৫. অতিপ্রাকৃত শক্তির জগৎ

পরিচ্ছেদ – পাঁচ : অতিপ্রাকৃত শক্তির জগৎ

মানুষ সাধারণত বিভিন্ন শক্তির আধার হিসেবে বিভিন্ন দেবদেবীর অস্তিত্বেও যেমন আস্থাশীল তেমনি আবার শুভ ও অশুভ বা মঙ্গলকর ও অমঙ্গলকর এই দুরকমের অতিপ্রাকৃত শক্তির সম্পর্কেও যথেষ্ট আস্থা পোষণ করে। শুভ অশুভ এই দুই শক্তি মানুষের কর্মজীবনের নির্দিষ্ট কতকগুলি দিকে যে বিশেষভাবে প্রভাব বিস্তার করে তাও আমরা যে কোন কারণেই হোক, বিশ্বাস করে থাকি। আর সেই জন্যেই ঐ শক্তির সন্তুষ্টি বিধানের জন্য নানারকমের ধর্মীয় আচার বিচার অনুষ্ঠান উৎসর্গ ইত্যাদির প্রচলন আছে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ভিন্ন ভিন্ন যুগে। তাছাড়া অশুভ শক্তির ঠিকমত সন্তুষ্টি বিধান করতে পারলে নানা দুঃখ দুর্দশা বা রোগ ভোগের হাত থেকে যেমন রেহাই পাওয়া সম্ভব তেমনি আবার অনেক রকমের কামনা বাসনা পূর্ণ করার সুযোগও মেলে; বহু আকাঙ্খিত বস্তু হাতের মুঠোয় আসে। এই বিশ্বাস বুকে নিয়েই যুগ যুগান্তর ধরে মানুষ অশুভ শক্তিকে সন্তুষ্ট করার বিচিত্র সব আচার অনুষ্ঠান পালন করে আসছে। অবশ্য ওঝা, রোজা বা গুণিনরাই মানুষের মনে এই জাতীয় বিশ্বাসকে জোরদার করে তুলেছে। গুণিনরাই গুণে গেঁথে নির্দিষ্ট রোগের কারণ হিসেবে দাঁড় করিয়েছে নির্দিষ্ট কোন অমঙ্গলকর অদৃশ্য শক্তিকে। ব্যক্তি মানুষের জটিল সমস্যা সমাধানের উপায় হিসেবেও কোন না কোন অশুভ শক্তির তৃপ্তি বিধানের বিধান দিয়েছে। ধর্মীয় ক্রিয়াকর্ম আচার অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। তাই লক্ষ্য করা গেছে যে, গুণিনরা কতিপয় দেবদেবীকে বেছে নিয়ে তাদের বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করেছে, এবং সেই সঙ্গে কিছু বিদেহী আত্মা বা স্পিরিটকে ধরে রেখেছে দেবদেবীর পাশাপাশি। সাধারণ মানুষকে গুণিনরা বুঝিয়েছে যে, ঐ সব বিদেহী আত্মাই বাতাসে ভর করে অহরহ ঘুরে বেড়ায় যত কিছু অনর্থের সৃষ্টি তারাই করে বেড়াচ্ছে মানুষের দৈনন্দিন জীবন যাত্রার পথে। হিন্দু ধর্ম শাস্ত্রে আমরা তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর উল্লেখ পেয়ে থাকি বটে কিন্তু তাদের গুণাবলী, আকৃতি বা গঠন, শক্তি ও তার প্রকাশ সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে কিছু জানা যায় না। তবে এই কোটি কোটি দেবদেবী ছাড়াও আরো কিছু বিদেহী শক্তি সম্পর্কে লোকের মনে অনেক রকমের বিশ্বাস আছে। এই বিদেহী শক্তিগুলিকে ইষ্টকর ও অনিষ্টকর হিসেবে দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে। উক্ত দুই শ্রেণীর বিদেহী শক্তিগুলির আকৃতি প্রকৃতি সম্পর্কে যা কিছু বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তা পৌরাণিক কাল থেকে হিন্দুধর্মাবলম্বী মানুষের মধ্যে বংশানুক্রমিকভাবেই চলে আসছে। লক্ষণীয় যে, বিদেহী শক্তিসমূহের আকৃতি বা রূপের বর্ণনা ধর্মীয় ভাবাবেগ ও কল্পনার আতিশয্যে সৃষ্টি হয়ে থাকলেও তা এক যুগের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করেছে তার পূর্ববর্তী যুগের মানুষের কাছে থেকে, উত্তরাধিকার সূত্রে। তবে বিদেহী শক্তির এই সমস্ত anthropometric forms ছাড়াও তাদের কার্যকলাপের রীতিনীতি ধরণ ধারণ প্রকৃতিও তাদের পরিতৃপ্ত করার নানান দিক বা বিষয় সম্পর্কে গুণিনরা অনেক কিছু জানে, অনেক কিছু বোঝে, আবার বেশ কিছু সংখ্যক অতিশয় সরল সিধে মানুষ ও বিদেহী শক্তি সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল।

বর্তমান পরিচ্ছেদে এমন কিছু দেবদেবী, বিদেহী ও নৈর্ব্যক্তিক শক্তির বিবরণ দেবার চেষ্টা করা হয়েছে যে গুলি গুপ্তবিদ্যাচর্চাকারীদের গুপ্তক্রিয়াকর্মের সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কযুক্ত। গ্রন্থকার এখানে তার আলোচনাকে শুধুমাত্র সাধারণ মানুষের ধর্মজীবনে ইন্দ্রজালের প্রত্যক্ষ প্রভাব ও বিশেষ করে গুণিনদের গুপ্তক্রিয়ার অনুশীলন, এই দুটি দিকেই আবদ্ধ রাখার চেষ্টা করেছেন। বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসকারী বিভিন্ন গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তি বা মানুষ তার অজ্ঞতা বা অবৈজ্ঞানিক চিন্তার জন্যেই যাদুধর্মের প্রাচীন প্রথা বা ট্র্যাডিশনকে আঁকড়ে থেকেছে বলে আমরা মনে করতে পারি। কিন্তু এ প্রশ্নের বিচার বিশ্লেষণে গ্রন্থকার এখানে আদৌ প্রয়াসী হন নি। তিনি এখানে কেবল দেখাতে চেয়েছেন যে, বিভিন্ন রকমের জটিল অবস্থা বা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্যে গুপ্তবিদ্যার কিরকম প্রয়োগ হয়ে থাকে, গুপ্ত প্রতিষ্ঠান কিভাবে গুপ্ত কার্যপ্রণালীর পরিচালনা করে; সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে গুপ্তসংস্থার ঘনিষ্ঠতা হল কি করে! সাধারণ মানুষ এটাই বা জানলো কি করে যে, অতি প্রাকৃত জগতের ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর সব অদৃশ্য শক্তি তাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে আসছে কোন সেই সুদূর অতীত কাল থেকে।

এ সব বিষয়ে আলোকপাত করার উদ্দেশ্যেই কিছু সংখ্যক পরিচিত দেবদেবী ও অতিপ্রাকৃত শক্তিকে বেছে নিয়ে তাদের কয়েকটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছে : এছাড়া তাদের বৈশিষ্ট্য-প্রকৃতি ও পুজো পাঠের বিভিন্ন ধরণ বা পদ্ধতির দিকেই বেশী করে দৃষ্টি দেবার প্রচেষ্টা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, আমাদের আলোচ্য দেবদেবীর মধ্যে এমন কয়েকটি আছে যারা সর্ব ভারতীয় দেবদেবী হিসেবে পূজিত হয়ে থাকে, তাদের বাদ দিয়ে আর যে সমস্ত দেবদেবীর উল্লেখ করা হয়েছে তারা পুরোপুরি আঞ্চলিক দেবদেবী হিসেবেই খ্যাত। আবার একই দেবতা যে বিভিন্ন নামে পরিচিত তা আমরা খুব সহজেই দেখতে পাই। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায় যে, সবার রক্ষাকর্তা হরি বা মধুসূদনই আবার বিষ্ণু বা নারায়ণ রূপে পুজো পেয়ে থাকেন। আরো অনেক দেবদেবীই এইভাবে সুখ্যাত হয়ে থাকেন তা আর না বললেও চলে। এখানে এখন আমাদের আলোচ্য দেবদেবী ও বিদেহী শক্তিগুলিকে কিভাবে শ্রেণী বদ্ধ। করা হয়েছে বার নম্বর সারণিতে তা স্পষ্ট।

সারণি বার
দেবদেবী ও বিদেহী শক্তির শ্রেণী বিন্যাস

ক্রমিক সংখ্যানামের বিবরণপুরুষ/নারীপরিচিতিঅবস্থানিক সীমা
নরসিংহ, নারায়ণ, গোপাল, হরি, বিষ্ণু, সত্যনারায়ণপুরুষবিষ্ণু (রক্ষাকর্তা)সর্বভারতীয়
ব্রহ্মাপুরুষব্রহ্মা (সৃষ্টিকর্তা)সর্বভারতীয়
মহাদেব/ শিব পঞ্চানন/রুদ্রপুরুষশিব (সংহারকর্তা)সর্বভারতীয়
লক্ষ্মীনারীঐশ্বর্যের দেবী (বিষ্ণুর ভাৰ্য্যা)সর্বভারতীয়
ভগবতী/কামাক্ষ্যা বিশালাক্ষ্মী/পার্বতী  নারীভগবতী (শিবজায়া)সর্বভারতীয়
চণ্ডীনারীইনি শিবজায়া হলেও পরিচিতি ভিন্নসর্বভারতীয়
কালীনারীইনি শিবজায়া হলেও পরিচিতি ভিন্নসর্বভারতীয়
শীতলানারীমহামারীর দেবীসর্বভারতীয়
মনসানারীসর্পকূলের দেবীসর্বভারতীয়
১০রামরঘুনাথপুরুষমহাকাব্যের নায়ক (বিষ্ণুঅবতার)সর্বভারতীয়
১১লক্ষ্মণপুরুষরামচন্দ্রের ভাইসর্বভারতীয়
১২মহাবীর হনুমানপুরুষরামভক্ত মহাবীর হনুমান (দৈবশক্তির অধিকারী)সর্বভারতীয়
১৩সীতানারীরামচন্দ্রের পত্নীসর্বভারতীয়
১৪আল্লাপুরুষবিশ্বস্রষ্টা, ঈশ্বর, (ইসলাম ধর্ম অনুসারে)সর্বভারতীয়
১৫সিংবোঙ্গাপুরুষউপজাতি গোষ্ঠী সাঁওতালী মুণ্ডা, ভূমিজ, বীবহড় প্রভৃতির পরম দেবতা বা ঈশ্বরআঞ্চলিক
১৬মারাংবুরুপুরুষপর্বতের দেবতা সাঁওতাল/মুণ্ডাআঞ্চলিক
১৭বরামপুরুষলোধা/ভূমিজ প্রভৃতি উপজাতির গ্রাম্যদেবতাআঞ্চলিক
১৮যুগিনীনারীদেবী শীতলার সহসঙ্গিনীআঞ্চলিক
১৯পিশাচিনীনারীডাইনীর প্রেতাত্মাআঞ্চলিক
২০মুনিসপুরুষপূর্বপুরুষের আত্মাআঞ্চলিক
২১চণ্ডপুরুষবাস্তুভূতআঞ্চলিক
২২সুপুরুষপুরুষপুরুষভূতআঞ্চলিক
২৩কালপুরুষপুরুষপুরুষভূতআঞ্চলিক
২৪যক্ষপুরুষধন সম্পদ আগলে রাখার ভূত/শক্তিআঞ্চলিক
২৫ভূত/প্রেত/পেতনিপুরুষ/নারীপুরুষ বা নারীর বেশে ঘুরে বেড়ান অতৃপ্ত আত্মাআঞ্চলিক
২৬চিরগুণিনারীসন্তান প্রসবকালে যে নারীর মৃত্যু ঘটেছে তার আত্মাআঞ্চলিক
২৭প্রেতাশিনীপুরুষ/নারীশিশুভূতআঞ্চলিক
২৮মেছুয়া (বেড়াল) গোমুয়া (গবাদি) বাগোয়া (বাঘ) ঘোড়া (ঘোড়া)পুরুষ/নারীউল্লিখিত পশুর আত্মা বা ভূতআঞ্চলিক

প্রদত্ত সারণি থেকে এটি পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, গ্রামের মানুষরা নানারকমের দেবদেবী ও অশরীরী শক্তি সম্পর্কে বিশেষভাবে অবগত আছেন; ঐ সব অতিপ্রাকৃত শক্তি বা অপদেবতার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যোগাযোগ স্থাপনে গুণিনরা যে সবসময়ই সক্ষম সে কথা গ্রামবাসীদের বলে বোঝানোর প্রয়োজন হয় না। কারণ গুণিনদের অলৌকিক ক্ষমতায় গ্রাম্য মানুষদের যে বিশ্বাস তা প্রায় সহজাত। আমাদের উল্লিখিত দেবদেবী ছাড়াও আরো বহু রকমের দেবতার অস্তিত্বে বিশ্বাস করে গ্রামের সাধারণ মানুষ। তারা মনপ্রাণ দিয়ে ঐ সমস্ত দেবতার পুজো করে; নানান সামগ্রী দিয়ে পুজো করার ধর্মীয় প্রথা যথাযথ ভাবে পালন করে। কিন্তু গ্রামবাসীদের জীবনে যখনই কোনরকম দুঃখ কষ্টের হঠাৎ করে উদয় হয় তখনই তারা সারণিতে উল্লিখিত কোন না কোন দেবতার কৃপা ভিক্ষে করে, যে কোনভাবে হোক, দৈবশক্তির সংস্পর্শে আসার জন্যে উদগ্রীব হয়ে ওঠে। কিন্তু শক্তির সংস্পর্শে আসার ক্ষমতা মায়াবী বা গুণিন ছাড়া আর তো কারো নেই। তাই তাদের হয়ে গুণিনই এগিয়ে যায় দেবতার সঙ্গে যোগাযোগ করতে আলৌকিক শক্তি প্রয়োগ করে। গুণিনদের নির্দেশ অনুসারে গ্রামবাসীরা বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানের যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করে। বহু রকমের কষ্ট স্বীকার করে হাসিমুখে। সুতরাং বিপদ মুক্তির উদ্দেশ্যে নানান ধর্মীয় আচারের প্রচলন আছে গ্রামীণ সমাজজীবনের বিভিন্ন স্তরে। এই সব আচার অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, লক্ষ্মী, ভগবতী, সিংবোঙা, মারাংবুর প্রভৃতি দেবদেবীর সন্তুষ্টি বিধানের কত রীতি নীতির যে প্রচলন হয়ে আসছে তার আর ইয়ত্তা নেই। তবে ভূত প্রেত বা অশুভ শক্তি বিতাড়ন করার জন্যে গুপ্তক্রিয়াকর্মের যে আসর বসে তাতে রাম/রঘুনাথ লক্ষ্মণ ও বীর হনুমানের নামেই গুণিনরা মন্ত্র পাঠ করে। স্ত্রী দেবতার মধ্যে মা চণ্ডী, মা শেতলা, ও মা মনসার প্রতি গ্রামবাসীদের শ্রদ্ধাভক্তি ও বিশ্বাস যথেষ্ট মাত্রায় দেখা যায়। তার কারণ, কঠিন সংকট ও দুরারোগ্য ব্যধির হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্যে এই তিন দেবীর কাছেই কিছু মানত করতে হয়। তাছাড়া সাপের রোজাদের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন মনসা। মনসার কৃপা না হলে সাপে কাটা রোগীকে বাঁচানো যায় না। তাই এই ত্রিদেবীই গাঁয়ের মানুষের কাছে বড়ই জাগ্রত। প্রত্যেক দেবীর চরণে সারা বছর ধরে গ্রামবাসীরা যথাসাধ্য ভক্তি অর্ঘ্য নিবেদন করে। কিন্তু এমন কিছু ভূত প্রেত প্রেতিনী আছে যারা কেবল গ্রামের মানুষদের অনিষ্ট সাধন করে। এরা যুগিনী, পিশাচিনী, মুনিস, চণ্ড, সুপুরুষ, কালপুরুষ, যক্ষ, চিরগুনী, প্রেতাসিনী ইত্যাদি নামে কুখ্যাত ও গ্রামবাসীদের প্রাত্যহিক জীবনের আতঙ্ক হয়েই আছে। আবার সেই সঙ্গেই গোমুয়া, মেছুয়া, বাগোয়া, ঘোরা ইত্যাদি নামেও আছে কিছু জীবজন্তুর অনিষ্টকারী প্রেতাত্মা (evil animal spirit) গ্রামবাসীদের গরু ছাগল ভেড়ার ওপর যখন তখন নজর দেয়। এই সমস্ত দুষ্ট শক্তির আক্রমণ থেকে সব কিছু রক্ষে করার দায়ভার বহন করে রোজা, ওঝা, গুণিন বা গণৎকাররা। প্রায় প্রতিটি গ্রামেই গুণিনদের লেগে থাকতে হয় দুষ্ট শক্তির আক্রমণ প্রতিহত ও তাকে বিতাড়ন করার নানারকম ক্রিয়াকর্মে। আমাদের উপস্থিত করা সারণিতে এই সব বিদেহী শক্তির উল্লেখ যেমন করা হয়েছে তেমনি আবার তারা কিভাবে কি জাতীয় অনিষ্ট সাধন করে এবং অনিষ্টের হাত থেকে বাঁচবার জন্যে দুষ্ট শক্তিকে তুষ্ট ও নিয়ন্ত্রণের নানান উপায় ও উল্লিখিত হয়েছে। এছাড়া, অশুভ শক্তিকে রুখে দেওয়া বা প্রতিহত করা, তার আক্রোশ পড়া মানুষের দুঃখ কষ্ট, দুর্ভাগ্য ইত্যাদি মোচন করার ব্যাপারে কি রকম ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে সে বিষয়েও পরবর্তী পৃষ্ঠাগুলিতে বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে।

(১) বিষ্ণু– ভগবান বিষ্ণু হলেন মূলত এক হিন্দু দেবতা। তিন দেবতার মধ্যে তিনিই হলেন প্রধান দেবতা। সর্ব শক্তিমান বলে এনাকে গণ্য করা হয়। সারা দেশের হিন্দু সম্প্রদায় ভগবান বিষ্ণুর একশ আটটি নামের সাথে পরিচিত। তিনিই হরি, নারায়ণ, সত্যনারায়ণ, গোপাল ও নরসিংহ নামেও এখানে উল্লিখিত হয়েছেন। বিষ্ণু বড়ই শান্তি প্রিয় দেবতা। ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিরা তাকে নিত্য পুজো করে। ভারতের বহু জায়গায় বড় বড় বিষ্ণু মন্দির প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। আমাদের বিভিন্ন পৌরাণিক কথা কাহিনীতে ভগবান বিষ্ণু বিশ্ব সংরক্ষণকারী বলে বর্ণিত হয়েছেন। আবার কখন কখন তাকে চতুর্ভুজ কিম্বা পঞ্চভূজ মূর্তিতেও দেখানো হয়েছে। লাঙল, চক্র, গদা, পদ্মধারী বিষ্ণুই হলেন চতুর্ভূজ বিষ্ণুমূর্তি। তাঁর গলায় থাকে একরাশ বনফুলের মালা। গুণিন তার রোগীদের রোগ নিরাময়ের পর বিষ্ণু পুজোর নির্দেশ দেয়। গ্রাম্য মহিলাদের অনেকেই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে যে, শুদ্ধাচারে নিয়মিত বিষ্ণু পুজো করলে যে কোন রকমের কঠিন স্ত্রী রোগ হোক না কেন, তা একেবারে সেরে যেতে বাধ্য। গুণিন তথা মায়াবীরা অধিকাংশ সময় বিষ্ণু পুজো করতে বলে শিষ্যদের। কারণ এই দেবতা মঙ্গল ছাড়া কখনো কারো অমঙ্গল করেন না। বহু ব্রাহ্মণ পুরোহিত কষ্টিপাথরের শালগ্রাম শিলা কে বিষ্ণু রূপে পুজো করে। শিলার ওপর চন্দন দিয়ে ওঁ বিষ্ণু’ লিখে ফল, মিষ্টি, চাল, কলা ও দূর্বা ঘাস দিয়ে ভগবান বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে নিবেদন করে।

(২) ব্রহ্মা — পরম আরাধ্য ব্রহ্মা হলেন ক্রিমূর্তির অন্যতম প্রধান দেবতা। তাকেই বলা হয় বিশ্বপিতা বা বিশ্বস্রষ্টা। ব্রহ্মার পুজো সাধারণ লোকের মধ্যে প্রচলন নেই বললেই চলে। কিন্তু মায়াবীরা অশুভ শক্তি বিতাড়ন মন্ত্রে ব্রহ্মার নাম বার বার উচ্চারণ করে। যাদুকরেরা নানাভাবে নানা উপচারে ব্রহ্মার পুজো করে এবং বিশ্বপিতাকে সব সময় সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করে। কারণ এই সব যাদুকরদের ঐকান্তিক বিশ্বাস হল, ব্রহ্মাই যাবতীয় ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতার উৎস। যাদু চিকিৎসায় বিভিন্ন ব্যাধি সারিয়ে তোলার অলৌকিক শক্তি ব্রহ্মাই অলক্ষ্যে যাদুকরদের জুগিয়ে থাকেন। সুতরাং ব্রহ্মাই হলেন যাদুকরদের ইষ্ট দেবতা।

(৩) শিব— ব্রহ্মা, বিষ্ণুর পর শিব বা মহেশ্বরই হলেন তৃতীয় প্রধান দেবতা। সমস্ত রকম ধ্বংসকার্য ও সংহারের দেবতা বলেই তাকে গ্রহণ করা হয়েছে। পুরাণ শাস্ত্রে ইনি বিস্মরণশীল প্রকৃতির দেবতা (ভোলানাথ) বলে বর্ণিত, এবং তিনি যেহেতু খুব সহজেই সন্তুষ্ট হন সেহেতু তিনি আশুতোষ। ইনি সদা সর্বদা সিদ্ধি বা ভাঙের নেশায় বিভোর এবং তার দুটি বড় বড় চোখের (শিবনেত্র) পাতা সব সময়ই আধখানা বোজা। আবার তিনিই যেহেতু সমস্ত দেবতার ওপরে সেহেতু তিনিই মহাদেব। রোজা, ওঝা ও গুণিনদের কাছে শিবই হলেন সব থেকে জাগ্রত দেবতা। কারণ গুণিরা মহাদেবের কাছে যা কিছু প্রার্থনা করে তা খুব তাড়াতাড়ি পূরণ হয়। তাছাড়া বহুদিনের পুরোন রোগ, শূলবেদনা, বাতের ব্যথা, শ্লেষ্ম, বুক পেটের জ্বালা যন্ত্রণা ইত্যাদি সারিয়ে তুলতে গুণিনরা সক্ষম হয় মহাদেবের কৃপায়। মহাদেবের ডানহাতে থাকে ত্রিশূল। তাঁকে পুজো করা হয় গরুর কাঁচা দুধ, ডাবের জল, ধুতরো ফুল ফল ও বেলপাতা দিয়ে। এগুলি মহাদেবের খুব প্রিয় বলেই মনে করা হয়। গুণিনরা শিষ্যদের নির্দেশ দেয় মহাদেবের পুজো করতে। কোন বড় অসুখ থেকে সেরে ওঠার দুচার দিনের মধ্যে মহাদেবের পুজো দেবার ধর্মীয় বিধান প্রচলিত আছে। শিবের সঙ্গে সব সময়ই যারা ঘুরে বেড়ায় তারা ভূত বলেই পরিচিত। সেইজন্যে শিবের আর এক নাম হল ভূতেশ্বর। ভূতের দল সব সময়ই শিবঠাকুরের হুকুমে হাজির। তাই গ্রামের কোন লোক ভূতের ভয় পাওয়া মাত্র শিবের নাম জপ করতে থাকে। সাধারণত শিবলিঙ্গই মন্দিরে মন্দিরে অধিষ্ঠিত থাকে। কিন্তু উজ্জ্বল বর্ণের চতুর্ভূজ শিবমূর্তির বর্ণনাও পৌরাণিক কাহিনীতে রয়েছে। শিবের পরনে থাকে ব্যাঘ্রচর্য, সারা অঙ্গে তাঁর ছাইভস্ম মাখানো। তাঁর ডান হাতে যেমন লোহার ত্রিশূল বাঁহাতে তেমনি একটি ডম্বৰু থাকে। তার গলায় থাকে ফুল পাতা মণি মুক্তো দিয়ে গাঁথা গোড়ের মালা । সোম ও শুক্র এই দুটি দিনকেই শিব পুজোর পবিত্র দিন বলে গ্রামীণ মানুষরা ধরে রেখেছে।

(৪) লক্ষ্মী –দেবী লক্ষ্মী হলেন ভগবান বিষ্ণুর সঙ্গিনী। ধন ও ঐশ্বর্যের দেবী হিসেবেই তিনি আরাধ্যা। দুর্ভাগ্য ও দরিদ্রতার নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে সৌভাগ্যের মুখ দেখার আশাতেই ঘরে ঘরে লক্ষ্মী পুজোর আয়োজন করা হয় বিশেষ বিশেষ দিনে। তবে বৃহস্পতিবারই লক্ষ্মী বার হিসেবেই চিহ্নিত। গ্রামের যে কোন পরিবারের মেয়ে বৌ ফুল ফল ও জল মিষ্টি আমডাল বসিয়ে দেবীর চরণ এঁকে বা আলপনা দিয়ে লক্ষ্মী পুজো করার প্রথা গ্রামঘরে যথেষ্ট পরিমাণেই প্রচলিত। ব্রাহ্মণ পুরোহিতরাও লক্ষ্মী পুজো করে সংস্কৃততে দেবীমন্ত্র উচ্চারণ করে। গ্রামবধূদের দেবভাষায় মন্ত্রোচ্চারণের ক্ষমতা না থাকলেও তারা একাগ্রচিত্তে লক্ষ্মীর পাঁচালি পাঠ করে পুজো সম্পন্ন করে। গ্রামে গঞ্জে লক্ষ্মী ঠাকুরের আদর খুব বেশী বলেই মনে হয়। ঘরের লক্ষ্মী পুজো ছাড়াও আশ্বিনে মা দুর্গার বারোয়ারি পুজো মণ্ডপে কোজাগরী লক্ষ্মীপূর্ণিমার দিনে লক্ষ্মী পুজো অনুষ্ঠিত হয় বেশ আড়ম্বরের সঙ্গে। তাছাড়া, গ্রামের ধর্মীয় সমাজজীবনে অঘ্রান (নভেম্বর-ডিসেম্বর) ও পৌষ (ডিসেম্বর-জানুয়ারী) মাসের প্রত্যেক বৃহস্পতিবারই প্রায় সর্বজনীন লক্ষ্মী পুজোর দিন হিসেবে নির্ধারিত হয়ে আছে। গ্রামের ছোট বড় সমস্ত বর্ণের মানুষই স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই অনুষ্ঠানে যোগদান করে।

পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে মা লক্ষ্মী হলেন চতুর্ভুজা। এক হাতে তার ছোট একটি ভাণ্ড বা পাত্র এবং সেটি হলো ধনধান্যের প্রাচুর্যের প্রতীক। দেবীর বাহন হল সাদা পেঁচা, যাকে আমরা বলি লক্ষ্মী পেঁচা। গাঁয়ের গুণিনরা লক্ষ্মীদেবীর প্রতি খুবই শ্রদ্ধাশীল। তারা শিষ্যদের কাছে লক্ষ্মীদেবীর মাহাত্মও প্রচার করে ও লক্ষ্মী পুজো করার আদেশ দেয়। বলা বাহুল্য, গুণিনের শিষ্য মাত্রেই সে আদেশ শিরোধার্য করে এবং গুণিনের ইচ্ছা অনুসারেই মাঝে মাঝে শিষ্য বিশেষকে বেশ একটু খরচ করেই লক্ষ্মী পুজোর আয়োজন করতে হয়।

(৫) ভগবতী/পার্বতী/বিশালাক্ষ্মী –দেবাদিদেব মহাদেবের প্রিয় সঙ্গিনী হলেন দেবী ভগবতী। এই দেবী হলেন মহাশক্তির আধার। এই দেবীই আবার পার্বতী ও বিশালাক্ষ্মী বলেও পৃজিত হন। কামরূপে প্রতিষ্ঠিতা দেবী কামাখ্যাকেও ভগবতী বলে মনে করা হয়। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে জানা যায় যে, দক্ষ যজ্ঞের আসরে সতী তাঁর পিতা দক্ষের মুখে স্বামী নিন্দা অর্থাৎ শিবনিন্দা শুনে দেহত্যাগ করেছিলেন। শিব তখন সতী দেহ কাঁধে করে নিয়ে এই মর্ত্যধামে প্রলয় নাচন শুরু করেন, তার ফলে পৃথিবী লয় পাবার উপক্রম হয়। পৃথিবীর পালনকারী ভগবান বিষ্ণু যারপরনাই আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন রুদ্রের তাণ্ডব নৃত্যে। শিবের কাঁধ থেকে সতীর দেহ সরিয়ে নিতে না পারলে প্রলয় নাচন থেকে শিবকে যে বিরত করা যাবে না, তা বিষ্ণু খুব ভালো মতই বুঝতে পারলেন। তিনি তখন খুব সতর্কতার সঙ্গে অদৃশ্য অস্ত্রের আঘাতে সতী অঙ্গ ছিন্ন করতে থাকেন। সতীর দেহ একান্ন টুকরো হয়ে এক এক জায়গায় গিয়ে পড়েছিল, সেই থেকে একান্নটি পবিত্রস্থান বা পীঠের সৃষ্টি হয়। প্রত্যেকটি পীঠই শক্তি সাধনায় পীঠ হিসেবে গণ্য হয়। অসমের কামাখ্যা পাহাড় ও এইরকমই এক মহাপীঠস্থানে পরিণত হয়। এই পাহাড়ে অধিষ্ঠিতা দেবী কামাখ্যা বড়ই জাগ্রত বলে আজও মনে করা হয়। আমাদের এই বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের যাদুকর ও গুণিনরা তাদের ঝাড়ফুঁকের বেশীর ভাগ মন্ত্রতন্ত্র দেবী কামাখ্যার নামে রচনা করে। গুপ্ত বিদ্যাচর্চাকারীরা কামাখ্যা মাকে তাদের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হিসেবেই গ্রহণ করে। এই দেবী মাহাত্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে গুপ্তবিদ্যাচর্চাকারীরা কামাখ্যা মাকে তাদের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হিসেবেই গ্রহণ করে। এই দেবী মাহাত্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে গুপ্তবিদ্যাচর্চার প্রতিষ্ঠানগুলির সদস্যরা অতিশয় ধূমধামের সঙ্গে প্রতিবছর শরৎকালে এক বিরাট অনুষ্ঠান করে। এই উৎসব চলে চারদিন এবং বিজয়া দশমীর দিন কামাখ্যা মায়ের মৃর্তি বিসর্জন দেয়। শারদীয়া উৎসবের চেয়ে বোধহয় কোন অংশে কম নয় গুপ্তবিদ্যাচর্চাকারীদের কামাখ্যা মায়ের শরকালীন উৎসব।

(৬) চণ্ডী — হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে যিনি চণ্ডী তিনিই আবার দশভুজা দুর্গা বা ভগবতী। কিন্তু উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে দেবী চণ্ডী শিকারের দেবী (Goddess of Hunting) হিসেবেই পরম আরাধ্যা। আক্ষরিক দিক থেকে চণ্ডীর অর্থ ভীষণ, ভয়ঙ্কর। গুণিনরা এই দেবীকে সন্তুষ্ট রাখার জন্যে নানারকমের আচার অনুষ্ঠান পালন করে বছরের বিভিন্ন সময়ে। কারণ মা চন্ডী কুপিত হলে আর রক্ষে নেই গুণিনদের; যাবতীয় গুণ শেষ হয়ে যায়। কিন্তু এই দেবীর অনুগ্রহ লাভ করতে পারলে গুণিনের জীবন ধন্য হয়ে যায়। যে কোন রকমের দীর্ঘস্থায়ী বা ক্ৰমিক রোগ নিরাময়ে গুণিন হয়ে যায় সিদ্ধ হস্ত। গুণিন তাই মনপ্রাণ দিয়ে চণ্ডীর পুজো করে। আবার পশ্চিম বঙ্গের কিছু কিছু গ্রামের মানুষ চোখের অসুখ ও স্নায়বিক দৌর্বল্য জনিত নানারকমের অসুখ নিরাময়ের জন্যে মা চন্ডীর মানত বা মানসিক করে। শোনা যায় যে, ঐ সব গ্রামের কিছু লোককে মা চন্ডী নাকি প্রায়ই স্বপ্নে দেখা দেন। কেউ তাঁকে লাল পেড়ে শাড়ি পরে আসতে দেখে, কেউ কেউ আবার দেবীর নাকে নথ, হাতে বল্লম, মাঝবয়সী স্ত্রীলোকের বেশে উপস্থিত হতে দেখে। ঘুমের মধ্যে অনেকের কাছে দেবী চন্ডী নাকি এক রূপসী নারী রূপে আবির্ভূত হয়ে থাকেন। কখন আবার ধীর, শান্ত, এক মাথা কটা চুল, ফুটফুটে সুন্দর, সহজ সবল, এক কিশোরীর রূপ ধরে দেবীর আগমন ঘটে, কারো কারো স্বপ্নে। ভোর রাত্রে তিনি ফুটফুটে সুন্দর ছোট্ট একটি মিষ্টি মেয়ে রূপে উপস্থিত হন।

দেবী চণ্ডী সম্পর্কে উপজাতীয় মানুষদের যে ধ্যান ধারণা তার সঙ্গে গোঁড়া হিন্দুদের ধারণায় অনেক প্রভেদ। হিন্দুদের ধারণা অনুসারে কঠোর আত্মসংযমের মধ্যে দিয়ে চণ্ডীপুজো করতে হয়, তা না হলে দেবী ক্ষুব্ধ হন। কিন্তু উপজাতি সম্প্রদায়ে একথা একেবারেই প্রযোজ্য নয়। তাই দেখা যায় যে, উপজাতি সম্প্রদায়ে অব্রাহ্মণ পুরোহিত চণ্ডী পুজো করে থাকে নির্বিকার চিত্তে এবং এইটাই হল উপজাতি সমাজে প্রচলিত রীতি। নামজাদা ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ও পুরোহিত এ ব্যাপারে কখন কোন রকম প্রতিবাদ তো করেই না বরং তারা উপজাতিদের চণ্ডী পুজোর আসরে স্বেচ্ছায় এসে হাজির হয় জাতপাতের গোঁড়ামি ত্যাগ করে। কিছু উপজাতি সম্প্রদায়ে মধ্যে চণ্ডীর পুজোয় বিভিন্ন জিনিষের সঙ্গে পোরামাটির হাতী ও ঘোড়া উৎসর্গ করলে মা চণ্ডী খুব সন্তুষ্ট হন বলেই তাদের বিশ্বাস।

৭) কালী — মা কালীকে বড়ই ভয়ংকর দেবী বলে মনে করা হয়। পৌরাণিক কাহিনীতেও তিনি ভয়ংকরী দেবী হিসেবেই বর্ণিত হয়েছেন। কুচকুচে কালো, বড়ো লকলকে লাল জিহ্বা বের করে মা কালী জটাধারী শিবকে ধরাশায়ী করে তাঁর বুকের ওপর দু’পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। মা যেন শিবের মৃতদেহকে পায়ের তলে চেপে রেখেছেন উলঙ্গিনী হয়ে। বিস্ফারিত হয়ে আছে তার তিনাট নয়ন। ছড়িয়ে রেখেছেন দুদিকের চারটি হাত। তাতে ধরে আছেন দু’হাতে দুটি ভয়ংকর আয়ুধ। ডানদিকের ওপর হাতে খাঁড়া ও নীচের হাতে ভল্ল; আর বাঁ পাশের হাত দুটির হাত দুটির প্রথমটিতে রক্তাক্ত এক নরমুণ্ড ও অপর হাতে তিনি ধরে রেখেছেন মানুষের রক্তেপূর্ণ একটি করোটি। যেজন্য দেবী ভয়ঙ্করী সকলের মনে এক ভীতি আনে। মায়ের আর একটি কাল্পনিক মূর্তিতে লক্ষ্য করা যায় যে, তাঁর বাঁ দিকের হাতে খড় ও অসুরের মুণ্ড এবং ডানদিকের দুহাতে অভয় মুদ্রা, বরদ মুদ্রা। অর্থাৎ এক হাতে অভয় দান করছেন অপর হাতে বর দান করছেন। গলায় তার নরমুণ্ডের মালা এবং মানুষের খণ্ড খণ্ড হাত সুতোয় গেঁথে কটি বেষ্টন করেছেন লজ্জার আবরণ হিসেবে। যে সব মানুষ বা অসুরের মুণ্ড তিনি খড়াঘাতে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছেন তাদেরই মুণ্ডমালা গলায় ধারণ করে আছেন বলে মনে করা হয়। আমাদের এই বাংলার বিভিন্ন জায়গায় বড় বড় কালী মন্দিরের সংখ্যা যে কম নয় তা আমরা জানি। কালী পুজোর সব থেকে উপযুক্ত রাত্রি হিসেবে কার্তিক মাসের অমাবস্যার রাত্রিকেই চিহ্নিত করা হয়। কালী পুজোয় ছাগ শিশু বলি দিয়ে মাকে খুশী করার বিধান আজও বিভিন্ন কালীস্থানে যথাযথ ভাবে পালিত হয়।

মা কালীর মূর্তির সঙ্গে যেহেতু নর মুণ্ড, নররক্তপূর্ণ করোটি ইত্যাদি জড়িয়ে আছে, সেহেতু মনে করা হয় যে, তিনি শ্মশানে মশানে মৃতদেহের মধ্যেই অধিকাংশ সময় বিচরণ করেন। তাঁকে তাই শ্মশানবাসিনীও বলা হয়।

তান্ত্রিক ও গুণিনরা নিজেদের গুপ্ত আচার অনুষ্ঠানের উন্নতি সাধনের জন্য কালীপুজো করে বিশেষ বিশেষ দিনক্ষণ দেখে। তবে শনিবারই হল সব থেকে উপযুক্ত দিন কালী সাধনা সংক্রান্ত নানান গুপ্ত ক্রিয়া কৌশলের ক্ষেত্রে। গুণিনরা আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের শিষ্যদের গুপ্তক্রিয়া শিক্ষারম্ভের উপযুক্ত দিন হিসেবে শনিবারটিকেই বেছে নিয়েছে।

(৮) শেতলা –ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে দেবী শেতলা প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন ভিন্ন ভিন্ন নামে। বিভিন্ন সংক্রামক ও মহামারী রোগ বিশেষ করে পানবসন্ত রোগের নিয়ন্ত্রণকারী দেবী হিসেবেই শেতলার মাহাত্ম প্রচারিত হয়ে থাকে। এই দেবী ক্ষুদ্ধ হলেই সংক্রামক রোগের ব্যাপক প্রচার হয় বলেই গ্রাম্য মানুষের বিশ্বাস। সুতরাং দেবীর সন্তুষ্টি বিধানের জন্যেই গ্রামে গঞ্জে এমনকি আধুনিক শহরেও বহু শেতলা মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গ্রামের গরীব মানুষ পাকা বড় মন্দির বানাতে না পারলেও মাটির ঘরে খড়ের কিম্বা টালির ছাদ দিয়ে শেতলা মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে। ব্রাহ্মণ পুরোহিতই দেবীর পুজো করে। মা শেতলার চরণে ছাগলের রক্ত দিলে মা খুশী হন বলে অধিকাংশ গ্রাম্য মানুষের বিশ্বাস। সেজন্যে কোথাও কোথাও শেতলার মন্দিরে ছাগল বলি দেবার রীতি প্রচলিত আছে। গ্রামদেশে যখনই যেখানে রোগব্যাধি মহামারীর রূপ নেয় তখনই, সেখানে শেতলা পুজোর ধূম বাড়ে। কারণ মা শেতলার অনুগ্রহ ছাড়া মহামারীর কবল থেকে রক্ষা পাওয়া কঠিন। হিন্দুদের বিশ্বাস অনুসারে ঠাকুরের গায়ের রং সবুজ তার দুটি হাত, দুটি চোখ এবং তিনি গাধার পিঠে চড়ে বেড়ান। সেজন্য দেবীর মূর্তি গড়া হয় গাধার পিঠে বসিয়ে অর্থাৎ গাধা-ই দেবীর বাহন। তার এক হাতে থাকে বসন্ত রোগের জীবাণুপূর্ণ একটি পাত্র ও আর একটি হাতে এক গাছি ঝাঁটা ধরিয়ে মাটির মূর্তি গড়া হয়। গ্রামবাসীদের অনেকের কাছে তিনি স্বপ্নে তো দেখা দেনই, আবার অনেক গ্রামবধূ নাকি মা শেতলাকে কোথাও কোথাও প্রকাশ্য দিবালোকেও দেখতে পায়। যখন কোন গ্রামে বসন্ত ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়ে তখন সেই গ্রামের বিভিন্ন দিকেই স্বয়ং শেতলা মা অতি সাধারণ এক গ্রাম্য মহিলার মত লাল পেড়ে সাদা শাড়ী পরে ঘুরে বেড়ান। তা সে যাই হোক, বসন্ত রোগকে গ্রামবাসীরা বলে ‘মায়ের দয়া’ অর্থাৎ মা শেতলার দেওয়া রোগ। তাই মাকে সন্তুষ্ট করতে বসন্ত রোগে আক্রান্ত পরিবারের লোকজনকে মায়ের নিয়ম হিসেবে বেশ কিছু বাধা নিষেধ মেনে চলতে হয় ন’দিন। আমিষ আহার ঐ কদিন একেবারেই নিষিদ্ধ। সধবাদের ক্ষেত্রে মাথায় তেল সিঁদুর চিরুনি ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। পান খাওয়াও বন্ধ রাখতে হয়। গুণিনের দেওয়া গাছ গাছড়া লতাপাতার ওষুধই হল ‘দেবওষুধ’ এবং তাতেই রোগীর রোগ নিরাময় হয়। গুণিন ছাড়া অর্থাৎ কোন চিকিৎসকের করণীয় কিছু থাকে না, আর তা থাকলেও গ্রামের লোকে তা বিশ্বাস করে না। তাই–গুণিনের গুপ্ত চিকিৎসার জোরে বসন্ত রোগী সুস্থ হলে রোগী ও গুণিন উভয়েই এক সঙ্গে মা শেতলার পুজো দেয়।

(৯) মনসা — সর্পকূলের নিয়ন্ত্রণকারী দেবী হলেন মনসা। সেইজন্যে গ্রাম সমাজে মনসা পুজোর গুরুত্ব খুবই বেশী। নাগফণী’ বা ‘মনসা’ নামে যে উদ্ভিদ তাকেই দেবী মনসার প্রতীক বলে ধরা হয়। গ্রামের বাড়ীতে বাড়ীতে একটি করে তুলসী মণ্ডপ যেমন থাকে তেমনি ঐ মণ্ডপে মনসা চারাও লাগান থাকে। সন্ধ্যাবেলায় গ্রামবধূরা তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বেলে শাঁখ বাজিয়ে মা মনসাকে প্রণাম করে ভক্তিভরে। বাংলা মাসের জৈষ্ঠ্য, আষাঢ় ও শ্রাবণ সংক্রান্তিতে যথেষ্ট ধূমধামের সঙ্গে মনসাপুজো করানো হয় ব্রাহ্মণ পুরোহিতকে দিয়ে। মেদিনীপুর জেলার বহু অঞ্চলে নানাজাতের বিষাক্ত সাপের রাজত্ব বললেই হয়। সুতরাং এই সব জায়গার অধিবাসীদের মধ্যে সর্পভীতি ভয়নকভাবেই বৃদ্ধি পেয়েছে।

সাপের রোজা বা গুণিনরাই মনসা দেবীর পুজো করার প্রেরণা জোগায় সাধারণ গ্রামবাসীদের মনে। মনসার মাহাত্ম্য গুণিনরাই দিকে দিকে প্রচার করে এবং তারা নিজেরাও মা মনসার পুজো করে ঢাকঢোল বাজিয়ে। বিষ ঝাড়ার ক্ষমতা পাওয়ার জন্যও রোজারা এই দেবীর চরণে নানারকম প্রার্থনা জানায়, মনসার নাম করেই সাপের বিষ নামানোর মন্ত্র রচনা করে। নৃবিজ্ঞানের দিক থেকে মনসার মনুষ্যাকৃতি (anthropomorphic form) সম্পর্কে বোঝান হয়েছে যে, এঁর সারা অঙ্গ ছোট ছোট লোমে পরিপূর্ণ এবং তার বাঁ চোখের দৃষ্টিশক্তি খুবই অল্প বা হারিয়ে গেছে বললেও চলে। সতীনের সঙ্গে ঝগড়া করতে গিয়েই তার এই চোখে আঘাত লেগেছিল বলেই গ্রাম্য মানুষের বিশ্বাস। দেবী মনসাকে নিয়ে বিস্তর গল্প লেখা হয়েছে। সেইসব পৌরাণিক গল্পে দেবী চরিত্রের প্রতিহিংসাপরায়ণতা ও হিংস্রতার : পরিচয় অতিরঞ্জিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

(১০) রাম/রঘুনাথ— মহাকাব্যের নায়ক বলেই ধরা হয় রামচন্দ্রকে। তাঁকে অবশ্যই ঈশ্বরের অবতার বলেও জ্ঞান করা হয়। এই অঞ্চলে রামচন্দ্রের পুজোর কোন রকম প্রচলন নেই বললেই চলে। তথাপি নন্দীগ্রামের জানকীনাথের মন্দিরটি খুবই প্রসিদ্ধ। তবে আজও এই অঞ্চলের মানুষ রামের প্রতি যথেষ্ট ভক্তি প্রদর্শন করে, কোন নির্জন প্রান্তরে বা ভূতুড়ে জায়গা বলে পরিচিত মাঠ ময়দান পেরিয়ে যাবার সময় সকলে রামনাম জপতে জপতে নিশ্চিন্তে চলে যায়। কারণ লোক বিশ্বাস এই যে, রামনামে ভূতেরা ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়। সুতরাং কোন ভূতের ক্ষমতা হবে না আক্রমণ করার।

(১১) লক্ষ্মণ –মহাকাব্যের অন্যতম নায়ক রামচন্দ্রের ভাই লক্ষণ। ভ্ৰাতৃভক্তির পরম পরাকাষ্ঠা হলেন শ্রীমান লক্ষণ। ভূতপ্রেতের ভয় থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্যে মানুষ লক্ষণের নামও স্মরণ করে।

(১২) মহাবীর হনুমান — রাম লক্ষ্মণ সীতা যখন বনবাসে গিয়েছিলেন তখন কালো মুখের বীর হনুমানই ছিলেন রামচন্দ্রের সব থেকে বড় ভক্ত ও বিশ্বস্ত অনুচর। লংকায় গিয়ে সীতা উদ্ধারের কাজে হনুমানই ছিলেন শ্রীরামচন্দ্রের প্রধান সহায়ক। রাবণ বধে হনুমান শ্রীরামচন্দ্রকে বিপুলভাবে সাহায্য করেছিলেন। সুতরাং হনুমানের বীরত্বের কথা গুণিনদের বহু যদুমন্ত্রেই উচ্চারিত হয়ে থাকে। গুণিনদের বিশ্বাস হনুমানের নামে ময়ুউচ্চারণ করলে মন্ত্রের শক্তি অনেকগুণ বৃদ্ধি পায়, ভূতপ্রেত বা অন্য যেকোন অশুভ শক্তি দূরে সরে কবে হনুমানের নামের অলৌকিক মহিমায়। তবে এই অঞ্চলে মহাবীর হনুমানের নামে হনুমান মন্দির বলে কোন মন্দির নেই।

(১৩) সীতা –শ্রীরামচন্দ্রের প্রিয়তমা পত্নী জানকী বা সীতার মহিমাও গুণিনদের কাছে কোন দিক থেকে কম নয়। বহু যাদুমন্ত্রেই দেবী সীতার নামযুক্ত হতে দেখা যায়। ভূতের রোজারাও সীতার নামে ভূত ঝাড়ার মন্ত্র পড়ে।

(১৪) আল্লা — ইসলাম ধর্মে আল্লাই হলেন পরম সৃষ্টিকর্তা। তিনি হলেন সর্বশক্তিমান পুরুষ। যে কোন বিপদের সময় মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ আল্লার দোয়া ভিক্ষে করে। মুসলমান গুণিন বা রোজা আল্লার নামে অশুভশক্তিকে তাড়ানোর জন্যে ওষুধ-বিষুধ, কবজ তাবিজ ইত্যাদি তৈরী করে আল্লার নামেই।

(১৫) সিং বোঙা— মুণ্ডা, বীরহোড়, সাঁওতাল গোষ্ঠীর প্রধান দেবতা বলে গণ্য করা হয় সিংবোঙাকে। এইসব গোষ্ঠীভুক্ত মানুষের বিশ্বাস হল, সিং বেঙা তাদের সমস্ত কাজকর্মে অংশগ্রহণ করেন এবং যে কোন ব্যক্তি তার অনুগ্রহ লাভ করতে পারে তাকে বিভিন্ন জিনিষ উৎসর্গ করে। ঐ দেবতা সাধারণত কোন লোকের ক্ষতি তো করেনই না বরং সমস্ত রকম দুষ্ট শক্তির আক্রমণ থেকে গোষ্ঠী জীবনকে নিরাপণ করেন বলেই বিশ্বাস। এই সমস্ত উপজাতিদের ধারণা অনুসারে সিংবোঙাই হলেন পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা। তিনিই ভগবান। সেই জন্যেই এই সব গোষ্ঠীর যাদুকরেরা তাদের যাবতীয় মন্ত্রতন্ত্রে সিং বোঙার দেবতার নাম উচ্চারণ করে। যাদুক্রিয়া কর্মের সাফল্য কামনা করে। সদাসর্বদা দেবতাকেই ভক্তিভরে স্মরণ করে।

(১৬) মারাংবুরু –পার্বত্য মুণ্ডারি উপজাতির আরাধ্য দেবতা হলেন মারাং বুরু। মুণ্ডা এবং হো আদিবাসীরাও এই দেবতার পুজো করে। এই আদিবাসী সম্প্রদায়ের মায়াবী বা যাদুকরেরা তাদের যাবতীয় গুপ্তাচারের মন্ত্র মারাংবুরুর নামেই রচনা করে বলে জানা যায়।

 (১৭) বরাম– লোধা ও ভূঁইয়াদের গ্রামরক্ষার দেবতা হলেন বরাম। ইনি পাহাড়ের কোন না কোন গুহায় বাস করেন এবং ইনি অতি শক্তিশালী দেবতা। কিছু কিছু লোধা ও ভূঁইয়া যাদুকরের সামনে বরাম নাকি মানুষের রূপ ধারণ করে সময় বিশেষে আর্বিভূত হন, তবে যে কোন একজন লম্বা লোকের তুলনায় নররূপী বরাম নাকি অনেক বেশী লম্বা। তার সারা দেহ বড় বড় লোমে ঢাকা। বড় একজোড়া গোঁফ। তাঁর হাতে থাকে মস্তবড় একটা কুঠার। ইনি সাধারণত বাঘ বা হাতীর পিঠে চেপে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ঘুরে বেড়ান। উপজাতিদের বক্তব্য অনুসারে মাঝে মাঝে গভীর রাতে বরাম ভয়ঙ্কর রেগে যান এবং বনের মধ্যে বীভৎসভাবে চীৎকার করতে শুরু করেন। আশপাশের লোকের কানে খরখর শব্দ আসে। এই দেবতাকে যদি খুব ভালো করে পুজো করা না হয় তাহলে গ্রামে নানারকমের রোগের প্রার্দুভাব হয়। তিনি গ্রামের গুণিন বা পুরোহিতকে স্বপ্নে দেখা দেন এবং তাঁর সেবা যে ঠিকমত হচ্ছেনা সেকথাও গুণিনের কানে অলক্ষ্যে ভেসে আসে। গ্রামবাসীরা তখন গুণিনের নির্দেশ ক্রমে ছাগল মুগী ইত্যাদি উৎসর্গ করে বরামের পুজো দেয় আড়ম্বরের সঙ্গে। বিভিন্ন প্রকারের রোগ ব্যাধি নিরাময়ের উদ্দেশ্যে মাটির হাতী ঘোড়া বরামের নামে উৎসর্গ করারও প্রথা আছে।

(১৮) যুগিনি– এটি হল এক ভয়ানক পেত্নী, কিন্তু ঐ পেত্নীই আবার মা শেতলার এক পরিচারিকা হিসাবে কাজ করে। দেবী শেতলা ক্রুদ্ধ হয়ে যদি কোন গ্রামে বসন্তরোগের সৃষ্টি করতে চান তবে ঐ কাজের ভার এই পেত্নীর ওপর ন্যস্ত হয়। লোকের বিশ্বাস যে বসন্তে আক্রান্ত হয়ে যারা মারা যায় তাদের গলাপচা দেহের মাংস খেয়ে ঐ পেত্নী তার উদরপূর্তি করে। সে যে কিভাবে হঠাৎ এসে হাজির হয় সে বিষয়ে অনেকে অনেক রকম বর্ণনা দিয়ে থাকে। কিছু লোকের মতে এই পেত্নী ইচ্ছামত রূপ বদলাতে পারে। গরমকালে সে ভরা ভর দুপুরে নির্জন মাঠে এক এক বেশ ধরে ঘুরে বেড়ায়। কারো কারো বর্ণনায়, এই পেত্নীর মাথা বলে কিছু নেই। তার ভয়ঙ্কর চোখ দুটো তার বুকের ওপর জ্বলজ্বল করে। আরো কিছু লোকের মতে পেত্নী হল মাঝবয়সী মেয়ে কিন্তু তার স্তন দুটি বুক থেকে কোমর অবধি ঝুলে থাকে। একা একা নির্জনে ঘুরে বেড়ানোর সময় তার চোখের সামনে যদি কেউ আচমকা পড়ে যায় তাহলে সে কিছুক্ষণের মধ্যেই ভয়ঙ্কর জ্বরে পড়ে ভুল বকতে থাকে। পরে ঐ জ্বর সারানোর জন্যে গুণিনরা আবার ঐ যুগিনীকেই স্মরণ করে, তার দয়া ভিক্ষে করে। তবে কিছু কিছু গুপ্তক্রিয়াকর্মের সাহায্যে এই পেত্নীর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। বিভিন্ন পাহাড়ী উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ যুগিনীর পুজো দেয় কালো মুরগী বলি দিয়ে। তাছাড়া, যে কোন কঠিন রোগ ভোগের পর যুগিনীর পুজো বাধ্যতামূলক ধর্মীয় রীতি হিসেবে আজও প্রচলিত।

(১৯) পিশাচিনী –ডাইনী মরে গিয়ে যে ভুতে পরিণত হয় তাকেই পিশাচিনী বলা হয়। যে সমস্ত নারী ডাইনীবৃত্তি সংক্রান্ত আচার অনুষ্ঠান করতে করতে মারা যায় তারা সকলেই পিশাচিনী হয় বলেই বিশ্বাস। পিশাচিনীয়া বড়ই সাংঘাতিক। শ্মশানেই তারা বেশীর ভাগ সময় ঘুরে বেড়ায় এবং রাতের বেলায় একা কোন লোককে দেখতে পেলেই পিশাচিনী আক্রমণ করে। এরাও যখন তখন রূপ বদলাতে পারে। জানা যায় যে, বেড়ালের রূপ ধরে লোকের বাড়ীতে ঢুকে এরা বাস করে। যে পুরুষের ওপর দৃষ্টি পড়ে তাকে সে নিজের কাছে টেনে রাখে। শিশুদের এরা প্রায়ই শুকিয়ে মারে বিষ নজর দিয়ে। তাই যখনই কোন শিশু কিছুই খেতে চায় না তখনই গুণিনের ডাক পড়ে এবং পিশাচিনীর নজর কাটাতে গুণিন তৎপর হয়। গাছগাছড়া দিয়ে।

(২০) মুনিশ — মুনিশকে বংশানুক্রমিক বা পুরুষানুক্রমিক বিদেহী আত্মা বলেই গ্রাম্য মানুষ বিশ্বাস করে আসছে। পরিবারের মঙ্গল সাধন করার জন্যেই পরিবারের মধ্যেই মুনিশ বাস করে শুভ শক্তি হিসেবে। সাধারণত কোন কোন পরিবারের এক এক জন সৎ ও ধর্মপরায়ণ ব্যক্তিই মৃত্যুর পর মুনিশ হয়ে যায়। ঐ পরিবারের লোকজনকে মুনিশ প্রায়ই স্বপ্নে দেখা দেয়। তাদের মঙ্গল করার আশ্বাস দেয়। মুনিশকে স্বপ্নে দেখার পর তার উদ্দেশ্যে পরিবারের লোকেরা নানাভাবে একে পুজো দেয়। কিন্তু ভালোভাবে যদি মুনিশের পুজো করা না হয় তাহলে মুনিশ যারপরনাই অসন্তুষ্ট হন, এবং তার ফলে, পরিবারের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ঘুমোতে ঘুমোতে চমকে ওঠে, এক নাগাড়ে কাঁদতে থাকে। সময় সময় মুনিশকে কাঠের খড়ম পরে গভীর রাতে বাড়ীর এদিক ওদিক ঘুরতেও নাকি দেখা যায়। তার গায়ে থাকে সাদা কাপড়ের জামা। পুকুরের ধারে হঠাৎ হঠাৎ মুনিশের খড়মের খটখট শব্দ কানে আসে অনেকেরই। এইভাবে আওয়াজ করে মুনিশ তার পরিবারের মানুষজনকে বুঝিয়ে দেয় যে, সে অত্যন্ত বিরক্ত ও অখুশী হয়েই ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাড়ীর কর্তা তখন গুণিন বা মায়াবীকে ডেকে মুনিশের অখুশী হবার কারণ অনুসন্ধান করতে বলে। গুণিন খুব তাড়াতাড়ি অনুসন্ধানের কাজ শেষ করে মুনিশকে খুশী করার যথাযথ বিধান দেয়। গুণিনের বিধান অনুযায়ী বাড়ীর মাঝ উঠোনে কিম্বা বাগানে ছোট একটা কাঠের জলচৌকি রেখে তার ওপর পেতলের একঘটি জলের মধ্যে একটা আমডাল মুনিশের নামে বসিয়ে রাখতে হয়। এইভাবে ঘট স্থাপনের পর সেটির চারপাশ রাঙিয়ে দিতে হয় সিঁদুর দিয়ে এবং একখানি নতুন ধুতি, এক গ্লাস দুধ ও বেশ কিছু পরিমাণ মন্ডা মেঠাই থালায় সাজিয়ে রাখতে হয় মুনিশকে সন্তুষ্ট করার জন্যে। তারপর পরিবারের সমস্ত লোক পরের দিন সকালে পুকুরের জলে স্নান করে মুনিশকে উৎসর্গ করা দুধ ও মিষ্টি মাথায় ঠেকিয়ে মুখে দেয় প্রসাদ বলে। পাড়া প্রতিবেশীদের ঘরে ও বিতরণ করা হয় মুনিশের প্রসাদ। যে বাড়ীতে মুনিশের অধিষ্ঠান হয় সে বাড়ীর লোকজনকে মুনিশ যে কেবল বিপদের হাত থেকে রক্ষে করে তাই নয় বরং বিপদ আসার আগেই পরিবারের সবাইকে মুনিশ সতর্ক করে দেয় নানারকমের সঙ্কেত পাঠিয়ে। তাই যে কোন পরিবারে মুনিশের অধিষ্ঠান যে বড়ই কল্যাণকর তাতে কোন সন্দেহ নেই।

(২১) চণ্ড– এ হল এক অনুগত বিদেহী আত্মা বা ভূত (tamed spirit or ghost)। গুণিন এই ভূতকে তার যাদুমন্ত্র বলে সৃষ্টি করে বলেই বিশ্বাস। সৃষ্টি করার পদ্ধতি বড়ই ভয়ঙ্কর। যে কোন এক ব্রাহ্মণ কিশোরকে গোপনে হত্যা করা হয়। তারপর মৃত কিশোরের দেহের এক খণ্ড হাড়ের সাহায্যে চণ্ডভূতের সৃষ্টি হয়। কোন কোন গুণিন বা মায়াবী চণ্ড নামে ভূত সৃষ্টি করার ক্ষমতা অর্জন করে বিশেষ রকমের গুপ্তক্রিয়াকর্মের সাহায্যে। যে গুণিনের কাছে এই হাড়ের টুকরো থাকে সে গুণিনের অলৌকিক ক্ষমতা বহুগুণে বৃদ্ধি পায় এবং ঐ গুণিন অন্যান্য ভূত প্রেত ও অশুভ শক্তির গতিবিধি লক্ষ্য করতে অন্যান্য গুণিনের তুলনায় অনেক বেশী সক্ষম হয়। অতিপ্রাকৃত জগতের ওপর গুণিন তার প্রভাব বিস্তার করতেও সক্ষম হয় চন্ডভূতের ওপর নির্ভর করে।

(২২) সুপুরুষ— যদি কোন ব্রাহ্মণ বালক উপনয়নের পবিত্র অনুষ্ঠানে হঠাৎ মারা যায় তাহলে সুপুরুষ নামে এক বিদেহী দুষ্ট শক্তির সৃষ্টি হয়। সাধারণ পথচারীকে এই দুষ্টশক্তি যখন তখন আক্রমণ করে অনিষ্ট সাধন করে নানাভাবে। গ্রাম্য মানুষের বিশ্বাস যে যুবতীদের পাওয়ার জন্যে এই বিদেহী আত্মা অতিশয় লালায়িত। সেইজন্যে যুবতীরাই বেশী করে সুপুরুষের আক্রমণের শিকার হয়। যুবতী মেয়ের ওপরই সুপুরুষকে অধিকাংশ সময় ভর করতে দেখা যায়, গুণিনের গণনা অনুসারে যখনই কোন মেয়ে হঠাৎ হঠাৎ জ্বরে পড়ে, চোখ লাল হয়ে যায়, জ্বরের ঘোরে ভুল বকে তখনই ধরে নিতে হবে যে সুপুরুষ তাকে ভর করেছে এবং গুণিনের ঝাড়ফুঁক শুরু হয়।

(২৩) কালপুরুষ– এটিও একটি ভয়ঙ্কর পুরুষ ভূত বা বিদেহী আত্মা। এই ভূত ইচ্ছামত রূপ ধারণ করতে পারে। যে সমস্ত যুবক অবিবাহিত অবস্থায় মারা যায় তারাই কালপুরুষ হয়ে ঘুরে বেড়ায় বলে বিশ্বাস। তাই স্বাভাবিক ভাবেই মেয়েদের প্রতি কালপুরুষের ভয়ঙ্কর আকর্ষণ থাকে এবং যৌন-সংসর্গের উদ্দেশ্যে কালপুরুষ আনাচে কানাচে লুকিয়ে থাকে। কখন কখন গভীর অন্ধকার রাতে বিরাট লম্বা দুটো হাত ঝুলিয়ে গটগট করে দুপায়ে তাকে ঘুরে বেড়াতেও কেউ কেউ নাকি দেখে থাকে। তার মাথার ওপর জ্বল জ্বল করতে থাকে ফালা ফালা দুটো চোখ। তার আক্রমণে ভয়ঙ্কর জ্বর ও বিকার অনিবার্য। কোন কোন মহিলা তার আক্রমণে বিকৃত মস্তিষ্ক হয়ে আবোল তাবোল কাজ করে। গুরুজনদের মুখের সামনে পা তোলে। গুণিন অবশ্য খুব তাড়াতাড়িই তাকে ঝাড়ফুক করে সুস্থ করে তোলে।

(২৪) যক্ষ কিম্বা যক্ষিণী –এ হল মানুষেরই বিদেহী আত্মা বা ভূত। সাধারণতঃ বাস করে পুকুরের জলের তলে। অতিশয় কৃপণ মেয়ে বা পুরুষ মরেই যক্ষ বা যক্ষিণী হয়। যে লোক (মেয়ে বা পুরুষ) জীবনে বহু অর্থ উপার্জন করে ও কোন সৎকাজে তা ব্যয় করেনি এমন কি নিজেও ভোগ না করে শুধু জমিয়ে রেখে মরে গেছে সেই লোকই যক্ষ বা যক্ষিণী হয়ে তার ধন সম্পত্তি আগলাতে আসে। যে জায়গায় তারা হাঁড়ি কলসী বা অন্য কোন কিছু করে টাকা কড়ি মণি মাণিক্য সোনাদানা ইত্যাদি গোপনে পুঁতে রেখে চলে যায়, সেই জায়গাতেই এই ভূতের আবাস হয়। সাধারণ মানুষের এই ধারণা বা বিশ্বাস থেকেই যক্ষের ধন’ বলে কথাটির প্রচলন হয়েছে।

যক্ষ পুকুরের জলের নীচে থাকে গ্রামীণ মানুষেরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে। সেহেতু বাচ্চা ছেলেমেয়ে পুকুরে ডুবে গেলেই মনে করা হয় যে যক্ষই তাকে টেনে নিয়েছে। শোনা যায় যে, কোন কোন মহিলা তার নিজের শিশুকে রাত্তির বেলায় পুকুরের জলে ডুবিয়ে দিয়ে আসতে বাধ্য হয় যক্ষের আক্রমণের শিকার হয়ে। এরকমের গুটিকয়েক ঘটনার বিবরণ গ্রন্থকার এই সব অঞ্চল থেকে পেয়েছেন। তবে এই সব দুর্ঘটনা থেকে শিশুদের রক্ষে করার জন্যে গুণিনরা যে নানারকমের যাদুমন্ত্রের প্রয়োগ করে থাকে তা বলা বাহুল্য।

(২৫) ভূত, প্রেত বা পেত্নী — মানুষের অকাল মৃত্যু ও অপমৃত্যুর জন্যই ভূতপেত্নীর সংখ্যা সমানে বাড়তে থাকে বলেই অধিকাংশ গ্রামের মানুষ মনে করে। তারা আরো মনে করে যে, অল্প বয়সে বা অকালে যে সমস্ত নারী বা পুরুষের মৃত্যু হয় তাদের অনেক আশা আকাঙ্খা অপূর্ণ থেকে যায়। তাই তারা মৃত্যুর পরে ভূত পেত্নী হয়ে ঐ সব আশা আকাঙ্খা পূরণ বা চরিতার্থ করার চেষ্টা করে। এই সব প্রেতাত্মারা যখন যেরকম রূপ ধারণ করা প্রয়োজন তারা মুহূর্তের মধ্যে সেই রূপ ধারণ করতে পারে। এই সমস্ত প্রেতাত্মা যেখানে সেখানে রাত, দুপুরে ঘুরে বেড়ায় নিঃসঙ্গ পথচারীকে আক্রমণ করে। গয়াধামের প্রেতশিলায় এইসব অতৃপ্ত আত্মার উদ্দেশ্যে পিণ্ডদান না করা পর্যন্ত এদের নাকি গতি হয় না। পিণ্ডদানের পর এরা একেবারে পরিতৃপ্ত হয়ে পৃথিবী থেকে নিজেদের সম্পূর্ণভাবে সরিয়ে ফেলে। গুণিনরা অবশ্য এই সব ভূত পেত্নীদের পুরোন গাছের গায়ে যে সময় সময় পেরেক মেরে আটকে রাখতে পারে গুপ্তযাদুমন্ত্রের জোরে সে কথার উল্লেখ আমরা আগেই করেছি।

(২৬) চিরগুণি –যে স্ত্রীলোক সন্তান প্রসব করতে গিয়ে মারা যায় তারই আত্মা চিরগুণি নামে এক ভয়ঙ্কর দুষ্ট শক্তিতে পরিণত হয়। সে জীবন্ত নারী বা পুরুষের সঙ্গ পাবার জন্য লালায়িত হয়ে শ্মশানে মশানে বা নির্জন কোন জলাশয়ের ধারে অহরহ ঘুরে বেড়াতে থাকে। কিন্তু যখনই কোন নারী বা পুরুষের ওপর চিরগুণি ভর করে তখনই তাদের দেহ উত্তপ্ত হতে থাকে এবং বিকারের নানান লক্ষণ দেখা যায়। চিরগুণি ভর করা কোন কোন মেয়ে ছেলেকে দেখা গেছে আপন মনে অনর্গল উন্মাদের মত নৃত্য করতে গলা ফাটিয়ে গান গাইতে। তাই গুণিনের যন্ত্রমন্তর প্রয়োগ ছাড়া তাকে সুস্থ করা কারো পক্ষে কোন ভাবেই সম্ভব হয়ে ওঠে না।

(২৭) প্রেতাশানি –এও একরকমের ভূত। যে কোন রূপ ধারণ করতে পারে বলে বিশ্বাস। সময় সময় কুকুর বেড়াল কিম্বা ছোট গরুর রূপ ধরে পথচারী মানুষের কাছে আনে। কুকুর বেড়াল হয়ে পা চাটে। গভীর রাতে এর খুব খিদে লাগে। তাই অদ্ভুত আওয়াজ করে কাঁদে বা চীৎকার করে। এই বিদেহী প্রেতাত্মা বেশীর ভাগ গর্ভবতী মহিলাদের ওপর ভর করে। সেজন্যে এ অঞ্চলের অধিকাংশ ঘরের বৌ মেয়েরা সন্তান সম্ভবা হলেই গুণিনের দেওয়া মন্ত্রপূত মাদুলী শেকড় বাকড় ধারণ করে বলে জানা যায়।

(২৮) বাগোয়া ভূত— যে ব্যক্তিকে বাঘে খায় তার আত্মাই বাগোয়া ভূতে পরিণত হয়ে বাঘের মতই ভয়ঙ্কর হিংস্র হয়ে ওঠে, বাঘের মতই হুংকার ছাড়ে এবং এক সময় বাগোয়া সত্যিকারের বাঘের রূপ পরিগ্রহ করে বলেই বিশ্বাস। এইভাবে বনে জঙ্গলে একের পর এক বাগোয়া ভূত বাঘ হয়ে ঘুরে বেড়ায় মানুষের খোঁজে। সুন্দর বন অঞ্চলের বহু মানুষের কাছে বাগোয়া ভূতের নানান গল্প শোনা যায়।

(২৯) মেছুয়া/গোমুয়া/ঘোড়া ভূত –এরা হল বিভিন্ন জন্তু জানোয়ারের বিদেহী আত্মা। মেছুয়া ভূতের (Machhua Spirit) উৎপত্তি মরা বেড়ালের আত্মা থেকে। রাত্তির বেলা পুকুরে বা খাল বিলে জাল ফেলে মাছ ধরতে গিয়ে সাধারণত জেলেদের চোখে পড়ে এই ভূত। মাছই এই ভূতের প্রধান খাদ্য বলে এর নাম হয়েছে মেছুয়া ভূত। খাল বিল বা যে কোন জলাশয়ের ধারের বড় বড় গাছেই এরা আড্ডা গাড়ে। এই ভূতের আগমন মালুম করা যায় তার গায়ের একটা বিশ্রী গন্ধ থেকে। গ্রাম ঘরের মানুষের বাড়ীর আশেপাশেও রাত বিরেতে এসে পড়ে এবং কোন বাড়ীর ত্রিসীমানায় মেছুয়া ভূতের ছায়াও যদি এসে পড়ে তাহলে ঐ বাড়ীর বাচ্চারা পেটের অসুখে ভুগতে শুরু করে। গুণিনের জলপড়া যদি সময় মত অসুস্থ বাচ্চার গায়ে মাথায় না পড়ে তাহলে তার আর বাঁচার আশা থাকে না।

গোমুয়া–~~ গরু বাচ্চা দিতে গিয়ে যদি মরে যায় তাহলে তার আত্মা থেকে গোমুয়া ভূতের উদ্ভব হয়। তবে গোমুয়া সাংঘাতিক ভূত বা দুষ্টশক্তির পর্যায় পড়ে না। মানুষের ওপর হামলা করে ও তার কোনরকম অনিষ্ট করে না। সময় সময় নিঃসঙ্গ পথচারীকে ভুল পথে চালিত করে ঘন্টার পর ঘন্টা। ফলে, ঐ ভ্রান্ত পথিক বা পথচারী বহু পথচলার পর ক্লান্তিতে অসুস্থ হয়ে যেতে পারে। আর সে প্রচণ্ড জ্বরে আক্রান্ত হয়ে তার চোখের দৃষ্টি সাময়িকভাবে ঝাপসা বা ঘোলাটে হয়েও যেতে পারে। অবশ্য গুণিনের মন্ত্র পড়া নুনজল বার কয়েক চোখে দেবার পরই চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিক হয়ে যায়।

ঘোড়া ভূত— মরা ঘোড়ার আত্মা থেকে ঘোড়া ভূতের উৎপত্তি। গোনুয়ার মত এ ভূতও মানুষের তেমন কোন অনিষ্ট করে না। তবে মাঝে মাঝে রাতের অন্ধকারে ঘোড়া ভূত অলক্ষে থেকে বিচিত্র শব্দ করে এবং নিঃসঙ্গ পথচারীকে ভুল পথে চালিত করে। তাকে ভয় দেখানোর জন্যে তাকে কোন জলাশয় বা নদীর কিনারায় এনে পৌঁছে দেয় তাতে ঐ ব্যক্তি ভয় পেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে কিম্বা কোনক্রমে বাড়ী পৌঁছে অজ্ঞান হয়ে যায়। এক্ষেত্রেও গুণিনের মন্ত্রপড়া নুন জলই তার জ্ঞান ফিরিয়ে আনতে পারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *