১.৫.১৯ আওরঙ্গজেব (শাসনকাল : ১৬৫৮ সাল থেকে ১৭০৭ সাল)

আওরঙ্গজেব (শাসনকাল : ১৬৫৮ সাল থেকে ১৭০৭ সাল)

শাহজাহানের পুত্রদের মধ্যে তৃতীয় পুত্র আওরঙ্গজেব ছিলেন সর্বাপেক্ষা অধিক শক্তিশালী, প্রতিভাসম্পন্ন এবং বিচক্ষণ। আওরঙ্গজেব হিন্দুত্ববাদীদের কাছে একটি ঘৃণ্য নাম। তিনি ইতিহাসে সবচেয়ে কুখ্যাত শাসক হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছেন। দীর্ঘ টানা ৫০ বছরের দিল্লির শাসনকর্তা তিনি, এহেন শাসনকর্তাকে কিছু ঐতিহাসিক গোঁড়া মুসলমান, হিন্দুবিদ্বেষী, অত্যাচারী, জিজিয়া কর আদায়কারী, হিন্দু মন্দির অপবিত্র ও ধ্বংসকারী শাসক বলে উল্লেখ করেছেন। আমাদের মগজে গেঁথে গেছে তাঁর অপকর্মের বিবরণ। ঘৃণা এতটাই বর্ষিত হয়েছে যে, অনেক ইতিহাস গ্রন্থে তাঁকে ‘ঔরঙ্গজীব’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁর প্রকৃত নাম আওরঙ্গজেব, ঔরঙ্গজীব নয়। বোঝাই যায় উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই তাঁর নাম বিকৃতি করা হয়েছে। তবে যাঁরা এসব বিপরীতে সত্যানুসন্ধানী এবং প্রকৃত প্রমাণ পেতে আগ্রহী, ঘাঁটতে হবে অনেক দলিল ও ঐতিহাসিক সমর্থন। বস্তুত যেমনভাবে আওরঙ্গজেব সম্পর্কে ইতিহাসের নামে মিথ্যা অপপ্রচার ও কুৎসার অবতারণা করা করা হয়েছে, তেমনটা অন্য কোনো মুসলিম শাসকের বিরুদ্ধে করা হয়নি। এতটাই যে, আওরঙ্গজেবের নামটা বিকৃতি করে বলা হল ঔরঙ্গজীব। জীব মানে প্রাণী বা জন্তু। আওরঙ্গজেবের নামের মধ্যে একটা জন্তু জন্তু ভাব আনা হল। আরবি, উর্দু বা ইংরেজি যে ভাষা থেকেই বাংলায় অনুবাদ করা হোক না-কেন, সেটা ‘ঔরঙ্গজীব’ হতে পারে না। নামটি অবশ্যই আওরঙ্গজেব। তাই বোধহয় ইতিহাসে লেখা হয়নি আওরঙ্গজেব কতটা উদার, মহৎ, ন্যায়পরায়ণ, নিজ ধর্মের প্রতি অটল বিশ্বাসী আর পরধর্মের অনুসারীদের প্রতি সহনশীল ছিলেন। শুধু এটকু তো বলাই যায়, আওরঙ্গজেব দীর্ঘ ৫০ বছর রাজত্ব (এর মধ্যে ১৬৫৮ সাল থেকে ১৬৮১ সাল, এই ২৩ বছর উত্তর ভারতে এবং ১৬৮১ সাল থেকে ১৭০৭ সালে মৃত্যু পর্যন্ত ২৬ বছর দাক্ষিণাত্যে) করার পরও হিন্দুধর্মের অস্তিত্ব এখনও বহাল তবিয়তে আছে। কোথাও বিন্দুমাত্র টোল খায়নি।

আওরঙ্গজেব যদি সত্যিই হিন্দুদের হত্যা করতেন, অত্যাচার-নির্যাতন করতেন, তাহলে ভারতে হিন্দু ও হিন্দুধর্মের অস্তিত্ব থাকত কি? যুক্তি বলে, থাকত না। শুধু আওরঙ্গজেব কেন, হিন্দুবাদী ব্রিটিশ-পোষিত ঐতিহাসিকরা প্রায় সমস্ত মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধেই কমবেশি হিন্দুদের উপর অত্যাচার-নির্যাতনের অভিযোগ এনেছে। প্রায় হাজার বছর ধরে ভারতবর্ষ শাসন করে গেছেন মুসলিম শাসকদের, আজ পর্যন্ত পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না, যেখান থেকে জানা যায় মুসলিম শাসকদের অত্যাচারে কোনো একটি জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু অন্য ধর্মের চাপ ও নির্যাতনে অন্য এক ধর্মাবলম্বী প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে, সেই ইতিহাস লেখা আছে। আমরা জানি ব্রাহ্মণ্যবাদীদের অত্যাচারে ভারত থেকে বৌদ্ধধর্ম প্রায় বিলীন হয়ে গেছে। এটা জলন্ত প্রমাণ। সম্ভব হলে পরে অন্য অধায়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। আওরঙ্গজেব নিশ্চয় ধার্মিক ছিলেন, তাই বলে তিনি কখনোই ভারতে ইসলামি শাসন কায়েম করেননি। ইসলামি আইনে অপরাধের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান আছে। নরহত্যা ও ব্যভিচারের শাস্তি প্রাণদণ্ড, চুরির অপরাধে হাত কেটে নেওয়া, মদ্যপানের অপরাধে চাবুক মারার বিধান আছে। হজরত মোহাম্মদ প্রবর্তিত ইসলামি আইনে আওরঙ্গজেব তাঁর সমগ্র জীবনে কোনো অপরাধীকে শূলে চড়িয়ে, না খেতে দিয়ে, বিষ প্রয়োগ করে অথবা কোনো ভারী বস্তুর চাপ দিয়ে শাস্তি দিয়েছেন এমন নজির কেউ কখনো দেখাতে পারবে না। অথচ এমন শাস্তি যদি তিনি দিতেনও, তাহলেও কিছু বলার নেই। কারণ সেই সময়কার শাসনব্যবস্থায় এরকম নিষ্ঠুর শাস্তির প্রচলন সারা পৃথিবীতেই। আরও ভয়ংকর ভয়ংকর শাস্তির বিধান ছিল। সে সময়ে আলাদা কোনো বিচারব্যবস্থা ছিল না আজকের মতো। কোনো বিচারালয় এবং বিচারপতিও ছিল না। বিচারালয় বলতে রাজদরবার এবং যিনিই শাসক, তিনিই বিচারপতি। তাই শাসক যদি কোনো অপরাধীকে শাস্তি প্রদান করতেন, সেই কলঙ্কের দাগ কেন শাসকের গায়ে লাগবে? বর্তমান শাসনব্যবস্থায় বিচারপতি শাস্তি প্রদান করেন, তাঁর গায়ে তো কলঙ্কের দাগ লাগানো হয় না! যিনি শাসক, তিনিই যখন শাস্তিপ্রদানকারী বিচারক হন, তখন তাঁকে নিষ্ঠুর মনে হতেই পারে। পৃথিবীতে এমন একটি শাসক আছে নাকি, যাঁর আমলে অপরাধ হয়নি এবং অপরাধ হলে অপরাধীকে নিষ্ঠুর শাস্তি দেওয়া হয়নি? তাঁরা কি ধর্ম-পরিচয় দেখে বিচার ও শাস্তিপ্রদান করতেন নাকি।

আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে পরম যত্নে হিন্দু নির্যাতনকারী, হিন্দু নিধনকারী এবং হাজার হাজার হিন্দু মন্দির ধ্বংসকারী অভিযোগ আনা হয়েছে। কিন্তু ঐতিহাসিকরা দেখতে পেলেন না আওরঙ্গজেব মোগল শাসকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম শাসক ছিলেন। দেখতে পেলেন না তিনি নিষ্ঠাবান, ধার্মিক, সমগ্র কোরান কণ্ঠস্থকারী, আলেম, সাধক, নিরপেক্ষ, উদার, দূরদর্শী, তীক্ষ্ণবুদ্ধি, ধীরস্থির, পণ্ডিত, বিদ্যানুরাগী ও দায়িত্বশীল শাসক ছিলেন। সংযমী, হিসেবী, মদ মুক্ত, নারীবিলাস মুক্ত একজন শাসক ছিলেন আওরঙ্গজেব। তিনি একজন বিলাসিতাহীন, রাজবেশী ফকির ও দরবেশ ছিলেন। সেই সময়কার মানুষ আওরঙ্গজেবকে ‘জিন্দাপীর’ বলতেন এবং বিশ্বাস করতেন। আওরঙ্গজেব কতটা সংযমী ও হিসেবী ছিলেন তার সবচেয়ে প্রমাণ পিতা শাহজাহানকে কারাগারে নিক্ষেপ। কারাগারে নিক্ষেপ কথাটা শুনলেই কেমন যেন নিষ্ঠুর নিষ্ঠুর শোনায়। সেই কারণে আওরঙ্গজেবকে নিন্দাও করা হয়– কেমন ছেলে, যে বাবাকে কারাগারে নিক্ষেপ করে! কতটা নিষ্ঠুর! এটা বুঝতে হবে, এ বন্দি সে বন্দি নয়। বন্দি বলতে যা বোঝায়, তা হল, কোনো অপরাধীর শাস্তি হিসাবে, অথবা বীরত্ব প্রকাশের উদ্দেশ্যে প্রতিদ্বন্দ্বীকে শৃঙ্খলিত করে কারারুদ্ধ করে রাখা। সেই বন্দির খাওয়া-শোওয়ায় চরম অব্যবস্থা থাকে। নানা কষ্টের মধ্যে থাকতে হয় বন্দিকে। কখনো-বা বন্দিকে দিয়ে কায়িক পরিশ্রম করানো হয়। শারীরিকভাবে অত্যাচার করা হয়। কিন্তু সম্রাট শাহজাহানের ক্ষেত্রে তেমন হয়নি। শাহজাহান ছিলেন সুসজ্জিত, সুরক্ষিত ও আরামদায়ক অট্টালিকায়, যেটা ছিল আকবর, হুমায়ুন, জাহাঙ্গির, মমতাজের আবাসস্থল-কর্মস্থল-গার্হস্থক্ষেত্র সব। সেটা কোনো কারাগার কক্ষ নয়। সেখানে ছিল শাহী পালঙ্ক, ইয়েমেনি চাদরে ঢাকা নরম গদি, এলাহি খাওয়া-দাওয়া, রাউন্ড দ্য ক্লক ২৪ ঘণ্টার শাহী ভৃত্যের সমাবেশ। এমনকি শাহজাহানের সমস্ত আত্মীয়স্বজন ইচ্ছেমতো আসা-যাওয়া করতে পারত। তাঁর স্নেহধন্য কন্যা রওশন বৃদ্ধ পিতার সেবায় দিনে-রাতে সর্বদা নিয়োজিত থাকত। আওরঙ্গজেব নিজেও রাজকার্যের অবকাশে দিনে একবার হলেও পিতার পদসেবা করতে আসতেন। বন্দিকালীন শাহজাহানের বয়স ছিল ৬৬। অতএব এই বৃদ্ধ বয়সে ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে তাঁর বিশ্রামেরও প্রয়োজন ছিল। তুলনা করলে হাল আমলে যেমনভাবে কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলুপ্ত করার সময় কেন্দ্রীয় সরকার কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রীকে ক্ষমতাচ্যুত করে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছিল। অর্থাৎ নজরবন্দি করে রাখা। সুতরাং এ ব্যাপারে আওরঙ্গজেবকে মোটেই নিষ্ঠুর বলা চলে না। তা ছাড়া সম্রাট শাহজাহান ছিলেন খুবই বিলাসিতা ও জাঁকজমকপ্রিয়। কোশাগার শূন্য করে তিনি তাজমহল গড়েছিলেন। তারপরেও আরও একটি সৌধ তিনি গড়তে চেয়েছিলেন। শাহজাহানকে বন্দি করে সেই সৌধ গড়া বন্ধ করে দেন আওরঙ্গজেব কোষাগারের অপচয় বন্ধ করেন। আওরঙ্গজেব যদি সে সময় শাহজাহানকে কারাগারে বন্দি না করতেন, তাহলে অর্থসংকটে দেশে হাহাকার পড়ে যেত, দেশের মানুষকে অনাহারে মরতে হত। কারণ শাহজাহানের কোষাগার শূন্য হয়েছে অত্যধিক ফালতু ব্যয়ের ফলে।

এখানেই শেষ নয়, ২০ কোটি ১২ লক্ষ টাকা ব্যয়ে নির্মিত তুষারশুভ্র তাজমহলও যথেষ্ট নয় মনে করে আরও একটি কৃষ্ণপাথরের তাজমহল গড়তে চেয়েছিলেন। পরিকল্পনা ছিল সেই কৃষ্ণ তাজমহলের ভিতরে থাকবে হীরা, পান্না, চুনি, পদ্মরাগের মতো দুর্মূল্য রত্নের সমাহার। তুষারশুভ্র তাজমহল ও কৃষ্ণ তাজমহলের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য থাকবে মাটির নিচ দিয়ে সুড়ঙ্গপথ। বিচক্ষণ ও দূরদর্শী আওরঙ্গজেব ভেবে দেখলেন এক তাজমহলেই সাম্রাজ্য সর্বস্বান্ত, তার উপর আরও নির্মাণ করলে দিল্লির রাজদরবার অর্থনৈতিক অবস্থা অতল গহ্বরে তলিয়ে যাবে। অর্থের শ্রাদ্ধ করে সৌধ নির্মাণের বিলাসিতা বা বাতিক আওরঙ্গজেবের বিন্দুমাত্র ছিল না। সেই কারণে দীর্ঘ ৫০ বছরে একটিও সৌধ গড়ে অর্থের অপচয় করেননি তিনি। বস্তুত বিলাসিতাহীন জীবনযাপনই ছিল আওরঙ্গজবের। দারাকে পরবর্তী শাসক হিসাবে শাহজাহান আবেগ ও স্নেহকাতরতায় মনোনীত করে গেলেও, দারা যুদ্ধবিদ্যা ও রাষ্ট্রপরিচালনায় একেবারেই অনভিজ্ঞ ছিলেন। যে যোগ্যতা সেই সময়কার শাসকদের অতি আবশ্যিক ছিল। এখনকার মতো শুধুমাত্র ভোটের জোরে শাসক হওয়া যেত না অযোগ্য হলেও। এখনকার শাসকদের সম্মুখসমরে গিয়ে জানকবুল করে যুদ্ধ করতে হয় না, কিন্তু তখনকারদের শাসকদের করতেই হত। মুসলিম শাসকরা কখনোই যুদ্ধ না-করে লক্ষ্মণ সেনের মতো পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যেত না। এহেন দারা অবশ্যই শাসক হিসাবে অযোগ্য। দারার এই অযোগ্যতার জন্য দায়ী পিতা শাহজাহানই। পিতার অত্যধিক স্নেহের ছায়ায় থেকে সে অনভিজ্ঞই থেকে গেলেন। সে সারাক্ষণ পিতার সঙ্গে সঙ্গেই থাকতেন। তিনি অসুস্থ পিতার সেবাশুশ্রুসা করতেন ঠিকই, আবার তিনিই ক্ষমতার লোভে গুজব রটিয়ে দিয়েছিলেন সম্রাট শাহজাহানের মৃত্যু হয়েছে। এদিকে তো কিছুদিন বাদে সম্রাট শাহজাহান সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন। সুস্থ হয়ে উঠলেও ইত্যবসরে দারা নিজেকে দিল্লির সম্রাট হিসাবে ঘোষণাও করে দেন। ঠিক সেই সময়, যে সময় আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যের বিজাপুরে সংগ্রামরত ছিলেন। আওরঙ্গজেবের অধীনে বিজাপুরে সংগ্রামরত সেনাদের রাজধানী দিল্লিতে ফিরে আসার নির্দেশ দেন দারা। উদ্দেশ্য, রাজধানীর প্রবেশের পথেই দারার সৈন্যরা আওরঙ্গজেব সহ তাঁর সৈন্যদের আক্রমণ করে হত্যা করে দেবে। দারার সেই উদ্দেশ্য সফল হয়নি। সফল না-হওয়ার কারণ, চালাকির দ্বারা কোনো মহৎ কাজ হয় না। এহেন ব্যক্তি সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হয়ে গেলে সেই সাম্রজ্যের কী দশা হত বুঝতে পেরেই আওরঙ্গজেব দারাকে হত্যা করেন। তা ছাড়া আওরঙ্গজেব ছিলেন দূরদর্শী ও বিচক্ষণ ব্যক্তি। পিতা শাহজাহান ও বড়ো দাদা দারার উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়ার মধ্য দিয়েই বোঝা যায় আওরঙ্গজেব কতটা দেশপ্রেমী ও প্রজাবৎসল ছিলেন। শাহজাহানের আর এক লোভী পুত্র মুরাদ। দারা কর্তৃক পিতার মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে তিনিও লোভ সংবরণ করতে না-পেরে আহমদাবাদেই রাজমুকুট ধারণ করে নিজেকে হিন্দুস্তানের সম্রাট বলে ঘোষণা করে দেন। 

অপরদিকে শাহজাহানের আর-এক পুত্র সুজা, যিনি সেসময় বাংলার শাসক ছিলেন। তিনিও দারা কর্তৃক প্রচারিত পিতার মৃত্যুর সংবাদে বাংলার স্বাধীন রাজা বলে ঘোষণা করে দেন। এমতাবস্থায় আওরঙ্গজেব অপদার্থ ভাইদের কথা ভেবে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। এমন ভাইদের হাতে দেশের দায়িত্ব তুলে দেওয়া মানে শিশুর হাতে ধারালো অস্ত্র তুলে দেওয়া! সেনাপতি মির জুমলাকে নিয়ে আওরঙ্গজেব যখন দিল্লির দিকে আসছিলেন, ঠিক সেই সময়েই গুজরাটের প্রশাসক মুরাদও দিল্লিতে আসছিলেন। কোনো বিবাদ ছাড়া আওরঙ্গজেব ও মুরাদ দুজনে একসঙ্গে দিল্লির দিকে অগ্রসর হন। আওরঙ্গজেব ও মুরাদকে দফারফা করার জন্য দারাশিকোহ রাজপুত সেনাপতি যশোবন্ত সিং ও কাশেম খানকে উজ্জয়িনীর দিকে পাঠিয়ে দেয়। দারাশিকোহর সেই বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাস্ত হয়। সেই বাহিনীর পরাজয়ে দারা ভয়ে ভীত হয়ে সিংহাসনের লোভ ছেড়ে গুজরাটে পালিয়ে যান। ১৬৫৮ সালে দারা আওরঙ্গজেব কর্তৃক গোয়ালিয়র দুর্গে দারা কারারুদ্ধ হন এবং ১৬৬১ সালে সেখানেই নিহত হন। বলা হয় তাঁকে ছল-চাতুরির আশ্রয়ে হত্যা করা হয়েছিল। বস্তুত দারা ছিলেন খুব সাহসী, কিন্তু মদ্যপানে তাঁর আসক্তি ছিল খুবই প্রবল এবং সেইসঙ্গে রাজনীতিতে ছিলেন অত্যন্ত বোকা। খাফি খানের মতে তিনি ছিলেন এমন নির্বোধ, যে সহজেই প্রতারিত হতেন। যাই হোক, এরপর আওরঙ্গজেব সরাসরি অগ্রসর হয়ে রাজধানী আগ্রা অধিকার করে পিতাকে আগ্রার দুর্গে নজরবন্দি রেখে স্বহস্তে শাসনভার গ্রহণ করেন। সম্রাট শাহজাহানও তাঁর যৌবনে পিতা জাহাঙ্গিরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। জাহাঙ্গির করেছিলেন তাঁর পিতা আকবরের বিরুদ্ধে। কিন্তু আওরঙ্গজেবের সময়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেশি ছিল এবং প্রত্যেক প্রতিদ্বন্দ্বীই ছিলেন যথেষ্ট দক্ষ। যাই হোক, নিজের ভাই মুরাদ বন্দি হয়ে প্রাণ হারান। দারাশিকোহ ও তাঁর পুত্র বন্দি হয়ে নিহত হন।

রাজপুত সেনাপতি যশোবন্ত সিং, যিনি দারার সেনাপতি ছিলেন, তিনি এবার আওরঙ্গজেবের পক্ষ নিলেন। যশোবন্ত। সিং আওরঙ্গজেবের পক্ষ নিলেও তলে তলে সুজার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন, যে কিনা আওরঙ্গজেবের প্রতিপক্ষ। শুধু তাই নয়, পরে সুজার সেনাপতি হয়ে আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে সৈন সংগ্রহ করতে পরামর্শ দিলেন সুজাকে। এরপর আওরঙ্গজেবের শিবির আক্রমণ করতে গেলে পরাজিত হয়ে পালিয়ে যান। সুজাও চিরতরে আরাকানে পালিয়ে যান আওরঙ্গজেবের সেনাপতি মির জুমলার তাড়া খেয়ে এবং মগদস্যুদের আক্রমণে মারা যান।

পিতা শাহজাহানের মৃত্যুর পর আওরঙ্গজেব নিজেকে দিল্লির সম্রাট হিসাবে ঘোষণা করেন। ১৬৫৯ সালের জুন মাসে দিল্লিতে তাঁর অভিষেক সম্পন্ন হয়। তিনি ‘আলমগির পাদশাহ গাজি’ উপাধি নেন। আওরঙ্গজেব অভিষেকের পর যথোচিত পুরস্কার ও উপঢৌকন বিতরণ করেছিলেন। তাঁর নিষ্কলুষ চরিত্র ভারতের মুসলমানদের অকুণ্ঠ সমর্থন। লাভে সহায়তা করেছিল। তিনি বিদ’আত ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। নিজে গান-বাজনায় দক্ষ হওয়া সত্ত্বেও তা শোনা ত্যাগ করেন। পৌত্তলিক ও বিদআতী উৎসবাদি বাতিল করেন। রহিত করেন শির নত করা এবং মাটিতে চুমু খাওয়া, যা পূর্বতন রাজন্যবর্গের জন্য করা হত। বিপরীতে তিনি ইসলামি সম্ভাষণ-বাক্য তথা ‘আসোলামু আলাইকুম’-এর মাধ্যমে অভিবাদন জানানোর নির্দেশ দেন। শাহজাহানের চতুর্থ পুত্র মুরাদ ছিলেন গুজরাটের শাসনকর্তা। অত্যধিক ভোগবিলাসী ও মদের প্রতি আসক্ত হওয়ায় তিনি আওরঙ্গজেবের হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছিলেন। বাবর, হুমায়ুন, আকবর, জাহাঙ্গির, শাহজাহান সকলেই আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে সংঘটিত সংঘর্ষে জয়লাভ করে সিংহাসন লাভ করেছিলেন। কাজেই উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব শাহজাহানের পুত্রগণের মধ্যে সংঘটিত হওয়া ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা মাত্র।

আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে ভ্রাতৃহত্যার অভিযোগ তোলা হয়। সত্যিই কি আওরঙ্গজেব ভাইদের হত্যা করে সিংহাসন দখল করেছিলেন? আওরঙ্গজেবের মতো এতবড়ো ফকির, সন্ন্যাসী, দরবেশ, জিন্দাপিরের পক্ষে কি সম্ভব নিজ ভাইদের হত্যা করা? তিনি যখন জটিল রাজনীতি থেকে নিজেকে মুক্ত রেখে সাধনা, উপাসনা ও কৃচ্ছসাধনের মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করতে চেয়েছিলেন, তাঁর পক্ষে কি ভাইদের হত্যা করা কি বাস্তবসম্মত? চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখা প্রয়োজন আছে। ঘটনার পর্যায়ক্রমে দেখা যাচ্ছে ভাইদের মৃত্যুর জন্য আওরঙ্গজেব মোটেই দায়ী নয়। নিজেদের অপরাধের কারণে দায়ের করা মামলায় আদালতের রায়ে দারাশিকোহ ও মুরাদের প্রাণদণ্ড কার্যকর হয়েছিল। মুরাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, আলি নকি খাঁ নামে জনৈক বিশিষ্ট কর্মচারীকে তিনি হত্যা করেছিলেন। আলি নকির এক নিকট আত্মীয় মুরাদের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ এনে বিচারপ্রার্থী হয়েছিলেন। সাক্ষী ও প্রমাণে আলি নকিকে মুরাদ যে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছিলেন, তা প্রমাণিত হলে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়। দারাশিকোহ ওরফে দারাও আদালতের বিচারকের রায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। আওরঙ্গজেবের সিংহাসন আরোহণের আগে বা সময়কালে নয়, সিংহাসন আরোহণের অনেক পরে দারাকে রাজদ্রোহিতা, গুপ্তচরবৃত্তি এবং শত্রুরাষ্ট্রের সঙ্গে অশুভ আঁতাতের অভিযোগে বিচারক প্রাণদণ্ডের নিদান দিয়েছিলেন। এছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে মদ্যপান (মদ্যপানের প্রসঙ্গে বলা যায়, সম্রাট আওরঙ্গজেব ছাড়া পূর্বের সমস্ত মোগল সম্রাটই তুখোড় মদ্যপ ছিলেন), ব্যভিচার ও স্বধর্ম ত্যাগেরও (দারা ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে হিন্দুতে পরিণত হয়েছিলেন বলে অভিযোগ) অভিযোগ ছিল। দারাশিকোহর মৃত্যুদণ্ড সম্রাট আওরঙ্গজেবের আদেশে নয়, বিচারকের আদেশে হয়েছিল।

এমতাবস্থায় একটা জটিল সংকট তৈরি হয়েছিল। তা হল, বেশিরভাগ হিন্দুপ্রজারা চাইছিল দারাশিকোহই সম্রাট হোক। সম্রাট শাহজাহানেরও ইচ্ছা ছিল দারাশিকোহই পরবর্তী সম্রাট হোক। সেটা অবশ্যই স্নেহবশত, যৌক্তিক নয়। কারণ দারার ধর্মাচরণ ছিল সম্পূর্ণ হিন্দুধর্ম ঘেঁষা। দারা মনে করতেন হিন্দুস্তানে হিন্দু জাতি সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাই তাঁদেরকে হাতে রাখতে পারলে সহজেই সম্রাট হওয়া সম্ভব। হিন্দুদের খুশি করতে দারাশিকোহ প্রচুর মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। সেই মন্দিরগুলিকে নানারকমের অলৌকিক কাহিনির প্রচলন করেছিলেন। যে কাহিনির একটি হল– বৃদ্ধ শাহজাহান অসুস্থ হলে দারা দেবতার শরণাপন্ন হন এবং দেবতার বরে শাহজাহান সুস্থ হয়ে ওঠেন। এসব বানোয়াট কাহিনি শুনে অনেক মুসলমানও মন্দিরের প্রতি আকৃষ্ট হয়। মন্দিরগুলি হিন্দু-মুসলমানের যুগ্ম তীর্থক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। দারা নিজেও হিন্দুধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। তিনি সম্রাট আকবরের রাজনৈতিক কৌশল অনুসরণ করতেন। তিনি আকবরের দীন ইলাহির অনুসরণে ‘মাজমাউল বাহরাইন’ নামে একটি ধর্মগ্রন্থও রচনা করেছিলেন। মাজমাউল বাহরাইন’ কথার অর্থ দুই সাগরের মিলন। দারা মনে করতেন হিন্দুধর্ম ও ইসলাম ধর্ম যেন দুটি সাগর। দারাশিকোহ সংস্কৃত সাহিত্যে অতি উচ্চ পর্যায়ের পণ্ডিত ছিলেন। তিনি ছয় মাস পরিশ্রম করে ফারসি ভাষায় উপনিষদ অনুবাদ করে কিছু টীকা টিপ্পনী সহ নিজের সৃষ্ট ধর্মের কথা সংযোজন করেন। সম্রাট আকবরের রাজনৈতিক কৌশল অনুসরণ করতেন জাহাঙ্গিরও। কিন্তু মুসলমান প্রজারা চাইছিল আওরঙ্গজেব সম্রাট হোক। দারাশিকোহ মোটেই সম্রাটের যোগ্য ছিলেন না। শাহজাহান বার্ধক্যজনিত কারণে সেসময় প্রচুর ভুলভাল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতেন। পিতার সেইকারী হঠকারী সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া মানে আওরঙ্গজেবের পক্ষে আত্মহত্যার সামিল। সমূহ বিপদ থেকে মুক্তির একটাই পথ, পিতা শাহজাহানকে সম্রাট পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া। পিতা শাহজাহানও দারাশিকোহর চক্রান্তে আওরঙ্গজেবকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু আওরঙ্গজেব পিতাকে হত্যা না-করে গৃহবন্দি করেছিলেন। কারণ ধর্মভীড় আওরঙ্গজেব জানতেন পিতৃহত্যা ইসলামের পরিপন্থী। যাই হোক, আওরঙ্গজেবের সিংহাসন নিরঙ্কুশ করে নিয়েছিলেন। প্রকৃত শাসক সর্বদাই তাঁর ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করবে, সেটাই বিচক্ষণতা। সেই বিক্ষণতা থেকে তাঁর চারপাশের (ভিতরের ও বাইরের) শত্রুদের দমন অথবা প্রয়োজনে নিধন করবেন। ক্ষমতাপিয়াসীরা এখনও সেটা করে থাকেন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাতেও। আওরঙ্গজেব তাঁর পূর্বপুরুষদের মতোই প্রজাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক উন্নতি চাইতেন। আওরঙ্গজেবের ধর্মনীতি যাই হোক না-কেন তিনি সাধারণ প্রজাদের মঙ্গল চাইতেন। প্রজাদের স্বার্থকে উপেক্ষা করে শাসন চালানো তাঁর কখনোই লক্ষ্য ছিল না। শাহজাহানের শাসনকালে লক্ষ লক্ষ টাকা রাজকোষের ক্ষতি হলেও আরঙ্গজেব সিংহাসনে বসার পরেই প্রজাদের দুর্দশা লাঘবের জন্য রাহাদারি’, ‘পাণ্ডারি’ প্রভৃতি ৮০ রকমের কর লোপ করেছিলেন। আওরঙ্গজেব তাঁর পূর্বপুরুষদের মতো বা পিতার মতো আড়ম্বর, বিলাস-বৈভবে জীবন কাটায়নি। তাঁর নৈতিক চরিত্র ছিল উঁচু মানের। তিনি রাষ্ট্রের অর্থ বিলাস আর আড়ম্বর করে অপচয় করেননি। ভোর ৫টা থেকে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত রাষ্ট্রের কাজে অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন। এমনকি তিনি শেষ ইচ্ছাপত্রে তথা উইলে তাঁর শব সকারের খরচ রাজকোষ থেকে না-নিয়ে কোরান শরিফ নকল (স্বহস্তে লিখিত) ও টুপি সেলাই বাবদ স্বোপার্জিত অর্থ থেকে ব্যয়ের ব্যবস্থা করে যান। এক সূত্র থেকে জানা যায়, মৃত্যুকালে তাঁর কাছে মাত্র ২১ টি স্বোপার্জিত মুদ্রা ছিল। তিনি কোরান শরিফ নিজহাতে লিখতেন। সেই লেখা থেকেই এই মুদ্রা অর্জন করেছিলেন। স্বোপার্জিত মুদ্রার একটা অংশ দিয়ে আওরঙ্গজেবের শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়। বাকি অবশিষ্ট মুদ্রা গরিবদের মধ্যে বিতরণ করে দেওয়া হয়। অন্য এক সূত্র থেকে পাওয়া যায়, তিনি কোরান শরিফ স্বহস্তে লিখে ৮০৫ টাকা সঞ্চয় করেছিলেন। এর থেকে মাত্র চার টাকা দুই আনা নিজের দাফনের জন্য বরাদ্দ নির্দিষ্ট করে উইল করে রেখেছিলেন। বাকি অর্থ দান করে দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। সেই উইলটি পাওয়া গিয়েছিল মৃত্যুর পর তাঁর বালিশের নীচে।

সম্রাট আওরঙ্গজেবের অন্য নাম আলমগির। পাঞ্জাবের একটি গ্রামের নামও আলমগির। গ্রামের এই নামের পিছনে এক ইতিহাস আছে, যা বিস্মৃতপ্রায়। ইতিহাসটি এরকম –ঘটনাটি তৎকালীন পাঞ্জাবের। আওরঙ্গজেবের প্রেরিত এক মুসলিম সেনাপতি ওখানকার এক গ্রামে একজন হিন্দু ব্রাহ্মণ যুবতাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসেন। সেনাপতি জানায়, এক মাস পর এসে তাঁকে বিয়ে করবে। ব্রাহ্মণ-পিতা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে সম্রাট আওরঙ্গজেবের শরণাপন্ন হন। আওরঙ্গজেব সেই ব্রাহ্মণ-পিতাকে আশ্বস্ত করে বললেন, বাড়ি ফিরে যান। বিয়ের দিন তিনি স্বয়ং উপস্থিত থাকবেন এবং এই খবরটা যেন গোপন থাকে। যথারীতি বিয়ের দিন সাধারণ পোশাকে আওরঙ্গজেব পৌঁছে যান সেই ব্রাহ্মণের বাড়ি। এদিকে সেই সেনাপতি বরের বেশে বিয়ের জন্য আসরে হাজির। সেনাপতি ব্রাহ্মণ-পিতার কাছে বিয়ের আগে মেয়েকে একটিবার দেখে নিতে চান বলে ইচ্ছা প্রকাশ করে। পূর্ব পরিকল্পনা মতো সম্রাট আওরঙ্গজেব যে ঘরে অপেক্ষা করছেন, সেই ঘরে মেয়ে আছেন বলে দেখিয়ে দেন ব্রাহ্মণ-পিতা। সেনাপতি খুশিতে ডগমগ হয়ে সেই ঘরটিতে ঢুকেই দেখেন স্বয়ং সম্রাট হাতে তলোয়ার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। সাক্ষাৎ যম যেন! ওই দৃশ্য দেখে মৃত্যুভয়ে বেহুশ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। কন্যার পিতা সম্রাটের এহেন দায়িত্ববোধ ও অসাম্প্রদায়িক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দেখে তাঁর কাছে ঋণ স্বীকার করেন। এ ঘটনার পর ব্রাহ্মণ পরিবার যে গ্রামে বসবাস করতেন, সেই গ্রামের নাম ‘আলমগির’ হয়ে যায়।

আওরঙ্গজেবের মাত্র চারজন স্ত্রীর কথা জানতে পারছি। একজন নবাব বাই বেগম, যিনি রাজপুরী জারাল রাজপুত রাজকন্যা। অপরজন দিলরাস বানু বেগম, যিনি ইরানের সাফাভি রাজকন্যা। তাঁর পাঁচ পুত্র (মোহাম্মদ সুলতান, বাহাদুর শাহ প্রথম, আজম শাহ, সুলতান মোহাম্মদ আকবর এবং মোহাম্মদ কাম বক্স) এবং দুই কন্যা (জেব-উন নেসা এবং বদর-উন-নেসা)। আরও দুজন স্ত্রী হলেন –আওরঙ্গবাদী মহল ও উদাইপুরী মহল। আরঙ্গজেব ছিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান সুন্নি মুসলমান। তিনি এতটাই ধর্মভীড় ছিলেন যে, যুদ্ধক্ষেত্রেও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন এবং নিয়মিত রমজান পালন করতেন। বস্তুত আওরঙ্গজেব ছিলেন হানিফার ইসলামীয় ব্যাখ্যায় বিশ্বাসী। সেই কারণেই। তাঁর প্রণীত আইনগুলি হানিফার মতের সঙ্গে সংগতি রেখে রচিত হয়েছিল। অনেকেই তাঁকে ‘ধর্মান্ধ’ বলতে পছন্দ করলেও আমি ধর্মভীড়’ মনে করি। ধর্মান্ধ’ আর ‘ধর্মভীড়’ শব্দদুটি নিশ্চয় সমার্থক নয়। আকবরের যুগের হিন্দু মুসলিমকে সমদর্শিতা এবং হিন্দু-মুসলিমের সমান অধিকার স্থাপনের নীতি তিনি ত্যাগ করেছিলেন। আওরঙ্গজেবের আমলে মোগল রাষ্ট্র অনেকটাই ধর্মাশ্রিত রাষ্ট্রে পরিণত হয়। অবশ্য তিনি কোনো বৈষয়িক উন্নতির আশায় ইসলামীয় শাসন প্রবর্তন করেননি। তিনি নিজেকে ইসলামের একনিষ্ঠ সেবক মনে করতেন।

সম্রাটের জন্মদিনে ‘তুলাদান’ অর্থাৎ সম্রাটের দেহের ওজনের সম্মান সোনা-রুপো দান করার প্রথা রদ করে দেওয়া হয়। কারণ এ প্রথা ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের। সম্রাট আকবরের আমল থেকে প্রতি সকালে জনসাধারণকে দর্শন দানের জন্য ‘ঝরোখা দর্শন প্রথাও রদ করা হয়। আওরঙ্গজেবের রাজত্বের ১১ বছরের দরবারে নৃত্য, সংগীত সবই নিষিদ্ধ হয়ে যায়। দরবারে নিযুক্ত গায়ক, বাদক প্রমুখদের পদচ্যুত করেন। দিল্লি থেকে বহিষ্কার করা হয় জ্যোতিষদেরও। এমনকি তাঁদের বার্ষিক পঞ্জিকা তৈরি করা থেকে নিবৃত্ত করা হয়। নিষিদ্ধ করা হয় মদ্যপান। জুয়াখেলাও নিষিদ্ধ হয়। নিষিদ্ধ হয় মুদ্রায় কলিমা খোদাই। মুদ্রায় কলিমা খোদাই না-করার কারণ, আওরঙ্গজেব চাইতেন না বিধর্মী বা হিন্দুরা মুদ্রায় ব্যবহৃত কলিমা স্পর্শ করুক। পিরের দরগায় বাতি দেওয়া নিষিদ্ধ হয়। দিল্লি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয় নর্তকী ও যৌনকর্মীদের।

এখানেই শেষ নয়— তিনি হিন্দুদের হোলি, দেওয়ালি, বসন্ত উৎসব নিষিদ্ধ করেন। এমনকি ফর্মান জারি করে। হিন্দুদের মন্দির ও বিদ্যালয়গুলি ভেঙে ফেলার জন্য প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের নির্দেশ দেন বলে এক সূত্রে জানা যায়। হিন্দুদের ধর্মমেলা, যাত্রা বন্ধ হয়। আওরঙ্গজেব তাঁর এক পুত্রকে লেখা একটি চিঠি থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, তিনি ধর্মে কতটা অনুগত ছিলেন। তিনি তাঁর ‘সুখী পুত্র মোহম্মদ মুয়াজ্জমকে লিখছেন– “একজন নিরপেক্ষ লোকের বিবরণ থেকে অবগত হয়েছি যে, তুমি এই বছর পারসিকদের প্রথানুযায়ী নওরোজের (নববর্ষের প্রথম দিন। এই উৎসব মুসলমান শাসক হিসাবে সম্রাট আকবরই চালু করেছিলেন।) উৎসব পালন করেছ। আল্লার অনুগ্রহের দোহাই, তোমার ঈমান মজবুত রেখেও তুমি কার কাছ থেকে প্রচলিত ধর্মমতের বিরুদ্ধে এই নতুন প্রথা গ্রহণ করেছ? স্পষ্টতই তুমি সেই আরববাসী কর্তৃক উপদিষ্ট হয়েছ, যিনি সৈয়দ উপাধিধারী বলে নিজেকে দাবি করে থাকেন; অথচ তিনি হলেন (সৈয়দ বংশীয়) কয়েকজন ভালো লোকের অসন্তুষ্টির কারণ। যাই ঘটুক না কেন, এটা মজুসিসের উৎসব। বিধর্মী হিন্দুদের বিশ্বাস মতে, এটা অভিশপ্ত বিক্রমজিতের (মালোয়ার অন্ধ্র রাজবংশের একজন হিন্দু যুবরাজ অজেয় বিক্রম। ইনি উজ্জয়িনীর শাসক ছিলেন। তিনি ছিলেন মানব-হিতৈষী, জনপ্রিয় ও কৃষ্টিপ্রেমী শাসক। তিনি একজন সাহিত্যের মহান পৃষ্ঠপোষক। বিক্রম কহরোরের যুদ্ধে সাইথিয়ানদের পরাজিত করেন এবং একটি হিন্দু সালের প্রবর্তন করেন, যা উত্তর ভারতে এখনও প্রচলিত আছে। ) রাজ্যাভিষেকের দিন এবং হিন্দু অব্দের আরম্ভ। এখন থেকে তুমি আর এই উৎসব পালন কোরো না এবং এরূপ বোকামি পুনরাবৃত্তি আর কোরো না।”

এখানে লক্ষণীয়, আওরঙ্গজেব হিন্দু রাজা বিক্রমজিতকে ‘অভিশপ্ত’ বলছেন, যা পাকিস্তানের একাত্তরের যুদ্ধে বাঙালি হিন্দুদের ‘মালাউন’ বলত। অর্থাৎ কোরান মতে অমুসলিম মানেই ‘অভিশপ্ত’, এটা আওরঙ্গজেব মানতেন। তবে পুত্রের প্রতি যে নির্দেশ সে যেন নওরোজ পালন না করে, এই নির্দেশের মধ্যে আমি অন্যায় দেখি না। কারণ আমি এক ধর্মে মানুষ হয়ে অন্য ধর্মের আচার-আচরণ পালন করব, এটা কোনো পরিবারে কেউই মেনে নেবে না। তবে আওরঙ্গজেবের দ্বিতীয় পুত্র মুয়াজ্জম যেমন পিতার বাধ্য পুত্র ছিলেন, তেমনি উদারমনস্ক ও দয়ালু ছিলেন। এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্য তাঁকে পাঁচ বছর কারাবাসও করতে হয়েছিল। কারণ পিতার নির্দেশে তিনি গোলকুণ্ডার বিরুদ্ধে অভিযান করেছিলেন। কিন্তু অভিযান করতে গিয়ে তিনি গোলকুণ্ডার শাসনকর্তা আবুল হাসানের সঙ্গে একটি অস্থায়ী চুক্তিতে আবদ্ধ হন এবং তাঁর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছিলেন। এ ঘটনায় আওরঙ্গজেব খুবই অসন্তুষ্ট হন এবং মুয়াজ্জমকে পাঁচ বছরের জন্য কারারুদ্ধ করে দেন। অবশ্য পাঁচ বছর পর তাঁকে মুক্তি দিয়ে আওরঙ্গজেব ১৭০০ সালে কাবুলের সুবাদার পদে নিয়োগ করেন।

আওরঙ্গজেবের সাম্রাজ্য

বিভিন্ন ইতিহাস থেকে জানতে পারছি সিংহাসনে বসার ১৭ বছরে ১৬৭৯ সালে আওরঙ্গজেব অ-মুসলিমদের উপর জিজিয়া কর ধার্য করেন। এছাড়া অন্য এক ফর্মান জারি করে হিন্দু কেরানি, পেশকার, কানুনগোদের চাকরি থেকে বহিষ্কার করে ওইসব পদে মুসলিমদের নিযুক্ত করেন। হিন্দুদের সতীদাহ প্রথাও নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন সম্রাট আরঙ্গজেব। রাজপুত ছাড়া অন্য হিন্দুদের জিম্মি বা দ্বিতীয় শ্রেণির বিধর্মী নাগরিক হিসাবে পালকি বা ঘোড়ায় চড়া নিষিদ্ধ করা হয়। আওরঙ্গজেবের ফর্মান অনুযায়ী বহু হিন্দু মন্দির ভেঙে ফেলা হয়। খ্যাত-অখ্যাত মিলিয়ে কত সংখ্যক মন্দির ভাঙা হয়েছিল তার সঠিক হিসাব পাওয়া না গেলেও কিছু ঐতিহাসিক বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে সেই সংখ্যা মোটামুটি ৫০০০ বলে মনে করেন। মা-আসির-ই-আলমগির-এ উল্লেখিত বিবরণ থেকে জানা যায়, শুধুমাত্র ১৬৭৯ সালেই তাঁর নির্দেশে ২০০টির বেশি হিন্দু মন্দির ধ্বংস করা হয়। এটাও লেখা হয়েছে যে, তিনি তাঁর অগ্রজ দারাশিকোকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন, কারণ দারার অপরাধ ছিল তিনি হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ নিয়ে উৎসাহ প্রকাশ করেছিলেন– যা ইসলাম ধর্মে চরম অপরাধ। আওরঙ্গজেবের কাছে দারাশিকোহ ছিলেন একজন মুরতাদ বা ধর্মত্যাগী। এইরকমই ইতিহাস রচিত হয়েছে। বস্তুত এসব অভিযোগ অতিরঞ্জিত এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে কতিপয় নব্য মুসলিম অত্যুৎসাহী হয়ে কয়েকটি হিন্দুমন্দির ধ্বংস করেছিল, সেইসঙ্গে পূজারী ব্রাহ্মণদেরও ক্ষতি করেছিল। এ ঘটনার ফলে ব্রাহ্মণরা সম্রাট আওরঙ্গজেবের দরবারে অভিযোগ জানাতে আসেন। সম্রাট ঘটনার বিবরণ দুঃখপ্রকাশ করেন এবং যাতে ক্ষতিপূরণ হয় তার জন্য প্রচুর অর্থপ্রদান করেন। এখানেই শেষ নয়। আওরঙ্গজেব এক অর্ডিন্যান্স জারি করে ঘোষণা করেন –“ইসলামি বিধান অনুসারে হিন্দুদের উপাসনালয়গুলির রক্ষণাবেক্ষণ বা তত্ত্বাবধান করা হবে। যেহেতু আমাদের কাছে আকস্মিক সংবাদ পৌঁছেছে যে, কতিপয় মুসলিম সম্প্রদায়ের লোক বারাণসী ধামে অবস্থিত হিন্দু প্রজাদের সঙ্গে অসম্মানজনক নিষ্ঠুর করেছে এবং ব্রাহ্মণ পূজারীদের উপাসনার অধিকারে বাধা প্রদান করেছে। এর ফলে তাঁদের মনে নিদারুণ ক্ষোভের জন্ম হয়েছে। অতএব এই অর্ডিন্যান্স জারির মাধ্যমে সাম্রাজ্যের সর্বত্র জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে, অর্ডিন্যান্স জারি হওয়ার তারিখ থেকে কোনো ব্রাহ্মণকে যেন তাঁদের উপাসনার কাজে কোনোরূপ বাধাদান বা কোনোপ্রকার প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা না হয়। আমাদের হিন্দুপ্রজারা যেন শান্তিতে বসবাস করতে পারেন এবং আমাদের সৌভাগ্য ও উন্নতির জন্য আশীর্বাদ করেন।”

সম্রাট আওরঙ্গজেবের নির্দেশে সরকারি অনুদানে বহু মন্দির পুনর্নির্মাণ হয়েছে বা মেরামত হয়েছে। কাশ্মীরে হিন্দুদের মন্দির রক্ষার জন্য সম্রাট আওরঙ্গজেব কর্তৃক যে সমস্ত জমি ও বৃত্তি দান করা হয়েছে, সেসব প্রমাণ পাওয়া যায় আওরঙ্গজেব স্বাক্ষরিত সমস্ত ফরমান থেকে। বালাজীর মন্দিরের কথা জানেন না, এমন হিন্দু এ দেশে বিরল। এটি চিত্রকোটের রামঘাটের উত্তরদিকে অবস্থিত। এটি আসলে বিষ্ণু মন্দির। এই মন্দিরটির দেয়ালে খোদিত করা করা আছে –“সম্রাট আওরঙ্গজেব নির্মিত বালাজী মন্দির”। শাসকের চোখে তাঁর প্রজারা কখনোই হিন্দু-মুসলিম ধর্মীয় বিভাজনে হয় না, হওয়া উচিত নয়। মুসলিমদের নিশ্চয়ই মূর্তিপুজোয় অংশগ্রহণ করা এবং মূর্তি বা মন্দির নির্মাণ করা নিষিদ্ধ। কিন্তু যখন সে শাসক, সকল প্রজার অভিভাবক, তখন হিন্দু তথা ভিন্ন সম্প্রদায় প্রজাদের উপাসনালয়ের কোনোরূপ ক্ষয়ক্ষতি হলে তার পুনর্নির্মাণ বা মেরামতের দায়িত্ব দেশের সরকার বা শাসকের উপর বর্তায়। আওরঙ্গজেব সর্বদা সেই রাজধর্ম পালন করার চেষ্টা করেছেন। ভারতের অন্যতম মন্দিরপ্রধান তীর্থস্থান বারাণসী বা বেনারসের বহু হিন্দুমন্দির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সম্রাট আওরঙ্গজেব যে প্রচুর জমি-জায়গির দান করেছিলেন, তা জমির রেকর্ডপত্রেই উল্লেখ আছে। শুধু আওরঙ্গজেব নয়, মোগল সম্রাট বাবর থেকে দ্বিতীয় বাহাদুর জাফর খাঁ পর্যন্ত সকল শাসকই ছিলেন পরধর্মসহিষ্ণু, উদারমনস্ক, মহৎ ও সহনশীল।

আগেই বলেছি আওরঙ্গজেব ছিলেন সুন্নি মুসলমান। সেইসঙ্গে তিনি ছিলেন শিয়া-বিরোধীও। মুসলিম হলেই যে সে জাতভাই ভেবে কোলে তুলে নাচবেন, তা নয়। শিয়া মতবাদ যে সুন্নি মতবাদকে ক্ষতি করতে পারে, এটা তিনি মনে করতেন। তা সত্ত্বেও প্রশাসনের ক্ষেত্রে ধর্মীয় ভণ্ডামি তিনি পছন্দ করতেন না। কর্মচারীর পার্থিব যোগ্যতা ও প্রয়োজনকে মাথায় রেখেই তিনি নিযুক্ত করতেন। সেই কারণেই দক্ষতার বিচারে তাঁর মন্ত্রীসভা, সেনাবাহিনী, সাম্রাজ্যের বিভিন্ন দপ্তরে অমুসলিমদের আধিক্য ছিল। তিনি নিষ্ঠাবান ইসলামী হলেও, তিনি ধার্মিক হলেও প্রয়োজনের বেশি কখনোই ধর্মীয় বাড়াবাড়ি পছন্দ করতেন না। কী হিন্দুদের, কী মুসলিমদের। তাঁর শাসনকালে একটা সময়ে হিন্দুদের মধ্যে মন্দির গড়ার ধুম পড়ে গিয়েছিল। একই জায়গায় ঘেঁষাঘেঁষি করে কখনো দশটা, কখনো কুড়িটা, কখনো-বা পঞ্চাশ থেকে একশোটা মন্দির গড়ে তুলতে শুরু করে দিয়েছিল। অনুরূপ মুসলিমরাও একই জায়গায় মসজিদ গড়তে শুরু করেছিল। এ ধরনের বাড়াবাড়ি আওরঙ্গজেবের কাছে দৃষ্টিকটু লাগত। মসজিদের ব্যাপারে তিনি মনে করতেন লোক সংকুলান না-হলে মসজিদের পরিসর বাড়ানো যেতে পারে, সংখ্যায় নয়। কাছাকাছি ছোটো ছোটো মসজিদ গড়ে তোলা তিনি নিষ্প্রয়োজন মনে করতেন। বেনারসে বহু অর্থব্যয়ে নতুন নতুন মন্দির গড়ার কাজ চলছিল। এক মন্দির অন্য মন্দিরকে সৌন্দর্যে ও বিশালতায় হারিয়ে দিতে এক প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গিয়েছিল যেন। এমতাবস্থায় স্থানীয় মুসলিম শাসক গোপনে সম্রাট আওরঙ্গজেবের কাছে। এক চিঠি লিখে জানান –“বেনারস হিন্দুদের একটি ধর্মীয় ঘাঁটি। উচ্চশ্রেণি থেকে নিম্নশ্রেণির সকলেই মনে করে সমস্ত উন্নতির ঠিকানা আছে এইসব মন্দিরের দেবতাদের হাতে। মন্দিরগুলিতে নিত্যনতুন নির্মাণ কাজ হয়েই চলেছে। বহু অর্থব্যয়ে তাতে কারুকার্যের প্রতিযোগিতাও সেই তালে চলছে। যদি এসব মন্দিরের পুরোহিত তথা ব্রাহ্মণদের উপর শক্তি প্রয়োগ করা হয়, তাহলে সেটা ঠিক হবে না। তবে যদি পুরোহিতদের উপাসনা ভিত্তি শিথিল করা যায়, তাহলে আমাদের ইসলামের প্রতি সাধারণ মানুষ আকৃষ্ট হতে পারে।”

এই পত্রের জবাবে সম্রাট আওরঙ্গজেব কী জানালেন? পরধর্মসহিষ্ণু সম্রাট যা জানালেন, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সম্রাট আওরঙ্গজেব লিখলেন –“প্রজাদের উন্নতি সাধন এবং সমস্ত নিম্ন সম্প্রদায়ের উন্নতি সাধন আমাদের দৃঢ় অঙ্গীকার ও উদ্দেশ্য। সেইহেতু আমাদের পবিত্র আইন অনুসারে আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি যে, পুরোনো যা আছে তা থাকবে। নষ্ট বা ধ্বংস করা যাবে না। কিন্তু নতুন করে কোনো মন্দির গড়া চলবে না। অন্যায়ভাবে কোনো পুরোহিত তথা ব্রাহ্মণদের কোনো ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা যাবে না। তাঁদের উপর কোনো হামলা করতে পারবে না। তাঁরা যেন পূর্বের মতোই নিজ নিজ কাজে নিয়োজিত থাকতে পারে এবং আল্লাহ দান আমাদের সাম্রাজ্যের স্থায়িত্বের জন্য সুস্থ মনে প্রার্থনা করতে পারে।” এই পত্র আওরঙ্গজেবকে অন্যভাবে চেনায় বইকি। এই পত্র এটাই প্রমাণ করে যে, সম্রাট আওরঙ্গজেব হিন্দু নিধনকারী, মন্দির ধ্বংসকারী ছিলেন না। প্রজানুরঞ্জক শাসক হিসাবেই তাঁকে চিহ্নিত করতে আপত্তি থাকার কথা নয়। তিনি প্রজাদের এতটাই হিতৈষী ছিলেন যে, জনশ্রুতি আছে, মন্দিরের পুরোহিতরা আরাধ্য দেবতার পুজোর সঙ্গে সঙ্গে সম্রাটকেও পরম শ্রদ্ধায় আরঙ্গজেবকেও স্মরণ করতেন পবিত্র মন্দির রক্ষাকারী সম্রাট হিসাবে।

এটা বাস্তব যে, কোনো দেশের কোনো সম্প্রদায়কে বা কোনো গোষ্ঠীকে হত্যা করে, তাঁদের উপাসনাগৃহ ধ্বংস করে কোনো শাসকের পক্ষেই ক্ষমতায় টিকে থাকা সম্ভব নয়। এগুলো ধ্বংস করা মানে বৃহৎ সংখ্যার মানুষের আবেগকে হত্যা করা। মানুষের আবেগকে হত্যা করা শাসকের কাছে আত্মহত্যার সামিল। দু বছর, পাঁচ বছর, দশ বছর নয় –টানা পঞ্চাশ বছর আওরঙ্গজেব তাঁর সাম্রাজ্য শাসন করেছিলেন। মৃত্যুকাল পর্যন্ত। সে সময় তাঁর মৃত্যু না-হলে আরও কত বছর সাম্রাজ্য চালাতেন, সে ব্যাপারে বিতর্কের অবকাশ থাকতেই পারে। কারণ ততদিনে। ভারত উপমহাদেশে ফরাসি, পর্তুগিজ, ডাচ, সর্বোপরি ব্রিটিশরা ঢুকে পড়েছে।

কোনো মুসলিম শাসকই অ-মুসলিমদের উপর অকারণে নির্যাতন করেননি। এমন কোনো প্রমাণ দাখিল করা যাবে না যে, মুসলিম শাসকরা অ-মুসলিমদের কচুকাটা করেছেন, মন্দির ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। যদি তা করত তাহলে প্রায় ৮০০ বছর ব্যাপী ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে রাজত্ব করতে পারত না নিরঙ্কুশভাবে। দেশের জনগণের উপর অত্যাচার করলে তার কী পরিণতি হয়, তার প্রমাণ ব্রিটিশরাজ। মেরে পিটিয়ে ঝাড়েমূলে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ব্রিটিশদের। ভারত থেকে ব্রিটিশদের নাম-ও-নিশান মিটিয়ে দেওয়া হয়েছে চিরকালের মতো। জনগণকে নিপীড়িত করলে শাসকের অস্তিত্ব বিপন্ন হবেই। মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে কোনো হিন্দুই আন্দোলন, বিদ্রোহী করেনি। বিদ্রোহ যে হয়নি তা নয়। তা খণ্ডিত, আঞ্চলিক বিদ্রোহ। আওরঙ্গজেবের শাসনামলে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু বিদ্রোহ হয়েছে ঠিকই। এবং তা কঠোর হাতে দমন করতে সক্ষম হয়েছেন সম্রাট আওরঙ্গজেব। এই বিদ্রোহের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করছি কিছু পরে।

মুসলিম শাসকরা যদি সত্যিই হিন্দুদের কচুকাটা করত, তাহলে ভারতে হিন্দুদের জনসংখ্যা মুসলমানদের চেয়ে চারগুণ হত না। উভয় সম্প্রদায়ের জন্মহারের কথা মাথায় রেখে বুঝতে হবে। হিন্দুদের অত্যাচারে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা যে ভারত থেকে বিলুপ্ত হয়েছে, নিশ্চিহ্ন হয়েছে, সেটাও মাথায় রাখতে হবে। কোনো সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর উপর হামলা-নির্যাতন করলে যে নির্যাতিত গোষ্ঠী সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে এবং নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, সেই তত্ত্বটাও মাথায় রাখতে হবে। তার হাতে-গরম প্রমাণ ভারতের বৌদ্ধ সম্প্রদায়। ভারতের তো হিন্দুরা সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়, চিরকালই। কিন্তু ভারতের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় জৈন, বৌদ্ধ ছাড়াও অনেক অ-হিন্দু অ-মুসলিম সম্প্রদায় বাস করে, তাঁরা কখনোই দাবি বা অভিযোগ করে না মুসলিম শাসকরা তাঁদের উপর নির্যাতন করেছিল। যত অভিযোগ ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু সম্প্রদায়ের, সকল হিন্দুদের নয়।

ভারতের যে মুসলিম শাসন ছিল, তাকে শুধু মুসলিম শাসক বললে ভুল হবে। শাসক মুসলিম হলেও সাম্রাজ্যের বড়ো বড়ো পদে হিন্দুরা অধিষ্ঠিত ছিল। এমনকি প্রধান সেনাপতির পদেও হিন্দুরা ছিল অনেক শাসকের আমলে। যোগ্যতার বিচারে মুসলিম শাসকরা কখনোই জাতভাইদের নিযুক্ত করেননি। যোগ্যতার প্রশ্নে কোনো শাসক কখনোই আপোস করে না। বর্তমান শাসনব্যবস্থায় অবশ্য আমরা দেখেছি প্রচুর অযোগ্য অশিক্ষিত ব্যক্তি উঁচু পদ দখলে রাখেন বা রাখতে সাহায্য করে। মুসলিম শাসনামলে যদি প্রজাদের প্রতি সামান্যতম অন্যায়-অবিচার হয়ে থাকে, তা হিন্দু কর্মচারীদের দ্বারাই সংঘটিত হয়েছে। ব্রিটিশ আমলেও আমরা দেখেছি ব্রিটিশরা যতটা-না ভারতীয়দের উপর অন্যায়-অত্যাচার করেছে, তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি অন্যায়-অত্যাচার করছে ভারতীয় রাজা জমিদার-নায়েব ও সরকারি কর্মচারীরা।

সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে হিন্দু কর্মচারীর সংখ্যা মহামতি সম্রাট আকবরের শাসনামলের চেয়েও বেশি ছিল। এটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য। সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে যেসব হিন্দু কর্মচারী বড়ো বড়ো পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে কয়েকজন হলেন– রাজা রামরূপ সিং, কবীর সিং, অর্ঘনাথ সিং, প্রেমদেব সিং, দিলীপ রায়, রসিকলাল ক্রোরী প্রমুখ। কবীর সিং ছিলেন আওরঙ্গজেবের উপদেষ্টা, অত্যন্ত কাছের আমলা। দিলীপ রায়ও ছিলেন আওরঙ্গজেবের বিশ্বস্ত ও ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি। রসিকলাল ক্রোরী ছিলেন সম্রাটের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন। রসিকলাল রাজস্ব বিভাগের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। আওরঙ্গজেবের আসামের যুদ্ধটা প্রেমদেব সিংকে দিয়েই পরিচালনা করিয়েছিলেন। হিন্দু রাজা রামরূপ সিংকে সম্রাট আওরঙ্গজেব এতটাই বিশ্বাস করতেন যে, শ্রীনগরের রাজার বিরুদ্ধে গোটা যুদ্ধ তাঁর পরিচালনাতেই সংঘটিত করিয়েছিলেন। এখানেই শেষ নয়, আওরঙ্গজেবের সাম্রাজ্যের পুলিশ, গুপ্তচর, রাজস্ব বিভাগের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগেও ব্যাপক সংখ্যায় হিন্দু কর্মচারী ছিল। শুধু তাই-ই নয়, ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বত্র গুপ্তচরের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ বৃত্তির সঙ্গে সবচেয়ে বেশি যুক্ত ছিল হিন্দুরাই। গুপ্তচর বা স্পাই একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ পদ, যে পদের উপর নির্ভর করে থাকে সাম্রাজ্য বা দেশের সুরক্ষা। রাজস্ব। বিভাগে মুন্সি পদে আওরঙ্গজেব মুসলিমদের চেয়ে হিন্দুদেরই বেশি পছন্দ করতেন। সম্রাট আওরঙ্গজেব এক আইন বা ফরমান জারি করে জানিয়ে দিয়েছিলেন, সরকারি দফতরের সর্বত্র যেন হিন্দু কর্মচারী নিয়োগ করা হয়। আওরঙ্গজেবের শাসনামলে এমন কোনো দফতর ছিল না, যেখানে হিন্দুদের আধিপত্য ছিল না। মুসলমান শাসকরা বোধহয় দেশকে অন্য সকলের চেয়ে আলাদাভাবেই দেখেন। আমরা যদি বাংলাদেশের দিকে তাকাই, সেখানেও দেখব, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হলেও, মুসলিম শাসক হওয়া সত্ত্বেও সে দেশের প্রশাসনিক সর্বোচ্চ পদগুলিতে হিন্দুরাই অলংকৃত করে রেখেছে। অন্য ধর্মাবলম্বী শাসকরা বোধহয় এতটা উদার নয়। কিছু ঐতিহাসিক লিখেছেন, আওরঙ্গজেব হিন্দু কর্মচারীদের বিশ্বাস করতেন না। এ অভিযোগ মোটেই ধোপে টেকে না, যদি যশোবন্ত সিং থাকে। যশোবন্ত সিং একজন প্রকৃতই বিশ্বাসঘাতক। এমন লোককে যদি বিশ্বাস করে শাসনকর্তা মনোনীত করে কাবুলে প্রেরণ করতে পারেন আওরঙ্গজেব, তাহলে বাকিদের কথা না উল্লেখ করলেও চলবে। যশোবন্ত সিং শেষ মুহূর্তে দারার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন। ফলে দারা পরাস্ত হয়ে এলাকা ছেড়ে পালাতে হয়েছিল। এরপর যশোবন্ত সিং আওরঙ্গজেবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। আওরঙ্গজেবের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে সুজার দলে ভিড়েছিলেন এবং আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে পুজার সৈন্য সংগ্রহ করছিলেন। সুজার পরাজয় হলে যশোবন্ত সিং পুনরায় আওরঙ্গজেবের শরণাপন্ন হন এবং ক্ষমাভিক্ষা করেন। এহেন বিশ্বাসঘাতককেও আওরঙ্গজেব ক্ষমা করে দেন নবির বাণী স্মরণ করিয়ে। আওরঙ্গজেবের হিন্দু সেনাপতি জয়সিংহকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন শিবাজীকে (কারাগারে বন্দি হলে) নজরে রাখার। শিবাজী জয়সিংহের নজর এড়িয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও আওরঙ্গজেব কখনোই জয়সিংহকে দায়ী করেননি। উদয়পুরের মহারাজা রাজসিংয়ের পুত্র রাজা ভীম সিং আওরঙ্গজেবের উচ্চমানের সামরিক অফিসার ছিলেন। তাঁর অধীনেই ছিল ৫০০০ হাজার সৈন্য।

আওরঙ্গজেবের বিষয়ে লিখতে গেলে শিবাজীকে বাদ দেওয়া যায় না। কারণ আওরঙ্গজেবের শাসনকালেই শিবাজীর উত্থান হয়। আওরঙ্গজেবকে সবচেয়ে বেশি অস্থির করে তুলেছিল এই মারাঠা শিবাজীই। শুধু আওরঙ্গজেবের সাম্রাজ্যেই নয়, গোটা ভারত উপমহাদেশে মানুষদের কাছেই মারাঠা জাতিরা ছিল সাক্ষাৎ ত্রাস। কে শিবাজী? শিবাজীকে বর্তমানে হিন্দু জাতীয়তাবাদীর পরাকাষ্ঠা বলা হলেও তিনি ছিলেন মূলত বর্গিদের পূর্বপুরুষ, ভয়ংকর হানাদার। বর্গিদের কথা মনে পড়ে? আসুন, একটু ফিরে দেখা যাক।

“খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো/বর্গি এলো দেশে/বুলবুলিতে ধান খেয়েছে/খাজনা দেব কিসে?/ধান ফুরল পান ফুরল/খাজনার উপায় কী?/আর কটা দিন সবুর করো/রসুন বুনেছি।”— বর্গি হল অষ্টাদশ শতাব্দীর লুটতরাজপ্রিয় মারাঠা অশ্বারোহী সৈন্যদল। আলিবর্দি খাঁ যখন বাংলার সিংহাসনে, সে সময় দিল্লির তখতে ছিল মোগলরা। পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে মোগলদের সঙ্গে মারাঠাদের তুমুল যুদ্ধ হয়েছিল। এই মারাঠাদের কিছু পথভ্রষ্ট মারাঠা সেনারাই বর্গি নামে পরিচিত। ভারত উপমহাদেশ জুড়েই তাঁরা তাণ্ডব শুরু করে দেয়। মারাঠাদের মধ্যে এই বর্গি-বীজ লুকোনো ছিল অনেক আগে থেকেই। শিবাজী ভোঁসলেও লুটতরাজ চালাত। কিন্তু তাঁর লুটতরাজ সীমাবদ্ধ ছিল আওরঙ্গজেবের সাম্রাজ্যের মধ্যেই। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর অনেক পরে মারাঠাদের ভয়ানকভাবে উত্থান হয়। বাংলায় বর্গি হামলা হয়েছিল বর্গিনেতা ভাস্কর পণ্ডিতের পরিচালনায়। নবাবের অতর্কিত আক্রমণে ভাস্কর পণ্ডিতের মৃত্যু হলে পরে রঘুজী ভোঁসলের নেতৃত্বে বাংলা আক্রমণ করা হয়। ১৭৪২ সাল থেকে ১৭৫১ সালে পর্যন্ত বর্গিদের নৃশংস আক্রমণের ভয়ে বাংলা সহ গোটা ভারত তটস্থ থাকত। বর্গিদের ভয়ে বিশেষ করে বাংলা থরহরি কম্পমান ছিল।

বাংলা, বিহার ও ওড়িশা মিলে মোট ছয় বার বর্গিরা আক্রমণ করেছিল। প্রথম মারাঠা আক্রমণ : ১৭৪২ সালের এপ্রিলে মারাঠা নেতা রঘুজী ভোঁসলের প্রধানমন্ত্রী ভাস্কর পণ্ডিতের নেতৃত্ব একটি বিরাট সৈন্যবাহিনী বাংলা আক্রমণ করে এবং সমগ্র বাংলা জুড়ে লুটপাট চালায়। তীব্র সংঘর্ষের পর বাংলার নবাব আলিবর্দি খান ১৭৪২ সালের এপ্রিলে বর্ধমানের প্রথম যুদ্ধে এবং সেপ্টেম্বরে কাটোয়ার প্রথম যুদ্ধে মারাঠাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করেন এবং বাংলা থেকে বিতাড়িত করেন। বাংলা থেকে বিতাড়িত হয়ে মারাঠারা ওড়িশা আক্রমণ করে প্রদেশটি দখল করে নেয়। কিন্তু নবাব আলিবর্দি ১৭৪২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে তাদেরকে সেখান থেকেও বিতাড়িত করেন। এরপর পরাজিত মারাঠারা বাংলা থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয় এবং সংঘর্ষের সমাপ্তি ঘটে। দ্বিতীয় মারাঠা আক্রমণ : প্রথম আক্রমণ ব্যর্থ হওয়ার পরের মাসেই ১৭৪৩ সালের মার্চে রঘুজী আবার বাংলা আক্রমণ করেন। মোগল সম্রাটের সঙ্গে স্বাক্ষরিত এক চুক্তি অনুযায়ী আর-এক মারাঠা নেতা এবং রঘুজীর প্রতিদ্বন্দ্বী পেশোয়া বালাজী বাজীরাও বাংলাকে রক্ষার জন্য অগ্রসর হন। নবাব আলিবর্দির অনুমতিক্রমে তিনি রঘুজীর বাহিনীকে আক্রমণ করে পরাজিত করেন এবং বাংলা থেকে বিতাড়িত করেন। ১৭৪৩ সালের জুন থেকে ১৭৪৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শান্তিতে অতিবাহিত হয়। তৃতীয় মারাঠা আক্রমণ : ১৭৪৪ সালের মার্চে মারাঠারা আবার বাংলা আক্রমণ করে। রঘুজীর প্রধানমন্ত্রী ভাস্কর পণ্ডিত এই অভিযানে মারাঠাদের নেতৃত্ব দেন। এ অভিযানকালে মারাঠারা সুকৌশলে আলিবর্দির সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখসমর এড়িয়ে চলে। ফলে যুদ্ধে তাদেরকে পরাজিত করা সম্ভব হয়নি। অবশেষে নবাব ছলনার আশ্রয় নেন এবং সন্ধি স্বাক্ষরের জন্য ভাস্কর পণ্ডিতসহ ২২ জন মারাঠা নেতাকে আমন্ত্রণ করে এনে তাঁদেরকে হত্যা করেন। এর ফলে বাংলায় মারাঠাদের তৃতীয় আক্রমণও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। চতুর্থ মারাঠা আক্রমণ : ১৭৪৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলার নবাব আলিবর্দি খানের আফগান সৈন্যরা বিদ্রোহ করে। এ সুযোগে রঘুজীর নেতৃত্বে চতুর্থ বারের মতো মারাঠারা বাংলা আক্রমণ করে। মারাঠারা একে একে ওড়িশা, মেদিনীপুর, বর্ধমান ও বীরভূম দখল করে নেয় এবং বিহারের দিকে অগ্রসর হয়। নবাব আলিবর্দির তাঁদের বিহার থেকে বিতাড়িত করেন। এরপর তাঁরা মুর্শিদাবাদ আক্রমণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। ১৭৪৫ সালের ডিসেম্বরে কাটোয়ায় আলিবর্দি তাঁদের পরাজিত করেন এবং ১৭৪৬ সালের এপ্রিলের মধ্যে তাঁদের আরও পিছু হটতে বাধ্য করেন। মারাঠারা মেদিনীপুরে আশ্রয় নেয়। ১৭৪৬ সালের অক্টোবরে নবাবের সেনাপতি মির জাফর মেদিনীপুর পুনরুদ্ধার করেন, কিন্তু পরের মাসেই মারাঠারা আবার মেদিনীপুর দখল করে নেয়। ১৭৪৭ সালের মার্চে বর্ধমানের যুদ্ধে মারাঠারা পরাজিত হয়ে মেদিনীপুরের দিকে পিছটান দেয়। এসময় আফগান বিদ্রোহীরা বিহার দখল করে নিলে আলিবর্দিকে তাঁদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হতে হয়। ১৭৪৮ সালের এপ্রিলের মধ্যে নবাব বিদ্রোহীদের দমন করেন এবং এরপর বাংলা থেকে মারাঠাদের বিতাড়িত করেন। ১৭৪৯ সালের মে মাসে নবাব কটক পুনরুদ্ধার করেন এবং জুনের মধ্যে মারাঠাদের ওড়িশা থেকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হন। এর মধ্য দিয়ে বাংলায় চতুর্থ মারাঠা আক্রমণের সমাপ্তি ঘটে। পঞ্চম মারাঠা আক্রমণ : চতুর্থ বারের মতো পরাজিত হওয়ার মাত্র এক সপ্তাহ পরেই ১৭৪৯ সালের জুনে মারাঠারা আবার ওড়িশা আক্রমণ করে দখল করে নেয় এবং বাংলায় হানা দিতে থাকে। তীব্র সংঘর্ষের পর নবাব আলিবর্দি মারাঠাদেরকে বাংলা থেকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হন, কিন্তু ওড়িশা মারাঠাদের দখলে থেকে যায়। দীর্ঘ ৯ বছরব্যাপী বাংলায় হানা দিয়ে মারাঠারা দুর্ভোগ ব্যতীত বিশেষ কিছু লাভ করতে পারেনি। অনুর্বর ওড়িশা প্রদেশ তাঁদের জন্য লাভজনক প্রমাণিত হয়নি এবং বাংলায় তাদের আক্রমণসমূহ সবসময়ই আলিবর্দির ক্ষিপ্রতার দরুন ব্যর্থ হয়েছে। ফলে ১৭৫১ সালে রঘুজী সন্ধির প্রস্তাব করেন। বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ সমস্যার মুখোমুখি হয়ে আলিবর্দি শেষপর্যন্ত এ প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং ১৭৫১ সালের মে মাসে মারাঠাদের সঙ্গে সন্ধি স্বাক্ষর করেন। তবে এ ঘটনার মাত্র ৫ বছর পর ব্রিটিশ তথা ইংরেজদের করতলগত হয়ে যায় বাংলা। ফলে মারাঠা-বর্গিরা মোগলদের পরির্বতে নতুন এক শক্তির মুখোমুখি হতে হয়, যে শক্তিটি মোগলদের চেয়ে সহস্রগুণ চতুর খল ও শক্তিশালী।

কেমন ছিল বর্গিদের আক্রমণ? হাড় হিম করা আক্রমণ। বাংলায় মারাঠা সৈন্যরা বাংলার জনসাধারণের উপর অবর্ণনীয় অত্যাচার-নির্যাতন চালাত। তাঁরা নির্বিচারে সমগ্র বাংলা জুড়ে লুটতরাজ ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। ১৭৪২ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে মুর্শিদাবাদ লুণ্ঠনের পর প্রত্যাবর্তনকালে মারাঠা হানাদারেরা পথিমধ্যে অসংখ্য গ্রাম জ্বালিয়ে দেয় এবং জ্বলন্ত গ্রামসমূহের সারি তাঁদের পদচিহ্ন হিসাবে থেকে যায়। ১৭৪২ খ্রিস্টাব্দের জুনে মারাঠারা হুগলি দখল করার পর তাঁদের উপদ্রবে এই অঞ্চলের লোকের দুর্দশা চরমে পৌঁছায়। মারাঠারা অসংখ্য সাধারণ মানুষকে হত্যা করে। ধারণা করা হয়, বাংলার প্রায় ৪,০০,০০০ অধিবাসী মারাঠা আক্রমণকারীদের হাতে প্রাণ হারিয়েছিল। বিপুল সংখ্যক নারী মারাঠাদের কাছে ধর্ষিতা হয়। ফলে বহু মানুষ তাঁদের পরিবারের নারীদের সম্মান রক্ষার জন্য তাঁদের বাড়িঘর ত্যাগ করেন এবং গঙ্গানদীর পূর্বতীরে চলে গিয়ে গোদাগারীতে আশ্রয় নেন। মারাঠা সৈন্যরা মেদিনীপুরে যায়, সেখানকার একটি বিখ্যাত রেশম-পালন কেন্দ্র রাধানগর লুট করে এবং জ্বালিয়ে দেয়। সপ্তদশ ও অস্টাদশ শতকে বাংলার রেশমি কাপড়ের আড়ংগুলি (আড়ং শব্দটা ফারসি। আড়ং বলতে বড়ো আকারের বাজারকে বোঝায়) ছিল জমজমাট। বর্গি আক্রমণে আড়ংগুলি লোকশূন্য হয়ে পড়ে। বাংলার অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়তে থাকে। বাংলাজুড়ে খাদ্যশস্যের অভাব দেখা দেয়, ব্যাবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। তা সত্ত্বেও গা-জোয়ারি করে বর্গিরা খাজনা আদায় করতে থাকে এবং পুবের যশোর জেলা অবধি বর্গিদের খাজনা আদায় ক্রমেই সম্প্রসারিত হতে থাকে। বর্গিদের নির্মম অত্যাচারে বহু লোক ভিটেমাটির মায়া ত্যাগ করে গঙ্গার পূর্বাঞ্চলে (বর্তমান বাংলাদেশে) চলে আসে। পরে পূর্বাঞ্চলের বাঙালিরাও বর্গি লুণ্ঠনের শিকার হয়। বাংলার ইতিহাসে মির জাফরের আগেও মির হাবিব নামে বাংলায় আরও একজন বিশ্বাসঘাতক ছিল। পারস্য সেই অভিজাতটি একসময় নবাব আলিবর্দি খানের ঘনিষ্ট ছিল। অথচ এই লোকটিই লোকাল এজেন্ট হিসাবে বর্গিদের সাহায্য করত। আসলে মির হাবিব ছিল রাজাকার, তার বাংলা সম্বন্ধে খুঁটিনাটি জ্ঞান ছিল। বর্গিরা সে জ্ঞান প্রয়োগ করে সহজেই বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। সেসময় বাংলার নবাব আলিবর্দি খান ও সিরাজ উদ-দৌল্লা যদি বর্গিদের প্রতিহত করতে সক্ষম না হত, বাংলা মারাঠিদের দখলে চলে যেত এবং বাঙালি খতম হয়ে যেত। বাঙালি শূন্য হয়ে যেত বাংলা। চলত মারাঠাদের আধিপত্য।

বর্গিদের কথা লিখলাম বলে এই নয় যে, শিবাজীও বর্গি ছিলেন। শিবাজীর অনেক অনেক পরে (১৭৪১ সাল থেকে ১৭৫১ সালের সময়কালে) প্রথম রঘুজী ভোঁসলে নেতৃত্বে গোটা দেশে বর্গিরা ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রথম রঘুজী ভোঁসলে। একজন মারাঠা সেনাপতি ছিলেন এবং ছত্রপতি শাহুর রাজত্বকালে পূর্ব-মধ্য ভারতের নাগপুর রাজ্যের শাসক ছিলেন।

মারাঠাদের অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন ছত্রপতি শিবাজী ভোঁসলে (১৬২৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৬৮০ সালের ৩ এপ্রিল); তিনিই ১৬৭৪ সালে মারাঠি সাম্রাজ্যটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মারাঠি সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল রাইগাড। ছত্রপতি’ শুনলে মনে হয় ছাতি মাথায় মানুষ বুঝি। মারাঠি ভাষায় ছত্রপতির অর্থ সম্রাট। সংস্কৃত শব্দ ক্ষেত্র (এলাকা) থেকে ছত্র, সুতরাং ছত্রপতি-ক্ষেত্ৰপতি-ফিল্ড মার্শাল। মোগল সাম্রাজ্যের মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠা দুর্ধর্ষ মারাঠা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ ভারতের সকল হিন্দু মৌলবাদীদের কলিজার টুকরা। ‘হিন্দু প্ৰজানিপীড়নকারী’ মুসলিম মোগল বাদশার বিপক্ষে তিনি ধারাল হিন্দু তলোয়ার নিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন বলে কথিত আছে। তবে পৃথিবীর অন্যান্য নেতার মতোই তাঁর আসল ধর্ম ছিল ক্ষমতা, ক্ষমতার লোভে তিনি মোগলের সঙ্গে আজ আড়ি দিতেন কাল তাকেই ‘বুকে আয় বাবুল’ বলে ডাক দিতেন। শিবাজী প্রতিষ্ঠিত মারাঠা বাহিনী ছিল প্রথম শ্রেণির গেরিলা যোদ্ধা, সংখ্যায় বৃহত্তর সৈন্যবাহিনীকে ছোটো ছোটো সুশিক্ষিত মারাঠা দলের ‘হিট অ্যান্ড রান’ পদ্ধতিতে নাকাল করতে জুড়ি ছিল না। ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গি এল দেশে, ছেলেবেলায় পড়া কবিতার বর্গি হল এই মারাঠা গেরিলার দল।

১৮১৮ সাল পর্যন্ত মারাঠা সাম্রাজ্যটি টিকে ছিল। মারাঠা সাম্রাজ্য পতনের কারণ ভারতবর্ষে নতুন শক্তির আগ্রাসন। মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব (১৬১৮ সালের ৪ নভেম্বর থেকে ১৭০৭ সালের ৩ মার্চ) কর্তৃক দক্ষিণ ভারতে সামরিক অভিযানের সময় মারাঠা সাম্রাজ্যটি ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। যার ফলে মারাঠারা মোগল শাসনের প্রতি বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। যেহেতু মোগল আমলে মারাঠারা ছিল হিন্দু ক্ষত্রিয় যোদ্ধা, সেইহেতু সম্রাট আওরঙ্গজেব মারাঠা সৈন্যদের মোগল সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে মারাঠাদের রোষ প্রশমিত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতে তেমন কোনো ফললাভ হয়নি। কিছু কিছু মারাঠা সেনাপতি সম্রাট আওরঙ্গজেবের অনুগত থাকলেও বেশিরভাগ মারাঠা সৈন্যই রোষবশত ভারত উপমহাদেশে মোগল শাসিত প্রদেশগুলিতে লুঠপাঠ আরম্ভ করত। রোষের শিকার মোগল শাসিত প্রদেশগুলিতে সুবা বাংলা ছিল অন্যতম। বাংলা মোগলশাসিত প্রদেশ বলেই ১৭৪২ সাল থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত বার বার বাংলায় বর্গিদের আক্রমণ সংঘটিত হতে থাকে।

শিবাজী কেমন মানুষ ছিলেন? হিন্দুদের রক্ষাকর্তা? শিবাজী সম্বন্ধীয় কোনো সূত্র থেকেই শিবাজীকে হিন্দুদের রক্ষাকর্তা হিসাবে পাওয়া যাচ্ছে না। বরং তাকে মারাঠার প্রাদেশিক নেতা হিসাবেই পাওয়া যাচ্ছে। মারাঠা নেতা মানে মারাঠা নেতাই, ভারতের হিন্দুদের কোনো নেতা নন। তিনি সমগ্র ভারত উপমহাদেশের হিন্দুনেতা হতেও চাননি। শিবাজী একজন লুটেরা, ডাকাত, খুনি এবং পাষণ্ড ধরনের এক লোক ছিলেন। দেবতার বিরুদ্ধে এহেন অভিযোগ-বিশেষণে হিন্দুবাদীরা ঘাবড়ে যাবেন না। চলুন একবার শিবাজীর একটু খোঁজ নেওয়া যাক— “শায়েস্তা খাঁ ছিলেন তৎকালীন বাংলায় নিয়োজিত সুবাদার। তিনি ছিলেন বাদশাহ আলমগিরের সুযোগ্য গভর্নর বা সুবাদার। মোগল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে মারাঠা, মগ, পর্তুগিজ দস্যুদের তিনি বিতাড়ন করেছিলেন। এসব সন্ত্রাসীদের শক্ত হাতে দমন করতে পেরেছিলেন বলেই তাঁর শাসনামলে বাংলার মানুষ অত্যন্ত শান্তিতে ছিল। লুটেরা, দস্যুদের দমন করার ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নির্ঝঞ্ঝাট হওয়ায় বাংলায় তাঁর শাসনামলে টাকায় আট মণ চাল পাওয়ার কিংবদন্তী রচিত হয়েছে। মোগল গভর্নর হিসাবে শায়েস্তা খাঁয়ের বিদায়পর্ব ছিল গৌরবব্যঞ্জক। বাংলার বিপুল জনতা মিছিলের মাধ্যমে তাঁকে বিদায় জানিয়েছিল। তাঁকে জীবনে এজন্য ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে প্রচুর। দস্যু হিন্দু মারাঠারা ছিল অত্যাচারী, কিন্তু কাপুরুষ। মারাঠাদের বিরুদ্ধে অভিযান শেষে একরাতে শায়েস্তা খাঁ তাঁর শয়নকক্ষে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। বিশ্রামরত নিরস্ত্র শায়েস্তা খাঁকে কাপুরুষের মতো অতর্কিতে আক্রমণ করেছিল মারাঠা দস্যুসর্দার শিবাজী। শায়েস্তা খাঁ জানালা ভেঙে বেরিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করেন। কিন্তু তাঁর অল্পবয়স্ক পুত্র দুর্ভাগ্যবশত ঘরেই থেকে যায়। তাঁর নিষ্পাপ পুত্রকে শিবাজী একা পেয়ে টুকরো টুকরো করে কেটে পৈশাচিক আনন্দ উপভোগ করে।” (সূত্র: চেপে রাখা ইতিহাস, ১৭৯ পৃষ্ঠা) ইতিহাসের বই খুললে শিবাজীকে পাবেন মারাঠা দস্যুদের নেতা হিসাবে। যাঁদের কাজই ছিল সাধারণ মানুষের ঘড়বাড়ি লুণ্ঠন, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ এবং মানুষ হত্যা করা।

দস্যু শিবাজী যখন তাঁর লুটপাট ও অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দিল তখন মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব ১০ হাজার সেনা নিয়ে সেনাপতি আফজল খাঁকে পাঠিয়েছিলেন মারাঠা দস্যুদের দমনের জন্য। খবর পেয়ে শিবাজী ভাবল, এত সেনার সঙ্গে তো পেরে ওঠা সম্ভব নয়। তাই সে অন্য মতলব আটল। ভুয়ো সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে শিবাজী গেল আফজল খাঁর সঙ্গে দেখা করতে। যুদ্ধক্ষেত্রে একটি নিয়ম হচ্ছে, কোনো পক্ষ থেকে কেউ সন্ধি করতে এলে তাঁকে সম্মান করতে হবে, তাঁর কোনো অনিষ্ট করা যাবে না কোনো অজুহাতেই। যথারীতি নিয়ম অনুযায়ী সেনাপতি আফজল খাঁ শিবাজীকে সাদর সম্ভাষণ জানাল। বিপক্ষ যত বড়ো শক্রই হোক, তাঁকে আদর-আপ্যায়ন করে আহ্বান করতেই হবে। সন্ধি করে শত্রুকে বন্ধু করা হয়েছে, সেই ইতিহাস আলাদা করে লেখা যায়। যাই হোক, এ সময় দুজনেই সৌজন্য সাক্ষাৎ করল। কিন্তু মারাঠা নেতা শিবাজী ছিল ধোঁকাবাজ। সে আগেই তাঁর পোশাকের নীচে ‘বাঘনখ’ নামক একটি ধারালো অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছিল, সাক্ষাতের সময় সে হঠাৎ সেনাপতি আফজল খানের উপর আক্রমণ করে তাঁকে হত্যা করে বসল।(তথ্যসূত্র: (১) ইতিহাসের ইতিহাস, গোলাম আহমদ মোর্তজা, পৃষ্ঠা-১২৩ ১২৪ (২) ভারতের ইতিহাস, রোমিলা থাপার।) শিবাজী আফজলের নাড়িভুঁড়ি বের করে দেওয়ার পর আবার একটা ছুরি দিয়ে কোপ মারেন। এই সময় আফজলের দেহরক্ষী এক কোপে শিবাজীর পাগড়ি দু-টুকরো করে ফেলেন। শিবাজীর দেহরক্ষী আবার এক কোপে সেই দেহরক্ষীর হাত কেটে ফেলেন। আর শিবাজী আফজলের দেহরক্ষীর ধড় থেকে মাথা আলাদা করে দেয়। শিবাজীর পাগড়ি দু-টুকরো হওয়াটা দারুণ ব্যাপার। কারণ শিবাজী বর্ম পরেছিলেন বলে দেহ সুরক্ষিত থাকলেও মাথাটা অরক্ষিতই ছিল। একটু এদিক-ওদিক হলেই নিজেও ‘শিবাজী মুণ্ডুদান কর্মসূচি’-র মহান কার্যক্রমে অংশ নিয়ে ফেলতেন। আফজল শিবাজীকে ডেকেছিলেন, নাকি শিবাজী আফজলকে এটা নিয়ে পরস্পর-বিরোধী মত আছে। Stewart Gordon রচিত ‘The Marathas’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, আফজল খান নিজেই শিবাজীকে ডেকে পাঠান। উইকিপিডিয়াতে শিবাজীর পেজে লেখা শিবাজীই চিঠি লিখে ডেকেছেন। আবার আফজল খানের পেজে লেখা আফজল দূত পাঠিয়ে ডেকেছেন। তবে যেই-ই ডাকুক, মারাঠারা এই ঘটনাকে মারাত্মক সম্মান করে ও যে-কোনো মূল্যে জয়ের একটা উদাহরণ হিসাবে দেখে।

“শিবাজী ছিলেন ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো লুণ্ঠক ও হন্তারক দস্যু। আর তিনি যাঁদের সংগঠিত করেছিলেন, সেই মারাঠা জাতি ছিল এমন অপরাধপ্রবণ যে, মুহূর্তের মধ্যে তাঁরা তাঁদের লাঙ্গলের ফালকে (ফলা) তরবারিতে রূপান্তরিত করে এবং ঘোড়া ধার অথবা চুরি করে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ অভিযানে ঝাঁপিয়ে পড়ত। আর এ ব্যাপারে তাঁরা হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে কোনো পার্থক্য করত না। মারাঠারা হিন্দু হলেও অবৈধ পন্থায় ধন-সম্পদ আত্মসাৎ করার জন্য তাঁরা অবাধে মন্দির ধ্বংস করেছে, গো-হত্যা করেছে এবং হিন্দু ব্রাহ্মণ ও পুরোহিতকে হত্যা করেছে। যেখানেই তাঁরা গিয়েছে সেখানেই কেবল ধ্বংস ও মৃত্যু রেখে এসেছে।” (The Princess of India, Sir Sullivan, London, 1875)। মিঃ হলওয়েল তাঁর ‘Interesting History/ Events Holl well’ গ্রন্থে লিখেছেন, “তাঁরা ভীষণতম ধ্বংসলীলা ও ক্রুরতম হিংসাত্মক কার্যে আনন্দ লাভ করত। তাঁরা ভূত গাছের বাগানে ঘোড়া ছুটিয়ে রেশম উৎপাদন একেবারে বন্ধ করে দেয়। দেশের সর্বত্র বিভীষিকায় ছায়া পড়েছে। গৃহস্থ কৃষক ও তাঁতিরা সকলেই গৃহত্যাগ করে পলায়ন করেছে। আড়তগুলো পরিত্যক্ত, চাষের জমি অকর্ষিত। খাদ্যশস্য একেবারে অন্তর্হিত, ব্যাবসা-বাণিজ্য একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে।” এই হল শিবাজী চরিত্রের প্রকৃত স্বরূপ। সেই শিবাজীকে মহান’ বানিয়ে মহারাষ্ট্রে তৈরি হয়েছে ৩৬০০ কোটি টাকা খরচ করে মূর্তি তৈরি হয়েছে। মারাঠা লুণ্ঠনের প্রত্যক্ষদর্শী গঙ্গারাম বাবু এক কবিতার লিখেছিলেন— “কারু হাত কাটে, কারু নাক কান,/একি চোটে কারু বধ এ পরাণ।/ভাল ভাল স্ত্রীলোক যত ধইরা লইয়া জাএ/আঙ্গুষ্ঠে দড়ি বাঁধি দেয় তার গলা এ।/একজনে ছাড়ে তারে আর জনে ধরে/রমণের ডরে ত্রাহি শব্দ করে।”

আওরঙ্গজেব শিবাজীকে দমন করার জন্য প্রতিজ্ঞা করেন ‘ইয়া তখত্ ইয়া তাবুত। অর্থাৎ হয় সিংহাসনে না হয় মৃত্যু। কিন্তু সম্রাটের দাক্ষিণাত্যে পৌঁছানোর আগেই ১৬৮০ সালে শিবাজী মারা যান। শিবাজীর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সর্দার শম্ভুজী গদিতে বসেন। শিবাজীর গুরু রামদাস মারাঠা শক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্যে উত্তেজক কবিতা লিখতে শুরু করেন। ইংরেজ ইতিহাসবেত্তা সিসেন্ট ও স্মিথ “The Oxford History of India’ গ্রন্থের বিবরণ অনুযায়ী দেখা যায়, ১৬৬৪ সালে স্মিথ নামে এক ইংরেজ স্বচক্ষে দেখেন সুরাটের এক তাঁবুতে বসে শিবাজীর নির্দেশে কীভাবে সম্পদ গোপনকারীদের হাত ও মাথা কেটে ফেলা হচ্ছে। শিবাজী যখন সম্পদ সংগ্রহ করত, তখন ভারতীয় দস্যু ও লুটেরার মতো নির্মম ও পৈশাচিক রূপ ধারণ করত। এই ইতিহাসবেত্তা শিবাজীর রাজ্যকে ‘দস্যু রাজ্য’ আখ্যাও দেন।

মারাঠা সাম্রাজ্য

সরদেশাই বলেন, সারা ভারতে হিন্দু সাম্রাজ্য স্থাপন করাই শিবাজীর লক্ষ্য ছিল। ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকারের মতে—”শিবাজী যে শুধুই মারাঠা জাতির স্রষ্টা ছিলেন এমন নয়, তিনি ছিলেন মধ্যযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভাবান জাতীয় স্রষ্টা।” একথা সর্বৈব সত্য নয়। শিবাজীর উদ্দেশ্য ছিল মারাঠা সাম্রাজ্য স্থাপন এবং বিস্তার। কখনোই হিন্দু সাম্রাজ্য স্থাপন করার কথা স্বপ্নেও ভাবেননি। গোটা ভারত ভূখণ্ডটাকে মারাঠারা দখল করার স্বপ্ন দেখত। তবে মারাঠাদের ভারী অস্ত্রের বহর ছিল খুব দুর্বল। কাজেই ঘোড়ায় চড়ে দ্রুত আক্রমণ করা তাঁদের খুব পছন্দের ছিল, আর এটাই স্বাভাবিক। নিদারুণ নৃশংসতা এবং অত্যধিক লুটপাটের কারণে তাঁরা ছিল কুখ্যাত। তবে যুদ্ধে তাঁদের পারদর্শিতা নাকি দেখার মতো ছিল। ডিউক অব ওয়েলিংটন স্যার আর্থার ওয়েলেসলি সহ বহু ইউরোপিয়ান মারাঠা সৈন্যদের সাহস আর দক্ষতা দেখে মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন, মারাঠারা নাকি ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের দেখা সবচেয়ে দুর্ধর্ষ বাহিনী। আফগানরাও একইভাবে মারাঠা সেনাবাহিনীর গুণগান গেয়েছেন। অসংখ্য দুর্গ এবং ভারতের সেরা দেশীয় নৌ-বাহিনী গড়ে তোলার জন্য মারাঠারা বিখ্যাত। কোনকান অঞ্চলে গড়ে ওঠে তাঁদের জাহাজ নির্মাণ কারখানা। মারাঠা নৌ-সেনারা গভীর সমুদ্রে বিশেষ সুবিধা করে উঠতে না-পারলেও হজযাত্রী এবং বিদেশি বাণিজ্য জাহাজে ব্যাপক লুটতরাজ চালিয়ে আরব সাগরে আতংক সৃষ্টি করেছিল। শৌর্যবীর্যের পাশাপাশি শঠতার জন্য কুখ্যাত ছিলেন মারাঠা নেতারা। নিজেদের মধ্যে হরদম রেষারেষি চলত। এমনকি মারাঠা দুর্গে সেনাপতি থাকত ৩ জন করে, যাতে কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করার সুযোগ না পায়। ক্ষমতা নিয়ে এই টানাটানি পরে তাঁদের সাম্রাজ্যে ভাঙন ডেকে নিয়ে আসে।

মারাঠারা সুদক্ষ শাসক ছিল। গোটা সাম্রাজ্যের অধিকাংশ এলাকা প্রভাবশালী ভূস্বামীদের হাতে দেওয়া হত। এঁদের নেতৃত্ব দিত একজন পেশোয়া। পেশোয়া মানে প্রধানমন্ত্রী। পেশোয়ার অধীনে থাকত ৮ জন মন্ত্রী এবং সেনাবাহিনী। এরা ছিল মারাঠা সাম্রাজ্যের মূল স্তম্ভ। পেশোয়ারা আবার সম্রাটের (ছত্রপতি) অধীনে থাকতেন। ‘ছত্রপতি পদটি শিবাজীর বংশ অর্থাৎ ভোঁসলে পরিবারের অধীনে ছিল। পরবর্তীতে ‘ছত্রপতি’ কেবলমাত্র আলংকরিক পদ হয়ে পড়ে। মূল ক্ষমতা চলে যায় পেশোয়াদের হাতে। এই শাসনব্যবস্থাকে বলা হয় মারাঠা কনফেডারেন্সি। মারাঠা সমাজে ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রাখার চেষ্টা করা হত। শাসনব্যবস্থা ছিল পরিবারতান্ত্রিক। সিন্ধিয়া, গায়কোয়াড়, ভাটসহ নানা প্রভাবশালী পরিবার সাম্রাজ্যের একেকটা অংশ অনেকটা স্বাধীনভাবে শাসন করতেন। মুসলিমদের সঙ্গে কোনো বৈরিতা ছিল না মারাঠাদের। মারাঠি মুসলিমরা অনেক জায়গাতেই গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন ছিল। খ্রিস্টানদেরকেও সহনীয় দৃষ্টিতে দেখার নীতি চালু ছিল মারাঠাদের মধ্যে। শিবাজী ছিলেন একজন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র এবং ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। সামান্য এক জায়গিরদারের অবহেলিত পুত্র শিবাজী শতধা বিভক্ত ও পারস্পরিক গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে লিপ্ত মারাঠাদের জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করে এক শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ জাতিতে পরিণত করেছিলেন।

মোগল বাদশাহরা মারাঠা পেশোয়াদের হাতের পুতুল হয়ে পড়ায় উপমহাদেশে ব্রিটিশদের মূল প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায় মারাঠারা। ততদিনে বাংলা ব্রিটিশদের হাতে চলে গিয়েছে। ক্ষমতা নিয়ে নিজের দরবারে দ্বন্দের সূত্রপাত হলে পেশোয়া রঘুনাথ রাও ব্রিটিশদের সঙ্গে এক গোপন চুক্তি করেন, যাতে তিনি কিছু অঞ্চলের বিনিময়ে ব্রিটিশদের কাছ থেকে সেনা সহায়তা চান। এ কথা চাউর হয়ে পড়লে মারাঠা নেতারা রঘুনাথকে তাড়িয়ে দেন। মারাঠাদেরকে শায়েস্তা করার জন্য কলকাতা থেকে পাঠানো হয় ওয়ারেন হেস্টিংসকে। ১৭৭৫-৮২ সাল পর্যন্ত মারাঠাদের সঙ্গে ব্রিটিশদের অনেকগুলো যুদ্ধ হয়। গোয়ালিয়রের সিন্ধিয়া বংশ এই যুদ্ধে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়। ১৭৮২ সাল সালবাইয়ের চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধ শেষ হয়। ব্রিটিশরা রঘুনাথের কাছ থেকে প্রাপ্ত অঞ্চলগুলোর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে। কিন্তু বিনিময়ে নতুন পেশোয়া দ্বিতীয় মাধব রাওকে মারাঠাদের বৈধ নেতা হিসাবে মেনে নেয় ও মহারাষ্ট্র অঞ্চল থেকে সৈন্য সরিয়ে নেয়। প্রায় ৩৪ হাজার ব্রিটিশ সৈন্য এই যুদ্ধে প্রাণ হারায়।

শিবাজীর উত্থানের আগ পর্যন্ত মারাঠাদের তেমন কেউ আমল দিত না। ভোঁসলে পরিবারের শাজীর ছেলে শিবাজী। বিজাপুরের আহমেদনগর দরবারের বড় অফিসার শাহুজী। সাওনের দুর্গে শিবাজীর জন্ম, পুনা শহরে তার বেড়ে ওঠা। ১৬২৭ সালের কথা। দাদাজী কোণ্ডদেব নামে এক বিচক্ষণ ব্রাহ্মণ তাঁর দেখভাল করত। খাঁটি মারাঠা শিক্ষায় শিক্ষিত শিবাজী। ঠিকমত কলম ধরতে না পারলেও কিন্তু ছিলেন লক্ষ্যভেদী তীরন্দাজ। বর্শা, তলোয়ার, ঘোড়দৌড় সবকিছুতেই একবারে তুখোড়। ব্রাহ্মণ গুরুর হিন্দু পুজোপাঠে শিবাজী অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন, আর জাতিভেদের অসীম গুরুত্ব তাঁর কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। ষোলো বছর বয়স হলে পরে তিনি নানাবিধ গুণ্ডা বদমাসদের সঙ্গে মেলামেশা শুরু করেন। অচিরেই সেইসব বন্ধুদের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন।

শিবাজীর কর্মজীবন আরম্ভ হয় তুর্ণা দুর্গ লুঠপাটের মধ্য দিয়ে। এটা ১৬৪৬ সালের কথা। লুটপাটের এক পর্যায়ে বিরাট স্বর্ণভাণ্ডারের খোঁজ পেলেন তিনি। প্রাচীন আমলের স্বর্ণ। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস হল এটা দেবীমাতা ভবানীর আশীর্বাদ। অতএব এই সোনা কোনো একটি মহৎ উদ্দেশ্যে ব্যয় করতে হবে। কেনা হল প্রচুর গোলাবারুদ। রায়গড়ে তৈরি হল ঝাঁ চকচকে নতুন একটা দুর্গ। পরবর্তী দুই বছর দুর্গের পর দুর্গ লুট করা শুরু করলেন। এর ফলে শিবাজী শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকলেন। বিজাপুরের রাজা খবর পেয়েও কোনো এক রহস্যময় কারণে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছিলেন না, শিবাজীর কাঁচা বাঁশ নুইয়ে দিলে ওই বাঁশ আর পরে ঠাসঠাস করার সুযোগ পেত না। শিবাজীর এমনই কপাল যে, এমনকি মোগল সাম্রাজ্যে হানা দেওয়ার পরেও মোগলসম্রাট আওরঙ্গজেব তেমন আমল দেননি। পরে অবশ্য এর জন্যে হাত কামড়েছিলেন তিনি। তাঁদের চোখের সামনে মারাঠা শিবাজী ‘সুপার পাওয়ার হয়ে ওঠে। একসময় বিজাপুরকে শিবাজী খাজনা দিতে বাধ্য করেন, আর আওরঙ্গজেবকে পিটিয়ে দাক্ষিণাত্য থেকে দূর করে দেন। 

যাই হোক, ওসব পরের কথা। কল্যাণনগর দখল করে গভর্নরকে জেলে ঢোকানোর খবর পাওয়ার পরে প্রথম বিজাপুর নড়েচড়ে বসে। সুলতান আদিল শা তাঁর কর্মচারী শিবাজীর পিতাকে বন্দি করেন এবং বলেন শিবাজী এসে ধরা দিলে তবেই তাঁকে মুক্তি দেওয়া হবে। শিবাজী মুশকিলে পড়লেন। এতদিন গোপনে মোগল এলাকা এড়িয়ে লুটপাট চালাতেন। বস্তুত বাদশাহী মিলিটারির তুলনায় তাঁর লোকবল কমই ছিল। বিজাপুরও যে তিনি অতি আয়াসেই করে জয় করে ফেলতে পারবেন সে ভরসা নেই। তিনি বরং নতুন ফন্দি আটলেন। ভাবলেন মোগলদের সঙ্গে চুক্তি করে বিজাপুর গুঁড়িয়ে দিলে কেমন হয়? শাহজাহানের কাছে সেই খবর পাঠানো হল। শিবাজীর ‘ভালো মানুষ’ পিতাকে বদমাইস’ বিজাপুরের আদিল শা বিনা কারণে বন্দি করে রেখেছে কেন শাহজাহানের কাছে তার জবাব চাইল। শাহজাহানের ফরমান জারির মাধ্যমে শিবাজীর পিতা মুক্ত হলেন। এমনকি মোগলসম্রাট শাহজাহান শিবাজীকে পাঁচ হাজার ঘোড়াও পাঠালেন।

সেসময় দাক্ষিণাত্যের গভর্নর হিসাবে নতুন চাকরিতে নিযুক্ত হয়েছেন আওরঙ্গজেব। বিজাপুরের শিয়া সুলতানের উপর তাঁর খুবই ক্রোধ ছিল। শাহজাহানের অসুস্থতার খবর পেয়ে তড়িঘড়ি করে আওরঙ্গজেব যখন দিল্লির দিকে যখন দৌড় দিলেন, তখন বিজাপুরের সুলতান মারাঠাদের শায়েস্তা করার কাজে মন দিলেন। ৫০০০ ঘোড়সওয়ার আর ৭০০০ সৈন্য নিয়ে বিজাপুরের কমান্ডার আফজাল খাঁ শিবাজীকে আক্রমণ করতে গেলেন। এই খবর পেয়ে শিবাজী আবার ফন্দি আটলেন। তিনি চিঠি লিখে জানালেন তাঁর অতীত কর্মকাণ্ডের জন্য তিনি খুবই দুঃখিত, লজ্জিত, ব্যথিত ও পীড়িত। খাঁ সাহেবের মতো সুদক্ষ ও বিচক্ষণ কমান্ডার তাঁর মতো তুচ্ছ লোকের সঙ্গে যুদ্ধ করতে আসছেন এর থেকে লজ্জার আর কিই-বা হতে পারে। খাঁ সাহেব চাইলে আস্ত একট দুর্গ তাঁকে আজকেই তুলে দিতে রাজি আছেন। শিবাজীর চিঠি পেয়ে আফজাল খাঁ অত্যন্ত খুশি হলেন এবং শিবাজীর সঙ্গে দেখা করতে রাজি হলেন। ঝুঁকে কুশল বিনিময় করার সময় শিবাজী হাতের তালুতে লুকিয়ে রাখা ধাতব নির্মিত ধারালো অস্ত্র দিয়ে পেট চিরে দিলেন আফজালের, তারপরে ছুরি বসিয়ে দিলেন বুকে। শিবাজীর সৈন্যরা পিছন থেকে আক্রমণ করল বিজাপুরের সিপাইদের, তারপরে কেটে ফালা ফালা করা হল তাঁদের।

এবার শিবাজী ঠিক করল কয়েকটা মোগল মারা যাক। তিনি আর প্রধানমন্ত্রী মোরারজী মিলে মোগল সাম্রাজ্যে ঝটিকা হানা দিয়ে লুটপাট আরম্ভ করলেন। আওরঙ্গজেবের তৎকালীন জেলা প্রশাসক শায়েস্তা খাঁ (আওরঙ্গজেবের মামা) ভাবলেন এঁদের একটা শিক্ষা দেওয়া দরকার। তিনি মারাঠা এলাকা দখল নিলেন, আর পুনায় যেখানে শিবাজী বড়ো হয়েছেন তার খুব কাছে সদর অফিস বানালেন। এখানে শিবাজী একটা দারুণ একটা সাহসিকতার পরিচয় দিলেন। এক গভীর নির্জন রাতে অল্প কিছু শাগরেদ নিয়ে শিবাজী শায়েস্তা খাঁর বাড়িতে হামলা করে বসলেন। শায়েস্তা খাঁ তাঁর প্রাণ নিয়ে কোনোমতে পালিয়েছিলেন বটে, কিন্তু কাটা পড়ে তাঁর একটি আঙুল। এরপর শিবাজী সুরাট আক্রমণ করে বিরাট লুটের ভাণ্ডার গড়ে তোলেন। তবে লুটের মাল আরও বাড়তে পারত, কিন্তু ‘বদমাইস’ ব্রিটিশ আর পর্তুগিজ তাঁদের জিনিস লুট করতে বাধা দেয়। শিবাজী এইবার ‘রাজা’ উপাধি নিলেন। নিজের ছাপমারা মুদ্রা দিয়ে বাজার ভরিয়ে দিলেন।

শিবাজী তলে তলে একটি নৌবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন, সেই সেনাবাহিনী দিয়ে মক্কাগামী হবু হাজিদের জাহাজ আক্রমণ করা শুরু করলেন। এই খবরে আওরঙ্গজেব ভয়ংকর ক্ষিপ্ত হলেন। শাহজাহান তখন বন্দি হলেও জীবিত। জয় সিং আর দলীর খাঁর অধীনে সৈন্য প্রেরিত হল। আওরঙ্গজেব জয় সিংয়ের ছেলেকে দরবারে জমা রেখে দিলেন, যাতে জয় সিং পরে চোখ উল্টে না দিতে পারে। শিবাজী অবশ্য এমতাবস্থায় চুক্তি করতে বাধ্য হলেন। মারাঠি অধিকৃত সমস্ত মোগল এলাকা ছেড়ে দিতে হল। তার বদলে তিনি বিজাপুরের কিছু অংশের রাজত্ব পেলেন, যার রাজস্বের এক-চতুর্থাংশ তিনি আদায় করতেন। এরপরে শিবাজী মোগল সম্রাটের বাহিনীতে যোগ দিলেন। আওরঙ্গজেবের আমন্ত্রণে ৫০০ সুশিক্ষিত ঘোড়সওয়ার নিয়ে শিবাজী রওনা দিলেন দিল্লি। কিন্তু দিল্লি পৌঁছেই তাঁর মনে হল তাকে বিরাট কোনো সম্মান কেন দেওয়া হল না! জেনারেল বা মেজর জেনারেল পদ না-দিয়ে তাঁকে কিনা সামান্য ক্যাপ্টেন মেজরের সম্মান! ছত্রপতি শিবাজী বলে কথা। যত্ন-আত্তি দূরের কথা, উলটে তাঁকে সোজা গারদে পোরা হল। পরে জয় সিংয়ের এক ছেলের সাহায্যে একটি ঝুড়ির ভিতরে লুকিয়ে তিনি পালাতে সক্ষম হলেন।

যোধপুরের যশবন্ত সিং আর দাক্ষিণাত্যের সুলতান মুয়াজ্জেমকে শিবাজীর বিপক্ষে পাঠালেন আওরঙ্গজেব। কিন্তু শিবাজী তাঁদের ঘুষ দিয়ে নিজেদের দলে ভিড়িয়ে নিলেন। বিজাপুর গোলকোন্ডা দখল করা হল, রাজধানী রায়গড়ে শিবাজী এলাকার রাজা হিসাবে নিজেকে ঘোষণা দিলেন। তাঁকে দাঁড়িপাল্লার একপাশে বসিয়ে অন্য পাল্লায় যতটা সোনা উঠল তা ব্রাহ্মণদের দান করা হল।

শিবাজীকে যে যতই ‘হিন্দুবাদী নেতা হিসাবে চিহ্নিত করুক না-কেন, মারাঠা অধিপতি শিবাজী কখনো সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করেননি। তবে তিনি মারাঠা জাতির বাইরে অন্য কিছু বুঝতেন না। আজও মহারাষ্ট্রের নেতা-মন্ত্রীরা মহারাষ্ট্র ও মারাঠিদের বাইরে কিছু বোঝেন না। তামিলদের পরেই মারাঠিদের ভাষাভিত্তিক জাত্যাভিমান লক্ষ করা যায়। সম্প্রতি মারাঠা অধিপতি ছত্রপতি শিবাজীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর তুলনা করায় খেপে লাল শিবসেনা। দিন কয়েক আগেই মোদির সঙ্গে শিবাজীর তুলনা টেনেছিলেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। সেই বক্তব্যের প্রসঙ্গেই কড়া প্রতিক্রিয়া দিয়েছে শিবসেনা। প্রবীণ সাংবাদিক ও লেখক সঈদ হামিদের লেখা ‘ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ এবং মুসলমান’ বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে শিবসেনা সাংসদ সঞ্জয় রাউত বলেন– “উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী সম্প্রতি মোদীজি ও শিবাজীর তুলনা করেছেন। কিন্তু তাঁরা ভুলে যাচ্ছেন ছত্রপতি শিবাজীর নামে কখনো দাঙ্গা বাঁধানোর অভিযোগ নেই। সেই মানের রাজনীতি তিনি করতেন না।”

মারাঠা সাম্রাজ্য হল একটি ঐতিহাসিক সাম্রাজ্য, যা খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতাব্দী থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ পর্যন্ত (১৬৭৪ সাল থেকে ১৮১৮ সাল) ভারতবর্ষের প্রায় সমগ্র অংশ জুড়ে বিদ্যমান ছিল। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ছত্রপতি শিবাজী। মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মারাঠা সাম্রাজ্য পেশওয়ার অধীনে বহুগুণ বিস্তৃত হয়। বিস্তারের সর্বোচ্চ সময়ে এটি উত্তরে পেশোয়ার থেকে দক্ষিণ ভারতে তামিলনাড় পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। মোগল সাম্রাজ্য ধ্বংস হলে ভারতে শেষ হিন্দু সাম্রাজ্য হিসাবে মারাঠা সাম্রাজ্যকেই বিবেচনা করা হয়। ১৭৬১ সালে মারাঠারা পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে পরাজিত হয়, যা উত্তর দিকে তাদের সাম্রাজ্যের বিস্তার রোধ করে। এর ফলে উত্তর ভারত কার্যত কিছুদিন মারাঠা সাম্রাজ্য থেকে বেরিয়ে যায়। যদিও ১৭৭০ সালে উত্তর ভারত আবার মারাঠা সাম্রাজ্যের অধীনে আসে। পরবর্তীতে মারাঠা সাম্রাজ্য সম্রাটের অধীনে কেন্দ্রীয়ভাবে শাসিত হওয়ার পরিবর্তে পেশোয়াদের অধীনে বিভক্ত হয়ে যায় ও কনফেডারেসি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।

ফিরে আসি আওরঙ্গজেবের খোঁজে। পাঠ্যবইয়ে যে ইতিহাস পাঠ করে ভারতের ছেলেমেয়েরা ইতিহাস জানে, তা হল— আওরঙ্গজেব নাকি ভীষণ অত্যাচারী সম্রাট ছিলেন এবং হিন্দুদের সে নাকি দু-চক্ষে দেখতে পারত না, তাঁর শাসনকালে নাকি লক্ষ লক্ষ হিন্দুদের ধরে ধরে মুসলমান বানানো হয়েছে এবং সে নাকি ভারতের বহু হিন্দু মন্দির ধবংস করেছে। আওরঙ্গজেব মানেই খুন খারাপ, অত্যাচার, লুণ্ঠন ও হিন্দুদের মুসলমানে ধর্মান্তরিত করার অপচেষ্টা। অভিযোগ, আওরঙ্গজেবের শাসনাধীনে গুজরাটের বিখ্যাত সোমনাথ মন্দির, বারাণসীর বিখ্যাত বিশ্বনাথ মন্দির এবং মথুরার কেশব রায় ধ্বংস করা হয়। মথুরার নাম পরিবর্তন করে ইসলামাবাদ রাখা হয়। মন্দির ভাঙার কাজের তদারকির জন্য মথুরায় দারোগা নিয়োগ করেন। আওরঙ্গজেব হিন্দু বণিকদের মালের উপর শতকরা ৫% এবং মুসলিম বণিকদের মালের উপর শতকরা আড়াই ভাগ শুল্ক ধার্য করেন। পরে মুসলিম বণিকদের উপর শুল্ক লোপ করা হয়। কিন্তু হিন্দু বণিকদের উপর শুল্ক অক্ষুণ্ণ রাখা হয়। সরকারে উচ্চ ও দায়িত্বপূর্ণ পদ থেকে ধীরে ধীরে রাজপুতদের বিতারণ করা হয়েছিল। হিন্দু যাতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে সে ব্যাপারে উৎসাহ দান করা হত। যদিও সম্রাট আওরঙ্গজেব গভীর বাস্তব বুদ্ধির লোক ছিলেন, কিন্তু ধর্মান্ধতা তাঁর বাস্তব বুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে। ভারতের বহু ধর্মীয় ও বহু সম্প্রদায়গত সমাজে কোনো একটি ধর্মের আধিপত্য কোনো রাষ্ট্রব্যবস্থা সমর্থন করলে সেই রাষ্ট্রের ঐক্য ও ভিত্তি দুর্বল হবে একথা সম্রাট বুঝতে সক্ষম হননি। সম্রাট এতটাই ধর্মান্ধ ছিলেন যে, তিনি দক্ষিণের শিয়া রাজ্যগুলি ধ্বংস করেন এবং গুজরাটের ইসমাইলি বোহরাদেরও নির্যাতন করেন। বিদ্রোহী শিখগুরু। তেগ বাহাদুর তাঁর ধর্মান্ধতার বলি হন। মৃত্যুর পর তাঁর শরীর টুকরো টুকরো করে ফেলে দেওয়া হয়। তেগ বাহাদুরের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র গোবিন্দ সিংহ মাত্র ৯ বছর বয়সে পিতার আসনে নিযুক্ত হন। গোবিন্দ সিংহ ছিলেন তাঁর পিতার মতোই একজন সিংহপুরুষ। তিনি ছিলেন শিখদের সর্বশেষ প্রধান গুরু। তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন মোগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে গেছেন। তাঁর ধর্মনীতির বিরুদ্ধে প্রায় সারাজীবনই জাঠ, সামী, বুন্দেলা, শিখ, রাজপুত ও মারাঠাদের সঙ্গে যুদ্ধরত থাকতে হয়েছে। শেষদিকে তিনি হতাশগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন।

তাঁর শাসনকালে মোগল সাম্রাজ্য ভারতের ভূখণ্ডে দক্ষিণ ও মধ্য পশ্চিম ভারতকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্যে যুদ্ধ চালায়। তাঁর নেতৃত্বে ভারতের দক্ষিণ অঞ্চলের দুই মুসলমান শাসিত রাজ্য, আদিল শাহির বিজাপুর ও কুতুবশাহির গোলকুণ্ডা ভারতের মোগল সাম্রাজ্য যুদ্ধ করে দখল করে। বিদারের যুদ্ধে সিরি মারজানকে পরাস্ত করতে ভারতের মোগল ফৌজ প্রথমবার রকেট ও গ্রেনেড ব্যবহার করে, যা ভারতীয় উপমহাদেশের সেই সময়ে ভাঙন ধরা সামন্তবাদী ব্যবস্থা ও উদীয়মান দেশি পুঁজিবাদের একটি লক্ষণ ছিল। ১৬৬৩ সালে আওরঙ্গজেবের নেতৃত্বে ভারতের মোগল সরকার লেহ ও লাদাখে নিজেদের প্রতিপত্তি কায়েম করে। আওরঙ্গজেব অন্যান্য রাজা-বাদশাদের থেকে কোনোভাবেই আলাদা ছিলেন না। তাঁর লক্ষ্য ছিল মোগল সাম্রাজ্যকে বাঁচিয়ে রাখা এবং তার পরিধি বৃদ্ধি করা। সেই লক্ষ্যেই আওরঙ্গজেব তাঁর রাজত্ব চালিয়েছিলেন, যা তাঁর পিতা শাহজাহানের থেকে শক্তিশালী সাম্রাজ্যে পরিণত হয়। আওরঙ্গজেব ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন না। ইতিহাসে কোনো রাজা-সম্রাটই ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন না। কারণ তাঁদের নিজেদের সভার ধর্মগুরুদের মতামত নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হত। ষোড়শ শতকে যখন আওরঙ্গজেব রাজত্ব করছিলেন তখন ধর্মনিরপেক্ষ সরকার বলে কিছু হত না, কারণ মানবসভ্যতা তখনও সেই স্তরে উন্নত হয়নি যে, গণতন্ত্র-প্রজাতন্ত্র ইত্যাদি মানুষের চেতনায় জায়গা নেবে। জনগণ সেই সময়ের অর্থনৈতিক অবস্থা, উৎপাদনের প্রক্রিয়া ও সম্পর্কের মধ্যে আবদ্ধ থেকে ধীরে ধীরে সামন্তবাদের ধ্বংসের দিকে যাচ্ছিলেন। যে ব্রাহ্মণ্যবাদ শত শত বছর ধরে ভারতের জনগণের উপর যে জগদ্দলের মতো চেপে বসেছিল সেই পাথরকে ইসলামে দীক্ষিত মোগল সম্রাটরাও সরাবার চেষ্টা করেনি তাঁদের রাজত্ব বাঁচাবার ও সাম্রাজ্য বাড়ানোর তাগিদে।

শিখ গুরু গোবিন্দ সিংহের সঙ্গে আরঙ্গজেবের লড়াই বহুদিন চলে এবং অনেকেই মনে করেন, এই লড়াইতে উস্কানি দেন পাহাড়ি রাজ্যের হিন্দু রাজারা, যাঁরা মোগল সম্রাটের কাছে শিখগুরুকে পরাস্ত করার আবেদন জানান। কিন্তু শিখগুরু গোবিন্দ সিংহের সঙ্গে ছিলেন বহু মুসলমান এবং মোগল সম্রাটের পক্ষে ছিলেন বহু হিন্দু এবং একজন পৌত্তলিকা পুজারী না-হয়ে তিনি অন্য একজন পৌত্তলিকা পুজো-বিরোধীকে কেন পৌত্তলিকা পূজারীদের কথা শুনে মারতে চাইছেন— এই প্রশ্ন তুলে গুরু গোবিন্দ সিংহ আওরঙ্গজেবকে ভৎর্সনা করেন। এ ছাড়াও মহারাষ্ট্রে শিবাজীর বিরুদ্ধে মোগল সম্রাট তাঁর সামরিক অভিযান চালান এবং পরবর্তীকালে শিবাজীর পুত্রকে হত্যা করেন। হয়তো-বা এই সব নিদর্শন তুলে আমাদের দেশের ব্রিটিশ শাসক ও হিন্দু ফ্যাসিবাদী শক্তি আরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করতে চায়, মুসলিমদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের মধ্যে ঘৃণা সৃষ্টি করতে। কিন্তু তাঁরা কেউ এ কথা বলে না যে, আরঙ্গজেবের সমস্ত সামরিক কর্মকাণ্ড ছিল রাজনৈতিক এবং এর সঙ্গে ধর্মের প্রচারের চেয়ে বেশি জরুরি ছিল তাঁর সাম্রাজ্য বাড়ানোর তাগিদ। যে তাগিদ সেই সময়ের সমস্ত রাজার মধ্যেই ছিল, কারণ সকলেই তাঁদের সাম্রাজ্যকে বিস্তার করতে চাইতেন। আওরঙ্গজেব মনে করতেন– “পিতা যদি কোনো কার্য সম্পন্ন করতে অসমর্থ হয়, তাহলে তাঁর পুত্রকে অবশ্যই সেই অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করতে হবে।”

মোগল শাসকদের দ্বারা ব্রিটিশরা ভয়ানকভাবে পর্যস্ত হয়েছিল। ব্রিটিশরা কোনোকালেই এই অপমান হজম করতে পারেনি এবং এর ফলে তাঁরা মোগল সাম্রাজ্যের ইতিহাসকে বিকৃত করে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার ঘৃণ্য কৌশল গ্রহণ করে। ভারতে ব্রিটিশরা তাঁদের ক্ষমতা কায়েম করতে দিল্লির মুসলিম সম্রাটের বিরুদ্ধে বিষ ছড়িয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের পরম বন্ধু সাজা ছাড়া আর কোনো সহজ পথ খোলা ছিল না। যার ফলে আজও শৈশব থেকে ইতিহাসের পাতায় আওরঙ্গজেব সম্পর্কে পক্ষপাতদুষ্ট নেতিবাচক শিক্ষাই দেওয়া হয় এবং কোনো ঐতিহাসিক এই নিয়ে বিশেষ উৎসাহে স্বাধীন গবেষণা করেন না তেমন। বেশিরভাগই গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসাতে ভালোবাসলেন। ব্রিটিশদের ফেলে যাওয়া শিক্ষাব্যবস্থা থেকে পাশ করে এই দেশের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ব্রিটিশ ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রতি এক বিশেষ ধরনের দুর্বলতা জন্মায়। তাঁরা ভাবে যে ব্রিটিশ ও আমেরিকানরা ভারতীয়দের থেকে অনেক শ্রেষ্ঠ এবং আমরা আজও অসভ্য। আমরাও চোখ বুজে ব্রিটিশদের দেবতার আসনে বসিয়ে দিয়েছি। আর তাই ট্রেনে-বাসে-ট্রামে-অফিসে-আদালতে এই আলোচনা অনেক শোনা যায় যে, ব্রিটিশরা থাকলে নাকি দেশের আরও অনেক উন্নতি হত! ব্রিটিশদের বাণী যেন বেদবাক্য।

‘The Times of India’-কে এলাহাবাদের সরবেস্বারি কলেজের বিশিষ্ট অধ্যাপক ও ঐতিহাসিক প্রদীপ কেশরবানি বললেন, আওরঙ্গজেব এরিলের সঙ্গম নদীর তীরে সোমেশ্বর মহাদেব মন্দিরের জন্যে এক বিশাল অঙ্কের টাকা ও একটা ভালো জায়গা অনুমোদন করেন। তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে তিনি কতকগুলি ঐতিহাসিক ঘটনাও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, এক মিলিটারি কাম্পেনের সময় আওরঙ্গজেব ও তাঁর সৈন্যরা ওই মন্দিরে পাশে বেশ কিছুদিন অবস্থান করেন। তিনি যে কয়দিন ছিলেন প্রতিদিন মন্দির শুধু দেখতেই আসতেন না, বরং মন্দির ভালোভাবে দেখাশুনা ও পরিচর্যা করার সমস্ত খরচখরচা দিতেন, এমনকি ভালো জমিও দান করেছেন। তিনি বলেন, এসমস্ত ঘটনা ওই মন্দির প্রাঙ্গণের ‘ধর্মদণ্ড’ নামে একটি ধর্মীয় পিলারের গায়ে উল্লেখ করা আছে। তিনি আরও জানান জাস্টিস সার নেতৃত্বে গঠিত কমিটির কাছে উজ্জয়নের মহা কালেশ্বর মন্দির, চিত্রকুটের বালাজী মন্দির, গুয়াহাটির উমানা মন্দির, সরঞ্জয়ের জৈন মন্দির এবং দক্ষিণ ভারতের বেশ কয়েকটি মন্দির কমিটির পক্ষ থেকে দেওয়া দস্তাবেজ থেকে জানা যায় আরঙ্গজেব ওইসব মন্দিরের জন্য বহু অর্থ দান করেছিলেন।

আওরঙ্গজেব ধর্মপ্রাণ ছিলেন একথা ঠিকই। কিন্তু অত্যাচারী ছিলেন একথা মোটেও সত্য নয়। আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব্রিটিশদের চক্রান্ত মিথ্যা ‘ইতিহাস’ লিখিয়েছে কিছু পেটোয়া ‘ঐতিহাসিক’, প্রসাদ লাভের লোভের। প্রসাদ যে পাননি তা নয়, অনেকেই পেয়েছেন। ব্রিটিশদের এ ব্যাপারে কোনো কার্পণ্য ছিল না। তাবেদারদের খুব পছন্দ করত ব্রিটিশরা। কৌশল হল হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কে চির ধরিয়ে পাকা একটা উপনিবেশ গড়ার ষড়যন্ত্র। আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে হিন্দু-নিধনের গপ্পো সম্পূর্ণভাবে ব্রিটিশদের কল্পনাপ্রসূত। পার্সিভ্যাল স্পিয়ার মন্তব্য করেছেন –“আকবরের নীতির সঙ্গে আওরঙ্গজেবের নীতির যে পার্থক্য, তা হল, আওরঙ্গজেব সচেতনভাবে হিন্দুদের প্রতি সহিষ্ণুতা দেখাতেন না এবং তাঁদের কখনো সমমর্যাদা দিতেন না। কিন্তু তাঁর তথাকথিত মন্দিরের ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা হল একটি শত্রুভাবাপন্ন কিংবদন্তী, যা বারাণসীর মন্দিরের স্থানে মসজিদ নির্মাণের মতো দু একটি প্রক্ষিপ্ত ঘটনার উপর গড়ে উঠেছে।” গবেষক জাহিরউদ্দিন ফারুকি তাঁর গবেষণা গ্রন্থে আওরঙ্গজেবের ধর্মনীতির বিস্তৃত ব্যাখ্যা করেছেন। বলেছেন– (১) আওরঙ্গজেব হানিফার ইসলামি ব্যাখ্যার অনুরাগী ছিলেন। হানিফার মত অনুসারে মুসলিম রাষ্ট্রে অমুসলিমদের জীবন, ধর্ম ও সম্পত্তির নিরাপত্তার বিধান আছে। আওরঙ্গজেব সাধারণভাবে হিন্দু নির্যাতন নীতি মেনে নেন এরকম কোনো প্রমাণ নেই। (২) হানিফার নির্দেশ আছে যে, মুসলিম রাষ্ট্রে পুরোনো মন্দির থাকতে পারে, নতুন মন্দির নির্মাণ করা যাবে না। আওরঙ্গজেব তাঁর বারাণসী ফর্মানে স্পষ্ট নির্দেশ দেন যে, পুরোনো মন্দির অক্ষত থাকবে, নতুন মন্দির নির্মাণে অনুমতি দেওয়া হবে না। স্থানীয় কর্মচারীরা অতিরিক্ত উৎসাহবশত ও ধর্মীয় অনুদারতার জন্য পুরোনো মন্দির ধ্বংস করে দেয়। (৩) আওরঙ্গজেব তাঁর রাজত্বের প্রথম ১২ বছর কোনো গোঁড়া ধর্মীয় নীতি নেননি। তিনি তাঁর পূর্বপুরুষদের সহিষ্ণুতা ও সমদর্শী নীতি নিয়ে চলেন। কিন্তু তিনি লক্ষ করেন, এই নীতির সুযোগে এক শ্রেণির হিন্দু স্বাধিকার-প্রমত্ত হয়েছে এবং কেন্দ্রের মোগল শক্তিকে অমান্য করছে। গুজরাটে হিন্দুরা এই প্রদেশে মসজিদ নির্মাণে বাধা সৃষ্টি করে বলে “আদাব-ই আলম’ গিরি থেকে জানা যায়। এছাড়া দিল্লি ও আগ্রার সন্নিহিত অঞ্চলে সন্নামী বিদ্রোহ এবং রাজপুতদের সত্নামী সম্প্রদায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা সম্রাটের দৃষ্টি এড়ায়নি। এই পটভূমিকায় আওরঙ্গজেব হিন্দুদের বিদ্রোহী মনোভাব সংযত করার কথা ভাবতে থাকেন। ইতিমধ্যে দক্ষিণে শিবাজীর অভ্যুত্থান ও তাঁর হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংকল্প সম্রাটকে চমকিত করে।

আওরঙ্গজেব সাধারণভাবে হিন্দুবিদ্বেষী ছিলেন একথাও বলা যাচ্ছে না। কারণ বারাণসীর ব্রাহ্মণদের নিষ্কর জমি দেওয়ার জন্য রাজা রাম সিংহকে অনুমতি দেন। আওরঙ্গজেব কখনোই বলপূর্বক ধর্মান্তরকরণের চেষ্টা করেনি। এ ধরনের কাজ তিনি মোটেই সমর্থন করতেন না। আওরঙ্গজেবের অধীনে বহু হিন্দু চাকরি করতেন। তিনি হিন্দুদের সঙ্গে মুসলিম রাজস্ব কর্মচারী নিয়োগ করে রাজস্ব বিভাগে সমতা আনেন। কারণ হিন্দু কেরানিরা মুসলিম সেনা ও কর্মচারীদের বেতন দেওয়ার সময় বহু অসুবিধা সৃষ্টি করত। আওরঙ্গজেব তাঁর সরকারি পদ থেকে প্রকৃতপক্ষে আফগান বা পাঠানদের যতদূর সম্ভব বহিষ্কার করেন। আফগানদের বহিষ্কার করার পর তিনি রাজপুত, সৈয়দ ও মোগলদের সাহায্যে প্রশাসন চালু রেখেছিলেন। জয় সিংহ, রাম সিংহ প্রভৃতি হিন্দুরা তাঁর অধীনে উচ্চপদে ছিলেন। আকবরের আমলে হিন্দু মনসবদার ছিল ৩২ জন, জাহাঙ্গিরের আমলে ৫৬ জন, শাহজাহানের আমলে ১১০ জন এবং আরঙ্গজেবের আমলে ১০৪ জন।

আওরঙ্গজেবের জিজিয়া কর পুনঃপ্রবর্তন সম্পর্কে বিভিন্ন যুক্তি দেখানো হয়। আওরঙ্গজেবের সমালোচকরা এই কর স্থাপন করার মধ্যে তাঁর ধর্মান্ধতা দেখে। ব্রিটিশরা জিজিয়া করের ব্যাপারে ভুল ব্যখ্যা করে মুসলিমদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের বিরূপ মনোভাব তৈরি করেছে। বস্তুত জিজিয়ার হার ছিল খুবই কম এবং এটি দিতে প্রজাদের তেমন কষ্ট হত না। এমন কোনো ভয়ংকর ব্যাপার ছিল না। এমনকি এই কর কিস্তিতেও আদায় হত। জিজিয়া অ-মুসলিমদের ধর্মান্তরিত করার উদ্দেশ্যে প্রবর্তিত হয় একথা বলা চলে না। “জিজিয়া ইসলামি রাষ্ট্রে বসবাসকারী অ-মুসলিমদের জন্য এমন এক ব্যবস্থা যা তাঁদের জান, মাল, ইজ্জত আব্রুর নিরাপত্তা দেয়। এই ব্যবস্থা এতটাই সুন্দর যে, যে কেউ নিরপেক্ষভাবে জিজিয়া সম্পর্কে জানবে সেই এতে মুগ্ধ না-হয়ে পারবে না। জিজিয়া নিয়ে ইংরেজ ঐতিহাসিকদের মিথ্যাচারে পা দিয়ে অনেকেই এটাকে খুব খারাপ ব্যবস্থা এবং অ-মুসলিমদের উপর অত্যাচার বলে মেনে নিয়েছেন। এবং অনেকে এও মনে করেন যে জিজিয়া হল জবরদস্তি অ-মুসলিমদের মুসলিম করার জন্য। জিজিয়া নিয়ে কিছু বলার আগে গোয়েবলসের একটা বাণী শুনুন। তিনি বলেছেন, “একটা মিথ্যা কথা যদি বহুজনের কাছে বহুবার বলা যায় তাহলে সেটাই সত্যে পরিণত হয়ে যায়।” আর জিজিয়ার ব্যাপারটা নিয়েও ঠিক তাই হয়েছে ভারত তথা পাশ্চাত্যের দেশগুলিতে। তা ছাড়া করের অত্যাচারের কথা যদি বলতেই হয়, তাহলে মনে করুন ব্রিটিশ শাসনামলের করব্যবস্থার কথা। নানা প্রকারের কর শোধ দিতে গিয়ে মানুষ কত জেরবার হত মনে করুন। কর পরিশোধ করতে না-পারার অপরাধে প্রজাদের উপর কী পরিমাণে নিপীড়ন-নির্যাতন করা হত মনে করুন। জমিদার-নায়েবরা কর অনাদায়ে গরিবদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিত। সে সব কথা ভুলে গেলেন কীভাবে? স্বাধীন ভারতেও কত রকমের কর দিতে হয় প্রত্যক্ষ-পরোক্ষে, সেটা ভেবে দেখেছেন কী? জিএসটির জাঁতাকলে কে পড়েননি?

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “ভারতবর্ষের যে ইতিহাস আমরা পড়ি এবং মুখস্থ করে পরীক্ষা দিই, তা ভারতবর্ষের ইতিহাসের এক দুঃস্বপ্নের কাহিনি মাত্র। শ্রী রমেশ মজুমদার বলেছেন, “সাম্প্রতিককালে সরকারি নির্দেশমতো সত্যকে এবং ইতিহাস রচনাশৈলীর মৌলনীতিকে জলাঞ্জলি দিয়ে ইতিহাস রচনার প্রয়াসকে সমর্থন করা যায় না।… ইংরেজরা বুঝিয়েছিলেন ভারতে হিন্দু ও মুসলমান উভয়ই প্রধান জাতি। এরা সদ্ভাবে সম্মিলিত হয়ে থাকলে ইংরেজদের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা অসম্ভব হবে। অতএব যাতে হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে সর্বদা মনোমালিন্য, ঘৃণা, বিদ্বেষ, বিষাদ, বিচ্ছেদ লেগে থাকে এই দুরভিসন্ধির বশে তারা Divide and Rule এই ভেদনীতি অবলম্বন করেন। ইংরেজরা ভারতের স্কুল, কলেজে মুসলিম বিদ্বেষমূলক শিক্ষানীতি প্রবর্তন করেন।” জানি না ইংরেজদের লেখা ইতিহাসকে ফেলে কবে আমাদের স্কুল কলেজে সত্য ইতিহাস পড়ানো হবে। তবে আশার প্রদীপ এখনও নেভেনি। অনেক ঐতিহাসিক, সমাজসেবী, লেখকরা এই দাবি করছেন। নিজেরা সত্যটা তুলে ধরছেন। ভারতের জাতীয় প্রবাদ ‘সত্যমেব জয়তে’। যেদিন স্কুল-কলেজে সঠিক ইতিহাস পড়ানো হবে সেইদিনই এই প্রবাদের সঠিক সন্মান দেওয়া হবে। ঐতিহাসিক সখারাম গণেশ দেউস্কর বলেছেন– “ইংরেজ ঐতিহাসিকরা হিন্দু ছাত্রদিগের হৃদয়ে মুসলমান বিদ্বেষানল প্রজ্বলিত রাখিবার জন্য বিশেষ যত্ন সহকারে চেষ্টা করিয়াছেন। পরিতাপের বিষয় কোনো কোনো অদূরদর্শী হিন্দু লেখকগণ কাব্য-নাটিকাদিতে মুসলমান ভ্রাতাদিগের প্রতি অনর্থক মিথ্যাবাদ করিয়া ইংরেজদের উদ্দেশ্য সিদ্ধির বিষয়ে সহায়তা করিতেছেন।”

আওরঙ্গজেব কি জোর করে হিন্দুদেরকে মুসলিম করিয়েছিলেন? আওরঙ্গজেবের দীর্ঘ ৫০ বছরের শাসনকালে এ ধরনের অভিযোগের কোনো নথি পাওয়া যায় না। অন্তত আমি পাইনি বিভিন্ন দেশি-বিদেশি বইপত্র ঘেঁটে। হিন্দু ধরে ধরে মুসলিম বানানো সুযোগ পায়নি তা তো নয়। শিবাজীর পৌত্র শাহু দীর্ঘ ৮ বছর আওরঙ্গজেবের কারাগারে বন্দি ছিলেন এবং বন্দিদশা কাটানোর পর হিন্দু হিসাবেই নিজরাজ্যে ফিরেছিলেন। তাঁকে জোর করে গোরুর মাংস খাওয়ানোও হয়নি, খনাও করা হয়নি। শিবাজীও বন্দি ছিলেন আওরঙ্গজেবের কারাগারে।

আওরঙ্গজেব কি হিন্দুদের মন্দির ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন? নিরাপত্তা ও উন্নয়নের প্রশ্নে মন্দির, মসজিদ, আবাসস্থল সবই ভাঙা পড়ে। সব যুগেই ভাঙা পড়ে। কলকাতা বিমানবন্দরের সম্প্রসারণের সময় যশোর রোডের দু-পাশে কত মন্দির ভাঙা হয়েছিল সবাই নিশ্চয় জানেন। নিজের চোখে দেখেছি কল্যাণী স্টেশন সংলগ্ন একটি মন্দিরকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। সারা ভারবর্ষেই এমন ঘটে। সারা পৃথিবীতেই ঘটে। খালিস্তানি আন্দোলনের সময় খালিস্তানিরা অমৃতসরের পবিত্র স্বর্ণমন্দিরকে ঘাঁটি বানিয়েছিল, অস্ত্রাগার বানিয়েছিল। সেসময়কার ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধি স্বর্ণমন্দিরে সেনা ঢুকিয়ে ‘অপারেশন ব্লু স্টার’ করিয়ে মন্দির ক্ষতবিক্ষত করেছিল। স্বর্ণমন্দিরকে কবজা করে নিয়েছিল ভিন্দ্রানওয়ালে। কবজা মুক্ত করেন মেজর জেনারেল বরাড়।

যাই হোক, আওরঙ্গজেবকেও এরকম অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল সাম্রাজ্যের অভিভাবক হিসাবে। তাঁর সময়েও মুসলমান শাসক ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের উত্তেজিত করার উদ্দেশ্যে যে সমস্ত মন্দিরে পুরোহিত-ব্রাহ্মণরা ঘাঁটি করে প্রচারকার্য চালিয়েছিল, সেইসব মন্দির ভেঙে ফেলার আদেশ আওরঙ্গজেব অবশ্যই দিয়েছিল। কোনো উপাসনালয়কে কেউ বা কোনো গোষ্ঠী যদি কুচক্রী রাজনৈতিক কেন্দ্রে পরিণত করে ফেলে, সেগুলি খুঁড়িয়ে দেওয়ার প্রয়োজন হয় বইকি। হজরতবাল মসজিদের ভিতর যখন জঙ্গিরা আত্মগোপন করছিল, তখন কি ভারতীয় সেনারা গুলিগালা করেনি? প্রয়োজন হলে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হত সেই মসজিদ। এছাড়া সম্রাট আকবরের সময়ে যেসব মসজিদগুলি ভেঙে হিন্দুতুষ্টির জন্য মন্দির বানিয়েছিলেন, সেই মন্দিরগুলি ভেঙে পুনরায় মসজিদ বানিয়েছিলেন আওরঙ্গজেব। এই কারণ দুটি ছাড়া আওরঙ্গজেব কোনো মন্দির ভেঙে ফেলা তো দূরের কথা, স্পর্শ পর্যন্ত করেননি।

প্রিয় পাঠক, আপনি বলতেই পারেন আওরঙ্গজেব মুসলিম বলেই বিধর্মী হিন্দুদের মন্দির ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন। প্রয়োজন হলে মন্দির কেন মসজিদও ভেঙে ফেলেছে মুসলিম শাসকরা। আওরঙ্গজেব একজন নিষ্ঠাবান হানিফি মুসলিম, সমগ্র কোরান কণ্ঠস্থকারী। আওরঙ্গজেব কোরান ও হাদিসের বাইরে কোনো কিছুই ভাবতেন না। সেদিক দিয়ে বিচার করলে শুধুমাত্র হিন্দুদের মন্দির বলেই ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন, একথা বলা যায় না। কারণ কোরান ও হাদিসে বিধর্মীদের উপাসনাগৃহ ভেঙে দেওয়া সমর্থন করে না। যদি সমর্থন করত, তাহলে যে ভারতে এত এত প্রাচীন মন্দির আজও দেখতে পান, সেগুলি কি থাকার কথা? উল্টোদিকে হিন্দুরাজারাও প্রচুর মন্দির ভেঙে উড়িয়ে দিয়েছেন। হিন্দুরাজারা কেন অসংখ্য মন্দির ভেঙেছিলেন? কেন ব্রাহ্মণ্যবাদীরা বৌদ্ধদের মন্দির-বিহার ধ্বংস করেছিলেন? প্রশ্ন করতে হবে তো।

ভারতে হিন্দুরাজারাও তো কম মন্দির ধ্বংস করেনি। সম্রাট শশাঙ্ক, রাজা হর্ষ, পুষ্যমিত্র, অজাতশত্রু, রাজা সুভাতবর্মন, চন্দ্রগুপ্ত, হর্ষবর্ধন, দ্বিতীয় পুলকেশী, মহেন্দ্রবর্মা, রাজেন্দ্র চোল কর্তৃক ধ্বংসপ্রাপ্ত হিন্দু-বৌদ্ধ-জৈন মন্দিরগুলির ইতিহাস কেন কার্পেটের নীচে থাকবে? সুলতান মাহমুদ এবং মোহাম্মদ ঘোরির মধ্যবর্তী সময়ের মানুষ কাশ্মীররাজ হর্য। ১০৮৯ থেকে ১১০১ সাল পর্যন্ত তাঁর রাজত্বকাল। তিনি শুধু যে সুদর্শন ও শৌখিন মানুষ ছিলেন তা-ই নয়, তাঁরও আর অনেক গুণ ছিল। সঙ্গীত ও শিল্পরসিক, স্বয়ং কবি ও বহুভাষাবিদ। শুরুতে তিনি কৃতিত্বের সঙ্গেই রাজত্ব চালিয়েছেন। কিন্তু তারপর নানা বিতর্ক, ভুলভ্রান্তি এবং কুকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তাঁর পরিণতিও খুব করুণ। লন্ডনের ‘The Guardian’ পত্রিকায় একটি বইয়ের আলোচনা প্রসঙ্গে হর্ষ সম্পর্কে উইলিয়াম ডালরিমপলের মন্তব্য –“শুধু এই কাশ্মীরি রাজা একাই অন্তত চার হাজার বৌদ্ধ পুণ্যস্থান ধ্বংস করার জন্য দম্ভ করতেন।”

কাশ্মীরের ইতিহাসকার কলহনের পিতা চম্পক ছিলেন হর্ষের মন্ত্রী। কলহন তাঁর ভারত ইতিহাসের অমূল্য উপাদানসমৃদ্ধ বই ‘রাজতরঙ্গিনী’- তে হর্ষ সম্পর্কে লিখেছেন— শুধু বৌদ্ধধর্মীয় ইমারতই নয়, কোনো গ্রাম নগর বা শহরে এমন একটা মন্দির অবশিষ্ট ছিল না যার বিগ্রহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি ‘তুরস্ক রাজা হর্ষ দ্বারা। মন্দির আক্রমণকারী বলেই হয়তো কলহন তাঁকে ‘তুরস্ক রাজা’ আখ্যা দিয়েছিলেন। তবে অর্থসম্পদের জন্যই যে তিনি মন্দির আক্রমণ করতেন তা নয়, বিগ্রহও উঠিয়ে নিয়ে যেতেন। এই ধ্বংসাত্মক কাজ পরিচালনার জন্য বিশেষ কর্মচারী পদও ছিল তাঁর। পদটার নাম দিয়েছিলেন ‘দেবোৎপাটননায়ক। তাঁরা বিগ্রহ নিয়ে যেসব জঘন্য কাণ্ড করতেন, তা কোনো মুসলমান শাসক বা রাজকর্মচারীরাও ভাবতে পারেননি। কলহনই লিখে গিয়েছেন এসব। হর্ষ একা নন, ধর্মস্থান লুট এবং ধ্বংস করার জন্য হিন্দু রাজাদের মধ্যে দায়ী আরও কেউ কেউ। রাজপুত পিরমার বংশের শাসক সুভাতবৰ্মন গুজরাট আক্রমণকালে দাভোই এবং ক্যাম্বের বহু জৈন মন্দির লুট করেছেন। শৈবদের হাতেও বহু বৌদ্ধ ও জৈন মন্দিরের ক্ষতি হয় বা সেগুলি পরে শিব মন্দিরে রূপান্তরিত হয়েছে। দশম ও একাদশ শতকের চোল বংশের শৈব সম্রাট প্রথম রাজা চোল এবং তাঁর পৌত্র রাজাধিরাজ চোলের বিরুদ্ধেও ইতিহাসে অভিযোগ চালুক্য রাজ্যের জৈন মন্দির লুণ্ঠন ও ধ্বংসের। ভারতে মন্দির ধংসের ইতিহাস মুসলিম শাসনের আগে থেকেই চলে এসেছে। ষষ্ঠ শতকের আর-এক শৈব শাসক মিহিরকুল বৌদ্ধ বিহার ও স্তূপ ধ্বংস এবং বৌদ্ধ ভিক্ষুদের হত্যা করার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। এই বিষয়ে একটি গবেষণা হচ্ছে রিচার্ড এম, ইটনের ‘Temple desecration in Pre-modern India’। রিচার্ড এম, ইটনের আরও একটি গবেষণা পড়ে দেখতে পারেন— Temple desecration and Indo-Muslim States’। পরাজিত রাজার অঞ্চলের মন্দির ধ্বংস মুসলিম শাসকদের একচেটিয়া ছিল না। মুসলিম শাসনকালেই হিন্দুরাজারা একই কর্মকাণ্ডের সাক্ষর রেখেছেন সযত্নে। কখনো শত্রুতায়, কখনো ধনসম্পদের লোভে মন্দির লুঠ করতেন মুসলিম শাসকদের মতো হিন্দু রাজারাও। ৬৯৩ সালে চালুক্য রাজা উত্তর ভারতে অভিযান চালিয়ে পরাজিত রাজাদের মন্দির থেকে গঙ্গা ও যমুনার মূর্তি লুণ্ঠন করেন। অষ্টম শতকে পাণ্ড্য রাজা শ্রীবল্লভ সিংহলে আক্রমণ চালিয়ে রাজধানী থেকে একটি সোনার বুদ্ধমূর্তি লুণ্ঠন করেন। এই একই শতকে কাশ্মীরের রাজা ললিতাদিত্যের রাজ্যে আক্রমণ চালিয়ে পালরাজারা কাশ্মীরের রাজাদের রাষ্ট্রদেবতা রামস্বামী নামে বিষ্ণুমূর্তি ধ্বংস করে দেন। চোদ্দো শতকে ওড়িশার সূর্যবংশী গজপতি বংশের রাজা কপিলেন্দ্র তামিল রাজাদের দেশে অভিযান চালিয়ে বহু শৈব ও বৈষ্ণবদের মন্দির ধ্বংস করে দেয়। [ (১) Vinay lal in Religion and Gewalt: Conflicte, Rituale, Deutungen (English version) Ed. Kaspar von Greyerz und Kim Siebenhuner, Vandenhoeck & Ruprecht, Germany, 2006, p 70-71 (3) Abraham Eraly, The First Srping: The Golden Age of India, Penguin Books India, New Delhi, 2011, p. 735)]।

মুসলমান শাসকরা কেবল মন্দিরই ভাঙেননি, মসজিদও ভেঙেছেন। বিদ্বেষে নয়, প্রয়োজনে ভেঙেছেন। হিন্দুরা যেমন মন্দির ধ্বংস করেছে, ঠিক তেমনই মসদিজও ধ্বংস করেছে জরুরি হয়ে পড়লে। রাজপুত রাজা ভীম সিংহ আমেদাবাদের ৩০০ টি মসজিদ ধ্বংস করেছিলেন। এই ভীম সিংহই পরবর্তী সময়ে আওরঙ্গজেবের সেনাপতি হয়ে মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। চিতোরে রাণা কুম্ভের একটি শিলালেখে উত্তীর্ণ আছে, রাণা ফিরোজ শাহের মসজিদ ভেঙেছিলেন। মহিপাল লাহোর বিজয়ের সময় বহু মসজিদ গুঁড়িয়ে দিয়ে মন্দির নির্মাণ করেন। চান্দোরি, সারাংপুর, রণথম্ভোরে মসজিদ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল রাণা সঙ্গের সামন্ত রায় সেন। ১৮০৯ সালে কাশীতে প্রায় ৫০ টি মসজিদ ধ্বংস করে। শিখ বদন সিংয়ের নেতৃত্বে জাঠ গোষ্ঠীরা আগ্রায় বাড়িঘর, বাগিচা ও মসজিদ ধ্বংস করে দেয়। ১৯৯২ সালে ৫০০ বছরের প্রাচীন বাবর-ই-মসজিদ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল হিন্দুরাই।

তাঁরা জোর করে তলোয়ারের ফলায় ফেলে হিন্দুদেরকে মুসলিম করে দিয়েছিল। এ অভিযোগ বাস্তবিক হতে পারে? দু-একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা দিয়ে তো সামগ্রিক বিচার হয় না। যদি তাই-ই হত, তাহলে মুসলিমদের প্রায় হাজার বছরের শাসনে ভারতে একটাও হিন্দু অবশিষ্ট থাকত না। উল্টে হিন্দুরাই ভারতে ঈর্ষণীয়ভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ। অথচ হিন্দুরা কীভাবে বৌদ্ধদের ভারত থেকে উৎখাত করেছে, সে ইতিহাস বড়োই রোমহর্ষক। যে ধর্মের জন্ম এই ভারতে, সেই ধর্ম আজ দূরবীণেও খুঁজে পাওয়া যায় না। সেই ধর্মের নাম বৌদ্ধধর্ম। হিন্দুদের অত্যাচারে তাঁরা আজ ভারতে বিলুপ্তপ্রায়। তবে হিন্দুদের অত্যাচার না বলে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের অত্যাচার বলাই সমীচীন। আজ সারা ভারতে বৌদ্ধ মাত্র ০.৭ শতাংশ। এঁরা সকলেই ব্রাহ্মণ্যধর্ম থেকে ধর্মান্তরিত। বুদ্ধকে হিন্দুদের বিষ্ণুর দশমাবতারের একজন হিসাবে যুক্ত ও প্রচার করেও ধর্মান্তর ঠেকানো যায়নি। তবে এটাও ঠিক, সেসময় যদি ব্রাহ্মণ্যবাদীরা বৌদ্ধদের নিশ্চিহ্ন না করত, তাহলে আজ ভারত বৌদ্ধদের দেশই হত। কারণ ব্রাহ্মণ্যবাদীদের অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে সংখ্যাগরিষ্ঠ তথাকথিত নীচুজাতিদের কাছে বৌদ্ধধর্মই ছিল একমাত্র বিকল্প। বৌদ্ধদের শক্তি ক্রমশ কমে আসায় সেই অত্যাচারিত মানুষগুলো পরে ইসলাম ধর্মে এসে আশ্রয় নেয়। গ্রহণযোগ্যতাও ছিল যথেষ্ট।

হিন্দুরা বৌদ্ধদের সবকিছু আত্মসাৎ করে নিয়েছে, ধর্ম-কর্ম সব। ড. বরসম্বোধি ভিক্ষু লিখেছেন— “Puri Temple was a famous Buddhist monastery where Buddha’s tooth relic were preserved. At that time it used to call Dantapuri. Every they used to celebrate ‘Ratha Yatra’ in the name of Buddha, Dhamma and Sangha. They used to pulled Three Rathas. When Buddhism fell down and tooth relic removed to Sri Lanka then they omitted Danta and use only Puri. Instead of Buddha Dhamma and Sangha they started to pull three rathas in the name of Balaram, Subhadra and Jagannath.” এ বিষয়ে স্বামী বিবেকানন্দও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় লিখেছেন– “পুরীর জগন্নাথ মন্দির আসলে ছিল বৌদ্ধ মঠ। হিন্দুরা দখল করে নিয়েছে।..হিন্দুধর্মে দেবমন্দিরের তেমন প্রাধান্য নেই। যদি সব মন্দির ধ্বংস হয়ে যায়, তাতেও বিন্দুমাত্র ক্ষতি হবে না।” (বাণী ও রচনা, ৪র্থ খণ্ড, ১৭৩ পৃষ্ঠা)।

এখানেই শেষ নয় –(১) বৌদ্ধধর্মে চার ধাম বা চার পুণ্যস্থানের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। চার পুণ্যস্থান হল লুম্বিনী, বুদ্ধগয়া, সারনাথ ও কুশীনগর। বুদ্ধ ভিক্ষু-ভিক্ষুণী, উপাসক-উপাসিকা প্রত্যককে জীবনে একবার চার তীর্থস্থান দর্শনের নির্দেশ দিয়েছেন। বৌদ্ধধর্মের চার তীর্থকে নিজেদের কাল্পনিক দেবী-দেবতাদের মন্দিরে পরিবর্তন করে তাঁদের ধর্মের গুরুত্ব দিতে চার ধাম যাত্রা শুরু করেছে।(২) বর্তমানে যেখানে যেখানে ব্রাহ্মণদের কাল্পনিক দেব দেবীদের বড়ো বড়ো মন্দির আছে, সে সবের প্রত্যেকটিতে ছিল বৌদ্ধধর্ম শিক্ষার কেন্দ্র। যেমন— অযোধ্যা, কাশী, রামেশ্বরম, মথুরা, পুরী, তিরুপতি প্রভৃতি। বৌদ্ধধর্ম পতনের পর সমস্ত মন্দিরকে কবজা করে রূপ পরিবর্তন করে। আপনারা গিয়ে দেখতে পারেন বর্তমানে তিরুপতি বালাজী মন্দিরের মূর্তি স্বয়ং বুদ্ধমূর্তি। এ মন্দিরকে ব্রাহ্মণেরা দখল করে বুদ্ধকে আভূষণ ও কাপড় লাগিয়ে পৃথক নাম দিয়েছে। তিরুপতি যে বুদ্ধ মন্দির ছিল তার অকাট্য প্রমাণ দিয়েছেন ড. যমুনা দাস লিখিত তাঁর ‘Tirupati was a Buddhist Shrine’ বইতে। হিন্দুত্বের সর্বদেবতার আলয়ে গৌতম বুদ্ধকে বিষ্ণুর অবতার হিসেবে আত্মস্থ করে নেওয়া হয়।এটাই ছিল বুদ্ধের জন্মস্থানেই বৌদ্ধধর্মের কফিনে মারা শেষ পেরেক। আদিশঙ্কর, মাধবাচার্য ও রামানুজ প্রমুখ হিন্দু দার্শনিক ও ধর্মবেত্তাদের আবির্ভাবে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা নবপ্রাণ ফিরে পায় –আর সেইসঙ্গে ভারতবর্ষ থেকে বৌদ্ধবাদ দ্রুত হারিয়ে যেতে থাকে। আসলে অশোকের পরে ভারতবর্ষের অধিকাংশ শাসকরাই হিন্দুত্বকে আনুকুল্য দেখানোর পাশাপাশি বৌদ্ধদের প্রতি ছিলেন বৈরী– আর এ কারণেই ভারতবর্ষে বৌদ্ধদের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে থাকে। অনেক দিক থেকেই বৌদ্ধবাদ সার্বিক অর্থে ম্রিয়মান হয়ে আসছিল।

সপ্তম শতাব্দীর চৈনিক বৌদ্ধ পদব্রাজক হিউয়েন সাঙ ভ্রমণবৃত্তান্ত থেকে অনেক তথ্য জানা যায়। যদিও কিছু জায়গাতে বৌদ্ধদের সমৃদ্ধ হতে দেখেছেন, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তিনি বৌদ্ধবাদকে দেখেছেন জৈন ও ব্রাহ্মণ শক্তির কাছে পরাভূত মৃতপ্রায় সত্তা হিসেবে। চালুক্যদের রাজত্বকালে হিউয়েন সাঙ লিখেছেন, চালুক্যদের শাসনামলে অন্ধ্র আর পল্লব শাসকদের অনুকুল্যে গড়ে ওঠা অনেক বৌদ্ধ স্তূপ মন্দির পরিত্যাক্ত কিংবা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এই অঞ্চলগুলো বৈষ্ণব-পূর্ব চালুক্যদের শাসনাধীনে আসে, যাঁরা বৌদ্ধদের প্রতি বৈরী ছিলেন। হিউয়েন সাঙের বাংলা ভ্রমণকালে গোঁড়া হিন্দু শশাঙ্ক ছিলেন বাংলার শাসক। তিনি শশাঙ্ককে একজন বিষাক্ত গৌড় সাপ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন –যিনি বাংলার বৌদ্ধ স্তূপ-মন্দিরগুলো ধ্বংস করেন আর তার রাজ্যের একেক বৌদ্ধ। সন্তদের মাথার জন্যে একশো স্বর্ণমুদ্রা করে পুরস্কার ঘোষণা করেন। হিউয়েন সাঙ সহ অনেক বৌদ্ধ সূত্রগুলোতে থানেশ্বরের বৌদ্ধ রাজা রাজ্যবর্ধনের হত্যার জন্যে শশাঙ্ককে দায়ী করা হয়। হিউয়েন সাঙ লিখেছেন, বুদ্ধগয়ার বোধিবৃক্ষ কাটা ছাড়াও ওখানকার বৌদ্ধ মূর্তিগুলোকে শিবলিঙ্গ দ্বারা প্রতিস্থাপন করেন। সেনরাজাদের সময়ে শৈব হিন্দুরা পায় শাসকদের আনুকুল্য, আর ওইদিকে বৌদ্ধদের তিব্বতের দিকে ঠেলে সরিয়ে দেওয়া হয়। পুরাণ গ্রন্থগুলো নিয়ে সামান্য গবেষণা করলেই দেখা যায়, এই ব্রাহ্মণ্য আখ্যানগুলো কীভাবে বৌদ্ধদের প্রতি শ্লেষ আর অবর্ণনীয় ভাষিক বর্বরতায় পরিপূর্ণ, যেখানে বৌদ্ধদের ক্ষতিকর আর ভয়ানক হিসাবে চিত্রিত করা হয়েছে। অষ্টম শতকের বিখ্যাত ব্রাহ্মণ্যবাদী দার্শনিক শঙ্করাচার্য বুদ্ধকে ‘জনতার শত্রু’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

ব্রাহ্মণ্য ধর্মে এমন কিছু ছিল না যাকে নৈতিকতার আধারে বিচার করা যায়। তাঁরা সব কিছু বৌদ্ধদের কাছ থেকে। চুরি করে বা ধার করে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মোহর লাগিয়ে তা হিন্দু ধর্মরূপে প্রচার করে আসছে। এখানে আমি তার কয়েকটি মাত্র দৃষ্টান্ত দেব।

(১) গুরু পূর্ণিমা : গৌতম বুদ্ধ আষাঢ়ী পূর্ণিমার দিনে সারনাথে প্রথমবার পাঁচ জন ঋষি বা পরিব্রাজককে দীক্ষা দিয়েছিলেন। সেদিন তাঁরা বুদ্ধকে গুরু বলে স্বীকার করেছিলেন বলে আষাঢ়ী পূর্ণিমাকে গুরু পূর্ণিমা রূপে মান্য করে আসতেন। বৌদ্ধ পরম্পরায় তা অনুসরণ করে এ দিনে ভিক্ষুরা গুরু দর্শনে বা বুদ্ধ পূজায় আসতেন। বৌদ্ধধর্ম সমাপ্ত হলে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের টীকাদারেরা তা কবজা করে নিজেদের গুরু পুর্ণিমা চালু করে বসেন।

(২) কুম্ভমেলা : কুম্ভমেলার প্রবর্তন করেছিলেন বৌদ্ধ সম্রাট হর্ষবর্ধন (৬০৬-৬৪৭)। উদ্দেশ্য ছিল মেলা আয়োজন করে বুদ্ধের বিচার ধারাকে সর্বসাধারণের নিকট পৌঁছে দেওয়া। এ মেলাতে দূর-দুরান্ত থেকে বৌদ্ধভিক্ষু, শ্রমণ, রাজা, প্রজা ও সৈনিকেরা অংশগ্রহণ করতে আসতেন। বৌদ্ধধর্মের পতনের পর ব্রাহ্মণেরা অন্ধবিশ্বাস ঢুকিয়ে কাহিনি বানিয়ে তা কুম্ভমেলায় রূপ দেয়।

(৩) চারধাম যাত্রা : বৌদ্ধধর্মে চারধাম বা চার পুণ্যস্থানের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। চার পুণ্যস্থান হল লুম্বিনী, বুদ্ধগয়া, সারনাথ ও কুশীনগর। বুদ্ধ ভিক্ষু-ভিক্ষুণী, উপাসক-উপাসিকা প্ৰত্যককে জীবনে একবার চার তীর্থস্থান দর্শনের নির্দেশ দিয়েছেন। বৌদ্ধধর্মের চার তীর্থকে নিজেদের দেবী-দেবতাদের মন্দিরে পরিবর্তন করে তাঁদের ধর্মের গুরুত্ব। দিতে চার ধাম যাত্রা শুরু করেছে।

(৪) জাতককথা : জাতকের গল্পগুলো বৌদ্ধধর্মে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। জাতকের গল্পের দ্বারা বুদ্ধ বোধিসত্তের দশ পারমী অনুশীলনের বর্ণনা করে শ্রোতাদের বোঝাতেন। পরবর্তীকালে এই সমস্ত জাতককথা নানা দেশে নানাভাবে তাঁদের মতো করে সাজিয়ে কাহিনি রচনা করেছে। বৌদ্ধধর্মকে পতন করে ব্রাহ্মণেরা জাতকের গল্পকে ব্রাহ্মণ্যকরণ করে ব্রাহ্মণেরা নিজেদের ধর্মে আত্মসাৎ করে এবং জাতকের সঙ্গে কিছু মনগড়া কাল্পনিক মসলা মিশিয়ে ও ঐতিহাসিক বৌদ্ধ স্থলের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে রামায়ণ ও মহাভারত রচনা করেছে। এ সম্পর্কে ড. সুকুমার সেনের মত কিছু গবেষক ও বিশেষজ্ঞ লেখালেখি করলে কট্টর ব্রাহ্মণ্যবাদীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন।

(৫) বিজয়া দশমী বা দশহরা : খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে সম্রাট অশোক ভয়ানক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে কলিঙ্গ বিজয় করার পর আশ্বিন দশমীর দিনে বৌদ্ধধর্মকে আলিঙ্গন করেছিলেন। এ দিন অশোক বিজয়া দশমী নামে প্রসিদ্ধ ছিল। এদিনে ব্রাহ্মণ সেনাপতি পুষ্যমিত্র শুঙ্গ মৌর্যবংশের দশম রাজা বৃহদ্রথ মৌর্যকে হত্যা করেছিলেন। মৌর্য সম্রাটেরা দশ পারমিতা পালন করতেন। বৃহদ্রথকে হত্যার মাধ্যমে মৌর্যবংশের দশ রাজার শাসনের অবসানের প্রতীকরূপে ব্রাহ্মণেরা এ দিন দশমুণ্ড রাবণের দহন প্রথা চালু করে দশহরা পালন শুরু করে। বৌদ্ধধর্ম সমাপ্ত করে ব্রাহ্মণেরা এ দিনে রামায়ণের রাম-রাবণের কাহিনি জুড়ে দশহরা বানিয়ে দেয়। তুলসীদাসের রামচরিতমানস অনুসারে রাবণ চৈত্র মাসেই মারা যান। আশ্বিন মাসে নয়।

(৬) দীপাবলি উৎসব : সম্রাট অশোক সমগ্র ভারতবর্ষে ৮৪০০০ বৌদ্ধ স্তূপ ও বিহার নির্মাণ করিয়েছিলেন। এ সমস্ত স্কুপ ও বিহার নির্মাণের পর সেগুলোর উঘাটন ও উৎসর্গ অনুষ্ঠান কার্তিক অমাবস্যায় করেছিলেন। অনুষ্ঠান উপলক্ষে সমগ্র জম্বুদীপ (ভারত) ব্যাপী দীপ জালিয়ে আলোকোৎসব করেছিলেন এবং তা স্মরণীয় করে রাখার জন্য প্রতিবছর দীপদানোৎসব’ নামে পালন করা হত। সমস্ত চৈত্যসমূহ কেবল ভারতেই প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এ দীপ দানোৎসব ভারতেই সীমাবদ্ধ ছিল। বৌদ্ধ রাজত্ব ধ্বংসের পরে ব্রাহ্মণেরা তাঁদের ধর্মের সঙ্গে জুড়ে দিতে রামায়ণের রামের সংযুক্তিকরণ করে দীপাবলি উৎসব পালনের রেওয়াজ করে।

(৭) লিঙ্গ-যোনি পুজো : পুষ্যমিত্র শুঙ্গের পতনের পরে প্রথম শতাব্দীতে বৌদ্ধধর্মের দুর্দশা শুরু হয়। ব্রাহ্মণেরা ভিক্ষুদের সঙ্গে তর্ক করতে বলত ঈশ্বর আছে যিনি সৃষ্টি করেছেন। তোমাদেরকেও ঈশ্বরই বানিয়েছেন। বৌদ্ধভিক্ষুরা ব্রাহ্মণদের বলতেন ঈশ্বর হল কল্পনামাত্র। মনুষ্য লিঙ্গ-যোনীর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্টি হয়েছে এবং ইহা প্রাকৃতিক পদ্ধতি। ব্রাহ্মণেরা প্রতিক্রিয়া স্বরূপ নিজেদের শক্তি বলে ভিক্ষুদেরকে লিঙ্গ-যোনি মূর্তি বানিয়ে পুজো করতে বাধ্য করেছিলেন। পরে এটাকে মনগড়া কাহিনি বানিয়ে পুরাণের শিবের সঙ্গে জুড়ে দেন। এবং পরবর্তীকালে মানুষ লিঙ্গ-যোনিকে শিবলিঙ্গ বলে পুজো চালু করে।

ব্রাহ্মণ্যবাদীরা যেভাবে বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে লড়াই করে বৌদ্ধধর্ম ধ্বংস করেছে, সেইভাবে ইসলাম ধর্ম তথা মুসলিমদের বিরুদ্ধে লড়াই দিতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। তার কারণ বৌদ্ধরা অহিংসায় বিশ্বাসী। প্রাণীহত্যা তাঁরা পাপ করতেন, এখনও করেন। সেই কারণে বৌদ্ধরা ব্রাহ্মণ্যবাদীদের বিরুদ্ধে পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। ভারত থেকে বৌদ্ধধর্মের ধ্বংসের কারণ অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম। এই ব্রাহ্মণ্যবাদীরাই মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে একেবারেই লড়াই দিতে পারেনি। কারণ মুসলিম শাসকরা ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ যুদ্ধবাজ এবং অবশ্যই নিষ্ঠুর। উল্টে মার খাওয়ার ভয়ে হিন্দুরা মুসলিম শাসকদের কাছে আত্মসমর্পণ করে বসে। মুসলিম শাসকদের সঙ্গে মিশে গিয়ে চাকরিবাকরি করতে শুরু করে দিলেন। তারপর প্রায় হাজার বছর ভারতে মুসলিম শাসনে কোনো হিন্দু রাজা বা শাসক মাথা তুলতেই পারল না। একেই বোধহয় বলে নরম মাটি যেখানে খড়ম ভাঙে সেখানে। সমগ্র ভারত উপমহাদেশ জুড়ে মুসলিমরা শাসন করে গেল নিশ্চিন্তে। এই হাজার বছরে একটা বিপ্লবীরও আবির্ভাব হয়নি। নিশ্চয় প্রয়োজন হয়নি। শুধু তাই নয়, ভারত থেকে চার্বাক মতবাদীরাও বিলুপ্ত হয়ে গেছে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের অত্যাচারে।

চার্বাক দার্শনিকদের মতবাদ ছিল ব্রাহ্মণ্যবাদের বিপরীত। এটি মূলত অধ্যাত্মবাদবিরোধী নিরীশ্বরবাদী ও বস্তুবাদী দর্শন। চার্বাক দর্শনের প্রভাব বুদ্ধের সময় ও প্রাক-বুদ্ধ যুগে উপস্থিত ছিল বলে অনেকে মনে করে থাকেন। চার্বাক দর্শনের সূত্রগুলির রচয়িতা রচয়িতা হিসাবে দেবগুরু বৃহস্পতির নাম উল্লেখ আছে। চার্বাকরা বেদ স্বীকার করত না। তাঁদের মতে বেদ অপৌরুষেয় নয়। যাঁরা বেদকে নিত্য বলেন, তাঁদের যুক্তি হল— যেহেতু বেদস্রষ্টাকে আমরা স্মরণ করতে পারি না, কাজেই তা অপৌরুষেয়। কিন্তু চার্বাকরা বলেন, কোনো কিছুর স্রষ্টাকে স্মরণে না আনতে পারলে প্রমাণিত হয় না যে সে বস্তুটি নিত্য। প্রাচীনকালের অনেক কূপ বা মন্দিরের স্রষ্টাকে স্মরণ করতে না পারলেও প্রমাণিত হয় না যে তা নিত্য বা কোনো পুরুষসৃষ্ট নয়। চার্বাকমতে বেদ হল ধূর্ত এবং ভণ্ড ব্রাক্ষণদের সৃষ্টি। এটি কেবল তাঁদের স্বার্থসিদ্ধির প্রচেষ্টামাত্র, যার কোনো ব্যাবহারিক উপযোগিতা নেই। তাঁরা বলেন, চতুর ব্রাহ্মণরা নিজেরা বেদে বিশ্বাস করেন না, কিন্তু যজমানকে বিশ্বাস করতে বলেন। তাঁদের যুক্তি– বেদে কথিত জ্যোতিষ্ঠিক যজ্ঞে পশুবলি দিলে সেই পশুর স্বর্গলাভ হয়– ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা একথা সত্য মনে করলে যজ্ঞে পশুবলির পরিবর্তে তাঁদের বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে বলি দিতেন, কারণ স্বর্গলাভই তো তাঁদের জীবনের লক্ষ্য। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। সুতরাং ব্রাহ্মণরা কেবল আত্মস্বার্থ রক্ষার্থে বেদ প্রচার করেন, যা প্রতারণা বই অন্য কিছু নয়। চার্বাকরা বলেন, বেদ অশ্লীল এবং অর্থহীন শব্দে পূর্ণ। অশ্বমেধ যজ্ঞের মন্ত্র এত অশ্লীল যে-কোনো রুচিসম্পন্ন ব্যক্তির পাঠের অযোগ্য। বেদে গো-জাতিকে মনুষ্য জাতি অপেক্ষা উন্নত বলা হয়েছে। চার্বাকমতে কেবল নপুংসকরাই বেদে বিশ্বাস করে। ভারতীয় অধ্যাত্মবাদের বিপরীতে চার্বাকদের আর-এক জোরালো মত হল দেহাত্মবাদ। অধ্যাত্মবাদীদের মতে দেহের মৃত্যু হয়, কিন্তু আত্মার জন্ম-মৃত্যু নেই –আত্মা শাশ্বত। চার্বাকরা আত্মার অস্তিত্বই স্বীকার করেন না, কারণ দেহ ব্যতীত আত্মা সত্তাহীন এবং আত্মা প্রত্যক্ষগোচর নয়। প্রত্যক্ষের বিষয় নয় বলে চার্বাকগণ ঈশ্বরের সত্তা স্বীকার করেন না। যা কিছু অতীন্দ্রিয়, প্রত্যক্ষবাদী চার্বাকদের কাছে তা অসৎ। তাঁরা বলেন, দুঃখ-কষ্ট জর্জরিত জগতের কারণরূপে ‘অসীম করুণাময়’ ঈশ্বরের অস্তিত্ব মানা যায় না।

একটু বিবেচনা করলে স্বীকার করে নিতেই হয়, আজ থেকে দু-আড়াই হাজার বছর আগের কিছু চিন্তাবিদ কী অসাধারণ বিপ্লবাত্মক চিন্তায় পৌঁছেছিলেন যে, সব কিছুই মৌলিক পদার্থের সমন্বয়ে গঠিত এবং মৃত্যুর পর মৃতদেহ মৌলিক পদার্থে বিলীন হয়ে যায়। দেহাতীত আত্মা বলে কিছু নেই। এমন চিন্তা মানুষের মাথায় এসেছিল সম্ভবত মৃত্যুর পর দেহের পরিণতি দেখে, অস্ত্র ও তৈজস্পত্রের ভঙ্গুরতা দেখে। মৃতদেহকে পচে-গলে মাটিতে মিশে যেতে দেখে, পুড়ে ছাই হয়ে শেষ হয়ে যেতে দেখে। অনুমান করে বলা যেতে পারে, তাদের এসব প্রত্যক্ষ প্রমাণ চতুর্ভূত বা পঞ্চভূত তত্ত্বে পৌঁছে দিয়েছিল। তাঁরা বলেন, ঈশ্বর প্রকল্পের মাধ্যমে ভণ্ড ও ধূর্ত ব্রাহ্মণেরা অজ্ঞ জনসাধারণকে প্রতারিত করে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। চার্বাক দর্শনে আত্মা বা চৈতন্যকে দেহধর্ম বলে বর্ণনা করা হয়েছে। আর এই বক্তব্যই ভাববাদী দার্শনিকের কাছে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বস্তুবাদী চার্বাক দর্শনের সঙ্গে ভাববাদী দর্শনের। সুদীর্ঘ লড়াই চলেছিল শুধুমাত্র আত্মা ‘অমর’ কি ‘মরণশীল’ এই নিয়ে।

এহেন মতবাদে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের ক্ষেপে যাওয়াটা স্বাভাবিক। এই চার্বাক দর্শন যদি একবার ভারত উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়তে পারত, তাহলে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা ভাতে মারা যেত। তাই এহেন মতবাদের বিনাশ অবশ্যই কাম্য হয়ে ওঠে। সেই কারণেই রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণাদিতে চার্বাকদের প্রচুর গালি দেওয়া হয়েছে। পালি সাহিত্য বিষয়ে সুপণ্ডিত রিস দেভিডস (Rhys Davids)-এর মতে মহাভারতের এক কুচরিত্র রাক্ষস চার্বাকের নাম থেকেই ভাববাদীরা বস্তুবাদী মতবাদটির নাম রাখেন চার্বাক দর্শন। মহাভারতে আছে, চার্বাক ছিল দুর্যোধনের বন্ধু আর-এক দুরাত্মা। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ-বিজয়ী ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে ব্রাহ্মণ ছদ্মবেশধারী চার্বাক জ্ঞাতিঘাতী হিসাবে ধিক্কার জানিয়ে আত্মঘাতী হতে প্ররোচিত করেছিল। কিন্তু উপস্থিত ব্রাহ্মণরা তাঁদের অতীন্দ্রিয় ক্ষমতায় চার্বাকের আসল পরিচয় জেনে ফেলে এবং যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা করেন। পাঠকগণ, বুঝতেই পারছেন, প্রাচীন ভাববাদীরা বস্তুবাদী মতবাদটির প্রতি মানুষের অশ্রদ্ধা ও ঘৃণা সৃষ্টির জন্যই এমন এক ঘৃণ্য রাক্ষস চরিত্রের নামে মতবাদটির নাম রেখেছিলেন। সে যুগের কিছু ভাববাদী চার্বাক বা লোকায়ত মতবাদকে দেবগুরু বৃহস্পতি প্রণীত বলে উল্লেখ করেছেন। পুরাণে আছে, অসুরদের পরাক্রমে বিধ্বস্ত দেবকুলকে রক্ষা করতে এক কৌশল অবলম্বন করেছিলেন দেবগুরু বৃহস্পতি। অসুরদের ধ্বংসের জন্য, অধঃপাতে নিয়ে যাওয়ার জন্য এই ভ্রান্ত মতবাদ রচনা করলেন। তারপর অসুরের ছদ্মবেশে অসুরদের মধ্যে বস্তুবাদী দর্শনটি প্রচার করলেন। ফলে নীতিভ্রষ্ট, ভ্রান্ত অসুররা দেবতাদের কাছে পরাজিত হল। এখানেও আমরা দেখতে পাচ্ছি, বস্তুবাদী চার্বাক মতবাদই অসুরদের ধ্বংসের কারণ হয়েছিল— এই রকম প্রচারের মধ্য দিয়ে বস্তুবাদী দর্শনের প্রতি আতঙ্ক এবং বিদ্বেষ সৃষ্টির চেষ্টা স্পষ্ট। শঙ্করাচার্য প্রমুখ ভাববাদী দার্শনিকেরা এই মতবাদকে ‘লোকায়ত’ নামে অবহিত করার কারণ হিসাবে জানিয়েছেন, দর্শনটি ইতর লোকের দর্শন, তাই ‘লোকায়ত দর্শন। এখানেও দার্শনিকদের লোকায়ত মতবাদের প্রতি অশ্রদ্ধা স্পষ্ট।

সাধারণ মানুষের মধ্যে যুক্তিবাদী চিন্তার বিরুদ্ধে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে রামায়ণ, মহাভারত’-এর মতো মহাকাব্যগুলোতেও ঢুকে পড়েছে অনেক নিন্দাজনক কাহিনি। রামায়ণের অযযাদ্ধাকাণ্ড পড়ন। রামচন্দ্র তখন চিত্রকূটে। ভরত এলেন। রামচন্দ্র ভরতকে রাজ্য-পরিচালন বিষয়ে উপদেশ দিতে গিয়ে বললেন– “ক্বচিন্ন লোকায়তিকান্ ব্রাহ্মণাংস্তাত সেবসে।/অনর্থকুশলা হতে বালাঃ পণ্ডিতমানিনঃ।” অর্থাৎ, “আশা করি তুমি লোকায়তিক ব্রাহ্মণদের সেবা করছ না। ওরা অনর্থ ঘটাতে খুবই পটু।” মহাভারতের শান্তিপর্বে পাচ্ছি এক ধনী বণিক রথে যাওয়ার সময় এক ব্রাহ্মণকে ধাক্কা মারে। ক্ষুব্ধ ব্রাহ্মণ অপমানের জ্বালা ভুলতে আত্মহত্যা কথা চিন্তা করে। দেবরাজ ইন্দ্র ব্রাহ্মণের আত্মহত্যার মধ্যে সর্বনাশের সংকেত দেখতে পেয়ে শিয়াল সেজে হাজির হলেন। ব্রাহ্মণকে পশুজীবনের বহু কষ্টের কথা বলে মানবজীবনের জয়গান গাইলেন। জানালেন, অনেক জন্মের পর পুণ্যের ফল সঞ্চয় করে এই মানবজন্ম পাওয়া। এমন মহার্ঘতম মানবজীবন, বিশেষত শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসাবে ব্রাহ্মণ হয়েই জন্মলাভের পরেও কেউ কি পারে সেই জীবন ধ্বংস করতে? অভিমানে আত্মহত্যা করা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ। নয়। শিয়াল, সে নিজেও আগের জন্মে ব্রাহ্মণ হয়েই জন্মেছিল। কিন্তু সে জন্মে চূড়ান্ত মূর্খের মতো এক মহাপাতকের কাজ করেছিল বলেই আজ এই শিয়ালের জন্ম।

চূড়ান্ত মূর্খের মত কাজটা কী?— “অহমাংস পণ্ডিতকো হৈতুকো দেবনিন্দকঃ।/আম্বীক্ষিকীং তর্কবিদ্যম্ অনুরক্তো নিরার্থিকাম।/হেতুবাদা প্রবদিতা বক্তা সুংসসু হেতুমৎ।/আক্রোষ্টা চ অভিবক্তা চ ব্রাহ্মবাক্যেষু চ স্বিজান। /নাস্তিকঃ সর্বশঙ্কী চ মূখঃ পণ্ডিতমানিকঃ 1/ভাস্য ইয়ং ফলনিবৃত্তিঃ শৃগালত্বং মম দ্বিজ। (শান্তিপর্ব- ১৮০/৪৭ ৪৯) অর্থাৎ, আমি ছিলাম এক বেদ-সমালোচক তার্কিক পণ্ডিত। নিরর্থক তর্কবিদ্যায় ছিলাম অনুরক্ত। বিচারসভায় ছিলাম তর্কবিদ্যার প্রবক্তা। যুক্তিবলে দ্বিজদের ব্রহ্মবিদ্যার বিরুদ্ধে আক্রোশ মেটাতাম। ছিলাম জিজ্ঞাসু মনের নাস্তিক। অর্থাৎ কিনা পাণ্ডিত্যভিমানী মূর্খ। হে ব্রাহ্মণ, তারই ফলস্বরূপ আমার এই শিয়ালজন্মও। এখানেও চার্বাকদের বিরুদ্ধে ইঙ্গিত।

ব্রাহ্মণ্যবাদীদের অদম্য প্রচেষ্টায় এরপর এমন একটা সময় এলো যখন শোষিত সাধারণ মানুষদের উপকারের জন্য চার্বাক দর্শন আত্মাবাদ ও ঈশ্বরবাদকে শাণিত যুক্তিতে খণ্ডন করছিল, সেই শোষিত সাধারণ মানুষই একসময় চার্বাক দর্শনকে এক নীতিহীন দর্শন বলে দূরে ঠেলে দিয়েছিল। এমনকি ‘চার্বাক’ শব্দটিকে লোকে গালাগাল বলেই ভাবতে শুরু করেছিল। আনন্দবাজার পত্রিকায় (৩১ মার্চ ২০১২) চিরদীপ উপাধ্যায় লিখেছেন– “চার্বাক বা লোকায়ত দর্শনের প্রবক্তারাও, অন্তত তাঁদের অধিকাংশই পুরুষ ছিলেন। তাঁদের লেখালিখিও বেবাক লোপাট হয়ে গিয়েছে। তাঁদের বস্তুবাদী দর্শনের প্রতি পরবর্তী কালের দাপুটে ভাববাদীদের ভয়ানক বিরাগ ছিল। গভীর আশঙ্কাও ছিল পরলোকের চিন্তা না করে ঋণং কৃত্বা ঘৃত পানের চার্বাকবচন কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিলে কে আর বেদ বেদাঙ্গ বেদান্তের পরোয়া করবে? অতএব যেখানে চার্বাক দর্শনের পুঁথিপত্র দেখবে, ধ্বংস করে দাও। ক্রমে ক্রমে সব শেষ হয়ে গেল। এবং হল না। চার্বাক মতের বিরোধীরা বস্তুবাদকে খণ্ডন করতে বসে বিধি অনুসারে প্রথমে সেই প্রতিপক্ষীয় তত্ত্বের সারকথাটা বলে নিতেন, তারপর নিজেদের তত্ত্ব দিয়ে সে মত খণ্ডন করতেন। এ দিক থেকে মহামূল্যবান একটি আকরগ্রন্থ হল মাধবাচার্যের সর্বদর্শনসংগ্রহ। চতুর্দশ শতাব্দীতে প্রণীত এই গ্রন্থে বেদান্তবাদী পণ্ডিত চার্বাকদর্শনের সারাৎসার লিপিবদ্ধ করেছিলেন, অতঃপর খণ্ডন। এই ভাবেই বিরোধীদের লেখায় চার্বাক দর্শন থেকে গেল। ভাগ্যিস সে কালের তার্কিকরা এ কালের মতো ছিলেন না, তা হলে কেবল নিজেদের মতই লিখতেন, বিপক্ষের অভিমত নথিভুক্ত করার কোনো চেষ্টাই করতেন না। আমরা চার্বাক নামটাও জানতে পারতাম না। ছাপাখানা আসার আগে পুঁথিপত্র হারিয়ে ফেলার আশঙ্কা স্বভাবতই বিপুল ছিল। এ বিষয়েও কোনো সন্দেহ নেই যে যাঁদের বই হারিয়ে গিয়েছে বলে আমরা জানি বা অনুমান করি, তাঁরা নিতান্তই সংখ্যালঘু, আরও অগণিত লেখা নেই হয়ে গিয়েছে, যার কথা আমরা জানিই না, জানবও না কোনও দিন।”

মুসলিম শাসকরা মন্দির ভাঙেননি, একথা নিশ্চয় মুসলমানও অস্বীকার করবেন না। অস্বীকার করার কথাও নয়। মন্দির ধ্বংস করেছিল নানা কারণে। বরং বলা ভালো করতে হয়েছিল। মূলত বেশিরভাগ মন্দির ধ্বংস হয়েছিল সামরিক অভিযানের ফলে। সামরিক অভিযানের ফলে মন্দির শুধু নয় হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ সবই ধ্বংস হয়। সামরিক মানুষের যেমন মৃত্যু হয়, তেমনি প্রচুর অসামরিক মানুষেরও মৃত্যু হয়। ধর্মবিদ্বেষ থেকে মন্দির ভাঙা হয়েছে এমন কোনো নথি পাওয়া যায় না। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের দেশে ধর্মবিদ্বেষী হয়ে কোনো মন্দির ভেঙে মুসলিম শাসক রেহাই পেত? গণ-অভ্যুত্থান ঘটে যেত না! মন্দির গুঁড়িয়ে দিয়ে, হিন্দুদের কুপিয়ে দিয়ে প্রায় ১০০০ বছর তাঁরা ভারত শাসন করতে পারত? মুসলমান শাসকরা যেখানে ভারত উপমহাদেশের বিস্তৃত অংশ শাসন করেছে দীর্ঘ ১০০০ বছর, সেখানে ব্রিটিশরা আংশিক ভারত শাসন করে মাত্র ১৫০ বছরেই ভারত ছেড়ে পালাতে হল। যাই হোক, মন্দির ধ্বংস হওয়ার আর-একটি অন্যতম কারণ মূল্যবান ধনসম্পদ। তকালে হিন্দু মন্দিরগুলোতে প্রচুর ধনরত্ন মজুত থাকত (মনে রাখতে হবে তখনকার সময়ে ব্যাংক ছিল না। এখন যেমন মন্দিরের সমস্ত ব্যাংকে গচ্ছিত রাখা হয়, তখন সে উপায় ছিল না। তাই মন্দিরের অভ্যন্তরেই মজুত রাখতে হত। মন্দিরের ভিতরে গোপন সুড়ঙ্গ ও মাটির নিচে গর্ত খুঁড়ে রাখা হত।)। আজও থাকে। যেমন সোমনাথের মন্দির। সোমনাথের মন্দির ছাড়াও বহু মন্দিরের ধনসম্পদ লুণ্ঠন করেছে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে। মন্দির অপবিত্র হলেও ভাঙা হয়। যেমন কাশীর বিশ্বনাথের মন্দির। যে হিন্দুরাজার স্ত্রীকে পুরোহিত মন্দিরের গর্ভগৃহে ধর্ষণ করেছিল, সেই হিন্দুরাজার নির্দেশেই আওরঙ্গজের মন্দির ভেঙে পুনর্নির্মাণ করেছিলেন। কিছু কিছু মন্দিরকে দুর্গ হিসাবেও ব্যবহার করতেন হিন্দুরাজারা। মজুত থাকত অস্ত্রশস্ত্র আর সেনা। ঠিক যেমন পাঞ্জাবের পবিত্র শিখ উপাসনাগৃহ অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির। খালিস্তানিরা এই স্বর্ণমন্দিরকে দুর্গ হিসাবে ব্যবহার করেছিল। প্রচুর অস্ত্র মজুত করে রাখা হয়েছিল। খালিস্তানি জঙ্গিরা এই মন্দিরেই আস্তানা গেড়েছিল। অপারেশন ব্লু স্টার’ করে খালিস্তানি জঙ্গিদের মোকাবিলা করা হয়েছিল। মূলত শিখমন্দির ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতেই ভারতীয় সেনাবহিনী ১০৫ মিমি অতি শক্তিশালী বিস্ফোরক স্কোয়াশ হেড শেল বিশিষ্ট ট্যাংক এগিয়ে গিয়েছিল। প্রায় ৫০০ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে খালিস্তানিদের উচিত জবাব দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। বলা হয়, এই কারণেই তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির মৃত্যু হয়েছিল শিখদের হাতেই। তবে কিছু দুষ্ট মুসলিম শাসকও ছিলেন, যাঁরা মন্দির ভেঙে মসজিদ বানিয়েছেন। যেমন –উজ্জয়িনীর মহাকাল মন্দির ধ্বংস এবং আজমিরে বিগ্রহ পালের বিদ্যালয়কে মসজিদে রূপান্তরিত করেছিলেন ইলতুৎমিস। দিল্লির কাওয়াতুল মসজিদও হিন্দু মন্দিরের ইট-পাথর দিয়ে তৈরি। বাদাউনে ইলতুৎমিসের মসজিদও মন্দির থেকে রূপান্তর। বহু মন্দির, মঠ প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে ধ্বংস হয়ে গেছে। আজও সারা ভারত ঘুরলে এরকম শত সহস্র পরিত্যক্ত ক্ষয়িষ্ণু মন্দির দেখা যাবে।

আজকে এমনই এক মানুষের কথা তুলে ধরব, যার গুরুত্ব বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে অভাবনীয়।বর্তমান ভারতে যখন চারপাশে মন্দির-মসজিদ নিয়ে চলছে ভয়াবহ অস্থিরতা ও অসহিষ্ণুতা, তখন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক নাম ইয়াসিন পাঠান। মুসলমান যুবক ইয়াসিন পাঠান। ইয়াসিন পাঠান এক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হয়েও যেভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের মন্দিরগুলিকে সংরক্ষণ করার জন্য তাঁর জীবনের অধিকতর সময় ব্যয় করে চলেছেন, তা সমগ্র ভারতবাসীর কাছে এক অভিনব দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। আসুন, একটু বিস্তারে যাই।

মোগল আমলে ১৭৩২ সালে বাংলা-বিহার-ওড়িশার নবাব আলিবর্দি খাঁ জনৈক বিদ্যানন্দ ঘোষালকে তল্কালীন রত্নচক পরগনায় খাজনা আদায়ের উদ্দেশ্যে তহশিলদার নিয়োগ করেন। বিদ্যানন্দ ঘোষাল ক্রমেই নিজগুণে বিশাল ধনাঢ্য ব্যক্তি হয়ে ফুলেফেঁপে উঠতে লাগলেন এবং ক্রমশ দেবসেবার জন্য অনেক মন্দির তৈরি করতে লাগলেন। বেশ সুখেই কাটছিল দিন; কিন্তু সুখ কোনো মানুষের কপালেই বেশিদিন টেকে না। নবাব তাঁর উপর ক্রুদ্ধ হলেন। নবাব আলিবর্দির বিষনজরে কেন পড়লেন কে জানে! মুর্শিদাবাদের দরবারে উপঢৌকন পৌঁছে দেওয়াতে গাফিলতি হয়েছিল। নবাব শাস্তির হুকুম দিলেন, হাতির পায়ের নিচে ফেলে বিদ্যানন্দ ঘোষালকে থেঁতলে দেওয়া হোক। জনশ্রুতি অনুসারে নাটক জমে উঠল এর পরেই। বিদ্যানন্দ ঘোষালকে থেঁতলে দেওয়ার জন্য যে হাতি আনা হয়েছিল সেই হাতি তার সামনে এসে আর কিছুতেই নড়ে না। মাহুত শত চেষ্টা করেও হাতিকে একচুল নড়াতে। পারল না। হাতির এই কাণ্ড দেখে নবাব আলিবর্দি নিজের ভুল বুঝতে পেরে বিদ্যানন্দ ঘোষালকে তৎক্ষণাৎ মুক্তি দিলেন।হাতি পা তুলে নিয়েছিল বলে এই জায়গাটির নাম হয় ‘পা-উথরা” অর্থাৎ পা তুলে নেওয়া। সেই থেকে এই জায়গার নাম হয়ে যায় পাথরা। এরপর বিদ্যানন্দ ও তাঁর উত্তরসূরীরা একের পর এক মন্দির বানিয়েছিলেন পাথরায়। অগুণতি মন্দির। যার অনেকগুলিই কালের গ্রাসে ধ্বংস হয়ে গেছে। অনেক মন্দিরের ভিতর থেকে মূর্তি লোপাট করেছে চোরেরা। এখন মাত্র ৮টি বাদে বাকি মন্দিরগুলিতে কেউ আর পুজো দিতেও আসে না। আর মাত্র ৩৪টি মন্দির টিকে আছে। পাথরা পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে কাঁসাই নদীর তীরে অবস্থিতি একটি ছোট্ট গ্রাম।

এ গেল পাথরা কথা। এবার আসি ইয়াসিন পাঠানের কথায়। ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দ। কর্মসূত্রে মেদিনীপুর থাকাকালীন ইয়াসিনের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল। উনি আমাদের পত্রিকার দপ্তরে এসেছিলেন তাঁর একটি বইয়ের সমালোচনা করার জন্য। বইটির নাম মন্দিরময় পাথরার ইতিবৃত্ত’। পেশায় শিক্ষক ছিপছিপে পাতলা গড়নের এই ভদ্রলোক পাথরা গ্রামের সর্বমোট ৩৪ টি হিন্দু মন্দিরকে সংরক্ষণ করার তাগিদ অনুভব করে গ্রামবার্তা’ নামক একটি পত্রিকার প্রবর্তন করেন। তাঁর সহকারী আরও দুজন বাদল কিশোর ভূঁইয়া ও আবদুল সাত্তার খান। অক্লান্ত পরিশ্রম ও দীর্ঘসময় ব্যয় করে তিন যুবক কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাথরার ইতিহাস খনন করতে থাকেন এবং সেই সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করে স্থানীয় অধিবাসীদের অবহিত করতে থাকেন। কাজটা মোটেই সহজ ছিল না। প্রচুর প্রতিকূলতা নিয়ে ইয়াসিন তাঁর কাজ করে গেছেন। ইয়াসিন পাঠানের কপালে জোটে দুর্ভোগ ও লাঞ্ছনা। ইয়াসিন। পাঠানকে স্থানীয় অধিবাসীদের দ্বারা নিগৃহীত হতে হয়। এমনকি সেখানকার অধিবাসীদের দ্বারা বিভিন্ন সময়ে তিনি প্রহৃতও হন।

গ্রামের শতকরা ৯৯ ভাগ মানুষজন তাদের বাসস্থান তৈরি করেছেন মন্দিরের ব্যবহৃত ইট দিয়ে। ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে স্থানীয় এক রাজনৈতিক নেতা এখানকার প্রাচীন দুর্গা মণ্ডপের ব্যবহৃত পাথরগুলি বিক্রি করবেন বলে মনস্থির করেন এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের মাওয়া নামক জায়গায় কালি মন্দির স্থাপনের কাজে এই পাথরগুলিকে গোপনে পাচার করার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু ঘটনাটি জানাজানি হলে ইয়াসিন পাঠান তীব্র প্রতিবাদ ও আন্দোলন শুরু করেন। অবশেষে অপরাজেয় ইয়াসিন পাঠান ১৯৯১ সালে হিন্দু-মুসলিম আদিবাসী সম্প্রদায় নির্বিশেষে গঠন করেন পাথরা পুরাতত্ত্ব সংরক্ষণ কমিটি। ইয়াসিনের এই কৃতিত্বে জন্য ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ডঃ শঙ্কর দয়াল শর্মা তাকে ‘সন্ত কবির’ পুরস্কারে ভূষিত করেন। মুসলমান যুবক ইয়াসিন পাঠানের নিরলস প্রচেষ্টা ও ত্যাগের ফলে ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ও তৎকালীন যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান প্রণব মুখার্জি ২০ লাখ টাকা প্রদান করেন পাথরা পুরাতত্ত্ব সংরক্ষণ কমিটিকে। ২০০৩ সালে ‘আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া’ পাথরায় ৩৪ টি মন্দির ও মন্দির সংলগ্ন ২৫ বিঘা জমি অধিগ্রহণ করেন এবং সংরক্ষণ প্রক্রিয়া শুরু করেন। ২০১৪ সালে ইয়াসিন পাঠান তাঁর রাষ্ট্রপতি পুরস্কার ফেরত দিতে চেয়ে চিঠি লিখেছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারকে। প্রতিবাদ ছিল— সরকারের পাথরা সংক্রান্ত পুরাতত্ত্ব যথাযথভাবে সংরক্ষণ না-হওয়ার ও সামগ্রিক অস্থিরতার প্রতি তাঁর প্রতিবাদ। যদিও তাঁর সেই আবেদন সরকার পত্রপাঠ খারিজ করে দেন এবং তাঁকে আশ্বস্ত করেন যে মন্দিরগুলির যথার্থ সংরক্ষণ ও জমি অধিগ্রহণ নিশ্চিতভাবে হবে। ইয়াসিন পাঠানের এই অসামান্য অবদানে পাথরা আজ এক ঐতিহাসিক নিদর্শন ও পর্যটন কেন্দ্ররূপে পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের ইতিহাস মানচিত্রে জায়গা করে নিয়েছে। আমাদের এটাই সৌভাগ্য, পাথরার ইতিহাস ও ইয়াসিন পাঠানের দীর্ঘ সংগ্রাম মিথ্যা হয়ে যায়নি। ইয়াসিনের দীর্ঘ ২৫ বছরের লড়াইয়ের স্বীকৃতি স্বরূপ কেন্দ্রীয় পুরাতত্ত্ব দপ্তর পাথরার মন্দির সংরক্ষণে তৎপর হয়। ভারত ভূখণ্ডে সম্রাট আওরঙ্গজেব যে কোনো মোঘল শাসকদের চেয়ে বেশি মন্দির নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। আওরঙ্গজেবের অনেক দোষ থাকতে পারে, কিন্তু হিন্দু বিদ্বেষের দোষটা আরোপিত, যেটা তাঁর প্রাপ্য নয়। কোনো শাসকই কেবলমাত্র সর্বগুণের আধার হয় না। দোষ থাকাটাও স্বাভাবিক। শাসক হলেও সেও তো মানুষ।

আওরঙ্গজেব আদর্শ শাসক ছিলেন কী ছিলেন না, তা নিয়ে দুই সম্প্রদায়ের বিতর্ক চলতেই পারে। কিন্তু এহেন শাসকের সাম্রাজ্যও একসময় তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে। কারণ– (১) সর্বাধিক বিস্তৃতি মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি সুদৃঢ় করার পরিবর্তে দুর্বল করেছিল। উত্তর-পূর্ব ভারতে সুদূর বাংলা ও আসামে, দক্ষিণ ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলিতে আওরঙ্গজেব সাময়িকভাবে সাফল্য লাভ করেন। উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের বিভিন্ন আফগান অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিতে একইভাবে সাফল্য অর্জন করেন। তবে তিনি দীর্ঘদিন রাজনৈতিক কর্তৃত্ব বজায় রাখতে পারেননি। অতীতে সমুদ্রগুপ্ত বা আলাউদ্দিন খলজি দুজনের কেউই দক্ষিণ ভারতে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ধরে রাখার চেষ্টা করেননি। (২) আওরঙ্গজেবের ভ্রান্তনীতির ফলেও মোগল সাম্রাজ্যের ভিত্তি দুর্বল হয়ে যায়। তিনি আকবর প্রবর্তিত রাজপুতদের সঙ্গে মিত্রতার নীতি পরিত্যাগ করে শত্রুতার সম্পর্ক গড়ে তোলেন। মারওয়ার ও মেবারের সঙ্গে তাঁর যে সংঘর্ষ শুরু হয়, তাতে মোগল সাম্রাজ্যের ভিত্তি দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। (৩) দাক্ষিণাত্যে শিবাজীর অ্যুথানের ফলে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল, তা মোকাবিলা করতে আওরঙ্গজেব একপ্রকার ব্যর্থই হন। দাক্ষিণাত্যে রাজনৈতিক অরাজকতা ও সুলতানি রাজ্যগুলির দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে শিবাজী মারাঠা সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে সচেষ্ঠ হন। আওরঙ্গজেব বিজাপুরের সুলতানের সহযোগিতায় শিবাজীর রাজ্য স্থাপনের প্রচেষ্টা প্রতিহত করতে সচেষ্ট হলেও, তা তাঁর নিজের অদূরদর্শিতায় নষ্ট হয়ে যায়। শিবাজীর অগ্রগমন তিনি রুখতে পানেননি। বরং মারাঠা শক্তি, বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা— এই তিন শক্তি মিলিতভাবে মোগলদের বিরুদ্ধে এক বড়ো প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। আওরঙ্গজেব বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা দখল করতে সক্ষম হলেও মারাঠাদের রুখতে পারেননি। ১৬৮০ সালে শিবাজীর মৃত্যুর পর মারাঠারা নেতৃত্বহীন হয়ে পড়লেও ব্যাপক লুঠতরাজ করে মোগলদের ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল। আওরঙ্গজেবের ভ্রান্ত দাক্ষিণাত্য নীতি মোগল সাম্রাজ্যের পতনের পথ আরও প্রশস্ত করেছিল। (৪) আওরঙ্গজেবের ভ্রান্ত নীতির ফলে শিখ, জাঠ ও সত্নাম বিদ্রোহ মোগল সাম্রাজ্যের শান্তি ও স্থায়িত্ব বিঘ্নিত করেছিল। এই বিদ্রোহগুলির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ফল মোগল সাম্রাজ্যের পক্ষে সুখকর হয়নি। আওরঙ্গজেব যতদিন জীবিত ছিলেন, ততদিন অবশ্য মোগল সাম্রাজ্য অটুট ছিল। কিন্তু তাঁর রাজত্বকালেই এই প্রশস্ত সাম্রাজ্যের পতনের পথ প্রস্তুত হয়। এবং (৫) আওরঙ্গজেবের শাসনকালের মধ্যেই ভারত উপমহাদেশের ঢুকে পড়েছিল পোর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ফরাসি, ব্রিটিশদের মতো উপনিবেশবাদীরা। মোগল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ এইসব এইসব বিদেশি শক্তিও, বিশেষ করে ব্রিটিশরা। কলকাঠি নাড়িয়েছে তাঁরাও। কৌশলগত কারণে ভূখণ্ড ভাগাভাগিতে ব্রিটিশদের জয় হয়েছে। বাকিদের সরে যেতে হয়েছে। পর্যদস্ত হয়েছে তৎকালীন ভারতের স্থানীয় শাসকরা। তাই আওরঙ্গজেব যেমনই শাসকই হোক না-কেন ভারতীয় শাসকদের শাসনের অবসান হতই। আমরা যতই মোগল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ খুঁজি না কেন, সেই কারণগুচ্ছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কথা উল্লেখ থাকে না। এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই শাক দিয়ে মাছ ঢাকার প্রয়াস ছিল। কারণ উপনিবেশবাদী ব্রিটিশদের লোক-বল, রাষ্ট্রীয় বল, অর্থ-বল ও অস্ত্র-বলের সঙ্গে কোনো ভারতীয় শাসকের পক্ষেই এটে ওঠা সম্ভব হত না। সেসময় বিশ্বের বহু দেশেই কোনো না কোনো সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র কোনো না-কোনো দেশে উপনিবেশবাদ কায়েম করে নিচ্ছিল। সবচেয়ে বেশি দেশে উপনিবেশ কায়েম করেছিল ব্রিটিশরা। তাঁদের শক্তির কাছে হার মেনেছিল প্রায় গোটা বিশ্ব। সেই শক্তি ক্ষয় হয়ে নিঃস্ব হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর।

হিন্দু হোক কিংবা মুসলিম, আওরঙ্গজেব তাঁর প্রজার অধিকার খর্ব কখনোই বরদাস্ত করেননি। কঠোরভাবে প্রকৃত অপরাধীদের মোকাবিলা করেছে। হিন্দু ও হিন্দুধর্মের প্রতি আওরঙ্গজেবের যে সহিষ্ণু মনোভাব ছিল, তা উজ্জয়িনীর মহাকালেশ্বর মন্দিরের পুরোহিতদের কাছ থেকে তার সমর্থন পাওয়া যায়। ইংরেজরা হিন্দুদের মনের ভিতর বিভেদ ঢুকিয়ে দিতেই আরঙ্গজেবের রাজনৈতিক জীবনকে কালিমালিপ্ত করে ইতিহাস রচনা করেছেন। সেই বানোয়াট ইতিহাস চর্চা আমরা করে চলেছি। কারণ আমাদের মনের ভিতর বিভেদতন্ত্র গেড়ে বসে গেছে। তাই জেনেশুনেও খাসির মাংসকে পাঁঠার মাংসই বলব। তাই আমরা আমাদের ইতিহাস মুখস্থ করতে থাকি –আওরঙ্গজেব ভয়ংকর, আকবর মহামতি। আসলে আওরঙ্গজেব ভয়ংকর নয়, আকবরও মহামতি নন। সাদা চামড়ার কী মাহাত্ম! ঐতিহাসিক Audrey Truschke ofa ‘Aurangzeb : The Life and Legacy of India’s Most Controversial King Farstasa– “Aurangzeb protected more Hindu temples than he destroyed. He employed more Hindus in his imperial administration than any prior Mughal ruler by a fair margin…”। অড্রে ট্রশকে লিখেছেন— আওরঙ্গজেব তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ও ধনী শাসক ছিলেন। তাঁর প্রায় ৫০ বছরের শাসনামলে (১৫৫৮-১৭০৭) প্রারম্ভিক আধুনিক ভারতের রাজনৈতিক প্রাকৃতিক দৃশ্যের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল এবং তাঁর উত্তরাধিকার বাস্তব ও কল্পনা করা যায়। আজ ভারত ও পাকিস্তানে বিশাল আকার ধারণ করেছে। আওরঙ্গজেবের একটি অংশ খুলেছেন, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভারতীয়দের কাছে অজানা। তাঁর শাসনকালে তাঁর ব্যক্তিত্বকে চিহ্নিত করে তিনি আওরঙ্গজেবের এমন একটি অংশ বিশ্লেষণ করেছেন যা রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তার উপর নির্ভর করে একই সাথে নির্মম এবং সৌম্য।

আওরঙ্গজেব আসলেই কি ধর্মীয় ধর্মান্ধ ছিলেন? যদি তা না হয় তবে আপনি কীভাবে তাঁর বইতে তাঁর ধর্মীয় নীতিগুলি বিশ্লেষণ করবেন? ‘Indian Express’-এর এক সাংবাদিকের এমন প্রশ্নে অড্রে ট্রুশকে বলেছেন– “According to modern definitions, Aurangzeb acted as a religious bigot in some ways. But he also acted in ways that we would describe, again using modern terms, as tolerant. Aurangzeb was not a modern man, and so it should be unsurprising that modern standards of bigotry do not advance our historical understanding of this Mughal king. In the book, I argue that we get far closer to grasping something of Aurangzeb’s world if we analyse his actions and policies according to his devotion to a set of pre-modern values, including piety, Mughal kingship, and justice, all of which were tempered by Aurangzeb’s seemingly insatiable thirst for earthly power.” আওরঙ্গজেব যখন ধর্মীয় গোঁড়ামির অনুভূত চিত্রের বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন তখন আপনি আমাকে কয়েকটি নির্দিষ্ট উদাহরণ দিতে পারেন? অড্রে ট্রশকে উত্তরে বলেছেন– “Aurangzeb protected more Hindu temples than he destroyed. He employed more Hindus in his imperial administration than any prior Mughal ruler by a fair margin (50% more Hindus, proportionally, than Akbar had included, for instance). Aurangzeb asked Hindu doctors and astrologers for advice throughout his life, even in his final years. Aurangzeb also destroyed some temples, reinstitute the jizya tax, and, along with the Marathas, caused mass human suffering in central and south India. The goal for a historian is to make sense of all of these aspects of Aurangzeb rather than singling out only one side of this complicated king.” উপনিবেশিক ঐতিহাসিকতায় কীভাবে আওরঙ্গজেবের চিত্রকে ক্ষতি করেছে? এক্ষেত্রে ইতিহাস রচনার নির্দিষ্ট কিছু ঘটনা বলুন। অড্রে টুশকে বলছেন— “British colonialists depicted Indo-Muslim kings overall as undesirable and held up Aurangzeb as uniquely horrific so that British colonialism might shine by comparison. A good example of this tactic is Elliot and Dowson’s The history of India, as told by its own historians, a multivolume work that translated excerpts of premodern Islamic texts that were selected to display the alleged barbarity of Indo-Muslim kings. Elliot and Dowson were quite open about their goals in their prefaces. In volume one’s preface, for example, Elliot proclaimed “the supremacy of the British (colonial] Government” over “Muhammadan” kings who display “the vices of a Caligula or a Commodus.” Dowson’s preface to the second volume says that readers can expect to see, through the translated excerpts, “Musulman despotism.” Even today, many people still cite this problematic work of colonial propaganda with little regard for its pro-British, pro-colonial agenda.” optezine a tan Gartepat প্রশ্নটি করলেন— আপনি কি বলবেন যে আজও আওরঙ্গজেবের চিত্রটি রাজনৈতিক লাভের জন্য ব্যবহৃত হয়? অড্রে ট্রুশকের সোজাসাপটা উত্তর –“British colonialism finds few defenders in India today, but Hindu nationalists have gobbled up colonial-era depictions of Mughal history, including Aurangzeb, and spit them out in order to foster anti-Muslim sentiment. This embrace of colonial ideas is unsurprising given the history of Hindu nationalism, but it is deeply detrimental to the founding fathers’ vision of India as a secular state that embraced members of all religious traditions.”

ভারতে মোগল সাম্রাজ্য সর্বাধিক বিস্তার লাভ করেছিল সম্রাট আরঙ্গজেবের শাসনকালে। তাঁর মৃত্যুর পর পরপর মোগল সাম্রাজ্যের ভাঙন শুরু হয়। শেষ হয় মোগল সাম্রাজ্যের প্রথম ইনিংস। দিল্লির মুসলিম শাসক দুর্বল হয়ে পড়ার কারণে ভারত আবার বাইরের হানাদার কর্তৃক আক্রান্ত হয়। শুরু হয় মোগল সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় ইনিংস। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর তিন দশক পর ভারত আক্রমণ করেন পারস্য সম্রাট নাদির শাহ। পারস্যের শাসক নাদির শাহ ১৭৩৮ সালে ভারত আক্রমণ করে যে হত্যালীলা, লুণ্ঠন এবং ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিলেন, তা ছিল এককথায় অবর্ণনীয়। ভারতের ইতিহাসে নাদির শাহের নাম তীব্র ঘৃণায় উচ্চারিত হয়। কারণ নাদির শাহ বর্বরতম সেই অভিযানে প্রায় দুই লক্ষ ভারতীয়কে হত্যা করেন। লুণ্ঠন করেন বিপুল পরিমাণ সম্পদ। হাজার হাজার নারী এবং সমর্থ পুরুষ বন্দি করার পর ক্রীতদাস করে দেশে ফিরে যান। বিশিষ্ট পণ্ডিত ফরাসি লেখক অ্যালেইন দানিয়েলু তাঁর ‘A Brief Hisory of India’ গ্রন্থে লিখেছেন –“তিনি মূল্যবান আসবাবপত্র, শিল্পকর্ম, ঘোড়া, কোহিনুর হিরে, বিখ্যাত ময়ূর সিংহাসন এবং ১৫০ মিলিয়ন স্বর্ণমুদ্রা লুঠ করে ইরানে নিয়ে যান।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *