০৫. পিথিকোফোবিয়া কিংবা অন্দরে বান্দর

পিথিকোফোবিয়া কিংবা অন্দরে বান্দর

জৈষ্ঠ্য মাসের প্রচণ্ড গরম নাকি মেঘহীন ফাঁকা আকাশে দাপট দেখানো পূর্ণচাঁদ-ঠিক কী কারণে আহাম্মদ মোক্তার ছাদে রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেটা আর স্মরণ করতে পারে না। তবে ঐ রাতের আগে-পরে তার জীবনে কী কী ঘটেছিল সে-কথা ঠিকই স্মরণে আছে। ঘটনাগুলো জ্বরগ্রস্ত মানুষের প্রলাপ হয়ে ফিরে আসে বার বার। বিচ্ছিন্ন কিন্তু জীবন্তভাবে ভেসে ওঠে অসুস্থ মোক্তারের মানসপটে। এই যেমন একটু আগে সারা শরীর আগুনের মতো গরম হয়ে ঘেমেটেমে ওঠার পর পরই সেইসব স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে আসতে শুরু করেছে।

চিরকুমার মোক্তার প্রচুর বই পড়তো। বহুকাল ধরে তার শোবার ঘরের দেয়ালে অজানা এক কবির দুটো লাইন শোভা পেয়েছে-যৌবন গেল যুদ্ধ কইরা কইরা আর বসন্ত যায় চক্ষের উপর দিয়া। কবিতার লাইন দুটোকে যেন যুগপভাবে নিজের চিরকুমার জীবনের সাফাই আর আক্ষেপ হিসেবে বেছে নিয়েছিল মোক্তার। তবে তাকে যারা চেনে তারা একটা বিষয়ে নিশ্চিত ছিল-বসন্ত চোখের উপর দিয়ে চলে যাওয়ার সময় মোক্তারের চোখের সামনে অবশ্যই মেলে ধরা ছিল একটা বই।

বই পড়া ছাড়া আহাম্মদ মোক্তার এই জীবনে আর কোনো কাজ করেছে বলে কেউ জানে না। অন্তত তার মহল্লার বাসিন্দাদের সে-কথা জানা নেই। সত্যি বলতে, তার জীবন বেশ নিস্তরঙ্গভাবে কেটে গেছে, সেখানে যুদ্ধের কোনো দামামা বাজেনি কখনও; সেজন্যে কবিতার লাইনদুটো আক্ষরিক অর্থে ধরে নেয়ারও সুযোগ নেই। ঐ এক প্রেম-বিয়ের ব্যাপারটা বাদ দিলে তার জীবন আসলে বেশ ছিমছাম, সমস্যামুক্ত। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান হিসেবে পুরনো ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ প্রাচীন মহল্লা গোয়াল নগরে বাপ-দাদার দোতলার বাড়িটি ভাড়া দিয়ে যা পায় তাতে করে একমাত্র বদ অভ্যেস সিগারেট খাওয়া আর প্রচুর বই কেনা একজন মানুষের জন্য যথেষ্টর চেয়েও বেশি।

মোক্তারের দাদা জরিপ ব্যাপারি নিজের পিতার উপর কোনো এক কারণে রাগ করে রায়সাহেব বাজারের নিজেদের বাড়ি ছেড়ে যখন এই গোয়াল নগরে চলে আসে তখন নাকি তিক্তমুখে তার প্রপিতামহ বলেছিলেন-বান্দরটা বান্দারগো লগেই থাকুক! বুড়ো জোর দিয়ে সবাইকে বলেছেন, তার কুলাঙ্গার ছেলে এবার সঠিক জায়গাতেই গেছে।

কথাটা আক্ষরিক অর্থেই সত্যি। মানুষের পাশাপাশি গোয়াল নগর মহল্লার আদি বাসিন্দাদের অন্যতম হলো একপাল বানর। দীর্ঘদিন ধরে বানরের সাথে বসবাস করে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে এখানকার মানুষজন। হিন্দু ধর্মাবলম্বী বাসিন্দার সংখ্যাধিক্যের কারণে বানরেরা দেবতার মর্যাদা পাবার কথা, কিন্তু তাদের বাঁদরামির কারণে দেবতার আসন থেকে বিচ্যুত করা হয়েছে। অযাচিত মেহমান হিসেবেই বেঁচেবর্তে আছে তারা দীর্ঘকাল ধরে। তাই রামের হনুমান হতে পারেনি কখনও! এক ছাদ থেকে আরেক ছাদে তারা লাফিয়ে যাবার সময়, কিংবা কার্নিশে বসে কিছু খেতে দেখলে দূর থেকে গোয়াল নগরের অল্পবয়েসি ছেলেপেলেরা বানর দেখলেই আজীবন সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠে একটা শ্লোকই আওড়াতো : ‘বান্দর বান্দর ভেচকি…তোর লাল পুটকি দেখছি!’

‘পুটকির’ মতো আপত্তিকর শব্দ ব্যবহার করলেও বানরের দল নির্বিকারই থেকে গেছে যুগের পর যুগ। কিন্তু আহাম্মদ মোক্তার সেই ছোটবেলা থেকে লক্ষ্য করে দেখেছে, সে যদি ভুলেও কখনও ছেলেপেলেদের পাল্লায় পড়ে এই শ্লোকটা বলে ফেলতো সাথে সাথে প্রতিক্রিয়া দেখাতে বানরেরা! রেগেমেগে তার দিকে তাকাতো কোনো কোনো বানর। যেন ভদ্রলোকদের মতো ‘পুটকি’ শব্দটা বান্দরদেরকেও সমানভাবে মর্মাহত করেছে!

এই গোয়াল নগরে ঢুকলেই এখানে ওখানে নানান আকৃতির বান্দর ঘুরে বেড়াতে দেখা যাবে। ছাদে, কার্নিশে, বৈদ্যুতিক পোস্টে, কিংবা তার বেয়ে চলা, ল্যাম্পপোস্ট বেয়ে বেয়ে ওঠানামা করা বানর দেখাটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এই মহল্লায় যারা নতুন আসে তারা বিস্ময় নিয়ে দেখে বানরদের এইসব কীর্তিকলাপ। কিন্তু গোয়াল নগরের বাসিন্দারা এতে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছে যে, পাশের বাড়ির দুষ্টু ছেলে ঝন্টু-মন্টুর মতোই গন্য করে। এলাকার লোকজন কিছু কিছু বানরকে আদর করে কিংবা তাদের ভয়াবহ বাঁদরামির কারণে মানুষের মতো নাম ধরেও ডাকে। সম্ভবত মানুষের মাঝে বানর আর মানুষের স্বভাবে বাঁদরামি থাকার কারণে তারা এমনটা করে। কিংবা মানুষের দূরতম আত্মীয় হবার কারণেও হতে পারে! জোর দিয়ে কোনো কিছুই বলা সম্ভব নয় গোয়াল নগরের বাসিন্দাদের অমন নামকরণ নিয়ে!

তো, রায়সাহেব বাজারের নিজ মহল্লা থেকে একটু দূরে, বানরের মহল্লা হিসেবে পরিচিত এই গোয়াল নগরে এসে নিজের জন্যে একটা বাড়ি পেতে মোক্তারের দাদাকে খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়নি। এক্ষেত্রে জরিপ বেপারির দ্রুত স্বাবলম্বি হবার গল্পের চেয়ে সর্বভারতীয় রাজনীতিই বেশি ভূমিকা পালন করেছিল।

হিন্দু অধ্যুষিত গোয়াল নগর দেশ বিভাগের যাতাকলে পড়ে গেলে অসংখ্য হিন্দুপরিবার চলে যায় কলকাতায়। আর যাদের কোনো উপায় ছিল

কিংবা পৈতৃকবাড়ি ছেড়ে যেতে চায়নি তারা এই নগরের মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকে। সেটা ছিল পানির দরে জল বেচা-কেনার সময়। জরিপ বেপারি ভুল করেনি, বেশ সস্তায় এই বাড়িটা কিনে নেয় এক হিন্দু ব্যবসায়ির কাছ থেকে। মেঝে থেকে সাত ফুট উঁচু লম্বা ফ্রেঞ্চ জানালা, কাঁচ লাগানো কপাট আর সেগুন কাঠের বিশাল বড় বড় দরজা বাড়িটাকে আভিজাত্য দান করেছে। এই বাড়ি কেনার সাথে সাথে কিছু আসবাবের মালিকও বনে গেছিল মোক্তারের দাদা। সুরেন্দ্র বাবুরা যখন কোলকাতায় চলে যায় তখন দুটো বড় পালঙ্ক, আলমিরা আর একটা লোহার সিন্দুক নেবার কথা মাথায়ই আনেনি-তাদের কাছে পৈতৃক প্রাণটাই বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল ওই ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ে।

দোতলার এই বিশাল বাড়িটি দেখার মতো। চারদিকে ঘেরা বাড়ির মাঝখানে বিশাল একটি উঠোন। এককালে সেখানে তুলসী গাছ ছিল-এখনও পাকা উঠোনের মাঝখানে একটা হালকা দাগ দেখা যাবে ভালো করে লক্ষ্য করলে। গাছটা উপড়ে ফেলে মেঝেটা পাকা করা হলেও পুরনো ক্ষতচিহ্নের মতো সেই দাগ জানান দিচ্ছে, এখানে এককালে কোনো কিছু আহত হয়েছিল!

বাড়িটা ছিল মোক্তারের দাদা জরিপ বেপারির খুব প্রিয়। মোক্তারের বাপ শামসু বেপারিও বেশ যত্ন নিয়েছে পুরনো বাড়িটার। গোয়াল নগরে এই বাড়ির সমবয়সি বাড়িগুলো অনেক আগেই ভেঙে পড়েছে, নয়তো ভেঙে ফেলা হয়েছে বসবাসের অনুপযোগি হয়ে যাবার কারণে, কিন্তু একমাত্র সন্তান হিসেবে আহাম্মদ মোক্তার ডেভেলপারদের লোভনীয় প্রস্তাবে সাড়া না দিয়ে আগলে রেখেছে বাড়িটা। অবশ্য বৃদ্ধ বাড়িটা প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ে আর তখন ডাক পড়ে মজু ওস্তাগারের। বাড়ির বিভিন্ন অংশ মেরামত করার কাজটা সে মোক্তারের বাপের আমল থেকেই করে আসছে। ব্যাপারটা এখন এমন এক রীতিতে পরিণত হয়েছে যে, মজু ওস্তাগার হয়তো বাজার করতে আসলো গোয়াল নগরসংলগ্ন রায়সাহেব বাজারের কাঁচাবাজারে, তখন সদাইপাতি কেনার পর মোক্তারের বাড়িতে হানা দেবে, আর সব সময় অন্য কারো চোখে পড়ার আগে তার চোখেই ধরা পড়বে বাড়ির কোথায় কী সারাই করতে হবে। এরপর বাড়ির মালিককে জিজ্ঞেস না করেই নিজ উদ্যোগে যোগাল নিয়ে চলে আসবে মেরামত করার জন্য। আহাম্মদ মোক্তার কখনও প্রশ্ন তোলেনি, আদৌ এসব মেরামতের দরকার আছে কী নেই। এর কারণ, খুব সম্ভবত মোক্তার চিরকুমার, কর্মহীন একজন মানুষ; আর তার বাড়ির ভাড়াটেদের সবাই কর্মজীবী। শুক্রবার বাদে সকাল দশটার পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাড়িটা সুনসানই থাকে। সুতরাং মজু ওস্তাগারের কল্যাণে একটু ‘কর্মমুখর পরিবেশ তৈরি হলে তাতে কার কী ক্ষতি! তার একাকি জীবনে একটু ভালো লাগা তৈরি হয় এতে। তারচেয়েও বড় কথা, পানখাওয়া রসালো মুখে মজু ওস্তাগার যে বিরামহীন গল্প করে সেটাও মোক্তারকে প্রলুব্ধ করে থাকে। সামান্য একজন রাজমিস্ত্রি হয়েও বড় লাট থেকে ঢাকার নবাব দিয়ে শুরু করা তার সব গল্পেই কোনো না কোনোভাবে, শেষ পর্যন্ত নিজেকেই প্রধান চরিত্র হিসেবে তুলে ধরে! বাকিরা যেন পার্শ্বচরিত্র! মোক্তারের ধারনা, এই লোক জীবনে যতো ইট দিয়ে বাড়ি বানিয়েছে তারচেয়েও বেশি গপ্পো জানে! আর জানে কীভাবে নিজেকে সেইসব গল্পের ভেতরে উপযুক্ত কোনো জায়গায় বসিয়ে দিতে!

আহাম্মদ মোক্তার স্মরণ করতে পারে, ঐদিনও মজু ওস্তাগার সারাদিন তার বাড়ির এখানে সেখানে মেরামতের কাজ করে গেছিল। তারপর রাতের বেলায় একটা শীতল পাটি, বালিশ আর এক বাটি পেস্তা বাদাম নিয়ে মোক্তার চলে গেছিল ছাদে। পটিতে শুয়ে আকাশের চাঁদ দেখে আর সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে জীবনানন্দ দাশের কবিতা সমগ্র বইটি পড়ার ইচ্ছেও জেগেছিল এক সময়, কিন্তু অসামান্য চাঁদের আলোও যে বইপাঠের জন্য সামান্য সেটা বুঝতে পেরে ইচ্ছেটা বাদ দিয়ে দেয়। অবশ্য স্মৃতি থেকে জীবনানন্দের একটি কবিতা আউড়েছিল এরপর :

বেবিলোন কোথা হারায়ে গিয়েছে-মিশর-অসুর কুয়াশাকালো;
চাঁদ জেগে আছে আজও অপলক, মেঘের পালকে ঢালিছে আলো!
সে যে জানে কত পাথারের কথা, কত ভাঙা হাট মাঠের স্মৃতি!
কত যুগ কত যুগান্তরের সে ছিল জোছনা, শুক্লা তিথি!

এরপরের লাইনগুলো মনে করতে বেগ পেয়েছিল সে। অনেক ভেবেও স্মৃতি থেকে সেগুলো তুলে আনতে পারেনি। কিন্তু সিগারেটে বেশ কয়েকটা টান দিতেই বিচ্ছিন্নভাবে আরও কিছু লাইন উদ্ধার করতে পারে স্মৃতির গহীন গহ্বর থেকে।

হয়তো তাহারা আমাদেরই মতো মধু-উৎসবে উঠিত মেতে
চাঁদের আলোয় চাঁদমারী জুড়ে, সবুজ চরায়, সবজি ক্ষেত!

এ পর্যন্ত এসে আবারও স্মৃতি হাতড়ে বেড়ায় আহাম্মদ মোক্তার। এক কালের তুখোড় স্মৃতিশক্তির এমন করুণ দশা দেখে আফসোস হয় তার। নিজের স্মৃতির উপরে বিরক্ত হয়ে সিগারেটের উচ্ছিষ্টটা ছাদের এক কোণে ছুঁড়ে ফেলে দিতেই আবারও কিছু পংক্তি উড়ে এসে জুড়ে বসে তার মাথায়।

….এমনি কোন-এক চাঁদিনীবেলায় দাঁড়াত নগরীতোরণে এসে!
কুমারীর ভিড় আসিত ছুটিয়া, প্রণয়ীর গ্রীবা জড়ায়ে নিয়া
হেঁটে যেত তারা জোড়ায় জোড়ায় ছায়াবীথিকার পথটি দিয়া!
তাদের পায়ের আঙুলের ঘায়ে খড়-খড়-পাতা উঠিত বাজি…

পাতার খড়-খড়ে শব্দ নয়, মোক্তারের কবিতায় বিঘ্ন ঘটায় অন্য কিছু। বুঝে ওঠার আগেই সে দেখতে পায় তার শিয়রে থাকা পেস্তা বাদামের বাটির সামনে উবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শিরিন!

হ্যাঁ, শিরিনই। মোক্তার এ ব্যাপারে নিশ্চিত। তার ক্ষ্যাপাটে দৃষ্টি ভোলার নয়। কিন্তু সে এখানে কীভাবে চলে এলো আবার!

পূর্ণিমার আলোয় অদ্ভুতভাবেই জ্বলজ্বল করছিল শিরিনের দুচোখ, সেই জ্বলজ্বলে চোখ স্থির হয়ে ছিল মোক্তারের উপরে। অলক্ষ্যে পেস্তা বাদামের বাটির দিকে হাত বাড়াতে গেছিল সে, ধরা পড়ে জমে যায় মূর্তির মতো। কিন্তু মোক্তারকে ভয় পেয়ে লাফ দিয়ে উঠতে দেখে যেন সম্বিত ফিরে পায় শিরিন, সঙ্গে সঙ্গে ভয়ঙ্কর মূর্তি ধারণ করে, বিদ্যুৎবেগে নখরযুক্ত থাবা বসিয়ে দেয় আহাম্মদ মোক্তারের ডান গালে।

.

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে মোক্তার। বিগত দু-দিন ধরে নিজের ঘরে বন্দি। শিরিনের আঁচড় বেশ ভালোমতোই দেবে আছে তার হালকা চাপদাড়ির গালে। তিনটি নখরের আঁচড়। তিনটি দাগ। দাগগুলোর চারপাশ কেমন লালচে হয়ে আছে। ওখানে হাত দিতেই সামান্য যন্ত্রণা টের পেলো। আঁচর খাওয়ার পরই ঘরে থাকা ডেটল তুলোয় ভিজিয়ে সেখানে লাগিয়েছিল সে। এখন মনে হচ্ছে, তার আসলে ডাক্তারের কাছে যাওয়া দরকার ছিল। ঐদিন রাতে গা কাঁপিয়ে জ্বর এসে পড়েছিল তার। সারাটা রাত কেটেছে আজেবাজে আর অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখে। সুতীব্র ভয়ে একাকি ঘরে কুঁকড়ে ছিল সে। সেই ভয় এখনও কমেনি। ভয়ের সঙ্গি হয়ে একটা প্রশ্ন তখন থেকেই ঘুরপাক খাচ্ছে তার মনে : ওটা তাহলে শিরিনই ছিল!

একদম নিশ্চিত সে। শিরিনের বামহাতটা দেখেছে-কজি থেকে সেটা কেমন বিকৃত হয়ে আছে। আঙুলগুলো প্রায় অকেজো। সুতরাং এটা শিরিন না হয়ে অন্য কেউ হতেই পারে না। সেই ক্ষিপ্ত আর পাগলাটে দুচোখ; সেই তারস্বরে চিঁচিঁ আর্তনাদ; মুখভঙ্গি…সবটাই শিরিনের!

কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব হলো?

কয়েক মাস আগে হঠাৎ করেই বানরের উৎপাত বেড়ে গেছিল মহল্লায়। কারণটা মহল্লাবাসির কাছেও অজানা ছিল না। ধীরে ধীরে গোয়াল নগরে গড়ে উঠছে সুরক্ষিত আর সুউচ্চ ভবন, ফলে বানরদের আবাস আর আহার-দুটোই সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। মহল্লার সত্তর-আশি বছরের বুড়োদের কাছ থেকে জানা যায়, তীব্র খাদ্য সঙ্কটে পড়লে অতীতেও বেশ কয়েকবার বানরের দল ক্ষিপ্ত হয়ে গেছিল। গোয়াল নগরবাসি কমসে কম এরকম দু তিনটি ঘটনার কথা স্মরণ করতে পারে। তেতাল্লিশের মন্বন্তর, চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ আর মাঝখানে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এমন তীব্র খাদ্য সঙ্কটে পড়ে গেছিল এই নগরের বানরকূল। আবারও সেই সঙ্কট এসে হাজির। বাড়িঘরের মহিলারা অতীষ্ঠ হয়ে উঠেছে। ছাদে কাপড় শুকাতে দিয়ে শান্তিতে থাকতে পারছে না কেউ। রান্নাঘরের খাবারের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত তারা। ঘরে ঢুকে বানরের দল খাদ্য ডাকাতি করা শুরু করে দিয়েছে। যেখানে যা পারছে লুটে নিচ্ছে হানাদারদের মতো।

শুরুটা কবে থেকে হয়েছিল সেটা আর মোক্তারের স্মরণে নেই। তবে একদিন দুপুরের আগেভাগে কাঁচা বাজার থেকে সদাইপাতি কিনে এনে ড্রইংরুমের এককোণে বড় ফ্রিজটার কাছে রেখে ঘর্মাক্ত মোক্তার হাতমুখ ধুয়ে আরাম করে টিভি দেখছিল। এক সময় টের পায় তার ঘরের দরজা দিয়ে কেউ ঢুকে পড়েছে। ফিরে তাকাতেই আত্মারাম খাঁচাছাড়া! একটা হুলো বানর ঢুকে পড়েছে তার ঘরে। মোক্তারের সাথে চোখাচোখি হতেই হুলোটা ক্ষিপ্ত হয়ে ধারালো দাঁত বের করে ভয় দেখায় তাকে। ভয়ে জমে গেছিল সে। তারপরও আস্তে করে দুয়েকবার হু-হুঁস্ শব্দ করেছিল বানরটা তাড়ানোর জন্য, কিন্তু হুলোটা তাকে হা করে ধারালো দাঁত দেখিয়ে কঠিন ভয় দেখায়। মোক্তার বুঝতে পারে আজ বানরের হাতে নাজেহাল হতে হবে তাকে। এর ধারালো দাঁত আর নখর তার শরীরে রেখে যাবে অসংখ্য ক্ষত। ঠিক তখনই, চিন্তাটা তার মাথায় আসে। ফ্রিজের সামনে রাখা সদাইপাতিগুলোর দিকে হাত তুলে ইঙ্গিত করে সে, তারপর দরজার দিকে। ইঙ্গিতটা স্পষ্ট-ওগুলো নিয়ে ভালোয় ভালোয় যেন বানরটা চলে যায়। হুলোটা তার ইঙ্গিত ঠিকই বুঝে ফেলে। আহাম্মদ মোক্তারের দিক থেকে এক পলকের জন্যেও চোখ না সরিয়েই আস্তে করে সদাইপাতিগুলোর মধ্যে শশা, কাঁচাকলা আর কিছু পেঁপে নিয়ে সোজা চলে যায় ঘর থেকে। চোখের নিমেষে সিঁড়ি দিয়ে চলে যায় ছাদে। তারপর এক ছাদ থেকে আরেক ছাদ হয়ে উধাও হয়ে যায়।

এই ঘটনার পর থেকে মোক্তার জানতে পারে, প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন বাড়িতে বানরের দল হানা দিচ্ছে। এ নিয়ে মহল্লাবাসি একমত হয় যে, বানরের দল অভাবে পড়েছে। তাদের অত্যাচার আরও বাড়বে। সবাইকে সজাগ থাকতে হবে এখন থেকে।

যাইহোক, এক সন্ধ্যায় নিজের ঘরে ফিরে মোক্তার যখন দেখে তার দোতলার ঘরদুটোতে লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়ে দিয়েছে বানরের দল, বহু মূল্যবান বই-পুস্তকের সংগ্রহে তাণ্ডব চালিয়েছে, প্রিয় বইগুলোর পাতা ছিঁড়ে কুটি কুটি করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে ঘরময়, তখন সে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। দোতলার ছাদে যাবার সিঁড়ি-ঘরের গ্রিলের দরজাটা বন্ধ করতে ভুলে গেছিল মোক্তার, তারচেয়েও বড় কথা নিজের ঘরের দরজাও বন্ধ করে বের হয়নি। কারণ দোতলা থেকে নিচতলায় যাবার সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে আরেকটি গ্রিলের দরজা আছে, ওটা বন্ধ করেই সব সময় বাইরে যেত, ঘরের দরজা বন্ধ করার প্রয়োজন পড়েনি কখনও। ঘটনা যা-ই হোক, তার এই অসতর্কতার জন্য বেশ কিছু প্রিয় আর দুষ্প্রাপ্য বইপুস্তক নষ্ট হয়ে যায়। কতো শখ করে কোলকাতা-দিল্লি ঘুরে বইগুলো সংগ্রহ করেছিল সে। বইগুলোর করুণ দশা দেখে আক্ষেপে প্রায় চিৎকার করে উঠেছিল মোক্তার। রাগে ক্ষিপ্ত হয়ে তখনই সিদ্ধান্ত নেয় এই অপকর্মের উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে। আর সেটা দিতে একদিনও দেরি করেনি। ঐদিন রাতেই সে সব ব্যবস্থা করে ফেলে। এজন্যে যে কৌশলটি অবলম্বন করে, সেটাও তার স্মৃতিতে গেঁথে আছে বহুকাল আগে থেকেই।

মোক্তার যখন বারো বছরের দুরন্ত এক কিশোর, ছাদ থেকে ছাদে ঘুড্ডি ওড়াতে ব্যস্ত তখন সে দেখেছে এক সকালে তার বিচক্ষণ চাচা বাজার থেকে ছোট ছোট খেলনার কলস নিয়ে এসেছে। চাচাকে জিজ্ঞেস করতেই জানতে পারে, এগুলো দিয়ে নাকি বানরের উৎপাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। কৌতূহলি হয়ে ওঠে মোক্তার। খেলনার কলস কিভাবে বানরের মতো বজ্জাত আর বুদ্ধিমান প্রাণীদেরকে উচিত শিক্ষা দেবে ভেবে পায়নি। তবে খুব বেশি মাথা ঘামানোরও দরকার পড়েনি তার। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই দেখতে পায় তার চাচা ছোট ছোট খেলনার কলসের ভেতরে খুদ আর লটকন আকৃতির অপরিপক্ক পেয়ারা ঢুকিয়ে দিচ্ছে। তার উৎসুক প্রশ্ন শুনে চাচা জানিয়েছিল, একটু অপেক্ষা করলেই সে দেখতে পাবে বানরের কাণ্ডকীর্তি। ঐ ছোট ছোট কলসগুলো তাদের বাড়ির ছাদে রেখে আসে তার চাচা, তারপর সন্ধ্যার আগেই একটি মজার দৃশ্য দেখতে পায় মোক্তার-কমপক্ষে তিনটা বানর হাতে কলস নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বানরগুলো কলস পেয়ে মনের আনন্দে থাকার কথা কিন্তু মোক্তার অবাক হয়ে দেখলো তাদের মুখ বেজার। কেউ কেউ ক্ষিপ্ত। কলস থেকে মুক্তি পাবার চেষ্টা করে যাচ্ছে!

পিচ্চি মোক্তারের প্রশ্ন : এমন বুদ্ধিমান প্রাণী বানর কেন কলসগুলো থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিতে পারছে না!

তার বিচক্ষণ চাচা জবাবে বলেছিল, বানর আসলে অতোটা বুদ্ধিমান নয় যতোটা সবাই মনে করে। এদের বোকামির কথা শুনলে নাকি মোক্তারের ভুরু কপালে উঠে যাবে। এ কথা শুনে মোক্তার আরও আগ্রহি হয়ে ওঠে, চেপে ধরে চাচাকে। তার চাচা হেসে জানায়, উঠতি যৌবনা মেয়েরা যেভাবে কসরত করে কাঁচের চুরির মধ্যে হাত গলিয়ে দেয় ঠিক সেভাবেই বানরেরা খুব কৌশল করে ছোট কলসের সরু মুখের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে ভেতরে থাকা খুদ আর পেয়ারা করায়ত্ত করে, তারপর খাবারগুলো মুঠোয় করে নিয়ে হাতটা বের করে আনার চেষ্টা করে। মুঠো করে রাখার কারণে তাদের সেই হাত কলসির ছোট মুখ দিয়ে আর বের হয়ে আসে না। সৃষ্টিকর্তা তাদেরকে বাঁদরামির বুদ্ধি দিলেও এই জ্ঞানটুকু দেননি যে, মুঠো ছেড়ে দিয়ে হাতটা অনায়াসে বের করে আনা সম্ভব। তাদের জৈবিক তাড়না কেবলমাত্র একটি চিন্তায় ঘুরপাক খায় : মুঠো ছেড়ে দিলে কষ্টার্জিত খাবারগুলো হাতছাড়া হয়ে যাবে যে!

বানরদের এমন বোকামিপূর্ণ চিন্তাভাবনার কথা জানতে পেরে যারপরনাই বিস্মিত হয়েছিল মোক্তার। সত্যি সত্যি তার ভুরু কপালে উঠে গেছিল। বানরদের বোকামি তাকে মুগ্ধ করেছিল বলা যায়।

তো, বাঁদরামির শাস্তি দেবার জন্য কলসির ভেতরে খুদ আর ছোট ছোট পেয়ারা রাখার পাশাপাশি ইঁদুর ধরার আঠাও দিয়ে দিলো সে। সেইসঙ্গে কলসিগুলোর মুখের চারপাশে নাইলনের চিকন দড়ি বেঁধে দড়ির অন্য মাথা বেঁধে রেখেছিল ছাদের এক কোণে। সে চেয়েছিল বানরগুলো যেন কেবল শায়েস্তা না হয়, তারা যেন রীতিমতো বন্দিও হয়ে পড়ে। আর সেটাই কাল হয়েছিল তার জন্য : রাতের বেলায় তিন তিনটি বানর ধরা পড়ে তার পাতা কলসির ফাঁদে। বেচারা বানরগুলো নিজেদের হাত ছাড়াবার জন্য অনেক চেষ্টা করেছিল কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। লম্ফঝম্ফ করতে করতে পাড়া মহল্লা এক করে ফেলেছিল তারা।

কিন্তু আহাম্মদ মোক্তার ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি এরপর কী ঘটতে পারে! সকাল হতেই দেখে মহল্লার যতো বানর আছে সব একযোগে হামলে পড়েছে তার বাড়ির ছাদে। সে এক দেখার মতো দৃশ্যই ছিল। শত শত বানর মোক্তারদের ছাদ দখল করে নেয়। তাদের গোষ্ঠির তিনটি বানরকে ছাড়ানোর জন্য যথেষ্ট বাঁদরামি করেছিল তারা কিন্তু বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে তিন সঙ্গিকে মুক্ত করতে পারেনি।

বানরের ভয়ে নিজের ঘরে এসে খিড়কি দিয়েছিল মোক্তার। কয়েক ঘণ্টা গৃহবন্দি থেকে বানরদের চিঁচিঁ শব্দ আর ছাদে দাপিয়ে বেড়ানোর প্রবল আওয়াজ শুনে গেছে সে। এরপর বাঁদরামি বদলে গিয়ে হিংস্রতায় রুপ নেয়। কতিপয় দুঃসাহসি বানর মোক্তারের ঘরের দরজা-জানালায় জোরে জোরে আঘাত করতে শুরু করে। এক পর্যায়ে এমন হয় যে, সে ভাবতে শুরু করে দরজা-জানালা বুঝি ভেঙেই যাবে! নিজের পৌরুষ বজায় রাখার জন্য ভয়ার্ত চিৎকারটা দমিয়ে রাখতে পারলেও মোক্তারের বুকের ধুকপুকানি তাতে একটুও কমেনি। আশেপাশের বাড়ির লোকজন এসব দেখে ভয়ে যার যার ঘরে গিয়ে আশ্রয় নেয়। পুরো মহল্লায় যেন কারফিউ পড়ে যায় এ সময়। মোক্তারদের আশেপাশের বাড়িঘরের অনেকেই জিম্মি হয়ে পড়ে। স্কুলে যাবার জন্য বাচ্চাদের নিয়ে বাড়ি থেকেও কেউ বের হবার সাহস করেনি তাদের গলি থেকে।

মোক্তারের বাড়ির উল্টোদিকের বাড়িটা রতন সুরের। বানরের উৎপাত শুরু হতেই সে ফোন দিয়েছিল কোতোয়ালি থানায়। পরে তার কাছ থেকে শোনা গেছে, তাকে নাকি থানা থেকে বলা হয়েছিল-বানর কিভাবে সামলাবে সেটা তাদের জানা নেই। সন্ত্রাসি হলে কথা ছিল! থানা থেকে কোনো সাহায্য না পেয়ে ফায়ার সার্ভিসে ফোন দেয় রতন সুর। কিন্তু তারা তাকে উল্টো পরামর্শ দেয়-কিছু খাবার-দাবার দিয়ে বানরগুলোকে যেন বিদায় করে দেয়া হয়। রতন যখন জানায় আটকে পড়া বানরগুলো উদ্ধার করতে হনুমান বাহিনী লঙ্কাকাণ্ড বাধাচ্ছে তখন সহজ সরল সমাধানের কথা বলে ফোনের ওপাশ থেকে : “তাইলে ওইগুলারে ছাইড়া দেন!”

এমন পরামর্শ শোনার পর রেগেমেগে বহু পুরনো ল্যান্ডফোনটা নাকি আছাড় মেরে ভেঙেই ফেলেছিল রতনবাবু। এটা অবশ্য রতন সুরের বাড়িয়ে বাড়িয়ে কথা বলা বাঁচাল বউয়ের ভাষ্য। গোয়াল নগরে খুব কম মানুষই তা বিশ্বাস করেছিল। এই মহিলা কি এক হাজার টাকা দিয়ে শাড়ি কিনে দশ হাজার টাকার গল্প করে না?

যাইহোক, রতন সুর যে রাগে গজ গজ করতে করতে আপন মনে বলেছিল ‘হালারপো, বিলাইর গলায় ঘন্টা লাগাইবো ক্যাঠা!’-এ ব্যাপারে অবশ্য কারো মনে কোনো সন্দেহ নেই।

মোক্তারদের ছাদে গিয়ে বানরগুলোর হাত মুক্ত করবে কে-প্রশ্নটি গোয়াল নগর মহল্লায় সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ঘুরপাক খেতে থাকে। এমনকি বিকেলে ডালপুরি আলুপুরি খেতে খেতেও অনেকে এটা নিয়ে ভেবেছিল। এ নিয়ে নানা মুনির নানা মত যখন চলছে তখন নিচতলার ভাড়াটিয়া আলেকবর মিয়াই একমাত্র মানুষ যে এগিয়ে আসে তাকে উদ্ধার করতে। এই লোকটাকে দুচোখেও দেখতে পারতো না মোক্তার। এর কারণ লোকটা দুনিয়ার অন্য কোনো কিছুর চেয়ে মোক্তারের বিয়ে না করার কারণ জানার ব্যাপারেই বেশি আগ্রহ দেখায়। প্রায়ই তাকে ইনিয়ে বিনিয়ে জিজ্ঞেস করে, সমস্যা কী? বিয়া করেন না ক্যান!’ ঢাকা শহরে এমন একটা বাড়ির মালিক হবার পরও সে কেন এত বছরেও বিয়ের নামগন্ধ নিচ্ছে না-তা নিয়ে লোকটার কৌতূহলের শেষ নেই।

লোকটার প্রশ্নের মধ্যে বিচ্ছিরি একটা ইঙ্গিত থাকে সব সময়। তার কথা বলার ভঙ্গিও খুবই অপ্রীতিকর। নিচতলার একটা রুম ভাড়া নিয়ে থাকে সে, কিন্তু কী কাজ করে, কোথায় যায় সে সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই কারোর। মহল্লায় ফিসফাস শোনা যায়, আলেকবর মিয়া নাকি খুবই ধরিবাজ টাইপের লোক। যাইহোক, বাড়িতে কখনও পুলিশ এসে আলেকবরের খোঁজ করেনি বলে আহাম্মদ মোক্তার এ নিয়ে আর মাথা ঘামায়নি। তারচেয়েও বড় কথা, ভাড়াটিয়াদের মধ্যে একমাত্র এই ধরিবাজটাই মাসের প্রথম দিন ভাড়া মিটিয়ে দেয় সব সময়। লোকটা দুপুর পর্যন্ত ঘুমায়, ঘরে ফেরে রাত একটা-দুটোর দিকে। তার ঘরের দরজা রাস্তার দিকে থাকায় এ নিয়ে মোক্তারকে মাথা ঘামাতে হয় না। আলেকবর মিয়া নিচতলায় এসে নিজের চাবি দিয়ে তার ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়ে। কাউকে সেজন্যে দরজা খুলে দেবার দরকারও পড়ে না।

মোক্তার যখন বানরের আক্রমণে নিজের ঘরে বন্দি তখন এই আলেকবর মিয়াই সাহস করে দোতলায় উঠে এসে দরজায় নক করে। এই লোক কীভাবে বানরদের জফা পেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এসেছিল সেটাও বিরাট এক রহস্য। যাইহোক, বিপদের সময় একজন সাহায্যকারি পেলে সবাই খুশি হয়, সেটা যার কাছ থেকেই আসুক না কেন-আহাম্মদ মোক্তারও খুশি হয়েছিল সেদিন।

আলেকবর জানায় ছাদ থেকে বানরগুলো তাড়ানো দরকার। এভাবে তো আর সহ্য করা যায় না। সকাল থেকে তাদের বাঁদরামি দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। বাড়ির বাইরে পর্যন্ত যেতে পারছে না। কিন্তু মোক্তার জানায়, বানরের দলকে কিভাবে তাড়ানো যায় সেটা তার মাথায় আসছে না। সে কেবল তার চাচার বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে একটু শায়েস্তা করতে চেয়েছিল। তার ধারণা ছিল এভাবে শায়েস্তা করা গেলে বানরের পাল আর উৎপাত করতে আসবে না মহল্লায়। কিন্তু এখন যেটা হয়েছে সেটা দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি।

আলেকবর মিয়া হেসে জানায়, কোনো সমস্যা নেই, তার কাছে একটা সহজ বুদ্ধি আছে। মোক্তার সন্দেহ করলেও কিছুক্ষণ পর বুদ্ধিটা সে ঠিকই দেখিয়েছিল। নিজের ঘর থেকে কী সব ওষুধ মেশানো খাবার নিয়ে এসে ছাদে ছুঁড়ে মারে লোকটা। ক্ষিপ্ত বানরের দল সেই খাবার পেয়ে কাড়াকাড়ি শুরু করে দেয়। বেচারা নাজেহাল হওয়া তিনটি বানর দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে দেখতে থাকে, তার জ্ঞাতিগুষ্ঠি আর স্বজাতিরা তাদেরকে উদ্ধার করার মিশন বাদ দিয়ে খাবার নিয়ে মারামারি শুরু করে দিয়েছে। তবে ঐ তিন বানরের আফসোস দীর্ঘস্থায়ি হয়নি। তাদেরকে আরও বিস্মিত করে দিয়ে দশ-বারোটি বানর অজ্ঞানপার্টির খপ্পড়ে পড়া লোকজনের মতোই একে একে লুটিয়ে পড়ে মোক্তারের ছাদে।

ঐদিন মোট দশটি বানর মারা গেছিল, তবে বারোটি বানর অজ্ঞান হলেও বেঁচে ছিল শেষ পর্যন্ত। জীবিত আর মৃত, সবগুলো বানরের ব্যবস্থা করেছিল আলেকবর মিয়া। মৃতগুলো সিটি কর্পোরেশনের ময়লার গাড়িতে তুলে দেয় সে আর জীবিতগুলোর হাত-পা-মুখ বেধে বড় একটা কার্টনবাক্সে ভরে কোথায় যে নিয়ে গেছিল সে কথা মোক্তারেরও জানা নেই। আলেকবর মিয়াকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল ওগুলো কোথায় রেখে এসেছে সে, তখন মুচকি হাসি দিয়ে হারামিটা বলেছিল, এ নিয়ে তাকে ভাবতে হবে না। তাদের একটা হিল্লা করে ফেলেছে। ভালো জায়গাতেই আছে ওরা। এসি রুমে আরামে থাকবে কটা দিন! লোকটার এমন কথা শুনে মোক্তার মোটেও খুশি হতে পারেনি। তবে এসব আলাপ আর বেশিদূর এগোয়ওনি। যার যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সবাই।

যে বারোটি বানর আলেকবর মিয়া হিল্লা করেছিল তার মধ্যে শিরিনও ছিল। কিন্তু এতদিন পর কোত্থেকে আবার হাজির হলো সে?

এমন সময় তার দরজায় কেউ টোকা দিলে সম্বিত ফিরে পেলো আহম্মদ মোক্তার। এই রাতবিরাতে তার বাসায় কেউ ঢোকার কথা নয়। তারচেয়েও বড় কথা, নিচের সিঁড়ি ঘরের গেটটা তালা দেয়া আছে। এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত।

তাহলে!

তার দরজায় যে-ই টোকা দিয়ে থাকুক না কেন সে ছাদ দিয়ে ঢুকেছে!

বুকটা ধক করে উঠল মোক্তারের। দরজার কাছে গেল ভীরু পায়ে। কান পেতে শুনে বোঝার চেষ্টা করলো ওপাশে কে আছে।

ধুপ ধুপ করে টোকা দিয়ে যাচ্ছে একজন। তবে শব্দটা শিশুদের কোমল হাতের মতো। তারপরই মোক্তারের সমস্ত রোমকূপ দাঁড়িয়ে গেল একটা শব্দ শুনে।

পুরনো সেগুন কাঠের দরজায় ধারালো নখ দিয়ে আঁচড় কেটে যাচ্ছে কেউ!

ক্যাচ্‌-চ্‌-চ্‌-চ্‌-চ্‌- চ্‌- চ্‌- চ্‌- চ্‌- চ্‌- চ্‌- চ্‌- চ্‌- চ্‌- চ্‌- চ্‌-!

শব্দটার স্থায়িত্ব হলো প্রায় কয়েক সেকেন্ড। আহম্মদ মোক্তারের সারা গা কাঁটা দিয়ে উঠল। কাঁচের প্লেটের উপরে কাঁটাচামচ দিয়ে ঘষলে যে শব্দ হয় সেটা কোনোকালেই সে সহ্য করতে পারতো না। আর এটাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতো তার পাড়া-মহল্লা থেকে শুরু করে স্কুলের সহপাঠিরা। তারা মোক্তারকে নিয়ে মজা করার সময় প্রায়ই এ কাজ করতো।

শব্দটা আবারও হলে মোক্তার আর সহ্য করতে পারলো না। হাত দিয়ে দু-কান শক্ত করে চেপে ধরে চিৎকার করে বলে উঠল :

“কে?” তারপর ঢোক গিলে আবার বলল, “ওই…কে?”

কোনো সাড়াশব্দ নেই।

“আরে ক্যাঠায়?” মোক্তারের বিরক্তি এখন চরম পর্যায়ে চলে গেছে।

জবাব হিসেবে শুধুই ধুপ ধুপ শব্দ হলো দরজায়।

মোক্তার ভয়ে সরে এলো দরজা থেকে।

এই মহল্লায় কে আছে যে, এই রাতবিরাতে এসে গপসপ করবে তার সাথে?!

“আরে, ক্যাঠায়!?” ভীতু কিন্তু জোরালো কণ্ঠে বলে উঠল মোক্তার।

“আমি শিরিন!”

প্রথমে আহম্মদ মোক্তার ভাবলো, তার মাথার ভেতরে কেউ যেন কথা বলে উঠেছে। কিন্তু কান পেতে শুনলো, বাইরে থেকেই আসছে শব্দগুলো। সমস্ত রোমকূপ আবারও দাঁড়িয়ে গেল তার ওপাশ থেকে নাকিসুরের কণ্ঠটা শুনে। জান্তব একটা ভয় জেঁকে ধরলো তাকে। যেন ভয়ের অক্টোপাস জাপটে ধরেছে। যেন কালচে একটা ধোঁয়া ঘিরে আছে তার চারপাশ জুড়ে। যেন অন্য কোনো ভুবনে বিরাজ করছে সে।

“দরজা খোল!” নাকিসুরে মেয়েলি কণ্ঠটা আবারও বলে উঠল।

মোক্তার টের পেলো তার কানে ভো ভো শব্দ হচ্ছে এখন।

“তর সাথে কথা আছে।”

বানরদের দুঃসাহস তাকে যারপরনাই বিস্মিত করেছে। একবারে তার ঘরের দরজায় এসে পড়েছে ওরা!

কী চায়? নাকি কৈফিয়ত চাইবে?

শিরিনের কণ্ঠটা তার কাছে কেমন যেন চেনা চেনাও লাগছে। একটু মনে করার চেষ্টা করলো।

হ্যাঁ। ধরতে পেরেছে। তাদের দু-বাড়ি পর মোমেনা বুড়ি নামের এক বিধবা মহিলা থাকতো, মহিলার মুখ যেমন কর্কশ আর চিকন ছিল তেমনি ছিল জঘন্য। পুরুষেরাও লজ্জা পেতো তার খিস্তি-গালি শুনে। কোনো কথার জবাবই সে গালি না দিয়ে কিংবা হেয় না করে দিতো না। এমনকি ‘সালাম’-এর মতো ধর্মিয় আদব-কায়দার বেলায়ও বুড়ি এ কাজ করতো। কেউ তাকে সালাম দিলেই বুড়ি ছড়া কেটে জবাব দিতো : ‘ওয়ালাইকুম আস্সালাম/রহমতের কালাম/আমি যার বান্দা/তুই তার গোলাম!’

ছোট ছোট বাচ্চারা হয়তো ঘুড়ি ওড়ার দিনগুলোতে দাপাদাপি করতো বুড়ির জীর্ণ টিনের ছাদে, তাই দেখে ক্ষেপে গিয়ে বুড়ি চিৎকার করে হাঁক দিতো-’তর নানীগো হাঙ্গা লাগছেনি! তর বাপে আরেকটা নিকাহ্ করছেনি!…এত রঙ লাগছে যে?!’ তারপর যেগুলো বলতো সেগুলো ব্যাটা মানুষও সচরাচর বলে কি না সন্দেহ। সেজন্যে গোয়াল নগরের পোটা পোলাপান তাকে দেখলেই শ্লোক কাটতো : মোমেনারে মোমেনা/মুখতো তর থামে না!

সেই বুড়ির বাজখাঁই গলার স্বর মোক্তারের স্মরণে আছে ঠিকই।

দরজার ওপাশ থেকে যে স্বরটা ভেসে আসছে সেটা মোমেনা খাতুনের! এ ব্যাপারে মোক্তারের মনে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু বুড়ি তো মরে গেছে আহম্মদ মোক্তারের যেদিন দুয়ানি হলো সেদিনই! সুন্নতে খত্না হবার পর অনেকটা বিয়ের অনুষ্ঠানের মতো করে পুরনো ঢাকার মুসলমান ঘরগুলো এই অনুষ্ঠান করতো ছুঁড়ে বেশ জাঁকজমকের সাথে। মোক্তারের বাবাও করেছিলেন তার একমাত্র ছেলের জন্য। আত্মীয়-স্বজন আর পাড়াপ্রতিবেশিদের দাওয়াত দিয়ে ভুড়িভোজ করানোর পর জামাই সেজে ঘোড়ার গাড়িতে করে ঢাকা শহর ঘুরে বেড়ানো-এই হলো দুয়ানি।

“মোক্তার! দরজা খোল! তর লগে আমার কথা আছে!” শিরিন আবারও ডেকে উঠল। “দরজা বন্ধ কইরা আর কতোক্ষণ থাকবি!”

পাথরের মতো জমে আছে মোক্তার। যেন তার চারপাশে একটা বৃত্ত এঁকে দেয়া হয়েছে, আর সেই বৃত্ত থেকে বের হলেই ‘জল্লা’ হয়ে যাবে-শৈশবের অর্থহীন এই খেলাটা কতোই না খেলতো তারা।

এবার কমপক্ষে পাঁচ-ছয়টি হাতের কিল আছড়ে পড়ল মোক্তারের ঘরের একশ’ বছরের পুরনো সেগুন কাঠের ভারি দরজাটার উপরে। পুরনো আর মজবুত দরজাটার উপরে মোক্তারের আস্থা আছে। কতোগুলো বান্দর এটা ভেঙে ভেতরে ঢুকতে পারবে না। কিন্তু এমন আস্থার মধ্যেও মোক্তারের কপাল বেয়ে দর দর করে ঘাম ছুটছে। দরজার পাশে যে জানালাটা আছে সেটার উপরের দিকে কপাট খোলা। মোক্তার আস্তে করে কপাটটার কাছে গেল দেখার জন্য।

সঙ্গে সঙ্গে একটা ভয়ঙ্কর জান্তব মুখ উঁকি দিলো জানালার শিকের ওপাশ থেকে। যেন জেলের গরাদে বন্দি কোনো বিকারগ্রস্ত খুনি শিকগুলো ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইছে। মুখ দিয়ে বিচ্ছিরি শব্দও করলো ওটা।

“খ্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ!”

কয়েক মুহূর্তের জন্য মোক্তারের হৃদস্পন্দন থমকে গেলেও জানালা থেকে পড়িমরি করে সরে যেতে পারলো সে।

আজগরও এসেছে?!

মোক্তার ভেবে পেলো না, আজগর তো কবেই মরে ভুত!

“দরজা খোল!”

তাকে তুই তোকারি করছে?! কিন্তু এটা আজগর হতে পারে না। গোয়াল নগরের লোকজন সবচাইতে বড়, হুলো বানরটাকে আজগর নামে ডাকে। যদিও এলাকার লোকেরা নামকরণের আগে আজগরকে ‘ওলা বলে ডাকতো। যাইহোক, কণ্ঠটা মোক্তারের কাছে আবারও চেনা চেনা লাগছে, যেমনটা লেগেছে শিরিনের বেলায়।

আফসু কন্ট্রোলার!

যদিও গোয়াল নগরের লোকজন ইংরেজি শব্দটার কৌলিন্য হরণ করেই ক্ষান্ত হয়নি, লোকটার আফসার উদ্দিন নামটাও বিকৃত করে ডাকেতো আপসু কনঠোলার বলে। স্বাধীনতার পর পর দেশে যখন খাদ্য সঙ্কট বেড়ে গেল তখন সরকার নিত্য প্রয়োজনীয় চাল-ডাল-লবন-তেল-সাবান সুলভে বিক্রি করার জন্য রেশনশপ চালু করেছিল। ওসব রেশনশপগুলোর লাইসেন্স যারা পেয়েছিল তাদেরকে লোকে কন্ট্রোলার বলে ডাকতো। তো, এই আফসু কন্ট্রোলার ছিল বজ্জাত টাইপের মানুষ। লোকে বলতো, সে রেশনশপের খাদ্যদ্রব্য অভাবি মানুষজনকে না দিয়ে ব্ল্যাকে বিক্রি করে রাতারাতি ধনী হয়ে গেছে। “কিরে হোগারপো! কই যাস?” সাধারণ কুলশাদিও সে এভাবেই সারতো। মুখ আর চরিত্র, দুটোই ছিল বাজে। তার সবচেয়ে প্রিয় সম্বোধন ছিল ‘ঘোড়ারপো’! রেগে গেলে হোগা বাদ দিয়ে ঘোড়ায় সওয়ার হতো সে!

“ওই ঘোড়ারপো…দরজা খোল!” আজগর বলে উঠল জানালার শিকের ওপাশ থেকে।

আহম্মদ মোক্তারের বিশ্বাস করতেও কষ্ট হলো। তবে কি তার এলাকার সব মৃত মানুষগুলোর আত্মা বান্দরদের উপর ভর করেছে?

কিন্তু বান্দরগুলো বেঁচে ফিরে এলো কী করে?

প্রশ্নটা ঘুরপাক খেতে লাগলো তার মাথায়।

আলেকবর মিয়া সবগুলোকে ধরে কোথায় যেন নিয়ে গেছিল। তাকে বলেছিল, সে নাকি ওগুলোর একটা ব্যবস্থা করেছে। মোক্তার ধরেই নিয়েছিল, সবকটাকে মেরে ফেলে দিয়ে এসেছে কোথাও। কিন্তু আলেকবর মিয়ার মতো শঠ লোকের কথা বিনসন্দেহে বিশ্বাস করার মতো লোক এ দুনিয়াতে খুব কমই পাওয়া যাবে। ধূর্ত এই লোক যা বলে তার কোনো কিছুই সত্যি না।

তবে কি আলেকবর মিয়া বানরগুলোকে মেরে ফেলেনি?

ওগুলো হয়তো বেচে দিয়েছিল বানরের খেলা দেখায় এরকম কারোর কাছে।

কিংবা অন্যদের কাছে!

আলেকবর একবার কথায় কথায় বলেছিল, এসি রুমে রেখে এসেছে। ওদের। এ কথা কেন বলেছিল?

এ কথা ভাবতে ভাবতে মোক্তারের নজর গেল তার সমৃদ্ধ বুকশেলফের দিকে। ওখানে এক বৃটিশ লেখকের একটি নন-ফিকশন বই তার মনোযোগ আকর্ষণ করলো। বইটার বিষয়বস্তু প্রাণঘাতি ভাইরাস নিয়ে হলেও বানরদের নিয়ে মারাত্মক একটি গল্প আছে : পশ্চিমের অসংখ্য মেডিকেল গবেষণার ল্যাবেটরিতে বানরের দরকার পড়ে। এইসব বানর সাপ্লাই দেয় কিছু কোম্পানি। তারা আফ্রিকার এক প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বিরল প্রজাতির রিসাস বানর ধরে ধরে ইউরোপ-আমেরিকার ল্যাবগুলোতে বিক্রি করতো। কিন্তু এক্সপেরিমেন্ট শেষে বেঁচে যাওয়া বানরগুলোকে হত্যা করতে না অনেক দেশই-ঐসব দেশের প্রাণী হত্যার বিরুদ্ধে কঠোর আইন থাকার দরুন। তো, ল্যাবগুলো এইসব বানরদের একটা সদগতি করতে সহজ উপায়ে-যাদের কাছ থেকে কিনেছিল তাদের কাছেই দিয়ে দিতো আফ্রিকার কোনো প্রত্যন্ত দ্বীপে, যেখানে মানুষজনের পা পড়ে না, সেখানে ওগুলো যেন ছেড়ে দিয়ে আসা হয়। বানর সাপ্লাই কোম্পানিগুলো তাই করেছিল। কিন্তু বিপত্তি বাধে অন্যখানে। পরবর্তি কালে যখন বানর সরবরাহ করতে গিয়ে সঙ্কটে পড়ল, তখন তারা দেখতে পেলো খুব সহজেই বানর পাওয়া যায়-আর সেগুলো ধরার খরচও খুব কম। যে দ্বীপে এক্সপেরিমেন্ট করা অসুস্থ বানরগুলো ছেড়ে দেয়া হয়েছে সেই দ্বীপটি কয়েক বছরের মধ্যে বানরে পরিপূর্ণ একটি দ্বীপে পরিণত হয়েছে। ওখান থেকে অনায়াসে বানর ধরে আবার সরবরাহ করাটা কোনো ব্যাপারই না।

এভাবে এক্সপেরিমেন্ট করা বানরদের বংশধর সরবরাহ করা শুরু করলো তারা। আর তাদের মাধ্যমেই ছড়িয়ে পড়ল প্রাণঘাতি একটি ভাইরাস! কেননা বানরগুলো মা-বাবার কাছ থেকে এক্সপেরিমেন্ট করা নানান জাতের ভাইরাস নিয়েই জন্মেছে। সেই ভাইরাস বিৰ্বিতিত হয়ে মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল।

এরকমই কোনো এক ল্যাবে পরীক্ষা করার সময় এক গবেষককে ভাইরাস বহনকারি বানর খামচি দিয়ে দেয়, তারপরই দ্রুত লোকটার মধ্যে শরীরিক পরিবর্তন দেখা দিতে শুরু করে। মাত্র দু-দিনেই সে বিভৎসভাবে মরে ভুত হয়ে পড়ে থাকে নিজের বাড়িতে। তাকে ল্যাবে না পেয়ে সহকর্মিরা বাড়িতে গিয়ে দেখে আগুনে পুড়ে যাওয়া মানুষের মতো শরীরের মাংস লালচে হয়ে ফুলে আলগা হয়ে আছে। লোকটাকে দেখে চেনাই যায়নি।

আরেকটি ঘটনা আছে : অন্য এক ল্যাবে অসতর্ক মুহূর্তে বানরের খামচি খাওয়ার পর এক গবেষকের মধ্যে অদ্ভুত পরিবর্তন দেখা দেয়। লোকটা নাকি ধীরে ধীরে বানরের মতো আচরণ করতে শুরু করে।

মাথা থেকে ভয়ঙ্কর চিন্তাগুলো নিয়েই আহম্মদ মোক্তার আবারও আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। গালের আঁচড়টা তাকে ভয়ঙ্কর এক পরিণতির কথা ভাবিয়ে তুলল যেন।

দরজার ওপাশে যে বানরগুলো আছে-শিরিন, আজগরসহ তাদের সাঙ্গপাঙ্গ-তারা কি তবে কোনো ল্যাবে এক্সপেরিমেন্টের শিকার হয়েছে? তারপর কাজশেষে আবারও কি আলেকবর মিয়াকে অসুস্থ বানরগুলো কোথাও ফেলে দিয়ে আসার কাজ দেয় তারা? আলেকবর মিয়া হয়তো বানরগুলো নিয়ে দূরে কোথাও ফেলে দিয়েছিল, কিন্তু বানরগুলো বেড়ালের মতোই পথঘাট চিনে চিনে চলে এসেছে এই গোয়াল নগরে!

এই যে বানরগুলো মানুষের মতো কথা বলছে তার কারণ কি ল্যাবের এক্সপেরিমেন্ট?! হয়তো বিরল কোনো ভাইরাসের প্রভাবে, কিংবা ওগুলোর শরীরে জেনেটিক্যালি কোনো পরিবর্তন করার ফলে মানুষের মতো কথা বলা শিখে গেছে!

এখনও শিরিনের ধুপধাপ শব্দ শুনতে পাচ্ছে মোক্তার। আর আজগরের গা শিউরে ওটা হিসহিসে হাসির শব্দ ক্ষণে ক্ষণে ভয় জাগিয়ে তুলছে তার মনে।

“শূয়োরের বাচ্চা!” দাঁতে দাঁত পিষে মোক্তার কথাটা বলল।

“ওই…কারে গালি দ্যাস! আজগরের বাজখাঁই কণ্ঠটা বলে উঠল জানালার পেছন থেকে।

“কারে আবার! আমাগো দিতাছে!” জবাব দিলো শিরিন। এখনও দরজার উপরে আঘাত করে যাচ্ছে সে।

“আলেকবরে দিছি…তো-তোমাগো না,” আহমদ মোক্তার চেঁচিয়ে বলল।

“আলেকবর!” শিরিন হিসহিসিয়ে বলল। “ঐ কুত্তারবাচ্চা তো আমাগো জীবন শ্যাষ কইরা দিছে!”

“হ…ওরে আমরা ছাড়ুম না!” আজগর সায় দিলো শিরিনের সাথে।

“কি করবি তোরা?” মোক্তার জানতে উৎসুক হয়ে উঠল।

খিচ-খিচ-খিচ করে দুটো বানর হেসে উঠল। তার সাথে পরক্ষণেই যোগ দিলো আরও কিছু বানর।

“আমাগো লগে যা করছে তা-ই করুম!” অবশেষে বলল শিরিন।

“এহনও কুত্তাটা বাড়িতে আহে নাই…একবার খালি আহুক!” আজগর রেগেমেগে বলল।

“ওরে ধরার আগে এইটারে ধরতে হইবো…ভুইল্যা যাইস না,” শিরিন অনেকটা সদারনির মতো করে বলে উঠল এবার। “এইটাই আমাগোরে ওর হাতে তুইল্যা দিছে।”

“হ। আমাগো অনেকেরে মাইরাও ফাইলাছে,” আজগর যোগ করলো। “তর হাতটাও খাম্ করছে।”

শিরিন এবার জান্তব একটা চিৎকার দিলো। আমিও ওর হাত খাম্ করুম!”

“আ-আমি মারিনি…” প্রতিবাদ করে উঠল আহম্মদ মোক্তার। “আলেকবর মিয়া মারছে!”

“হ, জানি!” গম্ভীর কণ্ঠে বলল আজগর। “তুই-ই হেরে ডাইক্যা আনছোস!”

“তুই-ই খুনি!” শিরিন তাল মেলালো। “তরে আমরা ছাড়ুম না।”

“ক্‌-কী করবি আমারে?” মোক্তার একটু তোতলালো।

খিচ্‌-চ্‌-চ্‌-চ্‌ করে আবারও শব্দ তুলল দুটো বান্দর। যেন আহম্মদ মোক্তারকে এই শব্দটার মতোই দুর্বোধ্য আর ভয়ানক কোনো শাস্তি দেবে।

“আ-আলেকবর তোগোরে নিয়া কী করছিল?” ঢোক গিলে প্রশ্নটা করেই ফেলল আহম্মদ মোক্তার।

“কী করছে?” বলল শিরিন। “হুনলে তুই পেচ্ছাব কইরা দিবি।”

“না, হাইগ্যা দিবো,” আজগর শুধরে দিলো শিরিনকে।

আহম্মদ মোক্তার আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। তার কাছে মনে হচ্ছে, এই বানরগুলো আসলে বেঁচে নেই। আলেকবর মিয়া তাদেরকে নৃশংস উপায়ে হত্যা করেছে। এখন যারা দরজার ওপাশ থেকে কথা বলছে তারা বানরগুলোর প্রেতাত্মা!

কিংবা ঐসব প্রেতাত্মা ভর করেছে কিছু বানরের উপরে!

“তুই তাইলে দরজা খুলবি না?” শিরিন বলে উঠল অধৈর্য হয়ে।

“না খুললে কী…আমরাও সারা রাইত এইখানে থাকুম…দেহি, হে কয়দিন ঘরে খিল মাইর‍্যা থাকে!” আজগর হাসতে হাসতে বলল কথাটা।

“তরা ভুল করতাছোস!” চিৎকার করে বলল আহম্মদ মোক্তার। “আমি তগো কোনো ক্ষতি করি নাই। আমি খালি তগো অত্যাচার থেইকা বাঁচবার চাইছিলাম।”

“তাই তুই আমাগোরে বিষ মিশাইয়া মারছোস!” শিরিন বলে উঠল।

“আমাগো অনেকেরে মারছে সে…আমরা কয়জন খালি বাঁইচ্যা গেছিলাম…তা-ও রক্ষা পাই নাই…আলেকবরের হাতে তুইল্যা দিছে!”

“হ…ওই খাটাশের বাচ্চাটার হাতে তুইল্যা দিছে আমাগো!”

“না!” শিরিনের কথার প্রতিবাদ করে উঠল মোক্তার। “আলেকবর নিজেই আসছিল আমারে সাহায্য করতে…আমি তারে ডাইকা আনি নাই। সে তগো সাথে কী করছে আমি কিছু জানি না।” একটু থেমে আবার বলল, “তরা আলেকবররে ধর…আমারে ক্যান…?!”

“ওরে তো ধরুমই…তরেও ছাড়ম না।” শিরিন বলল রেগেমেগে।

“তরা আসলে আলেকবরের বালটাও ছিঁড়তে পারবি না তাই আসছোস আমারে ধরতে!” আহম্মদ মোক্তার দাঁতে দাঁত পিষে বলে উঠল।

“খিককককক!” হেসে উঠল আজগর। “ওরে তো ধরবি তুই…আমরা না!”

“কী!” বিস্ময়ের সাথে জানতে বলে উঠল মোক্তার।

“তু-ই আমাগো হাতে আলেকবরে তুইল্যা দিবি!”

“হ, ওইটারে আমাগো হাতে তুইল্যা দিবি তুই!” শিরিনও সায় দিলো আজগরের সাথে।

“আ-আমি তুইলা দিমু!” অবিশ্বাসের সাথে বলল মোক্তার। “ক্যান তুইলা দিমু!? তুইলা দিলে আমার কী লাভ?”

“তাইলে তরে আমরা ছাইড়া দিমু!” প্রস্তাবটা দিলো শিরিন। কিন্তু বলল হালকা চালে।

বিশ্বাস করলো না মোক্তার। “তোগোরে বিশ্বাস করি না!”

“না করলে নাই!” আজগর বলে উঠল। “বইস্যা বইস্যা বাল ফালা!”

মোক্তার ভেবে পেলো না কী বলবে।

“আমরা তগোর মতা না,” শিরিন যোগ দিলো এবার, “যা কই তা-ই করি আমরা। বান্দরা কখনও মিছা কথা কইছে, হুনছোস?”

না। মোক্তার কখনও বান্দরদের মিথ্যে বলতে শোনেনি। “আমি যদি আলেকবরে তগোর হাতে তুইল্যা দেই তরা ওরে কী করবি?” প্রশ্নটা না করে পারলো না সে।

“খি-খি-খি!” করে হেসে উঠল আজগর। আর শিরিন কিচকিচ শব্দ তুলল।

“ওরে কী করুম তর জানোনের দরকার নাই,” বলল আজগরই।

“হ, তর কিছু জানানোর দরকার নাই।”

এ পর্যন্ত মোক্তারের বেশ স্মরণ আছে, কিন্তু তারপর কী হয়েছিল সেসব তার কাছে এখনও অস্পষ্ট। স্মৃতিগুলো কেমন লেপ্টে যায় কাঁচা রঙের মতো। যেন দলা পাকানো রঙের সমাহার। কোনটা আগে, কোনটা পরে ঘটেছিল সে বুঝতে পারে না। কিছু কিছু স্মৃতি পুরোপুরি উধাও। যেন স্মৃতিগুলো কেটে টুকরো টুকরো করে পাজলের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেয়া হয়েছে। এখন মোক্তারকে সেই অংশগুলো জোড়া লাগিয়ে নিতে হবে।

মোক্তার চেষ্টা করলো জোড়া লাগাতে।

হুম। আলেকবর এসেছিল তার ঘরে। সে কি নিজে থেকে এসেছিল নাকি মোক্তার তাকে ডেকে নিয়ে এসেছিল সেটা অবশ্য স্পষ্ট নয়।

“কাহিনী কী?” আলেকবর তার ঘরে ঢুকে বলেছিল। “কী হইসে? আপনেরে এমন দেখাইতেসে ক্যান?”

“আপনে ঐ বান্দরগুলারে নিয়া কী করছেন, ঠিক কইরা কন্ তো?” অনেক কষ্টে নিজের রাগ দমন করে মোক্তার জানতে চেয়েছিল।

অবাক হয়েছিল ঘোরেল লোকটা। “বান্দর নিয়া কী করছি তা জাইন্যা আপনের কী কাম?”

“আছে আছে,” জোরে মাথা দুলিয়ে বলেছিল মোক্তার। “যা জিগাইতাছি ঠিক ঠিক জবাব দেন।”

“আরে মিয়া, ঝারি মারেন ক্যান? আপনের ঝারি আমি ডরাই নাকি?” আলেকবর চোখমুখ বিকৃত করে বলেছিল।

বিস্মিত হয়েছিল মোক্তার। “তুই ডরাইবি না তর বাপে ডরাইবো!” চিৎকার করে বলেছিল সে। রাগে কাঁপছিল।

“ওই!” পাল্টা চিৎকার দিয়ে বলে আলেকবর মিয়া। “মুখ সামলাইয়া কথা কইবি! বাড়িওলা হইছোস তো কী হইসে, তরে আমি বাল দিয়াও পুছি না!”

আহম্মদ মোক্তারের সারা শরীর রাগে পুড়তে শুরু করে এ কথা শুনে। মাথায় খুন চেপে যায়। “তরে আমি কী করুম তুই জানোস না!”

“তুই করবি আমার বাল!” আলেকবর তাকে পাত্তাই দেয় না। “হালার মাইগা ব্যাটা…আমারে ফাপড় মারে!”

“তুই কী কইলি?!” রেগেমেগে বলে ওঠে মোক্তার। দাঁতে দাঁত পিষতে শুরু করে।

“তরে মাইগা কইছি! এই মহল্লার সবতে জানে তুই একটা মাইগা! বিয়া করোস নাই তো হের লাইগ্যাই!”

মোক্তারের মনে হলো লোকটার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়বে এক্ষুণি। কিন্তু সারাজীবনে সে একবারের জন্য হলেও এ কাজ করেনি। কতোবার পাড়ামহল্লার ছেলেপেলে আর স্কুলের সহপাঠিদের হাতে নিগৃহিত হয়েছে, একবারের জন্যেও প্রতিরোধ করতে পারেনি। তবে মনে মনে তাদের প্রত্যেককে বিভিন্ন উপায়ে, অত্যন্ত নৃশংসভাবে আঘাত করেছে। ঐ পর্যন্তই। বাস্তবে আহম্মদ মোক্তার কাউকে চড়ও মারেনি।

“এইসব ধানাইপানাই বাদ দিয়া কন, আমারে ডাকছেন ক্যান?” আলেকবর মিয়া চেঁচিয়ে বলল। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে-ই বাড়িওয়ালা। আর মোক্তার নিছক একজন ভাড়াটে।

“আমি না,” কথাটা বলেই ফেলল আহম্মদ মোক্তার। “তরে ডাকছে শিরিন।”

“কি!” বিস্মিত হলো আলেকবর। কিন্তু একইসাথে মেয়েমানুষের নাম বলায় কৌতূহলিও সে। “শিরিন?! এইটা আবার কে?”

“আছে একজন।”

“আমারে ডাকে ক্যান সে?” লাম্পট্যের হাসি ঝুলিয়ে বলল ঘোরেল লোকটা। “কই সে…আপনের ঘরে আছেনি?”

“…ছাদে…” আস্তে করে বলল মোক্তার।

“ছাদে?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো সে।

“শিরিন কে? নামটা চিনা চিনা লাগতাছে!”

আলেকবর কিছু স্মরণ করার যে চেষ্টা করেছিল সেটা মোক্তারেরও স্মরণে আছে। কিন্তু তারপর ঘটনা আবার অস্পষ্ট আর ঘোলাটে হয়ে ওঠে। টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলো জোড়া লাগাতে বেগ পেলো।

যাইহোক, কৌতূহলি হয়েই সম্ভবত আলেকবর মিয়া ছাদে গেছিল। তারপর কী হয়েছে মোক্তারের মনে নেই। কেবল মনে আছে ছোট্ট একটা গোঙানি দিয়েছিল সে। তারপর নিজের ঘরে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে নাকি সঙ্গে সঙ্গেই ছাদে গেছিল সেটা আর মনে করতে পারলো না।

ছাদে গিয়ে মোক্তার দেখতে পায় শিরিন আর আজগর তাদের দলবল নিয়ে ভূপাতিত হওয়া আলেকবর মিয়াকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে।

“আমাগো কাম শ্যাষ!” আজগর বলেছিল মোক্তারকে দেখে। তার হাতে একটা পিতলের ফুলদানি। মোক্তারের দাদার আমলের এই ফুলদানিটা বেশ ভারি। তার অলক্ষ্যে কখন যে এটা হাতিয়ে নিয়ে চলে গেছে আজগর টেরই পায়নি সে।

শিরিন প্রসন্ন ভঙ্গিতে বলে তখন, “তরে আর কিছু করলাম না। আমরা আমাগো কথা রাখলাম।”

বান্দরগুলো সরে যেতেই মোক্তার দেখতে পায় আলেকবর মিয়া পড়ে আছে। “ওরে তরা কী করছোস?”

তার এ প্রশ্নের জবাব কেউ না দিয়ে এক এক করে ছাদ থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে বান্দরগুলো চলে যেতে শুরু করলো।

মোক্তার খুব কাছে এসে আলেকবর মিয়াকে দেখলো। লোকটার মাথার পেছন থেকে রক্ত বের হয়ে ছাদে জমে আছে। তার মুখে খামচির দাগ সুস্পষ্ট।

একটু দূরে ফুলদানিটা পড়ে থাকতে দেখে মোক্তার বুঝে গেল ওটা দিয়েই আঘাত করা হয়েছে আলেকবর মিয়াকে। একাধিক আঘাত। লোকটার মাথা থেতলে দেয়া হয়েছে।

মোক্তারের নিঃশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম হলো। তার ছাদে একজনকে খুন করা হয়েছে! এই লাশ নিয়ে এখন সে কী করবে?

.

যেন একটা দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে উঠল আহম্মদ মোক্তার। আর এটা বুঝতে কয়েক সেকেন্ড লাগলো তার। চারপাশে তাকিয়ে দেখলো সে তার বাসার ছাদে নেই। আছে অন্য একটা ঘরে।

তারপরই টের পেলো তার হাত-পা বাঁধা।

হাসপাতাল!

হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো মোক্তার। ঘেমেটেমে একাকার সে। এতোক্ষণ তাহলে দুঃস্বপ্ন দেখছিল।

যাইহোক, একটা লাশ নিয়ে কী করবে-এমন কঠিন পরিস্থিতি থেকে আপাতত মুক্তি পেয়েছে। সবটাই বাজে স্বপ্ন। অসুস্থ শরীরে এমন স্বপ্ন দেখাটা স্বাভাবিক। ছোট্ট ঘরটার দিকে তাকালো আরেকবার। ঘরের উজ্জ্বল আলো জ্বলে উঠেছে। নেপথলিনের গন্ধটা নাকে আসতেই আরও বেশি করে নিশ্চিত হলো-হাসপাতালেই আছে।

দরজার দিকে চেয়ে দেখলো একজন মেল-নার্স দাঁড়িয়ে আছে। লোকটাকে দেখে চেনা চেনা লাগলো তার।

“নকূল না?” মনে করতে পারলো মোক্তার।

হাসি দিলো মেল-নার্স। “ডাক্তার আসতাছে…” কথাটা বলেই সে কাছে। এগিয়ে এলো। “আবার জ্বর আসছে নাকি?”

মোক্তার কিছু বলল না।

কথাটা শেষ করার আগেই একজন পুরুষ আর আরেকজন নারী ডাক্তার ঘরে ঢুকলো, তাদের পেছন পেছন ঢুকলো কিছু অল্পবয়েসি ছেলেমেয়ে-সবার পরনে ডাক্তারি অ্যাপ্রোন।

“এই যে মি. মোক্তার…” বলে উঠল পুরুষ ডাক্তার। “ক্লাসিক্যাল কেস অব পিথিকাফোবিয়া।”

অল্পবয়েসি ছেলেমেয়েগুলো মাথা নেড়ে সায় দিয়ে মোক্তারের দিকে ভালো করে তাকালো। সবার দৃষ্টি এখন তার দিকে। ব্যাপারটা তাকে অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিলো আবার।

“কিন্তু এই পেশেন্টের ক্ষেত্রে কেসটা আরও জটিল,” বলল মহিলা ডাক্তার। এর পাশাপাশি মাল্টিপাল পারসোনালিটিতেও ভুগছে সে।”

ফ্যাল ফ্যাল চোখে চেয়ে রইলো রোগি।

“তার মাল্টিপাল পারসোনালিটিটা আবার খুব জটিল,” যোগ করলো পুরুষ ডাক্তার।

উন্মুখ হয়ে চেয়ে রইলো অল্পবয়েসি ছেলেমেয়েগুলো।

“তার একটি সত্তা বানর হিসেবে রূপান্তরিত হয়েছে…অথচ তার মধ্যে পিথিকাফোবিয়াও আছে। এটা খুবই রেয়ার কেস।”

“এজন্যেই এই পেশেন্ট আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এরকম কেস সচরাচর দেখা যায় না,” মহিলা ডাক্তার বলল।

আহম্মদ মোক্তারের কাছে কণ্ঠদুটো চেনা চেনা লাগছে। মনে করার চেষ্টা করতেই তার চোখ গেল পুরুষ ডাক্তারের অ্যাপ্রোনের বুকের দিকে, যেখানে নাম লেখা থাকে : ডা. আজগর আলী!

এবার নারী ডাক্তারের দিকে তাকালো সে।

ডা. শিরিন বানু!

বুকটা ধক করে উঠল মোক্তারের। ডাক্তারদের চেহারা ভালো করে লক্ষ্য করলো সে।

এবার সব কিছু পরিস্কার!

শিরিন আর আজগরই!

“না! না!” চিৎকার দিলো মোক্তার। হাত-পায়ের বাঁধন থেকে মুক্ত হবার জন্য উদভ্রান্তের মতো আচরণ করতে শুরু করলো।

“সে খুবই ভায়োলেন্ট হয়ে যায়,” বলল আজগর। “তার হাতে তার এক ভাড়াটিয়া খুন হয়েছে…যদিও তার দাবি, খুনটা করেছে কতোগুলো বানর।”

“তুই করেছিস আজগর!” চিৎকার করে বলে উঠল মোক্তার। “তোরা করছোস….তুই আর শিরিন! তোরা সবতে মিল্যা করছোস!”

মাথা দোলালো নারী আর পুরুষ ডাক্তার। আর অবাক চোখে তাকে দেখতে থাকা অল্পবয়েসি ছেলেমেয়েগুলো আরও বেশি কৌতূহলি হয়ে তাকে দেখতে লাগলো এখন।

“নিজেরা মাইরা আমার নাম দিতাছোস!”

“একটা ইনজেকশন দিয়ে দাও,” আজগর বলে উঠল। “পেশেন্ট আবার ভায়োলেন্ট হয়ে উঠেছে।”

সঙ্গে সঙ্গে বেডের পাশে থাকা মেডিসিন ক্যাবিনেটের ড্রয়ার খুলে ফেলল নকূল।

“না! না! না!” প্রাণপনে চিৎকার দিলো মোক্তার। কিন্তু একটু পরই টের পেলো তার হাতে সূঁচালো কিছু বিঁধছে।

কয়েক মুহূর্ত পর নিস্তেজ হয়ে গেল সে।

বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নেমেই দরজার দিকে ছুটে যাচ্ছে আহম্মদ মোক্তার। দেখতে পেলো নকূল দরজা আগলে দাঁড়িয়ে পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের মধ্যে একটা হৈ হল্লা শুরু হয়ে গেল। চারদিক থেকে চিৎকার আর চেঁচামেচি। মোক্তার আর কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা বাথরুমের দিকে দৌড় দিলো। তার পেছনে কতোগুলো মানুষ কিংবা বানরের দল তাড়া করছে!

বাথরুমে ঢুকেই দরজাটা বন্ধ করে দিলো সে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।

বান্দরদের হাতে বন্দি সে!

বান্দরের দল তাকে রেহাই দেয়নি তাহলে!

দরজায় আঘাত করার শব্দ শুনতে পেলো এবার। তাকে বাইরে বের হতে বলছে নকূল, আজগর, শিরিন। সঙ্গে আরও অনেকগুলো কণ্ঠ।

“ভালোয় ভালোয় বাইর হন…নইলে কিন্তু দরজা ভাইঙ্গা ঢুকবো ভিতরে!” নকূল বলে উঠল। “শালা বান্দরের বাচ্চা!”

গালিটা শুনে আহম্মদ মোক্তারের কপালে ভাঁজ পড়ল। কী মনে করে যেন বাথরুমের বেসিনের উপর রাখা আয়নাটার দিকে তাকালো সে।

আয়নায় তাকিয়ে আছে একটা ওলা বান্দর!

তারপর বুকের সমস্ত বাতাস জড়ো করে, বান্দর হতে অস্বীকৃতি জানিয়ে একটা চিৎকার দিলো সে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *