১০. নবাবী আমল

দশম পরিচ্ছেদ – নবাবী আমল

মুর্শিদকুলী খান

১৭১৭ খ্রীষ্টাব্দে মুর্শিদকুলী খান বাংলার সুবাদার বা নবাব নিযুক্ত হইলেন। এই সময়ে দিল্লির অকর্মণ্য সম্রাটগণের দুর্বলতায় ও আত্মকলহে মুঘল সাম্রাজ্য চরম দুর্দশায় পৌঁছিয়াছিল। সুতরাং এখন হইতে বাংলার সুবাদারেরা প্রায় স্বাধীন ভাবেই কার্য করিতে লাগিলেন এবং বংশানুক্রমে সুবাদার বা নবাবের পদ অধিকার করিতে লাগিলেন। ইহার ফলে বাংলায় নবাবী আমল আরম্ভ হইল। কিন্তু বাংলা হইতে দিল্লি দরবারে রাজস্ব পাঠান হইত এবং বাদশাহী সনদের বলেই সুবাদারী পদে নূতন নিয়োগ হইত।

মুর্শিদকুলী খান ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু বাল্যকালে একজন মুসলমান তাঁহাকে ক্রয় করিয়া পুত্রবৎ পালন করে এবং পারস্য দেশে লইয়া যান। সেখান হইতে ফিরিয়া আসিয়া মুর্শিদকুলী খান বহু উচ্চ পদ অধিকার করেন এবং অবশেষে বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হন। মুর্শিদকুলী বহুকাল সুযোগ্যতার সহিত দিওয়ানী কার্য করিয়াছিলেন, সুতরাং সুবাদার হইয়াও রাজস্ব-বিভাগের দিকে তিনি খুব বেশি ঝোঁক দিতেন। পরে এ সম্বন্ধে বিশদভাবে আলোচনা করা হইবে। তাঁহার সময়ে দেশে শান্তি বিরাজ করিত এবং ছোটখাট বিদ্রোহ সহজেই দমিত হইত। এইরূপ ঘটনার মধ্যে সীতারাম রায়ের সহিত যুদ্ধই প্রধান। ইহাও পরে আলোচিত হইবে। মুর্শিদকুলী খানের শাসনকালে আর কোনও উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ঘটনা ঘটে নাই।

শুজাউদ্দীন মুহম্মদ খান

মুর্শিদকুলী খানের কোন পুত্র-সন্তান ছিল না। তাঁহার মৃত্যুর পর তাঁহার জামাতা শুজাউদ্দীন মুহম্মদ খান মুর্শিদকুলীর দৌহিত্র ও মনোনীত উত্তরাধিকারী সরফরাজ খানকে না মানিয়া নিজেই বাংলা ও উড়িষ্যার সুবাদারের পদে অধিষ্ঠিত হইলেন (জুন, ১৭২৭ খ্রীষ্টাব্দ)। হাজী আহমদ এবং আলীবর্দী নামক দুই ভ্রাতা, রাজস্ব বিভাগের বিচক্ষণ কর্মচারী আলমচাঁদ এবং বিখ্যাত ধনী জগৎশেঠ ফতোদ তাঁহার সভায় খুব প্রতিপত্তি লাভ করিলেন।

শুজাউদ্দীনের অনেক গুণ ছিল, কিন্তু তিনি বিলাসী ও ইন্দ্রিয়পরায়ণ হওয়ায় ক্রমে রাজকার্য বিশেষ কিছু দেখিতেন না এবং উপরোক্ত চারিজনের উপরই নির্ভর করিতেন। দিল্লির বাদশাহও প্রাদেশিক ব্যাপারে কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করিতেন না। সুতরাং নবাবের অনুগ্রহভাজন বিশ্বস্ত কর্মচারীরা নিজেদের স্বার্থ সাধন করার প্রচুর সুযোগ পাইলেন এবং ইহার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করিলেন। নিজেদের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখিবার জন্য ইহারা নবাবের সহিত তাঁহার পুত্রদ্বয়ের কলহ ঘটাইতেন।

১৭৩৩ খ্রীস্টাব্দে বিহার প্রদেশ বাংলা সুবার সহিত যুক্ত হইল। তখন শুজাউদ্দীন বাংলাকে দুই ভাগ করিয়া পশ্চিম, মধ্য ও উত্তর বাংলার কতক অংশের শাসনভার নিজের হাতে রাখিলেন; পূর্ব, দক্ষিণ ও উত্তর বাংলায় অবশিষ্ট অংশের জন্য ঢাকায় একজন এবং বিহার ও উড়িষ্যা শাসনের জন্য আরও দুইজন নায়েব নাজিম নিযুক্ত হইলেন। আলীবর্দী খান বিহারের প্রথম নায়েব নাজিম হইলেন। মীর হবীর গ্রামে ঢাকার নায়েব নাজিমের একজন দক্ষ কর্মচারী ত্রিপুরার রাজপরিবারের অন্তর্কলহের সুযোগ লইয়া সহসা ত্রিপুরা আক্রমণ করিয়া রাজধানী চণ্ডগড় ও রাজ্যের অন্যান্য অংশ দখল ও বহু ধনরত্ন লুণ্ঠন করিয়া আনিলেন। বীরভূমের আফগান জমিদার বদিউজ্জমান বিদ্রোহ করিয়াছিলেন, কিন্তু শীঘ্রই বশ্যতা স্বীকার করিতে বাধ্য হইলেন। শুজাউদ্দীনের শাসনকালে ঢাকায় চাউলের দর আবার টাকায় আট মণ হইয়াছিল।

সরফরাজ খান

শুজাউদ্দীনের মৃত্যুর পর তাঁহার পুত্র সরফরাজ খান বাংলার নবাব হইলেন (মার্চ, ১৭৩৯ খ্রীষ্টাব্দ)। সরফরাজ একেবারে অপদার্থ এবং নবাবী পদের সম্পূর্ণ অযোগ্য ছিলেন এবং অধিকাংশ সময়েই হারেমে কাটাইতেন। সুতরাং শাসন কার্যে বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হইল এবং নানা প্রকার ষড়যন্ত্রের সৃষ্টি হইল। হাজী আহ্মদ ও আলীবর্দী খান এই সুযোগে বাংলা দেশে প্রভুত্ব স্থাপনের চেষ্টা করিতে লাগিলেন। হাজী আহমদ মুর্শিদাবাদ দরবারে নবাবের বিশ্বস্ত কর্মচারীরূপে তাঁহাকে স্তে কিবাক্যে তুষ্ট রাখিলেন–ওদিকে আলীবর্দী খান পাটনা হইতে সসৈন্যে বাংলার দিকে যাত্রা করিলেন (মার্চ, ১৭৪০ খ্রীষ্টাব্দ)। হাজী আহমদ মিথ্যা আশ্বাসে নবাবকে ভুলাইয়া অবশেষে সপরিবারে আলীবর্দীর সঙ্গে যোগ দিলেন।

সরফরাজ খান সসৈন্যে অগ্রসর হইয়া বর্তমান সুতীর নিকটে গিরিয়াতে পৌঁছিলেন। ১৭৪০ খ্রীষ্টাব্দের ১০ই এপ্রিল গিরিয়াতে দুই পক্ষের মধ্যে ভীষণ যুদ্ধ হইল। এই যুদ্ধে সরফরাজ পরাজিত ও নিহত হইলেন। দুই তিন দিন পরে আলীবর্দী মুর্শিদাবাদ অধিকার করিলেন। তিনি মৃত নবাবের পরিবারবর্গের প্রতি খুব সদয় ব্যবহার করিলেন এবং তাঁহারা যাহাতে যথোচিত মর্যাদার সহিত জীবন যাপন করিতে পারেন, তাঁহার ব্যবস্থা করিলেন। আলীবর্দী তাঁহার উপকারী প্রভুর পুত্রকে হত্যা করিয়া মহাপাপ করিয়াছিলেন, সন্দেহ নাই। তিনিও তাহা স্বীকার করিয়া সরফরাজের আত্মীয় স্বজনের নিকট দুঃখ ও অনুতাপ প্রকাশ করিলেন। তাঁহার দুষ্কর্মের জন্য তাঁহার প্রতি জনসাধারণের বিরাগ ও অশ্রদ্ধা দূর করিতে তিনি সকলের সহিত সদয় ব্যবহার ও অনেককে অর্থ দিয়া তুষ্ট করিলেন। দিল্লির বাদশাহ এবং তাঁহার প্রধান সভাসদগণকে প্রচুর উৎকোচ প্রদান করিয়া তিনি সুবাদারী পদের বাদশাহী সনদ পাইলেন। মুঘল সাম্রাজ্যের যে কতদূর অবনতি ঘটিয়াছিল ইহা হইতেই তাহা বুঝা যায়।

আলীবর্দী খান

আলীবর্দী খানও সুখে বা শান্তিতে বাংলার নবাবী করিতে পারেন নাই। নবাব শুজাউদ্দীনের জামাতা রুস্তম জং উড়িষ্যার নায়েব নাজিম ছিলেন–তিনি সসৈন্যে কটক হইতে বাংলা দেশ অভিমুখে যাত্রা করিলেন (ডিসেম্বর, ১৭৪০ খ্রীষ্টাব্দ)। আলীবর্দী নিজে তাঁহার বিরুদ্ধে অগ্রসর হইয়া বালেশ্বরের অনতিদূরে ফলওয়ারির যুদ্ধে তাঁহাকে পরাজিত করিলেন (মার্চ, ১৭৪১ খ্রীষ্টাব্দ)। আলীবর্দী তাঁহার ভ্রাতুষ্পুত্রকে উড়িষ্যার নায়েব নাজিম নিযুক্ত করিয়া মুর্শিদাবাদে ফিরিলেন। কিন্তু এই নূতন নায়েব নাজিমের অযোগ্যতা ও দুর্ব্যবহারে প্রজাগণ অসন্তুষ্ট হওয়ায় রুস্ত ম জং একদল মারাঠা সৈন্যের সাহায্যে পুনরায় উড়িষ্যা দখল করিলেন। নূতন নায়েব নাজিম সপরিবারে বন্দী হইলেন (অগস্ট, ১৭৪১ খ্রীষ্টাব্দ)। আলীবর্দী আবার উড়িষ্যায় গিয়া রুস্তম জংয়ের সৈন্যবাহিনীকে পরাজিত করিলেন (ডিসেম্বর, ১৭৪১ খ্রীষ্টাব্দ)। মুর্শিদাবাদ ফিরিবার পথে আলীবর্দী সংবাদ পাইলেন যে নাগপুর হইতে ভেঁসলারাজের মারাঠা সৈন্য বাংলা দেশের অভিমুখে আসিতেছে।

মারাঠা সৈন্য পাঁচেকের মধ্য দিয়া বর্ধমান জিলায় পৌঁছিয়া লুঠপাট আরম্ভ করিল। নবাব দ্রুতগতিতে বর্ধমানে পৌঁছিলেন (এপ্রিল, ১৭৪২ খ্রীষ্টাব্দ), কিন্তু অসংখ্য মারাঠা সৈন্য তাঁহাকে ঘিরিয়া ফেলিল। তাঁহার সঙ্গে ছিল মাত্র তিন হাজার অশ্বারোহী ও এক হাজার পদাতিক–বাকী সৈন্য পূর্বেই মুর্শিদাবাদে ফিরিয়া গিয়াছিল। আলীবর্দী বর্ধমানে অবরুদ্ধ হইয়া রহিলেন এবং মারাঠারা তাঁহার রসদ সরবরাহ বন্ধ করিয়া ফেলিল। অবশেষে কোন মতে মারাঠা ব্যুহ ভেদ করিয়া বহু কষ্টে তিনি কাটোয়ায় পৌঁছিলেন। মারাঠা বাহিনীর নায়ক ভাস্কর পণ্ডিত ফিরিয়া যাইতে মনস্থ করিলেন, কিন্তু পরাজিত ও বিতাড়িত রুস্তম জংয়ের বিচক্ষণ নায়েব মীর হবীবের পরামর্শ ও সাহায্যে পুনরায় যুদ্ধ চালাইলেন। একদল মারাঠা নবাবের পশ্চাদ্ধাবন করিল-বাকী মারাঠারা চতুর্দিকে গ্রাম জ্বালাইয়া ধনসম্পত্তি লুঠ করিয়া ফিরিতে লাগিল। মীর হবীরের সহায়তায় মারাঠা নায়ক ভাস্কর পণ্ডিত এক রাত্রির মধ্যে ৭০০ অশ্বারোহী সৈন্যসহ ৪০ মাইল পার হইয়া মুর্শিদাবাদ শহর আক্রমণ করিয়া সারাদিন লুঠ করিলেন–পরদিন সকালে (৭ই মে, ১৭৪২ খ্রীষ্টাব্দ) আলীবর্দী মুর্শিদাবাদে পৌঁছিলে, মারাঠা সৈন্য কাটোয়া অধিকার করিল এবং ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে রাজমহল হইতে মেদিনীপুর ও জলেশ্বর পর্যন্ত বিস্তৃত ভূখণ্ড মারাঠাদের শাসনাধীন হইল। এই অঞ্চলে মারাঠারা অকথ্য অত্যাচার করিতে লাগিল। ব্যবসায় বাণিজ্য ও শিল্প পোপ পাইল। লোকেরা ধন, প্রাণ ও মান রক্ষার জন্য দলে দলে ভাগীরথীর পূর্ব দিকে পলাইতে লাগিল। সমসাময়িক ইংরেজ ও বাঙালী লেখকরা এই বীভৎস অত্যাচারের যে কাহিনী লিপিবদ্ধ করিয়াছেন তাহা চিরদিন মারাঠা জাতির ইতিহাসে কলঙ্কের বিষয় হইয়া থাকিবে। বাঙালীরা মারাঠা সৈন্যদিগকে ‘বর্গী’ বলিত। বাংলা দেশে মারাঠা সৈন্যদের মধ্যে এক শ্রেণীর নাম ছিল শিলাদার। ইহারা নিজেদের ঘোড়া ও অস্ত্রশস্ত্র লইয়া যুদ্ধ করিত। নিম্নশ্রেণীর যে সমুদয় সৈন্যদের অশ্ব ও অস্ত্র মারাঠা সরকার দিতেন তাহাদের নাম ছিল বার্গীর! বর্গী এই বার্গীরেরই অপভ্রংশ। বর্গীদের অত্যাচার সম্বন্ধে সমসাময়িক গঙ্গারাম কর্ত্তৃক রচিত মহারাষ্ট্র পুরাণ হইতে কয়েক ছত্র উদ্ধৃত করিতেছি :

ছোট বড় গ্রামে জত লোক ছিল।
বরগির ভএ সব পলাইল ॥
চাইর দিগে তোক পলাঞ ঠাঞি ঠাঞি।
ছত্তিস বর্ণের লোক পলাএ তার অন্ত নাঞি ॥
এই মতে সব লোক পলাইয়া জাইতে।
আচম্বিতে বরগি ঘেরিলা আইসা সাথে ॥
মাঠে ঘেরিয়া বরগি দেয় তবে সাড়া।
সোনা রূপা লুটে নেএ আর সব ছাড়া ॥
কারূ হাত কাটে কারূ নাক কান।
একি চোটে কারা বধএ পরাণ ॥
ভাল ভাল স্ত্রীলোক জত ধইরা লইয়া জাএ।
অঙ্গুষ্ঠে দড়ি বাঁধি দেয় তার গলাএ।
একজনে ছাড়ে তারে আর জনা ধরে।
রমণের ভরে ত্রাহি শব্দ করে ॥
এই মতে বরগি কত পাপ কৰ্ম্ম কইরা।
সেই সব স্ত্রীলোকে জত দেয় সব ছাইড়া ॥
তবে মাঠে লুটিয়া বরগি গ্রামে সাধাএ।
বড় বড় ঘর আইসা আগুনি লাগাএ।
বাঙ্গালা চৌআরি জত বিষ্ণু মোণ্ডব।
ছোট বড় ঘরে আদি পোড়াইল সব ॥
এই মতে জতসব গ্রাম পোড়াইয়া।
চতুর্দিগে বরগি বেড়াএ লুটিয়া ॥
কাহুকে বাঁধে বরগি দিআ পিঠ মোড়া।
চিত কইরা মারে লাথি পাএ জুতা চড়া ॥
রূপি দেহ দেহ বোলে বারে বারে।
রূপি না পাইয়া তবে নাকে জল ভরে ॥
কাহুকে ধরিয়া বরগি পখইরে ডুবা।
ফাঁকর হইঞা তবে কারু প্রাণ জাএ।

–মহারাষ্ট্র পুরাণ, চিন্তয়সী সংস্করণ, ১৩৭৩

আলীবর্দী নিশ্চিত ছিলেন না। বর্ষাকালে পাটনা ও পূর্ণিয়া হইতে সৈন্য সংগ্রহ করিয়া বর্ষাশেষে তিনি কাটোয়া আক্রমণ করিলেন। মারাঠা লুঠপাটের টাকায় খুব ধুমধামের সহিত দুর্গা পূজা করিতেছিল–কিন্তু সারারাত্রি চলিয়া ঘোরাপথে আসিয়া আলীবর্দীর সৈন্য সহসা নবমী পূজার দিন সকালবেলা নিদ্রিত মারাঠা সৈন্যকে আক্রমণ করিল। মারাঠারা বিনা যুদ্ধে পলাইয়া গেল। ভাস্কর পণ্ডিত পলাতক মারাঠা সৈন্য সংগ্রহ করিয়া মেদিনীপুর অঞ্চল লুঠিতে লাগিলেন এবং কটক অধিকার করিলেন। আলীবর্দী সসৈন্যে অগ্রসর হইয়া কটক পুনরধিকার করিলেন এবং মারাঠারা চিল্কা হ্রদের দক্ষিণে পলাইয়া গেল (ডিসেম্বর, ১৭৪২ খ্রীষ্টাব্দ)।

ইতিমধ্যে দিল্লির বাদশাহ মারাঠারাজ সাহুকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় চৌথ আদায় করিবার অধিকার দিবেন এইরূপ প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন এবং সাহু নাগপুরের মারাঠারাজ রঘুজী ভোসলাকে ঐ অধিকার দান করিয়াছিলেন। কিন্তু দিল্লির বাদশাহ এই বিপদ হইতে রক্ষা পাইবার জন্য পেশোয়া বালাজী রাওর সাহায্য প্রার্থনা করিলেন। বালাজী ও রঘুজীর মধ্যে বিষম শত্রুতা ছিল। সুতরাং বালাজী অভয় দিলেন যে ভোঁসলার মারাঠা সৈন্যদের তিনি বাংলা দেশ হইতে তাড়াইয়া দিবেন (নভেম্বর, ১৭৪২ খ্রীষ্টাব্দ)।

১৭৪৩ খ্রীষ্টাব্দের প্রথম ভাগে রঘুজী ভেসলা ভাস্কর পণ্ডিতকে সঙ্গে লইয়া বাংলা দেশ অভিমুখে অগ্রসর হইলেন এবং মার্চ মাসে কাটোয়ায় পৌঁছিলেন। ওদিকে পেশোয়া বালাজী রাও বিহারের মধ্য দিয়া বাংলা দেশের দিকে যাত্রা করিলেন। সারা পথ তাঁহার সৈন্যেরা লুঠপাট ও ঘর-বাড়ী-গ্রাম জ্বালাইতে লাগিল–যাঁহারা পেশোয়াকে টাকা-পয়সা বা মূল্যবান উপঢৌকন দিয়া খুশী করিতে পারিল তাহারাই রক্ষা পাইল।

ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে বহরমপুরের দশ মাইল দক্ষিণে নবাব আলীবর্দী ও পেশোয়া বালাজী রাওয়ের সাক্ষাৎ হইল (৩০শে মার্চ, ১৭৪৩ খ্রীষ্টাব্দ)। স্থির হইল যে বাংলার নবাব মারাঠারাজ সাহুকে চৌথ দিবেন এবং বালাজী রাওকে তাঁহার সামরিক অভিযানের ব্যয় বাবদ ২২ লক্ষ টাকা দিবেন। পেশোয়া কথা দিলেন যে ভেসলার অত্যাচার হইতে বাংলা দেশকে তিনি রক্ষা করিবেন।

রঘুজী ভেসলা এই সংবাদ পাইয়া কাটোয়া পরিত্যাগ করিয়া বীরভূমে গেলেন। বালাজী রাও তাঁহার পশ্চাদ্ধাবন করিলেন এবং রঘুজীকে বাংলা দেশের সীমার বাহিরে তাড়াইয়া দিলেন। এই উপলক্ষে কলিকাতার বণিকগণ ২৫,০০০ টাকা চাঁদা তুলিয়া কলিকাতা রক্ষার জন্য মারাঠা ডিচ’ নামে খ্যাত পয়ঃপ্রণালী কাটাইয়াছিলেন। ১৭৪৩ খ্রীষ্টাব্দের জুন মাস হইতে পরবর্তী ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত বাংলা দেশ মারাঠা উৎপীড়ন হইতে রক্ষা পাইল।

ইতিমধ্যে মারাঠারাজ সাহু ভোসলা ও পেশোয়াকে ডাকাইয়া উভয়ের মধ্যে গোলমাল মিটাইয়া দিলেন (৩১শে অগস্ট, ১৭৪৩ খ্রীষ্টাব্দ)। বাংলার চৌথ আদায়ের বাঁটোয়ারা হইল। বিহারের পশ্চিম ভাগ পড়িল পেশোয়ার ভাগে, আর বাংলা, উড়িষ্যা ও বিহারের পূর্বভাগ পড়িল ভেসলার ভাগে। স্থির হইল যে, উভয়ের নিজেদের অংশে যথেচ্ছ লুঠতরাজ করিতে পারিবেন। একজন অপরজনকে বাধা দিতে পারিবেন না।

এই বন্দোবস্তের ফলে ভাস্কর পণ্ডিত পুনরায় মেদিনীপুরে প্রবেশ করিলেন (মার্চ, ১৭৪৪ খ্রীষ্টাব্দ)। সমস্ত ব্যাপার শুনিয়া আলীবর্দী প্রমাদ গণিলেন। বালাজী রাওকে যে উদ্দেশ্যে তিনি টাকা দিয়াছিলেন, তাহা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হইল এবং আবার মারাঠাদের অত্যাচার আরম্ভ হইল। এদিকে তাঁহার রাজকোষ শূন্য; পুনঃ পুনঃ বর্গীর আক্রমণে দেশ বিধ্বস্ত এবং সৈন্যদল অবসাদগ্রস্ত; তখন নবাব আলীবর্দী ‘শঠে শাঠ্যং সমাচরেৎ’ এই নীতি অবলম্বন করিলেন। তিনি চৌথ সম্বন্ধে একটা পাকাপাকি বন্দোবস্ত করিবার জন্য ভাস্কর পণ্ডিতকে তাঁহার শিবিরে আমন্ত্রণ করিলেন। ভাস্কর পণ্ডিত নবাবের তাঁবুতে পৌঁছিলে তাঁহার ২১ জন সেনানায়ক ও অনুচর সহ তাঁহাকে হত্যা করা হইল (৩১শে মার্চ, ১৭৪৪ খ্রীষ্টাব্দ)। অমনি মারাঠা সৈন্য বাংলা দেশ ত্যাগ করিয়া চলিয়া গেল।

নবাব আলীবর্দীর অধীনে ৯০০০ অশ্বারোহী ও কিছু পদাতিক আফগান সৈন্য ছিল। এই সৈন্যদলের অধ্যক্ষ গোলাম মুস্তাফা খান নবাবের অনুগত ও বিশ্বাসভাজন ছিলেন এবং তাঁহারই পরামর্শে ও সাহায্যে ভাস্কর পণ্ডিতকে নবাবের তাঁবুতে আনা সম্ভবপর হইয়াছিল। ভাস্কর পণ্ডিত নবাবের সহিত সাক্ষাৎ করিতে ইতস্তত করিলে মুস্তাফা কোরানের শপথ করিয়া তাঁহাকে অভয় দেন এবং সঙ্গে করিয়া নবাবের তাঁবুতে আনিয়া হত্যা করেন। নবাব অঙ্গীকার করিয়াছিলেন যে মুস্তাফা ভাস্কর পণ্ডিত ও মারাঠা সেনানায়কদের হত্যা করিতে পারিলে তাহাকে বিহার প্রদেশের শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত করিবেন। নবাব এই প্রতিশ্রুতি পালন না করায় মুস্তাফা বিহারে বিদ্রোহ করেন (ফেব্রুয়ারী, ১৭৪৫ খ্রীষ্টাব্দ) এবং রঘুজী ভোসলাকে বাংলা দেশ আক্রমণ করিতে উত্তেজিত করেন। মুস্তাফা পাটনার নিকট পরাজিত হন কিন্তু রঘুজী বর্ধমান পর্যন্ত অগ্রসর হন।

বর্ধমানে রাজকোষের সাত লক্ষ টাকা লুঠ করিয়া রঘুজী বীরভূমে বর্ষাকাল যাপন করেন এবং সেপ্টেম্বর মাসে বিহারে গিয়া বিদ্রোহী মুস্তাফার সঙ্গে যোগ দেন। নবাবের সৈন্য যখন বিহারে তাহাদের পশ্চাদ্ধাবন করেন, তখন উড়িষ্যার ভূতপূর্ব নায়েব মীর হবীরের সহযোগে মারাঠা সৈন্য মুর্শিদাবাদ আক্রমণ করে (২১শে ডিসেম্বর, ১৭৪৫ খ্রীষ্টাব্দ)। আলীবর্দী বহু কষ্টে দ্রুতগতিতে মুর্শিদাবাদে প্রত্যাবর্তন করিলে রঘুজী কাটোয়ায় প্রস্থান করেন ও আলীবর্দীর হস্তে পরাজিত হন। পরে তিনি নাগপুরে ফিরিয়া যান কিন্তু মীর হবীর মারাঠা সৈন্যসহ কাটোয়াতে অবস্থান করেন। পরে আলীবর্দী তাহাকেও পরাজিত করেন (এপ্রিল, ১৭৪৬ খ্রীষ্টাব্দ)। এই সব গোলমালের সময় আলীবর্দীর আরও দুইজন আফগান সেনানায়ক মারাঠাদের সহিত গোপনে ষড়যন্ত্র করায় নবাব তাঁহাদিগকে পদচ্যুত করিয়া বাংলা দেশের সীমানার বাহিরে বিতাড়িত করেন।

বিতাড়িত আফগান সৈন্যের পরিবর্তে নূতন সৈন্য নিযুক্ত করিয়া আলীবর্দী উড়িষ্যা পুনরধিকার করিবার জন্য সেনাপতি মীর জাফরকে প্রেরণ করেন। মীর জাফর মীর হবীরের এক সেনানায়ককে মেদিনীপুরের নিকট পরাজিত করেন (ডিসেম্বর, ১৭৪৬ খ্রীষ্টাব্দ)। কিন্তু বালেশ্বর হইতে মীর হবীর একদল মারাঠা সৈন্য সহ অগ্রসর হইলে মীর জাফর বর্ধমানে পলাইয়া যান। অতঃপর মীর জাফর ও রাজমহলের ফৌজদার নবাব আলীবর্দীকে গোপনে হত্যা করিবার চক্রান্ত করেন এবং নবাব উভয়কেই পদচ্যুত করেন। তারপর ৭১ বৎসরের বৃদ্ধ নবাব স্বয়ং অগ্রসর হইয়া মারাঠা সৈন্যবাহিনীকে পরাজিত করিলেন এবং বর্ধমান জিলা মারাঠাদের হাত হইতে উদ্ধার করিলেন (মার্চ, ১৭৭৭ খ্রীষ্টাব্দ)। কিন্তু উড়িষ্যা ও মেদিনীপুর মারাঠাদের হস্তে রহিল।

১৭৪৮ খ্রীষ্টাব্দের আরম্ভে আফগান অধিপতি আহম্মদ শাহ দুররাণী পঞ্জাব আক্রমণ করেন। এই সুযোগে আলীবর্দীর পদচ্যুত ও বিদ্রোহী আফগান সৈন্যদল তাহাদের বাসস্থান দ্বারভাঙ্গা জিলা হইতে অগ্রসর হইয়া পাটনা অধিকার করে। আলীবর্দীর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা হাজী আহমদের পুত্র জৈনুদ্দীন আহমদ (ইনি আলীবর্দীর জামাতাও) বিহারের নায়েব নাজিম ছিলেন। বিদ্রোহী আফগানেরা জৈনুদ্দীন ও হাজী আহমদ উভয়কেই বধ করে এবং আলীবর্দীর কন্যাকে বন্দী করে। দলে দলে আফগান সৈন্য বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দেয়। উড়িষ্যা হইতে মীর হবীরের অধীনে একদল মারাঠা সৈন্যও পাটনার দিকে অগ্রসর হয়। আলীবর্দী অগ্রসর হইয়া ভাগলপুরের নিকটে মীর হবীরকে এবং পাটনার ২৬ মাইল পূর্বে গঙ্গার তীবরর্তী কালাদিয়ারা নামক স্থানে আফগানদের ও তাহাদের সাহায্যকারী মারাঠা সৈন্যদের পরাজিত করিয়া পাটনা অধিকার করেন এবং বন্দিনী কন্যাকে মুক্ত করেন (এপ্রিল, ১৭৪৮ খ্রীষ্টাব্দ)।

১৭৪৯ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসে আলীবর্দী উড়িষ্যা আক্রমণ করেন এবং এক প্রকার বিনা বাধায় তাহা পুনরুদ্ধার করেন। কিন্তু তিনি ফিরিয়া আসিলেই মীর হবীরের মারাঠা সৈন্যরা পুনরায় উহা অধিকার করে।

অতঃপর উড়িষ্যা হইতে মারাঠা আক্রমণ প্রতিরোধ করিবার জন্য আলীবর্দী স্থায়িভাবে মেদিনীপুরে শিবির সন্নিবেশ করিলেন (অক্টোবর, ১৭৪৯ খ্রীষ্টাব্দ)। কিন্তু ইহা সত্ত্বেও মীর হবীর পরবর্তী ফেব্রুয়ারী মাসে আবার বাংলাদেশে লুঠপাট আরম্ভ করিলেন এবং রাজধানী মুর্শিদাবাদের নিকটে পৌঁছিলেন। নবাব সেদিকে অগ্রসর হইলেই মীর হবীর পলাইয়া জঙ্গলে আশ্রয় লইলেন-আলীবর্দী মেদিনীপুরে ফিরিয়া গেলেন (এপ্রিল, ১৭৫০ খ্রীষ্টাব্দ) এবং সেখানে স্থায়িভাবে বসবাসের বন্দোবস্ত করিলেন। ইতিমধ্যে সংবাদ আসিল যে মৃত জৈনুদ্দীনের পুত্র এবং নবারের দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌল্লা পাটনা দখল করিবার জন্য সেখানে পৌঁছিয়াছেন। আলীবর্দী পাটনায় ছুটিয়া গেলেন, এবং গুরুতররূপে পীড়িত হইয়া মুর্শিদাবাদে ফিরিলেন। কিন্তু মারাঠা আক্রমণের ভয়ে সম্পূর্ণ সুস্থ হইবার পূর্বেই আবার তাঁহাকে কাটোয়া যাইতে হইল (ফেব্রুয়ারী, ১৭৫১ খ্রীষ্টাব্দ)।

বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া মুর্শিদাবাদের সিংহাসন অধিকার করার পর হইতেই উড়িষ্যার আধিপত্য লইয়া ভূতপূর্ব নবাবের জামাতা রুস্তম জঙ্গের সহিত আলীবর্দীর সংঘর্ষ আরম্ভ হয়। মারাঠা আক্রমণকে তাঁহার অবান্তর ফল বলা যাইতে পারে, কারণ রুস্তম জঙ্গের নায়েব মীর হবীরের সাহায্য ও সহযোগিতার ফলেই তাহারা নির্বিঘ্নে মেদিনীপুরের মধ্য দিয়া বাংলা দেশে আসিত। সুতরাং বিগত দশ বৎসর যাবৎ আলীবর্দীকে মীর হবীর ও মারাঠাদের সঙ্গে যে অবিশ্রাম যুদ্ধ করিতে হয়, তাহা তাঁহার পাপেরই প্রায়শ্চিত্ত বলা যাইতে পারে। অবশ্য আলীবর্দী যে অপূর্ব সাহস, অধ্যবসায় ও রণকৌশলের পরিচয় দিয়াছিলেন, তাহা সর্বথা প্রশংসনীয়। কিন্তু ৭৫ বৎসরের বৃদ্ধ আর যুদ্ধ চালাইতে পারিলেন না। মারাঠারাও রণক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিল। সুতরাং ১৭৫১ খ্রীষ্টাব্দের মে মাসে উভয় পক্ষের মধ্যে নিম্নলিখিত তিনটি শর্তে এক সন্ধি হইল।

১। মীর হবীর আলীবর্দীর অধীনে উড়িষ্যার নায়েব নাজিম হইবেন–কিন্তু এই প্রদেশের উদ্বৃত্ত রাজস্ব মারাঠা সৈন্যের ব্যয় বাবদ রঘুজী ভোঁসলে পাইবেন।

২। ইহা ছাড়া চৌথ বাবদ বাংলার রাজস্ব হইতে প্রতি বৎসর ১২ লক্ষ টাকা রঘুজীকে দিতে হইবে।

৩। মারাঠা সৈন্য কখনও সুবর্ণরেখা নদী পার হইয়া বাংলা দেশে প্রবেশ করিতে পারিবে না।

সন্ধি হইবার এক বৎসর পরেই জনোজী ভেঁসলের মারাঠা সৈন্যরা মীর হবীরকে বধ করিয়া রঘুজীর এক সভাসদকে উড়িষ্যার নায়েব নাজিম পদে বসাইল (২৪শে অগস্ট, ১৭৫২ খ্রীষ্টাব্দ)। সুতরাং উড়িষ্যা মারাঠা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হইয়া গেল।

বাংলা দেশে আবার শান্তি বিরাজ করিতে লাগিল। কিন্তু দিল্লির বাদশাহী হইতে স্বাধীনতার প্রথম ফলস্বরূপ বিগত দশ বারো বৎসরের যুদ্ধ বিগ্রহ ও অন্ত দ্বন্দ্বে বাংলার অবস্থা অতিশয় শোচনীয় হইয়া উঠিয়াছিল। আলীবর্দী শাসনসংক্রান্ত অনেক ব্যবস্থা করিয়াও বিশেষ কিছু করিয়া উঠিতে পারিলেন না। তারপর ১৭৫৪ খ্রীষ্টাব্দে তাঁহার এক দৌহিত্র ও পর বৎসর তাঁহার দুই জামাতা ও ভ্রাতুষ্পুত্রের মৃত্যু হইল। আশী বৎসরের বৃদ্ধ নবাব এই সকল শোকে একেবারে ভাঙ্গিয়া পড়িলেন। ১৭৫৬ খ্রীষ্টাব্দের ১০ই এপ্রিল তাঁহার মৃত্যু হইল।

বাংলায় ইউরোপীয় বণিক সম্প্রদায়

পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে পর্তুগীজদেশীয় ভাস্কো-দা-গামা আফ্রিকার পশ্চিম ও পূর্ব উপকূল ঘুরিয়া বরাবর সমুদ্রপথে ভারতবর্ষে আসিবার পথ আবিষ্কার করেন। ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম ভাগেই পর্তুগীজ বণিকগণ বাংলা দেশের সহিত বাণিজ্য করিতে আরম্ভ করেন। ১৫১৭ খ্রীষ্টাব্দে তাঁহারা চট্টগ্রামে ও সপ্তগ্রামে বাণিজ্য কুঠি তৈরী করিবার অনুমতি পায়। ১৫৭৯-৮০ খ্রীষ্টাব্দে সম্রাট আকবর ভাগীরথী-তীরে হুগলি নামক একটি নগণ্য গ্রামে পর্তুগীজদিগকে কুঠি তৈরী করিবার অনুমতি দেন এবং ইহাই ক্রমে একটি সমৃদ্ধ সহর ও বাংলায় পর্তুগীজদের বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র হইয়া উঠে। ইহা ছাড়া বাংলায় হিজলী, শ্রীপুর, ঢাকা, যশোহর, বরিশাল ও নোয়াখালি জিলার বহুস্থানে পর্তুগীজদের বাণিজ্য চলিত। ষোড়শ শতাব্দীর শেষে চট্টগ্রাম ও ডিয়াঙ্গা এবং সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমে সন্দ্বীপ, দক্ষিণ শাহবাজপুর প্রভৃতি স্থান পর্তুগীজদের অধিকারভুক্ত হয়। কিন্তু বাংলায় পর্তুগীজদের প্রভাব বেশিদিন স্থায়ী হয় নাই। কারণ পর্তুগীজদের বাণিজ্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আরও দুইটি জিনিষ বাংলায় আমদানি হয়-খ্রীষ্টীয় ধর্মপ্রচারক এবং জলদস্যু। এই উভয়ই বাঙালীর আতঙ্কের কারণ হইয়া উঠিয়াছিল। আরাকানের রাজা ডিয়াঙ্গা পর্তুগীজদের হত্যা করিয়া সন্দ্বীপ অধিকার করেন। পর্তুগীজদের আগ্নেয় অস্ত্র ও নৌবহর কেবল বাংলার নহে মুঘল বাদশাহেরও ভয়ের কারণ হইয়া উঠিয়াছিল, কারণ এই দুই শক্তির বলে তাহারা দুর্ধর্ষ হইয়া উঠিয়া স্বাধীন জাতির ন্যায় আচরণ করিত। শাহ্জাহান যখন বিদ্রোহী হইয়া বাংলা দেশে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন, তখন পর্তুগীজরা প্রথমে নৌবহর লইয়া তাঁহাকে সাহায্য করিতে অগ্রসর হয়; কিন্তু পরে বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া তাহাকে ত্যাগ করে। ফিরিবার পথে তাহারা শাহ্জাহানের বেগম মমতাজমহলের দুইজন বাদীকে ধরিয়া অকথ্য অত্যাচার করে। এই সমুদয় কারণে শাহজাহান সম্রাট হইয়া কাশিম খানকে বাংলা দেশের সুবাদার নিযুক্ত করার সময় এই নির্দেশ দিলেন যে অবলিম্বে হুগলি দখল করিয়া পর্তুগীজ শক্তি সমূলে ধ্বংস করিতে হইবে এবং যাবতীয় শ্বেতবর্ণ পুরুষ, স্ত্রী, শিশু ইসলাম ধর্ম্মে দীক্ষিত অথবা ক্রীতদাসরূপে সম্রাটের দরবারে প্রেরিত হইবে। ১৬৩২ খ্রীষ্টাব্দে কাশিম খান হুগলি অধিকার করিলেন। ৪০০ ফিরিঙ্গি স্ত্রী-পুরুষকে বন্দী করিয়া আগ্রায় পাঠানো হইল। তাহাদিগকে বলা হইল যে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করিলে তাহারা মুক্তি পাইবে, নচেৎ আজীবন ক্রীতদাসরূপে বন্দী হইয়া থাকিতে হইবে। অধিকাংশই মুসলমান হইতে আপত্তি করিল এবং আমরণ বন্দী হইয়াই রহিল। হুগলির পতনের সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাদেশে পর্তুগীজ প্রাধান্যের শেষ হইল।

পর্তুগীজদের পরে আরও কয়েকটি ইউরোপীয় বণিকদল বাংলাদেশে বাণিজ্য বিস্তার করে। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম হইতেই ওলন্দাজেরা বাংলায় বাণিজ্য করিতে আরম্ভ করে। ১৬৫৩ খ্রীষ্টাব্দে হুগলির নিকটবর্তী কুঁচুড়ায় তাহাদের প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র দৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁহার অধীনে কাশিমবাজার ও পাটনায় আরও দুইটি কুঠি স্থাপিত হয়। দিল্লির বাদশাহ ফারুখশিয়র ওলন্দাজদিগকে শতকরা সাড়ে তিন টাকার পরিবর্তে আড়াই টাকা শুল্ক দিয়া বাণিজ্য করিবার অধিকার প্রদান করে। ফরাসী বণিকেরাও সম্রাটকে ৪০,০০০ টাকা এবং বাংলার নবাবকে ১০,০০০ টাকা ঘুষ দিয়া ঐ সুবিধা লাভ করেন। কিন্তু ১৭৪০ খ্রীষ্টাব্দের পূর্বে তাঁহারা বাংলায় বাণিজ্যের সুবিধা করিতে পারেন নাই। হুগলির নিকটবর্তী চন্দননগরে তাঁহাদের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল।

ইংরেজ বণিকেরা প্রথমে পর্তুগীজ ও ওলন্দাজ বণিকদের প্রতিযোগিতায় বাংলা দেশে বাণিজ্যে বিশেষ সুবিধা করিতে পারেন নাই। ১৬৫০ খ্রীষ্টাব্দে তাঁহারা নবাবের নিকট হইতে বাংলা দেশে বাণিজ্য করিবার সনদ পান এবং পরবর্তী বৎসর হুগলিতে কুঠি স্থাপন করেন। ১৬৬৮ খ্রীষ্টাব্দে ঢাকা এবং অনতিকাল পরেই রাজমহল এবং মালদহেও তাহাদের কুঠি স্থাপিত হয়। এই সমুদয় অঞ্চলে শুজা ইংরেজদিগকে বার্ষিক তিন হাজার টাকার বিনিময়ে বিনা শুল্কে বাংলায় বাণিজ্য করিবার অধিকার দেন। কিন্তু বাংলার মুঘল কর্মচারীরা নানা অজুহাতে এই সুবিধা হইতে ইংরেজদিগকে বঞ্চিত করে। ইংরেজ বণিকগণ শায়েস্তা খান ও সম্রাট ঔরঙ্গজেবের নিকট হইতেও ফরমান আদায় করেন; কিন্তু তাহাতেও কোন সুবিধা হয় না। ইংরেজরা তখন নিজেদের শক্তিবৃদ্ধির দ্বারা আত্মরক্ষা করিতে সচেষ্ট হইলেন। ইতিমধ্যে হুগলির মুঘল শাসনকর্ত্তা ১৬৮৬ খ্রীষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে ইংরেজদের কুঠি আক্রমণ করিলেন। ইংরেজরা বাধা দিতে সমর্থ হইলেও ইংরেজ এজেন্ট জব চার্ণক সেখানে থাকা নিরাপদ মনে না করিয়া, প্রথমে সুতানুটি (বর্তমান কলিকাতার অন্তর্গত), পর হিজলীতে তাহাদের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপিত করিলেন এবং তাঁহাদের ক্ষতির প্রতিশোধস্বরূপ বালেশ্বর সহরটি পোড়াইয়া দিলেন। মুঘলসৈন্য হিজলী অবরোধ করিলে উভয় পক্ষের মধ্যে সন্ধি হইল এবং ১৬৮৭ খ্রীষ্টাব্দে ইংরেজরা সুতানুটিতে ফিরিয়া গেলেন (সেপ্টেম্বর, ১৬৮৯ খ্রী)। কিন্তু লণ্ডনের কর্তৃপক্ষ পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলায় একটি সুদৃঢ় ও সুরক্ষিত স্থান অধিকার দ্বারা নিজেদের স্বার্থ রক্ষার ব্যবস্থা করিতে মনস্থ করিলেন। জব চার্ণকের আপত্তি সত্ত্বেও ইংরেজরা সুতানুটি হইতে বাণিজ্যকেন্দ্র উঠাইয়া, সমস্ত ইংরেজ অধিবাসী ও বাণিজ্য-দ্রব্য জাহাজে বোঝাই করিয়া জলপথে চট্টগ্রাম আক্রমণ করিলেন। কিন্তু ব্যর্থ মনোরথ হইয়া মাদ্রাজে (১৬৮৮ খ্রী) ফিরিয়া গেলেন। আবার উভয় পক্ষে সন্ধি হইল। বাংলার সুবাদার বার্ষিক তিন হাজার টাকার বিনিময়ে ইংরেজদিগকে বিনাশুল্কে বাণিজ্য করিতে অনুমতি দিলেন। ১৬৯০ খ্রীষ্টাব্দের অগস্ট মাসে ইংরেজরা আবার সুতানুটিতে ফিরিয়া আসিয়া সেখানে ঘরবাড়ী নির্মাণ করিলেন। ১৬৯৬ খ্রীষ্টাব্দে শোভাসিংহের বিদ্রোহ উপলক্ষে কলিকাতার দুর্গ দৃঢ় করা হইল এবং ইংলণ্ডের রাজার নাম অনুসারে ইহার নাম রাখা হইল ফোর্ট উইলিয়ম। বার্ষিক ১২,০০০ টাকায় সুতানুটি, কলিকাতা ও গোবিন্দপুর, এই তিনটি গ্রামের ইজারা লওয়া হইল। ১৭০০ খ্রীষ্টাব্দে মাদ্রাজ হইতে পৃথকভাবে বাংলা একটি স্বতন্ত্র প্রেসিডেন্সীতে পরিণত হইল। ১৭১৭ খ্রীষ্টাব্দে ইংরেজ বণিকগণের প্রতিনিধি সুরম্যানকে সম্রাট ফারুখশিয়র এই মর্মে এক ফরমান প্রদান করেন যে ইংরেজগণ শুল্কের পরিবর্তে মাত্র বার্ষিক তিন হাজার টাকা দিলে সারা বাংলায় বাণিজ্য করিতে পারিবেন, কলিকাতার নিকটে জমি কিনিতে পারিবেন এবং যেখানে খুশী বসবাস করিতে পারিবেন। বাংলার সুবাদার ইহা সত্ত্বেও নানারকমে ইংরেজ বণিকগণের প্রতিবন্ধকতা করিতে লাগিলেন। কিন্তু তথাপি কলিকাতা ক্রমশই সমৃদ্ধ হইয়া উঠিল। ইহার ফলে মারাঠা আক্রমণের সময় দলে দলে লোক কলিকাতায় নিরাপদ আশ্রয় লাভ করিয়াছিল। ইহাও কলিকাতার উন্নতির অন্যতম কারণ।

কিন্তু মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পরে যখন মুর্শিদকুলী খান স্বাধীন রাজার ন্যায় রাজত্ব করিতে লাগিলেন তখন নবাব ও তাঁহার কর্মচারীরা সমৃদ্ধ ইংরেজ বণিকদিগের নিকট হইতে নানা উপায়ে অর্থ আদায় করিতে লাগিলেন। নবাবদের মতে ইংরেজদের বাণিজ্য বহু বৃদ্ধি পাইয়াছে এবং তাঁহাদের কর্মচারীরাও বিনা শুঙ্কে বাণিজ্য করিতেছে, সুতরাং তাহাদের বার্ষিক টাকার পরিমাণ বৃদ্ধি করা সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত। ইহা লইয়া প্রায়ই বিবাদ-বিসংবাদ হইত আবার পরে গোলমাল মিটিয়া যাইত। কারণ বাংলার নবাব জানিতেন যে ইংরেজের বাণিজ্য হইতে তাঁহার যথেষ্ট লাভ হয়-ইংরেজরাও জানিতেন যে নবাবের সহিত শত্রুতা করিয়া বাণিজ্য করা সম্ভব হইবে না। সুতরাং কোন পক্ষই বিবাদ-বিসংবাদ চরমে পৌঁছিতে দিতেন না। নবাব কখনও কখনও টাকা না পাইলে ইংরেজদের মাল বোঝাই নৌকা আটকাইতেন। ১৭৩৬ খ্রীষ্টাব্দে এইরূপ একবার নৌকা আটকানো হয়। কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠিয়ালরা ৫৫,০০০ টাকা দিলে নবাব নৌকা ছাড়িয়া দেন।

নবাব আলীবর্দী ইউরোপীয় বণিকদের সহিত সদ্ভাব রক্ষা করিয়া চলিতেন এবং তাঁহাদের প্রতি যাহাতে কোন অন্যায় বা অত্যাচার না হয় সেদিকে লক্ষ্য। রাখিতেন। কারণ ইহাদের ব্যবসায় বজায় থাকিলে যে বাংলা সরকারের বহু অর্থাগম হইবে, তাহা তিনি খুব ভাল করিয়াই জানিতেন। তবে অভাবে পড়িলে টাকা আদায়ের জন্য তিনি অনেক সময় কঠোরতা অবলম্বন করিতেন। মারাঠা আক্রমণের সময়ে তিনি ইংরেজ, ফরাসী ও ওলন্দাজ বণিকদের নিকট হইতে টাকা আদায় করেন। ১৭৪৪ খ্রীষ্টাব্দে সৈন্যের মাহিনা বাকী পড়ায় তিনি ইংরেজদের নিকট হইতে ত্রিশ লক্ষ টাকা দাবী করেন এবং তাহাদের কয়েকটি কুঠি আটক করেন। পরে অনেক কষ্টে ইংরেজরা মোট প্রায় চারি লক্ষ টাকা দিয়া রেহাই পান। ইংরেজরা বাংলার কয়েকজন আর্মেনিয়ান ও মুঘল বণিকের জাহাজ আটকাইবার অপরাধে আলিবর্দী তাঁহাদিগকে ক্ষতিপূরণ করিতে আদেশ দেন ও দেড় লক্ষ টাকা জরিমানা করেন।

দাক্ষিণাত্যে ইংরেজ ও ফরাসী বণিকেরা যেমন স্থানীয় রাজাদের পক্ষ অবলম্বন করিয়া ক্রমে ক্রমে শক্তিশালী হইতেছিলেন, বাংলা দেশ যাহাতে সেরূপ না হইতে পারে সে দিকে আলীবর্দীর বিশেষ দৃষ্টি ছিল। ইউরোপে যুদ্ধ উপস্থিত হইলে তিনি ফরাসী, ইংরেজি ও ওলন্দাজ বণিকগণকে সাবধান করিয়া দিয়াছিলেন যে তাঁহার রাজ্যের মধ্যে যেন তাহাদের পরস্পরের মধ্যে কোন যুদ্ধ-বিগ্রহ না হয়। তিনি ইংরেজ ও ফরাসীদিগকে বাংলায় কোন দুর্গ নির্মাণ করিতে দিতেন না, বলিতেন “তোমরা বাণিজ্য করিতে আসিয়াছ, তোমাদের দুর্গের প্রয়োজন কি? তোমরা আমার রাজ্যে আছ, আমিই তোমাদের রক্ষা করিব।” ১৭৫৫ খ্রীষ্টাব্দে তিনি দিনেমার (ডেনমার্ক দেশের অধিবাসী) বণিকগণকে শ্রীরামপুরে বাণিজ্য কুঠি নির্মাণ করিতে অনুমতি দেন।

সিরাজউদ্দৌলা

নবাব আলীবর্দীর কোন পুত্র সন্তান ছিল না। তাঁহার তিন কন্যার সহিত তাঁহার তিন ভ্রাতুষ্পুত্রের (হাজী আহম্মদের পুত্র) বিবাহ হইয়াছিল। এই তিন জামাতা যথাক্রমে ঢাকা, পূর্ণিয়া ও পাটনার শাসনকর্ত্তা ছিলেন। আলীবর্দীর জীবদ্দশায়ই তিন জনের মৃত্যু হয়। জ্যেষ্ঠা কন্যা মেহের উন্-নিসা ঘসেটি বেগম নামেই সুপরিচিত ছিলেন। তাঁহার কোন পুত্র সন্তান ছিল না কিন্তু বহু ধন-সম্পত্তি ছিল এবং স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি ঢাকা হইতে আসিয়া মুর্শিদাবাদে মতিঝিল নামে সুরক্ষিত বৃহৎ প্রাসাদ নির্মাণ করিয়া সেখানেই থাকিতেন। মধ্যমা কন্যার পুত্র শওকৎ জঙ্গ পিতার মৃত্যুর পর পূর্ণিয়ার শাসনকর্ত্তা হন।

কনিষ্ঠা কন্যা আমিনা বেগমের পুত্র সিরাজউদ্দৌলা মুর্শিদাবাদের মাতামহের কাছে থাকিতেন। তাঁহার জন্মের পরেই আলীবর্দী বিহারের শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত হন। সুতরাং এই নবজাত শিশুকেই তাঁহার সৌভাগ্যের মূল কারণ মনে করিয়া তিনি ইহাকে অত্যধিক স্নেহ করিতেন। তাঁহার আদরের ফলে সিরাজের লেখাপড়া কিছুই হইল না, এবং বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গেই তিনি দুর্দান্ত, স্বেচ্ছাচারী, কামাসক্ত, উদ্ধত, দুর্বিনীত ও নিষ্ঠুর যুবকে পরিণত হইলেন। কিন্তু তথাপি আলীবর্দী সিরাজকেই নিজের উত্তরাধিকারী মনোনীত করিলেন। আলীবর্দীর মৃত্যুর পর সিরাজ বিনা বাধায় সিংহাসনে আরোহণ করিলেন।

ঘসেটি বেগম ও শওকত্সঙ্গ উভয়েই সিরাজের সিংহাসনে আরোহণের বিরুদ্ধে ছিলেন। নবাব-সৈন্যের সেনাপতি মীরজাফর আলী খানও সিংহাসনের স্বপ্ন। দেখিতেন। আলীবর্দীর ন্যায় মীরজাফরও নিঃস্ব অবস্থায় ভারতে আসেন এবং আলীবর্দীর অনুগ্রহেই তাঁহার উন্নতি হয়। মীরজাফর আলীবর্দীর বৈমাত্রেয় ভগিনীকে বিবাহ করেন এবং ক্রমে সেনাপতি পদ লাভ করেন। আলীবর্দী প্রতিপালক প্রভুর পুত্রকে হত্যা করিয়া নবাবী লাভ করিয়াছিলেন। মীরজাফরও তাঁহারই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করিয়া সিরাজকে পদচ্যুত করিয়া নিজে নবাব হইবার উচ্চাকাঙ্ক্ষা মনে মনে পোষণ করিতেন।

ঘসেটি বেগমের সহিত সিরাজের বিরোধিতা আলীবর্দীর মৃত্যুর পূর্বেই আরম্ভ হইয়াছিল। তাঁহার স্বামী ঢাকার শাসনকর্ত্তা ছিলেন, কিন্তু তিনি ভগ্নস্বাস্থ্য ও অতিশয় দুর্বল প্রকৃতির লোক ছিলেন, বুদ্ধিশুদ্ধিও তেমন ছিল না। সুতরাং ঘসেটি বেগমের হাতেই ছিল প্রকৃত ক্ষমতা এবং তিনিই তাঁহার অনুগ্রহভাজন দিওয়ান হোসেন কুলী খানের সাহায্যে দেশ শাসন করিতেন। হোসেন কুলীর শক্তি ও সম্পদ বৃদ্ধিতে সিরাজ ভীত হইয়া উঠিলেন এবং একদিন প্রকাশ্য দরবারে আলীবর্দীর নিকট অভিযোগ করিলেন যে হোসেন কুলী তাঁহার (সিরাজের) প্রাণনাশের জন্য ষড়যন্ত্র করিতেছে। আলীবর্দী প্রিয় দৌহিত্রকে কোনমতে বুঝাইয়া প্রকাশ্যে কোন হঠকারিতা করিতে নিরস্ত করিলেন। ঘসেটি বেগমের সহিত হোসেন কুলীর অবৈধ প্রণয়ের কথাও সম্ভবত সিরাজ ও আলীবর্দী উভয়ের কানে গিয়াছিল। সম্ভবত সেইজন্যই আলীবর্দী সিরাজকে তাঁহার দুরভিসন্ধি হইতে একেবারে নিবৃত্ত করেন নাই। মাতামহের উপদেশ সত্ত্বেও সিরাজ প্রকাশ্য রাজপথে হোসেন কুলী খানকে বধ করিলেন (এপ্রিল, ১৭৫৪ খ্রী)। অতঃপর ঘসেটি বেগম রাজবল্লভ নামে বিক্রমপুরের একজন হিন্দুকে দিওয়ান নিযুক্ত করিলেন। রাজবল্লভ সামান্য কেরানীর পদ হইতে নিজের যোগ্যতার বলে নাওয়ারা (নৌবহর) বিভাগের অধ্যক্ষপদে উন্নীত হইয়াছিলেন। হোসেন কুলীর মৃত্যুর পর তিনিই ঘসেটির দক্ষিণ হস্ত এবং ঢাকায় সর্বেসর্বা হইয়া উঠিলেন। সিরাজ উহাকে ভালচক্ষে দেখিতেন না। সুতরাং ঘসেটি বেগমের স্বামীর মৃত্যুর পরই সিরাজ রাজবল্লভকে তহবিল তছরূপের অপরাধে বন্দী করিলেন এবং তাঁহার নিকট হিসাব-নিকাশের দাবী করিলেন (মার্চ, ১৭৫৬ খ্রী)। বৃদ্ধ আলীবর্দী তখন মৃত্যুশয্যায়, তথাপি তিনি রাজবল্লভকে তখনই বধ না করিয়া হিসাব-নিকাশ পর্যন্ত তাঁহার প্রাণ রক্ষার আদেশ করিলেন। সিরাজ রাজবল্লভকে কারাগারে রাখিলেন এবং রাজবল্লভের পরিবারবর্গকে বন্দী ও তাঁহার ধনসম্পত্তি লুঠ করিবার জন্য রাজবল্লভের বাসভূমি রাজনগরে (ঢাকা জিলায়) একদল সৈন্য পাঠালেন। সৈন্যদল রাজনগরে পৌঁছিবার পূর্বেই রাজবল্লভের পুত্র কৃষ্ণদাস সপরিবারে সমস্ত ধনরত্নসহ পুরীতে তীর্থযাত্রার নাম করিয়া জলপথে কলিকাতায় পৌঁছিলেন এবং কলিকাতার গভর্নর ড্রেককে ঘুষ দিয়া কলিকাতা দুর্গে আশ্রয় লইলেন। সম্ভবত ঘসেটি বেগমের ধনরত্নও এইরূপে কলিকাতায় সুরক্ষিত হইল।

ঘসেটি বেগম ও মীরজাফর উভয়েই আলীবর্দীর মৃত্যুর পর শওকৎ জঙ্গকে সাহায্যের আশ্বাস দিয়া মুর্শিদাবাদ আক্রমণ করিতে উৎসাহিত করিলেন। কিন্তু এই উৎসাহ বা প্ররোচনার আবশ্যক ছিল না। শওকৎ জঙ্গ আলীবর্দীর মধ্যমা কন্যার পুত্র, সুতরাং কনিষ্ঠা কন্যার পুত্র সিরাজ অপেক্ষা সিংহাসনে তাঁহারই দাবি তিনি বেশি মনে করিতেন এবং তিনি দিল্লিতে বাদশাহের দরবারে তাঁহার নামে সুবেদারীর ফরমানের জন্য আবেদন করিলেন।

সিরাজ সিংহাসনে আরোহণ করিয়াই তাঁহার অবস্থা উপলব্ধি করিতে পারিলেন। মীরজাফরের ষড়যন্ত্রের কথা সম্ভবত তিনি জানিতেন না। ঘসেটি বেগম ও শওকৎ জঙ্গকেই প্রধান শত্রু জ্ঞান করিয়া তিনি প্রথমে ইহাদিগকে দমন করিবার ব্যবস্থা করিলেন। মতিঝিল আক্রমণ করিয়া সিরাজ ঘসেটি বেগমকে বন্দী করিলেন ও তাঁহার ধনরত্ন লুঠ করিলেন। তারপর তিনি সসৈন্যে শওকৎ জঙ্গের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করিলেন। কিন্তু দুইটি কারণে ইংরেজদের প্রতিও তিনি অত্যন্ত অসন্তুষ্ট ছিলেন। প্রথমত, তাহারা রাজবল্লভের পুত্রকে আশ্রয় দিয়াছে। দ্বিতীয়ত, তিনি শুনিতে পাইলেন ইংরেজরা তাঁহার অনুমতি না লইয়াই কলিকাতা দুর্গের সংস্কার ও আয়তনবৃদ্ধি করিতেছে। শওকৎ জঙ্গের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্ৰা করিবার পূর্বে তিনি কলিকাতার গভর্নর ড্রেকের নিকট নারায়ণ দাস নামক একজন দূত পাঠাইয়া আদেশ করিলেন যেন তিনি অবিলম্বে নবাবের প্রজা কৃষ্ণদাসকে পাঠাইয়া দেন। কলিকাতার দুর্গের কি কি সংস্কার ও পরিবর্তন হইতেছে, তাহা লক্ষ্য করিবার জন্যও দূতকে গোপনে আদেশ দেওয়া হইল।

১৭৫৬ খ্রীষ্টাব্দের ১৬ই মে সিরাজ মুর্শিদাবাদ হইতে সসৈন্যে শওকৎ জঙ্গের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করিলেন। ২০শে মে রাজমহলে পৌঁছিয়া তিনি সংবাদ পাইলেন যে তাঁহার প্রেরিত দূত গোপনে কলিকাতা সহরে প্রবেশ করে, কিন্তু কলিকাতার কর্তৃপক্ষের নিকট দৌত্যকার্যের উপযুক্ত দলিল দেখাইতে না পারায় গুপ্তচর মনে করিয়া তাহাকে তাড়াইয়া দেওয়া হইয়াছে। এই অজুহাতটি মিথ্যা বলিয়াই মনে হয়। কলিকাতার গর্ভনর ড্রেক সাহেব ঘুষ লইয়া কৃষ্ণদাসকে আশ্রয় দিয়াছিলেন এবং তাঁহার বিশ্বাস ছিল পরিণামে ঘসেটি বেগমের পক্ষই জয়লাভ করিবে। এই জন্যই তিনি সিরাজের বিরুদ্ধাচরণ করিতে ভরসা পাইয়াছিলেন।

কলিকাতার সংবাদ পাইয়া সিরাজ ক্রোধে জ্বলিয়া উঠিলেন এবং ইংরেজদিগকে সমুচিত শাস্তি দিবার জন্য তিনি রাজমহল হইতে ফিরিয়া ইংরেজদিগের কাশিমবাজার কুঠি লুঠ ও কয়েকজন ইংরেজকে বন্দী করিলেন। ৫ই জুন তিনি কলিকাতা আক্রমণের জন্য যাত্রা করিলেন এবং ১৬ই জুন কলিকাতার উপকণ্ঠে পৌঁছিলেন। কলিকাতা দুর্গের সৈন্যসংখ্যা তখন খুবই অল্প ছিল-কার্যক্ষম ইউরোপীয় সৈন্যের সংখ্যা তিন শতেরও কম ছিল এবং ১৫০ জন আর্মেনিয়ান ও ইউরেশিয়ান সৈন্য ছিল। সুতরাং নবাব সহজেই কলিকাতা অধিকার করিলেন। গভর্নর নিজে ও অন্যান্য অনেকেই নৌকাযোগে পলায়ন করিলেন এবং ফলতায় আশ্রয় লইলেন। ২০শে জুন কলিকাতার নূতন গভর্নর হলওয়েল আত্মসমর্পণ করিলেন এবং বিজয়ী সিরাজ কলিকাতা দুর্গে প্রবেশ করিলেন।

সিরাজের সৈন্যরা ইউরোপীয় অধিবাসীদের বাড়ী লুঠ করিয়াছিল; কিন্তু কাহারও প্রতি অত্যাচার করে নাই। সিরাজও হলওয়েলকে আশ্বস্ত করিয়াছিলেন। সন্ধ্যার সময় কয়েকজন ইউরোপীয় সৈন্য মাতাল হইয়া এ-দেশী লোককে আক্রমণ করে। তাহারা নবারের নিকট অভিযোগ করিলে নবাব জিজ্ঞাসা করিলেন, এইরূপ দুবৃত্ত মাতাল সৈন্যকে সাধারণত কোথায় আটকাইয়া রাখা হয়? তাহারা বলিল, অন্ধকূপ (Black Hole) নামক কক্ষে। সিরাজ হুকুম দিলেন যে, ঐ সৈন্যদিগকে সেখানে রাত্রে আটক রাখা হউক। ১৮ ফুট দীর্ঘ ও ১৪ ফুট ১০ ইঞ্চি প্রশস্ত এই কক্ষটিতে ঐ সমুদয় বন্দীকে আটক রাখা হইল। পরদিন প্রভাতে দেখা গেল দম বন্ধ হইয়া অথবা আঘাতের ফলে তাহাদের অনেকে মারা গিয়াছে।

এই ঘটনাটি অন্ধকূপ হত্যা নামে কুখ্যাত। প্রচলিত বিবরণ মতে মোট কয়েদীর সংখ্যা ছিল ১৪৬, তাঁহার মধ্যে ১২৩ জনই মারা গিয়াছিল। এই সংখ্যাটি যে অতিরঞ্জিত, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। সম্ভবত ৬০ কি ৬৫ জনকেই ঐ কক্ষে আটক করা হইয়াছিল। ইহাদের মধ্যে কত জনের মৃত্যু হইয়াছিল, তাহা সঠিক জানিবার উপায় নাই। কিন্তু ২১ জন যে বাঁচিয়াছিল, ইহা নিশ্চিত।

ইতিমধ্যে শওকৎ জঙ্গ বাদশাহের উজীরকে এক কোটি টাকা ঘুষ দিয়া সুবাদারীর ফরমান এবং সিরাজকে বিতাড়িত করিবার জন্য বাদশাহের অনুমতি পাইয়াছিলেন। সুতরাং তিনি সিরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করিলেন। সিরাজও কলিকাতা জয় সমাপ্ত করিয়া ১৭৫৬ খ্রীষ্টাব্দের সেপ্টেম্বরের শেষে সসৈন্যে পূর্ণিয়া অভিমুখে অগ্রসর হইলেন। ১৬ই অক্টোবর নবাবগঞ্জের নিকট মনিহারী গ্রামে দুই দলে যুদ্ধ হইল। এই যুদ্ধে শওকৎ জঙ্গ পরাজিত ও নিহত হইলেন।

অল্পবয়স্ক হইলেও সিরাজ মাতামহের মৃত্যুর ছয়মাসের মধ্যেই ঘসেটি বেগম, ইংরেজ ও শওকৎ জঙ্গের ন্যায় তিনটি শত্রুকে ধ্বংস করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন ইহা তাঁহার বিশেষ যোগ্যতার পরিচয় সন্দেহ নাই। কিন্তু এই সাফল্যলাভের পর তাঁহার সকল উদ্যম ও উৎসাহ যেন শেষ হইয়া গেল।

কলিকাতা জয়ের পর ইহার রক্ষার জন্য উপযুক্ত কোন বন্দোবস্ত করা হইল না। ইংরেজের সঙ্গে শত্রুতা আরম্ভ করিবার পর যাহাতে তাহারা পুনরায় বাংলা দেশে শক্তি ও প্রতিষ্ঠা স্থাপন করিতে না পারে, তাঁহার সুব্যবস্থা করা অবশ্য কর্তব্য ছিল; কিন্তু তাহাও করা হইল না। ইংরেজ কোম্পানী মাদ্রাজ হইতে ক্লাইবের অধীনে একদল সৈন্য ও ওয়াটসনের অধীনে এক নৌবহর কলিকাতা পুনরুদ্ধারের জন্য পাঠাইল। নবাবের কর্মচারী মাণিকচাঁদ কলিকাতার শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত হইয়াছিলেন। ক্লাইব ও ওয়াটসন বিনা বাধায় ফলতায় উদ্বাস্তু ইংরেজদের সহিত মিলিত হইলেন (১৫ই ডিসেম্বর, ১৭৫৬ খ্রীষ্টাব্দ)। ১৭৫৬ খ্রীষ্টাব্দের ২৭শে ডিসেম্বর ইংরেজ সৈন্য ও নৌবহর কলিকাতা অভিমুখে যাত্রা করিল। নবাবের বজবজে একটি ও তাঁহার নিকটে আরও একটি দুর্গ ছিল। মাণিকচাঁদ এই দুইটি দুর্গ রক্ষার্থে অগ্রসর হইতেছিলেন-পথে ক্লাইবের সৈন্যের সঙ্গে তাঁহার সাক্ষাৎ হইল। সহসা আক্রমণের ফলে ইংরেজদের কিছু সৈন্য মারা গেল। কিন্তু মাণিকাদের পাগড়ীর পাশ দিয়া একটি গুলি যাওয়ার শব্দে ভীত হইয়া তিনি পলায়ন করিলেন। ইংরেজরা বজবজ দুর্গ ধ্বংস করিল এবং বিনা যুদ্ধে কলিকাতা অধিকার করিল (২রা জানুয়ারী, ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দ)। ইংরেজরা যে পূর্বেই ঘুষ দিয়া মাণিকচাঁদকে হাত করিয়াছিল, সে সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নাই। মাণিকচাঁদের সহিত ক্লাইবের পত্র বিনিময় হইতে স্পষ্ট বুঝা যায় যে কলিকাতা হইতে ইংরেজরা বিতাড়িত হইয়া ফলতায় আশ্রয় গ্রহণের পরেই মাণিকচাঁদ নবাবের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া গোপনে ইংরেজদের পক্ষ অবলম্বন করেন। অর্থের প্রভাব ছাড়া ইহার আর কোন কারণ দেখা যায় না। ১৭৬৩ খ্রীষ্টাব্দে মাণিকচাঁদের পুত্রকে ইংরেজ গভর্নমেন্ট উচ্চ পদে নিযুক্ত করেন–এই প্রসঙ্গে কাগজ-পত্রে লেখা আছে যে মাণিকচাঁদ ত্রিশ বৎসর যাবৎ ইংরেজের অনেক উপকার করিয়াছেন।

কলিকাতা অধিকার করিয়াই ইংরেজরা সিরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিল (৩রা জানুয়ারী, ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দ)। ওদিকে সিরাজও কলিকাতা অধিকারের সংবাদ পাইয়া যুদ্ধযাত্রা করিলেন। ১০ই জানুয়ারী ক্লাইব হুগলি অধিকার করিয়া সহরটি লুঠ করিলেন এবং নিকটবর্তী অনেক গ্রাম পোড়াইয়া দিলেন। সিরাজ ১৯শে জানুয়ারী হুগলি পৌঁছিলে ইংরেজরা কলিকাতায় প্রস্থান করিল। ৩রা ফেব্রুয়ারী সিরাজ কলিকাতার সহরতলীতে পৌঁছিয়া আমীরাদের বাগানে শিবির স্থাপন করিলেন।

৪ঠা জুন ইংরেজরা সন্ধি প্রস্তাব করিয়া দুইজন দূত পাঠাইলেন। নবাব সন্ধ্যার সময় তাহাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলিলেন, কিন্তু পরদিন পর্যন্ত আলোচনা মুলতুবী রহিল। কিন্তু ইংরেজ দূতেরা রাত্রে গোপনে নবাবের শিবির হইতে চলিয়া গেল। শেষ রাত্রে ক্লাইব অকস্মাৎ নবাবের শিবির আক্রমণ করিলেন। অতর্কিত আক্রমণে নবাবের পক্ষের প্রায় ১৩০০ লোক হত হইল, কিন্তু প্রাতঃকালে নবাবের একদল সৈন্য সুসজ্জিত হওয়ায় ক্লাইব প্রস্থান করিলেন। মনে হয়, ইংরেজ দূতেরা নবাবের শিবিরের সন্ধান লইতেই আসিয়াছিল এবং তাহাদের নিকট সংবাদ পাইয়া ক্লাইব অকস্মাৎ আক্রমণ করিয়া নবাবকে হত অথবা বন্দী করার জন্যই এই আক্রমণ করিয়াছিলেন। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে কুয়াসায় পথ ভুল করিয়া নবাবের তাঁবুতে পৌঁছিতে অনেক দেরী হইল এবং নবাব এই সুযোগে ঐ তবু ত্যাগ করিয়া গেলেন।

এই নৈশ আক্রমণের ফলে ইংরেজরা যে সব দাবি করিয়াছিল নবাব তাহা সকলই মানিয়া লইয়া তাহাদের সহিত সন্ধি করিলেন (৯ই ফেব্রুয়ারী, ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দ)। নবাবের সৈন্যসংখ্যা ৪৫,০০০ ও কামান ইংরেজদের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। তথাপি তিনি এইরূপ হীনতা স্বীকার করিয়া ইংরেজদের সহিত সন্ধি করিলেন কেন ইহার কোন সুসঙ্গত কারণ খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। তবে দুইটি ঘটনা নবাবকে অত্যন্ত বিচলিত করিয়াছিল। প্রথমত, এই সময়ে সংবাদ আসিয়াছিল যে আফগানরাজ আহমদ শাহ আবদালী দিল্লি, আগ্রা, মথুরা প্রভৃতি বিধ্বস্ত করিয়া বিহার ও বাংলা দেশের দিকে অগ্রসর হইতেছে। ইহাতে নবাব অতিশয় ভীত হইলেন এবং যে কোন উপায়ে ইংরেজদের সহিত মিত্রতা স্থাপন করিতে সঙ্কল্প করিলেন।

দ্বিতীয়ত, নবাবের কর্মচারী ও পরামর্শদাতারা প্রায় সকলেই সন্ধি করিতে উপদেশ দিলেন। ইহারা নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করিতেছিলেন এবং সম্ভবত নবাব তাঁহার কিছু কিছু আভাসও পাইয়াছিলেন। কারণ যাহাই হউক, এই সন্ধির ফলে নবাবের প্রতিপত্তি অনেক কমিয়া গেল এবং ইংরেজের শক্তি, প্রতিপত্তি ও ঔদ্ধত্য যে অনেক বাড়িয়া গেল, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। কতকটা ইহারই ফলে রাজ্যের প্রধান প্রধান ব্যক্তিগণ তাহাকে সিংহাসনচ্যুত করিবার জন্য ষড়যন্ত্র আরম্ভ করিলেন।

সিরাজ নবাব হইয়া সেনাপতি মীরজাফর ও দিওয়ান রায়দুর্লভকে পদচ্যুত করেন এবং জগৎশেঠকে প্রকাশ্যে অপমানিত করেন। এই তিন জনই ছিলেন সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের প্রধান উদ্যোক্তা। সিরাজের বিরুদ্ধে ঘসেটি বেগমের যথেষ্ট আক্রোশের কারণ ছিল–সুতরাং তিনিও অর্থ দিয়া ইহাদের সাহায্য করিতে প্রস্তুত হইলেন। উমিচাঁদ নামক একজন ধনী বণিক সিরাজের বিশ্বাসভাজন ছিলেন। তিনিও ষড়যন্ত্রে যোগ দিলেন।

এই সময় ইউরোপে ইংলণ্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে যুদ্ধ আরম্ভ হইল। ইংরেজরা ফরাসীদের প্রধান কেন্দ্র চন্দননগর অধিকার করিয়া বাংলার ফরাসী শক্তি নির্মূল করিতে মনস্থ করিল। সিরাজউদ্দৌলা ইহাতে আপত্তি করিলেন এবং হুগলির ফৌজদার নন্দকুমারকে ইংরেজরা চন্দননগর আক্রমণ করিলে তাহাদিগকে বাধা দিতে আদেশ করিলেন। উমিচাঁদ ইংরেজদের পক্ষ হইতে ঘুষ দিয়া নন্দকুমারকে হাত করিলেন এবং ক্লাইব চন্দননগর অধিকার করিলেন (২৩শে মার্চ, ১৭৫৭ খ্রী)।

এই সময় হইতে সিরাজদ্দৌলার চরিত্রে ও আচরণে গুরুতর পরিবর্তন লক্ষিত হয়। তিনি ক্লাইবকে ভয় দেখাইয়াছিলেন যে ফরাসীদের বিরুদ্ধে ইংরেজরা যুদ্ধ করিলে তিনি নিজে ইংরেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করিবেন। ক্লাইব তাহাতে বিচলিত না হইয়া চন্দননগর আক্রমণ করিলেন। চন্দননগর আক্রমণের সময় রায়দুর্লভ, মাণিকচাঁদ ও নন্দকুমারের অধীনে প্রায় বিশ হাজার সৈন্য ছিল। তাঁহারা কোন বাধা দিলেন না এবং নবাবও ইহার জন্য কোন কৈফিয়ৎ তলব করিলেন না। তিনি নিজে তো ইংরেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করিলেনই না, বরং চন্দননগরের পতন হইলে ক্লাইবকে অভিনন্দন জানাইলেন। তারপর ক্লাইব যখন নবাবকে অনুরোধ করিলেন যে পলাতক ফরাসীদের ও তাহাদের সমস্ত সম্পত্তি ইংরেজদের হাতে দিতে হইবে, তখন তিনি প্রথমত ঘোরতর আপত্তি করিলেন এবং কাশিমবাজারের ফরাসী কুঠির অধ্যক্ষ জ্যাঁ ল সাহেবকে অনুচরসহ সাদর অভ্যর্থনা করিয়া আশ্রয় দিলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত তিনি তাঁহার বিশ্বাসঘাতক অমাত্যদের পরামর্শে জঁ ল সাহেবকে বিদায় দিলেন। সম্ভবত ইহার অন্য কারণও ছিল। সিরাজ জানিতেন যে ফরাসীরা দাক্ষিণাত্যে নিজামের রাজ্যে কর্ত্তা হইয়া বসিয়াছেন। বাংলা দেশে যাহাতে ইংরেজ বা ফরাসী কোন পক্ষই ঐরূপ প্রভুত্ব করিতে না পারে, তাঁহার জন্য তিনি ইহাদের একটির সাহায্যে অপরটিকে দমনে রাখিবার চেষ্টা করিতেছিলেন। এইজন্য তিনি যখন শুনিলেন যে ফরাসী সেনাপতি বুসী দাক্ষিণাত্য হইতে একদল সৈন্য লইয়া বাংলার অভিমুখে যাত্রা করিয়াছেন, তখন তিনি ইংরেজ কোম্পানীর সাহায্য প্রার্থনা করেন। আবার ইংরেজ যখন ফরাসীদের চন্দননগর অধিকার করিল, তখন তিনি ক্রুদ্ধ হইয়া একদল সৈন্য পাঠাইলেন এবং বুসীকে দুই হাজার সৈন্য পাঠাইতে লিখিলেন। এই সময়ে (১০ই মে, ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দ) পেশোয়া বালাজী রাও ইংরেজ কোম্পানীর কলিকাতার গভর্নরকে লিখিলেন যে তিনি ইংরেজকে ১,২০,০০০ সৈন্য দিয়া সাহায্য করিবেন এবং বাংলা দেশকে দুই ভাগ করিয়া ইংরেজ ও পেশোয়া এক এক ভাগ দখল করিবেন। ক্লাইব সিরাজকে ইহা জানাইলে তিনি ইংরেজের প্রতি খুশী হইয়া সৈন্য ফিরাইয়া আনিলেন।

বেশ বুঝা যায় যে ইহার পূর্বেই সিরাজের বিরুদ্ধে গুরুতর ষড়যন্ত্র চলিতেছিল এবং ষড়যন্ত্রকারীরা ইংরেজের সহায়তায় সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত করিবার জন্য তাঁহাদের স্বার্থ অনুযায়ী নবাবকে পরামর্শ দিতেছিলেন। সিরাজ কূটরাজনীতি এবং লোকচরিত্র এই উভয় বিষয়েই অনভিজ্ঞ ছিলেন। যদিও মীরজাফরকে তিনি সন্দেহ করিতেন, তথাপি তাহাকে বন্দী করিতে সাহস করিতেন না। নবাব একবার ক্রুদ্ধ হইয়া মীরজাফরকে লাঞ্ছিত করিতেন আবার তাঁহার স্তোকবাক্যে ভুলিয়া তাঁহার সহিত আপোষ করিতেন। রায়দুর্লভ, উমিচাঁদ প্রভৃতি বিশ্বাসঘাতকদের কথায় তিনি ফরাসীদের বিদায় করিয়া দিলেন অর্থাৎ একমাত্র যাহারা তাঁহাকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সাহায্য করিতে পারিত তাহাদিগকে দূর করিয়া দিয়া তিনি চক্রান্তকারীদের সাহায্য করিলেন।

সিরাজের অস্থিরমতিত্ব, অদূরদর্শিতা, লোকচরিত্রে অভিজ্ঞতা প্রভৃতি ছাড়াও তাঁহার চরিত্রে আরও অনেক দোষ ছিল। তাঁহাকে সিংহাসনচ্যুত করিবার জন্য যাহারা ষড়যন্ত্র করিয়াছিল, তাহাদের বিচার করিবার পূর্বে সিরাজের চরিত্রসম্বন্ধে আলোচনা করা প্রয়োজন। এ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ পরস্পরবিরোধী মত দেখিতে পাওয়া যায়। ইংরেজ ঐতিহাসিকরা তাঁহার চরিত্রে বহু কলঙ্ক কালিমা লেপন করিয়াছে। ইহা যে অন্তত কতক পরিমাণে সিরাজের প্রতি তাহাদের বিশ্বাসঘাতকতার সাফাই-স্বরূপ লিখিত, তাহা অনায়াসেই অনুমান করা যাইতে পারে। সমসাময়িক ঐতিহাসিক সৈয়দ গোলাম হোসেন লিখিয়াছেন যে সিরাজের চপলমতিত্ব, দুশ্চরিত্রতা, অপ্রিয় ভাষণ ও নিষ্ঠুরতার জন্য সভাসদেরা সকলেই তাঁহার প্রতি অসন্তুষ্ট ছিল। এই বর্ণনাও কতকটা পক্ষপাতদুষ্ট হইতে পারে। কিন্তু বাংলা দেশের কবি নবীনচন্দ্র সেন তাঁহার ‘পলাশীর যুদ্ধ’ কাব্যে সিরাজের যে কলঙ্কময় চিত্র আঁকিয়াছেন তাহাও যেমন অতিরঞ্জিত, ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় এবং নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ সিরাজউদ্দৌলাকে যে প্রকার স্বদেশবৎসল ও মহানুভব বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন, তাহাও ঠিক তদ্রূপ। সিরাজের চরিত্রের বিরুদ্ধে বহু কাহিনী এদেশে প্রচলিত আছে তাহাও নির্বিচারে গ্রহণ করা যায় না। কিন্তু ফরাসী অধ্যক্ষ জঁ ল সিরাজের বন্ধু ছিলেন, সুতরাং তিনি সিরাজের সম্বন্ধে যাহা লিখিয়াছেন, তাহা একেবারে অগ্রাহ্য করা যায় না। তিনি এ-সম্বন্ধে যাহা লিখিয়াছেন তাঁহার সারমর্ম এই : “আলীবর্দীর মৃত্যুর পূর্বেই সিরাজ অত্যন্ত দুশ্চরিত্র বলিয়া কুখ্যাত ছিলেন। তিনি যেমন কামাসক্ত তেমনই নিষ্ঠুর ছিলেন। গঙ্গার ঘাটে যে সকল হিন্দু মেয়েরা স্নান করিতে আসিত তাহাদের মধ্যে সুন্দরী কেহ থাকিলে সিরাজ তাঁহার অনুচর পাঠাইয়া ছোট ডিঙ্গিতে করিয়া তাহাদের ধরিয়া আনিতেন। লোক-বোঝাই ফেরী নৌকা ডুবাইয়া দিয়া জলমগ্ন পুরুষ, স্ত্রী ও শিশুদের অবস্থা দেখিয়া সিরাজ আনন্দ অনুভব করিতেন। কোন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে বধ করিবার প্রয়োজন হইলে আলীবর্দী একাকী সিরাজের হাতে ইহার ভার দিয়া নিজে দূরে থাকিতেন, যাহাতে কোন আর্তনাদ তাঁহার কানে না যায়। সিরাজের ভয়ে সকলের অন্তরাত্মা কাঁপিত ও তাঁহার জঘন্য চরিত্রের জন্য সকলেই তাঁহাকে ঘৃণা করত।”

সুতরাং সিরাজের কলুষিত চরিত্রই যে তাঁহার প্রতি লোকের বিমুখতার অন্যতম কারণ, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। তবে ষড়যন্ত্রকারীদের অধিকাংশ প্রধানত ব্যক্তিগত কারণেই সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত করিবার ষড়যন্ত্র করিয়াছিলেন। এরূপ ষড়যন্ত্র নূতন নহে। সতের বৎসর পূর্বে আলীবর্দী এইরূপ ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া বাংলার নবাব হইয়াছিলেন। সিরাজউদ্দৌলা নিজের দুষ্কৃতি ও মাতামহের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করিলেন।

সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত করিবার গোপন পরামর্শ মুর্শিদাবাদে অনেক দিন হইতেই চলিতেছিল। প্রথমে স্থির হইয়াছিল যে নবাবের একজন সেনানায়ক ইয়ার লতিফকে সিরাজের পরিবর্তে নবাব করা হইবে। লতিফ ইংরেজদের সাহায্য লাভের জন্য গোপনে দূত পাঠাইলেন। ইংরেজরা এই প্রস্তাব সানন্দে গ্রহণ করিল, কারণ তাহাদের বরাবর বিশ্বাস ছিল যে সিরাজ ইংরেজের শত্রু। সিরাজ ফরাসীদের সহিত মিলিত হইয়া ইংরেজকে বাংলা দেশ হইতে তাড়াইবেন, ইংরেজদের সর্বদাই এই ভয় ছিল। সিরাজ তাহাদিগকে খুশি করিবার জন্য আশ্রিত জ্যাঁ ল সাহেবকে বিদায় দিয়াছিলেন। কিন্তু ইংরেজরা তাহাতেও সন্তুষ্ট না হইয়া ল সাহেবের বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠাইল। সিরাজ ক্রোধান্ধ হইয়া ইহার তীব্র প্রতিবাদ করিলেন এবং পলাশীতে একদল সৈন্য পাঠাইলেন। এই ঘটনায় ইরেজদের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মিল যে সিরাজের রাজত্বে তাহারা বাংলায় নিরাপদে বাণিজ্য করিতে পারিবে না। সুতরাং সিরাজকে তাড়াইয়া ইংরেজের অনুগত কোন ব্যক্তিকে নবাব করিতে পারিলে তাহারা বাংলা দেশে প্রতিপত্তি লাভ করিতে পারিবে। ইংরেজদের এই মনোভাব জানিতে পারিয়া মীরজাফর স্বয়ং নবাব পদের প্রার্থী হইলেন। তিনি নবাবের সেনাপতি; সুতরাং তিনিই ইংরেজদিগকে বেশী সাহায্য করিতে পারিবেন, এইজন্য ইংরেজরাও তাঁহাকে মনোনীত করিল।

নবীনচন্দ্র সেন তাঁহার ‘পলাশীর যুদ্ধ’ কাব্যের প্রথম সর্গে এই ষড়যন্ত্রের যে চিত্র আঁকিয়াছেন, তাঁহার কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নাই। সাত আটজন সন্ত্রাস্ত ব্যক্তি রাত্রিযোগে সম্মিলিত হইয়া অনেক বাদানুবাদের পর অবশেষে সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত করিবার প্রস্তাব গ্রহণ করিলেন, ইহা সর্বৈব মিথ্যা। রানী ভবানী, কৃষ্ণচন্দ্র ও রাজবল্লভের মুখে নবীনচন্দ্র বড় বড় বক্তৃতা দিয়াছেন, কিন্তু তাঁহারা এ ষড়যন্ত্রে একবারেই লিপ্ত ছিলেন না। প্রধানত মীরজাফর ও জগৎশেঠ কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠির অধ্যক্ষ ওয়াটস্ সাহেবের মারফৎ কলিকাতার ইংরেজ কাউনসিলের সঙ্গে এই বিষয়ে আলাপ করেন। উমিচাঁদ আর রায়দুর্লভও ষড়যন্ত্রের বিষয় জানিতেন এবং ইহার পক্ষপাতী ছিলেন। ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দের ১লা মে কলিকাতার ইংরেজ কমিটি অনেক বাদানুবাদ ও আলোচনার পর মীরজাফরের সঙ্গে গোপন সন্ধি করা স্থির করিল এবং সন্ধির শর্তগুলি ওয়াটস্ সাহেবের নিকট পাঠানো হইল। সন্ধির শর্তগুলি মোটামুটি এই :

১। ফরাসীদিগকে বাংলা দেশ হইতে তাড়াইতে হইবে।

২। সিরাজউদ্দৌলার কলিকাতা আক্রমণের ফলে কোম্পানীর ও কলিকাতায় অধিবাসীদের যাহা ক্ষতি হইয়াছিল, তাহা পূরণ করিতে হইবে। ইহার জন্য কোম্পানীকে এক কোটি, ইংরেজ অধিবাসীদিগকে পঞ্চাশ লক্ষ ও অন্যান্য অধিবাসীদিগকে সাতাশ লক্ষ টাকা দিতে হইবে।

৩। সিরাজউদ্দৌলার সহিত সন্ধির সব শর্ত এবং পূর্বেকার নবাবদের ফরমানে ইংরেজ বণিকদিগকে যে সমুদয় সুবিধা দেওয়া হইয়াছিল, তাহা বলবৎ থাকিবে।

৪। কলিকাতার সীমানা ৬০০ গজ বাড়ানো হইবে এবং এই বৃহত্তর কলিকাতার অধিবাসীরা সর্ববিষয়ে কোম্পানীর শাসনাধীন হইবে। কলিকাতা হইতে দক্ষিণে কুলপি পর্যন্ত ভূখণ্ডে ইংরেজ জমিদার-স্বত্ব লাভ করিবে।

৫। ঢাকা ও কাশিমবাজারে কুঠি ইংরেজ কোম্পানী ইচ্ছামত সুদৃঢ় করিতে এবং সেখানে যত খুশী সৈন্য রাখিতে পারিবে।

৬। সুবে বাংলাকে ফরাসী ও অন্যান্য শত্রুদের আক্রমণ হইতে রক্ষা করিবার জন্য কোম্পানী উপযুক্ত সংখ্যক সৈন্য নিযুক্ত করিবে এবং তাঁহার ব্যয় নির্বাহের জন্য পর্যাপ্ত জমি কোম্পানীকে দিতে হইবে।

৭। কোম্পানীর সৈন্য নবাবকে সাহায্য করিবে। যুদ্ধের অতিরিক্ত ব্যয়ভার নবাব দিতে বাধ্য থাকিবেন।

৮। কোম্পানীর একজন দূত নবাবের দরবারে থাকিবেন, তিনি যখনই প্রয়োজন বোধ করিবেন নবাবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে পারিবেন এবং তাহাকে যথোচিত সম্মান দেখাইতে হইবে।

৯। ইংরেজের মিত্র ও শত্রুকে নবাবের মিত্র ও শত্রু বলিয়া পরিগণিত করিতে হইবে।

১০। হুগলির দক্ষিণে গঙ্গার নিকটে নবাব কোন নূতন দুর্গ নির্মাণ করিতে পারিবেন না।

১১। মীরজাফর যদি উপরোক্ত শর্তগুলি পালন করিতে স্বীকৃত হন, তবে ইংরেজরা তাঁহাকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার সুবাদার পদে প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য যথাসাধ্য সাহায্য করিবে।

সন্ধি স্বাক্ষরিত হইবার পূর্বে উমিচাঁদ বলিলেন যে মুর্শিদাবাদের রাজকোষে যত টাকা আছে তাঁহার শতকরা পাঁচ ভাগ তাঁহাকে দিতে হইবে নচেৎ তিনি এই গোপন সন্ধির কথা নবাবকে বলিয়া দিবেন। তাঁহাকে নিরস্ত করার জন্য এক জাল সন্ধি প্রস্তুত হইল, তাহাতে ঐরূপ শর্ত থাকিল–কিন্তু মূল সন্ধিতে সেরূপ কোন শর্ত রহিল না। ওয়াটসন এই জাল সন্ধি স্বাক্ষর করিতে রাজী না হওয়ায় ক্লাইব নিজে ওয়াটসনের নাম স্বাক্ষর করিলেন।

যতদিন এইরূপ ষড়যন্ত্র চলিতেছিল ততদিন ক্লাইব বন্ধুত্বের ভান করিয়া নবাবকে চিঠি লিখিতেন, যাহাতে নবাবের মনে কোন সন্দেহ না হয়। কিন্তু মীরজাফর কোরান-শপথ করিয়া সন্ধির শর্ত পালন করিবেন এই প্রতিশ্রুতি পাইয়া ক্লাইব নিজ মূর্ত্তি ধারণ করিলেন। নবাবও মীরজাফরের ষড়যন্ত্রের বিষয় কিছু কিছু জানিতে পারিলেন এবং তাঁহাকে বন্দী করিতে মনস্থির করিয়া একদল সৈন্য ও কামানসহ মীরজাফরের বাড়ি ঘেরাও করিলেন। মীরজাফর ক্লাইবকে এই বিপদের সংবাদ জানাইয়া লিখিলেন যে তিনি যেন অবিলম্বে যুদ্ধযাত্রা করেন। মীরজাফর গোপনে ওয়াটসকে লিখিলেন তিনি যেন অবিলম্বে মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করেন। ওয়াটস্ এই চিঠি পাইয়া ১৩ই জুন অনুচরসহ মুর্শিদাবাদ হইতে চলিয়া গেলেন। ক্লাইবও মীরজাফরের চিঠি পাইয়া নবাবকে ঐ তারিখে চিঠি লিখিয়া জানাইলেন যে তাঁহার সহিত ইংরেজদের যে সকল বিষয়ে বিরোধ আছে, নবাবের পাঁচ জন কর্মচারীর উপর তাঁহার মীমাংসার ভার দেওয়া হউক এবং এই উদ্দেশ্যসাধনের জন্য তিনি সসৈন্যে মুর্শিদাবাদ যাত্রা করিতেছেন। তিনি যে পাঁচজন কর্মচারীর নাম করিলেন, তাহারা সকলেই বিশ্বাসঘাতক এবং ইংরেজের পক্ষভুক্ত। এই চিঠি পাইয়া এবং ওয়ার্টসের পলায়নের সংবাদ পাইয়া সিরাজ ইংরেজের প্রকৃত মনোভাব বুঝিতে পারিলেন। এবং এতদিন পরে মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতা সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হইলেন। মোহনলাল, মীরমদন প্রভৃতি বিশ্বস্ত অনুচরেরা পরামর্শ দিল যে মীরজাফরকে অবিলম্বে হত্যা করা হউক। বিশ্বাসঘাতক কর্মচারীরা নবাবকে মীরজাফরের সহিত মিটমাট করিবার উপদেশ দিলেন। এই বিষম সঙ্কটের সময় সিরাজ তাঁহার অস্থিরমতিত্ব, কূট রাজনীতিজ্ঞান ও দূরদর্শিতার অভাব এবং লোকচরিত্র সম্বন্ধে অনভিজ্ঞতার চূড়ান্ত প্রমাণ দিলেন। মীরজাফরের বাড়ি ঘেরাও করিয়া তিনি তাঁহাকে পরম শত্রুতে পরিণত করিয়াছিলেন। অকস্মাৎ তিনি ভাবিলেন যে অনুনয় বিনয় করিয়া মীরজাফরকে নিজের পক্ষে আনিতে পারা যাইবে। মীরজাফরের বাড়ির চারিদিকে তিনি যে কামান ও সৈন্য পাঠাইয়াছিলেন তাহা ফিরাইয়া আনিয়া তিনি পুনঃ পুনঃ মীরজাফরকে সাক্ষাতের জন্য ডাকিয়া পাঠাইলেন। যখন মীরজাফর কিছুতেই নবাবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিলেন না, তখন নবাব সমস্ত মানমর্যাদা বিসর্জন দিয়া স্বয়ং মীরজাফরের বাটীতে গমন করিলেন। মীরজাফর কোরান স্পর্শ করিয়া নিম্নলিখিত তিনটি শর্তে নবাবের পক্ষে থাকিতে রাজী হইলেন :

১। সমূহ বিপদ কাটিয়া গেলে মীরজাফর নবাবের অধীনে চাকুরী করিবেন না।

২। তিনি দরবারে যাইবেন না।

৩। আসন্ন যুদ্ধে তিনি কোন সক্রিয় অংশ গ্রহণ করিবেন না।

আশ্চর্যের বিষয় এই যে, সিরাজ এই সমুদয় শর্ত মানিয়া লইলেন এবং উপরোক্ত তৃতীয় শর্তটি সত্ত্বেও মীরজাফরকেই সেনাপতি করিয়া তাঁহার অধীনে এক বিপুল সৈন্যদলসহ যুদ্ধযাত্রা করিলেন। পলাশির প্রান্তরে ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দের ২২শে জুন তারিখে ইংরেজ সেনাপতি ক্লাইব ও নবাবের সৈন্য পরস্পরের সম্মুখীন হইল। ক্লাইবের সৈন্যসংখ্যা ছিল মোট তিন হাজার-২২০০ সিপাহী, ৮০০ ইউরোপীয়ান–পদাতিক ও গোলন্দাজ। নবাবের মোট সৈন্য ছিল ৫০,০০০ ১৫,০০০ অশ্বারোহী এবং ৩৫,০০০ পদাতিক। নবাবের মোট ৫৩টি কামান ছিল। সিষ্ট্রে নামক একজন ফরাসী সেনানায়কের অধীনেও কয়েকটি কামান ছিল। মোহনলাল ও মীরমদনের অধীনে ৫,০০০ অশ্বারোহী ও ৭,০০০ পদাতিক সৈন্য ছিল। ২৩শে জুন প্রাতঃকালে যুদ্ধ অরম্ভ হইল। নবাবের পক্ষে সিনফ্রে গোলাবর্ষণ আরম্ভ করিলেন। ইংরেজ সৈন্যও গোলাবর্ষণ করিল এবং আম্রকাননের অন্তরালে আশ্রয় গ্রহণ করিল। ইহাতে উৎসাহিত হইয়া সিনফ্রে, মোহনলাল ও মীরমদন তাঁহাদের সৈন্য লইয়া ইংরেজ সৈন্য আক্রমণ করিলেন। মীরজাফর, ইয়ার লতিফ ও রায়দুর্লভের অধীনস্থ বৃহং সৈন্যদল দর্শকের ন্যায় চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া ছিল। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও নবাবের ক্ষুদ্র সেনাদলে বীরবিক্রমে অগ্রসর হইয়া ইংরেজ সৈন্যদের বিপন্ন করিয়া তুলিল। এই সময় অকস্মাৎ একটি গোলার আঘাতে মীরমদনের মৃত্যু হইল। ইহাতে নবাব অতিশয় বিচলিত ও মতিচ্ছন্ন হইয়া মীরজাফরকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। মীরজাফর প্রথমে আসেন নাই, কিন্তু পুনঃ পুনঃ আহ্বানের ফলে সশস্ত্র দেহরক্ষী সহ নবাবের শিবিরে আসিলেন। নবাব দীনভাবে নিজের পাগড়ী খুলিয়া মীরজাফরের সম্মুখে রাখিলেন এবং আলীবর্দীর উপকারের কথা স্মরণ করাইয়া নিজের প্রাণ ও মান রক্ষার জন্য মীরজাফরের নিকট করুণ নিবেদন জানাইলেন। মীরজাফর আবার কোরান স্পর্শ করিয়া নবাবকে অভয় দিলেন এবং বলিলেন “সন্ধ্যা আগতপ্রায়–আজ আর যুদ্ধের সময় নাই। আপনি মোহনলালকে ফিরিয়া আসিতে আজ্ঞা করুন। কাল প্রাতে আমি সমস্ত সৈন্য লইয়া ইংরেজ সৈন্য আক্রমণ করিব।” নবাব মোহনলালকে ফিরিতে আদেশ দিলেন। মোহনলাল ইহাতে অত্যন্ত আশ্চর্য বোধ করিয়া বলিয়া পাঠাইলেন যে “এখন ফিরিয়া যাওয়া কোনক্রমেই সঙ্গত নহে। এখন ফিরিলেই সমস্ত সৈন্য হতাশ হইয়া পলাইতে আরম্ভ করিবে।” নবাবের তখন আর হিতাহিতজ্ঞান বা কোন রকম বুদ্ধি বিবেচনা ছিল না। তিনি মীরজাফরের দিকে চাহিলেন। মীরজাফর বলিলেন, “আমি যাহা ভাল মনে করি তাহা বলিয়াছি, এখন আপনার যেরূপ বিবেচনা হয় সেইরূপ করুন।” নির্বোধ নবাব মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার স্পষ্ট প্রমাণ পাইয়াও তাঁহার মতই গ্রহণ করিলেন, একমাত্র বিশ্বস্ত অনুচর মোহনলালের উপদেশ গ্রাহ্য করিলেন না। তিনি পুনঃ পুনঃ মোহনলালকে ফিরিবার আদেশ পাঠাইলেন। মোহনলাল অগত্যা ফিরিতে বাধ্য হইলেন। … ….

এই সমুদয় বিদ্রোহ থামিতে না থামিতেই মীরজাফরের সৈন্যদল বিদ্রোহ করিল। তাহাদের অনেক বেতন বাকী ছিল সুতরাং তাহারা পুনঃ পুনঃ ইহা পরিশোধ করিবার জন্য নবাবের নিকট আবেদন করিল। নবাব ক্রুদ্ধ হইয়া অনেক সৈন্য বরখাস্ত করিলেন। ইহার ফলে সৈন্যরা তাঁহার প্রাসাদ অবরোধ করিল। নবাবের দুর্ব্যবহারে বিহারের দুইজন জমিদার সুন্দর সিংহ ও বলবন্ত সিংহ বিদ্রোহ করিলেন।

ইতিমধ্যে আর এক গুরুতর সংকট উপস্থিত হইল। এই সময়ে দিল্লির সাম্রাজ্য নামেমাত্র পর্যবসিত হইয়াছিল। দিল্লির নামসর্বস্ব বাদশাহ দ্বিতীয় আলমগীর মাত্র দিল্লি ও তাঁহার চতুর্দিকে সামান্য ভূখণ্ডে রাজত্ব করিতেন কিন্তু প্রকৃত ক্ষমতা ছিল তাঁহার উজীরের হস্তে। ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দের জানুয়ারী মাসে আফগান সুলতান আহমদ শাহ আবদালী দিল্লি আক্রমণ করিলেন এবং উজীর গাজীউদ্দীন ইমাদ্-উল-মুলক আত্মসমর্পণ করিলেন (জানুয়ারী, ১৭৫৭ খ্রী)। আবদালী রুহেলা নায়ক নাজীবউদ্দৌল্লাকে দিল্লিতে তাঁহার প্রতিনিধি হিসাবে রাখিয়া প্রস্থান করিলেন। পূর্বেই বলা হইয়াছে যে আবদালীর এই আক্রমণে ভীত হইয়াই সিরাজউদ্দৌলা ইংরেজদিগের সহিত ফেব্রুয়ারী মাসে সন্ধি করিয়াছিলেন।

আবদালীর প্রস্থানের পরই মারাঠাগণ দিল্লি আক্রমণ করিল (অগস্ট, ১৭৫৭ খ্রী) এবং নাজীবউদ্দৌল্লাকে সরাইয়া আবার গাজীউদ্দীনকে উজীর নিযুক্ত করিল। গাজীউদ্দীন বাদশাহ ও তাঁহার পুত্র (বাদশাহজাদা) উভয়ের সঙ্গেই খুব দুর্ব্যবহার করিতেন। তাঁহার হাত হইতে পরিত্রাণ লাভের জন্য বাদশাহজাদা দিল্লি হইতে পলায়ন করিয়া নাজীবউদ্দৌল্লার আশ্রয় গ্রহণ করিলেন (মে, ১৭৫৮ খ্রীষ্টাব্দ)। বাদশাহ দ্বিতীয় আলমগীর তাঁহার পুত্রকে বাংলা বিহার ও উড়িষ্যার সুবাদার নিযুক্ত করিয়াছিলেন। বাংলার নবাব পরিবর্তন এবং আভ্যন্তরিক অসন্তোষ ও বিদ্রোহের সুযোগে অকর্মণ্য মীরজাফরকে পদচ্যুত করিয়া বাংলার মসনদে বাদশাহজাদাকে বসাইবার জন্য এলাহাবাদের সুবাদার মুহম্মদ কুলী খান ও অযোধ্যার নবাব শুজাউদ্দৌল্লা বাদশাহজাদাকে সম্মুখে রাখিয়া বিহার আক্রমণ করিতে মনস্থ করিলেন। পূর্ব্বোক্ত বিহারের বিদ্রোহী জমিদার দুইজনও তাঁহাদের সঙ্গে যোগ দিলেন।

এই আক্রমণের সংবাদে মীরজাফর অত্যন্ত বিচলিত হইলেন, কারণ তাঁহার সৈন্যেরা পূর্ব হইতেই বিদ্রোহী ছিল। শাহজাদার সংবাদ শুনিয়া জমিদারদের মধ্যে অনেকেই তাঁহার সঙ্গে যোগ দিতে মনস্থ করিল। নবাব অনন্যোপায় হইয়া সোনা রূপার তৈজসপত্র বিক্রয় করিয়া সৈন্যগণের বাকী বেতন কতকটা শোধ করিলেন এবং ইংরেজ সৈন্যের সাহায্য প্রার্থনা করিলেন। শাহজাদাও ক্লাইবের সাহায্য প্রার্থনা করিলেন। ইতিমধ্যে বাদশাহ উজীরের চাপে পড়িয়া শাহজাদার পরিবর্তে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার অন্য সুবাদার নিযুক্ত করিলেন এবং মীরজাফরকে আদেশ দিলেন যেন অবিলম্বে শাহজাদাকে আক্রমণ ও বন্দী করেন। শাহজাদা পাটনা দুর্গ আক্রমণ করিয়াছিলেন (মার্চ, ১৭৫৯ খ্রীষ্টাব্দ)। কিন্তু ক্লাইবের হস্তে তিনি পরাজিত হইলেন। তখন শাহজাদা ইংরেজের নিকট কিছু অর্থ সাহায্য চাহিলেন। ক্লাইব তাঁহাকে দশহাজার টাকা দিলে তিনি বিহার ছাড়িয়া চলিয়া গেলেন। দিল্লির উজীর শাহজাদার পরাজয়ে খুশী হইয়া বাংলায় মীরজাফরের কর্তৃত্ব অনুমোদন করিলেন এবং মীরজাফরের অনুরোধে ক্লাইবকে একটি সম্মানসূচক পদবী দিলেন। মীরজাফরও ক্লাইবকে এই পদের উপযুক্ত জায়গীর প্রদান করিলেন।

এই যুদ্ধে মীরজাফরের পুত্র মীরন নবাব-সেনার নায়ক ছিলেন। মীরন কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মচারীর প্রতি দুর্ব্যবহার করায় তাঁহারা মীরনের প্রস্থানের পরই কয়েকজন জমিদারের সঙ্গে একযোগে বিদ্রোহ করিয়া শাহজাদাকে আবার বিহার আক্রমণের জন্য আমন্ত্রণ করিলেন। এই আমন্ত্রণ পাইয়া ১৭৫৯ খ্রীষ্টাব্দের অক্টোবর মাসের শেষভাগে শাহজাদা আবার বিহার আক্রমণ করিবার উদ্দেশ্যে যাত্রা করিলেন। শোন নদের নিকট পৌঁছিয়া তিনি সংবাদ পাইলেন যে তাঁহার। পিতা উজীর কর্ত্তৃক নিহত হইয়াছেন। অমনি তিনি দ্বিতীয় শাহ আলম নামে নিজেকে সম্রাট বলিয়া ঘোষণা করিলেন এবং অযোধ্যার নবাব শুজাউদ্দৌল্লাকে উজীর নিযুক্ত করিলেন। তিনি অভিষেকের আমোদ-উৎসবে বহু সময় কাটাইলেন। এই অবসরে পাটনায় রামনারায়ণ দুর্গ রক্ষার বন্দোবস্ত শেষ করিলেন এবং ক্যাইলোডের অধীনে একদল ইংরেজ সৈন্য পাটনায় পৌঁছিল। ইংরেজ সৈন্য পৌঁছিবার পূর্বেই রামনারায়ণ বাদশাহী ফৌজকে আক্রমণ করিয়া পরাস্ত হইলেন (৯ই ফেব্রুয়ারী, ১৭৬০ খ্রী)। কিন্তু শাহ আলম পাটনার নিকট পৌঁছিলেও দুর্গ আক্রমণ করিতে ভরসা পাইলেন না এবং ২২শে ফেব্রুয়ারী ক্যাইলোডের হস্তে পরাস্ত হইয়া তিনি বিহার সহরে প্রস্থান করিলেন। অতঃপর শাহ আলম মুর্শিদাবাদ আক্রমণের জন্য কামগার খানের অধীনস্থ একদল অশ্বারোহী সৈন্য লইয়া পাহাড় ও জঙ্গলের মধ্য দিয়া অগ্রসর হইয়া বিষ্ণুপুর পৌঁছিলেন। এইখানে একদল মারাঠা সৈন্য তাঁহার সঙ্গে যোগ দিল। এই সময় মীরজাফরের নবাবীর শেষ অবস্থা এবং বাংলা দেশেরও চরম দুরবস্থা। সম্ভবত এই সকল সংবাদ শুনিয়াই শাহ আলম বাংলা দেশ আক্রমণ করিতে উৎসাহিত হইয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহার আশা পূর্ণ হইল না। তাঁহার কতক সৈন্য দামোদর নদ পার হওয়ার পরই ইংরেজ সৈন্যের সহিত তাহাদের একটি খণ্ডযুদ্ধ হইল (৭ই এপ্রিল, ১৭৬০ খ্রী)। শাহ আলম তখন তাড়াতাড়ি ফিরিয়া অরক্ষিত পাটনা দুর্গের সম্মুখে উপস্থিত হইলেন। কিন্তু ইংরেজ সৈন্য পাটনায় পৌঁছিলে (২৮শে এপ্রিল, ১৭৬০ খ্রী) বাদশাহ পাটনা ত্যাগ করিয়া রাণীসরাই নামক স্থানে উপস্থিত হইলেন। এখানে ফরাসী অধ্যক্ষ জ্যাঁ ল সাহেব তাঁহার সহিত যোগ দিলেন। কিন্তু হাজীপুরে ইংরেজ সৈন্য খাদিম হোসেনকে পরাজিত করিলে (১৯শে জুন) বাদশাহ ভগ্নমনোরথ হইয়া বিহার প্রদেশ হইতে প্রস্থান করিয়া যমুনা তীরে পৌঁছিলেন (অগস্ট, ১৭৬০ খ্রীষ্টাব্দ)।

বাদশাহ শাহ আলমের আক্রমণের সুযোগ লইয়া মারাঠা সেনানায়ক শিবভট্ট বৃহৎ একদল সৈন্যসহ কটক আক্রমণ করিলেন। ১৭৬০ খ্রীষ্টাব্দের আরম্ভে তিনি মেদিনীপুর অধিকার করিলেন। বীরভূমের জমিদারও তাঁহার সঙ্গে যোগ দিলেন। মীরজাফর তখন ইংরেজ সৈন্যের সাহায্য প্রার্থনা করিলেন। ইংরেজ সৈন্য অগ্রসর হইবামাত্র শিবভট্ট বিনা যুদ্ধে বাংলা দেশ হইতে প্রস্থান করিলেন।

এই সময়ে পূর্ণিয়ার নায়েব নাজিম খাদিম হোসেন খানও বিদ্রোহী হইয়া শাহ আলমের সঙ্গে যোগ দিবার জন্য অগ্রসর হইয়াছিলেন। মীরন ও ক্যাইলোড দুই সেনাদল লইয়া তাঁহাকে বাধা দানের জন্য অগ্রসর হইলেন। ১৬ই জুন খাদিম হোসেন খান পরাজিত হইয়া পলায়ন করিলেন এবং নবাবের সৈন্য তাঁহার পশ্চাদ্ধাবন করিল। কিন্তু ৩রা জুলাই অকস্মাৎ শিবিরে বজ্রাঘাতে মীরনের মৃত্যু হওয়ায় নবাবসৈন্য ফিরিয়া আসিল।

এইরূপে ১৭৬০ খ্রীষ্টাব্দে শাহ আলম ও শিবভট্টের আক্রমণ এবং খাদিম হোসেনের বিদ্রোহ বাংলা দেশকে ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলিয়াছিল। কিন্তু ইংরেজ সৈন্যের সহায়তায় মীরজাফর এই তিনটি বিপদ হইতেই উদ্ধার পাইলেন।

কিন্তু অচিরেই আর এক বিপদ উপস্থিত হইল। ইংরেজ ও ফরাসীদের ন্যায় ওলন্দাজরাও বাংলায় বাণিজ্য করিত এবং হুগলির নিকটবর্তী চুঁচুড়ায় তাহাদের বাণিজ্য-কুঠি ছিল। মীরজাফরকে নবাবী পদে প্রতিষ্ঠা করিয়া ইংরেজদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি বাড়িয়া যাওয়ায় ওলন্দাজেরা অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হইল এবং মীরজাফরকে নবাবের উপযুক্ত মর্যাদা দেখাইল না। নবাব ওলন্দাজ কর্তৃপক্ষের নিকট জবাবদিহি দাবি করিলেন। কিন্তু তাহারা ত্রুটি স্বীকার না করিয়া লম্বা এক দাবি-দাওয়ার ফর্দ পেশ করিল। ক্লাইবের পরামর্শমত নবাব ওলন্দাজদের বাণিজ্য বন্ধ করিবার পরওয়ানা বাহির করিবামাত্র ওলন্দাজরা মীরজাফরের প্রাপ্য সম্মান দিল।

কিন্তু ইংরেজদের সহিত ওলন্দাজদের গোলমাল মিটিল না। একে তো ইংরেজরা বিনা শুল্কে বাণিজ্যের বিশেষ সুবিধা পাইত, তারপর মীরজাফরের নিকট হইতে তাহারা আরও কতকগুলি অধিকার লাভ করিয়াছিল। ইহার বলে ওলন্দাজদের যত জাহাজ গঙ্গা দিয়া যাইত, ইংরজেরা তাহা খানাতল্লাসী করিত এবং ইংরেজ ভিন্ন অন্য কোন জাতির লোককে জাহাজের চালক (pilot) নিযুক্ত করিতে দিত না। ইহার ফলে ওলন্দাজদের বাণিজ্য অনেক কমিয়া যাইতে লাগিল। উপায়ান্তর না দেখিয়া ওলন্দাজরা ইংরেজের সঙ্গে যুদ্ধ করা স্থির করিল এবং এই উদ্দেশ্যে তাহাদের শক্তির প্রধান কেন্দ্র হইতে বহু সৈন্য আনাইবার ব্যবস্থা করিল। ১৭৫৯ খ্রীষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে ইউরোপীয় ও মলয় সৈন্য বোঝাই ছয় সাতখানি জাহাজ গঙ্গায় পৌঁছিল। মীরজাফর তখন কলিকাতায় ছিলেন। তিনি ওলন্দাজদিগকে বাংলা দেশ হইতে তাড়াইবার প্রস্তাব করিলেন। ইংরেজরা ইহাতে সম্মত হইল না, কারণ ইউরোপে ইংরেজ ও ওলন্দাজদের মধ্যে পূর্ণ শান্তি বিরাজ করিতেছিল। তাহারা নবাবকে অনুরোধ করিল যেন তিনি ওলন্দাজদিগকে ইংরেজদের বিরুদ্ধতা হইতে নিবৃত্ত করেন। তদনুসারে নবাব কলিকাতা হইতে মুর্শিদাবাদে যাইবার পথে হুগলি ও কুঁচুড়ার মাঝামাঝি এক জায়গায় দরবারের আয়োজন করিয়া ওলন্দাজদিগকে উপস্থিত হইতে আদেশ দিলেন। দরবারে ওলন্দাজ কর্তৃপক্ষেরা নবাবকে বুঝাইতে চেষ্টা করিল যে ইংরেজরাই তাঁহার দুর্বলতা ও দেশের দুর্দশার কারণ এবং তাঁহার অনুগ্রহ পাইলে তাহাকে তাহারা এই বিপদ হইতে উদ্ধার করিতে পারে। নবাবকে চুপ করিয়া থাকিতে দেখিয়া তাহারা ভরসা পাইল এবং প্রার্থনা করিল যে নবাব তাহাদিগের সেনাদলকে আসিতে দিবেন এবং ইংরেজরা যাহাতে কোন বাধা না দেয় তাহারা ব্যবস্থা করিবেন। নবাব ইহাতে আপত্তি করায় তাহারা বলিল যে সৈন্যবোঝাই জাহাজগুলি শীঘই ফেরৎ পাঠানো হইবে। ইহাতে খুশি হইয়া নবাব তাহাদিগকে সংবর্ধনা করিলেন এবং তাহাদের বাণিজ্যের সুবিধা করিয়া দিতে প্রতিশ্রুত হইলেন।

কিন্তু নবাব চলিয়া যাইবার পরই ওলন্দাজরা এমন ভাব দেখাইল যে নবাব তাহাদিগকে সৈন্যবোঝাই জাহাজ আনিতে অনুমতি দিয়াছেন। তাহারা জাহাজগুলি আনিবার ও নূতন সৈন্য সগ্রহের ব্যবস্থা করিতে লাগিল।

ইহাতে ইংরেজদের সন্দেহ হইল যে নবাব তলে তলে ওলন্দাজদের সহায়তা করিতেছিলেন। অনেক ইংরেজের দৃঢ় বিশ্বাস হইল যে নবাবই গোপনে ওলন্দাজদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করিয়া সৈন্য আনার ব্যবস্থা করিয়াছেন। ক্লাইবও নবাবকে এক কড়া চিঠি লিখিলেন যে ওলন্দাজদের সহিত মিত্ৰতা করিলে ভবিষ্যতে তিনি মীরজাফরের সহিত কোন সম্বন্ধ রাখিবেন না। নবাব প্রতিবাদ করিয়া জানাইলেন যে ইংরেজের সহিত বন্ধুত্বের প্রমাণ দিতে তিনি সর্বদাই প্রস্তুত আছেন। ক্লাইব তাঁহাকে সসৈন্যে ইংরাজদিগের সঙ্গে মিলিত হইবার আমন্ত্রণ করিলেন। নবাব লিখিলেন যে কলিকাতা হইতে মুর্শিদাবাদে যাতায়াতের ফলে তিনি বড় ক্লান্ত, সুতরাং নিজে না যাইয়া পুত্রকে পাঠাইবেন।

ইতিমধ্যে ওলন্দাজেরা ইংরেজদের সাতখানি জাহাজ আটক করিল এবং ফলতায় নামিয়া ইংরেজের নিশান ছিঁড়িয়া ফেলিয়া ঘর বাড়ী জ্বালাইয়া দিল। ক্লাইব ভাবিলেন যে নবাবের সহায়তা না থাকিলে ওলন্দাজেরা এতদূর সাহস করিত না। সুতরাং তিনি নবাবকে লিখিলেন যে তাঁহার পুত্র বা সৈন্য পাঠাইবার প্রয়োজন নাই। কিন্তু তিনি যদি সত্যসত্যই ইংরেজের বন্ধু হন তবে ওলন্দাজদিগের যেভাবে যতদূর সম্ভব অনিষ্ট করিবেন। নবাব তৎক্ষণাৎ রামনারায়ণকে আদেশ দিলেন যেন ওলন্দাজদের পাটনার কুঠি অবরোধ করা হয় এবং তাহাদের নানা ভাবে উৎপীড়ন করা হয়। তাঁহার পরামর্শদাতাদের অনেকেই তাঁহাকে ওলন্দাজদের বিরুদ্ধে যাইতে নিষেধ করিল, কিন্তু মীরজাফর তাহাদের কথায় কর্ণপাত করিলেন না এবং হুগলিতে ওলন্দাজদের বাণিজ্য বন্ধ করিবার জন্য ফৌজদারের নিকট পরওয়ানা পাঠাইলেন। ইংরেজরা ওলন্দাজদের বরাহনগরের কুঠি দখল করিলেন। তাহারা নবাবের নিকট নালিশ করিল, কিন্তু কোন ফল হইল না।

২১শে নভেম্বর, ১৭৫৯ খ্রীস্টাব্দে ওলন্দাজরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হইল এবং ৭০০ ইউরোপীয় এবং প্রায় ৮০০ মলয় সৈন্য জাহাজ হইতে নামাইল। ক্লাইব এই সংবাদ পাইয়া ফোর্ডের অধীনে একদল সৈন্য পাঠাইলেন। চন্দননগর ও চুঁচুড়ার মাঝামাঝি বেদারা নামক স্থানে দুই দলে যুদ্ধ হইল এবং অল্পক্ষণের মধ্যেই ওলন্দাজেরা সম্পূর্ণরূপে পরাস্ত হইয়া ২৫শে নভেম্বর বশ্যতা স্বীকার করিল।

তৎকালীন ইংরেজদের মধ্যে সকলেরই দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে মীরজাফর ওলন্দাজদের সঙ্গে গোপনে ষড়যন্ত্র করিয়াছিলেন। ইহার স্বপক্ষে প্রধান যুক্তি ছিল দুইটি। প্রথমত, মীরজাফরের সহায়তায় ভরসা না থাকিলে তাহারা কখনও ইংরেজের সহিত যুদ্ধ করিতে ভরসা পাইত না-এবং ওলন্দাজ কোম্পানী তাহাদের কর্তৃপক্ষের নিকট চিঠিতে স্পষ্টই এইরূপ সহায়তা পাওয়ার সম্ভাবনা জানাইয়াছিলেন। দ্বিতীয়ত, মীরজাফরের দরবারের একদল অমাত্য যে ওলন্দাজদের সাহায্যে বাংলার ইংরেজদিগের প্রভাব খর্ব করিয়া নবাবের স্বাধীনভাবে রাজত্ব করিবার ব্যবস্থা করিতে বিশেষ ইচ্ছুক ছিলেন এবং এই দলে যে মীরন, রামনারায়ণ প্রভৃতিও ছিলেন, এরূপ মনে করিবার কারণ আছে।

মীরজাফরের স্বপক্ষেও দুইটি প্রবল যুক্তি আছে। প্রথমত, সন্দেহ থাকিলেও ইংরেজরা মীরজাফরের বিরুদ্ধে কোন নিশ্চিত প্রমাণ পায় নাই। পাইলে মীরজাফরের প্রতি তাহাদের ব্যবহার অন্যরূপ হইত। দ্বিতীয়ত, ১৭৫৯ খ্রীষ্টাব্দের ২২শে অক্টোবর–অর্থাৎ সৈন্যবোঝাই ওলন্দাজ জাহাজগুলি বাংলা দেশে পৌঁছিবার পর-কলিকতার কাউসিল বিলাতের কর্তৃপক্ষকে এই বিষয় চিঠিতে জানাইয়া, সঙ্গে সঙ্গে লিখিয়াছেন যে নবাব এ বিষয়ে কিছু জানিতেন না এবং তিনি ইহাতে ওলন্দাজদের প্রতি বিষম ক্রুদ্ধ হইয়াছেন।

কোন কোন ইংরেজ লিখিয়াছেন যে মীরজাফর মহারাজা রাজবল্লভের সাহায্যে ওলন্দাজদিগের সহিত গোপনে ষড়যন্ত্র করিয়াছিলেন। অনেক ইংরেজের এরূপ ধারণাও ছিল যে মহারাজা নন্দকুমারের চক্রান্তেই বর্ধমান, বীরভূম ও অন্যান্য স্থানের জমিদারগণ ও খাদিম হোসেন খান বিদ্রোহ করিয়াছিলেন এবং শাহজাদা ও মারাঠা শিবভউ বাংলা দেশ আক্রমণ করিয়াছিলেন। বর্তমানকালে অনেকের বিশ্বাস, এই সকলের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজদের অধীনতাপাশ হইতে বাংলা দেশকে মুক্ত করা এবং এইজন্য নন্দকুমার স্বদেশভক্তরূপে সম্মানের পদে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছেন। সুতরাং নন্দকুমারের সম্বন্ধে যেটুকু তথ্য জানিতে পারা যায় তাঁহার আলোচনা প্রয়োজন।

নন্দকুমার যে সিরাজউদ্দৌলার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া ইংরেজদিগকে চন্দননগর অধিকার করিতে সাহায্য করিয়াছিলেন, তাহা পূর্বেই বলা হইয়াছে। সুতরাং সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর নন্দকুমার ইংরেজ ও মীরজাফর উভয়েরই প্রিয়পাত্র হইয়া নিজের উন্নতিসাধন করিতে সমর্থ হইলেন। মীরজাফর যখন সিংহাসনচ্যুত হইলেন তখন নন্দকুমার তাঁহার বিশেষ অন্তরঙ্গ ও বিশ্বাসভাজন হইলেন। ইংরেজ লেখকগণের মতে অতঃপর নন্দকুমার নানা উপায়ে ইংরেজ কোম্পানীর অনিষ্টসাধন চেষ্টা করিতে লাগিলেন। গভর্নর ভ্যানসিটার্ট নন্দকুমারের বাড়ী হইতে প্রাপ্ত কতকগুলি গোপনীয় পত্রের সাহায্যে শাহজাদা এবং পণ্ডিচেরীর ফরাসী কর্তৃপক্ষের সহিত ইংরেজের বিরুদ্ধে তাঁহার চক্রান্তের বিষয় কাউনসিলের নিকট উপস্থিত করিয়া তাহাকে নিজের বাড়ীতে নজরবন্দী করিয়া রাখিলেন। কিন্তু যে কোন উপায়েই হউক, নন্দকুমার ৪০ দিন পরে মুক্ত হইলেন।

ইংরেজরা যখন মীর কাশিমের সহিত যুদ্ধ ঘোষণা করিয়া মীরজাফরকে আবার নবাব করিবার প্রস্তাব করিলেন, তখন মীরজাফর যে কয়েকটি শর্তে এই পদ গ্রহণে রাজী হইলেন তাঁহার একটি শর্ত এই যে নন্দকুমার তাঁহার দিওয়ান হইবেন এবং অনিচ্ছাসত্ত্বেও সেই সঙ্কটকালে ইংরেজেরা ইহাতে রাজী হইলেন।

ইংরেজ লেখকরা বলেন যে দিওয়ান হইবার পরও নন্দকুমার ইংরেজদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করিয়াছিলেন। মীর কাশিমের সহিত তিনি এই বন্দোবস্ত করিয়াছিলেন যে তিনি ইংরেজ সৈন্যের সমস্ত সংবাদ মীর কাশিমকে জানাইবেন–মীর কাশিম পুনরায় নবাব হইলে নন্দকুমারকে দিওয়ানের পদ দিবেন। এতদ্ব্যতীত তিনি কাশীর রাজা বলবন্ত সিংহকে ইংরেজের পক্ষ ত্যাগ করিয়া তাহাদর বিরুদ্ধে শুজাউদ্দৌল্লার সঙ্গে যোগ দিবার জন্য প্ররোচিত করিয়াছিলেন। এই দুইটি অভিযোগ সম্বন্ধে গভর্নর ভ্যাটসিটার্ট বহু অনুসন্ধানের ফলে যে সমুদয় প্রমাণ সংগ্রহ করিয়াছিলেন, তাহাতে ইহার সত্যতা সম্বন্ধে বিশেষ কোন সন্দেহ থাকে না।

নন্দকুমারের বিরুদ্ধে তৃতীয় অভিযোগ এই যে তিনি শুজাউদ্দৌল্লাকে লিখিয়াছিলেন যে, তিনি যদি ইংরেজদিগকে বাংলা দেশ হইতে তাড়াইতে পারেন, তবে তিনি তাঁহাকে এক কোটি টাকা এবং বিহার প্রদেশ দিবেন। শুজাউদ্দৌল্লা রাজী না হওয়ায় তিনি কয়েক লক্ষ টাকাসহ একজন উকীল পাঠাইয়াছিলেন এবং শুজাউদ্দৌল্লা রাজী হইয়াছিলেন। এই অভিযোগ সম্বন্ধে বিশ্বস্ত কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নাই। তবে মীরজাফর যে শুজাউদ্দৌল্লাকে মীর কাশিমের পক্ষ ত্যাগ করাইয়া তাঁহার সঙ্গে যোগ দেওয়াইবার জন্য বহু চেষ্টা করিয়াছিলেন এবং কতকটা সফলও হইয়াছিলেন, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। সুতরাং নন্দকুমারের বিরুদ্ধে তৃতীয় অভিযোগ মীরজাফরের আচরণ দ্বারা সমর্থিত হয় না। আর মীরজাফরের অজ্ঞাতসারে এবং বিনা সমর্থনে যে নন্দকুমার এক কোটি টাকা ও বিহার প্রদেশ শুজাউদ্দৌল্লাকে দিবার প্রস্তাব করিবেন, ইহা বিশ্বাসযোগ্য নহে। পূর্ব-অভিজ্ঞতার পরে মীরজাফরও যে ইংরেজদিগকে তাড়াইবার জন্য ষড়যন্ত্র করিবেন, খুব বিশ্বস্ত প্রমাণ না থাকিলে সত্য বলিয়া গ্রহণ করা উচিত নহে।

কলিকাতার ইংরেজ কাউসিল কিন্তু এই সমস্ত অভিযোগের বিষয় বিবেচনা করিয়া ১৭৬৫ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসে নন্দকুমারকে বন্দী করিয়া কলিকাতায় পাঠাইলেন। তাঁহাকে তাঁহার নিজের বাড়ীতেই নজরবন্দী করিয়া রাখা হইল এবং শাসন সংক্রান্ত ব্যাপারে তাঁহার কোন হাত রহিল না। কিছুদিন পরে তিনি আবার ইংরেজদের অনুগ্রহ লাভে সমর্থ হইয়াছিলেন।

নন্দকুমার ইংরেজকে তাড়াইবার জন্য ষড়যন্ত্র করিয়াছিলেন–এই অভিযোগের সত্যতার উপর নির্ভর করিয়া বর্তমান যুগে কেহ কেহ তাঁহাকে দেশপ্রেমিক বলিয়া অভিহিত করেন এবং দশ বৎসর পরে ইংরেজ আদালতে তাঁহার প্রাণদণ্ড হইয়াছিল বলিয়া তাহাকে দেশের প্রথম শহীদ বলিয়া সম্মান দিয়া থাকেন। বলা বাহুল্য তাঁহার প্রাণদণ্ড হইয়াছিল জাল করিবার অভিযোগে– ইংরেজকে তাড়াইবার প্রসঙ্গমাত্রও সেই বিচারের সময় কেহ উচ্চারণ করে নাই। তাঁহার প্রাণদণ্ড ন্যায় হইয়াছিল কি অন্যায় হইয়াছিল এ সম্বন্ধে তাঁহার মৃত্যুর পর দেড়শত বৎসর পর্যন্ত বহু বিতর্ক হইয়াছে। এবং এখনও সন্দেহের যথেষ্ট অবসর আছে। কিন্তু এই সুদীর্ঘকাল মধ্যে কেহ কল্পনাও করে নাই যে তিনি দেশের জন্য প্রাণ দিয়াছিলেন। কারণ ইংরেজ তাড়াইবার অভিযোগ কতদূর সত্য তাহা বলা কঠিন এবং সত্য হইলেও তাঁহার উদ্দেশ কি ছিল আজ তাহা জানিবার কোন উপায় নাই। তিনি স্বীয় প্রভু সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে ইংরেজদের সঙ্গে চক্রান্ত করিয়াছিলেন, তারপর মীরজাফরের স্বপক্ষে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করিয়াছিলেন, এবং মীরজাফরের বিপক্ষে মীর কাশিমের সহিত ষড়যন্ত্র করিয়াছিলেন। অতএব স্বভাবতই তিনি যে স্বার্থ সাধনের জন্য চক্রান্ত করিয়াছিলেন এরূপ অনুমান করা অসঙ্গত নহে। সুতরাং ইংরেজদের বিরুদ্ধে তাঁহার চক্রান্ত নিছক স্বদেশপ্রেম অথবা নিজের স্বার্থসিদ্ধির উপায়মাত্র তাহা কেহই বলিতে পারে না এবং তিনি সত্যই ইংরেজকে তাড়াইতে যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াছিলেন কিনা, তাহাও নিশ্চিত করিয়া বলা যায় না।

নবাব মীরজাফর যে অযোগ্য ও অপদার্থ ছিলেন, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু তাঁহার দেশদ্রোহিতার ফলেই যে বাংলা দেশ তথা ভারতবর্ষ ইংরেজের অধীন হইল এই অভিযোগ পুরাপুরি সত্য নহে। রাজ্যলাভের জন্য প্রভুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র-ইহা তখন অনেকেই করিত। তাঁহার পূর্বে আলীবর্দী এবং তাঁহার পরে মীর কাশিম উভয়েই ইহা করিয়াছিলেন। মীরজাফর যখন ইংরেজের সাহায্য লাভের জন্য ষড়যন্ত্র করেন তখন তাঁহার পক্ষে ইহা কল্পনা করাও অসম্ভব ছিল যে ইহার ফলে ইংরেজরা বাংলা দেশের সর্বময় কর্ত্তা হইবে।

মীর কাশিম

মীরজাফরের অযোগ্যতা ও অকর্মণ্যতায় ইংরেজ কোম্পানী তাঁহার প্রতি অত্যন্ত অসন্তুষ্ট ছিলেন। তাঁহার পুত্র মীরন ইংরেজদের প্রতি বিরূপ ছিলেন এবং ইংরেজরা ইহা জানিত। কিন্তু মীরন কার্যক্ষম এবং পিতার প্রধান পরামর্শদাতা ছিলেন। নবাবের উপর তাঁহার প্রভাবও খুব বেশি ছিল। অকস্মাৎ বজ্রাঘাতে মীরনের মৃত্যু হইল (৩রা জুলাই, ১৭৬০ খ্রীষ্টাব্দ)। ইংরেজরা এই ঘটনার সুযোগ লইয়া নবাবের উপর তাহাদের আধিপত্য আরও কঠোরভাবে প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিল।

যদিও মীরজাফর ইংরেজ কোম্পানী ও ইংরেজ কর্মচারীদিগকে বহু অর্থ। দিয়াছিলেন–তথাপি তাহাদের দাবি মিটিল না। ওদিকে রাজকোষ শূন্য। সুতরাং মীরজাফরের আর টাকা দিবার সাধ্য ছিল না; নূতন ইংরাজ গর্ভনর ভ্যানসিটার্ট প্রস্তাব করিলেন যে চট্টগ্রাম জিলা কোম্পানীকে ইজারা দেওয়া হউক কিন্তু মীরজাফর ইহাতে কিছুতেই সম্মত হইলেন না। নবাবের জামাতা মীর কাশিমের হাতে অনেক টাকা ছিল, এবং যখন মীরজাফরের সৈন্যরা বিদ্রোহ করে তখন তিনিই টাকা দিয়া তাহা মিটাইয়া দেন। মীরনের মৃত্যুর পর নবাবের উত্তরাধিকারী কে হইবে, এই প্রশ্ন উঠিলে দুইজন প্রতিদ্বন্দ্বী দাঁড়াইল। প্রথম মীরনের পুত্র। মীরনের দিওয়ান রাজবল্ল খুব ধনী ছিলেন এবং পূর্ব হইতেই ইংরেজের বন্ধু ছিলেন। তিনি মীরনের পুত্রের পক্ষে থাকায় একদল ইংরেজ তাঁহাকে সমর্থন করিলেন। আর এক দল কাশিমের দাবি সমর্থন করিলেন। রাজবল্লভ ও মীর কাশিম উভয়েই অর্থশালী ও ইংরেজের অনুগত; সুতরাং মীরজাফরের হাত হইতে প্রকৃত ক্ষমতা কাড়িয়া লইয়া ইহাদের যে কোন একজনের হাতে দেওয়া ইংরেজের প্রধান চেষ্টার বিষয় হইল। মীরজাফর প্রথমে মীরনের পুত্র এবং মীর কাশিম উভয়ের স্বপক্ষেই মত দিলেন কিন্তু একজনকে মনোনীত করিতে ইতস্তত করিলেন–পরে যখন বুঝিলেন যে মীর কাশিম ও রাজবল্লভ দুইজনই ইংরেজের অনুগৃহীত–তখন এই দুইজনকেই বাদ দিয়া মীর্জা দাউদ নামক এক তৃতীয় ব্যক্তির হাতেই আপাতত সমস্ত ক্ষমতা দিতে মনস্থ করিলেন।

১৭৬০ খ্রীষ্টাব্দের জুলাই মাসে ভ্যান্‌সিটার্ট ইংরেজ কোম্পানীর কলিকাতা প্রেসিডেন্সির গভর্নর হইয়া আসিলেন। তিনি মীর কাশিমের পক্ষ লইলেন এবং কলিকাতার কাউনসিল তাঁহার সঙ্গে বন্দোবস্ত করিবার ভার গভর্নরের উপর দিলেন। মীর কাশিম বলিলেন যে, নবাবের বর্তমান পরামর্শদাতাদিগকে সরাইয়া যদি তাঁহার উপর শাসনের সকল দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব দেওয়া হয় তাহা হইলে তিনি কোম্পানীকে প্রয়োজনীয় অর্থ সরবরাহ করিতে পারেন, কিন্তু বলপ্রয়োগ ভিন্ন নবাব কিছুতেই এই বন্দোবস্তে রাজী হইবেন না। অতঃপর ভ্যানসিটার্ট ও মীর কাশিমের মধ্যে অনেক গোপন পরামর্শ চলিল। ইহার ফলে মীর কাশিম ও ইংরেজদের মধ্যে এই শর্তে এক সন্ধি হইল যে, মীরজাফর নামে নবাব থাকিবেন–কিন্তু মীর কাশিম নায়েব সুবাদার হইবেন এবং শাসন সংক্রান্ত সকল বিষয়েই তাঁহার পুরাপুরি কর্তৃত্ব থাকিবে। ইংরেজরা প্রয়োজন হইলে মীর কাশিমকে সৈন্য দিয়া সাহায্য করিবেন-এবং ইহার ব্যয় নির্বাহার্থে বর্ধমান, মেদিনীপুর ও চট্টগ্রাম এই তিন জিলা ইংরেজদিগকে ‘ইজারা বন্দোবস্ত’ করিয়া দিবেন। ইংরেজের প্রাপ্য টাকা কিস্তিবন্দী করিয়া শোধ দেওয়া হইবে।

কলিকাতার কাউনসিল মীরজাফরকে এই সন্ধির শর্ত স্বীকার করাইবার জন্য গভর্নর ভ্যানসিটার্ট ও সৈন্যাধ্যক্ষ ক্যাইলোডকে একদল সৈন্যসহ মুর্শিদাবাদে পাঠাইলেন। পাছে নবাব কিছু সন্দেহ করেন, এইজন্য প্রকাশ্যে ঘোষণা করা হইল যে ঐ সৈন্যদল পাটনায় যাইতেছে, কারণ বাদশাহ শাহ আলম পুনরায় বিহার আক্রমণ করিবেন এইরূপ সম্ভাবনা আছে।

ইতিমধ্যে মীরজাফরের দুরবস্থা চরমে পৌঁছিয়াছিল। ১৪ই জুলাই, ১৭৬০ খ্রীষ্টাব্দে তাঁহার সৈন্যদল আবার বিদ্রোহী হয়, কোষাধ্যক্ষ ও অন্যান্য কর্মচারীদিগকে পাল্কী হইতে জোর করিয়া নামাইয়া নানারূপ লাঞ্ছনা করে, নবাবের প্রাসাদ ঘেরাও করে, নবাবকে গালাগালি করে এবং তাহাদের প্রাপ্য টাকা না দিলে নবাবকে মারিয়া ফেলিবে এইরূপ ভয় দেখায়। এই সঙ্কটের সময়েই মীর কাশিম তিন লক্ষ টাকা নগদ দিয়া এবং বাকী টাকার জামীন হইয়া অনেক কষ্টে গোলমাল থামাইয়া দেন। পাটনাতেও সৈন্যরা বিদ্রোহী হইয়া রাজবল্লভকে নানারূপ লাঞ্ছনা করে, তাঁহার বাড়ী ঘেরাও করে এবং তাঁহার জীবন বিপন্ন করিয়া তোলে। রাজকোষ শূন্য থাকায় বাংলার নবাব সৈন্যদলকে বেতন দিতে পারেন নাই, সুতরাং বাংলারাজ্য রক্ষা করিবার জন্য কোন সৈন্যই ছিল না এবং দুর্বল ও সহায়হীন নবাব পুত্তলিকার মত সিংহাসনে উপবিষ্ট ছিলেন, তাঁহার কোন ক্ষমতাই ছিল না। এদিকে তাঁহারই প্রদত্ত অর্থে পরিপুষ্ট ইংরেজ কোম্পানীর নিয়মিত বেতনভুক্ত সৈন্য সংখ্যা ছিল ১০০০ ইউরোপীয় এবং ৫০০০ ভারতীয়। সুতরাং ইংরেজ কোম্পানীকে বাধা। দিবার কোন সাধ্যই তাঁহার ছিল না।

তথাপি ১৪ই অক্টোবর যখন ভ্যানসিটার্ট মুর্শিদাবাদে নবাবের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া মীর কাশিমের সহিত সন্ধি অনুযায়ী বন্দোবস্ত করিবার প্রস্তাব করিলেন, মীরজাফর কিছুতেই সম্মত হইলেন না। পাঁচদিন ধরিয়া কথাবার্তা চলিল–ইংরেজ গভর্নর মীরজাফরকে রাজ্যের বর্তমান অবস্থার পরিণাম বর্ণনা করিয়া নানারূপ ভয় দেখাইলেন কিন্তু কোন ফল হইল না। অবশেষে ২০শে অক্টোবর প্রাতঃকালে ক্যাইলোড ও মীর কাশিম একদল সৈন্য লইয়া মুর্শিদাবাদে নবাবের প্রাসাদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিয়া গভর্নরের পত্র নবাবের নিকট পাঠাইলেন। ইহার সারমর্ম এই : “আপনার বর্তমান পরামর্শদাতাদের হাতে ক্ষমতা থাকিলে অচিরেই আপনার নিজের ও কোম্পানীর সর্বনাশ হইবে। দুই তিনটি লোকের জন্য আমাদের উভয়ের এইরূপ সর্বনাশ হইবে, ইহা বাঞ্ছনীয় নহে। সুতরাং আমি কর্নেল ক্যাইলোডকে পাঠাইতেছি–তিনি আপনার কুপরামর্শদাতাদিগকে তাড়াইয়া রাজ্যশাসনের সুবন্দোবস্ত করিবেন।”

নবাব এই চিঠি পাইয়া বিষম ক্রুদ্ধ ও উত্তেজিত হইলেন এবং ইংরেজকে বাধা দিবার সঙ্কল্প করিলেন। কিন্তু ঘণ্টা দুই পরেই নবাবের মাথা ঠাণ্ডা হইল এবং তিনি মীর কাশিমকে নবাবী পদ গ্রহণ করিতে আহ্বান করিলেন। তারপর তিনি ক্যাইলোডকে বলিলেন যে তাঁহার জীবন রক্ষার দায়িত্ব তাঁহার (ক্যাইলোডের) হাতেই রহিল। ভ্যানসিটার্ট বলিলেন যে শুধু তাঁহার জীবন কেন, তিনি ইচ্ছা করিলে তাঁহার রাজ্যও নিরাপদে রাখিতে পারেন, কারণ তাঁহাকে রাজ্যচ্যুত করিবার কোনরূপ অভিসন্ধি চাহাদের নাই। মীরজাফর বলিলেন, “আমার রাজ্যের সখ মিটিয়াছে। আর থাকিলে মীর কাশিমের হাতে আমার জীবন বিপন্ন হইবে, সুতরাং কলিকাতায় বাসের ব্যবস্থা করিলে আমি সুখে শান্তিতে থাকিতে পরিব।” ২২শে অক্টোবর মীরজাফর একদল ইংরেজ সৈন্য পরিবৃত হইয়া কলিকাতা যাত্রা করিলেন। মীর কাশিম বাংলার নবাব হইলেন।

মীর কাশিম নবাব হইয়া দেখিলেন যে রাজকোষে মণি-মরকতাদি ও নগদ মাত্র ৪০ কি ৫০ হাজার টাকা আছে। তিনি সব মণিরত্ন বিক্রয় করিলেন। ইহা ছাড়া প্রায় তিন লাখ টাকার সোনা ও রূপার তৈজসপত্র ছিল, এগুলি গালাইয়া টাকা ও মোহর তৈরি হইল। কিন্তু ইংরেজকে ইহা অপেক্ষা অনেক বেশি টাকা দিবার শর্ত ছিল–সুতরাং তিনি তাঁহার ব্যক্তিগত তহবিল হইতে অনেক টাকা দিলেন। নবাবী পাইবার দুই সপ্তাহের মধ্যে তিনি ইংরেজ সৈন্যের ব্যয়নির্বাহের জন্য নগদ দশ লক্ষ টাকা দিলেন এবং মাসিক এক লক্ষ টাকা কিস্তিতে আরও দশ লক্ষ টাকা দিতে প্রতিশ্রুত হইলেন। পাটনার সৈন্যের জন্য আরও পাঁচ লক্ষ টাকা দিতে হইল। সন্ধির শর্তম, বর্ধমান, মেদিনীপুর ও চট্টগ্রাম এই তিন জিলার রাজস্ব কোম্পানীর হস্তগত হইল। ইহা ছাড়া কোম্পানীর বড় বড় কর্মচারীকে টাকা দিতে হইল। গভর্নর ভ্যানসিটার্ট পাইলেন পাঁচ লক্ষ, ক্যাইলোড় দুই লক্ষ, এবং আরও পাঁচজন পদানুযায়ী মোটা টাকা পাইলেন। এই সাতজন কর্মচারী পাইলেন ১৭,৪৮,০০০ এবং সৈন্যদের জন্য নগদ ১৫ লক্ষ টাকা লইয়া মোট ৩২,৪৮,০০০ টাকা মীর কাশিমকে দিতে হইল।

মীর কাশিমের সৌভাগ্যক্রমে কলিকাতা কাউন্সিলের ‘বিশিষ্ট সমিতির সদস্যরাই তখন কেবল তাঁহার সহিত গোপন বন্দোবস্তের কথা জানিতেন। সুতরাং কাউন্সিলের অপরাপর সদস্যেরা টাকার ভাগ কিছুই পাইলেন না। অতএব তাঁহারা সাধারণ লোকের ন্যায় মীরজাফরকে অপসারণ করিয়া মীর কাশিমকে নবাব করা অত্যন্ত গর্হিত ও নিন্দনীয় কাজ বলিয়া মত প্রকাশ করিলেন।

মসনদে বসিবার জন্য মীর কাশিমকে বহু অর্থ ব্যয় করিতে হইয়াছিল। সুতরাং নানা উপায়ে তিনি অর্থ সংগ্রহে প্রবৃত্ত হইলেন। মীরজাফরের কয়েকজন অনুচর তাঁহার অনুগ্রহে নিতান্ত নিম্নশ্রেণীর ভৃত্য হইতে রাজস্বসংক্রান্ত উচ্চ পদে নিযুক্ত হইয়া বহু অর্থ সঞ্চয় করিয়াছিল। মীর কাশিম ইহাদিগকে এবং ইহাদের অধীনস্থ কর্মচারীদিগকে পদচ্যুত ও কারারুদ্ধ করিয়া তাহাদের যথাসর্বস্ব রাজ-সরকারে বাজেয়াপ্ত করিলেন। তিনি প্রায় সকল কর্মচারীরই হিসাব-নিকাশ তলব করিলেন এবং ইহার ফলে বহু লোকের সর্বনাশ হইল। বহু অভিজাত সম্প্রদায়ের লোক এমন কি আলীবর্দীর পরিবারবর্গও নানা কল্পিত মিথ্যা অপরাধের ফলে সর্বস্ব নবাবকে দিতে বাধ্য হইয়া পথের ফকীর হইলেন। এইরূপ নানাবিধ উপায়ে অর্থ সংগ্রহ ও ব্যয় সংক্ষেপ করিয়া মীর কাশিম রাজকোষ পরিপুষ্ট করিলেন এবং ইংরেজের ঋণ অনেকটা পরিশোধ করিলেন।

মীরজাফরের দুর্বল শাসন, বাদশাহজাদার বিহার আক্রমণ ও নবাবী পরিবর্তনের সুযোগ লইয়া অনেক জমিদার বিদ্রোহী হইয়াছিলেন–মীর কাশিম ইংরেজ সৈন্যের সাহায্যে মোদিনীপুরের বিদ্রোহীদলকে দমন করিয়া বীরভূমের দিকে অগ্রসর হইলেন। বীরভূমের জমিদার আসাদ জামান খাঁ প্রায় বিশ হাজার পদাতিক ও পাঁচ হাজার ঘোড়সওয়ার লইয়া এক দুর্গম প্রদেশে আশ্রয় লইয়াছিলেন। কিন্তু অকস্মাৎ আক্রমণে তিনি সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হইয়া বশ্যতা স্বীকার করিলেন। বর্ধমানও সহজেই মীর কাশিমের পদানত হইল। মুঙ্গেরের নিকটবর্তী করকপুরের রাজা বিদ্রোহী হইয়া মুঙ্গেরের দিকে অগ্রসর হইয়াছিলেন কিন্তু ইংরেজ ও নবাবের সৈন্যেরা তাঁহাকে পরাজিত করিল। বীরভূম ও বর্ধমানের এই যুদ্ধে মীর কাশিম স্বয়ং সেনানায়ক ছিলেন। সুতরাং নবাবী সৈন্য যে ইংরেজ সৈন্যের তুলনায় কত অপদার্থ ও অকর্মণ্য তাহা তিনি প্রত্যক্ষ করিলেন। এই উপলব্ধির ফলে, এবং সম্ভবতঃ ইংরেজদের সহিত সংঘর্ষের অবশ্যম্ভাবিতা বুঝিতে পারিয়া তিনি অবিলম্বে তাঁহার সেনাদল ইউরোপীয় পদ্ধতিতে শিক্ষিত করিবার ব্যবস্থা করিলেন। এরূপ আমূল পরিবর্তন খুবই কষ্টকর ও সময়সাধ্য-সুতরাং তাঁহার তিন বৎসর রাজ্যকালের মধ্যে তিনি যে কতকটা কৃতকার্য হইয়াছিলেন, ইহাই তাঁহার কৃতিত্বের পরিচয়। সম্ভবতঃ তাঁহার এই নূতন সামরিক নীতি যথাসম্ভব ইংরেজদিগের নিকট হইতে গোপন রাখার জন্য তিনি মুর্শিদাবাদ হইত মুঙ্গেরে রাজধানী স্থানান্তরিত করিলেন। নানা উপায়ে অর্থ সংগ্রহ করিয়া তিনি তাঁহার উদ্দেশ্য সাধনে ব্রতী হইলেন। মুঙ্গেরে পুরাতন দুর্গ সুসংস্কৃত হইল। ইউরোপীয় দক্ষ শিল্পীগণের উপদেশে ও নির্দেশে কর্মকুশল দেশীয় শিল্পকারগণ উকৃষ্ট কামান, বন্দুক, গুলি গোলা, বারুদ প্রভৃতি সামরিক উপকরণ প্রস্তুত করিতে লাগিল। উপযুক্ত সৈনিক ও কর্মচারীর অধীনে নবাবের সৈন্যদল ইউরোপীয় সামরিক পদ্ধতিতে শিক্ষিত হইল। কলিকাতার বিখ্যাত আমানী বণিক খোঁজা পির ভ্রাতা গ্রেগরী মীর কাশিমের প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত হইল। ‘চন্দ্রশেখর’ উপন্যাসে গ্রেগরী বা ‘গরগিন খাঁ’ ‘গুরগন খাঁ’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন। গরগিন খা’ সেনাপতি হওয়ায় অনেক আর্মানী নবাবের সৈন্যদলে যোগদান করে এবং তিনি ভ্রাতা খোঁজা পিদ্রুর সাহায্যে গোপনে ইউরোপীয় অস্ত্রশস্ত্র ক্রয় করিবার ব্যবস্থা করেন।

নবাবের সৈন্যদল তিনভাগে বিভক্ত হয়–অশ্বারোহী, পদাতিক ও গোলান্দাজ। প্রথম বিভাগের নায়ক ছিলেন মুঘল সেনানায়কগণ, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগ আর্মানী, জার্মান, পর্তুগীজ ও ফরাসী নায়কদের অধীনে পরিচালিত হইত। ইহাদের মধ্যে আর্মানী মার্কার ও ফরাসী সমরু এই দুইজন বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন। মার্কার ইউরোপে যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষা এবং হল্যাণ্ডে যুদ্ধ করিয়াছিলেন। সমরুর প্রকৃত নাম ওয়ালটার রাইনহার্ড (Walter Reinhard)। ইনি ফরাসী জাহাজের নাবিক হইয়া ভারতে আসেন এবং সুমনের (Sumner) অথবা সোমার্স (Somers) নামে ফরাসী সৈন্যদলে ভর্তি হন। ইহা হইতেই সমরু নামের উৎপত্তি। তিনি পূর্বে ইংরেজ, ফরাসী, অযোধ্যার সফদরজঙ্গ ও সিরাজউদ্দৌলার অধীনে সেনানায়ক ছিলেন। ইহারা এবং আরো কয়েকজন দক্ষ সেনানায়ক মীর কাশিমের অধীনে ছিলেন।

এই শিক্ষিত সেনাদলের সাহায্যে মীর কাশিম বেতিয়া রাজ্য জয় করিয়া নেপাল রাজ্য আক্রমণ করিলেন। সম্মুখ যুদ্ধে জয়লাভ করিয়াও গুপ্ত আক্রমণে ব্যতিব্যস্ত হইয়া তিনি ফিরিয়া আসিতে বাধ্য হইলেন।

১৭৬০ খ্রীষ্টাব্দের অগস্ট মাসে শাহ আলমের দ্বিতীয়বার বিহার আক্রমণের কথা পূর্বেই বলা হইয়াছে। ঐ বৎসরই বর্ষাকাল শেষ হইলে শাহ আলম ফরাসী সৈন্য ও তাঁহাদের অধ্যক্ষ ল সাহেবকে সঙ্গে লইয়া তৃতীয়বার বিহার আক্রমণ করিলেন। ইংরেজ সৈন্যাধ্যক্ষ কারন্যাক তাঁহাকে সম্পূর্ণরূপে পরাস্ত করিয়া (১৫ই জানুয়ারী, ১৭৬১ খ্রী) ল ও ফরাসী সেনানায়কদের বন্দী করিলেন। শাহ আলম ইংরেজদের সহিত সন্ধির প্রস্তাব করিলে কারন্যাক গয়ায় গিয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া পাটনায় লইয়া আসেন। এই সময়ে বাংলার নূতন নবাব মীর কাশিম বর্ধমানে ও বীরভূমে বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি পাটনায় আসিয়া শাহ আলমের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। … …

শুল্কের ব্যাপার ছাড়াও কোম্পানীর কর্মচারীরা নবাবের প্রজার উপর নানা রকম উৎপীড়ন করিত। ঢাকার কর্মচারীরা ব্যক্তিগত আক্রোশ বশতঃ শ্রীহট্টে একদল সিপাহী পাঠাইয়া সেখানকার একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে বধ করিয়াছিলেন এবং স্থানীয় জমিদারকে জোর করিয়া ধরিয়া লইয়া গিয়া বন্দী করিয়াছিলেন। এইরূপ অত্যাচারের ফলে প্রজাগণ অনেক সময় গ্রাম ত্যাগ করিয়া পলায়ন করিতে বাধ্য হইত। ইংরেজের সঙ্গে কলহ বা যুদ্ধের আশঙ্কায় অত্যাচারী ইংরেজ কর্মচারীকে নিজে দণ্ড না দিয়া প্রজাদের দুরবস্থা সম্বন্ধে মীর কাশিম গর্ভনরের নিকট পুনঃ পুনঃ আবেদন করেন। ১৭৬২ খ্রীষ্টাব্দের ২৬শে মার্চ তারিখের চিঠির মর্ম এই–“কলিকাতা, কাশিমবাজার, পাটনা, ঢাকা প্রভৃতি সকল কুঠির ইংরেজ অধ্যক্ষ তাঁহাদের গোমস্তা ও অন্যান্য কর্মচারীসহ খাজনা আদায়কারী, জমিদার, তালুকদার প্রভৃতির মতন ব্যবহার করেন আমার কর্মচারীদের কোন আমলই দেন না। প্রতি জিলা ও পরগনায়, প্রতি গঞ্জে, গ্রামে কোম্পানীর গোমস্তা ও অন্যান্য কর্মচারিগণ তেল, মাছ, খড়, বাঁশ, ধান, চাউল, সুপারি এবং অন্যান্য দ্রব্যের ব্যবসা করে, এবং তাহারা কোম্পানীর দস্তক দেখাইয়া কোম্পানীর মতই। সকল সুযোগ-সুবিধা আদায় করে।” অন্যান্য পত্রে নবাব লেখেন যে “তাহারা বহু নূতন কুঠি নির্মাণ করিয়া ব্যবসা উপলক্ষে প্রজাদের উপর বহু অত্যাচার করে। তাহারা জোর করিয়া সিকি দামে দ্রব্য কেনে এবং আমার প্রজা ও ব্যবসায়ীদের উপর নানা অত্যাচার করে। কোম্পানীর দস্তক দেখাইয়া তাহারা শুল্ক দেয় না এবং ইহাতে আমার পঁচিশ লক্ষ টাকা লোকসান হয়। ইহার ফলে দেশের ব্যবসায়ীরা ও বহু প্রজা সর্বস্বান্ত হইয়া দেশ ছাড়িয়া চলিয়া যাইতেছে।”

কয়েকজন ইংরেজও এইরূপ অত্যাচারের কথা উল্লেখ করিয়াছেন। বাখরগঞ্জ হইতে সার্জেন্ট ব্রেগো ১৭৬২ খ্রীষ্টাব্দের ২৬শে মে গভর্নর ভ্যানসিটার্টকে যে পত্র লেখেন তাঁহার মর্ম এই–“এই স্থানটি বাণিজ্যের একটি প্রধান কেন্দ্র ছিল। কিন্তু নিম্নলিখিত কারণে এ স্থানের ব্যবস্থা একেবারে নষ্ট হইয়া গিয়াছে। একজন ইংরেজ বেচাকেনার জন্য একজন গোমস্তা পাঠাইলেন। সে অমনি প্রত্যেক লোককে তাঁহার দ্রব্য কিনিতে অথবা তাঁহার নিকট তাহাদের দ্রব্য বেচিতে বলে, যদি কেহ অস্বীকার করে বা অশক্ত হয় তবে তৎক্ষণাৎ তাহাকে বেত্রাঘাত অথবা কয়েদ করা হয়। যে সমস্ত দ্রব্যের ব্যবসায় তাহারা নিজেরা চালায় সেই সব দ্রব্য আর কেহ কেনাবেচা করিতে পারিবে না, করিলে তাহাকে শাস্তি দেওয়া হয়। ন্যায্য দামের চেয়ে জিনিসের দাম তাহারা অনেক কম করিয়া ধরে এবং অনেক সময় তাহাও দেয় না। যদি আমি এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করি, অমনি আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে। এইরূপে বাঙালী গোমস্তাদের অত্যাচারে প্রতিদিন বহু লোক শহর ছাড়িয়া পলাইতেছে। পূর্বে সরকারী কাছারীতে বিচার হইত কিন্তু এখন প্রতি গোমস্তাই বিচারক এবং তাঁহার বাড়ীই কাছারী। তাহারা জমিদারদেরও দণ্ডবিধান করে এবং মিথ্যা অভিযোগ করিয়া তাহাদের নিকট হইতে টাকা আদায় করে।”

১৭৬২ খ্রীষ্টাব্দের ২৫শে এপ্রিল ওয়ারেন হেষ্টিংস এইসব অত্যাচারের কাহিনী গভর্নরকে জানান। তিনি বলেন যে “কেবল কোম্পানীর গোমস্তা ও সিপাহী নহে, অন্য লোকও সিপাহীর পোষাক পরিয়া বা গোমস্তা বলিয়া পরিচয় দিয়া সর্বত্র লোকের উপর যথেচ্ছ অত্যাচার করে। আমাদের আগে একদল সিপাহী যাইতেছিল, তাহাদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে অনেকে আমার নিকট অভিযোগ করিয়াছে। আমাদের আসার সংবাদে শহর ও সরাই হইতে লোকেরা পলাইয়াছে–দোকানীরা দোকান বন্ধ করিয়া সরিয়া পড়িয়াছে।”

২৬শে মের পত্রে হেষ্টিংস লেখেন–“সর্বত্র নবাবের কর্তৃত্ব প্রকাশ্যে অস্বীকৃত ও অপমানিত; নবাবের কর্মচারীরা কারারুদ্ধ; নবাবের দুর্গ আমাদের সিপাহী দ্বারা আক্রান্ত।”

গভর্নর ভ্যানসিটার্ট লিখিয়াছেন–“আমি গোপনে অত্যাচারী ইংরেজ কর্মচারীদের সাবধান করিয়াছি; কিন্তু অত্যাচারের কোন উপশম না হওয়ায় বোর্ডের সভায় ইহা পেশ করিয়াছি। অথচ বোর্ডের সদস্যরা এ বিষয়ে কোন মনোযোগই দিলেন না। কারণ, তাঁহাদের বিশ্বাস নবাব আমাদের সঙ্গে কলহ করার জন্যই এই সব মিথ্যা সংবাদ রটাইতেছেন। নবাবের অভিযোগে বিশ্বাস করি বলিয়া তাঁহারা আমাকে গালি দেন ও শত্রু বলিয়া মনে করেন। যদিও প্রতিদিন অভিযোগের সংখ্যা বাড়িয়াই চলিতেছে, তথাপি প্রতিকার তো দূরের কথা, ইহার একটির সম্বন্ধেও কোন তদন্ত হয় নাই।”

নবাবের প্রধান অভিযোগ ছিল ইংরেজদের বে-আইনী ব্যবসায়ের বিরুদ্ধে। বাদশাহের ফরমান অনুসারে যে সকল দ্রব্য এদেশে জাহাজে আমদানী হয় অথবা এদেশ হইতে জাহাজে রপ্তানী হয়, কেবল সেই সকল দ্রব্যই কোম্পানী বেচাকেনা করিতে পারিবেন এবং কোম্পানীর মোহরাঙ্কিত দস্তক’ দেখাইলে তাঁহার উপর কোন শুল্ক ধার্য হইবে না। কিন্তু কেবল কোম্পানী নয়, তাহাদের ইংরেজ কর্মচারীরাও অন্য সকল দ্রব্য-লবণ, সুপারি, তামাক প্রভৃতি-বাংলা দেশের মধ্যেই বেচাকেনা করিত এবং কেম্পানীর দস্তক দেখাইয়া কেহই শুল্ক দিত না। লবণের গোলা হইতে সর্বত্র দেশী ব্যাপারীদের সরাইয়া ইংরেজরা প্রায় একচেটিয়া বাণিজ্য করিত এবং ইহাতে নবাবের প্রভূত লোকসান হইত। এতদ্ব্যতীত ইংরেজ বণিকের সহিত নবাবের কর্মচারীদের বিবাদ উপস্থিত হইলে ইংরেজরাই তাঁহার বিচার করিত। নবাব বা তাঁহার কর্মচারীদিগকে কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করিতে দিত না। সুতরাং যাহারা কোন অপরাধ করিত সেই অপরাধের বিচারের ভারও তাহাদের উপরেই ছিল।” গর্ভনর ভ্যানসিটার্ট নবারের অভিযোগগুলি ন্যায়সঙ্গত মনে করিয়াছিলেন বলিয়াই হউক অথবা মীর কাশিমের নিকট হইতে বহু অর্থ পাইয়াছিলেন বলিয়াই হউক নবাবের পক্ষ লইয়া কাউনৃসিলের ইংরেজ সদস্যদের সহিত অনেক লড়িয়াছিলেন এবং কিছু কিছু কৃতকার্য হইয়াছিলেন। রামনারায়ণকে ইংরেজ গভর্নমেন্ট বরাবর নবাবের বিরুদ্ধে আশ্রয় দিয়াছিলেন কিন্তু নবাবের চিঠিতে উল্লিখিত ১৬ই জুনের ঘটনার দুইদিন পরে কলিকাতার কমিটি রামনারায়ণকে পদচ্যুত করে এবং কর্নেল কূট ও মেজর কারন্যাককে পাটনা হইতে স্থানান্তরিত করে। অগস্ট মাসে পাটনায় নূতন নায়েব-সুবাদার নিযুক্ত করার ব্যবস্থা হয় এবং সেপ্টেম্বর মাসে ভ্যানসিটার্টের আদেশে রামনারায়ণকে নবাবের হস্তে অর্পণ করা হয়। নবাব তাঁহার নিকট হইতে যতদূর সম্ভব টাকা আদায় করিয়া অবশেষে তাহাকে হত্যা করেন। কেবলমাত্র ইংরেজের অনুগ্রহের আশায় বা ভরসায় যাহারা স্বীয় প্রভুর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করিয়াছিলেন, তাঁহাদের অদৃষ্টে যে কত নিগ্রহ ও দুঃখভোগ ছিল, মীরজাফর, মীর কাশিম, রামনারায়ণ প্রভৃতি তাঁহার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

ইংরেজ কোম্পানীর কর্মচারীদের সম্বন্ধে নবাব যে অভিযোগ করিতেন, ভ্যানসিটার্ট তাঁহারও প্রতিকার করিতে যত্নবান হইলেন। ১৭৬২ খ্রীষ্টাব্দের শেষভাগে তিনি নবাবের নূতন রাজধানী মুঙ্গেরে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া এক নূতন সন্ধি করিলেন। স্থির হইল যে ভবিষ্যতে ইংরেজরা লবণের উপর শতকরা ৯ টাকা হারে শুল্ক দিবে। এ দেশীয় বণিকেরা শতকরা ৪০ টাকা শুল্ক দিত। সুতরাং নির্ধারিত শুল্ক দিয়াও ইংরেজদের অনেক লাভ থাকিত। কিন্তু এই সুবিধার পরিবর্তে সন্ধির আর একটি শর্তে স্থির হইল যে অতঃপর নবাবের কর্মচারীদের সহিত ইংরেজ বণিক বা তাঁহার গোমস্তার কোন বিবাদ বাধিলে নবাবের আদালতেই তাঁহার বিচার হইবে। ভ্যানসিটার্টের স্পষ্ট নিষেধ সত্ত্বেও কলিকাতা কাউসিল এই মীমাংসা গ্রহণ করিবার পূর্বেই নবাব তাঁহার কর্মচারীদিগকে এই বিষয় জানাইলেন এবং তদনুরূপ শুল্ক আদায় করিতে নির্দেশ দিলেন।

শুল্ক ব্যাপার সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হইয়া ১৭৬৩ খ্রীষ্টাব্দে জানুয়ারী মাসে মীর কাশিম “গরগিন খাঁ”র অধীনে এক সৈন্যদল নেপাল জয় করিবার জন্য পাঠাইলেন। মকবনপুরের নিকটে এক যুদ্ধে নবাবসৈন্য গুখাদিগকে পরাজিত করিয়া রাত্রে নিশ্চিন্তে নিদ্রা যাইতেছিল। অকস্মাৎ গুর্খাদের আক্রমণে ছত্রভঙ্গ হইয়া পলাইল। নবাবের বহু সৈন্য নিহত হইল এবং বহু অস্ত্র-শস্ত্র কামান-বন্দুক গুর্খাদের হস্তগত হইল।

এদিকে ভ্যানসিটার্ট নবাবের সহিত নূতন বন্দোবস্ত করায় ইংরেজ বণিকরা ক্রুদ্ধ হইয়া কলিকাতা বোর্ডের নিকট ইহার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করিল এবং বোর্ড এই নূতন বন্দোবস্ত নাকচ করিয়া দিল। ভ্যানসিটার্ট বোর্ডের সদস্যদিগকে স্মরণ করাইয়া দিলেন যে বাদশাহী ফরমানে এরূপ আভ্যন্তরিক বাণিজ্যের অধিকার দেওয়া হয় নাই, এবং কোম্পানীর ইংলণ্ডীয় কর্তৃপক্ষ একাধিকবার নির্দেশ দিয়াছেন যে লবণ, সুপারি প্রভৃতি যে সমুদয় দ্রব্যের বেচাকেনা বাংলাদেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ তাঁহার জন্য নির্ধারিত শুল্ক দিতে হইবে–কারণ তাহা না হইলে নবাবের রাজস্বের অনেক ক্ষতি হইবে। কিন্তু ইহা সত্ত্বেও ইংরেজরা বহুদিন যাবৎ যে সুবিধা ভোগ করিয়া আসিতেছে, তাহা ছাড়িয়া দিতে রাজী হইল না এবং ভ্যানসিটার্টের নূতন বন্দোবস্ত কাউনসিল নাকচ করিয়া দিলেন। অগত্যা ভ্যানসিটার্ট নবাবকে লিখিলেন–“বাদশাহী ফরমান এবং বাংলার নবাবদের সহিত সন্ধি অনুসারে কোম্পানীর দস্তকের বলে বিনা শুল্কে আভ্যন্তরিক ও বিদেশীয় বাণিজ্য করিবার সম্পূর্ণ অধিকার ইংরেজ বণিকদের আছে। সুতরাং ইংরেজ বণিকেরা এই অধিকারের জোরে পূর্বের ন্যায় বিনা শুল্কে বাংলা দেশের অভ্যন্তরে সকল দ্রব্যের ব্যবসা করিতে পারে ও করিবে। তবে প্রাচীন প্রথা অনুসারে লবণের উপরে শতকরা আড়াই টাকা হিসাবে শুল্ক দিবে। কেবল দুইটি কুঠিতে তামাকের উপর শুল্ক দিবে।”

কলিকাতা কাউনৃসিলের এই নূতন সিদ্ধান্ত প্রচারিত হইবার পূর্বেই পাটনায় নবাবের সহিত ইংরেজ কুঠির অধ্যক্ষ এলিস সাহেবের এক সংঘর্ষ হইল। নবাবের সহিত ভ্যানসিটার্টের যে নূতন বন্দোবস্ত হইয়াছিল তদনুসারে নবাবের কর্মচারীরা ইংরেজ বণিকের নিকট শুল্ক দাবি করে। এলিস ইহাতে ক্রুদ্ধ হইয়া নবাবের কর্মচারীদের বিরুদ্ধে একদল সৈন্য পাঠান এবং তাহাদের অধ্যক্ষ আকবর আলী খানকে বন্দী করিয়া পাটনায় লইয়া আসেন। নিজের চোখের উপর এই রকম অত্যাচারে নবাব ক্রোধে ক্ষিপ্তপ্রায় হইয়া তাঁহার কর্মচারীকে উদ্ধার করিবার জন্য ৫০০ ঘোড়সওয়ার পাঠাইলেন। ইহারা উক্ত কর্মচারীকে না পাইয়া এলিসের প্রহরীদের আক্রমণ করিল। চারিজন প্রহরী হত হইল এবং নবাবের সৈন্য এলিসের অবশিষ্ট প্রহরী ও গোমস্তাদের বন্দী করিয়া আনিল। নবাব তাহাদিগকে ভৎর্সনা করিয়া ছাড়িয়া দিলেন। কলিকাতা কাউনৃসিল ভ্যানসিটার্টের সহিত নবাবের নূতন বন্দোবস্ত নাকচ করিয়া দেওয়ায় ভবিষ্যতে এইরূপ গোলযোগ বন্ধ করিবার অভিপ্রায়ে নবাব সমস্ত জিনিষের উপরই শুল্ক একেবারে উঠাইয়া দিলেন (১৭ই মার্চ, ১৭৬৩ খ্রীষ্টাব্দ)। গভর্নরকে লিখিলেন, তাঁহার আর রাজত্ব করিবার সখ নাই; সুতরাং তাহাকে রেহাই দিয়া ইংরেজরা যেন অন্য নবাব নিযুক্ত করে।

সমস্ত শুল্ক তুলিয়া দেওয়ায় বাংলার রাজস্ব অর্ধেক কমিয়া গেল। অত্যাচার, অপমান ও অরাজকতা নিবারণের জন্য নবাব এ ক্ষতিও সহ্য করিতে প্রস্তুত হইলেন। কিন্তু কলিকাতা কাউনসিলের অধিকাংশ সদস্য নবাবের প্রস্তাবে অমত করিলেন। তাঁহারা বলিলেন ইংরেজ বণিক ছাড়া আর সকলের নিকট হইতেই শুল্ক আদায় করিতে হইবে–কারণ তাহা না হইলে ইংরেজ বণিকদের অতিরিক্ত মুনাফা বন্ধ হয়।

ইংরেজ ঐতিহাসিক মিল লিখিয়াছেন, স্বার্থের প্ররোচনায় মানুষ যে কতদূর ন্যায়-অন্যায় বিচাররহিত ও লজ্জাহীন হইতে পারে, ইহা তাঁহার একটি চরম দৃষ্টান্ত।

এই সিদ্ধান্তে উপস্থিত হইয়া কলিকাতা কাউসিল মুঙ্গেরে নবাবের নিকট অ্যামিয়ট ও হে নামক দুই সাহেবকে পাঠাইয়া নিম্নলিখিত দাবিগুলি উপস্থাপিত করিলেন।

১। নবাব ও ভ্যানসিটার্টের মধ্যে নূতন বন্দোবস্ত অনুসারে নবাবের কর্মচারীদিগকে যে সকল আদেশ দেওয়া হইয়াছিল তাহা প্রত্যাহার করা এবং ইহার জন্য ইংরেজদের যে ক্ষতি হইয়াছে, তাঁহার পূরণ করা।

২। শুল্ক রহিত করিবার আদেশ প্রত্যাহার করা।

৩। নবাবের কর্মচারীদের সহিত ইংরেজ বণিকদের বা তাহাদের গোমস্তার এবং কোম্পানীর কর্মচারীদের কোন বিবাদ উপস্থিত হইলে কোম্পানীর কুঠির ইংরেজ অধ্যক্ষের হস্তেই তাঁহার বিচারের ভার দেওয়া।

৪। বর্ধমান, মেদিনীপুর ও চট্টগ্রাম জিলা ইংরেজ কোম্পানীকে বর্তমান ইজারার পরিবর্তে সম্পূর্ণ স্বত্ব বা জায়গীর দেওয়া।

৫। দেশীয় মহাজনেরা যাহাতে কোম্পানীর টাকা বিনা বাটায় গ্রহণ করে এবং কোম্পানী যাহাতে ঢাকা ও পাটনার টাকশালে তিন লক্ষ টাকা তৈরী করিতে পারে, তাঁহার ব্যবস্থা করা।

৬। নবাবের দরবারে একজন ইংরেজ প্রতিনিধি (Resident) রাখা।

নবাব দ্বিতীয় ও তৃতীয় শর্তে রাজী হইলেন না। তিনি বলিলেন, “ইংরেজরা বহু সন্ধি করিয়াছে এবং তাহা অবিলম্বে ভঙ্গ করিয়াছে–আমি কোন সন্ধি ভঙ্গ করি নাই। সুতরাং নূতন সন্ধির কোন অর্থ হয় না।” তারপর একখানি সাদা কাগজ তাহাদের হাতে দিয়া বলিলেন, “তোমাদের যাহা ইচ্ছা ইহাতে লিখিয়া দাও, আমি সই করিব-কিন্তু আমার কেবল একটি দাবি–তাহা এই যে দেশের যেখানে যত ইংরেজ সৈন্য আছে তাহাদিগকে সরাইয়া নিবে।”

নবাব বুঝিতে পারিলেন যে শীঘ্রই ইংরেজদের সহিত তাঁহার যুদ্ধ বাধিবে। সুতরাং কলিকাতা হইতে যে কয়েকখানা ইংরেজের নৌকা অস্ত্র বোঝাই করিয়া পাটনায় পাঠান হইয়াছিল, তিনি সেগুলি আটক করিলেন এবং বলিলেন, পাটনা হইতে ইংরেজ সৈন্য না সরাইলে তিনি ঐ নৌকাগুলি ছাড়িবেন না। কিন্তু যখন তিনি শুনিলেন যে এলিস পাটনা দুর্গ আক্রমণের ব্যবস্থা করিতেছে তখন তিনি নৌকাগুলি ছাড়িয়া দিলেন; এবং ঐ তারিখেই (২২ জুন) গভর্নরকে এলিসের গোপন ব্যবস্থার খবর দিয়া লিখিলেন—”আমি পুনঃপুনঃ আপনাকে অনুরোধ করিয়াছি, আবারও করিতেছি–আপনি আমাকে রেহাই দিয়া অন্য নবাব নিযুক্ত করুন।”

নবাব নূতন সন্ধির শর্ত না মানায় অ্যামিয়ট ও হে নবাবের রাজধানী মুঙ্গের ত্যাগ করিলেন। ২৭শে জুন রাত্রে এলিস পাটনা আক্রমণ করিলেন। নবাবের সৈন্যেরা নিশ্চিন্তে ঘুমাইতেছিল–অতর্কিত আক্রমণে তাহারা বিপর্যস্ত হইল–এবং এলিস পাটনা দুর্গ জয় করিতে না পারিলেও পাটনা নগরী অধিকার করিলেন। বহু লুণ্ঠন ও হত্যাকাণ্ড অনুষ্ঠিত হইল। এবারে মীর কাশিমের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙ্গিল। তিনি পাটনা পুনরায় অধিকারের জন্য মার্কারের অধীনে একদল সৈন্য পাঠাইলেন। তাহারা পাটনা নগরী অধিকার করিয়া ইংরেজ কুঠি আক্রমণ করিল। ইংরেজরা আত্মসমর্পণ করিল এবং এলিস ও আরও অনেকে বন্দী হইল।

নবাব এলিসের আকস্মিক আক্রমণের কথা ভ্যানসিটার্টকে জানাইলেন এবং ক্ষতি পূরণের দাবি করিলেন। অ্যামিয়ট সাহেব মীর কাশিমের নিকট দৌত্যকার্যে বিফল হইয়া আরও কয়েকজন ইংরেজসহ মুঙ্গের হইতে কলিকাতা অভিমুখে যাত্রা করিয়াছিলেন। মীর কাশিম পাটনার সংবাদ পাইয়া মুর্শিদাবাদে আদেশ পাঠাইলেন যে অ্যামিয়টের নৌকা যেন আটক করা হয়। তাঁহাকে হত্যা করিবার কোন আদেশ ছিল না কিন্তু অ্যামিয়ট নবাবের আদেশ সত্ত্বেও নৌকা হইতে নামিতে অথবা আত্মসমর্পণ করিতে রাজী হইলেন না এবং নবাবের যে সমুদয় নৌকা তাঁহাকে ধরিতে আসিয়াছিল, ইংরেজ সৈন্যকে তাহাদের উপর গুলি বর্ষণ করিতে আদেশ দিলেন। কিছুক্ষণ যুদ্ধের পর নবাব সৈন্য অ্যামিয়টের নৌকাগুলি দখল করিল। ইংরেজ পক্ষের একজন হাবিলদার ও দুই একজন সিপাহী পলাইল-বাকী সকলেই আহত বা বন্দী হইল। অ্যামিয়টও মৃত্যুমুখে পতিত হইল। এই ঘটনা পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড বলিয়াই সাধারণতঃ ইতিহাসে বর্ণিত হয়–কিন্তু অ্যামিয়টের আদেশে নবাবের নৌকাসমূহের বিরুদ্ধে গুলি ছোঁড়ার ফলেই যে এই দুর্ঘটনা হয়, কোন কোন ইংরেজ লেখকও তাহা স্বীকার করিয়াছেন।

পাটনায় এলিস ও অন্যান্য ইংরেজদিগকে বন্দী করায় কলিকাতার কাউনসিল মীর কাশিমের বিরুদ্ধে বিষম উত্তেজিত হইয়া উঠিলেন। তারপর ৩রা জুলাই অ্যামিয়টের নিধন-সংবাদে তাঁহারা মীর কাশিমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিলেন এবং মীরজাফরকে পুনরায় বাংলার নবাবী-পদে প্রতিষ্ঠা করিলেন। ইংরেজরা ঐ দুই ঘটনার অনেক পূর্বেই মীর কাশিমের সহিত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হইতেছিলেন। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি কলিকাতার কাউনসিলে যুদ্ধ বাধিলে কোন্ সেনানায়ক কোন্ দিকে অগ্রসর হইবেন তাহা নির্ণীত হইয়াছিল এবং ১৮ই জুন যুদ্ধের ব্যবস্থা আরও অগ্রসর হইয়াছিল।

মীর কাশিম যে যুদ্ধের জন্য একেবারে প্রস্তুত ছিলেন না, এমন কথা বলা যায় না। ইহার সম্ভাবনায়ই তিনি একদল সৈন্য ইউরোপীয় প্রথায় শিক্ষিত করিয়াছিলেন। তাঁহার সৈন্য সংখ্যা ৫০ হাজারের অধিক ছিল। ইংরেজ সেনাপতি মেজর অ্যাডামস্ চারি হাজার সিপাহী ও সহস্রাধিক ইউরোপীয় সৈন্য লইয়া তাঁহার বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা করিলেন (জুলাই, ১৭৬৩ খ্রীষ্টাব্দ)।

মীর কাশিম মুর্শিদাবাদ রক্ষার জন্য বিশ্বাসী নায়কদের অধীনে বহুসংখ্যক সৈন্য সেখানে পাঠাইলেন এবং তাহাদিগকে কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠি অবরোধ করার আদেশ দিলেন। কাশিমবাজার সহজেই অধিকৃত হইল এবং বন্দী ইংরেজগণ মুঙ্গেরে প্রেরিত হইয়া তথা হইতে পাটনাতে নীত হইলেন।

নবাবী সৈন্যের সেনাপতি তকী খানের সহিত মুর্শিদাবাদের নায়েব নবাব সৈয়দ মুহম্মদ খানের সদ্ভব ছিল না–সৈয়দ মুহম্মদ তকী খানকে প্রতি পদে বাধা দিতে লাগিলেন এবং মুঙ্গের হইতে যে তিন দল সৈন্য তকী খানের সহিত যোগ দিতে আসিয়াছিল, তাহাদের নায়কগণকে কুপরামর্শ দিয়া তকী খানের শিবির হইতে দূরে রাখিলেন। অজয় নদের তীরে নবাবী সৈন্যের এই দলের সহিত একদল ইংরেজ সৈন্যের যুদ্ধ হইল। নবাবসৈন্যের সহিত কামান ছিল না-ইংরেজ সৈন্যের কামানের গোলায় তাহারা বিধ্বস্ত হইল। তথাপি নবাবসৈন্য অতুল সাহসে চারি ঘণ্টাকাল যুদ্ধ করিল। কিন্তু অবশেষে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করিল।

বিজয়ী ইংরেজ সৈন্য কলিকাতা হইতে আগত মেজর অ্যাডামূসের সৈন্যের সহিত যোগ দিল। ইহার দুই তিন দিন পরে ১৯শে জুলাই তকী খানের সহিত কাটোয়ার সন্নিকটে ইংরেজদের যুদ্ধ হইল। এই যুদ্ধে তকী খান অশেষ বীরত্ব ও সাহসের পরিচয় দেন। বহুক্ষণ যুদ্ধের পর তকী খান আহত হইলেন এবং তাঁহার অশ্ব নিহত হইল। তকী খান আর একটি অশ্বে চড়িয়া ভীমবেগে ইংরেজ সৈন্য আক্রমণ করিলেন। এই সময় আর একটি গুলি তাঁহার স্কন্ধদেশ বিদীর্ণ করিল। ক্ষতস্থানের রক্ত কাপড়ে ঢাকিয়া অনুচরগণের নিষেধ না শুনিয়া তকী খান পলায়নপর ইংরেজদিগকে অনুসরণ করিয়া একটি নদীর খাতের কাছে পৌঁছিলেন। সেখানে ঝোঁপের আড়ালে কতকগুলি ইংরেজ সৈন্য লুকাইয়া ছিল। তাঁহাদেরই একজন তকী খানকে লক্ষ্য করিয়া গুলি ছুঁড়িল-তকী খানের মৃত্যু হইল। অমনি তাঁহার সৈন্যদল ইতস্তত পলাইতে লাগিল। মুঙ্গের হইতে যে তিন দল সৈন্য আসিয়াছিল তাহারা যুদ্ধে কোন অংশগ্রহণ না করিয়া দূরে দাঁড়াইয়াছিল। তাহারাও এবারে পলায়ন করিল। ইংরেজরা কাটোয়ার যুদ্ধে জয়লাভ করিলেন।

এই যুদ্ধে নবাবসৈন্যের পরাজয় হইলেও তকী খান যে সাহস, সমরকৌশল ও প্রভুভক্তি দেখাইয়াছেন তাহা ঐ যুগে সত্য সত্যই দুর্লভ ছিল। মুঙ্গের হইতে আগত সেনাদলের নায়কেরা যদি তাঁহার সহায়তা করিতেন তবে যুদ্ধের ফল অন্যরূপ হইত। তাহাদের সহিত তুলনা করিলে তকী খানের বীরত্ব ও চরিত্র আরও উজ্জ্বল হইয়া উঠে। দুঃখের বিষয় সাহিত্য-সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চন্দ্রশেখর উপন্যাসে তকী খানের একটি অতি জঘন্য চিত্র আঁকিয়াছেন। ইহা সম্পূর্ণ অলীক ও অনৈতিহাসিক। এই বীরের ললাটে যে কলঙ্ক কালিমা বঙ্কিমচন্দ্র লেপিয়া দিয়াছেন তাহা কথঞ্চিত দূর করিবার জন্যই তকী খানের কাহিনী সবিস্তারে বিবৃত হইল।

কাটোয়ার যুদ্ধক্ষেত্র হইতে বিজয়ী ইংরেজ সৈন্য মুর্শিদাবাদের দিকে অগ্রসর হইল। মুর্শিদাবাদ রক্ষার জন্য যথেষ্ট সৈন্য ছিল; কিন্তু অযোগ্য ও অপদার্থ নায়েব নবাব সৈয়দ মুহম্মদ মুঙ্গেরে পলায়ন করিলেন। এক রকম বিনা যুদ্ধেই মুর্শিদাবাদ ইংরেজের হস্তগত হইল। মুর্শিদাবাদের অধিবাসীরা–বিশেষত হিন্দুগণ মীর কাশিমের হস্তে উৎপীড়িত হইয়াছিলেন। জগৎশেঠ, মহারাজা রাজবল্লভ প্রভৃতি সম্ভ্রান্ত হিন্দুগণকে মীর কাশিম মুঙ্গেরে কারারুদ্ধ করিয়া রাখিয়াছিলেন, কারণ তাঁহার মনে সন্দেহ হইয়াছিল যে ইহারা ইংরেজের পক্ষভুক্ত। সুতরাং মুর্শিদাবাদে মীরজাফর ও ইংরেজ সৈন্য বিপুল সংবর্ধনা পাইলেন।

কাটোয়ার যুদ্ধে ইংরেজদের বহু লোকক্ষয় হইয়াছিল–সুতরাং তাঁহারা দুই পল্টন নূতন সৈন্য সংগ্রহ করিয়া পুনরায় অগ্রসর হইলেন। গিরিয়ার প্রান্তরে দুই দলে যুদ্ধ হইল (২রা অগস্ট)। আসাদুল্লা ও মীর বদরুদ্দীন প্রভৃতি মীর কাশিমের কয়েকজন সেনানায়ক অতুল বিক্রমে যুদ্ধ করিলেন। মীর বদরুদ্দীন ইংরেজ সৈন্যের বামপার্শ্ব ভেদ করিয়া অগ্রসর হইলেন; এবং তখন ইংরেজ সৈন্য জলে ঝাঁপ দিয়া পড়িতে লাগিল। এই সময়ে ইংরেজ সৈন্যের দক্ষিণ পার্শ্ব আক্রমণ করিলেই জয় সুনিশ্চিত ছিল। কিন্তু তাঁহার পূর্বেই বদরুদ্দীন আহত হওয়ায় তাঁহার সৈন্যদের অগ্রগতি থামিয়া গেল। এই অবসরে মেজর অ্যাডাম্‌স প্রবলবেগে আক্রমণ করায় নবাবসৈন্য ছত্রভঙ্গ হইয়া পলায়ন করিল। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, নবাবসৈন্যের দুই প্রধান নায়ক সমরু ও মার্কার এ যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত থাকিয়াও যুদ্ধে বিশেষ কোন অংশগ্রহণ করেন নাই। অনেকে মনে করেন তাঁহারা নবাবের সহিত বিশ্বাসঘাতকতা করিয়াছেন কিন্তু এ সম্বন্ধে স্পষ্ট কোন প্রমাণ নাই।

গিরিয়ার যুদ্ধে পরাজিত নবাবসৈন্য কিছুদূর উত্তরে উধুয়ানালার দুর্গে আশ্রয় লইল। ইহার একধারে ভাগীরথী ও অপর পাশে উধুয়া নামক নালা এবং ইহারই মধ্য দিয়া মুর্শিদাবাদ হইতে পাটনা যাইবার বাদশাহী রাজপথ। রাজপথের পার্শ্বদেশেই প্রশস্ত ও গভীর নালা এবং তাঁহার পাশেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পর্বতমালা ক্রমশ বিস্তারিত হইতে হইতে উত্তরাভিমুখে চলিয়া গিয়াছে। এই দুর্ভেদ্য গিরিসঙ্কটে একটি ক্ষুদ্র দুর্গ ছিল। মীর কাশিম নূতন দুর্গ-প্রাচীর নির্মাণ করিয়া তদুপরি সারি সারি কামান সাজাইয়াছিলেন। এই প্রাচীর এত সুদৃঢ় ছিল যে দীর্ঘকাল গোলাবর্ষণেও তাহা ভগ্ন হইবার সম্ভাবনা ছিল না। বহু সংখ্যক নবাবীসৈন্য এই দুর্গরক্ষার জন্য পাঠান হইয়াছিল।

ইংরেজরা বহু গোলাবর্ষণ করিয়াও যখন দুর্গপ্রাচীর ভাঙ্গিতে পারিল না তখন নবাবসৈন্যের ধারণা হইল যে এই দুর্গ জয় করা ইংরেজের সাধ্য নহে। এইজন্য তাহারা আর পূর্বের ন্যায় সতর্কতার সহিত দুর্গ পাহারা দিত না এবং নৃত্যগীতে চিত্ত বিনোদন করিত। এই সময়ে এক বিশ্বাসঘাতক নবাবী সৈনিক দুর্গ হইতে গোপনে রাত্রিতে পলায়ন করিয়া ইংরেজ শিবিরে উপস্থিত হইল। সে ইংরেজ সেনাপতিকে জানাইল যে জলগণ্ডের এমন একটি অগভীর স্থান আছে, যেখানে হাঁটিয়া পার হওয়া যায়। সেই রাত্রিতেই ইংরেজ সেনা অস্ত্রশস্ত্র মাথায় করিয়া নিঃশব্দে ঐ স্বল্প গভীর স্থানে জলগণ্ড পার হইয়া দুর্গমূলে সমবেত হইল। নিদ্রামগ্ন প্রহরীদিগকে হত্যা করিয়া কয়েকজন ইংরেজ সৈনিক প্রাচীর বাহিয়া দুর্গমধ্যে প্রবেশ করিল এবং দুর্গদ্বার খুলিয়া দিল। অমনি বহু ইংরেজ সৈন্য দুর্গের ভিতরে প্রবেশ করিল; তখন নিদ্রিত নবাবীসৈন্য অতর্কিত আক্রমণে বিভ্রান্ত হইয়া পলায়ন করিতে লাগিল। নবাবের সেনানায়কগণ পলায়নের পথরোধ করিয়া ঘোষণা করিলেন, যে পলায়ন করিবে তাহাকেই গুলি করা হইবে। নিজ পক্ষের গুলিবর্ষণে বহু নবাবসৈন্য নিহত হইল, তথাপি তাহারা ইংরেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিবার জন্য অগ্রসর হইল না। আরাটুন, মার্কাট ও গরগিন খাঁ বিনাযুদ্ধে দুর্গ সমৰ্পণ করিয়া পলায়ন করিলেন। এইরূপে ৪০,০০০ সৈন্য ও শতাধিক কামান দ্বারা রক্ষিত এই দুর্ভেদ্য দুর্গ এক হাজার ইউরোপীয় ও চারি হাজার সিপাহী জয় করিল। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে উল্লিখিত বিদেশী দুই সেনানায়কের বিশ্বাসঘাতকতার ফলেই উধুয়ানালায় মীর কাশিমের পরাজয় হইয়াছিল। “গরগনি খা”র ভ্রাতা খোঁজা পি ইংরেজদের বন্ধু ছিলেন তিনি যে ইংরেজ সেনানায়ক অ্যাডাম্‌সের অনুরোধে উধুয়ানালায় মাটি ও আরাটুনের নিকট ইংরেজদের উপকার করিবার জন্য চিঠি লিখিয়াছিলেন, তাহা পরবর্তীকালে নিজেই স্বীকার করিয়াছেন।

এইরূপ পুনঃ পুনঃ পরাজয়ে ও সেনানায়কের বিশ্বাসঘাতকতার কাহিনী শুনিয়া মীর কাশিম উন্মত্তবৎ হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হইলেন। তিনি ৯ই সেপ্টেম্বর ইংরেজ সেনাপতিকে পত্র লিখিয়া জানাইলেন যে তাঁহার সৈন্যদের অত্যাচারে তিন মাস যাবৎ বাংলা দেশ বিধ্বস্ত হইতেছেযদি তাহারা এখনও নিবৃত্ত না হয় তাহা হইলে তিনি এলিস ও ইংরেজ বন্দীদের হত্যা করিবেন। তাঁহার সেনানায়কগণের বিশ্বাসঘাতকতায় তিনি সকলের উপরেই সন্দিহান হইয়া উঠিয়াছিলেন। এবং মুঙ্গের দুর্গে বন্দী জগৎশেঠ, মহারাজা রাজবল্লভ, স্বরূপচাঁদ, রামনারায়ণ প্রভৃতি সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদিগকে এবং আরও বহু বন্দীকে গলায় বালি বা পাথর ভরা বস্তা বাঁধিয়া দুর্গপ্রাকার হইতে গঙ্গাবক্ষে নিক্ষেপ করিয়া নির্মমভাবে হত্যা করিলেন। কাহারও কাহারও মতে জগৎশেঠকে গুলি করিয়া মারা হয়। তারপর আরাব আলি খাঁ নামক একজন সেনানায়কের হাতে মুঙ্গের দুর্গের ভার অর্পণ করিয়া পাটনায় গমন করিলেন। পথিমধ্যে দুইজন সৈন্য “গরগিন খা”কে হত্যা করে। ইংরেজ সৈন্য ১লা অক্টোবর মুঙ্গের দুর্গ অবরোধ করিল এবং আরাব আলি খাঁর বিশ্বাসঘাতকতায় ঐ দুর্গ অধিকার করিল। কতক নবাবীসৈন্য ইংরেজের পক্ষে যোগ দিয়া নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করিল। এই সংবাদ শুনিয়াই নবাব ইংরেজ বন্দীদিগকে হত্যা করিবার আদেশ দিলেন। নৃশংস সমরু অতি নিষ্ঠুরভাবে এই আদেশ পালন করিল। একমাত্র ডাক্তার ফুলার্টন ব্যতীত ইংরেজ নরনারী, বালকবালিকা সকলেই নিহত হইল (৫ই অক্টোবর, ১৭৬৩ খ্রীষ্টাব্দ)।

ইংরেজ সৈন্য ২৮শে অক্টোবর পাটনার নগরোপকণ্ঠে উপনীত হইল। মীর কাশিম ইহার পূর্বেই তাঁহার সুশিক্ষিত অশ্বারোহী সৈন্য লইয়া পলায়ন করিয়াছিলেন। পাটনার দুর্গ রক্ষার যথেষ্ট বন্দোবস্ত থাকা সত্ত্বেও ৬ই নভেম্বর ইংরেজ সৈন্য এই দুর্গ অধিকার করিল। তখনও মীর কাশিমের শিবিরে তাঁহার ৩০,০০০ সুশিক্ষিত সেনা এবং সমরুর সেনাদল ও মুঘল অশ্বারোহিগণ ছিল। কিন্তু পুনঃ পুনঃ পরাজয়ের ফলে ভগ্নোদ্যম হইয়া তিনি বাংলা দেশ ত্যাগ করাই স্থির করিলেন এবং অযোধ্যার নবাব উজীর শুজাউদ্দৌল্লার আশ্রয় ও সাহায্য ভিক্ষা করিয়া পত্র লিখিলেন। কর্মনাশা নদীর তীরে পৌঁছিয়া তিনি শুজাউদ্দৌল্লার উত্তর পাইলেন। শুজাউদ্দৌল্লা স্বহস্তে একখানি কোরাণের আবরণ-পৃষ্ঠায় মীর কাশিমকে আশ্রয় দানের প্রতিশ্রুতি লিখিয়া পাঠাইয়াছেন দেখিয়া মীর কাশিম আশ্বস্ত হইয়া বহু ধনরত্নসহ সপরিবারে এবং সুশিক্ষিত সেনাদল লইয়া এলাহাবাদে শিবির স্থাপন করিলেন। এই সময় সম্রাট শাহ আলম শুজাউদ্দৌল্লার আশ্রয়ে বাস করিতেছিলেন। এই তিন দল যাহাতে মিত্ৰতাবদ্ধ না হইতে পারে তাঁহার জন্য মীরজাফর, শাহ আলম ও শুজাউদ্দৌল্লা উভয়ের নিকটেই গোপনে দূত পাঠাইলেন।

মীর কাশিম বহু অর্থদানে উভয়ের পাত্রমিত্রকে বশীভূত করিলেন। তাঁহারা তাঁহাকে বাংলা দেশ উদ্ধারের জন্য সাহায্য করিবেন, এই মর্মে এক সন্ধি হইল।

এদিকে ইংরেজ সেনাপতি অ্যাডাম্‌সের মৃত্যু হওয়ায় মেজর কারন্যাক ঐ পদে নিযুক্ত হইলেন। তিনি প্রথমে বক্সারে শিবির স্থাপন করিয়াছিলেন, কিন্তু রসদের অভাবে পাটনায় ফিরিয়া আসিতে বাধ্য হইলেন। পাটনার পশ্চিমস্থ সমস্ত প্রদেশ বিনা যুদ্ধেই মীর কাশিমের হস্তগত হইল এবং তিনি ও অযোধ্যার নবাব মিলিত হইয়া পাটনায় ইংরেজ শিবির অবরোধ করিলেন। পরে বর্ষাকাল উপস্থিত হইলে বক্সারে শিবির সন্নিবেশ করিলেন। কিন্তু ইংরেজ সৈন্য তাঁহাদের পশ্চাদ্ধাবন করিল না।

বক্সার শিবিরে অবস্থানের সময় সমরু ও অন্যান্য কুচক্রীদের ষড়যন্ত্রে শুজাউদ্দৌল্লা মীর কাশিমের প্রতি খুবই খারাপ ব্যবহার করিতে লাগিলেন। যথেষ্ট অর্থ না দিতে পারায়, মীর কাশিমকে ভর্ৎসনা করিলেন। অর্থাভাবে সৈন্যদের বেতন দিতে না পারায় সমরু তাঁহার সেনাদল ও অস্ত্রশস্ত্র লইয়া শুজাউদ্দৌল্লার আশ্রয় গ্রহণ করিল। তারপর সমরু নূতন প্রভুর আদেশে পুরাতন প্রভুর শিবির লুণ্ঠন করিয়া মীর কাশিমকে বন্দী করিয়া শুজাউদ্দৌল্লার শিবিরে লইয়া গেল। শুজাউদ্দৌল্লা নিরুদ্বেগে বক্সারে নৃত্যগীত উপভোগ করিতে লাগিলেন।

ইতিমধ্যে মেজর মনরো কারন্যাকের পরিবর্তে সেনাপতি নিযুক্ত হইয়া বক্সার অভিমুখে অগ্রসর হইলেন। আরার নিকটে নবাবসৈন্য তাঁহাকে বাধা দিতে গিয়া পরাজিত হইল। ইংরেজ সেনা বক্সারের নিকট পৌঁছিলে শুজাউদ্দৌল্লা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হইলেন। ১৭৬৪ খ্রীষ্টাব্দের ২২শে অক্টোবর তারিখের প্রাতে মীর কাশিমকে মুক্তি দিয়া শুজাউদ্দৌল্লা ইংরেজদিগকে আক্রমণ করিলেন। যুদ্ধে ইংরেজদের জয়। হইল। শাহ আলম অমনি ইংরেজদের সঙ্গে যোগ দিলেন। শুজাউদ্দৌল্লা ও মীর কাশিম রোহিলখণ্ডে পলায়ন করিলেন। ইংরেজ সৈন্য অযোধ্যা বিধ্বস্ত করিল। মীর কাশিম কিছুদিন রোহিলখণ্ডে ছিলেন–তাঁহার পরে সম্ভবত ১৭৭৭ খ্রীষ্টাব্দে অতি দরিদ্র অবস্থায় দিল্লির এক জীর্ণ কুটিরে তাঁহার মৃত্যু হয়।

ইংরেজের সহিত মীর কাশিমের যুদ্ধে একটি বিশেষ ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। পলাশীতে ক্লাইব মীরজাফর ও রায়দুর্লভের বিশ্বাসঘাতকতার ফলেই জিতিয়াছিলেন–এবং সেখানে বিশেষ কোন যুদ্ধও হয় নাই। কিন্তু মীর কাশিমের সৈন্যদল ইংরেজ সৈন্যের তিন চার গুণ বেশী ছিল। তাহারা বীর বিক্রমে যুদ্ধ করিয়াছিল। সুতরাং তাহাদের পুনঃ পুনঃ পরাজয় এই সিদ্ধান্তই সমর্থন করে যে ইংরেজরা সামরিক শক্তি ও নৈপুণ্যে ভারতীয় অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ছিল এবং বাহুবলেই বাংলা দেশে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন।

মীর কাশিমের পতনের অনতিকাল পরে গভর্নর ভ্যানসিটার্ট তাঁহার সম্বন্ধে যাহা লিখিয়াছেন, তাঁহার সারমর্ম এই—”নবাব কোন দিন আমাদের ব্যবসায়ের কোন অনিষ্ট করেন নাই। কিন্তু আমরা প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত অতি সামান্য ও তুচ্ছ কারণে প্রতিদিন তাঁহার শাসনব্যবস্থায় পদাঘাত করিয়াছি এবং তাঁহার কর্মচারীদের যথেষ্ট নিগ্রহ করিয়াছি। বহু দিন পর্যন্ত নবাব অপমান ও লাঞ্ছনা সহ্য করিয়াছেন, কারণ তাঁহার আশা ছিল যে আমি এই সমুদয় দূর করিতে পারি। তিনি প্রতিবাদ করিয়াছেন, কিন্তু প্রতিশোধ লন নাই।

“এই যুদ্ধের জন্য যে আমরাই দায়ী–এলিসের পাটনা আক্রমণই যে এই যুদ্ধের কারণ তাহা কেহই অস্বীকার করিতে পারে নাই। যে কোন নিরপেক্ষ ব্যক্তি মীর কাশিমের দিক হইতে ঘটনাগুলি বিচার করিবেন, তিনিই বলিবেন যে এলিসের পাটনা আক্রমণ বিশ্বাসঘাতকতার একটি চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত এবং ইহা হইতেই প্রমাণিত হয় যে আমরা যে সব সন্ধি ও শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করিয়াছি তাহা স্তোকবাক্য মাত্র এবং মীর কাশিমকে প্রতারিত করিয়া তাঁহার সর্বনাশ সাধনের উপায় মাত্র।

“যখন আমাদের সহিত মীর কাশিমের যুদ্ধ বাধিল তখন তিনি বক্তিগত ভাবে কোন সাহস ও বীরত্বের পরিচয় দেন নাই। কিন্তু তাঁহার সৈন্যদল যে সাহস ও প্রভুভক্তি দেখাইয়াছেন হিন্দুস্থানে তাঁহার দৃষ্টান্ত খুবই বিরল। তাঁহার রাজ্যের দূরতম প্রদেশে তাঁহার কোন প্রজা পাটনায় যুদ্ধে পরাজয় ও তাঁহার পলায়নের চেষ্টার পূর্বে বিদ্রোহ করে নাই বা আমাদের সঙ্গে যোগ দেয় নাই। প্রজারা যে তাঁহাকে ভালবাসিত ইহা তাঁহারই পরিচয়।

“মুঙ্গেরের হত্যাকাণ্ডের পূর্বে মীর কাশিম কোন নিষ্ঠুরতার পরিচয় দেন নাই। কিন্তু তিন বৎসর পর্যন্ত তিনি যাহা সহ্য করিয়াছিলেন, তাঁহার কথা এবং তাঁহার গুরুতর ভাগ্য বিপর্যয়ের কথা স্মরণ করিলে এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডজনিত অপরাধও তত গুরুতর মনে হইবে না। ধনসম্পদশালী দেশের আধিপত্য হইতে কপর্দকহীন ভিখারী অবস্থায় প্রাণের জন্য পলায়ন-এই আকস্মিক দুর্ঘটনায় মস্তিষ্ক বিকৃত হইবার ফলে ও সাময়িক উত্তেজনার ফলে তিন বৎসরের পূঞ্জীভূত অপমানের প্রতিহিংসা গ্রহণে প্রণোদিত হইয়াই তিনি এই দুষ্কার্য করিয়াছিলেন, এ কথা স্মরণ করিলে আমরা তাঁহার চরিত্র সম্বন্ধে সঠিক ধারণা করিত পারিব।”

ভ্যানসিটার্টের এই উক্তি মোটামুটিভাবে সত্য বলিয়া গ্রহণ করা যায়। কিন্তু মীর কাশিম যে নিষ্ঠুর প্রকৃতির ছিলেন না ইহা পুরাপুরি স্বীকার করা যায় না। অর্থ সংগ্রহের জন্য তিনি বহু নিষ্ঠুর কার্য করিয়াছিলেন। রামনারায়ণ যতদিন ইংরেজের আশ্রিত ছিলেন মীর কাশিম তাঁহার কোন অনিষ্ট করিতে পারেন নাই। যে কোন কারণেই হউক, ইংরেজরা যখনই রামনারায়ণকে আশ্রয় হইতে বঞ্চিত করিল তখনই মীর কাশিম তাঁহার সর্বস্ব লুণ্ঠন করিয়া তাহাকে বন্দী করিলেন। তারপর ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধে হরিয়া পলায়ন করিবার পূর্বে তিনি কেবল ইংরেজ বন্দীদিগকে নহে, রামনারায়ণ, জগৎশেঠ, রাজবল্লভ প্রভৃতি রাজ্যের কয়েকজন প্রধান প্রধান ব্যক্তিকে নিমর্মভাবে হত্যা করেন। সুতরাং তাঁহার বিরুদ্ধে নিষ্ঠুরতার অভিযোগ একেবারে অস্বীকার করা যায় না।

এই প্রসঙ্গে সমসাময়িক মুসলমান ঐতিহাসিক সৈয়দ গোলাম হোসেনের মন্ত ব্য বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। তিনি মীর কাশিমের কয়েকজন বিশিষ্ট সভাসদের সহিত ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত ছিলেন এবং নবাবের অপকীর্তি ও সঙ্কীর্তি উভয়েরই উল্লেখ করিয়াছেন। তিনি লিখিয়াছেন

“মীর কাশিম বঙ্গীয় সেনানায়ক ও সিপাহী দলের প্রভুভক্তিতে বিশ্বাস করিতেন না বলিয়া, অনেক সময়ে সামান্য কারণে অনেকের প্রাণদণ্ড করিতেও ইতস্তত করেন নাই। কিন্তু দেওয়ানী ও ফৌজদারী বিচারকার্যে অথবা পণ্ডিত সমাজের মর্যাদা রক্ষা কার্যে তিনি যেরূপ ন্যায়বিচারের দৃষ্টান্ত রাখিয়া গিয়াছেন তাহাতে তাঁহাকে তৎসময়ের আদর্শ নরপতি বলিলেও অত্যুক্তি করা হইবে না। তিনি সপ্তাহে দুই দিবস যথারীতি বিচারাসনে উপবেশন করিতেন। নিম্নপদস্থ বিচারকগণের বিচার কার্যের পর্যালোচনা করিতেন। স্বয়ং অর্থী, প্রত্যর্থ ও তাহাদের সাক্ষীগণের বাদানুবাদ শ্রবণ করিয়া বিচার কার্য সম্পাদনা করিতেন। তাঁহার আমলে কোন রাজকচারী উৎকোচ গ্রহণ করিয়া ‘হাঁ’কে ‘না’ করিয়া দিতে পারিতেন না। জমিদারদিগের উৎপীড়ন হইতে দুর্বল প্রজাদিগকে রক্ষা করা তাঁহার বিশেষ প্রিয় কার্য মধ্যে পরিগণিত হইয়াছিল। সিরাজউদ্দৌলা বহু ব্যয়ে যে ইমামবাড়ী প্রস্তুত করিয়াছিলেন, তিনি তাঁহার গৃহসজ্জা বিক্রয় করিয়া দরিদ্রদিগকে বিতরণ করিয়া দিয়াছিলেন।”

মীর কাশিম ইংরেজদের হস্তে পদে পদে যেভাবে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হইয়াছিলেন তাহাতে স্বতঃই তাঁহার প্রতি আমাদের সহানুভূতি হয়। কিন্তু স্মরণ রাখিতে হইবে যে ইংরেজদের যে সকল কার্যের বিরুদ্ধে তিনি তীব্র প্রতিবাদ ও পুনঃ পুনঃ অভিযোগ করিয়াছেন, বেআইনী হইলেও মীরজাফরের আমল হইতেই তাহা প্রচলিত ছিল। মীরজাফর নবাব হইয়া যে সমুদয় পরওয়ানা দিয়াছিলেন তাহাতে বাংলা দেশের অভ্যন্তরে বিনা শুল্কে কোম্পানীর বাণিজ্য করিবার অধিকার স্বীকৃত হইয়াছে। আর কোম্পানীর কর্মচারীরা মীরজাফরের আমল হইতে এরূপ অবৈধ বাণিজ্য করিয়াছে এবং নবাবের কর্মচারীরা বাধা দিলে নিজেরাই তাঁহাদের বিচার করিয়া শাস্তি দিয়াছে।

মীর কাশিম যখন ইংরেজ কর্মচারীদিগকে ঘুষ দিয়া তাহাদের অনুগ্রহে মীরজাফরকে সরাইয়া নিজে নবাব হইয়াছিলেন তখন তাঁহার বোঝা উচিত ছিল যে ন্যায় হউক অন্যায় হউক ইংরেজ যে সব সুযোগ সুবিধা পাইয়াছে তাহা কখনও ত্যাগ করিবে না। বরং নূতন নূতন সুবিধার দাবি করিবে। নবাবী লাভের মূল্যস্বরূপ তিনিও অনেক নূতন সুবিধা ও অধিকার ইংরেজকে দিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। ইংরেজের বেআইনী ব্যবসা বন্ধ করিতে হইলে তাহাদের সহিত যে সন্ধির ফলে তিনি নবাব হইয়াছিলেন, সেই সন্ধিতেই তাঁহার উল্লেখ করা উচিত ছিল। তিনি বেশ জানিতেন ইংরেজ কখনও তাহাতে রাজী হইবে না। সন্ধির সময়ে এ প্রসঙ্গ না ভোলায় তিনি প্রকারান্তরে ইহা মানিয়াই লইয়াছিলেন। সুতরাং পরে এই বিষয় লইয়া আপত্তি করার স্বপক্ষে যুক্তি থাকিতে পারে, কিন্তু ন্যায়ের বা আইনের দোহাই দিয়া নিজেকে সম্পূর্ণ নিরপরাধ ও উৎপীড়িতের পর্যায়ে ফেলা যায় না।

নিজের প্রভু, রাজা ও শ্বশুরের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া তিনি যে গুরুতর অপরাধ করিয়াছিলেন তাহা কোন রকমেই ক্ষমা করা যাইতে পারে না। কেহ কেহ মনে করেন বাংলার স্বাধীনতা রক্ষার জন্য তাঁহার প্রাণপণ চেষ্টা দ্বারা তিনি তাঁহার অপরাধের ক্ষালন করিয়াছেন। অবশ্য সিরাজউদ্দৌলার পরবর্তী নবাবদের সহিত তুলনা করিলে এ বিষয়ে তাঁহার শ্রেষ্ঠত্ব অবিসংবাদিত। বঙ্কিমচন্দ্র মীর কাশিমকে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব’ আখ্যা দিয়া বাঙালীর হৃদয়ে তাঁহাকে উচ্চ স্থান দিয়াছেন। কিন্তু পূর্বে মীর কাশিমের নবাবী সম্বন্ধে যাহা বলা হইয়াছে তাহা স্মরণ করিলে বলিতে হইবে যে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রদত্ত উপাধি কেবল আংশিকভাবে সত্য। মীর কাশিমের চার বৎসর নবাবীর মধ্যে প্রায় তিন বৎসর স্বাধীনভাবে তিনি বিশেষ কিছুই করিতে পারেন নাই। তিনি স্বাধীনতা লাভের জন্য চেষ্টা করিয়াছিলেন; কিন্তু কৃতকার্য হইতে পারেন নাই। ১৭৬৩ খ্রীষ্টাব্দের পূর্বে মীর কাশিমকে স্বাধীন নবাব বলিয়া মনে করিবার কোন সঙ্গত কারণ নাই।

মীর কাশিমের পর (১৭৬৪-৬৬)

মীর কাশিমের সহিত যুদ্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরেই কলিকাতা কাউনসিল তাঁহাকে সিংহাসনচ্যুত করিয়া মীরজাফরকে পুনরায় মসনদে প্রতিষ্ঠিত করিতে সংকল্প করেন। তদনুসারে ১৭৬৩ খ্রীষ্টাব্দের ১০ই জুলাই মীরজাফরের সহিত ইংরেজদের এক নূতন সন্ধি হয়। মীরজাফর ইংরেজ সৈন্যের ব্যয় নির্বাহাৰ্থ বর্ধমান, মেদিনীপুর ও চট্টগ্রাম জেলা ইংরেজদিগকে দিলেন। ইংরেজদিগকে বিনা শুঙ্কে বাংলা দেশে বাণিজ্য করিতে (কেবল লবণের উপর আড়াই টাকা শুঙ্ক থাকিবে) অনুমতি দিলেন। ১২,০০০ অশ্বারোহী ও ১২,০০০ পদাতিকের বেশি সৈন্য না রাখিতে স্বীকৃত হইলেন। ইংরেজের একজন প্রতিনিধিকে মুর্শিদাবাদে স্থায়ীরূপে বসবাস করিতে অনুমতি দিলেন; এবং ইংরেজ কোম্পানীকে ত্রিশ লক্ষ টাকা দিতে রাজী হইলেন। এই সমুদয় শর্তের বিনিময়ে ইংরেজগণ মীর কাশিমকে পদচ্যুত করিয়া মীরজাফরকে পুনরায় নবাব করিতে প্রতিশ্রুত হইলেন।

সন্ধির শর্ত ব্যতীত মীরজাফরের অনুরোধে কোম্পানী আরও কয়েকটি প্রস্তাবে স্বীকৃত হইল।

১। মীরজাফর খোঁজা পিকে সৈন্য বিভাগে এবং মহারাজা নন্দকুমারকে দিওয়ানী বিভাগে নিযুক্ত করিতে পারিবেন।

২। যদি নবাবের কোন প্রজা বা কর্মচারী কলিকাতায় আশ্রয় গ্রহণ করে, তবে নবাব দাবি করিলে তাহাকে (নবাবের নিকট) ফেরৎ পাঠাইতে হইবে।

৩। নবাবের কোন কর্মচারীর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ থাকিলে ইংরেজরা সরাসরি তাঁহার বিচার করিতে পারিবেন না।

৪। নবাব ইংরেজ গভর্নরের নিকট সৈন্য-সাহায্য চাহিলে অবিলম্বে তাহা পাঠাইতে হইবে এবং ইহার ব্যয় বাবদ নবাবকে কিছুই দিতে হইবে না।

বলা বাহুল্য, এই দ্বিতীয় বার নবাবী লাভের জন্যও মীরজাফরকে সন্ধির শর্ত অনুযায়ী ত্রিশ লক্ষ ব্যতীত আরও অনেক টাকা দিতে হইল।

মীরজাফর মেজর অ্যাডসের সৈন্যদলের সঙ্গে ১৭৬৪ খ্রীষ্টাব্দের ২৪শে জুলাই মুর্শিদাবাদে পৌঁছিয়া প্রাসাদে বাস করিতে লাগিলেন। নগরে কিছু গোলযোগ, মারামারি ও লুঠপাট আরম্ভ হইল কিন্তু ধনী ও অভিজাত সম্প্রদায় স্বস্তি র নিঃশ্বাস ফেলিলেন এবং যথারীতি নূতন নবাবের দরবারে উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে অভিনন্দন জানাইলেন।

মীরজাফর ইংরেজ সৈন্যের সঙ্গে পাটনায় পৌঁছিলেন এবং সুবাদারীর সনদ পাইবার জন্য শুজাউদ্দৌল্লার সঙ্গে গোপনে কথাবার্তা চালাইতে লাগিলেন। বাদশাহকে বার্ষিক ২৭ লক্ষ এবং উজীরকে ২ লক্ষ টাকা দিবার শর্তে তিনি প্রার্থিত বাদশাহী সনদ প্রাপ্ত হইলেন। কিন্তু ইংরেজ কাউনসিল ইহা অনুমোদন করিলেন না। শুজাউদ্দৌল্লা ও বাদশাহের সহিত এরূপ গোপন কথাবার্তায় সন্দিহান হইয়া ইংরেজরা মীরজাফরের অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁহাকে পাটনা ত্যাগ করিয়া কলিকাতায় আসিতে বাধ্য করিল। তারপর বক্সার যুদ্ধের পর শাহ্ আলম উজীরের সঙ্গ ত্যাগ করিয়া বারাণসীতে অবস্থান করিতেছিলেন। মীরজাফর ইংরেজদের অনুমতি লইয়া তাঁহার নিকট সুবাদারীর আবেদন জানাইয়া লোক পাঠাইলেন। বাদশাহ এই আবেদন মঞ্জুর করিয়া সুবাদারীর সনদ ও খিলাৎ পাঠাইলেন (জানুয়ারী, ১৭৬৫ খ্রীষ্টাব্দ)। অল্পদিনের মধ্যেই মীরজাফরের গুরুতর পীড়া হইল। মত্যু আসন্ন জানিয়া তিনি ইংরেজ কর্মচারী ও প্রধান ব্যক্তির সম্মুখে নাবালক পুত্র নজমুদ্দৌল্লাকে উত্তরাধিকারী ঘোষণা করিয়া তাহাকে মসনদে বসাইলেন এবং নন্দকুমারকে তাঁহার দিওয়ান মনোনীত করিলেন। ১৭৬৫ খ্রীষ্টাব্দের ৫ই ফেব্রুয়ারী মীরজাফরের মৃত্যু হইল। কথিত আছে যে মৃত্যুর অনতিকাল পূর্বে তিনি মহারাজা নন্দকুমারের অনুরোধে মুর্শিদাবাদের নিকটবর্তী কিরীটেশ্বরীর মন্দির হইতে দেবীর চরণামৃত আনাইয়া পান করিয়াছিলেন।

মীরজাফরের মৃত্যুর পর ইংরেজ কাউসিল নজমদ্দৌল্লাকে এই শর্তে নবাব করিলেন যে তিনি নামে নবাব থাকিবেন, কিন্তু সমস্ত শাসনক্ষমতা একজন নায়েব সুবাদারের হস্তে থাকিবে। ইংরেজের অনুমোদন ব্যতীত তিনি কোন নায়েব সুবাদার নিযুক্ত বা বরখাস্ত করিতে পারিবেন না। অর্থাৎ পরোক্ষভাবে ইংরেজই বাংলার শাসনভার গ্রহণ করিল। এই শর্তে নবাবী করিবার জন্য নজমুদ্দৌল্লা ইংরেজ গভর্নর ও অন্যান্য সদস্যগণকে প্রায় চৌদ্দ লক্ষ টাকা উপঢৌকন দিলেন।

অতঃপর গভর্নর ভ্যানসিটার্ট অনুগত বাদশাহ শাহ্ আলমকে অযোধ্যা প্রদেশ দান করিবেন, এইরূপ প্রতিশ্রুতি দিলেন। কিন্তু শীঘই তাঁহার স্থানে ক্লাইব পুনরায় গভর্নর হইয়া কলিকাতায় আসিলেন (মে, ১৭৬৫ খ্রীষ্টাব্দ)। তিনি এই ব্যবস্থা উল্টাইয়া শুজাউদ্দৌল্লার সঙ্গে সন্ধি করিলেন। তাঁহাকে তাঁহার রাজ্য ফিরাইয়া দেওয়া হইল, বিনিময়ে তিনি নগদ ৫০ লক্ষ টাকা এবং এলাহাবাদের উপর অধিকার ছাড়িয়া দিলেন। তারপর ক্লাইব শাহ্ আলমের সহিত সন্ধি করিলেন। এলাহাবাদ ও চতুস্পার্শ্ববর্তী ভূখণ্ড শাহ্ আলমকে দেওয়া হইল। তৎপরিবর্তে বাদশাহ ইংরেজ কোম্পানীকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দিওয়ান নিযুক্ত করিয়া এক ফরমান দিলেন। নবাবের সহিত সন্ধির ফলে বাংলার সৈন্যবল ও শাসনক্ষমতা পূর্বেই ইংরেজের হস্তগত হইয়াছিল।

দিওয়ানী পাইবার পর রাজস্ব আদায়ের ভারও ইংরেজরা পাইল। স্থির হইল যে প্রতি বত্সর আদায়ী রাজস্ব হইতে মুর্শিদাবাদের নাম-সর্বস্ব নবাব ৫৩ লক্ষ এবং দিল্লির নাম-সর্বস্ব বাদশাহ ২৬ লক্ষ টাকা পাইবেন। বাকী টাকা ইংরেজরা ইচ্ছামত ব্যয় করিবে। নবাবের বার্ষিক বৃত্তি কমাইয়া ১৭৬৬ খ্রীষ্টাব্দে ৪১ লক্ষ এবং ১৭৬৯ খ্রীষ্টাব্দে ৩২ লক্ষ করা হইয়াছিল। প্রকৃতপেক্ষ বাংলার নবাবী আমল ১৭৬৫ খ্রীষ্টাব্দেই শেষ হইল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *