তার পেছনে সিকিউরিটি মনিটরে দেখা যাচ্ছে, ল্যাংডন মুখোশটি আলোর সামনে তুলে ধরে কী যেনো দেখছে।

“ওটা আমি অল্প সময়ের জন্য নিয়েছিলাম,” ল্যাংডন বললো, মনে মনে প্রার্থনা করলো এটা যেনো সত্যি হয়। “ইগনাজিও আমাকে আশ্বস্ত করেছিলেন আপনি এতে কিছু মনে করবেন না!”

কোনো জবাব দিলো না মার্তা। হতভম্ব হয়ে গেছে সে। বুঝতেই পারছে না ল্যাংডন কেন তার সঙ্গে মিথ্যে বলেছিলো…তারচেয়েও বড় কথা, এরকম একটা কাজ করার পর এই প্রফেসর কিভাবে এখন শান্তভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিকিউরিটি টেপটা দেখছে!

আমি যে কেসটা খুলেছি সে ব্যাপারে আমার কোনো ধারণাই নেই!

“রবার্ট,” সিয়েনা ফিসফিসিয়ে বললো। “দেখো! তুমি কি জানি একটা খুঁজে পেয়েছো!” এসব ঘটনা ঘটতে থাকলেও মনিটরের পর্দা থেকে মেয়েটি চোখ সরায় নি।

পর্দায় দেখা যাচ্ছে মুখোশটি হাতে নিয়ে আলোর সামনে তুলে ধরে কী যেনো দেখে যাচ্ছে ল্যাংডন। তার মনোযোগ এখন আর্টিফ্যাক্টটার পেছনের দিকে।

ক্যামেরার এই অ্যাঙ্গেল থেকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য দান্তের মৃতচোখ দুটো একেবারে ল্যাংডনের চোখের সাথে খাপে খাপে মিলে গেলো যেনো। তার মনে পড়ে গেলো-সত্য কেবলমাত্র মৃতের চোখেই দেখা যেতে পারে-টের পেলো শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল একটি প্রবাহ বয়ে যাচ্ছে।

ল্যাংডনের কোনো ধারনাই নেই মুখোশের পেছনে সে আসলে কী দেখছিলো। তবে ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ইগনাজিওকে কিছু একটা বলতেই মোটা লোকটির চোখেমুখে তিক্ত ভাব ফুটে উঠলো, পকেট থেকে চশমা বের করে পরে নিলো সে। মুখোশের পেছন দিকটা বার বার দেখতে লাগলো ভদ্রলোক…উদভ্রান্তের মতো মাথা ঝাঁকিয়ে আন্দিতো’তে পায়চারি করতে লাগলো অস্থিরভাবে।

হঠাৎ করেই তারা দু’জন মুখ তুলে তাকালো, বোঝাই যাচ্ছে রেস্টরুম থেকে মার্তা ফিরে আসছে। ল্যাংডন দ্রুত পকেট থেকে একটি জিপলক ব্যাগ বের করে মুখোশটি ভরে নিলো তারপর ওটা দিয়ে দিলো ইগনাজিওর হাতে। মনে হলো অনেকটা অনিচ্ছায় ভদ্রলোক তার বৃফকেসে ভরে রাখলো সেটা। ল্যাংডন চট করে কেবিনেটের দরজাটা বন্ধ করে দিলো এবার। দেরি না করে তারা দুজন কেবিনেটের সামনে থেকে চলে গেলো মার্তার দিকে যেনো তাদের চুরির ব্যাপারটা সে ধরে ফেলতে না পারে।

এবার দু’জন গার্ডই তাদের পিস্তল তাক করলো ল্যাংডনের দিকে।

মনে হলো কিছুটা টলে গেলো মার্তা, টেবিলের প্রান্ত ধরে ভারসাম্য রক্ষা করলো সে। “আমি বুঝতে পারছি না!” রাগে গজগজ করে বললো। “আপনি আর ইগনাজিও বুসোনি দান্তের মৃত্যু-মুখোশটি চুরি করেছেন?”

“না!” জোর দিয়ে বললো ল্যাংডন, নিজের পক্ষে সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করলো সে। “একরাতের জন্য মুখোশটি ভবনের বাইরে নিয়ে যেতে ওটার মালিকের কাছ থেকে আমরা পারমিশন পেয়েছিলাম।”

“ওটার মালিকের কাছ থেকে পারমিশন নিয়েছিলেন?” ভুরু কুচকে জানতে চাইলো মার্তা। বারট্রান্ড জোবরিস্টের কাছ থেকে!?”

“হ্যাঁ! মি: জোবরিস্ট আমাদেরকে মুখোশের পেছনে কিছু মার্কিং পরীক্ষা করে দেখার জন্য অনুমতি দিয়েছিলেন। গতকাল দুপুরে উনার সঙ্গে আমাদের দেখাও হয়েছিলো!”

মার্তার চোখ দুটো জ্বলে উঠলো যেনো। “প্রফেসর, আমি একদম নিশ্চিত করেই বলছি, আপনি বারট্রান্ড জোবরিস্টের সাথে গতকাল দুপুরে দেখা করেন। নি।”

“আমরা অবশ্যই দেখা করেছি-”

সিয়েনা ল্যাংডনের হাতটা আস্তে করে ধরে তাকে বিরত করলো। “রবার্ট…” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো সে। “আজ থেকে ছয় দিন আগে, বারট্রান্ড জোবরিস্ট এখান থেকে মাত্র কয়েক ব্লক পরে বাদিয়া টাওয়ারের উপর থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেছেন।”

.

অধ্যায় ৪২

পালাজ্জো ভেচ্চিও’র উত্তর দিকে ভায়েন্থা তার মোটরসাইকেলটি রেখে পায়ে হেঁটে পিয়াজ্জা দেল্লা সিনোরিয়া হয়ে রওনা দিয়েছে। লগ্নিয়া দেই লানজির সামনে দিয়ে যাবার সময় অসংখ্য শিল্পকর্ম থেকে নিজের চোখ দুটো সরাতে পারলো না, আর সবগুলো শিল্পকর্ম যেনো একটা থিমকেই তুলে ধরেছে : নারীর। উপরে পুরুষের আধিপত্যের সহিংস রূপ।

দ্য রেইপ অব দি স্যাবিস।

দ্য রেইপ অব পলিজেনা।

পার্সিয়াস হোন্ড দি সিভিয়ারন্ড হেড অব মেডুসা।

চমৎকার, ভাবলো ভায়েন্থা। মাথার টুপিটা আরেকটু নীচে নামিয়ে দিয়ে এমনভাবে এগিয়ে যেতে লাগলো যেনো এই সাত সাকলে বেড়াতে আসা একজন দর্শনার্থী। সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে আর সব দিনের মতোই পালাজ্জো ভেচ্চিও একদম স্বাভাবিক।

কোনো পুলিশ নেই, ভাবলো ভায়েন্থা। অন্ততপক্ষে এখন পর্যন্ত।

ভেতরে রাখা অস্ত্রটি যাতে বাইরে থেকে বোঝা না যায় সেজন্যে জ্যাকেটের জিপটা গলা পর্যন্ত তুলে দিয়ে প্রবেশপথের দিকে পা বাড়ালো সে। ইল মিউজিও দি পালাজ্জোর সাইন দেখে নক্সা করা দুটো আর্টিয়াম পেরিয়ে চলে এলো বিশাল একটি সিঁড়ির কাছে। ওটা চলে গেছে দোতলায়। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় পুলিশের ডিসপ্যাঁচ থেকে যে কথাগুলো শুনেছিলো সেটা স্মরণ করলো :

ইল মিউজিও দি পালাজ্জো ভেওি..দান্তে অলিঘিয়েরি।

ল্যাংডন অবশ্যই এখানে আছে।

সাইন দেখে হল অব ফাইভ হান্ড্রেড নামের বিশাল একটি গ্যালারিতে চলে এলো ভায়েন্থা-প্রচুর দর্শনার্থী বিভিন্ন শিল্পকর্ম আর ভাস্কর্য দেখছে মুগ্ধ হয়ে। ভায়েন্থার অবশ্য এসব দেখার কোনো ইচ্ছে নেই। দ্রুত সে দেখতে পেলো ঘরের ডানকোণে আরেকটি জাদুঘরের সাইন। একটা সিঁড়ির দিকে তীর চিহ্ন দেয়া।

ওখানে যাবার পথে তার নজরে পড়লো একদল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রি একটা ভাস্কর্য দেখে হাসাহাসি করছে আর ছবি তুলছে।

ভাস্কর্যের ফলকে লেখা : হারকিউলিস অ্যান্ড ডায়োমিডিস।

ভাস্কর্যটার দিকে তাকিয়ে ভুরু কুচকে গেলো তার।

গ্রিক মিথোলজির দুই বীরের একটি ভাস্কর্য-সম্পূর্ণ নগ্ন তারা-একে অন্যের সাথে কুস্তি লড়ছে। হারকিউলিস উল্টো করে তুলে ধরেছে ডায়োমিডিসকে, আছাড় মারার প্রস্তুতি নিচ্ছে যেনো, আর ডায়োমিডিস শক্ত করে হারকিউলিসের বিচি ধরে রেখেছে! যেনো বলতে চাচ্ছে, “তুমি কি নিশ্চিত, আমাকে ছুঁড়ে মারবে?”

তিক্তমুখে তাকালো ভায়েন্থা। কারো বিচি ধরে তার সাথে কথা বলা!

অদ্ভুত ভাস্কর্য থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করলো সে। একটা বেলকনির উপর এসে পড়লো এবার। ওখান থেকে নীচের হলটা দেখা যায়। জাদুঘরের প্রবেশদ্বারের বাইরে প্রায় ডজনখানেক দর্শনার্থী অপেক্ষা করছে। ঢোকার জন্য।

“দেরিতে খুলছে,” এক পর্যটক নিজে থেকেই বললো তাকে।

“কি জন্যে জানেন?” জানতে চাইলো সে।

“না। কিন্তু অপেক্ষা করতেও দারুণ লাগছে। চারপাশটা দেখুন, কী দারুণ ভিউ!”

বেলকনি দিয়ে নীচে তাকালো ভায়েন্থা।

নীচে দেখতে পেলো এক পুলিশ এসে পৌঁছেছে মাত্র। একেবারেই স্বাভাবিকভাবে হেলেদুলে হেঁটে যাচ্ছে সিঁড়ির দিকে।

একটা স্টেটমেন্ট নিতে আসছে সে, ভায়েন্থা অনুমাণ করলো। লোকটার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে এটা নিতান্তই রুটিন কল-পোর্তা রোমানায় ল্যাংডনকে ধরার মতো যে আয়োজন দেখেছে সেরকম কিছু নয়।

এখানে যদি ল্যাংডন থেকে থাকে তাহলে তারা ঝটিকা অভিযান চালাচ্ছে না কেন?

ভায়েন্থা বুঝতে পারলো, হয় ল্যাংডন এখানে নেই, নয়তো ব্রুডার এবং পুলিশ এখনও দুয়ে দুয়ে চার মেলাতে পারে নি।

পুলিশের লোকটি উপরে উঠে এলে ভায়েন্থা নিজেকে আড়াল করে দাঁড়ালো। কনসোর্টিয়াম তাকে পরিত্যাগ করেছে, সে চাইছে না কোনোভাবে তার উপস্থিতি কেউ জেনে যাক।

“এসপেত্তা!” একটা চিৎকার ভেসে এলো।

পুলিশের লোকটি ঠিক ভায়েন্থার পেছনে এসে থমকে দাঁড়ালো সেটা শুনে। ভয়ে হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো তার। বুঝতে পারলো চিৎকারটা এসেছে পুলিশের ওয়াকিটকি থেকেই।

“আতেন্দি আই রিনফোরজি!” কণ্ঠটা আবার বললো।

সাপোর্টের জন্য অপেক্ষা? ভায়েন্থা আঁচ করতে পারলো পরিস্থিতি বদলে গেছে।

ঠিক তখনই জানালার বাইরে দেখতে পেলো আকাশে কালো রঙের একটি জিনিস, আস্তে আস্তে সেটার আকার বড় হচ্ছে। ববোলি গার্ডেন থেকে পালাজ্জো ভেচ্চিওর দিকে ছুটে আসছে ওটা।

ড্রোন, বুঝতে পারলো ভায়েন্থা। ব্রুডার জেনে গেছে। এখন সে এদিকেই আসছে।

.

প্রভোস্টকে ফোন করার জন্য কনসোর্টিয়ামের ফ্যাসিলিটেটর লরেন্স নোলটন নিজেকে ভৎর্সনা করে যাচ্ছে। সে আগেই বুঝেছিলো ভিডিওটা আপলোড করার আগে প্রভোস্টকে প্রিভিউ করতে বললে কী জবাব পেতো। আর ঠিক তাই হয়েছে।

ওটার কনটেন্ট কি সেটা নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই। প্রটোকলই হলো আসল কথা।

এই সংস্থায় তরুণ বয়সে যোগ দেবার সময় তাকে যে মন্ত্রটা শেখানো। হয়েছিলো সেটা স্মরণ করলো নোলটন। কোনো প্রশ্ন নয়, শুধু কাজ করে যাবে।

একান্ত অনিচ্ছায় মেমোরি স্টিকটা আগামীকালের সকালের জন্য কিউতে রেখে দিলো সে। ভাবতে লাগলো, এই উদ্ভট মেসেজটা পেয়ে মিডিয়াগুলো কী করবে। তারা কি এটা আদৌ প্রচার করবে?

অবশ্যই করবে। এটা বারট্রান্ড জোবরিস্টের মেসেজ।

.

অধ্যায় ৪৩

রাগে গজগজ করতে করতে ভিডিও রুম থেকে বের হয়ে এলো মার্তা আলভারেজ, ল্যাংডন আর তার বোনকে গার্ডদের অস্ত্রের মুখে রেখে এসেছে। বাইরে এসে জানালা দিয়ে নীচের পিয়াজ্জা দেল্লা সিনোরিয়ার দিকে তাকালো। পুলিশের গাড়িটা পার্কিংলটে দেখতে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে।

সময় হয়েছে।

মার্তা এখনও বুঝতে পারছে না রবার্ট ল্যাংডনের মতো একজন সম্মানিত লোক তার সাথে কেন এমন ধোঁকাবাজি করে অমূল্য একটি আর্টিফেক্ট চুরি করতে গেলো।

আর ইগনাজিও বুসোনি তাকে সাহায্য করেছেন!? অচিন্তনীয়!

মার্তা তার নিজের ক্ষোভ জানানোর জন্য সেলফোনটা বের করে ইল দুমিনোর অফিসে ফোন করলে মাত্র একবার রিং হবার পরই কলটা রিসিভ করা হলো।

“উফিসিও দি ইগনাজিও বুসোনি,” পরিচিত নারী কণ্ঠটি জবাব দিলো।

মার্তা সব সময়ই ইগনাজিওর সেক্রেটারির সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করে তবে আজ তার সাথে প্যাচাল পারার মতো মেজাজে নেই। “ইউজেনিয়া, সোনো মার্তা। দেভো পারলারে কন ইগনাজিও।”

হঠাৎ করেই অদ্ভুত এক নীরবতা নেমে এলো লাইনে তারপরই উন্মাদগ্রস্তের মতো চিৎকার করতে শুরু করলো সেক্রেটারি মেয়েটি।

“কসা সাকসিদো?” মার্তা জানতে চাইলো। কি হয়েছে?

ইউজেনি কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলে গেলো, সে এইমাত্র অফিসে এসে শুনেছে গতকাল রাতে দুমোর কাছে এক গলিতে ইগনাজিওর হার্ট অ্যাটাক হয়। তিনি অ্যাম্বুলেন্সে কল করলে তারা সময়মতো আসতে পারে নি। বুসোনি ওখানেই মারা গেছেন।

মার্তার মনে হলো তার পা দুটো যেনো টলে গেছে। আজ সকালে সে খবরে শুনেছে গতরাতে এক নাম না জানা কর্মকর্তা হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে কিন্তু সেই লোকটা যে ইগনাজিও এটা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারে নি।

“ইউজেনিয়া, আসকোলতামি,” তাড়া দিলো মার্তা। নিজেকে বহু কষ্টে শান্ত রেখে বলে গেলো এইমাত্র পালাজ্জোর ভিডিও ক্যামেরায় কি দেখতে পেয়েছে-গতরাতে দান্তের মৃত্যু-মুখোশটি ইগনাজিও আর রবার্ট ল্যাংডন মিলে চুরি করেছে। এখন অস্ত্রের মুখে রাখা হয়েছে ল্যাংডনকে।

“রবার্ট ল্যাংডন!?” ইউজেনিয়া বিস্ময়ে বলে উঠলো। “সেই কন ল্যাংডন অরা??” আপনি এখন ল্যাংডনের সাথে আছেন?!

মনে হলো ইউজেনিয়া আসল ব্যাপারটা ধরতে পারে নি। হ্যাঁ, কিন্তু মুখোশটি–

“দেভে পারলারে কন লুই!” চিৎকার করে বলে উঠলো ইউজেনিয়া। তার সঙ্গে আমাকে এক্ষুণি কথা বলতে হবে!

.

সিকিউরিটি রুমের ভেতরে গার্ডদের অস্ত্রের মুখে থাকা ল্যাংডনের মাথা ব্যথা ক্রমশ বাড়তে লাগলো। আচমকা দরজাটা সশব্দে খুলে যেতেই দেখা গেলো। মার্তা আলভারেজ ঢুকছে।

খোলা দরজা দিয়ে ল্যাংডন স্পষ্ট শুনতে পেলো বাইরে থেকে ড্রোনের গুঞ্জনটা ভেসে আসছে, সেই শব্দের সঙ্গি হয়েছে আগুয়ান সাইরেনের আওয়াজ। তারা জেনে গেছে আমরা কোথায় আছি।

“এ অ্যারাইভা লা পোলিজিয়া,” গার্ডদের বললো মার্তা। তাদের একজনকে বাইরে পাঠালো পুলিশকে ভেতরে নিয়ে আসার জন্য। অন্যজন এখনও ল্যাংডনের দিকে অস্ত্র তাক করে রেখেছে।

ল্যাংডনকে অবাক করে দিয়ে মার্তা তার দিকে একটা সেলফোন বাড়িয়ে দিলো। “আপনার সাথে একজন কথা বলতে চাইছে,” বললো সে। তার কণ্ঠে রহস্য। “আপনাকে বাইরে গিয়ে কথা বলতে হবে, এখানে নেটওয়ার্ক পাবেন না।”

তারা সবাই ঘর থেকে বের হয়ে গ্যালারির কাছে চলে এলো। বেশ কয়েকটি জানালা দিয়ে সূর্যের আলো এসে পড়েছে সেখানে। জানালাগুলোর ওপাশে, নীচে অবস্থিত পিয়াজ্জা দেল্লা সিনোরিয়া। অস্ত্রের মুখে থাকা সত্ত্বেও সঙ্কীর্ণ পরিসরের ঘর থেকে বের হতে পেরে কিছুটা স্বস্তি পেলো ল্যাংডন।

একটা জানালার কাছে গিয়ে ফোনে কথা বলতে বললো মার্তা।

কিছু বুঝতে না পেরে ফোনটা হাতে নিয়ে কানে দিলো। রবার্ট ল্যাংডন বলছি।”

“সিনোর,” একটা নারীকণ্ঠ ইংরেজিতেই বললো। “আমি ইউজেনিয়া আন্তোনুচ্চি, ইগনাজিও বুসোনির সেক্রেটারি। আপনি গতকাল রাতে উনার। অফিসে যখন আসছিলেন তখন আপনার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো।”

কিছুই মনে পড়লো না ল্যাংডনের। “হ্যাঁ?”

“আমি খুবই দুঃখিত খবরটা দেবার জন্য, ইগনাজিও গতকাল রাতে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন।”

ল্যাংডন শক্ত করে ফোনটা ধরলো। ইগনাজিও বুসোনি মারা গেছেন?!

মহিলা এবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। “ইগনাজিও মারা যাবার আগে আমাকে ফোন করেছিলেন। তিনি আমার কাছে একটা মেসেজ দিয়ে গেছেন, বলে গেছেন আমি যেনো ওটা অবশ্যই আপনাকে দেই। আমি মেসেজটা আপনার জন্য প্লে করে দিচ্ছি।”

ল্যাংডন কিছু ঘরঘর শব্দ শোনার পর ইগনাজিও বুসোনির মৃদু কণ্ঠস্বরটি শুনতে পেলো কানে।

“ইউজেনিয়া,” হাফাতে হাফাতে বলছেন তিনি। “প্লিজ, এটা যেনো রবার্ট ল্যাংডন শুনতে পায় সেই ব্যবস্থা কোরো। আমি বিরাট সমস্যায় পড়ে গেছি। আমার মনে হয় না এটা অফিসে নিয়ে আসতে পারবো।” যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠলো ইগনাজিও, লম্বা একটি বিরতি নেমে এলো সেই সাথে। এরপর যখন কথা বলতে শুরু করলেন তার কণ্ঠটা ক্লান্ত আর দুর্বল শোনালো। “রবার্ট, আশা করি তুমি পালাতে পেরেছে। তারা এখনও আমার পেছনে লেগে আছে…আর আমি…আমি মোটেও ভালো নেই। আমি ডাক্তারের কাছে যাবার চেষ্টা করছি, কিন্তু…” আবারো বিরতি। যেনো ইল দুমিনো নিজের শেষ শক্তিটুকু সঞ্চয় করে নিচ্ছেন কথা বলার জন্য, তারপর বলতে লাগলেন…”রবার্ট, মন দিয়ে শোনো। তুমি যা খুঁজছিলে সেটা খুবই নিরাপদে লুকিয়ে রাখা আছে। তোমার জন্য দরজাটা খোলা রয়েছে, তবে খুব দ্রুত কাজ করতে হবে। প্যারাডাইস পঁচিশ।” আবারো বিরতি দিয়ে অবশেষে বললেন, “ঈশ্বর তোমার সহায় হন।”

শেষ হয়ে গেলো মেসেজটি।

ল্যাংডনের হৃদস্পন্দন দ্রুতগতির হয়ে গেলো, সে জানে একজন মৃত্যুপথযাত্রির শেষ নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পেলো এখন। তাকে উদ্দেশ্য করে যে কথাগুলো বলা হলো সে-কথাগুলো তার উদ্বেগ-উদ্বিগ্নতা মোটেও কমাতে পারলো না। প্যারাডাইস ২৫? আমার জন্য দরজাটা খোলা আছে? কথাটা বিবেচনা করে দেখলো সে। কোন দরজাটার কথা সে বোঝাতে চেয়েছে?! এসব কথার একটাই মানে হতে পারে, ইগনাজিও মুখোশটি নিরাপদে কোথাও লুকিয়ে রেখেছেন।

ইউজেনিয়ার কণ্ঠটা আবারো লাইনে শোনা গেলো। “প্রফেসর, আপনি কি বুঝতে পেরেছেন?”

“কিছুটা।”

“আমি কি আপনার জন্য কিছু করতে পারি?”

কথাটা একটু বিবেচনা করে দেখলো ল্যাংডন। “এই মেসেজটা যেনো অন্য কেউ শুনতে না পায় সে ব্যবস্থা করবেন।”

“পুলিশের কাছেও না? একজন ডিটেক্টিভ আমার স্টেটমেন্ট নিতে আসবে একটু পর।”

আড়ষ্ট হয়ে গেলো ল্যাংডন। পিস্তল তাক করে রাখা গার্ডের দিকে তাকালো। সে, তারপর দ্রুত ফিসফিসিয়ে বললো, “ইউজেনিয়া…কথাটা হয়তো অদ্ভুত শোনাবে, কিন্তু ইগনাজিও দোহাই লাগে, এই মেসেজটা এক্ষুণি ডিলিট করে ফেলুন। আর পুলিশকে বলবেন না আপনি আমার সঙ্গে কথা বলেছেন। বুঝতে পেরেছেন? পরিস্থিতি খুবই জটিল আর-”

ল্যাংডন টের পেলো তার পিঠে অস্ত্রের ব্যারেলটি দিয়ে তো মারা হয়েছে। ঘুরে তাকিয়ে দেখলো অস্ত্রধারী গার্ড মার্তার ফোনটা ফেরত চাইছে।

দীর্ঘ নীরবতার পর ইউজেনিয়া বললো, “মি: ল্যাংডন, আমার বস আপনাকে বিশ্বাস করতেন,..তাই আমিও আপনাকে বিশ্বাস করলাম।”

লাইনটা কেটে গেলো।

গার্ডের হাতে ফোনটা দিয়ে দিলো ল্যাংডন। “ইগনাজিও বুসোনি মারা গেছেন,” সিয়েনাকে বললো সে। “গতরাতে জাদুঘর থেকে বের হবার পর হার্ট অ্যাটাকে তিনি মারা যান।” একটু থেমে আবার বললো, “মুখোশটি নিরাপদে আছে। মৃত্যুর আগে ইগনাজিও ওটা লুকিয়ে রেখে যেতে পেরেছেন। আমার মনে হয় তিনি আমাকে একটা কু দিয়েছেন ওটা খুঁজে বের করার জন্য।”

প্যারাডাইস ২৫।

সিয়েনার চোখে আশার ঝলক দেখা গেলেও মার্তার দিকে তাকাতেই দেখা গেলো তার চোখেমুখে সন্দেহ আর অবিশ্বাস।

“মার্তা, ল্যাংডন বললো। “আমি দান্তের মুখোশটা আবার ফেরত দিতে পারবো, কিন্তু তার জন্য আমাকে যেতে দিতে হবে। এক্ষুণি।”

অট্টহাসি দিয়ে উঠলো মার্তা। “আমি এমন কাজ করবো না! আপনি নিজে ঐ মুখোশটি চুরি করেছেন। পুলিশ আসছে-”

“সিনোরা আলভারেজ,” সিয়েনা তাদের কথার মাঝখানে ঢুকে পড়লো। “মি দিসপিয়াসি, মা নন লে আব্বিয়ামো দেত্তো লা ভারিতা।”

ল্যাংডন বিষম খেলো। সিয়েনা করছেটা কি?! তার বলা কথাগুলো পুরোপুরি বুঝতে পেরেছে সে। মিসেস আলভারেজ, আমি দুঃখিত, আমরা আপনার কাছে সত্যি কথা বলি নি।

সিয়েনার কথা শুনে মার্তাও চমকে উঠলো। তার এই চমকে যাবার কারণ হলো হঠাৎ করেই সিয়েনা চোস্ত ইতালিতে কথা বলে যাচ্ছে।

“ইনানজিতুত্তো, নন সোনো লা সোরেল্লা দি রবার্ট ল্যাংডন, ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বললো সিয়েনা। প্রথম কথা হলো, আমি রবার্ট ল্যাংডনের বোন নই।

.

অধ্যায় ৪৪

মার্তা অলিভারেজ বুকের কাছে দু’হাত ভাঁজ করে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সোনালি চুলের তরুণীকে ভালো করে দেখলো।

“মি দিসপিয়াসি,” সিয়েনা বলে যেতে লাগলো, এখনও চমৎকারভাবে ইতালিয়ান ভাষায় কথা বলছে সে। “লে আবিয়ানো মেননিতো সু মলতে কোসে।” অনেক বিষয়ে আমরা আপনার কাছে মিথ্যে বলেছি।

মার্তার মতো গার্ডকেও হতবিহ্বল দেখাচ্ছে, যদিও পিস্তলটা এখনও তা করে রেখেছে সে।

ইতালিয়ান ভাষায়ই অনর্গল কথা বলে মার্তাকে সব খুলে বললো সিয়েনা। সে আসলে ফ্লোরেন্সের হাসপাতালে কাজ করে, যেখানে গতরাতে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ল্যাংডন এসেছিলো। প্রাণে বেঁচে গেলেও এরপর থেকে ল্যাংডনের স্মৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বিশেষ করে গুলিবিদ্ধ হবার আগে কি ঘটেছিলো সে সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই নেই। সেজন্যেই ভিডিওটা দেখে সে যারপরনাই বিস্মিত হয়েছে।

“তুমি তোমার মাথার আঘাতটা দেখাও,” ল্যাংডনকে বললো সিয়েনা।

ল্যাংডনের চুলের ফাঁকে যখন সেলাইগুলো দেখতে পেলো মার্তা তখন মুখে হাতচাপা দিয়ে জানালার ধারিতে বসে পড়লো সে।

গত দশ মিনিটের মধ্যে মার্তা শুধু মৃত্যু-মুখোশটি চুরির ঘটনাই জানতে পারে নি, সেইসাথে জানতে পেরেছে এই চুরিটা করেছে এমন দু’জন চোর যাদের একজন সম্মানিত আমেরিকান প্রফেসর আর অন্যজন তার স্বদেশীয় এবং বিশ্বস্ত সহকর্মী, যে কিনা এখন মৃত,..তাছাড়া ল্যাংডন তার সাথে যে তরুণীটিকে নিজের বোন বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো সে এখন বলছে, এসব একদমই মিথ্যে। মেয়েটা নাকি একজন ডাক্তার, তার হাসপাতালেই ল্যাংডন গুলিবিদ্ধ হয়ে এসেছিলো…সে আবার অনর্গল ইতালিয়ান ভাষায় কথা বলতে পারে।

“মার্তা,” গম্ভীর কণ্ঠে বললো ল্যাংডন। “আমি জানি কথাটা বিশ্বাস করা সহজ নয়, কিন্তু সত্যি বলছি, গতকাল রাতের ঘটনা আমার একদম মনে নেই। আমি এও না জানি কী জন্যে ইগনাজিও এবং আমি ঐ মুখোশটি চুরি করেছিলাম।”

চোখ দেখে মার্তা বুঝতে পারলো প্রফেসর সত্যি কথা বলছে।

“আমি মুখোশটি ফেরত দেবো আপনার কাছে,” বললো সে। “আমি কথা দিচ্ছি। কিন্তু আপনি আমাকে এখান থেকে যেতে না দিলে সেটা করতে পারবো না। পরিস্থিতি খুবই জটিল। আমাদেরকে যেতে দিতেই হবে, আর সেটা এক্ষুণি।”

অমূল্য মুখোশটি ফেরত পাবার জন্য মরিয়া হলেও ল্যাংডনকে এখান থেকে যেতে দেবার কোনো ইচ্ছে নেই মার্তার। পুলিশ কোথায়?! জানালা দিয়ে নীচে পার্ক করা পুলিশের গাড়িটা দেখলো সে। অদ্ভুত ব্যাপার, সেই অফিসার এখনও জাদুঘরে আসছে না কেন! দূর থেকে অদ্ভুত একটি গুঞ্জনও মার্তার কানে যাচ্ছে। ক্রমশ বাড়ছে সেই গুঞ্জনটা।

এটা আবার কি?

ল্যাংডন এখন আকুতি ভরা কণ্ঠে বললো, “মার্তা, আপনি ইগনাজিওকে চেনেন। ভালো কোনো কারণ না থাকলে তিনি ঐ মুখোশটি চুরি করতেন না। ঘটনা আসলে অনেক বিরাট। মুখোশটির মালিক বারট্রান্ড জোবরিস্ট একজন বিভ্রান্ত ব্যক্তি। আমাদের মনে হচ্ছে ভদ্রলোক সাংঘাতিক কোনো ঘটনার সাথে জড়িত। সবকিছু ব্যাখ্যা করার মতো সময় আমার হাতে নেই। কিন্তু আমি হাতজোড় করে বলছি, আমাদেরকে বিশ্বাস করুন।”

মার্তা ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইলো। মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছে না।

“মিসেস আলভারেজ,” মার্তার চোখে চোখ রেখে বললো সিয়েনা। “আপনি যদি আপনার ভবিষ্যৎ আর পেটের বাচ্চাটার মঙ্গল চান তাহলে আমাদেরকে এক্ষুণি এখান থেকে যেতে দেবেন।”

পেটের উপর হাত রাখলো মার্তা, যেনো অনাগত সন্তানকে রক্ষা করতে চাচ্ছে, তার এই সন্তানের ব্যাপারে এভাবে হুমকি দেয়ায় সে খুশি হতে পারলো না।

বাইরে থেকে তীক্ষ্ণ শুঞ্জনটা এখন আরো বেড়ে গেলো, জানালা দিয়ে মার্তা বাইরে তাকালেও আওয়াজটার উৎস খুঁজে পেলো না তবে অন্য কিছু দেখতে পেলো সে।

গার্ডও দেখতে পেলো, দেখতে পেয়ে তার চোখ দুটো গোল গোল হয়ে গেলো।

নীচের পিয়াজ্জা দেল্লা সিনোরিয়া’তে লোকজনের ভীড়টা দুভাগে ভাগ হয়ে গেলো সারি সারি পুলিশের গাড়ি ছুটে আসছে বলে। অবাক করার ব্যাপার হলো কোনো সাইরেন বাজানো হচ্ছে না তবে গাড়িগুলোর সামনে আছে দুটো কালো রঙের ভ্যান। সেই ভ্যান দুটো এসে থামলো প্রাসাদের দরজার সামনে। সঙ্গে সঙ্গে ওটার ভেতর থেকে কালো ইউনিফর্ম পরা কিছু সৈনিক লাফিয়ে নেমে পড়লো, তাদের সবার হাতে অস্ত্র, দেরি না করে এ সঙ্গে সবাই ঢুকে পড়ছে। প্রাসাদের ভেতরে।

তীব্র ভয় জেঁকে বসলো মার্তার মধ্যে। এরা আবার কারা?!

সিকিউরিটি গার্ডকেও ভড়কে যেতে দেখা গেলো।

তীক্ষ গুঞ্জনটা আচমকা বেড়ে গেলো এবার। একেবারে কানে এসে লাগলো। জানালার ঠিক বাইরে ছোট্ট একটা হেলিকপ্টার দেখে সঙ্গে সঙ্গে সরে গেলো সে।

মেশিনটা বড়জোর দশ গজ দূরে বাতাসে ভেসে আছে, ঠিক যেনো চেয়ে আছে ঘরের ভেতরে থাকা লোকগুলোর দিকে। জিনিসটা খুব বেশি হলে এক গজের মতো লম্বা হবে, সামনের দিকে সিলিন্ডার আকৃতির একটি নলের মতো আছে। সেটা তাদের দিকে তাক করা।

“গুলি করবে!” চিৎকার করে বললো সিয়েনা। “স্তা পার স্পারারে! সবাই মেঝেতে শুয়ে পড়ো! তুত্তি এ তেরা!” জানালার ঠিক নীচে হাটু গেড়ে বসে পড়লো সে। মার্তা প্রচণ্ড ভয় পেলেও মেঝেতে উপুড় হয়ে বসে পড়লো সিয়েনার দেখাদেখি। গার্ডও একই কাজ করলো, স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়ায় নিজের অস্ত্রটা তাক করলো হেলিকপ্টারের দিকে।

মার্তা জানালার নীচে উপুড় হয়ে বসে থেকেই দেখতে পেলো ল্যাংডন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এখনও। অবাক হয়ে চেয়ে আছে সিয়েনার দিকে। সে আসলে বিশ্বাস করছে না ওরকম একটা মেশিন থেকে কোনো বিপদ আসতে পারে।

সিয়েনা কয়েক মুহূর্তের জন্য মাটিতে বসে পড়লেও সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে ল্যাংডনের হাত ধরে হলওয়ের দিকে টেনে নিয়ে গেলো। পরমুহূর্তেই ভবনের প্রধান প্রবেশদ্বারের দিকে ছুটতে শুরু করলো তারা দু’জন।

গার্ড হাটু গেড়ে বসে থেকেই অস্ত্রটা তাক করলো তাদের দিকে। পলায়নরত দু’জনকে গুলি করতে উদ্যত হলো সে।

“নন স্পারি!” মার্তা তাকে আদেশ করলো। “নন পসসোনো স্কাপ্পারে।” গুলি কোরো না! তারা পালাতে পারবে না।

.

ল্যাংডন আর সিয়েনা দৃষ্টিসীমা থেকে উধাও হয়ে গেলেও মার্তা জানে তারা উপরে উঠতে থাকা পুলিশ আর সেনাদের মুখোমুখি পড়ে যাবে।

“জোরে?” তাড়া দিলো সিয়েনা। ল্যাংডনের সাথে দৌড়াচ্ছে সে। যে পথ দিয়ে এখানে এসেছিলো ঠিক সে-পথ দিয়েই ছুটে যাচ্ছে আবার। মেয়েটা আশা করেছিলো পুলিশ আসার আগেই তারা প্রধান প্রবেশদ্বারের কাছে পৌঁছে যেতে পারবে, কিন্তু এখন বুঝতে পারছে সেই সম্ভাবনা প্রায় শূন্যের কোঠায়।

ল্যাংডনের মনেও একই আশংকা। হুট করেই হলওয়ের ইন্টারসেকশনের কাছে এসে থমকে দাঁড়ালো সে। “এ পথ দিয়ে আমরা পালাতে পারবো না।”

“আসো তো!” সিয়েনা তাকে তাগাদা দিলো তার সাথে আসার জন্য। “আমরা এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না, রবার্ট!”

মনে হলো ল্যাংডন কিছুটা বিপর্যস্ত, বাম দিকে তাকালো সে। ওখানে একটা নাতিদীর্ঘ করিডোর আছে, ছোট্ট আর মৃদু আলো জ্বলতে থাকা একটি কক্ষে গিয়ে শেষ হয়েছে। ঘরের দেয়াল জুড়ে আছে বহু পুরনো মানচিত্র, মাঝখানে লোহার তৈরি বিশাল আকারের একটি গ্লোব। ধাতব গোলকটির দিকে তাকিয়ে আলতো করে মাথা দোলালো ল্যাংডন তারপর বেশ জোরে জোরে।

“এদিক দিয়ে,” বললো ল্যাংডন, গ্লোবের দিকে ছুটে গেলো সে।

রবার্ট! নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে এগিয়ে গেলো সিয়েনা। করিডোরটি জাদুঘরের আরো ভেতরে ঢুকে গেছে, বের হবার পথ থেকে অনেকটা দূরে।

“রবার্ট?” পেছন পেছন দৌড়ে এসে বললো। “তুমি কোথায় যাচ্ছো?!”

“আর্মেনিয়া দিয়ে যেতে হবে,” জবাবে বললো সে।

“কি??”

“আর্মেনিয়া,” আবারো বললো ল্যাংডন, তার দৃষ্টি একেবারে সামনের দিকে নিবদ্ধ। “আমার উপর ভরসা রাখো।”

.

একতলা নীচে হল অব ফাইভ হান্ড্রেডের বেলকনিতে থাকা ভীতসন্ত্রস্ত পর্যটকদের ভীড়ে নিজেকে লুকিয়ে রাখলো ভায়েন্থা, কারণ ব্রুডার আর এসআরএস টিম তাদের অতিক্রম করে চলে যাচ্ছে জাদুঘরের দিকে। নীচ তলায় দরজাটা বন্ধ করার প্রচণ্ড শব্দ শোনা গেলো। পুরো জায়গাটা সিল করে দিয়েছে পুলিশ।

ল্যাংডন যদি এখানে থেকে থাকে তাহলে সে ফাঁদে পড়ে গেছে। দুঃখের বিষয়, ঠিক একই কথা ভায়েন্থার বেলায়ও প্রযোজ্য।

.

অধ্যায় ৪৫

ওক কাঠের দেয়াল আর কাঠে মোড়ানো ছাদের কারণে হল অব জিওগ্রাফিক্যাল ম্যাপস’কে দেখে মনে হয় পাথর আর প্লাস্টারের ইন্টেরিওরের অনিন্দ্য সুন্দর আর পালাজ্জো ভেচ্চিও থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি জগত।

এটা আসলে এই ভবনের জামা-কাপড় রাখার ঘর ছিলো, বিশাল ঘরটিতে রয়েছে কয়েক ডজন ক্লোসেট আর কেবিনেট। একসময় এগুলো ছিলো গ্র্যান্ড ডিউকের নিজস্ব ব্যবহার্য আসবাব। বর্তমান সময়ে এর দেয়াল জুড়ে আছে। অনেকগুলো মানচিত্র-চামড়ার উপরে হাতে-আঁকা তিপান্নটি ম্যাপ-আর এসবই ১৫৫০ সালে এ পৃথিবীর ভৌগলিক রূপটি যেরকম ভাবা হতো তার নিদর্শন।

এই হলের অসাধারণ কাটোগ্রাফি সংগ্রহের মধ্যে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য বস্তুটা হলো ঘরের মাঝখানে রাখা বিশাল আকারের গ্লোবটি। মাপ্পা মুন্ডি নামে পরিচিত ছয় ফিট উচ্চতার এই গোলকটি সেই আমলে এ বিশ্বের সবচাইতে বড় ঘূর্ণায়মান গ্লোব ছিলো। বলা হয়ে থাকে, সামান্য আঙুলের স্পর্শেই নাকি এটা বিরামহীনভাবে ঘুরতে পারতো। বর্তমান সময়ে গ্লোবটি এই ভবনে আসা দর্শনার্থীদের জন্য শেষ দর্শনীয় বস্তু হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে, কারণ এরপর আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। সুতরাং পর্যটকের দল গ্লোবটি এক চক্কর দিয়ে যেখান থেকে এসেছিলো সেখানেই আবার ফিরে যায়।

দম ফুরিয়ে হল অব ম্যাপসে এসে পৌঁছালো ল্যাংডন আর সিয়েনা। তাদের সামনে রাজকীয়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে মাপ্পা মুন্ডি। কিন্তু ল্যাংডন ওটার দিকে তাকিয়েও দেখলো না। বরং তার চোখ ঘুরে বেড়ালো দেয়ালগুলোর দিকে।

“আমাদেরকে আর্মেনিয়া খুঁজে বের করতে হবে!” বললো ল্যাংডন। “মানে আর্মেনিয়ার মানচিত্রটা!”

তার এরকম কথা শুনে সিয়েনা যারপরনাই অবাক হলেও কোনো প্রশ্ন না করে গ্লোবের কাছে ছুটে গিয়ে ডান দিক থেকে মানচিত্রটা খুঁজতে শুরু করলো।

ল্যাংডন খুঁজতে লাগলো বামদিক থেকে।

আরব, স্পেন, গ্রিস…

আজ থেকে পাঁচশত বছর আগে যখন পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশের মানচিত্র ছিলো না, এবং অনেক জায়গা আবিষ্কৃতই হয় নি সেটা বিবেচনায় নিলে এখানে প্রতিটি দেশের যে মানচিত্র রয়েছে সেগুলো যেমন চমৎকার তেমনি বিস্তারিত।

আর্মেনিয়া কোথায়?

অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী ল্যাংডন কয়েক বছর আগে এখানকার ‘সিক্রেট প্যাসেজ টুর’-এর কথা স্মরণ করতে পারলেও সেটা পরিস্কার নয়, একদম ঝাপসা আর কুয়াশাচ্ছন্ন বলে মনে হচ্ছে। ঐ টুরের লাঞ্চের পর দুই গ্লাস নেব্বিওলো পান করেছিলো সে সম্পর্কে তেমন কিছুই মনে নেই। উপযুক্তভাবেই নেবিওলো শব্দের মানে হলো হালকা কুয়াশা। তারপরও ল্যাংডনের স্পষ্ট মনে আছে এই গ্লোবের আর্মেনিয়ার ম্যাপটির অনন্যসাধারণ গুণ রয়েছে।

আমি জানি এটা এখানেই আছে, ভাবলো ল্যাংডন। অসংখ্য মানচিত্রে চোখ বুলাতে লাগলো সে।

“আর্মেনিয়া!” বেশ জোরেই বললো সিয়েনা। “এই তো, এখানে!”

ল্যাংডন সিয়েনার পাশে চলে এলো, এটা ঘরের ডান দিকের কর্নার। মেয়েটা তাকে দেখিয়ে দিলো আর্মেনিয়ার মানচিত্র কোথায়। তার চোখেমুখে। এমন একটা অভিব্যক্তি যেনো বলতে চাইছে : “আর্মেনিয়া তো পেলাম-এখন কি?”

ল্যাংডন জানে ব্যাখ্যা করার মতো সময় তাদের হাতে নেই। কোনো কথা না বলে ম্যাপটার বিশাল কাঠের ফ্রেম ধরে নিজের দিকে মুখ করালো। পুরো ম্যাপটা ঘুরে যেতেই কাঠের দেয়ালের একটি অংশ সরে গিয়ে বেরিয়ে এলো একটি গুপ্ত পথ।

“দারুণ,” মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো সিয়েনা। “তাহলে এটাই সেই আমের্নিয়া।”

আর কোনো কথা না বলে গুপ্তপথে ঢুকে পড়লো মেয়েটি, তার পেছন পেছন ল্যাংডন। ভেতরে ঢুকেই দেয়ালটা আবার বন্ধ করে দিলো সে।

সিক্রেট প্যাসেজ টুরটির স্মৃতি ঝাপসা থাকলেও গুপ্তপথটির কথা ল্যাংডনের স্পষ্ট মনে আছে। সিয়েনা আর সে ভেতরে ঢুকতেই যেনো মনে হলো লুকিংগ্লাসের ভেতর দিয়ে তারা দু’জন চলে যাচ্ছে পালাজ্জো ইনভিসিবিলিতে-পালাজ্জো ভেচিওর অভ্যন্তরে একটি গোপন জগত-যেখানে ঢুকতে পারতো কেবল তঙ্কালীন ডিউক আর তার ঘনিষ্ঠজনেরা।

দরজার ভেতরে ঢুকে চারপাশটা দেখে নিলো ল্যাংডন-ফ্যাকাশে পাথরের হলওয়ে, উপর দিকের সারি সারি জানালা দিয়ে আসা আলোই একমাত্র আলোর উৎস। হলওয়েটি দরজা থেকে পঞ্চাশ গজের মতো লম্বা।

এবার বাম দিকে তাকালো। ওখানে সরু একটি সিঁড়ি উঠে গেছে উপরে। মুখটা আটকে রাখা আছে শেকল দিয়ে। সিঁড়ির উপরে সতর্কীকরণ সাইন : USCITA VIETATAI

সিঁড়ির দিকেই এগিয়ে গেলো ল্যাংডন।

“না!” আৎকে উঠলো সিয়েনা। এখানে বলা আছে ‘নো এক্সিট।”

“ধন্যবাদ,” বাঁকা হাসি দিয়ে বললো ল্যাংডন। “আমি ইতালিয়ান ভাষা পড়তে জানি।”

শেকলটা হুক থেকে খুলে কাঠের দরজার হাতলের সাথে আটকে রাখলো যাতে বাইরে থেকে দরজাটা আর খোলা না যায়।

“ওহ্,” মুচকি হেসে বলে উঠলো সিয়েনা। “আইডিয়াটা খারাপ না।”

“এরফলে দরজাটা খুলতে ওদের একটু সময় লাগবে,” বললো ল্যাংডন। “তবে আমাদের অতোটা সময় লাগবে না। আমার সাথে আসো।”

.

আর্মেনিয়ার ম্যাপটি অবশেষে দরজা খুলে দিলে এজেন্ট ব্রুডার আর তার লোকজন সঙ্কীর্ণ করিডোর দিয়ে দ্রুত ঢুকে পড়লো। শেষ মাথায় কাঠের দরজাটা খুলতেই ঠাণ্ডা বাতাস এসে লাগলো ব্রুডারের চোখেমুখে, সূর্যের আলোয় দু’চোখ ঝলসে যাবার উপক্রম হলো তার।

সে পৌঁছে গেছে একটি খোলা ওয়াকওয়ে’তে, পালাজ্জোর ছাদের কোণ ঘেষে চলে গেছে। ওয়াকওয়েটার দিকে তাকালো সে, আরেকটি দরজার কাছে গিয়ে থেমেছে ওটা। প্রায় পঞ্চাশ গজ লম্বা হবে, এরপর আবার ভবনে ঢুকে পড়েছে।

ওয়াকওয়ের বাম দিকে তাকালো ব্রুডার, হল অব ফাইভ হান্ড্রেডের গম্বুজ আকৃতির ছাদটি পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। ওটা ডিঙানো অসম্ভব। এবার ডান দিকে তাকালো। ওখানকার ওয়াকওয়েটার দু’পাশে খাড়া দেয়াল চলে গেছে একেবারে নীচের দিকে। অবধারিত মৃত্যু।

সামনের দিকে তাকালো আবার। “এদিকে!”

ব্রুডার আর তার লোকজন সামনের দিকে দ্বিতীয় দরজাটার কাছে এগিয়ে গেলো, তাদের মাথার উপর সার্ভিলেন্স ড্রোন শকুনের মতো চক্কর খাচ্ছে।

দরজা দিয়ে হুরমুর করে ঢুকতেই ব্রুডার আর তার লোকজন থমকে দাঁড়ালো। একে অন্যের সাথে আরেকটুর জন্যে ধাক্কা লেগে যেতো।

তারা দাঁড়িয়ে আছে পাথরের তৈরি ছোট্ট একটি কক্ষে, প্রবেশ করার দরজাটি ছাড়া বের হবার আর কোনো দরজা বা পথ সেখানে নেই। ভেতরে দেয়ালের কাছে একটি কাঠের ডেস্ক আছে। তার উপরে দেয়ালজুড়ে রয়েছে একটি বিকৃত অবয়বের ফ্রেসকো, যেনো তাদের দিকে চেয়ে তামাশা করছে সেটা।

এটা কানাগলি।

দেয়ালে থাকা একটি প্ল্যাকার্ডে তথ্য নির্দেশিকা দেয়া আছে, সেটার দিকে ছুটে গেলো তার এক লোক। “দাঁড়ান,” বললো সে। “এটাতে বলছে এখানে একটি ফিনেস্ত্রা আছে-গোপন জানালা আর কি।”

ঘরের ভেতরটা ভালো করে দেখলো ব্রুডার কিন্তু গোপন জানালার কোনো আলামত চোখে পড়লো না। সে নিজে প্ল্যাকার্ডটা পড়ে দেখলো।

এ জায়গাটি এক সময় ডাচেস অব বিয়ানকা কাপ্লেল্লার স্টাডি ছিলো, এখানে একটি গোপন জানালাও রয়েছে-উনা ফিনো সেগরাতা-যা দিয়ে হল অব ফাইভ হান্ড্রেডে স্বামীর বক্তৃতা লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতো বিয়ানক।

ঘরটা আবারো ভালো করে দেখলো ব্রুডার। এবার তার চোখে পড়লো একটি ফুটো। দেয়ালে চমৎকারভাবে লুকিয়ে রাখা আছে সেটি। তারা কি এখান দিয়ে পালিয়েছে?

ফুটোটা দিয়ে চোখ রাখলো ব্রুডার, এটা দিয়ে কোনো মানুষের পক্ষে পালানো সম্ভব নয়, আর রবার্ট ল্যাংডনের পক্ষে তো নয়-ই। ফুটোর ওপাশে অনেক নীচে, কম করে হলেও কয়েক তলা হবে, হল অব ফাইভ হাড্রেডের মেঝেটা দেখতে পেলো সে। তাহলে ওরা গেছেটা কোথায়?

ফুটো থেকে চোখ সরিয়ে নিতেই ব্রুডারের মনে হলো সারাদিনের হতাশা জমতে জমতে এখন পাহাড়সম উঁচু হয়ে গেছে। জীবনে যেটা করে নি সেটাই করলো ব্রুডার, রেগেমেগে চিৎকার করে মাথা ঝাঁকালো উদভ্রান্তের মতো।

ছোট্ট কক্ষটিতে গর্জনের মতোই শোনালো সেটা।

নীচের হল অব ফাইভ হান্ড্রেডে ঘুরে বেড়ানো পর্যটকের দল আর পুলিশ চমকে উঠে তাকালো বহু উপরে থাকা ফুটোটার দিকে। এমন শব্দ শুনে তারা হয়তো মনে করলো ডাচেসের গোপন স্টাডিতে খাঁচায় বন্দী জন্তু-জানোয়ার রাখা হচ্ছে আজকাল।

.

সিয়েনা ব্রুকস আর রবার্ট ল্যাংডন ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে।

কয়েক মিনিট আগে ল্যাংডনের চালাকিটা দেখেছে সিয়েনা। যেখানে লেখা ছিলো নো এক্সিট সেখান দিয়েই তারা চলে এসেছে এখানে।

রবার্ট!” কিছু বুঝতে না পেরে চাপাস্বরে বললো সে। “সাইন বলছে ‘নো এক্সিট”! তাছাড়া আমরা তো নীচে যাবো!”

“তাই তো যাচ্ছি,” পেছন ফিরে বললো ল্যাংডন। “তবে কখনও কখনও নীচে যাবার জন্য তোমাকে উপরেও উঠতে হয়।” চোখ টিপে দিলো সে। “শয়তানের নাভির কথা মনে আছে?”

এসব কী বলছে সে? পেছন পেছন যেতে লাগলো সিয়েনা।

“তুমি কি ইনফার্নো পড়েছো?” জিজ্ঞেস করলো ল্যাংডন।

হ্যাঁ…সেটা সাত বছর বয়সে। মুহূর্তেই তার মনে পড়ে গেলো। “ওহ্, শয়তানের নাভি!” বললো সে। “মনে পড়েছে এখন।”

সিয়েনা বুঝতে পারলো ল্যাংডন আসলে দান্তের ইনফানেরি শেষ অংশটুকুর কথা বলছে। এইসব ক্যান্টোতে নরক থেকে দান্তের পলায়ন আর বিশালাকৃতির লোমশ শয়তানের পেট বেয়ে নাভিতে পৌঁছানোর কথা বর্ণনা করা আছে নাকি পৃথিবীর কেন্দ্রে। এমন সময় পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ শক্তি দিক পরিবর্তন করে ফেলে, আর দান্তে নীচের দিকে নামার বদলে হঠাৎ করেই উপরে উঠতে শুরু করেন।

ইনফার্নো খুব একটা মনে নেই সিয়েনার, শুধু মনে আছে পৃথিবীর অভিকর্ষ নিয়ে দান্তের বর্ণনা তাকে হতাশ করেছিলো। দান্তে যতো জিনিয়াসই হয়ে থাকুন কেন পদার্থ বিজ্ঞানের ভেক্টর শক্তিগুলো পুরোপুরি বুঝতেন না।

সিঁড়ির উপরে উঠে গেলো তারা। ওখানে যে একমাত্র দরজাটা আছে খুললো ল্যাংডন। সেটাতে লেখা আছে : সালা দেই মোদেল্লি দি আর্কিতেওরা।

সিয়েনা ঢোকার পর দরজাটা বন্ধ করে দিলো ল্যাংডন।

ঘরটা বেশ ছোটো আরা সাদামাটা। কয়েকটি কাঠের কেস রাখা সেখানে, ওগুলোর ভেতরে রাখা আছে কিছু কাঠের মেডেল। পালাজ্জোর নক্সা করার জন্য ভাসারি যেসব মডেল করেছিলেন সেগুলোই এখানে প্রদর্শন করা হয়েছে। মডেলগুলোর দিকে খুব একটা তাকালো না সিয়েনা। তার দৃষ্টি ঘুরপাক খেতে লাগলো ঘরের চারপাশে। যেমনটি সাইনে লেখা ছিলো : কোনো দরজা নেই, জানালাও নেই…নো এক্সিট।

“১৩০০ সালের মাঝামাঝি সময়ে,” ল্যাংডন আস্তে করে বললো, “এথেন্সের ডিউক শত্রুর আক্রমণের ভয়ে পালাবার জন্য গোপন পথ তৈরি করেন প্রাসাদে। এটাকে বলা হয় এথেন্সের ডিউকের সিঁড়ি। এটা নেমে গেছে নীচের একটা সরু গলিতে, ছোট্ট একটা হ্যাঁচের মধ্যে। আমরা যদি ওখানে চলে যেতে পারি তাহলে কেউ আমাদেকে বের হতে দেখবে না।” মডেলগুলোর মধ্যে একটার দিকে। ইঙ্গিত করলো সে। “দ্যাখো, এটার পাশে খেয়াল করো?”

ও আমাকে উপরে নিয়ে এসে মডেল দেখাচ্ছে!

ক্ষুদাকৃতির মডেলে সিয়েনা দেখতে পেলো প্রাসাদের উপর থেকে একটা সিঁড়ি নেমে গেছে নীচের রাস্তায়, চমৎকারভাবেই সেটা ভবনের দেয়ালের আড়ালে লুকানো।

“আমি সিঁড়িটা দেখতে পাচ্ছি, রবার্ট,” বললো সিয়েনা। “কিন্তু ওটা তো এই ভবনের একেবারে উল্টো দিকে অবস্থিত। আমরা কখনও ওখানে যেতে পারবো না!”

“একটু বিশ্বাস রাখো, বাঁকা হাসি দিয়ে বললো সে।

নীচতলা থেকে প্রচন্ড একটা শব্দ হলো এ সময়। এর একটাই অর্থ, আর্মেনিয়ার ম্যাপটি আবারো ব্যবহার করা হয়েছে। দাঁড়িয়ে থেকে কান পাতলো তারা। পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলো। সেনারা উঠে আসছে।

নীচ থেকে পায়ের আওয়াজগুলো মিইয়ে যেতেই ল্যাংডন বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে এক্সিবিট রুমের বিভিন্ন ডিসপ্লে অতিক্রম করে অন্যপ্রান্তের দেয়ালে বিশাল একটি কাপবোর্ড সদৃশ্য জিনিসের সামনে চলে এলো। কাপবোর্ডটি এক বর্গগজের মতো আয়তনের, মেঝে থেকে তিন ফুট উপরে অবস্থিত। কোনো রকম দ্বিধা না করেই ল্যাংডন হাতটা ধরে টান মেরে দরজা খুলে ফেললো।

বিস্ময়ে এক পা পিছিয়ে গেলো সিয়েনা।

জায়গাটা দেখে মনে হলো গুহার মতোই কিছু একটা…যেনো কাপবোর্ডের দরজাটা অন্য এক জগতের দুয়ার খুলে দিয়েছে তাদের সামনে। ওপাশে শুধুই অন্ধকার।

“আমার সাথে সাথে আসো,” বললো ল্যাংডন।

দরজার কাছেই দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা আছে একটি ফ্ল্যাশলাইট, সেটা হাতে নিয়ে বিস্ময়কর ক্ষিপ্রতায় প্রফেসর ঢুকে পড়লো সেই অন্ধকার গর্তে!

.

অধ্যায় ৪৬

লা সোফিত্তা, ভাবলো ল্যাংডন। এ বিশ্বের সবচাইতে নাটকীয় চিলেকোঠা।

অন্ধকার জায়গাটার ভেতরে বাতাস গুমোট আর অতি প্রাচীন, যেনো শত শত বছরের প্লাস্টারগুলো আর দেয়ালে আটকে না থেকে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। ফাঁকা জায়গাটায় খ্যাচ খ্যাচ করে শব্দ হচ্ছে, ল্যাংডনের মনে হলো বিশাল কোনো জম্ভর পেট বেয়ে উঠে যাচ্ছে সে।

সমতল জায়গায় চলে আসামাত্র হাতের ফ্ল্যাশলাইটটা জ্বালালো ল্যাংডন। অন্ধকার বিদীর্ণ করলো সেটার আলোক রশ্মি।

তার চোখের সামনে যেনো অন্তহীন এক টানেল চলে গেছে। জায়গায় জায়গায় মাকড়ের জাল রয়েছে, আরো আছে হল অব ফাইভ হান্ড্রেডের বিম, কর্ড আর অন্যান্য স্থাপনার কঙ্কালসদৃশ্য কাঠামোর উন্মুক্ত রূপ।

কয়েক বছর আগে ল্যাংডন নেব্বিওলো খেয়ে সিক্রেট প্যাসেজ টুরে এখানে এসেছিলো। তখন দেখেছিলো, আর্কিটেকচারাল মডেল রুমে দেয়াল কেটে কাপবোর্ডসদৃশ্য যে জানালা রয়েছে সেটা দিয়ে ফ্ল্যাশলাইটের আলো ফেলে দর্শনার্থীরা এই ভবনের কাঠামোটির সুনিপুণ কাজ দেখতে পায়।

সিয়েনার পক্ষে এরকম জায়গা দিয়ে চলাচল করাটা কষ্টকর বলে ল্যাংডন তার ফ্ল্যাশলাইটটি সামনে পেছনে ফেলতে লাগলো পথটা পরিস্কারভাবে দেখানোর জন্য।

এ প্রান্তে টানেলটির নীচে কোনো মেঝে নেই, অসংখ্য আনুভূমিক সাপোর্টিং বিমগুলোর উপর দিয়ে চলে যেতে হচ্ছে ওদের, এটা অনেকটা রেললাইনের উপর দিয়ে যাবার মতো।

সামনের একটি লম্বা শ্যাফটের দিকে ইঙ্গিত করে চাপাকণ্ঠে বললো ল্যাংডন, “এ জায়গাটা হল অব ফাইভ হান্ড্রেডের ঠিক উপরে। আমরা যদি ঐ প্রান্তে চলে যেতে পারি তাহলে এথেন্সের ডিউকের সিঁড়িতে কিভাবে যেতে হয় সেটা আমি জানি।”

তাদের সামনে অসংখ্য বিম আর সাপোর্টের যে গোলকধাঁধাটি আছে তার। দিকে সন্দের দৃষ্টিতে তাকালো সিয়েনা। তার কাছে মনে হলো এই মাচাঙের মতো জায়গা দিয়ে সামনের দিকে এগোতে হলে বাচ্চারা যেভাবে রেললাইনের উপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে এগোয় সেভাবে যেতে হবে। বিম আর সাপোর্টগুলো বেশ বড়, খুব সহজেই ওগুলোর উপর দিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করে চলাচল করা সম্ভব কিন্তু সমস্যা একটাই, বিম আর সাপোর্টগুলো এতো দূরে দূরে অবস্থিত যে লাফ দিয়ে নিরাপদে পার হওয়া কঠিন।

“মনে হয় না এক বিম থেকে আরেক বিমে লাফ দিয়ে এগোতে পারবো,” নীচুস্বরে বললো সিয়েনা।

ল্যাংডন নিজেও এ নিয়ে সন্দিহান। এখান থেকে নীচে পড়ে যাওয়া মানে নির্ঘাত মৃত্যু। দুটো বিমের মাঝখানে ফ্ল্যাশলাইটের আলো ফেললো সে।

আট ফিট নীচে, লোহর রডে ঝুলে আছে একটি পাটাতন-অনেকটা ফ্লোরের মতো-ওটা চলে গেছে যতোদূর তাদের চোখ যায়। তবে দেখে মনে হচ্ছে খুব একটা মজবুত আর দৃঢ় নয়। ধুলো জমে একাকার।

পাটাতনটি দেখিয়ে সিয়েনা বললো, “আমরা কি ওটা দিয়ে হেঁটে যেতে পারবো?”

যদি না তুমি এখান থেকে পড়ে নীচের হল অব ফাইভ হান্ড্রেডে পড়তে চাও।

“সত্যি বলতে কি, এরচেয়ে ভালো পথ আছে,” শান্তকণ্ঠে বললো ল্যাংডন। মেয়েটাকে ভয় পাইয়ে দিতে চাইছে না। বিমগুলো টপকে আরো সামনে এগোতে লাগলো সে। তার লক্ষ্য মাঝখানে যাওয়া।

তার আগের সফরে এসে আর্কিটেকচারাল মডেল রুমের ভিউয়িং জানালা দিয়ে দেখেছিলো এই টানেলের মতো মাচাঙটির মাঝখানে পায়ে হাটার পাটাতন রয়েছে, ওটা দিয়ে হেঁটে আরেকটা দরজা পেরিয়ে বিপরীত দিকের অ্যাটিক তথা চিলেকোঠায় যাওয়া যায়। কড়া মদ খাওয়া স্মৃতিটা যদি তার সাথে প্রতারনা না করে তাহলে এই মাচাঙের মাঝখানে একটা পাটাতন রয়েছে।

কিন্তু ল্যাংডন বিম আর সাপোর্টগুলো ডিঙিয়ে মাঝখানে চলে এসে জায়গামতো একটি পাটাতন দেখতে পেলো ঠিকই কিন্তু সেটা তার স্মৃতির সাথে একদমই বেমানান।

ঐ দিন আসলে কতোটুকু নেৰ্বিওলো পান করেছিলাম আমি?

রবার্ট ল্যাংডন চেয়ে আছে পাতলা কাঠের সরু একটি পাটাতনের দিকে। বিমগুলোর উপর সেটা আড়াআড়িভাবে ফেলে একটা ক্যাটওয়াকের মতো পথ তৈরি করা হয়েছে-পায়ে হাটা ব্রিজের চেয়ে সার্কাসের টাইট-রোপের সাথেই এর মিল বেশি।

এই নড়বরে দূর্বল কাটামোটি তৈরি করা হয়েছে ইঞ্জিনিয়াররা যেনো মেরামতের কাজের জন্য চলাচল করতে পারে।

“মনে হচ্ছে এই পাতলা বোর্ডের উপর দিয়ে হেঁটে যেতে হবে,” সরু বোর্ডের দিকে দ্বিধাগ্রস্তভাবে চেয়ে বললো ল্যাংডন।

কাঁধ তুললো সিয়েনা। তাকে অবশ্য নির্বিকার দেখাচ্ছে। “বন্যার সময় ভেনিসের যে অবস্থা হয় এটা তারচেয়ে বেশি খারাপ নয়।”

ল্যাংডন বুঝতে পারলো মেয়েটি সত্যি কথাই বলেছে। সাম্প্রতিক সময়ে ভেনিসের সেন্ট মার্কস স্কয়ারে সে গেছিলো প্রায় একফুট পানি ডিঙিয়ে। তার হোটেল থেকে ঐ ব্যাসিলিকায় যেতে হয়েছিলো এরকমই সরু আর পাতলা কাঠের পাটাতনের উপর দিয়ে। সিলিন্ডার আকৃতির ব্লক আর প্লাস্টিকের বালতি উপুড় করে তার উপর পাতলা কাঠের পাটাতন বিছিয়ে বানানো হয়েছিলো একটি ব্রিজ! নিজের প্রিয় জুতোটি ভিজে গেলেও মনে মনে সান্ত্বনা দিয়েছিলো, রেনেসাঁ যুগের একটি মাস্টারপিস দেখার জন্য একটি লোফার নষ্ট করা কী আর এমন।

এসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে সরু পাটাতনের উপর দিয়ে এগোতে শুরু করলো ল্যাংডন। মনে মনে আশা করলো সিয়েনা যেনো উদ্বিগ্ন বোধ না করে। অবশ্য সে জানে, বাইরে থেকে যতোটা আত্মবিশ্বাসীই দেখাক না কেন, ভেতরে ভেতরে সে ভয় পাচ্ছে। প্রতিটি পদক্ষেপে তার হৃদকম্পন বাড়ছে সমান তালে। পাটাতনের মাঝখানে চলে এলে তার ওজনের ভারে নাজুক পাটাতনটি দেবে গেলো কিছুটা। খ্যাচ করে একটা শব্দও হলো। সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত এগোতে শুরু করলো আবার। অবশেষে নির্বিঘ্নেই পৌঁছে গেলো অন্যপ্রান্তে।

হাফ ছেড়ে বাঁচলো সে। ঘুরে তাকালো সিয়েনার দিকে। ফ্ল্যাশলাইটের আলো ফেলে মেয়েটাকে সাহস দেবার জন্য কিছু বলতে যাবে, কিন্তু দেখতে পেলো সে ভয়ডরহীনভাবে এগিয়ে আসছে। তার এসবের কোনো দরকারই নেই। সিয়েনার হালকাঁপাতলা গড়নের কারণে পাটাতনটি যেমন দেবে গেলো না, তেমনি খ্যাচ করে ভীতিকর কোনো শব্দও হলো না। খুব সহজেই সে চলে এলো। এ প্রান্তে।

নতুন উদ্যমে ল্যাংডন এবার দ্বিতীয় পাটাতনের দিকে পা বাড়ালো। তার পৌঁছানোর আগপর্যন্ত অপেক্ষা করলো সিয়েনা। ল্যাংডন তার জন্যে আলো ফেললে সে আবার শুরু করলো এগোতে। এভাবে একটা মাত্র ফ্ল্যাশলাইটের সাহায্যে পালাক্রমে তারা ধীরে ধীরে এগিয়ে যেত লাগলো মাচাঙসদৃশ্য পথ দিয়ে। তাদের নীচে পুলিশের ওয়াকিটকির শব্দ ছাদ পর্যন্ত চলে আসছে।

ল্যাংডনের ঠোঁটে মুচকি হাসি ফুটে উঠলো। আমরা হল অব দি ফাইভ হাড্রেডের উপরে ভাসছি, ভরহীন আর অদৃশ্য হয়ে।

রবার্ট,” সিয়েনা চাপাকণ্ঠে বললো। “তুমি বলছো, ইগনাজিও তোমাকে বলে গেছেন মুখোশটা কোথায় খুঁজে পাবে?”

“হ্যাঁ…তবে সাংকেতিক ভাষায়।” ল্যাংডন দ্রুত বলে গেলো ইগনাজিও চান নি মুখোশের অবস্থানের কথাগুলো অ্যালারিং মেশিনে রেকর্ড হয়ে থাকুক। তাই অনেকটা সাংকেতিকভাবেই তথ্যটা তাকে জানিয়ে গেছেন। “উনি প্যারাডাইস এর কথা বলেছেন, আমি ধারণা করছি ডিভাইন কমেডির শেষ অংশকেই বুঝিয়েছেন। তার কথাটা ছিলো ‘প্যারাডাইজ পঁচিশ।”

সিয়েনা তার দিকে তাকালো। “উনি নিশ্চয় পঁচিশ নাম্বার ক্যান্টোর কথা বলেছেন।”

“আমিও তাই মনে করছি,” বললো ল্যাংডন। মহাকাব্যের একটি ক্যান্টোকে অধ্যায়ের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। ডিভাইন কমেডি’র তিনটি অংশে মোট একশতটি ক্যান্টো রয়েছে।

ইনফার্নো ১-৩৪
পারগেটরিও ১-৩৩
পারাদিসো ১-৩৩

প্যারাডাইস পঁচিশ, ভাবলো ল্যাংডন। আশা করলো তার তীক্ষ্ণ স্মৃতিশক্তি পুরো মহাকাব্যটি স্মরণ করতে সক্ষম হবে। কিন্তু ধারেকাছেও না-আমাদের দরকার এক কপি ডিভাইন কমেডি।

“আরো ব্যাপার আছে,” বলতে লাগলো সে। “ইগনাজিও আমাকে শেষ যে কথাটা বলেছেন সেটা হলো : দরজাটা খোলা আছে তোমার জন্য, তবে খুব দ্রুত করতে হবে। “ একটু থেমে সিয়েনার দিকে তাকালো সে। “ক্যান্টো পঁচিশে সম্ভবত ফ্লোরেন্সের নির্দিষ্ট একটি জায়গার কথা বলা আছে। দরজা আছে এরকম একটি জায়গা।”

কপালে চোখ তুললো সিয়েনা। “কিন্তু এই শহরে কয়েক ডজন দরজা রয়েছে।”

“হ্যাঁ, সেজন্যেই প্যারাডাইস-এর ক্যান্টো পঁচিশ আমাদের পড়ে দেখতে হবে।” আশাব্যঞ্জক হাসি দিলো সে। “নিশ্চয় ডিভাইন কমেডি’র পুরোটা তোমার মুখস্ত নেই, নাকি আছে?”

হতভম্ব হয়ে তাকালো মেয়েটি। “আকাইক ইতালিয়ান ভাষায় লেখা চৌদ্দ হাজার লাইন, আমি পড়েছিলাম সেই কবে, শৈশবে।” মাথা ঝাঁকালো সে। “তুমি হলে অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী, প্রফেসর। আর আমি নিতান্তই একজন ডাক্তার।”

তারা এগোতে থাকলে ল্যাংডন ভাবলো, এতোক্ষণ ধরে তারা দুজন একসাথে অনেক বাধা-বিপত্তি পেরোলেও সিয়েনা এখনও নিজের অসাধারণ মস্তিষ্কের যে ক্ষমতা আছে সে-কথাটা চেপে যাচ্ছে। নিতান্তই একজন ডাক্তার? ল্যাংডন মুচকি হাসলো আপন মনে। এ পৃথিবীর সবচাইতে বিনয়ী ডাক্তার, ভাবলো সে। পেপার ক্লিপিংগুলোর কথা মনে করলো। অসাধারণ স্মৃতিশক্তি এই মেয়ের। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো সেই স্মৃতিও এ পৃথিবীর সবচাইতে দীর্ঘ কবিতা মুখস্ত করার জন্য যথেষ্ট নয়।

চুপচাপ তারা দু’জন আরো কয়েকটি বিম পেরিয়ে গেলো সামনের দিকে। অবশেষে অন্ধকারে সামনের দিকে একটা হৃদয় আকৃতির খোপ দেখলো ল্যাংডন। ভিউয়িং প্লাটফর্ম! এখান থেকে পাটাতনটি বেশ শক্তপোক্ত হয়ে চলে গেছে দরজা পর্যন্ত। এমনকি এইটুকু পথে রেলিংও দেয়া আছে। ল্যাংডন জানে এথেন্সের ডিউকের সিঁড়িটা খুব কাছেই।

আরেকটু এগোতেই ল্যাংডন নীচে তাকিয়ে দেখতে পেলো মাত্র আট ফুট নীচে লুনেটটা। এই ভবনের ছাদে যেসব সুনেট, অর্থাৎ অর্ধ-বৃত্তাকারের ক্যানভাস আছে সেগুলো দেখতে প্রায় একই রকম। কিন্তু সামনের লুনেটটা অন্যগুলোর তুলনায় বেশ বড়।

দ্য অ্যাপোথিসিস অব কসিমো ফাস্ট, ল্যাংডন মনে মনে বললো। এই বিশাল আকৃতির লুনেটটা ভাসারির সবচেয়ে দামি পেইন্টিং-হল অব দি ফাইভ হান্ড্রেডের গম্বুজাকৃতির ছাদের মাঝখানের লুনেটটা। ল্যাংডন প্রায়ই তার ছাত্রছাত্রিদেরকে এটা স্লাইডের মাধ্যমে দেখিয়ে থাকে। এর সাথে যে আমেরিকার ক্যাপিটলের অ্যাপোথিওসিস অব ওয়াশিংটন-এর বেশ মিল রয়েছে সেটা উল্লেখ করতেও ভোলে না। অপেক্ষাকৃত নব্য রাষ্ট্র আমেরিকা যে কেবল ইটালির কাছ থেকে রিপাবলিকের ধারণাটিই পায় নি তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ এটি।

আজ ল্যাংডন অবশ্য অ্যাপোথিওসিসটা স্টাডি করার চাইতে যতো দ্রুত সম্ভব অতিক্রম করতেই বেশি ব্যগ্র। যেতে যেতে পেছন ফিরে সিয়েনাকে বললো তারা প্রায় পৌঁছে গেছে।

এটা করতে গিয়ে ডান পাটা ফসকে গেলো পাটাতন থেকে, হুরমুর করে সামনের দিকে পড়ে যেতে উদ্যত ল্যাংডন কিন্তু কোনো রকমে নিজের ভারসাম্য রক্ষা করতে পারলো উপুড় হয়ে বসে পড়ে।

তবে বড় দেরি হয়ে গেছে।

তার হাটুর আঘাতে পাটাতনটি নড়ে উঠলো, দু’হাত দিয়ে সামনের একটা বিম ধরে ফেললো সে। হাতের ফ্ল্যাশলাইটটা পড়ে গেলো নীচের ক্যানভাসের উপর। জালের মতোই সেটা কাজ করলো। ফ্ল্যাশলাইটা আটকে রইলো সেখানে। ল্যাংডন তড়িঘড়ি একটা বিমের উপর উঠতেই পাতলা কাঠের পাটাতনটি আট ফিট নীচে ভাসারির অ্যাপোথিসিস-এর ক্যানভাসের ফ্রেমের কাঠের উপর গিয়ে পড়লো।

শব্দটা প্রতিধ্বনি হলো মাচাঙের উপরে।

নিজের পায়ে দাঁড়াতেই সিয়েনার দিকে তাকালো ল্যাংডন। একেবারে ভড়কে গেছে সে।

নীচের ক্যানভাসের উপর পড়ে থাকা ফ্ল্যাশলাইটের মৃদু আলোতে ল্যাংডন দেখতে পেলো সিয়েনা তার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু তার সামনে

কোনো পাটাতন নেই। ওটা পড়ে গেছে নীচে। এতো বড় ফাঁক পার হওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। তার চোখ দেখে ল্যাংডন বুঝতে পারলো সেও বুঝে গেছে কি ঘটেছে।

.

ভায়েন্থার চোখ চলে গেলো নক্সা করা গম্বুজের ছাদের দিকে।

“অ্যাটিকে ইঁদুর আছে নাকি?” কাছে ক্যামকর্ডার হাতে দাঁড়িয়ে থাকা এক লোক ঠাট্টা করে বললো।

অনেক বড় ইঁদুর, মনে মনে বললো ভায়েন্থা। হলের ছাদে বৃত্তাকারের পেইন্টিংটার দিকে তাকালো সে। ক্যানভাস থেকে একটু ধুলোও পড়লো নীচে। ভায়েন্থা দেখতে পেলো ক্যানভাসের একটি জায়গা ঝুলে গেছে, কোনো কিছু পড়ে থাকার আলামত…যেনো অন্যদিক থেকে কেউ ধাক্কা দিয়েছে।

“সম্ভবত পুলিশ অফিসারদের কারোর পিস্তল পড়ে গেছে ওটার উপর, উপরের দিকে চেয়ে ক্যামকর্ডার হাতে লোকটি বললো। “তারা আসলে কি খুঁজছে বলে মনে করেন? ওদের কাজকারবার দেখে তো খুবই উত্তেজনা বোধ করছি।”

“ওটা কি একটা ভিউয়িং প্লাটফর্ম?” জানতে চাইলো ভায়েন্থা। “লোকজন ওখানে যেতে পারে?”

“অবশ্য পারে।” জাদুঘরের প্রবেশদ্বারের দিকে ইঙ্গিত করলো সে। “ওই দরজাটার ভেতরে আরেকটা দরজা আছে, একটা ক্যাটওয়াকের মাধ্যমে অ্যাটিকে যাওয়া যায়। ওখানে গেলে আপনি ভাসারির ফ্রেমের কাঠামোটি দেখতে পাবেন। অসাধারণ সুন্দর।”

হল অব দি ফাইভ হান্ড্রেড ব্রুডারের গলা শোনা গেলো আচমকা। “ওরা তাহলে গেলো কোথায়?!”

কিছুক্ষণ আগে গগনবিদারি চিৎকারের মতোই তার কণ্ঠে তীব্র ক্ষোভ টের পাওয়া গেলো। পাশের একটা ঘরেই আছে সে। ভায়েন্থা স্পষ্ট শুনতে পেলো তার কথা।

আবারো ছাদের উপরে থাকা ক্যানভাসের দিকে তাকালো সে। অ্যাটিকে ইঁদুর আছে, ভাবলো। পালাবার পথ খুঁজে বেড়াচ্ছে তারা।

ক্যামকর্ডার হাতে থাকা লোকটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে সে জাদুঘরের প্রবেশদ্বারের দিকে ছুটে গেলো। দরজাটা বন্ধ, কিন্তু পুলিশ অফিসারদের আনাগোনার কারণে অনুমাণ করলো ওটা লক করা নেই।

তার অনুমাণই সত্যি প্রমাণিত হলো।

.

অধ্যায় ৪৭

পিয়াজ্জার বাইরে পুলিশের আগমনের পর যে হট্টগোল শুরু হয়ে গেছে তার মধ্যে মাঝবয়সী এক লোক লগ্নিয়া দেই লানজির অন্ধকারাচ্ছন্ন কোণে দাঁড়িয়ে গভীর মনোযোগর সাথে সব কর্মকাণ্ড দেখে যাচ্ছে। তার চোখে পাতলা ফ্রেমের চশমা, উলের তৈরি নেকটাই আর এক কানে পরে আছে স্বর্ণের একটি পিন।

এসব দেখতে দেখতে ঘাড় চুলকাতে শুরু করলো সে। এক রাতের মধ্যে তার শরীরে লালচে ছোপ জন্মেছে, আর সেটা খারাপের দিকেই যাচ্ছে ক্রমশ। চোয়ালের দিকে, গালে আর চোখের নীচে কিছু লালচে গোটাও উঠেছে।

আঙুলের নখের দিকে যখন তাকালে দেখতে পেলো ওগুলো রক্ত-লাল হয়ে আছে। পানির মতো চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্তও পড়ছে সেখান থেকে। পকেট থেকে রুমাল বের করে আঙুলগুলো মুছে নিলো, ঘাড় আর গালের গোটাগুলোর উপর রুমাল চেপে ধরলো সে।

গোটাগুলো পরিস্কার করার পর আবারো তাকালো পালাজ্জোর বাইরে পার্ক করা কালো রঙের দুটো ভ্যানের দিকে। কাছের ভ্যানটার পেছনের সিটে দু’জন লোক আছে।

একজন কালো পোশাকের সশস্ত্র সৈনিক।

অন্যজন একটু বয়স্ক তবে সাদা-চুলের অপরূপ সুন্দরী এক মহিলা, সে পরে আছে নীল রঙের নেকলেস। সৈনিকটিকে দেখে মনে হচ্ছে সে একটা সিরিঞ্জ প্রস্তুত করছে।

ভ্যানের ভেতরে ডা: এলিজাবেথ সিনস্কি পালাজ্জোর দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো কিভাবে এই সঙ্কটটি এতো খারাপের দিকে গেলো।

“ম্যাম,” সৈনিকটি গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো।

ঘোরলাগা চোখে সৈনিকের দিকে তাকালো ডাক্তার। তার বাহুটা ধরে রেখেছে শক্ত করে। অন্য হাতে সিরিঞ্জ। “নড়বেন না।”

ইনজেকশনটা দিয়ে দিলো সৈনিক। “আবার ঘুমাতে যান।”

চোখ বন্ধ করতেই তার মনে হলো অন্ধকার থেকে এক লোক তার দিকে চেয়ে আছে। তার চোখে হালকা ফ্রেমের চশমা আর গলায় নেকটাই। মুখটা লালচে ছোপে ভরে আছে। কয়েক মুহূর্তের জন্য তার মনে হলো লোকটাকে সে চেনে, কিন্তু আবারো চোখ মেলে যখন তাকালো দেখতে পেলো লোকটা নেই। উধাও হয়ে গেছে।

.

অধ্যায় ৪৮

চিলেকোঠার মাচাঙের উপর অন্ধকারে ল্যাংডন আর সিয়েনা এখন একে অন্যের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন। দু’জনের মধ্যে প্রায় বিশ ফুটের মতো ফাঁকা জায়গা। তাদের আট ফিট নীচে বিচ্ছিন্ন হওয়া পাটাতনের টুকরোটি ভাসারির অ্যাপোথিওসিস-এর ক্যানভাসের উপর পড়ে আছে। ওখানে আরো পড়ে আছে ফ্ল্যাশলাইটটি, সেটি এখনও জ্বলছে। ফলে ক্যানভাসের উপর ছোটোখাটো জ্বলজ্বলে পাথরের মতো লাগছে সেটা।

“তোমার পেছনে যে পাটাতনটি আছে,” নীচুস্বরে বললো ল্যাংডন। “ওটা কি টেনে এ পর্যন্ত নিয়ে আসতে পারবে?”

পাটাতনটির দিকে তাকালো সিয়েনা। “অন্যপ্রান্তটি নীচে পড়ে যাবে তাহলে।”

ল্যাংডন নিজেও এই ভয়টা করছিলো। তারা দুজন এখান থেকে ভাসারির ক্যানভাসের উপর পড়ে যাক সেটা কোনোভাবেই চাইছে না।

“আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে, বিমগুলো যেসব দেয়ালসসংলগ্ন সরু কাঠের উপর দিয়ে চলে গেছে এখন সেখান দিয়ে এগোতে লাগলো সে। ল্যাংডনও বিমগুলো সাবধানে টপকাতে শুরু করলো ফ্ল্যাশলাইটের আলো ছাড়া। তারা দু’জন পাশের দেয়ালের কাছে ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে চলে এলো।

“নীচে,” আস্তে করে বললো সিয়েনা, তাদের নীচে অস্পষ্ট গহ্বরটি দেখালো। “ফ্রেমের শেষ মাথায়। ওখানকার দেয়াল অবশ্যই একটু বেশি মোটা, কারণ দেয়ালের ঐ জায়গাটায় ফ্রেমের সাপোর্টগুলো ঠেক দেয়া হয়েছে। ওখান দিয়ে আমি আস্তে আস্তে এগোতে পারবো।”

ল্যাংডন কিছু বলার আগেই সিয়েনা বিম আর সাপোর্টগুলো ধরে নীচে নেমে গেলো। ওগুলোকে সে ব্যবহার করলো অনেকটা মইয়ের মতো। নীচের একটি কাঠের সাপোর্টিং বিমের উপর পা রাখতেই খ্যাচ করে শব্দ করলো, তবে সেটা সিয়েনার হালকা-পাতলা দেহ ধরে রাখতে সক্ষম হলো। এরপর দেয়ালের ফিত অংশে পা দিয়ে একটু একটু করে এগোতে লাগলো ল্যাংডনের দিকে, যেনো কোনো ভবনের কার্নিশ দিয়ে এগিয়ে আসছে সে।

নাজুক বরফ, মনে মনে বললো ল্যাংডন। তীরের কাছাকাছি থাকো।

অবশেষে সিয়েনা পৌঁছে গেলো ল্যাংডনের ঠিক নীচে। নতুন করে আশার আলো দেখতে পেলো সিম্বলজিস্ট। সম্ভবত তারা সত্যি সত্যি এখান থেকে বের হতে পারবে এবার।

আচমকা তাদের সামনে ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে দরজা খোলার শব্দ শুনতে পেলো ল্যাংডন। দ্রুত পদক্ষেপে কেউ এগিয়ে আসছে ওয়াকওয়ে দিয়ে। এবার একটি ফ্ল্যাশলাইটের আলো দেখা গেলো, অন্ধকার জায়গাটির এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতে লাগলো সেই আলোকরশ্মি। প্রতি মুহূর্তে সেটা তাদের কাছে এগিয়ে আসছে। আবারো হতাশায় ডুবে যেতে শুরু করলো ল্যাংডন। কেউ তাদের দিকে আসছে-মেইন ওয়াকওয়েটা দিয়ে এগিয়ে আসছে সে, তাদের পালাবার পথ রুদ্ধ করে দিয়ে।

“সিয়েনা, থেমো না। আসতে থাকো,” বললো সে। “পুরো দেয়ালটা পার হও। শেষ মাথায় একটা এক্সিট আছে। ওখান দিয়ে যে আসছে আমি তাকে সামলাচ্ছি।”

“না!” চাপাস্বরে বেশ তাড়া দিয়ে বললো সিয়েনা। “রবার্ট, যেও না। ফিরে আসো!”

কিন্তু ততোক্ষণে ল্যাংডন রওনা দিয়ে দিয়েছে। পাটাতনের মাঝখানে চলে যাচ্ছে সে, তার আট ফুট নীচে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে সিয়েনা।

মাচাঙের মাঝখানে পৌঁছানো মাত্রই ফ্ল্যাশলাইট হাতে আবছায়া একটি অবয়ব এসে দাঁড়ালো ভিউয়িং প্লাটফর্মের উপরে। এক হাতে নীচু রেলিংটা ধরে রেখেছে সে, অন্য হাতে ফ্ল্যাশলাইট, সেটার আলো সরাসরি ল্যাংডনের মুখের উপর পড়লো।

তীব্র আলোয় চোখ কুচকে ফেললো ল্যাংডন, দেরি না করে দু’হাত তুলে আত্মসমর্পণ করলো সে। আর কখনও নিজেকে এতোটা বিপদগ্রস্ত মনে হয় নি। তার-হল অব দি ফাইভ হান্ড্রেড-এর উপরে কোনো রকম ভারসাম্য রক্ষা করে দাঁড়িয়ে আছে, আর তার চোখ বিদীর্ণ করছে তীব্র আলোকরশ্মি।

লাংডনের মনে হলো এই বুঝি গুলি করা হবে তাকে লক্ষ্য করে কিংবা। আদেশের সুরে বলবে আত্মসমর্পণ করতে কিন্তু কিছুই হলো না। কয়েক মুহূর্তের নীরবতা নেমে এলো যেনো। এবার ফ্ল্যাশের আলো তার মুখ থেকে সরে পেছনের অন্ধকারে গিয়ে পড়লো। বোঝাই যাচ্ছে তার পেছনে কে আছে সেটা খুঁজে দেখছে। চোখের উপর থেকে আলোটা সরে যেতেই ল্যাংডন দেখতে পেলো আবছায়া অবয়বটি তাদের পালাবার পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে। অবয়বটি এক নারীর। হালকা-পাতলা দেহ, কালো রঙের পোশাক পরা। তার মাথার বেসবল ক্যাপটার নীচে যে স্পাইক করা চুল আছে সেটা বুঝতে কষ্ট হলো না ল্যাংডনের।

সিম্বলজিস্টের সারা শরীর আড়ষ্ট হয়ে গেলো.। সঙ্গে সঙ্গে একগাদা ছবি এসে ভীড় করলো তার চোখের সামনে। ডাক্তার মারকোনি হাসপাতালের মেঝেতে পড়ে কাতরাচ্ছে।

মেয়েটা আমাদেরকে খুঁজে পেয়েছে। এখন সে তার অসমাপ্ত কাজ শেষ করবে।

গ্রিক ডাইভারদের ছবিটা ভেসে উঠলো তার মনের পর্দায়, যারা সাগরের তলদেশে টানেলের ভেতর দিয়ে সাঁতার কাটার সময় শেষমাথায় গিয়ে পাথরের দেয়ালের সম্মুখিন হতো।

খুনি তার ফ্ল্যাশলাইটটা আবারো ল্যাংডনের মুখের উপর ফেললো।

“মি: ল্যাংডন,” চাপাস্বরে বললো সে। “আপনার বন্ধু কোথায়?”

আৎকে উঠলো ল্যাংডন। এই খুনি আমাদের দুজনকে শেষ করতে এসেছে এখানে।

ল্যাংডন তার পেছন ফিরে একটু তাকালো। খুনিকে বোঝাতে চাইলে সিয়েনা পেছনে কোথাও আছে। “এসবের সাথে ওর কোনো সম্পর্ক নেই। তুমি তো আমাকে চাও, তাই না?”

মনে মনে ল্যাংডন প্রার্থনা করলো সিয়েনা যেনো দেয়াল ধরে ধরে এগিয়ে যেতে থাকে। নিঃশব্দে ভিউয়িং প্লাটফর্মটা পেরিয়ে যদি আরেকটু সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে তাহলে মাঝখানের ব্রডওয়াকে ফিরে যেতে পারবে, ঠিক স্পাইক করা মেয়েটির পেছনে। সেখান থেকে খুব সহজেই চলে যেতে পারবে দরজার কাছে।

আবারো তার পেছনে আলো ফেলে অন্ধকারে খুঁজে বেড়ালো খুনি। চোখের সামনে থেকে আলো সরে যেতেই কয়েক মুহূর্তের জন্য মেয়েটিকে দেখতে পেলো ল্যাংডন, তার পেছনে ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে আরেকটা অবয়ব।

ওহ্ ঈশ্বর, না!

সিয়েনা আসলেই দেয়াল ধরে ধরে মাঝখানের ব্রডওয়াকের দিকে চলে গেছে কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো সে তাদের আক্রমণকারীর থেকে মাত্র দশ গজ দূরে।

সিয়েনা, না! তুমি খুব কাছে চলে এসেছে! ও তোমার আওয়াজ শুনতে পাবে!

আবারো ফ্লাশলাইটের আলো এসে পড়লো লাংডনের উপরে।

“আমার কথা মন দিয়ে শুনুন, প্রফেসর,” খুনি ফিসফিসিয়ে বললো। “আপনি যদি প্রাণে বাঁচতে চান তাহলে আমি বলবো আমাকে বিশ্বাস করুন। আমার মিশনটি বাতিল হয়ে গেছে। আপনার ক্ষতি করার কোনো কারণ নেই আমার। আপনি আর আমি এখন একই দলে পড়ে গেছি। ভালো করেই জানি কিভাবে আপনাকে সাহায্য করতে হবে।”

এসব কথা ল্যাংডনের কানে খুব একটা গেলো না, তার সমস্ত মনোযোগ সিয়েনার দিকে, চুপিসারে সে ভিউয়িং প্লাটফর্মের পেছনে ওয়াকওয়ের উপর উঠে এসেছে, অস্ত্রধারী মেয়েটির একদম কাছাকাছি।

পালাও! মনে মনে বলে উঠলো ল্যাংডন। এখান থেকে পালাও!

ল্যাংডনকে আরো সন্ত্রস্ত করে সিয়েনা উপুড় হয়ে অন্ধকারে চুপচাপ ঘাপটি মেরে আছে।

.

ভায়েন্থার চোখ ল্যাংডনের পেছনে অন্ধকারের দিকে। ঐ মেয়েটা গেলো কোথায়? তারা দুজন কি আলাদা হয়ে গেছে নাকি?

যেভাবেই হোক এ দু’জন যেনো ব্রুডারের হাতে না পড়ে সে ব্যবস্থা করতে হবে তাকে। এটাই আমার একমাত্র আশা।

“সিয়েনা?!” ফিসফিসিয়ে বললো ভায়েন্থা। “আমার কথা যদি শুনতে পাও তাহলে ভালো করে শুনে রাখো। নীচে যেসব লোকজন রয়েছে তাদের হাতে ধরা পড়ো না। তারা কিন্তু আমার মতো এতোটা ভালো হবে না। আমি একটা পালানোর পথ জানি। তোমাদেরকে সাহায্য করতে পারবো। আমাকে বিশ্বাস করো।”

“বিশ্বাস করবো তোমাকে?”প্রায় চিৎকারের মতো করেই বললো ল্যাংডন, যেনো আশেপাশে কেউ শুনতে পায়। “তুমি একজন খুনি!”

সিয়েনা তাহলে আশেপাশেই আছে, বুঝতে পারলো ভায়েন্থা। ল্যাংডন আসলে তাকে শোনাতে চাইছে…মেয়েটাকে সতর্ক করার চেষ্টা করছে।

আবারো বললো ভায়েন্থা। “সিয়েনা, পরিস্থিতি কিন্তু খুব জটিল, তবে আমি তোমাকে এখান থেকে বের করতে পারবো। তোমার অপশনগুলো বিবেচনা করো। ফাঁদে পড়ে গেছো। তোমার আর কোনো উপায় নেই।”

“তার উপায় আছে,” বেশ জোরেই বললো ল্যাংডন। “তোমার কাছ থেকে যতো দূর সম্ভব পালাতে পারবে সে। এ ক্ষমতা তার রয়েছে।”

“সব কিছু বদলে গেছে, ভায়েন্থা জোর দিয়ে বললো। “তোমার কোনো ক্ষতি করার ইচ্ছে নেই আমার।”

“তুমি ডাক্তার মারকোনিকে খুন করেছো! আর আমি এও বুঝতে পারছি তুমিই আমার মাথায় গুলি করেছিলে!”

ভায়েন্থা এবার বুঝতে পারলো তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি তার কোনো কথাই বিশ্বাস করবে না।

কথা বলা শেষ। তাকে আর বোঝানো যাবে না। সময় নষ্ট না করে জ্যাকেটের ভেতর থেকে সাইলেন্সার পিস্তলটি বের করে আনলো।

.

ওয়াকওয়ের উপর অন্ধকারে উপুড় হয়ে ঘাপটি মেরে আছে সিয়েনা। অস্ত্রধারী মেয়েটার থেকে মাত্র দশ গজ দূরে। এই অন্ধকারেও মেয়েটার আবছায়া অবয়ব দেখে চিনতে একটুও কষ্ট হলো না তার। যে অস্ত্রটা দিয়ে ডাক্তার মারকোনিকে হত্যা করেছিলো ঠিক সেই অস্ত্রটাই এখন তার হাতে।

ও গুলি করবে, সিয়েনা বুঝে গেলো। মেয়েটির শারিরীক ভাষা আঁচ করতে পারছে।

অস্ত্রধারী মেয়েটি ল্যাংডনের দিকে দু’পা এগিয়ে গেলো এবার, ভাসারির অ্যাপোথিওসিস-এর উপর যে ভিউয়িং প্লাটফর্মটি আছে সেটার শেষমাথায় নীচু রেলিংয়ের কাছে এসে ল্যাংডনের বুক বরার পিস্তল তাক করলো।

“কেবল কয়েক মুহূর্তের জন্য যন্ত্রণাটি টের পাবেন,” বললো সে। “কিন্তু এছাড়া আমার আর কিছু করারও নেই।

.

টৃগার টেপার মুহূর্তে অপ্রত্যাশিতভাবে পায়ের নীচে থাকা পাটাতন কেঁপে উঠলে ভায়েন্থার পিস্তলটি সরে গেলো কিছুটা। সে জানে ফায়ারিং হলেও ওটা আর ল্যাংডনের দিকে তাক করা ছিলো না। একটু সরে গেছিলো সেই মুহূর্তে।

টের পেলো তার পেছনে কিছু একটা ধেয়ে আসছে।

খুব দ্রুতই আসছে।

চট করে নিজের পিস্তলটা ১৮০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে ফেললো পেছন থেকে ধেয়ে আসা আক্রমণকারীর দিকে। এক ঝলক দেখতে পেলো সোনালি-চুলের একজন অন্ধকার থেকে ছুটে আসছে তার দিকে, প্রচণ্ড গতিতে ভায়েন্থার সাথে ধাক্কা লাগলো তার। অস্ত্রটা আবারো হিস করে শব্দ করলো কিন্তু সোনালি-চুলের আক্রমণকারী তার পিস্তলের ব্যারেলের নীচে থাকায় লক্ষ্য ভেদ হলো না, উপরন্তু ভায়েন্থাকে নীচ থেকে উপরের দিকে তুলে দিলো সে।

ভায়েন্থার পা দুটো পাটাতন থেকে শূন্যে উঠে গেলো কিছুটা আর তার শরীরের মাঝখানটা গিয়ে পড়লো রেলিংয়ের উপর। পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচার জন্য দু’হাত দিয়ে কিছু একটা ধরার চেষ্টা করলো, কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে গেছে। ততোক্ষণে। রেলিং টপকে নীচের অন্ধকারে পড়ে গেলো ভায়েন্থা। আছড়ে পড়লো আট ফুট নীচে ধুলোময় মেঝের উপর। অদ্ভুত ব্যাপার, যেখানে সে পড়লো সেই জায়গাটা বেশ নরম অনুভূত হলো তার কাছে…এটা তার কল্পনায়ও ছিলো না…যেনো নরম কোনো বিছানার উপর গিয়ে পড়লো তার শরীরটা। এখন

তার ওজনে সেই নরম মেঝেটা দেবে গেলো কিছুটা।

হতবুদ্ধিকর ভায়েম্বা চিৎ হয়ে পড়ে থেকে দেখতে পেলো তার আক্রমণকারীকে। সিয়েনা ব্রুকস আট ফিট উপরে রেলিং থেকে ঝুঁকে তার দিকে চেয়ে আছে। বিস্মিত ভায়েন্থা কিছু বলার জন্য মুখ খুললো কিন্তু আচমকা তার নীচে প্রচণ্ড জোরে ছিঁড়ে যাবার শব্দ হলো।

যে মোটা কাপড়ের উপর সে পড়ে আছে সেটা তার ওজন বহন করতে না পেরে ছিঁড়ে গেলো।

ভায়েন্থা আবারো পড়তে শুরু করলো নীচে।

এবার প্রায় তিন সেকেন্ডের দীর্ঘ একটি পতন অনুভব করতে পারলো সে। এই সময়ে উপরে থাকা চমৎকার পেইন্টিংটা দেখতে পেলো-বিশাল বৃত্তাকারের একটি ক্যানভাসে প্রথম কসিমো স্বর্গীয় মেঘের উপর দেবশিশুদ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে আছেন-ক্যানভাসটি এখন ঠিক মাঝখান থেকে চিড়ে ছবিটাকে বিভক্ত করে দিয়েছে।

তারপর হঠাৎ করেই পতনের ধাক্কা টের পেলো সে, সঙ্গে সঙ্গে ভায়েন্থার জগৎ অন্ধকারে ডুবে গেলো।

.

উপরে, বরফের মতো জমে থাকা রবার্ট ল্যাংডন বিস্ময়মাখা দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে আছে চিড়ে যাওয়া অ্যাপোথিসিস-এর মধ্য দিয়ে নীচের মেঝের দিকে। হল অব দি ফাইভ হান্ড্রেডের পাথরের মেঝেতে স্পাইক করা চুলের মেয়েটির নিথর দেহ পড়ে আছে, তার চারপাশটা রক্তে সয়লাব। তবে হাতের অস্ত্রটি এখনও ধরে রেখেছে সে।

সিয়েনার দিকে তাকালো ল্যাংডন, সেও চেয়ে আছে নীচের দিকে। অপ্রীতিকর দৃশ্যটি দেখে থ বনে গেছে। অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো, “আমি এটা চাই নি…”

“তুমি স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে,” নীচুস্বরে বললো ল্যাংডন। “আরেকটুর জন্য সে আমাকে খুন করে ফেলতো।”

নীচে বাজতে থাকা অ্যালার্মের তীব্র আওয়াজ ছেঁড়া ক্যানভাসের মধ্য দিয়ে চলে এলো উপরে। সিয়েনাকে আস্তে করে রেলিং থেকে সরিয়ে দিলো ল্যাংডন। “আমাদেরকে যেতে হবে।”

.

অধ্যায় ৪৯

ডাচেস বিয়ানকা কাপ্পেল্লোর সিক্রেট স্টাডি থেকে হল অব দি ফাইভ হান্ড্রেডে প্রচণ্ড জোরে আছড়ে পড়ার শব্দ এবং তার পর পর হৈহল্লাটা শুনতে পেলো এজেন্ট ব্রুডার। দেয়ালের ফোকরটার দিকে ছুটে গিয়ে নীচের দিকে তাকালো সে। রাজকীয় পাথরের মেঝেতে যে দৃশ্যটি দেখতে পেলো সেটা হজম করতে কয়েক সেকেন্ড লেগে গেলো তার।

জাদুঘরের অ্যাডমিনিস্ট্রেটর গর্ভবতী মহিলা তার পাশে এসে ফোকর দিয়ে নীচে তাকাতেই আৎকে উঠে মুখে হাত চাপা দিলো-নিথর একটি দেহ পড়ে আছে, তার চারপাশে গোল হয়ে আছে ভীতসন্ত্রস্ত পর্যটকের দল। মহিলা এবার আস্তে করে হল অব দি ফাইভ হান্ড্রেড-এর উপরের দিকে তাকালো, আৎকে উঠলো সে। ব্রুডার কাছে এসে তার দৃষ্টি অনুসরন করে ছাদের বৃত্তাকারের ক্যানভাসের দিকে তাকালো-মাঝখান থেকে ক্যানভাসটি চিঁড়ে আছে।

মহিলার দিকে ঘুরলো সে। “ওখানে আমরা কিভাবে যেতে পারবো?”

.

ভবনের অন্যপ্রান্তে ল্যাংডন আর সিয়েনা অ্যাটিক থেকে নেমে দরজার দিকে ছুটে যাচ্ছে দম ফুরিয়ে। কয়েক মুহূর্ত পরই ল্যাংডন লাল রঙের পর্দার পেছনে একটি অ্যালকোভ খুঁজে পেলো। এর আগে এখানে যে সিক্রেট প্যাসেজ টুর করেছিলো সে সময়কার কথা মনে করলো সে।

এথেন্সের ডিউকের সিঁড়ি।

এখন চারপাশ থেকে ভেসে আসছে পায়ের আওয়াজ আর হৈহল্লা। ল্যাংডন জানে তাদের হাতে একদম সময় নেই। পদটা সরিয়ে ছোট্ট একটা সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে সিয়েনাকে নিয়ে ঢুকে পড়লো সে।

কোনো কথা না বলে পাথরের সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করলো তারা। এই সিঁড়িটা খুবই সঙ্কীর্ণ আর ভীতিকর U আকৃতিতে নেমে গেছে নীচের দিকে। যতোই নীচে নামতে লাগলো মনে হলো ততোই সঙ্কীর্ণ হয়ে আসছে সেটা। ল্যাংডনের মনে হলো দু’পাশের দেয়াল যেনো তাকে চাপা দেবার জন্য আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে।

অবশেষে নীচে নেমে এলো তারা।

সিঁড়ির নীচে ছোট্ট একটি পাথরের কক্ষ রয়েছে, এর দরজাটা এ পৃথিবীর সবচাইতে ছোটো হলেও সেটা দেখে যারপরনাই স্বস্তি পেলো ল্যাংডন। লোহার বোল্টসহ ভারি কাঠের দরজাটি মাত্র চার ফিট উঁচু।

“দরজার ওপাশে পথঘাটের শব্দ শুনতে পাচ্ছি আমি,” ফিসফিসিয়ে বললো সিয়েনা। তাকে দেখে মনে হচ্ছে এখনও ভড়কে আছে। “ওপাশে কি?”

“ভায়া দেল্লা নিন্না,” জবাবে বললো ল্যাংডন। জনবহুল রাস্তাটির ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠলো। “তবে ওখানে পুলিশও থাকতে পারে।”

“তারা আমাদের দেখে চিনতে পারবে না। তারা খুঁজে বেড়াচ্ছে এক সোনালি চুলের তরুণী আর কালো চুলের পুরুষ মানুষকে।”

অবাক হয়ে তার দিকে তাকালো ল্যাংডন। “আমরা তো তা-ই…”।

মাথা ঝাঁকালো সিয়েনা, তার চোখেমুখে ফুটে উঠলো বিষণ্ণতা। “আমি এটা তোমাকে দেখাতে চাই নি রবার্ট, কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো আমি আসলে এরকমই দেখতে।” এ কথা বলেই মাথার সোনালি চুলটা ধরে এক টানে খুলে ফেললে বেরিয়ে এলো তার ন্যাড়া মাথা।

আৎকে উঠে এক পা পিছিয়ে গেলো ল্যাংডন। সিয়েনা যে আসলে উইগ পরেছিলো এটা সে কল্পনাও করে নি। তারচেয়েও বড় কথা, এই একটা জিনিস সরিয়ে ফেলতেই মেয়েটাকে আর চেনা যাচ্ছে না। ল্যাংডন ভালো করে দেখলো, সিয়েনা ব্রুকস একেবারেই টেকো। তার মাথার চামড়া বেশ মসৃণ আর ফ্যাকাশে, অনেকটা কেমোথেরাপি নেয়া ক্যান্সার রোগিদের মতো দেখাচ্ছে তাকে। সে কি অসুস্থ?

“আমি জানি,” বললো সে। “লম্বা কাহিনী। এবার মাথাটা নীচু করো।” উইগটা তুলে ধরলো সে। বোঝাই যাচ্ছে ওটা ল্যাংডনের মাথায় চাপাতে চাইছে।

মেয়েটা কি সত্যি ওটা আমার মাথায় পরাবে? অনিচ্ছাসত্ত্বেও সিম্বলজিস্ট মাথাটা নীচু করতেই সিয়েনা উইগটা চাপিয়ে দিলো তার মাথায়। খুব ভালোমতো ফিট হলো না ওটা, তবে মেয়েটা চেষ্টা করলো ভালোমতো লাগিয়ে দিতে। এরপর সে এক পা পিছিয়ে দেখে নিলো কেমন দেখাচ্ছে। সম্ভষ্ট বলে মনে হলো না। এবার ল্যাংডনের টাইটা খুলে কপালের উপর দিয়ে মাথায় বেধে দিলো, অনেকটা ব্যান্ডানার মতো করে। ফলে উইগটা শক্ত করে লেগে রইলো তার মাথায়।

সিয়েনা এবার নিজের দিকে মনোযোগ দিলো। প্যান্টের পা দুটো গুটিয়ে নিলো সে, পায়ের মোজা দুটো গোড়ালি পর্যন্ত নামিয়ে দিলো। উঠে দাঁড়াতেই তার ঠোঁটে দেখা গেলো বাঁকা হাসি। সিয়েনা ব্রুকস এখন পাঙ্ক-রক স্কিনহেড। এক সময়কার শেক্সপিরিয়ান অভিনেত্রীর চমকে যাবার মতো রূপান্তর।

“মনে রেখো,” বললো সে, “মানুষের বডি-ল্যাঙ্গুয়েজই তাকে চিনতে নব্বই পার্সেন্ট ভূমিকা রাখে। সুতরাং যখন হাটবে তখন একজন বয়স্ক রকারের মতো হাটবে।”

বয়স্ক। ঠিক আছে, ওটা আমি পারবো, মনে মনে বললো ল্যাংডন। রকার? আমি নিশ্চিত নই।

এ নিয়ে কোনো কথা বলার আগেই সিয়েনা দরজার বোল্ট খুলে ফেললো। মাথা নীচু করে বেরিয়ে পড়লো কাঁকড় বিছানো পথে। এরপর রাস্তায় বেরিয়ে এলো ল্যাংডন।

বেখাপ্পা এক কপোতকপোতিকে পালাজ্জো ভেচ্চিও’র নীচের ছোট্ট দরজা দিয়ে বাইরে আসতে দেখে কিছু লোকজন চোখ কুচকে তাকালেও দ্বিতীয়বার কেউ ফিরেও তাকালো না তাদের দিকে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ল্যাংডন আর সিয়েনা পূর্ব দিকে এগোতে শুরু করলো, মিশে গেলো লোকজনের ভীড়ে।

.

পাতলা ফ্রেমের চশমা পরা লোকটি তার রক্তাক্ত চামড়া নিয়ে লোকজনের ভীড় ঠেলে রবার্ট ল্যাংডন আর সিয়েনা ব্রুকসের থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে হেঁটে চলেছে। ওদের চাতুর্যপূর্ণ ছদ্মবেশ ধারণ সত্ত্বেও ভায়া দেল্লা নিন্নার পাশে ছোট্ট দরজা দিয়ে বের হতেই সে চিনে ফেলেছে ওদেরকে।

কয়েক বুক পর্যন্ত অনুসরণ করার পরই দম ফুরিয়ে হাপিয়ে উঠলো সে। তার বুকটা ব্যথা করতে লাগলো। বাধ্য করলো জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে। তার কাছে মনে হচ্ছে কেউ বুঝি তার বুকে চাকু বসিয়ে দিয়েছে।

যন্ত্রণার চোটে দাঁতে দাঁত চেপে রইলো সে, জোর করে ফ্লোরেন্সের পথঘাট দিয়ে চলতে থাকা ল্যাংডন আর সিয়েনার পিছু পিছু চলতে লাগলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *