ঘুম – এডগার অ্যালান পো

ঘুম – এডগার অ্যালান পো

মঁসিয়ে ভালডিমারের অস্বাভাবিক কেস রীতিমত উত্তেজনার সৃষ্টি করেছিল কেন, সে বিষয়ে অবাক হওয়ার ভান দেখানোর আর কোনো কারণ আছে বলে আমি মনে করি না। পুরো ব্যাপারটাকেই বলা যায় অলৌকিক ব্যাপার। সাময়িকভাবে বিষয়টা জনসমক্ষে আনা হবে না, এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আরও কিছু গবেষণা করার জন্য, যাতে অত্যাশ্চর্য ঘটনাটায় কিছু আলোকপাত করা যায়-বিচিত্র প্রহেলিকাকে প্রাঞ্জল করা যায়। কিন্তু গোপন করতে গিয়ে এমন কানাঘুষা শুরু হয়ে গিয়েছিল যে আসল ব্যাপারটা পাঁচজনের কানে না পৌঁছে, পৌঁছেছিল ডালাপালা মেলে ছড়িয়ে পড়া

অতিরঞ্জিত এক বিবরণ। ঢিঢি পড়ে গিয়েছিল সমাজের নানা মহলে এবং স্বভাবতই অবিশ্বাস আর বিদ্রুপের বন্যা বয়ে গিয়েছিল হাটেবাজারে।

ঠিক যা ঘটেছিল, তা নিবেদন করা সঙ্গত মনে করি এই কারণেই। সংক্ষেপে ব্যাপারটা এই

গত তিন বছর ধরে মেসমেরিজম বিদ্যায় আকৃষ্ট হয়েছিলাম আমি। নয় মাস আগে হঠাৎ খেয়াল হলো পরপর এত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা সত্ত্বেও একটা বিষয় বরাবরই বাদ পড়ে গেছে। বিষয়টা রীতিমত অত্যাশ্চর্য তো বটেই, যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে তার কূল-কিনারাও পাওয়া যায় না।

জ্যান্ত মানুষকে সম্মোহন করার চেষ্টা তো কেউ করেনি। যে মানুষটা মরতে চলেছে, তাকে যদি মেসমেরাইজ করা যায়, মরে যাওয়ার পর ব্যাপারটা কি দাঁড়ায়-সেটা দেখাও তো দরকার। এমনও তো হতে পারে যে সম্মোহন করে মৃত্যুকে ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব?

এ ধরনের উদ্ভট এক্সপেরিমেন্টে নামবার আগে অনেকগুলো পয়েন্ট বিবেচনা করা দরকার। তার মধ্যে মূল পয়েন্ট তিনটে : প্রথম, মৃত্যুও মুহূর্তে চৌম্বক প্রভাব মানুষটার ওপর কার্যকর হয় কিনা; দ্বিতীয়, যদি কার্যকর হয়, তবে আসন্ন মৃত্যু সম্মোহনের প্রভাবকে বাড়িয়ে দেয়, না কমিয়ে দেয়; তৃতীয়, কতদিন যমরাজকে ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব।

শেষের পয়েন্টটাই কিন্তু আমাকে নাড়া দিল সবচেয়ে বেশি। অস্থির হয়ে গেলাম কৌতূহল চরিতার্থ করার জন্য।

কিন্তু কাকে নিয়ে অভিনব এই এক্সপেরিমেন্টে নামা যায়? মনে পড়ল বন্ধুবর মঁসিয়ে আরটেস্ট ভালডিমারের কথা। বিবলিথিকা ফরেনসিকা বইটা লিখে যিনি যথেষ্ট নাম করেছেন এবং ছদ্মনামে লিখেছেন ইস্‌সাছার মার্ক্স। তার লেখা গর্গনচুয়া আর ওয়ালেন্সটাইন বই দুখানির নামও কারও অজানা নয়। মঁসিয়ে ভালডিমার ১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে থাকেন নিউইয়র্কের হারলেম অঞ্চলে। চেহারায়। বাড়াবাড়ির ছিটেফোঁটাও নেই। শরীরের নীচের দিকটা জন র‍্যানডর্ফের নিম্নাঙ্গের মতো। চুল মিশমিশে কালো-কিন্তু জুলফি ধবধবে সাদা। ফলে অনেকেরই ধারণা চুলটা আসল নয়-নকল; মানে পরচুলা। অত্যন্ত নার্ভাস প্রকৃতির মানুষ। সম্মোহনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আদর্শ ব্যক্তি। বার দুই-তিন তাঁকে ঘুম পাড়িয়ে ছিলাম অতি সহজেই-বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু নাকাল করে ছেড়েছিলেন বেশ কয়েকবার। ভদ্রলোকের ধাতটা এমনই অদ্ভুত যে আগেই আন্দাজ করা যায় না ঠিক কি ঘটতে পারে। কখনোই ওঁর ইচ্ছাশক্তি পুরোপুরি কজায় আনতে পারিনি। আমরা যাকে বলি ক্লেয়ারভয়্যান্স-সোজা কথায় যাকে বলে অলোকদৃষ্টি বা অতীন্দ্রিয় দৃষ্টি-এই ব্যাপারটিতে ওঁর ওপর আস্থা রাখা যায়নি কোনো দিনই। ব্যর্থতার কারণ হিসেবে অবশ্য আমি দায়ী করেছি তার স্বাস্থ্যের টলমল অবস্থাকে-কখন যে ভালো আছেন, আর কখন যে কাহিল হচ্ছেন-তার কোনো ঠিক নেই। ওঁর সঙ্গে আমার আলাপ হওয়ার মাসকয়েক আগে ডাক্তাররা একবাক্যে রায় দিয়েছিলেন, রোগটা দুরারোগ্য-থাইসিস। মরতে হবেই জেনে উনি কিন্তু বিচলিত হননি। মৃত্যুকে প্রশান্ত মনে বরণ করার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন।

উদ্ভট আইডিয়াটা মাথায় আসতে এই সব কারণেই মঁসিয়ে ভালডিমারের কথাটাই মনে এল সবার আগে। ওঁর মনের চেহারা আমার অজানা নয়-আমার অদ্ভুত এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে বাধা দিতে যাবেন না। আমেরিকায় ওঁর কোনো আত্মীয়-স্বজনও নেই যে বাগড়া দিতে আসবে। তাই প্রসঙ্গটা নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করলাম ভদ্রলোকের সঙ্গে। অবাক হলাম তাঁর আগ্রহ আর উত্তেজনা দেখে। অবাক হওয়ার কারণ আছে বইকি। আমার সম্মোহনের খপ্পরে বারবার নিজেকে সঁপে দিয়েও সম্মোহনের বিদ্যেটা নিয়ে কস্মিনকালেও গদগদ হননি ভালডিমার। ব্যাধিটা এমনই যে মৃত্যু কবে হবে কখন হবে তা যখন সঠিকভাবে হিসাব করে বলে দেওয়া সম্ভব নয় তখন উনি বললেন, ডাক্তাররা যখনই বলে যাবে মৃত্যুর দিন আর সময়, তার ঠিক চব্বিশ ঘন্টা আগে উনি আমাকে ডেকে পাঠাবেন।

মাস সাতেক আগে ভালডিমারের স্বহস্তে লেখা এই চিঠিটি পেলাম :

মাই ডিয়ার পি–

স্বচ্ছন্দে এখন আসতে পারেন। কাল মাঝরাত পর্যন্ত আমার আয়ু-বলে। গেলেন দুজন ডাক্তার। সময় হয়েছে। চলে আসুন।

ভালডিমার

চিঠি লেখার আধঘণ্টা পর চিঠি পৌঁছোলো আমার হাতে, তার ঠিক পনেরো মিনিট পর আমি পৌঁছোলাম মুমূর্ষ মানুষটার শয্যার পাশে। দিন দশেক তাঁকে দেখিনি। কিন্তু দশ দিনেই চেহারার হাল যা হয়েছে, আঁতকে ওঠার মতো। মুখ সিসের মতো বিবর্ণ; চোখ একেবারেই নিষ্প্রভ; এতটাই ক্ষীণকায় হয়ে গেছেন যে গালের চামড়া কুঁড়ে যেন হনু বেরিয়ে আসতে চাইছে। অবিরল শ্লেষ্ম বেরোচ্ছে। নাক-মুখ দিয়ে। নাড়ি প্রায় নেই বললেই চলে। তা সত্ত্বেও অটুট মনোবল আর শেষ দৈহিক শক্তিকে আঁকড়ে থাকার ফলে টিকে আছেন এখনো। চাঙ্গা হওয়ার। জন্য নিজেই ওষুধ নিয়ে খেলেন। ঘরে যখন ঢুকলাম, দেখলাম পকেটবুকে কি লিখছেন। কথা বললেন সুস্পষ্ট স্বরে। দুপাশে দাঁড়িয়ে দুই ডাক্তার। বালিশে ঠেস দিয়ে বসে আছেন ভালডিমার কোনোমতে পিঠ সোজা করে।

ডাক্তার দুজনকে আড়ালে ডেকে এনে শুনে নিলাম বন্ধুবরের শরীরের অবস্থা। বাঁদিকের ফুসফুস গত আঠারো মাস ধরে শক্ত হয়ে এসেছে এবং এখন তা একেবারেই অকেজো। ডানদিকের ফুসফুসের ওপরের অংশের অবস্থাও তাই। নিচের দিকটা দগদগে হয়ে রয়েছে অসংখ্য ক্ষতে। কয়েক জায়গায় ফুসফুস একেবারেই ফুটো হয়ে গেছে এবং পাঁজরার সঙ্গে আটকে রয়েছে। ডানদিকের এই অবস্থা ঘটেছে সম্প্রতি। ফুসফুস শক্ত হয়েছে খুবই তাড়াতাড়ি-অস্বাভাবিক গতিবেগে। একমাস আগেও লক্ষণ ধরা পড়েনি। ফুসফুস যে পাঁজরার সঙ্গে লেগে রয়েছে, এটা ধরা পড়েছে মাত্র তিন দিন আগে। থাইসিস ছাড়াও হৃদ্যন্ত্রের মূল ধমনীও নিশ্চয় বিগড়েছে-যদিও তা যাচাই করে দেখা এখন আর সম্ভব নয়। কেননা, ভালডিমার মারা যাবেন রবিবার রাত বারোটা নাগাদ। একথা হলো শনিবার সন্ধ্যে সাতটার সময়ে।

ডাক্তারদের বললাম, পরের দিন রাত দশটা নাগাদ যেন রোগীর বিছানার পাশে হাজির থাকেন। বিদায় নিলেন দুই ডাক্তার। ভালডিমারের পাশে বসলাম। শরীরের বর্তমান অবস্থা আর আসন্ন এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করলাম। ঐরকম শোচনীয় অবস্থাতেও ওঁর আগ্রহ তিলমাত্র কমেনি দেখে অবাক হলাম। তাড়া লাগালেন সময় নষ্ট না করে তক্ষুনি যেন শুরু করে দিই এক্সপেরিমেন্ট। দুজন নার্স ছিল ঘরে। কিন্তু নির্ভরযোগ্য সাক্ষী সামনে না রেখে কাজ শুরু করতে মন চাইল না। দুর্ঘটনা ঘটতে কতক্ষণ? তাই বললাম, এক্সপেরিমেন্ট শুরু হবে পরের দিন রাত আটটা নাগাদ। আটটার সময়ে একজন মেডিক্যাল স্টুডেন্টকে রাখব ঘরের মধ্যে। ছোকরার নাম থিওডোরের। ডাক্তাররা না এসে পৌঁছানো পর্যন্ত অপেক্ষা করলেই ভালো হতো। কিন্তু ভালডিমারের পীড়াপীড়িতে আর তার শারীরিক অবস্থা দেখে বেশি দেরি করতে চাইলাম না।

মি. এল যা দেখেছিলেন এবং যা শুনেছিলেন-সব হুবহু লিখে নিয়েছিলেন। তাঁর সেই লেখা থেকেই এই প্রতিবেদন হাজির করছি আপনাদের সামনে।

পরের দিন আটটার সময়ে ভালডিমারের হাত ধরে জিজ্ঞেস করলাম–যতদুর পারেন, স্পষ্টভাবে বলুন মি. এল-এর সামনে এই এক্সপেরিমেন্টে আপনার সায় আছে কিনা।

ক্ষীণ কিন্তু সুস্পষ্ট স্বরে উনি বললেন–হ্যাঁ, আমি সম্মোহিত হতে চাই এক্ষুনি। অনেক দেরি করে ফেলেছেন। সঙ্গে সঙ্গে শুরু করলাম হস্তচালান-যেভাবে এর আগে ওঁকে ঘুম পাড়িয়েছি বহুবার-ঠিক সেইভাবে। কপালে দু-একবার টোকা দিতেই শুরু হয়ে গেল সম্মোহনের প্রভাব। কিন্তু দশটা নাগাদ ডাক্তার দুজন এসে না পৌঁছানো পর্যন্ত সেরকম ফল পেলান না। ডাক্তারদেও জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ওঁদের কোনো আপত্তি আছে কিনা। ওঁরা বললেন, রোগীর মৃত্যুযন্ত্রণা শুরু হয়ে গেছে-এখন অনায়াসেই সম্মোহনের ঝুঁকি নেওয়া চলে। আমি তখন হাত চালালাম নিচের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলাম ভালডিমারের ডানচোখের দিকে।

ওঁর নাড়ি তখন অতিশয় ক্ষীণ, আধমিনিট অন্তর নিশ্বাস ফেলছেন অতিকষ্টে।

পনেরো মিনিট অব্যাহত রইল এই অবস্থা। তারপর গভীর শ্বাস ফেললেন ভালডিমার। নিশ্বাসের কষ্ট আর রইল না-কিন্তু আধমিনিটের ব্যবধানটা থেকেই গেল। হাত-পা বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে এল।

এগারোটা বাজার পাঁচ মিনিট আগে প্রকৃত সম্মোহনের মোক্ষম লক্ষণগুলো প্রকাশ পেল। ঘুমের ঘোরে যারা হেঁটে বেড়ায়, তাদের চোখের সাদা অংশে যেরকম একটা ভাব ফুটে ওঠে, ঠিক সেইরকম ভাব প্রকাশ পেল তাঁর চোখে। দ্রুত হাত চালালাম বার কয়েক। থিরথির করে কেঁপে উঠে বন্ধ হয়ে গেল চোখের পাতা। তাতেও সন্তুষ্ট না হয়ে জোরে জোরে আরও কয়েকবার হাত চালিয়ে এবং আমার ইচ্ছাশক্তিকে পুরোপুরি খাঁটিয়ে শক্ত এবং সহজ করে আনলাম ওঁর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। দু-পা দু-হাত সটান বিছানার ওপর মেলে ধরে মাথা ঈষৎ উঁচিয়ে স্থির হয়ে রইলেন ভালডিমার।

তখন মধ্যরাত্রি। ঘরে যারা ছিলেন, তাঁদেরকে বললাম ভালডিমারকে ভালোভাবে দেখে নিতে। প্রত্যেকেই একবাক্যে বললেন, উনি এখন পুরোপুরি সম্মোহিত। ডক্টর ডি অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে উঠলেন-সারা রাত থাকতে চাইলেন। ডক্টর এফ বলে গেলেন ভোর হলেই চলে আসবেন। মি. এল আর নার্স দুইজন রইলেন ঘরে।

রাত তিনটে পর্যন্ত ভালডিমারকে রেখে দিলাম একইভাবে। ডক্টর এফ বিদায় নেওয়ার সময়ে ওঁকে যেভাবে দেখে গিয়েছিলেন, তখনো হুবহু সেইভাবেই। নাকের সামনে আয়না ধরলে শুধু বোঝা যাচ্ছে নিশ্বাস পড়ছে। চোখ বন্ধ, হাত-পা মার্বেল পাথরের মতো শক্ত আর ঠান্ডা। কিন্তু মৃত্যুর লক্ষণ নেই শরীরের কোথাও। ভালডিমারকে এর আগে সম্মোহিত অবস্থায় রেখে একটা ব্যাপারে পুরোপুরি সফল হইনি কখনোই। ডান বাহুর ওপর হাত চালিয়ে ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে আমার হাত নাড়ার অনুকরণে তাঁর হাত নাড়াতে পারিনি! মৃতবৎ ভালডিমারের ক্ষেত্রে সেই চেষ্টা আবার করলাম-ব্যর্থ হব জেনেই করলাম। কিন্তু অবাক হয়ে গেলাম। আশ্চর্যভাবে সফল হওয়ায়। আমার হাত যেদিকে যেদিকে গেল, ওঁর হাতও নড়তে লাগল সেই দিকে।

জিজ্ঞেস করলাম, সিয়ে ভালডিমার, আপনি কি ঘুমোচ্ছেন? উনি জবাব দিলেন না। কিন্তু থিরথির করে কেঁপে উঠল ঠোঁটজোড়া। পরপর তিনবার জিজ্ঞেস করলাম একই প্রশ্ন। তৃতীয় বারে ওঁর চোখের পাতা খুলে গেল। শিথিলভাবে নড়ে উঠল ঠোঁট এবং দুঠোঁটের ফাঁক দিয়ে অতি অস্পষ্ট ফিসফিসানির মতো ভেসে এল

হ্যাঁ, ঘুমোচ্ছি। জাগাবেন না! মরতে দিন এইভাবেই!

হাত আর পা দেখলাম আগের মতোই শক্ত অথচ আমি হাত নাড়ালেই উনি ডানহাত একইভাবে নাড়াচ্ছেন।

প্রশ্ন করলাম, বুকে ব্যথা এখনো অনুভব করছেন?

জবাবটা এল তক্ষুনি, তবে আগের চাইতে আরও অস্পষ্টভাবে, কোনো ব্যথা নেই-আমি মারা যাচ্ছি!

ভোরের দিকে এফ না আসা পর্যন্ত ভালডিমারকে আর ঘাটালাম না। রোগী এখনো বেঁচে আছে দেখে উনি তো স্তম্ভিত। নাড়ি টিপে এবং ঠোঁটের কাছে আয়না ধরে পরখ করে নিয়ে আমাকে বললেন প্রশ্ন চালিয়ে যেতে।

আগের মতোই মিনিট কয়েক ভালডিমার কোনো জবাব দিলেন না। মনে হলো, শক্তি সঞ্চয় করছেন। পরপর চারবার একই প্রশ্ন করলাম। চতুর্থবারে অতি ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন

হ্যাঁ, এখনো ঘুমিয়ে আছি-মারা যাচ্ছি।

ডাক্তাররা বললেন, ভালডিমারের এই প্রশান্ত অবস্থাকে টিকিয়ে রাখা হোক মৃত্যু না আসা পর্যন্ত। মৃত্যুর নাকি আর দেরি নেই, বড়জোর আর কয়েক মিনিট।

আগের প্রশ্নটাই আবার জিজ্ঞাসা করলাম ভালডিমারকে।

সঙ্গে সঙ্গে আশ্চর্য পরিবর্তন দেখা গেল মুখাবয়বে। চক্ষুগোলক আস্তে আস্তে ঘুরে উঠে গেল ওপর দিকে, চোখের তারা অদৃশ্য হয়ে গেল সেই কারণেই; বিবর্ণ হয়ে গেল চামড়া-সাদা কাগজের মতো; দুই হনুর ওপর জ্বরভাবযুক্ত উত্তপ্ত চক্রাকার দাগ দুটো নিভে গেল আচমকা। নিভে গেল শব্দ দুটো ব্যবহার করলাম। বিশেষ কারণে। মনে হলো, ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দেওয়া হলো জ্বলন্ত মোমবাতি। এতক্ষণ দাঁত ঢাকা ছিল ওপরের ঠোঁট ঝুলে থাকায় অকস্মাৎ কাঁপতে কাঁপতে ওপরের ঠোঁট ওপর দিকে গুটিয়ে যাওয়ায় প্রকট হলো দাঁতের সারি-ঝপাৎ করে নীচের চোয়াল ঝুলে পড়ায় বেরিয়ে পড়ল ফুটে ওঠা কালচে জিভ। ঘরে যারা উপস্থিত ছিলেন, মৃত্যু দেখে তাঁরা অভ্যস্ত। তা সত্ত্বেও ভালডিমারের ঐ ভয়ানক মুখচ্ছবি দেখে সভয়ে সিঁটিয়ে খাটের পাশে পেছিয়ে গেলেন প্রত্যেকেই।

জানি পাঠকের মনে অবিশ্বাস দানা বাঁধছে। তা সত্ত্বেও যা ঘটেছিল, হুবহু তা বলে যাব।

ভালডিমারের সারা অঙ্গে প্রাণের আর কোনো লক্ষণ না দেখে আমরা ধরে নিলাম উনি মারা গেছেন। নার্সদের তদবিরের ওপরে তাকে ছেড়ে দেওয়াই ঠিক করলাম সবার মত নিয়ে। ঠিক তক্ষুনি ভীষণভাবে কেঁপে উঠল তার জিভ। কাঁপতে লাগল পুরো এক মিনিট ধরে। তারপর হাঁ হয়ে থাকা নিথর চোয়ালের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এল এমন ভয়ানক এক কণ্ঠস্বর যার বর্ণনা দেওয়া আমার পক্ষে বাতুলতা। শব্দটা কর্কশ, ভাঙা ভাঙা এবং শূন্যগর্ভ। বীভৎস। মানুষের কান কখনো এরকম বিকট শব্দ শোনেনি। দুটো কারণে তা অপার্থিব-অন্তত আমার তাই মনে হয়েছিল। প্রথম, শব্দটা যেন ভেসে এল বহুদূর থেকে, পাতাল থেকে। দ্বিতীয়টি, আঠালো বস্তুর মতো চটচটে ছিল ওই শব্দ।

শব্দ আর কণ্ঠস্বর-এর কথাই কেবল বললাম। আরও একটু খুলে বলা যাক। আওয়াজটা আশ্চর্য রকমের রোমাঞ্চকর স্পষ্ট শব্দাংশ। মিনিট কয়েক আগে ভালডিমারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, উনি এখনো ঘুমাচ্ছেন কিনা। উনি তার জবাব দিলেন এইভাবে

হ্যাঁ;–না-ঘুমিয়েছিলাম-এখন-এখন মারা গেছি।

গায়ের লোম খাড়া হয়ে গিয়েছিল শব্দটার বীভৎস উচ্চারণে; শব্দ যে এরকম লোমহর্ষকভাবে উচ্চারিত হতে পারে, এরকম থেমে থেমে মেপে মেপে জিভ দিয়ে বেরোতে পারে-অতি বড় দুঃস্বপ্নেও কেউ তা কল্পনা করতে পারবেন না। সুতরাং, গায়ে কাঁটা যে দিয়েছিল তা অস্বীকার করার জো নেই। এক কথায় শব্দটা উচ্চারিত হওয়ার মতো নয় একেবারেই-কিন্তু তবুও তা ভয়াল অনুকম্পন তুলে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে ঠিকরে এসেছিল জিভ দিয়ে যেন কবরের অন্ধকার থেকে। মেডিক্যাল স্টুডেন্ট মি. এল অজ্ঞান হয়ে গেলেন। নার্স দুজন দৌড়ে পালিয়ে গেল ঘর থেকে। কিছুতেই আর তাদেরকে ফিরিয়ে আনা যায়নি। আমার অবস্থাটা যে কিরকম দাঁড়িয়েছিল সেই মুহূর্তে, পাঠকের কাছে তা ধোঁয়াটে রাখতে চাই না। বুদ্ধিশুদ্ধি একেবারে লোপ পেয়েছিল বললেই চলে। ঘণ্টাখানেক কারও মুখে আর একটা শব্দও বেরোয়নি। একনাগাড়ে মি. এল-এর জ্ঞান ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে গেছি। উনি জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর কথাবার্তা শুরু হলো ভালডিমারের অবস্থা নিয়ে।

অবস্থার বর্ণনা আগে যা দিয়েছিলাম, দেখা গেল তার রদবদল হয়নি-ভালডিমার রয়েছেন ঠিক একইভাবে। আয়না ধরলে নিশ্বাসের লক্ষণ আর ধরা পড়ছে না-তফাত শুধু এইখানে। বাহু থেকে রক্ত টেনে বার করার চেষ্টা ব্যর্থ হলো। আমার ইচ্ছাশক্তি দিয়ে বাহু আর নাড়াতেও পারছিলাম না। সম্মোহনের ভাব দেখা যাচ্ছিল কেবল ভালডিমারের জিভে। যতবার প্রশ্ন করেছি, ততবার জিভ থরথর করে কেঁপে উঠেছে, যেন আপ্রাণ চেষ্টা করছে জবাব দেওয়ার-কিন্তু স্বর ফুটছে না। আমি ছাড়া অন্যরা প্রশ্ন করে ব্যর্থ হয়েছেন, এমনকি যুগ্ম-সম্মোহনের প্রভাবেও অন্যকে দিয়ে প্রশ্ন করে ফল পাইনি-ভালডিমারের জিভ নিথর থেকেছে। অন্য নার্সদের জুটিয়ে এনে তাদের জিম্মায় ভালডিমারকে রেখে দশটার সময়ে ডাক্তার দুজন আর মি. এলকে নিয়ে বেরিয়ে এলাম বাড়ি থেকে।

বিকেলের দিকে আবার সবাই এলাম রোগীকে দেখতে। অবস্থা আগের মতোই। আবার ওঁকে জাগানোর চেষ্টা কওে কোনো লাভ নেই, এ বিষয়ে একমত হলাম প্রত্যেকেই। পরিষ্কার দেখা গেল, মৃত্যু বলতে যা বোঝার সম্মোহনের প্রভাবে তাকে আটকে রাখা সম্ভব হয়েছে। এ অবস্থায় ওঁকে ফের জাগাতে গেলে মৃত্যু ত্বরান্বিত হবে।

সেদিন থেকে গত সপ্তাহ পর্যন্ত, ঝাড়া সাত মাস একইভাবে পড়ে থেকেছেন ভালডিমার। ডাক্তার এবং অন্যান্যদের নিয়ে দেখে এসেছি মাঝে মাঝে। নার্সদের তদবিরে ছেদ পড়েনি মুহূর্তের জন্যেও।

গত শুক্রবার ঠিক করলাম, আবার ওঁকে জাগানোর চেষ্টা করা যাক। সর্বশেষ এই এক্সপেরিমেন্টের ফল শুভ হয়নি এবং এ নিয়েই যত কিছু কানাঘুষার সূচনা ঘটেছিল আড়ালে আবডালে।

সম্মোহনী প্রক্রিয়ার বিধিমত হস্তচালনা করে বেশ কিছুক্ষণ বিফল হলাম। তারপর দেখা গেল কনীনিকা আস্তে আস্তে একটুখানি নামল নিচের দিকে। সেইসঙ্গে বিকট দুর্গন্ধময় হলদেটে রস বেরিয়ে এল নেমে আসা চোখের তারার আশপাশ দিয়ে।

চেষ্টা করলাম ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে ভালডিমারের বাহু আবার চালনা করা যায় কিনা। ব্যর্থ হলাম। ডক্টও এফ-এর ইচ্ছানুসারে তখন একটা প্রশ্ন করলাম :

মঁসিয়ে ভালডিমার, এই মুহূর্তে আপনার ইচ্ছে বা অনুভূতি কি ধরনের, বলতে পারবেন?

মুহূর্তের মধ্যে হনু দুটোর ওপর জ্বরতপ্ত চক্রাকার লোহিত আভা জেগে উঠল। থরথর করে কেঁপে উঠল জিভ-যেন ভীষণভাবে ঘুরপাক খেতে লাগল হাঁ করা মুখগহ্বরের মধ্যে। চোয়াল আর ঠোঁট আগের মতোই আড়ষ্ট ছিল বলে হাঁ হয়ে আছে মুখটা এই সাত মাস। তার পরেই, বেশ কিছুক্ষণ পরে, কদাকার সেই স্বর ঠিকরে ঠিকরে বেরিয়ে এল জিভ দিয়ে

ঈশ্বরের দোহাই! তাড়াতাড়ি করুন! তাড়াতাড়ি! হয়, ঘুম পাড়িয়ে দিন, না হয় জাগিয়ে দিন!–এক্ষুনি! এইমাত্র! আমি মারা গেছি!

ভীষণ ঘাবড়ে গেলাম। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। তারপর ভালডিমারকে সুস্থ করবার চেষ্টা করলাম। ব্যর্থ হলাম একেবারেই। চেষ্টা করলাম জাগাতে। ইচ্ছাশক্তি সংহত করে ধস্তাধস্তি করে গেলাম বললেই চলে। লক্ষ করলাম, কাজ হচ্ছে। ভালডিমারের সম্মোহনের প্রভাব কেটে যাবে এখুনি। ঘরসুদ্ধ লোক সাগ্রহে চেয়ে রইলেন কি হয় দেখবার জন্য।

যা হয়েছিল, তা এমনই অসম্ভব কাণ্ড যা দেখার জন্য প্রস্তুত থাকতে পারে না। কোনো মানুষ।

দ্রুত হাত চালিয়ে যাচ্ছি আর শুনছি বিকট বীভত্স হাহাকার-মারা গেছি! মারা গেছি! কথাটা বেরোচ্ছে কিন্তু ঘুরপাক খাওয়া জিভ থেকে, ঠোঁট থেকে নয়। তারপরেই আচমকা আমার হাতের নিচেই পুরো দেহটা এক মিনিটের মধ্যে কুঁচকে, গুটিয়ে ছোট্ট হয়ে খুঁড়িয়ে, একদম পচে গেল। বিছানাময় পড়ে রইল কেবল অতি জঘন্য এবং অত্যন্ত দুর্গন্ধময় খানিকটা জলীয় পদার্থ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *