ফেরোমন

ফেরোমন

পর্ব আফ্রিকার ডার-এস-সালাম শহর থেকে সমদ্রপথে লঞ্চে চেপে আমরা রুফিজি নদীর মোহনার দিকে চলেছি। আমরা মানে প্রাণিতত্ত্ববিদ নবগোপাল ঘোষ অর্থাৎ আমাদের মামাবাবু, আমার বন্ধু সুনন্দ, আমি শ্রীমান অসিত ও বিল হার্ডি। আমরা তিনজন ভারতীয় বেশ কিছুদিন ধরে ডার-এস-সালামের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের কিউরেটর ডক্টর হাইনের আতিথেয়তা ভোগ করছি। ইতিমধ্যে আমাদের একটা অ্যাডভেঞ্চার হয়ে গেছে! রুফিজি নদীর মোহনার কাছে একটা দ্বীপে মামাবাবু সরীসৃপ ও পাখির মাঝামাঝি কোনো জীবের এক দুর্লভ প্রস্তরীভূত কঙ্কাল আবিষ্কার করেন এবং ঘটনাচক্রে সেই ফসিলটা আবার সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে যায়। দ্বীপের অধিবাসীরা টাঙ্গানিকার এক গ্রাম থেকে ফসিলটা দ্বীপে নিয়ে গিয়েছিল। আমাদের এই দ্বিতীয় অভিযানের উদ্দেশ্য হল, যে গ্রামে ফসিলটা পাওয়া গিয়েছিল, তারই আশেপাশে ওই রকম আরও অন্য ফসিলের অনুসন্ধান করা। মামাবাবুর বিশ্বাস ছিল, বিল হার্ডি ওই গ্রামে যাবার একটা সহজ রাস্তা বাতলে দিতে পারবেন, কারণ সে ওই গ্রামে গিয়েছিল। সেই রকমই অনুরোধ করে একটা চিঠি পাওয়ামাত্র বিল ডার-এস-সালামে চলে আসেন এবং তার পরদিনই আমরা রওনা হয়ে যাই। এখানে বলা দরকার–হ্যার্ডি নামক এই শ্বেতাঙ্গ শিকারী পর্যটকটি সারা পূর্ব আফ্রিকায় ডেয়ারিং বিল নামে খ্যাত। তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময়টাই তিনি আফ্রিকা মহাদেশ চষে বেড়িয়েছেন। দীর্ঘ ঋজু বলিষ্ঠ চেহারা, বয়স পঞ্চাশের উপর, কিন্তু কানের পাশে সামান্য কয়েকটা পাকা চুল ছাড়া কোথাও প্রৌঢ়ত্বের ছাপ নেই।

মামাবাবু এতক্ষণ ডেকে বসে ভারি মনোযোগ দিয়ে জুওলজি পত্রিকা পড়ছিলেন, এখন সেটা বন্ধ করে প্রায় আপন মনেই বলে উঠলেন, আশ্চর্য আবিষ্কার..ফেরোমন!

বিল হার্ডি কিছুদূরে ঠোঁটে পাইপ কামড়ে চোখ বুজে লঞ্চের রেলিং-এর উপর পা তুলে বসে আছেন। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার সম্বন্ধে তার বিন্দুমাত্র কৌতূহল নেই। মামাবাবর সঙ্গে নানান জায়গায় নানান অ্যাডভেঞ্চারের সঙ্গে জড়িত থাকার ফলে আমাদের দুজনের মধ্যেই সেটা বেশ বেশি পরিমাণেই সঞ্চারিত হয়েছে, তাই জিজ্ঞেস না করে পারলাম না–

ফেরোমন কী জিনিস, মামাবাবু?

মামাবাবু তার চশমার কাঁচটা রুমালে মুছতে মুছতে বললেন, ফেরোমন গড়ে প্রাণিদেহ-নিঃসৃত একরকম রাসায়নিক বস্তু। অনেক প্রাণী এর সাহায্যে পরস্পরের মধ্যে। নানারকম যোগাযোগ করে।

আমি আর সুনন্দ পরস্পর মুখ চাওয়াচায়ি করলাম।

পরিষ্কার হল না? মামাবাবু মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলেন, “বেশ, আরো সহজ করে। বলছি। বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর দেহকোষ থেকে এক বা একাধিক রকম লালা বা রস . বেরোয়। যে জিনিসটা বেরোয়, সেটা হল কয়েকটা রাসায়নিক পদার্থের সংমিশ্রণ। এগুলোর প্রত্যেকটির গন্ধ বা স্বাদ একটা বিশেষ সংকেত বহন করে। সেই সংকেতের ভাষা কেবল ওই প্রজাতির প্রাণীরাই বুঝতে পারে। যে রাসায়নিক বস্তুর সাহায্যে এই সাংকেতিক যোগাযোগ সম্ভব হচ্ছে, তাকেই বলে ফেরোমন। কোনো কোনো উন্নত প্রাণী, যাদের মখের ভাষা আছে, তাদের মধ্যেও বিশেষ প্রয়োজনে ফেরোমনের ব্যবহার দেখা যায়। যেমন, হরিণের মৃগনাভি বা কস্তুরী একরকম ফেরোমন। পুরুষ কস্তুরীমৃগ এর তীব্র সুবাস বাতাসে ছড়িয়ে তার হরিণীকে ডাকে। তবে কীট-পতঙ্গ ইত্যাদি নিম্নশ্রেণির জীবের ব্যাপারে বলা চলে যে তাদের সামাজিক জীবনটা একেবারে পুরোপুরি ফেরোমন নিয়ন্ত্রণ করে। যেমন পিঁপড়ে, পিঁপড়ে নিয়েই গবেষণা হয়েছে সবচেয়ে বেশি। পিঁপড়েরা চোখে দেখে না সেটা জানো বোধ হয়। বিভিন্ন প্রজাতির পিঁপড়ের মধ্যে অন্তত দশ রকম ফেরোমন আবিষ্কার করা গেছে। কোনোটার গন্ধে তারা বিষাদের সংকেত দেয়, কোনোটার সাহায্যে তারা মৃত সঙ্গীকে আবিষ্কার করে। কোনোটা তাদের সার বেঁধে পথ চলতে সাহায্য করে, আবার কোনো ফেরোমনের সাহায্যে তারা সাথীকে কাছে ডাকে।

ফেরোমনের বৃত্তান্ত শুনে সত্যিই আমাদের অবাক লাগছিল। মামাবাবু কয়েক সেকেন্ড দম নিয়ে আবার বলে চললেন, অনেক জাতের পোকা ক্ষেতের শস্য নষ্ট করে। কীটনাশক ওষুধ ব্যবহার করেও তাদের ধ্বংস করা যায় না। মনে করো, কোনো পোকা ধান নষ্ট করে। আবিষ্কার করা গেল যে ওই জাতের স্ত্রী পোকা ফেরোমনের সাহায্যে পুরুষ পোকাকে কাছে ডাকে। তারপর ল্যাবরেটরিতে ওই ফেরোমনের রাসায়নিক মিশ্রণ আবিষ্কার হল। তৈরি হল কৃত্রিম ফেরোমন। ব্যস, এইবার কৃত্রিম ফেরোমন ধানক্ষেতের একপাশে ছড়িয়ে রেখে দাও। তখন কী হবে? পুরুষ পোকারা ছুটে আসবে কৃত্রিম ফেরোমনের গন্ধ পেয়ে আর সেই সুযোগে তাদের ধ্বংস করে ফেলা যাবে। আমেরিকায় এই উপায়ে প্রতি বছর হাজার হাজার জিপসি মথ ধ্বংস করে শস্য বাঁচানো হয়।

ফেরোমনের বর্ণনা হয়তো আরো কিছুক্ষণ চলত, কিন্তু বাধ্য হয়ে থামাতে হল। সামনেই শহর দেখা যাচ্ছে। নদীর মোহনায় ছোট্ট শহর, নাম মোহোরা। এই মোহোরা। থেকেই আমাদের হাঁটা-পথে এগোতে হবে ফসিলের সন্ধানে। আমরা উঠে পড়লাম।

সাফারির প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ডার-এস-সালাম থেকে নিয়ে এসেছিলাম। বিল একটা রাইফেল ও পিস্তল এনেছিলেন। তাছাড়া ডক্টর হাইনের বন্দুকটা আমরা চেয়ে এনেছিলাম। বিল বলেছিলেন, শিকার আমি ছেড়ে দিয়েছি। অযথা প্রাণিহত্যা করতে আর ভালো লাগে না তবে আমাদের মাংসের দরকার হবে, টাটকা মাংস। তাই মাঝে মাঝে টোটা খরচ। করব।

মোহোরা থেকে বিল চারজন চাম্বা পোর্টার ভাড়া করলেন। এরা মালপত্র বইবে। দরকার মতো মাটি পাথর খুঁড়বে। একজন কিছুটা রান্নাও জানে। শহর ছেড়ে পরদিন আমরা উন্মুক্ত প্রকৃতির রাজ্যে পদব্রজে যাত্রা করলাম।

বেশি তাড়াতাড়ি এগোতে পারছিলাম না। একে খারাপ পথ, তার উপর মামাবাবুর বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান। পথে যেতে যেতে তিনি মাঝে মাঝে আমাদের অপেক্ষা করতে বলছিলেন। নতুন ধরনের পোকা-মাকড়, সরীসৃপ ইত্যাদি দেখে তিনি দাঁড়িয়ে পড়ছিলেন। চোখে দূরবিন লাগিয়ে গভীর মনোযোগে লক্ষ করছিলেন। কখনও স্পেসিমেনটি জীবিত বা মৃত অবস্থায় সংগ্রহ না করে ছাড়ছিলেন না। নিজেই দেরি করছিলেন, আবার তারপরই আমাদের চলো চলো, এগোও, বলে তাড়া লাগাচ্ছিলেন।

বিল পথ চলতে চলতে আমাদের নানারকম গাছপালা চেনাচ্ছিলেন। আফ্রিকার বনভূমিতে পথ চলার কায়দা-কানুন রপ্ত করাচ্ছিলেন। ছোট-বড় জীবজন্তু দেখিয়ে বোঝাচ্ছিলেন তাদের বয়স, মেজাজ ইত্যাদি।

প্রায় পনেরো মাইল পথ চললাম। একবার মাত্র দপরে খেতে থেমেছিলাম। তারপর টানা হন্টন। সন্ধে নাগাদ তাঁবু ফেললাম। সবাই বেশ ক্লান্ত, রান্নার জোগাড় হতে থাকে। বিল বললেন, কাল আমরা নদীর কাছ ছেড়ে বাঁ দিকে বেঁকে যাব। প্রথমে একটা? স্টেপ অর্থাৎ তৃণভূমি পড়বে। সেটা পেরিয়ে ছোট ছোট পাহাড়ের সারি। ওইখানেই সেই গ্রাম ছিল। এতদূর অবধি আসতে অসুবিধা হয়নি, তবে স্টেপের মধ্যে দিয়ে দিক নির্ণয় করা একটু কঠিন। যা হোক, মনে হয় ঠিকঠাক পৌঁছে যাব। কতগুলো চিহ্ন আমার মনে আছে।

মামাবাবু একটা প্যাকিং বাক্সকে টেবিল বানিয়ে কিছু পোকামাকড়ের স্পেসিমেন পরীক্ষা করতে লাগলেন। আমি ও সুনন্দ বিলের কাছে বসে রইলাম গল্প শোনার আশায়।

বিল একটা গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে আরাম করে পা ছড়িয়ে একমনে কিছুক্ষণ পাইপ টানতে টানতে দূরে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, আফ্রিকার প্রকৃতিতে মায়া আছে বুঝলে, আজ রাতে চাঁদ উঠবে। তখন দেখবে কি অদ্ভুত রহস্যময় দেশ। এই বিশাল মহাদেশের কতটুকুই বা আজ পর্যন্ত আমরা জেনেছি–এখানকার অসংখ্য জীবজন্তু, গাছপালা, এ দেশের উপজাতিদের রীতিনীতি।

প্রশ্ন করলাম, আপনি প্রথম কবে আফ্রিকায় আসেন?

আজ থেকে তিরিশ বছর আগে, মাত্র বাইশ বছর বয়সে।

কী করতে এসেছিলেন? শিকার?

দূর দূর! তখন আমি ভালো করে বন্দুক চালাতেই জানতাম না। এলাম স্রেফ খেয়ালে পড়ে।

যাঃ! স্কটল্যান্ড থেকে এত দূরে অকারণে? সুনন্দ প্রতিবাদ জানাল।

সত্যি বলছি, কিছু ভেবে আসিনি। এসেছিলাম নিছক অ্যাডভেঞ্চারের নেশায়। আফ্রিকা সম্বন্ধে আমার তখন ধারণা ছিল অতি সামান্য, শুধু জানতাম এ এক বিশাল অজানা। রহস্যময় দেশ। ঠিক করলাম, যেমন এ দেশের অধিবাসীরা প্রায় খালি হাতে মহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বেড়ায়, আমিও তেমনি বেড়াব। তারপর একটু একটু করে আফ্রিকান চিনলাম। উবসক নামে আমার প্রথম উপজাতি যুবক গাইডটি হল আমার গুরু। বন্ধও বলতে পারো। জানো, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ আরম্ভ হবার দু-বছর পরও আমি জানতে পারি যে, এমন এক সর্বনাশা যুদ্ধ চলছে! মোম্বাসা থেকে কিছু দরকারি জিনিস আনতে একজন পোর্টার পাঠিয়েছিলাম। জিনিস এল খবরের কাগজের মোড়কে। সেই কাগজ পডে জানলাম ওয়ালর্ড-ওয়র লেগেছে।

বলেন কি! কোনো শ্বেতাঙ্গের সঙ্গে আপনার দেখাই হয়নি এই দু-বছর? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

না। কোনো শ্বেতাঙ্গের সঙ্গে দেখা হয়নি! রেডিও শুনিনি, খবরের কাগজ পড়িনি। এই বিরাট দেশের কয়েকটি শহর এবং বাঁধা পথঘাটের বাইরে বিদেশি লোক বড় একটা পা বাড়ায় না। আর আমি ঘুরতাম অজানা প্রকৃতি-রাজ্যে। পশু শিকার করে, ছাল বা দাঁত উপজাতির কারো হাতে শহরে পাঠাতাম চিঠি দিয়ে। সে দাম নিয়ে আসত কিংবা বদ জিনিস কিনে আনত। কখনও শিকারের মাংস বা ছালের বিনিময়ে উপজাতিদের গ্রাম থেকে প্রয়োজনীয় খাবার জোগাড় করতাম। আর আমার জীবনধারণের প্রয়োজন ছিল অতি সামান্য। শুধু ঘুরতাম, প্রাণভরে দেখতাম। শিকার করতাম।

.

০২.

পরদিন খুব ভোরে উঠে রওনা দিলাম। সারাদিন হাঁটলাম। কয়েকটা বড় বড় তৃণভূমি পেরোলাম। দেখলাম অজস্র জন্তুর ভিড়–নানারকম অ্যান্টিবোপ হরিণ, জিরাফ, জেব্রা, উটপাখি। একটা গাছের ছায়ায় দেখি কর্তা-গিন্নি দুই বাচ্চা নিয়ে এক সিংহ পরিবার। সিংহ-সিংহী পা ছড়িয়ে দিবানিদ্রা দিচ্ছে, দুটো বাচ্চা পাশে লুটোপুটি করছে। তাদের মাত্র পঞ্চাশ গজ দূরে কতগুলো জেব্রা নিশ্চিন্ত মনে ঘাস খাচ্ছে। বিল বললেন, সিংহদের এখন খিদে নেই। তাই জেব্রারা নির্ভয়। সিংহ অযথা শিকার করে না।

সমতল তৃণভূমির মাঝে মাঝে এক-একটা ছোট পাহাড়। পাহাড়ে গাছপালা খুব কম। ক্ষীণস্রোতা কয়েকটি নদী দেখলাম। উপজাতি গ্রামেরও দেখা পেয়েছিলাম। মাত্র কয়েকটি গ্রামের কাছে আমরা যাইনি।

তৃতীয় দিন ভূপ্রকৃতির চেহারা বদলে গেল। রুক্ষ উঁচু-নিচু মাঠ। পাথুরে জমি। নেড়া ছোট পাহাড়। বাবলাজাতীয় কাটাবন। দু-একটা বাওবাব গাছ বেঁটে মোটা শরীরের ওপর ডালপালা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঘাসবন কম।

সকাল ৯টা নাগাদ বিল একজায়গায় থামলেন। চারদিক দেখে বললেন–এইখানে এক গ্রাম ছিল। আমি যে গ্রামে গিয়েছিলাম তাদের সঙ্গে এই গ্রামের লোকেরই যুদ্ধ হয়। দেখছি এ গ্রামও ধ্বংস হয়ে গেছে।

চারদিকে উঁচু-নিচু মাটির ঢিপি। শুকনো গর্ত। এগুলি কোনো পরিত্যক্ত গ্রামের চিহ্ন সন্দেহ নেই। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এরা চলে গেল কেন?

বোধ হয় জলের অভাবে। গ্রামের পাশ দিয়ে একটা খাল ছিল। দেখ তার শুকনো খাত। টাঙ্গানিকার এ অঞ্চলে জলের বড় অভাব।

যে জায়গায় যাচ্ছি সেটা আর কদ্দূর? মামাবাবু প্রশ্ন করলেন।

কাছেই। মাত্র মাইল তিনেক।

আমরা আবার এগোলাম।

লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে আমরা উত্তেজিত হয়ে পড়লাম। এখানেও জনবসতির চিহ্ন ছড়ানো রয়েছে। বিল দেখালেন–ওই যে কিছু দূরে এ্যানিটের স্তূপ দেখা যাচ্ছে, ওর পাদদেশে আমি কার্লো পাথরের স্তর দেখেছিলাম।

শিলাস্তূপের কাছে গেলাম। স্কুপের পূর্বদিকে এক বড় গোল চত্বর। চত্বরের পাথরে রঙ কালচে। মামাবাবু দেখে বললেন, মনে হয় বহু যুগ আগে এখানে জলাশয় ছিল। কাদামাটি জমে শ্লেট-পাথর হয়ে গেছে। এ ধরনের শ্লেট-পাথরে নানা রকম ফসিল পাওয়া যায়। হঠাৎ কাদায় ডুবে গিয়ে প্রাণিদেহ অবিকৃত অবস্থায় ক্রমে ফসিল হয়ে যায়।

চত্বরের মাঝখানে বেশ বড় ফাটল। অনেকখানি গভীর। এইখানেই বোধহয় সেই অতি প্রাচীন পাখির ফসিল পাওয়া গিয়েছিল।

ঠিক হল আমরা গ্রামের কাছে তাঁবু ফেলব। কারণ ওখানে জল ছিল। একটা বড় পাথরের গর্তে পরিষ্কার টলটলে জল জমে ছিল। কাল থেকে খোঁড়াখুঁড়ি আরম্ভ হবে। মামাবাবু চলে গেলেন খাদটা ভালো করে পরীক্ষা করতে। আমরা তাব খাটালাম, রান্নার জোগাড় করলাম। তারপর কফি খেতে খেতে গল্প শুরু হল।

বিল বললেন, আমি যখন কুড়ি বছর আগে এসেছিলাম, তখন জায়গাটা এত রুক্ষ অনুর্বর ছিল না। বেশ ঘাস আর গাছ ছিল।

কেন এমন হল? সুনন্দ বলল।

ঠিক জানি না। তবে উপজাতিরা অতিরিক্ত গরু-ছাগল চরিয়ে অনেক সময় ওপরের মাটি আলগা করে ফেলে। বৃষ্টি হলে সেই মাটি ধুয়ে পাথর বেরিয়ে পড়ে।

বিকেলের দিকে বিল রাইফেল নিয়ে বেরোলেন। মাইল দুই-তিন ঘুরে তিনি একটা মস্ত শুয়োর মারলেন। পোর্টাররা শুয়োরটার ছাল ছাড়িয়ে খণ্ড খণ্ড করে কেটে তাঁবুতে এসে আগুনে ঝলসাতে শুরু করে দিল। বিল বড় একখণ্ড মাংস নিয়ে নিজের হাতে রোস্ট করলেন। আমরা খেলাম। চমৎকার স্বাদ হয়েছিল।

মামাবাবু, আমি, সুনন্দ এবং তিনজন পোর্টার সকালে সেই কার্লো পাথরের চত্বরে হাজির হলাম। আমাদের সঙ্গে পাথর খোঁড়ার জন্য গাঁইতি, শাবল, ছেনি ইত্যাদি সরঞ্জাম ছিল। মামাবাবু ফাটলের মধ্যে একটা জায়গা দেখিয়ে দিতে পোর্টাররা পাথর খসাতে শুরু করল। মামাবাবু মাঝে মাঝে পরীক্ষা করতে লাগলেন। কয়েক জায়গায় এইভাবে খোঁড়াখুঁড়ি চলল। কয়েকটা শামুকের ফসিল বের হল। মামাবাবু বললেন, সাবধানে কাজ করতে হবে। সময় লাগবে। এ যাত্রায় আমরা যা খুঁজছি পাব কিনা জানি না। তবে জায়গাটায় নানা রকম ফসিল আছে সন্দেহ নেই। এবার না পাই পরে আবার আসব।

সারাদিন কাজ করে আমরা ফিরে এলাম।

বিল বেরিয়েছিল চারিদিকটা একটু দেখতে। পুরনো গ্রামের চারপাশ ঘরেছে। একটা ছোট হরিণ মেরে এনেছিল। আমাদের সঙ্গে নানারকম টিনের খাবার আছে কি পোর্টারদের টাটকা মাংস চাই। সেদিনও বিল নিজের হাতে মাংসের রোস্ট তৈরি করে খাওয়ালেন। বুঝলাম ডেয়ারিং বিল কেবল নামকরা শিকারী নন, পাকা রাঁধনিও বটে। বললেন, বছরের পর বছর বনে-জঙ্গলে মাঠে-ঘাটে ঘুরেছি। শিকারের মাংসই চল একমাত্র খাদ্য। সবরকম জন্তুই খেতাম। আর উপজাতির লোকদের কাছে শিখতাম কোন মাংস কী করে রাঁধতে হয়। তার সঙ্গে সভ্য জগতের মশলাপাতি লাগিয়ে জিভে স্বাদ আনতাম। কেমন হয়েছে রান্না?

পরদিন সকাল দশটা নাগাদ।

মামাবাব পোর্টারদের নিয়ে খাদের ভিতর। আমি ও সুনন্দ ওপরে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ দেখলাম, শিলাস্তপের পাশ দিয়ে একজন শ্বেতাঙ্গ এই দিকে আসছে। আশ্চর্য হলাম। হঠাৎ এ কোত্থেকে? ভ্রমণকারী না শিকারী? চাপাস্বরে ডাকলাম–মামাবাবু, এক সাহেব এদিকে আসছে। 

মামাবাবু তাড়াতাড়ি ওপরে উঠে এলেন।

লোকটি ক্রমশ কাছে এগিয়ে এল।

বেশ লম্বা। বয়সে যুবক। সুপুরুষ। শক্ত জোয়ান চেহারা। পরনে খাকি ফুলপ্যান্ট। রঙচঙে হাফশার্ট। মাথায় শোলার টুপি। লোকটি দরাজ গলায় হেঁকে বলল, “আপনাদের দেখতে এলাম। এখানে বিদেশি কাউকে দেখব ভাবিনি। খোঁড়াখুঁড়ি করছেন? কিছুর সন্ধান পেয়েছেন নাকি?

মামাবাবু জবাব দিলেন, হ্যাঁ, একটু পরীক্ষা করছি জায়গাটা। এখনও কিছু পাইনি। আপনি?

লোকটি হেসে উঠল। তাই তো, এখনও পরিচয় দিইনি। অভদ্রের মতো প্রশ্ন করছি। অনেক দিন সভ্যজগতের বাইরে কাটাচ্ছি কিনা, ভব্যতা ভুলে গেছি। হ্যাঁ, আমার নাম টেলর। ব্রুস টেলর। পেশা প্রাণিবিজ্ঞান চর্চা।

মামাবাবু একটু ভ্রু কুঁচকে ভাবলেন। তার মুখ দেখলাম উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। উৎসাহিত হয়ে বললেন, আচ্ছা, আপনিই কি ফেরোমন বিশেষজ্ঞ ব্রুস টেলর? যাঁর প্রবন্ধ এই সেদিন পড়লাম জুওলজি পত্রিকায়?

ভদ্রলোক একটু হেসে বললেন, হ্যাঁ, লেখাটা আমারই বটে। পড়েছেন? কেমন লেগেছে?

মামাবাবু রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। এ লেখাটা তো দারুণ হৈ-চৈ ফেলেছে বিজ্ঞানীমহলে। ফেরোমন নিয়ে এত গভীর গবেষণা কেউ করেনি। আপনার আর একটা লেখা বোধহয় বছরখানেক আগে জুওলজি পত্রিকায় বেরিয়েছিল। সেটাও আমি পড়েছি। ফেরোমন যে জীবজন্তু, বিশেষত কীটপতঙ্গের জীবন-যাত্রাকে এতখানি নিয়ন্ত্রিত করে, আগে কেউ ভাবতে পারেনি। অন্তত ভাবলেও, আপনিই প্রথম প্রমাণ দিয়েছেন। আচ্ছা, আপনি লিখেছেন যে, কয়েক রকম শস্যরক্ষায় কৃত্রিম ফেরোমন দ্বারা পেস্ট কনট্রোল সম্ভব। আপনি কি ল্যাবরেটরিতে তেমন কৃত্রিম ফেরোমন তৈরি করেছেন?

ঢেলর মৃদু হেসে বললেন, হ্যাঁ, করেছি। তাদের ফলাফল মোটামুটি সন্তোষজনক। তবে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন আছে।

মামাবাবু বললেন, যদূর জানি, কয়েকটি ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সে আপনাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, কিন্তু আপনি যাননি। লোকের ধারণা, আপনি একজন রহস্যময় এবং দাম্ভিক ব্যক্তি। যাক, আমার ভুল ভাঙল। আর আপনি যে বয়সে এত নবীন, সেটাও ভাবতে পারিনি।

টেলর বললেন, আমার পরিচয় তো পেলেন। এবার আপনাদেরটা জানতে পারি কি? মনে হচ্ছে, আমরা একই লাইনের লোক।

মামাবাবু বললেন, প্রায় তাই। আমি ভারতীয়। কলকাতায় প্রাণিবিজ্ঞানের অধ্যাপনা করি। যদিও বিদ্যা অতি সামান্য। নাম–নবগোপাল ঘোষ। এটি আমার ভাগনে সুনন্দ। আর এই ছেলেটি সুনন্দর বন্ধু অসিত। আমাদের সঙ্গে আরও একজন আছেন। আমাদের গাইড। বিখ্যাত শিকারী মিস্টার হার্ডি। তিনি আপাতত বন্দুক নিয়ে কিঞ্চিৎ খাদ্য-সংগ্রহ করতে বেরিয়েছেন।

টেলর চোখ বড় বড় করে বললেন, “বাপরে, আপনি প্রোফেসর! তবে তো বুঝে-শুনে কথা বলতে হবে।

মামাবাবু বললেন, আপনি তো আমার ছাত্র নন যে, নম্বর কাটব। বরং আমি আপনার ছাত্র হতে রাজি আছি।

টেলর বললেন, দলবল বেঁধে এসেছেন যখন, তখন এখানে কিছু পাবার আশা আছে মনে হচ্ছে। কীসের ফসিল? অবশ্য ওই ব্যাপারে আমার বিশেষ উৎসাহ নেই।

মামাবাবু তাড়াতাড়ি বললেন, না, না, সঠিক কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে বেরোই্নি। আফ্রিকায় এসেছিলাম কয়েকটা লেকচার দিতে। স্রেফ কেতাবি বক্তৃতা। হাতে ক-দিন সময় পেলাম তাই বেরিয়ে পড়লাম। আফ্রিকা দেখা হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে সামান্য অনুসন্ধান। যদি লেগে যায় বরাতে, নাম-টাম হয়ে যায়! এত বয়সেও তো তেমন কিছু করে উঠতে পারলাম না। এই পাথরের স্তরটা দেখে মনে হল ফসিল থাকতে পারে। তাই খুঁড়ছি। আফ্রিকার পূর্বাঞ্চলে কত বৈজ্ঞানিক প্রাগৈতিহাসিক যুগের জীব-জন্তুর ফসিল পেয়েছে। তবে আমার আসল লক্ষ্য প্রস্তরচিত্র। আদিম মানবের আঁকা ছবি।

মামাবাবুর আসল লক্ষ্য শুনে ব্রুস টেলরের মতো আমরাও চমকালাম, এ উদ্দেশ্য তো কখনও টের পাইনি। সুনন্দ ও আমি চোখাচোখি করলাম। বুঝলাম, টেলরের কাছে তার আগমনের উদ্দেশ্য চেপে যাচ্ছেন মামাবাবু।

টেলর চিন্তিতভাবে বললেন, রক-পেন্টিং? রকপেন্টিং তো উত্তরে আছে শুনেছি। টাঙ্গানিকার কলডোয়া, কিলোসা, ফেঙ্গা পর্বতে অনেক প্রাচীন চিত্র আবিষ্কার হয়েছে। কিন্তু এধারে কই–

মামাবাবু বলে ওঠেন, হ্যাঁ, এধারে পাওয়া যায়নি, সেই জন্যেই তো খুঁজছি। পেলে নাম হবে।

পেন্টিং আর কোথায় খুঁজছেন? আপাতত তো দেখছি ফসিলের সন্ধানে লেগে গেছেন। টেলরের কণ্ঠে যেন সামান্য রহস্য।

মামাবাবু হাসেন।দেখি কয়েকটা দিন এখানে কাজ করে। কিছু না পাই তো চলে যাব।

কোন দিকে যাবেন? টেলর বলেন।

ভাবছি দক্ষিণ-পশ্চিমে যাব।

দক্ষিণ-পশ্চিমে? টেলর যেন আঁতকে ওঠেন। তেসি বেল্টের মধ্য দিয়ে যাবেন? সাধ করে বিপদ ডেকে আনবেন? তাছাড়া ওদিকে কোনো রক-পেন্টিং আছে বলে তো জানি না। বরং সোজা পশ্চিমে যান। ওদিকে অনেক ছোটখাটো পাহাড় আছে। হয়তো পেন্টিং দেখতে পাবেন।

দক্ষিণ-পশ্চিমে বুঝি তেসি মাছির এলাকা? হুঁ। তাহলে তো বিপজ্জনক রাস্তা। মামাবাবু চিন্তিত হয়ে বললেন, আপনি ও-এলাকাটা চেনেন?

হ্যাঁ, কারণ আমি আপাতত তেসি ফ্লাই নিয়ে কিঞ্চিৎ গবেষণা করছি।

তাই নাকি? মামাবাবু উৎসাহিত হয়ে ওঠেন।

টেলর গম্ভীর স্বরে বলেন, টাঙ্গানিকার এই অভিশাপকে তাড়ানো যায় কিনা চেষ্টা করছি। আর এ ব্যাপারে ফেরোমন কতটা সাহায্য করতে পারে পরীক্ষা করছি।

মামাবাবু হঠাৎ বললেন, আপনি এখানে কি কোনো রিসার্চের কাজে রয়েছেন? কাছাকাছি কোথাও উঁবু ফেলেছেন?

টেলর বললেন, না, তেমন কোনো কাজে আসিনি। শ-খানেক মাইল দূরে এক তেসি ফ্রাইবেল্ট থেকে ফিরছিলাম, পথে রেস্ট নিচ্ছি। আর আশপাশের ঝোঁপগুলো পরীক্ষা করছি। কালই পাততাড়ি ওঠাতাম, তবে ইচ্ছে হচ্ছে আপনাদের যখন পেয়ে গেলাম, কাল একবার আড্ডা মারতে আসব। কথা বলার লোক পাই না। পরশু পালাব।

আপনার তাঁবু কোন দিকে?

ওই দিকে। মাইল দুই দূরে। আচ্ছা, আজ চলি। কাল আসব। টেলর যেন একটু ব্যস্ত। হয়ে পা বাড়ালেন। বোধহয় কোনো কাজের কথা মনে পড়ে গেল।

লম্বা লম্বা পা ফেলে টেলর ফিরে চললেন। শিলাস্তূপের গা ঘেঁষে বাঁক নেবার আগে একবার ফিরে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে হাত নাড়লেন। তারপর পাথরের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

সুনন্দ বলে উঠল, এর লেখাই সেদিন পড়ছিলেন, না মামাবাবু?

হ্যাঁ। অদ্ভুত লোক। দু-এক বছর আগেও কেউ এর নাম জানত না। পর পর কয়েকটা লেখায় বৈজ্ঞানিক মহলে আলোড়ন তুলে দিয়েছে। ভালো করে এর পরিচয়টা অবধি কেউ জানে না। তবে লেখা পড়ে মনে হয়, লোকটি অতি পণ্ডিত। দীর্ঘ সাধনা আছে। পঙ্গপালের ফেরোমন যে তাদের বংশবৃদ্ধির জন্য দায়ী, এ এক আশ্চর্য আবিষ্কার। আরও কয়েকটি কীটপতঙ্গের জীবনযাত্রায় তাদের ফেরোমন কীভাবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়, টেলর লেখায় তার উল্লেখ করেছেন। তবে বিশদভাবে কিছু বলেননি। লিখেছেন, তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। এক্সপেরিমেন্ট শেষ হলে বিষয়টির ওপর একটি প্রামাণিক বই লিখবেন। পথিবীর অনেক বৈজ্ঞানিক টেলরের গবেষণার ফলাফল জানার জন্য সব অপেক্ষায় আছেন।

তাঁবুতে ফিরে দেখলাম, বিল আরাম করে কফি খাচ্ছেন। আমাদের দেখে চোরে উঠলেন।হ্যালো সায়ান্টিস্টস, তারপর, পাখির গ্রেট গ্রেট গ্রেট অ্যানসেসটরের ফসিলের হদিস মিলল?

মামাবাবু বললেন, অত সোজা নাকি? সময় লাগবে। আপনি কোথায় গিয়েছিলেন?

একটা রাউন্ড মেরে এলাম মাইল কয়েক।

বিলকে টেলরের কথা বলা হল। কালকে আবার টেলর আসবেন শুনে বিল বললেন, খেয়েছে! ওসব বৈজ্ঞানিক আলোচনার মধ্যে আমি নেই। কাল আমি সন্ধের পর ফিরব।

আমরা আশ্বাস দিলাম, কোনো ভয় নেই। টেলর মোটেই খিটখিটে পণ্ডিত নন। দিব্বি হাসি-খুশি, আমুদে।

একা-একা ঘুরতে আপনার ভালো লাগে? একটা মতলব ছিল আমার প্রশ্নে। বিল বললেন, একজন সঙ্গী পেলে তো ভালোই লাগত। পাচ্ছি কই? তুমি আসবে?

মাথা নেড়ে সায় দিলাম। আসলে আমারও রোদে দাঁড়িয়ে পাথর কাটা দেখতে আগ্রহ ছিল না। বিলের সঙ্গে ঘোরায় কত মজা!

সুনন্দ আর কী করে! কটমট করে আমাকে দেখে নিল। কিন্তু সে প্রাণিবিজ্ঞানের ছাত্র। আমার মতো ফাঁকি দেওয়া তার শোভা পায় না।

রাত্তিরে খাবার সময় মামাবাবু বললেন, সবাই মনে রেখো আমাদের এখানে আগমনের আসল উদ্দেশ্য যেন টেলর টের না পায়।

কেন? টেলরকে জানাতে আপত্তি কীসের? আমি প্রশ্ন করলাম, উনি তো অন্য বিষয় নিয়ে কাজ করছেন। বললেন তো ফসিলের ব্যাপারে ওঁর আগ্রহ নেই।

মুখে বলছেন বটে, কিন্তু ওঁর হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে, বেশ আগ্রহ আছে। মিসিং-লিঙ্ক- এর মতো গুরুত্বপূর্ণ ফসিল এখানে পাবার সম্ভাবনা আছে বলা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আমরা তো আপাতত কদিন পরে চলে যাব। হয়তো খালি হাতে ফিরতে হবে, তারপর উনি যদি এসে ফসিল খুঁজতে শুরু করেন?

বিল হো-হো করে হেসে উঠলেন। বাঃ, আপনারা বৈজ্ঞানিকরা তো সহজ মানুষ নন। কত লুকোচুরি!

হ্যাঁ,–-তা তো আছেই। বৈজ্ঞানিক জগতে জোচ্চুরির অভাব নেই। কত লোক অন্য লোকের গবেষণার ফল মেরে দিয়ে নিজের নামে প্রকাশ করে বিখ্যাত হয়ে গেছে। তাই সাবধান হতে হয়।

.

০৩.

পরদিন বিলের সঙ্গে টই-টই করলাম। যেদিকে ব্রুস টেলরের তাঁবু, সেদিকে যাইনি। মামাবাবু বারণ করেছিলেন। নিজে থেকে যখন ডাকছেন না, তখন যাওয়া উচিত নয়। হয়তো ব্যস্ত থাকবেন, তাছাড়া বেড়াবার পক্ষে ওদিকটা সুবিধের নয়! উঁচুনিচু জমি। খাজ-খাঁজ চড়াই-উৎরাই। আমরা অন্য দিকে গেলাম। বিল একটা পায়ে-চলা পথ আবিষ্কার করলেন। বললেন, সারা আফ্রিকায় বন-প্রান্তরে এমনি অজস্র পায়ে-চলা পথ দেখতে পাবে। পথগুলির শেষে পাবে হয় কোনো গ্রাম কিংবা জলাশয়। ঝর্না বা নদী।

ঠিকই বলেছিলেন বিল। কয়েক মাইল এগিয়ে দেখলাম এক ছোট জলাশয়। কিন্তু কাছে। যেতে পারলাম না। কারণ একপাল হাতি সেখানে মহানন্দে জলকেলি করছে। একটা একাসিয়া গাছের পাশে দাঁড়িয়ে দূরবিন দিয়ে সেই মজার দৃশ্য দেখতে লাগলাম। মস্ত মস্ত প্রাণীগুলো ছোট ছেলের মতো এ ওর গায়ে জল ছিটোচ্ছে। কাদা ছুঁড়ছে। বেশ কয়েক ঘণ্টা সেখানে বসে রইলাম। ওখানে বসেই খেয়ে নিলাম। বিকেলে তাঁবুতে ফিরলাম। একটুক্ষণ পরে মামাবাবু ও সুনন্দর সঙ্গে এলেন টেলর। টেলরের সঙ্গে বিলের আলাপ হল। একটু পরেই দেখলাম দুজনে আফ্রিকার গল্পে মেতে উঠেছেন। টেলর আফ্রিকার বহু দুর্গম অঞ্চলে ঘুরেছেন। বহু উপজাতির রীতি-নীতি জানেন।

কিভু হ্রদের তীরবাসী ওয়াটুতসি উপজাতির কথা উঠতে দুজনে ভারি উৎসাহিত হয়ে উঠলেন।

বিল বললেন, ভারি শৌখিন জাতি। কী লম্বা! ওদের নাচ দেখেছেন?

দেখেছি। দারুণ জমকার্লো ব্যাপার। মাথায় সিংহের কেশর। পরনে হরিণের চামড়া। গায়ে রুপোর গয়না। পায়ে ছোট ছোট ঘণ্টা বাঁধা। নাচের তালে তালে কী বিরাট লাফ।

বিল বললেন, সত্যি, লাফাতে পারে বটে। ওদের ন্যাশনাল স্পোর্টস হলো হাইজাম্প। একবার দেখেছিলাম, ঘটা করে হাইজাম্প হচ্ছে। বিশ্বাস করুন, গ্রামের অর্ধেকের বেশি জোয়ান পুরুষ ছ-ফুট হাইট লাফ দিয়ে পেরিয়ে গেল। কায়দা-টায়দার বালাই নেই। স্রেফ ছুটে এসে বেড়া ডিঙোনো লাফ। ওদের ট্রেন করলে নির্ঘাত অলিম্পিক জিতবে।

হঠাৎ টেলর হো-হো করে হাসতে লাগলেন।

কী হল?

ওয়াটুতসি বৌদের কথা মনে পড়ে গেল। উঃ, কি মোটা!

বিলও হাসেন।রাইট। কেবল খাইয়ে খাইয়ে বৌদের মোটা করে। যত মোটা তত নাকি সুন্দরী। বেচারা বৌগুলো শেষে ভালো করে হাঁটতে পারে না। খেতে না চাইলে স্বামী শাশুড়ি পিটিয়ে, জোর করে খাওয়ায়! বুঝুন যন্ত্রণা!

আমি ও সুনন্দ মুগ্ধ হয়ে তাদের গল্প গিলছিলাম, তবে মামাবাবুর ইচ্ছে ছিল টেলরকে গবেষণা সম্বন্ধে কিছু জিজ্ঞেস করেন। কিন্তু টেলর প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গেলেন। মামাবাবু বললেন, কখনও ইন্ডিয়ায় গেলে খবর দেবেন। দেখা করব।

নাঃ, এখন বিদেশে যাবার ইচ্ছে নেই। আফ্রিকায় অনেক কাজ বাকি। টেলর উঠে পড়লেন, চলি আজ। আর বোধহয় আপনাদের সঙ্গে দেখা হচ্ছে না, কাল চলে যাচ্ছি। বড় আনন্দে কাটল বিকেলটা।

 কোন দিকে যাবেন? মামাবাবু প্রশ্ন করলেন।

মাইল দশ দূরে আমার এক আস্তানা আছে। সেখানে কদিন থাকব।

টেলর সেদিন একজন উপজাতীয় সঙ্গী এনেছিলেন। সে আমাদের পোর্টারদের সঙ্গে বসে খুব আড্ডা দিচ্ছিল। টেলর ডাকলেন–গোরো, চল।

সন্ধ্যা নেমে গেছে। গোয়রা একটা মশাল জ্বালল। দুজনে ফিরে চলল, ক্রমে পাথরের আড়ালে মশালের আলো অদৃশ্য হয়ে গেল।

বিল মন্তব্য করলেন, আশ্চর্য লোক! ইনি চার দেওয়ালের মধ্যে দিনের পর দিন ঘোর গবেষণা করছেন, ভাবা শক্ত। বরং ভ্রমণকারী বা অ্যাডভেঞ্চারার বললে মানায় বেশি।

.

০৪.

টেলর চলে যাবার পর মামাবাবু নিশ্চিন্তে কাজ শুরু করলেন।

রাত্রে মামাবাবু বললেন, জানেন বিল, পোর্টারদের হাবভাব সুবিধের মনে হচ্ছে না।

কেন?

লোকগুলো মাঝে মাঝে নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করছিল। পাথরের টিলাটার দিকে বারবার তাকাচ্ছিল। কেমন ভয়-ভয় ভাব।

ভয়! কেন, স্তূপটাকে ভয় পাবার কী আছে? ওখানে কোনো বন্য জন্তু থাকার কথা নয়। বেশ, কাল আমি যাব। রহস্যটা বোঝার চেষ্টা করব?

পরদিন বিল মামাবাবুদের সঙ্গে গিয়ে খাদের কাছে একটা পাথরে বসে পাইপ টানতে লাগলেন।

কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ একটা আর্তনাদ। তাড়াতাড়ি খাদের ভিতর উঁকি দিয়ে দেখি একজন পোর্টারের হাত থেকে দরদর করে রক্ত পড়ছে। ফাস্ট-এড-এর বাক্স সঙ্গে ছিল। লোকটির হাতে ব্যান্ডেজ করে দিলাম। সামান্য কেটেছে।

মামাবাব জানালেন, একজনের হাত থেকে গাঁইতি ছুটে গিয়ে লেগেছে। ভাগ্যিস মাথায় লাগেনি। লোকগুলো কেবল নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। অসাবধান হয়ে কাজ করছে। তাই ফস্কেছে।

পোটাররা এদিকে কাজ বন্ধ করে খাড়া দাঁড়িয়ে গেল। কী ব্যাপার? তোমাদের তন লাগেনি, সাবধানে কাজ করো।

তারা মাথা নেড়ে বলল, “না, বানা (সোয়হিলি ভাষায়–হুজুর), এখানে আমরা খুঁডতে পারব না।

কেন?

এই পাহাড়ে এক পুণ্যাত্মা থাকেন। তিনি বিরক্ত হচ্ছেন। এবার অঙ্গের ওপর দিয়ে ফাঁড়া কেটেছে। এরপর বিষম বিপদে পড়ব।

পুণ্যাত্মা? তিনি আবার কে? বিল বললেন।

আছেন বানা। তিনি গোসাপের রূপ নিয়ে আছেন। বহুকাল এই জায়গায় বাস করছেন। তার দয়ায় এ অঞ্চলে বৃষ্টি হয়। বিষাক্ত মাছিরা এখানে আসে না।

কে বলল তার কথা? তোমরা তো এ অঞ্চলের লোক নও।

গোরা, হুজুর।

বঝন কাণ্ডটা, বিল বললেন, টেলরের সঙ্গীটি কেমন উপকার করে গেছে। এরা খুব সাহসী, কিন্তু বড় সংস্কারাচ্ছন্ন। দেবতা, অপদেবতা সবাইকেই বেজায় ভয়। এখন এদের দিয়ে এখানে কাজ করানো খুব শক্ত ব্যাপার।

বিল অনেক চেষ্টা করলেন। ভয় দেখালেন। লোভ দেখালেন। কিন্তু পোর্টাররা অনড়। শেষে বললেন, বেশ, খুড়তে হবে না। আপাতত কদিন এখানে থাকো। আমি অন্য লোক খুঁজছি, তখন তোমাদের ছেড়ে দেব।

বিল আমাদের বললেন, দেখি কাল আর একবার চেষ্টা করব। ভালো পুজোটুজো দিলে যদি হয়।

কিন্তু পরদিন ভোরে উঠে আবিষ্কার করলাম সব ক-জন পোর্টার পালিয়েছে। বোধহয় মাঝরাতে সরে পড়েছে। এরা কিছু টাকা আগাম নিয়েছিল। হয়তো ভাবল, আমরা যদি জোর করে কাজ করাই, তাই পালিয়েছে।

আমরা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম। ভারী ভারী শাবল, গাঁইতি ইত্যাদি খোঁড়ার যন্ত্র। মাসখানেকের রসদ। মামাবাবুর বৈজ্ঞানিক জিনিসপত্র। এত মাল চারজনে বয়ে নিয়ে ফিরে যাওয়াও তো অসম্ভব। তাছাড়া এদূর এসে কিছু চেষ্টা না করে ফিরে যাব? এত আয়োজন বৃথা যাবে?

বিল রাইফেল ঘাড়ে বেরোলেন। যদি কাছাকাছি কোনো গ্রাম থেকে লোক জোগাড় করা যায়। ফিরলেন সন্ধের সময়।

নাঃ, পেলাম না। প্রায় দশ মাইল ঘুরে একটা গ্রাম পেয়েছিলাম, কিন্তু তারাও রাজি হল এখানে কাজ করতে।

পরামর্শসভা বসল, কী করা যায়?

বিল বললেন, এখন একমাত্র উপায় বৈজ্ঞানিক টেলর। উনি এ অঞ্চল ভালো করে চেনেন। হয়তো চেষ্টা করলে পোর্টার জোগাড় করে দিতে পারবেন। মানে, এরা যাতে এখানে কাজ করে তার ফন্দি বাতলে দিতে পারবেন।

আমাদের এত খোঁড়ার আগ্রহ দেখে টেলরের এই জায়গা সম্বন্ধে সন্দেহ বাড়বে না তো? আমি বললাম।

কী উপায়! মামাবাবু জানালেন। কিন্তু টেলরের আস্তানায় পৌঁছব কী করে? সুনন্দ বলল।

পায়ের চিহ্ন অনুসরণ করব, বিল বললেন, কিছু কিছু ট্র্যাকারের বিদ্যে আমার জানা। আছে। মাত্র দুদিন আগে ওরা ফিরে গিয়েছে। চিহ্ন পাওয়া যাবে। কাল ওদের তাঁবু কোথায় ছিল খুঁজে বার করব। তারপর অনুসরণ আরম্ভ হবে। ওর আস্তানা তো বেশি দূরে নয়।

টেলরের তাঁবুর চিহ্ন খুঁজে পেতে অসুবিধা হয়নি। একটা বড় গাছের তলায় দেখলাম খুঁটি পোঁতার গর্ত, পোড়া কাঠ। কাছেই এক ছোট পাহাড়। বিল মাটির ওপর চোখ রেখে ধীরে ধীরে ঘুরতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর বললেন, চলুন, এগোনো যাক। ওদের ট্র্যাক পেয়েছি। তবে টেলর যাবার আগে আর একদল এখান থেকে একই পথে গিয়েছিল। পায়ের চিহ্ন কতগুলো কিছু পুরনো। রোদের তেজ বাড়ার আগে রওনা দিই। যতটা পারি জিনিস বয়ে নিয়ে যাই, বাকি কোনো গুহার মধ্যে লুকিয়ে রেখে যাই।

.

০৫.

বিল অনেকটা সামনে এগিয়ে চললেন। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মাটির ওপর। আমরা পিছনে চললাম। বিল বললেন, আমায় ট্র্যাকারের বিদ্যে শিখিয়েছিল এক ঝানু মাসাই। সে যে-কোনো পশু বা মানুষের পায়ের চিহ্ন ধরে তাকে মাইলের পর মাইল অনুসরণ করতে পারত। পাথর বা শক্ত মাটির বুকেও ঠিক তার চিহ্ন খুঁজে বের করত। চিহ্ন দেখে বলে। প্রাণীটির ওজন কত, বয়স ইত্যাদি খুঁটিনাটি। আমিও কিছুটা পারি, তবে তার মতো নয়।

ঘণ্টা দই এগোবার পর বিল সহসা থামলেন। মখে আঙুল দিয়ে আমাদের চুপ করতে ইঙ্গিত করলেন। কানে কতগুলো বিচিত্র শব্দ এল। খটখট, ধুপধাপ। নিঃশব্দে গিয়ে একটা। ঝোঁপের আড়ালে দাঁড়ালাম। বন্য-প্রকৃতিরাজ্যের এক অদ্ভুত ছবি আমাদের সামনে ফুটে উঠল।

এক টুকরো সমতলভূমিতে দুটো প্রকাণ্ড পুরুষ-হরিণ মত্ত হয়ে যুদ্ধ করছে। খানিক দূরে সাত-আটটা মেয়ে-হরিণ ও তিন-চারটে বাচ্চা। মেয়ে-হরিণগুলো কৌতূহলী চোখে লড়াই দেখছে। কখনও আবার নির্বিকারভাবে ঘাস-পাতা চিবুচ্ছে।

বিল বললেন, ইলান্ড। কে দলপতি হবে তাই নিয়ে লড়াই লেগেছে। যতক্ষণ না একটা হেরে দল ছেড়ে পালাবে ততক্ষণ যুদ্ধ চলবে।

এই দ্বন্দ্ব কখন আরম্ভ হয়েছিল জানি না। আরও আধঘণ্টা চলল। ক্রমে একটা হরিণ। পিছু হটতে লাগল। সে অবসন্ন হয়ে পড়েছে। গা দিয়ে রক্ত ঝরছে। একবার গুঁতো খেয়ে মাটিতে পড়ে গেল। অন্য হরিণটা তাকে শিং-এর ধাক্কায় ঠেলে নিয়ে চলল। শেষে পরাজিত হরিণটি পিছন ফিরে দৌড় লাগাল। বিজয়ী কয়েক কদম তার পিছনে তেড়ে গিয়ে, দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগল।

ঠিক এই সময় আমাদের ডান ধারে এক ঝোঁপের ভিতর থেকে একজন বিচিত্র লোক মাথা তুলে দাঁড়াল। ঢেঙ্গা, রোগা, লম্বাটে মুখ। ঘাড় অবধি রুক্ষ কঁকড়া চুল। মুখভর্তি গোঁফ-দাড়ি। গায়ে ময়লা জামা ও কার্লো প্যান্ট। কাঁধে তিন-চারটে বড় বড় থলি। হাতে একটা মুভি ক্যামেরা। কে রে বাবা! হিপি নাকি? আফ্রিকার এই গহনে?

লোকটি নিশ্চয় আমাদের আসা দেখেছিল? একগাল হেসে হেঁকে বলল, “হাল্লো, কেমন দেখলে? ভয় হচ্ছিল, বেরসিকের মতো গুলি করে বসবে বুঝি। খুব লড়েছে। ফার্স্ট ক্লাস ছবি উঠল।

লোকটির গলা শুনে হরিণের দল চকিতে দৌড়ে হাওয়া হয়ে গেল।

লোকটি আমাদের কাছে এসে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে নিজের পরিচয় দিল—জুসেপি আন্তোনিও। শখের ফোটোগ্রাফার। তোমরা? শিকারী নাকি?

আমরাও নিজেদের পরিচয় দিলাম। বিল বললেন, অতগুলো ঝুলি কেন কাঁধে। পোর্টার নেই?

ছিল একজন। পালিয়েছে। একজনকে ধার দাও না তোমরা।

আরে আমাদেরও তো পালিয়েছে। পোর্টারের খোঁজেই তো চলেছি।

শুনে আন্তোনিওর কি হাসি–বাঃ বাঃ! বেশ বেশ! তা তোমাদের সঙ্গে কয়েকটা দিন কাটানো যাক, আপত্তি আছে? তোমাদের লোক জোগাড় হলে আমারও হয়ে যাবে। তাছাড়া অনেকদিন কথা বলার লোক পাইনি। একটু আড্ডা দেওয়া যাবে। তবে আমি কিন্তু বাপু আইন মেনে চলতে পারব না, বলে রাখছি।

মানে?

মানে, ঠিক সময় খাওয়া, শোওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। দেশে ভালো চাকরি করতাম। সময়মতো অফিস যেতে হত বলে কাজ ছেড়ে দিলাম। আগে অবসর সময়ে ফোটোগ্রাফি করতাম, এখন মনের সুখে দিনরাত ওই নিয়ে মেতে আছি। এ দেশটাও চমৎকার। সাবজেক্টের অভাব নেই। কতরকম জন্তু-জানোয়ার, কীটপতঙ্গ।

আন্তোনিও বয়সে যুবক। তার হাতমুখ নেড়ে চুল ঝাঁকিয়ে কথা বলার ধরন ভারি মজার। বোঝা যায়, লোকটি বেজায় দিলখোলা। সুনন্দ রসিকতা করল–আপনার নিশ্চয় অনেক পয়সা! চাকরি ছেড়ে দিলেন।

মোটেই না।

তাহলে চলে কী করে?

মাঝে মাঝে দেশে ফিরে ছবি বিক্রি করি। আরে, হলিউডের সিনেমা কোম্পানিগুলো তো আমার ছবি কেনার জন্যে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। জীবজন্তুর এমন অ্যাকশন ফোটোগ্রাফি কি সহজে পাওয়া যায়?

সুনন্দ বলল, মিস্টার আন্তোনিও, প্রথম আলাপে আপনি আশা করি আমাদের একটা ছবি তুলবেন। অসিতের চেহারাটা পছন্দ না হলে আমার তুলন। বলেন তো পোজ করি।

আন্তোনিও গম্ভীরভাবে বলল, সরি! মানুষের ছবি তুলে আমি ফিল্ম নষ্ট করি না।

সুনন্দর দমে যাওয়া মুখ দেখে আমি সুযোগ বুঝে ফোড়ন কাটলাম, মিস্টার আন্তোনিও। আপনি অনায়াসে ওর ছবি নিতে পারেন। ওকে মানুষ ভাববার কোনো কারণ নেই।

মামাবাবু ও বিল হো-হো করে হেসে উঠলেন। আন্তোনিও আমার কথা শুনে যেন কথাটা যাচাই করবার জন্যে সুনন্দকে একবার আপাদমস্তক জরিপ করে নিল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ছবি তুলল না।

আবার চললাম। বিল সামনে, আমরা তাকে অনুসরণ করছি। আন্তোনিও প্রায়ই দলছাড়া হয়ে পড়ছিল। কখনো গাছের ওপর বাঁদরের দাঁত খিঁচুনি দেখে মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছিল। কখনো বিচিত্রবর্ণ প্রজাপতি দেখে ক্যামেরা তাক করছিল। আবার ছুটতে ছুটতে এসে আমাদের সঙ্গ ধরছিল।

আট-নয় মাইল যাবার পর বিল দাঁড়ালেন। বললেন, ওই দূরে ছোট ছোট ঝোঁপের ঘন জঙ্গল দেখা যাচ্ছে, ওখানে নিশ্চয়ই তেসি ফ্লাই আছে। দেখ, বনের চারপাশের জমির ঘাস পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। সমস্ত ঝোঁপঝাড় কেটে ফেলা হয়েছে। তেসি মাছি ওই রকম বনে আড্ডা গাড়ে। বড় পাতাবহুল গাছের বন বা ছোট ছোট ঘাসবনে থাকে। এখানকার লোকে তাই তেসি ফ্লাই এলাকার চারপাশের বড় ঘাস পুড়িয়ে, ঝোঁপঝাড় কেটে দেয়। যাতে এই মাছি ছড়িয়ে না পড়ে। টেলর দেখছি বনটা এড়িয়ে ডান পাশ দিয়ে ঘুরে গেছে।

আমরা চক্রাকারে তেৎসি মাছির এলাকাটা ঘুরে বনের উল্টো দিকে উপস্থিত হলাম। দূরে বড় বড় গাছে ছাওয়া একখণ্ড সবুজ বন দেখা যাচ্ছিল। বিল সোজা সেই দিকে এগিয়ে গেলেন।

বনের মধ্যে এক পায়ে-চলা পথ ধরে মাত্র পঞ্চাশ গজ মতো ঢুকেই দেখি বন শেষ হয়ে গেছে। সামনে ছোট ছোট ঘাসে ঢাকা পরিষ্কার এক টুকরো জমি এবং তার ভিতর উঁচ পাঁচিলে ঘেরা একটি মাটির বাড়ি। মনে হল, বড় বড় গাছের বেড়া দিয়ে বাড়িটিকে যেন ইচ্ছে করেই লোকচক্ষুর আড়ালে লুকিয়ে রাখা হয়েছে।

বিল বললেন, টেলর ওই বাড়িতে ঢুকেছে।

প্রাচীর-সংলগ্ন মস্ত কাঠের গেটটা একটু ফাঁক করা ছিল। আমরা ভিতরে ঢুকে পড়লাম। বাড়ির দরজায় কয়েকবার করাঘাত করতে শুনলাম ভিতরে খটখট আওয়াজ। দরজা খুলে একটি মুখ উঁকি মারল। সে-মুখ টেলরের নয়।

পুরু চশমার কাঁচে ঢাকা দুটো বিস্ফারিত রাগী চোখের সামনা-সামনি হয়ে আমরা চমকে দু-পা পিছিয়ে গেলাম।

মুখখানা এক বৃদ্ধের। মাথাজোড়া টাক। টিয়াপাখির মতো নাক। তার বাঁ গালের ওপর এক বীভৎস চিহ্ন। পোড়ার দাগ। গালের মাংস কুঁচকে মুখের রূপ বিকৃত করে। তুলেছে।–কাকে চাই? বৃদ্ধ কড়া গলায় প্রশ্ন করল।

এখানে মিস্টার টেলর থাকেন?

হ্যাঁ, কিন্তু সে এখন নেই।

কোথায় গেছেন?

জানি না।

কবে ফিরবেন? আমাদের বিশেষ দরকার।

ও। বৃদ্ধ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাদের দেখল। তারপর বলল, বোধহয় দু-একদিনের মধ্যে। আর কিছু জিজ্ঞাস্য আছে? বৃদ্ধ দরজার ফাঁকটা কমিয়ে আনল।

বলবেন, ঘোষ এসেছিল, আর বিল। একটু দরকার।

বেশ, বলব। জাম্বো কোথায় গেলি। যত উটকো লোক ঢুকে পড়ে–বলতে বলতে সে দরজাটা বন্ধ করে দিল। চকিতে দেখলাম লোকটির হাতে একটি লাঠি। সে লাঠিতে ভর দিয়ে একটু খুঁড়িয়ে হাঁটছে।

আমরা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। টেলরের আস্তানায় এ কোন বদমেজাজি বুড়ো? টেলরের কোনো অ্যাসিস্টেন্ট নাকি? মনে হয়, লোকটার মাথার গোলমাল আছে। যা হোক, টেলর ফেরা অবধি অপেক্ষা করতে হবে।

পাঁচিলের বাইরে একটি উপজাতীয় লোকের সঙ্গে দেখা। এই বোধহয় জাম্বো। সে আমাদের অবাক হয়ে দেখছিল। বিল বলল, “তুমি টেলরের কাছে কাজ করো?,

হ্যাঁ, বানা।

টেলর কবে ফিরবেন?

দু-একদিনের মধ্যে।

আচ্ছা, এখানে খাবার জল কোথায় পাওয়া যাবে, কাছাকাছি?

ওই দিকে একটা ঝর্না আছে। সে বাড়ির পিছন দিকে দেখাল।

বেশ। টেলর এলে বলবে তার বন্ধুরা ওখানে অপেক্ষা করছে। আমরা তাঁবু ফেলছি।

 লোকটি ঘাড় নেড়ে জানাল–বলব।

হঠাৎ–কোত্থেকে আন্তোনিও হাজির হল। সে কখন সটকে পড়েছিল খেয়াল করিনি।পোর্টারের ব্যবস্থা হল?

বললাম, টেলর নেই। দু-একদিন অপেক্ষা করতে হবে।

বেশ বেশ। জায়গাটা খাসা। অনেক সাবজেক্ট পাওয়া যাবে। সে উৎসাহিতভাবে চারদিক দেখল।

ঝর্না খুঁজে পেতে অসুবিধা হল না। বাড়ির আধ মাইলের মধ্যেই। কয়েকটা বড় বড় পাথরের চাঙড়ের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে ক্ষীণ জলস্রোত। পরিষ্কার টলটলে জল নুড়ি পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে। স্রোত ক্রমশ চওড়া হয়ে এঁকেবেঁকে কিছু দূরে ঘন বনের মধ্যে প্রবেশ করেছে। উৎসের কাছেই আমরা তাঁবু ফেললাম।

মামাবাবু বেজায় গম্ভীর হয়ে গেলেন। কথাবার্তা নেই, কী জানি ভাবছেন। তাঁবু খাঁটিয়ে, রান্নার জোগাড় করছি, হঠাৎ তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন–মনে পড়েছে–কার্লো! ডক্টর ফিলিপ কার্লো!

কার্লো কে?

ওই বৃদ্ধ। কেবল ভাবছি, কোথায় দেখেছি। সেই নাক। কথা বলার ভঙ্গি। গলার স্বর। বড্ড চেনা। তবে দশ বছর আগে দেখেছিলাম। তখন মাথায় অনেক চুল ছিল; আর গালের পোড়া দাগটা ছিল না। এখন ভীষণ বড়োটে হয়ে গেছেন। কিন্তু কা্ররলো এখানে কী করছেন?

কার্লো কে? বিল বললেন।

একজন প্রাণিবিজ্ঞানী। ট্রপিকাল অঞ্চলের পোকামাকড-বিশেষজ্ঞ। কলকাতায় এক কনফারেন্সে দেখেছিলাম। বেজায় রাগী। তবে অসাধারণ পণ্ডিত। শুনেছিলাম, তান ট্রপিকাল অরণ্যে প্রচুর ঘোরেন। কয়েক বছর ওঁর কোনো লেখা আমার চোখে পড়েনি। কার্লো কি টেলরের সঙ্গে রিসার্চ করছেন?

বদরাগী বুড়ো কার্লোর রহস্য আমাদের সবার মনে কৌতূহল জাগাল। কিন্তু টেলরের সঙ্গে দেখা না হলে এ-রহস্য সমাধানের উপায় নেই।

.

০৬.

ব্রুস টেলর পরদিন ভোরেই হই-হই করে হাজির হলেন।

কী ব্যাপার? আপনারা? বললেন যে পশ্চিমে যাবেন?

বিশেষ প্রয়োজনে এলাম। আপনার সাহায্য দরকার।

কিন্তু এলেন কী করে?

আপনার পদচিহ্ন অনুসরণ করে।

বিল নিয়ে এসেছেন।

বটে, বটে! তা দরকারটা কী শুনি?

মামাবাবু আমাদের পোর্টারদের কাহিনি শোনালেন।

শুনে টেলর বেজায় হাসলেন। একটা বুড়ো গোসাপ ওই পাহাড়ে থাকে জানি, কিন্তু সে যে দেবতা জানতাম না। তিনি গোরোর ওপর চটে উঠলেন, ব্যাটারা বড় বাজে বকে। এখন বুঝুন ঠেলা! ঠিক আছে, আমি আজই তোক পাঠাচ্ছি কাছের গ্রামে। তবে ভয় হয়, সংস্কার বড় মারাত্মক জিনিস। ওখানে কাজ করতে কেউ রাজি হবে কিনা জানি না। যা হোক, আমি সবরকম চেষ্টাই করে দেখব।

টেলর কুণ্ঠিতভাবে বললেন, “আমি কাল ছিলাম না। অতিথি সৎকার করতে পারলাম না। তা আমি নেই খবরটা দিল কে?

এক বৃদ্ধ। বিল জানালেন।

আলাপ হল তার সঙ্গে?

আলাপ! বিল আঁতকে ওঠেন, “বাপরে কী মেজাজ! বলল–নেই। শিগগিরি ফিরবে। ব্যস! মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিল। দুটোর বেশি প্রশ্ন করলে মেরেই বসত।

টেলর লজ্জিতভাবে বললেন, ছিঃ ছিঃ, কী কাণ্ড!

মামাবাবু এবার প্রশ্ন করলেন, “আচ্ছা, বৃদ্ধটির নাম কি ফিলিপ কার্লো?

টেলর অবাক। আপনি চেনেন কার্লোকে? আলাপ আছে?

না। একবার মাত্র দেখেছিলাম। অনেক দিন আগে। উনি কি আপনার সঙ্গে কাজ করছেন?

হুঁ, কাজ করছেন বটে, কিন্তু তাতে লাভ না হয়ে বরং আমার ক্ষতিই হচ্ছে।

কেন? অমন পণ্ডিত লোক।

তা ঠিক। কিন্তু ডক্টর কার্লো এখন রুগ্‌ণ। ওঁর শরীর মন কোনোটাই সুস্থ নয়। দেখলে তো, আপনাদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করলেন!

ব্যাপারটা কী?

ব্যাপার খুবই দুঃখজনক। এত বড় প্রতিভার ওই পরিণতি হবে ভাবিনি। টেলর বিষণ্ণভাবে একটু চুপ করে থেকে বলতে শুরু করলেন, প্রায় আড়াই বছর আগে ডক্টর কার্লোর সঙ্গে আমার আলাপ হয় এক উপজাতি গ্রামে। বিষাক্ত পোকার কামড়ে আদিবাসীরা কী কী টোটকা ব্যবহার করে তিনি এ বিষয়ে অনুসন্ধান করছিলেন। কয়েকদিন পর আমি সে-গ্রাম ছেড়ে চলে যাই। মাত্র তিন দিন পরে ওই গ্রামের একজন এসে আমায় খবর দিল কার্লোর গুরুতর দুর্ঘটনা ঘটেছে। কীভাবে তার কুটিরে আগুন লাগে। জ্বলন্ত পোশাকে উদভ্রান্ত অবস্থায় দৌড়ে পালাতে গিয়ে তিনি এক খাদের মধ্যে পড়ে যান। পায়ে আঘাত লাগে। গ্রামের লোক তাঁকে তিরিশ মাইল দূরে এক মিশনারি হাসপাতালে নিয়ে গেছে।

তাড়াতাড়ি হাসপাতালে গেলাম। কার্লো মাস দুই ভুগে সুস্থ হলেন, কিন্তু একটা পা জখম হয়ে গেল। তাছাড়া মুখটা পুড়ে গিয়ে বিকৃত হয়ে গেল। আমি অনুরোধ করলাম–ফিরে যান। কিন্তু কার্লো রাজি হলেন না। উনি জেদ ধরলেন আমার সঙ্গে যাবেন। আমি একটু সাহায্য করলে এখানে রিসার্চ চালাতে পারবেন।

বাধ্য হয়ে সঙ্গে নিয়ে এলাম। ল্যাবরেটরিতে এনে রাখলাম। দুঃখের বিষয়, কিছুদিন পরে বুঝলাম কার্লো ভীষণ মানসিক শ পেয়েছেন। কোনো কঠিন গবেষণা ওঁর পক্ষে সম্ভব নয়। দিনের পর দিন গুম্ হয়ে থাকেন। কারো সামনে বেরোতে চান না। রাতে ঘুম হয় না। অকারণে উত্তেজিত হয়ে ওঠেন।

ওঁকে ডাক্তার দেখালেন না কেন? মামাবাবু বললেন।

চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু কিছুতেই ডাক্তারের কাছে যেতে রাজি হলেন না। মনে হয়, ধারণা হয়েছিল, ওঁকে পাগলা গারদে রাখা হবে।

কোনো আত্মীয়কে যদি খবর দিতেন।

তেমন কারও ঠিকানা পেলাম না। ডারবান থেকে ওঁর পরিচিত এক ভদ্রলোককে ডেকে এনেছিলাম, কার্লো তাকে অপমান করে তাড়িয়ে দেন। জোর করতে সাহস হল না। যদি স্ট্রোক হয়ে যায়! ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। এত বড় ব্রেন, সত্যি কি পাগল হয়ে যাবে? তাই আমার কাজের মধ্যে ওঁকে ডাকতে লাগলাম। আমার গবেষণা নিয়ে আলোচনা করতাম। একটু একটু করে দেখি উনি ফেরোমন সম্বন্ধে আগ্রহী হয়ে উঠলেন। তখন ভালোই লেগেছিল। যদি এত বড় পণ্ডিতের সাহায্য পাই! আমিই প্রস্তাব দিই, আসুন আমরা একসঙ্গে কাজ করি। পরে বুঝলাম, নিজের পায়ে কুড়ুল মেরেছি। কার্লো ফেরোমন নিয়ে মেতে গেলেন এবং ল্যাবরেটরি অধিকার করে বসলেন। আমাকে একা কিছুতেই কাজ করতে দেবেন না। সব সময় আমার ওপর সর্দারি করবেন। কার্লোকে পেয়ে আমার কোনো উপকার হল না। কারণ, কোনো সমস্যা নিয়ে টানা কাজ করার মতো শরীর বা মনের অবস্থা উনি হারিয়ে ফেলেছিলেন। বিষয়টা ওঁর কাছে নতুন। শুধু নানারকম উদ্ভট কল্পনা করেন আর আমাকে তার কল্পনামাফিক কাজ করতে বলেন। আজ বছরখানেকের ওপর এই অবস্থা চলছে। আমার কাজের খুব ক্ষতি হচ্ছে। যতটা পারি ওঁকে লুকিয়ে কাজ করি। উনি উপস্থিত থাকলে বড় ডিসটার্বেন্স হয়। মহা সমস্যায় পড়েছি। কী যে করি–

টেলর মাথায় হাত দিয়ে হতাশভাবে বসে রইলেন। সত্যি, এত নামী বৈজ্ঞানিকের এই শোচনীয় পরিণতি ভাবতে কষ্ট হয়।

মামাবাবু বললেন, যদি অনুমতি করেন তো ডক্টর কার্লোর সঙ্গে আমি একবার আলাপ করব। চেষ্টা করব ওঁকে শহরে ভালো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে।

খুব ভালো কথা। যদি পারেন তো মহা উপকার হয়। আমার অবস্থাটা তো বুঝছেন। তবে দয়া করে ওঁর কাছে ফেরোমন প্রসঙ্গ তুলবেন না।

কেন?

কারণ, এটা হল টপ সিক্রেট, মানে কার্লোর ভাষায়। উনি স্থির করেছেন, ফেরোমন নিয়ে কয়েকটা যুগান্তকারী আবিষ্কার করবেন। কিন্তু যতদিন না রিসার্চ কমপ্লিট হয়, আমায় বারণ করেছেন যেন এ-বিষয়ে কেউ জানতে না পারে। তাহলেই নাকি অন্য বৈজ্ঞানিকরা এই লাইনে রিসার্চ শুরু করে দেবে। হয়তো আমাদের গবেষণার সূত্র চুরি করার ষড়যন্ত্র। হবে।

কিন্তু জুওলজি পত্রিকায় যে আপনি পেপার পাবলিশ করেছেন? সুনন্দ একটু মজা করে।

লুকিয়ে। জানতে পারলে বৃদ্ধ কেলেঙ্কারি করবে। আচ্ছা বলুন তো প্রোফেসর, আমার এত দিনের সাধনা কি ওঁর খামখেয়ালিপনার জন্য বৃথা যাবে? এতটা আত্মত্যাগ কি সম্ভব? কেন আমি আমার গবেষণার ফল প্রকাশ করব না? কেন আমি আমার একান্ত নিজস্ব পরিশ্রমলব্ধ গবেষণায় অন্যকে ভাগ বসাতে দেব? আমার লেখায় অন্যের নাম যুক্ত করব?

মামাবাবু সায় দিলেন, আপনি ঠিকই বলছেন। আপনার কোনো অন্যায় হয়নি। আপনি যথেষ্ট করছেন। কিন্তু এভাবে চললে তো আপনাদের দুজনেরই ক্ষতি। আমি একবার চেষ্টা করবই। আপনি কার্লোর সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দেবেন?

নিশ্চয়! তবে সুযোগ বুঝে, যেদিন ওঁর মন বেশ শান্ত থাকবে।

টেলর বিদায় নিলেন। আমরা কীভাবে টেলরকে কার্লোর কবল থেকে উদ্ধার করা যায় তাই নিয়ে গবেষণা শুরু করে দিলাম। মামাবাবু বারবার বলতে লাগলেন, এত বড় বৈজ্ঞানিক প্রতিভাকে এভাবে নষ্ট হতে দেওয়া কক্ষনো উচিত নয়। চেষ্টা করতেই হবে। ওঁকে ভালো করে তোলার।

.

পরদিন সকালে মামাবাবু, সুনন্দ ও আমি বেড়াতে বেরিয়েছিলাম। ল্যাবরেটরির কাছে টেলরের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। টেলর বললেন, প্রভাতে বায়ুসেরন ও কিঞ্চিৎ পদচারণ। আমার অভ্যাস। চলুন ভিতরে।

কার্লো? আমি সভয়ে প্রশ্ন করি।

ঘুমোচ্ছেন। ঘুম আসছিল না, তাই মাঝরাতে ঘুমের বড়ি খেয়েছেন। চলুন ল্যাবরেটরি দেখাব।

ল্যাবরেটরিতে ঢুকে আমরা অবাক। শহর থেকে এত দূরে, গহনে এমন আধুনিক নানা জায়গায় আমার আরও কয়েকটা ল্যাবরেটরি আছে। তবে এটাই সেরা।নিজনে কাজ করতে আমার ভালো লাগে।

মামাবাবু ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলেন। কতগুলো লেবেল-আঁটা শিশি দেখিয়ে বললেন, এগুলোর মধ্যে কি ফেরোমন আছে?

হ্যাঁ। কৃত্রিম উপায়ে বানিয়েছি।

টেলর জাম্বোকে ডেকে কফি বানাতে বললেন। বিদায় নেবার সময় আশ্বাস দিলেন, আশা করছি আপনাদের পোর্টারের খবর শিগগিরি পাবেন।

রাত্রে আন্তোনিও জানাল, প্রোফেসর ঘোষ, আজ পাগলা বৈজ্ঞানিককে দেখলাম।

কে, কার্লো?

হ্যাঁ! পাঁচিলের বাইরে একটা পাথরের ওপর বসেছিলেন। আমায় দেখেই চট করে ভিতরে ঢুকে গেলেন। জানেন, ওঁকে আমি আগে দেখেছি।

কোথায়?

লিবিয়ায়। চার বছর আগে। সাহারার প্রান্তে এক মরূদ্যানে। আলাপ হয়নি। দূর থেকে দেখেছিলাম। সেদিনও ওই এক ভঙ্গিতে বসেছিলেন। বেদুইন শেখরা বলেছিলেন–সাহেব বেশ কিছুদিন ওই মরূদ্যানে আছে। পোকামাকড় নিয়ে কী সব পরীক্ষা করে। বেজায় রাগী।

আর কোনো শ্বেতাঙ্গ ছিল সেখানে?

না। তখন অবশ্য কার্লোর গালে পোড়া দাগ ছিল না। তবে আমার ফোটোগ্রাফারের চোখ ঠিক চিনেছে।

.

০৭.

টেলর সেদিন এলেন না। পরদিন সকাল আটটা নাগাদ দেখা করতে এলেন। বললেন। কয়েকজন পোটার জোগাড় হয়েছে, কিন্তু মুশকিল হল, তারাও পাহাড়ের কাছে পাথর কাটতে রাজি হচ্ছে না। আপাতত না হয় এদের নিয়ে রকপেন্টিং-এর খোঁজে বেরিয়ে পড়ুন! ফসিল উদ্ধার পরে করবেন।

মামাবাবু চিন্তা করতে থাকেন।

এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে আন্তোনিও হাজির হল। কোন কাকভোরে সে ক্যামেরা ঘাড়ে বেরিয়েছিল। এসেই বলল, চা খাব। ওঃ, আজ দুটো জব্বর সাবজেক্ট পেয়েছি।

কী সাবজেক্ট? এক নম্বর, একপাল বুনো কুকুর। কী গ্রেসফুল! একটা প্রকাণ্ড জেব্রার পিছনে তাড়া করে ছুটছিল। অনেক ছবি নিয়েছি।

বিল তাড়াতাড়ি বললেন, আন্তোনিও, এমন কর্ম কক্ষনো করবেন না। বুনো কুকুর আফ্রিকার সবচেয়ে হিংস্র জীব। অকারণে শিকার করে। বাগে পেলে মানুষকেও ছাড়ে না।

তাঁর কথায় কান না দিয়ে আন্তোনিও বলল, দু-নম্বর হল পিঁপড়ে। লক্ষ লক্ষ পিঁপড়ে একটা গাছে বাসা বেঁধেছে। গাছের অর্ধেকটা পর্যন্ত থিকথিক করছে, পিঁপড়েতে গুঁড়ি ও ডালগুলো ঢেকে গেছে। মাইলখানেক দূরে ওই বনের মধ্যে। হ্যাঁ, একটা ওয়াটার-হোল আবিষ্কার করেছি। বিল, যাবেন নাকি? দুজনে পাশে লুকিয়ে থাকব। জন্তুদের জল খাবার ছবি তুলব। রাতেও থাকব, দেখব। উঁহু, আর কেউ নয়। ভিড় হলে জন্তুরা আসবে না। বিল, যাবেন?

যাব। বিল সম্মতি জানাল।

আন্তোনিও হুড়হুড় করে কথা বলে যাচ্ছিল, হঠাৎ থেমে টেলরের দিকে চাইল, মশাইকে তো আগে দেখিনি!

তাকে টেলরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম।

ও, আপনাকে চিনি। মানে নাম শুনেছি, দারুণ বৈজ্ঞানিক। আপনিই তো আমাদের পোর্টার জোগাড় করে দেবেন?

টেলর বলল, চেষ্টা করছি। আপনার পেতে অসুবিধা হবে না। প্রোফেসরের জন্যই ভাবনা। হ্যাঁ, প্রোফেসর, ভেবে দেখলাম আপনার ওই জায়গাটা অনুসন্ধান না করে চলে যাওয়া উচিত হবে না। আমি অন্য গ্রামে চেষ্টা করি। কটা দিন ধৈর্য ধরুন। কোথাও যাবেন না। এখানেই থাকবেন। আচ্ছা বিদায়।

দুপুর একটা নাগাদ টেলর গোরোকে নিয়ে আবার হাজির হলেন। সঙ্গে তাঁবু ও কিছু জিনিস। বললেন, এক জায়গায় রকপেন্টিং-এর সন্ধান পেয়েছি। লাঞ্চ হয়ে গেছে তো? তবে যান, দেখে আসুন। গোয়রা আপনাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। মাত্র দু-মাইল পথ। সন্ধের আগে ফিরে আসতে পারবেন।

বেশ যাচ্ছি। কিন্তু তবু নিয়ে বেরিয়েছেন যে?

আজ ঝর্নার কাছে কাটাব। ল্যাবরেটরিতে ফিরছি না। কার্লোর মেজাজ অত্যধিক খারাপ। আমার সঙ্গে একটু কথা কাটাকাটি হয়ে গেছে। কী করব, মাঝে মাঝে ধৈর্যচ্যুতি হয়। যাহোক, এখন ওর সামনে না যাওয়াই ভালো। কাল সকালে ওর মেজাজ ঠাণ্ডা হলে ফিরব। বনের মধ্যে একটা মস্ত মৌচাক আছে। বসে বসে মৌমাছি দেখি। আপনারা ফিরে এলে গল্প হবে।

দুই নয়, অন্তত চারমাইল হাঁটতে হল। চৌকো বড় একটা পাথরের গায়ে লাল-কালো রেখায় কয়েকটা জিরাফ ও হরিণ আঁকা। একটা কাগতাড়ুয়া গোছের মানুষের ছবি। দেখলে মনে হয় ছোট ছেলে এঁকেছে।

মামাবাবু একটু পরীক্ষা করেই গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, বাজে খাটলাম। চলো ফিরি।

একটু জিরিয়ে ফিরতি পথে হন্টন দিলাম।

টেলর আমাদের তাঁবুর কাছে অপেক্ষা করছিলেন।

বললেন, কেমন দেখলেন?

ঠকেছি, এগুলো তেমন প্রাচীন নয়। মামাবাবু জানালেন।

ইস, লোকটা দেখছি বাজে খবর দিল। টেলর কাঁচুমাচুভাবে বললেন। টেলর তার তাঁবুতে আমাদের কফি খেয়ে যেতে ডাকলেন। কিন্তু মামাবাবু আর গেলেন না। বড্ড ক্লান্ত।

আন্তোনিও একটা বাঁদরছানা ধরেছিল। তাঁবুর খুঁটিতে সেটা বাঁধা থাকত। আবিষ্কার করলাম সেটা ইতিমধ্যে পালিয়েছে।

.

০৮.

অঘোরে ঘুমোচ্ছিলাম। হঠাৎ শুনলাম মামাবাবুর কণ্ঠস্বর, সুনন্দ, অসিত। ওঠো, ওঠো।

ধড়মড় করে উঠে বসলাম–কী ব্যাপার?

কেমন শব্দ হচ্ছে শুনতে পাচ্ছ? মামাবাবু বললেন।

গভীর রাত। বাইরে হালকা চাঁদের আলো, অগ্নিকুণ্ডের কাঠগুলো নিবুনিবু। তাঁবুর পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকালাম। কান পাতলাম। হ্যাঁ, কতগুলো অস্বাভাবিক শব্দ। খড়-খড়, মড়-মড়। বনের ভিতর কারা যেন ছুটোছুটি করছে। মাঝে মাঝে ভীত বাঁদরের কিচিমিচি। পাখির ডাক। শব্দগুলো যেন ক্রমশ এগিয়ে আসছে। কে বা কারা আসছে? কোন জানোয়ার? রহস্যময় আফ্রিকায় এ কোন্ অজ্ঞাত বিপদের পদধ্বনি? বন্দুক এগিয়ে রাখি। বিল নেই তাই অসহায় লাগছিল।

অগ্নিকুণ্ডের ক্ষীণ আলোয় দেখলাম, কয়েকটা মেঠো ইঁদুর লাফাতে লাফাতে পালাল। সঙ্গে সঙ্গে দুটো শেয়াল ও পরেই একটা হায়না দ্রুত তাঁবুর গা ঘেঁষে ছুটে গেল। এরা ভয় পেয়েছে। কিন্তু কেন?

মামাবাবু নিশ্চল। সর্ব ইন্দ্রিয় উন্মুখ। একদৃষ্টে বনের দিকে চেয়ে আছেন। সহসা তিনি টর্চ জ্বাললেন। কয়েক মুহূর্ত টর্চের জোরালো আলো ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হল। তারপরই তিনি সভয়ে বললেন, ওই দেখো!

দেখলাম, অদুরে বনের প্রান্তের মাটির ওপর একটা চওড়া কালো দাগ। ও কি, দাগটা যে সচল। যেন প্রকাণ্ড এক আলকাতরার স্রোত বনের মধ্য থেকে বেরিয়ে ধীরে গড়িয়ে আসছে। স্রোতের মুখ অন্তত দশ গজ চওড়া, বস্তুটি যে কী বুঝতে পারছিলাম না।

মামাবাবু উত্তেজিতভাবে দ্রুত বলতে লাগলেন-আর্মি-অ্যান্ট। বুঝতে পারছ না? লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি পিঁপড়ের বাহিনী। ঠিক সৈন্যবাহিনীর মতো সারিবদ্ধভাবে মার্চ করে চলে। হিংস্র মাংসাশী ক্ষুধার্ত এই পিঁপড়েদের খপ্পড়ে পড়লে দুনিয়ার ছোট-বড় কোনো প্রাণীর নিস্তার নেই। সামনে যাকে পায় আক্রমণ করে। প্রাণভয়ে তাই সবাই পালায়। মনে হয় আন্তোনিও এই বাহিনীটাকেই গাছের গায়ে বিশ্রাম নিতে দেখেছিল। কিন্তু এরা এদিকে এল কেন? আশ্চর্য! এরা বনের ছায়া বা বড় ঘাসবনের মধ্য দিয়ে চলে। উন্মুক্ত প্রান্তর, শুকনো মাটি, পাথরের ওপর দিয়ে চলে না। দেখ দেখ, পিঁপড়ের ঝাক সোজা তাঁবুর দিকে এগিয়ে আসছে। চল পালাই, সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত!

তাঁবু ছেড়ে বেরোব, হঠাৎ মামাবাবু দাঁড়িয়ে পড়লেন। সুনন্দ, বাঁদর বাচ্চাটা কি দড়ি ছিঁড়ে পালিয়েছে?

না, দড়ি খুলে। অত শক্ত গেরো কী করে যে খুলল!

হুম! চল। বিলের পিস্তলটা সঙ্গে নাও! মামাবাবু অন্ধকারে চলতে শুরু করলেন। একবার জিজ্ঞেস করলাম–কোথায় যাচ্ছেন?

টেলরের তাঁবুতে। কথা বোলো না।

নিঃশব্দে আমরা টেলরের তাঁবুর কাছে এসে দাঁড়ালাম। দেখি অত রাতেও টেলর জেগে। তাঁবুর বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। মামাবাবু যে কাণ্ড করলেন তাতে আমরা তে স্তম্ভিত। টেলরের পিছনে গিয়ে বন্দুক তাক করে বলে উঠলেন, কী শুনছেন মিস্টার টেলর?

টেলর বিদ্যুৎবেগে ফিরে দাঁড়াতেই মামাবাবু বললেন, “উঁহু, এগোবেন না, তাহলে গুলি করতে বাধ্য হব। সুনন্দ, তুমি একে পিস্তল নিয়ে পাহারা দাও। নড়লেই গুলি করবে। অসিত, খেয়াল রেখো–গোরো আছে কি না। আমি আসছি–

টেলর রাগে অগ্নিশর্মা। চিৎকার করে উঠলেন, আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে প্রোফেসর ঘোষ! মামাবাবু ভ্রূক্ষেপ না করে টেলরের তাঁবুর ভিতর ঢুকলেন।

একটুক্ষণ পরে বেরিয়ে এলেন। হাতে একটা বড় শিশি। মিস্টার টেলর, আর্মি-অ্যান্ট-এর ফেরোমন-এর শিশি এখানে কেন? আর শিশিটা খালি কেন?

তার জন্যে কি আপনাকে কৈফিয়ত দিতে হবে? আমাকে যেতে দিন। টেলর অপমানে ফুলছে।

যাদের পিঁপড়ে লেলিয়ে দিয়ে মারবার চেষ্টা করেছিলেন, তারা কৈফিয়ত দাবি করতে পারে বৈকি!

কী যা-তা বলছেন!

ঠিকই বলছি। বোগাস রকপেন্টিং দেখেই বুঝলাম আপনার কোনো মতলব আছে। তাঁবু থেকে কিছুক্ষণ আমাদের সরিয়ে রাখলেন। কোনো ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের আভাস পেলাম। তাই সতর্ক ছিলাম। যাক, আপনি এখন আমাদের বন্দী। ষড়যন্ত্রের কারণ কাল অনুসন্ধান করব। সুনন্দ ওর হাত বাঁধো।

টেলর জ্বলন্ত দৃষ্টিতে মামাবাবুকে দেখতে লাগলেন। কোনো কথা বললেন না।

বন্দী টেলর সমেত আমরা আমাদের তাঁবুর কাছে আশ্রয় নিলাম। টর্চের আলোয় দেখলাম, তাঁবু এবং তার চারপাশে থিকথিক করছে পিঁপড়ে। যেন কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে জায়গাটা।

মামাবাবুর নির্দেশে টেলরের পা-ও বাঁধলাম। বলা যায় না যদি দৌড়ে পালায়। তারপর ভোর হওয়ার প্রতীক্ষা করতে লাগলাম।

পুবের আকাশ সামান্য ফর্সা হবার সঙ্গে সঙ্গে পাখ-পাখালির কলতান শুরু হল। ঠিক তখুনি কানে এল আন্তোনিওর শিস। মেজাজে সুর ভাঁজতে ভাজতে আসছে। চেঁচিয়ে ডাকলাম, আন্তোনিও, মিস্টার হার্ডি, আমরা এখানে।

আমাদের ওই অবস্থায় দেখে বিল অবাক। কী ব্যাপার, টেলরকে বেঁধে রেখেছেন?

কারণ উনি আমাদের প্রাণনাশের চেষ্টা করেছিলেন!

কীভাবে?

পিঁপড়ে লেলিয়ে দিয়ে।

অ্যাঁ, পিঁপড়ে লেলিয়ে দিয়ে! লোকটা যাদুবিদ্যা জানে নাকি? বিস্ময়ে বিলের চোখ গোল হয়ে ওঠে। আন্তোনিও মাথা নেড়ে বলল, “হুঁ, উইচ-ক্রাফট। আমি শুনেছি। উপজাতীয় ওঝারা মন্ত্রের সাহায্যে সিংহ লেলিয়ে দিতে পারে।

না, জাদু নয়। অতি সূক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক কৌশল। এই শিশিটা দেখছেন, এর মধ্যে ফেরোমন ছিল। কৃত্রিম উপায়ে তৈরি। শিশির গায়ে লেখা রয়েছে আর্মি-অ্যান্ট। তার নিচে লেখা দেখুন–Trail Substance। আর্মি-অ্যান্ট অন্ধ। প্রত্যেক পিঁপড়ে চলার সময় পিছনের। দিকের একটি শুড়ের সাহায্যে মাটিতে একরকম ফেরোমন লাগাতে লাগাতে যায়। এই ফেরোমন-এর নাম Trail Substance। সেই ফেরোমন-এর গন্ধ শুঁকে পিছনের পিঁপড়ে সামনের পিঁপড়েকে অনুসরণ করে দলবদ্ধভাবে এগোয়। আমাদের অনুপস্থিতির সুযোগে টেলর আন্তোনিওর দেখা আর্মি-অ্যান্ট-এর আস্তানা থেকে আমাদের তাঁবু অবধি এই ফেরোমন ছড়িয়ে রেখেছিল। রাতে পিঁপড়ের ঝক চলতে শুরু করে গন্ধ অনুসরণ করে। আমাদের তাঁবুর দিকে এগিয়ে আসে।

উঃ, খুব বেঁচে গেছেন। টের পেলেন কী করে! ঘুম ভেঙে গিয়েছিল বুঝি? বিল বললেন।

আমি জেগেছিলাম। সুনন্দ, অসিত ঘুমোচ্ছিল। নানা কারণে টেলরের ওপর আমার সন্দেহ দানা বাঁধছিল। আজ রক-পেন্টিং দেখেই বুঝলাম, হয়তো আজই বিপদ আসবে।

কেন, রক-পেন্টিংয়ে কী ছিল?

বাজে ছবি। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে আঁকা। হয়তো টেলরের নিজস্ব শিল্পচর্চা। বুঝলাম, আমাদের কায়দা করে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঘুম আসছিল না। মন কোনো বিপদের আশঙ্কা করছিল। তবে আক্রমণ যে এমন বিচিত্র উপায়ে হবে তা অবশ্য আন্দাজ করতে পারিনি! টেলর আঁটঘাট বেঁধেই কাজে নেমেছিলেন। বাঁদরটাকে অবধি ছেড়ে দিয়েছিলেন, পাছে সে চিৎকার করে আমাদের জাগিয়ে দেয়। আমার আর একটা সন্দেহ হয়, আমাদের খাবার জলে কিছু মিশিয়ে দিয়েছিলেন টেলর। খুব সম্ভব ঘুমের ওষুধ। টেলর, সত্যি করে বলুন তো কী করেছিলেন?

টেলর কোনো উত্তর দিল না।

মামাবাবু বললেন, রক-পেন্টিং দেখতে বেরোবার আগে আমি তাঁবুর জিনিসপত্র ভালো করে পরীক্ষা করে যাই। ফিরে এসে তাঁবুতে ঢুকে লক্ষ করে দেখলাম মাটিতে বসানো খাবার জলের জগটা যেন একটু সরানো হয়েছে। জলের রঙও কেমন সামান্য ঘোলা। কোনো রিস্ক না নিয়ে জলটা ফেলে দিই।

অর্থাৎ ওই জল খেলে? আমি সভয়ে বলে উঠি।

হ্যাঁ, আমাদের ঘুম আর কোনো দিনও ভাঙত না।

আমার ইচ্ছে হচ্ছে শয়তানটাকে এক্ষুনি গুলি করে মারি। বিলের ক্রুদ্ধ গর্জনে টেলর যেন শিউরে উঠল। কিন্তু প্রোফেসর, একটা রহস্য বুঝতে পারছি না। আপনাদের হত্যা করে ওর লাভ কী? বিল প্রশ্ন করলেন।

সেটা বোধহয় ডক্টর কার্লোর সঙ্গে কথা বললে বুঝতে পারব। সুনন্দ, আন্তোনিও, তোমরা টেলরকে পাহারা দাও। বিল, অসিত আমার সঙ্গে এসো।

গেট বন্ধ ছিল। পাঁচিল টপকে ভিতরে ঢুকে ঘরের দরজায় করাঘাত করলাম। গোরা কবাট খুলে দিল। তাকে এক ধাক্কায় সরিয়ে আমরা ভিতরে প্রবেশ করলাম। বিল গোরোকে কঠোর গলায় বললেন, চালাকির চেষ্টা করলেই গুলি খাবে। বিল তাকে একটা খালি ঘরে পুরে শিকল লাগিয়ে দিলেন। তারপর কার্লোর খোঁজে আমরা ল্যাবরেটরি ঘরে হাজির হলাম।

.

০৯.

কার্লো একটা চেয়ারে বসে চিন্তামগ্ন ছিলেন। আমাদের দেখে চমকে উঠলেন।–একি, রিপোর্টার! তোমরা এখানে কেন? না, ফেরোমন রিসার্চ সম্বন্ধে আমি এখন একটি কথাও বলব না। কাজ শেষ না হলে কাউকে কিছু জানাব না। কার্লো প্রায় মারতে আসেন আর কি!

মামাবাবু শান্ত গলায় বললেন, “আমরা রিপোর্টার, কে বলেছে?

কেন, টেলর।

টেলর আপনাকে ভুল বুঝিয়েছে। আমি একজন প্রাণিবিজ্ঞানী। আপনার প্রতিভাকে শ্রদ্ধা করি। আমি জানতে এসেছি, ফেরোমন নিয়ে কে গবেষণা করছে? আপনি, না টেলর? না, দুজনে একসঙ্গে?

ফুঃ! টেলর ফেরোমন-এর কী বোঝে? কোনো মৌলিক গবেষণা করার মতো ওর মাথাই নেই।

কিন্তু জুওলজি পত্রিকায় টেলর নিজের নামে ফেরোমন-এর ওপর দুটি প্রবন্ধ লিখেছে। আমি নিজে পড়েছি। একেবারে মৌলিক গবেষণা। প্রথমটা পঙ্গপালের বংশবৃদ্ধিতে ফেরোমন-এর প্রভাব। দ্বিতীয়টি কৃত্রিম ফেরোমন তৈরি সম্বন্ধে।

কার্লোর দৃষ্টি বিস্ফারিত। সর্বনাশ! তার মানে সে আমার লেখা চুরি করেছে। গবেষণা সংক্রান্ত আরও অনেক মূল্যবান পেপারস্ একসঙ্গে ছিল। ওর কাজ ছিল আমার লেখা টাইপ করে এখানে গুছিয়ে রাখা। উঃ কী বিশ্বাসঘাতক, কী শয়তান! কোথায় সে

কার্লোর চেহারা ক্ষিপ্ত ব্যাঘ্রের মতো।

আচ্ছা, টেলরের সঙ্গে আপনার পরিচয় হয় কীভাবে? মামাবাবু প্রশ্ন করলেন।

কার্লো কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিলেন। তারপর বললেন–প্রথম পরিচয় এক উপজাতি গ্রামে। তারপর অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে হাসপাতালে থাকার সময় ও আমায় দেখতে আসে। সেবাযত্ন করে। হাসপাতাল থেকে বেরোবার পর টেলরই আমাকে এই নির্জনে ল্যাবরেটরি বানিয়ে কাজ করার পরামর্শ দেয়। দুর্ঘটনায় আমার মুখ বিকৃত হয়ে গেছিল। লোকে হাঁ করে মুখের দিকে চেয়ে থাকত। ফলে লোকজনের ভিড় আমার কাছে তখন অসহ্য হয়ে উঠেছিল। তার প্রস্তাব তাই সানন্দে গ্রহণ করি। ও আমাকে নিজের পয়সা খরচ করে ল্যাবরেটরি বানিয়ে দিয়েছিল। দরকারমতো নানা জায়গায় সঙ্গে করে নিয়ে যেত।

টেলর আফ্রিকায় কী করছিল? বিল জিজ্ঞেস করল। ঠিক জানি না। বলেছিল, ও একজন প্রাণিবিজ্ঞানী। বিভিন্ন প্রজাতির পিঁপড়ের তালিকা তৈরি করছে। খুব ভদ্র ছিল। কৃতজ্ঞতাবশে ভেবেছিলাম আমার আবিষ্কারে ওর নামটাও জুড়ে দেব। ভাবতে পারিনি আমায় ঠকাবে। আমার এতদিনের সাধনা চুরি করবে! ওঃ!

মনকে শক্ত করুন ডক্টর কার্লো। আপনার কাগজপত্র আশা করছি উদ্ধার করতে পারব। মনে হয় ও অপেক্ষায় ছিল আপনার গবেষণা শেষ হলে, আপনাকে চিরতরে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়ে সমস্ত গবেষণা নিজের নামে প্রকাশ করে বিখ্যাত হবে। কেউ টের পেত

তার জোচ্চুরি। দৈবাৎ আমি আপনাকে চিনে ফেলাতে তার প্ল্যান ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম হল। তখন আমাদের খতম করার পরিকল্পনা করল।

সে কি! হ্যাঁ, আপনারই তৈরি কৃত্রিম ফেরোমন-এর সাহায্যে! আচ্ছা ডক্টর কার্লো, কয়েকদিন আগে টেলর একটা ছোট পাহাড়ের কাছে তাঁবু ফেলেছিল। সেখানে কি আপনিও ছিলেন? আপনার জুতোর ছাপ যেন আমি লক্ষ করেছি। বিল কার্লোর জুতোর দিকে চেয়ে বললেন।

হ্যাঁ, ছিলাম। আমি আগে চলে আসি। টেলর পরে এল। ওখানে কী করছিলেন? মামাবাবু প্রশ্ন করলেন। আমি ওই পাহাড়ের গুহায় কিছু আদিম মানবের পাথরের অস্ত্র-শস্ত্র দেখতে পাই। টেলরকেও দেখিয়েছিলাম। জিনিসগুলো পরীক্ষা করছিলাম হঠাৎ টেলর বলল, বৃষ্টি নামবে। আপনি এখুনি ফিরে যান, আমি কয়েকদিন পরে যাচ্ছি।

হুম্। ঠিক আছে। আপনি বিশ্রাম করুন, উত্তেজিত হবেন না। আমরা চললাম।

আমার পেপার্স? কার্লো আর্তনাদ করে উঠলেন।

দেখি, কী করতে পারি।

বাইরে এসে মামাবাবু বললেন, টেলরের ওপর আমার প্রথম সন্দেহ জাগে কখন, জানো? আন্তোনিওর কথা শুনে।

কী কথা?

সেই যে আন্তোনিও বলল, লিবিয়ায় এক মরূদ্যানে সে কার্লোকে দেখেছিল। একা। অথচ টেলরের প্রবন্ধে ছিল সে ঠিক ওই সময়ে এবং ওই জায়গায় পঙ্গপাল নিয়ে রিসার্চ করে। ফলে আমার ধোঁকা লাগল–কে গবেষণা করছিল? টেলর না কার্লো? টেলর কি তবে কার্লোর কাজ চুরি করেছেন? আমার অনুমান দেখলাম সঠিক।

বন্দী গোলোর ঘরের শিকল খুলে মামাবাব ভিতরে ঢুকলেন। গোরো মাটিতে বলে চিল। ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল। মামাবাব ধমক দিয়ে বললেন, “আমাদের পোটারদের দেবতার গল্প বলে ভয় দেখাতে কে তোমায় নির্দেশ দিয়েছিল? সত্যি কথা বলবে, নইলে–

টেলর সাহেব, বানা।

মামাবাবু আর কথা না বলে শিকল তুলে দিয়ে বেরিয়ে এলেন।টেলর কেন এখানে আমাদের কাজ বন্ধ করতে চেয়েছিল বুঝতে পারছ?

হ্যাঁ, পাছে আমরা ওই গুহার সন্ধান পাই।

অতি লোভে তাঁতি নষ্ট। মামাবাবু মন্তব্য করলেন।

.

১০.

মামাবাবু টেলরকে প্রশ্ন করলেন, কার্লোর পেপার্স কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন?

আমি লুকোইনি। টেলরের মিষ্ট ভদ্রতার মুখোশ খসে পড়েছে। চোখে ক্রুর হিংস্র দৃষ্টি।

ও, ভালো কথায় কাজ হবে না। বেশ আপনার দাওয়াই আপনারই ওপর প্রয়োগ করব। দেখি, কথা বেরোয় কিনা? সুনন্দ অসিত, টেলরকে ওই গাছটার সঙ্গে বাঁধে।

ফেরোমন-এর শিশিতে সামান্য তলানি পড়েছিল। মামাবাবু তাতে খানিক জল মেশালেন। তারপর আমাদের তাঁবুর কাছে গেলেন।

তখন তাঁবুতে খোলা খাবার একটুকরোও অবশিষ্ট ছিল না। বিল একটা হরিণ মেরে। গাছে ঝুলিয়ে রেখেছিল। শুধু কঙ্কালটা দুলছে। তাঁবুর কাপড়টা অবধি কেটে কুটিকুটি করেছে ক্ষুধার্ত পিপীলিকারা।

মামাবাবু সাবধানে তাঁবুর কাছে গিয়ে পিপীলিকা ব্যুহের গা থেকে ফেরোমন ঢালতে ঢালতে পিছিয়ে এলেন। থামলেন টেলরের সামনে। তারপর সরে আমাদের কাছে এসে বললেন, দেখা যাক।

গভীর আগ্রহে লক্ষ করি। কিছুক্ষণ পরে দেখলাম কয়েকটা পিঁপড়ে ফেরোমন-এর গল্প শুঁকে শুঁকে আস্তে আস্তে এগোচ্ছে। দেখতে দেখতে চারদিক থেকে দলে দলে পিঁপড়ে ছুটে এসে তাদের অনুসরণ করতে লাগল। কয়েক মিনিটের মধ্যে এক বিশাল বাহিনী ফেরোমনের গন্ধ বেয়ে সড়সড় করে এগিয়ে চলল। আন্তোনিও চট করে তার ক্যামেরা বাগিয়ে ধরল।

মামাবাবু বেশ দার্শনিকভাবে বলতে লাগলেন–বুঝলে অসিত, আর্মি-অ্যান্টরা হল যাযাবর। দল বেঁধে কেবল ঘোরে। দিনের বেলায় গাছ বা পাথরের ছায়ায় বিশ্রাম নেয়। রাতে পথ চলে। এদের আর এক নাম ড্রাইভার অ্যান্ট।

আঁ-আঁ! চমকে উঠে দেখি টেলর প্রাণপণে বাঁধন ছেড়বার চেষ্টা করছেন। তার বিস্ফারিত দৃষ্টি আগুয়ান পিঁপড়ে বাহিনীর ওপর নিবদ্ধ।

মামাবাবু বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ না করে বললেন, আমি-অ্যান্ট-এর এই প্রজাতির নাম ডরিলাস। এদের সাউথ আমেরিকান জাতিভাইদের নাম হল অ্যাকিটন। এদের সম্বন্ধে অনেক গল্প আছে।

আমায় ছেড়ে দাও! আমি বলছি। টেলর আর্তনাদ করে ওঠে। পিঁপড়ের স্রোত তখন মাত্র হাত কুড়ি দূরে।

কোথায়?

গুদোম ঘরে, মাটির নিচে সিন্দুকে।

উত্তম। সুনন্দ, ওকে খুলে সরিয়ে আনো।

সুনন্দ বলল, মিস্টার আন্তোনিও, তুমি কখনও আর্মি-অ্যান্ট-এর ভোজের ছবি তুলেছ? দারুণ সাবজেক্ট। টেলর যদি অনুগ্রহ করেন–

খুলে দাও! টেলর উন্মাদের মতো চেঁচালো। পিঁপড়ে বাহিনী তখন দশ হাত তফাতে। সুনন্দ দ্রুত তার বাঁধন খুলে সরিয়ে আনল।

মামাবাবু বাকি ফেরোমনটুকু গাছের চারপাশে গোল করে ছড়িয়ে দিলেন। টেলরকে বললেন, আশা করি সত্যি কথা বলছেন। মিথ্যে হলে কিন্তু এবার নির্ঘাৎ আপনাকে পিঁপড়ের ভোজে লাগাব।

একটা মজার ব্যাপার দেখলাম। সারিবদ্ধ পিঁপড়েরা এসে গাছের গুঁড়ির চারধারে ক্রমাগত গোল হয়ে ঘুরতে শুরু করল। চক্কর খেয়েই চলেছে! কখন থামবে কে জানে!

গুদোমঘরের আবর্জনা সরিয়ে, মেঝের তক্তা উঠিয়ে সিন্দুক আবিষ্কার করতে দেরি হল । মস্ত সিন্দুক। অনেক খোপ। একটা খোপ খুলে মামাবাবু বললেন, এই যে পেয়েছি। তিনি ফাইলটা বাইরে-দাঁড়ানো কার্লোর হাতে দিলেন। ভিতরের কাগজপত্রে চোখ বুলিয়েই কার্লো, পেয়েছি, পেয়েছি বলে মামাবাবুকে আনন্দে জাপটে ধরলেন।

আমি দেখলাম, বিল সিন্দুকের অন্য খোপগুলো ঘাঁটছেন। কয়েকটা বড় বড় মোড়ক খুলে মন দিয়ে দেখলেন। ঘরের তাক ও কোণগুলো তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগলেন। একটু পরে আমরা বেরিয়ে এলাম।

টেলরকে ল্যাবরেটরিতে একটা চেয়ারে বসিয়ে আমরা ঘিরে বসলাম। টেলরের মুখ ভাবলেশহীন। যেন বেকায়দা অবস্থাটা সে খানিক সামলে নিয়েছে। বলল, “আপনাদের কার্যসিদ্ধি হয়েছে। এবার আমায় ছেড়ে দিতে পারেন। মনে রাখবেন, আমার বিরুদ্ধে আপনাদের অভিযোগগুলো একটাও কোর্টে টিকবে না। বরং উল্টে আমি আপনাদের বিরুদ্ধে মানহানির মোকদ্দমা আনতে পারি।

উঃ, সাংঘাতিক লোক! কী নার্ভ! একটু হকচকিয়ে গেলাম।

বিলের গম্ভীর গলা শুনলাম–মিস্টার টেলর, আইন-কানুন সম্বন্ধে আপনার বেশ জ্ঞান আছে দেখছি। কিন্তু চোরা কোকেন-কারবারিকেও কি আইন ছেড়ে দেবে? কী বলেন?

টেলরের মুখ দেখলাম ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।

মোহোরাতে আমার এক পুলিশ ইন্সপেক্টর বন্ধু বলেছিল, টাঙ্গানিকায় চোরা কোকেন। চালান খুব বেড়ে গেছে। দলটাকে কিছুতেই ধরা যাচ্ছে না। এদের ব্রেন একজন শ্বেতাঙ্গ। দলের খুব কম লোক তাকে চেনে। বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক টেলর বোধহয় সেই লোক। কি, ঠিক বলছি?

টেলর রেগে বললেন, আমায় মিথ্যে মামলায় জড়াবার চেষ্টা করছেন।

বেশ বেশ, পুলিশ আসুক। গুদোম-ঘর সার্চ করুক। তারপর আমার কথার সত্যি-মিথ্যে তারা বিচার করবে। টেলর গোঁজ মেরে বসে রইল।

টেলরকে একটা খালি ঘরে বন্দী করে বাইরে থেকে তালা দেওয়া হল।

মামাবাবু কার্লোকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি এখন কী করবেন?

ভাবছি ফিরে যাব। আপনারা কবে ফিরছেন?

আপনি সঙ্গে গেলে এখুনি ফিরতে পারি।

বেশ তাই যাব। আমার কাজ প্রায় শেষ। বাকিটুকু না হয় নাইরোবিতে বসে করব। সেখানে মার্টিন নামে এক ছোকরা প্রাণিবিজ্ঞানী আছে। বহুবার সে আমার অধীনে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তাকে অ্যাসিস্ট্যান্ট করে নেব। আচ্ছা ঘোষ, এই ল্যাবরেটরির কী হবে?

কেন, যা-যা দরকারি জিনিস আছে সঙ্গে নিয়ে চলুন।

কিন্তু এসব তো টেলরের সম্পত্তি।

তাতে কী হয়েছে? টেলর আপনাকে ঠকাতে চেয়েছিল। তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে বৈকি! মামাবাবু নির্বিকারভাবে মন্তব্য করলেন।

পরদিন সকালে টেলরের ঘর খুলে দেখা গেল, পাখি পালিয়েছে। ঘর ফাঁকা। আবিষ্কার হল, ঘর থেকে পাঁচিলের বাইরে অবধি এক গোপন সুড়ঙ্গপথ। বিল আপশোস করলেন, ঘরটা পরীক্ষা করে দেখা উচিত ছিল।

সুনন্দর মন খারাপ হয়ে গেল। ইস, লোকটাকে শাস্তি দেওয়া গেল না। এত বড় জোচ্চোর! তার ওপর আমাদের মারার চেষ্টা করেছিল।

বিল সুনন্দর পিঠ চাপড়ে বললেন, ব্রাদার, শাস্তি ও পাবে। আর কোনো দিন টেলর সভ্যজগতে আত্মপ্রকাশ করতে পারবে না। জেলের ভয়ে পালিয়ে বেড়াবে। হয়তো ধরাও পড়বে। এও কি কম শাস্তি?

ঠিক হল, এখান থেকে আমরা যাব সেই খাদের কাছে। যে কদিন হাতে সময় অন্য ফসিলের অনুসন্ধান করব। বিল পোটার জোগাড় করে ফেললেন। গোসাপ দেবতার বাপারটা ছিল টেলরের কারসাজি। স্থানীয় লোকদের সে ভয় দেখিয়ে রেখেছিল, যাতে তারা খাদে খোঁড়াখুঁড়ি করতে রাজি না হয়। টেলর পালিয়ে যেতে তাদের ভয় ভেঙে গেল।

মামাবাবুর সঙ্গে কার্লোও মহা উৎসাহে ফসিলের সন্ধানে লেগে গেলেন। কয়েকটি দুষ্প্রাপ্য ফসিল উদ্ধার হল কিন্তু দুঃখের বিষয়, মামাবাবু যে ফসিলটি খুঁজতে এসেছিলেন তা পাওয়া গেল না।

ছ-দিন পর আমরা ডার-এস-সালাম ফিরে যাবার জন্য তাঁবু ওঠালাম।

ফসিল পেলেন না বলে মামাবাবুর দেখলাম মোটেই দুঃখ নেই। আমি সমবেদনা জানাতে গিয়েছিলাম। হেসে বললেন, আরে, এসব আবিষ্কার কি সহজে হয়! লাক চাই। কেউ সারা জীবন খুঁজেও পায় না, আবার কেউ দুদিনেই আবিষ্কার করে ফেলে। তবে হার মানছি না, পরের বছর আবার আসব। আর, শূন্য হাতে ফিরছি কে বলল? এত বড় একটা আবিষ্কার করে ফেললাম যে!

কী আবিষ্কার? আমার ধাঁধা লাগে।

কেন, ব্রুস টেলরের প্রকৃত পরিচয় আবিষ্কার করলাম। এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র ফাস করে দিলাম। আর ফাউ হিসাবে কেমন এক অ্যাডভেঞ্চার জুটে গেল বরাতে।

তা বটে! সুনন্দ সায় দিল, আফ্রিকায় আমাদের দ্বিতীয় অ্যাডভেঞ্চারটা ভালোই হল! আমি বললাম, যদিও কিঞ্চিৎ বিপজ্জনক!

আন্তোনিও আমাদের অনেক দূর অবধি পৌঁছে দিল। তারপর একজন পোর্টার সঙ্গে নিয়ে বিদায় নিল। তাকে যেন একটু মনমরা দেখাচ্ছিল। যাবার আগে বিনা অনুরোধে আমাদের সবাইকার ফোটো তুলে সে একগাদা ফিল্ম নষ্ট করে ফেলল!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *