সরাইখানার ভূত – গাই প্রেস্টন

সরাইখানার ভূত – গাই প্রেস্টন

গ্রামের ডাক্তারদের জীবন বেশ কষ্টের। কারণ, বিশাল গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় তাদের একটা সেকেলে সাইকেল ছাড়া যানবাহন বলতে আর কিছুই থাকে না। এই সাইকেলটা নিয়েই ডাক্তার গ্রামের এবড়োখেবড়ো পথ, ভাঙা রাস্তা অতিক্রম করে তারা রোগী দেখতে যান সময়ে-অসময়ে।

এক শীতের রাত। সাড়ে চারটার সময় কলিংবেলের আওয়াজে সাটন নামে এক ডাক্তারের ঘুম ভেঙে যায়। অত্যন্ত বিরক্ত হন তিনি। ডাক্তার সাটন অবিবাহিত। বাড়িতে একাই থাকেন। কলিংবেলের আওয়াজ একটানা বেজেই। চলেছে। কিন্তু ডাক্তারের মোটেও ইচ্ছে নেই উঠে গিয়ে দরজা খোলার। ডাক্তার ভাবলেন, দরজা খুলেই হয়তো তাকে শুনতে হবে-উইলির পায়ের আঙুল ব্যথা হয়েছে। তাকে যেতে হবে তাড়াতাড়ি। ওরা ভাবে ডাক্তারদের বুঝি ঘুমানোর কোনো প্রয়োজন নেই। বেলের শব্দ পাত্তা না দিয়ে ডাক্তার আরও জড়োসড়ো হয়ে লেপ মুড়ি দিলেন।

কিন্তু যেভাবে কলিংবেলের আওয়াজ হচ্ছে তাতে ডাক্তারের বুঝতে অসুবিধা হলো না যে আগন্তুক মহা নাছোড়বান্দা। শেষ পর্যন্ত তিনি দরজা খুলতে বাধ্য হলেন।

দরজার বাইরে অন্ধকারে তাকাতেই ঝড়ের বেগে এক লোক প্রবেশ করল। ঘরের ভেতরে। এবং দরজা বন্ধ করে দিয়ে সে জড়িয়ে ধরল ডাক্তারকে। ডাক্তার চেষ্টা করেও হাত ছাড়িয়ে নিতে পারলেন না। আগন্তুক আরও জোরে ডাক্তারকে চেপে ধরল। কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, আপনিই কি ডাক্তার সাটন? আমার একজন ডাক্তার দরকার খুব।

হ্যাঁ, আমি সাটন, বললেন ডাক্তার।

তাহলে বলুন আমি কি পাগল? ঈশ্বরের দোহাই আপনার।

ডাক্তার উত্তর দেবার আগে তাকালেন আগন্তুকের দিকে। আশ্চর্য তার চেহারা, চুলগুলো এলোমেলো। ঘামে ধুলোয় চটচটে পোশাক ছিন্নভিন্ন। রক্ত আর ধুলো কাদায় বীভৎস হয়ে আছে তার চেহারা। চোখেও বুনোদৃষ্টি। আগন্তুকের কণ্ঠে উদ্বেগ আর আকুতির প্রকাশ দেখে ডাক্তার বললেন, খুব ভয় পেয়েছেন দেখছি! এই বলে তাকে একটা চেয়ারে বসতে দিলেন। একটু ব্র্যান্ডি এনে তাকে খেতে দিলেন। আগন্তুক ব্র্যান্ডিটুকু এক ঢেকে গিলে ফেলল। আস্তে আস্তে তার মুখে রক্তের আভাস ফুটে উঠল।

এরপর কিছুক্ষণ নীরবতা বিরাজ করল ঘরে। ডাক্তার ভালো করে তার রোগীকে লক্ষ করলেন। বুঝতে পারলেন তাড়াহুড়ার কিছু নেই, রোগী নিজেই সামলে উঠে তার অবস্থার কথা জানাবে। আগন্তুক বেশ নার্ভাস হয়ে পড়েছে তাতে সন্দেহ নেই। তার স্নায়ুর উপর যে প্রচণ্ড চাপ পড়েছে তা সহ্য করা তার পক্ষে বেশ কঠিন হচ্ছে।

ডাক্তারের ধারণাই সঠিক হলো। কিছুক্ষণ পর মুখ খুলল আগন্তুক

আমার নাম ফ্রাঙ্ক মেথুয়েন। ফটোগ্রাফির প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে আমার ব্যবসা। আমার কোম্পানি মেসার্স বার্ডসে অ্যান্ড ব্ল্যাক দিন পনেরো হলো আমার উপর এই জেলার ভার দিয়েছে। আমি জানি এলাকাটা আদৌ সুবিধার নয়। কিন্তু চাকরি করতে গেলে অত বাছবিচার চলে না। প্রায়ই আমাদের এমন কিছু কাজ করতে হয় যা আমরা মোটেও পছন্দ করি না। আমি লন্ডনের মানুষ। কিন্তু আমাকে যদি ককারমাউথের কাছে হায়ারে বাধ্য হয়ে কাজ করতে হয় তখন আমার মনের অবস্থা নিশ্চয়ই বুঝতে পারবেন।

ডাক্তার মাথা ঝাঁকিয়ে তাকে উৎসাহ দিলেন এবং আরও দুগেলাস ব্র্যান্ডি ঢাললেন। আগন্তুক যদিও তাকে ভোরের অনেক আগে বিছানা থেকে তুলেছে তবু ডাক্তার তার ব্যাপারে বেশ কৌতূহলী হয়ে উঠলেন। তাছাড়া তার ঘুমের ঘোরও অনেকক্ষণ হলো কেটে গেছে। ফায়ার প্লেসের কাঠও এতক্ষণে গনগনে হয়ে ঘরটাকে বেশ আরামদায়ক করে তুলেছে।

আগন্তুক বলে চলেছে–চেষ্টা করছি অন্য কিছু করতে। কিন্তু তেমন কিছুই করতে পারছিলাম না। এই জলা এলাকায় আর কী ব্যবসা হতে পারে। শেষ পর্যন্ত ঠিক করলাম ওয়ার্কিংটন আর হোয়াইট হ্যাঁভেন জেলায় চেষ্টা করে দেখব, তাই গতরাতে বাইকে করে বেরিয়ে পড়লাম। যাতে সময় থাকতে থাকতেই হোয়াইট হ্যাঁভেনের রয়্যাল হোটেলে পৌঁছে গোসল সেরে, একটু ঘুমিয়ে সকালবেলা আবার কাজে বেরোতে পারি। কিন্তু আমার ভাগ্য ছিল বিরূপ।

হঠাৎ নির্জন এলাকায় আমার বাইক অচল হয়ে গেল, আমি তখন একা নির্জন জলা এলাকায়। দেখলাম আমার পেট্রোল ট্যাংকে লিক হয়েছে। এবং বাড়তি পেট্রোলের ট্যাংকেও দেখলাম খুব সামান্য তেল আছে। নিশ্চয়ই কেউ চুরি করেছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমি লিকটা চুইংগাম দিয়ে সাধ্যমতো মেরামত করে নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করলাম। কিন্তু মাত্র সিকি মাইলের মতো এগিয়েছি, এমন সময় আবার তেল চুঁইয়ে পড়তে লাগল। সম্পূর্ণ আটকে পড়লাম আমি। রাত দশটা। চারদিকে পিচের এত অন্ধকার। ধারে কাছের গ্রাম সেখান থেকে অন্তত ছমাইলের মতো। কোথাও জনমানবের সাড়া নেই। তার উপর আবার কুয়াশা ক্রমেই ঘন হয়ে উঠছে। আমি মোটেও ভীতু নই। তবুও কেন জানি অমঙ্গলের আশঙ্কায় মন ভরে উঠল। সেই অমঙ্গল যেন আমার দুরবস্থা দেখে খুশিতে বাকবাকুম। তার নিশ্বাস আমি অনুভব করছি। তার দাঁড়াগুলো যেন আমাকে ঝোঁপের ভেতরের গর্তটার দিকে এগোতে বলছে। আমি বাধা দিতে চেষ্টা করছি। কিন্তু পারছি না। তার বিরুদ্ধে আমি যেন অসহায়।

গর্তটার কাছাকাছি গিয়ে স্বস্তির সঙ্গে অনুভব করলাম অমঙ্গলের প্রভাব আমার উপর থেকে সরে যাচ্ছে। হঠাৎ দেখলাম আমার ঠিক সামনেই একটা সরাইখানা। এতক্ষণ আমি যেটার প্রত্যাশায় ছিলাম। এ যেন নির্বান্ধব দেশে এক পরম বন্ধুর আবির্ভাব। অবশ্য সরাইখানাটা সম্পূর্ণ অন্ধকারে ঢাকা। কিন্তু যেমন করে হোক নিশ্চয় মালিককে জাগাতে পারব। ভালো খাবারের আশায় উৎফুল্ল হয়ে উঠলাম, অমঙ্গলের আশঙ্কা ইতিমধ্যে দূর হয়ে গেছে। সরাইখানাটা একটা ঝোঁপের আড়ালে থাকায় এতক্ষণ চোখে পড়েনি।

সরাইখানাটা বেশ বড়ই বলা চলে। তবে একটু সেকেলে ধরনের। একটা রঙ করা সাইন চোখে পড়ল। অন্ধকারে লেখাটা পড়া সম্ভব হলো না। আমার কাছে যদিও কোনো কিছু অস্বাভাবিক ঠেকল না। তবু দেখলাম, কুয়াশায় পুরো এলাকাটা ঢাকা থাকলেও সরাইয়ের বাগানে কিন্তু মোটেই কুয়াশা নেই।

বাইক যেখানে আছে সেখানে রেখেই দরজায় গিয়ে নক করলাম। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ পেলাম না। দরজায় আবার নক করে আশপাশে একটু ভালো করে তাকালাম। দেখলাম সরাইয়ের দেয়ালে রোদে জলে অস্পষ্ট হয়ে যাওয়া একটা ছবি। ছবিতে একটা কফিন আঁকা। চারটে মুণ্ডুহীন মানুষ কফিনটা বহন করছে। তার নিচে লেখা-পথের শেষ প্রান্ত।

বুঝলাম সরাইয়ের মালিকের মধ্যে বেশ রসবোধ আছে। ছবিটা নিয়ে চিন্তা করছিলাম, এমন সময় সরাইয়ের ভেতর হঠাৎ একটা শব্দ পেলাম। আর ডান দিকের জানালায় ক্ষীণ আলোর আভাস চোখে পড়ল আমার। কিছুক্ষণ পর আর সেই আলো দেখা গেল না। বুঝলাম আমার নক করাটাকে ওরা মনের ভুল ভেবে ফিরে যাচ্ছে। ভাবছি এবার প্রচণ্ড জোরে দরজায় ঘা দেব। এমন সময় একটা অস্ফুট শব্দ আমার কানে এল। কে যেন চটি পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে আসছে। খিল খোলার শব্দ হতেই ধীরে ধীরে দরজাটা খুলে গেল।

যাকে সামনে দেখলাম সে মানুষটি ছোটখাটো। মুখ গোলাকার। তাতে দাড়ি গোঁফ বা ভ্রুর বালাই নেই। মাথায় পুরোনো আমলের টুপি। গায়ে একটা লম্বা কালো পোশাক। তবে সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার, লোকটার চোখ বলতে কিছু নেই। দুহাত বাড়িয়ে হাতড়াতে হাতড়াতে এগিয়ে আসছে।

এ পর্যন্ত বলে শিউরে উঠল মেথুয়েন। ডাক্তার খানিকটা এগিয়ে বসলেন। বললেন, তারপর? বলে যান।

তার পাশে এক মহিলা একটা মোমবাতি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। দুজনের মধ্যে বেশ পার্থক্য লক্ষ করলাম। মহিলাটি মাঝারি গড়নের। অপূর্ব সুন্দরী। কালো ভ্রু। বড় বড় দুচোখে এক আশ্চর্য জ্যোতি। আমাকে সে লক্ষ করছিল।

আমার অসুবিধার কথা জানিয়ে আশ্রয় চাইলাম। আমার গলার স্বর শুনে চক্ষুহীন, লোকটি হাত বাড়িয়ে আমার মুখ স্পর্শ করতে লাগল। ভাবলাম এ লোকই হয়তো সরাইখানার মালিক।

আমার মুখে হাত দেওয়াতে বেশ বিরক্তি লাগল। মহিলাটি বুঝতে পেরে তাকে বলল ওকে আসতে দাও, একে দিয়ে বেশ চলবে। একথা শুনে সরাইয়ের মালিক সরে দাঁড়িয়ে আমাকে হাতের ইশারায় ভেতরে ঢুকতে বলল।

আবার থামল মেথুয়েন। বিশ্বাস করুন, যদি আমি তখন কাছাকাছি অন্য কোনো আশ্রয় পেতাম, এমনকি কোনো মুরগির ঘর বা গোলাবাড়িও থাকত সেখানেই রাত কাটাতাম। এক মুহূর্তও ওই সরাইখানায় থাকতাম না। ডাক্তার সাটন মাথা নেড়ে সায় দিলেন মেথুয়েনের কথায়। মেথুয়েন আবার শুরু করল–কিন্তু আমি তখন নিরূপায়। ওরা যে আমাকে আশ্রয় দিতে রাজি হয়েছে

এই ভেবে নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হলো। মালিক আমার মধ্যে যতই আতংকের সৃষ্টি করুক। জলা এলাকার বাইরে রাত কাটানোর চেয়ে তা অনেক ভালো।

মহিলাটি আমাকে কোনো কথা না বলে দোতলায় একটা শোবার ঘরে নিয়ে গেল। কিছু খাবার আর গোসল করতে চাইলে সে নেতিবাচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। ভাবলাম, সে ক্লান্ত। তাই এ নিয়ে কিছু বললাম না। এবং এভাবে রাতের বেলায় তার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটানোর জন্য দুঃখ প্রকাশ করলাম। তারপর তাকে শুভরাত্রি জানালাম। তাতে সে রহস্যপূর্ণ হাসি হেসে বেরিয়ে গিয়ে বাইরে থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিল। আমি ঘরে একা রয়ে গেলাম।

ভালো করে লক্ষ করলাম ঘরটা। বিশেষ কোনো ফার্নিচারের বালাই নেই। ঘরের এক কোণে একটা বেসিন, তোয়ালে, আর দেয়াল বরাবর গোটা দুয়েক চেয়ার। আর একটা দেয়ালে খুব বড় একটা ওক কাঠের সিন্দুক। ঘরের একদিকে একটা খাট, আর অন্য দিকটায়। একটা ছোট দরজা ছাড়া আর কিছু নেই। দরজাটা খোলার চেষ্টা করলাম। ব্যর্থ হলাম। চাবির গর্ত দিয়ে তাকিয়ে অন্ধকারে ওপাশে কিছুই দেখতে পেলাম না। যা হোক, আমি ক্লান্ত, এবার ঘুমোব। পোশাক। ছাড়তে শুরু করলাম। একটা প্রকাণ্ড ব্রোঞ্জের বাতি ছাড়া ঘরে আর কোনো আলো নেই। বাতিটা জানালার কাছে একটা টেবিলের ওপরে। এত ভারী যে ওটাকে টেবিলে রাখতে মনে হয় তিনজন লোকের দরকার হয়েছিল। সেটার আলোও অস্পষ্ট। পোশাক ছাড়তে ছাড়তে মনে হলো সুন্দরী মহিলা চক্ষুহীন দৈত্যটার স্ত্রী নয়তো? তাই যদি হয় তাহলে তার জীবন নিশ্চয় অনেক কষ্টের। এমন এক লোকের সঙ্গে এমন নির্জন জায়গায় বাস করার এত শান্তি তাকে কি অপরাধে ভোগ করতে হচ্ছে কে জানে। যখন শুতে যাব, তখন আবার গোসলের ইচ্ছে প্রবল হয়ে উঠল।

আবার একবার দেয়ালের ছোট দরজাটার কাছে এগিয়ে গেলাম। দরজায় তালা দেওয়া। আমার কাছে সব সময়ই কিছু পুরোনো চাবি থাকে, যদি কখনো কাজে লাগে। এক্ষেত্রে কাজও হলো, খোলা গেল দরজাটা। আহ কি স্বস্তি গোসল করতে পারব। বাতির খোঁজ করলাম, কারণ অত বড় বাতিটা নিয়ে আসা অসম্ভব। কিন্তু পেলাম না। অগত্যা অন্ধকারেই গোসল করার সিদ্ধান্ত নিলাম।

কল ছেড়ে দিলাম। শোবার ঘর থেকে যা সামান্য আলো আসছে তাতে দেখলাম, পানিতে আয়রন বেশি থাকার জন্যই বেশ কালো দেখাচ্ছে। অথবা অব্যবহারের ফলেই মরচে পড়ে পানির এই রঙ। টবটা লোহার, অত্যন্ত পুরোনো আমলের।

আমি টবে নামলাম। সঙ্গে সঙ্গে আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। হায় ঈশ্বর। একি? টবটার চারপাশ আর তলাটা রক্তে পিচ্ছিল। তাড়াতাড়ি লাফিয়ে উঠে এলাম। তারপর বোধহয় মুহূর্তের জন্য আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।

জ্ঞান ফিরলে লক্ষ করলাম আমি টবটার পাশে শুয়ে আছি। জমে থাকা রক্তে আমার পা আর গোড়ালি লাল হয়ে গেছে।

আমার নিশ্চিত ধারণা হলো এ রক্ত মানুষের। গুছিয়ে চিন্তা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেললাম। যখন বিছানার ফিরে যাবার শক্তি পেলাম, প্রথমেই রক্ত মুছে ফেললাম। রক্ত মোছার পর একটু সুস্থ বোধ করলাম। পুরো ব্যাপারটা শান্তভাবে ভাবতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছুতেই এ সম্ভব বলে মনে হলো না। তবে রক্তের যে চিহ্ন তোয়ালেতে রয়েছে তাতে একে স্বপ্ন বলেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এ সত্য এবং অত্যন্ত ভয়ংকর।

কতক্ষণ বসে থেকে মন সংহত করার চেষ্টা করেছিলাম জানি না, হতে পারে। পাঁচ মিনিট, তবে মনে হলো অনন্তকাল। শেষ পর্যন্ত জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে আমি পোশাক পরতে শুরু করলাম। পাশের ঘরেই সেই মূর্তিমান আতঙ্ক। একথা জানার পর আর ঘুমানো সম্ভব নয় এবং ওই বাথরুমেই যে দেহটা কোথাও লুকানো আছে তাতে সন্দেহ নেই। নিশ্চয়ই তার শরীরের সমস্ত রক্ত নিমিষে নিংড়ে নেওয়া হয়েছে। যেন প্রকাণ্ড কোনো জোক তার সব রক্ত শুষে নিয়ে ওই টবে রেখেছে।

হ্যাঁ, জোঁক, জোকই বটে-অন্ধ সরাইয়ের মালিককে জোঁকের সঙ্গে তুলনা করা যায়। কে ওর পরবর্তী শিকার হতে চলেছে? শিউরে উঠল শরীর। দৌড়ে জানালার কাছে গেলাম। না ওই পথে পালানো অসম্ভব। কারণ এতক্ষণ যা আমার দৃষ্টি এড়িয়েছিল তা চোখে পড়ল। জানালার উপর থেকে নিচ পর্যন্ত রয়েছে অত্যন্ত মজবুত ছটা লোহার শিক। দৌড়ে গেলাম দরজার কাছে। সেটাও তালা দেওয়া। অর্থাৎ, আমি বন্দী।

কী করব ভেবে না পেয়ে দাঁড়িয়ে আছি, এমন সময় আবার সিঁড়ি দিয়ে ভেসে এল চটির আওয়াজ। আওয়াজটা ক্রমেই এগিয়ে আসছে। থামল দরজার সামনে।

বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছি। প্রায় নিঃশব্দে দরজায় চাবি পড়ল, একটু একটু করে দরজাটা খুলে গেল। মহা আতঙ্কে সব শক্তি হারিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। বুক ধড়ফড় করছে, শিরা দপদপ করছে। কী ভয়ংকর সেই স্তব্ধতা।

হঠাৎ আমি বাকশক্তি ফিরে পেলাম, চিৎকার করে উঠলাম–যাও, চলে যাও বলছি। তারপর দরজাটার উপর ছিটকে পড়ে সেটা বন্ধ করে দিলাম। সেই আতঙ্কের মধ্যেও শুনতে পেলাম পায়ের আওয়াজ ক্রমেই পিছিয়ে যাচ্ছে। তারপর আবার নিস্তব্ধতা। ভয় পাবার জন্য ধিক্কার দিলাম নিজেকে। কেন যে সেই অন্ধ, মূর্তিমান আতঙ্কের মাথায় ঘিলু উড়িয়ে দেইনি। তাহলেই তো পালাতে পারতাম। আসলে ওকে দেখেই আমার সারা শরীর অবশ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর আমি সাহস সঞ্চয় করে খুললাম দরজাটা। মনে ভয় জাগানোর এত গাঢ় অন্ধকার। ভিতর থেকে দরজাটা বন্ধ করে দেব তাও অসম্ভব। কারণ চাবিটাই নেই।

দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে গেলাম ঘরের অন্য প্রান্তে, চেষ্টা করলাম প্রকাণ্ড সিন্দুকটাকে সরাতে। বেশ পরিশ্রমের পর কোনো রকমে তা করা গেল। সেটাকে দরজার সঙ্গে আটকে দিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। এখন আর কিছু করার নেই। শুধু ভোরের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া। আমি আলো না নিভিয়েই শুয়ে পড়লাম।

মনে মনে ঠিক করলাম পরিস্থিতি অনুযায়ী কাজ করব। অলসভাবে চিত হয়ে শুয়ে আছি, হঠাৎ দেখি, ঠিক আমার মুখের সামনে একটা বিরাট মাকড়সা একটা সুতোয় ভর করে ঝুলছে। মাকড়সাই একমাত্র আমার মনে বিতৃষ্ণার সৃষ্টি করে। সেই মাকড়সাটা সুতো ধরে ঝুলছে না। ভালো করে লক্ষ করলাম, একটা খুব সরু ধাতব পদার্থ বেয়ে নেমে আসছে ওটা।

এক দৃষ্টিতে মাকড়সাটার দিকে তাকিয়ে আছি। চেষ্টা করছি জেগে থাকতে। কিন্তু ক্লান্ত শরীর আর তা মানল না। ঘুমিয়ে পড়লাম এক সময়।

হঠাৎ অস্বস্তি নিয়ে ঘুম ভেঙে গেল। সরসর করে কী যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে গায়ের ওপর। চাপা আর্তনাদের সঙ্গে পলকের মধ্যে বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নেমে এলাম। আর সেই মুহূর্তেই সেই সুচালো অত্যন্ত ভারী ধাতব বস্তুটা যেটা থেকে মাকড়সাটা ঝুলছিল সেটা ভয়ংকর বেগে পড়ল ঠিক যেখানে আমি শুয়ে ছিলাম সে জায়গায়। আমার গায়ে সেই মাকড়সাটা ঘুরে বেড়াচ্ছিল। বলতে কি, মাকড়সাটার জন্যই আমি প্রাণে বেঁচে গেলাম।

বেশ অকৃতজ্ঞতার পরিচয় দিয়ে আমি মাকড়সাটাকে শরীর থেকে ঝেড়ে ফেললাম। এতক্ষণে বুঝতে পারলাম ব্যাপারটা কি হয়েছিল। ধাতব সুচালো বস্তুটা হচ্ছে একটা বর্শার এত বস্তুর একাংশ, ছাদের একটা গর্তের ওপর তার বাকি অংশটা অদৃশ্য। মানুষ খুনের জন্য শয়তানি বুদ্ধির পরাকাষ্ঠা।

ভাগ্যের জোরেই বেঁচে গেলাম সে যাত্রা। ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ভাবছি কি করা যায়। এমন সময় মনে হলো যেন দরজার বাইরে থেকে আঁচড়ানোর আওয়াজ আসছে। না, এ আমার উত্তেজিত স্নায়ুর ভুল শোনা। তবু কান পেতে দাঁড়িয়ে থাকলাম। তারপর বিছানার পাশের দেয়ালের ওপার থেকে যে মৃদু আঁচড়ের আওয়াজ আমার কানে এল সেটা যে বাস্তব তাতে সন্দেহ রইল না।

ফিরলাম সেদিকে। দেয়ালটার একটা ফাটল একটু একটু করে স্পষ্ট হলো। তারপর সেই ফাটল দিয়ে অস্পষ্ট আলো দেখা গেল।

তাড়াতাড়ি নিভিয়ে দিলাম বাতিটা। ঠিক করলাম এবার আর আমল দেব না ভয়। মরিয়ার সাহস নিয়ে আমি বাথরুমে গিয়ে দরজাটা ফাঁক করে দেখতে। লাগলাম, নিজেকে যথাসম্ভব আড়াল রেখে। দেখলাম সেই ফাঁক ক্রমেই বড় হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত সরাইয়ের মালিক ঢুকে পড়ল সেখান দিয়ে। মুহূর্তের জন্য থেমে দাঁড়াল। তারপর হাতড়াতে হাতড়াতে, নিশব্দে, আন্দাজ করে করে আমার বিছানার দিকে এগোল, এবং হাতড়াতে হাতড়াতে ধাতব বস্তুটি অনুভব করে পরম তৃপ্তির সঙ্গে দেহটা খুঁজতে ব্যস্ত হলো। ভদ্রমহিলাও তার পিছু পিছু এগোচ্ছিল। সরাইয়ের মালিককে হতাশাব্যঞ্জক আওয়াজ করতে দেখেই সে সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপারটা আঁচ করে ফেলল। বলে উঠল বাথরুমটা, বাথরুমটা, তাড়াতাড়ি। তারপর কিছুটা টেনে, কিছুটা ঠেলে চক্ষুহীন দানব দ্রুত আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। পলকের মধ্যে আমি সেখান থেকে পালাবার পথ খুঁজতে লাগলাম। টবের উপরের চৌবাচ্চাটার ওখান দিয়ে একটু তারার আলো চোখে পড়ল। বিদ্যুতের বেগে আমি উঠে পড়লাম সেখানে। ওখানে শুয়ে হাঁপাতে লাগলাম। একটা বিকট দুর্গন্ধ নাকে আসছে। তবুও আমি নড়াচড়া করতে সাহস পেলাম না। একটু পরেই বাথরুমের দরজাটা খুলে গেল। আততায়ীরা প্রবেশ করল। আমাকে দেখতে পাবে নাকি ওরা? মনে মনে ঈশ্বরের সাহায্য প্রার্থনা করলাম। কী যেন বলে মহিলাটি ঝুঁকে পড়ল। তারপর টবের ভেতর থেকে আন্দাজে একটা কুড়াল তুলে নিয়ে বীভৎস হাসি হেসে উঠল। যেন কোনো বন্যজন্তু মাংসের গন্ধ পেয়েছে।

চেঁচিয়ে আমাকে বলল, নেমে আসুন বলছি, আমার ভাড়া মিটিয়ে যান। তবু আমি চুপচাপ রয়ে গেলাম দেখে মোমবাতিটা অন্ধের হাতে দিয়ে বেয়ে উঠতে শুরু করল।

এক মুহূর্ত দেরি না করে কনুই দিয়ে কাঁচ ভেঙে ফেললাম। বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। এমন সময় মহিলাটিও উঠে এল। হিংস্র বাঘিনীর মতো এগিয়ে আসছে সে।

ঠিক তখনই আমি পা পিছলে পড়ে গেলাম। হাতে আর পায়ে নরম পদার্থের ছোঁয়া পেলাম। তাকালাম নিচে। আতংকের উপর আতংক। একরাশ গলিত মৃতদেহের উপর আমি পড়ে গেছি। নারী আর পুরুষের অসংখ্য লাশ সেখানে। কোনোটা কাটা গলার, কোনোটা আবার তখনো সেই অবস্থায় পৌঁছায়নি। বুঝলাম এরা সবাই সরাইখানার আতিথ্য গ্রহণ করেছিল।

কোনোরকম সেখান থেকে উঠে ছাদের ঢালু টালির উপরে নামলাম। ফিরে দেখি, মহিলাটিও অত্যন্ত ক্রুদ্ধভাবে সেই স্কাইলাইট দিয়ে বেরিয়ে আসছে। এ । জায়গায় একটা গাছের ডাল চোখে পড়ল। যা ধরে নিষ্কৃতি মিলতে পারে। ডালটা প্রায় ধরেছি এমন সময় আমার পা পিছলে গেল। আরেকটু হলেই সর্বনাশ হতো। আমি প্রাণপণে ডালটা চেপে ধরে ঝুলতে থাকি। এখন যদি পড়ে যাই হাত পা ভাঙবে, ধরাও পড়ব। ধরা পড়া মানেই মৃত্যু।

একটু পরেই লক্ষ করলাম মহিলাটি উল্লসিত চিৎকার করে উঠল। মহা আতঙ্কের সঙ্গে লক্ষ করলাম সে কুড়ালটা দোলাচ্ছে। পরমুহূর্তেই ডান হাতে একটা ভয়ংকর আঘাত অনুভব করলাম। বুঝতে পারলাম আমি নিচে পড়ে যাচ্ছি। যাই হোক, এই অবস্থাতেও কোনো মতে উঠে দৌড়ে পালাতে লাগলাম।

রাতের আঁধারে কতক্ষণ দৌড়েছি জানি না। শেষ পর্যন্ত যখন পেছন ফিরে দেখলাম কেউ তেড়ে আসছে কিনা, দেখলাম যেখানে সরাইটা ছিল পুরো জায়গাটা জুড়ে ওখানে জ্বলছে আগুন। সেই আগুনে অন্ধকার আকাশ আলোকিত।

মেথুয়েনের কাহিনি শেষ হলো। তার কপালে ঘামের বড় বড় বিন্দু ফুটে উঠেছে। যেন কাহিনির বর্ণনা করতে যে সে আবার ঘটনাস্থলে চলে গেছে।

ডাক্তার বললেন, অত্যন্ত ভয়ংকর কাহিনি। শেষ পর্যন্ত সরাইখানায় আগুন লেগে গেল। কিন্তু কিভাবে?

আমার ধারণা মহিলা যখন অন্ধ লোকটাকে মোমবাতি ধরতে দিয়েছিল তখন সেই আগুন কোনো দাহ্য পদার্থে লেগে যায়। তারপর সেই আগুন সবখানে ছড়িয়ে পড়ে, বলল মেথুয়েন।

আপনি দিব্যি সব বুঝিয়ে দিতে পারেন দেখছি। ঠাট্টার সুরে বললেন ডাক্তার।

মেথুয়েন উঠে চেয়ারটার পেছনে গেল। তার মুখ অত্যন্ত ফ্যাকাশে। ডাক্তারের দিকে ফেরার আগে সে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য চেয়ারের হাতলটা বাঁ হাতে চেপে ধরল। তারপর বলল, তাহলে আপনি ভাবছেন আমি পাগল? তাই যদি হয়, তাহলে এটার কী ব্যাখ্যা দেবেন? এই বলে সে চট করে পকেট থেকে কাটা ডান হাতটা বের করল। সে হাতের চারটে আঙুল নেই। শরীরের সাথে। হাতের কাটা বাকি অংশে ব্যান্ডেজ করা। চটচটে রক্তে মাখা সেই ব্যান্ডেজ। মেথুয়েন ভারসাম্য না রাখতে পেরে পড়ে যাচ্ছিল, ডাক্তার সাটন ধরে ফেললেন তাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *