০৪. রাজা গণেশ ও তাঁহার বংশ

চতুর্থ পরিচ্ছেদ – রাজা গণেশ ও তাঁহার বংশ

রাজা গণেশ

রাজা গণেশ বাংলার ইতিহাসের একজন অবিস্মরণীয় পুরুষ। তিনিই একমাত্র হিন্দু, যিনি বাংলার পাঁচ শতাধিক বর্ষব্যাপী মুসলিম শাসনের মধ্যে কয়েক বৎসরের জন্য ব্যতিক্রম করিয়া হিন্দুশাসন প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। অবশ্য গণেশের মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই এই হিন্দু অভ্যুদয়ের পরিসমাপ্তি ঘটে। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও গণেশের কৃতিত্ব সম্বন্ধে সংশয়ের অবকাশ নাই। রাজা গণেশ খাঁটি বাঙালী ছিলেন, ইহাও এই প্রসঙ্গে স্মরণীয়।

‘তবকাৎ-ই-আকবরী’, ‘তারিখ-ই-ফিরিশতা’, ‘মাসির-ই-রহিমী’ প্রভৃতি গ্রন্থে গণেশ সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত বিবরণ পাওয়া যায়। ‘রিয়াজ-উস-সলাতীন’-এর বিবরণ অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ; বুকাননের বিবরণী, মুল্লা তকিয়ার বয়াজ, দরবেশদের জীবনীগ্রন্থ ‘মিরাৎ-উল আসরার’ প্রভৃতি সূত্রেও গণেশ সম্বন্ধে কয়েকটি কথা পাওয়া যায়। কিন্তু এই সূত্রগুলি পরবর্তীকালের রচনা। সম্প্রতি গণেশ সম্বন্ধীয় কিছু কিছু সমসাময়িক সূত্রও আবিষ্কৃত হইয়াছে; যেমন,–দরবেশ নূর কুত্ত্ব আলম ও আশরফ সিনানীর পত্রাবলী, ইব্রাহিম শকীর জনৈক সামন্তের আজ্ঞায় রচিত এবং গণেশ ও ইব্রাহিমের সংঘর্ষের উল্লেখসংবলিত ‘সঙ্গীতশিরোমণি’ গ্রন্থ, চীনসম্রাট কর্ত্তৃক বাংলার রাজসভায় প্রেরিত প্রতিনিধিদলের জনৈক সদস্যের লেখা শিং-ছা শ্যং-লান’ গ্রন্থ, আরবী ঐতিহাসিক ইব্‌ নৃ-ই-হজর ও অল-সখাওয়ীর লেখা গ্রন্থদ্বয়, দনুজমর্দনদেব ও মহেন্দ্রদেবের মুদ্রা প্রভৃতি।

উপরে উল্লিখিত সূত্রগুলি বিশ্লেষণ করিয়া রাজা গণেশের ইতিহাসটি মোটামুটিভাবে পুনর্গঠন করা সম্ভব হইয়াছে। এই পুনর্গঠিত ইতিহাসের সারমর্ম নিম্নে প্রদত্ত হইল।

রাজা গণেশ ছিলেন অত্যন্ত শক্তিশালী একজন জমিদার। উত্তরবঙ্গের ভাতুড়িয়া অঞ্চলে তাঁহার জমিদারী ছিল। তিনি ইলিয়াস শাহী বংশের সুলতানদের অন্যতম আমীরও ছিলেন।

গিয়াসুদ্দীন আজম শাহ, সৈফুদ্দীন হজা শাহ, শিহাবুদ্দীন বায়াজিদ শাহ ও আলাউদ্দীন ফিরোজ শাহের আমলে বাংলার রাজনীতিতে গণেশ বিশিষ্ট ভূমিকা গ্রহণ করিয়াছিলেন এবং শেষ দুইজন সুলতানের আমলে তিনিই যে বাংলাদেশের প্রকৃত শাসক ছিলেন তাহা পূর্বেই বলা হইয়াছে। ৮১৭ হিজরার (১৪১৪-১৫ খ্রী) শেষদিকে গণেশ আলাউদ্দীন ফিরোজ শাহকে সিংহাসনচ্যুত (ও সম্ভবত নিহত) করেন এবং নিজের শক্তিশালী সৈন্যবাহিনীর সাহায্যে মুসলমান-রাজত্বের সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করিয়া স্বয়ং বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন।

কিন্তু বেশিদিন রাজত্ব করা তাঁহার পক্ষে সম্ভব হইল না। বাংলার মুসলিম সম্প্রদায়ের একাংশ বিধর্মীর সিংহাসন অধিকারে অসন্তুষ্ট হইয়া তাঁহার প্রচণ্ড বিরোধিতা করিতে লাগিলেন। ইহাদের নেতা ছিলেন বাংলার দরবেশরা। রাজা গণেশ এই বিরোধিতা কঠোরভাবে দমন করিলেন এবং দরবেশদের মধ্যে কয়েকজনকে বধ করিলেন। ইহাতে দরবেশরা তাঁহার উপর আরও ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিলেন। দরবেশদের নেতা নূর কুত্ত্ব আলম উত্তর ও পূর্ব ভারতে সর্বাপেক্ষা পরাক্রান্ত নৃপতি জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহিম শকীর নিকট উত্তেজনাপূর্ণ ভাষায় এক পত্র লিখিয়া জানাইলেন যে গণেশ ঘোরতর অত্যাচারী এবং মুসলমানদের পরম শত্রু; তিনি ইব্রাহিমকে সসৈন্যে বাংলায় আসিয়া গণেশের উচ্ছেদসাধন করিতে অনুরোধ জানাইলেন। ইব্রাহিম শর্কী এই পত্র পাইয়া এ বিষয়ে জৌনপুরের দরবেশ আশরফ দিমনানীর উপদেশ প্রার্থনা করিলেন এবং তাঁহার সম্মতিক্রমে সৈন্যবাহিনী লইয়া বাংলার দিকে রওনা হইলেন।

যে সমস্ত দেশের উপর দিয়া ইব্রাহিম গেলেন, তাহাদের মধ্যে মিথিলা বা ত্রিহুত অন্যতম। বিহুত জৌনপুরের সুলতানের অধীন সামন্ত রাজ্য। কিন্তু এই সময়ে ত্রিহুতের রাজা দেবসিংহকে উচ্ছেদ করিয়া তাঁহার স্বাধীনচেতা পুত্র শিবসিংহ (কবি বিদ্যাপতির পৃষ্ঠপোষক) রাজা হইয়াছিলেন। তিনি জৌনপুররাজের অধীনতা অস্বীকার করিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়াছিলেন এবং রাজা গণেশের সহিত মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ হইয়াছিলেন। গণেশের সহিত যেমন বাংলার দরবেশদের সংঘর্ষ বাধিয়াছিল, শিবসিংহের সহিতও তেমনি ত্রিহুতের দরবেশদের সংঘর্ষ বাধিয়াছিল। ইব্রাহিম শর্কী যখন ত্রিহুতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন, তখন শিবসিংহ তাঁহার সহিত সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হইলেন এবং পরাজিত হইয়া পলায়ন করিলেন। ইব্রাহিম তাঁহার পশ্চাদ্ধাবন করিলেন এবং তাঁহার সুদৃঢ় দুর্গ লেহরা জয় করিয়া তাঁহাকে বন্দী করিলেন। অতঃপর ইব্রাহিম শিবসিংহের পিতা দেবসিংহকে আনুগত্যের সর্তে ত্রিহুতের রাজপদে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করিলেন।

ইহার পর ইব্রাহিম আবার তাঁহার অভিযান শুরু করিলেন এবং বাংলায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। রাজা গণেশ তাঁহার বিপুল সামরিক শক্তির নিকট দাঁড়াইতে পারিলেন না। তাঁহার উপরে তাঁহার পুত্র রাজনীতিচতুর যদু (নামান্তর জিক্সল) পিতার পক্ষ ত্যাগ করিয়া ইব্রাহিমের পক্ষে যোগ দিলেন। তখন গণেশ সরিয়া দাঁড়াইতে বাধ্য হইলেন। যদু রাজ্যের লোভে নিজের ধর্ম পর্যন্ত বিসর্জন দিলেন। ইব্রাহিম যদুকে মুসলমান করিয়া বাংলার সিংহাসনে বসাইলেন। যদু সুলতান হইয়া জলালুদ্দীন মুহম্মদ শাহ নাম গ্রহণ করিলেন। ৮১৮ হিজরার (১৪১৫-১৬ খ্রী) মাঝামাঝি সময়ে এই ঘটনা ঘটিয়াছিল।

অতঃপর ইব্রাহিম দেশে ফিরিয়া গেলেন। জলালুদ্দীনের সিংহাসনে আরোহণের ফলে বাংলার আবার হিন্দু-প্রাধান্যের অবসান ঘটিয়া মুসলিম-প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হইল। কিন্তু এই পরিবর্তন বেশিদিন স্থায়ী হইল না। রাজা গণেশ কিছুদিন পরে সুযোগ বুঝিয়া প্রত্যাবর্তন করিলেন এবং অল্পায়াসে নিজের ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করিলেন। পুত্র জলালুদ্দীন নামে সুলতান রহিলেন, কিন্তু তিনি পিতার ক্রীড়নকে পরিণত হইলেন। বাংলা দেশে আবার হিন্দুধর্ম্মের জয়পতাকা উড়িতে লাগিল। গণেশ আবার তাঁহার প্রতিপক্ষ দরবেশদিগকে ও অন্যান্য মুসলমানদিগকে দমন করিতে লাগিলেন। এই ব্যাপার দেখিয়া নূর কুত্ত্ব আলম অত্যন্ত মর্মাহত হইলেন এবং কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি পরলোকগমন করিলেন।

এদিকে রাজা গণেশ যখন নানা দিক দিয়া নিজেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ মনে করিলেন, তখন তিনি পুত্র জলালুদ্দীনকে অপসারিত করিয়া স্বয়ং ‘দনুজমর্দনদেব’ নাম গ্রহণ করিয়া সিংহাসনে আরোহণ করিলেন। ‘দনুজমর্দনদেব’-এর বঙ্গাক্ষরে ক্ষোদিত মুদ্রাও প্রকাশিত হইল, এই মুদ্রাগুলির এক পৃষ্ঠায় রাজার নাম এবং অপর পৃষ্ঠায় টাকশালের নাম, উৎকীর্ণ হওয়ার সাল এবং “চণ্ডীচরণপরায়ণস্য” লেখা থাকিত। ‘দনুজমর্দনদেব’-রূপে সমগ্র ১৩৩৯ শকাব্দ (১৪১৭-১৮ খ্রী) এবং ১৩৪০ শকাব্দের (১৭১৮-১৯ খ্রী) কিয়দংশ রাজত্ব করিবার পর রাজা গণেশ পরলোকগমন করিলেন। সম্ভবত তিনি জলালুদ্দীন (যদু)-কে তাঁহার ইচ্ছার বিরুদ্ধে হিন্দুধর্ম্মে পুনর্দীক্ষিত করাইয়াছিলেন এবং তাঁহাকে বন্দী করিয়া রাখিয়াছিলেন। সম্ভবত জলালুদ্দীনের ষড়যন্ত্রেই গণেশের মৃত্যু হয়।

স্বল্প সময়ের জন্য রাজত্ব করিলেও রাজা গণেশ বাংলার অধিকাংশ অঞ্চলের উপরই তাঁহার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করিতে পারিয়াছিলেন। উত্তরবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গের প্রায় সমস্তটা এবং মধ্যবঙ্গ, পশ্চিমবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গের কতকাংশ তাঁহার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

রাজা গণেশ যে প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বের অধিকারী এবং কুশাগ্রবুদ্ধি কূটনীতিজ্ঞ ছিলেন, তাহা তাঁহার পূর্ববর্ণিত ইতিহাস হইতেই বুঝা যায়। তিনি নিষ্ঠাবান হিন্দুও ছিলেন। চণ্ডীদেবীর প্রতি তাঁহার আনুগত্যের কথা তিনি মুদ্রায় ঘোষণা করিয়াছিলেন; বিষ্ণুভক্ত ব্রাহ্মণ পদ্মলাভের তিনি চরণপূজা করিতেন, এ কথা পদ্মনাভের বংশধর জীব গোস্বামীর সাক্ষ্য হইতে জানা যায়। পরমধর্মদ্বেষ হইতে রাজা গণেশ একেবারে মুক্ত হইতে পারেন নাই। কয়েকটি মসজিদ ও ঐস্লামিক প্রতিষ্ঠানকে তিনি ধ্বংস করিয়াছিলেন। তিনি বহু মুসলমানের প্রতি দমননীতি প্রয়োগও করিয়াছিলেন, তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক কারণে উহা করিয়াছিলেন। মুসলমানদের প্রতি গণেশের অত্যাচার সম্বন্ধে কোন কোন সূত্রে অনেক অতিরঞ্জিত বিবরণ স্থান পাইয়াছে। ফিরিশতার কথা বিশ্বাস করিলে বলিতে হয় গণেশ অনেক মুসলমানের আন্তরিক ভালবাসাও লাভ করিয়াছিলেন। ফিরিশতার মতে গণেশ দক্ষ সুশাসকও ছিলেন।

গৌড় ও পাণ্ডুয়ার কয়েকটি বিখ্যাত স্থাপত্যকীর্তি গণেশেরই নির্মিত বলিয়া বিশেষজ্ঞরা মনে কনের। ইহাদের মধ্যে গৌড়ের ‘ফতে খানের সমাধি-ভবন’ নামে পরিচিত একটি সৌধ এবং পাণ্ডুয়ার একলাখী প্রাসাদের নাম উল্লেখযোগ্য। গণেশ বিখ্যাত আদিনা মসজিদের সংস্কার সাধন করিয়া উহাকে তাঁহার কাছারীবাড়ীতে পরিণত করিয়াছিলেন বলিয়া প্রবাদ আছে।

গণেশের নাম প্রায় সমস্ত ফার্সী পুথিতেই ‘কান্‌স্’ লেখা হইয়াছে, এই কারণে কেহ কেহ মনে করেন তাঁহার প্রকৃত নাম ছিল ‘কংস’। কিন্তু প্রাচীন ফার্সী পুঁথিতে প্রায় সর্বত্রই ‘গ’ (গাফ্‌)-এর জায়গায় ‘ক’ (কাফ্‌) লিখিতে হইত বলিয়া ইহার উপর গুরুত্ব আরোপ করিতে পারা যায় না। বুকাননের বিবরণী এবং কয়েকটি বৈষ্ণব গ্রন্থের সাক্ষ্য হইতে মনে হয়, ‘গণেশ’ই তাঁহার প্রকৃত নাম। কোন কোন সূত্রের মতে তাঁহার নাম ছিল ‘কাশী’।

মহেন্দ্রদেব

গণেশ বা দনুজমর্দনদেবের সমস্ত মুদ্রাই ১৩৩৯ ও ১৩৪০ শকাব্দের। ১৩৪০ শকাব্দেই আবার মহেন্দ্রদেব নামে আর একজন হিন্দু রাজার মুদ্রা পাওয়া যাইতেছে। ইঁহার মুদ্রাগুলি দনুজমর্দনদেবের মুদ্রারই অনুরূপ।

ইহা হইতে বুঝা যায় যে, মহেন্দ্রদেব দনুজমর্দনদেবের উত্তরাধিকারী এবং সম্ভবত পুত্র। কোন কোন পণ্ডিত মনে করেন মহেন্দ্রদেব জলালুদ্দীনেরই হিন্দু নাম, পিতার মৃত্যুর পরে জলালুদ্দীন কিছু সময়ের জন্য এই নামে মুদ্রা প্রকাশ করিয়াছিলেন। কিন্তু এই মত গ্রহণযোগ্য নহে। মহেন্দ্রদেব তাঁহার মুদ্রায় নিজেকে ‘চণ্ডীচরণপরায়ণ’ বলিয়াছেন, যাহা নিষ্ঠাবান মুসলমান জলালুদ্দীনের পক্ষে সম্ভব নহে।

‘তারিখ-ই ফিরিশতা’র মতে গণেশের আর একজন পুত্র ছিলেন, ইনি জলালুদ্দীনের কনিষ্ঠ। দনুজমর্দনদেবের ও জলালুদ্দীনের মুদ্রার মাঝখানে মহেন্দ্রদেবের মুদ্রার আবির্ভাব হইতে এইরূপ অনুমান খুব অসঙ্গত হইবে না যে, মহেন্দ্রদেব জলালুদ্দীনের কনিষ্ঠ ভ্রাতা, গণেশের মৃত্যুর পরে তিনি সিংহাসনে অভিষিক্ত হইয়াছিলেন; কিন্তু জলালুদ্দীন অল্প সময়ের মধ্যেই মহেন্দ্রদেবকে অপসারিত করিয়া সিংহাসন পুনরাধিকার করেন। অবশ্য ইহা নিছক অনুমান মাত্রা। কিন্তু ‘তারিখ-ই-ফিরিশতা’ গ্রন্থে এই অনুমানের প্রচ্ছন্ন সমর্থন পাওয়া যায়।

মুদ্রার সাক্ষ্য হইতে দেখা যায়, ১৪১৮ খ্রীষ্টাব্দের এপ্রিল হইতে ১৪১৯ খ্রীষ্টাব্দের জানুয়ারী–এই নয় মাসের মধ্যে দনুজমর্দনদেব, মহেন্দ্রদেব ও জলালুদ্দীন–তিনজন রাজাই রাজত্ব করিয়াছিলেন। ইহা হইতে বুঝা যায়, মহেন্দ্রদেব খুবই অল্প সময় রাজত্ব করিতে পারিয়াছিলেন।

জলালুদ্দীন মুহম্মদ শাহ

জলালুদ্দীন মুহম্মদ শাহ দুই দফায় রাজত্ব করিয়াছিলেন–প্রথমবার ৮১৮-১৯ হিজরায় (১৪১৫-১৬ খ্রী) এবং দ্বিতীয়বার ৮২১-৩৬ হিজরায় (১৪১৮-৩৩ খ্রী)।

প্রথমবারের রাজত্বে জলালুদ্দীনের রাজসভায় চীন-সম্রাটের দূতেরা আসিয়াছিলেন। চীনা বিবরণী ‘শিংছা-শ্যং-লান’ হইতে জানা যায় যে, জলালুদ্দীন প্রধান দরবার ঘরে বসিয়া চীনা রাজদূতদের দর্শন দিয়াছিলেন ও চীন-সম্রাট কর্ত্তৃক প্রেরিত পত্র গ্রহণ করিয়াছিলেন। ইহার পর তিনি চীনা দূতদের এক ভোজ দিয়া আপ্যায়িত করিয়াছিলেন, এই ভোজে মুসলমানী রীতি অনুযায়ী গোমাংস পরিবেশন করা হইয়াছিল এবং সুরা দেওয়া হয় নাই। অতঃপর জলালুদ্দীন দূতদের প্রত্যেককে পদমর্যাদা অনুযায়ী উপহার প্রদান করেন এবং স্বর্ণময় আধারে রক্ষিত একটি পত্র চীন-সম্রাটকে দিবার জন্য তাঁহাদের হাতে দেন।

জলালুদ্দীনের দ্বিতীয়বার রাজত্বেরও কয়েকটি ঘটনার কথা জানিতে পারা যায়। আবদুর রজ্জাক রচিত ‘মতলা-ই-সদাইন’ ও চীনা গ্রন্থ ‘মিং-শ-বৃ’-এর সাক্ষ্য পর্যালোচনা করিলে জানা যায়, ১৪২০ খ্রীষ্টাব্দে জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহিম শর্কী জলালুদ্দীনের রাজ্য আক্রমণ করিয়াছিলেন। তৈমুরলঙ্গের পুত্র শাহরুখ তখন পারস্যের হিরাটে ছিলেন; তাঁহার নিকটে এবং চীন-সম্রাট য়ুং-লোর নিকটে দূত পাঠাইয়া জলালুদ্দীন ইব্রাহিমের আক্রমণের কথা জানান। তখন শাহরুখ ও য়ুং লো উভয়েই ইব্রাহিমকে ভর্ৎসনা করিয়া অবিলম্বে আক্রমণ বন্ধ করিতে বলেন, ইব্রাহিমও আক্রমণ বন্ধ করেন।

আরাকান দেশের ইতিহাস হইতে জানা যায় যে, আরাকানরাজ মেং সোয়উন (নামান্তর নরমেইখলা) ব্রহ্মের রাজার সহিত যুদ্ধে পরাজিত হইয়া রাজ্য হারান এবং বাংলার সুলতানের অর্থাৎ জলালুদ্দীন মুহম্মদ শাহের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করেন। জলালুদ্দীনকে আরাকানরাজ শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাহায্য করায় জলালুদ্দীন প্রীত হইয়া তাঁহার রাজ্য উদ্ধারের জন্য এক সৈন্যবাহিনী দেন। ঐ সৈন্যবাহিনীর অধিনায়ক বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া ব্রহ্মের রাজার সহিত যোগ দেয় এবং আরাকানরাজকে বন্দী করে। আরাকানরাজ কোনক্রমে পলাইয়া আসিয়া জলালুদ্দীনকে সব কথা জানান। তখন জলালুদ্দীন আর একজন সেনানায়ককে প্রেরণ করেন এবং ইহার প্রচেষ্টায় ১৪৩০ খ্রীষ্টাব্দে আরাকানরাজের হৃত রাজ্য উদ্ধার হয়। কিন্তু জলালুদ্দীনের উপকারের বিনিময়ে আরাকানরাজ তাঁহার সামন্ত হইতে বাধ্য হইলেন।

ইব্‌ন্‌-ই-হজর ও অল-সখাওয়ীর লেখা গ্রন্থদ্বয় হইতে জানা যায় যে, জলালুদ্দীন ইসলামের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন এবং তাঁহার পিতা কর্ত্তৃক বিধ্বস্ত মসজিদগুলির সংস্কার সাধন করেন; তিনি আবু হানিফার সম্প্রদায়ের মতবাদ গ্রহণ করেন; মক্কায় তিনি অনেকগুলি ভবন ও একটি সুন্দর মাদ্রাসা নির্মাণ করাইয়া ছিলেন; খলিফার নিকট এবং মিশরের রাজা অল-আশরফ বাসবায়ের নিকট তিনি অনেক উপহার পাঠাইয়াছিলেন; খলিফা জলালুদ্দীনের প্রার্থনা অনুযায়ী জলালুদ্দীনকে সম্মান-পরিচ্ছদ পাঠাইয়া তাঁহার “অনুমোদন” জানান।

উপরে প্রদত্ত বিবরণ হইতে জানা যায় যে, জলালুদ্দীন নিষ্ঠাবান মুসলমান ছিলেন। ইহার প্রমাণ অন্যান্য বিষয় হইতে পাওয়া যায়। প্রায় দুই শত বৎসর ধরিয়া বাংলার সুলতানদের মুদ্রায় ‘কলমা’ উৎকীর্ণ হইত না, জলালুদ্দীন কিন্তু তাঁহার মুদ্রায় ‘কলমা খোদাই করান। রাজত্বের শেষদিকে জলালুদ্দীন খলীফ আল্লাহ (ঈশ্বরের উত্তরাধিকারী) উপাধি গ্রহণ করেন। জলালুদ্দীন তাঁহার পূর্বতন ধর্ম অর্থাৎ হিন্দুধর্ম্মের প্রতি বিশেষ সহানুভূতিশীল ছিলেন বলিয়া মনে হয় না। বুকাননের বিবরণী অনুসারে তিনি অনেক হিন্দুকে জোর করিয়া মুসলমান করিয়াছিলেন, যাহার ফলে বহু হিন্দু কামরূপে পলাইয়া গিয়াছিল। ‘রিয়াজ’-এর মতে ইতিপূর্বে জলালুদ্দীনকে হিন্দুধর্ম্মে পুনর্দীক্ষিত করার ব্যাপারে যে সমস্ত ব্রাহ্মণ অংশগ্রহণ করিয়াছিল, জলালুদ্দীন ক্ষমতাপ্রাপ্ত হইয়া তাহাদের যন্ত্রণা দিয়া গোমাংস খাওয়াইয়াছিলেন।

কিন্তু ‘স্মৃতিরত্নহার’ নামক সামসাময়িক গ্রন্থ হইতে জানা যায় যে, এই জলালুদ্দীনই রায় রাজ্যধর নামক একজন নিষ্ঠাবান হিন্দুকে তাঁহার সেনাপতির পদে নিযুক্ত করিয়াছিলেন। ‘স্মৃতিরত্নহার’-এর লেখক বৃহস্পতি মিশ্রও জলালুদ্দীনের নিকটে কিছু সমাদর পাইয়াছিলেন। ইহা হইতে বুঝা যায় যে, জলালুদ্দীন হিন্দুধর্ম্মের অনুরাগী না হইলেও যোগ্য হিন্দুদের মর্যাদা দান করিতেন। সংস্কৃত পণ্ডিত বৃহস্পতি মিশ্রের সমাদর করার কারণ হয়ত জলালুদ্দীনের প্রথম জীবনে প্রাপ্ত সংস্কৃত শিক্ষা।

মুসলমান ঐতিহাসিকদের মতে জলালুদ্দীন সুশাসক ও ন্যায়বিচারক ছিলেন। ‘রিয়াজ’-এর মতে তিনি জনাকীর্ণ পাণ্ডুয়া নগরী পরিত্যাগ করিয়া গৌড়ে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন।

জলালুদ্দীনের রাজ্যের আয়তন খুব বিশাল ছিল। প্রায় সমগ্র বাংলা দেশ ও আরাকান ব্যতীত–ত্রিপুরা ও দক্ষিণ বিহারেরও কিছু অংশ অন্তত সাময়িকভাবে তাঁহার রাজ্যভুক্ত হইয়াছিল বলিয়া মুদ্রার সাক্ষ্য হইতে মনে হয়।

জলালুদ্দীন ১৪৩৩ খ্রীষ্টাব্দের গোড়ার দিক পর্যন্ত জীবিত ছিলেন বলিয়া প্রমাণ পাওয়া যায়। সম্ভবত তাঁহার অল্প কিছুকাল পরেই তিনি পরলোকগমন করেন। পাণ্ডুয়ার একলাখী প্রাসাদে তাঁহার সমাধি অছে।

শামসুদ্দীন আহ্মদ শাহ

জলালুদ্দীন মুহম্মদ শাহের মৃত্যুর পর তাঁহার পুত্র শামসুদ্দীন আহমদ শাহ সিংহাসনে আরোহণ করেন। আইন-ই-আকবরী’, ‘তবকাত-ই-আকবরী’, ‘তারিখ-ই ফিরিশতা’, ‘রিয়াজ-উস্-সলাতীন’ প্রভৃতি গ্রন্থের মতে শামসুদ্দীন আহমদ শাহ ১৬ বা ১৮ বৎসর রাজত্ব করিয়াছিলেন। কিন্তু ইহা সত্য হইতে পারে না। কারণ শামসুদ্দীন আহ্মদ শাহের রাজত্বের প্রথম বৎসর অর্থাৎ ৮৩৬ হিজরা (১৪৩২-৩৩ খ্রী) ভিন্ন আর কোন বৎসরের মুদ্রা পাওয়া যায় নাই। এদিকে ৮১৪ হিজরা (১৪৩৭-৩৮ খ্রী) হইতে তাঁহার পরবর্তী সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহের মুদ্রা পাওয়া যাইতেছে। বুকাননের বিবরণী অনুসারে শামসুদ্দীন তিন বৎসর রাজত্ব করিয়াছিলেন। এই কথাই সত্য বলিয়া মনে হয়।

ফিরিশতার মতে শামসুদ্দীন মহান, উদার, ন্যায়পরায়ণ এবং দানশীল নৃপতি ছিলেন। কিন্তু ‘রিয়াজ’-এর মতে শামসুদ্দীন ছিলেন বদমেজাজী, অত্যাচারী এবং রক্তপিপাসু; বিনা কারণে তিনি মানুষের রক্তপাত করিতেন এবং গর্ভবতী স্ত্রীলোকদের উদর বিদীর্ণ করিতেন। সমসাময়িক আরব-দেশীয় গ্রন্থকার ইব-ই হজরের মতে শামসুদ্দীন মাত্র ১৪ বৎসর বয়সে রাজা হইয়াছিলেন। এ কথা সত্য হইলে বলিতে হইবে, তাঁহার সম্বন্ধে ফিরিশতার প্রশংসা এবং ‘রিয়াজ’-এর নিন্দা–দুইই অতিরঞ্জিত।

‘রিয়াজ’ ও বুকাননের বিবরণীর মতে শামসুদ্দীনের দুই ক্রীতদাস সাদী খান ও নাসির খান ষড়যন্ত্র করিয়া তাঁহাকে হত্যা করেন। এই কথা সত্য বলিয়া মনে হয়, কারণ একলাখী প্রাসাদের মধ্যস্থিত শামসুদ্দীনের সমাধির গঠন শহীদের সমাধির অনুরূপ।

শামসুদ্দীন সম্বন্ধে আর কোন সংবাদ জানা যায় না। তাঁহার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাদেশে গণেশের বংশের রাজত্ব শেষ হইল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *