১৩. মহীয়সী

১৩. মহীয়সী

[এক]

কোনোভাবেই ঘুম আসছে না চোখে। ঘরময় পায়চারি করতে করতে হোসেন যখন শরীরটাকে বিছানায় এলিয়ে দিতে এলো, তখন মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে। গোটা তল্লাট মরণ-ঘুমে আচ্ছন্ন। হেমন্তের দীর্ঘ রাত, দৃষ্টির অনুকূলে কুয়াশার ঘন আবরণ ব্যতীত আর কোনোকিছুই দৃশ্যমান নয়। নিবিড় নিস্তব্ধতার এই নৈশপ্রহরে বহুদূর থেকে ভেসে আসা কয়েকটা খাকি শেয়ালের অস্পষ্ট হাঁকডাক ছাড়া তামাম ধরণিই থমথমে হয়ে আছে যেন।

খাটের সাথে লাগোয়া জানলাটা খুলে দেয় হোসেন। জানলা খুলবার সাথে সাথে বরফ-জমা বাতাস হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে তার বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেয়। বাইরে নিশ্চপ অন্ধকার। সেই অন্ধকারে দৃষ্টি ফেললে দৃষ্টি ফেরত আসে–এমন নিবিড় আর ঘন তার আস্তরণ। হোসেন ধপ করে জানলাটা আটকে দিয়ে খাটের ওপর এসে বসে। চোখে তার একফোঁটা ঘুম নেই। আগামীকাল যে ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে, তার আনন্দের আতিশয্যে হোসেন আত্মহারা প্রায়।

এবারে মনে হচ্ছে কিছু একটা হবে। ঢাকা শহরের নামকরা এক সাপ্তাহিক পত্রিকা থেকে তার ডাক এসেছে। এমন একটা জায়গায় যদি কাজ জুটে যায়, হোসেনের জীবন থেকে দীর্ঘদিনের বেকারত্বের অভিশাপ বিদায় নেবে। আর তা ছাড়া, মিডিয়ায় কাজ করাটাও হোসেনের বহুদিনের লালিত স্বপ্ন। স্বপ্ন আর সামথ্যের সম্মিলিত যোগসাজশ হোসেনের জীবনে খুব একটা ঘটেনি।

দিন কয়েক আগে এক অদ্ভুত মানুষের সাথে দেখা হয় হোসেনের। মানুষটাকে আশেপাশের কোনো এলাকার বলে চিহ্নিত করা গেলো না। হতে পারে দূরের কোনো এক জেলা থেকে নিতান্তই পথ ভুল করে এদিকে চলে এসেছেন। কিন্তু মানুষটার ধারণা সে এই পৃথিবীর কোনো জীব নয়, অন্য কোনো গ্রহ থেকে দুর্ঘটনাক্রমে এই গ্রহে ছিটকে আসা কোনো এক হতভাগা! সবাই তাকে পাগল ভেবে হাসি-তামাশা করে বিদেয় হলেও, ঘটনাটায় হোসেনের ভারি আগ্রহ জন্মালো। লোকজন সরে গেলে সে মানুষটার আরও কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে তার হাবভাব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। লোকটাকে দেখে তার দাবির সত্যতা নিয়ে ঘোরতর সন্দেহ করবার অবকাশ থাকে। মুখে চাপা দাড়ি, গায়ে পাঞ্জাবি-পায়জামা, উস্কোখুস্কো চুল এবং পথভারে ক্লান্ত চেহারা–এসবের কোনোটাই ভিনগ্রহী বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। তবুও হোসেন সরে যায় না, লোকটার প্রতি তার একটা অন্যরকম মায়া জন্মায়।

লোকটা বিড়বিড় করে বলে, ‘উহ, এই সূর্যের আলো এমন কটকটে কেন? আমাদের দুনিয়ার সূর্যের আলো কতো মোলায়েম আর স্নিগ্ধ! আজলা ভরে নিয়ে ওই আলো পান করা যায়, ওই আলোতে ডুব দেওয়া যায়। আমাদের সূর্যটা কতো সুন্দর, কিন্তু এই সূর্যটা এতো বিতিকিচ্ছিরি কেন?’

হোসেন হাসলো। হাসার মতোই ব্যাপার! এমন ভারি অদ্ভুত কথা হোসেন আগে। কোনোদিন শোনেনি। একবার মনে হলো, লোকটার কাছে কিছু জানতে চাইলে কেমন হয়? কিন্তু সে খেয়াল করেছিলো লোকটা কারও সাথে কথা বলে না, কারও কথার কোনো উত্তর দেয় না, কেবল নিজে নিজে বিড়বিড় করে।

বিকেল গড়াতেই পৌরসভা থেকে একটা গাড়ি এসে লোকটাকে তুলে নিয়ে গেলো। লোকটার ঠিকানা পাওয়া গেছে বলে জানা যায় এবং আরও জানা যায়, লোকটা একইসাথে মানসিক ভারসাম্যহীন, ইনসমনিয়ার রোগী। সারারাত জেগে থাকে, আবোল-তাবোল বকে আর সারাদিন মোষের মতো ঘুমায়।

ঘটনাটা দাগ কেটেছিল হোসেনের মনে, বিশেষ করে লোকটার অদ্ভুত কথাগুলো। আগে থেকে তার টুকটাক লেখাজোখার অভ্যেশ ছিলো, অদ্ভুত লোকটার অদ্ভুত ঘটনাকে নিয়ে একটা গল্প লিখে ফেলবার ঝোঁক তার মনে প্রবল হয়ে উঠলো তাই।

সে রাতে ফিরেই হোসেন খাতা নিয়ে বসে পড়লো। ধীরে ধীরে লিখে চললো এক অতি অলৌকিক গল্প। বাস্তবের লোকটা যদিও মানসিক এবং ইনসমোনিয়ার রোগী বলে জানা গিয়েছিলো, কিন্তু হোসেন গল্পটাকে চিত্রায়িত করলো একেবারে ভিন্নভাবে। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে লোকটা নিজেকে অন্যগ্রহের বলে দাবি করছিলো বারবার। হোসেনও গল্পের কাহিনিকে সেদিকে প্রবাহিত করলো। গল্পের উপজীব্য একটা প্রাণী যে দেখতে হুবহু মানুষের মতো হলেও, সে আদতে মনুষ্য-গ্রহের কোনো জীব নয়। তার আবাসস্থল মহাশূন্যের নীহারিকা, গ্রহপঞ্জি, তারকালোক ছাড়িয়ে ভিনগ্রহের কোনো এক ভূতুড়ে জগতে। সেখানকার বাস-পদ্ধতির কোনো এক ত্রুটির কারণে তাকে ছিটকে পড়তে হয় দোপেয়ে মানুষদের এই গ্রহে। কিন্তু সেই ভূতুড়ে গ্রহের প্রাণীটা কীভাবে মানুষের মতো কথা বলছে, কীভাবে মানুষের মতোই তার হাবভাব, গড়ন-গাড়ন সে এক বিরাট রহস্য! সেই রহস্যের মায়াজাল ভাঙতে ভাঙতে এগিয়ে চলে হোসেনের গল্প।

ভিনগ্রহী আগন্তুক শিরোনামের যে গল্পটা হোসেন লিখলো, তার সকলরব প্রশংসা

করলো বন্ধুমহল। আলমগীর বললো, ‘তুই একেবারে ফাটিয়ে দিয়েছিস বন্ধু! দীর্ঘদিন পর এতো ভালো একটা গল্প পড়লাম। ইমপ্রেসিভ!’

শাওনের মুখে লাগামের বালাই থাকে না। কথা বলতে দিলেই ওর মুখে খই ফোটে। হোসেনের গল্প পড়ে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে অসংযত শাওনও নিজেকে বেশ সংযত করে বললো, ‘তুই শালা তো রাতারাতি তারকা বনে যাবি রে হোসেন! কী গল্পটাই না লিখেছিস তুই! সত্যি বলছি।’

মুখরা সমালোচক হিশেবে পরিচিত আড্ডার সাহিত্য-বান্ধব বন্ধু মিজানের মুখেও হোসেনের প্রশংসা-কীর্তন! মিজান বললো, ‘হোসেন, দারুণ একটা গল্প হয়েছে। এটা। আমি একটা পরামর্শ দিই, এটাকে তুই ঢাকার সাপ্তাহিক কোনো কাগজে পাঠিয়ে দে। আমি নিশ্চিত ওরা অনায়েশে ছাপিয়ে দেবে। ভাগ্য ভালো থাকলে সেলামিও পেতে পারিস।’

মিজানের পরামর্শটা মনে ধরলেও, মুখে একপ্রকার উড়িয়েই দিয়েছিলো হোসেন। বলেছিলো, ‘ধুর, কী সব যে বলিস তোরা! এটা আহামরি কিছুই হয়নি। আসলে ওই অদ্ভুত লোকটা থেকে এই গল্পের মূল উপাদান এসেছে বলেই তোদের কাছে গল্পটাকে ভালো লাগছে। পেছনের গল্পটা না জানলে এটা পড়তে পড়তে তোদের হাই উঠে যেতো। কিন্তু তাই বলে ঢাকাইয়া কাগজে লেখা পাঠিয়ে মান-ইজ্জত খোয়াবো, এমন আহাম্মক আমি নই।’

হোসেনের কথা শুনে ছ্যাঁৎ করে উঠলো শাওন। সে নিজে কখনো সোজা কথার সোজা জবাব না দিলেও, অন্যজনের বাঁকা কথা সহ্য করতে সে একদম অনাগ্রহী। রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে সে বললো, ‘হয়েছে জ্বালা! একটুখানি প্রশংসা পেলো, আর এখন এমন অভিনয় করছেন যেন ভাজা মাছটা উল্টে খেতে না জানবার মতোই কচি খোকা তিনি।

শাওনের অগ্নিবাণ নিক্ষেপে হস্তক্ষেপ করে মিজান আবার বলে উঠলো, ‘আমার পরিচিত এক কাকা আছেন ঢাকায়। ভালো একটা প্রেসে কাজ করেন। শেষবার ঢাকা থেকে কাকার সাথে সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘নয়াদিন’-এর অফিসে গিয়েছিলাম। বেশ খাতির-যত্ন পেয়েছিলাম সেদিন আমরা। আমার ধারণা, কাকাকে বলা গেলে কাকা তোমার গল্পটা ছাপাবার একটা বন্দোবস্ত করে দিতে পারবেন।’

শাওনের স্পষ্ট গলা, ‘এতো ভালো গল্পটার জন্য কাকা-চাচার কাছে ধরনা দিতে হবে কেন? ওই পত্রিকার ঠিকানায় আমরা গল্পটা পাঠিয়ে দেখি। ভালো লাগলে ওরা ছাপাবে। ভালো না লাগলে বাদ। অন্য কোথাও দেওয়া যাবে তখন।’

নীরস স্পষ্টবাদী এবং লাগামহীন মুখের অধিকারী হলেও কথাটা খারাপ বলেনি শাওন। আর তা ছাড়া, অন্য কারও সহায়তায় নিজের যোগ্যতা প্রমাণে বাহাদুরি নেই–এ কথা হোসেন জানে। সকলের মতামতও তা-ই, আগে গল্পটা সাপ্তাহিক ‘নয়াদিন’-এ পাঠানো হোক, যা হয় হবে।

পরদিন সকালেই ডাকযোগে হোসেনের গল্পটা ঢাকার নামকরা সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘নয়াদিন’-এর ঠিকানা বরাবর পাঠিয়ে দেওয়া গেলো। এরপর যাপিত জীবনের জাঁতাকলে সকলে যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

বলা নেই, কওয়া নেই একদিন হোসেনের ঠিকানায় একটা চিঠি এসে হাজির। সম্প্রতি সাপ্তাহিক নয়াদিনের সম্পাদক ব্যতীত জীবনে সে কোনোদিন কাউকে কোনো চিঠি লেখেনি। ফলে পৃথিবীতেও এমন কেউ নেই যে হোসেনকে চিঠি লিখতে পারে। নিজের লেখা নিয়ে খুব বেশি আশাবাদী ছিলো না বলেই হয়তো, নয়াদিনে যে একটা গল্প পাঠানো হয়েছিলো এবং তার প্রত্যুত্তরও যে আসতে পারে–তা বেমালুম ভুলে বসেছিলো সে।

চিঠি হাতে নিয়ে যারপরনাই বিস্মিত হলো হোসেন। হলুদ খামের ওপর খুব স্পষ্ট করে, গোটা গোটা অক্ষরে লেখা ‘আদিত্য আদি, সম্পাদক, সাপ্তাহিক নয়াদিন।’ প্রাপকের ঠিকানায় লেখা তার নাম। স্বপ্নও এতো সুন্দর আর এতো আকস্মিক হয় কি না জানে না হোসেন! এতো নামকরা একটা পত্রিকার সম্পাদক তার নামে চিঠি পাঠিয়েছে–তা যেন হোসেনের কাছে সেই মধুর স্বপ্নের মতো, চোখ খুললেই যা হাপিস হয়ে যায়। কিন্তু এই যে হোসেনের সামনে দিয়ে চেঁচাতে চেঁচাতে একটা অটো চলে গেলো, দর্জিবাড়ির উঠোনে ঐ যে ছেলেমেয়ের দল কী এক দারুণ খেলায় হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে, মাথার ওপর দিয়ে সাঁই করে চলে গেলো যে অ্যারোপ্লেন–এ সবকিছু একযোগে কীভাবে স্বপ্ন হতে পারে!

ওটা স্বপ্ন ছিলো না। হোসেন সত্যি সত্যিই নয়াদিন সম্পাদকের চিঠি পেয়েছে। চিঠিতে যা লেখা ছিলো তা হোসেনের এক জীবনে পাওয়া সবচেয়ে সেরা প্রাপ্তি।

সুহৃদ,

আপনার ‘ভিনগ্রহী আগন্তুক’ গল্পটা পড়ে শেষ করলাম। বহুদিন পর চোখ ডুবিয়ে এতো দুর্দান্ত একটা রহস্য গল্প পড়া হলো। গল্পভর্তি যেমন সাসপেন্স আছে, তেমনই আছে পাঠককে শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়ার অসম্ভব ক্ষমতা। আপনার গল্পটা ‘নয়াদিন’-এর আগামী সাময়িকীতে আমরা বিশেষভাবে ছাপাতে চাই। ‘নয়াদিন’-কে বেছে নেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। ‘নয়াদিন’-এ নিয়মিত লিখবেন এই প্রত্যাশী। আপনার জন্যে ছোট্ট একটা উপহার পাঠানো হয়েছে। উপহারটা গ্রহণ করে আমাদের কৃতার্থ করবেন।

ধন্যবাদান্তে
আদিত্য আদি
সম্পাদক, সাপ্তাহিক নয়াদিন।

চিঠির ভেতরে অন্য একটা খামে মোড়ানো পাঁচ হাজার টাকা পাওয়া গেলো। মিজানের কথা বৃথা যায়নি মোটেও। পত্রিকা-অফিস গল্পটার জন্যে ভালো অঙ্কের সেলামিও পাঠিয়ে দিয়েছে। হোসেনের মনে ঈদের দিনের মতো আনন্দ! তার ইচ্ছে করছে দর্জিবাড়ির উঠোনে খেলাধুলোয় মজে থাকা ছেলেপিলের দলে মিশে গিয়ে হেসে লুটোপুটি খেতে। আহ, জীবন মাঝে মাঝে এতো সুন্দর কেন?

মাসখানেক পর হোসেনের ঠিকানায় আরও একটা চিঠি এসে হাজির। প্রেরক আগের জনই–নয়াদিনের সম্পাদক আদিত্য আদি।

সুহৃদ,

ভালোবাসা জানবেন। আপনি জেনে পুলকিত হবেন যে, আপনার ‘ভিনগ্রহী আগন্তুক’ গল্পটি ইতোমধ্যেই পত্রিকায় ছাপানো হয়েছে এবং তা আমাদের পাঠকদের বেশ ভালোবাসা কুড়িয়েছে। আপনার পরবর্তী গল্প পড়ার জন্য মুখিয়ে থাকা পাঠকদের অপেক্ষার প্রহর খুব বেশি দীর্ঘ হবে না_ এই প্রত্যাশা। আর হ্যাঁ, আপনার যদি সময় হয় তাহলে নয়াদিন অফিসে চায়ের নিমন্ত্রণ রইলো। কোনো এক হেমন্ত-সন্ধ্যায় আমরা ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ হাতে দারুণ গল্প-আড্ডায় মেতে উঠবো।

ধন্যবাদান্তে
আদিত্য আদি
সম্পাদক, সাপ্তাহিক নয়াদিন।

হোসেন যেন এক ঘোর-লাগা সময়ের আবেষ্টনীর মাঝে বন্দী হয়ে পড়েছে। তার উদাসী, উচ্ছন্নে যাওয়া সময়গুলো এভাবে প্রাণ ফিরে পাবে, এভাবে সেগুলো চাঞ্চল্যে ভরে যাবে তা এখনো হোসেনের কাছে রূপকথার মতো মনে হয়।

হোসেনের প্রকাশ-ব্যাকুল আনন্দ ছুঁয়ে গেছে তার আড়ার বন্ধুদেরও। ঠোঁটকাটা শাওন ব্যগ্র কণ্ঠে বললো, ‘যা বলেছিলাম তা-ই হলো। হোসেন মিয়া এখন তারকাখ্যাতির পথে আরও একধাপ আগাইয়া গেলো। নয়াদিনের সম্পাদক চিঠি লিখে চায়ের নিমন্ত্রণ দেয়! উহ, কী সৌভাগ্য তোের! বড় হয়ে আমাদের ভুলে যাসনে বন্ধু।’

হোসেন বললো, কিন্তু, আদিত্য আদি সাহেব কী উদ্দেশ্যে আমাকে নিমন্ত্রণ জানালেন তা পরিষ্কার বোঝা গেলো না। তোর কী মনে হয় মিজান?’

মিজান তার স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্য চেহারায় আরও প্রকট করে, শার্টের কোনা দিয়ে চশমার কাঁচ পরিষ্কার করতে করতে বললো, ‘একদম সহজ। এরা বিনা উদ্দেশ্যে খাতির জমাতে কাউকে ডেকে নেয় না। ওদের সময়গুলোও অতো সস্তা নয়। কিছু একটা উদ্দেশ্য তো আলবৎ আছে। আমি মনে হয় বুঝতে পারছি কিছুটা।’

মিজানের পর্যবেক্ষণের ওপরে সকলের গভীর আস্থা আছে। মিজান কোনো বিষয়ে কোনো মন্তব্য করবে, কিন্তু তার পেছনে যথেষ্ট যুক্তি, যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত থাকবে না, তা কখনো হতে দেখা যায়নি। শাওন তাকে যতোই হেসে উড়িয়ে দিক, মনে মনে সকলে, এমনকি শাওনও মিজানের পর্যবেক্ষণলব্ধ উপলব্ধি এবং মতামতকে শ্রদ্ধা করে।

‘বুঝতেই যখন পারছিস, পেটের ভেতরে আটকে রেখেছিস কেন? বলে ফেল না শুনি।’ শশব্যস্ত হয়ে মিজানের দিকে তীক্ষ্ণ কথার বাণ ছুঁড়ে দিলো ধৈর্যহারা প্রকৃতির শাওন।

শাওনের এই প্রকৃতির সাথে সবাই পরিচিত বলে ওর এমন চাঁছাছোলা কটাক্ষ আর তীর্যক মন্তব্যে কেউ তেমন গা করে না।

‘আমার ধারণা, ওরা হোসেনকে পত্রিকার কাজে নিয়োগ দিতে চায়। হতে পারে হোসেনের অনবদ্য গল্পটা পড়ে তাদের ধারণা হয়েছে, এমন ধাঁচের গল্প যে লিখতে পারে, তাকে দিয়ে অনায়েশেই পত্রিকার ব্যাপক কাজ করানো যাবে। নয়তো একজন নবীন লেখককে এতোবড়ো একটা পত্রিকার সম্পাদক যেচে নিমন্ত্রণপত্র পাঠাবেন, এটা কল্পনাতীত। এটা গুরুজী রবীন্দ্রনাথ, উস্তাদজী মুজতবা আলীর বেলাতেও ঘটেনি।’ বললো মিজান।

‘কাজকর্ম বলতে? কেমন ধারার কাজকর্ম?’ পাশ থেকে জিগ্যেশ করলো হাবিব।

‘তোরা আবার ভাবিস না যেন হোসেনকে চা আনা-নেওয়ার কাজে যোগ দিতে বলবে ওরা। প্রতিভার মূল্যায়নে এতোটা কৃপণ ওরা নয়। যোগ্য লোক পেলে ওরা মাটিতেও কামড় দেয়। কাজ বলতে আমি বোঝাতে চেয়েছি, এই যেমন ধর পত্রিকার জন্য ফিচার লেখা, বিশেষ সংখ্যাগুলোর জন্য গল্প লেখা, দরকার হলে মাঝেমধ্যে। অন্যদের লেখায় কলম চালানো। এই আর কী!’

‘তা তো বেশ ভালো কাজ তাহলে। এটা হলে আমাদের হোসেন মিয়ার তো কপাল খুলে যায়। হে হে হে।’ মুখরা শাওনের পুনঃরসিকতা।

[দুই]

কাজ? নয়াদিন পত্রিকায় কাজ করবে হোসেন? যে পত্রিকায় লেখা প্রকাশ করার জন্যে কতো ডাকাবুকো লেখকেরা দিনের পর দিন, রাতের পর রাত অপেক্ষা করে থাকে, সেই পত্রিকার একজন হয়ে উঠবে হোসেন? সত্যিই কি আদিত্য সাহেবের মনে এমন কোনো অভিপ্রায় আছে হোসেনকে ঘিরে?

এমন ঘোর-লাগা সময়ে আসলে ঘুমোনো যায় না। হোসেনেরও ঘুমোনোর তাড়া নেই। মানুষের জীবনে এ রকম রাত খুব বেশি আসে না। যখন আসে, তখন। সেগুলোকে উপভোগ করে কাটাতে হয়। সময়টাকে উপভোগ করতে গিয়েই হোসেনের চোখ থেকে ঘুম পালিয়েছে।

এমন হিমধরা হেমন্ত-নিশীথে ধরণির বুকে আর কেউ বুঝি জেগে নেই একা হোসেন ছাড়া। আজ রাতে আর কারও জীবনে কী আনন্দের কোনো উপলক্ষ্য আসেনি, যা তার চোখের ঘুম কেড়ে নেবে? যা তাকে ভাসিয়ে দেবে অনাবিল আনন্দস্রোতে?

হোসেনের ভাবনায় ছেদ পড়ে। পাশের ঘর থেকে কাশির শব্দ শোনা গেলো মাত্র। গায়ে শাল জড়িয়ে হোসেন এস্তপায়ে শব্দটার অকুস্থলের দিকে হেঁটে গেলো।

আলতো করে ভিজে দেওয়া ঘরের কপাট। নিস্তেজ হয়ে আসা একটা মোমের শরীর থেকে বিচ্ছুরিত মৃদু আলো ঘরটাকে রহস্যময় করে তুলেছে। ওই আলোতে এক নারী ছায়ামূর্তি হোসেনের দৃষ্টিগোচর হয়। জায়নামাযে বসে আছেন হোসেনের মা জাহানারা বেগম। হোসেন দরজায় ঠকঠক শব্দ করে দু’বার।

‘হোসেন?’ মৃদু গলায় জিগ্যেশ করেন জাহানারা বেগম।

‘হ্যাঁ মা, আমি। তুমি জেগে আছো?’

‘হ্যাঁ বাবা। ভেতরে আয়।’

হোসেন ভেতরে এলো। জাহানারা বেগম মোমবাতির প্রায় নিভে যাওয়া আগুন থেকে একটা কুপিবাতি ধরালেন। এতোক্ষণের আলো-আঁধারি ভাবটা কেটে গিয়ে ঘরময় এখন সফেদ আলোর ছড়াছড়ি।

‘ঘুমাসনি কেন?’, পুনরায় জিগ্যেশ করেন জাহানারা বেগম।

‘ঘুম আসছিল না।’

‘ভোরের ট্রেন ধরা লাগবে তা ভুলে গেলি, বাবা?’

‘কই, ভুলিনি তো।’

‘ভুলে না গেলে তো ঘুমানোর কথা। ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখ নিয়ে ট্রেন ধরা যায়?’

‘ও তুমি ভেবো না তো মা। ভাবছি আর ঘুমাবো না আজ। কটা বাজে এখন? তিনটে! রাত তো শেষ হয়ে এলো প্রায়। আর ঘুমিয়ে কাজ নেই।’

জাহানারা বেগম খাটে উঠে বসেন। হোসেন মায়ের কোলে মাথা রেখে বললো, ‘জানো মা, আগামীকালের দিনটা আমার জীবনের পরম আকাঙ্ক্ষিত একটা দিন হয়তো। ওই যে পত্রিকাটার কথা তোমায় বললাম, পুরো দেশে ওদের বেশ নামডাক। যার-তার লেখা ওরা ছাপায় না। বাঘা বাঘা লেখকেরাও ওই পত্রিকায় জায়গা পেতে হিমশিম খায়। সেই তারাই আমার লেখাটা বেশ উৎসাহের সাথে ছাপালো। শুধু কি তা-ই? ভালো অঙ্কের সম্মানি তো দিলোই, সাথে তাদের অফিসে চায়ের দাওয়াত। ভাবো তাহলে কেমন কদর পেয়েছি আমি!’

জাহানারা বেগম অস্ফুট স্বরে বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ! সম্মান দেওয়ার মালিক কেবলই আল্লাহ। তো, তুই কি আনন্দে আত্মহারা হয়ে ঘুমোতে পারছিস না বাবা?’

‘তা যা বলেছো তুমি, মা। আনন্দে আত্মহারা! হা হা হা। একদম ঠিক। আনন্দে আত্মহারা হয়ে আছি বলেই আমার চোখ থেকে ঘুম উধাও হয়ে গেছে। আমার মনে হয় কি জানো, আজ রাতে পৃথিবীতে আমি ছাড়া আর কারও মনে আনন্দ নেই, আর কারও জীবনে আনন্দের কোনো উপলক্ষ্য নেই। পৃথিবীর সব আনন্দ, সব রং আজ কেবল আমার জন্যেই বরাদ্দ।’

ছেলের আনন্দ দেখে জাহানারা বেগমের চোখে পানি এসে যায়। বাপ-মরা ছেলেটা কতো দ্রুতই-না বড় হয়ে গেলো তার। হোসেনের বেড়ে ওঠার পেছনে জাহানারা বেগমের যে সংগ্রাম আর সংযমের গল্প আছে, সেই গল্পটা তার গল্প-লিখিয়ে ছেলে লিখবে কোনোদিন? আজ তার নাম-ডাক চারদিকে, যখন সে অনেক বড় হবে, তখন কি সে তার বুড়ো মা’কে, যে নিজের সবটা দিয়ে তাকে আগলে রেখেছিল শতো ঝড়-ঝঞ্ঝাটে, মনে রাখবে? না রাখলেও কীই বা হবে? প্রাপ্তির আশায় বাবা-মায়েরা সন্তান মানুষ করে না। বাবা-মায়ের ভালোবাসাগুলো হয় নিঃস্বার্থ, নির্লোভ আর নির্ঝঞ্ঝাট।

ঘরে একটা চাপা স্তব্ধতা নেমে এলো। কিছুক্ষণ কারও মুখে কোনো কথা নেই। জাহানারা বেগম ছেলের মাথায় হাত বুলাচ্ছেন পরম মমতায়।

নীরবতা ভেঙে হোসেন বললো, ‘আচ্ছা মা, তুমি কেন জেগে আছো এখনো?’

স্মিত হেসে জাহানারা বেগম বললেন, ‘ছেলের আনন্দের দিনে মায়েরও তো আনন্দ হয়, তাই না বাবা?’

‘তা হয়, কিন্তু…’ জায়নামাযের দিকে তাকিয়ে হোসেন জিগ্যেশ করলো, ‘তুমি এতো রাতে সালাত পড়ছিলে?’

‘হ্যাঁ, তোর জন্যে দুআ করছিলাম আল্লাহর কাছে।’

‘বেশ তো। কী বলছিলে আল্লাহকে?’

‘বলছিলাম আগামীকাল তুই যে উদ্দেশ্যে যাচ্ছিস, তাতে যদি তোর জন্যে কল্যাণ থাকে, তবেই যেন তোর ওখানে মন টিকে। যদি তোর জন্যে কল্যাণ না থাকে, তবে তোর মনটাকে যেন আল্লাহ ওখান থেকে ফিরিয়ে দেন।’

জাহানারা বেগমের অদ্ভুতুড়ে দুআর কথা শুনে মনে মনে হাসলো হোসেন। সে ভাবে, ‘আমার আবার ওখানে মন টিকবে না! কতো আরাধ্য সে জগৎ! কতো দীর্ঘ রজনী তপস্যা করলে ও জগতে ঠাঁই পাওয়া যায়! এমন স্বপ্ন আর সৌভাগ্যকে পায়ে ঠেলবে–এতোটা আহাম্মক হোসেন নয়।’

[তিন]

‘কাকে চাই?’, দারোয়ান মতো একজন একপ্রকার তেড়ে এসে প্রশ্নটা করলো হোসেনকে।

‘আমি নয়াদিনের সম্পাদক আদিত্য আদি সাহেবের সাথে দেখা করতে এসেছি।’

‘কী নাম?’’

‘মোহাম্মদ হোসেন।’

‘ওই যে বেঞিটা দেখছেন, চুপচাপ ওখানে গিয়ে বসে পড়ুন। ভেতর থেকে ডাক আসলে আমি বলব,’ শাসনের সুরেই কথাগুলো বললো লোকটা। বলে অবশ্য বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারলো না। নতুন আরেক আম-আদমির আগমন দেখে ওদিকেই ছুট লাগাতে হলো তাকে। তাকেও প্রশ্ন করলো, ‘কাকে চাই?’

লোকটার কাঁচুমাচু উত্তরে সন্তুষ্ট হতে না পেরে তাকেও আগের বেঞিটা দেখিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করতে বলা হলো।

খানিক বাদে একপ্রকার ছুটে এলো সেই লোকটা।

‘আপনাদের মধ্যে হোসেন কে?’

হোসেন দাঁড়িয়ে বললো, ‘আমি।’

এবারে দারোয়ান লোকটার চেহারায় কোনো রূঢ়তা লক্ষ করা গেলো না; বরং তার বদলে রয়েছে সীমাহীন শ্রদ্ধা আর আনুগত্যের ছাপ। কণ্ঠেও নেই খানিক আগের সেই কাঠিন্য।

‘দুঃখিত স্যার, আপনাকে এতোক্ষণ বসে থাকতে হলো। আদি স্যার আপনাকে ভেতরে নিয়ে যেতে বললেন।’

মুহূর্তের ব্যবধানে একই লোকের দু’রকম আচরণে খানিকটা ঘাবড়ে গেলো হোসেন। মানুষটার চোখেও এখন লজ্জা আর অনুশোচনার আবহ দেখা যাচ্ছে।

‘কোনো সমস্যা নেই। অপেক্ষা করতে আমার ভালোই লাগে।’

জগতের কারও কারও কাছে অপেক্ষা জিনিসটা যে সত্যিই উপভোগের–তা বোঝা নয়াদিন অফিসের এই দারোয়ানের সাধ্যের বাইরে। সুতরাং, হোসেনের কথাটা তার কাছে দরকারি বিনয় এবং একপ্রকার অদরকারি ভণিতা বলেই মনে হলো। ফলে, ঠোঁটের কোণে একটা মিথ্যে হাসি আনবার ব্যর্থ প্রচেষ্টার মাঝে যা স্পষ্ট হয়ে ধরা দিলো তা হলো এই–হোসেনের কথায় লোকটা একটুও পুলকিত হতে পারেনি।

‘আসুন আসুন, মিস্টার হোসেন। আপনার সাথে দেখা করবার জন্যে অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছি।’ কথাগুলো বলতে বলতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন এক সুদর্শন ভদ্রলোক। তার সৌম্য-শান্ত চেহারার মাঝে সত্যিকার আনন্দের ঝিলিক দোল খাচ্ছে। তার চোখের দৃষ্টিতে ভণিতা-বিহীন অপেক্ষার অবসানের আবহ। নাহ, ভুল জায়গায় এসে পড়েনি হোসেন।

একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে হোসেন বললো, ‘ধন্যবাদ।’

‘কী খাবেন বলুন? চা না কফি?’

‘যেকোনো একটা কিছু হলেই হবে। না হলেও সমস্যা নেই কিন্তু।’

‘মাই প্লেজার! কিছু একটা তো হওয়া চাই-ই, তা নাহলে যে আমার নিমন্ত্রণপত্রের যথার্থতা বজায় থাকলো না। আমরা তো ধোঁয়া ওঠা কাপ হাতে নিয়ে আড্ডায় মেতে উঠবার শর্তে আবদ্ধ। হা হা হা।’

এতোখানি বিগলিত বিনয়ে হোসেন সত্যিই মুগ্ধ হলো। সে বসে আছে দেশের অন্যতম প্রধান সাপ্তাহিক পত্রিকা নয়াদিন সম্পাদকের সামনে। বাইরে আরও কতো মানুষ উন্মুখ হয়ে আছে তার সাথে একটু দেখা করার জন্যে। সেই মানুষটা চিঠিতে লেখা নিতান্ত অনুল্লেখযোগ্য কথাটাও মনে রেখে দিয়েছেন ভেবে যারপরনাই অভিভূত হলো হোসেন।

ফোন করে দু-কাপ কফির কথা বলে হোসেনের দিকে তাকালেন আদি সাহেব। মুখে তার সহজাত স্মিত হাসি।

‘আপনাকে দেখে আমি কিন্তু বেশ অবাকই হয়েছি বলা চলে।’

তাকে দেখে অবাক হওয়ার কী কারণ থাকতে পারে সেটা হোসেন বুঝতে পারলো না। তবে কী তার কোনো আচরণ খুবই অপ্রত্যাশিত ঠেকেছে আদি সাহেবের কাছে? হোসেন অস্বস্তিবোধ করছে বুঝতে পেরে আদি সাহেব বললেন, ‘তেমন কিছু না। আসলে আপনার গল্পটা পড়ে আমি এতোখানি মুগ্ধ হয়েছি, আমার ধারণা ছিলো আপনি হয়তো কোনো বয়স্ক লোকটোক হবেন। কিন্তু আপনি দেখছি একেবারে তাগড়া জোয়ান! হা হা হা। আমি যতোখানি অবাক হয়েছি, খুশি হয়েছি তারচে বেশি। আমাদের আজকালকার তরুণদের লেখার মাঝে প্রাণ পাই না কেমন যেন! কেমন যেন খাপছাড়া, অগোছালো ধরনের। আর সবাই তো সম্মিলিতভাবে একই ধারার গল্প-উপন্যাস লিখবার পণ করেছে বলা যায় একপ্রকার। তরুণদের নিয়ে আমার এই নিরাশার সময়ে আপনার মতো একজন তরুণের আবির্ভাব দুঃখের গহ্বর থেকে আমাকে অনেকটাই টেনে তুলেছে। তরুণরা এখনো যে অসাধারণত্ব উপহার দিতে পারে–মিইয়ে যাওয়া আমার সেই বিশ্বাসের পুনর্জাগরণ হলো আপনাকে দেখে।’

আজ হোসেনের বারবার বিস্মিত হবার দিন। এতোটা মূল্যায়ন সে স্বপ্নেও আশা করেনি। সেই প্রথম চিঠিপ্রাপ্তির দিন থেকে আজ অবধি সে যেন এক নিঃসীম স্বপ্নলোকের যাত্রী হয়ে চলেছে।

কফি চলে এলে আদি সাহেব হোসেনকে কফি নেওয়ার অনুরোধ করেন। কফিতে চুমুক দিতে দিতে তিনি বললেন, ‘আমার দুর্ভাগ্য যে আপনাকে আমি এতো দেরিতে আবিষ্কার করলাম। আগে কোন কোন পত্রিকায় লিখেছেন আপনি?

হোসেন সলজ্জ চেহারায় বললো, ‘আসলে, আমি এর আগে অন্য কোথাও লিখিনি কখনো।’

চোখজোড়া কপালে উঠে গেলো নয়াদিন সম্পাদকের। দৃষ্টি যে তার কোন দিগন্তে গিয়ে স্থির হয়ে গেলো তা বোঝা গেলো না। তার বিশ্বাস হচ্ছে না যে, হোসেন এর আগে অন্য কোথাও লেখালেখি করেনি। তিনি বিস্ময় জড়ানো কণ্ঠে বললেন, ‘মাই গুডনেস! আপনি এর আগে কোথাও লেখেননি?’

‘জি না।’

‘আই সি! আপনি তো আস্ত একটা আশ্চর্য মানুষ ভাই! মানে সত্যি বলছি, আমার এখন মনে হচ্ছে, আপনার ভিনগ্রহী আগন্তুক গল্পটার চরিত্রের মতো আপনিও অন্যকোনো গ্রহ থেকে টুস করে এখানে এসে পড়েছেন! আই অ্যাম টোটালি এস্টোনিশড!’

হোসেন নির্বাক, মুগ্ধ শ্রোতা হয়ে শুনে যায় নয়াদিন সম্পাদকের কথা।

‘তার মানে, নয়াদিনেই আপনার প্রথম লেখা ছাপা হয়েছে?’

‘জি৷’

‘অ্যামেইজিং!’ সম্মুখে উপবিষ্ট নয়াদিন সম্পাদকের চোখেমুখে গভীর উত্তেজনার ছাপ। হাজারো মানুষের কাছে যা স্বপ্নেরও অতীত, আপনার জীবনে তা সহজ বাস্তবতা! You are so lucky Mr. Hossen, and we are lucky as well to have the chance to discover a merit like you’.

কথা-আড্ডায় বিস্ময়-পর্ব পার হয়ে যায়, বেলা গড়িয়ে তখন সন্ধ্যা হয় হয় অবস্থা। হোসেন বললো, ‘নয়াদিন পত্রিকা এবং তাদের বদান্যতার কথা অনেকদিন মনে থাকবে আমার। স্মৃতিটুকু জীবনের আনন্দ হিশেবে জমা রেখে দেবো।’

হোসেনের কথার সুরে বিদায়ের আভাস পেয়ে আদি সাহেব বললেন, কিন্তু মিস্টার হোসেন, নয়াদিন তো আপনার সাথে সেই আনন্দ-স্মৃতিকে অনেকদূর পর্যন্ত বিস্তৃত করতে চায়।

ধড়ফড় করে ওঠে হোসেনের বুক। মনে হলো সেই আকাঙ্ক্ষিত মুহূর্তের একেবারে সন্নিকটে দাঁড়িয়ে হোসেন। হাত বাড়ালেই ছুঁতে পাবে স্বপ্ন, যে স্বপ্ন আকাশের নীলের মতোই অসীম, ঝরনার জলের মতোই নিঝর। কিন্তু হোসেন হাত বাড়ায়, নয়াদিনের বাড়ানো হাতকে স্পর্শ করে স্বপ্নের দুনিয়ায় পদার্পণ করাই তার ইচ্ছে।

‘আপনি সম্ভবত বুঝতে পারেননি। যাহোক, খোলাসা করেই বলা যাক। আপনার ভিনগ্রহী আগন্তুক গল্পটা পড়ে আমরা, মানে নয়াদিন পরিবার সত্যিকার অর্থেই বিমোহিত হয়েছি। এমন চমৎকার বর্ণনাশৈলীতে ভরপুর এতো দুর্দান্ত গল্পের দেখা হররোজ মেলে না। আমরা বেশ অনেকদিন থেকে একজন সম্পাদকের খোঁজে আছি, যিনি নয়াদিনের একটা বিরাট অংশের দায়িত্ব নিতে সক্ষম। দায়িত্বটা পুরোপুরি লেখালেখি-নির্ভর। যোগ্যতা হিশেবে তাকে অবশ্যই সৃজনশীল চিন্তার অধিকারী এবং ভালো লিখিয়ে হতে হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, অনেক খুঁজেঠুজেও আমরা এমন কাউকে পাইনি, যার ওপর নয়াদিন নির্ভয়ে নির্ভর করতে পারে। গড়পড়তা ভালো লেখা তো অনেকেই লেখে মিস্টার হোসেন, কিন্তু সম্পাদকের টেবিলে থাকা আমাদের মতো মানুষগুলোই জানে ওসব লেখার কতোখানি সত্যিকার লেখা হয়ে ওঠে। কিন্তু আপনার গল্পটা পড়বার পর থেকেই আমার মনে হয়েছে, ইউ আর দ্য পারসন উই আর লুকিং ফর। আপনাকে নিয়ে আমাদের এখানে দু-দফা বৈঠক হয়েছে। আপনার গল্পটার শক্তির জায়গা, কাহিনি-বিন্যাসে আপনার মুনশিয়ানা এবং গল্পের ভাষা নির্মাণে আপনার যে শিল্প-মন, তার সবিস্তার ব্যাখ্যা আমি সকলের কাছে পরিষ্কার করেছি। আপনার লেখাটাকে আতশ কাঁচের নিচে অনেক যাচাই-বাছাই করার পরেই কিন্তু আপনাকে চায়ের নিমন্ত্রণ জানিয়ে পত্র লেখা হয়েছে।’

‘কিন্তু…’

হোসেনকে থামিয়ে দেন নয়াদিন সম্পাদক। স্মিত হেসে তিনি বলেন, আমি জানি আপনি এখন কী বলবেন। আপনার একটামাত্র গল্প পড়ে নয়াদিনের মতো এমন তুখোড় জনপ্রিয় একটা পত্রিকা এই উপসংহারে কীভাবে আসতে পারে যে, আপনি এই কাজের উপযুক্ত, তাই তো?’

চুপ করে থাকে হোসেন। নীরবতাকেই সম্মতির লক্ষণ ধরে নিয়ে তিনি পুনরায় বলেন, না, নয়াদিন এমন কাঁচা কাজ কখনোই করবে না মিস্টার হোসেন। নয়াদিন বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ কয়েকটা সাহিত্য-পত্রিকার মধ্যে অন্যতম। এমন একটা পত্রিকা কারও একটা লেখা পড়ে তাকে এতোবড়ো পদে এনে বসিয়ে দেবে, এমন দুর্মতি নয়াদিন কর্তৃপক্ষের হয়নি।

আলোচনাটা এবার জটিল থেকে জটিলতর হতে শুরু করেছে। আদি সাহেব কেবল দেখতেই সুদর্শন নন, গুছিয়ে কথা বলাতেও তিনি বেশ সিদ্ধহস্ত। শ্রোতাকে মুগ্ধ করে রাখবার একটা সম্মোহনী শক্তি আছে তার গলায়। নয়াদিন বেশ যোগ্য লোককেই বসিয়েছে তাদের সর্বোচ্চ পদে–হোসেন ভাবে।

‘মিস্টার হোসেন’, হোসেনের ভাবনায় ছেদ পড়লো আদি সাহেবের কথায়। আপনি সম্ভবত বুঝতে পারছেন যে, নয়াদিন পত্রিকা আপনাকে একটা দুর্দান্ত কাজের সুযোগ দিতে চায়, যা আপনার প্রতিভাকে বিকশিত করার কাজে সহায়ক হবে। তবে এর জন্যে আপনাকে আরও একটু পরিশ্রম করতে হবে।’

‘যেমন?’, জানতে চাইলো হোসেন।

খানিকটা নড়েচড়ে বসলেন আদি সাহেব। পাশে থাকা পানির বোতল থেকে ঢকঢক করে পানি গিলে নিয়ে বললেন, ‘সামনের নারী দিবসকে কেন্দ্র করে আমাদের একটা বড়ো প্রজেক্ট আছে। প্রজেক্টটির নাম মহীয়সী। আমাদের দেশে যারা নারীমুক্তির আন্দোলনে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন, তাদের জীবনকে তুলে ধরাই ওই প্রজেক্টটির মূল লক্ষ্য।’

‘কিন্তু আমার কাজ কী হবে এখানে?’

‘আপনার কাজ খুব সহজ, মিস্টার হোসেন। আপনার সত্তার সাথেও তা ভীষণভাবে যায়।’

‘দুঃখিত, আমি বুঝতে পারলাম না ঠিক।’

হো হো করে হেসে উঠলেন আদি সাহেব। হাসতে হাসতেই বললেন, ‘না বুঝতে পারাটাই স্বাভাবিক। আপনার জায়গায় আমি হলেও হয়তো বুঝতাম না। যাহোক, আর কোনো ভূমিকা নয়, আমরা সরাসরি কাজের কথায় ঢুকে পড়ি। আপনি যে ভালো গল্প লেখেন তা আপনার গল্পটা পড়েই আমরা নিশ্চিত হয়েছি। তবে, নয়াদিনে কাজ করতে হলে আমাদের জন্য আপনাকে আরও একটা গল্প লিখতে হবে। এবারের গল্পের প্লট আমরাই আপনাকে দিয়ে দেবো। এটাকে ঠিক প্লট বলা যায় না যদিও, বলতে পারেন কাহিনি-বিন্যাসের একটা প্রাথমিক সূত্র। আপনাকে সেই সূত্র ধরে আগাতে হবে এবং লিখতে হবে একটা পূর্ণাঙ্গ গল্প। ধরে নিতে পারেন, ওটাই আপনার কাজের ফাইনাল ইন্টারভিউ। ওটাতেও যদি আপনি নয়াদিনকে সন্তুষ্ট করতে পারেন, উই আর রেডি টু কনগ্রাচুলেট ইউ হিয়ার।’

স্বপ্নটাকে যতোটা সহজলভ্য মনে হয়েছিলো প্রথমে, সেটা আসলে ততোটা সহজ নয়। কিন্তু হোসেন দমে যাওয়ার পাত্র না। এতোদূর এসেও ব্যর্থ-মনোরথে ফিরে যাবে, তা হতে দেওয়া যায় না। আর, একটা গল্পই তো তারা চাইলো কেবল! গল্প। লিখতে হোসেনের ভালোই লাগে। ডায়েরিতে কতো কতো গল্প লিখে ড্রয়ারবন্দী করেছে সে! জোছনার গল্প, জোনাকি আর ঝিঁঝিপোকার গল্প, তারাদের গল্প, নীল আকাশের গল্প। কী নিয়ে গল্প লেখেনি সে?

‘ঠিক আছে। নয়াদিনের এই প্রস্তাবে আমি রাজি আছি’, মুহূর্ত বাদে আদি সাহেবের চোখের দিকে তাকিয়ে কথাটা বললো হোসেন।

‘ধন্যবাদ। আমি জানতাম আপনি দ্বিমত করবেন না। একজন জাত গল্পকার মানুষ গল্প লিখবার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে পারেই না।’

আরও অনেক গল্প হয় দু’জনের মাঝে। হোসেনকে বুঝিয়ে দেওয়া হয় গল্প লিখবার প্রাথমিক সূত্রও। সুলেখা সাথী নামের একজন পরিচিত নিবেদিতপ্রাণ নারী আন্দোলন কর্মীকে ঘিরেই রচিত হবে ‘মহীয়সী নামের গল্পটি। কিন্তু যাকে ঘিরে রচিত হবে গল্প, তার সম্পর্কে তো হোসেনের জানা থাকা চাই। সে বন্দোবস্ত নয়াদিন পত্রিকা করে দেবে। মিস সুলেখা সাথীর বাসায় আগামীকাল এবং তার পরের দিন হোসেন যাবে এবং গল্পের জন্য যতোখানি তথ্যের রসদ দরকার, সবটা সুলেখা সাথীর মুখ থেকেই শুনে নেবে সে।

[চার]

বড়ো একটা অ্যাপার্টমেন্টের কাছে এসে দাঁড়ালো হোসেনের রিকশা। রিকশাওয়ালা তার গামছা দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললো, ‘নামেন মামা। এই বাসাডাই।’

হোসেন তার নোটবুকে টুকে আনা ঠিকানার সাথে মিলিয়ে নেয় একবার। হ্যাঁ, চলে এসেছে সে সঠিক জায়গায়। রিকশাভাড়া চুকিয়ে দিয়ে গেইটের কাছে আসতেই বুড়োমতো একজন লোক দৌড়ে এলো হোসেনের দিকে।

‘কী চাই?’

‘এটা তো মিস সুলেখা সাথীর বাসা, তাই না?’

‘জি।’

‘আমি সাপ্তাহিক নয়াদিন পত্রিকা থেকে এসেছি মিস সুলেখা সাথীর সাথে দেখা করতে।’

‘আপনার নাম?’

‘হোসেন।’

বয়স্ক ভদ্রলোক গেইট খুলে দিয়ে বললেন, ‘আসুন।’

হোসেন ভেতরে ঢুকতেই তিনি পুনরায় বললেন, ‘সোজা গিয়ে হাতের বামে লিফট। তিন নম্বর ফ্লোরে থাকেন সুলেখা ম্যাডাম।’

লোকটাকে হয়তো আগ থেকেই সব বলে দেওয়া ছিলো, তাই প্রবেশ-পথে কোনো বিড়ম্বনার শিকার হতে হলো না হোসেনকে। লিফটের কাছাকাছি যেতেই আরও একজন বয়স্ক মানুষের দেখা মিললো। তিনি নিজ থেকেই বললেন, ‘আপনার নাম কি হোসেন?’

‘জি।’

‘আমার সাথে আসুন, ম্যাডাম আপনাকে সাথে নিয়ে যেতে বলেছেন।’

এখানে সবকিছু এতো গোছালো দেখে নয়াদিন সম্পাদককে মনে মনে একটা ধন্যবাদ দিলো হোসেন। লোকটা সত্যিই কাজের মানুষ!

হোসেন কোনোদিন রাজপ্রাসাদ দেখেনি, কিন্তু মিস সুলেখা বেগমের বাসায় প্রবেশ করে হোসেনের মনে হলো, সে সত্যি সত্যি একটা অনিন্দ্য সুন্দর রাজপ্রাসাদে ঢুকে পড়েছে। কী অপূর্ব সুন্দর করে সাজানো চারদিক! দেয়ালে দেয়ালে শ্বেত পাথরের কারুকাজ। দেখলে মনে হয় যেন গভীর সমুদ্রতলের অপার সৌন্দর্য এখানে লেপ্টে দেওয়া হয়েছে। সেগুলোর আশেপাশে কতো বিচিত্র রঙের আল্পনা আঁকা! দামি পেইন্টিংয়ে ফুটে উঠেছে শহুরে আভিজাত্য! বহুমূল্য আসবাবের দিকে তাকালে ঘরটাকে পাঁচতারা হোটেল, আর দুর্লভ সংগ্রহে চোখ পড়লে রীতিমতো জাদুঘর না ভেবে উপায় থাকে না।

হোসেন একটা নরম, শাদা সোফায় গিয়ে বসে। চারদিকের এতো এতো দামি জিনিসপত্রের মাঝখানে নিজেকে খুবই বেমানান আর অসহায় লাগে তার। ঘরটার যেখানেই চোখ পড়ছে, সেখানেই দৃষ্টি থতমত খেয়ে থমকে যেতে চাইছে।

‘সুপ্রভাত মিস্টার হোসেন’, একটা মেয়েলি কণ্ঠস্বর ভেসে এলো হোসেনের কানে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে সে দেখে, জলপাই রঙের শাড়ি পরা এক মহিলা তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে হোসেনের মনোযোগ নিবিষ্ট ছিলো বলে মহিলার আগমন-বার্তা টের পায়নি সে।

বসা থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে হোসেন বলে, ‘সুপ্রভাত।’

‘আপনিই তাহলে ভিনগ্রহী আগন্তুক গল্পটার লেখক! আমি তো ভেবেছিলাম বেশ বয়সটয়স হবে আপনার, কিন্তু আদিত্য সাহেবের কাছে আপনার ব্যাপারে শুনে অনেকটাই তাজ্জব হয়েছি বৈ কি! তা যা-ই হোক মিস্টার হোসেন, গল্পটা কিন্তু সুপার-ডুপার লেভেলের! কনগ্র্যাটস!

‘ধন্যবাদ।’

‘কী খাবেন? চা না কফি?’

‘চা।’

মিস সুলেখা গলা ছেড়ে বললেন, ‘রাজিয়া, অ্যাই রাজিয়া…।’

রাজিয়ার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে তিনি হনহন করে হেঁটে চলে গেলেন ভেতরে। একটু পরে এসে বললেন, ‘দুঃখিত মিস্টার হোসেন, আপনাকে একা বসিয়ে রেখে গিয়েছিলাম।

‘না না, কোনো সমস্যা নেই।’

‘আপনি সম্ভবত আমার একটা ইন্টারভিউ নিতে এসেছেন, তাই না?’

‘ঠিক ইন্টারভিউ নয় আসলে। নয়াদিন পত্রিকা আমাকে একটা দায়িত্ব দিয়েছে। মহীয়সী শিরোনামে আমাকে একটা গল্প লিখতে হবে। ওই গল্পটার পটভূমিকায় থাকবেন মূলত আপনি। ধরে নিতে পারেন, আপনার জীবন এবং কাজকে ঘিরে আমাকে গল্পটা লিখতে হবে।’

‘ফাইন। আপনার মতো দুর্দান্ত গল্পকারের হাতে আমার বিনির্মাণ হবে জেনে পুলক অনুভব করছি।’

‘আমি কিন্তু বিখ্যাত কেউ নই।’

তবে বিখ্যাত হতে যাচ্ছেন। হা হা হা।’

‘মহীয়সী’ গল্পটা লিখবার রসদ সংগ্রহের নিমিত্তে মিস সুলেখা সাথীকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যায় হোসেন। রাজিয়া নামের সাত বা আট বছরের একটা মেয়ে চা নিয়ে এলে মিস সুলেখা তাকে বললেন, ‘উনাকে চায়ের কাপটা এগিয়ে দে।’

হোসেনের জন্য ট্রে থেকে চায়ের কাপ তুলতে গেলে চা সমেত কাপটা রাজিয়ার হাত থেকে উল্টে পড়ে যায়। টেবিলে থাকা একটা নোটপ্যাড চা লেগে ভিজে নাস্তানাবুদ হয় সাথে সাথে। এতোক্ষণ ধরে মিস সুলেখার সাথে আলাপের চুম্বকাংশ এই প্যাডে টুকে নিচ্ছিলো হোসেন। ঘটনাটায় রেগেমেগে আগুন হয়ে যান মিস সুলেখা। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তিনি বেসামাল হয়ে ওঠেন। রাজিয়ার গালে কষে একটা চড় লাগিয়ে দিয়ে বেশ তিরিক্ষি গলায় চেঁচিয়ে উঠে বলেন, ‘দূর হ আমার চোখের সামনে থেকে। আপদ কোথাকার! একটা কাজ ঠিকমতো করতে পারিস না!’

শান্ত পরিবেশে হঠাৎ কেমন যেন স্পষ্ট হতে লাগলো একটা অস্থিরতার ছাপ। ধমক খেয়ে রাজিয়া ভয়ে কাঁপতে শুরু করলো। ভয়ার্ত হরিণীর মতো তার চোখ দুটো বিহ্বল হয়ে উঠেছে। সে বুঝতে পারছে না কার কাছে ক্ষমা চাইবে। মিস সুলেখার কাছে, না হোসেনের কাছে।

নোটে টুকে নেওয়া লেখাগুলো ভিজে নষ্ট হওয়াতে হোসেন তেমন কষ্ট না পেলেও, বেচারি রাজিয়াকে এমন বেকায়দায় পড়তে দেখে তার মনটা হুহু করে উঠলো।

মিস সুলেখা অনুনয়ের সুরে হোসেনের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার নোটপ্যাডটা নষ্টই হয়ে গেলো! কিছু মনে করবেন না মিস্টার হোসেন।

‘না না, এটা মোটেও সিরিয়াস ব্যাপার নয়। এগুলো আমার মনেই থাকবে সব। নোট করার একটা অভ্যাস আছে বলেই আসলে নোট করা।’

সোফায় বসতে বসতে সুলেখা সাথী বললেন, ‘আর বলবেন না! বাসায় একদল জন্তু-জানোয়ার পালছি আমি। কারও দ্বারা কোনো কাজ হয় না। একটা কাজ যদি এরা ভালোমতো করতে পারতো! কিন্তু অন্ন-ধ্বংসের বেলাতে সবাই একেবারে সোয়া সের!’

হোসেন নির্বিকার হয়ে বসে থাকে। এমন কোনো সাংঘাতিক ঘটনা এখানে ঘটেনি, যার জন্যে মিস সুলেখাকে এতোখানি উত্তেজিত হতে হবে। একটা বাচ্চা মেয়ের হাত থেকে চায়ের কাপ পড়ে যাওয়াটা আহামরি কোনো ব্যাপার নয়। আর, দামি দামি জিনিসপত্রে ভরপুর যার ঘর, একটা কাঁচের কাপ ভাঙাতে তার কী এমন ক্ষতি হয়ে গেলো বোঝা গেলো না। মিস সুলেখার এমন অকারণ রাগ এবং নিরীহ কাজের মেয়ের ওপরে এমন চড়াও মনোভাব হোসেনকে দারুণভাবে হতাশ করলো। এমন একটা চরিত্রকে সে ‘মহীয়সী’ গল্পের জন্য কোনোভাবেই কল্পনা করতে পারছে না।

‘মিস্টার হোসেন, মিস সুলেখার কণ্ঠে আবার স্নিগ্ধতা ফিরে আসে। সংবিৎ ফিরে পায় হোসেন।’

‘জি।’

‘আপনাকে আরেকটু কষ্ট দেবো। একটা জরুরি প্রোগ্রামে আমাকে যেতে হবে এখন। বেশি দূরে নয় যদিও, বেইলী রোডেই। আপনার যদি কোনো অসুবিধে না হয়, আমি না ফেরা পর্যন্ত আপনি এখানে একটু অপেক্ষা করবেন, প্লিজ।’

‘কোনো সমস্যা নেই। আমি অপেক্ষা করবো।’

‘থ্যাংকিউ মিস্টার হোসেন।’

[পাঁচ]

হোসেনের চোখ আটকে আছে ‘দূরবীন’ টিভির পর্দায়। তাতে ঘটা করে বেইলী রোডে অনুষ্ঠিত হওয়া ‘নারী অধিকার’ আন্দোলনের লাইভ প্রোগ্রাম দেখানো হচ্ছে। কোনো এক মহিলা গার্মেন্টস কর্মীর গায়ে হাত তোলায় গার্মেন্টস মালিকের ওপর ভীষণভাবে ক্ষিপ্ত হয়েছেন তারা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আজকের এই প্রতিবাদী জনসভা, এবং তাতে অন্যতম প্রধান অতিথি হিশেবে যোগ দিয়েছেন নারী আন্দোলনের সুপরিচিত মুখ সুলেখা সাথী।

আনুষ্ঠানিকতা পর্ব শেষ হলে মঞে সুলেখা সাথীকে তার বক্তব্য প্রদানের জন্য আহ্বান করা হয়। স্টেজে উঠে সুলেখা সাথী নারীর অধিকার সচেতনতা, নারীর কাজ এবং জীবনের স্বাধীনতা, শৃঙ্খল থেকে নারীর মুক্তির নানান কায়দা-কানুন এবং কর্তব্যের কথা বলার পর বললেন, আমি এখানে দাঁড়িয়ে ওই গার্মেন্টস মালিক, যে কিনা তার একজন মহিলা কর্মীর গায়ে হাত তোলার দুঃসাহস দেখিয়েছে, তার যথোপযুক্ত শাস্তির দাবি করছি। নিঃসন্দেহে এটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নারীকে শোষণের একটা করুণ দৃশ্যপট! একজন নারীকে অসম্মান করার, তার গায়ে হাত তোলার, তাকে অপমান-অপদস্থ করার অধিকার এই পুরুষ সমাজকে কে দিয়েছে? আমি আমাদের নারী সমাজকে বলতে চাই, আপনারা আপনাদের বেদনার কথা মন খুলে বলুন। আমরা পুরুষতান্ত্রিকতা বিবর্জিত, নারীর জন্য মুক্ত-স্বাধীন একটা দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখি, যেখানে নারী তার অধিকার বুঝে নেবে কড়ায়-গন্ডায়। নারী সমাজকে যে বা যারাই অপমান করতে চাইবে, শোষণ করতে চাইবে, তাদের বিরুদ্ধে আমরা গড়ে তুলব দুর্বার আন্দোলন। আগামীর বাংলাদেশ পুরুষের শোষণমুক্ত, নারী অধিকারের বাংলাদেশ।

মিস সুলেখা সাথীর কথাগুলো এরচে বেশি আর শুনতে পারল না হোসেন। রিমোট কন্ট্রোলে জোরে কষাঘাত করে টিভির সুইচ অফ করে দিলো সে। ভিজে যাওয়া নোটপ্যাডটার দিকে বারংবার তাকাচ্ছে হোসেন। কুঁচকে যাওয়া সেই কাগজগুলোর ভেতর থেকে যেন একটা প্রতিধ্বনি ভেসে আসছে–‘দুর হ এখান থেকে। আপদ কোথাকার! একটা কাজ ঠিকমতো করতে পারিস না!’

[ছয়]

‘কিন্তু মিস্টার হোসেন’, বললেন নয়াদিন সম্পাদক আদিত্য আদি, ‘আমরা আপনার ওপরে ভরসা করে অন্য কোনো অপশন চিন্তাও করিনি। এই মুহূর্তে এসে আপনি কিনা বলছেন যে, মহীয়সী গল্পটা আপনি লিখতে পারবেন না!’

হোসেন বেশ গম্ভীর গলায় বললো, ‘জি, আমি ঠিক করেছি ওই গল্পটা আমি লিখবো না।’

‘আমি পত্রিকার একজন সম্পাদক মাত্র, মিস্টার হোসেন। পত্রিকা কর্তৃপক্ষকে আমি কী জবাব দেবে আপনি বলতে পারেন?’

‘তাদের বলবেন, আমি গল্পটা লিখতে অপারগ। আমার অপারগতাকে তারা যেন ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখেন। ‘কিন্তু সমস্যাটা ঠিক কোথায় তা তো জানতে হবে, তাই না?’

‘সমস্যাটা পুরোটাই আমার। আমি আসলে এমন কাউকে নিয়ে গল্প লিখতে পারি না, যিনি তার কাজে, তার কথায় সৎ নন। যিনি নিজের ঘরে একজন অত্যাচারী, কিন্তু বহিরাবরণে বেশ ধরেন ত্রাণকর্তার।’

‘মিস্টার হোসেন, আমি বুঝতে পারছি না আপনার কথা।’

‘আপনাকে বুঝাতে পারছি না বলে ক্ষমাপ্রার্থী। এখানে স্বপ্নের মতো কিছু সময় কেটেছে আমার। এমন দুর্দান্ত মুহূর্তগুলো আমাকে উপহার দেওয়ার জন্যে কৃতজ্ঞতা। ভালো থাকবেন।’

আজীবনের লালিত একটা স্বপ্নকে পায়ে ঠেলে চলে যাচ্ছে হোসেন। একটা ভালো ক্যারিয়ার, একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ, একটা নির্মল, নিষ্কণ্টক জীবনের হাতছানিকে। কিন্তু হোসেন একটুও বেদনাহত নয়। স্বপ্নভঙ্গের যাতনা তাকে কাবু করেনি মোটেও। যে সত্যের মুখোমুখি হোসেন হয়েছে, সেই সত্যকে ধারণ করতে পারাটাও তার জীবনের সেরা একটা প্রাপ্তি।

মিস সুলেখা সাথীর জীবন নিয়ে মহীয়সী শিরোনামে একটা গল্প হোসেন যখন-তখন লিখে দিতে পারে। গল্পে মিস সুলেখা সাথীকে মহীয়সী, আলো হাতে চলা এক নির্ভীক নারীমূর্তি আর সমাজের এক অনন্য দর্পণ হিশেবে তুলে ধরতে হোসেনকে। একদমই বেগ পেতে হবে না। কিন্তু মিস সুলেখা সাথীর সাথে এই বিশেষণগুলো কতোখানি খাপ খায়? যে মহিলা নিজের ঘরের কাজের মেয়ের সাথেই সামান্য। ব্যাপারে এমন অমানবিক আচরণ করতে পারে, তার গায়ে হাত তুলতে পারে, সে যখন অন্য এক নির্যাতিত মহিলার জন্যে কাঁদে, জনসভা করে, রক্ত-গরম করা বক্তৃতা দেয়, তখন তা মাছের মায়ের পুত্রশোকের মতোই শোনায় বৈ কি! সেই কান্নায় সত্যিকার আবেগ নেই, রক্তে আগুন ধরানো সেই কথাগুলোতে নেই সত্যিকার প্রতিবাদের সুর। দিনশেষে তা কেবল জনপ্রিয়তা আর আখের গোছানোর মাধ্যম ছাড়া আর কী হবে? এমন এক নারী-চরিত্রকে মহান, মহীয়ান, মহানুভবতার রূপ দিতে হোসেন তাই ভীষণ অনীহ। হোসেন আর যা-ই হোক, নিজের সাথে অসৎ হতে পারবে না।

[সাত]

হেমন্তের দুপুর। দিনগুলো বড্ড ছোটো এ সময়। সকাল হওয়ার আগে যেন দুপুর হয়ে যায়, বিকেলের আগে নেমে যায় সন্ধ্যা। কিন্তু দুপুরবেলার রোদটা বেশ ঝাঁঝালো। সেই ঝাঁঝালো রোদে চামড়ায় আগুন ধরে যাওয়ার অবস্থা দাঁড়ায় কখনোসখনো।

এমন এক তীব্র দাবদাহের দুপুরে, পাট-পাতার বেড়া দিয়ে তৈরি রান্নাঘরে চুলোয় ভাত বসিয়েছেন জাহানারা বেগম। ভাতের মধ্যে একটা আলু আর কয়েকটা কাঁচামরিচ দেওয়া। ধোঁয়ায় চারদিক যেন অন্ধকার হয়ে উঠেছে।

নিঃশব্দে রান্নাঘরের কাছে এসে দাঁড়ালো হোসেন। সে দেখতে পেলো, ভীষণ মনোযোগের সাথে তার মা চুলোয় আগুন ধরাবার চেষ্টা করছেন। কেন জানি, আগুন জ্বলে উঠেও পরমুহূর্তে নিভে যাচ্ছে আবার। জাহানারা বেগমও দমে যান না, যতোবার নিভে যায় আগুন, ততোবার তিনি দ্বিগুণ প্রচেষ্টায় মুখর হয়ে ওঠেন।

যেভাবে নিঃশব্দে সেখানে এসে দাঁড়িয়েছিলো হোসেন, সেভাবেই সরে গেলো সে। তার হাতে সময় খুব কম। মহীয়সী গল্পটা তাকে লিখতেই হবে, যেভাবেই হোক।

[আট]

সাপ্তাহিক নয়াদিন পত্রিকার ঠিকানায় একটা চিঠি পাঠাচ্ছে হোসেন। সাথে খামে মোড়ানো তার লেখা মহীয়সী গল্পটাও।

বরাবর,
সম্পাদক
সাপ্তাহিক নয়াদিন

জনাব, আমার প্রীতি জানবেন। আপনার সাথে কাটানো মধুময় সময়গুলো উপভোগ করেছি বেশ। পাড়া-গাঁ থেকে যাওয়া একজন নিতান্ত সাধারণ যুবকের লেখার যে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা আপনি করেছেন, তাতে আমি রীতিমতো মুগ্ধ হয়েছি। আপনার অকৃপণ আন্তরিকতা এবং হৃদ্যতা অনেকদিন মনে রাখবো। আপনার সাথে আমার শেষ সাক্ষাৎটা যথেষ্ট আন্তরিকতার ছিলো না বলে আমি ভীষণ দুঃখিত। আপনি জেনে আনন্দিত হবেন যে–মহীয়সী শিরোনামের গল্পটা আমি শেষ পর্যন্ত লিখতে পেরেছি। তবে, এই গল্প সুলেখা সাথীর নয়,

আমার মা জাহানারা বেগমের। মহীয়সী বলে যদি কাউকে কল্পনা করতে হয়, মা তখন আমার কাছে সবথেকে সেরা উদাহরণ। সেই ছোটোবেলায় বাবাকে হারানোর পর থেকে মায়ের সংগ্রাম দেখতে দেখতে বেড়ে উঠেছি আমি। স্বামী হারানো একজন সরলা নারীর জীবনে যতোখানি সংগ্রামের গদ্য আর পদ্য থাকতে হয়, আমি দেখেছি, আমার মায়ের জীবনে তার সবটাই ভীষণ-রকম উপস্থিত। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো, এই মহীয়সী নারী-চরিত্রকে এতো কাছে থেকেও আমি এতোদিন চিনতে পারিনি। বুঝতেও পারিনি তার ত্যাগের মাহাত্ম্য, আবিষ্কার করতে পারিনি তার সংগ্রামের সাহসী গল্পটাকে। নয়াদিন পত্রিকাকে আরও একটা ধন্যবাদ এই কারণে যে, সুলেখা সাথী নামের একজনের মুখোমুখি তারা আমাকে না করলে হয়তো আমার মায়ের গল্পটা আমার সামনে কখনোই ভাস্বর হয়ে উঠতো না। আমি হয়তো কখনোই অনুধাবন করতে পারতাম না একজন সত্যিকারের মহীয়সী কাকে বলে। আপনাদের পছন্দের চরিত্রকে মহীয়সীরূপে চিত্রায়িত করতে না পারার জন্যেও দুঃখিত। আমি জানি না তিনি সত্যিকারের মহীয়সী চরিত্র কি না, তবে গল্পের মহীয়সীকে নিয়ে একবিন্দুও সংকোচ নেই আমার। আমার কাছে তিনিই অনন্যা, তিনিই মহীয়সী। তাই তার গল্পটাই লিখে পাঠালাম।

ইতি
হোসেন

হোসেন জানে তার এই গল্প নয়াদিন পত্রিকা কোনোদিন ছাপাবে না। এই গল্পে শহুরে আভিজাত্য নেই, নেই চোখধাঁধানো প্রাসাদ কিংবা হুংকার আর তর্জন-গর্জনের উপাদান। এই গল্প এক গ্রামীণ সাধারণ নারীর গল্প। এই গল্প নিয়ে অন্তত আর যা-ই হোক–বাণিজ্য হবে না। কিন্তু গল্পটা লিখতে পেরে হোসেন পুলক অনুভব করছে। সত্যকে আলিঙ্গন আর মুখোশের আড়ালে থাকা মিথ্যাকে পায়ে ঠেলতে পারার আনন্দে আনন্দিত সে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *