৩০. ল্যাংডন আর সিয়েনা

অধ্যায় ৩০

ল্যাংডন আর সিয়েনা একটি সুযোগ পেয়ে গেছিলো।

পেশীবহুল সৈনিকটি যখন দরজায় আঘাত করে যাচ্ছিলো তখন তারা গুহা থেকে হামাগুঁড়ি দিয়ে সামনের চেম্বারে চলে আসে। ছোট্ট জায়গাটি খরখরে পাথরের মোজাইকে সাজানো। এর মাঝখানে প্রমাণ সাইজের বাথিং ভেনাস-এর একটি মূর্তি, পেছন ফিরে নাভাস ভঙ্গিতে চেয়ে আছে সে।

ল্যাংডন আর সিয়েনা মূর্তিটার বেইজের নীচে সেঁটে থাকে কিছুক্ষণ। এখন তারা অপেক্ষা করছে সেখানেই। তাদের দৃষ্টি গুহার দেয়াল জুড়ে থাকা প্রাকৃতিকভাবে তৈরি খাঁজগুলোর দিকে।

“বের হবার সব পথ সিকিউর করা হয়েছে!” বাইরে থেকে একজন সৈনিক চিৎকার করে বললো। ইংরেজিতে কথা বললেও তার বাচনভঙ্গিটা ধরতে পারলো না ল্যাংডন। “ড্রোনটাকে ব্যাক-আপে পাঠান। আমি এই গুহাটা চেক করে দেখছি।”

পাশে দাঁড়ানো সিয়েনার শরীর যে আড়ষ্ট হয়ে উঠেছে সেটা টের পেলো ল্যাংডন।

কয়েক মুহূর্ত পরই গুহার ভেতরে ভারি বুটের শব্দ শোনা যেতে লাগলো। পায়ের আওয়াজটি দ্রুত প্রথম কক্ষের দিকে এগিয়ে এসেছে, দ্বিতীয় কক্ষে ঢুকতেই সেটা আরো জোরে শোনালো। একেবারে তাদের দিকে চলে আসছে। সেটা।

গুটিসুটি মেরে রইলো ল্যাংডন আর সিয়েনা।

“গেই!” দূর থেকে অন্য একটি কণ্ঠ চিৎকার করে বললো। “ওদেরকে পেয়ে গেছি আমরা!”

পায়ের আওয়াজটি থেমে গেলো সঙ্গে সঙ্গে।

ল্যাংডন এখন শুনতে পেলো পাথরের পথ থেকে কেউ গুহার দিকে দৌড়ে আসছে। “পজিটিভ আইডি!” হাফাতে হাফাতে বললো কণ্ঠটি। “আমরা বেশ কয়েকজন পর্যটককে জিজ্ঞাসাবাদ করে জেনেছি কয়েক মিনিট আগে দু’জন নারী-পুরুষ প্রাসাদের কস্টিউম গ্যালারির দিকে গেছে…ওটা পালাজ্জোর পশ্চিমে অবস্থিত।”

সিয়েনার দিকে তাকালো ল্যাংডন, তার ঠোঁটে মৃদু হাসি।

সৈনিকটি বুক ভরে দম নিয়ে আবার বলতে লাগলো, “পশ্চিম দিকের এক্সিটটা প্রথমেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে…আমরা নিশ্চিত তাদেরকে গার্ডেনের ভেতরে আটকে ফেলতে পেরেছি।”

“তোমার মিশন শুরু করো,” কাছে থাকা এক সৈনিক বললো। “ওদেরকে ধরার সাথে সাথে আমাকে জানাবে।”

পাথরের পথের উপরে বেশ কয়েকটি পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেলো এবার, সেই সাথে ড্রোনটাও উড়ে গেলো। নীরব হয়ে পড়লো জায়গাটা।

ল্যাংডন মূর্তিটার বেইজের পাশ থেকে মাথাটা বের করে উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করতেই সিয়েনা হাত ধরে টেনে নিলো। মুখে আঙুল দিয়ে চুপ থাকার ইশারা করলো তাকে। মাথা নেড়ে ইঙ্গিত করলো, এখনও নেতাগোছের সৈনিকটি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে গুহার মুখের সামনে।

সে কিসের জন্য অপেক্ষা করছে!

“আমি ব্রুডার,” হঠাৎ করেই বলে উঠলো সে। “আমরা তাদেরকে কোণঠাসা করে ফেলেছি। কিছুক্ষনের মধ্যে আপনার কাছ থেকে আমি কনফার্মেশান চাইছি।”

লোকটা ফোনে কথা বলছে কারো সাথে। তার কণ্ঠ শুনে মনে হচ্ছে ঠিক যেনো তাদের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। গুহাটি এখন প্যারাববালিক মাইক্রোফোনের মতো কাজ করছে, সব ধরণের শব্দ একত্র করে সেগুলোকে পেছনে ঠেলে দিচ্ছে।

“আরেকটা ব্যাপার আছে,” বললো ব্রুডার। “ফরেনসিক থেকে আমি একটু আগে আপডেট পেয়েছি। ঐ মেয়েটি অ্যাপার্টমেন্টে সাবলেট ছিলো। আসবাবপত্রসহ। বোঝাই যাচ্ছে অল্প সময়ের জন্য। বায়োটিউবটি আমরা লোকেট করতে পেরেছি, কিন্তু প্রজেক্টরটি নেই। আমি আবারো বলছি, প্রজেক্টরটি নেই। আমাদের ধারণা ওটা এখনও ল্যাংডনের কাছে আছে।”

সৈনিকটির মুখে নিজের নাম শুনে ল্যাংডনের শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল প্রবাহ বয়ে গেলো।

পায়ের আওয়াজ আরো বেড়ে গেলো এবার। ল্যাংডন বুঝতে পারলো লোকটি গুহার ভেতরে ঢুকে পড়ছে। তবে তার পদক্ষেপের মধ্যে আগের সেই সতর্কতা নেই, যেনো ফোনে কথা বলতে বলতে হাটছে।

“ঠিক, লোকটি বললো। “ঐ অ্যাপার্টমেন্টে অভিযান চালানোর একটু আগে ফরেনসিক কনফার্ম করেছে ওখান থেকে একটি কল করা হয়েছে বাইরে।”

ইউএস কনসুলেট, ভাবলো ল্যাংডন। তার মনে পড়ে গেলো, ঐ টেলিফোনটি করার পর পরই স্পাইক করা চুলের মেয়েটি এসে পড়ে। কিন্তু প্রশিক্ষিত সৈনিকেরা চলে এলে মেয়েটি উধাও হয়ে যায়।

আমরা তাদেরকে সব সময় থোকা দিতে পারবো না।

গুহার পাথরের মেঝের উপর বুটের শব্দ এখন তাদের থেকে মাত্র বিশ ফিট দূরে হবে। লোকটি দ্বিতীয় কক্ষে ঢুকে পড়লো, এভাবে এগোতে থাকলে একটু পরই সে তাদের দুজনকে দেখে ফেলবে ভেনাসের বেইজের নীচে।

“সিয়েনা ব্রুকস,” হঠাৎ করেই লোকটা বলে উঠলো। একেবারে পরিস্কার কণ্ঠে।

ল্যাংডনের পাশে থাকা সিয়েনা চমকে উঠলো, মাথা নীচু করে রেখেছিলো এতোক্ষণ, কথাটা শোনার পর মনে করলো সৈনিকটি বুঝি তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মুখ তুলে তাকালো সে কিন্তু কাউকে দেখতে পেলো না।

“ওরা মেয়েটার ল্যাপটপ চেক করে দেখছে,” দশ ফিট দূর থেকে কণ্ঠটা বলে উঠলো এবার। “আমি অবশ্য এখন পর্যন্ত কোনো রিপোর্ট পাই নি। তবে আমি নিশ্চিত, ওই ল্যাপটপ থেকেই ল্যাংডন তার হারভার্ডের ই-মেইলে ঢুকেছিলো।”

এই কথাটা শুনে সিয়েনা অবিশ্বাসে তাকালো ল্যাংডনের দিকে। যেনো দারুণ শক পেয়েছে সে…অনেকটা বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হওয়া ব্যক্তির অভিব্যক্তি তার চোখেমুখে।

ল্যাংডনও কম বিস্মিত হয় নি। এভাবেই তারা আমাদেরকে ট্রেস করতে পেরেছে?! তার চোখেমুখে ক্ষমাপ্রার্থনার অভিব্যক্তি ফুটে উঠলে সিয়েনা মুখ সরিয়ে নিলো। তার অভিব্যক্তি দেখে কিছু বোঝা গেলো না।

“ঠিক,” সৈনিকটি তৃতীয় কক্ষে ঢুকে পড়লো, এখন ল্যাংডনদের থেকে মাত্র ছয় ফিট দূরে আছে সে। আর দু’পা এগোলেই দেখতে পাবে মূর্তির বেইজের ওপাশে তারা দুজন ঘাপটি মেরে আছে।

“একদম ঠিক, আরো এক পা এগিয়ে বললো সে। হুট করেই সৈনিকটি থমকে দাঁড়ালো। “একটু দাঁড়ান।”

ল্যাংডন বরফের মতো জমে গেলো, ধরা পড়ে যাওয়ার দ্বারপ্রান্তে এখন।

“একটু দাঁড়ান, আপনার কথা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে না,” সৈনিকটি বললো। দ্রুত কয়েক পা পিছিয়ে দ্বিতীয় কক্ষে চলে গেলো সে। “নেটওয়ার্ক পাচ্ছিলো না। এবার বলুন…” কয়েক মুহূর্ত ওপাশ থেকে শুনে জবাব দিলো। “হ্যাঁ, আমিও তাই মনে করি। তবে অন্ততপক্ষে আমরা জানি কে এটা ডিল করছে।”

তার পায়ের আওয়াজ আবারো সরে গেলো দূরে, গুহা থেকে বের হয়ে সেটা এসে পড়লো বাইরের পাথরের জমিনে। তারপর পুরোপুরি উধাও।

ল্যাংডনের আড়ষ্ট কাঁধ দুটো স্বাভাবিক হয়ে এলে সিয়েনার দিকে তাকালো। মেয়েটার চোখ দুটো যেনো আগুনে জ্বল জ্বল করছে।

“তুমি আমার ল্যাপটপ ব্যবহার করেছো?! তোমার ই-মেইল চেক করার জন্য?”

“আমি খুবই দুঃখিত, সিয়েনা…ভেবেছিলাম তুমি এটা বুঝতে পারবে। আমার আসলে খোঁজ করার দরকার ছিলো।”

“এজন্যেই এতো সহজে আমাদেরকে খুঁজে পেয়েছে ওরা! এখন তো তারা আমার নামটা পর্যন্ত জেনে গেছে!”

“আমি আবারো ক্ষমা চাইছি। আসলে বুঝতে পারি নি…অপরাধি ভঙ্গিতে কাচুমাচু খেলো ল্যাংডন।

ঘুরে তাকালো সিয়েনা, উদাসভাবে চেয়ে রইলো এবড়োথেবড়ো পাথরের দেয়ালের দিকে। প্রায় এক মিনিট সময় ধরে তাদের কেউই কথা বললো না। ল্যাংডন ভাবতে লাগলো সিয়েনা তার পার্সোনাল ডেস্কের আইটমেগুলোর কথা ভাবছে কিনা-মিড সামার নাইটস ড্রিম-এর একটি প্লেবিল আর প্রোডিজি এক মেয়ের উপরে লেখা কিছু আর্টিকেলের পেপার ক্লিপিংস। ও কি সন্দেহ করছে আমি ওগুলো দেখে ফেলেছি? যদি তা-ই হয়ে থাকে তাহলে সে কেন তাকে জিজ্ঞেস করছে না, ল্যাংডন এরইমধ্যে মেয়েটার সাথে বেশ সমস্যা পাকিয়ে ফেলেছে, সুতারং এ ব্যাপারে কিছু জানতে চাইলে সে বলবে না।

“তারা জেনে গেছে আমি কে,” আস্তে করে বললো সিয়েনা, ল্যাংডন সেটা শুনতেই পেলো না। পরবর্তী দশ সেকেন্ড পর পর কয়েকটি দীর্ঘশ্বাস ফেললো মেয়েটি। যেনো নতুন বাস্তবতার সাথে নিজেকে মানিয়ে নেবার চেষ্টা করছে। ল্যাংডন বুঝতে পারলো মেয়েটি কঠিন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে।

কোনো কথা না বলেই উঠে দাঁড়ালো সিয়েনা। “আমাদেরকে যেতে হবে, বললো সে। “আমরা যে কস্টিউম গ্যালারিতে নেই সেটা ওরা খুব জলদিই বুঝে যাবে।”

ল্যাংডনও উঠে দাঁড়ালো। “হ্যাঁ, কিন্তু কোথায় যাবো?”

“ভ্যাটিকান সিটিতে?”

“কী বললে?”

“আমি অবশেষে বুঝতে পেরেছি তুমি এর আগে যে কথাটা বলেছিলে সেটার মানে কি…ববোলি গার্ডেনের সাথে ভ্যাটিকান সিটির একটা মিল আছে।” ছোট্ট ধূসর দরজাটার দিকে ইঙ্গিত করলো সে। “এটা সেই প্রবেশপথ, তাই না?”

মাথা নেড়ে সায় দিতে কার্পন্য করলো ল্যাংডন। “আসলে এটা বের হবার পথ। কিন্তু আমি ভুল ভেবেছিলাম। মনে করেছিলাম এটা দিয়ে ভেতরে যাওয়া যাবে। কিন্তু দেখতেই পাচ্ছে, যাওয়া যাবে না।” সৈনেকের সাথে গার্ডের কথোপকথন ভালোভাবেই শুনেছে ল্যাংডন।

“কিন্তু আমরা যদি ওটার ভেতর দিয়ে যেতে পারি,” মুখে মুচকি হাসি হেসে বললো সিয়েনা। “তাহলে এর মানে কী দাঁড়াবে বুঝতে পেরেছো?” এবার। হাসিটা আরো চওড়া হলো। এর মানে দাঁড়াবে এক দিনে রেনেসাঁর এক শিল্পী আমাদের দু’জনকে দু’দুবার সাহায্য করলেন।”

ল্যাংডন নিঃশব্দে হেসে ফেললো, কয়েক মিনিট আগে ঠিক এমনটিই সে ভেবেছিলো। “ভাসারি। ভাসারি।”

সিয়েনার প্রাণখোলা হাসি দেখে ল্যাংডন বুঝতে পারলো মেয়েটি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছে। “আমার মনে হয় এটা উপর থেকে একটি ইশারা,” অনেকটা ঠাট্টারছলে বললো সে। “আমরা ঐ দরজাটা দিয়ে ভেতরে ঢুকবো।”

“ঠিক আছে…তার মানে আমরা ঐ গার্ডকে পাশ কাটিয়ে চলে যাবো?”

সিয়েনা গুহা থেকে বের হতে শুরু করলো। “না, তার সাথে আমি কথা বলবো।” ল্যাংডনের দিকে ফিরে তাকালে সিয়েনার চোখে আবারো সেই আগুন দেখা গেলো। “আমার উপর ভরসা রাখতে পারো, প্রফেসর। আমি যদি চাই তাহলে বেশ ভালোই পটাতে পারি।”

.

ধূসর দরজার উপরে আবারো আঘাতের শব্দ হলো।

এবার আরো বেশি দৃঢ় আর অস্থিরভাবে।

সিকিউরিটি গার্ড আর্নেস্তো রুশো রাগে গজ গজ করতে শুরু করলো। ঐ শীতল চোখের সৈনিকটি নিশ্চয় আবার ফিরে এসেছে। তবে এবার তার টাইমিং খুব খারাপ। টিভিতে যে ফুটবল ম্যাচ দেখছিলো সেটার বাড়তি সময়ে গড়িয়েছে। আর ফিওরেন্তিনা একজন খেলোয়াড় হারিয়ে দশ জন নিয়ে খেলছে এখন, বিপদে পড়ে গেছে তারা।

আঘাতের শব্দটি অব্যাহত আছে।

আর্নেস্তো এতো বোকা নয় যে বাইরে কি হচ্ছে না হচ্ছে সে ব্যাপারে কিছুই বুঝতে পারছে না-সকাল থেকে সাইরেন বেজেই চলছে, পুলিশের সাথে যোগ দিয়েছে সেনারা-কিন্তু তার কাজের সাথে কোনো লেনদেন নেই, কিংবা সরাসরি তার কাজে প্রভাব ফেলে না এরকম কিছুতে সে জড়ায় না।

পাজ্জো এ কলোই বাদা অ্যাই ফাত্তি আলক্রই।

কিন্তু এটাও ঠিক ঐ সৈনিকটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ কেউই হবে, তাকে পাত্তা না দেয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আজকাল ইটালিতে একটা চাকরি খুঁজে পাওয়া সহজ কথা নয়। খেলাটার দিকে একবার তাকিয়ে অনিচ্ছায় পা বাড়ালো ঐ দরজার দিকে।

সে বিশ্বাস করে না তাকে শুধু নিজের ছোট্ট অফিসে বসে বসে টিভিতে খেলা দেখার জন্য বেতন দেয়া হয়। সম্ভবত প্রতিদিন কম করে হলেও দু’বার ভিআইপি কোনো গেস্ট উফিজ্জি গ্যালারি ঘুরতে ঘুরতে চলে আসে এই দরজার সামনে। আর্নেস্তো তাদের জন্য দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকতে দেয় যাতে করে তারা ববোলি গার্ডেনে চলে যেতে পারে খুব সহজে।

এখন দরজার উপর আঘাতটি আরো বেড়ে গেছে। স্টিল গেটটা খুলে ভেতরে ঢুকে যথারীতি ওটা লাগিয়ে চলে গেলো দরজার কাছে।

“সি?” বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললো সে।

কোনো জবাব না দিয়ে আবারো আঘাতের শব্দ হলো।

ইনসোম্মা! দরজার তালা খুলে আশা করলো একটু আগে যে শীতল চোখ দুটো দেখতে পেয়েছিলো সেটাই দেখবে আবার।

কিন্তু দরজায় যে মুখটা দেখতে পেলো সেটা অনেক বেশি আকর্ষণীয়।

“চিয়াও,” সাদা চুলের এক সুন্দরী মেয়ে বললো মিষ্টি করে হেসে। তার দিকে বাড়িয়ে দিলো ভাঁজ করা কিছু কাগজ। আর্নেস্তো স্বভাববশত কাগজগুলো নেবার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলো। কিন্তু যে মুহূর্তে কাগজগুলো ধরেছে তখনই বুঝতে পারলো এগুলো আর কিছু না, মাটিতে পড়ে থাকা নষ্ট কাগজ। মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে তার কব্জি ধরে ফেললো শক্ত করে আর বুড়ো আঙুল দিয়ে চেপে ধরলো হাতের তালুর ঠিক নীচে।

আর্নেস্তোর মনে হলো কোনো ধারালো চাকু দিয়ে বুঝি তার কব্জিটা কেটে ফেলছে। এই তীব্র যন্ত্রণার সঙ্গি হলো ইলেক্ট্রক শকের মতো অসাড়তা। মেয়েটি তার দিকে আরেকটু এগিয়ে আসতেই চাপটা কয়েক গুন বেড়ে গেলো। তীব্র যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়লো হাতে। এক পা পিছিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করলো সে কিন্তু তার পা দুটো অবশ হয়ে গেলে হাটু গেড়ে বসে পড়তে বাধ্য হলো। বাকিটা ঘটলো কয়েক মুহূর্তে।

খোলা দরজা দিয়ে কালো সুট পরা দীর্ঘদেহী এক লোক ঘরে প্রবেশ করেই দরজাটা বন্ধ করে দিলো। কোমরে আটকানো ওয়্যারলেসটি নেবার চেষ্টা করলো আর্নেস্তো কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে একটা হাত তার ঘাড় মুচড়ে দিলো। তার পেশীগুলো কর্মক্ষমহীন হয়ে পড়লো মুহূর্তে। দম বন্ধ হবার জোগার হলো এবার। দীর্ঘদেহী লোকটি সামনে এগোতেই মেয়েটি তার ওয়্যারলেস সেট ছো মেরে নিয়ে নিলো। কালো সুট পরা লোকটি আর্নেস্তোর মতোই মেয়েটির কর্মকাণ্ড দেখে যারপরনাই বিস্মিত।

“দিম মাক,” লম্বা লোকটিকে স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো সোনালি চুলের মেয়েটি। “চায়নিজ প্রেসার পয়েন্ট। এই জ্ঞানটি যে তিনহাজার বছর ধরে টিকে আছে তার সঙ্গত কারণ অবশ্যই রয়েছে।”

লোকটি অবাক হয়ে দেখতে লাগলো।

“নন ভগলিয়ামো ফার্তি দেল মেইল,” আর্নেস্তোর কানে কানে বললো মেয়েটি। তার ঘাড়ের চাপটা কমিয়ে আনলো। আমরা তোমার কোনো ক্ষতি করবো না।

মেয়েটার হাত আলগা হতেই আর্নেস্তো নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো, সঙ্গে সঙ্গে আবারো বেড়ে গেলো প্রেসার। আবারো অবশ হয়ে গেলো তার পেশীগুলো। যন্ত্রনায় কাতর হয়ে উঠলো সে, শ্বাস নিতেও কষ্ট হলো।

“দোব্বিয়ামো পাসারে,” বললো সে। আমরা এখান থেকে শুধু বের হতে চাই। স্টিলের গেটটার দিকে ইঙ্গিত করলো। দরজা খোলার আগে নিয়মানুযায়ী আর্নেস্তো ওটা বন্ধ করে দিয়েছিলো। “দোভে লা চিয়াভে?”

“নন সেলহো,” কোনোরকমে বলতে পারলো সে। আমার কাছে ওটার চাবি নেই।

দীর্ঘদেহী লোকটি গেটের সামনে গিয়ে ভালো করে দেখে নিলো। “এটা কম্বিনেশন লক,” মেয়েটাকে বললো সে। তার উচ্চারণ একদম আমেরিকানদের মতো। ‘

আর্নেস্তোর সামনে হাটু গেড়ে বসলো মেয়েটি। তার বাদামি চোখ দুটো বরফের মতোই শীতল। “কুয়ালে লা কম্বিনেজিওনি?” জানতে চাইলো সে।

“নন পাসো!” জবাব দিলো আর্নেস্তো। “এটা খোলার অনুমতি আমার নেই”।

স্পাইনে কিছু একটা টের পেতেই আর্নেস্তোর পুরো শরীর অবশ হয়ে গেলো সঙ্গে সঙ্গে, মাটিতে শুয়ে পড়লো সে। পর মুহূর্তেই জ্ঞান হারালো।

জ্ঞান ফিরে আসার পর আর্নেস্তোর মনে হলো বেশ কয়েক মিনিট ধরে সে অচেতন ছিলো। এক মেয়ের সাথে কিছু কথাবার্তা, হাতে তীব্র যন্ত্রণা…মাটিতে পড়ে যাওয়া। তারপর সবটাই ঝাপসা।

মাথাটা পরিস্কার হতেই অদ্ভুত একটি দৃশ্য দেখতে পেলো সে-তার জুতো জোড়া পাশেই পড়ে আছে কিন্তু ফিতাগুলো নেই। এরপই সে বুঝতে পারলো নড়তে চড়তে পারছে না। একপাশে কাত হয়ে আছে, তার হাত-পা জুতোর ফিতা দিয়ে বাধা। চিৎকার দেবার চেষ্টা করলো কিন্তু কোনো শব্দ বের হলো না। তার জুতোর মোজা দলা পাকিয়ে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে মুখে। তবে সত্যিকারের ভীতিকর মুহূর্তটি এলো একটু পরই, যখন সে দেখতে পেলো তার টিভি সেটটায় ফুটবল খেলা চলছে। আমি আমার অফিসে…স্টিলের গেটের ভেতরে?!

বহু দূর থেকে আর্নেস্তো শুনতে পেলো মানুষের পায়ের আওয়াজ, করিডোর দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে তারা…তারপর আওয়াজটা কমতে কমতে মিইয়ে গেলো পুরোপুরি। নন এ পসিবিলি! কিভাবে জানি সোনালিচুলের মেয়েটি তাকে দিয়ে এমন একটি কাজ করিয়ে নিয়েছে যেটা না করার জন্যই তাকে মাসে মাসে বেতন দেয়া হয়-ভাসারি করিডোরের প্রবেশদ্বারের যে লক কম্বিনেশনটি আছে সেটা বলে দিয়েছে সে।

.

অধ্যায় ৩১

ডা: এলিজাবেথ সিনস্কির মনে হচ্ছে সে বমি করে দেবে, ঘোরলাগা অনুভূতিটাও বেড়ে গেছে আগের চেয়ে অনেক বেশি। পিত্তি প্যালেসে পার্ক করা ভ্যানের পেছনের সিটে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে সে। তার পাশে বসে থাকা সৈনিকটি চিন্তিত ভঙ্গিতে চেয়ে আছে তার দিকে।

একটু আগে সৈনিকটির ওয়্যারলেসে একটা বার্তা ভেসে আসছিলো-কস্টিউম গ্যালারিতে কিছু একটা হচ্ছে-এটা শুনে অন্ধকার গহ্বর থেকে এলিজাবেথের মন জেগে ওঠে। সেই অন্ধকার গহ্বরে সবুজ চোখের দানবকে স্বপ্নে দেখেছে সে।

তাকে নিউইয়র্কের কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশান্স-এর অন্ধকার অফিসে নেয়া হয়েছিলো, সেখানে উন্মাদগ্রস্ত এক রহস্যময় আগন্তুকের ভয়ঙ্কর সব কথা শুনে গেছে। আবছায়া অবয়বটি ঘরময় পায়চারি করেছে-প্রজেক্টরে দান্তের ইনফার্নোর ভীতিকর কিছু ছবির সামনে ছিলো সে, তাই মুখটা ভালো করে দেখা যায় নি। তবে বোঝা গেছে বেশ দীর্ঘদেহী একজন মানুষ।

“কাউকে না কাউকে এ যুদ্ধটা করতেই হবে,” অবয়বটি সিদ্ধান্ত দেবার ভঙ্গিতে বলেছিলো, “তা না হলে এটাই হবে আমাদের ভবিষ্যৎ। অঙ্ক কষে এটা গ্যারন্টি দেয়া যায়। মানবজাতি এখন সিদ্ধান্তহীনতা, বিলম্বে কাজ করা আর ব্যক্তিগত লোভ-লালসার প্রায়শ্চিত্ত করতে যাচ্ছে…নরকের চক্রগুলো আমাদের পায়ের নীচে অপেক্ষা করছে, অপেক্ষা করছে আমাদের সবাইকে গিলে খেয়ে ফেলার জন্য।”

এলিজাবেথ তখনও এই লোকটির নারকীয় পরিকল্পনার কথা ভেবে যাচ্ছিলো। একটু আগেই সে তার উন্মাদগ্রস্ত পরিকল্পনাটি জানিয়েছে। কথাটা শুনে আর সহ্য করতে পারে নি, লাফ দিয়ে উঠে গেছিলো সে। “আপনি এসব কী বলছেন-”

“এটাই আমাদের একমাত্র অপশন,” লোকটি কথার মাঝখানে শীতলকণ্ঠে বলে ওঠে।

“সত্যি বলতে কী,” জবাবে ডাক্তার বলে, “আমি এটাকে বলবো, ক্রিমিনাল টাইপের চিন্তাভাবনা!”

লোকটি কাঁধ তোলে। “স্বর্গে যেতে হলে নরক পেরিয়ে যেতে হয়। এটা দান্তে আমাদেরকে শিখিয়েছেন।”

“আপনি বদ্ধ উন্মাদ!”

“উন্মাদ?” লোকটি এমনভাবে বলেছিলো যেনো সে আহত বোধ করেছে। “আমি? আমার তা মনে হয় না। পাগল হলো বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা, যারা চোখের সামনে গহ্বরটি দেখেও অস্বীকার করে যাচ্ছে। উন্মাদ হচ্ছে একটা অস্ট্রিচ পাখির মতো, চারপাশে হায়েনার দল দেখেও বালিতে মুখ গুঁজে থাকে।”

এলিজাবেথ তার সংস্থার পক্ষে সাফাই গাওয়ার আগেই সেই লোক প্রজেক্টরের ছবি বদল করে ফেলে।

“হায়েনাদের কথা বলছিলাম,” নতুন ছবিটার দিকে ইঙ্গিত করে বললো সে। “বর্তমান সময়ে মানবজাতির মধ্যে যেসব হায়েনা ঘোরাফেরা করছে তাদের এক দল আছে এখানে…তারা দ্রুত কাছে এগিয়ে আসছে।”

পরিচিত একটি ছবি দেখে এলিজাবেথ বেশ অবাকই হয়েছিলো। বিশ্বের পরিবেশ বিপর্যয়ের সাথে বিশ্বস্বাস্থ্য কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সেদিকগুলো তুলে ধরে এই গ্রাফটি গতবছর প্রকাশিত হয়েছিলো বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা থেকে।

তালিকায় অন্যসব কিছুর সাথে ছিলো :

সুপেয় পানির চাহিদা, ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা, ওজোন স্তরের ক্ষয়, সামুদ্রিক সম্পদের ব্যবহার বৃদ্ধি, প্রাণীকূলের বিলুপ্তি, কাবেনি ঘনীভূত, বনাঞ্চলের বিনাশ এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি। গত শতাব্দীতে এসব নেতিবাচক ইন্ডিকেটরগুলো নিয়ে সবাই সরব হতে শুরু করে। বর্তমান সময়ে এগুলো ভয়ঙ্কর গতিতে বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে।

Diagram

Description automatically generated

এই গ্রাফটি যখনই দেখে এলিজাবেথের একই রকম প্রতিক্রিয়া হয়-চূড়ান্ত রকমের অসহায়ত্ব বোধ। একজন বিজ্ঞানী হিসেবে পরিসংখ্যানের কার্যকারিতায় সে বিশ্বাস করে, এই গ্রাফটি যে ভয়ঙ্কর ছবি চিত্রিত করেছে সেটা দূরবর্তী কোনো সময়ের…একেবারেই নিকট ভবিষ্যতের।

জীবনের অনেকটা সময়ই এলিজাবেথ তার সন্তান ধারণ না করার অক্ষমতার জন্য তীব্র দুঃখবোধে আক্রান্ত হতো, এটা তাকে তাড়িয়ে বেড়াতো কিন্তু যখনই সে এই গ্রাফটি দেখে তখনই এক ধরণের স্বস্তি বোধ করে আর কোনো মানব সন্তানকে এ পৃথিবীতে নিয়ে আসে নি বলে।

আমি আমার সন্তানের জন্য এই ভবিষ্যৎ উপহার দেবো?

“বিগত পঞ্চাশ বছরে,” দীর্ঘদেহী লোকটি বলে ওঠে, “প্রকৃতির বিরুদ্ধে আমাদের পাপ জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।” একটু থেমে আবার সে বলে, “আমি মানবজাতির আত্মা নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা যখন এই গ্রাফটি প্রকাশ করে তখন সারাবিশ্বের রাজনীতিক, ক্ষমতাবানেরা এবং পরিবেশ আন্দোলেনের কর্মীরা জরুরি সামিটের আয়োজন করে, তারা সবাই আন্দাজ করার চেষ্টা করে কোন সমস্যাটি সবচাইতে মারাত্মক এবং কোনটাকে আমরা সমাধান করার আশা করতে পারি। ফলাফল কি? গোপনে তারা মাথায় হাত দিয়ে কেঁদেছে। আর প্রকাশ্যে সারাবিশ্বকে জানিয়েছে সমস্যাগুলো খুবই জটিল আর তারা এগুলোর সমাধান করার জন্যে কাজ করে যাচ্ছে।”

“এসব ইসু খুবই জটিল!”।

“বাজে কথা!” জবাবে বলে ওঠে লোকটি। “আপনি ভালো করেই জানেন এই গ্রাফটি খুব সহজ-সরল আর একক একটি সমস্যাই তুলে ধরেছে-এমন একটি সমস্যা যা অন্য সমস্যাগুলোর জন্ম দিয়েছে-সেটা হলো এ বিশ্বের জনসংখ্যা বৃদ্ধি!”

“আসলে আমার মনে হয় এটা এতোটা সরল নয়, আরেকটু-”

“জটিল? আসলে তা নয়। সরল বলে কিছু নেই। আপনি যদি মাথাপিছু বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ অব্যাহত রাখতে চান তাহলে আপনাকে খুব কম জনসংখ্যা রাখতে হবে এ পৃথিবীতে। আপনি যদি যানবাহন থেকে নির্গত দূষিত পদার্থ কমাতে চান তাহলে ড্রাইভারের সংখ্যা অবশ্যই কমাতে হবে। আপনি যদি চান সমুদ্রের মৎস সম্পদ আগের অবস্থায় ফিরে যাক তাহলে মাছ ভক্ষণ করে এমন মানুষের সংখ্যা কমাতেই হবে!”

এলিজাবেথের দিকে তাকায় সে, তার কণ্ঠ আরো বেশি জোরদার হয়ে ওঠে। “চোখ মেলে দেখুন! আমরা মানবজাতির বিনাশের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি আর বিশ্বনেতারা বোর্ডরুমে বসে সৌরশক্তি, নবায়নযোগ্য জ্বালানী এবং হাইব্রিড অটোমোবাইলের গবেষণার পেছনে টাকা ঢেলে যাচ্ছে। এটা আপনার কাছে ধরা পড়ে না-এরকম উচ্চশিক্ষিত একজন বিজ্ঞানী হিসেবে-আপনি এটা বুঝতে পারছেন না? ওজোন স্তরের ক্ষয়, সুপেয় পানির হ্রাস এবং দূষণ কোনো রোগ নয়-এগুলো নিছক সিমটম। আসল রোগটি হলো জনসংখ্যা বৃদ্ধি। অতিরিক্ত জনসংখ্যা। এই সমস্যাটিকে যদি আমরা মোকাবেলা করতে না পারি তাহলে মনে রাখবেন, আমরা আসলে বাড়ন্ত ক্যান্সার টিউমারের চিকিৎসার জন্য সামান্য ব্যান্ড-এইড লাগিয়ে দেবার মতো বোকামি করছি।”

“আপনি মানবজাতিকে ক্যান্সার মনে করেন?” এলিজাবেথ জানতে চায়।

“মনে রাখবেন, ক্যান্সার সুস্থ কোষের অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি ছাড়া আর কিছু না। আমি বুঝতে পারছি আপনি আমার আইডিয়াটাকে মোটেও পছন্দ করছেন না, কিন্তু আপনাকে আশ্বস্ত করে বলতে পারি, সমস্যাটি যখন দোরগোড়ায় এসে হাজির হবে তখন এরচেয়ে পছন্দসই ভালো বিকল্প খুঁজে পাবেন না। আমরা যদি সাহসী পদক্ষেপ নিতে না পারি তাহলে

‘সাহসী?” তেঁতে ওঠে এলিজাবেথ। “আপনি যা বলছেন সেটাকে সাহসী বলা ঠিক হচ্ছে না। বলুন পাগলামী!”

“ডা: সিনস্কি,” লোকটির কণ্ঠ এবার অদ্ভুত রকমের শান্ত শোনালো। “আমি আপনাকে এখানে ডেকে এনেছি তার কারণ আমি আশা করছি আপনি-বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার অবিসংবাদিত মুখপাত্ৰ-হয়তো সম্ভাব্য সমাধানের পথটি খুঁজে বের করার জন্য সাগ্রহে আমার সাথে কাজ করতে চাইবেন।”

অবিশ্বাসের সাথে চেয়ে থাকে এলিজাবেথ। “আপনি বলতে চাচ্ছেন বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা আপনার সাথে যৌথভাবে কাজ করবে…এরকম একটি আইডিয়া নিয়ে?”

“সত্যি বলতে কি, হ্যাঁ,” বলে সে। “আপনার সংস্থাটি ডাক্তারে পরিপূর্ণ। একজন ডাক্তার যখন গ্যাংরিনের রোগী পায় তখন কিন্তু তারা মোটেও দ্বিধা না করে পা কেটে ফেলে রোগীর জীবন বাঁচিয়ে থাকে। কখনও কখনও এমনও সময় এসে হাজির হয় যখন দুটো শয়তানের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম শয়তানটাকে বেছে নিতে হয় আমাদের।”

“এটা একেবারেই আলাদা কিছু।”

“না, এটা একদম সেরকমই। পার্থক্যটা হলো মাত্রাগত।”

যথেষ্ট শুনেছে এলিজাবেথ, হুট করে দাঁড়িয়ে যায় সে। “আমাকে প্লেন ধরতে হবে।”

দীর্ঘদেহী লোকটি আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে তার পথ রোধ করে দাঁড়ায়। “সাবধান করে দেবার জন্য বলছি। আপনাদের সাহায্য-সহযোগীতা ছাড়াও আমি খুব সহজেই এই আইডিয়াটা নিয়ে নিজের মতো করে কাজ করতে পারবো।”

“সাবধান করে দিচ্ছেন,” পাল্টা বলে ওঠে এলিজাবেথ। “আমি এটাকে সন্ত্রাসী হুমকি বলে মনে করছি। আমরা এটাকে এভাবেই দেখবো।” মোবাইলফোনটা হাতে তুলে নেয় সে।

হেসে ওঠে লোকটি। “হাইপোথেটিক্যাল একটি বিষয় নিয়ে আপনি আমার বিরুদ্ধে রিপোর্ট করবেন? দুভাগ্য হলো, আপনাকে ফোন করতে হলে একটু অপেক্ষা করতে হবে। এই ঘরটি ইলেক্ট্রনিক্যালি শিল্ডেড। আপনার ফোনে নেটওয়ার্ক পাবেন না।”

আমার কোনো নেটওয়ার্ক সিগন্যালের দরকার নেই, বদ্ধ উন্মাদ কোথাকার। ফোনটা চোখের সামনে তুলে ধরে এলিজাবেথ, লোকটি কিছু বুঝে ওঠার আগেই দ্রুত একটা ছবি তুলে ফেলে। মোবাইল ক্যামেরার ফ্ল্যাশের আলো তার সবুজ চোখে প্রতিফলিত হলে কয়েক মুহূর্তের জন্য ডক্টরের মনে হয় লোকটাকে সে চেনে।

“আপনি যে-ই হোন না কেন,” বলে সে, “আমাকে এখানে ডেকে এনে মারাত্মক ভুল করেছেন। এয়ারপোর্টে পৌঁছানোর আগেই আমি বের করে ফেলবো আপনি কে। তারপর আপনার নাম বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা, সিডিসি এবং ইসিডিসি’র সম্ভাব্য বায়োটেররিস্টের তালিকায় ঠাঁই পাবে। আপনার উপর দিন রাত আমাদের লোকজন নজরদারি করবে। আপনি যদি কোনো ম্যাটেরিয়াল কেনার চেষ্টা করেন আমরা সঙ্গে সঙ্গে জেনে যাবো। যদি কোনো ল্যাব তৈরি করেন আমরা সেটাও জেনে যাবো। আমাদের চোখে ফাঁকি দিয়ে কোথাও পালাতে পারবেন না।”

দীর্ঘক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে লোকটি, যেনো তার ফোনসেটটি ছিনিয়ে নেবে এরপর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একটু সরে গিয়ে অদ্ভুত হাসি দিয়ে ওঠে। “তাহলে ধরে নিন, আমাদের নৃত্য শুরু হয়ে গেছে।”

.

অধ্যায় ৩২

ইল করিদোইয়ো ভাসারিয়ানো-দ্য ভাসারি করিডোর-মেদিচি শাসক গ্র্যান্ড ডিউক প্রথম কসিমের নির্দেশে ১৫৬৪ সালে ডিজাইন করেছিলেন স্বয়ং গিওর্গিও ভাসারি, এর উদ্দেশ্য ছিলো পিত্তি প্যালেস থেকে আরনো নদীর ওপারে পালাজ্জো ভেচ্চিও’তে অবস্থিত প্রশাসনিক ভবনের সাথে একটি নিরাপদ প্যাসেজ তৈরি করা।

ভ্যাটিকান সিটির বিখ্যাত পাসোত্তোর মতোই ভাসারি করিডোর একটি সিক্রেট প্যাসেজওয়ে। এটির দৈর্ঘ প্রায় এক কিলোমিটার, ববোলি গার্ডেনের পূর্ব কোণ থেকে পন্তে ভেচ্চিও অতিক্রম করে সর্পিলভাবে উফিজ্জি গ্যালারির মধ্য দিয়ে চলে গেছে পুরনো প্রাসাদ পর্যন্ত।

বর্তমান সময়েও ভাসারি করিডোর নিরাপদ প্যাসেজ হিসেবে ব্যবহৃত হয় তবে সেটা সম্ভ্রান্ত মেদিচি’দের জন্য নয়, বরং আর্টওয়ার্কের জন্য। এর দীর্ঘ এবং নিরাপদ দেয়ালের অভ্যন্তরে সংরক্ষিত আছে বিরল সব পেইন্টিং-বিখ্যাত উফিজ্জি গ্যালারির মধ্য দিয়েও চলে গেছে এটি তাই গ্যালারির বাড়তি সব ছবি রাখা আছে এখানে।

কয়েক বছর আগে ছুটি কাটাতে এখানে বেড়াতে আসে ল্যাংডন, তখন এই প্যাসেজওয়েটি ঘুরে ঘুরে দেখেছিলো। করিডোরের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় অসংখ্য পেইন্টিংয়ের সমাহার দেখে তার মাথা খারাপ হয়ে গেছিলো-এরমধ্যে রয়েছে এ বিশ্বের সবচাইতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আত্মপ্রতিকৃতির সংগ্রহ। বেশ অগ্রহ নিয়ে বেশ কয়েকবার থেমে করিডোরের ভিউয়িং পোর্টালগুলো উঁকি মেরে দেখেছে সে। এলিভেটেড ওয়াকওয়ে দিয়ে যাওয়ার সময় ভ্রমণকারীরা এসব পোর্টাল দিয়ে দেখে বুঝতে পারে তারা এখন কোথায় আছে।

আজ সকালে অবশ্য ল্যাংডন আর সিয়েনা দৌড়ে পার হতে লাগলো। করিডোেরটি। অন্যপ্রান্তে তাদের পিছু নেওয়া লোকগুলো থেকে যতোটা সম্ভব দূরে যাওয়াই তাদের উদ্দেশ্য। ল্যাংডন ভাবতে লাগলো হাত-পা-মুখ বাধা গার্ডকে আবিষ্কার করতে কতোটা সময় লাগতে পারে। তাদের সামনে টানেলটি যতোই কাছে চলে আসছে ল্যাংডন আঁচ করতে পারছে তারা যা খুঁজছে সেটা যেনো ক্রমশ এগিয়ে আসছে কাছে।

Cerca trova…মৃতের চোখ…এবং আমার পেছনে কে বা কারা লেগেছে সেটার জবাব।

সার্ভিলেন্স ড্রোনের আওয়াজটি তাদের থেকে এখন অনেক দূরে। টানেল ধরে যতোই এগোতে লাগলো ল্যাংডন ততোই তার মনে হতে লাগলো এই প্যাজেটি আর্কিটেকচেরাল দিক থেকে কতোটা উচ্চাভিলাষি ছিলো। প্রায় পুরোটা প্যাসেজই শহরের উপর দিয়ে এলিভেটেড হয়ে চলে গেছে। ভাসারি করিডোরটাকে মনে হয় বিশালাকারের সাপ, পিত্তি প্যালেস থেকে আরনো নদীর ওপারে পুরনো ফ্লোরেন্সের প্রাণকেন্দ্র পর্যন্ত চলে যাওয়ার সময় অসংখ্য বাড়িঘর পাশ কাটিয়ে চলে গেছে। সঙ্কীর্ণ, আর সাদা রঙ করা প্যাসেজওয়েটি মনে হয় অনন্ত এক যাত্রাপথ, মাঝেমধ্যে ডানে-বামে মোড় নিয়ে তার অভীষ্ট লক্ষ্য পূর্ব দিকে এগিয়ে গেছে আরনো নদীর ওপারে।

করিডোরের সামনে থেকে হঠাৎ করেই লোকজনের আওয়াজ ভেসে এলে থমকে দাঁড়ালো সিয়েনা। ল্যাংডনও থামলো তবে মেয়েটির কাঁধে হাত রেখে আশ্বস্ত করলো তাকে। কাছের একটি ভিউয়িং পোর্টালের দিকে ইঙ্গিত করলো সে।

নীচে পর্যটকের দল ঘুরে বেড়াচ্ছে।

পোর্টাল দিয়ে তাকিয়ে দেখলো তারা দু’জনে এখন পন্তে ভেচ্চিও’র উপরে আছে-মধ্যযুগে তৈরি হওয়া পাথরের একটি পায়েহাটা সেতু, যা পুরনো শহরের সাথে সংযোগ হিসেবে কাজ করছে। তাদের নীচে সকালের প্রথম দিকে আসা পর্যটকের দল কেনাকাটায় আর সেতুর উপর দিয়ে পারাপার হতেই ব্যস্ত। আজকের দিনে ওখানকার বেশিরভাগ দোকানই হলো স্বর্ণ আর অলঙ্কারের, তবে এরকমটি সব সময় ছিলো না। প্রথম দিকে এই সেতুর উপরে প্রচুর মাংসের। দোকান বসততা কিন্তু ১৫৯৩ সালের পর থেকে তাদেরকে আর দেখা যায় নি। এর কারণ ভাসারি করিডোর দিয়ে যাওয়ার সময় ডিউক মহোদয়ের সূক্ষ্ম-নাকে মাংসের কটু গন্ধ এসে লাগার পর তিনি ওখান থেকে সব ধরণের মাংসের দোকান উচ্ছেদ করার আদেশ দেন।

সেতুটির উপরে একটি নির্দিষ্ট জায়গার কথা মনে পড়লো ল্যাংডনের, ওখানে ফ্লোরেন্সের সবচাইতে কুখ্যাত নরহত্যাটি সংঘটিত হয়েছিলো ১২১৬ সালে। বুয়োনদেলমন্তে নামের সম্ভ্রান্ত পরিবারের এক যুবক ভালোবাসার মানুষটির জন্য পরিবারের পছন্দে অন্যত্র বিয়ে করতে রাজি না হওয়ায় তাকে এই সেতুর উপরে নির্মমভাবে খুন করা হয়।

তার মৃত্যুকে বিবেচনা করা হয় ‘ফ্লোরেন্সের ইতিহাসে রক্তাক্ত একটি অধ্যায় হিসেবে, কারণ এরফলে গুয়েলফ আর গিবিলিনিস’রা শত বছরের দীর্ঘ এক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এই রাজনৈতিক ঘটনাটি আবার দান্তেকে তার জন্মস্থান ফ্লোরেন্স ছাড়তে বাধ্য করেছিলো। সেজন্যে কবি তিক্ততার সাথে তার ডিভাইন কমেডিতে এ ঘটনাটিকে অমর করে রেখেছেন : ও বুয়েনদেলমন্তে, তুমি তোমার বিয়ের প্রতিশ্রুতি থেকে পালিয়ে কী তাণ্ডবই না বয়ে এনেছে।

আজকের দিনে সেতুটির উপরে খুন হবার সেই জায়গার কাছাকাছি তিনটি আলাদা আলাদা ফলক দেখা যায়-প্রত্যেকটাতেই দান্তের পারাদিসোর ১৬ ক্যান্টো থেকে উদ্ধৃতি রয়েছে। তাদের মধ্যে একটি আছে পন্তে ভেচ্চিও’র গোড়ায় : কিন্তু অন্তিম শান্তিতে ফ্লোরেন্সে একজন ক্ষতবিক্ষত হয় পাথরের সেতুর উপরে…হতভাগা একজন।

সেতুটির নীচে বয়ে যাওয়া পানির দিকে তাকালো ল্যাংডন। পশ্চিমে অবস্থিত পালাজ্জো ভেচ্চিও’র একমাত্র মিনারটির প্রতিবিম্ব পড়েছে ঢেউ খেলানো। জলরাশির উপর। ল্যাংডন আর সিয়েনা আরনো নদীর মাঝপথে থাকলেও তারা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারছে না এমন এক জায়গায় চলে যাচ্ছে যেখান থেকে ফিরে আসার কোনো পথ নেই।

.

ত্রিশ ফিট নীচে, পন্তে ভেচ্চিও’র কাঁকড় বিছানো পথের উপর ভায়েন্থা উদ্বিগ্ন হয়ে দলে দলে আসা লোকজনের ভীড়টাকে পর্যবেক্ষণ করছে। সে জানেও না তার একমাত্র মোক্ষ লাভের সুযোগটি কয়েক মুহূর্ত আগে মাথার উপর দিয়ে চলে গেছে।

.

অধ্যায় ৩৩

নোঙর করা মেন্দাসিয়াম-এর অনেক নীচে ফ্যাসিলিটেটর নোলটন তার নিজের কিউবিকলে বসে আছে, ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছে নিজের কাজের প্রতি মনোযোগ। দিতে। এক ঘণ্টা ধরে প্রচণ্ড আতঙ্কের সাথে সে ভিডিওটি দেখেছে বার বার, নয় মিনিটের আত্মকথনটি বিশ্লেষণ করে বুঝতে পারছে জিনিয়াস আর উন্মাদের মাঝমাঝি কিছু হবে এটি।

ভিডিওটি শুরু থেকে ফাস্ট-ফরোয়ার্ড করে কোনো কু খোঁজার চেষ্টা করলো। হয়তো এরকম কিছু তার চোখে পড়ে নি। পানিতে ডুবে থাকা ফলক…উজ্জ্বল হলুদ-বাদামী তরলের ব্যাগ বাদ দিয়ে…পাখির চঞ্চুসদৃশ্য অবয়বটিতে চলে এলো আবার-পানি চুঁইয়ে পড়া গুহার দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে আছে বিকৃত একটি অবয়ব…নীচ থেকে তার মুখে এসে পড়েছে মৃদু লালচে আলো।

ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠটা শুনলো নোলটন, রূপকাশ্রয়ী কথাগুলোর মানে খোঁজার চেষ্টা করলো সে। বক্তব্যের মাঝখানে দেয়ালের অবয়বটি আরো বড় হয়ে গেলো, কণ্ঠটাও হয়ে উঠলো চড়া।

দান্তের নরক কোনো কল্পিত বিষয় নয়…এটা ভবিষ্যৎবাণী!
সীমাহীন দুর্দশা। তীব্র যন্ত্রণাময় দুর্ভোগ। এটাই ভবিষ্যতের চিত্র।
লাগামহীনভাবে বৃদ্ধি পাওয়া মানবজাতি প্লেগ আর ক্যান্সারের মতোই আচরণ করবে…প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম আমাদের সংখ্যা বেড়েই চলবে যতোক্ষণ না এক সময় আমাদের সদগুনগুলোকে পরিপুষ্ট করা পার্থিব স্বস্তি এবং ভ্রাতৃত্ববোধ পুরোপুরি নিঃশেষ হয়ে পড়বে…জেগে উঠবে আমাদের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা দানব…সন্তানদের আহার জোগাতে মারামারি খুনোখুনি করবে সবাই।
এটাই দান্তের নয়টি চক্রের নরক।
এটাই অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।
ম্যালথাসের গাণিতিক হিসেবের মতো হিংস্র ভবিষ্যৎ আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে, আমরা এখন দাঁড়িয়ে আছি নরকের প্রথম চক্রে…জানি না কতো দ্রুত আরো নীচে তলিয়ে যাবার দ্বারপ্রান্তে রয়েছি আমরা।

ভিডিওটা পজ করলো নোলটন। ম্যালথাসের অঙ্ক? ইন্টারনেট ব্রাউজ করে দ্রুত জেনে নিলো উনিশ শতকের ইংরেজ গণিতজ্ঞ এবং জনসংখ্যাবিদ টমাস রবার্ট ম্যালথাস সম্পর্কে। জনসংখ্যার বৃদ্ধির ব্যাপারে ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব হিসেবে পরিচিত একটি ভয়াবহ মতবাদ রয়েছে তার। পৃথিবীর জনসংখ্যার তার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলে বিরাট বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে যাবে সব কিছু। তখন মানুষ খাদ্য-পানীয় আর প্রয়োজনীয় দ্রব্যের অভাবে একে অন্যের সাথে মারামারি করে রোগব্যধিতে ভুগে নিঃশেষ হতে শুরু করবে।

ম্যালথাসের জীবনী এবং তার বিখ্যাত বই অ্যান এসে অন দি প্রিন্সিপ্যাল অব পপুলেশন্স-এর কিছু উদ্ধৃতি পড়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে উঠলো নোলটন;

জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার এই ধরিত্রীতে মানুষের জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদের উৎপাদনের চেয়ে অনেক বেশি। সে-কারণে মানবপ্রজাতির মধ্যে অকাল মৃত্যুর হার বেড়ে যাবে একটা সময়। মানুষের নৈতিক গুণাবলীর বিনাশের কারণে দ্রুত কমে আসবে জনসংখ্যা। ফলশ্রুতিতে মানবপ্রজাতি হয়ে উঠবে ধ্বংসযজ্ঞের এক বিরাট সৈন্যবাহিনী। প্রায়শই তারা লিপ্ত হবে মারামারি আর খুনখারাবির মতো কাজে। পরিবেশ বিপর্যয়, খারাপ ঋতুর আবির্ভাব, মহামারি, খরা, অতিবৃষ্টি, প্লেগের মতো ভয়ঙ্কর রোগে আক্রান্ত হবে। তারা, হাজারে হাজারে, লাখ লাখে মানুষ মৃত্যুবরণ করবে, দ্রুত কমে আসবে পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা। এরপরও দুর্দশার শেষ হবে না, ধেয়ে আসবে সর্বব্যাপী দুর্ভিক্ষ, আর এই দুর্ভিক্ষের কষাঘাতে অতি দ্রুত পৃথিবীর জনসংখ্যা হ্রাস পেয়ে সহ্যসীমার মধ্যে চলে আসবে।

এটা পড়ে নোলটনের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো, পজ করা ভিডিওতে পাখির ঠেটিসদৃশ্য অবয়বটির দিকে তাকালো সে।

লাগামহীন মানবজাতি প্লেগ আর ক্যান্সারের মতো আচরণ করবে।

লাগামহীন। কথাটা নোলটন পছন্দ করলো না।

দ্বিধার সাথেই ভিডিওটা আবার প্লে করলো সে।

ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠটা বলে যাচ্ছে :

হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা মানে দান্তের নরককে স্বাগত জানানো…গাদাগাদি করে অনাহারে থেকে পাপের সাগরে ডুবে যাওয়া।

তাই সাহসী একটি পদক্ষেপ নিয়েছি আমি।

অনেকেই হয়তো ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাবে, কিন্তু মুক্তির জন্যে সব সময়ই মূল্য চুকাতে হয়।

একদিন পৃথিবী আমার এই আত্মত্যাগের সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে পারবে।

আমিই যে তোমাদের মোক্ষ।

আমি সেই ছায়া।

আমি পোস্টহিউম্যান যুগের প্রবেশদ্বার।

.

অধ্যায় ৩৪

পালাজ্জো ভেচিওর সাথে বিশাল বড় একটি দাবাবোর্ডের বেশ সাদৃশ্য রয়েছে। এর সুদৃঢ় আয়তক্ষেত্রের সম্মুখভাগটি বর্গাকৃতিতে খাঁজ কাটা, দেখতে অনেকটা দাবা খেলার ঘুঁটি কিস্তির মতো, পিয়াজ্জা দেল্লা সিনোরিয়ার দক্ষি-পূর্ব দিকে অটল প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে।

ভবনটির ব্যতিক্রমধর্মী দূর্গের মতো একটি চতুষ্কোন মিনার ফ্লোরেন্স শহরের প্রতাঁকে পরিণত হয়েছে। ইটালিয়ান সরকারের একটি ভবন হিসেবে শক্তিমত্তা প্রকাশ করার জন্যই বুঝি এর সম্মুখভাবে পেশীবহুল মানুষের কিছু মূর্তি রয়েছে, আর সেটা যেনো বেড়াতে আসা অতিথিদেরকে প্রকারান্তরে ভয়ই দেখায়। আম্মন্নাতি’র পেশীবহুল নেপচুন নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে চারটি ঘোড়ার উপর, সমুদ্রে ফ্লোরেন্সের যে আধিপত্য সেটারই যেনো প্রতীকিরূপ হিসেবে। বিশ্ববিখ্যাত ভাস্কর্য মাইকেলাঞ্জেলোর ডেভিড-এর একটি রেপ্লিকা স্থাপন করা হয়েছে। পালাজ্জোর প্রবেশপথের সামনে। ডেভিড-এর সাথে যোগ দিয়েছে হারকিউলিস আর ককাস-বিশালাকারের আরো দুটো নগ্ন পুরুষ মূর্তি-যারা নেপচুন-এর সাটুর-এর সাথে জোটবদ্ধ হয়ে নিজেদের লিঙ্গ প্রদর্শন করে পালাজ্জো’তে আসা দর্শনার্থীদেরকে স্বাগত জানাচ্ছে!

সাধারণত ল্যাংডন পিয়াজ্জী দেল্লা সিনোরিয়া থেকে তার পালাজ্জো ভেচ্চিও ভ্রমণ শুরু করে থাকে, ওখানকার নগ্নমূর্তি আর সেগুলোর লিঙ্গ-আধিক্য সত্ত্বেও ইউরোপের প্রাজাগুলোর মধ্যে ওটাই তার কাছে সবচাইতে প্রিয়। লগিয়া দেই লানজি’তে অবস্থিত মেদিচি’দের উন্মুক্ত ভাস্কর্যের গ্যালারির সিংহগুলো দেখার পর ক্যাফে রিভয়রি’তে বসে এসপ্রেসো কফি না খেলে পিয়াজ্জা দর্শন পূর্ণতা পায় না।

আজ ল্যাংডন আর তার সঙ্গি পরিকল্পনা করেছে তারা পালাজ্জো ভেচ্চিও’তে প্রবেশ করবে ভাসারি করিডোর দিয়ে, অনেকটা মেদিচি’দের আমলে ডিউকেরা যেভাবে ওখানে যেতো, ঠিক সেভাবে বিখ্যাত উফিজ্জি গ্যালারিটা পাশ কাটিয়ে করিডোের দিয়ে এঁকেবেঁকে পুরনো প্রাসাদের ভেতরে। এ পর্যন্ত আসার পরও তারা কোনো পায়ের শব্দ শুনতে পেলো না পেছনে তারপরও করিডোর থেকে বের হওয়া নিয়ে ল্যাংডন একটু উদ্বিগ্ন বোধ করছে।

এখন আমরা পৌঁছে গেছি, বুঝতে পারলো ল্যাংডন। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে বিশাল আর ভারি কঠের দরজাটি। পুরনো প্রাসাদে ঢোকার পথ।

অত্যাধুনিক মেকানিজমের তালা থাকার পরও দরজায় রয়েছে একটি হরাইজন্টাল বার।

দরজায় কান পেতে শোনার চেষ্টা করলো ল্যাংডন। ওপাশ থেকে কিছুই শুনতে পেলো না। বারটা ধরে আস্তে করে ধাক্কা দিলো সে।

লকটা ক্লিক করে শব্দ করলো।

কাঠের দরজাটি কয়েক ইঞ্চির মতো ফাঁক হতেই ল্যাংডন উঁকি মেরে দেখলো ওপাশটা। ছোট্ট একটি প্রকোষ্ঠের মতো। ফাঁকা। নীরব।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে দরজা খুলে সরে দাঁড়ালো সে, সিয়েনাকে ইশারা করলো ভেতরে প্রবেশ করার জন্য। আমরা ভেতরে ঢুকে পড়ছি।

পালাজ্জো ভেচ্চিও’র ভেতরে নিরিবিলি সেই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ল্যাংডন নিজের চিন্তাভাবনা গুছিয়ে নিলো। তাদের সামনে একটি দীর্ঘ হলওয়ে দরজার কাছ থেকে মোড় নিয়ে চলে গেছে বহু দূরে। তাদের বামে, কিছুটা দূর থেকে মৃদু কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। শান্ত আর প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা। পালাজ্জো ভেচ্চিও অনেকটা ইউনাইটেড স্টেটসের ক্যাপিটল ভবনের মতোই একই সঙ্গে সরকারী অফিস এবং পর্যটকদের জন্য একটি দর্শণীয় স্থান। সকালের এ মুহূর্তে যে কণ্ঠগুলো শোনা যাচ্ছে সেগুলো মূলতঃ সিভিল সার্ভিসের কর্মচারীদের। দিনের কাজকর্ম শুরু করার প্রস্তুতি নিতে যাচ্ছে তারা।

হলওয়ের কিছুটা সামনে এগিয়ে কর্নারে গিয়ে মেরে দেখলে ল্যাংডন আর সিয়েনা। এটা নিশ্চিত, হলওয়ের শেষদিকে একটি খোলা জায়গা আছে, সেখানে কয়েক ডজন সরকারী কর্মচারী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছে আর এসপ্রেসি। কফিতে চুমুক দিচ্ছে।

“ভাসারির মুরাল,” সিয়েনা ফিসফিসিয়ে বললো, “তুমি বলছো ওটা হল অব ফাইভ হান্ড্রেড-এ আছে?”

মাথা নেড়ে সায় দিয়ে খালি জায়গাটার দিকে ইঙ্গিত করলো, ওখানে একটি প্রবেশপথ দেখা যাচ্ছে। খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে হলওয়েটাও চোখে পড়ছে দূর থেকে। “সমস্যা হলো ঐ খোলা জায়গাটা পেরিয়ে ওখানে যেতে হবে।”

“তুমি নিশ্চিত?”

সায় দিলো ল্যাংডন। “তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে আমরা ওখানে যেতে। পারবো না।”

“তারা সবাই সরকারী কর্মচারী। আমাদেরকে লক্ষ্য করবে না তারা। এমনভাবে হেঁটে যাবে যেনো তুমিও এখানকারই একজন।”

সিয়েনা ল্যাংডনের সুটটা ঠিকঠাক করে ধুলো-ময়লা ঝেড়ে দিয়ে কলারটাও ঠিক করে দিলো। “তোমকে দেখে বেশ লাগছে, রবার্ট।” দুষ্টু হাসি দিলো মেয়েটি। এরপর নিজের সোয়েটারও ঠিকঠাক করে খালি জায়গার দিকে পা বাড়ালো।

তাকে অনুসরণ করলো ল্যাংডন। একেবারে স্বাভাবিকভাবেই তারা দু’জন। হেঁটে গেলো খোলা জায়গাটার দিকে। জায়গাটার কাছাকাছি আসতেই সিয়েনা ইতালিয়ান ভাষায় অনর্গল কথা বলতে শুরু করলো ল্যাংডনের সাথে-কৃষিখামারের ভর্তুকি বিষয়ক কথাবার্তা। আস্তে আস্তে দেয়ালের কাছ ঘেষে তারা এগিয়ে যেতে লাগলো এভাবে। ল্যাংডন অবাক হয়ে দেখতে পেলো কেউ তাদের দিকে দ্বিতীয়বারের মতো তাকাচ্ছে না।

খোলা জায়গাটা পেরিয়ে তারা দু’জন হলওয়ের দিকে এগোলো।

শেক্সপিয়ারের প্লেবিলের কথা মনে পড়ে গেলো ল্যাংডনের। দুষ্ট পুক। “তুমি তো দেখছি পাক্কা অভিনেত্রী,” বিড়বিড় করে বললো সে।

“সেটাই তো ছিলাম,” স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বলে দিলো সিয়েনা। তার কণ্ঠ শুনে একটু উদাস মনে হলো।

আরো একবার ল্যাংডনের মনে হলো সে যতোটুকু জানতে পেরেছে। তারচেয়ে অনেক বেশি দুঃখ-যন্ত্রণা রয়েছে এই মেয়েটির অতীত জীবনে। এরকম বিপজ্জনক একটি পরিস্থিতিতে তাকে জড়িয়ে ফেলে এক ধরণের অনুশোচনা বোধও হলো তার। নিজেকে এই বলে স্মরণ করিয়ে দিলো, এখনও কোনো কিছু করা হয় নি, শুধুমাত্র এটাকে দেখা ছাড়া।

টানেল দিয়ে সাঁতরে যাও…আর প্রার্থনা করো আলো যেনো দেখা যায়।

হলওয়ে দিয়ে ঢোকার সময় ল্যাংডনের মনে হলো তার স্মৃতি ভালোমতোই কাজ করতে শুরু করেছে। হলওয়ের এক কর্নারে ছোট্ট একটি ফলকে তীর চিহ্ন দিয়ে লেখা আছে : ইল সালোনি দেই সিকোয়েনসেন্তা। দ্য হল অব দি ফাইভ হান্ড্রেড, মনে মনে বললো ল্যাংডন। আশা করলো প্রশ্নগুলোর জবাব হয়তো এখানেই নিহিত আছে। শুধুমাত্র মৃতের চোখেই সত্য দেখতে পাবে। এর মানে কি?

“রুমটা হয়তো এখনও লক করা আছে,” কর্নারের কাছে আসতেই ল্যাংডন বললো। হল অব ফাইভ হান্ড্রেড পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও এই সকালে এখনও পালাজ্জো খোলা হয় নি।

“তুমি কি এটা শুনছো?” থমকে দাঁড়িয়ে বললো সিয়েনা।

ল্যাংডনও শুনতে পেলো সেটা। কর্নার থেকে একটা মেশিনের গুঞ্জন ভেসে আসছে। দয়া করে বলবে না এটা একটা ইনডোর ড্রোন। সতর্কতার সাথে ল্যাংডন কনার দিয়ে উঁকি মেরে দেখলো।

ত্রিশ গজ দূরে হল অব ফাইভ হান্ড্রেডের কাঠের দরজাটির সামনে এক কেয়ারটেকার লোক ক্লিনিং মেশিন দিয়ে মেঝে পরিস্কার করে যাচ্ছে।

দরজার প্রহরী।

দরজার বাইরে তিনটি সিম্বলের একটি প্লাস্টিক সাইনবোর্ডের একটির দিকে মনোযোগ গেলো ল্যাংডনের। এমনকি নগন্য একজন সিম্বলজিস্টের পক্ষেও এটার মর্মোদ্ধার করা সহজ, এগুলো বর্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপী সার্বজনীন আইকনে পরিণত হয়েছে : একটি ভিডিও ক্যামেরা, কাপের আইকনের উপর X চিহ্ন দেয়া; একটা বক্সের ভেতর নারী-পুরুষের অবয়ব।

ল্যাংডন এবার এগিয়ে গেলো দ্বাররক্ষীর দিকে। পেছন পেছন সিয়েনা।

দ্বাররক্ষী মুখ তুলে তাকাতেই অবাক হয়ে বলে উঠলো, “সিনোরি?” ল্যাংডন আর সিয়েনাকে হাত তুলে থামার ইশারা করলো সে।

ল্যাংডন তার দিকে তাকিয়ে যন্ত্রনাদায়ক হাসি দিয়ে-অনেকটা চোখমুখ কোঁচকানোর মতো করে-দরজার উপরে সিম্বলগুলোর দিকে ইঙ্গিত করলো। “তয়লেত্তে,” কণ্ঠ চেপে বললো সে।

দ্বাররক্ষী কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করলেও ল্যাংডনকে তার সামনে অস্বস্তিকর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সহমর্মিতার সাথে মাথা নেড়ে ভেতরে যাবার অনুমতি দিলো।

দরজার কাছে গিয়ে সিয়েনার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে দিলো ল্যাংডন। “সহানুভূতি হলো সার্বজনীন একটি ভাষা।”

.

অধ্যায় ৩৫

এক সময় হল অব ফাইভ হান্ড্রেড ছিলো এ বিশ্বের সবচেয়ে বড় ঘর। এটা নির্মাণ করা হয়েছিলো ১৪৯৪ সালে পুরো রিপাবলিকের পাঁচশত সদস্যের গ্র্যান্ড কাউন্সিল, তথা কনসিগলিও ম্যাগ্নিওরি’র মিটিংয়ের জন্য, আর এ থেকেই হলটির এমন নামকরণ।

কয়েক বছর পর প্রথম কসিমোর শাসনামলে এটাকে সংস্কার করে আরো বড় করা হয়। প্রথম কসিমো ছিলেন ইটালির সবচেয়ে ক্ষমতাবান ব্যক্তি, তিনি পুরো প্রজেক্টের দায়িত্ব এবং এর স্থপতি হিসেবে নিয়োগ দেন মহান গিওর্গিও ভাসারিকে।

অসাধারণ প্রকৌশলের নিদর্শন এই ভবনটির ছাদ ভাসারি আরো উঁচু করে দেন। বাইরে থেকে আলো-বাতাস ঢোকার জন্য ঘরের চারদিকে ছাদের নীচ থেকে অসংখ্য জানালাও জুড়ে দেন তিনি। এরফলে ফ্লোরেন্সের সবচেয়ে অভিজাত শোরুম হিসেবে এটি পরিণত হয়, যেখানে রাখা হয়েছে ফ্লোরেন্সের অসাধারণ সব স্থাপত্য, ভাস্কর্য আর পেইন্টিং।

ল্যাংডনের কাছে অবশ্য এর মেঝেটাই সবথেকে আকর্ষণীয় বলে মনে হয়। এখানে এলেই তার চোখ চলে যায় ঐ মেঝের দিকে। মেঝেটা কোনো সাধারণ স্থান নয়। লালচে পাথরের পারকোয়েটের মেঝের উপর কালো গ্রিড থাকায় বারো হাজার বর্গফিটের জায়গাটিকে অনেক বেশি দৃঢ়, মজবুত, গভীর আর ভারসাম্যপূর্ণ বলে মনে হয়।

ঘরের একপ্রান্তে চোখ তুলে তাকালো ল্যাংডন, ওখানে রাখা আছে ছয়টি ডায়নামিক ভাস্কর্য-দ্য লেবারস অব হারকিউলিস অ্যান্ড ডায়োমিডিস-ছয়জনের একটি সৈন্যদল। ল্যাংডন ইচ্ছে করেই দেখতে অপ্রীতিকর হিসেবে তকমা জুড়ে দেয়া হারকিউলিস অ্যান্ড ডায়োমিডিস-এর উপর থেকে চোখ সরিয়ে নিলো, যাদের নগ্ন শরীর কুস্তিরত অবস্থায় আছে, একে অন্যের লিঙ্গ ধরে রেখেছে। তারা-পেনাইল গ্রিপ-এটা দেখলেই ল্যাংডনের ভুরু কুচকে যায়।

ডানে দক্ষিণ দিকের দেয়াল বরাবর দাঁড়িয়ে আছে মাইকেলাঞ্জেলোর অসাধারণ কাজ জিনিয়াস অব ভিক্টরি, এটা বরং অনেক বেশি প্রীতিকর। প্রায় নয় ফিট উঁচু এই ভাস্কর্যটি অতিরক্ষণশীল পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াস, যিনি ইল পাপা তেরিবিলি হিসেবেই বেশি পরিচিত ছিলেন, তার সমাধিতে স্থাপন করার উদ্দেশ্যে বানানো হয়েছিলো। সমকামীতাকে ভ্যাটিকান যে চোখে দেখে সেটা বিবেচনায় নিলে এই ব্যাপারটা ল্যাংডনের কাছে নিয়তির নির্মম পরিহাস বলেই মনে হয়। মূর্তিটি তমাসো দেই কাভালিয়েরি নামের এক যুবকের আদলে নির্মাণ করে তার বিখ্যাত প্রেমিক মাইকেলাঞ্জেলো। এই প্রেমিককে উদ্দেশ্য করেই মহান ভাস্কর লিখেছিলেন তিনশ’য়ের মতো সনেট।

“আমি বিশ্বাস করতে পারছি না এর আগে এখানে আসি নি,” পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সিয়েনা আপন মনে বলে উঠলো। হঠাৎ করেই তার কণ্ঠ শান্ত আর গম্ভীর হয়ে উঠেছে। “এটা খুবই সুন্দর।”

সায় দিলো ল্যাংডন। তার মনে পড়ে গেলো এখানে প্রথম আসার দিনটির কথা-পৃথিবীর বিখ্যাত ক্লাসিক্যাল পিয়ানোবাদক মারিয়েলি কেইমেলের একটি কনসার্ট। এই হলটি যদিও রাজনৈতিক মিটিং আর গ্র্যান্ড ডিউকদের আলোচনা সভা করার উদ্দেশ্যে বানানো হয়েছিলো, কিন্তু আজকাল এখানে জনপ্রিয় সঙ্গীতকার, লেকচারার, গালা পার্টি আর ডিনারের আয়োজন চলে। শিল্পকলার ইতিহাসবিদ মরিজিও সেরাসিনি থেকে শুরু করে গুচ্চি মিউজিয়ামের অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের লেকচার যেমন চলে তেমনি ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট-এর ফ্যাশন শো পর্যন্ত এখানে অনুষ্ঠিত হয়। মাঝেমধ্যে ল্যাংডন ভাবে, প্রথম কসিমো যদি দেখতেন তার জমকালো ব্যক্তিগত হলটি সিইও আর ফ্যাশন মডেলে পরিপূর্ণ হয়ে আছে তাহলে তার কেমন লাগতো।

এবার দেয়ালজুড়ে থাকা বিশাল মুরালের দিকে তাকালো ল্যাংডন। তাদের উদ্ভট একটা ইতিহাস আছে, এরমধ্যে রয়েছে লিওনার্দো দা ভিঞ্চির ব্যর্থ পেইন্টিং টেকনিক এক্সপেরিমেন্ট, যার ফলে জন্ম নেয় একটি গলিত-মাস্টারপিস। পিয়েরো সোদারিনি আর ম্যাকিয়াভেলির নেতৃত্বে আরেকটি আর্টিস্টিক শো ডাউনও হয়েছিলো এখানে। ফলে রেনেসাঁর এই দুই কাণ্ডারি মাইকেলাঞ্জেলো আর লিওনার্দো ভিঞ্চির মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিলো এক ধরণের প্রতিযোগীতা। তাদেরকে আদেশ করা হয়েছিলো একই ঘরে মুখোমুখি দুই দেয়ালে তারা যেনো দুটি ম্যুরাল সৃষ্টি করে।

আজ অবশ্য ল্যাংডনের সমস্ত মনোযোগ অন্য একটি ঐতিহাসিক রহস্যময়তার দিকে নিবদ্ধ।

Cerca trova.

“কোটা ভাসারির?” মুরালগুলো দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করলো সিয়েনা।

“বলতে গেলে প্রায় সব কটাই,” জবাবে জানালো ল্যাংডন, সে জানে এই ঘরটা সংস্কার করার সময় ভাসারি তার সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে ঘরের প্রায় সব মুরালগুলোই আবার পেইন্টিং করেছিলেন।

“তবে ঐযে মুরালটি দেখছো,” দূরের ডান দিকে একটি মুরাল দেখিয়ে বললো ল্যাংডন, “ওটা দেখতেই আমরা এখানে এসেছি-ভাসারির ব্যাটল অব মার্সিয়ানো।”

মুখোমুখি অবস্থানে থাকা দুই সামরিক বাহিনীর চিত্রটি বিশাল-পঞ্চান্ন ফিট লম্বা এবং তিনতলার মতো উঁচু। ছবিটাতে ধূসর আর সবুজের প্রভাব বেশি-সৈনিক, ঘোড়া, বর্শা আর নিশানের সহিংস এক প্যানোরামা।

“ভাসারি, ভাসারি,” ফিসফিসিয়ে বললো সিয়েনা। “এখানেই কোথাও তার সিক্রেট মেসেজটি লুকিয়ে রাখা আছে?”

মুরালের উপরে তাকিয়ে মাথা নেড়ে সায় দিলো ল্যাংডন। সবুজ রঙের একটি যুদ্ধের নিশানা খুঁজে বেড়ালো সে, যেটাতে ভাসারি রহস্যময় সেই মেসেজটি লিখে রেখেছেন-CERCATR0VA। “বায়নোকুলার ছাড়া নীচ থেকে ওটা খালি চোখে দেখা প্রায় অসম্ভব,” ল্যাংডন কথাটা বলেই উপরের একটা জায়গা দেখালো, “তবে উপরের মাঝামাঝি জায়গাটায়, পাহাড়ের পাশে ঐ যে খামার বাড়িটা দেখা যাচ্ছে, তার নীচে যদি দেখো, তাহলে ছোট্ট একটা সবুজ রঙের নিশানা দেখতে পাবে।”

“দেখেছি!” ঠিক জায়গাতেই তার চোখ পড়েছে।

এরকম তারুণ্যভরা চোখ যদি তার থাকতো, একটু আফসোসই করলো ল্যাংডন।

তারা দু’জন মুরালটির দিকে আরেকটু এগিয়ে গেলো। অবশেষে তারা এখানে এসেছে। তবে একটাই সমস্যা, ল্যাংডন জানে না তারা কেন এখানে এসেছে। কোনো কথা না বলে চুপচাপ ভাসারির মাস্টারপিসটা দেখে গেলো সে।

আমি যদি ব্যর্থ হই…তাহলে সবাই মারা যাবে।

তাদের পেছনে দরজাটা মৃদু শব্দ করে খুলে গেলে দ্বাররক্ষীকে দেখা গেলো মেঝে পরিস্কার করার যন্ত্র নিয়ে উঁকি মারছে। সিয়েনা তার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে হাত নাড়লো। দ্বাররক্ষী কয়েক মুহূর্ত তাদের দিকে চেয়ে থেকে দরজাটা। বন্ধ করে দিলো আবার।

“আমাদের হাতে বেশি সময় নেই, রবার্ট,” তাড়া দিলো সিয়েনা। “তোমাকে ভাবতে হবে। এই পেন্টিংটা দেখে কি তোমার কিছু মনে পড়ছে? যেকোনো ধরণের স্মৃতি?”।

ছবিটার দিকে ভালো করে তাকালো ল্যাংডন।

শুধুমাত্র মৃতের চোখেই সত্য দেখতে পাবে।

ল্যাংডন ভেবেছিলো সম্ভবত এই ম্যুরালে কোনো লাশ ফাঁকা দৃষ্টিতে চেয়ে থাকবে ছবিতে থাকা অন্য কোনো কুর দিকে…কিংবা এই ঘরের কোথাও। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো ল্যাংডন এখন মুরালে কম করে হলেও কয়েক ডজন লাশ দেখতে পাচ্ছে কিন্তু তাদের কারোর চোখই নির্দিষ্ট কোথাও চেয়ে নেই।

শুধুমাত্র মৃতের চোখেই সত্য দেখতে পাবে?

একটি লাশ থেকে আরেকটি লাশের মধ্যে রেখা টেনে কোনো সংযোগ বের করার চেষ্টা করলো সে, ভাবলো কোনো আকৃতি দাঁড়ায় কিনা। কিন্তু কিছুই খুঁজে পেলো না।

জোর করে স্মৃতি হাতরাতে গিয়ে ল্যাংডন টের পেলো তার মাথা ব্যথাটা আবার ফিরে এসেছে। মাথার ভেতরে কোথাও থেকে যেনো সাদা-চুলের ঐ মহিলা ফিসফিসিয়ে বলছে : খুঁজলেই পাবে।

“কি খুঁজবো?!” চিৎকার করে বলতে চাইলো ল্যাংডন।

জোর করে চোখ দুটো বন্ধ করে ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলো সে। সচেতন চিন্তা থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করলো। আশা করলো তার স্বজ্ঞা তাকে কিছু ইঙ্গিত দেবে।

ভেরি সরি।

ভাসারি।

Cerca trova।

শুধুমাত্র মৃতের চোখেই সত্য দেখতে পাবে।

তার মন বলছে, সে একদম সঠিক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। নিশ্চিত করে। বলতে পারবে না, তবে কেন জানি তার এও মনে হচ্ছে কয়েক মুহূর্ত পরই যা। খুঁজতে এসেছে তা পেয়ে যাবে।

.

ডিসপ্লে কেসের মধ্যে থাকা লাল ভেলভেটের প্যান্ট আর টানিকের দিকে উদাস হয়ে চেয়ে আছে এজেন্ট ব্রুডার, মনে মনে অভিসম্পাত দিচ্ছে। পুরো কস্টিউম গ্যালারিটা তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখেছে তার এসআরএস টিম কিন্তু কোথাও ল্যাংডন আর সিয়েনা ব্রুকসের খোঁজ পায় নি।

সার্ভিলেন্স আর রেসপন্স সাপোর্ট, রেগেমেগে ভাবলো সে। এতো কিছু থাকার পরও একজন কলেজ শিক্ষক এসআরএস টিমকে ফাঁকি দিতে পারলো? তারা গেছেটা কোথা!

“প্রতিটি এক্সিট সিল করা আছে, তার এক লোক বললো তাকে। “একমাত্র সম্ভাবনা হলো, ওরা এখনও গার্ডেনেই আছে। এখানে আসে নি।”

কথাটা তার কাছে যৌক্তিক বলে মনে হলেও সঙ্গে সঙ্গে ব্রুডারের মনে হতে লাগলো, ল্যাংডন আর সিয়েনা এরইমধ্যে অন্য কোনো পথ খুঁজে পেয়েছে।

“ড্রোনটা আবার ওখানে পাঠাও,” ঝটপট বলে উঠলো ব্রুডার। “স্থানীয় পুলিশকে বলো গার্ডেনের দেয়ালের বাইরেও যেনো ব্যাপক তল্লাশী অভিযান চালায়। ধুর বাল!

তার লোকজন দ্রুত কাজে নেমে পড়তেই ব্রুডার ফোনটা বের করে দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিকে কল করলো। “ব্রুডার বলছি,” বললো সে। “বলতে বাধ্য হচ্ছি, খুবই বড়সড় একটা ঝামেলায় পড়ে গেছি আমরা। সত্যি বলতে, অনেকগুলো ঝামেলা।”

.

অধ্যায় ৩৬

শুধুমাত্র মৃতের চোখেই সত্য দেখতে পাবে।

ভাসারির নৃশংস যুদ্ধের ছবিটার প্রতিটি ইঞ্চি পর্যবেক্ষণ করার সময় সিয়েনা বার বার এ কথাটি বলে গেলো মনে মনে। তার আশা কিছু একটা পাওয়া যাবে এখানে।

সবত্রই লাশের চোখ দেখতে পাচ্ছে সে।

কোনটাতে আমরা খুঁজবো?!

সে ভাবতে লাগলো সম্ভবত মৃতের চোখ বলতে ব্ল্যাক ডেথের ছোবলে সারা ইউরোপে যে অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি হয়েছে তার কথাই বলা হয়েছে।

নিদেনপক্ষে প্লেগের মুখোশের ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করে…

হুট করেই শৈশবের একটি ছড়া মনে পড়ে গেলো তার : Ring around the rosie. A pocketful of posies. Ashes, ashes. We all fall down!

ইংল্যান্ডে থাকার সময় স্কুলে যখন পড়তো তখন এই ছড়াটা সে প্রায় আবৃত্তি করতো যতোদিন না জানতে পেরেছিলো এটা ১৬৬৫ সালে লন্ডনের গ্রেট প্লেগ থেকে উদ্ভুত। বলা হয়ে থাকে Ring around the rose বলতে এখানে প্লেগ রোগের সিমটম হিসেবে শরীরে যে লাল-লাল গোটা হয় সেটার কথা বলা হয়েছে। আক্রান্ত ব্যক্তি A pocketful of posies অর্থাৎ পকেট ভর্তি ফুল রাখতো নিজের দেহের চামড়ায় পচনের ফলে যে দুর্গন্ধ হতো সেটা আড়াল করার জন্য। প্রতিদিন শত শত মানুষ প্লেগের করাল গ্রাসে মৃত্যুবরণ করতো আর তাদের লাশগুলো আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হতো সঙ্গে সঙ্গে। তাই ছড়াটাতে উল্লেখ করা হয়েছে : Ashes, ashes. We all fall down.

“ফর দি লাভ অব গড,” আচমকা বিড়বিড় করে বলে উঠলো ল্যাংডন। সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে বিপরীত দিকের দেয়ালে মুখ করে দাঁড়ালো।

তার দিকে তাকালো সিয়েনা। “কি হয়েছে?”

“এক সময় এ নামে একটি আর্টপিস এখানে ডিসপ্লে করা হয়েছিলো। ফর দি লাভ অব গড।”

অবাক হয়ে সিয়েনা দেখতে পেলো ল্যাংডন ঘরের অন্যপ্রান্তে ছোট্ট একটি কাঁচের দরজার দিকে ছুটে গিয়ে সেটা খোলার চেষ্টা করছে। দরজাটা লক করা। কাঁচের দরজায় গাল ঠেকিয়ে ভেতরে দেখার চেষ্টা করলো সে।

সিয়েনা আশা করলো, ল্যাংডন যা-ই খুঁজুক না কেন সে যেনো দ্রুত সেটা করে কারণ দ্বাররক্ষী আবারো ঘরে ফিরে এসেছে, ল্যাংডনকে লক করা কাঁচের দরজার সামনে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে সে।

দ্বাররক্ষীর দিকে তাকিয়ে আবারো হাত নেড়ে মিষ্টি করে হাসলো সিয়েনা কিন্তু লোকটা তার দিকে শীতল চোকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চলে গেলো।

লো স্তুদিওলো।

কাঁচের দরজার ওপাশে, ঠিক যেখানে cerca trova শব্দটি লেখা আছে, তার বিপরীতে জানালাবিহীন ছোট্ট একটি কক্ষ আছে। প্রথম ফ্রান্সেস্কোর গোপনে। স্টাডি করার জন্য এটির নক্সা করে দেন ভাসারি। আয়তক্ষেত্রের এই দিওলোটির উপরের দিকে ব্যারেল-ভল্টেড সিলিংয়ের দিকে উঠে গেছে সিলিন্ডার আকৃতিতে। এরফলে কক্ষটির ভেতরে ঢুকলে মনে হবে বিশাল আকারের সিন্দুকের ভেতরে আছে বুঝি।

উপযুক্তভাবেই ভেতরের সাজসজ্জা চকচকে জিনিস দিয়ে করা হয়েছে। কক্ষটির দেয়াল আর ছাদ জুড়ে আছে ত্রিশটিরও বেশি পেইন্টিং। একে অন্যের সাথে এতোটাই কম দূরত্বে আছে সেগুলো, দেখে মনে হবে কোনো ফাঁকই রাখা হই নি। দ্য ফল অব ইকারুস…অ্যান অ্যালেগোরি অব হিউম্যান লাইফ…নেচার প্রেজেন্টিং প্রমিথিউস উইদ স্পেকটাকুলার জেম্স….

কাঁচের দরজা দিয়ে ভেতরে তাকাতেই আপন মনে বিড়বিড় করে ল্যাংডন বলে উঠলো, “মৃতের চোখ।”

কয়েক বছর আগে প্রথমবারের মতো পালাজ্জোর একটি প্রাইভেট সিক্রেট প্যাসেজ দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে এই লো স্তুদিওলো’তে এসেছিলো ল্যাংডন। এই পালাজ্জো’তে অসংখ্য সিক্রেট দরজা, সিঁড়ি আর প্যাসেজওয়ে আছে মৌমাছির চাকের মতো। এমনকি বেশ কয়েকটি পেইন্টিংয়ের পেছনে রয়েছে এরকম কিছু জিনিস, এ সম্পর্কে জানতে পেরে খুব অবাক হয়েছিলো সে।

তবে এসব সিক্রেট প্যাসেজগুলো নিয়ে ল্যাংডন এখন ভাবছে না। তার ভাবনার বিষয় হলো একটি সাহসী আর আধুনিক আর্ট পিস, এক সময় যেটা ডিসপ্লে করা হতো এখানে-ফর দি লাভ অব গড়-ডেমিয়েন হাস্টের বিতর্কিত একটি আর্ট পিস। ভাসারির বিখ্যাত দিওলো’তে ওটা ডিসপ্লে করার পর পর বেশ হৈচৈ পড়ে গিয়েছিলো।

সলিড প্লাটিনামে তৈরি প্রমাণ সাইজের মানুষের মাথার একটি খুলি, পুরোটা খুলিতে আট-হাজারেরও বেশি ছোটো ছোটো ডায়ন্ড বসানো। সবটা মিলিয়ে অসাধারণ একটি দৃশ্য। ফাঁকা চক্ষু-কোটরে জীবন আর মৃত্যুর ঝলকানি সৃষ্টি করতো, জীবন-মৃত্যু…ভয়ঙ্কর আর সুন্দরের মতো বিপরীত দুটো সিম্বলকে একসাথে প্রকাশ করতো। যদিও হারে ডায়মন্ডের মাথার খুলি অনেক আগেই লো স্তুদিওলো থেকে অপসারণ করা হয়েছে তারপরও আর্ট পিসটার কথা স্মরণ করতেই তার মাথায় একটা আইডিয়ার উদ্ভব হলো।

মৃতের চোখ, ভাবলো সে। মাথার খুলির সাথে নিশ্চয় এটা উতরে যায়, তাই না?

মাথার খুলির থিমটি দান্তের ইনফার্নোতে বার বার ব্যবহার করা হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো নরকের শেষ চক্রে কাউন্ট উগোলিনোকে দেয়া ভয়াবহ শাস্তিটি-শঠ বিশপের মাথার খুলি অনন্তকাল ধরে চিবানো হচ্ছে।

আমরা কি একটা মাথার খুলির খোঁজ করছি?

ল্যাংডন জানে, রহস্যময় দিওলো বানানো হয়েছিলো দুর্লভ বস্তুর ক্যাবিনেট’-এর ঐতিহ্য অনুসরণ করে। এখানকার দেয়ালে রাখা প্রায় সবগুলো পেইন্টিংয়ের পেছনেই রয়েছে গোপন কাপবোর্ড, আর এসব কাপবোর্ডে ডিউক তার কাছে থাকা অদ্ভুত আর কৌতূহলোদ্দীপক সব জিনিস রাখতেন-বিরল খনিজদ্রব্য, চমৎকার পালক, নটিলাসের শেলের ফসিল, এমনকি গুজব আছে এক সাধুর পায়ের হাঁড় এবং একমুঠো সিলভারও রয়েছে সেখানে।

তবে ল্যাংডনের সন্দেহ এসব জিনিস বহু আগেই এখান থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। হাস্টের মাথার খুলি ছাড়া আর কোনো খুলি এখানে ডিসপ্লে করা হয়েছে বলেও সে কখনও শোনে নি।

এই কক্ষের বাইরে হলের দরজাটি সশব্দে খুলে গেলে ল্যাংডনের চিন্তা বাধাগ্রস্ত হলো। এরপর পরই শোনা গেলো দ্রুত পদক্ষেপের আওয়াজ।

“সিনোরি!” রাগতস্বরে একটি কণ্ঠ চিৎকার করে বলে উঠলো। “ইল সালোনি নন এ এপাতো!”

ল্যাংডন ঘুরে দেখলো এক নারী কর্মচারী তাদের দিকে ধাই ধাই করে এগিয়ে আসছে। ছোটোখাটো গড়নের, ছোটো বাদামী চুল তার। মহিলার পেট অসম্ভব রকমের স্ফীত-গর্ভবতী। তাদের কাছে আসতে আসতে রেগেমেগে হাতঘড়ি দেখিয়ে বলতে লাগলো মহিলা, হলটা এখন কেন খোলা হয়েছে। কাছে আসতেই ল্যাংডনের সাথে তার চোখাচোখি হয়ে গেলো, সঙ্গে সঙ্গে থমকে দাঁড়িয়ে মুখে হাত-চাপা দিলো সে।

“প্রফেসর ল্যাংডন!” বিস্মিত আর বিব্রত হয়ে বললো মহিলা। “আমি খুবই দুঃখিত! আমি জানতাম না আপনি এখানে আছেন। আপনাকে আবারো স্বাগতম!”

বরফের মতো জমে গেলো ল্যাংডন। সে একদম নিশ্চিত, এই মহিলাকে জীবনেও কখনও দেখে নি।

.

অধ্যায় ৩৭

“আমি তো আপনাকে দেখে চিনতেই পারি নি, প্রফেসর!” ল্যাংডনের কাছে এগিয়ে আসতে আসতে ইংরেজিতে বলতে লাগলো মহিলা। “মানে আপনার এরকম পোশাক দেখে আর কি।” ল্যাংডনের ব্রিওনি সুটটার দিকে ইঙ্গিত করে প্রশংসার দৃষ্টিতে হাসলো সে। “খুবই ফ্যাশনেবল। আপনাকে দেখে একদম ইতালিয়ানদের মতো লাগছে।”

ল্যাংডনের মুখ হা-হয়ে গেলো, গলা শুকিয়ে কাঠ। তারপরও ভদ্রতাবশে হাসি দিলো সে। “গুড…মর্নিং,” বলতে গিয়ে হোঁচট খেলো। “আপনি কেমন আছেন?”

মহিলা হেসে তার পেটে হাত রাখলো। “একেবারে কাহিল অবস্থা। ছোট্ট কাতালিনা সারা রাত লাথি মেরে গেছে।” কথাটা বলেই ঘরের চারদিকে তাকিয়ে কিছুটা অবাক হলো সে। “ইল দুমিনো বলেন নি আপনি আবার আজকে ফিরে আসছেন। ধরে নিচ্ছি উনি আপনার সাথেই আছেন?”

ইল দুমিনো? কার কথা বলা হচ্ছে সে সম্পর্কে ল্যাংডনের কোনো ধারণাই নেই।

মহিলা তার হতবিহ্বল অবস্থা দেখে আশ্বস্ত করার জন্য হাসি দিলো। “ঠিক আছে, ফ্লোরেন্সে সবাই তাকে এই ডাকনামেই চেনে। তিনিও এতে কিছু মনে করেন না।” চারপাশে তাকালো আবার। “উনি কি আপনাকে এখানে ঢোকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন?”

“উনিই করে দিয়েছেন, কাছে এসে বললো সিয়েনা। “তবে উনার একটি ব্রেকফাস্ট মিটিং আছে। “আমাদেরকে বলেছেন, আমরা যদি এখানে ঘুরেফিরে দেখি তাহলে আপনি কিছু মনে করবেন না।” হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে দিলো সিয়েনা। “আমি সিয়েনা। রবার্টের ছোটো বোন।”

মহিলা সিয়েনার হাত ধরে বেশ আন্তরিকতার সাথে করমর্দন করলো। “আমি মার্তা আলভারেজ। আপনি কতোই না সৌভাগবতী-প্রফেসর ল্যাংডনের গাইড হতে পেরেছেন।”

“হ্যাঁ, সেটাই,” সিয়েনাও হেসে বলে উঠলো।”ও খুবই স্মার্ট!”

মহিলা সিয়েনাকে ভালো করে দেখতে শুরু করলে অদ্ভুত এক নীরবতা নেমে এলো ঘরে। “খুবই মজার তো,” বললো অবশেষে, “আমি অবশ্য আপনাদের মধ্যে চেহারার কোনো মিলই খুঁজে পাচ্ছি না। শুধু উচ্চতা ছাড়া।”

লাংডনের মনে হলো ধরা পড়তে যাচ্ছে। এই সেরেছে।

“মার্তা, ল্যাংডন কথার মাঝখানে ঢুকে পড়লো, আশা করলো মহিলার নামটা সঠিকভাবেই বলেছে। “আপনাকে ঝামেলায় ফেলে দেয়ার জন্য খুবই দুঃখিত। কিন্তু…মানে…আপনি হয়তো ধরতে পেরেছেন আমি এখানে কেন এসেছি।”

“কী যে বলেন,” মাথা দুলিয়ে বললো মহিলা। “আপনি এখানে কি জন্যে এসেছেন সেটা আমি জীবনেও ধরতে পারবো না।”

ল্যাংডনের পাস বেড়ে গেলো। কী বলবে বুঝতে পারলো না। তার ধারণা এই বুঝি ধরা পড়ে যাবে। হঠাৎ চওড়া হাসি দিয়ে হো হো করে হেসে ফেললো মার্তা।

“প্রফেসর, আমি ঠাট্টা করছিলাম। আমি অবশ্যই ধরতে পেরেছি আপনি কেন আবার ফিরে এসেছেন। সত্যি বলতে কী, আমি জানি না আপনি ওটার মধ্যে চমকপ্রদ কী খুঁজে পেয়েছেন, তবে আপনি আর ইল দুমিনো যেহেতু গতরাতে উপরতলায় প্রায় এক ঘণ্টার মতো সময় কাটিয়েছেন, তখন আমি ধারণা করতেই পারি, আপনি আপনার বোনকেও ওটা দেখাতে নিয়ে এসেছেন?”

“ঠিক…” প্রফেসর কোনোমতে বলতে পারলো। “ঠিক বলেছেন। আপনাদের যদি কোনো সমস্যা না হয়…আমি সিয়েনাকে ওটা দেখাতে চাই?”

মার্তা দ্বিতীয় তলার বেলকনির দিকে তাকিয়ে কাঁধ তুললো। “সমস্যা নেই। আমি এখন ওখানেই যাচ্ছি।”

হলের পেছনে দোতলার বেলকনির দিকে তাকিয়ে ল্যাংডনের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো। গতরাতে আমি ওখানে ছিলাম? তার কিছুই মনে পড়লো না। বেলকনিটা ঠিক cerca trova শব্দটি যে উচ্চতায় আছে সেই বরাবর অবস্থিত। সেটা দিয়ে পালাজ্জোর জাদুঘরেও যাওয়া যায়। এখানে এলে একবার হলেও সেখানে যায় ল্যাংডন।

মার্তা তাদেরকে নিয়ে দোতলার দিকে যেতেই থমকে দাঁড়ালো, যেনো ওখানে যাওয়ার ব্যাপারে মত বদলিয়েছে সে। “প্রফেসর, আপনি কি নিশ্চিত, এরচেয়ে কম অপ্রীতিকর জিনিস আপনার বোনকে আমরা দেখাতে পারবো না?”

কী বলবে ভেবে পেলো না ল্যাংডন।

“আমরা অপ্রীতিকর জিনিস দেখতে যাচ্ছি?” জানতে চাইলো সিয়েনা। “সেটা কি? ও তো আমাকে বলে নি।”

স্মিত হেসে ল্যাংডনের দিকে তাকালো মার্তা। “প্রফেসর, আপনি কি চান আপনার বোনকে আমি ওটার ব্যাপারে কিছু বলি, নাকি আপনি নিজেই সেটা বোনকে বলবেন?”

সুযোগটা লুফে নিলো ল্যাংডন। “নিশ্চয়, আপনি বললেই বেশি ভালো হয়, মার্তা।”

সিয়েনার দিকে ফিরে আস্তে আস্তে বললো মহিলা। “আমি জানি না আপনার ভাই আপনাকে কি বলেছে, তবে উপরতলায় জাদুঘরে গিয়ে একটি অদ্ভুত মুখোশ দেখতে যাচ্ছি আমরা।”

সিয়েনার চোখ দুটো গোল হয়ে গেলো। “কিসের মুখোশ? কার্নিভেলি’তে যেরকম কুৎসিত প্লেগ মুখোশ পরা হয় সেটার কথা বলছেন?”

“আপনার আন্দাজের প্রশংসা করতে হয়,” বললো মার্তা। “তবে ওটা প্লেগ মুখোশ নয়। একটু অন্যরকম মুখোশ। এটাকে বলা হয় মৃত্যু-মুখোশ।”

ল্যাংডন সশব্দে আৎকে উঠলে ভুরু কুচকে তাকালো মার্তা, তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হলো প্রফেসর একটু বেশি নাটকীয়তা সৃষ্টি করছে বোনকে ভয় পাইয়ে দেবার জন্য।

“আপনার ভায়ের কথায় কান দেবেন না,” বললো সে। পনেরো শতকে মৃত্যু-মুখোশের বেশ প্রচলন ছিলো। জিনিসটা আসলে মৃত মানুষের মুখের পাস্টার কাস্ট। মারা যাবার ঠিক পরমুহূর্তে এটা নেয়া হতো।”

মৃত্যু-মুখোশ। ফ্লোরেন্সে জ্ঞান ফিরে পাবার পর এই প্রথম পরিস্কারভাবে একটা বিষয় অন্তত বুঝতে পারলো সে। দান্তের ইনফার্নো…cerca trova…মৃতের চোখের মধ্য দিয়ে সত্য দেখা। মুখোশ!

সিয়েনা জানতে চাইলো, “এই মুখোশটি কার মুখের কাস্ট ছিলো?”

ল্যাংডন আস্তে করে সিয়েনার কাঁধে হাত রেখে শান্তকণ্ঠে জবাব দিলো। “একজন বিখ্যাত ইতালিয়ান কবি। তার নাম দান্তে অলিঘিয়েরি।”

.

অধ্যায় ৩৮

ভূ-মধ্যসাগরের প্রখর সূর্যের আলো এসে পড়েছে উত্তাল অ্যাড্রিয়াটিক সাগরে ভেসে বেড়ানো মেন্দাসিয়াম-এর ডেকের উপর। প্রভোস্ট খুবই ক্লান্ত বোধ করছে, দ্বিতীয়বারের মতো স্কচ পান করে নিজের অফিসের জানালা দিয়ে উদাস হয়ে চেয়ে আছে সে।

ফ্লোরেন্স থেকে কোনো ভালো খবর আসে নি।

সম্ভবত অনেকদিন পর অ্যালকোহল পানের জন্যই হবে হয়তো, অদ্ভুত রকমের বেসামাল আর অসহায় বলে মনে হচ্ছে নিজেকে…যেনো তার জাহাজটির ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে গেছে, দিকবিদিক হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সমুদ্রস্রোতে।

অনুভূতিটা প্রভোস্টের জন্য একেবারেই নতুন। তার জগতে সব সময়ই একটি নির্ভরযোগ্য কম্পাস থাকে-প্রটোকল-আর সেটা কখনও পথ বাতলে দিতে ভুল করে নি। প্রটোকল হলো এমন একটি বিষয় যা তাকে আগেপিছে না ভেবে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে।

এই প্রটোকলের জন্যই ভায়েন্থাকে অস্বীকার করা হয়েছে। আর সেটা প্রভোস্ট করেছে কোনো রকম দ্বিধা ছাড়াই। বর্তমান সমস্যাটি শেষ হলেই তার সাথে আমি এই ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলবো।

প্রটোকলের কারণেই প্রভোস্ট তার সব ক্লায়েন্টের ব্যাপারে যতোদূর সম্ভব কম জানতে চায়। অনেক আগেই সে ঠিক করেছিলো কনসোর্টিয়াম তাদের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে কোনো রকম নৈতিক দায়দায়িত্বের বিচার-বিবেচনা করবে না।

সার্ভিস দাও।

ক্লায়েন্টকে বিশ্বাস করো।

কোনো প্রশ্ন কোরো না।

বেশিরভাগ কোম্পানির ডিরেক্টরদের মতোই প্রভোস্ট কেবলমাত্র সার্ভিস অফার করে থাকে, যা আইনী কাঠামোর মধ্যেই সম্পন্ন করা যাবে। হাজার হোক, ভভো কোম্পানির গাড়ি যদি কোনো স্কুলের সামনে দিয়ে স্পিড লিমিট ভঙ্গ করে কিংবা ডেল কম্পিউটার দিয়ে কেউ যদি ব্যাঙ্ক একাউন্ট হ্যাঁক করে তার জন্যে কোনোভাবেই এর নির্মাতাদেকে দায়ি করা যায় না।

এখন সবকিছু উন্মোচিত হয়ে পড়ায় মনে মনে প্রভোস্ট তার বিশ্বস্ত কন্ট্যাক্টের মুণ্ডুপাত করলো এরকম একজন ক্লায়েন্টকে কনসোর্টিয়ামে পাঠানোর জন্য।

“উনার যে কাজ তাতে খুব একটা খরচাপাতি হবে না, কিন্তু এরজন্যে বেশ ভালো পারিশ্রমিক পাবে কনসোর্টয়াম,” কন্ট্যাক্ট তাকে আশ্বস্ত করে বলেছিলো। “লোকটা খুবই মেধাবী, নিজের ক্ষেত্রে হোমরাচোমরা একজন, আর অবিশ্বাস্য রকমেরই ধনী। উনি কেবল চান দু’এক বছরের জন্য উধাও হয়ে যেতে। একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্টের কাজ করার জন্য উনার একটু সময় দরকার।”

খুব একটা চিন্তাভাবনা না করেই প্রভোস্ট রাজি হয়ে যায়। দীর্ঘমেয়াদী রিলোকেশন সব সময়ই লাভজনক একটি কাজ। তাছাড়া প্রভোস্ট তার কন্ট্যাক্টকে বিশ্বাসও করতো।

প্রত্যাশামতোই এই কাজটাতে খুব সহজে প্রচুর টাকা আসতে লাগলো। সেটা অবশ্য গত সপ্তাহের আগপর্যন্ত।

এখন এই লোকটা যে ঝামেলা পাকিয়েছে তার ফলে প্রভোস্টকে স্কচের বোতলে ঘুরপাক খেতে হচ্ছে আর দিন গুনতে হচ্ছে কখন ক্লায়েন্টের সাথে তার সমস্ত লেনদেন শেষ হবে।

তার ডেস্কের ফোনটা বেজে উঠলো এ সময়। প্রভোস্ট জানে তার ফ্যাসিলিটেটরদের অন্যতম নোলটন নীচতলা থেকে ফোন করেছে।

“হ্যাঁ,” ফোনটা তুলে বললো সে।

“স্যার,” নোলটন বলতে শুরু করলো। তার কণ্ঠে উদ্বিগ্নতা। “এই ব্যাপারটা নিয়ে আপনাকে বিরক্ত করার জন্য আমি সত্যি লজ্জিত কিন্তু আপনি তো জানেন, আগামীকাল একটি ভিডিও মিডিয়াতে আপলোড করার শিডিউল রয়েছে আমাদের।”

“হ্যাঁ, জানি,” জবাবে বললো প্রভোস্ট। “এটা কি প্রস্তুত করা হয়েছে?”

“জি, স্যার। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আপলোড করার আগে আপনি ওটা একবার দেখে নিলো ভালো হতো।”

প্রভোস্ট থেমে গেলো। কথাটা শুনে দ্বিধায় পড়ে গেলো কিছুটা। “ঐ ভিডিও’তে কি আমাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে কিংবা আমাদের গোপনীয়তা ফাঁস করার মতো কিছু রয়েছে?”

“না, স্যার। তবে ওটার কনটেন্ট খুবই উদ্বেগজনক। ক্লায়েন্ট নিজে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে।”

“থামো, আর বলতে হবে না,” আদেশের সুরে বললো প্রভোস্ট। এরকম একজন সিনিয়র ফ্যাসিলিটেটর প্রটোকল ভঙ্গ করার কথা বলতে পারে ভেবে যারপরনাই অবাক হলো সে। “কনটেন্ট কি সেটা আমাদের দেখার বিষয় নয়। ক্লায়েন্ট যা-ই বলে থাকুক না কেন, ওটা আগামীকাল রিলিজ করে দেবে। আমাদের এই ক্লায়েন্ট কিন্তু খুব সহজেই ইলেক্ট্রনিক্যালি ভিডিওটি রিলিজ করতে পারতেন কিন্তু তিনি সেটা করেন নি। তিনি আমাদের ভাড়া করেছেন। টাকা দিয়েছেন। বিশ্বাস করেছেন।”

“জি, স্যার।”

“আর তোমাকেও সিনেমার ক্রিটিক হিসেবে এখানে নিয়োগ দেয়া হয় নি,” একটু ধমকের সাথেই বললো প্রভোস্ট। “তোমাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার জন্য। যে কাজের দায়িত্ব তোমার উপরে দেয়া হয়েছে শুধু সেটা করো।”

.

পন্তে ভেচ্চিও’তে ভায়েন্থা অপেক্ষা করছে। সেতুর উপর দিয়ে চলাচল করতে থাকা শত শত মুখ খতিয়ে দেখছে সে। ল্যাংডন যে সেতুটা পার হয় নি সে ব্যাপারে একদম নিশ্চিত, কারণ কড়া নজরদারি করছে দীর্ঘক্ষণ ধরে। কিন্তু ড্রোনটা চুপ মেরে গেছে। মনে হচ্ছে ওটার ট্র্যাকিং-সার্ভিসের আর দরকার নেই।

ব্রুডার তাহলে ওকে ধরে ফেলেছে।

না চাইলেও সে ভাবতে শুরু করলো কনসোর্টিয়াম-এর তদন্তটি কি রকম হতে পারে। কিংবা কতোটা খারাপ। আবারো অস্বীকৃত হওয়া সেই দু’জন এজেন্টের ছবি ভেসে উঠলো ভায়েন্থার মনের পর্দায়…তাদের আর কোনো খবর জানা যায় নি। দেখাও যায় নি। ওরা আসলে অন্য পেশায় চলে গেছে, নিজেকে আশ্বস্ত করে বললো। সেও কি টুসকানি পার্বত্য এলাকা পাড়ি দিয়ে গাড়ি চালিয়ে উধাও হয়ে যাবে, নিজের দক্ষতা কাজে লাগিয়ে শুরু করবে নতুন কোনো জীবন?

কিন্তু ওদের হাত থেকে কতোদিন লুকিয়ে থাকা যাবে?

অসংখ্য টার্গেট হাঁড়ে হাঁড়ে টের পেয়েছে কনসোর্টিয়াম একবার কারোর উপর নজর ফেললে প্রাইভেসি শব্দটি আজগুবি হয়ে ওঠে। এটা নিছক সময়ের ব্যাপার।

আমার ক্যারিয়ার এভাবেই শেষ হয়ে যাবে? ভাবলো সে। এখনও মেনে নিতে পারছে না কনসোর্টিয়ামের সাথে তার দীর্ঘ বারো বছরের সম্পর্ক কয়েকটি দুর্গের কারণে শেষ হয়ে যাবে। এক বছর ধরে সে কনসোর্টিয়ামের সবুজ চোখের ক্লায়েন্টের চাহিদা মেটানোর কাজ তদারকি করে গেছে অতন্দ্রপ্রহরীর মতো। তার লাফিয়ে পড়ে মৃত্যুবরণ করার জন্য তো আমি দায়ি হতে পারি না…কিন্তু তারপরও মনে হচ্ছে তার সাথে সাথে আমারও পতন হয়ে গেছে।

ব্রুডারকে হারিয়ে দিতে পারলেই কেবল তার ফিরে যাবার সুযোগ তৈরি হবে…কিন্তু এটা যে সহজ কাজ হবে না সেটা ভালো করেই জানে।

গতরাতে আমি আমার সুযোগটা পেয়েছিলাম কিন্তু কাজে লাগাতে পারি নি।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিজের মোটরবাইকটির দিকে তাকাতে হঠাৎ করে একটা শব্দ শুনে নড়েচড়ে উঠলো সে। শব্দটা আসছে দূর থেকে…অতি পরিচিত তীক্ষ্ণ একটি শব্দ।

ভড়কে গিয়ে উপরের দিকে তাকালো। অবাক হয়ে দেখতে পেলো সার্ভিলেন্স ড্রোনটি আবারও আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে। এবার পিত্তি প্যালেসের দিকে ছুটে যাচ্ছে ওটা। ছোট্ট ক্রাফটিকে প্যালেসের উপর চক্কর দিতে দেখলো ভায়েন্থা।

ড্রোন ডিপ্লয়মেন্টের একটাই অর্থ।

তারা এখনও ল্যাংডনকে ধরতে পারে নি।

সে তাহলে কোথায়?

.

মাথার উপর তীক্ষ্ণ শব্দটি ডা: এলিজাবেথ সিনস্কিকে ঘোর থেকে টেনে আনলো আবার। ড্রোনটা এখনও আকাশে? কিন্তু আমি ভেবেছিলাম…।

ভ্যানের পেছনের সিটে একটু নড়েচড়ে উঠলো সে। তার পাশে এখনও সেই তরুণ এজেন্ট বসে আছে। চোখ বন্ধ করে ডক্টর তীব্র যন্ত্রণা আর বমি বমি ভাব থেকে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করলো। তবে সবথেকে বেশি চেষ্টা করলো। সুতীব্র এক ভীতি থেকে।

সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে।

তার শত্রু লাফিয়ে পড়ে মারা গেলেও সে এখনও লোকটার আবছা অবয়ব স্বপ্নে দেখে। কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সের অন্ধকার অফিসে দাঁড়িয়ে থেকে লেকচার দিচ্ছে।

কেউ না কেউ সাহসী পদক্ষেপ যে নেবেই এটা একেবারেই অনিবার্য, লোকটা বলেছিলো। তার সবুজ চোখ দুটো জ্বল জ্বল করে উঠেছিলো তখন। আমরা যদি না নেই তাহলে কে নেবে? আর এখন যদি না নেই তাহলে কখন নেবো?

এলিজাবেথ জানে লোকটাকে তখনই থামিয়ে দিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে সোজা জেএফকে এয়ারপোর্টে চলে যাওয়া ভালো ছিলো কিন্তু উন্মাদটার পরিচয় জানা আর তার মুখ দেখার জন্য উদগ্রীব ছিলো সে, তাই মোবাইলফোন বের করে দ্রুত একটা ছবি তুলে নেয় তার।

ছবিটা দেখতে পেয়ে ভীষণ আৎকে উঠেছিলো সে। ড: এলিজাবেথ সিনস্কি ভালো করেই জানে এই লোকটা কে। ভালো সংবাদ হলো, লোকটাকে খুব সহজেই ট্র্যাকডাউন করা যাবে। কিন্তু খারাপ সংবাদ হলো, নিজের ক্ষেত্রে লোকটি জিনিয়াস-খুবই বিপজ্জনক একজন মানুষ।

একজন অসাধারণ মানুষের মস্তিষ্কের সাথে যদি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য যোগ হয় তখন… তার চেয়ে বেশি সৃষ্টিশীল আর কিছু হয় না.. যেমন হয় না ধ্বংসাত্মক কিছু।

ত্রিশ মিনিট পর এয়ারপোর্টে পৌঁছে সে তার টিমকে ফোন করে জানিয়ে দেয় ঐ লোকটিকে যেনো সিআইএ, সিডিসি, ইসিডিসিসহ সংশ্লিষ্ট সবগুলো এজেন্সির বায়োটেররিজম ওয়াচ তালিকায় রাখা হয়।

জেনেভায় ফিরে যাবার আগে এরচেয়ে বেশি আমার পক্ষে আর করা সম্ভব নয়, মনে মনে বলেছিলো সে।

ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে সে তার ব্যাগ, পাসপোর্ট আর টিকেট তুলে দেয় অ্যাটেন্ড্যান্টের হাতে।

“ওহ, ড: সিনস্কি,” হেসে বলেছিলো অ্যাটেন্ড্যান্ট। “এক ভদ্রলোক একটু আগে আপনার জন্য মেসেজ রেখে গেছেন।”

“কী বললেন?” এলিজাবেথ জানতো তার ফ্লাইট সম্পর্কিত তথ্য কেউ জানে না।

“খুব লম্বা আর সবুজ চোখের এক লোক।”

হাত থেকে ভ্যানিটি ব্যাগটা প্রায় পড়েই যাচ্ছিলো। সে এখানে এসেছে? কিভাবে! চারপাশে দ্রুত তাকিয়ে দেখে এলিজাবেথ।

“উনি চলে গেছেন,” অ্যাটেন্ড্যান্ট বলে। “তবে আপনাকে এটা দিতে বলে গেছেন।” ভাঁজ করা একটি কাগজ বাড়িয়ে দেয়া হয় এলিজাবেথের দিকে।

কাঁপতে কাঁপতে এলিজাবেথ কাগজটি খুলে হাতেলেখা নোটটি পড়েছিলো। এটা ছিলো দান্তে অলিঘিয়েরির বিখ্যাত একটি উদ্ধৃতি :

নরকের সবচাইতে অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গাটি তাদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে যারা ভালো আর মন্দের সংঘাতের সময়। নিজেদের নিরপেক্ষতা বজায় রাখে।

.

অধ্যায় ৩৯

মার্তা আলভারেজ ক্লান্তদৃষ্টিতে হল অব ফাইভ হান্ড্রেড-এর দোতলায় অবস্থিত জাদুঘরে ওঠার সঙ্কীর্ণ সিঁড়িটার দিকে তাকালো।

পোসো ফার্সেলা, নিজেকে সুধালো সে। আমি এটা পারবো।

পালাজ্জো ভেচ্চিও’র একজন আর্টস এবং কালচারাল অ্যাডমিনেস্ট্রেটর মার্তা এইসব সিঁড়ি দিয়ে কত শতবার উঠে গেছে তার কোনো হিসেব নেই, কিন্তু ইদানিং আটমাসের গর্ভাবস্থায় এসে সিঁড়ি দিয়ে ওঠাটাকে কঠিন কাজ বলেই মনে হয়।

“মার্তা, আপনি কি নিশ্চিত, এলিভেটর দিয়ে উঠবেন না?” রবার্ট ল্যাংডনকে খুব চিন্তিত দেখালো। কাছেই যে ছোট্ট একটি সার্ভিস এলিভেটর আছে সেটার দিকে ইঙ্গিত করলো সে। এটা শুধুমাত্র শারীরিক প্রতিবন্ধী দর্শনার্থীদের ব্যবহারের জন্য।

কথাটা শুনে আন্তরিকভাবে হাসি দিয়ে মাথা ঝাঁকালো মার্তা। “গতরাতেও আপনাকে বলেছি, ডাক্তার আমাকে বলেছেন এক্সারসাইজ করলে বেবির জন্য ভালো। তাছাড়া, প্রফেসর আমি জানি, আপনার ক্লোস্ট্রোফোবিক আছে।”

|||||||||| কথাটা শুনে ল্যাংডন চমকে উঠলো। “ওহ, ঠিক। এটা যে আপনাকে বলেছিলাম তা ভুলেই গেছি।”

ভুলে গেছেন? মার্তা একটু হতবুদ্ধি হলো। ঘটনাটা বারো ঘণ্টারও কম আগে, আর এই ভীতির জন্য যে শৈশবের একটি ঘটনা থেকে সেটা নিয়েও তো বিস্তারিত কথা হয়েছে তাদের।

গতরাতে ল্যাংডনকে নিয়ে তার রহস্যময় আর অস্বাভাবিক মোটা বন্ধু ইল দুমিনো যখন এলিভেটরের কাছে আসে দোতলায় ওঠার জন্য তখন সে আর মার্তা সিঁড়ি ব্যবহার করেছিলো। যেতে যেতে তখনই মার্তার কাছে শৈশবের কুয়োয় পড়ে যাওয়ার ঘটনাটি বলেছিলো সে। এটা বলতেও ভোলে নি সেই থেকে তার ক্লস্ট্রোফোবিক তৈরি হয়েছে।

এখন ল্যাংডনের ছোটো বোন তার পনিটেইল দোলাতে দোলাতে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাচ্ছে কিন্তু মার্তা আর ল্যাংডন ধীরে ধীরে এক একটা ধাপ পেরোতে লাগলো। দম ফুরিয়ে যাওয়ার জন্য দু’একবার থেমে জিরিয়ে নিলো সে। “আমি খুব অবাক হচ্ছি আপনি আবার সেই মুখোশটা দেখতে এসেছেন,” বললো মহিলা। “ফ্লোরেন্সে যতো দর্শনীয় বস্তু আছে সেটা বিবেচনায় নিলে এটা অনেক কম আগ্রহের একটি জিনিস।”

কোনো মন্তব্য না করে শুধু কাঁধ ঝাঁকালো ল্যাংডন। “আমি শুধু সিয়েনাকে দেখানোর জন্য আবার এসেছি। আর আমাদেরকে এই অসময়ে ঢুকতে দেয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

“ঠিক আছে, ঠিক আছে।”

ল্যাংডনের সুনামের কারণেই গতরাতে গ্যালারিটা খুলে দিতো মার্তা, কিন্তু তার সঙ্গে ছিলেন ইল দুমিনো। এর মানে ওটা খুলে না দেবার কোনো উপায়ই ছিলো না।

ইগনাজিও বুসোনি-লোকটি পরিচিত ইল দূমিনো নামে-ফ্লোরেন্সের সাংস্কৃতিক জগতে এজন কেউকেটা। মিউজিও দেল অপেরা দেল দুমো’র দীর্ঘদিন যাবত ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করা ইগনাজিও ফ্লোরেন্সের সব উল্লেখযোগ্য দর্শনীয়স্থানগুলোর তদারকি করেন-ইল দুমো-বিশাল লাল রঙের গম্বুজের ক্যাথেড্রাল যা কিনা ফ্লোরেন্সের স্কাইলাইন আর ইতিহাসে প্রভাব বিস্তার করে আছে। এই স্থাপনাটির প্রতি ভদ্রলোকের নিখাদ ভালোবাসা, তার চারশত পাউন্ডের বিশাল শারিরীক ওজন এবং সর্বোপরি ভালোমানুষ হিসেবে পরিচিতির কারণে লোকজন তাকে ইল দুমিনো অর্থাৎ ‘ছোট্ট গম্বুজ’ নামে ডাকে।

এই ইল দুমিনের সাথে ল্যাংডনের পরিচয় হলো কিভাবে সে ব্যাপারে মার্তার কোনো ধারণা নেই। গতকাল ভদ্রলোক তাকে ফোন করে জানায় একজন গেস্টকে একান্তে দান্তের মৃত্যু-মুখোশটি দেখানোর ব্যবস্থা করতে হবে। যথন দেখা গেলো গেস্ট একজন বিখ্যাত আমেরিকান সিম্বলজিস্ট এবং শিল্পকলার ইতিহাসবিদ রবার্ট ল্যাংডন তখন মার্তা যারপরনাই উচ্ছ্বসিত হয়েছিলো। একসঙ্গে দু’দুজন বিখ্যাত মানুষকে সাহচার্য দিতে পেরে খুশিই হয়েছিলো সে।

দোতলায় উঠে মার্তা কোমরে হাত দিয়ে গভীর করে দম নিতে লাগলো। সিয়েনা ততোক্ষণে বেলকনির কাছে গিয়ে নীচের হল অব ফাইভ হান্ড্রেড দেখছে।

“এই ঘরের সবচাইতে প্রিয় ভিউ আমার,” হাপাতে হাপাতে বললো মার্তা। “এখান থেকে আপনি মুরালটি একেবারে ভিন্ন পারসপেক্টিভে দেখতে পাবেন। আমার ধারণা আপনার ভাই আপনাকে বলেছে এই মুরালে রহস্যময় একটি মেসেজ রয়েছে?” মুরালটির নির্দিষ্ট জায়গা দেখিয়ে বললো সে।

উচ্ছ্বসিত হয়ে সায় দিলো সিয়েনা। “Cerca trova।”

ল্যাংডন ঘরের দিকে তাকাতে লাগলে মার্তা তাকে দেখে একটা বিষয় খেয়াল করলো। আগের দিনের চেয়ে একটু ক্লান্ত আর বিধ্বস্ত লাগছে প্রফেসরকে। তার নতুন সুটটা মার্তার পছন্দ হলেও শেভ করে নি বলে ফ্রেশ লাগছে না। তাছাড়া পরিপাটী করে আচড়ানো চুলগুলোও আঠালো হয়ে আছে। যেনো দীর্ঘ সময় ধরে গোসল করে নি।

ল্যাংডনের সাথে চোখাচোখি হবার আগেই মার্তা ম্যুরালের দিকে তাকালো। “আমরা এখন Cerca trova যে উচ্চতায় আছে ঠিক সেই উচ্চতায় রয়েছি,” বললো সে। “এখান থেকে খালি চোখেই লেখাটা দেখতে পাবেন।”

মনে হলো ল্যাংডনের বোন মুরালটার ব্যাপারে নির্বিকার। “আমাকে দান্তের মৃত্যু-মুখোশের ব্যাপারে বলো। ওটা কেন পালাজ্জো ভেচ্চিও’তে রাখা আছে?”

যেমন ভাই তেমনি তার বোন, মনে মনে গজগজ করে বললো মার্তা। এখনও বুঝতে পারছে না ঐ মুখোশটার ব্যাপারে তাদের এতো আগ্রহ কেন। তবে এটাও ঠিক দান্তের মৃত্যু-মুখোশের অদ্ভুত একটি ইতিহাস আছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে, শুধুমাত্র ল্যাংডনই একমাত্র ব্যক্তি নয় যে এটার ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে। “তো আমাকে বলে, দান্তের ব্যাপারে তুমি কতোটুকু জানো?”

প্রফেসরের বোন কাঁধ তুললো। “স্কুলে সবাই যতোটুকু পড়েছে ততোটুকু। দান্তে একজন ইতালিয়ান কবি, তিনি বিখ্যাত তার ডিভাইন কমেডি’র জন্য, যেখানে কবি তার কল্পনায় নরক পরিদর্শনের বর্ণনা করেছেন।”

“আংশিক সঠিক,” জবাবে বললো মার্তা। এই কবিতায় দান্তে আসলে নরক থেকে পালিয়েছেন, পারগেটরি পেরিয়ে অবশেষে চলে গেছেন স্বর্গে। তুমি যদি কখনও ডিভাইন কমেডি পড়ে থাকে তাহলে দেখবে এই ভ্রমণটি তিনটি ভাগে বিভক্ত-ইনফার্নো, পারগেটরিও এবং পারাদিসো।” মার্তা তাদের দুজনকে বেলকনির পরে যে প্রবেশদ্বারটি আছে সেখানে যাবার ইশারা করলো। এই পালাজ্জো ভেচ্চিও’তে ঐ মুখোশটি রাখার সাথে অবশ্য ডিভাইন কমেডির কোনো সম্পর্ক নেই। বরং সম্পর্ক আছে সত্যিকারের ইতিহাসের সাথে। দান্তে এই ফ্লোরেন্স শহরেই থাকতেন, অন্য যেকারোর চেয়ে তিনি এ শহরটাকে অনেক বেশি ভালোবাসতেন। তিনি ছিলেন খুবই সুপরিচিত এবং প্রভাবশালী একজন ফ্লোরেস্তাইন। কিন্তু এখানকার রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে দান্তে ভুলপক্ষকে সমর্থন করে বসেন, সেজন্যে তাকে নির্বাসনে যেতে হয়েছিলো-তাকে এ শহরের প্রাচীরের বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে বলা হয়েছিলো জীবনে যেনো এখানে ফিরে না। আসে।” দম নেবার জন্য থামলো মার্তা। তারা এখন জাদুঘরের প্রবেশদ্বারের সমানে চলে এসেছে। কোমরে হাত দিয়ে আবারো কথা বলতে শুরু করলো সে। “অনেকে বলে থাকে দান্তের মৃত্যু-মুখোশ এতোটা বিষণ্ণ হবার কারণ হলো তার এই নিবার্সন। তবে আমার কাছে অন্য একটা তত্ত্ব আছে। আমি আবার একটু রোমান্টিক মানুষ, তাই আমার ধারণা এই বিষণ্ণ অভিব্যক্তির কারণ আর কিছু না, বিয়েত্রিচ নামের এক মহিলা। মনে রাখবে, দান্তে সারাটা জীবন মনেপ্রাণে ভালোবেসে গেছেন এই বিয়েচি পৰ্তিনারিকে। তবে দুঃখের ষিয় হলো বিয়েত্রিচ করেন অন্য একজনকে। তার মানে দান্তে কেবল তার প্রিয় শহর থেকেই দূরে ছিলেন না, দূরে ছিলেন ভালোবাসার সেই মানুষটি থেকেও। বিয়াত্রিচের প্রতি তার এই প্রেমই হলো ডিভাইন কমেডি’র মূল থিম।”

“মজার তো,” সিয়েনা এমনভাবে বললো যেনো এসব কথা তার কানেই যাচ্ছে না ঠিকতো। তারপরও আমি বুঝতে পারছি না এই মৃত্যু-মুখোশটি কেন পালাজ্জো’তে রাখা আছে?”

মার্তার মনে হলো ল্যাংডনের বোনের মধ্যে অদ্ভুত রকমের অস্থিরতা আর প্রচ্ছন্ন অভদ্রতা কাজ করছে।

“তো,” হাঁটতে হাঁটতে আবারও বলতে লাগলো সে, “দান্তে মারা যাবার পরও ফ্লোরেন্সে তার প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিলো তাই তাকে সমাহিত করা হয় রাভেন্নাতে। তবে তার সত্যিকারের ভালোবাসার কারণে বিয়াত্রিচের কবর হয় ফ্লোরেন্সে। দান্তে যেহেতু ফ্লোরেন্সেকে প্রচণ্ড ভালোবাসতেন সেজন্যে তার মৃত্যু মুখোশটি এখানে এনে রাখা হয়েছে তার সম্মানের প্রতি এক ধরণের সৌজন্যতা দেখিয়ে।”

“আচ্ছা,” বলেলো সিয়েনা। “কিন্তু বিশেষ করে এই ভবনে কেন রাখা হলো সেটা?”

“পালাজ্জো ভেচ্চিও ফ্লোরেন্সের সবচাইতে পুরনো একটি প্রতীক, দান্তের সময় এটি ছিলো শহরের প্রাণকেন্দ্র। সত্যি বলতে, ক্যাথেড্রালে একটি বিখ্যাত ছবি আছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে দান্তে শহরের প্রাচীরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন সমাজচ্যুত একজন হিসেবে, তার ব্যাকগ্রাউন্ডে পালাজ্জোর টাওয়াটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। অনেকদিক থেকেই তার মৃত্যু-মুখোশটি এখানে এনে রাখার সঙ্গত কারণ রয়েছে। আমরা মনে করি মুখোশটি এখানে এনে রাখার মাধ্যমে অবশেষে দান্তেকে এই শহরে আবারো ঢুকতে দেয়া হলো।”

“দারুণ,” বললো সিয়েনা। তাকে একটু সন্তুষ্ট বলে মনে হলো। “ধন্যবাদ তোমাকে।”

জাদুঘরের দরজার সামনে এসে তিন-তিনবার টোকা দিলো মার্তা। “সোনো ইও, মার্তা! বুয়েনগিওরনো!”

ওপাশ থেকে চাবি ঘরানোর শব্দ শোনা গেলো, তারপর দরজা খুলে গেলে দেখা গেলো এক বয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে আছে হাসিমুখে। হাতঘড়ি দেখে লোকটা বললো, “এ উন পো প্রেস্তো।” একটু আগে এসে পড়লেন যে?

পাশে দাঁড়ানো ল্যাংডনকে দেখিয়ে মার্তা তাকে বুঝিয়ে বললো কেন এ সময় এসেছে এখানে। গার্ডের মুখ সঙ্গে সঙ্গে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। “সিনোরি! বেনতোরনাতো!” আবারো স্বাগতম আপনাকে!

“গ্র্যাজি,” হাসিমুখে জবাব দিলো ল্যাংডন।

ভেতরে ঢুকে পড়লো সবাই। ছোটোখাটো একটি ফয়ার পেরিয়ে ভারি একটা দরজার কাছে চলে এলো তারা। গার্ড সিকিউরিটি অ্যালার্ম বন্ধ করে লকটা খুলে ভেতরে ঢোকার জন্য হাত নেড়ে ইশারা করলো তাদেরকে। “এক্কো ইল মিউজিও!”

মার্তা তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে অতিথিদের সঙ্গে করে ঢুকে পড়লো ভেতরে।

এই জাদুঘরটির স্পেস আসলে সরকারী অফিস হিসেবে ব্যবহার করার জন্য নক্সা করা হয়েছিলো। সেজন্যে চারপাশটা ছড়ানো ছিটানো নয়, যেমনটি বেশিরভাগ জাদুঘরের বেলায় দেখা যায়। বরং ছোটো ছোটো ঘর আর হলওয়ের একটি গোলকধাঁধাতুল্য জায়গা এটি।

“দান্তের মৃত্যু-মুখোশটি ওখানে,” সিয়েনাকে বললো মার্তা। “ওটা ডিসপ্লে করা আছে লানদিতো নামের বড় বড় দুটো ঘরের মাঝখানের একটি জায়গায়। অ্যান্টিক কেবিনেটে জিনিসটা রাখা, তাই খেয়াল না করলে সহজে চোখে পড়ে না। অনেক দর্শনার্থী ওটার সামনে দিয়ে হেঁটে গেলেও মুখোশটা না দেখেই চলে যায়!”

ল্যাংডন মন্ত্রমুগ্ধের মতো সোজা ওখানে হেঁটে গেলো বড় বড় পা ফেলে, যেনো মুখোশটার কোনো শক্তি আছে কাছে টেনে নিয়ে যাবার। সিয়েনাকে কর্নই দিয়ে আলতো করে গুতো মারলো মার্তা। “দেখে মনে হচ্ছে আর কোনো জিনিস দেখার ব্যাপারে তোমার ভায়ের আগ্রহ নেই, তবে তোমাকে আমি ম্যাকিয়াভেলির আবক্ষ মূর্তি আর হল অব ম্যাপস-এ রাখা মাপ্পা মুন্দিটা দেখাবো।”

সিয়েনা আস্তে করে মাথা নেড়ে সায় দিয়ে ল্যাংডনের দিকে এগিয়ে গেলো। মার্তা তাদের দু’জনের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারলো না। তারা যখন তৃতীয় রুমে চলে এলো তখনও মার্তা বেশ কিছুটা পিছিয়ে, হঠাৎ করে সে থেমে গেলো।

“প্রফেসর?” হাপাতে হাপাতে ডাকলো সে। “মুখোশটা দেখানোর আগে…আপনি হয়তো…আপনার বোনকে…গ্যালারির অন্য জিনিসগুলো দেখাতে চাইবেন?”

ঘুরে তাকালো ল্যাংডন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে অন্য কিছু ভাবছে। “কি বললেন?”

কাছের একটি ডিসপ্লে কেসের দিকে ইশারা করলো মার্তা। “একেবারে প্রথমদিককার… ডিভাইন কমেডি’র একটি কপি।”

ল্যাংডন যথন দেখলো কপালে হাত দিয়ে মার্তা হাপাচ্ছে তখন তার একটু মায়াই হলো। “মার্তা, আমাকে ক্ষমা করবেন। অবশ্যই, ঐ কপিটা দেখতে পেলে তো ভালোই হয়।”

মার্তার কাছে চেলে গেলো ল্যাংডন। অ্যান্টিক কেসের ভেতরে বহু পুরনো আর জীর্ণশীর্ণ চামড়ায় বাধানো একটি বই খোলা অবস্থায় রাখা, অলংকৃত করা প্রথম পৃষ্ঠাটি দেখা যাচ্ছে : লা দিভিনা কম্মোদিয়া : দান্তে অলিঘিয়েরি।

“অবিশ্বাস্য,” অবাক হয়ে বললো ল্যাংডন। “প্রথম পৃষ্ঠাটি আমি চিনতে পেরেছি। জানতাম না আপনাদের কাছে নমিস্টার এডিশনের কোনো কপি আছে।”

অবশ্যই আপনি জানতেন, মনে মনে বললো মার্তা। সে পুরোপুরি বিভ্রান্ত। গতরাতেই তো এটা আপনাকে দেখিয়েছি আমি!

“চৌদ্দ শতকের মাঝামাঝি সময়ে,” সিয়েনাকে দ্রুত বলতে লাগলো ল্যাংডন, “জন মিস্টার দান্তের বই প্রথম প্রিন্ট করেন। মাত্র কয়েকশ’ কপি ছাপিয়েছিলেন তিনি, বর্তমানে কেবল কয়েক ডজন বই টিকে আছে। এগুলো খুবই দুর্লভ।”

মার্তার কাছে এবার মনে হলো ল্যাংডন তার বোনের সামনে নিজেকে তেমন কিছু জানে না বলে জাহির করার চেষ্টা করছে।

“এই কপিটা লরেন্তিয়ান লাইব্রেরি থেকে ধার করা, মার্তা জানালো। “তুমি আর রবার্ট যদি সময় পাও তাহলে ওখানে একবার ঘুরে আসবে। তাদের ওখানে চমৎকার একটি সিঁড়ি আছে, ওটার ডিজাইন করেছিলেন মাইকেলাঞ্জেলো। ওই জায়গাটিই পৃথিবীর প্রথম পাবলিক রিডিংরুম। প্রতিটি সিটের সাথে বইগুলো শেকল দিয়ে বাধা যাতে কেউ ওগুলো সঙ্গে করে নিয়ে যেতে না পারে। এর কারণ ওখানকার অনেক বই-ই মাত্র এক কপি করে টিকে আছে এ বিশ্বে।”

“বিস্ময়কর,” মিউজিয়ামের ভেতরে তাকিয়ে বললো সিয়েনা। “আর মুখোশটা আছে ওখানে, তাই না?”

এতো তাড়া কিসের? আবারো বুক ভরে দম নিয়ে নিলো মার্তা। “তবে তুমি হয়তো এটার কথা শুনলে বেশি কৌতূহলী হবে।” এককোণে থাকা ছোট্ট একটি সিঁড়ির দিকে ইঙ্গিত করলো সে। ওটা চলে গেছে ছাদের দিকে। “ওটা দিয়ে র‍্যাফটারের ভিউয়িং প্ল্যাটফর্মে যাওয়া যায়। ওখান থেকে নীচের দিকে তাকিয়ে তুমি ভাসারির বিখ্যাত ঝুলন্ত ছাদ দেখতে পাবে। চাইলে ওখানে যেতে পারো তোমরা, আমি না হয় এখানে অপেক্ষা।

“প্লিজ, মার্তা,” কথা শেষ হবার আগেই বলে উঠলো সিয়েনা। “আমি আসলে মুখোশটি দেখতে চাইছি। আমাদের হাতে বেশি সময় নেই।”

সুন্দরী তরুণীর দিকে তাকিয়ে মার্তা একটু হতবুদ্ধি হয়ে গেলো। অচেনা লোকজনকে তুমি করে সম্বোধন করার নতুন ফ্যাশনটিকে সে একদম পছন্দ করে না। আমি সিনোরা আলভারেজ, মনে মনে বললো সে। আর আমি তোমাকে অনুকম্পা করছি।

“ঠিক আছে, সিয়েনা,” কাটাকাটাভাবে বললো মার্তা। “মুখোশটি ওখানে।”

মার্তা আর কোনো কথা বললো না। গতরাতে লাংডন আর ইল দুমিনো প্রায় আধঘণ্টার মতো সময় নিয়ে মুখোশটি দেখে গেছে। তাদের আগ্রহ দেখে মার্তার মধ্যেও কৌতূহল জন্মেছিলো। তাদের কাছে জানতে চেয়েছিলো গত এক বছর ধরে এই মুখোশটি নিয়ে যে পর পর কতোগুলো ঘটনা ঘটে গেছে তার সাথে তাদের এই মুখোশ দর্শনের কোনো সম্পর্ক আছে কিনা। ল্যাংডন আর ইল দুমিনো একটু কুণ্ঠিত হয়েছিলো প্রশ্নটা শুনে। সত্যিকারের কোনো জবাব তারা দেয় নি।

এখন তারা আন্দিতার সামনে এগিয়ে যাবার সময় ল্যাংডন তার বোনকে বলতে লাগলো কিভাবে মৃত্যু-মুখোশ তৈরি করা হয়। মার্তা সব শুনে বুঝতে পারলো, তার বলা কথাগুলো একদমই সঠিক। অথচ এই লোক একটু আগে বলেছে ডিভাইন কমেডির দুর্লভ কপিটি এর আগে দেখে নি। আজব।

“মৃত্যুর পর পরই,” ল্যাংডন বলছিলো, “মৃতব্যক্তিকে শুয়ে দেয়া হতো, তার মুখে মাখিয়ে দেয়া হতো অলিভ অয়েল। তারপর তরল প্লাস্টার সেই মুখের উপর মেখে দিতো সুন্দর করে, ঢেকে দেয়া হতো পুরোটা মুখ-ঠোঁট, নাক, চোখের পাতা-একেবারে কপালের উপরে থাকা চুলের রেখা থেকে শুরু করে ঘাড় পর্যন্ত। প্লাস্টারগুলো শক্ত হয়ে গেলে খুব সহজেই সেটা মুখ থেকে তুলে ফেলা যেতো। সেই পাস্টারের ছাঁচে আবার নতুন প্লাস্টার ঢেলে মৃতব্যক্তির মুখের আদল পাওয়া যেতো। একেবারে হুবহু। এটা অবশ্য করা হতো খুবই বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ আর প্রতিভাবানদের বেলায়। দান্তে, শেক্সপিয়ার, ভলতেয়ার, তাসূসো, কিটস, এরকম। যারা আছে তাদের সবার মৃত্যু-মুখোশ রয়েছে।”

“এই যে সেই মুখোশ, আন্দিতো’র বাইরে তারা সবাই চলে এলে মার্তা বললো। ল্যাংডন আর তার বোনকে ভেতরে ঢোকার জন্য সরে দাঁড়ালো সে। “বাম দিকের দেয়ালের কাছে রাখা ডিসপ্লে কেসের ভেতরে ওটা আছে।”

“ধন্যবাদ, তোমাকে।” কথাটা বলে সঙ্কীর্ণ করিডোরে ঢুকে পড়লো সিয়েনা। ডিসপ্লে কেসের সামনে দাঁড়িয়ে ভালো করে দেখলো সে। তার চোখ দুটো সঙ্গে সঙ্গে বড় হয়ে গেলো। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা তার ভায়ের দিকে তাকালো। ভুরু কুচকে চেয়ে আছে সে।

এরকম প্রতিক্রিয়া হাজার বার দেখেছে মার্তা। দর্শনার্থীরা প্রথমবারের মতো এই মুখোশটি দেখে প্রায়শই ভড়কে যায়, আৎকে ওঠে-দান্তের বলিরেখাযুক্ত ভয়ালদর্শন মুখ, বাঁকানো নাক, আর বন্ধ করে রাখা চোখ।

সিয়েনার পাশে এসে দাঁড়ালো ল্যাংডন। সঙ্গে সঙ্গে এক পা পিছিয়ে গেলো সে। একবারে ঘাবরে গেছে।

আর্তনাদ করে উঠলো মার্তা। চে এসাগেরাতো। তাদের পাশে এসে দাঁড়ালো। কেবিনেটের ভেতরে তাকাতেই ভড়কে গেলো সে। প্রায় জোরেই বলে উঠলো, “ওহুমিও দিও!”

ক্যাবিনেটের ভেতরে লাল সাটিনের কাপড়ের উপর যেখানটায় দান্তের মুখোশ ঝুলে থাকার কথা সেখানে কিছুই নেই। একদম ফাঁকা!

এ দৃশ্য দেখে মুখে হাতচাপা দিয়ে দিলো মার্তা। তার নিঃশ্বাস বেড়ে গেলো। পাশের একটি পিলার ধরে ভারসাম্য রক্ষা করলো কোনোমতে। অবশেষে ফাঁকা ক্যাবিনেট থেকে চোখ সরিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো, প্রবেশপথের সামনে। থাকা নাইটগার্ডের উদ্দেশ্যে ছুটলো সে।

“লা মাসকেরা দি দান্তে!” উন্মাদগ্রস্তের মতো চিৎকার করতে লাগলো। “লা মাসকেরা দি দান্তে এ স্পারিতা!”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *