২. পরম্পরায়িত সংস্কার

পরিচ্ছেদ – দুই : পরম্পরায়িত সংস্কার

গুপ্ত প্রতিষ্ঠানের উদ্ভাবন

সভ্যতার ঊষালগ্নে আদিম মানুষ প্রকৃতির পানে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি মেলে কখনও তাকায়নি। তারা তাদের বুদ্ধির অনতিক্রম্য প্রাকৃতিক কোন ঘটনাকেই কার্যকারণ সম্পর্কের সূত্র ধরে বিচার করতে যখন শেখেনি তখন তারা তাদের আদিম বিশ্বাস ও নানান বিভ্রান্তির মধ্যে থেকে প্রকৃতির বুকে অহরহ ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলির উৎস কোন না কোন অতিপ্রাকৃত শক্তির অদৃশ্য হাত বলেই মেনে নিয়েছিল। তারা মনে করত যে, অতিপ্রাকৃত জগতের এক এক রকম শক্তি লোকালয়ের আনাচে কানাচে লুকিয়ে থেকে প্রতিটি লোকের অদৃষ্ট নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের এই সব সহজ সরল ভাবনাচিন্তাই কালক্রমে এক গুচ্ছ বিশ্বাসের রূপ নেয়। সারা বিশ্বের আদিম মানব-গোষ্ঠী অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবেই এই বিশ্বাস বুকে নিয়ে জীবন অতিবাহিত করেছে। তাদের মধ্যে থেকেই এক সময় একদল বিশেষজ্ঞ বেরিয়ে আসে গোষ্ঠী জীবনকে নিরাপদ করতে, আশা আকাঙ্খা পূরণ করতে। এরা তাদের যৎসামান্য জ্ঞানবুদ্ধির বলে রোগ ব্যাধি, মহামারী ইত্যাদির সম্ভাব্য কারণ সম্পর্কে কিছু কিছু অভিজ্ঞতা অর্জনে সক্ষম হয়; রোগ ব্যাধি ভূতপ্রেত দুর্ঘটনা ইত্যাদি প্রতিরোধ কল্পে অনেক রকমের সহজ সরল কুশল পদ্ধতির প্রচলন করে।

এই সব পদ্ধতির প্রয়োগ ও কার্যকারিতা সম্পর্কে সাধারণ লোকের মনে গভীর আস্থার সঞ্চার হয়; পদ্ধতিগুলির নিয়মিত অনুশীলন ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে যথাযথ প্রয়োগের উদ্দেশ্যেই একের পর এক গুপ্তসংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের উৎপত্তি হতে থাকে। এইভাবেই নানান গুপ্তক্রিয়াকর্ম সংক্রান্ত রকমারী বিশ্বাস আদিম গোষ্ঠীর সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে নির্দিষ্ট একটি বিশ্বাস-বলয় বা উৎসারিত প্রথায় (beliefsystem) পরিণত হয়। কালক্রমে এই প্রথা বা লোকবিশ্বাস সমগ্র সমাজজীবনের সঙ্গে মিশে যায় অঙ্গাঙ্গী ভাবে। এর সাহায্যে গোষ্ঠী মানুষের রীতিনীতি আচার আচরণ এমন ভাবেই নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হতে থাকে যাতে কিনা যাবতীয় দুঃখ দুর্দশা ও সংকট পূর্ণ সমস্যা সমাধানের পথ সহজ থেকে সহজতর করে তোলা সম্ভব হয়।

আদিম মানুষেরা অতিপ্রাকৃত জগতের শ্রেণীবিন্যাস করে এক এক রকমের গুণ সম্পন্ন দেবদেবীর প্রবর্তন করেছিল। সব থেকে নীচের শ্রেণীতে এমন কতকগুলি অশরীরী শক্তির কল্পনা করেছিল যারা কেবল মানুষের অনিষ্ট করার জন্যেই যেখানে সেখানে লুকিয়ে থাকত। ঐ সব শক্তির বিরুদ্ধেই প্রার্থনা, পুজোপাঠ, অর্ঘ্য, উৎসর্গ ইত্যাদির প্রচলন করে। আবার এদেরই সন্তুষ্টি বিধানের জন্যে বহুরকমের গুপ্ত আচার অনুষ্ঠানের প্রবর্তন করতে হয়েছিল বিভিন্নভাবে। তবে ভবিষ্যৎ কথন সম্পর্কীয় অজস্র ক্রিয়া প্রক্রিয়ার অনুশীলন শুধু যে আদিম মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল তা কখনই নয়, উন্নত সমাজের সংস্কৃতি সম্পন্ন বহু মানুষের মধ্যে ভবিষ্যৎ জানার প্রবণতা যথেষ্ট পরিমাণেই ছিল। আদিম সমাজে রহস্যচর্চাকে যারা বংশগত পেশা হিসেবে গ্রহণ করত, তারা অবশ্য নিজেদের দলভুক্ত মানুষের সেবা করত নানা রকম ভাবে। তাই খুব স্বাভাবিক ভাবেই রহস্যচর্চা জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং রহস্যমূলক ক্রিয়াকর্ম জনসাধারণের উপযোগী বলেই যে গণ্য হয়েছিল তা কতকটা স্থির ভাবেই আমরা বলতে পারি।

বিশ্বের বিভিন্ন সংস্কৃতির পৌরাণিক সাহিত্য বাদেও আফ্রিকার উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলের ইতিবৃত্ত থেকে রহস্যচর্চা বিষয়ক রাশি রাশি চমকপ্রদ দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছে ইভানস প্রিচার (১৯৩৭), ন্যাডেল (১৯৫২), মারউইক (১৯৫৮), মিল্টন ও উইনটার (১৯৬৩) প্রমুখ নৃবিজ্ঞানী তাদের মূল্যবান সব গ্রন্থে। যদিও এই সব দৃষ্টান্ত সমকালীন ইংল্যান্ডে অবাস্তব ও অবিশ্বাস্য বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তথাপি এ্যালেন ম্যাকফারলেন প্রণীত Witchcrafin Tudor and Stuart England নামক বিখ্যাত গ্রন্থের দৃষ্টান্তসমূহ প্রমাণ করে যে, বর্তমান ইংল্যান্ডে রহস্যচর্চার দ্বার মোটেই রুদ্ধ হয়ে যায়নি।

গবেষণামূলক এই নিবন্ধে বিশেষ করে এটিই দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে, বর্তমান ভারতের শিক্ষাদীক্ষা ও প্রযুক্তি বিদ্যার ক্ষেত্রে বহু পরিবর্তন পরিবর্ধন প্রসার ও অগ্রগতি হওয়া সত্ত্বেও ডাকিনীবিদ্যা, মায়াবিদ্যা এবং এমন কি ওঝা, রোজা, গুণিন, গণৎকার প্রভৃতির গুপ্ত ও রহস্যজনক ক্রিয়াকান্ডের প্রতি সাধারণ মানুষের মনে এখনও যে কত গভীর বিশ্বাস রয়ে গেছে তা একটু অনুধাবন করলেই বোঝা যায়। মালিনস্কি (১৯২২) খুব জোরের সঙ্গেই ঘোষণা করেছিলেন যে, সমাজ জীবনের কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য ও পরিবেশের সঙ্গে রহস্যবিদ্যা সম্পর্কীয় নানান বিশ্বাস ঘনিষ্ঠভাবেই সম্পর্কযুক্ত হয়ে থাকে আর তা থাকে বলেই এসবের অস্তিত্বও যথারীতি টিকে থাকে বিভিন্ন গোষ্ঠী বা সামাজিক সংস্কৃতিভুক্ত মানুষের আচার আচরণের মধ্যে দিয়ে। এই সমস্ত সংস্থার বিভিন্ন দিক নিয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।

উপস্থিত পরিচ্ছেদে নানান দৃষ্টান্তের সাহায্যে গ্রন্থকার দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে, রহস্যচর্চার অর্ন্তভুক্ত বহু বিচিত্র বিশ্বাস ও গুপ্তপ্রতিষ্ঠানের কার্যপ্রণালীর ধারা হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসছে, অর্থাৎ মানব সমাজের উষা কাল থেকেই অব্যাহত আছে এই ধারা; আর ভারতীয় গ্রামীণ জনগণের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হিসেবেই বেঁচে আছে এই সমস্ত বিশ্বাস। এই রকমভাবে পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও এর প্রতিরূপ আমরা লক্ষ্য করে থাকি। ভারতের আদিবাসী অর্থাৎ যারা এ দেশের মাটিতে প্রথম বসত করে (autochthonous tribes), তাদের মধ্যে প্রচলিত এই জাতীয় নানা বিশ্বাসের কিছু কিছু উদাহরণও লেখক উপস্থিত করেছেন। আজও বেশ কিছু সংখ্যক উপজাতি গোষ্ঠী আদিম সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য ভালোভাবেই ধরে রেখেছে; তাদের বংশ পরম্পরায় চলে আসছে যুগ যুগ ধরেই এই সব বৈশিষ্ট্য। সমাজ বিজ্ঞানীরা তাই মনে করেন যে, বহু আদিম অন্ধ বিশ্বাস ও সেগুলির এক এক রকমের বৈশিষ্ট্য কি করে যে আজকের লোক সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত হল এবং গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক জীবন যাত্রার পথে ঐ সমস্ত বিশ্বাসের মূল্য ও কার্যকারিতা যে কতখানি তা বিষদভাবে অবগত হওয়ার প্রয়োজন আছে, সেই প্রয়োজনেই এই সমস্ত বিষয়ের গভীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা হওয়া একান্তই কাম্য।

আমরা এ কথা খুব ভালো মতই জানি যে, ভারতের প্রায় সমস্ত উপজাতি গোষ্ঠীর মানুষ দুষ্ট ও ইষ্ট বা ব্ল্যাক এণ্ড হোয়াইট উভয় যাদুতেই ছিল ভয়ানক বিশ্বাসী। দুষ্ট যাদুচর্চার প্রকৃতি সব সময়ই সমাজবিরোধী বলে চিহ্নিত। দুষ্ট স্বভাব বা খল যাদুকরেরা সাধারণত ব্যক্তি মানুষের অনিষ্ট সাধনে লিপ্ত থাকে এবং অনিষ্ট সাধনের ক্ষমতা তাদের জন্মগত বলেই জনসাধারণের বিশ্বাস। অনেকেরই ধারণা যে, ষ্ট যাদুচর্চায় পারদর্শী হয়ে বল যাদুকর বিভিন্ন অশুভ শক্তির কাছ থেকে অনিষ্ট করার বিশেষ বিশেষ ক্ষমতা লাভ করে। এই সব দুষ্ট প্রকৃতির যাদুকররাই সাধারণত ডান-ডাইনী, মায়াবী-মায়াবিনী হিসেবে কুখ্যাত হয়ে থাকে। এরা ছাড়াও আরো কিছু সংখ্যক ব্যক্তি আছে যাদের অনিষ্টকর ক্ষমতা লাভের উৎস হল এমন কিছু ঘোট মাপের দেবদেবী যারা নাকি বীর বলে খ্যাত বিভিন্ন পৌরাণিক গল্পগুচ্ছে। এরা কিন্তু সবই এক এক ধরণের অতিপ্রাকৃত জগতের শক্তি। এই সব শক্তি বা বীরদের আশীবাদ পুষ্ট হয়ে খল যাদুকরেরা এমন সব ক্ষমতার অধিকারী হয়, যার জোরে তারাই আবার ডান-ডাইনী, মায়াবিনীদের অশুভ দৃষ্টির প্রভাব ও প্রকোপ খর্ব করতে সমর্থ হয়। বেশ কিছু গুপ্ত ক্রিয়াকম সম্পাদন ও মন্ত্রতন্ত্রের সাহায্যে এইসব খল যাদুকরেরা অতিপ্রাকৃত শক্তির অনুকম্পা লাভে যখন সমর্থ হয়, তখন তারা যে কোন দুষ্ট শক্তিকে রুখে দেওয়া ও তাড়িয়ে দেবার ক্ষমতাও হাতে পেয়ে যায়। অশুভ শক্তির কোপে পড়া যে কোন ব্যক্তিকে মন্ত্রপূত ওষুধ দিয়ে খুব সহজেই সারিয়ে তোলে। এরাই সাধারণতঃ ইংরিজী অকাল্ট বিদ্যায় মেডিসিন-ম্যান, ডিভাইনার, উইচ ফাইভার বা একসরসিষ্ট নামে পরিচিত হয়েছে। কখন কখন এরা ভূতে পাওয়া রুগীর কানে কিম্বা তার দেহের যে অংশে ভূত বা অপদেবতা ভর করেছে বলে মনে করে সেই অংশে সজোরে ঘুষি মেরে রুগীকে সুস্থ করে তোলে।

এই রকম ঘটনা থেকে আপাততঃ এটাই বোঝা যাচ্ছে যে, বাস্তবে কিছু কিছু অদ্ভুত ধরণের পরিস্থিতির মোকাবিলার প্রয়োজনেই দুই যাদুচর্চার সূত্রপাত হয়েছিল মানুষের স্বাভাবিক বোধশক্তি ও প্রতিরোধ ক্ষমতাকে একেবারে তুচ্ছ জ্ঞান করে। গ্রামের কোন লোকের দেহে যদি একসঙ্গে নানারকমের উপসর্গ দেখা দেয়, যদি একটি গাছ ধীরে ধীরে শুকিয়ে যেতে থাকে, কোন স্ত্রীলোকের বুকের দুধ কিম্বা গরুর বাঁটের দুধ হঠাৎ শুকিয়ে যায়, কিম্বা কোন শিশুর অকস্মাৎ মৃত্যু হয়, তাহলে এই সমস্ত ঘটনাকে খল যাদুকরের গোপন কারসাজি বলে ধরা হয়। সুতরাং এই কারসাজির বিরুদ্ধে শক্তিশালী ক্রিয়া প্রক্রিয়া প্রয়োগের প্রয়োজন বোধ হয়ে থাকে। গ্রামবাসীদের এই প্রয়োজন মেটানোর উদ্দেশ্যে গ্রামের গুণিন বা গণৎকার এগিয়ে আসে। আর ঐ সমস্ত অঘটনের কারণ অনুসন্ধান করে ও তার প্রতিবিধানের জন্য নানারকমের বিধান সৃষ্টি করে। এই সমস্ত ঘটনা সাধারণ মানুষের জ্ঞান গরিমার বাইরে বলেই গুপ্তবিদ্যা বিশেষজ্ঞের একান্ত প্রয়োজন, সব কিছু অনুসন্ধান করে দেখা ও তার যথাযথ ব্যবস্থা করার জন্যে। কিন্তু খুব সহজে বিশেষজ্ঞ হওয়া যায় না। অত্যন্ত কঠোর নিয়ম কানুনের মধ্যে থেকে তালিম নিতে হয় বেশ কয়েক বছর। তাই সমস্ত দিক থেকে গোপনীয়তা রক্ষে করে নানা রকমের জটিল ক্রিয়াকান্ডের গুপ্ত রীতি-নীতি, কৃচ্ছসাধনের মধ্যে দিয়ে পালন করতে হয় গুপ্তচর্চায় একজন শিক্ষাণবিশকে।

.

উপজাতিয় বিশ্ব-দৃষ্টির দিগবলয়

ভারতীয় উপজাতি সমাজে প্রচলিত অতিপ্রাকৃত দুষ্ট শক্তি সম্পর্কীয় বিশ্বাস, বিভিন্ন উপজাতি গোষ্ঠী জীবনের ধ্যানধারণার প্রকৃতি নির্ণয় এবং রোজা ওঝা কিভাবে অশুভ শক্তির সম্মুখীন হয়, তা দেখানোর উদ্দেশ্যেই এখানে সামান্য কিছু দৃষ্টান্তের উল্লেখ করা হয়েছে। পন্ডিত ব্যক্তিদের প্রকাশিত প্রায় সমস্ত রকম জাতিবিদ্যা বিষয়ক গ্রন্থের বিবরণে নানা রকমের আলৌকিক বিশ্বাস ও মানব জীবনের ক্ষেত্রে অশরীরী দুষ্ট শক্তির অনিষ্ট সাধনের ক্ষমতা সম্পর্কে আমরা বহু দৃষ্টান্তই পেয়ে থাকি, এবং বেশ কিছু গুপ্ত ক্রিয়া কৌশল আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দুষ্টশক্তিকে যে রুখে দেওয়া সম্ভব, সে কথাও মানব বিজ্ঞানীরা বলে থাকেন। মধ্য প্রদেশের গন্দ ও ভুইয়ারা বিশ্বাস করে যে, গুনিয়া (Sooth-sayer) ও পাড়না (Padna)-রা অতি মানবিক ক্ষমতার অধিকারী হয় বিশেষ কিছু অদৃশ্য ও অতিপ্রাকৃত শক্তির সাহায্য পেয়ে, স্টিফেন ফিউক (১৯৬০: ৬০৮) এর বক্তব্য অনুসারে,

“The sooth-sayer’s task is to diagnose a casc to play the intermediary between the man and the super-human powers by revealing to the clients what exactly these invisible powers demand from them.”

গানের সাহায্যে অর্থাৎ বিভিন্ন সুরে গান গেয়ে গুনিয়ারা ঠাকুর দেও (Thakur deo) নামে দেবতাকে নামিয়ে এনে সাপে কাটা রুগীকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তুলতে তারা নাকি সিদ্ধ হস্ত।

কোল উপজাতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন গ্রফিথস সাহেব, ১৯৪৬ সালে। তাঁর মত অনুসারে কোল ধর্ম ও যাদু–

“religion and magic are inextrecably mixed so that it is hard to say where one begins and the other leaves off.”

তিনি কোন ডাইনীবৃত্তির প্রাঞ্জল বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন যে ডাইনীরা কি করে–

“are able to cast spells which reach far beyond the range of normal powers and are able to work havoc against whom so ever they are directed.”

কোলরা ডাইনীর অশুভদৃষ্টি (evil eye) ভয়ানকভাবে বিশ্বাস করে। নজর (nazar) কথাটির প্রচলন অনেক আদিম গোষ্ঠীর মধ্যেই দেখা যায়। এই শব্দের অর্থ হল, ডাইনী যদি কারোর ওপর নজর দেয় তাহলে কিছুদিনের মধ্যেই সেই ব্যক্তির সর্বাঙ্গ একটু একটু করে শুকিয়ে যেতে থাকে, এবং শেষ পর্যন্ত তার মৃত্যু অবধারিত। জন্মগতভাবে ডাইনীর মধ্যে এমন কিছু অনিষ্টকর ক্ষমতা থাকে যেটাকে সে বন্দুকের গুলির মত অন্যের দেহে প্রবেশ করিয়ে দিতে পারে বিষ নজরে নজর দিয়ে।

দুষ্ট শক্তিকে খুঁজে বার করার জন্য কোলরা ভবিষ্যৎ জানার চেষ্টা করে গভীর ভাবে, এবং ভবিষ্যৎ কথনে যারা বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠে তারাই তাদের সমাজে বৈগা (Baiga) বলে পরিচিত বা খ্যাত। সুতরাং যে কোন জায়গায় যে কোন দুষ্ট শক্তি লুকিয়ে থাক না কেন, বৈগা তা বলে দেয় ভবিষ্যৎ কথনের পদ্ধতি প্রয়োগ করে। সাধারণত দেখা যায় যে, বৈগা অনুসন্ধানের নির্দিষ্ট জায়গায় হাজির হয়েই চালের গুঁড়ো দিয়ে মাটিতে একটি বৃত্ত অংকন করে এবং বৃত্তের কেন্দ্রস্থলে জ্বালিয়ে রাখা হয় বড় একটি মাটির প্রদীপ। তারপর কিছু শস্যদানা গুণে গেঁথে বৃত্তের একধারে রেখে দেয়। সারা রাত প্রদীপ জ্বলতে থাকে। পরের দিন গুনিয়া এসে শস্যদানাগুলো গুণে দেখে ঠিক আছে কিনা এবং একটি দানাও যে নিজের জায়গা থেকে সরবে না, সে কথা গুনিয়া আগে থেকেই জানিয়ে রাখে। সব শেষে চালওঁড়োর বৃত্ত পরীক্ষা করে যদি দেখা যায় যে, বৃত্তের দাগে কোথাও একটু বিকৃতি বা নড়চড় হয়েছে তাহলেই ধরে নেওয়া হয় যে, কোন না কোন অশরীরী দুষ্টশক্তির আক্রমণ হয়েছে মন্ত্রপূত বৃত্তের ওপর। অতএব অনুসন্ধানের কাজ শুরু করতে গুণিয়া আর একটুও দেরী করে না।

বৈগা যাদুকরদের প্রসিদ্ধিও যেমন তারা তেমনি নিজেদের অসাধারণ অলৌকিক শক্তির আকর বলে মনে করে। যেসব ব্রাহ্মণরা বৈগাদের ঘরের কাছে পিঠে বাস করে, তারাও যে কোনরকম সমস্যা সমাধানে, যেমন কোন বন্ধ্যা নারীর বন্ধ্যাত্ব ঘুচিয়ে তাকে সমৃদ্ধ করা, গোপন চক্রান্তে জয়যুক্ত হওয়া, তাড়াতাড়ি ক্ষেতের ফসল পাকিয়ে তোলা, হারিয়ে যাওয়া জিনিসের সন্ধান দেওয়া ইত্যাদি ব্যাপারে বৈগাদের স্মরণাপন্ন হয়। এলউইন সাহেব লিখছেন

“The Baiga charms are necessary for the growth of the crops, the potency of a bridegroom, the frustration of the witches, the protection of the village against bears and tigers.” – (Elwin 1939: 338-358)

পাহাড়ি ভূঁইয়াদের মধ্যে চার শ্রেণীর যাদুকরের পরিচয় মেলে। যাদুকররা যে কেবল দুষ্ট শক্তিকে তাড়িয়ে দেবার ক্ষমতা রাখে তা নয়, তারা বিভিন্ন দুষ্ট শক্তিকে নিজেদের কাছে মন্ত্র বলে বশীভূত করে রাখতে পারে যতদিন ইচ্ছে, গোষ্ঠী জীবনের নানা উন্নতি সাধনের কাজে তাদের লাগিয়ে থাকে প্রয়োজন অনুসারে। পাহাড়ি গুনিয়ারা সাপে কামড়ানো রুগীকে সাধ্য প্রকারে মরতে দেয়না এবং যে কোন রকমের আঘাত, কাটাছেঁড়া ইত্যাদি অল্প সময়ের মধ্যে সারিয়ে তুলতে যথেষ্ট পারদর্শী হয়। তারা এই সমস্ত কাজ করে–

“Through spells combined with blowing on the patient with their mouth and making passes on him with their hands.” – (Roy, 1935: 235)

খেড়িয়া উপজাতিদের মধ্যেও অনেক রকম বিশ্বাস আছে। তারা রহস্যচর্চাকারীদের নির্দিষ্ট দুটি শ্রেণীতে ভাগ করে। ইষ্টকর যাদু বা হোয়াইট ম্যাজিক চর্চাকারীরা দেওনা (deona) বা ইংরিজীতে ডিভাইনার বলে খ্যাত, এবং অনিষ্টকর যাদু বা ব্ল্যাক ম্যাজিকচর্চাকারীদের বলে ডাইন বিশাই (Dain-Bishai) অর্থাৎ ইংরেজী উইচ। উভয় যাদুচর্চাকারী তথা বিশেষজ্ঞদের সব সময়ই কোন না কোন বড় মাপের ডাকিনীবিদ্যা বিশাবদের অধীনে থাকতে হয়। তা না হলে ডাকিনীবৃত্তি সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যপ্রণালী (modus operandi)র রহস্য উদঘাটনা সম্ভব হয় না। তবে প্রতিটি কার্যপ্রণালীর অনুশীলনের ক্ষেত্রে সতর্কতা ও গোপনীয়তা রক্ষা করাই হল অপরিহার্য শর্ত। নৃবিজ্ঞানী শরৎচন্দ্র রায়ের অভিমত হল যে, এই সমস্ত কার্যপ্রণালীর চর্চা কেবল মাত্র উপজাতি গোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, গ্রামের সাধারণ মানুষ ও বিশেষ করে চাষী সম্প্রদায়ের মধ্যে রহস্যচর্চার প্রচলন যথেষ্টই আছে। নৃবিজ্ঞানী তাঁর বিখ্যাত ইংরিজী গ্রন্থে “Oraon Religion and customs (1928) ওরাওদের সম্পর্কে বহু রকমের চমকপ্রদ তথ্য পরিবেশন করেছেন। অতিপ্রাকৃত জগৎ সম্পর্কে ওরাঁওদের বিচিত্র বিশ্বাস যেভাবে তাদের প্রাত্যহিক কর্মজীবনের সঙ্গে গভীরভাবে মিশে আছে তা নৃবিজ্ঞানী শরৎচন্দ্র অতিচমৎকার ভাবে দেখিয়েছেন। আবার ঐ সমস্ত বিশ্বাসের ওপর ভর করে তারা যে কিভাবে নানা রকমের ভবিষ্যৎ ঘটনার অশুভ সংকেত পেয়ে থাকে, সতর্কতা ও সাবধানতা অবলম্বন করে এবং ধর্মীয় উপায়ে না হয় মন্ত্র প্রয়োগের মাধ্যমে কি করে দুষ্ট শক্তির দমন কিম্বা বিনাশ করে তাও ঐ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে বিশদভাবে। কিন্তু প্রশ্ন হল, রহস্যবিদ্যা বিশেষজ্ঞরা সাধারণত কিভাবে কাজ করে? শ্রীযুক্ত রায় এ বিষয়ে বলছেন যে,

“By way of precaution, he has come to employ magical and religious rites in conjunction with his normal activities of hunting, fishing and agriculture in order that the course of such activities may run smooth and the desired goal may be duly attained without a hitch. He recognises and appreciates both the natural and supernatural forces and agencies shaping human destiny and seeks to utilise them both for the benefit according to his lights.” – (Roy: 1928: 5)

শ্ৰীযুক্ত রায় তার ঐ গ্রন্থের আর এক জায়গায় বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন–

Any one who is attracted to the profession by love of gain, may also go in for training in the necessary rites and penances, incantations and spells under some adept in the technique of the magic art and, in time, set himself up as a regular medicineman, variously known as Mati or Ojha, or Dcona. The Bhagat or Sakha finds out through his mcdiumistic powers the name of wilch or sorcerer who has set up some spirit or other to cause any sickness or other calamity and the sacrifices demanded by the spirit so sct up. the Mati or Ojha or Deona not only performs divination but also nutralises the ill-cffects of the evil eye and exorcises spirits, conducts necessary sacrificial rites to subdue or placate or expel them.” – (Roy: 1928: 11)

অতিপ্রাকৃত নানারকমের দুষ্টশক্তি ও তাদের অনিষ্টকারিতা সম্পর্কে মুণ্ডা উপজাতিদের ধ্যানধারণা বিশ্বাস ইত্যাদিতে ওঁরাওদের সঙ্গে বিশেষ কোন পার্থক্য নেই বলা চলে। সাঁওতাল সমাজে ডাইনী ভীতি বড়ই ভয়ংকর। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস যে, ডাইনী মাত্রেই যে কোন লোককে চোখের নিমেষে শেষ করে দিতে পারে। সাঁওতালদের মধ্যে হঠাৎ যদি কেউ দুর্ঘটনায় মারা যায় তাহলে তা যে কোন ডাইনীর মারণ মন্ত্রের ফল বলেই ধরে নেওয়া হয়। সাঁওতাল অধ্যুষিত গ্রামের মানুষ তাই গুণিনকেই তাদের একমাত্র রক্ষাকর্তা বলে মনে করে। সমস্ত রকম নিরাপত্তার যাদুমন্ত্র গুণিন ছাড়া আর কারো হাতেই থাকে না বলেই যে কোন রকম বিপদেই গুণিনের শরণাপন্ন হতে হয় সাধারণ সাঁওতাল মেয়ে ও পুরুষকে। আর বিপদ কাটানোর জন্যে গুণিন যে সমস্ত ক্রিয়াকর্মের পরামর্শ দেয় গাঁয়ের মোড়ল বা হেডম্যানকে তা পালন করতে হয় অক্ষরে অক্ষরে বিনা বাক্য ব্যয়ে।

ডাইনীদের সম্পর্কে বিচিত্র সব ধারণার সৃষ্টি হয়েছে সাঁওতাল সমাজে। সাঁওতালদের অধিকাংশই বিশ্বাস করে যে, ডাইনী গভীর রাত্রে চর্তুদিকে একা একা ঘুরে বেড়ায়। সময় সময় হাতে একটা মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখে। কেউ হয়ত এক ডাইনীকে এক জায়গায় দেখে এসেছে আবার সেই ডাইনী অনেক দূরের কোন এক জায়গায় অন্যের চোখে পড়তে পারে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে। সমস্ত দুর্ঘটনা, অনাবৃষ্টি ইত্যাদির মূলে যে ডাইনীদেরই কালো হাত কাজ করে সে বিশ্বাস সাঁওতালদের প্রায় মজ্জাগত। ডাইনীদের গোপন শিক্ষা বা ট্রেনিং সম্পর্কে সাঁওতাল মাত্রেই জানে যে, ডাইনীরা তাদের কোমরে এক গাছা ঝাঁটা খাসা করে পাকিয়ে বেঁধে নেয় এবং বগলের তলে একটা করে জীর্ণ কুলো চেপে রেখে যে কোন নির্দিষ্ট জায়গায় কিম্বা তাদের বিশেষ বিশেষ কুঞ্জবনে গিয়ে গুরুর কাছে হাজির হয় অন্ধকার রাতে। সেখানে পৌঁছেই ডাইনীদের প্রথম কাজ হল বড় একটা মুগীর রক্ত উৎসর্গ করা দেবতার নামে, কি সবাই মিলে একসঙ্গে বসে ভাত ও মুগীর মাংসে উদর পূর্তি করা, তারপর রাত দুপুরে নানারকমের মন্ত্রতন্ত্র আওড়ে ও গান গেয়ে গেয়ে ডাইনীবিদ্যার দীক্ষা নেয়। ক্রমশ তারা দক্ষতা অর্জন করতে থাকে ডাইনীবৃত্তিতে এবং অতি অল্প দিনের মধ্যে পেশাদারী ডাইনী বলে খ্যাত হয়। তবে ডাইনীদের দমন করার জন্যে সমস্ত উপজাতি সম্প্রদায়েই আছে ওঝা। এরা সাধারণতঃ

(ক) কোন ব্যাধির কারণ ও ডাইনী অনুসন্ধানের কাজে ভবিষ্যৎ কথনের রকমারি পদ্ধতি অবলম্বন করে।

(খ) সাঁওতাল ওঝা নিজস্ব অনুগত বংগা (Spirits) আবিষ্কার করে এবং তাদের দিয়েই দুষ্ট বংগায় ভর করা অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করে।

ভবিষ্যৎ গণনার জন্য এরা শাল (Shorea robusta) পাতা, সরষে, রেড়ি বা মহুয়ার তেল ব্যবহার করে। এক জোড়া কাঁচা শাল পাতা তেলে চুবিয়ে নিয়ে তার ওপর কিছুক্ষণ হাত ঘষতে থাকে মন্ত্র উচ্চারণ করে। বলা বাহুল্য ঐ পাতার ওপর অজ্ঞাত ডাইনীর যে মৃর্তি ফুটে ওঠে তা কেবল ওঝারই দৃষ্টিগোচর হয়। ওঝার একটুও দেরী হয় না ডাইনীকে চিনে ফেলতে। দুষ্ট ডাইনী বলে কেউ চিহ্নিত হলে তার বাঁচার রাস্তা প্রায় বন্ধ হয়েই যায়। আজও সাঁওতাল সমাজে ডাইনী নিধনের রীতি জবরদস্তভাবেই বহাল আছে।

লোধা সমাজেও গুণিনদের যথেষ্ট প্রভাব ও প্রার্দুভাব। যদি কোন জরুরী অবস্থায় স্থানীয় গুণিনকে কেউ হাতের কাছে না পায় তাহলে অন্য আর এক গ্রাম থেকে নামজাদা লোধা গুণিনকে ডাক দিয়ে আনতে হয়। ভূতে কিম্বা ডানে খাওয়া রুগীর চিকিৎসার জন্যে ভিন্ন গাঁয়ের গুণিনকে ডাক দিলে তাকে যথাযোগ্য পারিশ্রমিক দেবার ব্যবস্থা আছে লোধা সমাজে। লোধাদের মধ্যে যখনই কারো কোন আকস্মিক দুর্ঘটনা ঘটে কিম্বা কোনরকম দুর্ভাগ্যের লক্ষণ দেখা যায় তখনই ওঝা বা গুণিনকে এনে হাজির করা হয় দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করার জন্যে। যেভাবেই হোক, কারণ জানার সঙ্গে সঙ্গে গুণিনের ক্রিয়াকর্ম আরম্ভ হয়ে যায়, প্রতিবিধান করার উদ্দেশ্যে। লোধা গুণিনকে দীর্ঘদিন সুদক্ষ গুরুর অধীনে থাকতে হয় স্বাধীন ভাবে চিকিৎসা করার দায়িত্ব কাঁধে নেবার জন্যে। মেদিনীপুরের,নারায়ণগড় থানার অন্তর্গত সাউরি নামে হো বা কোল আদিবাসীরা যে ডাইনীর ভয়ে বিহার প্রদেশের এক গ্রাম ত্যাগ করে ওখানে এসে বসত করছে গ্রন্থকার তা বিলক্ষণ অবগত আছেন।

যে সমস্ত উপজাতি গোষ্ঠীর উল্লেখ এখানে করা হয়েছে তারা আমাদের অনুসন্ধানের নির্দিষ্ট অঞ্চলেই বসবাস করে। অন্য কোন গবেষক যদি উল্লিখিত উপজাতি ছাড়া ভারত উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে বসবাসকারী উপজাতিদের নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ব্রতী হন তাহলে এটি খুবই স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে আমাদের এই অঞ্চলের উপজাতি গোষ্ঠীর মধ্যে যে সমস্ত বিশ্বাস লক্ষ্য করা যায় তা অন্যান্য উপজাতি সমাজে একই ভাবে প্রচলিত।

উত্তর পূর্ব ভারতের মণিপুরে বসবাসকারী পুরুম (Purum) উপজাতি হল প্রাচীন কুকি (Kuki) উপজাতিরই এক শাখা। এরা ওঝাকে মাইপা (Maipa) বলে। জাদুচিকিৎসার সাহায্যে (magico-medical service) সমাজের সেবা করাই মাইপার কর্তব্য। আকস্মিক রোগভোগ বিপদ আপদের কারণ অনুসন্ধান ও তার উপযুক্ত ব্যবস্থা বা চিকিৎসা লোধা গুণিনের মত মাইপার কাঁধে চাপিয়ে রেখে পুরুম আদিবাসীরা একেবারে নিশ্চিন্ত। মাইপার গণনার কাজ হয় তেলের সাহায্যে। কোন দুষ্টশক্তির আক্রমণ বা আক্রোশের কারণ জানামাত্র তাকে সন্তুষ্ট করা হয় মুগীর মাংস দিয়ে, মাইপার বিধান মত।

উত্তর পূর্ব ভারতের মাতৃতান্ত্রিক খাসি উপজাতির মধ্যেও এই একই বিধান প্রচলিত। তাদের গণৎকার নংকহম (Nongkham) বলে পরিচিত। খাসি মেয়ে পুরুষের দেহ যেকোন রোগেই আক্রান্ত হোক না কেন, নংকহমের বিচারে তা দুষ্টশক্তির অভিশাপ বা আক্রমণ। সুতরাং রোগমুক্তির গুরুভার ঐ নংকহমের স্কন্ধেই ন্যস্ত থাকে।

নাগাল্যান্ডের উপজাতি সেমা নাগাদের গুপ্তবিদ্যা সংক্রান্ত নানান বিশ্বাস ও এই বিদ্যাচর্চার নানান দিক বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করেছেন হাটন সাহেব (১৯৬৮: ২১৩) তাঁর বক্তব্য অনুসারে,

“If a Man is ill or laid, he will often go and consult a “Thunoni” who will tell that there is a dirt in his body.”

সুতরাং রুগীর গায়ে যে কোন নোংরা পদার্থ বা ধুলো মাটি যেভাবেই লেগে থাক না কেন গণৎকার এক চিমটি দিয়ে উঠিয়ে দেয় এবং রোগও দুচার দিনেই সেরে যায়। আংগামি নাগা উপজাতিদের মধ্যেও ভবিষ্যৎ কথনের নানান প্রক্রিয়ার প্রচলন আছে। তাদের মধ্যে গোনাগাথা ও ডাইনীবৃত্তি চর্চা করার অধিকার সেইসব নাগারাই পায় যারা গোষ্ঠী মানুষের সামনে বিশেষ রকমের জ্ঞান গরিমা ও জাদুকৌশলের প্রমাণ দাখিল করতে পারে। এরাই রহস্যবিদ্যার বিশেষজ্ঞ বলে নির্বাচিত হয়ে থাকে। কিন্তু গ্রামবাসীরা তাদের নির্বাচন করে না, বরং নিজেদের প্রতিষ্ঠা তারা নিজে নিজেই পেয়ে যায় অতিপ্রাকৃত শক্তির নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে।

দক্ষিণ ভারতের নীলগিরি পার্বত্য অঞ্চলের টোডা উপজাতিদের যদি পরীক্ষানিরীক্ষা করা যায় তাহলে তাদের বিচিত্র রকমের সব গুপ্ত ক্রিয়া কাণ্ডের সঙ্গে পরিচিত হতে পারি। টোডারা তাদের গণৎকার বা ডিভাইনারকে ঐশী অঙ্গভঙ্গি সম্পন্ন মানুষ (god-gesticulating man) বলে জ্ঞান করে। বহু বিচিত্র ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে টোডারা বিশ্বাস করে যে, তাদের মধ্যে যে সব ব্যক্তি গণৎকার হয়ে ওঠে সে সব ব্যক্তির পেছনে থাকে মৃত বাপ ঠাকুরদা ও আত্মীয় কুটুমদের অলৌকিক শক্তি বা প্রেরণা; এবং এই শক্তি তারা উত্তরাধিকার সূত্রেই পেয়ে থাকে। কোন একজন টোডা যখনই কোনরকম দুর্ভাগ্যের শিকার হয় তখনই গণৎকার (Tenol) এর কাছে ছুটে যায় দুর্ভাগ্যের কবল থেকে বেরিয়ে আসার উপায় জানতে। টোডা উপজাতি সমাজে ভবিষ্যৎ কথনের কার্যকারিতা বা প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে রিভারস সাহেব যে তথ্য পরিবেশন করেছেন তা উল্লেখ করা দরকার। তিনি লিখেছেন —

“Sickness or death of a Toda or any of his family; sickness or death of a buffalo; failure of milk in a buffalo and persistent kicking off its call; failure to make a buffalo go to the spot at which it is to be killed during a funeral ceremony; failure of milk to coagulate; burning down of a dairy; disappearance of the bells of a dairy; or loss of a lifting stone.” – (Rivers, 19: 249)

অন্যান্য উপজাতিদের মত, দুর্ভাগ্যের কারণ অনুসন্ধানের জন্যে টোডারাও গণৎকারকে দিয়ে গণনা করায়। গণৎকার তার পরিবারের কারো কাছে এ বিষয়ে গোপন শিক্ষা এমন ভাবেই পেয়েছে যার জোরে সে যে কোন রকম দুর্ভাগ্যের সূচনাতেই তা প্রতিরোধ করতে পারে। কোন রোগীর চিকিৎসা করার সময় ঐ গণৎকার বা মায়াবী বিচিত্র ভাবে মন্ত্রোচ্চারণ করে এবং রোগ প্রতিরোধ বা নিরাময়ের উপায় সহজেই বাতলে দেয়। আবার সে যদি কারো অনিষ্ট সাধন করতে চায় দুষ্ট যাদু প্রয়োগ করে তাহলে সে ওই ব্যক্তির মাথার এক গাছা চুল ও তার জামা কাপড়ের এক টুকরো যে ভাবেই হোক হাতিয়ে নেয়, এবং ঐ দুটি জিনিষের ওপর দুষ্ট যাদুর প্রয়োগ করে। তারপর ঐ গুলি নিয়ে গিয়ে সেই ব্যক্তির বাড়ীর আশেপাশে যে কোন খড়ের গাদায় লুকিয়ে রেখে আসে। রেখে আসার কিছুক্ষণের মধ্যে থেকেই উক্ত ব্যক্তি একের পর এক বিপদে জড়িয়ে পড়তে থাকে। দুষ্ট যাদুর এই ভয়ংকর অনিষ্টের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার কোন উপায়ই সে খুঁজে পায়না। হারিয়ে যেতে থাকে তার স্বাভাবিক বোধ শক্তি।

অতিপ্রাকৃত জগতের শক্তি সম্পর্কে ভারতীয় উপজাতি সম্প্রদায়ে প্রচলিত যে সমস্ত ধ্যানধারণা তারই কিছু কিছু দৃষ্টান্ত এখানে উল্লেখ করা হল। আরো বহু রকমের বিশ্বাস আমাদের দেশের উপজাতি গোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত আছে। এই সমস্ত বিশ্বাসের ফলেই গুপ্তবিদ্যাচর্চাকারীদের বিচিত্র রকমের রহস্যজনক ক্রিয়াকলাপের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে উপজাতি সমাজে। আর আদিবাসী গোষ্ঠীর বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন চাহিদা আশা আকাঙ্খা পূরণ করার ব্যাপারে এক শ্রেণীর গুপ্তক্রিয়াকুশলী নানান কৌশলের মধ্যে দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে উপজাতি সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে। তারাই গোষ্ঠী জীবনকে সমস্ত দিক থেকে নিরাপদ করার আশ্বাস দিয়েছে। এছাড়াও কিছু কিছু ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনের মধ্যে দিয়ে সুখ স্বাচ্ছন্দ ও সৌভাগ্যের মুখ দেখবে বলে বিশ্বাস করত যে কোন গোষ্ঠী বা উপজাতি সম্প্রদায়ের প্রত্যেকটি মানুষ।

.

শ্রুতি ও শাস্ত্র

আমরা এ যাবৎ যা কিছু বলার চেষ্টা করে এসেছি তা থেকে অন্তত এটি পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, প্রাচীন ভারতের আদিম মনুষ্য সমাজে অতিপ্রাকৃত শক্তি সম্পর্কে বহু বিচিত্র ধ্যান ধারণার প্রচলন আবহমান কাল থেকেই ছিল। আদিম গোষ্ঠী বলতে যখন আদিম সংস্কৃতি (Primeval culture) বুঝিয়ে থাকে, তখন ঐ আদিযুগীয় সংস্কৃতিকেই অন্যসব সংস্কৃতির ভিত্তি বা সীমারেখা (base line) হিসেবে বিচার করা হয়। সমস্ত আদিম গোষ্ঠীর মানুষেরাই বলতে গেলে নিঃসঙ্গ অবস্থায় বিচ্ছিন্নভাবে বাস করত, এবং সেজন্যে অপর কোন সভ্যতা বা সংস্কৃতির রীতিনীতি, প্রথা বা প্রণালীর সংস্পর্শে আসার অবকাশ ছিল এদের খুবই সামান্য। তাই এদের মধ্যে প্রচলিত ঐতিহ্যগত ধ্যানধারণা বা ট্র্যাডিশনকে অতিশয় প্রাচীন বলে ধরা যেতে পারে। ঐ আদিম সমাজের গুপ্তবিদ্যা অনুশীলনকারী তথা বিশেষজ্ঞরা যে কিভাবে তাদের কার্যপ্রণালীর গোপনীয়তা রক্ষে করে গুপ্তচর্চার সাধারণ প্রবণতা বা গতিকে বাঁচিয়ে রাখতে সমর্থ হয়েছিল সে কথাও আমরা আগের আলোচনা থেকে জানতে পেরেছি। পরবর্তী কালে, বৈদিক ভারতে, কিম্বা বলা যায়, শ্রুতি বা বেদের যুগে এসে আমরা দেখতে পাই যে, বহু রহস্যজনক ধ্যানধারণা বা অদৃশ্য শক্তি সম্পর্কীয় বিষয়গুলির সংমিশ্রণ ঘটে যায় ধর্মীয় দার্শনিক তত্ত্বের সঙ্গে, আর এই সংযুক্তির মূলে ছিল তথাকথিত আর্যদের সঙ্গে ভারতের আদিম নিবাসী তথা প্রাক-আর্যগোষ্ঠীর মিথস্ক্রিয়া। ঐশী শক্তির সত্ত্বার সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক স্থাপন বা সাযুজ্য লাভের উপায় হিসেবে নানা রকমের স্তব, স্তোত্র, নৈবেদ্য, উৎসব ইত্যাদির প্রচলন হয়। এই সমস্ত ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে দৈব শক্তি সমূহের সন্তুষ্টি বিধান ও তাদের দয়াদাক্ষিণ্য লাভ করাই ছিল মানুষের অন্তরের আকাঙ্খা। তবে এইসব আচার পালনের ব্যাপারে মানুষের বিশেষ একটি লক্ষ্য ছিল। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত সম্পূর্ণ সক্রিয়তার মধ্যে দিয়ে যাপন করে নিজের বাস্তব অস্তিত্বকে যতদূর সাধ্য ও সম্ভব মূল্যময় করে তোলাই ছিল সে লক্ষ্য। ইংরিজী পরিভাষায় এই লক্ষ্যকে এক কথায় এগজিসটেনশ্যালিজম্ (existentialism) বললে বোধহয় ভুল হয় না। এই লক্ষ্য স্থির রেখে, প্রাকৃতিক ঘটনার ওপর নিয়ন্ত্রণ বা আধিপত্য বিস্তার করার জন্যে যাদুক্রিয়ার প্রয়োজনীয়তা মানুষ একান্ত ভাবেই অনুভব করেছিল। এ প্রসঙ্গে অথর্ববেদ বর্ণিত মন্ত্রতন্ত্রই হল প্রকৃষ্ট উদাহরণ। মন্ত্রশক্তি প্রয়োগ করে কীভাবে যে শারীরিক জ্বালাযন্ত্রণা ও অশুভশক্তির আক্রোশজনিত মানসিক রোগব্যাধি প্রতিরোধ ও নিরাময় সম্ভব তা আমাদের অথর্ববেদে খুবই স্পষ্ট। এই বেদ গ্রন্থে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানকারীর সর্বাঙ্গীন সুস্থতা ও কল্যাণ কামনা করে তার শক্রর প্রতি আঘাত হানার অজস্র উপায় অবলম্বনের মন্ত্র উপস্থিত করা হয়েছে। এ জাতীয় মন্ত্র বা নির্দেশ সম্বলিত যে সুদীর্ঘ সারণির পরিচয় পেয়ে থাকি তা নিঃসন্দেহে যাদু বিষয়ক ক্রিয়া কৌশলকে ভিত্তি করেই প্রণীত হয়েছিল : এসবের মুখ্য উদ্দেশ্য হল, যে কোন রকম রহস্যমূলক বিদ্যাচর্চায় পরিপূর্ণভাবে দক্ষতা অর্জন করা।

এই সমস্ত ঘটনাই প্রমাণ করে যে, আদিম কাল থেকে রহস্যচর্চার যে ধারা ও কার্যপ্রণালী বংশপরম্পরায় চলে আসতে থাকে অবিচ্ছিন্নভাবে তা যাযাবর আর্যজাতির বিভিন্ন ক্রিয়াকর্মের ক্ষেত্রেও গভীরভাবে আরোপিত হয়েছিল। সংস্কৃত ভাষার প্রভাবে (Sanskritic influence) যে বৈদিক যুগের যাদুমন্ত্র প্রভাবিত হয়েছিল তা স্পষ্টই লক্ষ্য করা যায়। এ সমস্ত কিছুর মূলে কিন্তু মানুষের বাস্তব অস্তিত্ব বজায় রাখার প্রশ্নই জড়িয়ে আছে; আর তা আছে বলেই মানুষের মনোজগতের বিপুল আশা আকাঙ্খার মতই মস্তুতন্ত্রের জগতের পরিধিও অতিশয় ব্যাপক। সেজন্য এই জগতের মধ্যে থেকে সাধারণ মানুষ সদাই পরিপূর্ণ করে তুলতে চায় তার অন্তরের যাবতীয় অভীপ্সা, ভোগ করতে চায় জড় জগতের সমস্ত রকম সুখ স্বাচ্ছন্দ আনন্দ।

তবে মানুষের জীবনের যে কোন ক্ষেত্রেই হোক না কেন, সেখানে অশুভ শক্তির একটা ধারণা সবসময়ই রয়েছে এবং এই ধারণা যে সমাজের শ্রীবৃদ্ধি ও স্থায়িত্বের পক্ষে বড়ই বিপদজনক তাও নিঃসংকোচে মনে করা হয়। অশুভ ও অনিষ্টকর শক্তির অদৃশ্য কালো হাত মানুষের সম্পদ হরণ করে, গরুর দুধ নিঃশেষ করে। ঘোড়ার দেহের মেদ মজ্জা গ্রাস করে, এবং তার বাসস্থানও ধ্বংস করে মাটিতে মিশিয়ে দেয়। সংক্ষেপে বলতে গেলে, দূর অতীতের সেই আদিম সমাজ ব্যবস্থায় প্রতিটি অনিষ্টকর কাজের জন্যে দায়ী করা হত এক দল অদৃশ্য দুষ্ট শত্রুকে। শত্রুরা অদৃশ্য হলেও, নানাভাবে এরা মানুষের মৌল স্বভাবের সঙ্গে নিজেদের মিশিয়ে দিয়ে ব্যক্তি মানুষের অনিষ্টসাধন করত অলক্ষ্যে থেকেই।

অথর্ববেদের অন্তর্ভুক্ত বেশ কিছু সংখ্যক যাদুমন্ত্রকে তাদের কার্যকারিতা অনুসারে বিভক্ত করে দু নম্বর সারণিতে উপস্থিত করা হয়েছে। সাধারণত এই সমস্ত মন্ত্র মানুষের পার্থিব আশা আকাঙ্খার পৃর্তি, অশুভ শক্তির বিতাড়ন ও রহস্যচর্চার প্রয়োজনেই সে সময়ে ব্যবহৃত হয়ে থাকত।

সারণি দুই
অথর্ববেদে উল্লিখিত মন্ত্রের কার্যকারিতা

আত্মরক্ষামূলক : রোগ প্রতিরোধী

(ক) সাপ বিছে ও বন্য জন্তুর কামড়ের বিরুদ্ধে।

(খ) ধান ক্ষেতের কীট নাশের বিরুদ্ধে।

আরোগ্যকর : (ক) কুষ্ঠ, যক্ষা ও শোথ ইত্যাদি রোগের বিরুদ্ধে।

(খ) হাড়ভাঙা ও সমস্ত রকম আঘাত নিরাময়ে।

(গ) যে কোন প্রকার দৈহিক ক্ষয় নিবারণে।

প্রতিরোধী মন্ত্র : (ক) শত্রুকে পরাস্ত করার মন্ত্র প্রয়োগপদ্ধতি।

সৃজনমূলক : (ক) সন্তান প্রসব পদ্ধতির সহজিকরণ।

(খ) কামদ মন্ত্রশক্তির প্রভাবে যেকোন বাঞ্ছিত কামিনীকে প্রভাবিত করা, তাকে নিজের অধীনে নিয়ে আসা এবং তার গৃহের পরিবারবর্গকে নিদ্রাচ্ছন্ন করে ঐ কামিনীর সঙ্গে সহবাসে তৃপ্তিলাভের নিমিত্ত মন্ত্রের প্রয়োগ, আবার সপত্নীর ওপর প্রভাব বিস্তার ও শক্ৰমাতাকে যে কোন রকমের যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতিতে ফেলে রাখার জন্যে মন্ত্রশক্তির প্রয়োগ।

বৈদিক যুগে চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন প্রকারের রোগ ব্যাধি চিকিৎসার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট করেছিলেন বেশ কিছু লতাপাতা শেকড় বাকড় বা ওষধি। ব্যক্তি বিশেষের দুর্ভাগ্যের কারণ নির্ণয় করার জনেই হোক, কি রোগ পরীক্ষা করে তার কারণ জানার জন্যেই হোক উভয় ক্ষেত্রেই চিকিৎসকরা নির্দিষ্ট কতকগুলি সংস্কৃত মন্ত্র উচ্চকণ্ঠে উচ্চারণ করতেন। আবার যদি কোন প্রেমিক তার প্রেমিকার গৃহে রাতের অন্ধকারে চুপিচুপি উপস্থিত হয়ে প্রেমিকার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাইত, তাহলে তাকেও যাদুমন্ত্রের আশ্রয় নিতে হত। প্রেমিকার গৃহের চারপাশে তাকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিতে হত মন্ত্রপূত জল। তার ফলে প্রেমিকার গৃহের প্রতিটি প্রাণী গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন থেকে প্রেমিকার সঙ্গে তার গোপন মিলনের পথ সুগম করত। এ সম্পর্কে যে সংস্কৃত শ্লোকটি পাই তা হল :

“স্বপ্তু মাতা, স্বপ্তু পিতা, স্বপ্তু স্বা
স্বপ্তু বিশপতিঃ,
স্বপনত্বস্যৈ জ্ঞাতিয়েঃ স্বপ্তু
যমাভিতো জনাঃ”

সরল অনুবাদ – হে নিদ্রাদেবী। পিতা, মাতা, আত্মীয়, পরিজন, অভিভাবক এমনকি গৃহপালিত কুকুরটিকেও গভীর নিদ্রায় নিদ্রিত রেখো, রাত্রিকালে আমি যখন আমার প্রিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতে রত হব।

এই মন্ত্রপাঠ করে সামান্য পরিমাণ জল মন্ত্রপূত করা হত। তারপর সেই জলের কিছুটা প্রেমিকার গৃহের অন্দর মহলে আবার কখন কখন গৃহের চারদিকে ছিটিয়ে দেওয়াই ছিল বিধান এবং বিধান অনুসারে গৃহের বাসিন্দারা আচ্ছন্ন হত গভীর নিদ্রায়। সেই অবসরে প্রেমিকার পক্ষে প্রেমিকের দর্শন পাওয়া হত খুবই সহজ।

সপত্নীকে দমন ও তার দিক থেকে স্বামীর মন বিষিয়ে দেবার জন্যে আর এক সপত্নী যে মন্ত্র পাঠ করত তাও অথর্ববেদে উল্লিখিত হয়েছে। যথা–

“নহিতে নাম জগ্রাহ নো অস্মিন রমমে পতৌ।
পরামেব পরাবতং সপত্নীং গময়ামসি।”

সরল অনুবাদ – ঈশ্বর প্রেরিত হে সুভাগ! হে দেবী সরস্বতী! তুমি দয়া করে অন্য কোন পুরুষের প্রতি আমার সপত্নীর মন আকৃষ্ট করাও যাতে আমার স্বামী তাকে ঘৃণা করে সদা সর্বদা আমার কাছেই থাকেন।

এই উদ্ধৃতি থেকে এটি স্পষ্ট বোঝা যায় যে, সাধারণ ব্যক্তি মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের বিভিন্ন সমস্যার সঙ্গে এই জাতীয় বিশ্বাসের কিছু না কিছু সম্পর্ক ছিল। বহুরকমের সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে নির্দিষ্ট কিছু কিছু মন্ত্রতন্ত্র ও ধর্মীয় আচার পালনের বিধান দিয়ে থাকত গুপ্তবিদ্যা বিশেষজ্ঞরা। সেজন্য এদের নির্দেশিত বিধান মাত্রেই কোন না কোন সমস্যা সমাধানের প্রতিষেধক দ্রব্য বা ঔষধ অর্থাৎ অ্যানটিডোট বলে বিবেচিত হত। সাধারণ লোক তো সব সময়ই চেষ্টা করে বাধা বিপত্তি পেরিয়ে এসে আকাঙ্খিত বস্তু হাতে পেতে, মনোবাসনা পূর্ণ করতে। গুপ্ত যাদুচর্চাকারীরা তাই ব্যক্তি বিশেষের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করত গুপ্ত আচার অনুষ্ঠান করে উপযুক্ত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে। তবে বাঞ্ছিত ফললাভ না করা পর্যন্ত দিনের পর দিন এই রকমের অনুষ্ঠান করে যাওয়াই ছিল গুপ্তবিদ্যা বিশেষজ্ঞদের বিধান। নিছক বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করেই এই সমস্ত ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনের প্রথা প্রচলিত হয় এবং এই প্রথা বা ‘বিলিফ সিস্টেম ক্রমে ক্রমে বিভিন্ন রকমের যৌগিক ক্রিয়া কর্মেও অনুপ্রবেশ করেছিল। এই কারণেই যোগ (Yoga) হল দর্শন ও ইন্দ্রজালের এক বিচিত্র সংমিশ্রণ। আমাদের মধ্যযুগীয় ভারতে যে সমস্ত যৌগিক প্রথা বা কাল্টের উদ্ভব হয় তার মধ্যে দুটি দিকের বিশেষ পরিচয় মেলে। একদিকে হল ব্যক্তিবিশেষের যোগ্যতা বলে অর্জিত অধিগত বিদ্যা, অপর দিকে হল অন্যের ওপর ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগের ক্ষমতা লাভ করা।

যাই হোক, বৈদিক যুগের পরে চাণক্য বা কৌটিল্য যাদু ও তন্ত্রমন্ত্রকে বিশেষভাবে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। এ প্রাধান্য যে কেবল ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্যে আরোপিত হয়েছিল তা নয়, বরং রাষ্ট্রের মঙ্গল কামনায় পরিচালনা, শত্রুদমন এবং অন্যান্য জাতি ও সম্প্রদায়ের আনুগত্য আদায়ের প্রয়োজনেও যথেষ্ট প্রাধান্য পেয়েছিল। তাই এই মন্ত্রে বলা হচ্ছে,

“বসম্‌ মে ব্রাহ্মণাঃ যান্তু
ভূমি পালক, ক্ষত্রিয়াঃ
বসম্‌ বৈশ্যা শূদ্রা
বসতাম্ যান্তু মে সদা।”

সরল অনুবাদ – সমস্ত ব্রাহ্মণ, সমস্ত ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রেরা যাতে আমার অনুগত হতে পারে, অর্থাৎ প্রয়োজনে এরা সকলেই যেন অতিশয় নিষ্ঠার সঙ্গে ও অকুণ্ঠ চিত্তে রাজ সেবায় নিযুক্ত হয় এই মন্ত্রের দৈবী শক্তি বলে।

একথা আগেই বলা হয়েছে যে, সভ্যতার প্রায় শুরু থেকেই সাপুড়ে বা ওঝা, কিম্বা ভবিষ্যৎ বক্তারা সমাজের ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ব্যক্তি বলে গণ্য হয়ে আসছিল। তাদের রহস্যচর্চায় কোনরকম বাধানিষেধ আরোপ করা হত না সমাজ জীবনের নানান প্রয়োজনীয়তার কথা চিন্তা করে। সুতরাং গুপ্তচর্চার প্রতিষ্ঠানগুলির কার্যকরী মূল্য যথেষ্ট বলে মনে করা হত সমাজ ও সম্প্রদায়ের কল্যাণকর দিক থেকে। অনেক এরকম যাদুমন্ত্র ও ধর্মীয় আচার আছে যার সাহায্যে যে কোন গৃহস্থ বাড়ীর লোকজনকে ঘুমপাড়িয়ে রহস্যচর্চাকারী নিজের স্বার্থসিদ্ধির পথ প্রশস্ত করার সুবর্ণ সুযোগ পায়। এই রকমই একটি মন্ত্র হল–

সুখ স্বপন্তু সিদ্ধার্থা
যমর্থম মার্গয়ামহে
যাবদ সুময়াদুদোয়ো
যাবর্থম ফলম্ মম।।

সরল অনুবাদ – হে নিদ্রাদেবি! আমি তোমাকে আহ্বান করি। আমার এই মন্ত্রটিকে তুমি এমন শক্তিশালী করে তোল যাতে এই মন্ত্র গৃহের বাসিন্দাদের চোখে ঘুমের ঘোর এনে দিতে সমর্থ হয় এবং নিদ্রিত অবস্থায় বাসিন্দারা যেন মধুর স্বপ্ন দেখতে থাকে এবং আমার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়।

পরবর্তী কালে লক্ষ্য করা যায় যে, গুপ্তবিদ্যাচর্চার প্রতিষ্ঠান সমূহো গুপ্ত বা রহস্যমূলক বিষয়গুলি হয়ে ওঠে ভয়ংকর শক্তিশালী তান্ত্রিক প্রথা বা কাল্টের • অন্তর্ভুক্ত হয়ে। অন্যান্য সব দুষ্ট যাদু বা ব্ল্যাক ম্যাজিকের মত তন্ত্রাচারের গোপন ক্রিয়াকর্ম শুধু ব্যক্তির স্বার্থপূরণের জন্যেই যে অনুষ্ঠিত হত তা নয়, বরং অপরের অনিষ্ট সাধন, মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তা বৃদ্ধি এবং ভয় ও আতঙ্ক সৃষ্টির জন্যেও অনুষ্ঠিত হয়ে থাকত যথেষ্ট গোপনীয়তার সঙ্গে। ব্যক্তি বিশেষের মনস্কামনা পূর্ণ করার উদ্দেশ্যে তান্ত্রিক সাধনার বিধান অনুযায়ী বিভিন্ন প্রকারের আচার পালিত হয়ে থাকে। এই সব কর্মানুষ্ঠানের রীতিনীতি যথাযথভাবে পালন করার জন্যে বিশেষ বিশেষ স্থান কাল দিনক্ষণ ইত্যাদি নির্ধারিত হয়ে থাকে তন্ত্রের বিধানে। যে সমস্ত ক্রিয়া তান্ত্রিক প্রথায় সাধারণ বা কমন বলে গণ্য হয়ে থাকে যে সমস্ত ক্রিয়া সম্পন্ন করার ক্ষমতা অর্জন করতে হয় নানারকম ভাবে যাদুমন্ত্র প্রয়োগ করে। এই জাতীয় তান্ত্রিক ক্রিয়াগুলিকে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিবৃত করা হয়েছে তিন নম্বর সারণিতে।

সারণি তিন
তন্ত্রাচারের বিবিধ ক্রিয়াকর্ম উপাদান ও প্রয়োগ পদ্ধতি

ক্রমিক সংখ্যাধরণপ্রয়োজনীয় উপাদানপ্রয়োগপদ্ধতিসময়/ঘণ্টা
বশীকরণলজ্জাবতী, অপসাৰ্গ, বহেরা অপরাজিতা ও চণ্ডালী লতা একসঙ্গে মিশিয়ে জলে সিদ্ধ করে মণ্ড প্রস্তুত।উদ্দিষ্ট ব্যক্তির দুচোখে ঐ মণ্ড নিয়ে কাজলের মত পরিয়ে দিতে হয়।কৃষ্ণপক্ষের চোদ্দ দিনের দিন নিশুতরাতে।
স্তম্ভমমহাশ্মশানের চিতাগ্নি কিম্বা কাঠ কয়লাঐ কয়লা দিয়ে প্রথমে মাটিতে। সংস্কৃত হ্রীং শব্দ লেখা তারপর বাঁহাতে গর্ত খুঁড়ে ঐ কয়লা পুঁতে বাঁ পায়ে গর্ত বুজিয়ে দেওয়া
আকর্ষণনতুন মাটির মালসায় একটি লাল ফুল এবং একটি পাঁঠা বলিগণেশের পুজো এবং যাকে আর্কষণ করার সংকল্প তাকে স্মরণ করে তিনবার তার নাম উচ্চারণ
বিদ্বেষ সৃষ্টি (বিশেষতঃ শত্রুর মনে)ঘোড়ার মল ও মোষের গোবরের সঙ্গে গোচোনার মিশ্রণএই মিশ্রণের সাহায্যে শত্রুকে লক্ষ্য করে মাটিতে তার নাম লিখে রা
উচাটননিমপাতা, ঘোড়ার মল, মোষের গোবর, কাকের বাসার কাঠি ও পালক এবং চিতার জ্বলন্ত কাঠ কয়লা।ঘোড়ার মল ও মোষের গোবরে তৈরী কালি দিয়ে উদ্দিষ্ট ব্যক্তির নাম নিমের পাতায় লিখে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া
মারণকোন ব্যক্তিকে অনিষ্টকর যাদুমন্ত্র বলে মারার জন্যে প্রয়োজনীয় উপাদান হল পাঁচটি কাঠের টুকরো দিয়ে প্রতিকৃতি প্রস্তুত করে চালের গুঁড়োর পিঠে, কুমোরের চাকের মাটি, ঝোলা গুড়, নুন, ঘোল থেকে ভোলা মাখন ও মোমতন্ত্রের মারণ ক্রিয়ার বিধি অনুসারে উদ্দিষ্ট ব্যক্তির প্রতিকৃতি দাহ করা হয় বিশেষ দিন ক্ষণের এক অনুষ্ঠানেআঠারো দিনের দিন গভীর রাতে

আমাদের এই সারণি থেকে দেখা যাচ্ছে যে, তান্ত্রিকরা যে সমস্ত যাদুমন্ত্র সম্মোহন ইত্যাদি প্রয়োগ করত তার সঙ্গে মন্ত্রপূত কিছু কিছু পদার্থ বা উপাদানের সংমিশ্রণও প্রায় অপরিহার্য ছিল। কোন ব্যক্তিকে আকর্ষণ করার জন্যে এমন কি রাজা, রানী, রাজকুমার, রাজকুমারী এবং সাধু সন্ন্যাসীদের ভালোবাসা ও আনুগত্য লাভের উদ্দেশ্যেও মন্ত্রের প্রয়োগ করা হত। সেরকম একটি মন্ত্র এখানে উদ্ধৃত করা হল :

“পুরুষোপ্যথবা নারী বেশ্যাবাপ্‌সরা সংগম্‌হ্‌
অচিরেণে সমায়াতি হরিদ্রাস্য প্রসাদতঃ
রাজা বা রাজরানী বা রাজপুত্রে অথবা মুনে।”

সরল অনুবাদ – “হে প্রভু গণপতি! তুমি সিদ্ধিদাতা। আমি তোমার নামে এই মন্ত্র প্রয়োগ করছি। তুমি দয়া করে এটিকে ব্যর্থ হতে দিও না। আমি যে ব্যক্তির অনুগ্রহ কামনা করি যে ব্যক্তিকে আমি জয় করতে চাই, সে ব্যক্তি একজন প্রণয়িনী, বারাঙ্গনা, অপ্সরা, রাজা, রানী, রাজকুমার, রাজকুমারী কিম্বা একজন মহাজ্ঞানী, নাহয় উচ্চবংশজাত সুপ্রতিষ্ঠিত কিম্বা নিম্নবংশজাত হোক না কেন আমি যেন আমার মনোবাসনা ও প্রয়োজন অনুসারে এখনি জয় করতে পারি।”

এই মন্ত্র পাঠ করার সময় হলুদ গাছ ব্যবহার করা হয়। কুমোরের চাকা থেকে কিছু পরিমাণ মাটি নিয়ে এসে ছোট ছোট দুটি থালা তা দিয়ে তৈরী করতে হয়। একটি থালায় গণেশের মূর্তি বসিয়ে তাকে তুষ্ট করতে হয় চারদিকে লাল ফুল একটি একটি করে সাজিয়ে রেখে। সন্তুষ্টি বিধানের এই তান্ত্রিক আচার চলতে থাকে এক নাগাড়ে সাতদিন, এবং আচার শেষে উদ্দিষ্ট ব্যক্তি সহজেই বশীভূত হয়ে থাকে বলে জানা যায়।

আবার শত্রুপক্ষের লোকেদের মধ্যে দ্বেষ-বিদ্বেষ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে গরুমোষ ও ঘোড়ার মলমূত্রের মিশ্রণে বিশেষ রকমের প্রলেপ প্রস্তুতের বিধান আছে। যে কোন দুজনের মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টি করার যদি বাসনা জাগে তাহলে ঐ প্রলেপ দিয়ে মাটিতে উভয়ের নাম লিখতে লিখতে মন্ত্রপাঠ করতে হয়। সে মন্ত্র হল :

“পরস্পরম বিপোবৈরম মিত্রেনা সহ নিশ্চিতম,
মহিষস্বপুরীসভ্যম, গোমূত্রেন সহ লিখেৎ।”

তুমি যদি দুই ব্যক্তির মধ্যে বিদ্বেষ বা শত্রুতা সৃষ্টি করতে প্রয়াসী হও তাহলে মহিষের বিষ্ঠার সঙ্গে গোমূত্র মিশিয়ে যে মিশ্রণ প্রস্তুত হয়, তা কাঠিতে করে উভয় ব্যক্তির নাম মাটিতে লিখে রাখ, তার ফলে ঐ দুই ব্যক্তির মধ্যে ঘনিষ্ট সম্পর্ক থাকা সত্বেও উভয়ে উভয়ের পরম শত্রু হয়ে দাঁড়াবে।

তন্ত্রশাস্ত্রে এরকমের বহু বিষয় সবিস্তারে বিবৃত বা বর্ণিত হয়েছে। এই সমস্ত বিষয়ের চাহিদা আমাদের সমাজ থেকে কোনদিনই নির্মূল করা সম্ভব নয়। কারণ সমাজ যখন বহু মানুষকে নিয়ে গড়ে ওঠে তখন ভিন্ন ভিন্ন মানুষের ভিন্ন ভিন্ন রুচি ও মানসিকতার বহিঃপ্রকাশও অনিবার্য। সেইজন্যে অতীতকাল থেকেই। গুপ্তবিদ্যাচর্চাকারী ও ক্রিয়াকুশলীরা সমাজের বিভিন্ন স্তরের বিপুল সংখ্যক মানুষকে নিজেদের মক্কেল হিসেবে হাতে পেয়ে আসছে ব্যবসায়িক ভিত্তিতে। ঐ সব ক্রিয়া-কুশলীরা তাদের কার্যপ্রণালীর কঠোর গোপনীয়তা ও নানা রকমের বাধা নিষেধ সব সময়ই বিশেষ মেনে চলে। বহু ক্ষেত্রেই তাদের গুপ্তক্রিয়ার প্রয়োগ সার্থক ও ইষ্টকর হয়ে থাকে বলেই গুপ্তবিদ্যাচর্চার প্রথা বা Cult এবং গুপ্ত প্রতিষ্ঠানের চাহিদা আমাদেরই সমাজের এক শ্রেণীর মানুষের মধ্যে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়ে এসেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *