দাঁত – নুট হ্যামসুন

দাঁত – নুট হ্যামসুন

ছোটবেলায় আমি যে এলাকায় ছিলাম, সে এলাকার গির্জাটা ছিল একটা পাহাড়ের ওপর। মূল গির্জার চারপাশে পাঁচিলের মধ্যে ছিল অনেকটা ভোলা জায়গা। কোনো পাহারাদার ছিল না সেখানে। তাই যখন খুশি সেখানে যেতে পারতাম। গির্জায় নয়, যেতাম আমি সেই ভোলা জায়গাটায়, যেখানে ছিল অনেকগুলো কবর। আর কবরগুলোই ছিল আমার মূল আকর্ষণ। প্রতিটি কবর ছিল আমার চেনা। গির্জা এলাকার একদিকে ছিল এক সমাধিকক্ষ। সেখানে ছোট বড় নানা আকারের হাড় ছড়ানো ছিটানো থাকত। সেই সমাধিকক্ষেও আমি একা একা অনেকটা সময় কাটাতাম। আর হাড়গুলো নাড়াচাড়া করতাম।

একদিন সেই সমাধিকক্ষে একটি বিচিত্র দাঁত খুঁজে পেলাম। কিছু না ভেবেই ওটি আমি পকেটে ভরলাম। ভেবেছিলাম দাঁতটিতে কোনো নকশা করব। অদ্ভুত জিনিস জোগাড় করার শখ আছে আমার। আর সেটা যদি মৃত মানুষের কোনো অঙ্গের মধ্যে পড়ে তাহলে তো কথাই নেই।

তখন শরৎকাল। দাঁত নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। পড়ার ঘরে না গিয়ে আগে গেলাম রান্নাঘরে। বাতিটা জ্বালালাম না। বাতি জ্বালালেই পোকার উৎপাত হবে বলে। স্টোভটা জ্বালালাম। তাতে রান্নাঘরের অন্ধকার বাড়ল বৈ কমল না। স্টোভের পাশে দাঁড়িয়ে একটা রেত দিয়ে দাঁতটা ঘষতে লাগলাম। কিন্তু একটু পরেই বুঝতে পারলাম, এই স্বল্প আলোতে কাজ করা সম্ভব না। বড় চুলাটা জ্বালাতে হবে। রান্নাঘরের যেখানে কাঠ থাকে সেখানে গিয়ে এক টুকরা কাঠও দেখতে পেলাম না।

রান্নাঘরের পাশেই ছাউনি। শুকনো কাঠ ছাউনিতেই থাকে। ছাউনির ভিতর ঢুকলাম। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। অন্যান্য দিন তো বাতি থাকে। আজ নেই কেন? অন্ধকারের মধ্যে এগোলাম। হঠাৎ এক ঝলক তীব্র আলো আমার চোখ একেবারে ধাধিয়ে দিল। ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম, কে, কে ওখানে? কোনো জবাব এল না। মনে মনে ভাবলাম, আমি হয়তো ভুল দেখেছি। সবটাই মনের ভুল। এই অন্ধকার ছাউনিতে আমি ছাড়া কেউ নেই।

অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে কাঠের স্তূপের কাছে গেলাম। একটা কাঠ হাতে নিতেই কে যেন আমার মাথায় আঘাত করল। যা দিয়ে আঘাত করল তা বরফের মতো ঠান্ডা! মাথায় হাত দিলাম। এটাও কি মনের ভুল? আবার হাত দিলাম। না, নেই! ঠান্ডা জিনিসটা এখন আর নেই! তবে কি সিলিং থেকে আমার মাথায় কিছু পড়েছিল? কিন্তু সেই কিছু একটা কী? এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর পেলাম না।

কাঠ নিয়ে রান্নাঘরে এলাম। বড় চুলাটা জ্বালালাম। পকেট থেকে দাঁতটা বের করে হাত রেত তুলে নিলাম। এইবার বেশ আলো হয়েছে। আরাম করে দাঁতটাকে ঘষা যাবে। দাঁতের ওপর রেতটা ধরলাম।

টুক-টুক-টুক! চমকে পিছনে তাকালাম। জানালায় একখানা বীভৎস মুখ! এ পাড়ার সবাইকে তো আমি চিনি। এ তাহলে কে? মুখে লাল দাড়ি, গলায় লাল মাফ লার জড়ানো। মাথার টুপিটাও লাল! এমন বীভৎস চেহারা আগে কখনো দেখিনি। আমার দিকে স্থির তাকিয়ে লোকটা নিঃশব্দে হাসতে লাগল। কী ভয়ংকর সেই হাসি!

দারুণ আতঙ্কে আমি থরথর করে কাঁপতে লাগলাম। আমার হাত থেকে দাঁতটা টুক করে মেঝেতে পড়ে গেল। মানুষটাও তখন ধীরে ধীরে জানালা থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল। অদৃশ্য হওয়ার আগে লোকটার উপরের পাটির দাঁতগুলোর দিকে চোখ পড়ল। দেখলাম ঠিক মাঝখানের দাঁত নেই একটা!

আমার শরীর কেমন অবশ হয়ে যাচ্ছিল। আর সামলাতে পারলাম না নিজেকে। রান্নাঘরের মেঝেতে ধপ করে বসে পড়লাম। অনেকক্ষণ ধরে আবোলতাবোল চিন্তা করলাম। হঠাৎ মনে হলো গির্জার যে জায়গাটায় দাঁতটা কুড়িয়ে পেয়েছি, সেখানে ওটা রেখে আসা উচিত। দাঁতটার জন্যই যত গণ্ডগোল হচ্ছে। কিন্তু রাতের বেলা একা একা গির্জায় ফিরে যাওয়ার সাহস হলো না।

এদিকে রান্নাঘরের আলো আঁধারির রহস্যময় পরিবেশে আমি একা! কেউ এল না আমাকে উদ্ধার করতে। আসবেই-বা কি করে, সবাই তো জানে আমি আমার পড়ার ঘরে পড়ছি। শরীরের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে আমি উঠে দাঁড়ালাম। রান্নাঘরের পিছনের দরজা খুলে বাইরে এলাম। দেখলাম যেখানে বাসন মাজা হয় সেখানে। দাড়িওয়ালা সেই লোকটা দাঁড়িয়ে। ফোকলা দাঁতে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।

লোকটাকে দেখে আর কোনো দিকে না তাকিয়ে দৌড় দিলাম গির্জার দিকে। গির্জার কাছে এসে হুঁশ হলো। এ আমি কি করলাম? এখন তো পিছিয়েও যাওয়া যাবে না। ভেতরে ঢুকলাম। কবরস্তানের কাছে যেতেই দেখলাম লাল দাড়িওয়ালা লোকটা একটা কবরের পাশে দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখে মাথার টুপিটা খুলে হাতে নিয়ে মাথাটা একটু নোয়ালো। যেন সমাধিভূমিতে আমাকে সাদর অভ্যর্থনা জানাল।

লোকটাকে দেখে এবার আমার স্থির বিশ্বাস জন্মাল, লোকটা জীবিত কেউ না। প্রেত ধরনের কিছু যার আত্মার মুক্তি হয়নি। ওর আত্মার মুক্তির জন্য আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানালাম। আমার প্রার্থনার পরও লোকটা (নাকি প্রেতটা) আমার দিকে তাকিয়ে সেই নিঃশব্দ, বীভৎস হাসিটা হাসতে লাগল।

আবার একটা প্রচণ্ড ভয়ের ঢেউ আমাকে ধাক্কা দিল। কাঁপা কাঁপা হাতে পকেট থেকে দাঁতটা বের করে লোকটার দিকে ছুঁড়ে মেরেই দৌড় দিলাম। অন্ধকারের মধ্যেই হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়ি ফিরে এলাম। সদর দরজায় দমাদম ঘুষি মারতে লাগলাম। শব্দ শুনে বাড়ির সবাই ছুটে এল। পরে ওদের কাছে শুনেছিলাম আমার চেহারা নাকি একেবারে ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল। আমাকে প্রায় চেনাই যাচ্ছিল না।

সেদিনের পর প্রেমূর্তির সঙ্গে আমার আরও অনেকবার দেখা হয়েছে। আমার জীবনটা একেবারে অতিষ্ট করে তুলেছিল প্রেতটা। মাঝে মাঝে মনে হতো নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করি। অপঘাতে মরলে আমিও প্রেত হয়ে যাব। তখন প্রেত হয়েই প্রেতের মোকাবিলা করতে পারব।

প্রেমূর্তিটা যতবারই এসেছে ততবারই সে আমার দিকে তাকিয়ে বীভৎসভাবে হাসত। আর প্রতিবার হাসির সময় ওর দাঁতের ফাঁকটা আরও বিকটভাবে প্রকাশ পেত।

প্রেতটা শেষবার এসেছিল তিন বছর আগে। এখন আমি বড় হয়েছি। চাকরি করছি। এক বিকেলে বাইরে বেড়াতে যাব তাই জুতাটা কালি করার জন্য একটা চাকরকে ডাকলাম। আমার ডাক সম্ভবত সে শুনতে পায়নি। তাই দরজা খুললাম চাকরটিকে ডাকার উদ্দেশে।

দরজা খুলতেই দেখলাম প্রেতটা দাঁড়িয়ে আছে। সেদিন আর ওকে ভয় পেলাম । বরং, খুব বিরক্ত হলাম ওকে দেখে। একটু ভর্ৎসনার সুরেই বললাম, তুমি আবার আমাকে বিরক্ত করতে এসেছ? তুমি কি কিছুতেই ছাড়বে না আমাকে?

কিছুক্ষণ চুপ করে রইল প্রেতটা। তারপর বিরাট হাঁ করে নিঃশব্দে হাসতে লাগল। তখনই দেখতে পেলাম তার উপরের দাঁতগুলোর মধ্যে কোনো ফাঁক নেই। প্রেতটা ফিরে পেয়েছে তার উপরের পাটির হারানো দাঁত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *