১০. ব্রিওনি স্যুট

অধ্যায় ১০

“বসো,” সিয়েনা বললো। “তোমাকে আমার কিছু প্রশ্ন করার আছে।”

রান্নাঘরে ঢোকার সময় ল্যাংডনের মনে হলো তার পা দুটো আগের চেয়ে অনেক বেশি দৃঢ়। প্রতিবেশির কাছ থেকে আনা ব্রিওনি সুট পরে আছে সে, তার গায়ে চমৎকারভাবে ফিট হয়েছে সেটা। এমনকি যে লোফারটা পরেছে পায়ে সেটাও পুরোপুরি তার সাইজের। এরপর থেকে ইটালিয়ান জুতো পরা শুরু করবে বলে মনে মনে পণ করলো।

যদি আমি দেশে ফিরে যেতে পারি তো, ভাবলো সে।

সিয়েনা যেনো পুরোপুরি বদলে গেছে-প্রকৃতিপ্রদত্ত এক সুন্দরী-ঘিয়ে রঙা সোয়েটার আর টাইট জিন্স পরে আছে এখন। তার শরীরের সাথে ওগুলো দারুণভাবেই মানিয়ে গেছে। চুলগুলো অবশ্য আগের মতোই সামনে থেকে টেনে পেছনে ঝুটি করে বাধা। তবে হাসপাতালের স্ক্রাবস পরে নি বলে তার মধ্যে আগের কর্তৃত্বপরায়ণতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, বরং অনেক বেশি নাজুক মনে হচ্ছে তাকে। ল্যাংডন খেয়াল করলো মেয়েটার দু’চোখ লাল টকটকে। যেনো এতোক্ষণ ধরে সে কেঁদেছে। এ কথা ভাবতেই তার মধ্যে আবারো অপরাধবোধ জেগে উঠলো।

“সিয়েনা, আমি খুবই দুঃখিত। টেলিফোনের মেসেজটা আমি শুনেছি। কী বলবো বুঝতে পারছি না।”

“ধন্যবাদ,” জবাবে বললো সে। “তবে এখন আমাদেরকে তোমার উপরেই বেশি মনোযোগ দিতে হবে। প্লিজ, বসো।”

মেয়েটার কণ্ঠ এখন বেশ দৃঢ় শোনালো। একটু আগে তার সম্পর্কে পড়া আর্টিকেলগুলোর বক্তব্যের সাথে এটা বেশি খাপ খায়।

“আমি চাই তুমি ভাবো,” বললো সিয়েনা। “আমরা কিভাবে এই অ্যাপার্টমেন্টে এলাম সেটা কি মনে করতে পারবে?”

ল্যাংডন বুঝতে পারলো না এটা কিভাবে প্রাসঙ্গিক হতে পারে। “ট্যাক্সিতে করে,” টেবিলের সামনে বসে বললো সে। “আমাদের লক্ষ্য করে একজন গুলি ছুঁড়েছে।”

“তোমাকে লক্ষ্য করে, প্রফেসর। এ ব্যাপারে কোনো ভুল নেই।”

“হ্যাঁ, তা ঠিক।”

“ট্যাক্সিতে যখন ছিলে তখন কি কোনো গোলাগুলির কথা মনে করতে পারো?”

অদ্ভুত প্রশ্ন। “হ্যাঁ, দুটো গুলি করা হয়েছিলো। একটা সাইড মিররে লাগে, অন্যটা লাগে পেছনের জানালায়।”

“ভালো, এবার চোখ বন্ধ করো।”

ল্যাংডন বুঝতে পারলো মেয়েটা তার স্মৃতিশক্তি পরীক্ষা করছে। কথামতোই চোখ বন্ধ করলো সে।

“আমি কি পরে আছি?”

ল্যাংডন মেয়েটাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। “কালো জুতো, নীল রঙের জিন্স, ঘিয়ে রঙী ভি-নেকের সোয়েটার। তোমার চুল সোনালি, কাঁধ পর্যন্ত নামানো। টেনে ঝুটি করে বাধা আছে। তোমার চোখ দুটো বাদামি।”

চোখ খুলে মেয়েটাকে দেখলো ল্যাংডন, যা বলেছে তার সাথে পুরোপুরি মিল আছে দেখে খুশি হলো সে। তার মানে তার স্মৃতিশক্তি ভালোমতোই কাজ করছে। একদম স্বাভাবিক আছে।

“ভালো। তোমার ভিজুয়াল কগনিটিভ ইপ্রিন্টিং দারুণ, তার মানে তোমার অ্যামনেসিয়া পুরোপুরি কেটে গেছে। তোমার স্মৃতি সংরক্ষণ প্রক্রিয়ায় কোনো স্থায়ী ক্ষতি হয় নি। বিগত কয়েকদিনে ঘটে যাওয়া ঘটনার মধ্যে থেকে নতুন কিছু কি স্মরণ করতে পারছো?”

“দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, না। তুমি যখন বাইরে গেলে তখন আমি আবারো ঐ দৃশ্যটা দেখেছি।” ল্যাংডন সিয়েনাকে বলে গেলো ঘোমটা দেয়া নারী, লাশের ছবি, R অক্ষর। এরপর সে জানালো, আকাশে ভেসে ওঠা পাখির ঠোঁটের মতো মুখোশ পরা ছবিটার কথা।

“আমি মৃত্যু?” চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো সিয়েনা।

“হ্যাঁ, ওটা তাই বলেছে।”

“ঠিক আছে…আমার মনে হয় এটা অনেকটা এরকম, আমি বিষ্ণু, এ বিশ্বের বিনাশকারী।”

সিয়েনা যেটা বললো সেটা প্রথম আণবিক বোমা পরীক্ষা করার সময় রবার্ট ওপেনহাইমার বলেছিলেন।

“পাখির ঠোঁটের মতো নাক…সবুজ চোখের মুখোশ?” বললো সিয়েনা, তাকে হতবুদ্ধিকর দেখাচ্ছে। “তোমার কি কোনো ধারণা আছে এরকম ছবি কেন তোমার মনের পর্দায় ভেসে উঠলো?”

“কোনো ধারণাই নেই। তবে এ ধরণের মুখোশ মধ্যযুগে বেশ প্রচলিত ছিলো।” একটু থামলো ল্যাংডন। “এটাকে বলে প্লেগ মুখোশ।”

সিয়েনাকে অদ্ভুতভাবেই ঘাবড়ে যেতে দেখালো। “প্লেগ মুখোশ?”

ল্যাংডন দ্রুত বলে গেলো সিম্বলের জগতের কথা। পাখির ঠোঁটসদৃশ্য মুখোশ মধ্যযুগে ব্ল্যাক ডেথ অর্থাৎ মরণঘাতি প্লেগের সমার্থক হয়ে উঠেছিলো। তেনো শতকের দিকে এই প্লেগের প্রাদুর্ভাবে সমগ্র ইউরোপের এক তৃতীয়াংশের মতো জনসংখ্যা হ্রাস পায়। বেশিরভাগ পণ্ডিত মনে করে, প্লেগে আক্রান্ত রোগির মাংস কালচে হয়ে যেতো বলে এই রোগের নামকরণ করা হয় ব্ল্যাক ডেথ। কিন্তু সত্যি কথা হলো, ব্ল্যাক বা কালো শব্দটি দিয়ে আসলে প্লেগের ভয়ঙ্কর মহামারি নিয়ে লোকজনের মধ্যে যে আতঙ্ক আর মৃত্যুভয় কাজ করতো সেটাই বোঝানো হয়েছে।

“পাখির ঠোঁটের মতো মুখোশ,” ল্যাংডন বললো, “মধ্যযুগে প্লেগের চিকিৎসায়রত ডাক্তাররা ব্যবহার করতো এই ভয়ঙ্কর ছোঁয়াচে রোগ থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করার জন্য। এখন কেবলমাত্র ভেনিসের কার্নিভালে পোশাক হিসেবে এটা পরা হয়ে থাকে-ইটালির ইতিহাসের একটি মর্মান্তিক অধ্যায়কে স্মরণ করে।”

“তুমি নিশ্চিত, ওরকম একটি মুখোশ দেখেছো?” জিজ্ঞে) লো সিয়েনা, তার কণ্ঠ এখন রীতিমতো কাঁপছে। “মধ্যযুগের প্লেগ রোগের ডাক্তাররা এটা পরতো?”

মাথা নেড়ে সায় দিলে ল্যাংডন। পাখির ঠোঁটসদৃশ্য মুখোশ দেখে ভুল করার কোনো সুযোগই নেই।

সিয়েনার ভুরু কোঁচকানো ভঙ্গি দেখে ল্যাংডন আঁচ করতে পারলো মেয়েটা কোনো দুঃসংবাদ দিতে যাচ্ছে তাকে, কিন্তু কিভাবে সেটা দিলে ভালো হয় বুঝে উঠতে পারছে না। আর ঐ মহিলা তোমাকে বলে যাচ্ছিলো খুঁজলেই পাবে?”

“হ্যাঁ। ঠিক আগেরবারের মতোই। কিন্তু সমস্যা হলো আমার কোনো ধারণাই নেই কী খুঁজবো আমি।”

তিক্তমুখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সিয়েনা। মনে হয় সেটা আমি জানি। তারচেয়েও বড় কথা ঐ জিনিসটা তুমি এরইমধ্যে পেয়েও গেছে।”

ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো ল্যাংডন। “তুমি কী বলছো?!”

“রবার্ট, হাসপাতালে যখন তুমি এলে তখন তোমার জ্যাকেটের পকেটে অস্বাভাবিক একটি জিনিস ছিলো। তুমি কি মনে করতে পারো সেটা কি?”

মাথা ঝাঁকালো ল্যাংডন।

“সাথে করে তুমি অদ্ভুত একটি জিনিস নিয়ে এসেছিলে…বলা ভালো খুবই চমকে যাবার মতো একটি জিনিস। তোমার শরীর থেকে জামা-কাপড় খুলে ফেলার সময় আমরা ওটা পেয়ে যাই।” টেবিলের উপর মেলে রাখা ল্যাংডনের রক্তলাগা হারিস টুইড জ্যাকেটের দিকে ইঙ্গিত করলো সে। “ওটা এখনও। পকেটের ভেতরেই আছে। তুমি দেখতে চাইলে দেখতে পারো।”

কিছু বুঝতে না পেরে নিজের জ্যাকেটের দিকে তাকালো ল্যাংডন। এ থেকে অন্তত এটা বোঝা গেলো ওরকম মুহূর্তে মেয়েটা কেন আমার জ্যাকেট নিতে গেলো। রক্তের দাগ লেগে থাকা জ্যাকেটটা হাতে নিয়ে এক এক করে সবগুলো পকেট খুঁজে দেখলো সে। কিছুই পেলো না। আবারো খুঁজে দেখলো। একই ফল। সিয়েনার দিকে ফিরে কাঁধ তুললো এবার। “কিছুই তো নেই।”

“গোপন পকেটটা খুঁজে দেখো।”

“কি? আমার জ্যাকেটে কোনো গোপন পকেট নেই।”

“নেই?” মেয়েটাকে হতবুদ্ধিকর দেখালো। “তাহলে কি…এই জ্যাকেটটা অন্য কারোর?”

ল্যাংডনের মাথা আবারো ঝিমঝিম করতে শুরু করলো। “না, তা হবে কেন, এটা আমারই জ্যাকেট।”

“তুমি নিশ্চিত?” আলবৎ! ভাবলো সে। এটা তো আমার প্রিয় পোশাক।

জ্যাকেটের ভেতরে থাকা লেবেলটা দেখালো সিয়েনাকে। ওটাতে হ্যারিস টুইডের আইকনিক গোলক আর তার চারপাশ জুড়ে থাকা বোতাম সদৃশ্য তেরোটি জুয়েল আর উপরে মলটিস ক্রশ রয়েছে।

“এটা দেখো,” এম্ব্রয়ডারি করা তার নামের আদ্যক্ষর-আর.এল-রয়েছে। সেখানে। ল্যাংডন সব সময়ই অর্ডার দিয়ে জ্যাকেট বানিয়ে নেয়। এরফলে ব্র্যান্ড নামের পাশাপাশি নিজের আদ্যক্ষরও বসিয়ে নিতে পারে। হারর্ভাডের মতো ক্যাম্পাসে কতোজন এরকম জ্যাকেট পরে তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। লন্ড্রি করতে দেবার পর এরটার সাথে ওরটার অদল বদল ঠেকাতেই এই ব্যবস্থা।

“আমি তোমার কথা বিশ্বাস করলাম,” জ্যাকেটটা তার হাত থেকে নিয়ে বললো সিয়েনা। “এবার দেখো।”

জ্যাকেটটা পুরোপুরি খুলে মেলে ধরলো সে। ভেতর দিকে কলারের পেছনে একটা সেলাই করা লাইন আছে। ওটা আসলে গোপন পকেট।

এটা আবার কি?!

ল্যাংডন নিশ্চিত এই পকেটটা সে এর আগে কখনও দেখে নি। এমনভাবে ওটা সেলাই আছে যে চোখে দেখলেও বোঝার কোনো উপায় নেই।

“এর আগে তো ওটা ছিলো না!” জোর দিয়ে বললো ল্যাংডন।

“তাহলে আমি ধরে নিতে পারি তুমি এটা কখনও দেখো নি?” পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা মসৃণ ধাতব জিনিস বের করে আনলো সে। ওটা আস্তে করে তুলে দিলো ল্যাংডনের হাতে।

জিনিসটার দিকে বাকরুদ্ধ হয়ে চেয়ে রইলো ল্যাংডন।

“তুমি কি জানো এটা কি?” জানতে চাইলো সিয়েনা।

“না…” চট করে বললো সে। “এরকম জিনিস এর আগে কখনও দেখি নি।”

“দুঃখের বিষয়, আমি এটা চিনি। আর আমি শতভাগ নিশ্চিত, এই জিনিসটার জন্যেই কেউ তোমাকে খুন করার চেষ্টা করছে।”

.

মেন্দাসিয়াম-এর প্রাইভেট রুমে পায়চারি করতে থাকা ফ্যাসিলিটেটর নোলটন এক ধরণের চরম অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেছে, কারণ এইমাত্র দেখা ভিডিওটি আগামীকাল সকালে সারাবিশ্বের সাথে শেয়ার করতে হবে।

আমি সেই ছায়া।

একটা গুজব শুনেছে সে, তাদের এই ক্লায়েন্ট নাকি বিগত কয়েক মাস ধরে মানসিক ভারসাম্যহীনতার মধ্যে ছিলো। কিন্তু এই ভিডিওটা দেখার পর এসব কথাকে আর গুজব বলে মনে হচ্ছে না। নোলটন জানে তার কাছে এখন দুটো উপায় রয়েছে। প্রতিশ্রুতি মোতাবেক আগামীকাল সকালে ভিডিওটি ডেলিভারি দেয়া অথবা পুণরায় বিবেচনা করার জন্য উপর তলায় প্রভোস্টকে ভিডিওটা দেখতে বলা।

আমি অবশ্য অবশ্য জানি উনি কী বলবেন, ভাবলো নোলটন। ক্লায়েন্টের কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতি কখনও দ্বিতীয়বার বিবেচনা করতে দেখে নি প্রভোস্টকে। উনি আমাকে এই ভিডিওটা সারাবিশ্বকে দেখানোর জন্য আপলোড করে দিতে বলবেন। এ নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন করতে দেবেন না…প্রশ্ন করলেই উনি আমার উপর ভীষণ ক্ষেপে যাবেন।

আবারো ভিডিওটার দিকে মনোযোগ দিলো নোলটন। বিশেষ করে নির্দিষ্ট একটি জায়গা আবারো দেখলো সে।

পাখির ঠোঁটসদৃশ্য মুখোশ পরা অবয়বটি ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠে বলছে :

নতুন অন্ধকার যুগ সমাগত।
শত শত বছর আগে, ইউরোপ তার নিজের দুর্দশায় নিপতিত হয়েছিলো-এর অধিবাসীরা দলে দলে অন্য কোথাও চলে গেছিলো, অভুক্ত অবস্থায় দিন কাটাতো, পাপ আর হতাশায় জর্জরিত ছিলো তারা। ঘন বন-জঙ্গলের মতোই তারা গাদাগাদি করে থাকতো, অনেকটা মৃতবৃক্ষের গন্ধে দম বন্ধ অবস্থায়। অপেক্ষায় ছিলো ঈশ্বরের কৃপা কখন তাদের উপর নেমে আসবে আলোকবর্তিকার মতো-যে আলো প্রজ্জ্বলিত হবে সেই আগুন পুড়িয়ে ফেলবে সমস্ত মৃতবৃক্ষ, বয়ে আনবে নতুন সূর্যালোক, আর পুণরায় জন্ম দেবে সুস্থ বৃক্ষরাজির।
সমূলে উৎপাটন হলো ঈশ্বরের স্বাভাবিক ব্যবস্থা।
নিজেদেরকে জিজ্ঞেস করো, ব্ল্যাক ডেথের পর কি এসেছিলো?
আমরা সবাই এর জবাব জানি।
রেনেসাঁ।
পুণর্জন্ম।
সব সময় এমনটিই হয়ে আসছে। মৃত্যুর পর আসে জীবন।
স্বর্গে পৌঁছাতে হলে মানুষকে ইনফার্নো পেরোতেই হবে।
এটাই আমাদের প্রভু শিক্ষা দিয়েছেন।
তারপরও সাদা চুলের মূর্খের কী দুঃসাহস, আমাকে দানব বলে ডাকে? সে কি এখনও ভবিষ্যতের অঙ্কটা অনুধাবন করতে পারে নি? কোন্ বিভীষিকা বয়ে আনবে এটা?
আমি সেই ছায়া।
আমি তোমাদের মুক্তি।
তাই তো আমি দাঁড়িয়ে আছি মাটির নীচে এই গুহায়, চেয়ে আছি এমন একটি জলাধারের দিকে যা কোনো তারাকে প্রতিফলিত করে না। এখানে এই ডুবন্ত প্রাসাদের পানির নীচে উদগীরিত হচ্ছে ইনফার্নো।
খুব শীঘ্রই এটা অগ্নিশিখায় বিস্ফোরিত হবে।
আর যখন এটা হবে, এ পৃথিবীর কোনো কিছুই সেটাকে থামাতে পারবে না।

.

অধ্যায় ১১

ল্যাংডনের মনে হলো তার হাতের জিনিসটা আকারের তুলনায় অনেক বেশি ওজনের। মসৃণ আর দৃঢ়, পালিশ করা ধাতব একটি সিলিন্ডার, দৈর্ঘে ছয় ইঞ্চির মতো হবে, উভয় দিকই গোলাকার, অনেকটা ছোটোখাটো টর্পেডোর মতো।

“জিনিসটা বেশি নাড়াচাড়া করার আগে,” সিয়েনা বললো তাকে, “তোমার উচিত এর অন্য দিকটা আগে দেখা।” একটা কাষ্ঠহাসি দিলো সে। “তুমি বলেছো তুমি সিম্বলজির প্রফেসর, তাই না?”

ধাতব সিলিন্ডারটার দিকে ভালো করে তাকালো ল্যাংডন। একটু ঘোরাতেই এর গায়ে লাল রঙের একটি সিম্বল দেখতে পেলো সে।

সঙ্গে সঙ্গে তার সমস্ত শরীর আড়ষ্ট হয়ে গেলো।

আইকনোলজির ছাত্র হিসেবে ল্যাংডন জানে কিছু কিছু ইমেজ আছে যেগুলো দেখামাত্রই মানব মনে দারুণ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে…মুহূর্তেই ভড়কে দেয়ার ক্ষমতা রাখে ওগুলো…এ মুহূর্তে চোখের সামনে যে সিম্বলটা আছে সেটা ঠিক ঐ ধরণেরই। দেরি না করে টেবিলের উপর সিলিন্ডারটি সাবধানে রেখে দিয়ে নিজের চেয়ারটা একটু পেছনে নিয়ে গেলো সে।

মাথা নেড়ে সায় দিলো সিয়েনা। “হুম। প্রথমবার এটা দেখে আমিও ঠিক এমনটিই করেছিলাম।”

সিলিন্ডারের গায়ের সিম্বলটি কতোগুলো ইমেজের জড়িয়ে থাকা একটি রূপ।

A picture containing icon

Description automatically generated

খুবই কুখ্যাত একটি সিম্বল। ল্যাংডন একবার পড়েছিলো, এই সিম্বলটা ১৯৬০’এর দশকে ডাউ কেমিকেল প্রবর্তন করেছিলো আগের একটি নিরীহ সিম্বলকে বাদ দিয়ে। আর সব সফল সিম্বলের মতো এটাও খুব সরল, বোধগম্য আর সহজেই পুণরুৎপাদন করা যায়। খুবই সুচতুরভাবে কাকঁড়ার আঙটাতুল্য হাত থেকে শুরু করে নিনজাদের ছুঁড়ে মারা চাকুর সাথে মিল রেখে তৈরি করা হয়েছে আধুনিককালের ‘বায়োহ্যাজার্ড’ সিম্বলটি। এ বিশ্বের সব ভাষার মানুষের কাছেই এটা এখন বিপজ্জনক-এর প্রতীক হিসেবে সুপরিচিত।

“এই ছোট্ট ক্যানিস্টারটি আসলে একটি বায়োটিউব,” সিয়েনা বললো। “বিপজ্জনক বস্তু পরিবহণের সময় এটা ব্যবহার করা হয়। আমাদের চিকিৎসাবিদ্যার দুনিয়ায় এটা খুব একটা দেখা যায় না। এর ভেতরে ফোমের প্যাডে পেঁচিয়ে নমুনাটি রাখা আছে। “আমি অনুমাণ করতে পারি…” সিম্বলটার দিকে ইঙ্গিত করলো সে, “এর ভেতরে প্রাণঘাতি কোনো কেমিকেল রয়েছে…কিংবা মারণঘাতি ভাইরাস?” একটু থামলো সিয়েনা। “আফ্রিকা থেকে ইবোলা ভাইরাসের প্রথম নমুনাটি ঠিক এরকম টিউবে করেই নিয়ে আসা হয়েছিলো।”

এরকম কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলো না ল্যাংডন। “এই বালের জিনিসটা। আমার পকেটে কি করে এলো! আমি একজন সামান্য শিল্পকলার ইতিহাসের প্রফেসর; আমি কেন এরকম জিনিস সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়াবো??”

দোমড়ানো মোচড়ানো মানবদেহের ভয়ঙ্কর ছবিগুলো আবার মনের পর্দায় ভেসে উঠলো…তাদের উপর ভেসে বেড়াচ্ছে প্লেগ মুখোশ।

ভেরি সরি…ভেরি সরি।

“যেখান থেকেই এটা এসে থাকুক না কেন,” বললো সিয়েনা, “অনেক উপরের লেভেল থেকে এসেছে। লিড-লাইন্ড টাইটানিয়াম। কার্যত অপ্রবেশ্য, এমনকি তেজস্ক্রিয়তাও ঢুকতে পারবে না এতে। আমি সরকারের দিকেই ইঙ্গিত করবো।” বায়োহ্যাজার্ড সিম্বলের পাশে স্ট্যাম্প আকৃতির কালো রঙের একটি প্যাডের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলো সে। “এটা আঙুলের ছাপ চিনতে পারে। হারিয়ে গেলে কিংবা চুরি হলে যেনো নিরাপদে থাকে সেজন্যে এই নিরাপত্তা ব্যবস্থা। নির্দিষ্ট একজন ব্যক্তিই এই টিউবটা খুলতে পারবে। অন্য কেউ না।”

যদিও ল্যাংডন মনে করছে তার মাথা ঠিকঠাকভাবেই কাজ করছে এখন তারপরও এই বিষয়টা পুরোপুরি বোধগম্য হচ্ছে না। আমি একটি বায়োমেট্রিক্যালি সিল করা ক্যানিস্টার বয়ে বেড়িয়েছি।

“তোমার পকেট থেকে এই জিনিসটা খুঁজে পাবার পর আমি চেয়েছিলাম ডাক্তার মারকোনিকে একান্তে সেটা দেখাতে, কিন্তু তুমি জেগে ওঠার আগে সে সুযোগ আমি পাই নি। তুমি যখন অচেতন ছিলে তখন তোমার বুড়ো আঙুল ব্যবহার করে ক্যানিস্টারটা খোলার কথাও ভেবেছিলাম। কিন্তু এই টিউবের ভেতরে আসলে কি আছে সেটা তো আমি জানি না তাই

“আমার বুড়ো আঙুল?” মাথা ঝাঁকালো ল্যাংডন। “এই জিনিসটা কোনোভাবেই আমার জন্যে প্রোগ্রাম করা হয় নি। আমার বুড়ো আঙুল ব্যবহার করে এটা খোলার কথা ভাবাটাও পাগলামি। বায়োকেমিস্ট্রির ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। এরকম কোনো কিছুর সাথে আমি কখনও জড়িতও ছিলাম না।”

“তুমি একদম নিশ্চিত?”

ল্যাংডন একশত ভাগ নিশ্চিত। বুড়ো আঙুলটা টিউবের ফিঙ্গার প্যাডে চেপে ধরলো সে। কিছুই হলো না। “দেখলে তো? আমি আগেই বলেছিলাম-”

টাইটানিয়ামের টিউবটা ক্লিক করে শব্দ করলে ভয় পেয়ে ল্যাংডন তার হাতটা সরিয়ে নিলো সঙ্গে সঙ্গে। যেনো আগুনের ছ্যাকা লেগেছে আঙুলে। বাপরে বাপ! ক্যানিস্টারের দিকে এমনভাবে চেয়ে রইলো যেনো এক্ষুণি ওটা থেকে প্রাণঘাতি কোনো গ্যাস বের হবে। তিন সেকেন্ড পর আবারো ক্লিক করে শব্দ হলে রি-লকিং হয়ে গেলো। বাকরুদ্ধ ল্যাংডন তাকালো সিয়েনার দিকে।

দীর্ঘশ্বাস ফেললো মেয়েটি। তাকেও খুব ভয়ার্ত দেখাচ্ছে। “এখন তো পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে এটা তুমি বহন করবে বলেই প্রোগ্রাম করা হয়েছে।”

ল্যাংডনের কাছে পুরো বিষয়টাই বেখাপ্পা বলে মনে হলো। “অসম্ভব। তার আগে আমাকে বলো, আমি কি করে এই জিনিস নিয়ে এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি পার হলাম?”

“হতে পারে তুমি কোনো প্রাইভেট জেটে করে এখানে এসেছো? কিংবা ইটালিতে পৌঁছানোর পর কেউ তোমাকে এটা দিয়েছে?”

“সিয়েনা, আমার উচিত কনসুলেটে ফোন করা। এক্ষুণি।”

“তুমি কি মনে করছে না সবার আগে এটা আমাদের খুলে দেখা উচিত?”

এ জীবনে অসংখ্যবার বাজে উপদেশ শুনেছে ল্যাংডন কিন্তু এই রান্নাঘরে বসে প্রাণঘাতি বস্তুর কন্টেইনার খুলে দেখার বুদ্ধিটা কোনোভাবেই মেনে নেবে না। “এই জিনিস আমি কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে দেবো। আর সেটা এখনই।”

নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো সিয়েনা। কথাটা নিয়ে একটু ভেবে গেলো। “ঠিক আছে, কিন্তু ওদেরকে ফোন করার পর থেকে তুমি তোমার রাস্তা দেখবে। আমি এসবের সাথে জড়াতে চাই না। তুমি ওদের সাথে অবশ্যই এখানে দেখা করতে পারবে না। ইটালিতে আমার ইমিগ্রেশন নিয়ে…মানে, একটু জটিলতা আছে।”

সিয়েনার চোখে চোখ রাখলো ল্যাংডন। “দেখো সিয়েনা, আমি শুধু জানি তুমি আমার জীবন বাঁচিয়েছো। তুমি যেভাবে চাইবে আমি ঠিক সেভাবেই এই পরিস্থিতিটা সামলাবো।”

কৃতজ্ঞতা জানিয়ে মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে জানালার কাছে চলে গেলো মেয়েটা। নীচের রাস্তার দিকে চেয়ে রইলো সে। “ঠিক আছে, আমাদেরকে ঠিক এভাবে কাজটা করতে হবে।”

দ্রুত একটা পরিকল্পনা করে ফেললো সিয়েনা। খুবই সহজ, চাতুর্যপূর্ণ আর নিরাপদ।

মেয়েটা তার সেলফোন বের করে ডায়াল করলো। চুপচাপ দেখে গেলো ল্যাংডন।

“ইনফরমাজিওনি আব্বোনাতি?” একেবারে চোস্ত ইতালিতে কথা বললো সে। “পা ফাভোরে, পুয়ো দারমি ইল নুমেরো দেল কসালাতো আমেরিকানো দি ফিরেনজে?”

একটু অপেক্ষা করার পর দ্রুত একটি ফোন নাম্বার টুকে নিলো সে। “গ্রাজি মিলে,” বলেই ফোনটা রেখে রেখে দিলো।

সিয়েনা তার সেলফোন আর ফোন নাম্বারটা বাড়িয়ে দিলো ল্যাংডনের দিকে। “নাও। তোমার কি মনে আছে কি বলতে হবে?”

“আমার স্মৃতি একদম ঠিক আছে,” হেসে বললো সে, তারপরই ফোন নাম্বারটা ডায়াল করতে শুরু করলো।

রিং হচ্ছে।

ফোনটা স্পিকার মোডে দিয়ে টেবিলের উপর রেখে দিলো, যাতে করে সিয়েনা শুনতে পায়। রেকর্ড করা একটি মেসেজ জবাব দিলো। কনসুলেট সম্পর্কে সাধারণ তথ্য জানতে চায় কিনা জিজ্ঞেস করলো, আরো জানালো সকাল ৮:৩০ আগে কনসুলেটের কাজকর্ম শুরু হয় না।

দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালো ল্যাংডন। ভোর ৬টা বাজে এখন।

“তবে জরুরি প্রয়োজনে,” রেকর্ড করা কণ্ঠ বলতে লাগলো, “আপনি সাত সাত নাম্বারে ডায়াল করে আমাদের নাইট ডিউটিতে থাকা অফিসারের সঙ্গে কথা বলতে পারেন।”

সঙ্গে সঙ্গে এক্সটেনশন নাম্বারে ডায়াল করলো ল্যাংডন।

আবারো রিং হবার শব্দ শোনা গেলো।

“কনসোলাতো আমেরিকানো,” জবাব দিলো ক্লান্তশ্রান্ত একটি কণ্ঠ। “সোনো ইল ফানজিওনারি দি তুনো।”

“লেই পারলা ইংলিসি?” জিজ্ঞেস করলো ল্যাংডন।

“অবশ্যই,” আমেরিকান ইংরেজিতে বলা হলো ওপাশ থেকে। “আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি?”

“আমি একজন আমেরিকান, ফ্লোরেন্সে এসেছি বেড়াতে, আমার উপরে আক্রমণ করা হয়েছে। আমার নাম রবার্ট ল্যাংডন।”

“পাসপোর্ট নাম্বারটা বলেন, প্লিজ,” হাই তুলে বললো লোকটি।

“আমি আমার পাসপোর্ট হারিয়ে ফেলেছি। আমার ধারণা ওটা চুরি হয়ে গেছে। আমার মাথায় গুলি করা হয়েছিলো। হাসপাতালে ছিলাম আমি। আমার এখন সাহায্যের দরকার।”

ওপাশের লোকটি যেনো নড়েচড়ে উঠলো। “স্যার!? আপনি বলছেন আপনাকে গুলি করা হয়েছে? দয়া করে আপনার পুরো নামটা আবার বলবেন কি?”

“রবার্ট ল্যাংডন।”

ওপাশের লোকটা কিবোর্ডে দ্রুত কিছু টাইপ করলে সেটা স্পষ্ট শুনতে পেলো ল্যাংডন। কম্পিউটারটা বিপ করে উঠলো। একটু বিরতি। সঙ্গে সঙ্গে আবারো টাইপ করার শব্দ। আবারো বিপ। তারপর তিন তিনটি বিপ করার শব্দ হলো।

দীর্ঘ নীরবতা নেমে এলো ওপাশ থেকে। “স্যার?”

লোকটা বললো। “আপনার নাম রবার্ট ল্যাংডন?”

“হ্যাঁ। আমি খুব সমস্যায় পড়ে গেছি।”

“ঠিক আছে, স্যার। আপনার নামটা অ্যাকশন ফ্লাগে রয়েছে, তাই আপনাকে আমি এক্ষুণি কনসাল জেনারেলের চিফ অ্যাডমিনেস্ট্রেটরের কাছে ট্রান্সফার করে দিচ্ছি।” একটু থামলো সে। যেনো কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছে না। একটু লাইনে থাকুন।”

“দাঁড়ান! আপনি কি বলতে পারেন—

ততোক্ষণে লাইনে রিং বাজা শুরু হয়ে গেছে।

চারবার রিং হবার পর সংযোগ পাওয়া গেলো।

“কলিন্স বলছি,” জবাব দিলো ফ্যাসফ্যাসে একটি কণ্ঠ।

বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে শান্ত ভঙ্গিতে বলা শুরু করলো ল্যাংডন। “মি: কলিন্স, আমার নাম রবার্ট ল্যাংডন। আমি একজন আমেরিকান, ফ্লোরেন্সে বেড়াতে এসেছি। আমাকে গুলি করা হয়েছে। আমার এখন সাহায্যের দরকার। আমি এক্ষুণি ইউএস কনসুলেটে আসতে চাচ্ছি। আপনি কি আমাকে সাহায্য করতে পারবেন?”

কোনো রকম দ্বিধা ছাড়াই গম্ভীর কণ্ঠটা জবাব দিলো, “ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আপনি বেঁচে আছেন, মি: ল্যাংডন। আমরা আপনাকে পাগলের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম।”

.

অধ্যায় ১২

কনসুলেট জানে আমি এখানে আছি?

ল্যাংডনের জন্যে এই খবরটা বেশ স্বস্তিদায়ক হলো।

মি: কলিন্স-যে নিজেকে কনসাল জেনারেলের চিফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে পরিচয় দিয়েছে-কথা বলছে বেশ দৃঢ়তার সাথে, একেবারে পেশাদার আমলাদের মতো কিন্তু তার কণ্ঠে এক ধরণের তাগাদাও আছে। “মি: ল্যাংডন, আপনার সাথে আমার এক্ষুণি কথা বলা দরকার। আর সেটা অবশ্যই টেলিফোনে নয়।”

ল্যাংডন চুপচাপ শুনে গেলে, কোনো বাধা দিলো না।

“আমি একজনকে পাঠিয়ে দিচ্ছি, সে আপনাকে এখানে নিয়ে আসবে,” বললো কলিন্স। “আপনি এখন কোথায় আছেন?”

সিয়েনাকে একটু নাভাস মনে হলে ল্যাংডন তাকে ইশারা করে আশ্বস্ত করলো। মেয়েটার পরিকল্পনা মতোই সব কিছু হবে।

“আমি পেনসিওনি লা ফিওরেন্তিনা নামের ছোট্ট একটি হোটেলে উঠেছি,” জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। সিয়েনা তাকে রাস্তার ওপারে এই হোটেলটার কথাই বলে দিয়েছিলো। কলিন্সকে রাস্তার নাম আর নাম্বার বলে দিলো এবার।

“ঠিক আছে,” জবাব দিলো লোকটি। “হোটেলের বাইরে যাবেন না। নিজের রুমেই থাকুন। এক্ষুণি একজনকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। রুম নাম্বারটা কতো?”

বানিয়ে বললো ল্যাংডন, “ঊনত্রিশ।”

“ঠিক আছে। বিশ মিনিট।” কণ্ঠ নীচে নামিয়ে বললো কলিন্স। “মি: ল্যাংডন, মনে হচ্ছে আপনি আহত এবং বিপর্যস্ত, কিন্তু তারপরও আমার জানা দরকার…আপনার কাছে কি ওটা আছে?”

আমার কাছে। প্রশ্নটা ধরতে পারলো ল্যাংডন। এর একটাই অর্থ হতে পারে। রান্নাঘরের টেবিলের উপর বায়োটিউবটার দিকে তাকালো সে। “জি, স্যার। আমার কাছেই আছে।”

কলিন্সের হাফ ছাড়ার শব্দ ফোনে স্পষ্ট শোনা গেলো। “আপনার কোনো খবর না পেয়ে আমরা ধরে নিয়েছিলাম…মানে, খুব খারাপ কিছু হয়েছে আপনার। এখন খুব শান্তি পাচ্ছি। যেখানে আছেন সেখানেই থাকুন। মাত্র বিশ মিনিট। তারপরই আপনার রুমে একজন আসবে।”

ফোন রেখে দিলো কলিন্স।

জেগে উঠে নিজেকে হাসপাতালে আবিষ্কার করার পর থেকে এই প্রথম একধরণের স্বস্তি পেলো ল্যাংডন। কনসুলেট জানে কি হয়েছে, খুব জলদি আমিও সব জানতে পারবো। চোখ বন্ধ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে। তার মাথা

থাটাও চলে গেছে।

“সব শুনে মনে হচ্ছে এমআই-৬’র কাজকারবার,” একটু ঠাট্টারছলেই বললো সিয়েনা। “তুমি কি আসলে স্পাই?”

এ মুহূর্তে ল্যাংডনের কোনো ধারণাই নেই সে আসলে কি। বিগত দুদিনের কোনো স্মৃতি তার ভাণ্ডারে নেই। ঐ সময়টাতে কি হয়েছে সে সম্পর্কে কিছুই জানে না। তবে বিশ মিনিট পরই সব খোলাসা হবে।

এখানে আসলে কি হচ্ছে?

সিয়েনার দিকে তাকালো, তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটতে যাচ্ছে একটু পরই, কিন্তু ল্যাংডনের মনে হচ্ছে মেয়েটার সাথে এখনও অসমাপ্ত কাজ বাকি রয়ে গেছে। দাড়িওয়ালা ডাক্তারের মৃত্যুদৃশ্য মনে করলো সে। “সিয়েনা,” ফিসফিসিয়ে বললো। “তোমার বন্ধু…ডাক্তার মারকোনি…তার ঘটনার জন্যে আমি সত্যি খুব দুঃখিত।”

উদাস হয়ে মাথা নেড়ে কেবল সায় দিলো মেয়েটি।

“তোমাকেও এসবের মধ্যে টেনে আনার জন্য দুঃখিত। আমি বুঝতে পারছি, হাসপাতালে তোমার অনেক ঝামেলা হবে…এ ঘটনা নিয়ে যদি কোনো তদন্ত হয়…” কথাটা আর বলতে পারলো না।

“ঠিক আছে,” বললো সিয়েনা। “জায়গা বদল করাটা আমার জন্য নতুন কিছু নয়। এতে আমি অভ্যস্ত।”

সিয়েনার উদাস চোখের দিকে তাকিয়ে ল্যাংডন বুঝতে পারলো মেয়েটির জীবন হঠাৎ করেই পাল্টে গেছে। এ মুহূর্তে ল্যাংডনের নিজের জীবনটাই এলোমেলো হয়ে আছে, তারপরও মেয়েটার জন্য খুব মায়া হচ্ছে তার।

ও আমার জীবন বাঁচিয়েছে…আর আমি ওর জীবনটা বিপর্যস্ত করে ফেলেছি।

প্রায় এক মিনিট তারা কোনো কথা বললো না। ঘরের বাতাস খুব ভারি অনুভূত হলো। যেনো তারা দুজনেই কথা বলতে চাইছে কিন্তু বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। হাজার হলেও, তারা একে অন্যের কাছে অপরিচিত, অদ্ভুত একটি ঘটনায় কিছুক্ষণের জন্য তাদের পথ এক হয়ে গেছিলো। তারা একসাথে কিছুটা পথ ভ্রমণও করেছে কিন্তু এখন সময় হয়েছে নিজেদের জন্য আলাদা আলাদা পথ বেছে নেয়ার।

“সিয়েনা,” অবশেষে নীরবতা ভেঙে বললো ল্যাংডন, “কনসুলেটে গিয়ে এই ঝামেলাটা মেটানোর পর আমি কি তোমাকে সাহায্য করতে পারবো…প্লিজ, এটা অন্যভাবে নিও না।”

“ধন্যবাদ,” জানালা থেকে বিন্ন মুখে ফিরে আস্তে করে বললো সে।

.

মিনিটের পর মিনিট কেটে গেলো নীরবতায়। সিয়েনা ব্রুকস একদৃষ্টিতে জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে থেকে ভাবতে লাগলো, আজকের দিনটা তাকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে। সে যা-ই হোক না কেন, তার দুনিয়াটা যে অনেক বদলে যাবে সে ব্যাপারে তার মনে কোনো সন্দেহ নেই।

সে জানে এটা সম্ভবত তার অ্যাড্রেনালাইনের জন্যই হবে, কিন্তু অদ্ভুতভাবেই আমেরিকান প্রফেসরের প্রতি এক ধরণের আকর্ষণ বোধ করছে। ভদ্রলোক খুবই হৃদয়বান একজন মানুষ কিন্তু সেইসাথে দারুণ হ্যান্ডসামও। অন্য এক জীবনে, রবার্ট ল্যাংডনের সাথে হয়তো সে জীবন কাটিয়ে দিতে চাইবে।

তবে সে আমাকে কখনও চাইবে না, ভাবলো সিয়েনা। আমি বরবাদ হয়ে গেছি।

নিজের আবেগকে দমন করতেই জানালার বাইরে কিছু একটা তার চোখে পড়লো। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো সে। জানালার কাঁচ দিয়ে নীচের রাস্তার দিকে.ভুরু কুচকে তাকালো। “রবার্ট, দেখো!”

ল্যাংডন জানালা দিয়ে চেয়ে দেখলো কালো কুচকুচে বিএমডব্লিউ মোটরসাইকেলটা পেনসিওনি লা ফিওরেন্তিনা হোটেলের সামনে এসে থেমেছে। কালো চামড়ার প্যান্ট আর সুট পরা মেয়েটিকে হেলমেট পরা অবস্থায়ও চিনতে ভুল হলো না। বাইকটা পার্ক করেই হেলমেট খুলে ফেললো সে। সিয়েনা টের পেলো ল্যাংডন জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে।

স্পাইক করা কালো চুলের সেই মেয়েটি!

সাইলের পিস্তল বের করে চেক করে দেখেই জ্যাকেটের ভেতরে রেখে দিলো আবার। প্যান্থারের মতো বড় বড় পা ফেলে ঢুকে পড়লো হোটলের ভেতরে।

“রবার্ট,” ভয়ার্ত কণ্ঠে ফিসফিসিয়ে বললো সিয়েনা। “তোমার দেশের সরকার তোমাকে খুন করার জন্য একজনকে পাঠিয়েছে!”

.

অধ্যায় ১৩

জানালার সামনে দাঁড়িয়ে রবার্ট ল্যাংডন টের পেলো প্রচণ্ড ভ তাকে গ্রাস করছে। রাস্তার ওপারে হোটেলের দিকে তার চোখ ঘুরে বেড়াতে লাগলো। স্পাইক চুলের মেয়েটি এইমাত্র হোটেলে ঢুকেছে। কিন্তু ঠিকানাটা সে কিভাবে পেলো বুঝে উঠতে পারছে না ল্যাংডন।

অ্যাড্রেনালাইন তার শরীরে প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করেছে, তার চিন্তাভাবনা আবারো বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। “আমার নিজের দেশের সরকার আমাকে খুন করার জন্য এক খুনিকে পাঠিয়েছে?”

সিয়েনাও তার মতোই বিস্মিত। “রবার্ট, তার মানে হাসপাতালে তোমার উপর যে আক্রমণ করা হয়েছে সেটাও তোমার সরকারের কাজ ছিলো।” দরজার কাছে গিয়ে লকটা চেক করে দেখলো সে। “ইউএস কনসুলেট যদি তোমাকে খুন করার পারমিশান দিয়ে থাকে…” কথাটা শেষ করতে পারলো না সে, তবে তার কোনো দরকার পড়লো না। ল্যাংডন বুঝতে পারলো সবটাই।

আমি কি করেছি বলে তারা মনে করছে? আমার দেশের সরকার কেন আমাকে শিকার করতে চাচ্ছে?!

আরেকবার তার কানে বেজে উঠলো মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ঢোকার সময় বিড়বিড় করে বলা কথাগুলো।

ভেরি সরি। ভেরি সরি।

“এখানে তুমি মোটেও নিরাপদ নও,” বললো সিয়েনা। “আমরা কেউই এখানে নিরাপদ নই।” রাস্তার দিকে ইঙ্গিত করলো সে। “ঐ মেয়েটা আমাদের দু’জনকে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যেতে দেখেছে। আমি বাজি ধরে বলতে পারি, তোমার দেশের সরকার আর পুলিশ আমাকে ট্রাক-ডাউন করার চেষ্টা করছে। আমি এখানে অন্য এক নামে সাবলেট থাকি। তারপরও ওরা আমাকে খুঁজে বের করতে পারবে।” টেবিলের উপর রাখা বায়োটিউবটার দিকে ফিরলো সে। “এক্ষুণি এটা খুলে দেখা উচিত তোমার।”

টাইটানিয়ামের জিনিসটার দিকে তাকালো ল্যাংডন, তার চোখে কেবল বায়োহ্যাজার্ড সিম্বলটাই পড়লো।

“এই টিউবের ভেতরে যা-ই থেকে থাকুক,” বললো সিয়েনা, “সম্ভবত তার একটা আইডি কোড, এজেন্সি স্টিকার, ফোন নাম্বার, এরকম কিছু রয়েছে। তোমার দরকার তথ্য। আমারও দরকার তথ্য! মনে রাখবে, তোমার সরকার আমার বন্ধুকে খুন করেছে!”

সিয়েনার কণ্ঠে যে যন্ত্রণা সেটা ল্যাংডনের চিন্তাভাবনাকে ঝাঁকি দিলো, মাথা নেড়ে সায় দিলো সে, ভালো করেই জানে মেয়েটা সত্যি বলছে। “হ্যাঁ…আমি খুবই দুঃখিত।” কথাটা বলেই তিক্ত একটা অনুভূতিতে আক্রান্ত হলো সে। টেবিলের উপর রাখা ক্যানিস্টারের দিকে তাকালো। তার মনে হচ্ছে এর ভেতরেই হয়তো প্রশ্নের জবাবগুলো লুকিয়ে আছে। “এটা খুলতে গেলে বিপজ্জনক ঘটনা ঘটতে পারে।”

একটু ভাবলো সিয়েনা। “এর ভেতরে যা-ই থাকুক না কেন, বেশ ভালোমতোই সংরক্ষণ করা আছে। সম্ভবত কোনো আঘাত-নিরোধক প্লেক্সিগ্লাস টেস্ট টিউবের ভেতরে রয়েছে। এই বায়োটিউবটি কেবলমাত্র এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পরিবহণের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।”

জানালা দিয়ে হোটেলের বাইরে পার্ক করা কালো মোটরসাইকেলটির দিকে তাকালো ল্যাংডন। মেয়েটি এখনও বাইরে বেরিয়ে আসে নি, তবে খুব দ্রুতই সে বুঝতে পারবে ল্যাংডন ওখানে নেই। এরপর মেয়েটি কি করবে সেটাই ভাবতে লাগলো…তাদের অ্যাপার্টমেন্টের দরজায় এসে নক করতে কতোটা সময় লাগতে পারে।

ল্যাংডন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। টাইটানিয়াম টিউবটি হাতে তুলে নিয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বায়োমেট্রিক প্যাডে বুড়ো আঙুলটা চেপে ধরলো। কয়েক মুহূর্ত পরই তীক্ষ্ণ একটা শব্দ করে ক্লিক করে উঠলো সেটা। টিউবটি আবারো লক হবার আগেই সিলিন্ডারটির দুই প্রান্ত ধরে বিপরীত দিকে মোচড় দিলো। একটা মোচড়ের পর ক্যানিস্টারটি আবারো তীক্ষ্ণ শব্দ করে উঠলো, ল্যাংডনের হাত ঘেমে উঠলো সঙ্গে সঙ্গে। আবারো মোচড় দিলো সে। টিউবটি সমান দু’ভাগে বিভক্ত…মোচড় দিতেই দুটো অংশ দুদিকে ঘুরতে শুরু করলো। অনেকটা স্কুর মতো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এটা লাগানো হয়েছে। ল্যাংডন জানে না ভেতরে কি আছে, কি অপেক্ষা করছে তাদের জন্য।

পাঁচবার ঘোরানোর পর দুটো অংশ আলাদা হয়ে গেলো অবশেষে। গভীর করে নিঃশ্বাস নিলো ল্যাংডন। দুটো অংশ টানতেই দেখতে পেলো মাঝখানে ফোম-রাবারের তৈরি একটি জিনিস বের হয়ে আসছে। টেবিলের উপর সেটা রাখলো ল্যাংডন। সুরক্ষার জন্য যে প্যাডটা ব্যবহার করা হয়েছে সেটা দেখতে অনেকটা টেনে লম্বা করা রাগবি মতো।

ল্যাংডন আস্তে আস্তে উপরের প্রটেক্টিভ ফোমটার ভাঁজ খুলতেই ভেতরের জিনিসটা বেরিয়ে এলো।

সিয়েনা ঘাড় সোজা করে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো জিনিসটার দিকে। “আমি অবশ্য এরকম কিছু আশা করি নি।”

ল্যাংডন নিজেও আশা করেছিলো অত্যাধুনিক ভায়াল জাতীয় কিছু দেখতে পাবে। কিন্তু বায়োটিউবের ভেতর থেকে যা বেরিয়ে এসেছে সেটাকে আর যা-ই বলা হোক আধুনিক বলা যাবে না। খোদাই করা নক্সাযুক্ত বস্তুটি দেখে মনে হলো হাতির দাঁতে তৈরি, আকৃতি অনেকটা মাঝারি গোছের মোমবাতির মতো।

“দেখে মনে হচ্ছে অনেক পুরনো,” ফিফিসিয়ে বললো সিয়েনা। অনেকটা…”

“সিলিন্ডার সিল-এর মতো, তাকে বললো ল্যাংডন। অনেকক্ষণ পর হাফ হেড়ে বাঁচলো যেনো।

৩৫০০ খৃস্টপূর্বাব্দে সুমেরিয়রা এটা আবিষ্কার করে। সিলিন্ডার সিল হলো খোদাই করা রোলের মাধ্যমে ছাপ দেয়ার পদ্ধতির প্রথম রূপ। সিলিন্ডারের মতো কিছুর গায়ে নক্সা, সিল, ছবি আর অক্ষর খোদাই করে লিখে সেটা দিয়ে নরম কাদা কিংবা টেরাকোটার উপর চালিয়ে দিলে ছাপ পাওয়া যেতো।

ল্যাংডন অনুমাণ করলো, এই সিলটি নিঃসন্দেহে খুবই বিরল এবং মূল্যবান কিন্তু এরকম একটা জিনিস কেন টাইটানিয়ামের ক্যানিস্টারের ভেতরে রাখা হলো সেটা বুঝে উঠতে পারলো না। সাধারণত জীবাণু অস্ত্র রাখা হয় এসবের মধ্যে।

সাবধানে সিলটা উল্টে আঙুল দিয়ে স্পর্শ করলো ল্যাংডন, টের পেলো এটাতে ভীতিকর একটি চিত্র খোদাই করা আছে-তিন মাথাবিশিষ্ট সিংওয়ালা শয়তান, যে কিনা তিন-তিনজন মানুষকে তার তিনটি মুখ দিয়ে একসাথে খেয়ে ফেলছে।

দারুণ প্রীতিকর।

এবার শয়তানের নীচে সাতটি অক্ষরের দিকে চোখ গেলো ল্যাংডনের। নক্সা করা ক্যালিওগ্রাফিটা লেখা হয়েছে উল্টো করে, ঠিক যেমনটি ছাপ দেয়ার রোলারে থাকে। তবে অক্ষরগুলো পড়তে ল্যাংডনের কোনো সমস্যাই হলো না–SALIGIA.

সিয়েনা লেখাটার দিকে ভুরু কুচকে চেয়ে উচ্চারণ করলো : “সালিগিয়া?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো ল্যাংডন। শব্দটা কানে যেতেই এক ধরণের ভীতি জেঁকে বসলো তার মধ্যে। “এটা লাতিন নিমোনিক। মধ্যযুগে ভ্যাটিকান এটা আবিষ্কার করে খৃস্টানদেরকে সাতটি মহাপাপের কথা স্মরণ রাখার জন্য। সালিগিয়া হলো সুপারবিয়া, আভারিশিয়া, লাক্সারিয়া, ইনভিদিয়া, গুলা, ইরা এবং আকেদিয়ার সংক্ষিপ্ত রূপ।”

সিয়েনা ভুরু কুচকালো আবার। “অহংকার, লোভ, যৌনাকাঙ্খা, ঈর্ষা, অতিভোজন, ক্রোধ আর আলস্য।”

ল্যাংডন মুগ্ধ হয়ে তাকালো মেয়েটার দিকে। “তুমি লাতিন জানো।”

“আমি ক্যাথলিক হিসেবে বেড়ে উঠেছি। সাতটি মহাপাপের কথা আমার জানা আছে।”

মুচকি হাসি দিয়ে সিলটার দিকে তাকালো ল্যাংডন, আবারো একই ভাবনা তার মাথায় ঘুরপাক খেলো, এই জিনিসটা কেন বায়োটিউবের ভেতরে রাখা হলো, যেনো এটা খুবই বিপজ্জনক কিছু।

“আমি ভেবেছিলাম এটা হাতির দাঁতে তৈরি,” বললো সিয়েনা। “কিন্তু এটা আসলে হাঁড়।” আর্টিফেক্টটা সূর্যের আলোয় তুলে ধরে দাগগুলোর দিকে ইঙ্গিত করলো। “হাতির দাঁতে দাগগুলো থাকে ডায়মন্ড-আকৃতিতে কিন্তু হাঁড় গঠিত হয় এরকম সমান্তরাল স্ট্রাইপ আর কালচে গর্তের সাহায্যে।”

আস্তে করে সিলটা তুলে নিয়ে খোদাইয়ের কাজটা আরো ভালো করে দেখলো। আসল সুমেরিয় সিলগুলোতে অবিকশিত অবয়ব আর কিউনিফর্ম লিপি খোদাই করা হতো। এই সিলটায় অবশ্য অনেক বেশি সূক্ষ্ম খোদাইর কাজ দেখা যাচ্ছে। মধ্যযুগ, অনুমাণ করলো ল্যাংডন। তারচেয়েও বড় কথা, এই নক্সাগুলোর অর্থ তার হেলুসিনেশনে দেখা দৃশ্যের সাথে ভয়ঙ্করভাবেই সম্পর্কযুক্ত।

চিন্তিত ভঙ্গিতে তার দিকে তাকালো সিয়েনা। “কি?”

“একই ধরণের থিম,” তিক্তমুখে বললো ল্যাংডন। সিলের একটি খোদাই করা চিত্রের দিকে ইঙ্গিত করলো সে। “এই তিন মাথাবিশিষ্ট শয়তানটাকে দেখো, মানুষখেকো শয়তান। মধ্যযুগে এই ইমেজটা খুবই প্রচলিত ছিলো-ব্ল্যাক ডেথের সাথে সম্পর্কিত একটি আইকন। তিনটি মুখ দিয়ে প্রতীকি অর্থে বোঝানো হতো কতোটা দ্রুততার সাথে প্লেগ রোগ জনসংখ্যাকে বিলুপ্ত করে দেয়।”

অস্বস্তির সাথে সিয়েনা বায়োহ্যাজার্ড টিউবের উপর সিম্বলটার দিকে তাকালো।

ল্যাংডনের সাথে কথা বলার সময় থেকে প্লেগ রোগের কথা ঘুরেফিরেই আসছে বার বার। “সালিগা মানবজাতির সমগ্র পাপের প্রতিনিধিত্ব করে…মধ্যযুগে একটি ধর্মীয় বিশ্বাস ছিলো যে-”

“এ কারণেই ঈশ্বর ব্ল্যাক ডেথ-এর সাহায্যে পৃথিবীকে শাস্তি দিয়েছেন, ল্যাংডনের বাক্যটি শেষ করলো সিয়েনা।

“হ্যাঁ।” একটু থামলো সে, কিছুক্ষণের জন্য চিন্তার ট্রেনটা হারিয়ে গেলো যেনো। এইমাত্র সিলিন্ডারের ব্যাপারে একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করেছে। সাধারণত কোনো সিলিন্ডার সিলের ভেতরটা ফাঁপা থাকে, ওটা দিয়ে এপাশ ওপাশ দেখা যায়। অনেকটা পাইপের মতো। কিন্তু এই সিলিন্ডারটির ভেতর ফাঁপা নয়। এটার ভেতরে কিছু একটা ঢোকানো আছে। শেষ মাথাটি দিয়ে বের হচ্ছে মৃদু আলো।

“এটার ভেতরে কিছু একটা আছে,” বললো ল্যাংডন। “মনে হচ্ছে কাঁচের তৈরি।” সিলিন্ডারটি উপর-নীচ করলো অন্যপ্রান্ত দেখার জন্য। এটা করার সময় ভেতরে থাকা ক্ষুদ্র কিছু জিনিস নড়েচড়ে উঠলো। অনেকটা বল-বেয়ারিংয়ের মতো কিছু।

জমে গেলো ল্যাংডন, শুনতে পেলো তার পাশে থাকা সিয়েনা হাফ ছাড়লো আস্তে করে।

এটা আবার কি??

“আওয়াজটা শুনেছো?” ফিসফিসিয়ে বললো সিয়েনা।

মাথা নেড়ে সায় দিয়ে সতর্কতার সাথে ক্যানিস্টারের একপ্রান্তে চোখ রাখলো ল্যাংডন। মনে হচ্ছে অন্য মুখটা বন্ধ…ধাতব কিছু দিয়ে।” টেস্ট টিউবের ক্যাপ, সম্ভবত?

এক পা পিছিয়ে গেলো সিয়েনা। “ওটা কি ভেঙে গেছে?”

“মনে হয় না।” টিউবটির কাঁচের মাথা ভালো করে দেখে নিলো সে। একটু নাড়াতেই ভেতরের নড়াচড়ার শব্দ শোনা গেলো আবার। তারপর হঠাৎ করে সিলিন্ডারের কাঁচের মাথাটি ভড়কে দেয়ার মতো কাণ্ড করে বসলো।

আলো বের হতে শুরু করলো ওটা দিয়ে। সিয়েনার চোখ দুটো গোল গোল হয়ে গেলো সঙ্গে সঙ্গে। “রবার্ট, থামো! একটুও নড়বে না!”

.

অধ্যায় ১৪

মূর্তির মতো জমে গেলো ল্যাংডন। তার দু’হাত চোখ বরাবর, স্থিরভাবে ধরে আছে সিলিন্ডারটি। সন্দেহ নেই, টিউবের একপ্রান্তের কাঁচ দিয়ে আলো বের হচ্ছে…এমনভাবে আলো নিক্ষেপ করছে যেনো ভেতরের জিনিসগুলো জেগে উঠেছে।

খুব দ্রুতই ভেতরের আলো মিইয়ে গিয়ে থেমে গেলো।

কাছে এগিয়ে এলো সিয়েনা, তার নিঃশ্বাস দ্রুত হয়ে উঠেছে। মাথা কাত করে কাঁচের ভেতর দিয়ে তাকালো।

“আবার নড়াও,” নীচুস্বরে বললো সে। “আস্তে আস্তে।”

টিউবটা আস্তে আস্তে উপর-নীচ করলো ল্যাংডন। ভেতরের ছোট্ট বস্তুটা আবারো টিউবের এ মাথা থেকে ও মাথা গড়িয়ে গিয়ে থেমে গেলো।

“আবার করো,” বললো সিয়েনা। “ধীরে ধীরে।”

কথামতোই কাজ করলো ল্যাংডন। এবার ভেতরের কাঁচটা মৃদু আলো ছড়ালো।

“এটা কোনো টেস্ট টিউবই হবে,” মেয়েটা জানালো, “ভেতরে একটা এজিটেটর বল আছে।”

এজিটেটর বলের ব্যাপারে ল্যাংডনের ধারণা রয়েছে। প্রে-পেইন্ট ক্যানে এটা ব্যবহার করা হয়-ডুবে থাকা একটি বল, ক্যানটা ঝাঁকালে রঙগুলোকে দৃঢ়ভাবে স্প্রে করতে সাহায্য করে।”

“সম্ভবত এর মধ্যে ফসফোরেসেন্ট কেমিকেল জাতীয় উপাদান রয়েছে, বললো সিয়েনা, “কিংবা বায়োলুমিনিসেন্ট অগানিজম, উত্তেজিত হলে যা আলো বিকিরিত করে।”

ল্যাংডন অবশ্য অন্যরকম ধারণা করছে। কেমিকেল গ্লো-স্টিক আর বায়োলুমিনিসেন্ট প্লাঙ্কটন দেখার অভিজ্ঞতা থাকার পরও হাতের সিলিন্ডারটির ভেতরে ওরকম কিছু আছে বলে মনে করলো না। টিউবটা আস্তে আস্তে আরো বার কয়েক নাড়ালো যতোক্ষণ না ওটা থেকে আলো বের হয়। তারপর লুমিনিসেন্ট প্রান্তটি হাতের তালুতে ধরলো। প্রত্যাশিতভাবেই মৃদু লালচে আলো দেখা গেলো তার চামড়ার উপর।

২০৮ আইকিউ অধিকারীও কখনও কখনও ভুল করে, এটা জানতে পেরে ভালোই লাগছে!

“এটা দেখো,” বললো ল্যাংডন। আবারো টিউবটা ঝাঁকালো তবে এবার বেশ জোরে জোরে। ভেতরে থাকা জিনিসটা খট খট করে শব্দ তুলতে শুরু করলো।

সিয়েনা ভয় পেয়ে চমকে উঠলো। “তুমি করছোটা কি!?”

টিউবটা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতেই লাইট সুইচের দিকে গিয়ে ঘরের বাতি নিভিয়ে দিলো ল্যাংডন। রান্নাঘরটা ডুবে গেলো প্রায় অন্ধকারে। “এর ভেতরে কোনো টেস্ট টিউব নেই,” ঝাঁকাতে আঁকাতেই বললো। “এটা একটা ফ্যারাডে পয়েন্টার।”

একবার ল্যাংডনের এক ছাত্র তাকে ঠিক এরকম একটি জিনিস দিয়েছিলো-লেজার পয়েন্টার ব্যবহার করতে পছন্দ করে না ব্যাটারির বিরামহীন অপচয়ের জন্য, আর এমন একটি পয়েন্টার ব্যবহারে তার কোনো আপত্তি নেই যা একটু পর পর ঝাঁকালে ওটার নিজস্ব কাইনেটিক শক্তি বৈদ্যুতিক শক্তিতে রূপান্তর করা যায়। ঐ জিনিসটা যখন ঝাঁকানো হয় তখন এর ভেতরে থাকা বল এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে একটা ছোট্ট প্যাডেলের উপর দিয়ে আসা যাওয়া করে ফলে ক্ষুদ্র একটি জেনারেটর বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে শুরু করে। সব দেখে মনে হচ্ছে, এই একই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে এই খোদাই করা হাঁড়ের ভেতরেও।

পয়েন্টারের একপ্রান্ত দিয়ে এবার আলো বের হতে থাকলে ল্যাংডন হাসি হাসি মুখে সিয়েনার দিকে তাকালো। “এবার শো দেখানোর পালা।”

রান্নাঘরের দেয়ালে সেই আলো নিক্ষেপ করতেই যে ছবিটা ভেসে উঠলো সেটা যেমন সিয়েনাকে চমকে দিলো তেমনি ল্যাংডনও কম অবাক হলো না।

দেয়ালে যে আলো প্রক্ষেপিত হয়েছে সেটা ছোট্ট লাল রঙের লেজারের মতো নয়, বরং বহু রঙের হাই-ডেফিনেশন ছবির। অনেকটা পুরনো দিনের সিনেমা দেখার প্রজেক্টরের মতোই দেয়ালে ছবিগুলো ভাসিয়ে তুললো সেটা।

হায় ঈশর! চোখের সামনে ভয়ঙ্কর ছবিটা দেখে ল্যাংডনের হাত কেঁপে উঠলো। এরকম মৃত্যুর দৃশ্যই তো আমি দেখে আসছি!

মুখে হাত চাপা দিয়ে সিয়েনা দুয়েক পা সামনে এগিয়ে এলো দৃশ্যটা দেখার জন্য।

ছবিটা মানুষের দুঃখ-দুর্দশার একটি করুণ তৈলচিত্র-নরকের বিভিন্ন স্তরে থাকা হাজার হাজার মানব সন্তানের শাস্তি ভোগের বিভৎস দৃশ্য। ভূগর্ভস্থ এই জগৎটি আঁকা হয়েছে মাটির নীচের কয়েকটি স্তরে, প্রতিটি স্তর আরো গভীরে চলে যাচ্ছে অনেকটা ফানেল আকৃতিতে। প্রতিটি স্তরে নরকের শাস্তি আর দুর্ভোগের করুণ চিত্র আঁকা। একেক রকম পাপীদের জন্য একেক রকম শাস্তি।

দেখামাত্রই ল্যাংডন ছবিটা চিনতে পারলো।

তার সামনে যে মাস্টারপিসটা রয়েছে সেটা ইটালির রেনেসাঁর অন্যতম পুরোধা ব্যক্তি সান্দ্রো বত্তিচেল্লির বিখ্যাত তৈলচিত্র লা মাপ্পা দেল ইনফার্নো। ভূগর্ভস্থ নরকের সচিত্র একটি ছবি। পরকালের জীবন সম্পর্কিত যতো ছবি আছে তার মধ্যে এই ম্যাপ অব হেল সবচাইতে ভীতিকর আর বিখ্যাত। আধুনিক কালেও মানুষ এই ছবি দেখে ভড়কে যায়।

বত্তিচেল্লির আঁকা প্রিমাভেরা কিংবা বার্থ অব ভেনাস-এর চেয়ে ম্যাপ অব হেল একেবারেই আলাদা একটি ছবি। এখানে শিল্পী ব্যবহার করেছেন বিষণ্ণ লালের আস্তরণ, সেপিয়া আর বাদামী রঙ।

ল্যাংডন টের পেলো তার জঘন্য মাথা ব্যথাটি আবার ফিরে এসেছে, আর হাসপাতালে জেগে ওঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত যতো অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে এটার কোনো তুলনায় হয় না। আরো বেশি হতবুদ্ধিকর, আরো বেশি প্রহেলিকার মধ্যে পড়ে গেলো সে। হেলুসিনেশনে যে দৃশ্যগুলো দেখছে তার সাথে এই ছবিটার সংযোগ রয়েছে।

আমি অবশ্যই বত্তিচেল্লির ম্যাপ অব হেল স্টাডি করেছি, ভাবলো সে কিন্তু এরকম কোনে স্মৃতি তার ভাণ্ডারে নেই।

ইমেজটা ভীতিকর হলেও এই পেইন্টিংয়ের বিষয়-বস্তু ল্যাংডনের মনে এক ধরণের অস্বস্তি তৈরি করলো। সে ভালো করেই জানে বত্তিচেল্লির এই পেইন্টিংটার আসল অনুপ্রেরণা ছিলো অন্য কিছু…তার চেয়ে দুশ বছর আগে জন্মানো আরেকজন শিল্পীর কাজ এটা সৃষ্টি করতে উদ্বুদ্ধ করেছে তাকে।

একটি মহৎ শিল্পকর্ম অন্য শিল্পীদেরও অনুপ্রাণিত করে।

বত্তিচেল্লির ম্যাপ অব হেল আসলে চৌদ্দ শতকের একটি সাহিত্যকর্মের ট্রিবিউট ছাড়া আর কিছু না…এই সাহিত্যকর্মটি এখন ইতিহাসের সবচাইতে মহৎ সাহিত্য হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে…নরকের ভীতিকর একটি চিত্র।

দান্তের ইনফার্নো।

.

রাস্তার ওপারে ভায়েন্থা চুপিসারে একটি সার্ভিস সিঁড়ি দিয়ে পেনসিওনি লা ফ্লোরেন্তিনা হোটেলের ছাদে চলে এলো। ল্যাংডন তার দেশের কনসুলেনটকে একটি ভুয়া রুম নাম্বার আর মিটিং প্লেসের ঠিকানা দিয়েছে। একটি মিরর মিট’-তার জগতে এটাকে এ নামেই ডাকা হয়। খুবই কমন একটি টেকনিক। নিজের আসল অবস্থানের কথা লুকাতে গিয়ে, ভুয়া ঠিকানা দিতে গিয়ে মনের অজান্তে সত্যিকারের অবস্থানের কথা জানিয়ে দেয়া। প্রায় সবক্ষেত্রেই, ভুয়া কিংবা মিররড়’ লোকেশন নির্বাচন করা হয় আসল লোকেশনের ঠিক বিপরীতে। ছাদের উপর এসে একটি লুকানোর জায়গা পেয়ে গেলো ভায়েন্থা। ওখান থেকে পুরো এলাকার সব কিছু বার্ডস-আই ভিউ থেকে দেখতে পেলো সে। ধীরে ধীরে তার চোখ গেলো রাস্তার উল্টো দিকের একটি ভবনের উপর।

মি: ল্যাংডন, এবার তোমার চাল।

.

ঠিক এই সময় মেন্দাসিয়াম-এর প্রভোস্ট নিজের মেহগনি কাঠের ডেস্ক থেকে উঠে এসে অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের নোনা বাতাসে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলো। অনেক বছর ধরে এই জাহাজটাই তার বাড়ি, আর আজ ফ্লোরেন্সে এমন সব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে যে এতোদিন ধরে বানানো তার সাম্রাজ্যটি হুমকির মুখে পতিত হয়েছে।

সব কিছু ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে তার ফিল্ড এজেন্ট ভায়েন্থা। এই মিশনটি শেষ হলে মেয়েটাকে এর জন্যে জবাবদিহি করতে হবে কিন্তু এ মুহূর্তে তাকে প্রভোস্টের খুব দরকার।

তাকে এই ভজঘট অবস্থার নিয়ন্ত্রণ পুণরায় নিতে হবে।

ব্যস্তভাবে কারোর পায়ের আওয়াজ শুনে পেছন ফিরে প্রভোস্ট দেখতে পেলো তার এক অ্যানালিস্ট দৌড়াতে দৌড়াতে চলে আসছে তার কাছে।

“স্যার?” মেয়েটি দম ফুরিয়ে বললো। “আমাদের হাতে নতুন তথ্য এসেছে।” সকালের নরম বাতাসকে বিদীর্ণ করলো তার উত্তেজিত কণ্ঠস্বর। রবার্ট ল্যাংডন একটু আগে তার হারভার্ড ই-মেইলে ঢুকেছে আনমাস্ক আইপি অ্যাড্রেস থেকে।” একটু থেমে প্রভোস্টের দিকে তাকালো সে। “ল্যাংডনের সঠিক অবস্থানটি এখন ট্রেস করা সম্ভব হবে।”

প্রভোস্ট খুবই বিস্মিত হলো এই ভেবে যে মানুষ এতোটা বোকা কী করে হতে পারে। এটা তো সবকিছু বদলে দেবে। উপকূলের দিকে চেয়ে রইলো সে, ব্যাপারটার তাৎপর্য বিবেচনা করে দেখলো। “এসআরএস টিম বর্তমানে কোথায় অবস্থান করছে সেটা আমরা জানি?”

“জি, স্যার। ল্যাংডনের অবস্থান থেকে দুই মাইলেরও কম দূরত্বে আছে তারা।”

সিদ্ধান্তটি নিতে প্রভোস্টের মাত্র কয়েক মুহূর্ত লাগলো।

.

“ল’ ইনফার্নো দি দান্তে,” ফিসফিসিয়ে বললো সিয়েনা, আলোকিত ছবিটার দিকে একটু এগিয়ে যেতেই তার অভিব্যক্তি বদলে গেলো। ভূগর্ভস্থ জগতের একটি ছবি রান্নাঘরের দেয়ালে ভেসে উঠেছে।

দান্তের কল্পনায় নরক, ভাবলো ল্যাংডন, এখানে ফুটে উঠেছে বর্ণিল রঙে।

বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম অসাধারণ এই সৃষ্টিকর্ম ইনফার্নো আসলে দান্তে অলিঘিয়েরির দিভাইন কমেদির তিনটি বইয়ের প্রথমটি। এটা ১৪২৩৩ লাইনের একটি মহাকাব্য, যেখানে দান্তে বর্ণনা করেছেন মাটির নীচে থাকা একটি জগৎকে, পারগেটরি নামক ক্ষণস্থায়ী নরক পার হয়ে অবশেষে স্বর্গে গিয়ে পৌঁছানোর একটি ভ্রমণ বিবৃত করেছেন কবি।

কমেদি’র তিনটি অংশ ইনফার্নো, পারগেতোরিও এবং পারাদিসো’র মধ্যে সবথেকে বেশি পঠিত এবং আলোচিত হচ্ছে এই ইনফার্নো।

১৩ শতকে রচিত দান্তের ইনফার্নো মধ্যযুগের নরকযন্ত্রণার ধারণাকেই পুণপ্রতিষ্ঠা করেছে। এর আগে জনমানুষের কাছে নরকের বিভীষিকা এতোটা বিনোদনের মাধ্যমে তুলে ধরা হয় নি। রাতারাতি দান্তের সৃষ্টিকর্ম বিমূর্ত নরককে মানুষের কাছে মূর্তিমান বিভীষিকা হিসেবে তুলে ধরেছিলো-বোধগম্য, স্পর্শযোগ্য আর অবিস্মৃত। মহাকাব্যটি প্রকাশ হবার পর পর যে ক্যাথলিক চার্চে উপস্থিতির পরিমাণ বেড়ে গেছিলো তাতে বিস্মিত হবার কিছু ছিলো না। ভীতসন্ত্রস্ত পাপীরা দান্তের ভূগর্ভস্থ জগতের হালনাগাদ সংস্করণ পড়ে চার্চের কাছেই আত্মসমর্পণ করেছিলো।

দান্তের বিভীষিকাময় নরককে যন্ত্রণাময় ভূগর্ভস্থ ফানেলের আকারে এঁকেছেন বত্তিচেল্লি-আগুন, সালফার, নর্দমা, দানবে পরিপূর্ণ জঘন্য এক জায়গা, যেখানকার প্রাণকেন্দ্রে অপেক্ষা করছে শয়তান নিজে। এটি তৈরি হয়েছে নয়টি আলাদা স্তরে, নরকের নয়টি চক্র, পাপীদের পাপের ভয়াবহতা অনুসারে একেকজনকে একেক স্তরে ঠাঁই দেয়া হয়। একেবারে উপরে কামুক’দের জন্য। তাদেরকে সেখানে পারলৌকিক ঝড়ে উড়িয়ে দেয়া হয়, নিজেদের রিপু নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যর্থ হবার একটি প্রতীকি রূপ হিসেবে। তাদের ঠিক নীচেই পেটুকেরা, মানুষের মলমূত্রের নর্দমায় মুখ ডুবিয়ে রাখা হয় তাদেরকে। অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ করার শাস্তি এটি। এর নীচে ধর্মদ্রোহীদের স্থান, তাদেরকে অনন্তকাল আগুনের কফিনে বন্দী করে রাখা হয়…এভাবেই ক্রমশ যতো নীচে যাওয়া হয় ততোই ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে শাস্তির মাত্রা।

এটা প্রকাশ হবার পর থেকে সাতটি শতাব্দী ধরে দান্তের এই নরক দর্শন অনুপ্রেরণা জুগিয়ে গেছে এ বিশ্বের অনেক বিখ্যাত শিল্পী-সাহিত্যিককে। লংফেলো, চসার, মার্ক্স, বালজাক, বোহেঁস, এমনকি বেশ কয়েকজন পোপ দান্তের ইনফার্নো’র উপর ভিত্তি করে লেখালেখি করেছেন। মন্তেরদি, লিসজিৎ, ওয়াগনার, চায়কোভস্কি আর পুচ্চিনি দান্তের সৃষ্টিকর্মের উপর ভিত্তি করে মহান সব সঙ্গীত সৃষ্টি করেছেন। এরকমই একজন হলেন ল্যাংডনের প্রিয় শিল্পী লরিনা। ম্যাককিনিট, যিনি এখনও বেঁচে আছেন। আধুনিককালের ভিডিও গেমস আর আই-পাডের বিভিন্ন অ্যাপসেও দান্তে সম্পর্কিত অনেক কিছু রয়েছে।

ল্যাংডন তার ছাত্রছাত্রিদের সঙ্গে দান্তের রচনার উৎকর্ষতা এবং তার সৃষ্টিকর্মে অনুপ্রাণিত হয়ে শত শত বছর ধরে যেসব কাজ হয়েছে সেসব নিয়ে আলোচনা করতে বরাবরই পছন্দ করে।

“রবার্ট,” বললো সিয়েনা। দেয়ালের চিত্রটা আরো কাছ থেকে দেখার জন্য এগিয়ে গেলো সে। “এটা দেখো!” ফানেল আকৃতির নরকের প্রায় তলানির দিকে ইঙ্গিত করলো।

যে জায়গাটা সে দেখালো সেটা পরিচিত ম্যালোববাজেস নামে-এর অর্থ শয়তানের গর্ত। এটা নরকের অষ্টম স্তর, দশটি আলাদা আলাদা গর্তে এটি বিভক্ত। প্রতিটিতে ঠাঁই পায় নির্দিষ্ট ধরণের জালিয়াত আর প্রতারকেরা।

সিয়েনা এবার আরো নির্দিষ্ট করে দেখিয়ে দিলো। “দেখো! তুমি না বলেছিলে, হেলুসিনেশানের সময় এরকম কিছু একটা দেখেছিলে?”

ল্যাংডন ভুরু কুচকে তাকালো কিন্তু কিছুই খুঁজে পেলো না। ক্ষুদ্র প্রজেক্টরটি তার শক্তি হারিয়ে ফেলায় প্রক্ষেপিত ছবিটা ম্রিয়মান হয়ে পড়েছে। ডিভাইসটি আবারো ঝাঁকিয়ে নিলো সে, তারপর দেয়াল থেকে আরো দূরে রান্নাঘরের কাউন্টারের উপর রাখলো যাতে করে দেয়ালের ছবিটা আরো বড় দেখায়।

ম্যাপ অব হেল ভালো করে দেখার জন্য সিয়েনার কাছে এগিয়ে গেলো ল্যাংডন। “দেখো। তুমি বলেছিলে হেলুসিনেশানে এরকম উল্টো করে মাটিতে মাথা থেকে কোমর পর্যন্ত পুঁতে রাখা একজন মানুষ দেখেছো…তার উরুতে R অক্ষরটি ছাপ মারা ছিলো?” এবার আরো নির্দিষ্ট করে দেখিয়ে দিলো সে। “এই তো, এটা!”

এই পেইন্টিংটা ল্যাংডন অনেকবার দেখেছে, ম্যালেবোজেসের দশম গর্তটিতে সব পাপীদেরকে উপুড় করে মাথা থেকে কোমর পর্যন্ত মাটিতে পুঁতে রাখা হয়েছে, তাদের পা-জোড়া কেবল মাটির উপরে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো এই পেইন্টিংটাতে একজন পাপীর পায়ে R অক্ষরটি কাদা দিয়ে লেখা, ঠিক যেমনটি ল্যাংডন দেখেছে তার দিবাস্বপ্নে।

হায় ঈশ্বর! চোখ কুচকে আরো ভালো করে দেখলো ছোট্ট অক্ষরটি। এই R অক্ষরটি বত্তিচেল্লির আসল পেইন্টিংয়ে ছিলো না, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত!”

“আরেকটা অক্ষর আছে,” সিয়েনা আঙুল তুলে দেখালো।

ল্যাংডন দেখতে পেলো ম্যালেবোজেসের দশম গর্তে এক ভণ্ড নবীকে মাথা নীচে পা উপরে দিয়ে রাখা হয়েছে। তার গায়ে E অক্ষরটি লেখা।

এসব কী হচ্ছে? এই পেইন্টিংটা তো মোডিফাই করা হয়েছে।

বাকি অক্ষরগুলো এবার তার চোখে একে একে ধরা পড়লো। দশটি গর্তে থাকা পাপীদের গায়ে ওগুলো লেখা। এক প্রলুব্ধকারীর গায়ে সে দেখতে পেলো C, যাকে কিছু শয়তান চাবুক পেটা করছে…আরেকটি R দেখা গেলো এক চোরের উপর, তাকে কিছু সাপ বিরামহীনভাবেই কামড়ে দিচ্ছে…ফুটন্ত আলকাতরার হ্রদে ডোবানো এক রাজনীতিবিদের গায়ে A।

“এইসব অক্ষর,” জোর দিয়ে বললো ল্যাংডন, “বত্তিচেল্লির আসল ছবিতে ছিলো না। এই ছবিটি ডিজিটালি এডিট করা হয়েছে।”

ম্যালেবোজেসের উপরে প্রথম গর্ত থেকে নীচের দশম গর্তের দিকে ভালো করে দেখে পড়তে লাগলো সে।

C… A … T… R… 0… V… A … C… E… R

“Catrovacer?” বললো ল্যাংডন। “এটা কি ইতালিয়ান ভাষা?”

মাথা ঝাঁকালো সিয়েনা। “লাতিনও নয়। আমি এটা চিনতে পারছি না।”

“একটা…সিগনেচার, সম্ভবত?”

“Catrovacer?” সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো মেয়েটি। “আমার কাছে মনে হচ্ছে না এটা কোনো নাম। কিন্তু এখানে দেখো।” ম্যালেবোজেসের তৃতীয় গর্তের দিকে ইঙ্গিত করলো সে।

ল্যাংডনের চোখ অবয়বটি দেখতে পাওয়ামাত্রই ভয়ার্ত অনুভূতিতে আক্রান্ত হলো সে। তৃতীয় গর্তে অসংখ্য পাপীদের ভীড়ে মধ্যযুগের একটি আইকনিক ইমেজ দেখা যাচ্ছে-আলখেল্লা আর মুখোশ পরিহিত, পাখির ঠোঁটসদৃশ্য নাক, চোখ দুটো মৃত মানুষের মতো।

প্লেগ মুখোশ।

“বত্তিচেল্লির আসল পেইন্টিংয়ে কি কোনো প্লেগ ডাক্তারের ছবি ছিলো?” জানতে চাইলো সিয়েনা।

“অবশ্যই না। এই ছবিটা যোগ করা হয়েছে।”

“বত্তিচেল্লি কি তার পেইন্টিংয়ে স্বাক্ষর করেছিলেন?”

ল্যাংডন মনে করতে পারলো না, তবে তার চোখ নীচের ডান দিকের কোণে চলে গেলো যেখানে সাধারণত কোনো পেইন্টিংয়ের স্বাক্ষর থাকে। এবার সে বুঝতে পারলো সিয়েনা কেন এ কথা জিজ্ঞেস করেছে। এখানে কোনো স্বাক্ষর নেই, তবে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে কিছু কথা লেখা : লা ভেরিতা এ ভিসিবিলি সলো আত্রাভারসো গ্নি ওচ্চি দেল্লা মরতে।

ল্যাংডন যেটুকু ইতালিয়ান ভাষা জানে তাতেই কথাগুলোর মানে বুঝতে পারলো। “ ‘শুধুমাত্র মৃতের চোখেই সত্য দেখতে পাবে।’ ”

মাথা নেড়ে সায় দিলো সিয়েনা। “উদ্ভট।”

তারা দুজন চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো দেয়ালে ভেসে ওঠা ছবিটার দিকে তাকিয়ে থেকে। আস্তে আস্তে ছবিটা মিইয়ে যেতে লাগলো এবার।

দান্তের ইনফার্নো, ভাবলো ল্যাংডন। ১৩৩০ সাল থেকেই পূর্বাভাসদানকারী আর্টের প্রেরণা দিয়ে আসছে।

দান্তের উপর ল্যাংডনের কোর্সে সব সময়ই ইনফার্নোর অনুপ্রেরণায় যেসব চিত্রকর্ম রয়েছে সেসব অন্তর্ভুক্ত থাকে। বত্তিচেল্লির ম্যাপ অব হেল-এর সাথে রদা’র অমর ভাস্কর্য দ্য থ শেডস, দ্য গেটস অব হেল…স্ত্রদানু’র ফ্লেগিয়াস প্যাডলিং গ্রু সাবমার্জ কডিস অন দি রিভার স্টিক্স…উইলিয়াম ব্লেকের। যৌনঅপরাধের পাপীরা অনন্তকাল ধরে ঘূর্ণিঝড়ে পতিত,..বর্জিয়ার অদ্ভুত আর। ইন্দ্রিয়পরায়ন ছবি যেখানে দান্তে আর ভার্জিল দুই নগ্ন মানুষকে বোতলবন্দী অবস্থায় দেখছে…বায়রো’র নির্যাতিত আত্মারা…সালভাদোর দালি’র জলরঙ আর উডকাটের অনেকগুলো সিরিজ ছবি…দোরে’র সাদা-কালো এচিংয়ের বিশাল কালেকশন, যেখানে মাটির নীচের দেবতা হেডেস আর ডানাযুক্ত শয়তানকে আঁকা হয়েছে।

এখন সব দেখে ল্যাংডনের মনে হচ্ছে দান্তের মহাকাব্যিক সৃষ্টি কেবলমাত্র মহান শিল্পী-সাহিত্যিকদেরই অনুপ্রেরণা যোগায় নি, অনিষ্ট করতে পারে এমন দুরাত্মাকেও অনুপ্রাণিত করেছে-যে কিনা বত্তিচেল্লির মাস্টারপিসটাকে বিকৃত করে দশটি অক্ষর, একজন প্লেগ ডাক্তার এবং একটি বাণী লিখেছে, যার অর্থ মৃতের চোখেই কেবল সত্য দেখা যায়। এই শিল্পী সেই ছবিটাকে খুবই উচ্চ প্রযুক্তির প্রজেক্টরে ঢুকিয়ে রেখে পুরো জিনিসটাকে বায়োটিউবের মতো একটি আধারে সংরক্ষণ করেছে।

কে এরকম কাজ করতে পারে সেটা ল্যাংডন কল্পনাও করতে পারলো না। এরচেয়ে অন্য একটা প্রশ্ন তাকে বেশি ভাবিয়ে তুললো।

আমি কেন এটা বহন করছিলাম?

রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে সিয়েনা আর ল্যাংডন যখন কালো সুটের খুনি এরপর কি করবে ভাবছে তখনই বাইরের রাস্তায় গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ আর রাস্তার পিচের সাথে টায়ারের ঘর্ষণ হলো। এরপরই গাড়ির দরজা খোলার শব্দ।

হতভম্ব হলেও দ্রুত জানালা দিয়ে নীচে তাকিয়ে দেখলো সিয়েনা।

একটি কালো রঙের আনমার্ক করা ভ্যান থেমেছে তাদের অ্যাপার্টমেন্টের নীচে। ভ্যান থেকে বেশ কয়েকজন লোক নেমে পড়লো, তাদের সবার পরনে কালো ইউনিফর্ম, তাদের বাম কাঁধে সবুজ রঙের গোলাকার মেডেল। সবার হাতে অটোমেটিক রাইফেল। ভাবভঙ্গি একেবারে মিলিটারির মতো। সংখ্যায় মোট চারজন। সময় নষ্ট না করে অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরে ঢুকে পড়লো তারা।

সিয়েনা টের পেলো তার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। রবার্ট!” চিৎকার করে বললো সে। “আমি জানি না তারা কারা কিন্তু আমাদের খোঁজ পেয়ে গেছে তারা!”

.

নীচের রাস্তায় এজেন্ট ক্রিস্টোফার ব্রুডার তার লোকজনকে তাড়া দিয়ে অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে ঢুকতে বললো। বেশ শক্তসামর্থ্য একজন লোক সে, তার মিলিটারি অভিজ্ঞতা তাকে অনেকটাই আবেগহীন করে তুলেছে, ডিউটি আর কমান্ডের ব্যাপারে সে কোনো ছাড় দেয় না। তার মিশন সম্পর্কে সে ভালোমতোই অবগত আছে, এটার ঝুঁকির ব্যাপারেও সে পুরোপুরি সচেতন।

যে সংগঠনের হয়ে সে কাজ করে তার রয়েছে অনেকগুলো ডিভিশন কিন্তু ব্রুডারের ডিভিশন-নজরদারি এবং রেসপন্স সাপোর্ট-কেবলমাত্র তখনই ডাকা হয় যখন সঙ্কটটা জঘন্য রকমের খারাপ হয়ে ওঠে।

তার লোকজন ভবনের ভেতর ঢুকে পড়লে ব্রুডার দাঁড়িয়ে রইলো প্রবেশ দরজার সামনে। পকেট থেকে কমিউনিকেশন ডিভাইসটি বের করে চার্জের দায়িত্বে যে আছে তার সাথে যোগাযোগ করলো।

“আমি ব্রুডার,” বললো সে। “আমরা ল্যাংডনকে তার কম্পিউটারের আইপি অ্যাড্রেস দিয়ে সফলভাবেই ট্র্যাকডাউন করতে পেরেছি। আমার টিম কাজে নেমে পড়েছে। তাকে পাওয়া মাত্রই আপনাকে জানাচ্ছি।”

.

ব্রুডারের উপরে, পেনসিওনি লা ফ্লোরেন্তিনার ছাদে ভীতিকর দৃষ্টিতে নীচের এজেন্টের দিকে চেয়ে আছে ভায়েন্থা। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না এটা।

তারা এখানে কি করতে এসেছে?!

মাথার খাড়া খাড়া চুলে হাত চালালো সে। হঠাৎ করেই বুঝতে পারলো গতরাতে তার অ্যাসাইনমেন্টটা ব্যর্থ হবার ফলাফল কতো কঠিন হতে পারে। সামান্য একটা কবুতরের ডাক সব বরবাদ করে দিয়েছে। পুরো পরিস্থিতির উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলো সে। যে মিশনটাকে খুব সহজ সরল বলে ভেবেছিলো…সেটা এখন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।

এসআরএস টিম যদি এখানে এসে থাকে তাহলে আমার সব শেষ হয়ে গেছে।

উদভ্রান্ত হয়ে সেট্রা এক্সএস কমিউনিকেশন্স ডিভাইসটি হাতে তুলে নিয়ে প্রভোস্টকে কল করলো সে।

“স্যার,” রেগেমেগে বললো। “এসআরএস টিম এখানে! ব্রুডারের লোকজন ঐ অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে ঢুকে পড়েছে!”

জবাব পাবার আশায় উন্মুখ হয়ে থাকলে সে কিন্তু ক্লিক করে একটা শব্দ হবার পরই ইলেক্ট্রনিক একটি কণ্ঠ শান্তভাবে বললো, “অনুমতিহীন প্রটোকল।”

ভায়েন্থা ফোনের ডিসপ্লের দিকে তাকালো, কম-ডিভাইসের স্ক্রিন অফ হয়ে গেলো আস্তে করে। তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো সঙ্গে সঙ্গে, বুঝতে পারলো কি হয়েছে। কনসোর্টিয়াম তার সাথে সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে ফেলেছে।

কোনো লিঙ্ক নেই। কোনো যোগাযোগ নেই।

আমাকে অস্বীকার করা হয়েছে।

এই শকটা কেবলমাত্র কয়েক মুহূর্ত টিকে রইলো।

তারপরই জেঁকে বসলো মারাত্মক ভীতি।

.

অধ্যায় ১৬

“জলদি আসো, রবার্ট!” তাড়া দিলো সিয়েনা। “আমার সাথে আসো!”

ঘর থেকে দিয়ে বের হবার সময়ও ল্যাংডনের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে দান্তের ভূগর্ভস্থ জগতের ছবিগুলো। এই মুহূর্তটার আগপর্যন্ত সিয়েনা ব্রুকস নিজেকে কঠিন সময়েও বেশ শান্ত আর ধীরস্থির রেখেছিলো কিন্তু এখন তার সেই খোলস যেনো ভেঙে পড়েছে তার মধ্যে দেখা যাচ্ছে সত্যিকারের ভয়।

হলওয়ে’তে সিয়েনা আগে আগে ছুটছে, তার পেছনে ল্যাংডন। এলিভেটরটা পেরিয়ে গেলো সে, ওটা এখন নীচের দিকে নামছে। যারা এইমাত্র অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকেছে তারা নিশ্চয় বোতাম টিপে এলিভেটরটা নীচে নামাচ্ছে। কোনো দিকে না তাকিয়ে এক দৌড়ে সে হলওয়ের শেষ মাথায় থাকা সিঁড়ির দিকে চলে গেলো।

ল্যাংডন মেয়েটাকে অনুসরণ করছে। তার পকেটে ক্ষুদে প্রজেক্টরটি। মাথায় এখনও ঘুরপাক খাচ্ছে নরকের অষ্টম চক্রের ঐ অদ্ভুত লেখাটা : CATROVACER। প্লেগ মুখোশ আর অদ্ভুত সেই সিগনেচারটার কথাও ভাবলো সে : শুধুমাত্র মৃতের চোখেই সত্য দেখতে পাবে।

এসব বেখাপ্পা জিনিসগুলো একটার সাথে আরেকটার সংযোগ করতে গিয়ে বেশ বেগ পেলো ল্যাংডন। এ মুহূর্তে মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছে না। সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে এসে যখন থামলো দেখতে পেলো সিয়েনা কান পেতে কিছু শোনার চেষ্টা করছে। ল্যাংডনও সিঁড়ির নীচ থেকে পায়ের শব্দগুলো শুনতে পেলো।

“বের হবার আর কোনো পথ নেই?” নীচু কণ্ঠে বললো ল্যাংডন।

“আমার সাথে এসো, চট করে বললো সিয়েনা।

এরইমধ্যে একবার তার জীবন বাঁচিয়েছে এই মেয়েটি তাই তাকে বিশ্বাস না করার কোনো কারণ দেখতে পেলো না। বুক ভরে দম নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে শুরু করলো সিয়েনার পেছন পেছন।

একতলা নীচে নামতেই পায়ের আওয়াজগুলো আরো জোড়ালো হয়ে উঠলো। বড়জোর এক বা দু’তলা নীচে আছে তারা।

মেয়েটা কেন সরাসরি ওদের কাছে চলে যাচ্ছে?

কোনো কিছু বলার আগেই সিয়েনা তার হাতটা খপ করে ধরে এক টানে নিয়ে এলো ফাঁকা হলওয়ে’তে-দীর্ঘ একটি করিডোর, সারি সারি বন্ধ দরজা একপাশে।

এখানে লুকানোর মতো জায়গা নেই!

সিয়েনা একটা সুইচ অফ করে দিতেই হলওয়ের কিছু বাতি বন্ধ হয়ে গেলো কিন্তু তাতে খুব একটা সুবিধা হলো না। লুকিয়ে থাকার জন্য এটা কোনো কাজেই আসবে না। তাদের দুজনকে এই আধো-আলো-অন্ধকারেও ভালোমতোই দেখা যাবে। পায়ের আওয়াজগুলো এবার আরো বেশি জোরে জোরে শোনা যাচ্ছে। ল্যাংডন জানে যেকোনো মুহূর্তে ওই লোকগুলো সিঁড়ি দিয়ে উঠে এখানে চলে আসবে।

“তোমার জ্যাকেটটা আমাকে দাও,” ল্যাংডনের জ্যাকেটটা ধরে টান দিয়ে বললো সিয়েনা। এরপর ল্যাংডনকে বাধ্য করলো তার পেছনে একটি আধখোলা দরজার ভেতরে নীচু হয়ে থাকতে। “একটুও নড়বে না।”

এই মেয়েটা করছে কি? তাকে তো ওরা দেখে ফেলবে!

সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই দু’জন সৈনিক থমকে দাঁড়ালো অন্ধকারাচ্ছন্ন হলওয়েতে সিয়েনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে।

“পার লামোরি দি দিও!” তাদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বললো সিয়েনা, তার কণ্ঠে প্রচণ্ড ক্ষোভ। “কসে কুয়েস্তে কনফিউশনি?”

সৈনিক দু’জন ভুরু কুচকে তাকালো, কী দেখছে সেটা যেনো পুরোপুরি বুঝতে পারছে না তারা।

সিয়েনা তার হাউকাউ অব্যাহত রাখলো। “তান্তো চিয়াসসো আ কুয়েস্তোরা?” সকালের এ সময় এতো হাউকাউ কেন!

ল্যাংডন এবার দেখতে পেলো সিয়েনা তার জ্যাকেটটা মাথার উপর এমনভাবে পেচিয়ে রেখেছে যে দেখে মনে হতে পারে ওটা কোনো বুড়ো মহিলার শাল। এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে সে তার পেছনে ল্যাংডনকে দেখা যাচ্ছে না। সিয়েনা এবার এক পা সামনে এগিয়ে গিয়ে বিকারগ্রস্ত বুড়িদের মতো চিৎকার করে উঠলো।

সৈনিকদের একজন হাত তুলে তাকে নির্দেশ করলো নিজের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে যাবার জন্য। “সিনোরা! রিএন্ট্রি সবিতো ইন কাসা!”

আরো এক পা এগিয়ে গিয়ে রেগেমেগে মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে ধরলো সিয়েনা। “আভিতে ইসভেগলিয়াতো মিও মারিতো, চে ই মালাতো!”

অবাক হয়ে শুনে গেলো ল্যাংডন। তারা তোমার অসুস্থ স্বামীকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলেছে?

অন্য সৈনিকটি এবার তার মেশিনগান তুলে সিয়েনার দিকে তাক করলো। “ফার্মা ও স্পারো!”

থমকে দাঁড়ালো মেয়েটি, তারপর গালাগালি করতে করতে পিছু হটে ফিরে এলো দরজার সমানে।

সৈনিক দু’জন আর দেরি করলো না, সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেলো দ্রুত।

পুরোপুরি শেক্সপিয়ার টাইপের অভিনয় নয়, ভাবলো ল্যাংডন, তবে দারুণ।

সিয়েনা মাথার উপর থেকে জ্যাকেটটা খুলে ল্যাংডনকে ফেরত দিলো। “ঠিক আছে, আমার সাথে আসো।”

এবার মেয়েটার পেছন পেছন যেতে তার মনে কোনো দ্বিধা কাজ করলো না।

লবির উপরে ল্যান্ডিংয়ে নেমে এলো তারা, ওখানে দেখা গেলো আরো দু’জন এলিভেটরে ঢুকে পড়ছে উপরে ওঠার জন্য। রাস্তার বাইরে আরেকজন সৈনিক দাঁড়িয়ে আছে ভ্যানটার পাশে। তার কালো ইউনিফর্মের উপর দিয়ে পেশীবহুল শরীরটা দেখা যাচ্ছে। নীরবে ল্যাংডন আর সিয়েনা নেমে গেলো বেইজমেন্টের দিকে।

আন্ডারগ্রাউন্ড কারপোর্টটা অন্ধকারাচ্ছন্ন আর প্রশ্রাবের গন্ধে ভরপুর। এককোণে অনেকগুলো স্কুটার, মোটরসাইকেল পার্ক করা আছে, সিয়েনা দৌড়ে চলে গেলো সেখানে। সিলভার রঙের একটি ট্রিকি’র সামনে থামলো সে-তিন চাকার একটি মপেড়। অনেকটা ইটালিয়ান ভেসপার মতো। ট্ৰিকির সামনের দিকে নীচে ছোট্ট একটি ম্যাগনেটাইজ কেস আছে, সেটা খুলে একটা চাবি বের করে ইঞ্জিন স্টার্ট দিলো সে।

দেরি না করে ল্যাংডন বসে পড়লো তার পেছনে। ধরার মতো কিছু নেই বলে ছোট্ট সিটে বসতে একটু সমস্যাই হলো তার।

“ভদ্রতা দেখানোর সময় এটা নয়,” বললো সিয়েনা। তার হাত দুটো ধরে নিজের কোমরে জড়িয়ে নিলো। “ধরে রাখো এভাবে।”

ল্যাংডন যতোটা ভেবেছিলো তারচেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী ট্রিকি নামের যানটা। দ্রুতগতিতে শব্দ করে বেইজমেন্টের গ্যারাজ থেকে ওটা বেরিয়ে গেলো বাইরের রাস্তায়। ভ্যানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সৈনিকটি চট করে তাকিয়ে দেখলো তাদের।

পেছন ফিরে সৈনিকটির দিকে তাকালো ল্যাংডন। হাতের অস্ত্রটি তুলে তাদের দিকে তাক করেছে মাত্র। মনে মনে প্রমাদ গুনলো। প্রথম গুলিটা এসে লাগলো ট্রিকির পেছনের ফেন্ডারে। অল্পের জন্যে তার স্পাইনে আঘাত করলো না। সেটা।

হায় ঈশ্বর!

সিয়েনা আচমকা বাম দিকে মোড় নিলে নিজের ভারসাম্য রাখতে হিমশিম খেলো ল্যাংডন।

“আমার দিকে ঝুঁকে থাকো!” চিৎকার করে বললো সে।

ল্যাংডন তাই করলো। এবার গতি বেড়ে গিয়ে বড় রাস্তায় চলে এলো তাদের ট্রিকিটা। পুরো এক ব্লক পেরিয়ে আসার পর বুক ভরে দম নিলো হারর্ভাডের প্রফেসর।

ঐ লোকগুলো কারা?

সিয়েনার চোখ রাস্তার দিকে। যানবাহনের ভীড়ের মধ্য দিয়ে এঁকেবেকে ছুটে চলেছে তাদের ট্রিকিটা। পথচারীদের অনেকে সামনে পড়ে ভড়কে গিয়ে এদিক ওদিক চলে গেলো। রাস্তার অনেকেই দেখলো ট্রিকির মতো একটি যানবাহন চালাচ্ছে এক মেয়ে আর তার পেছনে শক্ত করে ধরে বসে আছে ব্রিওনি সুট পরা ছয় ফুট লম্বা মাঝবয়সী এক লোক।

ল্যাংডন আর সিয়েনা তিন ব্লক পার হয়ে আসার পর একটি চৌ-রাস্তার মোড়ে এসে পড়লো। ঠিক এ সময় কালো রঙের একটি ভ্যান দ্রুত ছুটে এলো তাদের পেছনে। অ্যাপার্টমেন্টের সমানে যে ভ্যানটা তারা দেখেছিলো ঠিক সেটাই।

সিয়েনা সঙ্গে সঙ্গে ডান দিকে মোড় নিয়ে পার্ক করে রাখা একটি ভ্যানের পেছনে এসেই হার্ড ব্রেক চাপলো। ল্যাংডনের বুক মেয়েটার পিঠের সাথে লেপ্টে গেলো সঙ্গে সঙ্গে। দেরি না করে ইঞ্জিন বন্ধ করে দিলো মেয়েটি।

তারা কি আমাদের দেখেছে?

ল্যাংডন আর সিয়েনা মাথা নীচু করে রাখলো।

কোনোরকম গতি না কমিয়ে ভ্যানটা চলে গেলো তাদের অতিক্রম করে। বোঝাই যাচ্ছে তাদেরকে দেখতে পায় নি। ভ্যানটা চলে যাওয়ার সময় কয়েক মুহূর্তের জন্যে ভেতরের একটি দৃশ্য দেখতে পেলো ল্যাংডন।

পেছনের সিটে দু’জন সৈনিকের মাঝখানে বন্দীর মতো বসে আছে অসম্ভব রূপবতী বয়স্ক এক নারী। তার চোখ দুটো আধবোজা, মাথাটা এমনভাবে নীচু করে রেখেছে যেনো ঝিমুচ্ছে কিংবা প্রায় অচেতন সে। তার গলায় একটি নেকলেস, মাথার চুল দীর্ঘ, কিছুটা কোকড়ানো আর সাদা।

কয়েক মুহূর্তের জন্য ল্যাংডন জিভ কামড়ে ধরলো। তার মনে হলো সে বুঝি ভুত দেখছে।

এটা হেলুসিনেশানে দেখা সেই মহিলা!

.

অধ্যায় ১৭

কন্ট্রোল রুম থেকে ঝড়ের বেগে বের হয়ে এলো প্রভোস্ট, মেন্দাসিয়াম-এর দীর্ঘ স্টারবোর্ড ডেকের উপর পায়চারি করতে করতে চিন্তাভাবনাগুলো জড়ো করার চেষ্টা করলো সে। ফ্লোরেন্সের অ্যাপার্টমেন্টের যে খবরটা এইমাত্র পেয়েছে সেটা একেবারেই অচিন্তনীয়।

নিজের অফিসে ফিরে যাবার আগে জাহাজটা প্রায় দু’বার চক্কর দিয়ে দিলো। পঞ্চাশ বছরের পুরনো হাইল্যান্ড পার্ক মল্ট নিয়ে বসে পড়লো সে। বোতলটা পেছনে রেখে গ্লাসে কোনো মদ না ঢেলেই কিছুক্ষণ বসে রইলো-নিজেকে বার বার স্মরণ করিয়ে দিলো এখনও সবকিছু তার নিয়ন্ত্রণে আছে।

বুকশেলফে রাখা একটি পুরনো আর মোটা বইয়ের দিকে তার চোখ গেলো-এক ক্লায়েন্টের কাছ থেকে উপহার পাওয়া…এমন এক ক্লায়েন্ট যার সাথে তার দেখা না হলেই বোধহয় সবচাইতে ভালো হতো।

এক বছর আগে…আমি কি করে জানতাম?

ক্লায়েন্টদের সাথে প্রভোস্ট সাধারণত দেখা-সাক্ষাত করে না তবে এই ক্লায়েন্টটি এসেছিলো খুবই বিশ্বস্ত একটি সূত্র থেকে তাই তার বেলায় একটু ব্যতিক্রম করেছিলো।

ঐদিন ক্লায়েন্ট যখন তার প্রাইভেট হেলিকপ্টারে করে মেন্দাসিয়াম-এ এসেছিলো তখন সমুদ্রটা ছিলো বেশ শান্ত। নিজের ক্ষেত্রে বিখ্যাত এই অতিথির বয়স ছেচল্লিশ, ক্লিন-কাট, বেশ লম্বা আর অন্তর্ভেদী সবুজ দু’চোখ।

“আপনি তো জানেনই,” এই বলে শুরু করেছিলো সে, “আমাদের এক মিউঁচুয়াল ফ্রেন্ড আপনাদের সর্ভিসের কথা রেকমেন্ডেট করেছে।” প্রভোস্টের চমৎকার অফিসে হাত-পা ছড়িয়ে বসেছিলো ক্লায়েন্ট, যেনো এটা তার নিজের ঘর। “এখন আপনাকে বলছি আমি কি চাই।”

“একটু থামুন,” কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বলে প্রভোস্ট। “আমাদের প্রটোকল একটু অন্য রকম। আপনাকে কিছু বলতে হবে না। আমি বলছি কি রকম সার্ভিস দিয়ে থাকি আমরা। সব শোনার পর আপনি ঠিক করবেন কোন্ ধরণের সার্ভিস আপনার দরকার।”

ক্লায়েন্ট একটু হতাশ হলেও ধৈর্য ধরে তার কথা শুনে যায়। সব শোনার পর জানায় কিছু দিনের জন্য অদৃশ্য হয়ে যেতে চায় সে, যাতে করে তার শত্রুদের কাছ থেকে নিজেকে আড়ালে রেখে নিজের কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখতে পারে।

মামুলি কাজ।

কনসোর্টিয়াম তার জন্যে ভুয়া আইডির ব্যবস্থা করে দেবে, সেইসাথে নিরাপদ একটি স্থান, যেখান থেকে সে তার সব ধরণের কর্মকাণ্ড পুরোপুরি গোপনীয়তা বজায় রেখে চালিয়ে যেতে পারবে-সেটা কি ধরণের কাজ তাতে কিছুই আসে যায় না। কনসোর্টিয়াম কখনও খতিয়ে দেখে না তাদের ক্লায়েন্ট কি উদ্দেশ্যে তাদের কাছ থেকে সার্ভিস চাইছে। যাদের হয়ে কাজ করছে তাদের সম্পর্কে যতোটা কম জানা যায় ততোই ভালো।

পুরো এক বছর ধরে বেশ মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে প্রভোস্ট সবুজ চোখের ক্লায়েন্টের জন্য নিরাপদ একটি স্বর্গের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলো। ক্লায়েন্ট হিসেবে লোকটা বেশ আদর্শ বলেই মনে হয়েছিলো তখন। তার সাথে কোনো রকম যোগাযোগ রাখতে না প্রভোস্ট তারপরও কাজের বিল ঠিক ঠিক সময়ে পরিশোধ করা হতো।

এরপর দু’সপ্তাহ আগে সব কিছু আচমকাই বদলে যায়।

অপ্রত্যাশিতভাবে ক্লায়েন্ট যোগাযোগ করে, তার সাথে একান্তে কথা বলার জন্য দেখা করতে চায়। ক্লায়েন্ট যে পরিমাণের টাকা দিয়েছে সেটা বিবেচনায় নিয়ে প্রভোস্ট দেখা করতে রাজিও হয়।

বিপর্যস্ত লোকটি যখন এই ইয়টে এসে নামলো তখন তাকে দেখে চেনার উপায় ছিলো না। বছরখানেক আগের সেই দৃঢ়, কেতাদুরস্ত আর ক্লিন-কাট লোকটি যেনো আমুল পাল্টে গেছে। এক সময়কার সুন্দর সবুজ চোখ দুটিতে বন্যতা জেঁকে বসেছে, তাকে দেখে মনে হচ্ছিলো…খুবই অসুস্থ।

তার কি হয়েছে? সে কি করছিলো এতোদিন ধরে?

প্রভোস্ট এসব ভাবতে ভাবতে লোকটাকে নিজের অফিসে নিয়ে আসে।

“ঐ সাদা-চুলের ডাইনী,” রেগেমেগে বলেছিলো ক্লায়েন্ট। “দিন দিন সে আমার কাছে এগিয়ে আসছে।”

ক্লায়েন্টের ফাইলের দিকে তাকিয়ে দেখে প্রভোস্ট। সাদা-চুলের রূপবতী মহিলার ছবি রয়েছে তার সামনে। “হ্যাঁ,” প্রভোস্ট বলে, “আপনার সাদা-চুলের ডাইনী। আমরা আপনার সব শত্রুদের ব্যপারেই সম্যক ধারণা রাখি। ঐ মহিলা যতো শক্তিশালীই হোক না কেন পুরো এক বছর তাকে আমরা আপনার ত্রি সীমানায় ঘেষতে দেই নি। এটা অব্যাহত থাকবে।”

সবুজ চোখের লোকটি উদ্বিগ্ন হয়ে তার মাথার চুল খামচে ধরে। “ওর সৌন্দর্যে বোকা বনে যাবেন না। ও খুবই বিপজ্জনক এক শত্ৰু।”

সত্যি, প্রভোস্ট মনে মনে বলেছিলো। প্রভাবশালী একজনের ব্যাপারে মনোযোগ আকর্ষণ করাতে কিছুটা অখুশি হয়েছিলো। সাদা-চুলের মহিলার যারপরনাই ক্ষমতা আর সম্পদ রয়েছে-তারপরও এ রকম কোনো প্রতিপক্ষের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার কথা বলায় সে একটু অসন্তুষ্ট হয়।

“যদি ঐ মহিলা কিংবা তার শয়তানের দল আমার অবস্থানের কথা জেনে যায়…” ক্লায়েন্ট বলতে শুরু করে আবার।

“এটা তারা করতে পারবে না, প্রভোস্ট তাকে আশ্বস্ত করে বলে। “এ পর্যন্ত আমরা কি আপনাকে ওর কাছ থেকে নিরাপদে রাখি নি? আপনি যা যা অনুরোধ করেছিলেন তার সবটা কি রক্ষা করি নি?”

“হ্যাঁ, লোকটা মেনে নিয়ে বলেছিলো। তারপরও বলছি, আমি খুব শান্তিতে ঘুমাতে পারবো যদি…” একটু থেমে যায় সে। “আমাকে জানতে হবে, আমার যদি কোনো কিছু হয়ে যায় তারপরও আপনি আমার শেষ ইচ্ছেটুকু বাস্তবায়ন করবেন।”

“সেটা কি?”

ব্যাগ থেকে ছোট্ট একটি সিল করা এনভেলপ বের করে লোকটি। “এই এনভেলপে যা আছে তা দিয়ে ফ্লোরেন্সের একটি সেফ-ডিপপাজিট বক্স খোলা যাবে। ঐ বক্সের ভেতরে আপনি পাবেন ছোট্ট একটি জিনিস। আমার যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে আপনি ঐ জিনিসটা একজনের কাছে ডেলিভারি দিয়ে দেবেন। এটা এক ধরণের উপহার বলতে পারেন।”

“খুব ভালো।” কলম তুলে নোট করতে শুরু করে প্রভোস্ট। কার কাছে। ওটা ডেলিভারি দেবো?”

“ঐ সাদা-চুলের মহিলার কাছে।”

অবাক হয়ে তাকিয়েছিলো প্রভোস্ট। “নিজের শত্রুকে উপহার দেবেন?”

“তাকে আরেকটু ঝামেলায় ফেলার জন্য।” চোখ দুটো বড় বড় করে বলে ক্লায়েন্ট। “হাঁড়ের তৈরি একটি চাতুর্যপূর্ণ কাঁটা। সে এটাকে একটা ম্যাপ হিসেবে আবিষ্কার করবে…তার নিজস্ব ভার্জিল…যা তাকে তার নরকে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে।”

কয়েক মুহূর্ত প্রভোস্ট তাকে ভালো করে দেখে নেয়। “আপনি যেমনটি চান। ধরে নিন কাজটা হয়ে গেছে।”

“সময়টা কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ,” তাড়া দিয়ে বলে লোকটি। “এই উপহারটি খুব শীঘ্রই ডেলিভারি দেয়া হবে না। আপনাকে এটা ততোদিন পর্যন্ত লুকিয়ে রাখতে হবে যতোদিন না…” থেমে যায় ক্লায়েন্ট, মনে হয় কোথায় যেনো হারিয়ে গেছে সে।

“যতোদিন না?” প্রভোস্ট জানতে চায়।

ক্লায়েন্ট হঠাৎ করে উঠে প্রভোস্টের ডেস্কের পেছনে পায়চারি করতে শুরু করে। তারপর একটা লাল কালির কলম নিয়ে ডেস্ক ক্যালেন্ডারের নির্দিষ্ট দিনে গোল করে বৃত্ত এঁকে দেয়। “মানে, এই দিনটির আগ পর্যন্ত।”

দীর্ঘশ্বাস চাপা দিয়ে নিজের অসন্তোষ লুকিয়ে ফেলে প্রভোস্ট। “বুঝেছি। এ দিনটির আগ পর্যন্ত আমি কিছু করবো না। ঠিক এই দিনে ডিপোজিট বক্স থেকে জিনিসটা নিয়ে সাদা-চুলের ঐ মহিলার কাছে পাঠিয়ে দেব। আপনাকে কথা দিলাম, আমি এটা করবো।” ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে তারিখটা দেখে নিলো ভালো করে। “আপনার ইচ্ছে অনুযায়ী আজ থেকে চৌদ্দ দিন পর এটা আমি করবো।”

“তার একদিনও আগে না!” বেশ জোর দিয়ে বলে ক্লায়েন্ট।

“বুঝেছি,” তাকে আশ্বস্ত করে বলে প্রভোস্ট। “একদিনও আগে না।”

এনভেলপটা নিয়ে ক্লায়েন্টের ফাইলে রেখে দিয়ে প্রয়োজনীয় নোট টুকে নেয় প্রভোস্ট। ভুলেও জিজ্ঞেস করে নি সেফ-ডিপপাজিটে রাখা ঐ জিনিসটা আসলে কি। এরকম নির্লিপ্ততা কনসোর্টিয়ামের দর্শনের ভিত্তি। শুধু সার্ভিস দিয়ে যাও। কোনো প্রশ্ন কোরো না। বিচার-বিবেচনাও করার দরকার নেই।

ক্লায়েন্ট যেনো হাফ ছেড়ে বেঁচেছিলো। “ধন্যবাদ আপনাকে।”

“আর কিছু?” জানতে চেয়েছিলো প্রভোস্ট।

“হ্যাঁ, আরেকটা জিনিস আছে।” পকেট থেকে লাল রঙের ছোট্ট একটা মেমোরি স্টিক বের করে সে। “এটা একটা ভিডিও ফাইল।” প্রভোস্টের সামনে স্টিকটা রেখে দিয়ে বলে ক্লায়েন্ট, “আমি চাই এটা যেনো সারা বিশ্বের গণমাধ্যমে আপলোড করা হয়।”

লোকটাকে কৌতূহল নিয়ে দেখতে শুরু করে প্রভোস্ট। এর আগে কনসোর্টিয়াম তাদের কোনো ক্লায়েন্টের জন্য এভাবে গণমাধ্যমে কোনো কিছু বিতরণ করে নি। এই লোকটার এরকম অনুরোধে অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করে সে। “ঠিক ঐ তারিখেই?” ক্যালেন্ডারের বৃত্ত চিহ্নিত তারিখটির দিকে ইশারা করে প্রভোস্ট।

“হ্যাঁ, ঐদিনই,” জবাব দেয় ক্লায়েন্ট। “তার এক মুহূর্তও আগে নয়।”

“বুঝতে পেরেছি।” মেমোরি স্টিকটির উপর ট্যাগ লাগিয়ে কিছু নোট লিখে রাখে সে। “তাহলে এই, আর কিছু নেই?” উঠে দাঁড়ায় প্রভোস্ট। বোঝাতে চায় মিটিংটা শেষ হয়ে গেছে।

ক্লায়েন্ট চুপচাপ নিজের সিটেই বসে থাকে। “না। আরেকটা শেষ অনুরোধ আছে।”

নিজের সিটে বসে পড়ে প্রভোস্ট।

ক্লায়েন্টের সবুজ চোখ দুটো জ্বল জ্বল করছিলো যেনো। “এই ভিডিওটা ডেলিভারি দেবার পর পরই আমি খুব বিখ্যাত হয়ে যাবো।”

আপনি ইতিমধ্যেই বেশ বিখ্যাত একজন মানুষ, প্রভোস্ট ভেবেছিলো।

“এর অনেকটা কৃতিত্ব আপনিও পাবেন,” লোকটি বলেছিলো তাকে। “আপনি আমাকে যে সার্ভিস দিয়েছেন তার জন্যেই আমি আমার মাস্টারপিসটা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছি…এই সৃষ্টিকর্মটি পুরো দুনিয়াকে বদলে দেবে। আপনি আপনার ভুমিকার জন্য গর্বিত বোধ করবেন।”

“আপনার মাস্টারপিসটা যা-ই হোক না কেন, অধৈর্য হয়ে বলে ওঠে প্রভোস্ট, “আপনি যে পুরোপুরি গোপনীয়তা বজায় রেখে এটা সৃষ্টি করতে পেরেছেন তাতেই আমি খুশি।”

“সেজন্যে ধন্যবাদ জানাতেই আপনার জন্য একটি ছোট্ট উপহার এনেছি।” বিপর্যস্ত লোকটি তার ব্যাগে হাত ঢোকায়। “একটি বই।”

প্রভোস্ট ভাবতে শুরু করেছিলো এই বইটা ক্লায়েন্টের গোপনে করে যাওয়া কাজটি কিনা। “আপনি কি এই বইটি লিখেছেন?”

“না,” বিশালাকৃতির বইটি ডেস্কের উপর রেখে বলে লোকটি। “বরং বলতে পারেন…এটা আমার জন্যে লেখা হয়েছিলো।”

হতভম্ব হয়ে প্রভোস্ট বইটার দিকে তাকালো। এই লোক মনে করে এই বইটা তার জন্যে লেখা হয়েছে? বইটি ক্লাসিক একটি সাহিত্যকর্ম…লেখা হয়েছে চৌদ্দ শতকে।

“বইটা পড়ে দেখবেন,” অদ্ভুত হাসি দিয়ে বলেছিলো ক্লায়েন্ট। “আমি কি করেছি সেটা বুঝতে দারুণ সাহায্য করবে।”

এ কথা বলেই বিপর্যস্ত লোকটি তড়িঘড়ি বিদায় জানিয়ে চলে যায়। লোকটার হেলিকপ্টার ইটালি উপকূলের দিকে উড়ে যাবার সময় নিজের অফিসের জানালা দিয়ে প্রভোস্ট দেখেছিলো।

তারপর বিশাল আকৃতির বইটির দিকে তাকায় প্রভোস্ট। চামড়ায় মোড়ানো কভারটি উল্টে ভেতরটা দেখে সে। প্রথম ছত্রটি ক্যালিওগ্রাফিতে লেখা, পুরো একটি পৃষ্ঠা জুড়ে জায়গা দখল করে রেখেছে।

ইনফার্নো।
জীবনভ্রমণের মধ্যখানে এসে
সহজ-সলর পথটি হারিয়ে
নিজেকে খুঁজে পেলাম এক অন্ধকার অরণ্যে।

পাতা উল্টে দেখেছিলো পৃষ্ঠাটির উল্টোদিকে তার ক্লায়েন্ট নিজের হাতে

একটি মেসেজ লিখে রেখেছে :

প্রিয় বন্ধু আমার, পথ খুঁজে পেতে সাহায্য করার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

এই দুনিয়াও আপনাকে ধন্যবাদ জানাবে।

এর কি মানে সে-সম্পর্কে প্রভোস্টের কোনো ধারণাই ছিলো না, তারপরও অনেকটুকু পড়েছিলো সে। তারপর বইটা বন্ধ করে বুকশেলফে রেখে দেয়। মনে মনে ভাবে, যাক, এই অদ্ভুত লোকটির সাথে তার পেশাগত সম্পর্ক খুব শীঘ্রই শেষ হয়ে যাবে। আর মাত্র চৌদ্দ দিন পর। ক্যালেন্ডারে দাগ দেয়া তারিখটির দিকে তাকায়।

এরপর থেকে এই ক্লায়েন্টের ব্যাপারে এক ধরণের উদ্বিগ্নতা পেয়ে বসে প্রভোস্টকে। এটা তার চরিত্রের বাইরে আচরণ। মনে হয়েছিলো লোকটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে তার কাছে এসেছিলো। অবশ্য তারপর থেকে প্রভোস্টের অনুমাণ মিথ্যে প্রমাণ করে দিয়ে কোনো রকম ঘটনাই ঘটে নি।

কিন্তু চিহ্নিত করা তারিখটির ঠিক আগের দিনই পর পর বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটতে শুরু করে ফ্লোরেন্সে। সঙ্কটটা সামলানোর চেষ্টা করে প্রভোস্ট কিন্তু দ্রুতই নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করে। সঙ্কটটার চূড়ান্ত ক্লাইমেক্সে পৌঁছায় তাদের ক্লায়েন্টের বাদিয়া টাওয়ারের উপরে ওঠার মধ্য দিয়ে।

সে ওখান থেকে লাফিয়ে মৃত্যুবরণ করে।

এরকম ভয়ঙ্করভাবে একজন ক্লায়েন্টকে হারানোর পরও প্রভোস্ট তার প্রতীজ্ঞা রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর থাকে। মৃতব্যক্তির শেষ ইচ্ছে বাস্তবায়নের জন্য। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে শুরু করে দেয় সে-সাদা-চুলের মহিলার কাছে ফ্লোরেরেন্সর সেফ-ডিপোজিটে রাখা বক্সটা ডেলিভারি দেয়া-যদিও সময়টা একেবারেই অনুকূলে নয়।

আপনার ক্যালেন্ডারে বৃত্ত আঁকা তারিখটির আগে নয়।

এনভেলপে সেফ-ডিপোজিটের যে কোডটা ছিলো সেটা ভায়েন্থাকে দিয়েছিলো প্রভোস্ট, ওটা তুলে আনতে ফ্লোরেন্সে গিয়েছিলো সে। কিন্তু ভায়েন্থা ফোন করে যে খবরটা দিলো সেটা যেমন চমকে যাবার মতো তেমনি ভয়ঙ্কর। সেফ-ডিপোজিট বক্সের ভেতরে রাখা জিনিসটা তার যাবার আগেই সরিয়ে ফেলা হয়েছে, অল্পের জন্যে সে নিজেও ধরা পড়ে যাওয়ার হাত থেকে বেঁচে যায়। কোনোভাবে ঐ সাদা-চুলের মহিলা একাউন্টটার ব্যাপারে জেনে যায়, তারপর নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করে ওটা করায়ত্ত করেই কেবল ক্ষান্ত হয় নি সেইসাথে বক্সটা যে নিতে আসবে তাকে অ্যারেস্ট করার ওয়ারেন্টেরও ব্যবস্থা করে।

এটা তিনদিন আগের ঘটনা।

ক্লায়েন্টের উদ্দেশ্য ছিলো এই জিনিসটা দিয়ে সাদা-চুলের মহিলাকে চুড়ান্ত অপমান করা।

এরপর থেকে কনসোর্টিয়াম মরিয়া হয়ে ছুটোছুটি করেছে–এর সমস্ত ক্ষমতা আর শক্তি ব্যবহার করেছে ক্লায়েন্টের শেষ ইচ্ছা পূরণ করার জন্য কিন্তু বার বার ব্যর্থ হয়েছে। এখন ফ্লোরেন্সে সব কিছু তালগোল পাকিয়ে যাবার পর প্রভোস্ট চেয়ে আছে নিজের ডেস্কের দিকে, সামনে কী ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে সেটা নিয়ে ভাবছে।

তার ক্যালেন্ডারে ক্লায়েন্টের নিজের হাতে বৃত্ত আঁকা তারিখটি যেনো তার দিকে চেয়ে আছে।

আগামীকাল।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও স্কচের বোতলের দিকে তাকালো সে। তারপর চৌদ্দ বছরের মধ্যে এই প্রথম এক গ্লাস মদ এক ঢোকে পুরোটা পান করে ফেললো।

.

নীচের ডেকে ফ্যাসিলিটেটর লরেন্স নোলন লাল রঙের ছোট্ট মেমোরি স্টিকটা তার কম্পিউটার থেকে টেনে বের করে ডেস্কের উপর রাখলো। এইমাত্র যে ভিডিওটি দেখেছে সেটা তার জীবনে দেখা সবথেকে অদ্ভুত একটি জিনিস।

আর সেটা একদম নয় মিনিট দীর্ঘ…একেবারে কাটায় কাটায়।

এক ধরণের অস্থিরতায় আক্রান্ত হয়ে নিজের ছোট্ট কিউবিকলে পায়চারি করতে লাগলো সে। আবারো ভাবতে লাগলো এই উদ্ভট ভিডিওটার বিষয় নিয়ে প্রভোস্টের সঙ্গে কথা বলবে কিনা।

শুধু তোমার উপর অর্পিত কাজটাই করো, নিজেকে সুধালো নোলটন। কোনো প্রশ্ন নয়। কোনো বিচার-বিবেচনা নয়।

মন থেকে জোর করে ভিডিওটা ঝেড়ে ফেলে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। আগামীকাল ক্লায়েন্টের অনুরোধের প্রেক্ষিতে এই ভিডিওটা সে মিডিয়াতে আপলোড করে দেবে।

.

অধ্যায় ১৮

ফ্লোরেন্সের এভিনিউগুলোর মধ্যে ভিয়ালে নিকোলো ম্যাকিয়াভেলিকে সবচাইতে অভিজাত হিসেবে গণ্য করা হয়। প্রশস্ত মোড় একেবেঁকে গেছে গাছপালা আচ্ছাদিত সমভূমির মধ্য দিয়ে, সাইকেলারোহী আর ফেরারি গাড়িপ্রেমীদের কাছে এটি প্রিয় জায়গা।

সিয়েনা খুব দক্ষভাবেই ট্রিকিটা চালিয়ে যাচ্ছে, পেছনে ফেলে যাচ্ছে ছোটো ছোটো বাড়িঘর, সারি সারি বৃক্ষশোভিত পথঘাট এবং শহরের পশ্চিমতীর। একটা চ্যাপেল অতিক্রম করে গেলো তারা, সেটার ঘড়িতে সকাল ৮টা বাজে। ঢং ঢং করে ঘণ্টার শব্দও শোনা গেলো।

সিয়েনাকে শক্ত করে ধরে রাখলেও ল্যাংডনের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে দান্তের ইনফার্নো…আর সাদা-চুলের অপরূপ সুন্দর সেই মহিলা, যাকে একটু আগে দেখেছে একটা ভ্যানের পেছনের সিটে দু’জন বিশালাকৃতির সৈনিকের মাঝখানে বসে থাকতে।

মহিলা যে-ই হোক নে কেন, ভাবলো ল্যাংডন, তারা তাকে পেয়ে গেছে।

“ভ্যানের ঐ মহিলা,” ট্রিকির কানফাটা শব্দের মধ্যেই বললো সিয়েনা। “তুমি নিশ্চিত, তাকেই দিবাস্বপ্নে দেখেছো?”

“একদম নিশ্চিত।”

“তাহলে বিগত দু’দিনে তার সাথে তোমার অবশ্যই দেখা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো তুমি কেন তাকে বার বার হেলুসিনেশানে দেখছো…আর সে-ই বা কেন তোমাকে বার বার বলে যাচ্ছে খুঁজলেই পাবে।”

একমত হলো ল্যাংডন। “আমি জানি না…তার সাথে দেখা হয়েছে কিনা সে-কথা তো আমার মনে পড়ছে না। তবে যখনই তার মুখটা দেখি তখনই ভেতর থেকে একটা তাড়া অনুভব করি, ঐ মহিলাকে আমার সাহায্য করা উচিত।”

ভেরি সরি। ভেরি সরি।

হঠাৎ করেই ল্যাংডনের মনে হলো তার এই অদ্ভুত ক্ষমা প্রার্থনাটি সাদা চুলের মহিলার সাথে সম্পর্কিত কিনা। আমি কি তাকে হতাশ করেছি? ভাবনাটা তার মধ্যে অপরাধ বোধের জন্ম দিলো।

ল্যাংডনের কাছে মনে হচ্ছে যেনো তার ভাণ্ডার থেকে শক্তিশালী একটি অস্ত্র সরিয়ে ফেলা হয়েছে। আমার কোনো স্মৃতি নেই। শৈশব থেকেই তার প্রখর স্মৃতিশক্তি আর এটাই তার সবচাইতে বড় বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ যার উপর অনেক বেশি নির্ভর করে সে। যে লোক তার চারপাশের সব কিছু একবার দেখামাত্রই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সমস্ত ডিটেইল মনে রাখতে অভ্যস্ত তার জন্য স্মৃতিহীন অবস্থা মানে রাডার ছাড়া অন্ধকারে কোনো প্লেন লাভ করার মতোই।

“মনে হচ্ছে জবাব খুঁজে পেতে হলে একটা সুযোগই আছে তোমার, আর তা হলো লা মাঙ্গার মর্মোদ্ধার করা,” বললো সিয়েনা। “এটার মধ্যে যে সিক্রেটই থেকে থাকুক কেন…এরজন্যেই তোমার পিছু নিয়েছে ওরা।”

সায় দিলো ল্যাংডন। catrovacer শব্দটা নিয়ে ভাবলো সে। এটা লেখা ছিলো দান্তের ইনফার্নোতে দোমড়ানো মোচড়ানো মানবদেহের পাশেই।

হঠাৎ করেই ল্যাংডনের মাথায় একটি চিন্তার উদয় হলো।

জ্ঞান ফিরে দেখি আমি ফ্লোরেন্সে…।

ফ্লোরেন্সের চেয়ে এ বিশ্বের আর কোনো শহর দান্তের সাথে বেশি সম্পর্কিত নয়। দান্তে অলিঘিয়েরির জন্ম ফ্লোরেন্সে, বেড়ে উঠেছেন ফ্লোরেন্সে, কিংবদন্তী মতে এই শহরেই বিয়াত্রিচের প্রেমে পড়েছিলেন তিনি, তারপর ফ্লোরেন্স ছেড়ে নির্বাসনে চলে যেতে বাধ্য করা হয়েছিলো তাকে। ঐ সময়টাতে নিজের প্রিয় জন্মস্থান ছেড়ে ভগ্ন হৃদয় নিয়ে ইটালির বিভিন্ন গ্রামীণ জনপদে ঘুরে বেড়াতেন কবি।

প্রাণাধিক ভালোবাসার সবকিছু ছেড়ে যেতে হয়, দান্তে লিখেছিলেন।

পারাদিসো’র সতেরোতম ক্যান্টোর এসব পংক্তি স্মরণ করতে করতে বহু দূরে আরনো নদীর তীরে পুরনো ফ্লোরেন্সের দিকে তার চোখ গেলো।

পুরনো শহরটার লে-আউট কল্পনা করলো ল্যাংডন-পর্যটকদের একটি গোলকধাঁধা, জনসংখ্যার আধিক্য এবং গাড়িঘোড়া ছুটে চলেছে বিখ্যাত সব ক্যাথেড্রাল, জাদুঘর, চ্যাপেল আর হাটবাজারের মধ্য দিয়ে। তার ধারণা সিয়েনা আর সে যদি ট্রিকিটা পরিত্যাগ করে তাহলে জনসমুদ্রে হারিয়ে যাবে।

“আমাদেরকে পুরনো শহরে যেতে হবে,” ল্যাংডন বললো। “কোনো জবাব যদি থাকে তো সেখানেই পাওয়া যাবে। পুরনো ফ্লোরেন্স ছিলো দান্তের সমগ্র জীবন।”

কথাটার সাথে সায় দিয়ে পেছনে ঘাড় বেঁকিয়ে তাকালো সিয়েনা। “এটা নিরাপদও হবে-লুকিয়ে থাকার জন্য প্রচুর জায়গা আছে সেখানে। পোর্তা রোমার দিকে যাই তাহলে। ওখান থেকে নদীটাও পার হওয়া যাবে।”

নদী, ভীতির সাথেই ল্যাংডন ভাবলো। দান্তের বিখ্যাত নরক ভ্রমণটিও শুরু হয়েছিলো নদী পার হয়েই।

সিয়েনা গতি বাড়িয়ে দিলে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো ল্যাংডনের। মনের পর্দায় ইনফার্নোর ছবিগুলো ভাসতে লাগলো। মৃত আর মৃত্যুপথযাত্রী, দশটি গর্তের ম্যালোববাজেস, প্লেগ ডাক্তার আর অদ্ভুত এক দুনিয়া-CATROVACER। লা মাপ্পা’র নীচে এই কথাটা লেখা ছিলো-মৃতের চোখেই কেবলমাত্র সত্য দেখতে পাবে-এটা দান্তের উক্তি কিনা ভাবলো সে।

আমি এটা চিনতে পারছি না।

দান্তের সৃষ্টিকর্ম ল্যাংডনের প্রায় মুখস্ত, একজন শিল্প-ইতিহাসের স্বনামখ্যাত প্রফেসর হিসেবে তার বিশেষত্ব হলো আইকনোগ্রাফি আর সিম্বলজি, তাই মাঝেমধ্যেই তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় দান্তের ল্যান্ডস্কেপে যে অসংখ্য সিম্বল রয়েছে সেগুলোর ব্যাখ্যা দেবার জন্য। কাকতালীয়ভাবে, কিংবা বলা যায় কাকতালীয়ভাবে নয়, দু’বছর আগে সে দান্তের ইনফার্নো’র উপর একটি লেকচার দিয়েছিলো।

‘স্বর্গীয় দান্তে : নরকের সিম্বলসমূহ।’

দান্তে অলিঘিয়েরি ইতিহাসের একটি সত্যিকারের আইকন হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে। সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে দান্তে সোসাইটিগুলো। সবচেয়ে পুরনো সোসাইটিটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ১৮৮১ সালে আমেরিকার ম্যাসাচুসেটসের ক্যামব্রিজে, এটি প্রতিষ্ঠাতা করেন হেনরি ওয়ার্ডসওর্থ লংফেলো। নিউ ইংল্যান্ডের এই কবি প্রথম আমেরিকান হিসেবে দ্য ডিভাইন কমেডি অনুবাদ করেন, তার এই অনুবাদকর্মটি সবচেয়ে বেশি পঠিত এবং আলোচিত।

দান্তের সৃষ্টিকর্মের একজন উল্লেখযোগ্য ছাত্র হিসেবে ল্যাংডনকে এ বিশ্বের সবচাইতে পুরনো দান্তে সোসাইটি-সোসিয়েতা দান্তে অলিঘিয়েরি ভিয়েনা-তাদের গুরুত্বপূর্ণ এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেবার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলো। অনুষ্ঠানটি হয়েছিলো ভিয়েনিজ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স-এ। এই অনুষ্ঠানের স্পন্সর-এক ধনী বিজ্ঞানী এবং দান্তে সোসাইটির সদস্য-অ্যাকাডেমির লেকচার হলের দু’হাজার সিট বুকিং করে ফেলেছিলো।

ল্যাংডন সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলে কনফারেন্সের ডিরেক্টর তাকে সম্ভাষণ জানান। লবি দিয়ে হেঁটে যাবার সময় সে লক্ষ্য করে বিশাল অক্ষরে পেছনের দেয়ালে লেখা আছে : ঈশ্বর যদি ভুল করে থাকেন তাহলে কি হবে?

“এটি একটি লুকাস ট্রবার্গের কাজ,” ফিসফিসিয়ে বলেছিলেন ডিরেক্টর। “আমাদের নতুন আর্ট ইন্সটলেশন। আপনি কি মনে করেন?”

বিশাল অক্ষগুলোর দিকে তাকিয়ে ল্যাংডন বুঝতে পারে নি কি বলবে। “উমম…তার তুলির আঁচড় খুবই দারুণ, কিন্তু তার নিজস্ব মতামতটি খুবই বিক্ষিপ্ত।”

ডিরেক্টর কিছু বুঝতে না পেরে তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়েছিলেন কিছুক্ষণ। ল্যাংডন কেবল আশা করেছিলো তার বক্তৃতার শ্রোতারা যেনো এই লোকের মতো না হয়। তারা যেনো আরেকটু ভালোমতো তার কথা বুঝতে পারে।

“মাইন ডামেন উন্ড হেরেন,” ল্যাংডন তার বক্তৃতা শুরু করেছিলো এভাবে। লাউডস্পিকারে তার কণ্ঠটা বেশ গমগম করছিলো। “উইলকোমেন, বিয়েনভেনু, ওয়েলকাম।”

ক্যাবারের বিখ্যাত একটি লাইন শ্রোতাদের মধ্যে তুমুল করতালি আর হাসির খোরাক হয়েছিলো।

আমি জানতে পেরেছি, আজকের এই শ্রোতাদের মধ্যে কেবলমাত্র দান্তে সোসাইটির সদস্যগণই নেই, সেইসাথে আছে অনেক বিজ্ঞানী আর ছাত্রছাত্রি, যারা এই প্রথমবারের মতো দান্তের সাথে পরিচিত হবে হয়তো। তাই ঐসব শ্রোতা, যারা পড়াশোনা নিয়ে এতোটাই ব্যস্ত ছিলো যে মধ্যযুগের ইতালিয়ান মহাকাব্য পড়ার ফুরসৎ পায় নি, আমি ভেবে দেখলাম তাদের জন্য এক নজরে দান্তের উপর কিছুটা আলোকপাত করাটাই ভালো হবে বিশেষ করে তার জীবন, কর্ম, এবং কেন তাকে ইতিহাসের একটি প্রভাবশালী চরিত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয় সেটা ব্যাখ্যা করবো।”

এবার আরো বেশি হাততালি।

ছোট্ট রিমোটটা ব্যবহার করে দান্তের কতোগুলো ছবি পর্দায় হাজির করলো ল্যাংডন। প্রথমটি আন্দ্রে দেল কাস্তানোর ফুল-লেন্থের পোর্ট্রেট, এখানে কবি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, তার হাতে দর্শনের একটি বই।

“দান্তে অলিঘিয়েরি,” শুরু করলো ল্যাংডন। “এই ফ্লোরেন্টাইন কবি দার্শনিক ১২৬৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন, আর মৃত্যুবরণ করেন ১৩২১ সালে। এই ছবিতে তাকে দেখা যাচ্ছে মাথায় লাল রঙের কাপুচ্চিও পরতে-এক ধরণের। টুপি, কানের দু’পাশে হুডসহ-সেইসাথে লাল আর হালকা কমলা রঙের লুক্কা আলখেল্লা। এই পোশাকের দান্তেকেই আমরা ছবিতে বেশি দেখে থাকি।”

এবার বত্তিচেল্লির আঁকা দান্তের আরেকটি ছবি পদায় ভেসে উঠলো। ভারি চোয়াল আর বাঁকানো নাক। এটাই দান্তের সবচেয়ে বিখ্যাত পোর্ট্রেট। “এখানেও দান্তেকে লাল কাপুচ্চিওতে দেখা যাচ্ছে। তবে বত্তিচেল্লি তার টুপিতে লরেল ফুলের পাপড়ি যোগ করেছেন অভিজ্ঞতার প্রতীকি অর্থে-এই সিম্বলটি ধার করা হয়েছে প্রাচীন গ্রিস থেকে। এমনকি আজেকের দিনেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এটা ব্যবহার করা হয়, বিশেষ করে পোয়েট লরিয়েট আর নোবেল লরিয়েটেদের অনুষ্ঠানে।”

আরো বেশ কয়েকটি ছবি পর পর দেখিয়ে গেলো ল্যাংডন। “এতোক্ষণ বিভিন্ন শিল্পীর আঁকা দান্তের ছবি দেখলেন, এবার দেখুন পিয়াজ্জা দি সান্তা ক্রুশ এ অবস্থিত তার মূর্তি…এবং গিওত্তোর আঁকা বারগেলল্লার চ্যাপেলের বিখ্যাত ফ্রেসকোটি।”

গিওত্তোর ফ্রেসকো পদায় ভেসে উঠলে ল্যাংডন মঞ্চের মাঝখানে চলে এলো।

“সন্দেহ নেই, আপনারা সবাই জানেন দান্তে তার সাহিত্যিক মাস্টারপিস দ্য ডিভাইন কমেডি’র জন্যেই সুপরিচিত-যেখানে কবি স্বয়ং পারগেটরির মধ্য দিয়ে নরকে ভ্রমণ করেন, অবশেষে স্বর্গে প্রবেশ করে ঈশ্বরের সঙ্গে সাক্ষাত করেন তিনি। আধুনিককালে আমরা কমেডি’ শব্দটি যে অর্থে ব্যবহার করি তার সাথে দান্তের কমেডি’র কোনো মিলই নেই। এখানে কমেডি ব্যবহৃত হয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি কারণে। চৌদ্দ শতকে ইতালিয়ান সাহিত্য দু’ধরণের ছিলো : ট্র্যাজেডি প্রতিনিধিত্ব করতে উচ্চমার্গীয় সাহিত্যকে, আর লেখা হতো ফর্মাল ইতালিয়ান ভাষায়; পক্ষান্তরে কমেডি প্রতিনিধিত্ব করতো নিম্নমানের সাহিত্যকে, এগুলো লেখা হতো দৈনন্দিন জীবনে ইতালিয়রা যে ভাষায় কথা বলে সেই কথ্য ভাষায়। এই সাহিত্য মূলতঃ জনসাধারণের জন্যেই লেখা হতো।”

প্রজেক্টরের সাইড এবার মিচেলিনোর আইকনিক ফ্রেসকোটি ফুটিয়ে তুললো পর্দায়। এখানে দান্তেকে দেখা যাচ্ছে ফ্লোরেন্স শহরের প্রাচীরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন, তার হাতে ডিভাইন কমেডি। ব্যাকগ্রাউন্ডে পারগেটরির পর্বত দাঁড়িয়ে আছে নরকের দরজার উপরে মাথা উঁচু করে। এই পেইন্টিংটি এখন রাখা আছে ফ্লোরেন্সের সান্তা মারিয়া দেল ফিওরি’র ক্যাথেড্রালে-সবাই যেটাকে ইল দুমো নামে চেনে।

“বইয়ের নাম দেখে আপনারা নিশ্চয় আন্দাজ করতে পারছেন, ল্যাংডন বলতে লাগলো, দ্য ডিভাইন কমেডি লেখা হয়েছে কথ্য ভাষা অর্থাৎ জনমানুষের ভাষায়। ফলে এই সাহিত্যকর্মটি ধর্মীয়, ইতিহাস, রাজনীতি, দর্শন আর সামাজিক বিবরণ হিসেবে জনসাধারণের কাছে প্রতিভাত হয়েছে ফিকশনের আকারে। এই সৃজনশীল কাজটি ইতালিয়ান সংস্কৃতির এমন একটি স্তম্ভ হয়ে উঠেছিলো যে দান্তের লেখার স্টাইলটি আধুনিক ইতালিয় ভাষার ভিত্তি রচনা করে দেয়।”

একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলো ল্যাংডন, “বন্ধুরা, দান্তের সৃষ্টিকর্মের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করাটা প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার। ধর্মীয়পুস্তক ছাড়া মানবেতিহাসে আর কোনো বই শিল্পকলা, সঙ্গিত কিংবা সাহিত্যের উপর এতো বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারে নি।”

দান্তের প্রভাবে সৃষ্টি করা বিভিন্ন সুরকার, শিল্পী আর লেখকদের কাজের বর্ণনা দিয়ে ল্যাংডন শ্রোতাদের দিকে তাকালো। “এবার বলুন, এখানে কি কোনো লেখক উপস্থিত আছেন?”

প্রায় এক-তৃতীয়াংশ শ্রোতা হাত তুলে ফেললো। হতভম্ব হয়ে গেলো ল্যাংডন। ওয়াও, হয় আজকের অনুষ্ঠানের শ্রোতারা এ বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান শ্রোতা নয়তো ই-পাবলিশিং সত্যি সত্যি দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে।

“তো, আপনারা যারা লেখক আছেন তারা অবশ্যই জানেন কোনো লেখককে প্রশংসা করতে হলে রাব-এর চেয়ে কার্যকরী আর কিছু হতে পারে না। এখানে যারা লেখক নন, তাদের জন্যে বলছি, বই-পুস্তকে বিখ্যাত আর পণ্ডিত ব্যক্তিদের যেসব প্রশংসাসূচক মন্তব্য থাকে সেটাকেই ব্লার্ব বলে। এর ফলে লেখকের কাজের যেমন প্রশংসা করা হয় তেমনি বইয়ের কাটতি বাড়াতেও বেশ সাহায্য করে। সেই মধ্যযুগেও ব্লার্ব প্রচলিত ছিলো। আর আমাদের দান্তের ভাগ্যে বেশ ভালোই প্রশংসা জুটেছিলো বলা চলে।”

স্লাইড বদলে দিলো ল্যাংডন। “আপনাদের বইয়ের কভারে এরকম কিছু পেলে কেমন লাগতো?”

তার চেয়ে বেশি মহানব্যক্তি এই বিশ্বে খুব একটা আসে নি।
–মাইকেলাঞ্জেলো

শ্রোতাদের মধ্যে ফিসফাস শুরু হয়ে গেলো।

“হ্যাঁ,” জোর দিয়ে বললো ল্যাংডন। “আপনারা সিস্টিন চ্যাপেলের ফ্রেসকো আর ডেভিড-এর স্রষ্টা হিসেবে যে মাইকেলাঞ্জেলোর কথা জানেন ইনি সেই ব্যক্তি। জগদ্বিখ্যাত পেইন্টার এবং ভাস্কর। অনেকেই জানেন না, একজন বড় মাপের কবিও ছিলেন তিনি। তার প্রায় তিনশ’র মতো কবিতা প্রকাশিত হয়েছে-এরমধ্যে একটি কবিতার নাম ‘দান্তে, যার নরক দর্শনের সুনিপুন বিবরণ মাইকেলাঞ্জেলোকে লাস্ট জাজমেন্ট আঁকতে অনুপ্রাণিত করেছিলো। আমার কথা বিশ্বাস না হলে দান্তের ইনফার্নোর তৃতীয় ক্যান্টো পড়ন আর সিস্টিন চ্যাপেলে গিয়ে দেখুন, বেদীর উপরে ঠিক সেরকমই একটি ছবি দেখতে পাবেন।”

আবারো সুইড বদলে দিলো ল্যাংডন। পর্দায় ভেসে উঠলো পেশীবহুল জসদৃশ্য এক মানুষ, বিশাল আকারের বৈঠা হাতে উদ্যত, লোকজনকে ভয় দেখাচ্ছে। “এ হলো দান্তের ভয়ঙ্করদর্শন ফেরিম্যান কেরুন। বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়া ভীতসন্ত্রস্ত যাত্রিদেরকে বৈঠা হাতে মারতে উদ্যত।”

নতুন একটি স্লাইড ভেসে উঠলো এবার-মাইকেলাঞ্জেলোর লাস্ট জাজমেন্ট এর ডিটেইল-এক লোককে ক্রুশবিদ্ধ করা হচ্ছে। “এ হলো হামান দ্য আগাগাইট, বাইবেলে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারার কথা বলা হলেও দান্তের কবিতায় তাকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছে। এখন আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন, সিস্টিন চ্যাপেলে মাইকেলাঞ্জেলো দান্তের বর্ণনাই বেছে নিয়েছেন, বাইবেলের বর্ণনা নয়।” হেসে ফেললল ল্যাংডন তারপর নীচুস্বরে বলে উঠলো, “পোপকে আবার এটা বলবেন না।”

সবাই হেসে উঠলো একসঙ্গে।

“দান্তের ইনফার্নো যন্ত্রণা আর দুর্দশার এমন এক জগতের ছবি চিত্রিত করেছে যা এর আগে কোনো মানুষ কল্পনাও করতে পারে নি, আর তার সাহিত্য নির্ধারণ করে দিয়েছে আমাদের আধুনিককালের নরকের দৃশ্যগত ধারণা।” আবারো থামলো ল্যাংডন। “বিশ্বাস করুন, অন্য সবার চেয়ে ক্যাথলিক চার্চেরই বেশি উচিত দান্তেকে ধন্যবাদ দেয়া। কারণ তার ইনফার্নো প্রকাশিত হবার পর পর ভীতসন্ত্রস্ত ধার্মিকের দল চার্চে উপস্থিত হতে শুরু করে। এ সংখ্যা রাতারাতি বেড়ে দাঁড়ায় তিনগুনে। শত শত বছর ধরেই এটা অব্যাহত রয়েছে।”

স্লাইডটা বদলে দিলো ল্যাংডন। “আজ আমরাও একই কারণে এখানে জড়ো হয়েছি।”

পদায় একটা লেখা ফুটে উঠলো : স্বর্গীয় দান্তে: নরকের সিম্বলসমূহ।

“দান্তের ইনফার্নো এমন একটি ল্যান্ডস্কেপ যা সিম্বলিজম আর আইকনোগ্রাফিতে বেশ সমৃদ্ধ। আমি প্রায়শই পুরো একটি সেমিস্টার এই বিষয়টা নিয়ে একটি কোর্স করিয়ে থাকি। আজরাতে আমার মনে হয় দান্তের ইনফার্নোর সিম্বলগুলো উন্মোচন করলেই এই মহান কবির পাশাপাশি আমরা হাঁটতে পারবো…নরকের দরজা পর্যন্ত।”

মঞ্চের সামনে চলে এলো ল্যাংডন, ভালো করে দেখলো শ্রোতাদেরকে। “আমরা যদি ভালোমতো নরক পরিদর্শন করতে চাই তাহলে আমাদের কাছে একটি ম্যাপ থাকলে ভালো হয়। এক্ষেত্রে সান্দ্রো বত্তিচেল্লির আঁকা ম্যাপের চেয়ে অন্য কোনো কিছু দান্তের নরককে এতো নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারে নি।”

রিমোট টিপে পর্দায় বত্তিচেল্লির মাপ্পা দেল ইনফার্নো প্রজেক্ট করলো সে শ্রোতাদের সামনে। ফানেল সদৃশ্য ভূগর্ভস্থ নরকের দৃশ্য দেখে উপস্থিত অনেকেই মৃদু আর্তনাদ করে উঠলো।

“বত্তিচেল্পি অন্যসব শিল্পীদের মতো নিজের মনের মাধুরি মিশিয়ে আঁকেন নি, তিনি দান্তের লেখার প্রতি পুরোপুরি বিশ্বস্ত ছিলেন। সত্যি বলতে কি তিনি দান্তের লেখা পড়তে গিয়ে এতোটা সময়ই ব্যয় করেন যে, মহান ইতিহাসবিদ গিওর্গিও ভাসারি বলেছেন দান্তের লেখার প্রতি বত্তিচেল্লি এতোটাই মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন যে তার যাপিত জীবন মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়ে পড়েছিলো। দান্তের লেখার উপর ভিত্তি করে দুই ডজনেরও বেশি ছবি এঁকেছিলেন বত্তিচেল্লি কিন্তু তার নরকের ম্যাপই হলো সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত।”

পেইন্টিংয়ের উপরের বামদিকটা দেখালো ল্যাংডন। “আমাদের ভ্রমণ শুরু হবে ঠিক এখান থেকে, মাটির উপরে। আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন দান্তে লাল রঙের জামা পরে আছেন, তার সঙ্গে আছে তার পথপ্রদর্শক-গাইড ভার্জিল, নরকের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। এখান থেকে তিনি নীচের দিকে ভ্রমণ করতে শুরু করবেন, ইনফার্নোর নয়টি চক্র পেরিয়ে অবশেষে মুখোমুখি হবেন…”

দ্রুত নতুন আরেকটি স্লাইড প্রক্ষেপ করলো ল্যাংডন-বত্তিচেল্লির ছবিতে আঁকা শয়তানের বিশাল একটি ছবি-ভয়ঙ্কর, তিন-মাথাবিশিষ্ট লুসিফার তার তিনটি মুখ দিয়ে তিন তিনজন মানব-সন্তানকে খেয়ে ফেলছে।

আবারো শ্রোতা-দর্শকেরা আৎকে উঠলো।

“এই ভয়ঙ্কর চরিত্রটির মধ্য দিয়ে আজকের রাতের ভ্রমণ শেষ হবে। এটা নরকের নবম চক্র, যেখানে শয়তান নিজে বসবাস করে। অবশ্য…” হঠাৎ করে থেমে গেলো ল্যাংডন। “এখানে যাওয়াটা পুরোপুরি মজার কিছু না, সুতরাং আমরা একটু পেছনে ফিরে যাই…নরকের দরজায়…যেখান থেকে আমাদের ভ্রমণ শুরু করেছি।”

পরের স্লাইডে চলে গেলো ল্যাংডন-গুস্তাভ দোরি’র একটি লিথোগ্রাফ, যেখানে দেখানো হয়েছে মুখসদৃশ্য একটি পর্বতের অন্ধকারাচ্ছন্ন সুড়ঙ্গপথ। প্রবেশপথের উপরে লেখা আছে : এখানে যে প্রবেশ করবে তার সমস্ত আশা তিরোহিত হবে।

“তাহলে…” হাসি দিয়ে বললো ল্যাংডন। “আমরা প্রবেশ করতে পারি?”

দূরে কোথাও টায়ারের সাথে পিচের ঘর্ষন শোনা যেতেই ল্যাংডনের সামনে থাকা শত শত শ্রোতা বাম্পের মতো উবে গেলো। তার মনে হলো সে হুমরি খেয়ে পড়ে যাচ্ছে। ভিয়ালে ম্যাকিয়াভেলির মাঝপথে ট্রিকিটা আচমকা থেমে গেলে সিয়েনার পিঠের উপর ধাক্কা খেলো সে।

এখনও ল্যাংডনের ঘোর কাটে নি। সে ভেবে যাচ্ছে তার চোখের সামনে আছে নরকের দরজা। ধাতস্থ হতেই দেখতে পেলো এখন কোথায় আছে।

“কি হয়েছে?” জানতে চাইলো সে।

তিনশ’ গজ সামনে পোর্তা রোমানার আঙুল তুলে দেখালো সিয়েনা-পুরনো ফ্লোরেন্সে ঢোকার পাথরের প্রাচীন প্রবেশপথ। “রবার্ট, আমাদের একটা সমস্যা হয়ে গেছে।”

.

অধ্যায় ১৯

এজেন্ট ব্রুডার নিম্নমানের অ্যাপার্টমেন্টের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করলো সে কী দেখছে। এখানে কোন শালায় থাকতো? ঘরের সাজসজ্জা বিক্ষিপ্ত আর বিশৃঙ্খল, অনেকটা কলেজের হোস্টেলের মতো।

“এজেন্ট ব্রুডার?” হল থেকে তার এক লোক ডাকলো তাকে। “আপনি এটা দেখে যান।”

হলের দিকে যেতে যেতে ব্রুডার ভাবলো স্থানীয় পুলিশ এরইমধ্যে ল্যাংডনকে গ্রেফতার করতে পেরেছে কিনা। ব্রুডার এই সমস্যাটি নিজেই সমাধান করতে বেশি পছন্দ করতো কিন্তু ল্যাংডনের পলায়ন সব কিছু গুবলেট করে দিয়েছে। আর কোনো উপায় না দেখে স্থানীয় পুলিশের সাহায্য নিতেই হয়েছে, পথেঘাটে বসাতে হয়েছে রোডব্লক। একটি হাল্কা মোটরবাইক খুব সহজেই দ্রুত গতিতে অলিগলি দিয়ে ছুটে যেতে পারে, আর সেটাই হয়েছে। তার ভ্যানটাকে ফাঁকি দিয়ে ওটা সটকে পড়েছে ফ্লোরেন্সের কোথাও। ইটালিয়ান পুলিশের একটা দুনাম আছে, তারা বাইরের কারো সাথে খুব একটা সহযোগীতা করে না, কিন্তু ব্রুডারের সংগঠনটি বেশ প্রভাবশালী, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে তাদের সুসম্পর্ক রয়েছে পুলিশ, কনসুলেট, অ্যাম্বাসি। আমরা কোনো আব্দার করলে কারোর সাহস নেই সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলার।

ছোট্ট একটি অফিসে ঢুকলো ব্রুডার, তার এক লোক চালু থাকা একটি ল্যাপটপের সামনে ল্যাটেক্স গ্লোভস পরে দাঁড়িয়ে আছে। “এই মেশিনটা সে ব্যবহার করেছে, লোকটা বললো। “ল্যাংডন এটা দিয়ে তার ই-মেইলে ঢুকেছিলো। কিছু সার্চও করেছে। ফাইলগুলো এখনও ক্যাড-এ আছে।”

ডেস্কের দিকে এগিয়ে গেলো ব্রুডার।

“এটা দেখে তো মনে হয় না ল্যাংডনের কম্পিউটার, টেকনিশিয়ান বললো। “এটা এস.সি আদ্যক্ষরের একজনের নামে রেজিস্টার করা-কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি পুরো নামটি পেয়ে যাবো।”

ব্রুডারের চোখ গেলো ডেস্কের এক কোণে স্তূপ করে রাখা কাগজের উপর। কিছু কাগজ নেড়েচেড়ে দেখতেই তার চোখ গেলো লন্ডন গ্লোব থিয়েটারের বহু পুরনো একটি প্লেবিল আর পত্রিকার আর্টিকেলের ক্লিপিংয়ের দিকে। ব্রুডার যতোই পড়লো ততোই তার চোখ দুটো বড় হতে শুরু করলো।

ডকুমেন্টগুলো হাতে নিয়ে হলে চলে এসে নিজের বসকে ফোন করলো সে। “ব্রুডার বলছি। মনে হয় ল্যাংডনকে যে সাহায্য করেছে তার পরিচয় পেয়ে গেছি।”

“কে সে?” জানতে চাইলো তার বস।

আস্তে করে দম ছেড়ে বললো ব্রুডার, “আপনি এটা বিশ্বাস করতে চাইবেন না।”

.

দুই মাইল দূরে বিএমডব্লিউ বাইকে করে এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছে ভায়েন্থা। বিপরীত দিক থেকে পুলিশের কিছু গাড়ি তাকে অতিক্রম করে যাচ্ছে সাইরেন বাজাতে বাজাতে।

আমাকে অস্বীকার করা হয়েছে, ভাবলো সে।

সাধারণত এই চার-স্ট্রোকের মোটারসাইকেলের মৃদু ভাইব্রেশন তার নাভটাকে শান্ত করে তোলে, তবে আজ সেটা করলো না।

বারো বছর ধরে ভায়েন্থা কনসোর্টিয়ামের হয়ে কাজ করে আসছে, গ্রাউন্ড সাপোর্ট থেকে স্ট্র্যাটেজি কো-অর্ডিনেশন, অবশেষে হাই র‍্যাঙ্কের ফিল্ড এজেন্ট। ক্যারিয়ার ছাড়া আমার আর কিছু নেই। ফিল্ড এজেন্টদেরকে কঠিন গোপনীয়তা রক্ষা, ভ্রমণ আর দীর্ঘ মিশনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। আর এসব করতে গিয়ে ব্যক্তিগত জীবন, সম্পর্ক বলে কিছু থাকে না।

এক বছর ধরে আমি এই মিশনটাতে রয়েছি, ভাবলো সে, এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না হুটহাট করে প্রভোস্ট তাকে মিশন থেকে তুলে নিয়েছে, পরিত্যাগ করেছে।

বারো মাস ধরে ভায়েন্থা কনসোর্টিয়ামের এই ক্লায়েন্টর জন্য সাপোর্ট সার্ভিস তদারকি করেছে-রহস্যময় সবুজ চোখের জিনিয়াস এক লোক, সে কেবল চেয়েছিলো কিছুদিনের জন্য ‘উধাও’ হয়ে থাকতে, যাতে করে নিজের শত্রু আর প্রতিপক্ষের অগোচরে থেকে নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারে। খুব কমই ভ্রমণ করতো লোকটি, আর সেটা করলেও প্রায় অদৃশ্যভাবে করতো, বেশিরভাগ সময় কাজেই ডুবে থাকতো সে। এই লোক কি ধরণের কাজ করতো সেটা ভায়েন্থার জানা নেই, জানার দরকারও ছিলো না, কারণ তাদের সাথে লোকটার চুক্তি ছিলো খুব সহজ-সরল-তাকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়ানো প্রভাবশালী শত্রুদের নাগাল থেকে দূরে রাখতে হবে, নিরাপদে রাখতে হবে।

পুরোপুরি পেশাদারিত্বের সাথে ভায়েন্থা কাজ করে গেছে, আর সব কিছুই ঠিকঠাকভাবে চলছিলো।

সেটা অবশ্য গত রাতের আগপর্যন্ত।

ভায়েন্থার মানসিক অবস্থা আর তার ক্যারিয়ার বিরাট সঙ্কটের মধ্যে পড়ে গেছে এখন। আমি এখন বহিরাগত।

অস্বীকৃত প্রটোকল মানে এজেন্টকে সঙ্গে সঙ্গে কাল বিলম্ব না করে সমস্ত মিশন থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া হবে, এবং সেইসাথে এলাকা থেকে দ্রুত চলে যেতে হবে। এজেন্ট যদি ধরা পড়ে যায় তাহলে কনসোর্টিয়াম তাকে অস্বীকার করবে। এজেন্টের সমস্ত জ্ঞান, তথ্য অস্বীকার করবে। এজেন্টরা ভালো করেই জানে এই সংগঠনটি কিভাবে নিজের প্রয়োজনে বাস্তবতাকে কুক্ষিগত করতে পারে।

এরকম অস্বীকৃত হওয়া মাত্র দু’জন এজেন্টকে চেনে ভায়েন্থা। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, তাদেরকে আর কখনও সে দেখে নি। ধরে নিয়েছিলো, কনসোর্টিয়াম তাদেরকে ডেকে জবাবদিহি করার পর বরখাস্ত করেছে এবং বলে দিয়েছে আর কখনও এই সংগঠনের কারো সাথে তারা যেনো যোগাযোগ না করে।

এখন অবশ্য এ ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছে না ভায়েন্থা।

তুমি একটু বেশি ভাবছো, নিজেকে বলার চেষ্টা করলো সে। ঠাণ্ডা মাথার খুনিদের চেয়ে কনসোর্টিয়ামের পদ্ধতিগুলো অনেক বেশি অভিজাত আর সূক্ষ্ম।

তারপরও ভয়ের একটি শিহরণ বয়ে গেলো তার মধ্যে।

হোটেলের ছাদ থেকে নীচের রাস্তায় ব্রুডারের টিমটাকে দেখার পরই তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছিলো সে যেনো পালিয়ে যায়। ভাবলো, তার এই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে বাঁচাতে পেরেছে কিনা।

এখন কেউ জানে না আমি কোথায় আছি।

ভিয়ালে দেল পোজ্জিও ইম্পারিয়ালের দিকে ছুটে যাবার সময় ভায়েন্থা বুঝতে পারলো, বিগত কয়েক ঘণ্টায় কিভাবে তার জীবনটা পাল্টে গেছে। গতরাতে সে উদ্বিগ্ন ছিলো তার উপর অর্পিত কাজটা রক্ষা করার জন্য। আর এখন সে উদ্বিগ্ন নিজের জীবন বাঁচাতে।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *