০৫. মাহমুদ শাহী বংশ ও হাবশী রাজত্ব

পঞ্চম পরিচ্ছেদ – মাহমুদ শাহী বংশ ও হাবশী রাজত্ব

নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহ

শামসুদ্দীন আহমদ শাহের পরবর্তী সুলতানের নাম নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহ। ইনি ১৪৩৭ খ্রীষ্টাব্দ বা তাঁহার দুই এক বৎসর পূর্বে সিংহাসনে আরোহণ করেন, ‘রিয়াজ’-এর মতে শামসুদ্দীন আহমদ শাহের দুই হত্যাকারীর অন্যতম সাদী খান অপর হত্যাকারী নাসির খানকে বধ করিয়া নিজে রাজ্যের সর্বময় কর্ত্তা হইতে চাহিয়াছিলেন, কিন্তু নাসির খান তাঁহার অভিসন্ধি বুঝিয়া তাহাকে হত্যা করেন এবং নিজে সিংহাসনে আরোহণ করেন। আহমদ শাহের অমাত্যেরা তাঁহার কর্তৃত্ব মানিতে রাজী না হইয়া তাঁহাকে বধ করেন এবং শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহের জনৈক পৌত্র নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহকে সিংহাসনে বসান। অন্য বিবরণগুলি হইতে ‘রিয়াজ’-এর বিবরণের অধিকাংশ কথারই সমর্থন পাওয়া যায় এবং তাহাদের অধিকাংশেরই মতে নাসিরুদ্দীন ইলিয়াস শাহের বংশধর। বুকাননের বিবরণীর হইতেও ‘রিয়াজ’-এর বিবরণের সমর্থন মিলে, তবে বুকাননের বিবরণীতে নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহকে ইলিয়াস শাহের বংশধর বলা হয় নাই। বুকাননের বিবরণীর মতে শামসুদ্দীন আহমদ শাহের ক্রীতদাস ও হত্যাকারী নাসির খান এবং নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহ অভিন্ন লোক।

আধুনিক ঐতিহাসিকদের অধিকাংশই ধরিয়া লইয়াছেন যে নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহ ইলিয়াস শাহী বংশের সন্তান, এই কারণে তাঁহারা নাসিরুদ্দীনের বংশকে “পরবর্তী ইলিয়াস শাহী বংশ” নামে অভিহিত করিয়াছেন। ইহার পরিবর্তে এই বংশের “মাহমুদ শাহী বংশ” নামই (নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহের নাম অনুসারে) অধিকতর যুক্তিসঙ্গত। ‘রিয়াজ’-এর মতে নাসিরুদ্দীন সমস্ত কাজ ন্যায়পরায়ণতা ও উদারতার সহিত করিতেন; দেশের আবালবৃদ্ধনির্বিশেষে সমস্ত প্রজা তাঁহার শাসনে সন্তুষ্ট ছিল; গৌড় নগরীর অনেক দুর্গ ও প্রাসাদ তিনি নির্মাণ করান। গৌড় নগরীই ছিল নাসিরুদ্দীনের রাজধানী। নাসিরুদ্দীন যে সুযোগ্য নৃপতি ছিলেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই, কারণ তাহা না হইলে তাঁহার পক্ষে সুদীর্ঘ ২৪/২৫ বৎসর রাজত্ব করা সম্ভব হইত না।

নাসিরুদ্দীনের রাজত্বকাল মোটামুটিভাবে শান্তিতেই কাটিয়াছিল। তবে উড়িষ্যার রাজা কপিলেন্দ্রদেবের (১৪৩৫-৬৭ খ্রী) এক তাম্রশাসনের সাক্ষ্য হইতে অনুমিত হয় যে, কপিলেন্দ্রদেবের সহিত নাসিরুদ্দীনের সংঘর্ষ হইয়াছিল। খুলনা যশোহর অঞ্চলে প্রচলিত ব্যাপক প্রবাদ এবং বাগেরহাট অঞ্চলে প্রাপ্ত এক শিলালিপির সাক্ষ্য হইতে মনে হয় যে, খান জহান নামে নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহের জনৈক সেনাপতি ঐ অঞ্চলে প্রথম মুসলিম রাজত্বের প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁহার পর বিদ্যাপতি তাঁহার দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী’তে বলিয়াছেন যে তাঁহার পৃষ্ঠপোষক ভৈরবসিংহ গৌড়েশ্বরকে “শ্রীকৃত করিয়াছিলেন; দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী’ ১৪৫০ খ্রীষ্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে লেখা হয়, সুতরাং ইহাতে উল্লিখিত গৌড়েশ্বর নিশ্চয়ই বাংলার তৎকালীন সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহ। সম্ভবত মিথিলার রাজা ভৈরবসিংহের সহিত নাসিরুদ্দীনের সংঘর্ষ হইয়াছিল। মিথিলার সন্নিহিত অঞ্চল নাসিরুদ্দীনের অধীন ছিল–ভাগলপুর ও মুঙ্গেরে তাঁহার শিলালিপি পাওয়া গিয়াছে। সুতরাং মিথিলার রাজাদের সহিত তাঁহার যুদ্ধ হওয়া খুবই স্বাভাবিক।

পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথমে চীনের সহিত বাংলার রাজনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ৩৪ বৎসর ধরিয়া এই সম্পর্ক অব্যাহত ছিল। নাসিরুদ্দীন দুইবার-১৪৩৮ ও ১৪৩৯ খ্রীষ্টাব্দে চীনা-ম্রাটের কাছে উপহারসমেত রাজদূত পাঠাইয়াছিলেন। প্রথমবার তিনি চীন-সম্রাটকে একটি জিরাফও পাঠাইয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহার পর চীনের সঙ্গে বাংলার যোগ বিচ্ছিন্ন হইয়া যায়। এ জন্য নাসিরুদ্দীন দায়ী নহেন, চীন-সম্রাটই দায়ী। য়ুং-লো (১৪০২-২৫ খ্রী) যখন চীনের সম্রাট ছিলেন তখন যেমন বাংলা হইতে চীনে দূত ও উপহার যাইত, তেমনি চীন হইতে বাংলায়ও দূত ও উপহার আসিত। কিন্তু য়ুং-লোর উত্তরাধিকারীরা শুধু বাংলার রাজার পাঠানো উপহার গ্রহণ করিতেন, নিজেরা বাংলার রাজার কাছে দূত ও উপহার পাঠাইতেন না। তাহারা বোধ হয় ভাবিতেন যে সামন্ত রাজা ভেট পাঠাইয়াছে, তাঁহার আবার প্রতিদান দিব কি*! [* চীন-সম্রাটরা পৃথিবীর অন্যান্য রাজাদের নিজেদের সামন্ত বলিয়াই মনে করিতেন।] বলা বাহুল্য এই একতরফা উপহার প্রেরণ বেশিদিন চলা সম্ভব ছিল না। তাঁহার ফলে উভয় দেশের সংযোগ অচিরেই ছিন্ন হইয়া যায়।

রুকনুদ্দীন বারবক শাহ

রুকনুদ্দীন বারবক শাহ নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহের পুত্র ও উত্তরাধিকারী। ইনি বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুলতান।

বারবক শাহ অন্তত একুশ বৎসর-১৪৫৫ হইতে ১৪৭৬ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করিয়াছিলেন; ইহার মধ্যে ১৪৫৫ হইতে ১৪৫৯ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি নিজের পিতা নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহের সঙ্গে যুক্তভাবে রাজত্ব করেন, ১৪৭৪ হইতে ১৪৭৬ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি তাঁহার পুত্রের সঙ্গে যুক্তভাবে রাজত্ব করেন, অবশিষ্ট সময়ে তিনি এককভাবে রাজত্ব করেন। বাংলার সুলতানদের মধ্যে অনেকেই নিজের রাজত্বের শেষদিকে পুত্রের সঙ্গে যুক্তভাবে রাজত্ব করিয়াছেন। সুলতানের মৃত্যুর পর যাহাতে তাঁহার পুত্রদের মধ্যে সিংহাসন লইয়া সংঘর্ষ না বাধে, সেইজন্যই সম্ভবত বাংলাদেশে এই অভিনব প্রথা প্রবর্তিত হইয়াছিল।

বারবক শাহ অনেক নূতন রাজ্য জয় করিয়া নিজের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। ইসমাইল গাজী নামে একজন ধার্মিক ব্যক্তি তাঁহার অন্যতম সেনাপতি ছিলেন। ইনি ছিলেন কোরেশ জাতীয় আরব। “রিসালৎ-ই-শুহাদা’ নামক একখানি ফার্সী গ্রন্থে ইসমাইলের জীবনকাহিনী বর্ণিত হইয়াছে; এই কাহিনীর মধ্যে কিছু কিছু অলৌকিক ও অবিশ্বাস্য উপাদান থাকিলেও মোটের উপর ইহা বাস্তব ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। “রিসালৎ-ই-শুহাদা’র মতে ইসমাইল ছুটিয়া-পটিয়া নামক একটি নদীতে সেতু নির্মাণ করিয়া তাঁহার বন্যা নিবারণ করিয়াছিলেন এবং “মান্দারণের বিদ্রোহী রাজা গজপতিকে পরাস্ত ও নিহত করিয়া তিনি মান্দারণ দুর্গ অধিকার করিয়াছিলেন একথাও এই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হইয়াছে; ইহার অন্তর্নিহিত প্রকৃত ঘটনা সম্ভবত এই যে, ইসমাইল গজপতি-বংশীয় উড়িষ্যার রাজা কপিলেন্দ্রদেবের কোন সৈন্যাধ্যক্ষকে পরাস্ত ও নিহত করিয়া মান্দারণ দুর্গ জয় করিয়াছিলেন। এই মান্দারণ দুর্গ বাংলার অন্তর্গত ছিল। কপিলেন্দ্রদেব তাহা জয় করেন। রিসালৎ’ এর মতে ইসমাইল কামরূপের রাজা “কামেশ্বরের” (কামতেশ্বর?) সহিত যুদ্ধে পরাজিত হইয়াছিলেন, কিন্তু রাজা তাঁহার অলৌকিক মহিমা দেখিয়া তাঁহার নিকট আত্মসমর্পণ করেন ও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। কিন্তু ঘোড়াঘাটের দুর্গাধ্যক্ষ ভাসী রায় ইসমাইলের বিরুদ্ধে রাজদ্রোহের ষড়যন্ত্র করার অভিযোগ আনায় বারবক শাহ ইসমাইলকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করেন।

মুন্না তকিয়ার বয়াজে লেখা আছে যে, বারবক শাহ ১৪৭০ খ্রীষ্টাব্দে ত্রিহুত রাজ্যে অভিযান করিয়াছিলেন, তাঁহার ফলে হাজীপুর ও তৎসন্নিহিত স্থানগুলি পর্যন্ত সমস্ত অঞ্চল তাঁহার রাজ্যভুক্ত হইয়াছিল এবং উত্তরে বুড়ি গণ্ডক নদী পর্যন্ত তাঁহার অধিকার বিস্তৃত হইয়াছিল; বারবক শাহ ত্রিহুতের হিন্দু রাজাকে তাঁহার সামন্ত হিসাবে ত্রিহুতের উত্তর অংশ শাসনের ভার দিয়াছিলেন এবং কেদার রায় নামে একজন উচ্চপদস্থ হিন্দুকে তিনি ত্রিহুতে রাজস্ব আদায় ও সীমান্ত রক্ষার জন্য তাঁহার প্রতিনিধি নিযুক্ত করিয়াছিলেন; কিন্তু পূর্ব্বোক্ত হিন্দু রাজার পুত্র ভরত সিংহ। (ভৈরব সিংহ?) বিদ্রোহ ঘোষণা করিয়া কেদার রায়কে বলপূর্বক অপসারিত করেন; ইহাতে ক্রুদ্ধ হইয়া বারবক শাহ তাঁহাকে শাস্তি দিবার উদ্যোগ করেন, কিন্তু ত্রিহুতের রাজা তাঁহার নিকট বশ্যতা স্বীকার করেন এবং তাহাকে আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি দেন। ফলে আর কোন গোলযোগ ঘটে নাই।

মুল্লা তকিয়ার বয়াজের এই বিবরণ মূলত সত্য, কেন না সমসাময়িক মৈথিল পণ্ডিত বর্ধমান উপাধ্যায়ের লেখা দণ্ডবিবেক’ হইতে সমর্থন পাওয়া যায়। ইতিপূর্বে ত্রিহুত জৌনপুরের শর্কী সুলতানদের অধীন সামন্ত রাজ্য ছিল। কিন্তু শর্কী বংশের শেষ সুলতান হোসেন শাহের অক্ষমতার জন্য তাঁহার রাজত্বকালে জৌনপুর সাম্রাজ্য ভাঙিয়া যায়। এই সুযোগেই বারবক শাহ ত্রিহুত অধিকার করিয়াছিলেন, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই।

বারবক শাহের শিলালিপিগুলিতে তাঁহার পাণ্ডিত্যের পরিচায়ক ‘অল-ফাজিল ও ‘অল-কামিল’ এই দুইটি উপাধির উল্লেখ দেখা যায়। বারবক শাহ শুধু পণ্ডিত ছিলেন না, তিনি বিদ্যা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকও ছিলেন। হিন্দু ও মুসলমান উভয় ধর্ম্মেরই অনেক কবি ও পণ্ডিত তাঁহার কাছে পৃষ্ঠপোষণ লাভ করিয়াছিলেন। ইঁহাদের মধ্যে একজন ছিলেন বৃহস্পতি মিশ্র। ইনি ছিলেন একজন বিখ্যাত পণ্ডিত এবং গীতগোবিন্দটীকা, কুমারসম্ভবটীকা, রঘুবংশটীকা, শিশুপালবধটীকা, অমরকোষটীকা, স্মৃতিরত্নহার প্রভৃতি গ্রন্থের লেখ। ইহার সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ গ্রন্থ অমরকোষটীকা ‘পদচন্দ্রি। বৃহস্পতির প্রথম দিককার বইগুলি জলালুদ্দীন মুহম্মদ শাহের রাজত্বকালে রচিত হয়; জলালুদ্দীনের সেনাপতি রায় রাজ্যধর তাঁহার শিষ্য ও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। জলালুদ্দীনের কাছেও তিনি খানিকটা সমাদর লাভ করিয়াছিলেন, ‘স্মৃতিরত্নহার’-এ তিনি জলালুদ্দীনের নাম উল্লেখ করিয়াছেন; ‘পদচন্দ্রিকা’র প্রথমাংশও জলালুদ্দীনেরই রাজত্বকালে–১৪১৩ খ্রীষ্টাব্দে রচিত হয়। কিন্তু ‘পদচন্দ্রিকা’র শেষাংশ অনেক পরে-১৪৭৪ খ্রীষ্টাব্দে রচিত হয়; তখন রুকনুদ্দীন বারবক শাহ বাংলার সুলতান। পদচন্দ্রিকায় বৃহস্পতি লিখিয়াছেন যে তিনি গৌড়েশ্বরের কাছে ‘পণ্ডিতসার্বভৌম’ উপাধি লাভ করিয়াছিলেন এবং রাজা তাঁহাকে উজ্জ্বল মণিময় হার, দ্যুতিমান দুইটি কুণ্ডল রত্নখচিত দশ আঙ্গুলের অঙ্গুরীয় দিয়া হাতির পিঠে চড়াইয়া স্বর্ণকলসের জলে অভিষেক করাইয়া ছত্র ও অশ্বের সহিত রায়মুকুট’ উপাধি দান করিয়াছিলেন। বিশারদ (সম্ভবত ইনি বাসুদেব সার্বভৌমের পিতা) নামে একজন পণ্ডিতের লেখা একটি জ্যোতির্বিষয়ক বচন হইতে বুঝা যায় তিনিও বারবক শাহের সমসাময়িক ছিলেন ও সম্ভবত তাঁহার পৃষ্ঠপোষণ লাভ করিয়াছিলেন।

‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ নামক বিখ্যাত বাংলা কাব্যের রচয়িতা মালাধর বসু বলিয়াছেন যে গৌড়েশ্বর তাঁহাকে “গুণরাজ খান” উপাধি দিয়াছিলেন। এই গৌড়েশ্বরই বারবক শাহ। বাংলা রামায়ণের রচয়িতা কৃত্তিবাসও তাঁহার আত্মকাহিনীতে লিখিয়াছেন যে তিনি একদিন গৌড়েশ্বরের সভায় গিয়াছিলেন এবং তাঁহার কাছে বিপুল সংবর্ধনা লাভ করিয়াছিলেন। এই গৌড়েশ্বর যে কে, সে সম্বন্ধে গবেষকরা এতদিন অনেক জল্পনা কল্পনা করিয়াছেন। সম্প্রতি এমন কিছু প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে, যাহা হইতে বলা যায়, এই গৌড়েশ্বর রুকনুদ্দীন বারবক শাহ। বর্তমান গ্রন্থের বাংলা সাহিত্য সংক্রান্ত অধ্যায়ে এ সম্বন্ধে আলোচনা করা হইয়াছে।

‘ফরঙ্গ-ই-ইব্রাহিমী’ নামক ফার্সী ভাষার একটি শব্দকোষ গ্রন্থের (শরনামা নামেই বিশেষভাবে পরিচিত) রচয়িতা ইব্রাহিম কায়ুম ফারুকীও বারবক শাহের পৃষ্ঠপোষণ লাভ করিয়াছিলেন। ইহার আদি নিবাস ছিল জৌনপুরে। বারবক শাহের উচ্ছ্বসিত স্তুতি করিয়া ফারুকী লিখিয়াছেন “যিনি প্রার্থীকে বহু ঘোড়া দিয়াছেন। যাহারা পায়ে হাঁটে তাহারাও (ইঁহার কাছে) বহু ঘোড়া দান স্বরূপ পাইয়াছে। এই মহান আবুল মুজাফফর, যাহার সর্বাপেক্ষা সামান্য ও সাধারণ উপহার একটি ঘোড়া।” ইব্রাহিম কায়ুম ফারুকীর গ্রন্থে আমীর জৈনুদ্দীন হারাওয়ী নামে একজন সমসাময়িক কবির নাম উল্লিখিত হইয়াছে। ফারুকী ইহাকে “মালেকুশ শোয়ারা” বা রাজকবি বলিয়াছেন। ইহা হইতে মনে হয়, ইনি বারবক শাহ ও তাঁহার পরবর্তী সুলতানদের সভাকবি ছিলেন।

বারবক শাহ যে উদার ও অসাম্প্রদিয়ক মনোভাবসম্পন্ন ছিলেন, তাঁহার প্রমাণ পাওয়া যায় হিন্দু কবি-পণ্ডিতদের পৃষ্ঠপোষকতা হইতে। ইহা ভিন্ন বারবক শাহ হিন্দুদের উচ্চ রাজপদেও নিয়োগ করিতেন। দ্রব্যগুণের বিখ্যাত টীকাকার শিবদাস সেন লিখিয়াছেন যে তাঁহার পিতা অনন্ত সেন গৌড়েশ্বর বারবক শাহের “অন্তরঙ্গ” অর্থাৎ চিকিৎসক ছিলেন। বৃহস্পতি মিশ্রের ‘পদচন্দ্রিকা হইতে জানা যায় যে, তাঁহার বিশ্বাস রায় প্রভৃতি পুত্রেরা বারবক শাহের প্রধান মন্ত্রীদের অন্যতম ছিলেন। পুরাণসর্বস্ব’ নামক একটি গ্রন্থের (সঙ্কলনকাল ১৪৭৪ খ্রী) হইতে জানা যায় যে ঐ গ্রন্থের সঙ্কলয়িতা গোবর্ধনের পৃষ্ঠপোষক কুলধর বারবক শাহের কাছে প্রথমে “সত্য খান” এবং পরে “শুভরাজ খান” উপাধি লাভ করেন, ইহা হইতে মনে হয়, কুলধর বারবক শাহের অধীনে একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিলেন। আমরা পূর্বেই দেখিয়া আসিয়াছি যে কেদার রায় ছিলেন ত্রিহুতে বারবক শাহের প্রতিনিধি, নারায়ণদাস ছিলেন তাঁহার চিকিৎসক এবং ভান্দসী রায় ছিলেন তাঁহার রাজ্যের সীমান্তে ঘোড়াঘাট অঞ্চলে একটি দুর্গের অধ্যক্ষ। কৃত্তিবাস তাঁহার আত্মকাহিনীতে গৌড়েশ্বরের অর্থাৎ বারবক শাহের যে কয়জন সভাসদের উল্লেখ করিয়াছেন, তাঁহার মধ্যে কেদার রায় এবং নারায়ণ ছাড়াও জগদানন্দ রায়, “ব্রাহ্মণ” সুনন্দ, কেদার খাঁ, গন্ধর্ব রায়, তরণী, সুন্দর, শ্রীবৎস্য, মুকুন্দ প্রভৃতি নাম পাওয়া যাইতেছে। ইহাদের মধ্যে মুকুন্দ ছিলেন “রাজার পণ্ডিত”; কেদার খা বিশেষ প্রতিপত্তিশালী সভাসদ ছিলেন এবং কৃত্তিবাসের সংবর্ধনার সময়ে তিনি কৃত্তিবাসের মাথায় “চন্দনের ছড়া” ঢালিয়াছিলেন; সুন্দর ও শ্রীবৎস্য ছিলেন “ধর্ম্মাধিকারিণী” অর্থাৎ বিচারবিভাগীয় কর্মচারী। গন্ধর্ব রায়কে কৃত্তিবাস “গন্ধর্ব অবতার” বলিয়াছেন, ইহা হইতে মনে হয়, গন্ধর্ব রায় সুপুরুষ ও সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন; কৃত্তিবাস কর্ত্তৃক উল্লিখিত অন্যান্য সভাসদের পরিচয় সম্বন্ধে কিছু জানা যায় না।

বারবক শাহের বিভিন্ন শিলালিপি হইতে ইকরার খান, আজমল খান, নসরৎ খান, মরাবৎ খান জহান, অলকা খান, আশরফ খান, খুর্শীদ খান, উজৈর খান, রাস্তি খান প্রভৃতি উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীদের নাম পাওয়া যায়। ইঁহাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন আঞ্চলিক শাসনকর্ত্তা; ইহাদের অন্যতম রাস্তি খান চট্টগ্রাম অঞ্চলের শাসনকর্ত্তা ছিলেন; ইহার পরে ইঁহার বংশধররা বহুদিন পর্যন্ত ঐ অঞ্চল শাসন করিয়াছিলেন।

বারবক শাহ শুধু যে বাংলার হিন্দু ও মুসলমানদেরই রাজপদে নিয়োগ করিতেন তাহা নয়। প্রয়োজন হইলে ভিন্ন দেশের লোককে নিয়োগ করিতেও তিনি কুণ্ঠাবোধ করিতেন না। মুল্লা তকিয়ার বয়াজ হইতে জানা যায় যে, তিনি ত্রিহুতে অভিযানের সময় বহু আফগান সৈন্য সগ্রহ করিয়াছিলেন। তারিখ-ই-ফিরিশতা’য় লেখা আছে যে বারবক শাহ বাংলায় ৮০,০০০ হাবশী আমদানী করিয়াছিলেন এবং তাহাদের প্রাদেশিক শাসনকর্ত্তা, মন্ত্রী, অমাত্য প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করিয়াছিলেন। এই কথা সম্ভবত সত্য, কারণ বারবক শাহের মৃত্যুর কয়েক বৎসর পরে হাবশীরা বাংলার সর্বময় কর্ত্তা হইয়া ওঠে, এমনকি তাহারা বাংলার সিংহাসনও অধিকার করে। হাবশীদের এদেশে আমদানী করা ও শাসনক্ষমতা দেওয়ার জন্য কোন কোন গবেষক বারবক শাহের উপর দোষারোপ করিয়াছেন কিন্তু বারবক শাহ হাবশীদের শারীরিক পটুতার জন্য তাহাদিগকে উপযুক্ত পদে নিয়োগ করিয়াছিলেন; তাহারা যে ভবিষ্যতে এতখানি শক্তিশালী হইবে, ইহা বুঝা তাঁহার পক্ষে সম্ভব ছিল না। প্রকৃতপক্ষে হাবশীদের ক্ষমতাবৃদ্ধির জন্য বারবক শাহ দায়ী নহেন, দায়ী তাঁহার উত্তরাধিকারীরা।

আরাকানদেশের ইতিহাসের মতে আরাকানরাজ মেং-খরি (১৪৩৪-৫৯ খ্রী) রামু (বর্তমান চট্টগ্রাম জেলার দক্ষিণপ্রান্তে অবস্থিত) ও তাঁহার দক্ষিণস্থ বাংলার সমস্ত অঞ্চল জয় করিয়াছিলেন এবং তাঁহার পুত্র ও উত্তরাধিকারী বসোআহপু (১৪৫৯-৮২ খ্রী) চট্টগ্রাম জয় করিয়াছিলেন। ইহা যদি সত্য হয়, তাহা হইলে বলিতে হইবে ১৪৭৪ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে বারবক শাহ চট্টগ্রাম পুনরধিকার করিয়াছিলেন, কারণ ঐ সালে উত্তীর্ণ চট্টগ্রামের একটি শিলালিপিতে রাজা হিসাবে তাঁহার নাম আছে।

বারবক শাহের বিভিন্ন প্রশংসনীয় বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে ইতিপূর্বেই আলোচনা করা হইয়াছে। তিনি একজন সত্যকার সৌন্দর্যরসিকও ছিলেন। তাঁহার মুদ্রা এবং শিলালিপিগুলির মধ্যে অনেকগুলি অত্যন্ত সুন্দর। তাঁহার প্রাসাদের একটি সমসাময়িক বর্ণনা পাওয়া গিয়াছে; তাহা হইতে দেখা যায় যে, এই প্রাসাদটির মধ্যে উদ্যানের মত একটি শান্ত ও আনন্দদায়ক পরিবেশ বিরাজ করিত, ইহার নীচ দিয়া একটি পরম রমণীয় জলধারা প্রবাহিত হইত এবং প্রাসাদটিতে “মধ্য তোরণ” নামে একটি অপূর্ব সুন্দর “বিশেষ প্রবেশপথ হিসাবে নির্মিত” তোরণ ছিল। গৌড়ের “দাখিল দরওয়াজা” নামে পরিচিত বিরাট ও সুন্দর তোরণটি বারবক শাহই নির্মাণ করাইয়াছিলেন বলিয়া প্রসিদ্ধি আছে।

বাংলার সুলতানদের মধ্যে রুকনুদ্দীন বারবক শাহ যে নানা দিক দিয়াই শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করিতে পারেন, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই।

শামসুদ্দীন য়ুসুফ শাহ

রুকনুদ্দীন বারবক শাহের পুত্র শামসুদ্দীন য়ুসুফ শাহ কিছুদিন পিতার সঙ্গে যুক্তভাবে রাজত্ব করিয়াছিলেন, পিতার মৃত্যুর পর তিনি এককভাবে ১৪৭৬-৮১ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। সর্বসমেত তাঁহার রাজত্ব ছয় বৎসরের মত স্থায়ী হইয়াছিল।

বিভিন্ন ইতিহাসগ্রন্থে শামসুদ্দীন য়ুসুফ শাহকে উচ্চশিক্ষিত, ধর্মপ্রাণ ও শাসনদক্ষ নরপতি বলিয়া অভিহিত করা হইয়াছে। ফিরিশতা লিখিয়াছেন যে য়ুসুফ শাহ আইনের শৃঙ্খলা কঠোরভাবে রক্ষা করিতেন; কেহ তাঁহার আদেশ অমান্য করিতে সাহস পাইত না; তিনি তাঁহার রাজ্যে প্রকাশ্যে মদ্যপান একেবারে বন্ধ করিয়া দিয়াছিলেন; আলিমদের তিনি সাবধান করিয়া দিয়াছিলেন, যেন তাহারা ধর্মসংক্রান্ত বিষয়ের নিষ্পত্তি করিতে গিয়া কাহারও পক্ষ অবলম্বন না করেন; তিনি বহু শাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন, ন্যায়বিচারের দিকেও তাঁহার আগ্রহ ছিল। তাই যে মামলার বিচার করিতে গিয়া কাজীরা ব্যর্থ হইত, সেগুলির অধিকাংশ তিনি স্বয়ং বিচার করিয়া নিস্পত্তি করিতেন।

য়ুসুফ শাহ যে ধর্মপ্রাণ মুসলমান ছিলেন তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। তাঁহার রাজত্বকালে গৌড় ও তাঁহার আশেপাশে অনেকগুলি মসজিদ নির্মিত হইয়াছিল। তাহাদের কয়েকটির নির্মাতা ছিলেন স্বয়ং য়ুসুফ শাহ। কেহ কেহ মনে করেন, গৌড়ের বিখ্যাত লোটন মসজিদ ও চামকাটি মসজিদ য়ুসুফ শাহই নির্মাণ করাইয়াছিলেন।

য়ুসুফ শাহের যেমন স্বধর্ম্মের প্রতি নিষ্ঠা ছিল, তেমনি পরধর্ম্মের প্রতি বিদ্বেষও ছিল। তাঁহার প্রমাণ, তাঁহারই রাজত্বকালে পাণ্ডুয়ায় (হুগলি জেলা) হিন্দুদের সূর্য ও নারায়ণের মন্দিরকে মসজিদ ও মিনারে পরিণত করা হইয়াছিল এবং ব্রহ্মশিলা নির্মিত বিরাট সূর্যমূর্ত্তির বিকৃতিসাধন করিয়া তাঁহার পৃষ্ঠে শিলালিপি খোদাই করা হইয়াছিল। পাণ্ডুয়ার (হুগলি) পূর্ব্বোক্ত মসজিদটি এখন বাইশ দরওয়াজা’ নামে পরিচিত। ইহার মধ্যে হিন্দু মন্দিরের বহু শিলাস্তম্ভ ও ধ্বংসাবশেষ দেখিতে পাওয়া যায়। পাণ্ডুয়া (হুগলি) সম্ভবত য়ুসুফ শাহের রাজত্বকালেই বিজিত হইয়াছিল, কারণ এখানে সর্বপ্রথম তাঁহারই শিলালিপি পাওয়া যায়।

জলালুদ্দীন ফতেহ্ শাহ

বিভিন্ন ইতিহাসগ্রন্থের মতে শামসুদ্দীন য়ুসুফ শাহের মৃত্যুর পরে সিকন্দর শাহ নামে একজন রাজবংশীয় যুবক সিংহাসনে বসেন। কিন্তু তিনি অযোগ্য ছিলেন বলিয়া অমাত্যেরা তাঁহাকে অল্প সময়ের মধ্যেই অপসারিত করেন। ‘রিয়াজ-উস্ সলাতীনে’র মতে এই সিকন্দর শাহ ছিলেন য়ুসুফ শাহের পুত্র; তিনি উন্মাদরোগগ্রস্ত ছিলেন; এই কারণে তিনি যেদিন সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন, সেই দিনই অমাত্যগণ কর্ত্তৃক অপসারিত হন। কিন্তু মতান্তরে সিকন্দর শাহ দুই মাস রাজত্ব করিয়াছিলেন। শেষোক্ত মতই সত্য বলিয়া মনে হয়; কারণ যে যুবককে সুস্থ ও যোগ্য জানিয়া অমাত্যেরা সিংহাসনে বসাইয়া ছিলেন, তাঁহার অযোগ্যতা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হইতে যে কিছু সময় লাগিয়াছিল, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। অবশ্য পরবর্তীকালে রচিত ইতিহাসগ্রস্থগুলির উক্তি ব্যতীত এই সিকন্দর শাহের অস্তিত্বের কোন প্রমাণ এ পর্যন্ত পাওয়া যায় নাই।

পরবর্তী সুলতানের নাম জলালুদ্দীন ফতেহ্ শাহ। ইনি নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহের পুত্র এবং শামসুদ্দীন য়ুসুফ শাহের খুল্লতাত। ইনি ৮৮৬ হইতে ৮৯২ হিজরা (১৪৮১-৮২ খ্রী হইতে ১৪৮৭-৮৮ খ্রী) পর্যন্ত রাজত্ব করেন। ইঁহার মুদ্রাগুলি হইতে জানা যায় যে ইহার দ্বিতীয় নাম ছিল হোসেন শাহ।

‘তবকাৎ-ই-আকবরী’ ও ‘রিয়াজ-উস্-সলাতীন’-এর মতে ফতেহ্ শাহ বিজ্ঞ, বুদ্ধিমান ও উদার নৃপতি ছিলেন এবং তাঁহার রাজত্বকালে প্রজারা খুব সুখে ছিল। সমসাময়িক কবি বিজয়গুপ্তের লেখা ‘মনসামঙ্গলে লেখা আছে যে এই নৃপতি বাহুবলে বলী ছিলেন এবং তাঁহার প্রজাপালনের গুণে প্রজারা পরম সুখে ছিল। ফার্সী শব্দকোষ শরনামা’র রচয়িতা ইব্রাহিম কায়ুম ফারুকী জলালুদ্দীন ফতেহ্ শাহের প্রশস্তি করিয়া একটি কবিতা রচনা করিয়াছিলেন।

কিন্তু বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গলের হাসন-হোসেন পালায় যাহা লেখা আছে, তাহা হইতে মনে হয়, ফতেহ্ শাহের রাজত্বকালে হিন্দু প্রজাদের মধ্যে অসন্তোষের যথেষ্ট কারণ বর্তমান ছিল। পালাটিতে হোসেনহাটী গ্রামের কাজী হাসন-হোসেন ভ্রাতৃ-যুগলের কাহিনী বর্ণিত হইয়াছে। এই দুই ভাই এবং হোসেনের শালা দুলা হিন্দুদের উপর অপরিসীম অত্যাচার করিত, ব্রাহ্মণদের নাগালে পাইলে তাহারা তাহাদের পৈতা ছিঁড়িয়া ফেলিয়া মুখে থুতু দিত। একদিন এক বনে একটি কুটিরে রাখাল বালকেরা মনসার ঘট পূজা করিতেছিল, এমন সময়ে তকাই নামে একজন মোল্লা ঝড়বৃষ্টির জন্য সেখানে আসিয়া উপস্থিত হয়; সে মনসার ঘট ভাঙিতে গেল, কিন্তু রাখাল বালকেরা তাহাকে বাধা দিয়া প্রহার করিল এবং নাকে খৎ দিয়া ক্ষমা চাহিতে বাধ্য করিল। তকাই ফিরিয়া আসিয়া হাসন-হোসেনের কাছে রাখাল বালকদের নামে নালিশ করিল। নালিশ শুনিয়া হাসন-হোসেন বহু সশস্ত্র মুসলমানকে একত্র সংগ্রহ করিয়া রাখালদের কুটির আক্রমণ করিল, তাহাদের আদেশে সৈয়দেরা রাখালদের কুটির এবং মনসার ঘট ভাঙিয়া ফেলিল। রাখালরা ভয় পাইয়া বনের মধ্যে লুকাইয়াছিল। কাজীর লোকেরা বন তোলপাড় করিয়া তাহাদের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করিল। হাসন-হোসেন বন্দী রাখালদের “ভূতের” পূজা করার জন্য ধিক্কার দিতে লাগিল।

এই কাহিনী কাল্পনিক বটে, কিন্তু কবির লেখনীতে ইহার বর্ণনা যেরূপ জীবন্ত হইয়া উঠিয়াছে, তাহা হইতে মনে হয় যে, সে যুগের মুসলমান কাজী ও ক্ষমতাশালী রাজকর্মচারীরা সময় সময় হিন্দুদের উপর এইরূপ অত্যাচার করিত এবং কবি স্বচক্ষে তাহা দেখিয়া এই বর্ণনার মধ্যে তাহা প্রতিফলিত করিয়াছেন।

জলালুদ্দীন ফতেহ্ শাহের রাজত্বকালেই নবদ্বীপে শ্রীচৈতন্যদেব জন্মগ্রহণ করেন–১৪৮৬ খ্রীষ্টাব্দের ১৮ই ফেব্রুয়ারী তারিখে।

চৈতন্যদেবের বিশিষ্ট ভক্ত যবন হরিদাস তাঁহার অনেক আগেই জন্মগ্রহণ করেন। ‘চৈতন্যভাগবত’ হইতে জানা যায় যে, হরিদাস মুসলমান হইয়াও কৃষ্ণ নাম করিতেন; এই কারণে কাজী তাঁহার বিরুদ্ধে “মুলুক-পতি” অর্থাৎ আঞ্চলিক শাসনকর্ত্তার কাছে নালিশ করেন। মুলুক-পতি তখন হরিদাসকে বলেন, যে হিন্দুদের তাঁহারা এত ঘৃণা করেন, তাহাদের আচার ব্যবহার হরিদাস কেন অনুসরণ করিতেছেন? হরিদাস ইহার উত্তরে বলেন যে, সব জাতির ঈশ্বর একই। মুলুক-পতি বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও হরিদাস কৃষ্ণনাম ত্যাগ করিয়া “কলিমা উচ্চারণ” করিতে রাজী হইলেন না। তখন কাজীর আজ্ঞায় হরিদাসকে বাজারে লইয়া গিয়া বাইশটি বেত্রাঘাত করা হইল। শেষ পর্যন্ত হরিদাসের অলৌকিক মহিমা দর্শন করিয়া মুলুক-পতি তাঁহার নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া বলিলেন যে আর কেহ তাঁহার কৃষ্ণনামে বিঘ্ন সৃষ্টি করিবে না। চৈতন্যদেবের জন্মের অব্যবহিত পূর্বে এই ঘটনা ঘটিয়াছিল; সুতরাং ইহা যে জলালুদ্দীন ফতেহ্ শাহের রাজত্বকালেরই ঘটনা তাহাতে কোন সন্দেহ নাই।

জয়ানন্দের ‘চৈতন্যমঙ্গল’ হইতে জানা যায় যে, চৈতন্যদেবের জন্মের অব্যবহিত পূর্বে নবদ্বীপের নিকটবর্তী পিরল্যা গ্রামের মুসলমানরা গৌড়েশ্বরের কাছে গিয়া মিথ্যা নালিশ করে যে নবদ্বীপের ব্রাহ্মণেরা তাঁহার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করিতেছে, গৌড়ে ব্রাহ্মণ রাজা হইবে বলিয়া প্রবাদ আছে, সুতরাং গৌড়েশ্বর যেন নবদ্বীপের ব্রাহ্মণদের সম্বন্ধে নিশ্চিত না থাকেন। এই কথা শুনিয়া গৌড়েশ্বর “নবদ্বীপ উচ্ছন্ন” করিতে আজ্ঞা দিলেন। তাঁহার লোকেরা তখন নবদ্বীপের ব্রাহ্মণদের প্রাণবধ ও সম্পত্তি লুঠ করিতে লাগিল এবং নবদ্বীপের মন্দিরগুলি ধ্বংস করিয়া তুলসীগাছগুলি উপড়াইয়া ফেলিতে লাগিল। বিখ্যাত পণ্ডিত বাসুদেব সার্বভৌম এই অত্যাচারে সন্ত্রস্ত হইয়া সপরিবারে নবদ্বীপ ত্যাগ করিয়া উড়িষ্যায় চলিয়া গেলেন। কিছুদিন এইরূপ অত্যাচার চলিবার পর কালী দেবী স্বপ্নে গৌড়েশ্বরকে দেখা দিয়া ভীতিপ্রদর্শন করিলেন। তখন গৌড়েশ্বর নবদ্বীপে অত্যাচার বন্ধ করিলেন এবং তাঁহার আজ্ঞায় বিধ্বস্ত নবদ্বীপের আমূল সংস্কার সাধন করা হইল। বৃন্দাবনদাসের ‘চৈতন্যভাগবত’ হইতে জয়ানন্দের এই বিবরণের আংশিক সমর্থন পাওয়া যায়। বৃন্দাবনদাস লিখিয়াছেন যে, চৈতন্যদেবের জন্মের সামান্য পূর্বে নবদ্বীপের বিখ্যাত পণ্ডিত গঙ্গাদাস রাজভয়ে সন্ত্রস্ত হইয়া সপরিবারে গঙ্গা পার হইয়া পলায়ন করিয়াছিলেন। বৃন্দাবনদাস আরও লিখিয়াছেন যে চৈতন্যদেবের জন্মের ঠিক আগে শ্রীবাস ও তাঁহার তিন ভাইয়ের হরিনাম-সঙ্কীর্তন দেখিয়া নবদ্বীপের লোকে বলিত “মহাতীব্র নরপতি” নিশ্চয়ই ইহাদিগকে শাস্তি দিবেন। এই নরপতি” জলালুদ্দীন ফতেহ্ শাহ। সুতরাং নবদ্বীপের ব্রাহ্মণদের উপর গৌড়েশ্বরের অত্যাচার সম্বন্ধে জয়ানন্দের বিবরণকে মোটামুটিভাবে সত্য বলিয়াই গ্রহণ করা যায়। বলা বাহুল্য এই গৌড়েশ্বরও জলালুদ্দীন ফতেহ্ শাহ। অবশ্য জয়ানন্দের বিবরণের প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি বিষয় সত্য না-ও হইতে পারে। গৌড়েশ্বরকে কালী দেবী স্বপ্নে দেখা দিয়েছিলেন এবং গৌড়েশ্বর ভীত হইয়া অত্যাচার বন্ধ করিয়াছিলেন–এই কথা কবিকল্পনা ভিন্ন আর কিছুই নয়। কিন্তু জয়ানন্দের বিবরণ মূলত সত্য, কারণ বৃন্দাবনদাসের চৈতন্যভাগবতে ইহার সমর্থন মিলে এবং জয়ানন্দ নবদ্বীপে মুসলিম রাজশক্তির যে ধরনের অত্যাচারের বিবরণ লিপিবদ্ধ করিয়াছেন, ফতেহ্ শাহের রাজত্বকালে রচিত বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গলের হাসন-হোসেন পালাতেও সেই ধরনের অত্যাচারের বিবরণ পাওয়া যায়। সুতরাং ফতেহ্ শাহ যে নবদ্বীপের ব্রাহ্মণদের উপর অত্যাচার করিয়াছিলেন, এবং পরে নিজের ভুল বুঝিতে পারিয়া অত্যাচার বন্ধ করিয়াছিলেন, সে সম্বন্ধে সংশয়ের অবকাশ নাই। এই অত্যাচারের কারণ বুঝিতেও কষ্ট হয় না। চৈতন্যচরিত-গ্রন্থগুলি পড়িলে জানা যায় যে, গৌড়ে ব্রাহ্মণ রাজা হইবে বলিয়া পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ পাদে বাংলায় ব্যাপক আকারে প্রবাদ রটিয়াছিল। চৈতন্যদেবের জন্মের কিছু পূর্বেই নবদ্বীপ বাংলা তথা ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ হিসাবে গড়িয়া উঠে এবং এখানকার ব্রাহ্মণেরা সব দিক দিয়াই সমৃদ্ধি অর্জন করেন; এই সময়ে বাহির হইতেও অনেক ব্রাহ্মণ নবদ্বীপে আসিতে থাকেন। এইসব ব্যাপার দেখিয়া গৌড়েশ্বরের বিচলিত হওয়া এবং এতগুলি ঐশ্বর্যবান ব্রাহ্মণ একত্র সমবেত হইয়া গৌড়ে ব্রাহ্মণ রাজা হওয়ার প্রবাদ সার্থক করার ষড়যন্ত্র করিতেছে ভাবা খুবই স্বাভাবিক। ইহার কয়েক দশক পূর্বে বাংলা দেশে রাজা গণেশের অভ্যুত্থান হইয়াছিল। দ্বিতীয় কোন হিন্দু অভ্যুত্থানের আশঙ্কায় পরবর্তী গৌড়েশ্বররা নিশ্চয় সন্ত্রস্ত হইয়া থাকিতেন। সুতরাং এক শ্রেণীর মুসলমানদের উস্কানিতে জলালুদ্দীন ফতেহ্ শাহ নবদ্বীপের ব্রাহ্মণদের সন্দেহের চোখে দেখিয়া তাহাদের উপর অত্যাচার করিয়াছিলেন, ইহাতে অস্বাভাবিক কিছুই নাই।

বৃন্দাবনদাসের চৈতন্যভাগবত’ হইতে জলালুদ্দীন ফতেহ্ শাহের রাজত্বকালের কোন কোন ঘটনা সম্বন্ধে সংবাদ পাওয়া যায়। এই গ্রন্থ হইতে জানা যায় যে চৈতন্যদেবের জন্মের আগের বৎসর দেশে দুর্ভিক্ষ হইয়াছিল; চৈতন্যদেবের জন্মের পরে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় এবং দুর্ভিক্ষেরও অবসান হয়; এইজন্যই তাঁহার ‘বিশ্বম্ভর নাম রাখা হইয়াছিল। চৈতন্যভাগবত’ হইতে আরও জানা যায় যে যবন হরিদাসকে যে সময়ে বন্দিশালায় প্রেরণ করা হইয়াছিল, সেই সময়ে বহু ধনী হিন্দু জমিদার কারারুদ্ধ ছিলেন; মুসলিম রাজশক্তির হিন্দু-বিদ্বেষের জন্য ইঁহারা কারারুদ্ধ হইয়াছিলেন, না খাজনা বাকী পড়া বা অন্য কোন কারণে ইহাদের কয়েদ করা হইয়াছিল, তাহা বুঝিতে পারা যায় না।

বৃন্দাবনদাস জলালুদ্দীন ফতেহ্ শাহকে “মহাতীব্র নরপতি” বলিয়াছেন। ফিরিশতা লিখিয়াছেন যে কেহ অন্যায় করিলে ফতেহ্ শাহ তাহাকে কঠোর শাস্তি দিতেন।

কিন্তু এই কঠোরতাই পরিণামে তাঁহার কাল হইল। ফিরিশতা লিখিয়াছেন যে এই সময়ে হাবশীদের প্রতিপত্তি এতদূর বৃদ্ধি পাইয়াছিল যে তাহারা সব সময়ে সুলতানের আদেশও মানিত না। ফতেহ্ শাহ কঠোর নীতি অনুসরণ করিয়া তাহাদের কতকটা দমন করেন এবং আদেশ-অমান্যকারীদের শাস্তিবিধান করেন। কিন্তু তিনি যাহাদের শাস্তি দিতেন, তাহারা প্রাসাদের প্রধান খোঁজা বারবকের সহিত দল পাকাইত। এই ব্যক্তির হাতে রাজপ্রাসাদের সমস্ত চাবি ছিল।

বিভিন্ন ইতিহাসগ্রন্থ হইতে জানা যায় যে, প্রতি রাত্রে যে পাঁচ হাজার পাইক সুলতানকে পাহারা দিত, তাহাদের অর্থ দ্বারা হাত করিয়া খোঁজা বারবক এক রাত্রে তাহাদের দ্বারা ফতেহ্ শাহকে হত্যা করাইল। ফতেহ্ শাহর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই বাংলায় মাহমুদ শাহী বংশের রাজত্ব শেষ হইল।

সুলতান শাহজাদা

বিভিন্ন ইতিহাসগ্রন্থের মতে ফতেহ্ শাহকে হত্যা করিবার পরে খোঁজা বারবক “সুলতান শাহজাদা” নাম লইয়া সিংহাসনে আরোহণ করে। ইহা সত্য হওয়াই সম্ভব, কিন্তু এই ঘটনা সম্বন্ধে তথা বারবক বা সুলতান শাহজাদার অস্তিত্ব সম্বন্ধে আলোচ্য সময়ে অনেক পরবর্তীকালে রচিত গ্রন্থগুলির উক্তি ভিন্ন আর কোন প্রমাণ মিলে নাই।

আধুনিক গবেষকরা মনে করেন বারবক জাতিতে হাবশী ছিল এবং তাঁহার সিংহাসনে আরোহণের সঙ্গে সঙ্গেই বাংলা দেশে হাবশী রাজত্ব সুরু হইল। কিন্তু এই ধারণার কোন ভিত্তি নাই, কারণ কোন ইতিহাসগ্রন্থেই বারবককে হাবশী বলা হয় নাই। যে ইতিহাসগ্রন্থটিতে বারবক সম্বন্ধে সর্বপ্রথম বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যাইতেছে, সেই তারিখ-ই-ফিরিশতা’র মতে বারবক বাঙালী ছিল।

‘তারিখ-ই-ফিরিশতা’ ও ‘রিয়াজ-উস্-সলাতীন’ অনুসারে ফতেহ্ শাহের প্রধান অমাত্য মালিক আন্দিল সুলতান শাহজাদাকে হত্যা করেন।

সুলতান শাহজাদার রাজত্বকাল কোনও মতে আট মাস, কোনও মতে ছয় মাস, কোনও মতে আড়াই মাস।

৮৯২ হিজরার (১৪৮৭-৮৮ খ্র) গোড়ার দিকে জলালুদ্দীন ফতেহ্ শাহ ও শেষ দিকে সৈফুদ্দীন ফিরোজ শাহ্ রাজত্ব করিয়াছিল। ঐ বৎসরেরই মাঝের দিকে কয়েক মাস সুলতান শাহজাদা রাজত্ব করিয়াছিল।

সুলতান শাহজাদা তাঁহার প্রভুকে হত্যা করিয়া সিংহাসন অধিকার করিয়াছিল। আবার তাহাকে বধ করিয়া একজন অমাত্য সিংহাসন অধিকার করিলেন। এই ধারা কয়েক বৎসর ধরিয়া চলিয়াছিল; এই কয়েক বৎসরে বাংলা দেশে অনেকেই প্রভুকে হত্যা করিয়া রাজা হইয়াছিলেন। বাবর তাঁহার আত্মকাহিনীতে বাংলা দেশের এই বিচিত্র ব্যাপারের উল্লেখ করিয়াছেন এবং যেভাবে এদেশে রাজার হত্যাকারী সকলের কাছে রাজা বলিয়া স্বীকৃতি লাভ করিত, তাহাতে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করিয়াছেন।

সৈফুদ্দীন ফিরোজ শাহ

পরবর্তী রাজার নাম সৈফুদ্দীন ফিরোজ শাহ। ‘তারিখ-ই-ফিরিশতা’ ও ‘রিয়াজ-উস্-সলাতীন’-এর মতে মালিক আন্দিলই এই নাম লইয়া সিংহাসনে আরোহণ করেন। সৈফুদ্দীন ফিরোজ শাহই বাংলার প্রথম হাবশী সুলতান। অনেকের ধারণা হাবশী সুলতানরা অত্যন্ত অযোগ্য ও অত্যাচারী ছিলেন এবং তাঁহাদের রাজত্বকালে দেশের সর্বত্র সন্ত্রাস ও অরাজকতা বিরাজমান ছিল। কিন্তু এই ধারণা সত্য নহে। বাংলার প্রথম হাবশী সুলতান সৈফুদ্দীন ফিরোজ শাহ মহৎ, দানশীল এবং নানাগুণে ভূষিত ছিলেন। তিনি বাংলার শ্রেষ্ঠ সুলতানদের অন্যতম। অন্যান্য হাবশী সুলতানদের মধ্যে এক মুজাফফর শাহ ভিন্ন আর কোন হাবশী সুলতানকে কোন ইতিহাসগ্রন্থে অত্যাচারী বলা হয় নাই।

বিভিন্ন ইতিহাসগ্রন্থে সৈফুদ্দীন ফিরোজ শাহ তাঁহার বীরত্ব, ব্যক্তিত্ব, মহত্ত্ব ও দয়ালুতার জন্য প্রশংসিত হইয়াছেন। ‘রিয়াজ-উস্-সলাতীন’-এর মতে তিনি বহু প্রজাহিতকর কাজ করিয়াছিলেন; তিনি এত বেশি দান করিতেন যে পূর্ববর্তী রাজাদের সঞ্চিত সমস্ত ধনদৌলত তিনি নিঃশেষ করিয়া ফেলিয়াছিলেন; কথিত আছে একবার তিনি এক দিনেই এক লাখ টাকা দান করিয়াছিলেন; তাঁহার অমাত্যেরা এই মুক্তহস্ত দান পছন্দ করেন নাই; তাঁহারা একদিন ফিরোজ শাহের সামনে একলক্ষ টাকা মাটিতে স্থূপীকৃত করিয়া তাহাকে ঐ অর্থের পরিমাণ বুঝাইবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। কিন্তু ফিরোজ শাহের নিকট এক লক্ষ টাকার পরিমাণ খুবই কম বলিয়া মনে হয় এবং তিনি এক লক্ষের পরিবর্তে দুই লক্ষ টাকা দরিদ্রদের দান করিতে বলেন।

‘রিয়াজ-উস্-সলাতীনে লেখা আছে যে, ফিরোজ শাহ গৌড় নগরে একটি মিনার, একটি মসজিদ এবং একটি জলাধার নির্মাণ করাইয়াছিলেন। তন্মধ্যে মিনারটি এখনও বর্তমান আছে। ইহা ফিরোজ মিনার’ নামে পরিচিত।

ফিরোজ শাহের মৃত্যু কীভাবে হইয়াছিল, সে সম্বন্ধে সঠিকভাবে কিছু জানা যায় না। কোন কোন মত অনুসারে তাঁহার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়; কিন্তু অধিকাংশ ইতিহাসগ্রন্থের মতে তিনি পাইকদের হাতে নিহত হইয়াছিলেন। ফিরোজ শাহ ১৪৮৭ খ্রী হইতে ১৪৯০ খ্রী–কিঞ্চিদধিক তিন বৎসর রাজত্ব করিয়াছিলেন।

রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে সৈফুদ্দীন ফিরোজ শাহ “ফতে শাহের ক্রীতদাস” ও “নপুংসক” ছিলেন। কিন্তু এই মতের সপক্ষে কোন প্রমাণ নাই।

নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহ (দ্বিতীয়)

পরবর্তী সুলতানের নাম নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহ। ইহার পূর্বে এই নামের আর একজন সুলতান ছিলেন, সুতরাং ইহাকে দ্বিতীয় নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহ বলা উচিত।

ইহার পিতৃপরিচয় রহস্যাবৃত। ‘ফিরিশ্‌তা’ ও ‘রিয়াজ’-এর মতে ইনি সৈফুদ্দীন ফিরোজ শাহের পুত্র, কিন্তু হাজী মুহম্মদ কন্দাহারী নামে ষোড়শ শতাব্দীর একজন ঐতিহাসিকের মতে ইনি জলালুদ্দীন ফতেহ্ শাহের পুত্র। এই সুলতানের শিলালিপিতে ইঁহাকে শুধুমাত্র সুলতানের পুত্র সুলতান বলা হইয়াছে-পিতার নাম করা হয় নাই। ফিরোজ শাহ ও ফতেহ্ শাহ-উভয়েই সুলতান ছিলেন, সুতরাং দ্বিতীয় নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহ কাহার পুত্র ছিলেন, তাহা সঠিকভাবে বলা অত্যন্ত কঠিন। তবে ইহাকে সৈফুদ্দীন ফিরোজ শাহের পুত্র বলিয়া মনে করার পক্ষেই যুক্তি প্রবলতর।

‘ফিরিশতা’, ‘রিয়াজ’ ও মুহম্মদ কাহারীর মতে দ্বিতীয় নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহের রাজত্বকালে হাবৃশ খান নামে একজন হাবশী (কন্দাহারীর মতে ইনি সুলতানের শিক্ষক, ফিরোজ শাহের জীবদ্দশায় নিযুক্ত হইয়াছিলেন) সমস্ত ক্ষমতা করায়ত্ত করেন, সুলতান তাঁহার ক্রীড়নকে পরিণত হন। কিছুদিন এইভাবেই চলিবার পরে (কন্দাহারীর মতে হাবৃশ খান তখন নিজে সুলতান হইবার মতলব আঁটিতেছিলেন) সিদি বদ্ নামে আর একজন হাবশী বেপরোয়া হইয়া উঠিয়া হাশ খানকে হত্যা করে এবং নিজেই শাসনব্যবস্থার কর্ত্তা হইয়া বসে। কিছুদিন পরে এক রাত্রে সিদি বদ পাইকদের সর্দারের সহিত ষড়যন্ত্র করিয়া দ্বিতীয় নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহকে হত্যা করে এবং পরের দিন প্রভাতে সে অমাত্যদের সম্মতিক্রমে (শামসুদ্দীন) মুজাফফর শাহ নাম লইয়া সিংহাসনে বসে।

মুজাফফর শাহ কর্ত্তৃক দ্বিতীয় নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহের হত্যা এবং তাঁহার সিংহাসন অধিকারের কথা সম্পূর্ণ সত্য, কারণ বাবর তাঁহার আত্মকাহিনীতে ইহার উল্লেখ করিয়াছেন।

শামসুদ্দীন মুজাফফর শাহ

শামসুদ্দীন মুজাফফর শাহ সম্বন্ধে কোন প্রামাণিক বিবরণ পাওয়া যায় না। পরবর্তী কালে রচিত কয়েকটি ইতিহাসগ্রন্থের মতে মুজাফফর শাহ অত্যাচারী ও নিষ্ঠুরপ্রকৃতির লোক ছিলেন; রাজা হইয়া তিনি বহু দরবেশ, আলিম ও সম্ভ্রান্ত লোকদের হত্যা করেন। অবশেষে তাঁহার অত্যাচার যখন চরমে পৌঁছিল, তখন সকলে তাঁহার বিরুদ্ধে দাঁড়াইল; তাঁহার মন্ত্রী সৈয়দ হোসেন বিরুদ্ধবাদীদের নেতৃত্ব গ্রহণ করিলেন এবং মুজাফফর শাহকে বধ করিয়া নিজে রাজা হইলেন।

মুজাফফর শাহের নৃশংসতা, অত্যাচার ও কুশাসন সম্বন্ধে পূর্ব্বোল্লিখিত গ্রন্থগুলিতে যাহা লেখা আছে, তাহা কতদূর সত্য বলা যায় না; সম্ভবত খানিকটা অতিরঞ্জন আছে।

কীভাবে মুজাফফর শাহ নিহত হইয়াছিলেন, সে সম্বন্ধে পরবর্তীকালের ঐতিহাসিকদের মধ্যে দুইটি মত প্রচলিত আছে। একটি মত এই যে, মুজাফফর শাহের সহিত তাঁহার বিরোধীদের মধ্যে কয়েক মাস ধরিয়া যুদ্ধ চলিবার পর এবং লক্ষাধিক লোক এই যুদ্ধে নিহত হইবার পর মুজাফফর শাহ পরাজিত ও নিহত হন। দ্বিতীয় মত এই যে, সৈয়দ হোসেন পাইকদের সর্দারকে ঘুষ দিয়া হাত করেন এবং কয়েকজন লোক সঙ্গে লইয়া মুজাফফর শাহের অন্তঃপুরে প্রবেশ করিয়া তাঁহাকে হত্যা করেন। সম্ভবত শেষোক্ত মতই সত্য, কারণ বাবরের আত্মকাহিনীতে ইহার প্রচ্ছন্ন সমর্থন পাওয়া যায়।

মুজাফফর শাহের রাজত্বকালে পাণ্ডুয়ায় নূর কুত্ত্ব আলমের সমাধি-ভবনটি পুনর্নির্মিত হয়। এই সমাধি-ভবনের শিলালিপিতে মুজাফফর শাহের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা আছে। মুজাফফর শাহ গঙ্গারামপুরে মৌলনা আতার দরগায়ও একটি মসজিদ নির্মাণ করাইয়াছিলেন। সুতরাং মুজাফফর শাহ যে দরবেশ ও ধার্মিক লোকদের হত্যা করিতেন–পূর্ব্বোল্লিখিত ইতিহাসগ্রন্থগুলির এই উক্তিতে আস্থা স্থাপন করা যায় না।

মুজাফফর শাহ ৮৯৬ হইতে ৮৯৮ হিজরা পর্যন্ত রাজত্ব করেন। তাঁহার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই বাংলা দেশে হাবশী রাজত্বের অবসান হইল। পরবর্তী সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহ সিংহাসনে আরোহণ করিয়া হাবশীদের বাংলা হইতে বিতাড়িত করেন। রুকনুদ্দীন বারবক শাহের রাজত্বকালে যাহারা এদেশের শাসনব্যবস্থায় প্রথম অংশগ্রহণ করিবার সুযোগ পায়, কয়েক বৎসরের মধ্যেই তাহাদের ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ ও তাঁহার ঠিক পরেই সদলবলে বিদায় গ্রহণ–দুইই নাটকীয় ব্যাপার। এই হাবশীদের মধ্যে সকলেই যে খারাপ লোক ছিল না, সৈফুদ্দীন ফিরোজ শাহই তাঁহার প্রমাণ। হাবশীদের চেয়েও অনেক বেশি দুবৃত্ত ছিল পাইকেরা। ইহারা এদেশেরই লোক। ১৪৮৭ হইতে ১৪৯৩ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে বিভিন্ন সুলতানের আততায়ীরা এই পাইকদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করিয়াই রাজাদের বধ করিয়াছিল। জলালুদ্দীন ফতেহ্ শাহের হত্যাকারী বারবক স্বয়ং পাইকদের সর্দার ও বাঙালী ছিল বলিয়া তারিখ-ই-ফিরিশতায় লিখিত হইয়াছে।

বাংলায় হাবশীদের মধ্যে যাঁহারা প্রাধান্যলাভ করিয়াছিলেন তাঁহাদের মধ্যে মালিক আন্দিল (ফিরোজ শাহ), সিদি ব (মুজাফফর শাহ), হাবশ খান, কাফুর প্রভৃতির নাম বিভিন্ন ইতিহাসগ্রন্থ ও শিলালিপি হইতে জানা যায়। রজনীকান্ত চক্রবর্তী তাঁহার ‘গৌড়ের ইতিহাসে’ আরও কয়েকজন “প্রধান হাবশী”র নাম করিয়াছেন; কিন্তু তাঁহাদের ঐতিহাসিকতা সম্বন্ধে কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *