০৩. লেখকের আসন

লেখকের আসন

একটা সময় ছিল চাইলেই লিখতে পারতেন তিনি। ভাবনার চেয়েও তার আঙুল বেশি জোরে দৌড়াতো; গল্প ছুটতো তার চাইতেও দ্রুত বেগে। এখন আগেভাগে ভেবে নিতে হয়, তারপর গুছিয়ে নিতে হয় কথামালা।

চোখ বন্ধ করে সিগারেটে দীর্ঘ একটা টান দিয়ে এতোক্ষণ ধরে গুছিয়ে নেয়া ভাবনাটা প্রকাশ করলেন লেখক এলান মাহমুদ : “সোমলতা দরজার শিয়রে দাঁড়িয়ে পড়ল কুণ্ঠিত পায়ে।” কিন্তু টাইপ করার সুপরিচিত খটাখট শব্দটা শুনতে না পেয়ে চোখ খুলতে বাধ্য হলেন তিনি। “কী হইছে?”

“সোমলতা দরজার সামনে এসে থমকে দাঁড়ালো। তার কুণ্ঠিত পা এগোতে দিলো না তাকে,” কম্পিউটারের সামনে হ্যাংলামতোন যে ছেলেটা বসে আছে, এলান মাহমুদের দিকে পাশ ফিরে বলে উঠল সে। “এটা দিলে কেমন হয়, ভাই?”

লেখক সিগারেটে আবারও একটা টান দিলেন। কম্পিউটার থেকে কয়েক হাত দূরে সেগুন কাঠে তৈরি ইজি চেয়ারে আরাম করে বসে আছেন তিনি, চেয়ারের প্রশস্ত হাতলের উপরেই রেখেছেন ক্রিস্টালের অ্যাস্ট্রেটা।

“এভাবে লিখলে লেখাটা বড় হবে…পড়তেও আরাম পাবে পাঠক…” যোগ করলো সাতাশ-আটাশ বছরের হালকা পাতলা গড়নের তরুণ।

মুখভর্তি ধোঁয়া নির্গত করার পর যথারীতি মাথা নেড়ে সায় দিলেন এলান মাহমুদ। “হুম।”

খটাখট টাইপের শব্দ তাকে স্বস্তি দিলো অবশেষে। রাজু নামের এই ছেলেটির হাত দিন দিন তুখোড় হয়ে যাচ্ছে। তার ক্ষিপ্রতা প্রশংসার যোগ্য। টাইপিংয়ে তার নির্ভুলতা বিস্ময়কর। প্রথম যখন ছেলেটি এ কাজ করতে শুরু করলো তখন কতোই না আড়ষ্ট ছিল। লেখকের মুখনিঃসৃত কথাগুলোর সাথে পাল্লা দিতে হিমশিম খেতে তার দশটি আঙুল।

“অজিত এখনও ঘুমাচ্ছে। তার বুকের ওঠানামা দেখলো সোমলতা,” বললেন লেখক।

টাইপের খটাখট শব্দ সরব করে তুলল ছোট্ট ঘরটা। একটা ছন্দে, একটা জটিল তালে সেই খটাখট শব্দ চলল আরও কিছুক্ষণ।

“কী লিখলা?” সন্দেহের সুরে জানতে চাইলেন লেখক। তার বলা বাক্যটির দৈর্ঘ আর টাইপিংয়ের সময়কালের মধ্যে যে একটা অসঙ্গতি রয়েছে ধরতে পেরেছেন।

“ঘরের মাঝখানে বিশাল পালঙ্কে শুয়ে থাকা অজিতের দিকে তাকালো সে। এখনও ঘুমাচ্ছে ছোট্ট শিশুর মতো। তার বুকের ওঠানামা দেখলো সোমলতা।” কম্পিউটার মনিটরের দিকে তাকিয়ে এইমাত্র নিজের টাইপ করা লেখাটি আউড়ালো রাজু।

লেখক বুঝতে পারছেন না কী বলবেন। তবে তিনি জানেন, ছেলেটা ঠিকই করেছে। এভাবে বাক্য সাজালে লেখা বড় হবে। আর বড় লেখা মানে বেশি পৃষ্ঠা…বেশি পৃষ্ঠা মানে বেশি ফর্মা…ফর্মা বেশি তো দামও বেশি…রয়্যালিটিও বেশি। তাছাড়া এভাবে লিখলে যে বর্ণনাটুকু যুক্ত হবে সেটা গল্পের জন্য ভালোই হয়।

“হুমম…” সায় দিয়ে আবারও সিগারেটে টান দিলেন লেখক। “অজিতকে ডাকবে কী ডাকবে না ভেবে পেলো না সোমলতা।”

“অজিতকে ডাকা দরকার কিন্তু তার ঘুমে ব্যঘাত ঘটানোর ইচ্ছে হলো সোমলতার। ঘুমন্ত অজিতের দিকে চেয়ে থাকলো কয়েক মুহূর্ত। অদ্ভুত এক ভালোলাগা ভর করলো তার মধ্যে।”

রাজুর কথাগুলো চুপচাপ অনুমোদন করে সায় দিলেন এলান মাহমুদ। দেখে মনে হতে পারে, এ মুহূর্তে সিগারেটেই বেশি মনোযোগ তার, কিন্তু তার ভাবনা চলে গেছে দশ বছর আগে। লেখালেখি করে আর চলছিল না তখন। সংসার বড় হয়েছে, তার দুটো মেয়েই তখন স্কুলে পড়ে। মাস শেষে প্রচুর খরচ, কিন্তু বছরে ছয়-সাতটি বই লিখে যে আয় হয় তা দিয়ে সংসার ঠিকমতো চলে না। অগত্যা চায়ের আড্ডায় তার কবিবন্ধু-যে কি না তার মতো কথাসাহিত্যিকদের টিটকারি মেরে পুলকানন্দ লাভ করে-বুদ্ধি দিলো, প্রতি বছর দশ-বারোটি করে বই লিখছে না কেন? প্রডাকশন না বাড়ালে আয় কেমনে বাড়বে!

প্রডাকশন!

মাসে একবার গোসল করা তার ঐ কবিবন্ধু এভাবেই কথাসাহিত্যকে মূল্যায়ন করতো। তিন বছর আগে সিফিলিসে আক্রান্ত হয়ে ভবলীলা সাঙ্গ হয়েছে তার। ওর লাশের সামনে যখন গেছিল তখন বিকট দুর্গন্ধের কারণে বন্ধুর জন্য যে শোক উথলে ওঠার কথা সেটা রীতিমতো দৌড়ে পালিয়েছিল।

তো, কবিবন্ধুর উপদেশটি তিনি হেসে উড়িয়ে দিলেও মনে মনে ঠিকই গ্রহণ করেছিলেন। যদিও জানতেন, বছরে দশ-বারোটি উপন্যাস লেখা মোটেও সহজ কাজ নয়। এ তো কবিতা নয় যে, চায়ের আড্ডায় খিস্তি করতে করতেও প্রসব করে দেয়া যায়! একটা মুরগি চাইলেও দিনে দুটো ডিম পাড়তে পারে না, আর লেখালেখি তো তারচেয়েও কঠিন কাজ। কখন যে লেখার মেজাজ আসবে আর কীভাবে যে মাথায় গল্প আসে সে কথা স্বয়ং ঈশ্বর ছাড়া আর কেউ জানে না বোধহয়।

কবিবন্ধুর প্রস্তাবটি অসম্ভব মনে হলেও এটাই সবচেয়ে বাস্তবসম্মত পথ বলে মনে করেছিলেন এলান মাহমুদ। তবে এত গল্প যে তিনি কখনও বানাতে পারবেন না সে-ব্যাপারে তার মনে কোনো সংশয় ছিল না। সুতরাং অসম্ভবকে সম্ভব করতে পুরনো অভ্যাসে ফিরে যান লেখক।

তার শুরুটা হয়েছিল দুই বাঙলার সব নামকরা লেখকদের একাধিক গল্প থেকে উপাদান নিয়ে, সুচতুরভাবে মিশিয়ে আস্ত একটি গল্প দাঁড় করানোর মধ্য দিয়ে। পাঠক হিসেবে তিনি বরাবরই ভালো ছিলেন। সত্যিকার অর্থে, লেখকদের মধ্যে তার মতো পড়ুয়া খুব কমই পাওয়া যাবে। হাজার-হাজার গল্প-উপন্যাস তিনি শুধু পড়েই ক্ষান্ত হতেন না, সেগুলো গেঁথে রাখতেন। মগজে। প্রকাশিত বই ছাড়াও বিভিন্ন পত্রপত্রিকা কিংবা লিটলম্যাগে প্রকাশিত গল্প তিনি গোগ্রাসে গিলতেন। তার এই সমৃদ্ধ পাঠের ভাণ্ডার থেকে কোন গল্পের কোন অংশ কীভাবে ব্যবহার করবেন তিনি সেটা অন্য কারোর পক্ষে বোঝা সহজ কাজ ছিল না। কেউ বুঝতেও পারেনি, তার প্রথম উপন্যাস ‘যে রাতে আমি এসেছিলাম’ আসলে চারজন প্রখ্যাত লেখকের চার-চারটা ভিন্ন গল্পের মিশেলে লেখা। সেখানে তার নিজের অবদান ছিল খুবই সামান্য। অন্য লেখকেরা যদি নিজেদের লেখার জমিন উর্বর করার জন্য পাঠ করে থাকেন তো তিনি এ কাজ করেন, অন্যের ক্ষেত থেকে আস্ত চারা চুরি করে নিজের ক্ষেতে বপন করার জন্য!

প্রথম কয়েক বছর এমন করেই লেখক হিসেবে ঠাঁই করে নিয়েছিলেন তিনি, তবে জনপ্রিয়তা পাবার পর এই বদ অভ্যেসটি বাদ দিয়ে দেন। কারণ, চারদিক থেকে একটু আধটু ফিসফাস শোনা যাচ্ছিল তিনি নাকি অন্যের গল্প মেরে দেন। কথাগুলো তার কানে গেলে মনে মনে গজরাতে গজরাতে বলেছিলেন, আরে বাবা! এ কাজ তো অনেকেই করে! গল্পের শেষে ছোট্ট করে লিখে দেয়-একটি বিদেশি কাহিনী অবলম্বনে লেখা…তাদেরকে না ধরে আমাকে নিয়ে এত কথা বলা হচ্ছে কেন?

যাইহোক, সেই কবিবন্ধুর প্রস্তাবটি ভেবে দেখার পর আবারও ফিরে গেছিলেন তার সেই পুরনো অভ্যেসে। এভাবে নিজের আর্থিক সমস্যা দূর করেছিলেন বটে, তবে এ কাজ যে বেশিদিন করা সম্ভব হবে না সেটাও বুঝতে পেরেছিলেন। আর ঠিক তখনই, অনেকটা দৈবঘটনার মতো এই রাজু নামের ছেলেটির আবির্ভাব ঘটে।

তার পাশের গ্রাম ব্রাহ্মনকীত্তার ছেলে রাজু। তার বাপের কী রকম এক ফুপাতোভায়ের বড়মেয়ের ছোটছেলে। ডিগ্রি পাস করে বেকার ঘরে বসেছিল। ছেলেটার বয়স্ক নানা এক সকালে নাতিকে বগলদাবা করে নিয়ে আসে এলান মাহমুদের ঢাকার বাসায়। সে তো মাশাল্লা অনেক বড় লেখক হয়ে গেছে, সারা দেশে তাকে চেনে। কতো বড় বড় মানুষের সাথে তার ওঠাবসা! তাদের কাউকে ধরে একটা চাকরির ব্যবস্থা নিশ্চয় সে করে দিতে পারবে এই ছেলেটার জন্য।

প্রথমে এলান মাহমুদ ভেবেছিলেন, চাচাকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে বলে দেবেন, ঢাকা শহরে কাউকে চাকরি দেয়া এত সহজ কাজ নয়। কিন্তু অভিজ্ঞ আর পোড়খাওয়া লেখক জানতেন, বাঙালিকে সরাসরি না বলতে নেই। অন্য কোনো জাতি হলে সরাসরি না শুনে কতোটা অখুশি হয় সে কথা তার জানা না থাকলেও, বাঙালি যে এরকম কিছু শুনতে অভ্যস্ত নয় তা ভালো করেই জানতেন। বাঙালিকে স্বপ্ন দেখাতে হয়-সেই স্বপ্ন যত অলীক আর অসম্ভবই হোক না কেন! পূরণ না হোক, তবু একটা আশ্বাস দিয়ে ঝুলিয়ে রাখতে হয় বাঙালিকে! এটা রাজনীতিকদের চেয়ে বেশি কে জানে!

তো, এলান মাহমুদও তাই করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন ছেলেটার একটা সিভি যেন রেখে যায়। কিছু করতে পারলে তিনি খবর দেবেন। বুড়ো খুব খুশিমনেই নাতিকে নিয়ে চলে গেছিল তখন। যাবার আগে দু-হাত তুলে বন্ধুপুত্রের জন্য দোয়াও করে যান।

এই ঘটনার কয়েকদিন পর এলান মাহমুদ সুন্দর একটি গল্প লেখার জন্য মনস্থির করেন। গল্পটা ঠিকমতো লিখতে পারলে দারুণ কিছু হবে। আর কদিন পরই বইমেলা, এরইমধ্যে আটটা উপন্যাস দাঁড় করিয়ে ফেলেছেন, এই গল্পটার সাথে আরেকটি গল্প যোগ করতে পারলে দশটা বই তৈরি হয়ে যাবে, বেশ ভালো অঙ্কের টাকা পাবেন তিনি। ইতিমধ্যে না লেখা উপন্যাসটির মুলো ঝুলিয়ে এক সাবেক কাপড় ব্যবসায়ি থেকে প্রকাশক বনে যাওয়া একজনের কাছ থেকে অগ্রিম কিছু টাকাও নিয়ে নিয়েছেন, তাই আর দেরি না করে গল্পটা লিখতে শুরু করে দেন। কিন্তু দ্বিতীয় দিন সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর আবিস্কার করলেন, তার ঘাড় আর পিঠে মারাত্মক ব্যথা হচ্ছে। তারচেয়েও বড় কথা, তার অতীব জরুরি ডানহাতটা নাড়াতেই পারছেন না। প্রচণ্ড ব্যথায় চোখমুখ কুঁচকে যাচ্ছে।

পরিচিত এক ডাক্তার দেখালেন তিনি। ভদ্রলোক ওষুধপত্র দিয়ে বলে দিলেন, আগামি এক সপ্তাহ তাকে বিশ্রাম নিতে হবে। ডানহাতে কোনো কাজ করা যাবে না।

এলান মাহমুদ পড়লেন বিপদে। এক সপ্তাহ লিখতে না পারাটা তার জন্য অসম্ভব কাজ। হাতে আর সময় নেই যে, একটা সপ্তাহ বসে বসে পার করে দেবেন।

ডাক্তার তার কথা শুনে মুচকি হাসলেন। আবারও বললেন, এক সপ্তাহ ডানহাতে কিছু করতে পারবেন না তিনি। যদি করতে যান তাহলে আরও বেশি সমস্যায় পড়বেন। তখন হয়তো এক মাসের জন্য লেখালেখি বন্ধ রাখতে হবে।

এলান মাহমুদের কপালে ভাঁজ পড়ে গেল কথাটা শুনে। তার এমন অবস্থা দেখে ওষুধের পাশপাশি পথ্য হিসেবে ডাক্তারই একটা পথ বাতলে দিলেন : তিনি কেন লেখালেখির জন্য বিকল্প কিছু ভাবছেন না? কাউকে দিয়ে টাইপ করিয়ে নিলেই পারেন। তার লেখাগুলো তো শেষ পর্যন্ত

প্রকাশক কম্পোজ করিয়েই নেন। তিনি কেন সরাসরি কাউকে দিয়ে সে কাজটা করিয়ে নিচ্ছেন না?

মানে, আমি মুখে বলবো আর অন্য কেউ সেটা কম্পোজ করবে?

হ্যাঁ।

এলান মাহমুদ সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পেরেছিলেন, এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

বাড়ি ফিরে তিনি এ নিয়ে অনেক ভাবলেন-কাকে দিয়ে কাজটা করানো যেতে পারে? ঠিক তখনই মনে পড়ে গেল চাচামিয়ার নাতি রাজুর কথা। ওদের সামনে অনেকটা লোক দেখানোর জন্য চোখ বোলাতে গিয়ে রাজুর সিভিতে দেখেছিলেন, ছেলেটা এক্সেল, পাওয়ারপয়েন্টের পাশিপাশি বাংলা টাইপিংও জানে। ছেলেটাকে টেম্পোরারি কোনো চাকরি দেবার কথা বলে কিছুদিন তার কাছে এনে রাখা যেতে পারে। বইমেলা শেষে হলে তাকে কোথাও ঢুকিয়ে দেবেন।

এরপর রাজুকে খবর পাঠানো হলে পরদিনই সে চলে আসে ঢাকায়। নদ্র একটি ছেলে। কোনো রকম অভিযোগ করে না। যা বলা হয় তা-ই করে চুপচাপ। খাওয়া-দাওয়া নিয়ে টু শব্দটিও করেনি কখনও। বরং টুকটাক রান্নাবান্নাও করতে পারে। প্রথমে তাকে চাচা বলে সম্বোধন করতো সে, লেখকের এটা পছন্দ হতো না। একদিন বলেই দিলেন, তাকে যেন ভাই বলে ডাকে-দূরবর্তি সম্পর্ক যা-ই হোক না কেন! ছেলেটাও তারপর থেকে ভাই বলেই ডাকে তাকে।

এরকম একজনকে পেয়ে লেখক যারপরনাই খুশি হয়েছিলেন। তিনি মুখে মুখে বলে যেতেন আর ছেলেটা টাইপ করে যেত। শুরুতে একটু জড়তা ছিল, কারণ ছেলেটার ঘরে কম্পিউটার ছিল না বলে দীর্ঘদিন টাইপিং করতে পারেনি। তবে সে জোর দিয়ে বলেছিল, কয়েকদিনের মধ্যেই তার টাইপিং যথেষ্ট দ্রুত হয়ে যাবে। টাইপিং কোর্সে নাকি সে প্রথম হয়েছিল। এলান মাহমুদও দেখেছেন, মাত্র পাঁচদিনেই ছেলেটা কেমন উন্নতি করতে পেরেছিল।

ছেলেটার টাইপিংয়ের গতি বেড়ে যাবার পর লেখক আবিস্কার করলেন, মাত্র এক সপ্তাহে আস্ত একটি উপন্যাস দাঁড়িয়ে গেছে! আর হবেই না বা কেন?–তিনি মুখে খই ফোঁটান তো ছেলেটা তার কিবোর্ডে ঝড় তোলে! অবচেতন মনেই রাজুর টাইপিং স্পিডের সাথে পাল্লা দিয়ে লেখকও দ্রুত গল্প বানাতে শুরু করে দিয়েছিলেন হয়তো। ঘটনা যা-ই হোক, ছেলেটা লেখকের জন্য পয়মন্ত হয়ে উঠল। লেখক বুঝতে পারলেন, এভাবে ইজি চেয়ারে বসে বসে গল্প বলে যাওয়া আর সেটা রাজু টাইপ করে দিলে তার জন্য বেশ সুবিধাজনকই হয়। নিশ্চিন্তে তিনি গল্প আর ভাষা নিয়ে ভাবতে পারেন। তাছাড়া ছেলেটার বাংলা ভাষায় দখলও বেশ। অনেক সময়ই তার বলা শব্দ-বাক্য বদলে দেয় সে। ফলে তার লেখা হয়ে ওঠে আরও বেশি ঝরঝরে।

ছেলেটাকে পেয়ে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেন এলান মাহমুদ। সার্বক্ষণিক লেখালেখি করার জন্য দুই রুমের একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে নেন। সংসারের নানান কাজ আর বউয়ের ঘ্যানঘানানির মধ্যে কি মনোযোগ ধরে রেখে লেখালেখি করা সম্ভব? তার দরকার নিরিবিলি একটি পরিবেশ, যেখানে নিশ্চিন্তে লেখালেখির মতো কাজ করে যেতে পারবেন।

তবে উল্টাপাল্টা সন্দেহ করার মতো লোকজন কখনও এদেশে কম ছিল না কখনও, আর এলান মাহমুদের আশেপাশে সেই সংখ্যাটা যেন একটু বেশিই ছিল। ফলে কেউ কেউ সন্দেহ করে, লেখক এসব অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করছেন। আসলে তিনি আলাদা ফ্ল্যাট নিয়েছেন মওজ-মাস্তি করার জন্য!

যাইহোক, রাজুকে সেই ফ্ল্যাটেই থাকার ব্যবস্থা করে দেন তিনি। মাঝেমধ্যে লেখালেখির ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে তিনিও ফ্ল্যাটে রাত কাটান। তবে সেটা লেখালেখির কারণে যে নয় তা রাজুর চেয়ে ভালো আর কে জানে।

ফ্ল্যাটে মাত্র দুটো ঘর। রাজু থাকে সামনের ঘরে, সেই ঘর ডিঙিয়ে পেছনের ঘরে যেতে হয়, যেখানে লেখক তার বন্ধুবান্ধব নিয়ে মাঝেমধ্যেই মদ্যপান করেন। তবে এসবের মধ্যেই তার কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ থাকে না। এক রাতে লেখক তার এক মেয়েভক্ত-কাম-বান্ধবিকে নিয়ে আসেন ফ্ল্যাটে। রাত বারোটার আগেই সামান্য একটু ঝামেলায় পড়ে যান তিনি-স্বাস্থ্যসচেতন মেয়েটি প্রটেকশান ছাড়া কোনোভাবেই রাজি হচ্ছিল না। অগত্যা লেখক বাড়ির বাইরে গিয়ে ডিসপেন্সারি থেকে যখন ওটা আনতে যাবেন তখনই রাজুর সাথে দেখা হয়ে যায় সামনের ঘরে। ঐদিন রাজু রাত জেগে ছিল। যদিও কাজ না থাকলে সব সময় খুব তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যেস ছিল তার। তো, লেখককে অতো রাতে বাইরে যেতে দেখে সে আগ বাড়িয়ে জানতে চায়, কোনো কিছুর দরকার পড়লে সে-ই না-হয় এনে দিতে পারবে। লেখক কেন কষ্ট করতে যাবেন?

বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, এমন প্রশ্ন শুনে এলান মাহমুদের লজ্জা পাবার কথা কিন্তু সেদিন অতিরিক্ত মদ্যপান আর উত্তেজনার কারণে লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে বলেই দেন, তার কী লাগবে। লেখকের মুখ থেকে এমন কথা শুনে রাজুর অভিব্যক্তিতে কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। একদম স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ছেলেটা ঘর থেকে বের হয়ে যায়, যেন বাড়ির কোনো মুরুব্বির জন্য মাথাব্যথার ট্যাবলেট আনতে যাচ্ছে!

লেখক ঐদিনই আবিস্কার করেন, এই ছেলেটা একেবারে ঘরের আসবাবপত্রের মতোই নিরাপদ! তার সামনে কী ঘটছে, কী করা হচ্ছে সেসব নিয়ে কোনো বিকার নেই। বেশ নির্ভরযোগ্যও বটে। এরকম আনুগত্য আর বিশ্বস্ততা…

“ভাই?”

ছেলেটার ডাক তার স্মৃতিতে বিঘ্ন ঘটালো। পাশ ফিরে তাকালেন রাজুর দিকে।

“তারপর কি?”

হাত তুলে ছেলেটাকে নিবৃত্ত করলেন তিনি। “ভাবতাছি…দাঁড়াও…”

কিন্তু গল্পের ভাবনায় নয়, এলান মাহমুদ আবারও ফিরে গেলেন স্মৃতির কাছে। এ মুহূর্তে গল্প নেই তার মাথায়। সিগারেটে ধোঁয়া নির্গত হতে থাকলো একটু পর পর কিন্তু মুখ দিয়ে কথা বেরোলো না।

গত বছরের একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে তার। তাহার কাছে যাই’ নামের একটি প্রেমের উপন্যাস লিখছিলেন। রাজু অনেকটাই সাহায্য করেছিল তাকে। তবে উপন্যাসের শেষটা নিয়ে দ্বিধায় ছিলেন তিনি। কোনোভাবেই শেষটা করতে পারছিলেন না। পর পর তিনদিন অতিবাহিত হয়ে গেলেও এন্ডিংটা আসছিল না মাথায়। এ সময় রাজু এগিয়ে আসে। চতুর্থ দিনে সে জানায়, তার অনুপস্থিতিতে গল্পের একটা এন্ডিং সে লিখে ফেলেছে। কথাটা শুনে অবাক হয়েছিলেন এলান মাহমুদ। রাজু যখন এন্ডিংটা তাকে পড়ে শোনালো তখন দেখলেন, বেশ ভালোই হয়েছে। এভাবে রাইটিং ব্লক থেকেও ছেলেটা তাকে উদ্ধার করতে শুরু করলো। ঐ গল্পটার এন্ডিং পাঠক খুব পছন্দ করলে এলান মাহমুদ এরপর থেকে রাজুর পরামর্শ ছাড়া কোনো গল্পের এন্ডিং ঠিক করতেন না। বলতে গেলে, বিগত এক বছর ধরে রাজুই তার সব গল্পের এন্ডিং লিখে দেয়। সেখানে লেখকের অবদান কমতে কমতে এখন শূন্যের কোঠায় চলে এসেছে।

প্রথম কখন রাজু তার লেখা সংশোধন করতে শুরু করলো?-ভাবলেন এলান মাহমুদ। দিন-তারিখ তার ঠিক মনে থাকে না, তবে কী দিয়ে সেটা শুরু হয়েছিল বেশ মনে আছে।

“অভি তার মাকে বলল, ‘সুমিত কোথায় গেছে, মা?

মা বলল, ‘সুমিত তোর চাচার বাসায় গেছে, বাবা…”-এমন কিছু বলেছিলেন লেখক।

কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে রাজু বলে উঠেছিল, “সুমিত কোথায়, মা?” জানতে চাইলো অভি।

“তোর চাচার বাসায়, বাবা।”

প্রতিটি সংলাপের আগে-পরে বলল/বলেছিল/বলেছে লেখার বাতিক ছিল এলান মাহমুদের। এটার বাহুল্য ব্যবহার যে পাঠকের কাছে অস্বস্তিকর ঠেকে তার জানা ছিল না। যদিও কিছু কিছু পাঠক এ নিয়ে আপত্তি জানিয়ে বলেছিল, তার বাক্য গঠনে আরও কিছু সমস্যা আছে, তিনি সেসব কথা আমলে নেননি। তার এমন লেখাই যেহেতু সফলতার মুখ দেখেছে, এটাই তার নিজস্বতা-এমনটাই ভাবতেন। তবে শুধুমাত্র জনপ্রিয়তা দিয়ে যে সবকিছুকে জায়েজ করা যায় না, এটাও জানা ছিল তার। অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ সাহিত্যিক তার লেখাকে বেশ দূর্বল আর কাঁচা বলেও সমালোচনা করতেন। এলান মাহমুদ এসব সমালোচনাকে ঈর্ষাকাতর লেখকদের চুলকানি হিসেবেই দেখে আসছিলেন।

“আমি তো এইভাবেই লেখি…সমস্যা কী?” তিনি জানতে চেয়েছিলেন রাজুর কাছে।

ছেলেটা কাচুমাচু খেয়ে বলেছিল, “কেমনজানি লাগে পড়তে…” তারপর সাহস সঞ্চয় করে বলেছিল, “এক লাইনে তিন বার মা না বলে একবার বললে ভালো হয় না, ভাই?”

কথাটা শুনে রাগ করেননি তিনি। ছেলেটার মধ্যে কেমন জানি একটা ব্যাপার আছে। অন্য কেউ এ কথা বললে তিনি অগ্নিশর্মা হয়ে যেতেন কিন্তু এই ছেলের সাথে ওরকম কিছু করা যায় না। ছেলেটার কথার মধ্যে প্রচণ্ড রকমের বিনয় থাকে সব সময়। তারচেয়েও বড় কথা, নীচুকণ্ঠে, এমন আন্তরিকতার সাথে কথা বলে যে, ওর ওপর ঠিক রাগ করা যায় না।

এলান মাহমুদও বুঝতে পেরেছিলেন, প্রতিটি সংলাপের আগে-পরে ‘বলল’ জুড়ে দিলে আসলেই কেমনজানি লাগে। লেখার মসৃণতা নষ্ট হয়।

তো, এভাবে তার লেখায় যেসব ছোটখাট সমস্যা ছিল সেগুলো রাজুর কারণে দূর হয়ে যেতে শুরু করলো। আর তিনিও ছেলেটার এসব সংশোধন অনুমোদন করে গেছেন কারণ পাঠক-সমালোচকের কাছ থেকে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পেয়েছিলেন বলে। একদিন দৈনিক মহাকাল-এর সাহিত্যসম্পাদক আজহার আলী বলেছিলেন, আজকাল নাকি তার লেখা বেশ পরিশীলিত হয়ে উঠছে।

কথাটা শুনে প্রথমে তার গা জ্বলে উঠেছিল। আরে ব্যাটা, পণ্ডিতের বাচ্চা! এতদিন কি আমি অপরিশীলিত কিছু লিখেছি!

কিন্তু মনের কথা মনেই রেখে দিয়েছিলেন তিনি। মুখে একটা কৃত্রিম হাসি এঁটে অযাচিত প্রশংসাটুকু হজম করে নিয়েছিলেন।

টাইপিংয়ের খটাখট শব্দে সম্বিত ফিরে পেয়ে তাকালেন এলান মাহমুদ। রাজু আপনমনে টাইপ করে যাচ্ছে। কিছু বলতে গিয়েও বললেন না। আনমনে সিগারেট টেনে গেলেন শুধু। তার মাথায় কোনো গল্প আসছে না এখন। কোনো শব্দও জন্ম নিচ্ছে না।

*

অজানা এক আশঙ্কা জেঁকে বসেছে এলান মাহমুদের ভেতরে। রাজুকে ঘরে না পেয়ে অস্থির হয়ে উঠেছেন তিনি।

বাড়ি থেকে এখানে আসার আগে যখন ফোন দিয়েছিলেন তখনই ছেলেটার ফোন বন্ধ পেয়েছেন। ছয়মাস আগে ছেলেটাকে সস্তা চায়নিজ মোবাইল কিনে দিয়েছিলেন যোগাযোগ করার সুবিধার্থে, এর আগে কখনও সেই ফোন বন্ধ পাননি।

ছেলেটাকে ফোনে না পেয়ে প্রথমেই যে বাজে আশঙ্কা করেছেন তিনি তার কারণ গত পরশুর একটি ঘটনা।

চার-পাঁচদিনের জন্য বন্ধুবান্ধব নিয়ে খাগড়াছড়িতে গেছিলেন এলান মাহমুদ। এটা ছিল তার সার্কেলের একটি প্লেজার ট্রিপ। তিনটি মেয়ে আর তার তিন বন্ধু উদ্দাম সময় কাটানোর উদ্দেশ্যেই গেছিল পার্বত্যাঞ্চলে, কিন্তু একটি অনাকাঙ্খিত ঘটনার কারণে দু-দিন পরই খুব ভোরে ঢাকায় ফিরে আসতে হয় তাদেরকে। বাসায় এসে সারাটা দিন ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেবার পর সন্ধ্যার দিকে চা খেতে খেতে তার মাথায় একটি গল্পের আইডিয়া চলে আসে-আর সেটা অবধারিতভাবেই তার খাগড়াছড়ির ট্যুরকে কেন্দ্র করে।

তিনজোড়া মাঝবয়সি নারী-পুরুষ বেড়াতে গেছে পাহাড়ি অঞ্চলে; মদ্যপ অবস্থায় একজনের মুখ ফসকে বলে ফেলা একটি গোপন কথাকে। কেন্দ্র করে সবার মধ্যে টানাপোড়েন শুরু হলো; সেই থেকে ঘটনা খুনখারাবির দিকে মোড় নিলো এক সময়।

শেষটা কী হবে সেটা মাথায় না থাকলেও লেখক উত্তেজনা বোধ করলেন দীর্ঘদিন পর তার মাথা থেকে মৌলিক একটি গল্প বের হচ্ছে বলে! প্রচণ্ড উত্তেজনা নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেন তিনি। রাজুকে ফোন করে বলতেও ভুলে গেলেন যে, তিনি আসছেন এখনই।

ফ্ল্যাটের দরজার একসেট চাবি তার কাছে থাকে সব সময়, অন্য আরেকটি সেট থাকে রাজুর কাছে। তো, মেইন দরজা খুলে ঘরে ঢুকতেই তিনি বুঝে গেলেন, রাজু ছাড়াও ঘরে আরও কেউ আছে! আর সেটা অবশ্যই কোনো মেয়েমানুষ!

দরজার ভেতরে একজোড়া হাইহিলের চেয়েও অবাক করার মতো সুপরিচিত একটি শব্দ ভেসে আসছিল।

দু-জন নারী-পুরুষের আনন্দধ্বণি!

তার অনুপস্থিতিতে রাজু ফ্ল্যাটে মেয়েমানুষ নিয়ে এসেছে। তার বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছিল প্রথমে। এরকম শান্তশিষ্ট, নন্দ্র একটি ছেলে এরকম কাজ করতে পারলো!

দরজায় জোরে জোরে নক করে রাজুকে ডেকে ইচ্ছেমতো বকাঝকা করার কথা প্রথমে মাথায় এলেও মহাভারতের সূচনার গল্পটি মনে পড়ে যাওয়ায় সেকাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখলেন। হাজার হলেও তিনি লেখক। তমসা নদীর তীরে ঋষি ব্যাধ দুটো পাখির মিলনের সময় পুরুষ পাখিটিকে তীরবিদ্ধ করে যে ভুল করেছিলেন সেটা তার পক্ষে করা সম্ভব নয়! এ দৃশ্য দেখে বল্মিকী এতটাই শোকে আক্রান্ত হয়েছিলেন যে, ব্যাধকে

অভিসম্পাত করে শ্লোক আউড়ে উঠেছিলেন তিনি, আর সেটাই হয়ে যায়। মহাভারত নামক মহাকাব্যের সূচনা। সম্ভত পৃথিবীর প্রথম সাহিত্য।

বাল্মিকীর অভিসম্পাত দেয়া শ্লোকটিও মনে পড়ে গেল এলান মাহমুদের।

মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ
যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতমঃ ॥

পংক্তিটা দপ করে তার সমস্ত রাগ নিভিয়ে দিলো যেন। সিদ্ধান্ত নিলেন, রাজুর লীলা শেষ হওয়া অবধি অপেক্ষা করবেন তিনি। দীর্ঘ আধঘণ্টা চুপচাপ বসে থেকে দুটো ছেলেমেয়ের রতিক্রিয়ার সেই সুপরিচিত ধ্বণি শুনে গেলেন। প্রচণ্ড রাগের মধ্যে এই আনন্দধ্বণি তার নিজেরও উত্থান ঘটালে একটু বিব্রতই হয়েছিলেন বটে।

তিনিও পুরুষ। রাজুর মতো তরুণের শারীরিক চাহিদার বিষয়টি মেনে নিতে তার কেন আপত্তি হচ্ছে? তার ভাড়া করা ফ্ল্যাটে এ কাজ করছে বলে? তিনি নিজে কি এ কাজ করেন না এখানে? এই ছেলেটার সামনেই দিনে পর দিন, রাতের পর রাত কতো মেয়েমানুষ নিয়ে এসেছেন…সারারাত উদ্দাম সময় কাটিয়ে চলে গেছেন সকালে। তাহলে? এতটা সঙ্কিৰ্ণমনা হলে কি চলে একজন লেখকের?

রাজু যখন দরজা খুলে লেখককে দেখতে পেলো তখন তার আরক্তিম মুখ থেকে সমস্ত রক্ত নেমে গেছিল মুহূর্তে। রাজুর প্রেমিকা কিংবা যে-ই হোক না কেন, মেয়েটি কোনো কথা না বলে ভীত হরিণের মতো দ্রুত ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে যায়।

রাজু মাথা নীচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল। একবারের জন্যেও লেখকের চোখের দিকে তাকায়নি। অনেক কথা শোনার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল সম্ভবত কিন্তু ছেলেটাকে অবাক করে দিয়ে এলান মাহমুদ কোনো কিছু না বলে হুট করেই বের হয়ে যান ফ্ল্যাট থেকে।

ঘটনার পরদিনও তিনি আর ফ্ল্যাটে যাননি। কেন যাননি তা তিনি নিজেও জানেন না। যদিও ছেলেটার উপরে কোনো রাগ ছিল না, তারপরও এক ধরণের অস্বস্তি জেঁকে বসেছিল তার মধ্যে। আসামি নয়, বিচারকই শরমিন্দা বোধ করছিলেন যেন! তবে এলান মাহমুদ জানতেন কারণটি : তিনিই পথ দেখিয়েছেন, রাজু কেবল সে পথে হেঁটে গেছে। তিনি যে পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে পারেননি তার কারণ হয়তো লুকিয়ে আছে এই সমাজের বহু পুরনো ঐতিহ্যের মধ্যে।

এখন এলান মাহমুদের ভেতরে জেগে ওঠা অস্থিরতা, আশঙ্কা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। তার উচিত ছিল ছেলেটার সাথে আরও বেশি স্বাভাবিক আচরণ করা। গতকাল ফোন করে টুকটাক কথা বললেও হতো। তিনি হয়তো বলতে পারতেন, পরদিন আসছেন, কাজ আছে। তাহলে ছেলেটা ধরে নিতো, যা-ই হয়েছে তা নিয়ে লেখক আর বাড়াবাড়ি করবেন না। ব্যাপারটা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতেই দেখেছেন।

দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালেন এলান মাহমুদ। সাড়ে এগারোটা বেজে গেলেও ছেলেটার কোনো খবর নেই। নিজের ভেতরে জেঁকে বসা অজানা আশঙ্কা দূর করার জন্য একটা সিগারেট বের করে ধরালেন তিনি। সিগারেটে যত জোরে টান দেন তারচেয়েও বেশি অস্থির হয়ে পায়চারি করলেন ঘরময়।

সামনে বইমেলা। প্রচুর কাজ করতে হবে তাকে। অল্প সময়ে নামাতে হবে তিন-তিনটি উপন্যাস। রাজুর সহায়তায় কাজটা ভালোমতোই করা সম্ভব। কিন্তু সেই রাজু কোথায় গেছে? লজ্জা পেয়ে গ্রামে চলে যায়নি তো?

ফ্ল্যাটটা ভালো করে দেখে নিলেন একবার। রাজুর ব্যবহার্য সবকিছুই আছে। ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে যাবার কোনো চিহ্ন দেখতে পাচ্ছেন না।

তাহলে? খারাপ কিছু হয়নি তো ছেলেটার?

সাড়ে বারোটার পর এলান মাহমুদের সমস্ত আশঙ্কা দূর করে অনেকটা বিরসবদনে ঘরে ঢুকলো রাজু। তাকে দেখে যারপরনাই স্বস্তি বোধ করলেন লেখক। কিন্তু সেই স্বস্তির আয়ু টিকে থাকলো বড়জোর কয়েক সেকেন্ড। রাজুর ডানহাতের কব্জিতে একটা ব্যান্ডেজ চোখে পড়তেই তার বুকটা  ধরফর করে উঠল।

“হাতে কী হইছে?!”

মলিনমুখে রাজু জানালো একটা কাজে বাইরে গেছিল সে, রিক্সায় করে বাসায় ফেরার সময় পেছন থেকে তার রিক্সাকে এক সিএনজি স্কুটার ধাক্কা মেরে বসে। রাজু ছিটকে রাস্তায় পড়ে গেলে ডানহাতের কব্জিটা ভেঙে যায়। আঘাত তেমন গুরুতর নয়, তবে তারপক্ষে আগামি এক মাসে এই হাত দিয়ে কোন কাজ করা সম্ভব নয়-ডাক্তারের কড়া নিষেধ।

“কী কও তুমি!” এলান মাহমুদ যেন আকাশ থেকে পড়লেন। “হায় হায়! এইটা কী হইলো! এখন কী হইবো তাইলে!”

“একটা আঙুলও নাড়াতে পারছি না, ভাই…অনেক ব্যথা করছে।” রাজু অপরাধির মতো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। তার নিছক হাত ভেঙেছে কিন্তু লেখকের মাথায় যে আকাশ ভেঙে পড়েছে সেটা বুঝতে পারছে

ভালোমতোই।

“আমারে তো প্রকাশক এই সপ্তাহের মইধ্যেই গল্প জমা দিতে কইছে…” লেখক বলে উঠলেন অনেকটা গজগজ করে। “বোঝোই তো, প্রুফ দেখতে হইবো…কাভার করতে হইবো…কত্তো কাজ বাকি!”

তালাশি নামের এক প্রকাশনী সামনের বইমেলায় এলান মাহমুদের কাছে একটা বই চেয়েছে। অগ্রিম টাকাও দিয়েছে এ বাবদ।

“এখন কী হইবো!” দ্বিতীয়বারের মতো কথাটা বললেন লেখক। “আমার মাথায় তো কিছুই ঢুকতাছে না।”

চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা রাজু মুখ খুলল আরও পাঁচ মিনিট পর। “ভাই,” আস্তে করে বলল সে নীরবতা ভেঙে। “একটা কথা বলবো?”

পায়চারি করতে থাকা এলান মাহমুদ থমকে দাঁড়ালেন। “বলো…”

“আপনি তো টাইপিং জানেন…” কথাটা শেষ না করে লেখকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো সে। এলান মাহমুদ সপ্রশ্ন দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে আছেন। তার দিকে। “আমি মুখে মুখে বললে আপনি টাইপ করতে পারবেন না?” একটু ভয়ে ভয়েই বলল শেষ কথাটি।

একটু ভাবলেন লেখক। “আমার যে স্পিড…তাতে কি হইবো?” অবশেষে বললেন তিনি।

“একটু স্লো হলেও কাজ হবে,” রাজু বলল বিনম্রভাবে। “আর তিন চারদিন টাইপ করার পর আপনার হাতের স্পিডও অনেক বেড়ে যাবে, দেখবেন।”

আনমনেই মাথা নেড়ে সায় দিলেন লেখক। কথাটা মিথ্যে বলেনি। এতোক্ষণ চোখে যে অন্ধকার দেখছিলেন সেটা যেন নাট্যমঞ্চের যবনিকার মতো সরে গেল নিমেষে। রাজু যদি মুখে মুখে বলে যায় তাহলে তো তিনি আস্তে আস্তে টাইপ করতেই পারেন। হয়তো ছেলেটার মতো দ্রুত হবে না, তাতে কী-একেবারে হাত গুটিয়ে বসে থাকার চেয়ে এটা অনেক ভালো। চারদিনের জায়গায় হয়তো ছয়দিন লাগবে-এই তো! এ আর এমন কী। প্রকাশককে এটা ওটা বলে ম্যানেজ করা যাবে। আর পর পর কয়েকদিন টাইপ করলে তার হাতের স্পিডও একটু বাড়বে। বইমেলার বাকি লেখাগুলো শেষ করা সম্ভব হবে তখন।

দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষ করে এলান মাহমুদ অনেকদিন পর বসে পড়লেন কম্পিউটারের সামনে।

“নির্ঝর রাত জাগে। কবে থেকে রাত জাগে সে জানে না…”

এলান মাহমুদ ফিরে তাকালেন পেছনে। “এইটা আবার কুন গল্প?!”

“নতুন একটা গল্প, ভাই…” জবাব দেয়া হলো এলান মাহমুদকে। “এক নিশাচরের জীবন নিয়ে…খুবই ইন্টারেস্টিং…আপনার ভালো লাগবে।”

এলান মাহমুদ কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে টাইপিংয়ে মনোযোগ দিলেন। দীর্ঘদিনের অনভ্যস্ত আঙুল কথাগুলো টাইপ করে ফেলল একটু জড়তা আর আড়ষ্টতার সাথে।

“প্রথম দিকে সে শুয়ে-বসে বই পড়ে কিংবা গান শুনে কাটিয়ে দিতো…”

টাইপের খটাখট শব্দটা শোনা গেল আবার।

“কিন্তু এখন সে প্রায় সারাটা রাতই শহরের নানান জায়গায় ঘুরে রাতটা পার করে দেয়…”।

রাজুর ধীরে ধীরে বলা কথাগুলো টাইপ করতে তেমন বেগ পেলেন না এলান মাহমুদ।

“তার এই নিশুতি অভিযানে অসংখ্য গল্প জমে আছে। সময় পেলেই এগুলো নিয়ে লিখতে বসে সে।”

“গল্প না বলে কাহিনী বললে ভালো হয় না?” রাজুর দিকে না তাকিয়েই বললেন।

“না, ভাই…গল্পই লেখেন।” একটু থেমে আবার বলতে হলো তাকে, “নিঝরের এই গল্পগুলোর কিছু কিছু অতিমাত্রায় অবাস্তব। শুনলে মনে হতে পারে কোনো লেখকের মস্তিষ্কপ্রসূত কল্পিত কাহিনী। কিন্তু সে জানে, গল্পগুলো একদম সত্যি। আর প্রতিটি গল্পে সে নিজেও একটি চরিত্র হিসেবে আছে…”

চুপচাপ টাইপ করতে লাগলো এলান মাহমুদ আর তার পেছনে, একটু বামদিকে আরামদায়ক ইজিচেয়ারে বসে আছেন লেখক। উদাস হয়ে নিজের মাথার মধ্যে থাকা গল্পটা বলে যাচ্ছেন বিরতি না দিয়েই। এক সময় অনেকটা আনমনেই, ডানহাতের ব্যান্ডেজ করা হাত দিয়ে ডানগালটা চুলকে নিলেন তিনি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *