১৭. কোচবিহার ও ত্রিপুরা

পরিশিষ্ট – কোচবিহার ও ত্রিপুরা

উপক্রমণিকা

বহু প্রাচীনকাল হইতেই বঙ্গদেশের উত্তর ও পূর্ব প্রান্তে বিভিন্ন মোঙ্গল জাতীয় লোক বাস করিত। তাহাদের মধ্যে অনেকে ক্রমে ক্রমে হিন্দুধর্ম ও বাংলাভাষা গ্রহণ করে। মধ্যযুগে ইহারা যে সমুদয় স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করিয়াছিল তাহাদের মধ্যে কোচবিহার ও ত্রিপুরাই সর্বপ্রধান এবং ইহাদের কতকটা নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক বিবরণ পাওয়া যায়। বাংলা দেশের সহিত প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিক সম্বন্ধ খুব বেশি না থাকিলেও মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাসে কোচবিহার ও ত্রিপুরার একটি বিশিষ্ট স্থান আছে। কারণ, প্রায় সমগ্র বঙ্গদেশে মুসলমানদের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত হইলেও কোচবিহার ও ত্রিপুরা যথাক্রমে বঙ্গদেশের উত্তর ও পূর্ব অঞ্চলের বিস্তীর্ণ ভূভাগে বহুদিন পর্যন্ত স্বাধীন হিন্দুরাজ্যরূপে বিরাজ করিত এবং শক্তিশালী মুসলমান রাজাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিয়া স্বাধীনতা বজায় রাখিতে সমর্থ হইয়াছিল। এই দুই রাজ্যেই ফার্সীর পরিবর্তে বাংলা ভাষাতেই রাজকার্য নির্বাহ হইত। এই দুই রাজ্যের হিন্দুধর্ম ও বাংলা-সাহিত্য সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা এই গ্রন্থে সম্ভবপর নহে। সংক্ষেপে বলা যাইতে পারে যে মধ্যযুগে বাংলা দেশে শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব প্রভৃতি যে সমুদয় ধর্মমত ও পূজাপদ্ধতি দেখা যায় তাহা মোটামুটিভাবে এই দুই রাজ্যেই প্রচলিত ছিল। প্রধানত রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় দুই রাজ্যেই বাংলা সাহিত্যের খুব উন্নতি হইয়াছিল। এই বাংলা সাহিত্যের অধিকাংশই সংস্কৃত, রামায়ণ, মহাভারত এবং পুরাণাদি অনুবাদ অথবা তদবলম্বনে রচিত। ইহাদের মধ্যে ঐতিহাসিক আখ্যানও আছে। এ বিষয়ে ত্রিপুরা রাজ্য কোচবিহার অপেক্ষা অধিকতর অগ্রসর ছিল। ত্রিপুরার ‘রাজমালার ন্যায় ধারাবাহিক ঐতিহাসিক কাহিনী এবং চম্পকবিজয়ের ন্যায় ঐতিহাসিক আখ্যানমূলক কাব্য কোচবিহারে নাই। তবে রাজবংশাবলী আছে। কিন্তু এই এক বিষয়ে কোচবিহারের সাহিত্য নূন হইলেও ধর্মগ্রন্থের অনুবাদ এই সাহিত্যে অনেক বেশি পরিমাণে পাওয়া যায়। ত্রিপুরায় রামায়ণ মহাভারতের অনুবাদ নাই, কোচবিহারে আছে। পুরাণাদি অনুবাদও সংখ্যার দিক দিয়া কোচবিহারেই বেশি। লোকের মনে ধর্মভাব জাগ্রত করাই ছিল এই সকল অনুবাদের উদ্দেশ্য। মৌলিক সাহিত্যসৃষ্টি এই দুই রাজ্যের কোনটিতেই বেশি নাই। এই দুই রাজ্যেই সংস্কৃত সাহিত্যেরও অনুশীলন হইত। অনেকে মত প্রকাশ করিয়াছেন যে বাংলার মুসলমান সুলতান ও ওমরাহের উৎসাহেই বাংলা সাহিত্য প্রতিষ্ঠা লাভ করিতে সমর্থ হইয়াছে। এ সম্বন্ধে (এই গ্রন্থের ‘ধর্ম ও সমাজ’ পরিচ্ছেদে) আলোচনা করা হইয়াছে। কোচবিহার ও ত্রিপুরার রাজগণের অনুগ্রহে ও পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা সাহিত্যের কি উন্নতি হইয়াছিল তাঁহার বিবরণ জানিলে উল্লিখিত মতবাদের নিরপেক্ষ বস্তুতান্ত্রিক আলোচনা করা সম্ভবপর হইবে।

কোচবিহার ও ত্রিপুরার রাজবংশের উৎপত্তি সম্বন্ধে বহু কাহিনী প্রচলিত আছে। কোচবিহারের প্রথম রাজা বিশু অথবা বিশ্বসিংহ চন্দ্রবংশীয় হৈহয় রাজকুলে এবং শিবের ঔরসে জন্মগ্রহণ করেন; এই বংশীয় দ্বাদশ রাজকুমার পরশুরামের ভয়ে, ‘মেচ জাতীয় এই পরিচয়ে আত্মগোপন করিয়াছিলেন। ত্রিপুরার ‘রাজমালার আরম্ভ এইরূপ

চন্দ্রবংশে মহারাজা যযাতি নৃপতি।
সপ্তদ্বীপ জিনিলেক এর রথে গতি ॥
তান পঞ্চসুত বহু গুণযুত গুরু।
যদুজ্যেষ্ঠ তুর্বসু দ্ৰহু অনু পুরু ॥

দ্রুহ্যু কিরাত রাজ্যের রাজা হইলেন। দ্রুর বংশে দৈত্য রাজার পুত্র ত্রিপুর স্বীয় নামানুসারে রাজ্যের নাম (কিরাত) পরিবর্তন করিয়া ত্রিপুর রাখিলেন।

বলা বাহুল্য যে এই সমুদয় কাহিনীর কোন ঐতিহাসিক মূল্য নাই। এই দুইটি রাজ্যের আদিম অধিবাসী ও রাজবংশ যে মঙ্গোলীয় জাতির শাখা এবং বাঙালী হিন্দুর সংস্পর্শে আসিয়া ক্রমশ হিন্দু ধর্ম ও সভ্যতা গ্রহণ করেন সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। উভয় রাজ্যের রাজারাই যে বাংলা দেশ হইতে বহু হিন্দুকে নিয়া নিজ রাজ্যে প্রতিষ্ঠা করিয়াই ইহার পথ সুগম করিয়াছিলেন তাহা এই দুটি রাজ্যের কাহিনীতে বর্ণিত হইয়াছে।

কোচবিহার

কোচবিহার নামের উৎপত্তি সম্বন্ধে বহু কাহিনী প্রচলিত আছে। তন্মধ্যে কোচ জাতির বাসস্থান বা বিহারক্ষেত্র হইতে কোচবিহার নামের উৎপত্তি–ইহাই সম্ভবপর বলিয়া মনে হয়। প্রাচীন হিন্দুযুগে এই অঞ্চল প্রাগজ্যোতিষ ও কামরূপ রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বাংলার মুসলমান রাজগণ, বখতিয়ার খিলজী, গিয়াসুদ্দীন ইউয়জ শাহ (এই গ্রন্থের প্রথম পরিচ্ছেদই), এবং ইখতিয়ারুদ্দীন য়ুজবক তুগরল খান কামরূপ রাজ্য আক্রমণ করেন তাহা পূর্বেই বলা হইয়াছে। এই শতাব্দেই শান জাতীয় আহোমগণ ব্রহ্মপুত্র নদীর উপত্যকার পূর্বাংশ অধিকার করে এবং ইহার নাম হয় আসাম। এই সময়েই কামরূপ রাজ্যের পশ্চিমাংশে এক নূতন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়। বর্তমান কোচবিহার শহরের সন্নিকটে কামতা বা কামতাপুর নামক স্থানে ইহার রাজধানী ছিল এবং এইজন্য ইহা কামতা রাজ্য নামে পরিচিত। বাংলার সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহ ১৪৯৮-৯৯ খ্রীষ্টাব্দে কামরূপ ও কামতা জয় করেন।

কামতা ও কামরূপ রাজ্য পতনের পরে ভূঁঞা উপাধিধারী বহু নায়ক এই অঞ্চলে ক্ষুদ্র রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। ইঁহাদেরই একজন, কোচজাতীয় হরিয়া মণ্ডলের পুত্র বিশু, অন্য নায়কদিগকে পরাজিত করিয়া আনুমানিক ১৫১৫ (মতান্তরে ১৪৯৬ অথবা ১৫৩০) খ্রীষ্টাব্দে কামতায় একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। ইহার রাজধানীর নাম হইল কোচবিহার (কুচবিহার)। বিশু রাজা হইয়া বিশ্বসিংহ’ এই নাম গ্রহণ করেন এবং ঐ অঞ্চল হইতে মুসলমান প্রভাব সম্পূর্ণরূপে দূর করেন। তিনি ব্রহ্মপুত্রের দক্ষিণ তীর দিয়া অগ্রসর হইয়া পূর্বে গৌহাটি পর্যন্ত রাজ্য বিস্তার করেন। তাঁহার রাজ্যের পশ্চিম সীমা ছিল করতোয়া নদী। বিশ্বসিংহ ব্রাহ্মণ্য ধর্ম্মের আচার-ব্যবহার গ্রহণ করেন এবং ব্রাহ্মণেরা তাঁহাকে ক্ষত্রিয় বলিয়া স্বীকার করেন। মুসলমানেরা কামতেশ্বরীর মন্দির ধ্বংস করিয়াছিল, বিশ্বসিংহ উহা পুনরায় নির্মাণ করেন এবং বিদেশ হইতে অনেক ব্রাহ্মণ আনাইয়া স্বীয় রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত করেন।

আনুমানিক ১৫৪০ (মতান্তরে ১৫৩৩) খ্রীষ্টাব্দে বিশ্বসিংহের মৃত্যু হইলে তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্র নরসিংহ রাজা হইলেন। অল্পকাল রাজত্ব করার পর তাঁহার মৃত্যু হইলে তাঁহার ভ্রাতা মল্লদেব নরনারায়ণ নাম গ্রহণ করিয়া সিংহাসনে আরোহণ করিলেন এবং কনিষ্ঠ ভ্রাতা শুক্লধ্বজকে মন্ত্রী ও প্রধান সেনাপতি পদে নিযুক্ত করিলেন। এই সময়ে পূর্ব আসামে সৈন্য চলাচল করিবার পথ অতি দুর্গম ছিল। আহোমদিগকে পরাজিত করিবার জন্য রাজা তাঁহার ভ্রাতা গোহাঁই (গোসাই) কমলকে সৈন্য ও যুদ্ধসম্ভার প্রেরণের উপযোগী একটি পথ প্রস্তুত করিতে আদেশ দিলেন। তদনুসারে কমল ভুটানের পর্বতমালা ও ব্রহ্মপুত্রের মধ্যবর্তী ভূভাগের উপর দিয়া কোচবিহার হইতে সুদূর পরশুকুণ্ড (মতান্তরে নারায়ণপুর) পর্যন্ত প্রায় ৩৫০ মাইল দীর্ঘ যে রাস্তা নির্মাণ করিয়াছিলেন তাঁহার কোন কোন অংশ এখনও আছে এবং ইহা “গোঁসাই কমল আলী” নামে পরিচিত। নরনারায়ণ ও শুক্লধ্বজ ব্রহ্মপুত্রের উত্তর তীরস্থ এই পথে গোয়ালপাড়া ও কামরূপের মধ্য দিয়া অগ্রসর হইলেন। আহোমদিগকে কয়েকটি খণ্ডযুদ্ধে পরাজিত করিয়া তাহারা ডিক্রাই বা ডিহং নদী পর্যন্ত পৌঁছিলে এই নদীর তীরে দুই দলে ভীষণ যুদ্ধ হয়। ‘দরংরাজবংশাবলী’ অনুসারে সাতদিন যুদ্ধের পর আহোমগণ পলায়ন করে এবং নরনারায়ণ আহোম রাজধানী অধিকার করেন। কিন্তু আহোম বুরঞ্জীর মতে কোচ সৈন্য প্রথম প্রথম জয় লাভ করিলেও পর পর দুইটি যুদ্ধে হারিয়া পশ্চাৎপদ হয়। এই যুদ্ধে শুক্লধ্বজ বিশেষ বীরত্ব প্রদর্শন করায় ‘চিলা রায় নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। চিলের মত ছোঁ মারিয়া অকস্মাৎ শত্রু সৈন্য বিপর্যস্ত করার জন্যই সম্ভবত তাঁহার এইরূপ নামকরণ হয়। কাহারও কাহারও মতে তিনি অশ্বপৃষ্ঠে ভৈরবী নদী পার হইয়াছিলেন বলিয়া চিলা রায় নামে খ্যাত হইয়াছিলেন।

কোচরাজ আহোমদিগকে পরাজিত করিয়াই ক্ষান্ত হন নাই। কাছাড়, মণিপুর, জয়ন্তিয়া, খয়রাম, দিমরুয়া, শ্রীহট্ট প্রভৃতি দেশেও সাময়িক অভিযান করিয়াছিলেন এবং এই সমুদয় দেশের রাজগণের অনেকেই পরাজিত হইয়া কোচরাজকে কর দিতে স্বীকৃত হইয়াছিলেন। এই প্রকারে ষোড়শ শতাব্দের শেষার্ধে কোচবিহার রাজ্য ভারতের পূর্ব সীমান্তে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী রাজ্যে পরিণত হয়।

এই সময়ে বাংলা দেশের অধিকার লইয়া পাঠান ও মুঘলেরা ব্যস্ত থাকায় কোচরাজ সেদিক হইতে কোন বাধা পান নাই। কিন্তু কররাণী বংশ বাংলায় সুপ্রতিষ্ঠিত হইলে সুলেমান কররাণী কোচরাজ্য আক্রমণ করেন। ইহার বিবরণ প্রথম পরিচ্ছেদেই দেওয়া হইয়াছে। কিন্তু অনতিকাল পরেই বাংলা দেশে পাঠানদের ধ্বংসের উপর মুঘল রাজশক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। নরনারায়ণ মুঘলদের সহিত মৈত্রী স্থাপনের জন্য আকবরের রাজসভায় বহু উপঢৌকনসহ এক দূত পাঠান এবং মুঘলরাজ ও নরনারায়ণ দুই সমকক্ষ রাজার ন্যায় সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হন। (১৫৭৮ খ্রীষ্টাব্দে)। বাংলা দেশে মুসলমান অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রায় চারি শত বৎসর পরে এই অঞ্চলে সর্বপ্রথম হিন্দু ও মুসলমান রাজ্যের মধ্যে শান্তিসূচক সন্ধি স্থাপিত হইল।

কিন্তু শীঘ্রই কোচবিহার রাজ্যে একটি গুরুতর পরিবর্তন ঘটিল। রাজা নরনারায়ণ বৃদ্ধবয়সে বিবাহ করেন এবং তাঁহার ভ্রাতুষ্পুত্র রঘুদেবকে রাজ্যের উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। কিন্তু নরনারায়ণের পর এক পুত্র হওয়ায় রঘুদেব রাজ্যলাভে নিরাশ হইয়া পূর্বদিকে মানস নদীর অপর পারে এক স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করিলেন। ভ্রাতুষ্পুত্রকে দমন করিতে না পারিয়া কোচরাজ তাঁহার সহিত আপসে মিটমাট করিলেন। স্থির হইল নরনারায়ণের পুত্র লক্ষ্মীনারায়ণ সঙ্কোশ নদীর পশ্চিম ভূভাগে রাজত্ব করিবেন এবং উক্ত নদীর পূর্ব অংশে রঘুদেব রাজা হইবেন। এইরূপে কোচবিহার রাজ্য দুইভাগে বিভক্ত হইল। পূর্বদিকের রাজ্য সাধারণত প্রাচীন কামরূপ নামেই পরিচিত হইত। এই বিভাগের ফলে কোচবিহার রাজ্য দুর্বল হইয়া পড়িল এবং ইহার খ্যাতি ও প্রতিপত্তি অনেক কমিয়া গেল। আর এই দুই রাজ্যের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলে উভয়েই মুঘলের পদানত হইল।

১৫৮৭ খ্রীষ্টাব্দে নরনারায়ণের মৃত্যুর পর তাঁহার পুত্র লক্ষ্মীনারায়ণ কোচবিহারের রাজসিংহাসনে আরোহণ করিলেন। বীরত্ব ও অন্যান্য রাজোচিত গুণ তাঁহার কিছুমাত্র ছিল না। ওদিকে রঘুদেবও স্বাধীন রাজার ন্যায় নিজের নামে মুদ্রা প্রচলন করিলেন। লক্ষ্মীনারায়ণ স্বয়ং রঘুদেবের সহিত যুদ্ধ করিতে ভরসা না পাইয়া রঘুদেবের পুত্র পরীক্ষিতকে পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহে উত্তেজিত করিলেন। রঘুদেব কঠোর হস্তে এই বিদ্রোহ দমন করিলে পরীক্ষিত লক্ষ্মীনারায়ণের আশ্রয় লাভ করিল। লক্ষ্মীনারায়ণের সহিত মুঘলরাজের সখ্যতার কথা স্মরণ করিয়া রঘুদেব মুঘলশ ঈশাখার সহিত বন্ধুত্ব করিলেন এবং কোচবিহার রাজ্যের অন্ত ভুক্ত বাহিরবন্দ পরগণা জয় করিতে মনস্থ করিলেন। লক্ষ্মীনারায়ণ নিরুপায় হইয়া এই বিপদ হইতে রক্ষা পাইবার জন্য মুঘল সম্রাটের বশ্যতা স্বীকার করিলেন (১৫৯৬ খ্রীষ্টাব্দে)। রঘুদেব বাহিরবন্ধ অধিকার করিয়া কোচবিহার আক্রমণ করিলেন। এই সময় মানসিংহ বাংলার শাসনকর্ত্তা ছিলেন। লক্ষ্মীনারায়ণ সাহায্য প্রার্থনা করিলে মানসিংহ সৈন্য পাঠাইলেন। রঘুদেব পরাজিত হইয়া কামরূপে ফিরিয়া গেলেন। বাহিরবন্দ পুনরায় কোচবিহার রাজ্যের অধীন হইল। এই যুদ্ধের বিবরণ পূর্বে উল্লিখিত হইয়াছে (নবম পরিচ্ছেদ)। ইসলাম খা মুঘল সুবাদাররূপে বাংলা দেশে আসিয়া কিরূপে বিদ্রোহী হিন্দু জমিদার ও পাঠান নায়কগণকে পরাজিত করিয়া মুঘল-শাসন দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন তাহা পূর্বেই বর্ণিত হইয়াছে (নবম পরিচ্ছেদ)। কোচবিহার ও কামরূপের পরস্পর বিবাদের সুযোগে এই উভয় রাজ্যই মুঘলের পদানত হইল। কামরূপের রাজা রঘুদেবের মৃত্যুর পর তাঁহার পুত্র পরীক্ষিতনারায়ণ রাজ হইলেন। তিনিও পিতার ন্যায় কোচবিহারের অধীনস্থ বাহিরবন্দ পরগণা অধিকার করিলেন। লক্ষ্মীনারায়ণ তাঁহার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিয়া গুরুতররূপে পরাজিত হইলেন। লক্ষ্মীনারায়ণ আহোম রাজার সাহায্য প্রার্থনা করিলেন। কিন্তু বিফল-মনোরথ হইয়া ইসলাম খাঁর শরণাপন্ন হইলেন। লক্ষ্মীনারায়ণ সম্পূর্ণরূপে মুঘলের দাসত্ব স্বীকার করিলে ইসলাম খাঁ তাঁহাকে সাহায্য করিতে প্রতিশ্রুতি দিলেন। পরীক্ষিত মুঘল সাম্রাজ্যের সামন্ত সুসঙ্গের রাজা রঘুনাথের পরিবারবর্গকে বন্দী করিয়াছিলেন। সুতরাং রঘুনাথও লক্ষ্মীনারায়ণের সঙ্গে যোগ দিলেন এবং তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া ইসলাম খাঁর দরবারে উপস্থিত হইলেন। মুঘল সম্রাটকে করদানে সম্মত হইয়া লক্ষ্মীনারায়ণ মুঘলের দাসত্ব স্বীকার করিলেন। এইরূপে স্বাধীন কোচবিহার রাজ্যের অবসান হইল।

অতঃপর লক্ষ্মীনারায়ণের প্ররোচনায় ইসলাম খাঁ কামরূপ রাজ্য আক্রমণ করিলেন। লক্ষ্মীনারায়ণও পশ্চিমদিকে হইতে কামরূপ আক্রমণ করিলেন। পরীক্ষিত সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হইয়া বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করিলেন (১৬১৩ খ্রীষ্টাব্দ)।

লক্ষ্মীনারায়ণ আশা করিয়াছিলেন যে পরাজিত রাজ্যের এক অংশ তিনি পাইবেন। যুদ্ধ শেষ হইবার পরে কামরূপ রাজ্যের শাসনভার তাহাকে দেওয়ায় এই আশা বদ্ধমূল হইল; কিন্তু অকস্মাৎ ইসলাম খাঁর মৃত্যু হওয়ায় (১৬১৩ খ্রী) সম্পূর্ণ অবস্থা-বিপর্যয় ঘটিল। লক্ষ্মীনারায়ণ নূতন সুবাদার কাশিম খাঁর সঙ্গে ঢাকায় সাক্ষাৎ করিলে তিনি প্রথমে তাঁহাকে সাদরে অভ্যর্থনা করিলেন কিন্তু পরিশেষে তাঁহাকে বন্দী করিয়া রাখিলেন। এই সংবাদে কোচবিহার রাজ্যে বিদ্রোহ উপস্থিত হইল, কিন্তু মুঘলসৈন্য সহজেই ইহা দমন করিল। অতঃপর লক্ষ্মীনারায়ণের পুত্র কোচবিহারের রাজপদে অভিষিক্ত হইলেন। লক্ষ্মীনারায়ণের বন্দীদশার সংবাদ ঠিক জানা যায় না। সম্ভবত এক বৎসর তাঁহাকে ঢাকায় রাখিয়া সম্রাটের দরবারে পাঠানো হয়। ১৬১৭ খ্রীষ্টাব্দে কাশিম খানের পরিবর্তে ইব্রাহিম খান নূতন সুবাদার হইয়া বাংলায় আসেন। তাঁহার অনুরোধে সম্রাট জাহাঙ্গীর লক্ষ্মীনারায়ণকে মুক্তি দেন (১৬১৭ খ্রী)। কিন্তু কোচবিহারে রাজত্ব করা তাঁহার অদৃষ্টে ছিল না। লক্ষ্মীনারায়ণ বাংলা দেশে ফিরিয়া আসিলে বাংলার সুবাদার তাঁহাকে কামরূপের মুঘল শাসনের সাহায্যার্থে তথায় প্রেরণ করেন। তিনি প্রায় দশ বৎসর কামরূপে অবস্থান করেন এবং সেখানেই তাঁহার মৃত্যু হয় (১৬২৬ অথবা ১৬২৭ খ্রীষ্টাব্দ)। পুত্র বীরনারায়ণ তাঁহার পরামর্শ অনুসারে কোচবিহারের রাজকার্য চালাইতে থাকেন এবং পিতার মৃত্যুর পর নিজ নামে রাজ্য শাসন করেন। তিনি মুঘলদরবারে রীতিমত কর পাঠাইতেন।

সাত বৎসর রাজত্ব করিয়া বীরনারায়ণের মৃত্যু হইলে তাঁহার পুত্র প্রাণনারায়ণ রাজা হন এবং ৩৩ বৎসর রাজত্ব করেন (১৬৩৩-৬৬ খ্রী)। প্রাণনারায়ণ রাজভক্ত সামন্তের ন্যায় আহোমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মুঘলসৈন্যের সাহায্য করেন। কিন্তু ১৬৫৭ খ্রীষ্টাব্দে সম্রাট শাহজাহানের অসুখের সংবাদ পাইয়া যখন বাংলার সুবাদার শুজা দিল্লির সিংহাসনের জন্য ভ্রাতা ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করিলেন তখন সুযোগ বুঝিয়া প্রাণনারায়ণ ঘোড়াঘাট অঞ্চল লুঠ করিলেন এবং স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া মুঘল সম্রাটকে কর দেওয়া বন্ধ করিলেন। ইহাতেও সন্তুষ্ট না হইয়া প্রাণনারায়ণ কামরূপ আক্রমণ করিলেন এবং মুঘল ফৌজদারের সৈন্যগণকে পরাজিত করিয়া হাজো পর্যন্ত অধিকার করিলেন। কিন্তু আহোমরাজ কোচবিহারের এই জয়লাভে ভীত হইয়া কোচবিহার রাজ্যের বিরুদ্ধে অগ্রসর হইলেন। গৌহাটির মুঘল ফৌজদার দুই দিক হইতে আক্রমণে ভীত হইয়া ঢাকায় পলায়ন করিলেন। আহোমসৈন্য বিনা আয়াসে গৌহাটি অধিকার করিল। অতঃপর কামরূপের অধিকার লইয়া কোচবিহার ও আহোম রাজ্যের মধ্যে যুদ্ধ হইল। প্রাণনারায়ণ মুঘলসৈন্য তাড়াইয়া ধুবড়ী অধিকার করিলেন। কিন্তু পরিণামে আহোমদেরই জয় হইল এবং কোচবিহাররাজ কামরূপের আশা পরিত্যাগ করিয়া স্বীয় রাজ্যে প্রত্যাবর্তন করিলেন।

ঔরঙ্গজেব সিংহাসনে আরোহণ করিয়াই মীরজুমলাকে বাংলার সুবাদার পদে নিযুক্ত করিলেন এবং বাংলার বিদ্রোহী জমিদারদিগকে কঠোর হস্তে দমন করিবার নির্দেশ দিলেন। প্রাণনারায়ণ ভীত হইলেন এবং ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া মীরজুমলার নিকট দূত পাঠাইলেন। মীরজুমলা দূতকে বন্দী করিলেন এবং কোচবিহারের বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠাইলেন। অবশেষে স্বয়ং সসৈন্যে কোচবিহার শহরের নিকট পৌঁছিলেন। প্রাণনারায়ণ রাজধানী ত্যাগ করিয়া ভুটানে পলায়ন করিলেন। কোচবিহার মীরজুমলার হস্তগত হইল (১৯শে ডিসেম্বর, ১৬৬১ খ্রী)। মীরজুমলা কোচবিহার। মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করিলেন এবং ইহার শাসনের জন্য ফৌজদার, দিওয়ান, প্রভৃতি নিযুক্ত করিলেন। কিন্তু তিনি আসাম অভিযানে যাত্রা করিবার পরেই কোচবিহারে জমির রাজস্ব আদায় সম্বন্ধে নূতন ব্যবস্থা করার ফলে প্রজারা বিদ্রোহী হইয়া উঠিল। বর্ষাগমে মীরজুমলার সৈন্য আসামে বিষম দুরবস্থায় পড়িল এবং কোচবিহারে মুঘলসৈন্য আসার কোন সম্ভাবনা রহিল না। এই সুযোগে রাজা প্রাণনারায়ণ ফিরিয়া আসিলেন। মুঘলসৈন্য কোচবিহার ত্যাগ করিতে বাধ্য হইল এবং প্রাণনারায়ণ পুনরায় স্বাধীনভাবে রাজত্ব করিতে আরম্ভ করিলেন (মে, ১৬৬২ খ্রীষ্টাব্দ)।

ইহার অনতিকাল পরেই মীরজুমলার মৃত্যু হইল (১৬ মার্চ, ১৫৬৬ খ্রী) এবং পর বৎসর শায়েস্তা খান বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হইলেন। তিনি রাজমহল পর্যন্ত আসিয়াই রাজধানী যাইবার পথে কোচবিহার জয় করিতে মনস্থ করিলেন। প্রাণনারায়ণের স্বাস্থ্য তখন ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে; রাজ্যের অভ্যন্তরেও নানা গোলযোগ। সুতরাং তিনি মুঘলের বশ্যতা স্বীকার করাই যুক্তিযুক্ত মনে করিলেন। তিনি এই উদ্দেশ্যে দূত পাঠাইলেন এবং যুদ্ধের ক্ষতিপূরণস্বরূপ মুঘল সুবাদারকে সাড়ে পাঁচ লক্ষ টাকা দিতে স্বীকৃত হইলেন। শায়েস্তা খান ইহাতে রাজী হইলেন (১৬৬৫ খ্র) এবং কোচবিহারের সীমান্ত হইতে মুঘলসৈন্য ফিরাইয়া আনিলেন। ইহার কয়েক মাস পরেই রাজা প্রাণনারায়ণের মৃত্যু হইল (১৬৬৬ খ্রীষ্টাব্দ)।

প্রাণনারায়ণের মৃত্যুর পর হইতেই কোচবিহারের আভ্যন্তরিক বিশৃঙ্খলা ক্রমশঃ বাড়িয়া চলিল। তাঁহার পুত্র মোদনারায়ণ ১৪ বৎসর রাজত্ব করেন (১৬৬৬-৮০ খ্রী), কিন্তু প্রাণনারায়ণের খুল্লতাত নাজীর মহীনারায়ণ এবং তাঁহার পুত্রেরাই প্রকৃত ক্ষমতা পরিচালনা করিতেন। ইহার ফলে রাজ্যে নানা গোলযোগের সৃষ্টি হইল। পরবর্তী রাজা বাসুদেবনারায়ণ মাত্র দুই বৎসর রাজত্ব করেন (১৬৮০ ৮২ খ্রী)। অতঃপর প্রাণনারায়ণের প্রপৌত্র মহীন্দ্রনারায়ণ (১৬৮২-৯৩ খ্রী) পাঁচ বৎসর বয়সে রাজা হইলেন কিন্তু নাজীর মহীনারায়ণের দুই পুত্র জগত্নারায়ণ ও যজ্ঞনারায়ণই রাজ্য চালাইতেন। তাহাদের অত্যাচারে রাজ্যে নানাবিধ অশান্তির সৃষ্টি হইল। এমন কি চাকলার ভারপ্রাপ্ত বহু কর্মচারী স্বাধীন রাজার ন্যায় ব্যবহার করিতে আরম্ভ করিলেন। কেহ কেহ মুঘলদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করিতে লাগিলেন। এই সুযোগে মুঘল সুবাদার পুনরায় কোচবিহার রাজ্য হস্তগত করিতে চেষ্টা করিলেন। ১৬৮৫, ১৬৮৭ ও ১৬৮৯ খ্রীষ্টাব্দে তিনটি সামরিক অভিযানের ফলে কোচবিহারের কতক অংশ মুঘলদের হস্তগত হইল।

অবশেষে কোচবিহাররাজ মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিলেন। যজ্ঞনারায়ণ সেনাপতি নিযুক্ত হইলেন এবং ভুটিয়ারাও তাঁহাকে সাহায্য করিল। দুই বৎসর (১৬৯১-৯৩ খ্রী) যাবৎ যুদ্ধ চলিল। অনেক পরগণার বিশ্বাসঘাতক কর্মচারীরা মুঘল সুবাদারকে কর দিয়া জমির মালিকানাস্বত্ব লাভ করিল। এই ভাবে ক্রমে ক্রমে কোচবিহার রাজ্যের অনেক অংশ মুঘলের অধিকারে আসিল।

রাজা মহীন্দ্রনারায়ণের মৃত্যুর পর (১৬৯৩ খ্রী) কিছুদিন পর্যন্ত গোলমাল চলিল। পরে তাঁহার পুত্র রূপনারায়ণ রাজত্ব করেন (১৭০৪-১৪ খ্রী)। তিনিও কিছুদিন যুদ্ধ করিলেন। কিন্তু ক্রমে ক্রমে বোদা, পাটগ্রাম ও পূর্বভাগ এই তিনটি প্রধান চাকলাও মুঘলেরা দখল করিল। ১৭১১ খ্রীষ্টাব্দে সন্ধি হইল। রূপনারায়ণ বর্তমান কোচবিহার রাজ্য পাইলেন এবং স্বাধীনতার চিহ্নস্বরূপ নিজ নামে মূদ্রা প্রচলনের অধিকারও বজায় রহিল। কিন্তু তিনি উল্লিখিত তিনটি চাকলার উপর শুধুমাত্র নামে বাদশাহের প্রভুত্ব স্বীকার করিয়া উহা নিজের অধীনে রাখার জন্য মুঘল বাদশাহকে কর দিতে স্বীকৃত হইলেন। কিন্তু নিজের নামে কর দেওয়া অপমানজনক মনে করায় ছত্রনাজীর কুমার শান্তনারায়ণের নামে ইজারাদার হিসাবে কর দেওয়া হইবে এইরূপ স্থির হইল।

এই সন্ধি স্থাপনের পরে বাংলার নবাবের সহিত রূপনারায়ণের মিত্রতা স্থাপিত হইয়াছিল এবং তিনি মুর্শিদকুলী খাঁর দরবারে উকিল পাঠাইয়াছিলেন।

রূপনারায়ণের মৃত্যুর পর তাঁহার পুত্র উপেন্দ্রনারায়ণ সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং ৫০ বৎসর রাজত্ব করেন (১৭১৪-৬৩ খ্রী)। তাঁহার দত্তক-পুত্র বিদ্রোহী হইয়া রংপুরের ফৌজদারের সাহায্যে কোচবিহার রাজ্য দখল করেন। উপেন্দ্রনারায়ণ ভুটানের রাজার সাহায্যে যুদ্ধ করিয়া মুঘলসৈন্য পরাস্ত করেন এবং পুনরায় সিংহাসন অধিকার করেন (১৭৩৭-৩৮ খ্রী)। মুঘলের সহিত কোচবিহারের ইহাই শেষ যুদ্ধ। ভুটান-রাজের সাহায্য গ্রহণের ফলে রাজ্যে ভুটিয়াদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি অনেক বাড়িল এবং পরবর্তীকালে ইহার ফলে নানারূপ অশান্তি ও উপদ্রবের সৃষ্টি হইয়াছিল।

ত্রিপুরা

ত্রিপুরার রাজবংশ যে খুবই প্রাচীন এবং মধ্যযুগের পূর্বেও বিদ্যমান ছিল সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। মধ্যযুগে এই রাজ্যের ও রাজবংশের একখানি ইতিহাস (বাংলা পদ্যে) রচিত হইয়াছিল। এই গ্রন্থের প্রস্তাবনায় উক্ত হইয়াছে যে রাজা ধর্মমাণিক্যের আদেশে বাণেশ্বর ও শুক্রেশ্বর নামক দুইজন প্রধান এবং চন্তাই (প্রধান পূজারী) দুর্লভেন্দ্র কর্ত্তৃক এই গ্রন্থ রচিত হয়। ধর্মমাণিক্য পঞ্চদশ খ্রীষ্টাব্দে রাজত্ব করেন। এই গ্রন্থের মূল সংস্করণ এখন আর পাওয়া যায় না। কিন্তু পরবর্তীকালে ইহা পরিবর্ধিত আকারে যে রূপ ধারণ করে বর্তমানে তাহাই ‘রাজমালা নামে পরিচিত। [ইহার দুইটি সংস্করণ মুদ্রিত হইয়াছে। প্রথমটি শ্ৰীকালীপ্রসন্ন সেন সম্পাদন করেন (১৯৩১ ৩৬ খ্রীষ্টাব্দে)। দ্বিতীয়টি ১৯৬৭ খ্রীষ্টাব্দে ত্রিপুরা সরকার প্রকাশিত করেন। এই দুইটি সংস্করণের মধ্যে অনেক তারতম্য দেখা যায়।]

রাজমালায় বর্ণিত হইয়াছে যে চন্দ্রবংশীয় যযাতি স্বীয় পুত্র দ্রুহু্যকে কিরাতদেশে রাজা করিয়া পাঠান এবং এই বংশে ত্রিপুর নামক রাজার জন্ম হয়। ইহার সময় হইতেই রাজ্যের নাম হয় ত্রিপুরা। ইনি দ্বাপরের শেষভাগে জন্মগ্রহণ করেন এবং ‘রাজমালার সম্পাদকের মতে সম্ভবত যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে উপস্থিত ছিলেন।

এই সমুদয় কাহিনীর যে কোন ঐতিহাসিক মূল্য নাই তাহা বলাই বাহুল্য। ত্রিপুরের পরবর্তী ৯৩ জন রাজার পরে ছেংথুম-ফা রাজার নাম পাওয়া যায়। ‘রাজমালা অনুসারে ইনি গৌড়েশ্বরকে যুদ্ধে পরাজিত করেন এবং এই গৌড়েশ্বর যে মুসলমান নরপতি ছিলেন সাহা সহজেই অনুমান করা যায়। সুতরাং এই রাজার সময় হইতেই ত্রিপুরার ঐতিহাসিক যুগের আরম্ভ বলিয়া গণ্য করা যাইতে পারে।

বাংলার মুসলমান সুলতান গিয়াসুদ্দিন ইউয়জ শাহ (১২১২-২৭ খ্রীষ্টাব্দ) পূর্ববঙ্গ ও কামরূপ আক্রমণ করিয়াছিলেন, কিন্তু নাসিরুদ্দীন মাহমুদের আক্রমণ সংবাদ পাইয়া ফিরিয়া যান। সম্ভবত ইহাই পরবর্তীকালে কোন গৌড়াধিপতির ত্রিপুরা আক্রমণ ও পরাজয়রূপে বর্ণিত হইয়াছে।

রাজমালায় বর্ণিত হইয়াছে যে ছেংথুম-ফার প্রপৌত্র ডাঙ্গর-ফার আঠারোটি পুত্র ছিল। সর্বকনিষ্ঠ রত্ন-ফা গৌড়ের রাজদরবারে কিছুদিন অবস্থান করেন এবং গৌড়েশ্বরের সৈন্যের সহায়ে ত্রিপুরার রাজসিংহাসন লাভ করেন। এই গৌড়েশ্বর নিঃসন্দেহে বারবক্ শাহ (১৪৫৫-১৪৭৬ খ্রীষ্টাব্দ)। রত্ন-ফা গৌড়েশ্বরকে একটি বহুমূল্য রত্ন উপহার দেন। গৌড়েশ্বর তাঁহাকে মাণিক্য উপাধি দেন। এতকাল ত্রিপুরার রাজগণ নামের শেষে ‘ফা’ উপাধি ব্যবহার করিতেন; স্থানীয় ভাষায় ‘ফা’-র অর্থ পিতা। অতঃপর ‘ফা’-র পরিবর্তে রাজাদের নামের শেষে মাণিক্য ব্যবহৃত হয়। সুতরাং রত্ন-ফা হইলেন রমাণিক্য।

‘রাজমালার’ এই কাহিনী কতদূর সত্য তাহা বলা যায় না। তবে পূর্ব্বোক্ত রাজা ধর্মমাণিক্য যে রত্নমাণিক্যের পূর্ববর্তী, মুদ্রার সাক্ষ্য হইতে তাহা জানা যায়। সুতরাং রত্নমাণিক্যই যে সর্বপ্রথম মাণিক্য’ উপাধি গ্রহণ করেন এই উক্তি সত্য নহে।

‘রাজমালায়’ এই সময়কার রাজবংশের যে তালিকা আছে মুদ্রার প্রমাণে তাহা ভ্রান্ত প্রমাণিত হইয়াছে। প্রকৃত বংশাবলী সম্বন্ধে পরিশিষ্টে আলোচনা করা হইয়াছে।

রাজমালায় বর্ণিত ত্রিপুরার রাজাদের মধ্যে সর্বপ্রথম ধর্মমাণিক্যের তারিখই সঠিক জানা যায়, কারণ তাঁহার একখানি তাম্রশাসনে ১৩৮০ শক অর্থাৎ ১৪৫৮ খ্রীষ্টাব্দের উল্লেখ আছে। “ত্রিপুর-বংশাবলী অনুসারে ধর্মমাণিক্য ৮৪১ হইতে ৮৭২ ত্রিপুরাব্দ অর্থাৎ ১৪৩১ হইতে ১৪৬২ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। ‘রাজমালায় ইঁহার পিতার নাম মহামাণিক্য, তাম্রশাসনে তাহাই আছে। সুতরাং অন্তত এই সময় হইতে ত্রিপুরার প্রচলিত ঐতিহাসিক বিবরণ মোটামুটি সত্য বলিয়া গ্রহণ করা যাইতে পারে। ধর্মমাণিক্যই যে ‘রাজমালা’-নামক ত্রিপুরার ঐতিহাসিক গ্রন্থ প্রণয়ন করান তাহা পূর্বেই উল্লিখিত হইয়াছে।

রাজা ধর্মমাণিক্যের পূর্বে বাংলার মুসলমান সুলতানগণ ত্রিপুরা আক্রমণ করিয়া ইহার কতকাংশ অধিকার করেন এবং ধর্মমাণিক্য তাঁহার পুনরুদ্ধার করেন–এই প্রচলিত কাহিনী কতদূর সত্য বলা যায় না। তবে শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহ (১৩০১-১৩২২ খ্রীষ্টাব্দ) ময়মনসিংহ ও শ্রীহট্ট প্রভৃতি তাঁহার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করিয়াছিলেন, ফকরুদ্দীন মুবারক শাহ চট্টগ্রাম জয় করিয়াছিলেন, শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ (১৩৪২-৫৮ খ্রীষ্টাব্দ) সোনারগাঁও ও কামরূপের কতক অংশ জয় করিয়াছিলেন ত্রিপুরার কতক অংশ জালালুদ্দীন মুহম্মদ শাহের (১৪১৮-৩৩ খ্রীষ্টাব্দ) রাজ্যভুক্ত হইয়াছিল–ইহা গ্রন্থের প্রথম পরিচ্ছেদসমূহে বলা হইয়াছে এবং ইহারা সম্ভবত ত্রিপুরা রজ্যেরও কতক অংশ জয় করিয়াছিলেন। কিন্তু শেষোক্ত সুলতানের মৃত্যুর পর হইতে রুকনুদ্দীন বারবক শাহের (১৪৫৫-৭৬ খ্রীষ্টাব্দ) রাজত্বের মধ্যবর্তী ২২ বৎসর কাল মধ্যে বাংলার সুলতানগণ খুব প্রভাবশালী ছিলেন না–আভ্যন্তরিক গোলযোগও ছিল। সুতরাং এই সুযোগে ধর্মমাণিক্য সম্ভবত ত্রিপুরার বিজিতাংশ উদ্ধার করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন।

ধর্মমাণিক্যের পরবর্তী রাজা রত্নমাণিক্য সম্বন্ধে ‘রাজমালায় বিস্তৃত বর্ণনা আছে। গৌড়েশ্বরের অনুমতিক্রমে তিনি দশ হাজার বাঙালীকে ত্রিপুরায় প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন। রত্নমাণিক্য যে বাংলা দেশীয় হিন্দুদের সংস্কৃতি ও সামজিক আচার-ব্যবহার সম্বদ্ধে প্রথমে খুবই অজ্ঞ ছিলেন, কিন্তু কিছু কাল পরে তাঁহার দিকে আকৃষ্ট হন-রাজমালায় তাঁহার স্পষ্ট উল্লেখ আছে। সুতরাং রত্নমাণিক্যের সময় হইতেই যে ত্রিপুরার সাহিত বাংলার ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ স্থাপিত হয় এবং বাংলার হিন্দুসংস্কৃতি ও সভ্যতা ত্রিপুরায় দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় এরূপ অনুমান করা যাইতে পারে। রত্নমাণিক্য অন্ততঃ ১৪৬৭ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করিয়াছিলেন।

এই সময়ে সৈন্যগণ খুব প্রবল হইয়া উঠে এবং যখন যাহাকে ইচ্ছা করে তাহাকেই সিংহাসনে বসায়। রাজা ধন্যমাণিক্য (১৪৯০-১৫১৪) ইহাদের দমন করেন এবং চয়চাগ নামক ব্যক্তিকে সেনাপতি নিযুক্ত করেন। তিনি ত্রিপুরার পূর্বদিকস্থিত কুকিদিগকে পরাজিত করিয়া তাহাদের পার্ব্বত্য বাসভূমি ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন এবং চট্টগ্রাম অধিকার করিয়াছিলেন। হোসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রীষ্টাব্দ) বাংলা দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা আনয়ন করিয়া পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলি আক্রমণ করেন। আসাম ও উড়িষ্যায় বিফল হইয়া তিনি ত্রিপুরা আক্রমণ করেন। ইহার বিবরণ পূর্বেই দেওয়া হইয়াছে (ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ)।

ধন্যমাণিক্যের পরে উল্লেখযোগ্য রাজা বিজয়মাণিক্য (১৫৩২-৬৩) আকবরের সমসাময়িক ছিলেন এবং আইন-ই-আকবরীতে স্বাধীন ত্রিপুরার রাজা বলিয়া স্বীকৃত হইয়াছেন। তিনি একদল পাঠান অশ্বারোহী সৈন্য গঠন করেন এবং শ্রীহট্ট, জয়ন্তিয়া ও খাসিয়ার রাজাদিগকে পরাজিত করেন। কররাণী রাজাগণের সঙ্গে তাঁহার সংঘর্ষের কাহিনী এবং সোনার গাঁ ও পদ্মানদী পর্যন্ত অভিযানের কাহিনী সমসাময়িক মুদ্রার প্রমাণে সমর্পিত হইয়াছে।

পরবর্তী প্রসিদ্ধ রাজা উদয়মাণিক্য রাজবংশে জন্মগ্রহণ করেন নাই। তাঁহার রাজ-জামাতাকে হত্যা করিয়া ত্রিপুরার সিংহাসন অধিকার করিয়াছিলেন (১৫৬৭)। তিনি রাজধানী রাঙ্গামাটিয়ার নাম পরিবর্তন করিয়া নিজের নামানুসারে উদয়পুর এই নামকরণ করিলেন। কথিত আছে যে মুঘলসৈন্য চট্টগ্রাম অধিকার করিতে অগ্রসর হইলে তিনি মুঘল সৈন্যের সঙ্গে ঘোরতর যুদ্ধ করিয়া পরাস্ত হন।

উদয়মাণিক্যের পুত্র জয়মাণিক্যকে (১৫৭৩) বধ করিয়া বিজয়মাণিক্যের ভ্রাতা অমরমাণিক্য ত্রিপুরার রাজসিংহাসনে আরোহণ করিলেন (১৫৭৭-৮১ খ্রী)। এইরূপে ত্রিপুরার পুরাতন রাজবংশ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হইল। তিনি একদিকে আরাকানরাজ ও অন্যদিকে বাংলার মুসলমান সুবাদারের আক্রমণ হইতে ত্রিপুরারাজ্য রক্ষা করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন এবং শ্রীহট্ট জয় করিয়াছিলেন।

অমরমাণিক্যের পুত্রদের মধ্যে সিংহাসনের জন্য ঘোরতর বিরোধ হয়। এই সুযোগে আরাকানরা ত্রিপুরার রাজধানী উদয়পুর আক্রমণ করিয়া লুণ্ঠন করিলেন। মনের দুঃখে অমরমাণিক্য বিষ খাইয়া প্রাণত্যাগ করিলেন। তাঁহার পৌত্র যশোধরমাণিক্যের রাজত্বকালে (১৬০০-১৬২৫ খ্রী) বাংলার সুবাদার ইব্রাহিম খান ত্রিপুরারাজ্য আক্রমণ করেন (১৬১৮ খ্রীষ্টাব্দ)। এই সময়ে মুঘল বাদশাহ জাহাঙ্গীর আরাকানরাজকে পরাস্ত করিবার জন্য ইব্রাহিম খানকে আদেশ করেন। সম্ভত আরাকান অভিযানের সুবিধার জন্যই ইব্রাহিম প্রথমে ত্রিপুরা জয়ের সংকল্প করিয়াছিলেন। ইহার জন্য তিনি বিপুল আয়োজন করেন। উত্তর-পশ্চিম ও পশ্চিম হইতে দুইদল সৈন্য স্থলপথে এবং রণতরীগুলি গোমতী নদী দিয়া রাজধানী উদয়পুরের দিকে অগ্রসর হইল। ত্রিপুরারাজ বীরবিক্রমে বহু যুদ্ধ করিয়াও মুঘলসৈন্য বা রণতরীর অগ্রগতি রোধ করিতে পারিলেন না এবং মুঘলেরা উদয়পুর অধিকার করিল। রাজা আরাকানে পলাইয়া যাইতে চেষ্টা করিলেন কিন্তু মুঘলসৈন্য তাঁহার পশ্চাদানুসরণ করিয়া তাঁহাকে সপরিবারে ও বহু ধনরত্নসহ বন্দী করিল। বিজয়ী মুঘল সেনাপতি কিছু সৈন্য উদয়পুরে রাখিয়া বহু হস্তী ও ধনরত্নসহ বন্দী রাজাকে লইয়া সুবাদারের নিকট উপস্থিত হইলেন।

ত্রিপুরাবাসিগণ অতঃপর কল্যাণমাণিক্যকে রাজপদে বরণ করেন (১৬২৬ খ্রী)। তাঁহার সহিত প্রাচীন রাজবংশের কোন সম্বন্ধ ছিল কিনা তাহা সঠিক জানা যায় না। তাঁহার সময়েও সম্ভবত বাংলার সুবাদার শাহ্ শুজা ত্রিপুরা আক্রমণ করিয়াছিলেন। কল্যাণের মৃত্যুর পর তাঁহার জ্যেষ্ঠপুত্র গোবিন্দমাণিক্য সিংহাসনে আরোহণ করিলে (১৬৬০) কনিষ্ঠ পুত্র নক্ষত্ররায় বাংলার সুবাদারের সাহায্যে সিংহাসনলাভের জন্য চেষ্টা করেন। গোবিন্দ ভ্রাতৃ-বিরোধের অবশ্যম্ভাবী অশুভ ফলের কথা চিন্তা করিয়া স্বেচ্ছায় রাজ্য ত্যাগ করেন এবং নক্ষত্ররায় ছত্রমাণিক্য নামে সিংহাসনে আরোহণ করেন (১৬৬১ খ্রী)। এই কাহিনী অবলম্বনে রবীন্দ্রনাথ রাজর্ষি’ উপন্যাস ও ‘বিসর্জন’ নাটক রচনা করেন। গোবিন্দমাণিক্যের মুদ্রা ও শিলালিপির তারিখ যথাক্রমে ১৬৬০ ও ১৬৬১ খ্রীষ্টাব্দ।

ছত্রমাণিক্যের মৃত্যুর পর অথবা অন্য কোন উপায়ে গোবিন্দমাণিক্য পুনরায় রাজ্যভার গ্রহণ করেন (১৬৬১-৬২ খ্রী)। তাঁহার পর তাঁহার পুত্র রামদেবমাণিক্য (১৬৭৬ খ্রীষ্টাব্দ) ও পৌত্র দ্বিতীয় রত্নমাণিক্য (১৬৮৫ খ্রীষ্টাব্দ) রাজত্ব করেন। রত্নমাণিক্য (২য়) অল্পবয়সে সিংহাসনে আরোহণ করায় রাজ্যে অনেক গোলযোগ ও অত্যাচার হয়। তিনি শ্রীহট্ট আক্রমণ করিয়াছিলেন বলিয়া ইহার শাস্তিস্বরূপ বাংলার সুবাদার শায়েস্তা খান ত্রিপুরা রাজ্য আক্রমণ করেন। ‘রাজমালায় বর্ণিত হইয়াছে যে রাজা রত্নমাণিক্যের পিতৃব্য-পুত্র নরেন্দ্ৰমাণিক্য শায়েস্তা খানকে ত্রিপুরাযুদ্ধে সহায়তা করিয়াছিলেন এবং তাঁহার পুরস্কারস্বরূপ শায়েস্তা খান তাঁহাকে ত্রিপুরার রাজপদে প্রতিষ্ঠিত করিয়া রত্নমাণিক্য ও তাঁহার তিন পুত্রকে বন্দী করিয়া সঙ্গে লইয়া যান (১৬৯৩ খ্রী)। কিন্তু তিন বৎসর পরে শায়েস্তা খান নরেন্দ্রমণিক্যকে রাজ্যচ্যুত করিয়া পুনরায় রত্নমাণিক্যকে রাজপদে প্রতিষ্ঠিত করেন (১৬৯৬ খ্রী)। রত্নমাণিক্যা প্রায় ১৬ বৎসর রাজত্ব করার পর তাঁহার ভ্রাতা মহেন্দ্ৰমাণিক্য তাঁহাকে বধ করিয়া সিংহাসনে আরোহণ করেন (১৭১২ খ্রীষ্টাব্দ)। মহেন্দ্রমাণিক্যের পর তাঁহার ভ্রাতা ধর্মমাণিক্য (২য়) সিংহাসন অধিকার করেন (১৭১৪ খ্রীষ্টাব্দ)।

ধর্মমাণিক্যের রাজ্যকালে ছত্রমাণিক্যের বংশধর (প্রপৌত্র?) জগত্রায় (মতান্ত রে জগত্রাম) রাজ্যলাভের জন্য ঢাকার নায়েব নাজিম মীর হবীবের শরণাপন্ন হইলেন। হবীব প্রকাণ্ড একদল সৈন্য লইয়া ত্রিপুরা আক্রমণ করিলেন এবং জগত্রায়ের প্রদর্শিত পথে অগ্রসর হইয়া সহসা রাজধানী উদয়পুরের নিকট পৌঁছিলেন। রাজা ধর্মমাণিক্য যুদ্ধে প্রথমে কিছু সাফল্য লাভ করিলেও অবশেষে পরাজিত হইয়া পর্বতে পলায়ন করিলেন (আ ১৭৩৫ খ্রীষ্টাব্দ)।

কেবলমাত্র পার্ব্বত্য অঞ্চল ব্যতীত ত্রিপুরা রাজ্যের অবশিষ্ট সমস্ত অংশই মুসলমান রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হইল। জগত্রায় স্বাধীন পার্ব্বত্য-ত্রিপুরারাজ্যের রাজা হইয়া জগত্মাণিক্য নামে সিংহাসনে আরোহণ করিলেন। মুসলমান অধিকৃত ত্রিপুরায় ২২টি পরগণা-চাকলা রোসনাবাদ–তাঁহাকে জমিদারিস্বরূপ দেওয়া হইল। ত্রিপুরারাজ্যের যে অংশ মুসলমান রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হইল তাহা বর্তমান বাংলা দেশের ময়মনসিংহ জিলার চতুর্থাংশ, শ্রীহট্টের অর্ধাংশ, নোয়াখালির তৃতীয়াংশ এবং ঢাকা জিলার কিয়দংশ লইয়া গঠিত ছিল। তন্মধ্যে জিলা ত্রিপুরার ছয় আনা অংশমাত্র ত্রিপুরপতিগণের জমিদারি। [শ্রীকৈলাসচন্দ্র সিংহ প্রণীত “ত্রিপুরার ইতিবৃত্ত”, ৪৫ পৃষ্ঠা]

এইরূপ রাজ্যলোভী জগত্রায়ের বিশ্বাসঘাতকতায় পাঁচশত বৎসরেরও অধিককাল স্বাধীনতা ভোগ করিয়া ত্রিপুরা রাজ্য নামেমাত্র আংশিকভাবে স্বাধীন থাকিলেও প্রকৃতপক্ষে মুসলমানের পদানত হইল।

ধর্মমাণিক্য বাংলার নবাব শুজাউদ্দীনকে সমস্ত অবস্থা নিবেদন করিলে তিনি জগত্সাণিক্যকে বিতাড়িত করিয়া ধর্মমাণিক্যকে পুনরায় রাজপদে প্রতিষ্ঠিত করিলেন। কিন্তু মীর হবীবের অন্যান্য ব্যবস্থার কোনও পরিবর্তন হইল না। বরং এই সময় হইতে একজন মুসলমান ফৌজদার সসৈন্যে ত্রিপুরায় বাস করিতেন। ইহার পর জয়মাণিক্য ও ইন্দ্ৰমাণিক্য নামে দুইজন রাজা যথাক্রমে ১৭৩৯ এবং ১৭৪৪ খ্রীষ্টাব্দে রাজত্ব করেন। অতঃপর ত্রিপুরার রাজনৈতিক ইতিহাসে রাজসিংহাসন লইয়া প্রতিদ্বন্দ্বিতা, মুসলমান কর্তৃপক্ষের সহায়তায় চক্রান্ত করিয়া এক রাজাকে সরাইয়া অন্য রাজার প্রতিষ্ঠা ও কিছুকাল পরে অনুরূপ চক্রান্তের ফলে পূর্ব রাজার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, ইত্যাদি ঘটনা ছাড়া আর বিশেষ কিছু নাই।

কোচবিহারের মুদ্রা

কোচবিহারের প্রথম রাজা বিশ্বসিংহের মুদ্রার উল্লেখ থাকিলেও অদ্যাবধি তাহা আবিষ্কৃত হয় নাই। দুর্গাদাস মজুমদার ‘রাজবংশাবলীতে’ (পৃষ্ঠা ১৬) লিখিয়াছেন যে, ১৩ শতকে মহারাজ বিশ্বসিংহ সিংহাসন লাভ করেন এবং নিজ নামে মুদ্রাঙ্কন করেন। [খানচৌধুরী আমানউল্লা সম্পাদিত ‘কোচবিহারের ইতিহাস’ (সংক্ষেপে ‘কোচ’) ১ম খণ্ড, পৃ. ২৮০ ও ২৮১ দ্রষ্টব্য]

রাজবংশাবলীতে বিশ্বসিংহের মুদ্রা সম্বন্ধে একটি কাহিনীও আছে। [শরৎচন্দ্র ঘোষাল কৃত ঐ পুস্তকের অনুবাদ A History of Cooch Behar p. 243 দ্রষ্টব্য। অতঃপর যে মুদ্রাগুলির বিবরণ দেওয়া হইয়াছে তাঁহার চিত্র এই গ্রন্থে আছে। ঐ পুস্তকে (p. 351) যে তিনটি তাম্র মুদ্রার কথা আছে, কোচবিহারের বিকৃত অর্ধ মুদ্রার মত হইলেও সেগুলি প্রকৃতপক্ষে কোচ মুদ্রা নহে, ভুটানে মুদ্রিত কোচ মুদ্রার অনুকরণ মাত্র।] ১৪১৯ শককে (১৪৯৭ খ্রীষ্টাব্দ) মহারাজ বিশ্বসিংহের সহিত আহোমরাজ সুহুংমুঙের সাক্ষাৎ হইলে বিশ্বসিংহ তাঁহাকে নিজ নামে মুদ্রিত ৫০০ মুদ্রা ও ৫টি হস্তী উপহার দেন। এই মুদ্রাগুলি দেখিয়া আহোমরাজ সুহুংমুঙ বিস্মিত হন এবং খেদের সহিত বলেন যে, তাঁহার বংশে ১৩ জন রাজা রাজত্ব করিলেও কেহই মুদ্রাঙ্কন করেন নাই। ইহার পরে অবশ্য সুহুংমুঙ নিজ নামে মুদ্রাঙ্কন করেন। প্রকৃতপক্ষে, শুধু বিশ্বসিংহই নহেন, তাঁহার ঠিক পরেই সাময়িকভাবে সিংহাসনে অধিষ্ঠানকারী তাঁহার প্রথম পুত্র নরসিংহেরও কোন মুদ্রা আবিষ্কৃত হয় নাই। তবে তৃতীয় রাজা (বিশ্বসিংহের দ্বিতীয় পুত্র) নরনারায়ণের সময় হইতে কোচ রাজারা প্রায় নিয়মিতভাবেই মুদ্রা নির্মাণ করিয়াছেন।

কোচরাজাদের স্বর্ণ, রৌপ্য, তাম্র ও পিতলের মুদ্রার কথা শোনা গেলেও তাহাদের শুধু রৌপ্য মুদ্রাই পাওয়া যায়। এই মুদ্রাগুলি ছাঁচে পেটা (die struck) ও গোলাকার। ঐগুলি মুসলমান সুলতানদের ‘তখা’ (টঙ্ক বা টাকা) নামক মুদ্রার রীতিতে পাতলা ও অপেক্ষাকৃত বৃহদাকারে প্রায় ১৭২ গ্ৰেণ (বা ১১.১৫ গ্রাম) ওজনে প্রস্তুত হইত। এগুলিতে কোন চিত্রণ (device) থাকে না, সুলতানদের মুদ্রার মতই ইহাদের মুখ্য (obverse) ও গৌণ দিকে (reverse) শুধু লেখন (legend বা inscription) থাকে। তবে সেই লেখন সংস্কৃত ভাষায় ও বাংলা অক্ষরে লিখিত হয়। কোচমুদ্রার মুখ্যদিকে রাজার বিরূদ (epithet) ও গৌণদিকে রাজার নাম ও শকাব্দে তারিখ লেখা হয়। কোচ রাজাদের বিরূদগুলি তাঁহাদের উপাস্য দেবদেবীর নাম ঘোষণা করে; যথা, ‘শিবচরণ-কমল-মধুকর’ বা ‘হর-গৌরী-চরণকমল-মধুকর।

কথিত আছে যে, চতুর্থ কোচরাজ লক্ষ্মীনারায়ণের সময় তদ্বারা শাসিত পশ্চিম কোচরাজ্য মুঘল বাদশাহের মিত্ররাজ্যরূপে পরিগণিত হইবার পর কোচরাজারা পূর্ণ টঙ্ক মুদ্রিত করিবার অধিকারে বঞ্চিত হন। একথা সম্ভবত ঠিক নহে। কারণ লক্ষ্মীনারায়ণের পৌত্র প্রাণনারায়ণেরও অর্ধ মূদ্রার সহিত ‘পূর্ণ মুদ্রাও’ পাওয়া যায়; অবশ্য প্রাণনারায়ণের পরবর্তী রাজাদের মুদ্রাগুলি ‘পূর্ণ’ টঙ্ক নহে, ‘অর্ধ’ টঙ্ক। এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যাইতে পারে যে, একদিকে নরনারায়ণ, লক্ষ্মীনারায়ণ ও প্রাণনারায়ণ এবং অপরদিকে নরনারায়ণের ভ্রাতুষ্পুত্র ‘পূর্ব কোচরাজ্যের অধীশ্বর রঘুদেবনারায়ণ ও তাঁহার পুত্র পরীক্ষিতনারায়ণই পূর্ণ টঙ্ক মুদ্রিত করিয়াছিলেন। লক্ষ্মীনারায়ণ ও প্রাণনারায়ণ যে অর্ধ মুদ্রাগুলি নির্মাণ করেন, সেগুলি তাঁহাদের পূর্ণ মুদ্রারই ক্ষুদ্রতর সংস্করণ।

প্রাণনারায়ণের পরবর্তী রাজাদের অর্ধ মুদ্রাগুলি বেশ একটু বিচিত্র ধরনের : পূর্ণ আকারের বৃহত্তর টঙ্কের ঘঁচ দিয়া ক্ষুদ্রতর আকারের অর্ধ টঙ্ক মুদ্রিত হওয়ায় তাহাদের উভয় পার্শ্বের লেখন শুধু আংশিকভাবে দৃষ্ট হয়। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজার নাম পড়া প্রায় দুঃসাধ্য হইয়া পড়ে। যাহা হউক, কোচ রাজাদের নামের শেষাংশ ‘নারায়ণ’ হইতেই এই জনপ্রিয় মুদ্রাগুলির নাম নারায়ণী মুদ্রা হইয়াছে। পরবর্তীকালে কোচবিহারের উত্তরস্থ ভুটান রাজ্যে কোচবিহারের অর্ধ মুদ্রা বিস্তৃতভাবে অনুকৃত ও প্রচলিত হয়।

নরনারায়ণের মুদ্রাগুলি বাংলা অক্ষরে লিখিত হইলেও আকৃতি ও প্রকৃতিতে সেগুলি হুসেনশাহী তখারই অনুরূপ। ইহাদের মুখ্যদিকে ‘শ্রীশ্রীশিবচরণ কমলমধুকরস্য’ ও গৌণদিকে ‘শ্রীশ্রীমন্নরনারায়ণস্য’ বা ‘নারায়ণ ভুপালস্য শাকে ১৪৭৭’, এই লেখন থাকে। নরনারায়ণের জ্যেষ্ঠ পুত্র লক্ষ্মীনারায়ণের মুদ্রার মুখ্য দিকে নরনারায়ণের মুদ্রার মতই “শ্রীশ্রীশিবচরণ কমলমধুকরস্য” লেখা থাকে এবং গৌণ দিকে থাকে “শ্রীশ্রীমল্লক্ষ্মীনারায়ণস্য শাকে ১৫০৯ ও ১৫৪৯ বা ১৫৫৯”। লক্ষ্মীনারায়ণের পরে তাঁহার পৌত্র প্রাণনারায়ণের পূর্ণ ও অর্ধ মুদ্রা পাওয়া গিয়াছে। সেগুলির মুখ্যদিকের লেখন (বা রাজার বিরূদ) পূর্ববৎ গৌণ দিকে শ্রীশ্রীমপ্রাণনারায়ণস্য শাকে ১৫৫৪, ১৫৫৫ বা ১৫৫৯ লিখিত থাকে। বৃটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত তাঁহার একটি মুদ্রায় শকাব্দের পরিবর্তে কোচবিহারের ‘রাজশকের’ তারিখ হিসাবে ‘শাকে ১৪০’ (= ১৬৪৯ খ্রীষ্টাব্দ) লেখা দেখা যায়। প্রাণনারায়ণের পুত্র মোদনারায়ণের ১৭৯ (?) রাজশকের তারিখ ও অসম্পূর্ণ লেখন সম্বলিত অর্ধ টঙ্ক পাওয়া গিয়াছে। তাঁহার পর (আমাদের আলোচ্য সময়ে) বাসুদেবনারায়ণ, রূপনারায়ণ ও উপেন্দ্রনারায়ণের তারিখবিহীন ও অসম্পূর্ণ লেখন সম্বলিত মামুলী অর্ধ টঙ্ক পাওয়া গিয়াছে; শুধুমাত্র বাসুদেব ও রূপনারায়ণের মধ্যবর্তী রাজা মহীন্দ্রনারায়ণের মুদ্রার কথা আমাদের জানা নাই। তাঁহার পর আধুনিক কাল পর্যন্ত মহীন্দ্রনারায়ণ ব্যতীত অন্য সকল কোচরাজারই তারিখহীন ও অসম্পূর্ণ লেখন সমন্বিত মামুলি অর্ধ টঙ্ক আবিষ্কৃত হইয়াছে।

অপর পক্ষে ‘পূর্ব’ কোচরাজ্যে নরনারায়ণের ভ্রাতৃম্পুত্র রঘুদেবনারায়ণও পূর্ণ টঙ্ক নির্মাণ করেন; তাহা নরনারায়ণের মুদ্রার অনুরূপ হইলেও তাঁহার মুখ্য দিকের লেখনে শুধুমাত্র ‘শিবের পরিবর্তে ‘হর-গৌরী’র প্রতি শ্রদ্ধা জানান আছে : যথা (মুখ্যদিকে) ‘শ্রীশ্রীহরগৌরীচরণ-কমলমধুকরস্য’ এবং (গৌণদিকে) ‘শ্রীশ্রীরঘুদেবনারায়ণভূপালস্য শাকে ১৫১০’। রঘুদেবের পুত্র পরীক্ষিত্নারায়ণের মুদ্রার লেখনও অনুরূপ : (মুখ্যদিকে) শ্রীশ্রীহরগৌরী-চরণ-কমলমধুকরস্য ও (গৌণদিকে) ‘শ্রীশ্রীপরীক্ষিনারায়ণ-ভূপালস্য শাকে ১৫২৫’। পূর্বকোচরাজ্যের আর কোন মুদ্রার কথা জানা নাই।

ত্রিপুরারাজ্যের মুদ্রা

ত্রিপুরারাজ্যের মধ্যযুগের ইতিহাসের উপাদান হিসাবে ‘রাজমালা, শিলালেখ ও মুদ্রাই প্রধান। ‘রাজমালা সম্বন্ধে ইতিপূর্বেই আলোচনা করা হইয়াছে। [এই গ্রন্থ প্রথমে শ্রীকালীপ্রসন্ন সেন তিন খণ্ডে সম্পাদন করেন (১৯২৬-৩১), পরে ত্রিপুরার শিক্ষা অধিকারী এক খণ্ডে প্রকাশিত করিয়াছেন (১৯৬৭)। প্রথমটিকে আমরা “রাজ, ১ম ২য় বা ৩য়” বলিয়া এবং দ্বিতীয়টিকে শুধু “রাজ” বলিয়া উল্লেখ করিব।] বর্তমান ‘রাজমালার যে দুইটি সংস্করণ মুদ্রিত অবস্থায় পাওয়া যায়, তুলনামূলকভাবে পাঠ করিলে তাহাদের মধ্যে বেশ কিছু পরস্পরবিরোধী ও একদেশদর্শী [যেমন, একটিতে বলা হইয়াছে যে, অনন্তমাণিক্য তাঁহার শ্বশুর কর্ত্তৃক নিহত ও সিংহাসনচ্যুত হন (রাজ, ২য়, পৃষ্ঠা ৬৫-৬৬), অন্যটিতে অনন্তমাণিক্যের মৃত্যু স্বাভাবিক ভাবেই ঘটিয়াছিল বলিয়া দেখান হইয়াছে (রাজ, পৃষ্ঠা ৪৪।১)] উপাদান চোখে পড়ে। কেহ কেহ মনে করেন যে, ‘রাজমালার বর্তমান সংস্করণগুলি উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমে সংকলিত হইয়াছে। [Cf. D.C. Sircar, JAS. Letters, 1951 pp. 76-77.] একথা আপাতদৃষ্টিতে ঠিক বলিয়াই মনে হয়।

অনেকে মনে করেন রাজা ত্রিপুর হইতেই রাজ্যের ত্রিপুরা নাম হয়। [রাজ, ১ম, পৃ.] কিন্তু প্রাচীন কোন গ্রন্থে বা শিলালেখে ত্রিপুরা নাম পাওয়া যায় না। সুতরাং ত্রিপুরা সম্ভবত ‘টিপ্রা’ নামক উপজাতির নামের সংস্কৃত রূপ। [কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক বন্ধুবর সুহাস চট্টোপাধ্যায় এইরূপ ধারণা পোষণ করেন।] যাহা হউক, ‘রাজমালায় বর্ণিত প্রথম ১৪৪ জন ত্রিপুরার রাজার মধ্যে শেষ দুই একজন ব্যতীত আর সকলেরই কাহিনী নিছক কল্পনাপ্রসূত।

ত্রিপুরায় প্রাপ্ত অতিবিরল শিলালেখগুলি বৈজ্ঞানিক প্রথায় প্রকাশিত না হওয়ায়, সেগুলি ইতিহাস রচনার উপাদান হিসাবে যথাযথভাবে ব্যবহার করা যায় না। [ত্রিপুরার শিক্ষা অধিকার’ ১৯৬৮ খ্রীষ্টাব্দে শিলালিপি-সগ্রহ’ নামে ত্রিপুরার রাজাদের শিলালিপিগুলি প্রকাশ করিয়াছেন, কিন্তু, দুঃখের বিষয়, তাহাদের মধ্যে তিনটি ছাড়া আর কোনটিরই যান্ত্রিক প্রতিলিপি নাই।]

এক্ষেত্রে ত্রিপুরার রাজগণের ইতিহাস-বিশেষতঃকাল নির্ণয়-সম্বন্ধে আমাদের প্রধান সম্বল ত্রিপুরার্ক মুদ্রা। এই মুদ্রা এ পর্যন্ত অতি বিরল ও দুপ্রাপ্য ছিল। সম্প্রতি ইহাদের বিশেষ চাহিদা হওয়ায় মুদ্রাব্যবসায়ীরা বহু ত্রিপুরামুদ্রা বাজারে বাহির করিয়া আনিয়াছেন। তাঁহাদের আনুকূল্যে অধুনা সংগৃহীত মুদ্রার অধিকাংশই আমরা বৈজ্ঞানিক প্রথায় পরীক্ষা করিতে পারিয়াছি।

ত্রিপুরার রাজাদের মধ্যে রত্ন-ফা বা রত্নমাণিক্যই প্রথম মুদ্রা নির্মাণ করেন। ‘রাজমালার তালিকা অনুযায়ী এই প্রথম রত্নমাণিক্য হইতে দ্বিতীয় ইন্দ্ৰমাণিক্য পর্যন্ত যে আটাশ জন রাজা অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত ত্রিপুরায় রাজত্ব করিয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে অন্তত একুশ জনের [এই পরিশিষ্টের শেষভাগে রাজগণের তালিকা দ্রষ্টব্য] মুদ্রা পাওয়া গিয়াছে। এই মুদ্রাগুলি অধিকাংশই ‘সাধারণ’ মুদ্রা হিসাবে নির্মিত হইলেও ইহাদের মধ্যে অন্তত কতকগুলি ‘স্মারক মুদ্রা হিসাবে মুদ্রিত হইয়াছিল। রাজ্যাভিষেক উপলক্ষে ও পরবর্তী কোন কোন সময় সাধারণ মুদ্রা নির্মিত হইত। রাজ্যজয়, তীর্থস্নান, তীর্থদর্শন প্রভৃতি বিশেষ ঘটনার স্মরণার্থে ‘স্মারক মুদ্রা মুদ্রিত হয়। কাছাড়রাজ ইন্দ্রপ্রতাপনারায়ণের ১৫২৪ শকে নির্মিত শ্রীহট্টবিজয়ের’ এবং হুসেন শাহের ‘কামরু, কামতা, জাজনগর ও ওড়িষা জয়ের’ বিখ্যাত স্মারক মুদ্রাগুলি ছাড়া ত্রিপুরা রাজাদের মত স্মারক মুদ্রা প্রচারের আর বিশেষ সমসাময়িক নজির নাই। [ইন্দ্রপ্রতাপনারায়ণের মুদ্রাটি লেখক কর্ত্তৃক Numismatic Chronicle–এ প্রকাশিত হইবে]

ত্রিপুরার মুদ্রাগুলি প্রধানত রৌপ্যনির্মিত, ছাঁচে-পেটা (die struck) ও গোলাকার। এগুলি তকালীন বাংলার সুলতানদের ‘তখা’ (টঙ্ক বা টাকা) নামক মুদ্রার অনুকরণে আনুমানিক ১৭২ গ্ৰেণ (বা ১১.১৫ গ্রাম) ওজনে তৈরী হইত। এগুলি পাঁচ প্রকারের : পূর্ণ, অর্ধ, এক-চতুর্থ, এক-অষ্টম ও এক-ষোড়শ। আলোচ্য সময়ে ত্রিপুরারাজ প্রথম (?) বিজয়মাণিক্যের একটিমাত্র পূর্ণ আকারের স্বর্ণ মুদ্রার কথা জানা যায়। [JRASB, 1910] ত্রিপুরার কোন তাম্র মুদ্রা পাওয়া যায় নাই। ছোটখাট কেনাবেচার কাজ সম্ভবত কড়ি দিয়াই চলিত।

দ্বিতীয় ইন্দ্ৰমাণিক্য ছাড়া আর সব মুদ্রা নির্মাণকারী রাজার রৌপ্য নির্মিত পূর্ণ টঙ্ক পাওয়া গিয়াছে। এই ইন্দ্ৰমাণিক্য ও কৃষ্ণমাণিক্যের কয়েকটি অতিবিরল অর্ধ টঙ্ক আবিষ্কৃত হইয়াছে। যশোধরমাণিক্য, গোবিন্দমাণিক্য, রামদেবমাণিক্য, দ্বিতীয় রমাণিক্য, দ্বিতীয় ধর্মমাণিক্য ও দ্বিতীয় ইন্দ্ৰমাণিক্যের এক-চতুর্থ টঙ্কের কথা আমরা অবগত আছি। এছাড়াও গোবিন্দের কয়েকটি এক-অষ্টম ও দ্বিতীয় ধর্মমাণিক্যের একটি এক-ষোড়শ মুদ্রাও পাওয়া গিয়াছে।

উত্তর-পূর্ব ভারতের মধ্যযুগের মুদ্রাগুলির মধ্যে ত্রিপুরা মুদ্রার স্থান বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ঐ সময়ে একমাত্র ত্রিপুরা মুদ্রাতেই চিত্রণ (device) দেখা যায় এবং ভারতীয় মুদ্রাগুলির মধ্যে শুধু এগুলিতেই রাজার নামের সহিত প্রায় নিয়মিত ভাবেই রাজমহিষীর নামও থাকে।

ত্রিপুরা মুদ্রার মুখ্যদিকে (obverse) শুধু লেখন (legend or inscription) থাকে এবং তাহা সংস্কৃত ভাষায় ও বাংলা অক্ষরে লিখিত। এই লেখনের প্রথমাংশে রাজার বিরূদ (epithet) এবং দ্বিতীয়াংশে রাজা ও রাণীর, অথবা শুধু রাজার নাম দেখা যায়। যথা–”ত্রিপুরেন্দ্র শ্রীশ্রীধন্যমাণিক্য শ্রীকমলাদেব্যৌ” অথবা “শ্রীনারায়ণ-চরণপরঃ শ্রীশ্রীরমাণিক্যদেবঃ”। ত্রিপুরা মুদ্রার গৌণদিকে (reverse) সাধারণতঃ ‘পৃষ্ঠে ধ্বজবাহী সিংহের মূর্ত্তি’ ও শকাব্দে তারিখ থাকে। ক্ষুদ্রাকৃতি মুদ্রায় স্থানাভাবে রাজার বিরূদ, রাজ-মহিষীর নাম, তারিখ ও কখন কখন রাজার নামে ‘মাণিক্য অংশটি দেখা যায় না। এক-চতুর্থ মুদ্রাগুলিতে কিন্তু তারিখ থাকেই। [জয়ন্তীপুর ও আহোম রাজাদের এক-চতুর্থ মুদ্রাগুলিতেও তারিখ থাকেই।]

ত্রিপুরার প্রথম মুদ্রা নির্মাণকারী রাজা রত্নমাণিক্য বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ত্রিপুরা মুদ্রার বিশিষ্ট রূপটির প্রবর্তন করেন। তাঁহার প্রাথমিক মুদ্রায় উভয় দিকেই তৎকালীন মুসলমান সুলতানদের মুদ্রার মতই শুধুই লেখন থাকে। পরে তিনি গৌণ দিকে ত্রিপুরা মুদ্রার পরিচায়ক সিংহের মূর্ত্তিটি অঙ্কিত করেন। তাঁহারও পরে সুলতানদের মুদ্রার মতই গৌণ দিকে একটি বৃত্তাকার প্রান্তিক লেখনে (circular marginal legend) টাকশালের নাম ও তারিখ লেখা হয়। রত্নের শেষ প্রকারের মুদ্রার লেখনে তাঁহার নামের সহিত মহিষীর নামও থাকে। শেষপর্যন্ত গৌণ দিকের লেখন-ছত্রের বিলোপ ঘটে [রত্নের পরে মুকুট ও ধন্যের কয়েকটি মাত্র প্রান্তিক লেখনযুক্ত মুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছে] এবং তাঁহার পরিবর্তে চিত্রণের নীচে শুধু শকাব্দে তারিখ লেখা হয়।

নিম্নলিখিত চারজন রাজার মাত্র পাঁচ প্রকার মুদ্রায় ত্রিপুরা মুদ্রার বিশিষ্ট সিংহমূর্ত্তির পরিবর্তে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বিচিত্র কয়েকটি চিত্রণ দেখা যায় :

লণ্ডনের একটি সংগ্রহে মুকুটমাণিক্যের ১৪১১ শকের একটি মুদ্রায় ‘সিংহের’ পরিবর্তে ‘গরুড়ের’ মূর্ত্তি আছে। [এই অনন্য মুদ্রাটি শীঘ্রই লেখক কর্ত্তৃক প্রকাশিত হইবে]

বিজয়মাণিক্যের ১৪৮০, ১৪৮১, ১৪৮২ শকে মুদ্রিত ব্রহ্মপুত্রের শাখানদী লক্ষ্যায় স্নানের এক প্রকার স্মারক মুদ্রার গৌণদিকে বৃষবাহন চতুর্ভুজ শিব ও সিংহবাহিনী দশভুজা দুর্গার অর্ধাংশ দিয়া গড়া একটি অনন্য ‘অর্ধনারীশ্বর’ মূর্ত্তি দেখা যায়। [বর্তমান লেখকই প্রথমে এই মুদ্রার চিত্রণটিকে অর্ধনারীশ্বর’ বলিয়া প্রতিপন্ন করেন। পূর্বে ইহাকে মহিষমর্দিনী মূর্ত্তি’ বলা হইত : (১) শ্রীকালীপ্রসন্ন সেন, ‘রাজমালা, ২য়, এবং (২) শ্রীক্ষিতীশচন্দ্র বর্ম্মণ, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৯শে পৌষ, ১৩৫৪ সাল, পৃ. ৯, ১১-১২।] এই বিজয়েরই ১৪৮৫ শকের পদ্মা-স্নানের আর এক প্রকার স্মারক মুদ্রায় ‘গরুড়-বাহিত বিষ্ণুর মূর্ত্তি’ আছে; এই বিষ্ণুর দক্ষিণে ও বামে যথাক্রমে একটি পুরুষ ও একটি নারীর দণ্ডায়মান মূর্ত্তি, এবং সমগ্র চিত্রণটি ‘প্রতিকোণে’ দুইটি করিয়া সিংহ-বাহিত চতুষ্কোণ একটি সিংহাসনের উপর প্রতিষ্ঠিত। [ইহা বর্তমানে লেখক প্রকাশ করিয়াছেন : Journ, Anc. Ind. Hist. Vol. III:p. 25, pl. XII, 3-4] এই একই প্রকার মুদ্রার মুখ্যদিকের লেখনের মধ্যভাগের একটি চতুষ্কোণের ভিতর ‘শিবলিঙ্গ’ থাকে।

১৪৮৬ শতকে মুদ্রিত বিজয়ায় অনন্তের এক প্রকার মুদ্রার গৌণদিকে শুধুমাত্র ‘গরুড়-বাহিত ‘বিষ্ণুর মূর্ত্তি’ দেখা যায়।” [ইহা বর্তমানে লেখক প্রকাশ করিয়াছেন : Journ, Anc. Ind. Hist. Vol. III:p. 25, pl. XII, 5-6]

যশোধর মাণিক্যের ১৫২২ শকে নির্মিত তিন প্রকার মুদ্রায় ‘ত্রিপুরা সিংহের’ উপর ‘বংশীবাদক কৃষ্ণের মূর্ত্তি’ অঙ্কিত আছে। ইহাদের একটিতে কৃষ্ণের পার্শ্বে শুধুমাত্র ‘একটি’ ও অন্যগুলিতে ‘দুইটি’ নারী বা গোপিনীর মূর্ত্তি দেখা যায়। [কৃষ্ণের উভয় পার্শ্বস্থ দুইটি গোপিনীর মূর্ত্তি-সম্বলিত একটি মুদ্রা শ্রীনলিনীকান্ত ভট্টশালী প্রকাশ করিয়াছেন : Numismatic supplement, No. XXXVII (JASB. 1923), p. N. 47. Fig. 2.]

মুদ্রণের তারিখ [প্রথম রত্নমাণিক্য ও ধন্যমাণিক্যের কয়েক প্রকারের প্রাথমিক টঙ্ক এবং (এক-চতুর্থ মুদ্রা ছাড়া) ক্ষুদ্রাকৃতি মুদ্রাগুলিতে তারিখ থাকে না] রাজার নাম ও বিরূদ [অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই বিরূদ মুদ্ৰানির্মাণকারী রাজার আরাধ্য দেবদেবীর নামকেই প্রকাশ করে] এবং রাণীর নাম [ভারতের আর কোন স্থানের মুদ্রায় রাজার নামের সহিত রাণীর নাম যুক্ত করা হয় না] লিখিত থাকায় ত্রিপুরার মুদ্রাগুলি ইতিহাসের উপাদান হিসাবে বিশেষ মূল্যবান। এগুলি বহু ক্ষেত্রে রাজমালার বর্ণিত তথ্যই যে শুধু সমর্থন করে, তাহাই নহে; ‘রাজমালা’য় নাই এমন নূতন তথ্যও এই মুদ্রার লেখনে উদ্ঘাটিত হয়। [যেমন : দেবমাণিক্য যে সুবর্ণগ্রাম জয় করিয়াছিলেন, তাহা শুধু তাঁহার এক প্রকার মুদ্রায় লিখিত ‘সুবর্ণগ্রামবিজয়ী’ এই বিরূদ হইতেই জানা যায়।] এই মুদ্রাগুলি কখন কখন ‘রাজমালার কোন কোন উক্তিকে সংশোধন বা ভুল বলিয়া প্রতিপন্ন করিয়াছে।

রাজমালার উল্লিখিত রত্ন-ফার সমসাময়িক ও তাঁহার তথাকথিত পৃষ্ঠপোষক ও তাঁহাকে ‘মাণিক্য’ উপাধি প্রদানকারী বাংলার সুলতান যে ঠিক কে ছিলেন, তাহা এতদিন অনুমানের বিষয় ছিল [ইঁহাকে কখনও তুঘরল খান্ বলিয়া (রাজ, ১ম. পৃ. ১৫৯, পাদটিকা), কখনও সুলতান : শামসুদ্দীন বলিয়া (ঐ, ১৬০), আবার কখনও বা সিকন্দর শাহ্ বলিয়া (বাংলা দেশের ইতিহাস, মধ্যযুগ, প্রথম সংস্করণ, পৃ. ৪৮৮) মনে করা হইয়াছে]; কিন্তু রত্নমাণিক্যের সম্প্রতি সংগৃহীত একটি মুদ্রায় স্পষ্টভাবে পাওয়া তারিখটি এই প্রশ্নের সমাধান করিয়াছে। তিনি ‘১৩৮৬ শকে’ (বা ১৪৬৪ খ্রীষ্টাব্দে) এই মুদ্রাটি নির্মাণ করেন; তাহা হইলে তাঁহার সমসাময়িক সুলতান শুধু (মাহমুদ শাহের পুত্র) রুকনুদ্দীন বারবক শাহই (১৪৫৫ ১৪৭৬ খ্রীষ্টাব্দে) হইতে পারেন। এই মহামূল্যবান মুদ্রাটিই আবার রাজমালায় প্রাপ্ত রত্ন-ফা ও তাঁহার পরবর্তী ছয়জন ত্রিপুরারাজের নিম্নলিখিত আনুপৌর্বিকতাকে কাল্পনিক বলিয়া প্রতিপন্ন করিয়াছে :

রত্নমাণিক্য

এক্ষেত্রে আশ্চর্যের বিষয় এই যে, রত্নের মুদ্রায় যখন ১৩৮৬, ১৩৮৮ ও ১৩৮৯ শকের তারিখ পাওয়া যাইতেছে, তখন তাঁহারই তথাকথিত পৌত্র মহামাণিক্যেরও পৌত্র ধন্যামাণিক্যের প্রাথমিক মুদ্রাগুলিতে ‘১৪১২ শকের’ তারিখ পাই। অতএব রাজমালার কথা সত্য হইলে বলিতে হইবে যে, ১৩৮৯ হইতে ১৪১২ শকাব্দের মধ্যে রতের পরে ও ধন্যের আগে মাত্র ২৩ বৎসরে চার পুরুষপরম্পরার (generations) পাঁচ জন রাজা ত্রিপুরা সিংহাসনে বসেন। ইহা কিছুতেই বিশ্বাসযোগ্য নহে। তাহা ছাড়াও রাজমালাতেই মহামাণিক্য-পুত্র ধর্মমাণিক্যের ১৩৮০ শকের একটি তাম্রলেখের উল্লেখ আছে। [এই তারিখটিকে বাংলা ও সংস্কৃতে নানাভাবে লেখা হইয়াছে : (১) ‘শাকে শূন্যাষ্ট বিশ্বাসে বর্ষে’ (রাজ, ২য়, পৃ. ৫); (২) ‘তের শত আশি শকে’ (ঐ); (৩) শূন্যাকষ্টহরনেব্রৈকমিতে সাকে = শূন্যাকষ্টকহরনেত্রৈকমিতে শাকে (রাজ, পৃ. ২১১)] ইহা সত্য হইলে মহামাণিক্য ও তৎপুত্র ধর্মমাণিক্য রত্নেরও পূর্ববর্তী রাজা ছিলেন বলিতে হইবে। এই পরিস্থিতিতে উল্লেখ করা যাইতে পারে যে, পূর্ব্বোল্লিখিত লণ্ডনস্থ মুকুটমাণিক্যের মুদ্রার যে প্রতিচ্ছবি (photograph) আমরা পাইয়াছি, তাহা হইতে বেশ বোঝা যায় যে, মুকুটমাণিক্য ধন্যের অব্যবহিত পূর্বে ১৪১১ শকে সিংহাসনারূঢ় ছিলেন। মুকুটের পক্ষে ধন্যের প্রপিতামহ হওয়া সম্ভব নহে। অন্যরূপ তথ্য ও প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত আমরা বোধ হয় রাজমালায় বর্ণিত ত্রিপুরার প্রথম সাতজন রাজার আনুপৌর্বিকতা নিম্নলিখিতভাবে সংশোধন করিতে পারি—

মহামাণিক্য

আমাদের এই ব্যবস্থা মানিলে হইবে যে, রত্ন-ফাকে ঘিরিয়া ‘রাজমালায় যে সব কাহিনী আছে, সেগুলি সর্বাংশে সত্য নহে। বিশেষত, রত্ন-ফা কর্ত্তৃক সর্বপ্রথম ‘মাণিক্য’ উপাধি গ্রহণ করার কথা ভুল; তাঁহার পূর্বেই মহামাণিক্য ও ধর্মমাণিক্য এই উপাধিতে ভূষিত ছিলেন।

রাজমালায় বর্ণিত আছে যে, ত্রিপুরার পরবর্তী ৯৩ জন রাজার পরে রাজত্বকারী ছেংথুমফা (কোন এক) গৌড়েশ্বরকে পরাজিত করেন। [রাজ, ১ম, পৃ. ৫৭-৫৯ : ছেংগুম্ফা খণ্ড।] সেই গৌড়েশ্বর সমসাময়িক কোন বাংলার সুলতানই হইবেন। মনে হয়, এই ছেংথুমফাই ত্রিপুরার প্রথম ঐতিহাসিক রাজা এবং তিনি সর্বপ্রথম ‘মাণিক্য’ উপাধি ধারণ করেন এবং পরবর্তীকালে ‘মহামাণিক্য’ [মহামাণিক্য সম্ভবত কোন ব্যক্তিগত নাম নহে; কারণ ইহা হইতে ‘মাণিক্য’ অংশটুকু বাদ দিলে যে ‘মহা’ শব্দটি থাকে, তাহা কাহারও নাম হইতে পারে না] বলিয়া খ্যাত হন।

রাজমালায় ছেংগুমের প্রপৌত্র ডাঙ্গরফার কথা আছে। সম্ভবত তিনি ছেংগুমের পুত্র ছিলেন, প্রপৌত্র নহেন। আমাদের বিশ্বাস, ত্রিপুরার এই দ্বিতীয় বিশিষ্ট রাজা ডাঙ্গরফারই হিন্দু নাম ধর্মমাণিক্য। [রাজমালা অনুযায়ী ডাঙ্গরফা রত্নের ঠিক অব্যবহিত পূর্বে রাজত্ব করেন। তাম্রলেখ ও মুদ্রার প্রমাণ হইতে দেখা যায় যে, রমাণিক্যের ঠিক পূর্বেই ছিলেন ধর্মমাণিক্য। ডাঙ্গরফা ও ধর্মমাণিক্য অভিন্ন হওয়াই সম্ভব।] দ্বিজ বঙ্গচন্দ্রের ত্রিপুরবংশাবলী অনুযায়ী মহারাজ ধর্মমাণিক্য ৮৪১ হইতে ৮৭২ ত্রিপুরাব্দ (অর্থাৎ ১৩৫৩-৮৪ শকাব্দ বা ১৪৩১-৬২ খ্রীষ্টাব্দ) পর্যন্ত ৩২ বৎসর রাজত্ব করেন। [রাজ, ১ম, পৃ. ৮১-৮২।] একথা সত্য হওয়া সম্ভব; কারণ রাজমালার মতেও ধর্মমাণিক্য ‘বত্রিশ বৎসর রাজ্যভোগ’ করেন [রাজ, ২য়, পৃ. ৮ : ‘বত্রিশ বৎসর রাজা রাজ্য ভোগ ছিল’] এবং (বঙ্গচন্দ্রের দেওয়া সময়ের মধ্যেই) ১৩৮০ শকে ধর্মসাগর উৎসর্গোপলক্ষে একখানি তাম্রশাসন দ্বারা ব্রাহ্মণদের ভূমি দান করেন। [রাজ, ২য়, পৃ. ৫ এবং পাদটীকা।]

যাহা হউক, আমাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দেখা যায় যে, ১৪৩১ খ্রীষ্টাব্দে ধর্মমাণিক্য বা ডাঙ্গরফার সিংহাসনারোহণের কিছু পূর্বে গৌড়ের কোন দুর্বল সুলতানের আমলে–অর্থাৎ যে সময় দনুজমর্দন বা রাজা গণেশ সাময়িকভাবে গৌড়ের কর্তৃত্ব আয়ত্তে আনেন সেই সময় ছেংগুম্ফা বা মহামাণিক্য পার্ব্বত্য চট্টগ্রাম ও শ্রীহট্টের মধ্যবর্তী বিস্তৃত ভূভাগ জয় করিয়া নূতন একটি রজ্যের পত্তন করেন। [এ পর্যন্ত রত্নমাণিক্যের মুদ্রার তারিখটি ঠিকমত না পড়িতে পারায় রত্নের রাজ্যকাল সম্বন্ধে যে ভুল ধারণা ছিল, তাঁহারই পরিপ্রেক্ষিতে এই সম্ভাব্য অবস্থাটি আমরা ধরিতে পারি নাই। এই গ্রন্থের চতুর্থ অধ্যায় দ্রষ্টব্য।]

ধর্মমাণিক্যের ঠিক পরেই ত্রিপুরায় রাজত্ব করেন সম্ভবত তাঁহার পুত্র রত্ন-ফা বা রত্নমাণিক্য। রত্ন ১৩৮৬ শকে প্রথম তারিখযুক্ত মুদ্রা প্রচলন করিলেও ঐ সময়ের অন্তত ২। ৩ বৎসর পূর্বেই যে সিংহাসনে বসেন, তকতৃক মুদ্রিত কয়েক প্রকার তারিখহীন মুদ্রাই তাঁহার সাক্ষ্য দেয়। [এই মুদ্রাগুলি প্রধানত চতুর্বিধ : (১) উভয় পার্শ্বে লেখনযুক্ত মুদ্রা–(মুখ্যদিকে) শ্রীনারায়ণচরণপরঃ (গৌণদিকে) শ্রীশ্রীরত্বমাণিক্যদেবঃ’; (২) (মুখ্যদিকে) শ্রীশ্রীরমাণিক্যদেবঃ (গৌণদিকে) সিংহমূর্ত্তি ও তাঁহার নীচে শ্রীদুর্গা’; (৩) (মুখ্যদিকে) শ্রীনারায়ণচরণপরঃ শ্রীশ্রীরঙ্গমাণিক্যদেবঃ’ (গৌণদিকে) সিংহমুর্তি ও তাঁহার নীচে শ্রীদুর্গা; (৪) মুখ্যদিকে লেখন দ্বিতীয় প্রকার মুদ্রার মত, কিন্তু গৌণদিকে শুধু সিংহের অবয়ব (outline)) আছে।] এই ভাবে দেখা যায় যে, ঠিক বঙ্গচন্দ্রের বর্ণনানুযায়ী ১৩৮৪ শকাব্দে ধর্মমাণিক্য বা ডাঙ্গরফার মৃত্যু হয় এবং অচিরেই রত্ন ত্রিপুরা-সিংহাসনে বসেন।

রাজমালার কাহিনী অনুযায়ী ডাঙ্গরফার অষ্টাদশতম পুত্র ছিলেন রত্ন-ফা। বেশ কিছুদিন তদানীন্তন বাংলার সুলতানের দরবারে থাকিয়া তাঁহারই সাহায্যে রত্ন পিতা ও জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাদের পরাজিত করিয়া ত্রিপুরার সিংহাসন লাভ করেন। কথিত আছে, রত্ন কর্ত্তৃক একটি মহামূল্য ‘মাণিক’ উপহার পাইয়া গৌড়েশ্বর তাঁহাকে ত্রিপুরারাজগণের পরিচয়সূচক ‘মাণিক্য’ উপাধিতে ভূষিত করেন। [আমরা আগেই দেখিয়াছি ইহা কিংবদন্তীমাত্র; সম্ভবত এই কাহিনীর কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নাই। বাংলা ‘রাজমালায় মাণিক্য’ উপাধি প্রদানকারীকে ‘গৌড়েশ্বর’ বলা হইয়াছে (রাজ, ১ম, পৃ. ৬৭); সংস্কৃত ‘রাজমালায় ইহাকে দিল্লীশ্বররূপে উল্লেখ করা হইয়াছে (ঐ, পৃ. ১৫৯)।] রত্নমাণিক্য একজন মহাপ্রতাপশালী রাজা ছিলেন। [রাজ, ১ম, পৃ. ৬৮-৬৯।] বর্তমানে রত্নের যে বহু প্রকার মুদ্রা পাওয়া যায়, সেগুলিতে শুধু পরীক্ষা-নিরীক্ষারই ছাপ নাই, সেগুলি ত্রিপুরার প্রাথমিক মুদ্রা হিসাবে বিচিত্র ও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁহার মুদ্রাগুলি হইতে বেশ বোঝা যায় যে, সগ্রামশীল বিজয়ী একটি উপজাতির অধীশ্বর রত্ন-ফা শাক্তদেবী দুর্গা ও নারায়ণ (বা বিষ্ণুর) প্রতি অনুরক্ত হইয়া উঠেন। তিনি প্রাথমিক একপ্রকার তারিখ ও চিত্রণহীন মুদ্রায় স্বীয় বিরূদ হিসাবে ‘শ্রীনারায়ণ-চরণপরঃ’ এই কথা লেখেন। পরবর্তী তারিখহীন মুদ্রাগুলির একদিকে রত্নমাণিক্য নিজের নাম ও অপরদিকে দুর্গার বাহন সিংহের মূর্ত্তি ও ‘শ্রীদুর্গা’ এই লেখন অঙ্কিত করেন। ১৩৮৬ ও ১৩৮৮ শকের মুদ্রাগুলিতে দুর্গা ও বিষ্ণু উভয়ের প্রতি তাঁহার শ্রদ্ধা প্রকাশ পায়। সিংহমূর্ত্তি সমন্বিত এই সব মুদ্রার গৌণদিকের লেখন-ছত্রে কখন ‘শ্রীদুর্গাপদপরঃ’, কখনও বা ‘শ্রীদুর্গারাধনাপ্তবিজয়ঃ’, [আমাদের পাওয়া রমাণিকের মুদ্রার প্রান্তিক লেখনের এই অংশটি কাটিয়া যাওয়ায় আমরা ইহাকে শ্রীদুর্গারাধমাপুবিজয়ঃ পড়িয়াছিলাম। ত্রিপুরা মিউজিয়ামে রক্ষিত পরিপূর্ণভাবে মুদ্রিত একটি মুদ্রা হইতে অধ্যাপক দীনেশচন্দ্র সরকার এই অংশটিকে ‘শ্রীদুর্গারাধনাপ্তবিজয়ঃ’ পড়িয়াছেন : বিশ্বভারতী পত্রিকা, ১০ম বর্ষ] আবার কখনও ‘শ্রীনারায়ণচরণপরঃ’ [ইতিপূর্বে একটি মুদ্রায় শ্রীদুর্গাপদপরঃ এই বিরূদ পড়া হইয়াছে : বিশ্বভারতী পত্রিকা, ১০ম বর্ষ। যে মুদ্রায় শ্রীনারায়ণচরণপরঃ এই বিরূদ আছে, তাহা শীঘ্রই বর্তমান লেখক প্রকাশ করিবেন] এই বিরূদ ও টাকশালের নাম হিসাবে ‘রত্নপুরে’ [রত্নপুর নিঃসন্দেহে রমাণিক্যের রাজধানী ছিল (রাজ, ১ম, পৃ. ৬৯)। সেখানে তাঁহার টাকশালও ছিল। রত্নমাণিক্যের পর আর কোন ত্রিপুরারাজের মুদ্রার টাকশালের নাম নাই] এই কথা লেখা থাকে। রত্নের ১৩৮৯ শকের মুদ্রা সিংহমূর্ত্তি বিহীন, কিন্তু বিচিত্র লেখনযুক্ত। [বর্তমান লেখক বাংলা দেশের ইতিহাস মধ্যযুগ, প্রথম সংস্করণে সর্বপ্রথম এই মুদ্রাটি প্রকাশ করেন।] ইহার মুখ্য ও গৌণদিকে যথাক্রমে ‘পার্ব্বতী-পরমেশ্বর-চরণপরৌ’ এবং শ্রীলক্ষ্মীমহাদেবী শ্রীশ্রীরত্বমাণিক্যৌ’, লেখা থাকে। এই মুদ্রা ‘রাজমালায় অনুল্লিখিত রত্নের মহিষী লক্ষ্মীর নামই শুধু ঘোষাণা করিতেছে না, তাহাকে রত্নের নামেরও পূর্বে স্থান দিতেছে।

১৩৮৯ শকের কতদিন পর পর্যন্ত রত্নমাণিক্য রাজত্ব করেন, তাহা বলা কঠিন। রাজমালার মতে রত্নের পর তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্র প্রথম প্রতাপমাণিক্য রাজা হন; কিন্তু অধার্মিক এই নৃপতিকে সেনাপতিরা নিহত করেন। প্রতাপ কতদিন সিংহাসনে বসিয়াছিলেন, তাহা বলা হয় নাই; তাঁহার কোন শিলালেখ ও মুদ্রাও মিলে নাই। প্রতাপের পর সেনাপতিরা তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা মুকুন্দ বা মুকুটমাণিক্যকে সিংহাসনে বসান। ‘রাজমালায় শুধু আছে যে বলবন্ত মুকুট

বহুদিন’ রাজ্যশাসন করেন। কিছু পূর্বে আমরা মুকুটের যে নবাবিষ্কৃত মুদ্রাটির কথা বলিয়াছি, তাঁহার বিবরণ নিম্নরূপ:

মুখ্যদিক : (লেখন) “শ্ৰীম [-] মহাদেবী শ্রীশ্রীমুকুটমাণিক্যৌ”

গৌণদিক : (চিত্রণ) গরুড়-মূর্ত্তি, (গরুড়ের চারিদিকে বৃত্তাকারে লেখন)
“নরনারায়ণে শ্রীশ্রীমুকুটমাণিক্যদেবঃ ১৪১১।” [লেখক শীঘ্রই এই মুদ্রাটি Numismatic Chronicle-এ প্রকাশ করিবেন]

১৪১১ শকের এই অনন্য ও অজ্ঞাতপূর্ব মুদ্রাটি যদি তাঁহার রাজ্যাভিষেকের সময় মুদ্রিত হইয়া থাকে, তবে বলিতে হইবে যে, তাঁহার রাজ্যকাল অতিশয় সীমিত ছিল; কারণ ১৪১১ শকের তারিখযুক্ত ধন্যমাণিক্যের মুদ্রা ঠিক পর বৎসরেই মুকুটের রাজত্বের সমাপ্তি ও ধন্যের রাজ্য-প্রাপ্তির কথা ঘোষণা করে।

ধন্যের ১৪১২ শকের মুদ্রা ছাড়াও আরও কতকগুলি তারিখবিহীন মুদ্রার [R.D. Banerji, In. Rep. Arch. Surv. Ind., 1913-14] প্রমাণ দৃষ্টে মনে হয় যে, ঐ তারিখেরও কিছু পূর্বে ধন্য সিংহাসনে বসেন এবং ঐসব মুদ্রা নির্মিত করেন। আবার রাজমালার কাহিনী অনুযায়ী, ধন্যের পূর্বে তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা দ্বিতীয় প্রতাপমাণিক্য রাজা হন, কিন্তু “অধার্মিক দেখি তারে লোকে মারে পরে”। এই দ্বিতীয় প্রতাপের কাহিনী নিতান্তই কাল্পনিক ও ভ্রমাত্মক। যতদূর মনে হয়, রত্নমাণিক্যের মৃত্যুর পর বেশ কিছুদিন ঐশ্বর্যলোভী, শক্তিশালী ও কুচক্রী সেনাপতিদের খেলা চলে, এবং তাহারা যাহাকে ও যখন খুশী সিংহাসনে বসায় ও সিংহাসনচ্যুত করে। এই ভাবে পর পর তথাকথিত ‘প্রথম’ প্রতাপ ও মুকুট রাজা হন; কিন্তু তাহাদের রাজত্ব বেশিদিন স্থায়ী হয় নাই। মুকুটমাণিক্য ও ধন্যমাণিক্যের মধ্যে সম্ভবত কোন প্রতাপের অস্তিত্ব ছিল না।

যাহা হউক, ত্রিপুরার তৃতীয় মুদ্রা নির্মাণকারী রাজা ধন্যমাণিক্যের মুদ্রা সব দিক দিয়া–অর্থাৎ আকৃতিতে, প্রকৃতিতে, চিত্রণে, লেখনে ও অক্ষর বিন্যাসে–রত্নমাণিক্যের সিংহমূর্ত্তি-সমম্বিত মুদ্রাগুলির অনুরূপ। [বিশেষ করিয়া রত্ন ও ধন্যের প্রাথমিক মুদ্রা পাশাপাশি রাখিয়া তুলনা করিলেই একথা স্পষ্ট হইবে; মনে হইবে যেন একই শিল্পীর হাতে উভয়ের মুদ্রা নির্মিত হইয়াছে।] ধন্যও তাঁহার প্রাথমিক মুদ্রায় তারিখ ও মহিষীর নাম লেখেন নাই। তাঁহারও (সম্প্রতি প্রাপ্ত) এক প্রকার মুদ্রার গৌণদিকে বৃত্তাকারে একটি লেখন-ছত্র উৎকীর্ণ আছে। এই লেখনটিতে “অরবিংদ-চরণপরায়ণ [ঃ] শুভমস্তু [শকে ১৪১২” ] লেখা আছে। [এই মুদ্রাটি বিখ্যাত সংগ্রাহক শ্ৰী জি.এস. বিদের সংগ্রহে আছে। তাঁহারই সৌজন্যে ও শ্রী পি.কে. উরির আনুকূল্যে আমরা এই মুদ্রাটি পরীক্ষা করিতে পারিয়াছি।] এই ১৪১২ শকেই মুদ্রিত ধন্যের অন্য প্রকার কতকগুলি মুদ্রায় তাঁহার বিরূদ হিসাবে ‘ত্রিপুরেন্দ্র’ কথাটি ও মহিষী ‘কমলা’র নাম পাওয়া যায়। ১৪২৮ শকের মুদ্রাগুলি পূর্ব্বোক্ত মুদ্রার প্রায় অনুরূপ হইলেও সেগুলিতে বিরূদ হিসাবে ‘বিজয়ীন্দ্র’ কথাটি লেখা থাকে। তাঁহার শেষ মুদ্রাগুলি ১৪৩৬ শকাব্দে (রাজমালার কথা মতই) ‘চাটিগ্রাম-বিজয়ের স্মারক মুদ্রা হিসাবে মুদ্রিত হইয়াছিল। মুখ্যাদিকে ইহাদের যে লেখন আছে, তাহা এইরূপ : “চাটিগ্রাম-বিজয়ি শ্রীশ্রীধন্যমাণিক্য শ্রীকমলাদেব্যৌ”।

রাজমালার মতে ধন্য বালকবয়সে রাজা হন এবং তিপ্পান্ন বৎসর রাজত্ব করিয়া নয় শ পঁচিশ সনে’ অর্থাৎ ত্রিপুরাব্দে (বা ১৪৩৭ শকে ১৫১৫ খ্রীষ্টাব্দে) পরলোক গমন করেন। তিপ্পান্ন বৎসর ধন্য নিশ্চয়ই রাজত্ব করেন নাই। কারণ আমরা ইতিপূর্বে দেখিয়াছি ধন্য ১৪১১-১২ শকে সিংহাসনে বসেন। এখন, তাঁহার মৃত্যু যদি ১৪৩৭ শকাব্দে হয়, তাহা হইলে তাঁহার রাজ্যকাল ২৬ বছরের বেশি হইতে পারে না। সম্ভবত তিপ্পান্ন বৎসর রাজত্ব করিয়া নহে, তিপ্পান্ন বৎসর বয়সে’ ধন্যমাণিক্য মারা যান। যাহা হউক, ত্রিপুরার ইতিহাসে ধন্যের সুদীর্ঘ ও ঘটনাবহুল শাসন বিশেষভাবেই উল্লেখযোগ্য।

অতি অল্প বয়সে রাজা হইয়া ধন্যমাণিক্য চক্রান্তকারী সেনাপতিদের সম্বন্ধে সন্ত্রস্ত হইয়া পড়েন ও নিতান্তই অসহায় বোধ করেন। শেষপর্যন্ত অবশ্য ছলনার আশ্রয় লইয়া তাহাদের বিনাশ করেন ও রাহুমুক্ত হন। [রাজ, ২য়, পৃ. ১৪-১৫।] শীঘ্রই তিনি বড় সেনাপতির কন্যা কমলাকে বিবাহ করিয়া নিশ্চিন্তে রাজকার্যে মনোনিবেশ করেন।

ধন্যমাণিক্যের আমলে ত্রিপুরারাজ্য বিশেষ সমৃদ্ধ হইয়া উঠে। তিনি মন্দির নির্মাণ, পুষ্করিণী খনন প্রভৃতি বহু পুণ্য ও জনহিতকর কার্য করিয়া সমধিক খ্যাতি অর্জন করেন। অপরপক্ষে তিনি ত্রিপুরার পূর্বদিকস্থ কুকিদের পার্ব্বত্য অঞ্চল আক্রমণ করিয়া তাহা নিজ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। বলা বাহুল্য, পার্শ্ববর্তী রাজ্যজয়ে উৎসাহিত হইয়াই, ১৪২৮ শকে নির্মিত এক প্রকার মুদ্রায় স্বীয় নামের পূর্বে ‘বিজয়ীন্দ্র’ এই উপাধি লেখেন।

শেষপর্যন্ত তদানীন্তন বাংলার সুলতান হুসেন সাহের সহিত তাঁহার বিরোধ বাধে। রাজমালার কাহিনী হইতে বোঝা যায় যে, প্রথম দিকে ধন্য বেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন; কিন্তু পরে অলৌকিকভাবে তিনি বিপন্মুক্ত হন এবং ১৪৩৫ শকে চাটিগ্রাম জয় করিয়া স্মারক মুদ্রা নির্মাণ করেন। [রাজ, পৃ. ২২: চৌদ্দ শ পাঁচত্রিশ শাকে সমর জিনিল। চাটিগ্রাম জয় করি’ মোহর মারিল।] রাজমালায় উল্লিখিত ১৪৩৬ শকের তারিখযুক্ত ধন্যমাণিক্যের স্মারক মুদ্রার কথা পূর্বেই বলা হইয়াছে। মনে হয়, ধন্য কর্ত্তৃক ১৪৩৫ শকের চাটিগ্রাম-বিজয় স্থায়ী হয় নাই, কারণ রাজমালায় আবার ১৪৩৭ শকে চাটিগ্রামে জয়ের কথা আছে। [রাজ, পৃ. ২৪ : চৌদ্দ শ সাত্রিশ শাকে চাটগ্রাম জিনে। শুনিয়া হোসন শাহা মহাক্রোধ মনে।]

ত্রিপুর-বংশাবলীর মতে ‘নয়শ পঁচিশ সনে’ অর্থাৎ ৯২৫ ত্রিপুরাব্দে বা ১৪৩৭ শকে ধন্যের পরলোক প্রাপ্তি ঘটে এবং অচিরেই তাঁহার পুত্র ধ্বজমাণিক্য রাজা হন ও ‘ক্রমাগত ছয় বৎসর রাজত্ব’ করিয়া ‘নয় শ একত্রিশ সনে’ বা ১৪৪৩ শকাব্দে মারা যান। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, রাজমালায় এই ধ্বজমাণিক্যের নামোল্লেখও নাই। সেই জন্য কেহ কেহ ধ্বজের অস্তিত্বই স্বীকার করেন না; এবং কাহারও মতে তিনি মাত্র এক বৎসর রাজত্ব করেন। [রাজ, পৃ. ১৭৮ দ্রষ্টব্য।] এই বিতর্কিত ধ্বজমাণিক্যের কোন শিলালেখ বা মুদ্রা আবিষ্কৃত হয় নাই।

ধ্বজমাণিক্য যদি সত্যই রাজত্ব করিয়া থাকেন, তবে ১৪৪২ শকাব্দে বা তাঁহার কিছু পূর্বে তাঁহার রাজত্বের সমাপ্তি ঘটিয়া থাকিবে; কারণ পরবর্তী রাজা দেবমাণিক্যের ঐ বৎসরের তারিখযুক্ত একটি মুদ্রা সম্প্রতি আবিষ্কৃত হইয়াছে। [আগরতলার সরকারী সংগ্রহালয়ে রক্ষিত এই মুদ্রাটি আমরা ওখানকার কিউরেটার শ্রীমতী রত্না দাসের সৌজন্যে পরীক্ষা করিতে পারিয়াছি।]

যাহা হউক, দেবমাণিক্যই ধন্যের পরবর্তী মুদ্রা নির্মাণকারী রাজা। রাজমালায় তাঁহার রাজত্বকাল সম্বন্ধে কিছুই লেখা নাই। তাঁহার সময়কার কোন শিলালিপি থাকিলেও আজিও তাহা অনাবিষ্কৃত রহিয়াছে। রাজমালার সম্পাদক কালীপ্রসন্ন সেন দেবমাণিক্যের কোন দ্রার কথা জানিতেন না। ১৯৫৬ খ্রীষ্টাব্দে মুহম্মদ রেজা-উর রহিম ঢাকা মিউজিয়ামে রক্ষিত তাঁহার ১৪৪৮ শকের তারিখযুক্ত একটি সাধারণ মুদ্রা প্রকাশ করিয়াছেন। [Journ. Pakistan Hist. Soc., Vol. IV. (1956)।] সম্প্রতি তাঁহার আরও দুইপ্রকার অতি মূল্যবান স্মারক মুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছে। রাজমালায় দেবমাণিক্যকর্ত্তৃক ভুলুয়া (বা নোয়াখালি) দখল করা, ফলমতি বা চন্দ্রনাথ তীর্থে গমন করিয়া মোহর মারা (অর্থাৎ মুদ্রা নির্মাণ করা) এর দুরাশায় স্নান তর্পণ করার কথা আছে। পূর্ব্বোল্লিখিত ১৪৪২ শকে মুদ্রিত দেবমাণিক্যের প্রথম প্রকার স্মারক মুদ্রায় দেবমাণিক্যকে। ‘দুরাশার-স্নায়ী’ বলা হইয়াছে। বলা বাহুল্য, এই মুদ্রা তিনি ভুলুয়া জয় করার পর দুরাশায় স্নান করিয়া মুদ্রিত করিয়া থাকিবেন। [এই মুদ্রার মুখ্যদিকে “[দু] বাসার স্না/য়ি ত্রিপুরশ্রীশ্রীদেবমানি/ক্য পদ্মাবতৌ” চার ছত্রের এই লেখন এবং গৌণদিকে বামমুখী সিংহমূর্ত্তি ও “শক ১৪৪২”, এই তারিখ আছে।] দ্বিতীয় প্রকার যে স্মারক মুদ্রাটি দেবমাণিক্য ১৪৫০ শকে নির্মাণ করেন, তাহাতে তাহাকে ‘সুবর্ণগ্রাম বিজয়ী’ বলা হইয়াছে। [এই মুদ্রাটির মুখ্যদিকে সুবর্ণগ্রা/ম বিজয়ি/শ্রীশ্রীদেব/মাণিক্যশ্রী/পদ্মাবতৌ” পাঁচ ছত্রের এই লেখন এবং গৌণদিকে বামমুখী সিংহমূর্ত্তি ও “শক ১৪৫০” এই তারিখ আছে।] এই মুদ্রার প্রমাণ হইতে বেশ বলা যায় যে, রাজমালায় বা অন্য কোথাও উল্লিখিত না হলেও দেবমাণিক্য সাময়িকভাবে অন্তত তৎকালীন বাংলার সুলতান নাসিরুদ্দীন নসরৎ শাহের (১৫১৯-৩২ খ্রী) নিকট হইতে সুবর্ণগ্রাম বা সোনারগাঁও জয় করিয়াছিলেন। দেবমাণিক্যের মুদ্রাগুলিতে মহিষী পদ্মাবতীর নাম পাওয়া যায়।

রাজমালার কাহিনী অনুযায়ী, দেবমাণিক্য মিথিলা নিবাসী তান্ত্রিক সন্ন্যাসী লক্ষ্মীনারায়ণ কর্ত্তৃক শ্মশান ক্ষেত্রে নিহত হন এবং তাঁহার চিতায় প্রধানা মহিষী (পদ্মাবতী?) আত্মোৎসর্গ করেন। [রাজ ২য় পৃ. ৩৬ দ্রষ্টব্য।] ‘ত্রিপুর বংশাবলী’ মতে এই ঘটনা ঘটে ৯৪৫ ত্রিপুরাব্দে বা ১৪৫৭ শকে। [রাজ ২য়, পৃ. ১৭৯, দ্রষ্টব্য।] কিন্তু ১৪৫৪ শকে নির্মিত দেবমাণিক্যপুত্র বিজয়মাণিক্যের মুদ্রা দৃষ্টে জানা যায় যে, ১৪৫৪ শকের পূর্বেই দেবমাণিক্যের রাজত্বের অবসান ঘটে। ১৪৫০ শকের তারিখ ছাড়াও ১৪৫২ শকাব্দের তারিখযুক্ত দেবমাণিক্যের সুবর্ণগ্রাম-বিজয়ের আর একটি স্মারক মুদ্রার কথা জানা যায়; এই মুদ্রাটি নকল না হইলে [আগরতলার শ্রীজহর আচার্য এই মুদ্রাটির একটি ফটোগ্রাফ দেখাইয়াছেন; তাহাতে “শক ১৪৫২” এই তারিখ আছে। কিন্তু ফটোগ্রাফ দৃষ্টে মুদ্রাটি নকল কিনা বলা কঠিন। (ত্রিপুরার মুদ্রার কিছু নকল বাজারে বাহির হইয়াছে।)] বলিতে হইবে যে, ১৪৫২ শকেও এই স্মারকমুদ্রা পুনর্মুদ্রিত হইয়াছিল এবং ঐ সময় পর্যন্ত দেবমাণিক্য সিংহাসনারূঢ় ছিলেন। রাজমালার মতে দেবমাণিক্যের হত্যার পর তাঁহার অন্য এক মহিষীর পুত্র শিশু ইন্দ্ৰমাণিক্যকে ত্রিপুরার সিংহাসনে বসান হয়; কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সেনাপতি দৈত্যনারায়ণের ব্যবস্থায় তিনি নিহত হন এবং তাঁহার স্থলে অল্পবয়স্ক (প্রথম) বিজয়মাণিক্যকে অভিষিক্ত করা হয়। [দেবমাণিক্যের হত্যার পর চন্তাই-এর কন্যা প্রধানা মহিষী ও জ্যেষ্ঠ পুত্র বিজয়ের মাতা (পদ্মাবতী?) ‘সতী’ হন। অন্য মহিষী দেবমাণিক্যের হত্যাকারী মিথিলানিবাসী তান্ত্রিক ব্রাহ্মণ লক্ষ্মীনারায়ণের সাহায্যে শিশুপুত্র (প্রথম) ইন্দ্ৰমাণিক্যকে সিংহাসনে বসান এবং বিজয়কে কারারুদ্ধ করান। কিন্তু সেনাপতি চৈতন্যনারায়ণ ইন্দ্রসহ ষড়যন্ত্রকারীদের হত্যা করান।–রাজ, ২য়, পৃ. ৩৮ এবং রাজ, পৃ. ৩৩/২ ও ৩৪/১ দ্রষ্টব্য।]

যাহা হউক, ‘রাজমালা’, ‘ত্রিপুর বংশাবলী’ ও মুদ্রায় প্রাপ্ত তথ্যের সামঞ্জস্য বিধান করিয়া ধন্যমাণিক্যের রাজ্যাবসান কাল হইতে বিজয়মাণিক্যের অভিষেককাল পর্যন্ত ত্রিপুরা ইতিহাসের একটি খসড়া রচনা করা সম্ভব। মনে হয়, ১৪৩৭ শকে শেষবার চাটিগ্রাম জয়ের পরই ধন্যমাণিক্য স্বর্গারোহণ করেন। সম্ভবত ধন্যের পর অখ্যাত ধ্বজমাণিক্য ১৪৪২ শক পর্যন্ত রাজত্ব করেন এবং তাঁহার পর আসেন দেবমাণিক্য। তিনি ১৪৫২ শকাব্দ পর্যন্ত সিংহাসনারূঢ় থাকেন। তাঁহার হত্যার পর তাঁহার শিশুপুত্র ইন্দ্ৰমাণিক্যকে সিংহাসনে বসান হয় এবং অচিরেই এই ভাগ্যহীন রাজপুত্রকে হত্যা করিয়া তাঁহার স্থলে তাঁহার বৈমাত্রেয় জ্যেষ্ঠভ্রাতা প্রথম বিজয়মাণিক্যকে ১৪৫৪ শকে বা তাঁহার কিছু পূর্বে রাজা করা হয়।

কেহ কেহ মনে করেন যে, বিজয়মাণিক্য ১৪৫০ হইতে ১৪৯২ শকাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। [রাজ, ২য় পৃ. ১৮০ দ্রষ্টব্য।] এই তারিখ দুইটির কোনটিই বিজয়ের রাজত্বকালের মধ্যে পড়ে না। ১৪৫৪ শকের তাঁহার প্রাথমিক মুদ্রা হইতে প্রমাণিত হয় যে, ঐ বৎসর বা তাঁহার কিছু পূর্বে বিজয়মাণিক্য অভিষিক্ত হন এবং ১৪৮৫ ও ১৪৮৬ শকাব্দে মুদ্রিত তাঁহার ও তাঁহার পুত্র অনন্তমাণিক্যের মুদ্রাগুলি হইতে জানা যায় যে, ১৪৮৫ বা ১৪৮৬ শকে বিজয়ের রাজত্বের সমাপ্তি ঘটে।

যাহা হউক, বিজয়মাণিক্যের যে বহুপ্রকার মুদ্রা পাওয়া যায়, সেগুলি নানাভাব উল্লেখযোগ্য। ১৪৫৪ হইতে ১৪৮৫ শকাব্দের মধ্যে মুদ্রিত এই মুদ্রাগুলিতে তাঁহার চারটি বিচিত্র বিরূদ ও চারজন মহিষীর নাম পাওয়া যায়। চার প্রকার মুদ্রায় তাঁহাকে ‘কুমুদীশদর্শী’, ‘প্রতিসিন্ধুসীম’ ‘ত্রিপুরমহেশ’ ও ‘বিশ্বেশ্বর’ বলা হইয়াছে। এগুলির লেখনে যথাক্রমে বিজয়া, লক্ষ্মী, সরস্বতী ও বাকদেবীর (বা বামাদেবীর) নাম আছে। ইঁহাদের মধ্যে রাজমালায় শুধুমাত্র লক্ষ্মীর নাম প্রত্যক্ষভাবে ও দ্বিতীয় এক রাণীর কথা পরোক্ষভাবে পাওয়া যায়। [রাজ, ২য় পৃ. ৪৩; রাজ, পৃ. ৩৬১ : “বিবাহ করিল রাজা বালা মহাদেবী। লক্ষি রহিল হিরাপুর বনবাস সেবি।”] সেনাপতি ও লক্ষ্মীর পিতা দৈত্যনারায়ণের প্রতাপে উত্ত্যক্ত হইয়া বিজয়মাণিক্য তাঁহাকে মাধব নামে এক ব্যক্তিকে দিয়া হত্যা করান। লক্ষ্মী আবার সব বৃত্তান্ত জানার পর পিতৃহন্তা মাধবকে সুকৌশলে হত্যা করান। ইহাতে বিজয় ক্রুদ্ধ হইয়া লক্ষ্মীকে নির্বাসন দেন এবং “পরে রাজা বিভা করে আর মহাদেবী।” কিন্তু পাত্রমিত্রদের অনুরোধে শেষপর্যন্ত আবার তিনি লক্ষ্মীকে গ্রহণ করেন। [রাজ, ২য় পৃ. ৪৩; রাজ, পৃ. ৩৬১।] মনে হয় এই পত্নীই বিজয়া। [বিজয়মাণিক্যের ১৪৫৪ ও ১৪৫৬ শকের প্রাথমিক দুই প্রকার মুদ্রায় এই বিজয়ার নাম আছে। পরবর্তী ১৪৫৮ শকাব্দের মুদ্রায় লক্ষ্মীর নাম পাওয়া যায়।] রাজমালায় উল্লিখিত বিজয়ের তিন প্রকার স্মারক মুদ্রাই আবিষ্কৃত হইয়াছে। [শ্রীকালীপ্রসন্ন সেন কর্ত্তৃক প্রকাশিত রাজমালায় (২য় লহর, পৃ. ৫৫) তিন প্রকার স্মারক মুদ্রার কথা থাকিলেও ত্রিপুরার শিক্ষা অধিকার কর্ত্তৃক সম্প্রতি প্রকাশিত রাজমালায় (পৃ. ৪১।২) ‘চারি’ প্রকার স্মারক মুদ্রার কথা আছে : (১) “ব্রহ্মপুত্রয়ী বলি মোহর মারিল”; (২) “ধ্বজঘট্টপদ পুণি (?) মোহর লিখীল; (৩) “লক্ষ্যায়ী বলি মোহর মারিয়া..”; (৪) “পদ্মাবতিস্নায়ী বলি মোহর মারিল”। প্রথম প্রকার মুদ্রা আজিও আবিস্কৃত হয় নাই।] প্রথমটি সুবর্ণগ্রাম জয়ের পর ব্রহ্মপুত্ৰতীরস্থ ধ্বজঘাট স্নানের, দ্বিতীয়টি ব্রহ্মপুত্রের শাখানদী লক্ষ্যা-স্নানের এবং তৃতীয়টি পদ্মাবতী স্নানের স্মরণে মুদ্রিত হয়। পূর্বেই উল্লেখ করা হইয়াছে যে, লক্ষ্যা-স্নানের স্মারক মুদ্রাগুলিতে শিব ও দুর্গার অংশে কল্পিত অনন্যপূর্ব ‘অর্ধনারীশ্বরের মূর্ত্তি এবং পদ্মাবতী-স্নানের স্মারক মুদ্রার মুখ্যদিকে ‘শিবলিঙ্গ’ ও গৌণদিকে সিংহাসনে স্থাপিত ‘গরুড়বাহিত বিষ্ণুর মূর্ত্তি’ অঙ্কিত দেখা যায়।

প্রথম বিজয়মাণিক্য একজন শক্তিমান নৃপতি ছিলেন। সুদীর্ঘ রাজত্বকালে তিনি ত্রিপুরার শ্রীবৃদ্ধি করিয়াছিলেন। তিনি মুঘলসম্রাট আকবরের সমসাময়িক ছিলেন এবং ত্রিপুরার স্বাধীন রাজা হিসাবে আইন-ই-আকবরীতে তাঁহার উল্লেখ আছে। [রাজ, ২য় পৃ. ১১৭।] তিনি পার্শ্ববর্তী শ্রীহট্ট, জয়ন্তিয়া ও খাসিয়া রাজ্য আক্রমণ ও জয় করেন। রাজমালায় বর্ণিত তাঁহার সহিত সমসাময়িক বাংলার সুলতানদের সংঘর্ষের এবং সোনারগাঁ ও পদ্মানদী পর্যন্ত তাঁহার অভিযানের কাহিনী ইতিপূর্বেই বর্ণিত তাঁহার স্মারক মুদ্রাগুলির লেখন হইতে সমর্থিত হইয়াছে। বেশ বোঝা যায় যে তাঁহার রাজত্বের শেষের দিকে (১৪৭৯ হইতে ১৪৮৫ শকের মধ্যে) এই সব সংঘর্ষ সংঘটিত হয় এবং প্রতিক্ষেত্রেই তিনি জয়ী হইয়া স্মারক মুদ্রা নির্মাণ করেন। রাজমালায় বিশদভাবে বিজয়ের রূপ বর্ণনা করা হইয়াছে। তিনি যে চন্দ্রকান্তি গৌর পুরুষ ছিলেন, তাহা তাঁহার ১৪৫৮ শকে নির্মিত এক প্রকার মুদ্রার ‘কুমুদীশদর্শী এই বিরূদ দ্বারা সমর্থিত হইয়াছে।

বিজয়ের পর তাঁহার পুত্র অনন্তমাণিক্য ১৪৮৫ শকের শেষে বা ১৪৮৬ শকের কোন এক সময় ত্রিপুরার সিংহাসনে বসেন। একথা প্রমাণ করে তাঁহার ১৪৮৬ শকাব্দে মুদ্রিত গরুড়বাহিত বিষ্ণুর মূর্ত্তিসমন্বিত প্রাথমিক মুদ্রা। এই মুদ্রায় তাঁহার কোন মহিষীর নাম নাই। তাঁহার পরবর্তী মুদ্রার মুখ্যদিকে তাঁহার ও মহিষী রত্নাবতীর নাম এবং গৌণদিকে সিংহমূর্ত্তির নিম্নে ‘শক ১৪৮৭’ লেখা থাকে। রাজমালায় কিন্তু ‘অনন্তমাণিক্য-রাণী জয়া মহাদেবী’র নাম আছে। [রাজ ২য়, পৃ. ৬৭।] যাহা হউক স্বীয় শ্বশুর গোপীপ্রসাদ কর্ত্তৃক অনন্ত অচিরেই নিহত হন। এই ঘটনা ঘটে সম্ভবতঃ ১৪৮৭. শকেই, কারণ রাজমালার কাহিনী অনুযায়ী তিনি ‘বৎসর দেড়েক’ রাজ্যশাসন করিয়াছিলেন। [রাজ ২য়, পৃ. ১৮১ দ্রষ্টব্য।]

জামাতাকে হত্যা করার পর গোপীপ্রসাদ উদয়মাণিক্য নাম গ্রহণ করিয়া ত্রিপুরার অধীশ্বর হইয়া বসেন। সম্ভবত তিনি প্রথম সরাসরি নিজেকে রাজা বলিয়া জাহির করেন নাই, এবং বেশ কিছুদিন কাটিয়া যাওয়ার পর ১৪৮৯ শকে অভিষিক্ত হইয়া সিংহাসনে বসেন ও ত্রিপুরার ‘মাণিক্য রাজাদের মতই ‘সিংহমূর্ত্তি’ সমন্বিত মুদ্ৰানির্মাণ করেন। এই সব মুদ্রায় তারিখ হিসাবে ‘১৪৮৯’ শকাব্দ ও রাণী হীরা মহাদেবীর নাম থাকে। চক্রান্তকারী উদয় কিন্তু কয়েক বৎসর কৃতিত্বের সহিত রাজত্ব করেন। তিনি চন্দ্রপুরে রাজধানী স্থাপন করেন এবং সেখানে চন্দ্ৰসাগর নামে দীঘি খনন করেন। সম্ভবত চন্দ্রপুরকেই তিনি উদয়পুর নাম দেন। তিনি চট্টগ্রাম বিজয়েছু মুঘলসৈন্য কর্ত্তৃক পরাজিত হইয়াছিলেন বলিয়া কথিত আছে। [রাজ, পৃ, ৭১।] রাজমালার মতে চৌদ্দশ আটানব্বই শকেতে’ ‘পঞ্চ বৎসর রাজত্ব করিয়া কামাসক্ত উদরমাণিক্য অপঘাতে মারা যান’। [রাজ. পৃ, ৭২।] কিন্তু তাঁহার মৃত্যুর এই তারিখটি সত্য হইতে পারে না। ১৪৮৬ ও ১৪৮৭ শকাব্দের মধ্যে দেড় বৎসর রাজত্ব করিবার পর যদি অনন্তমাণিক্য নিহত হইয়া থাকেন এবং তাঁহার পর যদি উদয় পাঁচ বৎসর রাজত্ব করেন, তাহা হইল ১৪৯২ শকের কাছাকাছি কোন সময় উদয়ের রাজত্বের সমাপ্তি ঘটিবার কথা। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে তাহা ঘটে নাই বলিয়া মনে হয়। সম্ভবত অনন্তের মুদ্রার শেষ তারিখ ১৪৮৭ এবং উদয়পুত্র জয়মাণিক্যের প্রাথমিক মুদ্রায় লিখিত তারিখ ১৪৯৫ শকের মধ্যে উদয়মাণিক্য প্রায় ৭।৮ বৎসর রাজত্ব করেন।

উদয়ের পর তাঁহার পুত্র প্রথম জয়মাণিক্য ১৪৯৫ শকে বা তাঁহার কিছু পূর্বে সিংহাসনে বসেন এবং ১৪৯৫ শকের তারিখ দিয়া মুদ্রা নির্মাণ করে। এই সব মুদ্রার কতকগুলিতে শুধুমাত্র তাঁহার একার নাম থাকিলেও কতকগুলিতে আবার তাঁহার মহিষী সুভদ্রা মহাদেবীর নাম দেখা যায়। জয়মাণিক্য দেবমাণিক্যের পুত্র অমরমাণিক্য কর্ত্তৃক সিংহাসনচ্যুত ও নিহত হন।

রাজমালার মতে ‘চৌদ্দ শ’ ঊনশত শকে অমরদেব রাজা হন’, [রাজ, ৩য়, পৃ. ১১] এবং ঐ বৎসরই আমরা অমরমাণিক্যকে মহিষী অমরাবতীর নাম সম্বলিত মুদ্রা নির্মাণ করিতে দেখি। রাজমালায় ১৫০০ শকে তৎকর্ত্তৃক ‘ভুলুয়া আমল’ করার কথা আছে। [রাজ, ৩য়, পৃ. ১১।] ১৫০২ শকাব্দের এক প্রকার মুদ্রায় তিনি ‘দিগ্বিজয়ী’ এই বিরূদ ব্যবহার করেন এবং পরবৎসরে উত্তীর্ণ তাঁহার শেষ মুদ্রায় আপনাকে ‘শ্রীহট্টবিজয়ী’ বলিয়া ঘোষণা করেন। ‘রাজমালাতেও তাঁহার এই শ্রীহট্ট বিজয়ের কথা আছে; তবে ইহার কৃতিত্ব প্রকৃতপক্ষে যুবরাজ রাজধরেরই ছিল বলিয়া জানা যায়। [রাজ, পৃ. ৪৭-৪৯ দ্রষ্টব্য।] অমরমাণিক্য শেষপর্যন্ত কুকীদের দ্বারা বিপর্যস্ত হন এবং কিছুদিনের মধ্যে আত্মহত্যা করেন। [রাজ, পৃ. ৬১ এবং ৬৩ দ্রষ্টব্য।]

অমরমাণিক্যের পর তৎপুত্র রাজধরমাণিক্য রাজা হন এবং ১৫০৮ শকে মহিষী সত্যবতীর সহিত মুদ্রা নির্মাণ করেন। রাজমালার লেখা অনুযায়ী তিনি ১২ বৎসর রাজত্ব করেন; [রাজ, পৃ. ২১৩ দ্রষ্টব্য] কিন্তু রাজমালার বৃত্তান্ত পাঠে ও তৎপুত্র যশোধরের ১৫২২ শকের প্রাথমিক মুদ্রা দৃষ্টে বেশ বোঝা যায় যে, তিনি প্রায় ১৫ বৎসর সিংহাসনারূঢ় ছিলেন।

যাহা হউক, ১৫২২ শকে বা তাঁহার কিছু পূর্বে রাজধরের পরেই যশোধরমাণিক্য অভিষিক্ত হন। তাঁহার ১৫২২ শকের ‘বংশীবাদক কৃষ্ণের মূর্ত্তি’ সমন্বিত মুদ্রার কথা ইতিপূর্বেই বলা হইয়াছে। এই মুদ্রাগুলির একটিতে শুধু মহিষী ‘লক্ষ্মীর’ [ভারতীয় মুদ্রার সুবিখ্যাত সংগ্রাহক শেঠ হনুমান প্রসাদ পোদ্দার মহাশয়ের সগ্রহে রক্ষিত এই মুদ্রাটি শীঘ্রই লেখক কর্ত্তৃক প্রকাশিত হইবে] এবং বাকীগুলির কোনটিতে ‘গৌরী ও লক্ষ্মীর’ ও কোনটিতে আবার ‘লক্ষ্মী, গৌর ও জয়া’ মহাদেবীর নাম দেখা যায়। অনন্য যে মুদ্রাটিতে শুধুমাত্র লক্ষ্মীর নাম আছে, তাঁহার গৌণদিকে কৃষ্ণের পার্শ্বেও শুধু ‘একজন’ গোপিনীর মূর্ত্তি দেখা যায়; বাকীগুলিতে কিন্তু কৃষ্ণের দুই পার্শ্বে দুইজন গোপিনী থাকেন। যাহা হউক, শেষপর্যন্ত যশোধরমাণিক্য বাংলার সমসাময়িক মুসলমান সুলতান কর্ত্তৃক পরাজিত, ধৃত এবং প্রথমে কাশীতে ও পরে মথুরায় নির্বাসিত হন। ১৫৪৫ শকের কাছাকাছি কোন সময়ে যশোধরমাণিক্যের মৃত্যু হইয়া থাকিবে। তাঁহার মৃত্যুর পর ত্রিপুরা রাজ্য আড়াই বৎসর মুসলমানদের অধীনে থাকিবার পর মহামাণিক্যের পুত্র গগনফার বংশজ কল্যাণমাণিক্য ১৫৪৭ শকাব্দে ত্রিপুরার সিংহাসনে বসেন এবং পর বৎসরের তারিখ দিয়া মুদ্রা নির্মাণ করেন। [রাজ, ৩য়, পৃ. ৬৬ : পরশ সাতচল্লিশ শকে রাজা হৈল। শুভদিনে মহারাজ মোহর মারিল।] এযাবৎ প্রাপ্ত তাঁহার ক্ষুদ্রাকৃতি মুদ্রাগুলিতে তাঁহার একারই নাম পাওয়া যাইত। কিন্তু সম্প্রতি আমরা তাঁহার একটি পূর্ণ টঙ্কের যে প্রতিকৃতি পাইয়াছি, তাহাতে তাঁহার মহিষী কলাবতীরও নাম আছে। রাজমালায় কল্যাণের মহিষী হিসাবে ‘কলাবতী’ ও ‘সহরবতী’র নাম পাওয়া যায়। [মুদ্রাটি বিলাতের একটি সংগ্রহশালায় আছে। কল্যাণ-মহিষীদের সম্বন্ধে ঐ, পৃ. ১৫৫ ও প্রথম পাদটিকা এবং পৃ. ১৫৬ ও তৃতীয় পাদটিকা দ্রষ্টব্য।] ১৫৮২ শকাব্দে বা তাঁহার কিছু পূর্বে কল্যাণের মৃত্যু হয়, এবং ঐ বৎসরই আমরা তাঁহার পুত্র গোবিন্দমাণিক্যকে মুদ্রা নির্মাণ করিতে দেখি। গোবিন্দের রাজত্ব প্রথম দিকে নিরঙ্কুশ ছিল না; বৈমাত্রেয় ভ্রাতা নক্ষত্র রায় সাময়িকভাবে তাঁহাকে সিংহাসনচ্যুত করিয়া রাজা হন এবং ছত্রমাণিক্য নাম লইয়া ১৫৮৩ শকের তারিখ সম্বলিত মুদ্রা নির্মাণ করেন। কিন্তু গোবিন্দ যে শীঘ্রই সিংহাসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হন, তাঁহার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৫৮৩ শকে উল্কীর্ণ তাঁহার একখানি শিলালেখ হইতে। [শিলালেখ-সংগ্রহ, পৃ. ২৬।] ইহার পর ঠিক কতদিন তিনি জীবিত ছিলেন, তাহা অনুমান সাপেক্ষ। ১৫৯৮ শকের কাছাকাছি কোন সময় তাঁহার মৃত্যু হইয়া থাকিবে, কারণ গোবিন্দের পুত্র ও পরবর্তী রাজা রামদেবমাণিক্য ঐ তারিখেই মহিষী রত্নাবতীর নামসম্বলিত মুদ্রা নির্মাণ করেন। রামদেবের নামযুক্ত কয়েকটি শিলালেখের মধ্যে শেষটি ১৬০৩ শকে উত্তীর্ণ হইয়াছিল। [শিলালেখ-সংগ্রহ, পৃ. ৩-৪।] তাঁহার পরে ঠিক কতদিন তিনি রাজত্ব করেন, তাহা জানা যায় না। তবে সম্ভবত তিনি ১৬০৭ শকের পূর্বে পরলোক গমন করেন। তাঁহার মৃত্যুর পর ত্রিপুরা রাজ্যে বিপর্যয় নামিয়া আসে এবং সিংহাসন লইয়া ঘোরতর দ্বন্দ্ব চলিতে থাকে। এই সময়কার ইতিহাস তমসাবৃত। রাজমালার একটি সংস্করণে এই সময়কার যে বিবরণ পাওয়া যায়, তাহা অত্যল্পই নহে, কিছুটা অস্পষ্টও। যতদূর বোঝা যায়, প্রথমে রামদেবের বংশীয় দ্বিতীয় রত্নমাণিক্য রাজা হন; কিন্তু অচিরেই তিনি তাঁহার খুল্লতাত-পুত্র নরেন্দ্র কর্ত্তৃক সিংহাসনচ্যুত হন। নরেন্দ্র শীঘ্রই আবার বিতাড়িত ও নিহত হইলে রত্নমাণিক্য সিংহাসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হন এবং কিছুদিন রাজত্ব করিয়া স্বীয় কনিষ্ঠ ভ্রাতা মহেন্দ্র কর্ত্তৃক নিহত হন। [ত্রিপুরা শিক্ষা অধিকার কর্ত্তৃক সম্প্রতি প্রকাশিত রাজমালার শেষ সাত পৃষ্ঠায় (৮৩২ হইতে ৮৯।২-এর মধ্যে) সংক্ষেপে এই কাহিনী বর্ণিত হইয়াছে।]

এযাবৎ শুধু ১৬০৭ শকে নির্মিত দ্বিতীয় রত্নমাণিক্যেরই কতকগুলি মুদ্রার কথা জানা ছিল। কিন্তু সম্প্রতি আমরা নরেন্দ্র ও মহেন্দ্রের দুইটি মুদ্রার অস্তিত্বের কথা জানিয়াছি। লণ্ডনের জাতীয় সংগ্রহশালায় রক্ষিত এই দুইটির একটি ১৬১৫ শকে নির্মিত নরেন্দ্রের ও অপরটি ১৬৩৪ শকে মুদ্রিত মহেন্দ্রের মুদ্রা। [আমাদের এক ইংরেজ বন্ধুর চিঠিতে এই তথ্য পাইয়াছি।] ইহারা সমসাময়িক ঘটনাবলীর উপর বিশেষ আলোকপাত করিয়াছে। ১৬০৭ শকাব্দে বা তাঁহার কিছু পূর্বেই রত্ন সিংহাসনে বসেন; কিন্তু নরেন্দ্রের সম্ভাব্য বৈরিতাসত্ত্বেও অন্তত ৮/৯ বৎসর রাজত্ব করেন। তাঁহার মুদ্রাগুলির মধ্যে কতকগুলিতে মহিষী সত্যবতী ও কতকগুলিতে ভাগ্যবতীর নাম দেখা যায়। যাহা হউক, ১৬১৫ শকের কাছাকাছি কোন সময় নরেন্দ্র রত্নমাণিক্যকে সিংহাসনচ্যুত করিয়া রাজা হন এবং, রাজমালার কথা সত্য হইলে, কিছু দিনের মধ্যে নিজেই বিতাড়িত ও নিহত হন। তাঁহার পর রত্ন আবার রাজ্যের কর্তৃত্ব লাভ করেন এবং বহুদিন রাজত্ব করিবার পর কনিষ্ঠ ভ্রাতা মহেন্দ্র কর্ত্তৃক ১৬৩৪ শকাব্দে বা তাঁহার কিছু পূর্বে নিহত হন। মহেন্দ্র প্রায় দুই বৎসর রাজত্ব করেন। তাঁহার মৃত্যুর পর কনিষ্ঠ ভ্রাতা দ্বিতীয় ধর্মমাণিক্য রাজা হন এবং ১৬৩৬ শকাব্দের তারিখযুক্ত দুই প্রকার মুদ্রা নির্মাণ করেন। প্রথম প্রকারের মুদ্রায় শুধু ধর্ম্মের নাম ও দ্বিতীয় প্রকার মুদ্রায় ধর্মমাণিক্য ও মহিষী ধর্মশীলার নাম থাকে। ধর্ম ঠিক কতদিন রাজত্ব করেন, তাহা বলা কঠিন; শুধু জানা যায় যে, তাঁহার পর তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা মুকুন্দ রাজা হন। মুকুন্দের কোন শিলালেখ ও মুদ্রা না থাকায় তাঁহার রাজত্বকাল সম্বন্ধেও আমরা সঠিক কোন ধারণা করিতে পারি না। মুকুন্দের পর ত্রিপুরারাজ্যে অভিষিক্ত হন কল্যাণান্বয় জগন্নাথের বংশধর দ্বিতীয় জয়মাণিক্য। সম্প্রতি আবিস্কৃত ইহার একটি মুদ্রায় তারিখ হিসাবে ‘১৬৬১’ ও মহিষীর নাম ‘জয়াবতী’ লেখা আছে। [এই মুদ্রাটিও শেঠ হনুমান প্রসাদ পোন্দার মহাশয়ের সংগ্রহে আছে। ইহা শীঘই লেখককর্ত্তৃক প্রকাশিত হইবে।] দ্বিতীয় জয়মাণিক্য প্রায় পাঁচ বৎসর রাজত্ব করেন। তাঁহার পর ১৬৬৬ শকে দ্বিতীয় ইন্দ্ৰমাণিক্য রাজা হন এবং ঐ তারিখ দিয়া কতকগুলি ক্ষুদ্রাকৃতি মুদ্রা নির্মাণ করেন। ইন্দ্র শেষ পর্যন্ত রাজ্যচ্যুত ও নিহত হন; তবে ঠিক কবে যে এই ঘটনা ঘটে তাহা বলা কঠিন। [ইন্দ্রের পর ত্রিপুরার সিংহাসনে বসেন জয়মাণিক্যের ভ্রাতা দ্বিতীয় বিজয়মাণিক্য। তাঁহার রাজ্যকাল সম্বন্ধে প্রায় কিছুই জানা যায় নাই।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *