হ্যাকার ২

মাসুদ রানা ৩৮৬ – হ্যাকার ২ (দ্বিতীয় খণ্ড) – কাজী আনোয়ার হোসেন – সেবা প্রকাশনী

প্রথম প্রকাশ : ২০০৮.

০১.

ইউ.এস. কোস্ট গার্ডের ডিপ সি প্যাট্রোল শিপ নিউবার্গ-এর অধিনায়ক কমাণ্ডার ইউজিন ডেকার লোকটা হাসিখুশি ধরনের। কখনও কারও সঙ্গে উঁচু গলায় কথা, বলেন না তিনি, শত সমস্যাঁতেও মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখেন। এই আচরণে কোনও কৃত্রিমতা নেই, আসলেই তিনি সদাহাস্য চরিত্রের মানুষ। সমুদ্রগামী জাহাজের… হোক সেটা সরকারী বা ব্যক্তিমালিকানাধীন… ক্যাপ্টেনদের এত অমায়িক হলে চলে না। নাবিক মানেই অস্থির আর বিশৃঙ্খল প্রকৃতির একদল মানুষ, তাদেরকে বশে রাখতে হলে নেতাকে হতে হয় কঠোর স্বভাবের। অবশ্য নরম প্রকৃতির এবং নিপাট ভালমানুষ হওয়ার পরও কমাণ্ডার ডেকার যে আজ পর্যন্ত লোক সামলানো নিয়ে কখনও ঝামেলায় পড়েননি, সেটার কৃতিত্ব প্রায়। পুরোপুরিই তাঁর সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড বা এক্সিকিউটিভ অফিসারদের দিতে হয়। সৌভাগ্যক্রমে সবসময় দক্ষ ও যোগ্য লোকদের এক্স.ও, হিসেবে পেয়েছেন তিনি, যারা অধিনায়কের কোমলতাকে নিজেদের কড়া শাসনের মাধ্যমে অধীনস্থদের ভুলিয়ে দিতে পারে। এ-কারণে নাবিকদের নিয়ে কখনও ঝামেলা পোহাতে হয় না ডেকারকে, মুখের হাসিটা স্বচ্ছন্দে ফুটিয়ে রাখতে পারেন।

আজ বহুদিন পর হাসিটা নিভেছে, কমাণ্ডার ডেকারের কপালে পড়েছে দুশ্চিন্তার রেখা। ঘটনাটা এতই অস্বাভাবিক যে, পুরো জাহাজের উপরই প্রভাব পড়েছে ক্যাপ্টেনের এই আচরণের। বিস্মিত হয়ে সবাই শুধু ভাবছে, হলোটা কী? হাসিখুশি মানুষটা হঠাৎ এমন বদলে গেল কেন?

কমাণ্ডার ডেকারের এই পরিবর্তনটা সোয়া দুই ঘণ্টা আগে হয়েছে, যখন কোস্টগার্ডের লস অ্যাঞ্জেলেস বেস থেকে তাঁর কাছে প্রায়োরিটি মেসেজটা এসেছে। নির্দেশের প্রথম অংশটা খুব একটা অস্বাভাবিক ছিল না–কোর্স বদলে মণ্টেগো আইস শেলফে যেতে বলা হয়েছে নিউবার্গকে। সেখানে একটা প্রাইভেট রিসার্চ ফ্যাসিলিটিতে ড, স্ট্যানলি ডোনেন নামে এক আমেরিকান বিজ্ঞানী আছেন, তাঁকে জাহাজে তুলে নিয়ে পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষায় থাকতে হবে। এই পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল, পুনশ্চ দিয়ে এরপর যেটা বলা হয়েছে, সেটাই ডেকারের উদ্বেগের কারণ। ওখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ফ্যাসিলিটির কর্তৃপক্ষ স্বেচ্ছায় বিজ্ঞানীকে হস্তান্তর না-ও করতে পারে; তবে তাদের কোনও ধরনের আপত্তি মেনে নেয়া যাবে না, প্রয়োজনে বলপ্রয়োগ করে হলেও ড, ডোনেনকে কবজা করতে হবে। এই শেষের বাক্যটাই তাঁর শান্তি কেড়ে নিয়েছে। নির্বিবাদী-শান্তিপ্রিয় মানুষ তিনি, সবার সঙ্গে সদ্ভাব রেখে চলেন। আর তাকেই কিনা বলা হচ্ছে একটা প্রাইভেট ফ্যাসিলিটিতে জোর করে ঢুকে একজন মানুষকে কিডন্যাপ করে আনতে! ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে নির্দেশটার ব্যাখ্যা চেয়েছিলেন ডেকার, জবাবে কাঠখোট্টাভাবে বলা হয়েছে–কোনও প্রশ্ন কোরো না, চুপচাপ অর্ডার ফলো করো। সেই সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয়েছে একটা বহুলব্যবহৃত বাক্য-এর সঙ্গে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার বিষয় জড়িত।

ক্যাপ্টেনের উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে মেসেজের সঙ্গে আসা দুটো সাদাকালো ফটোগ্রাফ-বিদেশি দুই যুবকের ছবি ওগুলো। মাসুদ রানা এবং রায়হান রশিদ। এরা কে, জানা নেই ডেকারের। মেসেজে এদেরকে বিপজ্জনক চরিত্র এবং যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আইস শেলফে নিজ অথবা ছদ্মপরিচয়ে এরা উপস্থিত থাকতে পারে বলে সতর্ক করা হয়েছে, এবং এদেরকে দেখামাত্র গ্রেফতার করার আদেশ দেয়া হয়েছে।

মেসেজ বলতে এতটুকুই। কোনও কারণ ব্যাখ্যা করা হয়নি, এমন উদ্ভট আদেশের পিছনে কোনও যৌক্তিকতাও দেখা যাচ্ছে না। গূঢ় একটা রহস্য যে আছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই; কিন্তু সেটা তাঁকে জানাতে অসুবিধেটা কোথায়? চাকরিজীবনের আটাশ বছর পেরিয়ে গেছে কমাণ্ডার ডেকারের, এখনও তাকে জুনিয়র ছেলে-ছোকরাদের মত বিনা প্রশ্নে লেজ নেড়ে অর্ডার ফলো করতে বলাটা রীতিমত অপমানের শামিল। স্বভাবতঃই মেজাজ খিঁচড়ে গেছে। ডেকারের। তা ছাড়া নির্দেশটা আসবার পর পরই রিসার্চ ফ্যাসিলিটির সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল–ওখান থেকে ওরা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে, বিজ্ঞানী ভদ্রলোককে কোনও অবস্থাতেই ছাড়া সম্ভব নয় ওঁদের পক্ষে। ওপর থেকে পাওয়া অর্ডারটার কারণে এই মুহূর্তে কমাণ্ডার ডেকারও নাচার। সামনে যে বড় ধরনের একটা ফাড়া অপেক্ষা করছে, সেটা অনুমান করতে জ্যোতিষী হবার প্রয়োজন নেই।

ব্রিজে ক্যাপ্টেন চেয়ারে বসে আছেন ডেকার, গভীর চিন্তায় মগ্নকী করবেন, কীভাবে বিনা সংঘাতে ডক্টরকে বের করে আনা যাবে, এসব ভেবে মাথার ঘাম পায়ে ফেলছেন। গন্তব্য থেকে মাত্র তিন মাইল দূরে আছে নিউবার্গ, খুব একটা সময়ও নেই হাতে, করণীয় সম্পর্কে খুব দ্রুত একটা সিদ্ধান্তে আসতে হবে তাকে। হঠাৎ দূর থেকে ভেসে আসা আবছা শব্দে চমকে উঠলেন প্রবীণ কমাণ্ডার, পাশ ফিরে তাকালেন লেফটেন্যান্ট কমাণ্ডার সিসিল ফ্লিনের দিকে।

কিছু শুনতে পেলে, এক্স.ও.?

কীসের কথা বলছেন, স্যর? ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল ফ্লিন।

পটকা ফাটার মত আওয়াজ হলো, শোনোনি?

আওয়াজ তো কত কিছুরই হতে পারে, স্যর। হয়তো গ্লেসিয়ার থেকে বরফ ভেঙে পানিতে পড়ছে।

বিরক্ত চোখে উপ-অধিনায়কের দিকে তাকালেন ডেকার, তার অভিজ্ঞ কান এত সহজে ধোকা খায় না। বরফ ভাঙার শব্দ নয় মোটেই। গুলির আওয়াজ! গোলাগুলি চলছে কাছেই কোথাও।

এখানে আবার গোলাগুলি করবে কে?

সেটাই তো জানার চেষ্টা করা উচিত তোমার! কমাণ্ডারের তেতে থাকা মেজাজটা আরও গরম করে দিচ্ছে লোকটা। কড়া গলায় তিনি বললেন, লুকআউটদের বলো ভাল করে চারপাশটা দেখতে। মন্টেগোর কাছাকাছি পৌঁছে গেছি আমরা… গোলমালটা ওখানেও হতে পারে।

মাথা ঝাঁকিয়ে ব্রিজের বাইরে দাঁড়ানো লুকআউটদের সঙ্গে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল ফ্লিন।

এই মুহূর্তে একটা আইসবার্গের আড়ালে আছে নিউবার্গ, ওটাকে পাশ কাটিয়ে সামনে এগোচ্ছে। দৃষ্টিসীমা থেকে আইসশেলফটা অদৃশ্য, নইলে মন্টেগোর ক্লিফ থেকে দু’জন মানুষসহ একটা স্নো-মোবিলকে সাগরে লাফ দিতে দেখতে পেত ওরা। অবশ্য একই কথা লাফ দেয়া স্নো-মোবিলের পিছু পিছু কিনার পর্যন্ত ছুটে আসা দুই খুনীর বেলাতেও খাটে-বাধাটুকুর জন্য আইস শেলফের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া, কোস্ট গার্ডের জাহাজটাকে ওরাও দেখতে পায়নি।

দুই মিনিট পর নিউবার্গ যখন আইসবার্গের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল, তখন খুনীরা আইস শেলফের কিনার থেকে সরে গেছে। বরফ-দ্বীপটার মাঝামাঝি মাথা উঁচু করে থাকা পাহাড়গুলোর দিকে ছুটছে–ওগুলোর আড়াল থেকে এস্কেপ চপারে উঠবে। নাক সোজা করে এবার মন্টেগোর দিকে ছুটতে শুরু করল জাহাজটা। বিজের দপাশের উইঙে দাঁড়ানো লকআউটরা এক্স, ওর ধমক খেয়ে সিধে হয়ে গেছে, চোখে বিনকিউলার লাগিয়ে সতর্ক দৃষ্টি বোলাচ্ছে আইস শেলফ আর তার আশপাশের সাগরের উপর। হঠাৎ ডানদিকে দাঁড়ানো নাবিকের চোখে ধরা পড়ল নড়াচড়া।

স্টারবোর্ড লুকআউট বলছি, স্যর। ম্যান ওভারবোর্ড! মানুষ…পানিতে মানুষ দেখতে পাচ্ছি আমি!

রিসার্চ ফ্যাসিলিটির সঙ্গে কথা বলার জন্য কমিউনিকেটরের দিকে যাচ্ছিলেন কমাণ্ডার ডেকার, চিৎকারটা শুনে চমকে গেলেন। তাড়াতাড়ি দরজা খুলে স্টারবোর্ড উইঙে বেরিয়ে এলেন তিনি।

কী সব আবোল-তাবোল বকছ? ধমকে উঠলেন কমাণ্ডার। কোথায় মানুষ?

গলা থেকে বিনকিউলারটা খুলে অধিনায়কের হাতে দিল নাবিক। ঠিকই বলছি, স্যর। ওই যে, টু-ওক্লকে দেখুন। সত্যি সত্যি মানুষ ভাসছে ওখানে।

দূরবীনটা চোখে লাগাতেই খাবি খাওয়ার অবস্থা হলো ডেকারের। ভুল দেখেনি দায়িত্বরত নাবিক। সত্যিই দুটো মাথা দেখা যাচ্ছে পানিতে, একটু একটু নড়ছেও। কারা এরা? পানিতে পড়ল কী করে? একটু আগে যে গুলির শব্দ শুনলেন, তার সঙ্গে ব্যাপারটার সম্পর্ক আছে কি? থাকার সম্ভাবনাই বেশি বলে মনে হলো তাঁর।

দ্রুত হিসেব কষলেন প্রবীণ কমাণ্ডারআর্কটিকের ঠাণ্ডা পানিতে তিন-চার মিনিটের বেশি বাঁচতে পারে না মানুষ। লোকদুটো যদি গুলির শব্দ হবার পরে পানিতে পড়ে থাকে, তারমানে অন্তত দুমিনিট পেরিয়ে গেছে। খুব বেশি হলে আর দুমিনিট সময় আছে হাতে, অথচ আরও পাঁচ মিনিটের আগে ওদের উদ্ধার করার মত পজিশনে পৌঁছুতে পারবে না নিউবার্গ। মানুষদুটোকে বাঁচাবার উপায় একটাই। ঝড়ের বেগে ব্রিজে ঢুকলেন তিনি।

এক্স.ও! রেসকিউ টিম আর জোডিয়াক বোট পানিতে নামাও, এক্ষুণি! আর মেডিক্যাল অফিসারকে সিক-বেতে রেডি হতে বলো–আমরা দু’জন মৃতপ্রায়। মানুষ অথবা তাদের লাশ আনতে যাচ্ছি!

প্রথম ধাপে বিশ ফুট নীচে আছড়ে পড়েছে রায়হানকে নিয়ে রানা, শক্ত বরফের উপর বারো ইঞ্চি তুষার থাকায় মারাত্মক আঘাত লাগেনি, তারপর একশ ত্রিশ ফুট উপর থেকে সাগরে পড়েও তেমন একটা লাগেনি বরফের উপর শুয়ে থাকায়। কিন্তু বরফখণ্ড সহ যেই পানির তলায় চলে গেল, তখনই প্রমাদ গুনল রানা। আহত রায়হানকে এতক্ষণ ছাড়েনি রানা, কিন্তু হিম-শীতল পানি আচমকা এমনই শক দিল যে ওর হাত থেকে ছুটে গেল তরুণ হ্যাকারের অজ্ঞান দেহটা। মুচকি হেসে ভাবল, তা হলে এই রকম মৃত্যুই লেখা ছিল ওর কপালে!

অনেকদূর তলিয়ে যাওয়ার পর ধীরেসুস্থে, হেলেদুলে আবার ভেসে উঠতে শুরু করল বিশাল বরফখণ্ড, সেই সঙ্গে ঠেলে তুলে নিয়ে আসছে রানাকে সারফেসে। পানির নীচে চোখ মেলে দেখল ও, রায়হানের অবশ শরীরটা নেমে যাচ্ছে নীচে। পাশ কাটাবার সময় হাত বাড়িয়ে ধরে ফেলল রানা আহত সঙ্গীর। কলার, টেনে তুলে নিল বরফের উপর।

এইটুকু করতে গিয়েই বুঝতে পারল, অবশ হয়ে যাচ্ছে ওর নিজের শরীরও; মগজের হুকুম মানতে চাইছে না পেশিগুলো। এখনও মরেনি যে এটাই আশ্চর্য! অবশ্য ইতোমধ্যে যে নরকযন্ত্রণা শুরু হয়েছে, তারচেয়ে মরে যাওয়াটাই বুঝি অনেক ভাল ছিল। আর্কটিকের বরফগলা শীতল পানি যে কেমন কষ্টদায়ক, তা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ বুঝবে না।

পতনের ধাক্কায় বুক থেকে সমস্ত বাতাস বেরিয়ে গিয়েছিল আগেই, হাঁসফাঁস করছে ফুসফুসটা। তবে চরম শীতল পানি যে অত্যাচারটা শুরু করল, তার যন্ত্রণার কাছে ফুসফুসের আকুতি হারিয়ে গেল। মাথার ভিতর অজস্র সুঁই যেন বিধতে শুরু করল হঠাৎ করে–মগজটাকে মোরব্বার মত কেচে ফেলছে। একই সঙ্গে শরীরের প্রতিটা অস্থিসংযোগে যেন ছুরি চালাচ্ছে কেউ, স্নায়ুগুলো। চিৎকার করে উঠছে ব্যথায়। এদিকে হাড়-মাংস পরিণত হয়েছে নিরেট পাথরে, কোনও কথাই শুনছে না পেশিগুলো।

জীবনে এই প্রথম মেরু সাগরের পানিতে পড়েনি রানা, অতীতেও একই অভিজ্ঞতা একাধিকবার হয়েছে ওর। কষ্টটুকু সহ্য করে জীবন বাঁচাতে হয়েছে। প্রতিবারই। তাই প্রবল শারীরিক বিদ্রোহের মাঝেও হতবুদ্ধি হলো না ও, মাথা ঠাণ্ডা রেখে পরের কাজগুলো করল। এখন সবার আগে দরকার এক বুক ভোলা। বাতাস। বরফখণ্ডের গদাইলস্করি চালে উপরে ওঠা পছন্দ হলো না ওর, ফেটে যাচ্ছে বুক, একটু আগে পৌঁছতে হবে; উঠে দাঁড়িয়ে লাফ দিল ও বরফের গায়ে পা বাধিয়ে–এক হাতে ধরে রেখেছে রায়হানের কলার।

কাজটা সহজ হলো না মোটেই–শরীরের কোষগুলো সাড়া দিতে চাইছে না। হাইপোথারমিয়া আক্রমণের প্রথম লক্ষণ এটা–মাংসপেশি আর অস্থিসংযোগ অসাড় হয়ে পড়া। মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহ কমে যাওয়ায় একটু পর শুরু হবে দৃষ্টিবিভ্রম বা হ্যালুসিনেশন। তারপর… অবশিষ্ট তাপটুকু দিয়ে শুধু শ্বাস-প্রশ্বাস আর হৃৎপিণ্ডকে চালু রাখবে শরীর, অন্যান্য সমস্ত কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দেবে। সবশেষে জমে যাবে মগজ–করাল মৃত্যু এসে গ্রাস করবে ওদের।

রানার চোখের সামনে পরিচিত প্রিয় মুখগুলো ভিড় করল–আর কখনও কি দেখতে পাবে ওদের? সবশেষে মনে পড়ল কঠিন দায়িত্বটার কথা–মানবসভ্যতার জন্য এক কঠিন দুর্যোগ অপেক্ষা করছে সামনে, একমাত্র ও-ই পারে সেটা ঠেকাতে। সচকিত হয়ে উঠল ও-না! ন্যায়-অন্যায়, শুভ-অশুভর লড়াইয়ে কিছুতেই ওর হেরে গেলে চলবে না!

শরীরের সমস্ত শক্তি একত্র করে হাত-পা ছুঁড়ল রানা-রায়হানকে টেনে ধরে ভুস করে একটু পরেই মাথা তুলল সারফেসে অজ্ঞান হ্যাকারকে দেখল ও, ছেলেটা গুলি খেয়েছে নিঃসন্দেহে। তবে সেটা কোথায় বা কতটা গুরুতর, তা বোঝার উপায় নেই এই মুহূর্তে। আইস শেলফের দিকে চোখ ফেরাল ও। মাত্র পঁচিশ থেকে ত্রিশ গজ দূরে ক্লিফের খাড়া দেয়াল, সোজা এসে মিশে গেছে। সাগরে–ওঠার কোনও উপায় নেই। সত্যিই কি তাই? আশপাশে এক টুকরো সমতল জায়গাও কি পাওয়া যাবে না, যেটায় উঠে ওরা আশ্রয় নিতে পারে?

যাবে… নিশ্চয়ই যাবে। আশায় বুক বেঁধে সাঁতার কাটতে শুরু করল রানা, রায়হানকে ধরে রেখেছে এক হাতে। যেভাবেই হোক শুকনোয় উঠতে হবে, তা হলে বাঁচার একটা উপায় বেরিয়ে যেতেও পারে। কিন্তু নির্মম মেরু সাগর তার দুই শিকারকে হাতছাড়া করতে রাজি নয়–মাত্র দশ গজ এগিয়েই রানা বুঝতে পারল, ওর হার হতে চলেছে। দয়া দেখাতে রাজি নয় প্রকৃতি, সলিল সমাধিই ওদের ভাগ্যে লেখা আছে। যতক্ষণ পারে যুদ্ধ চালিয়ে গেল রানা, কিন্তু খানিক। পর আপনাআপনিই থেমে গেল হাত-পায়ের নড়াচড়া, মুদে এল চোখের পাতা।

তবে আর একটু জেগে থাকলেই রাবারের তৈরি ইনফ্লেইটেবল জোডিয়াক বোটটাকে দেখতে পেত ও–শক্তিশালী আউটবোর্ড ইঞ্জিনের কল্যাণে তীরের মত ছুটে আসছে সেটা।

.

০২.

টানা চার ঘণ্টার জার্নি শেষে মণ্টেগো আইস শেলফে পৌঁছুল ইউ.এস. এয়ারফোর্সের এফ-১৪ জেট ফাইটারটা। ভাসমান দ্বীপটাকে ঘিরে একটা চক্কর দিল ওটা, তারপর রেডিওতে কো-অর্ডিনেট জেনে নিয়ে ল্যাণ্ড করতে শুরু করল।

আইস শিটের উপর এখনও রয়ে গেছে সকালে আসা ডিসি-থ্রি বিমানটা, যেতে দেয়া হয়নি। ওটার একশো গজ বাঁয়ে নতুন করে আরেকটা মেক-শিফট রানওয়ে বানানো হয়েছে; ওখানেই নামল. এফ-১৪। ট্যাক্সিইং শেষে স্থির হবার পর ইঞ্জিন কাটঅফ করল পাইলট, তারপর খুলে দিল ফাইবারগ্লাসের ক্যানোপিটা। সঙ্গে সঙ্গে আর্কটিকের শীতল বাতাস ঝাঁপিয়ে পড়ল খোলা। ককপিটে।

আপনি ঠিক আছেন তো, স্যর? পিছন ফিরে আরোহীকে জিজ্ঞেস করল পাইলট।

জবাব না দিয়ে অস্ফুট স্বরে গাল দিয়ে উঠল ডগলাস বুলক ওরফে বুলডগ। বৈমানিক নয় সে, মাক-থ্রি বেগে ছুটে চলা ফাইটারটায় বসে থাকতে থাকতে তার মাথা ধরে গেছে, আক্রান্ত হয়েছে মোশন সিকনেসে। উদাত বমিটা রীতিমত কসরত করে ঠেকিয়ে রাখতে হয়েছে তাকে। মিনিটখানেক অপেক্ষা করে সুস্থির হবার চেষ্টা করল সে, তারপর নেমে এল ককপিট থেকে। পা টলমল করছে, শরীর পুরোপুরি ভারসাম্য ফিরে পায়নি এখনও। আরেকটু হলেই পড়ে যেত, কোত্থেকে যেন একজন লোক এসে ধরে ফেলল তাকে।

কে সা নিল বুলডগ। কড়া গলায় বলল, হয়েছে। সাহায্য করতে হবে না আমাকে! দাঁতে দাঁতে ঠোকাঠুকি শুরু হয়ে গেছে তার, কথা বলার সময় কাঁপুনি ঠেকাতে মুখ খিঁচিয়ে রাখতে হলো।

ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল লোকটা। হাতে ধরা ভারি পশমি জ্যাকেট আর প্যান্ট বাড়িয়ে ধরল। এগুলো পরে নিন, স্যর।

ছোঁ মেরে কাপড়গুলো নিয়ে সামনে তাকাল বুলডগ। দুটো ট্র্যাক্টর এসে থেমেছে ল্যাণ্ড করা ফাইটারের পাশে, সেগুলো থেকে নেমে এসেছে ছজন মানুষ। প্রবীণ এক অফিসার সামনে এগিয়ে এলেন। বললেন, গুড আফটারনুন, মি. বুলক। মণ্টেগোতে স্বাগতম।

প্যান্টে পা গলাতে গলাতে বুলডগ জানতে চাইল, কে আপনি?

কমাণ্ডার ইউজিন ডেকার–কোস্ট গার্ড শিপ নিউবার্গের কমাণ্ডিং অফিসার।

আপনার জাহাজ কোথায়?

আইস শেলফের পাশেই আছে। নোঙর করে অপেক্ষা করছে।

কীসের অপেক্ষা? ব্রাইটনের বানচোতরা এখনও ওই বিজ্ঞানীটাকে হ্যাঁণ্ডওভার করেনি?

ইতস্তত করলেন ডেকার। ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। আপনি এনরুটে ছিলেন বলে রেডিওতে জানানো হয়নি কিছু। ইয়ে… এখানে একটা মিস-হ্যাপ ঘটে গেছে।

মিস-হ্যাপ! কী হয়েছে?

বিজ্ঞানী ভদ্রলোক মারা গেছেন।

জ্যাকেটের চেন বন্ধ করতে গিয়ে থমকে গেল বুলডগ। কী বললেন?

ঠিকই শুনেছেন। ড. স্ট্যানলি ডোনেন ইজ ডেড।

হোয়াট! কীভাবে?

গুলি খেয়ে। লাশটা ফ্যাসিলিটির বাইরে… বরফের উপর পেয়েছি আমরা, মাথার একটা পাশ উড়ে গেছে। আমার ধারণা, স্নাইপার শট।

চকিতে রানার স্নাইপিং দক্ষতার কথা মনে পড়ে গেল বুলডগের। এর সঙ্গে মাসুদ রানার কোনও কানেকশন নেই তো?

ঘটনার সময় আইস শেলফে উপস্থিত ছিল সে, ড, ডোনেনের সঙ্গেও ছিল–এটুকু শিয়োর হওয়া গেছে। তবে তারপর কীভাবে কী ঘটেছে, তা বলতে পারছে না কেউ।

কেউ কিছু বলতে পারছে না মানে? খেঁকিয়ে উঠল বুলডগ।

হাত তুলে আইস-ট্র্যাক্টরের দিকে ইশারা করলেন ডেকার। চলুন, যেতে যেতে বলছি। আমার ধারণা, ফ্যাসিলিটিটা দেখতে চাইবেন আপনিওখানে ছোটখাট একটা যুদ্ধ ঘটে গেছে। ভিতরের লোকজনও পুরোপুরি সুস্থ নয়। গ্যাসের সাইড-এফেক্টে ভুগছে সবাই এখনও। আমার মেডিক্যাল টিম শুশ্রূষা চালিয়ে যাচ্ছে।

আপনার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। কীসের গ্যাস, কীসের যুদ্ধ?

যুদ্ধ করেছে–আপনারা?

না, মি. বুলক। দুঃখের বিষয়, শোটা আমরা পৌঁছুনোর আগেই শেষ হয়ে গেছে, হাসলেন ডেকার। দাঁড়িয়ে না থেকে চলুন রওনা হয়ে যাই। পথেই শোনাব সব। কোনও কিছু অস্পষ্ট মনে হলে ফ্যাসিলিটির সিকিউরিটি চিফ ব্যাখ্যা করতে পারবে।

.

ধীরে ধীরে চোখ মেলল রানা। চকিতের জন্য মাথার ভিতরটা শূন্য মনে হলো, কিছু নেই যেন ওখানে। তারপরই মনে পড়ে গেল সব-ইউনোকোড, ভাইরাস, ড, ডোনেন, রিসার্চ ফ্যাসিলিটি, আততায়ীর আক্রমণ, আর সব শেষে ক্লিফ থেকে লাফিয়ে পড়া। একটু নড়েচড়ে চারপাশটা দেখল ও-সবখানে সাদা রঙের আধিক্য, ঠিক যেন হাসপাতাল; দেয়ালগুলো বাল্কহেডের মত-রেড ক্রস চিহ্ন দেখা গেল দুজায়গায়। বুঝতে অসুবিধে হলো না, কোনও একটা শিপের সিক বেতে আছে। নিজের দিকে নজর দিল রানা–দুধসাদা একটা বিছানায় শুয়ে আছে ও, শরীর মোটা কম্বলে ঢাকা, পরনে কিছু নেই।

ওকে নড়তে দেখে বিছানার পাশে দাঁড়ানো একজন মেডিক্যাল অ্যাসিসটেন্টকে চঞ্চল হয়ে উঠতে দেখা গেল। স্যর! এই ভদ্রলোকের জ্ঞান ফিরেছে।

গলায় স্টেথস্কোপ ঝুলিয়ে ইউনিফর্ম পরা এক অফিসারকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল–কাঁধের অ্যাপিউলেটে লাল স্ট্রাইপ… তারমানে ডাক্তার। বয়স চল্লিশের কোঠায়, চেহারাটা হাসিখুশি। কাছে এসে বললেন, থ্যাঙ্ক গড় যে জেগে উঠেছেন। কণ্ঠে আন্তরিকতা টের পাওয়া গেল। ভয় পাচ্ছিলাম কোমাতে চলে গেলেন কি না।

কে আপনি? দুর্বল গলায় জানতে চাইল রানা।

লেফটেন্যান্ট কমাণ্ডার ব্রায়ান ডারমট, আমি এখানকার… মানে সিজিএস নিউবার্গের মেডিক্যাল অফিসার। অবশ্য আপনি আমাকে আপনার দ্বিতীয়-জীবনদানকারীও বলতে পারেন।

সিজিএস, মানে কোস্ট গার্ড শিপ। রানা বুঝতে পারল, এটা ওই জাহাজটাই, যেটা ড. ডোনেনকে নিয়ে যেতে আসছিল। ওদেরকে সাগর থেকে উদ্ধার করে এনেছে নিশ্চয়ই।

দুঃখিত, ডাক্তার সাহেব, হালকা গলায় বলল রানা। দ্বিতীয়-জীবনদানকারীর উপাধিটা বহু আগেই একজন নিয়ে নিয়েছেন। এমনকী তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, কোনওটাই খালি নেই। আসলে জীবনদানকারীদের লিস্টে আপনি যে কত নম্বর, সেটা জানতে হলে আমাকে কাগজ-কলম নিয়ে হিসেবে বসতে হবে।

হেসে ফেললেন ডা. ডারমট। আপনি বেশ রসিক লোক, মি. রানা। অবশ্য আপনার গায়ের পুরনো ক্ষতচিহ্নগুলো দেখেই আমার মনে হচ্ছিল, আমরা ডাক্তাররা না থাকলে বহু আগেই আপনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতেন।

উঠে বসতে বসতে রানা জিজ্ঞেস করল, আপনি আমার নাম জানলেন কী করে?

ওমা, ছবিসহ আপনার আর মি. রায়হান রশিদের অ্যারেস্ট ওয়ারে এসেছে না?

সঙ্গীর নামটা শুনেই একটু চঞ্চল হয়ে উঠল রানা। কোথায় রায়হান?

ওই তো, আঙুল তুলে দেখিয়ে দিলেন ডারমট-পাশের একটা বেডে শুয়ে আছে তরুণ হ্যাকার, গলা পর্যন্ত চাদরে ঢাকা, চোখ বন্ধ। চাদরের তলা থেকে বাম কাঁধের যেটুকু বেরিয়ে আছে, সেটা সম্পূর্ণ ব্যাণ্ডেজে মোড়া।

রানার চেহারায় উদ্বেগ লক্ষ করে ডাক্তার বললেন, চিন্তা করবেন না, মি. রশিদ সম্পূর্ণ বিপদমুক্ত।

গুলি লেগেছিল ওর…

কাঁধে, জানালেন ডারমট। তবে সিরিয়াস ছিল না আঘাতটা-মাংস ভেদ করে বেরিয়ে গেছে বুলেট, ক্রিটিকাল কোনও আর্টারিও ঘেঁড়েনি। মূল সমস্যাটা দেখা দিয়েছিল আপনারা দু’জনই সাব-যিরো পানিতে এক্সপোজড হওয়ায়। হার্ট থেমে যেতে বসেছিল, ডিফিব্রিলেটরের শক দিয়ে আবার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরিয়ে আনতে হয়েছে।

তারমানে এখন আর কোনও সমস্যা নেই?

আমার তো মনে হয় না, বললেন ডারমট। আপনারা ইয়াং মেন… দুএক ঘণ্টার মধ্যেই সম্পূর্ণ ফিট হয়ে যাবেন বলে আশা করছি। মি. রশিদের কাঁধটা দুচারদিন আড়ষ্ট হয়ে থাকতে পারে, আর কিছু নয়।

থ্যাঙ্কস, ডক্টর, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল রানা। আপনি আমাদের জীবন বাঁচিয়েছেন।

ধন্যবাদ দেবার কিছু নেই, হাসলেন ডারমট। আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি, আর কিছু নয়।

সেটাই বা কজন করে, বলুন? বিশেষ করে রোগী যখন এমন দু’জন মানুষ, যাদের অ্যারেস্ট করার অর্ডার পেয়েছেন আপনারা?

রোগীর পরিচয় আমার কাছে রোগী হিসেবেই, মি. রানা। অন্য কিছু না। আপনারা ক্রিমিনাল, নাকি ভাল মানুষ–সেটা ভাবার জন্য ক্যাপ্টেন আর অন্যেরা। আছে।

হুম, সেটাই তো দেখছি, সিক-বের দরজায় সশস্ত্র সেন্ট্রি দাঁড়িয়ে আছে। দেখে মন্তব্য করল রানা।

বিশ্রাম নিন, বলে চলে গেলেন ডারমট।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই চোখ মেলল রায়হান, পাতাদুটো পিট পিট করল-বোঝার চেষ্টা করছে কোথায় আছে।

ওয়েলকাম ব্যাক! বলল রানা।

উহহ! কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠতে গিয়ে কাঁধের ব্যথায় গুঙিয়ে উঠল রায়হান। বলল, ব্যথা পাচ্ছি যখন, বুঝতে পারছি, বেহেশতে চলে আসিনি।

বেহেশত হলে মন্দ হতো না, রানা বলল। আসলে ছোটখাট একটা দোজখে আছি আমরা এ-মুহূর্তে।

কেন? কোথায় আমরা?

কোস্ট গার্ডের শিপটায়। ওরা আমাদের তুলে এনেছে পানি থেকে। আর হ্যাঁ, বন্দি আমরা… বুলডগ ওদের কাছে হুলিয়া পাঠিয়েছে।

কপালটা দেখছি সব দিক থেকেই বিট্রে করছে, মাসুদ ভাই। ডোনেন স্যরকে হারালাম, কোস্ট গার্ডের হাতে বন্দি হয়ে গেলাম… অ্যাসাইনমেন্টটা বোধহয় আর কমপ্লিট করা সম্ভব হচ্ছে না।

এখুনি হতাশ হয়ো না, রানা বলল। তোমার অবস্থা কী, সেটা বলো। কাজকর্ম করতে পারবে? পালাতে গেলে তোমার সাহায্য দরকার।

কাঁধে বোঝা ওঠাতে না বললে অসুবিধে নেই, রায়হান বলল। কিন্তু সুস্থ হওয়া না হওয়াতে কী এসে-যায়? সাগরের মাঝখানে রয়েছি আমরা, এখান থেকে পালাবেন কীভাবে?

ব্যবস্থা একটা হয়ে যাবে।

নাহয় পালালামই, তারপর? ডোনেন স্যর মারা যাওয়ায় আর কেউ ইউনোকোডের ভাইরাসটার ব্যাপারে সাহায্য করতে পারবে না আমাদের।

আছে, রায়হান। শেষ ইউনো… ড, এলিসা ভ্যান ব্যুরেন। তার কাছে যাবো আমরা।

ভদ্রমহিলা কোথায় আছেন…আদৌ বেঁচে আছেন কি না–জানি না আমরা। তা ছাড়া তিনি যে আমাদের সাহায্য করবেন, সেটারই বা গ্যারান্টি কী?

জবাব দেয়ার সুযোগ পেল না রানা, দরজা দিয়ে সিক-বেতে নতুন একজন মানুষকে ঢুকতে দেখা গেল লেফটেন্যান্ট কমাণ্ডার সিসিল ফ্লিন, এক্সিকিউটিভ অফিসার।

গুড আফটারনুন, ডক্টর, ডারমটের দিকে তাকিয়ে অভিবাদন বলল ফ্লিন। শুনলাম ওদের জ্ঞান ফিরেছে, তাই দেখতে এলাম।

শুধু দেখতে? ডারমট ভুরু কোঁচকালেন। আমার তো মনে হয়, তোমার অন্য কোনও মতলব আছে, এক্স.ও।

মতলবটতলব কিছু না, এদেরকে আইস শেলফে পাঠাতে হবে। ওখানে সিআইএ-র এক অফিসার এসেছেন। ওদের সঙ্গে কথা বলতে চান।

পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করল রানা আর রায়হান-নিশ্চয়ই বুলডগ পৌঁছে গেছে মণ্টেগোতে।

মেডিক্যাল অফিসার বললেন, তাকে বলে দাও, পেশেন্টরা পুরোপুরি সুস্থ নয়। কথা বলতে হলে যেন এখানে এসেই বলে।

কাঁধ ঝাঁকাল ফ্লিন। সরি, ডক্টর। ওই ভদ্রলোককে অর্ডার দেয়ার মত ক্ষমতা আমাদের কারও নেই।

তাতে কিছু যায়-আসে না, রাগী গলায় বললেন ডারমট। রোগীর ভালমন্দ দেখার দায়িত্ব আমার, সেজন্য যে-কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারি আমি।

ওই ব্যাটাকে বলে দাও, আমি পেশেন্টদের ছাড়তে রাজি হইনি।

শুধু শুধু ঝামেলা করবেন না তো, বিরক্ত গলায় বলল ফিন। এদের প্রতি এত দরদ দেখানোর কিছু নেই। রেডিওতে ক্যাপ্টেন জানালেন–আইস শেলফে আট-নয়টা লাশ পাওয়া গেছে… খুন হওয়া। আমার মন বলছে, কাণ্ডটা এদেরই।

কী!

ঠিকই বলছি। এদের ব্যাকগ্রাউণ্ড জানা গেছে–দু’জনই বাংলাদেশি স্পাই। বিশেষ করে ওই মাসুদ রানা একটা জাত-খুনী।

রানার বিছানার দিকে এগিয়ে গেলেন ডারমট। কথাটা কি সত্যি, মি. রানা?

কী কথা? রানা জিজ্ঞেস করল।

আপনারা আইস শেলফে আট-নজন মানুষ খুন করে এসেছেন?

না, শান্ত গলায় উত্তর দিল রানা। আমরা কাউকে খুন করিনি।

তা হলে কে করেছে?

ভাল প্রশ্ন করেছেন, জবাবটা আমরাও জানতে চাই।

মানে!

খুনগুলো কে করেছে, তা জানা নেই আমাদের।

কথা ঘোরাবেন না, মি. রানা, ধমকের সুরে বলল ফ্লিন। রিসার্চ ফ্যাসিলিটিতে সবাইকে বেহুশ অবস্থায় পাওয়া গেছে, শুধু আপনারা দু’জনই সজ্ঞান ছিলেন… নইলে ওখান থেকে বেরিয়ে এসে পানিতে লাফ দিতে পারতেন না। খুন আপনারা করেননি তো করেছেটা কে?

সবাই যদি বেহুঁশই থাকে, তা হলে আমরা তো দিব্যি ঘুরেফিরে বেড়াতে পারতাম, তাই না? বাঁকা সুরে বলল রানা। পানিতে কেন লাফ দিয়েছিলাম বলে মনে হয় আপনার–গরম লাগছিল বলে?

হয়েছিলটা কী, বলুন তো? জানতে চাইলেন ডারমট।

খুনীরা আমাদেরও মেরে ফেলার চেষ্টা করছিল, ওদের হাত থেকে বাঁচতে স্নো-মোবিল নিয়ে আইস শেলফ থেকে সাগরে ঝাঁপ দিই আমরা।

এইমাত্র না বললেন, খুন কে করেছে, তা দেখেননি?

আমার কথার অর্থ বুঝতে ভুল হয়েছে আপনাদের, রানা বলল। খুনীদের দেখেছি আমরা, ওদের বিরুদ্ধে লড়াইও করেছি, কিন্তু ওদের পরিচয় সম্পর্কে কিছু জানা নেই আমাদের।

এরা এটা-সেটা বলে আমাদের বিভ্রান্ত করছে, ডক্টর, বলল ফ্লিন। কিছু বিশ্বাস করবেন না। এরা স্পাই, মানুষকে বোকা বানাতে ওস্তাদ। কেসটা। সিআইএ-র, ওদেরকেই ডিল করতে দিন।

বিশ্বাস-অবিশ্বাস কোনওটাই করছি না আমি, শান্ত গলায় বললেন ডারমট। তবে এটা তো সত্যি–ওরা পুরোপুরি সুস্থ নয়। এই মুহূর্তে ওদেরকে কোথাও মুভ করবার অনুমতি দেব না আমি।

ব্যাপারটা এখন আর আপনার-আমার লেভেলে নেই। অনুমতি দেবেন কি দেবেন না, সেটায় কিছু যায়-আসে না। এদেরকে আমি, রিসার্চ ফ্যাসিলিটিতে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

কী আশ্চর্য! তুমি অন্তত ক্যাপ্টেনকে জানাও ব্যাপারটা। তিনি আমার কথা এক ফুঁতে উড়িয়ে দেবেন বলে বিশ্বাস করি না আমি। এরা অসুস্থ… দুর্বল। এই অবস্থায় ইন্টারোগেট করা হলে মারাও যেতে পারে।

মরলই বা! এরা অ্যামেরিকার শত্রু, মরলে দেশেরই উপকার হয়।

কী বলছ যা-তা! রেগে গেলেন ডারমট। বিনা বিচারে দু’জন মানুষকে মরতে দেব আমি? কক্ষনো না। তুমি কথা বলতে না চাইলে ক্যাপ্টেনের সঙ্গে আমিই কথা বলতে যাচ্ছি। ততক্ষণ তুমি কিছু করবে না!

স্ট্যাণ্ড ব্যাক, ডক্টর, আদেশের সুরে বলল ফ্লিন। দিস ইয মাই অর্ডার!

তুমি… তুমি আমাকে অর্ডার দেওয়ার কে? রেগে গিয়ে বললেন ডারমট। মেডিক্যাল অফিসার সরাসরি ক্যাপ্টেনের আণ্ডারে কাজ করে, তোমার আণ্ডারে। নয়। তা ছাড়া চাকরির দিক থেকেও তুমি আমার অনেক জুনিয়র। কোন্ সাহসে। আমাকে অর্ডার দিচ্ছ?

ক্যাপ্টেনের অনুপস্থিতিতে এক্স.ও. হিসেবে এই জাহাজে আমিই এখন কমাণ্ডে আছি, স্যর, বলল ফ্লিন। ইশারায় দরজায় দাঁড়ানো অস্ত্রধারী সেন্ট্রিদের ভিতরে নিয়ে এল সে। ওদের দেখিয়ে বলল, প্লিজ, সিন ক্রিয়েট করবেন না, আপনারই ক্ষতি হবে।

তুমি এত খেপেছ কেন, বলো তো? বিস্মিত গলায় প্রশ্ন করলেন ডাক্তার।

জবাব দিল না ফ্লিন, গরম চোখে তাকিয়ে রইল মেডিক্যাল অফিসারের দিকে। লোকটা গোঁয়ার টাইপের, বুঝতে পারছে রানা, সেই সঙ্গে সম্ভবত উচ্চাভিলাষীও। সিআইএ-র নাম শুনে তাই লাফিয়ে উঠেছে, নিজের কর্মদক্ষতা দেখানোর মওকা খুঁজছে। মনে মনে নিশ্চয়ই গোপন একটা আশা আছে। তার–সিআইএ-র উঁচু পদের একজনের চোখে নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে পারলে ভবিষ্যতে প্রমোশন-টমোশনের ক্ষেত্রে তদবির করতে সুবিধে হবে। এ কোনও গোপন কথা নয় যে, অ্যামেরিকার যে-কোনও বাহিনীর উঁচু পদে পৌঁছুতে গেলেই ইন্টেলিজেন্স কমিউনিটির… বিশেষ করে সিআইএ থেকে ক্লিয়ারেন্স পেতে হয়। রানার অনুমানটা যে ভুল নয়, তা একটু পরেই বোঝা গেল।

একজন সেন্ট্রির দিকে তাকিয়ে ফ্লিন বলল, বন্দিদের জন্য কাপড়ের ব্যবস্থা করো। আর আমাদের হেলিকপ্টারটাকে বলো আইস শেলফ থেকে জাহাজে ফিরে আসতে। আমি নিজেই ওদের নিয়ে যাবো রিসার্চ ফ্যাসিলিটিতে।

হাসি পেল রানার-লোকটা তা হলে সত্যিই ডগলাস বুলকের সামনে হিরো সাজতে চাইছে… ইমপ্রেস করতে চাইছে একজন হাই-র্যাঙ্কিং সিআইএ অফিসারকে; কিন্তু এই লেফটেন্যান্ট কমাণ্ডার বেচারা কি জানে, বুলডগ কখনও কারও নামে ভাল রিপোর্ট দেয় না!

.

০৩.

আপনারা সবাই একেকটা অপদার্থ ছাড়া আর কিছু না! সরোষে বলল ডগলাস বুলক। মেজাজ খিঁচড়ে রয়েছে তার, মুখের ভাষায় সেটা গোপন করার কোনও চেষ্টাও করছে না। রিসার্চ ফ্যাসিলিটির ডিরেক্টরের রুমে বসে আছে সে-ওখানে উপস্থিত স্বয়ং ডিরেক্টর আর ফ্যাসিলিটির সিকিউরিটি চিফকে বাক্যবাণে তুলোধুনো করছে।

এভাবে আমাদের গালাগাল দেয়াটা উচিত হচ্ছে না আপনার, আহত কণ্ঠে বললেন ডিরেক্টর লায়াল ফ্যানিং। যা ঘটে গেছে, তাতে আমাদের কিছু করার ছিল না।

তা হলে এই হাঁদারামদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন দিচ্ছেন কেন? সিকিউরিটি চিফ ট্রেভর ব্লিকম্যানকে দেখাল বুলডগ।

এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে, অহমে আঘাত পেয়ে বলে উঠল সিকিউরিটি চিফ। হতে পারেন আপনি বিরাট কিছু, তাই বলে আমাদের যা খুশি গালাগাল করার অধিকার নেই আপনার।

গাল দিচ্ছি না, সত্যিই তুমি একটা হাঁদারাম, চিবিয়ে চিবিয়ে, বলল। বুলডগ। কেমনতরো সিকিউরিটি চিফ তুমি, অ্যাঁ? প্রথমে মাসুদ রানা ঢুকে পড়ল… তারপর আবার কে না কে ঢুকে কমাণ্ডো হামলা চালাল… এখানে আদৌ কোনও সিকিউরিটি ছিল বলে তো মনে হয় না। ত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতা তোমার, না? তা হলে রানা তোমাকে বেকুব বানাল কীভাবে, অজ্ঞান করে ফেলল কীভাবে?

জীবনে এই প্রথম এমন প্রফেশনালদের মোকাবেলা করতে হয়েছে। আমাকে, মিন মিন করে বলল ব্লিকম্যান। দু-একটা ভুল-ত্রুটি হতেই পারে…

শাট আপ! সাফাই গেয়ো না। তোমাদের গাধামির জন্য কত বড় একটা সর্বনাশ ঘটে গেছে, তা কল্পনাও করতে পারবে না। ড. ডোনেন আমাদের জন্য একটা অমূল্য রত্ন ছিল, তার মৃত্যুতে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে–জানো? গড ড্যাম ইট! এখন তোমাদের সবকটাকে ধরে নিয়ে গিয়ে ফাটকে পোরা উচিত আমার।

কী করার ছিল আমার…

কোস্ট গার্ডের মেসেজ পাবার পর আরও সতর্ক হওনি কেন? ড. ডোনেনকে দূরে কোথাও সরিয়ে নাওনি কেন?

কথায় না পেরে কাঁধ ঝাঁকাল ব্লিকম্যান। সখেদে বলল, সব ওই শালা মাসুদ রানার দোষ। ওকে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখলে এসবের কিছুই ঘটত না।

ও আমার ধারণা, ছেলেটাকে অকারণে দোষারোপ করছেন আপনারা, শান্ত। গলায় বলে উঠলেন কমাণ্ডার, ডেকার, টেবিলের একপাশে এতক্ষণ চুপচাপ বসে ছিলেন তিনি। আমার লোকজন যতটুকু আলামত পেয়েছে, তাতে তো মনে হয়–বিজ্ঞানী ভদ্রলোককে বাঁচাবারই চেষ্টা করেছে রানা। ফ্যাসিলিটির ভিতরে লড়াইয়ের চিহ্ন পেয়েছি আমরা–হ্যামলাকারীদের সঙ্গে লড়াই করার জন্য তো ও আর রায়হান রশিদ ছাড়া আর কেউ ছিল না। রানা নিজে যদি ডোনেনকে খুন করেই থাকে, তা হলে ডোমের বাইরে নিয়ে করল কেন? স্নাইপ-শটেই বা মেরেছে কেন? এখানে একসঙ্গে ছিল, পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে গুলি করাটাই কি যুক্তিসঙ্গত ছিল না? তা ছাড়া সবকিছুর পর পানিতেই বা ঝাঁপ দিতে যাবে। কেন?

আপনাকে ওখানে বসে থিয়োরি কপচাতে বলেনি কেউ, ধমকের সুরে বলল বুলডগ। আপনার লোকজন কোথায়? রানা আর তার সাগরেদকে এখনও হাজির করেনি কেন?

চলে আসবে, বললেন ডেকার। তবে আমি এখনও বলব, এ-মুহূর্তে ওদেরকে এখানে নিয়ে আসাটা ঠিক হচ্ছে না। পালিয়ে তো আর যাচ্ছে না, সুস্থ হয়ে উঠলে যত খুশি জিজ্ঞাসাবাদ করা যাবে।

ওকে আপনি চেনেন না, কমাণ্ডার। কৈ মাছের প্রাণ, ঠাণ্ডা পানির মত সামান্য জিনিসে কিছু হয় না ওর। এই মুহূর্তে হাজির করুন ওকে এখানে। আমি জানতে চাই, ফ্যাসিলিটিতে ঘটেছেটা কী? কে খুন করেছে ড. ডোনেনকেও, নাকি অন্য কেউ?

দরজায় নক হলো এই সময়।

কাম ইন, বললেন ফ্যানিং।

দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল কোস্ট গার্ডের এক জেসিও। কমাণ্ডার ডেকারের দিকে তাকিয়ে বলল, এক্সকিউজ মি, স্যর। জাহাজে একটা ক্রাইসিস দেখা দিয়েছে।

কী ক্রাইসিস?

ব্যাপারটা আমাদের দুই বন্দিকে নিয়ে…

.

খুব একটা সময় দেয়া হয়নি রানা আর রায়হানকে, সশস্ত্র চারজন গার্ডের সামনে দ্রুত জামাকাপড় পরতে হয়েছে, এখন গরু-ছাগলের মত খেদিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে নিউবার্গের হেলিকপ্টার ডেকে। এখনও পুরোপুরি সুস্থ নয় ওরা–শরীর দুর্বল, হাত-পা একটু একটু কাঁপছে। তবে অসুস্থতার মাত্রাটা তারচেয়ে বেশি করে দেখাচ্ছে রানা, কয়েকবার পড়ে যাবার ভান করল ও-দেখা গেল প্রতিবারই কেউ না কেউ এসে ধরে ফেলছে ওকে।

চলতে চলতে চারপাশে নজর বোলাচ্ছে রানা, মুক্তির কোনও উপায় আছে। কি না, সেটা যাচাই করছে। কিন্তু আশার আলো জাগিয়ে তোলার মত তেমন কিছু দেখতে পাচ্ছে না ও। লেফটেন্যান্ট কমাণ্ডার ফ্লিন তার কাজ ভালই জানে, ব্রাইটনের রিসার্চ ফ্যাসিলিটিতে ক্লিকম্যানকে কীভাবে ওরা বোকা বানিয়েছিল, তা-ও শুনেছে হয়তো; সে-কারণে কোনও ফাঁক রাখছে না নিরাপত্তায়। অসুস্থ এবং দুর্বল ভেবে ওদের হ্যাঁণ্ডকাফ পরানো হয়নি বটে, তবে ছোট-খাট একটা প্লাটুন নিয়োগ করা হয়েছে দুই বন্দিকে এসকর্ট করে নিয়ে যাবার জন্য। এসকটদের প্রত্যেকের সাজ দেখে মনে হচ্ছে, যুদ্ধ করতে যাচ্ছে তারা–পুরোদস্তুর ব্যাট ফেটিগ পরেছে। মাথায় রয়েছে হেলমেট, হাতে লোডেড এমপি-ফাইভ মেশিনগান, কোমরের ও ওয়েববেল্টে স্পেয়ার অ্যামিউনিশন, বুকের উপর বুলেটপ্রুফ ভেস্ট, তা থেকে ঝুলছে হ্যাঁণ্ড-গ্রেনেডের গোছা, পিঠে ঝোলানো হ্যাঁভারস্যাকে আরও কত কী আছে, কে জানে! বন্দিদের বুকে ভয় জাগানোই একমাত্র কারণ নয়, উচ্চাভিলাষী এক্স.ও, নিশ্চয়ই এই মহা-আয়োজন দেখিয়ে বুলডগকে মুগ্ধ করবার আশায় আছে। লোকটার এই বাড়াবাড়িটাকেই কীভাবে নিজেদের সুবিধায় পরিণত করা যায়, অসুস্থতার অভিনয় করতে করতে সেটা নিয়ে ভাবছে রানা।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ওয়েদার ডেকে পৌঁছে গেল দলটা। শিপের আফটে নিয়ে যাওয়া হলো রানা আর রায়হানকে। ওখানেই জাহাজের হেলিপ্যাড। অস্ত্রধারী আরও কিছু সেইলরকে নিয়ে সেখানে হিরোর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল লেফটেন্যান্ট কমাণ্ডার ফ্লিনকে–তার পরনেও এসকর্টদের মত যুদ্ধ-পোশাক। পার্থক্য শুধু এই যে, সেইলরদের মত সাবমেশিনগান বহন করছে না সে, সাইড আর্মস্ হিসেবে কোমরের হোলস্টারে শুধু পিস্তল রেখেছে একটা।

বন্দিরা পৌঁছে গেছে দেখে পাশে দাঁড়ানো কমিউনিকেটরের দিকে তাকাল এক্স.ও, ধমকের সুরে জিজ্ঞেস করল, কপ্টারটা এখনও আসছে না কেন?

চলে আসবে, স্যর, কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বলল কমিউনিকেটর। বলল তো এখুনি রওনা হচ্ছে।

আবার যোগাযোগ করো, আমরা এখানে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকব?

মাথা ঝাঁকিয়ে ওয়াকিটকি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল কমিউনিকেটর। সেদিকে তাকিয়ে ধপ করে ডেকের উপর বসে পড়ল রানা, দেখাদেখি রায়হানও। ভাব করছে যেন দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না।

এ কী! বসে পড়লেন কেন? খেঁকিয়ে উঠল ফ্লিন। উঠুন বলছি!

সম্ভব নয়, ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল রানা। আমরা আর পারছি না।

ফাজলামি করবেন না আমার সঙ্গে, হুমকি দিল ফ্লিন। নিজ থেকে দাঁড়ান, নইলে লাথি মেরে ওঠাব।

লাথি কেন, চাইলে গুলিও করে দিতে পারেন, রায়হান বলল। তবে আমাদের জায়গায় থাকলে বুঝতেন, গুলিবিদ্ধ হয়ে আর্কটিকের পানিতে নাকানি-চোবানি খেলে শরীরে শক্তি থাকে কি না।

রেগে গিয়ে আরও কিছু বলতে শুরু করল ফ্লিন, তবে তার গলার আওয়াজ চাপা পড়ে গেল রোটরের, ভারি গর্জনে। চোখ তুলে আইস শেলফের উপর থেকে একটা ডাবল এইচ-সিক্স যিরো মডেলের সিকোরস্কি হেলিকপ্টারকে জাহাজের দিকে নেমে আসতে দেখল রানা। ইউ. এস, কোস্ট গার্ডের সনাতন সাদা-কমলায় রং করা যান্ত্রিক ফড়িংটাকে দেখে ঠোঁটের কোণে চকিতের জন্য একটা হাসি উঁকি দিয়েই মিলিয়ে গেল ওর।

ডাবল এইচ-৬০ আসলে সিকোরস্কির বহুল-ব্যবহৃত এস-সেভেন্টি সিরিজেরই একটা পরিবর্তিত মডেল। আর্মি, নেভি আর এয়ারফোর্সও ব্যবহার করে এই একই হেলিকপ্টার–তবে একেক বাহিনীর প্রয়োজন অনুসারে ডিজাইনে পার্থক্য আছে। আমি যেটা ব্যবহার করে, সেটাকে বলা হয় ব্ল্যাক হক, নেভিরটা সি-হক, বিমান বাহিনী ব্যবহার করে পেভ-হক; আর সবশেষে হলো কোস্ট গার্ডের মডেলটা–নাম জে-হক।

লং-রেঞ্জ সার্চ অ্যাণ্ড রেসকিউ-র জন্য বিশেষভাবে ডিজাইন করা হয়েছে জে-হককে। পঁয়ষট্টি ফুট দীর্ঘ এই আকাশযানটা দশ হাজার কেজি ওজন বইতে পারে, ছুটতে পারে ঘণ্টায় দুইশ মাইল বেগে–বিনা রিফুয়েলিঙে কাভার করতে পারে সাতশ নটিক্যাল মাইল… মানে ডাঙার হিসেবে তেরোশ কিলোমিটার। দূরত্ব। সার্চ অ্যাণ্ড রেসকিউ-র পাশাপাশি এই হেলিকপ্টার ড্রাগ-ট্রাফিক ইন্টারসেপশন, কার্গো লিফট এবং স্পেশাল অপারেশনে ব্যবহার করা হয়।

শিপের উপর এসে হোভার করে স্থির হলো জে-হক, তারপর ধীরে ধীরে নামতে শুরু করল। আরেকবার চেঁচাল ফ্লিন, রানা আর রায়হানকে উঠে দাঁড়াতে বলছে। কাঁধ ঝাঁকাল ওরা, যেন পারবে না। হেলিকপ্টারের চাকাগুলো ডেক ছতেই এই অবাধ্যতা আর সহ্য হলো না এক্স ও-র। এসকর্টদের ইশারা করল। দুই বন্দিকে জোর করে ওঠাতে। অর্ডার পেয়েই এগোতে শুরু করল চারজন সশস্ত্র সেইলর।

রায়হানের দিকে তাকিয়ে কী করতে হবে, সে-ব্যাপারে নির্দেশ দিল রানা… বাংলায়, যাতে অন্যেরা বুঝতে না পারে। শেষে জিজ্ঞেস করল, পারবে তো?

আশা করি, সংক্ষেপে জবাব দিল তরুণ হ্যাকার।

ঠিক আছে, তৈরি থাকো। আমার দিকে চোখ রেখো।

বন্দিদের দু’পাশে এসে দাঁড়িয়েছে লোকগুলো। প্রথমে শুধু মুখে উঠতে বলল, রানারা শুনছে না দেখে দু’জন করে দু’পাশ থেকে চেপে ধরল ওদের-হ্যাঁচকা টানে দাঁড় করিয়ে ফেলল, তারপর টেনে নিয়ে যেতে থাকল ল্যাণ্ড করা হেলিকপ্টারের দিকে।

এভাবে টানাহেঁচড়ায় ব্যথা পাচ্ছে দুই বিসিআই এজেন্ট, তবু একবিন্দু সহযোগিতা করল না সেইলরদের। শরীরের ভার পুরোটাই চাপিয়ে দিল লোকগুলোর হাতে, যেন দু’পায়ে একটুও শক্তি নেই। এমনিতে হয়তো ওদেরকে এভাবে নিয়ে যেতে কষ্ট হতো না চার সেইলরের, কিন্তু এই মুহূর্তে পুরোদস্তুর। ফাইটিং গিয়ার পরে থাকায় তাদের শরীরে অন্তত বিশ পাউণ্ড বাড়তি বোঝা রয়েছে–স্বাভাবিক মুভমেন্টেই অসুবিধে হচ্ছে, তার ওপর জগদ্দল পাথরের মত আচরণ করতে থাকা দু’জন পূর্ণবয়স্ক মানুষকে টানতে গিয়ে ঘাম বেরিয়ে গেল তাদের। মাত্র কয়েক গজ যেতেই হাত ফসকে গেল রানাকে ধরে থাকা একজনের, অন্যজনও পারল না একা ওকে আটকে রাখতে

ডেকের উপর। ধড়াম করে মুখ থুবড়ে পড়ল রানা, ব্যথায় ককিয়ে উঠল। রায়হানকে টানতে থাকা অন্য দু’জনও থেমে গেল শব্দ শুনে।

হোয়াট দ্য হেল… গাল দিয়ে উঠল ফ্লিন, ছুটে এল পড়ে থাকা মানুষটার দিকে, রানা তখন কাতরাচ্ছে। সারাদিন খাওনি কিছু? গায়ে শক্তি নেই কেন? অপরাধীর মত দাঁড়িয়ে থাকা দুই সেইলরকে ধমকে উঠল এক্স.ও।

সরি, স্যর, বলে তাড়াতাড়ি রানাকে আবার তুলতে গেল ওরা।

থামো, বলল ফ্লিন। দেখি নিজে ওঠে কি না। রানার দিকে তাকাল। কী, মি, রানা? পা চালাবেন একটু, নাকি এভাবে আরও দুচারটে আছাড় খেতে চান?

একবারই যথেষ্ট, কাতরানোর সুরে বলল রানা। ধরতে হবে না আর, আমি উঠছি।

বিজয়ীর ভঙ্গিতে অধীনস্থদের দিকে তাকাল ফ্লিন, মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে বোঝাতে চাইল–দেখেছ, কীভাবে তাঁদোড় লোককে শায়েস্তা করতে হয়?

রানা তখন অস্কার পাবার মত অভিনয় করছে–ডেকের উপর পড়ে গিয়ে খুব একটা ব্যথা পায়নি ও, তারপরও ভাব দেখাল যেন এইমাত্র কোনও চ্যাম্পিয়ন রেসলার মাথার উপর তুলে আছাড় মেরেছে ওকে। দুহাত আর হাঁটুতে ভর দিয়ে হামা দেয়ার ভঙ্গিতে প্রথমে স্থির হলো ও, ওটুকুতেই জান বেরিয়ে যাবার চেহারা করল, তারপর কাঁপতে কাঁপতে সোজা হয়ে দাঁড়াতে শুরু করল ধীরে ধীরে।

আড়চোখে পরিস্থিতিটা দেখে নিল রানা, ওর অভিনয়ে সবার মধ্যে সামান্য হলেও ঢিলেঢালা ভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। বিপদের আশঙ্কা করছে না কেউ–অসুস্থ একজন মানুষ… ঠিকমত যে দাঁড়াতেই পারছে না, সে আর কী ঘটাতে পারে? এসকর্টদের অস্ত্র ধরা হাতগুলো একটু নেমে গেছে নীচে, দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে অলস একটা ভাব… এটাই চাইছিল ও। রায়হান তাকিয়ে আছে ওর দিকে, মাথাটা খুব সামান্য ঝাঁকিয়ে ইশারা দিল রানা।

এক্সিকিউটিভ অফিসার দাঁড়িয়ে আছে একদম কাছে, তার কাঁধ পর্যন্ত মাথা তুলল ও দুলতে দুলতে, তারপরই বদলে গেল সবকিছু। সবাই তাকিয়ে ছিল রানার দিকে, কিন্তু এক লহমায় ও যেটা ঘটাল, তা ঠিকমত দেখতে পেয়েছে–এমন কথা কেউ বলতে পারবে না। প্রতিক্রিয়ার তো প্রশ্ন ওঠে না।

কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঝট করে সোজা হলো রানা, অভিনয়ের ইতি ঘটিয়েছে। তলোয়ার চালানোর মত করে একসঙ্গে দুহাত সমান্তরাল ভাবে ছুঁড়ল ও, অবিশ্বাস্য দ্রুততায়। মুভমেন্টটা আসলে কারাতে চপ। দু’পাশে দাঁড়ানো দুই এসকর্টের গলায় পড়ল আঘাত–শ্বাসনালী ভেঙে না গেলেও গুরুতরভাবে জখম হয়েছে। দৃষ্টি বিস্ফারিত হয়ে গেল লোকদুটোর, শ্বাস নিতে পারছে না… হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল ডেকে। তবে সেদিকে নজর নেই রানার, এসকর্টদের অচল করে দিয়েই বিদ্যুৎবেগে হাত বাড়িয়েছে ও লেফটেন্যান্ট কমাণ্ডার ফ্লিনের দিকে–নাগালের মধ্যেই রয়েছে সে। লোকটার ডান কাধ ধরে নিজের দিকে টান দিল রানা, তাল সামলাতে না পেরে আরও কাছে চলে এল এক্স,ও, ব্যালেন্স নষ্ট হয়ে গেছে পুরোপুরি, লাটিমের মত পাক খেয়ে ঘুরে যাচ্ছে একই সঙ্গে। শিকারের পিঠ নিজের দিকে চলে আসতেই আবার ছোবল দিল রানা–বাম হাতটা ফ্লিনের কাঁধের উপর দিয়ে নিয়ে পেঁচিয়ে ধরল গলা, ডান হাতে লোকটার কোমরের হোলস্টার থেকে পিস্তলটা ছোঁ মেরে তুলে নিল। পুরো ব্যাপারটা। ঘটতে সময় লাগল দুসেকেণ্ডেরও কম!

রায়হানের দিকে তাকাল রানা–নিজেকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে তরুণ হ্যাকারও, একটা কাঁধ অবশ থাকলেও অসুবিধে হয়নি। একজন এসকর্টের থুতনিতে মাথা দিয়ে সজোরে আঘাত করেছে ও, ভাল হাতটা দিয়ে অন্যজনের উরুসন্ধিতে ঘুসি মেরেছে-ওকে ছেড়ে দিয়ে আঘাত সামলাতে ব্যস্ত লোকদুটো।

ঘটনার আকস্মিকতায় বোবা বনে গেছে হেলিপ্যাডে দাঁড়ানো সব লেক। হঠাৎ সংবিৎ ফিরে পেল তারা, হাতের অস্ত্র তুলে তাক করল দুই বন্দির দিকে।

বোকামি কোরো না, হুমকির সুরে বলল রানা, হাতের পিস্তলটা নাড়ল। কেউ স্মার্টনেস দেখাতে চেষ্টা করলে গুলি করে তোমাদের এক্স.ও-র খুলি। উড়িয়ে দেব।

নিজেরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করল অস্ত্রধারী লোকগুলো, কী করবে বুঝতে পারছে না। রানার কনুইয়ের ভাজে জুডো ফ্লিপে আটকা পড়েছে ফ্লিন, নড়াচড়া করার উপায় নেই। গলায় চাপ পড়ায় দম নিতে হাঁসফাস করছে, কথা বলা বা অর্ডার দেবার তো প্রশ্নই ওঠে না–এই মুহূর্তে তাই লোকগুলো নেতৃত্বশূন্য।

কাছে আসার চেষ্টা কোরো না, যোগ করল রানা। আর্মস ফেলে দাও সবাই।

দ্বিধা দেখা গেল এসকর্টদের চেহারায়, হুকুম তামিল করবে কি না–সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। ফ্লিনের গলার উপর থেকে চাপ একটু কমাল রানা। বলল, ওদেরকে বলুন, আমার কথামত কাজ করতে। নইলে আপনিই ভুগবেন।

কিচ্ছু বলব না আমি! সরোষে বলল ফ্লিন। কত বড় ভুল করছেন, তা জানেন না আপনি, মি. রানা। এখনও সময় আছে, আমাকে ছেড়ে দিন।

আর তা হলেই বুঝি বেকসুর খালাস পেয়ে যাবো? বিদ্রূপ করল রানা। পরিস্থিতিটা কী ধরনের–সেটা আপনারই বরং জানা নেই, মিস্টার। সিআইএ থেকে যে ভদ্রলোক এসেছেন, তার হাতে পড়া চলবে না আমাদের কিছুতেই। আমরা এখন মরিয়া, দয়া করে নিজের বিপদ ডেকে আনবেন না বাধা দিতে গিয়ে। কথা শুনুন–সেটাই আপনার জন্য মঙ্গল হবে।

মরিয়া হয়ে কোনও লাভ নেই, মি. রানা। যাবার কোনও জায়গা নেই আপনাদের। আত্মসমর্পণ করুন!

অ! কথা শুনবেন না তা হলে? কঠিন হয়ে উঠল রানার গলা। একরোখা লোকটাকে বশ করতে গেলে নিষ্ঠুর না হয়ে উপায় নেই। এক্স.ও-র ডান হাতের মাংসপেশিতে পিস্তলের নল ঠেকিয়ে গুলি করল ও।

চিৎকার করল ফ্লিন, বুলেটটা তার বাইসেপ ফুটো করে বেরিয়ে গেছে। হিসেব করে গুলিটা করেছে রানা, আঘাতটা সিরিয়াস নয়–একটু ট্রিটমেন্ট পেলেই কয়েকদিনের মধ্যে সেরে যাবে। তবে এ-মুহূর্তে অসহ্য ব্যথায় চেঁচাচ্ছে ফ্লিন–জীবনে এই প্রথম গুলি খেয়েছে সে।

লোকটার কানের কাছে মুখ নিয়ে রানা বলল, আমি যে সিরিয়াস, সেটা বুঝতে পেরেছেন এখন? সবাইকে বলুন আর্মস ফেলে দিতে। নইলে পরের গুলিটা মগজে ঢুকবে।

কাতরাতে কাতরাতে মাথা ঝাঁকাল ফ্লিন। অধীনস্থদের দিকে তাকিয়ে বলল, ড্রপ আর্মস… ড্রপ আর্মস!

ডেকের উপর ঝন ঝন আওয়াজ উঠল অস্ত্র ফেলার। রানা আদেশ দিল, বাড়তি অ্যামিউনিশন আর গ্রেনেডগুলোও ফেলো।

নির্দ্বিধায় তা-ও মেনে নিল সেইলররা। তারপর রানার নির্দেশে চলে যেতে বাধ্য হলো হেলিপ্যাড থেকে।

রায়হান এগিয়ে গিয়ে ডেকের উপর থেকে গোলাবারুদ সংগ্রহ করছে, সেদিকে তাকিয়ে রানা বলল, গ্রেনেড নাও যে-কটা পারো।

যুদ্ধ করবেন ভাবছেন নাকি? অবজ্ঞার ছাপ ফুটল ফ্লিনের গলায়। দিবাস্বপ্ন দেখে লাভ নেই। শুধু কোস্ট গার্ড নয়, যুক্তরাষ্ট্রের আর্মি, নেভি, এয়ারফোর্স থেকে শুরু করে সমস্ত বাহিনী আপনাদের শিকার করতে বের হবে। ওই কটা অস্ত্র দিয়ে কিছু করতে পারবেন না, বেঘোরে মারা পড়বেন।

সেটা সময় হলেই দেখা যাবে রানা হাসল, জিম্মিসহ ল্যাণ্ড করা কপ্টারের দিকে ফিরল ও, পিস্তল তাক করল ককপিটের দিকে। প্লেক্সিগ্নাসের ওপাশে পাইলটের চোখে আতঙ্ক ফুটতে দেখা গেল, রানার ইশারায় তাড়াতাড়ি ডেকে নেমে এল সে।

ভাগো, সংক্ষেপে বলল রানা।

পড়িমরি করে ছুটে পালাল পাইলট।

রায়হানের কাজ শেষ হয়েছে। দুটো এমপি-ফাইভ জোগাড় করেছে ও, একটা হ্যাঁভারস্যাকে নিয়েছে বাড়তি অ্যামিউনিশন আর গ্রেনেড। পাশে এসে রিপোর্ট করার ভঙ্গিতে বলল, আমি রেডি।

হেলিকপ্টারটা ওড়াতে পারবে? হাতের কারণে অসুবিধে হবে না তো?

পারব, আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল রায়হান-বিসিআই এজেন্ট হিসেবে সব ধরনের আকাশযান চালানোর ট্রেইনিং পেয়েছে ও। কিন্তু আপনি কী করবেন? এই ভদ্রলোককে জিম্মি হিসেবে সঙ্গে নিচ্ছি নাকি? ওঁকে পাহারা দেবেন?

উঁহুঁ, ওঁর সঙ্গে এখানেই আমাদের বিচ্ছেদ হতে যাচ্ছে, রানা বলল।

হেলিকপ্টারে রায়হানের চড়ে বসা পর্যন্ত অপেক্ষা করল ও, তারপর বলল, গুড বাই, লেফটেন্যান্ট কমাণ্ডার ফ্লিন!

যান, খেপাটে গলায় বলল এক্স.ও। আর তো জ্যান্ত দেখব না আপনাকে, তবে কবরে ফুল দিতে যাব নিশ্চয়ই।

খুব খুশি হব তা হলে, হাসিমুখে বলল রানা, তারপর পিস্তলের বাঁট দিয়ে সজোরে আঘাত করল লোকটার ঘাড়ে। জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল ফ্লিন।

লাফ দিয়ে কপ্টারে উঠল রানা। লেটস গো, রায়হান!

কোনদিকে যাব? টেকঅফ করতে করতে প্রশ্ন করল তরুণ হ্যাকার।

পরে বলছি। আগে জাহাজকে ঘিরে চক্কর দাও কয়েকটা। যাবার আগে কয়েকটা কাজ সেরে নিতে হবে আমাদের।

.

ওয়াকিটকিতে নিউবার্গের ডিউটি অফিসারের সঙ্গে কথা বলছেন কমাণ্ডার ডেকার-তরুণ এক লেফটেন্যান্ট সে, নাম এড্রিয়ান কনর। চাকরিতে অভিজ্ঞতা খুব কম লেফটেন্যান্টের, রিপোর্ট দিচ্ছে কাঁপা কাঁপা গলায়। স্পিকারে তার গলায় কী ঘটেছে শুনতে পেয়ে স্থবির হয়ে গেছে রিসার্চ ফ্যাসিলিটির ডিরেক্টরের। অফিসে বসা প্রতিটা মানুষ। ব্যাপারটা বিশ্বাসই করতে পারছে না কেউ-কোস্ট গার্ডের মত সুশৃঙ্খল একটা বাহিনীর হাত থেকে কেউ পালায় কীভাবে! তবে ঘটনার শেষ হয়নি এখনও। ওয়াকিটকিতে হঠাৎ করে গোলাগুলির শব্দ ভেসে এল।

স্যর! স্পিকারে ডিউটি অফিসারের চিৎকার শোনা গেল। ওরা আমাদের দিকে গুলি করছে।

হোয়াট! গর্জে উঠল বুলডগ। ওরা সব বসে বসে আঙুল চুষছে নাকি? পাল্টা গুলি করতে বলুন!

মাথা ঝাঁকালেন ডেকার। রেডিওতে নির্দেশ দিলেন, চুপচাপ বসে থেকো না। রিটার্ন ফায়ার!

ইয়েস, স্যর!

পরমুহূর্তেই বিস্ফোরণের মত প্রচণ্ড আওয়াজ হলো। ওয়াকিটকিতে আর্তনাদের মত করে উঠল লেফটেন্যান্ট কনর। হা ঈশ্বর! ওরা গ্রেনেড ফাটাচ্ছে!

চোখে বিস্ময় নিয়ে বুলড়গের দিকে ফিরলেন কমাণ্ডার ডেকার। লোকগুলো কি পাগল নাকি? পালাচ্ছে পালাক, কিন্তু এভাবে যুদ্ধ বাধিয়েছে কেন?

নিশ্চয়ই কোনও উদ্দেশ্য আছে, বুলডগ বলল। কারণ ছাড়া একটা আঙুলও নাড়ায় না মাসুদ রানা।

কী করা যায়; সে-ব্যাপারে কোনও পরামর্শ আছে আপনার?

পরামর্শ না, অ্যাকশনই নিচ্ছি আমি, ফ্যাসিলিটির ডিরেক্টরের দিকে তাকাল বুলডগ। আমার সঙ্গে যে ফাইটার পাইলট এসেছে, তাকে খবর দিন। এক্ষুণি টেকঅফ করতে হবে ওকে। দেখি, শালার মাসুদ রানা কীভাবে একটা জেট ফাইটারের সঙ্গে যুদ্ধ করে।

গুড আইডিয়া, মি, বুলক, স্বীকার করলেন কমাণ্ডার ডেকার।

মাথা ঝাঁকিয়ে ইন্টারকম নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন লায়াল ফ্যানিং–পাইলটকে খবর পাঠাচ্ছেন, একই সঙ্গে একটা ট্রাক্টর রেডি করবার নির্দেশ দিচ্ছেন লোকটাকে এয়ারস্ট্রিপে পৌঁছে দেয়ার জন্য।

এক্স.ও. কোথায়? ডিউটি অফিসারের কাছে জানতে চাইলেন ডেকার।

সিক বেতে, স্যর। ওঁর এখনও জ্ঞান ফেরেনি। তবে ইনজুরিটা সিরিয়াস নয় বলে শুনলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেন্স ফিরে আসবে বলে আশা করছেন ডক্টর।

তা হলে ততক্ষণ তোমাকেই সামলাতে হবে সব, কনর। ডিফেণ্ড দ্য শিপ! প্রয়োজনে যে-কোনও ধরনের ফোর্স ব্যবহার করতে অনুমতি দিচ্ছি তোমাকে।

গোলাগুলি আর গ্রেনেডের জন্য আমরা তো ডেকে বেরুতেই পারছি না, স্যর! কীভাবে ডিফেণ্ড করব?

কথাটা শুনতে পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল বুলডগ, গাধা নাকি? পোর্টহোল দিয়ে গুলি করতে পারছে না?

পোর্টাল… বললেন ডেকার। সেই সঙ্গে যত ওপেনিং আছে, সেগুলো দিয়ে গুলি করো।

ওভাবে ওদের আদৌ কোনও ক্ষতি করা যাবে বলে মনে হয় না।

তাতে অসুবিধে নেই। শুধু ব্যস্ত করে রাখো কিছুক্ষণ, আমাদের এখানে একটা এফ-১৪ ফাইটার আছে। ওটা যাচ্ছে তোমাদের সাহায্য করতে।

করছেনটা কী আপনি! বিস্মিত গলায় বলল বুলডগ।

কেন? থতমত খেয়ে গেলেন ডেকার। কী হয়েছে?

ওপেন চ্যানেলে আমার প্ল্যান ফাঁস করে দিলেন? রাগী গলায় বলল বুলডগ। হেলিকপ্টারের রেডিওতে সব কমিউনিকেশন মনিটর করছে নিশ্চয়ই। মাসুদ রানা। এখন ও কী করবে, বুঝতে পারছেন?

দাঁত দিয়ে জিভ কাটলেন কমাণ্ডার, ভুলটা ধরতে পেরেছেন। বুলগের আশঙ্কাকে সত্যি প্রমাণ করার জন্যই যেন কয়েক মুহূর্তের মধ্যে লেফটেন্যান্ট কনর রিপোর্ট দিল, হামলা থেমে গেছে, স্যর। রোটরের আওয়াজও হালকা হয়ে যাচ্ছে… চলে যাচ্ছে কপ্টারটা।

কোথায় যাচ্ছে এক্ষুণি দেখো।

আইস শেলফ… আইস শেলফের দিকে যাচ্ছে…

শিট! গাল দিয়ে উঠল বুলডগ, বসা থেকে তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল, তারপর দরজা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল।

প্রবীণ কমাণ্ডার তাড়াতাড়ি রেডিওতে নির্দেশ দিলেন, আলাস্কায় আমাদের সিটকা আর কোডিয়াক এয়ার স্টেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করো। উই নিড ব্যাকআপ।

ইয়েস স্যর।

কথা শেষ করে করিডরে বেরিয়ে এলেন কমাণ্ডার ডেকার, বুলগের পথ। ধরে ছুটতে শুরু করলেন নিজেও। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলেন গ্যারাজে।

ফাইটারের পাইলট তখনও রওনা হতে পারেনি, ডগলাস বুলকের হাঁকডাকে পুরো জায়গাটা থর থর করে কাঁপছে। একটু পরেই রেডি হয়ে গেল একটা আইস-ট্রাক্টর, পাইলটকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ডোম থেকে।

বিশাল আকারের যানটার পিছু পিছু র‍্যাম্প ধরে বেরুল বুলডগও–খোলা প্রান্তরে গিয়ে পুরো ব্যাপারটা নিজ চোখে দেখতে চায়। ডেকার তাকে অনুসরণ করলেন।

সারফেসে পা দিতে না দিতেই হেলিকপ্টারের রোটরের আওয়াজ শোনা গেল। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই আইস শেলফের একপাশ থেকে উঠে আসতে দেখা গেল জে-হককে… দূর থেকে বিশাল এক ফড়িঙের মত দেখাচ্ছে ওটাকে। একটু হোভার করল ওটা, তারপরই টার্গেট দেখতে পেয়ে টার্ন করল–ছুটছে এখন মেকশিফট এয়ারস্ট্রিপটার দিকে। ওখানেই ল্যাণ্ড করে আছে এফ-১৪ আর সকালে আসা ডিসি-থ্রিটা।

ট্রাক্টরে অস্ত্রসহ দু’জন বাড়তি লোক দিয়েছে বুলডগ, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবার জন্য একটা ওয়াকিটকি নিয়েছে সঙ্গে। সেটটা মুখের কাছে তুলে সে চেঁচাল, ট্রাক্টর টিম… ফায়ার করো! ফায়ার করো!! কপ্টারটাকে পৌঁছুতে দিয়ো না!!!

লাভ নেই, স্যর, ওপাশ থেকে জবাব ভেসে এল। ওরা আমাদের এফেক্টিভ রেঞ্জের বাইরে আছে, স্পিডও অনেক বেশি। গুলি তো লাগবেই না, মাঝখান থেকে শুধু শুধু বুলেট নষ্ট হবে।

শাট আপ! হুঙ্কার দিল বুলডগ। লেকচার দিতে পাঠাইনি তোমাদের… পাঠিয়েছি অর্ডার ফলো করতে। আমি বলছি–ফায়ার!

ট্র্যাক্টরের জানালা দিয়ে গুলি করতে শুরু করল দুই অস্ত্রধারী, অস্ত্রের গর্জনে কেঁপে উঠল পুরো আইস শিট। তবে জে-হকের গায়ে একটা বুলেটও লাগেনি, আগের মতই ছুটতে থাকল এয়ারস্ট্রিপের দিকে।

ফায়ার, গাধার বাচ্চারা! ফায়ার!! ওয়াকিটকিতে চেঁচাচ্ছে বুলডগ। লাগাতে না পারিস, অন্তত ওদেরকে ব্যস্ত করে রাখ কিছুক্ষণ।

সিআইএ কর্মকর্তার পাগলাটে আচরণ দেখে কিছু বলা থেকে বিরত থাকলেন কমাণ্ডার ডেকার–সেধে গালাগাল শোনার মানসিকতা নেই তার। তবে পরিষ্কার বুঝতে পারছেন, খামোকাই হল্লা করছে লোকটা, এয়ারস্ট্রিপে পৌঁছুনো থেকে জে-হকটাকে ঠেকানোর কোনও উপায়ই নেই।

পোড় খাওয়া অধিনায়কের ধারণাই ঠিক প্রমাণিত হলো–কয়েক মিনিটের ভিতরেই ল্যাণ্ড করা দুই আকাশযানের উপরে পৌঁছে গেল রানাদের হেলিকপ্টারটা। এর পর শুরু হলো তাণ্ডব। শিপের উপর এতক্ষণের গোলাগুলি কিছুই ছিল না, এবার জে-হক থেকে এমপি-ফাইভ দিয়ে যা করা হলো, সেটাকে কেবল মুষলধারে বৃষ্টির সঙ্গেই তুলনা করা যেতে পারে।

অটোমেটিক মেশিনগানের গুরুগম্ভীর আওয়াজ চাপা দিয়ে ফেলল রোটরের শব্দকে, এর সঙ্গে যুক্ত হলো গ্রেনেড বিস্ফোরণের মুহূর্মুহূ গর্জন-যেন প্রলয়ঙ্করী কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ বয়ে যাচ্ছে মন্টেগো আইস শেলফের উপর দিয়ে। এফ-১৪ আর ডিসি-থ্রির উপর এয়ার রেইড চালাচ্ছে জে-হক, অস্ত্র হিসেবে। বিমানের বিরুদ্ধে এমপি-ফাইভ, তেমন ভারি কিছু না হলেও ক্রমাগত গুলি করতে পারায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে; এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গ্রেনেডগুলো। টানা দশ মিনিট হামলাটা চালিয়ে গেল রানারা, তারপর ক্ষান্ত হলো।

বিস্মিত দৃষ্টিতে জে-হককে দিক পাল্টে ডোমের দিকে ছুটে আসতে দেখল বাইরে দাঁড়ানো দর্শকরা। ইতোমধ্যে দুই কর্তাব্যক্তির পিছু পিছু কোস্ট গার্ডের বেশ কিছু সেইলর আর ফ্যাসিলিটির সিকিউরিটি গার্ড বেরিয়ে এসেছে। তাদের দিকে তাকিয়ে বুলডগ বলল, যার যার কাছে অস্ত্র আছে, তা নিয়ে পজিশন নাও। কপ্টারটা এদিকে আসছে যখন, ওটাকে ঘায়েল করব আমরা।

এদিকে আসছে কেন? বোকা বোকা কণ্ঠে নিজেকেই যেন প্রশ্ন করলেন। কমাণ্ডার ডেকার।

কথাটার জবাব দেয়ার প্রয়োজন মনে করল না বুলডগ, কাছে দাঁড়ানো এক সেইলরের হাত থেকে ছোঁ মেরে কেড়ে নিল একটা মেশিনগান, তারপর ব্ল্যাম্পের আড়ালে পজিশন নিয়ে অন্যদেরও তা-ই করতে নির্দেশ দিল।

 এলোমেলো গুলি ছুঁড়ো না কেউ, হুঁশিয়ার করে দিল বুলডগ। আমি বলব কখন-কোথায় শুট করতে হবে।

সেইলররা পজিশন নিয়ে ফেলেছে–রাম্পের পাশে চারজন, গ্যারাজের ভাঙা • একজিট ডোরের ফোকরের পাশে আরও তিনজন। সবার হাতে অটোমেটিক মেশিনগান-রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে আসন্ন লড়াইটার জন্য, তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে জে-হকের আকৃতি, ডোমের সঙ্গে দূরত্ব কমে আসছে ক্রমেই।

এসো, মাসুদ রানা, বিড়বিড় করল বুলডগ। আজ একটা বোঝাপড়া হবে তোমার সঙ্গে।

মনের আশাটা পূর্ণ হলো না বেচারার–এতক্ষণ সরলরেখা ধরে গ্যারাজের দিকেই আসছিল হেলিকপ্টারটা, কিন্তু কাছাকাছি পৌঁছে আচমকা দিক বদলাল। এবার অর্ধবৃত্তাকার একটা পথ ধরে ডোমের অন্যদিকে চলে যাচ্ছে জে-হক, একই সঙ্গে বাড়াচ্ছে উচ্চতা। এক পলকের জন্য জানালায় রানার চেহারা দেখতে পেল বুলডগ-ওর দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছে! বোঝা গেল, লড়াইয়ে নামার কোনও ইচ্ছেই নেই বাঙালি ছোকরার, বিনা রক্তপাতে কার্যসিদ্ধি করতে চাইছে… সে-কারণেই অন্যপাশ হয়ে ডোমের উপরে যাচ্ছে। কিন্তু স্পাইয়ের বাচ্চার উদ্দেশ্যটা কী?

কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই দৃষ্টিসীমার আড়ালে চলে গেল জে-হক-ডোমের উপরে চলে গেছে, দেখা যাচ্ছে না আর। ওখানে কী করছে ওটা, ভেবে পেল না বুলডগ। একটু পরেই কানে ভেসে এল নতুন করে উপযুপরি গুলি আর বিস্ফোরণের শব্দ… আবারও হামলা শুরু করা হয়েছে। আশপাশে কোথাও বরফ ছিটকাতে না দেখে বিস্মিত হলো ব্যুরো চিফ, আক্রমণটা ডোমের উপরের অংশে করা হচ্ছে! দৌড়ে আড়াল থেকে বেরিয়ে এল সে, র‍্যাম্প ধরে ছুটে গিয়ে ঢুকল গ্যারাজে। সামনে পড়লেন লায়াল ফ্যানিং, হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে আছেন।

উপরে কী আছে? জিজ্ঞেস করল বুলডগ।

অ্যাঁ! যেন ঘোরের মধ্যে আছেন ফ্যাসিলিটির ডিরেক্টর, প্রশ্নটা বুঝতেই পারছেন না।

গাধার মত দাঁড়িয়ে থাকবেন না! ধমকে উঠল বুলডগ। জবাব দিন প্রশ্নের! ডোমের উপরে কী আছে?

… কিছু না, থতমত খেয়ে বললেন ফ্যানিং। শুধু আমাদের কমিউকেশনের ডিশ অ্যান্টেনা ছাড়া আর কিছু নেই ওখানে।

ডিশ অ্যান্টেনা! আঁতকে উঠল বুলডগ। এতক্ষণে রানার মতলব বুঝতে পেরেছে সে–সব ধরনের কমিউনিকেশন-ব্যবস্থা নষ্ট করে দিচ্ছে ও।

কমাণ্ডার ডেকারও বুলডগের পিছে পিছে হাঁপাতে হাঁপাতে ঢুকেছেন গ্যারাজে, ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন তিনিও। তাড়াতাড়ি ওয়াকিটকি মুখের কাছে তুলে শিপের ডিউটি অফিসারকে ডাকলেন, কনর, সিটকা বা কোডিয়াক স্টেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছ?

নেগেটিভ, স্যর, জবাব দিল তরুণ লেফটেন্যান্ট। গুলি আর গ্রেনেড বিস্ফোরণে আমাদের সমস্ত কমিউনিকেশন অ্যান্টেনা ড্যামেজ হয়ে গেছে… মনে হচ্ছে ওগুলোকেই টার্গেট করেছিল ওরা।

কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, বলতে পারো?

আমরা এখনও ড্যামেজ অ্যাসেসমেন্ট করছি, স্যর। তবে এই মুহূর্তে ডিসট্রেস সিগনাল পাঠাবার অবস্থায়ও নেই আমরা।

শিট! গাল দিয়ে উঠলেন ডেকার। যত তাড়াতাড়ি পারো কমিউনিকেশন চালু করো, কনর। কুইক!

আমরা চেষ্টা করছি, স্যর। তবে দুঘণ্টার আগে একটা সেটও চালু করা যাবে বলে মনে হচ্ছে না।

ততক্ষণে ওরা পগার পার হয়ে যাবে, কনর। রিপেয়ার কমপ্লিট হওয়া চাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব…

আর শোনার প্রয়োজন মনে করল না বুলডগ। নিজের ওয়াকিটকিতে ফাইটার পাইলটের সঙ্গে যোগাযোগ করল। তোমরা পৌঁছেছ?

ইয়েস, মি, বুলক।

রিপোর্ট দাও–ফাইটারটা নিয়ে টেকঅফ করতে পারবে?

অসম্ভব, স্যর। গুলি করে ক্যানোপি ভেঙে ফেলেছে ওরা, তারপর ককপিটের ভিতরে গ্রেনেড ফেলেছে-কনসোল বলে কিছু অবশিষ্ট নেই।

আর ডিসি-থ্রি?

ওটার টেইল ফিনের অ্যালেরন গুঁড়িয়ে দিয়েছে গুলিতে। টেকঅফ হয়তো করা যাবে, কিন্তু নাক বরাবর ছাড়া আর কোনও দিকে মুভ করতে পারবে না বিমানটা।

শোকে পাথর হয়ে গেল বুলডগ, চেঁচাচ্ছে না আর। সর্বনাশটা বুঝতে আর বাকি নেই তার–ফাইটার আর ডিসি-থ্রি অচল, তারমানে জে-হকটাকে ধাওয়া করা সম্ভব নয় কোনওমতেই। দুঘণ্টার আগে কমিউনিকেশনও চালু হচ্ছে না, অথচ এক থেকে দেড় ঘণ্টার মধ্যে আলাস্কা বা কানাডার উত্তর উপকূলের যে-কোন জায়গায় পৌঁছানোর ক্ষমতা আছে হেলিকপ্টারটার। কারও সঙ্গে যোগাযোগ করে যে ওদের ইন্টারসেপ্ট করতে বলবে, সে উপায় নেই।

গোলাগুলি আর বিস্ফোরণের শব্দ থেমে গেছে লক্ষ করে র‍্যাম্পে বেরিয়ে এল বুলড়গ। ডোমের উপর থেকে সরে গেছে হেলিকপ্টারটা, ওটাকে দক্ষিণ-পূর্বমুখী একটা কোর্স ধরে আইস, শেলফ থেকে চলে যেতে দেখল। সঙ্গে থাকা লোকজনকে গুলি করতে আর বলল না সে, তাতে লাভ নেই কোনও; নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল শুধু অপসৃয়মাণ যান্ত্রিক ফড়িংটার দিকে। আরও একবার তাকে ঘোল খাইয়ে পালিয়ে যাচ্ছে মাসুদ রানা, অসহায়ের মত চেয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করার নেই বুলডগের।

বুকের ভিতরে একটা চাপা ক্রোধ তড়পাচ্ছে, কিন্তু সেটাকে বেরিয়ে আসতে দিল না সে। বিড়বিড় করে শুধু বলল, রানা, তোমার শেষ না দেখে আমি ছাড়ব না!

.

০৪.

০৫ মে। অ্যামস্টারড্যাম, হল্যাণ্ড।

দ্বাদশ শতাব্দীতে ছোট্ট একটা জেলে-গ্রাম হিসেবে গোড়াপত্তন হওয়া জনপদটা কালের পরিক্রমায় এখন পরিণত হয়েছে গোটা একটা দেশের রাজধানীতে। অ্যামস্টারড্যাম আজ ইয়োরোপের সবচেয়ে বড় শহরগুলোর একটা–পুরো মহাদেশের শিল্প আর বাণিজ্যের একটা প্রধান প্রাণকেন্দ্র। নৈসর্গিক আর স্থাপত্য সৌন্দর্যের দিক থেকেও খুব একটা পিছিয়ে নেই এই মহানগরী, কাব্যিক পরিবেশের অপূর্ব শহর ভেনিসের সঙ্গে প্রায়ই তুলনা করা। হয় অ্যামস্টারডামের প্রাচীন অংশটাকে।

সকাল সাড়ে আটটায় এই রাজধানীর বিশ্ববিখ্যাত শিফল এয়ারপোর্টে ল্যাণ্ড করল কে.এল.এম-এর একটা সুপরিসর বোয়িং-কানেক্টিং ফ্লাইট এটা, এসেছে ব্রাযিলের রিয়ো ডা জেনিরো থেকে পর্তুগালের লিসবান হয়ে। ট্যাক্সিং করে ধীরে ধীরে টার্মিনাল ভবনের পাশে এসে দাঁড়াল ওটা, এবার বিল্ডিঙের শরীর থেকে একটা ক্রোকোডাইল ডিসএম্বারকেশন টিউব! প্রসারিত হয়ে এসে ঠেকল বিমানের ফ্রণ্ট একজিটের চারপাশে।

একটু পরেই খুলে দেয়া হলো দরজা, পিল পিল করে বেরিয়ে আসতে শুরু করল যাত্রীরা-লম্বা জার্নির ক্লান্তি সবার চোখেমুখে, চলাফেরায় তাড়াহুড়ো দেখে বোঝা যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যার যার গন্তব্যে গিয়ে বিশ্রাম নিতে চায়। এসব যাত্রীর ভিড়ে রয়েছে প্রায় ছ’ফুট লম্বা এক-অশ্বেতাঙ্গ যুবক, গায়ের চামড়া রোদে পোড়া তামাটে রঙের। এমনিতে কালো চুল ব্যাকব্রাশ করে রাখে সে, তবে এ-মুহূর্তে এলোমেলো হয়ে আছে তার ঘন কেশরাজি। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা রয়েছে। তার, নাকের নীচে মাঝারি আকৃতির একটা গোফ জুলফিটা বেশ লম্বা, নাকের গড়ন একটু বাঁকা, যেন কোনওকালে বেমক্কা ঘুসি খেয়ে চিরতরে স্বাভাবিক আকৃতি হারিয়েছে ওটা। অবশ্য এই চেহারা যে পুরোপুরিভাবেই মেকাপ-আর্টিস্টের গড়া, তা কল্পনা করতে পারবে না কেউ। দীর্ঘ ষোলো ঘণ্টা একসঙ্গে জার্নি করলেও সহযাত্রীদের কারও জানা নেই, ছদ্মবেশের আড়ালে অত্যন্ত সুপুরুষ এক বাঙালি যুবক লুকিয়ে আছে, যার দিকে একবার চোখ পড়লে পলক ফেলা কঠিন, তরুণীরা, ওকে দেখে নিজের অজান্তেই দুর্বল হয়ে পড়ে।

মাসুদ রানা!

দরজায় দাঁড়ানো ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্টের বিদায় সম্ভাষণের জবাবে ভদ্রতাসূচক একটা হাসি দিয়ে একজিট দিয়ে বেরিয়ে এল ও, ডিসএম্বারকেশন টিউব ধরে এগোতে শুরু করল সামনে, অন্যান্য যাত্রীদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে।

সংকীর্ণ প্যাসেজটার বিভিন্ন জায়গায় নিয়মমাফিক দাঁড়িয়ে আছে বেশ কজন। এয়ারপোর্ট অফিশিয়াল–যাত্রীদের সুবিধা-অসুবিধা… সেই সঙ্গে নিরাপত্তা নিশ্চিত করবার দায়িত্ব তাদের কাঁধে। লোকগুলোর উপস্থিতি অস্বাভাবিক কিছু নয়, তারপরও সতর্ক দৃষ্টি বোলাল রানা সন্দেহজনক কোনও আচরণ করে কি কেউ, সেটা খেয়াল রাখছে।

দুশ্চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে রানার মাথা। রায়হানের হিসেব অনুসারে। হল্যাণ্ডের স্থানীয় সময় আগামীকাল রাত দুটোয় আঘাত হানবে ইউনো-ভাইরাস, শুরু হয়ে যাবে সাইবার জগতের প্রলয়কাণ্ড। সব মিলিয়ে হাতে সময় আছে ষোলো ঘণ্টার মত, অথচ অ্যাসাইনমেন্টে ওদের অগ্রগতি কিছু হয়নি বললেই চলে। আগে যেখানে ছিল, এখনও সেখানেই রয়ে গেছে। অ্যান্টি-ভাইরাসটা এখনও কাউকে দিয়ে তৈরিই করাতে পারেনি, বিলি করা তো অনেক পরের কথা। দশজনের মধ্যে আটজন ইউনো আগেই মারা পড়েছেন, নবম জন… ড. স্ট্যানলি ডোনেনের খোঁজ পেয়েছিল ও, কিন্তু তাকে রক্ষা করতে পারেনি। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে রানার, সেই সঙ্গে মনের ভিতরে একটা চাপা ক্রোধও অনুভব করছে–খুনীদের নিজ হাতে শায়েস্তা না করা পর্যন্ত তা থামবে না। কিন্তু সেটা আদৌ সম্ভব কি না, বোঝা যাচ্ছে না। পুরো ব্যাপারটার পিছনে কে কলকাঠি নাড়ছে, সেটা জানা যায়নি এখনও… প্রতিশোধ নেয়া বা শায়েস্তা করার জন্য শক্রর পরিচয় তো জানতে হবে প্রথমে!

পুরো মিশনটা আরও কঠিন করে তুলেছে ডগলাস বুলক। মণ্টেগো আইস। শেলফ থেকে পালাবার পর কেটে গেছে প্রায় আটচল্লিশ ঘণ্টা–এই সময়টা সক্রিয়ভাবে রহস্য-সমাধানের কাজে ব্যবহার করতে পারেনি রানা আর রায়হান… সেটা বুলডগের কারণে। ওদের কাছে ঘোল খাওয়ায় প্রচণ্ড ধাতানি দিয়েছে তাকে সিআইএ চিফ, আবার ডিমোশনের হুমকি দিয়েছে; এখন রানার ওপর আক্রোশ মেটাবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে লোকটা। আশ্চর্যের ব্যাপার, যা ঘটেছে তার জন্য সম্পূর্ণ দায়ী করছে সে নিজেকে নয়, মাসুদ রানাকে। এই খেপা কুকুরের চোখে ধুলো দেয়ার ব্যবস্থা করতে হয়েছে ওদের, নষ্ট হয়েছে। মূল্যবান অনেকটা সময়।

কোস্টগার্ডের হেলিকপ্টারটা নিয়ে আলাস্কার সীমান্তে একটা জনমানবহীন পাহাড়ী এলাকায় নেমেছিল ওরা–আকাশযানটাকে দুই পাহাড়ের মাঝখানে একটা সংকীর্ণ গিরিখাতে ল্যাণ্ড করিয়েছে, তারপর গাছপালার ভাঙা ডাল আর পাতা দিয়ে ক্যামোফ্লাজে ঢেকেছে। ওখান থেকে পায়ে হেঁটে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ওরা ঢুকেছে কানাডায়। পুরোপুরি সুস্থ ছিল না দু’জনের কেউ, পরিশ্রমে শারীরিক সহ্যশক্তির শেষসীমায় পৌঁছে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত অনেক কষ্টে একটা ছোট্ট সীমান্ত-শহরে পৌঁছায় ওরা, সেখান থেকে টেলিফোনে রানা এজেন্সির মন্ট্রিয়ল শাখার স্ক্র্যাম্বলড় লাইনে যোগাযোগ করে রানা। শাখাপ্রধান আহসান হাবিব আগে থেকেই স্ট্যাণ্ডবাই ছিল ড. ডোনেনসহ ওদেরকে মণ্টেগো আইস শেলফ থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসবার জন্য, ফোন পাওয়ামাত্র বিমান পাঠিয়ে দেয় ছোট্ট শহরটার কাছাকাছি একটা এয়ারফিল্ডে। ওটায় চড়ে মন্ট্রিয়লে পৌঁছায় রানা আর রায়হান, আশ্রয় নেয় এজেন্সির একটা সেফ হাউজে।

ওখান থেকেই পরবর্তী কাজগুলো করেছে ওরা। সুস্থতা ফিরে পেতে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নেয়ার পাশাপাশি খোঁজ নিতে শুরু করেছে শেষ ইউনো ড. এলিসা ভ্যান বুরেনের ব্যাপারে। এজেন্সির অপারেটররা চমৎকার কাজ দেখিয়েছে, বারো ঘণ্টার ভিতরেই ভদ্রমহিলার সমস্ত ডিটেইলস্ জোগাড় করে এনেছে। পারিবারিক সমস্ত তথ্য পাওয়া গেছে ওখান থেকে, সেই সঙ্গে জানা গেছে–লেখাপড়া শেষ করে তিনি তাঁর পিতৃভূমি হল্যাণ্ডে ফিরে গেছেন, অ্যামস্টারড্যামে একটা সফটওয়্যার কোম্পানি খুলে গত দশ বছর ধরে ব্যবসা করছেন। পেশার প্রতি অত্যন্ত নিবেদিতপ্রাণ উ. বুরেন, আজ পর্যন্ত বিয়ে করেননি, একার চেষ্টায় প্রতিষ্ঠানটাকে ইয়োরোপের শীর্ষ-বিশটা কম্পিউটার-ভিত্তিক কোম্পানির একটায় পরিণত করেছেন। শুরুতে শুধু সফটওয়্যার তৈরি করত তার ক্রিয়েল-টেক কোম্পানি, আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত একটা অ্যান্টি-ভাইরাস সফটওয়্যার ওটার প্রধান প্রোডাক্ট, নাম ক্রিয়েল-প্রোটেক্ট। নাম-ডাক ছড়িয়ে পড়ায় সম্প্রতি হার্ডওয়্যার, মানে কম্পিউটারের বিভিন্ন যন্ত্রাংশও তৈরি করতে শুরু করেছে কোম্পানিটা; সামনের বছর থেকে পুরো কম্পিউটারই বাজারে ছাড়া হবে বলে বিজ্ঞাপন দেয়া হচ্ছে।

তবে খবর বলতে এটুকুই, এ-মুহূর্তে ভদ্রমহিলা কোথায় আছেন, তা জানতে পারেনি রানা এজেন্সির অ্যামস্টারড্যাম শাখার অপারেটররা–কোম্পানির স্টাফরা মুখ খুলছে না। কখন খবর পাওয়া যাবে, সে অপেক্ষা করবার সময় ছিল না, ড. বুরেনকে নিজেই খুঁজে বের করার সিদ্ধান্ত নিয়ে রানা চলে এসেছে হল্যাণ্ডে।

কানাডা থেকে কনকর্ড জেট ধরে মাত্র চার ঘণ্টায় অ্যামস্টারড্যামে আসা সম্ভব হলেও সময় ব্যয় করতে হয়েছে অনেক গুণ বেশি–সাধারণ ফ্লাইটে এসেছে, সেইসঙ্গে ঘুরপথ ব্যবহার করেছে ও। আমেরিকান সরকারের অনুরোধে কোস্ট গার্ডের জাহাজের উপর হামলাকারী দু’জন বাংলাদেশি যুবককে ধরতে কানাডা সরকার দেশের বাইরে গমনকারী সব ধরনের বিমান এবং অন্যান্য ট্রান্সপোর্টের উপর নজরদারির ব্যবস্থা করেছে বলে খবর পেয়েছিল ওরা। তা ছাড়া নিজস্ব সিআইএ এজেন্টদেরও কানাডার ভিতরে তৎপর করে তুলেছিল বুলডগ ওদের খোঁজে। প্রয়াত ড. ডোনেনের সূত্র ধরে লোকটা ড. বুরেনের খবর পেয়ে গেছে কি না, কে জানে! যদি পেয়ে থাকে, তা হলে রানারা যে কানাডা থেকে অ্যামস্টারড্যামে যাবে, এটা অনুমান করা কঠিন কিছু নয়। এই রুটের সব ফ্লাইটের উপর কড়া চোখ রাখবে সে। বাধ্য হয়ে বিকল্প পথ ধরেছে রানা আর রায়হান। ছদ্মবেশে দেশ ত্যাগ করে একজন গেছে ব্রাযিলে, অন্যজন মরক্কোতে। সেখান থেকে আবারও পরিচয় বদল করে কানেক্টিং ফ্লাইটে এসেছে হল্যাণ্ডে।

ধীর পায়ে অন্যান্য যাত্রীদের সঙ্গে মিশে কাস্টমস্ ডেস্কের দিকে এগোল রানা। এই মুহূর্তে ব্যস্ত এয়ারপোর্টের হাজারো সাধারণ যাত্রীর একজন ও, আলাদা কোনও বিশেষত্ব চোখে পড়বে না কারও। ফর্মালিটি সম্পন্ন করার জন্য লাইনে দাঁড়াল রানা, বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেলে আফ্রিকান এক দম্পতির পর পালা এল। দু’জন কাস্টমস অফিসার রয়েছে ডেস্কে তাদের একজনের। হাতে পাসপোর্ট আর কাগজপত্র তুলে দিয়ে এক পলকের জন্য চারপাশে নজর বোলাল রানা–অফিসারদের পিছনে দু’জন সিকিউরিটির লোক দাঁড়িয়ে গল্প করছে সুটপরা তৃতীয় একজনের সঙ্গে… দেখে, অ্যামেরিকান মনে হচ্ছে। বুলগের লোক নয়তো!

অবশ্য ব্যাপারটা নিয়ে খুব একটা দুশ্চিন্তা করতে হলো না ওকে। ঢিলেঢালা ভাব লক্ষ করা গেল লোক তিনটের মধ্যে। একবারের জন্য অলস ভঙ্গিতে তাকাল ওর দিকে, তারপর আবার গল্পে মগ্ন হয়ে পড়ল।

কনভেয়ার বেল্টে রানার লাগেজ এসে গেছে, টান দিয়ে সুটকেসটা তুলে নিল একজন কাস্টমস অফিসার, ডেস্কের উপর রেখে খুলে দেখল ভিতরটা।

অন্যজন ওর পাসপোট আর কাগজপত্র চেক করছে।

মি. রিকার্ডো গোমেজ, বলল অফিসার। আপনি দেখছি একজন। ফ্রিকোয়েন্ট ট্রাভেলার, বহু দেশে গেছেন। কী করেন আপনি?

খুক করে কাশল রানা। বলল, কেন, দেখতে পাচ্ছেন না? আমার কাগজেই তো লেখা আছে–আমি য্যানডার আয়রন কোম্পানির ইন্টারন্যাশনাল রিপ্রেজেন্টেটিভ।

বিভিন্ন দেশে যাবার ব্যাপারটা সত্যি। রিকার্ডো গোমেজ চরিত্রটা বিসিআই এজেন্টদের একটা ইমার্জেন্সি কাভার হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে। সেটাকে জিইয়ে রাখার জন্য গোমেজের ছদ্মবেশে সারা বছরই কেউ না কেউ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়ায়।

হুঁ, কাজটা কী আপনার? জিজ্ঞেস করল অফিসার।

আমার কোম্পানি ব্রাযিলের বিভিন্ন খনি থেকে লোহা তুলে সারা পৃথিবীতে রপ্তানি করে। ক্লায়েন্টদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার পাশাপাশি অর্ডার সংগ্রহ, বিল দেয়া… এসব আমাকে দেখতে হয়। সে-কারণেই এত ছোটাছুটি।

এখানেও কি…

হ্যাঁ, আপনাদের দেশের দুটো বড় বড় শিপইয়ার্ডের সঙ্গে কথা চলছে–চুক্তি হয়ে গেলে ওদের সারা বছরের ব্যবহার্য সব লোহা আমরা সাপ্লাই করব।

ঠিক আছে, সন্তুষ্ট হয়ে কাগজপত্র ফিরিয়ে দিল অফিসার। তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে সুটকেস নিয়ে হাঁটতে শুরু করল রানা। এক ফাঁকে পিছন ফিরে অ্যামেরিকান লোকটাকে আরেকবার দেখে নিল। না, তাকাচ্ছে না সে এদিকে, এখনও আগের মতই গল্পে ব্যস্ত। ব্যাটা এখানে করছেটা কী!

প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জ থেকে বেরিয়ে এল রানা, সুটকেসটা নামিয়ে রাখল পেভমেন্টে। বিশেষ একটা ভঙ্গিতে মাথার চুলে হাত বোলাতেই একশো গজ দূরে পার্ক করে থাকা একটা সেডান গাড়ি জ্যান্ত হয়ে উঠল, এগিয়ে এসে একেবারে ওর পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল ওটা।

দরজা খুলে নেমে এল ড্রাইভার, আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে ধরল রানাকে, যেন বহুদিন পর দেখা হয়েছে দুই নিকটাত্মীয়ের। মুখে হাসি ফুটিয়ে পাল্টা আলিঙ্গন করল রানা, তারপর সুটকেসটা গাড়ির ট্রাঙ্কে রেখে ড্রাইভারসহ চড়ে বসল সেডানে।

এয়ারপোর্ট ছেড়ে এ-ফোর হাইওয়েতে উঠে এল গাড়িটা, দ্রুতবেগে ছুটছে অ্যামস্টারড্যামের শহরতলির দিকে। সতর্ক চোখে পিছনদিকে নজর রাখছিল রানা, মিনিট দশেক পেরিয়ে যাবার পরও সন্দেহজনক কিছু দেখতে না পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল–না, অনুসরণ করা হচ্ছে না ওদেরকে। একটু খটকা অবশ্য মনের ভিতর রয়েই গেল–এয়ারপোর্ট সিকিউরিটির সঙ্গে অ্যামেরিকান লোকটা কী করছিল? কাস্টমস্ ডেস্কে তার উপস্থিতি কোনও স্বাভাবিক ঘটনা ছিল না।

কী ব্যাপার, মাসুদ ভাই? জিজ্ঞেস করল ড্রাইভারের ছদ্মবেশধারী রায়হান-মরক্কো থেকে দুঘণ্টা আগে পৌঁছেছে ও। রানার কথামত ছোটখাট কয়েকটা কাজ সেরেছে এখানে নেমে, তারপর নতুন ছদ্মবেশে একটা গাড়ি ভাড়া করে এয়ারপোর্টে গিয়েছিল ওকে রিসিভ করতে। আপনাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে। কেন?

কাস্টমসের ওখানে একটা লোককে দেখলাম, বলল রানা। এয়ারপোর্টের কেউ নয়, সিকিউরিটির দু’জনের সঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছিল, চেহারা-সুরতে অ্যামেরিকান মনে হলো…

আমিও দেখেছি তো! বলে উঠল রায়হান।

ভুরু কোঁচকাল রানা। কখন?

দুঘণ্টা আগে… আমি যখন ল্যাণ্ড করলাম।

তখনও ছিল? রানা বিস্মিত। কী করছিল?

কিচ্ছু না। ভয় হচ্ছিল আমাকে ধরার জন্যই দাঁড়িয়ে আছে কি না, কিন্তু দেখলাম ফিরেও তাকাল না। হাব-ভাবে মনে হলো অপেক্ষা করছে অন্য কোনও কিছুর জন্য।

অবাক ব্যাপার তো! রানা বলল। আমার উপরও নজর দেয়নি। তা হলে ওখানে খাম্বা হয়ে আছে কীসের জন্য?

উই ব্যাটা কিন্তু একা না, রায়হান বলল। অন্তত আরও তিনজন চোখে পড়েছে আমার।

কোথায়? আমি তো দেখিনি।

ওরা যেখানে আছে, সেদিকে যাননি বোধহয়। একজনকে দেখেছি ক্যাফেটেরিয়ায়, একজন ছিল ইন্টারন্যাশনাল লাউঞ্জে, শেষজন ইমিগ্রেশন। ডেস্কের ওখানে।

হুম। তুমি এত সব জায়গায় গিয়েছিলে কেন?

এয়ারপোর্টে খুব কড়া সিকিউরিটি দেখলাম, বাইরেও তখন পুলিশের একটা ভ্যান ছিল। তাই ভিতরেই কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করে অবস্থাটা যাচাই করেছি।

ভাল করেছ, রানা বলল। এদিকের খবরাখবর কী? নাঈমের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে? রানা এজেন্সির অ্যামস্টারড্যাম শাখার প্রধান নাঈম আযমের কথা বলছে ও।

মাথা ঝকাল রায়হান। হোটেলে উঠেই ফোন করেছিলাম।

কী বলল ও?

অত বিস্তারিত আলোচনা তো করতে পারিনি, সাঙ্কেতিক ভাষায় কথা বলতে হয়েছে, যাতে আড়ি পাতলেও কেউ কিছু বুঝতে না পারে। নাঈম ভাই শুধু এটুকু বললেন যে, এখনও ড. বুরেনের খোঁজ বের করতে পারেননি তিনি। ভদ্রমহিলা যে দেশের ভিতরেই আছেন, এটা শিয়ের হওয়া গেছে… তবে ওই। পর্যন্তই। তিনি যে কোর্থীয় গা-ঢাকা দিয়েছেন, সেটা বলতে পারছে না কেউ।

হুঁ, তারমানে ড. ডোনেনের ওয়ার্নিংটাকে সিরিয়াসলি নিয়েছিলেন তিনি, বলল রানা। এখনও বেঁচে আছেন বলেই মনে হচ্ছে… মৃত্যুসংবাদ যেহেতু পাওয়া যায়নি।

কতক্ষণ থাকবেন সেটাই প্রশ্ন। খুনীরা ডোনেন স্যরকে তো আর্কটিকে গিয়ে পর্যন্ত খুন করে এল!

তারচেয়েও বড় সমস্যা হচ্ছে সময়, রীনা গম্ভীর। ডেডলাইনের মাত্র ষোল ঘণ্টা বাকি–এর মধ্যে ড বরেনকে খুঁজে বের করতে হবে। অ্যান্টিভাইরাসটাও তৈরি করিয়ে নিতে হবে।

এখন তা হলে কী করতে চান, মাসুদ ভাই? রায়হান জিজ্ঞেস করল। ক্রিয়েল-টেকের হেড অফিসে যাবো? ওখানে কেউ না কেউ নিশ্চয়ই জানে, ওদের বস কোথায় আছে। ভুলিয়ে-ভালিয়ে পেট থেকে কথা বের করার একটা অ্যাটেম্পট নেয়া যেতে পারে।

তাতে লাভ হবে বলে মনে হয় না, রানা মাথা নাড়ল। ওভাবে খোঁজ বের করা গেলে নাঈমই পারত। কে জানে, সত্যিই হয়তো কেউ জানে না, ভদ্রমহিলা কোথায় গেছেন।

তা হলে?

একটু চিন্তা করল রানা। তারপর জিজ্ঞেস করল, ড. বুরেনের যেসব ইনফরমেশন দিয়েছে নাঈম, তাতে ওঁর বাড়ির ঠিকানা আছে?

এক মিনিট, বলে স্টিয়ারিং হুইল থেকে একটা হাত সরিয়ে ড্যাশবোর্ডের উপর থেকে একটা নোটবুক তুলে নিল রায়হান। গাড়ির গতি কমিয়ে একটু সাইড করল, তারপর নোটবুকটার পাতা ওল্টাতে শুরু করল। একটু পরেই বলল, এই যে… এই তো! আছে ঠিকানাটা-১০৮, গ্রুমবার্গ অ্যাভিনিউ, আলমির।

গাইড ম্যাপ আছে তোমার কাছে?

মাথা ঝাঁকাল রায়হান। গ্লাভ কম্পার্টমেন্ট খুলে চার ভাঁজ করা একটা ম্যাপ বের করে দিল। সেটা খুলে মনোযোগ দিয়ে দেখল রানা। বলল, হুঁ, অভিজাত এলাকা দেখছি! চলো ওখানে।

গিয়ে লাভটা কী? নাঈম ভাই বলেছেন, বাড়িটা খালি… তালা মারা। গত এক মাস ধরেই ওভাবে পড়ে আছে ওটা।

বাড়িটা একটু তল্লাশি করে দেখতে চাই। ভদ্রমহিলা কোথায় যেতে পারেন, তার কোনও সূত্র হয়তো পাওয়া যাবে।

মাথা ঝাঁকিয়ে আবার সেডানটাকে সামনে বাড়াল রায়হান।

.

আধঘণ্টা পর।

শিফল থেকে আলমিরের দূরত্ব মাত্র তেরো মাইল, চোখের পলকেই যেন পৌঁছে গেল রানা আর রায়হান। রোড-মার্কিং আর দোকানপাটের, সাইনবোর্ড দেখে দেখে এরপর খুঁজে বের করল ড. এলিসা ভ্যান বুরেনের বাড়িটা। ওয়েস্টেইনডারপ্লাসেন লেকের পারে বেশ বড় সড় একটা জায়গা নিয়ে সেখানে ভদ্রমহিলার দোতলা বাড়ি। চমৎকার দেখতে, সীমানাটা সুন্দর করে ছাটা গুল্মের নিচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। দুর্বা ঘাসে ঢাকা বিশাল লনের শোভা বর্ধন করছে চমৎকারভাবে বানানো বেশ কটা ফ্লাওয়ার বেড আর নিচু স্তম্ভে বসানো কিছু ভাস্কর্য। বৃত্তাকার ড্রাইভওয়ের মাঝখানটা বড় বড় পাতাঅলা কলাগাছ আর গোলাপঝাড় দিয়ে সাজানো। পিছনে একটা ছোট ডক রয়েছে, সেখানে নতুন মডেলের একটা ঝকঝকে স্পিডবোট বাঁধা–মনে হচ্ছে অবসরে কম্পিউটার বিজ্ঞানী নৌ-ভ্রমণ করতে পছন্দ করেন।

সেডানটা মাইলখানেক দূরের একটা পার্কিং লটে রেখে বাড়িটার চারপাশ ঘুরে-ফিরে দেখল রানারা, কিন্তু ভিতরে ঢোকার কোনও পথ পেল না। সামনে-পিছনে সব দরজা-জানালা বন্ধ, তালাগুলোও যা-তা নয়, একেবারে অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিক লক। অবস্থা দেখে মনে হলো, অ্যালার্মও ফিট করা আছে, জোর করে বা ভেঙে ঢুকতে গেলে পুলিশকে সতর্ক করে দেবে।

কীভাবে ঢোকা যায়, এ নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করেছিল রানা, কিন্তু রায়হানের হাসিতে ভাবনায় ছেদ পড়ল। কী ব্যাপার? জানতে চাইল ও।

ইলেকট্রনিক লক, মাসুদ ভাই, বলল রায়হান। ওটার কোড ভাঙাটা আমার জন্য কোনও ব্যাপারই না। বরং সাধারণ তালা হলেই কিছু করতে পারতাম না।

সেক্ষেত্রে তালার জাদুকর আমি সাজতাম, রানা হাসল। তাড়াতাড়ি কাজে নেমে পড়ো, সময় খুব মূল্যবান।

দৌড়ে চলে গেল রায়হান, মিনিট দশেকের মধ্যে ফিরে এল–গাড়ি থেকে নিজের ল্যাপটপ কম্পিউটার নিয়ে এসেছে। অ্যামস্টারড্যামে নেমেই নতুন এই কম্পিউটারটা কিনেছে ও।

বাড়ির পিছনের দরজার ইলেকট্রনিক লকের কাভার খুলে ফেলল তরুণ হ্যাকার, কম্পিউটারের সঙ্গে ডেটা কেইবল দিয়ে সংযোগ ঘটাল ওটার, তারপর অ্যাকসেস কোড ব্রেক করায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। একটু দূরে দাঁড়িয়ে পাহারায় থাকল রানা, কেউ এসে পড়ে কি না খেয়াল রাখছে।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ক্লিক করে শব্দ হলো, মাথা ঘুরিয়ে লকের গায়ে সবুজ আলো জ্বলতে দেখল ও খুলে গেছে ওটা! রায়হানের মুখ হাসি হাসি, ভুরু নাচিয়ে ভাব করল–কী, বলেছিলাম না?

গুড জব, রায়হান, রানা বলল। তারপর ওকে নিয়ে ঢুকে পড়ল বাড়ির ভিতর।

দরজার ওপাশে কিচেন, সেখানে দেখার কিছু নেই। করিডর ধরে বাড়ির মূল অংশে চলে এল ওরা দু’জন। নিচতলায় বড় একটা হলঘরের মত আছে-বৃত্তাকার, চারপাশে বেশ কটা দরজা দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন রুমে যাবার জন্য। হলের ঠিক মাঝখান থেকে দোতলায় চলে গেছে একটা চওড়া সিঁড়ি। পুরো বাড়িটাই দামি কার্পেটে মোড়া। কাঠের প্যানেলিং করা দেয়ালে শোভা পাচ্ছে নানা ধরনের পেইন্টিংআর স্টাফ করা জন্তুর মাথা। হলঘরের একপাশে সাজিয়ে রাখা বেশ কিছু দুর্লভ অ্যান্টিকও চোখে পড়ল। পুরো দৃশ্যটাতেই প্রাচুর্যের ছাপ।

হুঁ, ভদ্রমহিলা বেশ ধনী, মনে হচ্ছে, মন্তব্য করল রানা।

আঙুল ফুলে কলাগাছ হননি, খান্দানি বড়লোক, বলল রায়হান। এত টাকা-পয়সা আর প্রভাব-প্রতিপত্তি থাকার পরও ওঁর বাবা যে কোন্ দুঃখে যুদ্ধ করতে গিয়েছিলেন, আমি বুঝি না।

ড. বুরেন সম্পর্কে পাওয়া তথ্যগুলো মনে পড়ছে ওর। এলিসার পূর্বপুরুষেরা এককালে ব্যারন ছিলেন, প্রচুর প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল তাদের। তবে তার বাবা ব্যারনদের একঘেয়ে জীবনযাপন পছন্দ করতেন না একদম। ভদ্রলোক অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় স্বভাবের ছিলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতেই সোজা গিয়ে নাম লেখালেন রয়্যাল এয়ারফোর্সে, পরিবারের কারও আপত্তি মানলেন না। রয়্যাল এয়ারফোর্সের আঠারো নম্বর ইস্ট ইণ্ডিজ স্কোয়াড্রনে বহুবার পাইলট হিসেবে যুদ্ধ করেছেন ১৯৪২ থেকে ৪৫ পর্যন্ত, কৃতিতুও দেখিয়েছেন অর ট্রেইনিঙের জন্য অ্যামেরিকায় গিয়ে ড. বুরেনের মায়ের সঙ্গে পরিচয় হয় তার, সেখান থেকে প্রেম আর প্রণয়। বছর দশেক আগে মারা গেছেন ভদ্রলোক। এলিসার মা মারা গেছেন আরও আগে, পরিবারটায় এখন তিনি আর তার এক ছোট ভাই ছাড়া আর কেউ নেই।

শুধু বাপ-দাদার পরিচয় নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারে না অনেকে, রানা বলল। তারা চায়, নিজের যোগ্যতায় কিছু করে দেখাতে।

ইস্‌স, আমাদের দেশে যারা পরিবারতন্ত্র চালাচ্ছে, তারা যদি এই কথাটা বুঝত!

হাসল রানা। ওসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ো না। যে-কাজে এসেছি, সেটাই করি চলো।

বাড়িটা তো অনেক বড়। কোথায় তল্লাশি করতে চান?

স্টাডি জাতীয় একটা কিছু আছে নিশ্চয়ই। চলো ওটা খুঁজে বের করি। ওখানকার কাগজপত্র ঘাটলে ড. বুরেন কোথায় যেতে পারেন, সেটার একটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে।

ব্যস্ত হয়ে পড়ল রানা আর রায়হান। নীচতলার সবগুলো দরজা খুলে খুলে উঁকি দিতে শুরু করল ভিতরে। একটু পরেই খোঁজ পাওয়া গেল স্টাডির-বাড়ির একপ্রান্তে ওটা। সঙ্গে ছোটখাট একটা লাইব্রেরিও আছে। রুমটা দেখে অফিসঘরের মত মনে হলো, ড. বুরেন সম্ভবত বাড়িতে থাকলে এখানেই অফিশিয়াল কাজকর্ম করেন।

স্টাডিতে কয়েকটা ফাইল কেবিনেট আছে, সেইসঙ্গে আছে একটা বড় ডেস্ক-টেবিল–সেটায় শোভা পাচ্ছে একটা আধুনিক কম্পিউটার। রায়হানকে ওটা অন করতে বলে নিজে কেবিনেটগুলোর দিকে এগিয়ে গেল রানা, ভিতরের গিজপত্র দেখবে। একটু পরেই হতাশ হতে হলো ওকে, সবকটা কেবিনেটই তালা মারা। রায়হানের গলা থেকেও একটা বিরক্তির শব্দ বেরুল।

কী হয়েছে? জিজ্ঞেস করল রানা।

পাসওয়ার্ড দেয়া আছে কম্পিউটারটায়, বলল রায়হান। ভিতরে ঢোকা যাচ্ছে না।

ক্র্যাক করার চেষ্টা করেছ?

তা আর বলতে! তবে একজন ইউনো তার পার্সোনাল কম্পিউটার সহজে হ্যাঁ করতে দেবেন, তা কি হয়? ইউনোকোডে একটা ডিফেন্স সিস্টেম খাড়া করা আছে এটায়, কিছুতেই ঢোকা সম্ভব নয়।

হুঁ, কেবিনেটগুলোও তালা দেয়া।

কী করা যায় তা হলে?

আমি আশপাশের রুমগুলোয় একটা চক্কর দিয়ে আসি, দেখব তালা খোলার মত কিছু পাওয়া যায় কি না। তুমি ওপরতলায় যাও, ড. বুরেনের বেডরুমটা খুঁজে বের করো। ওখানে ব্যক্তিগত জিনিসপত্র যা পাবে, সব নিয়ে এসো এখানে।

কী জিনিসপত্র আনব?

ফ্যামিলি অ্যালবাম, চিঠিপত্র… এসব আর কী! কপাল ভাল হলে ডায়েরি-টায়েরিও পেয়ে যেতে পারো।

তাতে লাভ?

ওসব দেখলে বোঝা যাবে, ড. বুরেন কোথায় কোথায় সাধারণত যান বা যেতে পারেন। যাও, দেরি কোরো না।

মাথা ঝাঁকিয়ে চলে গেল রায়হান। রানাও বেরুল স্টাডি থেকে। পাশের দুটো রুম দেখা শেষ করেছে, হঠাৎ ইঞ্জিনের ভারি শব্দে সচকিত হয়ে উঠল ও। ড্রাইভওয়েতে একটা গাড়ি এসে থেমেছে। খানিক পরে সদর দরজা খোলার শব্দ হলো, কয়েক সেকেণ্ড ব্যবধানে হলঘরে আবছাভাবে পায়ের আওয়াজ… রায়হান না, অন্য কেউ! হাঁটার ভঙ্গি অন্যরকম, মনে হচ্ছে হিল পরে আছে। তারমানে নারী!

বিস্ময় বোধ করল রানা। কে হতে পারে? গত একমাস থেকে এই বাড়িটা তালাবন্ধ অবস্থায় পড়ে আছে বলে জানিয়েছে নাঈম, কেউ নাকি থাকে না। তা হলে কে এল হঠাৎ করে? ড. বুরেন নিজেই নন তো!

দরজা ফাঁক করে সাবধানে উঁকি দিল ও। পরমুহূর্তেই দমে গেল। নাহ, ভাগ্যদেবী এত সদয় হয়ে ওঠেননি। বয়স্কা কম্পিউটার-বিজ্ঞানী নয় নবাগতা, অন্য মানুষ। অল্পবয়েসী একটা মেয়ে-বয়স তেইশ-চব্বিশের বেশি হবে না। প্ল্যাডের তৈরি ধূসর রঙের স্কার্ট আর জ্যাকেট পরে আছে, পায়ে কন্ট্রাস্ট কালারের হাই হিল, কাঁধে ঝুলছে ব্যাগ। হলঘরে এসে স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে দেয়ালে লাগানো হুকে হাতে ধরা একটা ওভারকোট ঝুলিয়ে রাখল সে, ব্যাগটা নামিয়ে রাখল পাশের টেবিলে, তারপর করিডর ধরে চলে গেল কিচেনের দিকে।

প্রমাদ গুণল রানা, ওখানে পিছনের দরজাটা খোলা পাবে মেয়েটা! ভেজানো আছে বটে, কিন্তু তালা তো দেয়া নেই! ব্যাপারটা কি লক্ষ করবে সে জবাবটা কিছুক্ষণের মধ্যেই পাওয়া গেল। হন্তদন্ত হয়ে করিডর ধরে মেয়েটাকে ছুটে আসতে দেখল ও, চেহারায় আতঙ্ক ফুটে রয়েছে। হলঘরে পৌঁছে এদিক-সেদিক তাকাল মেয়েটা, যেন বোঝার চেষ্টা করছে–অনুপ্রবেশকারী এখনও বাড়িতে রয়েছে কি না। কী বুঝল কে জানে, ইতস্তত করে সে এগিয়ে গেল একপাশের ছোট্ট টুলের উপর রাখা, টেলিফোনটার দিকে, নিশ্চয়ই পুলিশে ফোন করতে যাচ্ছে।

আর বসে থাকা যায় না, পুলিশ এসে পড়লে মহাবিপদ দেখা দেবে। সাবধানে দরজা খুলে বেরিয়ে এল রানা, সন্তর্পণে এগিয়ে গেল মেয়েটার দিকে, ওর দিকে পিছন ফিরে রয়েছে সে। ডায়াল শেষ করতেই পৌঁছে গেল নাগালের মধ্যে।

শেষ মুহূর্তে ঘাড়ের কাছে কারও উপস্থিতি অনুভব করতে পারল তরুণী, ঝট করে ঘোরার চেষ্টা করল। কিন্তু তার আগেই পিছন থেকে ছোবল হানল রানা–এক হাতে জাপটে ধরল মেয়েটাকে, অন্য হাতে চেপে ধরেছে মুখ, যাতে চেঁচাতে না পারে।

ছাড়া পাবার জন্য মোচড়ামুচড়ি শুরু করল তরুণী, কিন্তু শক্তিতে রানার সঙ্গে পারার কথা নয় বেচারির, শীঘি হার মানল।

রিসিভারটা নামিয়ে রাখো, শান্ত গলায় বলল রানা, বাঁধন আলগা করেনি এক চুল।

কাঁপা কাঁপা হাতে আদেশটা পালন করল বন্দিনী, তার দুচোখে রাজ্যের ভয় আর আতঙ্ক জমা হয়েছে। মুখ চেপে ধরে রাখা হাতটায় গাল বেয়ে কয়েক ফোঁটা পানি এসে পড়তেই রানা বুঝতে পারল, কাঁদছে মেয়েটা। নরম সুরে ও বলল, ভয় পেয়ো না, আমি তোমার কোনও ক্ষতি করব না। মুখের ওপর থেকে। হাত সরাতে পারি, যদি তুমি চিৎকার করবে না বলে কথা দাও। কী, চেঁচাবে?

ভয়ার্ত ভঙ্গিতে মাথা দোলাবার চেষ্টা করল মেয়েটা।

ঠিক আছে, বলে হাত সরাল রানা, জাপটে ধরে থাকা অন্য হাতটায়ও আস্তে আস্তে ঢিল দিতে শুরু করল। শেষ মুহূর্তে ঘটল বিপত্তি।

ইয়াল্লা! এটা আবার কে?

সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছিল রায়হান, ওদেরকে দেখে বিস্মিত হয়ে বলে উঠেছে কথাটা। হঠাৎ ওর কণ্ঠ শুনে একটুর জন্য অন্যমনস্ক হয়েছিল ও, সেই সুযোগে কনুই চালাল মেয়েটা, একই সঙ্গে ডান পায়ের হিল সজোরে নামিয়ে আনল রানার পায়ের পাতায়।

পাঁজরের নীচে বেমক্কা আঘাত পেয়ে গুঙিয়ে উঠল রানা, পায়ের ব্যথাটা অনুভব করল তার চেয়েও বেশি। নিজের অজান্তেই বন্দিনীর শরীর থেকে হাত আলগা হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিল তরুণী, ছুটল করিডর হয়ে কিচেনের দিকে।

শিট! গাল দিয়ে উঠল রায়হান।

ধরো ওকে, দম নেয়ার জন্য খাবি খেতে খেতে বলল রানা। পালাতে দিয়ো না!

হাতে ধরা সমস্ত কাগজপত্র সিঁড়িতে ফেলে দিল রায়হান, রেলিং টপকে লাফ দিয়ে নামল মেঝেতে। করিডর ধরে ছুটতে শুরু করল ও-ও।

.

০৫.

কিচেনের দরজা খুলে বেরিয়ে গেছে তরুণী। আগপাছ ভাবল না রায়হান, ওই পথে ঝড়ের বেগে ও-ও বেরুল। কিন্তু একটা ভীত-পলায়নপর মেয়েও যে উপস্থিতবুদ্ধি খাটাতে পারে, সেটা ওর মাথায় ছিল না। দরজা দিয়ে বেরুতেই মেয়েটার বাড়িয়ে দেয়া পায়ে পা বেধে হুমড়ি খেয়ে পড়ল ও। জোরে দৌড়াচ্ছিল,ল্যাঙ খাওয়ার পর তাই ব্যালেন্স বলতে কিছু রইল না, জড় বস্তুর মত মুখ থুবড়ে পড়ল পাথর বিছানো ওয়াকওয়েতে, নাকমুখ ঠুকে গেল বিশ্রীভাবে। ওখানেই যাতনার শেষ হলো না, পাশ থেকে পেটে দমাদ্দম লাথি খেয়ে নিঃশ্বাস বেরিয়ে যাবার অবস্থা হলো, নিজের অজান্তেই কাতরে উঠল তরুণ হ্যাকার।

ঝিমঝিম করছে মাথা, কষ্ট করে সামান্য একটু তুলতেই মেয়েটাকে দৌড়ে বাড়ির পিছনের ডকের দিকে চলে যেতে দেখল রায়হান। খানিক পর স্পিডবোট স্টার্ট হবার শব্দ শুনে মুখ কালো হয়ে গেল ওর। আনমনে মাথা নাড়ছে, এমন সময় কিচেনে পায়ের শব্দ হলো–রানা এসেছে।

এ কী অবস্থা! দরজায় পৌঁছেই বিস্মিত কণ্ঠে বলল ও।

মেয়ে তো নয়, জিনিস একটা! তিক্ত গলায় বলল রায়হান। আমাকে ল্যাঙ মেরে ফেলে পালিয়েছে।

পালিয়েছে! রানা ভুরু কোঁচকাল। কোনদিকে?

আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল তরুণ হ্যাকার। লেকে… ডক থেকে স্পিডবোটটা নিয়ে গেছে।

কী বলছ! তুমি না ঠিক পিছেই ছিলে? ফাঁকি দিল কীভাবে?

ওর বুদ্ধি আছে বলতে হবে–পাগলের মত ছোটাছুটি না করে আমার জন্য দরজার বাইরে ফাঁদ পেতে অপেক্ষা করছিল। বেরুনোর সময় পা ঠেকিয়ে দিয়েছে… তারপর লাথি!

ট্রেইনড্‌ চিড়িয়া মনে হচ্ছে?

উঁহুঁ, লাথি মারা দেখে তো তেমনটা লাগল না। সাধারণ মানুষের মত এলোপাতাড়ি কিক। নাহ… মাসুদ ভাই, ট্রেইনিং-ফ্রেইনিং কিছু না, স্রেফ সাহস আর উপস্থিতবুদ্ধির জোরে পার পেয়ে গেছে।

সাধারণ, না? চিন্তিত গলায় বলল রানা। পালা করে চারপাশটা দেখল ও, তারপর তাকাল ডকের দিকে। তা হলে লেকের দিকে গেল কেন? সাধারণ মানুষ হলে তো রাস্তার দিকে যাবার কথা… ওর গাড়িটাও রয়েছে ড্রাইভওয়েতে, পালালে ওটা নিয়ে পালাবে।

বুদ্ধি ভাল, বললাম না? রায়হান বলল। সামনে যাবার জন্য ওকে যেতে হতো বাড়ির বাইরে দিয়ে একটা পাশ ঘুরে। সময় যা লাগত, তাতে আপনি সামনের দরজা দিয়ে গিয়ে ওকে ইন্টারসেপ্ট করতে পারতেন। এজন্যেই ঝুঁকি নেয়নি, ডক দিয়ে পালিয়েছে।

হুম, রানা মাথা নাড়ল। ব্যাপারটা তা-ও ঠিক মিলছে না। এত তাড়াতাড়ি স্পিডবোট স্টার্ট দিয়ে পালাল কেমন করে? আগে থেকে অভ্যস্ত না হলে পারার কথা নয়। বাড়ির লক খোলার কোড ছিল ওর কাছে, হাঁটাচলাও করছিল খুব স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে… তার মানে হয় এ-বাড়িতেই থাকে, নয়তো প্রায়ই আসা-যাওয়া করে। কে হতে পারে? ড. বুরেনের ফ্যামিলিতে তো এ-বয়সের কোনও মেয়ে আছে বলে রিপোর্ট পাইনি!

আমি তো চেহারাই দেখতে পাইনি, তা হলে ওঁর ফাইলে যাদের যাদের ছবি দেখেছি, তাদের কেউ কি না আন্দাজ করা যেত। আপনি দেখেছেন, মাসুদ ভাই?

দূর থেকে। কাছে যখন গেলাম, তখন তো পিছন থেকে জাপটে ধরেছিলাম… চেহারা দেখার উপায় ছিল না।

তা হলে আর মাথা ঘামিয়ে লাভ কী? হতাশ গলায় বলল রায়হান। চলুন তাড়াতাড়ি কেটে পড়ি। বাজি ধরে বলতে পারি, ওই মেয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ নিয়ে ফিরে আসবে।

হুঁ, ঠিকই বলেছ, রানা একমত হলো। কপালটাই মন্দ–মেয়েটার আচার-আচরণে ড. বুরেনের খুব কাছের কেউ বলে মনে হলো, ওর সঙ্গে কথা বলতে পারলে নিশ্চয়ই কোনও তথ্য পাওয়া যেত। কী আর করা, চলো।

বাড়ির ভিতরে কয়েক পা গিয়েই থমকে গেল ও।

কী হলো? জিজ্ঞেস করল রায়হান।

লেক… রায়হান! লেক!! উত্তেজিত কণ্ঠে বলল রানা। ওখান থেকে সহজে কোথাও যেতে পারবে না মেয়েটা, দূর থেকেও দেখা যাবে কোথায় যাচ্ছে, বা ডাঙায় নামছে।

তো? ধাওয়া করবেন?

জবাবটা সরাসরি দিল না রানা, মুখে একটু হাসি ফুটল শুধু। আমার মনে হচ্ছে, মেয়েটাকে এখনও হারাইনি আমরা!

.

মাটিতে গা মিশিয়ে ডক থেকে কয়েক গজ দূরে রডোডেনড্রনের একটা ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে আছে তরুণী। পাতার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে হঠাৎ দেখতে পেল দুই অনুপ্রবেশকারীকে দৌড়ে আসছে। ডকের একেবারে কিনারে গিয়ে থামল লোকদুটো, দূরে চলে যাওয়া স্পিডবোটটাকে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে দেখছে।

বুদ্ধিটা মন্দ হয়নি–বোটে ওঠেইনি সে, বোলার্ড থেকে বাঁধন খোলার পর ওটাকে স্টার্ট দিয়ে সোজা ছেড়ে দিয়েছে লেকের মাঝখানটা লক্ষ্য করে। তারপর নিজে এসে লুকিয়েছে ঝোঁপের পিছে। ব্যাটারা এখন ওই বোটের পিছনে ছুটে মরুক গে, ওকে আর বাগে পাবে না। আইডিয়াটা যে কাজে লেগেছে, তা ওদের হাবভাব দেখেই বোঝা গেল।

শিট! চলে গেছে তো অনেক দূর! অল্পবয়েসী তরুণ বলল। শিট-টুকু বুঝলি ও, বাকিটুকু কী ভাষা কে জানে!

তাতে কী? ইংরেজিতে বলল তারচেয়ে একটু বড়জন, হাবভাবে তাকেই নেতা মনে হচ্ছে। এত সহজে পার পেতে দিচ্ছি না। আশপাশের বেশিরভাগ প্রপার্টিতেই ডক আছে। আরেকটা স্পিডবোট ম্যানেজ করা কঠিন হবে না।

যদি ধার দিতে রাজি না হয়? এবার তরুণটিও কথা বলছে ইংরেজিতে।

তা হলে জোর করে নেব। চলো!

উল্টো ঘুরে ডক থেকে ছুটে চলে গেল দুই যুবক। স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল তরুণীর বুক থেকে। বড় বাঁচা বেঁচে গেছে। এবার পুলিশকে খবর দিয়ে বদমাশদুটোকে ধরাবার ব্যবস্থা করতে হয়।

তাড়াহুড়ো করল না মেয়েটা, পুরো দশ মিনিট অপেক্ষা করল-প্রতিপক্ষের। লোকদু’জনকে বাড়ি থেকে দূরে চলে যেতে সময় দিচ্ছে। যখন নিরাপদ বোধ। করল, ঝোঁপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল, তারপর সাবধানে ফিরতে শুরু করল বাড়ির দিকে। খোলা জায়গায় থাকল না ও, লেক থেকে শত্রুরা ওকে দেখে ফেলুক–তা চায় না। গাছপালা আর ঝোঁপঝাড়ের প্রাচীরকে কাভার হিসেবে ব্যবহার করে পিছনের দরজায় পৌঁছুল, তারপর ঢুকে পড়ল বাড়িতে।

পা টিপে টিপে হলঘরে পৌঁছুল ও, ভীত দৃষ্টিতে ইতি-উতি তাকাল। যখন মনে হলো ভয়ের কিছু নেই, ধীরে ধীরে তুলে নিল টেলিফোনের রিসিভারটা–পুলিশে ফোন করবে।

পরমুহূর্তেই ভুরু কুঁচকে গেল মেয়েটার, ফোনটায় কোনও ডায়াল টোন নেই। ব্যাপার কী, লাইনটা ডেড হয়ে গেল কীভাবে? সেটের পিছনে লাগানো লাইনটা পরীক্ষা করল সে, বাঁধন ছেঁড়া দড়ির মত হাতে উঠে এল ওটা দেয়ালের সকেট থেকে জ্যাক্টা খুলে রাখা হয়েছে। নিচু হয়ে ওটা আবার লাগাতে যাবে, এমন সময় একটা কণ্ঠ শুনতে পেয়ে ভীষণভাবে চমকে উঠল।

খামোকা কষ্ট কোরো না। লাইনটা কানেকশন দিয়ে লাভ নেই, ফোন তো আর করতে পারছ না!

সোজা হয়ে ঝট করে ঘুরল তরুণী-কণ্ঠস্বরটা কার, তা দেখার জন্য। মাত্র দশ গজ দূরে রানাকে দেখতে পেয়ে ভূত দেখার মত চমকে উঠল–সদর দরজার দিকে যাবার পথটা আগলে দাঁড়িয়ে আছে ও, বেড়ালের মত নিঃশব্দে কখন যে এত কাছে চলে এল, টেরই পায়নি। উল্টো ঘুরতেই কিচেনে যাবার করিডরের সামনে রায়হানকে দেখতে পেল, ওদিকে যাবারও পথ বন্ধ। ফাঁদে পড়ে গেছে বেচারি।

পালাবার চেষ্টা কোরো না, বলল রানা। আর যা-ই হোক, পর পর দুবার। ঘায়েল হবার মত কাঁচা লোক নই আমরা।

স্পিডবোট নিয়ে পালাবার নাটক করতে গিয়েই ভুল করেছে মেয়েটা। তার মধ্যে যে-ধরনের বুদ্ধিমত্তার প্রমাণ পেয়েছে রানা, তাতে লেকে যাওয়াটা সাজে না। আড়াল না থাকায় খোলা পানিতে অনেক দূর থেকে ট্র্যাক করা যায়। যে-কোনও জলযানকে, আরেকটা বোট নিয়ে সহজে ধাওয়া করা যায়, এমনকী পার ধরে সামনে কোথাও গিয়ে ফাঁদ পেতে অপেক্ষাও করা যায়। বুদ্ধিমতী একটা মেয়ের সেটা বুঝতে অসুবিধে হবার কথা নয়। এ-ধরনের পরিস্থিতিতে বোট নিয়ে লেকে না নেমে বরং কাছাকাছি কোথাও থেকে পুলিশে খবর দেয়ার চেষ্টা করাই যুক্তিসঙ্গত পদক্ষেপ। সেটা অনুমান করে রানা নিজেও একটু নাটক করেছে। ডকে গিয়ে ভাব দেখিয়েছে যেন আরেকটা বোট নিয়ে ধাওয়া করতে যাবে। তারপর বাড়ির ভিতরে এসে ঘাপটি মেরে ছিল।

পরিষ্কার আতঙ্ক ফুটল তরুণীর চেহারায়। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, প.. প্লিজ, আমাকে য… যেতে দিন। ভয়ের চোটে তোতলাচ্ছে সে। আ… আমি কাউকে ক… কিছু বলব না… জড়িয়ে যাওয়া কথার মধ্যেও ব্রিটিশ টানটা কানে বাজল রানার।

থামো! হালকা ধমক দিল ও। আগেই বলেছি, তোমার কোনও ক্ষতি করব না আমরা। শুধু কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই।

আ… আমি কিছু জানি না। আমি এ-বাড়ির কেউ নই।

তা হলে করছটা কী এখানে? কে তুমি?

তরুণী জবাব দেয়ার আগেই কথা বলে উঠল রায়হান। জাস্ট আ মিনিট! কাছে এসে ভাল করে দেখল তাকে। বলল, তুমি ইভা লরেন্স না?

অবাক হয়ে গেল মেয়েটা। হ্যাঁ, আপনি জানলেন কী করে?

ভুরু কোঁচকাল রানা। তুমি একে চেনো?

মাথা ঝকাল রায়হান। হ্যাঁ। ইভার দিকে তাকাল ও। তুমি এখানে কেন, ইভা? ড. ভ্যান বুরেনের সঙ্গে তোমার কী সম্পর্ক?

আমি ওঁর পার্সোনাল সেক্রেটারি, বিস্ময়টা চেপে রেখে জবাব দিল মেয়েটা। ম্যাডাম তো বেশ কিছুদিন থেকে নেই, তাই কয়েকদিন পর পর এসে ওঁর বাড়িঘরের অবস্থাটা দেখে যাই। আজও সেজন্যেই এসেছি। কিন্তু আপনারা কারা? আমার নাম জানলেন কেমন করে?

রানার দিকে তাকাল রায়হান। বাংলায় জিজ্ঞেস করল, বলব? বলে দেব, মাসুদ ভাই?

আগে বলো, কে এই মেয়ে? তুমি ওকে চেনো কীভাবে?

আমার একরকম সহপাঠী বলতে পারেন। কয়েক বছর আগে প্রিন্সটন ভার্সিটিতে এক্সচেঞ্জ স্টুডেন্ট হিসেবে একটা সিমেস্টার আমার সঙ্গে পড়েছে। বেসিক্যালি ও অক্সফোর্ডের ছাত্রী।

হুম, আমাদের শত্রুপক্ষ হবার কোনও সম্ভাবনা নেই তো?

মনে হয় না, একদম সহজ-সরল টাইপের মেয়ে–ছমাস খুব কাছ থেকে দেখেছি তো!

খুব কাছ থেকে!

ইয়ে… কিছুদিন ডেটিং করেছি আমরা।

হেসে ফেলল রানা। বেশ, বেশ, কম্পিউটার ছাড়া অন্যকিছুর প্রতিও মনোযোগ দাও তা হলে! শুনে খুশি হলাম।

না, মানে… জীবনে ওই প্রথম, ওই শেষ, মাসুদ ভাই। মেয়েদের সঙ্গে তো কথাই বলতে পারি না আমি। গায়ে পড়ে আমার সঙ্গে ভাব জমিয়েছিল ও, কেন যেন আমাকে কিছুটা পছন্দ করত, আমি যদিও ততটা আকৃষ্ট ছিলাম না। বিদেশি কোনও মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ব না বলে ঠিক করেছিলাম বহুদিন আগে, তাই ব্যাপারটা সিরিয়াস পর্যায়ে গড়াবার আগেই সাবধানে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলাম।

ব্রেকআপটা তিক্ত কোনও পরিস্থিতিতে হয়নি তো? মানে… এখন নিজের পরিচয় দিলে ও আবার তোমাকে থাপ্পড়-টাপ্পড় মেরে বসবে না তো?

না, না। তা হবে কেন? ও ইংল্যাণ্ডে ফিরে যাবার আগ পর্যন্ত ভাল বন্ধুত্ব ছিল আমাদের মধ্যে। কিন্তু আপনি হঠাৎ এসব ব্যাপার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাইছেন কেন?

মেয়েটা ড. বুরেনের সেক্রেটারি। ভদ্রমহিলা কোথায় আছেন, তা জানা থাকতে পারে ওর। এমনিতে তো বলবেই না, ভয় দেখালে দাঁতকপাটি লেগে যেতে পারে। তারচেয়ে…

ওহ নো! আপনি নিশ্চয়ই বলতে চাইছেন না…

হ্যাঁ, বৎস, মুচকি হাসল রানা। যা ভাবছ, ঠিক তা-ই করতে বলছি। মেয়েটা তোমার প্রতি দুর্বল–এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে পেট থেকে কথা বের করো।

তখন দুর্বল ছিল, প্রতিবাদ করল রায়হান। এখনও আছে, তার গ্যারান্টি কী? ওর সঙ্গে গত কয়েক বছরে আমার একটা কথাও হয়নি।

সম্পর্কটা ঝালাই করে নাও, বলল রানা। কথা বাড়িয়ো না, যা বলছি-সেটা করো।

দ্বিধা করতে থাকল তরুণ হ্যাকার। ইভা বলল, আপনারা কী নিয়ে কথা বলছেন এত, জানতে পারি? ভয় কিছুটা কমেছে ওর, তোতলাচ্ছে না আর।

রানার দিকে করুণ চোখে একবার তাকাল রায়হান, তারপর ফিরল মেয়েটার দিকে। আস্তে আস্তে পরচুলা থেকে শুরু করে বাকি সব ছদ্মবেশ খুলে ফেলল। বলল, হাই, ইভা! চিনতে পারো?

চমকে উঠল তরুণী। রায়হান রশিদ।

যাক, চিনতে পেরেছ তা হলে! রানাকে দেখাল রায়হান। ইনি আমার। বস্… বড় ভাইও বলতে পারো–মাসুদ রানা।

এ তুমি… মানে তোমরা এখানে কী করছ? হতভম্ব ভাবটা কাটাতে পারছে না ইভা। চোরের মত এ-বাড়িতে ঢুকেছ কেন?

বিরাট লম্বা গল্প… এ-মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। তবে এটুকু জেনে রাখো–কিছু চুরি করতে আসিনি। এসেছি তোমার বস্… মানে, ড. এলিসা ভ্যান বুরেনের খোঁজে।

কিন্তু ম্যাডাম তো অনেকদিন হলো নেই। কোথায় গেছেন, কাউকে বলে যাননি।

যোগাযোগও করেন না?

নাহ।

তা কী করে হয়? তা হলে ওঁর ব্যবসা চলছে কীভাবে?

বোর্ড অভ ডিরেক্টরস আছে, ওরাই চালাচ্ছে।

নিজের ছদ্মবেশ খুলতে খুলতে গলা খাকারি দিল রানা, ইশারায় রায়হানকে বোঝাতে চাইছে–সরাসরি কাজের কথায় যাওয়াটা ঠিক হচ্ছে না। প্রথমে পুরনো ঘনিষ্ঠতাটুকু জাগিয়ে তুলতে হবে, তারপর আসবে প্রশ্ন করবার পালা। ইঙ্গিতটা ধরতে পারল তরুণ হ্যাকার, তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গ পাল্টাল ও।

যাক গে, ওসব বাদ দাও। নিজের কথা বলল। ড. বুরেনের সঙ্গে জুটলে কীভাবে?,

কীসের সঙ্গে জোটা? কপাল মন্দ, বুঝেছ? ভাল একটা রেজাল্ট করেও এখন ফুট-ফরমাশ খেটে মরছি-পার্সোনাল সেক্রেটারির চাকরি কোনও চাকরি হলো? দেখতে পাচ্ছ না–হাউসমেইডের মত বাড়ি দেখাশোনা করছি?

তা হলে এই চাকরি নিয়েছ কেন?

সেক্রেটারি হবার জন্য কি আর নিয়েছি? দীর্ঘশ্বাস ফেলল ইভা। জানা গেল, ভার্সিটি থেকে বের হবার পর কিছুদিন বেকার বসে ছিল সে, তারপর পত্রিকায় দেখল হল্যাণ্ডের ক্রিয়েল-টেক-এর বিজ্ঞাপন-জুনিয়র প্রোগ্রামার খোঁজা হচ্ছে। অ্যাপ্লাই করে যোগ দিল চাকরিতে। কিন্তু প্রথম দুমাসের ইভ্যালিউয়েশন পিরিয়ডে ভাল পারফর্ম করতে পারেনি ও, প্রোগ্রামার হিসেবে। ওকে আর রাখতে চায়নি কোম্পানি। অবশ্য ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়নি একেবারে, ড. বুরেনের সেক্রেটারির পোস্টটা খালি ছিল… তাতে জয়েন করবে কি না, জানতে চাওয়া হয়।

একেবারে বেকার বসে থাকবার চেয়ে ওটা করা ভাল মনে হয়েছিল, বলল। ইভা। ভেবেছি, কিছুদিন কোম্পানিতে কাটাতে পারলে ওরা কীভাবে কী করে, কী ধরনের যোগ্যতা চায়–তা বুঝতে পারব। তাতে পরের বারে আবারও প্রোগ্রামার হিসেবে যোগ দেয়ার একটা সুযোগ পাওয়া যাবে। আফটার অল, এত নামকরা একটা প্রতিষ্ঠান–এখানে কাজ করতে পারাটাও তো বিরাট একটা ব্যাপার, তাই না?

তা তো বটেই, স্বীকার করল রায়হান।

সেজন্যেই আর আপত্তি করিনি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বিরাট ভুল করেছি। চার মাসও পুরো হয়নি, অলরেডি দম আটকে আসছে…

হেসে ফেলল রায়হান। ভয়-টয় সব কাটিয়ে উঠেছে ইভা, সেই আগের মত তার উচ্ছল-চঞ্চল রূপ ফিরে পেয়েছে। সহজ-সরল একটা মেয়ে, যে কোনও প্যাঁচঘোচ বোঝে না; সারাক্ষণ বকবক করে।

ওদের একটু একা হবার সুযোগ করে দিল রানা। তোমরা গল্প করো, আমি বাইরে থেকে একটা চক্কর দিয়ে আসি।

ধূমপায়ী রিকার্ডো গোমেজের ছদ্মবেশ নেয়ায় পকেটে লাইটার আর সিগারেট ছিল, বাড়ির পিছনে বেরিয়ে এসে একটা ডানহিল ধরাল রানা। অলস ভঙ্গিতে টান দিতে থাকল… সময় নষ্ট করছে আসলে। এ-ধরনের পরিস্থিতিতে যা হয়, মাথার ভিতরে আবারও পুরনো ভাবনাগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠল।

এলিসা ভ্যান বুরেন কোথায় গেছেন? সেক্রেটারি মেয়েটা কি তার সন্ধান জানে? জানলেও ওর কাছ থেকে রায়হান কি সেটা জেনে নিতে পারবে? সময় ফুরিয়ে আসছে দ্রুত, শেষ ইউনোক খুঁজে বের করা এবং তার কাছ থেকে অ্যান্টিভাইরাস জোগাড়ের মাধ্যমেই শুধু সামাল দেয়া যেতে পারে আশু বিপর্যয়টাকে।

ধাঁধার মত মনে হচ্ছে একাদশ ইউনোর ব্যাপারটা। কে সে? কোত্থেকে উদয় হলো? কেনই বা ভাইরাস ছড়িয়ে পুরো পৃথিবীর কম্পিউটার ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিতে চায়? এতে তার লাভটা কী? নাকি স্রেফ প্রতিহিংসার বশে এই কাজ করছে? যদি তা-ই হয়, তা হলে কার ওপর রাগ এই রহস্যময় ইউনোর?

যতই ভাবছে, ততই নিত্যনতুন প্রশ্ন উদয় হচ্ছে রানার মনে। জবাব পাওয়া যাচ্ছে না কোনওটার। শুধু এটুকু বুঝতে পারছে ও-নাটের গুরু যে-ই হয়ে। থাকুক, সে অত্যন্ত ধুরন্ধর প্রকৃতির। সব দিক গুছিয়ে মাঠে নেমেছে মানুষটা, প্ল্যানিঙে বিন্দুমাত্র ভুলত্রুটি নেই। কৌতূহলী স্বভাবের রায়হান যদি নাসার কম্পিউটারে হ্যাঁক না করত, তা হলে ভয়ঙ্কর ভাইরাসটার বিষয়ে কেউ কিছুই জানতে পারত না। বিনা মেঘে বজপাতের মত এক মহাবিপর্যয় ঘটে যেত। অবশ্য ব্যাপারটা জেনেই লাভটা কী হয়েছে? আটজন ইউনোকে আগেই নিখুঁতভাবে পরপারে পাঠিয়ে দিয়েছে সে, কারও কিছু করার ছিল না। নবমজন, মানে ড, স্ট্যানলি ডোনেনের ওপর হামলার সময় রানা ওখানে উপস্থিত ছিল বটে, কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তাকে বাঁচাতে পারেনি ও।

মন্টেগো আইস শেলফে দেখা খুনীদের কথা মনে পড়ল রানার-সাধারণ কেউ ছিল না তারা, উঁচু দরের ট্রেইনিং পাওয়া পুরোপুরি প্রফেশনাল লোক। এরা কারও পিছনে লাগলে তার মৃত্যু নিশ্চিত। এলিসা ভ্যান বুরেনের জন্য দুশ্চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল ও। রহস্যময় ইউনোর কূট-উদ্দেশ্য সফল হবার পথে এই ভদ্রমহিলাই এখন একমাত্র বাধা, তাকে বাঁচতে দেয়া হবে না। কিছুতেই। ভাইরাসের হামলার ডেডলাইন প্রায় এসে গেছে, ইতোমধ্যে বেচারি ইউনোর কপালে কিছু ঘটে গেছে কি না, কে জানে। যদি না ঘটে থাকে, তা হলে যেভাবেই হোক ভদ্রমহিলাকে খুঁজে বের করে তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা। করতে হবে। দায়িত্বটা রানাকেই নিতে হবে, লুকিয়ে থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারবেন না ড. বুরেন। স্পেশাল ফোর্সের প্রাক্তন কমাণ্ডো ভাড়া করবার মত অর্থ আর কানেকশন যার আছে, তার পক্ষে নিরীহ একজন বিজ্ঞানীকে খুঁজে বের করা কোনও ব্যাপারই না। মণ্টেগো আইস শেলফের মত একটা জায়গায় ড, স্ট্যানলি ডোনেনের খোঁজে খুনীদের পৌঁছে যাওয়াটা সেটাই প্রমাণ করে।

লেকের পারে একটা গাছের ছায়ায় বসে এসব ভাবতে ভাবতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল রানা, পিছনে পায়ের শব্দে সংবিৎ ফিরল। ঘাড় ফেরাতেই রায়হানকে দেখতে পেল-বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে। ইভাও রয়েছে সঙ্গে, একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা।

কী খবর? জানতে পেরেছ কিছু? জিজ্ঞেস করল রানা।

না, মাসুদ ভাই। সরি। চেহারায় হতাশ একটা ভাব তরুণ হ্যাকারের। ইভা সত্যিই জানে না, ড. বুরেন কোথায় আছেন।

মিথ্যে বলছে না তো? রানা ভুরু কোঁচকাল।

উঁহুঁ, রায়হান মাথা নাড়ল। আমি যে খারাপ লোক নই, তা ভাল করেই জানে ও। আমাকে বিশ্বাসও করে। জেনেও না জানার ভান করবার কোনও কারণ নেই।

কী বলেছ ওকে? কেন ওর বসকে খুঁজছি আমরা, সেটা জানতে চেয়েছিল নিশ্চয়ই?

তা চেয়েছে।

সত্যি কথা বলে দিয়েছ?

হ্যাঁ, তবে গোপন কোনও কিছু ফাস করিনি। শুধু এটুকু বলেছি যে, কম্পিউটার সেক্টরের একটা বড় ক্রাইসিস সমাধানের জন্য ড. বুরেনকে প্রয়োজন। সমস্যাটা মিটে গেলে সব খুলে বলব বলে কথা দিয়েছি। সহজ-সরল মেয়ে… এতেই সন্তুষ্ট হয়েছে।

তা হলে আমাদের সাহায্য করছে না কেন? কিছু জানে না বলে মুখে কুলুপ। এঁটে বসে আছে কেন?

মুখে কুলুপ আঁটেনি তো! রায়হান প্রতিবাদ করল। ড. বুরেন বিপদের মধ্যে আছেন শুনে আমাদেরকে সাহায্য করতে বরং উতলা হয়ে আছে। কিন্তু সমস্যা হলো, ভদ্রমহিলার খবর সত্যিই জানে না ও, জানা সম্ভবও নয়। তিনি নাকি কোথাও বেশিদিন থাকছেন না। দুচারদিন পর পর জায়গা পাল্টে পুরো দেশময় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। হঠাৎ তিনি এমন যাযাবরের মত আচরণ করছেন। কেন, সেটা ওর কাছেও একটা রহস্য।

স্মার্ট মুভ, কারণটা ধরতে পেরে মন্তব্য করল রানা। ড. বুরেন নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, খুনীরা দুর্ঘটনার আদলে মৃত্যু সাজায়। ওদের ফাঁকি দেয়ার সবচেয়ে ভাল পন্থা হচ্ছে, নিজের জীবনযাত্রা পাল্টে ফেলা। কোনও রুটিন অনুসরণ না করলে কাউকে দুর্ঘটনার ফাঁদে ফেলা প্রায় অসম্ভব একটা কাজ।

বুঝতেই পারছেন, ইভা আমাদের কাছে কিছু লুকোচ্ছে না, রায়হান বলল।

হুঁ। কিন্তু আমাদের কাজে আসার মত কোনও ইনফরমেশনও তো দিতে পারছে না। ড. বুরেন আদৌ বেঁচে আছে কি না, সেটা বলতে পারবে?

পেরেছে, রায়হান হাসল। বহাল তবিয়তেই আছেন এখনও তিনি। আজ ভোরেই ফোনে ওর সঙ্গে কথা হয়েছে ইভার।

ফোনে!

ওফ্‌ফো! বলতে ভুলেই গেছি–ডক্টরের সঙ্গে একটা মোবাইল ফোন আছে-প্রাইভেট একটা নাম্বার, বিশ্বস্ত লোকজন ছাড়া আর কেউ জানে না ওটা। ওটার মাধ্যমেই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছেন।

ওঁর সঙ্গে ফোন আছে? রানার চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

হ্যাঁ, রায়হান বলল। কথা বলবেন?

বলতে তো হবেই। দেখি, সামনাসামনি দেখা করবার ব্যাপারে কনভিন্স করতে পারি কি না। ইভার দিকে এগিয়ে গেল। ড. বুরেনের সঙ্গে আমাকে একটু যোগাযোগ করিয়ে দেবে?

ফোনে?

হ্যাঁ।

একটু ইতস্তত করল ইভা। বলল, রেগে যেতে পারেন… ফোন-টোন করার ব্যাপারে কড়া নিষেধ করে দিয়েছেন তো!

আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে রানা বলল, গ্যারান্টি দিচ্ছি–আমার সঙ্গে কথা বলার পর রাগ-টাগ সব ভুলে যাবেন উনি। বরং আমাদেরকে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছ বলে ধন্যবাদ দেবেন।

সিদ্ধান্ত নিতে একটু সময় ব্যয় করল তরুণী সেক্রেটারি, শেষে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, রায়হানের জন্য খেলামই নাহয় একটু বকা! জ্যাকেটের ভিতরের পকেট থেকে নিজের মোবাইল বের করল ও, বোতাম চেপে ফোনবুক। থেকে নির্দিষ্ট নাম্বারটা স্ক্রিনে এনে ডায়াল করল।

কয়েক বার রিং হতেই ওপাশ থেকে সাড়া পাওয়া গেল।

হ্যালো?

গুড মর্নিং, ম্যাম। আমি ইভা বলছি।

কী ব্যাপার? হঠাৎ ফোন করেছ কেন? তোমাকে না বলেছি, একদম ইমার্জেন্সি না হলে আমাকে ফোন করবে না? একটু রুষ্টই মনে হলো মহিলা-বিজ্ঞানীকে।

ইয়ে… ব্যাপারটা ইমার্জেন্সিই। দু’জন ভদ্রলোক এসেছেন আমার কাছে, আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান। বললেন আপনাকে সাহায্য করতে পারবেন…

হোয়াট। এত জোরে এলিসা চেঁচিয়ে উঠলেন যে দরে দাঁড়িয়েও সেটা শুনতে পেল রানা আর রায়হান। সরোষে তিনি বললেন, বোকা মেয়ে কোথাকার! কোথাকার কে এসে আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইল, আর তুমি তাদের সামনে আমার গোপন নাম্বারে ফোন করলে?

একেবারে অপরিচিত কেউ নয়, ম্যাম। ওদের একজন আমার পুরনো বন্ধু-ওকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করা যায়…

গড় ড্যাম ইট! তুমি কাকে বিশ্বাস করো না করো, তাতে আমার কী এসে যায়? আশ্চর্য ব্যাপার, উল্টোপাল্টা কাজ করে এখন আবার সাফাই গাইছ? কত করে বললাম যে, কেউ আমার খোঁজ জানতে চাইলে কিছু বোলো না…

ধমক খেয়ে ইভার চেহারা কালো হয়ে গেছে, চোখের কোণে চিকচিক করছে পানি… কেঁদেই ফেলবে বোধহয়। ওর এ-অবস্থা দেখে তাড়াতাড়ি ফোনটা নিয়ে নিল রানা। বলল, এক্সকিউজ মি, ড. বুরেন। দয়া করে লাইনটা কেটে দেবেন না। আপনার সেক্রেটারির সঙ্গে রাগারাগি না করে আমার কথাগুলো শুনুন প্রথমে। তা হলেই বুঝতে পারবেন, ও অন্যায় করেছে কি না।

কে আপনি? বিরক্ত গলায় জানতে চাইলেন এলিসা।

আমার নাম মাসুদ রানা। আপনি হয়তো রানা ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির নাম শুনে থাকবেন, আমি ওটার ডিরেক্টর।

রানা এজেন্সি? একটু চিন্তা করলেন যেন এলিসা। অ্যামস্টারড্যামে আপনাদের একটা অফিস আছে বোধহয়, তাই না?

হ্যাঁ।

হুম! তো মি. রানা? হঠাৎ আমাকে আপনার দরকার পড়ল কেন?

একটা মাত্র শব্দেই ব্যাপারটা আপনাকে বোঝাতে পারি আমি। ইভার কাছ থেকে একটু দূরে সরে এল রানা, যাতে ওর কথা শুনতে না পায়। তারপর বলল, ইউনোকোড!

অপর প্রান্তে চুপ হয়ে গেলেন এলিসা, চমকটা সামলানোর চেষ্টা করছেন। সম্পূর্ণ অজানা-অচেনা একজন মানুষ তার আর ইউনোকোডের মধ্যে সম্পর্কটা আবিষ্কার করল কী করে, সেটাই ভাবছেন বোধহয়। কয়েক মুহূর্ত নীরবতায় কাটার পর আস্তে আস্তে তিনি বললেন, ইউনোকোড সম্পর্কে কী জানেন আপনি, মি. রানা?

মোটামুটি সবই, ডক্টর। আপনাদের দশজনের সবার পরিচয় জানি আমি। জানি, তারা খুন হয়ে গেছেন। সেই সঙ্গে এটাও জানি, বাঁচার জন্য পালিয়ে বেড়াচ্ছেন আপনি।

এত কিছু কীভাবে জেনেছেন আপনি? থমথমে গলায় প্রশ্ন করলেন এলিসা।

ড. স্ট্যানলি ডোনেন বলেছেন আমাকে।

স্ট্যানলি? কোথায়? সরি, তিনি আর বেঁচে নেই।

না-আ! কী বলছেন এসব!

ব্যাপারটা সত্যি, ডক্টর। তাকে খুন করা হয়েছে, আমি নিজে উপস্থিত ছিলাম সেখানে। ওঁর সন্দেহটাই সত্যি ছিল–আসলেই ইউনোদের টার্গেট করে। পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে। আপনিও নিরাপদ নন।

সেটা আমিও জানি, মি, রানা। কিন্তু যেটা আমার মাথায় ঢুকছে না, তা হলো–কেন এভাবে আমাদের খুন করছে কেউ। আমরা বিপজ্জনক নই, কখনও। কারও ক্ষতিও করিনি।

এই প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে আছে, ম্যাম। পুরো রহস্যটাই আমার জানা।

তা হলে খুলে বলুন সব।

ফোনে নয়, রানা বলল। আপনার সঙ্গে সামনাসামনি কথা হওয়া প্রয়োজন আমার। তা ছাড়া বললামই তো, আপনি নিরাপদ নন। আমার ওপর যদি আস্থা রাখেন, তা হলে প্রোটেকশনের জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারি আমি।

আপনার সঙ্গে দেখা করতে বলছেন?

দেখা আমিই করব, ম্যাম। শুধু ঠিকানাটা দিন।

আপনি নিজেই যে খুনীদের কেউ নন, সেটা জানব কেমন করে?

এ-মুহূর্তে জানার উপায় নেই, সেটা স্বীকার করি। আপাতত নিজের ইন্সটিঙ্কটের উপর নির্ভর করেই সিদ্ধান্তটা নিতে হবে আপনাকে। শুধু এটুকু আশ্বাস দিতে পারি, আমি আপনার ক্ষতি চাই না।

হুম, গম্ভীর ভঙ্গিতে বললেন এলিসা। আমার ভালমন্দ নিয়ে আপনি এত চিন্তিত কেন, জানতে পারি?

চিন্তাটা করতেই হচ্ছে, ডক্টর, রানা বলল। কারণ, সারা পৃথিবী জুড়ে একটা বিরাট বিপর্যয় দেখা দিতে যাচ্ছে আজ রাতের মধ্যে। একমাত্র আপনিই পারবেন সেটা ঠেকাতে। এ-কারণে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, আপনার সঙ্গে দেখা। হওয়া প্রয়োজন আমার।

বিপর্যয় মানে?

দেখা হলেই সব জানতে পারবেন।

আপনি দেখি আমাকে কৌতূহলী করে তুললেন, বললেন এলিসা। তারপর কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে সিদ্ধান্ত জানালেন, আপনার কথাবার্তা পছন্দ হয়েছে। আমার, মি. রানা। ঠিক আছে, দেখা করতে রাজি আছি আমি আপনার সঙ্গে।

দ্যাটস গ্রেট! স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল রানা। কোথায় আসতে হবে?

এই মুহূর্তে ফ্লেভোল্যাণ্ড প্রভিন্সে আছি আমি, বিডিংহুইসেনের দক্ষিণে… আমাদের পারিবারিক পুরনো ম্যানরে। আপনি কোথায়?

আপনার আলমিরের বাড়িতে।

হুঁ, তা হলে তো পাঁচ ঘণ্টার মত লেগে যাবে পৌঁছুতে।

আমি চেষ্টা করব আরও তাড়াতাড়ি আসতে।

নো রাশ, আমি অপেক্ষা করব।

ম্যানরটার ঠিকানা যদি আরেকটু পরিষ্কার করে বলতেন…।

মুখে বোঝানো কঠিন। তারচেয়ে ইভা আছে না আপনাদের সঙ্গে, ওকে নিয়ে আসুন। ও সব চেনে।

ঠিক আছে, এক্ষুণি রওনা হচ্ছি আমরা।

আই শ্যাল বি ওয়েইটিং।

লাইন কেটে দিলেন বিজ্ঞানী। ইভার দিকে ফিরল রানা। বলল, দেখা করতে রাজি হয়েছেন ড. বুরেন। তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে বলেছেন।

কোথায়?

ওঁর পুরনো ফ্যামিলি ম্যানরে।

সে তো বহু দূরের পথ…

কেন, যেতে আপত্তি আছে তোমার? জিজ্ঞেস করল রায়হান।

না, না, আপত্তি ঠিক না। আসলে এদিকে অনেক কাজ…

কিন্তু তুমি না গেলে আমরা যে পথই চিনতে পারব না, বলল রানা।

আচ্ছা, আচ্ছা, যাব। হাসল ইভা। রায়হানের সঙ্গে এতদিন পর দেখা… ওকে এত তাড়াতাড়ি ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। কখন যেতে হবে?

এখুনি রওনা দিতে চাই, বলল রানা।

ঠিক আছে। গাড়ি কি আমারটা নেব, নাকি আপনাদের সঙ্গে আছে?

রাস্তাঘাটে নষ্ট করবার মত সময় নেই আমাদের হাতে, রানা মাথা নাড়ল। আরও দ্রুতগামী কিছু দরকার।

দ্রুতগামী!

ইয়েস, ডিয়ার। রানা একটু হাসল। আশপাশে কোনও ফ্লাইং ক্লাব আছে?

.

আটলান্টিক মহাসাগরের বিশ হাজার ফুট উঁচু দিয়ে চারশো আঠারোজন যাত্রী নিয়ে অ্যামস্টারড্যামের দিকে ছুটে চলেছে মেক্সিকান এয়ারলাইন্সের বোয়িং-৭৪৭ বিমানটা। আরোহীদের মধ্যে রয়েছে আলফা টিমের তিন সদস্য। মণ্টেগো আইস শেলফে কাজ শেষ হবার পর হেলিকপ্টারসহ একটা গ্লেসিয়ারে চব্বিশ ঘণ্টা কাটিয়েছে ওরাঁ, তারপর চলে গিয়েছিল মেক্সিকোর ইউকাটানে। কাগজে কলমে গত একটা সপ্তাহ ওখানেই থাকার কথা ওদের। উপস্থিতিটা প্রমাণ করবার জন্য ওখানে কয়েক ঘণ্টা জনসমক্ষে ঘোরাফেরা করেছে। তিনজনে, একটা সেমিনারেও অ্যাটেও করেছে। তারপর সরকারী এয়ারলাইনে। রওনা হয়েছে অ্যামস্টারড্যামের দিকে। আলফা-যিরোর নির্দেশ এরকমই ছিল।

এক্সিকিউটিভ ক্লাসের গদিমোড়া সিটে বসে আয়েশ করে হাতের ড্রিঙ্কে চুমুক দিচ্ছিল আলফা-ওয়ান, দৃষ্টি নিবদ্ধ অন্য হাঁতে ধরা একটা ম্যাগাজিনে, এমন সময় একজন ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট এগিয়ে এল। মেয়েটার হাতে ইন-ফ্লাইট সার্ভিসের একটা কর্ডলেস ফোন, কাছে এসে বলল, এক্সকিউজ মি, স্যর। আপনার একটা কল আছে।

থ্যাঙ্কস, বলে হাত বাড়িয়ে সেটটা নিল কঠিন চেহারার যুবক, ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল, তারপর ওটা ঠেকাল কানে।

ইয়েস?

কোথায় তোমরা? ওপাশ থেকে আলফা-যিরোর অতি-পরিচিত কণ্ঠ শোনা গেল।

বিমানে ফোন করে আবার জানতে চাইছ? বিদ্রূপ ঝরল আলফা-ওয়ানের কণ্ঠে।

বাঁকা কথা না বললে তোমার পেটের ভাত হজম হয় না, তাই না? বিরক্ত শোনাল আলফা-যিরোর গলা। কখন পৌঁছুচ্ছ, সেটা বলো।

হাতঘড়ি দেখল আলফা-ওয়ান। শেডিউল অনুসারে আরও আড়াই ঘণ্টা। তবে যে-রকম লক্কর-ঝক্করমার্কা বিমানে উঠেছি, তাতে আরও এক-আধ ঘণ্টা দেরি হলে অবাক হব না।

কিন্তু তোমাদেরকে যে এখুনি দরকার!

তা হলে লিয়ারজেটটা পাঠিয়ে দাওনি কেন? জার্নিটা আরামদায়কও হত, তাড়াতাড়িও পৌঁছুতে পারতাম।

কেন পাঠাইনি, তা তুমি ভাল করেই জানেনা। প্রাইভেট বিমানের আরোহীদের সবাই আলাদা চোখে দেখে। সাধারণ ফ্লাইটে ট্র্যাভেল করায় লোকের নজর এড়াতে পারছ।

সেক্ষেত্রে কখন পৌঁছুব-কখন পৌঁছুব বলে অস্থির হচ্ছ কেন?

কারণ, ফাইনাল একটা টার্গেট রয়েছে তোমাদের জন্যে। সময় কম, এখুনি ওখানকার ব্যবস্থা নিতে হবে।

তাড়াটা কীসের?

সেটা ওপেন চ্যানেলে বলা যাবে না। শুধু এটুকু জেনে রাখো, যা করার এক্ষুণি করতে হবে।

হুম, ভালই সমস্যা দেখছি।

কী করা যায়, কোনও পরামর্শ দিতে পারো?

কাজটা গারফিল্ডকে দাও না কেন? আজকাল তো অ্যামস্টারড্যামেই অপারেট করছে সে। যোগ্য লোক, আগেও তোমার হয়ে কাজ করেছে।

সে তো বহুদিন আগে, বলল আলফা-যিরো। তা ছাড়া আমাকে চেনে না সে, এখন যদি বুঝে ফেলে, আমি কে?

বুঝলই বা, প্রয়োজনে পরে ওকে সরিয়ে দিতে পারব।

বলছ? একটু যেন চিন্তা করুল আলফা-যিরো। ঠিক আছে, ওকেই দিই তা হলে কাজটা।

.

অ্যামস্টারড্যামের একটা পাবে বসে মদ গিলছে ঝাঁটাগুঁফো গারফিল্ড। মাইকেল এবং ডেবি ওয়ালডেনকে খুন করবার পর আঠারো বছর কেটে গেলেও তার গোঁফটা সেই আগের মতই রয়ে গেছে। পরিবর্তন হয়েছে শুধু বয়সের বেড়েছে ওটা। দক্ষতায়ও বিন্দুমাত্র মরচে ধরেনি আজও। আইনের চোখ ফাঁকি দেবার জন্য কিছুদিন পর পর কার্যক্ষেত্র বদলায় সে, ঘাঁটি গাড়ে ইয়োরোপের বিভিন্ন দেশে। গত ছমাস থেকে অ্যামস্টারড্যাম তার প্লে-গ্রাউণ্ড।

ভাইব্রেশনে দেয়া মোবাইলটা বুক পকেটে নাচানাচি করছে দেখে কানে তুলল গারফিল্ড। চাঁছাছোলা ভঙ্গিতে বলল, কে এবং কী চাই–জলদি বলে ফেলো।

হ্যালো, গারফিল্ড! তোমার জন্য একটা কাজের সন্ধান আছে আমার কাছে। বিনিময়ে সাধারণ রেটের দ্বিগুণ টাকা পাবে।

কে আপনি? ভুরু কোঁচকাল পোড় খাওয়া খুনী।

পুরনো মক্কেল, বলল আলফা-যিরো। কটসওল্ডের পাহাড়ী এলাকায় বহুদিন আগে আমার একটা কাজ করে দিয়েছিলে তুমি।

মনে পড়ে গেল গারফিল্ডের। মুচকি হেসে বলল, এতদিন পর আবার আমাকে স্মরণ করছেন দেখে খুশি হলাম। বলুন, কী খেদমত করতে পারি?

সচরাচর যা করো, তা-ই। সাফ-সুতরোর কাজ।

সংখ্যা?

মূল টার্গেট একজন, তবে সঙ্গে আরও মানুষ থাকতে পারে। আমি চাই না। কোনও সাক্ষী থাকুক।

তা আমি রাখিও না, বলল আঁটাফো। টার্গেটের ডিটেইলস্ কখন দেবেন?

ডিটেইলস দেবার সময় নেই। আমি অল্প সময়ের জন্য তার লোকেশনটা জানতে পেরেছি, দেরি হলে সরে পড়তে পারে। কাজেই ডিটেইলসের চিন্তা বাদ দিয়ে এক্ষুণি বেরিয়ে পড়ো, লোকেশনে গিয়ে খতম করে এসো।

এক্ষুণি! গারফিল্ড অবাক।

কেন, পারবে না?

একটু ভাবল গারফিল্ড। তোক একটু বেশি করে নিতে হবে তো… কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। টাকা কিন্তু ডাবলের বেশি দিতে হবে!

ও নিয়ে ভেবো না।

ঠিক আছে, টার্গেট সম্পর্কে বলুন।

সংক্ষেপে বলল আলফা-যিরো। শুনে মাথা ঝাঁকাল বঁটাফো। কোথায় পাওয়া যাবে তাকে?

ভ্যান বুরেনস্ এস্টেট, ফ্লেভোল্যাণ্ডে।

.

০৬.

সাড়ে সাতশ বর্গকিলোমিটার আয়তনের মার্কারমির হ্রদের উপরে ছোট্ট একটা পাখির মত দেখাচ্ছে রানাদের চার সিটের সেসনা বিমানটাকে। অমনটা দেখানোই স্বাভাবিক, আকার-আয়তনে এই হ্রদ যে-কোনও উপসাগরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে। হল্যাণ্ডের মূল ভূখণ্ড আর ফ্লেভোল্যাণ্ড নামের দ্বীপটার মাঝখানে এর অবস্থান। আয়নার মত স্বচ্ছ ও শান্ত পানিতে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হচ্ছে দ্বিগুণ উজ্জ্বলতা নিয়ে, সেদিকে তাকালে চোখ ধাধিয়ে যেতে চায়। তাই একেবারে শেষ মুহূর্তের আগে সামনে উদয় হওয়া হ্রদের তটরেখা দৃষ্টিগোচর হলো না ওদের।

বিমানের পাইলটের সিটে রয়েছে রানা, পাশে বসেছে ইভা লরেন্স–গাইড করবার জন্য। রায়হান পিছনে। পর পর চারটে ফ্লাইং ক্লাবে চেষ্টা করতে হয়েছে। ওদের, তারপর ভাড়া পাওয়া গেছে এই সেসনাটা। কোনও রকম বুকিং ছাড়া এত দ্রুত যে একটা বিমান পাওয়া গেছে, সেটাই বিরাট সৌভাগ্য। ঘোরাঘুরিতে যেটুকু সময় ব্যয় হয়েছে, সেটাকে অপচয় বলা যায় না কিছুতেই। মার্কারমির হ্রদটাকে আকাশপথে আড়াআড়িভাবে অতিক্রম করায় ওরা এখন সড়কপথের পাঁচ ঘণ্টার রাস্তা মাত্র চল্লিশ মিনিটে পাড়ি দিতে পারছে।

সামনে তীরের দেখা পেয়ে ইভার কাঁধে টোকা দিল রানা। বলল, ফ্লেভোল্যাণ্ডে পৌঁছে গেছি। এবার কোনদিকে যেতে হবে, দেখাও।

লেক থেকে প্রায় ত্রিশ মাইল দূরে ভ্যান বরেনস এস্টেট বলল ইভা। সোজা পথে আরও দশ মিনিট যান। তারপর একটু চক্কর দিতে হতে পারে।

কেন, জায়গাটা তুমি চেনো না?

রাস্তা ধরে গেলে চোখ বন্ধ করে যেতে পারব, তবে উপর থেকে সবকিছু অন্যরকম দেখাচ্ছে। কী করব, আকাশে তো পথ চেনার মত কোনও ল্যাণ্ডমার্ক বা সাইনপোস্ট নেই!

একমত হলো রানা। ব্যাপারটা ওর নিজেরই বোঝা উচিত ছিল। আসলে ড. বুরেনের কাছে পৌঁছুনোর চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে বলে অতটা গভীরভাবে ভাবেনি।

লেকের তীর অতিক্রম করে মাটির উপরে পৌঁছুতেই আলোর উৎপাত কমে গেল, এবার নীচের সবকিছু ঠিকমত দেখা যাচ্ছে। দশ মিনিট প্রয়োজন হলো না, তার আগেই ইভা উত্তেজিত গলায় বলে উঠল, মি. রানা! ডানে… ওই যে হাইওয়ে-টা দেখতে পাচ্ছেন? ওটা বিডিংহুইযেন যাবার রাস্তা। ফলো করুন পথটাকে। শহর পর্যন্ত পৌঁছে গেলে বাকিটুকু চিনতে আর অসুবিধে হবে না।

মাথা ঝাঁকিয়ে কন্ট্রোল কলাম ঘোরাল রানা। ধীরে ধীরে বাঁক নিয়ে হাইওয়ের উপরে সমান্তরালভাবে চলে এল সেসনা, এবার সোজাসুজি ছুটছে।

রায়হান বলল, যাচ্ছি তো বিমান নিয়ে, এস্টেটে ল্যাণ্ড করতে পারব তো?

পারব, ইভা জবাব দিল। ওখানে একটা এয়ারস্ট্রিপ তৈরি করিয়েছেন এলিসা ম্যাডাম, মাঝে মাঝে ছোট বিমান বা হেলিকপ্টার নিয়ে আসেন কি না! তা ছাড়া ওঁর কালেকশনের বিমানগুলো ওড়ানোর জন্যেও ব্যবহার হয় ওটা।

কালেকশন!

পুরনো বিমান সংগ্রহের ঝোঁক আছে ম্যাডামের। এয়ারস্ট্রিপের পাশে একটা হ্যাঙ্গারে রাখা হয় ওগুলো।

এয়ারক্র্যাফট হোক, বা গাড়ি… অ্যাস্ট্রিক হলে প্রচুর সময় দিতে হয়। এসবের পিছনে, রানা বলল। রেস্টোরেশন, মেইনটেন্যান্স–এসব অনেক ঝক্কি-ঝামেলার কাজ। ড. বুরেন ম্যানেজ করেন কীভাবে?

নিজে তো করেন না কিছু, বলল ইভা। মাইনে বাঁধা লোক আছে, ওরাই সব সামলায়।

রায়হান বিস্মিত গলায় বলল, নিজে যদি কিছু না-ই করবেন, তা হলে এসব কালেকশন রাখার মানেটা কী?

কাঁধ ঝাঁকাল ইভা। বড়লোকের খেয়াল… আর কী বলব একে?

সেসনার সামনে বিডিংহুইযেন শহর উদয় হলো কিছুক্ষণের মধ্যে। এবার দ্বিধা কেটে গেল ইভার, রানাকে গাইড করতে শুরু করল। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ভ্যান ব্যুরেনস এস্টেটে পৌঁছে গেল বিমানটা। দূর থেকে ম্যানরটা দেখতে পেল রানা, পিছনদিকে শখানেক গজ দূরে এয়ারস্ট্রিপটা, কিন্তু কোনও হ্যাঙ্গার চোখে পড়ল না। ব্যাপারটা ইভাকে বলতেই আঙুল তুলে স্ট্রিপের একপ্রান্তে ছোট একটা টিলা দেখাল ও। জানাল, ওটার শরীর কেটেই তৈরি করা হয়েছে। হ্যাঙ্গারটা।

বৃত্তাকার একটা পথে ঘুরে এসে এয়ারস্ট্রিপের সঙ্গে সেসনাকে অ্যালাইন করল রানা, ধীরে ধীরে ল্যাণ্ড করতে শুরু করল। মাটিতে চাকার স্পর্শ হতেই প্রবল ঝকিতে কাঁপতে শুরু করল ছোট্ট বিমাটা–স্ট্রিপটা খুব একটা ব্যবহার হয় না নিশ্চয়ই, এখানে-সেখানে ঘাস আর মাটির আস্তর পড়ে এবড়ো-থেবড়ো হয়ে আছে।

হ্যাঙ্গার থেকে ত্রিশ গজ দূরে, এয়ারস্ট্রিপের একপাশে সেসনাকে দাঁড় করাল রানা। সিটবেল্ট খুলতে খুলতে বলল, চলো নামি।

উহ্‌ আহ্‌ শব্দ করে বিমান থেকে মাটিতে পা রাখল রায়হান। বলল, এত চমৎকার একটা আকাশভ্রমণের ফিনিশিং যে ঘোড়ার পিঠে চড়ার মত ঝাঁকুনিপূর্ণ। হবে, কল্পনাও করিনি।

কথাটা শুনে খিলখিল করে হেসে ফেলল ইভা। রানাও হাসছে। ঘোড়ায় চড়ার অভ্যেস থাকলে তো ঝাঁকুনিতে অসুবিধে হবার কথা নয়। আবার এ-কথা বোলো না যে, মেরু অঞ্চলের সার্ভাইভাল ট্রেইনিঙের মত হর্স-রাইডিং-টাও ফাঁকি দিয়েছ।

উঁহ, বলে দিয়ে আবার বিপদে পড়ি আর কী!

কী বললে? রানার কপালে ভ্রুকুটি।

দাঁত দিয়ে জিভ কাটল রায়হান-মনে মনে বলতে চেয়েছিল কথাটা, অজান্তেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। চেহারাটা করুণ করে বলল, সরি, মাসুদ ভাই। ঘোড়ার গায়ের বিটকেল দুর্গন্ধ একদমই সইতে পারি না আমি। ট্রেইনিঙের সময় খুব চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু তিন দিনের বেশি টিকতে পারলাম না!

তা-ই? বাঁকা সুরে বলল রানা। চিন্তা কোরো না, এ-রোগের মহৌষধ আছে আমার কাছে।

কী, মাসুদ ভাই? সাগ্রহে জিজ্ঞেস করল রায়হান।

দেশে ফিরে ঘোড়ার আস্তাবলে সাতদিন থাকবে তুমি।

অ্যাঁ!

কীসের ট্রেইনিং বা কীসের ঘোড়া নিয়ে কথা হচ্ছে, বুঝতে পারছে না ইভা।, কিন্তু গুরু-শিষ্যের কথা বলার ভাবভঙ্গি দেখে ও হাসতে হাসতে প্রায় লুটোপুটি খাচ্ছে। রাগী চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রায়হান বলল, হয়েছে, অত হাসতে হবে না। থামো বলছি!

ও আসলেই একটা ফাঁকিবাজ, মি. রানা, বলল ইভা। ভার্সিটিতে দেখেছি তো! নিজের পছন্দের বাইরে কোনও কাজই করতে চায় না।

কী আশ্চর্য! গোমড়ামুখে বলল রায়হান। তুমি হঠাৎ আমার কুৎসা রটাতে শুরু করলে কেন?

কুৎসা কোথায়? সত্যি কথাই তো বলছি।

সত্যি কথা, না? তা হলে আমিও তোমার কীর্তি বলে দিই? মাসুদ ভাইকে বলব, কীভাবে ইনিয়ে-বিনিয়ে আমাকে প্রেমপত্র লিখেছিলে তুমি?

আমি ইনিয়ে-বিনিয়ে প্রেমপত্র লিখেছি? রেগে যাবার ভান করল ইভা।

অবশ্যই!

থামো, এখন, হাসি চাপা দিয়ে বলল রানা। এসব নিয়ে পরে ঝগড়াঝাটি করতে পারবে। আগে ড. বুরেনের সঙ্গে দেখা করে হাতের কাজটা তো সারি!

দুই সঙ্গীকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল ও-হ্যাঙ্গারের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া নুড়ি বিছানো পথটা ধরে ম্যানরের দিকে যাচ্ছে। পিছনের দরজায় পৌঁছে টোকা দিল রানা, কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে আবারও নক করল রানা। এবারও সব চুপচাপ। হাতল ঘুরিয়ে পাল্লাটা খুলতে চাইল, কিন্তু ওটা তালাবদ্ধ।

ব্যাপারটা কী? একটু বিস্মিত হয়ে বলল ও। কেউ খুলতে আসছে না কেন?

শুনতে পায়নি হয়তো, আন্দাজ করল রায়হান। এত বড় বাড়ি, না পাওয়াটাই স্বাভাবিক।

তা-ই হবে, ইভা একমত হলো। চাকরবাকর নেই এখানে। বহু বছর থেকে ম্যানরে কেউ থাকে না কি না, তাই কর্মচারী বলতে একজন মাত্র কেয়ারটেকার রাখা হয়েছে। ও হয়তো কোথাও কাজে ব্যস্ত।

তা হলে চলো সামনে দিয়ে গিয়ে চেষ্টা করি, প্রস্তাব করল রানা। ওখানে কলিং বেল আছে তো?

তা আছে।

ম্যানরের পাশ ঘুরে সামনের দিকে যেতে শুরু করল তিনজনে। পিছনদিকটা ঘুরে একটা পাশ শেষ করেছে, আর একটু এগিয়ে বাঁক নিলেই সামনে পৌঁছে যাবে… এমন সময় কানে ভেসে এল ইঞ্জিনের ভারী গর্জন।

গাড়ি স্টার্ট নেয়ার শব্দ না? ভুরু কুঁচকে বলল রায়হান।

রানাও সেটা বুঝতে পেরেছে, আর বোঝার সঙ্গে সঙ্গেই একটা শঙ্কা উদয় হলো মনে। কোনও কথা না বলে ছুটতে শুরু করল ও, দেখাদেখি রায়হান আর ইভাও। বাঁক ঘুরে সামনে পৌঁছুতেই ড্রাইভওয়েতে গাড়িটাকে দেখতে পেল ওরা–একটা ঝকঝকে ক্রাইসলার। চলতে শুরু করেছে গাড়িটা, চাকা গড়াচ্ছে রাস্তায়, বেরিয়ে যাচ্ছে ড্রাইভওয়ে থেকে। পলকের জন্য ড্রাইভিং সিটে বসা মাঝবয়েসী এক মহিলাকে দেখা গেল।

ওই তো এলিসা ম্যাডাম! বলে উঠল ইভা।

আরে, আরে! চলে যাচ্ছেন কেন? বিস্মিত কণ্ঠে বলল রায়হান।

ড. বুরেন! থামুন!! চেঁচিয়ে উঠল রানা।

ঘাড় ফিরিয়ে চিৎকারের উৎসের দিকে তাকালেন প্রৌঢ়া ইউনো, ছুটে আসতে থাকা মানুষ তিনজনকে দেখে আতঙ্ক ফুটল তাঁর চোখে। পরমুহূর্তে ওঁর হাতে একটা লুগার পিস্তল দেখতে পেল রানা, ওদের দিকে তাক করছেন। বিস্ফারিত দৃষ্টিতে অস্ত্রটার মুখে মাজুল ফ্ল্যাশ দেখতে পেল ও এবার, প্রচণ্ড আওয়াজে প্রকম্পিত হয়ে উঠল চারপাশ–এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়ছেন বিজ্ঞানী।

জীবন বাঁচানোর জন্য মাটিতে ডাইভ দিল রানা, মাথার উপর দিয়ে ছুটন্ত বুলেটের শিস শুনতে পেল। ইভাকে টান দিয়ে রায়হানও শুয়ে পড়েছে। হতভম্ব। গলায় বলল, হোয়াট দ্য হেল! ভদ্রমহিলা গুলি করছেন কেন?

এসব নিয়ে ভাবল না রানা, গুলির শব্দ থামতেই মাথা তুলে দেখে নিল অবস্থাটা। ক্লিপ বোধহয় খালি হয়ে গেছে এলিসার, সোজা হয়ে আবার ড্রাইভিঙে মন দিয়েছেন তিনি। ড্রাইভওয়ে থেকে বেরিয়ে গেছে ক্রাইসলার, ধীরে ধীরে গতি বাড়ছে। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল ও, ছুটতে শুরু করল গাড়িটার পিছু পিছু।

রিয়ারভিউ মিররে ধাবমান, যুবককে দেখতে পেয়ে আঁতকে উঠলেন বিজ্ঞানী। জানালা দিয়ে মাথা বের করে খালি পিস্তলটা নাচালেন–রানাকে ভয় দেখিয়ে নিরস্ত করবার চেষ্টা। তবে ভয় পেল না রানা, ভদ্রমহিলা যে এত দ্রুত অস্ত্রটা রিলোড করতে পারেননি–সেটা বুঝতে পারছে। প্রাণপণে দৌড়াতে থাকল ও, গাড়ি আর নিজের মাঝখানের ব্যবধানটা কমিয়ে আনছে দ্রুত।

নিরুপায় হয়ে স্পিড বাড়াতে শুরু করলেন এলিসা, তবে রানা তার আগেই নাগালের মধ্যে পৌঁছে গেছে। এক লাফে ক্রাইসলারের পিছনদিকে উঠে পড়ল ও, সেখান থেকে হাঁচড়ে-পাঁচড়ে ছাতে। যাতে পিছলে পড়ে না যায়, সেজন্যে উপুড় হয়ে ক্রসের ভঙ্গিতে শুয়ে পড়ল, দুহাতে আঁকড়ে ধরে রেখেছে ছাতের দু’পাশ।

থামুন, ড. বুরেন! চেঁচাল রানা। থামুন বলছি।

কথা শুনলেন না বিজ্ঞানী, পাগল হয়ে গেছেন যেন, চেপে ধরলেন অ্যাকসেলারেটর। হু হু করে গতি বেড়ে গেল গাড়ির, রানার মুখে চাবুক হয়ে ঝাঁপটা মারছে বাতাস। বন বন করে এবার হুইল ঘোরাতে শুরু করলেন এলিসা-সাপের মত মোচড় দিতে শুরু করল ক্রাইসলার, একবার ডানে, একবার বামে–গা ঝাড়া দেয়ার ভঙ্গিতে অনাহুত আরোহীকে ফেলে দিতে চাইছে। প্রমাদ গুণল রানা, শরীরের টানে মঠিতে শক্তি পাচ্ছে না, দুই পা এলোমেলোভাবে বেরিয়ে যাচ্ছে ছাতের উপর থেকে পড়ে যাবে যে-কোনও মুহূর্তে। তারচেয়ে বেশি ভয় পাচ্ছে ড. বুরেনকে নিয়ে–যেভাবে উন্মাদের মত ড্রাইভ করছেন, দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।

ফর গডস্ সেক! স্পিড কমান, ম্যাম। আমার কথা শুনুন!

না শোনার পণ করেছেন যেন এলিসা, দাতে দাঁত পিষে বাম দিকে প্রচণ্ড বেগে ঘোরালেন গাড়ি, পরমুহূর্তে আবার ডানে। এবার আর টিকতে পারল না রানা, ছাতের কিনার থেকে হাত ছুটে গেল, উড়ে গিয়ে এস্টেটের রাস্তার পাশের ঘেসো জমিতে আছড়ে পড়ল ও। পতনের ধাক্কায় বুক থেকে বেরিয়ে গেল সব বাতাস।

বিজ্ঞানী নিজেও ব্যালেন্স হারিয়েছেন একই সঙ্গে। পাগলা ইঞ্জিনকে বশে রাখতে পারলেন না, রাস্তার অন্যপাশে নেমে গেল ক্রাইসলার, সোজা ছুটে যাচ্ছে একসারি ওক গাছের দিকে।

প্রচণ্ড শব্দে সংঘর্ষ ঘটল। মাথা তুলে গাড়িটাকে মোটা একটা গাছের গায়ে মুখ গুঁজে থাকতে দেখল রানা, সামনের দিকটা তুবড়ে গেছে, ধোঁয়া বেরুচ্ছে। ওখান থেকে আগুন ধরে গেছে বোধহয়। শারীরিক কষ্টটাকে অগ্রাহ্য করে উঠে দাঁড়াল রানা। দৌড়াতে শুরু করল দুর্ঘটনাস্থলের দিকে, প্রৌঢ়া বিজ্ঞানীকে তাড়াতাড়ি বের করে আনতে হবে, ফুয়েল লাইনে আগুন পৌঁছে গেলে সর্বনাশ!

ড্রাইভিং সিটে এলিয়ে পড়ে আছেন এলিসা ভ্যান ব্যুরেন, কাছে গিয়ে তাড়াতাড়ি ঘাড়ের পাশে আঙুল রাখল ও। নাহ্, নিয়মিতই হার্টবিট হচ্ছে–মারা যাননি ভদ্রমহিলা। তোবড়ানো চেসিসের চাপে দরজাটা আটকে গেছে, জানালা দিয়ে অজ্ঞান দেহটা বের করে আনল রানা। এবার চোখে পড়ল কপালের কালসিটে দাগটা–এয়ারব্যাগ ঠিকমত ডেপ্লয় হয়নি ক্রাইসলারের, স্টিয়ারিং হুইলের সঙ্গে মাথা ঠুকে যাওয়ায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন বেচারি।

একটু পরেই হাঁপাতে হাঁপাতে এসে হাজির হলো রায়হান আর ইভা।

হা যিশু! ক্র্যাশ করা গাড়িটার দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠল ইভা। ম্যাডামের কিছু হয়নি তো?

হালকা আঘাত, বলল রানা। হাসপাতালে নেবার মত কিছু নয়।

তা হলে চলুন ম্যানরে নিয়ে যাই, ওখানে ফাস্ট এইডের সরঞ্জাম আছে।

বাড়িটাতে ঢোকা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছি না, রানা বলল। এলিসা ওভাবে পালাচ্ছিলেন কেন? খুনীদের ধাওয়া খেয়ে নয়তো! রায়হান, তোমরা তো পিছনে ছিলে… কাউকে দেখতে পেয়েছ?

মাথা নাড়ল তরুণ হ্যাকার। না, দেখিনি। কোনও শব্দও কানে আসেনি।

খুনী! চোখ কপালে তুলল ইভা। এলিসা ম্যাডামকে আবার খুন করতে চাইবে কে?

সেসব পরে বলব, রানা বলল। তোমরা দু’জন এখন এক কাজ করো, দৌড়ে ম্যানরে চলে যাও। ওখানে কেউ লুকিয়ে আছে কি না, খুঁজে দেখো। ড. বুরেনকে আমি নিয়ে আসছি, বাড়িতে ঢুকে কোনও ফাঁদে পড়তে চাই না।

আপনার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, ইভা বলল। ফাঁদ, মানে? কীসের ফাঁদ?

ওর হাত ধরে টান দিল রায়হান। সময়মত সবকিছু আমি ভেঙে বলব তোমাকে। এখন চলো তো!

চলে গেল তরুণ-তরুণী। এলিসার অজ্ঞান দেহটা কাঁধে তুলে নিল রানা-খুব একটা ভারী নন বিজ্ঞানী। ছিপছিপে শরীর, স্বাস্থ্যের নিয়মিত যত্ন নেন নিশ্চয়ই। আলতো করে তাকে ধরে রাখল ও, তারপর ছোট ছোট কদমে। হাঁটতে শুরু করল ম্যানরের দিকে।

.

দুঘণ্টা পর জ্ঞান ফিরল এলিসা ভ্যান বুরেনের।

ম্যানরের দোতলায়, মাস্টার বেডরুমের বিছানায় শুইয়ে রাখা হয়েছে তাকে দেয়া হয়েছে প্রয়োজনীয় সেবা-শুশ্রূষা। বাড়ির আনাচে-কানাচে, এমনকী বাইরে–আশপাশের বেশ কিছুটা জায়গা তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখেছে রানারা, কিন্তু কোনও অনুপ্রবেশকারীর দেখা পায়নি, কোনও ধরনের হামলারও চিহ্ন নেই কোথাও। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, ম্যানরের কেয়ারটেকার লোকটাও নেই বাড়িতে। তা হলে কেন এত ভয় পেলেন ভদ্রমহিলা, কেন পাগলের মত পালিয়ে যাবার চেষ্টা করলেন, কেনই বা রানাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লেন–এসব প্রশ্নের কোনও সদুত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে তার মুখেই সব শোনার জন্য অপেক্ষা করছে ওরা। মূল্যবান সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু করার কিছুই নেই। ইভা অবশ্য জিজ্ঞেস করেছিল, স্মেলিং সল্ট শুকিয়ে বা বিকল্প কোনও কায়দায় বিজ্ঞানীকে দ্রুত জাগিয়ে তুলবার একটা চেষ্টা করবে কি না, রানা রাজি হয়নি। ভয় পাবার পাশাপাশি অ্যাকসিডেন্টের ফলে শ পেয়েছেন তিনি, জোর করে জ্ঞান ফেরালে হিতে বিপরীত হতে পারে। তাড়াহুড়োর ফল কখনও ভাল। হয় না, তারচেয়ে শরীরকে তার নিজস্ব নিয়মে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে দেয়াটাই মঙ্গল।

ধীরে ধীরে চোখ মেললেন এলিসা, বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকালেন, যেন বুঝতে পারছেন না কিছু। কথা বললেন না, এদিক-সেদিক তাকাবার চেষ্টা করলেন

কেমন বোধ করছেন? একটু ঝুঁকে আন্তরিক কণ্ঠে জানতে চাইল রানা।

জবাব দিলেন না প্রৌঢ়া বিজ্ঞানী, এক হাত তুলে,কপালটা পরখ করলেন। ব্যাণ্ডেজটা হাতড়ে দেখতে দেখতে দৃষ্টি স্বাভাবিক হয়ে এল তাঁর; বোঝা গেল, সব মনে পড়ে যাচ্ছে।

অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল আপনার মনে আছে?

মাথা ঝাঁকালেন এলিসা। তীক্ষ্ণ চোখে রানাকে দেখলেন একটু, পরক্ষণেই ভয়ার্ত একটা ভাব ফুটে উঠল তার চেহারায়। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, আ… আপনি আমাকে ধাওয়া করছিলেন…।

রিল্যাক্স! আশ্বাস দেয়ার ভঙ্গিতে বলল রানা। আমাকে ভয় পাবার কিছু নেই। আমি মাসুদ রানা, আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসছিলাম। ফোনে কথা হয়েছিল, ভুলে যাননি নিশ্চয়ই?

আপনার তো পাঁচ ঘণ্টা পরে আসবার কথা, আড়াই ঘণ্টায় পৌঁছুলেন কী করে?

বিমানে এসেছি আমরা।

আমরা!

ইঙ্গিতে দুই সঙ্গীকে দেখাল রানা। রায়হান রশিদ… আর ইভাকে তো আপনি চেনেনই।

ও…ওটা আপনাদের বিমান ছিল? বিস্মিত হয়ে বললেন এলিসা। আমি তো ওটার শব্দ শুনেই কেটে পড়তে যাচ্ছিলাম। ভেবেছিলাম, বোধহয় আমাকে মারতে আসছে কেউ।

সে-কারণেই আমাদের দিকে গুলি করেছিলেন? পিস্তল পেয়েছেন কোথায়?

আত্মরক্ষার জন্য একটা রাখি আজকাল। বিব্রত একটা ভাব ফুটল এলিসার চেহারায়।

সরি, খুব ভুল হয়ে গেছে। আসলে আপনাকে আগে কখনও দেখিনি কি না! চিনব কী করে, বলুন?

আপনার সেক্রেটারি তো ছিল! বলল রায়হান। ওকে দেখেও বুঝতে পারেননি, আমরা কারা?

ভয়ে মাথা কাজ করছিল না, ওকে লক্ষই করিনি, বললেন এলিসা।

দুঃখিত, আপনারা কেউ আহত হননি তো?

তা হইনি, রানা বলল। পাগলামি করতে গিয়ে উল্টো আহত হয়েছেন তো আপনি! কেমন বোধ করছেন এখন… কোনও অসুবিধে?

মাথাটা ব্যথা করছে খুব…

আমি এক্ষুণি কফি নিয়ে আসছি। বলে বেরিয়ে গেল ইভা।

আপনার কেয়ারটেকারকে কোথাও খুঁজে পাইনি আমরা, রায়হান বলল।

সে কোথায়?

মা অসুস্থ, তাই গত দুমাস থেকে ছুটিতে আছে, বললেন এলিসা।

এলাকায় সবাই জানে, ম্যানর এখন খালি, কেউ নেই। সেজন্যেই এখানে লুকোতে এসেছিলাম, মনে হচ্ছিল চুপচাপ কয়েকটা দিন কাটিয়ে দেয়া যাবে। এস্টেটে এমনিতেই লোকজনের আনাগোনা কম, বাড়ি খালি হলে তো আসবারই কথা নয় কারও।

চোর-ছ্যাঁচোড় আসতে পারে না?

এ-বাড়িতে দামি জিনিসপত্র বলতে তেমন কিছু নেই। চোরেরা জানে সে-কথা।

কিন্তু আপনার হ্যাঙ্গারে অ্যান্টিক বিমান আছে বলে শুনলাম, সেগুলো নিশ্চয়ই দামি?

বিমান চুরি করা কি চাট্টিখানি কথা? একটু হাসলেন বিজ্ঞানী। নেবে কীভাবে, লুকাবে কোথায়? ধরা পড়ে যাবে না? তা ছাড়া হ্যাঙ্গারে অটোমেটিক অ্যালার্ম সিস্টেম আছে। কালেকশনটা সম্পূর্ণ নিরাপদ।

আচ্ছা! বুঝতে পেরে মাথা ঝাঁকাল রায়হান।

ডক্টর, কাজের কথায় এল রানা, যে-সমস্যাটার ব্যাপারে আপনার কাছে। এসেছি, সেটা খুলে বলতে পারি এখন?

ওর কথা যেন শুনতেই পাচ্ছেন না এলিসা, ডান হাতের কবজিতে বাঁধা হাতঘড়িটাতে টোকা দিচ্ছেন–অ্যাকসিডেন্টের সময় ঝাঁকি খেয়ে বন্ধ হয়ে গেছে ওটা। চালু হচ্ছে না দেখে জিজ্ঞেস করলেন, এখন কটা বাজে?

নিজের ঘড়ি দেখল রায়হান। দুপুর হয়ে গেছে। একটা বাজে।

কথাটা শুনে একটু চঞ্চল হয়ে উঠলেন যেন বিজ্ঞানী।

মনে মনে হিসেব করে রানা বলল, তার মানে আর মাত্র তেরো ঘণ্টা বাকি ডেডলাইনের।

ডেডলাইন! অবাক হলেন এলিসা।

হ্যাঁ, ম্যাম, রানা বলল। তেরো ঘণ্টা পর ভয়ঙ্কর একটা কম্পিউটার-ভাইরাস আঘাত হানতে যাচ্ছে সারা পৃথিবী জুড়ে। কম্পিউটার-জগৎকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেবে ওটা।

সেটার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী?

ওটা ইউনোকোডে তৈরি, ম্যাম। আর আমাদের ধারণা, ভাইরাসটাকে প্রতিরোধ করবার মত কেউ যাতে বেঁচে না থাকে, সেটা নিশ্চিত করতেই ইউনোদের খুন করা হচ্ছে।

কী বলছেন!

ব্যাপারটা সত্যি। ভাইরাসটার কপি রয়েছে আমাদের কাছে।

এ… এটা অবিশ্বাস্য। ইউনোকোডের ভাইরাস তো একজন ইউনো ছাড়া আর কারও পক্ষে তৈরি করা সম্ভব নয়!

তীক্ষ্ণ চোখে রানা আর রায়হানের দিকে তাকালেন এলিসা, চেহারায় কী যেন খুঁজছেন। থমথমে গলায় বললেন, আমার বন্ধুরা সবাই মারা গেছে–ইউনোদের মধ্যে একমাত্র আমিই বেঁচে আছি। আপনাদের কি ধারণা, ভাইরাসটা আমার বানানো? সে-কারণেই এসেছেন এখানে?

তা ভাবছি না আমরা, ম্যাম, রায়হান মাথা নাড়ল। ড. ডোনেন আমাদের বলেছেন, আপনাদের বাইরে একাদশ একজন ইউনো আছে। এসব সম্ভবত তারই কীর্তি।

ওটা স্ট্যানলির কল্পনাবিলাস, মি. রশিদ-আমিও শুনেছি। এগারো নম্বর ইউনো বলে কেউ নেই… থাকতে পারে না।

তা হলে এই ভাইরাসটা এল কোত্থেকে, বলতে পারেন? একটা সিডি তুলে দেখাল তরুণ হ্যাকার। ওর রেখে আসা ল্যাপটপ কম্পিউটার থেকে ভাইরাসটার একটা কপি রানা এজেন্সির লস অ্যাঞ্জেলেস শাখাপ্রধান নাফিজ ইমতিয়াজ পাঠিয়ে দিয়েছিল মরক্কোতে, অ্যামস্টারড্যামে আসবার পথে ওটা নিয়ে এসেছে রায়হান।

ওর প্রশ্ন শুনে মাথা নাড়লেন এলিসা। বললেন, তা আমি বলতে পারব না। ওটা আসলে ইউনোকোডে তৈরি ভাইরাস কি না, সেটা আগে পরীক্ষা করে দেখতে হবে আমাকে।

শুধু পরীক্ষা করলেই হবে না, ডক্টর, বলল রানা। ওটার একটা অ্যান্টিডোটও তৈরি করতে হবে আপনাকে… মানে একটা অ্যান্টিভাইরাস। সেজন্যেই আপনার কাছে এসেছি আমরা। পারবেন?

যদি ইউনোকোডেরই ব্যাপার হয়ে থাকে, তা হলে নিশ্চয়ই পারব, জোর দিয়ে বললেন এলিসা। তবে এখানে বসে কিছু করার নেই আমার, আলমিরে যেতে হবে… আমার বাড়িতে। ইউনোকোডে কাজ করবার মত আমার সমস্ত রিসোর্স রয়ে গেছে ওখানে।

অ্যান্টিভাইরাসটা তৈরি করতে কতটা সময় লাগবে?

ভাইরাসটা না দেখা পর্যন্ত বলি কী করে? কয়েক ঘণ্টা তো বটেই… কয়েক দিনও লেগে যেতে পারে।

তা হলে তো এক্ষুণি কাজটা শুরু করে দেয়া দরকার, রানা বলল।

আমিও তা-ই বলছি, সায় দিলেন এলিসা। বিছানা থেকে নেমে পড়লেন।

আপনাদের সঙ্গে বিমান আছে না? চলুন… আমাকে বাড়িতে নিয়ে চলুন।

মাথা ঝাঁকিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল রানা আর রায়হান। ট্রে হাতে এই

সময় দরজায় উদয় হলো ইভা-কফি নিয়ে এসেছে।

ম্যাডাম, কফি।

রেখে দাও, বললেন এলিসা। আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে, এখুনি রওনা দিতে হবে।

খেয়েই নিন, রানা বলল। মাথাব্যথাটা কেটে যাবে, সুস্থ বোধ করবেন। দেরি তো যা হবার এমনিতেও হয়েছে, আর দু-চার মিনিটে কিচ্ছু হবে না।

অসহায়ভাবে ওর দিকে একবার তাকালেন প্রৌঢ়া বিজ্ঞানী, তারপর তুলে নিলেন কাপটা। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খালি করলেন ওটা, চেহারা দেখেই বোঝা গেল–তাড়াহুড়োয় জিভ পুড়িয়ে ফেলেছেন।

চলুন, চলুন, আর দেরি করাটা ঠিক হবে না, খালি কাপটা নামিয়ে রেখে বললেন এলিসা।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল চারজনে। পিছনের নুড়ি বিছানো ওয়াকওয়ে ধরে দ্রুত হাঁটছে এয়ারস্ট্রিপের দিকে–সামনে রানা, ওর পিছনে ড. বুরেন, ইভা আর রায়হান।

হ্যাঙ্গারের দরজার সামনে পৌঁছেছে মাত্র, এমন সময় রোটরের শব্দে সচকিত হয়ে উঠল ওরা। চোখের পলকে একটা বেল হেলিকপ্টার উদয় হলো, মাথার উপরে চক্কর দিচ্ছে ওটা। থমকে দাঁড়াল রানারা, আকাশানটার উদ্দেশ্য বোঝার চেষ্টা করছে। উড়ে গিয়ে ল্যাণ্ড করা সেসনাটার উপরে গিয়ে স্থির হলো হেলিকপ্টার, ওটা থেকে কিছু একটা ফেলা হলো নীচে। গড়িয়ে জিনিসটা চলে গেল বিমানের তলায়। জ্বলতে থাকা ফিউযটা দেখেই ওটা কী বুঝে ফেলল রানা।

ডিনামাইট!

গেট ব্যাক! চেঁচিয়ে উঠল ও। গেট ব্যাক এভরিবডি!

পরমুহূর্তেই বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটল–চার জোড়া বিস্ফারিত চোখের সামনে টুকরো টুকরো হয়ে গেল ছোট্ট সেসনাটা।

.

০৭.

শকওয়েভের ধাক্কায় মাটিতে আছড়ে পড়ল রানা আর ওর সঙ্গীরা–মাথা ভো ভো করছে শব্দের প্রচণ্ডতায়।

কোনওমতে নিজেদের সামলে মাথা তুলল চারজনে। ব্যস্ত চোখে চারপাশটা জরিপ করল রানা, আড়াল খুঁজছে।

হায়, হায়! বলে উঠল ইভা। আমাদের বিমান… ওটা… ওটা… ঘটনার আকস্মিকতায় ভাষা হারিয়েছে ও।

গেছে… সিকিউরিটি ডিপোজিটের টাকাটা চিরতরে গেছে! স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে কৌতুক করল রায়হান।

লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল রানা। বিস্ফোরণে নিজেদের যেন কোনও ক্ষতি না হয়, সেজন্য একটু দূরে সরে গেছে হেলিকপ্টারটা, ফিরে আসবে এখুনি, তার। আগেই গা-ঢাকা দিতে হবে।

ড. বুরেন! আমাদের কাভার নিতে হবে। হ্যাঙ্গারে ঢোকা যাবে?

মাথা ঝাঁকিয়ে উঠে দাঁড়ালেন প্রৌঢ়া ইউনো, ছুটতে শুরু করলেন হ্যাঙ্গারের বিশাল প্রবেশপথের দিকে, পিছু পিছু বাকিরা। ব্লাস্ট ডোরের পাশে একটা ছোট প্যানেল–সেটার সামনে পৌঁছে তাড়াতাড়ি অ্যাকসেস কোড পাঞ্চ করতে শুরু করলেন বিজ্ঞানী।

পিছনে গুরুগম্ভীর আওয়াজ শুনে মাথা ঘোরাল রানা, আঁতকে উঠল হেলিকপ্টারটাকে ছুটে আসতে দেখে। দু’পাশের দরজা খোলা ওটার, মেশিনগান তাক করে সেখানে বসে আছে দু’জন, রেঞ্জের মধ্যে পৌঁছুলেই গুলি করতে শুরু করবে।

ফর গডস সেক, ডক্টর! তাড়া দিল রানা। তাড়াতাড়ি করুন।

দুহাত রীতিমত কাঁপছে এলিসার, প্যানেলের বাটনগুলো টিপতে পারছেন ঠিকমত, একটার জায়গায় অন্যটায় চাপ পড়ে যাচ্ছে। অবস্থাটা লক্ষ করে তাঁকে সরিয়ে আনল রায়হান। বলল, আমি দেখছি ব্যাপারটা। কোডটা বলুন।

মাথা ঝাঁকিয়ে বলতে শুরু করলেন বিজ্ঞানী, সিক্স… ওয়ান… টু… ওয়ান… ফোর… ওয়ান… টু… ফাইভ… যিরো… এইট!

ক্র্যাং জাতীয় একটা সঙ্কেত শুনে বোঝা গেল, নিষ্ক্রিয় হয়েছে সিকিউরিটি সিস্টেম। এবার হিস হিস শব্দে খুলতে শুরু করল হ্যাঙ্গারের যন্ত্রচালিত পাল্লা, দু’পাশে সরে যাচ্ছে। রোটরের শব্দকে ছাপিয়ে পিছনে গুলি ছোঁড়ার আওয়াজ হলো, হেলিকপ্টার থেকে ফায়ার করছে দুবৃত্তরা, শিকারকে হাতছাড়া করতে চায় না।

আর দেরি করল না রানা, দরজা যতটুকু ফাঁকা হয়েছে, তার মধ্য দিয়েই ধাক্কা দিয়ে ঢুকিয়ে দিল তিন সঙ্গীকে; নিজেও সবার শেষে ডাইভ দিয়ে ঢুকে পড়ল হ্যাঙ্গারে। ওর পিছু পিছু দুই সারিতে ছুটে এল বুলেটবৃষ্টি, ধুলো ওড়াচ্ছে, শেষ কয়েকটা ঠক্ ঠক করে বিধল হ্যাঙ্গারের দরজায়।

বন্ধ করো! চেঁচিয়ে উঠল রানা। বন্ধ করো দরজা!

একছুটে ভিতরদিককার প্যানেলের দিকে ছুটে গেল রায়হান, ক্লোজ বাটন টিপে দিল। আবার বন্ধ হয়ে যেতে শুরু করল ব্লাস্ট ডোর। শেষ মুহূর্তে ফাঁকা দিয়ে তাকাল রানা, হেলিকপ্টারটাকে ল্যাণ্ড করতে দেখল, সশস্ত্র ছজন খুনী নেমে আসছে ওটা থেকে। এরপরই আটকে গেল পাল্লা, নিকষ অন্ধকারে ছেয়ে গেল হ্যাঙ্গারের ভিতরটা। খুটখাট শব্দ শোনা গেল, প্যানেলের পাশের একটা সুইচ টিপে আলো জ্বালল রায়হান।

ক… কে ওরা? হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করল ইভা। কেন আমাদের উপর হামলা করছে?

জবাব দিতে পারল না রানা, এলিসা এগিয়ে এসেছেন ওর দিকে, থর থর করে কাঁপছেন প্রৌঢ়া ইউনো। ভীত গলায় বললেন, ওরা এসে পড়েছে, মি. রানা। এবার আমার পালা!

এত ভয় পাচ্ছেন কেন? হালকা গলায় বলল রানা। আমরা আছি?

হ্যাঙ্গারের দরজায় ধাতব শব্দে কেঁপে উঠলেন এলিসা। ওপাশ থেকে গুলি করা হচ্ছে–পাল্লাটা কতটা শক্ত সেটাই পরীক্ষা করা হচ্ছে বোধহয়।

কী-ই বা করবেন আপনারা! আতঙ্কিত স্বরে বললেন বিজ্ঞানী। ওরা প্রফেশনাল খুনী, নিশ্চয়ই পুরো প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে। ভিতরে ঢুকে নির্বিচারে খুন করবে আমাদের।

চুপচাপ খুন হতে আপত্তি আছে আমার, শান্ত গলায় বলল রানা, যদিও পরিস্থিতির প্রতিকূলতা ভাল করেই বুঝতে পারছে। প্রতিপক্ষ নিঃসন্দেহে সংখ্যায় ভারি, সেই সঙ্গে অত্যাধুনিক অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত। অথচ ওর আর রায়হানের কাছে শুধু দুটো অটোমেটিক পিস্তল ছাড়া আর কিছু নেই, অ্যামিউনিশনের পরিমাণও সীমিত। করণীয় ঠিক করতে চারপাশটা দেখল ও। শত্রুরা যাতে এখানে ঢুকতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে প্রথমে। তাই জিজ্ঞেস করল, ব্লাস্ট ডোর ছাড়া হ্যাঙ্গারে ঢোকার আর কোনও পথ আছে?

মাথা ঝাঁকালেন এলিসা। পিছনে… সার্ভিস এন্ট্রান্স।

রায়হান…

আমি এক্ষুণি বন্ধ করছি ওটা। বলে ছুটে চলে গেল তরুণ হ্যাকার।

দরজা আটকে কোনও লাভ নেই, মি. রানা, ইভা বলল। লোকগুলোর কাছে বোমা আছে, দরজা উড়িয়ে দিতে পারবে।

শ্রাগ করল রানা, ব্যাপারটা ও-ও জানে। সামনের ব্লাস্ট ডোরের পাল্লা অবশ্য অনেক পুরু, ওটা সহজে হার মানবে না; কিন্তু সার্ভিস এন্ট্রান্সে নিশ্চয়ই সাধারণ দরজাই ব্যবহার করা হয়েছে। ওটা সহজেই ভেঙে ফেলতে পারবে দুবৃত্তরা।

রায়হান ফিরে এসে ওর আশঙ্কাটাই সত্যি বলে প্রমাণ করল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ছিটকিনি লাগিয়ে দিয়ে এসেছি, ইলেকট্রনিক লকও আছে–কিন্তু জিনিসটা তেমন জুতসই নয়, মাসুদ ভাই। গুলি করেই তালা-ছিটকিনি সব ভেঙে ফেলা যাবে… ওদের কাছে তো ডিনামাইটও আছে।

সঙ্গে খুব বেশি ডিনামাইট আছে বলে মনে হয় না… এ-ধরনের ব্লাস্ট ডোর ভাঙতে হবে, ওরা সেটা নিশ্চয়ই আগে থেকে জানত না? রানা মাথা নাড়ল। ওদের স্টক ওই সামনের দরজাতেই খরচ হয়ে যাবে।

সামনে ব্যবহার করবে কেন? বিস্মিত কণ্ঠে বলল ইভা। রায়হান কী বলল, শোনেননি? পিছনের দরজাটা দুর্বল, বোমা ফাটাতে হলে ওখানে ফাটাবে।

না, রানা বলল। ওটা ছোট দরজা, একসঙ্গে একজন-দু’জনের বেশি ঢুকতে পারবে না ওরা। আমরা সহজেই গুলি করে ফেলে দিতে পারব। এ-ধরনের পরিস্থিতিতে দ্বিমুখী আক্রমণ চালাতে হয়, তাই দু’পাশ দিয়ে ঢুকতে চেষ্টা করবে ওরা। সামনে দিয়ে ঢুকতে হলে ওখানে ডিনামাইট ব্যবহার করা ছাড়া উপায় নেই। পিছনের দরজাটা ওরা সম্ভবত গুলি করেই ভাঙতে চেষ্টা রবে।

তা হলে?

সামনে আপাতত কিছু করার নেই, তা ছাড়া পাল্লাদুটো ভাঙতেও সময় নেবে। চলো, পিছনে ওদের কাজ বাড়াই।

সঙ্গীদের নিয়ে সার্ভিস ডোরের দিকে ছুটল রানা। আশপাশে যত টুল চেস্ট, বেঞ্চ আর স্টোরেজ লকার পেল, সব নিয়ে ঠেস দিল দরজাটার গায়ে। ব্যারিকেডটা আক্রমণকারীদের কিছুক্ষণের জন্যে হলেও ঠেকিয়ে রাখবে। কাজ শেষে হ্যাঙ্গারের মাঝখানে ফিরে এল সবাই।

এবার ভিতরে রাখা বিমানগুলোর উপর নজর দিল রানা–সব মিলিয়ে পাঁচটা আকাশযান আছে। দুটো ফ্লোট প্লেন, একটা পুরনো আমলের গ্লাইডার, একটা হচ্ছে সিঙ্গেল ইঞ্জিনের বাইপ্লেন, আর সব শেষ বিমানটা অতিকায়… দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আমলের একটা বি-২৫ মিচেল বম্বার-রেস্টোরেশনের জাদুতে নতুনের মত ঝকঝক করছে।

ওটা আমার বাবার পুরনো বিমান, রানার আগ্রহী দৃষ্টি লক্ষ করে বললেন এলিসা। যুদ্ধের সময় এটা নিয়েই অনেক অভিযানে গেছেন তিনি। কয়েক বছর আগে বাতিল অবস্থায় কিনে নিয়েছি আমি।

রেস্টোরেশন করা হয়েছে দেখছি, রানা বলল। এটা ওড়ানো যায়?

যন্ত্রপাতি সবই মেরামত করা হয়েছে, এলিসা বললেন, মাসদুয়েক আগে ইঞ্জিন টেস্ট করিয়েছিলাম, তাতেও কোনও ত্রুটি পাওয়া যায়নি… তবে উড়বে কি না, তা বলতে পারছি না। ওটা পরীক্ষা করে দেখা হয়নি।

বিস্মিত দৃষ্টিতে রানার দিকে তাকাল রায়হান। বলল, মতলবটা কী আঁটছেন, বলুন তো, মাসুদ ভাই? আপনি নিশ্চয়ই এটা নিয়ে…

ঠিকই আন্দাজ করেছ, রানা সায় দিল। জনবল বা ফায়ারপাওয়ার–কোনওটাতেই পেরে উঠব না আমরা। তারচেয়ে কেটে পড়বার চেষ্টা করাটাই কি যুক্তিসঙ্গত নয়?

তাই বলে এই মান্ধাতার আমলের বিমানে? টেকঅফই হয়তো করবে না ওটা!

শুরুতেই হতাশ হও কেন?, যন্ত্রপাতিকে এত অবহেলা করা উচিত নয়–ফোক্সভাগেন গাড়ি দেখোনি, সেই কোন্ আমলে তৈরি হয়েছিল, অথচ আজও চলে।

এটা কোনও ফোক্সভাগেন গাড়ি নয়, মাসুদ ভাই। কমপক্ষে তেষট্টি বছরের পুরনো যুদ্ধবিমান,

রিস্টোর করা, যোগ করল রানা। ইঞ্জিনে সমস্যা নেই যখন, উড়তে পারবে না কেন?

উড়তে গেলে শুধু ইঞ্জিন নয়, ডানা-ফ্ল্যাপ-অ্যালেরন… অনেক কিছুর প্রয়োজন হয়। সেগুলো ঠিক আছে কি না, বুঝব কীভাবে?

নিশ্চিত হবার উপায় তো একটাই, তাই না?

রায়হানকে নিয়ে বি-২৫-এর দিকে এগিয়ে গেল রানা, চারপাশ থেকে ফিউজলাজটা ঘুরে-ফিরে দেখল।

স্ট্রাকচারাল কোনও সমস্যা দেখতে পাচ্ছি না, মন্তব্য করল ও, তাকাল সঙ্গীর দিকে। তোমার কী মনে হয়?

হ্যাঁ, স্বীকার করল রায়হান। সব অক্ষতই মনে হচ্ছে। কিন্তু ফ্লাই করবার পর হাজারটা সমস্যা দেখা দিতে পারে।

যখনকারটা তখন দেখা যাবে, রানা বলল। তা ছাড়া এটা নিয়ে আমরা আটলান্টিক পাড়ি দিতে যাচ্ছি না, শুধু এস্টেট থেকে বেরুতে পারলে হয়, তারপর নিরাপদ একটা জায়গায় ল্যাণ্ড করে ফেলব।

ওদের দিকে এগিয়ে এলেন এলিসা। আপনারা এই বিমানটা নিয়ে এভাবে মেতে উঠলেন কেন, জানতে পারি?

ভদ্রমহিলার দিকে ফিরল রানা। এস্টেট থেকে পালাতে হবে আমাদের, ডক্টর। আর হেলিকপ্টারকে শুধু বিমানই পিছে ফেলতে পারে।

এমনভাবে বলছেন যেন হাওয়া খেতে বেরুবেন! ইউনোর কণ্ঠে বিস্ময়। বাইরের ওরা টেকঅফ করতে দেবে আমাদের? গুলি করবে না?

করবে, রানা মাথা ঝাঁকাল। আর সেজন্যেই ছোট বিমানগুলোর দিকে না তাকিয়ে এটার উপর নজর দিচ্ছি। স্মল আর্মস দিয়ে গুলি করে অন্তত একটা বম্বারকে থামানো সম্ভব নয়। যতই গুলি লাগুক, আমরা টেকঅফ করতে পারব।

অকাট্য যুক্তি শুনে কাঁধ ঝাঁকালেন এলিসা, পিছিয়ে গেলেন।

চাকাগুলোয় খুব একটা বাতাস নেই, মাসুদ ভাই, একটা টায়ার পরীক্ষা করে বলল রায়হান। যেরকম এবড়োথেবড়ো রানওয়ে, তাতে হুমড়ি খেয়ে পড়ব। বাতাস ভরতে হবে।

ওদিকে এয়ারহোস দেখেছি, রানা আঙুল তুলল। চলো, নিয়ে আসি।

সময় কিন্তু নেই খুব একটা। ব্যাটারা যে-কোনও মুহূর্তে ঢুকে পড়বে।

আগে বাইরের দিককার চাকায় হাওয়া দেব, ছুটতে শুরু করে বলল রানা। সময় পেলে ভিতরেরগুলোয়।

হ্যাঙ্গারের একপাশের দেয়ালের ব্রাকেট থেকে এয়ারহোস খুলে আনল ওরা, পাম্প চালু করে বি-২৫-এর টায়ারগুলো ফোলাতে শুরু করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই কম্প্রেসরের হিসহিসানি, ছাপিয়ে ভেসে এল সার্ভিস ডোরের উপর গুলিবর্ষণের শব্দ। প্রায় একই সময়ে সামনের দিকেও গুমগুম ধ্বনি শোনা গেল–ডিনামাইট ফাটাতে শুরু করেছে হামলাকারীরা। Fর হাত থেকে এয়ারহোস ফেলে দিল রানা–পিছনের দটো আউটার টায়ার আর নোজ হুইলের চাকায় যথেষ্ট পরিমাণ বাতাস ভরা গেছে, আপাতত টেকঅফ করতে অসুবিধে হবে বলে মনে হয় না। সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে বলল, বিমানে উঠে পড়ো সবাই। রায়হান, তুমিও।

আপনি? জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল রায়হান।

দরজাটা খুলতে হবে কেউ একজনকে, ভুলে গেছ?

আপনি কেন? আমিই তো পারি।

না, তুমি আমাদের পাইলট। লড়াইয়ের দিকটা আমি সামলাব।

ঢোঁক গিলল তরুণ হ্যাকার। এই মুড়ির টিনটা আমাকে ওড়াতে হবে?

কেন, বিমান চালানোর ট্রেইনিঙেও ফাঁকি দিয়েছ নাকি?

তা দিইনি, তবে সিলেবাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার কোনও বম্বার চালানোর টপিক ছিল না।

বেসিক নিয়মকানুন সবই এক, খুব একটা সমস্যা হবে না, রানা সাহস জোগাল। যাও, দেরি কোরো না। ইঞ্জিন স্টার্ট দাও, পাল্লা খুলে যাবার পর আমরা খুব একটা সময় পাবো না।

পাল্লা না হয় খুললেন, আপনি চড়বেন কীভাবে?

বেলি-হ্যাচটা খোলা রেখো। যাও।

আদেশ পেয়ে আর দ্বিধা করল না রায়হান, ড. বুরেন আর ইভাকে নিয়ে উঠে পড়ল বম্বারে। রানা চলে গেল প্যানেলের সামনে, রায়হানের সঙ্কেত পেলে দরজা খুলে দেবে। হ্যাঙ্গারের পিছনে গুলিবর্ষণ বাড়ছে প্রতি মুহূর্তে, সামনেও আরেকবার বিস্ফোরণের শব্দ হলো–শত্রুরা মরিয়া হয়ে উঠছে।

কাঁচ মোড়া ককপিটে পাইলটের উঁচু সিটে গিয়ে বসল রায়হান, প্রি-ফ্লাইট চেক করবে। প্যানেলের গজগুলোর কাঁচ ঘোলা হয়ে গেছে বয়সের ভারে, ঠিকমত দেখা যাচ্ছে না কিছু। ঢোঁক গিলে সাহস সঞ্চয়ের চেষ্টা করল ও-কাজটা সহজ হবে না মোটেই। দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলে মনকে প্রশান্ত করবার চেষ্টা করল, মাথাটা পরিষ্কার থাকলে ফ্লাইঙের কায়দাকানুন নিয়ে ভাবতে হবে না, সহজাতভাবেই আঙুলের ডগায় চলে আসবে সবকিছু। ঘোলা ডায়ালগুলো নিয়ে চিন্তা করল না আর, সবকটার উপর সারাক্ষণ নজর রাখতে হয় না পাইলটকে। যেগুলো প্রয়োজনীয়, সেগুলো রুমাল দিয়ে মুছে নিল ও। তারপর দ্রুত সিস্টেমস্ চেক করতে শুরু করল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সন্তুষ্টি বোধ। করল–কোথাও কোনও ঝামেলা দেখতে পাচ্ছে না।

দুই পাইলটের সিটের মাঝখানের কনসোলে রয়েছে ফুয়েল আর এয়ারস্পিড় গজ, সেই সঙ্গে রেডিও-সেখানে প্রজাপতির মত নেচে বেড়াল রায়হানের আঙুল, পুরো কনসোলই এবার পিনবল মেশিনের মত আলোয় ভরে গেল। এবার আল্লাহকে ডাকতে ডাকতে ইগনিশন সুইচ অন করল ও, সঙ্গে সঙ্গে ক্রুদ্ধ বাঘের মত গর্জন করে উঠল টারবাইন–ককপিটের কাঁচ ভেদ করে ডানাগুলোর দিকে তাকাতেই পাখাগুলোকে ধীরে ধীরে ঘুরতে দেখা গেল।

প্রপেলারের গগনবিদারী আওয়াজ বাড়ছে ক্রমেই, বাড়ছে পাখার ঘূর্ণন,.. রায়হান বুঝতে পারল, ঠিকমতই কাজ করছে ইঞ্জিনগুলো। বুড়ো আঙুল তুলে রানাকে সঙ্কেত দিল ও।

হ্যাঙ্গারের দরজার সুইচ টিপে দিল রানা, তারপর ছুটতে শুরু করল। বি-২৫-এর দিকে। পলকের জন্য ব্লাস্ট ডোরের ফাঁক হওয়া জায়গাটায় একটা ছায়ামূর্তি দেখতে পেল ও-ওর দিকে একটা মেশিনগান তাক করছে। দৌড়ের গতি কমাল না রানা, ছুটন্ত অবস্থাতেই পিস্তল তুলে গুলি করল, বিশাল হ্যাঙ্গারের ভিতরে প্রতিধ্বনি তুলল আওয়াজটা। টলে উঠল ছায়ামূর্তি, হাত থেকে খসে পড়ল মেশিনগানটা, কাঁধ চেপে ধরে সরে গেল হ্যাঙ্গারের মুখ থেকে।

ঠিক তখুনি সার্ভিস ডোর ভেঙে ভিতরে ঢুকল হামলাকারীদের দ্বিতীয় দল। পিস্তল তুলে গুলি করতে গেল রানা, কিন্তু তার প্রয়োজন হলো না। প্রচণ্ড শব্দে প্রপেলারের পিছন দিয়ে বেরুতে থাকা বাতাসের ব্যাকড্রাফটের সামনে পড়ে গেল লোকগুলো, খড়কুটোর মত উড়ে গিয়ে আছড়ে পড়ল হ্যাঙ্গারের দেয়ালে। দৃশ্যটা দেখে চওড়া হাসি ফুটল রানার ঠোঁটে। হ্যাঁচ গলে বিমানে উঠে পড়ল ও।

ইভা আর এলিসা রয়েছেন ক্রু-কম্পার্টমেন্টে, ওদেরকে সিটবেল্ট বাঁধতে বলে ককপিটে গিয়ে ঢুকল রানা। বলল, এবার তোমার শো, রায়হান। কেমন বুঝছ অবস্থা?

ফুয়েল ফিড অ্যাডজাস্ট করছে তরুণ হ্যাকার, থ্রটলগুলো ঠেলে রেখেছে। সামনের দিকে, ইঞ্জিনগুলোকে ক্রমান্বয়ে নিয়ে যাচ্ছে ফুল পাওয়ারে; এখনও ব্রেক রিলিজ করেনি, ব্লাস্ট ডোর পুরোপুরি খুলে গেলে করবে। রানার প্রশ্নের জবাবে জানাল, বয়সটা বিবেচনায় রাখলে এই বুড়িটার পারফর্মেন্স চমৎকার বলতে হবে।

টেকঅফ করা যাবে তো?

মনে তো হয়।

সামনের দিকে আঠার মত সেঁটে রয়েছে রায়হানের দৃষ্টি। বেরুবার মত ফাঁক পেলেই আগে বাড়বে। মানুষ ঢোকার মত জায়গা হয়ে গেছে ইতোমধ্যেই, তারপরও হামলাকারীরা কেউ ভিতরে ঢুকছে না, সম্ভবত রানার গুলিতে একজন আহত হওয়ায় ভয় পেয়েছে তারা। ধীরে ধীরে দু’পাশে সরে যাচ্ছে ব্লাস্ট ডোর, আধাআধি পৌঁছে থামল একবার-ডিনামাইটের বিস্ফোরণে- আঁকাবাঁকা হয়ে যাওয়া একটা অংশ আটকে গেছে দেয়ালের কাছে গিয়ে। তবে বেশিক্ষণ থাকল না ওভাবে, শক্তিশালী মোটর টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে গেল পাল্লাটাকে।

এবার, রায়হান! এবার!! গ্যাপটাকে বড় হতে দেখে চেঁচিয়ে উঠল রানা।

মাথা ঝাঁকিয়ে ব্রেক রিলিজ করল রায়হান, একই সঙ্গে থ্রটল ঠেলে দিল আরও সামনের দিকে। মেঝেতে ঘষা খেয়ে ঘুরতে শুরু করল বম্বারের চাকা, জ্যা-মুক্ত তীরের মত এগোল নাক বরাবর। গগনবিদারী আওয়াজ তুলে হ্যাঙ্গার থেকে বেরিয়ে এল বি-২৫।

.

০৮.

অতিকায়, যুদ্ধবিমানটাকে হ্যাঙ্গার থেকে বেরিয়ে আসতে দেখে চমকে গেল বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা গারফিল্ড আর তার সঙ্গীরা। তবে বিস্ময়টা দ্রুত কাটিয়ে উঠে গুলি ছুঁড়তে শুরু করল তারা, বম্বারটাকে থামাতে চায়। ঠক ঠক করে বুলেট এসে বিধতে শুরু করল বি-২৫-এর গায়ে, একের পর এক ক্ষত সৃষ্টি হতে থাকল। তবে থামল না ওটা, ছুটতে থাকল আগের মত।

কী করবে, সেটা ঠিক করতে এক মুহূর্তও সময় নিল না অভিজ্ঞ খুনী। মুখের কাছে ওয়াকিটকি তুলে কপ্টারের পাইলটকে নির্দেশ দিতে শুরু করল গারফিল্ড।

ক্রু-কম্পার্টমেন্টে উঁকি দিল রানা, চেঁচিয়ে বলল, মাথা নামিয়ে রাখুন। আপনারা, পোর্টহোল ভেঙে গুলি ঢুকতে পারে!

ইভা নির্দ্বিধায় মেনে নিয়েছে নির্দেশটা, তবে প্রৌঢ়া ইউনো ওর কথাটা শুনতে পেয়েছেন বলে মনে হলো না। পাগলের মত নিজের মোবাইল টেপাটিপি করছেন তিনি, কার সঙ্গে যেন যোগাযোগ করবার চেষ্টা চালাচ্ছেন…লাইন পাচ্ছেন না। রানা ধমকে উঠল, ড. বুরেন! করছেনটা কী আপনি? মাথা নামাতে বললাম না?

আমি… আমি বাইরের সাহায্য পাওয়ার চেষ্টা করছি… থতমত খেয়ে জানালেন এলিসা।

কেউ সাহায্য করতে পারবে না আমাদের এ-মুহূর্তে। ফোন রাখুন। সাহায্য যদি চাইতেই হয়, দুহাঁটুতে মাথা গুঁজে ওপরঅলার কাছে চান।

বিহ্বল দৃষ্টিতে রানার দিকে একটু তাকিয়ে রইলেন এলিসা, তারপর কুঁজো হয়ে পড়লেন সিটে।

মাসুদ ভাই! রায়হানের চিৎকার শোনা গেল সামনে থেকে।

ঝট করে ঘুরল রানা। কী হয়েছে?

মুখে কিছু বলল না রায়হান, আঙুল তুলে দেখাল সামনের দিকটা। উইণ্ডশিল্ডের মধ্য দিয়ে শত্রুদের হেলিকপ্টারটাকে দেখতে পেল রানা–কখন যেন টেকঅফ করেছিল ওটা, এখন ধীরে ধীরে নেমে আসছে রানওয়ের উপর, ল্যাণ্ড করতে যাচ্ছে ওদের রাস্তা জুড়ে। বি-২৫-কে না থামিয়ে উপায় নেই, নইলে সোজা কপ্টারটার গায়ে গিয়ে আছড়ে পড়বে।

কী করব? পরামর্শের আশায় গুরুর দিকে তাকাল রায়হান।

কো-পাইলটের সিটে গিয়ে বসল রানা, সিটবেল্ট বাধল, চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে ওর। গম্ভীর গলায় বলল, স্পিড বাড়াও।

কী!

ঠিকই শুনছ… স্পিড বাড়াতে বলছি, টেকঅফের জন্য অন্তত একশো নটে পৌঁছুতে হবে তোমাকে।

কীসের টেকঅফ? আমরা… আমরা ক্র্যাশ করব হেলিকপ্টারটার গায়ে!

সত্যিই করব কি না, সেটাই দেখতে চাই, বলল রানা। স্পিড বাড়াও এক্ষুণি, তাড়াতাড়ি ওটার কাছে চলে যেতে চাই, পাইলট ব্যাটা যেন নেমে যেতে না পারে। দেখিই না, সুইসাইড করে আমাদের ঠেকানোর মত সাহস আছে কি ওর।

এতক্ষণে গুরুর মতলবটা ধরতে পারল রায়হান, মুচকি হেসে থ্রটলটা একেবারে শেষপ্রান্ত পর্যন্ত ঠেলে দিল ও।

রানওয়ে আটকে ল্যাণ্ড করতে পেরে আত্মতুষ্টির হাসি হাসছিল কপ্টারের পাইলট, কিন্তু কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই সেটা মুছে গিয়ে আতঙ্ক ভর করল চেহারায়। অতিকায় বি-২৫ মূর্তিমান দানবের মত ধেয়ে আসছে ছোট্ট যান্ত্রিক ফড়িংটার দিকে, ওটাকে পিষে ফেলতে চাইছে… স্পিড কমাবার কোনও লক্ষণ নেই, আরও বাড়িয়েছে যেন। ওটার আরোহীরা নিঃসন্দেহে পাগল, নইলে এভাবে আত্মহত্যা করতে চায় কেউ? তাড়াতাড়ি দরজা খুলে নেমে যেতে চাইল, কিন্তু নার্ভাসনেসের কারণে হাতলই খুঁজে পেল না বেচারা। দাঁতে দাঁতে ঠোকাঠকি শুরু হয়ে গেছে তার, দিব্যচোখে নিজের মরণ দেখতে পাচ্ছে–বিশাল। এক বম্বারের আকৃতি নিয়ে ছুটে আসছে সেটা।

বাঁচার উপায় একটাই, তাড়াতাড়ি পেডাল চেপে কন্ট্রোল স্টিক আঁকড়ে ধরল আতঙ্কিত পাইলট। বনবন করে ঘোরার গতি বেড়ে গেল রোটরের, পাছা উঁচু করে সরে যেতে শুরু করল কপ্টারটা। লেজটা মাত্র রানওয়ের কিনারা পেরিয়েছে, এমন সময় পৌঁছে গেল বি-২৫, টেইল রোটরের মাত্র কয়েক ফুট দূর দিয়ে সবেগে এয়ারস্ট্রিপের অন্যপ্রান্তের দিকে ছুটে চলে গেল ওটা। বাতাসের ধাক্কায় আধপাক ঘুরে গেল কপ্টার, ব্যালেন্স ফিরে পেতে জান-প্রাণ দিয়ে খাটল কয়েক মুহূর্ত।

এতকিছু অবশ্য দেখতে পাচ্ছে না রানা, ওর চোখ সেঁটে রয়েছে। এয়ারস্পিড় ডায়ালে।

ষাট…

সত্তর…

আশি…

এমনিতেই পুরনো ইঞ্জিন… তার ওপর যোগ হয়েছে এবড়োথেবড়ো রানওয়ের কারণে ক্রমাগত ঝাঁকুনি, সবগুলো চাকায় ঠিকমত বাতাসও দেয়া হয়নি–স্বভাবতই গতিবেগ বাড়ছে অত্যন্ত ধীরে, স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি সময় লাগছে।

রায়হান জানাল, রানওয়ে শেষ হয়ে আসছে, মাসুদ ভাই। টেকঅফ করব?

আরেকটু…

সরি, এখুনি যদি ডানা না মেলি, তা হলে পুরো পথ ড্রাইভ করে যেতে হবে।

এয়ারস্পিড গজ নব্বই নট গতিবেগ দেখাচ্ছে–প্রয়োজনের তুলনায় দশ নট কম। পিছন থেকে গুলি করা হচ্ছে এখনও, যতক্ষণ সারফেসে থাকছে, বিমানটার গায়ে আঘাতের সংখ্যা বাড়ছে ততই। বড় ধরনের কোনও ক্ষতি হলে শেষ পর্যন্ত হয়তো উড়াল দিতেই পারবে না বি-২৫। তাই কাঁধ ঝাঁকিয়ে রানা। বলল, ও,কে, চেষ্টা করে দেখো।

নির্দেশ পেয়েই ইয়োক ধরে টানতে শুরু করল রায়হান, ফ্ল্যাপ নামিয়ে দিয়েছে আগেই… বাতাসের অবলম্বন নিয়ে বিমানটাকে ভাসিয়ে তুলতে চায়। ধীরে ধীরে নাক তুলল বি-২৫, মাটি থেকে শূন্যে উঠে গেল নোজ হুইল, ওভাবেই ছুটল কয়েক মুহূর্ত। তবে গতি কম থাকায় পিছনটা তুলতে পারল না রায়হান, একটু পরেই মাটিতে আবার নেমে এল সামনের চাকা, ফুটবলের মত ড্রপ খেল কয়েকটা।

রানওয়ের শেষ প্রান্ত আর একশ গজও নয়, টোক গিলল তরুণ হ্যাকার। সষ্টিকর্তার নাম জপে আবারও ইয়োক ধরে টানতে থাকল ও উইণ্ডশিল্ডে উদয় হতে থাকা রুক্ষ-বন্ধুর জমি আর গাছপালার সারিগুলোকে ভুলে যেতে চাইল… পা-দুটো ফ্লোরবোর্ডের উপর এমনভাবে চেপে ধরেছে, যেন ওখানে গাড়ির মত অ্যাকসেলারেটর আছে। রানাও রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে ফলাফলটা দেখার জন্য।, এইবার সাড়া দিল প্রাচীন যুদ্ধবিমান, রানওয়ের একেবারে শেষ মাথায় গিয়ে উঠে গেল বাতাসে, দশ গজও বাকি ছিল না তখন। ইঞ্জিন একজস্টের প্রবল ধাক্কায় নীচের গাছপালা বেঁকে গেল, যেন সাইক্লোন বয়ে যাচ্ছে–আরেকটু হলেই বম্বারের তলার সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটত।

আটকে রাখা দমটা শব্দ করে ছাড়ল রায়হান, কপালের পাশ দিয়ে সরু ধারায় ঘাম ঝরছে ওর। পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছল। তারপর বলল, বড় বাঁচা বেঁচে গেছি।

রানা অবশ্য অতটা খুশি হতে পারছে না। গম্ভীর গলায় বলল, এখনও বেঁচেছি বলা যাবে না। আঙুল তুলে একটা গজ দেখাল ও। দুই নম্বর ইঞ্জিনটা কাজ করছে না।

ইয়াল্লা! বলেন কী!

ককপিটের দরজায় ইভা উদয় হলো এসময়। বলল, ডানদিকের ডানায় ধোয়া দেখতে পাচ্ছি আমরা পোর্টহোল দিয়ে।

ইঞ্জিনের ঘড়ঘড় আওয়াজই বলে দিচ্ছে কী ঘটেছে, তারপরও জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল রানা। দেখা গেল, ওর আশঙ্কাটাই সত্যি। গুলি লেগেছে। ইঞ্জিনটায়, কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে, ছন্দ হারিয়ে থেমে থেমে ঘুরছে পাখাগুলো। ব্যাপারটা রায়হানকে বলল ও।

ফুয়েল লাইনও হিট হয়েছে, গজের দিকে তাকিয়ে বলল তরুণ হ্যাকার। আমাদের তেল ফুরিয়ে আসছে।

চুপচাপ নতুন দুঃসংবাদটা হজম করল রানা। সুইচ টিপে বন্ধ করে দিল দুনম্বর ইঞ্জিন। গতিবেগ কমে গেল অনেকটা, অলটিচ্যুড মেইনটেন করতেই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে এখন রায়হান। রানা বলল, যতক্ষণ পারো ভেসে থাকো আমি দেখছি, ল্যাণ্ড করবার মত কোনও জায়গা পাওয়া যায় কি না।

দূরে কোথাও পৌঁছুতে না পারলে হেলিকপ্টারটা আমাদের খুঁজে বের করে ফেলবে, মাসুদ ভাই।

জানি, রানা বলল। দেখো কতদূর যেতে পারো। দুশ্চিন্তা বোধ করছে ও, প্ল্যানটা পুরোপুরি সফল হয়নি। শত্রুদের অস্ত্রশস্ত্র বেশ শক্তিশালী ছিল, একটা ইঞ্জিন বিকল করে দিতে পেরেছে তারা। এখন আর এই বিমান নিয়ে আলমির পৌঁছুনো সম্ভব নয়, বিডিংহুইযেনের আশপাশে কোথাও ল্যাণ্ড করতে হবে… খুনীদের নাগালের মধ্যে।

পরিস্থিতিটা যে আরও গুরুতর, সেটা প্রমাণ হয়ে গেল মিনিট দশেকের মধ্যেই। নতুন করে গুলির শব্দে চমকে উঠল বি-২৫-এর আরোহীরা, ঠক ঠক করে বিমানের গায়ে আবারও বিধতে শুরু করেছে বুলেট।

হোয়াট দ্য হেল! বিস্মিত গলায় বলল রায়হান। আবার গুলি করছে কে?

জানালা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারতে থাকল রানা, এক পলকের জন্য চোখে, পড়ল রূপালি রঙের হেলিকপ্টারটা… বম্বারের একদম কাছে পৌঁছে গেছে ওটা, গুলি ছুঁড়ছে।

হেলিকপ্টারটা, রায়হান… ওটা চলে এসেছে… সমস্ত লোকজনসহ, তিক্ত গলায় বলল রানা।

অ্যাঁ! কী বলছেন?

সত্যি!

হেলিকপ্টার নিয়ে বিমানকে ধরে ফেলল?

আমাদের স্পিড় কী পরিমাণ কমে গেছে, সে-খেয়াল আছে? হেলিকপ্টার। কেন, একটা পাখিও এখন ওভারটেক করে চলে যেতে পারবে।

শিট! কী করব এখন? স্পিড বাড়াব?

যে-অবস্থা বিমানের… প্রেশার দিলে একমাত্র ইঞ্জিনটাও খসে পড়বে, রানার কণ্ঠে বিষাদ। কো-পাইলটের সিট ছেড়ে উঠে পড়ল ও। তোমার অমিউনিশনগুলো দাও, দেখি ওদের তাড়ানো যায় কি না।

কী যে বলেন না, মাসুদ ভাই! পকেট হাতড়াতে হাতড়াতে বলল রায়হান। আমাদের অটোমেটিক পিস্তল দিয়ে একটা হেলিকপ্টারকে ঘায়েল করা অসম্ভব। পাখি তো নয় যে, ঢিল ছুঁড়লেই ভয় পেয়ে পালিয়ে যাবে–আহত হোক বা না হোক।

দেখিই না চেষ্টা করে। সঙ্গীর কাছ থেকে বাড়তি ক্লিপগুলো নিল রানা।

আবার ইপ্রোভাইজ করবেন কিছু?

যদি সুযোগ থাকে। বলে ককপিট ছেড়ে ক্রু-কম্পার্টমেন্টে চলে এল রানা।

ইভা আগেই ফিরে এসেছিল নিজের সিটে, ওকে দেখে আতঙ্কিত গলায়। জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে, মি. রানা?

তেমন কিছু না, হালকা গলায় বলল রানা, সাহস দেবার চেষ্টা করছে। আমাদের এস্টেটের বন্ধুরা ফিরে এসেছে। বিদায় না নিয়ে ওভাবে চলে আসায় খুব রাগ করেছে ওরা।

 হাহাকারের মত করে উঠলেন এলিসা, মোবাইল ফোনটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন আবার–সাহায্য চাইবেন বোধহয় কারও কাছে। ওঁকে এবার আর বাধা দিল না রানা, যদি ফোন করে শান্তি খুঁজে পান, তা হলে অসুবিধে কী? ওর, হাতের পিস্তলটা লক্ষ করেছে ইভা। বলল, ওই জিনিস নিয়ে যুদ্ধ করতে যাচ্ছেন নাকি?

না, না, রানা হাসল। এ দিয়ে কি আর যুদ্ধ করা যায়? একটু ফায়ারিং প্র্যাকটিস করব আর কী। তোমরা দরজার সামনে থেকে সরে যাও, গায়ে যেন গুলি না লাগে।

আর আপনি?

আমাকে নিয়ে ভেবো না। বুলেটকে কীভাবে ফাঁকি দিতে হয়, তা আমার জানা আছে।

আবার মেশিনগানের ভারি আওয়াজ শোনা গেল, এবার আরও কাছ থেকে। ইভা আর এলিসাকে বিমানের পিছনদিকে পাঠিয়ে দিয়ে একজিট ডোরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল রানা, গুলিবর্ষণে বিরতির জন্য কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করল, তারপর মোচড় দিল হাতলে, খুলে ফেলল পাল্লাটা।

প্রবল বেগে বাতাস হামলা চালাল খোলা জায়গাটায়, ভিতর-বাইরের বায়ুচাপ সমান করে আনছে। থর থর করে কেঁপে উঠল পুরো বহুবার, ব্যালেন্স। মেইনটেন করতে রীতিমত যুঝতে হচ্ছে এখন রায়হানকে। ককপিট থেকে চেঁচিয়ে বলল, যা করার তাড়াতাড়ি করুন, মাসুদ ভাই! এভাবে বেশিক্ষণ ফ্লাই করা সম্ভব নয়।

একজিট ডোরের পাশের বাল্কহেড ধরে কোনওমতে তাল সামলাল রানা, তারপর সোজা হয়ে বাইরে তাকাল। প্লেনটাকে ঝাঁকি খেতে দেখে একটু সরে গিয়েছিল হেলিকপ্টারটা, এখন আবার এগিয়ে আসছে–ওটার খোলা দরজায় ঝটাগুফো এক লোককে দেখতে পেল ও, দাঁত বের করে হাসছে। লোকটার হাতে একটা হেভি মেশিনগান, বোঝা যাচ্ছে–ওটার কল্যাণেই এক নম্বর ইঞ্জিনটাকে এত সহজে ঘায়েল করতে পেরেছে। এবার দ্বিতীয়টার পালা। ইতোমধ্যেই গুলি খেয়ে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে বাম দিকের উইঙের একটা অংশ, দৃষ্টিসীমার মধ্যে দু-নম্বর ইঞ্জিনের যতটুকু দেখা যাচ্ছে, সেখানেও দুটো গর্ত চোখে পড়ল।

দাঁতে দাঁত পিষল রানা-প্ল্যানটা পুরোপুরি মাঠে মারা পড়ছে। বিমানটা নিয়ে কিছুতেই ফাঁকি দেয়া সম্ভব নয় কপ্টারটাকে, ক্রমাগত গুলির আঘাতে দফারফা হয়ে গেছে বম্বারের, আহত পাখির মত ধীর হয়ে গেছে গতি, কিছুক্ষণের মধ্যেই মাটিতে খসে পড়বে। ক্র্যাশটা থেকে যদি কোনওভাবে বেঁচেও যায়, খুনীদের হাত থেকে বাঁচতে পারবে না।

ঝাঁটাগুফো আবারও ইঞ্জিনকে টার্গেট করছে দেখে হাতের পিস্তল তুলে গুলি করতে শুরু করল রানা–যতক্ষণ সম্ভব ইঞ্জিনটাকে রক্ষা করতে হবে। হেলিকপ্টারটার দিকে তাক করে খালি করে ফেলল ক্লিপ। নিশানা ঠিক করতে সময় ব্যয় না করায় তাতে অবশ্য তেমন লাভ হলো না, বেশিরভাগ গুলিই চলে। গেল এদিক-সেদিক, একটা শুধু গিয়ে লাগল কপ্টারে… তাও লেজের দিকে। মেশিনগানধারী লোকটাকে আহত করা গেল না, পাইলটের গায়েও আঁচড় লাগেনি।

সামান্য সময়ের জন্য হেলিকপ্টারের ভিতরে শরীর টেনে নিয়েছিল ঝাঁটাগুঁফো গারফিল্ড রানার পিস্তল থেমে যেতেই আবার উদয় হলো দরজায়, মুখটায় বিজয়ীর হাসি। ইঞ্জিন না, এবার রানাকে লক্ষ্য করে মেশিনগান তুলল সে, টিপে দিল ট্রিগার।

বৃষ্টির মত অঝোর ধারায় বি-২৫-এর দরজার দিকে ছুটে এল ভারি শেল, মোরব্বার মত কেচে ফেলতে থাকল প্রাচীন আকাশযানটার নাজুক দেহ।

মাজল ফ্ল্যাশ দেখতে পেয়েই ফ্লোরে ডাইভ দিয়েছে রানা, প্রবল আওয়াজে কানে তালা লেগে যাবার উপক্রম হলো ওর, দৃষ্টিসীমায় থাকা ছোটখাট জিনিসপত্র আর সিটের ফোম গুলির আঘাতে ছিঁড়ে-খুঁড়ে উড়তে দেখল। মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে দরজার ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়া প্রাণঘাতী বুলেটগুলো, উপুড় হয়ে সেগুলোকে ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করছে ও, ক্রল করে সরে যেতে থাকল দরজা থেকে দূরে।

গুলির শব্দটা সামান্য সময়ের জন্য থামতেই হঠাৎ সামনে ড. বুরেনের পা দেখতে পেল রানা। সিট ছেড়ে উঠে পড়েছেন ভদ্রমহিলা। কী যেন হয়েছে ওঁর, মোবাইলে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি বোধহয়, বিপদের মুখে পড়ে এখন আর মাথাটা স্বাভাবিকভাবে কাজ করছে না। ঘোর লাগা একটা দৃষ্টি প্রৌঢ়া ইউনোর চোখে, ছুটে যেতে চাইছেন একজিটের দিকে। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে তাকে ধরে ফেলল রানা। কড়া গলায় বলল, করছেনটা কী আপনি?

ছাড়ন আমাকে, মি. রানা! বিকারগ্রস্তের মত বললেন এলিসা। এভাবে মরা চলবে না আমার… যে করেই হোক, বাঁচতে হবে।

সেজন্যেই বুঝি বিমান থেকে লাফ দিতে যাচ্ছেন? পাগল হয়ে গেছেন। নাকি? যান বলছি, বসুন গিয়ে সিটে!

প্রতিবাদ করার জন্য মুখ খুললেন এলিসা, ঠিক তক্ষুণি বিকট শব্দে ভেঙে পড়ল বেশ কটা পোর্টহোল। আবার গুলি করছে কপ্টারের মেশিনগানার। ইভা চিৎকার করে উঠল আতঙ্কে, রানাও ধাক্কা দিয়ে ড. বুরেনকে সহ মেঝেতে শুয়ে পড়ল।

মাসুদ ভাই! ককপিট থেকে রায়হানের ডাক ভেসে এল। দুনম্বর ইঞ্জিনটাও গেছে! আমরা ক্র্যাশ করতে চলেছি!

হতাশায় ঠোঁট কামড়ে ধরল রানা–আর কোনও সুযোগ নেই বাঁচবার। শেষ পর্যন্ত হার মানতেই হচ্ছে ওদেরকে। আনমনে মাথা নাড়তে গিয়ে হঠাৎ দিব্যচোখে খুব পরিচিত একটা চেহারা দেখতে পেল ও। কাঁচাপাকা ভ্রূ-র নাচের অন্তর্ভেদী চোখজোড়া বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে, যেন বলতে চাইছে–এত সহজে হাল ছেড়ে দিলে? বাকি পৃথিবীর কথা ভাবলে না? এজন্যেই কি এত বড় একটা দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছিলাম তোমাকে? মনে মনে গাল দিল রানা, শালার মরার সময়ও বুড়োর জ্বালাতন থামবে না দেখছি!

পরমুহূর্তেই সচকিত হয়ে উঠল ও-বুকের গহীনে ক্রুদ্ধ বাঘের মত গর্জে উঠল বাঁচার ইচ্ছা আর কর্তব্যবোধ। ঝট করে সোজা হলো রানা, চঞ্চল দৃষ্টিতে তাকাল চারপাশে। বাল্কহেড়ের গায়ে ব্র্যাকেটে ঝোলানো একটা ফ্লেয়ার পিস্তলের উপর চোখ আটকে গেল ওর।

মাসুদ ভাই! আবার ডাক শোনা গেল রায়হানের। কী করব?

টিকে থাকো যতক্ষণ সম্ভব, গলা উঁচু করে নির্দেশ দিল রানা। তারপর তাকাল ইভার দিকে। ড. বুরেনকে সামলাও।

এলিসার হাত ধরে তাকে সিটে নিয়ে গেল তরুণী সেক্রেটারি। রানাকে জিজ্ঞেস করল, কী করতে যাচ্ছেন?

এমন কিছু, যা ওরা কল্পনাও করতে পারবে না, সংক্ষেপে জবাব দিল রানা। উঠে দাঁড়িয়ে ব্র্যাকেট থেকে ফ্লেয়ার পিস্তলটা সংগ্রহ করল ও; পাশে ঝোলানো বক্সে অ্যামিউনিশনও আছে, সেখান থেকে নিল স্মোক ফ্লেয়ার–পিস্তলে লোড করে ফেলল ওটা।

ভীষণভাবে দুলছে বি-২৫, তাল সামলে ধীরে ধীরে একজিটের পাশে চলে গেল রানা। চেঁচিয়ে বলল, স্পিড কমাও, রায়হান। কাছে আসতে দাও হেলিকপ্টারটাকে।

কী! রায়হান অবাক!

হ্যাঁ। একটাই শট নেবার সুযোগ পাবো, ওটা দূরে থাকলে মিস হয়ে যেতে পারে। বিমানটাকে স্থির রাখার চেষ্টা করো, নিশানা ঠিক করতে হবে আমাকে।

গুরুর ওপর অগাধ আস্থা তরুণ হ্যাকারের, আর কোনও প্রশ্ন না করে হুকুম তামিল করল। ইঞ্জিনের আওয়াজ বদলে গেল কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে, আর.পি.এম. কমিয়ে দিয়েছে ও। দরজা দিয়ে উঁকি দিল রানা–ওর প্ল্যান। মোতাবেকই ঘটছে সব। কপ্টারটা বম্বারের পোর্ট উইঙের পাশে… একেবারে গায়ের উপর এসে পড়েছে–নিশ্চিত শটে বিমানটাকে অচল করে দিতে চায়। মুখে নিষ্ঠুর হাসি ফুটল রানার, ফাঁদে পা দিয়েছে শক্ররা।

পিস্তলটা আগেই রিলোড করে ফেলেছিল, দরজার ফ্রেমের আড়াল থেকে শুধু হাতটা বের করে এলোপাতাড়ি ফায়ার করল ও। আগের বারের মতই কপ্টারের ভিতর শরীর ঢুকিয়ে ফেলল মেশিনগানার, যাতে গুলি না খায়। হাতের ক্লিপটা খালি হতেই ঝট করে ভোলা একজিটের সামনে উদয় হলো রানা, অটোমেটিকটা ফেলে দিয়েছে, এখন হাতে শুধু ফ্লেয়ার-গানটা। সময় নিয়ে লক্ষ্য স্থির করল ও, তারপর দম আটকে টিপে দিল ট্রিগার।

শটটা নিখুঁত হলো–উড়ে গিয়ে সোজা হেলিকপ্টারের খোলা দরজা দিয়ে কেবিনের ভিতরে পড়ল স্মোক ফ্লেয়ার। কয়েক মুহূর্ত বিরতি দিয়ে বিস্ফোরিত হলো ওটা।

চোখের পলকে কপ্টারের ভিতরটা ভরে গেল কমলা রঙের রাশ রাশ ঘন ধোঁয়ায়। বাতাসের শোঁ শোঁ আর ইঞ্জিনের গর্জন ছাপিয়ে শোনা গেল আরোহীদের চেঁচামেচি-খক্‌ খক্ করে কাশছে তারা, শাপ-শাপান্ত করছে। প্রতিপক্ষকে। ধোয়ায় ঢেকে গেছে উইণ্ডশিল্ডও, পাইলট সামনের কিছুই দেখতে। পাচ্ছে না, হেলিকপ্টারটা মাতালের মত টলমল করছে।

দৌড়ে ককপিটে এসে ঢুকল রানা, রায়হানকে বলল, ধাক্কা মারো ওটাকে। আঙুল তুলে কপ্টারটা দেখাল ও।

মাথা ঝাঁকাল তরুণ হ্যাকার, ফুট পেডালে চাপ দিল, কন্ট্রোল কলামও। ঘোরাচ্ছে একই সঙ্গে।

কাত হয়ে গেল বি-২৫, বাঁয়ে চাপছে–এক গাড়ি দিয়ে আরেক গাড়িকে যেভাবে পাশ থেকে ধাক্কা দেয়া হয়, ঠিক সেভাবে আঘাত করতে যাচ্ছে ছোট্ট হেলিকপ্টারটাকে। শেষ মুহূর্তে আগ্রাসী বিপদটা দেখতে পেল ঝাঁটাগুঁফো। গারফিল্ড, ধোয়ার হাত থেকে বাঁচতে দরজায় মুখ বের করেছিল সে, কিন্তু তখন। আর কিছু করার নেই।

প্রথমে বম্বারের গায়ে ঘষা খেল কপ্টারের রোটরব্লেড, ইস্পাত ঘেঁড়ার বিশ্রী শব্দ হলো–চোখের পলকে আটফট লম্বা একটা ক্ষত দেখা দিল বি শরীরে, একই সঙ্গে দুমড়েমুচড়ে গেল ব্লেডগুলোও। ওখানেই শেষ নয়, রোটর ধ্বংস করে কপ্টারের প্রায় গায়ের উপর উঠে পড়ল যুদ্ধবিমানটা… যেন ছোট্ট ফড়িঙের উপর সওয়ার হলো দৈত্যাকার বাজপাখি! গারফিল্ডের বিস্ফারিত। চোখদুটো বিস্ফারিতই রয়ে গেল, প্রবল বেগে এসে কপ্টারটার শরীরে যখন বম্বারটা ধাক্কা দিল, উল্টেপাল্টে পড়ে গেল সে।

ফিউজলাজের একটা পাশ পুরো থেঁতলে গেল হেলিকপ্টারটার, পরমুহূর্তেই ঘটল বিস্ফোরণ। কমলা রঙের আগুনের একটা পিণ্ডতে পরিণত হলো, আকাশযানটা, খসে পড়ল আকাশ থেকে। দৃশ্যটা দেখে এক চিলতে হাসি ফুটল রানার ঠোঁটে।

রায়হান অবশ্য হাসতে পারছে না, সংঘর্ষে ওদের বিমানেরও ক্ষতি হয়েছে। দুমড়ে-মুচড়ে গেছে অনেকখানি জায়গা, বাল্কহেড ফেটে গেছে, আগুন ধরে গেছে ওখানটায়। ধীরে ধীরে করাল শিখা এগিয়ে যাচ্ছে ডানার দিকে, ফুয়েল লাইনের স্পর্শ পেলে বিস্ফোরণ ঘটবে। ব্যাপারটা রানাকে বলল ও।

ল্যাণ্ড করো, নির্দেশ দিল রানা।

নীচে যতদূর দেখা যায় সবটাই গাছপালায় ঢাকা, এক টুকরো পরিষ্কার জমিও চোখে পড়ছে না–সেদিকে তাকিয়ে টোক গিলল রায়হান। বলল, ল্যাণ্ডিংটা খুব রাফ হবে, মাসুদ ভাই।

করার নেই কিছু, রানা, অবিচল। ওখানেই নামো। তারপর ফিরল পিছন দিকে, চেঁচিয়ে বলল, রেডি থাকুন আপনারা, ড. বুরেন। আমরা ক্র্যাশ-ল্যাণ্ডিং করতে যাচ্ছি।

কো-পাইলটের সিটে বসে সিটবেল্ট বেঁধে ফেলল রানা। দোয়া-টোয়া জানলে পড়তে শুরু করে দিন, রায়হান বলল,ওর দিকে তাকিয়ে।

রিল্যাক্স, রানা বলল। মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ করো, আমি তোমাকে সাপোর্ট দেব।

কয়েক মিনিট পরেই ফ্লোভোল্যাণ্ডের জঙ্গলের মাথায় আছড়ে পড়ল বি-২৫। প্রথম আঘাতেই খসে পড়ল দু’পাশের ডানা আর ইঞ্জিন, পুরো বিমানই কেঁপে উঠল তাতে। মড় মড় করে উঠল গোটা এয়ারফ্রেম, ডিমের খোসার মত ভেঙে পড়তে চাইছে। তারপরও থামল না পতন, লতাপাতার আচ্ছাদন তছনছ করে মাটির দিকে পড়তে থাকল বম্বারটা। পথে যত গাছপালা পাচ্ছে, সব ভেঙেচুরে ফেলছে। একেকটা আঘাতে ওটার শরীরেও ঘা তৈরি হচ্ছে কুষ্ঠ রোগীর মত।

ভিতরে ক্রমাগত ঝাঁকুনি খেয়ে চলেছে আরোহীরা, একটুও বিরতি নেই; ফলে দুই নারী-যাত্রী আতঙ্কে চেঁচাবারও ফুরসত পাচ্ছে না। সমস্ত পোর্টহোল, সেই সঙ্গে উইণ্ডশিল্ডের কাঁচ ভেঙে গেছে ইতোমধ্যে, ছিটকে আসা টুকরোগুলোর আঁচড়ে শরীরের উন্মুক্ত জায়গা কেটে গেছে কম-বেশি সবারই… রক্ত ঝরছে, কিন্তু অসহ্য ঝাঁকুনির কাছে এই ব্যথা কিছুই নয়। ওদের কাছে মনে হচ্ছে, দেহের প্রতিটা জয়েন্ট খুলে পড়ে যাবে কিছুক্ষণের মধ্যে।

হঠাৎই ভাঙা উইণ্ডশিল্ডের ওপাশে মাটি দেখতে পেল রানা। কথা বলার উপায় নেই, শুধু ইশারায় রায়হানকে সতর্ক করবার চেষ্টা করল। তরুণ হ্যাকার ওর ইঙ্গিত আদৌ দেখতে পেয়েছে বলে মনে হলো না, বিমানটার ব্যালেন্স ফেরাবার কোনও লক্ষণই দেখা গেল না তার মধ্যে। কো-পাইলটের কন্ট্রোল কলাম নিয়ে একাই একটু চেষ্টা করল রানা, কিন্তু কুলিয়ে উঠতে পারল না। শেষ কয়েকটা গাছকে ধ্বংস করে দিয়ে সারফেসে পৌঁছে গেল বি-২৫, টর্পেডোর ভঙ্গিতে নাক দিয়ে সোজা আঘাত করল মাটিতে।

প্রচণ্ড এক ঝাঁকিতে চোখে অন্ধকার দেখল রানা; সিটবেল্টের স্ট্র্যাপ ভয়াবহ শক্তি নিয়ে চেপে ধরেছে বুকটা, শ্বাস নেয়াই কষ্টকর হয়ে পড়ল। একটা ব্যাপারই শুধু চোখে পড়ল ওরক্যাশের ধাক্কায় নাক থেতলে গেছে বম্বারের, সেই চাপে ভেঙেচুরে সামনের কনসোলটা ছুটে আসছে ওর দিকে… কপালের একপাশে এসে খুব জোরে বাড়ি খেল একটা ভাঙা টুকরো।

এরপর আর কিছু মনে নেই ওর।

.

০৯.

চমৎকারভাবে সাজানো একটা রুমমেঝেতে দামি কার্পেট, দরজা-জানালায় ঝুলছে মখমলের পর্দা, দেয়ালে সুদৃশ্য পেইন্টিং, মাথার উপরে ক্রিস্টালের ঝাড়বাতি, সেই সঙ্গে সুন্দর আসবাবপত্র। ঠিক মাঝখানটায় রয়েছে অ্যান্টিক খাটটা। চোখ মেলে দেখল রানা, ওটার তুলতুলে বিছানায় শুয়ে আছে। জ্ব কুঁচকে গেল ওর, ভুল দেখছে না তো! এখানে এল কীভাবে ও?

কপালে চিন্তার রেখা ফুটল, চোখের দৃষ্টি সতর্ক। উঠে বসে কামরাটার উপর নজর বোলাল রানা। ব্যাপারটা দৃষ্টিবিভ্রম নয়, সত্যিই সুসজ্জিত একটা রুমে রয়েছে ও। হঠাৎ খেয়াল করল, ভাঙা কাঁচের আঁচড়ে কেটে যাওয়া হাত আর মুখের ক্ষতগুলো ব্যাণ্ডেজে ঢাকা, কপাল বরাবরও রয়েছে একটা। নিপুণভাবে ড্রেসিং করা হয়েছে প্রতিটি ক্ষত।

কে নিয়ে এল ওকে এখানে? চিকিৎসাই বা দিল কে? ভাবতে ভাবতে বিছানা ছেড়ে নেমে পড়ল রানা। দরজা খুলে বেরিয়ে এল রুম থেকে। সংকীর্ণ একটা করিডর চোখে পড়ল ওর, এটাও কার্পেটে মোড়া। কোথাও কাউকে দেখা যাচ্ছে না। প্যাসেজ ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটা ল্যাণ্ডিঙে পৌঁছুল ও, সিঁড়ি ধরে নেমে এল নীচের ফয়েই-য়ে।

সামনেই সদর দরজা, সেটা খুলে বাইরে পা রাখতেই সুন্দর একটা বাগান চোখে পড়ল–গাছগাছালিতে ছাওয়া। লনের চারপাশের কেয়ারিতে ফুটে রয়েছে। রং-বেরঙের হাজারো ফুল। হঠাৎ একদিকের ঝোঁপ নড়ে উঠতে দেখল ও, দু’জন লোক বেরিয়ে এল আড়াল থেকে, লম্বা লম্বা পা ফেলে এদিকেই এগিয়ে আসছে। হাঁটার ভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এরা সশস্ত্র-কোটের আড়ালে শোল্ডার হোলস্টারে পিস্তল রয়েছে।

দ্বিধায় পড়ে গেল রানা–এরা শত্ৰু না মিত্র, জানা নেই; গা-ঢাকা দেবে না, চিন্তা করছে। পরমুহূর্তেই বাতিল করে দিল চিন্তাটা, শক্র হলে ও দেখামাত্র অস্ত্র উঁচিয়ে ছুটে আসত লোকদুটো, এভাবে হেলে-দুলে হাটত না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিল রানা।

কাছে এসে বেঁটেমত লোকটা বলল, নীচে নেমে এলেন কেন? বিশ্রাম নিন, স্যর।

কে তোমরা? জানতে চাইল রানা।

গাস ফর্ক, নিজের পরিচয় দিল লোকটা। সঙ্গীকে দেখাল, এ হচ্ছে উইন। ফ্রেইবেল। আমরা আপনাদের পাহারা… না, না, নিরাপত্তা নিশ্চিত করছি।

কাদের নিরাপত্তা?

এই তো… আপনার আর আপনার সঙ্গীদের।

কিন্তু তোমরা কে?

ক্রিয়েলটেকের সিকিউরিটি ডিভিশনের লোক আমরা, স্যর।

ক্রিয়েল-টেক… মানে ড. বুরেনের কোম্পানি?

জী, স্যর। ম্যাডাম আপনাদের দিকে নজর রাখার জন্য বলেছেন আমাদেরকে।

নজর রাখতে বলেছেন মানে? রানা বিস্মিত হলো। ড. বুরেন কোথায়?

ঘণ্টাখানেক আগেই তো চলে গেছেন তিনি। আমাদের এখানেই থাকতে বলে গেছেন।

চলে গেছেন! রানার বিস্ময় আরেকটু বাড়ল। কোথায়?

সেটা তো বলতে পারব না। তবে আপনাদের জন্য একটা মেসেজ দিয়ে গেছেন।

কী মেসেজ?

পকেট থেকে একটা মুখবন্ধ খাম বের করে দিল গাস। সেটা খুলে একটা চিঠি পেল রানা। তাতে লেখা:

মি. মাসুদ রানা,
আপনার জ্ঞান ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারলাম না বলে দুঃখিত। আমার জীবন বাঁচানোর জন্য নিজ মুখে ধন্যবাদ দেয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু ইতোমধ্যে অনেক সময় পেরিয়ে গেছে, আর দেরি করা ঠিক হবে না, তাই অ্যান্টি-ভাইরাসটার উপর কাজ করবার জন্য রওনা হয়ে গেলাম। মি. রশিদের পকেট থেকে সিডিটা নিয়ে নিয়েছি। আমার জন্য ভাববেন না, নিজের নিরাপত্তার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করেছি। কাজ শেষে যোগাযোগ করব।
–এলিসা ভ্যান বুরেন

দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল রানা–ভদ্রমহিলা একা একা চলে গেলেন,.. আবার। যদি কোনও বিপদ হয়! খুনীদের একটা দলকে ব্যর্থ করে দেয়া গেছে মানে তো এই নয় যে, শত্রুক্ষ হাল ছেড়ে দেবে। অবশ্য প্রৌঢ়া ইউনোর যুক্তিটাও বুঝতে পারছে ও–অ্যান্টিভাইরাস তৈরির কাজটা দ্রুত শুরু করা প্রয়োজন ছিল।

চিঠিটা পকেটে গুঁজে গাসের দিকে তাকাল ও। জিজ্ঞেস করল, রায়হান আর ইভা কোথায়?

ওপরতলাতেই আছেন–আলাদা আলাদা কামরায়।

কী অবস্থা ওদের?

সামান্য কাটাছেঁড়া ছাড়া তেমন সিরিয়াস কোনও ইনজুরি নেই কারো, এতক্ষণে জ্ঞান ফিরে আসবার কথা। চলুন, নিয়ে যাচ্ছি আপনাকে ওঁদের কাছে।

ফ্রেইবেলকে পাহারার দায়িত্ব দিয়ে রানাকে নিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকল গাস। হাঁটতে হাঁটতে খুলে বলল প্লেন-ক্র্যাশের পরের ঘটনাগুলো।

বম্বারটা জঙ্গলে আছড়ে পড়বার পর অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল আরোহীদের সবাই, শুধু ড. বুরেন ছাড়া। কপাল খুব ভাল তার, আঘাতও পেয়েছেন সবার। চেয়ে কম। মোবাইলে নিজের সিকিউরিটি চিফকে খবর দেন তিনি, আধঘণ্টার মধ্যে একটা রেসকিউ টিম আর হেলিকপ্টার নিয়ে দুর্ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে যায় ক্রিয়েল-টেকের লোকজন। সবাইকে নিয়ে আসে ড. বুরেনের এই বাগানবাড়িতে। অ্যামস্টারড্যাম থেকে দুমাইল দূরে এই বাড়িটা, ড্রুইভেনড্রেশটে। এখানে পৌঁছুবার পর একজন বিশ্বস্ত ডাক্তারের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয় সবার। রানাদের অবস্থা স্টেবল করার জন্য ঘুমের ইঞ্জেকশন দেন তিনি, তবে এলিসার জন্য তেমন কিছু প্রয়োজন হয়নি, তিনিও রাজি ছিলেন। না। ফার্স্ট এইড নিয়ে রওনা হয়ে গেছেন কী এক জরুরি কাজ সারার জুন্য, সঙ্গে নিয়েছেন সিকিউরিটি ডিভিশনের কিছু বাছাই করা লোক, গাস আর ফ্রেইবেলকে রেখে গেছেন রানাদেরকে পাহারা দেবার জন্য।

দোতলার একটা কামরার সামনে এসে নক করল গাস। দরজা খুলল রায়হান, রানাকে দেখেই হড়বড় করে বলল, ব্যাপার কী, মাসুদ ভাই? কোথায় আমরা? এটা আবার কে…

হাত তুলে ওকে থামাল রানা। বলল, চিন্তা কোরো না, সব ঠিক আছে। ড. বুরেনের বাগানবাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে আমাদের।

আপনারা কথা বলুন, আমি মিস লরেন্সকে ডেকে নিয়ে আসছি। বলে চলে গেল গাস।

রুমের ভিতরে ঢুকল রানা। এই কামরাটাও ওরটার মত চমৎকারভাবে সাজানো। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল ও, কীভাবে ওরা এই বাড়িতে এসে পৌঁছেছে–সেটা খুলে বলল। একটু পরেই হাজির হলো ইভা, চোখে বিহ্বল একটা দৃষ্টি ওর–যে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা হয়েছে বেচারির, সেটার শক এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

তুমি ঠিক আছ? উদ্বিগ্ন গলায় জানতে চাইল রায়হান।

কোনওমতে মাথা নাড়ল ইভা। বলল, বুক ধড়ফড় করছে এখনও। বার বার ক্র্যাশ আর গোলাগুলির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।

হাত ধরে ওকে বিছানায় এনে বসাল রায়হান। রানাকে জিজ্ঞেস করল, এখন কী করবেন, কিছু ঠিক করেছেন?

ড. বুরেনের সঙ্গে কথা বলে দেখি, রানা বলল। ওঁর সঙ্গেই থাকা উচিত আমাদের। নতুন করে হামলা চালানো হতে পারে ওঁর ওপর, আমরা না থাকলে বিপদে পড়বেন। ইভার দিকে তাকাল ও। ড. বুরেনের নাম্বারটা দাও তো।

নিজের মোবাইলটা বের করে দিল ইভা। নাম্বারটা দেখে ডায়াল করল রানা, নিভৃতে কথা বলবার জন্য বেরিয়ে এল করিডরে।

হ্যালো! ওপাশ থেকে সাড়া দিলেন এলিসা।

ড. বুরেন, মাসুদ রানা বলছি।

আপনার জ্ঞান ফিরেছে? থ্যাঙ্ক গড!

আপনার লোকেশন কোথায়?

কোথায় যাচ্ছি, সেটা তো জানেনই, ইচ্ছে করে গন্তব্যটা উহ্য রাখলেন ইউনেনা। এখনও পৌঁছুইনি, পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যেই পৌঁছুব বলে আশা করছি।

তা হলে ওখানেই অপেক্ষা করতে থাকুন, আমরা যত শীঘ্রি পারি চলে আসছি।

তার কোনও প্রয়োজন নেই, মি. রানা…

প্রয়োজন আছে কি নেই, সেটা এতক্ষণে বুঝে ফেলার কথা আপনার। আবারও হামলা হতে পারে…

হামলা ঠেকাবার মত প্রস্তুতি নিয়েছি আমি, জানালেন এলিসা। সঙ্গে দশজন বডিগার্ড রেখেছি, তা ছাড়া ওখানে বেশিক্ষণ থাকবও না আমি, প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার আর অন্যান্য ইকুইপমেন্ট নিয়েই বেরিয়ে পড়ব। কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত পুরো সময়টা আমি মুভমেন্টের ওপর থাকব, নির্দিষ্ট কোনও লোকেশনে স্থির থাকব না, কাজেই কোথায় আমাকে পাবেন আপনারা–সেটা নিশ্চিতভাবে বলতে পারছি না।

একটা রঁদেভু পয়েন্ট ঠিক করা যেতে পারে…

নেগেটিভ, মি. রানা। সেটা খুব রিস্কি হয়ে যাবে। আমার ধারণা–আমার মোবাইল কলগুলো মনিটর করছে কেউ, সকালে আপনার সঙ্গে কথা বলতে শুনেছে। নইলে ফ্যামিলি এস্টেটে যে আমি লুকিয়ে রয়েছি, তা জানতে পারত না। কাজেই কোথাও দেখা করার চিন্তা বাদ দিন। যেভাবে কাজ করতে চাইছি, ওভাবেই করতে দিন।

আমরা তা হলে কী করব?

বিশ্রাম নিতে থাকুন, আমি মাঝে মাঝে যোগাযোগ করে কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে জানাব আপনাকে। কোথাও চলে যাবেন না কিন্তু! কাজটা শেষ করে ওখানেই আপনাদের হাতে অ্যান্টিভাইরাসটা পৌঁছে দিতে চাই আমি।

ব্যবস্থাটা রানার ঠিক পছন্দ হচ্ছে না, তারপরও ভদ্রমহিলার অকাট্য যুক্তির সঙ্গে পেরে না ওঠায় নিমরাজি হলো। ওর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে এলিসা। হেসে বললেন, হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে বলছি না আপনাকে, মি, রানা। সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য কয়েকটা ঘণ্টা শুধু বিশ্রাম নিতে বলছি। আপনার কাজ তো শেষ হয়নি, অ্যান্টিভাইরাসটা তৈরি করবার পর সেটার ডিস্ট্রিবিউশন তো আপনাকেই করতে হবে।

ঠিক আছে, এখানেই অপেক্ষা করছি আমি। আপনি কিন্তু যোগাযোগ রাখবেন… কখন কী ঘটে, কিছু বলা যায় না। আমার সাহায্য প্রয়োজন হতে পারে। রায়হানও খুব ব্রাইট ছেলে, প্রোগ্রামিঙের কাজে আপনাকে আইডিয়া দিতে পারবে।

কিচ্ছু ভাববেন না, আশ্বাস দিলেন এলিসা। দরকার হলে নিশ্চয়ই খবর দেব আপনাদের। এখন তা হলে রাখি, ঠিক আছে? লাইন কেটে দিলেন প্রৌঢ়া বিজ্ঞানী।

.

আলসমিরে ড. বুরেনের বাড়ির সামনে এসে থামল ছোট্ট গাড়িবহরটা। মোট তিনটে গাড়ি–সামনে আর পিছনে রয়েছে সিকিউরিটি টিম, মাঝেরটায় এলিসা, তাঁর সঙ্গে দু’জন বডিগার্ড রয়েছে। ড্রাইভওয়েতে এসে থামতেই দরজা খুলে নেমে পড়লেন কম্পিউটার-বিজ্ঞানী, সঙ্গের লোকজনকে বললেন বাইরে পাহারা দিতে।

ইলেকট্রনিক লকের কোড পাঞ্চ করে তালা খুললেন তিনি, ঢুকে পড়লেন বাড়ির ভিতরে। পরনের ওভারকোটটা খোলার জন্য সময় নষ্ট করলেন না, হন হন করে হেঁটে চলে গেলেন স্টাডিতে। ডেস্কে বসে কম্পিউটারটা সবে অন করেছেন, এমন সময় হাতল ঘোরানোর শব্দ শুনে চোখ তুলে তাকালেন।

স্টাডির দরজা খুলে গেছে, এক এক করে প্রবেশ করল তিন জন যুবক, চালচলনে শৃঙ্খলাবদ্ধ তারা–দলনেতার চেহারায় কাঠিন্য।

আলফা টিম!

স্থির হয়ে গেলেন এলিসা, এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন তিন খুনীর দিকে। ডেস্কের সামনে এসে এক সারিতে দাঁড়িয়েছে ওরা, কোনও কথা বলছে না। কয়েক মুহূর্ত ওভাবেই কাটল।

শেষ পর্যন্ত চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন প্রৌঢ়া ইউনো, হেঁটে গিয়ে থামলেন আলফা-ওয়ানের সামনে। রাগে চেহারাটা লাল হয়ে উঠেছে তাঁর, হঠাৎ চড় মেরে বসলেন যুবককে।

 অপ্রত্যাশিত আঘাতে হকচকিয়ে গেল বাকি দু’জন। সোজা হয়ে বিস্মিত কণ্ঠে আলফা-ওয়ান বলল, কী ব্যাপার, চড় মারলে কেন?

তোমার পরামর্শ শুনতে গিয়ে কত বড় বিপদে পড়েছিলাম, জানো? ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন এলিসা।

আহাম্মকের বাচ্চা গারফিল্ড আমাকে সুদ্ধ শেষ করে দিতে যাচ্ছিল! হারামজাদা নিজের ফোনটাও বন্ধ করে রেখেছিল… অপারেশনটা যে বাতিল করতে বলব, তার কোনও উপায় ছিল না। আর তোমাদেরই বা হয়েছিল কী? এতবার রিং দিলাম, ফোন ধরলে না কেন?

ইতস্তত করল আলফা-ওয়ান। ইয়ে… ইচ্ছে করে করিনি কিছু। আমরা। আসলে একটা ঝামেলায় পড়ে গেছি…

ঝামেলা!

স্টাডির দরজা সশব্দে খুলে গেল সঙ্গে সঙ্গে, সদর্পে ভিতরে ঢুকল বেঁটে-খাটো এক লোক। হঠাৎ দেখায় তাকে কেউকেটা বলে মনে হয় না; তবে মুখ যখন খুলল, বোঝা গেল–এ লোক যে-সে মাল নয়।

গুড আফটারনুন, ড. এলিসা ভ্যান বুরেন! উদাত্ত কণ্ঠে সম্ভাষণ জানাল ডগলাস বুলক ওরফে বুলডগ, মুখে মিটি মিটি হাসি লেগে রয়েছে তার। নাকি আপনাকে আলফা-যিরো বলে ডাকলে খুশি হবেন?

.

১০.

ভীষণভাবে চমকে উঠলেন এলিসা, চিন্তা-ভাবনা এলোমেলো হয়ে গেল তার। এই অচেনা লোকটা তার গোপন পরিচয় জানল কী করে? কোনওমতে তিনি বললেন, ম,.. মানে! ক… কী বলছেন এসব?

মুখের হাসিটা একটুও হালকা হলো না তাঁদোড় সিআইএ কর্মকর্তার। বাঁকা সুরে বলল, বলতে চাইছেন, এদের আপনি চেনেন না? আপনি এই তথাকথিত আলফা টিমের নিয়োগকর্তা নন?

কীসের আলফা টিম? এ হচ্ছে আমার ছোট ভাই থিও… ওই দু’জন ওর বন্ধু-কার্টার আর মেলভিন।

তা তো বটেই… তা তো বটেই! সমঝদারের ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল বুলডগ। এসব কাজে নিজের ভাইয়ের চেয়ে বিশ্বস্ত লোক আর কোথায় পাবেন বলুন?

খুব আবোল-তাবোল বকছেন কিন্তু! রেগে গেলেন এলিসা। কে আপনি?

অধমের নাম ডগলাস বুলক। আই অ্যাম ফ্রম সিআইএ।

সিআইএ! হার্ট অ্যাটাক করবে যেন এলিসার, ধপ করে বসে পড়লেন পাশের একটা চেয়ারে।

ইয়েস, ম্যাম। হাসির বদলে এবার সিরিয়াস একটা ভাব ফুটে উঠল বুলডগের চেহারায়। আরেকটা চেয়ার টেনে মুখোমুখি বসল সে। কাজেই বুঝতে পারছেন, আবোল-তাবোল বকার জন্য আসিনি আমি এখানে। আপনার আর আপনার ভাইয়ের সমস্ত কীর্তি-কাহিনি জানা হয়ে গেছে আমার।

আমি… আমি কিছুই বুঝতে পারছি না…

অস্বীকার করে কোনও লাভ নেই, ডক্টর, কঠিন গলায় বলল বুলড়গ। সব জানি আমিনজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে খুন করিয়েছেন আপনি। আপনার গুণধর ভাই মণ্টেগো আইস শেলফের একটা রিসার্চ ফ্যাসিলিটিতে ঢুকে আটজন স্টাফকে খুন করেছে। পালাবার কোনও পথ নেই আপনাদের। যথেষ্ট পরিমাণ লোক রয়েছে আমার সঙ্গে, বাড়ির চারপাশে পজিশন নিয়ে অপেক্ষা করছে তারা। আপনার এই আলফা টিম… সেইসঙ্গে বডিগার্ডদের অনায়াসে কচুকাটা করতে পারবে ওরা।

আ… আপনি কি আমাদের গ্রেফতার করতে এসেছেন? ঢোঁক গিলে জিজ্ঞেস করলেন এলিসা।

আমি কী করব, সেটা নির্ভর করছে আপনার নেয়া সিদ্ধান্তের উপর। জেলে যেতে পারেন, আবার আমাকে সাহায্য করে আরাম-আয়েশেও থাকতে পারেন।

আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।

ইউনো-ভাইরাসের অ্যান্টিডোট, ড. বুরেন, বলল বুলডগ। ওটা আমার চাই।

ইউনো-ভাইরাস!

বিরক্তির একটা ভাব করল বুলডগ। আবার নাটক করছেন! বললাম না, সব জানি আমি?

কিন্তু… কীভাবে?

ভুলটা আপনার ভাইয়ের, হাসল বুলডগ। রিসার্চ ফ্যাসিলিটির ক্যামেরাগুলোতে নিজেদের ছবি উঠতে দেয়নি ও, তবে ব্রাইটনের লোকেরা যে। ড্রাইভারদের উপর নজর রাখার জন্য আইস-ট্র্যাক্টরগুলোতেও লুকানো ক্যামেরা বসিয়েছিল, সেটা সে জানত না। ওগুলো অপারেশন সেন্টারে লাইভ ফিড দিত না, ট্রাক্টরেই বসানো মেশিনে ভিডিও রেকর্ড করে রাখত–পরে চেক করে দেখার জন্য। তাই টেপগুলোর খোঁজ পেতে আমার দেরি হয়েছে। তবে পরে ওখান থেকেই ওর ছবি পাই আমি। ফ্যাসিলিটিতে হামলার আলামত দেখে বুঝতে পারছিলাম, কাজটা স্পেশাল ফোর্সের ট্রেইনিং পাওয়া সৈনিক ছাড়া আর কারও পক্ষে সম্ভব নয়। আর্কটিকে আমাদের একটা লিসেনিং পোস্টও আপনাদের স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন ইন্টারসেপ্ট করেছিল, কথাবার্তা শুনে আলফা-টিম যে সাধারণ কোনও খুনীর দল নয়, এ-ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হই। খুনীদের ছবি নিয়ে স্পেশাল ফোর্সের ডাটাবেজে সার্চ করতে শুরু করি, ওখান। থেকেই পেলাম প্রাক্তন ক্যাপ্টেন থিও ভ্যান বুরেনের নামটা।

ড. স্ট্যানলি ডোনেন সম্পর্কেও খোঁজ নিচ্ছিলাম আমরা–দেখলাম, ছাত্রজীবনে খুব ঘনিষ্ঠ নজন বন্ধু ছিল তাঁর… একজন ছাড়া সবাই মারা গেছে, রহস্যজনকভাবে। সেই একজন হচ্ছেন আপনি-থিও ভ্যান বুরেনের একমাত্র বোন! ব্যস, দুয়ে দুয়ে চার মেলাতে আর কী অসুবিধে হয়? পুরো ব্যাপারটাই পরিষ্কার হয়ে গেছে আমার কাছে-ভাইরাসটা আপনি ছেড়েছেন, বাকিদের নিজের ভাইয়ের মাধ্যমে সরিয়ে দিয়েছেন, যাতে প্রতিষেধকটা তৈরি করতে না পারে কেউ।

কোনও কথা ফুটল না এলিসার মুখে–এই লোক সত্যিই তাঁর নীল নকশার নাড়িনক্ষত্র জেনে ফেলেছে।

আপনাকেই প্রথমে খোঁজ করছিলাম আমরা, বলে চলল বুলডগ। কিন্তু কোথায় যে ঘাপটি মেরেছেন, তা বের করতে পারলাম না। শেষে আপনার ভাইয়ের দিকে নজর দিলাম, দেখলাম তিনি ভালমানুষের মত মেক্সিকো থেকে অ্যামস্টারড্যামের দিকে রওনা দিয়েছেন… ওঁর কীর্তিকলাপ যে আমরা জেনে ফেলব, সেটা আন্দাজও করতে পারেননি বোধহয়। নিজ নামেই ট্র্যাভেল করছিলেন সেজন্যে। তিনজনকেই ধরার জন্য ফাঁদ পাতি আমরা, নেদারল্যাণ্ড সরকারকে জানাই স্মাগলিং সংক্রান্ত একটা বিষয়ে ওদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে চাই। অনুমতি পেতে অসুবিধে হয়নি, গত চব্বিশ ঘণ্টা ধরে শিফল এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করেছে আমার লোকজন, আজ ওরা ল্যাণ্ড করার সঙ্গে সঙ্গে আটক করেছে…

ওরা আমাদের ফোনগুলো নিয়ে নিয়েছে, সেজন্যেই তোমার কল রিসিভ করতে পারিনি, বলল থিও।

বুলগের দিকে মুখ তুলে তাকালেন এলিসা, নিজেকে সামলে নিয়েছেন। আমাদের নিয়ে কী করতে চান আপনি?

বললাম না, কী করব–সেটা আপনার উপর নির্ভর করছে? চেয়ারে হেলান দিল বুলডগ।

অ্যান্টি-ভাইরাসটা পেলেই ছেড়ে দেবেন আমাদের?

ব্যাপারটা এত সহজ নয়, ডক্টর, হাসল বুলডগ। প্রথমে দু-একটা প্রশ্নের জবাব দিতে হবে আপনাকে।

কী প্রশ্ন?

আপনাকে দেখে মোটেও উন্মাদ বলে মনে হয় না। বরং এখন পর্যন্ত যা তথ্য-প্রমাণ পেয়েছি, তাতে তো মনে হচ্ছে অনেক প্ল্যান-প্রোগ্রাম করে মাঠে নেমেছেন। তাই আমি জানতে চাই, আসলে আপনার উদ্দেশ্যটা কী? ভাইরাসটা কেন তৈরি করেছেন? পুরো দুনিয়ার সমস্ত কম্পিউটার ধ্বংস করে দিয়ে লাভটা কী আপনার?

দ্বিধায় পড়ে গেলেন এলিসা, সব বলবেন কি বলবেন না, সেটা ঠিক করতে পারছেন না।

সময় কিন্তু বেশি নেই আপনার হাতে, গম্ভীর গলায় বলল বুলডগ।

লোকাল অথরিটি এখনও আসল ঘটনা জানে না, সবকিছু বলে দিয়ে ওদের হাতে যদি তুলে দিই আপনাদের, খুনের দায়ে নির্ঘাত ফাঁসিতে ঝুলবেন। সারা। পৃথিবীকে বিপদে ফেলবার কারণে আর কী কী শাস্তি হতে পারে, তা আর না-ই বা বললাম। আমার সঙ্গে লুকোচুরি না করলেই ভাল করবেন।

হার মানলেন প্রৌঢ়া ইউনো। নীচ কণ্ঠে ব্যাখ্যা করতে শুরু করলেন তার পরিকল্পনা। সবকিছু খুলে বললেন তিনি, কিছুই বাদ রাখলেন না। শুনতে শুনতে মুখের হাসি আরও বিস্তৃত হয়ে গেল বুলডগের। এলিসার কথা শেষ হতেই উৎফুল্ল গলায় বলল, ওয়াণ্ডারফুল! আপনি তো দেখি আমার প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে গেছেন, ডক্টর! অপূর্ব… এক কথায় অপূর্ব আপনার প্ল্যান!

তাতে লাভ কী, কাজে তো আর লাগাতে পারলাম না, গোমড়ামুখে বললেন বিজ্ঞানী।

কে বলল কাজে লাগাচ্ছেন না? ধুরন্ধর সিআইএ কর্মকর্তার চোখে শয়তানির ঝিলিক। বিশ্বাস করুন, আমার সাহায্য নিয়ে পুরো ব্যাপারটাকে কয়েক গুণ বেশি সফল করে তুলবেন আপনি!

অবাক হয়ে গেলেন এলিসা, আলফা-টিমের সদস্যদের চেহারায়ও বিস্ময়। তারমানে ভাইরাসটাকে ঠেকাতে চান না আপনি?

চাই তো বটেই, তবে শুধু অ্যামেরিকাতে, বুলডগ বলল। অন্য জায়গায় যত খুশি আঘাত হানুক ওটা, তাতে আমাদেরই লাভ। আপনার ওই প্ল্যানের জোরে পুরো পৃথিবীর উপর রাজত্ব করতে পারব আমরা। হাত মেলান, ডক্টর! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বন্ধু হতে চলেছেন আপনি।

এবার হাসি ফুটল এলিসার মুখে। প্রতিপক্ষের বাড়িয়ে দেয়া হাত ধরে করমর্দন করলেন তিনি। থিও বলল, এই খুশিতে ড্রিঙ্ক করা যেতে পারে, কী বলেন, মি. বুলক?

শিওর!

আলফা টিমের তিন সদস্য শ্যাম্পেন আর গ্লাস নিয়ে এল, মদ বিতরণ করা হলো সবার মাঝে।

আমাদের সাফল্যের আশায়! বলে গ্লাস ঠোকাঠুকি করা হলো।

একটা ব্যাপার আপনাকে বলা হয়নি, মি, বুলক! শ্যাম্পেনে চুমুক দিয়ে বললেন এলিসা।

কী?

প্ল্যানটা সফল করার পথে একটা ছোট বাধা রয়েছে–তার নাম মাসুদ রানা।

রানা? ভুরু কোঁচকাল বুলডগ। আমি ওর ব্যাপারে জানি। মন্টেগোতে ও-ই আপনার দলের সঙ্গে লড়াই করে ড. ডোনেনকে বাঁচাবার চেষ্টা করছিল।

ওটা মাসুদ রানা ছিল? বিস্মিত কণ্ঠে বলল কার্টার ওরফে আলফা-টু।

ব্যাটা তো আমাদের সামনে সাগরে পড়ে গিয়েছিল। মরেনি?

না, মরেনি, বললেন এলিসা। বহাল তবিয়তে বেঁচে যে আছে, শুধু তাই নয়। আমার কাছে পর্যন্ত পৌঁছেও গেছে।

রানা কঠিন চিজ, স্বীকার করতে বাধ্য হলো বুলডগ। অ্যামস্টারড্যামে ও যে পৌঁছুবেই, তা জানতাম আমি। ওর মত একগুয়ে লোককে ঠেকাবার কোনও উপায় নেই ভেবে ওদিকে আর শক্তি খরচ করিনি, কারণ আমি জানি–আপনি যেহেতু পুরো ব্যাপারটার মূলে, সেহেতু আপনার তরফ থেকে কোনও সাহায্যই পাবে না সে। বরং আপনিই আমার হয়ে ওকে পথ থেকে সরিয়ে দেবেন বলে ভেবেছিলাম।

চেষ্টা তো করেছি, তিক্ত গলায় বললেন এলিসা। ওকেই মারার জন্য গারফিল্ডকে খবর দিয়েছিলাম, গর্দভটা আমাকেও সাক্ষী ভেবে মেরে ফেলতে যাচ্ছিল। রানার কারণে বেঁচে গেছি। গারফিল্ডকে উল্টো ও-ই খতম করে দিয়েছে।

আপনাকে সন্দেহ করেনি তো?

উঁহু। কোথাকার কোন এগারো নম্বর ইউনোকে দায়ী ভাবছে ও। আমাকে চাপাচাপি করছে অ্যান্টিভাইরাসটা তৈরি করে দেবার জন্য। ভুলভাল বুঝিয়ে ওকে আমার বাগানবাড়িতে রেখে এসেছি, বলেছি জিনিসটা তৈরি করতে যাচ্ছি।

এগারো নম্বর ইউনো! বুলডগের কপালে কুটি দেখা দিল, ব্যাপারটা তার কাছে নতুন।

ওটা স্রেফ গল্পগাথা, মি, বুলক, আশ্বস্ত করলেন এলিসা। আমাদের দশজনের বাইরে আর কোনও ইউনো নেই, কখনও ছিল না, থাকতে পারে না।

তা হলে তো ভালই। কিন্তু এই রানার ব্যাপারে একটা ব্যবস্থা নিতে হয়। ভীষণ নাছোড়বান্দা লোক… অ্যান্টিভাইরাসটার জন্য দোজখ পর্যন্ত তাড়া করে বেড়াবে আপনাকে। যদি নিতান্তই না পারে, আর বিপর্যয়টা ঘটে যায়… তখন বেরুবে প্রতিশোধ নিতে।

ডেনজারাস লোক, থিও একমত হলো। ওকে ছোট করে দেখা ঠিক হবে না।

তা বুঝতে পেরেছি আমি, ভাইয়ের দিকে তাকালেন এলিসা। ভাবছিলাম তোমাকেই পাঠাব ওর ব্যবস্থা নিতে। কিন্তু এখন যখন মি. বুলক আমাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েই ফেলেছেন…।

চাইছেন আমিই ওকে খতম করি? বুলডগ জিজ্ঞেস করল।

লোকটা যে ভয়ঙ্কর, তা তো আপনারা সবাই বলছেন। ছজন লোক আর অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়েও পেরে ওঠেনি গারফিল্ডের মত অভিজ্ঞ খুনী। রানাকে শেষ করতে চাইলে বড় একটা টিম দরকার, যাতে ও মেরে কুলিয়ে উঠতে না পারে। আমার মনে হয়, আপনিই এ-ধরনের আয়োজন সবচেয়ে ভালভাবে করতে পারবেন। তা ছাড়া লোকাল অথরিটি পরবর্তীতে বিষয়টা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে চাইলেও আপনি সেটা ট্যাকেল করতে পারবেন।

মাথা ঝাঁকাল বুলডগ। কথাটা মন্দ বলেননি আপনি। মাসুদ রানা আর রায়হান রশিদের সঙ্গে শেষ বোঝাপড়াটা করতে চাই আমিও। আপনার ওই বাড়িতে দু’জনেই আছে তো?

আছে। সঙ্গে দু’জন গার্ড আর আমার সেক্রেটারিও আছে।

হুঁ, এই তিনজনের ব্যাপারে কী করতে চান?

ওরা কেউই আমার কলজের টুকরো নয়, গোটা প্ল্যানের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই ওদের, বাঁকা সুরে বললেন এলিসা। রানা বা রায়হানের কাছে। গোটা ব্যাপারটা শুনে থাকতে পারে–এমন কারও বেঁচে না থাকাটাই বরং মঙ্গল আমাদের জন্য।

সেক্ষেত্রে এটা ছেলেখেলা হবে, মন্তব্য করল থিও। বাড়িটা আমাদেরই হওয়ায় বাড়তি সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে, কাউকে বাঁচানোর ঝামেলাও থাকছে না… মি. বুলকের দরকার কী, আমরা তিনজনেই গিয়ে সেরে আসতে পারি কাজটা।

নেতিবাচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন এলিসা। না, কম লোক পাঠাবার ঝুঁকি নেব না আমি। তা ছাড়া এটাও চাই না–তোমরা রানার সামনে এক্সপোজড় হয়ে যাও। মি. বুলকই এ-কাজের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। কী, মি. বুলক, আপনি রাজি তো?

উইথ প্লেয়ার, হাসল বুলডগ। রানাকে একটা শিক্ষা দেবার জন্য আমি বহুদিন ধরে অত্যন্ত উৎসুক হয়ে আছি।

তা হলে আসুন, মাসুদ রানা আর রায়হান রশিদের আশু-মৃত্যু উপলক্ষে পান করি।

ক্রুর হাসি হেসে যার যার গ্লাস তুলে ধরল ষড়যন্ত্রকারীরা।

.

১১.

ড্রুইভেনড্রেশটে সন্ধ্যা নেমেছে।

দোতলার সামনের দিকের একটা কামরায় জানালার পাশে চেয়ার নিয়ে বসে আছে রায়হান, পাহারা দিচ্ছে। যদিও বাইরে গাস আর ফ্রেইবেল রয়েছে, তারপরও রানা কোনও ঝুঁকি নিতে চায় না। তাই ড. বুরেনের সঙ্গে কথা হবার পর থেকে দোতলায় একটা ওয়াচ-পোস্ট বসিয়েছে ও। নিজেরা পালা করে পাহারা দিচ্ছে ওখানে বসে।

বসে থাকতে থাকতে চোখদুটো একটু লেগে এসেছিল তরুণ হ্যাকারের, হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে ধড়মড় করে উঠে বসল। রানা এসে ঢুকেছে। জিজ্ঞেস করল, কী, ঘুমিয়ে পড়েছিলে নাকি?

না… ইয়ে… মানে…।

রিল্যাক্স, সারাদিন যা ধকল গেছে, তাতে শরীর একটু বিশ্রাম চাইতেই পারে। হাতে ধরা একটা প্লেট বাড়িয়ে দিল রানা-স্ন্যাকস্ নিয়ে এসেছে। কিছু মুখে দাও, শক্তি পাবে। সামনে আরও কাজ রয়েছে আমাদের।

প্লেটটা হাতে নিয়ে ঘড়ি দেখল রায়হান-ছটা বিশ বাজে। বলল, গিয়েছিলেন কোথায়? আপনার তো আরও বিশ মিনিট আগে এসে আমাকে রেহাই দেয়ার কথা।

আরেকটা চেয়ার টেনে বসল রানা। পুরো বাড়ি আর আশপাশটা রেকি করে দেখলাম তাতেই সময় লেগে গেল। অবশ্য ফেরার তাড়া ছিল না, তোমাকে ইভার সঙ্গে খুব গল্প জুড়তে দেখলাম তো, ভাবলাম একটু দেরি করলেও তোমরা সেটা খেয়াল করবে না।

হুঁহ, গল্প না ছাই! আপনি যাবার একটু পরেই কেটে পড়েছে ও। স্যাণ্ডউইচে একটা কামড় দিয়েই মুখ বাঁকিয়ে ফেলল রায়হান। এহ্ হে, কে বানিয়েছে এটা?

গম্ভীর হয়ে গেল রানা। আমি। কেন, ভাল হয়নি?

অপ্রস্তুত একটা হাসি হাসল তরুণ হ্যাকার। না, না, অসাধারণ হয়েছে…

চাপা মেরো না, রানা বলল। বানানোর পর আমিও একটা খেয়েছি–স্বাদটা এখনও মুখে লেগে আছে।

হেসে ফেলল রায়হান। কষ্ট করে আপনি আবার স্যাণ্ডউইচ বানাতে গেলেন কেন?

রান্নার লোক পেলাম না, কী করব? ইভাকেও দেখলাম না কোথাও।

গেল কোথায় ও, চলুন তো দেখি। আমাকে তো বলেছিল দশ মিনিটের মধ্যে ফিরবে। উঠে দাঁড়াল রায়হান।

দু’জনে বেরিয়ে এল করিডরে, একেকটা রুমের দরজা খুলে ভিতরে উঁকি। দিতে শুরু করল। রায়হানের কামরায় পাওয়া গেল সেক্রেটারিকে–তরুণ হ্যাকারের ল্যাপটপটা অন করে কাজ করছে।

ওদেরকে ঢুকতে দেখে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল ইভা, চেহারায় ধরা পড়ে যাবার ভাব।

কী করছ তমি এখানে বসে? জিজ্ঞেস করল রায়হান।

ইয়ে… অপরাধীর মত বলল ইভা। সময় কাটছিল না, তাই ভাবলাম একটু গেম খেলি…

বসে বসে কম্পিউটার গেম খেলছ! আর আমরা তোমাকে খুঁজে মরছি।

কেন?

দাঁত বের করে হাসল রায়হান। মাসুদ ভাই অসাধারণ এক স্যাণ্ডউইচ বানিয়েছেন, সেটা তোমাকে না খাইয়ে শান্তি পাচ্ছি না।

রায়হান!… চোখ রাঙিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল রানা, ঠিক সেই সময়ে ওর কোমরের কাছে খড় খড় করে উঠল ওয়াকিটকি–বাইরের দুই প্রহরীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য একটা সেট চেয়ে নিয়েছে ও।

মি, রানা! শুনতে পাচ্ছেন? সেটটা মুখের কাছে তুলল রানা। হ্যাঁ, গাস। কী ব্যাপার?

আশপাশ থেকে কিছু লোককে এগিয়ে আসতে দেখছি… কথা শেষ হলো না বেচারার, দুপ করে একটা শব্দ হলো স্পিকারে, পরমুহূর্তে কেটে গেল যোগাযোগ।

থমকে গেল রানা–কীসের শব্দ ছিল ওটা, বুঝতে পেরেছে। সাইলেন্সার লাগানো অস্ত্র দিয়ে খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়েছে গাস ফর্ককে। ফ্রেইবেল রক্ষা পেয়েছে, এমনটা ভাবারও কোনও কারণ নেই। রুমের বাতি নিভিয়ে দৌড়ে জানালার কাছে গেল ও। পর্দা সরিয়ে সাবধানে উঁকি দিল বাড়ির পিছনদিকে।

অন্ধকারটা সয়ে আসতে একটু সময় লাগল, তারপরই অভিজ্ঞ চোখে ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে নড়াচড়া টের পেল ও। মনে মনে ভাগ্যকে গাল পাড়ল রানা। করিডরে বেরিয়ে অন্যপাশের রুমটায় গেল ও, ওখান থেকে জানালা দিয়ে বাড়ির সামনেটা দেখল। এদিকেও একই অবস্থা।

ওর পিছু পিছু রায়হান আর ইভাও এসেছে। তরুণী সেক্রেটারি বিস্মিত কণ্ঠে বলল, হচ্ছেটা কী?

রানার চেহারা থমথম করছে। নতুন একটা দল এসেছে আমাদের ব্যবস্থা করবার জন্য। এটা আগেরগুলোর চেয়ে বড়… বিশ-পঁচিশজনের কম হবে না। কর্ডন করে পুরো বাড়ি ঘিরে ফেলেছে ওরা।

কী বলছেন! ইভা প্রায় চেঁচিয়ে উঠল। গাস আর ফ্রেইবেল…

মুখে কিছু না বলে শুধু মাথা নাড়ল রানা।

ওহ নো! ফুঁপিয়ে উঠল ইভা।

বিমূঢ় দেখাল রায়হানকে। পঁচিশজন! শিট… কীভাবে ঠেকাব ওদের?

ঝড়ের বেগে চিন্তা করল রানা। তারপর বলল, সেলারে… কুইক!

.

কর্ডনটা ধীরে ধীরে ছোট করে আনছে বুলডগের বাহিনী–এরা সবাই তার প্রতি। বিশ্বস্ত সিআইএ এজেন্ট, ইয়োরোপের বিভিন্ন জায়গা থেকে এই মিশনের জন্য ডেকে আনা হয়েছে, প্রত্যেকেই অত্যন্ত দক্ষ। দাড়ি-কমা মেনে রেইড অপারেশনটা চালাচ্ছে দলটা–শুরুতে আত্মগোপন করে থাকলেও বৃত্তের আকার ছোট করে আনায় এখন আর লুকোছাপা করছে না, গাছগাছালি আর ঝোঁপঝাড়ের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে। কর্ডন থেকে নিরাপদ দূরত্বে, একশো গজ পিছনে রয়েছে বুলডগ–হঠাৎ গোলাগুলি শুরু হলে বেঘোরে প্রাণ হারাতে চায় না।

বাড়ি থেকে ত্রিশ গজ দূরত্বে পৌঁছে গেছি আমরা, রেডিওতে রিপোর্ট দিল অ্যাসল্ট টিমের নেতা। এখন পর্যন্ত কেউ গুলি করেনি আমাদের লক্ষ্য করে।

হুঁ, তাই বলে অসতর্ক হয়ে পোড়ো না, বুলডগ বলল। আমাদের টার্গেট অত্যন্ত ঘাগু লোক, সে তক্কে তক্কে থাকবে তোমাদের বোকা বানানোর জন্যে।

ডোন্ট ওয়ারি, স্যর, বলল টিম লিডার। আমরা অ্যালার্ট রয়েছি। আপনি পারমিশন দিলে ভিতরে ঢুকতে পারি।

একটু অপেক্ষা করো, হুড়মুড় করে ভিতরে ঢুকলে নিজেই বিপদে পড়বে। চারপাশ থেকে রিপোর্ট নাও, পুরোপুরি শিয়ের হয়ে তারপর ঢোকো।

ইয়েস, স্যর।

একটু দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে বুলডগ। এলিমেন্ট অভ সারপ্রাইজটা নষ্ট হয়ে গেছে–বাইরের ওই গার্ডের সঙ্গে যে রানার ওয়াকিটকিতে যোগাযোগ থাকবে, সেটা কে ভাবতে পেরেছিল! লোকটাকে গুলি করতেও দেরি হয়ে গেছে, তার আগেই বাড়িতে রেইডের খবর জানিয়ে দিয়েছে ব্যাটা, রানাকে সতর্ক করে দিয়েছে। এখন কী ধরনের ডিফেন্সিভ অ্যাকশন নেয় বাঙালিটা, সেটা আন্দাজ করা সম্ভব হচ্ছে না–মাথা দারুণ চালু ছোকরার, কী করবে, ঈশ্বরই জানেন।

ডগলাস বুলকের মানসচোখে ভেসে উঠছে আরকানসাসে এক বছর আগে সেই মিশনারি চার্চ অবরোধের ঘটনাটা। পুরনো গির্জাটায় মাসুদ রানাকে কোণঠাসা করে ফেলেছিল এফবিআই, সিক্রেট সার্ভিস আর পুলিশের সমন্বয়ে গড়া ফেডারেল টাস্ক ফোর্স, বিল্ডিংটায় আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল ওকে পুড়িয়ে মারার জন্য। এক কথায় অসম্ভব ছিল রানার বেঁচে থাকা। অথচ সবাইকে অদ্ভুত কৌশলে বোকা বানিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল ও, কেউ কিছু টেরও পায়নি। এবারও তেমন কিছু ঘটে কি না–সেই শঙ্কা মাথা থেকে তাড়াতে পারছে না বুলডগ।

এলিসা ভ্যান বুরেন আর তার ভাই অবশ্য গ্যারান্টি দিয়ে বলেছে, তাদের বাগানবাড়ি থেকে পালাবার জন্য গোপন সুড়ঙ্গ-টুড়ঙ্গ নেই–স্বস্তির ব্যাপার এটাই! ফাঁকি দেয়ার উপায় নেই রানার, বাঁচার জন্য লড়তেই হবে তাকে। তবে ছোকরার কাছে যে অটোমেটিক পিস্তল ছাড়া আর কিছু নেই, সেটাও জানা গেছে। এলিসার কাছ থেকে। বাড়িতে আর কোনও অস্ত্রও নেই, কাজেই লড়াইটা সংক্ষিপ্তই হওয়া উচিত। ভেবে-চিন্তে রানার কোর্স অভ অ্যাকশন একটাই দেখতে পাচ্ছে বুলডগবাড়ির আনাচে-কানাচে লুকিয়ে থেকে ভিতরে ঢোকা টিমটার উপর চোরাগোপ্তা হামলা চালাতে পারে সে।

আবার জ্যান্ত হয়ে উঠেছে রেডিও। টিম লিডার জানাল, সবার রিপোর্ট পেয়েছি আমি, স্যর। কোথাও কোনও অস্বাভাবিকতা দেখা যাচ্ছে না। অনুমতি দিন, তা হলে ইনফিলট্রেট করি।

ঠিক আছে, বলল বুলডগ। বাইরে অর্ধেক লোক রেখে বাকিরা ঢোকো। এক সঙ্গে… বাড়ির চারপাশ থেকে ঢোকা চাই। আর হ্যাঁ, টার্গেট সম্ভবত লুকিয়ে থাকবে; তোমাদের চমকে দিয়ে আড়াল থেকে আক্রমণ করতে পারে। সতর্ক থেকো।

কিচ্ছু ভাববেন না, ভিতরে গিয়েই চিরুনির মত তল্লাশি শুরু করব। ব্যাটা লুকিয়ে থেকে সুবিধে করতে পারবে না।

দ্যাটস গুড।

আর কিছু?

না। কমেন্স অ্যাটাক!

.

দোতলা বাড়িটার নীচে, ভূগর্ভস্থ সেলারে এসে ঢুকেছে রানারা। আসবার পথে কিচেন থেকে নিয়ে এসেছে একটা গ্যাস সিলিণ্ডার, বার্নার, সেইসঙ্গে কিছু স্টিলের তৈজসপত্র আর কাঁচের ছোট বোতল। জিনিসগুলো মাটিতে নামিয়ে। রেখে হাঁপাতে হাঁপাতে রায়হান বলল, কিছু মনে করবেন না, মাসুদ ভাই। –আপনার ওপর পুরো আস্থা আছে আমার, তারপরও বলব–এখানে ঢুকে কাজটা বোধহয় ভাল করেননি। এই ভাড়ার ঘর হচ্ছে একটা কানা গলির মত–কোথাও যাবার উপায় নেই। কোণঠাসা হয়ে পড়ব তো!

জিনিসপত্রগুলো দেখাল রানা। এগুলো কি এমনি এমনি এনেছি ভাবছ?

মতলব যে কিছু একটা এঁটেছেন, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু কাজটা উপরে কোথাও করা যেত না?

উঁহুঁ, রানা মাথা নাড়ল। উপরে থাকলে দশ মিনিটও টিকতাম না, ধরা পড়ে যেতাম।

সে তো এখানেও পড়ব, রায়হান মনে করিয়ে দিল।

দেরিতে, যোগ করল রানা। সেলারের ট্র্যাপডোরটা বয়সের ভারে কিচেনের মেঝের সঙ্গে মিশে গেছে, সহজে চোখে পড়ে না খেয়াল করেছ নিশ্চয়ই? উপরে তল্লাশি করতে করতে হয়রান হয়ে তারপর এটার দিকে নজর দেবে ওরা। বাড়িটার যা আকার, তাতে বিশ-পঁচিশ মিনিট সময় পাবো আমরা। প্ল্যানটা সফল করতে বাড়তি সময়টুকু দরকার।

প্ল্যানটা কী আপনার? জিজ্ঞেস করল ইভা।

এসো, দেখাচ্ছি। দুই সঙ্গীকে সেলারের এক প্রান্তে নিয়ে গেল রানা-বাড়ির আশপাশের বাগানে ব্যবহারের জন্য ওখানে বেশ কিছু সারের বস্তা স্তূপ করে রাখা, রেকি করার সময় দেখে গেছে ও।

বেছে বেছে দুটো বস্তা বের করল রানা, ভুরু কুঁচকে সেগুলোর লেবেল পড়ল রায়হান। প্রথমটা পটাশিয়াম নাইট্রেট, দ্বিতীয়টা এক ধরনের মিশ্র সার। কিছু বুঝতে পারল না রায়হান, জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল।

এটার মধ্যে সালফার আছে, দ্বিতীয় বস্তাটা দেখিয়ে বলল রানা।

তো?

সেলারের আরেকটা কোণের দিকে আঙুল তুলল রানা, ওখানে ফায়ারপ্লেসে ব্যবহারের জন্য কয়লার বস্তা রাখা হয়েছে।

কী যে দেখাচ্ছেন আপনি, আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না, বিরক্ত গলায় বলল ইভা।

রায়হান অবশ্য দ্রুত চিন্তা করছে। পটাশিয়াম নাইট্রেট, সালফার… আর কয়লা… হঠাৎ দৃষ্টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল ওর। উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, গানপাউডার!

একজ্যাক্টলি! হাসল রানা। সংখ্যায় শত্রুরা বেশি বটে, তবে ছোটখাট দুয়েকটা বোমা বানিয়ে সমীকরণটা আমাদের অনুকূলে নিয়ে আসা যায়। কী বলো?

তা তো বটেই, রায়হানও হাসছে।

কী বলছেন এসব! ইভা অবাক। এই সার আর কয়লা মিলিয়ে আপনারা গানপাউডার বানিয়ে ফেলবেন?

ঠিক ধরেছ, রানা বলল। বিশুদ্ধ সালফার না থাকায় জিনিসটা হানড্রেড পারসেন্ট শক্তিশালী হবে না বটে, তবে আমাদের কাজ চলবে।

ফিউজ আর সিল দরকার আমাদের, মাসুদ ভাই, রায়হান চাহিদা জানাল।

শুকনো দড়ি দেখেছি ওখানে, রানা আঙুল তুলে প্রবেশপথের পাশটা দেখাল। একটা মেইন্টেন্যান্স লকারও আছে। দেখো, সিল করার মত কিছু পাওয়া যায় কি না। মোম হলেই চলবে।

 মিনিটখানেকের মধ্যেই সবকিছু নিয়ে ফিরে এল রায়হান। একটা ডিশে মোমবাতি ভেঙে ছোট ছোট মোমের টুকরো ফেলল রানা, তারপর সেটা রাখল আগুনের উপরে–ইতোমধ্যেই বার্নারটায় গ্যাস সিলিণ্ডার থেকে লাইন দিয়েছে ইভা, জ্বেলেছে চুলোটা। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই গলে তরল হয়ে গেল মোম। এবার আরেকটা পাত্রে পরিমাণমত সালফারের মিশ্রণ, পটাশিয়াম নাইট্রেট আর কয়লা ঢালা হলো। একটা খুন্তি দিয়ে ভাল করে সবকিছু মেশাল রানা। রায়হান এই ফাঁকে শুকনো দড়িতে পটাশিয়াম নাইট্রেট মাখিয়ে সেগুলোকে ফিউজে পরিণত করল।

তৈরি হয়ে গেছে গানপাউডার-কাঁচের ছোট বোতলগুলোয় ওগুলো ভরে ফেলল তিনজনে, মাঝখান দিয়ে বেরিয়ে এল ফিউজ, সবশেষে মোম ঢেলে আটকে দেয়া হলো মুখগুলো। সবমিলিয়ে আটটা বোমা বানানো গেল এভাবে।

শব্দ করে শ্বাস ফেলল রানা। ইভা জিজ্ঞেস করল, মাত্র এই কটা বোমা। দিয়ে হারাতে পারবেন উপরের লোকগুলোকে?

হারজিত বলতে কী বোঝাচ্ছ, তার উপর নির্ভর করে, রানা বলল। যত যা-ই করি, ওদের সবাইকে ঘায়েল করা কিছুতেই সম্ভব হবে না আমাদের পক্ষে। আমি চাইছি গ্যারাজ পর্যন্ত পৌঁছুতে, ওখানে একটা ল্যাণ্ড রোভার আছে। বোমা ফাটিয়ে যদি ওদের চমকে দিতে পারি, তা হলে গাড়িটা নিয়ে পালিয়ে। যেতে অসুবিধে হবে না, হতভম্ব অবস্থায় থাকবে তো, বাধা দেয়ার সময় পাবে না। যে-কটা বানিয়েছি, তাতে কাজ হবার কথা।

কিচেন থেকে গ্যারাজ কিন্তু অনেক দূর, শুকনো গলায় বলল ইভা।

জানি। চেষ্টার পাশাপাশি ভাগ্যের সহায়তা প্রয়োজন হবে আমাদের।

ঘড়ি দেখল রায়হান। সময় কিন্তু অনেকটা পেরিয়ে গেছে, মাসুদ ভাই। এখুনি বেরিয়ে না পড়লে আটকা পড়ব, ওরা এসে যাবে।

হ্যাঁ, চলো। ওর হাতে চারটে বোমা ধরিয়ে দিল রানা। আগুন জ্বালানোর কিছু আছে তোমার কাছে?

কিচেন থেকে ম্যাচ নিয়ে নেব। আপনার লাগবে?

চুলো জ্বালতে ইভাকে গ্যাস-লাইটারটা দিয়েছিল, ওটা ফেরত নিয়ে রানা। বলল, আমার কাছে লাইটার আছে।

তা হলে চলুন, বেরিয়ে পড়া যাক।

ট্র্যাপডোরের পাল্লা একটু উঁচু করে উঁকি দিল রানা। কিচেনটা খালি দেখা গেল, এক দফা তল্লাশি চালিয়ে চলে গেছে হামলাকারীরা। সমস্ত কেবিনেট আর মিটসেফের দরজা হাঁ করে খোলা, উন্মুক্ত হয়ে পড়ে রয়েছে রিফ্রিযারেটর আর ডিপ ফ্রিটাও। লোকগুলো মোটেই ঝুঁকি নিচ্ছে না, মানুষ লুকোবার মত সব জায়গায় হানা দিচ্ছে। ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিল ও—ট্রাপডোরটার রঙ মেঝের সঙ্গে মিশে গেছে বলে। নইলে এতক্ষণে লাশ হয়ে পড়ে থাকতে হতো।

নিশ্চিত হয়ে সঙ্গীদের ইশারা করল রানা, তিনজনে হামাগুড়ি দিয়ে উঠে। এল কিচেনে। মেঝের সঙ্গে শরীর মিশিয়ে রেখেছে, যাতে জানালা দিয়ে বাইরে থেকে দেখা না যায় ওদের। কিচেনের বাইরে করিডরে হামলাকারীদের আনাগোনার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে, জানালা দিয়ে সন্তর্পণে উঁকি দিয়ে বাড়ি ঘেরাও করে থাকা লোকগুলোকেও দেখতে পেল ওরা। ঠোঁট কামড়ে কোর্স অভ অ্যাকশন ঠিক করতে শুরু করল রানা, ব্যস্ত দৃষ্টি বোলাচ্ছে চারপাশে।

বামদিকের দেয়ালে ডাম্বওয়েইটারটা নজর কাড়ল ওর ছোট্ট একটা লিফটের মত জিনিস ওটা, নীচতলার রান্নাঘর থেকে ওটায় করে খাবারদাবার দোতলার ডাইনিং রুমে ওঠানো-নামানো হয়। এগিয়ে গিয়ে শাফটটার আকার-আয়তন, পরীক্ষা করল রানা–বেশ সরু। ইভা অবশ্য সহজেই উঠতে পারবে, কিন্তু ওর আর রায়হানের কষ্ট হবে।

তরুণী সেক্রেটারির দিকে তাকাল রানা। দড়ি বাইতে পারো?

ইতিবাচক ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল ইভা।

গুড! রায়হান, নীচের মেইন্টেন্যান্স লকার থেকে একটা বোল্ট কাটার বা স্প্যানার নিয়ে এসো।

একটু পরেই ফিরে এল রায়হান, বোল্ট কাটার এনেছে। ডাস্থওয়েইটারের শেলফটাকে কেইব থেকে কেটে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল রানা, নামিয়ে রাখল শাফটের নীচদিকে। এরপর ইভাকে বলল ভিতরে ঢুকে পড়তে।

কেইবটা বেয়ে ওপরতলায় চলে যাও। কিন্তু বেরিয়ো না, কিছুক্ষণ ঝুলে থেকো। রায়হানের দিকে ফিরল রানা। ওর পিছনে তুমি থাকবে।

আর আপনি?

সবার শেষে। ভাল কথা, দেয়ালে পা ঠেকিয়ে রেখো, কেইবণ্টার উপর বেশি প্রেশার পড়লে উপর থেকে খুলে পড়তে পারে।

মাথা ঝাঁকিয়ে শফটের ভিতর ঢুকে গেল ইভা আর রায়হান, কোনও প্রশ্ন করল না আর। পকেট থেকে ছোট্ট বোমাগুলো বের করল রানা। ফিউযে আগুন ধরিয়ে কিচেনের বিভিন্ন জায়গায় স্থাপন করল। এরপর পিস্তল বের করে জানালা লক্ষ্য করে ধাই ধাই করে কয়েকটা গুলি করল ও।

হৈ-হৈ, রব উঠল বাইরে থেকে, পরমুহূর্তেই নরক ভেঙে পড়ল যেন কিচেনের মধ্যে। বৃষ্টির মত ছুটে এল কর্ডন টিমের, ছোঁড়া বুলেটগুলো। জানালার কাঁচ ভেঙে পড়ল, দেয়াল ফুটো হতে থাকল মোরব্বার মত।

রানা অবশ্য এসবের জন্য অপেক্ষা করছে না, গুলি ছুঁড়েই ডাম্বওয়েইটারের শাফটে ঢুকে পড়েছে ও, টেনে বন্ধ করে দিয়েছে দরজাটা। উপরে ঝুলতে থাকা রায়হানের পা স্পর্শ করে বলল, তৈরি থাকো, বিস্ফোরণ ঘটবে এখুনি। পড়ে যেয়ো না আবার!

কর্ডন টিমের গুলি থেমে গেল মিনিটখানেকের মধ্যে। লাথি মেরে কিচেনের দরজা ভাঙার শব্দ হলো, অ্যাটাক গ্রুপের সদস্যরা ভিতরে ঢুকছে। কামরাটার মাঝ পর্যন্ত পৌঁছুল তারা, এমন সময় ফাটল বোমাগুলো–প্রায় একই সঙ্গে। আগুনের একটা গোলা দখল করল কিচেনটাকে, হামলাকারীরা ঝলসে গেল সে আগুনে। শকওয়েভের ধাক্কায় শাফটের ভিতরে পলেস্তরা খসে পড়তে শুরু করল।

বেরোও, ইভা! চেঁচিয়ে উঠল রানা,। বেরোও!

*

বিস্ফোরণের শব্দে চমকে উঠল বুলডগ ওয়াকিটকি তুলে জিজ্ঞেস করল, হচ্ছেটা কী ওখানে?

বোমা, স্যর! হাঁপাতে হাঁপাতে জবাব দিল টিম লিডার। কিচেনে বোমা ফাটানো হয়েছে!

হোয়াট! খেপাটে গলায় বলল বুলডগ। ওরা বোমা পায় কোত্থেকে?

জানি না। তবে পাঁচজনকে হারিয়েছি আমি।

আর রানা?

ভিতরে নেই সে। নিশ্চয়ই সরে পড়েছে।

কীভাবে? তোমরা নজর রাখছিলে না সবখানে?

রাখছিলাম, স্যর। কিন্তু ব্যাটা গেল কোথায়, বুঝতে পারছি না।

একটু ভাবল বুলডগ, পরক্ষণেই উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার চেহারা। মাটির নীচে… নিশ্চয়ই সেলারে গিয়ে ঢুকেছে হারামজাদা। সব লোক জড়ো করো, সেলারটা ধুলোয় মিশিয়ে দেয়া চাই!

ইয়েস, স্যর!

কয়েক মিনিটের মধ্যেই তৈরি হয়ে গেল দলটা, ট্র্যাপোর খুলে সেলারের ভিতরে ছুঁড়ে দিল এক ঝাঁক গ্রেনেড। মুহূর্মুহূ গর্জনে কেঁপে উঠল গোটা বাড়ি।

তারপরও সন্তুষ্ট নয় টিম লিডার। সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে বলল, আবার!

আরও এক ঝাঁক গ্রেনেড ফেলা হলো ভিতরে। আরেক দফা বিস্ফোরণে কাপল বাড়িটা। এবার হাসি ফুটল টিম লিডারের মুখে। ওয়াকিটকিতে রিপোর্ট দিল সে, ইটস্ ডান, স্যর। টার্গেটকে কিমা বানিয়ে ফেলেছি আমরা।

লাশ দেখাও আমাকে! বলল বুলডগ। তার আগে আমি স্বস্তি পাবো না।

দলের লোকজনকে নিয়ে সেলারে ঢুকল টিম লিডার। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে তল্লাশি শুরু করল। আর ঠিক তখুনি ওয়াকিটকিতে ভেসে এল আর্তনাদের মত একটা কণ্ঠ। দোতলায় ব্যাকআপ হিসেবে দু’জনকে রেখে আসা হয়েছিল, তাদেরই একজন উন্মাদের মত চেঁচাচ্ছে।

দিস ইজ ফক্সট্রট-ফাইভ! উই আর আণ্ডার অ্যাটাক… উই আর আণ্ডার অ্যাটাক!!

.

দোতলার করিডর ধরে ছুটছে রানা, পিছু পিছু রায়হান আর ইভা। হঠাৎ সামনে অ্যাটাক টিমের দু’জন উদয় হলো। তিন টার্গেটকে ওপরতলায় আশা করেনি তারা, চমকে গেল মুহূর্তের জন্য, দেরি করে ফেলল হাতের উজি সাবমেশিনগান তুলতে। সুযোগটা হাতছাড়া করল না রানা, ছুটন্ত অবস্থাতেই হাতের পিস্তল তুলে গুলি করল। লোকগুলো বুলেটপ্রুফ ভেস্ট পরে আছে, তাই বুকের বদলে নিশানা করল আরেকটু উপরে উন্মুক্ত জায়গায়।

সামনের লোকটার গলায় ঢুকে গেল বুলেট, খাবি খেতে খেতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল সে-শ্বাসনালী ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে, বিশ্রী ঘড় ঘড় শব্দে বেরিয়ে আসছে তাজা রক্ত। দ্বিতীয় জনের রিফ্লেক্স চমৎকার, মাজত্ ফ্ল্যাশ দেখেই ডাইভ দিয়েছে সে, গুলি ফাঁকি দিয়ে পাশের একটা রুমে ঢুকে পড়ল। ভিতরে তাকে চেঁচাতে শোনা গেল-ওয়াকিটকিতে সাহায্য চাইছে।

দিস ইজ ফক্সট্রট-ফাইভ! উই আর আণ্ডার অ্যাটাক… উই আর আণ্ডার অ্যাটাক…

গাসের কথা মনে পড়ল রানার, ঠিক এই রকম একটা পরিস্থিতিতেই বেচারাকে নির্মমভাবে খুন করেছে এরা। নিষ্ঠুর ভঙ্গিতে নির্দেশ দিল ও, রায়হান, চুপ করাও ওকে।

মাথা ঝাঁকিয়ে পকেট থেকে একটা বোমা বের করল তরুণ হ্যাকার, দাঁত দিয়ে কেটে ফিউজটা ছোট করে নিল, তারপর আগুন ধরিয়ে ছুঁড়ে দিল রুমের ভিতরে, দরজা ফাঁক করে।

মাত্র পাঁচ সেকেণ্ডের বিরতি পড়ল কাজটুকুর জন্য। আবার ছুটতে শুরু করল ওরা। পিছনে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটল, কাতর একটা ধ্বনি ভেসে এল রুম থেকে।

দৌড়াতে দৌড়াতে বাড়ির অন্যপ্রান্তে পৌঁছে গেল তিনজন। সামনেই নীচে যাবার আরেকটা সিঁড়ি, সেটা ধরে নেমে এল গ্রাউণ্ড ফ্লোরে। হইচই শোনা গেল, করিডর ধরে ছুটে আসছে সেলার থেকে উঠে আসা দলটা। রানার আদেশের জন্য অপেক্ষা করল না রায়হান, আরেকটা বোমায় আগুন ধরিয়ে সজোরে ছুঁড়ে দিল ধাওয়াকারীদের উদ্দেশে। প্রাণ বাঁচাতে লাফ দিয়ে সরে গেল লোকগুলো, করিডরের মাঝখানে প্রচণ্ড শব্দে ফাটল বোমাটা।

গ্যারাজে যাবার দরজার সামনে পৌঁছে গেছে রানা, লাথি মেরে খুলে ফেলল ওটা–দুই সঙ্গীসহ দৌড়ে গিয়ে উঠে পড়ল ল্যাণ্ড রোভারে। সঙ্গে চাবি না থাকায় টান দিয়ে ড্যাশবোর্ডের তলা থেকে বের করে আনল এক গোছা তার, ইগনিশনের ওয়্যারিঙে স্পার্ক ঘটিয়ে স্টাট দিল ইঞ্জিনে।

সিটবেল্ট বাঁধো, দুই সঙ্গীকে বলল ও।

গিয়ার দিল রানা, সজোরে চেপে ধরল অ্যাকসেলারেটর। কংক্রিটের মেঝেতে টায়ার ঘষা খাবার কর্কশ শব্দ হলো, হ্যাঁণ্ডব্রেক রিলিজ করতেই তীরের মত সামনে বাড়ল ল্যাণ্ড রোভার-গ্যারাজের দরজা চুরমার করে দিয়ে বেরিয়ে এল বাইরে।

বুলডগ তখন রেডিওতে চিৎকার জুড়েছে–স্টপ দেম! স্টপ দেম!!

তাতে লাভ হলো না। বাড়ি থেকে মাত্র ত্রিশ গজ দূরে ছিল কর্ডন টিম, তাই প্রতিক্রিয়ার কোনও সময়ই পেল না তারা, চোখের পলকে গাড়িটা চড়ে বসল তাদের গায়ের উপর। সামনে দু’জন মানুষ পড়ে গেছে দেখেও স্পিড কমাল না রানা, বাম্পারের ধাক্কায় উড়িয়ে দিল ব্যাটাদের। ফলে কর্ডনের মাঝখানে একটা ফাঁক পেয়ে গেল ল্যাণ্ড রোভার, সেখান দিয়ে অপ্রতিরোধ্য ঝড়ের মত বেরিয়ে। গেল বেষ্টনী ভেদ করে।

এতক্ষণে সংবিৎ ফিরে পেল বাকিরা, পলায়নরত বাহনটার পিছু পিছু দৌড়াতে শুরু করল, অস্ত্র তুলে ফায়ারও করছে একই সঙ্গে। ল্যাণ্ড রোভারের পিছনে ইস্পাতের ফুলকি উড়ল, ভেঙে পড়ল কাঁচ, গুলির আঘাতে রিয়ার-এণ্ড ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছে গাড়িটার।

মাথা নামিয়ে রাখো! চেঁচিয়ে নির্দেশ দিল রানা।

আঁকাবাঁকা পথ ধরে ছুটছে ল্যাণ্ড রোভার, কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই পিছে ফেলে দিল পদব্রজে ছুটতে থাকা ধাওয়াকারীদের। একটু পরেই পৌঁছে গেল বাগানবাড়ির মূল ফটকে–বন্ধ ওটা, এবারও স্পিড কমাল না রানা, গেট ভেঙে বেরিয়ে এল রাস্তায়।

শব্দ করে শ্বাস ফেলল ইভা। থ্যাঙ্ক গড যে বেরিয়ে আসতে পেরেছি।

এখুনি খুশি হয়ো না, বলল রায়হান। বিপদ এখনও কাটেনি।

মানে!

ওদের সঙ্গে কোনও গাড়ি ছিল না, খেয়াল করেছ? ওগুলো নিশ্চয়ই আশপাশে কোথাও আছে… ব্যাকআপ টিমসহ।

রায়হান ঠিকই বলেছে, শান্তস্বরে বলল রানা, চোখ রিয়ারভিউ মিররে।

পিছনে তাকিয়ে দেখো।

মাথা ঘুরিয়েই আঁতকে উঠল ইভা। তীব্র বেগে ওদের ট্রেইল ধরে ছুটে আসছে দুটো ফোর্ড এস.ইউ.ভি-ড্রাইভারের বিপরীত পাশের জানালা দিয়ে শরীরের একাংশ বের করে রেখেছে দু’জন গানার, তাদের হাতের উজি সাবমেশিনগানগুলো দূর থেকেও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।

ওহ নো…

কথা শেষ হলো না তরুণী সেক্রেটারির, গুলি শুরু করল খুনীরা।

.

১২.

রাস্তার অ্যাসফল্টে কর্কশ শব্দ তুলে চলেছে চাকাগুলো–ঘন ঘন স্টিয়ারিং ঘোরাচ্ছে রানা, এঁকে বেঁকে বুলেটবৃষ্টিকে ফাঁকি দিতে চায়। লাভ বলতে টায়ারগুলোকে এখনও বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছে, কিন্তু ছাঁকনির মত ফুটো হয়ে যাচ্ছে ল্যাণ্ড রোভারের চেসিস; এখনও যে দেয়াল ভেদ করে গুলিগুলো যাত্রীদের গায়ে এসে লাগেনি, সেটা স্রেফ ভাগ্যের জোরে।

চুপচাপ বসে থেকো না, রায়হান! পাশে তাকিয়ে চেঁচাল রানা। ফায়ার করো!

মাথা ঝাঁকাল তরুণ হ্যাকার, সিটবেল্ট খুলে ফেলে উল্টো ঘুরল সে, কোমর থেকে পিস্তল বের করে ফেলেছে। ইভা তার সিটে শুয়ে পড়েছিল আগেই, মেয়েটার উপর দিয়ে হাত প্রসারিত করল ও, পিছনের ভাঙা উইৎশিল্ডের ফাঁক। দিয়ে গুলি করতে শুরু করল।

একটা ফোর্ডের কাঁচে ফাটল ধরতে দেখা গেল, তবে আরোহীদের কেউ আহত হয়নি। পাল্টা গুলিতে তাদের ক্রোধ আরও বেড়ে গেল যেন, আগের চেয়ে দ্বিগুণ পরিমাণে গুলি করতে থাকল তারা।

রায়হানের ম্যাগাজিন খালি হয়ে গেছে, সিটের আড়ালে শরীরে নামিয়ে গাল দিয়ে উঠল ও। শিট! আমার অ্যামিউনিশন শেষ, মাসুদ ভাই।

নিজের জ্যাকেটের পকেটে হাত দিয়ে রানারও মুখ কালো হয়ে গেল। একটাই ক্লিপ আছে। ওটা রায়হানের হাতে দিয়ে বলল, এ-ই আমাদের শেষ। সম্বল।

এ দিয়ে কিছু হবে না, মাসুদ ভাই। খামোকা গুলি খরচ করার কোনও মানে দেখতে পাচ্ছি না।

হায় হায়! পিছনের সিট থেকে হাহাকার করে উঠল ইভা। তোমাদের গুলি শেষ?

ফুয়েল গজের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়াল রানা–সর্বনাশের ষোলকলা পূর্ণ হয়েছে, কাঁটাটা দ্রুত বাঁয়ে ঘুরে যাচ্ছে। আমাদের ফুয়েল লাইনও হিট হয়েছে, দুঃসংবাদটা অন্যদের জানিয়ে দিল ও।

ইয়াল্লা! রায়হানের চেহারা দেখে মনে হলো এক চামচ তেতো ওষুধ তাকে খাইয়ে দিয়েছে কেউ। তা হলে?

দ্রুত চিন্তা করল রানা। অস্ত্র বলতে শুধু রায়হানের কাছে তিনটে বোতল-বোমা বাকি রয়েছে। ওগুলো বের করতে বলল ও।

লাভ কী? ওগুলো ওদের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে কোনও কাজ হবে না। পাশ কাটিয়ে চলে আসতে পারবে।

প্লানটা কাজে লাগলে পাশ কাটাতে পারবে না।

কী প্ল্যান?

খুলে বলল রানা।

ভাল বুদ্ধি বের করেছেন, হাসি ফুটল রায়হানের ঠোঁটে।

দুটো বোমা নাও, রানা বলল। ফিউয একদম ছোট করে ফেলে ওখান থেকে একটা দাও আমাকে, অন্যটা তুমি রাখো।

কথামত কাজ করল রায়হান। বোমাটা হাতে নিয়ে গাড়িটাকে সিধে করল। রানা, এবার সরলরেখায় ছুটছে–শত্রুদেরকে ওর পছন্দমত পজিশনে আসতে দিচ্ছে আসলে।

অনুমানটা সঠিক বলে প্রমাণ হলো। ল্যাণ্ড রোভারটা আর ডান-বাম করছে না দেখে সমান্তরালভাবে পিছনের দুকোণে চলে গেল ফোর্ডদুটো, গতি বাড়িয়ে পাশাপাশি আসবার চেষ্টা করছে, যাতে পাশ থেকে নিশ্চিত শটে টায়ার ফাটিয়ে। দিতে পারে।

রায়হানের দিকে তাকিয়ে ইশারা করল রানা, সঙ্গে সঙ্গে লাইটার দিয়ে দুটো ফিউযেই আগুন ধরাল তরুণ হ্যাকার। বোমাটা কায়দা করে ধরে রানা বলল, হোল্ড অন!

পরমুহূর্তেই সজোরে ব্রেক কষল ও। থমকে গেল ল্যাণ্ড রোভার, ঘোরা বন্ধ করে চাকাগুলো বিশ্রী শব্দে ঘষা খাচ্ছে রাস্তায়, থামিয়ে ফেলছে গাড়িটাকে। অকস্মাৎ এমনটা ঘটায় তাল মেলাতে পারল না ফোর্ডদুটো, সবেগে অতিক্রম করে যেতে থাকল থেমে পড়া বাহনটাকে।

প্রতিপক্ষের খোলা জানালাগুলো পাশাপাশি পৌঁছুতেই নড়ে উঠল দুই বিসিআই এজেন্ট, আলতো করে ছুঁড়ে দিল বোমাদুটো-সোজা এস.ইউ.ভি-দুটোর ভিতরে গিয়ে পড়ল ওগুলো। ঘটনাটা এতই অপ্রত্যাশিত যে, সেটাকে প্রতিরোধ করার কোনও উপায় রইল না শত্রুদের–ফিউযের দৈর্ঘ্য ছোট হওয়ায় রিঅ্যাকশনের সময়ও পেল না তারা। গাড়ির মধ্যে বোমা নিয়ে সোজা। চলে গেল সামনে।

ল্যাণ্ড রোভার থেকে বিশ গজ দূরে ঘটল বিস্ফোরণ। ছোটখাট দুটো আগুনের গোলা লাফ দিয়ে উঠল ফোর্ডগুলোর ভিতরে-আরোহীরা অক্কা পেল তৎক্ষণাৎ।

দৃশ্যটা দেখে হাততালি দিয়ে উঠল রায়হান। রানার মুখেও নিষ্ঠুর হাসি।

তোমরা কারাবলো তো? বিস্মিত কণ্ঠে বন্ধুকে জিজ্ঞেস করল ইভা। রায়হান, তোমাকে তো এমন ভয়ঙ্কর মানুষ বলে কখনও কল্পনাও করিনি আমি।

ভয়ঙ্কর মানুষ, আমরা নই, ইভা; ভয়ঙ্কর ওরা! আঙুল তুলে সামনেটা দেখাল রায়হান। আমরা নির্দোষ-ভালমানুষ… স্রেফ আত্মরক্ষা করছি, আর কিছু নয়।

কিন্তু এতসব কীভাবে সম্ভব হচ্ছে তোমাদের পক্ষে? এভাবে লড়াই করতে কোথায় শিখেছ?

সেসব নাহয় পরেই আলোচনা করা যাবে, রানা নাক গলাল। এখনও আমাদের ঝামেলা শেষ হয়নি। বাগানবাড়ির টিমটা যে-কোনও মুহূর্তে চলে আসবে।

এই গাড়ি নিয়ে ওদের ফাঁকি দেয়া সম্ভব নয়, মাসুদ ভাই, একেবারে বারোটা বেজে গেছে, বলল রায়হান, ফাঁকা রাস্তাটার উপর চোখ বোলাল ও। আর কোনও গাড়িও দেখছি না যে, দখল করে পিঠটান দেব।

তাতে লাভও হবে না। ব্যাটাদেরকে যে-রকম মরিয়া দেখছি, কিছুতেই পিছু ছাড়বে বলে মনে হচ্ছে না।

তা হলে?

একটা পাবলিক-প্লেসে পৌঁছুতে হবে আমাদেরকে। লোকজনের ভিড়ে মিশতে পারলে পালানো সহজ হবে, দেখে ফেললেও সবার সামনে খোলাখুলি হামলা চালাবার সাহস পাবে না ওরা।

হুঁ, ঠিক বলেছেন।

ইভার দিকে ফিরল রানা। যেভাবে ফুয়েল ঝরছে, তাতে টেনে-টুনে হয়তো মিনিট পনেরো চালাতে পারব গাড়িটা। এর মধ্যে কোনও পাবলিক-প্লেসে পৌঁছুনো যাবে?

একটু ভাবল ইভা। তারপর বলল, হ্যাঁ, রেলওয়ে স্টেশন… বিয়লমার অ্যারেনা এখান থেকে খুব কাছে। সামনে একটা বাইপাস রোড আছে, ওটা ধরে গেলে দশ থেকে বারো মিনিটের মধ্যে পৌঁছুনো সম্ভব।

গুড, বলে গিয়ার দিল রানা, জ্বলন্ত ফোর্ডগুলোকে পাশ কাটিয়ে সামনে ছোটাল ল্যাণ্ড-রোভারটাকে।

দূর থেকেই আগুনটা চোখে পড়ল বুলডগের। পাশে গিয়ে গাড়িটা যখন থামানো হলো, চোয়াল ঝুলে পড়ল তার।

এগুলো কি… এগুলো কি…

হ্যাঁ, স্যর, পাশ থেকে বলল অ্যাসল্ট টিমের নেতা। আমাদেরই গাড়ি। আরও চারজন হারালাম আমরা।

মুখের ভাষা হারাল বুলডগ, কিছু বলতে পারছে না। সন্দেহ হলো তার–মাসুদ রানা লোকটা রক্তমাংসের মানুষ, নাকি অন্যকিছু? এত আয়োজন করে হামলা চালাবার পরও সে বেঁচে যায় কী করে? আক্রমণের পরিকল্পনা যখন করা হচ্ছিল, তখন একটাও খুঁত চোখে পড়েনি তার। মনে হচ্ছিল কোনও সুযোগই পাবে না ব্যাটা বাঙালি, অসহায়ভাবে মারা পড়বে। কিন্তু বাস্তব বলছে অন্য কথা-ছোকরা তো মরেইনি, এ-পর্যন্ত উল্টো তেরোজনকে খতম করে দিয়েছে। কিচেনে পাঁচজন, দোতলায় দুই, কর্ডন টিমে আরও দুই, আর ব্যাকআপ টিমের চারজন… চ্যাম্পিয়ন খেলোয়াড়ের মত স্কোর বাড়িয়ে চলেছে। ব্যাটা। প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে বুলডগের জনবল। নিজের অজান্তেই ভয়। ভয় করে উঠল সিআইএ কর্মকর্তার মনে-পিছু না হটলে কখন না জানি বাকিদের পাশাপাশি নিজেকেও পরপারে পাড়ি জমাতে হয়।

অ্যাসল্ট টিমের লিডারও বোধহয় একই কথা ভাবছে। নিচু গলায় সে বলল, ইয়ে…স্যর। আরও কিছু লোক জোগাড় না করে বোধহয় এগোনোটা ঠিক হবে না…

আঁতে ঘা লাগল বুলডগের, গরম চোখে তাকাল সঙ্গীর দিকে। খেঁকিয়ে উঠে বলল, কী বললে! এতই যদি ভয় করে তো চুড়ি পরে বসে থাকো গে।

রাগ করছেন কেন, স্যর? অবস্থাটা তো নিজ চোখেই দেখছেন। পুরো টিম নিয়েও কিছু করা যায়নি রানার, আর এখন তো লোক অর্ধেক কমে গেছে

শাট আপ! খেপে গেল বুলডগ। গাধার বাচ্চা গাধা! পুরো অপারেশনটা লেজে-গোবরে করে এখন আবার যুক্তি দেখাচ্ছ আমাকে?

আমরা আবার গোলমাল করলাম কোথায়? যেভাবে ব্রিফিং দিয়েছেন, ঠিক সেভাবেই তো কাজ করেছি।

খবরদার, মুখে মুখে কথা বলবে না! হুমকি দিল বুলডগ। আজ রাতের ভিতরই রানা আর ওর সাগরেদকে নিকেশ করা চাই। যদি না পারো, তোমাদের প্রত্যেকের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে বোঝাপড়া করব আমি।

কাঁচুমাচু হয়ে গেল টিম লিডারের মুখ। জী, স্যর। এখন তা হলে কী করব?

লোকাল ল-এনফোর্সমেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করো। খোঁজ নাও, ভাঙাচোরা ল্যাণ্ড-রোভারটা কোনদিকে গেছে।

.

বিয়ল্‌মার রেলস্টেশন।

মাইলখানেক দূরে রাস্তার পাশে গাড়িটা ফেলে রেখে এসেছে রানারা, টিকেট কেটে ঢুকেছে স্টেশনে। জায়গাটা বেশ পছন্দ হয়েছে ওদের–প্রচুর লোকজন রয়েছে ভিতরে, এদের মাঝে মিশে যেতে কষ্ট হবে না। তা ছাড়া সিকিউরিটিও খুব কড়া, স্টেশনের প্রবেশপথে মেটাল ডিটেক্টর রয়েছে, অস্ত্র নিয়ে কেউ ঢুকতে পারবে না; সেই সঙ্গে রয়েছে পুলিশি প্রহরা।

প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে চারপাশটা একটু দেখল রানা, পরবর্তী করণীয় নিয়ে ভাবছে। এখানে বেশি সময় কাটানোর ইচ্ছে নেই ওর, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সরে যেতে চায়। এই স্টেশনে মেট্রো সার্ভিসের ট্রেন থামে বলে ওগুলোরই একটায় চড়ার সিদ্ধান্ত নিল। রায়হানকে বলল টিকেট কেটে আনতে।

দশ মিনিট পরে ফিরে এসে তরুণ হ্যাকার জানাল, এ-মুহূর্তে লোকাল ট্রেন নেই কোনও। আসবে একটা, তবে আধঘণ্টা পরে। জিজ্ঞেস করল, ওটার টিকেট আনব?

নাহ্, আধঘণ্টা অপেক্ষা করাটা রিস্কি হয়ে যায়, বলল রানা। এখুনি ছাড়বে, এমন কোনওটা নেই?

ওই যে, ওটা, রায়হান আঙুল তুলে দেখাল।

ঝকঝকে একটা ট্রেন দেখা যাচ্ছে প্ল্যাটফর্মের পাশে, আকৃতিটা অদ্ভুত, মাথাটা তীক্ষ্ণ বর্শার মত, যেন একটা রেসিং কার। বগিগুলো সাদা আর মেরুন। রঙে নকশাকাটা। নামটা ফুটে আছে ঝকঝকে অক্ষরে: থেলিস।

ওটা হাই-স্পিড ট্রেন, অভ্যন্তরীণ যাত্রী পরিবহন করে না, জানাল ইভা। ওটায় যদি চড়ি, তা হলে হয় প্যারিস, নাহয় ব্রাসেলসে গিয়ে নামতে হবে।

কিছু বলল না রানা, আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে গেল ট্রেনটার দিকে। হাই-স্পিড। ট্রেনের কথা শুনেছে অনেক, ছবিতেও দেখেছে, কিন্তু এখনও চড়া হয়ে ওঠেনি। ট্রেইন-আ-গ্রা-ভিতে বা সংক্ষেপে টি.জি.ভি বলে এগুলোকে।

স্থলপথে যত ধরনের যানবাহন আছে, তার মধ্যে এক বিস্ময়, এই টিজিভিআধুনিক ট্রান্সপোর্টেশনের সর্বোৎকৃষ্ট নমুনা। মাটিতে চললেও এগুলো পাল্লা দিতে পারে যে-কোনও যাত্রীবাহী আকাশযানের সঙ্গে। হাই-স্পিড রেলের প্রধান বৈশিষ্ট্য এর দ্রুত গতি। সবচেয়ে আস্তে যেটা চলে, সেটারও গতিবেগ ঘণ্টায় দুশ কিলোমিটার। গিনেস বুকে সর্বোচ্চ ৫৭৪ কিলোমিটার বেগে চলার রেকর্ড রয়েছে একটা জাপানি টিজিভির। এই স্পিড সাধারণ রেললাইনে অর্জন করা সম্ভব নয়, তাই টিজিভির ট্র্যাক ভিন্ন ধরনের। চৌম্বকীয়। পাত বসিয়ে তৈরি করা হয় হাই-স্পিড রেলওয়ে–ওগুলোর উপর দিয়ে। বিপরীতমুখী চুম্বকের প্রভাবে ভেসে থাকে টিজিভির বগিগুলো, চাকা আর রেললাইনের মধ্যকার ঘর্ষণজনিত কোনও রকম বাধা না থাকায় ছুটতে পারে অনায়াসে। দিন দিন প্রযুক্তিটার আরও উন্নতি হচ্ছে। শুরুতে এই ট্রেনগুলোয়। মেকানিক্যাল যা যা ছিল, তার সবই আজকাল প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। কম্পিউটার দিয়ে। টিজিভি এখন অত্যন্ত জনপ্রিয় একটা যোগাযোগ মাধ্যম, ইন্টারন্যাশনালি পরিচালিত হয় বলে প্রচুর ইয়োরোপিয়ান আজকাল বিমান বাদ দিয়ে এতেই ভ্রমণ করে।

মুগ্ধ দৃষ্টিতে ট্রেনটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে রানা জিজ্ঞেস করল, এটা কি এখান থেকেই সোজা প্যারিসে চলে যাবে নাকি?

না, রায়হান বলল। অ্যামস্টারড্যাম-সেন্ট্রালে একটা স্টপেজ আছে। বোধহয়। কিন্তু ওখানে যাবার জন্য তো টিকেট দেবে না, নিলে দেশের বাইরে যাবার টিকেটই কাটতে হবে।

নো প্রবলেম, ঘুরল রানা। চলো নিয়ে আসি।

মাত্র দশ-বারো ইউরো খরচ করে যেখানে যাওয়া যায়, সেখানে যেতে আপনি হাজার ইউরো খরচ করবেন? ইভা চোখ কপালে তুলল।

হাসল রানা। ব্যাপারটা কেউ কল্পনাও করবে না, তাই না? সেটাই তো চাই!

দুই সঙ্গীকে নিয়ে টিকেট কাউন্টারের দিকে এগোল ও। ইভার হাতে ক্রেডিট কার্ড দিয়ে পাঠাল টিকেট কিনতে, রায়হান আর ও দাঁড়িয়ে থাকল একটু পিছনে।

হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠল তরুণ হ্যাকার, রানার হাত ধরে চোখ দিয়ে ইশারা করল। রুক্ষ চেহারার কয়েকজন যুবক এসে ঢুকেছে স্টেশনে। ল্যাণ্ড রোভারটা নিশ্চয়ই খুঁজে পেয়েছে ওরা, রেলস্টেশনটা কাছাকাছি একমাত্র পাবলিক-প্লেস হওয়ায় বুঝতে পেরেছে–শিকারেরা এখানেই আসবে। হাত খালি লোকগুলোর, তারপরও কোটের আড়ালে লুকিয়ে রাখা আগ্নেয়াস্ত্রের উপস্থিতি পরিষ্কার বোঝা গেল। একজনের চেহারা চিনতে পারল রানাড. বুরেনের বাগানবাড়িতে নীচতলার করিডরে দেখেছে একে।

ইয়াল্লা, বিস্মিত ভঙ্গিতে বলল রায়হান। এরা অস্ত্র নিয়ে ভিতরে ঢুকল কীভাবে? মেটাল ডিটেক্টরে ধরা পড়ে যাবার কথা তো!

জবাবটা পরমুহূর্তেই পাওয়া গেল। দৃঢ় পদক্ষেপে আরও কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হলো ডগলাস বুলক। গেটে নিশ্চয়ই সিআইএ-র ক্রিডেনশিয়াল দেখিয়েছে লোকটা; সেজন্যেই অস্ত্রসহ ঢুকতে দিয়েছে গার্ডেরা। ভিতরে ঢুকেই সঙ্গীদের নির্দেশ দিতে শুরু করল সিআইএ কর্মকর্তা, মাথা ঝাঁকিয়ে পুরো স্টেশনে ছড়িয়ে পড়ল লোকগুলো।

দৃশ্যটা দেখে স্থবির হয়ে গেল তরুণ হ্যাকার। তোতলাতে তোতলাতে বলল, এ… এরা সব বুলগের লোক, মাসুদ ভাই!

রানারও ভুরু কুঁচকে গেছে। ব্যাপারটা ঠিক মিলছে না–ড্রুইভেনডেটে বুলডগ কেন ওদের খুন করবার চেষ্টা করবে? তা-ও এত ব্যাপক আয়োজন করে? ড. বুরেন তার ফার্স্ট প্রায়োরিটি হবার কথা, আর নিরীহ একজন বিজ্ঞানীকে ধরার জন্য শুরুতেই বাইরে দাঁড়ানো প্রহরীদের খুন করে ফুল-স্কেল অ্যাসল্ট চালাতে হয় না। রানা ভদ্রমহিলার সঙ্গে আছে, এটা ভেবে সতর্কতা নিতে পারে সে, তাই বলে ওভাবে হামলা করার তো কথা নয়। কারণ ও-রকম আক্রমণে এলিসারও মারা যাবার সম্ভাবনা থাকে।

একটা জিনিস ভাবলেই প্রশ্নগুলোর জবাব মেলে। তা হলো–রানা আর রায়হান যে ওখানে একা আছে, জানত সে। ড. বুরেন নেই, সেটাও জানত। এজন্যেই নিশ্চিন্তে হামলা করতে পেরেছে। কিন্তু ওভাবে ভাবলেও নতুন প্রশ্ন উদয় মনে। শেষ ইউনোকে বাগে পাবার চেষ্টা না করে দলবল নিয়ে ওদের খুন করতে উতলা হয়ে উঠবে কেন বুলডগ? নাহ, বোঝা যাচ্ছে না কিছু।

মাথা তুলে ডিসপ্লে বোর্ড আর ওটার পাশে ঝোলানো স্টেশনের মস্ত ঘড়িটার দিকে তাকাল রানা। এখনও পাঁচ মিনিট বাকি আছে থেলিস টিজিভি ছাড়তে। বুলগের লোকজন যেভাবে গরুখোঁজা করছে ওদের, ট্রেনে চড়তে গেলে দেখে ফেলবে। ভাবনাচিন্তা করে একটাই পথ দেখতে পেল ও। রায়হানকে বলল, আমি ডাইভারশন তৈরি করতে যাচ্ছি, ইভাকে নিয়ে তুমি ট্রেনে উঠে পোড়ো।

আপনি?

মৃদু হাসল রানা। আমাকে নিয়ে ভেবো না, ঠিকই চলে আসব। কিন্তু আগে ওদের মনোযোগ ফেরাতে হবে, নইলে তোমরাও ট্রেনে উঠতে পারবে না।

রায়হানকে পিছনে ফেলে হাঁটতে শুরু করল রানা, স্টেশনের যাত্রীদের। আড়াল নিয়ে এগোচ্ছে। এঁকে-বেঁকে অনেকদূর ঘুরল ও, তবে দুমিনিটের ভিতরই পৌঁছে গেল লক্ষ্যস্থলে। স্টেশনের প্রবেশপথের এক পাশে একা দাঁড়িয়ে আছে বুলডগ, তাকেই টার্গেট করেছে ও। ঘুরে তার পিছনদিকে চলে গেল ও, সন্তর্পণে এগিয়ে সোজা গিয়ে থামল একেবারে পিঠের সঙ্গে বুক ঠেকিয়ে।

চমকে উঠে ঘোরার চেষ্টা করল বুলডগ, কিন্তু কিডনিতে একটা খোঁচা খাওয়ায় থেমে গেল। ওটা একটা কলম, কিন্তু সেটা বোঝার উপায় নেই কুত্তার বাচ্চার।

নড়বেন না, গুলি করে দেব তা হলে! হুমকির সুরে বলল রানা।

কথাটা বিশ্বাস করল বুলডগ, চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। যেভাবে ছিল। সেভাবেই। পিছন থেকে হাতড়ে তার শোল্ডার হোলস্টার থেকে অটোমেটিকটা কেড়ে নিল রানা। কলমটা সরিয়ে ফেলে এবার ওটাই চেপে ধরল বন্দির পিঠে।

পিস্তল ছিল না আপনার কাছে, না? নিজেকে চাবুকপেটা করতে ইচ্ছে হলো বুলগের, এত সহজে বোকা বনেছে বলে।

থাকলে কি আর মালিকেরটা তার পিঠে ধরি? হাসল রানা। আর কোনও কথা নয়, আসুন আমার সঙ্গে। খবরদার, চালাকি করবেন না। আপনার পিস্তলে আপনাকেই মারতে চাই না আমি।

পিঠে খোঁচা খেয়ে হাঁটতে শুরু করল বুলডগ।

.

১৩.

প্ল্যাটফর্মের একপাশে অ্যাসিসটেন্ট স্টেশন ম্যানেজারের অফিসরুম, হাঁটিয়ে বন্দিকে ওখানে নিয়ে গেল রানা। ভেবেছিল বুলগের নাম ভাঙিয়ে রুমটা খালি করাবে, কিন্তু তার প্রয়োজন হলো না। অফিসটা এমনিতেই খালি-ম্যানেজার কোথায় যেন গেছে।

দেখে মুখে হাসি ফুটল রানার। একটা চেয়ার টেনে বসতে দিল বন্দিকে, তারপর দরজা বন্ধ করে আরেকটা চেয়ার টেনে নিজেও বসল মুখোমুখি।

এবার… মি, বুলক, বলল রানা। কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দেবেন আপনি।

বিদ্রুপের হাসি হাসল বুলডগ। কীসের প্রশ্ন? আপনার খেল খতম, মি. রানা। অন্যকিছু ভেবে নিজেকে প্রবোধ দেবেন না। আমাকে বন্দি করে কোনও ফায়দাই হবে না আপনার। অনেক আগেই হেরে বসে আছেন আপনি।

কী বলতে চান, পরিষ্কার করে বলুন, কঠিন হয়ে উঠল রানার চেহারা।

কিছু বলব না আমি। শুধু এটুকু জেনে রাখুন, পুরো দুনিয়াকে উদ্ধারের যে দায় কাঁধে নিয়েছেন আপনি, তাতে সফল হবার সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে।

মানে!

মানে হচ্ছে–ইউ আর ফাইটিং ফর আ লস্ট ক্য, মি. রানা। যতই কেরামতি দেখান, ফলাফলটা অনেক আগেই নির্ধারিত হয়ে গেছে।

কী!

হ্যাঁ, মি. রানা। অ্যান্টিভাইরাসটা পেয়ে গেছি আমি, ইতোমধ্যে পেন্টাগনে পৌঁছে গেছে ওটা। সেই সঙ্গে এটাও নিশ্চিত করেছি–আপনি যেন কিছুতেই ওটার কোনও কপি না পান।

ড. বুরেন! কোথায় তিনি? কী করেছেন আপনি তাকে নিয়ে?

সেসব নিয়ে আপনাকে আর ভাবতে হবে না–ওই ভদ্রমহিলা আর কোনও কাজে আসবেন না আপনার।

মেরে ফেলেছেন ওঁকে?

উত্তর না দিয়ে বুলড়গ শুধু হাসল।

জবাব দিন, মি. বুলক!

গলা চড়িয়ে লাভ হবে না।-ইটস ওভার, মি. রানা।

সেজন্যেই আমাকে আর রায়হানকে খুন করতে গেছেন? যদি হেরে গিয়েই থাকি আমরা, তা হলে আর মারার দরকার কী? সামনে এসে আমাদের অপমান করলেই কি যথেষ্ট ছিল না?

ছেঁড়া সুতোকে কখনও ঝুলে থাকতে দিতে হয় না, মি. রানা। ওটাকে কেটে ফেলে দিতে হয়। আপনি ভবিষ্যতে সত্য প্রকাশ করে গোটা পৃথিবীর সামনে অ্যামেরিকার ইমেজ ধুলোয় মিশিয়ে দেবেন, সেটা কীভাবে হতে দিই, বলুন?

দেশের ইমেজ, নাকি আপনার? ষড়যন্ত্রটা ফাস হয়ে গেলে আপনার সাধের অ্যামেরিকা কাকে কোরবানির ছাগল বানাবে, তা আমি জানি না ভেবেছেন?

যা খুশি ভাবতে পারেন, নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল বুলডগ। আপনার ভাবাভাবিতে কিছু যাবে-আসবে না–কিছুই করতে পারবেন না কি না! দৌড়-ঝাঁপ বন্ধ করে বরং আত্মসমর্পণ করুন, বাঁচার একটা সুযোগ দিতে পারি আপনাকে।

আমাকে আত্মসমর্পণ করতে বলছেন! রানা বলল। এ-মুহূর্তে বেকায়দায় তো আছেন আপনি।

এটা কোনও সমস্যাই না, মনে হচ্ছে, একটুও চিন্তিত নয় বুলডগ।

আমাকে বেশিক্ষণ আটকে রাখতে পারবেন না আপনি, আমার লোকজন ঠিকই খোঁজ করতে শুরু করবে। বরং নিজেই ফাঁদের মধ্যে রয়েছেন আপনি, মি. রানা। এখানকার পুলিশকে আপনাদের ব্যাপারে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে–স্টেশন থেকে বেরুতে তো পারবেনই না, ট্রেনে চড়তে গেলেও অ্যারেস্ট হয়ে যাবেন।

তাই নাকি? বাঁকা সুরে বলল রানা। আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল ও, কিন্তু বাইরে স্টেশনের পাবলিক-অ্যাড্রেস সিস্টেমের মাইক গম গম করে ওঠায় চুপ হয়ে গেল।

অ্যাটেনশন প্লিজ। দিস ইজ দ্য লাস্ট বোর্ডিং কল ফর থেলিস এক্সপ্রেস টু প্যারিস। আই রিপিট…

একটু ভাবল রানা। এগিয়ে গিয়ে টেবিলের উপর থেকে তুলে নিল ইন্টারকমের রিসিভার। নির্দিষ্ট নাম্বারটা খুঁজে নিয়ে ডায়াল করে বলল, ইনফরমেশন ডেস্ক? আমি একটা বিজ্ঞপ্তি প্রচার করতে চাই…

ওর কথাগুলো শুনতে পেয়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেল বুলডগের। বিস্মিত কণ্ঠে বলল, মানেটা কী এর?

এখুনি দেখবেন, বলে পিস্তলটা উল্টো করে সজোরে বন্দির ঘাড়ের উপর আঘাত করল রানা।

চিৎপটাং হয়ে পড়ে গেল বুলডগ মেঝেতে–জ্ঞান হারায়নি, কিন্তু চোখে অন্ধকার দেখছে, নড়তে পারছে না। আর তখনই শোনা গেল ঘোষণা।

অ্যাটেনশন প্লিজ! ডগলাস বুলক নামে একটি ছোট্ট বাচ্চাকে প্ল্যাটফর্মে খুঁজে পাওয়া গেছে। বাবা-মার নাম-পরিচয় কিছু বলতে পারছে না সে, কাঁদছে। বাচ্চাটির অভিভাবকদের জরুরি ভিত্তিতে স্টেশনের অ্যাসিসটেন্ট ম্যানেজারের অফিসে যোগাযোগ করতে বলা হচ্ছে।

সঙ্গে সঙ্গে খড় খড় করে উঠল বুলড়গের ওয়াকিটকি। উত্তেজিত গলায় প্রশ্ন। করা হলো, স্যর, আপনি কোথায়? পাবলিক-অ্যাড্রেসে কী সব বলা হচ্ছে…

পড়ে থাকা বুলডগের কোমর থেকে ওয়াকিটকিটা খুলে আনল রানা, মুখের কাছে এনে নাকি সুরে বলল, হেল্প! হেল্প!! আমাকে মেরে ফেলল…

হোয়াট দ্য… স্যর, আমরা এখুনি আসছি!

হাত থেকে সেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিল রানা।

কাতরাতে কাতরাতে বুলডগ বলল, ইউ আর আ ডেড ম্যান, রানা! তোমাকে আমি ছাড়ব না!

নিষ্ঠুরভাবে হাসল রানা। আপনি না ছাড়ুন, তবে এবারের মত আমি আপনাকে ছেড়ে দিচ্ছি। যাবার আগে একটা কথা বলি–স্বার্থের জন্য পুরো পৃথিবীকে বিপদে ফেলে কাজটা আপনি একদমই ভাল করেননি, মি, বুলক। এ-ধরনের মানুষ নামের পিশাচকে মনে-প্রাণে ঘৃণা করি আমি। এবার ছাড়লাম ঠিকই, কিন্তু যদি এ-পথ থেকে সরে না দাঁড়ান, আগামীবার আমি কোনও দয়া দেখাব না। গুড বাই।

অফিস থেকে প্ল্যাটফর্মে বেরিয়ে এল রানা। ওর প্ল্যানটা কাজে লেগেছে–হাঁকডাক করতে করতে বসের খোঁজে ছুটে আসছে সিআইএ এজেন্টরা। সবকিছু ভুলে ছুটে আসছে পুলিশও-তিন পলাতককে ধরার জন্য যত পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল, সব মাথায় উঠেছে। জুতোর ফিতে বাঁধার ভঙ্গিতে বসে পড়ল রানা, ওকে পেরিয়ে চলে যেতে দিল দলটাকে। লোকগুলো দূরে সরে যেতেই উঠে দাঁড়াল ও, ছুটতে শুরু করল টিজিভির দিকে–ওটার কম্পার্টমেন্টগুলোর দরজা বন্ধ হতে শুরু করেছে। একটা জানালায় রায়হান আর ইভার মুখ দেখতে পেল, হাতছানি দিয়ে ডাকছে ওকে। একেবারে শেষ মুহূর্তে ট্রেনে উঠতে পারল ও-দরজা প্রায় বন্ধ হয়েই গিয়েছিল, সামান্য ফাঁকটার মধ্য দিয়ে কোনওমতে লাফিয়ে কম্পার্টমেন্টে ঢুকল রানা। সোজা হতেই দেখল, যাত্রীরা বাঁকা চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।

সরি, একটু হেসে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল ও, বাথরুমে দেরি করে ফেলেছি।

কুঞ্চিত ভ্রূগুলো সোজা হয়ে গেল, যাত্রীরা সবাই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। হেঁটে গিয়ে রায়হানের পাশে গিয়ে বসল রানা।

কী করে এসেছেন, বলুন তো? জিজ্ঞেস করল তরুণ হ্যাকার। বুলডগের নামে অদ্ভুত একটা অ্যানাউন্সমেন্ট শুনলাম.

জবাব না দিয়ে জানালার দিকে চোখ ফেরাল রানা-না, ট্রেনটাকে থামাতে ছুটে আসছে না কেউ।

নিরাপদেই বিয়ার অ্যারেনা থেকে বেরিয়ে এল থেলিস টিজিভি।

.

অফিসরুম থেকে ধরাধরি করে বুলডগকে বের করে আনল তার এজেন্টরা। একটু সুস্থ বোধ করতেই গা-ঝাড়া দিয়ে সবাইকে সরিয়ে দিল সে। খেপাটে গলায় বলল, ছাড়ো আমাকে! এখন আর দরদ দেখাতে হবে না! কানার দল, চোখে ঠুলি পরে ঘুরছিলে নাকি? হারামজাদা রানার বাচ্চা আমাকে ধরে নিয়ে গেল, তোমরা কেউ দেখতেও পেলে না?

গালি খেতে খেতে বিরক্ত হয়ে গেছে অ্যাসল্ট টিমের লিডার। তিক্ত গলায় বলল, শুধু আমাদের দোষ দেন কেন? আপনিও তো দেখেননি ওকে।

আবার মুখে মুখে কথা! সবকটা আবার আমাকে বাঁচাতে ছুটে এসেছে। এটা যে একটা ডাইভারশন ছিল, সেটা বোঝোনি?

মুখ কালো করে ফেলল সবাই-আসলেই বোকার মত কাজ করেছে। টিম লিডার তাড়াতাড়ি বলল, চিন্তা করবেন না, স্যর। এখুনি চিরুনিখোঁজা করছি…

হ্যাঁ, মাসুদ রানা তোমার জন্য বসে আছে আর কী! রাগে চোখদুটো জ্বলছে বুলড়গের। পগার পার হয়ে গেছে ও, বুঝলে, পগার পার হয়ে গেছে! পাশে দাঁড়ানো এক পুলিশ অফিসারের দিকে তাকাল সে। অ্যানাউন্সমেন্টটা হবার পর কোনও ট্রেন ছেড়েছে?

হ্যাঁ, বললেন অফিসার। একটা হাই-স্পিড ট্রেন, নন-স্টপ… প্যারিসে যাচ্ছে।

প্যারিস! টিম লিডার বলল। তা হলে ওটায় চড়েনি…

সব শোনার আগেই কথা বলো কেন? খেঁকিয়ে উঠল বুলডগ। অফিসার, আর কোনও স্টপেজ আছে ওটার?

মাথা ঝাঁকালেন ভদ্রলোক। অ্যামস্টারড্যাম সেন্ট্রাল থেকেও যাত্রী উঠবে ওটায়।

ওখানকার সিকিউরিটিকে সতর্ক করে দিন…

কথা শেষ হলো না বুলগের, কোটের পকেটে মোবাইল বেজে ওঠায় থেমে কানে তুলল ফোনটা। জটলা থেকে একটু দুরে সরে এসে বলল, হ্যালো;

হ্যালো, মি. বুলক! ওপাশ থেকে এলিসার কণ্ঠ শোনা গেল। তর সইছিল না, তাই নিজেই ফোন করে ফেললাম। সব ঠিকঠাকমত শেষ হয়েছে তো?

কীসের শেষ… হারামজাদাটা আমার নাকে দম তুলে রেখেছে, এখনও ধাওয়া করে বেড়াচ্ছি ওকে।

কী বলছেন! থমকে গেলেন এলিসা। এইমাত্র ড্রুইভেনড্রেশটের পুলিশ ডিপার্টমেন্ট থেকে ফোন এসেছিল, আমার বাগানবাড়িতে নাকি গোলাগুলি হয়েছে, লাশ পাওয়া গেছে কয়েকটা। আমি তো ভাবলাম, কাজ শেষ করে ফেলেছেন আপনারা।

কিছুই শেষ হয়নি, বুলডগ বলল। লাশ ওগুলো সব আমার লোকের। হারামজাদা রানা ওদেরকে মেরে পালিয়েছে।

পালিয়েছে! কথাটা এলিসার বিশ্বাস হচ্ছে না। কীভাবে?

সেসব পরে শুনবেন, এখন সময় নেই। একটা হাই-স্পিড ট্রেনকে ইন্টারসেপ্ট করতে যাচ্ছি আমি।

আবোলতাবোল কী বকছেন এসব? বিরক্ত হলেন এলিসা।

ড্রুইভেনড্রেশটে হাই-স্পিড ট্রেন আসে কোত্থেকে?

ওখানে নেই আমরা। রানা পালিয়ে বিয়লমারে এসেছে, এখানকার রেলস্টেশন থেকে একটা টিজিভিতে চড়ে বসেছে ও–ট্রেনটা অ্যামস্টারড্যাম সেন্ট্রালে থামবে। ওখানে যাচ্ছি আমরা।

কী নিয়ে একটা টিজিভিকে ধাওয়া করবেন, শুনি? বিদ্রূপ করলেন প্রৌঢ়া ইউনো। পকেটে বিমান-টিমান নিয়ে ঘুরছেন নাকি?

অপমানটা নীরবে সহ্য করল বুলডগ-ভুল কিছু বলেননি এলিসা। ট্রেনের আগে কোনওমতেই পৌঁছুনো সম্ভব নয় তার পক্ষে। মিনমিন করে বলল, ওখানকার পুলিশ রেডি থাকবে…

হুঁহ, মাসুদ রানা বনাম রেলওয়ে পুলিশ-ফলাফলটা কি বলে দিতে হবে আপনাকে?

মুখ দিয়ে কথা বেরুল না বুলড়গের–কৈফিয়তের ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। এলিসা রাগী গলায় বললেন, আপনাকে কাজটা দেয়াই ভুল হয়েছে দেখছি। এরচেয়ে থিওকে পাঠালেই ভাল করতাম।

আর সহ্য হলো না বুলডগের। গলা চড়িয়ে বলল, হয়েছে, আর খোটা দেবেন না। চেষ্টার কোনও ত্রুটি করিনি আমি–ওর যদি কপাল ভাল হয় তো আমার কী করার আছে, বলুন?

তা হলে আর ওখানে গেছেন কী করতে? হুল ফোঁটালেন যেন এলিসা। ডিমে তা দিতে?

এতদিন শুধু লোকজনকে গালাগাল করেছে, নিজে এমন গালি কখনও খায়নি বুলডগ। নিজের ওষুধ নিজের উপর পড়ায় তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল। সে। বলল, যথেষ্ট হয়েছে, ডক্টর। আর একটা কথাও বলবেন না! আমি কী করি, সেটা দেখিয়ে দিচ্ছি আপনাকে। যেখানে যত লোক আছে, সবাইকে মাঠে নামাচ্ছি এখুনি। আগামী কয়েক ঘণ্টার মধ্যে রানার নাম-নিশানাও থাকবে না আর দুনিয়ায়!

আপনার কি মাথা খারাপ হয়েছে? এত বাড়াবাড়ি করতে গেলে আমাদের উপরই তো নজর পড়ে যাবে সবার!

ভয় পাচ্ছেন? বাঁকা হাসি হাসল বুলডগ। তা হলে নিজেই একটা বুদ্ধি দিন দেখি?

বুদ্ধি-টুদ্ধির কিছু নেই, যা করার আমিই করছি, শান্ত গলায় বললেন এলিসা। আপনারা ফিরে আসুন।

কেন… কী করতে চাইছেন আপনি?

সেটা দেখতেই পাবেন। ফিরে আসুন এখুনি।

আর কিছু বলার সুযোগ পেল না বুলডগ, লাইন কেটে দিয়েছেন প্রৌঢ়া ইউনো।

.

বুলগের কাছে কী কী শুনে এসেছে, সব রায়হানকে খুলে বলছে রানা–কথাবার্তা হচ্ছে বাংলায়, ইভাকে এখনও কিছু জানতে দিতে চায় না। ওরা। অল্পবয়েসী নাজুক স্বভাবের মেয়ে ও, সবকিছু শুনে ভয় পেয়ে যেতে পারে।

রায়হানের কপালে ভাঁজ পড়ে গেছে অ্যান্টিভাইরাসটা বুলগের পেয়ে যাবার খবর শুনে। জিজ্ঞেস করল, আপনার কী মনে হয়, মাসুদ ভাই? ব্যাটা সত্যি কথা বলেছে?

চাপা মারার কোনও কারণ দেখতে পাচ্ছি না, রানার কণ্ঠেও দুশ্চিন্তার ছাপ। যেভাবে বুক ফুলিয়ে কৃতিত্ব জাহির করছিল, তাতে ব্যাপারটা সত্যি হবারই সম্ভাবনা বেশি।

তার মানে কি ড. বুরেনকে মেরে ফেলেছে?

ও-কথা তো বলেনি। দুনিয়ার শেষ ইউনোকে খুন করে ফেলবে বুলডগ? ইউনোকোডের মত শক্তিশালী একটা জিনিসকে চিরতরে হারাবে? কক্ষনো না। হতে পারে, তিনি বন্দি; আমাদের কাজে আসবেন না বলতে সেটাই বুঝিয়েছে হয়তো।

ব্যাটাকে ছেড়ে দিলেন কেন? ভদ্রমহিলাকে কোথায় আটকে রেখেছে, সেটা প্যাদানি দিয়ে বের করতে পারলেন না?

তাতে লাভ হতো না–মুখ খুলত না ওর মত ঘাগু লোক। কথা আদায়ের জন্য দেরি করতে গিয়ে আমরা উল্টো ধরা পড়ে যেতাম।

ছেড়ে দিয়েই বা লাভ কী হয়েছে? ডক্টর বুরেনের খোঁজ কি আর পাবো আমরা?

জানি, সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ, স্বীকার করল রানা। ধরা পড়ে গেলে তা-ও থাকত না। সেজন্যেই চলে আসতে বাধ্য হয়েছি। দেখি, ট্রেন থেকে নেমে একটা কিছু করব। দরকার হলে বুলডগ বা তার সঙ্গীদের কাউকে তুলে নিয়ে আসব।

বেশ কিছুক্ষণ থেকেই আশপাশের যাত্রীদের গুঞ্জন কানে আসছিল ওদের, কিন্তু আলোচনায় মগ্ন থাকায় গুরুত্ব দেয়নি। হঠাৎ পুরো ট্রেনটা দুলে উঠতেই

সংবিৎ ফিরে পেল দুই বিসিআই, এজেন্ট, লক্ষ করল–সহযাত্রীদের চেহারায় আতঙ্ক ফুটে উঠেছে। ইভাকে জিজ্ঞেস করল রানা, অ্যাই, কী হয়েছে?

ওরা বলছে, ট্রেনটা নাকি দিক বদলে ফেলেছে, বলল ইভা। এখন আর অ্যামস্টারড্যাম সেন্ট্রালের দিকে যাচ্ছে না এটা, অন্যদিকে ছুটছে।

ধ্যাত, হাত নাড়ল রায়হান। কী যে বলো না! খামোকা রুট বদলাবে কেন?

না, না, ইভা মানতে রাজি নয়। কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। ট্রেনের গতি কীভাবে বাড়ছে, খেয়াল করেছ?

অসঙ্গতিটা রানাও ধরতে পারল। এবার। সত্যিই স্পিড বাড়ছে টিজিভির–সেটা অস্বাভাবিক কিছু ছিল না, যদি না একই সঙ্গে দুলুনি সৃষ্টি হতো। ম্যাগনেটিক ট্র্যাকের উপর ভাসতে থাকা এই রেলগাড়িতে দুলুনি তো দূরের কথা, সামান্যতম কম্পন অনুভব হবার কথা নয়। কোথাও একটা ঘাপলা আছে।

আইল ধরে একজন অ্যাটেনডেন্টকে আসতে দেখা গেল, যাত্রীরা হেঁকে ধরছে তাকে। কিন্তু কোনও জবাবই দিচ্ছে না লোকটা, মুখে হাসি ফুটিয়ে সবাইকে আশ্বস্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছে। কাছে আসতেই খপ করে তার হাত চেপে ধরল রানা। উঠে দাঁড়িয়ে কড়া গলায় বলল, থামো! আমাদের প্রশ্নের জবাব দিয়ে যাও।

কী ব্যাপার, স্যর? কোনও সমস্যা? মুখ দিয়ে মধু ঝরছে যেন। অ্যাটেনডেন্টের।

সত্যিই কি দিক পাল্টেছি আমরা?

না, ইয়ে… মানে…

জবাবটা যে ইতিবাচক, সেটা বুঝতে আর অসুবিধে হলো না কারও। রানা জানতে চাইল, ট্রেনটা দুলছে কেন?

ইয়ে… সামান্য টেকনিক্যাল ফল্ট, এক্ষুণি সেরে যাবে।

হৈ হৈ করে উঠল যাত্রীরা, হাত তুলে তাদের শান্ত করল রানা। অ্যাটেনডেন্টকে জিজ্ঞেস করল, কী ধরনের টেকনিক্যাল ফল্ট এটা, বলতে পারো?

চেহারা থেকে হাসিখুশি মুখোশটা খসে পড়ল লোকটার। বলল, আমাকে ছেড়ে দিন, স্যর। আমি কিছু জানি না। কোনও প্রশ্ন থাকলে ড্রাইভার ক্যাবে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন।

ঠিক আছে, পথ দেখাও। ওখানে নিয়ে চলো আমাদের।

অ্যাটেনডেন্টের পিছু পিছু হাঁটতে শুরু করল রানা, রায়হান আর ইভা; বেশ কজন যাত্রীও পিছু নিল। একটার পর একটা কম্পার্টমেন্ট পেরিয়ে এগোচ্ছে ওরা, দলে যোগ দিচ্ছে নতুন নতুন উদ্বিগ্ন যাত্রী–সবাই জানতে চায়, আসলে হচ্ছেটা কী? শেষ পর্যন্ত ড্রাইভার ক্যাবে যখন পৌঁছুল রানারা, তখন পিছে অন্তত চল্লিশজনের একটা মিছিল হয়ে গেছে।

ইতোমধ্যে আরও বেড়েছে টিজিভির গতি, ভীষণভাবে ডানে-বাঁয়ে কাত হয়ে যাচ্ছে ট্রেনটা। কোনওমতে তাল সামলে দরজায় নক করল অ্যাটেনডেন্ট। বুয়েক মুহূর্ত পর পাল্লা খুলে উঁকি দিল মাঝবয়েসী ড্রাইভার-চেহারাটা দুশ্চিন্তায় ছাইবর্ণ ধারণ করেছে।

কী ব্যাপার, এখানে এত ভিড় কীসের?

একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল সব যাত্রী, একের পর এক প্রশ্ন করছে। তাড়াতাড়ি তাদেরকে শান্ত করল রানা। বলল, আমাকে কথা বলতে দিন। ফিরল ও ড্রাইভারের দিকে। বুকের ওপর ঝোলানো নেম-ট্যাগটা দেখে জিজ্ঞেস করল, ট্রেনে কি কোনও সমস্যা হয়েছে, মিস্টার থিয়েসেন?

একটু ইতস্তত করল ড্রাইভার। তারপর বলল, হয়েছে যে, সেটা তো বুঝতেই পারছেন। নইলে কি আর আপনারা এখানে আসতেন?

কী সমস্যা?

কথা বলল না থিয়েসেন, কাঁধ ঝাঁকাল শুধু।

জবাব দিন, মিস্টার, রায়হান বলল। কোনও বিপদ হলে সেটা জানার অধিকার আছে সবার।

সামনের দিকে মুখ বাড়াল থিয়েসেন। নিচু গলায় বলল, ট্রেনের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছি আমি। কোনও রকম কমাণ্ডই নিচ্ছে না কন্টোল প্যানেল। স্পিডও বেড়ে যাচ্ছে, অপটিমাম লিমিট ছাড়িয়ে গেছে ইতোমধ্যে, সেজন্যই দুলছে। আরও যদি বাড়ে, তা হলে স্রেফ ছিটকে যাবো আমরা। অবস্থাদৃষ্টে ওটাই ঘটবে বলে মনে হচ্ছে।

থমকে গেল সবাই–বিপদের গুরুত্ব বুঝতে পারছে। ঘণ্টায় তিনশ কিলোমিটারেরও বেশি বেগে ছুটতে থাকা এই ট্রেন যদি লাইনচ্যুত হয়ে ক্র্যাশ করে, দুমড়ে-মুচড়ে আস্ত থাকবে না আর; মারা যাবে সব যাত্রী। এক মুহূর্তের জন্য চুপ রইল জটলাটা, তারপরই শুরু হলো তারস্বরে চেঁচামেচি।

থামুন আপনারা! চিৎকার করে ধমক দিল রানা। মাথা ঠাণ্ডা রাখুন। ডাইভারের দিকে তাকাল ও। সরুন, দেখতে দিন ব্যাপারটা।

থিয়েসেনকে পাশ কাটিয়ে ক্যাবে ঢুকল রানা, রায়হান আর ইভা; বাকিদের জায়গা হলো না, দরজা থেকে উঁকিঝুঁকি মারতে থাকল তারা।

ক্যাবের ভিতরটা ছোট্ট একটা ককপিটের মত, একজনই ড্রাইভার বসতে পারে। সামনে রয়েছে বিশাল উইণ্ডশিল্ড, সেখানকার দৃশ্যটা স্থির নয়–তীব্রবেগে ছুটে আসছে সবকিছু, যেন গায়ের উপর লাফিয়ে পড়বে। উইণ্ডশিল্ডের ঠিক নীচেই রয়েছে অর্ধবৃত্তাকার কনসোল, তাতে নানা ধরনের বোতাম আর এলসিডি স্ক্রিন শোভা পাচ্ছে।

এখানে সব কম্পিউটার-কন্ট্রোলড়? জানতে চাইল রানা।

হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল থিয়েলেন। কিছু একটা হয়েছে অনবোর্ড কম্পিউটারে, কোনও কমাণ্ড নিচ্ছে না।

রায়হানের দিকে তাকাল রানা। কিছু করতে পারবে?

চেষ্টা করে দেখতে পারি, বলল তরুণ হ্যাকার। তবে একটা কম্পিউটার দরকার। ওরটা বাগানবাড়িতে রয়ে গেছে, আনতে পারেনি।

দরজায় উঁকি দিতে থাকা যাত্রীদের দিকে ঘুরল রানা। কারও কাছে একটা ল্যাপটপ কম্পিউটার পান কি না, দেখুন তো! পেলে নিয়ে আসুন।

ছুটে চলে গেল কয়েকজন, ফিরে এল একটু পরেই–তোশিবা-র নতু মডেলের একটা ল্যাপটপ নিয়ে এসেছে। দুলুনি বেড়ে গেছে আরও, কনসোলে সঙ্গে যন্ত্রটার সংযোগ দিতে গিয়ে রীতিমত কসরত করতে হলো রায়হানকে-ব্যালেন্স রাখতে পারছে না, ক্যাবের এপাশ থেকে ওপাশে গড়িয়ে পড়ে যেতে চাইছে শরীরটা। অবস্থা দেখে এগিয়ে এল ইভা, বন্ধুকে সাহায্য করল। দু’জনের চেষ্টায় কিছুক্ষণের মধ্যেই ডেটা কেইবল দিয়ে টিজিভির কন্ট্রোলের সঙ্গে জুড়ে দেয়া গেল কম্পিউটারটাকে।

ল্যাপটপটা কোলের উপর রেখে ড্রাইভারের সিটে বসে পড়ল রায়হান। দ্রুত কয়েকটা বাটন চেপে ট্রেনের কন্ট্রোল ইন্টারফেসটা নিয়ে এল স্ক্রিনে। প্রথমে নরমাল কমাণ্ড দিয়ে চেষ্টা করল ট্রেনটাকে থামাতে, তাতে কাজ না হওয়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল পুরো সিস্টেমটার অ্যানালিসিসে। কী-বোর্ডে ঝড় তুলল ওর আঙুলগুলো, একটার পর একটা প্রোগ্রাম বের করে আনছে পরীক্ষা করবার জন্যে।

পিছনে ধুপধাপ শব্দ শুনে ঘাড় ফেরাল রানা-ক্যাবের বাইরে অপেক্ষমাণ যাত্রীরা দুলুনিতে তাল সামলাতে পারেনি, একে অন্যের গায়ে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেছে মেঝেতে। কম্পার্টমেন্টগুলো থেকে মহিলাদের আতঙ্কিত চিৎকার ভেসে এল, একই সঙ্গে তারস্বরে কান্না জুড়েছে কয়েকটা বাচ্চা।

আপনারা যার যার সিটে ফিরে যান, লোকগুলোকে বলল ও। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই কোনও জানাবার মত কিছু থাকলে আমি গিয়ে বলব আপনাদের।

প্রতিবাদ করল না কেউ, আছাড় খেয়ে শিক্ষা হয়ে গেছে সবার। তাড়াতাড়ি বাল্কহেড ধরে নিজ নিজ কম্পার্টমেন্টে ফিরতে শুরু করল তারা।

ইভা, তুমিও যাও। এখানে কিছু করার নেই তোমার।

না, দৃঢ় গলায় বলল মেয়েটা। যাবো না আমি কোথাও। মরলে আপনাদের সঙ্গেই মরব।

কাঁধ ঝাঁকিয়ে রায়হানের দিকে তাকাল রানা। রায়হান, তাড়াতাড়ি করো। আর বেশিক্ষণ টিকবে না ট্রেনটা, যে-কোনও মুহূর্তে লাইন থেকে ছিটকে যেতে পারে।

ল্যাপটপের ডালাটা বন্ধ করে ধীরে ধীরে ওর দিকে চেয়ার ঘোরাল তরুণ হ্যাকার, চেহারায় মেঘ জমেছে। মন খারাপ করা গলায় বলল, সরি, মাসুদ ভাই। আমার পক্ষে কিছুই করা সম্ভব নয়।

কেন? বড় কোনও সমস্যা হয়েছে?

শুধু বড় না, সর্ববৃহৎ, তিক্ত গলায় বলল রায়হান। কন্ট্রোলটায় গলদ নেই, কিন্তু ওটাকে কাজ করতে দেয়া হচ্ছে না। বাইরে থেকে ট্রেনের গোটা সিস্টেমটাকে দখল করে নেয়া হয়েছে। ইচ্ছে করেই রুট বদলে স্পিড বাড়িয়ে। দেয়া হয়েছে, যাতে অ্যাকসিডেন্ট ঘটে।

রীতিমত একটা ধাক্কা খেল রানা। তুমি বলতে চাইছ..

হ্যাঁ, মাসুদ ভাই। এটা ইউনোকোডের কীর্তি… ট্রেনটা ডাচ রেলওয়ের মেইনফ্রেমে সংযুক্ত, ওটার ভিতর দিয়ে এসে পুরো সিস্টেমটাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে নিয়েছে আমাদের প্রতিপক্ষ ওই ইউনো। ইউনোকোড দিয়ে একটার পর একটা কমাণ্ড পাঠাচ্ছে। আমাদের কিছু করার নেই… চুপচাপ মরা ছাড়া।

থমকে গেল রানা–দুঃসংবাদটা বিশ্বাস করতে পারছে না। এ কীভাবে সম্ভব? ওকে আর রায়হানকে পথ থেকে সরাবার জন্য ওই ইউনো পুরো এক-ট্রেনভর্তি মানুষ মেরে ফেলতে চাচ্ছে? এদের মধ্যে নিরীহ নারী আর শিশুও তো আছে। লোকটা কি মানুষ না পিশাচ?

অসহায় বোধ করল রানা। নির্দোষ মানুষগুলোকে বাঁচাবার জন্য মনটা আকুলি-বিকুলি করতে শুরু করেছে, কিন্তু এটাও জানে–আসলে কিছুই করার নেই ওর। রায়হানের কথাই ঠিক, চুপচাপ মৃত্যুকে বরণ করে নেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই ওদের। বিষণ্ণ দৃষ্টিতে একবার রায়হান, আরেকবার ইভার দিকে তাকাল ও।

রায়হানেরও একই অবস্থা–পিছনের কম্পার্টমেন্ট থেকে ভেসে আসা বাচ্চাদের কান্নার শব্দে বুকটা ভেঙে যেতে চাইছে ওরও। ফিসফিস করে বলল,

মাসুদ ভাই, অন্তত বাচ্চাগুলোকে বাঁচানোর একটা চেষ্টা করতেই হবে…

মাথা ঝাঁকিয়ে একমত প্রকাশ করতে যাচ্ছিল রানা, কিন্তু ইভাকে দেখে থেমে গেল। চেহারায় আমূল পরিবর্তন এসেছে তরুণী সেক্রেটারির, চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে–দৃঢ়প্রতিজ্ঞার একটা ছাপ ঠিকরে বেরুচ্ছে ওর মুখাবয়ব থেকে। ড্রাইভারস ক্যাবের বাল্কহেড ধরে ধরে দৃঢ় পায়ে সামনে এগোল মেয়েটা, রানার দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে পাশ কাটাল, সোজা গিয়ে থামল রায়হানের সামনে।

চেয়ার ছাড়ো, আদেশের সুরে বন্ধুকে বলল ইভা। বসতে দাও আমাকে।

মানে? রায়হানের কপালে ভাঁজ পড়ল।

কথা বোলো না তো! ধমক দিল ইভা। সরো এখান থেকে।

ব্যক্তিত্বে আমূল পরিবর্তন এসেছে তরুণীর, কেন যেন নিজেকে ওর সামনে খুব ক্ষুদ্র মনে হলো রায়হানের। কারণটা ধরতে না পারায় কৌতূহলী হয়ে ছেড়ে দিল সিটটা, ইভাকে বসতে দিল।

হাবভাবে কোনও জড়তা লক্ষ করা গেল না, ল্যাপটপটার ডালা তুলে কয়েকটা বোম চাপল ইভা। টিজিভির কন্ট্রোল ইন্টারফেসের প্রোগ্রাম ভেসে উঠল স্ক্রিনে, সেটা মাত্র দশ সেকেণ্ড দেখল ও, তারপরই আরও দুটো বোতাম চেপে পুরো পর্দাটা খালি করে দিল। এবার রায়হানের চেয়েও দ্রুতগতিতে কী-বোর্ডে টাইপ করতে শুরু করল মেয়েটা–চোখের পলকে নতুন একটা ইন্টারফেস উদয় হলো স্ক্রিনে–তাতে বিচিত্র সব বর্ণ ফুটে উঠছে।

যতই লেখা বাড়ল, ততই একটা পরিবর্তন টের পেল রানা। টিজিভির ইঞ্জিনের আওয়াজ বদলে গেল–ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসছে। দুলুনিও কমে যাচ্ছে একই সঙ্গে। বিস্ময়ে চোয়াল ঝুলে পড়বার অবস্থা হলো ওর—অবিশ্বাস্য একটা ব্যাপার আন্দাজ করতে পারছে।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই সমস্ত বিপদ কাটিয়ে উঠল টিজিভি। দোলাদুলি নেই হয়ে গেল একেবারে, গতিটাও খুব মোলায়েম একটা পর্যায়ে এসে পড়ল। তারপরও থামল না ইভা, ল্যাপটপটায় কাজ করে চলল। শেষে আর দুমিনিট পর একেবারেই থেমে গেল ট্রেনটা–বিশাল এক প্রান্তরের মাঝে এসে দাঁড়িয়েছে।

সমস্ত কম্পার্টমেন্ট থেকে হুল্লোড় শোনা গেল, জীবনসংশয়ী বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ায় খুশি বাধ মানছে না কারও। ইভা তার কম্পিউটারের একটা বাটন চাপতেই খুলে গেল সব দরজা, উত্তেজিত যাত্রীরা বেরিয়ে পড়ল মাঠে–পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে মুক্ত বাতাস ফুসফুসে টেনে নিচ্ছে।

হাততালি দিয়ে উঠল ড্রাইভার থিয়েসেন। দারুণ দেখিয়েছেন আপনি, ম্যাম। আমাদের সবার জীবন বাঁচিয়েছেন।

রানাও হাসছে। গুড জব, ইভা। গুড জব ইনডিড!

রায়হানের মুখে হাসি নেইমাথা এলোমেলো হয়ে গেছে ওর, পরিষ্কারভাবে চিন্তা করতে পারছে না কিছু। হতভম্ব হয়ে বলল, ক্.. কিন্তু কীভাবে? কীভাবে সম্ভব হলো এটা?

ল্যাপটপটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল ইভা, সরাসরি জবাব দিল না, রহস্যের হাসি হাসল শুধু। বলল, কেন, বুঝতে পারছ না?

ও একজন ইউনো, রায়হান, রানা বলল। ইভা-ই সেই একাদশ ইউনো!

দুঃখিত, আমার নাম ইভা নয়।

এবার রানার চমকাবার পালা। তা হলে কে তুমি?

আমি ক্রিস্টিনা ওয়ালডেন।

মাইকেল আর ডেবি ওয়ালডেনের মেয়ে?

মাথা ঝকাল রহস্যময়ী মেয়েটা। একাদশ ইউনোও নই আমি। নম্বর দিয়েই যদি পরিচিতি হয়, তা হলে আমি এক নম্বর ইউনো। কারণ… শান্ত কণ্ঠে বজ্রপাতটা ঘটাল এবার ও, … আমিই ইউনোকোডের স্রষ্টা!

.

১৪.

ট্রেনটা যেখানে থেমেছে, সেখান থেকে মাত্র তিন মাইল দূরে হাসেলউইযেন নামে ছোট্ট একটা শহর–অ্যামস্টারড্যামের দক্ষিণে জায়গাটা, আটচল্লিশ কিলোমিটার দূরে। ড্রাইভার থিয়েসেনের মুখে শহরটার কথা শুনে পায়ে হেঁটে ওখানে চলে গেল রানারা, ট্রেনে আর বসে থাকল না। টিজিভি-টার খোঁজে, সেই সঙ্গে যাত্রীদের উদ্ধারের জন্য বিভিন্ন সরকারি সংস্থার লোকজনের পাশাপাশি পুলিশও চলে আসবে খুব শীঘ্রি, তাদের হাতে ধরা পড়তে চায় না ওরা।

রানা আর রায়হানের মাথায় গিজ গিজ করছে একগাদা প্রশ্ন, কিন্তু দ্রুত এলাকাত্যাগের তাড়া থাকায় সেগুলো ক্রিস্টিনাকে জিজ্ঞেস করতে পারছে না। হাসেলউইমেন থেকে একটা ফোক্সভাগেন গাড়ি ভাড়া করে অ্যামস্টারড্যামের দিকে রওনা হবার পর প্রথম ফুরসত মিলল। শহরের সীমানা পেরিয়ে হাইওয়েতে পৌঁছুতেই নবীন ইউনোর দিকে ঘাড় ফেরাল রানা, ড্রাইভারের ঠিক পাশের সিটেই বসেছে মেয়েটা, রায়হান বসেছে পিছনে।

দেখো ক্রিস্টিনা…

আমাকে টিনা বলে ডাকুন, বাধা দিয়ে বলল মেয়েটা।

ওকে, টিনা… এবার মনে হয় আমাদের সবকিছু খুলে বলা উচিত তোমার। নিজেকে এক নম্বর ইউনো… ইউনোকোডের স্রষ্টা বলে দাবি করলে, কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব?

মিথ্যে কিছু বলিনি আমি, শান্তস্বরে জানাল টিনা, আপনাদের সবকিছু খুলে বলতেও আপত্তি নেই, কিন্তু আগে আপনারা আমাকে বলুন–এসব কী ঘটছে? ইউনোকোন্ড নিয়ে কী ঘটাচ্ছে ওই ডাইনিটা?

ডাইনি! রায়হান অবাক। কার কথা বলছ?

কার কথা আবার, এক ও অদ্বিতীয় ড. এলিসা ভ্যান বুরেনের কথা।

এ… এসবের পিছনে উনি জড়িত? একের পর এক চমক আর সামলাতে পারছে না রায়হান, কথা আটকে যাচ্ছে মুখে।

কীসের সঙ্গে জড়িত–সেটাই তো জানতে চাইছি।

রানাকে দেখে মনে হলো না, ড. বুরেনের খবরটা ওর কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল। আসলে যুক্তি দিয়ে বিচার করে পুরো ব্যাপারটা কিছুক্ষণ আগেই আঁচ করে ফেলেছে ও। ট্রেনের ঘটনায় প্রমাণ হয়ে গেছে, টিনা একাদশ ইউনো হলেও খারাপ কেউ নয়। তা হলে একমাত্র এলিসাই হতে পারেন সমস্ত অঘটনের মূল, ইউনো-ভাইরাসের পিছনের ব্যক্তিটি। বুলডগ কীভাবে এত সহজে অ্যান্টি-ভাইরাসটা পেল কিংবা কেনই বা ওদেরকে খুন করতে মরিয়া হয়ে উঠল–সেটাও বোঝা যাচ্ছে এ-থেকে। এলিসা নিশ্চয়ই হাত মিলিয়েছেন সিআইএ-র সঙ্গে, সে-কারণেই ভদ্রমহিলার পথের কাঁটা মাসুদ রানা আর রায়হান রশিদকে খতম করাটা ফরজ হয়ে গিয়েছিল বুলড়গের জন্যে। লোকটার কথাগুলোও এখন আর ধাঁধার মত মনে হচ্ছে না–সত্যিই খেলাটায় অনেক আগেই হার হবার কথা রানার… ড. ডোনেনের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে। কারণ পুরো ষড়যন্ত্রটার উদ্যোক্তা, শেষ ইউনো, ড. বুরেন কখনোই ওর হাতে ভাইরাসটার প্রতিষেধক তুলে দিতেন না।

রায়হান অবশ্য এত গভীরভাবে ভাবছে না ব্যাপারটা নিয়ে, টিনার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল, ধ্যাত, কী যে বলো না! ড. বুরেন মন্দ মানুষ হতে যাবেন কেন? ফ্লেভোল্যাণ্ডে ওঁর ওপর হামলা করল না খুনীরা?

হামলাটা আসলে ড. বুরেনের ওপর হয়েছিল বলে মনে হচ্ছে না আমার। কাছে, রানা বলল। বরং ভদ্রমহিলা যেভাবে পালিয়ে যাচ্ছিলেন, তাতে তো মনে হচ্ছে–ফাঁদটা আমাদের জন্য পেতে সরে পড়বার চেষ্টা করছিলেন তিনি। আমরা বিমান নিয়ে যাওয়াতেই প্ল্যানটার দফারফা হয়ে যায়-পাঁচ ঘণ্টার বদলে আড়াই ঘণ্টায় পৌঁছে যাই, তখনও এলিসা ম্যানরে, আমাদের সামনে পড়লে

কেটে পড়ার উপায় থাকবে না ভেবে তাড়াহুড়ো করে পালিয়ে যেতে চাইলেন… গুলিও ছুঁড়েছিলেন সেজন্যে। গাড়িটা অ্যাকসিডেন্ট করাতে শেষ। পর্যন্ত যেতে পারলেন না। জ্ঞান ফেরার পর সময় জানতে পেরে কেমন অস্থির হয়ে পড়লেন, খেয়াল করোনি? কারণ, বুঝতে পেরেছিলেন, খুনীদের আসবার সময় হয়ে গেছে। তাই কথা বলে সময় নষ্ট করেননি, আমাদের দুচার কথা। শুনেই অ্যান্টিভাইরাস তৈরি করে দিতে রাজি হয়ে গেছেন; আসলে আমাদের প্লেনে চড়ে এস্টেট থেকে সরে পড়তে চাইছিলেন যত দ্রুত সম্ভব। নাহ, রায়হান… একবিন্দু ভুল বলছে না টিনা–ড. বুরেনই সবকিছুর মূলে।

কিন্তু তিনি তো কেটে পড়তে পারেননি, বরং আমাদের সঙ্গে মরতে বসেছিলেন, রায়হান যুক্তি দেখাল। খুনীরা যদি ওঁরই পাঠানো হয়ে থাকে, তা। হলে ওরা নিজের এমপ্লয়ারকে মারার চেষ্টা করবে কেন?

আমার মনে হয়, এলিসাকে চিনত না খুনীরা। সেজন্যেই মেরে ফেলতে চেয়েছে। ভদ্রমহিলা পাগলের মত মোবাইল টেপাটেপি করছিলেন, নিশ্চয়ই ওদেরকে থামতে বলার জন্য… কিন্তু যোগাযোগ করতে না পারায় বিমানের দরজায় গিয়ে লোকগুলোকে সঙ্কেত দিতে চাইছিলেন–আমি ভেবেছিলাম মাথা খারাপ হয়ে গেছে ওর, লাফ দিতে চাইছেন।

এবার অসঙ্গতিগুলো রায়হানও ধরতে পারছে। তারমানে… সত্যিই ড. বুরেন ভাইরাসটা ছেড়েছেন?

কীসের ভাইরাসের কথা বলছ তোমরা? জিজ্ঞেস করল টিনা।

যেটা নিয়ে এতকিছু ঘটছে, রানা বলল।

খুলে বলুন আমাকে।

নাসার কম্পিউটারে পাওয়া সিগনালটা থেকে শুরু করে যা যা ঘটেছে, সব খুলে বলল রানা আর রায়হান। শুনতে শুনতে চোখ বড় হয়ে গেল টিনার, বিস্ময় চাপা দিতে পারছে না। রানাদের কথা শেষ হতেই বলল, কী বলছেন আপনারা! সমস্ত ইউনোকে মেরে ফেলেছে হারামজাদীটা? সারা দুনিয়ার সমস্ত কম্পিউটার ধ্বংস করে দিতে যাচ্ছে? এত বড় একটা ব্যাপার… আর আমি কিছুই জানি না? নিজেকে চড় মারতে ইচ্ছে হচ্ছে আমার–ডাইনিটা এত কিছু ঘটিয়ে চলেছে, অথচ আমি কিচ্ছু টের পেলাম না… কীসের গোয়েন্দাগিরি করছি আমি তা হলে গত চারটে মাস?

গোয়েন্দাগিরি!

ইউনোকোড নিয়ে শাঁকচুন্নিটার একটা বদ-মতলব আছে বলে জানতাম। আমি, সেজন্যেই ক্রিয়েলটেকে চাকরি নিয়েছিলাম। ইচ্ছে করে প্রোগ্রামারের কাজকর্ম খারাপভাবে করেছি, কারণ ট্রেইনিঙে যারা খারাপ করবে, তাদের মধ্য থেকে একজনকে সেক্রেটারি বানানো হবে–এই খবর পেয়ে গিয়েছিলাম আমি। আসলে এলিসার কাছাকাছি পৌঁছুতে চাইছিলাম।

জাস্ট আ মিনিট, রানা বাধা দিল। উনি যে কুমতলব আঁটছেন, সেটা তুমি আগে থেকে জানলে কী করে?

ওসব পরে বলি? আগে ভাইরাসটার ব্যাপারে কিছু একটা করা দরকার। আপনাদের কাছে ওটার কপি আছে?

চেহারায় তিক্ততা ফুটিয়ে মাথা দোলাল রায়হান। সিডিটা নিয়ে গেছে। তোমার ওই শাঁকচুন্নি।

ধেত্তেরি! সখেদে বলল টিনা। তা হলে আমি কাজ করব কেমন করে? বানাব কীভাবে অ্যান্টিভাইরাসটা?

মুখটা হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল রায়হানের। পিছন থেকে বাড়িয়ে ধরল ট্রেন থেকে আনা ল্যাপটপটা–মালিক ভদ্রলোক খুশির ঠেলায় দান করে দিয়েছেন। এটা ওদের।

কী করব এটা নিয়ে? ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করল টিনা।

নাসার মেইনফ্রেমে হ্যাঁক করবে, রায়হান বলল। অডিও সিগনালটার আরেকটা কপি ডাউনলোড করে আনবে। আমিই পারতাম, কিন্তু তাতে অনেক সময় লাগবে। তবে তুমি যদি ইউনোকোড ব্যবহার করো, তা হলে কাজটা চোখের পলকে সারা যাবে।

নাসায় ঢুকতে হলে তো কানেকশন পেতে হবে। এটায় মডেম আছে?

মাথা ঝাঁকাল রায়হান। আঙুল বাড়িয়ে দেখাল, এই তো… ওয়্যারলেস মডেম, বিল্ট-ইন।

খুশি হয়ে উঠল টিনা। চমৎকার! আমি এখুনি কাজ শুরু করে দিচ্ছি। কিন্তু নাসার মেইনফ্রেম তো অনেক বড়, সিগনালটা ঠিক কোথায় সেভ করে রাখা হয়েছে–জানব কী করে?

আগে হ্যাক তো করো, আমি বলে দেব-কোথায় গেলে পাওয়া যাবে ওটা।

ল্যাপটপটা অন করে ব্যস্ত হয়ে পড়ল তরুণী ইউনো। পাশে রানা উসখুস করছে–এই রহস্যময়ীর সব কথা না জানা পর্যন্ত মনে স্বস্তি পাচ্ছে না। তাই জিজ্ঞেস করল, টিনা, কাজের ফাঁকে ফাঁকে দুয়েকটা প্রশ্নের জবাব দিতে পারবে?

২৪৫

তা পারব। কী জানতে চান?

তোমার সম্পর্কে। ইউনোকোড শিখলে কীভাবে তুমি? তোমার বাবা-মা যখন মারা যান, তখন তো তোমার বয়স খুব অল্প হবার কথা। ছোট্ট একটা বাচ্চার পক্ষে কোডটা কীভাবে শেখা সম্ভব?

শিখব কেন? আমিই ওটার স্রষ্টা, বললাম না? পাঁচ বছর বয়সে কোডটা আবিষ্কার করি আমি।

কী যে বলছ তুমি, কিছুই বুঝতে পারছি না, রায়হান বিরক্ত হলো। পাঁচ বছরের একটা বাচ্চা বুঝি ইউনোকোড আবিষ্কার করতে পারে?

পারে, যদি বাচ্চাটা অস্বাভাবিক মেধার অধিকারী হয়, কথা বলছে, কিন্তু কাজ থেমে নেই টিনারযন্ত্রের মত কীবোর্ডে নেচে বেড়াচ্ছে ওর আঙুল।

বিজ্ঞানের ভাষায় ওদের চাইল্ড-জিনিয়াস বা প্রডিজি বলে। কখনও শোনোনি, তিন-চার বছরের বাচ্চা কলেজ-ইউনিভার্সিটির লেখাপড়া শেষ করে ফেলেছে?

মাথা ঝাঁকালু রায়হান, এবার ব্যাপারটা মাথায় ঢুকেছে ওর। তুমি… তুমি চাইল্ড-জিনিয়াস ছিলে?

হ্যাঁ, টিনা বলল। ঠিক ধরেছ।

কিন্তু… সেটা জানে না কেন কেউ? এমনকী অন্যান্য ইউনোরা… যাঁরা মাইকেল আর ডেবি ওয়ালডেনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন, তারাও তো জানেন না কিছু।

বাবা-মা কাউকে বলেননি ব্যাপারটা। বলতেন ঠিকই, কিন্তু তার আগেই কম্পিউটারে কাজ করতে করতে নিজের অজান্তে কোডটা আবিষ্কার করে বসলাম। আমি। আমার বাবা খুব সাবধানী মানুষ ছিলেন, তিনি মাকে বুঝিয়েছিলেন

ইউনোকোডের মত শক্তিশালী একটা জিনিস যে আমার আবিষ্কার, সেটা প্রকাশ পেলে আমার বিপদ হতে পারে। ইনটেলিজেন্স কমিউনিটি থেকে শুরু করে দুনিয়ার তাবৎ খারাপ মানুষ আমাকে বাগে পাবার চেষ্টা করবে। তাই সাধারণ বাচ্চার মত বড় করা হয় আমাকে, কোডটা বাবা-মা ওঁদের নিজেদেরই আবিষ্কার বলে বন্ধুদের কাছে প্রচার করেন…

ড. ডোনেনের মুখে শোনা ঘটনাটা মনে পড়ল রানার, হঠাৎ করেই নাকি একদিন ইউনোকোড নিয়ে হাজির হয়েছিলেন মাইকেল আর ডেবি। … এমন একটা কোডের ধারণা কবে ওদের মাথায় এল, বা কবে থেকে কাজ করে জিনিসটাকে ডেমোনস্ট্রেশনের মত পর্যায়ে নিয়ে এল, তা আমাদের বলেইনি। অবস্থা দেখে মনে হলো, ব্যাপারটা আমাদের কাছে গোপন রাখছিল ওরা…

রহস্যটা পরিষ্কার হচ্ছে এবার। ইউনোকোডের ধারণা সত্যিই নিজেদের মাথায় আসেনি ওয়ালডেন দম্পতির-ওটা ওঁদের মেয়ের আবিষ্কার ছিল। বিষয়টা হয়তো গোপনই করতে চেয়েছিলেন তারা, কিন্তু দু’জনের ভিতরের বিজ্ঞানী সত্তা এমন উন্নত একটা কম্পিউটার-কোডকে চাপা দিয়ে রাখতে দেয়নি। সেজন্যেই বন্ধুদের কাছে ওটা নিজেদের আবিষ্কার বলে উপস্থাপন করেছিলেন তাঁরা, যাতে বিপদ-আপদ হলে নিজেদের হয়, তাঁদের সন্তান নিরাপদ থাকে। হয়েছেও তা-ই।

টিনা, জিজ্ঞেস করল রানা। তোমার বাবা-মাকে খুন করা হয়েছে বলে সন্দেহ করেছিলেন ড. ডোনেন। সেটা কি সত্যি?

হ্যাঁ, মি. রানা, বলল টিনা। যদিও কোনও প্রমাণ নেই, তবে আমি জানি–ডাইনি এলিসাই কাজটার জন্য দায়ী।

কিন্তু কেন?

এই মহিলা যে ইউনোকোড নিয়ে কোনও একটা ষড়যন্ত্র, আঁটছে, সেটা জেনে ফেলেছিল তারা। তখন খুব খেপে যান বাবা-মা, ওর মতলব সবার কাছে ফাঁস করে দেবেন বলে হুমকি দেন। সেজন্যেই মরতে হয়েছে ওঁদের।

তুমি ব্যাপারটা জানতে?

অল্প-স্বল্প। ছোট ছিলাম তো, বাবা-মা কেউই আমাকে কিছু বলেননি। আমি আড়ি পেতে শুনেছিলাম, দু’জনে আলোচনা করছেন বিষয়টা নিয়ে। নাম-টাম কিছু শুনিনি, শুধু এটুকু শুনেছি–ইউনোদের কেউ একজন বিশ্বাসঘাতকতা করতে চাইছে। তাকে কীভাবে ঠেকানো যায়, এ-নিয়ে চিন্তা করছিলেন ওঁরা। পরে জিজ্ঞেস করব ভেবেছিলাম, কিন্তু পরদিনই খুন করা হলো ওঁদের। সবাই বলল দুর্ঘটনা, আমি প্রতিবাদ করতে চাইলাম, কিন্তু সাত বছর বয়েসী একটা বাচ্চার কথা কে বিশ্বাস করে, বলুন? নানা-নানীর কাছে পাঠিয়ে দেয়া হলো আমাকে, ওখানেও তারা আমার কথা শুনলেন না। তাই শেষ পর্যন্ত চুপ হয়ে গেলাম আমি, ঠিক করলাম নিজেই এই রহস্য ভেদ করব।

নিজেকে গুটিয়ে নিলাম আমি। আমার মেধার কথা কাউকে কোনওদিন জানতে দিলাম না। নানা-নানী পর্যন্ত কখনও বোঝেননি, তাদের নাতনি একজন জিনিয়াস। কলেজে ওঠার পর কিছুটা স্বাবলম্বী হলাম, আর তখনই শুরু করলাম কাজ। প্রথমেই এফিডেভিট করে নিজের নাম পাল্টে ফেললাম, হয়ে গেলাম ইভা লরেন্স, যাতে আমার পরিচয় কেউ জানতে না পারে। এরপর নামলাম গোয়েন্দাগিরিতে। ইউনোদের মধ্যে কে আমার বাবা-মার হত্যাকারী, সেটা জানাই ছিল আমার মূল লক্ষ্য।

একে একে জীবিত আট ইউনোর সবার কাছে গেছি আমি, মিথ্যে পরিচয়ে। কলেজ আর ভার্সিটির ছুটিতে মেইডের কাজ করেছি আমি কুর্ট মাসডেন আর ভাল মর্টিমারের বাড়িতে, ডুইট গার্ডনার আর হার্বাট গ্রান্টের বাচ্চাদের বেবিসিটারও হয়েছি, ট্রিসিয়া মিলনারের অফিসে ইন্টার্ন হিসেবে ছিলাম কিছুদিন, অ্যামেরিকায় এক্সচেঞ্জ স্টুডেন্ট হিসেবে গিয়েছিলাম সম্পূর্ণ নিজের আগ্রহে–স্ট্যানলি ডোনেন আর লুই পামারের ব্যাপারে তদন্ত করব বলে…

ড. ডোনেন তো তোমার শিক্ষক ছিলেন, রানা বলল। কিন্তু লুই পামারের কাছে ভিড়েছ কীভাবে?

সেমেস্টার ফাইনালের ছুটিতে নিউ ইয়র্কে গিয়ে ওঁর স্ত্রীর পার্সোনাল অ্যাসিসটেন্ট হয়েছিলাম আমি, হেসে বলল টিনা। ভদ্রমহিলা সারাদিন ফুট-ফরমাশ খাটাতেন আমাকে।

রানাও হাসল।

ড. ডোনেনও সহজ পাত্র ছিলেন না, আমাকে একদমই কাছে ঘেঁষতে দিতেন না তিনি, বলে চলল টিনা। ভদ্রলোক কী করেন না করেন, কিছু বুঝতে পারছিলাম না। শেষে ওঁর কম্পিউটারে হ্যাঁক করতে শুরু করলাম, একদিন ইউনোদের মিটিঙেও হানা দিলাম…

 কিন্তু ধরা পড়ে গেলে, তাই না? বলে উঠল রায়হান। ডোনেন স্যর বলেছেন আমাদের চার বছর আগে একাদশ ইউনোর সন্ধান পান তিনি… তুমি তখন আমাদের ভার্সিটিতে ছিলে!

ড. ডোনেন ভীষণ সতর্ক আর চালাক মানুষ ছিলেন, টিনা স্বীকার করল। আমি তো প্রায় ধরাই পড়ে যাচ্ছিলাম। ভাগ্যিস, ইউনোকোডটা খুব ভাল করে ব্যবহার করতে জানি, নিজেরই তৈরি তো, সেজন্যেই কোনওমতে নিজেকে বাঁচাতে পেরেছিলাম।

হুঁ, রানা বলল। তারপর কী ঘটল?

কী আর হবে? ড. ডোনেনের ধারেকাছেও ভিড়তে পারলাম না আমি, কম্পিউটারে হানা দেয়াও বন্ধ করতে হলো। তাই ওঁর ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে বিকল্প একটা কায়দা বের করলাম–ওঁর সবচেয়ে প্রিয় ছাত্রের গার্লফ্রেণ্ড হয়ে গেলাম আমি, যাতে ওর সাথে সাথে আমিও ভদ্রলোকের কাছে যখন-তখন চলে যেতে পারি। ডোনেনের ব্যাপারে অস্বাভাবিক কোনও তথ্য জানলে যেন ছাত্রটি নিজেই আমাকে সব জানায়…

ইয়াল্লা! মাথায় হাত দিল রায়হান। সেজন্যে… সেজন্যেই তুমি গায়ে পড়ে আমার সঙ্গে ভাব জমিয়েছিলে? আজও নিশ্চয়ই একই কারণে আমার সঙ্গে জুটেছ। ড. বুরেনকে কেন খুঁজছি আমরা, কী ঘটছে তলে তলে–এসব জানাটাই তোমার মূল উদ্দেশ্য ছিল।

অভিযোগটা একেবারে মিথ্যে নয়, টিনা কাধ ঝাঁকাল।

তারমানে আমাকে তুমি কখনোই পছন্দ করতে না? মন খারাপ করা সুরে বলল রায়হান, খুব যেন আঘাত পেয়েছে বেচারা। আমি স্রেফ তোমার স্বার্থ উদ্ধারের হাতিয়ার, তাই না?

ওর কথাগুলো স্পর্শ করল তরুণী ইউনোকে। কাজ থামিয়ে ঘুরে বন্ধুর চোখে চোখ রাখল মেয়েটা, বলল, আমি তো সেটা বলিনি, রায়হান। কাজেকর্মে অমনটাই মনে হতে পারে, কিন্তু সত্যি বলতে কী… একটু থামল ও, নারীসুলভ লজ্জাবোধ পেয়ে বসেছে ওকে। ইতস্তত করে বলল, ইয়ে… আমি তোমাকে খুবই পছন্দ করি। বন্ধু হিসেবে নয়, আরও… আরও বড় কিছু হিসেবে। আমার জীবনটা যদি এমন না হত, তা হলে হয়তো তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে পারতাম…

আর কিছু শুনল না রায়হান, সামনের দিকে ঝুঁকে এসে গভীর মমতায় চুমু খেল প্রেমিকাকে। দুফোঁটা চোখের জল নেমে এল টিনার গাল বেয়ে–এ-অশ্রু আনন্দের, ভালবাসার।

পাশ থেকে গলা খাঁকারি দিল রানা, তা শুনে সংবিৎ ফিরে পেল দু’জনে। তাড়াতাড়ি পরস্পরকে ছেড়ে সোজা হয়ে বসল ওরা, অগ্রজপ্রতিমের দিকে তাকাতে পারছে না–যেন লুকিয়ে প্রেম করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেছে।

কাবাব মে হাড্ডি হতে হলো বলে দুঃখিত, মুচকি হেসে বলল রানা। সম্ভব হলে গাড়ি থামিয়ে নেমে যেতাম, তোমাদের একা হতে দিতাম। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে তা পারছি না। তাই তোমাদের পর্বটা আপাতত মুলতবি রাখতে হবে। দায়িত্বের কথা ভুলে যাওনি নিশ্চয়ই?

না, না, তাড়াতাড়ি আবার ল্যাপটপে কাজ শুরু করল টিনা।

আচ্ছা, সাতজনের কথা তো শুনলাম, একটু অপেক্ষা করে বলল রানা। এদের কেউ যে তোমার বাবা-মাকে খুন করেনি, সেটা বুঝলে কী করে? এলিসা। ভ্যান বুরেনকেই সন্দেহ করতে শুরু করলে কেন?

ওই সাতজনের ব্যাপারে সন্দেহ করবার মত কিছু পাইনি বলে, টিনা জানাল। খুব ভালমত খোঁজখবর নিয়েছি আমি–তাতে ওঁদের নিরীহ-ভালমানুষ বলেই মনে হয়েছে। কিন্তু এই ভ্যান ব্যুরেন হলো ভিন্ন চিজ। আপাতদৃষ্টিতে একনিষ্ঠ একজন বিজ্ঞানী, পেশার প্রতি নিবেদিতপ্রাণ… কিন্তু তার আসল রূপ কী, জানেন? জানেন, কীভাবে তার কোম্পানিটাকে এত উপরে তুলে এনেছে? কূটচাল চেলে আর পেশিশক্তি খাঁটিয়ে। প্রতিভাবান প্রোগ্রামারদেরকে অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে ভাগিয়ে আনে সে, হয় টাকার লোভ, নয়তো ভয় দেখিয়ে। অথচ তার কোম্পানি থেকে কেউ বেরুতে পারে না। প্রতিদ্বন্দ্বীদের কোম্পানির লোকজনকেও হাতে রাখে সে, ওদের প্রোডাক্টে নানা রকম ভাইরাস আর বাগ ঢোকাবার জন্যে–যাতে তিতিবিরক্ত হয়ে কাস্টোমারেরা ক্রিয়েলটেকের প্রোডাক্টের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ভ্যান বুরেনের ওই অ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যার… ক্রিয়েল-প্রটেষ্ট… কীভাবে পুরস্কার পেয়েছে, জানেন? নিজের তৈরি ভাইরাস ধ্বংস করে। এসব নিয়ে বাজারে অনেক গুজব প্রচলিত আছে। একটু খোঁজ নিলেই কানে আসবে আপনার, আমারও এসেছে। সবকিছু শুনে আমার মনে হয়েছে-একমাত্র এই মহিলাই ইউনোকোডকে মন্দ কাজে ব্যবহার করতে পারে। ছাত্রাবস্থায় হল্যান্ডে আসার কোনও সুযোগ ছিল না, তাই কিছু করতে পারিনি, কিন্তু ভার্সিটি থেকে বের হবার পর থেকেই তক্কে তক্কে ছিলাম, প্রথম সুযোগেই ক্রিয়েলটেকে চাকরি নিয়ে ঢুকে পড়েছি। ওখানে ঢোকার পর সমস্ত সন্দেহের অবসান হলো আমার, বুঝতে পারলাম–এলিসা ভ্যান ব্যুরেনই আমার বাবা-মাকে খুন করেছে।

কীভাবে? জানতে চাইল রায়হান।

বছরখানেক আগে এক ব্যবসায়ী রীতিমত ঘোষণা দিয়ে এলিসার কুকীর্তি ফাস করে দেবার জন্য মাঠে নেমেছিল, হঠাৎ করে হেলিকপ্টার-ক্র্যাশে মারা পড়ে বেচারা, টিনা বলল। একদিন ব্যাপারটা নিয়ে ছোট ভাইয়ের সঙ্গে আলোচনা করছিল ডাইনিটা–পুলিশ নাকি কেসটা রি-ওপেন করতে চাইছে, তাতে গোমর ফাস হয়ে যাবে। তাই কাকে কাকে টাকা খাওয়াতে হবে, সেটাই ঠিক করছিল ওরা। আড়াল থেকে সব শুনে ফেলি আমি। তখনই বুঝতে পারি, স্বার্থের জন্য মানুষ খুন করবার অভ্যেস আছে এই মহিলার। সে ছাড়া আর কে-ই বা আমার বাবা-মাকে খুন করতে পারে?

ওঁর ভাইও জড়িত এসবের সঙ্গে?

সমস্ত নোংরা কাজ তো ও-ই করে। শেয়ালের মত চতর, আর বাঘের মত ভয়ঙ্কর ওই থিও ভ্যান বুরেন। ছিল অ্যামেরিকান আর্মির ক্যাপ্টেন, স্পেশাল ফোর্সের মেম্বার… কিন্তু সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে এখন চলে এসেছে বোনের কাছে–ক্ষমতা আর টাকার লোভে। স্পেশাল ফোর্সের দুই পেয়ারের বন্ধুকেও নিয়ে এসেছে সঙ্গে। ওরা তিনজন এখন এলিসার ব্যক্তিগত লাঠিয়াল–ভয় দেখানো, খুনোখুনি, ব্ল্যাকমেইল… সব এরাই সামলায়।

তিনজন? ভুরু কুঁচকে গেল রানার। স্পেশাল ফোর্সের প্রাক্তন সদস্য?

ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে রায়হানও। মাসুদ ভাই, এরাই গিয়েছিল মণ্টেগো আইস শেলফে!

হ্যাঁ, তাতে কোনও সন্দেহ নেই, রানা বলল। খুব ভাল হলো ওদের পরিচয় জানতে পেরে। এবার বোঝাপড়া করা যাবে শয়তানগুলোর সঙ্গে। দৃঢ়প্রতিজ্ঞার ছাপ ফুটল ওর বলার ভঙ্গিতে।

এই সময় একটা সঙ্কেত শোনা গেল ল্যাপটপের স্পিকারে, নাসার মনোগ্রাম উদয় হয়েছে স্ক্রিনে। ঢুকে পড়েছি মেইনফ্রেমে, জানাল টিনা। এখন কী করতে হবে?

দেখিয়ে দিল রায়হান, আর ওর নির্দেশনা মেনে ত্রিশ সেকেণ্ডের মধ্যেই ভাইরাস-আক্রান্ত অডিও-সিগনালটা ডাউনলোড করে ফেলল তরুণী ইউনো। ওটা স্টাডি করতে শুরু করল।

টানা পনেরো মিনিট জিনিসটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করল ও, তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হেলান দিল সিটে। ব্যাপারটা লক্ষ করে রানা জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার,ওভাবে শ্বাস ফেলছ কেন?

এলিসা ভ্যান বুরেনের কীর্তি দেখে, বলল টিনা। সত্যি, জিনিস বানিয়েছে একটা! ডাইনিটা যে কতখানি কুটিল, তা এই ভাইরাসটা দেখলেই বোঝা যায়। প্রোগ্রামিংটা মারাত্মক জটিল।

কুটিল মহিলার জটিল ভাইরাসটাকে এবার তুমি সুটিল… মানে সরল করে ফেলো, হেসে সুর করে বলল রায়হান। তা হলেই তো হয়।

সরি, মাথা নাড়ল টিনা। মিথ্যে আশা দেব না তোমাদের। কাজটা সহজ নয়, ঝামেলা আছে অনেক।

পারবে না তুমি? জিজ্ঞেস করল রানা।

পারব, তবে ঠিক সময়ে শেষ করতে পারব কি না–তার কোনও গ্যারান্টি নেই। কারণ শুধু প্রোগ্রামটা লিখলেই হবে না, ওটা ঠিকমত কাজ করে কি না, তা-ও পরীক্ষা করে দেখতে হবে। নানা রকম ক্রটি বেরুতে পারে, সেগুলো আবার সংশোধন করতে হবে-কাজ অনেক। অথচ রাত দুটো পর্যন্তই তো সময়সীমা, তাই না?

এ কী দুঃসংবাদ শোনাচ্ছ! রায়হানের গলায় উদ্বেগ। ইউনোকোঁডের স্রষ্টা… দুনিয়ার সবচেয়ে দক্ষ ইউনোই যদি এমন কথা বলে, তা হলে হবে কেমন করে? চেষ্টা তো অন্তত করো!

তা তো করবই। তবে খারাপ খবরটা আগেই জানিয়ে রাখলাম। দেখো, আমার দিকে ওভাবে তাকিয়ো না। জীবনে কোনওদিন অ্যান্টিভাইরাস তৈরি করেছি নাকি আমি? তারওপর ডাইনিটা নিশ্চয়ই অনেক সময় নিয়ে আর মাথা খাঁটিয়ে তৈরি করেছে এটা–চোখের পলকে সমাধান করে দেব, ভাবলে কী করে?

হুঁ, সময় নিয়েই বানিয়েছে ভাইরাসটা, রানা একমত হলো। কমপক্ষে আঠারো বছর।

আঠারো বছর! রায়হান অবাক হলো।

হ্যাঁ, রানা ব্যাখ্যা করল। এলিসার কুমতলব জেনে ফেলায় মরতে হয়েছিল মাইকেল আর ডেবিকে। আঠারো বছর আগে।

এই ভাইরাস বানাতে আঠারো বছর লেগেছে বলে মনে করো তুমি? বিস্মিত কণ্ঠে টিনাকে জিজ্ঞেস করল রায়হান।

সময় প্রচুর দেয়া হয়েছে নিঃসন্দেহে, উত্তর দিল টিনা। তবে আঠারো বছর একটু বেশি হয়ে যায়।

আক্ষরিক অর্থে বলিনি কথাটা, রানা বলল। বলতে চেয়েছি যে, গত আঠারো বছর ধরে প্ল্যান আঁটছিলেন এলিসা। কাজে পরিণত করেছেন এই এতদিন পরে।

কিন্তু এতদিন হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবার মানেটা কী? রায়হান বলল। কম্পিউটারই যাঁর ধ্যান-জ্ঞান, টাকা বানানোর উৎস… তিনিই বা হঠাৎ করে সারা দুনিয়ার সমস্ত কম্পিউটার ধ্বংস করে দিতে চাইছেন কেন?

পিছনে গূঢ় একটা রহস্য যে আছে, তাতে সন্দেহ নেই, টিনা স্বীকার করল। তবে এতদিন পর কেন ভাইরাসটা ছাড়া হয়েছে, সেটা বোধহয় আন্দাজ করতে পারি। তুমিই ভাবো, রায়হান, আঠারো বছর আগে এই ভাইরাস। আক্রমণ করলে বিরাট কোনও ক্ষতি কি হত? তখন তো মানুষ কম্পিউটারের উপর খুব একটা নির্ভরশীল ছিল না। কিন্তু এখনকার কথা ধরো, বিশেষ করে গত দুতিন বছরে কম্পিউটারের কী ধরনের প্রসার হয়েছে। দৈনন্দিন জীবন থেকে শুরু করে শিক্ষা-দীক্ষা, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, সরকার পরিচালনা, প্রতিরক্ষা… সবকিছু এখন কম্পিউটার-নির্ভর হয়ে গেছে। এলিসা এ-সময়টা বেছে নিয়েছে একটাই কারণে–এখনই ইউনো-ভাইরাস স্মরণকালের সবচেয়ে। বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি ঘটাতে পারবে। ১৯৯০-এ তা সম্ভব ছিল না।

ঠিকই বলেছে ও, রানা সায় দিল। দুনিয়াটাকে পুরোপুরি কম্পিউটার-নির্ভর হবার জন্যই এতকাল অপেক্ষা করেছেন এলিসা।

মহিলার ধৈর্য আছে বলতে হবে, মন্তব্য করল রায়হান।

শুধু ওর প্রশংসাই করলে? টিনা বলল। আমাদের কোনও দোষ নেই বলতে চাইছ? যন্ত্রপাতির উপর মানুষের অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতার কারণেই তো এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। আমরা দিন দিন যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছি–এটা কি কোনও শুভ লক্ষণ?

তাই বলে কোথাকার কোন্ ছিট-পাগল পুরো মানবসভ্যতাকে ধ্বংস করে দেবে, বুলডগের মত স্বার্থান্বেষী সেটার ফায়দা লুটবে–এমন তো হতে দেয়া যায় না। এলিসা ভ্যান ব্যুরেনকে ঠেকাতেই হবে, টিনা। অ্যান্টিভাইরাসটা তোমাকে তৈরি করতেই হবে।

রাত দুটোর মধ্যে কাজটা শেষ করা।

দুটো না, আরও আগে। ওটা ডিস্ট্রিবিউট করতে সময় দরকার আমাদের।

কী বলছ এসব! ছঘণ্টাও নেই হাতে, আমি কীভাবে অসম্ভবকে সম্ভব করব? এতই যদি তাড়া থাকে, তা হলে আগেই আমাকে বলেনি কেন? সারাটা দিন একসঙ্গে আছি, অথচ তুমি আর মি. রানা তো আমাকে একটুও বিশ্বাস করোনি। সারাক্ষণ গুজুর-গুজুর, ফুসুর-ফাসুর করেছ নিজেদের মধ্যে… আমাকে বুঝতে দিয়েছ কিছু?

ওমা! ডেকে বলতে হবে কেন? আমরা কি ছাই জানি নাকি যে, তুমি একজন ইউনো। এতকিছু ঘটতে দেখে তোমারই তো নিজ থেকে সব খুলে বলা উচিত ছিল।

কী-ই-ই! এখন সব দোষ আমার?

ঝগড়া শুরু করে দিয়েছে প্রেমিক-প্রেমিকা, প্রমাদ গুনে তাড়াতাড়ি নাক গলাল রানা। থামো, থামো, ঝগড়াঝাটি করে লাভ নেই এখন। যা হবার তো হয়েই গেছে। টিনার দিকে তাকাল ও। সত্যিই অ্যান্টিভাইরাসটা বানাতে পারবে না তুমি?

সময় নেই হাতে, কী করব, বলুন? টিনা কাঁধ ঝাঁকাল। তারপরও চেষ্টা করে দেখছি, যদি পারা যায়! তবে সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ, এটা আগেই বলে রাখছি।

সেক্ষেত্রে বিকল্প একটা ব্যবস্থা চিন্তা করে রাখাই ভাল, রানা বলল।

কীসের বিকল্প ব্যবস্থা? রায়হান বুঝতে পারছে না। একমাত্র টিনার তৈরি অ্যান্টিভাইরাস ছাড়া আর কোনওভাবেই ঠেকানো সম্ভব নয় বিপর্যয়টা।

ওরটাই একমাত্র হতে যাবে কেন? রানা ভুরু নাচাল। রেডিমেড আরেকটা অ্যান্টিভাইরাস আছে, বুলডগ ওটা পেয়ে গেছে… মনে নেই? জিনিসটা নিঃসন্দেহে এলিসা তৈরি করে রেখেছেন আগে থেকে, নইলে এত দ্রুত বুলডগকে দিতে পারতেন না। ওটাই চুরি করব আমরা–ওঁর কম্পিউটার থেকে!

.

১৫.

অ্যামস্টারড্যামে পৌঁছেই রানা এজেন্সির একটা সেফ হাউসে উঠল ওরা। ওখান থেকে বিসিআই হেডকোয়ার্টারে ফোন করল রানা, মেজর জেনারেল (অব) রাহাত খানের কাছে অ্যাসাইনমেন্টের অগ্রগতি সম্পর্কে ব্রিফ করল। সবকিছু শুনে গম্ভীর সুরে চিফ জানতে চাইলেন, কী মনে হয় তোমার, ডেডলাইনের মধ্যে অ্যান্টিভাইরাসটা জোগাড় করতে পারবে?

আমি এখনও হাল ছাড়ছি না, স্যর, রানা বলল। টিনা যদি ওটা বানাতে না-ও পারে, ড. বুরেনের কাছ থেকে চুরি করে আনব বলে ঠিক করেছি।

হুম, ওই ডগলাস বুলক কিন্তু তোমাকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করবে। সাবধানে থেকো।

থাকব, স্যর।

বেস্ট অভ লাক, বলে লাইন কেটে দিলেন রাহাত খান।

খাওয়া-দাওয়া শেষে দুই সঙ্গীকে নিয়ে আবার মিটিঙে বসল রানা। অ্যামস্টারড্যামে আসার পথে পরে আর বিশেষ কথা হয়নি ওদের মধ্যে, টিনা যাতে অখণ্ড মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে পারে, তাই নীরব হয়ে গিয়েছিল ও আর রায়হান। এবার মিটিঙে বসার পর নতুন করে আবার আলোচনা শুরু হলো। রানা জানতে চাইল, কাজ কর, টিনা?

হতাশ ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল তরুণী ইউনো। একদমই এগোচ্ছে না। অডিও সিগনালটা অনেক বড়, ওটার আনাচে-কানাচে লুকিয়ে আছে ভাইরাসটার বিভিন্ন অংশ। একটা অংশ ঠেকানোর ব্যবস্থা করি তো আরেকটা এসে উদয় হয়। খুব বিশ্রী অবস্থা।

তা হলে ধরে নিতে পারি যে, ডেডলাইনের ভিতরে অ্যান্টিভাইরাসটা তৈরি করতে পারছ না তুমি?

হুঁ। আপনার ওই বিকল্প প্ল্যানটাই কাজে লাগাতে হবে এখন। রেডিমেড অ্যান্টিভাইরাসটা জোগাড় করতে হবে।

কীভাবে? রায়হান প্রশ্ন রাখল। ড. বুরেন একজন ইউনো, তাঁর কম্পিউটারে কোনও ধরনের হ্যাঁকিং করা সম্ভব নয়।

টিনা, তুমি পারবে না? রানা জিজ্ঞেস করল।

চেষ্টা করে দেখতে পারি, টিনা বলল। অন্তত এই হতচ্ছাড়া ভাইরাসটা নিয়ে মাথা ঘামানোর চেয়ে অনেক সহজ হবে ওটা।

এলিসাকে এত বোকা ভাবা উচিত হচ্ছে না তোমার, রায়হানকে গম্ভীর দেখাল। টিজিভি-র ঘটনাটার পর মহিলা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে, এগারো নম্বর ইউনো সত্যিই আছে। ইউনোকোড দিয়ে ইউনোকোডের মোকাবেলা করেছ তুমি, তাকে হারিয়ে দিয়েছ… এই অবস্থায় আমি হলে তোমার হ্যাঁকিঙের শিকার হতে চাইতাম না কিছুতেই। কম্পিউটারের সব ধরনের কানেকশন খুলে রেখে দিতাম, যাতে বাইরে থেকে ওটায় কিছুতেই ঢোকা না যায়।

সেক্ষেত্রে ফিষিক্যালি অ্যান্টিভাইরাসটা সংগ্রহ করব আমরা, রানা বলল। ওঁর বাড়িতে গিয়ে কম্পিউটার অন করে জিনিসটা বের করব।

ব্যাপারটা ওই মহিলা বা বুলডগ আন্দাজ করতে পারবে না ভাবছেন?

জানার উপায় একটাই, বলে মোবাইল ফোন হাতে নিল রানা। সেফ হাউসে পৌঁছুবার পর পরই শাখাপ্রধান নাঈম আযমের সঙ্গে কথা বলে রানা এজেন্সির অপারেটর মারুফকে আলসমিরে পাঠানো হয়েছে এলিসার ব্যাপারে খোঁজখবর নেয়ার জন্য; ওর সঙ্গে যোগাযোগ করল রানা, মিনিটদুয়েক কথা বলল। শেষে ফোনটা নামিয়ে রেখে বলল, তোমার আশঙ্কাই ঠিক, রায়হান। বাড়িটাকে যখের ধনের মত পাহারা দিচ্ছে সিআইএ এজেন্টরা, ওটা এখন একটা দুর্গম দুর্গ।

হতাশায় মাথা দোলাল রায়হান।

একটা হামলা করে দেখা যেতে পারে…

এক মিনিট, মি. রানা, বাধা দিয়ে বলে উঠল টিনা, কী যেন মনে পড়ে গেছে ওর। আরেক জায়গায় পাওয়া যেতে পারে অ্যান্টিভাইরাসটা।

কোথায়? সাগ্রহে জিজ্ঞেস করল রানা।

ক্রিয়েলটেকের হেডকোয়ার্টারে… ড. বুরেনের অফিসে! ওখানে তার আরেকটা কম্পিউটার আছে, আর আমি যদ্দর জানি–ওটায় সব ধরনের ফাইল আর সফটওয়্যারের একটা করে ব্যাকআপ রাখে ডাইনিটা।

অ্যান্টিভাইরাসটাও থাকবে?

থাকা তো উচিত। কম্পিউটারটাকে কোনও নেটওয়ার্কে সংযুক্ত রাখে না এলিসা–হ্যাকিঙের ভয়ে। কাউকে কাছেও ঘেঁষতে দেয় না। সে না থাকলে ওই অফিসে কারও ঢোকাও বারণ। এত লুকোছাপার একটাই মাত্র কারণ থাকতে পারে: কম্পিউটারটায় ইউনোকোড সংক্রান্ত সব ধরনের জিনিস আছে। তারমানে ভাইরাস এবং অ্যান্টিভাইরা-দুটোই।

তা হলে তো ওখানেও পাহারার ব্যবস্থা করবে মহিলা, রায়হান বলল।

মনে হয় না, টিনা মাথা নাড়ল। বিল্ডিংটা এমনিতেই সুরক্ষিত। সিকিউরিটি ডিভিশনের কমপক্ষে দশজন গার্ড অফ-আওয়ারে পাহারা দেয়। ওখানে। তা ছাড়া পুরো বিল্ডিঙে আট্রা-হাইটেক সিকিউরিটি সিস্টেম বসানো আছে, চুরি করে কারও পক্ষেই ঢোকা সম্ভব নয়। দরজা-জানালা তো দূরের কথা, ভেন্টিলেশনের একটা ডাক্টের মুখও যদি আনশিডিউলড়ভাবে ভোলা হয়, পুলিশ স্টেশনে অ্যালার্ম বেজে উঠবে। আর খুলবেনই বা কীভাবে, বিল্ডিংটার সব ধরনের ওপেনিং ইলেকট্রিফায়েড করে রাখা হয়। ব্যবস্থাটার সঙ্গে কম্পিউটার বা ইলেকট্রনিকসের কোনও সম্পর্ক নেই যে হ্যাঁকিং করে বন্ধ। করবেন, শুধুমাত্র হেডকোয়ার্টারের কন্ট্রোল সেন্টার থেকে বিদ্যুৎপ্রবাহটা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। নিখুঁত একটা নিরাপত্তা ব্যবস্থা–প্রায়ই এ-নিয়ে গর্ব করে ডাইনিটা–তার হেডকোয়ার্টারে নাকি একটা পিঁপড়েরও ঢোকার উপায় নেই।

তা হলে তো খুবই ভাল, সুযোগটা কাজে লাগাব আমরা, রানা বলল। তবে আসলে ওখানে আজ বাড়তি কোনও ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কি হয়নি, সেটা আগে জেনে নিতে হবে।

নাঈমকে ফোন করল ও, ক্রিয়েলটেকের হেডকোয়ার্টারে কাউকে পাঠাতে বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু শাখাপ্রধান বলল–ড. বুরেনের খোঁজ পাবার জন্য দুদিন আগে থেকেই বিল্ডিঙটার পাশে একজন ওয়াচার বসিয়েছে সে। ওখানে সিআইএ বা কোম্পানির সিকিউরিটি ডিভিশনের লোকজনের কোনও অস্বাভাবিক তৎপরতা আছে কি না, সেটা জিজ্ঞেস করতেই কয়েক মিনিট অপেক্ষা করতে বলল। ওয়াচারের সঙ্গে আরেকটা ফোনে কথা বলে নিল নাঈম, তারপর জানাল–না, সবকিছুই স্বাভাবিক রয়েছে বিল্ডিংটায়। সন্ধ্যা নামতেই নিয়মিত প্রহরীরা ডিউটিতে যোগ দিয়েছে, তারা ছাড়া আর কোনও লোক যায়নি ওখানে।

থ্যাঙ্ক ইউ, নাঈম। বলে লাইন কেটে দিল রানা। তারপর ফিরল রায়হান আর টিনার দিকে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন মনে হচ্ছে। বিল্ডিংটায় হানা দেয়া যেতে পারে, ওখানে বুলডগ লোক পাঠায়নি।

এমনভাবে বলছেন যেন গেলেই দরজা খুলে ঢুকতে দেয়া হবে আমাদের, টিনা ভুরু কোঁচকাল। বললাম না, যা সিকিউরিটি আছে, সেটা ভেদ করেই ঢোকা সম্ভব নয় কারও পক্ষে।

হাইটেক সিস্টেমটাকে তুমি যদি অচল করে দিতে পারো, তা হলে দশজন গার্ডকে সামলানো আমার আর রায়হানের জন্য কোনও ব্যাপারই না।

ব্যাপারটা, এখনও ধরতে পারেননি আপনি, মি, রানা। ওটা একটা অত্যাধুনিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা–কেউ অনুপ্রবেশ করলেই শুধু অ্যালার্ম বাজায় না, সিস্টেমটা কোনও কারণে অচল হয়ে গেলেও পুলিশ স্টেশনে বিপদসঙ্কেত পাঠায়।

যদি সঙ্কেত পাঠানোর লাইনটাই কেটে দিই?

সিগনালটা ওয়্যারলেস পদ্ধতিতে যায়–তার-টারের কোনও ঝামেলাই নেই।

হাসি ফুটল রানার ঠোঁটে। তা হলে ফ্রিকোয়েন্সি-জ্যামার ব্যবহার করব আমরা, নাঈম এনে দিতে পারবে।

তাতে তো শুধু সঙ্কেত পাঠানোটা থামবে। বিদ্যুতায়িত ওপেনিংগুলোর ব্যাপারে কী করবেন? ওটা তো বন্ধ করতে পারব না আমি।

বিল্ডিঙটার ইলেকট্রিক সাপ্লাই বন্ধ করে দিলে কেমন হয়? প্রস্তাব দিল রায়হান।

দুঃখিত, টিনা মুখ বাঁকাল। ওখানে ব্যাকআপ জেনারেটর আছে, দশ সেকেণ্ডের মধ্যেই অন্ হয়ে যায় ওটা।

রানা জিজ্ঞেস করল, যদি একটা হেলিকপ্টারে করে ছাদে নামি, তা হলে, কাজ হবে? উপরে নিশ্চয়ই সিকিউরিটি এত কড়া না?

আরও বেশি, টিনা বলল। ছাদের উপরে আলাদা একটা সিকিউরিটি পোস্টই আছে। তা ছাড়া ওখানকার সিঁড়িঘরের দরজা আর ভেন্টিলেশনের শাফটে সবচেয়ে বেশি ভোল্টের কারেন্ট দেয়া হয়েছে।

শিট! ওটা কি অফিস, না জেলখানা? বিরক্ত গলায় বলল রায়হান।

রানাও চিন্তায় পড়ে গেছে। হুম, তা হলে ঢোকার পথগুলো ইলেকট্রিফায়েড হওয়াতেই সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ঠিক করে বলো তো, টিনা, ইলেকট্রিফায়েড নয়–এমন কোনও দরজা-জানালা কি একেবারেই নেই?

থাকবে না কেন? টিনা বলল। বিল্ডিঙের ইনডোরে কোনও কিছু ইলেকট্রিফায়েড নয়। কিন্তু ওখানে পৌঁছুতে হলে আপনাকে আউটার-সাইডের বাধা পেরোতেই হবে–এমনভাবেই ডিজাইন করা হয়েছে সিস্টেমটা।

মাথা নিচু করে একটু ভাবল রানা, ক্রিয়েলটেক হেডকোয়ার্টারের নিরাপত্তাব্যবস্থাকে ফাঁকি দেয়ার উপায় নিয়ে চিন্তা করছে। কিন্তু আশার আলো দেখতে পেল না, সিস্টেমটা সত্যিই নিখুঁত। হঠাৎ কী যেন টোকা দিল মগজে, মাথা তুলে ও বলল, টিনা, বিল্ডিংটার ব্লু-প্রিন্ট দেখাতে পারবে আমাকে?

পারব, বলে ল্যাপটপটা টেনে নিল তরুণী ইউনো। মিউনিসিপ্যাল ডিপার্টমেন্টের কম্পিউটারে রাজধানীর সমস্ত ইমারতের নকশা আছে, সেখানে হ্যাঁক করে কয়েক মিনিটের ভিতরই ব্লু-প্রিন্টটা বের করে আনল ও। স্ক্রিনে ফুটে উঠল ক্রিয়েলটেকের দশতলা হেডকোয়ার্টারের একটা ত্রিমাত্রিক মডেল!

ড. বুরেনের অফিসটা কোথায়? জিজ্ঞেস করল রানা।

দশতলার একটা অংশে আঙুল রাখল টিনা। এখানে।

রুমটার সঙ্গে লাগোয়া আরেকটা বড় কামরা দেখা যাচ্ছে। রানা ওটা দেখিয়ে বলল, এটা কী?

এলিসার অ্যাপার্টমেন্ট–মাঝে মাঝে অফিসেই রাত কাটায় সে।

আর এটা? অ্যাপার্টমেন্টের দেয়াল ঘেঁষে বড় একটা শাফট নেমে গেছে নিচতলা পর্যন্ত, ওটা দেখাচ্ছে রানা।

প্রাইভেট এলিভেটর। লবি থেকে সরাসরি অ্যাপার্টমেন্টে ওঠে ওটা।

ঠোঁট কামড়ে কী যেন ভাবল রানা। তারপর বলল, অ্যামস্টারড্যামের স্যুয়ারেজ সিস্টেমের প্ল্যানটা দেখাও তো।

মাথা ঝাঁকিয়ে মিউনিসিপ্যাল ডেটাবেজের আরেকটা অংশে অনুপ্রবেশ করল টিনা, এবার স্ক্রিনে ভেসে উঠল মাকড়সার জালের মত হিজিবিজি একটা ছবি।

ক্রিয়েলটেকের বিল্ডিংটা যেখানে, ওই অংশটা, জুম করো, নির্দেশ দিল রানা।

যুইডাস ডিস্ট্রিক্ট… হ্যাঁ, এই তো। কয়েকটা বাটন চাপল টিনা, অ্যামস্টারড্যামের নির্দিষ্ট একটা অংশের স্যুয়ারেজ সিস্টেম কয়েক গুণ বড় হয়ে দেখা গেল পর্দায়।

এটার উপরে বিল্ডিঙের ব্লু-প্রিন্টটা ওভারল্যাপ করতে পারো? রানা জিজ্ঞেস করল।

নিশ্চয়ই। স্যুয়ারেজ সিস্টেমের নকশার উপরে ক্রিয়েলটেক হেডকোয়ার্টারের টপ-ভিউ আউটলাইনটা নিয়ে এল টিনা, সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়ে উঠল রানার হৃৎপিণ্ড।

রায়হানও খেয়াল করেছে ব্যাপারটা। উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, মাসুদ ভাই, এলিভেটর শাফটটার ঠিক নীচ দিয়ে স্যুয়ারেজের একটা টানেল আছে!

টিনাও দেখল। বিস্মিত হয়ে রানাকে জিজ্ঞেস করল, আপনি জানতেন, শাফটের তলায় টানেল পাওয়া যাবে?

তা জানতাম না, রানা স্বীকার করল। একটা চান্স নিয়ে দেখলাম–মনে হচ্ছিল থাকতে পারে।

এই শাফট ধরে উপরে উঠবেন তা হলে?

যদি ওটার ভিতরে শক খাবার ব্যবস্থা না থাকে, হাসল রানা।

নেই, টিনা জানাল। কিন্তু শাফটে ঢুকবেন কীভাবে? প্ল্যানটা ভাল করে দেখল ও। শাফটের তলা আর স্যুয়ারেজের ছাদের মাঝখানে চার ফুট পুরু। কংক্রিট লেয়ার আছে। ম্যানহোল জাতীয় কিছু নেই জায়গাটায়।

ফোকর করে নেব, রানা বলল, তারপর তাকাল রায়হানের দিকে। নাঈমের সঙ্গে যোগাযোগ করো–কয়েক পাউণ্ড সি-ফোর দরকার আমাদের, সেই সঙ্গে সিধ কাটার আরও কিছু সরঞ্জাম। যত দ্রুত সম্ভব ডেলিভারি দিতে হবে।

মাথা ঝাঁকিয়ে ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল রায়হান।

টিনা গম্ভীর হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে দেখে রানা জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার? ওভাবে কী দেখছ?

আপনাদের, বলল টিনা। অদ্ভুত মানুষ আপনারা–প্রথম দেখায় ভদ্রলোক মনে হয়, অথচ লড়াই করেন প্রশিক্ষিত সৈনিকের মত, মাথার বুদ্ধি মাস্টারমাইণ্ড ক্রিমিনালের মত… এইমাত্র যেভাবে ক্রিয়েলটেকে ঢোকার প্ল্যান বের করলেন, তা কেবল প্রফেশনাল চোরই করতে পারে। এদিকে আবার পৃথিবীকে বাঁচানোর মহান লক্ষ্য নিয়েও কাজ করছেন। কোনওটার সঙ্গেই কোনওটা মেলে না। আসলে… কে আপনারা?

সবকিছুর মিশেল… মুচকি হেসে বলল রানা। আমরা এসপিওনাজ এজেন্ট!

.

রাত বারোটা। যুইডাস ডিস্ট্রিক্ট, অ্যামস্টারড্যাম।

স্যুয়ারেজ টানেলের শ্যাওলা পড়া ভেজা দেয়ালে প্রতিফলিত হচ্ছে টর্চের আলো, পথ দেখে গোড়ালি সমান পানিতে ছপ ছপ করে পা ফেলে হেঁটে চলেছে তিনজন মানুষ–সবার সামনে মাসুদ রানা, পিছু পিছু ক্রিস্টিনা ওয়ালডেন আর রায়হান রশিদ। মাথার উপর রাজধানীর ব্যস্ত বাণিজ্যিক এলাকা, মাঝরাতেও নিচ্ছুপ হয়ে যায়নি। ম্যানহোলের ছাকনি ভেদ করে মাঝে মাঝেই ভেসে আসছে। যানবাহনের আওয়াজ, পথচলা মানুষের কথাবার্তা। সেসব দিকে কোনও মনোযোগ নেই নীচের তিনজনের, নিজেদের মধ্যেও কথা বলছে না, যত দ্রুত সম্ভব পৌঁছুতে চাইছে গন্তব্যে। এমনকী স্যুয়ারেজ লাইনের উৎকট দুর্গন্ধটাও অগ্রাহ্য করে এগোচ্ছে ওরা।

টানেলের শাখা-প্রশাখা হয়ে টানা বিশ মিনিট হাঁটার পর থামল রানা, ডানদিকের সংকীর্ণ একটা অংশে এসে ঢুকেছে। হাতে একটা পোর্টেবল জিপিএস ট্র্যাকার রয়েছে ওর, সেটার রিডিং দেখল। পকেট থেকে নোটবুক বের করে কো-অর্ডিনেট, মেলাল, তারপর উপরদিকটা ইঙ্গিত করে ও বলল, এসে গেছি, এখানেই হবার কথা এলিভেটর শাফটটার তলা।

কথাটা শুনে ঝটপট পিঠ থেকে ব্যাকপ্যাকটা নামাল রায়হান, সেটা থেকে চারটে সি-ফোর এক্সপ্লোসিভের ব্লক বের করল–দুটো নিজে রাখল, বাকি দুটো রানাকে দিল। মোড়ক খুলে ব্লকগুলো পাকিয়ে আড়াই ফুট দৈর্ঘ্যের চারটে স্ট্রিপে পরিণত করল ওরা। এরপর সেগুলোকে, বর্গাকারভাবে টানেলের ছাদে সেঁটে দিল।

বিস্ফোরণের শব্দ শুনে গার্ডেরা সতর্ক হয়ে যাবে না? জানতে চাইল টিনা।

কিছু বুঝতেই পারবে না, সতর্ক হবে কেমন করে? রানা উত্তর দিল, হাতদুটো ব্যস্ত ওর–রায়হানের কাছ থেকে ডিটোনেটর নিয়ে বিস্ফোরকে খুঁজে দিচ্ছে। দশতলা উঁচু এলিভেটর শাফট সাউণ্ডওয়েভটাকে-ভাগাভাগি করে ছড়িয়ে দেবে পুরো বিল্ডিঙেফলে তীব্রতা অনেক কমে যাবে ওটার। মৃদু একটা শব্দ হয়তো শুনবে ওরা, কিন্তু কম্পন অনুভব করবে না কোনও। তাই শব্দটার উৎস খুঁজে বের করা কিছুতেই সম্ভব হবে না ওদের পক্ষে।

তা হলে তো ভালই।

মোবাইল ফোন তুলে নাঈম আযমের সঙ্গে যোগাযোগ করল রানা, ক্রিয়েলটেকের মুখোমুখি আরেকটা বিল্ডিঙের ছাদে রয়েছে শাখাপ্রধান। জ্যামারটা চালু করো, নাঈম। আমরা ভিতরে ঢুকব এখনই।

ঠিক আছে, মাসুদ ভাই।

ডিটোনেটরের সঙ্গে টাইমারের সংযোগ দিল রানা, দুই মিনিটে স্থির করল কাউন্টডাউন। এরপর সঙ্গীদের নিয়ে টানেল ধরে পিছিয়ে গেল ও, একটা জাংশানে পৌঁছে আড়াল নিল।

কাঁটায় কাঁটায় ঠিক দুই মিনিট পর বিস্ফোরণ ঘটল সি ভরে গেল গোটা জায়গাটা, পায়ের নীচে কেঁপে উঠল মেঝে। আড়াই ফুট বাই আড়াই ফুট আকারের একটা স্ল্যাব ধপাস করে খসে পড়ল টানেলের ছাদ থেকে। ধুলোটা মিলিয়ে যাবার জন্য একটু দেরি করল ওরা, তারপর এগিয়ে গেল সদ্য সৃষ্টি হওয়া ফোকরটার দিকে।

আলো ফেলে ছাদটা দেখল রানা, কাজটা চমৎকার হয়েছে-ফোঁকরটা ছাড়া আশপাশের কংক্রিটে একটুও ফাটল ধরেনি। গর্তটার মধ্য দিয়ে ছোট্ট টর্চের আলোকরশ্মি হারিয়ে যাচ্ছে এলিভেটর শাফটের নিকষ অন্ধকারে, কোনও প্রতিফলন নেই, তারমানে কেইবল-কারটা একদম উপরে রয়েছে এখন। ভালই হলো, ভাবল ও, কারটা থেকে অ্যাপার্টমেন্টের দরজা খুলতে সুবিধে হবে।

রায়হান, প্রথমে তুমি. নির্দেশ দিল রানা, দুহাতের খাঁজে খাঁজে আঙুল আটকে সামনে মেলে ধরেছে।

মাথা ঝাঁকিয়ে এগিয়ে এল তরুণ হ্যাকার। প্রথমে ফোকর দিয়ে ছুঁড়ে দিল ব্যাকপ্যাকটা, তারপর রানার হাতে পা রেখে এক ঝটকায় উঠে গেল উপরদিকে শরীরের উর্ধ্বাংশ গর্তে ঢকিয়ে আঁকড়ে ধরল ভিতরদিককার কিনারা দুহাতে ভর দিয়ে কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই শাফটে অদৃশ্য হয়ে গেল। একটু পরেই একটা দড়ি ফেলল ও।

টিনার দিকে তাকিয়ে রানা বলল, এবার তুমি।

দড়ি বেশ ভালই বাইতে পারে তরুণী ইউনো, তা ছাড়া ওদের তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে শুকনো ও-ই, তাই ফোকরটা ছোট্ট হলেও ঝটপট উঠে যেতে পারল। রানার অবশ্য একটু অসুবিধে হলো–কাঁধ বেশ চওড়া ওর, গর্তে আরেকটু হলে আটকে যেত। কোনাকুনিভাবে শরীরটা রেখে বানমাছের মত পিছলে এলিভেটর শাফটে উঠে এল ও সবার শেষে।

নিচতলার অ্যাকসেস ডোরের পাল্লায় কান পেতে রেখেছে টিনা। ফিসফিসিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করল রানা, কিছু শুনতে পাচ্ছ?

মাথা নাড়ল তরুণী। একটু আগে বুটের শব্দ পেয়েছিলাম, দরজার ওপাশ দিয়ে হেঁটে গেছে একজন গার্ড, তবে এখন সব চুপ।

হাঁটার ভঙ্গিতে কোনও অস্থিরতা ছিল?

মনে তো হলো না।

গুড। তা হলে চলো, উপরে রওনা দিই।

কীভাবে? আবার দড়ি-টুড়ি বাইতে হবে না তো?

টর্চের আলোটা শাফটের দেয়ালের উপর ঘুরিয়ে আনল রানা-দু’পাশে দুই সারি ল্যাডার দেখা গেল, মেইন্টেন্যান্সের জন্য তৈরি করা হয়েছে। দড়ি বাইতে হবে না, এগুলো ব্যবহার করব, আলো নেড়ে দেখাল ও। এসো।

দশতলার অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছুতে দেয়াল বেয়ে প্রায় একশো ফুট উঠতে হবে ওদের, কাজটা ছোটখাট একটা পাহাড় চড়ার মত। তাই ঠিক করা হলো, সবার সামনে রানা থাকবে। শারীরিকভাবে সবচেয়ে ফিট ও, তা ছাড়া ক্লাইম্বিঙে অভিজ্ঞ, কোমরে সেফটি লাইন বেঁধে টিনা আর রায়হানকে সাপোর্ট দেবে। ওর পিছনেই থাকবে কম্পিউটার-বিশেষজ্ঞ জুটি। দু’জনের বেল্টেই মুখখোলা একটা করে ট্যালকম পাউডারের ছোট্ট থলে বেঁধে দিল ও। কিছুক্ষণ পর পর হাত ডোবাবে এতে, বলে দিল রানা। তালু ঘেমে গেলে কিন্তু ল্যাডার থেকে মুঠি ফসকে যেতে পারে।

সতর্কতামূলক আরও দুএকটা উপদেশ দিল ও, তারপর উঠতে শুরু করল দেয়াল বেয়ে।

তিনতলা পর্যন্তও পৌঁছুতে পারল না, তার আগেই কাতরে উঠল টিনা, হাতের পেশি টনটন করছে বেচারির। রায়হান অবশ্য বিসিআইয়ের ট্রেইনিঙের বদৌলতে অনেক ফিট, তারপরও পাঁচতলায় গিয়ে ওরও অবস্থা কাহিল হয়ে গেল।

মাসুদ ভাই, থামুন একটু।

মি. রানা, আর পারছি না আমি!

দুই সঙ্গীর আবেদনে একদমই কান দিল না রানা, নির্দয়ের মত উঠে চলল উপরদিকে–সেফটি লাইনে টান দিয়ে ওদেরকে চলতে বাধ্য করছে। থামা যাবে

এক মুহূর্তের জন্য, থামলে টিনা আর রায়হানের পেশি বিদ্রোহ করে বসবে, পরে আর চলতেই পারবে না ওরা।

পরিশ্রমে দরদর করে ঘামছে রানা, হাত ছুটে যেতে চাইছে বারে বারে। পাউডার মাখলেও তা টিকছে না বেশিক্ষণ। ক্লাইম্বিঙের হিসেবে একশো ফুট ওর জন্যে কোনও ব্যাপারই হবার কথা নয়, কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। পাহাড় চড়ার সময় মাঝে মাঝে চাতাল খুঁজে বিশ্রাম নেয়া যায়, এমনকী ঝুলন্ত অবস্থায় থেমে পড়লেও অসুবিধে হয় না ওর। কিন্তু এখন দুই সঙ্গীকে সচল রাখার স্বার্থে একটুও বিশ্রাম নিতে পারছে না, তার উপর টিনা নিজের শরীরের প্রায় পুরো ভর-ই চাপিয়ে দিয়েছে সেফটি লাইনে, চলতেই পারছে না বলতে গেলে বেচারি, তাকে অনেকটা টেনেই তুলতে হচ্ছে। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মত রয়েছে। ভারি ব্যাকপ্যাকটা-রায়হানের কষ্ট হবে ভেবে ওটা নিজের পিঠে ঝুলিয়েছে রানা। বাড়তি বোঝার কারণে ল্যাডারের ধাতব সরু ধাপগুলো তালুর মাংস কেটে বসে যেতে চাইছে। টিনা এখন আর কথা বলার মত অবস্থায় নেই, রায়হানও ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ফেলছে।

আটতলায় পৌঁছুতেই চোখে অন্ধকার দেখার মত অবস্থা হলো রানার। জ্যাকেটের কাঁধে আটকানো টর্চের আলোয় আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে কেইবল কারের তলা–এখনও অনেক দূরে ওটা। কাঁধ আর বাইসেপের পেশি টন টন করছে ওর, মনে হচ্ছে চাপ আর সইতে পারবে না ওগুলো। দুনিয়া জাহান্নামে যাক, আগে থেমে একটু বিশ্রাম করে নিই–এমন একটা চিন্তা জেঁকে বসতে চাইছিল, কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়াল কর্তব্যবোধ। তাড়াতাড়ি মাথা ঝাঁকিয়ে ভাবনাটা দূর করল ও। দাঁতে দাঁত পিষে একের পর এক ধাপ পেরোতে থাকল, মাথাটা একেবারে শূন্য করে দিয়েছে, কিছুই ভাবছে না আর, শুধু উপরে পৌঁছুতে চাইছে।

যেন অনন্তকাল পর কেইবল কারের কাছে পৌঁছুল ওরা, পাশের গ্যাপটা গলে উঠে গেল আরও উপরে, ওটার ছাদে। রায়হান আর টিনাকে টেনে তুলল। রানা, তারপর ওদের পাশে নিজেও শুয়ে পড়ল। সারা শরীর থর থর করে কাঁপছে ওর, হাপরের মত ওঠানামা করছে বুক।

থ্যাঙ্ক ইউ, মি. রানা, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল টিনা। আপনি না থাকলে আর উঠতে হতো না আমাকে, নীচে পড়ে হাড়গোড় ভাঙতাম।

ধন্যবাদ না জানিয়ে বরং মিস্টার বলা ছাড়ো, কপট রাগের সুরে বলল রানা। ওটা শুনলে নিজেকে কেমন পর-পর মনে হয়।

কী ডাকব তা হলে?

কেন, রায়হানের মত মাসুদ ভাই বলতে পারো না? তোমার মত জিনিয়াস একটা ছোট বোন পেলে কত খুশি হবো আমি, জানো?

হাঁপানোর মাঝেও হেসে ফেলল টিনা। ঠিক আছে, মাসুদ ভাই। অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।

ধাতস্থ হতে বেশ কিছুক্ষণ নিল ওরা। হাত-পায়ে সাড়া ফিরে আসতেই ঝট করে উঠে বসল রানা। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, আধঘণ্টা পেরিয়ে গেছে শাফটে ঢোকার পর।

গেট আপ, সঙ্গীদের বলল ও। ব্রেকটাইম শেষ হয়ে গেছে।

তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল রায়হান আর টিনা। ছাদের অ্যাকসেস প্যানেল খুলে কেইবন্ কারের ভিতরে নেমে এল তিনজনে। ব্যাকপ্যাক থেকে দুটো লোহার পাত বের করল রানা আর রায়হান, সেগুলো দিয়ে চাড় দিতেই খুলে গেল এলিভেটর ডোর, অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে পড়ল ওরা।

ওপাশটা অন্ধকার, আলো নেই কোনও। টর্চটা টিনার হাতে দিয়ে রানা বলল, পথ দেখাও।

মাথা ঝাঁকিয়ে হাঁটতে শুরু করল তরুণী ইউনো, অ্যাপার্টমেন্টের সিটিংরুম পেরিয়ে একটা বন্ধ দরজার সামনে নিয়ে গেল দুই সঙ্গীকে। নব ঘুরিয়ে খোলা গেল না দরজাটা।

ওপাশেই এলিসার অফিস, ফিসফিস করে জানাল টিনা। কিন্তু দরজাটা তালা দেয়া।

ইলেকট্রনিক লক?

না। চাবি দিয়ে খুলতে হয়।

সরো, বলল রানা। এটা তা হলে আমার ডিপার্টমেন্ট।

ব্যাকপ্যাক থেকে একটা কিট বের করল ও, হাঁটু গেড়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল চাবির ছিদ্রটা নিয়ে, টিনাকে বলল আলোটা ধরে রাখতে। মিনিটখানেকের মধ্যেই ক্লিক করে একটা শব্দ হলো–তালা খুলে গেছে। নবে মোচড় দিয়ে পাল্লাটা খুলে ফেলল ও, টিনাকে সামনে পাঠিয়ে পিছু পিছু ঢুকল রায়হানকে নিয়ে।

টর্চের আলোটা খুব বেশি শক্তিশালী নয়, তারপরও রুমটার আকৃতি বুঝতে অসুবিধে হলো না। বিশাল ওটা, অন্তত চলিশ ফুট বাই ত্রিশ ফুট। হঠাৎ দেখায়। হলঘর বলে মনে হয়। আসলে ডিজাইন করা হয়েছে পুরনো আমলের রাজা-বাদশাদের দরবারের মত করে। ওয়েইটিং রুম থেকে দরজা ঠেলে ঢোকার পর অনেকটা জায়গা হেঁটে আসতে হয় কামরাটার অন্যপ্রান্তে, ওখানে দেড় ফুট উঁচু একটা মঞ্চের মত করে তার উপর বসানো হয়েছে এলিসার বিশাল ডেস্ক-টেবিল। নিজেকে সম্ভবত সম্রাজ্ঞী ভাবে কুচক্রী ইউনো, ডেস্কের মুখোমুখি চেয়ারে যতক্ষণ না বসতে বলা হচ্ছে, ততক্ষণ নীচে প্রাচীন আমলের প্রজার মত দাঁড়িয়ে থাকতে হবে অতিথিকে।, ডেস্কটার উপরেই এক কোণে দেখা যাচ্ছে কম্পিউটারটা, সিপিইউ-টা নীচে। ঘুরে ওটার সামনে চলে গেল তিন অনুপ্রবেশকারী, কয়েক মুহূর্তের জন্য থেমে দাঁড়াল। এখনও ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না যে, গন্তব্যে পৌঁছে গেছে… কঠিন যে-দায়িত্বটা নিয়ে গত কয়েকদিন পাগলের মত ছোটাছুটি করছে, সেটা। সম্পাদনের দ্বারপ্রান্তে এসে গেছে ওরা।

রুদ্ধশ্বাসে রায়হান বলল, এখানে আছে তো অ্যান্টিভাইরাসটা?

দোয়া করো যাতে থাকে, রানা বলল। এটাই আমাদের শেষ ভরসা।

এখুনি জানা যাবে, বলে পাওয়ার-সুইচ অন করল টিনা। ধীরে ধীরে আলোকিত হয়ে উঠল মনিটর, বুট করে একটা স্ক্রিনে এসে. স্থির হলো–পাসওয়ার্ড চাইছে।

চেয়ার টেনে বসে কম্পিউটারের সামনে বসে পড়ল তরুণী ইউনো, হাত রাখল কীবোর্ডে। সিকিউরিটি সিস্টেমটা ইউনোকোডে তৈরি হলেও সেটা ওর জন্য কোনও সমস্যা নয়। কয়েক মিনিটের মধ্যেই এনক্রিপশন ভেঙে পাসওয়ার্ডটা দূর করে ফেলল ও, ঢুকে পড়ল হার্ড ডিস্কে। অ্যান্টিভাইরাস। প্রোগ্রামটার খোঁজে একটা সার্চও শুরু করে দিল।

মিনিটখানৈক চলল সার্চ, তারপরই স্ক্রিনের সার্চ উইণ্ডোতে একটা ফাইল উদয় হতে দেখা গেল। সেটা ওপেন করে কী যেন দেখল টিনা কয়েক মুহূর্ত, তারপর উইণ্ডোটা ক্লোজ করে দিয়ে রায়হানের দিকে ফিরল। বলল, সিডি দাও।

মন্ত্রমুগ্ধের মত ওর কাজ দেখছিল রানা আর রায়হান, কথাটা কানে গেলেও অর্থটা অনুধাবন করতে পারল না। তরুণ হ্যাকার শুধু শব্দ করল, অ্যাঁ?

সিডি দাও, প্রোগ্রামটা তুলে নিতে হবে ওটায়।

এখান থেকেই ডিস্ট্রিবিউট করে দেয়া যায় না?

উঁহুঁ, একটা সমস্যা চোখে পড়েছে। ওটা দূর করে নিতে হবে। বাড়িয়ো না, সিডি দাও।

রানার হাত থেকে ব্যাকপ্যাকটা নিয়ে একটা ব্যাঙ্ক সিডি বের করল রায়হান, তুলে দিল সঙ্গিনীর হাতে। ওটা সিপিইউ-র সিডি রাইটার ড্রাইভে ঢোকাল টিনা, কীবোর্ডের বাটন চেপে কমাণ্ড দিল অ্যান্টিভাইরাসটা ডিস্কে কপি করতে। মাত্র দুমিনিট লাগল জিনিসটা সিডিতে তুলে নিতে, তারপরই ড্রাইভ থেকে ওটা বের করে বক্সে ভরল টিনা, উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চলো, যাওয়া যাক।

কোথাও যাবে না তোমরা!

গমগম করে উঠল কামরাটা বাজখাই গলার স্বরে, একই সঙ্গে জ্বলে উঠল সবগুলো বাতি। চমকে উঠে মুখ তুলতেই বজ্রাহতের মত স্থির হয়ে গেল তিন অনুপ্রবেশকারী। ওয়েইটিং রুমের দরজা খুলে গেছে, সেখান দিয়ে উদ্যত সাবমেশিনগান হাতে ভিতরে ঢুকেছে আলফা টিমের প্রথম দুই সদস্য। অ্যাপার্টমেন্টে যাবার দরজাটাও খুলে গেল এই সময়, সেখান দিয়ে এসে ঢুকল আলফা-থ্রি–এরা সবাই আশপাশে ঘাপটি মেরে ছিল।

সবশেষে বিজয়ীর ভঙ্গিতে অফিসে ঢুকল ডগলাস বুলক। গটমট করে সামনে এগিয়ে এল। মুখে অনাবিল হাসি ফুটিয়ে বলল, পৃথিবীটা বড় ছোট জায়গা! আবার দেখা হয়ে গেল আমাদের, মি. রানা। কী মজার ব্যাপার, তাই না?

.

১৬.

বিপদের প্রতিটা বুঝতে এক মুহূর্তও লাগল না রানার–পৃথিবীকে বাঁচানো-টাচানো তো অনেক পরের কথা, ওদের নিজেদেরই সময় ফুরিয়ে এসেছে। ওদেরকে প্রলোভন দেখিয়েছে বুলডগ ক্রিয়েলটেকের হেডকোয়ার্টারে। আসবার জন্য; আর ফাঁদটায় ঠিকই পা দিয়ে বসেছে ওরা। লোকটার হাসি দেখে। বিভ্রান্ত হবার কিছু নেই, অসহায়ভাবে খুন হতে হবে ওদেরকে। যা করার এক্ষুণি করতে হবে, নইলে বাঁচার কোনও সম্ভাবনা নেই।

সেকেণ্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে একটা প্ল্যান এসে গেল ওর মাথায়, ঠিক সচেতনভাবে নয়, ইন্সটিঙ্কট-ই বলে দিল কী করতে হবে। ঝট করে উবু হয়ে। গেল ও, হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে ফ্লোরে রাখা ব্যাকপ্যাক-টার মধ্যে–ডেস্কের আড়ালে রয়েছে ওটা, শত্রুপক্ষের দৃষ্টিসীমার বাইরে।

খবরদার, মাসুদ রানা! হুঙ্কার দিয়ে উঠল বুলডগ, কপট হাসিটা উধাও হয়ে গেছে মুখ থেকে। কোনও চালাকি করতে যাবেন না! সোজা হয়ে দাঁড়ান, বলছি।

এবার রানার মুখে হাসি ফুটল। ধীরে ধীরে সোজা হলো ও, এক হাতে ধরে রেখেছে ব্যাকপ্যাকটা। বলল, চালাকি করলাম কোথায়? আমি তো এটা তুলতে যাচ্ছিলাম।

বোকা পেয়েছেন আমাকে? সরোষে বলল বুলডগ। ভেবেছেন আপনার ধোঁকাবাজি কিছুই বুঝি না আমি?

বোকা হতে যাবেন কেন? রানা বলল। বোকা হলে কি আর আমাকে এভাবে ফাঁদ পেতে ধরতে পারতেন? মাঝে মাঝে শুধু ভাগ্যটা আপনার সঙ্গে বেঈমানী করে, এই যা!

শোল্ডার হোলস্টার থেকে একটা পিস্তল বের করে ভয় দেখানোর ভঙ্গিতে নাড়ল বুলডগ। হেঁদো কথা বাদ দিয়ে ব্যাগটা টেবিলের উপর নামিয়ে রাখুন, তারপর সরে আসুন ওখান থেকে।

এত কাঠখোট্টাভাবে না বললেও হয়, হাসিটা ধরে রাখল রানা। মিষ্টি কথার ভক্ত আমরা, ভদ্রভাবে অনুরোধ করলে জানটাও দিয়ে দিতে পারি।

তা হলে দয়া করে ডেস্কের পিছন থেকে বেরিয়ে এসে বাধিত করুন, বিদ্রূপ করল বুলডগ।

যথাজ্ঞা! বলে উঁচু জায়গাটা থেকে নেমে এল রানা, দাঁড়াল গিয়ে ওর একেবারে কাছাকাছি, দেখাদেখি টিনা আর রায়হানও-ওদের দু’জনের মুখই দুশ্চিন্তায় শুকিয়ে গেছে। রানা হঠাৎ ঠাট্টা-মশকরায় মেতে উঠল কেন, সেটাও বুঝতে পারছে না কেউই।

হাতদুটো উপরে তুলে ফেলুন, মি. রানা, বলল বুলডগ। ও-দুটোকে বড্ড ভয় পাই আমি, কখন কী করে বসে!

শিয়োর, বলে হ্যাঁণ্ডস আপ ভঙ্গিতে দাঁড়াল রানা।

টিনা আর রায়হানকেও একই ভাবে দাঁড়াতে ইশারা করল বুলডগ, তারপর তাকাল আলফা-থ্রির দিকে। ব্যাগটা চেক করে দেখো। রানা এমনি এমনি ওটা নিয়ে ব্যস্ত হয়েছিল বলে মনে হয় না। আমরা অস্ত্র তাক করে আছি, তারপরও ওটা তুলতে পাগল হয়ে গেল… ব্যাগটার প্রতি এত আকর্ষণের পিছনে নিশ্চয়ই গূঢ় কোনও কারণ আছে।

ঠিকই ধরেছেন, বলল রানা, কৌতুক করছে এখনও। খুব শখ করে কিনেছিলাম ব্যাগটা, মরার সময় জড়িয়ে ধরে মরতে চাই।

তাই নাকি? ব্যঙ্গ ঝরল বুলগের কণ্ঠে। তাহলে তো খুব চিন্তার কথা। মরার সময় মাসুদ রানা যে-জিনিস জড়িয়ে ধরে রাখবে, সেটা তো যে-সে বস্তু হবার কথা নয়। টেবিলের দিকে এগোতে থাকা আলফা-থ্রিকে ডাকল সে।

মেলভিন, ব্যাগটা সাবধানে নাড়াচাড়া কোরো। ওটায় সম্ভবত বুবি ট্র্যাপ আছে।

কী যে বলেন না! রানা হাসল। প্রিয় জিনিসে বুবি ট্র্যাপ বসাতে যাব কেন?

চুপ! আর একটা কথাও না! দাঁত খিচাল বুলডগ। আলফা-ওয়ান আর টুকে ইশারা করল বন্দিদের দেহ তল্লাশি করতে।

একপাশের দেয়াল ঘেঁষে হাত-পা ছড়িয়ে দাঁড় করানো হলো রানাদের, তারপর দক্ষ হাতে সার্চ শুরু করল কার্টার ওরফে আলফা-টু। ওদের দিকে পিছন ফিরে রয়েছে বন্দিরা, তার পরেও নিশ্চিন্ত হতে পারছে না, রানা ও রায়হানের দিকে অস্ত্র তাক করে রেখেছে বুলডগ আর থিও। প্রথমেই রানা ও রায়হানের। শরীর তল্লাশি করল আলফা-টু। হোলস্টারের পিস্তল, আস্তিনের ভাঁজে লুকানো ছুরি, বেল্ট-বাকলের ভিতর থেকে স্টীলের ওয়ায়্যার–সবকিছুই নিয়ে নিল সে; এমনকী হাতের ঘড়ি, পকেটে রাখা ওয়ালেট… কিছু বাদ দিল না। রায়হানকে অ্যান্টিভাইরাসের সিডিটা দিয়েছিল তরুণী ইউনো, ওটাও নিয়ে নেয়া হলো।

দুই বিসিআই এজেন্টের পর এবার টিনার পালা। বিশ্রী হাসি হেসে ওর দিকে এগোল আলফা-টু, পিছনে গিয়ে বলল, কী হে সুন্দরী, তোমার কোথায় কী লুকিয়ে রেখেছ?

জবাব দিল না টিনা। বন্দিনীকে তল্লাশি করতে করতে মুখের কুৎসিত হাসিটা আরও বিস্তৃত হলো আলফা-টুর, নিরস্ত্র মেয়েটাকে বাগে পেয়ে হাত দিচ্ছে এখানে-সেখানে। পা থেকে সার্চ শুরু করল সে, টিনার নিতম্ব আর উরুসন্ধিতে সময় নষ্ট করে যখন বুকে এসে পৌঁছুল, তখন শরীরে রীতিমত শিহরণ বইছে বদমাশটার। পিছন থেকে স্তনদুটো আঁকড়ে ধরল সে, মুখ দিয়ে জান্তব আওয়াজ করছে।

হাত সরাও! শীতল গলায় বলে উঠল রায়হান, ব্যাপারটা লক্ষ করে ভয়ঙ্কর ক্রোধে শরীর কাঁপছে ওর। নইলে এই মুহূর্তে তোমাকে খুন করব আমি!

যেন সংবিৎ ফিরে পেয়েছে, এমনভাবে টিনাকে ছেড়ে পিছিয়ে গেল আলফা-টু। পরমুহূর্তেই হেসে উঠল গলা ছেড়ে। বুলডগের দিকে তাকিয়ে বলল, শুনছেন, ব্যাটা কী বলে? ও নাকি আমাকে খুন করবে!

দেয়ালের দিক থেকে ঘুরে দাঁড়াল রায়হান। প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে বলল, সত্যিই তোমাকে খুন করব আমি, শুধু আরেকবার ওর গায়ে হাত দিয়ে দেখো।

ওমা, তাই নাকি? বিদ্রূপ করল আলফা-টু। তা হলে তো এখুনি মাগীটাকে ন্যাংটো করে সার্চ করা দরকার।

চেষ্টা করেই দেখো! বলল রানা। ঘুরে দাঁড়িয়েছে ও-ও, চোখ দিয়ে আগুন ঝরছে। মরলে মরবে, কিন্তু চোখের সামনে ছোট বোনের সম্মানহানি হতে দেবে না।

আমাকে চ্যালেঞ্জ করছ? খেপাটে গলায় বলল আলফা-টু। এখুনি টের পাবে ফলটা। আমার হাতেই মরবে তোমরা। হাতের সাবমেশিনগানটা তুলল সে।

থামো! ধমক দিয়ে উঠল থিও। পাগলামি কোরো না, কার্টার!

ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে দলনেতার দিকে ফিরল আলফা-টু। কীসের থামাথামি? এই দুই কুত্তার বাচ্চা কি কম ভুগিয়েছে আমাদের মণ্টেগো আইস শেলফে? ওদেরকে খুন করার জন্য সেদিন থেকেই হাত নিশপিশ করছে আমার।

সেজন্য যথাসময়ে সুযোগ দেয়া হবে তোমাকে, শান্ত গলায় বলল থিও। গুলি করে মেরে পুলিশি ঝামেলায় জড়ানো ঠিক হবে না। ওদের মৃত্যুটা হবে আর সব ইউনোদের মত–দুর্ঘটনার আদলে। শরীরে বুলেটের আঘাত থাকলে সব কেঁচে যাবে না?

যুক্তিটা বুঝতে পেরে নিজেকে সামলাল অভিজ্ঞ খুনী। বন্দিদের দিকে তাকিয়ে বলল, আয়ু একটু বাড়ল তোমাদের। তবে জেনে রাখো, মরণটা আমার হাতেই হবে–শুধু একটু দেরিতে, এ-ই আর কী।

তুমিও আমার হাতেই মরবে, রাগী গলায় বলল রায়হান–টিনার সঙ্গে বদমাশটা যা করেছে, তার পর কিছুতেই নিজেকে শান্ত রাখতে পারছে না। হাসিখুশি স্বভাবের তরুণ হ্যাকার।

কীভাবে? সকৌতুকে বলল আলফা-টু। আবারও তাক লাগানো কোনও খেলা দেখাবে ভাবছ নাকি? পারলে দেখাও না! আমি জানতে চাই, এই রকম একটা পরিস্থিতিতে কারও কিছু করার থাকে কি না। কে জানে, কোনও একদিন আমি নিজেও তো এমন অবস্থায় পড়তে পারি।, দরজায় শব্দ হলো এ-সময়, সবার মনোযোগ টুটে গেল, এই সুযোগে ফিসফিস করে রায়হানকে রানা বলল, তৈরি থাকো, ব্যাটাদের খায়েশ পূর্ণ হবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। একটাই সুযোগ পাব পালানোর, এদেরকে আমি সামলাব,

তুমি টিনাকে সঙ্গে রেখো। বাংলায় বলল কথাটা, শত্রুরা শুনলেও যাতে বুঝতে না পারে।

এলিসা ভ্যান ব্যুরেনকে দেখা যাচ্ছে দরজায়, উঁকি দিচ্ছেন। বললেন, সবকিছু নিয়ন্ত্রণে তো? আমি আসতে পারি এবার?

আসুন, আসুন, বলল বুলডগ। এখন আর কোনও ভয় নেই। বন্দিদের নিরস্ত্র করা হয়েছে।

ব্যাকপ্যাকটা চেক করাও শেষ হয়েছে আলফা-থ্রির। বলল, কিছু নেই এখানে। টেবিলের উপর স্তূপ করে রাখা দড়ি, নানা রকম কিট, আর অন্যান্য জিনিসপত্র দেখাচ্ছে সে, টিনার ল্যাপটপ কম্পিউটারটাও আছে ওর মধ্যে।

খামোকাই ভয় পাচ্ছিলেন আপনি, মি. বুলক।

ভুরু কুঁচকে রানার দিকে তাকিয়ে রইল বুলডগ। আপনি দেখি আমাকে। হতাশ করে দিচ্ছেন, মি. রানা। চমক দেখানোর জন্য কিছুই বুঝি নেই আর। আপনার হাতে?

থাকলে তো দেখতেই পেতেন, কাঁধ ঝাঁকাল রানা।

তাই বলে কোনও রকম ব্যাকআপ প্ল্যান ছাড়া বাঘের গুহায় পা রেখেছেন, এটা তো বিশ্বাস করতে পারছি না।

প্ল্যান-ট্রান সব গোল্লায় গেছে। ভাল কথা, আপনারা এসেছেন কখন। এখানে? আমার লোক দেখতে পায়নি কেন?

হেসে উঠল বুলডগ। আপনার মাথা কীভাবে কাজ করে, তা এতদিনে বুঝে গেছি আমি। বিল্ডিঙের বাইরে যে ওয়াচার রাখবেন, সেটা আন্দাজ করতে পেরেছি। সেজন্যে হেলিকপ্টারে এসেছি আমরা, ছাদের হেলিপ্যাডে এসে নেমেছি।

হুম, এবার তা হলে সত্যিই টেক্কা দিয়েছেন আমাকে, প্রশংসার সুরে বলল রানা।

প্রশংসায় খুশি হলো বুলডগ। বলল, ঠিক এই কথাটাই আপনার মুখ থেকে শুনতে উন্মুখ হয়ে ছিলাম আমি।

এলিসা এসে দাঁড়িয়েছেন বুলডগের পাশে, গা-জ্বালানো সুরে বললেন, অত দূরে দাঁড়িয়ে রইলে কেন, ইভা? এসো, কাছে এসো–শেষবারের মত দেখে প্রাণটা জুড়িয়ে নিই।

দ্বিধা করল টিনা, কিন্তু অস্ত্র নেড়ে নির্দেশটা পালন করতে ইশারা করল। আলফা-ওয়ান। মেয়েটা নড়ছে না দেখে হাত ধরে ওকে নিয়ে এগোতে শুরু করল রানা, রায়হান অনুসরণ করল ওদেরকে। শত্রুদের ডানে গিয়ে থামল রানা, ঘুরে এমনভাবে দাঁড়াল যাতে ওদের মুখোমুখি হতে গেলে ডেস্কটার দিকে পিঠ থাকে মানুষগুলোর। নিজের সুবিধেমত একটা পজিশনে প্রতিপক্ষকে দাঁড় করাতে চাইছে ও, ঘটলও তা-ই।

ঘুরে বন্দিদের মুখোমুখি হলো এলিসা ভ্যান ব্যুরেন, বুলডগ, থিও আর কার্টার। আলফা-থ্রি, মানে মেলভিনও এসে যোগ দিল তাদের সঙ্গে। সবার অস্ত্র তাক করা আছে সামনের দিকে। মুচকি হেসে ধুরন্ধর বিজ্ঞানী টিনাকে বললেন, ছোট্ট ক্রিস্টিনা ওয়ালডেন… কত্তো বড় হয়ে গেছ তুমি!

চমকে উঠল টিনা। আ… আপনি আমাকে চেনেন?

আগে চিনতাম না, এখন চিনে ফেলেছি। ভেবে দেখলাম, টিজিভিটাকে যেভাবে বাঁচানো হয়েছে, তা রানা বা রায়হানের পক্ষে সম্ভব নয়। বাকি রইলে। তুমি, তাই মি, বুলককে বলেছিলাম তোমার ব্যাপারে একটু খোঁজখবর নিতে। তোমার নাম বদলানোর রেকর্ডটা খুঁজে বের করতে একটুও সময় নেননি তিনি। ভালই খেল দেখিয়েছ, বাছা। মরার আগে মাত্র সাত বছর বয়েসী একটা বাচ্চাকে ইউনোকোড শিখিয়ে দিয়ে যাবে মাইকেল আর ডেবি–এটা কে-ই বা কল্পনা করতে পারবে?

কেউ শেখায়নি আমাকে, রাগী গলায় বলল টিনা। আমিই ওটা আবিষ্কার করেছি।

তা-ই নাকি? ভুরু কোঁচকালেন প্রতিভাবান ইউনো, টিনার কথার অর্থ ধরতে পারলেন পরমুহূর্তেই। ও মাই গড! তুমি চাইল্ড-প্রডিজি ছিলে! কী আশ্চর্য, মাইকেল আর ডেবি তো কোনওদিন বলেনি আমাদের।

বলবে কী করে? তার আগেই তো ওঁদের খুন করেছেন আপনি।

ছি ছি, এভাবে বলছ কেন? ওরা তো নিজেরাই নিজেদের মরণ ডেকে এনেছিল। আমার সঙ্গে হাত মেলাবার প্রস্তাব দিয়েছিলাম ওদের, ইউনোকোডের আবিষ্কর্তারা দলে থাকলে সুবিধে হবে ভেবেছিলাম, কিন্তু আদর্শের বুলি কপচাতে থাকল বোকাদুটো। আমার প্ল্যান সবার কাছে ফাঁস করে দেবে বলে হুমকি দিল। তা কি হতে দেয়া যায়? কত কষ্ট করে ইউনোকোডের মত একটা অব্যর্থ অস্ত্রের সন্ধান পেয়েছি আমি, এমন একটা জিনিসের আশাতেই তো কুর্ট মাসডেনের প্রেমিকা হয়ে নীরস পণ্ডিতের দলে যোগ দিয়েছিলাম। দিনের পর দিন বোরিং মানুষলোকে, সহ্য করেছি একটাই কথা ভেবে–কোনও একদিন বিশাল একটা কিছু আবিষ্কার করবে এই জিনিয়াসেরা, আর আমি সেটার ফায়দা লুটব। আদর্শের বুলি কপচে কেউ আমার মুখের গ্রাস কেড়ে নেবে, তা আমি মেনে নেব কেন?

সেজন্যে নিরীহ দু’জন মানুষকে খুন করবেন?

আমি খুন করতে যাব কেন? আমি কি খুনী? যদি তা-ই হতাম, তা হলে। তো আজ তোমাদের তিনজনকেই শেষ করে দিতে পারতাম–প্লেন-ক্র্যাশের পর অজ্ঞান ছিলে, আমাকে বাধা দিতে কীভাবে? কিন্তু কপাল ভাল তোমাদের, রক্ত-টক্ত একেবারেই সহ্য করতে পারি না আমি। তাই খুন করে অন্যেরা, মাই ডিয়ার ক্রিস্টিনা, আমি স্রেফ হুকুম দিই।

কে খুন করেছে আমার বাবা-মাকে? ফুঁসে উঠে জিজ্ঞেস করল টিনা।

আপনার ভাই?

না, না, তখনও খুনোখুনির বয়স হয়নি ওর। কাজটা আমি গারফিল্ড নামে আরেকজনকে দিয়েছিলাম–আজ দুপুরে ওর হাতে মরতে পারতে তুমিও, যদি মি. রানা ওকে বাঁচতে দিতেন আর কী! ওঁকে ধন্যবাদ দেয়া দরকার, কারণ। গর্দভটা আরেকটু হলে আমাকেও শেষ করে দিতে যাচ্ছিল।

ধন্যবাদ-টা দেবেন না দয়া করে, কপট সুরে অনুরোধ করল রানা। আপনার ওই গর্দভটাকে ব্যর্থ করে দিলাম কেন, এই দুঃখে মরে যাচ্ছি আমি।

জোরে হেসে উঠলেন এলিসা। আপনি দারুণ রসিক লোক, মি. রানা। সত্যি, আপনাকে খুব মিস করব আমি।

একটা প্রশ্নের জবাব দেবেন, ড. বুরেন? রায়হান বলে উঠল।

নিশ্চয়ই, হাসি থামালেন এলিসা। মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের শেষ অনুরোধ তো রক্ষা করতেই হয়।

কেন আপনি এ-কাজ করছেন? জানতে চাইল রায়হান। আপনি একজন ইউনো–আপনাদের ঈশ্বর বলে ভাবি আমরা… কম্পিউটার জগতের সবাই। আর কেউ হলে মেনে নেয়া যেত, কিন্তু আপনি কেন দুনিয়ার সমস্ত কম্পিউটার

ধ্বংস করে দিতে চাইছেন? এতে লাভ কী আপনার?

লাভ-ক্ষতির প্রশ্ন আসছে কেন? বাঁকা সুরে বললেন এলিসা। কারণ ছাড়া ঈশ্বর তো মাঝে মাঝে পৃথিবীতে গজব নাজেল করেনই–এটাও তেমন একটা কিছু ভেবে নিন না!

মিথ্যে বলছেন আপনি, কাটা কাটা স্বরে বলল টিনা। ঐশ্বরিক ক্ষমতা দেখাতে নয়, আপনি ভাইরাস ছেড়েছেন দুনিয়াটাকে হাতের মুঠোয় নেবার জন্য।

মানে! রায়হান ভুরু কোঁচকাল।

অ্যান্টিভাইরাসটায় সমস্যা আছে, বলেছিলাম না? কী ওটা, জানো? ওটায় একটা ব্যাকডোর রাখা হয়েছে। এই অ্যান্টিভাইরাস যে-ই ব্যবহার করবে, তার কম্পিউটারের সমস্ত তথ্য অটোমেটিক্যালি এসে জমা হতে থাকবে। ক্রিয়েলটেকের সার্ভারে।

তো?

ইউনো-ভাইরাসের আতঙ্ক থেকে বাঁচার জন্য পৃথিবীর সমস্ত দেশ ব্যবহার করবে ওটা-ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি থেকে শুরু করে প্রতিরক্ষা পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে। আর তাদের সমস্ত গোপন তথ্য স্রেফ ঘরে বসে পেয়ে যাবে এই মেয়েলোক। রাগী গলায় বলল টিনা। একজনের কাছে আরেকজনের তথ্য বিক্রি করতে পারবে, চাইলে অর্থনীতিকে ধসিয়ে দিতে পারবে, এমনকী যে-কোনও দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকেও ধ্বংস করবার চাবিকাঠি এসে যাবে ওর হাতে। পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাশালী মানুষ হয়ে যাবে ও।

কিন্তু… কিন্তু ভাইরাসটা তো আগেই কেয়ামত ঘটিয়ে ফেলবে, তথ্য চুরির জন্য কোনও কম্পিউটারই তো অবশিষ্ট থাকবে না!

থাকবে, মি. রশিদ, থাকবে। হাসলেন এলিসা। আমার ভাইরাস কম্পিউটারের সমস্ত যন্ত্রাংশ ধ্বংস করে ঠিকই–কিন্তু হার্ড ডিস্কে রক্ষিত ডেটা। নষ্ট করে না, শুধু ইউনোকোডে এনক্রিপ্ট করে ফেলে। পুরনো সমস্ত তথ্য ফেরত পাওয়া সম্ভব, কিন্তু সেজন্যে আমার অ্যান্টিভাইরাসটা ব্যবহার করতে হবে। বুঝতেই পারছেন, পৃথিবীর কম্পিউটার-ব্যবস্থাকে অচল করে দিচ্ছি না আমি, শুধু দুএকদিনের জন্য সামান্য একটা ক্রাইসিস তৈরি করে আমার অ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যারটা সবখানে ঢোকানোর ব্যবস্থা করছি। এক অর্থে এটাকে একটা মার্কেটিং ক্যাম্পেইন বলতে পারেন।

সামান্য ক্রাইসিস! রায়হান চোখ কপালে তুলল। দুনিয়ার সব কম্পিউটার রিপ্লেস করতে হবে আপনার এ-কাজের ফলে। সফটওয়্যার আর হার্ডওয়্যার কিনতে বিলিয়ন-বিলিয়ন ডলার খরচ হয়ে যাবে–এটা সামান্য মনে হচ্ছে। আপনার কাছে? ফর গডস্ সেক, ডক্টর, এখনও সময় আছে, থামান ভাইরাসটাকে।

এসব বলে লাভ নেই, রায়হান, শান্ত গলায় বলল রানা। ন্যায়-অন্যায়বোধ সব হারিয়ে গেছে ওঁর মধ্য থেকে। থাকবেই বা কীভাবে, ওই বিলিয়ন-বিলিয়ন ডলারের বেশিরভাগটাই ওঁর পকেটে আসবে কি না!

টাকাটা স্রেফ উপরি পাওনা, প্রতিক্রিয়াহীনভাবে বললেন এলিসা। আমি চাই ক্ষমতা… অঢেল ক্ষমতা। সেজন্যেই দুনিয়ার সমস্ত গোপন তথ্য আমার হাতের মুঠোয় আনতে চাই। আফটার অল, নলেজ ইজ পাওয়ার–এটা জানেন নিশ্চয়ই?

সে-কারণেই ঈশ্বরের আসন ছেড়ে দিয়ে চোরের খাতায় নাম লিখিয়েছেন? বিদ্রূপ করল রানা, রায়হানের দিকে তাকিয়ে বলল, খামোকাই এঁকে পুজো করেছ তুমি, রায়হান। ঈশ্বর-টিশ্বর কিছু নন এই মহিলা, স্রেফ আরেকজন হ্যাকার–তথ্য চুরি করা যার পেশা।

আপনার এই ষড়যন্ত্র কোনওদিন সফল হবে না, এলিসা, টিনা বলল।

কেউ কোনও সমাধান রের করতে পারবে না, কিন্তু আপনার অ্যান্টিভাইরাস জাদু দেখিয়ে বেড়াবে… তারপরও দুনিয়ার মানুষ কিছু বুঝতে পারবে না ভেবেছেন?

বুঝতে বুঝতে অনেক দেরি হয়ে যাবে, ডিয়ার ক্রিস্টিনা। তখন কারও কিছু করার থাকবে না, এলিসা বললেন। ততদিনে গোটা দুনিয়ার কম্পিউটার-ব্যবস্থা আমার হাতের মুঠোয় চলে আসবে, কেউ ঝামেলা করতে চাইলে অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে শুরু করে আরেকটা বিশ্বযুদ্ধও বাধিয়ে দিতে পারব। তা ছাড়া… বুলডগের দিকে তাকালেন তিনি, … এখন যেহেতু অ্যামেরিকার সাপোর্ট পেয়ে গেছি, আমার গায়ে তো ফুলের টোকাও দিতে পারবে না কেউ।

ভালই চুক্তি করেছেন, বুলডগকে বলল রানা। এলিসা আপনাদের কাছে সমস্ত চুরি করা তথ্য দেবেন, আর তার বদলে ওঁকে প্রোটেকশন দেবেন আপনারা–তাই না? আপনার তো দেখি দিন দিন অবনতিই হচ্ছে। ছিলেন সিআইএ-র স্পেশাল অ্যাসিসটেন্ট ডিরেক্টর, ডিমোশন পেয়ে হয়েছিলেন ব্যুরো চিফ, আর সেখান থেকে এক ধাক্কায় চোরের সাগরেদ?

খেপল না চতুর সিআইএ কর্মকর্তা। মৃদু হেসে বলল, যা খুশি ভাবতে পারেন আপনি, মি. রানা। কিন্তু অ্যামেরিকা আমাকে তার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বীরের খেতাব দিতে যাচ্ছে। আমার দেশকে আমি অপরাজেয় এক শক্তিতে পরিণত করতে যাচ্ছি–আপনার মত চুনোপুটির কথায় কিছু যাবে-আসবে না।

বড়াইটা একটু পরেই নাহয় করুন, এখনও তো শেষ হয়নি খেলা।

শেষ হয়নি মানে? অনেক আগেই তো হেরে বসে আছেন আপনি, বলিনি?

হেরেছি কি হারিনি, সেটাই তো দেখতে বলছি আপনাকে।

কী বলতে চান? সতর্ক হয়ে উঠল বুলডগ।

জবাব দিতে পারল না রানা, ঠিক সেই মুহূর্তেই তীক্ষ্ণ একটা বিপ বিপ শব্দ ভেসে এল ডেস্কের দিক থেকে। টাইমারের যিরো কাউন্টডাউনে পৌঁছানোর সঙ্কেত ওটা–বুঝতে অসুবিধে হলো না পোড় খাওয়া সিআইএ কর্মকর্তার।

শিট! চেঁচিয়ে উঠল বুলডগ। বোমা!

এলিভেটর শাফটে ফোকর করার পরও সি-ফোরের একটা বাড়তি ব্লক রয়ে গিয়েছিল রানার কাছে। বুলডগ আর আলফা টিমকে অস্ত্র বাগিয়ে অফিসে ঢুকতে দেখে ওটার জন্যই ব্যাকপ্যাকে হাত ঢুকিয়ে দিয়েছিল ও, ব্যাগটা হাতে করে তোলার আগেই বিদ্যুৎবেগে ব্লকটায় একটা ডিটোনেটর আর টাইমার ফিট করেছে, তারপর ছুঁড়ে দিয়েছে ডেস্কের তলায়। যদিও বুলডগ ওকে সন্দেহ করেছিল, কিন্তু ডেস্কের তলায় কোনও কিছু খোঁজার কথা মাথাতেই আসেনি লোকটার। তাই নিরাপদেই রয়ে গেছে বোমাটা, টাইমার এখন এসে পৌঁছেছে। শূন্যের ঘরে।

চিৎকারটা দিয়েই ফ্লোরে ডাইভ দিয়ে পড়ল বুলডগ, পিছনে কান-ফাটানো শব্দে ঘটল বিস্ফোরণ। ভেঙে পড়ল অফিসের সব কাঁচ, ভেঙে-চুরে উড়ে চলে গেল ডেস্কটা। এলিসা আর আলফা টিম ঠিকমত ডাইভ দিতে পারেনি, পিঠে ধাক্কার মত খেল তারা, উড়ে গিয়ে দেয়ালে আছড়ে পড়ল। কায়দা করে বোমার, দিকে পিঠ ফিরিয়ে এজন্যেই ওদের দাঁড় করিয়েছিল রানা, যাতে শকওয়েভের ধাক্কাটা শত্রুদের উপর দিয়ে যায়।

বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে রানা নিজেও দুই সঙ্গীকে নিয়ে ঝাঁপ দিয়েছিল। মেঝেতে, গুম গুম শব্দের রেশটা কাটতেই ঝট করে উঠে উড়াল। তারস্বরে সিকিউরিটি অ্যালার্ম বাজছে কোথায় যেন, শব্দটা অগ্রাহ্য করল ও, দৌড়ে গিয়ে। আলফা টিমের অচেতনপ্রায় সদস্যদের কাছ থেকে দুটো মেশিনগান নিল। শয়তানগুলোকে গুলি করে মেরে ফেলাই উচিত, কিন্তু আহত-অসহায় মানুষকে খুন করবার শিক্ষা পায়নি ও। নিজের অজান্তেই ট্রিগার থেকে আঙুল সরিয়ে ফেলল রানা, কার্টারের পকেট থেকে অ্যান্টিভাইরাসের সিডিটা বের করতে করতে বিড়বিড় করল, তোমাদের সঙ্গে পরে বোঝাপড়া হবে আমার–যখন। সজ্ঞান থাকবে।

একটা মেশিনগান নিজে রেখে অন্যটা রায়হানের দিকে ছুঁড়ে দিল রানা, বেরিয়ে পড়তে ইশারা করল। টিনাকে নিয়ে অ্যাপার্টমেন্টের দরজার দিকে এগোতে যাচ্ছিল তরুণ হ্যাকার, বাধা দিল ও। শাফট ধরে নামার সময় নেই। ছাদে চলল।

লাথি মেরে দরজা খুলে ওয়েইটিং রুমে বেরিয়ে এল ওরা, সেখান থেকে করিডরে। রাস্তা দেখাও। টিনাকে নির্দেশ দিল রানা।

নীরবে করিডরের ডানদিকটা দেখিয়ে দিল তরুণী, সেদিকে ছুটতে শুরু করল তিনজনে। পিছনে হইচই শোনা গেল, বিস্ফোরণের শব্দ পেয়ে বিল্ডিঙের। সিকিউরিটি গার্ডেরা ছুটে আসছে। অটোমেটিক রাইফেলের ক্যাট ক্যাট আওয়াজ হলো, পলায়নপর মানুষ তিনজনের পিছনে মেঝেতে খসে পড়ল দেয়ালের পলেস্তারা।

ঝট করে উল্টো ঘুরল রানা। মেশিনগানটা কোমরের কাছে তুলে অঝোর ধারায় ছুঁড়ল গুলি–নিশানা-টিশানা করার ঝামেলায় যাচ্ছে না, প্রতিপক্ষ ভয় পেয়ে না এগোলেই চলে। উদ্দেশ্যটা সফল হলো–করিডরের দূরপ্রান্ত থেকে ভেসে এল আতঙ্কিত চিৎকার, লাফ দিয়ে আড়ালে চলে যাচ্ছে গার্ডেরা।

ম্যাগাজিনটা খালি হতেই হাতের অস্ত্রটা ছুঁড়ে ফেলে দিল রানা, উল্টো ঘুরে রায়হান আর টিনাকে অনুসরণ করল। ত্রিশ গজ পেরোতেই একটা ল্যাণ্ডিং পড়ল, সঙ্গে ছাদে যাবার সিঁড়ি। দ্রুত উপরে উঠতে শুরু করল ওরা।

সামনেই ইলেকট্রিফায়েড দরজা, তবে সেটা নিয়ে সময় নষ্ট করল না রানা। রায়হানের কাছ থেকে দ্বিতীয় মেশিনগানটা নিয়ে গুলি করে ওটার কবজা উড়িয়ে দিল ও বোমা বিস্ফোরণের কারণে এমনিতেই অ্যালার্ম বাজছে, দরজাটা ভেঙে ফেললে তাতে ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না।

গার্ড পোস্টটা কোথায়? ছাদে বেরুনোর আগে টিনার কাছে জানতে চাইল। রানা।

বাঁয়ে, বিশ ফুট দূরে, উত্তর দিল তরুণী ইউনো।

আর হেলিপ্যাড?

ডানে। পঁচিশ গজের মত যেতে হবে।

গুড, রায়হানের দিকে ফিরল রানা। বুলডগ একটা হেলিকপ্টার নিয়ে এসেছে, ওটা নিশ্চয়ই আছে হেলিপ্যাডে। আমি কাভার দেব, তুমি আর টিনা সোজা ওটায় উঠে পোড়ো। ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে রাখবে, যাতে আমি চড়ামাত্র টেকঅফ করতে পারো।

ঠিক আছে, মাসুদ ভাই।

ও.কে., তৈরি হও তা হলে। থ্রি, টু, ওয়ান… গো!

লাথি মেরে দরজাটা খুলে ফেলল রানা, এক গড়ান দিয়ে বেরিয়ে এল ছাদে। হাঁটু গেড়ে পজিশন ঠিক করতেই পোস্ট ছেড়ে বেরিয়ে আসা দুই গার্ডকে দেখতে পেল-ওর দিকে রাইফেল তলছে। মেশিনগান থেকে বাশফায়ার করল ও, এক গার্ডের হাঁটুর নীচে বিধল গুলি, কংক্রিটের উপর লুটিয়ে পড়ল সে, অন্যজন ঝাঁপ দিয়ে একটা জাংশান বক্সের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল।

আরেকবার গুলি করে আহত লোকটাকে পরপারে পাঠিয়ে দেয়া থেকে বিরত থাকল রানা, গাস ফর্ক আর ফ্রেইবেলের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে, এরাও হয়তো ওই দু’জনেরই মত–স্রেফ দায়িত্ব পালন করছে, এলিসা ভ্যান বুরেনের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে কোনও সম্পর্কই হয়তো নেই এদের।

পিছনে পায়ের শব্দ হলো–রায়হান আর টিনা হেলিপ্যাডের দিকে ছুটে যাচ্ছে। দ্বিতীয় গার্ড একটু মাথা বের করল পরিস্থিতি বোঝার আশায়, কিন্তু তার ছইঞ্চি দূর দিয়ে একটা ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে ভয় পাইয়ে দিল রানা। তাড়াতাড়ি আবার মাথাটা টেনে নিল গার্ড।

একটু পরেই চারপাশ কাঁপিয়ে চালু হলো হেলিকপ্টারের ইঞ্জিন, রোটরব্লেডের ধাক্কায় ঘূর্ণির মত পাক খেয়ে উঠল বাতাস। পিছাতে শুরু করল রানা, ছোট ছোট বিরতিতে গুলি করছে, আড়াল থেকে বেরুতে দিচ্ছে না গার্ডকে। হেলিপ্যাডের সিঁড়ির কাছে গিয়ে গুলিবর্ষণ থামাল ও, উল্টো ঘুরে ছুট লাগাল অপেক্ষারত আকাশযানটার দিকে। এবার বেরিয়ে এল গার্ড, রাইফেল তুলে গুলি ছুঁড়তে শুরু করল রানার দিকে। ছুটন্ত পায়ের পিছনে ছিটকে উঠল কংক্রিটের গুড়ো, লক্ষ্যবস্তুকে না পেয়ে ছাদে নিষ্ফল কামড় বসাচ্ছে বুলেটগুলো।

লাফ দিয়ে কপ্টারে চড়ে বসল রানা, তারপর ঘুরে টেনে দিল দরজাটা। চেঁচিয়ে উঠল, গো, রায়হান… গো!

রোটরের আওয়াজ বদলে গেল, ছাদ ছেড়ে শূন্যে ভেসে পড়েছে। হেলিকপ্টার। ঠক ঠক শব্দ শুনে বোঝা গেল, এবার আকাশযানটাকে লক্ষ্য করে গুলি করছে গার্ড–কপ্টারের শরীরে এসে বিধছে তার অব্যর্থ বুলেটগুলো।

মাসুদ ভাই, থামান ব্যাটাকে! পাইলটের সিট থেকে চেঁচিয়ে বলল রায়হান। ইঞ্জিনে গুলি লাগলে কিন্তু সর্বনাশ!, জানালা গলে মেশিনগানটা বের করল রানা, ক্রমাগত গুলি ছুঁড়ে গেল যতক্ষণ না ম্যাগাজিনটা শেষ হয়। ফাঁকা চেম্বারে হ্যাঁমারটা যখন খটাস করে পড়ল, তখন ছাদের সীমানা পেরিয়ে গেছে হেলিকপ্টার, নাক ঘুরিয়ে চলে যাচ্ছে দূরে।

ফোঁস করে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল রানা। সিটে হেলান দিয়ে। শেষবারের মত তাকাল ক্রিয়েলটেক হেডকোয়ার্টারের ছাদের দিকে–খোঁড়াতে। খোঁড়াতে সেখানে উদয় হয়েছে পাঁচজন মানুষ।

বুলডগ, ড. বুরেন আর আলফা টিম। তীব্র আক্রোশ নিয়ে তাকিয়ে আছে তারা মিলিয়ে যেতে থাকা যান্ত্রিক ফড়িংটার দিকে।

.

১৭.

এবার কী, মাসুদ ভাই? জিজ্ঞেস করল রায়হান। কী করতে চান?

সেটা টিনার উপর নির্ভর করছে। বলল রানা তাকাল তরুণী ইউনোর। দিকে। কী করা যায়, টিনা? রেডিমেড অ্যান্টিভাইরাসটা নিয়ে এসেছি বটে, কিন্তু ওটা তো ব্যবহার করা যাবে না। করলে ড. বুরেনের প্ল্যানটা সফল হয়ে। যাবে, পৃথিবীর সব কম্পিউটার থেকে তথ্য চুরি করতে পারবে সে।

টিনা বলল, ব্যাকডোরের অপশনটা মুছে দিয়ে প্রোগ্রামটা ঠিক করে ফেলতে পারব আমি। এখনই কাজটা শুরু করে দিতে পারতাম, কিন্তু বোমা ফাটিয়ে আমার ল্যাপটপটা উড়িয়ে দিয়েছেন আপনি।

ভেবো না, বলল রানা। নতুন একটা তোমাকে জোগাড় করে দেব। এখুনি। কিন্তু কথা হলো মাত্র দেড় ঘণ্টা সময় হাতে, এর মধ্যে অ্যান্টিভাইরাসটা মেরামত করে নিতে পারবে তুমি?

পারব, তবে সবখানে ডিস্ট্রিবিউট করবার মত যথেষ্ট সময় পাবো কি না, তা বলতে পারি না। শিডিউলে এমনিতেই যথেষ্ট পিছিয়ে পড়েছি আমরা। আমার তো ইচ্ছে ছিল, এলিসার অফিস থেকেই ডিস্ট্রিবিউশনটা শুরু করব; ব্যাকডোরটা চোখে পড়ায় করিনি।

ভালই সমস্যা হলো দেখছি। সবখানে যদি বিলি করা না যায়, তা হলে জিনিসটা মেরামত করেই বা লাভ কী হবে?

কী করার আছে বলুন? কাঁধ ঝাঁকাল টিনা। ব্যাকডোর সরাতে অন্তত ত্রিশ থেকে চল্লিশ মিনিট দিতেই হবে আমাকে। আর পৃথিবীর সব ইন্টারনেট সার্ভারে, ওটা পাঠাবার জন্য আরও এক ঘণ্টা। সব মিলিয়ে দেড় থেকে দুঘণ্টার মামলা–যদি এই মুহূর্তে আমাকে একটা কম্পিউটার দিতে পারেন আর কী!

ল্যাণ্ড করব, মাসুদ ভাই? অনুমতি চাইল রায়হান। নীচে নেমে দেখি, কোথাও একটা কম্পিউটার পাওয়া যায় কি না।

না, মাথা নাড়ল রানা। ক্রিয়েলটেক থেকে দূরে সরে যেতে হবে। আমাদের। বুলডগ আর এলিসা এখুনি পাগলা কুকুরের মত ছুটে আসবে, কাছাকাছি ল্যাণ্ড করলে আমাদের সহজে খুঁজে বের করে ফেলবে ওরা।

কিন্তু সময় যে ফুরিয়ে আসছে। প্রতিবাদ করল রায়হান। এখুনি। অ্যান্টিভাইরাসটা নিয়ে কাজ শুরু করা দরকার টিনার।

জানি, কিন্তু কাজ করার জন্য বেঁচে থাকতে হবে না প্রথমে?

এ দেখি উভয়সঙ্কটে পড়া গেল, তিক্ত সুরে বলল রায়হান।

টিনার দিকে ফিরল রানা।

মানলাম, তোমার কাজটার জন্য আধঘণ্টা লাগবেই লাগবে। কিন্তু ডিস্ট্রিবিউশনের জন্য প্রয়োজনীয় সময়টা কমিয়ে আনা। যায় না? মানে… খুব দ্রুত অ্যান্টিভাইরাসটা বিলি করবার কায়দা নেই কোনও?

একভাবেই সেটা করা যেতে পারে–অত্যন্ত শক্তিশালী একটা কম্পিউটার। দিয়ে, বলল টিনা। পৃথিবীর যেখানে যত নেটওয়ার্ক আছে, সেগুলোর সবকটায় একই সময়ে সংযুক্ত হতে হবে ওটাকে। শুধু সংযুক্ত হলেও হবে না; প্রত্যেক নেটওয়ার্কের নানা রকম সিকিউরিটি থাকে, সেসবকে ইনফিলট্রেট করে অ্যান্টিভাইরাসটা ঢোকানোর ব্যবস্থা করতে হবে। আর এইসব কাজ করতে হবে একসঙ্গে একই সময়ে। মিলিয়ন-মিলিয়ন গিগাবাইট তথ্য আদান-প্রদান হবে। কাজটা করার সময়ে, কাজেই এত বড় প্রেশার সামলানোর মত ক্ষমতাও থাকতে হবে কম্পিউটারটার।

কী সব টেকনিক্যাল কথাবার্তা বলছ, কিছুই বুঝতে পারছি না, রানা ভুরু কোঁচকাল। এতকিছু না-বলে সোজাভাবে বলো না, কী চাই তোমার কাজটা সারতে?

 সুপার-কম্পিউটার, মাসুদ ভাই, হাসল টিনা। একটা সুপার কম্পিউটার দরকার আমার।

শুধু ডিস্ট্রিবিউশনের জন্যে তো? ব্যাকডোর সরাবার কাজটা তো যে-কোনও কম্পিউটারেই করতে পারবে, তাই না?

হ্যাঁ।

গুড। এখুনি ম্যানেজ করে দিচ্ছি সব। রায়হানের দিকে তাকাল রানা। পাঁচ মিনিটের জন্য ল্যাণ্ড করো কোথাও। একটা ফোন করতে হবে আমাকে।

পাঁচ মিনিটে আপনি কীভাবে একটা সুপার-কম্পিউটার এনে দেবেন। আমাকে? বিস্মিত কণ্ঠে বলল টিনা।

এনে দেব তো বলিনি! বলেছি ম্যানেজ করে দেব। তোমাকে শুধু ব্যাকডোর সরিয়ে অ্যান্টিভাইরাসটাকে ওই কম্পিউটার পর্যন্ত পৌঁছে দিতে হবে, বিলি-বণ্টন ওটা নিজেই করে ফেলতে পারবে।

কী বলছেন এসব! একটা যন্ত্র আবার নিজে নিজে কাজ করে কীভাবে?

মুচকি হাসল রানা। করে… করে। ভিনাসকে তো তুমি দেখোনি!

.

ওয়াশিংটনে এখনও ভোর হয়নি, হবে হবে করছে। এই সময়টাতেই সবচেয়ে গভীর ঘুম হয় সবার; ন্যাশনাল আণ্ডারওয়াটার অ্যাণ্ড মেরিন এজেন্সি… সংক্ষেপে নুমার কম্পিউটার-বিশেষজ্ঞ, কালো মানিক ল্যারি কিং-ও তার ব্যতিক্রম নয়। আরাম করে কম্বলমুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছিল সে, স্বপ্নও দেখছিল। আচমকা বেরসিকের মত বেডসাইড টেবিলে রাখা ফোনটা বেজে উঠতেই নিদ্রাদেবীর আরাধনা শিকেয় উঠল। চোখ মেলে পিট পিট করে তাকাল ল্যারি, ঘড়ি দেখল। ভুরু কুঁচকে গেছে তার, এমন চমৎকার ঘুমটা ভেঙে গেলে কারই বা ভাল লাগে!

এখনও বেজে চলেছে ফোনটা, বিরক্ত হয়ে রিসিভারটা তুলল ল্যারি, কানে ঠেকাল। অপরপক্ষের কোনও কথা শোনার আগেই তিক্ত কণ্ঠে বলল, এটা যদি ইমার্জেন্সি কল না হয়, তা হলে তোমার খবর আছে–তুমি যে-ই হও না বাপু!

কী আশ্চর্য, ইমার্জেন্সি ছাড়া বন্ধুকে ফোন করা যায় না বুঝি? ওপাশ থেকে রানার গলা ভেসে এল।

ক… কে? রানা নাকি?

ঠিক ধরেছ। তা, কী ধরনের খবর করবে আমার, জানতে পারি?

হেসে উঠল ল্যারি। তোমার জন্য আমার ফোনের লাইন সবসময় ভোলা, রানা। তাই বলে যখন-তখন ফোন করে আমার ঘুমের বারোটা না বাজালেও পারো।

ওটুকু দয়া দেখাতে রাজি আছি আমি, যদি ছোট্ট একটা কাজ করে দাও।

কী কাজ?

ইউনো-ভাইরাসের ব্যাপারে শুনেছ তো?

হ্যাঁ, তোমাদের বিসিআই থেকে একটা ওয়ার্নিং পাঠানো হয়েছে আমাদের কাছে। কেউ সেটা গুরুত্বের সঙ্গে না নিলেও আমি কোনও চান্স নিচ্ছি না। নুমার কম্পিউটার সেকশন বন্ধ করে দিয়েছি মি. রেডক্লিফের সঙ্গে কথা বলে। জর্জ রেডক্লিফ নুমার ডেপুটি ডিরেক্টর, অ্যাডমিরুল হ্যাঁমিলটনের অনুপস্থিতিতে তিনিই এখন সবকিছু দেখাশোনা করছেন। যতক্ষণ না পুরো ব্যাপারটার সত্য-মিথ্যে যাচাই করতে পারছি, কোনও কম্পিউটারই আর অন্ করব না।

সিদ্ধান্তটা পাল্টাতে হবে তোমাকে, রানা বলল। ভিনাসকে এখুনি চাই আমি।

ভিনাস হচ্ছে ল্যারি কিঙের নিজ হাতে তৈরি এক অত্যাশ্চর্য সুপার-কম্পিউটার। অন্যান্য যে-কোনও সুপার-কম্পিউটারের চাইতে কয়েক গুণ উন্নত ওটা-ক্ষমতার দিক থেকে তো বটেই, সেই সঙ্গে নেক্সট জেনারেশন আর্টিফিশিয়াল-ইন্টেলিজেন্সের কারণে। অত্যন্ত স্মার্ট কম্পিউটার এই ভিনাস–নিজ থেকে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, মানুষের সঙ্গে বাক্য-বিনিময় করতে পারে, করতে পারে আরও অনেক কিছু। থ্রি-ডি ইন্টারফেসে কম্পিউটারটাকে একটি অপূর্ব সুন্দরী মেয়ের চেহারা দিয়েছে ল্যারি, মানুষের সঙ্গে কথোপকথনটা উপভোগ্য হবার জন্য। ভিনাস নামেই ডাকে সে এই নারীমূর্তি এবং কম্পিউটারটাকে।

ব্যাপারটা কী? প্রশ্ন করল ল্যারি। হঠাৎ ভিনাসকে কী প্রয়োজন পড়ল তোমার?

ভাইরাসের ব্যাপারটা সত্যি, রানা বলল। ওটার একটা অ্যান্টিভাইরাস জোগাড় করেছি আমি, সেটা ভিনাসের মাধ্যমে আধঘণ্টায় সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিতে হবে, নইলে কেয়ামত নেমে আসবে তোমাদের সাইবার-জগতে।

ধড়মড় করে উঠে বসল ল্যারি। কী বলছ এসব! ইউনোকোড তার মানে সত্যিই আছে?

হ্যাঁ, ল্যারি। তবে এসব নিয়ে আলোচনার সময় নেই এখন। তাড়াতাড়ি ভিনাসকে অনলাইনে আনো, অ্যান্টিভাইরাসটা ঠিকঠাক করে যত দ্রুত সম্ভব আপলোড করে দিতে চাই আমি।

ওপেন লাইনে পাঠিয়ো না ওটা, ল্যারি বলল। তা হলে যে-কেউ ইণ্টারসেপ্ট করতে পারবে।

কীভাবে পাঠাব?

নুমার সমস্ত শিপে ভিনাসের সিকিউরড় নেটওয়ার্ক আছে, যে-কোনও একটাতে গিয়ে শিপের কম্পিউটারেই লোড করে দাও প্রোগ্রামটা। তা হলে হেডকোয়ার্টার পর্যন্ত আর টানাহেঁচড়া করতে হবে না, শিপের কম্পিউটার থেকেই ওটা ডিস্ট্রিবিউট করে দিতে পারবে ভিনাস।

আমি এখন অ্যামস্টারড্যামে, এখানে নুমার শিপ পাবো কোথায়? তা ছাড়া সময়ও নেই হাতে।

এমনি এমনি নিষেধ করছি না। আজকাল ভিনাসের সমস্ত আনসিকিউরড় ডেটা-ট্রান্সফারে ইন্টারসেপ্ট করছে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা–গোয়েন্দাগিরি করছে ওরা আমাদের উপর। ওপেন লাইনে প্রোগ্রামটা পাঠালে ওটা মাঝপথেই চুরি হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে।

ভাল বিপদে পড়া গেল! বিরক্ত স্বরে বলল রানা। বিকল্প কোনও উপায় আছে?

কেন, আমাদের কোনও জাহাজে যেতে পারবে না?

হেলিকপ্টার একটা অবশ্য আছে আমার সঙ্গে, রানা বলল। কাছাকাছি কোনও শিপ থাকলে চেষ্টা করে দেখতে পারি।

একটু ধরো তা হলে। বলে টেবিল থেকে একটা ফাইল নিয়ে এল ল্যারিওটায় নুমার বিভিন্ন শিপের গতিবিধির রিপোর্ট রয়েছে। কয়েকটা পাতা উল্টাল সে, তারপর রানাকে বলল, আছে একটা শিপ। সি-স্কুইরেল, নর্থ সি-তে উপকূল জরিপ করছে। হল্যাণ্ডের পূর্ব উপকূল থেকে দশ মাইল দূরে নোঙর করে আছে ওটা, তারমানে… অ্যামস্টারড্যাম থেকে চল্লিশ মাইল ডিসট্যান্সে।

তা হলে তো যাওয়া সম্ভব ওখানে, বলল রানা। তুমি শিপে খবর পাঠিয়ে দাও, ল্যারি। আমরা পনেরো মিনিটের মধ্যে ওখানে পৌঁছুচ্ছি।

ঠিক আছে। রানাকে জাহাজের কো-অর্ডিনেটস দিল ল্যারি। তারপর বলল, আমিও নুমা হেডকোয়ার্টারে যাচ্ছি। ভিনাসকে জাগিয়ে খবর দেব তোমাকে।

.

ডেকলাইটের আলোয় সাগরের বুকে ঝলমল করতে থাকা সি-স্কুইরেল-কে আকাশ থেকে দেখাচ্ছে বিয়েবাড়ির মত–যেন উৎসব চলছে ওখানে, তাই এত সাজসজ্জা। আসলে হেলিকপ্টারটার ল্যাণ্ডিঙে সাহায্য করবার জন্য আলোগুলো জ্বেলেছে জাহাজের ক্রু-রা। কাছে গিয়ে জাহাজটাকে ঘিরে একবার চক্কর দিল রায়হান, তারপর ডেকের উপর ধীরে ধীরে নামাতে শুরু করল কপ্টারটাকে।

এখানেই আসবার কথা আমাদের? জিজ্ঞেস করল টিনা, চোখে সন্দেহ। ওর। কাছ থেকে দেখার পর জলযানটাকে জাহাজ বলে মনে হচ্ছে না ওর কাছে।

হাসল রানা। কোনও সন্দেহ নেই, এটাই সি-স্কুইরেল।

টিনার এই মনোভাবে অবাক হবার কিছু নেই, হঠাৎ দেখায় সি-স্কুইরেলকে। একটা ড্রিলিং প্ল্যাটফর্ম বলেই ভ্রম হয়। সি-স্কুইরেল আসলে একটা সোয়াথ… মানে, স্মল ওয়াটারপ্লেন এরিয়া টুইন হাল শিপ-আণ্ডারওয়াটার সার্ভে এবং রিসার্চের জন্য বিশেষভাবে ডিজাইন করা জাহাজ। ক্যাটামারান কনসেপ্টে তৈরি হওয়া এই জাহাজ–অন্যান্য যে-কোনও টুইন হাল শিপের চেয়ে উন্নত। পুরো কাঠামোটাকে ভাসানোর জন্য বয়া-র মত দুটো টিউব আছে এর–পানির নীচে। থাকে। ওগুলোর উপর প্ল্যাটফর্মের মত করে বসানো হয়েছে পুরো সুপারস্ট্রাকচার–দৃষ্টিবিভ্রম, ঘটে সেজন্যেই। অবশ্য চেহারাটা জাহাজের মত হোক বা না-হোক, অন্যান্য যে-কোনও জলযানের চেয়ে নিরাপদে ভাসতে পারে সোয়াথ শিপ। টুইন হালের মাঝে ফাঁকা থাকায় সবসময় দুতিন রকম ওয়েভ প্যাটার্ন থাকে জাহাজটার নীচে, পরস্পরের প্রভাব নিষ্ক্রিয় করে ফেলে ওগুলো; ওয়াটারলাইন ভলিউম কম হবার কারণে ঢেউও ধাক্কা দেবার সময় খুব বেশি জায়গায় আছড়ে পড়তে পারে না–ফলে উত্তাল সাগরেও দুলুনি খুব একটা হয় না এসব জাহাজে।

ডেকে হেলিকপ্টারটা নেমে আসতেই দু’জন মানুষ এগিয়ে এল অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাতে। ইঞ্জিন বন্ধ করে নামল রানারা, মুখোমুখি হলো তাদের।

দু’জনের মধ্যে অপেক্ষাকৃত বয়স্ক ভদ্রলোক জাহাজের ক্যাপ্টেন, তিনি হেসে বললেন, ওয়েলকাম টু সি-স্কুইরেল, মি, রানা। আমাকে চিনতে পারছেন?

ম্যাট ডিলান… আপনাকে কি ভোলা যায়? রানাও হাসল-নুমার অনারারি * প্রজেক্ট ডিরেক্টর ও, প্রতিষ্ঠানটার প্রায় সবাইকেই চেনে।

যে-দিনকাল পড়েছে এখন, ভুলতে সময় লাগে না। গত বছরের অ্যানুয়াল মিটিঙের পর থেকে তো দেখাই হয়নি আর আপনার সঙ্গে।

আমি একটু পুরনো টাইপের মানুষ, বর্তমান দিনকালের প্রভাব সহজে পড়ে

আমার উপর, ক্যাপ্টেন ডিলানের সঙ্গে হাত মেলাল রানা, তারপর পরিচয় করিয়ে দিল সঙ্গীদের।

ক্যাপ্টেনও তাঁর সঙ্গীকে পরিচয় করালেন, এ-হচ্ছে ডেভিড ওয়েবার–আমার ফাস্ট অফিসার।

হাউ ডু ইউ ডু, সবার সঙ্গে হাত মেলাল ওয়েবার।

পরিচয়ের পালা শেষ হতেই কাজের কথায় এল রানা। ল্যারি কিং বলেছে আপনাদের, কী করতে হবে?

শুধু এটুকুই যে, শিপের কম্পিউটারে কিছু কাজ করবেন আপনারা। ব্যাপারটা কী, জরুরি কিছু না হলে তো রাতদুপুরে এভাবে ছুটে আসবার কথা নয় আপনার।

সবকিছু পরে খুলে বলব, এখন কম্পিউটার সেকশনে নিয়ে চলুন আমাদের। সময় খুব কম।

ঠিক আছে, আসুন।

রানাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন ডিলান।

শিপে নামব কীভাবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা হচ্ছিল আমার, হাঁটতে হাঁটতে বলল রানা। ডেকে আপনাদের নিজেদের একটা চপার-ই তো থাকার কথা, তাই না? কোথায় ওটা?

ক্রদের নিয়ে মেইনল্যাণ্ডে গেছে, জানালেন ডিলান। গত দুমাস ধরে টানা সার্ভে করছি আমরা, বিশ্রাম-টিশ্রাম নিইনি একটুও। আজই প্রথম ডাঙায় যাবার সুযোগ দিয়েছি, তাই বেশিরভাগ লোকই চলে গেছে। জাহাজে এখন শুধু আটজন আছি আমরা।

গেছে ভালই হয়েছে, রানা বলল। নইলে চপারটাও যেত না, আমরাও ল্যাণ্ড করতে পারতাম না।

ডেকের একপাশে বিশাল এক উইঞ্চে ঝোলানো রয়েছে, একটা ওয়ান-ম্যান। ট্রাইটন মিনি-সাবমেরিন পার হবার সময় ওটা লক্ষ করে রায়হান জিজ্ঞেস করল, এটা কীসের জন্য?

এবার জবাব দিল ওয়েবার। আণ্ডারওয়াটার সার্ভে করছি আমরা, প্রায়ই নামতে হয় পানির নীচে, সেজন্যেই আনা হয়েছে ওটা।

কৌতূহলী দৃষ্টিতে সাবমেরিনটা দেখল রায়হান আর টিনা। গ্রীক দেবতার নামে নাম ওটার চেহারায়ও শক্তিমত্তার প্রতিফলন ঘটছে। ইস্পাতের তৈরি। ছোটখাট একটা লৌহদানব এই ট্রাইটন-চুয়াল্লিশ ফুট লম্বা, সাড়ে পাঁচ ফুট উঁচু। ককপিটের জায়গাটা গোলাকৃতি ফাইবারগ্লাসের তৈরি, দেখলে মাছ রাখার পাত্রের কথা মনে পড়ে যায়। দু’পাশ থেকে দুটো মেকানিক্যাল হাত বেরিয়ে এসেছে ওটার, সামনের দিকে প্রসারিত হয়ে আছে–ওদুটো দিয়ে সি-বেড থেকে নানা রকম নমুনা সংগ্রহ করা হয়।

ওয়েদার-ডেক পেরিয়ে সুপারস্ট্রাকচারে ঢুকে পড়ল দলটা। সরু একটা করিডর ধরে একটু এগিয়েই বাঁয়ের একটা দরজা খুললেন ডিলান-ওপাশে শিপের কম্পিউটার সেকশন।

একটা অন্ করা কম্পিউটার দেখিয়ে দিলেন ক্যাপ্টেন। এটা রেডি রাখা। হয়েছে আপনাদের জন্য।

চেয়ার টেনে ওটার সামনে বসে পড়ল টিনা, ড্রাইভে ঢোকাল অ্যান্টিভাইরাসের সিডিটা, তারপর ব্যস্ত হয়ে পড়ল ব্যাকডোরটা সরানোর কাজে।

ডিলানকে অনুরোধ করে একটা স্যাটেলাইট ফোন আনল রানা। সেটা থেকে ল্যারি কিঙের মোবাইলে রিং করল।

হ্যালো?

ল্যারি, রানা বলছি। তুমি তৈরি আছ?

হ্যাঁ, ভিনাস স্ট্যাণ্ডবাই রয়েছে। প্রোগ্রামটা আপলোড করেছ?

একটু কাজ করতে হচ্ছে ওটার উপরে, আধঘণ্টা লাগবে হয়তো। তুমি রেডি থেকো, আমি জানাব কখন ডিস্ট্রিবিউশন করতে হবে।

ঠিক আছে, অপেক্ষায় থাকছি আমি।

.

ঠিক সেই মুহূর্তে কানে আরেকটা ফোন ঠেকিয়ে বসে আছে ডগলাস বুলক, মনোযোগ দিয়ে শুনছে অপরপক্ষের কথা। আনমনে একটু মাথা নাড়ল সে, তারপর বলল, ধন্যবাদ।

কী খবর, খোঁজ পাওয়া গেল? জিজ্ঞেস করল থিও ওরফে আলফা-ওয়ান, কার্টারের হাতে ব্যাণ্ডেজ বাঁধছে সে। ফার্স্ট এইডের ট্রেইনিং রয়েছে। আলফা-টিমের সবার, নিজেরাই নিজেদের শুশ্রষা করছে।

এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের সঙ্গে কথা বললাম, বুলডগ বলল।

হেলিকপ্টারটাকে উপকূল পেরুনো পর্যন্ত ট্র্যাক করতে পেরেছে ওরা।

উপকূল! ভুরু কোচকালেন এলিসা। সাগরে গেছে? মাথা ঝাঁকাল বুলডগ।

কিন্তু কেন?

নিশ্চয়ই কোনও শিপে গেছে, অনুমান করল বুলডগ। অ্যান্টিভাইরাসটা ওখান থেকে সবখানে পাঠাবার ব্যবস্থা করবে।

শিপে কেন? ডাঙা থেকে চেষ্টা করতে পারত না?

বাড়তি কোনও সুবিধে পাচ্ছে নিশ্চয়ই, বুলডগ বলল। আর বাড়তি সুবিধে বলতে একটা জিনিসই মাথায় আসছে–নুমা! ওদের একটা আন্ট্রা-সফিসটিকেটেড সুপার-কম্পিউটার আছে। আমার মনে হচ্ছে, নুমার শিপ থেকে ওই কম্পিউটারটার সাহায্যে কাজ উদ্ধার করতে চাইছে রানা।

বিস্মিত কণ্ঠে এলিসা বললেন, নুমা তো অ্যামেরিকার… মানে আপনাদেরই সরকারি সংস্থা। ওরা কেন রানাকে সাহায্য করবে?

আর বলবেন না, বিরক্তি ফুটল বুলডগের কণ্ঠে। নুমার ডিরেক্টর অ্যাডমিরাল জর্জ হ্যাঁমিলটন আর তার সঙ্গের সব লোক হচ্ছে মানবদরদী। অ্যামেরিকার স্বার্থ নিয়ে মোটেই মাথাব্যথা নেই ওদের, ভাবে দুনিয়ার কথা। রানা আবার ওখানকার অনারারি প্রজেক্ট ডিরেক্টর; কাজেই ওরা যে সুযোগ পেলে রানাকে সাহায্য করবে, তা আমি আগে থেকেই জানি। সে-কারণেই আপনার দেয়া ওই অ্যান্টিভাইরাসের কপি ওদেরকে দিতে নিষেধ করে দিয়েছিলাম আমি, ব্যাটাদের একটু নাস্তানাবুদ করার ইচ্ছে ছিল–বিভিন্ন সময়ে সিআইএ-কে কম ভোগায়নি ওরা!

কিন্তু এখন তো ঠিকই পেয়ে যাচ্ছে অ্যান্টিভাইরাসটা, কার্টার বলল। শুধু তা-ই নয়, গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়েও দিতে যাচ্ছে।

পারবে না, কঠিন গলায় বলল বুলডগ। রানা কোন্ জাহাজে গেছে, সেটা বের করতে পাঁচ মিনিটও লাগবে না আমার। এখুনি একটা টিম রেডি করে…

হুঁহ্‌, টিটকিরি মারল থিও, আপনার টিম যে কত কী করতে পারে, সেটা দেখা গেছে ড্রুইভেনড্রেশটে।

আর একটু আগে তোমরাই বা কী দেখিয়েছ? তেতে উঠে জানতে চাইল।

ওটা আপনার শো ছিল, আমাদের নয়। আপনার কথামত কাজ করতে গিয়েই যত ঝামেলা হয়েছে। এবার আমাদেরকে আমাদের মত চলতে দিন। দেখবেন মাসদ রানাকে কীভাবে শায়েস্তা করি!

এই আহত অবস্থায়? মুখ বাঁকাল বুলডগ। দিব্যি সুস্থ থাকার পরও তো মণ্টেগো আইস শেলফে রানার চুলটাও ছিঁড়তে পারোনি।

রানার ব্যাপারে ওটা আমাদের লার্নিং পিরিয়ড ছিল। শিক্ষা যা পাবার, পেয়ে গেছি আমরা। এবার আর কোনও ভুলত্রুটি হবে না। আর সুস্থতার কথা? চেহারায় হিংস্রতা ফুটল আলফা-ওয়ানের। আহত বাঘই সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হয়–এটা জানেন তো?

চুপ করে রইল বুলডগ।

আলফা-থ্রির দিকে তাকাল থিও। মেলভিন, তাড়াতাড়ি একটা চপার আনাও, সেই সঙ্গে প্রচুর আর্মস-অ্যামিউনিশন। এবার মাসুদ রানার রক্ষা নেই।

.

১৮.

ধীরে ধীরে অধৈর্য হয়ে উঠছে রানা আর রায়হান। সি-স্কুইরেলে আসার পর বিশ মিনিট কেটে গেছে, এখনও কাজ শেষ হয়নি টিনার। রাত দুটোয় আঘাত হানার কথা ইউনো-ভাইরাসের, এখন বাজে একটা একুশ। আর মাত্র ঊনচল্লিশ মিনিট বাকি আছে প্রলয় ঘটতে। টিনা যদি আগামী নমিনিটের মধ্যে কাজ শেষ করতে না পারে, তা হলে ভিনাসের পক্ষেও পৃথিবীর সব জায়গায় প্রোগ্রামটা পাঠিয়ে দেয়া সম্ভব হবে না।

আর কতক্ষণ, টিনা? জিজ্ঞেস করল রানা। স্ক্রিনে ফুটে থাকা অদ্ভুত সঙ্কেতগুলো থেকে একটুও চোখ ফেরাল না তরুণী ইউনেনা। শুধু বলল, আর একটু, মাসুদ ভাই।

কিন্তু সময় তো ফুরিয়ে আসছে।

আমি তো চেষ্টা করছি তাড়াতাড়ি কাজটা সারতে। একটু ধৈর্য ধরুন।

এত সময় নিচ্ছ কেন? অস্থির গলায় বলল রায়হান।

সোর্স-কোড থেকে ব্যাকডোরের অংশটা শুধু মুছে দিলেই হতো না?

উঁহুঁ, মাথা নাড়ল টিনা। ইউনোকোড একটা কবিতার মত জিনিস–ছন্দ মেনে কাজ করে। মাঝখান থেকে হঠাৎ একটু অংশ মুছে দিলে ছন্দটা নষ্ট হয়ে, যায়, ওটা আর কাজ করতে পারে না। তাই জিনিসটা আমাকে নতুন করে দ করাতে হচ্ছে। একটু সময় তো লাগবেই।

আর কিছু বলার থাকে না এর পরে। অস্থিরতায় উসখুস করতে থাকল। রায়হান। ওর অবস্থা দেখে রানা বলল, চলো, ডেকে গিয়ে একটু হাওয়া খেয়ে আসি।

কাঁধ ঝাঁকিয়ে প্রস্তাবটায় রাজি হলো তরুণ হ্যাকার। ঠিক আছে, চলুন।

কম্পিউটার সেকশন থেকে বেরিয়ে এল রানা আর রায়হান, করিডর ধরে বেরিয়ে এল শিপের পিছনদিকে। মাত্র কয়েক পা এগিয়েছে ওরা, এমন সময় একটা শো শো শব্দে সচকিত হয়ে উঠল। চোখ তুলতেই আকাশ থেকে তীক্ষ্ণ একটা আকৃতি ছুটে আসতে দেখা গেল, পিছন দিয়ে আগুন ঝরছে।

ওটা একটা রকেট!

দুই বিসিআই এজেন্টের বিস্ফারিত দৃষ্টির সামনে ল্যাণ্ড করা হেলিকপ্টারটায় আঘাত করল ওটা। পরমুহূর্তেই বিস্ফোরিত হলো।

দপ করে জ্বলে উঠল শিখা, কমলা রঙের একটা আগুনের গোলা গ্রাস করল আকাশযানটাকে, প্রচণ্ড শব্দে ছিন্নভিন্ন করে ফেলল চোখের পলকে। শকওয়েভের ধাক্কায় উল্টে ডেকের উপর পড়ে গেল রানা ও রায়হান।

কানের ভিতর বোঁ বোঁ শব্দ হচ্ছে, তারপরেও হামলাকারী চপারটার আওয়াজ ঠিকই শুনতে পেল রানা। মাথা তুলতেই শিপের একপাশ থেকে উদয়। হতে দেখল ওটাকে–আকাশের পটভূমিতে কেন যেন ভৌতিক একটা ছায়া মনে হচ্ছে ওটাকে। একেবারে শিপের উপরে এসে থামল চপারটা, তিনটে দড়ি ফেলা। হলো নীচের্যাপলিং করে নেমে আসতে চাইছে আলফা টিম।

লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল রানা, রায়হানকেও টেনে তুলল। জাহাজের ভিতরে… জলদি! আদেশের সুরে বলল ও।

দুদ্দাড় করে সুপারস্ট্রাকচারে এসে ঢুকল দু’জনে, টেনে বন্ধ করে দিল ভিতরে ঢোকার দরজাটা। পিছনে হৈচৈ শোনা গেল, দু’জন ক্রু নিয়ে ছুটে

আসছেন ক্যাপ্টেন ডিলান। কাছে এসে বললেন, হা যিশু, হয়েছেটা কী?

ম হামলা করেছে আমাদের উপর, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল রানা। হেলিকপ্টারটা উড়িয়ে দিয়েছে ওরা।

হোয়াট!

দুঃখিত, ব্যাপারটা আমাদের জন্য ঘটছে।

ক…কী! কেন?

কী-কেন-কীভাবে… সব পরে শোনাব আপনাকে, রানা বলল। আগে আত্মরক্ষা করা দরকার। কী ধরনের আর্মস আছে আপনার কাছে?

এটা রিসার্চ শিপ, মি. রানা। আমাদের কাছে অস্ত্র থাকবে কোত্থেকে?

হতাশায় ঠোঁট কামড়াল রানা। হাত একেবারে খালি, সময়ও নেই যে কিছু বানিয়ে নেবে। রায়হানের দিকে তাকিয়ে বলল, টিনাকে সরিয়ে ফেলতে হবে কম্পিউটার সেকশন থেকে।

কিন্তু ওর তো কাজ শেষ হয়নি!

যতটুকু করেছে, সেটা একটা পোর্টেবল কম্পিউটারে শিফট করে নিক।তা। হলে গা ঢাকা দিয়েও কাজ চালিয়ে যেতে পারবে। ক্যাপ্টেনের দিকে তাকাল। রানা। ল্যাপটপ আছে শিপে?

ইতিবাচক ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালেন ডিলান।

নিয়ে আসুন একটা। কুইক!

ছুটে চলে গেলেন ডিলান। রায়হানসহ কম্পিউটার সেকশনে গিয়ে ঢুকল রানা-ওখানে কাজ থামিয়ে বসে আছে টিনা, চোখে আতঙ্কিত দৃষ্টি। ওদেরকে দেখে বলল, ওরা এসে গেছে, তাই না?

হ্যাঁ, তবে চিন্তা কোরো না, রানা আশ্বাস দিল। আমি আর রায়হান ওদের সামলাবো। তোমাকে একটা ল্যাপটপ কম্পিউটার এনে দেয়া হচ্ছে-ওটায় সব তুলে নাও। ক্যাপ্টেন লুকানোর জায়গা দেখিয়ে দেবেন, ওখানে বসে কাজটা শেষ করে ফেলো।

হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল টিনা। কাজ করে কোনও লাভ নেই, মাসুদ ভাই। আমরা হেরে গেছি।

কী বলছ এসব!

আঙুল তুলে স্যাটেলাইট ফোনটা দেখাল টিনা, ওটার রিসিভার তোলা।

ল্যারি কিং লাইনে আছেন, ওঁর সঙ্গে কথা বলে দেখুন।

ভুরু কুঁচকে রিসিভারটা কানে ঠেকাল রানা। কী হয়েছে, ল্যারি?

ভিনাস ইজ গন, রানা, হাহাকারের মত শোনাল ল্যারির গলা। ওকে হারিয়েছি আমি!

মানে?

অদ্ভুত একটা কোড এসে ভিনাসের পুরো সিস্টেম দখল করে নিয়েছে, রানা। আমার সমস্ত সিকিউরিটি ভেঙে গুঁড়ো করে দিয়েছে ওটা, ভিনাস আর আমার নিয়ন্ত্রণে নেই এখন।

শিট! ওটা ইউনোকোড! বলল রানা। দাঁড়াও, দেখি কী করা যায়। টিনার দিকে তাকাল ও। টিজিভি-র মত ভিনাসকে দখল করে নিয়েছে এলিসা।

তুমি কিছু করতে পারো?

পারি, কিন্তু ওদিকে সময় দিলে অ্যান্টিভাইরাসটা ঠিক করব কখন? হতাশা ঝরল তরুণী ইউনোর কণ্ঠে। আর অ্যান্টিভাইরাসটাই যদি ঠিক না হয়, তা হলে ভিনাসের কন্ট্রোলই বা ফিরিয়ে এনে লাভ কী?

পরিস্থিতিটা বুঝতে পেরে ঠোঁট কামড়ে ধরল রানা। একূল-ওকূল-সব কূল হারিয়েছে ওরা। ভিনাস নেই, অ্যান্টিভাইরাসটাও রেডি হয়নি, হলেও ডিস্ট্রিবিউট করা যাবে না–কাজেই ইউনো-ভাইরাসটাকে ঠেকানো আর কোনও উপায় বা সময়, কোনওটাই নেই। শুধু তা-ই নয়, শিপে নেমে এসেছে আলফা টিমের ভয়ঙ্কর খুনীরা, আত্মরক্ষার জন্য কোনও অস্ত্র নেই ওদের কাছে–কাজেই জীবন বাঁচানো যাচ্ছে না সম্ভবত।

এমন দিশেহারা অবস্থায় আগে কখনও পড়েনি রানা। রায়হান আর টিনা তাকিয়ে আছে ওর দিকে–ভাবছে মাসুদ ভাই নিশ্চয়ই একটা কিছু বাঁচার পথ বের করবেন। কিন্তু করবেটা কী ও? কিছুই বুঝতে পারছে না।

ল্যাপটপ নিয়ে ক্যাপ্টেন ডিলানকে কম্পিউটার সেকশনে ঢুকতে দেখে সংবিৎ ফিরল ওর। তাড়াতাড়ি মাথা ঠাণ্ডা করে সিস্টেম্যাটিক্যালি এগোবার সিদ্ধান্ত নিল। এতে সফল হবে না বিফল হবে–তা পরে দেখা যাবে।

টিনার দিকে তাকাল রানা। বলল, ল্যাপটপটা নাও। তোমার কাজটুকু তুলে ফেলো ওটায়। গলার স্বর আশ্চর্য রকম শান্ত ওর, সমস্ত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ঝেড়ে ফেলেছে। যা হবার হোক, কিন্তু নিজের কায়দায় কাজ করে যাবে ও। ক্যাপ্টেনের দিকে তাকিয়ে বলল, টিনা… সেই সঙ্গে আপনার সমস্ত ক্রু নিয়ে একদম নীচের ডেকে চলে যান–লুকিয়ে থাকুন, যাতে অ্যাসল্ট টিমটা সহজে খুঁজে না পায় আপনাদের।

আপনারা? জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে রানা আর রায়হানের দিকে তাকাচ্ছেন ডিলান।

লোকগুলোর সঙ্গে লড়াই করার মত ট্রেইনিং শুধু আমাদের দু’জনেরই আছে। তাই আমরা ওদের ঠেকাবার চেষ্টা করব।

কিন্তু আপনাদের কাছে তো কোনও অস্ত্র নেই!

কে বলেছে নেই? একটু হাসল রানা। ধৈর্য-সাহস-বুদ্ধি… এগুলো কি অস্ত্র নয়?

যাবেন না, মাসুদ ভাই, অনুনয় করল টিনা। এবার আর ওদের সঙ্গে পারবেন না আপনি। এবার আপনার কাছে গানপাউডার বা বোমা কিছুই নেই।

তবু আমাকে যেতে হবে, টিনা, শান্তভাবে বলল রানা। নিজে মরি তাতে ক্ষতি নেই, কিন্তু তোমাদের খুন হতে দেখতে পারব না আমি। অবশ্য রায়হান যদি থেকে যেতে চায়…

কী বলছেন, মাসুদ ভাই! আহত কণ্ঠে বলে উঠল রায়হান। আপনি একা একা মৃত্যুর মুখে ঝাঁপিয়ে পড়বেন, আর আমি সেটা চুপচাপ বসে দেখব? কক্ষনো না! আমি আছি আপনার সঙ্গে।

প্লিজ, রায়হান, ফিসফিস করল টিনা। তোমাকে… তোমাকে আমি হারাতে চাই না।

এগিয়ে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরল তরুণ হ্যাকার। ঠোঁটে চুমো দিয়ে বলল, আমাকে তুমি কখনও হারাবে না, টিনা। কাছে থাকি বা দূরে, আমি সবসময় তোমারই থাকব।

প্লিজ, আমার কথা শোনো…

আমাকে আর বাধা দিয়ো না, টিনা। আমি, কাপুরুষের মত মরতে চাই না, মরতে হলে লড়াই করেই মরব।

চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে এল টিনার। বলল, ঠিক আছে, যাও, কিন্তু মরবার অনুমতি দিচ্ছি না। আমার কাছে ফিরে আসতে হবে তোমাকে।

আমি আপ্রাণ চেষ্টা করব। বলে হাসল রায়হান। তারপর তাকাল রানার দিকে। চলুন, মাসুদ ভাই, থিও আর ওর দোস্তদের দেনা-পাওনা মিটিয়ে দিয়ে আসি।

.

ছড়িয়ে পড়েছে আলফা টিম। একসঙ্গেই টার্গেটদের খোঁজে তল্লাশি শুরু করেছিল তারা, কিন্তু প্রথম ডেকে কাউকে না পেয়ে বুঝতে পেরেছিল–শিকারেরা সবাই লুকিয়ে পড়েছে। জাহাজটা বেশ বড়, পালিয়ে। পালিয়ে বেড়াতে পারে মাসুদ রানা আর তার সঙ্গীরা, খুনীরা তিনজনেই একসঙ্গে থাকলে হয়তো আর খুঁজেই পাবে না ওদের। তাই ঠিক করা হয়েছে, সুপারস্ট্রাকচারের তিনটে অংশ থেকে তল্লাশি শুরু করবে ওরা–মিলবে এসে জাহাজের কেন্দ্রে। এ পদ্ধতিতে এগোলে ফাঁদে পড়া ইঁদুরের দশা হবে। শিকারদের, ধরা পড়তে বাধ্য হবে।

এ-মুহূর্তে আলফা-টু রয়েছে জাহাজের তিনতলায়–একে একে সমস্ত কেবিন চেক করতে করতে এগোচ্ছে। এই ডেকের বেশিরভাগ কামরাই বিভিন্ন। ধরনের আফস আর ল্যাব, অ্যাকোমোডেশন নেই কোনও অফিসগুলোয় লুকানোর কোনও জায়গাই নেই, ল্যাবগুলোরও কমবেশি একই অবস্থা–তাই একটু হলেও ঢিল পড়েছে তার পেশিতে। দায়সারা ভঙ্গিতে তল্লাশি করছে সে।

সিঁড়ির আগে শেষ কামরাটা কেমিক্যাল ল্যাব, ওটারও দরজা খুলে যেন-তেনভাবে উঁকি দিল সে, কিন্তু ভিতরে চোখ পড়তেই থেমে গেল। লাইট জ্বলছে না, কিন্তু পোর্টােল দিয়ে আসা চাঁদের আলোয় আবছাভাবে ধরা পড়ছে। একটা ছায়ামূর্তি–টেবিলের পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সেটা।

সাবধানে ভিতরে ঢুকল আলফা-টু। পা টিপে এগোেল কয়েক কদম, তারপর বিনা নোটিশে মেশিনগান তুলে ব্রাশফায়ার করতে শুরু করল। ঠং ঠং করে শব্দ হতে থাকল ইস্পাতের বাল্কহেডে বুলেট আঘাত করায়, একই সঙ্গে মূর্তিটাও একপাশে কাত হয়ে পড়ে গেল।

এবার সুইচ টিপে লাইট জ্বালল আলফা-টু, এগিয়ে গেল গুলিবিদ্ধ শিকারকে দেখতে। টেবিলের পাশে পৌঁছুতেই মুখ দিয়ে একটা খেদোক্তি বেরিয়ে এল তার–মানুষ নয় ওটা, কোট-হ্যাঙ্গার। দণ্ডের মত লম্বা জিনিসটায় ঝোলানো ছিল একটা ল্যাব-ওভারকোট, উপরে আবার একটা টুপিও আছে–অন্ধকারে এটাকেই মানুষ বলে মনে হচ্ছিল।

আলফা-টু যখন ঝুঁকে কোট হ্যাঙ্গারটা দেখছে, ঠিক তখুনি পিছনে বাল্কহেডের গায়ে তৈরি ক্লজিটের দরজা খুলে গেল ধীরে ধীরে, সাবধানে ওখান থেকে বেরিয়ে এল একজন মানুষ। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় খুব তীক্ষ্ণ আলফা-টু-এর, বিপদটা টের পেয়ে গেল সে কীভাবে যেন। ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল ব্যাপার কী দেখার জন্য।

দৃশ্যটা দেখে খুশি হওয়া উচিত তার, একজন শিকারকে পেয়ে গেছে সে, দাঁড়িয়ে আছে কয়েক গজ দূরেই, কিন্তু কেন যেন মন কুডাক ডেকে উঠল। সামনে দাঁড়ানো রায়হান রশিদের হাতদুটোই এর কারণ। পাতলা কাঁচের তৈরি একটা প্রমাণ সাইজের বিকার ধরে আছে ও, সেটার বেশিরভাগটাই স্বচ্ছ তরলে ভরা। সন্দেহ নেই, এটা একটা ফাঁদ–কোট-হ্যাঙ্গারটাকে মানুষের আদলে সাজিয়ে প্রলুব্ধ করা হয়েছে তাকে। কিন্তু হাতে ধরা জিনিসটা কী?

কৌতূহলটা নিবৃত্ত করতে চাইল না অভিজ্ঞ খুনী, মেশিনগানটা সোজা করে গুলি করার চেষ্টা করল, কিন্তু রায়হান তার চেয়ে এগিয়ে আছে। বিদ্যুৎবেগে বিকারটা ছুঁড়ে দিল ও, সেটা এসে সজোরে আছড়ে পড়ল কার্টারের মুখে। শব্দ করে ভেঙে গেল পাত্রটা, ভিতরের তরলটা ভিজিয়ে ফেলল তাকে।

সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড যন্ত্রণা অনুভব করল আলফা-টু। হিস হিস শব্দ হচ্ছে, মুখমণ্ডল পুড়িয়ে ফেলছে তরলটা-ওটা আসলে ঘন সালফিউরিক অ্যাসিড! অস্ত্র। ফেলে দিয়ে মুখ চেপে ধরল সে, হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল, গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে। পানি… পানি দরকার তার, অ্যাসিডটা ধুয়ে ফেলতে হবে, কিন্তু চোখে যে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না! ঘন অ্যাসিড চোখের মণি গলিয়ে ফেলেছে, থিকথিকে ধারায় বের করে দিচ্ছে অক্ষিকোটর থেকে–কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে অপটিক্যাল নার্ভের চ্যানেল ধরে পৌঁছে যাবে মগজের ভিতরেও।

কাত হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল আলফা-টু, সারা শরীর এমনভাবে কাঁপছে যেন হাই ভোল্টেজ কারেন্ট বয়ে যাচ্ছে ভিতর দিয়ে। একটু পরেই থেমে গেল তার নড়াচড়া, কিন্তু অ্যাসিডটা তখনও কাজ করে যাচ্ছে–মাংস পুড়িয়ে, হাড় ভেদ করে ধ্বংস করে দিচ্ছে পুরো করোটিকে। দৃশ্যটা বীভৎস, উৎকট দুর্গন্ধও। ছড়িয়ে পড়েছে ল্যাবের ভিতরে, কিন্তু নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল রায়হান। মনের মধ্যে করুণা অনুভব করছে না কোনও, বিষাক্ত একটা কীটকে পায়ের। তলায় ফেলে মারলে যেমনটা লাগে–ঠিক তেমনই একটা অনুভূতি কাজ করছে। ওর ভিতরে। বিষাক্ত কীট-ই ছিল লোকটা–অসহায় মানুষকে খুন করে বেড়াত। টিনাকে নিয়েও বাড়াবাড়ি করেছে।

আগেই বলেছিলাম, বিড়বিড় করল রায়হান, তুমি আমার হাতে মরবে!

.

১৯.

উনিশ রানার ভাগ্য অবশ্য রায়হানের মত ভাল নয়-ফাঁদ পাতার সময় পায়নি ও, তার আগেই পড়ে গেছে আলফা-থির সামনে। খুনীরা যে ওদের খোঁজে ছড়িয়ে পড়ে তল্লাশি শুরু করবে, সেটা জানত ও। চতুর এবং দক্ষ তিন সৈনিক একসঙ্গে থাকলে কোনও ধরনের অস্ত্র ছাড়া তাদের ঘায়েল করা এক কথায় অসম্ভব। তাই বিচ্ছিন্ন থাকা অবস্থাতেই একে একে লোকগুলোকে খতম করার প্ল্যান এঁটেছিল ও-রায়হানকে পাঠিয়ে দিয়েছিল কেমিক্যাল ল্যাবে ফাঁদ পাতার জন্য, নিজে রয়ে গেছে নীচে।

সেটাই হয়েছে কাল, এই ডেকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের মত কিছুই পায়নি ও, ফাঁদ পাতার মতও ভাল জায়গা নেই। লুকিয়ে লুকিয়ে এক কেবিন থেকে আরেক কেবিনে ঢু মেরে বেড়াচ্ছিল, কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। সোনার রুম থেকে ২ রডরে বেরুতেই বটের শব্দ পেল রানা। লুকিয়ে পড়ার সময় পেল না, চোখের পলকে বামদিকে, বিশ গজ দূরের মোড় ঘুরে উদয় হলো আলফা-থ্রি।

চমৎকার রিফ্লেক্স লোকটার, টার্গেটকে দেখতে পেয়েই কোমরের কাছে ধরা মেশিনগান থেকে ফায়ার করল, তবে রানাও কম যায় না। সেকেণ্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে মেঝেতে ডাইভ দিয়ে গুলিবৃষ্টি এড়াল ও, ডিগবাজি খেয়ে চলে এল ডানদিকের দ্বিতীয় মোড়টার আড়ালে। পিছনে ফুলকি উড়ল, ব্যর্থ বুলেটগুলো বাল্কহেডে ঘষা খেয়ে আগুন ঝরাচ্ছে।

কাঁধের পেশিতে ব্যথা অনুভব করল রানা, হাত দিতেই আঙুলে রক্ত মেখে গেল–একটা গুলি মাংস ভেদ করে বেরিয়ে গেছে। দাঁতে দাঁত পিষে কষ্টটা সহ্য করল ও, উঠে দাঁড়িয়ে ছুটতে শুরু করল–লুকানোর একটা জায়গা খুঁজছে। সামনেই একটা হ্যাঁচ পড়ল-পাশের বাল্কহেডে তীরচিহ্ন দিয়ে লেখা: ডাইভিং পুল।

হ্যাচটা গলে নীচের কম্পার্টমেন্টে নেমে এল ও। ভিতরে ব্যস্ত দৃষ্টি বোলাতেই বৃত্তাকার পুলটা দেখতে পেল–সাগরের নীল পানি ঝলমল করছে, এখান দিয়ে নীচে নামে ডুবুরিরা। কী যেন ভাবল রানা, তাড়াতাড়ি খুঁজে বের করল ডাইভিং স্টোরটা–একপাশের বাল্কহেডে ওটার দরজা পাওয়া গেল। স্টোররুমটায় ঢুকে ক্লজিটের দরজা খুলল রানা, ভিতরে রাখা ডাইভিং ইকুইপমেন্টের মধ্যে ঝড়ের বেগে হাত চালাল।

অক্সিজেন সিলিণ্ডার আর মাস্ক সরিয়ে দুটো হারপুন গান পেল ও, কিন্তু এতে কাজ হবে না। অটোমেটিক মেশিনগানের বিরুদ্ধে হারপুন গান কিছুই নয়, তা ছাড়া খুনীরা কেভলারের তৈরি বুলেটপ্রুফ ভেস্ট পরে আছে, বর্শাগুলো সেটা ভেদ করতে পারবে না। আরেকটু খুঁজল ও, হঠাৎ টিউবলাইট আকৃতির পাঁচফুট লম্বা একটা সাদা দণ্ড দেখতে পেয়ে মুখে হাসি ফুটল–এটাই চাইছিল।

মিনিটখানেক পরেই উপরে হ্যাঁচের কাছে এসে পৌঁছুল আলফা-থ্রি। সাবধানে, সতর্ক পদক্ষেপে এগিয়েছে সে, রানার তৈরি কোনও ফাঁদে পড়তে। চায় না, তাই একটু দেরি হয়েছে। তীক্ষ্ণ চোখে মেঝেতে নজর বোলাল সে, রানার ক্ষত থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরা রক্ত একটা ট্রেইল তৈরি করেছে, হ্যাঁচ ধরে নীচে নেমে গেছে সেটা। দুর্ধর্ষ খুনীর মুখে হাসি ফুটল-যাক, শিকারকে আহত করা গেছে। চারপাশ বন্ধ একটা কম্পার্টমেন্টে নেমেছে ব্যাটা, ওখানে। সহজে শিকার করা যাবে ওকে–ব্যাপারটা স্রেফ হাঁড়ির মধ্যে মাছ মারার মত হতে যাচ্ছে। মেশিনগানটা ভাল করে বাগিয়ে ধরল সে, তারপর পা টিপে নামতে শুরু করল সিঁড়ি ধরে।

অর্ধেকের মত নেমে এসেছে, এমন সময় সিঁড়ির দুধাপের মাঝখানের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এল একটা সাদা রঙের লাঠির মত জিনিস। সোজা নীচে গেটিঙের ফাঁক দিয়ে রানাকে দেখতে পেল আলফা-থি, অ্যালুমিনিয়ামের একটা পোল ঢুকিয়ে ওর পায়ে বাধাতে চাইছে গর্দভটা–ভাবছে। সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে ফেলে দেবে তাকে। হেসে উঠল দুর্ধর্ষ খুনী-কী ছেলেমানুষি করছে লোকটা! থেমে দাঁড়িয়ে নীচদিকে রানার উপর অস্ত্র তাক করল আলফা-থ্রি, লাথি দিয়ে সরিয়ে দিতে গেল পোলটা।

ঠিক তক্ষুণি শোনা গেল বিস্ফোরণের মত একটা শব্দ।

অসহ্য যন্ত্রণার একটা ঢেউ বয়ে গেল আলফা-থ্রির শরীরে, চোখের সামনে। দপ করে জ্বলে উঠল কী যেনগুলি আর করা হলো না তার। চেষ্টা করেও ব্যালেন্স ধরে রাখতে পারল না সে, একদিকে কাত হয়ে পড়ে গেল সিঁড়িতে, গড়াতে শুরু করেছে। ধাতব ল্যাডারে নির্মমভাবে ঠোকর খেতে খেতে কম্পার্টমেন্টের মেঝেতে এসে আছড়ে পড়ল, হাত থেকে মেশিনগানটা ছুটে চলে গেছে আগেই।

কোনওমতে মাথা তুলল আলফা-থ্রি, চারপাশে ছড়ানো-ছিটানো রক্ত দেখে অবাক হলো–বুঝতে পারছে না, এত রক্ত এল কোত্থেকে! দাঁড়াবার চেষ্টা। করতে গিয়েই দৃষ্টি বিস্ফারিত হয়ে গেল তার, এবার ধরতে পারছে রহস্যটা, হাটুর ছইঞ্চি, নীচ থেকে তার ডান পা-টা উধাও হয়ে গেছে, অঝোর ধারায় সেখান দিয়ে বেরিয়ে আসছে রক্ত… তার নিজের রক্ত!

আতঙ্কিত দৃষ্টিতে মাথা ঘোরাল আলফা-থ্রি-রানাকে দৃঢ় পায়ে এগিয়ে আসতে দেখল, এখনও লোকটার হাতে সাদা রঙের পোলটা রয়েছে, ডগা থেকে ধোয়া বেরুচ্ছে ওটার। জিনিসটা আসলে ব্যাং-স্টিক, বা পাওয়ারহেড শার্ক-কন্ট্রোল ডিভাইসঅ্যালুমিনিয়ামের পোলটার ভিতরে একটা প্রেশার-সেন্সিটিভ ফায়ারিং মেকানিজম আছে, ওটার সাহায্যে এক্সপ্লোসিভ শেল ছোঁড়া হয়। লাঠির মত নিরীহদর্শন হলেও ব্যাং-স্টিক আসলে শক্তিশালী একটা অস্ত্র হাঙরের হাত থেকে বাঁচার জন্য ডুবুরিরা ব্যবহার করে এটা। এসব জানা ছিল না আলফা-থ্রির, বোকার মত লাথি মেরে নিজের পা উড়িয়ে দিয়েছে বেচারা।

নির্দয় ভঙ্গিতে এগোচ্ছে রানা, ব্যাং-স্টিক থেকে খালি শেলটা ফেলে দিয়ে নতুন একটা ভরল–ডাইভিং স্টোরের ক্লজিটে বাড়তি অ্যামিউনিশনও পেয়েছে। ও। নিজের পরিণতি কী হতে যাচ্ছে, তা নিয়ে আর সন্দেহ রইল না আলফা-থ্রির, কাঁপা কাঁপা হাতে কোমরে হাত দিল সে, হোলস্টার থেকে পিস্তলটা বের করে আনতে চাইছে।

কোনও তাড়া লক্ষ করা গেল না রানার মধ্যে, পড়ে থাকা খুনীর পাশে এসে শান্ত ভঙ্গিতে দাঁড়াল ও, তাকে পিস্তলটা বের করে আনতেও বাধা দিল না। অস্ত্রটা ওর দিকে তাক হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল রানা, তারপরই নড়ে উঠল।

গুডবাই! বলে ব্যাং-স্টিকটা তলোয়ার বেঁধানোর ভঙ্গিতে সজোরে নামিয়ে আনল ও খুনীটার গলায়।

.

সি-স্কুইরেলের লোয়ার ডেকে তল্লাশি চালাচ্ছে আলফা-ওয়ান। হঠাৎ খড় খড় করে উঠল ওয়াকিটকিটা। গুরুগম্ভীর স্বরে তার নাম ধরে ডাকা হলো, থিও, জবাব দাও।

ভুরু কুঁচকে গেল আলফা-ওয়ানের। মুখের কাছে সেট তুলে সে বলল, কে… আলফা-থ্রি, তুমি?

না, থিও। আমি মাসুদ রানা।

বিস্মিত হলো থিও। তুমি আমাদের ফ্রিকোয়েন্সি পেয়েছ কীভাবে?

ফ্রিকোয়েন্সি পাইনি, ওয়াকিটকিটাই পেয়ে গেছি। মেলভিনের সেটটা এখন আমার কাছে।

থমকে গেল আলফা-ওয়ান। আর ও?

বলে দেয়ার প্রয়োজন আছে কি?

তুমি ওকে মেরে ফেলেছ?

হ্যাঁ। এবার তোমার পালা, আমি আসছি তোমার জন্য।

মাথার ভিতর যেন অ্যালার্ম বাজতে শুরু করেছে আলফা-ওয়ানের। তাড়াতাড়ি ওয়াকিটকিতে ডাকল কার্টারকে। আলফা-টু, অ্যাবোর্ট! অ্যাবোর্ট অপারেশন!! ফিরে এসো এক্ষুণি। রানা…

কথা শেষ হলো না তার, ওয়াকিটকিতে ভেসে এল নতুন একটা কণ্ঠ,কার্টারের সেটে কথা বলছে মানুষটা। দুঃখিত, আলফা-টু জবাব দিতে পারছেন না। পরপারের উদ্দেশে ওয়ান-ওয়ে টিকেট নিয়ে রওনা হয়ে গেছেন তিনি।

গলাটা রায়হানের।

চমকে গেল থিও–দুই সঙ্গীকে হারিয়েছে সে। তারমানে মাসুদ রানা আর রায়হান রশিদ এখন ওদের অস্ত্রশস্ত্রের কল্যাণে সশস্ত্র! দেয়ালের লিখন পড়তে একটুও অসুবিধে হলো না অভিজ্ঞ খুনীর-যুদ্ধটায় হার হয়েছে তার। দুর্ধর্ষ ওই দুই বাঙালির সঙ্গে একা কিছুতেই পেরে উঠবে না সে।

ওয়াকিটকিতে এবার বোনকে ডাকল থিও, এলিসা, তুমি শুনতে পাচ্ছ?

সব শুনেছি আমি, হন্তদন্ত ভঙ্গিতে জবাব দিলেন প্রৌঢ়া বিজ্ঞানী, হামলাকারী হেলিকপ্টারটায় বুলডগের সঙ্গে রয়েছেন তিনি। তুমি জলদি আফট ডেকে চলে এসো, আমরা তোমাকে পিকআপ করে নিচ্ছি।

উল্টো ঘুরে দৌড়াতে শুরু করল আলফা-ওয়ান। ল্যাডার বেয়ে উপরে উঠল। তারপর দুদ্দাড় করে বেরিয়ে এল আফট ডেকে।

মাথার উপরে রোটরের গর্জন শোনা গেল, হেলিকপ্টারটা চলে এসেছে। কিন্তু ওখান থেকে দড়ি ফেলার সুযোগ পেলেন না এলিসা, ব্রিজের ছাদে উদয় হলো একটা ছায়া–এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়তে শুরু করল। ঠ্যাক ঠ্যা করে বিশ্রী শব্দে কপ্টারের গায়ে বিধতে শুরু করল বুলেট, উইণ্ডশিল্ডেও ফাটল ধরাল।

গাল দিয়ে উঠল বুলডগ, পাইলটকে বলল, সরে যাও! সরে যাও এখান থেকে!!

না-আ! চেঁচিয়ে উঠলেন এলিসা। আমার ভাই রয়েছে নীচে। ওকে ফেলে যেতে পারব না আমি।

না সরলে আমাদেরও ওর সঙ্গে যোগ দিতে হবে, কঠিন গলায় বলল বুলডগ। অ্যাই ব্যাটা পাইলটের বাচ্চা! সরতে বললাম না তোকে? *

মাথা ঝাঁকিয়ে কন্ট্রোল কলাম ঘোরাল পাইলট, সাঁই করে সি-স্কুইরেলের। উপর থেকে সরে গেল কপ্টার, দূরে চলে যাচ্ছে। জানালার কাঁচে হাত রেখে বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন এলিসা।

ডেকের উপর আলফা-ওয়ানেরও একই দশা, মুখের ভাষা হারিয়েছে সে। আপন বোন… যার জন্য এতকিছু করেছে, মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়েছে, নিদ্বিধায় মানুষ খুন করেছে… সে-ই কি না তাকে ফেলে চলে গেল! আচমকা প্রচণ্ড ক্রোধ ভর করল থিও-র মধ্যে। উন্মাদের মত চেঁচিয়ে উঠল সে, সবকিছু ভুলে গিয়ে টিপে ধরল মেশিনগানের ট্রিগার, সুপারস্ট্রাকচারের দিকে ফিরে বৃষ্টির মত গুলি করছে, সবকিছু ঝাঁঝরা করে ফেলতে চায়।

রাগে অন্ধ হয়ে গেছে সে, নইলে বিপদটা টের পেত সময় থাকতেই। যখন পেল তখন আর করার কিছু নেই। শরীরের খুব কাছে বিশাল একটা অবয়বের। উপস্থিতি টের পেয়ে চমকে উঠে মাথা ঘোরাল সে, উইঞ্চে ঝোলানো ট্রাইটন মিনি-সাবমেরিনটাকে বিকট এক পেণ্ডুলামের মত ছুটে আসতে দেখল। সরবার সময় পেল না আলফা-ওয়ান, সজোরে তাকে এসে আঘাত করল সেটা, ঠিক একটা গলফ বলের মত উড়িয়ে দিল।

বাতাস কেটে ডেকের আরেক প্রান্তে গিয়ে আছড়ে পড়ল থিও, চেঁচিয়ে উঠল ব্যথায়, শরীরের একপাশের সমস্ত হাড় ভেঙে গেছে তার। সুস্থ পাশটায় ভর দিয়ে একটু উঁচু হলো সে–তাকাল উইঞ্চ অপারেটরের বক্সটার দিকে। চাঁদের আলোয় প্লেক্সিগ্নাসের উল্টোপাশে বসা মাসুদ রানাকে চিনতে একটুও অসুবিধে হলো না তার–গুলিবৃষ্টি ভেদ করে এগোতে পারায় ওখানে গিয়ে ঢুকেছে ও, উইঞ্চে ঝোলানো সাবমেরিনটাকেই অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে।

তিক্ত একটা হাসি হাসল আলফা-ওয়ান। লোকটার উপস্থিতবুদ্ধির সঙ্গে কিছুতেই পেরে উঠছে না, তার জীবনে শনি হয়ে উদয় হয়েছে এই বাঙালিটা। তীব্র ঘৃণায় ভাল হাতটা দিয়ে সাবমেশিনগানটা তুলে ধরল কঠিন চেহারার যুবক, কাঁধ থেকে স্ট্র্যাপে ঝোলানো থাকায় অস্ত্রটা এখনও রয়ে গেছে তার কাছে। সময় নিয়ে লক্ষ্য স্থির করল সে, কিন্তু ট্রিগার চাপতে গিয়েই থমকে গেল–চাঁদের আলো আর পড়ছে না তার গায়ে, উপর থেকে নেমে এসেছে। একটা কালো ছায়া। মুখ তুলে তাকাতেই মিনি-সাবটাকে আবার দেখতে পেল। উইঞ্চ ঘুরিয়ে ওটাকে ঠিক তার মাথার উপরে নিয়ে এসেছে রানা।

কী ঘটতে যাচ্ছে বুঝতে পেরে একটা কথাই শুধু বলল আলফা-ওয়ান। হা, ঈশ্বর।

পরমুহূর্তেই ট্রাইটন থেকে উইঞ্চের হোল্ডিং ক্ল্যাম্প আলগা করে দিল রানা, প্রবল বেগে পঞ্চাশ, টন ওজনের ডুবোজাহাজটা নেমে এল হতভাগ্য খুনীর উপর। যেন তেলাপোকাকে মাড়িয়ে দেয়া হয়েছে–এমন একটা থ্যাচ শব্দ হলো। ট্রাইটনের নীচে ভর্তা হয়ে গেল থিও ভ্যান ব্যুরেন ওরফে আলফা-ওয়ান।

.

চলে যায়নি হেলিকপ্টারটা, সি-স্কুইরেল থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে হোভার করছে। চোখে বিনকিউলার লাগিয়ে ডেকের দিকে তাকিয়ে আছেন এলিসা ভ্যান ব্যুরেন, চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেলেন তাঁর একমাত্র ভাইয়ের শেষ পরিণতি। দৃষ্টি বিস্ফারিত হয়ে গেল প্রৌঢ়া ইউনোর, চেঁচালেন না, শুধু বিনকিউলার নামিয়ে ফিসফিস করলেন, ওরা… ওরা থিওকে খুন করেছে!

বুলডগের হাতেও আরেকটা দূরবীন রয়েছে, সে-ও প্রত্যক্ষ করেছে ব্যাপারটা। বিরক্ত গলায় বলল, উচিত হয়েছে! গাধা কোথাকার, আমাকে টিম আনতে দেয়নি, মাত্র তিনজনে গেছে রানাকে খতম করতে… মরবেই তো!

খবরদার, মি. বুলক! চেঁচিয়ে উঠলেন এলিসা। আমার ভাইকে একটা গালিও দেবেন না!

চুমো দিলেই বা কী লাভ হবে? সরোষে বলল বুলডগ। আপনার পুরো প্ল্যান চৌপাট হয়ে গেছে। আলফা টিম শেষ, কাজেই আর কোনও চিন্তা নেই রানার। এখন শান্তিতে অ্যান্টিভাইরাসটা ডিস্ট্রিবিউট করে দেবে ও।

অসম্ভব! নুমার কম্পিউটারটাকে অচল করে দিয়েছি আমি। সিটে রাখা ল্যাপটপটা দেখালেন এলিসা-ওটার মাধ্যমেই ভিনাসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছেন তিনি।

তাতে কী? দুনিয়ায় সুপার-কম্পিউটার কি ওই একটা? ক্রিস্টিনা মেয়েটা আছে রানার সঙ্গে, সে ইউনোকোড ব্যবহার করে আরেকটা কম্পিউটারে ঢুকে পড়তে পারে, সেটার সাহায্য নিতে পারে।

তা হলে?

ওদেরকে এখুনি খতম করে দিতে হবে। ইউনোকোড ব্যবহারের কোনও সুযোগই দেয়া যাবে না ওদের।

আমিও তো সেটাই চাই, বললেন এলিসা। আমার ভাইয়ের খুনের প্রতিশোধ নিতে হবে আমাকে। কিন্তু কীভাবে সেটা সম্ভব? আমরা দু’জনে তো। ওদের সঙ্গে পেরে উঠব না।

একটু ভাবল বুলড়গ। হঠাৎ হাসি ফুটল তার মুখে, এলিসার দিকে তাকিয়ে বলল, পারবেন, ডক্টর। আমাকে প্রয়োজন নেই, আপনি একাই ওদের পুরো জাহাজটাকে ধ্বংস করে দিতে পারবেন।

কীভাবে?

ডাচ নেভির একটা জাহাজের সিস্টেমে হ্যাঁক করে। আসুন, বুঝিয়ে দিই কী করতে হবে আপনাকে…

.

উপকূল থেকে মাত্র চল্লিশ মাইল দূরে উত্তর সাগরে টহল দিচ্ছে রয়্যাল নেদারল্যাণ্ডস নেভির মিসাইল-ফ্রিগেট ভ্যান অ্যামস্টেল। রাতের ওয়াচ বলে ডিউটিতে একটু ঢিলেঢালা ভাব, পোস্টে বসে অনেকেই ঝিমুচ্ছে-ওয়েপনস। সিস্টেমে বসা লিডিং সি-ম্যান জর্গেনসেনও তাদের দলে। প্রায় ঘুমিয়েই পড়ছিল। সে, হঠাৎ টুটে গেল তন্দ্রাটা। কনসোলে হঠাৎ একটা বাতি জ্বলে উঠেছে অস্বাভাবিকভাবে। সন্দেহ হলো জর্গেনসেনের, তন্দ্রার ঘোরে ভুল করে কোনও কিছুতে চাপ দিয়ে ফেলেছে কি না। তাড়াতাড়ি সবকিছু চেক করে দেখল সেনা, এমন কোনও প্রমাণ তো দেখা যাচ্ছে না! কনসোলের দ্বিতীয় বাতিটা জ্বলতেই ঝট করে সোজা হলো অভিজ্ঞ নাবিক, গোলমালটা ধরতে পেরেছে। প্রথমবার তার ভুলে একটা বাতি জ্বলতে পারে, কিন্তু এবার তো কিছুই করেনি সে!

সামনের এলসিডি মনিটরটা আলোকিত হয়ে উঠতেই চমকে গেল জর্গেনসেন–হচ্ছেটা কী এসব? কে অন করছে সবকিছু? মনিটরে ভেসে ওঠা। প্রটোকলটা চোখে পড়ল এবার, সঙ্গে সঙ্গে হার্ট অ্যাটাক করবার মত অবস্থা হলো তার, তাড়াতাড়ি কীবোর্ড নিয়ে টিপতে শুরু করল, কমাণ্ডটাকে ক্যানসেল করে দিতে চায়। এবার আরেক দফা অবাক হতে হলো তাকে-কোনও কাজই হচ্ছে না কীবোর্ডে, নিজের মত চলছে সিস্টেমটা, যেন ওটার জীবন আছে, নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি আছে!

চেয়ার ছেড়ে ধড়মড় করে উঠে পড়ল জর্গেনসেন, নিজের অজান্তেই পিছিয়ে গেল দু’পা। নিজ চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না–এ অসম্ভব, এ হয় কী করে? তাড়াতাড়ি ইন্টারকম তুলে অফিসার অভ দ্য ওয়াচের সঙ্গে যোগাযোগ করল। জর্গেনসেন, স্যর। একটা ইমার্জেন্সি দেখা দিয়েছে, আপনি এক্ষুণি ওয়েপনস্ কন্ট্রোলে আসুন।

মিনিটখানেক পরেই চলে এল অফিসার অভ দ্য ওয়াচ। সমস্যাটা শুনে এক মুহূর্তও দেরি করল না, খবর দিল অধিনায়ককে। রাতের পোশাক পরেই ছুটে এলেন ক্যাপ্টেন জেনাস ক্রমবার্গ, ইউনিফর্ম পরার জন্য সময় নষ্ট করেননি।

হচ্ছেটা কী এখানে? গরম গলায় জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

মিসাইল-কন্ট্রোল জ্যান্ত হয়ে উঠেছে, স্যর, বলল জর্গেনসেন। ওটা প্রি-লঞ্চ চেক করতে শুরু করেছে।

জ্যান্ত হয়ে উঠেছে মানে? কে অন করেছে ওটা?

আমি না, স্যর। আমার কাছে তো সিকিউরিটি কোড-ই নেই।

ড্রিল-চেকের জন্য কোড দরকার হয় নাকি?

এটা ড্রিল নয়, স্যর। সত্যি সত্যি লঞ্চিং সিকোয়েন্স চালু হয়েছে। প্রটোকলটা নিজ চোখে দেখুন।

চোখ রগড়ে মনিটরের দিকে তাকালেন ক্যাপ্টেন ক্রমবার্গ, সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠলেন। এ অসম্ভব, সত্যি সত্যি একটা মিসাইল লঞ্চ হতে যাচ্ছে! সিকিউরিটি কোড পাঞ্চ করা ছাড়া সম্ভব নয় কাজটা, আর কোডটা একমাত্র তিনিই জানেন।

কীভাবে ঘটল এটা? জর্গেনসেনকে জিজ্ঞেস করলেন ক্যাপ্টেন।

জানি না, স্যর। নিজে নিজেই হচ্ছে সব।

থামাও ওটাকে, কুইক!

আমি চেষ্টা করেছি, কিন্তু কোনও ইনপুটই নিচ্ছে না সিস্টেমটা।

মাস্টার কন্ট্রোলে যাও। ওখানকার কোড দিয়ে নিষ্ক্রিয় করে দাও কনসোলটাকে।

ছুটে চলে গেল জর্গেনসেন। ফিরে এল একটু পরেই, চেহারা ছাইবর্ণ ধারণ করেছে। কাজ হচ্ছে না, স্যর। ওয়েপনস সিস্টেমটা মাস্টার কন্ট্রোল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, ওখানকার কোনও কমাণ্ড পৌঁছুচ্ছে না এখানে।

মনিটর দেখে অফিসার অভ দ্য ওয়াচ বলল, টার্গেট সিলেকশন হচ্ছে, ক্যাপ্টেন।

কো-অর্ডিনেটটা কীসের, তা বের করো এক্ষুণি।

ব্রিজে ছুটে গেল অফিসার। রেকর্ড দেখে ইন্টারকমে জানাল, ওটা একটা অ্যামেরিকান সার্ভে শিপ, ক্যাপ্টেন। নাম, সি-স্কুইরেল–নুমার জাহাজ।

গুড গড! আঁতকে উঠলেন ক্রমবার্গ। এগিয়ে গিয়ে কনসোলের অ্যাবোর্ট বাটন পাগলের মত টিপতে শুরু করলেন।

কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না, অমোঘ নিয়তির মত লঞ্চার থেকে বেরিয়ে গেল মিসাইলটাছুটতে শুরু করল টার্গেটের দিকে।

.

২০.

টিনাকে নিয়ে সি-স্কুইরেলের কম্পিউটার-সেকশনে ফিরে এসেছে রানা আর রায়হান। তরুণী ইউনো জানাল, অ্যান্টিভাইরাস প্রোগ্রামটা থেকে ব্যাকডোরটা সরিয়ে ফেলেছে ও।

গুড, এখুনি শিপের কম্পিউটারে ঢোকাও ওটা, রানা বলল। তারপর ভিনাস থেকে তাড়াও এলিসাকে।

ঘড়ি দেখল টিনা–একটা চল্লিশ বেজে গেছে। বলল, কিন্তু সময় তো আর নেই, মাসুদ ভাই। অ্যান্টিভাইরাসটা তো সবখানে পৌঁছানো সম্ভব নয়।

যতটুকু পারা যায়, তা-ই করো। যদি অর্ধেক দুনিয়াকেও বাঁচাতে পারি, সেটাই বা মন্দ কী?

মাথা ঝাঁকিয়ে কম্পিউটারের সামনে বসে পড়ল টিনা। নুমা হেডকোয়ার্টারে ভিনাসকে দখল করা কোডের লিঙ্ক ধরে খুঁজে বের করল সেটার উৎস। মিনিটখানেকের মধ্যেই এলিসার ল্যাপটপে ঢুকে পড়ল, ও, কোডটাকে নিশ্চল। করে দিতে গেল। কিন্তু একটা জিনিস চোখে পড়তেই থমকে গেল তরুণী ইউনো। নতুন একটা কমাণ্ড পাঠানো হচ্ছে ল্যাপটপ থেকে… সেটা যাচ্ছে। একটা নেভি শিপের কম্পিউটারাইজড় ফায়ার কন্ট্রোল সিস্টেমে।

ওহ গড! করছে কী ডাইনিটা!

কী হয়েছে? জানতে চাইল রানা।

একটা মিসাইল লঞ্চ করেছে ও–আমাদের টার্গেট করে!

হোয়াট! এলিসার কাছে মিসাইল এল কোত্থেকে?

মিসাইলটা ডাচ নেভির। ওদের একটা শিপের কম্পিউটার দখল করে নিয়ে কাজটা করছে ও।

চোয়াল শক্ত হয়ে গেল রানার-রেগে গেছে ভীষণ। সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে শয়তান মহিলাটা। রায়হান আর টিনাসহ ওকে মারতে চাইছে, সেটা নাহয় মেনে নেওয়া যায়; কিন্তু সি-স্কুইরেলে তো নিরীহ আরও মানুষ আছে! তাদের এভাবে খুন করার মানেটা কী! মেয়েমানুষ বলে একটু দয়া দেখাবে। ভেবেছিল, কিন্তু সেটা আর সম্ভব হচ্ছে না।

রায়হানের দিকে তাকাল রানা। ওদের হেলিকপ্টারটা কোথায়?

কাছাকাছিই আছে, যায়নি এখনও… ছাদ থেকে নামার সময় আমাদের স্টারবোর্ড সাইডে দেখে এসেছি ওটাকে।

ব্রিজে যাও, রেইডার থেকে ওদের একজ্যাক্ট পজিশনটা এনে দাও আমাকে।

কোনও প্রশ্ন না করে বেরিয়ে গেল রায়হান।

কী করতে চান? খসখসে স্বরে জানতে চাইল টিনা, নতুন করে আতঙ্ক বাসা বেঁধেছে ওর ভিতরে। একটা মিসাইলের হাত থেকে কীভাবে বাঁচা সম্ভব, সেটা বুঝতে পারছে না।

আমি কিছু করব না, করবে তুমি, বলল রানা। ডাচ নেভির সমস্ত মিসাইল কম্পিউটার-গাইডেড, তারমানে যেটা ছুটে আসছে, সেটাও। ওটাকে ইন্টারসেপ্ট করবে তুমি।

কীভাবে ইন্টারসেপ্ট করব?

মিসাইলটার সঙ্গে একটা ডেটা-লিঙ্ক আছে, মিড-ফ্লাইটে টার্গেট-বদল, এবং সেলফ-ডেস্ট্রাক্ট কমাণ্ড রিসিভ করার জন্য। লিঙ্কটায় ঢুকতে হবে তোমাকে।

আমি… আমি পারব না, মাসুদ ভাই, ভয়ার্ত গলায় বলল টিনা। আমি কোনওদিন এ-ধরনের কাজ করিনি!

তুমি পারবে, টিনা, দঢ় গলায় বলল রানা। তুমি হচ্ছ ইউনোকোডের স্রষ্টা-সাইবার জগতের সত্যিকার ঈশ্বর। আর ঈশ্বর পারেন না, এমন কোনও কাজ নেই।

অদ্ভুত দৃষ্টিতে রানার দিকে তাকাল টিনা, কথাটা ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছে ওকে। মুহূর্তের মধ্যে চেহারায় আমূল পরিবর্তন এল ওর, আতঙ্ক আর দ্বিধা সরে গিয়ে সেখানে বাসা বাধল দৃঢ়সংকল্প। আর কিছু না বলে সোজা হলো ও, হাত রাখল কীবোর্ডে।

.

হেলিকপ্টারের ভিতরে রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে বুলডগ আর এলিসা। চেহারায় উত্তেজনা থাকলেও ভিতরে ভিতরে উল্লাস অনুভব করছে তারা। মিসাইল ছোঁড়া হয়ে গেছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই ওটা এসে আঘাত করবে সি-স্কুইরেলকে। দলবল-সহ মাসুদ রানা ডুবে মরবে, একই সঙ্গে দূর হয়ে যাবে সমস্ত ঝামেলা। ইউনো-ভাইরাস আর পনেরো মিনিট পর নির্বিঘ্নে আঘাত হানতে পারবে বিশ্বজুড়ে, বিজয় হবে তাদের।

আশু-সাফল্যের কথা ভেবে হেসে উঠতে যাচ্ছিল দু’জনে, এমন সময় পাশে রাখা ওয়াকিটকিটা জ্যান্ত হয়ে উঠল। এলিসা ভ্যান ব্যুরেন… ডক্টর, আপনি শুনতে পাচ্ছেন?

রানার গলা চিনতে অসুবিধে হলো না, বুলগের, আলফা-থ্রির সেটে যোগাযোগ করছে। হাত বাড়িয়ে ওয়াকিটকিটা তুলে নিল সে, খুশি খুশি গলায় বলল, মি. মাসুদ রানা! হোয়াট আ প্লেজ্যান্ট সারপ্রাইজ!

মি. বুলক নাকি? আপনিও আছেন ওখানে?

থাকব না কেন? নিজ চোখে আপনার মরণ না দেখে কি শান্তি পাব ভেবেছেন?

তারমানে আপনি জানেন, ড. বুরেন আমাদের লক্ষ্য করে একটা মিসাইল লঞ্চ করেছেন?

জানব না কেন, আইডিয়াটা তো আমিই দিয়েছি।

আপনি? একটু থামল রানা। তারপর শান্ত গলায় বলল, আপনি পাগল হয়ে যাননি তো, মি. বুলক? কার উপরে মিসাইল মেরেছেন, জানেন? আপনার নিজেরই দেশের উপরে… সি-স্কুইরেল একটা অ্যামেরিকান সরকারি শিপ,

এখানে আপনার দেশের বেশ কয়েকজন নিরীহ নাগরিক আছেন।

গোল্লায় যাক দেশ! গরম গলায় বলল বুলডগ। আপনাকে খতম করার জন্য জনা কয়েক অ্যামেরিকান মরলে আমার কিছু যায়-আসে না।

আমাকে খতম করার জন্য, নাকি নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য?

যেভাবে খুশি ভাবতে পারেন, অবহেলার সুরে বলল বুলডগ। আপনি মরলেই তো আমার স্বার্থসিদ্ধি হয়, তাই না?

তারমানে নিরীহ মানুষগুলোর জীবনের কোনও মূল্যই নেই আপনার কাছে?

কান খুলে শুনুন, মি. রানা, একটা জিনিসকেই মূল্য দিই আমি–নিজেকে, নিজের উচ্চাশাকে। আমার পথে আমি কোনও কাঁটা সহ্য করি না-হোক সে অ্যামেরিকান, বা আপনার মত একটা ভেতো বাঙালি!

দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা। সীমাটা আপনি তা হলে ছাড়িয়েই গেলেন, মি. বুলক–স্বার্থের সামনে মনুষ্যত্বকে সম্পূর্ণ বিকিয়ে দিলেন। কাজটা ভাল করলেন না, আমি আগেই আপনাকে সাবধান করেছিলাম–নিজেকে শুধুরে না নিলে আগামীতে আমি আপনাকে আর দয়া দেখাব না।

চেয়েছি নাকি যে দেখাবেন? বিদ্রূপ করল বুলডগ। আপনার সময় তো ফুরিয়ে এসেছে, এখুনি রওনা দেবেন ঈশ্বরের কাছে। মরার আগে সর্বশক্তিমানের কাছে আপনারই দয়া ভিক্ষা করা উচিত।

আমারটা আমাকেই ভাবতে দিন, হাসল রানা। তবে আপনার দিকটা না ভেবে পারছি না আমি। তাই শেষবারের মত একটা সুযোগ দিতে চাই–মিসাইলটা কোনও কিছুতে হিট করবার আগেই ধ্বংস করে দেয়া সম্ভব, করবেন কি না বলুন।

না, মি. রানা, চেঁচিয়ে উঠলেন এলিসা। নেভার!

দুঃখিত, আমাকেও ওঁর সঙ্গে একমত হতে হচ্ছে, বুলডগ বলল।

সেক্ষেত্রে আমিও দুঃখ প্রকাশ করছি, শান্ত গলায় বলল রানা। আপনাদের দয়া দেখাতে পারছি না বলে।

কী বলতে চান? সতর্ক হয়ে উঠল বুলডগ।

বলতে চাই যে, আপনারা দু’জনই মানবজাতির কলঙ্ক। স্বার্থ আর ক্ষমতার লোভে পিশাচ হয়ে গেছেন আপনারা–খুন করছেন নিরীহ মানুষ… এমনকী প্রিয়জনদেরও। এলিসা তাঁর সবচেয়ে কাছের নজন বন্ধুকে খুন করেছেন, আপনিও ক্রিয়েলটেকের দু’জন গার্ডকে ড্রুইভেনড্রেশটে নির্মমভাবে মেরে ফেলেছেন। টিজিভি-র কয়েকশো যাত্রীকে মেরে ফেলতে যাচ্ছিলেন আপনারা, এখন আবার মিসাইল দিয়ে ধ্বংস করে দিতে চাচ্ছেন নিজেরই দেশের একটা জাহাজকে–নিরীহ বিজ্ঞানী আর কু-সহ! কী আর বলব, মানুষ নামের যোগ্য নন আপনারা।

গাল দিচ্ছেন আমাদের? খেপে উঠল বুলডগ। পাছার মধ্য দিয়ে মিসাইলটা যখন ঢুকবে…

দুঃখিত, ওটা আমার নয়, আপনাদের পাছায় ঢুকবে, বলল রানা। ভেবেছেন কী, সঙ্গে একজন ইউনো আছে বলে যা-খুশি তাই করে বেড়াতে পারবেন? জেনে রাখুন, মি, বুলক, এলিসা ভ্যান বুরেন সাইবার জগতের ঈশ্বর নন, ঈশ্বরের বেশধারী একটা ভণ্ড-শয়তান। আসল ঈশ্বর আছে আমাদের সঙ্গে, ইউনোকোড সৃষ্টি করেছে ও, তাই যা-খুশি-তা করবার ক্ষমতা একমাত্র ওর-ই আছে।

ধাক্কা দিচ্ছে, রানা ধাপ্পা দিচ্ছে! চেঁচিয়ে বললেন এলিসা। মিসাইলটা এখনও আমার নিয়ন্ত্রণে আছে, ত্রিশ সেকেণ্ডের মধ্যেই হিট করবে ওটা–এত অল্প সময়ে ঈশ্বরও পারবে না ওটাকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করতে।

তা-ই? হাসল রানা। আরেকবার তাকান তো নিজের কম্পিউটারের দিকে!

এক সঙ্গে ল্যাপটপের মনিটরের দিকে তাকাল বুলডগ আর এলিসা–সবকিছু সরে গিয়ে ওখানে জ্বলজ্বল করে ভাসছে একটা বাক্য… নিষ্ঠুর পরিহাস বলতে হবে, ইউনো-ভাইরাসটা অ্যাক্টিভেট হবার সময় এই বাক্যটা দিয়েই সারা পৃথিবীকে একটা মেসেজ দিতে চেয়েছিলেন কুচক্রী ইউনো:

ইউ আর ডুমড্‌।

পাগলের মত কীবোর্ড টিপলেন এলিসা, কিন্তু কম্পিউটারটা সাড়া দিল না একটুও। হঠাৎ থমকে গেলেন তিনি, রোটরের গর্জন ছাপিয়ে কানে ভেসে আসছে অন্য একটা শব্দ। জানালা দিয়ে তাকাতেই তীব্র বেগে ছুটে আসতে থাকা মিসাইলটাকে দেখতে পেলেন তারা। জাহাজ নয়, ওটা আসছে হেলিকপ্টারটার দিকে!

কন্ট্রোল কলাম নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ড. বুরেনের একান্ত অনুগত পাইলট, সরিয়ে নেবার চেষ্টা করল যান্ত্রিক ফড়িংটাকে। কিন্তু বেচারার সে-চেষ্টায় কোনও লাভ হলো না, মিসাইলটা ইতোমধ্যে টার্গেট লক করে ফেলেছে।

প্রচণ্ড বেগে গিয়ে কপ্টারের গায়ে আঘাত করল ক্ষেপণাস্ত্রটা, ফিউজলাজ ভেঙে ঢুকে গেল শরীরে… তারপরই বিস্ফোরিত হলো। চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে উড়ে গেল আকাশযানটার বেশিরভাগ অংশ, যে-টুকু অবশিষ্ট রইল, সে-টুকু পরিণত হলো জ্বলন্ত একটা অগ্নিপিণ্ডে, খসে পড়ল সুনীল সাগরে। পানিতে কয়েক সেকেণ্ড ভেসে রইল ধ্বংসস্তূপটা, এরপর ধীরে ধীরে তলিয়ে গেল অতলে।

.

আড়মোড়া ভেঙে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল টিনা। হালকা গলায় বলল, বসে থাকতে থাকতে কোমরে ব্যথা হয়ে গেছে। মাসুদ ভাই, চলুন না, ওয়েদার ডেক থেকে একটু ঘুরে আসি? রায়হান, তুমি আসবে?

ঘুরতে যাবে মানে? চোখ কপালে তুলল রায়হান। অ্যান্টিভাইরাসটা ডিস্ট্রিবিউট করতে হবে না? ভিনাস…

এলিসার ল্যাপটপটা অচল হবার সঙ্গে সঙ্গে ভিনাসের নিয়ন্ত্রণ ফিরে গেছে মি. ল্যারি কিঙের কাছে, বাধা দিয়ে বলল টিনা। ওটা এখন নিজ থেকেই কাজ। করতে পারবে। অবশ্য… না করতে পারলেও অসুবিধে নেই।

কী বলছ এসব! পনেরো মিনিটও নেই, ভিনাস ঠিক থাকলেও তো সবখানে। পৌঁছুনো সম্ভব নয় অ্যান্টিভাইরাসটা। আর তুমি কি না বলছ…

আবার বাধা দিল টিনা। বলল, খামোকা দুশ্চিন্তা করছ। ভিনাস-টিনাস নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না কাউকে, অ্যান্টিভাইরাসটা নির্ধারিত সময়ের ভিতরেই পৌঁছে যাবে সব জায়গায়। সত্যি বলতে কী, পৌঁছুনোর পরও চার-পাঁচ মিনিট সময় বেঁচে যাবার কথা।

ক… কিন্তু কীভাবে? রায়হানকে বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে।

সহজ, ব্যাখ্যা করল টিনা। প্রোগ্রামটায় নতুন কয়েকটা লাইন ঢুকিয়ে দিয়েছি আমি। ফলে অ্যান্টিভাইরাসটা এখন একটা সেলফ-রেপ্লিকেটিং ভাইরাসের মত কাজ করবে। একটা থেকে দুটো, দুটো থেকে চারটা, চারটা থেকে ষোলোটা… এভাবে প্রত্যেক কম্পিউটারই অন্যান্য কম্পিউটারে ছড়িয়ে দিতে থাকবে ওটা–প্রায় আলোর গতিতে, যতক্ষণ না পৃথিবীর সমস্ত কম্পিউটারে পৌঁছে যায় ওটা। আমার হিসেব বলছে, মোটামুটি পাঁচ থেকে সাত মিনিটেই ডিস্ট্রিবিউশনটা শেষ হয়ে যাবে। কাজটার জন্য সুপার কম্পিউটারের। প্রয়োজন নেই, বুঝেছ?

কখন… কীভাবে তুমি এতকিছু করলে? হতভম্ব হয়ে প্রশ্ন করল রায়হান, বিস্ময়ে মুখের কথা আটকে যাচ্ছে ওর।

মুচকি হাসল টিনা। কখন-কীভাবে… এসব প্রশ্ন করতে হয় না ঈশ্বরকে। রানার দিকে তাকাল ও। ঈশ্বর যা চায়, তা-ই করতে পারে, ঠিক না?

রানাও হাসল। একদম ঠিক।

থ্যাঙ্ক ইউ, মাসুদ ভাই, কৃতজ্ঞতা জানাল টিনা। আমার মধ্যে কী ক্ষমতা আছে, সেটা আপনি না বললে কোনওদিন উপলব্ধিই করতে পারতাম না।

ধন্যবাদ দিতে হবে না, রানা বলল।

ডেকে চলো, খুব সুন্দর চাঁদ উঠেছে আজ। চাঁদের আলোয় বড় ভাইটাকে একটু সঙ্গ দিলেই খুশি হব আমি।

কম্পিউটার সেকশন থেকে বেরিয়ে ওয়েদার ডেকে গেল ওরা। নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল আকাশের দিকে, মনে প্রশান্তি নিয়ে। নীরবতা ভেঙে একসময় দীর্ঘশ্বাস ফেলল টিনা, বলল, আমার ভবিষ্যৎ কী, মাসুদ ভাই? ইউনোকোডের কথা জেনে ফেলেছে অনেকে, আমার ব্যাপারেও নিশ্চয়ই তথ্য পেয়ে যাবে। বাকি জীবন কি পালিয়ে বেড়াতে হবে আমাকে?

ভবিষ্যটা কেমন হবে, সেটা তুমিই ঠিক করবে, রানা বলল। আমি শুধু পরামর্শ দিতে পারি।

দিন না!

লোকের ভয়ে ইউনোকোডকে চাপা দিয়ে ফেলো না তুমি। জিনিসটা অত্যন্ত শক্তিশালী, মানুষের ক্ষতি করা যায় ঠিক, কিন্তু উপকারেও তো আসতে পারে। তোমার বাবা-মা জানতেন সেটা সেজন্যেই গোপনে হলেও গবে করে গেছেন, কোডটাকে পৃথিবীর উপকারে ব্যবহারের জন্য একটা পর্যায়ে। আনতে চেয়েছেন। তাদের পথেই তোমাকে চলতে অনুরোধ করব আমি।

কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব? আমার পিছনে যদি মন্দ লোকেরা শেয়ালের মত ধাওয়া করতে থাকে, তা হলে গবেষণা আমি করব কী করে?

আমি যদি তোমাকে নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিই, তা হলে করবে?

আপনি আমাকে আশ্রয় দিতে পারবেন? সব বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করতে পারবেন?

আমি একা পারব না, তবে বিসিআই পারবে। বাংলাদেশেই গবেষণার একটা জায়গা করে দেয়া হবে তোমাকে… যদি তোমার আপত্তি না থাকে আর কী!

একটু দ্বিধা করল টিনা–বিদেশি একটা এসপিয়োনাজ সংস্থার হাতে নিজেকে সঁপে দেয়া ঠিক হবে কি না, তা বুঝতে পারছে না।

ব্যাপারটা বুঝতে পারল রানা। বলল, দুশ্চিন্তার কোনও কারণ নেই তোমার। বিসিআই একটা এসপিয়োনাজ, সংস্থা ঠিকই, কিন্তু কিছু নীতি মেনে চলে। কখনও মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগ নিই না আমরা, জোর-জুলুম করে কাউকে কিছু করতে বাধ্যও করি না। আমি কথা দিতে পারি, ইচ্ছের বিরুদ্ধে কখনোই কিছু করতে বলা হবে না তোমাকে।

আমি যদি বলি, গবেষণা সফল না হওয়া পর্যন্ত আমার কাছ থেকে কিছুই পাবেন না আপনারা?

বলো। কোনও অসুবিধে নেই।

গবেষণাটা শেষ হতে যদি অনেক বছর লেগে যায়?

আমরা অপেক্ষা করব।

হাসি ফুটল টিনার ঠোঁটে। তা হলে প্রস্তাবটা বিবেচনা করতে রাজি আছি আমি।

কিন্তু এত বড় একটা কাজ কি একা শেষ করতে পারবে তুমি? সন্দেহ প্রকাশ করল রায়হান। কোডটা আবিষ্কার করেছ ঠিকই, কিন্তু তোমার বাবা-মা আর তার বন্ধুরাও তো কম প্রতিভাবান ছিলেন না। বিশ বছর খেটে তারাও তো পারেননি কিছু করতে!

কী বলতে চাও? প্রশ্ন করল টিনা।

বলছি যে, তোমার সহকারী প্রয়োজন–সৎ, বিশ্বস্ত, দক্ষ… এমন কেউ, যে। ইউনোকোন্ড নিয়ে নতুন কোনও ষড়যন্ত্র আঁটবে না, আবার তোমাকে জানপ্রাণ। দিয়ে সাহায্যও করতে পারবে। সোজা কথায়… নতুন ইউনো।

ব্যাপারটা কী, নিজের কথাই বলছ নাকি? ভুরু নাচাল টিনা। ইউনো হতে চাও?

ধ্যাত্, ইউনো হতে চাইব কেন? অবজ্ঞার সুরে বলল রায়হান। আমি তো চাই আরও বড় কিছু হতে।

কী? বিস্মিত হয়ে জানতে চাইল টিনা।

এগিয়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরল তরুণ হ্যাকার। আমি চাই তোমার জীবনসঙ্গী হতে।

ঠোঁটদুটো কেঁপে উঠল টিনার, আবেগের উচ্ছ্বাসে কথা বলতে পারছে না। গভীরভাবে ওকে চুমো খেল রায়হান, টিনাও সাড়া দিচ্ছে। এভাবে কেটে গেল কয়েকটা মুহূর্ত, তারপর হঠাৎই সংবিৎ ফিরে পেল তরুণী ইউনো।

অ্যাই ছাড়ো, ছাড়ো। করছটা কী… মাসুদ ভাইয়ের সামনে… বলতে বলতে থেমে গেল টিনা।

রানা নেই। ওদের দু’জনকে একা হবার সুযোগ দিয়ে কখন যেন চলে গেছে ও।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *