১.৩ প্রথম পর্ব – ভাটা

হঠাৎ আলো

দুপুরের দিকে জল যখন বাড়তে শুরু করল, পিয়া লক্ষ করল আগের মতো অত ঘন ঘন আর দেখা যাচ্ছে না ডলফিনগুলোকে। ডেটাশিটটা এক ঝলক দেখে নিঃসন্দেহ হল ও জোয়ার আসার সাথে সাথে মনে হচ্ছে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে ওরা।

সকালের দিকটায় পিয়া কাজ করছিল ঝড়ের গতিতে। ওর ধারণা ছিল এটা একটা ভেসে বেড়ানো শুশুকের দল, আপাতত এখানে আছে, কিন্তু যে-কোনও সময়ে চলে যাবে নজরের বাইরে। কিন্তু এতক্ষণ ধরে প্রাণীগুলোর হাবভাব লক্ষ করে বিশেষ কোনও গন্তব্য ওদের আছে বলে তো মনে হচ্ছে না। বরঞ্চ বোধ হচ্ছে শুধু এই জায়গাটুকুতেই ঘোরাঘুরি করে ভাটার সময়টা কাটিয়ে দিতে চাইছিল ওরা। জল যেই বাড়তে শুরু করেছে, এখন আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে এখান থেকে। কিছুই বোঝা যাচ্ছে না মাথামুণ্ডু, নিজের মনেই বলল পিয়া। এই ডলফিনদের সম্পর্কে ওর যেটুকু জানা আছে এদের ব্যবহার তো একেবারেই খাপ খাচ্ছে না তার সঙ্গে।

সাধারণত দুটো উপজাতিতে ভাগ করা যায় এই ওর্কায়েলা ডলফিনদের। একটা জাত ভালবাসে সমুদ্র উপকূল অঞ্চলের লোনা জল, আর অন্যটা নদীনালা বা মিষ্টি জলে থাকতে পছন্দ করে। দু’দলের মধ্যে শারীরিক গঠনগত কোনও তফাত নেই, তফাত শুধু বাসস্থান নির্বাচনে। এই দু’জাতের মধ্যে সমুদ্র উপকূলবর্তী ডলফিনদেরই দেখা যায় বেশি। দক্ষিণ এশিয়া এবং উত্তর অস্ট্রেলিয়া অঞ্চলে বেশ কয়েক হাজার এ ধরনের ডলফিন আছে বলে জানা গেছে। অন্য দিকে মিষ্টি জলের ওর্কায়েলারা সংখ্যায় অনেক কম–ক্রমশ আরও কমে আসছে। এশিয়ার কোনও কোনও অঞ্চলের নদীতে এদের আর কয়েকশো মাত্র অবশিষ্ট আছে। উপকূলীয় প্রজাতির ডলফিনরা সাধারণত বেশিক্ষণ এক জায়গায় থাকে না, সমুদ্রের তীর বরাবর ভেসে ভেসে বেড়ায়। কিন্তু মিঠে জলের প্রজাতির প্রাণীগুলি নিজেদের নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যেই থাকতে পছন্দ করে। খুব বৃষ্টির সময় নদীর জল বেড়ে গেলে মাঝে মাঝে শিকারের পেছন পেছন খানিকটা দূরে কোনও খাল বা নালা, এমনকী ধানক্ষেতের মধ্যে পর্যন্ত চলে আসতে দেখা গেছে এদের। কিন্তু শুখা মরশুমে জল কমে এলে ফের এরা ফিরে যায় সেই নিজেদের নির্দিষ্ট জায়গাতে। অনেক সময় ভূপ্রাকৃতিক কারণে বা নদীর স্রোতের হেরফেরে নদীর নীচে গভীর পুকুরের মতো খাতের সৃষ্টি হয়। সাধারণত ওই পুকুর’-গুলোতে থাকতে পছন্দ করে মিষ্টি জলের ডলফিনরা। কম্বোডিয়াতে কাজ করার সময় নম পেন থেকে লাওস সীমান্ত পর্যন্ত মেকং নদী বরাবর এরকম অনেকগুলি ‘পুকুর’-এর সন্ধান পেয়েছিল পিয়া। তখন দেখেছিল বছরের পর বছর ধরে একই ডলফিন একই নির্দিষ্ট ‘পুকুরে’ বার বার ফিরে আসছে। কিন্তু প্রতি বছরই ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শত শত কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ভাটির দিকে চলে যেত ওরা। একবার তো লাওস সীমান্ত অঞ্চলের একটা ডলফিন নম পেনের কাছাকাছি গিয়ে একটা মাছ-ধরা জালে জড়িয়ে মারা পড়ল।

সুন্দরবনে এসে পিয়া ভেবেছিল এখানে যদি কোনও ওর্কায়েলা দেখতে পায় সেটা নিশ্চয়ই উপকূলীয় প্রজাতির হবে। সেটাই স্বাভাবিক মনে হয়েছিল, কারণ এখানকার নদী-খাড়িগুলির জল যথেষ্ট লোনা। কিন্তু আজকে যে অভিজ্ঞতা হল তার পর তো মনে হচ্ছে ভুল ভেবেছিল ও। এগুলো যদি উপকূলীয় প্রজাতির ডলফিনই হয় তা হলে নদীর মধ্যের এই পুকুরে এরকম দল বেঁধে ঘোরাঘুরি করছে কেন। ওদের স্বভাব তো এরকম নয়–শুধু মিষ্টি জলের ডলফিনরাই এরকম করে। কিন্তু সে ডলফিন তো এখানে এত লোনা জলে থাকার কথা নয়। আর তা ছাড়া নদীর ডলফিনরা এরকম হঠাৎ করে দুপুরবেলা তাদের ‘পুকুর’ ছেড়ে উধাও হয়ে যায় না। পুরো একটা ঋতু তারা সেখানে কাটায়। তা হলে কী ধরনের প্রাণী এগুলো? আর এদের এরকম অদ্ভুত ব্যবহারের মানেটাই বা কী?

ভাবতে ভাবতে হঠাৎ একটা নতুন চিন্তা মাথায় এল পিয়ার। আচ্ছা, এরকম কি হতে পারে যে মেকং-এর ডলফিনরা যেটা বছরে একবার করে, এই সুন্দরবনের শুশুকেরা সেটাই করে প্রতিদিন দু’বার করে? হতেই পারে যে এই ভাটির দেশের পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার জন্য এই নতুন উপায় বের করেছে এরা? মেকং ডলফিনদের বার্ষিক জীবনছন্দকে এখানকার প্রাত্যহিক জোয়ার-ভাটার চক্রের সঙ্গে মিলিয়ে এক এক দিনের হিসেবে সংক্ষিপ্ত করে নিয়েছে এই শুশুকগুলো?

পিয়া বুঝতে পারছিল যদি কোনওভাবে বিষয়টা ও প্রমাণ করতে পারে, তা হলে একটা আশ্চর্য নিটোল নতুন তত্ত্ব খাড়া করা যাবে; স্তন্যপায়ী প্রাণীদের বিশৃঙ্খল অভ্যাসের জগতে সেটা হবে এক বিরল সৌন্দর্যের প্রতীক। তবে তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল এই লুপ্তপ্রায় প্রজাতির সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও সে তত্ত্বের বিশাল ভূমিকা থাকবে। এই বিশেষ দহগুলোকে এবং এই ডলফিনদের যাতায়াতের পথগুলোকে যদি চিহ্নিত করা যায় তা হলে সেই অঞ্চলগুলোর ওপর জোর দিয়ে পরবর্তী কালে সংরক্ষণের কাজ করা যাবে। অনেক বেশি কার্যকরী হবে সেই ব্যবস্থা। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সামান্য দু-একটা সূত্র শুধু পাওয়া গেছে। তত্ত্ব দাঁড় করাতে গেলে আরও বহু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে হবে পিয়াকে। যেমন, কী ধরনের শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তনের ফলে এখানকার জোয়ার-ভাটার চক্রের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পেরেছে এই শুশুকরা? এদের দৈনিক জীবনছন্দটাই সেভাবে বদলে গেছে তাও ঠিক বলা যায় না, কারণ জোয়ার-ভাটার সময় এখানে প্রতিদিনই পালটে যায়। বর্ষার সময় যখন নদীতে মিষ্টি জলের পরিমাণ বেড়ে যায়, তখনই বা কী হয়? সে সময় তো জলে নুনের মাত্রা অন্য সময়ের মতো থাকে না। এই দৈনিক পরিযাণ চক্র কি তা হলে দীর্ঘতর কোনও ঋতুছন্দের মাত্রার ওপর নতুন খোদকারি?

অনেক দিন আগে পড়া একটা স্টাডির কথা মনে পড়ল পিয়ার। তাতে দেখা গিয়েছিল গোটা ইয়োরোপ মহাদেশে যত প্রজাতির মাছ আছে তার চেয়ে অনেক বেশি প্রজাতির মাছ দেখতে পাওয়া যায় এই সুন্দরবনে। সেখানে বলা হয়েছিল এত বিচিত্র জাতের জলজ প্রাণী এখানে পাওয়া যাওয়ার কারণ হল এখানকার জলের প্রকৃতির বিভিন্নতা। গাঙ্গেয় বদ্বীপের এই বিশেষ অঞ্চলটিতে নদী এবং সাগরের জল সর্বত্র সমান ভাবে এসে মেশে না। বরং বলা যায় সুন্দরবনের নদী-খাড়িতে এই দুই জলস্রোত পরস্পরের মধ্যে ঢুকে আসে–কোনও কোনও জায়গায় মিষ্টি জলের স্রোত নদী বা খাঁড়ির একেবারে নীচের মাটি বরাবর বয়ে চলে; ফলে হাজারো বৈচিত্র্যের সৃষ্টি হয় তোনাভাব এবং পলির মাত্রায়, তৈরি হয় শত শত বিভিন্ন জৈবক্ষেত্র। এই অণুজীবমণ্ডলগুলি তাদের নিজের নিজের গতিতে কতকটা বেলুনের মতো ভেসে বেড়ায় জলের মধ্যে। অবিরাম তারা জায়গা বদলায়, কখনও চলে যায় মাঝনদীতে, আবার ফিরে আসে তীরের কাছাকাছি। কোনও কোনও সময় সমুদ্রের মধ্যেও অনেকদূর পর্যন্ত এগুলো ভেসে চলে যায়, আবার কখনও নদী-খাঁড়ি বেয়ে উজান ঠেলে চলে আসে অনেক ভেতরে। এই প্রতিটি বেলুন হল একেকটি ভাসমান জীবগোলক, তাতে ঠাসা থাকে তার নিজস্ব প্রাণী ও উদ্ভিদজগৎ। আর জলের মধ্যে দিয়ে যখন এরা ভেসে চলে, পেছন পেছন সারে সারে চলতে থাকে শিকারি প্রাণীর দল। এই বিভিন্ন পরিবেশমণ্ডলের অস্তিত্বের জন্যই বিশালকায় কুমির থেকে শুরু করে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মাছ পর্যন্ত বিভিন্ন মাপের জলজ প্রাণীদের নিয়ে বৈচিত্র্যময় এক বিশাল জীবজগতের সৃষ্টি হয়েছে এই সুন্দরবনে।

এখন এই নৌকোর ওপর বসে এই সমস্ত কিছুর মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ আর সম্পর্কের কথা ভাবতে ভাবতে মনের মধ্যে একের পর এক এত সব সম্ভাবনার দরজা খুলে যেতে লাগল যে মাথা ধাঁধিয়ে গেল পিয়ার; চোখ বন্ধ করে ফেলল ও হাতের সামনে অজস্র সূত্র, কত কিছু করতে হবে এখন, বহু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে হবে; কাজ চালানোর মতো শিখে নিতে হবে অনেকগুলি বিষয়–হাইড্রলিক্স, সেডিমেন্টেশন জিওলজি, ওয়াটার কেমিস্ট্রি, ক্লাইমেটোলজি; একটা ঋতু-ভিত্তিক গণনা করতে হবে এখানকার ডলফিনদের, ওদের যাতায়াতের পথের ম্যাপ তৈরি করতে হবে, গ্রান্টের জন্য কাঠখড় পোড়াতে হবে, নানা রকম পারমিট আর পারমিশনের জন্য দরখাস্ত করতে হবে; কোনও কূল কিনারা নেই কাজের। ওকে সুন্দরবনে পাঠানো হয়েছে মাত্র দু’সপ্তাহ সময় দিয়ে, ছোট একটা সার্ভে করার জন্য। বাজেটও খুবই কম। কিন্তু যেসব প্রশ্ন এখন মাথায় ঘুরছে তার উত্তর খুঁজে বের করা তো এক দু’সপ্তাহের কাজ নয়, বছরের পর বছর সময় দিতে হবে, কয়েক দশক লাগলেও আশ্চর্য হবে না পিয়া। নদীনালায় ঘুরে ঘুরে ফিল্ড রিসার্চই করতে হতে পারে পনেরো-কুড়ি বছর ধরে। এই প্রজেক্ট শেষ করতে গেলে সে সময়টা অন্তত দিতে হবে ওকে। এমনকী, বলা যায় না, হয়তো সারা জীবন ধরেও কাজ করে যেতে হতে পারে।

যে সমস্ত ফিল্ড বায়োলজিস্টরা স্মরণীয় কাজ করার মতো বিষয় খুঁজে পেয়েছেন যেমন কিনিয়ার পার্বত্য অঞ্চলে কাজ করেছেন জেন গুডল, কুইন্সল্যান্ডের জলাভূমিতে কাজ করেছেন হেলেন মার্শ–কত সময় তাদের ঈর্ষা করেছে পিয়া। কিন্তু খুব একটা উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই বলে ওর নিজের কপালেও একদিন এরকম কিছু জুটে যেতে পারে বলে কখনও ভাবেনি। তা সত্ত্বেও এই সুযোগ এসে গেল হাতের সামনে। এবং এরকম অকল্পনীয়ভাবে–যখন মনে হচ্ছিল কিছুই ঠিকমতো হচ্ছে না, কেবলই একের পর এক বাধা আসছে কাজে। ছোটবেলায় যেসব আশ্চর্য আবিষ্কারের গল্প পড়ে বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ জন্মেছিল, সেই গল্পগুলি মনে পড়ল পিয়ার। কেমন অদ্ভুত, প্রত্যেক ক্ষেত্রেই কিন্তু অনুপ্রেরণা এসেছিল সাধারণ সব দৈনন্দিন ঘটনা থেকে যেমন আর্কিমিডিস আর তার বাথটাব, নিউটন আর সেই আপেলগাছ। অবশ্য সেসব আবিষ্কারের সাথে ওর এই কাজকে কোনওভাবেই তুলনা করা যায় না, কোনওরকম কোনও মিলও নেই কিন্তু অন্তত ও এখন বুঝতে পারছে কীভাবে হয় ব্যাপারটা, কেমন করে একটা আশ্চর্য ভাবনার ঝলক হঠাৎ মাথায় এসে যায়, আর এক মুহূর্তে ঠিক হয়ে যায় এই কাজটাই তাকে করে যেতে হবে বাকি জীবন ধরে।

বড় বৈজ্ঞানিক হবে এরকম উচ্চাশা পিয়ার কোনওদিনই ছিল না। যদিও জলচর প্রাণীদের ও ভালবাসে এবং তাদের বিষয়ে জানার আগ্রহও আছে, কিন্তু মনে মনে পিয়া ভাল করেই জানে যে শুধু সেইজন্যই ও এ কাজ করতে এসেছে তা ঠিক নয়। বাকি অনেকের মতোই ওইসব প্রাণীদের প্রতি ভালবাসা ছাড়াও ফিল্ড বায়োলজিতে ওর আকর্ষণের আরেকটা কারণ এই কাজের ইন্টেলেকচুয়াল দিক–এখানে ও নিজের মতো করে কাজ করতে পারবে, রোজ কোনও নির্দিষ্ট অফিসে হাজিরা দিতে হবে না, চেনাজানা জগতের পরিধির বাইরে বাইরে কাজ করা যাবে, এবং পরস্পরের প্রতি দায়বদ্ধ অথচ আলগা সম্পর্কের একটা নিজস্ব সমাজও থাকবে। এখন এই বিশাল কাজ যদি ও হাতে নেয়, সেই ব্যাপারগুলি হয়তো খুব একটা কিছু পালটাবে না, কারণ আপাতত বেশিরভাগ সময়টাই কাটবে সেই দরখাস্ত লেখা, গ্রান্ট জোগাড়ের চেষ্টা আর ওই রকম সব গতানুগতিক কাজে। আর শেষ পর্যন্ত যাই হোক না কেন এই গবেষণার ফলে বিজ্ঞান জগতে যে মারাত্মক কিছু তোলপাড় হয়ে যাবে তা তো নয়। কিন্তু এসব কিছু সত্ত্বেও, এভাবে নিজের ভবিষ্যৎ ঠিক করে নেওয়া বা আগামী বছরগুলিতে কী করবে সে চিন্তার দায় থেকে মুক্তি পাওয়ার মধ্যে যে কী তৃপ্তি তা কি পিয়া আগে কখনও ভাবতে পেরেছিল? আর বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন কিছু না ঘটাতে পারলেও, এটা তো ঠিক যে শেষ পর্যন্ত সফল যদি হয় পিয়া–এমনকী আংশিক ভাবেও যদি হয় তা হলেও বর্ণনামূলক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এক চমৎকার অবদান হিসেবে থেকে যাবে ওর কাজ। তাই যথেষ্ট; বেঁচে থাকার কৈফিয়ত হিসেবে অন্য কিছুর আর দরকার নেই পিয়ার। অন্তত এই পৃথিবীতে থাকার সময়টুকু ও বাজে খরচ করেছে সে অপবাদ তো কেউ দিতে পারবে না।

.

ময়না

কানাই নীলিমার দরজায় গিয়ে আবার যখন কড়া নাড়ল তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে বিছানা থেকে উঠে মাসি জামাকাপড় পালটে নিয়েছে দেখে ভাল লাগল ওর।

“আরে কানাই,” নীলিমা ডাকল হাসিমুখে, “আয় আয়, ভেতরে আয়।”

সকালের মন খারাপের এতটুকুও চিহ্ন নেই আর মাসির মুখে। কানাই আন্দাজ করল নিশ্চয়ই এতক্ষণ অফিসে কাজকর্ম করে মুড ভাল হয়ে গেছে। মেসো মারা যাওয়ার ধাক্কা, এতগুলো বছরের একাকিত্ব তা হলে এভাবেই ভুলে থেকেছে মাসি–কাজের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রেখে।

“ময়নাকে খবর দিয়েছি, এক্ষুনি এসে যাবে ও,” বলল নীলিমা, “তোকে নিয়ে একবার হাসপাতালটা ঘুরিয়ে দেখাতে বলেছি ওকে।”

“ময়না করেটা কী এখানে?” কানাই জিজ্ঞেস করল।

“ও এখানকার ট্রেনি,” নীলিমা জবাব দিল। “অনেক বছর ধরে এই ট্রাস্টে কাজ করছে, সেই আমরা যখন ‘বেয়ারফুট নার্স প্রোগ্রাম’ চালু করেছিলাম তখন থেকে। ওই প্রোজেক্টটা নেওয়া হয়েছিল এখানকার সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছনোর জন্য, দূরদূরান্তের গ্রামের লোকেরাও যাতে কিছু অন্তত চিকিৎসার সুবিধা পায় সেই জন্য। কয়েকজন নার্সকে আমরা সাধারণ কিছু ট্রেনিং দিয়ে দিয়েছিলাম–সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি, নিউট্রিশন, কিছু প্রাথমিক চিকিৎসা, প্রসবের কাজ, আরও টুকিটাকি দু-একটা–যেমন কেউ জলে ডুবলে কী করতে হবে, এইসব। জলে ডোবার ঘটনা তো আকছার লেগেই আছে এখানে। তারপর ওই নার্সরা যার যার গ্রামে ফিরে গিয়ে নিজেরা ট্রেনিং ক্লাস চালায়।”

“কিন্তু তারপর তো ময়নার পদোন্নতি হয়েছে মনে হয়?”

“তা হয়েছে,” নীলিমা বলল। “এখন ও আর বেয়ারফুট নার্স নয়। হাসপাতালে পুরোদস্তুর নার্স হওয়ার জন্য ট্রেনিং নিচ্ছে। বছর কয়েক আগেই দরখাস্ত করেছিল, আর ওর রেকর্ডও বেশ ভাল ছিল, তাই হাসপাতালে নিয়ে নেওয়া হল ওকে। কিন্তু মজার ব্যাপার হল এতদিন ও কাজ করছে আমাদের সঙ্গে, কিন্তু ও যে কে সেটাই জানতাম না আমরা মানে ও যে আমাদের কুসুমের ছেলের বউ সেটাই জানা যায়নি। একদিন ঘটনাচক্রে আমি জানতে পারলাম ব্যাপারটা।”

“কী করে?”

“আমি একদিন বাজারে গেছি, বুঝলি তো,” নীলিমা বলল, “হঠাৎ দেখি সেখানে ময়না, একটা ছোকরার সঙ্গে কথা বলছে; সঙ্গে একটা বাচ্চা। এখন, ফকিরকে এর আগে আমি যখন দেখেছি তখন তো ও বছর পাঁচেকের একটা বাচ্চা ছেলে। কাজেই বাজারে দেখে ওকে আমি চিনতে পারিনি। তো, আমি ময়নাকে জিজ্ঞেস করলাম, “এই ছোঁড়াটা তোর বর নাকি রে? ও বলে, ‘হা মাসিমা, আমার বর। জিজ্ঞেস করেছি, নাম কী রে ওর?’ বলে, ফকির মণ্ডল। এমনিতে নামটা খুবই কমন, কিন্তু আমি ঠিক বুঝতে পেরে গেছি। বললাম, এ কী রে? তুই কে বল তো? আমাদের কুসুমের ছেলে ফকির নাকি তুই?’ তো সে বলে ‘া।”

“যাক, তবু ভাল, কানাই বলল। “ফকির অন্তত নিরাপদে লুসিবাড়িতেই আছে।”

“ভাল হলে তো ভালই ছিল,” বলল নীলিমা, “কিন্তু খুব একটা ভাল নেই রে ওরা।”

“তাই? কেন?”

নীলিমা বলল, “ময়না মেয়েটা বেশ বুদ্ধিমতী, উচ্চাশাও আছে। বাড়ির দিক থেকে কোনও উৎসাহ ছাড়াই নিজের চেষ্টায় খানিকটা লেখাপড়া শিখেছে। ওদের গ্রামে কোনও স্কুল ছিল না, বেশ কয়েক কিলোমিটার হেঁটে আরেকটা গ্রামে গিয়ে রোজ স্কুল করত। ফাইনাল পরীক্ষাতেও ভালই করেছিল। তারপর ঠিক করল কলেজে ভর্তি হবে–ক্যানিং কি অন্য কোথাও। নিজে নিজেই সব ব্যবস্থা করে ফেলেছিল, এমনকী শিডিউলড কাস্ট সার্টিফিকেটও জোগাড় করেছিল, কিন্তু বাড়ির লোকেরা কিছুতেই যেতে দেবে না। ওকে আটকানোর জন্য বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেলল। পাত্র ঠিক করল ফকিরকে। ছেলে হিসেবে ফকির এমনিতে সব দিক থেকেই ভাল, কিন্তু লেখাপড়া কিচ্ছু জানে না, নদী থেকে কাঁকড়া ধরে সংসার চালায়।

“তবে একটা ভাল ব্যাপার হল ময়না কিন্তু হাল ছাড়েনি,” বলল নীলিমা। “নার্স হবে বলে এমনই মনস্থির করে ফেলেছে ও, যে ট্রেনিং-এর সময়টা লুসিবাড়িতে থাকলে সুবিধে হবে বলে ফকিরকে পর্যন্ত নিয়ে চলে এসেছে এখানে।”

“ফকির খুশি তাতে?”

“মনে তো হয় না,” নীলিমা বলল। “মাঝে মাঝেই তো শুনি গণ্ডগোল হচ্ছে সেই জন্যই বোধহয় থেকে থেকেই ও নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। খুঁটিনাটি সব কিছু জানি না, মেয়েগুলো তো সব বলেও না আমায়। কিন্তু এটা জানি খুব ঝামেলার মধ্যে কাটছে ময়নার। আজকেই তো সকালে ভীষণ মনমরা দেখলাম ওকে।”

“তার মানে আজকে এসেছে ও কাজে?”

“হ্যাঁ, এসেছে তো,” নীলিমা বলল। “যে-কোনও সময় এসে যাবে এখানে। আমিই ওকে পাঠিয়েছি একবার হাসপাতালে, কয়েকটা ওষুধ এনে দেওয়ার জন্যে।

“কিন্তু ফকির কি আজকেও বাড়ি ফেরেনি?”

“না,” বলল নীলিমা, “আর চিন্তায় চিন্তায় বেচারি ময়নার মাথা খারাপ। সেজন্যেই ওকে বলেছি তোকে নিয়ে হাসপাতালটা দেখাতে, খানিকক্ষণ অন্তত যাতে অন্য কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থাকে।”

দরজায় খটখট করে আওয়াজ হল একটা। গলাটা একটু তুলে সাড়া দিল নীলিমা, “ময়না নাকি রে?”

“হ্যাঁ মাসিমা।”

“ভেতরে আয়।”

কানাই ফিরে দেখল মাথায় ঘোমটা দেওয়া অল্পবয়সি একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। খোলা দরজা দিয়ে বাইরের উজ্জ্বল আলো উপছে ঢুকে আসছে ঘরে, কিন্তু সেদিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে বলে ছায়া পড়েছে মেয়েটির মুখে, কানের দুলদুটো আর নথটা শুধু ঝিকমিক করছে; ওর ছায়া ছায়া ডিমাকৃতি মুখে নক্ষত্রপুঞ্জের তিনটে তারার মতো জ্বলজ্বল করছে সেগুলো।

“ময়না, এ হল কানাইবাবু,” আলাপ করিয়ে দিল নীলিমা, “আমার বোনপো।” ঘরের ভেতর ঢুকে এল মেয়েটি। বলল, “নমস্কার।”

“নমস্কার।” এখন আলো পড়েছে ময়নার মুখে, কাছে থেকে দেখেই কানাই লক্ষ করল একটু ধেবড়ে গেছে ওর চোখের কাজল। গায়ের রং মসৃণ কালো, কুচকুচে কালো চুল তেলে

মা টানা ভুরু, ‘পষ্ট চোয়াল; এক নজর দেখেই কানাই বলতে পারে সারা দুনিয়া ওর বিরুদ্ধে গেলেও নিজের জেদ রাখতে এ মেয়ে পিছপা হবে না। তবুও চোখের লালচে ভাব দেখে বোঝা গেল একটু আগেও কাঁদছিল ময়না।

“শোন কানাই,” ইংরেজিতে বলল নীলিমা, যাতে ময়না বুঝতে না পারে, “একটু সাবধান। মেয়েটার মন মেজাজ কিন্তু মনে হয় ভাল নেই।”

“ঠিক আছে মাসি,” বলল কানাই।

“রাইটি-ও, দেন,”নীলিমা বলল, “আই সাপোজ ইউ হ্যাড বেটার বি গোয়িং।”

“রাইটি-ও!” মাসিকে ইংরেজি বলতে এর আগে বিশেষ শোনেনি কানাই; এরকম স্পষ্ট সুন্দর উচ্চারণ শুনে আশ্চর্য হয়ে গেল ও। এত বছর এই ভাটির দেশে থেকে নীলিমার বাংলাটার থেকে শহুরে ছাপ মুছে এসেছে, প্রায় এখানকার লোকেদের ভাষার মতোই হয়ে গেছে সেটা। কিন্তু ইংরেজিটা বোধহয় বিশেষ ব্যবহার হয় না বলেই রজনের স্ফটিকের মধ্যে ফার্নের পাতার মতো অক্ষত রয়ে গেছে। সময়ের স্পর্শ তাতে পড়েনি, রোজকার ব্যবহারের মলিনতা ছুঁতে পারেনি ব্রিটিশ আমলের স্কুলে শেখা সে ইংরেজিকে। কানাইয়ের মনে হল যেন হারিয়ে যাওয়া কোনও ভাষা শুনছে ও, ফুরিয়ে যাওয়া সেই ঔপনিবেশিক যুগের উচ্চমধ্যবিত্ত সমাজের মুখের ভাষা, যে ভাষা বলা হত সেকালের ইলোকিউশন স্কুল আর ডিবেটিং সোসাইটিতে শেখা স্পষ্ট দ্বিধাহীন উচ্চারণে।

.

হাসপাতালের রাস্তায় যেতে যেতে কানাই ময়নাকে জিজ্ঞেস করল, “মাসিমা কি আপনাকে বলেছেন যে আমি আপনার শাশুড়িকে চিনতাম?”

“না তো!” অবাক হয়ে কানাইয়ের দিকে তাকাল ময়না। “কিচ্ছু বলেননি তো মাসিমা। সত্যি চিনতেন?”

“হ্যাঁ,” কানাই বলল। “চিনতাম। অনেককাল আগে যদিও। ওর বয়েস তখন খুব বেশি হলে পনেরো-টনেরো হবে, আর আমি আরও ছোট।”

“কেমন ছিলেন উনি?”

“আমার যেটা মনে আছে সেটা হল ওর তেজ,” বলল কানাই। “ওইটুকু বয়েসেই খুব তেজি ছিল ও।”

মাথা নাড়ল ময়না। “লোকে বলে নাকি একটা ঝড়ের মতো ছিলেন উনি।”

“হ্যাঁ,” বলল কানাই। “সেরকমও বলা যেতে পারে। অবশ্য আপনি তো বোধহয় দেখেননি ওকে, তাই না?”

“না,” বলল ময়না। “উনি যখন মারা যান তখন তো আমি ছোট বাচ্চা। কিন্তু অনেক গল্প শুনেছি ওনার সম্পর্কে।”

“আপনার স্বামী কিছু বলেন না ওর কথা?”

কুসুমের কথা বলতে বলতে মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল ময়নার, কিন্তু ফকিরের প্রসঙ্গ উঠতেই আবার যেন মেঘ জমল সেখানে। “না,” ও বলল। “ও তো কখনও বলেই না ওনার কথা। আমার মনে হয় খুব একটা মনেও নেই ওর। উনি মারা যাওয়ার সময় তো ও খুবই ছোট ছিল–” কাধটা একটু ঝাঁকিয়ে কথাটা শেষ করে দিল ময়না। এ প্রসঙ্গটা আর না-টানাই ভাল মনে হল কানাইয়ের।

হাসপাতালের কাছাকাছি চলে এসেছিল ওরা। বাড়িটা কাছ থেকে দেখে নতুন করে বুঝতে পারল কানাই কী বিশাল কর্মযজ্ঞের পৌরোহিত্য করছে এখানে নীলিমা। এমনিতে যে বাড়িটা বিরাট বড় বা দেখতে খুব চমৎকার তা নয়–সাধারণ একটা দোতলা বাড়ি, চৌকো টাইপের জুতোর বাক্সর মতো দেখতে। ছাই-রঙা বাইরের দেওয়াল, আর সাদা বর্ডার টানা রয়েছে জানালা এবং লম্বা বারান্দার রেলিংগুলো বরাবর। সামনে একটা বাগান, তাতে বেশিরভাগই গাঁদাফুলের গাছ। কিন্তু সাধারণ হলেও, এই ভাটির দেশের কাদা আর ছাতলার মধ্যে ঝকঝকে তকতকে এই বাড়িটাকেই আকাশছোঁয়া বহুতলের মতো বলে মনে হচ্ছে। কানাইয়ের মনে হল শুধু এই বাড়িটা দেখেই অনেকটা ভরসা পাবে রোগীরা।

বাড়িটার বহিরঙ্গের সে প্রভাব ময়নার ওপরেও পড়েছে দেখা গেল। কানাইকে নিয়ে হাসপাতালে ঢুকতে ঢুকতেই একটা স্পষ্ট পরিবর্তন লক্ষ করা গেল ওর হাবেভাবে। প্রতিটি পদক্ষেপে মনে হল আরও ঋজু, আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছে ওর চলাফেরার ভঙ্গি যেন বাড়িটার সংস্পর্শে আসতে-না-আসতেই সংসারভারগ্রস্ত এক স্ত্রী ও মায়ের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসছে চটপটে পেশাদার একটা নতুন মানুষ।

হাসপাতালের গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে একটা দরজার সামনে কানাইকে নিয়ে এল ময়না। “এটা আমাদের মেটারনিটি ওয়ার্ড,” কথাটা বলার সময় গর্বে গলাটা যেন বুজে এল ওর।

এমনিতে হাসপাতাল-টাসপাতালের ব্যাপারে আদৌ কোনও আগ্রহ নেই কানাইয়ের। কিন্তু এই জায়গাটা ব্যতিক্রম: প্রতিটি ওয়ার্ড এত টিপটপ, দেখে অবাক না হয়ে পারল না ও। পুরো হাসপাতালটা তকতকে পরিষ্কার, আর যদিও মোটে চল্লিশটা বেড, কিন্তু হাসপাতালের আয়তনের তুলনায় ব্যবস্থাদির কোনও খামতি নেই। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সব পৃষ্ঠপোষকদের পয়সায় কেনা, বলল ময়না। তাদের মধ্যে দেশের লোকও আছে কিছু, আবার বিদেশিও অনেকে আছে। প্যাথোলজি ল্যাব আছে, একটা এক্স-রে রুম আছে, এমনকী একটা ডায়ালিসিস মেশিন পর্যন্ত আছে। হাসপাতালের ওপরের তলায় দু’জন। রেসিডেন্ট ডাক্তার থাকেন। তাদের মধ্যে একজন তো প্রায় দশ বছর আছেন এই লুসিবাড়িতে। অন্যজন ডাক্তারি পাশ করার পর ভেলোরের নামকরা হাসপাতালে প্রশিক্ষণ শেষ করে নতুন এসেছেন এখানে। ময়না বলল দু’জনকেই আশেপাশের সমস্ত দ্বীপের লোকজন খুব শ্রদ্ধা করে আর ভালবাসে। যে পেশেন্টই আসে হাসপাতালে, ডাক্তারবাবুদের জন্য হাতে করে কিছু না কিছু একটা নিয়ে আসে–কখনও একটা নারকেল, বা কিছু কেওড়া ফল, না হলে পাতায় মুড়ে একটা মাছ, কখনও বা দু-একটা মুরগি।

ময়না বলল এত নামডাক হয়ে গেছে এখন হাসপাতালটার যে দূরদূরান্ত থেকে রোগীরা এখানে দেখাতে আসে। এমনও অনেকে আসে এই লুসিবাড়ি হাসপাতালে যাদের পক্ষে ক্যানিং, এমন কী কলকাতা পর্যন্ত চলে যাওয়া এর তুলনায় সহজ হত। কারণ এখানকার সবাই জানে যে এ হাসপাতালে সামান্য খরচে যে যত্ন পাওয়া যায় সেরকম যত্ন অনেক জায়গায় অনেক পয়সা দিয়েও পাওয়া যায় না। আবার এত মানুষ এখানে যাতায়াত করে বলে এলাকার বেশ কিছু লোকের কিছু জীবিকার সংস্থান হয়েছে। গত কয়েক বছরে কতগুলো সাইকেল ভ্যানের স্ট্যান্ড হয়েছে। নতুন চায়ের দোকান আর গেস্ট হাউসগুলো তো রমরম করে চলছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এখন লুসিবাড়ির বেশিরভাগ লোকেরই জীবিকার উৎস এই হাসপাতাল।

দোতলায় উঠে ময়না দেখাল এ হাসপাতালে নির্মলের একমাত্র অবদান বিশাল একটা ওয়ার্ড, সাইক্লোন ঠেকানোর জন্য বিশেষভাবে বানানো। জানালাগুলিতে মোটা কাঠের পাল্লা দেওয়া, আর দরজাগুলো সব লোহার ফ্রেমে বাঁধানেনা। এমনিতে ট্রাস্টের কাজে কর্মে বিশেষ নাক গলাত না নির্মল, কিন্তু এই হাসপাতাল যখন তৈরি হয় তখন দেখতে এসেছিল যে সাইক্লোন ঠেকানোর ব্যবস্থা সব ঠিকমতো নেওয়া হয়েছে কিনা। সেরকম কিছু করা হয়নি শুনেই একেবারে আঁতকে উঠল–ভাটির দেশের বিধ্বংসী সব সাইক্লোনের ইতিহাস সবাই ভুলে গেছে নাকি? সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি লুসিবাড়িতে কখনও হবে না নাকি? নির্মলের নিবন্ধাতিশয্যেই শেষে তৈরি হল এই ওয়ার্ড।

দোতলার বারান্দা থেকে হাসপাতালের চারদিকের দোকানঘর আর ছোট ছোট কুঁড়েগুলো কানাইকে দেখাল ময়না। “ওদিকে দেখুন কানাইবাবু, দোকানগুলো দেখুন হাসপাতালের আশেপাশে। কত্তগুলো হয়েছে দেখেছেন?”

হাসপাতালটা নিয়ে ময়নার গর্ব দেখে বেশ ভাল লাগল কানাইয়ের, প্রায় অভিভূত হয়ে গেল ও। জিজ্ঞেস করল, “আপনি ফকিরকে কখনও নিয়ে এসেছেন এখানে?”

ছোট্ট করে একবার মাথা নাড়ল ময়না। “না।”

“কেন?”

মুখটা একটু বাঁকিয়ে বলল, “ও আসতে চায় না–বলে কেমন যেন লাগে ওর এখানে।”

“এখানে মানে–এই হাসপাতালে, না লুসিবাড়িতে?”

“দুটোই,” বলল ময়না। “এখানে ওর ভাল লাগে না।”

“কেন বলুন তো?”

“গাঁয়ে যেমন ছিল তার থেকে সব আলাদারকম এখানে।”

“কী রকম আলাদা?”

কাঁধ ঝাঁকাল ময়না। “ওখানে ও সব সময় টুটুলকে নিয়ে থাকত–টুটুল আমাদের ছেলে,” বলল ও। “ট্রাস্টের কাজের জন্যে আমাকে অনেকটা সময় বাইরে বাইরে থাকতে হত তো, আর ও সারাদিন টুটুলকে নিয়ে নদীতে নদীতে ঘুরত। কিন্তু এখানে আসার পর আমাকে সেটা বন্ধ করে দিতে হল।”

“তাই? কেন বন্ধ করতে হল?”

“কারণ টুটুলকে তো স্কুলে যেতে হবে, না কি?” একটু যেন ঝঝ ময়নার গলায়। “ও-ও বাপের মতো কঁকড়া ধরে বেড়াবে সেটা আমি চাই না। ওতে কোনও ভবিষ্যৎ আছে নাকি?”

“কিন্তু ফকির তো তাই করে।”

“করে তো, কিন্তু কতদিন আর করবে বলুন?” বলল ময়না। “মাসিমা তো বলেন নতুন যেসব জাল-টাল লোকে ব্যবহার করছে তাতে পনেরো বছরের মধ্যে নদীতে মাছ আর কিছু থাকবে না।”

“কী নতুন জাল?”

“ওই যে সব নাইলন জাল চালু হয়েছে এখন। চিংড়ির মীন–মানে বাগদা চিংড়ির পোনা–ধরে ওতে করে। জালের ফুটোগুলো এত ছোট যে তাতে মীনের সঙ্গে অন্য সব মাছের ডিমও উঠে আসে। মাসিমা একবার চেষ্টা করেছিলেন নাইলন জাল বন্ধ করতে, কিন্তু কিচ্ছু করা গেল না।”

“কেন?”

“কেন আবার? চিংড়ির ব্যবসায় তো প্রচুর লাভ। আর সব নেতাদের ওরা পয়সা খাইয়ে রাখে। ওদের আর কী? নেতাদেরও কিছু যায় আসে না। মরবে তো আমাদের মতো লোকেরাই। আমাদেরই তাই ভাবতে হবে কী করা যায়। সেইজন্যেই তো আমি চাই টুটুলটা যাতে ভালভাবে লেখাপড়া শেখে। নইলে কী হবে ওর বলুন তো?” এক নিশ্বাসে এতগুলো কথা বলে গেল ময়না।

“আপনি যদি ভাল করে ফকিরকে বোঝান ও নিশ্চয়ই বুঝতে পারবে,” কানাই বলল।

“সে চেষ্টা কি করিনি ভেবেছেন?” গলার আওয়াজ চড়ে গেল ময়নার। “কতবার বোঝানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু কী বুঝবে ও বলুন? লেখাপড়া জানে না তো এসব জিনিস ওকে বোঝানো অসম্ভব।”

ওর কথা শুনতে শুনতে কানাইয়ের মনে হচ্ছিল এই পরিস্থিতির মধ্যে থেকেও নিজের জগটুকু সম্পর্কে একটা পরিষ্কার ধারণা আছে ময়নার। আর কী করে সেখানে চলতে হবে সেটাও ও ভাল করেই জানে। অবাক লাগছিল কানাইয়ের, শেষবার যখন ও এই ভাটির দেশে এসেছিল তারপর থেকে কত পালটে গেছে সবকিছু। বাইরের পরিবর্তনই শুধু নয়, মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, সবকিছুই অনেক বদলে গেছে। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ এই হাসপাতালটা তার সুযোগ সুবিধা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, সবকিছুই। এইসব পরিবর্তনের মধ্যে ময়নার মতো প্রতিভাময়ী একটা মেয়ের স্বপ্ন ওরকম একজন স্বামীর জন্য অপূর্ণ থেকে যাবে ভাবতেও খারাপ লাগল কানাইয়ের।

“দেখুন।”

একটা অপারেটিং থিয়েটারের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ওরা। হঠাৎ ময়না গিয়ে দরজার কাঁচ লাগানো গোল ফুটোটার মধ্যে উঁকি দিয়ে ভেতরে দেখতে লাগল। দেখছে তো দেখছেই। কানাই ভাবল ভেতরে নিশ্চয়ই কোনও অপারেশন চলছে। কিন্তু অবশেষে ময়না সরে এসে ওকে যখন দেখতে দিল, কানাই দেখল ঘরটা খালি, শুধু যন্ত্রপাতিগুলো রয়েছে।

“কী দেখছিলেন এতক্ষণ?” ও জিজ্ঞেস করল ময়নাকে।

“এই নতুন যন্ত্রগুলো। আমার খুব ভাল লাগে ওগুলো দেখতে,” একটু হেসে বলল ময়না। “আমার কোর্সটা শেষ হয়ে গেলে আমিও হয়তো একদিন কাজ করব ওখানে।”

“নিশ্চয়ই করবেন।”

ঠোঁটদুটো একটু কোঁচকাল ময়না। “ভগবান জানে।”

ওর গলা শুনে স্পষ্ট বুঝতে পারল কানাই, যে এই নার্স হওয়ার স্বপ্ন ওর কোনও সাধারণ শখের ব্যাপার নয়–এ স্বপ্নের উৎস যে আকাঙ্ক্ষায়, সম্পূর্ণতায় বা ঋদ্ধিতে মনের মধ্যে লালিত তার রূপ কোনও কবিতা বা উপন্যাসের তুলনায় কোনও অংশে কম নয়। নিজেকে আরও পরিশীলিত করে সামনের বিরাট পৃথিবীর দিকে হাত বাড়ানোর দুর্দম ইচ্ছার চেহারাটা আজ ফের ধরা দিল কানাইয়ের কাছে। ময়নার কথা শুনতে শুনতে ও যেন হারিয়ে যাওয়া নিজের ছবি নতুন করে খুঁজে পেল।

দরজার গায়ের গোল কাঁচটার মধ্যে নিজের মুখের ছায়ার পাশে ময়নার মুখটা দেখতে পেল কানাই। কাঁচের গায়ে টোকা দিয়ে অন্ধকার অপারেটিং থিয়েটারটার দিকে দেখাল ময়না। “এই ঘরটাতেই আমার টুটুল হয়েছিল,” ও বলল। “মাসিমাই আমার ভর্তির সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। জানেন, আমার আগে আমাদের বাড়ির কোনও মেয়ে বাচ্চা হওয়ার সময় হাসপাতালে ভর্তি হয়নি। টুটুল যখন হয়, তখন তিনজন নার্স ছিল এখানে। আমাকে দেওয়ার আগে ওরা সবাই একবার করে কোলে নিল ওকে। আমার শুধু মনে হচ্ছিল ওদের কী ভাগ্য; খুব ইচ্ছে করছিল তখন ওদের মতো হতে।”

স্পষ্ট পড়া যাচ্ছিল ময়নার মুখে আঁকা উচ্চাশার ছবি। সেদিকে তাকিয়ে অদ্ভুত একটা মমতায় ভরে গেল কানাইয়ের মন: আমাদের একান্ত নিজস্ব সব আকাঙ্ক্ষা–যেগুলো হয়তো সারাজীবন ধরে শুধু আড়াল করার চেষ্টা করে যাই আমরা–হঠাৎ তার ছায়া যদি ছেলেবেলার পুরনো কোনও ছবিতে চোখে পড়ে তা হলে যেমন মনে হয়, খানিকটা সেইরকম একটা কোমল অনুভূতিতে মনটা ছেয়ে গেল ওর।

“চিন্তা কোরো না ময়না,” বলল কানাই। “খুব শিগগিরই এখানে কাজ করবে তুমি।” কথাটা বলেই খেয়াল হল জিজ্ঞেস না করেই ও ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করেছে ময়নাকে। ব্যাপারটা ইচ্ছাকৃত নয়, কিন্তু সেটা নিয়ে কিছু বলার দরকার আছে বলে মনে হল না কানাইয়ের। মনে হল এই তো ভাল। আলাদা করে বলার কী-ই বা প্রয়োজন?

.

কাঁকড়া

ঠিক দুপুর নাগাদ, জল বেশ খানিকটা বেড়ে ওঠার পর পরিষ্কারই বোঝা গেল আস্তে আস্তে দূরে সরে যাচ্ছে শুশুকগুলো। শেষের কয়েকবার মা আর ছানার জুড়িটাকেই শুধু দেখতে পেল পিয়া। জলের ওপর নানারকম সব কসরত দেখাল তারা। সেরকম আগে কখনও বিশেষ দেখেনি পিয়া। প্রথমে পরপর কয়েকবার এমনভাবে ভেসে উঠল যে দুটো ডলফিনেরই পুরো শরীর দেখতে পাওয়া গেল জলের ওপর। ছানাটা দেখা গেল মিটার খানেকের মতো লম্বা আর মা-টা তার দেড়গুণ মতো। একটু পরে ফের দেখা গেল বার দুয়েক। চমৎকার লাগছিল দেখতে। মা আর ছানা মুখ দিয়ে ফোয়ারার মতো জল ছুঁড়ে দিচ্ছে শূন্যে। এই ‘থুতু ছেটানোর’ অভ্যেসটা এ জাতীয় ডলফিনদের একটা বৈশিষ্ট্য–পিয়ার নিজের ধারণা এটা ওরা করে শিকারকে বিভ্রান্ত করার জন্য। এত সুন্দর লাগছিল দেখতে যে ডেটাশিট রেখে ক্যামেরা বের করল পিয়া। মিনিট কয়েক পরেই আশ্চর্য এক কাণ্ড করল ছানা ডলফিনটা একটা মাছকে শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে আবার লুফে নিল মুখে। শিকার নিয়ে খেলা করাটা এদের বংশের ধারা–এই ওর্কায়েলা-দের জ্ঞাতি খুনে তিমিরও এ স্বভাব আছে। কিন্তু এত বছর নদী-নালায় ঘুরে ঘুরে কাজ করলেও, সব মিলিয়ে মাত্র বার ছয়েক এরকম দৃশ্য চোখে পড়েছে পিয়ার। আর এই প্রথম তার একটা স্পষ্ট ছবি তুলতে পারল ও।

খানিক বাদেই এ দুটো ডলফিনও বেপাত্তা হয়ে গেল। এখন দেখতে হবে সন্ধেবেলা জল নামলে আবার এখানে ফিরে আসে কিনা আঁকটা।

পিয়া যখন নৌকোর আগায় বসে জলের দিকে নজর রাখছিল, ফকির আর টুটুল তখন ডিঙির পেছন দিকটায় বসে খুব ধৈর্য ধরে একগোছা মাছ ধরার সুতোর পরিচর্যা করছিল। সুতোগুলো দেখে প্রথমটায় একটু চিন্তিত হয়েছিল পিয়া, কারণ কিছু কিছু মাছ ধরার সরঞ্জামে ডলফিনদেরও অনেক সময় আটকে পড়তে দেখা গেছে। কিন্তু ভাল করে দেখে বুঝতে পারল ফকিরের সুতোগুলো এতই পলকা, ডলফিনের মতো অত বড় প্রাণীকে তাতে আটকাতে পারবে না। এই নিয়ে তাই আর কোনও উচ্চবাচ্য করেনি ও। এই সামান্য সুতোগুলোতে কিছুই আসে যায় না। মাছেরাও মনে হল একইরকম ভাবছে; সারা সকাল চেষ্টা করে বাপ ব্যাটা কেউই একটা চুনোপুঁটিও ধরে উঠতে পারল না। কিন্তু ওদের দুজনের তাতে দেখা গেল কোনও হেলদোল নেই মনে হল, যা করছে তাই নিয়েই বেশ আছে, অন্তত আপাতত।

কিন্তু ফকির আর টুটুল কখন ফিরতে চাইবে কে জানে। রাত্রে পিয়া আশা করেছিল সূর্য উঠলেই বোধহয় রওয়ানা হবে ওরা। কিন্তু এই ডলফিনগুলো এসেই সব পালটে দিল। এখন তো মনে হচ্ছে অন্তত কাল সকাল পর্যন্ত থাকতে হবে এখানে। সুন্দরবনের এই ডলফিনেরা এখানকার জোয়ার-ভাটার চক্রের সঙ্গে নিজেদের মতো করে খাপ খাইয়ে নিয়েছে কিনা তা বোঝার এটাই একমাত্র উপায় এখন দেখা যাচ্ছে আরও একটা ভাটা আর জোয়ার এখানে অপেক্ষা করে যাওয়া। অবশ্য এরকম হতেই পারে যে এ সমস্তই নিছক ওর কল্পনা, আর সে কল্পনা যদিও বা সত্যি হয় তা হলেও তার সমর্থনে উপযুক্ত তথ্য জোগাড় করে উঠতে বছরের পর বছর কেটে যাবে। এখনকার মতো অন্তত আরও একটু কিছু প্রমাণ চাই পিয়ার, সামান্য কিছু ইঙ্গিত, যাতে অন্তত বোঝা যায় যে ওর চিন্তাটা ঠিক দিকেই এগোচ্ছে। পরের সূর্যোদয়টা পর্যন্ত যদি কোনওভাবে থাকতে পারে এই জায়গাটায়, তা হলেই ওর চলবে।

সময় যত কাটতে লাগল ডলফিনদের ছেড়ে ফকির আর তার ছেলেকে নিয়ে উদ্বেগ বাড়তে থাকল পিয়ার। আর কতক্ষণ ওরা ধৈর্য ধরে থাকতে চাইবে এখানে কে জানে? কী করলে আটকে রাখা যাবে ওদের? পিয়া লক্ষ করছে ওদের ওই মাটির স্টোভটা একবারও জ্বালানো হয়নি আজকে। বাপ ব্যাটা শুধু কয়েকটা শুকনো রুটি খেয়ে আছে সকাল থেকে। ভাল লক্ষণ নয়। তার মানে রসদ ফুরিয়ে আসছে ওদের। অন্য কোনও পরিস্থিতি হলে ও আরও কিছু টাকা অফার করতে পারত ফকিরকে; কিন্তু এক্ষেত্রে সে প্রসঙ্গ তোলা যায় না কারণ সঙ্গে টুটুল আছে। বাবার কিছু বাড়তি পয়সা রোজগার হবে বলে ওইটুকু ছেলে খিদে সহ্য করে বসে থাকবে সেটা আশা করা যায় না। ‘: পিয়ার নিজেরই মিনারেল ওয়াটার কমে এসেছে, কিন্তু ও জানে যেটুকু আছে তা দিয়েই ও চালিয়ে নিতে পারবে। ওদের দুজনের জন্যেই ওর চিন্তা। শেষ পর্যন্ত থাকতে না-পেরে কোনওদিন ও যা করেনি তাই করল: ওর সাবধানে জমিয়ে রাখা নিউট্রিশন বারের প্যাকেট থেকে কয়েকটা বের করে দিতে চাইল ওদের। ফকির নিল না, কিন্তু টুটুল একটা নিয়ে বেশ তারিয়ে তারিয়েই খেল। একটু নিশ্চিন্ত হল পিয়া। সেরকম দরকার হলে আরও কয়েকটা বার দিয়ে দেবে ও তাতে যদি থেকে যায় ওরা তা হলেই পুষিয়ে যাবে ওর। কিন্তু তবুও মনটাকে শান্ত করতে পারছিল না পিয়া। ডেটাশিট ভরতে ভরতে বারবার আড়চোখে চাইছিল ওদের দুজনের দিকে। ওদের প্রতিটি ওঠাবসায় চমকে চমকে উঠছিল ও এই রে! এই বোধহয় ওরা ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করছে।

কিন্তু কেন কে জানে, সেরকম কিছুই হল না শেষ পর্যন্ত। রওয়ানা হওয়ার ব্যাপারে ওদের দু’জনের কারওরই কোনও আগ্রহ দেখা গেল না। দুপুরে সামান্য কিছু শুকনো রুটি মধু দিয়ে খেয়ে বাপ ব্যাটা গিয়ে ছইয়ের ভেতর ঢুকে শুয়ে পড়ল।

আশা-নিরাশার দোলায় পিয়ার টেনশন এদিকে বেড়েই চলেছে। ভাটা পড়া পর্যন্ত এই কয়েকটা ঘণ্টা চুপ করে এক জায়গায় বসে থাকতেই পারছে না ও। শেষে ঠিক করল এই সময়টা নদীর নীচের এই জায়গাটার ম্যাপ তৈরি করবে। সত্যিই ওই ওর্কায়েলা-দের জড়ো হওয়ার মতো কোনও দহ এখানটায় আছে নাকি দেখা যাবে। এ ধরনের ম্যাপ তৈরির কিছু অভিজ্ঞতা ওর আছে, এটুকু জানে যে খুব একটা কঠিনও নয় কাজটা, তবে বেশ ঝামেলার: ডেপ্‌থ সাউন্ডিং করে নদীর নীচ থেকে ফিরে আসা প্রতিধ্বনি মেপে মেপে গভীরতার মাপ কাগজে তুলতে হবে, তারপর সেগুলো জুড়ে জুড়ে নদীগর্ভের ঢালের একটা রেখাচিত্র বানাতে হবে। গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেমের সুবিধা থাকায় অবশ্য প্রত্যেকবার শব্দ ক্ষেপণের জায়গার নিখুঁত অবস্থানটা ঠিক করে নেওয়া সহজ, ফলে নিয়মিত জ্যামিতিক বৃত্তচাপ বরাবর ঠিকমতো রিডিংগুলো নেওয়াও খুব একটা কঠিন হবে না।

কিন্তু সমস্যা হল ফকিরকে সেটা বোঝানো যাবে কী করে?

আস্তে আস্তে ছইয়ের সামনে গেল পিয়া, দেখল বেঘোরে ঘুমোচ্ছে ফকির আর তার ছেলে। দু’জনেই পাশ ফিরে শুয়ে আছে, বাবার শরীরের বাঁকের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে টুটুলের ছোট্ট চেহারাটা দেখা যাচ্ছে। ছেলেটা একটু নাদুস-নুদুস, বাপের প্রায় কঙ্কালসার কাঠখোট্টা ভাবের একেবারে উলটো। ফকিরের গায়ে তো খালি হাড়-পাঁজরা আর পাকানো পেশি কয়েকটা। পুরুষের গঠনতন্ত্রের শুধু সারটুকু দিয়ে যেন তৈরি ওর শরীরটা। আচ্ছা, ছেলেটা কি তা হলে বাবার থেকে ভাল খেতে পায়? এর মধ্যে নিশ্চয়ই কোনও গল্প আছে, সেটা জানতে পারলে বেশ হত। ছেলেটার দেখাশোনা কে করে? কেউ কি নিজে না-খেয়ে রেখে দেয় খাবারটা, যাতে ঠিক মতো খেতে পায় টুটুল?

ঘুমের মধ্যে একসঙ্গে ওঠানামা করছিল দু’জনের বুক। ওদের শ্বাসের ছন্দটা দেখে মা ডলফিন আর ছানাটার কথা মনে পড়ে গেল। এত নিশ্চিন্তে ওদের ঘুমোতে দেখে নিজের মনটাও একটু শান্ত হল পিয়ার–ওর মনের ভেতরের উথাল পাথালের সঙ্গে ওদের এই শান্তির ঘুমের আকাশ পাতাল ফারাক। ফকিরকে জাগানোর জন্য হাতটা বাড়াতে একটু দ্বিধা হচ্ছিল পিয়ার: এই ভরদুপুরের কাঁচা ঘুমটা ভাঙিয়ে দিলে কি ও বিরক্ত হবে? তারপর যদি বাড়ি ফিরে যেতে চায় তক্ষুনি? পিয়া দেখল ফকিরের কপালের পাশ দিয়ে একটা ঘামের ফোঁটা গড়িয়ে নামছে চোখের কোণের দিকে। কিছু না-ভেবেই একটা আঙুল বাড়িয়ে ঘামটা মুছে দিল ও।

সঙ্গে সঙ্গে জেগে গেল ফকির। উঠে বসল ধড়মড় করে। পিয়ার আঙুলের ডগাটা ওর চামড়ার যে জায়গায় ছুঁয়েছিল সেখানটা ঘষতে লাগল হাত দিয়ে। অপ্রস্তুত হয়ে একটু পিছিয়ে গেল পিয়া। মুখ থেকে বেরিয়ে এল, “আই অ্যাম সরি। আই ডিডন্ট মিন…” নির্লিপ্তভাবে মাথাটা একবার ঝাঁকাল ফকির, তারপর হাত মুঠো করে চোখ কচলাতে লাগল, যেন বাকি ঘুমটুকু ঘষে ঘষে চোখ থেকে মুছে দিতে চাইছে।

“লুক!” পজিশনিং মনিটরটা ফকিরের মুখের সামনে ধরে স্ক্রিনের দিকে ইশারা করল পিয়া। “ওভার হিয়ার।” আশ্চর্য হয়ে দেখল ফকির বুঝতে পারছে ওর বক্তব্য। তারপর পিয়া যখন ওই বিন্দু আর রেখাগুলোর মানে বোঝাতে শুরু করল, মনিটরটার দিকে ঝুঁকে পড়ে মন দিয়ে দেখতে লাগল ফকির।

সবচেয়ে কঠিন সমস্যাটা হল মনিটরের পর্দায় যে ওদের এখনকার অবস্থানটা দেখা যাচ্ছে সেটা কী করে ওকে বোঝাবে পিয়া। বিভিন্ন কিছুর দিকে ইশারা করে বোঝানোর চেষ্টা করল–একবার স্ক্রিনের দিকে, একবার নিজের দিকে, একবার ফকিরের দিকে, একবার ছেলেটার দিকে, কিন্তু কোনও লাভ হল না। পিয়া দেখল ঘাবড়ে যাচ্ছে ফকির, ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না কী করবে। মনে হল ইশারাগুলিতে ও ভেবেছে ওকে কাছে সরে আসতে বলছে পিয়া। পাগল পাগল লাগছিল পিয়ার। কী করে বোঝানো যায় একে! শেষে ঠিক করল অন্য কায়দা করে দেখবে একবার। একটা কাগজ নিয়ে এল পিয়া। ব্যাপারটাকে দ্বিমাত্রিক ক্ষেত্রে নিয়ে এলে হয়তো বোঝানো একটু সহজ হবে। সরল একটা ছবি দিয়ে, বাচ্চারা যেমন কাঠি কাঠি হাত-পাওয়ালা মানুষ আঁকে সেরকম এঁকে ফকিরকে জিনিসটা বোঝানোর চেষ্টা করবে ও। কিন্তু মুশকিল হল, ছবি আঁকাটা পিয়ার কখনওই ঠিক আসে না। অর্ধেকটা এঁকেও হঠাৎ থেমে গেল ও। নতুন একটা সমস্যার কথা মাথায় এল এবার। আগে যখনই এরকম মানুষের ছবি ও এঁকেছে, মহিলা বোঝানোর জন্যে সবসময় কাঠিটার মধ্যে একটা তিনকোণা স্কার্ট এঁকে দিয়েছে। কিন্তু এখানে তো তা করলে চলবে না–এখানে তো পুরুষের পরনে লুঙ্গি আর মহিলার পরনে প্যান্ট। কাগজটাকে দলা পাকিয়ে ফেলল পিয়া। ফেলেই দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু ওর হাত থেকে সেটা প্রায় ছিনিয়ে নিল ফকির, গুছিয়ে রেখে দিল জ্বালানি করবে বলে।

পরের ছবিটা ও শুরু করল জায়গাটার মোটামুটি একটা নকশা দিয়ে। নিজেদের অবস্থানটা দেখানোর আগে প্রথমে নদীর পাড়ের বাকটা এঁকে নিল। দেখা গেল ঠিকই আন্দাজ করেছিল ও, ত্রিমাত্রিক ক্ষেত্র ছেড়ে দুই মাত্রায় আসতেই ফল পাওয়া গেল: ওর নকশাটার সঙ্গে মনিটরের পর্দার লাইনগুলো কীভাবে মিলে যাচ্ছে একবার দেখিয়ে দিতেই জলের মতো সোজা হয়ে গেল বাকিটা। পেনসিলের কয়েকটা আঁচড়েই তারপর ও ফকিরকে বুঝিয়ে দিল কীভাবে মোটামুটি ত্রিভুজাকার একটা বৃত্তচাপের মধ্যে পরপর সমান্তরাল পথে নৌকোটা বেয়ে নিয়ে যেতে হবে ওকে। চাপের শীর্ষবিন্দুটা প্রায় ছুঁয়ে থাকবে নদীর অন্য পাড়টাকে।

পিয়া ভেবেছিল বোধহয় গাঁইগুঁই করবে ফকির, এমনকী হয়তো নাও রাজি হতে পারে। কিন্তু আদৌ সেরকম কিছু ঘটল না। বরং মনে হল বেশ খুশিই হয়েছে ও, এমনকী উৎসাহের চোটে চেঁচিয়ে-মেচিয়ে টুটুলকে পর্যন্ত ঘুম থেকে তুলে দিল। ওই সরলরেখা বরাবর পারাপারের ব্যাপারটাতেই মনে হল ওর বেশি উৎসাহ। কেন, সেটা একটু পরেই বুঝতে পারল পিয়া–যখন তক্তার নীচ থেকে একগোছা মাছ ধরার সুতো বের করে আনল ফকির। বোঝাই যাচ্ছে এই সুযোগে ও কিছু মাছ ধরে নিতে চায়।

কিন্তু মাছ ধরার সুতোটা দেখে একটু ধাঁধা লাগল পিয়ার। এশিয়ার বিভিন্ন নদীতে জেলেদের সঙ্গে ও কাজ করেছে, এরকম কিছু তো কোথাও আগে দেখেনি। একটু মোটা নাইলনের শক্ত সুতো, আর পুরো দৈর্ঘ্য বরাবর মিটার খানেক পরপর একটা করে ওজন বাঁধা ছোট ছোট টুকরো করা টালি কতগুলো। আরও অদ্ভুত যেটা, বঁড়শি-টরশির কোথাও কোনও বালাই নেই। তার বদলে ওজনগুলোর মাঝে মাঝে মাছের শুকনো হাড়কাটা কয়েকটা বাঁধা রয়েছে। কিছুই বোঝা যাচ্ছে না কী করে কাজ করে জিনিসটা। দেখে তো মনে হচ্ছে যেন ওরা আশা করছে যে মাছেরা নিজের থেকেই এসে আটকে যাবে সুতোটার মধ্যে, আর ওরা শুধু সেটা গুটিয়ে তুলবে। কিন্তু সেরকম কি আদৌ সম্ভব? তা হলে কী ধরবে ওটা দিয়ে? কোনওরকম কোনও ব্যাখ্যাই খুঁজে পেল না পিয়া। তবে একটা ব্যাপার অন্তত পরিষ্কার, ওই সুতোতে ডলফিনদের কোনও ক্ষতি হবার সম্ভাবনা নেই। তাই নৌকো যদি ঠিকঠাক পথে চলে তা হলে ওতে আপত্তি করারও কোনও কারণ দেখল না পিয়া।

আবার নৌকোর আগার দিকটায় ফিরে গেল ও, ম্যাপ বানানোর সব প্রস্তুতি করতে শুরু করল। মনিটরটা হাতে নিয়ে ফকিরকে ইশারা করে দেখাল ঠিক কোন জায়গাটা থেকে শুরু করতে হবে। তারপর, টুটুলও মাছ-ধরা সুতোর প্রথম ওজনটা জলে ফেলল, আর তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ইকো সাউন্ডারটাও ডুবিয়ে দিয়ে বোতাম টিপল পিয়া।

প্রথম দফায় প্রায় কিলোমিটার খানেক যেতে হল ওদের। সবটা সুতোই এর মধ্যে জলে ফেলা হয়ে গেছে টুটুলের। পুরোটা যাওয়ার পর আবার যখন নৌকোর মুখ ফিরিয়ে উলটোদিকে চলতে শুরু করল ওরা, তখন পিয়া আবিষ্কার করল কী করে ওরা ওই সুতোটা দিয়ে। সুতোটা টেনে তোলার সময় দেখা গেল সাত-আটটা টোপ পরপরই একটা করে কাঁকড়া ঝুলছে। শক্ত করে পঁাড়া দিয়ে চেপে ধরে আছে সুতোয় বাঁধা মাছের কাঁটাগুলো। ফকির আর টুটুল একটা জাল দিয়ে কাঁকড়াগুলোকে ছাড়িয়ে আনল, তারপর পাতা দিয়ে ভর্তি একটা পাত্রের মধ্যে রেখে দিল সেগুলোকে। দেখতে দেখতে হাসি পেয়ে গেল পিয়ার। এর থেকেই তা হলে ‘ক্র্যাবি’ কথাটা এসেছে ইংরেজিতে? এত একগুঁয়ে প্রাণীগুলো, ধরা পড়বে তবু খাবার ছাড়বে না।

বার কয়েক যাতায়াতের পরই বোঝা গেল ঠিকই ভেবেছিল পিয়া, নদীর নীচে একটা ঢালু জায়গাতেই এসে জমা হয় ডলফিনগুলো। সাউন্ডিং করে দেখা গেল নদীর খাতটা এই জায়গায় এসে পাঁচ থেকে আট মিটার পর্যন্ত গম্ভীর হয়ে গেছে; ফলে ভাটায় জল নেমে গেলেও ডলফিনরা এখানে এসে স্বচ্ছন্দে কাটাতে পারে সেই সময়টা।

নদীর নীচের এই দহ শুধু যে ডলফিনদের জন্যই উপযুক্ত তা নয়–কঁকড়াদেরও মনে হয় খুবই বাড়বাড়ন্ত এখানে। প্রতিবার যাতায়াতের সময়ই রাশি রাশি কঁকড়া উঠে আসছে ফকিরের সুতোয়। শুরুতে পিয়া ভেবেছিল ওদের দুজনের কাজের বোধহয় ব্যাঘাত ঘটবে–ওর ডেথ সাউন্ডিং-এর ফলে ফকিরের মাছেরা পালিয়ে যাবে অথবা উলটোটা হবে। কিন্তু ও সবিস্ময়ে লক্ষ করল আদৌ সেরকম কিছু ঘটল না। সুতোটা জলে ফেলার জন্য প্রত্যেকবারই একেবারে ঠিক সময়ে নৌকো থামিয়েছে ফকির। ঠিক ওই সময়গুলোতেই পিয়ারও থামার দরকার ছিল সাউন্ডিং নেওয়ার জন্য। তা ছাড়া ফকিরের সুতোটা ঠিকমতো পথপ্রদর্শনের কাজেও সাহায্য করছিল–সুতো বরাবর একেবারে সোজা পথে চলছিল নৌকোটা। আর ফেরার সময়ও প্রতিবারই ঠিক যে জায়গাটা থেকে রওয়ানা হয়েছিল নিঃসন্দিগ্ধভাবে সেখানটাতেই এসে পৌঁছনো যাচ্ছিল আবার। অন্য সময় হলে প্রতিবারই পথ ঠিক রাখার জন্য ওর গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেমটা ব্যবহার করতে হত পিয়াকে। কিন্তু এখানে ওই সুতোটা দিয়েই সে কাজ হয়ে যাচ্ছিল। শুধু প্রত্যেকবার পারাপারের সময় বৃত্তচাপ বরাবর আগেরবারের থেকে যাতে ঠিক পাঁচ মিটার দুরে যাত্রা শুরু হয় সেটা ঠিক করার জন্য মনিটরটা কাজে লাগাতে হচ্ছিল। এতে কিন্তু ফকিরেরও লাভ হচ্ছিল, কারণ কখনওই এক জায়গায় দু’বার পড়ছিল না ওর কাঁকড়া-ধরা সুতোটা।

খুবই আশ্চর্যের বিষয় যে এতটুকুও বিরোধ হচ্ছিল না ওদের দুজনের কাজের। আশ্চর্যের এইজন্য যে একজন কাজ করছে ভূসমলয় কক্ষের কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে, আর অন্যজনের কাজের সরঞ্জাম হল কয়েকটা মাছের কাটা আর ভাঙা টালির টুকরো। কিন্তু দু’জন একেবারে দু’রকমের মানুষ, যারা পরস্পরের সঙ্গে একটা বাক্যও বিনিময় করতে পারে না, একজন কী ভাবছে অন্যজনের সেটা জানা বা বোঝার কোনও উপায়ই নেই, তারা যে একই সঙ্গে নির্বিবাদে নিজের নিজের কাজ করে যাচ্ছে, সেটা মনে হল আরও বিস্ময়কর–যেন প্রায় দৈবঘটিত। ব্যাপারটাতে শুধু যে পিয়াই আশ্চর্য হয়েছে তা নয়, একবার হঠাৎ করে ফকিরের চোখে চোখ পড়ায় ওর মুখের ভাবেও বোঝা গেল বেশ অদ্ভুত লাগছে ওর। দু’জনের উদ্দেশ্য এবং তৃপ্তির এরকম স্বচ্ছন্দ মিশ্রণ কী করে সম্ভব হল সেটা ও যেন বুঝে উঠতে পারছে না।

কঁকড়ার পাত্রটা ভর্তি হয়ে যাওয়ার পর সেটার মুখটা একটা অ্যালুমিনিয়ামের প্লেট দিয়ে ঢেকে কাঁকড়াগুলোকে নৌকোর খোলের মধ্যে ঢেলে দেওয়ার জন্য পিয়ার হাতে দিল ফকির। ঢাকনা ফাঁক করে পিয়া দেখল ভেতর থেকে গোটা পনেরো কঁকড়া কটমট করে ওর দিকে চেয়ে দাঁড়া শানাচ্ছে। ডিঙির খোলের মধ্যে পাত্রটা উলটে দিতে হুড়মুড় করে একটা লম্বা শেকলের মতো বেরিয়ে এল কাঁকড়াগুলো, প্রচণ্ড রেগে খটখট আওয়াজ করতে করতে ঢুকে গেল তক্তার নীচে। কাঁকড়াদের এই অভাবনীয় মুখরতায় হাসি পেয়ে গেল পিয়ার। ওর জন্ম হয়েছিল জুলাই মাসে। মাঝে মাঝেই ওর তাই মনে হয়েছে এত প্রাণী থাকতে প্রাচীনকালের লোকেরা কাঁকড়াকে কেন রাশিচক্রের মধ্যে ঢুকিয়েছিল। কিন্তু এখন এই কঁকড়াগুলোকে তড়বড় করে নৌকোর খোলের মধ্যে ঢুকে যেতে দেখতে দেখতে পিয়ার মনে হল প্রাণীগুলোর বিষয়ে আরও কিছু জানা থাকলে বেশ হত। মনে পড়ল একবার একটা ক্লাসে ওদের এক অধ্যাপক দেখিয়েছিলেন কিছু প্রজাতির কাঁকড়া কীভাবে তাদের বাসার কাদাটা সত্যি সত্যি ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে কাদার প্রতিটা দানা ওরা সাফ করে ঘষে ঘষে। ওই কঁকড়াদের পায়ে এবং শরীরের ধার বরাবর সূক্ষ্ম লোমের আবরণ থাকে। সেই লোমগুলোই আণুবীক্ষণিক বুরুশ আর চামচের মতো কাজ করে। ওগুলো দিয়েই কাদার সূক্ষ্ম কণার গায়ে লেগে থাকা ক্ষুদে শ্যাওলা আর অন্যান্য সব খাদ্যবস্তু চেঁছে তোলে ওরা। একই সঙ্গে স্বাস্থ্যবিভাগ এবং পরিচ্ছন্নতা দপ্তরের কাজ করে এই কাঁকড়ারা–বাদাবনের পচা পাতা, জঞ্জাল সাফ করে ওরাই বাঁচিয়ে রাখে বনকে। ওরা না-থাকলে তো নিজেদের আবর্জনার চাপেই দমবন্ধ হয়ে মারা পড়ত জঙ্গলের সব গাছ। বাদাবনের জৈবতন্ত্রের একটা বিরাট অংশই যে এই কঁকড়ারা, সেটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে? ডালপাতা সমেত সমস্ত গাছের তুলনায়ও যে একটা বাদাবনে কাঁকড়াদের গুরুত্ব বেশি সেটা তো সত্যি? কেউ একজন তো বলেইছিলেন যে ম্যানগ্রোভের বদলে এই ধরনের নদীমুখের জঙ্গলগুলির নাম কঁকড়াদের নামেই হওয়া উচিত। কারণ বাঘ বা কুমির বা ডলফিন নয়, এই কঁকড়ারাই হল গোটা বাদাবনের জৈবতন্ত্রের মূল ধারক।

এতদিন পর্যন্ত এই সমস্ত বিষয়ে যখনই ভেবেছে পিয়া–এই জৈবতন্ত্র, মূল প্রজাতি এইসব–সবসময়েই নিজেকে তার বাইরে রেখে, অন্যান্য সমস্ত কিছুর পরিপ্রেক্ষিতে ভেবেছে। সংক্ষেপে, প্রকৃতির পরিপ্রেক্ষিতে ভেবেছে–কারণ কে বলেছে যে মনুষ্যসৃষ্ট সমস্ত কিছুকে বাদ দিয়ে যা বাকি থাকে তাই হল ‘প্রকৃতি’? কিন্তু আজকে যে ও এখানে এসেছে সে তো নিজের ইচ্ছায় আসেনি; এই কঁকড়াদের জন্যই এসেছে। কারণ এরাই হল ফকিরের জীবিকা, আর এরা–থাকলে ফকির জানতেও পারত না কোথায় কোন নদীর দহে এই ওর্কায়েলাশুশুকেরা আসে। হয়তো ঠিকই করেছিল সেই প্রাচীনকালের লোকেরা। হয়তো আসলে পিয়ার নিয়তির জোয়ার ভাটার দিক নির্দেশ করছে এই কাঁকড়ারাই। কে বলতে পারে!

.

ভ্রমণকাহিনি

গেস্ট হাউসে ফিরে কানাই দেখল টিফিন ক্যারিয়ারে করে দুপুরের খাবার রেখে গেছে। ময়না। সাদামাটা খাবার ভাত, মুসুরির ডাল, একটা চচ্চড়ি আলু, মাছের কাটা আর কী একটা শাক দিয়ে। শাকটা ঠিক চিনতে পারল না কানাই। আর ছিল কুচো মৌরলা মাছের পাতলা ঝোল। ঠান্ডা হয়ে গেলেও খাবারটা অমৃতের মতো লাগল কানাইয়ের। দিল্লিতে ওর যে রাঁধুনি আছে সে লক্ষৌর লোক। নানারকম মোগলাই খাবারই সে বেশি বানায়। ফলে বহুদিন এরকম সাধারণ বাঙালি খাবার কপালে জোটেনি কানাইয়ের। প্রতিটা খাবারের স্বাদ যেন ওর মাথার মধ্যে গিয়ে বিস্ফোরণ ঘটাতে লাগল। শেষ পর্যন্ত এত খেয়ে ফেলল যে পেটটা আইঢাই করতে লাগল একেবারে।

খাওয়ার পর বাসনপত্র সরিয়ে রেখে ওপরে নির্মলের পড়ার ঘরে গেল কানাই। দরজাটা বন্ধ করে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল ডেস্কটার সামনে। তারপর নোটবইটা খুলল।

কানাই, সেই ১৯৭০-এ শেষ যারা কুসুমকে দেখেছিল লুসিবাড়িতে, তাদের মধ্যে তুমি ছিলে একজন। সে বছর বনবিবি জহুরানামা পালা চলার সময় হঠাৎই নিখোঁজ হয়ে যায় ও। যেন একটা ঝড় ওকে তুলে নিয়ে চলে গিয়েছিল কোথাও, এতটুকু চিহ্নও রেখে যায়নি। কেউ জানত না কোথায় গেল কুসুম। সেই শেষ। তারপরে আর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি ওর। সত্যি বলতে কী, ওর কী যে হল তা নিয়ে আমরা কেউ মাথাও ঘামাইনি। খুবই দুঃখের বিষয় হলেও সত্যি, এই ভাটির দেশের অনেক ছেলেমেয়েই এভাবে হারিয়ে যায় শহরের ভিড়ে। এরকম ঘটনা এত ঘটে যে খেই রাখা মুশকিল।

তারপর বহু বছর কেটে গেল, আমারও অবসরের সময় চলে এল। অস্বীকার করলে.মিথ্যে বলা হবে, আমার বুকটা একটু দুরুদুরু করছিল বইকী। প্রায় তিরিশ বছর হেডমাস্টারি করেছি। এই স্কুল, এই ছাত্ররা, তাদের পড়ানো–এসবই জীবনের অংশ হয়ে গিয়েছিল আমার। ক্লাসরুম আর রুটিনের নিয়মের বাইরে বেরিয়ে আমি বাঁচব কী নিয়ে? বহু বছর আগের সেই অসম্বন্ধ দিনগুলির কথা মনে পড়ে গেল আমার, যখন পৃথিবীটাকে এত নৈরাশ্যময় আর জটিল মনে হত যে সবসময় খালি শুয়ে থাকতেই ইচ্ছে করত। আবার যদি সেরকম হয়? সে সময় আমার মনের অবস্থাটা নিশ্চয়ই তুমি কল্পনা করতে পারছ।

ছকে-বাঁধা জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি হল তার অর্থহীনতাটা বোঝা যায় বড় দেরিতে। কত বছর ধরে আমি নীলিমাকে বলেছি যে আমি ওপরে আমার স্টাডিতে বসে লেখার কাজ করছি। শুনে খুব খুশি হত নীলিমা। এই যে চারিদিকে ওর এত খ্যাতি, প্রতিপত্তি, আর আমার কিছুই নেই, সেটা ওর ভাল লাগত না। ওর বিশ্বাস ছিল আমি একজন লেখক, কবি। ও চাইত কবি হিসেবে, লেখক হিসেবে আমাকেও সবাই চিনুক, জানুক। কিন্তু সত্যি কথা হল লুসিবাড়িতে এতগুলো বছরে একটা শব্দও লিখিনি আমি। শুধু তাই নয়, আমার আরেকটা ভালবাসার জিনিস বই পড়া, সে অভ্যাসটাকেও বিসর্জন দিয়েছিলাম একেবারে। অবসরের সময় যত এগিয়ে আসতে লাগল, এই সবকিছুর জন্য ভীষণ অনুশোচনা হতে লাগল আমার। একদিন কলকাতায় গিয়ে আমার এক সময়কার প্রিয় দোকানগুলোতে বইপত্র ঘেঁটে অনেকটা সময় কাটালাম, দেখলাম বই কেনার সামর্থ্য আমার আর নেই। একটা মাত্র নতুন বই নিয়ে ফিরে এলাম লুসিবাড়িতে। বার্নিয়ের ভ্রমণকাহিনি। তুমিই কিনে দিয়েছিলে সেটা আমাকে।

আমার স্কুল থেকে বিদায়ের দিন যত এগিয়ে আসতে লাগল, পরিষ্কার বোঝা গেল অন্য মাস্টারমশাইরা সাগ্রহে অপেক্ষা করে আছেন আমার যাওয়ার জন্য। আমার মনে হয় না তার মধ্যে বিদ্বেষের ভাব খুব একটা ছিল। আসলে অনাগত ভবিষ্যতের গর্ভে কী লুকোনো আছে সেটা দেখার জন্যই ওরকম উদগ্রীব হয়েছিলেন ওঁরা। কেউ যদি কোনও জায়গায় একটানা তিরিশ বছর কাজ করে, সেখানকার দেওয়ালের গায়ে শ্যাওলার মতো হয়ে যায় সে। নতুন দিনের আলোয় কেমন করে তা শুকিয়ে ঝরে যায় সেটা সকলেই দেখতে চায়।

আমার অবসরের খবর যত ছড়াতে থাকল, বহু নিমন্ত্রণ পেতে থাকলাম আমি আশেপাশের অন্য সব দ্বীপের স্কুলগুলো থেকে, সেসব জায়গায় একবার ঘুরে আসার জন্য। আগে হলে হয়তো রাজি হতাম না, কিন্তু এখন কবির সেই সতর্কবাণী মনে পড়ল আমার–”থেমে যাওয়ার অর্থ অস্তিত্বহীনতা”। কাজেই খুশি হয়েই সে সব নিমন্ত্রণ গ্রহণ করতে লাগলাম। একদিন এরকমই এক নিমন্ত্রণ এল কুমিরমারি দ্বীপ থেকে। আমার পরিচিত একজন সেখানে থাকতেন। লুসিবাড়ি থেকে কুমিরমারির দূরত্ব খুব একটা কম নয়, বেশ কয়েকবার ফেরি পার হয়ে যেতে হয়। স্থির করলাম যাব।

যেদিন সকালে আমার যাওয়ার কথা, ঘটনাচক্রে নীলিমা সেদিন বাড়ি ছিল না, ট্রাস্টের কাজে কোথাও গিয়েছিল। আমিও খালি বাড়িতে মনের আনন্দে অনেকক্ষণ ধরে আমার ঝোলা গোছালাম। একটা বই ঢোকালাম, তারপর মনে হল আরও একটা নিই–এত দূরের পাড়ি, অনেক পড়ার জিনিস লাগবে। এই করতে করতে সময়ের হিসাব ভুলে গেলাম আমি–ক’টার সময় নৌকো আছে, জেটি পর্যন্ত হেঁটে যেতে কতক্ষণ লাগবে–সব গোলমাল করে ফেললাম। তারপর কী হল সে আর বিশদ বলার কিছু নেই। এইটুকু বললেই চলবে যে প্রথম নৌকোটা ধরতে পারলাম না আমি। অর্থাৎ পরের কোনও ঘাটেও আর ফেরি ধরতে পারব না।

হতাশ হয়ে বাঁধের ওপর বসেছিলাম, হঠাৎ দেখি একটা চেনা চেহারা–নৌকো নিয়ে যাচ্ছে সামনে দিয়ে। হরেন নস্করকে বহু বছর দেখিনি, কিন্তু ওই তাগড়াই চেহারা আর সরু চোখ দেখে সঙ্গে সঙ্গেই চিনতে পারলাম ওকে। কিশোর বয়সি একটি ছেলে ছিল সঙ্গে, নিশ্চয়ই ওর বড় ছেলে।

তড়িঘড়ি বাঁধ বেয়ে নেমে গিয়ে ডাকলাম ওকে–”হরেন! হরেন! একটু দাঁড়াও!”

কাছাকাছি আসতে অবাক হয়ে হরেন বলল, “সার? আপনি এখানে? আমি তো ছেলেকে নিয়ে আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম। ও আপনার স্কুলে ভর্তি হতে চায়।”

ছেলেটার কাঁধে হাত রাখলাম আমি। “অবশ্যই ওর ভর্তির ব্যবস্থা করে দেব। কিন্তু আমারও যে একটা উপকার করে দিতে হবে হরেন।”

“নিশ্চয়ই সার। কী করতে হবে বলুন।”

“হরেন, আমাকে এখন একবার কুমিরমারি যেতেই হবে। তুমি নিয়ে যাবে?”

“কেন নিয়ে যাব না সার? এটুকু করতে পারব না আপনার জন্য? উঠে আসুন, উঠে আসুন।” ছেলের পিঠে একটা চাপড় মেরে ওকে বলল একাই বাড়ি ফিরে যেতে। তারপর একবারও পেছনে না তাকিয়ে আমরা রওয়ানা হলাম কুমিরমারির উদ্দেশ্যে।

চলতে শুরু করেই আমার মনে হল বহু বছর পরে হরেনের নৌকোর মতো এরকম নৌকোয় চড়লাম। গত কয়েক বছরে যখনই লুসিবাড়ির বাইরে যাওয়ার দরকার হয়েছে–খুব একটা বেশি হয়নি অবশ্য–সাধারণত লঞ্চ বা ভটভটিতেই যাতায়াত করেছি। এখন এই নৌকোয় বসে চারপাশের চেনা দৃশ্যগুলোই কেমন অন্যরকম মনে হতে লাগল–যেন নতুন দৃষ্টিতে দেখছি আমি। ছাতা দিয়ে রোদ আড়াল করে বসে একটা বই বের করলাম–সেই বার্নিয়ের ভ্রমণকাহিনি–আর যেন কোনও জাদুমন্ত্রে বইয়ের যে পাতাগুলো খুলল ঠিক সেই জায়গাটাতেই সাহেব ভাটির দেশে তার অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছেন।

হরেন বলল, “কী পড়ছেন সার? গল্পের বই? আমাকেও একটা গল্প বলুন না ওটা থেকে। অনেক দূরের পথ তো, শুনতে শুনতে যাওয়া যাবে বেশ।”

“ঠিক আছে, আমি বললাম, “শোনো তা হলে।

“এই বইটা লিখেছিলেন একজন খ্রিস্টান পাদরি। ফরাসি দেশ থেকে ১৬৬৫ সালে এসেছিলেন ভারত ভ্রমণ করতে। তখনও চৈতন্য মহাপ্রভুর কথা আমাদের গ্রামগঞ্জের মানুষের বেশ মনে আছে। আর দিল্লির মসনদে তখন ছিলেন মুঘল বাদশা আওরঙ্গজেব। তো, আমাদের পাদরিসাহেব ছিলেন জেসুইট সম্প্রদায়ের মানুষ। নাম ছিল সোয়া বার্নিয়ে। সাহেবের সঙ্গে ছিল দু’জন পর্তুগিজ পথপ্রদর্শক আর বেশ কিছু চাকর-বাকর। সকলে মিলে তো এসেছেন এই বাদাবনে। কিন্তু প্রথম দিনেই সাহেবরা খিদের জ্বালায় অস্থির। সঙ্গে খাবার ছিল, কিন্তু ডাঙায় নেমে রান্না করার সাহস আর হয় না। এখানকার বাঘের হিংস্রতার বহু গল্প তারা শুনে এসেছেন, সবাই। তাই খুব সাবধান। অবশেষে নদীর মাঝে একটা সুবিধাজনক চড়া পাওয়া গেল। সেখানে নেমে রান্না করা হল–দুটো মুরগি আর একটা মাছ। খাওয়া-দাওয়ার পরে তো আবার রওয়ানা হল নৌকো। একেবারে অন্ধকার নামা পর্যন্ত তারা চললেন। সন্ধের মুখে মুখে নিরাপদ একটা খাঁড়িতে ঢুকে দু’দিকের তীরের থেকে বেশ খানিকটা দূরে এসে নোঙর ফেলা হল। সাহেবদের মনে হল জন্তুজানোয়ারের আক্রমণের সম্ভাবনা অনেক কম হবে এই মাঝখাঁড়িতে। তবুও, বাড়তি সাবধানতা হিসেবে ঠিক হল পালা করে রাত জেগে পাহারা দেওয়া হবে। পাদরি সাহেব লিখেছেন কী ভাগ্যিস তাকেও রাত জাগতে হয়েছিল সেখানে, সেইজন্যেই অপূর্ব এক দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য হল তার–চাঁদের আলোয় রামধনু।”

“ও!” হরেন বলে উঠল, “আমি জানি কোন জায়গায় হয়েছিল এটা। নিশ্চয়ই গেরাফিতলার কাছটায় হবে।”

“রাবিশ,” আমি বললাম, “কী করে জানবে তুমি হরেন? তিনশো বছরেরও আগেকার ঘটনা, সেটা তুমি কী করে জানবে?”

“আমিও দেখেছি তো, “ হরেন প্রতিবাদ করল, “ঠিক যেমন আপনি বলছেন–একটা বড় নদী দিয়ে গিয়ে একটা খাঁড়ি, সেরকম। শুধু সে জায়গাটায় দেখা যায় ওই চাঁদের রামধনু। পূর্ণিমার রাতে কুয়াশা থাকলে রামধনু হয় ওখানটায়। সে যাকগে, আপনি গল্পটা বলুন সার।”

“বাদাবনে আসার তৃতীয় দিনে বার্নিয়ে আর তার দলবল আবিষ্কার করলেন যে তাঁরা পথ হারিয়ে ফেলেছেন। একবার এ নদী দিয়ে যান, একবার সে খাঁড়িতে ঢোকেন–আর যত এরকম ঘুরতে থাকেন, আরও গুলিয়ে যায় পথ। ভয়ে সবার প্রাণ শুকিয়ে গেছে, ভাবছেন বুঝি এই গোলোকধাঁধা থেকে বেরোনোই যাবে না কোনওদিন, এখানেই বোধ হয় ঘুরে মরতে হবে। এইরকম সময়, আবার এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। নৌকো থেকে দেখা গেল দূরে একটা বালির চরের ওপর কিছু লোক কী যেন করছে। নৌকোর মুখ ঘোরানো হল সেদিকে। সাহেবরা ভেবেছিলেন নিশ্চয়ই স্থানীয় জেলে-টেলে হবে, ওদের কাছ থেকে বেরোনোর পথ জেনে নেওয়া যাবে। কিন্তু কাছে গিয়ে দেখা গেল লোকগুলি পর্তুগিজ। নুন তৈরি করছে ওই বালির চরে।”

“ওহ!” লম্বা একটা শ্বাস ছেড়ে বলল হরেন। “ও জায়গাটা তো আমি চিনি। কেঁদোখালি যাওয়ার পথে পড়ে। ওদিকে একটা জায়গা আছে যেখানে এখনও গ্রামের কিছু লোক নুন তৈরি করে। আমার ছোটকাকা একবার এক রাত্তির ছিল ওই চরে। সারারাত কাদের সব গলা শুনেছে। অদ্ভুত ভাষায় কী সব কথা বলছে। নিশ্চয়ই

ওই ভূতগুলোই হবে। সে যাকগে সার, আপনি বলুন গল্পটা।”

“চারদিনের দিন, তখনও এই ভাটির দেশ থেকে বেরোতে পারেননি পাদরিসাহেব আর তার দলবল। সন্ধে হয়ে এসেছে, তখন আবার একটা খাঁড়ির মাঝে গিয়ে নোঙর ফেলা হল। সে রাত এক অসাধারণ রাত। প্রথমে তো হাওয়া বন্ধ হয়ে গেল; সারা জঙ্গলে একটা গাছের পাতা নড়ছে না। তারপর, নৌকোর চারপাশের বাতাস আস্তে আস্তে গরম হয়ে উঠতে লাগল। ক্রমে এত গরম হয়ে গেল যে পাদরি আর তার দলবলের প্রায় দম বন্ধ হয়ে আসার মতো অবস্থা হল। তারপর হঠাৎ মনে হল নৌকোর চারপাশের জঙ্গলে যেন আগুন লেগেছে; গাছে গাছে থিকথিক করছে অজস্র জোনাকি। এমনভাবে উড়ছিল জোনাকিগুলো, মনে হচ্ছিল যেন গাছের ডাল আর শেকড়গুলোর ওপর দিয়ে আগুন নেচে বেড়াচ্ছে। প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেল মাঝিরা। পাদরি লিখেছেন, “উহাদের মনে হইতেছিল ওইগুলি সব ভূতপ্রেত।”

“কিন্তু সার,” অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে হরেন জিজ্ঞেস করল, “মনে হচ্ছিল কেন লিখেছে সার? ওগুলো তো ভূতই। তা ছাড়া আবার কী?”

“আমি জানি না, হরেন। পাদরি যা লিখেছেন সেটাই আমি বলছি।”

“ঠিক আছে সার, ঠিক আছে। বলুন, আপনি বলুন।”

“পরের রাতটা আরও সাংঘাতিক সম্পূর্ণরূপে ভয়াবহ এবং বিধ্বংসী’, লিখেছেন সাহেব। কথা নেই বার্তা নেই, হঠাৎ প্রচণ্ড এক ঝড় উঠল। ওদের নৌকোটাকে ঠেলে নিয়ে ঢোকাল এক খাঁড়ির মধ্যে। কোনওরকমে সেটাকে পাড়ের কাছে নিয়ে গিয়ে যত দড়িদড়া ছিল সব দিয়ে কষে বাঁধা হল একটা গাছের সঙ্গে। কিন্তু ভয়ানক সে ঝড়ের দাপট; হাওয়ার মুখে দড়ি বেশিক্ষণ টিকল না। খানিক পরেই টুকরো টুকরো হয়ে গেল সব বাঁধন, মনে হল ঝড়ের তোড়ে এক্ষুনি নৌকো খাঁড়ির নিরাপদ আশ্রয় থেকে ভেসে যাবে মোহনায়, উথাল পাথাল ঢেউয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে একেবারে। আর সমস্তক্ষণ অঝোরে বৃষ্টি, মনে হইতেছিল যেন কেউ বৃহৎ বারিভাণ্ড লইয়া নৌকার উপর জল নিক্ষেপ করিতেছে, আর মস্তকের সম্মুখে অনবরত এমন উজ্জ্বল বিদ্যুৎচমক আর কর্ণবিদারক বজ্রপাত হইতে লাগিল যে সে রাত্রে আমাদিগের প্রাণ বাঁচানোর আশা আর রহিল না।”

“এইরকম সময়ে ‘এক আকস্মিক এবং স্বতস্ফূর্ত চেষ্টায়’ পাদরিসাহেব আর তার দুই পর্তুগিজ পথপ্রদর্শক জঙ্গলের গাছের পাচালো শেকড়গুলি দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন। তাদের হাতগুলোও যেন জীবন্ত শেকড়ের মতো হয়ে লেগে রইল গাছের সঙ্গে। প্রায় দুই ঘটিকা কাল, যতক্ষণ সে ঝঞ্ঝা তীব্র গতিতে বহিয়া চলিল’, ততক্ষণ ওঁরা সেইভাবে রইলেন।”

“এই রে!” বলে উঠল হরেন। “নিশ্চয়ই সে গণ্ডীটা পেরিয়ে গিয়েছিল।”

“কোন গণ্ডী হরেন?”

“বললেন না সার, যে ওরা হারিয়ে গেছিল?”

“হ্যাঁ, বললাম তো।”

“আর দেখতে হবে না! তা হলে তাই হয়েছিল। নিশ্চয়ই ভুল করে গণ্ডীটা পেরিয়ে গিয়েছিল, আর একেবারে দক্ষিণরায়ের এলাকায় কোনও দ্বীপে গিয়ে পড়েছিল। ওরকম কোথাও কিছু নেই হঠাৎ ঝড় শুরু হয়ে গেল–ওরকম হলেই বুঝতে হবে ও দক্ষিণরায় আর তার দানোগুলোর কারসাজি।”

আর ধৈর্য রাখতে পারলাম না আমি। বললাম, “হরেন, ঝড়ঝঞ্ঝা হল প্রাকৃতিক ব্যাপার, কারও ইচ্ছা অনিচ্ছার ওপর সেটা নির্ভর করে না।”

এত রূঢ়ভাবে কথাটা বলেছিলাম আমি যে হরেন আর প্রতিবাদ করল না, কিন্তু একমতওঁ হল না আমার সঙ্গে। “ঠিক আছে সার,” ও বলল, “আমার বিশ্বাস আমার কাছে, আপনার বিশ্বাস আপনার কাছে। তারপর গল্পটা কী হল বলুন।”

আমার মনে হল একমাত্র কবিই ওর মতো এইরকম মানুষদের চিনতে পেরেছিলেন–‘পেশি আর সারল্যে ভরপুর।’

অনেকক্ষণ একটানা লেখা হয়ে গেল কয়েক ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে বোধহয়। আমার ডটপেনের কালিও ফুরিয়ে এসেছে। এত বছর না লিখলে এরকমই হয় প্রতিটা মুহূর্ত যেন স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ হয়ে ফিরে আসে, ছোট ছোট ঘটনাকে মনে হয় যেন বিশ্বদর্শন।

আমাকে এখানে ফকিরের কাছে রেখে কুসুম আর হরেন বেরিয়েছে। ওরা দেখতে গেছে যে গুজবটা সত্যি কিনা মরিচঝাঁপিতে হামলা হতে পারে সেই গুজব; যদি সেটা সত্যি হয় তা হলে কখন হতে পারে সে হামলা?

আপশোস হচ্ছে। এতগুলো বছর কত সময় ছিল আমার হাতে, কিন্তু একটা শব্দও লিখিনি আমি। আর এখন আমার নিজেকে আরব্যোপন্যাসের সেই শাহজাদির মতো মনে হচ্ছে–ভ্রান্তস্থিতি, ভ্রান্তলিঙ্গ–ছুটন্ত কলম হাতে কোনওরকমে রাতটা পার করে দেওয়ার চেষ্টা করছি…

.

গর্জনতলা

শেষবার নদী পেরোনোর পর ফকিরের নৌকো এসে থামল অগভীর জলে, পাড় থেকে মাত্র কয়েক মিটার দূরে। পিয়ার আন্দাজ একেবারে ঠিক প্রমাণিত হয়েছে, সন্দেহের কোনও অবকাশই নেই আর–সাউন্ডিং-এর ফলাফল অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে বাঁকের মুখে, নদীর কনুইয়ের ঠিক ভেতরের দিকটায় কিলোমিটার খানেক জায়গা জুড়ে বেশ খানিকটা গম্ভীর হয়ে গেছে খাতটা। চারপাশ থেকে আস্তে আস্তে ঢালু হয়ে এসে কিডনি আকৃতির একটা বেসিন সৃষ্টি হয়েছে সেখানে। কোথাও কোথাও সেটা নদীর খাতের থেকে আট মিটারের মতো বেশি গম্ভীর হলেও, গড়ে সে গভীরতা মিটার পাঁচেকের বেশি নয়। সংক্ষেপে, শুখা মরশুমে জল কমে এলে মেকং নদীর নীচের যে ‘পুকুর’গুলিতে ওর্কায়েলারা এসে জমা হয়, প্রায় সবদিক থেকেই সুন্দরবনের এই নদীখাতের দহের সঙ্গে তার ভীষণ মিল।

জল এখন অনেকটাই ওপর দিয়ে বইছে। হাত কয়েকের বেশি আর দেখা যাচ্ছে না। পাড়ের কাদা। বনের গাছগুলোও ঠিক চোখের সমান উচ্চতায়–নৌকোর থেকে উঁচুতেও নয়, নিচুতেও নয়। পাড়ের কাছে এ জায়গাটা এতই অগভীর যে এখানে আর সাউন্ডিং-এর কোনও মানেই হয় না। বেশ কয়েকঘণ্টা পর এতক্ষণে একটু গা ঢিলে দিল পিয়া। দূরবিনটা নামিয়ে চোখ রাখল পাড়ের সবুজের দিকে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ কাদার মধ্যে ইটের টুকরোর মতো কী যেন একটা নজরে এল। দূরবিন দিয়ে ভাল করে একবার দেখল পিয়া। হ্যাঁ, ঠিকই মনে হয়েছিল, ইটের টুকরোই বটে। একটা টুকরো শুধু নয়, পাড় জুড়ে রাশি রাশি পড়ে রয়েছে ওরকম ভাঙা ইট। ওপরের ঘন জঙ্গলের দিকে নজর করে দেখা গেল গায়ে গায়ে লেগে থাকা গাছগুলোর মধ্যে কয়েকটা গজিয়ে উঠেছে পুরনো মাটির দেওয়ালের ওপর, আর কয়েকটার শেকড়-বাকড়ের মধ্যে জড়িয়ে রয়েছে থাক থাক ইট।

ফকিরকে ডাকল পিয়া, “লুক–দেয়ার।” পাড়ের দিকে একবার ফিরে দেখে মাথা নাড়ল ফকির। হাত দিয়ে সেদিকে দেখিয়ে বলল, “গর্জনতলা”। পিয়া আন্দাজ করল হয়তো কোনও একদিন এই নামে কোনও বসতি ছিল এখানে। “গর্জনতলা?” মাথা নেড়ে সায় দিল ফকির। নামটা জেনে খুশি হল পিয়া, চটপট টুকে নিল নোটবইয়ে। ঠিক করল এই পরিত্যক্ত গ্রামের নামেই ভাটার সময় ডলফিনদের জড়ো হওয়ার জায়গাটার নামকরণ করা হবে–‘গর্জনতলা, দহ’।

হঠাৎ লাফিয়ে উঠল টুটুল। অল্প দুলে উঠল নৌকোটা। নোটবই থেকে চোখ তুলে পিয়া দেখল খানিক দূরে পাড়ের একটা গাছের দিকে আঙুল তুলে দেখাচ্ছে ও। আশপাশের অন্য গাছের তুলনায় সেটা বেশি লম্বা, এই বাদাবনের গাছের মতো নয় ঠিক, খানিকটা যেন বার্চের মতো দেখতে–পাতলা ডালপালা, হালকা রঙের বাকল, বনের অন্যসব গাছের ঘন সবুজের সামনে এর পাতাগুলোকে মনে হচ্ছিল প্রায় রুপোলি।

পিয়ার নদী পারাপারের কাজ হয়ে যাওয়ার পর হঠাই নৌকোর মুখ এদিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিল ফকির। একটু আশ্চর্য হয়েছিল পিয়া। এর আগে জঙ্গলের এতটা কাছে ও কখনও আসেনি, মনে হচ্ছিল যেন এই প্রথম এল বনের মুখোমুখি। আগে জঙ্গল যেটুকু দেখেছে সে হয় অর্ধেক জলে ডোবা, নয়তো দূরের উঁচু পাড় থেকে জলের ওপর ঝুঁকে থাকা কালো ছায়ার মতো। সামনাসামনি দেখে অবাক হয়ে গেল ও। চোখে যেন ধাঁধা লাগিয়ে দেয় এই গাছগাছালির সারি। পর্দা বা দেওয়ালের মতো যে জঙ্গলটা চোখের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তা শুধু নয়, যেন ধন্দে ফেলে দিচ্ছে মানুষের দৃষ্টিকে, যেন খুব ভেবেচিন্তে বানানো প্রহেলিকা। আকার, ঢং, বর্ণ আর বিন্যাসের এত বৈচিত্র্য এখানে যে চোখের সামনে থাকা জিনিসও হঠাৎ করে নজরে আসে না, লুকিয়ে থাকে অসংখ্য রেখার জটের মধ্যে–বাচ্চাদের হেঁয়ালি ছবির মতো।

শেষ একবার জোরালো বৈঠা মেরে ফকির দাঁড় তুলে নিল। পাড়ের কাদায় আস্তে একবার ধাক্কা খেয়ে থেমে গেল ডিঙিটা। ফকির উঠে দাঁড়িয়ে ম্যাজিকের মতো কবজির ছোট্ট একটা মোচড়ে পরনের লুঙ্গিটাকে ল্যাঙ্গোটের মতো বানিয়ে ফেলল। তারপর নৌকোর পাশের দিকে পা ঝুলিয়ে বসে ঝুপ করে নেমে পড়ল জলে, আর নৌকোটাকে আরও একটু ঠেলে দিল পাড়ের দিকে। ডিঙির একেবারে সামনে বসে পিয়া দেখল পাড়ের অনেকটা ওপরের দিকে বসে আছে ও, সামনের ঢাল জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে জটপাকানো ম্যানগ্রোভের দেওয়াল।

টুটুলকে কোলে তুলে নিয়ে হাত দিয়ে পিয়াকে ইশারায় ডাকল ফকির। পিয়া বুঝতে পারল নৌকো থেকে নেমে ওর পেছন পেছন যেতে বলছে। কিন্তু কোথায় যাচ্ছে ও? পিয়ার ইশারায় প্রশ্নের জবাবে শুধু হাত তুলে সামনের জঙ্গলের পেছনে দ্বীপের ভেতরের দিকটা দেখাল ফকির।

“ইন দেয়ার?”

আবার হাত নেড়ে ডাকল ওকে ফকির। ইশারা করল তাড়াতাড়ি যেতে। এক মুহূর্ত দ্বিধা করল পিয়া; কাদা, পোকামাকড়, ঘন বন–এসব ওর একটুও পছন্দ নয়। কিন্তু এ সবগুলিই প্রচুর পরিমাণে রয়েছে পাড়ের ওপর। অন্য যে-কোনও অবস্থাতেই কিছুতেই এরকম জঙ্গলের মধ্যে গিয়ে ঢুকত না পিয়া, কিন্তু ফকিরের সঙ্গে ও যেতে পারে। কেন যেন মনে হয় ওর সঙ্গে থাকলে বিপদের কোনও ভয় নেই।

“ওকে। আই অ্যাম কামিং,” হাঁটু অব্দি প্যান্টটা গুটিয়ে নিয়ে নৌকোর পাশের দিক দিয়ে পা বাড়িয়ে দিল পিয়া। পায়ের তলা থেকে কাদা সরে গেল ওর ভারে। একটা ভেজা ভেজা খপাৎ শব্দ করে মাটির ভেতরে যেন টেনে নিল পা-টা। পিয়া একটুও প্রস্তুত ছিল না এর জন্যে, কারণ ফকির যখন নেমে দৌড়ে পাড়ে উঠে গেল তখন একবারও মনে হয়নি কাদা এত গভীর এখানে। সামান্য যেটুকু সামনে ঝোঁক দিয়ে নামতে হল নৌকো থেকে, এ কাদায় ব্যালান্স হারানোর জন্য সেটুকুই যথেষ্ট। কাদা যেন গোড়ালিটা কামড়ে ধরে টানছে পেছনের দিকে, শরীরটাকে সরিয়ে দিচ্ছে ভরকেন্দ্র থেকে। হঠাৎ পিয়া দেখল মুখ থুবড়ে উলটে পড়ে যাচ্ছে ও, হাতদুটো সামনে বাড়ানো–কাদা থেকে বাঁচার জন্য। কিন্তু ঠিক সময়ে ওর একেবারে সামনে এসে গেল ফকির। নিজের শরীর দিয়ে পিয়াকে ঠেকানোর জন্য দাঁড়িয়ে পড়ল ওর মুখোমুখি। ধপাস করে ফকিরের কাঁধের ওপর এসে পড়ল পিয়া, ওর গায়ের সেই নোনা গন্ধ আবার এসে লাগল নাকে। হাতের সামনে কোনও থাম কি গাছ পেলে পড়ন্ত মানুষ যেমন তাকে জড়িয়ে ধরে নিজেকে সামলায়, ফকিরকে সেরকম দু হাতে জড়িয়ে ধরল পিয়া। একটা হাতে আঁকড়ে ধরল ফকিরের স্কন্ধার হাড়। অন্য হাতটা পিছলে গেল ওর খালি গায়ের চামড়ার ওপর দিয়ে, একেবারে পিঠের শেষটায় এসে থামল। মুহূর্তের জন্য সংকোচে অবশ হয়ে গেল পিয়া। ঠিক সেইসময়ে টুটুলের গলা শুনতে পেল ও। পিয়ার দুরবস্থা দেখে মজা পেয়ে হাসছে–শিশুসুলভ আনন্দে। আস্তে আস্তে আঙুল সরিয়ে নিয়ে ফকিরের গা ছেড়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল পিয়া। ওকে সোজা করে দাঁড় করাতে ফকির যখন কনুইয়ের তলা দিয়ে এক হাত গলিয়ে দিল, পিয়া দেখল ও-ও হাসছে। সে হাসিতে নিষ্ঠুরতা নেই। পিয়ার পড়ে যাওয়ার চেয়ে আচমকা গভীর কাদায় নামার পর ওর ভ্যাবাচ্যাকা ভাবটাতেই যেন বেশি মজা পেয়েছে ফকির।

পিয়া নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পর ছোট্ট একটু মূকাভিনয় করে দেখিয়ে দিল ফকির, কেমন করে হাঁটতে হবে এই কাদার মধ্যে। প্রথমে একটা পা তুলে বুড়ো আঙুলটা কঁকড়ার পঁাড়ার মতো কুঁকড়ে ধরল, তারপর কাদার মধ্যে যেন পুঁতে দিল পা-টাকে। পিয়া নিজে চেষ্টা করল এবার, কয়েক পা এগোল ঠিক মতো, তারপর পিছলে গেল আবার। সৌভাগ্যবশত ফকির পাশেই ছিল। ওর হাতটা ধরে কোনওরকমে টাল সামলে নিল। কাদা পার হয়ে পাড় বরাবর টানা দুর্ভেদ্য জঙ্গলে ঢুকে পড়া পর্যন্ত হাতটা ধরে রইল পিয়া।

ফকিরের সঙ্গে দেখা গেল একটা ধারালো দা আছে। পিয়াকে ছেড়ে এগিয়ে গেল ও, ডাইনে বাঁয়ে দা চালিয়ে ডালপাতা কেটে কেটে ঢুকতে লাগল ঘন বনের ভেতরে। সামান্য পরেই জঙ্গলের দেওয়াল ভেদ করে একটা খোলা জায়গায় এসে পড়ল ওরা। বনের মধ্যে একচিলতে ফাঁকা ঘাসজমি, কয়েকটা বেঁটে খেজুরগাছ ছাড়া আর কোনও গাছ নেই সেখানে।

ফাঁকা জায়গাটার শেষে ছোট একটা গুমটি মতো ঘর–কয়েকটা খুঁটির ওপর দাঁড় করানো। একদৌড়ে টুটুল সেটার সামনে চলে গেল। কাছে গিয়ে পিয়া দেখল গুমটি নয়, পাতা দিয়ে তৈরি একটা ছোট মন্দিরের মতো–ওটা দেখে ওর মায়ের পুজোর টেবিলের একটা সুদূর স্মৃতি ভেসে এল পিয়ার মনে। তফাত শুধু এ মন্দিরের মূর্তিগুলির সাথে পিয়ার চেনা হিন্দু ঠাকুর দেবতাদের কোনও মিল নেই। সবচেয়ে বড়টি স্ত্রী মূর্তি টানা টানা চোখ, শাড়ি পরা; তার পাশে আকারে একটু ছোট একটি পুরুষের মূর্তি। দু’জনের মাঝখানে নিচু হয়ে বসে আছে একটা বাঘ–গায়ের ডোরাকাটা দাগ দেখে বাঘ বলে আন্দাজ করা গেল সেটাকে।

পিয়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল ফকির আর টুটুল মিলে একটু পুজো মতো করল সেখানে। প্রথমে কিছু ফুল পাতা নিয়ে এসে মূর্তিগুলির সামনে রাখল। তারপর মন্দিরের সামনে মাথা হেঁট করে জোড়হাতে দাঁড়িয়ে ফকির মন্ত্রের মতো কিছু একটা আওড়াতে লাগল। কয়েক মিনিট শোনার পর পিয়া ধরতে পারল মন্ত্রটার মধ্যে একটা লাইন ধুয়ার মতো ঘুরে ঘুরে আসছে। তার মধ্যে একটা শব্দ মনে হল ‘আল্লা’। এতক্ষণফকিরের ধর্ম নিয়ে মাথা ঘামায়নি পিয়া, কিন্তু এখন মনে হল ও হয়তো মুসলমান। কিন্তু সেটা ভাবার পরেই খেয়াল হল মুসলমান হলে তো এরকম মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করবে না। ফকির যেটা করছে তার সাথে ওর মা যেরকম পুজো করত তার বেশ মিল রয়েছে। কিন্তু মন্ত্রের শব্দগুলো শুনে আবার অন্যরকম মনে হচ্ছে।

তবে যাই হোক না কেন তাতে কীই বা আসে যায়? এখানে দাঁড়িয়ে এরকম একটা অদ্ভুত পুজো দেখার সুযোগ পেয়েই ও খুশি।

মিনিট কয় পরে আবার ফিরতি পথ ধরল ওরা। জঙ্গল ভেদ করে নদীর কাছে পৌঁছে পিয়া দেখল সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিমে, এদিকে নদীর জলও নামতে শুরু করেছে। এবার খুব সাবধানে পা টিপে টিপে কাদার মধ্যে দিয়ে হেঁটে ডিঙিটার কাছে গিয়ে পৌঁছল পিয়া। নৌকোয় উঠতে যাবে, এমন সময় হাত নাড়ল ফকির। কিছু একটা দেখাতে চাইছে কাদার মধ্যে। মিটার বিশেক দূরে হাঁটু গেড়ে বসে আছে ও মাটির দিকে ইশারা করছে হাত দিয়ে। পিয়া একটু এগিয়ে গেল। দেখল কাদার মধ্যে একটা গর্তের মতো কিছু দেখাচ্ছে ফকির। কাঁকড়া বিজবিজ করছে সেটার মধ্যে। ভুরুদুটো একটু তুলে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল পিয়া। ফকির একটা হাত তুলে দেখাল, যেন ওকে বলতে চাইছে গর্তটা কীসের একটা হাতের ছাপ। ব্যাপারটা ঠিক মাথায় ঢুকল না পিয়ার। ভুরু কুঁচকে ভাবতে লাগল ফকির ছাড়া আর কে হাত দিতে যাবে ওই কাদার মধ্যে? হঠাৎ খেয়াল হল হাত’ নয়, ও বোধহয় ‘পা’ বোঝাতে চাইছে–মানে ‘থাবা”। “টাইগার?” শব্দটা উচ্চারণ করতে যেতেই আঙুল তুলে বারণ করল ফকির। পিয়া আন্দাজ করল নিশ্চয়ই কোনও কুসংস্কার আছে–নাম উচ্চারণ করা বা ইঙ্গিতেও প্রসঙ্গটার উল্লেখ করা চলবে না।

ছাপটার দিকে আবার তাকাল পিয়া। দেখে কিন্তু ফকির যা বলছে সেরকম কিছু বুঝল না ও। দাগটা যেখানে আছে তাতেই ওর বেশি সন্দেহ হচ্ছিল–ওই জায়গায় আসতে গেলে তো জঙ্গল থেকে পুরো বেরিয়ে আসতে হবে জন্তুটাকে। তা হলে তো জল থেকে ওর চোখে পড়ত। আর একটা বাঘ যদি কাছাকাছি থাকে তা হলে ফকিরই বা এরকম নিশ্চিন্তে থাকে কী করে? কিছুই ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।

ঠিক তখনই একটা শ্বাস ফেলার মতো শব্দ শুনতে পেল পিয়া। সঙ্গে সঙ্গে বাঘ-টাঘের সমস্ত চিন্তা উবে গেল ওর মাথা থেকে। দূরবিন তুলে দেখল কুঁজের মতো দুটো জিনিস জল কেটে ভেসে যাচ্ছে। সেই মা ডলফিন, ছানাটার সঙ্গে সাঁতরাচ্ছে। জল নামার সাথে সাথে আবার ফিরে এসেছে ডলফিনগুলো। যেরকম আন্দাজ করেছিল পিয়া, তার সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে ওদের গতিবিধির ধরন।

.

আলোড়ন

হঠাৎ দপদপ করতে করতে নিভে গেল টেবিলের ওপরের আলোটা। তখনও মেসোর ঘরে বসে একমনে লেখাটা পড়ছিল কানাই। একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে খানিকক্ষণ বসে রইল চুপ করে। বাইরে জেনারেটারের ধকধক শব্দটা কমতে কমতে মিলিয়ে গেল। একটা নিঝুম ভাব মেঘের মতো ধীরে ধীরে ছড়িয়ে গেল গোটা দ্বীপটার ওপর। কানাই যেন শুনতে পাচ্ছিল তার এগিয়ে আসা, ভাবছিল নিস্তব্ধতার প্রসঙ্গে ইংরেজিতে কেন যে ‘ফল’ বা ‘ডিসেন্ড’ শব্দগুলো ব্যবহার করা হয় কে জানে–শুনতে লাগে যেন ওপর থেকে নেমে আসা পর্দা কি ছুরি। জেনারেটার বন্ধ হওয়ার পর যে নৈঃশব্দ্য এখন অনুভব করছে কানাই, তার মধ্যে পড়ে যাওয়া কি থিতিয়ে পড়ার ভাব তো নেই। বরং কুয়াশা কি মেঘের সঙ্গেই তার মিল বেশি–যেন দূর থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে এল গুঁড়ি মেরে, কিছু শব্দকে ঢেকে দিল তার চাদরে, কিছু শব্দকে আবার স্পষ্ট করে তুলল–ঝিঁঝিপোকার ডাক, দূরের কোনও রেডিয়ো থেকে ভেসে আসা একটা গানের টুকরো, হঠাৎ একটা পাচার কর্কশ চিৎকার। প্রত্যেকটা শব্দই শোনা গেল সামান্য দু-এক মুহূর্তের জন্য, তারপরেই যেন আবার ঝাপসা হয়ে ঢাকা, পড়ে গেল কুয়াশায়। এরকমভাবেই হঠাৎ একটা অচেনা শব্দ কানে এল কানাইয়ের, খুব সামান্য সময়ের জন্য, তারপরেই মিলিয়ে গেল শব্দটা। প্রতিধ্বনির মতো বহু দূর থেকে জলের ওপর দিয়ে ভেসে আসা সে আওয়াজ হয়তো শোনাই যেত না জেনারেটার চালু থাকলে। তা সত্ত্বেও সে শব্দের মধ্যে নগ্ন দাপট, শক্তি এবং হিংস্রতার ভয়ংকর প্রকাশ বুঝতে এতটুকু অসুবিধা হল না। ছোট্ট একটু আওয়াজ, কিন্তু তাতেই যেন মুহূর্তের জন্য নিথর হয়ে গেল সমস্ত দ্বীপ, অন্যসব শব্দ যেন থেমে গেল হঠাৎ। আর তারপরেই শুরু হয়ে গেল কানে তালা-ধরানো শোরগোল–সবচেয়ে বেশি শোনা যাচ্ছিল কুকুরগুলোর পাগলের মতো চিৎকার।

দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে ছাদে বেরিয়ে এল কানাই। আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করল কখন ফের বদলে গেছে চারপাশের রূপ। যেন কোনও মহাকাব্য লেখকের কলমের আঁচড়ে। চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারদিক। দিনের বেলা যে ছবি দেখেছিল, জ্যোৎস্নায় ধুয়ে গিয়ে এখন যেন তার রুপোলি নেগেটিভটুকু রয়ে গেছে চোখের সামনে। আবছা আঁধারে ঢাকা দ্বীপগুলোকেই এখন মনে হচ্ছে টলটলে দিঘি, আর গোটা নদীর বিস্তার জুড়ে যেন পড়ে রয়েছে বিশাল এক চকচকে ধাতুর পাত।

“কানাইবাবু?”

ঘুরে তাকিয়ে কানাই দেখল মাথায় ঘোমটা দেওয়া এক ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে দরজায়।

“ময়না?”

“হ্যাঁ।”

“শুনতে পেয়েছ?” বলতে-না-বলতেই আবার সেই আওয়াজ–একইরকম অস্পষ্ট প্রতিধ্বনি, খানিকটা যেন বহু দূর থেকে ভেসে আসা কোনও রেলগাড়ির শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে সারা দ্বীপ জুড়ে ফের শুরু হয়ে গেল কুকুরদের কোরাস, যেন শব্দটা আবার হবে বলে এতক্ষণ অপেক্ষা করে ছিল ওরা।

“এটা কি…” বলতে শুরু করেই কানাই দেখল কেমন যেন কুঁকড়ে গেল ময়না। থেমে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “নামটা বলতে নেই, না?”

“না,” ময়না বলল। “জোরে বলতে নেই এ নাম।”

“কোথা থেকে আসছে মনে হয় শব্দটা?”

“যে-কোনও জায়গা থেকে হতে পারে,” বলল ময়না। “আমি ঘরে বসেছিলাম, বসে বসে অপেক্ষা করছি, তখন ওটা শুনতে পেলাম। স্থির হয়ে আর বসে থাকতে পারলাম না।”

“ফকির তা হলে এখনও ফেরেনি?”

“না।”

এবার কানাই বুঝল জন্তুটার গর্জনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগ রয়েছে ময়নার উদ্বেগের। “চিন্তা কোরো না,” ওকে প্রবোধ দেওয়ার জন্য বলল কানাই। “নিশ্চয়ই সাবধানেই আছে ফকির। কী করতে হয় না হয় সে তো ও জানে।”

“ও?” রাগ যেন ঝরে পড়ছে ময়নার গলায়। “ওকে জানলে আর এ কথা বলতেন না আপনি। সব লোকে যা করে, ও ঠিক তার উলটোটা করবে। অন্য যারা মাছ ধরতে যায়, আমার বাবা, আমার ভাইরা, প্রত্যেকে ডিঙিতে রাত কাটালে সবার নৌকো একসঙ্গে বেঁধে মাঝনদীতে গিয়ে থাকে, যাতে কিছু হলে সবাই মিলে সামাল দিতে পারে। কিন্তু ফকির তা করবে না। ও নিজের মতো কোথাও একটা গিয়ে থাকবে; চারদিকে হয়তো সেখানে একটা জনপ্রাণীও নেই।”

“কেন?”

“ও ওইরকমই, কানাইবাবু,” ময়না বলল। “নিজের বোঝ নিজে বোঝে না। একেবারে বাচ্চাদের মতো করে।”

চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে ময়নার মুখের সোনার বিন্দু তিনটে। আবার নক্ষত্রপুঞ্জের তিনটে তারার কথা মনে হল কানাইয়ের। যদিও যত্ন করে আঁচলটা টানা মাথার ওপর, কিন্তু ময়নার একদিকে একটু হেলানো মুখের অস্থির ভাবটুকু ওর মার্জিত শাড়ি পরার ঢংয়ের সঙ্গে ঠিক যাচ্ছে না, মনে হল কানাইয়ের।

“একটা কথা বলো তো ময়না,” খানিকটা যেন মজা করে ওকে খেপানোর সুরে বলল কানাই, “বিয়ের আগে তুমি চিনতে না ফকিরকে? মানে, ও কীরকম মানুষ সেটা জানতে না?”

“হ্যাঁ,” ময়না বলল। “আমি ওকে জানতাম, কানাইবাবু। ওর মা মারা যাওয়ার পর তো হরেন নস্করই ওকে মানুষ করেছে। ওদের গ্রাম আর আমাদের গ্রাম তো একেবারে পাশাপাশি।”

“আচ্ছা, তুমি তো বুদ্ধিমতী মেয়ে, ময়না,” কানাই বলল। “যদি জানতেই ও কীরকম লোক, তা হলে ওকে বিয়ে করলে কেন?”

মনে হল যেন নিজের মনেই একটু হাসল ময়না। “সে আপনি বুঝবেন না।”

ময়নার প্রত্যয়ী ভঙ্গিটা যেন বিছুটির মতো এসে লাগল কানাইয়ের গায়ে। “আমি বুঝব না?” কর্কশ শোনাল ওর গলার স্বর। “তুমি জান আমি ছয়-ছয়টা ভাষা জানি? সারা পৃথিবী ঘুরেছি আমি? আমি কেন বুঝব না?”

ঘোমটা খসে গেল ময়নার, মিষ্টি করে একটু হাসল ও কানাইয়ের দিকে তাকিয়ে। “আপনি ক’টা ভাষা জানেন তাতে কিছু আসে যায় না কানাইবাবু। আপনি তো মেয়েমানুষ নন, আর আপনি ওকে চেনেনও না। আপনি বুঝবেন না।”

হঠাৎ ফিরে চলে গেল ময়না। কানাই দাঁড়িয়ে রইল, একা।

.

শোনা

ডলফিনগুলোর ধীর নিয়মিত শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দে একটু ঝিমুনি মতো এসে গিয়েছিল পিয়ার। হঠাৎ যেন স্বপ্নের মধ্যে থেকে ভেসে আসা প্রচণ্ড একটা গুমগুম আওয়াজে চটকাটা ভেঙে গেল। চোখ খুলে উঠে বসতে বসতেই আবার চারদিক চুপচাপ। প্রতিধ্বনির রেশটুকুও নেই আর। ডিঙির গায়ে জলের ধাক্কায় মৃদু একটা ছলাৎ ছলাৎ শব্দ শুধু কানে আসছে। ফটফটে জ্যোৎস্নায় তারাগুলোকে দূরে ক্ষুদে ক্ষুদে আলোর বিন্দুর মতো মনে হচ্ছে।

নৌকোটা দুলতে শুরু করল হঠাৎ। তার মানে ফকিরও জেগে আছে। মাথাটা একটু তুলে পিয়া দেখল ডিঙির ঠিক মাঝখানটায় আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে বসে আছে ফকির। উঠে পড়ে কাঁকড়ার মতো হামা দিয়ে গিয়ে ওর পাশে বসল পিয়া। “কীসের আওয়াজ ওটা?” ভুরুদুটো একটু তুলে মাথা ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল ইশারায়। একটু হাসল ফকির, কিন্তু সোজাসুজি কোনও জবাব দিল না। হাতটা তুলে অস্পষ্টভাবে পাড়ের দিকে ইশারা করল একবার। তারপর থুতনিটা হাঁটুর ওপর রেখে বিকেলে ওরা যে দ্বীপটায় গিয়েছিল সেটার দিকে চেয়ে রইল একদৃষ্টে। এতদূর থেকে জলের ওপর হালকা জরির নকশার মতো লাগছে এখন দ্বীপটাকে।

শুশুকগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে নৌকোটার চারপাশে। দু’জনে বসে চুপচাপ সেই শব্দ শুনল খানিকক্ষণ। একটু পরে পিয়া শুনতে পেল খুব আস্তে আস্তে গুনগুন করছে ফকির। একটু হেসে ও বলল, “সিং। লাউডার। সিং।” আরও বার দুই বলার পর নিচু গলায় গাইতে শুরু করল ফকির। আগের দিন যে গানটা গাইছিল তার থেকে এ সুরটা একেবারে অন্যরকম–মাঝে মাঝে প্রাণোচ্ছল, কয়েকটা কলি আবার ধীর, শান্ত। পিয়ার মনে হল যেন নিজের মনের ভাবের ছায়া দেখতে পাচ্ছে ওই সুরে। ফকিরের গান আর তার ফাঁকে ফাঁকে ডলফিনদের শ্বাসের শব্দ শুনতে শুনতে কেমন একটা তৃপ্তিতে ভরে উঠল ওর মনটা। এই মায়াময় পরিবেশে নৌকোর ওপর একজন বিশ্বাসী মানুষের পাশে বসে ওই শুশুকদের চলাফেরার শান্ত শব্দ শোনা–এর চেয়ে সুখ আর কী আছে?

কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল ওরা দু’জন। পিয়ার মনে হল ফকির যদিও চেয়ে আছে সামনের তীরের দিকে, কিন্তু আসলে কিছুই দেখছে না ও। ঘুম এসে গেছে নাকি? যেমন অনেক সময় মানুষ আধো-ঘুমে থাকলেও দেখে মনে হয় জেগে আছে। নাকি নিজের ভাবনাতেই ডুবে আছে ও? হারিয়ে যাওয়া কোনও স্মৃতির ছেঁড়া সুতো জোড়া দেওয়ার চেষ্টা করছে মনে মনে?

কী দেখবে ফকির ফিরে তাকালে? একটা কুঁড়েঘরের ছবি মনে এল পিয়ার ক্যানিং-এর আশেপাশে যেরকম দেখেছে–মাটির দেওয়াল, খড়ের চাল, হেঁচা বাঁশের। দরজা। ফকিরের বাবাও হয়তো একজন জেলে পাকানো দড়ির মতো হাত পা, বহু বছরের রোদে জলে পোড়খাওয়া মুখ; ওর মা-র চেহারা শক্ত সমর্থ, কিন্তু ক্লান্তির ছাপ তাতে–দিনের পর দিন ঝুড়ি ঝুড়ি মাছ আর কঁকড়া বাজারে বয়ে নিয়ে যাওয়ার হাড়ভাঙা খাটুনি স্থায়ী ছাপ রেখে গেছে চেহারায়। ছোট্ট ফকিরের খেলার সাথীর কোনও অভাব নেই, চারদিকে একগাদা বাচ্চা-কাচ্চা দৌড়ে বেড়াচ্ছে। সংসারে স্বাচ্ছল্য নেই, কিন্তু পরিবারের মধ্যে উষ্ণতার কোনও অভাব নেই। এরকম পরিবারের কথা বাবার মুখে শুনেছে পিয়া: অভাব আর দারিদ্রই সেখানে একসাথে বেঁধে রাখে সকলকে।

বিয়ের আগে কি কখনও ওর বউয়ের মুখ দেখেছে ফকির? ওর নিজের বাবা মা-র কথা শুনেছে পিয়া, তারা নাকি বিয়ের আগে দেখেছিল পরস্পরকে, এমনকী কথাও বলেছিল। অন্য সব আত্মীয়স্বজনদের সামনে অবশ্য। কিন্তু ওরা তো শহরের লোক, মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত। ফকিরদের গ্রামে নিশ্চয়ই বিয়ের আগে বর-কনেকে ওরকম দেখা করতে দেয় না। হয়তো বিয়ের যজ্ঞের সময়ই প্রথম ওরা দেখেছে দুজন দুজনকে। হয়তো তার পরেও চোখ তুলে তাকায়নি ওর বউ, যতক্ষণ না রাতে ওদের কুঁড়ের মাটির দেয়াল দেওয়া ঘরে গিয়ে শুয়েছে পাশাপাশি। তখনই হয়তো প্রথম ভাল করে চেয়ে দেখেছে বরের দিকে, মনে মনে ধন্যবাদ দিয়েছে ভাগ্যকে, এরকম জোয়ান, টানা টানা চোখের সুন্দর বর জুটিয়ে দেওয়ার জন্য। হয়তো এরকম বরেরই স্বপ্ন দেখে এসেছে ও বরাবর, এর জন্যেই এতদিন প্রার্থনা করেছে ভগবানের কাছে।

উঠে পড়ল পিয়া, আবার গিয়ে শোবে। ডিঙির সামনের দিকে পেতে রাখা বিছানায় গিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে মনোযোগ দিল ডলফিনগুলোর দিকে। ভরা জোয়ার এসে গেছে, কিন্তু এখনও দহটা ছেড়ে যায়নি ওরা। তার মানে রাতে ওরা শিকারে বেরোয় না। কাল তা হলে ভাটা শেষ হলে দেখতে হবে তখন ওরা কী করে।

শুয়ে শুয়ে কল্পনা করতে লাগল পিয়া আধোঘুমে দহটার মধ্যে পাক খেয়ে যাচ্ছে ডলফিনগুলো, জলের মধ্যে ভেসে আসা প্রতিধ্বনি শুনছে কান পেতে, ছবি আঁকছে–ত্রিমাত্রিক সব ছবি, যার অর্থ একমাত্র ওরাই উদ্ধার করতে পারে। খুব ভাল লাগে পিয়ার ওদের জগৎটার কথা ভাবতে: যেখানে ‘দেখা’ আর ‘শোনা’য় কোনও ফারাক নেই, যেখানে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগই অস্তিত্ব রক্ষার একমাত্র উপায়।

সে তুলনায় নিজের জগতে—এখানে–কত লক্ষ যোজন দূরত্ব ওর আর ফকিরের মধ্যে। ওই জ্যোৎস্নার নদীর দিকে চেয়ে কী ভাবছে ফকির? জঙ্গলের কথা? কঁকড়ার কথা? কোনওদিনই জানতে পারবে না পিয়া। শুধু যে ভাষার ব্যবধানের জন্য তা নয়, জানতে পারবে না কারণ মানুষদের জগৎটাই এরকম। একমাত্র মানুষই পৃথিবীতে আসে অন্যের কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখার ক্ষমতা নিয়ে। ফকির আর ও, ওরা দু’জন দু’জনকে যতটা জানে, তাতে ওরা যদি দুটো গাছ কি পাথরও হত তফাত বিশেষ কিছু হত না। সেভাবে ভাবলে একদিক থেকে এটাই তো ভাল, এই কথা না বলতে পারাটা–অন্তত এটুকু তো বলা যাবে যে নিজেদের কাছে সৎ আছে ওরা। কারণ ডলফিনরা যেমন তাদের প্রতিধ্বনির আয়নাতেই পৃথিবীটাকে দেখে, তার সঙ্গে তুলনা করলে মানুষের ভাষা তো শুধু কিছু কৌশল, চোখের দিকে তাকিয়েই মনের কথা পড়ে নেওয়া সম্ভব–এই ভুল ধারণার বাহন মাত্র।

.

তীরে ভেড়া

অবশেষে কুমিরমারি। সেখানেই সেদিন মরিচঝাঁপির কথা প্রথম শুনলাম আমি। দুটো দ্বীপের দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়। যে স্কুলটায় গিয়েছিলাম সেখানকার মাস্টারমশাইদের মধ্যেও অনেকেই দেখেছেন যখন রিফিউজিরা আসে। হাজারে হাজারে লোক নাকি এসেছে–বড় নৌকোয়, ছোট নৌকোয়–যে যা পেয়েছে। তাতে করেই গিয়ে উঠেছে মরিচঝাঁপিতে। মাস্টারমশাইদের আত্মীয়স্বজনদের মধ্যেও নাকি কেউ কেউ ভিড়ে গেছে ওদের সঙ্গে, বিনে পয়সায় জমি পাওয়া যাবে সেই আশায়। সবাই আশ্চর্য হয়েছে উদ্বাস্তুদের বুকের পাটা দেখে। কেউ কেউ আবার বলেছে এই নিয়ে পরে গন্ডগোল বাঁধতে পারে। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের জায়গা, সরকার কি আর এমনি ছেড়ে দেবে? তাড়িয়ে ছাড়বে ওদের ওই দ্বীপ থেকে।

আমি আর এই নিয়ে মাথা ঘামাইনি তখন। আমার কী যায় আসে?

দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরে হরেন আর আমি ধীরে সুস্থে রওয়ানা হলাম লুসিবাড়ির উদ্দেশে। নৌকো করে যাচ্ছি বাড়ির পথে, এমন সময় হঠাৎ ঝড় উঠল। দেখতে না দেখতে তুমুল হাওয়ার তোড় হুড়মুড় করে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমাদের ওপর–অদ্ভুত রণমূর্তিতে ক্ষ্যাপা মোষের মত আক্রমণ করল আমাদের। এজন্যই এখানকার লোকে মনে করে যে অলৌকিক কিছু একটা আছে এই ঝড়গুলোর পেছনে। কয়েক মিনিট আগে পর্যন্ত যে নদী একেবারে শান্ত ছিল সেখানে এখন উথাল পাথাল ঢেউ, মোচার খোলার মতো নৌকোটাকে তুলে আছড়াচ্ছে। খানিক আগেও যে নৌকোকে নাড়াতে দম বেরিয়ে যাচ্ছিল হরেনের, সে এখন হু হু করে ছুটে চলেছে আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে।

“এবার কি তা হলে শেষ, হরেন?” জিজ্ঞেস করলাম আমি।

“না সার,” ও বলল, “এর থেকেও কত বড় ঝড় পার করে দিয়েছি–”

“কবে?”

“সত্তর সালে। আগুনমুখা ঝড়ে পড়েছিলাম। সে যদি আপনি দেখতেন তা হলে তো এটাকে কোনও ঝড়ই মনে হত না আপনার। কিন্তু সে অনেক লম্বা গল্প সার। এখন আগে কোনওরকমে পাড়ে নিয়ে গিয়ে তুলি নৌকোটাকে।” ডান হাত তুলে একটা দ্বীপের দিকে দেখাল হরেন।

“মরিচঝাঁপি, সার। ঝড় থামা পর্যন্ত ওখানেই গিয়ে অপেক্ষা করতে হবে আমাদের।”

আমি আর কী বলব? পেছন থেকে হাওয়ার চাপ থাকায় একটু পরেই গিয়ে পাড়ে ঠেকল নৌকো। সেটাকে ঠেলে ডাঙায় তুলতে হরেনের সঙ্গে হাত লাগালাম আমিও। তারপর ও বলল, “সার, কোথাও একটা গিয়ে উঠতে হবে আমাদের। কোনও চালা-টালার নীচে।”

“এখানে কোথায় গিয়ে উঠব হরেন?”

“ওইখানটায় সার। একটা ঘর দেখা যাচ্ছে।”

আর কথা না বাড়িয়ে ওর পেছন পেছন দৌড়োলাম। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়ছে, আমার চশমার কাঁচ বেয়ে ধারা নামছে জলের, কোনওরকমে শুধু হরেনের পিঠটার দিকে নজর রেখে দৌড়ে চলেছি সামনের দিকে।

একটা চালাঘরের সামনে গিয়ে পৌঁছলাম আমরা। দরমার বেড়া আর গোলপাতার ছাউনি দেওয়া ঘর। দরজার কাছে এসে হরেন একটা হাঁক ছাড়ল, “ঘরে কেউ আছ নাকি গো?

খুলে গেল দরজাটা। আমি গিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। চোখ পিটপিট করতে করতে চশমা খুলে কাঁচটা মুছছি, এমন সময় শুনতে পেলাম কে যেন বলছে, “সার? আপনি!”

নীচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম একজন অল্পবয়সি মহিলা হাঁটু গেড়ে বসে প্রণাম করছে আমাকে। আমি চিনি না ওকে, কিন্তু ও আমাকে চেনে। তাতে অবশ্য আমি বিশেষ আশ্চর্য হইনি। বহু বছর এক জায়গায় শিক্ষকতা করলে পথেঘাটে যার সঙ্গেই দেখা হয় এই একই ব্যাপার ঘটে। ছাত্রছাত্রীরা বড় হয়ে যায়, স্মৃতিশক্তি তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে পারে না। নতুন নতুন মুখগুলিকে তাদের পুরনো চেহারার সঙ্গে মেলাতে পারি না।

“সার, আমি কুসুম,” মেয়েটি বলল।

এত দূরে এই মরিচঝাঁপিতে ঝড় বাদলের মধ্যে আশ্রয় খুঁজতে এসে শেষে কুসুমের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে এ আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। “অসম্ভব!”

চশমাটা শুকিয়ে গেছে ততক্ষণে। নজর করে দেখলাম একটা বাচ্চা ছেলে উঁকি মারছে মেয়েটির পেছন থেকে। “ওটা আবার কে?” জিজ্ঞেস করলাম আমি।

“ও আমার ছেলে, ফকির।”

একটু ঝুঁকে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে গেলাম, কিন্তু ছুট্টে পালাল ছেলেটা। মায়ের আঁচলের তলা থেকে উঁকি দিয়ে দেখতে লাগল।

“খুব লাজুক, সার,” হেসে বলল কুসুম।

হঠাৎ আমার খেয়াল হল হরেন তখনও বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। বুঝলাম আমাকে সম্মান দেখানোর জন্য ভেতরে ঢোকেনি ও। মনে মনে একটু খুশিও হলাম, আবার বিরক্তিও লাগল। খুশি হলাম, কারণ মানুষের শ্রদ্ধার মূল্য বুঝবে না দুনিয়ায় এরকম সাম্যবাদী কেউ কি আছে? কিন্তু রাগ হল এই কথা ভেবে যে, ও কি জানে না এইরকম হাত-জোড় করা ভাব আমি পছন্দ করি না?

দরজা দিয়ে মাথা বের করে দেখলাম ওই অঝোর বৃষ্টির মধ্যে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে ও। “কী ব্যাপার কী হরেন?” আমি বললাম। “ভেতরে এসো, ভেতরে এসো। এখন কি এইসব আদিখ্যেতার সময় নাকি?”

ভেতরে এল হরেন। খানিকক্ষণ কারও মুখে কোনও কথা নেই–বহুদিন পর চেনা মানুষদের সঙ্গে দেখা হলে অনেক সময় যেমন হয়। কুসুমই মুখ খুলল প্রথম, “তুমি?” হরেন তার স্বভাবসিদ্ধ ঢঙে বিড়বিড় করে কী যে জবাব দিল কিছুই বোঝা গেল না। তারপর বাচ্চাটাকে ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে কুসুম বলল, “এই যে ফকির, আমার ছেলে।” ছেলেটার চুলে হাত বুলিয়ে হরেন বলল, “বেশ বেশ!”

“আর তোমার বাড়ির কী খবর?” জিজ্ঞেস করল কুসুম। “ছেলেপুলেরা নিশ্চয়ই সব বড় বড় হয়ে গেছে?”

“ছোটটার পাঁচ বছর হল, “হরেন বলল। “আর বড়টার এই চোদ্দো চলছে।” হাসল কুসুম। তারপর ঠাট্টার সুরে বলল: “বল কী গো? তা হলে তো প্রায় বিয়ের বয়স হয়ে গেল বলতে গেলে।”

“না,” হঠাৎ একটু জোরেই বলে উঠল হরেন। “যে ক্ষতি আমার হয়েছিল ওর বেলায় সেটা হতে দেব না আমি।”

কথাটা লিখলাম একটা উদাহরণ হিসেবে, অনেক অস্বাভাবিক সময়েও মানুষ কেমন তুচ্ছ সব বিষয়ে কথা বলে সেটা বোঝানোর জন্য।

“কাণ্ডটা দেখো একবার,” আমি বললাম। “এতদিন পরে খোঁজ পাওয়া গেল কুসুমের, আর আমরা কিনা হরেন আর তার ছেলেমেয়েদের নিয়েই কথা বলে যাচ্ছি তখন থেকে।”

একটা মাদুর পাতা ছিল মাটিতে, তার ওপরে বসে পড়লাম আমি। কুসুমকে জিজ্ঞেস করলাম কোথায় ছিল ও এতদিন, আর কী করেই বা এই মরিচঝাঁপিতে এসে পৌঁছল।

“কী বলব সার,” বলল কুসুম। “সে অনেক বৃত্তান্ত।”

বাইরে থেকে বাতাসের গর্জন কানে আসছে, বৃষ্টিরও থামার কোনও লক্ষণ নেই। “এমনিতেও তো কিছুই করার নেই এখন,” আমি বললাম। “তার থেকে তোর গল্পটাই বল, শুনি।”

হাসল কুসুম। “ঠিক আছে সার। আপনাকে আর না বলি কী করে? যা যা ঘটেছিল সবই বলছি।”

মনে আছে, সে কাহিনি বলতে গিয়ে গলার স্বর বদলে গেল কুসুমের, কথা বলার ঢঙে ছন্দ যোগ হল–স্পষ্ট তার লয় আর মাত্রা। নাকি সে আমারই স্মৃতির ছলনা? কে জানে। সে যাই হোক, ওর সেই কথাগুলি এখন বন্যার স্রোতের মতো নেমে আসছে আমার মনে। তার সঙ্গে তাল রেখে পক্ষীরাজের মতো উড়িয়ে নিয়ে যেতে হবে আমার কলমকে। মূর্তিমতী বাগদেবী সেদিনের সেই কুসুম; আমি তার লিপিকর মাত্র।

“মা কোথায়, খোঁজ কেউ পারে কি বলতে? আঁধারে হাতড়ে মরি, পথ জেনে নিতে অনেককে শুধোলাম। কেউ বলে শুনি, ধানবাদ নামে কোনও শহরেতে কোথা মাকে ওরা নিয়ে গেছে। সেখানে কী করে যেতে হবে জানি না তো। জিজ্ঞাসা করি, অচেনা বা চেনা লোক যাকে পাই পথে। এই গাড়ি সেই গাড়ি রেলগাড়ি ধরে, অবশেষে পৌঁছই ধানবাদে গিয়ে।

“স্টেশনে নামার পর অন্ধকার দেখি, কী করে এখানে আমি খুঁজে পাব মাকে? খনির শহরে সেই সেখানে বাতাসে ধোঁয়া ধুলো লোহাগন্ধ চারিদিকে ভাসে। লোকজন পথেঘাটে আদতে আলাদা, তেমন মানুষ আগে দেখিনি কখনও। লোহা দিয়ে গড়া যেন মুখের জবান। কথা বলে, শব্দ যেন বেজে বেজে ওঠে। চোখের চাহনি যেন জ্বলন্ত কয়লা, তাকালেই মনে হয় হ্যাঁকা লাগে গায়ে। একে সেখানে আমি ছেঁড়া ফ্রক পরা, ছোট মেয়ে, ভয়ে বুক দুরু দুরু করে।

“অদৃষ্ট কিন্তু ছিল সহায় আমার। অজানিতে ভগবান বাতলে দিল পথ। ঘুগনির ফেরিওয়ালা স্টেশনে সেখানে সওদা সাজিয়ে বসে খদ্দেরের আশে। কাছে গিয়ে তার সাথে কথা বলে আমি দেখি যে ভাটির দেশ তারও জন্মভূমি! নাম তার রাজেন, ছিল বাসন্তীতে বাড়ি। গরিব ঘরের ছেলে, খুবই ছেলেবেলা দেশ ছেড়ে চলে আসে পেটের ধান্দায়। একদিন কলকাতা শহরে হঠাৎই চলন্ত বাসের নীচে চাপা পড়ে সে যে এক পা খোয়াল তার। তারপর থেকে এটা ওটা ফেরি করে ট্রেনে ও স্টেশনে। ভাগ্যচক্র অবশেষে নিয়ে এল তাকে, ধানবাদ শহরে এই। এখানে কপালে জুটে গেল ঝুপড়ি এক, সেখানেই থাকে। রেললাইনের পাশে, বেশি দূরে নয়। যখন শুনল রাজেন বৃত্তান্ত আমার, বলল সাহায্য নিশ্চয় করবে আমাকে। কিন্তু ততদিন আমি থাকব কোনখানে? চলে এসো ঝুপড়িতে আমার সঙ্গেই থেকে যাবে, অসুবিধা কিছুই হবে না। তুমি তো একাই, আমি একলাই থাকি। দু’জনের জন্যে ঘরে যথেষ্ট জায়গা,বলল রাজেন। আমি ধীর পায়ে পায়ে ওর পিছু পিছু যাই রেললাইন ধরে। সেখানে গিয়ে তো ডরে বুক কেঁপে ওঠে। কে জানে কেমন ঠাঁই, নিরাপদ কিনা। সারারাত জেগে থাকি। ঝম ঝম করে ট্রেন যায়, সেই শব্দ শুনি শুয়ে শুয়ে।

“বহুদিন কেটে গেল রাজেনের ঘরে। লজ্জায় পড়িনি এক মুহূর্ত কখনও। মানুষ সে ভাল ছিল, দয়ার হৃদয়। এরকম কটা লোক খুঁজে পাওয়া যায়? ঠিক বটে, সেখানেও কানাঘুষো ছিল–”দেখ রে, ল্যাংড়া রাজু কাকে নিয়ে থাকে। সেসব কখনও আমি গায়েতে মাখিনি। বলুক যা মন চায়। কী বা যায় আসে?

“অবশেষে একদিন রাজেনই মায়ের খোঁজ নিয়ে এল। নাকি এক জায়গায় ট্রাক-ড্রাইভাররা সব আসে প্রতিদিন, খাঁটিয়ায় বিশ্রাম করে সেথা, আর ভাড়া করে মেয়েদের। সেখানেই নাকি মা আমার কাজ করে। রাজেনের সাথে একদিন গোপনেতে গিয়ে দেখা করি। মাকে তো দেখেই বুকে ঝাপাই তখনি। কিন্তু মুখে কথা নেই–বাক্যহারা আমি; এ কী দেখি, মা তো নয়, মায়ের কঙ্কাল: কুঁকড়ে গেছে শুকনো মুখ, রোগা জীর্ণ দেহ। সে চেহারা দেখে কষ্টে ভেঙে গেল বুক। ফিসফিসে গলা মার, অস্ফুটে বলল, “দেখিস না, কুসুম, চোখ বন্ধ করে ফেল। এ চেহারা মুছে ফেল মন থেকে তোর। আগেকার আমাকেই মনে রেখে দিস, সেই যবে তোর বাবা বেঁচে ছিল আর, কষ্ট ছিল, তবু ছিল ভরা সংসার। সবই সেই দিলীপের দোষ। সে রাক্ষস, মিথ্যেবাদী, বলেছিল খুঁজে দেবে কাজ ভাল কোনও জায়গায়। শেষে এইখানে নিয়ে এসে ঠেকিয়েছে। এর চেয়ে ভাল ছিল দেশে পড়ে থেকে শাকপাতা খেয়ে কোনও মতে বেঁচে থাকা, সে তবু মানের। দিলীপ দানব সেই আনল আমাকে, বেচে দিল অন্য সব পশুদের কাছে। তুই হেথা থাকিস না, ফিরে যা, ফিরে যা। কিন্তু মন তবু চায় একবার আরও দেখে নিই তোর মুখ জনমের মতো। যাওয়ার আগেতে শুধু আর একটি বার দেখা করে যাস এই অভাগীর সাথে।

“সে রাতের মতো আমি ফিরি ঝুপড়িতে। হপ্তা এক-দেড় পরে রাজেন আবার নিয়ে গেল আমাকে সে মায়ের ডেরায়। তখনই রাজেন দিল বিয়ের প্রস্তাব। বলে মাকে, অনুমতি দাও যদি তুমি, কুসুমকে বউ করে রেখে দিই কাছে। নতুন জীবন হবে ওর, আর আমি দুঃখ সুখ ভাগ করে নেব ওর সাথে।অবশেষে দেখি মা-র মুখে হাসি ফোটে: এর চেয়ে সুসংবাদ কী বা হতে পারে? কী ভাগ্য কুসুম! বনবিবির দয়ায় বর পাবি, ঘর পাবি এর চেয়ে সুখ কিছু যে কপালে আছে ভাবিনি কখনও।রাজেন বলল, ‘মা গো, তোমাকেও সাথে নিয়ে যাব চুরি করে। এখানে কিছুতে আমরা তোমাকে আর দেব না থাকিতে। এ তোমার জায়গা নয়। কিছুদিন আরও থাক যদি প্রাণে তুমি বাঁচবে না আর। মা-কে সাথে করে নিয়ে ফিরি সেইদিনই রাজেনের ঝুপড়িতে। সে যে কত সুখ! তার পর বিয়ে হল রাজেন ও আমার। মা দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিল আমাদের। তখন কি জানতাম এ মা-র মুকতি? তিন মাসও তারপর কাটল না আর: আমাদের সুখী দেখে মা নিল বিদায়। সে মা-র নিয়তি ছিল–কী বা করা যাবে? আরও দু’বছর যদি বাঁচত পরাণে, দেখে যেত ফকিরকে ছেলেকে আমার।

“কত মাস কেটে গেল সেই ধানবাদে। মাঝে মাঝে দু’জনেই ভাবি ফিরে যাই, এ খনির দেশ ছেড়ে। এ তো নয় ঘর। এখানের সব কিছু বড় ভিনদেশি। লোহার ওপরে হুঁটি, মনে পড়ে খালি, ভাটির দেশের কাদা জন্ম থেকে জানা। এখানে রেলের লাইন চারিদিক বেড়ে, দেখি আর ভাবি সেই রায়মঙ্গল, কতদূরে চেনা সেই বানভাসা নদী। স্বপ্নে দেখি ঝড় আসে উথাল পাথাল, বাদাবন থরথর হাওয়ার বেগেতে। ছোট ছোট দ্বীপ কত নদী দিয়ে ঘেরা, সোনালি শেকলে যেন বাঁধা পড়ে থাকে। জোয়ারের কথা ভেবে দু’চোখে জোয়ার, মনে পড়ে মোহনার থইথই জলে ভেসে যায় নিচু দ্বীপ, মনে হয় যেন জলের নীচেতে কত মেঘ জমে আছে। রাত্রে দেশের কথা মনে করি আর গল্প করি, স্বপ্ন দেখি। সকালে আবার ফিরে আসি ফের সেই লোহা কয়লার জগতে। মনের দুখ মনে রাখি চেপে।

“এভাবেই চলে গেল চারটি বছর। তারপর সে জীবনও শেষ হয়ে গেল: চলতে শুরু করল ট্রেন, রাজেন তখনও পায়নি পয়সা তার যাত্রীদের থেকে। ইঞ্জিনের তেজ বাড়ে, রাজেনও দৌড়ায়। হঠাৎ মোচড় লাগে খোঁড়া পায়ে তার, হোঁচটে ছিটকে পড়ে চাকার নীচেতে। কী আর বলার আছে? সময়ের আগে চলে গেল। কখনও তো

ভাবিইনি আমি এভাবে হঠাৎ করে ছেড়ে চলে যাবে। সান্ত্বনা, ফকির আছে দান রাজেনের। তাকে বুকে নিয়ে ফের ভাবি চলে যাব চেনা দেশে, চেনা ঘরে ফিরব আবার। কিন্তু ভয় লাগে প্রাণে, বাচ্চা কোলে নিয়ে কার কাছে হাত পেতে দাঁড়াব সেখানে? যদি কিছু নাই জোটে কী করে সংসার চালাব? আবার যদি দিলীপের পায়ে গিয়ে পড়তে হয় তা’লে কী হবে আমার?

“মনে হয় বনবিবি দেখেছিল সবই, নিজের আসন থেকে। কারণ একদিন হঠাৎ খবর পাই বিরাট মিছিল যাবে এ শহর দিয়ে, পুবদেশ পানে। পরদিনই এল তারা, মানুষের ঢল নেমে এল ধানবাদে। রেললাইন ধরে দেখি ক্লান্ত মুখ সব ধুলোয় ধূসর পা টেনে টেনে চলে। কাঁধে ছানাপোনা, বোঁচকা কুঁচকি যত, সারা সংসার টেনে নিয়ে হেঁটে চলে ভূতের মতন। কোথায় চলল এরা? কোথা থেকে আসে? সবাই অচেনা মুখ, এ শহরে আগে এদের কাউকে আমি দেখিনি কখনও। দাঁড়িয়ে দেখছি আমি সেই জনস্রোত, হঠাৎ পড়ল চোখে বয়স্কা মহিলা আমার মায়ের মতো–পা হড়কিয়ে পড়ে। তাকে নিয়ে আসি। ওদের দলের আরও কেউ কেউ আসে মহিলার সাথে। জল আর খাবার দিই, দেখি কী ভীষণ ক্লান্ত সব। বিশ্রামের খুবই দরকার। রহো, ব্যয়ঠো, বলি আমি হিন্দি ভাষায়, বিশ্রাম নিতে বলি ওদের সেখানে। জবাব আসে বাংলায়, আমি তো অবাক। চেনা শব্দ, চেনা ভাষা–কানে মধু ঢালে। কে তোমরা? কোথা থেকে আসছ এভাবে? কোথায়ই বা যেতে চাও? শুধোলাম আমি। “তুমি আমাদের বোন। বলি শোনো তবে, দীর্ঘ কাহিনি সেই,’ বলে শুরু করে।

“আমরা বাংলারই লোক, খুলনা জেলার। ভাটি দেশে ঘর ছিল, জঙ্গলের কাছে। সে ঘর জ্বালিয়ে দিল যুদ্ধের সময়। আমরা পালিয়ে আসি, বর্ডার পেরিয়ে। এদেশে ঢুকতেই পাকড়াও করল পুলিশ, বাস ভরে নিয়ে গেল উদ্বাস্তু শিবিরে। সে এক অচেনা ঠাই, এরকম আগে জীবনে দেখিনি। বড় ভয়ংকর লাগে। ধূ ধূ করে মাঠ; মাটি টকটকে লাল, রক্তে ধোয়া যেন। যারা সে দেশের লোক তাদের কাছেতে সেই একই লাল মাটি সোনার সমান, তারা তাই ভালবাসে। যেভাবে আমরা ভালবাসি কাদামাটি, বাদাবন, নোনা জল–ঠিক সেরকমই। কিন্তু আমাদের সেথা বসে না তো মন। চেষ্টা প্রাণপণ করি, তবু কীরকম মাথার ভেতরে সেই নদী ডাক দেয়, জোয়ারের টান লাগে শিরায় শিরায়। আমাদেরই বাপ কাকা বহুদিন আগে হ্যামিলটনের ডাকে সাড়া দিয়েছিল, নদীর টানের সাথে কী লড়াই লড়ে বাদাবন সাফ করে গড়েছিল গ্রাম। একই ভাবে এখনও তো গড়ে নিতে পারি নতুন বসতি আরও, ভাবি মনে মনে। ভাটির দেশেতে আরও কত খালি দ্বীপ এখনও তো পড়ে আছে–মানুষ থাকে না। আমাদেরই এক দল গিয়ে দেখে এল বড় খালি চর এক, মরিচঝাঁপিতে। তারপর বহু মাস প্রস্তুতি নিতে চলে গেল। অবশেষে বেচেবুচে সব রওয়ানা হলাম। কিন্তু সাথে সাথে দেখি, পেয়াদা পুলিশ সব লেগেছে পেছনে। ট্রেনে থিকথিক করে পুলিশের লোক, রাস্তা বন্ধ করে রাখে, আটকে দেবে বলে। তবু পিছু হটব না কিছুতে আমরা–হাঁটতে শুরু করে দিই রেললাইন ধরে।

“শুনি বসে বসে আর বুকে আশা জমে; এরা তো নিজেরই লোক, আত্মীয় আমার–একই ভাষা, রক্তে একই জোয়ারের টান, একই স্বপ্ন দেখি, মনে একই সুর বাজে। এরাও মাখতে চায় সেই কাদামাটি হাতে-পায়ে, দেখতে চায় জোয়ারের নদী। আমি কেন তবে আর দূরে সরে থাকি? কী লাভ এখানে থেকে, এই ধানবাদে? জং-ধরা শহরে এই মুখে রক্ত তুলে পরিশ্রম করে যাব আমরণ কাল? পুঁটুলি গুছিয়ে নিই, কাপড় কখানা গাঁঠরি বেঁধে তুলে দিই ফকিরের কাঁধে। রাজেনের স্মৃতি বুকে নেমে আসি পথে। অনেক দূরের পাড়ি সে মরিচঝাঁপি।

“এই হল কাহিনি, সার। এই আমার কথা। এভাবেই পৌঁছলাম এইখানে এসে।”

খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম আমরা, যে যার নিজের ভাবনা নিয়ে কুসুম আর ফকির, হরেন আর আমি। মনে মনে যেন দেখতে পাচ্ছিলাম ওরা হেঁটে আসছে, ওই হাজার হাজার মানুষ, শুধু ভাটির দেশের কাদায় আরেকবার পা রাখার জন্য। দেখতে পাচ্ছিলাম ওরা আসছে, দলে দলে ছেলেমেয়ে বাচ্চা বুড়ো সারাজীবনের সমস্ত সঞ্চয় পুঁটুলিতে করে মাথায় নিয়ে হেঁটে আসছে এই মরিচঝাঁপির দিকে। মনে হল এদের কথাই তো কবি বলতে চেয়েছিলেন, যখন লিখেছিলেন:

“পৃথিবীর প্রতিটি ধীর মন্থর ঘূর্ণন এখন কিছু উত্তরাধিকারহীন সন্তানের জনক,
যার কাছে ভূত কিছুর অর্থ নেই, আসন্নেরও মান নেই কোনও।”

.

ধাওয়া

সকালেও দেখা গেল বাড়ি যাওয়ার কোনও উদ্যোগ করছে না ফকির। পিয়াও তাড়া দেওয়ার প্রয়োজন মনে করল নাঃ যতক্ষণ এই ডলফিনগুলোর সঙ্গে কাটাতে পারে ততই ওর ভাল।

খানিকটা বেলায় জল ফের বাড়তে শুরু করা পর্যন্ত দহটার মধ্যেই রয়ে গেল প্রাণীগুলো। তারপর আবার আধঘণ্টা যেতে না যেতেই উধাও হয়ে গেল–ঠিক আগের দিনের মতো। তফাত শুধু জোয়ার আসার সময়ের।

তা হলে, এখন যেটা জানা বাকি রয়ে গেল তা হল এখান থেকে বেরিয়ে এরা যায় কোথায়। ফকির হয়তো জানলেও জানতে পারে। নানারকম ইশারা আর অঙ্গভঙ্গি করে অবশেষে ফকিরকে ওর প্রশ্নটা বোঝাতে পারল পিয়া: এই নৌকো করে কি ডলফিনগুলোর পেছন পেছন যাওয়া যাবে? সাগ্রহে মাথা নাড়ল ফকির, সঙ্গে সঙ্গে নোঙর তুলে ফেলল।

দহটা ছেড়ে যখন বেরোল ওরা, তখনও জোয়ারের জল ঢুকছে। ফলে স্রোতের টানে নৌকোর গতিও বাড়ল খানিকটা। গর্জনতলা পেছনে ফেলে একটা মোহনায় এসে পৌঁছল ওরা। নৌকোর গলুইয়ে দাঁড়িয়ে পিয়া লক্ষ করল থইথই জোয়ারে ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছে চারপাশের দ্বীপগুলো।

দূরবিনে চোখ রেখে সামনে অনেকটা দূরে একবার জলের ওপর এক জোড়া পাখনা দেখতে পেল পিয়া। কিন্তু মোহনা পেরিয়ে যেতে যেতেই সেগুলির আর কোনও চিহ্ন দেখা গেল না। তবে ফকিরকে দেখে মনে হল ও ঠিক জানে কোথায় যেতে হবে। নির্দ্বিধায় ডিঙির মুখ ঘুরিয়ে প্রথমে একটা বড় খাঁড়িতে পড়ল, সেখান থেকে আবার ঢুকল সরু একটা খালে। খানিক যাওয়ার পর হঠাৎ দাঁড় নামিয়ে ইশারা করল পাড়ের দিকে। দূরবিন সমেত মুখ ফিরিয়ে পিয়া দেখল তিনটে কুমির শুয়ে আছে কাদার ওপর। আগে চোখে পড়েনি কারণ এতক্ষণ ও শুধু জলের দিকেই মনোযোগ দিয়েছিল। ও আন্দাজ করল এদেরও হয়তো ফকির আগে এই জায়গায় দেখেছে। চোখের সামনেই শুয়ে ছিল তিনটে কুমির, কিন্তু কাদামাখা শরীরগুলো এমনভাবে চারপাশের সঙ্গে মিশেছিল যে প্রাণীগুলো কত বড় সেটাও ঠিক ভাল করে বোঝা যাচ্ছিল না। একটা কুমির আবার হাঁ করে ছিল। এত বড় রাক্ষুসে হাঁ, যে পিয়ার মনে হল দাঁড়ানো অবস্থায় গোটা একটা মানুষ তার মধ্যে ঢুকে যাবে–অন্তত ওর নিজের মাপের একটা লোক তো বটেই।

এই খালটা তুলনায় একটু সরু, ফলে এখন যদি ভাটার সময় হত, ওই কুমিরগুলোর খুব কাছ দিয়ে যেতে হত ওদের। কিন্তু জোয়ার থাকার ফলে অনেকটা দূরে আছে এখন প্রাণীগুলো পাড়ের বেশ খানিকটা ওপরের দিকে। নৌকোটা ওদের নজরে পড়েছে বলে মনে হল না, কিন্তু খানিক পরে দূরবিন ঘুরিয়ে দেখতে গিয়ে পিয়া লক্ষ করল মাত্র দুটো কুমির শুয়ে আছে এখন সেখানে। তিন নম্বরটা কখন পিছলে নেমে গেছে জলে। কাদার ওপর দিয়ে তার হেঁচড়ে নামার ফলে যে লম্বাটে গর্তটা তৈরি হয়েছে সেটা এর মধ্যেই ভরাট হয়ে যেতেও শুরু করেছে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আর কোনও চিহ্ন রইল না দাগটার; পাড়ের পলি ফের যেমন কে তেমন–আগের মতোই মসৃণ, চকচকে।

হঠাৎ টুটুল একটা চিৎকার করে হাত তুলে কী একটা দেখাল সামনের দিকে। চট করে দূরবিন ঘুরিয়ে পিয়া একটা ডলফিনের লেজ এক ঝলক দেখতে পেল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মিলিয়ে গেল সেটা জলের তলায়। কুমির দেখতে গিয়ে খামখা সময় নষ্ট করেছে বলে পিয়ার একটু রাগ হল নিজের ওপর। কিন্তু মিনিট খানেক পরেই আবার দেখা গেল একটা লেজ–জলের ওপরে একেবারে খাড়া যেন মাথার ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ডলফিনটা। তার পরেই আরও এক জোড়া লেজ দেখা গেল সেটার পাশে, একইরকম খাড়া হয়ে আছে জলের ওপরে। পিয়া চিনতে পারল, সেই মা আর ছানা ডলফিনটা–ওই দহের মধ্যে যাদের দেখেছিল। জল বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাজারো ছোট ছোট খাঁড়ির সৃষ্টি হয়েছে। চারপাশে, আশেপাশের দ্বীপগুলোতে ডাঙার মধ্যে বেশ খানিকটা করে ঢুকে গেছে সেগুলো। সেরকমই একটা খাঁড়িতে ঢুকে খাবার খুঁজছে ডলফিনগুলো। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে খুবই কম গভীরতা খাড়িটার, এমনকী ফকিরের নৌকোও ঢুকবে না সেখানে।

তবে ডলফিনগুলো ওখানে কী করছে চোখ বুজে সেটা বলে দিতে পারে পিয়া: এক দল মাছকে তাড়া করে নিয়ে ঢুকেছে ওরা ওই অগভীর জলে, আর মাছগুলো ওদের হাত থেকে পালাবার ব্যর্থ চেষ্টায় গিয়ে লুকিয়েছে কাদার মধ্যে। তারপর খরগোশ যেমন করে ক্ষেতের থেকে গাজর তুলে খায়, অনেকটা সেই ভাবে জলের নীচে কাদা থেকে মাছ তুলে তুলে খাচ্ছে ডলফিনগুলো।

ওর এত দিনের অভিজ্ঞতায় একবারই মাত্র এই দৃশ্যের ব্যতিক্রম দেখেছে পিয়া। ইরাবডিড নদীতে। সেখানে তখন একটা সার্ভের কাজ চলছিল। তারই মধ্যে খানিকটা সময় বের করে নিয়ে মান্দালয়ের উত্তরের এক গ্রামে দুই জেলের কাছে গিয়েছিল ওরা। ওরই চেনা আরেকজন সিটোলজিস্ট বলে দিয়েছিল এই জেলেদের কথা। বলেছিল, ওদের সঙ্গে গেলে এমন এক অভিজ্ঞতা হবে পিয়ার, নিজের চোখে দেখেও যা বিশ্বাস করা কঠিন।

সেই দুই জেলের সঙ্গে আলাপ করে দেখা গেল তারা আসলে বাবা আর ছেলে। বাবা মাঝবয়সি, আর ছেলের বয়স বড়জোর চোদ্দো কি পনেরো। দুপুর এগারোটা নাগাদ তাদের মাছধরা ডিঙিতে চড়ে বসল পিয়া আর ওর দোভাষী। মাপে সে ডিঙিটা মোটামুটি এই ফকিরের নৌকোরই সমান, কিন্তু কোনও ছই ছিল না সেটাতে। সেই এগারোটার সময়ই এত গরম সেখানে যে নদীর জল পর্যন্ত মনে হচ্ছিল ঝিম ধরে আছে, বিশেষ কোনও নড়াচড়া নজরে আসছে না। পিয়া আশ্বস্ত হল দেখে যে খুব একটা দুরে ওদের যেতে হবে না। পাড় থেকে নদীর ভেতরে মিটার বিশেক যাওয়ার পরেই বয়স্ক লোকটি একটা লাঠি বের করে সেটা দিয়ে নৌকোর গায়ে বাড়ি মারতে লাগল। মিনিট কয়েকের মধ্যে একটা মসৃণ চকচকে পাখনা দেখা গেল জলের ওপরে। একটু পরে আরও কয়েকটা পাখনা ভেসে উঠল আশেপাশে। কমবয়সি জেলেটি তখন মাছ ধরার জালটা নিয়ে সেটার ধারে ধারে বাঁধা ধাতুর টুকরোগুলোতে ঝম ঝম করে আওয়াজ করতে শুরু করল। সেই শব্দ শুনে দল ছেড়ে বেরিয়ে এল দুটো ডলফিন। বাকিরা যে জায়গায় ছিল সেখানেই রয়ে গেল, আর এই জোড়াটা এগিয়ে এল নৌকোর খুব কাছে। ডিঙির মুখের কয়েক মিটার দূরে এসে হঠাৎ গোল হয়ে ঘুরতে শুরু করল ডলফিন দুটো, যেন একটা আরেকটার লেজ ধরার চেষ্টা করছে। দোভাষীর মাধ্যমে জেলেরা বোঝাল যে এক দল মাছকে ঘিরে ধরে নৌকোর দিকে নিয়ে আসছে ডলফিন দুটো।

বেশ খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে দেখতে লাগল জেলে দু’জন। একটু পরে কমবয়সি জেলেটি উঠে দাঁড়াল। মুখ দিয়ে গুবগুব একটা আওয়াজ করে মাথার ওপর দু’-এক পাক ঘুরিয়ে নিয়ে জালটা ছুঁড়ে দিল জলে। ডলফিন দুটো যেখানে বৃত্তাকারে পাক খাচ্ছিল, ঠিক তার কেন্দ্রে গিয়ে পড়ল জালটা। জাল ডুবতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে বুজকুড়ি উঠতে লাগল জলে। দু-একটা ছোট ছোট রুপোলি মাছ লাফিয়ে উঠল, আর ডলফিনগুলো আরও দ্রুত সাঁতরাতে লাগল, ক্রমশ ছোট করে আনতে লাগল পাক খাওয়ার বৃত্তটা। দলের বাকি ডলফিনগুলোও এবার যোগ দিল ওই দুটোর সঙ্গে, তিরবেগে ঘুরতে থাকল জালের চারদিকে, লেজের বাড়ি মারতে লাগল জলে ছড়িয়ে পড়া মাছগুলোকে জালের কাছাকাছি তাড়িয়ে আনার জন্য।

দুই জেলে এবার টেনে তুলল জালটা, সঙ্গে সঙ্গে খাবি খাওয়া কিলবিলে একটা রুপোলি পিণ্ড যেন ভেঙে ছড়িয়ে পড়ল নৌকোর ওপর। মনে হচ্ছিল যেন একটা পিনাটা ফাটানো হয়েছে, আর প্রচুর ঝিলমিলে কাগজ ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। ডলফিনগুলোও এর মধ্যে তাদের ভোজ শুরু করে দিয়েছে। জালটা যখন জলে ডুবছিল তার চাপে বহু মাছ গিয়ে গেঁথে গিয়েছিল নদীর নীচের নরম মাটিতে। সেই জলের তলার ফসল তুলে এখন খাচ্ছে ওরা। মহা উৎসাহে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সেই মাছগুলির ওপর, মাথা নিচু করে লেজ শূন্যে তুলে শিকার ধরছে; আর জলের ওপরে মনে হচ্ছে তাদের কিলবিলে লেজের একটা ছোট জঙ্গল তৈরি হয়েছে।

একেবারে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল পিয়া এই দৃশ্য দেখে। মানুষ এবং বন্যপ্রাণীদের পরস্পরনির্ভরশীলতার এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর কিছু আছে? ভেবে পেল না ও। কত যে বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে এই জলজীবনে তার কোনও সীমা পরিসীমা নেই।

.

স্বপ্ন

বাইরে ঝড়ের গর্জন থামার কোনও লক্ষণ নেই। বোঝা গেল সে রাতে আর লুসিবাড়ি ফেরা সম্ভব নয়।

“সার,” একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অবশেষে বলল হরেন, “মনে হচ্ছে কুসুমের ঘরের মেঝেতেই আজকের রাতটা কাটাতে হবে আমাদের।”

“যা ভাল বোঝ,” বললাম আমি। “তুমি যা ঠিক করবে তাই হবে।”

খানিক পরে ভাত চাপাল কুসুম। ফকির ক’টা ট্যাংরা মাছ ধরে এনেছিল, তাই দিয়ে ঝোল রাঁধল। খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেলে ঘরের একপাশে হরেন আর আমার জন্য মাদুর পেতে দিল, আর নিজে ফকিরকে নিয়ে শুল আরেক কোনায়। অনেক রাতে, ঝড় তখন থেমে গেছে, একবার দরজা খোলার আওয়াজ কানে এল। বুঝলাম হরেন বেরোল, নৌকোটা ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে আসতে। তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়লাম, বিকারগ্রস্ত জ্বরো রোগীর মতো সে ঘুম, একটা ঘোরের মধ্যে যেন ছটফট করতে লাগলাম।

“সার”–কুসুমের গলা শুনতে পেলাম। অন্ধকারে মুখ দেখা যাচ্ছে না। “শরীর খারাপ লাগছে?”

“না তো। কিছু তো হয়নি। কেন রে?”

“না, আপনি ঘুমের মধ্যে চেঁচিয়ে উঠলেন একবার, তাই ভাবলাম।”

কুসুম আস্তে আস্তে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে টের পেলাম। চোখে জল এল আমার। “ওসব বুড়ো মানুষের রাতের বেলার ভয়,” অবশেষে বললাম আমি। “এখন ঠিক আছি রে। যা, ছেলের কাছে যা। ঘুমো গিয়ে।”

সকালবেলা উঠে দেখি আকাশে এক ছিটে মেঘ নেই কোথাও। এরকম একটা ঝড়ের পরে তাই হয় সাধারণত। ঝকঝকে রোদে ধুয়ে যাচ্ছে গোটা দ্বীপ আর নদী। কুসুমের ঘর থেকে বেরিয়ে দেখি কাছাকাছি আরও কয়েকটা এরকম কুঁড়ে রয়েছে। হেঁটে হেঁটে খানিকটা দূর পর্যন্ত গেলাম, দেখলাম বনবাদাড় সাফ করা মাঠের ওপর আরও অনেক ঘর কয়েকটা কুঁড়ে, কিছু গুমটি, বস্তি মতো কয়েকটা। যেরকম হয় এ ধরনের ঘর এই ভাটির দেশে বাঁশ, দরমা আর মাটি দিয়ে তৈরি। কিন্তু একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করলাম: ঘরগুলো কিন্তু যেখানে সেখানে ইচ্ছে মতো বানানো হয়নি।

কী আশা করেছিলাম আমি? নোংরার মধ্যে এলোমেলো ভাবে কিছু মানুষ কোনওরকমে একসঙ্গে গাদাগাদি করে বাস করছে? ‘রিফিউজি’ শব্দটার অর্থ তো সেরকমই হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু যা দেখলাম তার সঙ্গে আমার কল্পনার কোনও মিলই নেই। রাস্তাঘাট এর মধ্যেই বানানো হয়ে গেছে; বাঁধ–দ্বীপজীবনের নিরাপত্তায় যার প্রধান ভূমিকা–তাও তৈরি হয়েছে; জমি ভাগ ভাগ করে বেড়া দিয়ে ঘেরা হয়ে গেছে; বেড়ার ওপর শুকোচ্ছে মাছধরা জাল। মহিলা পুরুষ সবাই যার যার ঘরের সামনে বসে বসে জাল সারাই করছে অথবা টোপ গাঁথছে কঁকড়া ধরার সুতোয়।

কী শৃঙ্খলা! কী পরিশ্রম! তাও মাত্রই কয়েক সপ্তাহ হল এরা এখানে এসেছে। দৃশ্যগুলি মনে গেঁথে নিতে নিতে একটা অদ্ভুত, মাতাল-করা উত্তেজনা এল আমার মধ্যে: হঠাৎ আবিষ্কার করলাম নতুন একটা কিছু জন্ম নিচ্ছে আমার চোখের সামনে, যা আগে কেউ কখনও দেখেনি। মনে হল নিশ্চয়ই ঠিক একই অনুভূতি হয়েছিল হ্যামিলটনের লঞ্চের ডেকে দাঁড়িয়ে বাদাবন সাফ করা দেখতে দেখতে। কিন্তু এই মরিচঝাঁপিতে যা হচ্ছে তার সঙ্গে হ্যামিলটনের কাজের একটা মূলগত ফারাক আছে; এটা কোনও একজন মানুষের ভাবনা নয়। যারা এখানে বসত করতে এসেছে এ তাদেরই নিজেদের স্বপ্ন, সেই স্বপ্নকেই বাস্তব করে তুলছে তারা।

আমার চলা থেমে গেল। বৃষ্টিভেজা রাস্তার ওপর এক জায়গায় ছাতায় ভর দিয়ে স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি, আমার কোঁচকানো ধুতি অল্প অল্প উড়তে লাগল সকালের ফুরফুরে বাতাসে। মনে হল আমার ভেতরে যেন একটা পরিবর্তন আসছে। কী বিস্ময়কর, আমি–বই মুখে করে সারা জীবন কাটানো একজন ইস্কুল মাস্টার আমার জীবদ্দশায় এরকম একটা ঘটনা দেখে যাচ্ছি যা কোনও শিক্ষিত বা ক্ষমতাবান মানুষের কল্পনাপ্রসূত নয়, শিক্ষা আর ক্ষমতা যাদের নেই তাদেরই নিজস্ব স্বপ্নের বাস্তবায়ন প্রত্যক্ষ করছি আমি!

মনে হল আমার শিরায় শিরায় যেন নতুন প্রাণ ফিরে আসছে। ছাতা ফেলে দিলাম হাত থেকে, বুক চিতিয়ে দাঁড়ালাম রোদ আর হাওয়ার মুখোমুখি। মনে হল যে শূন্যতাকে এত দিন দু’হাতে আঁকড়ে ছিলাম আমি, এক রাত্রে তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি দূরে।

ভীষণ উত্তেজিত অবস্থায় আবার ফিরে গেলাম কুসুমের ঘরে। আমার চেহারা দেখে ঘাবড়ে গেল ও। বলল, “কী হয়েছে সার? আপনার জামা কাপড়ে কাদা লাগা, মুখটা লাল হয়ে গেছে… আপনার ছাতাটা কোথায় গেল?”

“সেসব কথা ছাড় এখন,” অধৈর্য লাগছিল আমার, “আগে বল, কে আছে এ সবের দায়িত্বে? কোনও কমিটি তৈরি হয়েছে? নেতা-টেতা কেউ আছে?”

“সে তো আছেই। কেন বলুন তো?”

“তাদের সঙ্গে আমি দেখা করব।”

“কেন সার?”

“কারণ, এখানে যা হচ্ছে তাতে আমিও কিছু করতে চাই, সাহায্য করতে চাই যে রকম পারি।”

“সে আপনি চাইলে করবেন। আমি না বলার কে?”

কুসুম আমাকে জানাল যে গোটা দ্বীপটাকে কয়েকটা ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রত্যেকটা ভাগের দায়িত্বে আছে কিছু লোক, তারাই সমস্ত ঠিক করছে কী করা হবে না হবে, জরুরি যা যা দরকার তারাই তার ব্যবস্থা করছে।

“তোদের ভাগটার মূল দায়িত্বে যে আছে তার কাছে নিয়ে চল আমাকে,” বললাম আমি। কুসুম পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল আমাকে, খানিক দূরে একটা কুঁড়ের দরজায়।

নেতাটি দেখলাম বেশ বুদ্ধিমান, কর্মঠ লোক, আদৌ কোনও স্বপ্নের জগতের বাসিন্দা নয়। কেউ এসে খামখা সময় নষ্ট করলে তাকে পাত্তা দেওয়ার মানুষ সে নয়। স্বল্পবাক, কিন্তু হাবেভাবে এমন একটা আত্মবিশ্বাসের ছাপ, যেন ও জানে যে সাফল্য হাতের নাগালের মধ্যে প্রায়। খুবই ব্যস্ত ছিল সে, কিন্তু যখন শুনল আমি একটা স্কুলের হেডমাস্টার–যদিও অবসর নেওয়ার সময় এসে গেছে প্রায় আমাকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে সব দেখাল। নতুন বানানো রাস্তা ধরে হেঁটে গেলাম আমরা, আমাকে দেখাতে দেখাতে নিয়ে গেল কী কী কাজ ওরা করেছে আসার পর থেকে এই কয় সপ্তাহে। মুগ্ধ হয়ে গেলাম আমি, কাজের বহর দেখে শুধু নয়, তার পেছনে যে সংগঠন, যে প্রতিষ্ঠান–কত যত্ন নিয়ে তা গড়ে তোলা হয়েছে, তাই দেখেও। দ্বীপে নিজেদের একটা সরকার তৈরি করে ফেলেছে এরা, জনগণনাও হয়েছে–এর মধ্যেই মরিচঝাঁপির লোকসংখ্যা ত্রিশ হাজার ছাড়িয়ে গেছে, আরও অনেক মানুষের জন্য এখনও জায়গা রয়ে গেছে। গোটা দ্বীপটাকে পাঁচটা ভাগে ভাগ করা হয়েছে, প্রতিটি পরিবারের জন্য বরাদ্দ হয়েছে পাঁচ একর করে জমি। আরও একটা ব্যাপারে ওদের বিচক্ষণতার পরিচয় পেলাম–ওরা বুঝেছে যে আশেপাশের প্রতিবেশী দ্বীপগুলির সহায়তা না পেলে এই বিশাল পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা সম্ভব নয়। দ্বীপের চারভাগের এক ভাগ তাই রেখে দেওয়া হয়েছে ভাটির দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের জন্য। এর মধ্যেই বেশ কয়েকশো পরিবার চলে এসেছে। সেখানেও।

দ্বীপ পরিক্রমার শেষে আমার গাইডের দু’হাত জড়িয়ে ধরলাম আমি: “ভবিষ্যৎ আপনাদেরই পক্ষে, কমরেড।”

একটু হাসল লোকটি। বলল, “আপনাদের সকলের সাহায্য ছাড়া কিছুই সম্ভব নয়।”

বোঝা গেল ও মনে মনে চিন্তা করছে কীভাবে কাজে লাগানো যায় আমাকে। বেশ ভাল লাগল আমার ব্যাপারটা। মনে হল ভাল লক্ষণ এটা–বাস্তববাদী চিন্তা।

“আমি সাহায্য করতে প্রস্তুত,” বললাম আমি। “বলুন, কীভাবে কাজে লাগতে পারি আপনাদের।”

“সেটা কয়েকটা জিনিসের ওপর নির্ভর করছে,” ও বলল। “যেমন ধরুন, এখন আমাদের কাছে সবচেয়ে জরুরি হল জনমত তৈরি করা, সরকারের ওপর কোনও ভাবে চাপ সৃষ্টি করা, যাতে আমাদের নিজেদের মতো থাকতে দেওয়া হয় এখানে। এমনভাবে ওরা প্রচার করছে যেন এ জায়গাটাকে ধ্বংস করে ফেলছি আমরা; যাতে লোকে ভাবে যে আমরা কিছু গুণ্ডা, জোর করে জমি দখল করেছি এখানে এসে। কিন্তু আমরা যে ঠিক কী করছি, কেন এসেছি এখানে, সেটা আমরা মানুষকে জানাতে চাই। আমরা চাই সত্যিটা সবাই জানুক–কী কী করেছি আমরা এখানে এই ক’দিনে, কতটা সফল হয়েছে আমাদের উদ্দেশ্য। এই ব্যাপারে কোনও সাহায্য করতে পারেন আপনি? কলকাতায় খবরের কাগজে চেনাশোনা আছে আপনার?”

খারাপ লাগল না আমার লোকটির মনোভাব; ঠিকই তো, এই পথেই তো এগোনো উচিত এখন। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে জানাতে হল, “কাগজের লোকেদের সঙ্গে চেনাশোনা ছিল এক সময়, কিন্তু এখন তো আর নেই।”

“তা হলে হোমরা-চোমরা আর কাউকে চেনেন? পুলিশের লোক, কি ফরেস্ট রেঞ্জার, বা পার্টির নেতা-টেতা কাউকে?”

“না,” বললাম আমি। “সে রকম কাউকে তো আমি চিনি না।”

একটু বিরক্ত হল লোকটি। বলল, “তা হলে আর কী করবেন আপনি আমাদের জন্য বলুন তো? কী কাজ হবে আপনাকে দিয়ে?”

সত্যিই তো। কী কাজ হবে আমাকে দিয়ে? এ জগতে কত মানুষ আছে যারা সত্যিকারের কাজের লোক, যাদের সত্যিকারের কিছু উপযোগিতা আছে। যেমন ধর নীলিমা। কিন্তু আমার মতো একজন স্কুল মাস্টার?

“একটা কাজ করতে পারি,” আমি বললাম, “আমি পড়াতে পারি।”

“পড়বেন?” মনে হল প্রাণপণে হাসি চাপার চেষ্টা করছে লোকটি। “কী পড়াবেন আপনি এখানে?”

“এই, যেখানে আপনারা এসেছেন সেই ভাটির দেশের কথা শেখাতে পারি বাচ্চাদের। আমার হাতে এখন অনেক সময় আর কিছুদিনের মধ্যেই রিটায়ার করব আমি।”

আমার বিষয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলল লোকটি। “আমাদের বাচ্চাদের এখানে নষ্ট করার মতো সময় নেই,” ও বলল। “খাবার জোগাড়ের জন্য বাড়ির বড়দের সাহায্য করতে হয় ওদের।”

তারপর একটু ভেবে আবার বলল, “অবশ্য পড়াশোনা করতে চায় এরকম ছাত্র যদি আপনি জোগাড় করতে পারেন তা হলে আমি কেন বাধা দেব? সে আপনার ব্যাপার; পড়ান, প্রাণে চায়।”

বিজয়গর্বে ফিরে এলাম আমি কুসুমের ঘরে। কী কী কথাবার্তা হয়েছে সব বললাম ওকে। “কিন্তু এখানে কাদের পড়াবেন সার আপনি?” স্পষ্ট আশঙ্কা ওর গলায়।

“কেন?” আমি বললাম। “তোর ছেলে ফকির আছে, এরকম আরও কয়েকজনকে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। যাবে না?” একটা অনিচ্ছার ছায়া যেন দেখতে পেলাম কুসুমের মুখে। প্রায় অনুরোধের সুরে তাই বললাম, “প্রতিদিন নয় রে। সপ্তাহে হয়তো একদিন, অল্প একটু সময়ের জন্য। আমি চলে আসব লুসিবাড়ি থেকে।”

“কিন্তু সার,” বলল কুসুম, “ফকির তো লিখতে পড়তে পারে না। এখানকার বেশিরভাগ বাচ্চারই সেই একই অবস্থা। ওদের কী শেখাবেন আপনি?”

সেটা ভাবিনি আমি আগে, কিন্তু যেন ঠোঁটের ডগায় কে জুগিয়ে দিল জবাবটা। বললাম, “কুসুম, ওদের আমি স্বপ্ন দেখতে শেখাব।”

.

অনুসরণ

খাঁড়ির মধ্যে মা ডলফিন আর তার ছানা যখন মাছ ধরতে ব্যস্ত, তখন পাশের খালে ডিঙিটাকে স্থির রাখতে দম বেরিয়ে যাচ্ছিল ফকিরের। স্রোত খুব বেশি এখানে, তার মধ্যেই কোনওরকমে একই জায়গায় চক্কর কেটে যাচ্ছিল ফকির, যাতে ডলফিনগুলো পিয়ার নজরের মধ্যে থাকে। যদিও হাওয়া নেই এক বিন্দু, তাও নদীতে এত ছোট ছোট ঢেউ আর ঘূর্ণি যে মনে হচ্ছে জল যেন ফুটছে।

ছ’খানা ডেটাশিট ভর্তি করার পর পিয়া ঠিক করল জল কতটা গভীর এখানে সেটা একবার মেপে দেখবে। নৌকোর সামনের দিকটাতেই বসেছিল ও, যেমন বসে সাধারণত, আর ফকির ছিল মাঝামাঝি জায়গায়, ঝপাঝপ দাঁড় ফেলছিল একবার ডাইনে, একবার বাঁয়ে। পিয়া ওর ডেস্থ সাউন্ডারটা জলে মাত্র ডুবিয়েছে, ঠিক সেই সময় হঠাৎই ফকিরের নজর গেল ওর দিকে। সঙ্গে সঙ্গে ফকিরের চোখ গোল গোল হয়ে গেল, এমন এক চিৎকার করল যে পিয়া যে অবস্থায় ছিল সে ভাবেই থমকে থেমে গেল, ওর কবজি পর্যন্ত তখনও জলে ডোবানো। দাঁড়-টাঁড় নৌকোর ওপর ফেলে ঝাঁপিয়ে পড়ল ফকির পিয়ার দিকে, হুমড়ি খেয়ে সামনে পড়ে অন্ধের মতো টান মারল ওর কবজি ধরে। উলটে পড়ে গেল পিয়া, জল থেকে ছিটকে উঠে এল ওর হাত, আর ডেপ্‌থ সাউন্ডারটা উড়ে গিয়ে পড়ল নৌকোর মাঝখানে।

ঠিক তখনই আচমকা জল তোলপাড় করে বিশাল একটা হাঁ-করা মুখ তিরবেগে উঠে এল নদী থেকে, এক মুহূর্ত আগেও পিয়ার কবজিটা যেখানে ছিল ঠিক সেই জায়গাটায়। চোখের কোনা দিয়ে পিয়া দেখল ঝকঝকে একজোড়া ধারালো দাঁতের সারি পাক মেরে ছিটকে উঠল তখনও ঝুলে থাকা হাতটার দিকে: এত কাছ ঘেঁষে গেল যে শক্ত খসখসে নাকের ডগাটা ঘষে গেল ওর কনুইয়ে, আর নিশ্বাসের সঙ্গে আসা জলের ছিটেয় ভিজে গেল হাতের সামনেটা। এক সেকেন্ড পরেই জলের তলা থেকে আসা প্রচণ্ড এক ধাক্কায় টলমল করে উঠল ডিঙিটা। এত জোরালো সে ধাক্কা, যে নৌকোর খোলের মধ্যে জমে থাকা জল ছিটকে উঠে এল, মড়মড় করে আওয়াজ হল একটা, আর ডিঙিটা এমনভাবে কাত হয়ে গেল, মনে হল নির্ঘাত উলটে যাবে। পিয়ার পায়ের কাছে রাখা ক্লিপবোর্ডটা পিছলে গিয়ে পড়ল জলে, নৌকোর পাটাতনের কাঠগুলো উলটে চলে এল হুড়মুড় করে।

টুটুল বসেছিল ছইটার ভেতরে। একটা বলের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে ব্যালান্স ঠিক রাখতে গিয়ে ডিগবাজি খেতে খেতে চলে এল সামনের দিকে। ঝপাস করে একটা আওয়াজ করে ফের সোজা হল নৌকোটা। একটা জলের পর্দা ছিটকে উঠল নদী থেকে। এক মুহূর্ত পরেই আরেকবার প্রচণ্ড ধাক্কা এল নীচ থেকে। এবার ডিঙির পেছনের দিকটায়। ভয়ানক দুলুনির মধ্যেই কোনও রকমে হাঁটু গেড়ে উঠে বসে একটা বৈঠা তুলে নিল ফকির। মাথার ওপরে সেটাকে এমন ভাবে তুলে ধরল, যাতে বৈঠার ডগাটা একটা ফলার মতো কাজ করে, তারপর প্রচণ্ড জোরে সেটা চালিয়ে দিল জলের ভেতরে। ঠিক সেই মুহূর্তেই আরেকবার ধাক্কা দিতে যাচ্ছিল কুমিরটা। বৈঠাটা গিয়ে পড়ল একেবারে ওর মাথার ওপর। ঘা-টা এত জোরে গিয়ে লাগল যে তার চোটে ঝপাৎ করে বন্ধ হয়ে গেল কুমিরের হাঁ করা মুখটা। বৈঠাটাও টুকরো টুকরো হয়ে গেল সে আঘাতে, ফলাটা হাতলের থেকে ভেঙে চারকির মতো পাক খেতে খেতে ছিটকে গেল জলের ওপর দিয়ে। আর, বুজকুড়ি তুলতে তুলতে দৃষ্টির আড়ালে তলিয়ে গেল কুমিরটা। ডুব মারার পর এক মুহূর্তের জন্য জলের মধ্যে ভুতুড়ে একটা ছায়ার মতো ওটার আকৃতি নজরে এল পিয়ার। দেখল প্রায় এই ডিঙির সমান বড় ছিল সরীসৃপটা।

ইতোমধ্যে ফকির ঠিক হয়ে বসে একজোড়া বৈঠা তুলে নিয়েছে হাতে। ডলফিনগুলো যে খাঁড়িটার মধ্যে শিকার ধরছিল, স্রোতের টানে তার থেকে বেশ কয়েকশো মিটার সরে এসেছে নৌকোটা। এবার ফকির প্রাণপণে বৈঠা চালিয়ে এ খাঁড়ি সে খাঁড়ি দিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আরও দূরে সরে যেতে লাগল জায়গাটা থেকে।

প্রায় মিনিট বিশেক ওইভাবে একটানা দাঁড় টেনে একটা সরু খালে এসে ঢুকল ওরা। এঁকেবেঁকে ঘন জঙ্গলে ভরা একটা দ্বীপের মধ্যে ঢুকে গেছে খালটা। তার মধ্যে দিয়ে নৌকোটাকে নিয়ে গিয়ে এমন একটা জায়গায় দাঁড় করাল ফকির যেখানে জোয়ারের টান আর বোঝা যায় না। নোঙর নামিয়ে চুপচুপে ভেজা গেঞ্জিটা গা থেকে টেনে খুলে ফেলল। তারপর গামছা নিয়ে বুক বেয়ে গড়িয়ে নামা ঘাম মুছতে লাগল।

দম ফিরে পেয়ে পিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “লুসিবাড়ি?”

সাগ্রহে রাজি হয়ে গেল পিয়া। বলল, “ইয়েস। লেটস হেড ফর লুসিবাড়ি। ইটস টাইম।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *