০৭. হিজল বনের গান

০৭. হিজল বনের গান

একটা জানলা। আকাশে একফালি চাঁদ। চাঁদের রুপোলি জোছনা জানলা গলে ভেতরে ঢুকে পড়ছে। খানিকটা দূরেই একটা পুকুর। পুকুরের পাড়ে দুটো হিজল গাছ। হিজলের গায়ে কিছু গুল্ম, আর তার নিচে একটা কবর। আমার মায়ের।

জানলার ধারে দাঁড়িয়ে, অপলক দৃষ্টিতে আমি তাকিয়ে আছি আমার মায়ের কবরটার দিকে। কবরের উঁচু ঢিপিটা যেন আমার বুকের ওপর বসে থাকা কোনো জগদ্দল পাথর। মনে হলো–হিজলের গাছ দুটোর মন খারাপ; আমার মতো। আমার বুকের ভেতর যে কালবোশেখি ঝড় বইছে, যে অমাবশ্যা আজ আমার হৃদয়াকাশে, তা হয়তো বা হিজলের গাছ দুটোর মনেও সমানতালে ঝড় তুলেছে। আমার মতোন, তাদেরও যে ভারি আদরে বড় করেছিলো আমার মা। মামাবাড়ি থেকে, আমাদের সেই বাড়ন্ত শৈশবের সময়ে মা দুটো হিজল চারা এনে লাগিয়েছিলেন এখানটায়। বাবা বলেছিলেন, এই গাছ কেউ শখ করে লাগায়?’ মা বললো, ‘কেউ লাগায় না বলেই তো আমি লাগালাম। বাবা চুপ হয়ে গেলেন। হিজল চারা নিয়ে আর কোনোদিন। মাকে কোনো প্রশ্ন করেননি। সেই হিজল চারার গাছ আজ শাখা-পল্লবে আকাশ। ছুঁয়েছে। কিন্তু মাটির চারাতে প্রথম যে স্বপ্ন বুনেছিল, সেই স্বপনচারিণী আজ অতীত।

আমার মনে পড়ে, পৌষের হাড়-কাঁপানো শীতে মা আমার পড়ার টেবিলের পাশে চুলো থেকে তুলে আনা কড়কড়ে কয়লা-আগুন নিয়ে বসে থাকত। ছেলের পরীক্ষা, রাত জেগে পড়তে হবে, শীত যদি ছেলেকে কাঁবু করে ফেলে অথবা ঠান্ডায় পড়াশোনা করতে গিয়ে ছেলে যদি নিউমোনিয়া বাধিয়ে বসে–এই ছিলো মায়ের ভয়। আমি পড়ি আর মা খানিক বাদে বাদে আগুন নেড়ে দেয়। একটা উষ্ণতা আমার গায়ে এসে ভর করে।

গ্রীষ্মে দিনের বেলা রোদের প্রখরতা, আর রাতজুড়ে তার হাপিত্যেশ। কিন্তু জননী আমার, ঠিক আগের মতোই, পুরোনো এক পাখা হাতে নিয়ে, আমার টেবিলের পাশে বসে অবিরাম অবিরত হাত চালাতো। যেন তার কোনো ক্লান্তি নেই।

একবার বৃষ্টিতে ভিজে ভীষণ অসুখ বাধিয়েছিলাম। দিন যায় রাত আসে, চোখ। মেলে আমি তাকাতে পারি না। শুনেছিলাম, মা সারাটা দিন আমার মাথার কাছে বসে থাকত। নাওয়া নেই, খাওয়া নেই। বাঁধভাঙা চোখের জল যেন নদী হতে চায়। পাশের বাড়ির মোতালেবের তালে পড়ে বৃষ্টিতে ভিজেছি বলে জীবনে আর কোনোদিন ওপাড়ায় মা আমাকে পা ফেলতে দিলো না। আমাকে নিয়ে তার ছিলো সীমাহীন ভয়। বুকের মানিকের যদি কিছু হয়ে যায়?

রুপোর থালার মতো আকাশে ঝকঝকে চাঁদ। জোছনায় উঠোন মাখামাখি। অল্প এগুলেই একটা আদিম পুকুর। তার পাড়ে দুটো হিজলের গাছ; তাদের গা আঁকড়ে ধরে কিছু গুল্ম। ঠিক তার নিচেই একটা কবর যেখানে শুয়ে আছে আমার পরম মমতাময়ী মা।

চাঁদের আলোতে আমি দেখতে পাচ্ছি, হিজলের গাছ দুটো দুলছে। বাতাসে কোথাও গুঞ্জন উঠেছে একটা সুরের। আমি শুনতে পাচ্ছি, আমার বুকের গহিন থেকে, আমার অন্তরাত্মা ভেদ করে একটা অপার্থিব সুর ভেসে আসছে। রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বা-ইয়ানি সগীরা! একটা গান। হিজল বনের গান।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *