০২. এই প্রেম, ভালোবাসা

০২. এই প্রেম, ভালোবাসা

[এক]

দুপুর থেকে বাইরে কয়লা-পোড়া রোদ। রোদের তেজ আর তাপে ঘরের ভেতরটাও উনুনের মতো গরম হয়ে আছে। মাথার ওপর অবিরাম, অবিশ্রান্তভাবে ঘুরতে থাকা সিলিং ফ্যানের হাওয়াগুলোও যেন বিদ্রোহ করে বসেছে। গায়ে হাওয়া লাগছে না আগ্নেয়গিরির তাপ লাগছে বোঝা মুশকিল।

এরই মাঝে রান্নাঘর থেকে খুন্তি হাতে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো রেবেকা। এসেই আমাকে বললো, ‘শুনছো, মাছের তরকারিতে না লবণ একটু বেশি হয়ে গেছে। পানি দিলেই কমে যেতো, কিন্তু তুমি তো অতো ঝোল পছন্দ করো না, তাই দিতে চাচ্ছি না। কোনো সমস্যা হবে তোমার?

আমি দেখলাম, কথাগুলো বলার সময় রেবেকার কপাল বেয়ে ঝরনাধারার মতো ঘাম ঝরছে। সে অভিজ্ঞ অভিনেত্রীর মতো, ওড়নার একটা অংশ দিয়ে চট করে তা মুছে নিয়ে আমার উত্তরের অপেক্ষায় দরজার কিনারে দাঁড়িয়ে আছে।

আমি হাঁসফাঁস করতে করতে বললাম, ‘দরকার কী বলো তো এতো কষ্ট করার? সাধারণ কিছু একটা হলেই বেশ চলে যেতো। এই গরমের মাঝে চুলোর পাড়ে বসে হরেক পদের তরকারি রান্না করার কোনো মানে আছে?

আমার এই কথাকে খুব একটা আমলে নিলো না রেবেকা। নিজের ওড়না দিয়ে দ্বিতীয়বার কপাল বেয়ে নামা ঘাম মুছতে মুছতে বললো, ‘সপ্তাহে এই একটা দিনই তো দুপুরে বাসায় খেতে পারো। অন্যসব দিন তো সেই বাইরেই ছুটোছুটি। কী যে খাও আল্লাহ মালুম! এই একদিনই যদি তোমাকে ভালো-মন্দ কিছু বেঁধে খাওয়াতে na পারি, তাহলে আর আমার স্ত্রী হওয়ার সার্থকতা কোথায়?

‘বেশ প্যাঁচাল পাড়া শিখে গেছেন আপনি! এই যে লম্বা লম্বা লেকচার শোনাচ্ছেন, নিজের চেহারাটার দিকে একবার তাকিয়েছেন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে?

‘ও আমার দেখে আর কী হবে, বলো? নতুন করে তো আর বিয়ে হবে না আমার! তোমার যদি আমাকে আর পছন্দ না হয় বলবে, আমি সোজা বাপের বাড়ি চলে যাবো।

‘হয়েছে বাবা হয়েছে! কান ধরছি! যার জন্যে চুরি করি সে-ই বলে চোর! বলতে গেলাম ভালো, হয়ে গেলাম খারাপ!

‘আমার অতো ভালো চাওয়া লাগবে না তোমার। এখন বলো তাড়াতাড়ি, খানিকটা লবণ বেশি হলে ঝামেলা হবে?

‘ঝামেলা মিটে যেতো যদি তুমি ওই গরম চুল্লি থেকে বেরোতে। বাইরে খেতে খেতে লবণ কম আর বেশি–দুটোই আমার মুখ-সওয়া হয়ে গেছে।

রেবেকা আর কোনো জবাব দিলো না। এক ভোঁ-দৌড়ে রান্নাঘরে চলে গেলো।

রেবেকা আসলে সত্যিই বলেছে। কাজের সুবাদে আমাকে ছুটে বেড়াতে হয় দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া। আমার কাজ হলো ফিচার লেখার উপাদান সংগ্রহ, এবং তা দিয়ে পত্রিকার জন্য ফিচার তৈরি করা। সাঁওতাল পল্লি থেকে শাপলার বন–কোথায় যাই না আমি গল্পের উপকরণ খুঁজতে? নিরন্তর ছুটতে গিয়ে দিন যে কখন রাত হয়ে যায়, রাত কেটে ভোর আসে–টেরই পাই না।

[দুই]

‘যেমন বুনো ওল তেমন বাঘা তেঁতুল’–প্রবাদ বাক্যকে সত্যি প্রমাণ করে, কটমটে সূর্যটাকে একদল দস্যি মেঘ এসে ঢেকে ফেলল৷ মুহূর্তকাল পরেই নেমে এলো অঝোর ধারার বৃষ্টি। অবিরাম ধারার বর্ষণ প্রকৃতিজুড়ে। বৃষ্টির এমন একাধিপত্য দেখে কে বুঝবে–একটু আগেও এখানে কাঠফাটা রোদ ছিলো? আকাশের বর্ষণে সবকিছু যেন এক অনুপম স্নিগ্ধতা আর শীতলতায় ভরে গেলো।

আমি দেখলাম, আমার জানালার কিনারে দুটো চড়ুই গা ঝাড়া দিয়ে বসেছে। হঠাৎ এমন ঝড়ো বৃষ্টিতে তারা সম্ভবত বিভ্রান্ত। এমন গা-শীতল করা আবহাওয়ায় নিজেকে চাঙা করে নিতে বেলকনিতে এসে দাঁড়ালাম। আকাশ থেকে প্রকাণ্ড আকারের বৃষ্টির ফোঁটা ঝরে পড়ছে। প্রচণ্ড গরমে হাহাকার করে ওঠা প্রকৃতিতে এই বৃষ্টি-জল একফালি স্বস্তি হয়ে ধরা দিলো।

বৃষ্টি আমার বরাবরই পছন্দের। এই একটা জিনিসকে নিয়েই সম্ভবত পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি সাহিত্য রচিত হয়েছে। আর, সেই সাহিত্যের তিনভাগের দুইভাগ হয়েছে কেবল ভারতীয় উপমহাদেশে। বৃষ্টি নিয়েও যে এতো চমৎকার সাহিত্য রচনা করা যায়–এই কথা অনেক ইউরোপীয়রা বিশ্বাস করতো না। তাদের কাছে বৃষ্টি ছিলো নিছক বিরক্তি আর বিড়ম্বনার কারণ। অবশ্য, উত্তর-আধুনিক ইউরোপ যখন দালান আর ইমারতে ভরে গেলো, প্রকৃতির সান্নিধ্য থেকে একপ্রকার দূরেই ছিটকে পড়লো ইউরোপিয়ানরা। বৃষ্টির সময় প্রকৃতি যে মনোহরা রূপ ধারণ করে– তা অবলোকনের সুযোগ আর থাকলই বা কই তাদের? এ জন্যে বোধকরি তারা ভাবতে পারতো না যে–বৃষ্টি নিয়েও চমৎকার সাহিত্য তৈরি করা যায় এবং দুর্দান্ত সাহিত্য তৈরি হয়েও আছে।

বৃষ্টি নিয়ে আমার এমন ভাবালুতার মাঝে ছেদ ঘটালো রেবেকা। সে বেলকনিতে আমার পাশে দাঁড়িয়ে বললো, ‘কী সুন্দর বৃষ্টি, তাই না গো?

হু।

‘মানুষের দুআ যে এতো দ্রুত কবুল হয়, তা দেখে আমি তাজ্জব বনে গেলাম, জানো?’

আমি কৌতূহলী দৃষ্টিতে রেবেকার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘বুঝিনি।

‘ওই যে, গরমে তুমি বেশ হাঁসফাঁস করছিলে না? তখন রান্নাঘর থেকে মনে মনে দুআ করছিলাম। বলছিলাম, আল্লাহ, একটা ঝুম বৃষ্টি দিয়ে চারপাশটা ঠান্ডা করে দাও। আমার জামাইটার অস্বস্তি লাগছে অনেক। এমন বৃষ্টি দাও যেন আমার জামাই বৃষ্টি নিয়ে একটা গল্পও লিখে ফেলতে পারে। হি হি হি।

‘তুমি কি সত্যিই এমন দুআ করেছিলে?

‘হ্যাঁ। এমনটাই তো জপছিলাম রান্নাঘরে। কিন্তু বিশ্বাস করো, সত্যি সত্যিই যে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামবে–তা আমার ধারণাতেই ছিলো না। আল্লাহ মাঝে মাঝে কতো দ্রুত দুআ কবুল করে ফেলেন, দেখলে?

আমি জানি রেবেকা মিথ্যে বলেনি। ও কখনোই মিথ্যে বলে না। আমাদের পাঁচ বছরের দাম্পত্য জীবনে কোনোদিন একটিবারের জন্যও তাকে আমি মিথ্যে বলতে দেখিনি। ও যখন এই দুআ করেছে বললো, তাহলে সেটা অবশ্যই সত্যি।

ফ্যানের নিচে বসে হাওয়া গিলতে থাকা আমার অস্বস্তি কাটাতে বৃষ্টির জন্য দুআ করেছে জ্বলন্ত চুলোর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক রমণী! কী অবিশ্বাস্য ভালোবাসা কী অনুপম মায়ার বন্ধন!

রেবেকা আবার বললো, বৃষ্টির সময় দুআ করলে ওই দুআও কবুল হয়। চলো, আমরা দুআ করি।

‘কী দুআ করবো?

‘যা মন চায় করো।

জানালা গলে, রেবেকার হাত চলে গেলো বাইরে। রিমঝিম বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে তার হাত। আমি দেখলাম, সে চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে কিছু বলছে। আমি জানি, তার এই বলার অনেকটা জুড়ে আমি আছি। ও আমাকে রাখবেই।

[তিন]

রাত নেমে গেছে অনেক আগেই। থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে এখন। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আমি ল্যাপটপ খুলে বসে পড়লাম। কালকেই আমাকে একটা ফিচার জমা দিতে হবে অফিসে। পত্রিকার ত্রৈমাসিক ম্যাগাজিন প্রকাশের সময় আর বেশি। নেই হাতে।

অনেকটুকু লেখার পরে খেয়াল করলাম, বাইরে আবার ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। বাতাসে জানালার কাঁচগুলো রিনিঝিনি শব্দ তুলছে। আমি পড়ার ঘর থেকে শোবার ঘরে এলাম। আলো জ্বালিয়ে দেখি রেবেকা ঘুমিয়ে পড়েছে। সারাদিনের সাংসারিক ব্যস্ততার পরে এক শান্তির ঘুমে বেঘোর সে। তার নিষ্পাপ, মায়াময় চেহারা, তাতে কোথাও কোনো অভিযোগের রেখা ফুটে নেই। এই মেয়েটা সারাটা দিন আমাকে নিয়ে ভাবে। আমার ভালো থাকা, আমার ভালো-লাগা নিয়ে তার কতো ভাবনা-চিন্তা! মাঝে মাঝে মনে হয়–মেয়েরা বোধকরি অন্য ধাতুতে গড়া। একেবারে অপরিচিত একটা মানুষ, একটা পরিবার, একটা পরিবেশকে তারা কতো নিবিড়ভাবে আপন করে নেয়! কতো সুন্দর করে তাতে এঁকে দেয় ভালোবাসার আল্পনা!

বেলকনিতে এসে দাঁড়ালাম আমি। বৃষ্টির সময়ে দুআ করলে সেই দুআ কবুল হয়। বাইরে হাত বাড়াতেই বৃষ্টির ফোঁটাগুলো আমার হাতে লেগে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। চোখ বুজে, হৃদয়ের গভীর থেকে ভাষা টেনে নিয়ে, বিড়বিড় করে বললাম, ‘পরওয়ারদিগার, রেবেকাকে আমি অসম্ভব ভালোবাসি। এই দুনিয়ার মতো, জান্নাতেও আমরা এভাবে কাছাকাছি, পাশাপাশি থাকতে চাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *