০৯. মুঘল (মোগল) যুগ

নবম পরিচ্ছেদ – মুঘল (মোগল) যুগ

মুঘল শাসনের আরম্ভ ও অরাজকতা

১৫৭৬ খ্রীষ্টাব্দে দাউদ খানের পরাজয় ও নিধনের ফলে বাংলাদেশে মুঘল সম্রাটের অধিকার প্রবর্তিত হইল। কিন্তু প্রায় কুড়ি বত্সর পর্যন্ত মুঘলের রাজ্যশাসন এদেশে দৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। বাংলাদেশে একজন মুঘল সুবাদার ছিলেন এবং অল্প কয়েকটি স্থানে সেনানিবাস স্থাপিত হইয়াছিল। কিন্তু কেবল রাজধানী ও এই সেনানিবাসগুলির নিকটবর্তী জনপদসমূহ মুঘল শাসন মানিয়া চলিত; অন্যত্র অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা চরমে পৌঁছিয়াছিল। দলে দলে আফগান সৈন্য লুটতরাজ করিয়া ফিরিত–মুঘল সৈন্যেরাও এইভাবে অর্থ উপার্জন করিত। বাংলার জমিদারগণ স্বাধীন হইয়া “জোর যার মুল্লুক তার” এই নীতি অনুসরণপূর্বক পার্শ্ববর্তী অঞ্চল দখল করিতে সর্বদাই সচেষ্ট ছিলেন। এক কথায় বাংলা দেশে আটশত বৎসর পরে আবার মাৎস্য-ন্যায়ের আবির্ভাব হইল।

দাউদ খানকে পরাজিত ও নিহত করিবার পরে, তিন বৎসরের অধিককাল দক্ষতার সহিত শাসন করিবার পর খান-ই-জহানের মৃত্যু হইল (১৯শে ডিসেম্বর, ১৫৭৮ খ্রী)। পরবর্তী সুবাদার মুজাফফর খান এই পদের সম্পূর্ণ অযোগ্য ছিলেন। এই সময় সম্রাট আকবর এক নূতন শাসননীতি মুঘল সাম্রাজ্যের সর্বত্র প্রচলিত করেন–সমগ্র দেশ কতকগুলি সুবায় বিভক্ত হইল এবং প্রতি সুবায় সিপাহসালার বা সুবাদার ছাড়াও বিভিন্ন বিভাগের প্রধান অধ্যক্ষগণ দিল্লি হইতে নির্বাচিত হইয়া আসিল। রাজস্ব আদায়েরও নূতন ব্যবস্থা হইল। এতদিন পর্যন্ত প্রাদেশিক মুঘল কর্মচারিগণ যে রকম বেআইনী ক্ষমতা যথেচ্ছ পরিচালনা ও অন্যান্য রকমে অর্থ উপার্জন করিতেন তাহা রহিত হইল। ফলে সুবে বাংলা ও বিহারের মুঘল কর্মচারিগণ বিদ্রোহ ঘোষণা করিল। আকবরের ভ্রাতা, কাবুলের শাসনকর্ত্তা মীর্জা হাকিম একদল ষড়যন্ত্রকারীর প্ররোচনায় নিজে দিল্লির সিংহাসনে বসিবার উদ্যোগ করিতেছিলেন। তাঁহার দলের লোকেরা বিদ্রোহীদের সাহায্য করিল। মুজাফফর খান বিদ্রোহীদের সহিত যুদ্ধে পরাজিত হইলেন। বিদ্রোহীরা তাঁহাকে বধ করিল (১৯শে এপ্রিল, ১৫৮০ খ্র.)। মীর্জা হাকিম সম্রাট বলিয়া বিঘোষিত হইলেন। বাংলায় নূতন সুবাদার নিযুক্ত হইল। মীর্জা হাকিমের পক্ষ হইতে একজন উকিল রাজধানীতে প্রতিষ্ঠিত হইলেন। এইরূপে বাংলা ও বিহার মুঘল সাম্রাজ্য হইতে বিচ্ছিন্ন হইল। ইহার ফলে আবার অরাজকতা উপস্থিত হইল। আফগান বা পাঠানরা আবার উড়িষ্যা দখল করিল।

এক বৎসরের মধ্যেই বিহারের বিদ্রোহ অনেকটা প্রশমিত হইল। ১৫৮২ খ্রীষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে আকবর খান-ই-আজমকে সুবাদার নিযুক্ত করিয়া বাংলায় পাঠাইলেন। তিনি তেলিয়াগড়ির নিকট যুদ্ধে মাসুম-কাবুলীর অধীনে সম্মিলিত পাঠান বিদ্রোহীদিগকে পরাজিত করিলেন (২৪ এপ্রিল, ১৫৮৩ খ্রী)। কিন্তু বিদ্রোহ একেবারে দমিত হইল না। মাসুম কাবুলী ঈশা খানের সঙ্গে যোগ দিলেন। পরবর্তী সুবাদার শাহবাজ খান বহুদিন যাবৎ ঈশা খানের সঙ্গে যুদ্ধ করিলেন। কিন্তু তাঁহাকে পরাস্ত করিতে না পারিয়া রাজধানী টাণ্ডায় ফিরিয়া গেলেন। সুযোগ বুঝিয়া মাসুম ও অন্যান্য পাঠান নায়কেরা মালদহ পর্যন্ত অগ্রসর হইলেন। উড়িষ্যায় পাঠান কুলু খান লোহানী বিদ্রোহ করিয়া প্রায় বর্ধমান পর্যন্ত অগ্রসর হইয়াছিলেন কিন্তু পরাজিত হইয়া মুঘলের বশ্যতা স্বীকার করিলেন (জুন, ১৫৮৪ খ্রী)।

১৫৮৫ খ্রীষ্টাব্দে বাংলায় বিদ্রোহ দমন করিবার জন্য আকবর অনেক নূতন ব্যবস্থা করিলেন, কিন্তু বিশেষ কোন ফল হইল না। অবশেষে শাহবাজ খান যুদ্ধের পরিবর্তে তোষণ-নীতি অবলম্বন ও উৎকোচ প্রদান দ্বারা বহু পাঠান বিদ্রোহী নায়ককে বশীভূত করিলেন। ঈশা খান ও মাসুম কাবুলী উভয়েই মুঘলের বশ্যতা স্বীকার করিলেন (১৫৮৬ খ্রী)। কিন্তু পাঠান নায়ক কুলু উড়িষ্যায় নিরুপদ্রবে রাজ্য করিতে লাগিলেন। তিনিও বাংলার দিকে অগ্রসর হইলেন না-শাহবাজ খানও তাঁহার বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠাইলেন না। সুতরাং ১৫৮৬ খ্রীষ্টাব্দে বাংলায় মুঘল আধিপত্য পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হইল। ১৫৮৭ খ্রীষ্টাব্দের শেষভাগে বাংলা দেশে অন্যান্য সুবার ন্যায় নূতন শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হইল। শাসন-সংক্রান্ত সমস্ত কার্য কতকগুলি বিভাগে বিভক্ত হইল এবং প্রত্যেক বিভাগ নির্দিষ্ট একজন কর্মচারীর অধীনস্থ হইল। সর্বোপরি সিপাহসালার (পরে সুবাদার নামে অভিহিত) এবং তাঁহার অধীনে দিওয়ান (রাজস্ব বিভাগ), বশী সৈন্যবিভাগ), সদর ও কাজী (দিওয়ানী ও ফৌজদারী বিচার), কোতোয়াল (নগর রক্ষা) প্রভৃতি অধ্যক্ষগণ নিযুক্ত হইলেন।

নূতন ব্যবস্থা অনুসারে ওয়াজিব খান প্রথম সিপাহসালার নিযুক্ত হইলেন–কিন্তু অনতিকাল মধ্যেই তাঁহার মৃত্যু হইলে (আগস্ট, ১৫৮৭ খ্রী) সৈয়দ খান ঐ পদে নিযুক্ত হইলেন। তাঁহার সুদীর্ঘ শাসনকাল (১৫৮৭-১৫৯৪ খ্রী) বাংলা দেশে আবার পাঠানরা ও জমিদারগণ শক্তিশালী হইয়া উঠিল।

মানসিংহ ও বাংলা দেশে মুঘল রাজ্যের গোড়াপত্তন

১৫৯৪ খ্রীষ্টাব্দে রাজা মানসিংহ বাংলাদেশের শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত হইলেন। পাঁচ হাজার মুঘলসৈন্যকে বাংলাদেশে জায়গীর দিয়া প্রতিষ্ঠিত করা হইল। রাজধানী টাণ্ডায় পৌঁছিয়াই তিনি বিদ্রোহীদিগকে দমন করিবার জন্য চতুর্দিকে সৈন্য পাঠাইলেন। তাঁহার পুত্র হিম্মৎসিংহ ভূষণা দুর্গ দখল করিলেন (এপ্রিল, ১৫৯৫ খ্রী)। ১৫৯৫ খ্রীষ্টাব্দের ৭ই নভেম্বর মানসিংহ রাজমহলে নূতন এক রাজধানীর পত্তন করিয়া ইহার নাম দিলেন আকবরনগর। শীঘ্রই এই নগরী সমৃদ্ধ হইয়া উঠিল। অতঃপর তিনি ঈশা খানের বিরুদ্ধে অগ্রসর হইলেন এবং পাঠানদিগকে ব্রহ্মপুত্রের পূর্বে আশ্রয় লইতে বাধ্য করিলেন। ঈশা খানের জমিদারীর অধিকাংশ মুঘল রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হইল। অন্যান্য স্থানেও বিদ্রোহীরা পরাজিত হইল। ১৫৯৬ খ্রীষ্টাব্দের বর্ষাকালে মানসিংহ ঘোড়াঘাটের শিবিরে গুরুতররূপে পীড়িত হন। এই সংবাদ পাইয়া মাসুম খান ও অন্যান্য বিদ্রোহীরা বিশাল রণতরী লইয়া অগ্রসর হইল। মুঘলদের রণতরী না থাকায় বিদ্রোহীরা বিনা বাধায় ঘোড়াঘাটের মাত্র ২৪ মাইল দূরে আসিয়া পৌঁছিল। কিন্তু ইতিমধ্যে জল কমিয়া যাওয়ায় তাহারা ফিরিয়া যাইতে বাধ্য হইল। মানসিংহ সুস্থ হইয়াই বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠাইলেন। তাহারা বিতাড়িত হইয়া এগারসিন্দুরের (ময়মনসিংহ) জঙ্গলে পলাইয়া আত্মরক্ষা করিল।

অতঃপর ঈশা খান নূতন এক কূটনীতি অবলম্বন করিলেন। শ্রীপুরের জমিদারবারো ভূঞার অন্যতম কেদার রায়কে ঈশা খান আশ্রয় দিলেন। কোচবিহারের রাজা লক্ষ্মীনারায়ণ মুঘলের পক্ষে ছিলেন। তাঁহার জ্ঞাতি ভ্রাতা রঘুদেবের সঙ্গে একযোগে ঈশা খান কোচবিহার আক্রমণ করিলেন। লক্ষ্মীনারায়ণ মানসিংহের সাহায্য প্রার্থনা করিলেন। ১৫৯৬ খ্রীষ্টাব্দের শেষভাগে মানসিংহ সৈন্য লইয়া অগ্রসর হওয়ায় ঈশা খান পলায়ন করিলেন। কিন্তু মুঘলসৈন্য ফিরিয়া গেলে আবার রঘুদেব ও ঈশা খান কোচবিহার আক্রমণ করিলেন। ইহার প্রতিরোধের জন্য মানসিংহ তাঁহার পুত্র দুর্জনসিংহের অধীনে ঈশা খানের বাসস্থান কাভু দখল করিবার জন্য স্থলপথে ও জলপথে সৈন্য পাঠাইলেন। ১৫৯৭ খ্রীষ্টাব্দের ৫ই সেপ্টেম্বর ঈশা খান ও মাসুম খানের সমবেত বিপুল রণতরী মুঘল রণতরী ঘিরিয়া ফেলিল। দুর্জনসিংহ নিহত হইলেন এবং অনেক মুঘলসৈন্য বন্দী হইল। কিন্তু চতুর ঈশা খান বন্দীদিগকে মুক্তি দিয়া এবং কোচবিহার আক্রমণ বন্ধ করিয়া মুঘল সম্রাটের বশ্যতা স্বীকার পূর্বক সন্ধি করিলেন। ইহার দুই বৎসর পর ঈশা খানের মৃত্যু হইল (সেপ্টেম্বর, ১৫৯৯ খ্রী)।

ভূষণা-বিজেতা মানসিংহের বীর পুত্র হিম্মৎসিংহ কলেরায় প্রাণত্যাগ করেন। (মার্চ, ১৫৯৭ খ্রী)। ছয় মাস পরে দুর্জনসিংহের মৃত্যু হইল। দুই পুত্রের মৃত্যুতে শোকাতুর মানসিংহ সম্রাটের অনুমতিক্রমে বিশ্রামের জন্য ১৫৯৮ খ্রীষ্টাব্দে আজমীর গেলেন। তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্র জগৎসিংহ তাঁহার স্থানে নিযুক্ত হইলেন। কিন্তু অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে আগ্রায় তাঁহার মৃত্যু হইলে তাঁহার বালক পুত্র মহাসিংহ মানসিংহের অধীনে বাংলার শাসনকর্ত্তার পদে নিযুক্ত হইলেন। এই সুযোগে বাংলা দেশে পাঠান বিদ্রোহীরা আবার মাথা তুলিল এবং একাধিকবার মুঘলসৈন্যকে পরাজিত করিল। উড়িষ্যার উত্তর অংশ পর্যন্ত পাঠানের হস্তগত হইল।

এই সমুদয় বিপর্যয়ের ফলে মানসিংহ বাংলায় ফিরিয়া আসিতে বাধ্য হইলেন। পূর্ববঙ্গের বিদ্রোহীরা গুরুতররূপে পরাজিত হইল (ফেব্রুয়ারী, ১৬০১ খ্রী)। পরবর্তী বৎসর মানসিংহ ঢাকা জিলায় শিবির স্থাপন করিলেন। শ্রীপুরের জমিদার কেদার রায় বশ্যতা স্বীকার করিলেন। মানসিংহের পৌত্র মালদহের বিদ্রোহীদিগকে পরাস্ত করিলেন। এদিকে উড়িষ্যার পরলোকগত পাঠান নায়ক কুলু খানের ভ্রাতুষ্পুত্র উসমান ব্ৰহ্মপুত্র নদী পার হইয়া মুঘল থানাদারকে পরাজিত করিয়া ভাওয়ালে আশ্রয় লইতে বাধ্য করিলেন। মানসিংহ তৎক্ষণাৎ ভাওয়াল যাত্রা করিলেন এবং উসমান গুরুতররূপে পরাজিত হইলেন। অনেক পাঠান নিহত হইল এবং বহুসংখ্যক পাঠান রণতরী ও গোলাবারুদ মানসিংহের হস্তগত হইল। ইতিমধ্যে কেদার রায় বিদ্রোহী হইয়া ঈশা খানের পুত্র মুসা খান, কুলু খানের উজীরের পুত্র দাউদ খান এবং অন্যান্য জমিদারগণের সহিত যোগ দিলেন। মানসিংহ ঢাকায় পৌঁছিয়াই ইহাদের বিরুদ্ধে সৈন্য প্রেরণ করিলেন। কিন্তু বহুদিন পর্যন্ত তাহারা ইছামতী নদী পার হইতে না পারায় মানসিংহ স্বয়ং শাহপুরে উপস্থিত হইয়া নিজের হাতি ইছামতীতে নামাইয়া দিলেন। মুঘল সৈনিকেরা ঘোড়ায় চড়িয়া তাঁহার অনুসরণ করিল। এইরূপ অসম সাহসে নদী পার হইয়া মানসিংহ বিদ্রোহীদিগকে পরাস্ত করিয়া বহুদূর পর্যন্ত তাহাদের পশ্চাদ্ধাবন করিলেন (ফেব্রুয়ারী, ১৬০২ খ্রী)।

এই সময় আরাকানের মগ জলদস্যুরা জলপথে ঢাকা অঞ্চলে বিষম উপদ্রব সৃষ্টি করিল এবং ডাঙ্গায় নামিয়া কয়েকটি মুঘল ঘাঁটি লুঠ করিল। মানসিংহ তাহাদের বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠাইয়া বহুকষ্টে তাহাদিগকে পরাস্ত করিলেন এবং তাহারা নৌকায় আশ্রয় গ্রহণ করিল। কেদার রায় তাঁহার নৌবহর লইয়া মগদের সঙ্গে যোগ দিলেন এবং শ্রীনগরের মুঘল ঘাঁটি আক্রমণ করিলেন। মানসিংহও কামান ও সৈন্য পাঠাইলেন। বিক্রমপুরের নিকট এক ভীষণ যুদ্ধে কেদার রায় আহত ও বন্দী হইলেন। তাঁহাকে মানসিংহের নিকট লইয়া যাইবার পূর্বেই তাঁহার মৃত্যু হইল (১৬০৩ খ্রী)। তাঁহার অধীনস্থ বহু পর্তুগীজ জলদস্যু ও বাঙালী নাবিক হত হইল।

অতঃপর মানসিংহ মগ রাজাকে নিজ দেশে ফিরিয়া যাইতে বাধ্য করিলেন। তারপর তিনি উসমানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আয়োজন করিলেন। উসমান পলাইয়া গেলেন। এইরূপে বাংলাদেশে অনেক পরিমাণে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়া আসিল।

জাহাঙ্গীরের রাজত্বের প্রারম্ভে বাংলা দেশের অবস্থা

মুঘল সম্রাট আকবরের মৃত্যুর পর তাঁহার পুত্র সেলিম জাহাঙ্গীর’ নাম ধারণ করিয়া সিংহাসনে আরোহণ করিলেন (১৬০৫ খ্রী)। এই সময় শের আফগান ইস্তলজু নামক একজন তুর্কী জায়গীরদার বর্ধমানে বাস করিতেন। তাঁহার পত্নী অসামান্য রূপবতী ছিলেন। কথিত আছে, জাহাঙ্গীর তাহাকে বিবাহের পূর্বেই দেখিয়া মুগ্ধ হইয়াছিলেন। সম্ভবত এই নারীর হস্তগত করিবার জন্যই মানসিংহকে সরাইয়া জাহাঙ্গীর তাঁহার বিশ্বস্ত ধাত্রী-পুত্র কুলুদ্দীন খান কোকাকে বাংলা দেশের সুবাদার নিযুক্ত করিলেন। কুলুদ্দীন খান বর্ধমানে শের আফকানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। উভয়ের মধ্যে বচসা ও বিবাদ হয় এবং উভয়েই নিহত হন (১৬০৭ খ্র)। শের আফকানের পত্নী আগ্রায় মুঘল হারেমে কয়েক বৎসর অবস্থান করার পর জাহাঙ্গীরের সহিত তাঁহার বিবাহ হয় এবং পরে নূরজাহান নামে তিনি ইতিহাসে বিখ্যাত হন।

কুলুদ্দীনের মৃত্যুর পর জাহাঙ্গীর কুলী খান বাংলা দেশের সুবাদার হইয়া আসেন। কিন্তু এক বৎসরের মধ্যেই তাঁহার মৃত্যু হয় এবং তাঁহার স্থলে ইসলাম খান বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হইয়া ১৬০৮ খ্রীষ্টাব্দের জুন মাসে কার্যভার গ্রহণ করেন। তাঁহার কার্যকাল মাত্র পাঁচ বৎসর–কিন্তু এই অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি মানসিংহের আরব্ধ কার্য সম্পূর্ণ করিয়া বাংলা দেশে মুঘলরাজের ক্ষমতা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন।

ইসলাম খানের সুবাদারীর প্রারম্ভে বাংলা দেশ নাম ত মুঘল সাম্রাজ্যের অন্ত ভুক্ত হইলেও প্রকৃতপক্ষে রাজধানী রাজমহল, মুঘল ফৌজদারদের অধীনস্থ অল্প কয়েকটি থানা অর্থাৎ সুরক্ষিত সৈন্যের ঘাটি ও তাঁহার চতুর্দিকে বিস্তৃত সামান্য ভূখণ্ডেই মুঘলরাজের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ ছিল। ইহার বাহিরে অসংখ্য বড় ও ছোট জমিদার এবং বিদ্রোহী পাঠান নায়কেরা প্রায় স্বাধীনভাবেই রাজ্য পরিচালনা করিতেন। মুঘল থানার মধ্যে করতোয়া নদীর তীরবর্তী ঘোড়াঘাট (দিনাজপুর জিলা), আলপসিং ও সেরপুর অতাই (ময়মনসিংহ), ভাওয়াল (ঢাকা), ভাওয়ালের ২২ মাইল উত্তরে অবস্থিত টোক এবং পদ্মা, লক্ষ্যা ও মেঘনা নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত বর্তমান নারায়ণগঞ্জের নিকটবর্তী ত্রিমোহানি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

যে সকল জমিদার মুঘলের বশ্যতা স্বীকার করিলেও সুযোগ ও সুবিধা পাইলেই বিদ্রোহী হইতেন, তাঁহাদের মধ্যে ইঁহারা সমধিক শক্তিশালী ছিলেন।

১। পূর্ব্বোক্ত ঈশা খানের পুত্র মুসা খান : বর্তমান ঢাকা ও ত্রিপুরা জিলার অর্ধেক, প্রায় সমগ্র মৈমনসিংহ জিলা এবং রংপুর, বগুড়া ও পাবনা জিলার কতকাংশ তাঁহার জমিদারীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। বাংলা দেশের তৎকালীন জমিদারগণ বারো ভূঞা নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন, যদিও সংখ্যায় তাঁহারা ঠিক বারো জন ছিলেন না। মুসা খান ছিলেন ইহাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ও অনেকেই তাহাকে নেতা বলিয়া মানিত। এই সকল সহায়ক জমিদারের মধ্যে ভাওয়ালের বাহাদুর গাজী, সরাইলের সুনা গাজী, চাটমোহরের মীর্জা মুমিন (মাসুম খান কাপুলীর পুত্র), খলসির মধু রায়, চাঁদ প্রতাপের বিনোদ রায়, ফতেহাবাদের (ফরিদপুর) মজলিস কুত্ত্ব এবং মাতঙ্গের জমিদার পলওয়ানের নাম করা যাইতে পারে।

২। ভূষণার জমিদার সত্রাজিৎ এবং সুসঙ্গের জমিদার রাজা রঘুনাথ : উঁহারা সহজেই মুঘলের বশ্যতা স্বীকার করেন এবং অন্যান্য জমিদারদের বিরুদ্ধে মুঘল সৈন্যের সহায়তা করেন। সত্রাজিতের কাহিনী পরে বলা হইবে।

৩। রাজা প্রতাপাদিত্য : বর্তমান যশোহর, খুলনা ও বাখরগঞ্জ জিলার অধিকাংশই তাঁহার জমিদারীর অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং বর্তমান যমুনা ও ইছামতী নদীর সঙ্গমস্থলে ধূমঘাট নামক স্থানে তাঁহার রাজধানী ছিল। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যে তাঁহার শক্তি, বীরত্ব ও দেশভক্তির যে উচ্ছ্বসিত বর্ণনা দেখিতে পাওয়া যায়, তাঁহার অধিকাংশেরই কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নাই।

৪। বাখরগঞ্জ জিলার অন্তর্গত বাকলার জমিদার রামচন্দ্র : ইনি রাজা প্রতাপাদিত্যের প্রতিবেশী ও সম্পর্কে জামাতা ছিলেন। ইনি বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ ছিলেন। কবিবর রবীন্দ্রনাথ “বৌঠাকুরাণীর হাট” নামক উপন্যাসে তাঁহার যে চিত্র আঁকিয়াছেন তাহা সম্পূর্ণ কাল্পনিক ও অনৈতিহাসিক।

৫। ভুলুয়ার জমিদার অনন্তমাণিক্য : বর্তমান নোয়াখালি জিলা তাঁহার জমিদারীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইনি লক্ষণমাণিক্যের পুত্র।

৬। আরও অনেক জমিদার : তাঁহাদের কথা প্রসঙ্গক্রমে পরে বলা হইবে।

৭। বিদ্রোহী পাঠান নায়কগণ : বর্তমান শ্রীহট্ট (সিলেট) জিলাই ছিল ইঁহাদের শক্তির প্রধান কেন্দ্রস্থল। ইঁহাদের মধ্যে বায়াজিদ কররানী ছিলেন সর্বপ্রধান। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেক পাঠান নায়কই তাহাকে নেতা বলিয়া স্বীকার করিত। তাঁহার প্রধান সহযোগী ছিলেন খাজা উসমান। বঙ্কিমচন্দ্র দুর্গেশনন্দিনী উপন্যাসে ইহাকে অমর করিয়া গিয়াছেন। উসমানের পিতা খাজা ঈশা উড়িষ্যার শেষ পাঠান রাজা কুলু খানের ভ্রাতা ও উজীর ছিলেন এবং মানসিংহের সহিত সন্ধি করিয়াছিলেন। সন্ধির পূর্বেই কুলু খানের মৃত্যু হইয়াছিল। খাজা ঈশার মৃত্যুর পর পাঠানেরা আবার বিদ্রোহী হইল। মানসিংহ তাহাদিগকে পরাজিত করিলেন। ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য তিনি উসমান ও অন্য কয়েকজন পাঠান নায়ককে উড়িষ্যা হইতে দূরে রাখিবার জন্য পূর্ব বাংলায় জমিদারি দিলেন; পরে উড়িষ্যার এত নিকটে তাহাদিগকে রাখা নিরাপদ মনে করিয়া এই আদেশ নাকচ করিলেন। ইহাতেই বিদ্রোহী হইয়া তাহারা সাতগাঁওয়ে লুঠপাট করিতে আরম্ভ করিল, সেখান হইতে বিতাড়িত হইয়া ভূষণা লুঠ করিল এবং ঈশা খানের সঙ্গে যোগ দিল। ব্রহ্মপুত্রের পূর্বে বর্তমান মৈমনসিংহ জিলার অন্তর্গত বোকাই নগরে উসমান দুর্গ নির্মাণ করিলেন। তিনি আজীবন ঈশা খান ও মুসা খানের সহায়তায় মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিয়াছেন। পাঠান নায়ক পূর্ব্বোক্ত বায়াজিদ, বানিয়াচঙ্গের আনওয়ার খান ও শ্রীহট্টের অন্যান্য পাঠান নায়কদের সঙ্গে উসমানের বন্ধুত্ব ছিল। এইরূপে উড়িষ্যা হইতে বিতাড়িত হইয়া পাঠান শক্তি ব্রহ্মপুত্রের পূর্বভাগে প্রতিষ্ঠিত হইল।

বাংলা দেশের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত রাজধানী রাজমহল হইতে পূর্বে ত্রিপুরা ও চট্টগ্রামের সীমা পর্যন্ত বিস্তৃত ভূভাগের অধিকাংশই মুঘল রাজশক্তির বিরুদ্ধবাদী বিদ্রোহী নায়কদের অধীন ছিল। রাজমহলের দক্ষিণে ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে তিনজন বড় জমিদার ছিলেন–মল্লভূম ও বাঁকুড়ার বীর হাম্বীর, ইঁহার দক্ষিণ পশ্চিমে পাঁচেতে শাম্স্ খান এবং ইহার দক্ষিণ-পূর্বে হিজলীতে সেলিম খান। ইহারা মুখে মুঘলের বশ্যতা স্বীকার করিতেন, কিন্তু কখনও সুবাদার ইসলামের খানের দরবারে উপস্থিত হইতেন না।

ইসলাম খানের কার্যকলাপ-বিদ্রোহী জমিদারদের দমন

সুবাদার ইসলাম খান রাজমহলে পৌঁছিবার অল্পকাল পরেই সংবাদ আসিল যে পাঠান উসমান খান সহসা আক্রমণ করিয়া মুঘল থানা আলপসিং অধিকার করিয়াছেন ও থানাদারকে বধ করিয়াছেন। ইসলাম খান অবিলম্বে সৈন্য পাঠাইয়া থানাটি পুনরুদ্ধার করিলেন এবং বাংলাদেশে মুঘল প্রভুত্বের স্বরূপ দেখিয়া ইহা দৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত করিতে মনস্থ করিলেন।

ইসলাম খান প্রথমেই মুসা খানকে দমন করিবার জন্য একটি সুচিন্তিত পরিকল্পনা ও ব্যাপক আয়োজন করিলেন। রাজা প্রতাপাদিত্য মুঘলের বশ্যতা স্বীকার করিয়া কনিষ্ঠ পুত্র সংগ্রামাদিত্যকে উপঢৌকনসহ ইসলাম খানের দরবারে পাঠাইলেন। স্থির হইল তিনি সৈন্যসামন্ত ও যুদ্ধের সরঞ্জাম লইয়া স্বয়ং আলাইপুরে গিয়া ইসলাম খানের সহিত সাক্ষাৎ এবং মুসা খানের বিরুদ্ধে অভিযানে যোগদান করিবেন। জামিন স্বরূপ সঞ্জামাদিত্য ইসলাম খানের দরবারে রহিল। বর্ষা শেষ হইলে ইসলাম খান এবং বৃহৎ সৈন্যদল, বহুসংখ্যক রণতরী ও বড় বড় ভারবাহী নৌকায় কামান বন্দুক লইয়া রাজমহল হইতে ভাটি অর্থাৎ পূর্ব বাংলার দিকে অগ্রসর হইলেন। মালদহ জিলায় গৌড়ের নিকট পৌঁছিয়া ইসলাম খান পশ্চিম বাংলার পূর্ব্বোক্ত তিনজন জমিদারের বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠাইলেন। বীর হাম্বীর ও সেলিম খান বিনা যুদ্ধে এবং শাম্স্ খান পক্ষাধিক কাল গুরুতর যুদ্ধ করার পর মুঘলের বশ্যতা স্বীকার করিলেন। মালদহ হইতে দক্ষিণে মুর্শিদাবাদ জিলার মধ্য দিয়া অগ্রসর হইয়া ইসলাম খান পদ্মা নদী পার হইলেন এবং রাজশাহী জিলার অন্তর্গত পদ্মা-তীরবর্তী আলাইপুরে পৌঁছিলেন (১৬০৯ খ্রী)। নিকটবর্তী পুঁটিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা জমিদার পীতাম্বর, ভাতুড়িয়া রাজ-পরগণার অন্তর্গত চিলাজুয়ারের জমিদার অনন্ত ও আলাইপুরের জমিদার ইলাহ্ বখশ ইসলাম খানের বশ্যতা স্বীকার করিলেন।

আলাইপুরে অবস্থানকালে ইসলাম খান ভূষণার জমিদার রাজা সত্রাজিতের বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠাইলেন। সত্রাজিতের পিতা মুকুন্দলাল পার্শ্ববর্তী ফতেহাবাদের (ফরিদপুর) মুঘল ফৌজদারের মৃত্যুর পর তাঁহার পুত্রগণকে হত্যা করিয়া উক্ত স্থান অধিকার করিয়াছিলেন। মানসিংহের নিকট বশ্যতা স্বীকার করিলেও তিনি স্বাধীন রাজার ন্যায় আচরণ করিতেন। তিনি ভূষণা দুর্গ সুদৃঢ় করিয়াছিলেন। মুঘলসৈন্য আক্রমণ করিলে সত্রাজিৎ প্রথমে বীরবিক্রমে তাহাদিগকে বাধা দিলেন কিন্তু পরে মুঘলের বশ্যতা স্বীকার করিলেন এবং ইসলাম খানের সৈন্যের সঙ্গে যোগ দিয়া পাবনা জিলার কয়েকজন জমিদারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিলেন।

পূর্ব প্রতিশ্রুতি মত রাজা প্রতাপাদিত্য আত্রাই নদীর তীরে ইসলাম খানের শিবিরে উপস্থিত হইলেন। স্থির হইল তিনি নিজ রাজ্যে ফিরিয়াই চারশত রণতরী পাঠাইবেন। পুত্ৰ সংগ্ৰামাদিত্যের অধীনে মুঘল নৌ-বহরের সহিত একত্র মিলিত হইয়া তাহারা যুদ্ধ করিবে। তারপর ইসলাম খান যখন পশ্চিমে ঘোড়াঘাট হইতে মুসা খানের রাজ্য আক্রমণ করিবেন, সেই সময় প্রতাপাদিত্য আড়িয়াল খাঁ নদীর পাড় দিয়া ২০,০০০ পাইক, ১০০০ ঘোড়সওয়ার এবং ১০০ রণতরী লইয়া ঈশা খানের রাজ্যের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত শ্রীপুর ও বিক্রমপুর আক্রমণ করিবেন।

বর্ষাকাল শেষ হইলে ইসলাম খান প্রধান মুঘল বাহিনীসহ করতোয়ার তীর দিয়া দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হইয়া পদ্মা, ধলেশ্বরী ও ইছামতী নদীর সঙ্গমস্থল কাটাসগড়ে উপস্থিত হইলেন-মুঘল নৌ-বাহিনীও তাঁহার অনুসরণ করিল। ইহার নিকটবর্তী যাত্রীপুরে ইছামতীর তীরে মুসা খানের এক সুদৃঢ় দুর্গ ছিল। এই দুর্গ আক্রমণ করাই মুঘল বাহিনীর উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু মুসা খানকে বিপথে চালিত করিবার জন্য ক্ষুদ্র একদল সৈন্য ও রণতরী ঢাকা নগরীর দিকে পাঠানো হইল।

মুসা খান যাত্রীপুর রক্ষার বন্দোবস্ত করিয়া তাঁহার বিশ্বস্ত ১০/১২ জন জমিদারের সঙ্গে ৭০০০ রণতরী লইয়া কাটাসগড়ে মুঘলের শিবির আক্রমণ করিলেন। প্রথম দিন যুদ্ধের পর মুসা খান রাতারাতি নিকটবর্তী ডাকচেরা নামক স্থানে পরিখাবেষ্টিত একটি সুরক্ষিত মাটির দুর্গ নির্মাণ করিলেন এবং পর পর দুই দিন প্রভাতে এই দুর্গ হইতে বাহির হইয়া ভীমবেগে মুঘলসৈন্যদিগকে আক্রমণ করিলেন। গুরুতর যুদ্ধে উভয় পক্ষেই বহু সৈন্য হতাহত হইল। অবশেষে মুসা খান ডাকচেরা ও যাত্রীপুর দুর্গে আশ্রয় লইলেন। মুঘলসৈন্য পুনঃ পুনঃ ডাকচেরা দুর্গ আক্রমণ করিয়াও অধিকার করিতে পারিল না। কিন্তু যখন মুসা খান ডাকচেরা রক্ষায় ব্যাপৃত তখন অকস্মাৎ আক্রমণ করিয়া ইসলাম খান যাত্রীপুর দুর্গ দখল করিলেন। তারপর অনেকদিন যুদ্ধের পর বহু সৈন্য ক্ষয় করিয়া ডাকচেরা দুর্গও দখল করিলেন। এই দুর্গ দখলের ফলে মুসা খানের শক্তি ও প্রতিপত্তি যথেষ্ট হ্রাস পাইল। ঢাকা নগরীও মুঘল বাহিনী দখল করিল। ইসলাম খান ঢাকায় পৌঁছিয়া শ্রীপুর ও বিক্রমপুর আক্রমণের জন্য সৈন্য পাঠাইলেন। মুসা খান রাজধানী রক্ষার ব্যবস্থা করিয়া লক্ষ্যা নদীতে তাঁহার রণতরী সমবেত করিলেন। এই নদীর অপর তীরে শক্রদলের সম্মুখীন হইয়া কিছুদিন থাকিবার পর মুঘলসৈন্য রাত্রিকালে অকস্মাৎ আক্রমণ করিয়া মুসা খানের পৈত্রিক বাসস্থান কাভু এবং পর পর আরও কয়েকটি দুর্গ দখল করায় মুসা খান পলায়ন করিতে বাধ্য হইলেন এবং তাঁহার রাজধানী সোনারগাঁও সহজেই মুঘলের করতলগত হইল। মুসা খান ইহার পরও মুঘলদের কয়েকটি থানা আক্রমণ করিলেন, কিন্তু পরাস্ত হইয়া মেঘনা নদীর একটি দ্বীপে আশ্রয় হইলেন। তাঁহার পক্ষে জমিদারেরাও একে একে মুঘলের বশ্যতা স্বীকার করিলেন।

অতঃপর ইসলাম খান ভুলুয়ার জমিদার অনন্তমাণিক্যের বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠাইলেন। আরাকানের রাজা অনন্তমাণিক্যকে সাহায্য করিলেন। অনন্তমাণিক্য একটি সুদৃঢ় দুর্গের আশ্রয়ে থাকিয়া ঘোরতর যুদ্ধ করিলেন। মুঘলসৈন্য ঐ দুর্গ দখল করিতে না পারিয়া উৎকোচদানে ভুলুয়ার একজন প্রধান কর্মচারীকে হস্তগত করিল। ফলে অনন্তমাণিক্যের পরাজয় হইল। তিনি আরাকান রাজ্যে পলাইয়া গেলেন। এখন তাঁহার রাজ্য ও সম্পদ সকলই মুঘলের হস্তগত হইল।

অনন্তমাণিক্যের পরাজয়ে মুসা খান নিরাশ হইয়া মুঘলের নিকট আত্মসমর্পণ করিলেন। ইসলাম খান মুসা খান ও তাঁহার মিত্রগণের রাজ্য তাহাদিগকে জায়গীর রূপে ফিয়াইয়া দিলেন। কিন্তু মুঘলসৈন্য এই সকল জায়গীর রক্ষায় নিযুক্ত হইল, জায়গীরদারদের রণতরী মুঘল নৌ-বহরের অংশ হইল এবং সৈন্যদের বিদায় করিয়া দেওয়া হইল। মুসা খানকে ইসলাম খানের দরবারে নজরবন্দী করিয়া রাখা হইল। এইরূপে এক বৎসরের (১৬১০-১১ খ্রী) যুদ্ধের ফলে বাংলাদেশে মুঘলের প্রধান শত্রু দূরীভূত হইল।

মুসা খানের সহিত যুদ্ধ শেষ হইবার পরেই ইসলাম খান পাঠান উসমানের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করিলেন। উসমান পদে পদে বাধা দেওয়া সত্ত্বেও মুঘল বাহিনী তাঁহার রাজধানী বোকাইনগর দখল করিল (নভেম্বর, ১৬১১ খ্রী)। উসমান শ্রীহট্টের পাঠান নায়ক বায়াজিদ কররানীর আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। ক্রমে ক্রমে অন্যান্য বিদ্রোহী পাঠান নায়কেরাও মুঘলের বশ্যতা স্বীকার করিল। কিন্তু পাঠান বিদ্রোহীদের সমূলে ধ্বংস করা আপাতত স্থগিত রাখিয়া ইসলাম খান যশোহরের রাজা প্রতাপাদিত্যকে দমন করিতে অগ্রসর হইলেন।

প্রতাপাদিত্য ইসলাম খানকে কথা দিয়াছিলেন যে তিনি স্বসৈন্যে অগ্রসর হইয়া মুসা খানের বিরুদ্ধে যোগ দিবেন। কিন্তু তিনি এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন নাই। সুতরাং ইসলাম খান তাঁহার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার আয়োজন করিলেন। মুসা খান ও অন্যান্য জমিদারদের পরিণাম দেখিয়া প্রতাপাদিত্য ভীত হইলেন এবং ৮০টি রণতরীসহ পুত্ৰ সংগ্ৰামাদিত্যকে ক্ষমা প্রার্থনা করিবার জন্য ইসলাম খানের নিকট পাঠাইলেন। কিন্তু ইসলাম খান ইহাতে কর্ণপাত না করিয়া উক্ত রণতরীগুলি ধ্বংস করিলেন।

প্রতাপাদিত্য খুব শক্তিশালী রাজা ছিলেন; সুতরাং ইসলাম খান এক বিরাট সৈন্যদলকে তাঁহার রাজ্য আক্রমণ করিতে পাঠাইলেন; সঙ্গে সঙ্গে প্রতাপাদিত্যের জামাতা বাকলার রাজা রামচন্দ্রের বিরুদ্ধে একদল সৈন্য প্রেরণ করিলেন। এই সময় চিলাজুয়ারের জমিদার অনন্ত ও পীতাম্বর বিদ্রোহ করায় যশোহর-অভিযানে কিছু বিলম্ব ঘটিল। কিন্তু ঐ বিদ্রোহ দমনের পরেই জলপথে ও স্থলপথে মুঘলসৈন্য অগ্রসর হইল। মুঘল নৌবাহিনী পদ্মা, জলঙ্গী ও ইছামতী নদী দিয়া বনগাঁর দশ মাইল দক্ষিণে যমুনা ও ইছামতীর সঙ্গমস্থলের নিকট শালকা (বর্তমান টিবি নামক স্থানে) পৌঁছিল। এইখানে প্রতাপাদিত্যের জ্যেষ্ঠ পুত্র উদয়াদিত্য একটি সুদৃঢ় দুর্গ নির্মাণ করিয়া তাঁহার সৈন্যের অধিকাংশ, বহু হস্তী, কামান এবং ৫০০ রণতরী সহ। অপেক্ষা করিতেছিলেন। তিনি সহসা মুঘলের রণতরী আক্রমণ করিয়া ইহাকে বিপর্যস্ত করিয়া তুলিলেন। কিন্তু ইছামতীর দুই তীর হইতে মুঘল বাহিনীর গোলা ও বাণ বর্ষণে উদয়াদিত্যের নৌবহর বেশী দূর অগ্রসর হইতে পারিল না এবং ইহার অধ্যক্ষ খাজা কামালের মৃত্যুতে ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়িল। উদয়াদিত্য শালকার দুর্গ ত্যাগ করিয়া পালন করিলেন। অধিকাংশ রণতরী, গোলাগুলি প্রভৃতি মুঘলের হস্তগত হইল।

ইতিমধ্যে বাকলার বিরুদ্ধে অভিযান শেষ হইয়াছিল। বাকলার অল্পবয়স্ক রাজা রামচন্দ্রের মাতার অনিচ্ছাসত্ত্বেও মুঘল বাহিনীর সহিত সাতদিন পর্যন্ত একটি দুর্গের আশ্রয়ে যুদ্ধ করিয়াছিলেন। মুঘলেরা ঐ দুর্গ অধিকার করিলে রামচন্দ্রের মাতা পুত্রকে বলিলেন মুঘলের সঙ্গে সন্ধি না করিলে তিনি বিষ পান করিবেন। রামচন্দ্র আত্মসমর্পণ করিলেন। ইসলাম খান তাঁহাকে ঢাকায় বন্দী করিয়া রাখিলেন এবং বাকলা মুঘল রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হইল। বাকলার যুদ্ধ শেষ করিয়া মুঘল বাহিনী পূর্বদিক হইতে প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে অগ্রসর হইল।

এই নূতন বিপদের সম্ভাবনায়ও বিচলিত না হইয়া প্রতাপাদিত্য পুনরায় রাজধানীর পাঁচ মাইল উত্তরে কাগরঘাটায় একটি দুর্গ নির্মাণ করিয়া মুঘলবাহিনীকে বাধা দিতে প্রস্তুত হইলেন। কিন্তু মুঘল সেনানায়কগণ অপূর্ব সাহস ও কৌশলের বলে এই দুর্গটিও দখল করিল। প্রতাপাদিত্য তখন মুঘলের নিকট আত্মসমর্পণ করিলেন। স্থির হইল যে মুঘল সেনাপতি গিয়াস খান নিজে তাঁহাকে ইসলাম খানের নিকট লইয়া যাইবেন, এবং যতদিন ইসলাম খান কোন আদেশ না দেন, ততদিন পর্যন্ত মুঘল বাহিনী কাগরঘাটায় এবং উদয়াদিত্য রাজধানী ধূমঘাটে থাকিবেন। ইসলাম খান প্রতাপাদিত্যকে বন্দী এবং তাঁহার রাজ্য দখল করিলেন। প্রবাদ এই যে, প্রতাপাদিত্যকে ঢাকায় একটি লোহার খাঁচায় বন্ধ করিয়া রাখা হইয়াছিল এবং পরে বন্দী অবস্থায় দিল্লি পাঠান হয়, কিন্তু পথিমধ্যে বারাণসীতে তাঁহার মৃত্যু হয়।

প্রতাপাদিত্য যথেষ্ট শক্তি ও প্রতিপত্তিশালী ছিলেন এবং শেষ অবস্থায় মুঘলদের সহিত বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়াছিলেন। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে তাঁহাকে যে প্রকার বীর ও স্বাধীনতাপ্রিয় দেশভক্তরূপে চিত্রিত করা হইয়াছে, উল্লিখিত কাহিনী তাঁহার সমর্থন করে না।

এক মাসের মধ্যেই (ডিসেম্বর, ১৬১১ খ্রীষ্টাব্দ–জানুয়ারী, ১৬১২ খ্রীষ্টাব্দ) যশোহর ও বাকলার যুদ্ধ শেষ হইল। কিন্তু শ্রীপুর, বিক্রমপুর ও ভুলুয়া ছাড়িয়া মুঘল বাহিনী চলিয়া আসায় সুযোগ পাইয়া আরাকানের মগ দস্যুগণ এই সমুদয় অঞ্চল আক্রমণ করিয়া বিধ্বস্ত করিল। ইসলাম খান তাহাদের বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠাইলেন। কিন্তু সৈন্য পৌঁছিবার পূর্বেই তাহারা পলায়ন করিল।

অতঃপর ইসলাম খান পাঠান উসমানের বিরুদ্ধে এক বিপুল সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করিলেন। শ্রীহট্টের অন্তর্গত দৌলম্বাপুরে এক ভীষণ যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে উসমানের অপূর্ব বীরত্ব ও রণকৌশলে মুঘল বাহিনী পরাস্ত হইয়া নিজ শিবিরে প্রস্থান করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে উসমান এই যুদ্ধে নিহত হন এবং রাত্রে তাঁহার সৈন্যেরা যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ করে (১২ই মার্চ, ১৬১২ খ্রীষ্টাব্দ)। উসমানের পুত্র ও ভ্রাতাগণ প্রথমে যুদ্ধ চালাইবার জন্য প্রস্তুত হইয়াছিল, কিন্তু পাঠান নায়কদের মধ্যে বিবাদ-বিসংবাদের ফলে তাহা হইল না–তাঁহারা মুঘলের বশ্যতা স্বীকার করিলেন। ইসলাম খান উসমানের রাজ্য দখল করিলেন এবং তাঁহার ভ্রাতা ও পুত্রগণকে বন্দী করিয়া রাখিলেন। শ্রীহট্টের অন্যান্য পাঠান নায়কদের বিরুদ্ধেও ইসলাম খান সৈন্য প্রেরণ করিয়াছিলেন। তাঁহারা প্রথমে মুঘল বাহিনীকে বাধা দিয়াছিলেন, কিন্তু উসমানের পরাজয় ও মৃত্যুর সংবাদ পাইয়া বশ্যতা স্বীকার করিলেন। শ্রীহট্ট সুবে বাংলার অন্তর্ভুক্ত করা হইল এবং প্রধান প্রধান পাঠানদের বন্দী করিয়া রাখা হইল। অতঃপর ইসলাম খান কাছাড়ের রাজা শত্রুদমনের বিরুদ্ধে সৈন্য প্রেরণ করিলেন। শত্রুদমন কিছুদিন যুদ্ধ করার পর বশ্যতা স্বীকার করিলেন এবং মুঘল সম্রাটকে কর দিতে স্বীকৃত হইলেন (১৬১২ খ্রীষ্টাব্দ)।

এইরূপে ইসলাম খান সমগ্র বাংলা দেশে মুঘল শাসন দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করিলেন। এই সমুদয় অভিযানের সময় ইসলাম খান অধিকাংশ সময় ঢাকা নগরীতেই বাস করিতেন, কারণ তিনি নিজে কখনও সৈন্য চালনা অর্থাৎ যুদ্ধ করিতেন না। মানসিংহও প্রায় দুই বৎসর ঢাকায় ছিলেন (১৬০২-৪ খ্রীষ্টাব্দ) এবং ইহাকে সুরক্ষিত করিয়াছিলেন। ইসলাম খান ঢাকায় একটি নূতন দুর্গ ও ভাল ভাল রাস্তা নির্মাণ করিয়াছিলেন। ওদিকে গঙ্গানদীর স্রোত পরিবর্তন রাজধানী রাজমহলে আর বড় বড় রণতরী যাইতে পারিত না। আরাকানের মগ ও পর্তুগীজ জলদস্যুদের আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্যও ঢাকা রাজমহল অপেক্ষা অধিকতর উপযোগী স্থান ছিল। এই সমুদয় বিবেচনা করিয়া ১৬১২ খ্রীষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে ইসলাম খান রাজমহলের পরিবর্তে ঢাকায় সুবে বাংলার রাজধানী প্রতিষ্ঠা করিলেন এবং সম্রাটের নামানুসারে এই নগরীর নূতন নাম রাখিলেন জাহাঙ্গীরনগর।

বাংলা দেশে মুঘল রাজ্য দৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত করিয়া ইসলাম খান অতঃপর কামরূপ রাজ্য জয়ের আয়োজন করিলেন। কামরূপে পূর্বে যে মুসলমান রাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়, পরে কোচবিহারের হিন্দু রাজা উহা দখল করেন। কোচবিহার রাজবংশের এক শাখা কামরূপে একটি স্বতন্ত্র রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিল। ইহা পশ্চিমে সঙ্কোশ হইতে পূর্বে বরা নদী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ইহার অধিপতি পরীক্ষিৎ নারায়ণের বহু সৈন্য, হস্তী ও রণতরী ছিল। কোচবিহার রাজ কি কারণে মুঘলের দাসত্ব স্বীকার করেন এবং কিরূপে তাঁহার প্ররোচণায় ও সাহায্যে ইসলাম খান কামরূপ রাজ্য আক্রমণ ওজয় করেন তাহা দ্বাদশ অধ্যায়ে বর্ণিত হইয়াছে।

ইহাই ইসলাম খানের শেষ বিজয়। কামরূপ জয়ের অনতিকাল পরেই ঢাকার নিকটবর্তী ভাওয়ালে তাঁহার মৃত্যু হয় (আগস্ট, ১৬১৩ খ্রীষ্টাব্দ)। মাত্র পাঁচ বৎসরের মধ্যে ইসলাম খান সমগ্র বাংলা দেশে মুঘল রাজশক্তি প্রতিষ্ঠা এবং শান্তি–শৃঙ্খলা ও সুশাসনের প্রবর্তন করিয়া অদ্ভুত দক্ষতা, সাহস ও রাজনীতিজ্ঞানের পরিচয় দিয়াছিলেন। আকবরের সময় মুঘলেরা বাংলা দেশ জয় করিয়াছিল বটে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বাংলা জয়ের গৌরব ইসলাম খানেরই প্রাপ্য এবং তিনিই বাংলা দেশের মুঘল সুবাদারদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলিয়া পরিগণিত হইবার যোগ্য। অবশ্য ইহাও সত্য যে মানসিংহই তাঁহার সাফল্যের পথ প্রশস্ত করিয়াছিলেন।

সুবাদার কাশিম খান ও ইব্রাহিম খান

ইসলাম খানের মৃত্যুর পর তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা কাশিম খান তাঁহার স্থানে বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হইলেন। কিন্তু জ্যেষ্ঠের বুদ্ধি ও যোগ্যতার বিন্দুমাত্রও তাঁহার ছিল না। তিনি স্বীয় কর্মচারী ও পরাজিত রাজাদিগের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করিতেন। কোচবিহার ও কামরূপের দুই রাজাকে ইসলাম খান যে প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন তাহা ভঙ্গ করিয়া কাশিম খান তাহাদিগকে বন্দী করিলেন। ইহার ফলে উভয় রাজ্যেই বিদ্রোহ উপস্থিত হইল এবং তাহা দমন করিতে কাশিম খানকে বেগ পাইতে হইল। অতঃপর কাশিম খান কাছাড়ের বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠাইলেন। সম্ভবতঃ কাছাড়ের রাজা শত্রুদমন মুঘলের অধীনতা অস্বীকার করিয়া বিদ্রোহী হইয়াছিলেন। কিন্তু সেখান হইতে মুঘলসৈন্য ব্যর্থ হইয়া ফিরিয়া আসিল-শত্রুদমন বহুদিন পর্যন্ত স্বাধীনতা রক্ষা করিলেন। বীরভূমের জমিদারগণও সম্ভবতঃ মুঘলের অধীনতা অস্বীকার করিয়াছিলেন। কাশিম খান তাঁহাদের বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠাইলেন, কিন্তু বিশেষ কোন ফল লাভ হইল না। আরাকানের মগ রাজা ও সন্দীপের অধিপতি পর্তুগীজ জলদস্যু সিবাষ্টিয়ান গোঞ্জালেস একযোগে আক্রমণ করিয়া ভুলুয়া প্রদেশ বিধ্বস্ত করিলেন (১৬১৪ খ্রীষ্টাব্দ)। পর বৎসর আরাকানরাজ পুনরায় আক্রমণ করিলেন, কিন্তু দৈবদুর্বিপাকে মুঘলের হস্তে বন্দী হইলেন এবং নিজের সমস্ত লোকজন ও ধনসম্পত্তি মুঘলদের হাতে সমর্পণ করিয়া মুক্তিলাভ করিলেন।

কাশিম খান আসাম জয় করিবার জন্য একদল সৈন্য পাঠাইলেন। তাহারা অহোম্রাজ কর্ত্তৃক পরাস্ত হইল। চট্টগ্রামের বিরুদ্ধে প্রেরিত মুঘল বাহিনীও পরাস্ত হইয়া ফিরিয়া আসিল। এইরূপে কাশিম খানের আমলে (১৬১৪-১৭ খ্রীষ্টাব্দ) বাংলায় মুঘল শাসন অত্যন্ত দুর্বল হইয়া পড়িল।

পরবর্তী সুবাদার ইব্রাহিম খান ফতেজঙ্গ ত্রিপুরা দেশ জয় করিয়া ত্রিপুরার রাজাকে সপরিবারে বন্দী করেন। এদিকে আরাকানরাজ মেঘনার তীরবর্তী গ্রামগুলি আক্রমণ করেন কিন্তু ইব্রাহিম তাঁহাকে তাড়াইয়া দেন। মোটের উপর ইব্রাহিম খানের আমলে বাংলা দেশে সুখ ও শান্তি বিরাজ করিত এবং মুঘলরাজের শক্তি ও প্রতিপত্তি পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল।

কিন্তু এই সময়ে এক অদ্ভুত ব্যাপারে বাংলা দেশের সুবাদার ইব্রাহিম খান এক জটিল সমস্যায় পড়িলেন। সম্রাট জাহাঙ্গীরের পুত্র শাহজাহান পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিলেন এবং পরাজিত হইয়া বাংলা অভিমুখে অগ্রসর হইলেন। শাহজাহান বাংলার পুরাতন বিদ্রোহী মুসা খানের পুত্র এবং শত্রু আরাকানরাজ ও পর্তুগীজ জলদস্যুদের সহায়তায় বাংলায় স্বাধীন রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করিতে বদ্ধপরিকর হইলেন। ইব্রাহিম প্রভু-পুত্রের সহিত বিবাদ করিতে প্রথমত ইতস্ততঃ করিতে লাগিলেন। কিন্তু অবশেষে শাহজাহান রাজমহল দখল করিলে দুই পক্ষে যুদ্ধ হইল। ইব্রাহিম পরাজিত ও নিহত হইলেন এবং শাহজাহান রাজধানী জাহাঙ্গীরনগর অধিকার করিয়া স্বাধীন রাজার ন্যায় রাজত্ব করিতে লাগিলেন (এপ্রিল, ১৬২৪ খ্রীষ্টাব্দ)। তিনি পূর্বেই উড়িষ্যা অধিকার করিয়াছিলেন। এবার তিনি বিহার ও অযোধ্যা অধিকার করিলেন। কিন্তু কিছুকালের মধ্যেই বাদশাহী ফৌজের হস্তে পরাজিত হইয়া তিনি বাংলা দেশ ত্যাগ করিয়া দাক্ষিণাত্যে ফিরিয়া গেলেন (অক্টোবর, ১৬২৪ খ্রী)। ইহার চারি বৎসর পরে পিতার মৃত্যুর পর শাহজাহান সম্রাট হইলেন।

সম্রাট শাহজাহান ও ঔরঙ্গজেবের আমলে বাংলা দেশের অবস্থা

সম্রাট শাহজাহানের সিংহাসনে আরোহণ (১৬২৮ খ্রী) হইতে ঔরঙ্গজেবের মৃত্যু (১৭০৭ খ্রী) পর্যন্ত বাংলা দেশে মুঘল শাসন মোটামুটি শান্তিতেই পরিচালিত হইয়াছিল। এই সুদীর্ঘকালের মধ্যে তিনজন সুবাদারের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। (১) শাহজাহানের পুত্র শুজা (১৬৩৯-১৬৫৯ খ্রী), (২) শায়েস্তা খান (১৬৬৪-১৬৮৮ খ্রী) এবং (৩) ঔরঙ্গজেবের পৌত্র আজিমুস্সান (১৬৯৮-১৭০৭ খ্রী)। এই যুগে বাংলার কোন স্বতন্ত্র ইতিহাস ছিল না। ইহা মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাসেরই অংশে পরিণত হইয়াছিল এবং ইহার শাসনপ্রণালীও মুঘল সাম্রাজ্যের অন্যান্য সুবার ন্যায় নির্দিষ্ট নিয়মে পরিচালিত হইত।

শাহজাহানের রাজত্বের প্রথম ভাগে হুগলি বন্দর হইতে পর্তুগীজদিগকে বিতাড়িত করা হয় (১৬৩২ খ্রী)। এ বিষয়ে পরে আলোচনা করা হইবে। অহহাদিগের সহিতও পুনরায় যুদ্ধ হয়। ১৬১৫ খ্রীষ্টাব্দে মুঘলসৈন্য অহোম রাজার হস্তে পরাজিত হয়। কামরূপের রাজা পরীক্ষিত্নারায়ণ কাশিম খানের হস্তে বন্দী হওয়ায় যে বিদ্রোহ উপস্থিত হইয়াছিল, তাহা পূর্বেই উক্ত হইয়াছে। ১৬১৫ খ্রীষ্টাব্দে তাঁহার মৃত্যুর পর চাহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা বলিনারায়ণ মুঘল-বিজয়ী অহোম রাজার আশ্রয় গ্রহণ করেন। ইহার ফলে অহোরাজ ও বাংলার মুঘল সুবাদারের মধ্যে বহুবর্ষব্যাপী যুদ্ধ চলে। বলিনারায়ণ মুঘলসৈন্যদের পরাজিত করিয়া কামরূপের ফৌজদারকে বন্দী করেন। বহুদিন যুদ্ধের পর অবশেষে মুঘলদেরই জয় হইল। মুঘলেরা কামরূপ জয় করিয়া অহোম রাজার সহিত সন্ধি করিল (১৬৩৮ খ্রী)। উত্তরে বরা নদী ও দক্ষিণে অসুরালি দুই রাজ্যের সীমানা নির্দিষ্ট হইল।

অতঃপর শুজার সুদীর্ঘ শান্তিপূর্ণ শাসনের ফলে বাংলা দেশে ব্যবসায়-বাণিজ্য ও ধনসম্পদ বৃদ্ধি হয় (১৬২৯-৫৯ খ্রী)। কিন্তু সিংহাসন লাভের জন্য ভ্রাতা ঔরঙ্গজেবের সহিত বিবাদের ফলে শুজা খাজুয়ার যুদ্ধে পরাস্ত হইয়া পলায়ন করেন (জানুয়ারী, ১৬৫৯ খ্রীষ্টাব্দে)। মুঘল সেনাপতি মীরজুমলা তাঁহার পশ্চাদ্ধাবন করিয়া ঢাকা নগরী দখল করেন (মে, ১৬৬০ খ্রীষ্টাব্দ)। শুজা আরাকানে পলাইয়া গেলেন। দুই বৎসর পরে আরাকানরাজের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করার অভিযোগে তিনি নিহত হইলেন।

অতঃপর মীরজুমলা বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হইলেন (জুন, ১৬৬০ খ্রীষ্টাব্দ)। শুজা যখন ঔরঙ্গজেবের সহিত যুদ্ধ করিতে ব্যস্ত ছিলেন, তখন সুযোগ বুঝিয়া কোচবিহারের রাজা কামরূপ ও অহোম্রাজ গৌহাটি অধিকার করিলেন (মার্চ, ১৬৫৯ খ্রীষ্টাব্দ)। তারপর এই দুই রাজার মধ্যে বিবাদের ফলে অহোরাজ কোচবিহাররাজকে বিতাড়িত করিয়া কামরূপ অধিকার করেন (মার্চ, ১৬৬০ খ্রীষ্টাব্দ)।

মীরজুমলা সুবাদার নিযুক্ত হইয়াই কোচবিহার ও কামরূপের বিরুদ্ধে এক বিপুল অভিযান প্রেরণ করিলেন (১৬৬১ খ্রীষ্টাব্দ)। কোচবিহাররাজ পলায়ন করায় বিনা যুদ্ধে মীরজুমলা এই রাজ্য অধিকার করিলেন এবং অহোম্রাজের বিরুদ্ধে অগ্রসর হইলেন। অহোরাজও পলায়ন করিলেন এবং তাঁহার রাজধানী মীরজুমলার হস্তগত হইল (মার্চ, ১৬৬২ খ্রীষ্টাব্দ)। বর্ষা আসিলে সমস্ত দেশ জলে ডুবিয়া যাওয়ায় মুঘল ঘাঁটিগুলি পরস্পর হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িল এবং খাদ্য সরবরাহেরও কোন উপায় রহিল না। মুঘল শিবির জলে ডুবিয়া গেল, খাদ্যভাবে বহু অশ্ব মারা গেল, সংক্রামক ব্যাধি দেখা দিল এবং বহু সৈন্যের মৃত্যু হইল। সুযোগ বুঝিয়া অহোম্ সৈন্য পুনঃপুনঃ মুঘল শিবির আক্রমণ করিল। অবশেষে বর্ষার শেষ হইলে এই দুঃখকষ্টের অবসান হইল। মীরজুমলা সৈন্যসহ অহোম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অগ্রসর হইলেন। কিন্তু অকস্মাৎ তিনি গুরুতর পীড়ায় আক্রান্ত হইয়া পড়িলেন। তখন অহোম্রাজের সহিত সন্ধি করিয়া মুঘলসৈন্য বাংলা দেশে ফিরিয়া আসিল। কিন্তু ঢাকায় পৌঁছিবার পূর্বে মাত্র কয়েক মাইল দূরে তাঁহার মৃত্যু হইল (মার্চ, ১৬৬৩ খ্রী)। এই সমুদয় গোলযোগের মধ্যে কোচবিহারের রাজা তাঁহার রাজ্য পুনরুদ্ধার করিলেন।

মীরজুমলার মৃত্যুর অব্যবহিত পরে প্রায় এক বৎসর যাবৎ বাংলা দেশের শাসনকার্যে নানা বিশৃঙ্খলা দেখা দিল। ১৬৬৪ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসে শায়েস্তা খান বাংলা দেশের সুবাদার হইয়া আসিলেন। মাঝখানে এক বৎসর বাদ দিয়া মোট ২২ বৎসর তিনি এই পদে নিযুক্ত ছিলেন। শায়েস্তা খান রাজোচিত ঐশ্বর্য ও জাঁকজমকের সহিত নিরুদ্বেগে জীবন কাটাইতেন এবং সম্রাটকে বহু অর্থ পাঠাইয়া খুশি রাখিতেন। বলা বাহুল্য নানা উপায়ে প্রজার রক্ত শোষণ করিয়াই এই টাকা আদায় হইত। একচেটিয়া ব্যবসায়ের দ্বারাও অনেক টাকা আয় হইত। সমসাময়িক ইংরেজদের রিপোর্টে শায়েস্তা খানের অর্থগৃধনুতার উল্লেখ আছে। তাঁহার সুবাদারীর প্রথম ১৩ বৎসরে তিনি ৩৮ কোটি টাকা সঞ্চয় করিয়াছিলেন। তাঁহার দৈনিক আয় ছিল দুই লক্ষ টাকা আর ব্যয় ছিল এক লক্ষ টাকা।

বৃদ্ধ শায়েস্তা খান নিজে যুদ্ধে যাইতেন না এবং হারেমে আরামে দিন কাটাইতেন কিন্তু উপযুক্ত কর্মচারীর সাহায্যে তিনি কঠোর হস্তে ও শৃঙ্খলার সহিত দেশ শাসন করিতেন। তিনি কুচবিহারের বিদ্রোহী রাজাকে তাড়াইয়া পুনরায় ঐ রাজ্য মুঘলের অধীনে আনয়ন করিলেন এবং ছোটখাট বিদ্রোহ কঠোর হস্তে দমন করিলেন। তাঁহার শাসনকালের প্রধান ঘটনা চট্টগ্রাম বিজয়। পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে আরাকানের রাজা চট্টগ্রাম জয় করিয়াছিলেন এবং ইহা মগ ও পর্তুগীজ জলদস্যুদের একটি প্রধান কেন্দ্র ছিল। ইহারা বাংলা দেশ হইতে বহু লোক বন্দী করিয়া নিত, তাহাদের হাতে ছিদ্র করিয়া তাঁহার মধ্য দিয়া বেত চালাইয়া, অনেককে এক সঙ্গে বাধিয়া নৌকার পাটাতনের নীচে ফেলিয়া রাখিত–প্রতিদিন উপর হইতে কিছু চাউল তাহাদের আহারের জন্য ফেলিয়া দিত। পর্তুগীজরা ইহাদিগকে নানা বন্দরে, বিক্রী করিত–মগেরা তাহাদিগকে ক্রীতদাস ও ক্রীতদাসীর ন্যায় ব্যবহার করিত। শায়েস্তা খান প্রথমে সন্দীপ অধিকার করিলেন (নভেম্বর, ১৬৬৫ খ্রীষ্টাব্দ)। এই সময় চট্টগ্রামে মগ ও পর্তুগীজদের মধ্যে বিবাদ বাধিল এবং শায়েস্ত খান অর্থ ও আশ্রয় দান করিয়া পর্তুগীজদিগকে হাত করিলেন। প্রধানতঃ তাহাদের সাহায্যেই তিনি চট্টগ্রাম জয় করিলেন (জানুয়ারী, ১৬৬৬ খ্রীষ্টাব্দ)। ঔরঙ্গজেবের আজ্ঞায় চট্টগ্রামের নূতন নামকরণ হইল ইসলামাবাদ এবং এখানে একজন মুঘল ফৌজদার নিযুক্ত হইলেন। নানা কারণে ইংরেজ বণিকদের সহিত শায়েস্তা খানের বিবাদ হয়। ১৬৮৮ খ্রীষ্টাব্দে জুন মাসে তাঁহার সুবাদারী শেষ হয়।

শায়েস্তা খানের নাম বাংলা দেশে এখনও খুব পরিচিত। তাঁহার সময় বাংলা দেশে টাকায় আট মণ চাউল পাওয়া যাইত। ১৬৩২ খ্রীষ্টাব্দে বাংলা দেশের চাউলের দাম ছিল টাকায় পাঁচ মণ। পূর্ববঙ্গে বহু চাউল উৎপন্ন হয় সুতরাং ঢাকায় চাউল আরও সস্তা হইবার কথা। এই চাউলের দামের কথা স্মরণ রাখিলে শায়েস্তা খানের দৈনিক আয় দুই লক্ষ আর দৈনিক ব্যয় এক লক্ষ টাকার প্রকৃত তাৎপর্য বোঝা যাইবে। এই এক লক্ষ টাকা ব্যয়ের পশ্চাতে যে দালান-ইমারত নির্মাণ, জাঁকজমক, দান-দক্ষিণা, আশ্রিত-পোষণ প্রভৃতি ছিল তাহাই সম্ভবত শায়েস্তা খানের লোকপ্রিয়তার কারণ।

শায়েস্তা খানের পর ঔরঙ্গজেবের ধাত্রীপুত্র অপদার্থ খান-ই-জহান বাহাদুর বাংলার সুবাদার হইলেন। এক বৎসর পরেই এই অপদার্থকে পদচ্যুত করা হইল। কিন্তু তিনি যাওয়ার সময় দুই কোটি টাকা লইয়া গেলেন। তাঁহার পর আসিলেন ইব্রাহিম খান। ইহার শাসনকালের প্রধান ঘটনা মেদিনীপুর জিলার অন্তর্গত ঘাটালের চন্দ্রকোণা বিভাগের একজন সাধারণ জমিদার শোভাসিংহের বিদ্রোহ। রাজা কৃষ্ণরাম নামে একজন পাঞ্জাবী বর্ধমান জিলার রাজস্ব আদায়ের ইজারা লইয়া ছিলেন। শোভসিংহ পার্শ্ববর্তী স্থানে লুঠতরাজ আরম্ভ করিলে কৃষ্ণরাম তাঁহাকে বাধা দিতে গিয়া নিহত হন (জানুয়ারী, ১৬৯৬ খ্রীষ্টাব্দ) এবং শোভারাম বর্ধমান দখল করেন। এইরূপে অর্থসংগ্রহ করিয়া শোভসিংহ অনুচরের সংখ্যা বৃদ্ধি করেন এবং রাজা উপাধি ধারণ করেন। উড়িষ্যার পাঠান সর্দার রহিম খান তাঁহার সহিত যোগদান করায় তাঁহার শক্তি বৃদ্ধি হয় এবং গঙ্গানদীর পশ্চিম তীরে হুগলির উত্তর ও দক্ষিণে ১৮০ মাইল বিস্তৃত ভূখণ্ড তাঁহার হস্তগত হয়। সুবাদার ইব্রাহিম খান এই বিদ্রোহের ব্যাপারে কোনরূপ গুরুত্ব আরোপ না করিয়া পশ্চিম বাংলার ফৌজদারকে বিদ্রোহ দমন করিতে আদেশ দিলেন। উক্ত ফৌজদার প্রথমে হুগলি দুর্গে আশ্রয় লইলেন, পরে বেগতিক দেখিয়া একরাত্রে পলায়ন করিলেন। শোভাসিংহের সৈন্য হুগলিতে প্রবেশ করিয়া শহর লুঠ করিল। ওলন্দাজ বণিকেরা পলায়মান ফৌজদার ও হুগলির লোকদের কাতর প্রার্থনায় একদল সৈন্য পাঠাইলে শোভসিংহ হুগলি ত্যাগ করিয়া বর্ধমানে গেলেন। তিনি রাজা কৃষ্ণরামের কন্যার উপর বলাৎকার করিতে উদ্যত হইলে এই তেজস্বিনী নারী প্রথমে ছুরিকা দ্বারা শোভসিংহকে হত্যা করেন–তারপর নিজের বুকে ছুরি বসাইয়া প্রাণত্যাগ করেন। শোভাসিংহের পর তাঁহার ভ্রাতা হিম্মৎসিংহ দলের কর্ত্তা হইলেন, কিন্তু সৈন্যেরা রহিম খানকেই নায়ক মনোনীত করিল। রহিম খান রহিম শাহ নাম ধারণ করিয়া নিজেকে রাজপদে অভিষিক্ত করিলেন। চারিদিক হইতে নানা শ্রেণীর লোক দলে দলে আসিয়া তাঁহার সঙ্গে যোগ দিল এবং ক্রমে তিনি দশ সহস্র ঘোড়সওয়ার ও ৬০,০০০ পদাতিক সংগ্রহ করিয়া নদীয়ার মধ্য দিয়া মখসুদাবাদ (বর্তমান মুর্শিদাবাদ) অভিমুখে অগ্রসর হইলেন। পথে একজন জায়গীরদার ও পাঁচ হাজার মুঘলসৈন্যকে পরাজিত করিয়া তিনি মখসুদাবাদ লুণ্ঠন করিলেন এবং রাজমহল ও মালদহ অধিকার করিলেন। তাঁহার অনুচরেরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হইয়া চারিদিকে লুঠপাট করিয়া ফিরিতে লাগিল (১৬৯৬-৯৭ খ্রিস্টাব্দ)।

এই সংবাদ পাইয়া ঔরঙ্গজেব ইব্রাহিম খানকে পদচ্যুত করিয়া পরবর্তীকালে আজিমুসসান নামে পরিচিত নিজের পৌত্র আজিমুদ্দীনকে বাংলার সুবাদার নিযুক্ত করিলেন এবং রহিম খানের পুত্র জবরদস্ত খানকে অবিলম্বে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিতে আদেশ দিলেন। জবরদস্ত খান বিদ্রোহী রহিম শাহকে পরাজিত করিয়া রাজমহল, মালদহ, মখসুদাবাদ, বর্ধমান প্রভৃতি স্থান অধিকার করিলেন। রহিম শাহ পলাইয়া জঙ্গলে আশ্রয় লইলেন।

আজিমুসসান বাংলা দেশে পৌঁছিয়া জবরদস্ত খানের কৃতিত্বের সম্মান করা দূরে থাকুক, তাঁহার প্রতি তাচ্ছিল্যের ভাব দেখাইলেন। ইহাতে ক্ষুণ্ণ হইয়া জবরদস্ত খান বাংলা দেশ ত্যাগ করিয়া চলিয়া গেলেন। ফলে রহিম শাহ জঙ্গল হইতে বাহির হইয়া আবার লুঠপাট আরম্ভ করিলেন এবং বর্ধমানের দিকে অগ্রসর হইয়া সন্ধির প্রস্তাব আলোচনার ছলে সুবাদারের প্রধান মন্ত্রীকে হত্যা করিলেন। তখন আজিমুসসান তাঁহার বিরুদ্ধে এক সৈন্যবাহিনী পাঠাইলেন। এই বাহিনীর সহিত যুদ্ধে রহিম শাহ পরাজিত ও নিহত হইলেন। বিদ্রোহীদের দল ভাঙ্গিয়া গেল। (অগস্ট, ১৬৯৮ খ্রীষ্টাব্দ)।

ঔরঙ্গজেবের রাজত্বের শেষভাগে বাংলা (ও অন্যান্য) সুবার শাসনপ্রণালীর কিরূপ অবনতি হইয়াছিল, তাহা বুঝাইবার জন্য শোভাসিংহের বিদ্রোহ বিস্তৃতভাবে বর্ণিত হইল। আর একটি বিষয়ও উল্লেখযোগ্য। এই বিদ্রোহের সময় কলিকাতা, চন্দননগর উঁচড়ার ইংরেজ, ফরাসী ও ওলন্দাজ বণিকেরা সুবাদারের অনুমতি লইয়া নিজেদের বাণিজ্য-কুঠিগুলি দুর্গের ন্যায় সুরক্ষিত করিল এবং এই সমস্ত স্থানই এই ঘোর দুর্দিনে বাঙালীর একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়স্থল হইয়া উঠিল। বাংলার ভবিষ্যৎ ইতিহাসে ইহার প্রভাব অত্যন্ত গুরুতর হইয়াছিল।

আজিমুসসান ১৬৯৮ খ্রীষ্টাব্দ হইতে ১৭১২ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার সুবাদার ছিলেন। শেষ দশ বৎসর তিনি বিহারেরও সুবাদার ছিলেন এবং ১৭০৪ খ্রীষ্টাব্দ হইতে পাটনায় বাস করিতেন। তিনি জানিতেন যে বৃদ্ধ সম্রাটের মৃত্যু হইলেই সিংহাসন লইয়া যুদ্ধ বাধিবে এবং এই জন্যই তিনি নানা অবৈধ উপায়ে এবং অনেক সময় প্রজাদের উৎপীড়ন করিয়া অর্থ সংগ্রহ করিতেন। কিন্তু দিওয়ান মুর্শিদকুলী খান খুব দক্ষ ও নিষ্ঠাবান কর্মচারী ছিলেন। তিনি আজিমুসসানের অবৈধ অর্থ সংগ্রহের পথ বন্ধ করিয়া দিলেন। ইহাতে ক্রুদ্ধ হইয়া আজিমুসসান মুর্শিদকুলী খানকে হত্যা করিবার জন্য ষড়যন্ত্র করিলেন। ইহা ব্যর্থ হইল, কিন্তু মুর্শিদকুলী খান সমস্ত ব্যাপার সম্রাটকে জানাইয়া অবিলম্বে দিওয়ানী বিভাগ মখসুদাবাদে সরাইয়া নিলেন। বহু বৎসর পরে সম্রাটের অনুমতিক্রমে মুর্শিদকুলীর নাম অনুসারে এই নগরীর নাম হয় মুর্শিদাবাদ।

ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর বাহাদুর শাহ সম্রাট হইলেন (১৭০৭ খ্রীষ্টাব্দ)। পুত্র আজিমুসসানের প্ররোচনায় সম্রাট মুর্শিদকুলী খানকে দাক্ষিণাত্যের দিওয়ান করিয়া পাঠাইলেন। কিন্তু বাংলার নতুন দিওয়ান বিদ্রোহী সেনার হস্তে নিহত হওয়ায় মুর্শিদকুলী খান পুনরায় বাংলার দিওয়ান নিযুক্ত হইলেন (১৭১০ খ্রীষ্টাব্দ)।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *