১৮. দায়মুক্তি ও দায়বদ্ধতা : বঙ্গবন্ধু ও আবুল ফজল

১৮. পরিশিষ্ট
দায়মুক্তি ও দায়বদ্ধতা : বঙ্গবন্ধু ও আবুল ফজল
আবুল মোমেন

পঁচাত্তরের আগস্টের মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞ বিবেকবান যেকোন মানুষকেই ভীষণভাবে আলোড়িত করেছিল। আমার বাবা অধ্যাপক আবুল ফজলকে তো বটেই। বঙ্গবন্ধু ওঁকে শ্রদ্ধা করতেন আন্তরিকভাবে। যোগাযোগের সূত্রপাৎ পাকিস্তান আমল থেকেই, বিশেভাবে ছয়দফাভিত্তিক স্বায়ত্বশাসনের আন্দোলনের সময় থেকে। এই হত্যাকাণ্ডে বাবার মনোকষ্টের আরও একটি কারণ ছিল বলে মনে হয়। পঁচাত্তরের শেষ নাগাদ বিচারপতি সায়েমের অনুরোধে, তার কয়েকজন মান্যগণ্য প্রবীণ উপদেষ্টার পীড়াপীড়িতে তিনি সরকারে যোগ দিয়েছিলেন শিক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে। বিচারপতি সায়েম এবং জেনারেল জিয়ার কাছ থেকে কথা নিয়ে দুটি শর্তে তিনি তাদের অনুরোধ রক্ষা করেছিলেন। শর্ত দুটি ছিল–সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জেলহত্যার বিচার এবং বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার নিরাপদে দেশে প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা। তাছাড়া সায়েম ও জিয়া উভয়েরই প্রতিশ্রুতি তো ছিলই দ্রুত গণতন্ত্রে ফিরে আসার। মনে মনে তার আরেকটা প্রত্যয় হয়ত ছিল যে তিনি সরকারে থাকলে সম্ভাব্য নির্যাতন-অন্যায় থেকে অনেককে বাঁচাতে পারবেন। সে কাজটা তিনি অনেকের ক্ষেত্রেই করেছেন। এঁদের মধ্যে মুক্তধারা প্রকাশনী সংস্থার স্বত্বাধিকারী চিত্তরঞ্জন সাহা কৃতজ্ঞতার সাথে বাবার সহায়তার কথা সবসময় বলতেন। তবুও আজীবনের গণতন্ত্রের পূজারী আর সমাজতন্ত্রে আস্থাশীল মানুষটি কেবল দু’জন ভিন্ন ধাতের টেকনোক্র্যাট মানুষের প্রতিশ্রুতির ওপর ভরসা করে থাকতে পারেন না। অস্বস্তি নিয়েই তিনি কাজ করছিলেন। আর যখন জেলহত্যা তদন্তে গঠিত বিচারবিভাগীয় কমিটিকে নিষ্ক্রিয় করে রাখতে দেখলেন এবং জেনারেল জিয়া ক্ষমতা আঁকড়ে ধরার দুরভিসন্ধি নিয়ে এগুচ্ছেন বলে সন্দেহ হচ্ছিল তখন তিনি তাঁর অবস্থান পরিষ্কার করার দিকে মনোযোগ দেন। সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়ার গুঞ্জন শুনে উপদেষ্টা বিনীতা রায়কে নিয়ে তাদের আপত্তির কথা জানান।

এ সময়ে উপদেষ্টা পদে থেকেই তিনি পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের পটভূমিতে ছোটগল্প লেখেন–মৃতের আত্মহত্যা। গল্পটি দেশের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য পত্রিকা সমকালে প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে পাঠকদের নজর কাড়ে। বেশ হইচই পড়ে যায়, কপি করে বিলি হয়ে হাতে হাতে ফিরতে থাকে।

গল্পটি তঙ্কালীন সরকারের নেপথ্যনায়ক জেনারেল জিয়ার প্রতি একজন উপদেষ্টার প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জও বটে। জিয়া তখন ধূর্ততার সঙ্গে খেলছিলেন, ফলে বিচারপতি সায়েম ও বয়োজ্যেষ্ঠ উপদেষ্টাদের আড়াল তাঁর প্রয়োজন ছিল। তাই এ নিয়ে তাকে ঘাটালেন না। কিন্তু বাবা যখন স্পষ্ট বুঝে গেলেন জিয়া কোন প্রতিশ্রুতিই রাখবেন না তখন সংঘাতের পথটা আরও অনিবার্য করে তুললেন পরপর একই বিষয়ে আরও দুটি গল্প প্রকাশ করে। তার আগে থেকেই বাবা সবসময় পকেটে পদত্যাগপত্র রাখতেন। এবং সায়েম ও জিয়াকে জানিয়েও রাখলেন তিনি আর সরকারে থাকতে চান না।

সাতাত্তরের জুনে, প্রায় কুড়ি মাস দায়িত্ব পালনের পর, উপদেষ্টার পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে ফিরে এলেন চট্টগ্রামে। ওঁকে তো অনেক চাপাচাপি করে উপদেষ্টা পদে যোগ দিতে রাজি করানো হয়েছিল। তাকে ধারণা দেওয়া হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িকভাবে তিনি এ পদে যোগ দেবেন ও স্বল্পসময় দায়িত্ব পালনের পর ফিরে যাবেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। উনি অবশ্য পুনরায় উপাচার্য পদে ফেরার কথা ভাবেন নি, ভেবেছিলেন নজরুল অধ্যাপক বা এরকম কোন পদে যোগ দেওয়ার সুযোগ হবে। তবে জিয়া এবং তাঁর শূন্যস্থান পূরণে অশালীনভাবে ব্যতিব্যস্ত সৈয়দ আলী আহসানের মনে ছিল অন্য চিন্তা। বাবার আর কোন দায়িত্বে ফেরা হয় নি।

.

২.

ষাটের দশক থেকে বাবা তাঁর ছাত্রজীবনের অর্জিত মুক্তবুদ্ধির চেতনাকে শাণিত করে নানা বিষয়ে যুক্তিপূর্ণ প্রবন্ধ লিখতে থাকেন। কথাসাহিত্যিক থেকে মননশীল প্রাবন্ধিক আবুল ফজলের উত্তরণ ঘটে এসময়। তখন আইউবের সামরিক ও ছদ্মসামরিক শাসনের বর্ম ভেদ করে বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটছিল। এতে সমকালীন বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইস্যুতে আবুল ফজলের লেখনির ভূমিকা অস্বীকার করা যাবে না। তখন রাজনৈতিক অঙ্গনে বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রাম তীব্র রূপ নিচ্ছিল মূলত বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে। ছয়দফা, স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলনের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা প্রাবন্ধিক আবুল ফজলের মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন তাদের চিন্তাবিদকে। বঙ্গবন্ধু এ সময়েই তাঁর লেখার প্রতি আকৃষ্ট হন এবং দুটি লেখা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে পুনর্মুদ্রণের জন্যে দুদফা চিঠিও লেখেন। ছোট্ট এ দুটি চিঠিতে বাবার প্রতি শেখ মুজিবের শ্রদ্ধাপূর্ণ সৌহার্দের প্রকাশ ঘটেছে। দুটি চিঠিই তিনি লিখেছেন তার ব্যক্তিগত প্যাডে। মূল বইতে পাঠক এ চিঠি দুটি পড়তে পাবেন।

শেখ সাহেব এবং বাবারও আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও সেই উত্তাল সময়ে চট্টগ্রামে একে অপরের আস্তানায় ঢু মেরেও ঘটনাচক্রে তারা দেখা করতে পারেন নি। অল্পের জন্যে অপরজনের সাক্ষাৎ লাভে তাঁদের উভয়ের চেষ্টা বিফলে গিয়েছিল। স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধুর একান্ত আগ্রহে তার গণভবনের দপ্তরে তাদের সাক্ষাৎ পরিচয় ও আলাপের সূচনা হয়েছিল। তারিখ ২০ মার্চ ১৯৭২।

প্রথম দেখা ও আলাপের টুকরো স্মৃতির সূত্রে বাবার কলমে বঙ্গবন্ধুর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও ফুটে উঠেছে। ‘আমি বারান্দার মাঝপথে থাকতেই তিনি তার কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে আমাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে হাত ধরে ভেতরে নিয়ে বসালেন। তিনি নিজেও বসলেন পাশে। হুকুম করলেন চায়ের। মুহূর্তে এক অসাধারণ উষ্ণ হৃদয়ের যেন পরশ পেলাম।’

বঙ্গবন্ধু বাবাকে প্রস্তাব দিলেন গণভবনে এসে থাকতে ও বসে বসে লিখতে। শুনে বাবা হাসলেন বটে কিন্তু ভিতরে ভিতরে ‘মুগ্ধও হলাম তার আন্তরিকতায়—গুণগ্রাহিতায়’।

প্রথম সাক্ষাতের মূল্যায়নে কোন পূর্বধারণার ছাপ থাকে না, স্বতঃস্ফূর্ত ও সতেজ মনের অনুভূতিই তাতে মেলে। বাবা লিখছেন ‘ফিরে এলাম এক অসাধারণ মানবিক উষ্ণতার স্পর্শ নিয়ে, এ উষ্ণতা অত্যন্ত আন্তরিক ও অকৃত্রিম এবং স্বতঃস্ফূর্ত’।

তারপর শেখ মুজিবকে ‘দেশের এ যুগের এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব’ আখ্যায়িত করে তিনি লিখছেন, ‘শালপ্রাংশু দেহ শেখ মুজিবের মুখের দিকে চেয়ে থাকা যায় অনেকক্ষণ ধরে। ঐ মুখে কোন রুক্ষতা কি কর্কশতার চিহ্ন ছিল না। তাঁর হাসি ছিল অপূর্ব, অননুকরণীয়। এমন হাসি অন্য কারও মুখে দেখেছি বলে মনে পড়ে না।’

আর ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাত্রে খবর তার কাছে এসেছে। বিনামেঘে বজ্রাঘাতের মত। অবর্ণনীয় সেই ক্ষতি তাঁকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছে। বাংলাদেশের স্রষ্টা স্বয়ং শেখ মুজিব, এমন অকল্পনীয় হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে পারেন তা ছিল তার কাছে অবিশ্বাস্য। লিখছেন–শেখ মুজিব না থাকাটা যে বাংলাদেশের জন্য কত বড় শূন্যতা তা ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। তিনি ছিলেন সারা দেশের সামনে ঐক্যের প্রতীক ও ঐক্য রক্ষাকারী মহাশক্তি। সে প্রতীক, সে শক্তি আততায়ীর গুলিতে আজ ধূলায় লুণ্ঠিত। এ নির্মম ঘটনায় যন্ত্রণাবিদ্ধ আমরা সবাই। যে যন্ত্রণা ভাষার অতীত।

একটু পরে আফশোসের সাথে লেখেন, ‘আমাদের সামনে আজ এমন কোন মহৎ কবি নেই, যে কবি বাংলাদেশের অন্তরের এ নীরব কান্নাকে ভাষায় কিংবা ছন্দে রূপ দিতে পারেন।’

বঙ্গবন্ধু তাঁর সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে অনেককেই নেতা মেনেছেন, কেউ কেউ ছিলেন তাঁর রাজনৈতিক গুরু। তবে মধ্য ষাট থেকে, বিশেষত ছয়দফাভিত্তিক স্বায়ত্বশাসনের দাবিতে পূর্ব বাংলা যখন বাঙালি জাতীয়তাবাদের জোয়ারে জেগে উঠেছিল তখন জায়মান অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের চিন্তানায়কদের সাথে বঙ্গবন্ধুর যোগাযোগ ঘটছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, ড. মোজাফফর আহমদ চৌধুরীসহ অনেকের সাথে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ যোগাযোগ বাংলাদেশের গঠন-পর্বের রাজনীতিতে কার্যকর ভূমিকা রেখেছিল। এ সময় প্রবীণ আবুল ফজল মুক্তবুদ্ধির সাহসী চিন্তাবিদ হিসেবে এ বাংলায় সর্বজনশ্রদ্ধেয় মনীষীর স্থান পেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক চেতনার অগ্রণী একজন চিন্তাবিদ লেখক হিসেবেই আবুল ফজলকে গভীর শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছিলেন, যা তাঁর ব্যক্তিগত চিঠিদ্বয়ে প্রকাশ পেয়েছে, বাবাকে প্রায় সত্তর বছর বয়সে উপাচার্য হিসেবে অস্থির চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হাল ধরার দায়িত্ব দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন এবং উপাচার্যের প্রতি আচার্যের ভূমিকা ও আচরণে বরাবর শ্রদ্ধাপূর্ণ ঔদার্য দেখিয়ে প্রকাশ করে গেছেন।

.

৩.

বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারবর্গের নৃশংস হত্যাকাণ্ড বাবা কিছুতেই ভুলতে পারছিলেন না, ‘মনের ওপর পাপের এক গুরুভার’ নামাতে পারছিলেন না।

নির্মম হত্যাযজ্ঞের সপ্তাহখানেক পরে ২৩-৮-৭৫ তারিখ ডায়েরিতে তিনি লেখেন, এক সপ্তাহ পার হয়ে গেল। তবুও পারছি না বিবেককে এতটুকু হালকা করে তুলতে। এক দুর্বহ বোঝার ভারে বিবেক আমার স্তব্ধ ও বোবা হয়ে আছে এ কদিন। এ এক অকল্পনীয় পাপের বোঝা আমার, আপনার, সারা বাংলাদেশের।

তিনদিন পরে ২৬-৮-৭৫ তারিখে লিখছেন- ‘বাংলাদেশের মানুষকে বাঙালি বলে পরিচয় দেওয়ার হিম্মৎ কে জুগিয়েছে? শেখ মুজিব ছাড়া এর কি দ্বিতীয় কোন জবাব আছে? শেখ মুজিবকে হত্যা করা মানে, এক অর্থে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে হত্যা করা। তিনি ছিলেন আমাদের স্বাধীনতার, আমাদের হিম্মৎ আর সংগ্রামের প্রতীক।’

ঐদিনই আরও লিখেছেন: ‘নিঃসন্দেহে শেখ ছিলেন এ যুগের সর্বপ্রধান বাঙালি। সে সর্বপ্রধান বাঙালিকে আমরা বাঙালিরাই কিনা নিজের হাতে হত্যা করলাম! আশ্চর্য, এমন অবিশ্বাস্য ঘটনাও সত্য হল।

‘বাঙালিকে বাঙালি বলে পরিচয় দিতে কে জুগিয়েছিল সাহস? শেখ মুজিব নয় কি? বজ্রগর্ভ আর অমিত প্রেরণার উৎস ‘জয়বাংলা’ স্লোগান কে তুলে দিয়েছিল বাঙালির মুখে? শেখ মুজিব নয় কি?’

সবশেষে মনের ভার ও বিবেকের পীড়াটা কিছুটা হলেও লাঘব করার জন্যেই যেন লিখলেন ‘বিবেকের সংকট’ নামে প্রবন্ধ। কিন্তু ৪ অক্টোবরের ডায়েরির লেখা থেকে জানতে পারি যে লেখাটি পাঠানোর পর তিন সপ্তাহ অতিবাহিত হলেও ‘ইত্তেফাক লেখাটি আজও ছাপেনি’।

.

৪.

এরকম দুর্বহ বিবেকের সংকটে পীড়িত হতে হতেই ইতিহাসের ঘূর্ণিচক্র তাকে টেনে নিয়ে গেল বাংলাদেশের বিতর্কিত এক সরকারের ভিতরে। উদার মানবিক আদর্শবাদ ও ব্যক্তিগত সততা ও আত্মমর্যাদার মূল্যবোধে বিশ্বাসী সাদাসিধে সত্তরোর্ধ মানুষটি শিক্ষা ও জীবনাদর্শে মোটামুটি তার চেনা বলয়ের উপদেষ্টা ও প্রেসিডেন্টের চাপ শেষ পর্যন্ত অগ্রাহ্য করতে পারেন নি।

তখন বাংলাদেশের ইতিহাসের চতুর ধূর্ত খলনায়ক জেনারেল জিয়ার অভিসন্ধি তাঁর কাছে পরিষ্কার হয়নি। তবে দিনে দিনে তাঁর বিবেকের সংকট বেড়েছে এবং সে ভার লাঘবের দায় কেবলই জোরদার হয়েছে। লেখকের যে ইতিহাসের প্রতি, দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি দায় আছে সেটা তিনি কখনও ভোলেন নি। ‘মৃতের আত্মহত্যা’ গ্রন্থের ভূমিকায় (কৈফিয়ৎ) তিনি এ ঘটনাকে ‘শতাব্দীর করুণতম, নিষ্ঠুরতম বিয়োগান্ত এক নাটক হিসেবে উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘আমি তেমন বড় লেখক নই। তবে ছোট লেখকও দায়িত্বমুক্ত নয়। এ বই আমার তেমন এক ছোট দায়িত্ব পালন।’

তাঁর এ গল্পগুলো সম্পর্কে তিনি আগেই একটু সতর্ক ও রক্ষণাত্মক অবস্থান নিয়েছেন। তাই পাঠকদের উদ্দেশ্যে তাঁর নিবেদন: ‘এ গল্পগুলিকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখতে হবে। হিংসা-বিদ্বেষ কিংবা প্রতিহিংসা-প্রতিশোধের মনোভাব থেকে এর উৎপত্তি নয়।’

‘মৃতের আত্মহত্যা’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় নভেম্বর ১৯৭৮, সমকাল প্রকাশনী থেকে। প্রকাশকের কথায় সামসুর রহমান সেলিম জানাচ্ছেন, ‘মৃতের আত্মহত্যা’ সমকালে প্রকাশিত হওয়ার পর সারা বাংলাদেশে এক বিপুল আলোড়নের সৃষ্টি হয়। শুধু তাই নয়। দেশ-বিদেশেও গল্পটির জন্য বিশেষ ঔৎসুক্য পরিলক্ষিত হয় এবং ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয় বলেও জানা গেছে। তারপর পনেরই আগস্টের ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবুল ফজল সাহেব আরও তিনটি ছোট গল্প লেখেন। প্রথম তিনটি গল্প ‘মৃতের আত্মহত্যার’, ‘নিহত ঘুম’, ও ‘ইতিহাসের কণ্ঠস্বর’ সমকালে প্রকাশিত হয়েছে। শেষ গল্প ‘কান্না বর্তমান গ্রন্থে সংযোজিত হয়েছে।”

মুজিব হত্যার পরপরই আবুল ফজল বিবেকের বোঝা ও পীড়া অনুভব করতে থাকেন, আর উপদেষ্টার দায়িত্বভার নিয়ে সে বোঝা ও সংকট কেবল গভীরতর হয়েছে। সেই বোঝা কিছুটা হলেও এবং নিজের মনের ভার হাল্কা করতে গিয়ে বাবা যেন একের পর এক এই গল্পগুলো লিখে গিয়েছেন।

গল্প শিল্পোত্তীর্ণ হল কিনা এ নিয়ে তিনি তেমন ভাবিত ছিলেন, শিল্প সৃষ্টির চেয়ে ব্যক্তিগতভাবে বিবেকের এবং ইতিহাসের দায় পালনই তাঁর কাছে ছিল মুখ্য। এ মর্মন্তুদ ঘটনার সুস্পষ্ট কার্যকর প্রতিবাদের দায় তিনি কিছুতেই ভুলতে পারেন নি। ৪-১০-৭৫ তারিখ ডায়েরিতে লিখেছেন: ‘শেখ সাহেবের হত্যা সম্পর্কে আমি অনবরত বিবেকের একটা দংশন অনুভব করছি। এত বড় একটা দ্বিতীয় কারবালা ঘটে গেল দেশে, নির্মমতায় যে ঘটনার জুড়ি নেই ইতিহাসে। সে সম্পর্কে দেশের সর্বাপেক্ষা সচেতন অংশ শিক্ষিত আর বুদ্ধিজীবী সমাজ কিছুমাত্র বিচলিত বোধ করছে না, এ ভাবা যায় না। আশ্চর্য, মননশীল লেখক-শিল্পীদের মধ্যেও তেমন একটা সাড়া দেখা যায়নি এ নিয়ে। আগের মতো এখনো আমাদের তরুণ কবিরা একটানা অতি নিরশ ও নিষ্প্রাণ প্রেমের বা ‘আমি-তুমি’ মার্কা কবিতা লিখে চলেছেন।’

বোঝা যায় পঁচাত্তরের আগস্টের পর থেকেই তিনি এ নিয়ে কিছু লেখার তাগিদ অনুভব করছিলেন। দু’সপ্তাহের মধ্যেই লেখেন ‘বিবেকের সংকট’ প্রবন্ধ। আর উপদেষ্টা পদে যোগ দিয়ে বোঝেন যে তার দায়মুক্তি ঐ লেখাতে ঘটে নি। সে দায় আরও ভালোভাবে তার ওপর চেপেছে। ফলে ৭৭-৭৮ দু’বছরে চারটি গল্প লিখলেন তিনি তাঁর ভাষায় দ্বিতীয় কারবালার ঘটনাবলী নিয়ে। তবে এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও বাঙালির ইতিহাসের নির্মম হত্যাযজ্ঞের এমন ঘটনার দ্বিতীয় নজির নেই। তাই সম্ভবত ঘটনার আকস্মিকতায় সকলেই হতচকিত হয়েছেন, হতবুদ্ধিও হয়েছেন। মনের এ বিপর্যয় কাটাতে একটু সময় লেগেছে বটে, কিন্তু অচিরেই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখার-কবিতা, ছড়া, গান–জোয়ার শুরু হয়েছে আবার।

.

৫.

’৭৭-এ প্রথম গল্প ‘মৃতের আত্মহত্যা’ যখন প্রকাশিত হচ্ছে ততদিনে সংবিধান স্থগিত, ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর কোপ পড়েছে, রাজনীতিহীনতার মধ্যেও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের উদ্যোগ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এ সময়ে সায়েম ও তার উপদেষ্টামণ্ডলীর আড়ালে জিয়া ও তার পার্শ্বচরদের ক্ষমতা ও প্রভাব বাড়ছিল। লেখক ও বিবেকি মানুষ আবুল ফজল আর চুপ থাকতে পারেন নি, নীরবে মেনে নিতেও পারেন নি। পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েই তিনি প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসেবে গল্পগুলো লিখতে ও প্রকাশ করতে শুরু করেন। কোন রকম রূপক বা প্রতাঁকের আশ্রয় নেননি প্রতিবাদী এ লেখক। চারটি গল্পের মধ্যে প্রথম দুটিতে মৃতের আত্মহত্যা ও নিহত ঘুম-ঘটনা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মানসিক যন্ত্রণার কথা তুলে ধরেছেন। আর পরের দুটিতে ইতিহাসের কণ্ঠস্বর ও কান্না পাই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় আপন মানুষদের মনোকষ্টের কাহিনী।

মৃতের আত্মহত্যার মূল চরিত্র সোহেলি, এক খুনী মেজরের স্ত্রী, দূর মরুভূমিতে যে কেবল দেশ ও পরিজনদের ছেড়ে থাকার নির্বাসন দণ্ড ভোগ করছে না, তার আপনজনের কৃতকর্মের জন্য সে যে আজ ‘খুনীর বৌ, বকুল খুনীর সন্তান’, এ পরিণতি সে মানতে পারে না। বকুল তাদের সন্তান, সোহেলির জীবন থেকে আনন্দ-উৎসাহ উধাও হয়ে যায়, স্বামীর অন্যায় খুনের জের টানে সে জীবনের প্রতি সকল আগ্রহ হারিয়ে। শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় নিরপরাধ বিবেকি নারী।

‘নিহত ঘুম’ গল্পটি এক অজ্ঞাতনামা সৈনিকের ডায়েরির অংশ হিসেবে তারই বচনে বিবৃত হয়েছে। এ সৈনিক ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছিল আর তারপর থেকে সে-ঘটনা দুঃসহ স্মৃতি হয়ে তাকে তাড়াতে থাকে। এক দিনের জন্যও সে আর ঘুমোতে পারে নি। শেষ পর্যন্ত তারও মৃত্যু ঘটে আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে।

তৃতীয় গল্পটির নাম ‘ইতিহাসের কণ্ঠস্বর’। এখানে পাই বঙ্গবন্ধুর ছোটচাচা শেখ আহমদ আলীর জবানিতে ‘দ্বিতীয় কারবালা’র ফলে তাদের জীবনও কিভাবে সেই একই ঘটনার দ্বারা তাড়িত হচ্ছে সে বিবরণী। তিনি চাইলেন বঙ্গবন্ধুর ঘরটি আবার সজীব করে তুলতে, বেঁচে যাওয়া নাতনিদের ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু এ ঘটনার অভিঘাত এতই প্রবল যে কারও পক্ষেই স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে যাওয়া সম্ভব হয় না। অদৃশ্য আওয়াজ তাদের অস্থির করে তোলে-তফাৎ যাও, সব ঝুট হ্যায়।

শেষ গল্প ‘কান্নায়’ তিনি সেদিনের হত্যাকাণ্ডের সবচেয়ে মর্মান্তিক ও নিষ্ঠুর শিকার শিশু রাসেলের এক সহপাঠী বন্ধুর জীবনেও এ ঘটনা কী ভয়ানক ছাপ ফেলে গেছে তা জানিয়েছেন। অধ্যাপক শহীদ ও আলফা বেগমের ছোট ছেলে শাহীন শেখ রাসেলের সাথে (গল্পে রুশো) একই স্কুলে একই সাথে পড়ে। দু’জনের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে মূলত রুশোরই টানে। এ গল্পে শিশু রাসেলের সারল্য ও জীবনের সৌন্দর্য, বেগম মুজিবের স্নেহমাখা মাতৃত্ব এবং বঙ্গবন্ধুর বাড়ির অনাড়ম্বর সাদাসিধে রূপ ফুটে ওঠে।

.

৬.

আবুল ফজল পঁচাত্তরের ঘাতকদের দায়মুক্তির বিধান নিয়ে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট ছিলেন এবং যে দুই শর্তে তিনি উপদেষ্টা পদে যোগ দিয়েছেলেন তাতে হত্যার তদন্ত ও বিচারের বিষয়টি ছিল প্রধান। বিচারের বিষয়ে সরকারের উদাসীনতা দেখে এবং প্রথম পর্যায়ে ইতিহাসের এমন জঘন্য হত্যাকাণ্ডে লেখক-শিল্পীদের তেমন প্রতিবাদ-প্রতিক্রিয়া দেখতে না পেয়ে তিনি ক্ষুব্ধ ও হতাশ হয়েছিলেন। তিনি প্রতিবাদের যে আয়ুধ হাতে তুলে নেন তাতে তাই যেন জোর পড়েছে প্রকৃতির বিচারের দিকে। মানুষ তার বিচার ব্যবস্থাকে অচল করে রাখলেও প্রকৃতির বিচার বন্ধ করা যায় না।

তবে এ প্রত্যাশার মধ্যে যেমন সততা ছিল তেমনি ছিল সারল্য। ইতিহাস আদতে তখন সরল ও সৎ পথ ছেড়ে ষড়যন্ত্র ও মিথ্যার কুটিল কুহকে ঢুকে পড়েছে। বাংলাদেশের মূলধারার রাজনীতি ধীরে ধীরে মাথা তুলেছে বটে কিন্তু সেই কুটিল কুহকের পথ থেকে যেন সম্পূর্ণ বেরিয়ে আসতে পারে নি। সংবেদনশীল বিবেকি লেখক আবুল ফজল যেমনটা আশা করেছেন যে খুনীরা, তাদের স্বজনরা আত্মোপলব্ধি করবে, আক্ষেপে ও অনুতাপে জ্বলবে–অন্যকথায় মনোযন্ত্রণার ভিতর দিয়ে সত্যের পথে আসবে তেমনটা বাস্তবে ঘটেছে বলে মনে হয় না।

শেষ দুটি গল্পের মধ্যে এ ঘটনায় সৎ সরল মানুষের কষ্টের কথা আছে, তারা এর থেকে কীভাবে পরিত্রাণ পাবেন সরাসরি তার ইশারা নেই। তবে স্বজনদের এমন কষ্টভোগের পরিণতি নিশ্চয় আবার মানুষের শুভবুদ্ধির জাগরণ ঘটাবে এবং দ্বিতীয় কারবালার ঘটনার বিচার-আদালতের ও প্রকৃতির উভয় বিচার নিশ্চিত করবে, এমনটাই তিনি বিশ্বাস করেছেন। আবুল ফজলের সে বিশ্বাস তার মৃত্যুর পরে শহীদজায়া জাহানারা ইমামের ঘাতক-দালাল বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে গত শতকের নব্বইয়ের দশক থেকে সত্যিই গণদাবিতে রূপান্তরিত হতে থাকে। বিশেষভাবে দেশের শিক্ষিত সচেতন তরুণসমাজ এ দাবির পক্ষে স্পষ্ট ভূমিকা নিতে শুরু করে। আর এই দুই দশক পরে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দ্বিতীয় দফায় নিরঙ্কুশ জয়ে ক্ষমতায় এসে প্রথমে বঙ্গবন্ধু ও পরিবারের হত্যাকারীদের বিচার করে রায় কার্যকরের ব্যবস্থা করেছেন। তারপর ট্রাইব্যুনাল গঠন করে একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচারের সূচনা করে রায় কার্যকর করছেন।

এখন ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে মূল্যায়ন করলে বোঝা যায় বঙ্গবন্ধু কেবল স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি ও রূপকার নন, তিনিই এ জাতির মহানায়ক। হত্যাকাণ্ডের প্রাথমিক ধকল কাটিয়ে সৃজনশীল মানুষ তাকেই উপজীব্য করে কবিতা-গান-প্রবন্ধ লিখতে শুরু করে। তার বহুমাত্রিক ভূমিকা, অবদান, ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। রাজনীতিতে, জাতীয় জীবনে ও ইতিহাসে তাঁর অবস্থান সবার আগে, সবার ওপরে।

একজন ছোট লেখকের ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের প্রয়াস জাতির পক্ষ থেকে ঋণ স্বীকারের এবং প্রতিবাদ ও বিচারের প্রথম পদক্ষেপ ছিল।

আজীবন মুক্তবুদ্ধির সাধক আবুল ফজল এ গল্পগুলোর মাধ্যমে নিজেকে দায়মুক্ত করলেন আর আপন বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ থাকলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *