০৪. চাওয়া না-চাওয়া

০৪. চাওয়া না-চাওয়া

[এক]

আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে তখন। যদিও বৃষ্টির মৌসুম নয়; অবেলার বৃষ্টি। অবেলার বলেই হয়তো বা বড্ড বেপরোয়া প্রকৃতি। নিকষ-কালো মেঘে ছেয়ে আছে। মাথার ওপরের আকাশ। যেন ভীষণ অনিয়মে পৃথিবীতে নেমে এসেছে রাত্রি-প্রহর।

আমাদের ঘরে টিমটিমে একটি আলো জ্বলছে। বাতাসের ঝাঁপটায় নিভু নিভু অবস্থা; বাতাস একটু কমলেই সজোরে, ভীষণ বিস্ফোরণে সমস্ত শক্তিসমেত সেটা দপ করে জ্বলে ওঠে। বাতাস আর কুপি-বাতির মধ্যে যেন অলিখিত কোনো যুদ্ধ লেগেছে; কার শক্তি বেশি তা প্রমাণে উভয়পক্ষ বিলকুল মরিয়া।

আমাদের মাটির ঘর। বাতাসের আঘাতে আলোর ছিন্নভিন্ন অংশ জানালার ভেতর দিয়ে দাওয়ায় আছড়ে পড়েছে। সেই আলোতে হাত-পা গুটিয়ে বসে আছি আমরা চার জন। আমি, বড় আপা, রুমু আর মারুফা। আমাদের মধ্যে বড় আপার ছটফটানিটাই সবচেয়ে বেশি। সে একটু পরপর জানালা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে ঘরের ভেতর। তার চোখেমুখে আশা আর ভয়ের এক অদ্ভুত সমন্বয়। বড় আপা কেন যে ভয় পাচ্ছে জানি না। কী নিয়ে সে এতো আশা করে আছে তাও আমার ধারণার বাইরে। এই ঘন-ঘোর বৃষ্টি-বাদলের দিনে কেনই বা ঘরের ভেতরে আমাদের থাকার অনুমতি মিলছে না তাও বোধগম্য হচ্ছে না কোনোভাবে। রুমু পুতুল-খেলায় ব্যস্ত। আজ এই বান-বাদলের দিনে তার পুতুলের বিয়ে হচ্ছে; আদরের পুতুল-কন্যাকে কীভাবে সে শ্বশুরবাড়ি পাঠাবে তা নিয়ে তার কপালে চিন্তার ভাঁজ। মারুফার সেদিকে কোনো মন নেই। সে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে; সম্ভবত কালো মেঘেদের ছুটোছুটিতে সে ভীষণ আনন্দ পাচ্ছে।

মাকে দেখা যাচ্ছে না আজ; মনে হয় কোনো কাজে ভীষণ ব্যস্ত। কিন্তু এমন দুর্যোগের দিনে মা একটিবার আমাদের খোঁজ নেবে না, তা কী করে হয়? মায়ের কি তাহলে কোনো অসুখ করেছে? বড় কোনো অসুখ? যে অসুখ হলে বিছানা ছেড়ে ওঠা যায় না?

শব্দ করে কথা বলা যাবে না; বড় আপার নির্দেশ। একটু আগেই সে আমাদের কড়া শাসনের সুরে বলে রেখেছে, ‘খবরদার! কোনো শব্দ করিস নে যেন!

বড় আপার কড়া শাসনের শব্দে আমরা তিনজনই চুপ মেরে গেলাম। কিন্তু মাকে তো অনেকক্ষণ হয় কোথাও দেখছি না। নিদেনপক্ষে তার গলার আওয়াজ হলেও শোনার কথা। কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে বড় আপার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললাম, মায়ের কি অসুখ করেছে আপা?’ সে আমার চাইতেও নিচু স্বরের ফিসফিসানি আওয়াজে বললো, ‘না।’

‘তাহলে?’

‘তাহলে কী?’

 ‘মাকে কোথাও দেখতে পাচ্ছি না যে?’

বড় আপা খানিকক্ষণ চুপ মেরে রইলো। যেন জটিল এক প্রশ্নের মুখোমুখি এনে ফেললাম তাকে। কিছুক্ষণ ভাবনা-চিন্তা করে আমার দিকে মুখ ফেরালো সে। আমার সতৃয় দৃষ্টিকে উপেক্ষা করা যাবে না দেখে বড় আপা বললো, ‘দেখবি। আরেকটু অপেক্ষা কর।

আরেকটু অপেক্ষা? ঠিক কতোক্ষণ অপেক্ষা করে থাকলে মিটে যাবে আরেকটু অপেক্ষার প্রহর? এই অনির্ধারিত, অমীমাংসিত, অনির্দিষ্ট ‘আরেকটু’ সময়কে পার করার জন্যে নতুন করে অপেক্ষার তপস্যা শুরু হলো মনে।

হঠাৎ খটখট আওয়াজ করে খুলে গেলো ঘরের সদর-দরজা। দরজা খুলে যেতেই ভেতর থেকে হনহন করে হেঁটে বেরিয়ে এলেন এক বয়স্ক মহিলা। চেহারায় তার প্রৌঢ়ত্বের ছাপ। এসেই বড় আপার কানে কানে ফিসফিসিয়ে কী যেন বললেন। বড় আপা এদিক-সেদিক ছুটোছুটি করে কতোগুলো জিনিস জোগাড় করে মহিলার হাতে দিতেই সেগুলো নিয়ে তিনি আবার হনহন করে ঘরের ভেতরে ঢুকে ধড়াম করে দরজা লাগিয়ে দিলেন। আমরা আরেকবার আলাদা হয়ে গেলাম। হয়তো বা আরও খানিকটা দীর্ঘায়িত হলো আমাদের অপেক্ষার প্রহর।

বড় আপা এবার নিজ থেকেই কথা বললো। ফিসফিসিয়ে নয়; বরং একটু জোরেই। বললল, ‘চল, আমরা হাত তুলে দুআ করি।’

আমি বললাম, ‘দুআ করবো কেন? মায়ের তো অসুখ করে নাই।’

বড় আপার চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে; আমার এমন অকপট প্রশ্নের প্রশ্রয়ে বড় আপা সম্ভবত খুশি হতে পারেনি। চেহারা থেকে বিরক্তির রেশটুকু গলার মধ্যে টেনে নিয়ে, বেশ কর্কশ গলায় সে বললো, ‘বড় কথা শিখেছিস! অসুখ হলেই খালি মানুষ দুআ করে?’

বড় আপার কথায় ভরসা আছে। তাকে কোনোদিন মিথ্যে বলতে দেখিনি আমরা। আজও যে মিথ্যে বলছে না সেটা জানি। কিন্তু, তাও মনে হচ্ছে আমি কিছু একটা জানতে পারছি না, অথবা আমাকে জানানো হচ্ছে না। কেন কে জানে! তবুও ফ্যালফ্যাল করে বড় আপার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মায়ের অনুপস্থিতিতে আপাই আমাদের সব। তার অনুগত থাকা একটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে আমাদের। আমার কৌতূহলী অথচ করুণ চেহারার দিকে তাকিয়ে আপার সম্ভবত মায়া হলো। মুখভরা একটা হাসি দিয়ে আমার দিকে তাকালো বড় আপা। তার হাসিতে এতোক্ষণের গুমোট পরিবেশে মুহূর্তে প্রাণের হিল্লোল দোল খেলো যেন! আকাশ মেঘে ভর্তি, তবু মনে হচ্ছে চারদিক খুব হালকা। দুর্যোগের এই ঘনঘটার দিনেও বড় আপার মুখের এই হাসি অনেক কিছুর ইঙ্গিত দেয়। চিন্তায় পড়ে যাওয়ার মতো কোনোকিছু মায়ের হয়নি। যদিও কিছু হয়ে থাকে, তা অবশ্যই ভালো কিছু। ভালো কিছুই যে হতে চলেছে, সেই সংবাদ একটু পরে আপার মুখ থেকেই শুনলাম অবশ্য। আমাদের ভাই-বোনদের সবাইকে উদ্দেশ্য করে আপা একটা নির্মল, নিরুদ্বেগ হাসি দিয়ে বললো, ‘আমাদের ঘরে আরেকটা বাবু আসবে রে।’

আমাদের ঘরে নতুন বাবু আসার সংবাদে সবচেয়ে বেশি বিস্মিত হয়েছে রুমু। তার ধারণা, আসমান থেকে টুপ করে একেকদিন আমরা আমাদের ঘরের ভেনুতে এসে পড়েছি। বড় আপা, আমি, মারুফা এবং সে–আমরা সবাই। কিন্তু আজ যে ঘরের দরজাই বন্ধ। দরজা বন্ধ থাকলে আসমান থেকে বাবুটা কোথায় এসে পড়বে? চোখেমুখে বিস্ময় ধরে রেখে রুমু আবার পুতুল-খেলায় মন দিলো। একটু পরেই রুমুকে বরযাত্রী বিদেয় করতে হবে। তার হাতে এখনো কতো কাজ! মারুফাও চুপচাপ। বড় আপার কথায় তার মধ্যে কোনো ভাবাবেগ দেখা গেলো না।

বাইরে এখনো অঝোর ধারার বৃষ্টি। কিন্তু সেই বৃষ্টির শব্দকে ছাপিয়ে, একটা নতুন কান্নার আওয়াজ বাতাসের কাঁধে ভর করে ভেসে এলো আমাদের কানে। বুঝতে দেরি হলো না যে নবজাতকের কান্না! কান্নার সেই শব্দে আমি প্রায় আঁতকে উঠেছি বলা চলে। চোখভরা বিস্ময় নিয়ে কান্নার অকুস্থলের দিকে তাকিয়ে আছে রুমু। ঘরের দরজা বন্ধ থাকা সত্ত্বেও আসমান থেকে কোনদিকে বাবুটা ঘরে এসে পড়েছে। তা সে বুঝে উঠতে পারছে না। আজ সম্ভবত রুমুর বিস্মিত হবার দিন। মারুফাও ঘাবড়ে গিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। কোনো সাড়া-শব্দ ছাড়াই সে চোখের পলক না ফেলে কান্নার আগমন-স্থলের দিকে তাকিয়ে আছে।

বয়স্ক মহিলাটা দরজা খুলে দাওয়ায় এসে দাঁড়াল। বড় আপাকে লক্ষ করে বললো, ‘মিনু, তোর বইন হইছে।’

আমাদের আরেকটা বোন হয়েছে। রুমু আর মারুফার আরও একজন খেলার সাথির আবির্ভাব ঘটেছে দুনিয়ায়। কিন্তু বড় আপার দিকে তাকাতেই তাকে বেশ বিমর্ষ দেখালো। তার বিপন্ন মুখাবয়বের কোথাও যেন কোনো অনিশ্চিত বিপদের সংকেত। অবস্থাদৃষ্টে মনে হলো, খুব অপ্রত্যাশিত কোনো ব্যাপার ঘটে গেছে, যার জন্য আমাদের কোনো প্রস্তুতি ছিলো না।

বৃষ্টির থামাথামির কোনো নামগন্ধ নেই। এরই মধ্যে কাজের পাওনা হিশেবে বয়স্ক ধাত্রী মহিলা কিছু চাল নিয়ে বৃষ্টির মধ্যে মাথার ওপর অর্ধ ছেঁড়া একটা ছাতা ছাপিয়ে বেরিয়ে পড়লো। আমাদের নতুন অতিথি এসেছে অনেকক্ষণ হয়ে গেলো। মা পাটিতে শুয়ে আছে। তার পাশে আগত নতুন মেহমান। রুমু পুতুল বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। মারুফাও আরেকটু দূরে, বিছানো চাটাইতে হাত-পা গুটিয়ে বেশ আরাম করে ঘুমুচ্ছে। আমি আর বড় আপা বসে আছি মায়ের পাশে। বাইরের আকাশের মতো মায়ের চেহারাতেও একটা বিষণ্ণতার ছাপ। আমাদের অধীর অপেক্ষা বাবার জন্যে। প্রতিদিনের ন্যায় আজকেও দিনের বেলায় বাবা বাসায় নেই।

ভারী বর্ষণ একটু কমলো বটে, তবুও বাইরে গেলে গা ভিজে ছপছপ করবে। এরই মধ্যে, হুড়মুড় করে উঠোন ভেঙে বাবার আবির্ভাব হলো। বাবাকে খুব ভয় পাই আমরা। তার ভারি লাল লাল চোখ। পাথরের মতো শক্ত দু-খানা হাত। আমরা জানি, বাবার শক্ত হাতের কিল খেলেই আমাদের গায়ে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর উঠে যায়। তাই বাবার কাছে কখনোই কোনো আদিখ্যেতা করার সাহস আমাদের কারও হয় না। বাবাকে সবচাইতে বেশি ভয় পায় মা। বাবার উপস্থিতিতে যেন মায়ের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। মায়ের এই ভয়ের কারণ আগে বুঝতাম না, কিন্তু আজকাল বুঝি। পান থেকে চুন খসলেই বাবার যে ভয়ংকর রূপ বেরিয়ে পড়ে, তাকে ভয় না করে উপায় কী? মায়ের পরে বাবাকে সবচেয়ে বেশি ভয় পায় বড় আপা। এরপর আমি। তারপর কে? সম্ভবত রুমু। মারুফা কি বাবাকে ভয় পায়? জানি না।

এরপরের ঘটনা খুব নাটুকে। নতুন কন্যাসন্তানের আগমন-বাণী শুনে বাবার সে কী তর্জন-গর্জন। বাবার এমন বীভৎস রূপ, এমন ভয়ংকর চেহারার কাছে বাইরের অশান্ত প্রকৃতিও যেন মামুলি! বাবার তাণ্ডবের কাছে কালবোশেখির মেঘের তাণ্ডবও যেন ফিকে হয়ে আসে।

এরপর কী থেকে যে কী হয়ে গেলো, কিছুই ভালোমতো বুঝে ওঠা গেলো না সেদিন। আমার মা, নিদারুণ প্রসববেদনা সহ্য করে যে খানিক আগেই জন্ম দিয়েছে একটি মানব-সন্তান, তাকে আমি আবিষ্কার করেছি উঠোনের মাঝে। জড়সড় অবস্থায়; কাঁদায় মাখামাখি। মা উঠে দাঁড়াতে পারছে না কোনোভাবে। উঠতে গেলেই ককিয়ে কেঁদে উঠে আবার মাটিতে ধপাস করে পড়ে যাচ্ছে। বড় আপা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে ঘরের এক কোণে। ভয়ার্ত চোখমুখ নিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে আছে আমার দুটো বোন। রুমু আর মারুফা। নতুন যে এসেছিল, সেও চিৎকার জুড়েছে সমানতালে। ঘরে বাইরের এই সীমাহীন সংকটের সামনে আমি বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।

আবারও ভারী বর্ষণ শুরু হয়েছে। সেই বর্ষণের মাঝে কোনোমতে উঠে দাঁড়িয়েছে আমার মা। মা কি কাঁদছে? অঝোর বৃষ্টিতে তা বোঝা মুশকিল। তাকে খুব অসহায় আর বিপন্ন দেখাচ্ছে। মাকে এই মুহূর্তে হতবিহ্বল হরিণীর মতন মনে হচ্ছে; বাঘের তাড়া খেয়ে যে ক্লান্ত, পিপাসার্ত। সংসারের সীমাহীন সংকটে যে মহিলা বটবৃক্ষ হয়ে আগলে রেখেছিল আমাদের, আজ তাকে এমন বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত দেখে আমার বুকের কোথাও যেন হুহু কান্নার রোল পড়ে গেলো।

এই ঘনঘোর বর্ষার বর্ষণের মাঝে উঠোনে নেমে মায়ের হাত ধরে বললাম, ‘ঘরে চলো, মা।

হাত ধরতেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো আমার মা। আমি দেখলাম, মায়ের চোখ বেয়ে নেমে আসছে নোনা জলের স্রোত; এই স্রোত যেন শ্রাবণ-ধারার জলকেও হার মানিয়ে দেয়। যেন অনেক কষ্টে বাঁধ দিয়ে রাখা জোয়ারের জল, শেষ চেষ্টাটুকু করেও আর যাকে আটকানো গেলো না। আমি মায়ের বুকের সাথে লেপ্টে রইলাম। এই স্নেহময় বুকে এক প্রলয়ংকরী ঝড় উঠেছে, যা কালবোশেখির ঝড়ের চাইতেও প্রবল। মহাসাগরের বুকে মহাদুর্যোগের সময় যে ঝড় ওঠে, সেই ঝড়ও মায়ের বুকের ঝড়ের কাছে নস্যি। সেদিন মা আমাকে মুখ ফুটে একটা কথাই বলেছিলো, ‘তোর বাপের মতো হোস নে, বাবা।

[দুই]

আজও বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি। ঝড়ো হাওয়ায় লন্ডভন্ড প্রকৃতি। আমি দাঁড়িয়ে আছি অপারেশান থিয়েটারের করিডোরে। ভেতরে আমার স্ত্রী রেবেকা। প্রচণ্ড প্রসব বেদনায় সে কাতর। অপারেশন থিয়েটারের দরজার ফাঁক গলে আসা তার চিৎকার আমার বুকের ভেতরটাকে ভেঙে খান খান করে দিচ্ছে। আজ আমাদের ঘরে নতুন আলো আসার দিন। ভয়, আশা আর আনন্দের ত্রিমুখী সংঘর্ষে আমি বিধ্বস্ত। বাইরের প্রকৃতির মতোই ছিন্নভিন্ন প্রায়। আমার মনে পড়ে যায় শৈশবের কথা। একদিন, এমন এক ঘনঘোর বরষা এবং আমার মা। আমি আর ভাবতে পারি না কিছুই। আমার মনে পড়ে যায় বড় আপার কথা, যে বছরখানেক আগে মরণ-জ্বরে মারা গেছে। সেদিন, সেই কালবোশেখি ঝড়ের দিনে আপা বলেছিলো, ‘চল, আমরা দুআ করি। সেদিনও অঝোর ধারার বৃষ্টি ছিলো। আচ্ছা, আপা কি জানতো বৃষ্টির সময় দুআ করলে সেই দুআ আল্লাহ কবুল করেন? হয়তো জানতো। সেদিন। কি আমি সত্যিই কোনো দুআ করেছিলাম? আমার মনে পড়ে না।

আমি আসমানের দিকে হাত তুলে বললাম, ‘পরওয়ারদিগার, আমার স্ত্রীকে ধৈর্য দিন। এই ভীষণ ব্যথা সইবার শক্তি তাকে দিন। আর, আমাকে কন্যাসন্তান দান করুন। আমি কন্যার বাবা হতে চাই।’

আজও বৃষ্টির কোনো থামাথামি নেই। আকাশে কালো মেঘের অবিরাম ছুটোছুটি। হঠাৎ মধুর এক কান্নার আওয়াজ! নতুন এক প্রাণের আবির্ভাবের সংকেত। আমার বুকের ভেতরে উথাল-পাথাল অবস্থা। কেমন আছে রেবেকা? আর, নতুন যে এলো সে?

একজন নার্স ছুটে বেরিয়ে এলো অপারেশন থিয়েটার থেকে। তার মুখ উজ্জ্বল। সে হাসিমুখেই বললো, আপনার মেয়ে হয়েছে।’

আমি তখন আনন্দে আত্মহারা! আল্লাহ আমার দুআ শুনেছেন? আমাকে কন্যার বাবা বানিয়েছেন? এতো দ্রুত আমার দুআ আসমান ভেদ করে আরশের মালিকের দরবারে পৌঁছে গেলো?

নার্স আরেক দৌড়ে বাবুটাকে নিয়ে এলো আমার কাছে। আমি ভালো করে দেখলাম তার চেহারা। দেখতে ঠিক যেন আমার মায়ের মতো। আমার মা, যে বুকের ব্যথায় কোঁকাতে কোঁকাতে আমার সামনে মারা গিয়েছিল। আমার কোল আলো করে যেন আমার মা-ই ফিরে এসেছে নতুন করে। সেই মা, যে কাকভেজা বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে, আমাকে বুকের সাথে জড়িয়ে বলেছিলো, ‘তোর বাপের মতো হোস নে, বাবা।’

আমি চুমু খেলাম আমার ছোট্ট মায়ের কপালে। সে চোখ মিটমিট করে আমার দিকে তাকালো। আমি বললাম, ‘মা দেখো, আমি আমার বাবার মতন হইনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *