১৭. শেখ কামাল : স্মৃতিচারণ

১৭. শেখ কামাল : স্মৃতিচারণ

খুব ধারাবাহিকভাবে নয়, মাঝে মাঝে অবসরমতো আমার দিনলিপি লেখার অভ্যাস আছে। ২৬-১০-৭৫ তারিখে দিনলিপি লিখতে গিয়ে হঠাৎ শেখসাহেবের জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামালের কথা মনে পড়লো। পিতার সঙ্গে তাকেও হত্যা করা হয়েছে। তার সাথে আমার মাত্র বার তিনেকের দেখা। স্রেফ দেখাই। তেমন কোনো আলাপ-পরিচয় ঘটেনি। একবারই দু’একটি কথা বিনিময়ের সুযোগ ঘটে।

প্রথমবার ওকে দেখেছি অত্যন্ত দূর থেকে। শুধু চোখের দেখা–তখন কিশোর কিংবা কৈশোর উত্তীর্ণের পথে ও। সন-তারিখ মনে নেই। খুবসম্ভব, ১৯৬৬-৬৭ই হবে। ঢাকার সুবিখ্যাত সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানটের বার্ষিক অনুষ্ঠান, ঢাকার ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট হলে। আমাকে করতে হয়েছিল সভাপতিত্ব। ভাষণ ইত্যাদি প্রাথমিক পর্ব শেষ হলে শুরু হলো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অর্থাৎ গানবাজনা, নৃত্য ইত্যাদি।

মঞ্চ থেকে নেমে এসে আমরা আসন নিয়েছি দর্শকদের চেয়ারে। আমার পাশে বেগম সুফিয়া কামাল। তিনি তখন ‘ছায়ানটের সভানেত্রী। সমবেত ঐকতানের প্রস্তুতি নিয়ে শিল্পীরা বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র হাতে মঞ্চে আসন নিয়েছে অর্ধবৃত্তাকারে। শিল্পীদের সারির মাঝখানে দীর্ঘকায় হ্যাংলাদেহ এক ছেলে সেতার হাতে ঋজু হয়ে আসন নিয়ে সংকেতের প্রতীক্ষায় বসে আছে আসন গেড়ে।

সে বয়সেও গোঁফের রেখা স্পষ্ট।

অঙ্গুলি নির্দেশ করে সুফিয়া কামাল বললেন—

: ওইটি মুজিবের ছেলে।

: কোন মুজিবের?

তখনো এক নামে চিহ্নিত হয়নি। শেখসাহেব।

: শেখ মুজিবের। ছায়ানটের ছাত্র।

শেখ মুজিব তখন জেলে। ভোগ করছেন দীর্ঘ কারাবাস।

তারপর সুদীর্ঘকাল গত হয়েছে। এর মধ্যে শুধু পদ্মা-যমুনা-মেঘনায় প্রচুর পানি গড়িয়ে যায়নি, দেশের ইতিহাসেও অবিশ্বাস্য রকম রদবদল ঘটে গেছে। সেদিনের কয়েদি আজ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। উপাচার্য হওয়ার পর বিভিন্ন সময় শেখসাহেবের সঙ্গে আমার দেখা-সাক্ষাৎ ঘটেছে। তাতে আলাপ-আলোচনা প্রসঙ্গে ছেলেদের শিক্ষা ও মানুষ করা সম্পর্কে আমার উৎকণ্ঠা তাকে আমি একাধিকবার জানিয়েছি। এই বইতে অন্যত্র তার উল্লেখ রয়েছে।

১৭ মার্চ শেখসাহেবের জন্মদিন। স্বাধীনতার পর ছাত্রলীগ প্রতিবছর এ দিনটি পালন করে থাকে। ১৯৭৪-এর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হওয়ার জন্য ঢাকার ছাত্রলীগ আমাকে অনুরোধ জানায়। আমি রাজি হলাম, তবে দিনে দিনে ফিরে আসতে চাই এ শর্তে।

তারা সেভাবে বিমানের টিকেট পাঠিয়ে দিয়েছিল।

১৭ তারিখ ঢাকা বিমানবন্দরে নেমে আমি চিন্তা করতে লাগলাম, ওরা আমাকে নিতে আসবে কিনা, এলেও আমি চিনতে পারবো কিনা। ওদের কারো সঙ্গে তো আমার দেখা নেই। এ যাবৎ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে ওদের প্রতিষ্ঠানের চট্টগ্রাম শাখার সদস্যদের কেউ কেউ। তাদের কেউ আবার আমার সহযাত্রীও হয়নি।

নিজের ছোট্ট হ্যান্ডব্যাগটি হাতে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায় মেয়ের বাসায় কী করে যাওয়া যায় সেকথা ভাবতে ভাবতে নির্গমনপথে এগোলাম। একধারে দেখলাম একটা ছিপছিপে গোঁফওয়ালা ছেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বেশ লম্বা বলে সহজে চোখে পড়ে। ছেলেটাকে আমি চিনতে পারলাম না।

লাউঞ্জের প্রবেশপথে ছেলেটি এগিয়ে এসে বলে—

: আপনাকে নিতে এসেছি।

বলেই আমার হাত থেকে ব্যাগটি আমার আপত্তি অগ্রাহ্য করে নিজের হাতে নিয়ে নিল। নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য জিজ্ঞাসা করলাম–

: তুমি ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে এসেছ?

: জি হাঁ।

নম্র কণ্ঠে জবাব দিলো ছেলেটি।

ওর পেছনে পেছনে হেঁটে এসে একটা গাড়িতে উঠে বসলাম। ড্রাইভারের সিটে গিয়ে বসলো ও নিজে। এবং শুরু করলো ড্রাইভ করতে। তার আগে ও জেনে নিয়েছে আমি কোথায় উঠবো। গাড়িতে তৃতীয় ব্যক্তি নেই। কিছুদূর যাওয়ার পর আমার মনে হঠাৎ কৌতূহল হলো, জিজ্ঞাসা করলাম–

: তুমি কি করো?

বলল–

: অনার্স পরীক্ষা দিয়েছি সোসিয়োলজিতে।

: ঢাকা থেকে?

: জি হাঁ।

শেখসাহেবের সঙ্গে ছেলেটির দৈহিক সাদৃশ্য আমার মনে ধীরে ধীরে স্পষ্টতর হয়ে উঠেছিল। জিজ্ঞাসা করলাম–

: তোমার নাম?

: শেখ কামাল।

: ও তুমি আমাদের শেখসাহেবের ছেলে।

: জি হাঁ।

 বললাম—

এত সব মন্ত্রীরা থাকতে আজকের অনুষ্ঠানে আমাকে কেন তোমরা নিয়ে এলে প্রধান অতিথি হতে?

তেমনি আবেগহীন কণ্ঠে ও বলল—

: আপনার এক কথা ওঁদের হাজার কথার সমান।

মনে মনে সংকোচ বোধ না করে পারলাম না।

এবারও আমার আপত্তি অগ্রাহ্য করে ও ব্যাগটি নিয়ে তেতলা পর্যন্ত উঠে এলো। যাওয়ার সময় বলে গেল—

: আমি আড়াইটার সময় আসবো আপনাকে নিয়ে যেতে, আমাদের সভা তিনটায় আরম্ভ হবে।

ঠিক তিনটার কিছু আগে এসে ও আমাকে ওর গাড়ি করে সভায় নিয়ে গিয়েছিল। সভায় ঢুকতেই কে এক ছেলে এসে আমার হাতে একটি ফুলের মালা দিলে বলল–

এটি শেখসাহেব পাঠিয়ে দিয়েছেন আপনার জন্য। তাঁর শরীর খারাপ না হলে তিনি আপনার সঙ্গে দেখা করতেন।

ওই সভাতে আমার প্রথমবারের মতো খোন্দকার মোশতাক আহমদের সাথে দেখা। তিনি ওই সভার অন্যতম বক্তা। আর এক বক্তা ছিলেন মোল্লা জালাল উদ্দিন। প্রতিমন্ত্রী ক্ষিতীশ মণ্ডলও ছিলেন মনে পড়ে। ওই সভায় শেখ কামাল কোনো ভূমিকা নেয়নি। সামনের দিকে কোনো সারিতেও ওকে দেখা গেল না। পেছনের দিকে কোথাও হয়তো এককোণে বসেছিল। মনে হলো নেপথ্যেই ওর ভূমিকা। সভাশেষে আবারও মেয়ের বাসায় নিয়ে গেল ও। বিমানের সময় দেরি নেই। তাই ওখানে আর বসা হলো না। আমার হাতব্যাগটি এবারও নিজের হাতে তুলে নিয়ে নিচে নেমে এসে গাড়ির দরজা খুলে আমাকে বসাল। এবারও নিজে ড্রাইভারের সিটে বসে স্টার্ট দিয়ে দিল। দেখলাম ও সব সময় একা।

এয়ারপোর্টে পৌঁছে বোর্ডিং কার্ড করার জন্য নিজেই ব্যাগটি হাতে নিয়ে কিউর পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো। রাষ্ট্রপ্রধানের ছেলে বলে কোনোরকম অগ্রাধিকার খাটাতে চাইল না। দেখে আমার খুব ভালো লাগলো। যখন ওর পালা এলো তখনই শুধু টিকেটটি বাড়িয়ে দিল। বোর্ডিং কার্ড-টার্ড হয়ে যাওয়ার পর বিমান ছাড়া পর্যন্ত ও থেকে যেতে চাইছিল। আমি অনেক বলে-কয়ে ওকে লাউঞ্জ থেকে বিদায় দিলাম। একই দিন ওর গাড়িতে ও আমাকে চারবার লিফট দিয়েছে কিন্তু নিজে চারবারও বোধকরি কথা বলেনি। তাতে মনে হলো ও অত্যন্ত স্বল্পবাক।

শুনেছি অত্যন্ত ক্রীড়াপ্রিয় ছিল। রাষ্ট্রপতির ছেলে হয়েও কোনো ধনীর মেয়েকে বিয়ে করেনি, বিয়ে করেছিল দেশের সেরা ক্রীড়াবিদ মেয়েটিকে। বাংলাদেশের সেরা ক্রীড়া সংস্থা ‘আবাহনী” ওরই নিজের সংগঠন, ওরই সৃষ্টি।

সেদিন দেখেছিলাম অবিকল বাপের মত করেই গোঁফ রেখেছে ও। সে দিনের ঋজু দেহ দীর্ঘ লিকলিকে চেহারার সুদর্শন তরুণটির -মধুর ছবি আমার মনে আজও গাঁথা হয়ে আছে। আজ ও নেই, বাংলাদেশের সেরা মেয়ে ক্রীড়াবিদ ওর নববধূটিও গেছে হারিয়ে।

[লেখকের অপ্রকাশিত দিনলিপি থেকে]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *