১৫. রিসেপশন কাউন্টারে

১৫.

রিসেপশন কাউন্টারে পঞ্চাশ হাজার টাকা জমা দিয়ে দিল লায়লা। বাদল এখনও ধাতস্থ হয়ে উঠতে পারেনি। থম হয়ে বসে আছে। কখনও কখনও ফুঁপিয়ে উঠছে। আশেপাশের লোকেরা বিস্মিত হয়ে দেখছে তাকে। তাই বাধ্য হয়ে কান্না গিলে নিতে হচ্ছে।

আপনাদের মেট্রন খুঁজছিলেন। লাল লিপস্টিক বলল, আপনারা সকালে মেয়ের সঙ্গে দেখা করেননি?

লায়লা উদ্বিগ্ন হয়ে জানায়, না…আসলে…!

তবে এখনই দেখা করুন। কথাটা বলেই সে ফের কম্পিউটারে নাক গুঁজে বসে পড়ল। সামনের মানুষটা যে অগাধ জলে পড়েছে সেটা দেখার প্রয়োজনও বোধ করল না।

বাদল তখনও পাথর হয়ে বসে ছিল। লায়লা তাকে এসে সব জানায়। মেয়ের সঙ্গে দেখা করেনি বলে একটা অপরাধবোধের ছাপ পড়ল তার চোখে। একটা ভয়ও চেপে ধরেছে। মেট্রন কেন দেখা করতে বলেছেন? রূপসার কিছু হয়নি তো? সে সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ায়।

মেট্রন তখন সম্ভবত রাউন্ড দিয়ে ফিরছিলেন। পথেই দেখা হয়ে গেল। বাদলের দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে গেল তাঁর, হোয়াট হ্যাঁপেন্ড? আপনি তো ব্লিড করছেন!

ও কিছু না! সামান্য অ্যাক্সিডেন্ট! বাদল নিজের কথা এড়িয়ে যায়, রূপসা! রূপসা কেমন…!

ওহ! ইয়েস শি ইজ ফাইন। মৃদু হাসলেন বর্ষীয়সী মহিলা, তবে কাল সারারাত কেঁদেছে। ক্রমাগত বাড়ি যাওয়ার কথা বলছিল। আজ দুপুরে ভাত খেয়েছে। তবে ভীষণ মনমরা হয়ে আছে। কী হয়েছে কিছুই বলছে না, ইনফ্যাক্ট কোনও কথাই বলছে না। ওর হার্টের যা কন্ডিশন, তাতে এমন মনমরা হয়ে থাকা ঠিক নয়। আপনারা একবার দেখা করে আসুন খুশি হবে। ১২২

আচ্ছা। বাদল যন্ত্রবৎ মাথা নাড়ে।

মেট্রন চলে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালেন, আপনার ঠোঁট কেটে রক্ত গড়াচ্ছে।

এর বেশি বলার দরকার ছিল না। ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরে বাদল ঠোঁট মুছে নেয়। করিডরটা থেকে আই সি ইউ কয়েক মুহূর্তের রাস্তাটুকু পেরোতে পেরোতেই বাদলের মুখভঙ্গি অদ্ভুতভাবে পালটে গেছে। পালটে যায় এতক্ষণের বিষাদগ্রস্ত ভাবও। এখন তার মুখে উঠে এসেছে তাজা চনমনে হাসি। বাইরে থেকে দেখলে হাসিটাকে বড় বেশি ঝলমলে দেখায়! আর সেজন্যই সন্দেহ হয়, এ হাসি হয়তো আসল হাসি নয়।

রূপসা মনমরা হয়ে বিছানায় শুয়ে ছিল। তার এখানে থাকতে ভাল। লাগে না। আশেপাশে সবাই ক্রিটিক্যাল পেশেন্ট। কথা বলার লোক নেই। সিস্টার বা ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলারও উপায় নেই! বাবার বারণ মনে আছে। তার ওপর একটি পেশেন্টের অবস্থা কাল ভোর রাত থেকেই খুব খারাপ। ভদ্রলোকের বয়েস অনেক। কাল রাত থেকেই ডাক্তাররা তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। সিস্টাররা নিজেদের মধ্যেই ফিসফাস করে বলাবলি করছে– লোকটা বাঁচবে না! ওর শেষ শ্বাস উঠে গেছে।

কথাটা শুনে আঁতকে উঠেছে সে। তার মানে কলকাতায় এলেই সব অসুখ সারে না! আগে সে কখনও মৃত্যু দেখেনি! এখন চোখের সামনে দেখছে! একটা মানুষ আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে, সর্বাঙ্গে লক্ষ লক্ষ সুচ ফোঁটানো। মাথা থেকে পা অবধি শুধু সুচ আর নল! জ্ঞান আছে কী নেই বোঝা যায় না। কিন্তু গলা দিয়ে ঘড়ঘড় একটা গোঙানির মতো আওয়াজ বেরিয়ে আসছে। তার মানে কষ্ট হচ্ছে।

রূপসার চোখ ফেটে জল আসে। এ কেমন নিষ্ঠুর দেশ। এখানে মিথ্যে কথা বলতে হয়, ছদ্মবেশ নিতে হয়! শতকষ্টেও আল্লার নাম নেওয়া বারণ! ওই লোকটা এত কষ্ট পাচ্ছে, অথচ কেউ ওর গায়ে, মাথায় আদর করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে না! আশেপাশে ওর আত্মীয় স্বজন কেউ নেই! আর ডাক্তার নার্সরা আদর তো করছেই না, বরং উলটে আরও বেশি বেশি করে সুচ ফুটিয়ে লোকটাকে অতিষ্ঠ করছে। সে একাই নরক যন্ত্রণা ভোগ করছে। এই যন্ত্রণা ভাগ করে নেওয়ার জন্য আর একটিও মানুষ সেখানে উপস্থিত নেই! নেই চোখের জল ফেলার জন্য আপনজনেরা!

রূপসা নিজের বেড থেকে নেমে গুটি গুটি ভদ্রলোকের দিকে গেল! কচি কচি হাত তার কপালে রেখে মাথার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। সে মুখ নামিয়ে লোকটার কানে কানে জানতে চায়, এখন একটু আরাম হচ্ছে?

বেবি!

সিস্টারের ধমক খেয়ে সে ফিরে তাকায়। একটা রাগ রাগ মুখের সিস্টার এসে চোখ গোলগোল করে বলল, কী করছ ওখানে? ফিরে এসো। নিজের বেড়ে চলে এসো।

রূপসা থমকে যায়। এখানে কি আদর করাও বারণ? সে আমতা আমতা করে বলে, ওর কষ্ট হচ্ছে যে! তাই আদর করে দিচ্ছি।

হোক। তোমায় আদর করতে হবে না। তুমি নিজের জায়গায় যাও। গো ব্যাক টু ইয়োর বেড!

নার্সের ধমক খেয়ে সে নিজের জায়গায় ফিরে আসে। তাকে এখন অদ্ভুত এক আশঙ্কা চেপে ধরেছে। লোকটার কষ্ট নিবারণ করাও যাবে না! এ কীরকম নিয়ম? তার যখন কষ্ট হয় তখন মা-বাবা কেমন সুন্দর মাথায় গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়। সমস্ত কষ্ট কমে যায় ওই এক স্পর্শে! অথচ এখানে সে উপায় নেই। রূপসা ভয় পেয়ে যায়। তবে কি তার কষ্ট হলেও মা-বাবা আসবে না! আদর করবে না! ওই লোকটার মতোই একা একা যন্ত্রণাভোগ করতে হবে। রূপসার বুকের ভেতরে আবার সেই একাকিত্ব ফিরে আসে। চতুর্দিকে শুধু দেওয়াল আর দেওয়াল! এই চার দেওয়ালের মধ্যে এক বারো বছরের বালিকা শীতল নিঃসঙ্গতায় আস্তে আস্তে কুঁকড়ে যায়।

চম্পক ঈশ্বরী! আজকে কেমন আছেন আপনি? দুপুরে ভাত খেয়েছেন?

বাবার উচ্ছ্বসিত গলা পেয়ে অসহায় বালিকা মুহূর্তের মধ্যে আশ্বস্ত হয়। নিরাপত্তা অনুভব করে। এই তো বাবা-মা আছে। নিঃসঙ্গতার শীতলতা কেটে গিয়ে আন্তরিকতার উষ্ণতার সঞ্চার হয় তার দেহে। সে চোখ বুজে বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এমনভাবে তাকে দুহাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে যেন বাবা এখনই রূপসাকে ছেড়ে পালিয়ে যাবে! বাবার বুকে পাগলের মতো মুখ ঘষতে ঘষতে বলল, আমি বাড়ি যাব। আমি এখানে থাকব না বাবা। আমি গ্রামে ফিরে যাব!

তার কাণ্ড দেখে বাদল ও লায়লা দুজনেই অবাক। বাদল হেসে বলে, পাগলি! হঠাৎ কী হল?

রূপসা মুখ তুলে তাকায়। কিন্তু চোখ তুলে তাকিয়েই সে যেন লক্ষ লক্ষ ভোল্টের বিদ্যুতের ছ্যাকা খেল! এ কী! বাবার কপালটা অমন ফুলে গেল কী করে! পাঞ্জাবিটা ছেঁড়া। পাঞ্জাবির ওপরে এখনও শুকনো রক্ত লেগে আছে। ঠোঁট কেটে গেছে! সে আঁতকে উঠেছে।

বাবা! এ কী!

বাদল অপ্রস্তুত হাসে, ও কিছু না রাস্তায় পড়ে গিয়েছি! মিথ্যে! মিথ্যে! বাবাও নিজেই জানে না যে সে মিথ্যেটাও ঠিক ভাবে বলতে পারে না! বাবা এ-ও জানে না যে, রূপসা বাবার মুখ দেখেই বুঝতে পারে কথাটা সত্যি কী মিথ্যে! রূপসার অন্তঃকরণ রাগে কেঁপে ওঠে! বাবা এখনও মিথ্যে বলছে। সে জলভরা চোখ তুলে বলল, তুমি মিথ্যে কথা বলছ বাবা!

কেঁপে উঠল বাদল। তবু নরম গলায় বলে, না, মা আমি সত্যিই পড়ে গিয়েছি।

আবার মিথ্যে! রূপসা ভয় পায়! এ কোন দেশ! কেমন নিষ্ঠুর দেশ! এখানে মায়া নেই, মমতা নেই, সত্য নেই– এমনকী ঈশ্বরও নেই! এ দেশে কেমন করে বাঁচবে সে!

বাবা! অভিমানী অশ্রু নিয়ে নির্বাক তাকিয়ে থাকে সে। এই চেয়ে থাকা একটাই আশায়। বাবা যদি সত্যি বলে!

মেয়ের দৃষ্টির সামনে আবার কুঁকড়ে যায় বাদল। যেভাবে রক্ত জমছে মেয়ের চোখে তাতে ভয় পাওয়াই স্বাভাবিক। রূপসার নাকের পাটা ফুলল। বাবা কেন এখনও সত্যি কথা বলছে না। এ দেশে এসে বাবা কেন এমন পালটে গেল! তার ক্ষোভ এবার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেল! অভিমানে সে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে পিছন ফিরে শুয়ে পড়ল।

রূপসা…মা!

কাতর কণ্ঠে ডাকল বাদল। আদরের ডাক শুনে রূপসা ফুঁপিয়ে ওঠে। অসহায় কান্না জড়ানো গলায় আর্তের মতো ডাকে, বাবা!

মা?

সে এবার ধড়মড়িয়ে উঠে বসে বাদলকে জাপটে ধরেছে, বাবা আমি এখানে থাকব না…আমি থাকব না বাবা। তুমি আমায় বাড়ি নিয়ে চলো। আমি ঠিক হয়ে যাব, এমনিই ঠিক হয়ে যাব…! কিন্তু এখানে থাকব না…!

রূপসা! মা গো! লায়লাও এবার এগিয়ে এসে মেয়ের মাথায় হাত রাখে, এমন বলে না।

রূপসা শান্ত হওয়ার বদলে আরও উত্তেজিত হয়ে ওঠে, এখানে থাকলে আমি মরে যাব বাবা! এখানে কেউ নেই, কিছু নেই…! কামিনী গাছ নেই! পাখি, প্রজাপতি নেই… আমার পশ্চিমের জানলা নেই… নদীর বাতাস নেই… আমার এখানে কেউ নেই… আমি মরে যাব মা…! এখানে কেউ সত্যি বলে না! চারদিকে শুধু দেওয়াল, জানলা নেই… আমার কষ্ট হয়… খুব কষ্ট হয়… খুব কষ্ট…!

বলতে বলতেই আবার সেই প্রচণ্ড কষ্ট! উত্তেজনার ধাক্কা অসুস্থ হৃদয় নিতে পারল না! রূপসা বাদলের কোলে এলিয়ে পড়ে…! বিড়বিড় করে বলে, বিষ! চতুর্দিকে শুধু বিষ! আমার কষ্ট হচ্ছে! কষ্ট হচ্ছে…! তোমরা কোথায়… আমি দেখতে পাচ্ছি না কেন? মা, বাবা!

বাদল চেঁচিয়ে উঠেছে, সি-স্টা-র! সি-স্টা-র!

রূপসার চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে আসছে। কানে ঠিকমতো শুনতে পাচ্ছে না। দ্রুত দৌড়ে আসছে নার্স। এক্ষুনি সরিয়ে নেবে মা-বাবাকে। তবু সে নিজের ক্ষুদ্র দেহের সমস্ত শক্তি জড়ো করে আঁকড়ে ধরে আছে। বাবার হাত। ধাক্কাধাক্কি করে ছাড়িয়ে নিতে গিয়ে রূপসার নখে কেটে গেল বাদলের হাত। রূপসা উন্মত্তের মতো হাত পা ছুড়ছে। চোখে দেখতে পাচ্ছে না, অথচ অন্ধের মতোই হাতড়ে হাতড়ে মা-বাবাকে খুঁজছে!

বেবি, কাম ডাউন! নার্স দ্রুত হাতে তার মুখে অক্সিজেন মাস্ক পরাতে পরাতে অন্য একজন সিস্টারকে উদ্দেশ করে বলল, কল ডা. গোয়েঙ্কা! কুইক! পেশেন্টের অ্যাসফিক্সিয়া হচ্ছে।

যাকে বলা হল সে দ্রুতবেগে বেরিয়ে গেল। রূপসা তখনও শান্ত হচ্ছে। না। প্রাণপণে তীক্ষ্ণ গলায় চিৎকার করে উঠল, বাবা-আ-আ-আ!

.

লোকটা আচমকা কেঁপে উঠল। দ্রুত মুখ তুলে বলল, উঁ?

মুনতাসীর চৌধুরী বাদল।

লোকটা, ওরফে বাদল তখনও ঘোর কাটিয়ে ওঠেনি। কোনওমতে বলল, অ্যাঁ?

জেলার সাহেব এবার এগিয়ে এসেছেন, আপনার জন্য সুখবর আছে। আপনার রিলিজের অর্ডার চলে এসেছে। বাংলাদেশ সরকার সব কাগজপত্র পাঠিয়ে দিয়েছেন। ভারত সরকারের পক্ষ থেকেও প্রয়োজনীয় নথিপত্র এসে গেছে। কাল ভোরেই আপনাদের দুজনকেই। ছেড়ে দেওয়া হবে। আপনারা দেশে ফিরে যেতে পারবেন। ইন্ডিয়ার বি এস এফ আপনাদের বর্ডার অবধি ছেড়ে দেবে…

বাদল কথাগুলো মন দিয়ে শুনছিল না। শুধু এইটুকুই বুঝেছে যে এবার তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে। খবরটা শুনে খুশি হবে কি না বুঝতে পারল না সে। শুধু নিজের অজান্তেই তার হাত একবার নিজের গাল ছুঁয়ে গেল। অনেকদিন দাড়ি কাটা হয়নি। মুখটা একেবারে জঙ্গল হয়ে আছে।

খবরটা দিয়ে হয়তো তার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করছিলেন জেলার সাহেব। বড় বড় চোখ তুলে সে তার দিকে তাকায়, জেলার সাহেব, একটা অনুরোধ ছিল।

বলুন।

আমাকে একটু ক্ষৌরির ব্যবস্থা করে দেবেন? বাদল আকাশের মতো চোখ দুটো জেলার সাহেবের ওপর নিবদ্ধ করে বলল, আমার মেয়ে বড় বাপসোহাগি! ও আমার মুখে দাড়ি সহ্য করতে পারে না তাই…!

জেলার সাহেব চুপ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। তারপরে মৃদু স্বরে জানালেন, আচ্ছা তাই হবে।

.

১৬.

অপারেশনটাকে আর ঠেকিয়ে রাখা গেল না।

মেডিক্যাল সুপারের গম্ভীর মুখ দেখে আত্মা শুকিয়ে গেল ওদের। রূপসার বেডের কাছে তখনও ডাক্তারদের হেভি অ্যাকশন চলছে। কাঁদতে কাঁদতেই একসময় আচমকা স্থির হয়ে গিয়েছিল সে। নিঃস্পন্দ! নিথর! তরুণ ডাক্তার ডা. গোয়েঙ্কা পাগলের মতো তার ওপর একলাফে চড়ে বসে বুকে দুমদাম কিল মারছিলেন। কয়েকটা দমবন্ধ মুহূর্ত। তারপরই হেঁচকি তুলে শ্বাস ফেলল রূপসা। ডা. গোয়েঙ্কা সিস্টারদের কর্তব্য বুঝিয়ে দিয়ে মাথার ঘাম মুছতে মুছতে গটগট করে বেরিয়ে গেলেন আই সি ইউ থেকে। ঢুকলেন সোজা সুপারের ঘরে। তার ঘন্টা দুয়েক পরই ওদের ডাক পড়ল!

দেখুন, ডক্টর রমানাথনের জন্য অপেক্ষা করার সময় আর নেই। ডা. গোয়েঙ্কা জানালেন, দিস ইজ মেজর কেস অব অ্যাসিস্টল! প্রায় দেড় মিনিটের জন্য পেশেন্টের কোনও কার্ডিয়াক ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যাকটিভিটি ছিল না। হার্ট কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল। দিস ইজ আ ফেটাল ওয়ার্নিং ম্যাম! এই পেশেন্ট একদম সময় দেবে না। ইনফ্যাক্ট সেকেন্ড চান্সও পাওয়া যাবে না।

মহিলা সুপার মাথা নাড়লেন, তা হলে ইমিডিয়েটলি অপারেট করতে হবে।

ইয়েস ম্যাম। ডা. গোয়েঙ্কা জোর দিয়ে বললেন, আজ রাতেই অপারেশন করতে হবে। ফেলে রাখলে যে-কোনও মুহূর্তে হার্ট কোলান্স করতে পারে। তখন আর কিছু করা যাবে না। ইমিডিয়েটলি মেকানিক্যাল ভালভ ইনসার্ট করা খুব জরুরি। হার্ট আর টানতে পারছে না!

সুপারের ভুরু দুটো আলতো প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে দিল। যেন জানতে চাইছেন, অতঃকিম?

আমি সিস্টারদের বলে দিয়েছি পেশেন্টকে অপারেশনের জন্য রেডি করতে। মেকানিক্যাল ভালভও রেডি আছে।

রিস্ক ফ্যাক্টর?

একটু রিস্ক নিতেই হবে ম্যাম। ডা. গোয়েঙ্কার কপালে সামান্য ভাঁজ, একটু আগেও প্রেশার ভীষণভাবে ফ্লাকচুয়েট করছিল। সিস্টাররা রেগুলার রিডিং নিচ্ছে। লাস্ট রিডিং-এ দেখলাম ব্লাড প্রেশার মেডিকেশনের ফলে অনেকটাই স্টেবল! কিন্তু কতক্ষণ থাকবে বলা মুশকিল! যে-কোনও মুহূর্তে আবার ফ্লাকচুয়েট করতে পারে, আবার নাও পারে। ওষুধের এফেক্ট থাকতে থাকতেই অপারেশন করে ফেলা ভাল।

ওকে চিন্তিত মুখে সুপার ওদের দিকে তাকালেন, আপনি তৈরি হন। অপারেশনটা হয়ে যাক।

ম্যাম। মাথা ঝাঁকিয়ে চলে গেলেন ডা. গোয়েঙ্কা।

সুপার একমুহূর্তের জন্য মুখ নিচু করে কী যেন ভাবলেন। তাঁর ডানহাতটা পেপার ওয়েটটাকে নাড়াচাড়া করছে। মুখ নিচু করেই বললেন, সবই তো শুনলেন। এমারজেন্সি অপারেশন করা ছাড়া আর উপায় নেই। ড. রমানাথন পরশুর আগে আসবেন না। অতক্ষণ অপেক্ষা করা ইমপসিবল।

বাদল ও লায়লা বিহুলের মতো তাকিয়ে থাকে। বাদল কোনওমতে উচ্চারণ করে, আমাদের কী করতে হবে?

আপনারা অলরেডি পঞ্চাশ হাজার সাবমিট করেছেন। বাকি টাকাটা অপারেশনের পর জমা করতে হবে। এ ছাড়া কিছু বন্ডে সাইন করে দিতে হবে। আপাতত এইটুকুই। বাদল যন্ত্রবৎ মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়াচ্ছিল। সুপার অন্যমনস্ক স্বরে বললেন, আর পারলে ভগবানকে ডাকুন। ডাক্তারের ওপর এইমুহূর্তে যদি কেউ থেকে থাকেন, তিনি ঈশ্বর!

বাদল মাথা নেড়ে চলে যায়। পিছন পিছন লায়লাও। দুজনের মুখই বিবর্ণ হয়ে এসেছে। হাতে আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা! এখনই রাত হয়ে এসেছে। বাইরে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার! এর মধ্যে কী করে আরও একলাখ টাকা জোগাড় করবে বুঝতে পারছে না ওরা। হাসপাতালের ওয়েটিং হলে এসে মোবাইলে অনেক কষ্টে সুদীপ্তবাবুকে ধরল বাদল। তিনি তখন সম্ভবত তাঁর যন্ত্রপাতি নিয়ে বসেছেন। বেশ কয়েকবার রিং হওয়ার পরে ফোনে আলগা দরবারির সুর ভেসে এল। পিছন পিছন ভদ্রলোকের গম্ভীর কণ্ঠস্বর– হ্যালো…?

হ্যালো…!

সুদীপ্তবাবু সম্ভবত বাদলের গলা শুনতে পাচ্ছেন না। ফলে আরও বেশ কয়েকবার হ্যালো…হ্যালো করলেন। তারপরই লাইনটা কেটে গেল। বাদল কিছুক্ষণ বোকার মতো মোবাইলটার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর আবার খুঁজে খুঁজে নম্বরটা বের করে ফোন করল। এবার রিং-ও হল না! বরং মোবাইল পিক পিক করে উঠেছে। সে অবাক হয়ে দেখে। মোবাইলে লেখা ফুটে উঠেছে, নো সার্ভিস।

ওদের পাশের সিটের ভদ্রলোক গোটা ব্যাপারটাই লক্ষ করছিলেন। এবার সহৃদয় কণ্ঠে বললেন, এখান থেকে কোনও নেটওয়ার্ক পাবেন না দাদা। বাইরে বেরিয়ে ট্রাই করুন।

বাদল মাথা নাড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে লায়লাও।

বাইরে তখনও টুপটাপ বৃষ্টি পড়ছে। তার মধ্যেই কোনও ক্লাবের উৎসব। মিছিল বেরিয়েছে। রাস্তা দিয়ে একটা বিরাট লরির মতো যান চলেছে। গড়গড়িয়ে, দুপাশে বাইক বাহিনী অনুসরণ করছে। তার ওপর এক যুবক মাইক হাতে নিয়ে লম্ফঝম্প করে কী গান গাইছে কে জানে। গানের চেয়েও মিউজিকের বহর বেশি! তার সামনে বাঙালির আদেখিলেপনা! কতগুলো দামড়া দামড়া বুড়ো লোক দুহাত তুলে উদ্দাম নৃত্য করছে!

লায়লা বোকার মতো কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকে! এমন দৃশ্য আগে সে কখনও দেখেনি। দুর্গাঠাকুরের ভাসানের সময় ওরাও নাচত। বটে, কিন্তু তা এত কুৎসিত নয়!

ওই লোকটা কী গান গাইছে বলো তো? সে বিস্মিত হয়ে বলে, বাংলা?

বাংলাই। বাদল নিস্পৃহ মুখে বলে, তবে একলাইনও বুঝতে পারছি না।

বলতে বলতেই সে একদিকে সরে গিয়ে সুদীপ্তবাবুকে ফোনে ধরল। এবার স্পষ্ট শোনা গেল ভদ্রলোকের গলা, হ্যালো?

হ্যাঁ দাদাভাই…! আমি বাদল বলছি।

কে-এ-এ-এ?

সম্ভবত ব্যাকগ্রাউন্ডে অমন ভয়ংকর চিৎকার চেঁচামেচির দরুণ সুদীপ্তবাবু বাদলের কথা শুনতে পেলেন না। চিৎকার করে বললেন, কে বলছেন?

বাদলও তারস্বরে চিৎকার করে, দাদাভাই! আমি বাদল!

অ্যাঁ-অ্যাঁ কো-ন দ-ল?

সে প্রায় হাঁকাড় পেড়ে বলে, কো-ন-ও দ-ল ন-য় দাদাভাই! আমি বা-দ-ল! বা-দ-ল!

বাদল? বলো কী ব্যাপার?

রূপসার অপারেশন হবে আজ রাতেই। অপারেশনের জন্য এক লাখ টাকা লাগবে? হ্যালো?

কী বললে?

গলার শিরা ফুলিয়ে সে চিৎকার করে আবার সংক্ষেপে ঘটনাটা জানায়। সমস্ত শুনে তিনি বললেন, বলো কী! এ-ক লা-খ টা-কা! একরাতের মধ্যে। সে তো বিরাট টাকার ধাক্কা!

বাদল থমকে গেল। এই ভদ্রলোকের মেজাজ মর্জি বোঝাই দায়! কখন যে আবেগে ভাসবেন, আবার কখন যে বেঁকে বসবেন তা বোধহয় স্বয়ং ঈশ্বরও জানেন না! সে আমতা আমতা করে বলে, আমি শোধ করে দেব দাদাভাই।

তুমি কবে শোধ করবে তার জন্য কি আমি বসে থাকব?

তা হলে অন্তত হেমন্তবাবুকে খবরটা দিয়ে দিন। যদি উনি কিছু ব্যবস্থা করতে পারেন…! আর কথা বলতে পারে না বাদল। তার গলা বুজে আসে।

আশ্চর্য লোক তো হে তুমি! সুদীপ্তবাবু চটে গেছেন, হেমন্ত কী করবে? সে কি ওপার থেকে এপারে আসবে তোমায় হেল্প করার জন্য? তা হলেই হয়েছে। তা ছাড়া এতদিন কি হেমন্ত তোমার পাশে পাশে থেকেছে? যত্তসব! একেই বলে বাঙালের বুদ্ধি! গজগজ করতে করতেই বললেন,  টাকাটা কাল সকালে পেলে চলবে তো?

সে কথা বলতে পারে না। কোনওমতে বলল, হুঁ।

ওকে। চিন্তা কোরো না। আমি কাল সকালে টাকা নিয়ে চলে আসব।

বাদল বাক্যালাপ শেষ করে ফোন কেটে দেয়। তখনও কানের কাছে চিল-চিৎকার অব্যাহত।

.

মধ্যরাতে রূপসার অপারেশন শুরু হল।

তাকে অপারেশন থিয়েটারের সামনে ট্রলিতে করে নিয়ে এল ওয়ার্ডবয়রা। রূপসা ক্লান্ত দৃষ্টিতে বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়েছে। মুখে করুণ অথচ স্মিত হাসি। মায়ের হাতের মধ্যে ছোট্ট হাতটা গুঁজে দিয়ে সে যেন একটু নিরাপত্তা বোধ করে বাবার গালে হাত বোলায়। অবিকল মাতৃস্নেহে বলে, বাবা, তুমি দাড়ি কাটোনি?

বাদল তার হাত জড়িয়ে ধরে চুমু খায়, এই তো! কালই কেটে ফেলব মা তুমি শুধু তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠো!

তারপর আমরা গ্রামে ফিরে যাব। রূপসা আস্তে আস্তে বলে, তাই না?

হ্যাঁ মা!

রূপসা শান্তিতে চোখ বুজল। তার ঠোঁটে তখনও স্মিত হাসি৷

তোমারও নেই ঘর
আছে ঘরের দিকে যাওয়া
সমস্ত সংসার
হাওয়া
উঠছে নীল ধূলোয় সবুজ অদ্ভূত;
দিনের অগ্নিদূত
আবার কালো চক্ষে বর্ষার নামে ধার
কৈলাস মানস সরোবর
অচেনা কলকাতা শহর
হাঁটি ধারে ধারে
ফিরি মাটিতে মিলিয়ে
গাছ বীজ হাড় স্বপ্ন আশ্চর্য জানা
এবং তোমার আঙ্কিক অমোঘ আবেদন
আবর্তন
নিয়ে
কোথায় চলছে পৃথিবী
আমারও নেই ঘর
আছে ঘরের দিকে যাওয়া

কতদিন পরে বাইরের দুনিয়ার আলো দেখল বাদল তার হিসেব রাখেনি। পুলিশ তাকে তার জামাকাপড় সমেত সবকিছু ফেরত দিয়ে দিয়েছে। এই মুহূর্তে লায়লাও তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সামনেই ইচ্ছামতী নদী। এইটুকু পেরোলেই ওপ্রান্তে নিজের গ্রাম। কতযুগ দেখেনি সে নিজের গ্রামের মাটি। কতদিন মেঠোপথ ধরে হেঁটে যায়নি। কতদিন ভিজে মাটির সোঁদা গন্ধ পায়নি সে! কতদিন ছাত্রছাত্রীদের ইতিহাসের গল্প বলেনি। কতদিন রূপসার মুখ দেখেনি…!

ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের বোটে উঠে বসল বাদল ও লায়লা। বাদলের চোখে পড়ল সীমান্তরক্ষীর বেশে দাঁড়িয়ে থাকা একটি পরিচিত মুখের দিকে। অর্জুন সিং রাওয়াত। তার মুখে অদ্ভুত একটা হাসি ভেসে ওঠে। অর্জুন তার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কী চেহারা হয়েছে লোকটার! গাল দুটো ভেঙে বসে গেছে! গায়ের রং ফ্যাকাশে। চেহারা কঙ্কালসার! এই কি রূপসার বাবা!

রূপসা ফিরে গেছে। আজ আমরাও ফিরছি! প্রফুল্ল হেসে বলল বাদল!

লায়লা চমকে ওঠে! কী বলছে লোকটা! ওর মাথার ঠিক আছে তো! নাকি শোকে-দুঃখে সত্যিই পাগল হয়ে গেল! তার চোখ ফেটে জল আসে। মুখে আঁচল খুঁজে বোবাকান্না চাপার চেষ্টা করছে সে! বাদল কিন্তু বেশ উল্লসিত দৃষ্টিতে চতুর্দিকটা দেখে। তার মনে যেন আর কোনও দুঃখ নেই। ..অপারেশন থিয়েটারের লাল আলোটা দপ করে জ্বলে উঠল।

ওয়েটিং হলে পায়চারি করে চলেছে বাদল। লায়লা বিড়বিড় করে ঈশ্বরকে ডাকছে। অপারেশন থিয়েটারের আলোটার দিকে তাকিয়েই বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠেছিল তার। ওরা ও টি-র সামনেই দাঁড়াতে চেয়েছিল। কিন্তু সুপার বলেছেন, ওয়েটিং হলেই অপেক্ষা করতে। অপারেশন শেষ হলেই ওদের আবার ওপরে ডাকা হবে।

বাদলের কপালে ভাঁজ! সে সামনের জানলা দিয়ে আকাশের দিকে তাকায়। মাঝরাতের আকাশ এখনও মেঘাচ্ছন্ন… ঝড় আসছে! আকাশে ঝলসে ঝলসে উঠছে বিদ্যুতের শিরা-উপশিরা! বাদল আসন্ন ঝড়ের অপেক্ষায় যেন দাঁড়িয়ে থাকে জানলার সামনে। ঝোড়ো হাওয়া হু হু করে এসে ঝাঁপটে পড়ে তার গায়ে। ওলোট পালোট করে দেয় সব কিছু। অন্যদিকে তখন অপারেশন থিয়েটারে চলছে আরেক নাটকের প্রস্তুতিপর্ব!

চেক ব্লাডপ্রেশার।
ওকে স্যার
ব্লাডঃ হিমোগ্লোবিন কাউন্ট?
ফাইন স্যার।
চেক হার্টবিট।
নর্মাল।
রিড লাইফলাইন।
নর্মাল।
টেম্পারেচার?
নর্মাল ডক্টর।
অ্যানাস্থেসিয়া?
ওকে স্যার।

ভিতরে ডাক্তাররা অপারেশনে ব্যস্ত। ডা. গোয়েঙ্কা, অ্যানাস্থেসিস্ট আর দুজন জুনিয়র ডাক্তার, সিস্টার উপস্থিত। মাথার ওপরে একটা বিরাট আলো পীতাভ রশ্মি এসে পিছলে পড়েছে রূপসার মুখে! তার ভুরুতে ভাঁজ। অ্যানাস্থেসিয়ার ঘোরে হয়তো কোনও স্বপ্ন দেখছে। ডা. গোয়েঙ্কা অপারেশনে মগ্ন। মাঝেমধ্যেই সহকারীর দিকে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন। সহকারী কখনও তুলো, কখনও কাঁচি, স্ক্যালপেল এগিয়ে দিচ্ছে। আপাতত টুংটাং শব্দ ছাড়া আর কোনও আওয়াজ নেই।

রূপসার চোখের সামনে তখন অন্য ছবি। ঝাপসা অন্ধকারে দেখা যায় ইচ্ছামতাঁকে। ইচ্ছামতীর বুকে তখনও রাতের কুয়াশা! আকাশে মেঘ জমাট হয়ে মুখ ভারী করেছে। ঈশান কোণে কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে ক্রুদ্ধ মেঘ। সে দাঁড়িয়ে আছে বিস্তীর্ণ প্রান্তরে। দৌড়ে এগিয়ে গেলেই ধরে ফেলবে ইচ্ছামতাঁকে। আর নদী পেরোলেই তার গ্রাম! তার দেশ!

অনেক দূর থেকে বাবার গলা নদীর হাওয়ায় ভেসে এল রূ-প-সা-আ-আ-আ! চলে আ-য়! পা-লি-য়ে আ-য় রূ-প-সা!

রূপসা উত্তর দিতে চায় কিন্তু তার গলা দিয়ে স্বর বেরোয় না! ও নদীর দিকে দৌড়ে যেতে চায়। কিন্তু দম বন্ধ হয়ে আসছে। নিশ্বাস নিতে পারছে না। দৌড়োতে গিয়ে পড়ে গেল সে।

ইতিমধ্যেই কতগুলো ছায়ামূর্তি কখন যেন তাকে ঘিরে ধরেছে। তাদের অদ্ভুত পোশাক। কেউ নার্সের পোশাক পরা, কেউ ডাক্তারের কেউ বা পেশেন্টের জামা পরে আছে কিন্তু কারও মুখ দেখা যায় না! সবাই কালো রঙের বীভৎস মুখোশ পরে আছে। তারা ওকে ঘিরে মানব প্রাচীর তৈরি করে ফেলেছে। অদ্ভুত বাজনার সঙ্গে তাকে ঘিরে ঘিরে নাচছে, হুলুধ্বনি করছে। অনেকটা যেমন বহুরূপী সাজ সেজে তাদের গ্রামে যে নাচিয়েরা ছৌ নাচ নাচে, অবিকল তেমন! নাচতে নাচতে চরকি পাক খাচ্ছে।

রূপসা ভয় পেয়ে সরে যায়। নাচিয়েরা নাচতে নাচতেই তাকে ধরতে চায়। সে কোনওমতে সরে সরে যাচ্ছে। ভয় পেয়ে কাঁদতে চাইছে! কিন্তু পারছে না! একজন আবার সার্কাসের খেলা দেখানোর মতোই উগরে দেয় আগুন! ওদের নাচের মধ্যেই রূপসা ছোট্ট দেহটাকে নিয়ে কোনওমতে এঁকেবেঁকে গুঁড়ি মেরে বেরিয়ে আসে মানবশৃঙ্খল থেকে! তারপর দৌড় লাগায় নদীর তীর লক্ষ্য করে।

রূ-প-সা-আ-আ-আ!

বাবার কণ্ঠস্বর অনুসরণ করছে রূপসা। সে পড়ি কি মরি করে কোনওমতে উপস্থিত হল নদীর তীরে। ওই তো! ওই তো কুয়াশার পাতলা চাদরে আচ্ছন্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাবা! বাবাকে ঘিরে ধরেছে এক রহস্যময় ধোঁয়া! বাবার মুখ দেখা যায় না। কিন্তু পরনে সেই পাঞ্জাবি।

সে এক ছুটে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে! ভীষণ কান্না পাচ্ছে! তবু কাঁদতে পারছে না! অপেক্ষা করছে, বাবার স্নেহের স্পর্শ বরাভয়ের মতো কখন ছুঁয়ে যাবে! কিন্তু বাবা তখনও উদাসীন। শুধু হতাশ হয়ে বলল, ওই দেখ…ওই দেখ…!

একটা ছপ ছপ শব্দ! রূপসা স্তম্ভিত হয়ে দেখল পাড়ে আর কোনও নৌকো নেই। শুধু একটা নৌকো। তীর ছেড়ে ক্রমাগত দূরে চলে যাচ্ছে! হয়তো নেয়ে বসেছিল। শেষ সওয়ারির জন্য। কিন্তু সেটাও ছেড়ে গেছে! বড্ড দেরি হয়ে গেল। বড় দেরি করে ফেলল রূপসা! সে হাত তুলে নৌকোটাকে থামানোর চেষ্টা করে। আশ্চর্য! নৌকোটায় কোনও সওয়ারি নেই! মাঝিকেও দেখা যাচ্ছে না! অথচ জল কাটার আওয়াজটা স্পষ্ট। শেষ নৌকোটাও চলে যাচ্ছে! তাকে থামানোর উপায় নেই!

রূপসা এতক্ষণে ফিরে পেয়েছে তার কণ্ঠস্বর। অসহায় চিৎকার করে উঠে বলে, ও মাঝি-ই-ই! দাঁ-ড়া-ও! আমাকে ওপারে নিয়ে যাও! আমি দেশে যাব! ও মা-ঝি-ই-ই-ই! দাঁ-ড়া-ও!

কিন্তু তার ডাক কেউ শুনল না। নৌকোটা আস্তে আস্তে হারিয়ে গেল। ইচ্ছামতীর কুয়াশায়! রূপসার কাঁদতে ইচ্ছে করে। বাবা তখনও নির্বিকার। রূপসা হাহাকার করে ওঠে, বা-বা!

বাবা এবার ফিরে তাকাল। রূপসা বিস্ময় বিস্ফারিত দৃষ্টিতে দেখল, বাবার মুখেও একটা কালো ভয়ানক মুখোশ! সে আঁতকে ওঠে৷

কাছেই তখন প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল!

.

আচমকা ইসিজি মেশিন ত্রাহি ত্রাহি রব তুলেছে! সিস্টার আর্তনাদ করে ওঠে, স্যার!

ইসিজি মেশিনের রেখা তখন যেন পাগল হয়ে গেছে। একবার লাফিয়ে উঠছে, একবার নীচে নেমে যাচ্ছে! চূড়ান্ত খামখেয়ালিপনায় লাফিয়ে উঠতে উঠতে আচমকা যেন শান্ত হয়ে যাচ্ছে। সমান হয়ে আসছে আঁকিবুকি রেখাগুলো।

শি ইজ কোলাপসিং!

সিস্টার বলে ওঠে।

ডা. গোয়েঙ্কা একবার বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকালেন ইসিজি মেশিনের রেখার দিকে। তারপরই বললেন, সিস্টার! সময় নেই! চার্জ! কুইক!

কয়েকশো ভোল্টের বিদ্যুবাহী মেশিন তৈরি হল হৃৎপিণ্ডকে চাঙ্গা করে তোলার জন্য। ডা. গোয়েঙ্কা বললেন, রেডি? ওয়ান, টু, থ্রি, চার্জ! এগেইন… এগেইন… ওয়ান টু থ্রি চার্জ!

রূপসার ছোট্ট দেহটা বিদ্যুতের ঝটকা খেয়ে অপারেশন বেড থেকে লাফিয়ে উঠল। কিন্তু তার হৃৎপিণ্ড ক্রমাগতই ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছে। অনেকদিনের ক্লান্তিতে, যন্ত্রণায় ডুবে যাচ্ছে ছোট্ট হৃদয়টা! অসংখ্য বিদ্যুতের ঝটকাও তার ঘুম ভাঙাতে পারল না। আস্তে আস্তে সোজা হয়ে গেল লাইনটা!

কেউ জানত না, তার হৃদয় অনেক আগেই ভেঙে গিয়েছিল। ভাঙা দেশের মতো ভাঙা হৃদয়ও জোড়া গেল না! ভগ্নহৃদয় বালিকার মনে চিরশান্তি দিয়ে গেল মৃত্যু!

ঝড়ের রাতে            ছিনু প্রহর গণি
হায়, শুনি নাই, শুনি নাই রথের ধ্বনি তব রথের ধ্বনি
গুরুগুরু গরজনে কাঁপি              বক্ষ ধরিয়াছিনু চাপি,
আকাশে বিদ্যুৎবহ্নি           অভিশাপ গেল লেখি
চিনিলে না আমারে কি!

.

১৭.

এই কপিটা আপনাদের। অন্যটা রাখুন। ওটা শ্মশানে জমা দিতে হবে। কাউন্টারে বসে থাকা শুকনো শকুনের মতো লোকটি বলে, দুটো কপিতেই সই করে দিন।

সুদীপ্তবাবু কোনও কথা না বলে কপিটা তুলে নিলেন। আজ সকালেই এসে পৌঁছেছেন ভদ্রলোক। এবং এসে প্রথমে বাদলকে দেখে বুঝতেই পারেননি যে এমন একটা মর্মান্তিক খবর বুকে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে সে! এ কদিন তার চোখের তলায় কালি পড়ে গিয়েছিল। দুই ভুরুর মাঝখানে সবসময়ই জমে থাকত অদ্ভুত একটা অসন্তোষ। অথচ আজ সেসব কিছুই নেই! আজ তাকে দেখে মনে হয়েছিল, এই মুহূর্তেই স্নিগ্ধ শিশিরে স্নান করে এসেছে বুঝি-বা! লায়লার বুকফাটা কান্নায় শেষপর্যন্ত বুঝলেন, সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে!

শ্মশান! বাদল চোখ তুলে তাকায়। এখন তার চোখে অদ্ভুত একটা প্রশান্তি খেলা করছে। সে শান্ত গলায় বলল, আপনি ভুল করছেন দাদা।

মানে? লোকটি গোলগোল চোখ করে তাকায়, কী ভুল করছি?

বাদলের মুখের রেখা সব স্থির, মুসলমানের মেয়ের দাহ হয় না। জনাজা হয়। রূপসারও তাই হবে।

সে কী! সে আঁতকে ওঠে। কম্পিউটার রেকর্ড দেখে নেয়, এই তো, রূপসা চৌধুরী, ডটার অব বাদল চৌধুরী অ্যান্ড লীলা চৌধুরী, ইন্ডিয়ান, কাস্ট হিন্দু ব্রাহ্মণ!

লোকটার সঙ্গে সঙ্গে আঁতকে ওঠেন সুদীপ্তবাবুও। বাদল এ কী জাতীয় শত্রুতা শুরু করেছে। তিনি ধাক্কা মেরে বাদলকে সরিয়ে দিতে চান। লোকটাকে বলেন, শোকে দুঃখে ওর মাথাটা গেছে। আমিই সই করে দিচ্ছি। কই দেখি?

না দাদাভাই! বাদল দৃঢ়ভাবে তাঁকে থামিয়ে দেয়, যথেষ্ট হয়েছে। এ কদিন ধরে অনেক পাপ করেছি। স্বর্গ-নরক, বেহেস্ত-দোজখ মৃত্যুর পর হয় কি না জানি না। কিন্তু এ কদিন ধরে মিথ্যের বেসাতি করতে করতে আমি বেঁচে থাকতেই মরে গেছি। মৃত্যুর আগে আমার মেয়ে আমাকে চিনতে পারেনি! লায়লা ভয়ের চোটে নিজের মেয়েকেও অস্বীকার করেছে। ঠগ জোচ্চোর, স্মাগলার, সবই হয়েছি। লায়লাও অনেক কষ্টে মিথ্যের বোঝা বয়ে চলেছে। আমাদের যা হয়েছে তা হয়েছে, কিন্তু আমার মেয়েটা নিষ্পাপ ছিল! সে মিথ্যের ভার বয়ে নিয়ে খোদার কাছে যাবে না।

বাদল!

তাঁকে হাত তুলে নিরস্ত করেছে সে, এখন রূপসার সঙ্গে সঙ্গে বাদল চৌধুরীও মরে গেছে। মুনতাসীর চৌধুরী বাদলকে এবার বাঁচতে দিন।

সেই পুরনো আত্মবিশ্বাসী বাদল আবার ফিরে এসেছে। আর তার সেই কুণ্ঠিত ভাব নেই। সে দৃঢ়, নির্ভীক স্বরে বলল, শুনুন, আমার পুরো নাম মুনতাসীর চৌধুরী বাদল। আমার স্ত্রীর নাম লীলা নয়, লায়লা চৌধুরী। রূপসা হিন্দুর মেয়ে নয়। মুসলমানের মেয়ে। মেয়ের চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশ থেকে বে-আইনি ভাবে চলে এসেছি৷ বলে একটু থামল। গভীর চোখ দুটো মেঝেতে নিবদ্ধ করে ফের বলে ওঠে সে, আমি চোর নই। স্মাগলার নই। আমিও বাঙালি, সর্বোপরি একজন মানুষও বটে কিন্তু আইনের চোখে শুধুমাত্র একজন অনুপ্রবেশকারী! এই বাংলাতেই আমাদের আদি বাড়ি ছিল, কিন্তু কে শুনবে সে কথা…!

কাউন্টারের লোকটা ততক্ষণে সিকিউরিটি অ্যালার্ম বাজিয়ে দিয়েছে। অত কষ্টেও হেসে ফেলল বাদল, সিকিউরিটির দরকার নেই। আমি পালাব না। এখানে এখনও আমার মেয়ে আছে। তাকে ছেড়ে কোথায় যাব? আপনি পুলিশে খবর দিন। ওরা না আসা পর্যন্ত বরং আমি আর দাদাভাই একটু মেয়ের কাছে বসে থাকি…!

বলতে বলতেই সে পিছনে ফিরেছে। কিন্তু সুদীপ্তবাবু কখন যে টুক করে সরে পড়েছেন টেরই পায়নি! সে সজোরে হেসে ওঠে!

লায়লা তখন মেয়ের মৃতদেহের সামনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মেয়ের মুখে বারবার হাত বোলাচ্ছে। যেন ঘুমিয়ে পড়েছে রূপসা। মায়ের স্পর্শে এখনই উঠে বসবে। বাদল নিশ্রুপে তার পিছনে এসে দাঁড়ায়। লায়লা তাকে দেখে চোখ বড় বড় করে! ইঙ্গিতে রূপসাকে দেখায়। যেন বলতে চাইছে– দেখো… দেখো। কী করেছ! কিন্তু কোনও শব্দ বেরোয় না তার মুখ দিয়ে। বাদলের শান্ত মুখ দেখে তার ক্ষোভ, রাগ সহ্যের বাইরে চলে যায়। সে রুদ্রাণীর মতো তেজে বাদলকে ধরে ঝাঁকাচ্ছে। একটা অদ্ভুত গোঙানি লায়লার বুক বেয়ে গলা দিয়ে বেরিয়ে আসছে। সে ভাষা বোঝার কেউ ছিল না। আসলে সে হয়তো বলতে চাইছিল, আমি বলেছিলাম… আমি ফিরে যেতে বলেছিলাম…!

কান্নাকে আর রোধ করতে পারল না লায়লা! শাখা-চুড়ি সুদ্ধ হাতটা প্রচণ্ড আক্রোশে বাদলের বুকের ওপর আছড়াতে আছড়াতে বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়ল। ততক্ষণে শাখা ভেঙে চুরমার হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে, মিথ্যের মতো। বাদলের পাঞ্জাবি সিঁদুরে লাল হয়ে গেছে! বাদল তখনও শান্ত! সে সজোর আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে লায়লাকে! কিন্তু তার নিজের চোখ মরুভূমির মতো শুকনো! একফোঁটা জলও নেই সেখানে!

কিছুক্ষণ বাদেই পুলিশ এসে হাজির হল। পুলিশকে আর ভয় পায় না বাদল। ওরা তখনও রূপসার দেহের সামনে দাঁড়িয়েছিল। পুলিশ অফিসারটি আগেই ঘটনাটা শুনেছেন। কারণ এরকম অদ্ভুত অনুপ্রবেশকারী আগে কখনও দেখেনি ভারতবর্ষ! এই অদ্ভুত ট্র্যাজেডির সামনে দাঁড়াতে তাঁরও কষ্ট হচ্ছিল। তবু টুপি খুলে মৃতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি বাদলের পিছনে এসে দাঁড়ালেন।

ও, আপনারা এসে গেছেন! বাদল এমনভাবে বলল, যেন পুলিশ নয়, তার বাড়িতে অতিথি এসেছে। একটু চুপ করে থেকে কী যেন ভাবল। তারপর অনুনয়ের ভঙ্গিতে বলল, একটা অনুরোধ ছিল। রাখবেন?

বলুন।

রূপসা ভীষণভাবে দেশে ফিরতে চেয়েছিল। মৃত্যুর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত বাড়ি ফিরতে চেয়েছিল। বাদল সস্নেহে মেয়ের চুল ঘেঁটে দেয়, ও তো এখন সব অপরাধের ঊর্ধ্বে। তাই না? আমাকে ফাঁসি দিলেও কোনও দুঃখ নেই কিন্তু আপনারা অন্তত ওকে নিজের দেশে ফিরিয়ে দিতে পারেন না? এখানে থাকলে ওরা ওকে মর্গে ফেলে রাখবে– তারপর বেওয়ারিশ লাশ বলে পুড়িয়ে দেবে। আমি মরেও শান্তি পাব না। বাবা হিসাবে আপনার কাছে এইটুকুই ভিক্ষা আমার। আপনি দেখবেন, যাতে ও নিজের দেশের মাটিতে মিশে যেতে পারে? আপনি একটু দেখবেন?…

সে দুহাত জোড় করে ফেলেছে। অফিসারের মাথা আরও অবনত হয়ে আসে। এই আশ্চর্য পরিণতির সামনে দাঁড়িয়ে তাঁরও বুক কেঁপে উঠেছে। কোনওমতে বললেন–আই উইল ট্রাই মাই বেস্ট। আমি ইন্ডিয়ান বিএসএফ-এর ডি আইজি মি. ভার্মার সঙ্গে কথা বলব।

আচ্ছা। বাদলের চোখে শীতালি পাখির মতো নেমে আসে প্রশান্তি– হাতকড়া এনেছেন তো? এই নিন!

হাতদুটো সামনের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে সে। অফিসার সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন। তারপর সসম্ভ্রমে বললেন, লাগবে না। আসুন…!

.

সেদিন রাতে ডিআইজি ভার্মার বাড়িতে জরুরি একটা ফোন এল। ডিআইজির মেয়ের সেদিন আঠেরোতম জন্মদিন। সেলিব্রেশনের মাঝখানেই বাধ্য হয়ে ফোনটা ধরতে হল তাঁকে। বেশ কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা। যেন ওপ্রান্তের কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেছেন। বেশ কিছুক্ষণ পর আস্তে আস্তে বললেন, আমরাও মানুষ। অফিসার আপনি কয়েদিটিকে জানিয়ে দিন, তার এই ইচ্ছেপূরণ করবে ভারতীয় বিএসএফ। একটু থেমে যোগ করলেন, আফটার অল। আমিও এক মেয়ের বাবা!

তারপরই একদিন একটি ছোট্ট কফিন নিয়ে ভারতবর্ষের বোট ইচ্ছামতীর কুয়াশায় মিলিয়ে গেল!

আজও তেমনই কুয়াশা! আজও ইচ্ছামতীর বুকে ছপ ছপ, টপ টপ শব্দ! আজও যেন নদী কাঁদছে! কুয়াশা ভেদ করে আস্তে আস্তে স্পষ্ট হল বাংলাদেশের জওয়ানদের বোট। আস্তে আস্তে নৌকোটা তীরে এসে ভিড়ল!

রূপসা! বাদল তীরে নেমেই পড়ি কি মরি করে দ্রুত ছুটে গেল নিজের বাড়ির দিকে। চিৎকার করে বলল, মা, আমি এসেছি। আমি ফিরে এসেছি। মাগো! রূপসা! আমার চম্পকঈশ্বরী!

লায়লা অবাক হয়ে তার কাণ্ড দেখে! বাদলের কি কিছুই মনে নেই? না সত্যিই সে উন্মাদ হয়ে গেছে! এমনভাবে বাড়ির চতুর্দিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে যেন রূপসার সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে! যেন রূপসা টু-কিই-ই-ই দিয়ে কোথায় লুকিয়ে পড়েছে খুঁজে পাচ্ছে না!

মা দেখ, সব বিষ আমি খেয়ে ফেলেছি! তোর ভাগের বিষটাও খেয়েছি। আমি নীলকণ্ঠ হয়েছি। আর কোথাও বিষ নেই! আর ভয় নেই। এবার বেরিয়ে আয়! আয় মাগো!

আর থাকতে না পেরে ডুকরে কেঁদে ওঠে লায়লা! তার উচ্ছ্বসিত কান্নার আওয়াজে বাদলও ফিরে তাকায়। না, সে লায়লাকে দেখছে না। বরং উদ্ৰান্ত দৃষ্টিতে তার পিছনের কামিনী গাছটাকে দেখছে! কামিনী গাছটা আবার শুকিয়ে গেছে। হয়তো এবার চিরদিনের মতোই! বাদল বিস্ফারিত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকে। ও কি শুকিয়ে গেল! সে ভয় পেয়ে যায়। অস্ফুটে বলে, আমার চম্পকঈশ্বরী! এ কী!

লায়লা কিছু বোঝার আগেই বাদল ছুটে গেল পুকুরপাড়ের দিকে। পাগলের মতো আঁজলা ভরে জল তুলে এনে গাছটার গোড়ায় দিচ্ছে! না, এভাবে মরে যেতে পারে না গাছটা! বাদল কিছুতেই ওকে মরতে দেবে না। জল চাই, আরও জল! সে খ্যাপার মতো বারবার দৌড়ে যাচ্ছে পুকুরের দিকে। আর অঞ্জলি ভরে জল এনে দিচ্ছে গাছটার গোড়ায়। বাঁচাতেই হবে! বাঁচাতে হবে! বাঁচাতেই হবে! জল ঢালতে হবে, আরও জল…!

আচমকা নিজেকে সামলাতে না পেরে গাছটার সামনেই হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল বাদল। তার হাতের অঞ্জলি থেকে জল পড়ে গেল মাটিতে। গাছটার শিকড়ে অশ্রুর মতো জলের ধারা নেমে যাচ্ছে। বিস্ফারিত দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই কেঁপে উঠল সে। তার সর্বশরীর কাঁপছে! মাটিতে নিজের মুখ চেপে ধরেছে মানুষটা। তবু এই কাঁপুনি থামানো যাচ্ছে না!

রূপসা! আমার চম্পকঈশ্বরী!

বুকফাটা হাহাকার করে উঠল বাদল। দীর্ঘ এক বছরের মধ্যে যে অশ্রু একবারও তার চোখে দেখা যায়নি এবার সে বুকের বাঁধ ভেঙে দুর্বার স্রোতে বেরিয়ে এল। সারা গায়ে মাটি মেখে প্রচণ্ড কান্নায় ভেঙে পড়ল সে!

লায়লা নীরবে তার কাঁধে হাত রাখে! তার চোখেও জল!

.

আকাশ বেয়ে তখন শঙ্খচিল উড়ান দিয়েছে। তাদের মাথার ওপরে উন্মুক্ত আকাশ! নীচে উন্মুক্ত জমি। কোনও বাধা-বন্ধ নেই। কোনও মানচিত্র নেই, ব্যারিকেড নেই, বর্ডার নেই! আলোতে উদ্ভাসিত ডানা মেলে দিয়ে তারা উড়ে চলেছে ভারতবর্ষের দিকে! শঙ্খচিলদের পাসপোর্ট লাগে না! ভিসা লাগে না!

আর মানুষ?… সুধাসাগরের তীরেতে বসিয়া পান করে শুধু হলাহল…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *