১২. টু-লেট

১২. টু-লেট

[এক]

বিধ্বস্ত শরীরখানা নিয়ে এপাশ ওপাশ করতে করতে শফিক ভাবছে, যদি আজকের রাতটা না কাটতো। যদি শেষ না হতো এই নিগুঢ় অন্ধকার, কতোই না ভালো। লাগত তার। এমন নয় যে সে অন্ধকার পছন্দ করে। খুব ছোটোবেলা থেকেই তার অন্ধকার-ভীতি প্রকট। কিন্তু আজকের অন্ধকারটা ভয়ের নয়, যেন শান্তির। যেন এই অন্ধকার রাত দীর্ঘ হলেই শফিক সুখী হয়।

শফিকের দীর্ঘ বেকার-জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে কাল। পানি-কলের চাকরিটা ছেড়ে দেওয়ার পর অনেক লম্বা একটা সময় তার কপালে আর কোনো চাকরি জোটেনি। এই অনেকদিন পর, অনেকদিন বললে তো কমই বলা হয়, বলা উচিত অনেক বছর পরে সে নতুন একটা চাকরি পেলো বলে। এতোগুলো বছর পরে নতুন চাকরি হাতে পেয়ে শফিকের উৎফুল্ল হওয়াই উচিত ছিলো; কিন্তু সে। জানে–রাত পেরুলেই তাকে পরিবার-পরিজন ছেড়ে পাড়ি জমাতে হবে সেই সুদুর ঢাকায়। স্ত্রী রেহানা, একটামাত্র মেয়ে আফরোজা আর বৃদ্ধ মা-বাবাকে ছেড়ে কীভাবে যে দিনগুলো কাটবে–সেই চিন্তায় সারাটা রাত ঘুমোতে পারেনি সে। নতুন চাকরি, তাও আবার ঢাকার বুকে, যেখানে একটা পদের জন্য হা করে থাকে হাজারটা মুখ, সতৃয় দৃষ্টি রেখে অপেক্ষায় থাকে হাজারখানেক চোখ। চাকরির জন্য চাতক পাখির মতন উদগ্রীব হয়ে থাকা এমন মানুষদের ভিড়ে, কখন শফিক নিজেকে প্রতিষ্ঠা করবে, আর কখন পরিবার নিয়ে থিতু হতে পারবে শহরের বুকে তা সে জানে না। মফস্বল থেকে উঠে আসা এক নিতান্ত সরল যুবকের জন্য যেখানে টিকে থাকাটাই দুষ্কর, সেখানে ঘর-বাঁধার স্বপ্ন দেখাটা খানিকটা বিলাসিতাই বটে।

শফিকের ঘুম আসছে না কোনোভাবেই। মেয়েটার দিকে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে। সে। সৌম্য-শান্ত আর পবিত্র চেহারার মেয়েটা কী এক নিবিড় ঘুমে আচ্ছন্ন! শফিক আলতোভাবে আফরোজার গায়ে হাত বুলায়, নিবিষ্টভাবে বুজে থাকা চোখের পাতা দু-খানায় চুমু খায় বারবার। আফরোজাকে ছাড়া কতোগুলো দিন তাকে থাকতে হবে তা ভাবতেই ধড়াস ধড়াস করে ওঠে তার হৃৎপিণ্ড। এই বিচ্ছেদ-ব্যথা সইবার জন্যে এখনই শফিক প্রস্তুত নয়।

বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে মায়ের চেহারাটা। রুণ শরীর নিয়ে প্রতিদিন দরজার কাছে শফিকের আগমনের পথ চেয়ে বসে থাকতো যে মহিলা, কাল হতে তার ছুটি। ছুটি বাবারও। ছেলের ফিরতে দেরি হলে, ভগ্ন শরীর সমেত মোড়ের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার অলিখিত যে দায়িত্ব তিনি বহুবছর ধরে পালন করে চলেছেন–কাল তার আশু-সমাপ্তি।

আর, স্ত্রী রেহানা, যাকে হৃদয়-উজাড় করে ভালোবাসে শফিক, যার সাথে কেটে গেছে তার অযুত-রাত্রি নিযুত-প্রহর, তাকে ছাড়া শফিক বাঁচতে পারবে? ভালোবাসা, রাগ আর অভিমানের এই সংসারে রেহানার সাথেই তো তার নিত্য বোঝাপড়া, তাকে রেখে একটা আলাদা জীবনে অভ্যস্ত হওয়ার কথা ভাবতে গেলেই তার বুক ফেটে কান্না আসে। কাঁদে সে ঠিকই, বিরহের দহনে বুকের ভেতরটা লন্ডভন্ড প্রায়, কিন্তু বাইরে তার প্রদর্শনী চলে না। পুরুষ মানুষ, শক্ত মনের হবে–জগতের নিয়ম কিনা!

[দুই]

‘আপনার নাম শফিক?’, সামনে উপবিষ্ট ভদ্রলোকের প্রথম প্রশ্ন।

‘জি’, ঘাড় কাত করে উত্তর দিলো শফিক।

‘চেয়ারে বসুন। আপনার ব্যাপারে ম্যানেজার সাহেব আমাকে বিস্তারিত বলেছেন।’

নীল শার্ট পরা লোকটা কথাগুলো বলতে বলতে ডেকের ওপর থাকা কাগজের স্তূপ থেকে একটা কাগজ টেনে নিয়ে মুখের সামনে ধরলেন। শফিকের বুঝতে বাকি নেই যে, এটা ওরই সিভি। কিছুক্ষণ চুপচাপ কাগজখানার ওপর সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে লোকটা বললেন, আপনার সিভি দেখে এর আগে আপনি সাপ্লাই চেইনের কোনো কাজ করেছেন বলে তো মনে হচ্ছে না।

‘জি না।’

‘তাহলে তো বেশ খাটতে হবে শফিক সাহেব।’

‘তা আমি পারবো।’

‘বেশ! আপনাকে উত্তর-জোনে কাজ করতে হবে। আপনি আমাদের উত্তর-জোনের ম্যানেজার বিপুলের অধীনে কাজ করবেন আপাতত। আপনার পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে আমরা আপনার পরবর্তী পজিশানের ব্যাপারে চিন্তা করবো। টিল দেন, গুড লাক।’

‘জি, ধন্যবাদ স্যার।’

অফিস থেকে বের হয়ে শফিক আকাশের দিকে তাকায়। এই শহরের দালানগুলোর চূড়া দেখতে হলে ঘাড় অনেকখানি কাত করা লাগে। ইট-পাথরের ইমারতে ভরা এই নতুন শহরে, জীবিকার তাগিদে ছুটে আসা হাজারো মানুষের ভিড়ে মিশে যায় শফিক। চেহারা ভিন্ন হলেও, সবার যেন অভিন্ন আত্মা, অভিন্ন অভিপ্রায়।

[তিন]

মাত্র তিন মাসের মাথায় শফিকের পদোন্নতি হয়। অন্যের অধীনে উত্তর-জোনে কাজে ঢুকেছিল, এখন সে নিজেই উত্তর-জোনের ম্যানেজার। বেতন আর ভাতাও বেড়েছে ভালো রকমের। বাড়ি থেকে ফেরার আগের রাতে শফিক আকাশের দিকে তাকিয়ে যে বিলাসিতাময় স্বপ্ন এঁকেছিল, এতো তাড়াতাড়ি তার নাগাল পাওয়া যাবে তা অকল্পনীয় ছিলো শফিকের কাছে। আগামীকাল ভোরের ট্রেনে চেপে গ্রাম থেকে শফিকের পরিবার ঢাকায় আসছে। নতুন একটা বাসা ভাড়া নিয়েছে সে। ঢাকা থেকে খানিকটা দূরে, একটা একতলা পুরোনো বাড়ি! অল্পের মধ্যেই পাওয়া গেছে বলতে হবে। বাড়ির সামনে একফালি উঠোনও আছে, যেখানে আফরোজা সারা দিনমান খেলতে পারবে। শফিকের রুমের জানলার সাথে লাগোয়া একটা কচি পেয়ারা গাছ। ভোরের আলো পড়লে গাছের পাতাগুলো যেন আরও ঘন সবুজ হয়ে ওঠে। সব মিলিয়ে শফিকের মনের মতো একটা জায়গা হয়েছে এটা। ঢাকাও নয়, আবার ঢাকা থেকে দূরেও নয়।

আজ রাতেও শফিকের চোখে ঘুম নেই। বিছানায় এপাশ ওপাশ করছে শুধু। আনন্দে আত্মহারা তার তনু-মন। কী আশ্চর্য! সেদিনের সেই রাত দীর্ঘ হলেই যেন বেঁচে যেতো শফিক। আর আজ একেবারে ভিন্ন ব্যাপার। ইচ্ছে করছে ভোরটাকে টেনে নিয়ে আসতে। এতো দীর্ঘ রাতও হয়?

[চার]

বেশ ভালোমতোই কাটছিল দিনগুলো। আফরোজার জন্যে স্কুল খোঁজারও তোড়জোড় শুরু হয়েছে। বাবা-মা আর স্ত্রী-সন্তান নিয়ে একটা সুখের সংসার গড়ে উঠেছে শফিকের, যে সংসারের স্বপ্ন বুকে চেপে সে ঢাকা শহরে পা দিয়েছিল। এই শহর তাকে এতো তাড়াতাড়ি আপন করে নেবে তা ছিলো শফিকের ভাবনারও অতীত।

এরই মাঝে পৃথিবীজুড়ে একটা গোলমাল শুরু হলো। এটাকে বিশ্বযুদ্ধ না বলে তারচাইতেও গুরুতর কোনো নামে অবহিত করা যায়। পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ চীনে আবির্ভাব হয়েছে এক নতুন ভাইরাসের। কতো ভাইরাসই তো প্রকৃতিজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। কিন্তু এই ভাইরাস সেরকম নয়। দুনিয়াজুড়ে মহামারি বাধিয়ে দেওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন এই অনুজীব হা-রে রে-রে করে তেড়ে এলো পৃথিবীর মানুষগুলোর দিকে। অচল হয়ে পড়লো গোটা দুনিয়া। থমকে গেলো প্রাণ-চাঞ্চল্যে ভরা পৃথিবী। চার দেয়ালের মাঝে বন্দী হয়ে পড়লো মানব-সভ্যতা।

গোটা দুনিয়া যখন গুটিয়ে এলো, সেই তালিকা থেকে বাদ যায়নি ঢাকাও। বন্ধ হয়ে গেলো একে একে সবকিছু, এবং বন্ধ হয়ে গেলো শফিকদের কাজও। বিদেশ থেকে সাপ্লাই আসা বন্ধ। সাপ্লাই না থাকলে কাজ থাকবে কোত্থেকে? কবে সবকিছু স্বাভাবিক হবে সে ব্যাপারে কেউ কিছুই জানে না। এক ঘোর অনিশ্চয়তার মধ্যে যেন থমকে গেলো শফিকের ভরপুর আনন্দের ঢাকাস্থ জীবনটাও।

একদিন অফিসের ম্যানেজারের ফোন এলো শফিকের কাছে। এই অনেকদিন পর অফিসের কোনো কর্তাব্যক্তির ফোন পেলো শফিক। যেন আনন্দে নেচে ওঠে শফিকের মন। তার মানে কাজ শুরু হতে যাচ্ছে আবারও। জীবনের ছন্দে ফিরে যাওয়ার কামনায় অস্থির শফিক ফোন তুলতেই ওপ্রান্ত থেকে একটা মোটা স্বর ভেসে এলো।

‘শফিক সাহেব বলছেন?’’

‘জি স্যার।’

‘ভালো আছেন?’

‘জি স্যার, ভালো।’

নীরবতা নেমে আসে দুজনের মাঝে। কারও মুখে কোনো কথা নেই আর। শফিক কান পেতে আছে একটা আকাঙ্ক্ষিত সু-খবরের আশায়। একটু বাদে, ওপাশের মোটা কণ্ঠস্বর-অধিকারী ব্যক্তি বললেন, ‘আপনাকে একটা কথা বলতে হচ্ছে শফিক সাহেব। কিছু মনে করবেন না। আমরা তো সাপ্লাই বেইজড প্রতিষ্ঠান। একটা সমস্যায় পড়ে গেছি তা বুঝতে পারছেন। কবে নাগাদ এই সমস্যা থেকে মুক্তি মিলবে বলতে পারছি না ঠিক। আর, এদিকে কোনো কাজ না উঠে এলে এতোগুলো কর্মীর বেতন চালিয়ে যাওয়াটাও আমাদের জন্য একপ্রকার দুঃসাধ্য। তাই অফিস থেকে কিছু কর্মীকে ছাটাই করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দুঃখজনকভাবে, আপনাকে আমরা আর চাকরিতে রাখতে পারছি না। সরি ফর দ্যাট। মাস তো প্রায় শেষ হতেই চলল। এই মাসের বেতন আপনার ব্যাংকে আমরা পাঠিয়ে দেবো। ঠিক আছে, শফিক সাহেব?’

একেবারে এক-নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলেন ভদ্রলোক। শফিক কেবল শুনে গেছে। এমন অবস্থায় কী আর বলবে সে? পায়ের নিচ থেকে বালি সরে গিয়ে যে অতল-গর্ত তৈরি হয়–শফিকের মনে হলো সে এমন কোনো গর্তে নিমজ্জিত হচ্ছে ধীরে ধীরে।

[পাঁচ]

ঢাকা থেকে খানিকটা দূরে, একতলা একটা পুরোনো বাসা। বাসার সামনে একফালি উঠোন যেখানে আফরোজা ধুলোয় মাখামাখি হতো সারাদিন। হর্ন বাজাতে বাজাতে একটা পিক-আপ এসে দাঁড়াল বাসাটার সামনে। আস্তে আস্তে ঘরের সমস্ত আবসবাবপত্র উঠে গেলো সেই পিক-আপে। বাইরে বেরিয়ে এলো রেহানা, আফরোজা আর শফিকের বাবা-মা। বাইরে বেরিয়ে এলো শফিকও। শফিকের চোখ আটকালো এক জায়গায়। কোন ফাঁকে বাড়ি-অলা এসে তার ঘরের ওপরে যে TO-LET লাগিয়ে গেছে সে টেরও পায়নি। ঝুলন্ত সেই TO-LET বোর্ড যেন অদূরে তাকিয়ে আছে নতুন কোনো শফিকের আশায়, যে একবুক স্বপ্ন নিয়ে ঢাকায় পা রাখার প্রহর গুনছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *