১৪. ভালোবাসা ভালোবাসি

১৪. ভালোবাসা ভালোবাসি

এক.

মুআয ইবনু জাবাল রাযিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অত্যন্ত প্রিয় একজন সাহাবি। নবিজি তাকে এত পছন্দ করতেন যে, কোথাও যাওয়ার সময় মুআয রাযিয়াল্লাহু আনহুকে সাথে নিয়ে নিজের বাহনে। চেপে বসতেন।

একদিন মুআয রাযিয়াল্লাহু আনহুর হাত ধরে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘মুআয, আল্লাহর শপথ আমি তোমাকে ভালোবাসি৷’[1]

নবিজি ভালোবাসেন মুআয রাযিয়াল্লাহু আনহুকে। যাকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বাছাই করেছেন মানবতার দূত হিশেবে, গোটা সৃষ্টি-জগতের জন্য যাকে রহমত হিশেবে পাঠানো হয়েছে, সপ্ত আসমানের ওপারে ডেকে নিয়ে যার সাথে সাক্ষাৎ করেছেন স্বয়ং বিশ্ব জাহানের অধিপতি–সেই মহা-মানব যখন কারো হাত ধরে বলেন, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’, একবার ভাবুন তো একজীবনে সেই প্রাপ্তিটা তখন কত বিশাল হয়ে দাঁড়ায়?

মুআয রাযিয়াল্লাহু আনহু সম্মানিত সেই মহা-সৌভাগ্যবানদের একজন!

তবে ভালোবাসার কথা জানিয়েই কিন্তু নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার দায়িত্ব শেষ করেননি। ভালোবাসার কথা জানানোর পর মুআয রাযিয়াল্লাহু আনহুকে তিনি এমন কিছু শিখিয়ে দেন, যা তাকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কাছেও করে তুলবে মহা-সম্মানিত।

মুআয রাযিয়াল্লাহু আনহুকে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘মুআয, আল্লাহর শপথ আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে বলছি, প্রতি সালাতের শেষে–আল্লাহুম্মা আ’ইন্নি ‘আলা যিকরিকা, ওয়া-শুকরিকা, ওয়া হুসনি ইবাদাতিক’ বলতে যেন কখনোই না ভুলো।[২]

ধরুন, কেউ এসে আপনাকে বললো, ‘ভাই, আল্লাহর কসম করে বলছি আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমার একটা কথা শোনো, প্রতিদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে আধা-ঘণ্টা হেঁটে আসার কথা যেন কখনোই ভুলো না।

এই কথা যদি কেউ এসে আপনাকে বলে, তার ভালোবাসার ব্যাপারে আর কোনো সন্দেহ আপনার থাকে না। সে আপনাকে এমনকিছু বাতলে দিচ্ছে, যা সত্যই আপনার জন্য উপকার বয়ে আনবে। প্রত্যহ ভোরবেলা স্নিগ্ধ বাতাসে আধ-ঘণ্টা হাঁটার অভ্যাস করতে পারাটা হতে পারে আপনার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ একটা অর্জন। আপনার শরীর, দেহ আর মনের জন্য তা নিঃসন্দেহে অতীব উপকারী। আপনি জানেন এই দাবিতে তার কোনো স্বার্থ নেই, তার কোনো অভিপ্রায় নেই।

ভালোবাসার কথা জানিয়ে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুআয রাযিয়াল্লাহু আনহুকে তেমনই একটা উপদেশ দিয়েছেন। নিঃস্বার্থ। মুআয রাযিয়াল্লাহু আনহুও জানেন–তার দুনিয়া ও আখিরাতকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করার জন্য কতই না উপকারী সেই উপদেশ!

মুআয রাযিয়াল্লাহু আনহুকে শিখিয়ে দেওয়া নবিজির সেই দুআর বাংলা ভাবার্থটা এমন–’ইয়া আল্লাহ, আপনাকে স্মরণ করার ব্যাপারে, আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ব্যাপারে, অতি-উত্তমভাবে আপনার ইবাদত করার ব্যাপারে আপনি আমাকে সাহায্য করুন।

দুআটা খুবই ছোটো, কিন্তু ছোট্ট এই দুআর ভেতরে যেন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার সাথে লেগে থাকার সমস্ত উপকরণ বিদ্যমান। দুআটায় তিনটা জিনিসের জন্য সাহায্য চাওয়া হচ্ছে–

» আল্লাহকে স্মরণের ব্যাপারে।

» আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ব্যাপারে।

» অতি-উত্তমভাবে আল্লাহর ইবাদত করার ব্যাপারে।

আল্লাহর স্মরণ তথা যিকিরকে বলা হয় আত্মার খোরাক। মোহ, লোভ, হিংসা, ঘৃণা, পাপ আর পঙ্কিলতার ছোঁয়ায় আমাদের আত্মা প্রতিনিয়ত দূষিত হতে থাকে। সেই দূষিত আত্মাকে কেবল যিকির-ই পারে সতেজ আর সজীব করে তুলতে। আল্লাহর স্মরণ মুছে দেয় অন্তরের দূষণ আর তাতে এনে দেয় অনাবিল প্রশান্তি। কুরআনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলছেন,

নিশ্চয় আল্লাহর স্মরণেই অন্তরগুলো প্রশান্ত হয়।[৩]

তরতর করে এগোতে থাকা সভ্যতায় আমাদের চিন্তাগুলো সর্বদা বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে। আমাদের চারপাশে তথ্য আর তত্ত্ব, জ্ঞান আর গরিমার বিপুল সমাহার। উপচে পড়া তথ্য আর তত্ত্বের দুনিয়ায় আমরা মাঝেমধ্যেই হাঁপিয়ে উঠি। জীবনের সঠিক গন্তব্য আর লক্ষ্য থেকেও হই বিচ্যুত। এমন বিভ্রান্তি আর বিরক্তির মুহূর্তগুলোতে যদি আমরা গভীরভাবে নিমগ্ন হতে পারি আল্লাহর স্মরণে, তাহলে রাহমানুর রাহিম ঠিক। ঠিক আমাদের বিচ্ছিন্ন অন্তরটাকে তার সঠিক রাস্তা চিনিয়ে দেন।

আল্লাহর স্মরণের পর দুআটায় যে জিনিসটা চাওয়া হয়েছে তা হলো–আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ের ব্যাপারে সাহায্য।

মানুষ খুব বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে থাকে। সে সবসময় কী পায়নি আর কী পাচ্ছে না, তা নিয়েই হাপিত্যেশ করে, কিন্তু যা কিছু সে পেয়েছে বা পাচ্ছে, তার জন্য কৃতজ্ঞতা জানানোর সৌজন্যবোধ খুব কমই তার মাঝে উপস্থিত।

গ্রহ থেকে গ্রহে মানুষ হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে পানি। তার আশা–যেখানে পানি থাকবে, সেখানেই পাওয়া যাবে প্রাণ ধারণের সম্ভাবনা। মঙ্গল, নেপচুন, প্লুটো আর ইউরেনাসসহ মহাশূন্যের অন্যসব জায়গায় যে পানি সোনার হরিণের মতোই দুর্লভ, সেই পানিকে পৃথিবী নামক গ্রহটায় আমাদের জন্য কত সহজলভ্য করেছেন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা; কিন্তু আমরা কি এই নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করি? কখনো দুআয় দুহাত তুলে আল্লাহকে বলেছি, ইয়া আল্লাহ, গোটা মহাবিশ্বে যা অপ্রতুল, তা কত অনায়াসে আপনি আমাকে দান করছেন নিত্যদিন। যে নিয়ামত না হলে আমার বাঁচা অসম্ভব হতো, না-চাইতেই তা কত অবলীলায় আমি পেয়ে যাচ্ছি। এই যে নিয়ামত আপনি আমাকে দান করছেন, এর জন্য আপনার দরবারে লাখো কোটি শুকরিয়া।

শুধু তো পানি নয়, প্রকৃতির আলো-হাওয়া থেকে শুরু করে সমস্ত উপকরণ মহান রব আমাদের জন্য সুচারুরূপে সৃষ্টি করেছেন এবং তা সহজলভ্য করেছেন আমাদের জীবনধারণের জন্য। প্রতিদিন যে পরিমাণ অক্সিজেন বাতাস থেকে আমরা গ্রহণ করি, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা যদি তার দাম নেওয়া শুরু করতেন, পৃথিবীর তাবৎ ধনকুবেররাই রাতারাতি ফকির হয়ে যাবে। আমার-আপনার মতো হাভাতে লোকেদের কথা তো বাদই দিলাম। প্রকৃতিজুড়ে এত এত নিয়ামত আমাদের জন্য বরাদ্দ, কিন্তু কোথাও তার জন্য আমাদের দিতে হয় না একটা পয়সা; তবু কখনো দুহাত তুলে একবার সেই মহান রবকে একটাবার ‘ধন্যবাদ জানানো হয়নি।

প্রাণ-প্রকৃতির নিয়ামতের জন্য শুকরিয়া নাহয় নাই-বা করলাম, সু-স্বাস্থের জন্য, সংসারের সচ্ছলতার জন্য, শান্তির জন্য, আয়-রোজগারে বারাকাহর জন্য, উত্তম স্বামী/স্ত্রী ও সন্তানাদির জন্য, ভালো চাকরির জন্য এবং সর্বোপরি আল্লাহর মনোনীত একমাত্র দ্বীন ইসলামে অন্তর্ভুক্ত হতে পারার জন্যও কি কখনো শুকরিয়া করেছি আমরা?

তাই তো কুরআনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেছেন, মানুষ বড়োই অকৃতজ্ঞ।[৪]

দুই.

কৃতজ্ঞতা জানাতে পারাটা খুব বড় একটা গুণ। কারো দ্বারা উপকৃত হওয়ার পর তার উপকারের স্বীকৃতি দিতে যারা কুণ্ঠাবোধ করে, যারা মুখ ফুটে একটা ধন্যবাদ বলতে পারে না, ব্যক্তিজীবনে অসুখী হবার সম্ভাবনা তাদের সবচেয়ে বেশি। যারা অন্যের উপকারের স্বীকৃতি দিতে তৎপর, ধরে নেওয়া যায় যে, তাদের অন্তরে বক্রতা নেই। যাদের অন্তরে বক্রতা নেই, জীবনে সুখী হওয়ার দৌঁড়ে তারাই সবচেয়ে এগিয়ে। কৃতজ্ঞ হতে পারাটাও জীবনের পরম এক অর্জন। সেই অর্জন লাভের জন্য নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুআয রাযিয়াল্লাহু আনহুকে আল্লাহর কাছ থেকে সাহায্য চাইতে বলেছেন।

আল্লাহর কাছে তৃতীয় যে সাহায্যটা মুআয রাযিয়াল্লাহু আনহুকে চাইতে বলেছিলেন নবিজি, সেটা হলো–উত্তমভাবে ইবাদত করতে পারা।

এখানে লক্ষণীয় যে, প্রথম দুটো ব্যাপারের চাইতে শেষ ব্যাপারটায় একটু জোর বেশি দেওয়া হয়েছে। প্রথম দুটোয় বলা হয়েছে–আপনার যিকিরের ব্যাপারে, আপনার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ব্যাপারে, কিন্তু শেষেরটায় বলা হয়নি যে, আপনার ইবাদত করার ব্যাপারে; বরং বলা হলো–উত্তমভাবে আপনার ইবাদত করার ব্যাপারে। ইবাদতের জায়গায় এসে একটু বাড়তি জোর, বাড়তি বিশেষণ যোগ হয়ে গেলো, কিন্তু কেন বলুন তো?

কারণ আপনার ইবাদত যখন ঠিক হবে, আপনার বাদবাকি সবকিছুই তখন ঠিক হতে শুরু করবে। উত্তমভাবে ইবাদত করতে পারার অর্থ হলো আল্লাহর একজন উত্তম বান্দা হতে শুরু করা। আদতে উত্তম ইবাদতের মাঝেই শুরুর দুইটা ব্যাপার বেশ ভালোভাবে মিলেমিশে আছে। রুকু আর সিজদায় আপনি যখন ‘সুবহা-না রব্বিয়াল আযীম আর সুবহা-না রব্বিয়াল আলা বলেন, আপনি তখন মূলত আল্লাহর যিকির করেন। যখন আপনি তিলাওয়াত করেন ‘আলহামদুলিল্লাহি রব্বিল আলামীন’, তখন আসলে আপনি আল্লাহর শোকর আদায় করেন। সুতরাং, একজন উত্তম ইবাদত-গুজার বান্দা একইসাথে একজন যিকিরকারী এবং একজন শোকর-আদায়কারীও বটে। এইজন্য ইবাদতের বেলায় এসে নবিজি জোরটা বাড়িয়ে দিলেন, কারণ আগের দুইটাতে যদি ঘাটতিও থাকে, শেষে এসে তা যেন পুষিয়ে দেওয়া যায়।

।জীবনের সবচেয়ে সেরা অর্জন হলো–আল্লাহর একজন অতি-উত্তম ইবাদতকারী বান্দা হতে পারা। এই অর্জন যারা লাভ করতে পারে, সফলতা তাদের জন্যই। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলছেন–

সেই সকল মুমিনরা সফল হয়েছে যারা তাদের সালাতে বিনয়ী।[৫]

সালাতে বিনয়ী হওয়ার অর্থ হলো–আল্লাহর সামনে ঠিক সেইভাবে দাঁড়ানো, যেভাবে দাঁড়াতে হয়, কিন্তু যান্ত্রিক জীবনের জাঁতাকলে আমাদের সমস্তকিছু যখন যন্ত্রের মতো গতানুগতিক, সেখানে আমাদের সালাতগুলোতে কতটুকু বিনয় আমরা রাখতে পারছি, সেটা নিয়ে ভেবেছি কখনো?

একটা ছোট্ট দুআ–আল্লাহুম্মা আইনি ‘আলা যিকরিকা, ওয়া শুকরিকা, ওয়া হুসনি ইবাদাতিক, কিন্তু এর মধ্যে যেন জুড়ে দেওয়া আছে জীবনের সবচেয়ে বড় তিনটা অর্জন লাভের গোপন রহস্য। মুআয ইবনু জাবাল রাযিয়াল্লাহু আনহুকে শিখিয়ে যাওয়া নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সেই ভালোবাসামাখা জীবনের পাঠগুলো আমরা আমাদের জীবনেও প্রতিফলিত করবো কি?

তিন.

মুআয রাযিয়াল্লাহু আনহুর প্রতি নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভালোবাসার কথা বলতে গিয়ে আমার আরো একটি ঘটনার কথা খুব মনে পড়ছে। একবার নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে খুবই প্রফুল্ল দেখে আয়িশা রাযিয়াল্লাহু আনহা বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ, আপনি তো খুবই খোশ-মেজাজে আছেন, আমার জন্য এখন একটু দুআ করুন না!

আয়িশা রাযিয়াল্লাহু আনহার এহেন আবদারে মুচকি হাসলেন আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। হেসে তিনি আল্লাহকে বলতে লাগলেন, ‘ইয়া আল্লাহ, আয়িশা পূর্বে করেছে এমন সকল গুনাহ আপনি ক্ষমা করে দিন। আয়িশা পরে করবে এমন সকল গুনাহও আপনি ক্ষমা করে দিন। আয়িশা প্রকাশ্যে করেছে এমন গুনাহ আপনি ক্ষমা করে দিন। আয়িশা গোপনে করেছে এমন গুনাহও আপনি ক্ষমা করে দিন। সে বুঝে করেছে এমন গুনাহ আপনি ক্ষমা করে দিন, না-বুঝে করেছে এমন গুনাহও আপনি ক্ষমা করে দিন।

আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় বান্দা, প্রিয় হাবিব যখন কারো জন্য ঠিক এভাবে দুআ করেন, বলুন তো সেই মানুষটার খুশিতে আত্মহারা না হয়ে উপায় আছে? নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখে নিজের জন্য এত চমৎকার দুআ শুনে খুশিতে আয়িশা রাযিয়াল্লাহু আনহাও পাগলপারা। আম্মাজান আয়িশা রাযিয়াল্লাহু আনহাকে খুশি হতে দেখে প্রীত হলেন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও। তবু তিনি জিগ্যেশ করলেন, ‘আয়িশা, আমার দুআয় তুমি খুশি হয়েছে?

খুশিয়াল গলায় আয়িশা রাযিয়াল্লাহু আনহা বললেন, আমি খুবই খুশি হয়েছি ইয়া রাসুলাল্লাহ।

তখন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘জানো আয়িশা, তোমার জন্য যে দুআ করলাম, ঠিক একই দুআ প্রতি সালাতের পর আমি আমার প্রতিটা উম্মতের জন্যই করি।’[৬]

এই হাদিসটা যেদিন প্রথম শুনি, আক্ষরিক অর্থেই সেদিন আমার চোখ বেয়ে টপ টপ করে পানি ঝরেছিলো। আমার নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই চৌদ্দশ বছর আগে বসেই আমার গুনাহের জন্য কেঁদে গেছেন, আমার ক্ষমালাভের জন্য আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে গেছেন জেনে কী যে এক ভালোলাগা আর ভালোবাসার অনুভূতি পেয়েছিলাম আমি, তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়!

আমি, আপনি, আমরা–আমরা সবাই প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মাহ। আমাদের গুনাহের মাফ চেয়ে তিনি আজ থেকে চৌদ্দশ বছর আগে কেঁদে গেছেন, আল্লাহর কাছে আর্জি জানিয়ে গেছেন, আকুল ফরিয়াদ করে গেছেন, যাতে আমাদের পূর্বের-পরের, প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য, বুঝে এবং না-বুঝে করা যাবতীয় গুনাহ আল্লাহ মাফ করে দেন। একজীবনে এরচেয়ে বড় পাওনা আমাদের জন্য আর কিছু হতে পারে কী!

হাদিসটা যদি এখনো আপনার মনে দাগ কাটতে পারে, যদি সেটা এখনো আপনার হৃদয়কোণে ভালোবাসার স্ফুরণ না ঘটায়, যদি এখনো আপনি বুঝতে না পারেন আপনার জন্য নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রেমময় প্রার্থনা, তাহলে যে দুআটা নবিজি আয়িশা রাযিয়াল্লাহু আনহার নাম ধরে করেছেন, সেখানে আয়িশা রাযিয়াল্লাহু আনহার নামের জায়গায় কেবল আপনার নামটা বসিয়ে নেন এবং অনুধাবন করুন, কতখানি ভালো তিনি আপনাকে বাসতেন!

চার.

‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বরুনা নামের এক মেয়েকে ভালোবেসে হাতের মুঠোয় প্রাণ নেওয়ার কথা বলেছিলো। শুধু কি তাই? ভালোবেসে সুনীল দুরন্ত ষাড়ের চোখে বেঁধেছিলো লাল কাপড় আর বিশ্ব সংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছিলো একশো আটটা নীলপদ্ম। কিন্তু বেচারি বরুনা সুনীলের কথা রাখলো না শেষ পর্যন্ত।

ভালোবেসে বেচারা সুনীলের সে কী পাগলামো! কিন্তু আমি ভাবি, আজ থেকে চৌদ্দশ বছর আগে যে মানুষটা আমাকে হৃদয় উজাড় করে ভালোবেসে গেলেন, যিনি মহান রবের দরবারে প্রতিটা সালাতের পরে আমার পাপ-মুক্তির জন্য ফরিয়াদ করে গেলেন, যিনি আমার কথা ভেবে গেলেন আমার অস্তিত্বেরও বহু শতাব্দী আগে, সেই মানুষটার ভালোবাসার কী প্রতিদান আমি দিচ্ছি? আমার কথায়, আমার চলনে-বলনে, আমার জীবনাচারে আছে কী তার ভালোবাসার প্রতিদানের কোনো ছাপ?

আমার একবার মনে হলো–আজ যদি নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার উঠোনে এসে দাঁড়ান, আমার ঘর থেকে ভেসে আসা গানের সুর কি তাকে বেদনাহত করবে না? সালাতের সময়ে আমাকে হাসি-আড্ডায় মেতে থাকতে দেখে, কাজে-কর্মে বিভোর থাকতে দেখে, টিভি-সোশ্যাল মিডিয়ায় বুঁদ থাকতে দেখে তিনি কি কষ্ট পাবেন না? তিনি এসে যদি দেখেন, আমি লোক ঠকাচ্ছি, মানুষের সাথে অসদাচরণ করছি, মানুষের ওপর জুলুম করছি, অন্যায়-অবিচারে ডুবিয়ে রেখেছি নিজেকে; যদি তিনি দেখেন, আমি কুরআনের আলোকে জীবনে স্থান দিতে কার্পণ্যবোধ করছি, তার সুন্নাহকে জীবনে আঁকড়ে ধরতে অনীহা দেখাচ্ছি, যদি তিনি একবার চেক করেন আমার ব্রাউজার হিস্ট্রি, যদি একবার ঢোকেন আমার ফোনের গ্যালারিতে, তিনি কতই না আফসোস নিয়ে বলতেন, ‘হায় উম্মাহ! তোমার জন্য আমি কত কেঁদে গেলাম, তোমাকে এত ভালোবেসে গেলাম আর তুমি এই দিলে আমার ভালোবাসার প্রতিদান?

আমি ভাবি আর লজ্জায় কুঁকড়ে যাই।

আমার মতো পাপী বান্দার গুনাহ মাফ চেয়ে যিনি কেঁদে গেলেন, যিনি আমাকে ভালোবেসে গেলেন অকাতরে, তার প্রতি ভালোবাসার কোনো দায় কি আমার নেই? তিনি আমার কাছে টাকা চান না, ধন-সম্পদ চান না, আমার বিত্ত-বিভব, নাম-যশ-খ্যাতি কোনোকিছুর প্রতিই তার দৃষ্টি নেই। তিনি আমাকে ভালোবেসেছেন কেবল আমার জন্যই। তিনি চান যাতে আমার ইহকাল আর পরকাল দুটোই সুন্দর হয়। ইহকালে একটা সুন্দর আর সুষ্ঠু জীবন অতিবাহিত করে পরকালে যেন আমি অনন্ত জান্নাতে অবগাহন করতে পারি–কায়মনোবাক্যে সেটাই তাঁর চাওয়া। দুনিয়ায়। এমন নিঃস্বার্থ ভালোবাসার নজির আর আছে কোথায়?

নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে ভালোবেসে গেলেন, তাকে। ভালোবেসে আমি কি পারি না তার সুন্নাহ দাড়িটুকু মুখে রেখে দিতে? তিনি অহর্নিশি ভেবেছেন আমাকে নিয়ে, আমার গোটা জীবনকে নিয়ে, আমি কি পারি না তার সুন্নাহ দ্বারা আমার জীবনটাকে রাঙিয়ে নিতে? হেরার যে আলো তিনি আমার জন্য তুলে এনেছেন, সেই আলোতে জীবনকে ভরিয়ে তুলতে কোনো কৃপণতা আমার সাজে? তাকে ভালোবেসে আমি কি পারি না আমার জীবনটাকে বদলে নিতে? যদি তাকে সত্যিই ভালোবেসে থাকি, তাহলে কি বেপর্দায় চলা আমার সাজে? আমার সাজে মিথ্যা বলে মানুষ ঠকানো? নন-মাহরামের সাথে দিব্যি ঘুরে। বেড়ানো, সম্পর্ক পাতানো, গান-নাটক-মুভিতে বুঁদ হয়ে থাকা?

নবিজির ভালোবাসাকে যদি ভালোবেসে থাকি, তাহলে আমার কি উচিত নয় জীবনটাকে নিয়ে আরেকবার ভাবতে বসা? সেই মহামানবের ভালোবাসার প্রতিদানে আরেকবার বদলে যাওয়ার চেষ্টা করা?

ভাবুন তো, আখিরাতে হাউযে কাউসারের পাড়ে দাঁড়িয়ে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তার চোখে-মুখে প্রতীক্ষার ছাপ স্পষ্ট। হঠাৎ তারস্বরে চিৎকার করতে করতে ছুটে এলেন আপনি আর বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ, আমি আসতে পেরেছি। আমি আপনার কাছে আসতে পেরেছি ইয়া রাসুলাল্লাহ!

প্রতীক্ষায় ক্লান্ত নবিজির চেহারায় যেন একটুকরো প্রশান্তি নেমে এলো। তিনি আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে আপনাকে বললেন, ‘আহলান ওয়া সাহলান।

এই দৃশ্যটার সাক্ষী হতে নিশ্চয় মন চাইছে আপনার? তাহলে চলুন না আজ থেকে নিজেদের একটু একটু করে বদলাতে শুরু করি।

———-
[1] সুনানু আবি দাউদ : ১৫২২; মুসনাদু আহমাদ : ২২১২৬; আল-আদাবুল মুফরাদ : ৬৯০

[2] সুনানু আবি দাউদ:১৫২২; মুসনাদু আহমাদ: ২২১২৬; সহিহু ইবনি খুযাইমা : ৭৫১; আল-আদাবুল মুফরাদ : ৬৯০-হাদিসের সনদ সহিহ

[3] সুরা রাদ, আয়াত : ২৮

[4] সুরা হজ, আয়াত : ৬৬

[5] সুরা মুমিনুন, আয়াত : ১-২

[6] সহিহু ইবনি হিব্বান : ৭১১১; মুসনাদুল বাযযার : ২৬৫৮-হাদিসের সনদ হাসান

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *