০৩. বাংলার স্বাধীন সুলতানগণ–ইলিয়াস শাহী বংশ

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – বাংলার স্বাধীন সুলতানগণ–ইলিয়াস শাহী বংশ

ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ

জিয়াউদ্দীন বারনির ‘তারিখ-ই-ফিরোজ শাহী’ গ্রন্থে ফখরুদ্দীনের বিদ্রোহের সংক্ষিপ্ত বিবরণ আছে। ইহার বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায় কিঞ্চিৎ পরবর্তীকালে রচিত ‘তারিখ-ই-মুবারক শাহী’ হইতে।

এই বিবরণ নির্ভরযোগ্য। এই গ্রন্থের মতে বহরাম খানের মৃত্যুর পর তাঁহার বর্ম্মরক্ষক ফখরুদ্দীন সোনারগাঁও অধিকার করিয়া নিজেকে স্বাধীন নৃপতি বলিয়া ঘোষণা করিলে লখনৌতির শাসনকর্ত্তা কদর খান, সাতগাঁওয়ের শাসনকর্ত্তা ইজুদ্দীন য়াহিয়া এবং সম্রাটের অধীনস্থ অন্যান্য উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা তাঁহাকে দমন করিবার জন্য যুদ্ধযাত্রা করেন। তাঁহাদের সহিত যুদ্ধে পরাজিত হইয়া ফখরুদ্দীন পলায়ন করেন। তাঁহার হাতি ও ঘোড়াগুলি কদর খানের অধীনে আসে। কদর খান লুঠ করিয়া অনেক রৌপ্যমুদ্রাও হস্তগত করেন। মালিক হিসামুদ্দীন নামে জনৈক পদস্থ অমাত্য কদর খানকে এই অর্থ রাজকোষে পাঠাইয়া দিতে বলিলেন। কিন্তু কদর খান তাহা করিলেন না। তিনি সৈন্যদের এই লুঠের কোনো ভাগও দিলেন না। ইহাতে সৈন্যেরা তাঁহার উপর অসন্তুষ্ট হইল এবং তাহারা ফখরুদ্দীনের সঙ্গে যোগ দিয়া কদর খানকে হত্যা করিল। ফখরুদ্দীন সোনারগাঁও পুনরধিকার করিলেন। লখনৌতিও তিনি সাময়িকভাবে অধিকার করিলেন এবং মুখলিশ নামে এক ব্যক্তিকে ঐ অঞ্চলে শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত করিলেন। কিন্তু কদর খানের অধীনস্থ আরিজ-ই-লস্কর (সৈন্যবাহিনীর বেতন-দাতা) আলী মুবারক মুখলিশকে বধ করিয়া লখনৌতি অধিকার করিলেন। তিনি মুহম্মদ তুগলককে লখনৌতিতে একজন শাসনকর্ত্তা পাঠাইতে অনুরোধ জানাইলেন। মুহম্মদ তুগলক দিল্লির শাসনকর্ত্তা য়ুসুফকে লখনৌতির শাসনকর্ত্তার পদে নিযুক্ত করিলেন। কিন্তু লখনৌতিতে পৌঁছিবার পূর্বেই য়ুসুফ পরলোকগমন করিলেন। মুহম্মদ তুগলক আর কাহাকেও তাঁহার জায়গায় নিযুক্ত করিয়া পাঠাইলেন না। এদিকে লখনৌতিতে কোনো শাসনকর্ত্তা না থাকায় বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়াছিল। ইহার জন্য ফখরুদ্দীনের আক্রমণ রোধ করাও কঠিন হইয়া পড়িয়াছিল। তাই আলী মুবারক বাধ্য হইয়া আলাউদ্দীন (আলাউদ্দীন আলী শাহ) নাম গ্রহণ করিয়া নিজেকে লখনৌতির নৃপতি বলিয়া ঘোষণা করিলেন।

ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ লখনৌতি বেশিদিন নিজের অধিকারে রাখিতে পারেন। নাই বটে, কিন্তু সোনারগাঁও সমেত পূর্ববঙ্গের অধিকাংশ বরাবরই তাঁহার অধীনে ছিল। সপ্তদশ শতাব্দীতে ঔরঙ্গজেবের অধীনস্থ কর্মচারী শিহাবুদ্দীন তালিশ লিখিয়াছিলেন যে ফখরুদ্দীন চট্টগ্রামও জয় করিয়াছিলেন এবং চাঁদপুর হইতে চট্টগ্রাম পর্যন্ত তিনি একটি বাঁধ নির্মাণ করাইয়াছিলেন; চট্টগ্রামের বহু মসজিদ ও সমাধিও তাঁহারই আমলে নির্মিত হয়।

ইবন বতুতা ফখরুদ্দীনের রাজত্বকালে বাংলা দেশে আসিয়াছিলেন। তিনি গোলযোগের ভয়ে ফখরুদ্দীনের সহিত দেখা করেন নাই। ইবন্ বক্তৃতার ভ্রমণ বিবরণী হইতে ফখরুদ্দীন সম্বন্ধে অনেক সংবাদ পাওয়া যায়। ইবন বতুতা লিখিয়াছেন যে, ফখরুদ্দীনের সহিত (আলাউদ্দীন) আলী শাহের প্রায়ই যুদ্ধ হইত। ফখরুদ্দীনের নৌবল বেশি শক্তিশালী ছিল, তাই তিনি বর্ষাকাল ও শীতকালে লখনৌতি আক্রমণ করিতেন, কিন্তু গ্রীষ্মকালে আলী শাহ ফখরুদ্দীনর রাজ্য আক্রমণ করিতেন, কারণ স্থলে তাঁহারই শক্তি বেশি ছিল। ফকীরদের প্রতি ফখরুদ্দীনের অপরিসীম দুর্বলতা ছিল। তিনি একবার শায়দা নামে একজন ফকীরকে তাঁহার অন্যতম রাজধানী সোদকাওয়াঙ’ অর্থাৎ চাটগাঁও শহরে তাঁহার প্রতিনিধি নিযুক্ত করিয়া জনৈক শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে গিয়াছিলেন। বিশ্বাসঘাতক শায়দা সেই সুযোগে বিদ্রোহ করে এবং ফখরুদ্দীনের একমাত্র পুত্রকে হত্যা করে। ফখরুদ্দীন তখন ‘চাটগাঁওয়ে’ ফিরিয়া আসেন। শায়দা তখন সোনারগাঁও-এ পলাইয়া যায় এবং ঐ স্থান অধিকার করিয়া বসিয়া থাকে, কিন্তু সোনারগাঁওয়ের অধিবাসীরা তাহাকে বন্দী করিয়া সুলতানের বাহিনীর কাছে পাঠাইয়া দেয়। তখন শায়দা ও অন্য অনেক ফকীরের প্রাণদণ্ড হইল। ইহার পরেও কিন্তু ফখরুদ্দীনের ফকীরদের প্রতি দুর্বলতা কমে নাই। তাঁহার আদেশের বলে ফকীররা মেঘনা নদী দিয়া বিনা ভাড়ায় নৌকায় যাতায়াত করিতে পারিত; নিঃসম্বল ফকীরদের খাদ্যও দেওয়া হইত। সোনারগাঁও শহরে কোনো ফকীর আসিলে সে আধ দীনার (আট আনার মতো) পাইত।

ইবন বতুতার বিবরণ হইতে জানা যায় যে ফখরুদ্দীনের আমলে বাংলাদেশে জিনিসপত্রের দাম অসম্ভব সুলভ ছিল। ফখরুদ্দীন কিন্তু হিন্দুদের প্রতি খুব ভালো ব্যবহার করেন নাই। ইবন বতুতা হব’ শহরে (আধুনিক শ্রীহট্ট জেলার অন্ত ভুক্ত) গিয়া দেখিয়াছিলেন যে সেখানকার হিন্দুরা তাহাদের উৎপন্ন শস্যের অর্ধেক সরকারকে দিতে বাধ্য হইত এবং ইহা ব্যতীত তাহাদের আরো নানারকম কর দিতে হইত।

কয়েকখানি ইতিহাসগ্রন্থের মতে ফখরুদ্দীন শক্রর হাতে নিহত হইয়া পরলোকগমন করিয়াছিলেন। কিন্তু কাহার হাতে তিনি নিহত হইয়াছিলেন, সে সম্বন্ধে বিভিন্ন বিবরণের উক্তির মধ্যে ঐক্য নাই এবং এই-সব বিবরণের মধ্যে যথেষ্ট ভুলও ধরা পড়িয়াছে। ফখরুদ্দীন সম্বন্ধে যে-সমস্ত তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গিয়াছে তাঁহার ভিত্তিতে নিঃসংশয়ে বলা যায় যে ফখরুদ্দীন ১৩৩৮ হইতে ১৩৫০ খ্রী পর্যন্ত রাজত্ব করিয়া স্বাভাবিক মৃত্যু বরণ করেন।

ফখরুদ্দীন সম্বন্ধে আর-একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় এই যে তাঁহার মুদ্রাগুলি অত্যন্ত সুন্দর, বাংলাদেশে প্রাপ্ত সমস্ত মুদ্রার মধ্যে এইগুলিই শ্রেষ্ঠ।

ইখতিয়ারুদ্দীন গাজী শাহ

ফখরুদ্দীন মুবারক শাহের ঠিক পরেই ইখতিয়ারুদ্দীন গাজী শাহ নামে এক ব্যক্তি পূর্ববঙ্গে রাজত্ব করিয়াছিলেন (১৩৪৯-১৩৫২ খ্রী)। ইখতিয়ারুদ্দীনের সোনারগাঁও এর টাকশালে উৎকীর্ণ অনেকগুলি মুদ্রা পাওয়া গিয়াছে। এই মুদ্রাগুলি হুবহু ফখরুদ্দীনের মুদ্রার অনুরূপ। এইসব মুদ্রায় ইখতিয়ারুদ্দীনকে “সুলতানের পুত্র সুলতান” বলা হইয়াছে। সুতরাং ইখতিয়ারুদ্দীন যে ফখরুদ্দীনেরই পুত্র, তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই। ইতিহাসগ্রন্থগুলিতে এই ইখতিয়ারুদ্দীন গাজী শাহের নাম পাওয়া যায় না, তবে ‘মলফুজুস-সফর’ নামে একটি সমসাময়িক সূফীগ্রন্থে ইহার নাম উল্লিখিত হইয়াছে।

৭৫৩ হিজরায় (১৩৫২-৫৩ খ্রী) শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ সোনারগাঁও অধিকার করেন। কোনো কোনো ইতিহাসগ্রন্থের মতে তিনি ফখরুদ্দীনকে এই সময়ে বধ করিয়াছিলেন। কিন্তু ইহা সত্য হইতে পারে না, কারণ ফখরুদ্দীন ইহার তিন বৎসর পূর্বেই পরলোকগমন করিয়াছিলেন। সম্ভবত ইখতিয়ারুদ্দীনই ইলিয়াস শাহের হাতে নিহত হন।

আলাউদ্দীন আলী শাহ

আলাউদ্দীন আলী শাহ কীভাবে লখনৌতির রাজা হইয়াছিলেন, তাহা ইতিপূর্বেই উল্লিখিত হইয়াছে।

ফখরুদ্দীন মুবারক শাহের সহিত আলী শাহের প্রায়ই সংঘর্ষ হইত। এ সম্বন্ধেও পূর্বে আলোচনা করা হইয়াছে।

আলী শাহ সম্ভবত লখনৌতি অঞ্চল ভিন্ন আর-কোনো অঞ্চল অধিকার করিতে পারেন নাই। তাঁহার সমস্ত মুদ্রাই পাণ্ডুয়া বা ফিরোজাবাদের টাকশালে নির্মিত হইয়াছিল। যতদূর মনে হয় তিনি গৌড় বা লখনৌতি হইতে পাণ্ডুয়ায় তাঁহার রাজধানী স্থানান্তরিত করিয়াছিলেন। ইহার পর প্রায় একশত বৎসর পাণ্ডুয়াই বাংলার রাজধানী ছিল। আলাউদ্দীন আলী শাহ ৭৪২ হিজরায় (১৩৪১ ৪২ খ্রী) সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং মাত্র এক বৎসর কয়েক মাস রাজত্ব করিয়া পরলোক গমন করেন। মালিক ইলিয়াস হাজী নামে তাঁহার অধীনস্থ এক ব্যক্তি ষড়যন্ত্র করিয়া তাহাকে বধ করেন এবং শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ নাম গ্রহণ করিয়া নিজে সুলতান হন।

পাণ্ডুয়ার বিখ্যাত শাহ জলালের দরগা’ আলাউদ্দীন আলী শাহই প্রথম নির্মাণ করাইয়াছিলেন।

শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ

শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহের পূর্ব-ইতিহাস বিশেষ কিছু জানা যায় না। চতুর্দ্দশ পঞ্চদশ শতাব্দীর আরবী ঐতিহাসিক ই-ই হজর ও আল-সখাওয়ীর মতে ইলিয়াস শাহের আদি নিবাস ছিল পূর্ব ইরানের সিজিস্তানে। পরবর্তীকালে রচিত ইতিহাসগ্রন্থগুলির কোনোটিতে তাঁহাকে আলী শাহের ধাত্রীমাতার পুত্র, কোনোটিতে তাঁহার ভৃত্য বলা হইয়াছে।

লখনৌতি রাজ্যের অধীশ্বর হইবার পর ইলিয়াস রাজ্যবিস্তার ও অর্থসংগ্রহে মন দেন। প্রথমে সম্ভবত তিনি সাতগাঁও অঞ্চল অধিকার করেন। নেপালের সমসাময়িক শিলালিপি ও গ্রন্থাদি হইতে জানা যায় যে, ইলিয়াস নেপাল আক্রমণ করিয়া সেখানকার বহু নগর জ্বালাইয়া দেন এবং বহু মন্দির ধ্বংস করেন; বিখ্যাত পশুপতিনাথের মূর্ত্তিটি তিনি তিন খণ্ড করেন (১৩৫০ খ্রী)। ইলিয়াস রাজ্যবিস্তার করিবার জন্য নেপালে অভিযান করেন নাই, সেখানে ব্যাপকভাবে লুঠপাট করিয়া ধন সংগ্রহ করাই ছিল তাঁহার মুখ্য উদ্দেশ্য। ‘তবকাৎ-ই-আকবরী’ ও ‘তারিখ-ই ফিরিশতা’য় লেখা আছে, ইলিয়াস উড়িষ্যা আক্রমণ করিয়া চিল্কা হ্রদের সীমা পর্যন্ত অভিযান চালান এবং সেখানে ৪৪টি হাতি সমেত অনেক সম্পত্তি লুঠ করেন। বারনির ‘তারিখ-ই-ফিরোজ শাহী’ হইতে জানা যায় যে ইলিয়াস ত্রিহুত অধিকার করিয়াছিলেন; ষোড়শ শতাব্দীর ঐতিহাসিক মুল্লা তকিয়ার মতে ইলিয়াস হাজীপুর অবধি জয় করেন। সিরাৎ-ই-ফিরোজ শাহী’ নামে একটি সমসাময়িক গ্রন্থ হইতে জানা যায় যে, ইলিয়াস চম্পারণ, গোরক্ষপুর ও কাশী প্রভৃতি অঞ্চলও জয় করেন। পূর্বদিকেও ইলিয়াস রাজ্যবস্তিার করিয়াছিলেন। মুদ্রার সাক্ষ্য হইতে দেখা যায় যে ইলিয়াস ইখতিয়ারুদ্দীন গাজী শাহের নিকট হইতে সোনারগাঁও অঞ্চল অধিকার করিয়া লইয়াছিলেন (১৩৫২ খ্রী)। কামরূপেরও অন্তত কতকাংশ ইলিয়াসের রাজ্যভুক্ত হইয়াছিল, কারণ তাঁহার পুত্র সিকন্দর শাহের রাজত্বের প্রথম বৎসরের একটি মুদ্রা কামরূপের টাকশালে উত্তীর্ণ হইয়াছিল।

এইভাবে ইলিয়াস শাহ নানা রাজ্য জয় করায় এবং পূর্বতন তুগলক সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত অনেক অঞ্চল অধিকার করায় দিল্লির সম্রাট ফিরোজ শাহ তুগলক ক্রুদ্ধ হন এবং ইলিয়াস শাহের বিরুদ্ধে অভিযান করেন। এই অভিযানের সময় ফিরোজ শাহ কর হ্রাস প্রভৃতির প্রলোভন দেখাইয়া ইলিয়াস শাহের প্রজাদের দলে টানিবার চেষ্টা করেন এবং তাহাতে আংশিক সাফল্য লাভ করেন। এই অভিযানের ফলে শেষপর্যন্ত ত্রিহুত প্রভৃতি নববিজিত অঞ্চলগুলি ইলিয়াসের হস্তচ্যুত হয়, কিন্তু বাংলায় তাঁহার সার্বভৌম অধিকার অক্ষুণ্ণই রহিয়া যায়।

জিয়াউদ্দীন বারনির ‘তারিখ-ই-ফিরোজ শাহী’, শামস্-ই সিরাজ আফিফ-এর ‘তারিখ-ই-ফিরোজ শাহী’ এবং অজ্ঞাতনামা সমসাময়িক ব্যক্তির লেখা ‘সিরাৎ-ই ফিরোজ শাহী’ হইতে ফিরোজ শাহ ও ইলিয়াস শাহের সংঘর্ষের বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়। এই তিনটি গ্রন্থই ফিরোজ শাহের পক্ষভুক্ত লোকের লেখা বলিয়া ইহাদের মধ্যে একদেশদর্শিতা উৎকটরূপে আত্মপ্রকাশ করিয়াছে। ইহাদের বিবরণের সারমর্ম এই।

ফিরোজ শাহ তাঁহার সিংহাসনে আরোহণের পরেই (১৩৫১ খ্রী) সংবাদ পান যে ইলিয়াস ত্রিহুত অধিকার করিয়া সেখানে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকলের উপর অত্যাচার ও লুঠতরাজ চালাইতেছে। ১৩৫৩ খ্রষ্টাব্দে ফিরোজ শাহ ইলিয়াসকে দমন করিবার জন্য এক বিশাল বাহিনী লইয়া বাংলার দিকে যাত্রা করেন। অযোধ্যা প্রদেশ হইয়া তিনি ত্রিহুতে পৌঁছান এবং ত্রিহুত পুনরধিকার করেন। অতঃপর ফিরোজ শাহ বাংলাদেশে উপনীত হইয়া ইলিয়াসের রাজধানী পাণ্ডুয়া জয় করিয়া লন। ইলিয়াস তাঁহার পূর্বেই পাণ্ডুয়া হইতে তাঁহার লোকজন সরাইয়া লইয়া একডালা নামক একটি অনতিদূরবর্তী দুর্গে আশ্রয় লইয়াছিলেন। এই একডালা যেমনই বিরাট, তেমনি দুর্ভেদ্য দুর্গ, ইহার চারিদিক নদী দ্বারা বেষ্টিত ছিল। ফিরোজ শাহ কিছুকাল একডালা দুর্গ অবরোধ করিয়া রহিলেন, কিন্তু ইলিয়াস আত্মসমর্পণের কোন লক্ষণই দেখাইলেন না। অবশেষে একদিন ফিরোজ শাহের সৈন্যেরা এক স্থান হইতে অন্য স্থানে যাওয়ায় ইলিয়াস মনে করিলেন ফিরোজ শাহ পশ্চাদপসরণ করিতেছেন (ইহা বারনির বিবরণে লিখিত হইয়াছে, আফিফ ও ‘সিরাৎ’-এর বিবরণ এক্ষেত্রে ভিন্নরূপ), তখন তিনি একডালা দুর্গ হইতে সসৈন্যে বাহির হইয়া ফিরোজ শাহের বাহিনীকে আক্রমণ করিলেন। দুই পক্ষে যে যুদ্ধ হইল তাহাতে ইলিয়াস পরাজিত হইলেন, এবং ইহার পর তিনি আবার একডালা দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করিলেন।

এতদূর পর্যন্ত এই তিনটি গ্রন্থের বিবরণের মধ্যে মোটামুটিভাবে ঐক্য আছে, কেবলমাত্র দুই একটি খুঁটিনাটি বিষয়ে পার্থক্য দেখা যায়; ইলিয়াস শাহ সম্বন্ধে বিদ্বেষমূলক উক্তিগুলি বাদ দিলে এই বিবরণ মোটের উপর নির্ভরযোগ্য। কিন্তু যুদ্ধের ধরন এবং পরবর্তী ঘটনা সম্বন্ধে তিনটি গ্রন্থের উক্তিতে মিল নাই এবং তাহা বিশ্বাসযোগ্যও নহে। বারনির মতে এই যুদ্ধে ফিরোজ শাহের বিন্দুমাত্রও ক্ষতি হয়। নাই, ইলিয়াসের অসংখ্য সৈন্য মারা পড়িয়াছিল এবং ফিরোজ শাহ ৪৪টি হাতি সমেত ইলিয়াসের বহু সম্পত্তি হস্তগত করিয়াছিলেন; ইলিয়াসের পরাজয়ের পরে ফিরোজ শাহ একডালা দুর্গ অধিকার করিবার প্রয়োজন বোধ করেন নাই, তিনি মনে করিয়াছিলেন যে ৪৪টি হাতি হারানোর ফলে ইলিয়াসের দম্ভ চূর্ণ হইয়া গিয়াছে। আফিফের মতে ইলিয়াস শাহের অন্তঃপুরের মহিলারা একডালা দুর্গের ছাদে দাঁড়াইয়া মাথার কাপড় খুলিয়া শোক প্রকাশ করায় ফিরোজ শাহ বিচলিত হইয়াছিলেন এবং মুসলমানদের নিধন ও মহিলাদের অমর্যাদা করিতে অনিচ্ছুক হইয়া একডালা দুর্গ অধিকারের পরিকল্পনা ত্যাগ করিয়াছিলেন; তিনি বাংলাদেশের বিজিত অঞ্চলগুলি স্থায়িভাবে নিজের অধিকারে রাখার ব্যবস্থাও করেন নাই, কারণ এ দেশ জলাভূমিতে পূর্ণ! ‘সিরাৎ-ই-ফিরোজ শাহী’র মতে ফিরোজ শাহ একডালা দুর্গের অধিবাসীদের, বিশেষত মহিলাদের করুণ আবেদনের ফলে একডালা দুর্গ অধিকারে ক্ষান্ত হইয়াছিলেন।

এই সমস্ত কথা একেবারেই বিশ্বাসযোগ্য নহে। ফিরোজ শাহ যে এই সমস্ত কারণের জন্য একডালা দুর্গ অধিকারে বিরত হন নাই, তাঁহার প্রমাণ–ইলিয়াস শাহের মৃত্যুর পরে তিনি আর একবার বাংলা দেশ আক্রমণ করিয়াছিলেন ও একডালা দুর্গ জয়ের চেষ্টা করিয়াছিলেন। মোটের উপর ইহাই সত্য বলিয়া মনে হয় যে ফিরোজ শাহ একডালা দুর্গ অধিকার করিতে পারেন নাই বলিয়াই করেন নাই। যুদ্ধের ফিরোজ শাহের কোন ক্ষতি হয় নাই-বারনির এই কথাও সত্য বলিয়া মনে হয় না। আফিফ লিখিয়াছেন যে উভয়পক্ষে প্রচণ্ড যুদ্ধ হইয়াছিল এবং পরবর্তী গ্রন্থ ‘তারিখ-ই-মুবারক শাহী’তে তাঁহার উক্তির সমর্থন পাওয়া যায়।

আসল কথা, ফিরোজ শাহ ও ইলিয়াস শাহের যুদ্ধে কোন পক্ষই চূড়ান্তভাবে জয়ী হইতে পারে নাই। ফিরোজ শাহ যুদ্ধের ফলে শেষপর্যন্ত কয়েকজন বন্দী, কিছু লুঠের মাল এবং কয়েকটি হাতি ভিন্ন আর কিছুই লাভ করিতে পারেন নাই। তাঁহার পক্ষেও নিশ্চয়ই কিছু ক্ষতি হইয়াছিল, যাহা তাঁহার অনুগত ঐতিহাসিকরা গোপন করিয়া গিয়াছেন। ইলিয়াস যুদ্ধের আগেও একডালা দুর্গে ছিলেন, এখনও সেখানেই রহিয়া গেলেন। সুতরাং কার্যত তাঁহার কোন ক্ষতিই হয় নাই। ফিরোজ শাহ যে কেন পশ্চাদপসরণ করিলেন, তাহাও স্পষ্টই বোঝা যায়। বারনি ও আফিফ লিখিয়াছেন যে, যে সময় ফিরোজ শাহ একডালা অবরোধ করিয়াছিলেন, তখন বর্ষাকাল আসিতে বেশি দেরি ছিল না। বর্ষাকাল আসিলে চারিদিক জলে প্লাবিত হইবে, ফলে ফিরোজ শাহের বাহিনী বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িবে, মশার কামড়ে ঘোড়াগুলি অস্থির হইবে এবং তখন ইলিয়াস অনায়াসেই জয়লাভ করিবেন, এই সব ভাবিয়া ফিরোজ শাহ অত্যন্ত বিচলিত বোধ করিতেছিলেন। ইহা হইতে বুঝা যায়, ফিরোজ শাহের আক্রমণের সময় ইলিয়াস প্রথমেই সম্মুখযুদ্ধ না করিয়া কৌশলপূর্ণ পশ্চাদপসরণ করিয়াছিলেন, ফিরোজ শাহকে দেশের মধ্যে অনেক দূর আসিতে দিয়াছিলেন এবং নিজে একডালার দুর্ভেদ্য দুর্গে আশ্রয় লইয়া বর্ষার প্রতীক্ষায় কালহরণ করিতেছিলেন। ফিরোজ শাহ ইলিয়াসের সঙ্গে একদিনের যুদ্ধে কোনরকমে নিজের মান বাঁচাইয়াছিলেন। কিন্তু তিনি এই যুদ্ধে ইলিয়াসের শক্তিরও পরিচয় পাইয়াছিলেন এবং বুঝিয়াছিলেন যে ইলিয়াসকে সম্পূর্ণভাবে পর্যুদস্ত করা তাঁহার পক্ষে সম্ভব হইবে না। উপরন্তু বর্ষাকাল আসিয়া গেলে তিনি ইলিয়াস শাহের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হইবেন। সেইজন্য, ইলিয়াসের হাতি জয় করিয়া তাঁহার দর্প চূর্ণ করিয়াছি, এই জাতীয় কথা বলিয়া ফিরোজ শাহ আত্মপ্রসাদ লাভ করিয়াছিলেন এবং মানে মানে বাংলা দেশ হইতে প্রস্থান করিয়াছিলেন।

ফিরোজ শাহ একডালার নাম বদলাইয়া ‘আজাদপুর’ রাখিয়াছিলেন। দিল্লিতে পৌঁছিয়া ফিরোজ শাহ ধুমধাম করিয়া ‘বিজয়-উৎসব’ অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন। কিন্তু বাংলা দেশ হইতে তাঁহার বিদায়গ্রহণের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ইলিয়াস তাঁহার অধিকৃত বাংলার অঞ্চলগুলি পুনরধিকার করিয়া লইয়াছিলেন। শেষপর্যন্ত এই দুই সুলতানের মধ্যে সন্ধি স্থাপিত হয়। সন্ধির ফলে ফিরোজ শাহ ইলিয়াস শাহের স্বাধীনতা কার্যত স্বীকার করিয়া লন। ইহার পরে দুই রাজা নিয়মিতভাবে পরস্পরের কাছে উপঢৌকন প্রেরণ করিতেন।

একডালার যুদ্ধে ইলিয়াস শাহের সৈন্যদের মধ্যে সর্বপেক্ষা বেশি বীরত্ব প্রদর্শন করে তাঁহার বাঙালী পাইক অর্থাৎ পদাতিক সৈন্যেরা। পাইকদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল হিন্দু। পাইকদের দলপতি সহদেব এই যুদ্ধে প্রাণ দেন।

এই একডালা কোন্ স্থানে বর্তমান ছিল, সে সম্বন্ধে এতদিন কিছু মতভেদ ছিল। তবে বর্তমানে এ সম্বন্ধে যে সমস্ত তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গিয়াছে, তাহাতে নিঃসংশয়ে বলা যায় যে গৌড় নগরের পাশে গঙ্গাতীরে একডালা অবস্থিত ছিল। [*এ সম্বন্ধে লেখকের বিস্তৃত আলোচনা—’বাংলার ইতিহাসের দুশো বছর’ গ্রন্থের (২য় সং)। অষ্টম অধ্যায় দ্রষ্টব্য।]

ইলিয়াস শাহ সম্বন্ধে প্রামাণিকভাবে আর বিশেষ কোন তথ্যই জানা যায় না। তিনি যে দৃঢ়চেতা ও অসামান্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন, তাহা ফিরোজ শাহের আক্রমণ প্রতিরোধ এবং পরিণামে সাফল্য অর্জন হইতেই বুঝা যায়। মুসলিম সাধুসন্তদের প্রতি তাঁহার বিশেষ ভক্তি ছিল। তাঁহার সময়ে বাংলা দেশে তিনজন। বিশিষ্ট মুসলিম সন্ত বর্তমানে ছিলেন–অখী সিরাজুদ্দীন, তাঁহার শিষ্য আলা অল হক এবং রাজা বিয়াবানি। কথিত আছে, ফিরোজ শাহের একডালা দুর্গ অবরোধের সময় রাজা বিয়াবানির মৃত্যু হয় এবং ইলিয়াস শাহ অসীম বিপদের ঝুঁকি লইয়া ফকীরের ছদ্মবেশে দুর্গ হইতে বাহির হইয়া তাঁহার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগদান করিয়াছিলেন, দুর্গে ফিরিবার আগে ইলিয়াস ফিরোজ শাহের সহিত দেখা করিয়া কথাবার্তা বলিয়াছিলেন, কিন্তু ফিরোজ শাহ তাঁহাকে চিনিতে পারেন নাই এবং পরে সমস্ত ব্যাপার জানিতে পারিয়া তাঁহাকে বন্দী করার এত বড় সুযোগ হারানোর জন্য অনুতাপ করিয়াছিলেন।

অধিকাংশ ইতিহাসগ্রন্থের মতে ইলিয়াস শাহ ভা বা সিদ্ধির নেশা করিতেন। ‘সিরাৎ-ই-ফিরোজ শাহী’র মতে ইলিয়াস কুষ্ঠরোগী ছিলেন। কিন্তু ইহা ইলিয়াসের শত্রুপক্ষের লোকের বিদ্বেষপ্রণোদিত মিথ্যা উক্তি বলিয়া মনে হয়।

ইলিয়াস শাহ ৭৫৯ হিজরায় (১৩৫৮-৫৯ খ্রী) পরলোকগমন করেন।

সিকন্দর শাহ

ইলিয়াস শাহের মৃত্যুর পর তাঁহার সুযোগ্য পুত্র সিকন্দর শাহ সিংহাসনে বসেন। তিনি সুদীর্ঘ তেত্রিশ বৎসর (আনুমানিক ১৩৫৮ হইতে ১৩৯১ খ্রী পর্যন্ত) রাজত্ব করেন। বাংলার আর কোন সুলতান এত বেশি দিন রাজত্ব করেন নাই।

সিকন্দর শাহের রাজত্বকালে ফিরোজ শাহ তুগলক আবার বাংলা দেশ আক্রমণ করেন। পূর্ব্বোল্লিখিত ‘সিরাৎ-ই-ফিরোজ শাহী’ এবং শামস্-ই-সিরাজ আফিফের ‘তারিখ-ই-ফিরোজ শাহী’ হইতে এই আক্রমণ ও তাঁহার পরিণামের বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়। আফিফ লিখিয়াছেন যে ফখরুদ্দীন মুবারক শাহের জামাতা জাফর খান দিল্লিতে গিয়া ফিরোজ শাহের কাছে অভিযোগ করেন যে ইলিয়াস শাহ তাঁহার শ্বশুরের রাজ্য কাড়িয়া লইয়াছেন; ফিরোজ শাহ তখন ইলিয়াসকে শাস্তি দিবার জন্য এবং জাফর খানকে শ্বশুরের রাজ্যের সিংহাসনে বসাইবার জন্য বাংলা দেশে অভিযান করেন। কিন্তু যখন তিনি বাংলাদেশে পৌঁছান, তখন ইলিয়াস শাহ পরলোকগমন করিয়াছিলেন এবং সিকন্দর শাহ সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। সুতরাং সিকন্দর শাহের সহিতই ফিরোজ শাহের সংঘর্ষ হইল।

আফিফ এবং ‘সিরাৎ’ হইতে জানা যায় যে, সিকন্দর ফিরোজ শাহের সহিত সম্মুখযুদ্ধ না করিয়া একডালা দুর্গে আশ্রয় লইয়াছিলেন। ফিরোজ শাহ অনেক দিন একডালা দুর্গ অবরোধ করিয়াছিলেন, কিন্তু দুর্গ অধিকার করিতে পারেন নাই। অবশেষে উভয় পক্ষই ক্লান্ত হইয়া পড়িলে সন্ধি স্থাপিত হয়।

আফিফ ও ‘সিরাৎ’-এর মতে সিকন্দর শাহের পক্ষ হইতেই প্রথমে সন্ধি প্রার্থনা করা হইয়াছিল। কিন্তু ইহা সত্য বলিয়া মনে হয় না। কারণ সন্ধির ফলে ফিরোজ শাহ কোন সুবিধাই লাভ করিতে পারেন নাই। পরবর্তী ঘটনা হইতে দেখা যায়, তিনি বাংলা দেশের উপর সিকন্দর সাহের সার্বভৌম কর্তৃত্ব স্বীকার করিয়া লইয়াছিলেন এবং সমকক্ষ রাজার মতই তাঁহার সঙ্গে দূত ও উপঢৌকন বিনিময় করিয়াছিলেন। আফিফের মতে সিকন্দর শাহ জাফর খানকে সোনারগাঁও অঞ্চল ছাড়িয়া দিতে চাহিয়াছিলেন, কিন্তু জাফর খান বলেন যে, তাঁহার বন্ধুবান্ধবের সকলেই নিহত হইয়াছে, সেইজন্য তিনি সোনারগাঁওয়ে নিরাপদে থাকিতে পারিবেন না; এই কারণে তিনি ঐ রাজ্য গ্রহণে স্বীকৃত হইলেন না। ফিরোজ শাহের এই দ্বিতীয় বঙ্গাভিযান শেষ হইতে দুই বৎসর সাত মাস লাগিয়াছিল।

সিকন্দর শাহের একটি বিশিষ্ট কীর্তি পাণ্ডুয়ার বিখ্যাত আদিনা মসজিদ নির্মাণ (১৩৬৯ খ্রী)। স্থাপত্য-কৌশলের দিক দিয়া এই মসজিদটি অতুলনীয়। ভারতবর্ষে নির্মিত সমস্ত মসজিদের মধ্যে আদিনা মসজিদ আয়তনের দিক হইতে দ্বিতীয়।

পিতার মত সিকন্দর শাহও মুসলিম সাধুসন্তদের ভক্ত ছিলেন। দেবীকোটের বিখ্যাত সন্ত মুল্লা আতার সমাধিতে তিনি একটি মসজিদ তৈরি করাইয়াছিলেন। তাঁহার সমসাময়িক পাণ্ডুয়ার বিখ্যাত দরবেশ আলা অল-হকের সহিতও তাঁহার ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল।

সিকন্দরের শেষ জীবন সম্বন্ধে ‘রিয়াজ’-এ একটি করুণ কাহিনী লিপিবদ্ধ হইয়াছে। কাহিনীটির সারমর্ম এই। সিকন্দর শাহের প্রথমা স্ত্রীর গর্ভে সতেরটি পুত্র ও দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে একটিমাত্র পুত্র জন্মগ্রহণ করে। দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভজাত পুত্র গিয়াসুদ্দীন সব দিক দিয়াই যোগ্য ছিলেন। ইহাতে সিকন্দরের প্রথমা স্ত্রীর মনে প্রচণ্ড ঈর্ষা হয় এবং তিনি গিয়াসুদ্দীনের বিরুদ্ধে সিকন্দর শাহের মন বিষাইয়া দিবার চেষ্টা করেন। তাহাতে সিকন্দর শাহের মন একটু টলিলেও তিনি গিয়াসুদ্দীনকেই রাজ্য শাসনের ভার দেন। গিয়াসুদ্দীন কিন্তু বিমাতার মতিগতি সম্বন্ধে সন্দিহান হইয়া সোনারগাঁওয়ে চলিয়া যান। কিছুদিনের মধ্যে তিনি এক বিরাট সৈন্যবাহিনী গঠন করিলেন এবং পিতার নিকট সিংহাসন দাবি করিয়া। লখনৌতির দিকে রওনা হইলেন। গোয়ালপাড়ার প্রান্তরে পিতাপুত্রে যুদ্ধ হইল। গিয়াসুদ্দীন তাঁহার পিতাকে বধ করিতে সৈন্যদের নিষেধ করিয়াছিলেন, কিন্তু একজন সৈন্য না চিনিয়া সিকন্দরকে বধ করিয়া বসে। শেষ নিঃশ্বাস ফেলিবার আগে সিকন্দর বিদ্রোহী পুত্রকে আশীর্বাদ জানাইয়া যান।

এই কাহিনীটি সম্পূর্ণভাবে সত্য কিনা তাহা বলা যায় না, তবে পিতার বিরুদ্ধে গিয়াসুদ্দীনের বিদ্রোহ এবং পুত্রের সহিত যুদ্ধে সিকন্দরের নিহত হওয়ার কথা যে সত্য, তাঁহার অনেক প্রমাণ আছে।

ত্রিপুরার রাজাদের ইতিবৃত্ত ‘রাজমালা’য় লেখা আছে যে, ত্রিপুরার বর্তমান রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা রত্ন-ফা (ইঁহার ১৩৬৪ হইতে ১৩৬৭ খ্রীষ্টাব্দের মুদ্রা পাওয়া গিয়াছে) যখন তাঁহার জ্যৈষ্ঠ ভ্রাতা রাজা-ফাঁকে উচ্ছেদ করিয়া ত্রিপুরার সিংহাসন অধিকার করিতে চাহেন, তখন তাঁহার অনুরোধে গৌড়ের “তুরুষ্ক নৃপতি” ত্রিপুরা আক্রমণ করেন এবং রাজা-ফাঁকে বিতাড়িত করিয়া রত্ন-ফাকে সিংহাসনে বসান। রত্ন-ফা “তুরুস্ক নৃপতি”র নিকট “মাণিক্য” উপাধি এবং একটি বহু মূল্য রত্ন পান। সম্ভবতঃ সিকন্দর শাহই এই “তুরুষ্ক নৃপতি”।

গিয়াসুদ্দীন আজম শাহ

ইলিয়াস শাহী বংশের একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, এই বংশের প্রথম তিনজন রাজাই অত্যন্ত যোগ্য ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ছিলেন। তন্মধ্যে ইলিয়াস শাহ ও সিকন্দর শাহ যুদ্ধ ও স্বাধীনতা রক্ষার দ্বারা নিজেদের দক্ষতার পরিচয় দিয়াছেন। কিন্তু সিকন্দর শাহের পুত্র গিয়াসুদ্দীর আজম শাহ খ্যাতি অর্জন করিয়াছেন তাঁহার লোকরঞ্জন ব্যক্তিত্বের জন্য। তাঁহার মত বিদ্বান, রুচিমান, রসিক ও ন্যায়পরায়ণ নৃপতি এ পর্যন্ত খুব কমই আবির্ভূত হইয়াছেন।

স্নেহপরায়ণ পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং রণক্ষেত্রে তাঁহাকে পরাজিত ও নিহত করিয়া সিংহাসন অধিকার গিয়াসুদ্দীনের চরিত্রে কলঙ্ক আরোপ করিয়াছে সন্দেহ নাই। তবে বিমাতার চক্রান্ত হইতে নিজেকে রক্ষা করিবার জন্য অনেকাংশে বাধ্য হইয়াই গিয়াসুদ্দীন এইরূপ আচরণ করিয়াছিলেন বলিয়া মনে হয়। এই দিক দিয়া বিচার করিলে তাহাকে সম্পূর্ণভাবে না হইলেও আংশিকভাবে ক্ষমা করা যায়।

গিয়াসুদ্দীন যে কতখানি রসিক ও কাব্যামোদী ছিলেন, তাহা তাঁহার একটি কাজ হইতে বুঝিতে পারা যায়। এ সম্বন্ধে ‘রিয়াজ’-এ যাহা লেখা আছে, তাঁহার সারমর্ম এই। একবার গিয়াসুদ্দীন সাংঘাতিক রকম অসুস্থ হইয়া পড়িয়া বাঁচিবার আশা ত্যাগ করিয়াছিলেন এবং সর্ব, গুল ও লালা নামে তাঁহার হারেমের তিনটি নারীকে তাঁহার মৃত্যুর পর শবদেহ ধৌত করার ভার দিয়াছিলেন। কিন্তু সেবারে তিনি সুস্থ হইয়া উঠেন এবং তাঁহার পর ঐ তিনটি নারীকে হারেমের অন্যান্য নারীরা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করিতে থাকে। ঐ তিনটি নারী সুলতানকে এই কথা জানাইলে সুলতান সঙ্গে সঙ্গে তাহাদের নামে একটি ফার্সী গজল লিখিতে সুরু করেন। কিন্তু এক ছত্রের বেশি তিনি আর লিখিতে পারেন নাই, তাঁহার রাজ্যের কোন কবিও ঐ গজলটি পূরণ করিতে পারেন নাই। তখন গিয়াসুদ্দীন ইরানের শিরাজ শহরবাসী অমর কবি হাফিজের নিকট ঐ ছত্রটি পাঠাইয়া দেন। হাফিজ উহা পূরণ করিয়া ফেরৎ পাঠান।

এই কাহিনীর প্রথমাংশের খুঁটিনাটি বিবরণগুলি সব সত্য কিনা তাহা বলা যায়, তবে দ্বিতীয়াংশ অর্থাৎ হাফিজের কাছে গিয়াসুদ্দীন কর্ত্তৃক গজলের এক ছত্র পাঠানো এবং হাফিজের তাহা সম্পূর্ণ করিয়া পাঠানো সম্পূর্ণ সত্য ঘটনা। ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত ‘আইন-ই-আকবরী’তেও এই ঘটনাটি সংক্ষেপে বর্ণিত হইয়াছে। ‘রিয়াজ’ ও ‘আইন’-এ এই গজলটির কয়েক ছত্র উদ্ধৃত হইয়াছে, সেইগুলি সমেত সম্পূর্ণ গজলটি (হাফিজের মৃত্যুর অল্প পরে তাঁহার অন্তরঙ্গ বন্ধু মুহম্মদ গুল অাম কর্ত্তৃক সংকলিত) দিওয়ান-ই-হাফিজে পাওয়া যায়, তাহাতে সুলতান গিয়াসুদ্দীন ও বাংলাদেশের নাম আছে।

গিয়াসুদ্দীনের ন্যায়নিষ্ঠা সম্বন্ধে ‘রিয়াজ’-এ একটি কাহিনী লিপিবদ্ধ হইয়াছে। সেটি এই। একবার গিয়াসুদ্দীন তীর ছুঁড়িতে গিয়া আকস্মিকভাবে এক বিধবার পুত্রকে আহত করিয়া বসেন। ঐ বিধবা কাজী সিরাজুদ্দীনের কাছে এ সম্বন্ধে নালিশ করে। কর্তব্যনিষ্ঠ কাজী তখন পেয়াদার হাত দিয়া সুলতানের কাছে সমন পাঠান। পেয়াদা সহজ পথে সুলতানের কাছে সমন লইয়া যাওয়ার উপায় নাই দেখিয়া অসময়ে আজান দিয়া সুলতানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তখন সুলতানের কাছে পেয়াদাকে লইয়া যাওয়া হইলে সে তাহাকে সমন দিল। সুলতান তৎক্ষণাৎ কাজীর আদালতে উপস্থিত হইলেন। কাজী তাঁহাকে কোন খাতির না দেখাইয়া বিধবার ক্ষতিপূরণ করিতে নির্দেশ দিলেন। সুলতান সেই নির্দেশ পালন করিলেন। তখন কাজী উঠিয়া দাঁড়াইয়া সুলতানকে যথোচিত সম্মান দেখাইয়া মসনদে বসাইলেন। সুলতানের বগলের নীচে একটি ছোট তলোয়ার লুকানো ছিল, সেটি বাহির করিয়া তিনি কাজীকে বলিলেন যে তিনি সুলতান বলিয়া কাজী যদি বিচারের সময় তাঁহার প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখাইতেন, তাহা হইলে তিনি তলোয়ার দিয়া কাজীর মাথা কাটিয়া ফেলিতেন। কাজীও তাঁহার মসনদের তলা হইতে একটি বেত বাহির করিয়া বলিলেন, সুলতান যদি আইনের নির্দেশ লঙ্ঘন করিতেন, তাহা হইলে আদালতের বিধান অনুসারে তিনি এ বেত দিয়া তাঁহার পিঠ ক্ষতবিক্ষত করিতেন –ইহার জন্য তাঁহাকে বিপদে পড়িতে হইবে জানিয়াও। তখন সুলতান অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইয়া কাজীকে অনেক উপহার ও পারিতোষিক দিয়া ফিরিয়া আসিলেন।

এই কাহিনীটি সত্য কিনা তাহা বলা যায় না। তবে সত্য হওয়া সম্পূর্ণ সম্ভব। কারণ গিয়াসুদ্দীনকে লেখা বিহারের দরবেশ মুজাফফর শামস বলখির চিঠি হইতে জানা যায় যে গিয়াসুদ্দীন সত্যই ন্যায়নিষ্ঠ ও ধর্মপরায়ণ ছিলেন। বল্‌খির চিঠি হইতে জানা যায় যে, গিয়াসুদ্দীন প্রথম দিকে সুখ এবং আমোদ-প্রমোদে নিমগ্ন ছিলেন, কিন্তু বলখির সহিত পত্রালাপের সময় তিনি পবিত্র ও ধর্মনিষ্ঠ জীবন যাপন করিতেছিলেন। গিয়াসুদ্দীন বিদ্যা, মহত্ত্ব, উদারতা, নির্ভীকতা প্রভৃতি গুণে ভূষিত ছিলেন এবং সেজন্য তিনি রাজা হিসাবে জনপ্রিয় হইয়াছিলেন। গিয়াসুদ্দীন কবিও ছিলেন এবং সুন্দর গজল লিখিয়া মুজাফফর শামস্ বলখিকে পাঠাইতেন।

বখি ভিন্ন আর একজন দরবেশের সহিত গিয়াসুদ্দীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তিনি আলা অল-হকের পুত্র নূর কুত্ত্ব আলম। ‘রিয়াজ’-এর মতে ইনি গিয়াসুদ্দীনের সহপাঠী ছিলেন। গিয়াসুদ্দীন ও নূর কুত্‌ আলম উভয়ে পরস্পকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করিতেন। কথিত আছে, নূর কুত্ত্ব আলমের ভ্রাতা আজম খান সুলতানের উজীর ছিলেন; তিনি নূর কুত্ত্বকে একটি উচ্চ রাজপদ দিতে চাহিয়াছিলেন, কিন্তু নূর কুত্ত্ব তাহাতে রাজী হন নাই।

মুজাফফর শামস্ বখি ও নূর কুত্ত্ব আলমের সহিত গিয়াসুদ্দীনের এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হইতে বুঝিতে পারা যায়, গিয়াসুদ্দীনও পিতা ও পিতামহের মত সাধুসন্ত দের ভক্ত ছিলেন। তাঁহার ধর্মনিষ্ঠার অন্য নিদর্শনও আমরা পাই। অলসখাওয়ী এবং গোলাম আলী আজাদ বিলগ্রামী নামে দুইজন প্রামাণিক গ্রন্থকারের লেখা হইতে জানা যায় যে, গিয়াসুদ্দীন অনেক টাকা খরচ করিয়া মক্কা ও মদিনায় দুইটি মাদ্রাসা নির্মাণ করাইয়া দিয়াছিলেন। মক্কার মাদ্রাসাটি নির্মাণ করিতে বার হাজার মিশরী স্বর্ণ-মিথকল লাগিয়াছিল। গিয়াসুদ্দীন নিজে হানাফী ছিলেন কিন্তু মক্কার মাদ্রাসায় তিনি হানাফী, শাফেয়ী, মালেকী ও হানবালী মুসলিম সম্প্রদায়ের এই চারিটি মজুহবের জন্যই বক্তৃতার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। ইহা ভিন্ন গিয়াসুদ্দীন মক্কাতে একটি সরাইও নির্মাণ করান এবং মাদ্রাসা ও সরাইয়ের ব্যয় নির্বাহের জন্য এই দুই প্রতিষ্ঠানকে বহুমূল্যের সম্পত্তি দান করেন। তিনি মক্কার আরাফাহ্ নামক স্থানে একটি খাল খনন করাইয়াছিলেন। গিয়াসুদ্দিন মক্কায় য়াকুৎ অনানী নামক এক ব্যক্তিকে পাঠাইয়াছিলেন, ইনিই এই সমস্ত কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করেন। গিয়াসুদ্দীন মক্কা ও মদিনার লোকদের দান করিবার জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ পাঠাইয়াছিলেন, তাঁহার এক অংশ মক্কা শরীফ গ্রহণ করেন এবং অবশিষ্টাংশ হইতে মক্কা ও মদিনার প্রতিটি লোককেই কিছু কিছু দেওয়া হয়।

বিদেশে দূত প্রেরণ গিয়াসুদ্দীনের একটি অভিনব ও প্রশংসনীয় বৈশিষ্ট্য। জৌনপুরের সুলতান মালিক সাওয়ারের কাছে তিনি দূত পাঠাইয়াছিলেন এবং তাঁহাকে হাতি উপহার দিয়াছিলেন। চীনদেশের ইতিহাস হইতে জানা যায়, চীন সম্রাট য়ুং-লোর কাছে গিয়াসুদ্দীন ১৪০৫, ১৪০৮ ও ১৪০৯ খ্রীষ্টাব্দে উপহার সমেত দূত পাঠাইয়াছিলেন। য়ুং-লো ইহার প্রত্যুত্তরস্বরূপ কয়েকবার গিয়াসুদ্দীনের কাছে উপহার সমেত দূত পাঠান।

কিন্তু গিয়াসুদ্দীন যে সমস্ত ব্যাপারেই কৃতিত্বের পরিচয় দিয়াছিলেন, তাহা নহে। কোন কোন ব্যাপারে তিনি শোচনীয় ব্যর্থতারও পরিচয় দিয়াছেন। যেমন, যুদ্ধবিগ্রহের ব্যাপারে তিনি মোটেই সুবিধা করিতে পারেন নাই। সিংহাসনে আরোহণের পূর্বে তাঁহার পিতার সহিত তাঁহার যে বিরোধ ও যুদ্ধ হইয়াছিল তাহাতে রাজ্যের সামরিক শক্তি বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছিল। সিংহাসনে আরোহণের পর গিয়াসুদ্দীন যে সমস্ত যুদ্ধে লিপ্ত হইয়াছিলেন, তাহাতেও সামরিক শক্তির অপচয় ভিন্ন আর কোন ফল হয় নাই। কোন কোন ক্ষেত্রে তাঁহাকে পরাজয় বরণ করিতে হয়। কথিত আছে, শাহেব খান (?) নামে এক ব্যক্তির সহিত গিয়াসুদ্দীন দীর্ঘকাল নিষ্ফল যুদ্ধ চালাইয়া প্রচুর শক্তি ক্ষয় করিয়াছিলেন, অবশেষে নূর কুত্ত্ব আলম উভয় পক্ষে সন্ধি স্থাপনের চেষ্টা করেন, কিন্তু সন্ধির কথাবার্তা চলিবার সময় গিয়াসুদ্দীন শাহেব খানকে আক্রমণ করিয়া বন্দী করেন এবং এই বিশ্বাসঘাতকতা দ্বারা কোনক্রমে নিজের মান বাঁচান। গিয়াসুদ্দীন কামরূপ-কামতা রাজ্যের কিছু অংশ সাময়িকভাবে অধিকার করিয়াছিলেন। কথিত আছে, গিয়াসুদ্দীন কামতা-রাজ ও অহোম-রাজের মধ্যে বিরোধের সুযোগ লইয়া কামতা রাজ্য আক্রমণ করিয়াছিলেন; কিন্তু তাঁহার আক্রমণের ফলে কামতা-রাজ অহোম-রাজের সঙ্গে নিজের কন্যার বিবাহ দিয়া সন্ধি করেন এবং তাঁহার পর উভয় রাজা মিলিতভাবে গিয়াসুদ্দীনের বাহিনীকে প্রতিরোধ করেন। তাঁহার ফলে গিয়াসুদ্দীনের বাহিনী কামতা রাজ্য হইতে প্রত্যাবর্তন করিতে বাধ্য হয়। মিথিলার অমর কবি বিদ্যাপতি তাঁহার একাধিক গ্রন্থে লিখিয়াছেন যে তাঁহার পৃষ্ঠপোষক শিবসিংহ একজন গৌড়েশ্বরকে পরাজিত করিয়াছিলেন; যতদূর মনে হয়, এই গৌড়েশ্বর গিয়াসুদ্দীন আজম শাহ।

গিয়াসুদ্দীন যে তাঁহার শেষ জীবনে হিন্দুদের সম্বন্ধে ভ্রান্ত নীতি অনুসরণ করিয়াছিলেন ও তাঁহার জন্যই শেষ পর্যন্ত তিনি শোচনীয় পরিণাম বরণ করিয়াছিলেন, তাহা মনে করিবার সঙ্গত কারণ আছে। মুজাফফর শামস্ বলখির ৮০০ হিজরায় (১৩৯৭ খ্রী) লেখা চিঠিতে পাই তিনি গিয়াসুদ্দীনকে বলিতেছেন যে মুসলিম রাজ্যে বিধর্মীদের উচ্চ পদে নিয়োগ করা একেবারেই উচিত নহে। গিয়াসুদ্দীন বলখিকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করিতেন ও তাঁহার উপদেশ অনুসারে চলিতেন। সুতরাং তিনি যে এই ব্যাপারে বখির অভিপ্রায় অনুযায়ী চলিয়াছিলেন অর্থাৎ রাজ্যের সমস্ত উচ্চ পদ হইতে বিধর্মী হিন্দুদের অপসারিত করিয়াছিলেন, ইহাই সম্ভব। ইহার স্বপক্ষে কিছু প্রমাণও আছে। গিয়াসুদ্দীন ও তাঁহার পুত্র সৈফুদ্দীন হজা শাহের রাজত্বকালে কয়েকবার চীন-সম্রাটের দূতেরা বাংলার রাজদরবারে আসিয়াছিলেন। তাঁহারা দেখিয়াছিলেন যে বাংলার সুলতানের অমাত্য ও উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের সকলেই মুসলমান, একজনও অমুসলমান নাই। এই কথা জনৈক চীনা রাজপ্রতিনিধিই লিখিয়া গিয়াছেন।

ফিরিশতার মতে হিন্দু রাজা গণেশ ইলিয়াস শাহী বংশের একজন আমীর ছিলেন। আবার ‘রিয়াজ’-এর মতে এই রাজা গণেশের চক্রান্তেই গিয়াসুদ্দীন নিহত হইয়াছিলেন। মনে হয়, বখির অভিপ্রায় অনুযায়ী কাজ করিয়া গিয়াসুদ্দীন রাজা গণেশ প্রমুখ সমস্ত হিন্দু আমীরকেই পদচ্যুত করিয়াছিলেন, তাঁহার ফলে রাজা গণেশ গিয়াসুদ্দীনের শত্রু হইয়া দাঁড়ান এবং শেষপর্যন্ত তিনি চক্রান্ত করিয়া গিয়াসুদ্দীনকে হত্যা করান। গিয়াসুদ্দীন যে শেষজীবনে সাম্প্রদায়িক মনোভাবসম্পন্ন হইয়াছিলেন, তাঁহার আর একটি প্রমাণ–তাঁহার রাজত্বকালে আগত চীনা রাজদূতদের কেবলমাত্র বাংলার মুসলমানদের জীবনযাত্রাই দেখানো হইয়াছিল, বাংলার হিন্দুদের সম্বন্ধে তাঁহারা কোন বিবরণই লেখেন নাই।

গিয়াসুদ্দীন যে কবি ও কাব্যামোদী ছিলেন, তাহা পূর্বেই বলা হইয়াছে। ইরানের কবি হাফিজের সঙ্গে তাঁহার যোগাযোগ ছিল, কিন্তু কোন ভারতীয় কবির সহিত তাঁহার কোন সম্পর্ক ছিল কিনা, সে সম্বন্ধে স্পষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। “বিদ্যাপতি কবি”-র ভণিতাযুক্ত একটি পদে জনৈক “গ্যাসদীন সুরতান”-এর প্রশস্তি আছে। অনেকের মতে এই বিদ্যাপতি কবি” মিথিলার বিখ্যাত কবি বিদ্যাপতি (জীবঙ্কাল আ. ১৩৭০-১৪৬০ খ্রী) এবং “গ্যাসদীন সুরতান (সুলতান)” গিয়াসুদ্দীন আজম শাহ। কিন্তু এই মত সমর্থন করা যায় না। বাংলা ‘ইউসুফ-জোলেখা কাব্যের রচয়িতা শাহ মোহাম্মদ সগীরের আত্মবিবরণীর একটি ছত্রের উপর ভিত্তি করিয়া অনেকে সিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে গিয়াসুদ্দীন আজম শাহ সগীরের সমসাময়িক ও পৃষ্ঠপোষক নৃপতি ছিলেন। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা সম্বন্ধে সংশয়ের যথেষ্ট অবকাশ আছে।

গিয়াসুদ্দীন আজম শাহ পিতার মৃত্যুর পর কুড়ি বৎসর রাজত্ব করিয়া ১৪১০ ১১ খ্রীষ্টাব্দে পরলোকগমন করেন।

সৈফুদ্দীন হজা শাহ, শিহাবুদ্দীন বায়াজিদ শাহ ও আলাউদ্দীন ফিরোজ শাহ

গিয়াসুদ্দীন আজম শাহের মৃত্যুর পর তাঁহার পুত্র সৈফুদ্দীন হজা শাহ সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি “সুলতান-উস্-সলাতীন” (রাজাধিরাজ) উপাধি ধারণ করিয়াছিলেন। সৈফুদ্দীন চীন-সম্রাট য়ুং-লোর কাছে দূত পাঠাইয়া গিয়াসুদ্দীনের মৃত্যুর ও নিজের সিংহাসনে আরোহণের সংবাদ জানাইয়াছিলেন। চীন-সম্রাটও বাংলার মৃত রাজার শোকানুষ্ঠানে যোগ দিবার জন্য এবং নূতন রাজাকে স্বাগত জানাইবার জন্য তাঁহার প্রতিনিধিদের পাঠাইয়াছিলেন।

সৈফুদ্দীনের রাজত্বকালের আর কোন ঘটনার কথা জানা যায় না। দুই বৎসর রাজত্ব করিবার পর সৈফুদ্দীন পরলোকগমন করেন। সৈফুদ্দীনের পরে শিহাবুদ্দীন বায়াজিদ শাহ সুলতান হন। ইব-ই-হজর নামে একজন সমসাময়িক আরব দেশীয় গ্রন্থকার লিখিয়াছেন যে হজা শাহ তাঁহার ক্রীতদাস শিহাব (শিহাবুদ্দীন বায়াজিদ শাহ) কর্ত্তৃক নিহত হইয়াছিলেন।

শিহাবুদ্দীন রাজার পুত্র না হইয়াও রাজসিংহাসন লাভ করিয়াছিলেন, কারণ অমিত শক্তিধর রাজা গণেশ তাঁহার পিছনে ছিলেন। বিভিন্ন ইতিহাসগ্রন্থের সাক্ষ্য বিশ্লেষণ করিলে মনে হয় যে, রাজা গণেশই শিহাবুদ্দীনের রাজত্বকালে শাসনক্ষমতা করায়ত্ত করিয়াছিলেন এবং রাজকোষও তাঁহারই হাতে আসিয়াছিল, শিহাবুদ্দীন নামে মাত্র সুলতান ছিলেন।

শিহাবুদ্দীন একবার চীনম্রাটের কাছে দূত মারফৎ একটি ধন্যবাদজ্ঞাপক পত্র পাঠান এবং সেই সঙ্গে জিরাফ, বাংলার বিখ্যাত ঘোড়া এবং এদেশে উৎপন্ন আরও অনেক দ্রব্য উপহারস্বরূপ পাঠান। তাঁহার পাঠানো জিরাফ চীনদেশে বিপুল উদ্দীপনা সৃষ্টি করে।

দুই বৎসর (১৪১২-১৪ খ্রী) রাজত্ব করিবার পরে শিহাবুদ্দীন পরলোকগমন করেন। কাহারও কাহারও মতে রাজা গণেশ তাঁহাকে হত্যা করাইয়াছিলেন। সমসাময়িক আরবদেশীয় গ্রন্থকার ই-ইর-হজরও লিখিয়াছেন যে গণেশ কর্ত্তৃক শিহাবুদ্দীন (শিহাব) নিহত হইয়াছিলেন। সম্ভবত শিহাবুদ্দীন গণেশের বিরুদ্ধে কোন সময়ে ষড়যন্ত্র করিয়াছিলেন এবং তাঁহারই জন্য গণেশ তাঁহাকে পৃথিবী হইতে সরাইয়া দিয়াছিলেন।

মুদ্রার সাক্ষ্য হইতে দেখা যায় শিহাবুদ্দীন বায়াজিদ শাহের মৃত্যুর পরে সিংহাসনে আরোহণ করেন তাঁহার পুত্র আলাউদ্দীন ফিরোজ শাহ। কিন্তু কোন ঐতিহাসিক বিবরণীতে এই আলাউদ্দীন ফিরোজ শাহের নাম পাওয়া যায় না। যতদূর মনে হয়, রাজা গণেশ শিহাবুদ্দীনের মৃত্যুর পরে তাঁহার শিশুপুত্র আলাউদ্দীনকে সিংহাসনে বসাইয়াছিলেন এবং তাঁহাকে নামমাত্র রাজা করিয়া রাখিয়া নিজেই রাজ্য শাসন করিয়াছিলেন।

আলাউদ্দীন ফিরোজ শাহের কেবলমাত্র ৮১৭ হিজরায় (১৪১৪-১৫ খ্রী) মুদ্রা পাওয়া গিয়াছে। ৮১৮ হিজরা হইতে জলালুদ্দীন মুহম্মদ শাহের মুদ্রা সুরু হইয়াছে। ইহা হইতে বুঝা যায় যে, কয়েকমাস রাজত্ব করার পরেই আলাউদ্দীন সিংহাসনচ্যুত হইয়াছিলেন। সম্ভবত রাজা গণেশই স্বয়ং রাজা হইবার অভিপ্রায় করিয়া আলাউদ্দীনকে সিংহাসনচ্যুত করিয়াছিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *