১০. জাতীয় প্রেসক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলন

১০.

৯-৪-৭৫

আজ ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে আমি একটি সাংবাদিক সম্মেলন করলাম। আলোচ্য বিষয় ছিল–শিক্ষাসমস্যা আর পরীক্ষার ফলাফল। বিভিন্ন পরীক্ষার ফলাফল এত শোচনীয়ভাবে নিচে নেমে যাওয়ার পশ্চাদপট আমি ব্যাখ্যা করেছিলাম সাংবাদিকদের সামনে। শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট আর সরকারি শিক্ষানীতির সমালোচনাও করেছিলাম আমি ওই সাংবাদিক সম্মেলনে। ইতিপূর্বে ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু পাইকারিভাবে দেশের শিক্ষিত সমাজকে খুব করে নিন্দা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নাম উল্লেখ না করে আমি তাঁর ওই মন্তব্যেরও সমালোচনা করেছিলাম কিছুটা কঠোর ভাষায়। পরদিন সব কাগজে আমার ওই সাংবাদিক সম্মেলনের সবিস্তার রিপোর্ট আমার ছবিসহ ছাপা হয়েছিল।

স্তাবকরা আমার এ সাংবাদিক সম্মেলনের কথা তিলকে তাল করে বঙ্গবন্ধুর কানে তুলেছেন। তাঁর প্রতিক্রিয়া আমাদের অজানা। তবে তারপর থেকে একটা গুজব, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলরের পদ থেকে আমাকে সরানো হচ্ছে ইত্যাদি। ইতিমধ্যে কমনওয়েলথ কনফারেন্স উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু দেশের বাইরে গেছেন। তিনি ফিরে এলে এসপার কি ওপার একটা কিছু হয়ে যাবে, একথা তখন সকলের মুখে মুখে। আমি নির্বিকার।

আমাদের ইংরেজির অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী একদিন আমার অফিসে খবর দিলেন তিনি আজ কিছুক্ষণের জন্য আমার সঙ্গে নিরিবিলি আলাপ করতে চান। বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর কমিটির সভা ছিল, সভাশেষে তাতে আসতে বললাম। দেখা হতেই তিনি বললেন–

: স্যার, আপনার একটি সুখবর আছে।

পূর্ব-প্রচারিত গুজবের সঙ্গে এ ‘সুখবরের’ কিছু লিঙ্ক আছে মনে করে আমি কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়ে উঠলাম। আমতা আমতা করে বললাম–

: এ বয়সে কী আর আমার সুখবর থাকতে পারে!

মোহাম্মদ আলী তখন সবিস্তার বললেন–তার ভগ্নিপতি ডাক্তার নূরুল ইসলাম (পিজি’র ডিরেক্টর) ফোন করে জানিয়েছেন গতকাল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তিনি কন্ফারেন্স শেষে জ্যামাইকা থেকে এসে শুনতে পান যে, আমাকে চাটগাঁ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরাবার চেষ্টা চলছে। কিছুমাত্র ইতস্তত না করে তিনি তখনই বঙ্গবন্ধুর কাছে ছুটে যান এবং তাকে বোঝাতে চেষ্টা করেন আমাকে সরালে প্রতিক্রিয়া মোটেও ভালো হবে না। আরো বহু কথার পর আমি যে তাঁর হিতৈষী তা-ও তিনি নাকি তাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুও নাকি বলেছেন—’আমি তাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করি, পিতার মতো ভক্তি করি। অথচ তিনি নাকি আমার কথার সমালোচনা করেছেন কঠোর ভাষায়।’

ডাক্তার ইসলাম তাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন এগুলো সব লোকের বানানো কথা। তারও আপনার সম্বন্ধে খুবই উঁচু ধারণা। শেষ কথা-আমাকে সরাবার সংকল্প আপাতত রাষ্ট্রপ্রধান ত্যাগ করেছেন। এটিই সুখবর। এ খবর আমাকে গোপনে জানাবার জন্য ডাক্তার ইসলাম তাকে বলে দিয়েছেন। কী জানি কেন মনে মনে খুব ধিক্কার বোধ করলাম।

স্বাধীনতার পর কত জনকে বিপদমুক্ত করার জন্য কতভাবেই না আমি চেষ্টা করেছি, তদবির করেছি বহু ক্ষমতাসীনের কাছে। এমনকি স্বয়ং রাষ্ট্রপতির কাছেও দরবার করেছি বহুবার। আজ আমার একটা সামান্য চাকরি রাখার জন্য আমার একজন হিতৈষীকে কিনা উল্টো শেখসাহেবের কাছে ওকালতি করতে হচ্ছে আমার হয়ে! অদৃষ্টের পরিহাস আর কাকে বলে। জীবিকার বন্ধন আমাদের আজ আত্মমর্যাদা রক্ষায়ও অপারগ করে তুলেছে। অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী যেটাকে সুখবর বলেছেন, সে সুখবর শুনে নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হলো।

.

২৬–৬-৭৫

আজ সিন্ডিকেটের সভা। সভাশেষে এক পাশে ডেকে নিয়ে সৈয়দ আলী আহসান (তখন তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক) আমাকে চুপি চুপি বললেন, তিনি ঢাকায় জেনে এসেছেন, দু’একদিনের মধ্যে নতুন উপাচার্যের নিয়োগ হচ্ছে। তিনি ফাইল পর্যন্ত দেখে এসেছেন। শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গেও তার দেখা হয়েছে। ১ জুলাই ডক্টর এনামুল হক এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে যোগ দিচ্ছেন। মাত্র গতকালই তিনি ঢাকা থেকে ফিরেছেন এবং সবকিছু জেনে এসেছেন। অতএব একদম টাটকা খবর! আমাকে পরামর্শ দিলেন–

: আপনার তাড়াতাড়ি ঢাকা গিয়ে তদৃবির করা উচিত।

সেইসঙ্গে যোগ করলেন–

আপনি না থাকলে আমার পক্ষে খুব দুঃখের হবে। এখানে চাকরি করাও দুঃসাধ্য হবে।

রাগ হলে আমাদের মুখে অনেক সময় ইংরেজি এসে যায়। বললাম–

I am the last person to make this sort of tadbeer. 069 ২৮ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের মিটিঙে আমি যাচ্ছি, তখন একবার রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করবো। সাক্ষাৎকার চেয়ে আজই ফোন করতে সেক্রেটারিকে বলে দেবো।

তিনি বিদায় নিলেন।

মনে মনে খুব বিরক্ত বোধ করছিলাম। আমি তো উপাচার্য হতে চাইনি। বঙ্গবন্ধু আমাকে ডেকে এ দায়িত্ব নিতে বলেছেন। আমি নিয়েছি। এখন আমার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে তিনি তো আমাকে ডেকে বলতে পারেন।

বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিবকে ফোন করে আমার ইচ্ছা জানানো হলো। বঙ্গবন্ধু ২৯ তারিখ সন্ধ্যে ৬টায় আমার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় দিয়েছেন।

২৭ তারিখ ডক্টর এনামুল হককে ফোন করলাম। বললাম–

২৮ তারিখ আমাকে গণভবনে যেতে হবে, দয়া করে আপনার গাড়িটা ওইদিন ৫টার সময় আমার মেয়ের বাসায় পাঠাবেন।

তিনি যথাসময়ে গাড়ি পাঠাবেন আশ্বাস দিলেন। তখন কৌতূহলবশত জিজ্ঞাসা করলাম

আপনি নাকি এখানে আসছেন? আর পহেলা জুলাই তারিখ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব নিচ্ছেন?

শুনে তিনি যেন আকাশ থেকে পড়লেন। বললেন–

আমি তো কিছুই জানি না। মাত্র একদিন আগে গণভবনে আমি এক ঘণ্টা কাটিয়ে এসেছি। শিক্ষামন্ত্রীও তখন ওখানে উপস্থিত ছিলেন। কেউ তো আমাকে ঘুণাক্ষরেও কিছু বলেননি। আমাকে সরাসরি চাটগাঁ চালান দেয়া হচ্ছে অথচ আমি কিছুই জানিনা!

তখন আমার বুঝতে বাকি থাকলো না, সম্পূর্ণ ব্যাপারটাই বোগাস।

.

১১.

২৮-৬-৭৫

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট মিটিং শুরু হলো বেলা ৩ টায়। ৫টা পর্যন্ত থেকে আমি কেটে পড়লাম। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য কেনা টয়োটা করোনায় চড়ে ঠিক ৫-৩০টায় গণভবনের দিকে রওয়ানা দিলাম। শেখসাহেবের ১৯৬৯-এ লেখা দু’খানা চিঠি আমার পুরনো ফাইলে ছিল (চিঠি দু’খানা বইয়ের প্রথমেই সন্নিবেশিত করা হয়েছে)।

ফাইল ঘেঁটে বের করে সে চিঠি দু’খানাও পকেটে করে নিয়ে এসেছি।

ওয়েটিং রুমে আমার পেছনে পেছনে ঢুকলেন মহীউদ্দিন আহম্মদ। আমার প্রাক্তন ছাত্র, বর্তমানে আওয়ামী লীগের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট। কারা যেন দল বেঁধে বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধনা জানাতে এসেছে। ওদের পালা শেষ হতেই সচিব এসে আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন। দেখেছি সবসময় সাক্ষাত্তার কিংবা সভা-সমিতির ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত প্রশংসনীয়ভাবে সময়সূচি রক্ষা করে চলেন। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে আমাকে অন্তত বসে থাকতে হয়নি কখনো।

ঢুকতেই বঙ্গবন্ধু তার স্বভাবসুলভ আন্তরিকতার সাথে আসোলামু আলায়কুম বলে এগিয়ে এসে আমার দু’হাত জড়িয়ে ধরলেন। আসন না নিয়ে দাঁড়ানো অবস্থায় আমি বলে উঠলাম–

: আজ আমি আপনার সঙ্গে ঝগড়া করতেই এসেছি।

তিনি বিস্মিত কণ্ঠে বললেন—

: কেন? কি করেছি আমি?

বললাম–

এসব কী শুনছি? আপনি নাকি আমার স্থলে নতুন একজন উপাচার্য পাঠাচ্ছেন অথচ আমাকে কিছু বলেননি!

তিনি অধিকতর অবাক হয়ে বললেন–

এ খবর আপনাকে কে দিলো? আমরা তো এমন কোনো কথা বলিনি। এমন কথা মুখ থেকেও তো আমরা বার করিনি একবারও।

নিজে থেকেই বললেন–

আপনাকে তো আমি নিজে থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব নিতে বলেছি। আর আজ আপনাকে না জানিয়েই ওই পদ থেকে সরিয়ে দেবো এমন কথা আপনি বিশ্বাস করলেন কী করে?

সেদিন আমি কিছুটা উত্তেজিত অবস্থায় ছিলাম। সে অবস্থায় মুখে অনেক কথা এসে গেলো।

বললাম–

আমি রাজনীতিবিদ নই, কোনোদিন করিওনি রাজনীতি। তবে যখন দেশের ডাক এসেছে, সবসময় আমি সাড়া দিয়েছি। এমনকি আওয়ামী লীগের ডাকেও বিভিন্ন সময় কীভাবে সাড়া দিয়েছি আমি তারও বিবরণ বয়ান করে গেলাম একটানা। এবার পকেট থেকে সে পুরনো চিঠি দু’খানা বের করে তার সামনে খুলে ধরে জিজ্ঞাসা করলাম–

এ চিঠি কি আপনি লেখেননি? তখন আপনি দেশের প্রধানমন্ত্রী কিংবা রাষ্ট্রপতি হবেন তা হয়তো ভাবেননি, দেশের মানুষও তা কল্পনা করেনি। আপনি বঙ্গবন্ধু হবেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হবে আর আপনি সে স্বাধীন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান হবেন এসব তো সেদিন স্বপ্নের বস্তু ছিল। সেদিন আপনি ছিলেন স্রেফ এক বিরোধী দলের নেতা। অবশ্য সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় নেতা। আয়ুবীয় সামরিক শাসনের প্রচণ্ড দাপটের দিনে আপনারা যখন সবাই জেলে, সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকীতে সভাপতিত্ব করার জন্য আওয়ামী লীগ নেতারা যখন কাকেও খুঁজে পাননি তখন চাটগাঁ থেকে হাওয়াই জাহাজে করে আমাকে কি নিয়ে আসা হয়নি? আমার সেদিনের লিখিত ভাষণ আওয়ামী লীগ কি পুস্তিকা আকারে ছেপে সারা দেশে বিলি করেনি? আপনারা কি জেলে বসে তা পড়েননি?

উত্তেজিত অবস্থায় সেদিন একটানা অনেক কথা শুনিয়ে দিয়েছিলাম শেখসাহেবকে।

মনে হলো মিথ্যা গুজবের কথা শুনে তিনি খুব দুঃখিত হয়েছেন।

বললাম—

: অমুক সাহেব তো ফাইল পর্যন্ত দেখে গেছেন বললেন।

অবাক কণ্ঠে বললেন–

কী ফাইল? আমার এখানে তো আপনার সম্বন্ধে কোনো ফাইল নেই। সব মিথ্যা কথা। আপনাকে আমি অত্যন্ত শ্রদ্ধা করি। আপনাকে অপমান করার কথা আমি ভাবতেই পারি না। আপনাকে জিজ্ঞাসা না করে আমি আপনার সম্বন্ধে কিছুই করবো না। আপনি থাকতে চান, পাঁচ বছর সাত বছর থাকুন না উপাচার্য।

হাসতে হাসতে বললাম—

: অতদিন কি আমি বাঁচাবো? বাঁচলেও কর্মশক্তি কি থাকবে?

বাঁচবেন, বাঁচবেন। মাশাআল্লাহ্ শরীর তো ভালোই দেখাচ্ছে।

আজ বঙ্গবন্ধুর সাথে মন খুলে আলাপ করে খুব আনন্দ পেলাম। মন ভারমুক্ত হলো। আশ্বস্ত বোধ করলাম। আরও আরও আশ্বস্ত হলাম তিনি যখন বললেন–

আপনাকে আমি বাকশালে যোগ দিতে বলবোনা। তবে আপনার কোনো শিক্ষক যদি যোগ দিতে চান তাকে আপনি বাধা দেবেননা।

বললাম–

: তা কেন আমি দিতে যাবো? যার যার স্বাধীন মতামতে আমি কেন শুধু শুধু হস্তক্ষেপ করতে যাবো?

যে প্রেস কনফারেন্স থেকে এতসব গুজবের উৎপত্তি, সে সম্বন্ধেও তার সঙ্গে এবার খোলাখুলি আলাপ হলো। বললেন–

আমার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বক্ততা আর আপনার প্রেস কন্ফারেন্স খুব কাছাকাছি সময়ের মধ্যে হয়েছে বলে লোকে আপনার বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা দেয়ার সুযোগ পেয়েছে। এটা একটা coincidence।

বুঝতে পারলাম তাকে কেউ কেউ বুঝিয়েছে আমি তাঁকে চ্যালেঞ্জ করেছি। আজকের আলাপের ফলে অনেক ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটলো।

অন্য দর্শনার্থীরা অপেক্ষা করে আছে। সচিবরা ঘন ঘন উঁকি দিচ্ছে তা আমি দেখতে পাচ্ছি। বুঝতেও পারছি ওদের ইঙ্গিত। অতএব আমি উঠে পড়লাম। তিনিও উঠে দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে বললেন–

: আপনি কী করে বিশ্বাস করতে পারলেন যে, আমি আপনাকে অপমান করতে পারি? আপনার কাছে আমি জানতে চাই এমন কথা আপনি বিশ্বাস করলেন কী করে? আমার সম্বন্ধে আপনি কী করে এমন একটা ধারণা করতে পারলেন? এ সম্বন্ধে আপনাকে আমি চ্যালেঞ্জ করছি। আশা করি আমার এ চ্যালেঞ্জের কথা আপনি লিখবেন।

আমি লেখার আশ্বাস দিয়ে দুই প্রশস্ত ও বলিষ্ঠ হাতে হাত মিলিয়ে বেশ হাল্কা মনে বেরিয়ে এলাম গণভবন থেকে। সঙ্গে নিয়ে এলাম বঙ্গবন্ধুর কিছু নতুন পরিচয়।

বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার আজকের সাক্ষাৎকারের কথা ঢাকা এবং চাটগাঁয় অনেকে জানতেন। ফলাফলের জন্য সবাই যেন উদগ্রীব। আমি ঢাকা যাত্রার পর মিনিটে মিনিটে নাকি আমার বাসায় ফোন আসছিল। সবাই একই প্রশ্ন–কী হলো? কী খবর? স্যার কি ফিরছেন? কোনো খবর দিয়েছেন? অর্থাৎ আমি আছি কি নেই এটুকুই সবাই জানতে চায়। এ খবরের জন্য সবাই উৎকণ্ঠিত।

অনেকের বিশ্বাস এ খবরের ওপর আমার জীবন-মরণ নির্ভর করছে। তাই এত উকণ্ঠা, মহলবিশেষে এত উৎসাহও।

সাক্ষাৎকারের বিবরণ শুনে অনেকে নিশ্চিন্ত হলেন, কেউ কেউ হলেন ভয়ানকভাবে হতাশ। মানবচরিত্র এত রহস্যময় যে তার হদিশ পাওয়া মুশকিল।

.

১২.

১৫-৮-৭৫

আজ ১৫ আগস্ট। শুক্রবার। মুসলমানদের জন্য সপ্তাহের পবিত্রতম দিন। রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে যাওয়ার কথা। এজন্য সাজসজ্জা, তোড়জোড় চলছে বেশ কয়েকদিন ধরে। রাষ্ট্রপতিকে যথোপযুক্তভাবে সংবর্ধনা জানানোর জন্য শিক্ষক-ছাত্রদের মহড়াও নাকি হয়ে গেছে কয়েক দফা। এ পরিদর্শনের গুরুত্ব সম্পর্কে স্বয়ং শেখসাহেবও ছিলেন সচেতন। ইতিপূর্বে কোনো চ্যান্সেলর এভাবে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করেননি।

এ পরিদর্শনে গিয়ে তিনি কী বলবেন, কী বলা উচিত হবে ইত্যাদি ব্যাপারে আগের দিন তিনি শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টাদের আলাপ-আলোচনার জন্য এক বৈঠক করেছেন। আলাপ-আলোচনার পর নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন অনার্স পরীক্ষায় যারা সবচেয়ে ভালো ফল করবে তাদের জন্য ২০টি আর আলাদাভাবে মেয়েদের জন্য ৫টি উচ্চমানের বৃত্তি ঘোষণা করবেন। আর এসব ছেলেমেয়েদের অবশিষ্ট শিক্ষাজীবনের সব খরচ রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকেই বহন করা হবে। এসব বৃত্তি শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সীমিত থাকবে না, বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরাই হবে এসব বৃত্তির হকদার। অর্থাৎ এসব বৃত্তির জন্য সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরাই করতে পারবে কম্পিট।

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আজকাল কোনোরকম গবেষণা করেনা বলে যত্রতত্র একটা বদনাম শোনা যায়। তাই গবেষণাকর্মে উৎসাহ দেয়ার জন্যও কিছু একটা করা দরকার–শেখসাহেব কথাটা নিজেই বললেন। সিদ্ধান্তও নিলেন নিজে শিক্ষকদের মধ্যে যারা মূল্যবান গবেষণা করবেন তাদের নগদ দশ হাজার টাকা পুরস্কার দেয়া হবে এবং উন্নততর গবেষণাকার্য চালিয়ে যাওয়ার জন্য বিদেশ যাওয়ার প্রয়োজন হলে সে ব্যবস্থাও সরকার থেকেই করা হবে। এ গবেষণা বৃত্তি ও পুরস্কার স্রেফ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সীমিত থাকবেনা-বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই হতে পারবেন এর দাবিদার। দেশে গবেষণা হোক এ আমি চাই। উপস্থিত মন্ত্রী আর সচিবরা তাঁর এ সিদ্ধান্তের প্রতিও তাদের পূর্ণ সমর্থন জানালেন।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাঁর ভাষণের জন্য নানা পরিসংখ্যান হাজির করেছিল, যেমন, প্রাইমারিতে কত ছাত্রছাত্রী পড়ে, মাধ্যমিকে কত, কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়েই বা কত ইত্যাদি। ওইসব দেখে শেখসাহেব নাকি বলেছিলেন–পরিসংখ্যানভিত্তিক বক্তৃতা দেয়া আমার পোষাবেনা, আর ওই ধরনের বক্তৃতায় আমি অভ্যস্তও নই। পরিসংখ্যানের মধ্যে আমি শুধু এটুকু জানতে চাই যে, পাকিস্তান আমলে বাজেটের শতকরা কত টাকা সামরিক খাতে আর কত টাকা শিক্ষা খাতে খরচ হতো আর এখন ঐ দুই খাতে তুলনামূলকভাবে আমরা কত খরচ করছি, এটুকুই আমার জানা দরকার। পরিশেষে আমি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে জিজ্ঞাসা করবো, সরকার তথা দেশের মানুষ তো বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এত টাকা খরচ করছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেশকে কী দিচ্ছে? ইত্যাদি।

মনে মনে সেদিনের ভাষণের এ খসড়া পরিকল্পনাটি শেখসাহেব করেছিলেন। ওই বৈঠকে উপস্থিত একজনের মুখ থেকে এ কথা আমি শুনেছি। তিনি এখনো সরকারি চাকুরে। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, আল্লাহ করেন আর এক! অক্ষরে অক্ষরে তা ঘটে গেল সেদিন। ভোর ছটায় সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লো এক ভয়াবহ দুঃসংবাদ। অবিশ্বাস্য এ দারুণ নির্মম সংবাদ শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। মর্মাহত হয়ে পড়লাম। দেশের ভবিষ্যৎ ভেবে শঙ্কিত হয়ে উঠলাম আমি নিজেও। তিনি তো শুধু একটি ব্যক্তি ছিলেন না, ছিলেন সারা বাংলাদেশের সংগ্রামী চেতনার প্রতীক। গত পঁচিশ বছর ধরে মিশে গিয়েছেন বাংলাদেশের মানুষের সত্তার সঙ্গে। শেষের দিকে আমার নিজেরও অনেক স্মৃতি জড়িত হয়ে পড়েছিল তাঁর সঙ্গে। মাত্র একমাস আগে ১৫ জুলাই তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রের বিবাহোত্তর সংবর্ধনা উৎসবে গণভবনের দরজায় তাঁর সঙ্গে দেখা। এ যে শেষ দেখা তা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি সেদিন। পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে আমন্ত্রিত অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাবার জন্য গণভবনের সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি।

গাড়ি থেকে নেমে আমি আর ডক্টর এনামুল হক সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই তিনি এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাঁর স্বাভাবিক উফুল্ল কণ্ঠে বলে উঠলেন–

: আপনি চাটগাঁ থেকে এসেছেন, খুব খুশি হলাম।

পাশে দাঁড়ানো ছেলের দিকে ইশারা করে বললেন—

: ছেলেকে দোয়া করুন।

ছেলে শেখ কামাল জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি করলো আমার ও ডক্টর এনামুল হকের সঙ্গে।

মেহমানরা সবাই যখন আসন নিয়ে নাস্তা করে গল্প-গুজবে ব্যস্ত তখন শেখসাহেব বর-কনে, আত্মীয়স্বজন এবং নতুন বেয়াইকেও সঙ্গে নিয়ে মেহমানদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করতে করতে ধীরে ধীরে হেঁটে চলেন দুই সারিতে বসা মেহমানদের মাঝখান দিয়ে। নতুন বেয়াইকে দেখিয়ে বললেন–

: ইনিই আমার বেয়াই।

এনামুল হক সাহেব ত্বরিত উত্তর দিলেন—

: দবিরউদ্দিনসাহেবকে তো বহুদিন থেকেই চিনি।

শেখসাহেব বললেন–

তখন ইঞ্জিনিয়ার হিসাবেই চিনতেন, আমার বেয়াই হিসেবে তো জানতেন না। এখন থেকে আমার বেয়াই হিসেবে জানুন।

বলে হেসে উঠলেন। তার স্বভাবসিদ্ধ অতুলনীয় হাসি।

আমাদের চাটগাঁয়ের কয়েকজনকে এক জায়গায় দেখে ঠাট্টা করে বলে উঠলেন–

চাটগাঁর মানুষদের এ এক দোষ, একজন আর একজনকে দেখলে এক জায়গায় এসে জড়ো হবেনই-বলে হাসতে হাসতে হেঁটে চললেন সামনের দিকে।

ডক্টর এনামুল হক আর আমি ছাড়া জাস্টিস ইদ্রিস আর চাটগাঁর এমপিদেরও কয়েকজন তখন একত্রে আলাপরত ছিলাম ওখানে।

যাঁর নামে আর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, যাকে দেশের মানুষ এতকাল ‘বঙ্গবন্ধু’ ‘জাতির জনক’ বলে অভিহিত করে এসেছে, যার নাম বাংলাদেশের ঘরে ঘরে উচ্চারিত, দূর দেশেও যার নাম সবচেয়ে সুপরিচিত, দেশের জন্য যার অন্তহীন নির্যাতন ভোগ এদেশের নর-নারীর কারো অজানা নয়, সে মানুষটির এ কী ভাগ্য! এ কী পরিণতি! আকস্মিকভাবে আজ ভোরে ঢাকা বেতার কিনা ঘোষণা করলো সে মানুষটিকে, সে পুরুষসিংহকে হত্যা করা হয়েছে। তাঁর বজ্রকণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়া হয়েছে।

অবাক বিস্ময়ে ভাবতে লাগলাম–এ কি নিয়তির খেলা! না আল্লার অনন্ত রহস্যের এ-ও আর এক রহস্য? Man proposes, God disposes-এ আপ্তবাক্যটাই শেষকালে সত্য হলো?

সামরিক বাহিনী খোন্দকার মোশতাক আহমদকে রাষ্ট্রপতি করেছে। তিনি শেখ মুজিবের দীর্ঘকালের সহকর্মী আর তার মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য! গণভবনের বিবাহোত্তর সংবর্ধনার অন্য আমন্ত্রিতদের সঙ্গে সেদিন তাঁকেও দেখেছিলাম! তাদের দীর্ঘদিনের নেতা আর দীর্ঘদিনের সহকর্মী শেখ মুজিবকে যেদিন সকালে হত্যা করা হয়েছে সেদিনই সন্ধ্যায় তাঁর ১৩জন সহকর্মী মন্ত্রী আর প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করলেন! এঁরা সবাই শেখ মুজিবের তৈরি, তাঁর নিজের হাতে গড়া। তিনি না থাকলে তাঁদের অনেকের কোনো রাজনৈতিক অস্তিত্বই থাকতো না। ক্ষমতা আর পদের প্রলোভন কি সবরকম মানবীয় আবেগ, অনুভূতি, বিবেক-বিবেচনা সমূলে বিনষ্ট করে দেয়? এজন্যই কি বলা হয়েছে Power is corrupting, power is degrading? না কি এ-ও মধ্যবিত্ত মানসিকতা?

শোনা যাচ্ছে নির্বিচারে শেখ পরিবারের সবাইকে হত্যা করা হয়েছে।

শিশু-নারী কাউকে রেহাই দেয়া হয়নি। অন্তরের অন্তস্থলে স্বতঃই উচ্চারিত হলো আল্লাহ এ যেন সত্য না হয়। পরে জানা গেছে বহুবারের বহু প্রার্থনার মতো আমার এ প্রার্থনাটাও আল্লাহর দরবারে কবুল হয়নি।

শেখ মুজিব প্রশাসক হিসেবে কিছু ভুল করেছেন এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। বিশ্বস্ত কারো অপরাধকে হয়তো তত গুরুত্ব দেননি। যোগ্যতা আর সিনিয়রিটি কখনো অগ্রাহ্য হয়েছে। কোনো কোনো অযোগ্য জুনিয়রদের পদোন্নতি ঘটেছে। হয়ত কিছুসংখ্যক স্বজন ও বশংবদ সুযোগ পেয়েছে। এসব অভিযোগ দিনে দিনে তার বিরুদ্ধে স্তূপীকৃত হয়েছে। নিয়োগ ও পদোন্নতির বেলায় সামরিক বাহিনীতে অবিচারটা নাকি সবচেয়ে বেশি হয়েছে। বিশেষ করে যারা পাকিস্তান থেকে ফিরে এসেছেন তাঁদের মধ্যে উচ্চ শিক্ষাপ্রাপ্ত অনেক অফিসারও রয়েছেন যাদের বিনা কারণে সন্দেহের চোখে দেখা হয়েছে। এবং তাদের দাবি হয়েছে উপেক্ষিত। এসব বহুতর কারণে সামরিক বাহিনীতে ভিতরে ভিতরে গড়ে ওঠা বড় রকমের অসন্তোষ হয়তো এতে মদদ যুগিয়েছে। তবে এত আকস্মিকভাবে এমন একটা ঘটনা ঘটবে তা কেউ ভাবতে পারেনি। এ আকস্মিকতাই সারা দেশকে করে দিয়েছে স্তব্ধ আর হতবাক।

যাই হোক, এ এক মহাসত্য যে, দোষে-গুণেই মানুষ। কোনো নেতৃত্বই সম্পূর্ণ নির্দোষ নয়। তবে বহুতর কারণে শেখ মুজিবের নেতৃত্ব আর অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে ইতিহাসে। এ যুগে বাংলাদেশে এমন ব্যক্তিত্ব আর দ্বিতীয়টি জন্মাবে কিনা সন্দেহ। বাঙালি নেতৃত্বের এক অসাধারণ নিদর্শন শেখ মুজিব। এ নেতৃত্বের সবরকম সবলতা-দুর্বলতার তিনি ছিলেন এক অসামান্য প্রতিভূ।

.

১৩.

বাঙালি জাতীয়তার জন্মদাতা আর সে চেতনার উদ্বোধক শেখ মুজিব। শেখ মুজিব না হলে স্বাধীন বাংলাদেশের আবির্ভাব হতো না। হলেও বিলম্বিত হতো। বাঙালি এসবের জন্য চিরকাল ঋণী থাকবে তার কাছে। তার সমতুল্য নির্ভীক আর এমন দুঃসাহসী নেতা বাংলাদেশে আর দেখা যায়নি। অশেষ নির্যাতনের মুখেও অবনমিত হননি কোনোদিন তিনি। হননি এতটুকুন ভীত-শঙ্কিত। শেষকালে চরিত্রের এ নির্ভীকতাই হয়তো তাঁর মৃত্যুর কারণ হয়েছে। রাষ্ট্রপ্রধানের সুরক্ষিত সরকারি বাড়িতে না থেকে তিনি থাকতেন নিজের অরক্ষিত বাড়িতে যেখানে নিরাপত্তার তেমন কোনো জোরদার ব্যবস্থার প্রয়োজন বোধ করেননি তিনি। বাংলাদেশের মানুষ তাঁকে হত্যা করবে কিংবা হত্যা করতে পারে এমন চিন্তা তার মনের ত্রিসীমানায়ও স্থান পায়নি কোনো দিন। তাই নিশ্চিন্ত নির্ভাবনায় ছিলেন সব সময়। তাঁর সম্বন্ধে বোধকরি কিঞ্চিৎ ঘুরিয়ে বার্নার্ড শ’র কথাটা প্রয়োগ করা যায়–It is dangerous to be too much confident. facay PC syns স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশে যেখানে অন্যান্য মূল্যবোধের মতো রাজনৈতিক মূল্যবোধও এখনো দানা বাঁধেনি।

শেখ মুজিবের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের ইতিহাসের এক উত্তাল ও অবিস্মরণীয় অধ্যায়ের, একটি ঘটনাবহুল অধ্যায়ের, অবসান ঘটলো।

এখন আমরা পা বাড়াচ্ছি এক অনিশ্চয়তার পথে।

.

২৩-৮-৭৫

শেখ মুজিব আর তার পরিবারবর্গের নির্মম হত্যা আমাদের মনের ওপর খুন আর পাপের এক গুরুভার বোঝা যেন চাপিয়ে দিয়েছে। এ ভার আমরা অনেকে প্রতিমুহূর্তে অনুভব না করে পারিনা। ফলে ভারাক্রান্ত হয়ে রয়েছে আমাদের বিবেক। এ ভার মুক্ত হওয়ার এক নিষ্ফল প্রয়াসেই লেখা হয়েছে ‘বিবেকের সংকট’ প্রবন্ধটি যা পরিশিষ্টে দেখতে পাওয়া যাবে।

এক সপ্তাহ পার হয়ে গেলো। তবুও পারছি না বিবেককে এতটুকু হালকা করে তুলতে। এক দুর্বহ বোঝার ভারে বিবেক আমার স্তব্ধ ও বোবা হয়ে আছে এ ক’দিন। এ এক অকল্পনীয় পাপের বোঝা–আমার, আপনার, সারা বাংলাদেশের।

বাঙালি কোমলপ্রাণ, আবেগপ্রবণ, গান আর কবিতা-প্রিয় জাতি ইত্যাদি বিশেষণ শুনতে শুনতে অহেতুক একটা উচ্ছ্বাস আর অহমিকাবোধ যে এক সময় আমরা না করতাম তা নয়। এ যে কতবড় মিথ্যা আর স্বরচিত ফাঁকা এক অর্থহীন স্তোকবাক্য তা ১৯৭০-৭১-এর পাকিস্তানি হামলার সময় নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়েছে। বাঙালি যে নির্বিচারে নিজের পরিচিত, হিতৈষী ও নিকট-প্রতিবেশীর ওপর সুযোগ পেলে কতখানি নির্মম হতে পারে সে দৃশ্য আমরা স্বচক্ষে দেখেছি।

বাংলাদেশের খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবী ও অধ্যাপকদের যারা হত্যা করেছে তারাও এদেশের শিক্ষিত তরুণ, সুজলা-সুফলা কোমল-প্রকৃতি আর কবিতা-প্রাণ বাংলাদেশেরই সন্তান।

শেখ মুজিবের হত্যা সম্বন্ধে বিদেশি সাংবাদিকদের যে বিশদ বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে তাতে মনে হয় এবারকার নির্মমতা পূর্বের যাবতীয় নির্মমতাকে ছাড়িয়ে গেছে। ছেলে-মেয়ে-বাচ্চা, সদ্য বিবাহিতা তরুণী বধূ, এমনকি বাড়ির চাকর-ঝি পর্যন্ত কাউকেও নাকি রেহাই দেয়া হয়নি।

তবে জীবনে-মরণে শেখ মুজিব শেখ মুজিবই থেকে যাবেন। শত্রুর সম্মুখীন হতে দ্বিধা করেননি জীবনে কোনোদিন। পালাননি, পালিয়ে নিজের গা কি প্রাণ বাঁচাতে চাননি একবারও। অবধারিত মৃত্যু জেনেও পাকিস্তানি হামলার সে ভয়াবহ রাত্রেও (১৯৭১-এর ২৫ মার্চ) তিনি নিজের বাড়ি ছেড়ে আত্মরক্ষার জন্য সরে পড়েননি। তাঁর সহকর্মীরা সবাই সরে পড়তে পারলে তার পক্ষে না পারার কোনো কারণই ছিলনা। তিনি ধরা দিয়েছেন। এ ধরা দেয়া যে নির্ঘাত মৃত্যুর হাতে ধরা দেয়া তার পক্ষে তা বুঝতে না পারার কথা নয়। কিন্তু শেখ মুজিব চির অকুতোভয়, বারে বারে কারারুদ্ধ হয়েছেন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ফাঁসির আশঙ্কাও যে ছিল না তা নয়। সব জেনে-শুনেও পালাননি, তাঁর সারা রাজনৈতিক জীবনে একবারও তিনি আত্মগোপন করে থাকেননি। কোনোদিন করেননি আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতি।

এবারও নির্ভয়ে মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েছেন। ১৫ আগস্ট (১৯৭৫) যারা সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত হয়ে তাঁর সামনে আবির্ভূত হয়েছিল, তিনি হয়তো বিশ্বাস করতে পারেননি তারা তাঁকে হত্যা করতে পারে এবং এত নির্মমভাবে এ মৃত্যুর থাবা যে তার প্রিয়তম কনিষ্ঠ পুত্র (যার বয়স দশ-এগারোর বেশি নয়) পর্যন্ত প্রসারিত হবে এ তিনি কেন, কেউই ভাবতে পারেনি। কারো দূর-কল্পনায়ও এ চিন্তা আসার কথা নয়। Truth is stranger than fiction-এ উক্তির সত্যতা নতুন করে যেন প্রমাণিত হলো শেখের জীবনে। এমন হত্যার বিবরণ কোনো উপন্যাসে বর্ণিত হলে পাঠকেরা অবাস্তব কল্পকাহিনী বলে উড়িয়ে দিতেন। কিন্তু এ যে এক নির্জলা সত্য!

১৫ আগস্টের ভোররাত্রির নির্মমতা কারবালার নির্মমতাকেও যেন ছাড়িয়ে গেছে। কারবালায় দু’পক্ষের হাতে অস্ত্র ছিল, তারা ছিল পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। আর সে হত্যা কোনো অর্থেই ঠাণ্ডা রক্তে ছিল না। সৈনিকের পেশা শনিধন, তার হাতের অস্ত্র উত্তোলিত হয় শত্রুর বিরুদ্ধে ন্যায়ের পক্ষে। সে যখন হত্যা করে, তখন তা নৈতিক নিয়ম-কানুনের আওতায় থেকেই তা করে। সৈনিক তো খুনি নয়–তার হাতের অস্ত্র নিরস্ত্র নিরপরাধের ওপর উদ্যত হয় না। অথচ গত ১৫ আগস্ট স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবের বাড়িতে তা-ই ঘটেছে। এ দিনের অপরাধ আর পাপ সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে বলে আমাদের আতঙ্কটা বেশি, কারণ বৃহৎ অপরাধ আর বৃহৎ পাপ বিনা দণ্ডে যায় না। বাংলার মানুষকে সে দণ্ড একদিন একভাবে না একভাবে ভোগ করতেই হবে। এটিও আমার এক বড় রকমের আতঙ্ক।

যিশুখ্রিস্টকে হত্যার পাপের বোঝা ইহুদিরা আজো বয়ে বেড়াচ্ছে। শেখ মুজিব যিশু ছিলেন না কিন্তু ছিলেন মানুষ। তার পরিবারের শিশুরা, ছেলেরা ও মেয়েরা সবাই মানুষ ছিল। ছিল আদম সন্তান। কোরআনে, আদমসন্তানদেরই বলা হয়েছে আশরাফুল মখলুকাৎ। ঝি-চাকরেরাও ব্যতিক্রম নয়। তাই স্বভাবতই মনে শঙ্কা জাগে–এ পাপের বোঝা বাঙালি আর বাংলাদেশকে না জানি কতকাল বইতে হয়। কারণ এ অপরাধ মানবতার বিরুদ্ধে, এ অপরাধের সীমা ব্যক্তিতে সীমিত থাকেনি। নিরপরাধের খুন বিনা বদলায় যায় না। সম্ভবত এটি এ যুগের বৃহত্তম নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড। এমন হৃদয়হীন নির্মমতার নজির ইতিহাসে অন্যত্রও মিলবে কিনা সন্দেহ।

.

১৪.

২৬-৮-৭৫

বিশ্ববিধান এক রহস্যময় ব্যাপার। এ রহস্যের তল পাওয়া যায় না, এ প্রায় মানববুদ্ধির অতীত। তবে দেখা গেছে প্রকৃতি বা বিশ্ববিধান কোনো রকম চরমকেই দীর্ঘদিন বরদাশত করে না। যেভাবে শেখ মুজিব আর তার পরিবারবর্গ আর আত্মীয়স্বজনকে অত্যন্ত অমানুষিক নিষ্ঠুরতার সাথে হত্যা করা হয়েছে তা প্রতিশোধের চরমতম এক ইতিহাস হয়ে থাকলো। এ চরম নির্মমতা কোন পরিণতিতে পৌঁছে কে জানে? দেখা গেছে সব চরমই ডেকে আনে বিনাশ। সে বিনাশ দেখা দেয় অত্যন্ত প্রচণ্ডতম মূর্তি নিয়ে। তাই দেশের ভবিষ্যৎ ভেবে আমি বার বার শঙ্কিত বোধ না করে পারি না।

আমার মনের একটি জিজ্ঞাসা, শেখ মুজিব কি কেবল একজন ব্যক্তি ছিলেন? বাংলাদেশের প্রতিটি নর-নারীর সত্তায় কি মিশে নেই তিনি? তাই মনে হচ্ছে তার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সত্তারও একটা অংশ যেন ধসে গেলো।

বাংলাদেশের মানুষকে বাঙালি বলে পরিচয় দেওয়ার হিম্মৎ কে যুগিয়েছে? শেখ মুজিব ছাড়া এর কি দ্বিতীয় কোনো জবাব আছে? শেখ মুজিবকে হত্যা করা মানে, এক অর্থে, বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে হত্যা করা। তিনি ছিলেন আমাদের স্বাধীনতার, আমাদের হিম্মৎ আর সংগ্রামের প্রতীক। কে আর বিপদ আর সংগ্রামের দিনে বাঙালিকে বজ্রকণ্ঠে ডাক দেবে? যে পুরুষসিংহ সে ডাক দিয়ে সারাদেশকে এক রণক্ষেত্রে পরিণত করতে পারতেন, পারতেন জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে, বিজয় পর্যন্ত সে ঐক্য অটুট রাখতে তাকে আমরা নিজের হাতে হত্যা করেছি। ইতিহাসে এক অকৃতজ্ঞ জাতি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকলাম আমরা চিরকালের জন্য।

এ পাপ আমাকে প্রতিদিন, প্রতি মূহুর্তে পীড়া দেয়। তাই এর উল্লেখ ফিরে ফিরে আসছে আমার এ রোজনামচায়।

বাংলাদেশে শেখ মুজিবই একমাত্র ব্যক্তি যার সম্বন্ধে হেমিংওয়ের এ উক্তিটি পুনরাবৃত্তি করা যায়–Man is not made for defeat. Man can be destroyed, but not defeated.

যাঁরা বলেন শেখ মুজিবের পতন হয়েছে। তারা ভুল বলেন। শেখ মুজিবের পতন হয়নি, শেখ মুজিবের পতন মানে বাংলাদেশের পতন। তা হতে পারে না। বলা যায় শেখ মুজিবের স্রেফ জৈব আর নশ্বর দেহটাকেই বিনষ্ট করা হয়েছে। করা হয়েছে ধ্বংস। শেখ মুজিবের পর যারা আবার সঠিক পথে বাংলাদেশকে চালাবেন তারা সবাই এক একজন ক্ষুদে শেখ মুজিব। তার হাতের তৈরি মানুষ।

শেখ মুজিব বহু জনসভায় বহুবার ঘোষণা করেছেন প্রয়োজন হলে বাংলার মানুষের জন্য তিনি শেষ রক্তবিন্দুও দান করবেন। যে অমোঘ ভবিষ্যদ্বাণী তাঁর মুখ থেকে বার বার উচ্চারিত হয়েছে তা যে অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবে এমন মর্মন্তুদ সত্য হয়ে দাঁড়াবে তা কে জানতো? তিনি বাংলাদেশ আর বাংলাদেশের মানুষের জন্য শুধু তাঁর নিজের নয় তাঁর বংশের শেষ রক্তবিন্দুও দান করে গেলেন। ইতিহাসে স্বদেশের জন্য এতবড় মূল্যদানের দ্বিতীয় নজির আছে কিনা সন্দেহ। বাংলাদেশের মানুষ এ মূল্যদানের প্রতিদান দিতে পারবে কি? এ বিরাট ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ তেমন বিরাট কোনো ফল পাবে কিনা তা আজও বলার উপায় নেই, এখনো তার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তাই স্বতঃই আশঙ্কা জাগে এ যুগের শ্রেষ্ঠতম (রাজনৈতিক অর্থে) বাঙালির আত্মদানও বুঝি ব্যর্থ হয়ে যায়। যে কোনো বৃহৎ ত্যাগকে সফল ও অর্থবহ করে তোলার জন্য যে যযাগ্যতার প্রয়োজন, মনে হয় তা আমাদের নেই।

‘বহু রক্ত দিয়েছি, প্রয়োজন হলে আরো রক্ত দেবো’- শেখের এ উক্তি শেখ নিজেই সত্যে পরিণত করে গেলেন! জীবন দিয়ে জীবন-সত্য পালনের এমন অভূতপূর্ব দৃষ্টান্তও অন্যত্র খুঁজে পাওয়া যাবে না।

নিঃসন্দেহে শেখ ছিলেন এ যুগের সর্বপ্রধান বাঙালি। সে সর্বপ্রধান বাঙালিকে আমরা বাঙালিরাই কিনা নিজের হাতে হত্যা করলাম! আশ্চর্য, এমন অবিশ্বাস্য ঘটনাও সত্য হলো।

বাঙালিকে বাঙালি বলে পরিচয় দিতে কে যুগিয়েছিল সাহস? শেখ মুজিব নয় কি? বজ্রগর্ভ আর অমিত প্রেরণার উৎস ‘জয়বাংলা’ স্লোগান কে তুলে দিয়েছিল বাঙালির মুখে? শেখ মুজিব নয় কি? জিন্দাবাদে সে জোর, সে চেতনা, সে উদ্দীপনা কোথায়? জয়বাংলা প্রদীপ্ত শিখা, জিন্দাবাদ ধার করা এক মৃত বুলি। গ্রামবাংলার শতকরা নব্বইজন যার অর্থই বোঝে না। এ যুগের শ্রেষ্ঠ বাঙালি মুসলমান শেখ মুজিব-এ কথা বললে কিছুমাত্র অত্যুক্তি করা হয় না। হিন্দু বাঙালিয়ানা আর মুসলমান বাঙালিয়ানায় কিছুটা পার্থক্য আছে। তাই মুসলমান কথাটা যোগ করলাম। তবে এ পার্থক্য সবসময় বিরোধমূলক নয়। শেখ মুজিবের বেলায় যেমন তা ছিল না। তাঁর সমগ্র মুসলিমানিত্ব নিয়েই তিনি এক পরিপূর্ণ বাঙালি ছিলেন। এমন বাঙালি বিরল। এ বিরল বাঙালিটিকেই কিনা হত্যা করা হয়েছে। আমরা নিজেরাই করেছি। এ যেন নিজের অঙ্গ নিজে ছেদন করা।

.

৪-৯-৭৫

বাংলাদেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান আর তাঁর পরিবারবর্গকে হত্যা করা হয়েছে। এ হত্যা ওখানে থেমে থাকেনি। তাঁর ভাই, ভাগিনা, ভগ্নিপতি ইত্যাদি বহু আত্মীয়স্বজনও এ হত্যার শিকার হয়েছেন। এঁরা কেউ কেউ শেখসাহেবের ক্ষমতার সুযোগ যে শুধু নিয়েছেন তা নয়, অনেকে সে সুযোগের অপব্যবহারও করেছেন নানাভাবে। শেখসাহেব কোমল প্রকৃতির মানুষ ছিলেন, হয়তো সামলাতে পারেননি। শোনা যায় এঁদের কারো কারো দৌরাত্ম নাকি সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তবে এদেশ সৃষ্টির ক্ষেত্রে এঁদের অবদানও খাটো করে দেখার মতো নয়। আমি ঢাকার বাইরে থাকি বলে স্বচক্ষে দেখার তেমন সুযোগ ঘটেনি। শেখের মতো এতখানি জনপ্রিয়তা পৃথিবীর কোনো নেতা কিংবা রাষ্ট্রনায়ক পেয়েছেন কিনা সন্দেহ। অথচ অতি অল্পকালের মধ্যে কী শোচনীয় পরিণতিই না তাঁর আর তাঁর কিছু আত্মীয়ের জীবনে নেমে এলো। তিনি সঠিক অর্থে শাসক হতে চাননি। সবসময় থেকেছেন, থাকতে চেয়েছেন জনপ্রিয় দলীয় নেতা। শাসক হওয়ার মতো দৃঢ়তা, মন-মেজাজ, দূরদর্শিতার ঘাটতি ছিল কী? একটা রাষ্ট্রের শাসক হওয়ার পরও দলীয় নেতার ভূমিকা তিনি ছাড়তে পারেননি। দলীয় সদস্যরা, ছোট-বড় সবাই, আর দূর কিংবা নিকট-আত্মীয়রা একজোট হয়ে যেন তার দুর্বলতার সুযোগ নিতে চেয়েছেন। ষোল আনায় খুশি থাকেননি কেউ কেউ, পেতে চেয়েছেন আঠারো আনা।

রাষ্ট্র পরিচালক দৃঢ়চিত্ত, নিরপেক্ষ আর দূরদর্শী না হলে তাঁর নিজের মানুষেরাই তাঁর প্রধান শত্রু হয়ে দাঁড়ায়। শেখসাহেবের বেলায়ও তাই হয়েছে। এ ধরনের আপনজনেরা নিজের হাতে কাকেও মারে না বটে কিন্তু মরার পথ তৈরি করে দেয়। তার অন্য শত্রুর চেয়ে এসব গৃহশত্রুদের থেকে বেশি করে সাবধান থাকতে হয়।

বিভীষণেরা সবসময় মারাত্মক ভূমিকা নিয়ে থাকে। শেখ ছদ্মবেশী, গৃহশত্রু সম্বন্ধে ছিলেন অন্ধ আর অনেকটা উদাসীন। যে কোনো ক্ষমতাসীনের পক্ষে শেখের জীবন থেকে পাঠ নেওয়া উচিত। সবসময় সাবধান থাকতে হয় আত্মীয়রূপী শত্রুদের কাছ থেকে। অনেক সময় আত্মীয়রা নিজেরাও হয়তো বুঝতে পারেন না বা বুঝতে চান না কীভাবে তারা নিজের পরম আত্মীয়েরও সর্বনাশ ডেকে আনছেন।

আমার মনে হয় শেখের শত্রুতা করেছেন তাঁর নিকট-আত্মীয়রা, তার আপনজনেরাই সবচেয়ে বেশি।

ক্ষমতা আর ক্ষমতার সুযোগ সন্ধান দুই-ই হয়ে থাকে অন্ধ। এরাই একদিন ডুবে মরে স্বখাত-সলিলে। শেখ পরিণাম ভেবে সবসময় কাজ করেননি। ইতিপূর্বে বাংলাদেশে বড় রকমের কোনো রাজনৈতিক হত্যা ঘটেনি! শেখের জীবনের এ মর্মন্তুদ ট্রাজেডি দিয়েই তার সূচনা। দেশের জন্য এ এক দারুণ অশুভ আর এক ভয়াবহ সূচনা।

.

৪-১০-৭৫

সাম্প্রতিক ঘটনায় শেখসাহেবের হত্যা সম্পর্কে আমি অনবরত বিবেকের একটা দংশন অনুভব করছি। এত বড় একটা দ্বিতীয় কারবালা ঘটে গেলো দেশে, নির্মমতায় যে ঘটনার জুড়ি নেই ইতিহাসে। সে সম্পর্কে দেশের সর্বাপেক্ষা সচেতন অংশ শিক্ষিত আর বুদ্ধিজীবী সমাজ কিছুমাত্র বিচলিত বোধ করছেন না, এ ভাবা যায় না। আশ্চর্য, মননশীল লেখক-তরুণ কবিরা একটানা অতি নিরস ও নিষ্প্রাণ প্রেমের বা ‘আমি তুমি’ মার্কা কবিতা লিখে চলেছেন। যে ‘আমি তুমি’ অনির্দিষ্ট কায়াহীন ছায়ামাত্র। অন্যদের লেখায়ও এ ভয়াবহ বিয়োগান্ত নাটকের কোনো প্রতিফলন এযাবৎ দেখিনি। এত বড় একক ট্র্যাজিক ঘটনা তারা আর কোথায় খুঁজে পাবেন লেখার জন্য?

এমনও হতে পারে অনেকে লিখছেন, লিখেছেন, কিন্তু ‘নিয়ন্ত্রিত’ পত্রপত্রিকা তা ছাপছে না।

‘বিবেকের সংকট’ নামে আমি একটি প্রবন্ধ লিখে ‘ইত্তেফাকে’ পাঠিয়েছি গত মাসের ১৫-১৬ তারিখের দিকে। ইত্তেফাক লেখাটা আজও ছাপেনি। এখন শুনছি লেখাটা সরকারি মহলের হাতে হাতে ফিরছে। তারা অনেকে পড়েছেন। তাঁদের মনোভাব ‘হিং টিং ছটের’ মতো।

দেশের এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেলো তাতে আমার মনে এতটুকু প্রতিক্রিয়া হয়নি, এর মতো জড়তা আমি কল্পনা করতে পারি না। আমার মন এখনো এতখানি জড়ত্ব পায়নি, এটি আমার পক্ষে যুগপৎ দুঃখ ও সান্ত্বনার কথা। দুঃখটা এ কারণে যে, সবকিছু আমাকে ভাবায়, চিন্তিত করে, যা আমার প্রতিকারের বাইরে তা-ও। এতে আমার মনের শান্তি নষ্ট হয়। কাটাতে হয় অনেক বিনিদ্র রাত। মন ও আবেগ-অনুভূতির জড়ত্ব পাওয়ার মতো দুর্ভাগ্য লেখকের জন্য আর কিছু হতে পারে না। আমার মন এখনো তেমন দশায় পৌঁছায়নি বলে আমি কিঞ্চিৎ সান্ত্বনা বোধ করে থাকি। আমার ওই না-মঞ্জুর লেখাটায় আমি শুধু বিবেকের মানবিক দায়-দায়িত্বের কথাই বলতে চেয়েছি। দোষারোপ করিনি কাকেও। বন্ধুর প্রতি বন্ধুর, সহকর্মীর প্রতি সহকর্মীর, প্রতিবেশীর প্রতি প্রতিবেশীর, মৃতের প্রতি জীবিতের, মুসলমানের প্রতি মুসলমানের ব্যবহারের কথা বলেছি শুধু। এ সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি ইসলাম আর ইসলামের নবীর শিক্ষার প্রতি। এমন লেখাও আজ ছাপা যাচ্ছে না আমাদের এ স্বাধীন আর সার্বভৌম দেশে। অদৃষ্টের পরিহাস ছাড়া একে আর কী বলবো? Sword is mightier than everything’–এ কথা, এত বড় চাক্ষুষ প্রমাণের পরও, আমার মন কিছুতেই মানতে রাজি নয়।

বিবেক, সব রকম মূল্যবোধ, যুগ-যুগান্তের ধর্মচেতনা, আইন ও নৈতিকতা সব কি মিথ্যা হয়ে যাবে? আমার মন বলছে–না। আমার কলম বলছে–না।

.

১৫.

বাংলা ভাষায় ‘অধিকার ভেদ’ বলে একটি কথা আছে। কথাটি মূল্যবান। অনেকে, বিশেষ করে যারা ক্ষমতাসীন, তাঁরা কথাটাকে মোটেও আমল দিতে চান না। অধিকারের সীমা সম্বন্ধে তাঁরা অনেক সময় থাকেন না সচেতন। চলেন না তার অধিকার মেনে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে নিজেই হন হাস্যস্পদ।

ইংরেজ আমলে সারা ভারতবর্ষ বিভক্ত ছিল নানা প্রদেশে। প্রাদেশিক গভর্নরেরা প্রদেশের অন্তর্গত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চ্যান্সেলরের দায়িত্বও পালন করতেন। তাঁদের পক্ষে সবচেয়ে সম্মানের আর গুরুত্বপুর্ণ দায়িত্ব ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশন বা সমাবর্তনে সভাপতিত্ব করা আর ডিগ্রি বা সনদ বিতরণ। বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট বা বিধান অনুসারে এ দায়িত্ব পালন চ্যান্সেলরের পক্ষে বাধ্যতামূলক।

বলাবাহুল্য, সেকালের গভর্নরেরা সবাই উচ্চশিক্ষিত হতেন, প্রায় সবাই আসতেন অক্সফোর্ড, কেম্ব্রিজের পথ মাড়িয়ে। এমনও কেউ কেউ ছিলেন যারা সাহিত্য-শিল্পে মূল্যবান অবদান রেখেছেন। কাজেই সমাবর্তনে তাদের উপস্থিতি বা সভাপতির আসনে তাদের তেমন বেমানান মনে হতো না।

পাকিস্তান আমলেও যারা গভর্নর হতেন, দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া, মোটামুটি সবাই শিক্ষিত ছিলেন। স্যার ফিরোজ খাঁ নূনের ‘আত্মজীবনী’ আমি পড়েছি, চমৎকার সাহিত্যকর্ম।

বাংলাদেশ হওয়ার পর স্বভাবতই প্রদেশ আর রইল না। প্রদেশ হয়ে গেলো একটি দেশ আর সার্বভৌম রাষ্ট্র। ফলে গভর্নর আর থাকলো না। রাষ্ট্রের সর্বপ্রধান কর্তা হয়ে গেলেন প্রেসিডেন্ট বা রাষ্ট্রপতি। সেই সঙ্গে তিনিই হলেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলির চ্যান্সেলরও। এ পদ যেমনি গুরুত্বপূর্ণ তেমনি নাজুকও। এ পদ দাবি করে কিছুটা একাডেমিক গুণাবলি।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি যোগ দেওয়ার পর জানতে পারলাম, প্রতিষ্ঠার পর থেকে কোন সমাবর্তনই হয়নি এ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ সাত-আট বছরে কয়েক হাজার ছেলে-মেয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে নানাদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকে চলে গেছে বিদেশে। এদের একমাত্র সম্বল প্রভিশনাল সার্টিফিকেট নামে একটি কাগজ। এতকাল এভাবে কাজ চলে এসেছে। একদিন এক অভিভাবক এসে জানালেন তার ছেলে আমেরিকায় ওখানকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছে, প্রভিশনাল সার্টিফিকেটের জোরে সে তো ভর্তি হয়েছে, কিন্তু মূল সার্টিফিকেট না দেখাতে পারলে ওর ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়াই হবে না। ওর সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এখন অরিজিনেল সার্টিফিকেট দাবি করছেন। ওটা ছাড়া নাকি ওর পরীক্ষা দেওয়া চলবে না। এরকম আরো বহু ছেলে-মেয়ের জীবনে হয়তো সমস্যা দেখা দিয়েছে, সামনেও দেখা দেবে। অতএব কনভোকেশন তথা সমাবর্তন না হলে নয়। এ ছাড়া পাকা বা কায়েমি ডিগ্রি দেওয়া যায় না। রেজিস্ট্রার আর পরীক্ষা-নিয়ন্ত্রককে ডেকে সমাবর্তনের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার নির্দেশ প্রদান করলাম। অডিটরিয়াম তখনো অসম্পূর্ণ, করতে হবে খেলার মাঠে সামিয়ানা খাঁটিয়ে। তাই সুদিন অর্থাৎ নভেম্বর-ডিসেম্বরের দরকার। কনভোকেশনে হাজির হয়ে ডিগ্রি গ্রহণের ফি নির্ধারিত করে তার বিজ্ঞপ্তিও দেওয়া হলো বিভিন্ন কাগজে। ডিগ্রির পাঠ ঠিক করে নিয়ে তা মুদ্রণের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হলো সরকারি প্রেসে। প্রাথমিক আয়োজন প্রায় শেষ।

শেখ মুজিব তখন রাষ্ট্রপতি। অতএব চ্যান্সেলরও। অ্যাক্টের বিধান অনুসারে তাকেই সমাবর্তনে করতে হবে সভাপতিত্ব। এবং সেইসঙ্গে ডিগ্রি বিতরণও। তিনি কর্মব্যস্ত। রাজনীতির লোক বলে তাঁর কর্মব্যস্ততা অন্য রাষ্ট্রপতির তুলনায় অনেক বেশি। কাজেই তাঁর কখন সময় হবে তা জেনে নেওয়াই এখন আমার প্রধান কাজ।

ফোনে সময় ঠিক করে নিয়ে এ উদ্দেশ্যে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে একদিন ঢাকায় গিয়ে গণভবনে উপস্থিত হলাম। তিনি খবর দিয়ে তদানীন্তন শিক্ষামন্ত্রী ডক্টর মোজাফফর আহমদ চৌধুরীকেও তখন ডেকে নিয়েছিলেন। আমার প্রস্তাব তাঁকে জানালাম–বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর এ যাবৎ কোনো সমাবর্তনই হয়নি, এটা অত্যন্ত দুঃখের বিষয়। পাস করে যাওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের খুব অসুবিধা হচ্ছে। আমি ঠিক করেছি, সেভাবে প্রস্তুতিও নিয়েছি, যেভাবেই হোক সমাবর্তন করে ফেলা। আপনি কখন যেতে পারবেন বলুন, সেভাবে দিন-তারিখ ঠিক করতে হবে, ছাপাতে হবে নিমন্ত্রণপত্র ইত্যাদি। তিনি যেন আকাশ থেকে পড়লেন–

: আমি কী করতে যাবো?

চ্যান্সেলর হিসেবে আপনাকেই সমাবর্তনে সভাপতিত্ব আর ডিগ্রি বিতরণ করতে হবে।

এ কাজ আমাকে দিয়ে হবে না, মানাবেও না। অতগুলো শিক্ষিত পণ্ডিতজনের সামনে আমার মতো একজন অল্পশিক্ষিতের পক্ষে কনভোকেশনে সভাপতিত্ব করা–আমি ভাবতেই পারি না। তাঁর এ কথা শুনে আমি আর মোজাফফরসাহেব একসঙ্গে বলে উঠলাম–

এ যে অ্যাক্টের বিধান। এ ছাড়া অর্থাৎ চ্যান্সেলরের উপস্থিতি ছাড়া কনভোকেশনই হতে পারে না যে।

তিনি বললেন–

এ যদি অ্যাক্ট হয় তবে সে অ্যাক্ট বদলানো কি যায় না?

তিনি নিজেই বললেন–

চ্যান্সেলরের পরিবর্তে শিক্ষামন্ত্রী, না হয় ভাইস চ্যান্সেলর নতুবা দেশের একজন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদেরই তো সমাবর্তনে সভাপতিত্ব করা উচিত। মোজাফফরসাহেব, আপনি এ মর্মে একটা অ্যামেন্ডমেন্ট তৈরি করে ফেলুন।

সেদিনের আলোচনা ওখানেই শেষ হলো। তার অল্পদিন পরে তো তিনিও রইলেন না এ দুনিয়ায়, আমিও থাকলাম না চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর। মোজাফফরসাহেবও শুধু যে মন্ত্রী থাকলেন না তা নয়, থাকলেন না এ পৃথিবীতেও! Man proposes God disposes. শেখসাহেবের কাণ্ডজ্ঞান অর্থাৎ বিবেচনাবোধ ও অধিকারের সীমা সম্বন্ধে সচেতনতা দেখে আমি সেদিন মুগ্ধ হয়েছিলাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন, প্রথম সমাবর্তন আজো হয়নি। সমাবর্তন উৎসবের প্রস্তুতিপর্ব আমি যেখানে ফেলে এসেছিলাম, মনে হয় আজো সেখানে স্তব্ধ হয়ে আছে। কিছু অগ্রগতি হয়ে থাকলে তা আমার অজানা। ব্যবহারিক সুবিধা-অসুবিধার অতিরিক্ত সমাবর্তনের একটা আবেগী দিকও আছে, তা-ও উপেক্ষণীয় নয়। সমাবর্তন ছাত্র-ছাত্রীদের জীবনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যন্ত আকর্ষণীয় ঘটনা। এক ভাবগম্ভীর পরিবেশে জ্ঞানী-গুণীজনের সমাবেশে একাডেমিক গাউন পরে ডিগ্রি গ্রহণের মধ্যে যে অপূর্ব শিহরণ আছে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা আজো সে শিহরণ থেকে বঞ্চিত।

আমার মতে সমাবর্তন প্রতি বছরই হওয়া উচিত, তাহলে আয়োজন করা সহজ হয় আর ছাত্রছাত্রীদেরও অকারণ প্রতীক্ষায় থাকতে হয় না এবং চ্যান্সেলরের পক্ষেও বছরে অন্তত একবার সরেজমিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের খবরাখবর নেওয়া সম্ভব হয়। সব বিশ্ববিদ্যালয়েরই এ নীতি অনুসরণ করা উচিত, অর্থাৎ প্রতি বছর ‘সমাবর্তন’ করে ফেলা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *