১৩. ধর্ম ও সমাজ

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ – ধর্ম ও সমাজ

হিন্দু ও মুসলমান

বাংলার প্রাচীন ও মধ্যযুগের ধর্ম এবং সমাজের মধ্যে একটি গুরুতর প্রভেদ আছে। প্রাচীন যুগে হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন প্রভৃতি বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায় থাকিলেও মূলতঃ ইহারা একই ধর্ম হইতে উদ্ভূত এবং ইহাদের মধ্যে প্রভেদ ক্রমশঃ অনেকটা ঘুচিয়া আসিতেছিল। প্রাচীন যুগের শেষে বৌদ্ধধর্ম্মের পৃথক সত্তা ছিল না বলিলেই হয়। জৈন ধর্ম্মের প্রভাবও প্রায় বিলুপ্ত হইয়াছিল। সুতরাং মুসলমানেরা যখন এদেশে আসিয়া বসবাস করিল তখন হিন্দু এই একটি সাধারণ নামেই তাহারা এখানকার জাতি ধর্ম ও সমাজকে অভিহিত করিল। মুসলমানের ধর্ম ও সমাজ সমস্ত মৌলিক বিষয়েই এত স্বতন্ত্র ছিল যে তাহারা কোন দিনই হিন্দুর সঙ্গে মিশিয়া যাইতে পারে নাই। মুসলমানদের পূর্বে গ্রীক, শক, পুতুব, কুষাণ, হুণ প্রভৃতি বিদেশী জাতি ভারতের অল্প বা অনেক অংশ জয় করিয়া সেখানেই স্থায়িভাবে বসবাস করিয়াছে এবং ক্রমে বিরাট হিন্দু সমাজের মধ্যে এমন ভাবে মিশিয়া গিয়াছে যে আজ তাহাদের পৃথক সত্তার চিহ্নমাত্র বিদ্যমান নাই। কিন্তু মুসলমানেরা মধ্যযুগের আরম্ভ হইতে শেষ পর্যন্ত স্থল-বিশেষে ১৩০০ হইতে ৭০০ বৎসর হিন্দুর সঙ্গে পাশাপাশি বাস করিয়াও ঠিক পূর্বের মতই স্বতন্ত্র আছে। ইহার কারণ এই যে, এই দুই সম্প্রদায়ের ধর্মবিশ্বাস ও সমাজ-বিধান সম্পূর্ণ বিপরীত। মন্দিরে দেবতার মূর্ত্তি প্রতিষ্ঠিত করিয়া নানা উপচারে তাঁহার পূজা করা হিন্দুদিগের ধর্ম্মের প্রধান অঙ্গ। কিন্তু মুসলমান ধর্মশাস্ত্রে দেবমূর্ত্তি পূজা যে কেবল অবৈধ তাহা নহে, মন্দির ও দেবমূর্ত্তি ধ্বংস করা অত্যন্ত পুণ্যের কার্য বলিয়া গণ্য হয়। আবার হিন্দুশাস্ত্রমতে মুসলমানেরা ম্লেচ্ছ ও অপবিত্র, তাহাদের সহিত বিবাহ, একত্রে পানভোজন প্রভৃতি সামাজিক সম্বন্ধ তো দূরের কথা তাহাদের স্পর্শও দূষিত বলিয়া গণ্য করা হয় তাহাদের সৃষ্ট অন্নজল গ্রহণ করিলে হিন্দু ধর্ম্মে পতিত ও জাতিচ্যুত হয়। গোমাংস ভক্ষণ, বিধবা-বিবাহ প্রভৃতি যে সমুদয় আচার ব্যবহার হিন্দুর দৃষ্টিতে অতিশয় গর্হিত, মুসলমান সমাজে তাহা সর্বজন স্বীকৃত। এইরূপ অশন বসন ভোজন ও জীবনযাপন প্রণালী সম্পূর্ণ ভিন্ন। হিন্দুরা বাংলা সাহিত্যের প্রেরণা পায় সংস্কৃত হইতে, মুসলমানেরা পায় আরবী ফরাসী হইতে। বিবাহাদির ও উত্তরাধিকারের আইন মুসলমান পণ্ডিত আবিরূণী (১০৩০ খ্রীষ্টাব্দ) বলিয়াছিলেন যে ‘হিন্দুরা যাহা বিশ্বাস করে আমরা তাহা করি না। আমরা যাহা বিশ্বাস করি হিন্দুরা তাহা করে না। নয় শত বৎসর পরে যে মুসলমানেরা পাকিস্তানের দাবি করিয়াছিল তাহারাও এই কথাই বলিয়াছিল। তাহারা পূর্ব্বোক্ত ও অন্যান্য প্রভেদের বিষয় সবিস্তারে উল্লেখ করিয়া তাহাদের উক্তির সমর্থন করিত। অষ্টম শতাব্দের আরম্ভে মুসলমানেরা যখন সিন্ধুদেশ জয় করিয়া ভারতে প্রথম বসতি স্থাপন করে তখনও হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে যে মৌলিক প্রভেদগুলি ছিল সহস্র বৎসর পরেও এক ভাষার পার্থক্য ছাড়া আর সমস্তই ঠিক সেইরূপই ছিল। হিন্দুর সর্বপ্রকার রাজনীতির অধিকার লোপ এবং এই ধর্ম ও সমাজগত প্রভেদ ও পার্থক্যই মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাসের সর্বপ্রধান দুইটি ঘটনা। রাজনৈতিক ইতিহাসে কেবল মুসলমান রাজাদের সম্বন্ধেই আলোচনা করা হইয়াছে কারণ মুসলমানেরাই ছিল রাজপদের অধিকারী হিন্দুরা ছিল তাহাদের দাস মাত্র। কোন হিন্দুর পক্ষে রাজপদ অধিকার করা যে কত অসম্ভব ছিল রাজা গণেশের কাহিনীই তাঁহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। কিন্তু গুরুতর প্রভেদ সত্ত্বেও হিন্দু ও মুসলমান উভয়েরই বিধিবদ্ধ ধর্ম ও সমাজ ছিল–সুতরাং পৃথকভাবে এই দুইয়ের আলোচনা করিতে হইবে।

মুসলমান ধর্ম ও সমাজ

মুসলমান ধর্ম ইসলাম নামে পরিচিত এবং ইহার মূলনীতিগুলি কোরাণ প্রভৃতি কয়েকখানি ধর্মশাস্ত্রের অনুশাসন দ্বারা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। সুতরাং পৃথিবীর সর্বত্রই মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাসে ও ধর্ম্মাচরণে সাধারণভাবে একটি মূলগত ঐক্য দেখা যায়। বাংলা দেশেও এই নিয়মের ব্যত্যয় হয় নাই।

যে সকল তুর্কী সৈন্য প্রথমে বাংলা দেশ জয় করিয়া এখানে বসবাস করিতে আরম্ভ করে তাহারা শিক্ষা ও সংস্কৃতির দিক দিয়া খুব নিম্নস্তরেই ছিল। অনেক নিম্নশ্রেণীর হিন্দু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করিয়া বাংলায় মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধি করিয়াছিল। হিন্দু সমাজে নিম্নশ্রেণীর লোকেরা নানা অসুবিধা ও অপমান সহ্য করিত। কিন্তু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করিলে যোগ্যতা অনুসারে রাজ্য ও সমাজে সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করার পক্ষেও তাহাদের কোন বাধা ছিল না। বখতিয়ার খিলজীর একজন মেচজাতীয় অনুচর গৌড়ের সম্রাট হইয়াছিলেন। এই সকল দৃষ্টান্তে উৎসাহিত হইয়া যে দলে দলে নিম্নশ্রেণীর হিন্দু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করিত ইহাতে আশ্চর্য বোধ করিবার কিছু নাই। অপর পক্ষে হিন্দুর উপর নানাবিধ অত্যাচার হইত। তাহাদিগকে জিজিয়া কর দিতে হইত, উচ্চপদে নিয়োগের কোন আশা তাহাদের ছিল না এবং রাজনৈতিক সকল অধিকার হইতেও তাহারা বঞ্চিত ছিল। এই সব কারণে হিন্দুদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণের প্রলোভন খুবই বেশি ছিল। ষোড়শ শতাব্দের প্রারম্ভে পর্তুগীজ পর্যটক দুয়ার্তে বারবোসা বাংলা দেশ সম্বন্ধে লিখিয়াছেন যে রাজ-অনুগ্রহ পাইবার জন্য প্রতিদিন হিন্দুরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। আবার, জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে মুসলমানদের সৃষ্ট পানীয় গ্রহণ ও দ্রব্য ভোজন এমন কি নিষিদ্ধ ভোজ্যের গন্ধ নাকে আসিলেও হিন্দুর জাতিচ্যুতি হইত। মুসলমান কোন হিন্দু নারীর অঙ্গ স্পর্শ করিলে সে স্বয়ং এবং কোন কোন স্থলে তাঁহার পরিবার ও আত্মীয়স্বজন জাতি ও ধর্ম্মে পতিত বলিয়া গণ্য হইত। এই সমুদয় হিন্দুর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। অনেক সময় জোর করিয়া হিন্দুকে মুসলমান করা হইত। আবার কোন কোন সময়ে কেহ কেহ স্বেচ্ছায় ফকীর ও দরবেশদের প্রভাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করিত। এই সকল কারণে বাংলায় মুসলমানদের সংখ্যা অনেক বাড়িয়া গেল। কিন্তু তাহাদের অধিকাংশই যে ধর্ম্মান্তরিত নিম্নশ্রেণীর হিন্দু সে বিষয়ে সন্দেহ নাই।

বাংলা দেশে বৌদ্ধ পাল রাজত্বের সময় অনেক বৌদ্ধ ছিল। সেন রাজারা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম্মের প্রাধান্য পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করেন; তাঁহার ফলে অনেক প্রাক্তন বৌদ্ধ সমাজের নিম্নস্তরে পতিত হয়। তাহারা মুসলমানদিগকে ত্রাণকর্ত্তা বলিয়াই মনে করিত। তাহাদের বিশ্বাস হইয়াছিল যে ব্রাহ্মণদের অত্যাচার বন্ধ করিবার জন্যই দেবতারা মুসলমানের মূর্ত্তিতে ভূতলে আসিয়াছেন। এ সম্বন্ধে “ধর্মপূজা বিধান” নামক গ্রন্থখানি বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। ধর্মপূজা বাংলায় বৌদ্ধধর্ম্মের শেষ স্মৃতিচিহ্ন রক্ষা করিয়াছে এবং তান্ত্রিক ও ব্রাহ্মণ্য মতের সহিত সংমিশ্রিত হইয়া এখনও পশ্চিমবঙ্গে নিম্নশ্রেণীর মধ্যে প্রচলিত আছে। উল্লিখিত গ্রন্থে ‘নিরঞ্জনের রূস্মা’ নামে একটি কবিতা আছে। ব্রাহ্মণেরা ধর্মঠাকুরের ভক্তদের সহিত কিরূপ দুর্ব্যবহার করিত প্রথমে তাঁহার বর্ণনা আছে। দক্ষিণা না পাইলেই তাহারা শাপ দেয়–সদ্ধর্মীদের বিনাশ করে ব্রাহ্মণদের ভয়ে সকলেই কম্পমান ইত্যাদি। ইহাতে বিচলিত হইয়া ভক্তেরা ধর্মঠাকুরের নিকট প্রার্থনা করিল :

মনেতে পাইয়া মর্ম     সভে বলে রাখ ধর্ম
তোমা বিনে কে করে পরিত্রাণ।
এইরূপে দ্বিজগণ     করে সৃষ্টি সংহরণ
এ বড় হইল অবিচার।

ভক্তের প্রার্থনা শুনিয়া বৈকুণ্ঠে ধর্মঠাকুরের আসন টলিল :

বৈকুণ্ঠে থাকিয়া ধর্ম      মনেতে পাইয়া মর্ম
মায়ারূপে হইল খনকার।
ধর্ম হইলা যবনরূপী      শিরে নিল কাল টুপি
হাতে শোভে ত্রিকচ কামান।
যতেক দেবতাগণ        সবে হয়ে একমন
আনন্দেতে পরিল ইজার।
বিষ্ণু হইল পয়গম্বর        ব্রহ্মা হৈল পাকাম্বর (হজরৎ মহম্মদ)
আদম্ভ হইয়া শূলপাণি।

এইরূপে গণেশ হইলেন গাজী, কার্তিক–কাজী, চণ্ডিকা দেবী–হায়্যা বিবি, ও পদ্মাবতী–বিবি নূর হইলেন। এইভাবে দেবগণ মুসলমানের রূপ ধারণ করিয়া জাজপুরে প্রবেশ করিল এবং মন্দিরাদি ভাঙ্গিয়া অনর্থ সৃষ্টি করিল।

এই কবিতাটি কোন্ সময়ের রচনা তাহা জানা নাই। ব্রাহ্মণদের অত্যাচারে সমাজের নিম্নশ্রেণীভুক্ত প্রাক্তন বৌদ্ধগণ মুসলমানদিগকেই হিন্দুর উপাস্য দেবতার স্থানে বসাইয়াছিল অর্থাৎ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করিয়াছিল উক্ত কবিতায় তাহাই প্রতিধ্বনিত হইয়াছে।

প্রথম যুগের তুর্কী সেনাগণ ও ধর্ম্মান্তরিত নিম্নশ্রেণীর হিন্দুদিগকে লইয়াই বাংলার মুসলমান সমাজ সর্বাগ্রে গঠিত হয়। কিন্তু ক্রমে ক্রমে বাহির হইতে উচ্চ শ্রেণীর মুসলমানও আসিয়া বাংলা দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করে। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মোঙ্গলরাজ চেঙ্গিস খাঁ সমগ্র মধ্য এশিয়ার তুর্কী মুসলমানদের রাজ্য এবং বোখারা, সমরখন্দ প্রভৃতি ইসলাম সংস্কৃতির প্রধান প্রধান কেন্দ্রগুলি ধ্বংস করেন। ইহার ফলে এই অঞ্চল হইতে গৃহহীন পলাতকেরা দলে দলে ভারতে তুর্কী মুসলমানদের রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করে। পরে তাহাদের অনেকে বাংলা দেশে বসতি স্থাপন করিল এবং বাংলার মুসলমান সুলতানগণ জ্ঞানী-গুণী মুসলমানদিগকে অর্থ ও সম্মান দিয়া নানা স্থানে প্রতিষ্ঠিত করিলেন। পরবর্তীকালে দিল্লিতে বিভিন্ন তুর্কী রাজবংশের উত্থান ও পতনের ফলে বিতাড়িত অনেক তুর্কী সম্ভ্রান্ত লোক বাংলায় আশ্রয় লইলেন। বাংলায় মুঘল রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হইলে অনেক সম্ভ্রান্ত মুসলমান রাজকর্মচারীরূপেও বাংলায় আসিতেন, ফলে বাংলার বাইরের ইসলাম সভ্যতার সহিত পরিচয় ঘনিষ্ঠ হইল। এইরূপে কালক্রমে বহু পণ্ডিত ও উচ্চশ্রেণীর মুসলমান বাংলায় আসিলেন এবং সংখ্যায় অল্প হইলেও ইঁহারা বাংলার মুসলমান সমাজে উচ্চতর শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রবর্তন করিলেন। আরবী ও ফার্সী সাহিত্যের উন্নতি হইল এবং ইসলাম ধর্ম্মেরও দ্রুত প্রসার হইতে লাগিল।

এই প্রসঙ্গে সুফী ও দরবেশ নামে পরিচিত একটি মুসলমান পীর বা ফকির সম্প্রদায়ের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য; কারণ প্রধানতঃ ইহাদের চেষ্টায়ই বাঙালী মুসলমানদের উন্নত ধর্মভাব ও সংখ্যা বৃদ্ধি সম্ভব হইয়াছিল। সুফীগণ মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া হইতে উত্তর ভারতবর্ষের মধ্য দিয়া বাংলায় আগমন করেন। খ্রষ্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীতে বাংলার সর্বত্র-শহরে ও গ্রামে-সুফীরা দুর্গা প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। ইঁহারা ইসলামীয় ধর্মশাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন এবং আধ্যাত্মিক সাধনায়ও উল্কর্ষ লাভ করিয়াছিলেন। প্রত্যেক সুফীরই বহু শিষ্য ছিল। ইঁহারা তাঁহাদিগকে ইসলামী শাস্ত্রে শিক্ষা ও আধ্যাত্মিক উন্নতি বিষয়ে দীক্ষা দিতেন। এই। শিষ্যেরাও আবার বড় হইয়া দর্গা প্রতিষ্ঠা করিয়া নূতন নূতন শিষ্যকে শিক্ষা-দীক্ষা দিতেন। রাজা প্রজা সকলেই সুফীদিগকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করিতেন। সুফীর দর্গা ও কবর পবিত্র বলিয়া গণ্য হইত। এই সব দর্গায় শিক্ষা-দীক্ষা ব্যতীত দরিদ্রের অন্নদান ও চিকিৎসা প্রভৃতির ব্যবস্থা ছিল।

অ-মুসলমানকে ইসলাম ধর্ম্মে দীক্ষিত করা মুসলমান শাস্ত্রমতে পুণ্য কার্য বলিয়া বিবেচিত হইত। সুফীগণ এই বিষয়ে অতিশয় তৎপর ছিলেন। সুফীদের মধ্যে অনেক পণ্ডিত ও সাধু ছিলেন এবং ধর্মনীতি অনুসরণ করিয়া জীবনযাপন করিতেন। তাঁহাদের উপদেশে ও দৃষ্টান্তে অনেক হিন্দু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করিত। মুসলমান আক্রমণের অব্যবহিত পূর্বে বাংলায় তান্ত্রিক ধর্ম্মের খুব প্রভাব ছিল। সাধারণ লোকে বিশ্বাস করি যে তান্ত্রিক সাধু বা গুরুর বহুবিধ অলৌকিক ক্ষমতা আছে। সুতরাং তাহাদিগকে অত্যন্ত ভক্তি শ্রদ্ধা করিত এবং তাঁহাদের বাসস্থান তীর্থক্ষেত্র বলিয়া গণ্য হইত। মুসলমানেরা বাংলা জয় করিবার পর অনেক সুফী দরবেশ ও পীর এই সব তান্ত্রিক সাধুকে স্থানচ্যুত করিয়া তাহাদের বাসস্থানেই দর্গা প্রতিষ্ঠা করিতেন : ক্ৰমে পীরগণও অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন বলিয়া খ্যাতি লাভ করিয়াছিলেন। লোকে মনে করিত পীরেরা ইচ্ছা করিলেই লোকের দুঃখ দুর্দশা মোচন করিতে পারেন, মৃত লোককে বাঁচাইতে পারেন আবার জীবন্ত মানুষকেও জাদুবলে মারিতে পারেন। একই সময়ে বিভিন্ন স্থানে থাকিতে পারেন এবং লোকের ভবিষ্যৎ বলিয়া দিতে পারেন। ফলে তান্ত্রিক সাধুর শিষ্যেরাও অনেকে স্থান মাহাত্মে এবং এইসব অলৌকিক ক্ষমতার খ্যাতিতে আকৃষ্ট হইয়া পীরের দর্গায় আসিত ও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করিত।

আবার পীর ও দরবেশ সুফীরা অনেক সময় হিন্দুরাজ্য জয় করিবার জন্য যুদ্ধও করিতেন। মুসলমানদের মধ্যে প্রবাদ আছে যে শাহ জালাল নামে এক সুফী দরবেশ তাঁহার পীর অর্থাৎ গুরুর আদেশে এবং উক্ত গুরুর ৭০০ শিষ্যসহ বহু যুদ্ধ করিয়া অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হিন্দুরাজ্য জয় করেন এবং সেখানে ইসলাম ধর্ম্মের প্রতিষ্ঠা করেন। পরিশেষে শ্রীহট্টের রাজাকে পরাজিত ও ঐ দেশ অধিকার করিয়া অনুচরগণসহ সেখানে বসবাস করেন। সম্ভবতঃ বাংলার সুলতানের সৈন্যদের সহায়তাই তিনি এই যুদ্ধে জয়লাভ করিয়াছিলেন। কোন কোন পীর সুলতান কর্ত্তৃক শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত হইয়াছিলেন এবং মুসলমান সেনাপতি হিন্দু রাজ্য জয় করিয়া পীর উপাধি এবং পীরের খ্যাতি ও সম্মান লাভ করিয়াছেন এরূপ ঐতিহাসিক দৃষ্টান্তও আছে। সুতরাং পীরেরা শস্ত্র ও শাস্ত্র দুইটিতেই সমান দক্ষ ছিলেন। ধর্মপ্রচার ও শস্ত্রচালনা এই দুই উপায়েই বাংলায় মুসলমান রাজ্য ও ইসলাম ধর্ম্মের বিস্তারে তাঁহারা সহায়তা করিতেন।

যে সকল নিম্নশ্রেণীর হিন্দুরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করিয়াছিল তাহারা আরবী জানিত না এবং যদিও কেহ কেহ সামান্য ফার্সি জানিত, তথাপি মুসলমান ধর্মশাস্ত্র সম্বন্ধে তাহাদের বিশেষ কোন জ্ঞানও ছিল না। ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত যে এই অবস্থা ছিল দুইজন মুসলমান লেখকের রচনা হইতে তাহা জানা যায়। একজন লিখিয়াছেন যে বাঙালী মুসলমানেরা না বোঝে আরবি, না বোঝে নিজের ধর্ম–গল্প কাহিনী প্রভৃতি লইয়াই তাহারা মত্ত থাকে। আর একজন মহাভারতের বাংলা অনুবাদ-সম্বন্ধে লিখিয়াছেন :

হিন্দু মোছলমান তাহা ঘরে ঘরে পড়ে।
খোদা রসুলের কথা কেহ না সোঙরে ॥ [স্মরণ করে]

তবে ইসলাম ধর্ম্মের যে পাঁচটি মূল তথ্য বা তত্ত্ব, তাঁহার মধ্যে প্রথম চারিটি–ইমান (ঈশ্বরে ও পয়গম্বরে বিশ্বাস), নমাজ, রোজা ও হজ (মক্কা প্রভৃতি তীর্থ দর্শন) বাঙালী মুসলমানেরাও যথারীতি পালন করত। পঞ্চম-জকাৎ অর্থাৎ নিজের আয়ের এক নির্দিষ্ট অংশ গরীব দুঃখীকে নিয়মিত দান–কতদূর প্রতিপালিত হইত তাহা বলা যায় না।

খাঁটি ইসলামের অতিরিক্ত এবং অননুমোদিত কতকগুলি সংস্কার ও প্রথা বাংলায় মুসলমান সমাজে প্রচলিত ছিল। কারণ নিম্নশ্রেণীর হিন্দুরা বহু সংখ্যায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করিলেও তাহাদের কোন কোন বিশ্বাস ও সংস্কার ছাড়িতে পারে নাই। সুতরাং তাহা ধীরে ধীরে মুসলমান সমাজে প্রবেশ করিয়াছে। ইহার কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিতেছি।

হিন্দুদের গুরুবাদ অর্থাৎ গুরুর প্রতি অবিচলিত শ্রদ্ধা ও ভক্তি মুসলমান পীরের প্রতি ভক্তিতে রূপান্তরিত হইয়াছিল ইহা পূর্বেই বলা হইয়াছে। কিন্তু ক্রমশঃ ইহা পঞ্চপীর-সত্যপীর, মাণিকপীর, ঘোড়াপীর, কুম্ভীরপীর, মদারী (মৎস্য ও কচ্ছপ) পীর–প্রভৃতির পূজায় পর্যবসিত হইল। বন্ধ্যার পুত্র লাভের জন্য নানা অনুষ্ঠান, কুম্ভীরের কৃপায় সন্তান লাভ হইলে প্রথম সন্তানটি কুম্ভীরকে দান, মদারীকে ভোজ্য দান, বৃক্ষে সূত্র বন্ধন ইত্যাদি নিম্নশ্রেণীর হিন্দুদের কুসংস্কার তাহাদের সঙ্গে সঙ্গে মুসলমান সমাজেও প্রবেশ করিল।

মোল্লা নামে আর একটি নূতন যাজকশ্রেণীর আবির্ভাবও উল্লেখযোগ্য। ইহারা হিন্দুদের পুরোহিতের মতন গ্রামবাসীর নিত্যনৈমিত্তিক ধর্ম্মানুষ্ঠান এবং বিবাহাদি ক্রিয়া অনুষ্ঠিত করিত। লোকের গলায় পুঁতি ঝুলাইয়া তাহাকে ভূতের উপদ্রব হইতে রক্ষা করিত এবং সঙ্গে সঙ্গে কসাইয়ের ব্যবসা অর্থাৎ মুরগী, বকরী ইত্যাদি জবাই করিত। এই সমুদয় হইতে যে অর্থলাভ হইত তাহাই ছিল তাহাদের উপজীব্য।

ষোড়শ শতাব্দীতে লিখিত কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে মোল্লার একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা আছে :

মোল্লা পড়ায়্যা নিকা    দান পায় সিকা সিকা
দোয়া করে কলমা পড়িয়া।
করে ধরি খর ছুরি     কুকুরা জবাই করি
দশ গণ্ডা দান পায় কড়ি ॥

পীরের ন্যায় মোল্লাও ইসলামের অননুমোদিত ধর্মযাজক এবং হিন্দু সমাজের গুরু পুরোহিতের অনুকরণ।

প্রাচীন মুসলমান সাধুসন্তদের ও পীরদের সমাধির প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং তাঁহাদের কৃপায় ব্যারাম-পীড়া হইতে আরোগ্যলাভ হইতে পারে এইরূপ বিশ্বাসও প্রচলিত ছিল। এরূপ বিশ্বাস ইসলাম ধর্ম্মের অননুমোদিত। অতএব ইহা সম্ভবতঃ হিন্দু সমাজের প্রভাব সূচিত করে। এইরূপ আরও অনেক কুসংস্কার মুসলমান সমাজে প্রচলিত ছিল।

হিন্দু সমাজে জাতিভেদের কিছু প্রভাবও মুসলমান সমাজে দেখা যায়। কারণ বাংলার মুসলমান সমাজে কয়েকটি বিশিষ্ট শ্রেণীর উদ্ভব হইয়াছিল। ইহাদের মধ্যে সৈয়দ (অর্থাৎ যাঁহারা হজরৎ মুহম্মদের বংশধর বলিয়া দাবি করেন), আলিম (পণ্ডিত ও শিক্ষাব্রতী), শেখ (পীর) ছিলেন উচ্চশ্রেণীভুক্ত এবং বিশেষ শ্রদ্ধা ও সম্মানের পাত্র। কাজীও উচ্চপদস্থ কর্মচারী এবং মোল্লারাও জনসাধারণ অপেক্ষা কিছু উচ্চস্তরের ছিল। ইহা ছাড়া তুর্কী, পাঠান, মোণল প্রভৃতিও বিভিন্ন শ্রেণী বলিয়া বিবেচিত হইত। কিন্তু এই শ্রেণীবিভাগ হিন্দুদের জাতিভেদের ন্যায় কঠোর ছিল না–ইহাদের মধ্যে পান ভোজনের বা স্পর্শদোষের বালাই ছিল না এবং বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে বিবাহাদিও একেবারে অপ্রচলিত ছিল না।

নিম্নশ্রেণীর মুসলমানের মধ্যেও বংশানুক্রমিক বৃত্তি অনুসারে অনেক শ্রেণী বিভাগ ছিল। কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে ইহাদের একটি সুদীর্ঘ তালিকা আছে। যথা গোলা, জোলা, মুকেরি [যাহারা বলদে করিয়া বিক্রেয় জিনিস নেয়], পিঠারি, কাবাড়ি [মৎস্য বিক্রেতা অথবা কসাই], সানাকার, হাজাম, তীরকর, কাগজী [যে কাগজ তৈরী করে], দরজি, বেনটা [যে বয়ন করে], রংরেজ [যে রং লাগায়], হালান ও কসাই।

কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে নূতন নগরপত্তনের যে বিস্তৃত বিবরণ আছে তাহা হইতে অনুমান করা যায় যে বড় বড় নগরে মুসলমানেরা একটি স্বতন্ত্র পাড়ায় বাস করিত। এই গ্রন্থের নিম্নলিখিত কয়েকটি পংক্তিতে ষোড়শ শতাব্দীতে মুসলমান সমাজের একটি মনোরম চিত্র পাওয়া যায় :

ফজর [প্রাতঃকাল] সময়ে উঠি        বিছায়ে লোহিত পাটী
পাঁচ বেরি [পাঁচবার] করয়ে নমাজ
ছোলেমানী মালা করে         জপে পীর পগম্বরে
পীরের মোকামে দেয় সঁজ ॥
দশ বিশ বেরাদরে         বসিয়া বিচার করে
অনুদিন কেতাব কোরাণ।
কেহ বা বসিয়া হাটে         পীরের শীরিণি বাঁটে
সাঁঝে বাজে দগড় [দামামা], নিশান ॥
বড়ই দানিসবন্দ [পণ্ডিত, ধার্মিক]         না জানে কপট ছন্দ
প্রাণ গেলে রোজা নাহি ছাড়ি।
যার দেখে খালি মাথা         তার সনে নাহি কথা
সারিয়া চেলার মারে বাড়ি ॥
ধরয়ে কম্বোজ বেশ         মাথাতে না রাখে কেশ
বুক আচ্ছাদিয়া রাখে দাড়ি।
না ছাড়ে আপন পথে         দশ রেখা টুপি মাথে
ইজার পরয়ে দৃঢ় দড়ি (করি?)।।
আপন টোপর নিয়া         বসিলা গাঁয়ের মিয়া
ভুঞ্জিয়া [আহার করিয়া] কাপড়ে মোছে হাত।

ষোড়শ শতকের প্রথম পাদে পর্তুগীজ বারবোসা বাংলা দেশের প্রধান একটি বন্দরের সম্ভ্রান্ত মুসলমানদের সম্বন্ধে লিখিয়াছেন, মুসলমানেরা পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা সাদা জোব্বা পরে–ইহার তলে লুঙ্গির মত কোমরে জড়ান কাপড় এবং উপরে কোমরে রেশমের কোমরবন্ধ হইতে রৌপ্যখচিত তরবারি ঝুলান থাকে। হাতে মণিমাণিক্যখচিত অনেকগুলি আংটি এবং মাথায় সূক্ষ্ম তুলার কাপড়ের টুপি। তাহারা খুব বিলাসী মেয়ে পুরুষ উভয়ই উৎকৃষ্ট খাদ্য ও মদ্যপানে অভ্যস্ত। প্রত্যেকের ৩/৪ বা ততোধিক স্ত্রী। তাহাদের পরণে মূল্যবান বস্ত্র ও অলঙ্কার কিন্তু তাহারা পর্দানসীন। নৃত্য গীত তাহাদের খুব প্রিয়। প্রত্যেকেরই অনেক ভৃত্য। সাধারণ লোকেরা খাটো কৃর্তা ও মাথায় পাগড়ী পরে। সকলেই জুতা ব্যবহার করে। ধনীদের জুতায় রেশম ও সোনার সুতার কাজ।

মুসলমানদের মধ্যে উচ্চশিক্ষা সাধারণতঃ ফার্সী ভাষার সাহায্যেই হইত। অনেকে আরবী ভাষারও চর্চ্চা করিতেন। বিদ্যাশিক্ষার জন্য মক্তব ও মাদ্রাসা ছিল। অনেক সুলতান এইরূপ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা করিতেন। সুফীদের দর্গাতেও শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। প্রাথমিক শিক্ষা বাংলা ভাষায় হইত। সাধারণতঃ বিদেশী ও স্বল্পসংখ্যক অভিজাত মুসলমান উর্দু ব্যবহার করিতেন তাছাড়া সকলেই বাংলা ভাষায় কথাবার্তা বলিত। মুসলমান সমাজে অবস্থাপন্ন লোকের ছেলে-মেয়েদের শিক্ষা সম্বন্ধে বিশেষ যত্ন নেওয়া হইত। মসজিদেও শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। সকলেই কোরাণ শরীফ পড়িত এবং অন্য এক বা একাধিক বিষয় শিখিত।

অনেক সময় অল্পবয়সেই ছেলেমেয়েদের বিবাহের সম্বন্ধ স্থির হইত কিন্তু বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার পূর্বে বিবাহ হইত না। বর ঘোড়ায় চড়িয়া শোভাযাত্রা করিয়া কনের বাড়ীতে যাইত–সেখানে কাজীর সামনে মোল্লা বিবাহ দিতেন। ধনীর বাড়ীতে ভোজ নৃত্যগীতাদি একাধিক দিন চলিত। বিবাহ সম্বন্ধে হিন্দুর অনেক লৌকিক আচার অনুষ্ঠান মুসলমান সমাজেও প্রচলিত ছিল।

ধনী পুরুষেরা বহু বিবাহ করিত এবং বিবাহবন্ধন ছেদও খুবই হইত। ধনীলোকের স্ত্রীদের সঙ্গে বহু দাসদাসী আসিত। পর্দার ব্যবস্থা খুব কড়া ছিল এবং বড়লোকের হারেমে খোঁজা প্রহরী নিযুক্ত হইত। নর্তকীর নৃত্য ও সঙ্গীত মুসলমান সমাজে খুবই আদৃত হইত।

স্মৃতিশাস্ত্র অনুমোদিত আদর্শ রক্ষণশীল হিন্দুধর্ম ও সমাজ

হিন্দু সংস্কৃতির দুইটি বিশেষত্ব আছে। প্রথমতঃ ইহা ধর্মকেন্দ্রিক-অর্থাৎ ধর্মকে কেন্দ্র করিয়াই ইহার সাহিত্য সমাজ শিল্প প্রভৃতি গড়িয়া উঠিয়াছে। দ্বিতীয়তঃ প্রাচীন যুগের সহিত যোগসূত্র রক্ষা। অর্থাৎ অতীতে যাহা ছিল তাহা সহসা বা সরাসরি অস্বীকার না করিয়া যথাসম্ভব তাঁহার সহিত অন্ততঃ বাহ্যিক একটি সামঞ্জস্য রক্ষার চেষ্টা। অল্পবিস্তর পরিবর্তন প্রতি সমাজেই যুগে যুগে ঘটে–উহা সমর্থনের জন্য শাস্ত্রবচন অগ্রাহ্য না করিয়া তাঁহার টীকা টিপ্পনী–অনেক সময় অসঙ্গত ব্যাখ্যাদ্বারা তাঁহার এরূপ অর্থ করা হইত যাহাতে পরিবর্তিত লোকমতের বা লৌকিক আচরণের সহিত সঙ্গতি রক্ষা হইতে পারে। এই জন্যই গুরুতর পরিবর্তন ঘটিলেও হিন্দুরা প্রাচীন স্মৃতির মর্যাদা রক্ষা করিয়া চলিয়াছে-অথচ সঙ্গে সঙ্গে নূতন নূতন টীকা রচনা করিয়া কালের অবশ্যম্ভাবী পরিবর্তনের সঙ্গে প্রাচীন শাস্ত্রের প্রতি বিশ্বাসের অভাব ঘটিতে দেয় নাই। সুতরাং মধ্যযুগে মনু, যাজ্ঞবল্ক্য প্রভৃতি প্রামাণিক স্মৃগ্রিন্থের নূতন নূতন টীকা হইয়াছে এবং স্মার্ত পণ্ডিতগণ নূতন নূতন নিবন্ধ লিখিয়া প্রতি অঞ্চলে যে সব নূতন প্রথা প্রচলিত হইয়াছে তাঁহার সহিত শাস্ত্রের সঙ্গতি রক্ষা করিবার চেষ্টা করিয়াছেন। ফলে একই স্মৃতির বিভিন্ন ব্যাখ্যা অথবা বিভিন্ন প্রদেশে বা বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন স্মৃতির নিবন্ধ প্রামাণিক বলিয়া গৃহীত হইয়াছে। বাংলা দেশেও মধ্যযুগে, শূলপাণি, রঘুনন্দন প্রভৃতি স্মার্ট পণ্ডিতগণ এই শ্রেণীর গ্রন্থ লিখিয়াছেন। সুতরাং বাংলার ধর্ম ও সমাজ মধ্যযুগে কি আদর্শে পরিচালিত হইত এই সমুদয় সংস্কৃত গ্রন্থ হইতে তাহা জানিতে পারা যায়। দুঃখের বিষয় বাংলাদেশের কয়েকজন বিখ্যাত নিবন্ধকারের জীবনকাল অদ্যাপি নিশ্চিতরূপে নির্ধারিত হয় নাই; তথাপি অধিকাংশ পণ্ডিতের মতে ১২০০ খ্রীষ্টাব্দ এবং উহার কিঞ্চিত পূর্ব বা পর হইতে যে সকল স্মৃতি ও অন্যান্য শাস্ত্রগ্রন্থ রচিত হইয়াছিল, ঐগুলি অবলম্বন করিয়া এবং সংশ্লিষ্ট অপরাপর বিষয়ক সংস্কৃত গ্রন্থাবলীর সাহায্যে মধ্যযুগে বঙ্গদেশের আদর্শ রক্ষণশীল সমাজের চিত্র অঙ্কন করিতেছি। স্মৃতি ও নিবন্ধ ভিন্ন বঙ্গদেশে রচিত বলিয়া অনুমিত বৃহদ্ধর্ম্মপুরাণ ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ [বাংলা দেশের ইতিহাস–প্রথম ভাগ-৩য় সংস্করণ, ১৭৬ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য] কৃষ্ণানন্দের তন্ত্রসার, প্রভৃতি গ্রন্থেও কিছু সামাজিক তথ্য আছে।

এখানে একটি কথা বলা আবশ্যক। স্মৃতি নিবন্ধাদিতে যে সকল বিধিনিষেধ। আছে, উহাদের কতটুকু প্রাচীনতর শাস্ত্রের প্রতিধ্বনিমাত্র এবং কতটুকু তদানীন্তন সমাজের প্রতিচ্ছবি তাহা নির্ণয় করা দুরূহ এবং প্রায় অসম্ভব বলিলেও অত্যুক্তি হয় না।

সুতরাং সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যে হিন্দুধর্ম ও সমাজের যে বাস্তব চিত্র প্রতিফলিত হইয়াছে তাহা পৃথকভাবে পরে আলোচিত হইবে।

১। ধর্মচর্যা : বাংলা দেশের স্মৃতিনিবন্ধগুলি হইতে মনে হয়, বাঙালীর জীবনে বার মাসেই পূজা পার্ব্বণ লাগিয়া থাকিত। লক্ষ্য করিবার বিষয় এই যে, বাংলা দেশে মধ্যযুগে বৈদিক যাগযজ্ঞাদির বিশেষ প্রচলন দেখা যায় না। সমাজে ব্রতানুষ্ঠানের ব্যাপক প্রচলন ছিল; এই ব্রত সংক্রান্ত আচার-আচরণে, বিশেষতঃ স্নানদানাদির ক্ষেত্রে পুরাণের যথেষ্ট প্রভাব দেখিতে পাওয়া যায়। বঙ্গীয় স্মৃতিনিবন্ধসমূহে, বিশেষতঃ শূলপাণি হইতে রঘুনন্দন ও গোবিন্দানন্দের কাল পর্যন্ত রচিত গ্রন্থগুলিতে, তন্ত্রের প্রগাঢ় প্রভাব দেখা যায়। বাংলা দেশের পূজাপার্ব্বণে তান্ত্রিক মন্ত্রের প্রয়োগ, তান্ত্রিক মণ্ডল, মুদ্রা, যন্ত্র প্রভৃতির ব্যবহার লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। জীবনে তান্ত্রিক দীক্ষার অপরিহার্যতাও এই দেশে স্বীকৃত হইয়াছিল।

সমাজে যে সকল সম্প্রদায়ের প্রভাব ছিল, তন্মধ্যে প্রধান শৈব, শাক্ত ও বৈষ্ণব। এই তিনটি প্রধান সম্প্রদায় ছাড়াও বাংলা দেশে সৌর, গাণপত্য, পাশুপত, পাঞ্চরাত্র, কাঁপালিক, কৌল প্রভৃতি বহু সম্প্রদায় বিদ্যমান ছিল। কোন কোন গ্রন্থে বৌদ্ধ, জৈন প্রভৃতি ধর্ম্মাবলম্বিগণেরও উল্লেখ আছে। চিরঞ্জীবের (১৭শ-১৮শ শতক) বিনোদতরঙ্গিণী’ নামক চম্পুকাব্য হইতে মনে হয়, কোন কোন স্থানে নিমন্ত্রণ উপলক্ষে সমবেত বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্ম সংক্রান্ত তর্ক বিতর্ক হইত। প্রত্যেক সম্প্রদায়েরই বিশিষ্ট আচার-আচরণ এবং স্বকীয় পূজাপার্ব্বণ পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। শাক্তগণের মধ্যে দেবী বা শক্তির পূজা প্রধান বলিয়া গণ্য হইত। দেবীপুরাণে শক্তিপূজার বিধান বিস্তৃতভাবে আলোচিত হইয়াছে। রঘুনন্দন এই পুরাণের প্রামাণিকত্ব স্বীকার করিয়াছেন। ‘বৃহদ্ধর্ম্মপুরাণ’, ‘দেবী-ভাগবত’, ‘মহাভাগবত পুরাণ’ প্রভৃতিতে শাক্তগণের ধর্মচর্যা সম্বন্ধে বহু তথ্য নিহিত আছে।

বাংলা দেশে প্রচলিত কালীপূজার প্রবর্তক ছিলেন ‘তন্ত্রসার’-প্রণেতা কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। এই দেশে প্রচলিত কালীমূর্ত্তির পরিকল্পনা করিয়াছিলেন কৃষ্ণানন্দ। উক্ত ‘বৃহদ্ধর্ম্মপুরাণে’ কালীর স্তুতিচ্ছলে (৩। ১৬। ৩৭-৪৫) তাঁহাকে ‘মঙ্গলচণ্ডিকা’ আখ্যায় অভিহিত করা হইয়াছে। দেবীভাগবতে’ও (৯। ১। ৮৩ ও ৯। ৪৭। ১ ৩৭ প্রভৃতিতে) দেবীর এক রূপ হিসাবে মঙ্গলচণ্ডীর প্রশস্তি ও পূজার উল্লেখ আছে। পরবর্তী বাংলা সাহিত্যে মঙ্গলচণ্ডী অবলম্বনে বহু আখ্যান উপাখ্যান রচিত হইয়াছিল এবং মঙ্গলচণ্ডীর পূজা অদ্যাবধি এই দেশে ব্যাপকভাবে প্রচলিত আছে।

সম্ভবতঃ এই দেশে রচিত ‘পদ্মপুরাণ’ এবং ‘ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে’ বৈষ্ণবগণের ধর্মকর্ম সম্বন্ধে বহু তথ্য পাওয়া যায়। গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণের নিকট রাধা কৃষ্ণের পূর্ণ শক্তি। কিন্তু, ইহাদের প্রধান উপজীব্য ‘ভাগবতপুরাণে’ রাধার স্পষ্ট উল্লেখ নাই। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে রাধাকে কৃষ্ণের বিলাসকলার কেন্দ্রগত রসস্বরূপ বলিয়া বর্ণনা করা হইয়াছে।

পূজাপার্ব্বণের মধ্যে বাংলা দেশে শারদীয়া পূজা বা দুর্গাপূজা সর্বাপেক্ষা প্রাধান্য লাভ করিয়াছিল। এই দুর্গাপূজার পদ্ধতি বৃহন্নন্দিকেশ্বর’ ও ‘নন্দিকেশ্বরপুরাণ’ দ্বারা প্রভাবিত। স্ব-গৃহ, জীর্ণস্থান, ইষ্টকরচিত স্থান ও দীপস্থিতিবিবর্জিত স্থান প্রভৃতিতে দুর্গাপূজা নিষিদ্ধ ‘স্বগৃহ’ শব্দের অর্থ বোধ হয় নিজের বাসের ঘর। শূলপাণির মতে, ইষ্টকরচিত স্থানে মৃত্তিকাবেদির উপরে দুর্গাপূজা হইতে পারে।

দুর্গার মূর্ত্তি হইবে দশভুজা এবং সিংহহাপরি স্থাপিতা। মূর্ত্তি সাধারণতঃ মৃন্ময়ী হইত। কিন্তু অন্য উপাদানের দ্বারাও উহা নির্মিত হইত বলিয়া মনে হয়; কারণ শূলপাণি বলিয়াছেন যে, মৃন্ময়ী প্রতিমাপক্ষে দেবীর স্নান দর্পণে বিধেয় এবং মূর্ত্তি স্নানযোগ্য হইলে স্নান প্রতিমাতেই করণীয়। সাত্ত্বিকী, রাজসী ও তামসী–এই ত্রিবিধ পূজাই বঙ্গীয় স্মৃতিকারগণের অনুমোদিত বলিয়া মনে হয়। সাত্ত্বিকী পূজায় থাকিবে জপ, যজ্ঞ ও নিরামিষ পূজোপকরণ। রাজসী পূজাতে পশুবলি হইবে এবং পূজোপকরণ হইবে আমিষ। তামসী পূজার ব্যবস্থা কিরাতগণের জন্য; এইরূপ পূজায় জপ, যজ্ঞ বা মন্ত্র নাই এবং পূজোপকরণ মদ্য মাংস প্রভৃতি।

‘কালিকাপুরাণের’ প্রমাণবলে শূলপাণি একপ্রকার সংক্ষিপ্ত দুর্গাপূজার ব্যবস্থা করিয়াছেন; এই ব্যবস্থানুসারে মাত্র পঞ্চোপকরণের দ্বারা দেবীপূজা হইতে পারে, যথা–পুষ্প, চন্দন, ধূপ, দীপ ও নৈবেদ্য। প্রতিকূল আর্থিক অবস্থাদি হেতু যে বহু দ্রব্যাদি দ্বারা পূজা করিতে অক্ষম, তাঁহার পক্ষে কেবল ফুল জল অথবা শুধু জলের দ্বারা পূজার বিধান আছে।

বাংলা দেশে প্রচলিত দুর্গাপূজা সংক্রান্ত আচার অনুষ্ঠানের মধ্যে শত্ৰুবলি এবং শবরোৎসব কৌতূহলোদ্দীপক। ‘দেবীপুরাণ’, ‘কালিকাপুরাণ’ প্রভৃতিতে শত্রুবলির উল্লেখ আছে। সাধারণতঃ মানকচুর পাতায় ঢাকা একটি পুতুলকে বলি দেওয়া হয়। প্রচলিত বিশ্বাস এই যে, ইহা দ্বারা একবৎসর পর্যন্ত শত্রুভয় হইতে মুক্ত থাকা যায়। ‘দুর্গোৎসববিবেক’, ‘দুর্গাপূজাতত্ত্ব’ প্রভৃতি নিবন্ধগুলিতে শত্ৰুবলির উল্লেখ নাই, কিন্তু পরবর্তী কালের বিদ্যাভূষণ ভট্টাচার্য নামক জনৈক অপ্রসিদ্ধ ব্যক্তি কর্ত্তৃক রচিত ‘দুর্গাপূজাপদ্ধতি’তে এই প্রথার উল্লেখ আছে। ইহা হইতে মনে হয়, এই প্রথা বাংলা দেশে কখনও বিলুপ্ত হয় নাই। শূলপাণি, রঘুনন্দন প্রভৃতি নিবন্ধকারগণ সম্ভবতঃ এই অনুষ্ঠানটিতে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন নাই।

বঙ্গীয় স্মৃতিনিবন্ধসমূহে বিবিধ দশমীকৃত্যের মধ্যে শবরোৎসবের ব্যবস্থা আছে। এই ব্যবস্থানুসারে জনগণ পরস্পরকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করিবে। যে এইরূপ গালাগালি অপরকে করিবে না এবং যাহাতে অপরে গালাগালি করিবে না, তাহারা উভয়েই দেবীর বিরাগভাজন হইবে। ‘শবরোৎসব’ শব্দটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে জীমূতবাহন বলিয়াছেন যে, ইহাতে শবরের ন্যায় সমস্ত শরীর পত্রাদি দ্বারা আবৃত ও কর্দমলিপ্ত করিয়া গীত ও বাদ্য করিতে হয়।

বঙ্গীয় স্মৃতিশাস্ত্রকারগণের মতে, বিভিন্ন মাসে নিম্নলিখিত ধর্ম্মানুষ্ঠান ও আচার প্রধান :

বৈশাখ–প্রাতঃস্নান, ব্রাহ্মণকে জলঘটদান, মসূরসহ নিষপত্র ভক্ষণ, বিষ্ণুকে শীতলজলে স্নান করান।

জ্যৈষ্ঠ–অরণ্যষষ্ঠী, সাবিত্রীব্রত ও দশহরা।

আষাঢ়–চাতুর্মাস্য ব্রত।

শ্রাবণ–মনসাপূজা।

ভাদ্র–জন্মাষ্টমীব্রত ও অনন্তব্রত।

আশ্বিন–দুর্গাপূজা, কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা।

কার্তিক–প্রাতঃস্নান, দীপান্বিতায় দিনে উপবাস ও পার্ব্বণশ্রাদ্ধ, সন্ধ্যায় পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে উল্কাদান প্রভৃতি; দূতপ্রতিপদ, ভ্রাতৃদ্বিতীয়া।

অগ্রহায়ণ–নবান্নশ্রাদ্ধ।

পৌষ–এই মাসে উল্লেখযোগ্য কোন অনুষ্ঠানের বিধান নাই।

মাঘ–রটম্ভীচতুর্দশী, শ্রীপঞ্চমীতে সরস্বতীপূজা, মাঘী সপ্তমীতে প্রাতঃস্নান ও সূর্যোপাসনা, বিধানসপ্তমীব্রত, আরোগ্যসপ্তমীব্রত, ভীষ্মষ্টমীতে ভীষ্মপূজা।

ফাল্গুন–শিবরাত্রিব্রত।

চৈত্র–শীতলাপূজা, বারুণীস্নান, অশোকাষ্টমী, রামনবমীব্রত, মদনত্রয়োদশী ও মদনচতুর্দশী তিথিতে পুত্রপৌত্রাদির সৌভাগ্য কামনায় এবং সমস্ত বিপথ হইতে ত্রাণলাভের আকাঙ্ক্ষায় মদনদেরের পূজা কর্তব্য। রঘুনন্দনের মতে, এই পূজায় মদনদেরের প্রীত্যর্থে অশ্লীল ভাষার প্রয়োগ বিধেয়।

বর্তমান প্রসঙ্গ শেষ করিবার পূর্বে কয়েকটি তান্ত্রিক অনুষ্ঠানের কথা বলা আবশ্যক। ‘তন্ত্রসারে’ শত্রুর অনিষ্টকল্পে বিদ্বেষণ, উচ্চাটন, অভিচার প্রভৃতি কতক অনুষ্ঠানপদ্ধতি লিপিবদ্ধ আছে। বশীকরণ পদ্ধতিও এই গ্রন্থে আলোচিত হইয়াছে। এই সকল অনুষ্ঠানে জনসাধারণের বিশ্বাস ও আচার-আচরণ প্রতিফলিত হইয়াছে।

শ্রাদ্ধ হিন্দুগণের একটি বিশেষ ধর্ম্মানুষ্ঠান। শ্রাদ্ধ বলিতে ঠিক কি বুঝায়, এই সম্বন্ধে বাঙালী স্মৃতিকারগণ প্রাচীন স্মৃতির বচনাদি আলোচনা করিয়া নিজস্ব সংজ্ঞা নির্দেশ করিয়াছেন। শূলপাণির মতে, সম্বোধন পদের দ্বারা আহূত উপস্থিত পিতৃপুরুষগণের উদ্দেশ্যে হবিত্যাগের নাম শ্রাদ্ধ। রঘুনন্দন বলিয়াছেন যে, বৈদিক প্রয়োগাধীন আত্মার উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধাপূর্বক অন্নাদি দানের নাম শ্রাদ্ধ। শ্রাদ্ধের উপযুক্ত স্থান ও সময়, শ্রাদ্ধকর্ত্তার পক্ষে বর্জনীয় কর্ম, শ্রাদ্ধে নিমন্ত্রণযোগ্য ব্যক্তি, শ্রাদ্ধে। দেয় অথবা বর্জনীয় খাদ্যদ্রব্য, শ্রাদ্ধের অধিকারী ব্যক্তি-ইত্যাদি বিষয়ে নিয়মাবলী স্মৃতিশাস্ত্রে বিস্তৃতভাবে লিখিত আছে।

২। নীতিবোধ : বঙ্গীয় স্মৃতিকারগণ বিবিধ ব্যসনকে তীব্রভাবে নিন্দা করিয়াছেন। অবৈধ যৌনসম্বন্ধের প্রতি তাঁহাদের দৃষ্টি সতর্ক। এইরূপ সম্বন্ধের মধ্যে গুর্বঙ্গনাগমন সর্বাপেক্ষা নিন্দিত। ‘গুর্বঙ্গনা’ শব্দের অর্থ, বাংলাদেশের স্মৃতিকারগণের মতে, মাতা। মাতার সপত্নী, ভগ্নী, আচাৰ্যকন্যা, আচাৰ্যানী এবং স্বীয় কন্যা প্রভৃতির সহিত যৌনসংসর্গও গুবঙ্গনাগমনের তুল্য। যে কোন লোকের পক্ষে নিঃসম্পর্কিত ব্যক্তির স্ত্রী, নিম্নতরবর্ণের স্ত্রীলোক, রজকপত্নী, রজস্বলা নারী ও গর্ভবতী নারীর সহিত সহবাস এবং ব্রহ্মচারীর পক্ষে যে কোন নারীর সহিত সহবাস প্রায়শ্চিত্তাহঁ; কিন্তু গুবঙ্গনাগমনজনিত পাপের তুলনায় ইহাদের সঙ্গে যৌনসম্পর্কের পাপ লঘুতর; গো প্রভৃতি ইতর প্রাণীর সহিত যোনিসম্পর্কও পাপজনক বলিয়া গণ্য হইয়াছে।

আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গীতে যাহা নীতিবিগর্হিত এমন কতক ব্যাপার এই দেশের স্মৃতিকারগণের সমর্থন লাভ করিয়াছিল বলিয়া মনে হয়। দাসী ও অবিবাহিতা নারীর সহিত যৌনসংযোগ অন্ততঃ শূদ্রের পক্ষে অবৈধ বিবেচিত হইত না বলিয়া মনে হয়; কারণ, ‘দায়ভাগে’ (৯।২৯) জীমূতবাহন শূদ্রের ঔরসে ও দাসীর অথবা অপর অবিবাহিতা নারীর গর্ভে জাত পুত্রের জন্য পিতার অনুমতিক্রমে পৈতৃক সম্পত্তির একটি ভাগের ব্যবস্থা করিয়াছেন। সুতরাং, দেখা যায় এইরূপ জারজ পুত্র সমাজে স্বীকৃত হইত।

প্রাচীন স্মৃতির অনুসরণে বঙ্গীয় স্মৃতিতেও বিবাহ-বন্ধন অত্যন্ত সুদৃঢ় বলিয়া বিবেচিত হইয়াছে। স্ত্রীর একমাত্র অসতীত্ব ভিন্ন অপর কোন কারণে পতি তাহাকে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করিতে পারিতেন না। স্ত্রী অপর কতক অপরাধে তিনি পতির সহাবস্থানে বঞ্চিত হইতেন বটে, কিন্তু গ্রাসাচ্ছাদনে বঞ্চিত হইতেন না।

দুর্গাপূজা প্রসঙ্গে শবরোৎসবের উল্লেখ পূর্বে করা হইয়াছে। অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি এই উৎসবের অঙ্গ। মনে হয়, ইহা অনার্য প্রভাবের একটি নিদর্শন।

জ্যেষ্ঠভ্রাতার পূর্বে কনিষ্ঠ ভ্রাতার বিবাহ বাঙালী স্মৃতিকারগণ গুরুতর অপরাধ বলিয়া গণ্য করিয়াছেন। এইরূপ বিবাহ এত পাপজনক যে, ইহার সঙ্গে সংযুক্ত সকলেই, এমন কি পুরোহিত পর্যন্ত, পতিত হইবেন। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা যদি পতিত বা বেশ্যাসক্ত, দুরারোগ্য ব্যাধিযুক্ত এবং মূক, অন্ধ, বধির প্রভৃতি না হন, তাহা হইলে তাঁহার অনুমতিক্রমে বিবাহ করিলেও কনিষ্ঠ ভ্রাতা অপরাধী হইবেন। বিধবা-বিবাহ ত দূরের কথা; একজনের উদ্দেশ্যে বাগদত্তা কন্যাও অপরের বিবাহের অযোগ্যা।

জ্যোষ্ঠা ভগ্নীর বিবাহের পূর্বে কনিষ্ঠার বিবাহও অত্যন্ত নিন্দনীয়।

৩। পাপ ও প্রায়শ্চিত্ত : পাপ দুই প্রকার–বিহিত কর্ম না করা এবং নিন্দিত কর্ম করা। পাপের ফলও দুই প্রকার–মৃত্যুর পর নরকে বাস অথবা জীবিত কালে পান, ভোজন ও বিবাহাদি ব্যাপারে সমাজে অচল হইয়া থাকা। ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত এই উভয়বিধ পাপের প্রায়শ্চিত্তের ফল সম্বন্ধে যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতি’র একটি বচন (৩।৫।২২৬) বিতর্কের সৃষ্টি করিয়াছে। বচনটি এই :

প্রায়শ্চিত্তৈরপৈত্যেনো যদজ্ঞানকৃতং ভবেৎ।
কামতো ব্যবহার্য বচনাদিহ জায়তে ॥

দ্বিতীয় পংক্তিতে ‘ব্যবহার্য’ পদের স্থলে ‘অব্যবহার্য’ পাঠ ধরিয়া শূলপাণি শ্লোকটির অর্থ করিয়াছেন যে, অজ্ঞানকৃত পাপ প্রায়শ্চিত্তের দ্বারা দূরীভূত হয়; কিন্তু জ্ঞানকৃত পাপ ইহা দ্বারা অপগত হইলেও পাপকর্মকারী সমাজে অব্যবহার্য থাকিবে।

প্রায়শ্চিত্ত শব্দটি প্রায়’ ও ‘চিত্ত’ এই দুইটি পদের দ্বারা গঠিত; ‘প্রায়’ অর্থাৎ তপ ও ‘চিত্ত’ বলিতে বুঝায় নিশ্চয়। অতএব প্রায়শ্চিত্ত শব্দে বুঝায় এমন তপশ্চর্যা যাহাদ্বারা পাপক্ষালন হইবে বলিয়া নিশ্চিতভাবে জানা যায়। প্রাচীন শাস্ত্রীয় প্রমাণমূলে রঘুনন্দন মনোজ্ঞ উপমার সাহায্যে প্রায়শ্চিত্তের ফল বুঝাইবার চেষ্টা করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন–

ক্ষার, উত্তাপ, প্রচণ্ড আঘাত ও প্রক্ষালনের ফলে যেমন মলিন বস্ত্র পরিষ্কৃত হয়, তেমন ভাবেই তপশ্চর্যা, দান ও যজ্ঞের দ্বারা পাপী পাপমুক্ত হয়।

পাপকারীর বয়স, বর্ণ, সে পুরুষ বা স্ত্রী ইত্যাদি বিচেনায় প্রায়শ্চিত্তের তারতম্য হয়।

ব্ৰহ্মহত্যা, সুরাপান, ভেয়, গুবঙ্গনাগমন এবং এই চতুর্বিধ পাপাঁচরণকারীর সহিত সংসর্গ-–এই পাঁচটি মহাপাতক বা গুরুতর পাপ বলিয়া স্বীকৃত হইয়াছে। দ্বিজবর্ণের কোন ব্যক্তি সজ্ঞানে সুরাপান করিলে মৃত্যুই তাঁহার প্রায়শ্চিত্ত; বিকল্প ব্যবস্থানুসারে চতুর্বিংশতিবার্ষিক ব্রত অনুষ্ঠেয়। ব্রাহ্মণ কর্ত্তৃক অজ্ঞানে সুরাপানের প্রায়শ্চিত্ত দ্বাদশবার্ষিক ব্রত; তাহা সম্ভবপর না হইলে ১৮০টি দুগ্ধবতী গাভী দান।

নরহত্যা প্রসঙ্গে বলা হইয়াছে যে, শুধু হত্যাকারীই দোষী নহে। নিম্নলিখিত ব্যক্তিগণও অপরাধী :

(১) অনুমন্তা–(ক) যে হত্যাকারীকে এই বলিয়া আশ্বাস দেয় যে, অপর যে ব্যক্তি বাধা দিলে হত্যা সম্ভবপর হইবে না তাহাকে সে রোধ করিবে। (খ) যে হত্যাকারীকে বিরত করিবার চেষ্টা করে না।

(২) অনুগ্রাহক–(ক) যে বধ্য ব্যক্তিকে অন্যমনস্ক করে। (খ) বধ্যব্যক্তির সাহায্যার্থে আগমনকারী ব্যক্তিকে যে বাধা দেয়।

(৩) নিমিত্তী–(ক) যৎকর্ত্তৃক ক্রোধোৎপাদন হেতু কোন ব্যক্তি স্বীয় প্রাণনাশে কৃতসঙ্কল্প হয়।

(৪) প্রযোজক–(ক) যে অনিচ্ছুক ব্যক্তিকে হত্যায় প্রবৃত্ত করে। (খ) হত্যায় প্রবৃত্ত ব্যক্তিকে যে উৎসাহ দেয়।

কোন ব্যক্তি কর্ত্তৃক সদুদ্দেশ্যে কৃত কর্মের ফলে কেহ নিহত হইলে ঐ ব্যক্তি নরহত্যার অপরাধে অপরাধী হয় না; অর্থাৎ হত্যা মাত্রই গুরুতর অপরাধ নহে, যদি তাহাতে হত্যার অভিসন্ধি না থাকে।

প্রায়শ্চিত্ত প্রসঙ্গে বঙ্গীয় স্মৃতিশাস্ত্রে তন্ত্রতা ও প্রসঙ্গ নামক দুইটি নীতি স্বীকৃত হইয়াছে। একই প্রকার পাপাঁচরণ পুনঃ পুনঃ করিয়া এবার মাত্র প্রায়শ্চিত্ত করিলেই পাপমুক্ত হওয়া যায়-এই নীতির নাম তন্ত্রতা। এক ব্যক্তি গুরুতর ও লঘুতর পাপ করিয়া গুরুতর পাপের প্রায়শ্চিত্ত করিলেই লঘুতর পাপ হইতেও মুক্ত হইবে-এই নীতির নাম প্রসঙ্গ।

পূর্বে বলা হইয়াছে যে, মহাপাতকীর সংসর্গেও মহাপাতক জন্মে। নিম্নলিখিতরূপ সংসর্গ পাপজনক :–

এক শয্যায় শয়ন, একাসনে উপবেশন, এক পংক্তিতে অবস্থান, ভাণ্ড বা পক্বান্নের মিশ্রণ, পাতকীর জন্য যজ্ঞসম্পাদন, অধ্যাপক, সহভোজন,

বৈবাহিক বা যৌনসম্পর্ক, ভাষণ, স্পর্শন সহযান ইত্যাদি। পাতকীর জন্য যজ্ঞসম্পাদন, পাতকীর সহিত বৈবাহিক বা যৌন সংসর্গ, পাতকীর উপনয়ন ও পাতকীর সহভোজন–এইরূপ সংসর্গ সদ্য পাতিত্যজনক। নিম্নলিখিতরূপ সংসর্গ একবৎসর কালের জন্য হইলে পাতিত্যজনক হয় :

পাতকীর সহিত এক পংক্তিতে ভোজন, একাসনে উপবেশন, এক শয্যায় শয়ন ও সহযান।

প্রাচীন স্মৃতির প্রমাণানুসারে বঙ্গীয় স্মৃতিতে অতিকৃচ্ছ, চান্দ্রায়ণ, তপ্তকৃচ্ছ, পরাক, প্রাজাপত্য, সান্তপন প্রভৃতি বিবিধ প্রায়শ্চিত্তমূলক ব্রতের ব্যবস্থা আছে। নানা কারণে এইরূপ ব্ৰতানুষ্ঠান সকলের পক্ষে সম্ভবপর নহে বলিয়া ধেনুসঙ্কলন বা ব্রতের পরিবর্তে ব্রাহ্মণকে ধেনুদানের ব্যবস্থা আছে; ব্রতভেদে দেয় ধেনুর সংখ্যা বিভিন্নরূপ।

৪। বর্ণাশ্রম-ব্যবস্থা : হিন্দুসমাজ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চতুর্বর্ণের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। এই চারিবর্ণের জন্যই বঙ্গীয় স্মৃতিনিবন্ধসমূহে বিধিনিষেধ লিপিবদ্ধ আছে। এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে লক্ষণীয় এই যে, জীবনের প্রতি পদক্ষেপেই ব্রাহ্মণবর্ণের প্রাধান্য স্থাপনের প্রয়াস স্মৃতিনিবন্ধগুলির পাতায় পাতায় রহিয়াছে। ব্রাহ্মণ উচ্চতম বর্ণ। কিন্তু অপর দুইটি দ্বিজবর্ণের, অর্থাৎ ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের তুলনায়ও শূদ্রের স্থান সমাজে অতিশয় হেয়।

শূদ্রের বেদপাঠের অধিকার নাই এবং বিভিন্ন সংস্কারের মধ্যে এক বিবাহ ভিন্ন অন্য কোন সংস্কারে শূদ্র অধিকারী নহে। অপর সকল বর্ণেরই স্বকীয় গোত্র আছে, কিন্তু শূদ্রের নিজস্ব কোন গোত্র নাই। উচ্চবর্ণের কোন ব্যক্তি কতক প্রকার হেয় কার্য করিলে শূদ্রবৎ পরিগণিত হইবেন। যেমন ঋতুমতী কন্যাকে বিবাহ করিলে তাঁহার পতি শূদ্রতুল্য বলিয়া পরিগণিত হইবেন; তাঁহার সহিত কথোপকথনও নিন্দনীয় হইবে। কয়েকটি মাত্র দ্রব্য ভিন্ন ক্ষুদ্র কর্ত্তৃক প্রস্তুত খাদ্যদ্রব্য ব্রাহ্মণের পক্ষে নিষিদ্ধ। বিনা জলে শূদ্রপক্ব এবং শূদ্র কর্ত্তৃক প্রস্তুত ক্ষীর ব্রাহ্মণ ভোজন করিতে পারেন। রঘুনন্দনের মতে, শূদ্র কর্ত্তৃক প্রস্তুত দধি ও শক্ত ব্রাহ্মণের ভক্ষ্য।

আইনকানুনের ক্ষেত্রেও ব্রাহ্মণগণের স্ববর্ণ-পক্ষপাতিত্ব এবং শূদ্রের প্রতি বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা পরিস্ফুট। রাজা স্বয়ং বিচারকার্য পরিদর্শন করিতে অক্ষম হইলে তিনি প্রতিনিধি নিযুক্ত করিবেন। শাস্ত্রীয় প্রমাণ উদ্ধার করিয়া বঘুনন্দন বলিয়াছেন যে, দুঃশীল’ হইলেও দ্বিজ এইরূপ প্রতিনিধি হইতে পারেন, কিন্তু শূদ্র ‘বিজিতেন্দ্রিয়’ হইলেও এই কাব্যের অযোগ্য।

বিচারে যখন দিব্য প্রমাণের প্রয়োজন হয়, তখন সর্বাপেক্ষা কষ্টকর দিব্যের ব্যবস্থা শূদ্রের জন্য এবং দ্বিজগণের পক্ষে অপেক্ষাকৃত সহজসাধ্য দিব্য প্রযোজ্য।

পুরাণ ও তন্ত্রের প্রভাবে বঙ্গীয় স্মৃতিকারগণ ধর্ম্মাচরণে স্ত্রীলোক এবং শূদ্রকে কিছু কিছু অধিকার দিয়াছেন। তান্ত্রিক দীক্ষালাভের অধিকার স্ত্রীলোক ও শূদ্র উভয়েরই আছে। দেবীপুরাণে’ চণ্ডাল, পুক্কস প্রভুতি অন্ত্যজ জাতিকে দেবীপূজার অধিকার দেওয়া হইয়াছে। দেবীপুরাণের মতে, দেবীপূজায় উচ্চতর নিগুণ ব্যক্তি অপেক্ষা গুণবান্ শূদ্রও শ্রেয়। বঙ্গীয় স্মৃতিকারগণ দুর্গাপূজায় শূদ্রের অধিকার স্বীকার করিয়াছেন। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য এই যে, বর্ণাশ্রমবহির্ভূত ম্লেচ্ছগণ হিন্দুর অপর কোন পূজাপার্ব্বণের অধিকারী না হইলেও দুর্গাপূজায় তাহাদিগকে অধিকার দেওয়া হইয়াছে।

চারিটি প্রধান বর্ণ ছাড়াও বাংলা দেশে বহু সঙ্কর বর্ণের বাস ছিল। খ্ৰীষ্টীয় এয়োদশ শতকের শেষভাগে বা তাঁহার কিঞ্চিৎ পরবর্তী কালে বাংলা দেশে রচিত বলিয়া বিবেচিত ‘বৃহদ্ধর্ম্মপুরাণে’ (৩১৩) ছত্রিশটি সঙ্কর বর্ণ বা মিশ্র জাতির উল্লেখ আছে। [বাংলা দেশের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড (তৃতীয় সং) ১৭৬ পৃ.]

ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস চতুরাশ্রম, এই ক্রমই বঙ্গীয় স্মৃগ্রিন্থসমূহে স্বীকৃত হইয়াছে। কোন একটি আশ্রমে মানুষকে থাকিতে হইবে, কারণ অনাশ্রমী ব্যক্তি অনেক ধর্মকার্যাদি করিবার অযোগ্য। এই প্রসঙ্গে রঘুনন্দনের একটি বিধান উল্লেখযোগ্য। গৃহিণীই গৃহ; সুতরাং, বিবাহের দ্বারা গার্হস্থ্যাশ্রমে প্রবেশ লাভ করা যায়। তাহা হইলে দেখা যায়, বিপত্নীক ব্যক্তি গার্হস্থ্যাশ্রমচ্যুত হয়। কিন্তু, পরিণত বয়সে কেহ বিপত্নীক হইলে তিনি বিবাহ করিতে পারিবেন না; ফলে আমরণ তাঁহাকে অনাশ্রমী থাকিতে হইবে। এই সমস্যার সমাধানকল্পে রঘুনন্দন শাস্ত্রীয় প্রমাণবলে বিধান করিয়াছেন যে, আটচল্লিশ বৎসর বয়ঃক্রমের পরে কেহ বিপত্নীক হইলে তাহাকে বলা হইবে ‘রাশ্রমী। অতএব তিনি অনাশ্রমী বলিয়া পরিগণিত হইবেন না এবং গৃহস্থের কর্তব্যে তিনি অধিকারী হইবেন। এই ব্যবস্থা হইতে মনে হয়, উক্ত বয়সের পরে বিপত্নীক ব্যক্তির বিবাহ তাঁহার অনুমোদিত ছিল না।

৫। নারীর স্থান : বৈদিক যুগে শাস্ত্রাদির চর্চ্চা এবং ধর্ম্মানুষ্ঠান প্রভৃতি কিছুতেই নারীর অধিকার পুরুষের তুলনায় কম ছিল বলিয়া মনে হয় না। বেদে বহু ব্রহ্মবাদিনী স্ত্রী-ঋষির নাম ও তাঁহাদের নামাঙ্কিত সূক্তাদি পাওয়া যায়। উপনিষদেও বিদুষী মহিলাগণ পুরুষগণের সঙ্গে শাস্ত্রীয় বিচারাদিতে অংশ গ্রহণ করিতেন বলিয়া জানা যায়। পরবর্তীকালে কিন্তু এই সকল ব্যাপারে স্ত্রীলোকের অধিকার সম্বন্ধে বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা সহজেই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। স্মৃতিশাস্ত্রের প্রামাণ্য গ্রন্থ ‘মনুসংহিতা’তেই বলা হইয়াছে যে, নারীর পৃথকভাবে করণীয় কোন যাগযজ্ঞ ব্রত উপবাসাদি কিছুই নাই; একমাত্র পতিসেবাই তাঁহার পরম ধর্ম এবং পতি ভিন্ন। তাঁহার যেন কোন সত্তাই নাই। পুরাণগুলিতে আবার অধিকাংশ ব্রতানুষ্ঠানে স্ত্রীলোকেরই অধিকার ঘোষণা করা হইয়াছে; ইহার যথেষ্ট ঐতিহাসিক কারণও বিদ্যমান।

অন্যান্য প্রদেশের স্মৃতিনিবন্ধগুলির ন্যায় বঙ্গীয় স্মৃতিগ্রন্থসমূহেও একদিকে যেমন আছে প্রাচীন স্মৃতির প্রভাব, অপরদিকে তেমনই রহিয়াছে পুরাণের প্রভাব। সুতরাং ব্ৰতাদি ব্যতীত অন্যপ্রকার ধর্ম্মানুষ্ঠানে স্মৃতিনিবন্ধকার স্ত্রীলোককে অধিকার দিয়াছেন বলিয়া মনে হয় না। ব্ৰতাদিতে পতির অনুমতিক্রমে নারীর অধিকার বঙ্গীয় স্মৃতিশাস্ত্রে স্বীকৃত হইয়াছে।

তান্ত্রিক দীক্ষায় কিন্তু বাঙালী শাস্ত্রকার স্ত্রীলোকের অধিকার স্বীকার করিয়াছেন। বাংলাদেশে কুমারীপূজার প্রথা এখনও প্রচলিত আছে। ইহা তান্ত্রিক প্রথা। তন্ত্রসারে কৃষ্ণানন্দ প্রমাণবলে বলিয়াছেন যে, কুমারীপূজা ব্যতিরেকে হোমাদির সম্পূর্ণ ফল পাওয়া যায় না। এক বৎসর হইতে ষোড়শবর্ষ পর্যন্ত বয়স্কা কুমারী পূজিতা হইতে পারে। মহাপদিনে, বিশেষতঃ মহানবমী তিথিতে, কুমারীপূজা অবশ্যকর্তব্য। দেবীপুরাণের মতে, কুমারী কন্যা স্বয়ং দেবীর মূর্ত প্রতীক; সুতরাং, দেবীপূজায় কুমারী পূজা অবশ্যকরণীয়। এই পুরাণে নারী মাত্রেই সবিশেষ শ্রদ্ধার পাত্র।

নারীর প্রতি সমাজের যে চিরন্তন শ্রদ্ধা ও অনুকম্পা, বঙ্গীয় স্মৃতিশাস্ত্রে তাঁহার ব্যতিক্রম দেখা যায় না। একই অপরাধের জন্য পুরুষ অপেক্ষা নারীর লঘুতর দণ্ডের বিধান দেখা যায়। পাপক্ষয়জনক প্রায়শ্চিত্তও স্ত্রীলোকের পক্ষে লঘুতর।

বঙ্গীয় স্মৃতিশাস্ত্রনিবন্ধে রজোদর্শনের পূর্বেই কন্যার বিবাহ অবশ্যকরণীয় বলিয়া নির্দেশ আছে; রজোদর্শনের পরে কন্যার পিত্রালয়ে বাস অতিশয় পাপজনক বলিয়া নিন্দিত হইয়াছে। কিন্তু, ইহাও বলা হইয়াছে যে অপাত্রে বিবাহ অপেক্ষা কন্যার আমরণ পিত্রালয়ে বাসও শ্রেয়। সাধারণতঃ জ্যেষ্ঠা কন্যার পূর্বে কনিষ্ঠা কন্যার বিবাহ তীব্রভাবে নিন্দিত হইয়াছে। কিন্তু রঘুনন্দন স্পষ্টই বলিয়াছেন যে, কুরূপত্বাদি হেতু জ্যেষ্ঠা কন্যার বিবাহে বিলম্ব হইলে কনিষ্ঠার বিবাহে কোন দোষ নাই।

প্রাচীন স্মৃতির প্রমাণ অনুসরণে জীমূতবাহন ‘আধিবেদনিক’ নামক একপ্রকার স্ত্রীধনের ব্যবস্থা করিয়াছেন। পতি অপর পত্নী গ্রহণ করিলে পূর্ব পত্নীকে যে অর্থাদি অবশ্যদান করিবেন উহার নাম ‘আধিবেদনিক’। জীমূতবাহনের পরবর্তী কোন বাঙালী স্মৃতিনিবন্ধকার এই শ্রেণীর স্ত্রীধনের উল্লেখ করেন নাই। অধিকাংশ বাঙালী নিবন্ধকার বল্লালসেনের (খ্রীষ্টীয় ১২শ শতক) পরবর্তী। বল্লাল-প্রবর্তিত কৌলীন্যপ্রথার প্রবর্তনের ফলে সমাজে কুলীনগণ যে মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিলেন, তাঁহার জন্য একজন কুলীননন্দন অপদার্থ হইলেও বহু স্ত্রী বিবাহ করিতেন। বহু বিবাহ এত ব্যাপক হইয়া পড়িয়াছিল বলিয়াই বোধ হয় ‘আধিবেদনিক’-এর প্রচলন লুপ্ত হইয়াছিল এবং নিবন্ধকারগণও ইহার বিধান করেন নাই।

প্রাচীন স্মৃতির ন্যায় বঙ্গীয় স্মৃতিশাস্ত্রেও অনেক ক্ষেত্রেই পতি হইতে পত্নীর পৃথক সত্তা স্বীকৃত হয় নাই। পতির সহিত বিবাহ-জনিত সম্বন্ধ ব্যতিরেকে স্থাবর সম্পত্তিতে স্ত্রীলোকের কোন অধিকার নাই। উত্তরাধিকারসূত্রে পতির সম্পত্তিতে স্ত্রীর যখন অধিকার জন্মে, তখনও তিনি মাত্র ভোগের অধিকারিণী; ঐ সম্পত্তিতে তাঁহার দান বিক্রয় করিবার অধিকার থাকে না। বিশিষ্ট কতক প্রকার স্ত্রীধনে স্ত্রীলোকের সম্পূর্ণ স্বত্ব স্বীকৃত হইয়াছে।

কোন কন্যা যদি বিবাহের পূর্বেই পিতৃহীন হন, তাহা হইলে তাহাকে বিবাহ দেওয়ার দায়িত্ব তাঁহার ভ্রাতার। এইরূপ ক্ষেত্রে, প্রাচীন স্মৃতি অনুসারে, ভ্রাতা বা ভ্রাতৃগণ ‘তুরীয়ক অংশ’ দান করিয়া বিবাহের ব্যয়ভার বহন করিবেন। যাজ্ঞবল্ক্যর টীকাকার বিজ্ঞানেশ্বরের মতে তুরীয়ক’ শব্দের অর্থ কন্যা পুত্র হইলে পৈতৃক সম্পত্তির যে অংশ লাভ করিতেন তাঁহার চতুর্থাংশ। ‘তুরীয়’-পদের আভিধানিক অর্থও এক-চতুর্থাংশ। জীমূতবাহন ও রঘুনন্দন ‘তুরীয়ক’ পদের অর্থ করিয়াছেন বিবাহোচিত দ্রব্যাদি; ইহা হইতে মনে হয়, বাঙালী স্মার্ত পৈতৃক সম্পত্তিতে কন্যার কোন প্রকার অংশের কল্পনা করিতেও কুণ্ঠিত।

স্বামীর নিকট হইতে পৃথক অবস্থান, ঘুরিয়া বেড়ান, অসময়ের নিদ্রা, অপরের গৃহে বাস প্রভৃতি স্ত্রীলোকের পক্ষে অতিশয় নিন্দনীয়। পতি বিদেশে থাকিলে নারী তাঁহার মঙ্গল প্রার্থনা করিবেন এবং অতিরিক্ত সাজসজ্জা বর্জন করিবেন; কিন্তু সম্পূর্ণরূপে অসজ্জিতা থাকিবেন না, কারণ ঐরূপ অবস্থায় থাকিলে তাহাকে বিধবার ন্যায় মনে হইবে।

স্ত্রীলোকের স্বাতন্ত্র নাই–মনুর এই নির্দেশ অনুসারে স্মৃতিকারগণ যে শুধু ইহলোকে নারীর পতি হইতে স্বাতন্ত্র্য অস্বীকার করিয়াছেন, তাহা নহে, পরলোকেও পতি পত্নীর আত্মার স্বতন্ত্র সত্তা স্বীকার করিতে তাঁহারা কুণ্ঠিত। প্রমাণবলে বঙ্গীয় স্মার্তগণ ব্যবস্থা করিয়াছেন যে, স্ত্রীলোকের মৃত্যুতিথি ভিন্ন অন্য সময়ে তদীয় আত্মার উদ্দেশ্যে পৃথক্‌ পিণ্ডদান বিধেয় নহে। মৃত্যুতিথি ভিন্ন অন্য সময়ে নিজ নিজ পতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত পিণ্ড হইতেই তাঁহারা স্বীয় অংশ গ্রহণ করিবেন।

বঙ্গীয় স্মৃতিনিবন্ধকারগণের মধ্যে রঘুনন্দনপূর্বযুগের শূলপাণি ও শ্রীনাথ ‘ভ্রাতৃমতী’ কন্যাকে বিবাহ করিতে বলিয়াছেন; ইহার তাৎপর্য এই যে, কন্যা ভ্রাতুমতী হইলে তাঁহার পুত্রিকাপুত্র হইবার আশঙ্কা থাকে না। ‘পুত্রিকাপুত্র’ শব্দটির অর্থ দ্বিবিধ। একটি অর্থে, যে পুত্রিকা সেই পুত্র; অর্থাৎ পুত্রহীন ব্যক্তি কন্যাকেই স্বীয় পুত্ররূপে মনোনীত করিতে পারেন। অপর অর্থে, তিনি সঙ্কল্প করিতে পারেন যে, কন্যার গর্ভে যে পুত্রসন্তান জন্মিবে সে-ই তাঁহার পুত্রস্বরূপ হইবে। মনে হয়, শূলপাণি শ্রীনাথের যুগেও বাংলা দেশে পুত্রিকাপুত্রের প্রচলন ছিল। ইহাদের মতে, পুত্রিকাপুত্রত্বের আশঙ্কা না থাকিলে ভ্রাতৃহীনা কন্যা বিবাহযোগ্যা।

প্রাচীন স্মৃতির অনুসরণক্রমে বঙ্গীয় স্মার্তগণ পৌনর্ভবা কন্যাকে বিবাহের বর্জনীয়া বলিয়া ব্যবস্থা করিয়াছেন। নিম্নলিখিত সাত প্রকার কন্যা পৌনর্ভবা বলিয়া অভিহিত–(১) বাগদত্তা, (২) মনোদত্তা, (৩) কৃতকৌতুকমঙ্গলা, (৪) উদকস্পর্শিতা, (৫) পাণিগৃহীতা, (৬) অগ্নিপরিগতা, (৭) পুনর্ভূভবা। এই বিধান হইতে দেখা যায়, বিধবা ত দূরের কথা, একজনের উদ্দেশ্যে বাগদত্তা কন্যাও অপরের পক্ষে বিবাহের অযোগ্য।

বঙ্গীয় স্মৃতিকারগণের মতে, স্ত্রীর কয়েকটি গুরুতর অপরাধ ছাড়া তাঁহার সঙ্গে স্বামীর সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছেদ হয় না। সগোত্রা কন্যার বিবাহ তীব্রভাবে নিন্দিত হইয়াছে। অজ্ঞতাবশতঃ সগোত্রা কন্যাকে বিবাহ করিলে তাঁহার উপর স্বামীর দাম্পত্যাধিকার থাকিবে না। সজ্ঞানে এইরূপ বিবাহের জন্য পত্নীর বর্জন ও চান্দ্রায়ণ প্রায়শ্চিত্ত বিধেয়; কিন্তু এই সকল ক্ষেত্রেই স্ত্রীর ভরণপোষণ স্বামীর অবশ্যকর্তব্য; সুতরাং বিবাহবন্ধন সম্পূর্ণরূপে ছিন্ন হয় না। নিম্নতর বর্ণের ব্যক্তির সহিত সহবাসের ফলে স্ত্রীর গর্ভোৎপত্তি, শিষ্য বা পুত্রের সহিত সহবাস হেতু স্ত্রীর গর্ভোৎপত্তি, স্ত্রীর অন্যবিধ হীন ব্যসনে আসক্তি বা তৎকর্ত্তৃক ধননাশ–এই কয়েকটি ক্ষেত্রে বিবাহবন্ধনের সম্পূর্ণ ছেদন বঙ্গীয় স্মার্তগণের অনুমোদিত বলিয়া মনে হয়। প্রথমোক্ত অপরাধের জন্য স্ত্রী পরিত্যাজ্যা, এমন কি বধ্যাও। উক্তরূপ সহবাসাদির ফলে স্ত্রী যতক্ষণ গর্ভবতী না হইবেন, ততক্ষণ তিনি প্রায়শ্চিত্ত দ্বারা দোষমুক্ত হইতে পারেন। ব্যভিচারিণী পত্নীর ভরণপোষণের কোন ব্যবস্থা দেখা যায় না। ইহা হইতে মনে হয়, স্ত্রীর ব্যভিচারই একমাত্র অপরাধ যাহার ফলে সম্পূর্ণরূপে বিবাহ-বিচ্ছেদ সম্ভবপর।

৬। খাদ্য ও পানীয় : বঙ্গদেশের যে সকল স্মৃতিনিবন্ধ প্রায়শ্চিত্তবিষয়ক, উহাদের মধ্যে নিষিদ্ধ খাদ্য ও পানীয় সম্বন্ধে বহু তথ্য পাওয়া যায়। শাস্ত্রীয় প্রমাণবলে শূলপাণি নিষিদ্ধ খাদ্যদ্রব্যগুলিকে নিম্নলিখিত শ্রেণীভুক্ত করিয়াছেন;–

(১) জাতিদুষ্ট–স্বভাবতঃ অপকারী; যথা–রসুন, পেঁয়াজ প্রভৃতি।

(২) ক্রিয়াদুষ্ট-–পতিত ব্যক্তির স্পর্শ প্রভৃতি কোন কারণে দূষিত।

(৩) কালদূষিত–পর্যুষিত।

(৪) আশ্রয়দূষিত–ইহার অর্থ স্পষ্ট নহে। মনে হয় ইহা মন্দ আশ্রয় বা পাত্রে রক্ষণ হেতু দূষিত বস্তুকে বুঝায়।

(৫) সংসর্গদুষ্ট–সুরা, রসুন, প্রভৃতি নিষিদ্ধ দ্রব্যের সংসর্গে দূষিত।

(৬) শহৃল্লেখ–বিষ্ঠাতুল্য; যে পদার্থের দর্শনে মনে ঘৃণার উদ্রেক হয়।

‘বৃহদ্ধর্ম্মপুরাণে’ (৩।৫।৪৪-৪৬) অমাবস্যা, পূর্ণিমা, চতুর্দশী, অষ্টমী, দ্বাদশী তিথি, রবিবার এবং রবিসংক্রান্তি ভিন্ন অন্যান্য দিনে মৎস্যভক্ষণের বিধান আছে। এই পুরাণের মতে, রোহিত, শকুল, শফরাদি মৎস্য এবং শুক্লবর্ণ সশল্ক মৎস্য ব্রাহ্মণের ভক্ষ্য।

সিদ্ধ চাউল, মুসুরির ডাল ও মৎস্য ভক্ষণ অন্যান্য প্রদেশের ব্রাহ্মণদের পক্ষে নিষিদ্ধ হইলেও স্মার্ত রঘুনন্দন এইগুলি অনুমোদন করিয়াছেন। হিন্দু যুগে ভবদেব ভট্টও ব্রাহ্মণদের মাছ মাংস খাওয়া সমর্থন করিয়াছেন। [বাংলা দেশের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড (তৃতীয় সং) ১৯৪ পৃ.]

বাংলা দেশের স্মৃতিশাস্ত্রে সুরাপান তীব্রভাবে নিষিদ্ধ হইয়াছে। ইহা পঞ্চবিধ মহাপাতকের অন্যতম। পৈষ্টী, গৌড়ী ও মাধ্বী–এই ত্রিবিধ মদ্য সুরা নামে অভিহিত। এই তিন প্রকার সুরা যথাক্রমে, অন্ন, গুড় এবং মধু হইতে জাত। সুরা শব্দের মুখ্যার্থ পৈষ্টী সুরা; ইহা পান করিলে দ্বিজগণের মহাপাতক হয়। অপর দ্বিবিধ সুরা শুধু ব্রাহ্মণের পক্ষে নিষিদ্ধ, অপর দুই দ্বিজবর্ণের পক্ষে নহে। সুরাপান সংক্রান্ত ব্যবস্থা হইতে মনে হয় সমাজে ইহা বহুল পরিমাণে প্রচলিত ছিল। ‘পান’ শব্দের অর্থ, শূলপাণির মতে, ‘কণ্ঠদেশাদধোনয়নম্‌’ অর্থাৎ গলাধঃকরণ; সুতরাং সুরার স্পর্শে, এমন কি মুখে লইয়া গিলিয়া না ফেলা পর্যন্ত, কোন পাতকের সম্ভাবনা ছিল বলিয়া মনে হয় না।

৭। বিবিধ আচার অনুষ্ঠান : প্রাচীন স্মৃতিতে বহুসংখ্যক সংস্কারের উল্লেখ আছে। মধ্যযুগে ঠিক কয়টি সংস্কার সমাজে প্রচলিত ছিল, তাহা বলা কঠিন। হলায়ুধের ‘ব্রাহ্মণসর্বস্ব’ নামক গ্রন্থে একটি তালিকায় নিম্নলিখিত দশটি সংস্কারের উল্লেখ আছে :

গর্ভাধান, পুংসবন, সীমন্তোন্নয়ন, জাতকর্ম, নামকরণ, নিষ্ক্রমণ, অন্নপ্রাশন চূড়াকরণ, উপনয়ন ও বিবাহ। এই তালিকায় রঘুনন্দন যোগ করিয়াছেন সীমন্তে নিয়নের পরে শোষ্যন্তীহোম এবং উপনয়নের পরে সমাবর্তন। হলায়ূধও এই দুইটির উল্লেখ করিয়াছেন; কিন্তু উক্ত তালিকার অন্তর্ভুক্ত করেন নাই। ইহা হইতে মনে হয়, এই দুইটি সংস্কারকে তেমন প্রাধান্য দেওয়া হইত না।

বিবাহ সম্বন্ধে কয়েকটি বিধিনিষেধ এইরূপ। সাধারণতঃ অশৌচ ধর্ম্মানুষ্ঠানের প্রতিবন্ধক। কিন্তু, বিবাহ আরব্ধ হইবার পরে অশৌচ কোন বাধা সৃষ্টি করিতে পারে না। মলমাসে ধর্মকার্য নিষিদ্ধ। কিন্তু, বিবাহারম্ভের পরে মলমাস বিবাহের অন্তরায় হইতে পারে না। রঘুনন্দন বলিয়াছেন, বিবাহারম্ভের পরে কন্যার রজোদর্শন হইলে বিবাহ পণ্ড হয় না। নান্দীমুখী বা বৃদ্ধিশ্রাদ্ধের দ্বারা বিবাহানুষ্ঠানের সূচনা হয়।

ক্ষুত বা হাঁচি সাধারণতঃ অশুভসুচক বলিয়া বিবেচিত হইলেও বিবাহে ইহা শুভসূচক। বিবাহে যন্ত্রসঙ্গীত ও স্ত্রীলোকের কণ্ঠসঙ্গীত এবং উলুধ্বনি শুভসূচক।

বিবাহস্থলে একটি গাভী বাঁধা থাকিবে। অহণান্তে বর পূর্বনিযুক্ত একজন নাপিতের অনুরোধে উহাকে মুক্ত করিবেন।

যদিও দানমাত্রেই দাতা বসিবেন পূর্বমুখ হইয়া এবং গ্রহীতা হইবেন উত্তরমুখ, তথাপি বিবাহে এই নিয়মের ব্যতিক্রম হয়। ব্যতিক্রম শব্দের অর্থ কেহ কেহ করিয়াছেন এই যে, দাতা হইবেন উত্তরমুখ এবং গ্রহীতা পূর্বমুখ। রঘুনন্দনের মতে, দাতা পশ্চিমমুখ হইবেন।

বিবাহানুষ্ঠানের অঙ্গস্বরূপ রঘুনন্দন জমুলমালিকা বা মুখচন্দ্রিকার উল্লেখ করিয়াছেন। প্রমাণ উদ্ধৃত করিয়া রঘুনন্দন বলিয়াছেন যে, জমুলমালিকা শব্দে বুঝায় সেই প্রথা যাহাতে বর ও কন্যাকে পরস্পরের সম্মুখীন করিয়া তাহাদিগকে পুস্পমাল্যে ভূষিত করা হয়। ইহা হইতে মনে হয়, জম্বুলমালিকা শব্দটি প্রথমে মালা বুঝাইলেও পরে যাহাতে ঐ মালা ব্যবহৃত হইত সেই অনুষ্ঠানকেই বুঝাইত।

বিবাহ সংক্রান্ত সকল অনুষ্ঠান সম্পন্ন হইলে দম্পতি অক্ষারলবণ ভোজ্যদ্রব্য গ্রহণ করিয়া ব্রহ্মচর্য অবলম্বনপূর্বক তিন রাত্রি একত্র হইয়া ভূমিতে শয়ন করিবেন। পারিভাষিক ‘অক্ষারলবণ’ শব্দে নিম্নলিখিত দ্রব্যসমূহকে বুঝায়–গাভীদুগ্ধ, গোদুগ্ধজাত ঘৃত, ধান্য, মুদ্র, তিল, যব, সামুদ্র ও সন্ধব লবণ।

বিবাহের পরে পিত্রালয় হইতে শ্বশুরালয়ে পৌঁছিয়া কন্যা সেইদিন সেখানে অনুগ্রহণ করিবে না। বিবাহিত কন্যার পুত্র না হওয়া পর্যন্ত কন্যার পিতা কন্যাগৃহে আহার করিবেন না।

বঙ্গীয় স্মৃতিশাস্ত্রে বহু ব্রতের বিধান আছে। ব্রতের সংজ্ঞা নির্দেশ করিতে গিয়া শূলপাণি বলিয়াছেন যে, যাহার মূলে আছে সঙ্কল্প এবং যাহা দীর্ঘকালানুপালনীয়’ তাহা ব্রত। জ্ঞাতিগণের জাতশৌচ ও মৃতাশৌচ ধর্মকার্যের প্রতিবন্ধক হইলেও ব্রত আরব্ধ হইলে উহা কোন বাধা সৃষ্টি করিতে পারে না; সঙ্কল্পই ব্রতের আরম্ভ। উপবাস ব্রতের অপরিহার্য অঙ্গ হইলেও অশক্তপক্ষে নিম্নলিখিত দ্রব্যভক্ষণে কোন দোষ হয় না :

জল, মূল, ফল, দুগ্ধ, ঘৃত, ব্রাহ্মণের অনুমোদিত বস্তু, আচার্যের অনুমতিক্রমে যে কোন খাদ্যদ্রব্য এবং ঔষধ।

উপবাসে অক্ষম ব্যক্তির রাত্রিতে ভোজনে কোন পাপ হয় না। ঋতুমতী, অন্তঃসত্ত্বা বা অন্যপ্রকারে অশুদ্ধা নারী স্বীয় ব্রতের জন্য প্রতিনিধি নিযুক্ত করিবেন এবং উপবাসাদি কায়িককৃত্য স্বয়ং সম্পাদন করিবেন। ব্রতদিনে নিম্নলিখিত কর্ম বর্জনীয়:

পতিত ও নাস্তিক ব্যক্তির সহিত আলাপ, অন্ত্যজ, পতিতা ও রজঃস্বলা নারীর দর্শন, স্পর্শ ও উহাদের সহিত কথোপকথন, গাত্রাভ্যঙ্গ, তামূলভক্ষণ, দন্তধাবন, দিবানিদ্রা, অক্ষক্রীড়া ও স্ত্রীসম্ভোগ।

যদিও মনুর মতে (৫।৫৫) ব্রতে ও উপবাসে স্ত্রীলোকের অধিকার নাই, তথাপি বাংলা দেশের স্মৃতিকারগণ পতির অনুমতিক্রমে এই সকল কার্যে পত্নীর অধিকার স্বীকার করিয়াছেন।

প্রতি পক্ষের একাদশী তিথিতে গৃহস্থের ও বিধবার উপবাস করণীয়। পুত্রবান গৃহী কৃষ্ণপক্ষে এই উপবাস করিবেন না। যাঁহার পুত্র বৈষ্ণব তিনি কৃষ্ণপক্ষে একাদশীর উপবাস করিতে পারেন। আট বৎসরের ঊর্ধ্বে ও আশী বৎসরের নিম্নে যাহাদের বয়স, তাহাদের উপবাস অবশ্যকরণীয়। একাদশীতে নিরমু উপবাসই বিধেয়। কিন্তু, অশক্তপক্ষে রাত্রিতে নিম্নলিখিত যে কোন দ্রব্য ভক্ষণ করা যায় :

হবিষ্যান্ন, ফল, তিল, দুগ্ধ, জল, ঘৃত, পঞ্চগব্য। এই তালিকায় পূর্ব পূর্ব দ্রব্য অপেক্ষা পর পর দ্রব্য প্রশস্তুতর।

বাস্তব জীবনে ধর্ম ও নীতি

মধ্যযুগে বাংলায় যে হিন্দু ধর্ম প্রচলিত ছিল তাহা প্রাচীন যুগের পৌরাণিক ধর্ম্মেরই স্বাভাবিক বিবর্তন। সাধারণতঃ উপাস্য দেবতা অনুসারে হিন্দুদিগকে পাঁচ ভাগে বিভক্ত করা হয়–বৈষ্ণব, শৈব, শাক্ত, সৌর ও গাণপত্য। যদিও অনেকেই পৃথকভাবে বিষ্ণু, শিব, শক্তি, সূর্য ও গণপতিকে ইষ্টদেব জ্ঞানে পূজা করিতেন তথাপি সাধারণতঃ ব্যবহারিক জীবনে প্রায় সকলেই স্মৃতিশাস্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী একত্রে ঐ পঞ্চ দেবতারই পূজা করিতেন। সুতরাং বৈষ্ণব, শৈব ও শাক্ত এই তিনটি প্রধান এবং সৌর ও গাণপত্য এই দুইটি অপ্রধান সম্প্রদায় থাকিলেও সাধারণতঃ হিন্দুদের মধ্যে বেশীর ভাগকেই স্মার্ত পঞ্চোপাসক বলাই যুক্তিসঙ্গত। নিত্য ও নৈমিত্তিক ধর্মকার্যে ‘পঞ্চদেবতাভ্যো নমঃ’ (পঞ্চদেবতাকে প্রণাম মন্ত্র পাঠ করিয়া ফুল জল অর্ঘ্য, প্রভৃতি দ্বারা পঞ্চদেবতার পূজা করিতেন। সাধারণতঃ ইষ্টদেবতার মূর্ত্তি বা প্রতীক কেন্দ্রস্থলে এবং অন্য চারি দেবতার মূর্ত্তি ও প্রতীক চারি কোণে রাখিয়া পূজা করা হইত। এখনও যে গৃহস্থের বাড়িতে প্রত্যহ নারায়ণ শিলা ও মৃৎ-শিবলিঙ্গের পূজা হয় ইহা পঞ্চোপাসনারই চিহ্ন।

এই ধর্ম্মানুষ্ঠানের পদ্ধতি সাধারণভাবে সকল হিন্দুদের সম্বন্ধেই প্রযোজ্য। তবে মধ্যযুগে যে কয়েকটি বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে রূপায়িত হইয়াছিল, অতঃপর তাঁহার সম্বন্ধে আলোচনা করিব।

মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাবের ফলে ষোড়শ শতকে বাংলায় এক অভিনব বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের অভ্যুত্থান হয়। গোপীগণের কিশোর কৃষ্ণের সহিত ও রাধার লাস্য ও মাধুর্যভাবপূর্ণ লীলাকে কেন্দ্র করিয়া ভগবদ্ভক্তি ও ঈশ্বরপ্রেমের বিকাশ–ইহাই ছিল এই সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য। চৈতন্যের পূর্বেও যে এই বৈষ্ণবধর্ম বাংলা দেশে প্রচলিত ছিল জয়দেবের গীতগোবিন্দ ও চণ্ডীদাসের ‘পদাবলী’ তাঁহার সাক্ষ্য দিতেছে। চৈতন্যের জন্মের অল্প কিছুকাল পূর্বে শ্রীমাধবেন্দ্র পুরী এই প্রেমধর্ম প্রচার করিয়াছিলেন। তাঁহার ঊনিশ জন শিষ্যের মধ্যে ঈশ্বরপুরী, পরমানন্দপুরী, শ্রীরঙ্গপুরী, কেশবভারতী ও অদ্বৈত আচার্য প্রভৃতি কয়েকজনের সঙ্গে চৈতন্যের সাক্ষাৎ হইয়াছিল ও ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ জন্মিয়াছিল। কিন্তু তথাপি কৃষ্ণভক্তিমূলক বৈষ্ণবধর্ম চৈতন্যের পূর্বে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে নাই। ‘চৈতন্য ভাগবতে’ [আদি, ২য় অধ্যায়] এ সম্বন্ধে চৈতন্যের অব্যবহিত পূর্বেকার নবদ্বীপের অবস্থা এইভাবে বর্ণিত হইয়াছে।

কৃষ্ণনাম ভক্তি শূন্য সকল সংসার।
প্রথম কলিতে হৈল ভবিষ্য-আচার ॥
ধর্মকর্ম লোক সবে এই মাত্র জানে।
মঙ্গলচণ্ডীর গীতে করে জাগরণে ॥
দম্ভ করি বিষহরি পূজে কোন জন।
পুত্তলি করয়ে কেহ দিয়া বহু ধন ॥

ভট্টাচার্য, চক্রবর্তী, মিশ্র সকলে শাস্ত্র পড়ায় কিন্তু,

“না বাখানে যুগ-ধর্ম কৃষ্ণের কীর্তন ॥
… … …
যেবা সব বিরক্ত তপস্বী অভিমানী।
তা সবার মুখেতেও নাহি হরিধ্বনি ॥
… … …
গীতা ভাগবত যে জানে বা পড়ায়।
ভক্তির ব্যাখ্যান নাহি তাঁহার জিহ্বায় ॥
… … …
সকল সংসার মত্ত ব্যবহার-রসে।
কৃষ্ণ-পূজা বিষ্ণু-ভক্তি কারো নাহি বাসে ॥
বাশুলী পূজয়ে কেহো নানা উপহারে।
মদ্যমাংস দিয়া কেহো যক্ষ পূজা করে ॥

তবে হরিভক্তিপরায়ণ কয়েকজন বৈষ্ণবও নবদ্বীপে ছিলেন–তাঁহাদের অগ্রণী অদ্বৈতাচার্য কৃষ্ণের ভক্তিবিহীন নগরবাসীদের দেখিয়া নিতান্ত দুঃখ পাইতেন। চৈতন্যদেব (১৪৮৬-১৫৩৩ খ্রীষ্টাব্দ) তাঁহার দুঃখ দূর করিলেন। তিনি নবদ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন, ২২ বৎসর বয়সে ঈশ্বরপুরীর নিকট দশাক্ষর কৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষিত হন, এবং ইহার দুই বৎসর পরে কেশব ভারতীর নিকট সন্ন্যাস গ্রহণ করেন (১৫১০ খ্রীষ্টাব্দ)। তাঁহার গার্হস্থ্য আশ্রমের নাম ছিল শ্রীবিশ্বম্ভর। দীক্ষাকালে নাম হইল ‘শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য, সংক্ষেপে চৈতন্য। সন্ন্যাস গ্রহণের পর তিনি অধিকাংশ সময় পুরীতেই থাকিতেন; কিন্তু উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের বহু তীর্থও ভ্রমণ করিয়া ছিলেন। শ্রীকৃষ্ণের লীলাভূমি বৃন্দাবন তখন প্রায় জনশূন্য হইয়া কোনক্রমে টিকিয়াছিল–তিনি আবার ইহাকে বৈষ্ণবধর্ম্মের একটি প্রধান কেন্দ্রে পরিণত করিলেন। দীক্ষা গ্রহণের পরেই নিত্যানন্দ, অদ্বৈত প্রভৃতি ভক্ত ও পার্ষদগণ চৈতন্যকে ঈশ্বরের অবতার বলিয়া ঘোষণা করেন। বৈষ্ণবগণের মতে ভগবানে ভক্তি ও সম্পূর্ণরূপে তাঁহার পদে আত্মসমর্পণ (প্ৰপত্তি) ইহাই মোক্ষলাভের একমাত্র পন্থা। কিন্তু এই নিষ্কাম ভক্তি শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মাধুর্য এই পাঁচটি ভাবের মধ্য দিয়া আত্মপ্রকাশ করে। এই মাধুর্য ভাবের প্রতীক কৃষ্ণের প্রতি গোপীদের ও রাধার প্রেম। এই প্রেমের উন্মাদনাই চৈতন্যের জীবনে প্রতিভাত হইয়াছিল। এই প্রেমের উচ্ছ্বাসে তিনি সত্য সত্যই সময় সময় উন্মাদ ও সংজ্ঞাশূন্য হইয়া পড়িতেন এবং এই প্রেম-রস আস্বাদনের প্রকৃষ্ট উপায় স্বরূপ হরিকৃষ্ণ নামসঙ্কীর্তনের প্রচলন করিয়াছিলেন। সপরিকর চৈতন্য বহু লোকজন সমভিব্যাহারে খোল করতালের বাদ্য সহযোগে গৃহে বা রাজপথে নামকীর্তন করিয়া বেড়াইতেন এবং অনেক সময় ভাবাবেগে মূৰ্ছিত হইয়া পড়িতেন। কৃষ্ণের প্রতি রাধিকার প্রেম তিনি নিজের জীবনে আস্বাদন করিতেন। কিন্তু এ প্রেম দিব্য ও দেহাতীত। ইহাই সংক্ষেপে এই অভিনব বৈষ্ণবধর্ম্মের মূলকথা। শ্রীচৈতন্য নিজে কোন তত্ত্বমূলক গ্রন্থ রচনা করেন নাই। তাঁহার সমসাময়িক বৃন্দাবনবাসী ছয়জন গোস্বামী শাস্ত্রগ্রন্থ রচনা করিয়া গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতকে একটি দার্শনিক ভিত্তির উপর স্থাপিত করিয়া ইহাকে বিশিষ্ট মর্যাদা দান করিয়াছেন। এই ছয়জন গোস্বামীর নাম-রূপ, সনাতন, জীব, রঘুনাথ দাস, রঘুনাথ ভট্ট ও গোপাল ভট্ট।

এই ছয় গোস্বামী ও অন্যান্য বৈষ্ণবগণের রচিত অসংখ্য সংস্কৃত গ্রন্থে গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতবাদ লিপিবদ্ধ আছে। এই সম্প্রদায়ের মূলকথা ‘গৌরপারম্যবাদ’ অর্থাৎ চৈতন্যই চরম সত্তা ও পরম উপেয়; চৈতন্য একাধারে কৃষ্ণ ও রাধা। এই দেশে ‘গৌরনাগরভাব’ও প্রচলিত ছিল; ইহাতে রাগানুগা ভক্তির সাহায্যে ভক্তগণ চৈতন্যকে নাগর এবং নিজেকে নাগরীরূপে কল্পনা করিয়া উপাসনায় প্রবৃত্ত হন। বাঙালী বৈষ্ণবগণের মতে, গোপীগণ কৃষ্ণবধূ কৃষ্ণের স্বকীয়া নারী; সুতরাং গোপীগণের সহিত পরকীয়াবাদ বিলাস নহে। গোপগণের সহিত গোপীগণের বিবাহ ও যৌনসম্বন্ধকালে গোপীগণ কৃষ্ণের মায়াশক্তিবলে প্রচ্ছন্ন ছিলেন এবং তাহাদের পরিবর্তে তদনুকারী কায়িকরূপ গোপগণের সংস্পর্শে আসিয়াছিলেন।

গৌড়ী বৈষ্ণবগণ ভক্তিকে অতি উচ্চ স্থান দিয়াছেন। ভক্তি হইতে পারে শুদ্ধা, জ্ঞানমিস্রা, যোগমিশ্রা ও কর্মমিশ্রা শুদ্ধা ভক্তি সর্বশ্রেষ্ঠ। অকৈতবা ভক্তির দুইটি অবস্থা–বৈধী ও রাগানুগা। শাস্ত্রোক্ত বিধিদ্বারা প্রবর্তিত হয় বলিয়া বৈধী ভক্তির ঈদৃশ নামকরণ হইয়াছে। রাগ বা সহজ চিত্তবৃত্তির অনুগমন করে বলিয়া দ্বিতীয় অবস্থার নাম রাগানুগা; ইহাতে শাস্ত্রীয় বিধির কোন প্রয়োজন নাই।

জীবকর্ত্তৃক ভগবানের সাক্ষাৎকার বা ভগবৎ প্রাপ্তিই মুক্তি। একমাত্র প্রীতির দ্বারাই এই সাক্ষাঙ্কার সম্ভব; সুতরাং, ভগবপ্রীতিই চরম কাম্য। শান্ত, দাস্য, মৈত্র, বাৎসল্য ও মাধুর্য–এই পাঁচটি ভগবপ্রীতির মূলীভূত ভাব; ইহারা উত্তরোত্তর শ্রেয়।

উল্লিখিত সংক্ষিপ্ত বিবরণ হইতে বাংলা দেশের বৈষ্ণবগণের ধর্মমত সম্বন্ধে মোটামুটি ধারণা করা যায়। তাঁহাদের আচার, আচারণ ও ধর্ম্মানুষ্ঠান সম্বন্ধে বহু তথ্য লিপিবদ্ধ আছে ‘হরিভক্তিবিলাস’ ও ‘সৎক্রিয়ারদীপিকা’ নামক দুইখানি গ্রন্থে। এই দুই গ্রন্থে পুরাণ ও তন্ত্রের গভীর প্রভাব বিদ্যমান; কিন্তু প্রচলিত স্মৃতিশাস্ত্রের অনুসরণ ইহাদের মধ্যে নাই। ‘হরিভক্তিবিলাসে’ গুরু, শিষ্য, দীক্ষা, দৈনন্দিন ধর্ম্মানুষ্ঠান, বিষ্ণুভক্তির স্বরূপ, ভক্তিতত্ত্ব, পুরশ্চরণ, মূর্ত্তিনির্মাণ, মন্দির নির্মাণ প্রভৃতি বিষয় আলোচিত হইয়াছে; ইহাতে স্মৃতিশাস্ত্রের সংস্কারগুলির কোন উল্লেখ নাই। ‘সৎক্রিয়াসারদীপিকা’য় গ্রন্থকার বলিয়াছেন যে, স্মৃতিশাস্ত্রোক্ত বিধান বৈষ্ণবগণের পক্ষে প্রযোজ্য নহে। কিন্তু, এই গ্রন্থে প্রাচীনতর কতক স্মৃতিগ্রন্থের, বিশেষতঃ বাঙালী স্মৃতিকার ভবদেব ভট্ট ও অনিরুদ্ধ ভট্টের স্মৃতিনিবন্ধের অনুসরণ লক্ষণীয়। ইহা হইতে মনে হয় যে সামাজিক ব্যাপারে গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণ সনাতন স্মৃতিশাস্ত্রকে সম্পূর্ণরূপে বর্জন করেন নাই। উক্ত উভয় গ্রন্থে পূর্বপুরুষের আত্মার উদ্দেশ্যে শাস্ত্রপ্রসঙ্গ বর্জিত হইয়াছে। ‘হরিভক্তিবিলাসে’ সংস্কারের উল্লেখ না থাকিলেও অপর গ্রন্থে সংস্কারসমূহের ব্যবস্থা আছে; তবে সংস্কারগুলির অনুষ্ঠানপদ্ধতি চিরাচরিত স্মার্ত মত অনুযায়ী নহে। সক্ৰিয়াসারদীপিকার ভগবদ্ধর্মের আচরণ অন্যান্য দেবদেবীর উপাসনা, পূর্বপুরুষের পূজা, এবং নিত্য, নৈমিত্তিক ও কাম্য অনুষ্ঠানাদি অপেক্ষা শ্রেয়। কৃষ্ণপূজা সকল পূজা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। বিবাহপ্রসঙ্গে গ্রন্থকার বলিয়াছেন যে, বর স্মৃতিশাস্ত্রোক্ত পঞ্চোপাসনা অর্থাৎ গণেশ, শিব, দুর্গা, সূর্য ও বিষ্ণুর পূজা সযত্নে পরিহার করিবেন। নবগ্রহ, লোকপাল এবং ষোড়শমাতৃকার পূজাও তাঁহার পক্ষে বর্জনীয়। ইহাদের পরিবর্তে বিম্বসেন, সনক প্রভৃতি পঞ্চ মহাভাগবত তাঁহার পূজ্য। এতদ্ব্যতীত কবি, হবি, অন্তরীক্ষ প্রভৃতি যোগীন্দ্র, ব্রহ্মা, শুকদেব প্রভৃতি ভাগবত, পৌর্ণমাসী, লক্ষ্মী প্রভৃতি বৈষ্ণবীও তকর্ত্তৃক পূজনীয়। তিনি যদি রাধা, কৃষ্ণ বা বিষ্ণুর কোন অবতারের উপাসক হন তাহা হইলে আনুষঙ্গিক দেবতাগণের পূজাও তাঁহার পক্ষে বিধেয়।

কিন্তু এই সমুদয় শাস্ত্র রচনার পূর্বেই চৈতন্যের সাত্ত্বিক ভাবযুক্ত দিব্য প্রেমোন্মাদনাপূর্ণ রাধাকৃষ্ণের আদর্শানুযায়ী ভগবদ্ভক্তির ও প্রেমের তরঙ্গ সারা দেশে এক অপূর্ব উন্মাদনার সৃষ্টি করিল-রাধাকৃষ্ণের লীলা ও হরিনাম কীর্তনে বাংলা দেশ প্রেমের ও ভক্তির বন্যায় যেন ডুবিয়া গেল। ইহাতে আনুষ্ঠানিক হিন্দুধর্ম্মের আচার বিচারের এবং জাতিভেদের বিশেষ কোন চিহ্ন ছিল না। স্ত্রীলোক, শূদ্র এবং আচণ্ডাল সকলকেই প্রেমের ধর্ম্মে দীক্ষিত করিয়া তাহাদের মনে ভগবৎপ্রেমের ও সাত্ত্বিকভাব জাগাইয়া ভোলাই ছিল চৈতন্যের আদর্শ ও লক্ষ্য।

রাধাকৃষ্ণের প্রেমের মহান আদর্শ চৈতন্যের পূর্বেও এ দেশে প্রচলিত ছিল। কিন্তু তাহা বহুল পরিমাণে সাত্ত্বিক ভাবশূন্য হইয়া নরনারীর দৈহিক সম্ভোগের প্রতীক হইয়া উঠিয়াছিল। জয়দেবের গীতগোবিন্দ কাব্য সমগ্র ভারতে সমাদর লাভ করিয়াছিল। কিন্তু সাধারণ নরনারীর দৈহিক সম্ভোগের যে বাস্তব চিত্র বর্তমান যুগে সাহিত্যে ও সমাজে হেয় ও অশ্লীল বলিয়া পরিগণিত হয়, তাঁহার নগ্নরূপও জয়দেব অঙ্কিত করিয়াছেন। গীতগোবিন্দের দ্বাদশ সর্গে রাধাকৃষ্ণের কামকেলির যে বর্ণনা আছে বর্তমান কালে কোন গ্রন্থে তাহা থাকিলে গ্রন্থকার দুর্নীতি প্রচারের অপরাধে আদালতে দণ্ডিত হইতেন। চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন সম্বন্ধে একজন বৈষ্ণবসাহিত্যের মহারথী লিখিয়াছেন যে “আদিরসের ছড়াছড়ি থাকায় কাব্যখানি প্রায় Pornography পর্যায়ে পড়িয়াছে।” [ডাঃ বিমানবিহারী মজুমদার – ষোড়শ শতাব্দীর পদাবলী সাহিত্য, ২৮৪ পৃ.] শুধু তাহাই নহে। এই কাব্যে বর্ণিত কৃষ্ণের চরিত্র বিশ্লেষণ করিয়া তিনি লিখিয়াছেন–কবির কৃষ্ণ কামুক, কপট, মিথ্যাবাদী, অতিশয় দাম্ভিক এবং প্রতিহিংসাপরায়ণ … রাধাকৃষ্ণের প্রণয় কাহিনীর ইহা অত্যন্ত বিকৃত রূপ। এমন কি কৃষ্ণকীর্তনের নায়ক কৃষ্ণ বারংবার রাধাকে বলিয়াছেন যে তাঁহার দেহসম্ভোগের জন্যই তিনি (কৃষ্ণ) পৃথিবীতে অবতার হইয়া জন্মিয়াছেন (অবতার কৈল আহ্মে তোর রতি আসে)।” [ডাঃ বিমানবিহারী মজুমদার – ষোড়শ শতাব্দীর পদাবলী সাহিত্য, ২৬৪-৬৫ পৃ.]  অনেক পণ্ডিতের মতে এই কৃষ্ণকীর্তন চৈতন্যের জন্মের অল্প পূর্বেই রচিত। সুতরাং জয়দেব হইতে আরম্ভ করিয়া তিনশত বৎসর যাবৎ রাধাকৃষ্ণের প্রেমের ছদ্ম আবরণে কামের নগ্নরূপ ও পরকীয়া প্রেমের মাহাত্ম বৈষ্ণবধর্মকে কলুষিত করিয়াছিল। অবশ্য চণ্ডীদাসের পদাবলীতে ও অন্যত্র বিশুদ্ধ উচ্চপ্রেমের আদর্শও চিত্রিত হইয়াছে। উচ্চাঙ্গ ভক্তিরসেরও যে অভাব আছে এমন নয়। অর্থনীতির একট মূলসূত্র এই যে যদি খাঁটি ও মেকী টাকা একত্র বাজারে চলে তবে ক্রমে ক্রমে খাঁটি টাকা লোপ পায়। চণ্ডীদাস গাহিয়াছেন “রজকিনী প্রেম নিকষিত হেম কামগন্ধ নাহি তাহে।” কিন্তু সাধারণ মানুষ ‘রজকিনী প্রেম’ এই দুটি কথার উপর যতটা জোর দিয়াছে, কামগন্ধহীন’ প্রেমের উপর ততটা নহে। চণ্ডীদাসের পদাবলী ও ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন একসঙ্গে প্রচারিত ও এক কবির লেখা হইলেও (এ বিষয়ে কেহ কেহ সন্দেহ করেন) কৃষ্ণকীর্তনের রাধাকৃষ্ণই জনপ্রিয় হইবেন ইহা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক।

এই কলুষতার মূর্ত প্রতিবাদ ছিলেন শ্রীচৈতন্য। চৈতন্যের বলিষ্ঠ পৌরুষ বিশুদ্ধ সাত্ত্বিক ভাব ও অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব, রাধাকৃষ্ণের প্রেমমূলক বৈষ্ণবধর্মকে এক অতি উচ্চ স্তরে তুলিল। পবিত্র ভক্তির প্রকাশ্য অনুভূতি, প্রাণোন্মাদকারী কীর্তন এবং রাধাকৃষ্ণের প্রেমের যে দিব্য আদর্শ তিনি নিজের জীবনে রূপায়িত করিয়াছিলেন, তাঁহার প্রবাহ সমস্ত কলুষতা ধুইয়া ফেলিল। বৈষ্ণবধর্ম্মে তখন নূতন প্রাণপ্রতিষ্ঠা হইল। এই প্রসঙ্গে চৈতন্যদেবের প্রবর্তিত একটি নিযম বিশেষভাবে স্মরণীয়। তাঁহার আজ্ঞায় বৈষ্ণব ভক্তগণের নারীর সহিত কথাবার্তা নিষিদ্ধ হইল। তাঁহার প্রিয় শিষ্য হরিদাস তাঁহারই ভোজনের জন্য একজন বর্ষীয়সী ভক্তিমতী মহিলার নিকট হইতে উৎকৃষ্ণ চাউল চাহিয়া আনিয়াছিলেন। এই নিয়মভঙ্গের অপরাধে তিনি হরিদাসকে ত্যাগ করিলেন।

হরিদাস কৈল প্রকৃতি সম্ভাষণ।
* * *
হেরিতে না পারি মুই তাঁহার বদন ॥

অন্যান্য ভক্তগণের অনুরোধ উপরোধেও তিনি বিন্দুমাত্র টলিলেন না। বলিলেন, “মানুষের ইন্দ্রিয় দুর্বার, কাষ্ঠের নারীমূর্ত্তি দেখিলেও মুনির মন চঞ্চল হয়। অসংযত চিত্ত জীব মর্কট-বৈরাগ্য করিয়া স্ত্রী-সম্ভাষণের ফলে ইন্দ্রিয় চরিতার্থ করিয়া বেড়াইতেছে।” মনের দুঃখে হরিদাস প্রয়াগে ত্রিবেণীতে ডুবিয়া আত্মহত্যা করিল।

এই নৈতিক উন্নতির ফলে এবং চৈতন্যের আদর্শ ও দৃষ্টান্ত বাঙালী হিন্দু যেন এক নবীন জীবন লাভ করিল। পবিত্র প্রেমের সাধক যে চৈতন্য কৃষ্ণ নাম করিয়া ধুলায় গড়াগড়ি দিতেন তিনি বাঙালীর সম্মুখে যে পৌরুষের আদর্শ তুলিয়া ধরিলেন মধ্যযুগে তাঁহার তুলনা মিলে না। নবদ্বীপের মুসলমান কাজীর হুকুমে যখন চৈতন্যের প্রবর্তিত কীর্তন গান নিষিদ্ধ হইল এবং কীর্তনীয়াদের উপর বিষম অত্যাচার আরম্ভ হইল, তখন অনেক বৈষ্ণব ভয় পাইয়া নবদ্বীপ ছাড়িয়া অন্যত্র যাইবার প্রস্তাব করিলেন। অবৈষ্ণব নবদ্বীপবাসী কেহ কেহ খুসি হইয়া বলিলেন “এইবার নিমাই পণ্ডিতের দর্প চূর্ণ হইবে–বেদের আজ্ঞা লঙ্ঘন করিলে এইরূপই শাস্তি হয়।” কিন্তু চৈতন্য দৃঢ়স্বরে ঘোষণা করিলেন, কাজীর আদেশ অমান্য করিয়া এই নবদ্বীপে থাকিয়াই কীর্তন করিব।

ভাঙ্গিব কাজীর ঘর কাজীর দুয়ারে।
কীর্তন করিব দেখি কোন্ কর্ম করে ॥
তিলার্ধেকো ভয় কেহ না করিও মনে।

তিন শত বৎসরের মধ্যে বাঙালী ধর্মরক্ষার্থে মুসলমানের অত্যাচারের বিরুদ্ধে মাথা তুলিয়া দাঁড়ায় নাই–মন্দির ও দেবমূর্ত্তি ধ্বংসের অসংখ্য লাঞ্ছনা ও অকথ্য অপমান নীরবে সহ্য করিয়াছে। চৈতন্যের নেতৃত্বে অসম্ভব সম্ভব হইল। চৈতন্য কীর্তনীয়ার দল লইয়া কাজীর বাড়ির দিকে অগ্রসর হইলেন। কাজী ক্রুদ্ধ হইয়া বাধা দিতে অগ্রসর হইল। কিন্তু বিশাল জনসমুদ্র মার মার কাট কাট শব্দে তাঁহার বাড়ীর দিকে অগ্রসর হইতেছে দেখিয়া কাজী পলাইল এবং সংকীর্তন নিষেধের আজ্ঞা প্রতাহৃত হইল।

চৈতন্যের আদর্শে ভক্তগণ ব্যক্তিগতভাবেও অনুপ্রাণিত হইয়াছিলেন। তাঁহার ভক্ত বৈদ্য চন্দ্রশেখরের বাড়ীতে যে দেবমূর্ত্তি ছিল তাহা স্বর্ণ নির্মিত মনে করিয়া যবন সৈন্য তাহা কাড়িয়া নিতে আসিল।

বক্ষে রাখিল ঠাকুর তবু না ছাড়িল।
চন্দ্রশেখরের মুণ্ড মোগলে কাটিল ॥

কিন্তু চৈতন্যের এই পৌরুষের আদর্শ বাঙালীর চিত্তে স্থায়িভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। কারণ বৈষ্ণব সম্প্রদায় দাস্য ও মাধুর্য ভাবেই বিভোর ছিলেন–পৌরুষকে মর্যাদা দেন নাই। এই বৈষ্ণবদের হাতে চৈতন্যের আদর্শের কিরূপ বিকৃতি ঘটিয়াছিল কাজীর সহিত বিরোধের বিবরণ হইতেই তাহা প্রমাণিত হয়। উপরে যে বিবরণ দেওয়া হইয়াছে তাহা সমসাময়িক চৈতন্য-চরিতকার বৃন্দাবনদাসের চৈতন্যভাগবত গ্রন্থে বিস্তৃতভাবে উল্লিখিত আছে। [চৈতন্য ভাগবত (মধ্য খণ্ড) ২৩ অধ্যায়] চৈতন্যের আদেশে তাঁহার অনুচরেরা যে কাজীর ঘর ও ফুলের বাগান ধ্বংস করিয়াছিল তাঁহার স্পষ্ট উল্লেখ আছে। কিন্তু বৈষ্ণবদের দাসবৃত্তিসুলভ মনোভাবের সহিত চৈতন্যের এই উদ্ধত’ ও হিংসাত্মক আচরণ সুসঙ্গত হয় না–সম্ভবত কতকটা এই কারণে এবং কতকটা মুসলমান রাজা ও রাজকর্মচারীর ভয়ে তাহারা চৈতন্যের জীবনের এই ইতিহাসপ্রসিদ্ধ ঘটনাটিকে প্রাধান্য দেন নাই এবং বিকৃত করিয়াছেন। সমসাময়িক বৃন্দাবনদাস ছিলেন গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী-কাহাকেও ভয় করিতেন না। সবিস্তারে তিনি সব লিখিয়াছেন। কিন্তু মুরারি গুপ্ত ছিলেন গৃহী। তিনি সুলতান হোসেন শাহের পুত্র নসরৎ শাহের রাজত্বকালে চৈতন্যের জীবনী লেখেন। কাজীর ব্যাপারটা ঘটিয়াছিল হোসেন শাহের রাজত্বকালে। সুতরাং যদিও বৃন্দাবনদাস লিখিয়াছেন যে কাজীর ঘর ভাঙ্গার ব্যাপারে মুরারি গুপ্ত একটি সক্রিয় অংশ গ্রহণ করিয়াছিলেন তথাপি মুরারি গুপ্ত এই ঘটনার বিন্দুমাত্র উল্লেখ করেন নাই। পরবর্তী চৈতন্য-চরিতকার কবিকর্ণপুর পরমানন্দ সেনও তাঁহার পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়াছেন। চৈতন্যের সমসাময়িক জয়ানন্দ মাত্র দুই ছত্রে কাজীর ঘর ভাঙ্গা ও পলায়নের উল্লেখ করিয়াছেন। ঘটনাটির প্রায় একশত বৎসর পরে বৃদ্ধ কৃষ্ণদাস কবিরাজ বৃন্দাবনে বসিয়া তাঁহার প্রসিদ্ধ বিরাট গ্রন্থ ‘‘চৈতন্যচরিতামৃত’ রচনা করেন। তখন আকবরের রাজ্য কেবল শেষ হইয়াছে। সুতরাং স্থান ও কালের দিক দিয়া মুসলমান সরকারের ভীতি অনেকটা কম থাকিবার কথা। এই কারণে তিনি কাজীর ঘটনা, তাঁহার ঘর, বাগান ধ্বংসের কথা সবিস্তারে বর্ণনা করিয়াছেন। কিন্তু তখন বৈষ্ণবদের মধ্যে দীন দাস্য ভাবের মহিমা পৌরুষের স্থান অধিকার করিয়াছেন। অতএব তিনি লিখিয়াছেন যে, এই হিংসাত্মক ব্যাপারে চৈতন্যের কোন হাত ছিল না, ইহা কয়েকটি উদ্ধতপ্রকৃতি লোকের কাজ। চৈতন্য কাজীকে ডাকাইয়া আনিলেন। বিনম্র বচনে

প্রভু কহে–এক দান মাগি হে তোমায়।
সংকীর্তন বাদ যৈছে না হয় নদীয়ায় ॥

কৃষ্ণদাস কবিরাজ কাজীর ঘটনা সংক্ষেপে বলিয়া তারপর লিখিয়াছেন :

বৃন্দাবন দাস ইহা চৈতন্য মঙ্গলে।
বিস্তারি বলিয়াছেন প্রভু কৃপাবলে ॥ [চৈতন্য চরিতামৃত, আদি, ১৭ অধ্যায়]

অথচ তাঁহার মতে চৈতন্য কাজীর ঘর ও বাগান ধ্বংস করার আদেশ দেন নাই। কিন্তু চৈতন্য ভাগবতে স্পষ্ট আছে :–

ক্রোধে বলে প্রভু ‘আরে কাজী বেটা কোথা।
ঝাট আন ধরিয়া কাটিয়া ফেলোঁ মাথা ॥
প্রাণ লা কোথা কাজী গেল দিয়া দ্বার।
ঘর ভাঙ্গ ভাঙ্গ’ প্রভু বলে বার বার ॥

এই কথা শুনিয়া

ভাঙ্গিলেক যত সব বাহিরের ঘর।
প্রভু বলে অগ্নি দেহ বাড়ির ভিতর ॥
পুড়িয়া মরুক সব গণের সহিতে।
সর্ব বাড়ী বেঢ়ি অগ্নি দেহ চারি ভিতে ॥

চৈতন্যের সহিত কাজীর সাক্ষাৎ বা তাঁহার কাছে কীর্তনের অনুমতি ভিক্ষা, স্বপ্ন দর্শনে কাজীর ভয় ও তজ্জন্য কীর্তনের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, কাজীর বৈষ্ণবধর্ম্মে ভক্তি প্রভৃতি কৃষ্ণদাসের অস্বাভাবিক ও অসঙ্গতিপূর্ণ কাহিনীর কিছুই চৈতন্যভাগবতে নাই। সমসাময়িক বৃন্দাবনদাস ও প্রায় শতবর্ষ পরে বৃন্দাবনের গোঁসাই শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত চৈতন্যের জীবনীতে যে সম্পূর্ণ পরস্পর বিরুদ্ধ দুইটি চিত্র অঙ্কিত হইয়াছে তাহা হইতে বোঝা যায় শ্রীচৈতন্য সম্বন্ধে বাঙালীর ধারণা কিরূপ পরিবর্তিত হইয়াছিল। প্রথমটিতে পাই চৈতন্য যাহা ছিলেন, দ্বিতীয়টিতে পাই চৈতন্য যাহা হইয়াছেন। গত তিন শতাধিক বৎসর বাংলার বৈষ্ণবগণ চৈতন্যের কেবল একটি মূর্ত্তিই ধ্যান ও ধারণা করিয়াছেন–কৃষ্ণ নাম জপিতে জপিতে ভাবাবেশে সংজ্ঞাহীন ভূলুণ্ঠিত ধূলিধূসরিত দেহ। কিন্তু তাঁহার যে দৃঢ় বলিষ্ঠ পূত চরিত্র ভক্তের সামান্য নীতিভ্রষ্টতাও ক্ষমা করে নাই এবং যিনি দুরাচারী যবনকে শাস্তি দিবার জন্য সদলবলে অগ্রসর হইয়া বলিয়াছিলেন “নির্যবন করো আজি সকল ভুবন”–বাঙালী তাহা মনে রাখে নাই। বাংলার পরাক্রান্ত সুলতান হোসেন শাহের রাজ্যে মুসলমান অত্যাচারের বিরুদ্ধে মাথা তুলিয়া দাঁড়াইয়া তিনি যে সাহস ও ধর্মনিষ্ঠার পরিচয় দিয়াছিলেন বাঙালী তাহা অচিরেই ভুলিয়া গিয়াছিল।

বস্তুত চৈতন্যের আদর্শ ও প্রভাব কোন দিক দিয়াই বেশি দিন স্থায়ী হয় নাই। তিনি সংকল্প করিয়াছিলেন যে, স্ত্রী, শূদ্র, মূর্খ আদি আচণ্ডালে প্রেম ভক্তি দান করিয়া তাহাদের জীবন উন্নত করিবেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি অবধূত নিত্যানন্দকে পুরী হইতে বঙ্গদেশে পাঠাইলেন। বলিলেন “তুমি যদি সন্ন্যাসীর জীবন যাপন কর, তবে মূর্খ, নীচ, দরিদ্র, পতিতকে আর কে উদ্ধার করিবে।” ইহার ফলে জাতিভেদের কঠোর নিগড় ভাঙ্গিয়া গেল এবং হিন্দু সমাজের নিম্নস্তরের যে সমুদয় শ্ৰেণী এতদিন উপেক্ষিত ও লাঞ্ছিত জীবনযাপন করিতেছিল তাহাদের এক বড় অংশ বৈষ্ণবধর্ম্মে দীক্ষিত হইল। পূর্বে বলা হইয়াছে যে নিম্নশ্রেণীর হিন্দুরা দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করিতেছিল। নিত্যানন্দ এবং তাঁহার সহচর ও অনুবর্তীদের প্রচারের ফলে তাহা সম্ভবত অন্তত আংশিক পরিমাণে রহিত হইয়াছিল।

চৈতন্য যে আনুষ্ঠানিক বিধি বিধান বাদ দিয়া স্ত্রী পুরুষ ও উচ্চ নীচ জাতি নির্বিশেষে সকলকে কেবল প্রেমভক্তিমূলক ধর্ম্মে দীক্ষা দিবার প্রথা প্রচলিত করিয়াছিলেন তাহাতে তৎকালীন হিন্দু সমাজে এক বিপ্লবের সূচনা দেখা দিল। বহু শূদ্র এবং খুব অল্প সংখ্যক হইলেও মুসলমানরাও বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করিল। জাতিভেদের ব্যবধান শিথিল হইল। হরিদাস ঠাকুরের যবন সংসর্গ থাকা সত্ত্বেও অদ্বৈত আচার্য তাহাকে শ্রাদ্ধের অগ্রভাগ প্রদান করিয়াছিলেন। ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ ও অন্যান্য জাতির সঙ্গেও কীর্তনে যবনেহ নাচে গায় লয় হরিনাম’। ব্রাহ্মণের জাতির সাধকেরা নিঃসঙ্কোচে ব্রাহ্মণকে মন্ত্র দিতে আরম্ভ করিল। রঘুনাথ দাস কায়স্থ হইয়া গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম্মের নিয়ামক ছয় গোস্বামীর মধ্যে স্থান পাইলেন। কালিদাস নামে রঘুনাথ দাসের জ্ঞাতি খুড়া শূদ্র ও অন্যান্য নীচ জাতীয় বৈষ্ণবের উচ্ছিষ্ট ভক্ষণ করিলেন। অসংখ্য ব্রাহ্মণ কায়স্থ নরোত্তম ঠাকুরের শিষ্য হইলেন। শ্রীখণ্ডের নরহরি সরকারের বংশে এই প্রথা এখনও প্রচলিত অর্থাৎ ব্রাহ্মণেরা তাঁহার বংশধরদের নিকট দীক্ষা লইয়া থাকে।

স্ত্রীলোকের অবস্থারও উন্নতি দেখা দিল। বলরাম দাসের পদে আছে, “সংকীর্তন মাঝে নাচে কুলের বৌহারি” অর্থাৎ কুলবধূরাও প্রকাশ্যে সংকীর্তনে যোগ দিতেন। শিবানন্দ সেনের স্ত্রী ও পরমেশ্বর মোদকের মাতার দৃষ্টান্ত হইতে মনে হয় বহু নারী প্রতি বৎসর রথযাত্রার সময় শ্রীচৈতন্যকে দর্শন করিতে পুরী যাইতেন। নিত্যানন্দের পত্নী জাহ্নবী দেবী খেতুড়ি মহোৎসবের সময় গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব গ্রহণ করিয়াছিলেন। তিনি বহু শিষ্যকে মন্ত্রদানও করিয়াছিলেন। অদ্বৈত-পত্নী সীতা দেবী পুরুষের প্রকৃতি ও বেশ ধারণ করিয়া যে সাধনার রীতি প্রবর্তিত করেন তাহা তাঁহার শিষ্যা নন্দিনী ও জঙ্গলীর বিবরণ হইতে জানা যায়। শ্রীনিবাস আচার্যের কন্যা হেমলতা ঠাকুরাণীও বহু শিষ্যকে মন্ত্র দিয়াছিলেন। [ড. বিমানবিহারী মজুমদার-পদাবলী সাহিত্য পৃ. ৩১৫-১৬]

কিন্তু এই সমুদয়ের মধ্য দিয়া যে ধর্ম ও সমাজ সংস্কারের একটি মহৎ সম্ভাবনা দেখা দিয়াছিল এক শতাব্দীর বেশি তাহা স্থায়ী হয় নাই। বরং নূতন ভাবে নানাবিধ কলুষতার আবির্ভাব হইল।

বৌদ্ধ সহজিয়া ও তান্ত্রিকদল পূর্বেই এদেশে ছিল। বৈষ্ণব ধর্ম্মের প্রচারে এগুলির প্রভাব অনেকটা কমিয়াছিল কিন্তু শীঘ্রই বৈষ্ণব সহজিয়ারা তাহাদের সহিত যোগ দিয়া দল বৃদ্ধি করিল। ইহারা প্রচলিত ধর্মমত এবং সামাজিক রীতিনীতি ও অনুষ্ঠানের ধার ধারিত না। বিভিন্ন পথে মুক্তিলাভের সন্ধান করিত। ইহাদের ধর্ম্মাচরণের একটি বিশিষ্ট অঙ্গ ছিল পরকীয়া প্রেম অর্থাৎ বর্তমান যুগের ভাষায় পরস্ত্রীর সহিত অবৈধ প্রণয় ও ব্যভিচার। বর্তমান কালের রুচির অমর্যাদা

করিয়া ইহার বিস্তৃত বর্ণনা করা অসম্ভব। আশ্চর্যের বিষয় এই যে এই পরকীয়া প্রেম যে স্বকীয়া প্রেম অর্থাৎ পরিণীতা স্ত্রীর সহিত বৈধ প্রেম অপেক্ষা আধ্যাত্মিক হিসাবে অনেক শ্রেষ্ঠ–ইহা বাংলায় বৈষ্ণব সমাজেও গৃহীত হইয়াছিল। ১৭৩১ খ্রীষ্টাব্দে জয়পুরের মহারাজা এই মত খণ্ডন করিবার জন্য কয়েকজন বৈষ্ণব পণ্ডিত পাঠাইয়াছিলেন। তাঁহারা নানা দেশে স্বকীয়া প্রেমের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করিয়া অবশেষে বাংলা দেশে আসিলেন। ছয়মাস বিতর্কের পরে গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণ তাঁহাদিগকে পরাজিত করিয়া পরকীয়া প্রেমের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত করিলেন। ইহার ফলে উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত কর্ত্তাভজা প্রভৃতি বহু সহজিয়া সম্প্রদায় এবং কিশোরী ভজন প্রভৃতি এমন নানাপ্রকার অনুষ্ঠান বাংলায় প্রচলিত ছিল, সুরুচি লঙ্ঘন না করিয়া তাঁহার বর্ণনা করা অসম্ভব।

শ্রীচৈতন্যদেব যে বিশুদ্ধ সাত্ত্বিক প্রেম ও ভক্তিবাদের উপর বৈষ্ণবধর্ম প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন কালক্রমে তাঁহার এই পরিণতি হইয়াছিল। তবে ইহা কেবল সহজিয়া ও বৈষ্ণব ধর্ম্মে সীমাবদ্ধ ছিল না। তান্ত্রিক ধর্ম্মেও বীভৎসতা চরমে উঠিয়াছিল। আনুষ্ঠানিক ব্রাহ্মণ্য ধর্ম্মেও ইহার প্রভাব দেখা যায়। বৃহদ্ধর্ম্মপুরাণে উক্ত হইয়াছে যে মানবদেহের অঙ্গসূচক অশ্লীল কথা দুর্গা পূজায় উচ্চারণ করিবে, কারণ দুর্গা ইহা উপভোগ করেন। কালবিবেকে নির্দেশ আছে যে কাম-মহোৎসবে অশ্লীল বাক্য উচ্চারণ করিবে। দুর্গাপূজার বর্ণনা প্রসঙ্গে নরনারীর যে সব ক্রীড়া ও বাক্য কালবিবেকে লিখিত আছে তাহা বর্তমান যুগে ভদ্র সমাজে উচ্চারণ করা যায় না, কিন্তু ইহা না করিলে বা না বলিলে নাকি ভগবতী ক্রুদ্ধা হইবেন। রাধাকৃষ্ণের লীলা বর্ণনায় গীতগোবিন্দ, কৃষ্ণকীর্তন প্রভৃতি গ্রন্থে যে নরনারীর দেহ সম্ভোগের নগ্নচিত্র প্রকটিত হইয়াছে তাহা পূর্বেই বলা হইয়াছে। পরবর্তী অনেক পদাবলীতেও ইহার অনুকরণ দেখিতে পাওয়া যায়। মোটের উপর একথা নিঃসন্দেহে বলা যাইতে পারে যে সাহিত্যে ও সমাজে যে শ্রেণীর অশ্লীলতা আজকাল ভব্য সমাজে নিন্দনীয় এবং আইনে দণ্ডনীয়–মধ্যযুগে ধর্ম্মের সূক্ষ্ম আবরণে তাহা ভদ্র ও শিক্ষিত সমাজে দোষাবহ বলিয়া মনে হইত না।

কিন্তু কেবল এই এক বিষয়েই চৈতন্যদেবের চেষ্টা ব্যর্থ হয় নাই। জাতিভেদের কঠোরতা দূর করিয়া নিম্নশ্রেণীর উন্নয়নের যে চেষ্টা তিনি করিয়াছিলেন এক শতাব্দীর বেশি তাহা স্থায়ী হয় নাই। ছয় গোস্বামীর অন্যতম গোপাল ভট্টের মতে কেবল ব্রাহ্মণেরাই ব্রাহ্মণ জাতিকে দীক্ষা দিতে পারেন। নীচ জাতীয় লোক উচ্চ জাতিকে দীক্ষা দিতে পারেন না। মধ্যযুগে বাংলার বাহিরে রামানন্দ, কবীর, নানক প্রভৃতি যে প্রচলিত ধর্মবিশ্বাস ও সংস্কারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিয়া হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে অসাম্প্রদায়িকভারে কেবলমাত্র এক ভগবানে বিশ্বাস ও ভক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত সার্বজনীন ধর্ম্মের প্রচার করিতেছিলেন বাংলা দেশে ইঁহাদের পূর্বেই চর্যাপদে তাঁহার সুষ্ঠু ইঙ্গিত দেখিতে পাওয়া যায়। চৈতন্যদেবও এই প্রকার সার্বজনীন ধর্মই প্রচার করিয়াছিলেন-তবে তিনি কবীর ও নানকের মত প্রাচীন ধর্ম ও আচারের সহিত যোগসূত্র একেবারে ছিন্ন করেন নাই। কিন্তু চৈতন্যের পরবর্তীকালে এবং কতকটা পূর্বেও বৌদ্ধ ও বৈষ্ণব সহজিয়া এবং তান্ত্রিক মতের প্রভাবে এমন কতকগুলি সম্প্রদায় গড়িয়া উঠিল বা প্রভাবশালী হইল যাহার উপাসকেরা শাস্ত্রোক্ত ধর্মমত ওআচার-অনুষ্ঠান বর্জনপূর্বক কেবলমাত্র গুরুর নির্দেশে অথবা স্বীয় অন্তরের অনুভূতিজাত প্রেম, বৈরাগ্য, ভক্তি প্রভৃতি দ্বারা আধ্যাত্মিক প্রগতির পথ নির্ণয় করিত। শুরুর প্রতি অবিচলিত নিষ্ঠা ও ভক্তি এবং নির্বিচারে তাঁহার আদেশ পালন এই সকল সম্প্রদায়ের অনেকেরই বিশিষ্ট লক্ষণ ছিল।

বর্তমান যুগের আদর্শ ও সংজ্ঞা অনুসারে এই সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে যে অশ্লীলতা, দুর্নীতি ও ব্যভিচার ছিল এবং স্ত্রী-পুরুষের অবাধ মিলনে তাহা অনেক সময় উৎকটরূপে দেখা দিত সে সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নাই। ইহাদের মতামত ও সাধন প্রণালী অনেকটা গুহ্য রহস্যে আবৃত থাকিলেও ইহাদের বাহ্যিক ও আচার ব্যবহার সম্বন্ধে যেটুকু বিবরণ পাওয়া যায় তাহা হইতেই ইহা প্রতীয়মান হইবে। কিন্তু তথাপি মধ্যযুগের বাংলার সংস্কৃতিতে ইহাদের যে একটা বিশিষ্ট স্থান আছে এবং অনেকগুলির একটা ভাল দিকও আছে তাহা অস্বীকার করিবার উপায় নাই। এজন্য ইহাদের কয়েকটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিতেছি।

তান্ত্রিক সাধন প্রণালী বহু প্রাচীন এবং একটি স্বতন্ত্র ধর্মসাধনার ধারা। পরবর্তীকালে বৌদ্ধ, শৈব, বৈষ্ণব প্রভৃতি সকল ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যেই ইহার প্রভাবযুক্ত এক বা একাধিক ছোটখাট দল গড়িয়া উঠিয়াছে। সুতরাং সাধারণত তান্ত্রিক সম্প্রদায় শাক্ত বলিয়া গণ্য হইলেও তান্ত্রিক, শৈব, বৈষ্ণব, বৌদ্ধ সম্প্রদায়ও আছে। তন্ত্রশাস্ত্রের কথা পূর্বে উল্লিখিত হইয়াছে। এই শাস্ত্রে তান্ত্রিকদিগকে বেদাচারী, বৈষ্ণবাচারী, শৈবাচারী, দক্ষিণাচারী, বামাচারী, সিদ্ধান্ত চারী এবং কৌলাচারী প্রভৃতি ক্রমোচ্চ নানা পর্যায়ে বিভক্ত করা হইয়াছে। সুতরাং ইহাদের মধ্যে কৌলাচারীই সর্বশ্রেষ্ঠ। কেহ এই সম্প্রদায়ে প্রবেশ করিতে ইচ্ছুক হইলে তাহাকে ঐ সম্প্রদায়ভুক্ত একজনের নিকট দীক্ষা নিতে হয় এবং দিবাভাগে নানাবিধ অনুষ্ঠানের পর ঘোষণা করিতে হয় যে সে পূর্বেকার ধর্মসংস্কার সমস্ত পরিত্যাগ করিল এবং ইহার প্রমাণস্বরূপ তাঁহার বৃদ্ধিশ্রাদ্ধ ক্রিয়া সম্পন্ন হয়। রাত্রিকালে গুরু ও শিষ্য আটজন বামাচারী তান্ত্রিক পুরুষ এবং আটটি স্ত্রীলোক (নর্তকী ও তাঁতির কন্যা, গণিকা, ধোপানী, নাপিতের স্ত্রী বা কন্যা, ব্রাহ্মণী, একজন ভূস্বামীর কন্যা ও গোয়ালিনী)সহ একটি অন্ধকার কক্ষে প্রবেশ করে এবং প্রতি পুরুষের পাশে একটি স্ত্রীলোক বসে। গুরু তখন শিষ্যকে নিম্নলিখিতরূপ উপদেশ দেন। আজি হইতে লজ্জা-ঘৃণা, শুচি-অশুচি জ্ঞান জাতিভেদ প্রভৃতি সমস্ত ত্যাগ করিবে। মদ্য, মাংস, স্ত্রীসম্ভোগ প্রভৃতি দ্বারা ইন্দ্রিয়বৃত্তি চরিতার্থ করিবে কিন্তু সর্বদা ইষ্টদেবতা শিবকে স্মরণ করিবে এবং মদ্য মাংস প্রভৃতি ব্রহ্মপদে লীন হইবার উপাদান স্বরূপ মনে করিবে। ইহার পর নানা প্রক্রিয়া ও মন্ত্র সহকারে সকলেই মদ্য পান ও মাংস ভক্ষণ করে–গোমাংসও বাদ যায় না। মদ্য পান। করিতে করিতে চেলা সম্পূর্ণ বেহুঁস হইয়া পড়ে তখন সে অবধূত সংজ্ঞা পায় এবং তাঁহার নূতন নামকরণ হয়। তারপর গুরু ও অন্যান্য সকলে চলিয়া যায় কেবলমাত্র চেলা ও একটি স্ত্রীলোক থাকে। তান্ত্রিকরা অনেক বীভৎস আচরণ করে, যেমন মানুষের মৃতদেহের উপর বসিয়া মড়ার মাথার খুলিতে উলঙ্গ স্ত্রী-পুরুষের একত্র সুরাপান ইত্যাদি।

তান্ত্রিকেরা তাহাদের এই সমুদয় আচারের সমর্থনকল্পে যে দার্শনিক তথ্যের অবতারণা করে তাঁহার মর্ম এই : কাম, ক্রোধ ইত্যাদি ব্যসন মানুষকে পাপের পথে চালিত করে। এই সমুদয় দূর না করিতে পারিলে মোক্ষ লাভ হয় না। শাস্ত্রকারেরা এই জন্য কঠোর তপস্যা ও ইন্দ্রিয় সংযমের বিধান দিয়াছেন। কিন্তু ইহা খুবই কষ্টকর–প্রায় অসাধ্য বলিলেই হয়। তান্ত্রিক বামাচারীরা এইজন্য প্রলোভন পরিহার ও ইন্দ্রিয় নিরোধের পরিবর্তে অপরিমিত ও যথেচ্ছ ইন্দ্রিয় বৃত্তির চরিতার্থ দ্বারা মানুষের মনকে ইহা হইতে বিমুখ করেন। অর্থাৎ পুনঃ পুনঃ অভ্যাসের ফলে এই সমুদয়ের প্রতি আর কোন আকর্ষণ থাকে না এবং এইভাবে ইন্দ্রিয় বৃত্তির নিরোধ হয়। বামাচারীরা বলে যে সাধারণ সন্ন্যাসীরা কঠোরতা অবলম্বন করিয়া অর্থাৎ সংসার হইতে দূরে থাকিলেই নিরাপদ থাকেন। কিন্তু বামাচারীরা প্রলোভন সম্মুখে থাকিলেও ইন্দ্রিয় বৃত্তি নিরোধ করিতে সমর্থন হন।

বৈষ্ণব সহজিয়ারা এই তান্ত্রিক দর্শনের ভিত্তিতেই পরকীয়া প্রেমের প্রতিষ্ঠা করে। প্রেমের দ্বারা ভগবানকে লাভ করাই তাহাদের চরম লক্ষ্য। সুতরাং প্রথমে নর-নারীর প্রেমের মধ্য দিয়াই এই প্রেমের স্বরূপ উপলব্ধি করিতে হইবে। নিজের স্ত্রী অপেক্ষা অন্য নারীর প্রতি আসক্তিই বেশি প্রবল হয় সুতরাং ইহাই এই প্রেমের প্রথম সোপান এবং প্রথমে স্থূল দেহজাত ও নিকৃষ্ট প্রবৃত্তি হইলেও ক্রমে ইহা ভগবানের প্রতি প্রেমে পরিণত হয়। কেহ কেহ আবার ইহার সঙ্গে আর একটু যোগ করে। মানুষের মন কাম প্রবৃত্তিতে চঞ্চল হয়। তাহা চরিতার্থ হইলেই মন শান্তভাব অবলম্বন করে এবং তাহাকে ভগবানের ধ্যানে সমাহিত করা যায়। কেহ কেহ মানবদেহের শিরা উপশিরার উপর ইহার প্রভাব অর্থাৎ কুণ্ডলিনী শক্তির জাগরণ প্রভৃতি নানা ব্যাখ্যা করেন।

সহজিয়ারা অনেক শাখায় বিভক্ত–যেমন আউল, বাউল, শাই, দরবেশ, নেড়া, সহজিয়া প্রভৃতি। ইহা ছাড়া কর্ত্তাভজা, স্পষ্টদায়ক, সখীভাবক, কিশোরী ভজনী, রামবল্লভি, জগনন্মাহিনী, গৌড়বাদী, সাহেবধানী, পাগলনাথি, গোবরাই প্রভৃতি সম্প্রদায়ও অনেক সহজিয়া শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করেন। এই সমুদয় বিভিন্ন শাখায় সহজিয়াদের ধর্মমত সামাজিক প্রথা ও সাধন প্রণালীর মধ্যে যথেষ্ট প্রভেদ থাকিলেও গুরুবাদ, স্ত্রী পুরুষের অবাধ মিলন ও পরকীয়া প্রেমের মাহাত্ম সকলেই স্বীকার করে। ইহাদের উৎসবে স্ত্রীলোকের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা থাকায় বহু স্ত্রীলোক ইহাতে যোগ দেয়। ঘোষপাড়া, রামকেলি, নদীয়া, শান্তিপুর, খড়দহ, কেন্দুলি, এবং বীরভূম, বাঁকুড়া ও মেদিনীপুর জিলায় সহজিয়াদের বহু কেন্দ্র আছে। সহজিয়াদের শাস্ত্র সবই প্রায় হাতে লেখা পুঁথিতে পাওয়া যায়–কিন্তু ইহার ভাষা সান্ধ্যভাষা-সাংকেতিক ও দুর্বোধ্য। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে সহজ বাংলা ভাষায় লিখিত কয়েকখানি পুঁথি আছে। এই সকল শাস্ত্রে পরকীয়া প্রেমের সমর্থনে কেবল তন্ত্রশাস্ত্র নহে, অথর্ব-সংহিতা, ছান্দোগ্যোপনিষৎ ও বৌদ্ধ কথাবতুর উল্লেখ করা হইয়াছে। অথর্বের উক্তি এস্থলে প্রযোজ্য নহে–কারণ ইহাতে স্ত্রীলোকের সহিত একাধিক ভূতপূর্ব স্বামীর মিলনের কথা আছে। ইহাতে স্ত্রীলোকের বহু বিবাহ প্রমাণিত হয় কিন্তু পরকীয়া প্রেম সমর্থিত হয় না। ছান্দোগ্যোপনিষদে দ্বিতীয় প্রপাঠকে ত্রয়োদশ খণ্ডের ‘ন কাঞ্চন পরিহরেৎ’ এই বচনে পরস্ত্রী সংগমের অনুমোদন আছে। শঙ্করাচার্যের ভাষ্যে ইহা বিশদরূপে ব্যাখ্যাত হইয়াছে। তবে তিনি লিখিয়াছেন “পরস্ত্রীগমনের নিষেধ বিধায়িকা স্মৃতি এই বামদেব্য সামোপনসা ভিন্ন অন্য স্থানেই বুঝিতে হইবে।” কিন্তু ইহা খুব প্রবল যুক্তি নহে–কারণ একখানি শ্রেষ্ঠ প্রামাণিক উপনিষদ যদি কোন উপাসনায় পরস্ত্রীগমন অনুমোদন করে তবে তান্ত্রিক ও সহজিয়ারা সেই দৃষ্টান্ত দ্বারা নিজেদের সমর্থন করিতে পারে।

বৌদ্ধগ্রন্থ কথাব্যুতে ‘একাধিপ্লয়ো’ নামক একটি প্রথার উল্লেখ আছে। যে কোন স্ত্রী-পুরুষ পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হইলে তাহাদের দৈহিক মিলন হইতে পারে।

এই সকল দৃষ্টান্তের উল্লেখ দেখিয়া মনে হয় যে পরকীয়া-প্রেমের ভিত্তিতে ভগবপ্রাপ্তির সাধনা হয়ত একটি প্রাচীন সাধনার ধারার অনুকরণ ঊধ্বতন মাত্র। অন্ততঃ বর্তমান যুগে আমরা ইহাকে যে চক্ষে দেখি মধ্য ও প্রাচীন যুগের দৃষ্টিভঙ্গি তাহা হইতে অন্যরূপ ছিল। এই প্রসঙ্গে স্মরণ রাখা কর্তব্য যে মধ্যযুগের কয়েকজন প্রধান স্মার্ত পণ্ডিতও তন্ত্রোক্ত সাধনার ধারাকে স্বীকার করিয়া লইয়াছেন। প্রাচীন যুগের শেষ পর্যন্ত শাস্ত্রকারেরা ইহাকে ধর্ম্মানুষ্ঠান বলিয়া স্বীকার করেন নাই।

এই সহজিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেকগুলি মধ্যযুগের শেষ পর্যন্ত সুপরিচিত ছিল। কয়েকটি এখনও আছে। দু একটির বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করিতেছি। কর্ত্তাভজা সম্প্রদায় আউলাদ নামক এক সাধু অষ্টাদশ খ্রীষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নদীয়া জিলার নানা স্থানে ইহা প্রচার করেন। ১৭৬৯ খ্রীষ্টাব্দে তাঁহার মৃত্যু হইলে নৈহাটির নিকট ঘোষপাড়া নিবাসী সদ্‌গোপ জাতীয় রামশরণ পাল ইহার কর্ত্তা হন। তিনি জাতিভেদ মানিতেন না এবং হিন্দু মুসলমান উভয়ই তাঁহার শিষ্য ছিল। এই সম্প্রদায়ের লোক কর্ত্তা বা গুরুকে সাক্ষাৎ ভগবান বা কৃষ্ণ বলিয়া মনে করিত এবং তাহাকেই ইষ্টদেবতা জ্ঞানে পূজা করিত। ক্রমে এই সম্প্রদায়ের খুব সমৃদ্ধি হয় ও ভক্তের সংখ্যা অসম্ভব বৃদ্ধি হয়। এই দলের মধ্যে নিম্নজাতীয় স্ত্রীলোকের সংখ্যাই ছিল খুব বেশি এবং গোপীরা কৃষ্ণকে যেমনভাবে কায়মনপ্রাণে ভজন, করিত ইহারাও সেইরূপ করিত। ঘোষপাড়ার মেলায় লক্ষাধিক লোকের সমাগম হইত, ইহার মধ্যে স্ত্রীলোকের সংখ্যাই ছিল অত্যন্ত অধিক। উনবিংশ শতাব্দীতেও রামশরণ পালের পুত্র রামদুলাল পালের অধ্যক্ষতায় এই সম্প্রদায় খুব প্রভাবশালী ছিল কিন্তু ঐ যুগের নীতির আদর্শ অনুসারে ইহাদের নীতি ও আচরণ খুব নিন্দনীয় বলিয়া পরিগণিত হইল। ইহার ফলে এই সম্প্রদায়ের প্রতিপত্তি নষ্ট হয়।

‘স্পষ্টদায়ক’ সম্প্রদায় ছিল কর্ত্তাভজার ঠিক বিপরীত। এই সম্প্রদায়ের লোকেরা গুরুকে ভগবানের অবতার মনে করিত না এবং তাঁহার কর্তৃত্বও খুব সীমাবদ্ধ ছিল। মুর্শিদাবাদ জিলার অন্তর্গত সৈদাবাদনিবাসী কৃষ্ণচন্দ্র চক্রবর্তীর শিষ্য রূপরাম কবিরাজ ইহার প্রতিষ্ঠা করেন। কর্ত্তাভজা দলের ন্যায় ইহারও বহু সংখ্যক গৃহস্থ শিষ্য ছিল। কিন্তু কর্তৃত্ব ছিল একদল সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীর হাতে। ইহারা একসঙ্গে এক মঠে ভ্রাতা ভগিনীর ন্যায় বাস করিত। ইহারা কৃষ্ণ ও চৈতন্যের স্তুতিমূলক গান গাহিয়া নৃত্য করিত। সন্ন্যাসীরা ভদ্রঘরের মেয়েদের আধ্যাত্মিক উপদেশ দিত। এই সকল মেয়েরাও মঠে আসিত। কলিকাতাই ইহাদের প্রধান কেন্দ্র ছিল।

সখীভাবক সম্প্রদায়ের পুরুষ ভক্তেরা স্ত্রীলোকের পোষাক পরিত, স্ত্রীলোকের নাম ধারণ করিত, এবং স্ত্রীলোকের ন্যায় কৃষ্ণ ও চৈতন্যের নামে নৃত্য গীত করিত। নিম্নশ্রেণীর লোকেরা ইহাদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করিত। মালদহ জিলার জঙ্গলিটোলা ইহাদের প্রধান কেন্দ্র ছিল। জয়পুর ও কাশীতেও এই সম্প্রদায়ের কিছু প্রতিপত্তি ছিল।

বর্তমান যুগের দৃষ্টিতে এই সকল সম্প্রদায়ের অনেক প্রথা ও ব্যবস্থা আপত্তিজনক ও অশ্লীল বলিয়া মনে হইলেও ইহাদের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য বিশেষ লক্ষণীয়। মধ্যযুগে বীর, নানক প্রভৃতি সাধুসন্তেরা যেমন প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্রের বিধি ও হিন্দুর প্রচলিত ধর্ম্মানুষ্ঠান ও সামাজিক বিধান সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করিয়া এক উদার বিশ্বজনীন ধর্ম্মের প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন এবং ইহার মূল ভিত্তি ছিল কেবলমাত্র ভগবান ও ভক্তের মধ্যে ঐকান্তিক প্রেম ও ভক্তি, বাংলার সহজিয়াদের মধ্যেও সেই ভাবের বিকাশ দেখিতে পাওয়া যায়। কিন্তু ইহার উৎস ছিল বাংলার বৌদ্ধ সহজিয়া মতের গ্রন্থ। এই সমুদয় গ্রন্থ মধ্যযুগে বা ইহার অনতিপূর্বে রচিত হইয়াছিল এবং এই প্রাচীন সহজিয়া সাধনার ধারাই যে বৈষ্ণব সহজিয়াদের মধ্যে প্রবাহিত হইয়াছিল তাহাতে সন্দেহ করিবার কোন কারণ নাই। সুতরাং বাংলার এই সাধনা যে মধ্যযুগে ভারতের অন্যান্য স্থানের অনুরূপ সাধনার পূর্ববর্তী এবং কবীর, নানক প্রভৃতির দৃষ্টান্ত বা ইসলামীয় সুফী প্রভাবের ফল নহে তাহা সহজেই অনুমান করা যায়। ইহার প্রমাণস্বরূপ সরোরুহপাদের (অর্থাৎ সরহপাদের ‘দোহাকোষ’ নামক গ্রন্থের সারমর্ম বর্ণনা করিতেছি।

“ধর্ম্মের সূক্ষ্ম উপদেশ গুরুর মুখ হইতে শুনিতে হইবে, শাস্ত্র পড়িয়া কিছু জ্ঞান লাভ হইবে না। গুরু যাহা বলিবেন, নির্বিচারে তাহা পালন করিবে।”

ষড়দর্শন খণ্ডন করিয়া সরোরুহ জাতিভেদের তীব্র ও বিস্তৃত প্রতিবাদ করিয়াছেন। তিনি বলেন, “ব্রাহ্মণ ব্রহ্মার মুখ হইতে হইয়াছিল; যখন হইয়াছিল, তখন হইয়াছিল, এখন ত অনন্যও যেরূপে হয়, ব্রাহ্মণও সেরূপে হয়, তবে আর ব্রাহ্মণত্ব রহিল কি করিয়া? যদি বল, সংস্কারে ব্রাহ্মণ হয়, চণ্ডালকে সংস্কার দেও, সে ব্রাহ্মণ হোক; যদি বল বেদ পড়িলে ব্রাহ্মণ হয়, তারাও পড়ক”। “হোম করিলে মুক্তি যত হোক না থোক, ধোঁয়ায় চক্ষের পীড়া হয় এই মাত্র।”

বেদ সম্বন্ধে উক্তি :

“বেদ ত আর পরমার্থ নয়, বেদ কেবল বাজে কথা বলে।”

বিভিন্ন ধর্ম্মের সাধু সন্ন্যাসীর সম্বন্ধে উক্তি :

‘ঈশ্বরপরায়ণেরা গায়ে ছাই মাখে; মাথায় জটা ধরে, প্রদীপ জ্বালিয়ে ঘরে বসিয়া থাকে, ঘরে ঈশান কোণে বসিয়া ঘণ্টা চালে, আসন করিয়া বসে, চক্ষু মিটমিট করে, কানে খু খুস্ করে ও লোককে ধাঁধা দেয়।’

‘ক্ষপণকেরা জৈন সাধু) আপনার শরীরকে কষ্ট দেয়, নগ্ন হইয়া থাকে এবং আপনার কেশোৎপাটন করে। যদি নগ্ন হইলে মুক্তি হয় তাহা হইলে শৃগাল কুকুরের মুক্তি আগে হইবে, যদি লোমোৎপাটনে মুক্তি হয় তবে…(তা জুবই নিত্যম্বহ’ ইতি), ময়ূরপুচ্ছ গ্রহণ করিলে যদি মুক্তি হয় তবে ময়ূর ও মৃগের মুক্তি হওয়া উচিত, তৃণ আহার করিলে যদি মুক্তি হয় তাহা হইলে হাতি-ঘোড়ার আগে মুক্তি হওয়া উচিত।’

‘যে বড় বড় শ্রমণ (বৌদ্ধ) স্থবির আছেন, কাহারও দশ শিষ্য, কাহারও কোটি শিষ্য সকলেই গেরুয়া কাপড় পরে, সন্ন্যাসী হয় ও লোক ঠকাইয়া খায়।’

‘সহজ পন্থা ভিন্ন পন্থাই নাই। সহজ পন্থা গুরুর মুখে শুনিতে হয়। যে যে উপায়েই মুক্তির চেষ্টা করুক না কেন, শেষে সকলকে সহজ পথেই আসিতে হইবে।’

এই সমুদয় উক্তির ঐতিহাসিক মূল্য খুবই গুরুতর। প্রচলিত সংস্কার আচার ও ধর্ম্মানুষ্ঠানের বিরুদ্ধে যুক্তিমূলক বিদ্রোহ আমাদিগকে বাংলার উনবিংশ শতাব্দীর নব জাগরণ বা রেনেসাঁসের (Renaissance) কথা স্মরণ করাইয়া দেয়। আর এই সাধনের ধারা যে মধ্যযুগে অব্যাহত গতিতে প্রবাহিত হইয়াছিল, বৈষ্ণব সহজিয়াদের অনুরূপ ধর্মমত তাহা প্রতিপন্ন করে। এই সহজিয়াদের একটি প্রকৃষ্ট নিদর্শন–বাউল সম্প্রদায়। ইহা এখনও একেবারে বিলুপ্ত হয় নাই এবং ইহাদের অনেক গানের মধ্য দিয়া আমরা সহজিয়া মতের প্রতিধ্বনি শুনিতে পাই। ধর্ম সম্প্রদায়ে সাধারণত যেরূপ প্রথাবদ্ধতা, গতানুগতিকতা, এবং রীতিপ্রবণতা দেখা যায়, বাউলেরা তাহা হইতে অনেকটা মুক্ত।

ভক্ত ও ভগবানের সম্বন্ধ ব্যক্তিগত অনুভূতির উপর প্রতিষ্ঠিত; দলবদ্ধ আচার অনুষ্ঠান পূজাপদ্ধতির সহিত তাঁহার কোন সম্বন্ধ নাই–বরং এগুলি তাহাদের মধ্যে ব্যবধানের সৃষ্টি করে মাত্র এবং মানুষ যে অনুষ্ঠানের ও ধর্মমতের অপেক্ষা অনেক বড় এই গানগুলির মধ্য দিয়া তাহা অতি সুন্দর ও সহজভাবে ফুটিয়া উঠিয়াছে। এ বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞের মত সংক্ষেপে উদ্ধৃত করিতেছি : [ক্ষিতিমোহন সেন, বাংলার সাধনা, ৭৬-৮৪ পৃ.]

“বাউলেরা জাতি, পঙতি, তীর্থপ্রতিমা, শাস্ত্রবিধি, ভেখ-আচরণ মানেন না। মানবতত্ত্বই তাদের সার। মানবের মধ্যে সর্ববিশ্বচরাচর, সেখানেই সাধনা। তাঁদের সাধনার মূল তত্ত্ব হল প্রেম। কাজেই ভগবানের সঙ্গে সমান হতে হবে। ভগবানও ঐশ্বর্যময়, বিশ্বপতি হলে হবে কি, প্রেমে তিনি ধরা দিতেই ব্যাকুল। তাই বাউল বলেন–

জ্ঞানের অগম্য তুমি প্রেমেতে ভিখারী।

এই বাউলেরা শাস্ত্রবিধি মানেন না। … আর পাগল তো কোন নিয়মের ধার ধারে না। তাই তাঁরা দেওয়ানা বা পাগল। বাউল বা বাতুল কথার অর্থও পাগল। বাউলেরা তাই গান করেন

তাই তো বাউল হৈনু ভাই।
এখন বেদের ভেদ বিভেদের
আর তো দাবি দাওয়া নাই।

লোক চলাচলের পথ বন্ধ্যা। তাতে ঘাসটুকুও জন্মাতে পারে না।–

গতাগতের বাংঝা পথে
আজায় না ঘাস কোনমতে।

এই লোকাঁচারের বন্ধ্যা পথে বাউলেরা অগ্রসর হতে নারাজ। তাই তাঁরা লোক প্রচলিত বিধিও মানেন না, আবার প্রাণহীন অবাস্তব তত্ত্বও বোঝেন না। তাঁরা চান মানুষ, কিন্তু সে মানুষ আস্ত মানুষ, যে সমাজের ভগ্নাংশ নয়। সেই পরিপূর্ণ মানুষই ব্যক্তি, ইংরেজীতে যাকে বলে পার্সনালিটি। তার মধ্যেই যে সব–

আদ্য অন্ত এই মানুষের, বাইরে কোথাও নাই। [চণ্ডীদাসের উক্তি স্মরণীয়—”সবার উপরে মানুষ সত্য তাঁহার উপরে নাই।”]

লোকমত এবং সম্প্রদায়গুলিই তো ভগবানের দিকে যাবার প্রেমপথের সব বাধা–

তোমার পথ ঢাইক্যাছে মন্দিরে মসজেদে।
তোমার ডাক গুনি সাঁই, চলতে না পাই
রুখে দাঁড়ায় শুরুতে মরশেদে ॥

এই জীবন্ত প্রেম কি মৃত শাস্ত্রের কাছে মেলে? তার খবর মেলে জীবন্ত মানুষের কাছে। তাঁরাই গুরু। শাস্ত্ৰষ্কারগ্রস্ত শুরু হলে চলবে না, চাই প্রেমে-প্রাণে-রসে ভরপুর গুরু। তিনি যে বিশেষ একটি মানুষ তা নয়। নিখিল চরাচরের সবকিছুই শুরু হয়ে আমার অন্তরে দিনের পর দিন অনন্তকাল ধরে সেই দীক্ষা দিচ্ছেন। তাই বাউলদের–

অধিক গুরু, পথিক গুরু, গুরু অগণন।
গুরু বলে কার্কে প্রণাম করবি মন?

আমাদের জীবন থেকে ভগবানকে নির্বাসিত করে রেখেছি। সেই জেলখানার নামই ঠাকুর ঘর। সেখানে দিনের মধ্যে এক আধটুকু সময় গিয়ে ঠাকুরের সঙ্গে দেখা বা মোলাকাত করে আসি। এইটুকু মোলাকাতেই মন তৃপ্ত হবে! যদি তিনি প্রেমময় প্রাণেশ্বর, তবে তাঁকে সর্বকাল ও জীবনের সর্বস্থান ছেড়ে দিতে হবে না?–

ও তোর কিসের ঠাকুর ঘর?
(যারে) ফাটকে তুই রাখলি আটক
তারে আগে খালাস কর।

সহজিয়া বৈষ্ণবদের সহিত বাউলদের কিছু প্রভেদ আছে। সহজিয়া বৈষ্ণবগণ রাধা ও কৃষ্ণের প্রেমের মধ্য দিয়া পরমাত্মার উপলব্ধি করেন। বাউলদের মতে প্রত্যেক ব্যক্তির অন্তরেই পরমাত্মা আছেন, তাঁহার সহিত যোগাযোগ স্থাপন করিতে পারিলেই পরমাত্মা বা ভগবানের উপলব্ধি হয়। এই মনের মানুষই বাউলের ভগবান এবং তাঁহার সহিত প্রত্যক্ষ সম্বন্ধ স্থাপনই বাউলের চরম ও পরম লক্ষ্য। এবং এই সম্বন্ধ প্রেমের মধ্য দিয়াই স্থাপিত হয়। অনেকে মনে করেন যে বাউলদের উপর সুফী সম্প্রদায়ের প্রভাব আছে। কিন্তু সুফীমতের উপর যে উপনিষদ ও সহজিয়ার যথেষ্ট প্রভাব আছে এবং সুফীদের চিন্তা ও সাধনার ধারা যে ভারতবাসীদের নিকট কোন নূতন তথ্য উপস্থিত করে নাই, ইহাও অনেকেই স্বীকার করিয়াছেন।

ভারতবর্ষের মধ্যযুগে যে বিশিষ্ট ধর্ম সম্প্রদায় নিরপেক্ষ, যুক্তিমূলক, আচার অনুষ্ঠানবর্জিত, জাতিভেদ ও সর্বপ্রকার শ্রেণীভেদরহিত, কেবলমাত্র ব্যক্তিগত ও বিশুদ্ধ অন্তর্নিহিত প্রেম ও ভক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত এই উদার সার্বজনীন ধর্মমত ভগবানকে লাভ করিবার প্রকৃষ্ট পথ বলিয়া কবীর, নানক, চৈতন্য প্রভৃতি বহু সাধুসন্ত প্রচার করিয়াছিলেন তাহা এই যুগের ধর্ম্মের ইতিহাসে একটি বিশিষ্ট মর্যাদা লাভ করিয়াছে। অনেকেই মনে করেন যে ইসলামের সহিত ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ইহার উৎপত্তির অন্যতম কারণ। কিন্তু বাংলা দেশের বৌদ্ধ ও বৈষ্ণব সহজিয়ারা যে মুসলমান সংস্পর্শে আসিবার বহু পূর্ব হইতেই এই সাধনার ধারার সহিত পরিচিত ছিল তাহা অস্বীকার করিবার উপায় নাই। সুতরাং ইহা বাংলার সংস্কৃতির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বলিয়া গ্রহণ করাই যুক্তিসঙ্গত। কবীর বা নানকের উপর ইসলাম কতটা প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল, এই গ্রন্থে তাঁহার আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু চৈতন্যের জীবনী ও ধর্মমত সম্বন্ধে যতটুকু জানিতে পারা যায় তাহাতে ইসলামের কোন প্রভাব কল্পনা করার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নাই। চৈতন্যের সহিত কবীর, নানক প্রভৃতির প্রভেদও বিশেষ লক্ষণীয়। চৈতন্য কৃষ্ণকে ঈশ্বর বলিয়া স্বীকার করিতেন। পুরীতে জগন্নাথ মূর্ত্তি দেখিয়া তাঁহার ভাবাবেশ হইয়াছিল। তিনি বৃন্দাবন প্রভৃতি তীর্থের মাহাত্ম স্বীকার করিতেন। জাতিভেদ না মানিলেও তিনি ইহা কিংবা প্রাচীন হিন্দুপ্রথা ও অনুষ্ঠান একেবারে বর্জন করেন নাই। কিছুকাল পরেই তাঁহার সম্প্রদায় জাতিভেদ ও ব্রাহ্মণদের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করিয়া লইয়াছিলেন। এই সমুদয়ই কবীর, নানক ও ইসলামীয় ধর্মমতের সম্পূর্ণ বিরোধী। চৈতন্যের ধর্মমতের সহিত ইহাদের যে সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়, তাহা প্রাচীন বৌদ্ধ সহজিয়ার প্রভাবেরই ফল, এই মত গ্রহণ করাই অধিকতর যুক্তিসঙ্গত। অর্থাৎ চৈতন্য ও বৈষ্ণব সহজিয়াগণ সকলেই প্রাচীন বৌদ্ধ সহজিয়ার সাধনা দ্বারাই অল্প বা বেশি পরিমাণে প্রভাবান্বিত হইয়াছিলেন। অন্য কোন বিদেশী প্রভাব স্বীকার করিবার প্রয়োজন নাই এবং ইহার সপক্ষে কোন যুক্তি বা প্রমাণও নাই। নাথ সম্প্রদায়ও অনেকটা সহজিয়াদের মতন–কেহ বৌদ্ধ ধর্ম হইতে কেহ বা হিন্দুধর্ম হইতে নাথ পন্থা গ্রহণ করেন।

এই নাথ বা যুগী সম্প্রদায়ও বাংলা দেশে খুব প্রভাবশালী হইয়াছিল এবং ক্রমে ভারতবর্ষের নানাস্থানে ছড়াইয়া পড়িয়াছিল। কায়-সাধন, হঠযোগ প্রভৃতি প্রক্রিয়ার সাহায্যে নানারূপ অলৌকিক শক্তি অর্জন এবং মৃত্যুর হাত হইতে পরিত্রাণ লাভ করাই ছিল ইহাদের লক্ষ্য। এই সম্প্রদায়ের গুরু গোরক্ষনাথ এবং শিষ্যা রাণী ময়নামতী ও তাঁহার পুত্র গোপীচান্দের কাহিনী বাংলা সাহিত্যের মাধ্যমে বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছে। এই সম্প্রদায় এখন কানফাটা যোগী নামে পরিচিত এবং বাংলার বাহিরে বিহার, নেপাল, উত্তর প্রদেশ, পঞ্জাব, গুজরাট ও মহারাষ্ট্রে এখনও ইহারা বহুসংখ্যায় বিদ্যমান। সংস্কৃত, হিন্দী, পঞ্জাবী, মারাঠি ও ওড়িয়া ভাষায় রচিত ধর্মশাস্ত্র এককালে এই সম্প্রদায়ের বিস্তৃতি ও প্রাধান্যের সাক্ষ্য দিতেছে।

ধর্মঠাকুরের পূজা এখনও পশ্চিমবঙ্গে কোন কোন স্থানে প্রচলিত আছে। শূন্যপুরাণ ও ধর্মপূজা বিধান নামে এই সম্প্রদায়ের দুইখানি বাংলা ভাষায় রচিত ধর্মশাস্ত্রে এই লুপ্তপ্রায় সম্প্রদায়ের পরিচয় ও পূজার অনুষ্ঠান বিবৃত হইয়াছে। বর্তমানে হাড়ী, ডোম, বাগদী প্রভৃতি নিম্নশ্রেণীর মধ্যেই ইহা প্রচলিত। কিন্তু ধর্মমঙ্গল নামক এক শ্রেণীর গ্রন্থ হইতে ইহার পূর্বপ্রভাব ও অনেক কাহিনী জানা যায়। এক অমিতবলশালী যোদ্ধা লাউসেনের যুদ্ধবিজয়কে কেন্দ্র করিয়াই এই সমুদয় কাহিনী রচিত হইয়াছে। ইহাদের মতে লাউসেন পালরাজগণের সমসাময়িক ছিলেন; কিন্তু ইহার কোন প্রমাণ নাই। সুতরাং লাউসেন কাল্পনিক ব্যক্তি বলিয়াই মনে হয়। কেহ কেহ ধর্মঠাকুরের পূজাকে বাংলায় বৌদ্ধধর্ম্মের শেষ নিদর্শন বলিয়া মনে করেন; কিন্তু বৌদ্ধধর্ম্মের স্পষ্ট উল্লেখ থাকিলেও ধর্মঠাকুরের পূজায় হিন্দুদের দেবী, তান্ত্রিক ধর্মমত এবং অনার্য আদিম জাতির ধর্মবিশ্বাসেরও যথেষ্ট নিদর্শন পাওয়া যায়। উচ্চশ্রেণীর হিন্দুদের বিরুদ্ধে এই সম্প্রদায়ের আক্রোশ এবং বিজেতা মুসলমানদের প্রতি সহানুভূতির কথা পূর্বেই উল্লেখ করা হইয়াছে। [এই অধ্যায়ের প্রারম্ভেই বর্ণিত]

এইরূপ আরও অনেক ধর্মমত প্রচলিত ছিল যাহা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম্মের অন্তবর্তী নহে এবং স্মৃতিশাস্ত্র অনুমোদিত আচার ব্যবহারেরও বিরোধী। দ্বাদশ শতাব্দী হইতেই বাংলায় বেদের পঠন-পাঠন এবং বৈদিক ক্রিয়াকর্মের প্রচলন অনেক কমিয়া গিয়াছিল এবং তান্ত্রিক মতের প্রভাব বাড়িয়াছিল। এমন কি, এই সকল মতের সমর্থনে পুরাণের অনুকরণে তাক্ষ্য, ব্রাহ্মণ, আগ্নেয়, বৈষ্ণব প্রভৃতি নামে কৃত্রিম পুরাণগ্রন্থ রচিত হইয়াছিল। তারপর মুসলমান আক্রমণের ফলে এয়োদশ শতাব্দীতে হিন্দুসমাজে অনেক বিপর্যয় ঘটে। বিশেষত অনেক লৌকিক ধর্ম প্রভাবশালী হইয়া উঠে এবং অনেক অনাচার সমাজে প্রবেশ করে। সমাজের নায়ক স্মার্ত পণ্ডিতগণের উপর ইহার প্রতিক্রিয়া দুই বিপরীত রকমের হয়। এক দল এই নূতন ভাবধারা ও আচার ব্যবহার কতক পরিমাণে স্বীকার করিয়া প্রাচীনের সহিত নূতনের সামঞ্জস্য সাধন করিতে চাহেন। অপর দল ইহাদিগকে আধুনিক এই আখ্যা দিয়া ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করেন। প্রথম শ্রেণীভুক্ত দুইজন প্রধান স্মার্ত ছিলেন শূলপাণি ও শ্রীনাথ আচার্য চূড়ামণি। শূলপাণি তান্ত্রিক ধর্ম এবং ইহার শাস্ত্র অপ্রামাণিক বলিয়া একেবারে ত্যাগ করেন নাই বরং পুরাণ ও প্রাচীন স্মৃতির অনুমোদন না থাকিলেও দোল, রাসলীলা প্রভৃতি বিধিসঙ্গত হিন্দু আচরণ বলিয়া গ্রহণ করেন। শ্রীনাথ আচার্য আরও অনেক দূর অগ্রসর হইলেন। তিনি বলিলেন যে শাস্ত্র বহির্ভূত হইলেও দেশপ্রসিদ্ধ আচার ব্যবহারও প্রামাণিক বলিয়া স্বীকার করিতে হইবে। তিনি এই সূত্র অনুযায়ী মৎস্যভক্ষণ প্রভৃতি অনুমোদন করিলেন।

তান্ত্রিক ধর্ম ও আচার পুরাপুরি সমর্থন না করিলেও তিনি তান্ত্রিকগ্রন্থগারুড় তন্ত্র, রুদ্র-যামল, শৈবাগম প্রভৃতি হইতে অনেক শ্লোক উদ্ধৃত করিয়াছেন। বল্লালসেন তাঁহার দানসাগরে তান্ত্রিক ও এই শ্রেণীর অর্ব্বাচীন গ্রন্থগুলিকে ভণ্ড প্রতারকের লেখা বলিয়া একেবারে বর্জন করিয়াছিলেন। সুতরাং দেখা যায় যে মধ্যযুগের প্রথম ভাগেই গোঁড়া হিন্দুদের ভিতরেও পরিবর্তনের সূত্রপাত হইয়াছিল। কিন্তু ইহা বেশীদূর অগ্রসর হয় নাই, কারণ প্রাচীনপন্থী স্মার্ত গোবিন্দানন্দ, অচ্যুত চক্রবর্তী, প্রভৃতি এই নূতন পন্থার তীব্র প্রতিবাদ করেন। এমন কি শ্রীনিবাস আচার্যের শিষ্য রঘুনন্দন ভট্টাচার্যও গুরুর অনেক মত খণ্ডন করিয়া প্রাচীন পদ্ধতি সমর্থন করিয়াছেন। রঘুনন্দন অগাধ পণ্ডিত ও সুনিপুণ নৈয়ায়িকের কৌশলসহকারে যে সমুদয় মত প্রতিষ্ঠা করিলেন বাংলার রক্ষণশীল হিন্দুসমাজ তাহাই গ্রহণ করিল। পরে আধুনিক স্মার্তদের প্রতিপত্তি ধীরে ধীরে কমিয়া গেল। কিন্তু রঘুনন্দনও তন্ত্রশাস্ত্র সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করেন নাই এবং কোন কোন বিষয়ে তন্ত্রের সাহায্যে স্মৃতির ব্যাখ্যা করিয়াছেন।

কিন্তু সমাজে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম্মের প্রাচীন আদর্শও অনেক পরিমাণে খর্ব হইল। বৃহদ্ধর্ম্মপুরাণ সম্ভবত এয়োদশ-চতুর্দ্দশ শতকের বাংলা দেশের ধর্ম ও সামাজিক পরিবর্তনের নিদর্শন বলিয়া গ্রহণ করা যাইতে পারে। ইহাতে বলা হইয়াছে যে ব্রাহ্মণেরা মদ্য, মাংস, মৎস্য সহকারে দেবপূজা করিতে পারে, শাস্ত্রানুসারে নরবলি দিতে পারে, আপকালে শূদ্রদিগকে ধর্মোপদেশ ও মন্ত্র দান করিতে পারে এবং পুরাণ পাঠ করিয়া শুনাইতে পারে।

যবন অর্থাৎ মুসলমানদের প্রতি তীব্র বিদ্বেষ এবং ঘৃণাও এই গ্রন্থে পরিস্ফুট হইয়াছে। উক্ত হইয়াছে যে যবনের সংস্পর্শ ও তাহাদের ভাষা ব্যবহার সুরাপানের তুল্য দূষণীয়। তাহাদের অনুগ্রহণ আরও দূষণীয় এবং ম্লেচ্ছ যবনী সংসর্গ সর্বদা পরিত্যজ্য।

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে যে ধর্মজীবনের চিত্র দেখিতে পাই তাহাও স্মৃতিশাস্ত্রের আদর্শ হইতে সম্পূর্ণ বিভিন্ন। চৈতন্য ভাগবতকার দুঃখের সহিত বলিয়াছেন যে ভক্তিমূলক বৈষ্ণব ধর্ম লোপ পাইয়াছে। ধর্ম্মের নামে যাহা প্রচলিত তাহা হয় তান্ত্রিক সাধনা অথবা লৌকিক দেবদেবীর পূজা। এক তান্ত্রিক সাধনার কথা তিনি লিখিয়াছেন :

রাত্রি করি মন্ত্র পড়ি পঞ্চ কন্যা আনে।
নানাবিধ দ্রব্য আইসে তা সবার সনে ॥
ভক্ষ্য ভোজ্য গন্ধমাল্য বিবিধ বসন।
খাইয়া তা সবা সঙ্গে বিবিধ রমন ॥

‘মদ্য, মাংস দিয়া যক্ষ পূজার ‘কথাও লিখিয়াছেন। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে নর-কপাল হস্তে যোগিনীর ভিক্ষা করার কথা আছে। পূর্বে সহজিয়া প্রসঙ্গে তান্ত্রিক অনুষ্ঠানের ইঙ্গিত দেওয়া হইয়াছে। শক্তিতত্ত্বমূলক তান্ত্রিক সাধনা যে প্রাচীন কাল হইতেই প্রচলিত এবং মধ্যযুগেই ইহা বঙ্গদেশীয় স্মার্তগণের স্বীকৃতি লাভ করে তাহা পূর্বেই বলা হইয়াছে। তান্ত্রিক শাক্ত সাধনার প্রভাব বৌদ্ধ, শৈব, বৈষ্ণব সকল ধর্ম্মেই দেখা যায়। মূলতঃ বেদান্তের ব্রহ্ম ও মায়া, সাংখ্যের পুরুষ ও প্রকৃতি এবং তন্ত্রের শিব ও শক্তি একই তত্ত্বের বিভিন্ন দিক বলিয়া গ্রহণ করা যাইতে পারে। ক্রমে ক্রমে বিষ্ণু ও লক্ষ্মী, কৃষ্ণ ও রাধা এবং রাম ও সীতা–এই সকল যুগলও এই তত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত হইয়াছেন। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে ইঁহারা সকলেই অভিন্ন এবং আজ পর্যন্তও রাধা-শ্যাম, ভবানী শঙ্কর, সীতা-রাম প্রভৃতি একই ভগবানের বিভিন্ন মূর্ত্তিরূপে পূজা পাইয়া আসিতেছেন। নানারূপে বিভিন্ন ধর্মমতের এই অপূর্ব সমন্বয় বা সামঞ্জস্য বাংলায় মধ্যযুগের হিন্দুধর্ম্মের একটি বৈশিষ্ট্য।

চৈতন্যভাগবতকার বর্ণিত মঙ্গলচণ্ডী, মনসা বা বাশুলী প্রভৃতি লৌকিক দেবীগণের পূজা এই যুগের আর একটি বৈশিষ্ট্য। এই সকল দেবীর মাহাত্ম-বর্ণন ও পূজা প্রচলনের জন্য এক শ্রেণীর কাব্যের উদ্ভব হয়। এইগুলি মঙ্গলকাব্য নামে পরিচিত। সেকালে পাঁচালী গায়করা ইহা অবলম্বন করিয়া গান গাহিত।

মঙ্গলকাব্য বাংলার নিজস্ব সম্পদ, ভারতবর্ষের অন্য কোন প্রদেশে নাই। বাংলা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যে সমুদয় অখ্যাত বা অল্পখ্যাত দেবদেবীর পূজা প্রচলিত ছিল, অথবা যে সব দেবদেবী প্রসিদ্ধ হইলেও সমাজের উচ্চকোটিতে স্বীকৃতি বা সম্মানের আসন পান নাই, প্রধানত তাঁহারাই মঙ্গলকাব্যের উপজীব্য। ইহাদের মধ্যে মনসা, মঙ্গলচণ্ডী, শীতলা, কালিকা, ষষ্ঠী, কমলা, বাশুলী, গঙ্গা, বরদা, গোসানী, ঘণ্টাকর্ণ প্রভৃতির নাম করা যাইতে পারে। এই সকল মঙ্গলকাব্য ও তাহাদের কাহিনী পঞ্চদশ পরিচ্ছেদে আলোচিত হইয়াছে। ইহাদের মধ্যে মনসা ও মঙ্গলচণ্ডীকাঁদেবীর মাহাত্ম কীর্তন করিয়া কয়েকজন প্রসিদ্ধ কবি কাব্য রচনা করিয়াছেন। এগুলি পাঁচালীগানের বিষয়বস্তু হওয়ায় এই দুই দেবী সমাজের সর্বশ্রেণীর জনপ্রিয়তা লাভ করিয়াছেন। কাজেই তাঁহাদের মর্যাদা ও ভক্তের সংখ্যাও বাড়িয়াছে।

শুধু দেবীমাহাত্ম্য বর্ণনা করাই প্রসিদ্ধ মঙ্গলকাব্যগুলির উদ্দেশ্য নহে। যে আদ্যাশক্তি সৃষ্টির মূল কারণ, যিনি চণ্ডীরূপে মার্কণ্ডেয় পুরাণে পূজিতা এবং সাংখ্যে প্রকৃতি বলিয়া অভিহিতা, সেই মহাদেবী আর উল্লিখিত লৌকিক দেবীগণ যে অভিন্ন ইহা প্রতিপাদন করা তাহাদের অন্যতম উদ্দেশ্য। মনসা ও মঙ্গলচণ্ডী সম্পর্কীয় কাব্যে ইহা পরিস্ফুট হইয়াছে। মনসা প্রাচীন পৌরাণিক যুগের দেবী নহেন। সর্প-দেবী নামে তিনি নানা স্থলে পূজিতা হইতেন এবং ক্রমে শিবের কন্যা বলিয়া খ্যাতি লাভ করেন। শিবভক্ত চাঁদ সদাগর যখন অবজ্ঞাভরে মনসাকে পূজা করিতে কিছুতেই রাজী হইলেন না তখন দৈববাণী হইল যে মনসা ও ভগবতী একই দেবী। চাঁদ সদাগর ইহা মানিয়া লইয়া মনসাকে পূজা করিয়া স্তব করিলেন : ‘আদ্যাশক্তি সনাতনী, মুক্তিপদ-প্রদায়িনী, জগতে পূজিতা তুমি জয়া।

মনসাও তখন তাঁহার স্বরূপ প্রকট করিলেন :

আকাশ পাতাল ভূমি       স্বজন সফল আমি
শক্তিরূপা সবাকার মাতা।
মহেশের মহেশ্বরী      মনোরূপা সুকুমারী
লক্ষ্মীরূপা নারায়ণ যথা ॥

মঙ্গলচণ্ডী কাব্যের আরাধ্যা দেবী অস্পৃশ্য ব্যাধ সমাজের দেবী। তিনি বনে গোধিকারূপে ব্যাধ কালকেতুকে দেখা দেন এবং শূকর মাংস তাঁহার পূজায় ব্যবহৃত হয়। খুল্লনার আরাধ্যা দেবী এই দেবী হইতে ভিন্ন এবং সভ্য ভব্য সমাজে মেয়েদের ব্রতের দেবী। কিন্তু মঙ্গলচণ্ডী কাব্যের প্রসাদে এই দুই দেবী মিলিয়া গিয়াছেন এবং পুরাণোক্তা মহাদেবী দুর্গা ও চণ্ডীদেবীর সহিত অভিন্ন বলিয়া পরিগণিত হইয়াছেন।

এইরূপে ষষ্ঠী, শীতলা প্রভৃতি মঙ্গলকাব্যে শঙ্করগৃহিণী শৈলসুতা রূপে বর্ণিত হইয়াছেন। ব্যাঘভয় নিবারণী কমলা দেবীও ‘সকলের শক্তি’ ও ‘জগতের মাতা, ‘পরম ঈশ্বরী জগতের মা’ এবং ‘ব্রহ্মা বিষ্ণু হর’ তাঁহাকে নিত্য পূজা করেন।

আজ পর্যন্ত এই সকল দেবদেবী প্রায় সর্বশ্রেণীরই পূজা পাইয়া আসিতেছেন। বাংলা সাহিত্যের মাধ্যমে ও পাঁচালীর গানে এই সকল দেবীর মাহাত্ম প্রচারই ইহার পথ প্রশস্ত করিয়াছে। সম্ভবত আর একটি কারণও ছিল। যখন দলে দলে নিম্নশ্রেণীর হিন্দুরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করিতেছিল তখন এই বিপর্যয়ের প্রতিকার স্বরূপ উচ্চশ্রেণীর হিন্দুরা এই সকল দেবীকে সম্মান ও স্বীকৃতি দিয়া নিম্নশ্রেণীদিগকে হিন্দুত্বের গণ্ডীর মধ্যে রাখিবার প্রয়াস পাইয়াছিলেন। মনে হয় এই কারণেই স্মার্ত রঘুনন্দন কৃত্য-তত্ত্ব অধ্যায়ে এই সকল লৌকিক দেবীদের পূজার বিধি দিয়াছেন। চণ্ডীমঙ্গলের কালকেতু আখ্যানেও নিম্নশ্রেণীর আর্থিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির কথাই ঘোষিত হইয়াছে। সংস্কৃত সাহিত্যে যে শ্রেণীর অধিকার ছিল না, বাংলা সাহিত্যের উদ্ভবে সেই শ্রেণীর দাবি ও সংস্কৃতি সমাজের সকল স্তরের কর্ণগোচরে আনার সুযোগ মিলিয়াছিল।

এই বাংলা সাহিত্যের কল্যাণেই আমরা স্মৃতি-বহির্ভূত ধর্ম্মের আরও কিছু বিবরণ পাই। ব্যাঘ্ৰ কুম্ভীরাদিকে দেবতা শ্রেণীর পর্যায়ভুক্ত করা ও তৎসংশ্লিষ্ট বহু কুসংস্কারপূর্ণ অনুষ্ঠানের কথা পূর্বেই বলা হইয়াছে। হিন্দু ও মুসলমান উভয় সমাজেই ইহা প্রচলিত ছিল।

জলদেবতা কুম্ভীরবাহনকালুরায় ও অরণ্যদেবতা শার্দুলবাহন দক্ষিণরায়-এই দুই দেবতার পূজা এখনও প্রচলিত আছে।

মধ্যযুগের শেষে যে হিন্দুদের মধ্যে সতীদাহ, গঙ্গায় সন্তানবিসর্জন, চড়কের আত্মঘাতী বীভৎস যন্ত্রণা প্রভৃতি নিষ্ঠুর প্রথা প্রচলিত ছিল তাহাও এই সংস্কারেরই পরিণতি মাত্র।

মধ্যযুগে প্রবর্তিত যে কয়েকটি নূতন ধর্ম্মানুষ্ঠান এখনও বাংলা দেশে বিশেষ প্রভাবশালী, তাহাদের মধ্যে দুর্গাপূজা ও কালীপূজা এই দুইটিই প্রধান। ইহার মুখ্য কারণ তান্ত্রিক সাধনার সহিত এই দুই অনুষ্ঠানের নিগূঢ় সংযোগ।

বর্তমানকালে যে পদ্ধতিতে দুর্গাপূজা হয় চতুর্দ্দশ শতাব্দী বা তাঁহার কিছু পূর্বেই তাঁহার সূত্রপাত হইয়াছিল; কিন্তু সম্ভবত ষোড়শ শতকের পূর্বে তাহা ঠিক বর্তমান আকার ধারণ করে নাই।

চৈতন্যভাগবতে [মধ্য-২৩ অধ্যায়] আছে :

মৃদঙ্গ মন্দিরা শঙ্খ আছে সর্ব ঘরে।
দুর্গোৎসব কালে বাদ্য বাজাবার তরে ॥

ইহা হইতে বুঝা যায় যে ষোড়শ শতাব্দীর পূর্বেই দুর্গাপূজা খুব জনপ্রিয় হইয়া উঠিয়াছিল। প্রচলিত প্রবাদ এই যে মনুসংহিতার বিখ্যাত টীকাকার কুল্লুক ভট্টের পুত্র রাজা কংস নারায়ণ নয় লক্ষ টাকা ব্যয় করিয়া দুর্গাপূজা করেন এবং রাজসাহী জেলার অন্তর্গত তাহিরপুরের রাজপুরোহিত পণ্ডিত রমেশ শাস্ত্রী যে দুর্গাপূজাপদ্ধতি রচনা করেন তাহাই এখন পর্যন্ত প্রচলিত। অবশ্য ইহার সপক্ষে কোনও প্রমাণ নাই এবং অন্যমতও আছে। তবে দুর্গাপূজা প্রথম হইতেই সাত্ত্বিক ভাবে সাধনার অপেক্ষা রাজসিক সমারোহ ও জাঁকজমকপূর্ণ উৎসব বলিয়াই পরিগণিত হইত।

মিথিলার কবি বিদ্যাপতি দুর্গাভক্ততরঙ্গিনীতে কার্তিক, গণেশ, জয়া-বিজয়া (লক্ষ্মী-সরস্বতী) এবং দেবীর বাহন সিংহ সমেত প্রতিমায় শারদীয়া দুর্গাপূজার উল্লেখ করিয়াছেন। সুতরাং মিথিলায়ও চতুর্দ্দশ শতকে অনুরূপ দুর্গাপূজার প্রচলন ছিল। ভারতের আর কোনও অঞ্চলে এই প্রকার দুর্গাপূজা প্রচলিত ছিল, এরূপ কোন প্রমাণ নাই।

মধ্যযুগের প্রথম ভাগে দুর্গাপূজার সহিত সংশ্লিষ্ট অশ্লীল বাক্য উচ্চারণ ও ক্রিয়াদির সম্বন্ধে কালবিবেক ও বৃহদ্ধর্মের উক্তি পূর্বে উল্লেখ করিয়াছি। মধ্যযুগের শেষ পর্যন্ত যে এই সমুদয় অশ্লীলতা দুর্গাপূজার অঙ্গীভূত ছিল, বিদেশীয় একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ হইতে তাহা জানা যায়। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে লিখিত এই বিবরণের সার মর্ম দিতেছি।

“দিনের পূজা শেষ হইলে ধনী লোকের বাড়ীতে দেবীর মূর্ত্তির সম্মুখে একদল বেশ্যার নৃত্যগীত আরম্ভ হয়। তাহাদের পরিধেয় বস্ত্র এত সূক্ষ্ম যে তাহাকে দেহের আবরণ বলা যায় না। গানগুলি অতিশয় অশ্লীল এবং নৃত্যভঙ্গী অতিশয় কুৎসিত। ইহা কোন ভদ্র সমাজে উচ্চারণ বা বর্ণনার যোগ্য নহে। অথচ দর্শকেরা সকলেই ইহা উপভোগ করেন–কোন রকম লজ্জা বোধ করেন না।” লেখক ১৮০৬ খ্রীষ্টাব্দে কলিকাতায় রাজা রাজকৃষ্ণের বাড়ীতে এই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন।

পূজায় পাঁঠা ও মহিষ বলি সম্বন্ধে তিনি লিখিয়াছেন, “নদীয়ার বর্তমান মহারাজার পিতা পূজার প্রথম দিন একটি পাঁঠা বলি দেন। তারপর প্রতিদিন পূর্বদিনের দ্বিগুণ সংখ্যা এবং এইরূপে ১৬ দিনে ৩২,৭৬৮ পাঁঠা বলি দেন। একজন সম্ভ্রান্ত হিন্দু আমাকে বলিয়াছেন যে তিনি এক বাড়ীর পূজায় ১০৮টি মহিষ বলি দেখিয়াছেন।

“বলি শেষ হইলে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে উপস্থিত দর্শকবৃন্দ নিহত পশুর রক্তলিপ্ত কর্দম গায়ে মাখিয়া উন্মত্তের মত নাচিতে আরম্ভ করে এবং তারপর রাস্তায় বাহির হইয়া অশ্লীল গীত ও নৃত্য করিতে করিতে অন্যান্য পূজা-বাড়ীতে গমন করে।”

মোটের উপর একথা বলিলে অত্যুক্তি হইবে না যে দুর্গাপূজায় রাজসিক ও তামসিক ভাবের যেরূপ প্রাধান্য ছিল তদনুপাতে সাত্ত্বিক ভাবের পরিচয় বিশেষ কিছু পাওয়া যায় না।

বাংলা দেশে প্রচলিত কালীপূজার প্রবর্তক ছিলেন সম্ভবত কৃষ্ণানন্দ আগম বাগীশ। তাঁহার তন্ত্রসার গ্রন্থে কালীপূজার বিধান সংগৃহীত হইয়াছে। অনেকে মনে করেন কৃষ্ণানন্দ চৈতন্যদেবের সমসাময়িক। কিন্তু অনেকের মতে ‘তন্ত্রসার’ নামক তন্ত্রশাস্ত্রের সার-সঙ্কলন-গ্রন্থ পরবর্তী কালে রচিত।

দীপালি উৎসবের দিনে কালীপূজার বিধান ১৭৬৮ খ্রীষ্টাব্দে রচিত কাশীনাথের ‘কালীসপর্যাবিধি’ গ্রন্থে পাওয়া যায়। ইহার খুব বেশী পূর্বে কালীপূজা সম্ভবত বাংলাদেশে সুপরিচিত ছিল না। প্রচলিত প্রবাদ অনুসারে নবদ্বীপের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রই কালীপূজার প্রবর্তন করেন এবং কঠোর দণ্ডের ভয় দেখাইয়া তাঁহার প্রজাদিগকে এই পূজা করিতে বাধ্য করেন।

তন্ত্রসারে কালী ব্যতীত তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, বগলা প্রভৃতি মহাবিদ্যাগণের সাধনবিধিও সংকলিত হইয়াছে। এই সমুদয় দেবীকে অবলম্বন করিয়া বাংলায় তন্ত্রসাধন বিশেষ প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল। কৃষ্ণানন্দ, ব্রহ্মানন্দ, পূৰ্ণানন্দ ও সর্বনান্দ ঠাকুর প্রভৃতি বিখ্যাত শাক্ত সাধকগণ ষোড়শ সপ্তদশ শতাব্দীতে বর্তমান ছিলেন। অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে আর একজন বিখ্যাত কালীসাধক রামপ্রসাদ সেন তাঁহার গানের মাধ্যমে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন।

দুর্গাপূজা কালীপূজা অপেক্ষা প্রাচীনতর। কিন্তু দুর্গাপূজা সাত্ত্বিক সাধনার বিকাশ হিসাবে কালীপূজা অপেক্ষা অনেক নিম্নস্তরের। এইজন্য দুর্গাপূজার প্রচলন ও জাঁকজমক বেশি হইলেও বাংলা দেশে শক্তিসাধকের নিকট কালীপূজাই অধিকতর উচ্চস্তরের বলিয়া গণ্য হয়।

বাস্তব সমাজের চিত্র

১। নানা জাতি : স্মৃতিশাস্ত্রে হিন্দুর সামাজিক ও গার্হস্থ্য জীবন এবং লৌকিক ধর্মসংস্কার ও ধর্ম্মানুষ্ঠানের বিধান আছে। এই সমুদয় ও অন্যান্য সংস্কৃত গ্রন্থে যে আদর্শ হিন্দু সমাজের চিত্র পাওয়া যায়-বাস্তব জীবনে তাহা কতদূর অনুসৃত হইত তাহা বলা শক্ত। সমাজের বাস্তব চিত্র পাওয়া যায় সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যে। ষোড়শ শতাব্দীতে (আ. ১৫৭৯ খ্রীষ্টাব্দ) রচিত মুকুন্দরামের কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে কালকেতুর নূতন রাজধানী বর্ণনা উপলক্ষে এবং অন্যান্য প্রসঙ্গে যে সামাজিক চিত্র অঙ্কিত হইয়াছে তাহা বাংলা দেশের মধ্যযুগের বাস্তব চিত্র বলিয়া গ্রহণ করা যাইতে পারে। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীর অন্যান্য কয়েকখানি গ্রন্থে, বিশেষত বৈষ্ণব সাহিত্যে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত সমাজচিত্রও এ বিষয়ের মূল্যবান উপকরণ। এই সমুদয়ের সাহায্যে বাঙালী সমাজের যে চিত্র আমাদের মানসচক্ষুতে ফুটিয়া ওঠে তাঁহার কয়েকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করিতেছি।

বাংলার হিন্দু সমাজে ব্রাহ্মণ কায়স্থ বৈদ্য সাধারণত এই তিন জাতিরই প্রাধান্য ছিল। মুকুন্দরাম তাঁহার নিজের জন্মস্থান দামুন্যা গ্রামের বর্ণনা আরম্ভে লিখিয়াছেন :

কুলে শীলে নিরবদ্য        ব্রাহ্মণ কায়স্থ বৈদ্য
দামুন্যায় সজ্জন-প্রধান।

প্রায় একশত বৎসর পূর্বেও যে হিন্দুসমাজে এই তিন জাতিরই প্রাধান্য ছিল বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গল হইতেও আমরা তাহা জানিতে পারি। ব্রাহ্মণেরা নানা শ্রেণীতে বিভক্ত ছিলেন। বাংলা দেশের ইতিহাসের প্রথম ভাগে ব্রাহ্মণদের মধ্যে শ্রেণীবিভাগ, কৌলীন্যপ্রথা ও কুলীনদের বাসস্থানের নাম অনুসারে গাঞীর সৃষ্টি, এবং এ বিষয়ে কুলজীর উক্তি সবিস্তারে আলোচিত হইয়াছে। মুকুন্দরাম প্রায় চল্লিশটি গাঁঞীর উল্লেখ করিয়াছেন–চাটুতি, মুখটী, বন্দ্য, কাঞ্জিলাল, গাঙ্গুলি, ঘোষাল, পুতিতুণ্ড, মতিলাল, বড়াল, পিপলাই, পালধি, মাসচটক প্রভৃতি। ইহার অনেকগুলি এখনও বাঙালী ব্রাহ্মণের উপাধিস্বরূপ ব্যবহৃত হয়। এই ইতিহাসের প্রথম ভাগে মধ্যযুগের কুলজী বর্ণিত ব্রাহ্মণের শ্রেণীবিভাগ সম্বন্ধে যাহা বলা হইয়াছে কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে তাঁহার সমর্থন পাওয়া যায়।

ব্রাহ্মণদের মধ্যে একদল ছিলেন খুব সাত্ত্বিক প্রকৃতির ও বিদ্বান। বেদ, আগম, পুরাণ, স্মৃতি, দর্শন, ব্যাকরণ, অলঙ্কার প্রভৃতি শাস্ত্রে তাঁহাদের পারদর্শিতা ছিল ও নানা স্থান হইতে বিদ্যার্থীগণ তাহাদের নিকট পড়িতে আসিত। কিন্তু মূর্খ বিপ্রেরও অভাব ছিল না, সম্ভবত ইহাদের সংখ্যাই বেশি ছিল; তাই মুকুন্দরাম ইহার সবিস্ত রি বর্ণনা করিয়াছেন :

মুখ বিপ্র বৈসে পুরে         নগরে যাজন করে।
শিখিয়া পূজার অনুষ্ঠান।
চন্দন তিলক পরে          দেব পূজে ঘরে ঘরে
চাউলের কোচড়া বান্ধে টান্ ॥
ময়রাঘরে পায় খণ্ড         গোপঘরে দধিভাণ্ড
তেলি ঘরে তৈল কুপী ভরি।
কেহ দেয় চাল কড়ি          কেহ দেয় ডাল বড়ি
গ্রাম যাজী আনন্দে সাঁতরি ॥

বিবাহাদি অনুষ্ঠান শেষ হওয়ামাত্র ব্রাহ্মণ এক কাহন দক্ষিণা আদায় করিত। ঘটক ব্রাহ্মণেরা উপযুক্ত পুরস্কার না পাইলে বিবাহ-সভা মধ্যে কুলের অখ্যাতি করিত।

গ্রহ-বিপ্র অর্থাৎ দৈবজ্ঞ ব্রাহ্মণেরা শিশুর কোষ্ঠি তৈরি করিত এবং গ্রহদোষ কাটাইবার জন্য শান্তি স্বস্ত্যয়ন করিত। মুকুন্দরাম মঠপতি বর্ণবিপ্রগণের উল্লেখ করিয়াছেন। সম্ভবত যে সব বৌদ্ধ ব্রাহ্মণ্য ধর্ম গ্রহণ করিয়াছিল তাহারা হিন্দুসমাজে পুরাপুরি গৃহীত হইত না এবং সাধারণ ব্রাহ্মণেরা তাহাদের পৌরোহিত্য করিত না। এইজন্য বৌদ্ধমঠের শ্রমণেরাই তাহাদের পৌরোহিত্য করিত এবং বর্ণ-বিপ্র নামে পরিচিত হইত।

অগ্রদানী ব্রাহ্মণেরও উল্লেখ আছে। ইহারা শ্রাদ্ধ ও মৃত্যুকালীন দান গ্রহণ করিত, এই কারণে ‘পতিত’ বলিয়া গণ্য হইত।

বৈদ্য জাতির মধ্যে বর্তমান কালের ন্যায় সেন, গুপ্ত, দাস, দত্ত, কর, প্রভৃতি উপাধি ছিল।

উঠিয়া প্রভাত কালে          উদ্ধা ফোঁটা করি ভালে
বসন-মণ্ডিত করি শিরে।
পরিয়া লোহিত ধুতি           কাঁধে করি খুঙ্গি পুঁথি
গুজরাটে বৈদ্যজনে ফিরে ॥

বৈদ্যগণ সম্বন্ধে বলা হইয়াছে :

বটিকায় কার যশ           কেহ প্রয়োগের বশ
নানা তন্ত্র করয়ে বাখান।

ইহার অর্থ সম্ভবত এই যে কোন কোন বৈদ্য ঔষধের অর্থাৎ বটিকা সেবনের ব্যবস্থা করিতেন, আবার কেহ কেহ ঝাড়ফুঁক তন্ত্রমন্ত্রের সাহায্যে ব্যাধির উপশম করিতেন। রোগ কঠিন দেখিলে বৈদ্যেরা রোগীর বাড়ি হইতে নানা ছলে পলাইতেন। চিকিৎসা বৈদ্যদের প্রধান বৃত্তি হইলেও অন্যান্য শাস্ত্রেও তাঁহাদের পারদর্শিতা ছিল। বৈষ্ণবগ্রন্থে চৈতন্যের ভক্ত বৈদ্য চন্দ্রশেখরকে ব্রাহ্মণ বলা হইয়াছে এবং বৈদ্যজাতীয় পুরুষোত্তম ‘হরিভক্তি তত্ত্বসার সংগ্রহ’ গ্রন্থের উপসংহারে নিজে শর্মা উপাধি ব্যবহার করিয়াছেন।

কায়স্থগণের মধ্যে ঘোৰ, বসু, মিত্র উপাধিধারীরা ছিল কুলের প্রধান। ইহা ছাড়া পাল, পালিত, নন্দী, সিংহ, সেন, দেব, দত্ত, দাস, কর, নাগ, সোম, চন্দ, ভঞ্জ, বিষ্ণু, রাহা, বিন্দ প্রভৃতি উপাধিধারীরাও ছিল। বর্তমান কালে রথযাত্রার জন্য প্রসিদ্ধ মাহেশ গ্রামের ঘোষেদের বিশেষ উল্লেখ দেখিয়া মনে হয় ইহা কায়স্থদের একটি প্রধান সমাজ স্থান ছিল। ইহারা লেখাপড়া জানিত এবং কৃষিকার্য করিত।

বৈষ্ণব পদকর্ত্তাদের মধ্যে ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ এই তিন জাতির লোকই দেখিতে পাওয়া যায়।  

মধ্যযুগের ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ প্রভৃতি জাতির উৎপত্তি, ইতিহাস ও শ্রেণীভেদ এবং বিভিন্ন শ্রেণীর শাখা ও তদন্তৰ্গত পরিবারের কুলের উৎকর্ষ ও অপকর্ষ বিচার তদনুসারে তাহাদের মধ্যে বৈবাহিক সম্বন্ধ, ভোজ্যান্নতা প্রভৃতির বিস্তারিত আলোচনা এবং সামাজিক বহু খুঁটিনাটি বিবরণ লইয়া অনেক গ্রন্থ রচিত হইয়াছিল। ইহাদের নাম কুলজী অথবা কুল-শাস্ত্র এবং গ্রন্থকর্ত্তারা ঘটক নামে পরিচিত ছিলেন। এই ইতিহাসের প্রথম ভাগে এই গ্রন্থগুলির সংক্ষিপ্ত আলোচনা আছে। বঙ্গে বিভিন্ন শ্রেণীর ব্রাহ্মণাদি জাতির উৎপত্তি সম্বন্ধে ইহাদের বিবরণের যে কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নাই তাহা স্পষ্ট বলা হইয়াছে। কিন্তু যে শ্রেণীভেদের বর্ণনা আছে এবং বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে পরস্পর আহার ও বৈবাহিক সম্বন্ধ প্রভৃতি পরিচালনা করার জন্য যে সমুদয় রীতিনীতির উল্লেখ আছে তাহা মধ্যযুগের বাংলার সম্বন্ধে মোটামুটি সত্য বলিয়া গ্রহণ করা যাইতে পারে। বহু সংখ্যক কুলজী গ্রন্থের মধ্যে নিম্নলিখিত কয়েকখানি সবিশেষ প্রসিদ্ধ : [বিস্তৃত বিবরণ ‘ভারতবর্ষ’, ১৩৪৬ কার্তিক সংখ্যা, ৬৫৭ পৃষ্ঠা]

১। হরিমিশ্রের কারিকা
২। এডুমিশ্রের কারিকা
৩। ধ্রুবানন্দের মহাবংশাবলী
৪। নুলো পঞ্চাননের গোষ্ঠীকথা
৫। বাচস্পতি মিশ্রের কুলরাম
৬। বরেন্দ্র কুলপঞ্জিকা (এই নামে অভিহিত বহু ভিন্ন ভিন্ন পুঁথি পাওয়া গিয়াছে)
৭। ধনঞ্জয়ের কুলপ্রদীপ
৮। রামানন্দ শর্মার কুলদীপিকা
৯। মহেশের নির্দোশ কুলপঞ্জিকা
১০। সর্বানন্দ মিশ্রের কুলতত্ত্বার্ণব

৩ নং পুঁথি ছাপা হইয়াছে এবং ইহা সম্ভবত পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষে রচিত। ৬, ৭ ও ৮ নং গ্রন্থের নির্ভরযোগ্য কোন পুঁথি পাওয়া যায় নাই। অন্যগুলি ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীর পূর্বে রচিত এরূপ মনে করিবার কারণ নাই। ১০ নং গ্রন্থ ছাপা হইয়াছে কিন্তু ইহা যে পুঁথি অবলম্বন করিয়া রচিত তাঁহার কোন উল্লেখ নাই। নগেন্দ্র নাথ বসুর মতে ১ ও ২ নং গ্রন্থ ত্রয়োদশ ও দ্বাদশ শতাব্দীতে রচিত এবং ১ নং গ্রন্থ হরিমিশ্রের কারিকা সর্বাপেক্ষা প্রামাণিক গ্রন্থ। তিনি এই দুই গ্রন্থ হইতে অনেক উক্তি উদ্ধৃত করিয়া বাংলার জাতি সম্বন্ধে একটি মতবাদ প্রচার করিয়াছিলেন; কিন্তু বহু অনুরোধ-উপরোধ সত্ত্বেও ঐ দুইখানির পুথি কাহাকেও দেখান নাই। তাঁহার মৃত্যুর পরে অন্যান্য কুলজীর সহিত এই পুঁথিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্রয় করে। তখন দেখা গেল যে এই গ্রন্থও প্রাচীন নহে এবং বসু মহাশয়ের উদ্ধৃত অনেক উক্তিও এই পুঁথিতে নাই। সুতরাং এই দুই পুঁথির মূল্য খুব বেশি নহে।

কুলশাস্ত্রের সংখ্যা অনন্ত বলিলে অত্যুক্তি হয় না; কারণ, ঘটকগণের বংশধরগণ এইগুলি রক্ষা করিয়াছেন ও প্রয়োজনমত পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করিয়াছেন। মধ্যযুগে বাংলায় সামাজিক মর্যাদাভ যেরূপ আকাক্ষণীয় ছিল, সামাজিক গ্লানি এবং অপবাদও সেইরূপ মর্মপীড়াদায়ক ছিল। বস্তুত মধ্যযুগে বাঙালী হিন্দুর সম্মুখে উচ্চতর কোন জাতীয় ভাব বা ধর্ম্মের আদর্শ না থাকায় সামাজিক শ্রেণীবিভাগ ও তৎসম্পর্কিত বিচার বিতর্কদ্বারা সামাজিক মর্যাদালাভ জীবনের চরম ও পরম লক্ষ্য এবং জাতীয় ধীশক্তির প্রধান প্রয়োগক্ষেত্রে পরিণত হইয়াছিল। সুতরাং ইহা খুবই সম্ভব এবং স্বাভাবিক যে ঘটকগণকে অর্থদ্বারা বা অন্য কোন প্রকারে বশীভূত করিয়া ব্যক্তি বা সম্প্রদায়বিশেষ নিজেদের আভিজাত্য গৌরব বৃদ্ধি অথবা বিরুদ্ধ পক্ষের সামাজিক গ্লানি ঘটাইবার জন্য প্রাচীন কুলশাস্ত্রের মধ্যে অনেক পরিবর্তন করাইয়াছেন কিংবা নূতন কুলশাস্ত্র লিখাইয়া পুরাতন কোন ঘটকের নামে চালাইয়াছেন। বর্তমান যুগেও এইরূপ বহু কৃত্রিম কুলজী-পুঁথি রচিত হইয়াছে। ইহাতে আশ্চর্য বোধ করিবার কিছু নাই। কারণ, জাতির সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য ইহার উৎপত্তিসূচক প্রাচীন গ্রন্থ হইতে উদ্ধৃত অনেক বচন এবং অনেক তথাকথিত প্রাচীন সংহিতা ও তন্ত্রগ্রন্থ যে প্রকৃতপক্ষে আধুনিক কালে রচিত হইয়াছে ইহাতে কোন সন্দেহ নাই।

পূর্ব্বোক্ত কুলশাস্ত্রগুলিতে প্রধানত ব্রাহ্মণদের কথাই আছে। বহু বৈদ্য কুল পঞ্জিকার মধ্যে দুইখানি প্রামাণিক গ্রন্থ রামকান্ত দাম প্রণীত কবিকণ্ঠহার ১৬৫৩ খ্রীষ্টাব্দে এবং ভরত মল্লিক কৃত চন্দ্রপ্রভা ১৬৭৫ খ্রীষ্টাব্দে রচিত। কায়স্থদের বহু কুল-পঞ্জিকা আছে; কিন্তু, কোন গ্রন্থই প্রাচীন ও প্রামাণিক বলিয়া গ্রহণ করা যায় না।

কুলশাস্ত্র মতে হিন্দুযুগেই ব্রাহ্মণ, বৈদ্য ও কায়স্থ জাতির মধ্যে গুণানুসারে কৌলীন্য প্রথার প্রবর্তন হয়। কুলীন ব্রাহ্মণগণের মধ্যে আবার ‘মুখ্য’ ও ‘গৌণ’ এই দুই শ্রেণীভেদ হইল। অন্যান্য ব্রাহ্মণেরা শ্ৰোত্রিয়, কাপ (বংশজ), সপ্তশতী প্রভৃতি নামে আখ্যাত হইলেন। কৌলীন্য প্রথা প্রথমে ব্যক্তিগত গুণের উৎকর্ষের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল–কিন্তু ক্রমে ইহা বংশানুক্রমিক হয়। পরে নিয়ম হইল কুলীনকন্যা যে ঘরে প্রদত্ত হইবে আবার সেই ঘর হইতে কন্যা গ্রহণ করিতে হইবে এবং এইরূপ আদানপ্রদানের বিচার করিয়া মাঝে মাঝে কুলীনগণের পদমর্যাদা স্থির করা হইবে। এইরূপ ‘সমীকরণ’ অনেকবার হইয়াছে। সর্বশেষে সম্ভবত পঞ্চদশ খ্রষ্টাব্দে দেবীবর ঘটক কুলীনদের দোষ বিচার করিয়া কতককে কৌলীন্যচ্যুত করিলেন এবং অল্পদোষাশ্রিত অন্য কুলীনগণকে ছত্রিশ ভাগ অথবা মেল-এ বিভক্ত করিলেন। প্রতি মেলের মধ্যেও বিবাহাদি ক্রিয়া সম্বন্ধে এরূপ কঠোর নিয়ম করা হইল যে কালক্রমে কয়েকটি নির্দিষ্ট পরিবার ছাড়া অন্য কুলীন পরিবারের সহিতও কুলীনদের বিবাহ হইতে পারিত না। ইহারই ফলে কুলীন সমাজের পুরুষের বহু বিবাহ, কন্যার বেশি বয়স পর্যন্ত বা চিরকালের জন্য অনূঢ়তা ও অবশ্যম্ভাবী ব্যভিচারের উদ্ভব হইল। কোন কুলীন ৫০, ৬০ বা ততোধিক বিবাহ করিয়াছে, বা অশীতিপর বৃদ্ধের সহিত পিসী, ভাইঝি সম্পান্বিতা ১০ হইতে ৬০ বৎসর বয়স্কা ২০/২৫টি অনূঢ়ার একসঙ্গে বিবাহ হইয়াছে এরূপ দৃষ্টান্ত বিংশ শতাব্দীতেও দেখা গিয়াছে। বলা বাহুল্য অনেক বিবাহিতা কুলীন কন্যা বিবাহ রাত্রির পরে আর স্বামীর মুখ দর্শন করিবার সুযোগ পাইত না।

ব্রাহ্মণ, বৈদ্য কায়স্থ ব্যতীত অন্যান্য জাতি সম্বন্ধে বৃহদ্ধর্ম্ম ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অবলম্বনে প্রথম ভাগে যাহা বলা হইয়াছে তাহা মধ্যযুগ সম্বন্ধেও প্রযোজ্য। সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যে এরূপ অনেক জাতি ও তাহাদের বৃত্তির উল্লেখ আছে।

১। বণিক গোপ-ইহাদের ক্ষেতের ফসলে বাড়ি ভরা থাকিত।

“মুগ, তিল গুড় মাসে        গম সরিয়া কাপাসে
সভার পূর্ণিত নিকেতন।”

২। তেলি–ইহারা কেহ চাষ করিত, কেহ ঘানি হইতে তৈল করিত, কেহ কেহ তৈল কিনিয়া আনিয়া বিক্রয় করিত।

৩। কামার–কুড়ালি, কোদালি, ফাল, টাঙ্গী প্রভৃতি গড়িত।

৪। তাম্বুলী–পান, সুপারি এবং কর্পূর দিয়া বীড়া বান্ধিয়া বিক্রয় করিত।

৫। নাপিত–কুলকর্ম ছাড়াও ইহারা মাসোহারা পাইয়া পালোয়ানদের ডলাই মলাই করিত।

৬। মোদক–ইহারা চিনির কারখানা করিত এবং খণ্ড (পাটালি গুড়), লাড়, প্রভৃতি

“পসরা করিয়া শিরে       নগরে নগরে ফিরে
শিশুগণে করয়ে যোগান।”

৭। দুই শ্রেণীর দাস–“মৎস্য বেচে করে চাষ।
দুই জাতি বৈসে দাস ॥”

৮। কিরাত ও কোল–হাটে ঢোল বাজাইত।

৯। সিউলীরা–খেজুরের রস কাটিয়া নানাবিধ গুড় প্রস্তুত করিত।

১০। ছুতার–চিড়া কুটিত, মুড়ি ভাজিত, ছবি আঁকিত।

১১। পাটনী–নৌকায় পারাপার করিত, ইহার জন্য রাজকর আদায় করিত।

১২। মারহাটারা–“শোলঙ্গে পিলুই কাটে,
ঘানি ফাঁড়ে চক্ষে দিয়া কাটা।”

প্রথম পংক্তির অর্থ দুর্বোধ্য–সম্ভবত প্লীহা কাটার কথা আছে।

জীবিকার্জনের এই সমুদয় বৃত্তির সহিত বেশ্যাবৃত্তিরও উল্লেখ আছে। কামিলা বা কেয়ালা জাতিকে ‘জায়াজীব’ বলা হইয়াছে। সম্ভবত ইহারা স্ত্রীকে ভাড়া দিয়া জীবিকা অর্জন করিত।

ইহা ছাড়া ক্ষত্রি, রাজপুত প্রভৃতির উল্লেখ আছে। ইহারা মল্ল-বিদ্যা শিক্ষা করিত। বাগদিদের সম্বন্ধে বলা হইয়াছে–”নানাবিধ অস্ত্র ধরে দশ বিশ পাইক করি সঙ্গে।”

দ্বিজ হরিরামের চণ্ডীকাব্যে (১৬শ শতাব্দী) [বঙ্গ সাহিত্য পরিচয়, পৃ. ৩১৫] এইরূপ তালিকা আছে। ইহার মধ্যে শূদ্রযাজী ব্রাহ্মণ, অনুষ্ঠু, সদৃগোপ উল্লেখযোগ্য। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে (১৭৫২ খ্রীষ্টাব্দ) ভারতচন্দ্র ‘অন্নদামঙ্গলে বর্ধমান নগরীতে বিভিন্ন জাতির যে বর্ণনা দিয়াছেন তাঁহার সহিত দুই শত বৎসর পূর্বেকার উল্লিখিত কবিকঙ্কণ চণ্ডীর বর্ণনার যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে। সুতরাং এই দুইটি মিলাইয়া বাংলায় মধ্যযুগের বিভিন্ন জাতির বাস্তব চিত্র অঙ্কিত করা যায়। এখানেও প্রথমে ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য এই দুই জাতির উল্লেখ। তাঁহার পরেই আছে: [বন্ধনীর মধ্যে পাঠভেদ দেওয়া হইল। ২য় ভাগ-১৩ পৃ.]

কায়স্থ বিবিধ জাতি দেখে রোজগারি।
বেণে মণি গন্ধ সোনা কাঁসারি শাঁখারি।।
গোয়ালা তামুলী তিলী তাঁতী মালাকার।
নাপিত বারুই কুরী (চাষা) কামার কুমার ॥
আগরি প্রভৃতি (ময়রা) আর নাগরী যতেক।
যুগি চাসাধোবা চাসাকৈবর্ত অনেক ॥
সেকরা ছুতার নুড়ী ধোবা জেলে গুঁড়ী।
চাঁড়াল বাগদী হাড়ী ডোম মুচী শুঁড়ী ॥
কুরমী কোরঙ্গা পোদ কপালি তিয়র।
কোল কলু ব্যাধ বেদে মাল বাজীকর ॥
বাইতি পটুয়া কান কসবি যতেক।
ভাবক ভক্তিয়া ভাঁড় নর্তক অনেক ॥” [বঙ্গীয়-সাহিত্য পরিচয়-পৃ. ৩১৫]

শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে আচারিজ (আচার্য, দৈবজ্ঞ?), সগুনী (ব্যাধ বা শাকুন শাস্ত্রবিৎ), ঝালিয়া (ঐন্দ্রজালিক?), ও বাদিয়া (সাপুড়ে) প্রভৃতির উল্লেখ আছে। এগুলি কেবলমাত্র ব্যক্তিগত বৃত্তি অথবা বৃত্তিগত জাতি নির্দেশ করিতেছে কি না তাহা বুঝা যায় না।

মধ্যযুগে প্রাচীনযুগের ন্যায় ক্রীতদাস ও ক্রীতদাসী সমাজের একটি বিশিষ্ট অঙ্গ ছিল। ইসলামের বিধি অনুসারে হিন্দু কোন মুসলমান দাস রাখিতে পারিত না, কিন্তু মুসলমান হিন্দু দাস রাখিতে পারিত। মুসলমানেরা হিন্দু রাজ্য জয় করিয়া বহু হিন্দু বন্দীকে ইসলাম ধর্ম্মে দীক্ষিত করিয়া ক্রীতদাসরূপে ব্যবহার করিত। ইহারা গৃহে ভৃত্যের কার্যে নিযুক্ত হইত কিন্তু যুবতী স্ত্রীলোক অনেক সময়ই উপপত্নী বা গণিকাতে পরিণত হইত। মুসলমান সুলতানেরা ভারতের বাহির হইতে বহু ক্রীতদাস ও ক্রীতদাসী আনয়ন করিতেন। আফ্রিকার অন্তর্গত আবিসিনিয়া হইতে আনীত বহু দাস বাংলায় ছিল। ইহাদিগকে খোঁজা করিয়া রাজপ্রাসাদে দায়িত্বপূর্ণ কার্যে নিযুক্ত করা হইত। এই হাবসী খোঁজারা যে এককালে খুব শক্তিশালী ছিল এবং এমন কি বাংলার সুলতান পদে যে আসীন ছিল তাহা পূর্বেই বলা হইয়াছে। অন্যান্য অনেক মুসলমান ক্রীতদাসও মধ্যযুগে খুব উচ্চপদ অধিকার করিয়াছিল। কেহ কেহ রাজসিংহাসনেও প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। ইন্বতার ভ্রমণবিবরণী (চতুর্দ্দশ শতকের মধ্যভাগ হইতে জানা যায় যে, সে সময় বাংলা দেশে খুব সুবিধাতে দাসদাসী কিনিতে পাওয়া যাইত। ইবক্তৃতা একটি যুবতী ক্রীতদাসী ও তাঁহার এক বন্ধু একটি বালক ক্রীতদাস ক্রয় করিয়াছিলেন।

হিন্দুদের মধ্যেও দাসত্ব প্রথা প্রচলিত ছিল। দাসদাসীরা গৃহকার্যে নিযুক্ত থাকিত। অনেক সময় কোন কোন যুবতী স্ত্রীলোককে উপপত্নীরূপেও জীবন-যাপন করিতে হইত। দাস ব্যবসা খুব প্রচলিত ছিল। বহু বালক-বালিকা এবং বয়স্ক পুরুষ ও স্ত্রীলোক অপহৃত হইয়া দাসরূপে বিক্রীত হইত। এইরূপ ক্রয়-বিক্রয় প্রকাশ্যভাবে হইত। অনেক সময় লোকে নিজেকেই বিক্রয় করিত। এইরূপ বিক্রয়ের দলিলও পাওয়া গিয়াছে। মগ ও পর্তুগীজেরা যে দলে দলে স্ত্রী-পুরুষকে ধরিয়া নিয়া দাসরূপে বিক্রয় করিত তাহা পূর্বেই বলা হইয়াছে।

আমেরিকার দাসদের তুলনায় ভারতীয় দাস-দাসী অনেক সদয় ব্যবহার পাইত। তবে কোন কোন স্থলে দাসগণকে অত্যন্ত নির্যাতন আর লাঞ্ছনাও সহ্য করিতে হইত।

তঅষ্টাদশ শতাব্দীতে দাসত্ব প্রথা খুব ব্যাপকভাবে প্রচলিত হইয়াছিল। দুর্ভিক্ষের সময় অথবা দারিদ্র্যবশতঃ লোকে নিজেকে অথবা পুত্রকন্যাকে দাসখত লিখিয়া বিক্রয় করিত। তখনকার দিনে কলিকাতায় ইউরোপীয় ও ইউরেশিয়ান সমাজে দাস রাখা একটি ফ্যাশান হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। ১৭৮৫ খ্রষ্টিাব্দে সার উইলিয়ম জোনস্ জুরীদিগকে উদ্দেশ্য করিয়া বলিয়াছিলেন “এই জনবহুল শহরে এমন কোন পুরুষ বা স্ত্রীলোক নাই বলিলেই চলে যাহার অন্তত একটিও অল্পবয়স্ক দাস নাই। সম্ভবত আপনারা সকলেই দেখিয়াছেন কিরূপে দাস-শিশুর দল বোঝাই করিয়া বড় বড় নৌকা গঙ্গা নদী দিয়া কলিকাতায় ইহাদের বিক্রয় করিবার জন্য লইয়া আসে। আর ইহাও আপনারা জানেন যে এই সব শিশু হয় অপহৃত না হয় ত দুর্ভিক্ষের সময় সামান্য কিছু চাউলের বিনিময়ে ক্রীত।” আফ্রিকা, পারস্য উপসাগরের উপকূল, আর্মেনিয়া, মরিশাস্ প্রভৃতি স্থান হইতে কলিকাতার দাস চালান হইত। বাংলা দেশ হইতেও বহু দাস-দাসী ইউরোপীয়ান বণিকেরা ভারতের বাহিরে চালান দিত। কলিকাতায় কয়েকটি ইংরেজ রীতিমত ক্রীতদাসের ব্যবসা করিত এবং এই উদ্দেশ্যে কেবল বাহির হইতে দাস-দাসীই আনিত না তাহাদের সন্তান-সন্ততিও বিক্রয় করিত। কলিকাতায় ইউরোপীয় ও ইউরেশিয়ান পরিবার দাস-দাসীদের উপর নিষ্ঠুর অত্যাচার করিত। ১৭৮৯ খ্রীষ্টাব্দে ইংরেজ গভর্নমেন্ট ভারত হইতে ক্রীতদাস বাহিরে পাঠানো বে-আইনী বলিয়া ঘোষণা করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে দাসত্ব-প্রথা ও দাস-ব্যবসা রহিত হয়।

সমসাময়িক সাহিত্য হইতে প্রমাণিত হয় যে মধ্যযুগে বাংলা দেশে তথাকথিত অনেক নিম্নশ্রেণী নানা কারণে সমাজে মর্যাদা লাভ করিয়াছিল।

হাড়ী, ডোম প্রভৃতি যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শিতার জন্য সম্মান পাইত। মাণিকচন্দ্র রাজার গানে আছে যে রাজা গোবিন্দচন্দ্রের মাতা তাঁহাকে এক হাড়ী জাতীয় গুরুর কাছে দীক্ষা নিতে বলিয়াছিলেন। শূন্যপুরাণ-রচয়িতা ডোম জাতীয় রামাই পণ্ডিত ধর্ম্মের পূজার পুরোহিত ছিলেন এবং ব্রাহ্মণণাচিত মর্যাদা পাইতেন। সহজিয়া ধর্ম্মে চণ্ডালীমার্গ এবং ডোম্বীমার্গ মুক্তির সাধনস্বরূপ বর্ণিত হইয়াছে। চণ্ডীদাসের সহিত রজকিনীর নাম পদাবলীতে যুক্ত আছে। স্মৃতি ও পুরাণের গণ্ডীর বাহিরে সহজিয়া, তান্ত্রিক, নাথ প্রভৃতি যে সকল নব্যপন্থী ধর্মসম্প্রদায়ের উদ্ভব হইয়াছিল তাহারাই বর্ণাশ্রম ধর্ম্মের গণ্ডীর বাহিরে এই সকল নিম্ন জাতিকে উচ্চ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিল। নাথ সম্প্রদায়ভুক্ত যোগীরাও সে যুগে বর্তমান কালের তুলনায় অনেক উচ্চ স্থান অধিকার করিত।

সুবৰ্ণবণিক, গন্ধবণিক প্রভৃতি জাতির লোক বাণিজ্য করিয়া লক্ষপতি হইত এবং সমাজে খুব উচ্চ স্থান অধিকার করিত। মঙ্গলকাব্যগুলিতে এই শ্রেণীর প্রাধান্য বর্ণিত হইয়াছে। স্মার্ত রঘুনন্দন সমুদ্রযাত্রা নিষেধ করিয়াছিলেন। কিন্তু বণিকেরা যে এই নিষেধ না মানিয়া সমুদ্রপথে বাণিজ্য করিত, মঙ্গলকাব্যে তাঁহার ভূরি ভূরি প্রমাণ আছে। এই ব্যাপারে বাস্তবের সহিত আদর্শের প্রভেদ অত্যন্ত বিস্ময়কর মনে হয়। অসম্ভব নহে যে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য প্রভৃতি উচ্চবর্ণেরা যাহাতে অর্থলালসায় কুলোচিত ধর্ম বিসর্জন দিয়া বণিকবৃত্তি অবলম্বন না করে সেইজন্যই রঘুনন্দন সমুদ্রযাত্রা নিষিদ্ধ করিয়াছিলেন।

এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে গন্ধবণিক, সুবর্ণবণিক প্রভৃতি জাতির মধ্যে উচ্চ শিক্ষার প্রচলন ছিল এবং ষষ্ঠীবর সেন, গঙ্গাদাস সেন প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করিয়াছেন। মধুসূদন নাপিত নলদময়ন্তী কাহিনী বাংলা কবিতায় বর্ণনা করিয়াছেন (১৮০৯ খ্রী)। তিনি লিখিয়াছেন যে তাঁহার পিতা এবং পিতামহও সাহিত্যক্ষেত্রে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে মাঝি কায়েৎ, রামনারায়ণ গোপ, ভাগ্যমন্ত ধুপী প্রভৃতি পুঁথি লেখকরূপে উল্লিখিত হইয়াছেন। [K.K. Datta. History of Bengal Subah, p.8] ইহা হইতে বুঝা যায় যে শিক্ষা ও জ্ঞান কেবল উচ্চশ্রেণীর মধ্যেই আবদ্ধ ছিল না।

ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ ব্যতীত অন্যান্য জাতির লোকও ধর্ম সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। সদ্‌গোপ জাতীয় রামশরণ পাল কর্ত্তাভজা সম্প্রদায়ের প্রধান অধ্যক্ষ ছিলেন।

পূর্বেই বলা হইয়াছে যে যবনের সৃষ্ট ভোজ্য বা পানীয় গ্রহণ করিলে হিন্দুর জাতিপাত হইত। ‘চৈতন্যচরিতামৃতে সুবুদ্ধি রায়ের কাহিনী ইহার একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। সুলতান হোসেন শাহ বাল্যকালে সুবুদ্ধি রায়ের অধীনে চাকরি করিতেন। এবং কর্তব্য কাজে অবহেলার জন্য সুবুদ্ধি তাঁহাকে চাবুক মারিয়াছিলেন। সুলতান হইবার পর হোসেন শাহের পত্নী এই কথা শুনিয়া সুবুদ্ধির প্রাণ বধ করার প্রস্তাব করেন। সুলতান ইহাতে অসম্মত হইলে তাঁহার স্ত্রী কহিলেন, তবে তাঁহার জাতি নষ্ট কর। অতএব “কয়োয়ার পাণি তার মুখে দেয়াইলা” অর্থাৎ মুসলমানের পাত্র হইতে জল খাওয়াইয়া সুবুদ্ধি রায়ের জাতিধর্ম নষ্ট করা হইল। সুবুদ্ধি কাশীতে গিয়া পণ্ডিতদের কাছে প্রায়শ্চিত্তের বিধান চাহিলেন। একদল বলিলেন “তপ্ত ধৃত খাইয়া প্রাণ ত্যাগ কর।” আর একদল বলিলেন, “অল্পদোষে এরূপ কঠোর প্রায়শ্চিত্ত বিধেয় নহে” তখন চৈতন্যদেব কাশীতে আসেন এবং সুবুদ্ধি তাঁহার কাছে নিজের কাহিনী ব্যক্ত করেন। চৈতন্যদেব বলিলেন, তুমি বৃন্দাবনে গিয়া “নিরন্তর কর কৃষ্ণনাম সংকীর্তন”। ইহাতে তোমার পাপ খণ্ডন হইবে এবং তুমি কৃষ্ণচরণ পাইবে।

অদ্ভুতাচার্যের রামায়ণের নিম্নলিখিত উক্তি হইতে মনে হয় যে যবনস্পর্শে জাতি নষ্ট হওয়ায় হিন্দুসমাজে যে ভাঙ্গন ধরিয়াছিল তাহা রোধ করার জন্য একদল উদারপন্থী ইহার প্রতিবাদ করিতেন।

বল করি জাতি যদি এত যবনে।
ছয় গ্রাস অন্ন যদি করায় ভক্ষণে ॥
প্রায়শ্চিত্ত করিলে জাতি পায় সেই জনে।

এইরূপে মুসলমান কর্ত্তৃক কোন কুলস্ত্রী ধর্ষিত হইলেও সমাজে যাহাতে সেই পরিবার জাতিচ্যুত না হয় দেবীবরের মেলবন্ধনে সেজন্য কতকগুলি মেল যবন দোষে দুষ্ট বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছে। অর্থাৎ দূষিত হইলেও তাহারা ব্রাহ্মণসমাজে স্থান পাইয়াছে। সম্ভবত একই রকমের দোষে এক বা একাধিক মেলের সৃষ্টি হইত তাহাদের পরস্পরের মধ্যে বিবাহাদি ভোজ্যান্নতা বজায় থাকিত। তবে এই সমুদয় চেষ্টায় খুব বেশি কাজ হয় নাই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যবন-স্পর্শে হিন্দু জাতিচ্যুত হইত এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করিত। আবার পিরালী, শেরখানী প্রভৃতি ব্রাহ্মণের মত কোন কোন পরিবার জাতিভ্রষ্ট হইয়াও হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে নাই। দেবীবর ঘটকও যবন-দোষে দুষ্ট ভৈরব ঘটকী, দেহটা, হরি মজুমদারী প্রভৃতি ব্রাহ্মণ সমাজের মেল উল্লেখ করিয়াছেন। তখন দক্ষিণ বাংলায় মগদের অত্যাচার ছিল–সেই জন্যই ‘মঘ দোষে দুষ্ট বাঙ্গাল মেলের উৎপত্তি হইয়াছিল। দেবীবর ঘটকের মেল বর্ণনা পড়িলে মনে হয় বাংলার ব্রাহ্মণেরা অধিকাংশই কোন না কোন দোষে দূষিত ছিলেন এবং এইজন্যই অসংখ্য মেলের বন্ধন সৃষ্টি করিয়া সমাজে ভিন্ন ভিন্ন গণ্ডীতে তাঁহাদের স্থান দেওয়া হইয়াছিল।

মুসলমান ও মগ ব্যতীত আর এক অস্পৃশ্য বিদেশী জাতি-পর্তুগীজ–এদেশে প্রাধান্য লাভ করিয়াছিল। পর্তুগীজ ও মগ জলদস্যুদের অত্যাচারের কথা অন্যত্র বলা হইয়াছে। পর্তুগীজেরা অনেকে বাংলায় স্থায়িভাবে বাস করিত। বরিশালের পূর্বে, নোয়াখালির দক্ষিণে ও চট্টগ্রামের পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের উত্তর প্রান্তে যে সমুদয় দ্বীপ ছিল সেখানেই তাহারা বেশির ভাগ বাস করিত এবং জলপথে দস্যুবৃত্তি করিত। সন্দ্বীপ দ্বীপটি কয়েক বৎসর যাবৎ পর্তুগীজ কার্বালোর অধীনে ছিল। তারপর সিবাস্তিও গন্স্যালভেস্ তিরৌ নামক একজন দুর্ধর্ষ জলদস্যু তিন বৎসর (১৬০৭ ১৬১০ খ্রী) সন্দ্বীপে স্বাধীন নরপতির ন্যায় রাজত্ব করিয়াছিল। তাঁহার অধীনে এক হাজার পর্তুগীজ ও দুই হাজার অন্যান্য সৈন্য, দুইশত ঘোড়সওয়ার এবং ৮০ খানি কামান দ্বারা রক্ষিত রণতরী ছিল। বাংলা দেশের কোন কোন জমিদার তাঁহার মিত্র ছিল। সৈনিক ও সেনানায়ক হিসাবে পর্তুগীজদের খুব খ্যাতি ছিল।

হুগলি হইতে সপ্তগ্রাম পর্যন্ত ভূভাগ তাহাদের অধিকারে ছিল। অন্যান্য বহ স্থানে তাহাদের বসতি ছিল। বাংলার বহু জমিদার এবং সময় সময় সুলতানেরাও পর্তুগীজ সেনা ও সেনানায়কদিগকে আত্মরক্ষার্থে নিযুক্ত করিতেন। মুঘল যুগেও বাংলার নবাবেরা পর্তুগীজ সৈন্য পোষণ করিতেন।

পর্তুগীজেরা সভ্যতা ও সংস্কৃতির দিক দিয়াও বাংলা দেশের কিছু উন্নতি করিয়াছিল। তাহারা একটি অনাথ আশ্রম এবং কয়েকটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করিয়া এই শ্রেণীর লোকহিতকর কার্যের পথ প্রদর্শন করিয়াছিল। তাহারা মিশনারী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং কখনও কখনও এ-দেশীয় ছাত্রদিগের গোয়াতে কলেজে পড়ার বন্দোবস্ত করিত। বাংলা গদ্য-সাহিত্য তাহাদের কাছে যে বিশেষরূপে ঋণী তাহা সাহিত্য-প্রসঙ্গে উল্লিখিত হইয়াছে। এককালে বাংলা দেশের উপকূলভাগে পর্তুগীজ ভাষা বিভিন্ন দেশীয় লোকের মধ্যে কথ্য ভাষ্যরূপে ব্যবহৃত হইত।

মধ্যযুগে পর্তুগীজদের নিকট হইতে কয়েকটি নূতন জিনিস বাংলায় আমদানী হয়। ইহাদের মধ্যে প্রথমেই উল্লেখযোগ্য তামাক। বর্তমান কালে ইহার ব্যবহারে আমরা এত অভ্যস্ত যে, ইহা যে মাত্র তিন চারিশত বৎসর আগে আমেরিকা হইতে পর্তুগীজেরা আমাদের দেশে আমদানি করিয়াছিল তাহা আমরা ভুলিয়া যাই। এইরূপে জামরুল, সফেদা, চীনাবাদাম, কমলালেবু, ম্যাঙ্গোষ্টীন, কেশুবাদাম, পেঁপে, আনারস, কামরাঙ্গা, পেয়ারা, আতা, নোনা প্রভৃতি ফল, লঙ্কা, মরিচ, নীল, রাঙ্গা আলু এবং কৃষ্ণকলি ফুলও পর্তুগীজদের আমদানি।* ‘কেদারা’ ও ‘মেজ’ এই দুইটি প্রাচীন শব্দ আমাদিগকে স্মরণ করাইয়া দেয় যে সম্ভবত চেয়ার ও টেবল প্রভৃতির ব্যবহার আমরা পর্তুগীজদের নিকট হইতেই শিখিয়াছি। এইরূপ আরও কয়েকটি শব্দ পঞ্চদশ পরিচ্ছেদের পরিশিষ্টে উল্লিখিত হইয়াছে। মধ্যযুগের শেষে তামাক খাওয়ার অভ্যাস যে কিরূপ সংক্রামক হইয়া উঠিয়াছিল, তাহা ১২০৮ বাংলা সনে লিখিত “তামাকু মাহাত্ম” নামক পুঁথি হইতে বোঝা যায়। ইহাতে আছে “দিবানিশি যেবা নরে, তামাকু ভক্ষণ করে, অন্তকালে চলে যায় কাশী”; আর “অপমৃত্যু নাহিক তাঁহার; এবং ইহাতে বহু রোগ সারে।

———-

* J.J.A. Campos, History of the Portuguese in Bengal. P. 253.

সম্রাট আকবরের সভাসদ আসাদ বেগ বিজাপুর হইতে তামাক আনিয়া ম্রাটকে উপহার দেন। আসাদ বেগ লিখিয়াছেন যে ইহার পূর্বে তিনি কখনও তামাক দেখেন নাই এবং মোগল দরবারেও ইহা সম্পূর্ণ অপরিচিত ছিল। সুতরাং অনেকে অনুমান করেন যে ষোড়শ শতকের শেষে অথবা সপ্তদশ শতকের প্রথমে ইহা ভারতে আমদানি হয়। কিন্তু বিপ্রদাস পিপিলাই তাঁহার ‘মনসা-বিজয়’ কাব্যে লিখিয়াছেন যে মুসলমানরা তামাক খাইতে খুব অভ্যস্ত। তিনি এই কাব্যের একটি শ্লোকে ইহার রচনাকাল ১৪১৭ শতাব্দ অর্থাৎ ১৪৯৫-৯৬ খ্রীষ্টাব্দ বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন। সুতরাং আকবরের, এমন কি পর্তুগীজদের ভারতে আগমনের পূর্বেই বাংলা দেশে তামাক প্রচলিত ছিল এরূপ সিদ্ধান্ত অসঙ্গত নহে। আসাদ বেগ আকবরকে তামাক উপহার দিলে আকবর জিজ্ঞাসা করিলেন, ইহা কি? তখন নবাব খান-ই-আজম বলিলেন যে ইহা তামাক এবং মক্কা ও মদিনায় ইহা সুপরিচিত। সুতরাং বাংলা দেশেও বিপ্রদাসের সময়ে মুসলমানদের তামাক খাওয়া অভ্যাস ছিল, ইহা একেবারে অসম্ভব নহে। অপর পক্ষে বিপ্রদাসের কাব্যে “খড়দহ শ্রীপাট” ও কলিকাতার উল্লেখ থাকায় অনেক মনে করেন যে হয় তাঁহার কাব্য রচনায় তারিখযুক্ত শ্লোকটি না হয় শ্রীপাট ও কলিকাতার উল্লেখযুক্ত পংক্তিগুলি প্রক্ষিপ্ত। তামাকের উল্লেখও কাব্য রচনায় তারিখ সম্বন্ধে সংশয়ের পোষকতা করে ও উল্লিখিতরূপে সংশয় অপনোদনের সমর্থন করে। (আসাদ বেগের বর্ণনা–J.N. Dasgupta, Bengal in the Sixteenth Century, pp.105, 1212 দ্রষ্টব্য। বিপ্রদাসের কাল নির্ণয়–শ্রীসুখময় মুখোপাধ্যায় প্রণীত প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের কালক্রম’ পৃ. ১১৯-২৪। ২৮৬-৮৭ দ্রষ্টব্য)।

———–

২। জ্ঞান ও বিদ্যা : লেখাপড়া শেখায় বাঙালীর চিরদিনই আগ্রহ ছিল। সাহিত্য প্রসঙ্গে ব্রাহ্মণদের নানাবিধ শাস্ত্রচর্চ্চার উল্লেখ করা হইয়াছে। গঙ্গাতীরে নবদ্বীপ বিদ্যাচর্চ্চার জন্য বিখ্যাত ছিল। চৈতন্যের সমসাময়িক নবদ্বীপের বর্ণনা কিঞ্চিৎ উদ্ধৃত করিতেছি :

নবদ্বীপ-সম্পত্তি কে বর্ণিবারে পারে।
এক গঙ্গাঘাটে লক্ষ লোক স্নান করে ॥
ত্রিবিধ বয়সে এক জাতি লক্ষ লক্ষ।
সরস্বতী দৃষ্টিপাতে সবে মহাদক্ষ ॥
সবে মহা-অধ্যাপক করি গর্ব ধরে।
বালকেও ভট্টাচাৰ্য্য সনে কক্ষা করে ॥
নানা দেশ হৈতে লোকে নবদ্বীপ যায়।
নবদ্বীপে পড়িলে সে বিদ্যারস পায় ॥
অতএব পড়য়ার নাহি সমুচ্চয়।
লক্ষ কোটি অধ্যাপক নাহিক নির্ণয় ॥” [চৈতন্য ভাগবত-আদি, ২য় অধ্যায়]

নব্যন্যায় ও স্মৃতি চর্চ্চার জন্য নবদ্বীপ বিখ্যাত ছিল। অদ্বিতীয় নৈয়ায়িক পণ্ডিত রঘুনাথ শিরোমণির সম্বন্ধে পূর্বেই উল্লেখ করা হইয়াছে। তাঁহার সম্বন্ধে অনেক গল্প বাংলার পণ্ডিত-সমাজে প্রচলিত আছে। একটি এই যে, মিথিলার পক্ষধর মিশ্রের চতুষ্পঠীতে অধ্যয়নকালে রঘুনাথ বিচারে পক্ষধরকে পরাস্ত করিয়াছিলেন। কিন্তু বর্তমানে অনেকে বিশ্বাস করেন না যে রঘুনাথ শিরোমণি পক্ষধর মিশ্রের ছাত্র ছিলেন। তাঁহারা বলেন, রঘুনাথের গুরু ছিলেন বাসুদেব সার্বভৌম। বাসুদেব সম্বন্ধেও একটি কিংবদন্তী প্রচলিত আছে। তৎকালে মিথিলাই নব্যন্যায়-চর্চ্চার প্রধান কেন্দ্র ছিল এবং যাহাতে এই প্রতিপত্তি অক্ষুণ্ণ থাকে এই জন্য উক্ত শাস্ত্রের প্রধান প্রধান গ্রন্থগুলি বা তাঁহার প্রতিলিপি মিথিলার বাহিরে কেহ লইয়া যাইতে পারিত না। প্রবাদ এই যে পক্ষধর মিশ্রের ছাত্র বাসুদেব সার্বভৌম চারি খণ্ড ‘চিন্তামণি’ ও ‘কুসুমাঞ্জলি’র কারিকাংশ কণ্ঠস্থ করিয়া আনিয়া নবদ্বীপে ‘সর্বপ্রথম’ ন্যায়শাস্ত্রের চতুষ্পঠী স্থাপন করিয়াছিলেন। বহুলপ্রচলিত হইলেও এই কাহিনীর মূলে কোন সত্য আছে কিনা তাহা নিশ্চিতরূপে বলা যায় না। নূতন যে সমুদয় প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে তাহাতে কেহ কেহ সিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে বাসুদেব পক্ষধরের ছাত্র ছিলেন না, এবং তাঁহার পূর্বেই বাংলায় নব্যন্যায়ের অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা প্রচলিত ছিল; কারণ, মিথিলার নব্যন্যায়ের গ্রন্থে ‘গৌড়মতের’ উল্লেখ আছে।

রঘুনাথ শিরোমণি পঞ্চদশ শতকের শেষার্ধে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাসুদেব সার্বভৌমের শিষ্য ছিলেন। শ্রীচৈতন্যদেবের জন্মের অব্যবহিত পূর্বে নবদ্বীপে যবনরাজ যে অত্যাচার করেন তাঁহার বিবরণ জয়ানন্দের ‘চৈতন্যমঙ্গল হইতে পরে উদ্ধৃত হইয়াছে। এই অত্যাচারের বর্ণনা করিয়া উপসংহারে জয়ানন্দ লিখিয়াছেন :

বিশারদসুত সার্বভৌম ভট্টাচার্য।
সবংশে উৎকল গেলা ছাড়ি গৌড় রাজ্য ॥
উকলে প্রতাপরুদ্র ধনুর্ময় রাজা।
রত্ন-সিংহাসনে সার্বভৌমে কৈল পূজা ॥

সার্বভৌম বহুদিন পুরীধামে অবস্থান এবং মহাবৈদান্তিক পণ্ডিত বলিয়া খ্যাতি ও বিপুল রাজসম্মান লাভ করেন। চৈতন্যদেব বহু তর্ক-বিতর্কের পর তাঁহাকে বৈদান্তি কের মায়াবাদ হইতে ভক্তিবাদে বিশ্বাস করান। প্রৌঢ় বাসুদেব তরুণ যুবক সন্ন্যাসীর ভক্তিবাদে দীক্ষিত হন। বাংলার এই দুই সুসন্তান সুদীর্ঘকাল উড়িষ্যায় বসবাস করিয়া যে রাজসম্মান ও লোকপ্রিয়তা অর্জন করেন তাহা একাধারে বাংলার পাণ্ডিত্য ও গৌরব সূচিত করে।

মধ্যযুগে বাংলায় সাত্ত্বিক প্রকৃতি ও পণ্ডিতাগ্রগণ্য অনেক ব্রাহ্মণের নাম পাওয়া যায়। আবার ঐশ্বর্যশালী ভোগবিলাসী ব্রাহ্মণেরও উল্লেখ আছে। চৈতন্যভাগবতে পুণ্ডরীক বিদ্যানিধির সভার যে বর্ণনা আছে তাহা প্রায় রাজসভার সদৃশ :

দিব্য খট্টা হিঙ্গুল-পিত্তলে শোভা করে।
দিব্য চন্দ্রাতপ তিন তাঁহার উপরে ॥
তঁহি দিব্য শয্যা শশাভে অতি সূক্ষ্মবাসে।
পট্ট-নেত বালিস শোভয়ে চারিপাশে ॥
… … …
দিব্য ময়ূরের শাখা লই দুই জনে।
বাতাস করিতে আছে দেহে সর্বক্ষণে। [চৈতন্য ভাগবত, মধ্য-৭ম অধ্যায়]
… … …

পরম ভক্ত পুণ্ডরীক চৈতন্যের অতিশয় প্রিয়পাত্র ছিলেন; কিন্তু তিনি বিষয়ীর মত থাকিতেন। সুতরাং এই চিত্র যে অন্তত বিষয়ী বিত্তশালী ব্রাহ্মণের পক্ষে প্রযোজ্য সে বিষয়ে সন্দেহ নাই।

পণ্ডিতদের রাজসম্মানও অনেকটা রাজসিক ভাবেরই ছিল। রায়মুকুট বৃহস্পতি মিশ্র কেবল স্মার্ত পণ্ডিত ছিলেন না, তিনি রঘুবংশ, মেঘদূত, কুমারসম্ভব, শিশুপালবধ, গীতগোবিন্দ প্রভৃতি কাব্যের এবং অমরকোষের টীকাও লিখিয়াছিলেন। [Indian Historical Quarterly. XVII, 458 ff. XXIX, 183] গৌড়েশ্বর জলালুদ্দীন এবং বারবক শাহ তাঁহাকে বহু সম্মান প্রদর্শন করিয়াছিলেন এবং তিনি উজ্জ্বল মণিময় হার, দ্যুতিমান কুণ্ডলদ্বয়, দশ অঙ্গুলির জন্য রত্নখচিত ভাস্বর ঊর্মিক (রতনচূড়) প্রভৃতি পুরস্কার পাইয়াছিলেন। তারপর নৃপতি তাঁহাকে হস্তিপৃষ্ঠে বসাইয়া স্বর্ণ-কলসের জলে অভিষেকান্তে ছত্র, হস্তী ও অশ্ব এবং রায়মুকুট উপাধি দান করেন। [রায়মুকুট সম্ভবত উচ্চ রাজপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন; সুতরাং এই সমুদয় সম্মান কেবল পাণ্ডিত্যের জন্য না হইতেও পারে। রায়মুকুট সম্বন্ধে অনেক তর্কবিতর্ক হইয়াছে (Ind. Hist. Quarterly (XVII, 442; XVIII, 75; XXVIII, 215; XXIX, 183; XXX, 264 দ্রষ্টব্য)। রায়মুকুট ১৪৭৪ খ্রীষ্টাব্দে জীবিত ছিলেন, সুতরাং তাঁহার পুত্রেরা এবং সম্ভবত তিনিও সুলতান বারবক শাহের অনুগ্রহভাজন ছিলেন।] বৃহস্পতির পুত্রেরা রাজমন্ত্রী পদ লাভ করেন; কিন্তু তাহা সত্ত্বেও তাঁহারা দিবিজয়ী পণ্ডিতরূপে খ্যাতিলাভ করিয়াছিলেন।

জমিদার ও ধনী লোকেরা বার্ষিক বৃত্তি অথবা ভূসম্পত্তি দান করিয়া ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের ভরণপোষণ করিতেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে নাটোরের রাণী ভবানী ও নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র বহু সংখ্যক পণ্ডিত ও টোলের ছাত্রদিগকে বৃত্তি দিয়া সংস্কৃত শিক্ষায় সাহায্য করিয়াছেন।

সে যুগে প্রাচীন কালের রাজাদের ন্যায় ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা দিগ্বিজয়ে বাহির হইতেন। বিদ্যাবত্তার জন্য প্রসিদ্ধ বহু স্থানে বিতর্ক সভায় অপর সকল পণ্ডিতকে পরাজয় করিতে পারিলে তাঁহার দিগ্বিজয়ী উপাধি হইত। চৈতন্যের সময়ে নবদ্বীপে এইরূপ এক দিগ্বজয়ী পণ্ডিত আসিয়াছিলেন। চৈতন্য-ভাগবতে ইহার যে বর্ণনা আছে তাহাতে বিশেষ লক্ষ করিবার বিষয় যে এই দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত “পরম-সমৃদ্ধ অশ্বগজযুক্ত” হইয়া আসিয়াছিলেন। আরও অনেক আখ্যান হইতে জানা যায় যে বড় বড় পণ্ডিতগণ তখন হাতি বা ঘোড়ায় চড়িয়া বহু লোকলস্কর সঙ্গে লইয়া চলিতেন।

বাংলা দেশের পণ্ডিতগণের মধ্যে প্রবাদ আছে যে মিথিলার নৈয়ায়িক পণ্ডিত পক্ষধর মিশ্র এইরূপ দিগ্বিজয়ে বহির্গত হন এবং হিন্দুস্থানের বহু পণ্ডিতকে তর্কে পরাস্ত করিয়া হাতি, উট ও বহু লোকলস্কর সহ নবদ্বীপে আসেন। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, এখানকার বড় পণ্ডিত কে? সকলেই গঙ্গার ঘাটে স্থানরত রঘুনাথ। শিরোমণিকে দেখাইয়া দিল। রঘুনাথ ছিলেন কানা–তাই তাহাকে দেখিয়া পক্ষধর মিশ্র ব্যঙ্গমিশ্রিত স্বরে বলিলেন : “অভাগ্যং গৌড় দেশস্য যত্র কাণঃ শিরোমণিঃ।” (গৌড়দেশের দুর্ভাগ্য যে এক কানা পণ্ডিতের শিরোমণি)। কিন্তু প্রবাদ অনুসারে এই কানা পণ্ডিতের নিকটই তিনি তর্কে পরাস্ত হইয়াছিলেন।

অষ্টাদশ শতাব্দীতে নদীয়া বা নবদ্বীপ সংস্কৃত শিক্ষার প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হইয়াছিল। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র সংস্কৃত পণ্ডিতদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং বহু পণ্ডিত তাঁহার রাজসভা অলঙ্কৃত করিয়াছিলেন। তিনি নিজেও সুপণ্ডিত ছিলেন এবং সভাস্থ পণ্ডিতগণের সহিত ন্যায়, ধর্মশাস্ত্র ও দর্শনের আলোচনা করিতেন। তাঁহার সভাকবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র কবি হিসাবে বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন।

নদীয়া ব্যতীত আরও কয়েকটি সংস্কৃত শিক্ষার কেন্দ্র ছিল। বাঁশবেড়িয়াতে অনেকগুলি চতুষ্পাঠী ছিল–এগুলিতে প্রধানত ন্যায়শাস্ত্রের অধ্যাপনা হইত। ত্রিবেণী, কুমারহট্ট, ভট্টপল্লী, গোলপাড়া, ভদ্রেশ্বর, জয়নগর, মজিলপুর, আন্দুল

ও বালিতে বহুসংখ্যক চতুষ্পঠী ছিল।

সংস্কৃত সাহিত্যে, বিশেষত স্মৃতি ও ন্যায়ের চর্চ্চায় যে ব্রাহ্মণেরাই অগ্রণী ছিলেন সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। তবে অন্যান্য জাতীয় লোকেরা, বিশেষত বৈদ্য জাতি, যে সংস্কৃত শাস্ত্রে অভিজ্ঞ ছিল তাঁহারও বহু প্রমাণ আছে। কয়েকজন মুসলমান পণ্ডিতও নানা সংস্কৃত শাস্ত্রে অভিজ্ঞ ছিলেন। পূর্ব্বোক্ত আলাওল ইহার এক প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। ধর্মঠাকুরের পূজারী সাধারণতঃ নীচ জাতীয় হইলেও সংস্কৃত চর্চ্চা করিতেন। শ্রীযুক্ত সুকুমার সেন লিখিয়াছেন : “দক্ষিণ রাঢ়ে স্থানে স্থানে এখনও ডোম ও বাগদী পণ্ডিতের টোল আছে। সেখানে ব্যাকরণ, কাব্য ইত্যাদির পঠন-পাঠন হয় এবং বামুনের ছেলেরাও পড়ে।” [সুকুমার সেন, মধ্যযুগের বাংলা ও বাঙালী, ৪৩ পৃ.] কয়েকজন স্ত্রীলোকও সংস্কৃত কাব্য ও বাংলা পদাবলী রচনা করিয়াছিলেন ও পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন।

বাংলা দেশের নানা স্থানে সংস্কৃত শিক্ষার জন্য বহু চতুস্পাঠী ও টোল ছিল। বর্ধমানের এক চতুষ্পঠীতে দ্রাবিড়, উকল, কাশী, মিথিলা প্রভৃতি স্থানের ছাত্র ছিল। [রামপ্রসাদের গ্রন্থাবলী পৃ. ৫। এই গ্রন্থে পাঠ্য বিষয়েও বর্ণনা আছে। (পৃ. ৫০-১)] রূপরাম চক্রবর্তীর আত্ম-কাহিনীতে আছে যে তিনি বাল্যকালে রঘুরাম ভট্টাচার্যের টোলে অমরকোষ, সংক্ষিপ্তসার ব্যাকরণ, পিঙ্গলের ছন্দঃসূত্র অথবা প্রাকৃতপৈঙ্গল এবং শিশুপালবধ, রঘুবংশ, নৈষধচরিত প্রভৃতি কাব্য পাঠ করিয়াছিলেন।

কবিকঙ্কণ-চণ্ডীতে শ্রীমন্তের বিদ্যাশিক্ষা প্রসঙ্গে সুদীর্ঘ পাঠ্য বিষয়ের তালিকা হইতে তৎকালে এই সম্বন্ধে একটি ধারণা করা যায়। প্রথমেই আছে :

রক্ষিত পঞ্জিকা টীকা         ন্যায় কোষ নাটিকা
গণবৃত্তি আর ব্যাকরণ।

তারপর পিঙ্গলের ছন্দঃসূত্র, দণ্ডী, ভারবি, মাঘ, জৈমিনি মহাভারত, নৈষধ, মেঘদূত, কুমারসম্ভব, সপ্তশতী, রাঘবপাণ্ডবীয়, জয়দেব, বাসবদত্তা, কামন্দকীদীপিকা, ভাস্বত, বামন, হিতোপদেশ, বৈদ্য ও জ্যোতিষ শাস্ত্র, স্মৃতি, আগম, পুরাণ প্রভৃতি।

প্রাথমিক শিক্ষা এবং বাংলা ভাষায় উচ্চশিক্ষার কি ব্যবস্থা ছিল তাহা বলা কঠিন। মধ্যযুগের শেষে অর্থাৎ অষ্টাদশ শতাব্দীতে প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা সম্বন্ধে একটি মোটামুটি ধারণা করা যায়। গ্রামে খড়ের ঘরে, কোন বাড়ির চণ্ডীমণ্ডপে বা খোলা জায়গায় পাঠশালা বসিত। গুরুমহাশয়েরা খুব সামান্যই বেতন পাইতেন; কিন্তু ছাত্ররা বিদ্যা সাঙ্গ করিয়া গুরুদক্ষিণা দিত। গুরুমহাশয়েরা বেতের ব্যবহারে কোন কার্পণ্য করিতেন না। হাত-পা বাঁধা, বুকের উপর চাপিয়া বসা প্রভৃতি শাস্তি র ব্যবস্থাও ছিল। সাধারণত গুরুমহাশয়দিগের বিদ্যা-বুদ্ধি খুব সামান্যই থাকিত। ছাত্রেরা ছয় সাত বৎসর পাঠশালায় থাকিয়া বাংলা পড়িতে ও লিখিতে পারিত এবং কিছু কিছু গণিত শিখিত। কড়ি ও পাথরের কুচি দিয়া সংখ্যা গণনা, যোগ বিয়োগ শিক্ষা দেওয়া হইত। হিসাব রাখা, চিঠিপত্র, দলিল ও দরখাস্ত লেখা প্রভৃতি প্রয়োজনীয় শিক্ষা পাঠশালাতেই হইত। শিশুরা প্রথমে বালির উপর খড়ের কুটা দিয়া লিখিত। তারপর খড়ি দিয়া মাটির মেজেতে লিখিত। ক্রমে ক্রমে কলাপাতায়, তালপাতায়, খাগ বা বাঁশের কঞ্চি দিয়া লেখা অভ্যাস করিত। তুলা দিয়া কাগজ তৈরি হইত–যাহারা তৈরি করিত তাহাদিগকে কাগজী বলিত। এই তুলট কাগজ ছাড়া তালপাতা ও ভূর্জপত্রে পুঁথি লেখা হইত। হরিতকী ও বয়ড়ার রস প্রদীপের কাল ভূষায় মিশাইয়া কালী তৈরি হইত।

ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমে শতকরা আটজনের বেশি ছাত্র পাঠশালায় পড়িত না এবং ছয়জনের বেশি লেখাপড়া জানিত না। তবে এই সংখ্যা সমস্ত মধ্যযুগের পক্ষেই প্রযোজ্য কিনা বলা শক্ত।

টোল ও চতুস্পাঠীতে সংস্কৃত ভাষায় উচ্চশিক্ষা হইত। সাধারণত গুরুর গৃহেই অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা চলিত। ইহার ব্যয়ের জন্য রাজা ও ধনী লোকেরা বার্ষিক বৃদ্ধি দিতেন।

পাঠশালা ছাড়াও কীর্তন, কথকতা, যাত্রা প্রভৃতি দ্বারা লোক-শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল।

৩। স্ত্রীজাতির অবস্থা : সমসাময়িক সাহিত্যে মেয়েদের পাঠশালায় যাওয়া এবং প্রাথমিক শিক্ষা লাভের কথা আছে। সুতরাং তাহারা মোটামুটি লিখিতে পড়িতে জানিত। ‘কবিকঙ্কণ-চণ্ডী’তে লহনা, ও খুল্লনা ও লীলাবতীর পত্র লেখা ও পত্র পাঠের উল্লেখ আছে। দয়ারামের ‘সারদামঙ্গলে’ রাজকুমার ও রাজকুমারীদের এবং রাসসুন্দরীর আত্মচরিতে ছেলেমেয়েদের একত্রে পাঠশালায় যাওয়ায় কথা আছে। দুই এক স্থলে–যেমন রামপ্রসাদের ‘বিদ্যাসুন্দর ও ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গলে–নায়িকা বিদ্যার উচ্চশিক্ষার উল্লেখ আছে, কিন্তু ইহা কতদূর বাস্তব সত্য তাহা বলা যায় না। রাণী ভবানীও সুশিক্ষিতা ছিলেন বলিয়া প্রসিদ্ধি আছে। তবে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগেও বাংলায় কয়েকজন বিদুষী মহিলা ছিলেন। দৃষ্টান্ত স্বরূপ হটী বিদ্যালঙ্কার, হটু বিদ্যালঙ্কার, প্রিয়ম্বদা দেবী, বিক্রমপুরের আনন্দময়ী দেবী এবং কোটালিপাড়ার বৈজয়ন্তী দেবীর সংস্কৃত ভাষায় পাণ্ডিত্যের উল্লেখ করা যাইতে পারে। ইঁহাদের মধ্যে হটী বিদ্যালঙ্কার সমধিক প্রসিদ্ধ। রাঢ় দেশের এই কুলীন বালবিধবা ব্রাহ্মণকন্যা সংস্কৃত ব্যাকরণ, কাব্য, স্মৃতি ও নব্যন্যায়ে পারদর্শী হইয়া কাশীতে একটি চতুম্পাঠী স্থাপন করেন ও বিদ্যালঙ্কার উপাধিতে ভূষিত হন। ইনি সভায় ন্যায়শাস্ত্রের বিচার করিতেন ও পুরুষ ভট্টাচার্যের ন্যায় বিদায় লইতেন। ১৮১০ খ্রীষ্টাব্দে ইনি বৃদ্ধ বয়সে প্রাণত্যাগ করেন। রূপমঞ্জরী, ওরফে হটু বিদ্যালঙ্কার, রাঢ়দেশবাসী নারায়ণ দাসের কন্যা। ব্রাহ্মণবংশে জন্ম না হইলেও নারায়ণ দাস কন্যাকে লেখাপড়া শিখাইয়াছিলেন এবং তাঁহাদের মেধাশক্তি দেখিয়া ষোল সতর বৎসর বয়সের সময় এক ব্রাহ্মণ বৈয়াকরণিকে গৃহে রাখেন। রূপমঞ্জরী গুরুগৃহে টোলের ছাত্রদের সঙ্গে ব্যাকরণ পড়িতেন। তারপর সাহিত্য, আয়ুর্বেদ ও অন্যান্য শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। অনেকে তাঁহার নিকট ব্যাকরণ, চরকসংহিতা ও নিদান প্রভৃতি বৈদ্যশাস্ত্র অধ্যয়ন করিত। অনেক কবিরাজ চিকিৎসাসম্বন্ধে তাঁহার উপদেশ গ্রহণ করিতেন। তিনি চিরকুমারী ছিলেন, মাথা মুড়াইয়া ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের মত শিখা রাখিতেন এবং পুরুষের মত উত্তরীয় ব্যবহার করিতেন। প্রায় একশত বৎসর বয়সে (বাংলা ১২৮২ সন) তাঁহার মৃত্যু হয়।

কিন্তু এইরূপ কয়েকটি মহিলার কথা জানা গেলেও অষ্টাদশ শতাব্দীতে স্ত্রীশিক্ষার [শ্রীব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, চতুস্পাঠী যুগে বিদুষী বঙ্গমহিলা (৭-১১ পৃ.)] খুব বেশি প্রচলন ছিল না। সম্ভ্রান্ত ঘরে এবং বৈষ্ণব সম্প্রদায়ে মেয়েদের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু সাধারণ গৃহস্থ ঘরে মেয়েদের লেখাপড়ার প্রথা এক রকম উঠিয়া গিয়াছিল বলিলেও অত্যুক্তি হইবে না। ইহার প্রধান কারণ দুইটি। প্রথমত, হিন্দুদের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মিয়াছিল যে লেখাপড়া শিখিলে মেয়ে বিধবা হইবে। দ্বিতীয়ত, বাল্যাবস্থা পার হইতে না হইতেই মেয়েদের বিবাহ দেওয়ার রীতি। সপ্তম বৎসরে কন্যাদান খুব প্রশংসনীয় ছিল এবং দশ বৎসরের অধিক বয়স পর্যন্ত কন্যার বিবাহ না দিলে গৃহস্থ নিন্দনীয় হইতেন এবং ইহা অমঙ্গলের কারণ বলিয়া বিবেচিত হইত।

মঙ্গলকাব্যগুলিতে বিবাহের বিস্তৃত বর্ণনা আছে। ইহা পড়িলে মনে হয় উনবিংশ শতাব্দীর শেষে অর্থাৎ অতি আধুনিক যুগের পূর্ব পর্যন্ত রক্ষণশীল হিন্দু পরিবারে এখনও যে সব অনুষ্ঠান প্রচলিত আছে তাহাই মধ্যযুগেও ছিল। অধিবাস, বাসি বিবাহ, বাসর ঘরে পুরস্ত্রীদের নির্লজ্জ ও অশ্লীল আচরণ, কুখাদ্য দিয়া জামাইয়ের সঙ্গে কৌতুক প্রভৃতির বিস্তৃত বর্ণনা মঙ্গলকাব্যগুলিতে আছে।

একটি বিষয়ে মধ্যযুগে বিবাহ-প্রথা বর্তমান যুগের প্রথা হইতে ভিন্ন ছিল। এখন কন্যার পিতা বর-পণ দেন-তখন বরের পিতা কন্যা-পণ দিতেন। নিম্নশ্রেণীর মধ্যে এখনও এই প্রথা প্রচলিত আছে; কিন্তু ক্রমশ বর-পণের প্রথা প্রচলিত হয়।

অল্প বয়সে বিবাহ হওয়ায় বালিকাবধূর শ্বশুরবাড়ি গমনের কালে বিয়োগ বিধুরা কন্যা ও তাঁহার মাতা, ভ্রাতা, ভগ্নীর ব্যথা সে যুগের ছড়ায় ধ্বনিত হইয়াছে।

ভাঙ্গা নাও মাদারের বৈঠা ঢলকে ওঠে পানি।
ধীরে ধীরে বারে মাঝি আমি মায়ের (ভাইয়ের, বুনের) কান্দন শুনি ॥

বাল্যবিবাহের ফলে বাল্যবিধবার সংখ্যাও অনেক ছিল। বর্তমান কালের বিধবাদের ন্যায়ই তাহাদের অশন-বসন-ভূষণ নিয়ন্ত্রিত ছিল। তবু শোকার্ত পিতা-মাতা নিয়ম লঙ্ন না করিয়া বাল্যবিধবা কন্যার শাঁখা সিন্দুরের অভাব দূর করিতে চেষ্টা করিতেন। ক্ষেমানন্দের মনসামঙ্গলে আছে :

“খনি বদলে দিব কাঁচা পাটের শাড়ী।
শঙ্খ (শাখা) বদলে দিব সুবর্ণের চূড়ী।
সিন্দুর বদলে দিব ফাউগের গুঁড়ি ॥”

এ বিষয়ে স্মার্ত রঘুনন্দনের ব্যবস্থা ছিল অতি কঠোর। একাদশীতে বালিকা, বৃদ্ধা সকল বিধবাকেই একেবারে উপবাসী থাকিতে হইবে। বর্তমান যুগেও কোন কোন রক্ষণশীল পরিবারে এই নিষ্ঠুর বিধান নিতান্ত বালিকা বয়সের বিধবাকেও পালন করিতে দেখা গিয়াছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে মহারাজা রাজবল্লভ বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের চেষ্টা কৰ্বিয়াছিলেন। কিন্তু মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রতিকূলতায় কৃতকার্য হন নাই।

পুরুষের বহুবিবাহ তখন খুবই প্রচলিত ছিল। সতীনের দুঃখ এবং প্রতিকার স্বরূপ নানা প্রকার ঔষধ খাওয়াইয়া ও অন্যান্য প্রক্রিয়া দ্বারা স্বামী বশ করার কথা অনেক মঙ্গলকাব্যে উল্লিখিত হইয়াছে। পুরুষের বহুবিবাহের ফলে পারিবারিক অশান্তির কথা সমসাময়িক সাহিত্যে প্রতিধ্বনিত হইয়াছে। ব্রাহ্মণ কুলীনকন্যার দুঃখের কাহিনী পূর্বে বর্ণিত হইয়াছে।

বিবাহের সময় নববধূর সঙ্গে অসংখ্য যুবতী দাসী এমন কি বধূর ভগ্নীকেও যৌতুক স্বরূপ দেওয়া হইত। এই প্রথা নাকি আধুনিক যুগেও উড়িষ্যায় ও অন্যান্য স্থানে প্রচলিত ছিল।

সমাজে যে স্ত্রীলোকের সতীত্বের সম্বন্ধে সন্দেহ ও অবিশ্বাস প্রচলিত ছিল, কবিকঙ্কণ-চণ্ডীতে তাঁহার আভাস পাওয়া যায়। খুল্লনা বনে বনে ছাগল চরাইত, এইজন্য তাঁহার স্বামী ধনপছি সওদাগরের কুটুম্বগণ তাঁহার সতীত্বে সন্দেহ প্রকাশ করিল এবং যতক্ষণ বিধিমতে তাঁহার সতীত্ব পরীক্ষা না হয় ততদিন তাঁহার গৃহে ভোজন করিতে অস্বীকার করিল। পণ্ডিতদের ব্যবস্থামত খুল্লনাকে ক্রমে ক্রমে জলেডোবা, সর্পদংশন, অগ্নিদহন, জতুগৃহদাহ, প্রভৃতি নানাবিধ “দিব্য পরীক্ষা দিয়া নির্দোষিতা প্রমাণ করিতে হইল। এই সমুদয় “দিব্য পরীক্ষার কতটা প্রাচীন প্রথা অনুযায়ী কবির কল্পনা আর কতটা বাস্তব সত্য তাহা বলা শক্ত। [দিব্য পরীক্ষা দ্বারা দোষ নির্ণয়ের কথা অন্যান্য কাব্যেও আছে। বর্তমানকালের জল পড়া, চাউল পড়া, নল চালা, বাটি চালা প্রভৃতি ইহার স্মৃতি বহন করিতেছে। ইউরোপের অনেক দেশে দিব্য পরীক্ষার প্রথা মধ্যযুগেও প্রচলিত ছিল।] কিন্তু ইহার পশ্চাতে যে কুলবধূর সতীত্ব সম্বন্ধে সন্দেহের ও অবিশ্বাসের ভাব বিদ্যমান তাহাতে সন্দেহ নাই। ইহার আর একটি প্রমাণও আছে। ধনপতি সদাগর যখন দীর্ঘকালের জন্য দূরদেশে বাণিজ্যযাত্রা করেন তখন খুল্লনা ছয় মাস গর্ভবতী। পাছে খুল্লনার সন্তান হইলে কোন নিন্দা হয় এইজন্য ধনপতি এক “জয়পত্র লিখিলেন :

অশেষ মঙ্গল-ধাম খুল্লনা যুবতী ॥
তোরে আশীর্বাদ প্রিয়া পরম পিরীতি।
সন্দেহ ভঞ্জন পত্র করিল নির্মিতি ॥
যখন তোমার গর্ভ হইল ছয় মাস।
সেই কালে নৃপাদেশে যাই পরবাস ॥ [কবিকঙ্কণ-চণ্ডী, দ্বিতীয় ভাগ-৬১৮ পৃ]

মধ্যযুগে হিন্দু সমাজে স্ত্রীলোকের অবরোধ প্রথা ছিল কিনা তাহা নিশ্চয় করিয়া বলা যায় না। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে রাধা ও অন্যান্য গোপীগণের স্বচ্ছন্দ ভ্রমণের বিবরণ হইতে মনে হয় অবরোধ প্রথা অথবা ঘোমটার প্রচলন তখনও হয় নাই। কিন্তু কৃত্তিবাসের রামায়ণে দেখিতে পাই যে সীতার চতুর্দোল কাপড় দিয়া ঘেরা হইয়াছিল।

সম্ভবত সর্বদেশে সর্বযুগেই যুদ্ধ বিগ্রহের সময় সৈন্যদের হস্তে স্ত্রীজাতির লাঞ্ছনা ও অপমানের সীমা থাকে না। মধ্যযুগের বাংলা দেশেও ইহার দৃষ্টান্ত আছে। বহারিস্তান-ই-ঘায়েবি নামক সমসাময়িক প্রামাণিক গ্রন্থে মুঘলসৈন্য কর্ত্তৃক প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কাহিনী বর্ণিত হইয়াছে। গ্রন্থকার নিজেই এই অভিযানের সেনানায়ক ছিলেন। তিনি লিখিয়াছেন যে তাঁহার সৈন্যেরা চারি হাজার স্ত্রীলোক বন্দী করিয়া আনিয়া সকলকে বিবস্ত্রা করিয়া রাখিয়াছিল। সেনাপতি সংবাদ পাইয়া যখন তাহাদিগকে মুক্তি দিবার আদেশ দিলেন, তখনও কাহারও অঙ্গে কোন পরিধান ছিল না। পাজামা, বিছানার চাদর, আলোয়ান প্রভৃতি দ্বারা কোন মতে লজ্জা নিবারণ করিয়া তাহাদিগকে গৃহে পাঠান হইল।

সতীদাহের ন্যায় বর্বরোচিত প্রথা তখনও প্রচলিত ছিল। কোন কোন স্ত্রীলোক স্বেচ্ছায় সতী হইতেন, কোন বাধা মানিতেন না এবং জ্বলন্ত চিতায় ঝাঁপ দিয়াও কোন কাতরতা প্রকাশ করিতেন না। আবার অনিচ্ছুক বিধবাকে শাস্ত্রের দোহাই দিয়া বা অন্য উপায়ে একবার রাজি করাইয়া তারপর সে মরিতে না চাহিলেও তাহাকে জোর করিয়া পোড়াইয়া মারা হইত। প্রত্যক্ষদর্শীরা এই দুই রকমেরই বর্ণনা করিয়াছেন। [১৮১৮ খৃষ্টাব্দে রাজা রামমোহন রায় সরকারের নিকট যে দরখাস্ত করিয়াছিলেন তাহাতে এইরূপ জোর করিয়া পোড়ইয়া মারার বহু দৃষ্টান্ত আছে, এরূপ উল্লেখ করিয়াছেন।]

৪। আহার : সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যে বাঙালী হিন্দুর ভোজন-দ্রব্যের যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। ভাঁড়দত্ত রাজাকে ভেট দিবার জন্য লইল কাঁচকলা, পুঁইশাক, কদলীর মোচা, বেগুন, কচু ও মুলা। সুতরাং এগুলি প্রিয় খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে পরিগণিত ছিল। চৈতন্যদেব শাক ভালবাসিতেন। তাঁহার মাতা ‘বিংশতি প্রকার শাক’ রাঁধিলেন। ভোজনে বসিয়া প্রভু শাক পাইয়া খুব খুশী হইলেন এবং অচ্যুতা, পটোল, হেলঞ্চা প্রভৃতি শাকের মহিমা কীর্তন করিলেন। [চৈতন্য-ভাগবত-অন্ত্যখণ্ড, ৪র্থ অধ্যায়]

ভোজন বিলাসেরও অনেক বর্ণনা আছে :

ওদন পায়স পিঠা       পঞ্চাশ ব্যঞ্জন মিঠা
অবশেষে ক্ষীর খণ্ড কলা ॥

‘চৈতন্যচরিতামৃতে সার্বভৌমের গৃহে চৈতন্যদেবের যে ভোজনের বর্ণনা আছে তাহাতে নিরামিষ আহার্যের বিপুল বর্ণনা পাই :

পীত সুগন্ধি ঘৃতে অন্ন সিক্ত কৈল।
চারিদিকে পাতে [কলার পাতা] ঘৃত বাহিয়া চলিল ॥ ২০৬
কেয়াপত্র কলার খোলা ডোঙ্গা সারি সারি।
চারিদিগে ধরিয়াছে নানা ব্যঞ্জন ভরি ॥ ২০৭
দশ প্রকার শাক, নিম্ব সুকুতার ঝোল।
মরিচের ঝাল, ছানাবড়া, বড়ী, ঘোল ॥ ২০৮
দুগ্ধতুষী, দুগ্ধকুষ্মাণ্ড, বেসারি, লাফরা।
মোচা ঘণ্ট, মোচা ভাজা বিবিধ শাকরা ॥ ২০৯
বৃদ্ধকুম্মাণ্ডবড়ীর ব্যঞ্জন অপার।
ফুলবড়ী ফলমূলে বিবিধ প্রকার ॥ ২১০
নব-নিষপত্রসহ ভৃষ্ট বার্তাকী।
ফুল বড়ী পটোলভাজা কুণ্ড মানচাকী ॥ ২১১
ভৃষ্ট-মাষ, মুদ্গসূপ অমৃতে নিন্দয়।
মধুরা বড়াম্লাদি অম্ল পাঁচ ছয় ॥ ২১২
মুদাবড়া মাঝবড়া কলাবড়া মিষ্ট ॥
ক্ষীরপুলী নারিকেলপুলী আর যত পিষ্ট ॥ ২১৩
কাঞ্জিবড়া দুগ্ধচিড়া দুগ্ধলকলকী।
আর যত পিঠা কৈল কহিতে না শকি ॥ ২১৪
ঘৃতসিক্ত পরমান্ন মৃকুণ্ডিকা ভরি।
চাপাকলা ঘনদুগ্ধ আম্র তাহা ধরি ॥ ২১৫
রসালা, মথিত দধি, সন্দেশ অপার।
গৌড়ে উৎকলে যত ভক্ষ্যের প্রকার ॥ ২১৬

(‘চৈতন্যচরিতামৃত, মধ্যলীলা, পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ)

আর এক শ্রেণীর ভক্ষ্যদ্রব্যের কথা ‘‘চৈতন্যচরিতামৃতে’ পাওয়া যায়। রাঘব পণ্ডিত যখন অন্যান্য ভক্তগণ সহ প্রভুর দর্শনের জন্য প্রতি বৎসর নীলাচলে যাইতেন তখন সংবৎসরের উপযোগী এই সমুদয় দ্রব্য ঝালিতে করিয়া লইয়া যাইতেন। ইহার মধ্যে থাকিত :

আম্রকাসুন্দী আদাকাসুন্দী ঝালকাসুন্দী নাম।
নেষু আদা আম্র-কোলি [কুল] বিবিধ বিধান ॥ ১৪
আমসী আম্রখণ্ড তৈলা আমতা।
যত্ন করি গুণ্ডি করি পুরাণ সুকুতা [পুরাতন পাটপাতা] ॥ ১৫
* * *
ধনিয়া মহুরী [মৌরী]-তণ্ডুল চূর্ণ করিয়া।
লাড় বান্ধিয়াছে চিনি পাক করিয়া ॥ ২০
শুণ্ঠিখণ্ড নাড় আর আমপিত্তহর।
পৃথক পৃথক বান্ধি বস্ত্রের কোথলী ভিতর ॥ ২১
কোলি শুণ্ঠি কোলিচূর্ণ কোলিখণ্ড আর।
কত নাম লৈব, শত প্রকার আচার ॥ ২২
নারিকেলখণ্ডনাড় আর নাড় গঙ্গাজল।
চিরস্থায়ী খণ্ডবিকার করিল সকল ॥ ২৩
চিরস্থায়ী ক্ষীরসার মণ্ডাদি বিকার।
অমৃত কর্পূর আদি অনেক প্রকার ॥ ২৪
শালিকাঁচুটি-ধান্যের আতব-চিড়া করি।
নূতন বস্ত্রের বড় থলী সব ভরি ॥ ২৫
কথোক চিড়া হুড়ুম [মুড়ি] করি ঘৃতেতে ভাজিয়া।
চিনি পাকে নাড় কৈল কপূরাদি দিয়া ॥ ২৬
শালিতণ্ডুলভাজা চূর্ণ করিয়া।
ঘৃতসিক্ত চূর্ণ কৈল চিনি পাক দিয়া ॥ ২৭
কর্পূর মরিচ এলাচি লবঙ্গ রসবাস [কাবাব চিনি]।
চূর্ণ দিয়া নাড় কৈল পরম সুবাস ॥ ২৮
শালিধান্যের খৈ পুন ঘৃতেতে ভাজিয়া।
চিনি পাকে উখরা [মুড়কি] কৈল কপূরাদি দিয়া ॥ ২৯
ফুটকলাই চূর্ণ করি ঘৃতে ভাজাইল।
চিনিপাকে কপূরাদি দিয়া নাড় কৈল ॥৩০

(‘চৈতন্যচরিতামৃত, অন্ত্যলীলা-দশম পরিচ্ছেদ)

ফল ও মিষ্টান্নের তালিকায় আছে :

“ছেনা [ছানা] পানা [সরবৎ] পৈড় [পেঁড়া] আম্র নারিকেল কাঁঠাল।
নানাবিধ কদলক আর বীজতাল [তালশাঁস] ॥ ২৪
নারঙ্গ ছোলঙ্গ টাবা কমলা বীজপুর [পাঁচ জাতীয় লেবুর নাম]।
বাদাম ছোহরা দ্রাক্ষা পিণ্ড খর্জুর [পর্তুগীজেরা যে অনেক নূতন ফল এদেশে আমদানি করিয়াছিল তাহা অন্যত্র উল্লিখিত হইয়াছে] ॥ ২৫
মনোহরা-লাড় আদি শতেক প্রকার।
অমৃত গুটিকা আদি ক্ষীরসা অপার ॥ ২৬

… ইত্যাদি। (মধ্যলীলা-১৪শ পরিচ্ছেদ।)

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে আরও বহু রন্ধনের ও ভোজনদ্রব্যের বর্ণনা আছে [নারায়ণ দেবের পদ্মা পুরাণ, ৫৬-৫৭ পৃ.। কবিকঙ্কণ-চণ্ডী, দ্বিতীয় ভাগ, ৩৭৯, ৫১৫-১৮, ৬০৮ পৃ.। দ্বিজ হরিরামের ও মাধবাচার্যের চণ্ডীকাব্য ও দ্বিজ বংশীদাসের মনসামঙ্গল (দীনেশচন্দ্র সেন, বঙ্গসাহিত্য পরিচয়, পৃ. ২২১-২৪, ৩৩৫, ৩৩৯)]। সপ্তদশ শতকের আরম্ভে ভারতে গোলআলুর প্রচলন হইয়াছিল। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে তাঁহার স্পষ্ট উল্লেখ নাই।

অন্যান্য তান্ত্রিক আচারের সঙ্গে বৈষ্ণবগণ মৎস্য মাংস আহার বর্জন করেন। সুতরাং বৈষ্ণব সাহিত্যে কেবল নিরামিষ ভোজ্যের তালিকা পাই। কিন্তু শাক্ত গ্রন্থে নিরামিষ আমিষ দুইরূপ ভোজ্য দ্রব্যেরই বর্ণনা আছে। নারায়ণ দেবের পদ্ম-পুরাণে বেহুলার বিবাহ উপলক্ষে রন্ধনের বিস্তৃত বর্ণনা আছে [তমোনাশচন্দ্র দাসগুপ্ত সম্পাদিত পদ্মা-পুরাণ, ৫৬-৫৭ পৃ.]। নিরামিষের মধ্যে আছে :

১। বেতআগ = বেতের কচি অগ্রভাগ, স্বাদে তিক্ত। সিদ্ধ করিয়া অথবা সুক্ত ইত্যাদিতে খাওয়া হইত। (ব্যাতাগ?); ২। বাইঙ্গন (বেগুন?); ৩। পাটশাক; ৪। ঘৃতে ভাজা হেলের্চা (হ্যালাঞ্চ?); ৫। লাউয়ের আগ (লাউয়ের ডগা?); ৬। মুগ দাইল আর মুগের বড়ি; ৭। ঘৃতে ভাজা সিঙ্গারি; ৮। তিলুয়া, তিলের বড়া, তিল কুমড়া; ৯। মউয়া আলু; ১০। পাকা কলার অম্বল; ১১। পোর লতার শাক ও আদা দিয়া সুখত (শুক্তা বা শুকতুনি)।

নিরামিষ রান্না সব ঘৃতে সম্ভার হইত।

মৎস্যের ব্যঞ্জন : ১। (বেসন দিয়া) চিথলের কোল ভাজা; ২। মাগুর মৎস্য দিয়া মরিচের ঝোল; ৩। বড় বড় কৈ মৎস্যে কাটার দাগ দিয়া জিরা লবঙ্গ মাখিয়া তৈলে ভাজা; ৪। মহাশৌলের অম্বল; ৫। ইচা (চিংড়ী) মাছের রসলাস; ৬। রোহিত মৎস্যের মুড়া দিয়া মাসদাইল; ৭। আম দিয়া কাতল মাছ; ৮। পাবদা মৎস্য ও আদা দিয়া সুখত (শুকতুনি); ৯। আমচুর দিয়া শৌল মৎস্যের পোনা; ১০। বোয়াল মৎস্যের ঝাটি (তেঁতুল মরিচ সহ); ১১। ইলিস মাছ ভাজা; ১২। বাঁচা, ইচা, শৌল, শৌলপোনা, ভাঙ্গনা, রিঠা, পুঠা (পুঁটিমাছ) ও বড় বড় চিংড়ী মাছ ভাজা।

সমস্ত ভাজাই তৈল দিয়া হইত।

মাংসের ব্যঞ্জন : খাসী, হরিণ, মেষ, কবুতর, কাউঠা (কেঠো, কচ্ছপ) প্রভৃতির মাংস দিয়া নানাবিধ ব্যঞ্জন ও অম্বল।

পিঠা : খিরিসা (ক্ষীরের পিঠা), চন্দ্রপুলি, মনোহরা, নালবড়া, চন্দ্ৰকাতি (চন্দ্ৰকান্তি?), পাতপিঠা।

প্রকাশ্যে মদ্যপান হিন্দু-মুসলমান উভয় সমাজেই নিন্দনীয় ছিল কিন্তু গোপনে মাদক দ্রব্যের খুবই প্রচলন ছিল।

মুসলমানেরা নানাবিধ পশুপক্ষীর মাংস, মিষ্টান্ন এবং তাজা শুকনা ও কাবুলী ফল, আচার প্রভৃতি খাইতে ভালবাসিত। রুটি খাওয়ারও প্রচলন ছিল কিন্তু অধিকাংশ মুসলমানই ভাত খাইত। হিন্দু মুসলমান উভয়েই পান খাইত এবং পান-সুপারি দিয়া অতিথিকে সমাদর করিত।

মানরিক গৌড়ে এক মুসলমান বাড়িতে নিমন্ত্রিত হইয়াছিলেন। ভোজ্য দ্রব্যের এত প্রাচুর্য ছিল যে আহার করিতে তিন ঘণ্টা লাগিয়াছিল।

দরিদ্রদের আহারের ব্যবস্থাও বাংলা সাহিত্যে বর্ণিত হইয়াছে।

ব্যাধ কালকেতুর পশু শিকার করিয়া সচ্ছল অবস্থা হইলে–

চারি হাড়ি মহাবীর খায় খুদ-জাউ।
ছয় হাণ্ডি মুসুরী-সুপ মিশ্যা তথি লাউ।
ঝুড়ি দুই তিন খায় আলু ওল পোড়া।
কচুর সহিত খায় করঞ্জা আমড়া ॥ [কবিকঙ্কণ চণ্ডী, ১ম ভাগ, পৃ. ১৮৮]

কোন কোন দিন হরিণী বেচিয়া দধিরও যোগাড় হইত। কিন্তু যখন শিকার জুটিত না এবং বাসী মাংস বিক্রয় হইত না, তখন ধার করিয়া খুদ ও লবণ আনিয়া ‘বনাতি (নালিতা) শাক’সহ খুদের জাউ দিয়াই উদর পূর্তি করিতে হইত। [কবিকঙ্কণ চণ্ডী, ১ম ভাগ, ২৩০ পৃ.] বাটির অভাবে মাটিতে গর্ত করিয়া তাঁহার মধ্যেই খাদ্য দ্রব্য রাখিয়া খাইতে হইত। [কবিকঙ্কণ চণ্ডী, দ্বিতীয় ভাগ ৬৪৬ পৃ.]

মানরিক লিখিয়াছেন, “গরীব লোকেরা ভাত, লবণ ও শাক এবং সামান্য কিছু তরকারীর ঝোল খাইত। কদাচিৎ দধি ও সস্তা মিঠাই জুটিত। মাছও খুব সুলভ ছিল না। পান্তাভাতের জল (আমানি) গরীবদের প্রধান খাদ্য ছিল।”

প্রাচীন যুগেও বর্তমান যুগের ন্যায় আহারান্তে পান, সুপারি, হরিতকী প্রভৃতি খাওয়ার অভ্যাস ছিল। অভ্যাগতকে পান-সুপারি দিয়া অভ্যর্থনা করা হইত।

৫। পোশাক-পরিচ্ছদ। সেকালে বাঙালী পুরুষেরা ধুতি, চাদর ও স্ত্রীলোকেরা সাধারণত খালি গায়ে শাড়ি পরিত। পুরুষের ‘চরণে পাদুকা’ ও মস্তকে পাগড়ির কথাও কবিকঙ্কণে আছে। লম্বা কোঁচা দিয়া কাপড় পরা হইত। নাগর অর্থাৎ বিলাসীদের রূপা ও ভেলভেটের জুতা, কানে সোনার অলঙ্কার, দেহ চন্দনচর্চিতা ও পরিধানে তসরের বস্ত্র থাকিত। ধনী পুরুষেরা বর্তমান কোটের ন্যায় ‘অঙ্গরাখা’ ও পাগড়ি পরিত। কোমরে পুরুষেরা পটুকা ও স্ত্রীলোকেরা নীবিবন্ধ পরিত। নীবিবন্ধের সঙ্গে কখনও কখনও ঘুঙ্গুর বাঁধা থাকিত। দরবারের পোশাক ছিল আলাদা ইজার, কোমরবন্ধ, কাবাই প্রভৃতি। ধনী স্ত্রীলোকের নানা রংয়ের রেশমের শাড়ীর বিচিত্র বর্ণনা পাওয়া যায়। কোন কোন স্ত্রীলোক পৌরাণিক পালার ছবি আঁকা কাঁচুলি ও ওড়না পরিত। নটীরা ইজার পরিত। গরীব লোকেরা কোমরে নেংটী জড়াইয়াই বেশির ভাগ সময় থাকিত। স্নানের সময় মেয়েরা হলুদ-কুঙ্কুম দিয়া গাত্র এবং আমলকী দিয়া কেশ ধৌত করিত। তারপর কেশ মার্জনা করিয়া ধুপ দিয়া চুল শুকাইত এবং চন্দন দিয়া দেহ লেপন করিত। অভ্রের চিরুনী দিয়া চুল আঁচড়াইত। বাঙালী বেহার, নব বেহার, পচিমা বেহার, দেব মহল প্রভৃতি নামের নানা প্রকার খোঁপা প্রচলিত ছিল। [নারায়ণ দেবের পদ্ম-পুরাণ, ৫০-৫১ পৃ.] সধবা স্ত্রীলোকেরা শাখা, সিন্দুর ও কাজল ব্যবহার করিত। ধনী গৃহিণীরা ‘কস্তুরীর পত্রাবলী’ কপালে, গালে ও স্তনে অঙ্কিত করিত। সমসাময়িক সাহিত্যে বঙ্গনারীর বহুবিধ অলঙ্কারের উল্লেখ আছে; যথা সিঁথি, বেশর (নর্থ), কুণ্ডল (কানবালা), হার, চক্রাবলী, অনন্ত, কেয়ূর, রাজু, তাবিচ, কবচ, জসম, রতনচূড়, শাখা ও খাড়। আরও কয়েকটি নূতন অলঙ্কারের নাম পাওয়া যায়–(১) হীরামঙ্গল কড়ি অথবা মদন কড়ি, সম্ভবত কড়ির ন্যায়। আকৃতির কর্ণভূষণ; (২) গ্রীবাপত্র–সম্ভবত চিক বা হাঁসুলির ন্যায় গলদেশে আঁটিয়া পরা হইত; (৩) হাতপদ্ম-হাতের পাতার উপরের দিকে পরিবার জন্য কঙ্কণের সহিত যুক্ত পদ্মাকৃতি অলঙ্কার; (৪) উজ্বটিকা বা উট সম্ভবত চুটকির ন্যায় পায়ের আঙ্গুলে পরা হইত।

সোনা, রূপা ও হাতির দাঁতে গয়না তৈরী হইত এবং মণিমাণিক্যে খচিত হইত।

৬। ক্রীড়া-কৌতুক : সে যুগে পাশাখেলা খুব প্রচলিত ছিল। ধনপতি সদাগর গৌড়ের রাজার সহিত “রাত্রিদিন খেলে পাশা ভক্ষণ সময় বাসা”। মেয়ে পুরুষ পাশা খেলায় মত্ত হইয়া কর্তব্য কাজ অবহেলা করিতেন এরূপ বহু কাহিনী আছে। বিষ্ণুপুরে গোল তাস খেলার প্রচলন ছিল। সম্ভবত পর্তুগীজরা এই তাসখেলা আমদানি করে। পায়রা উড়ান প্রতিযোগিতা একটি খুব জনপ্রিয় ক্রীড়া ছিল। আলাওলয়ের পদ্মাবতীতে চৌগাঁ খেলার উল্লেখ আছে। ইহা বর্তমান পোলা (Polo) খেলার ন্যায়। গেণ্ডুয়া অর্থাৎ কাঠের বল লোফালুফির খেলাও প্রচলিত ছিল। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে চচরী খেলার কথা আছে কিন্তু ইহা ঠিক কি রকম খেলা ছিল বলা যায় না। মল্ল ক্রীড়াও জনপ্রিয় ছিল। কবিকঙ্কণ-চণ্ডীতে [প্রথম ভাগ, ৩৫১ পৃ.] আছে–

দোসর যমের দূত       বৈসে যত রাজপুত
মল্লবিদ্যা শেখে অবিরতি।

তারপর আখড়া-ঘরে মল্লযুদ্ধ অর্থাৎ কুস্তির বৈঠক হইত। ঘনরামের ধর্মমঙ্গলে [৬২. ৭৯-৮২ পৃ.] মল্লযুদ্ধ বা কুস্তির বিস্তৃত বিবরণ আছে। দৈহিক শক্তির দৃষ্টান্তস্বরূপ লোহার বাঁটুল চূর্ণ করা, বুকে বেলভাঙ্গা, মুঠা করিয়া সরিষা হইতে তৈল নিষ্কাশন, ঊর্ধ্বে তরবারি নিক্ষেপ করিয়া পুনরায় তাহা মুঠার মধ্যে ধরা প্রভৃতি মাণিক গাঙ্গুলীর ধর্মমঙ্গলে আছে।

নৃত্যগীতের খুবই প্রচলন ছিল। চৈতন্য-ভাগবতে রামায়ণের কাহিনী ও কৃষ্ণলীলা অবলম্বনে যাত্রা অভিনয়ের কথা আছে। সীতা হরণের কাহিনী শুনিয়া যবন দর্শকেরাও কাঁদিত এবং দশরথের ভূমিকা অভিনয় করিতে করিতে এক অভিনেতার সত্যসত্যই প্রাণবিয়োগ হইয়াছিল। স্বয়ং শ্রীচৈতন্যও কৃষ্ণলীলার অভিনয় করিতেন। [চৈতন্য-ভাগবত-৫৩, ২৩৭ পৃ.] অনেক বাদ্যযন্ত্রের উল্লেখ আছে–যথা শঙ্খ, ঘণ্টা, ডফ, মৃদঙ্গ, জগঝম্প, ডরু ও বিষাণ।

সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় ছিল পাঁচালী গান। প্রাচীন বাংলা কাব্যগুলি প্রায় সবই ছিল এই শ্রেণীর। প্রধান গায়ক (মূল গায়েন) এক হাতে চামর ও আর এক হাতে মন্দিরা এবং পায়ে নূপুর পরিয়া নাচের ভঙ্গীতে গাহিতেন, সঙ্গে সঙ্গে মৃদঙ্গবাদক তাল দিত। যাত্রাদলের ন্যায় দুইজন দোহারও ধুয়া ধরিত। ইহা ব্যতীত ছিল তরজা ও কবি গান (দুই পক্ষের মধ্যে গানে ও কবিতায় প্রশ্নোত্তরের ও উত্তর প্রত্যুত্তরের প্রতিযোগিতা)। এই শ্রেণীর গানের মধ্যে মাঝে মাঝে অশ্লীলতার প্রাধান্য থাকিত–এগুলিকে খেউড় বলা হইত।

চীনদেশীয় পর্যটকেরা লিখিয়াছেন যে প্রতিদিন খুব ভোরে এক শ্রেণীর পেশাদার লোক ধনী ও উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের পাড়ায় দ্বারে দ্বারে গিয়া সানাই, ঢোল প্রভৃতি শ্রেণীর বাদ্য বাজায়। তারপর প্রাতরাশের কালে প্রতি বাড়িতে গিয়া মদ্য, ভোজ্যদ্রব্য, টাকা-পয়সা ও অন্যান্য দ্রব্য উপহার পায়।

চীনারা বাঘের সাথে খেলারও বর্ণনা দিয়াছেন। এক শ্রেণীর লোক বাজারে কিংবা বাড়িতে লোহার শিকলে বাঁধা একটি বাঘ নিয়া যায়। শিকল খুলিয়া দিলে বাঘটি মাটিতে শুইয়া পড়ে। তারপর লোকটি বাঘকে মারিতে থাকে এবং বাঘ উত্তেজিত হইয়া তাঁহার উপর লাফাইয়া পড়ে। লোকটিও বাঘকে লইয়া মাটিতে পড়ে। কয়েকবার এইরূপ করিয়া লোকটি বাঘের গলায় হাত ঢুকাইয়া দেয়। [বাংলার ইতিহাসের দুশো বছর, ২য় সং, পৃ. ৪৭৯] তারপর বাঘটাকে আবার শিকল দিয়া বাঁধিয়া রাখে। খেলা শেষ হইলে দর্শকেরা লোকটিকে টাকা এবং বাঘের খাওয়ার জন্য মাংস দেয়। এটি অনেকটা বর্তমান যুগে সার্কাসের বাঘের খেলার মত।

৭। যুদ্ধ-প্রণালী : মধ্যযুগে বাঙালীরা যে বেশে লড়াই করিত সমসাময়িক সাহিত্যে তাঁহার চিত্র অঙ্কিত হইয়াছে। রূপরাম চক্রবর্তীর ধর্মমঙ্গলে লাউসেনের যুদ্ধকালীন পোশাকের বর্ণনা :

পরিলা ইজার খাসা নাম মেঘমালা।
কাবাই পরিলা দশদিগ করে আলা ॥
পামরি পটুকা দিয়া বান্ধে কোমরবন্ধ।

মোগল ও পাঠান সৈন্যের “কাল ধল রাঙ্গা টুপি সভাকার মাথে” এবং পায়ে মোজা। হাতি ও ঘোড়ার সওয়ার এবং পদাতিক–এই তিন শ্রেণীর সৈন্য ধনুক, খড়গ, ঢাল, বর্শা ও কামান লইয়া কাড়া দামামা বাজাইয়া যুদ্ধযাত্রা করিত। ডোম, হাড়ি প্রভৃতি নিম্নশ্রেণীর পাইকেরা বহু সংখ্যায় সৈন্যদলে যোগ দিত। অধীনস্থ রাজা ও জমিদারেরা হাজার হাজার সৈন্য লইয়া যুদ্ধে যোগ দিত। কেহ চারি হাজার ‘চৌহান সিপাই’, কেহ ‘বিয়াল্লিশ কাহন’ তীরন্দাজ, কেহ সাত হাজার ঘোড়া, কেহ দশ হাজার রাণা, কেহ আট বা আশী হাজার ঢালি নিয়া আসিত। বাগদি সেনাপতির ‘হাতে বালা, কানে সোনা’ এবং তাঁহার পাইকদের ‘কোমরে ঘাঘর, গলায় ওড়ের মালা, হাতে ধনুক বাণ’। পঞ্চাশ হাজার ডোম সৈন্য চলিল :

কড়া বাজে ডিগ-ডিগ টিঙ্গ-টিঙ্গ পড়া।
হাড়ি পাইক সাজিল সর্দার লোহার-গড়া ॥
পায় বাজে নূপুর ঘাঘর বাজে ঢালে।
ঘুরুল্যা বাতাস পারা ঘুরা ঘুরা বুলে ॥

কালু ডোম সেনাপতির পদে উন্নীত হইয়াছিল। তাঁহার স্ত্রীও যুদ্ধ করিত। সৈন্যদলের মধ্যে হিন্দু, মুসলমান, বাঙালী, রাজপুত, উড়িয়া, তেলেঙ্গীর উল্লেখ আছে। কোল সৈন্যেরাও জয়ঢাক বাজাইতে বাজাইতে আসিত। তাহাদের

চিকুরে চিরনি আছে অঙ্গে রাঙামাটি।
জাত্যের স্বভাবে তীর ধরে দিবারাতি ॥ [সুকুমার সেন, মধ্যযুগের বাংলা ও বাঙালী, ৩৩-৩৭ পৃ.]

রূপরামের বর্ণনা কাল্পনিক হইলেও ইহা হইতে সেকালের সামরিক শ্রেণীর ও যুদ্ধযাত্রার কিছু আভাস পাওয়া যায়।

কলিঙ্গরাজ ও কালকেতুর প্রসঙ্গে কবিকঙ্কণ-চণ্ডীতেও [৬৬. প্রথম ভাগ, ৩৮০-৮১ পৃ.] যুদ্ধের বর্ণনা আছে–

কাট কাট বলি তাজে          কলিঙ্গ নৃপতি সাজে
গজঘণ্টা বাজে উতরোল।
সাজ সাজ পড়ে ডাক         বাজে দামা রণ-ঢাক
কলিঙ্গে উঠিল গণ্ডগোল ॥
শত শত মত্ত হাতী          লইলেন সেনাপতি
শুণ্ডে বান্ধে লোহার মুদ্গর।
* * *
আশী গণ্ডা বাজে ঢোল          তের কাহন সাজে কোল
করে ধরে তিন তিরকাঠি।
পরিধান পীতধড়ি          মাথাতে জালের দড়ি
অঙ্গে সবে মাখে রাঙা মাটি ॥
বাজন-নূপুর পায়          বিবিধ পাইক ধায়
রায়বাশ ধরে খরশান।
সোনার টোপর শিরে         ঘন সিংহনাদ পুরে
বাঁশে বান্ধে চামর নিশান ॥

এই বর্ণনায় চারি ঘোড়ায় টানা রথের উল্লেখ আছে। কিন্তু এই যুগের যুদ্ধে রথ ব্যবহার হইত, এরূপ কোন প্রমাণ নাই। সম্ভবত এই বর্ণনায় রামায়ণ-মহাভারতের কিছু প্রভাব আছে। ঢাক, ঢোল, ভেরী, জগঝম্প, দামামা, রণশিঙ্গা, কাংস্য করতাল, কাঁসি, ঘণ্টা, কাড়া প্রভৃতি বাদ্যের শব্দে রণক্ষেত্র মুখরিত হইত।

সমসাময়িক সাহিত্যে নানা প্রকার অস্ত্রশস্ত্রের উল্লেখ দেখা যায়, কিন্তু সবগুলিই ব্যবহৃত হইত কিনা বলা কঠিন। শূল জাতীয়—’নেঞ্জা’ (বর্তমান ল্যাজা), বর্শা, শক্তি বা শেল; কুঠার জাতীয়-পরশু, ডাবুশ, পরশ্বধ, পটিশ; মুগুর জাতীয়–ভূষণ্ডী, ভোমর, মুদার; পাশ ও চক্রেরও উল্লেখ আছে। বাঙালীর প্রধান অস্ত্র ছিল রায়বাশ, ধনুকবাণ, অসি বা খড়গ এবং ঢাল। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে ‘টাকার’ নামে অস্ত্রের উল্লেখ আছে। ইহা ঠিক কোন্ জাতীয়, তাহা বলা যায় না।

ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম পাদ শেষ হইবার পূর্বেই বাংলা দেশে যুদ্ধে আগ্নেয়াস্ত্র–কামান, বন্দুক ব্যবহৃত হইত। তখনও উত্তর-ভারতের অন্য কোন অঞ্চলে ইহা প্রচলিত হয় নাই।

যুদ্ধপ্রসঙ্গে মাধবাচার্যের চণ্ডীকাব্যের [৮২ পৃ.। বঙ্গ সাহিত্য পরিচয় পৃ. ৩২৭] নিম্নলিখিত অংশটি বিশেষ প্রণিধানযোগ্য।

পলাইল যোগী পাইক মনে ভয় পায়্যা।
সমরে রহিল কাটামুণ্ড শিরে দিয়া ॥
কর্মকার পাইক বলে করিয়া বিনয়।
বীর গুরু বধিতে তোমার ধর্ম নয় ॥
নট পাইক বলে বাপু আমি পাইক নহি।
বেগার ধরি আনিছে পরের ভার বহি ॥
পলায় বিশ্বাস পাইক ভয় ত্রাস পায়্যা।
আকুল হইয়া কান্দে মুখে হাত দিয়া ॥
যতেক ব্রাহ্মণ পাইক পৈতা ধরি করে।
দন্তে তৃণ ধরি তারা সন্ধ্যা মন্ত্র পড়ে ॥
যত যত যোগী পাইক দণ্ড ধরি করে।
রক্ষ রক্ষ বলি তারা বিনয় ত করে ॥

ইহা হইতে অনুমিত হয় যে ব্রাহ্মণাদি সমস্ত জাতির লোকই সৈনিকের কার্য করিত (অথবা করিতে বাধ্য হইত)। কিন্তু সে যুগে (এবং এ যুগেও) যে ডোম বাগদিরা সমাজের সর্বনিম্নস্তরে অবস্থিত এবং অবহেলিত, তাহারা যে সাহস ও বীরত্বের পরিচয় দিত উচ্চশ্রেণীর বাঙালীরা তাহা পারে নাই। ‘অন্নদামঙ্গলে বর্ধমানের গড়ের যে বর্ণনা আছে তাহাতে ইউরোপীয়, মোগল, পাঠান, ক্ষত্রিয়, রাজপুত, বুন্দেলা প্রভৃতি বিদেশী সৈন্যের কথা আছে কিন্তু বাঙালী হিন্দু সৈন্যের কোন উল্লেখ নাই। ইহাও প্রকারান্তরে উক্ত মতের সমর্থন করে। অবশ্য অন্য প্রমাণের সমর্থন ব্যতীত এই সিদ্ধান্ত সত্য বলিয়া গ্রহণ করা যায় না। কারণ মুসলমানদের ঐতিহাসিক গ্রন্থে বাঙালী পাইকের সাহস বীরত্ব ও সমরকৌশলের ভূয়সী প্রশংসা আছে। আর বাঙালী পাইকের মধ্যে যে উচ্চশ্রেণীয় ছিল না তাহা নিঃসংশয়ে বলা যায় না।

নদীমাতৃক বাংলা দেশে রণতরীর খুব ব্যবহার ছিল এবং নৌযুদ্ধে বাঙালীদের সহিত দিল্লির ফৌজ আঁটিয়া উঠিতে পারিত না।

৮। বিবিধ : মধ্যযুগে সাধারণ লোকের মধ্যে বহু কুসংস্কার প্রচলিত ছিল। মন্ত্র বা ঔষধ দ্বারা উচাটন, বশীকরণ, বন্ধ্যার সন্তানলাভ প্রভৃতির উল্লেখ আছে।

জ্যোতিষ-গণনার প্রতি লোকের অগাধ বিশ্বাস ছিল। শিশুর জন্ম হইবার পরই গণক ডাকাইয়া কোষ্ঠী তৈরী করা হইত। যাত্রা, বিবাহ প্রভৃতি ব্যাপারে শুভদিন দেখিতে হইত। তবে কেহ কেহ ইহা মানিতেন না। ধনপতির বাণিজ্যর যাত্রার সময় দৈবজ্ঞ রাশিচক্র গণনা করিয়া এবং পঞ্জিকা দেখিয়া বলিল :

এমন যাত্রীর সাধু শুন অভিসন্ধি।
এ যাত্রায় লোক গেলে তথা হয় বন্দী ॥
এমন শুনিয়া সাধু মুখ কৈল বাঁকা।
নফরে হুকুম দিয়া মারে ঘাড়ধাক্কা ॥ [কবিকঙ্কণ-চণ্ডী, ২য় ভাগ ৬১৯ পৃ.]

বলা বাহুল্য গণকের গণনা পুরাপুরিই ফলিয়াছিল এবং এই কাহিনী শুনিয়া জ্যোতিষ গণনার প্রতি লোকের বিশ্বাস আরও দৃঢ় হইয়াছিল। ঝাঁড়-ফুঁক, মন্ত্র-তন্ত্র, তুক তাকে লোকের খুব বিশ্বাস ছিল। ওঝা মন্ত্র পড়িয়া ভূত ছাড়াইত, ব্যারাম-পীড়া সারাইত।

গর্ভাধান হইতে আরম্ভ করিয়া জাতকের মৃত্যু পর্যন্ত যে সব লৌকিক আচার অনুষ্ঠান এখনও রক্ষণশীল সমাজে প্রচলিত আছে, মধ্যযুগের সাহিত্যে তাঁহার প্রায় সবগুলিরই উল্লেখ আছে। ধনপতি ও খুল্লনার বিবাহ, অন্তঃসত্ত্বা কালে খুল্লনার অবস্থা ও আনুসঙ্গিক সাধভক্ষণাদির অনুষ্ঠান, তাঁহার পুত্রের জন্ম ও পরবর্তী অনুষ্ঠান, পুত্রের ষষ্ঠী, আটকলাই, নামকরণ, ঘুম-পাড়ানী গান, শ্রীমন্তের বাল্যক্রীড়া, কর্ণবেধ, বিদ্যারম্ভ, উচ্চ শিক্ষা, ধনপতির পিতৃশ্রাদ্ধ প্রভৃতির বিস্তৃত বর্ণনা পড়িতে পড়িতে মনে হয় মধ্যযুগের বাঙালীর সংস্কার ও লৌকিক আচারের বিশেষ কোন পরিবর্তন হয় নাই।

সেকালে লোকের পশুপক্ষী পালিবার খুব সখ ছিল। রাজা গোবিন্দচন্দ্র যখন সন্ন্যাস গ্রহণ করিয়া রাজপ্রাসাদ হইতে বাহির হইলেন তখন তাঁহার পোষা পাখী, গরু, হাতি ও কুকুর আর্তনাদ করিয়া উঠিল। “নও বুড়ি কুত্তা কান্দে চরণেত পড়িয়া”। অর্থাৎ তাঁহার ১৮০টি পোষা কুকুর ছিল। লোকে পোষা পাখীর পায়ে নূপুর লাগাইত ও অনেক খরচ করিয়া পাখীর খাঁচা নির্মাণ করিত।

ধনী বিলাসীদের গৃহে বহু আসবাবের বর্ণনা পাওয়া যায়। স্বর্ণরৌপ্যখচিত পালঙ্ক, মশারি, শীতলপাটি, কম্বল, গালিচা, আয়না, স্বর্ণখচিত দোলা, রথ বা শকট, শামিয়ানা, নানাপ্রকার চামর ও পাখা, গজদন্ত নির্মিত পাশা, সোনার পিড়ি, প্রভৃতি উল্লেখ আছে।

বাংলা দেশে জিনিসপত্র খুব সস্তা হওয়ায় বহু বিদেশী এখানে বসবাস করিত। সপ্তদশ খ্রীষ্টাব্দে বার্নিয়ার লিখিয়াছেন যে এই কারণে ওলন্দাজ কর্ত্তৃক বিতাড়িত বহু পর্তুগীজ ও ট্যাঁস ফিরিঙ্গী (halfcaste) এই দেশে আশ্রয় লয়। এ দেশে অনেক গীর্জা আছে এবং এক হুগলি (Hogouli) শহরেই প্রায় আট নয় হাজার খ্রীষ্টান বাস করে। ইহা ছাড়া আরও পঁচিশ হাজার খ্রীষ্টান এ দেশে বাস করে। এই দেশের ঐশ্বর্য, জীবনযাত্রার স্বাচ্ছন্দ্য ও এদেশের মেয়েদের মধুর স্বভাবের ফলে ইংরেজ, পর্তুগীজ ও ওলন্দাজদের মধ্যে একটি প্রবাদ-বাক্যের উৎপত্তি হইয়াছে যে “বাংলা দেশে শতশত প্রবেশের দ্বার আছে কিন্তু বাহিরে যাইবার একটিও পথ নাই।” এই সমুদয় বিদেশীদের প্রভাবে বাংলা দেশে যে সকল নূতন খাদ্য, পানীয়, কৃষিজাত দ্রব্য, আসবাবপত্র ও নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যের প্রচলন হইয়াছে তাহা পূর্বে ও পঞ্চদশ পরিচ্ছেদের পরিশিষ্টে উল্লিখিত হইয়াছে। রালফ ফিচ কোচবিহারে ছাগল, মেষ, কুকুর, বিড়াল, পাখী ও অন্যান্য জীবজন্তুর জন্য আরাগ্যশালা (হাসপাতাল) ছিল বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন।

৯। বাঙালীর নীতি ও চরিত্র : মধ্যযুগে বাঙালীর নীতি ও চরিত্র সম্বন্ধে বৈদেশিক ভ্রমণকারীরা পরস্পর-বিরুদ্ধ মত প্রকাশ করিয়াছেন। জোয়ানেস্ ডি লায়েট (Joannes De Leat) বলিয়াছেন (১৬৩০ খ্রীষ্টাব্দে) যে তাহারা খুব চতুর চালাক কিন্তু স্বভাব চরিত্র খুবই খারাপ; পুরুষেরা চুরি ডাকাতি করে, স্ত্রীলোক লজ্জাহীনা ও অসতী। সপ্তদশ শতকে শুটেন (Gautier Schouten) বলেন যে লাম্পট্য ও দুর্নীতি ভারতের সর্বত্রই আছে তবে বাংলা দেশে অন্য প্রদেশ হইতে বেশি। মানরিক (Sebastiao Manrique) লিখিয়াছেন (১৬২৮ খ্রীষ্টাব্দে) যে বাঙালীরা ভীরু ও উদ্যমহীন, পরের পা চাটিতে অভ্যস্ত। তাহাদের মধ্যে একটি ছড়া প্রচলিত আছে ‘মারে ঠাকুর না মারে কুকুর’–অর্থাৎ যে প্রহার করিতে পারে তাহাকে ঠাকুরের মত মান্য করিব আর যে না মারে তাহাকে কুকুরের মত ঘৃণা করিব। এই ছড়াটির মধ্য দিয়াই তাহাদের স্বভাব ফুটিয়া উঠিয়াছে।

অপর দিকে চীনাদের বিবরণে (পঞ্চদশ শতকের প্রারম্ভে) বাঙালীর সতোর ও দয়া-দাক্ষিণ্যের উচ্চ প্রশংসা আছে। তাহারা কোন চুক্তি করিলে তাহা ভঙ্গ করে না, এমন কি দশ হাজার মুদ্রার চুক্তি করিলেও তাহারা কাহাকেও ঠকায় না এবং নিজ গ্রামের দুঃস্থ লোকদিগকে নিজেরাই পোষণ করে, সাহায্যের জন্য অন্য গ্রামে যাইতে দেয় না। [Visva-bharati Annals, I. p. 112, 113, 116] তবে চীনাদের বাঙালী সমাজের সম্বন্ধে জ্ঞান খুব বেশি ছিল বলিয়া মনে হয় না; কারণ তাহারা লিখিয়াছে যে এদেশে হিন্দুদের মধ্যে স্বামী মরিলে স্ত্রীলোক এবং স্ত্রী মরিলে স্বামী আর দ্বিতীয়বার বিবাহ করে না। ইউরোপীয় বিদেশীদের কথা কতদূর সত্য তাহা বলা যায় না। অসম্ভব নহে যে পঞ্চদশ শতকের খুলনায় সপ্তদশ শতকে বাঙালী চরিত্রের অবনতি হইয়াছিল। কিন্তু দুর্নীতি ও ধূর্ততা বিষয়ে ইউরোপীয় লেখকেরা যে খুব অতিরঞ্জিত করেন নাই, ঊনবিংশ শতকের বাঙালী চরিত্র তাহা অনেকটা সমর্থন করে। মুকুন্দরাম বর্ণিত ভাঁড়দত্তের চরিত্র বাঙালী সমাজের একটি শ্রেণীর প্রতীক বলিয়া গ্রহণ করা যাইতে পারে।

ধনী ও সম্ভ্রান্ত বাঙালীরা আহার, পরিচ্ছদ, অলঙ্কার প্রভৃতি বিষয়ে যে বিলাসিতার চূড়ান্ত করিতেন; নারীদেহ ভোগ, মদ্যপান ও অন্যান্য ব্যভিচারে খুবই আসক্ত ছিলেন এবং ইহা যে অস্বাভাবিক বলিয়া গণ্য হইত না তাঁহার যথেষ্ট প্রমাণ আছে। গণিকাগৃহে গমন ও স্বগৃহে বাইজীর নৃত্যগীত ও অবাধ মদ্যপান, ধনী লোকের একটি বৈশিষ্ট্য বলিয়াই গণ্য হইত।

অশ্লীলতা ও নর-নারীর দৈহিক সম্ভোগ সম্বন্ধে যে আদর্শ বর্তমানে প্রচলিত মধ্যযুগের আদর্শ তাহা হইতে অন্যরূপ ছিল বলিয়াই মনে হয়। ধর্ম্মানুষ্ঠানের সহিত যে সকল অশ্লীল আচার ও আচরণ জড়িত ছিল, তান্ত্রিক ও সহজিয়া সম্প্রদায় এবং দুর্গাপূজার শবরোৎসব উপলক্ষে তাহা বর্ণিত হইয়াছে। এগুলি সে যুগের স্মৃতিশাস্ত্রে ধর্ম্মের অঙ্গ বলিয়া স্বীকৃতি লাভ করিয়াছে। জয়দেবের গীতগোবিন্দ, চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, বৈষ্ণব পদাবলী ও ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল প্রভৃতি গ্রন্থে, অর্থাৎ মধ্যযুগের প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত, শৃঙ্গার রসের যে উৎকট বর্ণনা আছে, বর্তমান কালের আদর্শ অনুসারে তাহা সুরুচি ও নীতির দিক দিয়া সমাজের খুব অধঃপতিত অবস্থাই সূচিত করে। সুতরাং মধ্যবিত্ত ও নিম্নশ্রেণীর মধ্যেও যে নীতির আদর্শ খুব উচ্চ ছিল তাহা বলা যায় না। অবশ্য বর্তমান যুগের আদর্শের মাপকাঠিতে বিচার করিয়াই এই ভাল মন্দ স্থির করা হইয়াছে। ইহার মধ্যে কোন্ যুগের আদর্শ ভাল, তাঁহার বিচার বর্তমান ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক।

ইউরোপীয় লেখকেরা যে বাঙালীর ভীরুতার উল্লেখ করিয়াছেন ঊনবিংশ শতকের পটভূমিতে দেখিলে তাহা অস্বীকার করিবার কোন সঙ্গত কারণ নাই। মধ্যযুগের ইতিহাসে বাঙালী সৈন্য যুদ্ধ করিয়াছে এবং সাহস ও বীরত্বের পরিচয় দিয়াছে, ইহার বহু বিবরণ পাওয়া যায়। কিন্তু সমসাময়িক সাহিত্য হইতে এ সিদ্ধান্ত করা অসঙ্গত হইবে না যে সাধারণত হাড়ী, ডোম, বাগদী প্রভৃতি নিম্নশ্রেণীর হিন্দুরাই পাইকের দলে ভর্তি হইয়া যুদ্ধ করিত। উচ্চতর শ্রেণীর হিন্দুগণ যে কিরূপ সাহসী ও সমরকুশল ছিল মাধবাচার্যের চণ্ডীকাব্য হইতে যে অংশ উদ্ধৃত করা হইয়াছে [চৈতন্য-ভাগবতে-৫৩, ২৩৭ পৃ.] তাহাতেই তাঁহার বর্ণনা পাওয়া যাইবে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাঙালীদের যে সাহস ও সামরিক শক্তির যথেষ্ট অভাব ছিল তাহা মধ্যযুগের–অন্তত ইহার শেষভাগের–অবস্থা সূচিত করে।

মানরিক বাঙালীর ভীরুতা ও উদ্যমহীনতার প্রসঙ্গে বলিয়াছেন যে ইহারা দাসত্ব ও বন্দিজীবনে অভ্যস্ত। মধ্যযুগের বাঙালী হিন্দুরা যে সুলতানী ও মুঘল আমলে স্বাধীনতা লাভের বিশেষ কোন চেষ্টা করে নাই ইহাই তাঁহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। এই দুই শাসনের মধ্যবর্তী অরাজক অবস্থার সময়ে বাঙালী হিন্দু জমিদারেরা স্বীয় প্রতিপত্তির জন্য লড়াই করিয়াছিলেন–কিন্তু তাহা বেশি দিন স্থায়ী হয় নাই। এ বিষয়ে পাঠান জাতীয় মুসলমানেরা অনেক বেশি উদ্যম ও সাহস দেখাইয়াছিল। হিন্দুর মধ্যে রাজা সীতারাম রায় একমাত্র ব্যতিক্রম। সুপ্রতিষ্ঠিত মুঘল রাজশক্তির বিরুদ্ধে তিনি স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করিয়াছিলেন। সমসাময়িক সাহিত্য ইহাই প্রমাণিত করে যে বাঙালী আত্মশক্তিতে বিশ্বাস করিত না। দৈব অনুগ্রহের উপর। নির্ভর করিতেই অভ্যস্ত ছিল।

কাজী যখন কীর্তন বন্ধ করিবার আদেশ দিলেন তখন সাধারণ বাঙালীর ভীরুতা ও দুর্বলতা যেরূপ প্রকট হইয়াছিল চৈতন্য-ভাগবতে তাঁহার বর্ণনা আছে। স্বয়ং চৈতন্যদেবের আদর্শ এবং প্রচেষ্টাও যে কোন স্থায়ী ফল প্রসব করে নাই তাহা পূর্বেই উল্লিখিত হইয়াছে [চৈতন্য ভাগবত (মধ্য খণ্ড) ২৩ অধ্যায়, চৈতন্য ভাগবত (আদি) ১৭ অধ্যায়]। ষোড়শ শতাব্দীর বাঙালীর এই মনোবৃত্তি ঊনবিংশ শতকের বাঙালীরাও উত্তরাধিকার সূত্রে পাইয়াছিল।

টমাস বাউরী (১৬৬৯-৭৯ খ্র) বাঙালী ব্রাহ্মণের মানসিক উৎকর্ষের বিশেষ প্রশংসা করিয়াছেন। যাঁহারা নব্যন্যায়ের জন্য সমগ্র ভারতবর্ষে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন, এ প্রশংসা ন্যায্যত তাঁহাদের প্রাপ্য। এই প্রসঙ্গে ইহাও উল্লেখযোগ্য যে অন্যান্য অনেক বিষয়ে হীন হইলেও বাঙালী চরিত্রের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল জ্ঞানার্জনের স্পৃহা, এবং হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়েই বিদ্যাশিক্ষার উৎকৃষ্ট ব্যবস্থা ছিল।

কিন্তু বাঙালীর জ্ঞানের আদর্শ ছিল অতিশয় সীমাবদ্ধ। বিদেশীর নিকট হইতে নূতন নূতন জ্ঞানলাভের স্পৃহা তাহাদের মোটেই ছিল না, এবং ভারতের বাহিরে যে বিশাল জগৎ আছে তাঁহার সম্বন্ধে তাহারা কিছুই জানিত না। পঞ্চদশ শতকে একাধিক রাজদূত বাংলা হইতে চীনে গিয়াছিল এবং চীন হইতে বাংলায় আসিয়াছিল। কিন্তু চীন দেশের তুলনায় বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির সম্বন্ধে বাঙালীর জ্ঞান খুব অল্পই ছিল। চীনদেশের তিনটি আবিষ্কার-মুদ্রণযন্ত্র, আগ্নেয়াস্ত্র ও চুম্বক দিগদর্শন যন্ত্রসভ্য জগতে যথাক্রমে শিক্ষা ও চিন্তার রাজ্যে, যুদ্ধে ও সমুদ্রযাত্রায় যুগান্তর আনয়ন করিয়াছিল; কিন্তু বাঙালীরা ইহার কোন সংবাদ রাখিত না। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে পাশ্চাত্য জগতে–নূতন নূতন চিন্তাধারার বিকাশ ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের অদ্ভুত উন্নতি সাধন হইয়াছিল কিন্তু বাংলা দেশে তথা ভারতে ইহার কোন প্রচার হয় নাই। যে সময়ে ইউরোপে নিউটন, লাইবনিজ, বেকন প্রভৃতি মানুষের প্রজ্ঞাশক্তি ও জ্ঞানের পরিধি বিস্তার করিতেছিলেন সেই সময় বাঙালীর মনীষা নব্যন্যায়ের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিচারে, বাঙালীর প্রজ্ঞা কোন্ তিথিতে কোন্ দিকে যাত্রা শুভ বা অশুভ এবং কোন্ ভোজ্য দ্রব্য বিধেয় বা নিষিদ্ধ তাঁহার নির্ণয়ে, এবং বাঙালীর ধর্মচিন্তা ও হৃদয়বৃত্তি স্বকীয়া অপেক্ষা পরকীয়া-প্রেমের আপেক্ষিক উৎকর্ষ প্রতিষ্ঠার জন্য ছয়মাস ব্যাপী তর্কযুদ্ধে নিয়োজিত ছিল।

হিন্দু ও মুসলমান সমাজের সম্বন্ধ

মধ্যযুগে বাংলার হিন্দু ও মুসলমান যে রাজনীতি, ধর্ম ও সমাজের গুরুতর বৈষম্যের জন্য দুইটি পৃথক সম্প্রদায়ে বিভক্ত হইয়া নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখিয়াছিল তাহা এই অধ্যায়ের প্রথমেই বলা হইয়াছে। তথাপি ছয় শত বৎসর যাবৎ এই দুই সম্প্রদায় একত্র বা পাশাপাশি বাস করিয়াছে। সুতরাং এ দুইয়ের মধ্যে কি প্রকার সম্বন্ধ গড়িয়া উঠিয়াছিল তাহা জানিবার জন্য স্বতই ঔৎসুক্য হয়। বিশেষত, যদিও এ বিষয়ে নিরপেক্ষ বিচারসহ তথ্য খুব কমই আমরা জানি, তথাপি কল্পনার দ্বারা এই অভাব পূরণ করিয়া অনেকেই ইহাদের মধ্যে একটি বিশেষ সৌহার্দ্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বভাবের চিত্র আঁকিয়াছেন। ইতিহাসে এই সকল অবাস্তব ভাব-প্রবণতার স্থান নাই। সুতরাং এই দুই সম্প্রদায়ের পরস্পরের প্রতি আচরণের যে কয়েকটি গুরুতর ও প্রয়োজনীয় তথ্য সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া যায় তাঁহার উল্লেখ করিতেছি।

ইসলামে ধর্ম ও রাষ্ট্রের নায়ক একই এবং উভয়ই শাস্ত্রের বিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই শাস্ত্রমতে মুসলমান রাজ্যে কাফের হিন্দুদের কোন স্থান নাই; ইহারা জিম্মি অর্থাৎ আশ্রিতের ন্যায় জীবনযাপন করিবে এবং নাগরিকের প্রধান প্রধান অধিকার হইতে বঞ্চিত থাকিবে। কুড়ি পঁচিশ দফায় ইহাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্দিষ্ট হইয়াছে। ইহাদের মধ্যে মাত্র তিনটির উল্লেখ করিলেই যথেষ্ট হইবে।

১। হিন্দুদিগকে নিজের জন্মভূমিতে বাস করিতে হইলে বিনীতভাবে মাথা পিছু একটি কর দিতে হইবে–ইহার নাম জিজিয়া।

২। হিন্দুরা দেবদেবীর মূর্ত্তির জন্য কোন মন্দির নির্মাণ করিতে পারিবে না। কার্যত ইহার ব্যাপক অর্থ দাঁড়াইয়াছিল যে, যে সকল মন্দির আছে তাহা ভাঙ্গিয়া ফেলাও পুণ্যের কাজ।

৩। যদি কোন অমুসলমান ইসলামের প্রতি অনুরক্ত হয় তাহাকে কেহ বাধা দিতে পারিবে না, কিন্তু যদি কেহ কোন মুসলমানকে অন্য ধর্ম্মে দীক্ষিত করে তাহা হইলে যে কোন মুসলমান ঐ দুই জনকেই স্বহস্তে বধ করিতে পারিবে।

ইসলামই একমাত্র সত্য ধর্ম–এইরূপ বিশ্বাস হইতেই এই সমুদয় বিধির প্রবর্তন হইয়াছে। মধ্যযুগ পৃথিবীতে ধর্ম্মান্ধতার যুগ। হিন্দু সমাজের অনেক কদাচার, নিষ্ঠুরতা, অবিচার ও অত্যাচার এই ধর্ম্মান্ধতারই ফল। সুতরাং আশ্চর্য বোধ করার কিছুই নাই।

উক্ত মৌলিক তিনটি নীতিই যে ভারতের অন্য স্থানের ন্যায় বাংলা দেশের মুসলমানেরা অনুসরণ করিত তাহাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নাই। দুই একটি দৃষ্টান্ত দিতেছি।

বর্তমান যুগে এক সম্প্রদায়ের হিন্দু প্রচার করিয়াছেন যে ইংরেজ শাসনের পূর্বে ভারত কখনও পরাধীন হয় নাই, কারণ মুসলমানেরা এদেশেই বসবাস করিত। এ যুক্তির অনুসরণ করিলে বলিতে হয় যে অষ্ট্রেলিয়ার ‘মাওরি জাতি এবং আমেরিকার ‘রেড ইণ্ডিয়ান’ অর্থাৎ আদিম অধিবাসীরা ধ্বংস হইয়াছে বটে কিন্তু কখনও পরাধীন হয় নাই, কারণ ইংরেজ শাসকেরা তাহাদেরই দেশেই বাস করিত। এ সম্বন্ধে ইহাও বলা আবশ্যক যে সুদীর্ঘ ছয় শত বৎসরের মধ্যে মাত্র একজন হিন্দু রাজা গণেশ–গৌড়ের সিংহাসনে আরোহণ করেন। কিন্তু বাংলার মুসলমানেরা জৌনপুরের মুসলমান সুলতানকে এই কাফেরকে সিংহাসনচ্যুত করার জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ করেন। তাঁহার ফলে গণেশ সিংহাসনচ্যুত হন এবং তাঁহার পুত্র ইসলাম ধর্ম অবলম্বন করিয়া রাজসিংহাসন অধিকারে রাখিতে সমর্থ হন।

কিন্তু হিন্দু রাজা হওয়া তো দূরের কথা ইহার সম্ভাবনামাত্রও মুসলমান সুলতানকে বিচলিত করিত। গৌড়ে ব্রাহ্মণ রাজা হইবে নবদ্বীপে এই রূপ একটি ভবিষ্যদ্বাণীর প্রচার হওয়ায় সুলতানের আজ্ঞায় নবদ্বীপে যে কী ভীষণ অত্যাচার হইয়াছিল তাহা প্রায়-সমসাময়িক গ্রন্থ জয়ানন্দের ‘চৈতন্যমঙ্গলে বর্ণিত আছে।

রাজনীতি ক্ষেত্রে হিন্দুর প্রতি সদ্ব্যবহারের প্রমাণস্বরূপ হিন্দুদের উচ্চ রাজপদে নিয়োগের কথা অনেকেই উল্লেখ করিয়াছেন। প্রথম দুইশত বৎসর সুলতানী রাজত্বের ইতিহাসে এইরূপ নিয়োগের কোন উল্লেখ নাই। পরবর্তীকালে দেখা যায় যে, রাজ-দরবারে বিরোধী মুসলমানদিগকে দমাইয়া রাখিবার জন্য হিন্দুদিগকে উচ্চপদে নিয়োগ করা হইত। যে কারণেই হউক গিয়াসুদ্দীন আজম শাহই (১৩৯০-১৪১০ খ্রী) প্রথমে হিন্দুদের উচ্চপদে নিয়োগ করেন। কিন্তু ইহাতে মুসলমান সমাজ বিচলিত হইল। সুফী দরবেশ হজরৎ মৌলানা মুজফফর শামস বলখি সুলতানকে চিঠি লিখিলেন যে এইরূপ নিয়োগ ধর্মশাস্ত্রের বিধিবিরুদ্ধ। তাহার সংখ্যা হাতের আঙ্গুলে গোণা যায়। আকবরের পরবর্তী যুগে আবার প্রাচীন ধ্বংসলীলা আরম্ভ হয় এবং ঔরংজেবের সময় ইহা চরমে ওঠে।

কিন্তু কেবল মন্দির ধ্বংস নহে, হিন্দুর ধর্ম্মানুষ্ঠানেও মুসলমানেরা বাধা দিত। নবদ্বীপে কাজীর আদেশে কীর্তন করা বন্ধ হইয়াছিল। পথে যাইতে যাইতে কাজী শুনিলেন যে গৃহমধ্যে বাদ্য-সহযোগে কীর্তন হইতেছে–ইহাতে কুপিত হইয়া

যাহারে পাইল কাজি মারিল তাহারে।
ভাঙ্গিল মৃদঙ্গ, অনাচার কৈল দ্বারে ॥ [চৈতন্যভাগবত, মধ্যখণ্ড, ২৩শ অধ্যায়]
কাজি বলে হিন্দুয়ানি হইল নদীয়া।
করিব ইহার শাস্তি নাগালি পাইয়া ॥ [চৈতন্যভাগবত মধ্যখণ্ড, ২৩শ অধ্যায়]

চৈতন্যদেব কি করিয়া কাজীকে নিবৃত্ত করিয়াছিলেন তাহা পূর্বে বর্ণিত হইয়াছে।

বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গলে (পঞ্চদশ শতাব্দী) হিন্দুর প্রতি মুসলমান কর্মচারীর অকথ্য অত্যাচারের বর্ণনা আছে।

যাহার মাথায় দেখে তুলসীর পাত।
হাতে গলে বান্ধি নেয় কাজির সাক্ষাৎ ॥
বৃক্ষতলে থুইয়া মারে বজ্র কিল।
পাথরের প্রমাণ যেন ঝড়ে পড়ে শিল ॥
* * *
ব্রাহ্মণ পাইলে লাগ পরম কৌতুকে।
কার পৈতা ছিড়ি ফেলে থুতু দেয় মুখে।

রাখাল বালকেরা ঘট পাতিয়া মনসা পূজা করিতেছিল, তাহাদের প্রতি অকথ্য নিষ্ঠুর অত্যাচার হইল। ঘট ভাঙ্গিয়া ফেলিল, যে কুম্ভকার ঘট গড়াইয়াছিল, তাহাকেও গ্রেপ্তার করা হইল। এই প্রসঙ্গে কাজীর উক্তি প্রণিধানযোগ্য :

হারামজাত হিন্দুর এত বড় প্রাণ।
আমার গ্রামতে বেটা করে হিন্দুয়ান ॥
গোটে গোটো ধরিব গিয়া যতেক ছেমরা।
এড়া রুটি খাওয়াইয়া করিব জাতি মারা ॥

এইভাবে “জাতি মারা”ই বাংলায় মুসলমান বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।

ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে রচিত হয়। ইহার মুখবন্ধে আছে, ‘দুরাত্মা’ নবাব আলিবর্দী খান উড়িষ্যায় হিন্দুধর্ম্মের প্রতি ‘দৌরাত্ম্য’ করায় নন্দী ক্রুদ্ধ হইয়া :

মারিতে লইলা হাতে প্রলয়ে শূল।
করিব যবন সব সমূল নির্মূল।

তখন শিব তাহাকে নিষেধ করিয়া বলিলেন–যে সাতারায় বর্গীর (মহারাষ্ট্র) রাজাই নবাবকে দমন করিবেন। [প্রথম ভাগ-১৬ পৃষ্ঠা] অন্যত্র কবি দেবী অন্নদার মুখ দিয়া বলাইয়াছেন, মুসলমানেরা–

যতেক বেদের মত, সকলি করিল হত, নাহি মানে আগম পুরাণ।
মিছা মালা ছিলি মিলি, মিছা জপে ইলি মিলি, মিছা পড়ে কলমা কোরাণ ॥
যত দেবতার মঠ, ভাঙ্গি ফেলে করি হঠ, নানা মতে করে অনাচার।
বামণ পণ্ডিত পায় থুথু দেয় তার গায়, পৈতা ছেড়ে খোঁটা মোছে আর ॥ [দ্বিতীয় ভাগ-১৯৬ পৃষ্ঠা]

এই কাব্যের মধ্যেই আছে যে সেনাপতি মানসিংহ যখন প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন তখন ভবানন্দ মজুমদার রসদ দিয়া মোগল সৈন্যদের প্রাণ রক্ষা করিয়াছিলেন এবং ইহার পুরস্কারস্বরূপ তিনি প্রতাপাদিত্যের রাজ্য ভবানন্দকে দিবার জন্য সম্রাট জাহাঙ্গীরকে অনুরোধ করেন। ইহাতে কূপিত হইয়া জাহাঙ্গীর হিন্দুধর্ম্মের অশেষ নিন্দা করিলেন এবং বলিলেন :

দেহ জ্বলি যায় মোর বামন দেখিয়া।
বামনেরে রাজ্য দিতে বল কি বুঝিয়া ॥

মুসলমান ধর্ম্মের সহিত হিন্দুধর্ম্মের বিস্তৃত আলোচনা করিয়া তিনি সখেদে নিঃশ্বাস ছাড়িয়া বলিলেন :

হায় হায় আখেরে কি হইবে হিন্দুর

এবং মনের গুপ্ত বাসনা ব্যক্ত করিয়া বলিলেন :

আমার বাসনা হয় যত হিন্দু পাই।
সুন্নত দেওয়াই আর কলমা পড়াই ॥ [দ্বিতীয় ভাগ-১৮৮ পৃষ্ঠা]

এই কথোপকথন যে সম্পূর্ণ কাল্পনিক তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু মুসলমান রাজত্ব অবসানের পাঁচ বৎসর পূর্বেও হিন্দুর প্রতি মুসলমানের মনোভাব সম্বন্ধে বাঙালী হিন্দুর কি ধারণা ছিল ‘অন্নদামঙ্গলের উক্তি হইতে তাঁহার পরিচয় পাওয়া যায়। বখতিয়ার খিলজী হইতে আলিবর্দী খানের রাজত্ব পর্যন্ত যে হিন্দু মুসলমানের সম্বন্ধ মনোবৃত্তির মৌলিক বিশেষ কোন পরিবর্তন হয় নাই, ‘অন্নদামঙ্গল তাঁহার সাক্ষ্য দেয়।

ধর্ম্মের দিক দিয়া যেমন মন্দিরে দেবদেবীর মূর্ত্তিপূজা, সমাজের দিক দিয়া তেমনি স্ত্রীলোকের শুচিতা ও সতীত্ব রক্ষা হিন্দুরা জীবনযাত্রায় প্রধান স্থান দিত। এদিক দিয়াও মুসলমানেরা হিন্দুদের প্রাণে মর্মান্তিক আঘাত দিয়াছে। দীনেশচন্দ্র সেন হিন্দু-মুসলমানের প্রীতির সম্বন্ধ উচ্ছ্বসিত ভাষায় বর্ণনা করিয়াছেন। কিন্তু তিনিও লিখিয়াছেন, “মুসলমান রাজা এবং শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিগণ ‘সিন্ধুকী’ (গুপ্তচর) লাগাইয়া ক্রমাগত সুন্দরী হিন্দু ললনাগণকে অপহরণ করিয়াছেন। ষোড়শ শতাব্দীতে ময়মনসিংহের জঙ্গলবাড়ীর দেওয়ানগণ এবং শ্রীহট্টের বানিয়াচঙ্গের দেওয়ানেরা এইরূপ যে কত হিন্দু রমণীকে বলপূর্বক বিবাহ করিয়াছেন তাঁহার অবধি নাই। পল্লীগীতিকাগুলিতে সেই সকল করুণ কাহিনী বিবৃত আছে।” [ বৃহৎ বঙ্গ–৬৫৩ পৃষ্ঠা] পঞ্চদশ শতাব্দীর বাংলা কাব্যেও এই প্রকার বলপূর্বক হিন্দু নারীর সতীত্ব নাশের উল্লেখ আছে।

সেন মহাশয়ের মতে এই প্রকার অপহরণের ফলে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে রক্তের সম্বন্ধ হইয়া তাহাদের মধ্যে “যেরূপ মেশামেশি হইয়াছিল, বোধ হয় ভারতের আর কোনও দেশে তাদৃশ ঘনিষ্ঠতা হয় নাই।” বিংশ শতাব্দীতে ‘ সেন মহাশয় এই “মেশামেশি” যে চোখে দেখিয়াছেন মধ্যযুগের হিন্দুরা ঠিক সেভাবে দেখে নাই। ইহা তাহাদের মর্মান্তিক দুঃখের কারণ হইয়াছিল এবং সেন মহাশয় এই সমুদয় কাহিনীকে করুণ’ আখ্যা দিয়া তাহা প্রকারান্তরে স্বীকার করিয়াছেন।

মধ্যযুগে রাজনীতিক অধিকার, ধর্ম্মানুষ্ঠান ও সামাজিক পবিত্রতা রক্ষা বিষয়ে আঘাতের পর আঘাত পাইয়া হিন্দুর যে অবস্থা হওয়া স্বাভাবিক তাহা মুসলমানদের সহিত প্রীতির সম্বন্ধ স্থাপনের অনুকূল নহে। এ বিষয়ে হিন্দু সাহিত্য হইতে যে ইঙ্গিত পাওয়া যায় তাহাও এই অনুমানের পোষকতা করে। সুলতান হোসেন শাহ হিন্দুদিগের প্রতি উদারতার জন্য বর্তমান কালে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন। কিন্তু তাঁহার কালেই নবদ্বীপে উল্লিখিত কাজীর অত্যাচার ঘটিয়াছিল এবং বিজয় গুপ্তও তাঁহার সমসাময়িক। ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থ হইতে জানা যায় যে তাঁহার বাল্যকালের প্রভু এক ব্রাহ্মণ তাঁহাকে কার্যে অবহেলার জন্য বেত্রাঘাত করিয়াছিলেন এইজন্য সুলতান হইয়া তিনি মুসলমান-শৃষ্ট জল খাওয়াইয়া তাঁহার জাতি নষ্ট করিয়াছিলেন। তিনি চৈতন্যদেবের জনপ্রিয়তা দেখিয়া কর্মচারীদিগকে বলিয়াছিলেন যেন তাঁহার প্রতি কোন অত্যাচার না হয়। কিন্তু তাঁহার হিন্দু কর্মচারীরা তাঁহার হিন্দু-বিদ্বেষ সম্বন্ধে জানিতেন সুতরাং তাঁহার কথায় আশ্বাস না পাইয়া গোপনে চৈতন্যকে সংবাদ পাঠাইলেন যেন তিনি অবিলম্বে হোসেন শাহের রাজধানী হইতে দূরে প্রস্থান করেন। [চৈতন্যভাগবত, অন্ত্যখণ্ড, ৪র্থ অধ্যায়] হোসেন শাহের মন্ত্রী সনাতন উড়িষ্যার বিরুদ্ধে অভিযানের সময় প্রভুর আদেশ সত্ত্বেও তাঁহার সঙ্গে যান নাই, কারণ তিনি দেবমূর্ত্তি ধ্বংস করিবেন। এই অপরাধে হোসেন শাহ তাঁহাকে কারারুদ্ধ করিয়াছিলেন। এই মন্ত্রীই তাঁহার ভ্রাতা রূপকে সঙ্গে লইয়া গোপনে চৈতন্যের সঙ্গে দেখা করিয়া তাঁহাকে রাজধানীর নিকট হইতে দূরে যাইতে বলিয়াছিলেন। এই সাক্ষাতের সময় দুই ভ্রাতা দুঃখ করিয়া বলিয়াছিলেন যে ‘গো-ব্রাহ্মণদ্রোহী স্নেচ্ছের অধীনে কার্য করিয়া’ তাঁহারা নিজেদের ‘অধম পতিত পাপী’ বলিয়া মনে করেন। [‘চৈতন্যচরিতামৃত, মধ্যলীলা, ১ম পরিচ্ছেদ] ‘উদার-হৃদয়’ হোসেন শাহের প্রতি সমসাময়িক হিন্দুর মনোভাব যে বিংশ শতাব্দীর হিন্দুদের মনোভাবের সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। তবে এই সুলতানের বা তাঁহার অনুচরদের প্রসাদপুষ্ট কবিগণ তাঁহাকে যথেষ্ট প্রশংসা করিয়াছেন। যশোরাজ খান নামক কবি তাঁহাকে ‘জগত ভূষণ’ এবং কবীন্দ্র পরমেশ্বর তাঁহাকে কলিযুগের কৃষ্ণ বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। ইহা হোসেন শাহের স্বরূপ বর্ণনা মনে না করিয়া মধ্যযুগের বাঙালী কবির দীর্ঘ-দাসত্ব জনিত নৈতিক অধঃপতনের পরিচায়ক বলিয়া গ্রহণ করাই অধিকতর সঙ্গত। কারণ মধ্যযুগের শেষে যখন ইংরেজ গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেষ্টিংস বিলাতের পার্লামেন্টে ভারতবাসীর প্রতি অত্যাচারের জন্য অভিযুক্ত হইয়াছিলেন তখন কাশীবাসী বাঙালী পণ্ডিতেরা তাঁহাকে এক প্রশস্তিপত্র দিয়াছিলেন। তাহাতে লেখা ছিল যে অর্থের প্রতি হেষ্টিংসের কোন লোভ ছিল না এবং তিনি কখনও কাহারও কোন অনিষ্ট করেন নাই। অথচ এই হেষ্টিংসই উক্ত পণ্ডিতদের জীবদ্দশায় অর্থের লোভে কাশীর রাজা চৈৎসিংহের ও অযোধ্যার বেগমদের সর্বনাশ করিয়াছিলেন এবং অনেকের মতে মহারাজা নন্দকুমারের ফাঁসির জন্য প্রধানত তিনিই দায়ী। সুতরাং মধ্যযুগে কবির মুখে রাজার স্তুতির প্রকৃত মূল্য কতটুকু তাহা সহজেই অনুমেয়।

মুসলমানদের ধর্ম্মের গোঁড়ামি যেমন হিন্দুদিগকে তাহাদের প্রতি বিমুখ করিয়াছিল, হিন্দুদের সামাজিক গোঁড়ামিও মুসলমানগণকে তাহাদের প্রতি সেইরূপ বিমুখ করিয়াছিল। হিন্দুরা মুসলমানদিগকে অস্পৃশ্য ম্লেচ্ছ যবন বলিয়া ঘৃণা করিত, তাহাদের সহিত কোন প্রকার সামাজিক বন্ধন রাখিত না। গৃহের অভ্যন্তরে তাহাদের প্রবেশ করিতে দিত না, তাহাদের সৃষ্ট কোন জিনিষ ব্যবহার করিত না। তৃষ্ণার্ত মুসলমান পথিক জল চাহিলে বাসন অপবিত্র হইবে বলিয়া হিন্দু তাহা দেয় নাই, ইবন্ বতুতা এরূপ ঘটনার উল্লেখ করিয়াছেন। ইহার সপক্ষে শাস্ত্রের দোহাই দিয়া হিন্দুরা যেমন নিজেদের আচরণ সমর্থন করিত, মুসলমানরাও তেমনি শাস্ত্রের দোহাই দিয়া মন্দির ও দেবমূর্ত্তি ধ্বংসের সমর্থন করিত। বস্তুত উভয় পক্ষের আচরণের মূল কারণ একই যুক্তি ও বিচার নিরপেক্ষ ধর্ম্মান্ধতা। কিন্তু ন্যায্য হউক বা অন্যায্য হউক পরস্পরের প্রতি এরূপ আচরণ যে উভয়ের মধ্যে প্রীতির সম্বন্ধ স্থাপনের দুস্তর বাধা সৃষ্টি করিয়াছিল ইহা অস্বীকার করিবার উপায় নাই। অনেক দিন যাবৎ অভ্যস্ত হইলে অত্যাচারও গা-সহা হইয়া যায়, যেমন সতীদাহ বা অন্যান্য নিষ্ঠুর প্রথাও হিন্দুর মনে এক সময়ে কোন বিকার আনিতে পারিত না। হিন্দু-মুসলমানও তেমনি এই সব সত্ত্বেও পাশাপাশি বাস করিয়াছে কিন্তু দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃভাব তো দূরের কথা স্থায়ী প্রীতির বন্ধনও প্রকৃতরূপে স্থাপিত হয় নাই।

অনেকে ছোটখাট বিষয়ের উল্লেখ করিয়া এই সত্যকে অস্বীকার করেন। পূর্ব্বোল্লিখিত ‘কাজী দলন’ প্রসঙ্গে ‘চৈতন্যচরিতামৃতে [আদি লীলা, ১৭শ পরিচ্ছেদ] আছে যে যখন চৈতন্যের বহুসংখ্যক অনুচর তাঁহার পূহ ধ্বংস করিল তখন কাজী চৈতন্যের সঙ্গে আপোষ করিবার জন্য বলিলেন :

গ্রাম সম্বন্ধে চক্রবর্তী হয় মোর চাচা।
দেহ সম্বন্ধ হৈতে হয় গ্রাম সম্বন্ধ সাঁচা ॥
নীলাম্বর চক্রবর্তী হয় তোমার নানা।
সে সম্বন্ধে হও তুমি আমার ভাগিনা ॥

ইহার উপর নির্ভর করিয়া অনেকে মধ্যযুগে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে একটি অচ্ছেদ্য উদার সামাজিক প্রীতির সম্বন্ধ কল্পনা করিয়াছেন। কিন্তু এই কাজীই যখন শুনিলেন যে তাঁহার আজ্ঞা লঙ্ঘন করিয়া চৈতন্য কীর্তন করিতে বাহির হইয়াছিলেন তখন ‘ভাগিনেয়’ সম্বন্ধে বলিয়াছিলেন :

(নিমাই পণ্ডিত)
মোরে লজ্জি হিন্দুয়ানি করে।
তবে জাতি নিমু আজি সবার নগরে ॥ [চৈতন্যভাগবত, মধ্যখণ্ড, ২৩শ অধ্যায়]

ইহাও স্মরণ রাখা কর্তব্য যে এই ‘কাজী মামা’ চৈতন্যের বাড়িতে আসিলে যে আসনে বসিতেন তাহা গঙ্গাজল দিয়া ধুইয়া শোধন করিতে হইত, জল চাহিলে যে পাত্রে জল দেওয়া হইত তাহাও ভাঙ্গিয়া ফেলিতে অথবা শোধন করিতে হইত। খাদ্যের কোন প্রশ্নই উঠিত না। নিমাই পণ্ডিত কাজী মামার বাড়ি গিয়া কিছু পান বা আহার করিলে জাতিচ্যুত হইতেন। ইহাতে আর যাহাই হউক মামা-ভাগিনেয়ের মধুর প্রীতি-সম্বন্ধ স্থাপিত হয় না।

ক্রমে ক্রমে মুসলমান সমাজেও ইহার প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। মুসলমানেরা হিন্দুর ভাত খাইত না। কেহ হিন্দুর আচার অনুকরণ করিলে তাহাকে কঠোর শাস্তি পাইতে হইত। যবন হরিদাস বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করিলে ‘মুলুকের পতি’ তাহাকে বলিলেন :

কত ভাগ্যে দেখ তুমি হঞাছ যবন।
তবে কেন হিন্দুর আচারে দেহ মন ॥
আমরা হিন্দুরে দেখি নাহি খাই ভাত।
তাহা তুমি ছাড় হই মহাবংশ-জাত ॥ [চৈতন্যভাগবত, আদিখণ্ড, ১৪শ অধ্যায়]

হরিদাসের প্রতি অতি কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা হইল। হুকুম হইল বাইশ বাজারে নিয়া গিয়া কঠোর বেত্রাঘাতে হরিদাসকে হত্যা করিতে হইবে। চৈতন্যভাগবতের এই কাহিনী কিছু অতিরঞ্জিত হইলেও সে যুগে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে কাল্পনিক মধুর প্রীতি-সম্বন্ধের সমর্থন করে না।

এ সম্বন্ধে সমসাময়িক সাহিত্যে যে দুই একটি সাধারণ ভাবের উক্তি আছে তাহাও এই মতের সমর্থন করে না। বিখ্যাত মুসলমান কবি আলাওল বাংলায় কবিতা লিখিয়াছেন বলিয়া অনেকে তাঁহার কাব্যের মধ্যে হিন্দু-মুসলমানের মিলনের সূত্র খুঁজিয়া পাইয়াছেন। কিন্তু তিনি নিঃসঙ্কোচে ইহাই প্রতিপাদন করিতে চেষ্টা করিয়াছেন যে হিন্দুর দেবতা মূর্খের দেবতা এবং ইসলামই সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম এবং মোক্ষলাভের একমাত্র উপায়। [T.K. Ray Chaudhuri, Bengal under Akbar and Jahangir, pp. 142-3] অপরদিকে বৈষ্ণব গ্রন্থ প্রেমবিলাসে মুসলিম শাসনকে সকল দুঃখের হেতু বলিয়া বর্ণনা করা হইয়াছে। অদ্বৈতপ্রকাশে মুসলমানদের আচার-ব্যবহারের নিন্দা করা হইয়াছে। জয়ানন্দের মতে ব্রাহ্মণদের পক্ষে মুসলমানদের আদব-কায়দা গ্রহণ কলিযুগের কলুষতারই একটি নিদর্শন মাত্র, ইত্যাদি।

হিন্দুরা যাহাতে মুসলমান সমাজের দিকে বিন্দুমাত্রও সহানুভূতি দেখাইতে না পারে তাঁহার জন্য হিন্দু সমাজের নেতাগণ কঠোর হইতে কঠোরতর বিধানের ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। এ বিষয়ে অনিচ্ছাকৃত সামান্য অপরাধেও হিন্দুরা সমাজে পতিত হইত। ইহার ফলে যে হিন্দুর সংখ্যা কমিতেছে এবং মুসলমানের সংখ্যা বাড়িতেছে তাহা হিন্দু সমাজপতিরা যে বুঝিতেন না তাহা নহে, কিন্তু তাহারা হিন্দুত্ব রক্ষা করিবার জন্য হিন্দুকে বিসর্জন দিতে প্রস্তুত ছিলেন। ফলে বাংলা দেশে মুসলমানেরা হিন্দু অপেক্ষা সংখ্যায় বেশি হইয়াছে; কিন্তু হিন্দুর ধর্ম, সমাজ ও সংস্কৃতি অক্ষত ও অবিকৃত আকারে অব্যাহতভাবে মধ্যযুগের শেষ পর্যন্ত স্বীয় বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করিতে সমর্থ হইয়াছে। অনেকে ইহা স্বীকার করেন না, সুতরাং এ বিষয়ে একটু বিস্তৃত আলোচনার প্রয়োজন।

হিন্দু ও মুসলমান সংস্কৃতি

বর্তমান শতাব্দীর প্রথম হইতে আমাদের দেশে একটি মতবাদ প্রচলিত হইয়াছে যে মধ্যযুগে হিন্দু ও মুসলমান সংস্কৃতির মিশ্রণের ফলে উভয়েই স্বাতন্ত্র হারাইয়াছে। এবং এমন একটি নূতন সংস্কৃতি গঠিত হইয়াছে যাহা হিন্দু সংস্কৃতিও নহে, ইসলামীয় সংস্কৃতিও নহে– ভারতীয় সংস্কৃতি। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে রাজা রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রভৃতি এবং শেষভাগে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতি বাংলার তদানীন্তন শ্রেষ্ঠ নায়কগণ ইহার ঠিক বিপরীত মতই পোষণ করিতেন, এবং উনবিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্য এই বিপরীত মতেরই সমর্থন করে। হিন্দু রাজনীতিকেরাই এই নূতন মতের প্রবর্তক ও পৃষ্ঠপোষক। মুসলমান নায়কেরা ভারতে ইসলামীয় সংস্কৃতির পৃথক অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন এবং এই বিশ্বাসের ভিত্তির উপরই পাকিস্তান একটি ইসলামীয় রাজ্যরূপে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে।

মুসলমান বিজেতারা ভারতে আসিয়া যে নূতন সংস্কৃতির সহিত পরিচিত হন, নিজেদের স্বাতন্ত্র রক্ষার জন্য তাহাকে হিন্দু সংস্কৃতি বলেন। ইহার পূর্বে ভারতবাসী এবং ভারতে প্রচলিত ধর্ম, সমাজ ও সংস্কৃতি হিন্দু সংজ্ঞায় চিহ্নিত হয় নাই। সুতরাং আলোচ্য বিষয় এই যে ১২০০-১৩০০ খ্রীষ্টাব্দে বাংলা দেশে যে সংস্কৃতি ছিল ১৮০০ সালে মুসলমানের সহিত মিশ্রণের ফলে তাঁহার এমন কোন পরিবর্তন হইয়াছে কিনা যাহা ইহাকে একটি ভিন্ন রূপ ও বৈশিষ্ট্য দিয়াছে। এই আলোচনার পূর্বে দুইটি বিষয় মনে রাখিতে হইবে। প্রথমতঃ, সকল প্রাণবন্ত সমাজেই স্বাভাবিক বিবর্তনের ফলে পরিবর্তন ঘটে। বাংলা দেশের মধ্যযুগের হিন্দুসমাজেও ঘটিয়াছে। কিন্তু এই পরিবর্তন কতটুকু ইসলামীয় সংস্কৃতির সংস্পর্শে ঘটিয়াছে বর্তমান ক্ষেত্রে কেবল তাহাই আমাদের বিবেচ্য।

দ্বিতীয়তঃ, দুই সম্প্রদায় একসঙ্গে বসবাস করিলে ছোটখাট বিষয়ে একে অন্যের উপর প্রভাব বিস্তার করে। কিন্তু সংস্কৃতি অন্তরের জিনিস-ইহার পরিচয় প্রধানতঃ ধর্মবিশ্বাস, সামাজিক নীতি, আইনকানুন, সাহিত্য, দর্শন, শিল্প ইত্যাদির মধ্য দিয়াই আত্মপ্রকাশ করে। সুতরাং সংস্কৃতির পরিবর্তন বুঝিতে হইলে এই সমুদয় বিষয়ে কি পরিবর্তন স্মৃটিয়াছিল তাহাই বুঝিতে হইবে।

হিন্দুর ধর্মবিশ্বাস ও সামাজিক নীতিতে ইসলামীয় ধর্ম্মের ও মুসলমান সমাজের প্রভাবে বিশেষ কোনই পরিবর্তন হয় নাই। জাতিভেদে জর্জরিত হিন্দু সমাজ মুসলমান সমাজের সাম্য ও মৈত্রীর আদর্শ হইতে অনেক শিক্ষা লাভ করিতে পারি, কিন্তু তাহা করে নাই। বহু কষ্ট ও লাঞ্ছনা সহ্য করিয়াও হিন্দু মূর্ত্তিপূজা ও বহু দেবদেবীর অস্তিত্বে বিশ্বাস অটুট রাখিয়াছে। হিন্দু আইনকানুনকে নূতন স্মৃতিকারেরা কিছু কিছু পরিবর্তন করিয়াছেন; কিন্তু তাহা সামাজিক প্রয়োজনে, ইসলামীয় আইনের কোন প্রভাব তাহাতে নাই।

বাংলা সাহিত্যে কতকগুলি আরবী ও ফার্সী শব্দের ব্যবহার ছাড়া আর কোন দিক দিয়া ইসলামীয় প্রভাবের পরিচয় পাওয়া যায় না। একদল মুসলমান লেখক ফার্সী সাহিত্যের আদর্শে অনুপ্রাণিত হইয়া বাংলায় রোমান্টিক সাহিত্যের আমদানি করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। হিন্দু সাহিত্যিকেরা তাহা সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করিয়া সাহিত্যকে ধর্ম্মের বাহনরূপেই ব্যবহার করিয়াছেন। [এনামুল হক ও আবদুল করিম, আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্য, ৬৯ পৃষ্ঠা] বাংলা দেশে নব্য-ন্যায় ও দর্শনের অন্য কোন শাখার যে সমুদয় আলোচনা হইয়াছে, তাহাতে এবং আয়ুর্বেদ ও অন্যান্য শাস্ত্রে ইসলামের কোন প্রভাব পরিলক্ষিত হয় না।

মধ্যযুগে হিন্দু শিল্পের উপর মুসলমানের প্রভাব বিশেষ কিছুই নাই। যে সকল দোচালা বা চৌচালা মন্দিরের বিষয় ১৫শ পরিচ্ছেদে উল্লিখিত হইয়াছে তাঁহার গঠনপ্রণালী হিন্দুর নিজস্ব নয়, মুসলমানের নিকট হইতে প্রাপ্ত, এ বিশ্বাসের যে কোন যুক্তিসংগত কারণ নাই তাহা সেখানে দেখান হইয়াছে। মন্দিরের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কোন অঙ্গে, যেমন ঢেউ-খেলান খিলানে সম্ভবত মুসলমানের প্রভাব আছে। কিন্তু ইহা সংস্কৃতির পরিবর্তন সূচনা করে না।

কেহ কেহ মনে করেন যে, সুফী দরবেশরা যে উদার ধর্মমত প্রচার করেন, তাহাতে হিন্দু ধর্মমতের পরিবর্তন ঘটিয়াছে। হিন্দুদের সম্বন্ধে সুফী দরবেশদের যে বিদ্বেষের ভাব ছিল তাহা পূর্বেই উল্লিখিত হইয়াছে। তাহারা যে ধর্মমত প্রচার করিত তাঁহার মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে হিন্দুধর্ম্মের প্রভাব ছিল। সর্বশেষে বক্তব্য এই যে, সুফীদের প্রভাব যদি কিছু থাকে তাহা হইলে আউল বাউল প্রভৃতি কয়েকটি অতি ক্ষুদ্র সম্প্রদায়ের মধ্যে আবদ্ধ ছিল। [এই পরিচ্ছেদের ‘বাস্তব জীবনে ধর্ম ও নীতি’ অংশে আলোচিত দ্রষ্টব্য] স্বয়ং চৈতন্যদেব, নানক, কবীরের ন্যায় যে উদার ভক্তিবাদ ও সামাজিক সাম্যবাদের প্রচার করিয়াছিলেন তাহাও শতবর্ষের মধ্যেই নিষ্ফল হইয়াছিল। বিরাট হিন্দুসমাজ পুরাণ ও স্মৃতিশাস্ত্ররূপ বৃহৎ বনস্পতির আশ্রয়ে গড়িয়া উঠিয়াছে। ক্ষুদ্র লতাপাতা চারিদিকে গজাইলেও বেশিদিন বাঁচে নাই এবং বিরাট হিন্দু সমাজের গায়েও কোন দাগই রাখিয়া যাইতে পারে নাই। ১২০০ খ্রীষ্টাব্দে হিন্দু ধর্ম ও সমাজ যাহা ছিল আর ১৮০০ খ্রীষ্টাব্দে হিন্দু ধর্ম ও সমাজ যাহা হইয়াছিল এ দুইয়ের তুলনা করিলেই এই উক্তির সত্যতা প্রমাণিত হইবে। হিন্দু সাধুসন্ত ও সুফী দরবেশ, ফকির প্রভৃতির মধ্যে ধর্মমতের উদারতা ও অপর ধর্ম্মের প্রতি যে শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি ছিল তাঁহার ফল স্থায়ী বা ব্যাপক হয় নাই।

আরও যে কয়েকটি যুক্তির অবতারণা করা হয় তাহা অকিঞ্চিৎকর। হিন্দু ও মুসলমান উভয়েই উভয় সম্প্রদায়ের সাধুসন্ত পীর ফকিরকে শ্রদ্ধা করিত। ইহা হইতে অনেকে হিন্দু-মুসলমানের ধর্ম্মের সমন্বয়ের কল্পনা করিয়াছেন। বাস্ত বিকপক্ষে এইরূপ শ্ৰদ্ধার কারণ ইহাদের অলৌকিক ক্ষমতায় বিশ্বাস। বিপদে পড়িলে লোকে নানা কাজ করে, সুতরাং আধিব্যাধি ও সমূহ বিপদ হইতে ত্রাণ বা ভবিষ্যৎ মঙ্গলের আশায় সাধারণ লোক অর্থাৎ হিন্দু-মুসলমান উভয়েই সাধু ও পীরদের সাহায্য প্রার্থনা করিত এবং তাহাদের দরগায় শিরনি মানিত। ইহা মানুষের একটি স্বাভাবিক প্রভৃত্তি। ইহাতে ধর্মসমন্বয়ের কোন প্রশ্নই উঠে না। হিন্দুরা মুসলমান পীরকে ভক্তি করিত, কিন্তু গৃহের মধ্যে ঢুকিতে দিত না এবং তাহাদের সৃষ্ট পানীয় বা খাদ্য গ্রহণ করিত না। নবাব মীরজাফরের মৃত্যুশয্যায় নাকি তাঁহাকে কিরীটেশ্বরী দেবীর চরণামৃত পান করান হইয়াছিল। এই ঘটনাটিও হিন্দু মুসলমানের মিলনচিহ্নস্বরূপ ব্যাখ্যাত হইয়াছে। বাঁচিয়া উঠিলে হয়ত তিনি ঐ দেবীর মন্দিরটিই ধ্বংস করিতেন। তাঁহার অনতিকাল পূর্বে নবাব মুর্শিদকুলী খান উহার নিকটবর্তী অনেক মন্দির ভাঙ্গিয়া মসজিদ নির্মাণ করিয়াছিলেন এবং ইহা মীরজাফরের জীবিতকালেই স্মৃটিয়াছিল। মুসলমানেরা হোলি খেলিত এবং হিন্দুরা মহরমের শোভাযাত্রায় যোগ দিত, ইহা স্বাভাবিক কৌতূহলের ও আমোদ-উৎসবের প্রবৃত্তির পরিচয় দেয়। ইহাতে ধর্মমত পরিবর্তনের কোন চিহ্ন খুঁজিতে যাওয়া বিড়ম্বনা মাত্র। আর কোটি কোটি মুসলমানদের মধ্যে একজন কি দুইজন হিন্দু দেবদেবীর পূজা করিলে তাহা ব্যক্তিগত উদারতার পরিচয় হইতে পারে, কিন্তু হিন্দু-মুসলমান ধর্ম্মের সমন্বয় সূচিত করে না। পূর্বে উল্লিখিত মুসলমান কর্ত্তৃক হিন্দুর মন্দির ধ্বংস ও ধর্ম্মানুষ্ঠানে বাধা দেওয়ার অসংখ্য কাহিনী ও সমসাময়িক বর্ণনা সত্ত্বেও যাঁহারা ধর্ম্মের ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সমন্বয়ের বা সম্প্রীতির প্রমাণ খুঁজিয়া বেড়ান, এই শ্রেণীর কতকগুলি দৃষ্টান্ত ছাড়া স্মরণ রাখিতে হইবে যে সত্যনারায়ণ ও সত্যপীরের কাহিনী অনেকটা এক হইলেও এখন পর্যন্তও হিন্দুরা তাহাদের অন্যান্য ধর্ম্মানুষ্ঠানের ন্যায় সত্যনারায়ণকে পূজা করে আর মুসলমানেরা অন্যান্য পীরের ন্যায় সত্যপীরকে শিরনি দেয়। সত্যপীরের পূজা তাঁহারা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ বলিয়া মনে করেন। সুতরাং এ বিষয়ে একটু বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন।

মধ্যযুগে হিন্দুরা যেমন সাধুসন্তদের ভক্তি করিতেন এবং কখনও কখনও তাঁহাদের পূজা করিতেন, মুসলমানেরাও সেইরূপ সুফীদরবেশদিগকে ভক্তি করিতেন এবং কোন কোন স্থলে তাহাদিগকে অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন মনে করিয়া ‘পীর’ আখ্যা দিয়া পূজা করিতেন। স্কন্দ পুরাণে সত্যনারায়ণের পূজার বিধান আছে–এবং এই পূজা হিন্দুদের মধ্যে এখন পর্যন্ত প্রচলিত। মধ্যযুগে সত্যপীরের পূজা হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই প্রচলিত ছিল। কিন্তু ষোড়শ শতাব্দীর পূর্বে ইহার প্রচলনের কোন প্রমাণ নাই। সত্যনারায়ণ ও সত্যপীরের পূজার ব্যবস্থা প্রায় অভিন্ন বলিলেও চলে, এবং এই দুয়ের কাহিনী অবলম্বনে অনেক পুঁথি ও পাঁচালী রচিত হয়। ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’য় কঙ্কনামক ব্রাহ্মণ রচিত ‘সত্যপীরের পাঁচালী’র উল্লেখ আছে–সনাতনপন্থী হিন্দুরা নাকি এই পাঁচালী নষ্ট করে এবং কঙ্ককে বধ করিবার জন্য ষড়যন্ত্র করে। এই কাহিনীর সত্যতা এবং ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’ কোন্ সময়ে রচিত এ সম্বন্ধে নিশ্চিত কিছু বলা যায় না। কেহ কেহ মনে করেন যে ষোড়শ শতাব্দীর শেষ পাদে শেখ ফয়জুল্লা রচিত ‘সত্যপীরের কাব্যই এই শ্রেণীর সর্বপ্রথম গ্রন্থ। অষ্টাদশ শতাব্দীতে হিন্দু ও মুসলমান রচিত বহু সংখ্যক সত্যপীরের পাঁচালী পাওয়া গিয়াছে–এ সম্বন্ধে সাহিত্য প্রসঙ্গে বিস্তৃত বিবরণ দেওয়া হইয়াছে। সত্যনারায়ণের পাঁচালীগুলিও প্রায় ঐ সময়ে লিখিত হয় এবং হিন্দু গ্রন্থকার রামেশ্বর ভট্টাচার্য, ভারতচন্দ্র প্রভৃতি সত্যপীর ও নারায়ণ যে অভিন্ন ইহা ঘোষণা করেন। রামেশ্বরের সত্যপীর ভক্তকে বলেন ‘রাম রহিম অভেদ’ আবার নারায়ণের রূপ ধারণ করিয়া ভক্তকে উপদেশ দেন।

নামভেদ তাহাতে নৈবেদ্য মাত্র ভেদ।
পীর বলি না জানিবে না ছাড়িবে বেদ ॥

সত্যপীর-সত্যনারায়ণের পূজার উৎপত্তি সম্বন্ধে দুইটি প্রচলিত মত যুক্তিযুক্ত বলিয়া মনে করা যাইতে পারে। যে সব হিন্দু ইসলাম ধর্ম্মে দীক্ষিত হইয়াছিলেন তাঁহারা দেবদেবী পূজার সংস্কারে এত আরক্ত ছিলেন যে তাঁহার পরিবর্তে পীরদের পূজায় আকৃষ্ট হন-এবং ইহার ফলেই সত্যনারায়ণের স্থলে সত্যপীরের পূজা প্রতিষ্ঠিত হয়। অপর মত এই যে সত্যপীরের পূজা প্রসিদ্ধি লাভ করার ফলে হিন্দু সমাজে ইহার পরিবর্তে সত্যনারায়ণের পূজা প্রচলিত হয়। প্রথম মতের সপক্ষে বলা যাইতে পারে যে স্কন্দ পুরাণে বর্ণিত সত্যনারায়ণ পূজার বিধি যদি মধ্যযুগে প্রক্ষিপ্ত বলিয়া অগ্রাহ্য না হয় তবে সত্যনারায়ণই যে সত্যপীরে পরিণত হইয়াছেন ইহা স্বীকার করিতেই হইবে। অপর দিকে সত্যপীরের পূজায় কোন দেবমূর্ত্তি বা শালগ্রাম থাকে না এবং পূজার শেষে দুধ, আটা, গুড়, কলার মিশ্রণে প্রস্তুত যে সিনি প্রসাদ রূপে বিতরিত হয় হিন্দুর অন্য কোন দেবদেবীর পূজায় তাঁহার প্রচলন ছিল এরূপ কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। কিন্তু উৎপত্তি যাহাই হউক “মধ্যযুগের শেষে বাংলায় সত্যপীরের পূজা হিন্দু-মুসলিম ধর্ম সমন্বয়ের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত” [শ্ৰীঅমিতাভ মুখোপাধ্যায় সতী পীরের সম্বন্ধে বিস্তৃত ও পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনার উপসংহারে এই মন্তব্য করিয়াছেন। (শতরূপা, বৈশাখ-আষাঢ়, ১৩৭৯, ৫৬-৬৪ পৃষ্ঠা)] বলিয়া যে গ্রহণ করা যায় না তাহা পূর্বেই বলা হইয়াছে।

এই সম্বন্ধে যে লৌকিক কাহিনী প্রচলিত আছে তাহাতে বিশ্বাস করিয়া হিন্দু ও মুসলমান উভয়েই বিপদ হইতে মুক্তি ও ভবিষ্যৎ মঙ্গল কামনায় সত্যনারায়ণ ও সত্যপীরের পূজা দিবে ইহা অস্বাভাবিক নহে। ধর্মসমন্বয় অর্থাৎ দু ধর্ম্মের মিশ্রণের ফলে নূতন ধর্মমতের প্রবর্তনের সঙ্গে ইহার কোন সম্বন্ধ নাই। আজিকার দিনেও এমন বহু গোঁড়া হিন্দু পুরোহিত ডাকিয়া নিয়মিত সত্যনারায়ণের পূজা করেন, যাঁহারা মুসলমানের সঙ্গে কোন ধর্ম বা সামাজিক সম্বন্ধের কথা শুনিলে শিহরিয়া উঠিবেন।

প্রাচীনকালে অর্থাৎ ১২০০ খ্রীষ্টাব্দের পূর্বে হিন্দুধর্ম্মের যাহা মূল নীতি ছিল, অর্থাৎ দেবদেবীর মূর্ত্তি পূজা ও তদানুষঙ্গিক অনুষ্ঠান, বেদ, পুরাণ প্রভৃতি ধর্মশাস্ত্রে অচল বিশ্বাস, ব্রাহ্মণ পুরোহিতের সাহায্যে শাস্ত্রের বিধান মত পূজাপার্ব্বণ, অন্তে বৃষ্টিক্রিয়া ও শ্রাদ্ধ, এবং ভগবান, পরলোক, জন্মান্তর, কর্মফল, অদৃষ্ট, স্বর্গ, নরক ইত্যাদিতে বিশ্বাস, দেবদ্বিজে ভক্তি ইত্যাদি, ১৮০০ খ্রীষ্টাব্দে ঠিক তাহাই ছিল। যদি কিছু যোগ বা পরিবর্তন হইয়া থাকে যেমন নূতন বৈষ্ণব মত, সহজিয়া মত ও নূতন লৌকিক দেবতার পূজা, ব্ৰতানুষ্ঠান প্রভৃতি–তাহাও কালের পরিবর্তনেই হইয়াছে, ইসলামের প্রভাবে নহে। হিন্দু সমাজ সম্বন্ধেও এই কথা খাটে। হিন্দু সমাজের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য–কঠোর জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতা, স্ত্রীলোকের বাল্যবিবাহ, বিধবা-বিবাহ নিষেধ, বাল্য-বিধবার দুর্দশা ও কঠোর জীবনযাত্রা, কৌলীন্যপ্রথা, সতীদাহ, স্বামীর সম্পত্তিতে অনধিকার-সকলই পূর্ববৎ ছিল। এই সকল দোষত্রুটি মুসলমান সমাজে ছিল না এবং প্রতিবেশী মুসলমানদের দৃষ্টান্তে এইগুলির অনৌচিত্য ও অপকারিতা হিন্দুর মনে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করিবে, ইহাই স্বাভাবিকভাবে প্রত্যাশা করা যায়। কিন্তু কার্যতঃ তাহা হয় নাই। অপরদিকে সর্ব ধর্মই যে সত্য এবং মুক্তির সোপান, হিন্দুর এই উদার ধর্মমত মুসলমান গ্রহণ করে নাই।

ভক্ষ্য, পানীয়, ভোজনপ্রণালী, বিবাহাদি লৌকিক সংস্কার ও অনুষ্ঠান বিষয়ে হিন্দুর উপর মুসলমানের বিশেষ কিছু প্রভাব লক্ষ্য করা যায় না। যাহারা দরবারে যাইতেন তাঁহাদের পোশাক-পরিচ্ছদ কতকটা মুসলমানী ধরনের ছিল, কিন্তু বাংলা দেশের বিরাট হিন্দু সমাজে ইহার প্রভাব স্থান ও সংখ্যায় খুবই সীমাবদ্ধ ছিল। প্রকৃত সংস্কৃতির সহিত ইহার সম্বন্ধ এতই ক্ষীণ যে ইংরেজেরা এদেশে আসিবার পর মুসলমানী পোশাকের বদলে বিলাতী পোশাকেরই চল হইল। আজ বাঙালী হিন্দুদের পোশাকের মধ্যে মুসলমানী প্রভাব বিশেষ কিছুই লক্ষ্য করা যায় না। হিন্দুর উপর মুসলমানের অনেক ছোটখাট প্রভাব হিন্দুরা এই পোশাকের ন্যায়ই ত্যাগ করিয়াছে। আজ আর তাঁহার চিহ্ন নাই। কারণ সেগুলি সংস্কৃতি নহে, তাঁহার বহিরাবরণ মাত্র। কিন্তু যদিও হিন্দুরা মুসলমানদের প্রভাব হইতে আত্মরক্ষা করিয়াছে, মুসলমানেরা যে হিন্দুর প্রভাব এড়াইতে পারে নাই তাহা পূর্বেই বলা হইয়াছে। ইহার প্রধান কারণ বাঙালী মুসলমানদের অনেকেই ধর্ম্মান্তরিত হিন্দু বা তাহাদের বংশধর। সুতরাং হিন্দুর ধর্ম ও সামাজিক সংস্কার তাহারা একেবারে ত্যাগ করিতে পারে নাই এবং তাহাদের সঙ্গে ইহার কতকগুলি মুসলমান-সমাজেও গৃহীত হইয়াছে। কিন্তু এই হিন্দু প্রভাবের ফলে যে ইসলাম-সংস্কৃতির মৌলিক কোন পরিবর্তন ঘটিয়াছে, এরূপ মনে করিবার কোন কারণ নাই।

এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা আবশ্যক যে অনেকে মনে করেন মুসলমান সুলতান ও ওমরাহের উৎসাহেই বাংলা সাহিত্য প্রতিষ্ঠা লাভ করিতে সমর্থ হইয়াছে। দুইটি বাস্তব ঘটনার উল্লেখ করিলেই এই ধারণার অসারতা প্রতিপন্ন হইবে।

প্রথমতঃ, বাংলা দেশে প্রায় ছয় শত বৎসর ব্যাপী মুসলমান রাজত্বে মুসলমান সুলতান ও তাঁহাদের অনুচরের মধ্যে বাংলা সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক যাহাদের নাম জানা গিয়াছে, তাহাদের সংখ্যা ছয় জনের বেশি নহে।

দ্বিতীয়তঃ, মধ্যযুগে কেবল বাংলায় নহে ভারতের সকল প্রদেশেই–এমন কি যেখানে মুসলমানদের আধিপত্য ছিল না এবং মুসলমান সুলতানের পৃষ্ঠপোষকতার কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না, সেইসব প্রদেশেও স্থানীয় কথ্যভাষা সাহিত্যের ভাষায় উন্নীত হইয়াছিল।

সুতরাং বাংলার মুসলমান সুলতানদের অনুগ্রহ না হইলে যে বাংলা সাহিত্যের প্রতিষ্ঠা হইত না এরূপ মনে করিবার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নাই। আর দেশের রাজা দেশের সাহিত্যিককে উৎসাহ দিবেন ইহাই স্বাভাবিক। ইহা না করিলে প্রত্যবায়, করিলে অত্যধিক প্রশংসার কোন কারণ নাই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে প্রকাশিত ইংরেজীতে লিখিত বাংলার ইতিহাস দ্বিতীয় ভাগে (History of Bengal, Vol. II.) সুলতান হোসেন শাহের বংশ সম্বন্ধে অধ্যাপক হাবীবুল্লাহ্ যে উক্তি করিয়াছেন, তাঁহার প্রথম অংশের সারমর্ম এই যে-উক্ত বংশের উদার শাসননীতির আশ্রয়েই বাঙালীর যে সাহিত্যিক প্রতিভা এতদিন রুদ্ধগতি হইয়াছিল তাহা অবরোধমুক্ত হইয়া বেগবতী নদীর মত প্রবাহিত হইয়াছিল এবং চরম উন্নতি লাভ করিয়াছিল। [Thus was a new dynasty established under whose enlightened rule the creative genius of the Bengali people reached its zenith. It was a period in which the vernacular found its due recognition as the literary medium through which the repressed intellect of Bengal v’as to find its release.
* * *
With this renaissance, the rulers of the house of Husain Shah are inseparably connected. It is almost impossible to conceive of the rise and progress of Vaishnavism or the development of Bengali literature at this period without recalling to mind the tolerant and enlightened rule of the Muslim Lord of gaur (The History of Bengal, published by the University of Dacca, Vol. II. pp. 143-44)]

হোসেন শাহের রাজত্বকাল ১৪৩৯ হইতে ১৫১৯ খ্রীষ্টাব্দ। ইহার পূর্বেই চণ্ডীদাসের পদাবলী, কৃত্তিবাসের বাংলা রামায়ণ, বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গল এবং মালাধর বসুর ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয় বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করিয়াছে। বিপ্রদাস পিপিলাই হোসেন শাহের রাজত্ব লাভের দুই বৎসরের মধ্যে তাঁহার মনসামঙ্গল রচনা করেন। সুতরাং মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের যে তিনটি প্রধান বিভাগ-অনুবাদ সাহিত্য, মঙ্গলকাব্য ও বৈষ্ণব পদাবলী–তাঁহার প্রতি বিভাগেই উৎকৃষ্ট কাব্য হোসেন শাহী আমলের পূর্বেই রচিত হইয়াছে। সুতরাং বাঙালী কবির সৃজনীশক্তি যে হোসেন শাহের পূর্বেই রুদ্ধ হইয়াছিল, এরূপ মনে করিবার কোন কারণ নাই। পদাবলী-সাহিত্য ও অনুবাদ-সাহিত্য যে চণ্ডীদাস ও কৃত্তিবাসের হাতে চরম উন্নতি লাভ করিয়াছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই। মঙ্গলকাব্যের মধ্যে যে দুইখানি বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গল অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বলিয়া গ্রহণ করা যাইতে পারে তাঁহার মধ্যে একখানি-মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল কাব্য-হোসেন শাহী বংশের অবসানের ৬০/৭০ বৎসর পর, এবং আর একখানি-ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল–তাঁহারও দেড়শত বৎসর পরে রচিত হইয়াছিল। সুতরাং হোসেন শাহী শাসনের আশ্রয়েই যে বাংলা সাহিত্যের চরম উন্নতি হইয়াছিল এই উক্তির সপক্ষে কোন যুক্তিই নাই।

এই উক্তির পর চৈতন্য এবং বৈষ্ণব ধর্ম ও পদাবলীর উল্লেখ করিয়া অধ্যাপক হবীবুল্লাহ্ আরও বলিয়াছেন যে হোসেন শাহের রাজত্বের মত উদার ও পরধর্ম সহিষ্ণু শাসন না থাকিলে বৈষ্ণব ধর্ম্মের অভ্যুদয় ও প্রসার এবং এই যুগে বাংলার সাংস্কৃতিক নব-জাগরণ (Renaissance) সম্ভবপর হইত না। হোসেন শাহের রাজত্বে নবদ্বীপের কাজী বৈষ্ণব ভক্তগণের প্রতি কিরূপ অত্যাচার করিয়াছিলেন। এবং চৈতন্যদেব যে কাজীর বিরুদ্ধে লড়াই করিয়াই বৈষ্ণবধর্ম্মের একটি প্রধান অঙ্গ হরিনাম সংকীর্তন প্রচলিত করিতে পারিয়াছিলেন, তাহা পূর্বেই বলা হইয়াছে। [এই অধ্যায়ের ‘বাস্তব জীবনে ধর্ম ও নীতি’ অংশে আলোচিত] হোসেন শাহের মন্ত্রী ও পারিষদেরা যে তাঁহার ভয়ে চৈতন্যদেবকে রাজধানী গৌড়ের সান্নিধ্য ত্যাগ করিয়া যাইতে বাধ্য করিয়াছিলেন, তাঁহারও উল্লেখ করা হইয়াছে। [এই অধ্যায়ের ‘বাস্তব জীবনে ধর্ম ও নীতি’ অংশে আলোচিত] আর ইহাও বিশেষভাবে স্মরণ রাখিতে হইবে যে শ্রীচৈতন্যদেব দীক্ষার পরে চব্বিশ বৎসর (১৫১০-৩৩ খ্রী) জীবিত ছিলেন–ইহার মধ্যে সর্বসাকুল্যে পুরা একটি বছরও তিনি হোসেন শাহী রাজ্যে অর্থাৎ বাংলা দেশে কাটান নাই। তাঁহার পরম ভক্ত ও হোসেন শাহের পরম শত্রু উড়িষ্যার পরাক্রান্ত স্বাধীন রাজা প্রতাপরুদ্রের আশ্রয়েই তিনি অবশিষ্ট জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটাইয়াছেন।

এই সমুদয় মনে রাখিলে সহজেই বুঝিতে পারা যাইবে যে অধ্যাপক হবীবুল্লাহর উক্তি এত অসার ও সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন যে তাহা আলোচনার যোগ্য নহে। তথাপি একটি বিশ্ববিদ্যালয় হইতে প্রকাশিত এবং আচার্য যদুনাথ সরকার কর্ত্তৃক সম্পাদিত বাংলার ইতিহাসের কোন উক্তিই অগ্রাহ্য করা যায় না। কারণ সাধারণ লোকে যে বিনা বিচারে তাহা সত্য বলিয়া মানিয়া লইবে ইহা অস্বাভাবিক বা আশ্চর্যের বিষয় নহে। এই জন্যই নিতান্ত অসার হইলেও অধ্যাপক হবীবুল্লাহর উক্তির বিস্তৃত সমালোচনা করিতে বাধ্য হইয়াছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *