০১. ইচ্ছামতীর বুকে

শঙ্খচিল – সায়ন্তনী পূততুন্ড
প্রথম সংস্করণ ডিসেম্বর ২০১৬
SANKHACHIL [Novel] by Sayantani Putatunda
.

চিত্রপরিচালক গৌতম ঘোষকে
কৃতজ্ঞতা সহ

.

০১.

ইচ্ছামতীর বুকে তখনও রাতের কুয়াশা জমে আছে। ভোরের রক্তিম আলো কুসুম রঙের আভা সদ্য তৈরি করেছে মাত্র! এখনও তেমন আলো ফোটেনি। তবে অন্ধকারও নেই। অনেকটা যেন দুর্ভেদ্য প্রহেলিকার মতো। কিছু দেখা যায়, কিছু যায় না। খানিক আলো, খানিক অন্ধকার!

তার মধ্যেই একটা ছোট্ট বিন্দু স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তার আবছা অবয়ব দেখে মনে হয়, সম্ভবত ভারতবর্ষ থেকে কোনও বোট এদিকে আসছে। ধোঁয়ার সুদূরবিস্তৃত আঁচলের নীচে এখনও সে পরদানশিন। তবু তার জল কেটে এগিয়ে আসার ছপাৎ ছপাৎ শব্দ দিব্যি শোনা যায়। শুধু ওই শব্দটুকুই যেন জীবন্ত মানুষের উপস্থিতির প্রমাণ। এই শব্দের মানে কেউ জানে না। এ নদীর তথাকথিত ছলছল, কলকল উল্লাসধ্বনি নয়। এ শব্দ একটু অন্যরকম। তার সঙ্গে তাল মিলিয়েছে নদীবক্ষে জমে থাকা কুয়াশা চুঁইয়ে জল পড়ার টপটপ আওয়াজ। সব মিলিয়ে শুনলে মনে হয় কেউ যেন কুয়াশায় মুখ লুকিয়ে নীরব অশ্রুপাত করে চলেছে।

কেউ জানে না, আসলে নদীও কাঁদে! বহুবছর ধরেই কেঁদে আসছে সে। শিশিরের শব্দে তার কান্না অনেকবার ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছে। কেউ শোনেনি, কেউ দেখেনি। কেউ জানারও চেষ্টা করেনি…!

উলটোদিকের বোটটা জল কেটে এবার আরও এগিয়ে এসেছে। বোটের উপরে পতপত করে উড়ছে ভারতীয় পতাকা। একটু মন দিয়ে লক্ষ করলেই দেখা যাবে, বোটের কেন্দ্রে শায়িত একটা ছোট্ট কফিন। তাকে চতুর্দিক দিয়ে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা। ওদের কারও মুখে কোনও অভিব্যক্তি নেই। থাকার কথাও নয়। মৃত্যুকে অনেকবার কাঁটাতারে ঝুলতে দেখেছে ওরা। তাই বোধহয় বিশেষ কোনও অনুভূতি ওদের মনে আঁচড় কাটে না।

ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের বোট মাঝখানে এসে থেমে গেল। ওরা এ প্রান্তে আসবে না। আসার অধিকার নেই। কারণ ইচ্ছামতীর বুকের মাঝখানে একটা অদৃশ্য কাঁটাতার নদীকেও করেছে দ্বিখণ্ডিত! ওদিকটা ইন্ডিয়া, এদিকটা বাংলাদেশ! একই বঙ্গ হল ভঙ্গ, পূরব ও পশ্চিম! সহোদর হওয়া সত্ত্বেও তাই রাম-রহিমের মিলন অসম্ভব! মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে এমন একটি মানুষ যে কোনওদিন এ মাটির ছিল না, হয়নি কখনও। লোকটা বিদেশি তাই দুই বাংলার মাঝখানে একটা লাল দাগ টেনে দিতে একবারও হাত কাঁপেনি!

অগত্যা মাঝনদীতে কফিন হস্তান্তরিত হল। বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীরা ওখানেই বোট নিয়ে প্রতীক্ষারত ছিল। তারা দ্রুত নৌকোয় তুলে নিয়েছে কফিনটাকে। কেউ লক্ষ করল না, এক ভারতীয় জওয়ানের হাত যেন মুহূর্তের ভগ্নাংশে কেঁপে গেল। পাথরকঠিন মুখে এক অব্যক্ত যন্ত্রণা ছাপ ফেলে যায়। তার পরই আবার সেই অবিচলিত ভাব ফিরে এসেছে। অন্য কেউ লক্ষ করল না ঠিকই, কিন্তু তার অন্তর্যামী জানলেন এই নির্লিপ্তি বড়ই কষ্ট আরোপিত!

ইচ্ছামতীর পাড়ে, বাংলাদেশ সীমান্তে বেশ কিছু মানুষ ততক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। তারা এই কফিনকে সমাধিস্থল অবধি নিয়ে যাবে। অর্থাৎ জনাজায় কন্ধা দেবে। মানুষগুলোকে দেখলে মনে হয় ওরা এখনও অদ্ভুত একটা ঘোরে আছে। অনেকটা বাজ পড়া বটগাছের মতো স্তম্ভিত।

সব তোমার জন্য! এ সব তোমার জন্য হয়েছে।

আচমকা একটি মানুষ যেন ঘোর কাটিয়ে উঠে প্রচণ্ড রাগে ফেটে পড়ল। তার পাশের বৃদ্ধ লোকটিকে উদ্দেশ করে উগরে দিল জ্বালাময়ী ক্ষোভ–ইন্ডিয়া ভক্তি! খুব ইন্ডিয়া প্রেম না? মেরা ভারত মহান! তবে এখানে কেন? নিজে কেন যাও না ওদেশে? এ দেশে কি হাসপাতাল নাই? আমরা কি বিনা চিকিৎসায় মরতেছি? মানুষটার গলায় গনগনে লাভার আঁচ–ওদেশে নাকি ভাল চিকিৎসা হয়! দুদিনেই সুস্থ করে ছেড়ে দেবে…! হ্যাঁ, দিয়েছে ছেড়ে। একেবারে চিরদিনের জন্য ছেড়ে দিয়েছে। আর ওর কোনও রোগ হবে না! আর কোনও কষ্ট নাই রে ওর…আর কোনও ব্যথা নাই রে…!

বলতে বলতেই হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল লোকটি! আর যাঁকে কথাগুলো বলা হল, তিনি মুখ নিচু করে নীরব ভাষায় যেন সব অপবাদ মাথায় তুলে নিলেন। অপবাদের বোঝা যতটা না ভারী তার চেয়েও আত্মগ্লানির প্রবল ভারে ক্রমশই যেন কুঁজো হয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। লম্বা, দীর্ঘাকৃতি মানুষটি অবশ্য শেষযাত্রায় সামিল হলেন। কিন্তু সেই ঋজু মেরুদণ্ড কেউ যেন দুটুকরো করে ভেঙে দিয়েছে। সারাজীবন মাথা উঁচু করে আসা মানুষটি মুখ লুকিয়ে করে চলেছেন ঐকান্তিক প্রার্থনা– ধরণী দ্বিধা হও!

কফিনের ভিতরে বাক্সবন্দি দেহটিকে বাইরে আনা হল। আর কিছুক্ষণ পরেই তার দেহসমেত সমস্ত আশা, স্বপ্ন মিলিয়ে যাবে মাটির গভীরে। এখন তাকে স্নান করানো হচ্ছে। এ গ্রামের মেয়েরা তাকে স্নান করিয়ে দেহের শেষ জাগতিক স্পর্শটুকুও ধুইয়ে দেবে! তারপর নতুন সুতির চাদর দিয়ে আপাদমস্তক ঢেকে দেওয়া হবে দেহ। মাদুরে মুড়ে, মক্কার দিকে মাথা রেখে তার প্রাণহীন দেহ অপেক্ষা করবে অন্তিম, এবং সবচেয়ে আপন স্পর্শটুকুর জন্য। মায়ের গর্ভের মতোই নিশ্চিন্ত এবং পবিত্র উষ্ণতা দিয়ে তাকে কোলে টেনে নেবে মাটি।

চতুর্দিকে স্নিগ্ধ নিশ্চল নীরবতা। তার মধ্যেই মৌলবিসাহেবের ঈষৎ কাঁপা কণ্ঠে উচ্চারিত হল অন্তিম বাণী–

সুভানক আল্লাহুম্মা, ওয়া বিহামদিকা, ওয়া বারাকাসমুকা, ওয়া তালা-আ জদুকা, ওয়া জাল্লা থানা উকা ওয়ালা ইলাহা ঘায়রুকা…!

এর মধ্যেই দেহটিকে আস্তে আস্তে গর্তের মধ্যে রেখে দেওয়া হয়েছে। পুরুষেরা মুঠো মুঠো করে মাটি ফেলছে গর্তে। মেয়েরা মুখে আঁচল চেপে উদগ্র কান্নার বেগ সামলানোর চেষ্টা করছে। যাওয়ার সময় কাঁদতে নেই। আত্মা মায়ায় জড়িয়ে পড়ে। তখন বেহেশতের রাস্তাটুকুও পার করা কঠিন।

কেউ খেয়াল করেনি, এই শোকদৃশ্যের মধ্যেই আচমকা আবির্ভাব হয়েছে এক অদ্ভুত আগন্তুকের। কোনওমতেই সে বাংলাদেশের মানুষ হতে পারে না। পরনে তখনও ভারতীয় সীমান্তরক্ষীর বেশ! টুপিটা শুধু মাথায় নেই। অন্যদের মতোই সেও একমুঠো মাটি নিয়ে এগিয়ে আসছে।

ওকে দেখে সকলেই অবাক! এই লোকটা তো ভারতের সীমান্তরক্ষী! বাংলাদেশি নয় অবাঙালি রাজপুত! মুসলিম নয়! অথচ জনাজায় অংশগ্রহণ করছে! এ কী! এমনকী মৌলবিসাহেবও অবাক। স্তম্ভিত গলায় বললেন, এ কী! আপনে তো মোছলমান নন!

সীমান্তরক্ষী মুখ তুলে তাকালও না। তার চোখ তখনও ভূগর্ভস্থ সাদা কাপড়ে মোড়া মানবদেহের দিকে। শূন্য সে দৃষ্টি। যন্ত্রচালিতের মতো মৃতদেহকে উপহার দিল একমুঠো মাটি! তার কানের কাছে তখনও দুটো কণ্ঠস্বর ঘোরাফেরা করছে!

…এই লড়কি! তুমি কে?

একটা দুষ্টু গলা খিলখিলিয়ে হেসে উঠল, আমি বাঘ, ভালুক নই গো৷ আমি মানুষ।

আবার সেই অদ্ভুত প্রশ্ন ফিরে আসে তার কাছে।

আপনে কি মোছলমান?

আপন মনেই বিড়বিড় করে উত্তর দেয় সে, নহি, ম্যায় ইনসান হুঁ।

একটা জীবন অসময়ে শেষ হয়ে গেলেও প্রকৃতির কিছু আসে যায় না। প্রাত্যহিক নিয়ম মেনে একটু পরেই পবিত্র আজানের সুরে ভরে উঠবে এই ছোট্ট সীমান্তবর্তী গ্রাম! সকালে ইচ্ছামতীর বুকে নেয়ের গান শোনা যাবে। সন্ধেবেলায় বেজে উঠবে শঙ্খ! নিয়মমতোই ভারতীয় আর বাংলাদেশি সীমান্তরক্ষীদের যৌথ ফ্ল্যাগ মার্চও হবে। যত না মৈত্রীর প্রতীক, তার চেয়েও বেশি আদিখ্যেতা! সে জানে, রাতেই মৈত্রী ভুলে গর্জন করে উঠবে হিংস্র বন্দুক! হয়তো বা একরাশ গোরুর পালকে ছেড়ে দেওয়া হবে সীমান্তে। গোরুপাচারকারী দল গোরুর পালের মধ্যেই হয়তো লুকিয়ে রাখবে একটা দুটো অনুপ্রবেশকারীকে! প্রচুর টাকার বিনিময়ে গোরুর ভিড়ে লুকিয়ে বাংলাদেশের বা ভারতবর্ষের বর্ডার পার করতে চাইবে কেউ! সীমান্তরক্ষীর রাইফেল গর্জন করে উঠবে। প্রথমটা ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার। ভয়ার্ত, বিস্ত গোরুর দল দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে শুরু করবে। তার মধ্যেই হয়তো শোনা যাবে সেনাবাহিনীর ভারী বুটের শব্দ।

পরক্ষণেই রাইফেল গর্জন! এবার শূন্যের উদ্দেশে নয়! একটা প্রাণহীন শরীর কাঁটাতারের ওপর এলিয়ে পড়বে! চতুর্দিকে বারুদ আর রক্তের গন্ধ। কালও এসব হয়েছে। রোজই হয়। তবু কিছুই থেমে থাকে না।

সে যন্ত্রচালিতের মতো চলতেই থাকে। দিশাহীন, অবিন্যস্ত পায়ে কোথায় যে যেতে চায় বুঝতে পারে না। একমুহূর্তের জন্যও লোকটা পিছনের দিকে তাকায়নি। পিছনের দিকে তাকালেই হয়তো কেউ

এখনই মিষ্টি সুরে ডেকে উঠবে, মিতা! ও মিতা!

মানুষটা এখন দৌড়াচ্ছে। যেন পালিয়ে যাচ্ছে। যেন এখনই কেউ ওর হাত টেনে ধরবে। যেন সমস্ত মায়া মমতার শিকল ছিঁড়ে পালিয়ে যেতে চায় সে। দাঁড়াবে না। আর দাঁড়াবে না। আর কোনওদিন এ পাড়ে আসবে না সে। কিছুতেই নয়!

ঠিক সেই মুহূর্তেই ইচ্ছামতীর ওপ্রান্তে, ভারতবর্ষের সীমানায় বসে ছিল দুটো মানুষ। একজন পুরুষ, অন্যজন মহিলা! একজোড়া ব্যথিত চোখ আকাশের দিকে তাকিয়ে আঁতিপাতি করে কী যেন খুঁজছে! ও প্রান্ত থেকে তখন শঙ্খচিলের দল উড়ে আসছে এদিকে। তাদের মেলে দেওয়া ডানায় নরম কোমল রং ছড়িয়ে দিয়েছে সূর্যের লাজুক আলো। তাদের মুক্ত, স্বাধীন ডানার রং দেখতে দেখতে চোখদুটো রক্তিম হয়ে ওঠে, জলে ভিজে যায় চোখের পাতা।

এতক্ষণে সব শেষ হয়ে গেছে তাই না?

অঞরুদ্ধ কণ্ঠে বলে নারীটি। পুরুষটি কিছু না বলে শুধু তাকে টেনে নেয় আরও একটু কাছে। এতক্ষণের নীরবতা ভেঙে তীব্র বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। পুরুষটির বুকে মুখ গুঁজে উগরে দিল সমস্ত যন্ত্রণা!

পুরুষটি তখন ভাবছিল, এর পরও কি বেঁচে থাকার কোনও মানে হয়? সে বিড়বিড় করে স্বগতোক্তি করে, এই জীবন লইয়া কী করিব? এই জীবন লইয়া কী করিতে হয়?

.

প্রজাপতিটা অনেকক্ষণ ধরেই কামিনী গাছটার চতুর্দিকে ঘুরঘুর করছিল। ফাঁক পেয়ে বোধহয় এবার জিরিয়ে নিতে বসল!

কিছু কিছু মানুষ আছে যারা শৈশব থেকেই বড় দুঃখী! কোনও আনন্দ-অনুষ্ঠানে গেলেও তাদের পাঁচের মতো মুখ দেখলে মনে হয় শ্রাদ্ধবাড়িতে এসেছে। সবসময় মুষড়ে থাকাটাই তাদের স্বভাব। এই কামিনী গাছটাও সেইসব মানুষের মতোই! কত বসন্ত এল গেল, আজও সে নতুন পাতায়, ফুলে নিজেকে সাজিয়ে তুলতে পারল না। বরং ক্রমাগতই যেন মুহ্যমান হয়ে পড়ছে। ওর যে কীসের এত দুঃখ তা আজও বোঝা যায়নি।

প্রজাপতিটা সবে দুদণ্ড বিশ্রাম করতে পেরেছিল। তার আগেই একটা উদ্ভট দৃশ্য হয়তো ধরা পড়ল তার পুঞ্জাক্ষিতে! বেচারির ঠিক পিছনেই একটা বিরাট চোখ উঁকি মারছে! ওরে বাবা! সে কী চোখ! দেখলে যে-কোনও মানুষ বাপ রে বলে চেঁচিয়ে উঠবে! অমন চোখ আর যাই হোক মানুষের হয় না! প্রজাপতিটা ঘাবড়ে গিয়েছে। তার ডানা থিরথির করে কেঁপে ওঠে! তার সঙ্গে তাল মিলিয়েই বিশাল চোখটা পিটপিটিয়ে উঠেছে। যেন কোনও প্রাগৈতিহাসিক জীব কটমটিয়ে দেখছে তার শিকারকে!

প্রজাপতি বেচারি হয়তো প্রাণ বাঁচাবার তাগিদে মুহূর্তের মধ্যেই হুড়মুড়িয়ে কেটে পড়ল।

আরে…আরে…!

রূপসা তাড়া করল ছোট্ট প্রজাপতিটাকে। তার পায়ের পায়েল ঝমঝমিয়ে সুরেলা শব্দ করে ওঠে। হাতের কাঁচের চুড়ি রিনরিনিয়ে ওঠে। কিন্তু আজকাল একটু দৌড়োলেই সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। দম আটকে আসে। তাই তাড়া করেও প্রজাপতিটাকে ধরা গেল না! সে হতাশ হয়ে ধুপ করে মাটির ওপরেই বসে পড়েছে। প্রজাপতির ডানায় কী কী রঙের মিশেল আছে, আতশকাঁচ দিয়ে সেটাই পর্যবেক্ষণ করতে চলেছিল বেচারি! কী করে জানবে যে আতশকাঁচের পেছনে তার সুন্দর চোখদুটো কীরকম ভয়ানক রূপ ধারণ করেছে!

রূপসা রেগে গিয়ে গরগর করে। আরও একটু বসে থাকলে কী ক্ষতিটা হত! প্রজাপতিটার ডানায় কী সুন্দর রুপোলি গুঁড়ো সাজানো ছিল। সেগুলো একদম স্থায়ী কারুকার্য, না ছুঁয়ে দেখলে অভ্রের গুঁড়োর মতো হাতেও লেগে যায় তাই এক্সপেরিমেন্ট করার তালে ছিল সে। নির্বোধ প্রজাপতিটা দিল সব ভেস্তে!

সে জোরে জোরে শ্বাস টানতে টানতে আপনমনেই গজগজ করে ওঠে, গাধা কোথাকার, রামছাগল একটা! উফফ।

কে রামছাগল? রূপসার বাবা তার অজান্তেই কখন যেন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। মেয়ের মাথার চুল ঘেঁটে দিয়ে বলল, কাকে গাল দেওয়া হচ্ছে আমার চম্পক ঈশ্বরী?

রূপসা কাঁদোকাঁদো গলায় জানায়, দেখো না বাবা, কী সুন্দর একটা প্রজাপতি এসে বসেছিল কামিনীগাছে। আমি যেই না আতশকাঁচ দিয়ে একটু ভালভাবে দেখতে গেছি, অমনি গাধাটা উড়ে গেল!

রূপসার বাবা মুনতাসীর চৌধুরী বাদল সজোরে হেসে ওঠে। এই এক অদ্ভুত মেয়ে. সবসময়ই উদ্ভট উদ্ভট কাণ্ড করে বসে থাকে।

চম্পক ঈশ্বরী! মুখ গম্ভীর করে বলল বাদল, রামছাগলের লম্বা দাড়ি থাকে। চারটে পা, আর গুঁতোনোর জন্য শিং থাকে। নজরে না পড়ার মতো হলেও, একটা লেজ থাকে বোধহয়…!

রূপসা সটান বাবার কোলে শুয়ে পড়েছে। ঘাসের শিষ আপনমনেই দাঁতে কাটতে কাটতে বলল, জানি।

তা হলে আপনি কি এটাও জানেন যে গাধারও চারটে পা থাকে, লেজ থাকে তবে শিং থাকে না। রামছাগল ব্যা ব্যা করে ডাকে। গাধা আরও ভয়ংকর জোরে ডাকতে পারে। বলেই বাদল গাধার ডাকের অক্ষম অনুকরণ করে, হি-চ-কা! হি-চ-কা!

উঃ। রূপসা বিরক্ত হয়ে কান চাপা দেয়, জানি তো। বাদলের চোখে দুষ্টুমি, তা হলে আপনি কি এটা জানেন যে দুটোর কোনওটাই উড়তে পারে না! অথবা দুটোর কোনওটারই ডানা নেই…অথবা…!

এবার বুঝতে পারল রূপসা! সে প্রজাপতিকে গাধা আর রামছাগল বলে ফেলায় বাবা তাকে প্যাক দিচ্ছে। ঠোঁট ফুলিয়ে কপট রাগ দেখিয়ে সে উঠে বসে। দুহাত কপালে ঠেকায়! যেন বলতে চাইছে, ঘাট হয়েছে। বাদল হেসে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। মেয়েটা বড় অদ্ভুত। ওর চিন্তাভাবনা দুনিয়াদারির বিপরীত দিকে চলে। বিজ্ঞানী নিউটন গাছ থেকে আপেল পড়তে দেখে কীভাবে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির আবিষ্কার করেছিলেন, গল্পচ্ছলে একবার বলেছিল বাদল। সবটা শোনার পর রূপসার প্রশ্ন, সবই তো বুঝলাম, কিন্তু নিউটন কি আপেলটা খেয়েছিলেন?

বাদল অবাক। বলে কী মেয়ে! সে তোক গিলে বলে, সে কথা তো বইয়ে বলা নেই! বোধহয় খাননি।

রূপসা গাল ফুলিয়েছে, তা হলে তো মস্ত করেছেন। মাধ্যাকর্ষণ আবিষ্কার করতে পারলেন, অথচ এটা আবিষ্কার করতে পারলেন না যে তাজা রসালো আপেল খেতে কত ভাল!

ব্যস। হয়ে গেল। এই ভয়ংকর যুক্তি খণ্ডন করে কার সাধ্যি! বাদল আরও একটু গাঢ় আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরেছে মেয়েকে। মেয়েটা সবদিক দিয়েই অন্যরকম। ওর কথা শুনলে মনে হয় না, মেয়ের বয়েস বারো বছর মাত্র! বয়েসের তুলনায় মনের পরিপক্কতা অনেক বেশি। অথচ দেহের দিক দিয়ে বড় শুকনো শুকনো। গোটা অবয়বের মধ্যে মুখটাই সবচেয়ে আকর্ষণীয়। কণ্ঠা বের করা শুকনো মরুভূমির মতো শীর্ণ শরীরে কে যেন আচমকা একটা মরূদ্যান বসিয়ে দিয়েছে। সজীব চোখদুটো চঞ্চল ভ্রমরের মতোই চতুর্দিকে কী যেন খুঁজে বেড়ায়। যা দেখে তার একেবারে গভীর পর্যন্ত অন্বেষণ না করা অবধি তার শান্তি নেই! বাদল মেয়েকে চম্পক ঈশ্বরী নামেই ডাকে। চম্পক ঈশ্বরীকে সবসময়ই চোখে হারাচ্ছে সে! মেয়ের মা লায়লা মুখে বলে, ঢং! অথচ মনে মনে সেও বাবা-মেয়ের পাগলামিকে যথেষ্টই প্রশ্রয় দেয়।

বাবা…ওই পাখিগুলো কোথায় যাচ্ছে?

বাদল আকাশের দিকে তাকায়। একঝাঁক শঙ্খচিল এই আকাশ থেকে ওই পাড়ের আকাশের দিকে পাড়ি দিয়েছে। সে উত্তেজিত হয়ে বলল, ওই দেখ! ওই দেখ! পাখিগুলো ইন্ডিয়ায় যাচ্ছে। আবার বাংলাদেশে ফিরে আসবে।

রূপসার বড় বড় দুচোখে বিস্ময় উপচে পড়ে, যাঃ, গেলেই হল। ওটা অন্য দেশ না? ইচ্ছে করলেই যাওয়া যায় বুঝি?

সে হেসে ফেলেছে। ভীষণ কোমল অথচ স্নেহমাখা তার হাসিটুকু। মায়াবী চোখদুটো উড়ে যাওয়া পাখির ঝাঁকের দিকে নিবদ্ধ রেখে বলল, ওরা যেতে পারে। ওদের কোনও নির্দিষ্ট দেশ নেই। ওদের একটাই দেশ! পৃথিবী।

রূপসা অবাক হয়ে পাখির উড়ে যাওয়া দেখে। ওদের পাসপোর্ট ভিসা লাগে না?

নাঃ।

বাবা… সে ফের ঘাসের শিষ চিবোতে চিবোতে বলে, হলে সোঁদরবনের বাঘ, পানির কামটদেরও পাসপোর্ট লাগে না?

সর্বনাশ! বাদল উচ্চস্বরে হো হো করে হেসে ওঠে, বাঘ আর কামটকে কি আটকানো যায়? যে আটকাতে যাবে তাকে খেয়ে ফেলবে না? ওরা তো গোটা মানচিত্রই খেয়ে ফেলেছে… যদি এমনভাবে মানুষও মানচিত্র খেয়ে ফেলতে পারত…! বলতে বলতেই উঠে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে ওঠে সে…

“দৃশ্য থেকে দ্রষ্টা অবধি ধারাবাহিকতা খেয়ে ফেলে।
অবশেষে যথাক্রমে খাব: গাছপালা, নদী-নালা,
গ্রাম-গঞ্জ, ফুটপাথ, নর্দমার জলের প্রপাত,
চলাচলকারী পথচারী, নিতম্ব-প্রধান নারী,
উড্ডীন পতাকাসহ খাদ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রীর গাড়ি–
আমার ক্ষুধার কাছে কিছুই ফেলনা নয় আজ।
ভাত দে হারামজাদা, তা না হলে মানচিত্র খাব।”

সে অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার বাবার জন্য গর্ব হয়। এমন বাবা আর কারও নেই। মানুষটার চেহারায়, প্রতি পদক্ষেপে যেন আত্মবিশ্বাস ঝলমলিয়ে ওঠে। যখন জোরালো গলায় কিছু বলে, তখন মনে হয় এটাই দুনিয়ার শেষ কথা!

বাদল বসে পড়েছে। তার চোখদুটো দেখলেই মনে হয় কেউ যেন কাজল দিয়ে এঁকেছে। সবচেয়ে মারাত্মক তার দৃষ্টি। তার চাউনি যতটা যুক্তি বুদ্ধিতে শাণিত, ঠিক ততটাই তেজোদ্দীপ্ত! ছাত্রছাত্রীরা এই তেজ, এই উদ্দীপনা দেখে অবাক হয়ে যায়। অসম্ভব প্রাণবন্ত মানুষটিকে তারা শ্রদ্ধা করে, ভয় পায় আবার ভালবাসে।

বাবা… আচমকা রূপসা উত্তেজিত হয়ে ওঠে ওই দেখো!

মেয়ের চুলে মুখ গুঁজে বলল বাদল, কী? উঁ?

দেখো! ইন্ডিয়া থেকে কুটুম আসছে গো!

বাদল এবার চোখ তুলে তাকায়। সত্যিই কুটুম আসছে। ওদিকে ভারতবর্ষের আকাশে ধূমায়িত হয়ে উঠেছে কালো জলভরা মেঘ। কিউমুলো নিম্বাস! মেঘ ছড়িয়ে পড়ছে এদিকেই। ক্রমাগত কুণ্ডলী পাকিয়ে ভয়াল জাকুটি করে এগিয়ে আসছে এদিকেই। ওপ্রান্তের গাছগুলোর সবুজ রং শুষে নিয়ে মেঘের ছায়া এঁকে দিয়েছে চারকোল ছবি। কালো আকাশের প্রতিবিম্ব পড়ে ইচ্ছামতীর জলও কালো! আকাশটাই যেন নদীতে মিশে গেছে। দূর থেকে কানে এল মাঝিদের গান—

বেলা গেল সন্ধ্যা হইল, কালো মেঘে গগন ছাইল হো-ও-ও-ও!/ ওই দেখ, থাইক্যা থাইক্যা গর্জে দেয়া (মেঘ) তীরের পানে ধাইও/ নাইকা ছৈয়া নাইকা ছানি, ছলাত ছলাত উঠে পানি হো-ও-ও-ও! । তুমি সাবধানে ধরিও হাল কিনার বাঁয়া যাইও। হেঁইও রে হেঁইও…হেঁইও রে হেঁইও…!

রূপসা উত্তেজিত হয়ে উঠে পড়ে। মাঝিদের গান ওর কানে গেছে। উলটোদিক থেকে প্রবল বিক্রমে ঝড় আসছে। সে ঝড়ের দিকেই দৌড়োয়। ওপ্রান্তকে স্তব্যস্ত করতে করতে ঝড় ইচ্ছামতীর ওপরে এসে পড়েছে। সে দুহাত মেলে দিয়ে যেন ঝড়ের সঙ্গে মিশে যেতে চায়! যেন একটা ছোট্ট ঝড় দুহাত বাড়িয়ে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় ঝড়কে স্বাগত জানাচ্ছে। ত্রাহি ত্রাহি করে গাছগুলো এদিক ওদিক মাথা ঝাঁকাচ্ছে। ধুলো ওড়াতে ওড়াতে ঝড় আসছে…এল…এসে পড়ল…!

সামাল সামাল সামাল ওরে সামলে তরী বাইও।

হেঁইও রে হেঁইও…!

ঝড়ের তাণ্ডব আর মাঝিদের গানের সঙ্গে অদ্ভুত ছন্দে নাচতে শুরু করল রূপসা। ও কোনওদিন নাচ শেখেনি। নাচলে ওর কষ্ট হয়। তবু বাদল বারণ করেনি। বড় মনের আনন্দে সে নাচছে। এইটুকু আনন্দ কেড়ে নেওয়ার অধিকার কি ঈশ্বরেরও আছে?

রূপসা হেলেদুলে নাচছিল। এ কোনও শিক্ষিত নাচ নয়। এ নৃত্য সহজাত! নদীর ওপর দিয়ে হু হু করে ঝোড়ো হাওয়া ঝাঁপটা মারছে। হাওয়ার দাপটে রূপসার রেশমি চুল চোখেমুখে এসে পড়ে। ওড়না উড়ছে! চুলের ঝাঁপটে তার মুখ দেখা যায় না। এখন তাকে দেখলে মনে হয় স্বয়ং প্রকৃতি এলোকেশী রূপ ধরে উন্মাদিনীর মতো নেচে বেড়াচ্ছে নদীর পাড়ে।

অদ্ভুত একটা আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে বাদলের মুখ। কাজল কালো চোখে এখন ঝিলমিল আনন্দ খেলে বেড়াচ্ছে। সে মেয়ের নাচের তালে তালে উদাত্ত গলায় গান ধরে, ওরে রে ওরে মাঝি, কোথায় মাঝি,/ প্রাণপণে, ভাই, ডাক দে আজি। তোরা সবাই মিলে বইঠা নে রে,। খুলে ফেল সব দড়াদড়ি…!

সেদিন দুজন খ্যাপা মানুষ ঝড়কে এভাবেই স্বাগত জানিয়েছিল…!

.

০২.

না তো ম্যায় কিসিকা হাবিব হুঁ, না তো ম্যায় কিসিকা রকিব হুঁ,
যো বিগড় গয়া উয়োহ নসিব হুঁ, যো উজড় গয়া উয়োহ দয়ার হুঁ

অনেকদিনের না কাটা দাড়িতে আচ্ছন্ন মুখটায় কোনও কষ্টের চিহ্ন ছিল না। এমন মুখে বোধহয় কোনও অনুভূতিই ছাপ ফেলে না। যন্ত্রণা সইতে সইতে সে মুখ বিষণ্ণ হতে ভুলে গিয়েছে। আনন্দ কাকে বলে, তাও হয়তো মনে নেই। বাদামি চোখদুটো বেশির ভাগ সময়ই ফ্যালফ্যাল করে কী যেন খোঁজে। এই মানুষটার প্রতি জেলার থেকে শুরু করে সামান্য হাবিলদার পর্যন্ত আকর্ষণ বোধ করে। মানুষটার বেদনাদায়ক লড়াইয়ের ইতিহাস সহানুভূতি জাগায় ঠিকই, তার থেকেও বেশি সম্ভ্রম জাগায় তার পরাজয়। এ যেন শেক্সপিরিয়ান ট্র্যাজেডির আরেক নায়ক। বাজে পুড়ে যাওয়া গাছের মতো বিধ্বস্ত, তবুও ঋজু। পরাজিত সৈনিক, তবু নিজের দায়ভার কাঁধে নিয়ে হেঁটে চলেছে। জেলের ছোট্ট কুঠুরিতে সবসময়ই হেঁটে বেড়ায় সে। আজ পর্যন্ত তাকে কেউ বসতে দেখেনি। সবসময়ই ছোট্ট সেলটার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত হেঁটে চলেছে। দেখলে ভয় হয়, বোধহয় কয়েক যুগ ধরে এভাবেই হেঁটে আসছে লোকটা। অথবা এমনভাবেই হেঁটে যাবে আরও কয়েক যুগ। ভুরু কুঁচকে, কপালে ভাঁজ ফেলে কয়েক আলোকবর্ষ ধরে ভাববে সে। ভেবেই যাবে।

মিয়াঁভাই৷

জেলারের গলার স্বরে অন্যমনস্ক চোখদুটো তুলে তাকায় মানুষটা। জেলার চমকে উঠলেন। কী হিমশীতল দৃষ্টি! হিমবাহ নেমে এসেছে ওর চোখ বেয়ে! এর চেয়ে নোনতা গরম জল থাকলে অনেক ভাল হত। এই জেলের অন্য কয়েদিদের দেখলে কিছু মনে হয় না। কিন্তু এই মানুষটার সামনে এসে দাঁড়ালে নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয়। এই কমাসে একেবারে বুড়িয়ে গেছে লোকটা। একমুখ কাঁচাপাকা দাড়ি, আর প্রশস্ত থেকে প্রশস্ততর হয়ে যাওয়া কপালের সঙ্গে চোখদুটোতেও অকালবার্ধক্য স্পষ্ট।

তিনি আড়চোখে খাবারের প্লেটের দিকে তাকালেন। যথারীতি আজও প্লেটের খাবার অভুক্ত পড়ে আছে।

মিয়াঁভাই, আজও খাবার খাননি? জেলার সহানুভূতিমাখা স্বরে মৃদু অনুযোগ করেন।

উত্তরে অদ্ভুত একটা হাসি হাসল সে। টেনে টেনে বলল, কেহ দো ইস হসরতো সে কহি ঔর যা বসে। ইৎনি জাগাহ কঁহা হ্যায় দিল-এ দাগদার মে!/ উ-এ-দরাজ মাঙ্গকে লায়ে থে চার দিন। দো আরজু মে কট গয়ে, দো ইনতেজার মে?

জেলার অসহায়, বিব্রত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। সেদিকে অবশ্য ওর খেয়াল নেই। একটা অদ্ভুত স্মিত হাসি ভেসে উঠেছে ঠোঁটে। এ হাসি হয়তো কান্নার থেকেও করুণ।

বাহাদুর-শাহ-জাফর-এর শায়রি! লোকটা আপনমনেই বিড়বিড় করে, কপালপোড়া আর কাকে বলে! ১৮৫৭ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর, খুনি গেটে লোকটার চোখের সামনে মেজর উইলিয়াম হডস তাঁর দুই ছেলে আর নাতিকে গুলি করে মারল! বাদশাও মৃত্যুর সামনে কী অসহায়! নিজের দেশের মাটিও পেলেন না! সাত বছর ধরে বর্মায় বন্দি ছিলেন। আর এই সাত বছরের প্রত্যেকটা মুহূর্ত ধরে নিজের মৃত্যুকামনা করে গিয়েছিলেন মানুষটা! মরার পরও নিজের দেশে ফিরতে পারলেন না…! কথাটা বলতে বলতেই থমকে গেছে সে। একটু থেমে ফের বলল, রেঙ্গুনেই লোকটার জনাজা হল! তাঁর কবরের ওপর কাঁদার জন্য একটা লোকও ছিল না! ভারতের মুঘলসম্রাট…!

জেলারের মুখে ভয় ছাপ ফেলল। মানুষটা তিনদিন ধরে খায়নি। জেলে আসার পরই নম্রভাবে তাঁর কাছ থেকে মির্জা গালিব, বাহাদুর শাহ জাফরের শায়রির বই আর রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা চেয়ে নিয়েছে। আর চেয়েছিল কিছু আঁকার সরঞ্জাম। জেলার দেখলেন, লোকটা কুঠুরির দেওয়ালে ভারতবর্ষের মানচিত্র এঁকে রেখেছে! একটা নয়, সারা দেওয়াল জুড়ে অগুনতি অবিভক্ত ভারতবর্ষের ম্যাপ! তাঁর বিস্মিত দৃষ্টি লক্ষ করেই হয়তো ফের কথা বলে উঠল মানুষটা। আবার সেই চাপা কান্না হাসি হয়ে ফুটে উঠেছে তার ঠোঁটে, চেষ্টা করছিলাম বাংলাদেশ আর ভারতবর্ষের মাঝখানে এল ও সির দাগটা টানার। কিন্তু কিছুতেই হচ্ছে না! কেন বলুন তো? স্যার সিরিল রেডক্লিফ তো পেরেছিলেন। আমি কেন পারছি না। কিছুতেই হচ্ছে না! কিছুতেই হচ্ছে না!

কিছুতেই হচ্ছে না। শব্দটায় রাগের চেয়ে বুকফাটা কান্নার আভাস বেশি। জেলার মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে নিজের গালেই ঠাস ঠাস করে দুটো চড় মারেন। তবু নিজেকে সংযত রেখে নম্রভাবেই বললেন, খেয়ে নিন মিয়াঁভাই। আমাকে অপরাধী করবেন না।

এতক্ষণে খেয়াল হল তার। কী ভেবে যেন আস্তে আস্তে তুলে নিল খাবারের থালা। ঠান্ডায় নেতিয়ে পড়া খাবার নির্বিবাদে মুখে পুরল। জেলার দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে যাচ্ছিলেন, আচমকা পিছন থেকে ডাক এল, জেলার সাহেব।

তিনি ফিরে তাকান, হ্যাঁ?

আমার রং ফুরিয়ে গেছে। আনিয়ে দেবেন? জেলারের দিকে অনুনয় ভরা দৃষ্টি মেলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল সে। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ফের বলল, এখানে বড় অন্ধকার। একটা জানলা আঁকব পশ্চিমের দেওয়ালে। আপনার আপত্তি নেই তো?

.

দড়াম করে পশ্চিমের জানলাটা খুলে দিল রূপসা!

বাদলের বউ, রূপসার মা লায়লা রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে ওঠে, ওরে, এখনই জানলাটা খুলিস না! মশা খাবে যে! একে তো একটুও খুন নেই শরীরে! যেটুকু বাকি আছে, সেটুকুও যদি মশায় খায়…

ও মা দেখবা আসো! মশার ভয়ে বিন্দুমাত্রও ভীত হল না রূপসা। উলটে চেঁচিয়ে বলল, সূর্যটা কেমন করে ডুবে যাচ্ছে।

লায়লা রান্নাঘরে বসে তরকারি কুটতে কুটতে আপন মনেই গজগজ করে। সূর্য তো রোজই ওঠে। রোজই অস্ত যায়। এতে দেখার কী আছে? যেহেতু বারণ করেছে, সেহেতু জানলাটা খুলবেই মেয়েটা! বয়েসের তুলনায় বড্ড বেশি ছেলেমানুষ। যা নিষেধ করা হবে সেটাই বেশি করে করবে ও!

যাঃ! রূপসা আফশোস সূচক শব্দ করে, নেমে গেল যে!

নেমে গেছে তো বেশ হয়েছে। জানলাটা বন্ধ করে দে।

তার বয়েই গেছে জানলা বন্ধ করতে। সে তিন লাফ মেরে ছুটল নদীর দিকে। হাতে দূরবিন। রোজ তাকে ফাঁকি দিয়ে টুপ করে সূর্যটা নদীর জলে ডুবে যায়। ডুবে যাওয়ার আগে সূর্যটা কমলা হয়ে যায়। কিন্তু ডুবে যাওয়ার সময়ও কি ওর রং অমন কমলা থাকে? না ফ্যাকাশে হয়ে যায়? রূপসার ধারণা ইচ্ছামতীর জল সূর্যের রং শুষে নেয়। সূর্যের রং চুরি করে বলেই তো ওর জল অমন সিঁদুরে আর কমলা রঙে রাঙা হয়! তবে সূর্যটা কি ফ্যাকাশে হয়ে যায় না? দেখতে হবে। দেখতেই হচ্ছে! দেখেই ছাড়বে আজ।

সে পড়িমড়ি করে দৌড়ে পানিত্তারের দিকে ছোটে। দৌড়োতে দৌড়োতে হাঁফায়। হাঁফাতে হাঁফাতে দৌড়োয়। পানিত্তারের কাছে এসে নদী কোমরে বাঁক তুলে চলে গেছে অন্যদিকে। নদীর পাশ ঘেঁষে এক টুকরো মাটি। একদিকে কাঁটাতারের কড়া নিষেধাজ্ঞা। অন্যদিকে ডিভাইডার দুই ভূমিকে আলাদা করে রেখেছে। এদিকটা বাংলাদেশ! আর একহাত দূরেই ভারতবর্ষ!

রূপসা যখন পৌঁছোল, তখন আর সূর্যটাকে দেখা যাচ্ছে না! ব্যাটা বোধহয় ডুবেই মলো! অথচ নদীর জলে তখনও সিঁদুরে কমলা রঙের ঝিলিমিলি! সে দূরবিনটাকে তুলে ধরে। এটা সদ্যই কিনে দিয়েছে বাবা। সেটাকে নাকে ঠেকিয়ে জলের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রূপসা। বাঃ, ভারী মজা তো! সূর্য ডুবে যাওয়ার পরও ইচ্ছামতীর জল কেমন রঙিন হয়ে থাকে। আকাশটাও কেমন গোলাপি রঙের হয়ে যায়। তখন নদীর জলে সিঁদুরে, কমলা, গোলাপি কত রং একসঙ্গে খেলা করতে থাকে। আগে তো কখনও লক্ষ করেনি রূপসা!

এই লড়কি! তুম কৌন হো?

রূপসা চমকে পিছনে ফেরে। কাঁটাতারের উলটোদিকে কখন যেন এক দীর্ঘাকৃতি ভারতীয় সীমান্তরক্ষী এসে দাঁড়িয়েছে। দেখলেই মনে হয়, ওর পূর্বপুরুষ নির্ঘাত কোনওকালে রাজা-গজা ছিল। কাটা কাটা নাকমুখ চোখ। সুঠাম দেহ। রোদে পুড়লেও টকটকে রঙের আভাস স্পষ্ট।

রূপসা মজা করে টুকটুক করে এগিয়ে যায়। তারপর টুক করে একটা পা তুলে এমন ভাব করে যেন এখনই ডিভাইডারের ওপ্রান্তে, ভারতবর্ষে পা রাখবে।

এই! জওয়ান চোখ পাকিয়ে মাথা নাড়ে, নেহি।

সে ফিচফিচ করে হাসতে হাসতে পা সরিয়ে নিয়ে পরমুহূর্তেই ফের পা নামাতে চায় ভারতবর্ষের মাটিতে। ভারী মজার খেলা পেয়েছে। জওয়ান হাউমাউ করে ওঠে, কঁহা না? নেহি! ইধার বিলকুল আসবে না।

বাচ্চা মেয়েটা ফের ফিকফিক করে হাসতে হাসতে ডিভাইডার টপকানোর ভান করে! জওয়ান এতক্ষণে বুঝতে পারে এটা বদমায়েশি হচ্ছে। সে কোনও কথা না বলে রাগী রাগী দৃষ্টিতে দেখতে থাকে। মেয়েটাকে।

রূপসার মনে হল এই মুহূর্তে ওর গায়ে একটা ঝলমলে রাজপোশাক, আর হাতে একটা তলোয়ার ধরিয়ে দিলে মন্দ হয় না! ভাবতেই ভারী হাসি পেয়ে গেল। প্রথমে একটা মৃদু হাসি উঁকি মারল তার ঠোঁটে। পরক্ষণেই ফিকফিক করে হাসতে শুরু করেছে।

হসতি হ্যায়! জওয়ান বেচারি হতভম্ব, কিঁউ হাসচ? হামি কী জোকার বনে গেছি!

কপাল আমার! হাসতে হাসতেই কপাল চাপড়ায় রূপসা, কথা শোনো! তুমি খামোখা বনে যাবা কেন? দিব্যি তো সামনে দাঁড়িয়ে আছ! এটা বন নয়। আমিও বাঘ-ভালুক নই। আমি মানুষ।

উত্তর শুনে জওয়ানের চোখ ছানাবড়া, ক্যায়া?

আমাদের গ্রামের আনিসুরভাই থাকলে কী বলত জানো? সে নিজের চুল আঙুলে জড়াতে জড়াতে বলে, বলত, মাউড়াটা যে কী ক্যাঁ ক্যাঁ করে কিস্যু বুঝি না। তুমি কি মাউড়া?

অগত্যা বাক্যালাপে ক্ষান্ত দিয়ে জওয়ান গটগট করে নিজের রাস্তা ধরে। রূপসা ভারী মজা পেয়েছে। সেও এপ্রান্ত থেকে লোকটার পিছনে ধাওয়া করে। অদ্ভুত ব্যাপার! মাঝখানে অদৃশ্য বর্ডার। তার দুপাশ দিয়ে দুটো মানুষ পাশাপাশি চলেছে৷ রূপসা চলতে চলতেই বকবক করতে শুরু করে তার মুন্ডুভোজন পর্ব।

আচ্ছা, তুমি কে? আমার নাম রূপসা, তোমার নাম কী গো?

জওয়ান তার দিকে তীব্র বিরক্তিমাখা দৃষ্টিতে একবার তাকায়। পরক্ষণেই হাঁটার গতিবেগ বাড়িয়ে দেয়।

আরে…আরে… রূপসা প্রাণপণে দৌড়োচ্ছে, এত জোরে জোরে হাঁটছ কেন? এমন দুম্বা দুম্বা পা ফেললে আমি কি পারি?

জওয়ান কথা শোনে না। আরও জোরে হাঁটতে শুরু করে। এ কী বিষম আপদ পেছনে পড়েছে! একেই মেজাজ খিঁচড়ে আছে। সে রাজস্থানের লোক। আগে রাজস্থানের বর্ডারেই তার পোস্টিং ছিল। চিরকাল বালি দেখেই অভ্যস্ত। তাকে কিনা পাঠিয়ে দেওয়া হল এই খাল বিলের দেশে! প্রায় বছরখানেক হল নিজের ঘর-পরিবারের মুখ দেখেনি। তার ওপর বালির দেশের মানুষ হয়ে চতুর্দিকে জল দেখে দেখে তার চিত্ত বিকল হতে চলেছে। এই মুহূর্তে তাই একদম খোশগল্প করার মেজাজে নেই। সে থমকে দাঁড়িয়ে বলল, পিছা মৎ করো। আপনি রাস্তা মাগো! বলেই ফের হনহন করে হাঁটা লাগিয়েছে।

অ্যাঁ? কী? রাস্তা মাপব! এত বড় রাস্তা একা কী করে মাপব? পাশ থেকে মিনতিভরা সুর ভেসে আসে, এই যো! শোনো না! একটু দাঁড়াও না…!

রূপসা দরদর করে ঘামছিল। লোকটার পাশাপাশি দৌড়োতে তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে! গোড়ালি, পায়ে, তলপেটে খিঁচ ধরেছে। দম যেন বন্ধ হয়ে আসে। কষ্টে তার মুখ লাল হয়ে উঠল। দম টানতে পারছে না। সব ঝাপসা হয়ে আসছে…কয়েক মুহূর্তের জন্য যেন সব আলো নিভে গেল…! একটা কালো পরদা ঝুপ করে পড়ে গেছে চোখের সামনে! সে হাত বাড়িয়ে জওয়ানটিকে থামতে বলতে চায়। কিন্তু তার আগেই…

আঃ!

অস্ফুট কাতরোক্তি করে ছোট মানুষটা লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। জোরে জোরে শ্বাস টানছে কিন্তু পারছে না! অসহ্য যন্ত্রণায় ধড়ফড় করছে মেয়েটি…!

ভারতীয় জওয়ান কাতর শব্দটা শুনে পিছনে তাকায়। রূপসাকে লুটিয়ে পড়তে দেখে সেও ভয় পেয়ে গেছে। নিজের বর্ডারের চিন্তা তার মাথায় উঠল! এস্তব্যস্ত হয়ে ছুটে গেল যন্ত্রণাকাতর মেয়েটির উলটোদিকে।

এই!… এ গুঁড়িয়া! ক্যায়া হুয়া? সে তাড়াতাড়ি রূপসাকে টেনে নেয় ডিভাইডারের ওপরে। এই মুহূর্তে বাচ্চা মেয়েটা শুয়ে আছে ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তরেখায়। এই মুহূর্তে সে কোনও দেশে নেই।

বাংলাদেশে, না ইন্ডিয়ায়! রূপসা তখন নেতিয়ে পড়েছে। একটু অক্সিজেনের জন্য ছটফট করছে! জওয়ান ঘাবড়ে গিয়ে তার মুখে আলতো চাপড় মারে। কিন্তু কোনও সাড়া নেই! বুকের ওপর হাত দিয়ে চাপ দিতে দিতে আর্টিফিশিয়াল ব্রিদিং দেওয়ার চেষ্টা করছে। যদি ছোট্ট মানুষটাকে কোনওভাবে একটু অক্সিজেন দেওয়া যায়। ব্যাকুলভাবে বলে, লাডো, ক্যায়া হুয়া?… গুঁড়িয়া!… উঠো… উঠ বেটা! বলতে বলতেই পাগলের মতো দৌড়োতে দৌড়োতে ক্যাম্পের দিকে গেল। পরমুহূর্তেই একটা জলের বোতল নিয়ে ফিরে এসেছে। চোখে মুখে জলের ঝাঁপটা দিতে দিতে তার ছোট্ট হাতে নিজের হাত ঘষতে ঘষতে বলে, হে ভগওয়ান! ক্যায়া হো গয়া ইসকো! অব ক্যায়া করু! গুঁড়িয়া!…এ গুড়িয়া…!

বেশ কয়েকবার জলের ঝাঁপটা দেওয়ার পর কাজ হল না। বেচারি জওয়ান কী করবে ভেবে পায় না। কী হল! ওদিকে পেট্রোলিং-এর সময়ও হয়ে গেছে। কিন্তু কী করে যাবে? মেয়েটাকে এভাবে একা ফেলে যাওয়া যায়? কী করবে বুঝতে না পেরে, স্তব্যস্ত হয়ে হয়তো নিজের সঙ্গীসাথিদের ডাকতেই যাচ্ছিল। এমন সময় আচমকা দেখল, তার গুড়িয়া একচোখে মিটমিটিয়ে তাকাচ্ছে! চোখে চোখ পড়তেই পুট করে চোখ বুজে ফেলে সে! ভারতীয় জওয়ান মুখভঙ্গি করে। আচ্ছা, তবে বদমায়েশি হচ্ছে। সে এবার চটেমটে বলল, গুড়িয়া, আঁখে খোলো। নেহি তো হামি চলা যায়েগা।

এবার চোখ মেলল রূপসা। শীর্ণ মুখ ঝলমলিয়ে উঠল হাসিতে। তার দুষ্টু হাসি দেখে জওয়ান রাগতে গিয়েও পারল না। ফিক করে হেসে বলে, বদমাশ লড়কি! শয়তানি করছিস তুমি!

রূপসা উঠতে গিয়েও পারল না। এখনও তার হাত-পা কাঁপছে। তবু এত কষ্টেও হাসি পেল। সেও হেসে বলে, ঠিক ধরেছি, তুমি মাউড়া!

জওয়ান আধো আধো বাংলায় বলে, ঔর তুম্ দুট্টু।

রূপসা তার গাল টিপে দেয়, তুমি খুব মিষ্টি।

ক্যায়া? সে চোখ গোলগোল করেছে, মিট্টি?

না রে বাবা! মিট্টি নয়, মিষ্টি। তুমি মিষ্টি।

জওয়ান মুখ গম্ভীর করে বলে, নেহি, তুমি মিট্টি।

না, তুমি।

নেহি, তুমি মিট্টি, তুমি মিট্টি, তুমি মিট্টি…!

সেই থেকে রূপসার আরেকটা আদরের নাম হল। মিট্টি–মানে মাটি।

.

০৩.

আমি বাংলায় গান গাই, আমি বাংলার গান গাই,
আমি আমার আমিকে চিরদিন এই বাংলায় খুঁজে পাই
আমি বাংলায় দেখি স্বপ্ন, আমি বাংলায় বাঁধি সুর
আমি এই বাংলার মায়াভরা পথে হেঁটেছি এতটা দূর
বাংলা আমার জীবনানন্দ, বাংলা প্রাণের সুখ
আমি একবার দেখি, বারবার দেখি, দেখি বাংলার মুখ

সেলের ভেতর থেকে একটা মৃদু সুর ভেসে আসছে। জমাদার ঝাঁট দিতে দিতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। সবে ভোর হয়েছে মাত্র। এখনও সব কয়েদির ঘুম ভাঙেনি। এমন সময় কে গান গায়?

সে কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে যায়। গানের সুরটা ডানদিকের সেল থেকে ভেসে আসছে৷ কে যেন মৃদু, অথচ বড় মধুর কণ্ঠে একমনে গান গেয়ে চলেছে। জমাদার বিস্মিত দৃষ্টিতে দেখে, সেই লোকটা চোখ বুজে গান গাইছে। সবাই বলে, ওর মাথাটা বিগড়ে গেছে। কখনও পাগলের মতো দেওয়ালে ভারতবর্ষের ম্যাপ আঁকে, কখনও উদাত্ত কণ্ঠে কবিতা আবৃত্তি করে। ও কোনও কথা বলে না। জেলার সাহেবের সঙ্গেই যা দু-একটা কথা বলে। কখনও খাবার খায়, কখনও খেতে ভুলে যায়। সারারাত ঘুমোয় না। খালি হেঁটে বেড়ায়।

জমাদার লোহার গরাদের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারল! অতি সন্তর্পণে ভিতরের দৃশ্যটা দেখে! লোকটা নতজানু হয়ে বসেছে পশ্চিমদিকে মুখ করে। পশ্চিমদিকের দেওয়ালে একটা জানলা আঁকা। সেই জানলার ফাঁক দিয়ে যেন সূর্য উঠছে। লোকটার বসার ভঙ্গি নামাজ পড়ার মতো হলেও সে আদৌ নামাজ পড়ছে না! বরং জানলার দিকে তাকিয়ে কার উদ্দেশে যেন গেয়ে চলেছে… সেলের স্বল্প পরিসরে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে তার কণ্ঠ

আমি বাংলায় কথা কই, আমি বাংলার কথা কই
আমি বাংলায় ভাসি, বাংলায় হাসি, বাংলায় জেগে রই
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখেশুনে খেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার
বাংলা আমার দৃপ্ত স্লোগান, ক্ষিপ্ত তির ধনুক,
আমি একবার দেখি, বারবার দেখি, দেখি বাংলার মুখ।

লোকটার মুখে অদ্ভুত স্বর্গীয় হাসি। আচমকা জমাদারের মনে পড়ে যায়, সেও বাঙালি। তার গায়ে কাঁটা দেয়। ঝট দিতে ভুলে গিয়ে সে একমনে গান শুনে যায়…! নিশ্চল, নিথর!

গানটা শেষ করে সুদীপ্তবাবু লাজুকভাবে উপস্থিত শ্রোতাবৃন্দের দিকে তাকালেন। সুদীপ্ত চৌধুরী ভারতবর্ষের মানুষ। লায়লা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ভারী সুরেলা মিষ্টি গলা ভদ্রলোকের। তিনি বাদলের স্কুলের হেডমাস্টার হেমন্তবাবুর বাল্যবন্ধু। টাকিতে থাকেন। কিছুদিনের জন্য বেড়াতে এসেছেন এখানে। হেমন্তবাবু রূপসাকে বড় ভালোবাসেন। সে অসুস্থ শুনে দেখা করতে এসেছেন, সঙ্গে বন্ধুটিকেও নিয়ে এসেছেন।

রূপসা তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে উঠে বসেছিল। তার চোখের তলায় কালির পোঁচ। স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তার দিদিমণি বলেছেন, বিশ্রাম দরকার। দৃষ্টি ক্লান্ত, তবু সপ্রতিভ। আস্তে আস্তে বলল, বেশ তো গানটা! দাদাভাই, তোমার ওই হাউমাউ বিলম্ব-টিলম্বের চেয়ে এই গান ঢের ভাল!

রূপসা হেমন্তবাবুকে দাদাভাই বলেই ডাকে। হেমন্তবাবু আবার শাস্ত্রীয় সংগীতের বড় অনুরাগী। রূপসাকে একবার দরবারির ওপরে একটা বিলম্বিত গ্রামাফোনে শুনিয়েছিলেন। রূপসা বার দুয়েক হাই তুলে ঘুমিয়ে পড়েছিল! সেই বিখ্যাত বিলম্বিতকেই সে বিলম্ব নাম দিয়েছে।

হেমন্তবাবু হেসে উঠেছেন, অমন বলে না। তোর এখনও বিলম্বিতের রস বোঝার বয়েস হয়নি রে দিদিভাই। যখন বুঝবা, তখন ছাড়তেই চাইবা না!

ছাড়তে তো তোমার বিলম্ব চায় না! তার চোখে ফের দুষ্টুমি উঁকি মারছে, আমি বাংলায় গান গাই– এই লাইনটা তোমার বিলম্বে কীভাবে গাওয়া হবে জানো? সকালবেলায় আমি দিয়ে শুরু হবে। বাংলায় পৌঁছাবা সে-ই ভরদুপুরে! গান-এ হয়তো মধ্যরাতে বা পরদিন ভোরে পৌঁছাবা! আর গাই কখন বেরোবে বলতে পারছি না! এর মাঝখানে শুনবা খালি হাউমাউ আঁউ আঁউ! যেন কুকুরে-বিড়ালে ঝগড়া লেগেছে।

সকলেই সমস্বরে হেসে ওঠেন। রূপসা এবার সুদীপ্তবাবুর দিকে ঝুঁকে পড়েছে।

আচ্ছা, তুমি তো ইন্ডিয়ায় থাকো!

হ্যাঁ মা। আমি টাকি-তে থাকি।

টাকি! রূপসা মুখভঙ্গি করে, কী বিচ্ছিরি নাম! শুনলেই কেমন টাকটাক মনে হয়!

ভদ্রলোক সজোরে হেসে নিজের কেশবিরল মাথাটা দেখালেন, ঠিকই বলেছ মা। এই যে! যেমন ঢাকির ঢাক বিখ্যাত, তেমনি টাকির টাকও খুব বিখ্যাত!

আচ্ছা! রূপসা কৌতূহলী, তবে ইন্ডিয়ায় থেকে তুমি এত ভাল বাংলা বলো কী করে?

সুদীপ্তবাবু হেসে ফেললেন, ইন্ডিয়ায় থাকি তো কী হয়েছে? আমিও তো বাঙালি। বাংলাই তো আমার মাতৃভাষা।

রূপসা অবাক!

তুমি ইন্ডিয়ার লোক না? ইন্ডিয়ার জাতীয়ভাষা তো হিন্দি। আমি ভূগোলে পড়েছি।

ভদ্রলোক হো হো করে হেসে উঠলেন। হেমন্তবাবুও হাসছেন।

খুকি। তাকে একটু আদর করে বলেন সুদীপ্ত, একসময় আমি তো এখানেই ছিলাম। এটাই আমার দেশ ছিল। তোমার এই হেমন্তদাদুর সঙ্গেই একসাথে কত খেলা করেছি। আমার কাকু থাকত টাকিতে। আর আমাদের বাড়িটা ঠিক হেমন্তদাদুর বাড়ির পাশে ছিল।

তবে এখন? তার অবুঝ প্রশ্ন, এখন কেন এখানে থাকো না?

প্রশ্নটা শুনে হেমন্তবাবুর মুখ বিষণ্ণ হয়ে যায়। বাদল সেটা লক্ষ করেই বলে ওঠে, চম্পক ঈশ্বরী! ওই যে এক সাহেবের গল্প বলেছিলাম না আপনাকে?

যে দুষ্টু লোকটা বাংলা ভাগ করে দিয়েছিল? রূপসা বলল, তা হলে ওপারেও সবাই বাংলায় কথা বলে? সবাই আমাদের মতো করেই কাপড় পরে? বাংলা গান গায়?

নিশ্চয়ই। বাদল তার কথাকে সমর্থন করে, আমরাও তো একসময় ওপারেই থাকতাম। আমাদেরও বাড়ি ওখানে ছিল। দাঁড়া…!

সে উত্তেজিত হয়ে ভিতরে নিজের পড়ার ঘরে চলে যায়। তার পড়ার ঘরটাতে শেষ কবে ঝাঁট পড়েছিল কে জানে। চতুর্দিকে ধুলো আর ঝুল! মাকড়শা, উইপোকা আর আরশোলা মহানন্দে বিচরণ করে চলেছে। বহুদিনের জমানো কাগজের স্তূপ প্রায় সিলিং ছুঁয়ে ফেলেছে। তার তলায় আকবরি আমলের টিনের ট্রাঙ্ক। বাদল পুরনো ট্রাঙ্কটা খোলে। বহুদিনের পুরনো দলিল-দস্তাবেজে ঠাসা ট্রাঙ্কটা। এসব বাদলের দাদামশাইয়ের আমলের কাগজ। উইপোকা প্রায় অর্ধেকটাই কেটে ফেলেছে। তবু মলিন কাগজগুলো পরম মমতায় তুলে নেয় বাদল। ছেলেমানুষের মতো গন্ধ শুঁকছে সে। ইতিহাসের গন্ধ! হলদে হয়ে যাওয়া ক্ষয়িষ্ণু কাগজে এখনও অক্ষরগুলো জ্বলজ্বল করছে।

আসসালাম আলেকুম ভাইজান,

আশা করি সব কুশল। আমরা কোনওক্রমে প্রাণ ধারণ করিয়া আছি। দাঙ্গা ক্রমাগতই ভয়াল রূপ ধারণ করিতেছে। হিন্দু পরিবারেরা এ পোড়ার দেশ ছাড়িয়া চলিয়া যাইতেছে ইন্ডিয়ায়। ওদেশটাকে ইন্ডিয়া বলিতে বড় কষ্ট হয় দোস্ত! তবু এটাই সত্য। সত্য যতই পীড়াদায়ক হউক, মানিয়া লইতেই হইবে! কল্য বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী দাদাভাই এ দেশ ছাড়িয়া সপরিবারে রওনা দিলেন ইন্ডিয়ার দিকে! উহাদিগকে বড় কষ্টে কদিন আমাদের বাড়িতেই লুকাইয়া রাখিয়াছিলাম। দুষ্কৃতীরা খোঁজ না পাইয়া উহাদের বাড়ি দখল করিয়া লইয়াছে। গোস্বামীদের পবিত্র তুলসীমঞ্চে প্রস্রাবাদি করিয়া, মঞ্চ ভাঙিয়া, নৃত্য করিয়াছে। ইহার পর পবিত্র রাধাকৃষ্ণের মূর্তি বাহির করিয়া, উহাদিগের পবিত্র পুঁথি, ধর্মগ্রন্থাদি বাহির করিয়া, প্রস্রাব করিয়া আগুন ধরাইয়া দিয়াছে। অতঃপর উহাদের ঘর দখল করিয়া শত্ত্বরের ব্যাসাত আখ্যা দিয়াছে। একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান হিসাবে পরধর্মের এইরূপ লাঞ্ছনা দেখিয়া যত না ভীত হইয়াছি, লজ্জিত হইয়াছি তাহার চতুগুণ। এবং বুঝিয়াছি দুষ্কৃতকারীদের কোনও ধর্ম নাই। উহারা হিংসা নামক ধর্মের পূজারি। মাঝেমধ্যে ভাবি, এই ধ্বংসের কি শেষ নাই?…।

এই অবধি শুনেই রূপসা ভয় পায়। কী নির্মম! তার চোখের সামনে যেন দৃশ্যগুলো জীবন্ত হয়ে উঠে আসছে। ওই তো…! একটা ঘর জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে গেল… চতুর্দিকে সব নরনারী প্রাণভয়ে ছুটোছুটি করছে… তাদের পেছনে দা হাতে দুবৃত্ত…!

সে ভয়ে বাদলের হাত চেপে ধরে। লোকগুলোকে নিজের দেশের মাটি থেকে এইভাবে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাকেও যদি কেউ এখান থেকে তাড়িয়ে দেয়…? শিউরে উঠে মেয়েটি মায়ের বুকে মুখ লুকিয়েছে…! অদ্ভুত আশঙ্কায় আশ্রয় খুঁজছে! বিড়বিড় করে বলল, আমি বাংলা ছেড়ে কোথাও যাব না… কোথাও না!

সম্মানীয় বৈষ্ণবপরিবারের এইরূপ দুর্দশা দেখিয়া তাহার পার্শ্ববর্তী হিন্দুগণ পলায়ন করিতেছে। বাবু অধর দত্ত, চাটুজ্যেমশাই ইহাদের সঙ্গে চণ্ডীমণ্ডপে বসিয়া কত শাস্ত্র আলোচনা করিয়াছি, মুসলমান ধর্মের গুঢ় তত্ত্বকথা ইহাদের মুখ হইতে শুনিয়া জ্ঞানার্জন করিয়াছি। বুঝিয়াছি সব ধর্মের যোগসূত্র একই ঈশ্বরের দিকে ধাবমান হয়। উন্নত মেধা, উচ্চ শিক্ষা সম্পন্ন হিন্দুরা, বা বলিতে পারা যায় ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সমগ্র উন্নত বাঙালি দেশ ছাড়িয়া চলিয়া যাইতেছে। এক্ষণে লক্ষ্মী সরস্বতী দুই-ই তাড়াইলি– মহাজনের এই কথাটির সত্যতা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করিতে পারিতেছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে কখনওই উহাদের হিন্দু পণ্ডিত ভাবি নাই, বরং শিক্ষিত মার্জিত বাঙালি ভাবিয়াছি। আর ভাবিব না। তুমিও হুগলিস্থিত প্রতিবেশী হিন্দুদের আত্মীয় ভাবিয়ো না। ইহাই আমাদের অদৃষ্টের পরিহাস!

আমি ঠিক জানি না, তোমাদের হুগলি প্রদেশে, রাঢ়বঙ্গে কী হইতেছে। তবে যাহাই হউক, স্পষ্ট বুঝিতে পারিতেছি সমগ্র বাঙালি জাতি দুইটি নির্দিষ্ট ভাগে ভাগ হইয়া গেল। বাঙালি বলিতে আর কেহ রহিল না। রহিল হিন্দু, এবং রহিল মুসলমান। এই সত্য আমাকে এতই মর্মাহত করিতেছে যে তাহা ভাষায় প্রকাশ করিব এমন ক্ষমতাও হারাইতেছি। তাই আমার পরামর্শ এই, তোমাকেও হয়তো দেশ ছাড়িতেই হইবে। তাহা যত তাড়াতাড়ি হয় ততই মঙ্গল। কারণ স্বদেশে লাঞ্ছনা সহিবার হইতে বিদেশে সম্মানীয় হওয়া বাঞ্ছনীয়। আমি এখন আশঙ্কা করিতেছি, বিজয়কৃষ্ণের মতো তোমাদিগের ঘরও হিন্দুরা প্রতিশোধস্পৃহায় জ্বালাইয়া না দেয়! পূত পবিত্র ধর্মের নামে দুর্ভাগা বাঙালিরা আজ সর্বত্র উদ্বাস্তু হইতেছে।

আশা করি, আমার এই পত্র উপদেশ হিসাবে লইবে না। বরং বন্ধুকৃত্য ভাবিয়ো। আল্লাহ-এর কৃপায় ভাবিজান আর তোমার সন্তানাদিরা সুস্থ থাকুক। পত্রের উত্তর আশা করি।

সালাম

তোমার দোস্ত আব্দুল গণি

পুনশ্চ–দেশ ছাড়িয়া যাইবার আগে বিজয়কৃষ্ণ দাদাভাই একটি প্রশ্ন করিয়াছিলেন। ব্যাকুল কণ্ঠে বলিয়াছিলেন, আজন্ম এই দেশে কাটাইয়া দিলাম। এই মাটিতে খেলা করিয়া, এই দেশের ভাষায় কথা বলিয়া, পদ্মার জলে স্নান করিয়া বড় হইয়াছি। আজ শুনিতেছি আমার দেশ, আর আমার নহে। ইহা এক্ষণে মুসলিম রাষ্ট্র হইয়াছে! পিতৃ পিতামহের মাটি আর আমার নাই। আর যে দেশটাকে কখনও চক্ষে দেখি নাই, তাই নাকি অধুনা আমার দেশ হইয়াছে! যে দেশ আপন ছিল, তাহা আজ কেন আমার নহে? আর যে মাটিকে বিভুই বলিয়া জানিয়াছি সেই দেশ কেমন করিয়া আমার হয় বলিতে পারো?

বলাই বাহুল্য, এ প্রশ্নের কোনও সদুত্তর আমি দিতে পারি নাই।

আচমকা বাদলের চোখের সামনে ভেসে উঠল অদ্ভুত এক দৃশ্য। ঝাপসা ঝাপসা…ছেঁড়া ছেঁড়া কতগুলো ছবি আচমকা বালক বয়েসে দাদামশাইয়ের কাছে শোনা গল্প থেকে জীবন্ত হয়ে ফিরে এল মুহূর্তের জন্য…

হুগলি জেলার ভাগীরথীর পাড়… ছোট্ট মাটির বাড়ি… কয়েকজন পুরুষের পিছনে কয়েকজন নারী শিশুদের হাত ধরে চলেছে…। বাড়ির ছাগলটা আচমকা কামড়ে টেনে ধরল কীর শাড়ি!.. নারীটি কেঁদে ফেললেন।… ছাগলটাকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে করতে তাঁর চোখ বেয়ে জল পড়ছে…! পুরুষেরা নির্বাক। প্রত্যেকটা মুখই বিষণ্ণ…।

ও-ও-ও মাঝি-ভাই! কো-ও-থা-আ-আ যা-আ-আ-ও?

কুয়াশায় ঢাকা নদীবক্ষ! উলটোদিকের নৌকো থেকে ভেসে এল। প্রত্যুত্তর–ইন্ডিয়া যাইতাছি ই-ই-ই! তুমি কই-ই-ই-ই?

পাকিস্তা–ন!

নৌকোয় তিলধারণের জায়গা নেই। নৌকোভরতি বাঙালি মুসলমান পরিবার চলেছে পূর্ব পাকিস্তানের দিকে। উলটোদিক থেকেও নৌকোর দল চলেছে তথাকথিত ইন্ডিয়ার অভিমুখে। সেই নৌকোর যাত্রী হিন্দু উদ্বাস্তু পরিবার। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকলেরই মুখে আতঙ্ক! কোথায় যাচ্ছে জানে না! অনির্দিষ্টের দিকে চলে যাওয়া মুখগুলোয় যেন জীবনের ছাপ অবশিষ্ট নেই। শিকড় ছিঁড়ে যাওয়া গাছের মতোই মুহ্যমান তারা…!

চিঠিটা পড়তে পড়তেই বাদলের চোখদুটো স্বপ্নাচ্ছন্ন হয়ে এসেছিল। এখন চোখদুটোর কোণে জল চিকচিক করছে। সে পড়া শেষ করে থামল। ঘরে তখন পিনপতনের স্তব্ধতা। রূপসা লায়লার বুকে মুখ লুকিয়ে আছে। হেমন্তবাবু মুখ নিচু করে কী যেন ভাবছেন। সুদীপ্তবাবু জানলার বাইরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাকিয়ে থাকতে থাকতেই মৃদু কম্পিত স্বরে গান ধরলেন–

আমি বাংলায় ভালবাসি, আমি বাংলাকে ভালবাসি
আমি তারই হাত ধরে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে আসি
আমি যাকিছু মহান বরণ করেছি বিনম্র শ্রদ্ধায়
মেশে তেরো নদী সাত সাগরের জল গঙ্গায় পদ্মায়
বাংলা আমার তৃষ্ণার জল তৃপ্ত শেষ চুমুক
আমি একবার দেখি, বারবার দেখি, দেখি বাংলার মুখ।

কী এক অদ্ভুত যন্ত্রণায় রূপসার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। ওইটুকু মেয়ে কী বুঝল কে জানে! কিন্তু কাঁপাস্বরে বারবার গেয়ে উঠল গানের শেষ কলিটা– আমি একবার দেখি, বারবার দেখি, দেখি বাংলার মুখ…আমি একবার দেখি, বারবার দেখি…

.

০৪.

তা হলে স্বীকার করছেন যে আপনাদের জ্ঞাতসারেই এই বেআইনি অনুপ্রবেশ ঘটে চলেছে? অন্তত মুনতাসীর চৌধুরী বাদলের ঘটনা তাই বলে! একটা পরিবার দিব্যি বর্ডার ক্রস করে গেল, এতদিন এখানে থাকল, অথচ দু দেশের জওয়ানরা কেউ জানতে পারল না! এটা কি আদৌ সম্ভব? না যেমন গোরু পাচার, মেয়ে পাচারের র‍্যাকেটে দুই পাড়ের সীমান্তরক্ষীদের সেটিং থাকে, তেমনি কাঞ্চনমূল্যে এখানেও সমঝোতা হয়েছে?

এতক্ষণ ভারতীয় বি এস এফ এর আই জি মি. ভার্মা শান্তভাবে প্রশ্নবাণের মোকাবিলা করছিলেন। এক সাংবাদিকের প্রশ্নে এবার হঠাৎ খেপে গেলেন। উত্তেজিত হয়ে বললেন, তখন থেকে খালি বর্ডার বর্ডার করে চলেছেন, কোন বর্ডারের কথা বলছেন মশাই? এটা একটা বর্ডার? কী ধরনের বর্ডার? একই জমি, একই নদী-নালা-খাল-বিল, একই রকম মানুষ, তাদের ভাষাও এক! কথা নেই বার্তা নেই মর্জিমতো মাঝখানে একটা লাইন টেনে দিলেই বর্ডার হয়ে গেল? ফাজলামি? এটা একটা অ্যাবসার্ড বর্ডার! জোর করে চাপিয়ে দেওয়া এল ও সি!

তার মানে আপনি বলতে চান যে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তটা অ্যাবসার্ড?

কেন? আই জি ভুরু কুঁচকে সাংবাদিকটির দিকে তাকালেন, আপনার বুঝি তা মনে হয় না? আমার তো শুধু অ্যাবসার্ড নয়, রিডিকুলাসও মনে হয়! জাস্ট একটা নোংরা রাজনৈতিক ঠাট্টা! আপনিই বলুন, ওই সীমান্তবর্তী গ্রামের মানুষগুলো কী করবে? তাদের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রই ভরসা! যদি আরও সিরিয়াস কন্ডিশন হয় তবে সাতক্ষীরা মেডিক্যাল কলেজ অবধি দৌড়োনো ছাড়া উপায় নেই! নিতে নিতেই পেশেন্ট শেষ হয়ে যাবে! অথচ ইচ্ছামতী পেরোলেই এদিকে টাকি শহর। হাতের এত কাছে ভাল হাসপাতাল। অথচ চলে আসার উপায় নেই! আপনাদের রিডিকুলাস এল ও সি মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। এই পরিস্থিতিতে একটা মানুষ কী করবে? আপনিই বলুন না। কী করবেন? যদি চোখের সামনে আপনার সন্তান মৃত্যুমুখী হয়ে পড়ে, সে আস্তে আস্তে নেতিয়ে পড়ে, ইমিডিয়েটলি চিকিৎসা শুরু না করলে সে মরে যাবে, এই পরিস্থিতিতে কি নিয়ম মেনে সাতক্ষীরা অবধি ছুটে যাবেন? ভারত থেকে ভিসা আসার অপেক্ষা করবেন? না সমস্ত নিয়ম ভেঙে তাড়াতাড়ি এপাড়ে টাকি শহরে নিয়ে আসবেন? তখন যদি সীমান্তরক্ষী আপনাকে আটকায়– সেটা কি খুব মানবিক মনে হবে?

সাংবাদিকটির মাথা নত হয়ে আসে। তার দিকে হিমশীতল দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে আই জি বলেন, বর্ডার! মাই ফুট! জানেন সীমান্তরক্ষীদের ওপর কী পরিমাণ চাপ? কিছু হলেই আপনারা আমাদের দিকে আঙুল তোলেন! বু-ল শিট! সীমান্তরক্ষীরা কি রোবট? তাদের মানবিকতা নেই? ওদের দিকে আঙুল না তুলে সেইসব অমানুষগুলোর কথা ফাঁস করতে পারেন না, যারা এই অ্যাবসার্ড বর্ডারটা টেনেছিল?

মুহূর্তে ভিড়টা নিস্তব্ধ হয়ে গেল। আই জি একবার জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে গটগট করে হেঁটে চলে গেলেন নিজের অফিসে।

অর্জুন সিং রাওয়াত নিঃশব্দে তাঁর চলে যাওয়া দেখছিল! তার দৃষ্টি অন্যমনস্ক। কী যেন ভাবছে। সে বাংলা পরিষ্কার করে বলতে পারে না। কিন্তু দিব্যি বোঝে। আই জি সাহেবের কথাগুলো বুঝেছে। সে জানত, কত বড় সত্যি কথা বলছেন ডি আই জি! সীমান্তরক্ষীরা রোবট নয়… তারাও মানুষ! তার হাত আচমকা বুকপকেট স্পর্শ করেছে। বুকপকেট থেকে সে যেন কী এক ঘোরে বের করে আনল একটা রুমাল।

সাদা রুমালটার বুকে বাহারি সুতোয় ফুলকাটা নকশা করা! একপাশে সবুজ রঙের সুতোয় জ্বলজ্বল করছে কয়েকটা শব্দ।

আমার মিতা।

.

কেসরিয়া বালম, আও নি, পধারো মাঢ়ে দেস…

অর্জুন সিং রাওয়াত অবসরসময়ে সংগীত চর্চা করছিল। শুধু সংগীত নয়, তার সঙ্গে খইনিচর্চাও চলছিল। যখনই তার নিজের পরিবারের কথা মনে পড়ে, মন খারাপ হয়, তখনই টুক করে চলে আসে পানিত্তারের বর্ডারে। কাঁটাতারের এপ্রান্তে এখানে দাঁড়িয়ে সে সূর্যাস্ত দেখে। অবশ্য সূর্যাস্ত দেখাই একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। সে জানে এই সময়ে মিট্টিও আসবে ওদিকে। কাঁটাতারের উলটোদিকে ঠিক এসে দাঁড়াবে পুঁচকি মেয়েটা। মিট্টি ভারী সুন্দর মেয়ে। তারও প্রায় এই বয়েসি একটা মেয়ে আছে। মিট্টিকে দেখলে তার কথাই মনে পড়ে যায়। ভাল লাগে। কিছুক্ষণের জন্য বুকটা পিতৃস্নেহে ভরে যায়। কখনও এই দুই বিজাতীয় মানুষ নীরবে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখে। কখনও খুনসুটি করে। আবার কখনও একজন ভারতীয় জওয়ান আর একটি বাচ্চা মেয়ে নিশূপে বন্ধুর মতো হাত ধরাধরি করে পাশাপাশি হেঁটে যায়। মাঝখানে নীরব সাক্ষীর মতো দাঁড়িয়ে থাকে কাঁটাতার বা ডিভাইডার। দুই দেশের মাটিতে দুজন হেঁটে চলেছে অথচ কত আপন! এমন অদ্ভুত সংযোগে দুটো হৃদয় সংযুক্ত হয়েছে যাকে ভাগ করার শক্তি কাঁটাতারেরও নেই। মিউি পেয়ারা বা বাদাম খেতে ভালবাসে। অর্জুন নিজের ভাগের বাদাম থেকে বাঁচিয়ে রেখে দেয়। গাছের পেয়ারা পেড়ে আনে। কখনও কখনও নিজের খাবারের প্লেটও নিয়ে কেটে পড়ে। জওয়ানরা জানে এই কাণ্ডের কথা। কিন্তু কেউ কিছু বলে না। বরং তারাও বড় উপভোগ করে এই মজাদার সম্পর্ক। প্রায়ই দেখা যায়, পানিত্তারের বর্ডারের ওপ্রান্ত থেকে ভারতীয় জওয়ান এপ্রান্তের এক বাংলাদেশি মেয়ের হাতে টুক করে গুঁজে দিল আপেল, পেয়ারা বা বাদাম। কখনও খাবারের প্লেটের ডিমসেদ্ধ পাচার করে দেয় ছোট্ট মেয়েটার হাঁ মুখে। কখনও বাবার মতো সস্নেহে দুধের গ্লাস নিয়ে ডিভাইডারের কাছে এসে মেয়েটাকে জোর করে গেলায়। মেয়েটা নাক কুঁচকে বলে, পঁচা, বিচ্ছিরি গন্ধ! খাব না!

অর্জুন সিং রাওয়াত মুখ গম্ভীর করে, দুধ খেতে হয়। নেহি তো তাকত হোবে কেইসে? এইসে সুখা সুখা লড়কিসে কৌন শাদি করবে? দুলহা বলবে, ইয়ে লড়কি হ্যায় কে ছিপকলি?

শাদি করব না আমি। মিট্টি গাল ফোলায়, চুলোয় যাক শাদি! যে আমায় শাদি করবে তাকে কামড়ে দেব! ঘ্যাঁক।

অর্জুন ছদ্মভয়ে দুধের গ্লাসসুদ্ধ হাত সরিয়ে নেয়, ওরে বাবা! লড়কি হ্যায় কে ডাকু! যো ভি কহো, কাটনে কো দৌড়তি হ্যায়! শাদি করবে না তো কী করবে? মস্তানি মারবে, ঔর ইনসানকো কাটবে? ঘ্যাঁক?

পড়াশোনা করব! মিট্টি হাত তুলে দেখায়, এই এত্ত–এত্তখানি পড়াশোনা করব।

পঢ়াই-লিখাই করতেও তাক লাগে। অব নখরা ছোড়ো ঔর দুধ পিয়ো!

সবই কিন্তু ঘটছে কাঁটাতার বা সীমান্তরেখাকে মাঝে রেখে। দেশের সীমান্ত আছে। মনের কোনও সীমান্ত নেই।

মিট্টি আপনমনে কচি গলায় গান গায়, অর্জুন অর্ধেক বোঝে, অর্ধেক বোঝে না। কিন্তু খুব গম্ভীর মুখে তাল মেলায়, যেন কত বুঝেছে। গান থামলে হাততালিও দেয়! বলে, ওয়াঃ, ওয়াঃ কেয়া বাত! অনেক সময় অন্য জওয়ানরাও ভিড় করে মিট্টির গান, নাচ দেখার জন্য। মিট্টি গান গায়, হা রে রে রে রে রে, আমায় ছেড়ে দে রে, দে রে। যেমন ছাড়া বনের পাখি মনের আনন্দে রে…!

সে আজও তাই ফাঁক পেয়ে এদিকে চলে এসেছে। অস্তাচলগামী সূর্যের দিকে তাকিয়ে খইনি বানাতে বানাতে আপনমনে হেঁড়ে বেসুরো গলায় বিকট চিৎকার করে গান গাইছিল। আচমকা পিছন থেকে সজোরে খিলখিল হাসির শব্দ এল!

অর্জুন মৃদু হাসে। সে জানে এটা কার হাসি। মেয়েটার পায়ের নূপুরের ছমছম শব্দ তার পরিচয় লুকিয়ে রাখতে পারে না। তবু কৃত্রিম চমকের ভান করে পিছনে ফিরল। যথারীতি মিট্টি! তার হাতে একটা রুমাল।

বোঝো! তুমি গান গাইছিলা! মিট্টি গোলগোল চোখ করল, আমি তো ভাবলাম সোঁদরবনের বাঘ সাঁতরে চলে এসেছে বুঝি! বলি কী, তুমি এবার বনেই যাও। এই গান শুনলে একটা বাঘও ওখানে থাকবে না। সব পালিয়ে যাবে!

রাজপুতের মুখ কপট রাগে গম্ভীর হয়, ইনা খরাব ভি গাই না হামি!

না, ইৎনা খারাপ গাও না! মিট্টি মিটিমিটি হাসছে, ভীষণ খারাপ গাও। আমি তোমাকে গান শিখিয়ে দেব মিতা?

অর্জুন মুখ কাঁচুমাচু করে মাথা নাড়ে। অতএব শুরু হয়ে গেল সংগীত শিক্ষা! ডিভাইডারের দুই দিকে বসে দুই দেশের দুই পাগল দুই বিজাতীয় কণ্ঠে সা রে গা মা পা ধা নি সাধছে! না, ঠিক দুজনেই সুর সাধছে না। বলা ভাল একজন সুর সাধছে, অন্যজন চিৎকার করছে। অর্জুন কিছুতেই সা বলতে পারে না, বলে শা-আ-আ-আ! মিট্টি কিছুতেই তাকে সুরে আনতে পারছে না। বেশ কিছুক্ষণ চিৎকার চেঁচামেচি শুনে মিট্টি হাল ছেড়ে দেয়। মাথা নেড়ে বলে, নাঃ! তোমার হবে না মিতা।

অর্জুন মনে মনে হেসে চিন্তিত মুখভঙ্গি করেছে, কিউ হোবে না মাস্টারনিজি! ইয়ে লো শা-আ-আ-আ! জেঁ-এ-এ-এ!

মিট্টি কানে হাতচাপা দেয়, ওঃ আমার কানদুটো যে গেল!

সে এবার জোরে হাসতে হাসতে থেমে যায়। মিট্টি মুখভঙ্গি করে, এইজন্যই আমাদের গ্রামের আনিসুর দাদা তোমাদের মাউড়া বলে। তুমি এক নম্বরের মাউড়া। কিছুই পারো না।

অর্জুন করুণ সুরে বলে, ফির? আমি তো কিছুই পারে না! ফির মেরা কী হবে?

জানি না। মিট্টি তার হাতের রুমালটা এগিয়ে দেয়, এটা দেখো তো কেমন হয়েছে?

ইয়ে ক্যায়া হ্যায়?

ভারী সুন্দর একটা সাদা রঙের রুমাল। তার ওপর লাল-সবুজ রঙের সুতোর কারুকাজ। রুমালটা দেখলেই মনে হয় শিল্পী নিজের মনের সমস্ত রং উজাড় করে দিয়েছে কাপড়ের টুকরোটার মধ্যে! অর্জুন অবাক হয়। এইটুকু মেয়ে এমন সেলাই করেছে বলে তার বিস্ময় নয়। তাদের গ্রামে এর থেকেও ছোট ছোট মেয়েরা সেলাই করতে জানে। তার বিস্মিত হওয়ার কারণ রুমালটাও নয়। সে অবাক হয় এর পরের কথাটায়, কেমন হয়েছে? মিতা, এটা না তোমার জন্য বানিয়েছি। পছন্দ হয়েছে?

তার জন্য বানিয়েছে! অর্জুন যেন কথা হারিয়ে ফেলে। কোনওমতে বলে, মেরে লিয়ে?

হ্যাঁ রে বাবা। মিট্টি হাসছে, এইমাত্রই শেষ করলাম। এই দেখো, এখানে তোমার নাম।

অর্জুনের চোখে বাষ্প জমেছে। এই ছোট্ট মেয়েটা তার জন্য এত কষ্ট করেছে। তার মতো একটা সামান্য লোকের জন্য। সে রুমালটা এমনভাবে স্পর্শ করে যেন সেটা রুমাল নয়! বড় দামি, বড় আপনার কিছু।

তোমার নাম কী লিখেছি দেখেছ?

অর্জুন চোখের জল সামলায়। সে মাথা নাড়ছে, নেহি, মুঝে বংলা লিখাই পড়না নেহি আতা। তুমি পঢ়ো! ওয়সে যো ভি লিখা হ্যায়, আচ্ছা হি লিখা হোগা…।

ধুর, তুমি না একটা কী! মিট্টি বলল, এই দেখো। এটা আ। এটা ময়ে আকার। এটা র। কী হল?

ক্যায়া?

আমার। তারপর ময়ে হ্ৰস্যি, ত এ আকার মিতা। সব মিলিয়ে কী হল বলো তো? সে হাসছে, আমার মিতা।

অর্জুনের বুকটা টনটন করে ওঠে। সে হাতের পিঠে চোখের জল মুছে বলে, বহুত আচ্ছা। অব ম্যায় যাঁউ?

ওই দেখো, দুমিনিট যেতে না যেতেই ফের হাঁউমাউ শুরু করলা। মিট্টি কী যেন ভাবে– আচ্ছা মিতা, তুমি তো ইন্ডিয়ায় থাকো তাই না?

মিতা মাথা নাড়ে। মেয়েটা কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল। তারপর বলল, ওখানে কি সব একই রকম? একই রকম মানুষ? একই রকম বাড়ি? একই ইচ্ছামতী? আচ্ছা, ওরাও কি বাংলায় কথা বলে?

অর্জুন মৃদু হাসে, হাঁ মিট্টি উধার সব এক। সবলোগ বাঙালা বোলতা হ্যায়। এক হামি হি মাউড়া!

তার রসিকতায় মিট্টি হাসল না। কী যেন ভেবে চলেছে সে, মিতা, যদি সবই এক হবে, তা হলে ওরা আমাদের তাড়িয়ে দিল কেন? তার বড় বড় চোখদুটোয় অবর্ণনীয় ব্যথা, জানো, বাবা বলেছে, আমরা একসময়ে ওখানেই থাকতাম। আর হেমন্ত দাদাভাইয়ের বন্ধুও এখানে থাকত। আমার বাবা কখনও মিথ্যে কথা বলে না! বাবার গুণগান করার সময় তার কণ্ঠে প্রচ্ছন্ন গর্ব ছলকে উঠল। তারপরই সে ফের অন্যমনস্ক, তাই যদি হয়, তবে কেন ওনাকে সবাই মিলে তাড়িয়ে দিল? কেন ওই দেশটাও আমার নয়? ওটাও তো বাংলা তাই না? আমার বাড়িতে কত জিনিস কত লোকের হাতে লেগে পড়ে গিয়ে ভেঙে যায়। বাবা, মা কী সুন্দর আঠা লাগিয়ে ফের জোড়া লাগিয়ে দেয়। তবে যে সাহেবটা দেশ ভেঙে দিয়েছিল, সে চলে যাওয়ার পরে কেউ দেশটাকেও জোড়া লাগিয়ে দিল না কেন?

অর্জুন কী বলবে ভেবে পায় না। কী করে বারো বছরের মেয়েটাকে বোঝাবে যে ভাঙা দেশ জোড়া লাগানো যায় না। সে কথা ঘোরানোর জন্য বলে, মিট্টি, তোমার ইন্ডিয়া আসতে ইচ্ছে হোয়?

ইচ্ছে করে। খুব ইচ্ছে করে। কিন্তু যাব না!

কিঁউ?

কেন যাব? মেয়েটা অদ্ভুত অভিমানে বলে ওঠে, কেন ওরা আমাদের তাড়িয়ে দিল? কেন এমন সুন্দর দেশটাকে ভেঙে দিল? আমি যাব না। একদম যাব না…কিছুতেই যাব না! অশ্রুবিকৃত কণ্ঠে কথাগুলো বলতে বলতে আচমকা উঠে পালিয়ে গেল সে। যেন আর কিছুক্ষণ থাকলেই কেউ তাকে জোর করে ভারতবর্ষে নিয়ে যাবে!

অর্জুন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে তার গমন পথের দিকে।

.

আজও সে অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়ে ছিল কাঁটাতারের ওপ্রান্তে! নীরব ব্যথিত দৃষ্টিতে দেখছিল, আজ কাঁটাতারের ওদিকে কেউ নেই! আর শোনা যাবে না নূপুরের শিঞ্জন। ছোট্ট শীর্ণ মুখটা আর উঁকি মারবে না! আর কিছু নেই! সে কোনওদিন আর আসেনি। আর আসবে না!

তৃষ্ণার্ত শূন্যদৃষ্টিতে তবু সে তাকিয়ে থাকে কাঁটাতারের ওপারে। ওপ্রান্তের শূন্যতা যেন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিতে চায় তার দুচোখ। দুচোখে স্মৃতির সঙ্গে বাষ্পের ভিড়। তবু অর্জুন সিং রাওয়াতের চোখ অপলকে ও প্রান্তের দিকে স্থির হয়ে থাকে…

আজও এই গাঁও অঝোরে চাহিয়া ওই গাঁওটির পানে,
নীরবে বসিয়া কোন কথা যেন কহিতেছে কানে কানে।
মধ্যে অথই শুনো মাঠখানি ফাটলে ফাটলে ফাটি,
ফাগুনের রোদে শুকাইছে যেন কী ব্যথারে মূক মাটি!
…তবু এই-গাঁও রহিয়াছে চেয়ে, ওই-গাঁওটির পানে,
কতদিন তারা এমনি কাটাবে কেবা তাহা আজ জানে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *