০৯. বিশ্বায়ন ও বাঙালির সত্তার অন্বেষা : একদিন বাঙালি ছিলাম রে

বিশ্বায়ন ও বাঙালির সত্তার অন্বেষা : একদিন বাঙালি ছিলাম রে

১. উপক্রমণিকা

একুশ শতকের শুরুতে লন্ডনের টেলিগ্রাফ পত্রিকায় একজন অজ্ঞাতনামা ইংরেজ পত্র লেখেন, ‘Being British is about driving a German car to an Irish pub for a Belgian beer, then travelling home, grabbing an Indian curry or a Turkish kebab on the way, to sit on Swedish furniture and watch American shows on a Japanese TV. And most British thing of all? Suspicion of anything foreign.’ (faltat To মানে হচ্ছে জার্মান গাড়িতে চড়ে আইরিশ গুঁড়িখানায় বেলজিয়ান বিয়ার পান, তারপর বাড়ি ফেরার পথে ভারতীয় ঝোল-তরকারি বা তুর্কি কাবাব তুলে নিয়ে, [বাড়িতে গিয়ে সুইডিশ আসবাবে বসে জাপানি টিভিতে আমেরিকান অনুষ্ঠান দেখা। ব্রিটিশ হওয়ার সবচেয়ে বড় লক্ষণ কী? বিদেশি সবকিছু নিয়ে খুঁতখুঁত। করা)। পত্রলেখকের খেদ, বিদেশি সবকিছুর জন্য ইংরেজদের সহজাত অনীহা সত্ত্বেও ব্রিটেনে সর্বস্তরে বিদেশি প্রভাব ছড়িয়ে পড়ছে। এ ধরনের দুঃখ শুধু ইংরেজদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এ ধরনের আক্ষেপ পৃথিবীর সর্বত্র দেখা যাচ্ছে। একই সময়ে বাংলাদেশে একটি জনপ্রিয় গানে শোনা যায় :

তোমরা একতারা বাজাইয়ো না
দোতারা বাজাইয়ো না
একতারা বাজাইয়ো না, ঢাক-ঢোল বাজাইয়ো না
গিটার আর ব্যাঞ্জো বাজাও রে।
একতারা বাজাইলে মনে পইড়া যায়
আমার একতারা বাজাইলে মনে পইড়া যায়
একদিন বাঙালি ছিলাম রে
একদিন বাঙালি ছিলাম রে ॥

আকস্মিকভাবে আবির্ভূত হয়ে বিশ্বায়ন সারা পৃথিবীতে ভাঙা-গড়ার খেলা শুরু করেছে। অথচ কেউই জানে না বিশ্বায়ন আমাদের কোথায় নিয়ে চলছে । সমাজতত্ত্ববিদ অ্যান্টনি গিডেন্স (১৯৯৯, ৬-৭) যথার্থই লিখেছেন, ‘We live in a world transformation affecting almost every aspect of what we do. For better or worse, we are being propelled into a global order that no one fully understands but which is making its effects felt upon all of us.’ (আমরা একটি রূপান্তরের জগতে বাস করছি, যা আমাদের কর্মের ভুবনে সবকিছু প্রভাবিত করছে। ভালো হোক বা মন্দ হোক, আমাদের এমন এক বিশ্বব্যবস্থায় টেনে নেওয়া হচ্ছে, যার সম্বন্ধে আমরা অনেক কিছু জানি না, অথচ যার প্রভাব আমরা স্পষ্টভাবে অনুভব করছি। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে কিছুই ঘটেনি, অথচ ভেতরে ভেতরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। পরিবার, রাষ্ট্র, ঐতিহ্য–সবই রূপান্তরিত হচ্ছে।)

তবে সর্বত্র একই ধরনের সত্তার রূপান্তর ঘটছে না। স্থানভেদে রূপান্তরের প্রকৃতি ভিন্ন হয়। রূপান্তরের প্রক্রিয়া নির্ভর করে প্রধানত দুটি উপাদানের ওপর। প্রথমত, ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক পরিবেশ, যা জাতিসত্তার মূল কাঠামো গড়ে তোলে। দ্বিতীয়ত, বাইরের অভিঘাত মোকাবিলায় ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে কী ধরনের কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। বর্তমান প্রবন্ধের মূল লক্ষ্য হলো বাঙালি সত্তার বিবর্তনের প্রবণতাগুলি চিহ্নিত করা। নিবন্ধটি তিনটি খণ্ডে বিভক্ত। প্রথম খণ্ডে বাঙালির সত্তা নির্মাণে ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক পরিবেশের প্রভাব পর্যালোচনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় খণ্ডে বাঙালিরা কীভাবে বাইরের অভিঘাত মোকাবিলা করেছে তা সংক্ষেপে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। শেষ খণ্ডে এই প্রবন্ধের মূল বক্তব্যগুলি তুলে ধরা হয়েছে।

২. বাঙালি-সত্তা বিনির্মাণে ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক বাতাবরণ

মা-বাবা যখন সন্তানের নাম রাখেন, তাঁরা আশা করেন যে তাঁদের সন্তান তার নামের যথার্থতা প্রমাণ করবে। দেশের নামের সঙ্গেও কি একই ধরনের প্রত্যাশা জড়িয়ে থাকে? হয়তো থাকে। ডেভিড এস স্নসন (David S. Slawson) লিখেছেন, ‘Names are an important key to what a society values. Anthropologists recognize naming as one of the chief methods for imposing order on perception.’ (নামগুলি হচ্ছে সমাজ কী চায় তা উন্মোচনের একটি চাবি। নৃতত্ত্ববিদেরা তাই নামকরণকে মানুষের ইন্দ্রিয়ানুভূতি সুবিন্যস্তকরণের একটি প্রধান পদ্ধতিরূপে গণ্য করে থাকেন।)।

দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশের নাম কখন এবং কে রেখেছিলেন, ইতিহাস তার হদিস দিতে পারে না। জাতি বা উপজাতি হিসেবে বঙ্গের উল্লেখ রয়েছে ৬০০ থেকে ৭০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের লেখা ঐতরেয় আরণ্যক-এ (দাশগুপ্ত, ২০০৪, ২৯)। ভূখণ্ড হিসেবে বঙ্গের নাম পাওয়া যায় কৌটিল্যের (খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী) অর্থশাস্ত্রে। তবে বাংলা নামের উৎপত্তি সম্পর্কে ইতিহাস কোনো আলোকপাত করতে পারেনি। ঐতিহাসিক উপাদানের অভাবে যে প্রশ্নের জবাব ঐতিহাসিকেরা দিতে পারেননি, তা সমাধান করার চেষ্টা করা হয়েছে ভাষাভিত্তিক বিশ্লেষণে। এ ক্ষেত্রে দুই ধরনের মতবাদ দেখা যায়।

কেউ কেউ ইঙ্গিত দিচ্ছেন, ‘বঙ্গ’ শব্দটি ‘গঙ্গা’ শব্দের অপভ্রংশ হতে পারে। গঙ্গাবিধৌত ভূমিখণ্ড হচ্ছে ‘বঙ্গভূমি’ (মুখোপাধ্যায়, ২০০০, ৬)। তবে এ মতবাদের দুটো দুর্বলতা রয়েছে। প্রথমত, গঙ্গা শব্দটি বঙ্গ শব্দটির চেয়ে অনেক বেশি পরিচিত। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে গঙ্গা আবহমান কাল ধরে পবিত্রতায় অভিষিক্ত। বঙ্গ নামের সঙ্গে গঙ্গার সম্পর্ক থাকলে প্রাচীন ধর্মগ্রন্থগুলিতে অবশ্যই তা জোর দিয়ে বলা হতো। এ ধরনের কোনো প্রমাণ দেখা যাচ্ছে না। পক্ষান্তরে হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলি বাংলা অঞ্চলের অধিবাসীদের ‘দস্যু’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। দ্বিতীয়ত, গঙ্গা-অববাহিকা শুধু বাংলা অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ নয়। বিহার ও উত্তর প্রদেশে গঙ্গার তীরে রয়েছে অনেক পবিত্র তীর্থস্থান। বঙ্গ ও গঙ্গা–শব্দ দুটির সম্পর্ক তাই অতিরঞ্জিত করা ঠিক হবে না।

দ্বিতীয় মতবাদ হলো, বঙ্গ শব্দটির উৎপত্তি তিব্বতি ভাষা থেকে। এই ভাষায় ‘বঙস’ শব্দের অর্থ আর্দ্র ও জলাভূমি (দাশ, ১৯৬৯, ১)। অনেক ক্ষেত্রেই এ ধরনের নাম বাইরের লোকেরাই দিয়ে থাকেন। যেমন হিন্দুধর্মের নামকরণ তাদের শাস্ত্রগুলি করেনি, করেছে ভিনদেশি যবনরা। সিন্ধু নদের দেশের মানুষদের ধর্মের নাম দেওয়া হয় হিন্দু।

হিমালয়ের চূড়ায় বসে তিব্বতের অধিবাসীরা পর্বতমালার নিচে ও দক্ষিণে অবস্থিত বিশাল জলাভূমির নাম দিয়েছে বাংলা। তবে বঙ্গ শব্দের উৎস গঙ্গা শব্দেই হোক আর ‘বঙস’ শব্দেই হোক, এর বক্তব্য কিন্তু অভিন্ন। মোদ্দা কথা হলো, বাংলাদেশ হচ্ছে নদ-নদীর দেশ, জলাভূমির, দেশ, বানভাসির দেশ, বিল-বাওড়-হাওরের দেশ। ঐতিহাসিক আবুল ফজলের ভাষায়, এটি হচ্ছে ভাটির দেশ। অতি প্রাচীনকাল থেকেই এই বাংলাদেশ বহিরাগতদের কাছে পরিচিত। অনেক পণ্ডিত মনে করেন যে এই ভূখণ্ডের বাংলাদেশ নামে পরিচিতি এসেছে মুসলমান শাসকদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক ঐক্য থেকে। আবার কেউ কেউ বলছেন, বাংলাদেশ ধারণাকে মূর্ত করেছে পঞ্চদশ শতকের ভাষাগত ঐক্য। অবশ্যই মুসলমান শাসন ও বাংলা ভাষার বিকাশ বাঙালি চেতনাকে শাণিত ও ঋদ্ধ করেছে।

বাংলাদেশের নাম মুসলমান শাসনের আগেই বহিরাগতদের কাছে পরিচিত ছিল। দক্ষিণ ভারতের রাজা রাজেন্দ্র চোল বাংলাদেশে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। তিনি ১০১২ থেকে ১০৪৪ খ্রিষ্টাব্দ সময়কালে রাজত্ব করেন। অনুমান করা হয়, ১০১২ থেকে ১০২৪ খ্রিষ্টাব্দ সময়কালে তার সেনাবাহিনী বাংলাদেশ আক্রমণ করে। এই অভিযানের কাহিনি বিবৃত হয়েছে রাজেন্দ্র চোলের তিরুমলয় (Tirumulai) শিলালিপিতে। এ অভিযান সম্পর্কে শিলালিপিটিতে বাংলাদেশ সম্পর্কে বর্ণনার নিম্নরূপ ইংরেজি অনুবাদ করেছেন অধ্যাপক কে কে নীলকান্ত শাস্ত্রী : ‘…after having forcibly attacked Ranasura, Vangladesa where rain water never stopped (and from which) Govindrachandra fled, having descended (from his) male elephant, elephants of rare strength, women and treasure (which he seized) after having been pleased to frighten strong Mahipala on the field of hot battle (with the noise of) conches (got from the deep sea), uttiraladam (on the shore of expansive ocean) producing pearls; and the Ganges whose waters bearing fragrant flowers dashed against the bathing places.’ (তিনি [অর্থাৎ রাজেন্দ্র চোলের সেনাপতি] বলপূর্বক রণসুর আক্রমণের পর এলেন বাংলাদেশে, যেখানে বিরতিহীন বৃষ্টি পড়ে, যেখানে গোবিন্দচন্দ্র তাঁর মরদ হাতির পিঠ থেকে নেমে পালালেন এবং বাজেয়াপ্ত করা হলো, অসাধারণ শক্তিশালী গজগুলি, ললনাদের ও মণিমাণিক্য এবং উত্তর রাঢ়ে বা উত্তরিলদামে যা বিশাল সমুদ্রের তীরে অবস্থিত] উত্তপ্ত যুদ্ধক্ষেত্রে [গভীর সমুদ্র থেকে আহরিত] অজস্র শঙ্খের ধ্বনিতে শক্তিশালী মহীপালকে ভয় দেখিয়ে জয় করা হয়। এখানে মুক্তা উৎপাদিত হয় এবং গঙ্গার স্রোতোধারায় ভেসে চলে সুরভিত পুষ্পসমূহ, যা স্নানের ঘাটের ওপর আছড়ে পড়ে) (উদ্ধৃত, মজুমদার, ১৯৬৩, ১৩৮)। তিরুমলয় শিলালিপির কোনো কোনো অংশের অনুবাদ নিয়ে মতদ্বৈধতা থাকলেও এ বিষয়ে কোনো মতভেদ নেই যে বাংলাদেশ নামটি (শুধু বঙ্গ বা বঙ্গাল নয়) কমপক্ষে এগারো শত বছরের পুরোনো; অবিরল বারিধারায় স্নাত এই দেশ; এখানে গঙ্গার ঘাটে ঘাটে সুগন্ধি ফুল আছড়ে পড়ে।

জলাভূমির প্রতিবেশই হচ্ছে বাংলার ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্তিত্বের সবচেয়ে বড় সত্য। নীহাররঞ্জন রায় যথার্থই বলেছেন, ‘বাংলার ইতিহাস রচনা করিয়াছে বাংলার ছোট-বড় অসংখ্য নদ-নদী । এই নদ-নদীগুলিই বাঙলার প্রাণ।’ (রায়, ১৪০০, ৭২) পরিবেশবিজ্ঞানীদের মতে, জলাভূমি হচ্ছে জৈব-বৈচিত্র্যের সবচেয়ে সমৃদ্ধ প্রতিবেশ। এই ভৌগোলিক বাতাবরণই বাংলাকে দিয়েছে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য। আবার কখনো কখনো প্রলয়ংকরী বন্যা, খরা, ঝড় ও জলোচ্ছাস বিপর্যস্ত করেছে এই জলাভূমির জনজীবন। পেলব পলিমাটিতে গড়া সমতটে প্রমত্ত নদ-নদীর উদ্দাম লীলায় হারিয়ে গেছে অজস্র জনপদ, অসংখ্য কীর্তি ও শস্যশ্যামল প্রান্তর। বাঙালি ভালোবেসে নদীর নাম দিয়েছে মধুমতী, ইছামতী, চিত্রা, কপোতাক্ষ, কলকলিয়া আরও কত কি! তেমনি আবার নদীর রুদ্র রূপকে বর্ণনা করেছে কালনি, মাথাভাঙ্গা, কীর্তিনাশা, ভৈরব, আগুনমুখা, ডাকাতিয়া ইত্যাদি নামে। এ প্রাকৃতিক পরিবেশ শুধু বাঙালির আর্থিক ভাগ্যই নিয়ন্ত্রণ করেনি, এ পরিবেশ বাঙালির সমাজ গড়েছে, সৃষ্টি করেছে–কবি জীবনানন্দ যাকে বলেছেন–আমার এ বাঙ্গালীর মন।

জলাভূমির প্রতিবেশে বাংলার গ্রামীণ বসতিগুলি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলের বসতির তুলনায় সুস্পষ্ট ভিন্ন আদলে বিকশিত হয়েছে। মার্কিন নৃতত্ত্ববিদ পিটার জে বারতুচি বাংলাদেশের গ্রামকে ‘ছলনাময়’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। ওলন্দাজ ঐতিহাসিক ভেলেম ভান সেলে (২০০৯, ৯) বাংলাদেশের গ্রামীণ বসতি সম্পর্কে লিখেছেন, ‘They are not clustered around a central square, protected by defensive walls or united in the maintenance of joint irrigation works. Instead they consist of scattered homesteads and small hamlets (para) perched on slightly elevated plots that become islands when moderate floods occur.’ (এই গ্রামগুলো বাইরে থেকে দেয়াল দিয়ে সংরক্ষিত একটি কেন্দ্রীয় চত্বর ঘিরে বসতি নয়; এরা যৌথ সেচকার্যের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ঐক্যবদ্ধ নয়। পক্ষান্তরে গ্রামগুলোতে রয়েছে ছড়ানো-ছিটানো বাড়িঘর এবং ছোট ছোট পাড়া। এরা কিছুটা উঁচু জমিতে স্থাপিত এবং এরা ছোটখাটো বন্যাতেই দ্বীপের মতো বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।) নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমি (খান, ২০০৪) বাংলাদেশের সত্তার অন্বেষা গ্রন্থে বাংলাদেশের গ্রামগুলিকে ‘উন্মুক্ত গ্রাম’ (open village) বলে বর্ণনা করেছি। প্রতি-তুলনায় দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলের গ্রামগুলো হচ্ছে ‘প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সঙ্ঘবদ্ধ’ (corporate) গ্রাম। এ ধরনের গ্রাম একই সঙ্গে প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব পালন করে। উন্মুক্ত গ্রামে শুধু সামাজিক সংযোগ ঘটে, কিন্তু প্রশাসনিক বা অর্থনৈতিক দায়িত্ব থাকে অত্যন্ত সীমিত।

তৃণমূলে গ্রামীণ সংগঠনের দুর্বলতা এ অঞ্চলের মানুষের জন্য একদিকে আশীর্বাদ, অন্যদিকে অভিশাপ। গ্রামীণ সংগঠনের দুর্বলতার ফলে এখানে প্রাক-পুঁজিবাদী সমাজে অতি প্রাচীনকাল থেকেই প্রবল ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ গড়ে উঠেছে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের জন্য এখানে সনাতন হিন্দুধর্ম শিকড় গাড়তে পারেনি। প্রথাগত সনাতনত্ব কখনো বাঙালির ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ খর্ব করতে পারেনি। তাই ধর্ম সম্পর্কেও বাঙালি দাবি করতে পারে : ‘আমি তাই ভাই করি। যখন চাহে এ মন যা/ করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা’। আরও বলতে পারে : ‘আমি অনিয়ম উচ্ছঙ্খল/ আমি দলে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল’। বাঙালির ধর্মে ব্যক্তিস্বাধীনতার সাথে যুক্ত হয়েছে মানবতাবাদ। দেবতার চেয়ে মানুষ বাঙালির কাছে অনেক বড়। তাই তো কবি লিখেছেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য/ তাহার উপরে নাই’।

দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলে অধিবাসীদের জীবনে গ্রামীণ সংগঠনের প্রাধান্যের ফলে সাধারণ মানুষের পক্ষে বর্ণভিত্তিক সমাজব্যবস্থার ও তার আদর্শ সনাতন হিন্দুধর্মের বলয়ের বাইরে যাওয়া সম্ভব হয়নি। অথচ প্রবল ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের চেতনায় উদ্বুদ্ধ বাঙালিরা এ দেশে ইসলাম আগমনের অনেক পূর্ব থেকেই ব্রাহ্মণ্যবাদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তান্ত্রিক আচার-অনুষ্ঠান ও আউল-বাউলের মতো লোকায়ত ধর্মসাধনায় নিজেদের নিয়োজিত করেছে। এই উপমহাদেশে ব্রাহ্মণ্যবাদের সবচেয়ে বেশি প্রতিপত্তি দেখা যায় দক্ষিণ ভারতে। এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অধ্যাপক ব্যাশাম (১৯৫৯, ১৯১) যথার্থই লিখেছেন যে শক্তিশালী গ্রামীণ সংগঠনের সক্রিয় বিরোধিতার ফলে দক্ষিণ ভারতে সনাতন হিন্দুধর্ম থেকে বিচ্যুতি সম্ভব হয়নি। একই দৃষ্টিকোণ থেকে আমি (খান, ২০০৪) বাংলাদেশের সত্তার অন্বেষা গ্রন্থে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে গ্রামীণ সংগঠনের দুর্বলতার ফলে বাংলার বদ্বীপ অঞ্চলের একটি বিশাল জনগোষ্ঠী বহিরাগত পীর-দরবেশদের আধ্যাত্মিক শক্তিতে আকৃষ্ট হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। অথচ গ্রামীণ সংগঠনের প্রতিপত্তির ফলে ভারতের মুসলমান শাসনের মূল কেন্দ্রগুলিতে হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া ও খাজা মইনুদ্দিন চিশতির মতো পীর-দরবেশদের পক্ষেও অনুরূপ সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়নি।

জলাভূমির এই ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ শুধু বাঙালির ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার আচরণকেই প্রভাবিত করেনি। এর স্বাক্ষর দেখা যায় বাংলার কবিতায়, তার চিত্রকলায়, তার স্থাপত্যে, তার সংগীতে। বাংলা কবিতার ঐশ্বর্য তার মহাকাব্যে নয়, তার গীতিকবিতায়। বাংলার মন্দির ছোট ও সংকীর্ণ। এখানে ভুবনেশ্বর, খাজুরাহো বা দাক্ষিণাত্যের মতো মন্দির-শহর গড়ে ওঠেনি। পক্ষান্তরে বাংলার গর্ব পটুয়াদের চিত্রের পটভূমি অত্যন্ত সংকীর্ণ। এখানে। অজন্তা-ইলোরার মতো চিত্র, সারনাথের বুদ্ধমূর্তি, দাক্ষিণাত্যের নটরাজমূর্তি এবং এলিফেন্টার ভাস্কর্য খুঁজে পাওয়া যাবে না। বাঙালির এসব বৈশিষ্ট্য ও অর্জনের পেছনে রয়েছে তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ।

তবে আবহমান কাল থেকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র বাংলার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনকে সমৃদ্ধ করলেও তার রাজনৈতিক জীবনকে বিপর্যস্ত করেছে। সমাজবিজ্ঞানের ভাষায়, এখানে সামাজিক পুঁজির নিদারুণ ঘাটতি রয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রবার্ট ডি পুটনামের (১৯৯৩, ১৬৭) মতে, সামাজিক পুঁজি হচ্ছে পারস্পরিক আস্থার প্রথাসিদ্ধ আচরণের ও সামাজিক সম্পর্ক-জালের মতো সংগঠনের বিশেষত্বগুলি, যা সমন্বিত কার্যকলাপ সহজ করে সামাজিক কার্যকারিতা বাড়িয়ে দেয়।

মানুষ একে অপরকে যত বিশ্বাস করবে সামাজিক পুঁজি তত বাড়বে। গুণগত ঐতিহাসিক তথ্য ও সমকালীন পরিমাণগত উপাত্ত এ ধারণাকে সমর্থন করে। সামাজিক পুঁজির অপ্রতুলতার ফলেই বাংলাদেশ অঞ্চলে বৃহৎ সাম্রাজ্য খুব অল্প ক্ষেত্রেই টেকসই হয়েছে। অধিকাংশ সময়েই খণ্ডরাজ্য ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক নিয়তি। নাথ, রাত, খড়গ, চন্দ্র, বর্মণ, পট্টিকেরা ও ভদ্র বংশের মতো ছোট রাজ্যগুলিই বারবার বাংলাদেশের মাটিতে বুনো ফুলের মতো ফুটেছে ও ঝরে পড়েছে। বাংলায় বারবার মাৎস্যন্যায়ের মতো রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দিয়েছে। মোগল ঐতিহাসিক আবুল ফজল বাংলাকে ‘বুলঘকখানা’ বা দাঙ্গা-হাঙ্গামার ঘর বলে আখ্যায়িত করেছেন। এসবের পেছনে রয়েছে সামাজিক পুঁজির ঘাটতি। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় এখনো বাংলাদেশের মানুষের পারস্পরিক আস্থা কম। ১৯৯৯-২০০১ সময়কালে পরিচালিত একটি সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে যে বাংলাদেশে মাত্র ২৩.৫ শতাংশ মানুষ একে অপরকে বিশ্বাস করে। অর্থাৎ ৭৬.৫ শতাংশ মানুষের মধ্যে এ ধরনের আস্থা নেই। বিশ্বের ৮০টি দেশে এ সমীক্ষা পরিচালিত হয়। বাংলাদেশে পারস্পরিক আস্থার হার ৮০টি দেশের গড় হারের চেয়ে প্রায় ১৫ শতাংশ কম (খান, ২০১১, ১১৩)। একমাত্র সান্ত্বনা হলো এই যে ফ্রান্সে মাত্র ২২.২ শতাংশ মানুষ একে অপরকে বিশ্বাস করে। ফ্রান্স। দীর্ঘদিন ধরে এই পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের ঘাটতির মাশুল দিয়েছে । ফ্রান্সের অধিবাসীদের মতো বাংলাদেশের মানুষেরাও সৃজনশীল, তবে একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন, উৎকেন্দ্রিক ও অগোছালো।

একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে একটি বড় প্রশ্ন হলো, সামাজিক পুঁজির এ অপ্রতুলতা নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে আজকের বিশ্বব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব কি না। সামাজিক পুঁজি শুধু রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের জন্যই অত্যাবশ্যক নয়। ভৌত ও মানবিক পুঁজির মতো সামাজিক পুঁজিও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য জরুরি। ফ্রানসিস ফুকুয়ামা তাঁর Trust গ্রন্থে চীন, জাপান ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়নে পারস্পরিক আস্থার সুফল চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন (ফুকুইয়ামা, ১৯৯৬)। পারস্পরিক আস্থা ও শ্রদ্ধাবোধ রাজনীতি ও অর্থনীতিতে একটি শুভচক্রের জন্ম দেয়। আস্থার সুফল আরও আস্থার সৃষ্টি করে। প্রশ্ন হলো, দীর্ঘদিন ধরে সযত্নে লালিত অবিশ্বাস ও অনাস্থা কি সহজে অতিক্রম করা সম্ভব হবে? হয়তো সবটুকু করা যাবে না। তবু আশার আলো যে একেবারে নেই তা বলা যাবে না। সমাজবিজ্ঞানীরা বলে থাকেন যে মানুষ বারবার ভুল করতে করতে ঠেকে শেখে (নর্থ, ১৯৯০)। এ রকম ঠেকে শেখার ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসেও ঘটেছে। পাল রাজবংশের উদ্ভবের আগে প্রায় ৫০ বছর ধরে রাজনৈতিক নৈরাজ্য বিরাজ করে। প্রাচীন ভারতে নৈরাজ্যকে মাৎস্যন্যায় বা মাছের মতো অবস্থা বলে বর্ণনা করা হতো। মাছের ভুবনে বড় মাছ যেমন ছোট মাছ গ্রাস করে, তেমনি অরাজক পরিস্থিতিতে দুর্বল জনগোষ্ঠী বড় লোকদের শিকার হয়। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রজারা বা প্রকৃতিপুঞ্জ গোপালকে রাজা নির্বাচন করে। খালিমপুর তাম্রশাসনে তাই লেখা হয়েছে : ‘তারপরে ছিলেন গোপাল। তিনি সমস্ত রাজাদের মাথার মণির মতো ছিলেন। মাৎস্যন্যায় অর্থাৎ অরাজকতা দূর করার জন্য প্রজারা তাকে রাজা নির্বাচিত করেছিলেন। পূর্ণিমা রাতের জ্যোৎস্নার অতিরিক্ত সাদা রং তার স্থায়ী কীর্তির অনুকরণ করতে পারত।’ (শাস্ত্রী, ১৯৯২, ১০৩)।

বাংলার ইতিহাসে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঐক্য অনেক দিন টিকেছে; আবার অনেক সময় ঐক্য অতি অল্প সময়ে উবে গেছে। তবে পালরা প্রায় ৪০০ বছর রাজত্ব করেছে। এই রাজনৈতিক ঐক্যই সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল। তার কারণ, পালরা ছিল পরমতসহিষ্ণু ও উদার। তাই বৌদ্ধ হয়েও পালদের পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের সমর্থন শতাব্দীর পর শতাব্দী অটুট রাখা সম্ভব হয়েছে। পালদের ইতিহাস প্রমাণ করে যে শুধু নির্বাচনই যথেষ্ট নয়; উদারনৈতিক মূল্যবোধ ছাড়া রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা টেকসই হয় না। আজ ১৪১৮ বঙ্গাব্দের উষালগ্নে দাঁড়িয়ে বারবার মনে প্রশ্ন জাগছে, আমরা আমাদের অতীত থেকে কি কিছু শিখছি না, ভবিষ্যতেও কি অতীতের ভুলগুলো বারবার পুনরাবৃত্তি করতে থাকব? দার্শনিক জর্জ সান্তায়ানা (George Santayana) যথার্থই লিখেছেন, ‘Those who do not remember the past are condemned to repeat it.’ (ইতিহাস থেকে যারা শিখে না তারা একই ভুল বারবার করে থাকে।)

৩. বাইরের অভিঘাতের মোকাবিলায় কৌশল

কবি লিখেছেন, এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ তবু রঙ্গে ভরা। এতক্ষণ ভঙ্গের কথা বললাম, এখন বাংলার ইতিহাসের রঙ্গের কথা বলি। বাংলার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় রঙ্গ হলো এর ইতিহাসের স্ববিরোধী প্রবণতাগুলি। বাঙালি সব সময়ই নিজেকে অন্যান্য জাতের তুলনায় শ্রেয় মনে করে। এই অভিব্যক্তির প্রকাশ দেখা যায় উনবিংশ শতাব্দীতে, যখন বাঙালিরা দাবি করত, ‘What Bengal thinks today, the rest of India thinks tomorrow.’ এই প্রত্যয়েরই প্রকাশ দেখতে পাই সপ্তদশ শতকের কবি আব্দুল হাকিমের রচনায়। তিনি লিখেছেন :

যে সব বঙ্গেত জন্মে হিংসে বঙ্গবাণী।
সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি ॥
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়।
নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশে ন যায় ॥

বাঙালিরা মনে করে যে তাদের কৃষ্টি, আচার-অনুষ্ঠান, তাদের শিল্প সাহিত্য-সংগীত ও তাদের জীবনযাত্রা একান্তই তাদের নিজস্ব সৃষ্টি। এগুলি ষোলো আনাই বাঙালির সম্পত্তি, এতে অন্য কারও কোনো অবদান নেই। ভালো করে তলিয়ে দেখলে এ কথা স্পষ্ট হবে যে আমরা যাকে একান্তই বাঙালির নিজস্ব বলে মনে করি, তাদের অধিকাংশেরই স্ফুরণ ঘটেছে বাইরের জগতের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায়। যা কিছু খাঁটি বাঙালি বলে আমরা বড়াই করি, তার অধিকাংশই গড়ে উঠেছে বাইরের উপাদানের সঙ্গে সংমিশ্রণে ।

প্রথমে পয়লা বৈশাখের কথা বলি। পয়লা বৈশাখ বঙ্গাব্দের নববর্ষ। ভারতের সর্বত্র কিন্তু বৈশাখ বছরের প্রথম মাস নয়। শকাব্দ বা বিক্রম সংবর্ত যারা অনুসরণ করেন তাঁদের জন্য পয়লা চৈত্র নববর্ষ। তাই উত্তর প্রদেশ, হিমাচল প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, রাজস্থান, বিহার, হরিয়ানা, ছত্তিশগড়, অন্ধ্র প্রদেশ, কর্ণাটক ও মহারাষ্ট্রে বৈশাখ বছরের দ্বিতীয় মাস। উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে, গুজরাটি পঞ্জিকায় বৈশাখ সপ্তম মাস। বঙ্গাব্দ প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত বাংলার পণ্ডিতেরা নেননি। সম্রাট আকবর বঙ্গাব্দ প্রবর্তন করেন ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে। তবে এ সনের হিসাব শুরু হয় সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহণের বছর, অর্থাৎ ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ বা ৯৬৩ হিজরি সাল থেকে। কেননা এই সনকে ভিত্তি করেই সম্রাটের সম্মানে চালু হয়েছিল তারিখে ইলাহি (সম্রাটের সন)। তবে নতুন সন প্রবর্তনের প্রণোদনায় শুধু সম্রাটের অমরত্বের মোহই ছিল না, এর পেছনে বাস্তব আর্থিক তাগিদ ছিল। ভারতের মুসলমান শাসকেরা চান্দ্রমাস-ভিত্তিক হিজরি সন অনুসরণ করে খাজনা আদায় করতেন। অথচ ফসল ফলত সৌরচক্র অনুসারে। চান্দ্র সনে সৌর সনের চেয়ে ১১ দিন কম। ঘূর্ণমান পঞ্জিকার ভিত্তিতে রায়তদের খাজনা দিতে অসুবিধা হতো। তাই ৯৬৩ হিজরিতে প্রবর্তিত তারিখে ইলাহিকে ভিত্তি করে চালু হলো বাংলা সন। তবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, বছর শুরু হবে হিজরি সনের প্রথম মাস মহরম থেকে। সে বছর মহরম ছিল বৈশাখ মাসে। কিন্তু তখন বাংলায় প্রচলিত শকাব্দের প্রথম মাস ছিল চৈত্র। সম্রাটের হুকুমে চৈত্র প্রথম মাসের মর্যাদা হারাল। উপরন্তু বাংলা সনের ভিত্তি সৌর বছর হওয়াতে প্রতি ৩৩ বছর পর বাংলা সন হিজরি সনের এক বছর পেছনে পড়তে থাকে।

ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলা সন হিন্দু কিংবা মুসলমান কারও কাছেই গ্রহণযোগ্য নয়। হিজরি পঞ্জিকায় কোনো পরিবর্তন মুমিন মুসলমানদের জন্য বেদাত। পৌত্তলিক সৌর সনও অগ্রহণীয়। আর তারিখে ইলাহির প্রবর্তক শেরেকের দোষে দুষ্ট। অন্যদিকে সনাতনপন্থী হিন্দুদের পক্ষে যবনদের পঞ্জিকা মেনে নিয়ে চৈত্রের পরিবর্তে মহরম মাসের অনুকরণে বৈশাখকে বছরের প্রথম মাস হিসেবে মেনে নেওয়া অনাচার। তবু বাংলা সন টিকে গেল। বাঙালি কবি সযত্নে বৈশাখকে আবাহন করলেন, ‘এসো হে বৈশাখ, এসো, এসো’। এ সন হিন্দুরও নয়, মুসলমানেরও নয়। এ পঞ্জিকা উভয়ের ঐতিহ্য ও বিশ্বাসের মিশেল। এর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো, এটি বাঙালির প্রয়োজন মিটিয়েছে। তাই এটি স্বদেশি না বিদেশি, তা নিয়ে বাঙালি মাথা ঘামায়নি।

পরস্পরবিরোধী শক্তির সমন্বয় সাধনায় বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি হলো বাংলা ভাষা। জন্মলগ্নেই এ ভাষার টুটি চেপে ধরেছে সমাজপতি ও ধর্মীয় নেতারা। হিন্দু ব্রাহ্মণরা বিশ্বাস করতেন যে সংস্কৃত হচ্ছে দেবতাদের পবিত্র ভাষা। সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা বাংলা কলুষিত। এ ভাষায় ধর্মের পবিত্র বাণী চর্চা নিষিদ্ধ। শাস্ত্রকারের বিধান দিলেন,

অষ্টাদশ পুরাণাণি রামস্য চরিতানি চ
ভাষায় মানব শ্রুত্বা রৌরব নরকং ব্ৰজেৎ।

অর্থাৎ রামায়ণ এবং অষ্টাদশ পুরাণের কথা কেউ বাংলায় শুনলে রৌরব নরকে যেতে হবে। অন্যদিকে মুসলমান আলেম-ওলামারা ফতোয়া দিলেন যে কোরআন-হাদিসের পবিত্র বাণী বাংলা ভাষায় চর্চা করলে নির্ঘাত দোজখে যেতে হবে। সপ্তদশ শতকের কবি শেখ মুত্তালিব তাই লিখেছেন :

মুসলমানি শাস্ত্রকথা বাঙ্গালা করিলুঁ
বহু পাপ হৈল মোর নিশ্চয় জানিলুঁ।

কিন্তু ব্রাহ্মণ ও ওলামাদের বাধা টেকেনি। মুসলমান সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলি বাংলায় অনূদিত হলো। আলেমদের ফতোয়া অগ্রাহ্য করে মুসলমানদের ধর্মীয় গ্রন্থগুলি বাংলায় ভাষান্তরিত হলো। হিন্দু মুসলমানের প্রাণের ভাষা হিসেবে বাংলা আত্মপ্রকাশ করল। সংস্কৃত ও পালি শব্দভান্ডারের সঙ্গে আরবি, ফারসি, উর্দু, হিন্দি শব্দ যোগ করে এর জয়যাত্রা শুরু। পরবর্তীকালে সাত সমুদ্র তেরো নদী দূরের দেশের ইংরেজি, ফরাসি ও পর্তুগিজ ভাষা একে আরও ঋদ্ধ করল । সমন্বয় ও সংমিশ্রণের মাধ্যমে বাংলা বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষার মর্যাদা অর্জন করল।

বাঙালিদের আরেকটি গর্বের বিষয় হলো তাদের রন্ধনপ্রণালি । আমাদের অনেকের মধ্যেই একটি ভুল ধারণা রয়েছে যে বাঙালির রন্ধনশৈলী আবহমান কাল থেকে গড়ে উঠেছে। এ ধারণা মোটেও সঠিক নয়। আজকের বাঙালি রান্নার প্রধান উপকরণ হচ্ছে মরিচ। মরিচকে দুই ভাগে ভাগ করা হয় : (১) লংকামরিচ ও (২) গোলমরিচ। লংকা বা লাল মরিচ আমেরিকা থেকে ভারত ও এশিয়ার পুরোনো ভুবনে আসে। আবুল ফজলের আইন-ই আকবরী থেকে দেখা যাচ্ছে যে সম্রাট আকবরের জন্য যে রান্না হতো তাতে কোনো লাল মরিচ ব্যবহার করা হতো না, কেননা লাল মরিচ তখনো ভারতে পৌঁছায়নি। সম্রাট আকবরের জন্য গোলমরিচ দিয়ে শাক রান্না হতো। ভেবে দেখুন, পোড়া লাল মরিচ দিয়ে সম্রাটকে যদি এক বেলা শাক খাওয়ানো যেত, তাতে কত বড় ইনাম পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল! চিন্তা করে দেখুন, সোনার বাংলায় আমাদের পূর্বপুরুষেরা গোলমরিচ-যুক্ত বা মরিচবিহীন রান্না মাছ সারা জীবন গলাধঃকরণ করেছেন। গোলাম মুরশিদ জানাচ্ছেন, ‘সতেরো শতকের আগে লঙ্কা মরিচের প্রচলন বঙ্গদেশে বা ভারতবর্ষে হয়নি’ (২০০৮, ৪৯৮)। আলু, টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি এখন হেঁশেলে গড়াগড়ি যাচ্ছে। অথচ এরা গত কয়েক শতাব্দী ধরে বাইরে থেকে এসেছে। বাঙালির প্রিয় রসগোল্লার আত্মপ্রকাশ ঘটেছে উনবিংশ শতকে। কেউ বলেন, রসগোল্লা পর্তুগিজদের অবদান; আবার কেউ কেউ বলেন, রসগোল্লা এসেছে উড়িষ্যা থেকে। তবে রসগোল্লা বঙ্গজ–এ দাবি এখন পর্যন্ত কেউ করছেন না। মিনিকেট চালের ভাতের সঙ্গে ফুলকপির ভাজি আর টমেটো সহযোগে তেলাপিয়া মাছের ঝাল ঝোল খেয়ে ঢেকুর তুলে কোনো বাঙালি যদি মনে করে যে তার খাদ্য চিরায়ত বাঙালি ঐতিহ্যের অঙ্গ, তবে সে ভুল করবে। কালের বিবর্তনে বাঙালির রান্না বিভিন্ন দেশের উপাদান নিয়ে মুখরোচক হয়ে উঠছে। এতে আতঙ্কের কোনো কারণ নেই।

এবার পোশাকের কথা বলি। বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের সবচেয়ে পছন্দের পোশাক হলো ‘পাঞ্জাবি’। নাম থেকেই বোঝা যায় এতে বাঙালিত্ব নেই। আশার কথা, বাঙালি মেয়েদের অনেকেই এখনো শাড়ি পরেন, তবে এ শাড়ি আবহমান বাংলার শাড়ি নয়। বাংলার চিরাচরিত শাড়ি সম্পর্কে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ঠিকই লিখেছেন, ‘আমাদের স্ত্রী লোকেরা যে কাপড় পরে, তাহা না পরিলেও হয়।‘’ ‘পেটিকোট এবং ব্লাউজ-বিহীন একমাত্র শাড়ি-সর্বস্ব পোশাক’ সম্পর্কে বলা হতো ‘দশ হাত কাপড়ে স্ত্রীলোক লেঙটো’। এ অবস্থা থেকে বাঙালি রমণীদের উদ্ধার করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বৌদি ও সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী। তিনি মহারাষ্ট্র ও গুজরাটের পারসি মহিলাদের কাছে বিলাতি ধাচে ব্লাউজ পেটিকোটসহ পশ্চিম ভারতীয় কায়দায় শাড়ি পরা রপ্ত করেন। সভ্যভাবে শাড়ি পরার কায়দা প্রবর্তন করে তিনি বঙ্গ ললনাদের আব্রু রক্ষা করেন (মুরশিদ, ২০০৮, ৪৭৮)। কাজেই আজকের শাড়িও বাঙালির একান্ত নিজস্ব পোশাক নয়।

৪. উপসংহার

সাহিত্য থেকে সংগীত, দর্শন থেকে চিত্রকলা সর্বত্র বাঙালি দেশজের সঙ্গে বহিরাগত উপাদানের সমন্বয়ের সাধনা করেছে। সমাজতত্ত্ববিদ বিনয় সরকার বলেছেন, ‘এক হিসাবে আধুনিক বাংলা সাহিত্য আগাগোড়া প্রায় সবই পাশ্চাত্য (বিশেষত বিলাতি) সাহিত্যের নকল। যেখানে নকল দেখা যায় না সেখানে আছে প্রভাব।‘’ বিনয় সরকারের এই উক্তিতে অবশ্যই অতিরঞ্জন রয়েছে। তবু এ মূল্যায়নকে একেবারে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়।

তবে দেশজ উপাদানের সঙ্গে বাইরের প্রভাবের সমন্বয় শুধু শিল্প, সাহিত্য বা দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে সীমাবদ্ধ নয়। এ ধরনের সমন্বয় সংগীতের ক্ষেত্রেও স্পষ্ট। বেহালা-হারমোনিয়ামের মতো বাদ্যযন্ত্র পশ্চিম থেকে এসেছে। অনেক গানে, বিশেষ করে কোনো কোনো রবীন্দ্রসংগীতে পাশ্চাত্য সংগীতের অনুরণন শোনা যায়, রবীন্দ্রসংগীতের ওপর বিলাতি গানের প্রভাব বিশ্লেষণ করতে গিয়ে মুরশিদ যথার্থই লিখেছেন, ‘…বিলাতে তিনি যে ফোক সং শুনেছিলেন এবং শিখেছিলেন, সেসব গান হলো কথাপ্রধান। সুরে সুরে অনেক কথা বলে যাওয়ার মতো। বাংলায় কীর্তন ও বাউল গান ছাড়া এ ধরনের কথাপ্রধান গান ছিল না। বাংলা গানে সুর কথাকে ছাপিয়ে যেতো। রবীন্দ্রনাথ বিলেতি আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে কথাপ্রধান গান লিখলেন।’ (২০০৮, ৩৩৪)। বাংলা ভাষায় বিদেশি শব্দের অবদান সুবিদিত। তবে বাঙালি লেখকেরা তাদের গুরু ভারতচন্দ্রের মান রেখেছেন। তারা বিদেশি শব্দ ব্যবহার করে তাদের লেখাকে অনেক রসাল করেছেন এবং প্রসাদগুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন। এ ধরনের সৃজনশীল আত্তীকরণের অজস্র উদাহরণ বাঙালি জীবনের সব ক্ষেত্র থেকেই দেওয়া যেতে পারে। বাঙালি কূপমণ্ডুক নয়। বাঙালিরা তাদের মনের বাতায়ন কখনো বন্ধ করে রাখেনি।

ঐতিহাসিকদের পশ্চাদমুখী ভবিষ্যৎদ্রষ্টা বা a prophet looking backwards রূপে বর্ণনা করা হয়ে থাকে। অতীতের প্রবণতা থেকে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্রক্ষেপণ সম্ভব। তবে একই সঙ্গে বর্তমানে যেসব পরিবর্তন ঘটছে তা-ও বিবেচনায় নিতে হবে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে দুটি পরিবর্তন বিশেষভাবে লক্ষণীয়। প্রথমত, বিশ্বায়ন পরকে আপন না করলেও দূরকে নিকট করেছে। যোগাযোগব্যবস্থায় বিপ্লবের ফলে বাইরের জগতের যেকোনো পরিবর্তনের প্রভাব অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। কাজেই বিশ্বব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। বিশ্বই শুধু আমাদের কাছে আসছে না। আমরাও বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছি। এই মুহূর্তে প্রায় ৭৫ লাখ বাংলাদেশি দেশের বাইরে নববর্ষের দিন কাটাচ্ছে। হয়তো পান্তা ভাত ও ইলিশ মাছ তাদের কপালে জুটছে না। তবু পয়লা বৈশাখ তাদের হৃদয়ে দীপ্যমান। এই বিশাল জনগোষ্ঠী বাংলাদেশকে বাইরের জগতের সঙ্গে অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। জাত্যভিমানের চোরাবালিতে বাঙালিদের আজ মুখ লুকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। অতীত ইতিহাসের কোনো পর্যায়েই বিশ্বের সঙ্গে বাঙালির এত নিবিড় বন্ধন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অবশ্য বাঙালিরা কখনো বাইরের জগৎকে বর্জন করেনি। আবার বাঙালিরা বাইরের জগতের কাছে তাদের সত্তাও কখনো বিকিয়ে দেয়নি। বাঙালি অনুকরণে বা হনু-করণে বিশ্বাস করে না। বাঙালির সাধনা বৈশ্বিকের সঙ্গে স্থানিকের সমন্বয়। এই সমন্বয়ের মাধ্যমেই বাঙালি পরিবর্তন সত্ত্বেও তার সত্তা বাঁচিয়ে রেখেছে। বাইরের অন্ধ অনুকরণ বা বিশ্বায়নের সঙ্গে সংঘাত কোনোটিই বাঙালির ঐতিহাসিক চরিত্রের সঙ্গে খাপ খায় না। বাইরের সঙ্গে ভেতরের সমন্বয়ের সাধনা বাংলার ইতিহাসের একটি বড় শক্তি।

বাঙালির জীবনে দ্বিতীয় বড় পরিবর্তন হলো সাম্প্রতিক কালে বাংলার ভৌগোলিক পরিবেশের অস্বাভাবিক পরিবর্তন। এককালে বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন, ‘বাঙালীর ইতিহাস চাই, নহিলে বাঙালী বাঁচিবে না।’ আজ জীবিত থাকলে তিনি বলতে বাধ্য হতেন, বাঙালীর ভূগোল বাঁচাইতে হইবে, অন্যথায় বাঙালী বাঁচিবে না। অতুল রূপরাশি নিয়ে পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যাদের মতো হারিয়ে গেছে বাংলার অসংখ্য নদ-নদী। শুকিয়ে যাচ্ছে ভাটি অঞ্চলের বিল, হাওর ও বাওড়। বাঙালির ভৌগোলিক অস্তিত্বের প্রতি হুমকি আসছে সব দিক থেকে। বাংলার দক্ষিণ ও মধ্য অঞ্চলের দিগন্তে আজ জলবায়ু পরিবর্তনের অশনিসংকেত। উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিমে নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহ বারবার অবরুদ্ধ হচ্ছে; অববাহিকার উজানে চলছে স্পর্শকাতর বনাঞ্চল ধ্বংসের দক্ষযজ্ঞ। এহেন অতি নাজুক ৫৫ হাজার বর্গমাইলে ১৬ কোটির বেশি মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটাতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও মনে রাখা দরকার যে বিশ্বায়িত অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতা করে আমাদের বাঁচতে হবে। এখানে টিকে থাকার প্রথম শর্ত হলো নিজের শক্তিতে বলিয়ান হওয়া। আজ তাই বাঙালির সবচেয়ে বড় প্রয়োজন শক্তিশালী সংগঠন। অথচ বাঙালির প্রবল ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের তোড়ে প্রতিষ্ঠানগুলি বারবার ভেসে যাচ্ছে। ব্যক্তিস্বাধীনতা ছাড়া বাঙালির অস্তিত্ব অর্থহীন। অন্যদিকে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান ছাড়া বাঙালি আজকের বিশ্বে টিকে থাকতে পারবে না। পাল শাসনের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখতে পাই যে গণতন্ত্রের ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত উদারনৈতিক ও পরমতসহিষ্ণু রাষ্ট্রব্যবস্থা অনেক দিন টিকে থাকতে পারে। প্রশ্ন হলো গোপালের নির্বাচনের মতো ঐকমত্যের রাষ্ট্রব্যবস্থার পুনরাবৃত্তি সম্ভব হবে কি?

অতীতের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাঙালিরা সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে দেশজ ও বহিরাগত সংস্কৃতির মধ্যে অপূর্ব সমন্বয় করেছে। অথচ রাজনীতির ক্ষেত্রে তার অন্তর্দ্বন্দ্বগুলি নিরসন করতে পারেনি। মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লরেন্স জিরিং (১৯৯২, ১) ঠিকই লিখেছেন, ‘Bangladesh is a country challenged by contradictions.’ (বাংলাদেশ স্ববিরোধিতায়– জর্জরিত একটি দেশ)। এই স্ববিরোধিতার সবচেয়ে বড় দ্বন্দ্বটি চলছে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে, ব্যক্তিস্বার্থের সঙ্গে গোষ্ঠীস্বার্থের এবং ঐক্যের সঙ্গে বিভক্তির। এই দ্বন্দ্বের সুচারু নিরসনের ওপরই নির্ভর করবে আগামী দিনের বাঙালির ইতিহাসের গতিধারা।

.

উল্লেখিত রচনাবলি (Works Cited)

খান, আকবর আলি। ২০১১। অন্ধকারের উৎস হতে। ঢাকা : পাঠক সমাবেশ।

––। ২০০৪। বাংলাদেশের সত্তার অন্বেষা। ঢাকা: বাংলা একাডেমী।

গিডেন্স, অ্যান্টনি (Giddens, Anthony) ১৯৯৯। Runaway World. London: Profile Books.

জিরিং, লরেন্স (Ziring, Lawrence)। ১৯৯২। Bangladesh From Mujib to Ershad. Dhaka: University Press Ltd.

দাশ, আশা। ১৯৬৯। বাংলা সাহিত্যে বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতি। কলকাতা: ক্যালকাটা বুক হাউস।

দাসগুপ্ত, বিপ্লব। ২০০৪। বাঙালি জাতি ও বাংলা ভাষা। কলকাতা: দে’জ পাবলিশিং।

নর্থ, ডগলাস সি (North, Douglas C.)। ১৯৯০। Institutions, Institutional Change and Economic Performance. New York: Cambridge University Press.

পুটনাম, রবার্ট ডি (Putnam, Robert D.)। ১৯৯৩। Making Democracy Work. Princeton: Princeton University Press.

ফুকুয়ামা, ফ্রানসিস (Fukuyama, Francis)। ১৯৯৫। Trust. New York: Simon and Schuster

ব্যাশাম, এ. এল. (Basham A. L.)। ১৯৫৯। The Wonder That Was India. New York: Grove Press.

মজুমদার, আর. সি. (Majumdar R. C) (সম্পাদিত)। ১৯৬৩। History of Bengal. vol.1, Dhaka: University of Dhaka.

মুখোপাধ্যায়, ব্রতীন্দ্রনাথ। ২০০০। বঙ্গ, বাঙালী ও ভারত। কলকাতা: প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স।

মুরশিদ, গোলাম। ২০০৮। হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি। ঢাকা: অবসর।

রায়, নীহাররঞ্জন। ১৪০০ বঙ্গাব্দ। বাঙ্গালীর ইতিহাস: আদি পর্ব। কলকাতা : দে’জ পাবলিশিং।

শাস্ত্রী, অশোক চট্টোপাধ্যায়। ১৯৯২। পাল অভিলেখ সংগ্রহ। কলকাতা : পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ।

সরকার, বিনয়। ২০০৩। বিনয় সরকারের বৈঠকে। কলকাতা : দে’জ পাবলিশিং।

সেন্দেল, ভেলেম ভান (Willem Van Schendal)। ২০০৯। A History of Bangladesh. Delhi: Cambridge University Press.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *