১১. খেলাঘর পাতা আছে এই এখানে

১১. খেলাঘর পাতা আছে এই এখানে

এক.

আমেরিকার টাইম স্কয়ারের নাম আমরা প্রায় সবাই শুনে থাকবে। পৃথিবীর সবচাইতে ব্যস্ত এলাকার তালিকায় সম্ভবত টাইম স্কয়ার তার ঐতিহ্য আর আভিজাত্য নিয়ে সবার শীর্ষে অবস্থান করে আছে। রিপোর্ট অনুসারে প্রতিবছর ৫০ মিলিয়ন মানুষ টাইম স্কয়ার পরিদর্শনে যায়!

তবে আমার ধারণা, ভাচুয়াল পৃথিবীকেও যদি আমরা আমাদের পৃথিবী ধারণার আওতাভুক্ত করি, টাইম স্কয়ারের এই বিশাল রেকর্ড নিমিষেই হাওয়া হয়ে যাবে! টাইম স্কয়ারের কিনারে বছরে ৫০ মিলিয়ন মানুষের পদচিহ্ন পড়ে কেবল, আর গ্লোবাল জরিপের মতে–সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীর সংখ্যা একদিনেই বাড়ে ১.৪ মিলিয়ন করে! প্রতি সেকেন্ডে নতুন করে ১৬ জন ব্যবহারকারী প্রতিনিয়ত যুক্ত হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়াতে! সোশ্যাল মিডিয়ার এই রেকর্ডের সামনে টাইম স্কয়ারের রেকর্ড তো একমুহূর্তও দাঁড়াতে পারবে না।

দুই.

প্রযুক্তি বদলে দিয়েছে দুনিয়ার মোড়। এখন আমরা ঘরে বসেই আমেরিকার নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করি, নাসার রকেট ছোঁড়ার দৃশ্য অবলোকন করি আর বন্ধুত্ব করি সুদূর সাইবেরিয়ার কোনো এক অপরিচিত মানুষের সাথে। প্রিয়জনের কাছে আমাদের যে চিঠি পৌঁছাতে আগে লেগে যেতো মাসের পর মাস, এখন আমাদের সেই বার্তা পৌঁছে যায় একটা ক্লিকেই। সময় লাগে কয়েক ন্যানো সেকেন্ড। এক অর্থে জীবন এখানে বড্ড সহজ!

কিন্তু জীবন কি সত্যিই সহজ হলো?

মুঠোফোনে আমেরিকার নির্বাচন আমরা তদারকি করছি ঠিকই, কিন্তু আমাদের ঘরের পাশে যে মানুষটা জীবনসংগ্রামে পরাজিত হতে চললো, তার জীবনটাকে কাছ থেকে দেখবার ফুরসত আমাদের হাতে কই?

নাসার রকেট ছোঁড়ার দৃশ্য দেখতে দেখতে হাত তালি দিয়ে আমরা বলছি, ‘মানব সভ্যতা আরো একধাপ এগিয়ে গেলো!

মানবসভ্যতা এগুলো ঠিকই, কিন্তু দারিদ্রের ভারে নুইয়ে পড়া আমাদের সমাজটা, যে সমাজ না আগালে আমরা আগাতে পারি না, তা নিয়ে আমাদের ভাবনা-চিন্তা কোথায়?

প্রযুক্তি দুনিয়াকে পুরে দিয়েছে আমাদের হাতের মুঠোয়। তবে একইসাথে, প্রযুক্তি আমাদের বন্দি করেছে মুঠোফোনের শেকলে। এখন আমাদের যাবতীয় আনন্দ বেদনা, সুখ-দুঃখ, চিত্ত-বিনোদনের উৎস হয়ে উঠেছে স্মার্টফোন। ছবিতে, স্টোরিতে, স্ট্যাটাস-টুইটে দুনিয়াকে প্রতিনিয়ত অবহিত করছি আমাদের দৈনন্দিন হালচাল। প্রাইভেসির দুনিয়ায় এখন আমাদের সমস্তকিছুই যেন ওপেন-সিক্রেট!

তিন.

আমেরিকার বিখ্যাত পত্রিকা সিএনএন ‘Being Thirteen’ শিরোনামে একটা ক্যাম্পেইন চালিয়েছিলো। তেরো বছর বয়সীদের মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের প্রবণতা কেমন, তা খতিয়ে দেখাই ছিলো ক্যাম্পেইনটার মূল উদ্দেশ্য। বলাই বাহুল্য–জরিপে উঠে আসা ফলাফল ছিলো রীতিমতো চমকপ্রদ ও ভয়ংকর! সেই ক্যাম্পেইনে তেরো বছরের এক কিশোরীকে জিগ্যেশ করা হয়, যদি তার হাতে থাকা স্মার্টফোনটা নিয়ে নেওয়া হয়, তার তখন কেমন অনুভূত হবে?

জবাবে ওই কিশোরী বললো, ‘প্রয়োজনে আমি টানা একসপ্তাহ খাবার খাবো না, কিন্তু স্মার্টফোন হাতছাড়া করতে আমি মোটেও রাজি নই।’

অন্য আরেকজন বললো, আমার হাতে যখন ফোন থাকে না, তখন আমার কাছে। সবকিছু খালি খালি লাগে। কোথায় যেন বিরাট এক শূন্যতা কাজ করে তখন।

স্মার্টফোন কিশোর-মনের ওপর কীভাবে প্রভাব ফেলছে, তা চিন্তা করলে রীতিমতো শিউরে উঠতে হয়। একজন কিশোরী টানা একসপ্তাহ কিছু না খেয়ে থাকবে, তবু স্মার্টফোন হাতছাড়া করতে সে একদম-ই রাজি নয়। এই প্রবণতাকে যদি আপনি ‘নেশা’ না বলেন, তাহলে নেশা বলতে ঠিক কী বোঝায় আমার জানা নেই।

আমার ধারণা, কেবল কিশোর শ্রেণি নয়, স্মার্টফোনের এই নেশা এখন মধ্যবয়স্ক, বয়স্কসহ আমাদের প্রায় সবার-ই। এই যে স্মার্টফোন-বিহীন দুনিয়াটাকে খালি খালি লাগে, আমাদের এই প্রবণতার পেছনে মূল কারণটা আসলে কী?

এক কথায় বললে–সোশ্যাল প্রোফাইল!

অনলাইন দুনিয়ায় অজান্তেই আমরা নিজেদের জন্য তৈরি করি একটা সোশ্যাল প্রোফাইল। সেই প্রোফাইল আমাদের টেনে ধরে রাখে ভার্চুয়াল জগতে। ধীরে ধীরে সেই প্রোফাইল ভারী হয় এবং আমরাও তাতে পুরোদস্তুর মজে যাই।

এই সোশ্যাল প্রোফাইল কীভাবে তৈরি হয়, তা জানার জন্য আমরা একজন মানুষের ভার্চুয়াল অ্যাক্টিভিটি কল্পনা করতে পারি। ভার্চুয়াল জগতে, তা হতে পারে ফেইসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, স্নাপচ্যাট, টিকটক বা লাইকি–তিনি যেদিন প্রথম অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন, সেদিনের তুলনায় তার আজকের অবস্থান পুরোপুরি ভিন্ন। সময়ের প্রেক্ষিতে তিনি এখানে ফলো করছেন অনেক প্রোফাইলকে এবং অনেক প্রোফাইল ফলো করছে তাকে। তার একটা পরিচয়ও এখানে দাঁড়িয়ে গেছে। এখানে তিনি হতে পারেন একজন ভালো লেখক, ভালো কবি, গায়ক অথবা ভালো বই পড়ুয়া, ভালো ভ্রমণ-পিয়াসু, ভালো রন্ধনশিল্পী, ভালো ফটোগ্রাফার, ভালো গ্রাফিক্স ডিজাইনার ইত্যাদি। এমনকি অন্যের লেখাতে জুতসই, শিক্ষণীয় মন্তব্য করার কারণেও আস্তে আস্তে একটা সোশ্যাল পরিচিতির তকমা তিনি পেয়ে যান। তার মন্তব্য দেখলেই আমরা বুঝতে পারি যে–তার ভাবনা, চিন্তা এবং বুঝবার ক্ষমতা বেশ প্রখর।

আমি বলছি না যে, এই গুণগুলো খারাপ কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় এসবের বিকাশ যথেষ্ট সমস্যার; তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় এই ধারাবাহিক পরিচিতি আস্তে আস্তে তার ওপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় এবং একসময় এই পরিচিতিকে টেনে নিয়ে যেতে তাকে রাত-দিন এখানে বুঁদ হয়ে থাকতে হয়।

ধরা যাক, তিনি ফেইসবুকে একটা নাতিদীর্ঘ লেখা লিখলেন এবং তাতে তিনি যথেষ্ট পরিমাণে মন্তব্য পেলেন। সাথে পেলেন অনেকগুলো লাইক। এ ধরনের আরো কন্টেন্ট তৈরিতে এই অর্জন তাকে অবশ্যই প্রলুব্ধ করবে এবং তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করবেন যে–তার কথা এবং চিন্তা মূল্য পেতে শুরু করেছে। যেহেতু তিনি অন্যদের নজর কাড়তে পারছেন, তাই এই বিশেষ নজরটাকে আরো বাড়াতে বা অন্তত ধরে রাখতে তিনি সচেষ্ট হয়ে ওঠেন।

সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষের নজর কাড়তে বা আলোচনায় থাকতে তার এই যে পরবর্তী প্রবণতা, বিজ্ঞান জানাচ্ছে, এটা হয় মস্তিষ্ক থেকে এক ধরনের হরমোন নিঃসরণের কারণে। পাঁচটা লাইককে দশটা করবার জন্য, দুটো মন্তব্যকে চারটে করার জন্য, ব্যাপক প্রশংসিত হবার জন্য তখন তার ভেতরে একটা প্রবণতা কাজ করে। এই প্রবণতাকে অনেকসময় সরাসরি বোঝা যায় না। মনে করা হয়–আমি তো নতুন কিছু শিখছি, নতুন কিছু শেখাচ্ছি, নতুন কিছু জানছি। নতুন কিছু শেখা, শেখানো আর জানার ভেল্কিতে প্রলুব্ধ হয়ে তাকে সোশ্যাল মিডিয়ায় কাটাতে হয়। ঘন্টার পর ঘণ্টা। স্ক্রল করতে হয় মাইলের পর মাইল, কিন্তু খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে–সোশ্যাল মিডিয়া ক্রল করে পুরোদিনে একজন ব্যক্তি যা-কিছু শেখে, তা খুবই সামান্য এবং ওই সামান্য জ্ঞানটার প্রভাবও তার জীবনে খুবই ক্ষণস্থায়ী।

এটা কেন হয় সেটাও আমি ব্যাখ্যা করছি।

ধরা যাক, একজন ব্যক্তি ফেইসবুকে দশজন লোককে ফলো করেন। যে দশজনকে তিনি ফলো করেন, সেই দশজন যে একই সময়ে এবং একই বিষয়ে লিখবে–তা কিন্তু বলা যায় না। এমনটা সম্ভবত কদাচিৎও ঘটে না। কারণ ব্যক্তি বিশেষের আগ্রহ অবশ্যই আলাদা আলাদা হয়ে থাকে। দেখা যায়, ওই দশজনের কেউ কুরআন হাদিসের কথা লেখে, কেউ লেখে রাজনীতি-সমাজনীতি নিয়ে। কারো লেখাজোকা হয় খেলাধুলাকেন্দ্রিক। কেউ চর্চা করে দর্শন আর কেউ হয়তো-বা আগ্রহ পায় বিজ্ঞানে বা সাহিত্যে। ওই লোক যখন ফেইসবুক স্ক্রল করে, তখন তার নিউজফিডে এই ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের, ভিন্ন ভিন্ন ভাবনার লেখাজোকা এসে হাজির হয়। কুরআন হাদিসের লেখাটা পড়ার পরে তার সামনে আসে দর্শনের আলাপ। দর্শনের আলাপ শেষ হলে আসে রাজনীতির মারপ্যাঁচ। রাজনীতি পর্ব সমাপ্ত হওয়ার পর সামনে এসে হাজির হয় বিজ্ঞানের তত্ত্বকথা। বিজ্ঞান বিদেয় নিলে আসে সাহিত্য আর সাহিত্যের পাঠ চুকা মাত্রই সেখানে খেলাধুলা ঢুকে পড়ে।

খুব অল্প সময়ের মধ্যে এতগুলো বিষয় যখন সামনে চলে আসে, তখন কোনো আলোচনার সারবস্তুই যে আসলে মাথায় ঢুকবে না–সেটাই স্বাভাবিক। একসাথে এতগুলো বিষয় পড়তে গিয়ে কোনো বিষয়ই ভালোভাবে পড়া হয় না। পড়লেও তা হয় নেহাতই চোখ বোলানো। এটা তো দশজন ব্যক্তিকে ফলো করলে যা অবস্থা হবে, তার হিশেব; বস্তুত সোশ্যাল মিডিয়ায় আমরা শয়ে শয়ে মানুষকে ফলো করি। আমাদের নিউজফিড নানান তথ্য, নানান বিষয় আর হরেক রকমের আলোচনায় যে ভর্তি থাকে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এতসব মানুষের এত এত লেখাজোকা, এত এত আলোচনা পড়তে গিয়ে আমরা নিজেদের অজান্তেই বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি এবং কোনো নির্দিষ্ট বিষয়কে তখন মস্তিস্কে আলাদা জায়গা দেওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে। সকালবেলা যে ভালো ব্লগটা পড়া হয় বা যে ভিডিও দেখে কোনো একটা কিছু শেখবার তাড়না কাজ করে মনে, টানা নিউজফিড ফ্রল। করার পর সেই ভালো ব্লগটার বিষয়বস্তুই মস্তিষ্ক থেকে হারিয়ে যায় অথবা নষ্ট হয়ে যায় ভিডিও দেখে পাওয়া স্পৃহাটুকুও।

মাত্রাতিরিক্ত সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার দিনশেষে আমাদের যা দুহাত ভরে দেয় তা হলো–একরাশ ক্লান্তি। মাইলের পর মাইল হাঁটলে আমরা যেমন শারীরিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়ি, মাইলের পর মাইল নিউজফিড স্ক্রল করার পর আমাদের মস্তিষ্কও সেরকম ক্লান্ত হয়ে পড়ে আর এই ক্লান্তি ধীরে ধীরে রূপ নেয় একটা মানসিক সমস্যায়।

আপনি হয়তো ভাবছেন–মাত্রাতিরিক্ত সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার থেকে কীভাবে মানসিক সমস্যা তৈরি হয়, তাই তো? এটা নিয়েও বিস্তর গবেষণা হয়েছে।

ওপরে আমরা ‘সোশ্যাল প্রোফাইল’ তৈরি এবং তা কীভাবে একজন মানুষকে সোশ্যাল মিডিয়ায় বুঁদ করে রাখে, তা সম্পর্কে বলেছি। এই সোশ্যাল প্রোফাইলকে টেনে নিয়ে যেতে, সেটাকে দিনের পর দিন আরো ভারী, আরো পোক্ত করে তুলতে এক অনিঃশেষ তাড়না কাজ করে মনে; কিন্তু কোনোভাবে যদি সেই সোশ্যাল প্রোফাইল তৈরিতে ব্যাঘাত ঘটে বা ঠিক যে লক্ষ্যমাত্রায় নিজেকে কল্পনা করা হয়, তা যদি অর্জন না করা যায়, তখন একটা মানসিক চাপ অনুভূত হয়। নিজেকে মনে হয় পরাজিত। মানুষ তখন নিজেকেই সন্দেহ করতে শুরু করে। ভাবে তার সৃজনশীলতার বুঝি অবনতি হচ্ছে। তাকে সম্ভবত মানুষজন আর পছন্দ করছে না। তার কন্টেন্ট দিয়ে সে বুঝি আর লোকজনকে সন্তুষ্ট করতে পারছে না। এ ধরনের এক হতাশাবোধ তাকে তখন তাড়িয়ে বেড়ায় এবং সেটা শেষ পর্যন্ত রূপ নেয় এক ভয়ংকর মানসিক বৈকল্যে। মানসিক অবস্থার এই পর্যায়ে চারপাশের সবাইকে এবং সবকিছুকে তার বিরক্ত লাগে।

খেয়াল করলে দেখবেন–সোশ্যাল মিডিয়ায় মাত্রাতিরিক্ত আসক্ত কাউকে যখন খেতে ডাকা হয়, অধিকাংশ সময়েই হয় সে নিরুত্তর থাকে অথবা বেশ বিরক্তিভরে সে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। শুধু খাওয়ার বেলাতেই নয়, সোশ্যাল নেটওয়ার্কের বাইরের কোনো কাজে সে আর উৎসাহ পায় না। তার মন চায়–কত দ্রুত কাজ শেষ করে স্মার্টফোন হাতে নেওয়া যাবে আর ডুব দেওয়া যাবে নীল-শাদার জগতে।

সোশ্যাল মিডিয়া আরো একভাবে হতাশা আর মানসিক অস্থিরতা তৈরি করে মানুষের মনে। গবেষকরা সেটাকে বলছেন FOMO (Fear Of Missing Out). অর্থাৎ, সোশ্যাল মিডিয়ায় আসক্ত একজন ব্যবহারকারীর মনে সর্বদা এই ভয় কাজ করে যে, সোশ্যাল মিডিয়ায় একটু অনুপস্থিত থাকলে দুনিয়ার কী না কী সে বুঝি মিস করে ফেলে!

দুনিয়ার কোথায় কী ঘটলো, কার কী হলো, কে কী করলো–এসবকিছুর সাথেই সে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখতে চায়। কোনো সংবাদ, কোনো ঘটনা, কোনো ইস্যু সে মিস করে যেতে চায় না। এই ‘চাওয়া প্রবণতাই তাকে টেনে ধরে রাখে নীল-শাদার দুনিয়ায়। যদি কোনোভাবে সে সোশ্যাল মিডিয়ায় আসতে না পারে কিংবা কোনো কারণে যদি তার সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট ডাউন হয়ে যায়, এক ভীষণ মানসিক অস্থিরতা তখন তাকে পেয়ে বসে। সোশ্যাল মিডিয়ায় আসতে না পারার ফলে তার মনে হয়, সে বুঝি দুনিয়া থেকেই ছিটকে পড়েছে। ঘটনার স্রোত থেকে ছিটকে পড়ার এই ভয়টাকেই গবেষকরা Fear Of Missing Out বলে অভিহিত করছেন।

চার.

আমার একবার জানতে ইচ্ছে হলো–এই যে সোশ্যাল মিডিয়াকে ঘিরে আমাদের এই নেশা, এই উন্মত্ত উন্মাদনা, দিন-রাত এক করে এখানে পুঁদ হয়ে থাকা, আমাদের অবস্থাই যদি এমন হয়, এসব মিডিয়া যাদের হাতে গড়া, তাদের অবস্থা জানি কী হবে! এমন কৌতূহল থেকেই আমি টেক-জায়ান্টদের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার এবং তাদের দৈনন্দিন জীবনে এসবের ভূমিকা নিয়ে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করতে লাগলাম। ফলাফল হিশেবে যা পেলাম, তাতে আমি একেবারে থ!

প্রযুক্তি-দুনিয়ায় যাকে প্রথম সারির একজন ধরা হয়, সেই অ্যাপল ব্রান্ডের সিইও স্টিভ জবসের বরাতে জানা যায়, তার শিশুরা আইপ্যাড ব্যবহারের ক্ষেত্রে কখনোই স্বাধীন ছিলো না। অর্থাৎ, ইচ্ছে হলেই শিশুরা আইপ্যাড নিয়ে বসে যেতে পারতো না বা সারাদিনমান আইপ্যাডে বুঁদ হয়ে থাকতে পারতো না। প্রতিদিন কত সময় তারা আইপ্যাড ব্যবহার করতে পারবে, তা নির্দিষ্ট করে দেওয়া ছিলো। এমনকি, রাতে খাওয়ার টেবিলে কোনো প্রকার ডিভাইস যাতে পরিবারের কারো হাতে না থাকে, সেদিকে থাকতো স্টিভ জবসের সজাগ দৃষ্টি। ওই সময়টায় এই টেক-বস শিশু এবং পরিবারের সবার সাথে মুখোমুখি কথা বলতে পছন্দ করতেন। আলাপ। করতেন বিভিন্ন বই নিয়ে, বিজ্ঞান নিয়ে, ইতিহাস নিয়ে।

গুগলের সিইও সুন্দর পিচাই-ও জানাচ্ছেন একই কথা। তার ঘরে শিশুদের জন্য ডিভাইস ও টেলিভিশন উন্মুক্ত নয়। কোনো রাখঢাক না রেখেই এই টেক-জায়ান্ট জানাচ্ছেন–এই কাজ তিনি তার শিশুদের ভালোর জন্যই করে থাকেন।

অ্যাপলের স্টিভ জবস বা গুগলের সুন্দর পিচাই কেবল নয়, মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসের ব্যাপারেও একই কথা। তার শিশুদের জন্যও স্ক্রিন-টাইম ছিলো যথেষ্টই সীমিত। ইউটিউবের সিইও এবং রেড্ডিটের প্রতিষ্ঠাতারাও তাদের শিশুদের স্ক্রিন-টাইম নিয়ে যথেষ্ট সতর্ক। স্ন্যাপচ্যাটের প্রতিষ্ঠাতা ইভান স্পাইগেল তো তার শৈশব-কৈশোরে মোবাইল ফোন-ই হাতে পাননি এবং তার আজকের সফলতার পেছনে ছোটোবেলার ডিভাইস-ফ্রি লাইফের যথেষ্ট ভূমিকা আছে বলে তিনি মনে করেন। তিনি নির্ধারণ করেছেন–তার শিশু সপ্তাহে সব মিলিয়ে কেবল দেড় ঘণ্টা স্মার্ট-ডিভাইস ব্যবহারের সুযোগ পাবে।

আমি আশ্চর্য বনে যাই–যেসব মানুষ তাদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি দিয়ে দুনিয়ার কোটি কোটি মানুষকে স্ক্রিনে বুঁদ করে রাখছে, তারা কেন নিজেদের এবং তাদের শিশুদের স্ক্রিন-টাইম নিয়ে এতখানি সতর্ক? এর পেছনের রহস্যটা কী? স্ক্রিনের সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিয়ে যারা ভাবছি যে, অনেক কিছুই আমরা শিখে ফেলছি, আমাদের মতো করে কেন ভাবতে পারেন না এসব স্ক্রিন কারিগরেরা?

কেন স্টিভ জবস তার শিশুকে আইপ্যাডের সামনে অবাধে ছেড়ে দিতে রাজি হন না? কেন ইউটিউবের সিইও তার শিশুদের ইউটিউবের সামনে বুঁদ হয়ে থাকতে বলেন না? কেন গুগলের সিইও তার শিশুদের ডুবে যেতে দেন না গুগলের সীমানাহীন তথ্য ভান্ডারে?

সচেতন পাঠক, এর একটাই কারণ–এখানে আপনি যতখানি না শেখার জন্য সময় ব্যয় করেন, তারচে বেশি সময় ব্যয় করেন আসক্তির কারণে। এসব সোশ্যাল মিডিয়ার এলগরিদম এমনভাবেই সাজানো, যাতে আপনি অনেক বেশি সময় এখানে কাটাতে বাধ্য হন। আপনি বাঁধা আছেন এক অদৃশ্য শেকলে। শেকলে বন্দিবস্থাকে দুনিয়ার কেউ ভালোবাসে না, কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া যে শেকল আপনার পায়ে পরায়, তা অন্যসব শেকলের চাইতে আলাদা। এই শেকলকে আপনি নিজের অজান্তেই ভালোবেসে ফেলেন। তাই তো সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢুকতে না পারলে আপনি অস্থির হয়ে যান। আপনি ভাবেন–আপনার দুনিয়া বুঝি থমকে গেলো!

পাঁচ.

এটা সত্য যে, সোশ্যাল মিডিয়ায় আসক্তি থাকলেও আমরা যে আদৌ আসক্ত, তা বুঝতে বা শনাক্ত করতে আমরা অধিকাংশই ব্যর্থ হই। এই আসক্তিটা আমাদের জীবনে এতখানি স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ায়–সেটাকে কখনো সন্দেহের চোখে দেখার কিংবা সেটা নিয়ে একটু উদ্বিগ্ন হওয়ার চিন্তা আমাদের মাথায় কখনোই আসে না। সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তিটা হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের রুটিন আর স্বাভাবিক অনেক রুটিন আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের জীবন থেকে।

আপনার মনে হয়তো প্রশ্ন জাগছে, সোশ্যাল মিডিয়াতে আপনি যে আসক্ত তা বুঝবেন কীভাবে, তাই তো? প্রশ্নটা আপনার একার নয়, দুনিয়ার অনেক-মানুষের। অনেক সাইকোলোজিস্ট, থেরাপিস্ট এবং ডিজিটাল-ডিটক্স নিয়ে কাজ করছে। এমন অনেক গবেষক এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তির অনেকগুলো লক্ষণ বিদ্যমান, কিন্তু সেসবের মধ্যে ভয়ানক পর্যায়ের কিছু লক্ষণ আছে, যা দেখে আপনি আঁচ করতে পারবেন যে, আপনার সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তির পর্যায় কতখানি।

সকালবেলা ঘুম ভাঙার পর স্মার্টফোনটার কথাই যদি সর্বাগ্রে আপনার মনে আসে এবং বিছানায় থাকাবস্থাতেই যদি আপনি ফেইসবুক, ইউটিউব, টুইটার বা ইনস্টাগ্রাম ক্ৰল করবার তাড়না অনুভব করেন, তাহলে ধরে নিতে পারেন যে, আপনি সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ ভালো রকমের আসক্ত।

ধরুন, আপনি কোনো কাজ করছেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে ফোন চেক করবার, নোটিফিকেশন চেক করবার তাড়না অনুভব করেন কি? ল্যাপটপ বা ডেস্কটপে কাজ করার সময় আপনি কি আলাদা ট্যাবে ফেইসবুক খুলে রাখেন, যাতে খানিক পর পর আপনি সেখানে ছুঁ মারতে পারেন? যদি আপনার মাঝে এই অভ্যাসটা থাকে, তাহলে তা সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তির অন্যতম লক্ষণ।

ধরুন, এক সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলেন যে, আপনি কোনোভাবে ফেইসবুকে ঢুকতে পারছেন না। হয়তো আপনার ফোনে ডাটা নেই অথবা ফেইসবুকের নিজস্ব কারিগরি সমস্যার কারণে ফেইসবুকে ঢুকতে আপনার সমস্যা হচ্ছে কিংবা এমনও হতে পারে–কোনো কারণে ফেইসবুক আপনার অ্যাকাউন্টটাকে সাসপেন্ড করে দিয়েছে। ভাবুন তো, ওই নির্দিষ্ট সকালটা আপনার কেমন কাটবে? নিশ্চয় একরাশ বিরক্তি আর অস্থিরতায়। সেদিনের স্বাভাবিক সবকিছুকে আপনার বিরক্তিকর মনে হবে। কখন আপনি পুনরায় ফেইসবুকে ফেরত যেতে পারবেন আর কীভাবে সাসপেন্ড হওয়া অ্যাকাউন্ট ফিরিয়ে আনতে পারবেন–এমন চিন্তায় বিক্ষিপ্ত থাকবে আপনার মন। খিটখিটে হয়ে থাকবে মেজাজ-মর্জি। এই ঘটনা যদি আপনার সাথে ঘটে থাকে বা ঘটবার আশংকা থাকে, ধরে নিতে পারেন যে, আপনি সোশ্যাল মিডিয়ায় জোরালোভাবে আসক্তদের একজন।

কোথাও বেড়াতে গেলে বা পরিবার আর বন্ধুদের সাথে সুন্দর সময় কাটানোর অনেক অনিন্দ্য সুন্দর মুহূর্তকে নিশ্চয় আপনি ক্যামেরাবন্দি করেন, তাই না? এসব মুহূর্তকে ক্যামেরাবন্দি করার সময় আপনার মনে কি বারংবার সোশ্যাল মিডিয়ার কথা ভেসে ওঠে? এই ছবিগুলোকে কত বাহারি ক্যাপশানে সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করবেন, তাতে কাকে কাকে ট্যাগ করবেন, সেসব দেখে অন্যদের কী প্রতিক্রিয়া হবে–এসব চিন্তা কি আপনার ভাবনা-জগতে এসে দোলা দেয়? উত্তর যদি হ্যাঁ, হয়, তাহলে ধরে নেওয়া যায়, আপনি একজন সোশ্যাল মিডিয়া আসক্ত ব্যক্তি।

ফেইসবুক-টুইটার-ইনস্টাগ্রামে দেওয়া পোস্টগুলো ঘন ঘন তদারকি করার প্রবণতা কি আপনার মাঝে বিদ্যমান? অর্থাৎ, আপনার লেখা বা ছবিগুলোতে কতগুলো লাইক-কমেন্ট পড়লো, কে কী মন্তব্য করলো, তা দেখার জন্য সারাক্ষণ কি আপনার মন আকুপাকু করে? যদি তা সত্য হয়, তাহলে সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তির ছোবল থেকে নিরাপদ নন আপনিও।

মাঝে মাঝে আপনার মনে হয়, যেন আপনি নোটিফিকেশনের শব্দ শুনতে পেলেন মাত্র, কিন্তু সত্য কথা হচ্ছে–আপনার সাথে বা আপনার আশেপাশে কোনো স্মার্টফোন-ই নেই। কেন এমন হয় জানেন? কারণ নোটিফিকেশনের শব্দে আপনার এমন অভ্যস্ততা চলে আসে যে, আপনার অবচেতন মন সর্বদা সেই শব্দকে আশা করে থাকে। এমনটা যদি আপনার সাথে হয়ে থাকে, তাহলে সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তির ব্যাপারে আপনাকে জরুরিভাবে ভাবতে হবে।

ফেইসবুকে কী লিখবেন, ইনস্টাগ্রামে কোন ছবিটা ছাড়বেন, টুইটারে কোন বিষয়ে পোস্ট করবেন, তা নিয়ে যদি আপনি আগাম ভাবনা-চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়েন এবং এর পেছনে যথেষ্ট সময় ব্যয় করেন, তাহলে ধরে নিতে পারেন যে, সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তির কোনো একটা পর্যায়ে আপনি ইতোমধ্যেই হাঁটতে শুরু করেছেন।

তাছাড়া বন্ধুদের সাথে কোথাও ঘুরতে যাওয়া বা আড্ডা দেওয়ার চাইতে যদি আপনি সোশ্যাল মিডিয়া লিংকে বেশি পছন্দ করেন, পরিবারের কোনো কাজ সুচারুরূপে করার চেয়ে ফেইসবুকে পোস্ট পড়াটা যদি আপনার কাছে অধিক গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে, তাহলে সোশ্যাল মিডিয়া আপনার জীবনে নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে নিশ্চিত।

আপনার এসাইনমেন্টটা যদি সঠিক সময়ে শেষ না করতে পারেন, যদি সঠিক সময়ে। ক্লাশে উপস্থিত না থাকতে পারেন, যদি কাজে যেতে আপনার প্রায় প্রত্যেকদিন দেরি হয়ে যায়, যদি আপনার ক্লাশের বা কাজের মান দিনের পর দিন কেবল খারাপ-ই হতে থাকে, যদি আপনি নতুন কিছু শেখবার জন্য সময় না করতে পারেন, যদি আপনি পরিবারে সময় দিতে হিমশিম খান–আপনার উচিত হবে সোশ্যাল মিডিয়ায় আপনার সময় ব্যয়ের দিকটাকে খতিয়ে দেখা। আস্তে আস্তে জীবনের গতি থেকে ছিটকে পড়ার আসল কারণ আপনি হয়তো এখানেই পেয়ে যাবেন।

হয়.

ইনসমোনিয়ার রোগীদের কথাবার্তা শুনলে আপনার খুবই কষ্ট হবে। রাতে একটু আরাম করে ঘুমোতে না পারার যে কী যন্ত্রণা–এটা কেবল তারাই জানে, যাদের নিঘুম রাত কাটে! যারা হাজার চেষ্টা করেও চোখের তারায় নামাতে পারে না একবিন্দু ঘুমের রেশ। রাতে একটু ঘুমোনোর জন্য তারা কত কত ডাক্তারের চেম্বারে, কত প্রকারের ওষুধ আর কত ধরনের চেষ্টা-তদবির যে করেন, তার কোনো ইয়ত্তা নেই।

প্রযুক্তি-বিস্ফোরণের এই যুগে এখন আমরা প্রায় সকলেই ইনসমোনিয়ার রোগী। ইনসমোনিয়ার রোগীদের সাথে আমাদের মৌলিক পার্থক্য হলো এই–তারা ঘুমোনোর চেষ্টা করেও ঘুমোতে পারে না, আর আমরা ঘুমোনোর চিন্তা বাদ দিয়ে রাতভর সোশ্যাল মিডিয়ায় বুঁদ হয়ে থাকি।

সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের জন্য আমাদের প্রত্যেকের হাতে একটা করে স্মার্টফোন আছে। বলাই বাহুল্য–এই স্মার্টফোনের স্ক্রিন থেকে বিচ্ছুরিত হয় একধরনের নীল আলো এবং এই নীল আলোই এখন আমাদের জন্য এক নীরব ঘাতকে পরিণত হয়েছে।

ব্যাপারটা বোঝার জন্য আপনাকে ঘুমের চক্রটা বুঝতে হবে। ঘুম আমাদের শরীরের জন্য অতীব প্রয়োজনীয় এবং মানবসভ্যতা টিকে থাকার অন্যতম অনুষঙ্গ। আমাদের দৈনন্দিন কার্যকলাপে যদি ঘুমের বন্দোবস্ত থাকতো, তাহলে মানবসভ্যতা কোনোদিনও টিকে থাকতে পারতো না। স্নায়ুতন্ত্র আছে এমন কোনো প্রাণীই ঘুমহীন বেঁচে থাকতে পারে না। ঘুম একপ্রকার অক্সিজেন গ্রহণের মতোই জরুরি।

আমাদের মস্তিষ্কে ঘড়ির মতো একটা অনন্য অসাধারণ প্রযুক্তি দিয়ে রেখেছেন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা। এটাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয়–’সার্কেডিয়ান রিদম। প্রতিদিনকার চব্বিশ ঘণ্টা সময় অনুসারে মস্তিষ্ক থেকে এই ঘড়ি শরীরের বিভিন্ন অংশে নানান সংকেত পাঠায় এবং শরীর সে মোতাবেক কাজ সম্পাদন করে। আমাদের ঘুমের জন্যও এই ঘড়িটা সংকেত তৈরি করে। মস্তিষ্ক থেকে মেলাটোনিন নামের একপ্রকার হরমোন নিঃসরণ হলেই আমাদের চোখে ঘুমের আবেশ এসে ভর করতে থাকে।

তবে মস্তিষ্ক কখন মেলাটোনিন হরমোন নিঃসরণ করবে তা নির্ভর করে সার্কেডিয়ান রিদম তথা আমাদের মস্তিষ্কে থাকা সেই ঘড়ির সংকেতের ওপরে। সেই ঘড়ির সংকেত পেলেই কেবল মস্তিষ্ক মেলাটোনিন নিঃসরণের কাজ আরম্ভ করে দেয়; কিন্তু সার্কেডিয়ান রিদম বা সেই ঘড়িটা কখন বুঝবে যে এখন মেলাটোনিন নিঃসরণের সময়? ঘড়িটা তা বুঝতে পারে আলোর উপস্থিতির ওপর ভিত্তি করে। অর্থাৎ, সার্কেডিয়ান রিদম যখন দেখে যে, আপনার চারপাশে আলোর উপস্থিতি ক্রমেই কমে আসছে, ফিকে হয়ে আসছে আলোর বিচ্ছুরণ, তখন সে বুঝতে পারে যে–রাত নামছে। রাত যেহেতু নামছে, সারাদিন কর্মব্যস্ততায় থাকা শরীরের অঙ্গগুলোর এখন একটু বিশ্রাম দরকার। আলোর অনুপস্থিতির ওপর ভিত্তি করে সার্কেডিয়ান রিদম মস্তিষ্কে সংকেত প্রেরণ করে–এখন রাত হয়েছে এবং ঘুমের জন্য মেলাটোনিন তৈরি করা দরকার। এই সংকেত পেয়ে মস্তিষ্ক মেলাটোনিন হরমোন নিঃসরণ শুরু করে এবং তা আস্তে আস্তে আমাদের চোখে এনে দেয় ঘুমের আবেশ। একসময় আমরা বিছানায় গা এলিয়ে দিই এবং আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি গভীর নিদ্রায়।

কিন্তু অতীব দুঃখের কথা হলো এই–আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আমাদের শরীরে যে প্রাকৃতিক পদ্ধতি দিয়ে রেখেছেন, আধুনিক প্রযুক্তির কারণে তা নানানভাবে ব্যাহত হচ্ছে আজকাল। ঘুমের জন্য আমাদের শরীরে থাকা এই প্রাকৃতিক পদ্ধতি আজ স্মার্টফোনের কবলে পড়ে বিধ্বস্ত-প্রায়।

স্মার্টফোন ব্যবহারের মাত্রা এবং তাতে নিবিড়ভাবে বুঁদ হয়ে থাকার পরিমাণ রাত হলেই বাড়ে৷ রাতে যেহেতু আমাদের হাতে কোনো কাজ থাকে না, তাই রাতের সময়টাতে আমরা ফেইসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার ও ইউটিউবে বিচরণ করি বেশি। বিছানায় শুয়ে একেবারে চোখের অতি-নিকটে স্মার্টফোন ধরে রাখাটা এখন আমাদের নিত্যকার অভ্যাস। এতে করে কী হয় জানেন? স্মার্টফোন থেকে বিচ্ছুরিত হওয়া নীল আলোর কারণে আমাদের মস্তিষ্কের সেই ঘড়ি তথা সার্কেডিয়ান রিদম বিভ্রান্ত হয়। এই নীল আলোর কারণে সে বুঝতে পারে না যে–এখন কি রাত না দিন। তার হিশেব মতে তখন রাত-ই হওয়ার কথা, কিন্তু বিচ্ছুরিত নীল আলো। তাকে মস্তিষ্কে মেলাটোনিন নিঃসরণের সংকেত প্রদানে বাঁধা দেয়। সে ধরে নেয়। এখনো রাত নামেনি, দিন-ই আছে। সুতরাং, মস্তিষ্কে মেলাটোনিন নিঃসরণের সংকেত পাঠানোর বদলে সে শরীরে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধির সংকেত দেয়, কোষে শক্তি বাড়ানোর সংকেতসহ সে এমন সংকেত মস্তিষ্কে প্রেরণ করতে থাকে, যা সে মূলত দিনের বেলা দিয়ে থাকে। ফলে, সার্কেডিয়ান রিদমের এমন সংকেত পেয়ে। আমাদের মস্তিষ্ক দিনের মতোই সক্রিয় হতে শুরু করে দেয়। দিনের বেলায় যেহেতু আমরা শারীরিক আর মানসিকভাবে কাজে লিপ্ত থাকি, তাই দিনে মস্তিষ্কের এমন সংকেত খুব স্বাভাবিক ও উপকারী, কিন্তু রাতে যেহেতু আমাদের কোনো কাজ করতে হয় না সাধারণত, তাই রাতে মস্তিষ্কের এমন সংকেত আমাদের জন্য সবিশেষ উপকারী নয়; বরং রাতে আমাদের জন্য যা দরকারি–একটা নিবিড় ঘুম–সেটাকেই এই নীল আলো ব্যাহত করে রাখে। মস্তিষ্ক যখন মেলাটোনিন নিঃসরণের সংকেত পায় না, তখন আমাদের চোখেও আর ঘুম নামে না।

সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্রল করতে করতে যখন আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি, তখন রাত প্রায় শেষ হয় হয় অবস্থা। মোবাইল ছেড়ে তখন আমরা ঘুমানোর চেষ্টা করি আর সার্কেডিয়ান রিদমকেও সুযোগ করে দিই মেলাটোনিন নিঃসরণের সংকেত তৈরির। তবে এই অভ্যাস আস্তে আস্তে আমাদের শরীরের ও জীবনের ওপর ফেলতে শুরু করে বিরূপ প্রভাব।

আপনি হয়তো বলতে পারেন, রাতে কম ঘুমালেও কী হবে, দিনের বেলা পর্যাপ্ত ঘুমিয়ে কেউ তা পুষিয়ে দিলেই হয়, কিন্তু ব্যাপারটা আদৌ সত্য নয়। রাতটা মূলত ঘুমের জন্যই নির্দিষ্ট করা। দিনের বেলা প্রকৃতির বিস্ফোরিত আলো, পাখ-পাখালির গুঞ্জন, চারপাশে মানুষের হই-হুঁল্লোড়, গাড়ির হর্ন ইত্যাদি আপনাকে ঠিক সেভাবে ঘুমোতে দেবে না, যেভাবে ঘুমোনোর সুযোগ আপনি রাতের বেলা পেয়ে থাকেন। রাতের বেলা প্রকৃতিজুড়ে এক স্নিগ্ধ আবেশ বিরাজ করে, যা ঘুমের জন্য অত্যন্ত সহায়ক। রাতে যেহেতু চারপাশের আলো অনেকখানি নিভে আসে, মানুষেরাও ঘুমিয়ে পড়ে এবং পশু-পাখি আর পাখ-পাখালিও ঘুমিয়ে থাকে, তখন ঘুমের জন্য তৈরি হয় এক অসাধারণ পরিবেশ। এমন শান্ত পরিবেশে আপনার যে ঘুম হবে, তার সাথে দিনের কোলাহল আর ঝাটময় পরিবেশে ঘুমের কোনো তুলনাই হয় না।

ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও ব্যাপারটা সত্য। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা কুরআনে বলেছেন তিনি নিদ্রাকে আমাদের বিশ্রামের জন্য প্রস্তুত করেছেন, রাতকে করেছেন। আবরণ আর দিনকে প্রস্তুত করেছেন জীবিকা তালাশের জন্য।[১]

স্মার্টফোনের বদৌলতে আমাদের ঘুমের চক্রে এই যে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে বা হচ্ছে, তা কীভাবে আমাদের জীবনে বিরূপ প্রভাব ফেলে জানেন? হার্ভার্ডের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, স্মার্টফোন থেকে বিচ্ছুরিত আলোর কারণে যারা রাতে পর্যাপ্ত ঘুমায় না, ধীরে ধীরে তারা ডায়াবেটিস, অবসাদ, হৃদরোগসহ নানান রোগের দিকে এগিয়ে যায়।

তাছাড়া অপর্যাপ্ত ঘুম আমাদের মানসিক সমস্যারও কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এমন একজন লোকের কথা ভাবা যাক, যাকে প্রতিদিন সকাল সাতটায় অফিসে হাজির থাকতে হয়। সাতটায় অফিস করার জন্য অন্ততপক্ষে তাকে সাড়ে পাঁচটায় ঘুম। থেকে জাগতে হবে। অফিসে যাওয়ার জন্য গোসল, খাওয়া-দাওয়া, প্রস্তুতি সারার জন্য এই সময়টা তার অবশ্যই দরকার। এখন সারারাত ফেইসবুক স্ক্রল করে কিংবা ইউটিউব ব্রাউজিং করে যদি সে ঘুমোতেই যায় রাত দুইটায়, চোখে ঘুম আসতে যদি তার আধা ঘণ্টা সময় লাগে, সব মিলিয়ে তার ঘুম হয় কেবল তিন ঘণ্টা। মাত্র তিন ঘণ্টা ঘুমিয়ে পরের দিন যখন সে অফিসে যাবে, তখন তার দিনটা কাটবে খুবই নাজুকভাবে। চোখে ঘুম ঘুম ভাব থাকবে, কাজে মন বসবে না, মনোযোগ বিচ্ছিন্ন থাকবে, মেজাজ খিটখিটে থাকবে ইত্যাদি। ঘন ঘন চা-কফি খেয়ে যতই সে শরীরকে চাঙা করার চেষ্টা করুক, অপর্যাপ্ত ঘুমের কারণে কর্মক্ষেত্রে ভুগতে তাকে হবেই।

সাত.

সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তি আমাদের জীবনে বয়ে আনতে পারে সমূহ বিপদ এবং এই বিপদের খেসারত হতে পারে ভীষণ ভয়াবহ। এই নেশা আরো তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে আমাদের জীবনটাকে বিপর্যস্ত আর বিধ্বস্ত করে দেওয়ার আগে আমাদের উচিত হবে এই ডিজিটাল ড্রাগের কবল থেকে যত দ্রুত পারা যায় বের হয়ে আসা। ধীরে ধীরে নেশার যে চক্র আমরা গড়ে তুলেছি, সেটাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে না পারলে আমাদের গুনতে হবে কঠিন মাশুল।

ভাবছেন, কীভাবে ভাঙবেন এই নেশার শেকল, তাই না?

এই মিছিলে আপনি একা নন, ডিজিটাল এই ড্রাগের নেশা থেকে বাঁচতে এখন মরিয়া দুনিয়ার হাজার-কোটি মানুষ। এই নেশা থেকে মুক্তির জন্য বিশেষজ্ঞরা বাতলাচ্ছেন এমন কিছু উপায় আমি আপনাকে শোনাতে পারি।

সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তির কবল থেকে বাঁচতে সবার আগে আপনাকে একটু নিজেকে নিয়ে বসতে হবে। কোনো এক শান্ত বিকেলে পুকুর-ঘাটে বসে কিংবা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে এক কাপ কফি খেতে খেতে চিন্তা করুন তো–এই যে মাইলের পর মাইল। ফেইসবুক লিং, ইউটিউব ব্রাউজিং, এসব আপনার জীবনে ঠিক কতটুকু দরকারি? কী হবে যদি আপনি রোজ পাঁচ ঘণ্টা ফেইসবুক ব্যবহার না করেন? যদি প্রতিদিন দুই-দেড়শো ইউটিউব ভিডিও আপনি না দেখেন, আপনার জীবনের কোথাও কি কোনো ব্যাঘাত ঘটবে?

প্রতিদিন পাঁচ থেকে সাত ঘণ্টা ফেইসবুক চালানোর ফলে আপনার স্বাভাবিক জীবনের যে ছন্দপতন, জীবনের সেই ছন্দের চাইতে ফেইসবুক আর ইউটিউব বেশি গুরুত্বপূর্ণ? মাত্রাতিরিক্ত সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তির কারণে আপনি আপনার পরিবারে ভালোমতন সময় দিতে পারছেন না, আপনার বাবা-মা’র দিকে খেয়াল দিতে পারছেন না, আপনার শিশুদের নিয়ে খেলাধুলোর সুযোগ পাচ্ছেন না–এসবকিছুর চেয়ে আপনার সোশ্যাল-জীবনটা কখনো কি বেশি প্রাধান্য পাওয়ার দাবি রাখে?

আমি জানি, এই প্রশ্নগুলো নিয়ে ভাবতে বসলে আমাদের প্রত্যেকের মন একটাই উত্তর দেবে–’সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তির চাইতে আমার পরিবার, আমার কাজ, আমার জীবন অনেক অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

এই গুরুত্বটা যদি আপনি উপলব্ধি করতে পারেন, তাহলে নেশার এই চক্র ভেঙে দেওয়া আপনার জন্য অনেক সহজ হয়ে যাবে। আপনার মন যদি এই নেশা থেকে বেরোনোর ব্যাপারে সায় দেয়, তাহলে এই অধ্যায়ের পরের অংশটুকু আপনার জন্য।

আট.

সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তি থেকে বের হওয়ার জন্য সবচেয়ে কার্যকরী যে পন্থা তা হলো–এটা ছাড়াও যে জীবন চলে, এখানে না আসলেও যে আপনি বাঁচবেন, এখানে টু না মারলেও যে আপনার ভালো একটা দিন কাটবে, তা বিশ্বাস করতে পারা। এই বিশ্বাস অর্জনের জন্য আপনাকে একটা কাজ করতে হবে–সপ্তাহে অন্তত একটা দিন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার পুরোপুরি বাদ দিতে হবে। পাঁচ মিনিট, দশ মিনিটের জন্যও না। আপনাকে স্থির করতে হবে যে–সপ্তাহের একটা নির্দিষ্ট দিন আপনি কোনোভাবেই সোশ্যাল মিডিয়ায় আসবেন না।

কাজটা একটু কঠিন বটে, কিন্তু বিশ্বাস করুন–এই কাজটা করতে পারলে ধীরে ধীরে আপনার আসক্তির লাগাম আপনি টেনে ধরতে পারবেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখন ‘Mental Health Day’, ‘Unplugging Day পালন হচ্ছে। এ সমস্ত দিনের প্রতিপাদ্য হচ্ছে–ওই দিন তারা সম্পূর্ণভাবে ডিজিটাল ডিভাইসের বাইরে থাকবে। অর্থাৎ, কোনো স্মার্টফোন, কম্পিউটারের সংস্পর্শে আসবে না। দুনিয়াজুড়ে স্মার্ট ডিভাইসের মাধ্যমে সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তি নামে যে মহামারি তৈরি হয়েছে, তা থেকে মুক্তি পেতেই উন্নত দেশগুলো এখন এসব পন্য কাজে লাগাতে মরিয়া।

সোশ্যাল মিডিয়ার লাগাম টেনে ধরতে আপনি নিজেও পালন করতে পারেন একটা Unplugigng Day. সপ্তাহে একটা নির্দিষ্ট দিন ঠিক করে নেন, যেদিন আপনি আপনার সকল সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টকে বয়কট করবেন। এটা হতে পারে। শুক্রবার, সোমবার, বৃহস্পতিবার অথবা আপনার সুবিধেমতো যেকোনো দিন। যদি অনলাইনে ওই দিন আপনার গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ থেকে থাকে–কোনো অনলাইন মিটিং, কোনো গুরুত্বপূর্ণ চ্যাট–আপনি তা আগের দিন সেরে নিতে পারেন বা পরের দিনের জন্য জমা করে রাখতে পারেন।

আপনার Unplugging Day তে আপনি ভালো একটা বই পড়ে শেষ করতে পারেন, বন্ধুদের সাথে কিংবা পরিবার নিয়ে যেতে পারেন পাহাড়ের কোলঘেঁষা। মনোরম কোনো প্রাকৃতিক দৃশ্যের কাছাকাছি অথবা সমুদ্রের সংস্পর্শে। আত্মীয়স্বজনদের বাসাতেও বেড়াতে যেতে পারেন। শখের ছাদ বাগান পরিচর্চা করতে পারেন, উঠোনে লাগাতে পারেন নতুন প্রিয় কোনো ফুল বা ফলের গাছ। সন্তানদের সাথে খেলাধুলো করা, এলাকার ছোটো আর বড়রা মিলে টিম করে ক্রিকেট বা ফুটবল খেলাসহ ভালো সময় কাটবে এমন যেকোনোকিছুতে নিজেকে যুক্ত করে নিতে পারেন।

এই অভ্যাসটা চর্চা করতে পারলে আপনার জীবনে এর বেশ ভালো রকমের প্রভাব দেখতে পাবেন। আপনি দেখবেন–নিজের কাজগুলো করার জন্য বেশ ভালো রকমের সময় পাচ্ছেন। আগে কাজ করতে গিয়ে যেখানে শেষ মুহূর্তে দৌঁড়াদৌঁড়িতে পড়তেন, এখন আর তা নেই। আপনি আরো বুঝবেন–একটা দিন আপনি ফেইসবুকে না আসাতে ফেইসবুকের তাতে কিছু যায় আসেনি। এমনকি ফেইসবুক দুনিয়ার কেউ আপনাকে মিস পর্যন্ত করেনি। একটা দিন আপনি ফেইসবুকে আসেননি বলে থেমে যায়নি পৃথিবীর অগ্রযাত্রা, স্থবির হয়ে যায়নি দুনিয়ার রাজনীতি, ভেঙে পড়েনি অর্থনীতি কিংবা কোথাও লেগে যায়নি কোনো বিশ্বযুদ্ধ। আপনি না থাকার পরেও দুনিয়া তার আপন গতিতেই চলেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় আপনার অনুপস্থিতি হয়তো দুনিয়ার কোথাও কোনো পরিবর্তন ঘটায় না, কিন্তু আপনার জীবনে এই অনুপস্থিতির অবদান কিন্তু অসামান্য!

মাত্রাতিরিক্ত সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের লাগাম টেনে ধরে যখন সেই সময়টুকুন আপনি পরিবারে দেন, যখন স্ত্রীর সাথে, শিশুদের সাথে, বাবা-মার সাথে কাটান সেই সময়গুলো, যখন ওই সময়গুলো বাঁচিয়ে আপনি সপ্তাহে ভালো দুটো বই পড়েন, একটা সুরা মুখস্থ করেন, সপ্তাহে দশ কিলোমিটার হাঁটেন, দশটা হাদিস পড়ে আমল করার চেষ্টা করেন, সোশ্যাল মিডিয়াতে কুঁদ হয়ে থাকা সময়কে বাঁচিয়ে যখন আপনি প্রতি সপ্তাহে একজন আত্মীয়কে দেখতে যান, দুজন ভালো বন্ধুর সাথে আড্ডা দেন, যখন ঘরের কাজগুলোতে স্ত্রী অথবা মাকে সাহায্য করেন, নিজের শখের কাজগুলোতে সময় দেন–আপনি কি মনে করেন, এগুলোর কোনো প্রভাব আপনার জীবনে পড়বে না? আমি শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি– ফেইসবুকে আপনি না আসলে বা কম আসলে যদিও তাতে মার্ক জুকারবার্গ কিংবা দুনিয়ার কিছু যাবে আসবে না, কিন্তু সেই সময়গুলোকে ভালো কোনো কাজে ব্যয়। করতে পারলে বদলে যাবে আপনার গোটা জীবন।

সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তির অন্যতম একটা কারণ হলো কানেক্টিভিটি। না, নতুন কোনো বন্ধুর সাথে যুক্ত হওয়াকে আমি খারাপ বলতে চাইছি না, কিন্তু নতুন বন্ধু তখনই উপকারী হয়ে ওঠে, যদি তার কাছ থেকে আপনি উপকারী কিছু জানতে বা । শিখতে পারেন। সোশ্যাল মিডিয়ার একটা কমন ট্রেন্ড হচ্ছে–এখানে মানুষ কোনো উদ্দেশ্য বা প্রয়োজনীয়তা না বুঝে যার-তার সাথে যুক্ত হয়ে পড়ে। ফলে ভাচুয়ালে। পার করা সময়গুলো আদৌ তার নিজের উপকারে আসছে কি না, সেটা সে আর বুঝে উঠতে পারে না।

যত বেশি মানুষের সাথে আপনি কানেক্টেড থাকবেন, তত বেশি সময় ভাচুয়ালে পার করার সম্ভাবনা আপনার ক্ষেত্রে বেড়ে যাবে। আপনার ইনবক্সে তখন অনেক হাই-হ্যালো থাকবে, অনেক কুশলাদি থাকবে, অনেক প্রশ্ন-জিজ্ঞাসা, অনেক তথ্য আসবে। সেগুলোর উত্তর দিতে আপনি ভালোই বোধ করবেন। নতুন কারো সাথে কানেক্টেড হওয়াটাকে আপনার কাছে একটা অর্জন বলেই মনে হবে, কিন্তু আমি আবারও বলি, এই কানেকশান তখনই অর্জন হয়ে উঠবে, যদি সেটা আপনাকে প্রোডাক্টিভ কোনো কাজে যুক্ত করার দিকে ধাবিত করে।

এই কানেক্টিভিটির আরেকটা মন্দ দিক হলো–এটা আমাদেরকে আমাদের বাস্তব জীবনের আড্ডা আর কানেকশানগুলো থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় মজবুত একটা কানেক্টিভিটি গড়তে গিয়ে আমরা আমাদের বাস্তবিক জীবনের সম্পর্কগুলো সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়ি অনেকসময়। সোশ্যাল মিডিয়াতে কমিউনিটি বিল্ডআপ করতে গিয়ে আমরা আমাদের স্ত্রীদের রান্নার প্রশংসা করতে ভুলে যাই, আমাদের সংসারগুলোকে তারা যেভাবে পরম আদর-যত্নে আগলে রাখে, সেটাকে মূল্যায়ন করার সুযোগ আমরা পাই না। স্ত্রীরাও ফুরসত পায় না স্বামীদের সঠিকভাবে মূল্যায়নের। তাদের শ্রম, চেষ্টা আর ত্যাগগুলোকে যথার্থ মর্যাদা তখন দেওয়া হয়ে ওঠে না অনেকসময়।

সোশ্যাল মিডিয়ার কানেক্টিভিটি আমাদেরকে আমাদের জীবনের সত্যিকার কানেক্টিভিটি থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। বাবা-মার সাথে বসে গল্প-গুজব করার, হাসি-আনন্দ উপভোগ করার, শিশুদের সাথে মনখুলে খেলবার, ভাই-বোনদের সাথে প্রাণোচ্ছল হয়ে মিশবার সুযোগগুলো কত দ্রুতই না হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের জীবন থেকে! আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি সোশ্যাল মিডিয়া কানেক্টিভিটিকে, কিন্তু বাস্তব জীবনের সম্পর্কগুলোকে করছি অবহেলা। জীবনের প্রতিটা লগ্নেই–সুখের কিংবা দুঃখের–বাস্তব জীবনের সম্পর্কগুলোই আমাদের পাশে থাকে এবং থাকবে। এই সম্পর্কগুলোকে অবহেলা করা মানে রূপো খুঁজতে গিয়ে হীরাকে পায়ে ঠেলা। সোশ্যাল মিডিয়ার এই কানেক্টিভিটির লাগাম টেনে ধরার জন্য আমাদেরকে খুবই সাবধান এবং সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আমাদের ভার্চুয়াল বন্ধুতালিকায় কাকে রাখবো, কাকে ফলো করবো, কোন চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করবো–এসব ব্যাপারে আমাদের হতে হবে ভীষণ খুঁতখুঁতে। এসব নেটওয়ার্কিং যেন আমাদের দূরে সরিয়ে না দেয় বাস্তব জীবনের সুন্দর পরিসর থেকে।

সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তির একটা অন্যতম বড় কারণ আমাদের সোশ্যাল প্রোফাইল। ব্যাপারটা আগেই আমি বিস্তারিত লিখেছি। এই সোশ্যাল প্রোফাইল তৈরির জন্য আমাদের অনেক বেশি কন্টেন্ট তৈরি করতে হয়। অনেক বেশি পোস্ট, অনেক বেশি ছবি, অনেক বেশি ভিডিও পাবলিশ করতে হয়। অনেক বেশি কন্টেন্ট-মুখর হতে গিয়ে আমাদের অধিক সময় এখানে ব্যয় করতে হয় সাধারণত। ফলে, এটার জন্য আমাদের ভাবতেও হয় প্রচুর। সোশ্যাল মিডিয়ায় অত্যধিক অ্যাক্টিভিজমের যদি লাগাম টেনে ধরা যায়, তাহলে সাশ্রয় করা যাবে আমাদের অনেক সময়ের। যত কম কন্টেন্ট, তত কম সময় সোশ্যাল মিডিয়ায়।

অনেককে দেখবেন, যারা একদিনে ফেইসবুকে পাঁচ থেকে দশটা পর্যন্ত পোস্ট দেয় নিয়ম করে। সমপরিমাণ ছবি আর ভিডিও আপলোডও করে। তারা যখন দেখে যে, তাদের লেখাগুলো অধিক মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে, ছবি আর ভিডিওগুলো অনেক মানুষ দেখছে, তখন তারা সারাক্ষণ ভাবতে থাকে পরের লেখাটা কোন বিষয়ে লেখা যায়, পরের ছবিটা কীসের ছবি দেওয়া যায়, পরের ভিডিওটা কোন বিষয়ের ওপর তৈরি করা যায়। এসব ভাবনা-চিন্তা সারাটা সময় তার মস্তিষ্কে কিলবিল করতে থাকে, যা তাকে বারংবার সোশ্যাল মিডিয়ায় ফিরে আসতে প্রলুব্ধ করে। ফলে যখনই সে সোশ্যাল মিডিয়ার বাইরে আসে, তার মনে হতে থাকে যে, সে বুঝি নিজের জগতের বাইরে চলে এসেছে।

সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তি কমাতে আমরা আমাদের অ্যাক্টিভিটিজের আধিক্য কমিয়ে আনতে পারি।

‘Mr. X commented on your post’, ‘Mr. Y accepted your friend requesť, ‘You have a new message from Mr. Z’, ‘Mr. L sent you a friend request’–এই জাতীয় নোটিফিকেশনগুলো আমাদের সকলের খুব প্রিয়, তাই না? ফেইসবুক ব্যবহার করছে কিন্তু এসব নোটিফিকেশনে অভ্যস্ত নয়–এমন লোক খুঁজে পাওয়া বেশ দুরূহ বটে!

আপনি জেনে বিস্মিত হবেন–ফেইসবুকে আপনার অধিক সময় ব্যয়ের অন্যতম একটা নেপথ্য কারণ এসব নোটিফিকেশন। সর্বপ্রথম এসবই আপনাকে প্রলুব্ধ করে যে–’এসো, এখানে তোমার জন্য কী আয়োজন অপেক্ষা করছে দেখে যাও। আপনার পোস্টে কেউ লাইক করেছে, ছবিতে কেউ কমেন্ট করেছে, আপনাকে কেউ একজন ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে, কেউ আপনার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট গ্রহণ করেছে–এসবে আপনি দারুণভাবে উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠেন। এগুলো চেক না করে আপনি তখন থাকতে পারেন না। নোটিফিকেশনের ওপর ক্লিক করে আপনি মুহূর্তে চলে আসেন নীল শাদার সোশ্যাল মিডিয়ায় আর ডুবে যেতে থাকেন আপনার জন্য সাজানো আয়োজনে। আপনি এসেছেন কেবল একটা নোটিফিকেশন চেক করতে, কিন্তু এসে দেখলেন আপনার কোনো এক বন্ধু মালদ্বীপ ভ্রমণের ছবি পোেস্ট করেছে। সেই নয়নাভিরাম ছবিগুলো দেখার জন্য আপনার মন তখন আকুপাকু করবেই। আপনি দেখতে শুরু করলেন সেগুলো এবং পড়তে লাগলেন পোস্টের নিচে থাকা মন্তব্যগুলোও। সেখানে একটা মন্তব্যে আপনার চোখ আটকালো। কেউ একজন তার নেপাল ভ্রমণ সংক্রান্ত পোস্টের লিংক দিয়ে লিখলো, ‘নেপালও সুন্দর। দেখে আসতে পারেন এভারেস্টের এই দেশটাও।

সেই লিংকে ক্লিক করে মুহূর্তে আপনি চলে গেলেন অন্য এক প্রোফাইলে। একে একে দেখতে লাগলেন নেপালের বিভিন্ন মনোহর প্রাকৃতিক দৃশ্য। সেসব দেখা শেষে নতুন পোস্ট দেখবার আশায় যখন আপনি রিফ্রেশবারে ক্লিক করলেন, আপনার সামনে উপস্থিত হলো কারো দুঃসংবাদ সম্বলিত কোনো লেখা। মনটা একটু খারাপই হবে তখন। সেটাকে পাশ কাটিয়ে স্ক্রল করে আর কিছুদূর গেলে দেখতে পাবেন আপনার কোনো এক ভার্চুয়াল বন্ধু বিয়ে করে ফেলেছে। ব্যাপারটা একদিকে আপনাকে আনন্দ দেবে, অন্যদিকে যদি আপনি অবিবাহিত হন, তখন একটু কষ্ট লাগাটা স্বাভাবিক বটে। আপনি কখন বিয়ে করতে পারবেন, কখন আপনার পরিবার এই ব্যাপারে তৎপর হবে–এসব চিন্তার ঘোর খানিকটা আপনাকে আচ্ছন্ন করতে পারে। একটা আনন্দমাখা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরেকটু সামনে গেলে দেশের রাজনৈতিক বা সামাজিক কোনো অবক্ষয়ের ঘটনা আপনার সামনে এসে পড়বে। আপনি যারপরনাই ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে ওঠবেন।

এ সবকিছুর শুরুটা কোথায় বলতে পারেন? ওই যে, আপনার ফোনে টুং করে আসা সেই নোটিফিকেশন। আপনি কিন্তু সেটা দেখার জন্যই মূলত ফেইসবুকে এসেছিলেন, কিন্তু মাঝখান দিয়ে কীভাবে কীভাবে যে ঘণ্টা দুই-তিন পার হয়ে গেলো, আপনি টেরই পেলেন না! হ্যাঁ, সোশ্যাল মিডিয়াগুলোর এলগরিদম ঠিক এভাবেই সাজানো। আপনি নানানভাবে এখানে আটকে যাবেন। আপনার ব্রেইনকে আপনার চাইতে তারা ভালো পড়তে পারে।

এই লাগামহীন স্ক্রলিং আরেকটা ক্ষতি করে। শুরুতে ভ্রমণ-সংক্রান্ত পোস্ট পড়ে আপনি আনন্দ পান। ঘুরতে যাওয়ার একটা বাসনা তৈরি হয় আপনার মনে। ঠিক এরপরেই হঠাৎ একটা দুর্ঘটনার সংবাদ এসে আপনার ভাবনায় জায়গা করে নেয় এবং আপনার মনকে ভরিয়ে তুলে বিষাদে। এরপর আরেকটা আনন্দ সংবাদ এবং তারপরে আরেকটা দুঃসংবাদ–এসব ঘটনা ঘন ঘন মুড সুইং করে দেয় আপনার, কিন্তু এত ঘন ঘন মুড সুইংয়ের জন্য আপনার মস্তিষ্ক কি প্রস্তুত? মেডিকেল সাইন্স জানাচ্ছে–মুডের বার কয়েক রদ-বদল মস্তিষ্ক স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে, কিন্তু যদি সেটা লাগামহীনভাবে, প্রতিনিয়ত ঘটতে থাকে আমাদের সাথে, আস্তে আস্তে তা গুরুতর স্বাস্থ্য-সমস্যা তৈরি করে আমাদের শরীরে। হতাশা, মানসিক সমস্যা, অলসতা-সহ নানানভাবে তা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে আমাদের জীবনকে।

আপনি অবশ্যই সোশ্যাল মিডিয়ার এলগরিদম পরিবর্তন করতে পারবেন না। সেই এখতিয়ার আপনার নেই। আপনি মানুষকে বলতে পারেন না, যেন তারা দুঃখ বাড়ায় এমন পোস্ট দেওয়া বন্ধ করে বা এমন পোস্ট বেশি দেয়, যেগুলো আনন্দ দেয়। আপনি যা করতে পারেন, তা হলো সেলফ-কন্ট্রোল। সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের মাত্রা সীমিত ও পরিমিত পর্যায়ে আনতে পারলে এমন দ্রুত মুড সুইংয়ের হাত থেকে বাঁচা সহজেই সম্ভব।

যেহেতু ফোনের স্ক্রিনে ভেসে থাকা নোটিফিকেশন আপনাকে সোশ্যাল মিডিয়ায় আসতে প্রলুব্ধ করে সর্বদা, আপনি ইচ্ছে করলে আপনার স্মার্টফোনের সেটিংস অপশানে গিয়ে নোটিফিকেশন অফ করে রাখতে পারেন। যে যে অ্যাপসের নোটিফিকেশনের কারণে আপনাকে বারংবার ভার্চুয়ালে ঢু মারতে হয়, সেই অ্যাপগুলোর নোটিফিকেশন বন্ধ করে রাখলে সেগুলো থেকে আর কোনো নোটিফিকেশন আপনার কাছে আসবে না, আর আপনিও তাড়না অনুভব করবেন না যখন-তখন ফোন হাতে নেওয়ার, ফেইসবুক-ইউটিউব-টুইটারে আসার। ফোনের সেটিংস থেকে নোটিফিকেশন অপশানে গেলে কোন কোন অ্যাপ থেকে নোটিফিকেশন বন্ধ করতে চান, সে অপশান আপনি অনায়াসে পেয়ে যাবেন। সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তি কমাতে এটা এক কার্যকরী কৌশল।

চাইলে আরেকভাবে আপনি আপনার সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের লাগাম টেনে ধরতে পারবেন। আপনার ফোনের সেটিংসয়ে Digital Wellbeing’ নামে একটা অপশান আছে। ফোনের স্ক্রিনে, সোশ্যাল মিডিয়ায় আপনি যে মাত্রাতিরিক্ত সময় ব্যয় করবেন তা ফোন কোম্পানিও বুঝতে পারে। তাই তারা গ্রাহকদের মানসিক স্বাস্থকে গুরুত্ব দিতে এ-ধরনের একটা অপশান ফোনগুলোতে রাখছে আজকাল। এই Digital Wellbeing অপশানে গিয়ে আপনি আপনার ফোনে থাকা কোন অ্যাপস একদিনে কতক্ষণ ব্যবহার করবেন, তার একটা সীমা ঠিক করে নিতে পারেন। ধরা যাক, আপনি স্থির করলেন যে–পুরোদিনে আপনি একঘন্টা ফেইসবুক অ্যাপ ব্যবহার করবেন। আপনি যদি ওই অপশানে ফেইসবুক অ্যাপের জন্য একঘণ্টা টাইম নির্ধারণ করে দেন, তাহলে ফেইসবুক অ্যাপ ব্যবহারের মাত্রা একঘন্টা পার হওয়ামাত্র ওই অ্যাপ একপ্রকার অকেজো হয়ে পড়বে। ওইদিনে আপনি কোনোভাবেই তখন আর ফেইসবুকে ঢুকতে পারবেন না। ঠিক পরেরদিন পুনরায় আপনি আবার একঘণ্টা ফেইসবুক ব্যবহারের সুযোগ পাবেন। যে-সকল অ্যাপসের কারণে আপনার প্রচুর সময় নষ্ট হয়, সেগুলোকে আপনি এভাবে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করতে পারেন।

সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তির একটা দৃশ্যমান প্রমাণ হলো–সকালবেলা বিছানায় থাকা অবস্থাতেই ফোন হাতে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢুকে পড়া। রাতে যখন ঘুমোতে আসে তখন প্রায় দুটো। সকালে যখন জাগে তখন দিনের নয়টা বাজে। এই সময়টুকুর মাঝে ফেইসবুকে কি-না-কী ঘটে গেলো, কে কী লিখে ফেললো, কে কী শেয়ার করে ফেললো–তা একবার দেখে না নিলে চলবে কেন? এমন চিন্তা থেকেই ঘুম-ভাঙা চোখে স্মার্টফোন হাতে নিয়ে ঢুকে পড়া হয় সোশ্যাল মিডিয়া সাইটে। এরপর স্ক্রলিং আর স্ক্রলিং। কোনো কূল-কিনারা নেই।

আপনার যদি এমন অভ্যাস থাকে, তাহলে সেটা ভাঙতে হবে। সকালবেলার স্নিগ্ধ আবহাওয়াটা, শান্ত পরিবেশটা সসাশ্যাল মিডিয়ার জ্যামে কাটিয়ে দেওয়ার জন্য নয়। সকালবেলা ঘুম ভাঙার পর শুরুতেই কখনো ফোন হাতে নেওয়া যাবে না। এটা ঠিক সময় দেখার জন্য, ক্যালেন্ডার চেক করার জন্য আজকাল ফোন হাতে না নিয়ে উপায় নেই কোনো; তবে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে–সময় দেখতে এসে সময় অপচয়ের জন্য আমরা যেন সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝুঁদ হয়ে না যাই।

কেবল সকালবেলা ঘুম-ভাঙা চোখে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার বর্জন করলে হবে না, রাতে ঘুমোতে যাওয়ার সময় স্মার্টফোন যেন আপনার আশেপাশে না থাকে, সেই বন্দোবস্তও আপনাকে করতে হবে। সেই দিনগুলোর কথা ভাবুন তো, যে দিনগুলোতে রাতে বিছানায় শুয়ে শুধু একটু ফেইসবুকে চোখ বোলানোর জন্য এসেছিলেন, কিন্তু যখন ফেইসবুক থেকে বের হলেন, তখন প্রায় শেষ রাত চলে। আপনি বুঝতেও পারেননি, কীভাবে এত সময় পার হলো! এটা একদিন-দুদিন বা অকস্মাৎ ঘটে এমন কোনো দৃশ্য নয়। এটা আমাদের প্রায় সবার নিত্যদিনকার রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তাছাড়া গবেষকরা বলছেন, রাতে ভালো একটা ঘুমের জন্য আমাদের উচিত হবে অন্ততপক্ষে ঘুমানোর এক থেকে দেড় ঘন্টা আগে যাবতীয় স্ক্রিনের আলো থেকে দূরে থাকা। স্ক্রিন থেকে নির্গত নীল আলো যেহেতু আমাদের মস্তিষ্কে মেলাটোনিন নিঃসরণে বাধা দেয়, তাই ভালো একটা ঘুম পেতে হলে দরকার রাত্রিবেলা যতটা সম্ভব ক্রিনের নীল আলো থেকে দূরে থাকা। আপনার যদি রাতে অনলাইনে জরুরি কোনো কাজ থাকে, তা যত দ্রুত সম্ভব সেরে নিয়ে নিজেকে ঘুমের জন্য আগেভাগেই প্রস্তুত করতে পারেন।

আপনাকে উপলব্ধি করতে হবে–সোশ্যাল মিডিয়ায় যে সময় আপনি অকাতরে ব্যয় করেন, তাতে আপনার কোনো না কোনো কাজ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেই। হয় আপনি পর্যাপ্ত পড়াশোনা করছেন না, নতুবা আপনি চাকরিতে ভালো পারফরমেন্স করতে পারছেন না, অথবা পরিবারে দিতে পারছেন না পর্যাপ্ত সময়। তাছাড়াও, খেয়াল করলে দেখবেন–সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তি আপনাকে আপনার শখগুলো থেকেও অনেকটাই দূরে সরিয়ে এনেছে। এই আসক্তি কাটানোর জন্য আপনাকে আপনার শখগুলোর কাছেও ফিরে যেতে হবে। বাগান করা, ঘুরতে যাওয়া, সামাজিক কাজকর্মে যুক্ত হওয়াসহ নানাবিধ কাজে নিজেকে ডুবিয়ে রাখলে সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তির লাগাম টেনে ধরা অনেকটাই সম্ভব।

নয়.

আমার এক ফেবু-বন্ধু গতবছর আমাকে ম্যাসেজ করে। তিনি মেডিকেলের ছাত্র। ম্যাসেজে তিনি লিখলেন, ‘আসোলামু আলাইকুম ভাই। কয়েকটা কথা শেয়ার করতে চাই আপনার সাথে। আসলে আমি বেশ অগোছালো জীবনযাপন করছি। সময়মতো সালাত, ঘুম, নিজের পড়া, টিউশান বা দৈনন্দিন কাজ–কোনোটাই ঠিকঠাকভাবে করতে পারছি না। এসবের পেছনে মূল যে কারণ, তা হলো মোবাইল আসক্তি। আরো স্পষ্ট করে বললে–ফেইসবুকের নেশা। ফেইসবুকের নেশার কারণে আমার সালাতেও ব্যাঘাত ঘটে। অযথা মাইলের পর মাইল ল করি। এই নেশা থেকে বেরোবার কোনো উপায় থাকলে যদি বলতেন।

তার সাথে কথা বলে জানলাম–ফেইসবুকে তিনি কোনো আজেবাজে গ্রুপ-পেইজ প্রোফাইলের সাথে যুক্ত নন। তিনি যা ফলো করেন, যাদের সাথে যুক্ত আছেন সবই এবং সবাই ইসলামিক। তিনি ইসলামিক বইয়ের গ্রুপে যুক্ত, ইসলাম নিয়ে লেখে এমন মানুষদের ফলো করেন, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে–ফলো লিস্টে ইসলামি পরিবেশ বজায় রেখেও কেন তার জীবন এরকম অগোছালো হয়ে উঠলো? কেন তার নাওয়া-খাওয়া, ঘুম, পড়াশোনা আর কাজের এমন বেহাল দশা? এমনকি–সালাত আদায়েও কেন তাকে পড়তে হচ্ছে সমস্যায়?

এই প্রশ্নটার জবাব খোঁজা জরুরি।

আমরা অনেকেই মনে করি–ফেইসবুকে নাহয় সাত-আট ঘণ্টা পার করছি, কিন্তু তা তো অহেতুক কাটছে না, আজেবাজে লেখা পড়ছি না, জিনিস দেখছি না। ইসলামিক লেখা পড়ছি, ইসলামিক ভিডিও দেখছি। সময়গুলো তো ভালো কাজেই কাটছে। সুতরাং, দিনের লম্বা সময় ফেইসবুকে এভাবে কাটালে তা তো খুব একটা মন্দ নয়।

এমন ভাবনার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলতে হয়–ভাবনাটা আংশিক ভালো, পুরোটা নয়। আপনি হয়তো সারাদিন অনেক ইসলামিক লেখা পড়ছেন, অনেক ইসলামি ক্লিপস দেখছেন, কিন্তু তা যদি আপনার বাস্তব জীবনে প্রয়োগ না করতে পারেন, তাহলে এতগুলো সময় এখানে দেওয়ার ফল কী? ফেইসবুকে বিভোর হয়ে ইসলামিক পোস্ট, ভিডিও দেখার কারণে যদি আপনার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যদি আপনি ঠিকমতো আপনার স্বামী-পরিবার-শিশুদের দেখভাল না করতে পারেন, যদি আপনি স্ত্রী-পরিবারকে সময় না দিতে পারেন, যদি আপনার পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যদি ভর্তি না হতে পারেন স্বপ্নের বিদ্যাপীঠে, যদি কর্মক্ষেত্রে আপনার পারফরম্যান্স কমে যায়, আপনার চাকরি হুমকির মুখে পড়ে, এমনকি যদি ঠিকঠাক সময়ে সালাত আদায় করতেই আপনি হিমশিম খান–এসবের বিনিময়েও কি কেবল ফেইসবুকে ইসলামিক পোস্ট পড়া, ভিডিও দেখাকে গুরুত্ব দেবেন? ইসলাম মানুষের জীবনে শৃঙ্খলা আনে, কিন্তু আপনি যেভাবে ইসলামকে শিখতে চাচ্ছেন তা কি আদৌ আপনার জীবনে শৃঙ্খলা এনে দিচ্ছে?

এর ফলাফল কী জানেন? একটা সময়ে আপনি আপনার ভুলটা বুঝতে পারবেন। না, ইসলামিক কন্টেন্টের সাথে সংযুক্ত থেকে ভুল করেছেন তা বলছি না, ভুলভাবে এখানে সময় ব্যয়ের ব্যাপারটা একদিন আপনার সামনে স্পষ্ট হবে, তবে অনেক দেরি হয়ে যাওয়ার পরে। একদিন যখন সম্পর্কগুলো ভেঙে খান খান হয়ে যাবে, কর্মক্ষেত্রে নিজের যোগ্যতা খুঁইয়ে যেদিন আপনি হতাশায় ডুবে যেতে থাকবেন, স্বপ্নের বিদ্যাপীঠে পড়তে না পেরে যেদিন আপনার বুকটা ভীষণ ভারী হয়ে উঠবে, যেদিন যোগ্যতার জন্য ভালো জায়গায় আপনার একটা চাকরি হবে না, একটা ক্যারিয়ার হবে না, সেদিন আপনি বুঝবেন–এসব অনিয়ন্ত্রিত, অপরিকল্পিত ফেইসবুকিং আপনাকে হতাশা ছাড়া জীবনে আর কিছু দেয়নি।

ফেইসবুকে নানান ইসলামিক লেখকদের লেখাজোকা পড়ে, ভালো বক্তাদের লেকচার-ভিডিও দেখে আপনার মনেও হয়তো তাদের মতো হওয়ার সাধ জাগে। তাদের মতো করে লিখবার, বলবার ইচ্ছে হয়তো আপনারও আছে। আপনিও চান তাদের মতো করে দ্বীন প্রচার করতে, দ্বীনের বার্তাসমূহ ছড়িয়ে দিতে। আপনার ইচ্ছেটা অবশ্যই প্রশংসনীয়, কিন্তু ইচ্ছেপূরণের জন্য যে রাস্তায় আপনি হাঁটছেন, তা আদৌ ঠিক না ভুল–তা কখনো জানতে চেয়েছেন? আপনি যাদের মতো হওয়ার জন্য দিন-রাত ফেইসবুকে পড়ে থাকছেন, তাদের কজন আপনার মতো করে ফেইসবুকে পড়ে থেকে নিজেকে গড়তে পেরেছে? যে লেখকের লেখা পড়ে আপনি অভিভূত হোন, তিনি কি আপনার মতো সারাদিনমান ফেইসবুকে পড়ে থেকে এত সুন্দর করে লিখতে শিখেছেন? নাকি, এর পেছনে তাকে ব্যয় করতে হয়েছে অনেক সময়, দিতে হয়েছে অনেক শ্রম? যার লেখায় বাহারি তথ্য আর নতুন ভাবনার দিগন্ত দেখে আপনি বিস্ময়াবিভূত হয়ে পড়েন, তিনি যদি দিন-রাত এক করে ফেইসবুকে কাটাতেন, পারতেন এতসব তথ্য আর ভাবনার নতুন নতুন দুয়ার আপনার সামনে উন্মোচন করতে? নাকি, এসবের জন্য তাকে অনেক পড়তে হয়, অনেক জানতে হয়? সম্ভব কি ফেইসবুকে বুঁদ হয়ে থেকে এতবেশি পড়া আর জানা? যে বক্তার বলার ধরন, জ্ঞানের সীমা-পরিসীমা আপনাকে মুগ্ধ করে রাখে, যার মতো হওয়ার চিন্তা আপনাকে স্বপ্নেও তাড়িয়ে বেড়ায়, ফেইসবুকে বুঁদ হয়ে থাকলে তিনি কি পারতেন তার সেসব যোগ্যতা অর্জন করতে?

আপনি স্বীকার করবেন যেভাচুয়ালে যাদের আপনি অনন্য, অসাধারণ হিশেবে চেনেন এবং যাদের মতো হওয়ার স্বপ্ন দেখেন, তারা সবাই একটা পদ্ধতির ভেতর দিয়ে, একটা ধারা বজায় রেখে এসব যোগ্যতা অর্জন করেছে। তাদের মতো হতে হলে আপনাকেও এগুতে হবে একটা পদ্ধতির ভেতর দিয়ে। এই পদ্ধতির ভেতর দিয়ে এগুতে হলে সবার আগে যা দরকার, তা হলো ফেইসবুকের নেশা ত্যাগ করা। ফেইসবুকে যে অপরিসীম সময় আপনি ব্যয় করছেন তার লাগাম টেনে ধরা।

তার মানে, আপনি কি ফেইসবুকে কারো লেখাই পড়বেন না? কারো কোনো ভিডিও-ই দেখবেন না? সবাইকে আনফ্রেন্ড আর আনফলো করে দেবেন?

দুঃখিত, আমাকে ভুল বুঝবেন না দয়া করে। আমি কিন্তু মোটেও তা বলতে চাইনি। আপনি অবশ্যই ফেইসবুকে আসবেন, ভালো লেখা পড়বেন, ভালো ভিডিওগুলো দেখবেন। তথ্য-বিপ্লবের দুনিয়ায় এটাও জ্ঞান বিকাশের একটা মাধ্যম, তবে ফেইসবুককে আপনি আপনার একজন ভালো বন্ধু হিশেবে নিতে পারেন।

ধরুন, আপনার বাড়ির পাশে আপনার খুব ভালো একটা বন্ধু আছে, যার সাথে আড্ডা দিলে আপনি অনেক কিছু জানতে পারেন, কিন্তু তাই বলে কি সেই বন্ধুর সাথে প্রতিদিন আপনি ছয়-সাত ঘণ্টা করে আড্ডা দেবেন? এটা আপনার ওই বন্ধু বা আপনি–দুজনের কারো জন্যই কি ভালো? আপনারা কি সর্বদা পারবেন এত লম্বা সময় আড্ডা দিতে? যদি দেন, এটা আপনাদের দৈনন্দিন স্বাভাবিক কাজগুলোতে ব্যাঘাত ঘটাবে না? যদি আপনারা প্রতিদিন আধ ঘন্টা বা এক ঘণ্টা সময় নির্ধারণ করে নিয়ে আড্ডা দেন, সেটা কিন্তু বেশ সহজ হয়ে যায় উভয়ের জন্য। দিনের চব্বিশ ঘণ্টা সময় থেকে এক-আধ ঘণ্টা সময় বের করা ততটা কঠিন নয়, যতটা কঠিন ছয়-সাত ঘণ্টা সময় বের করা। আর এতে জীবনের স্বাভাবিক কাজগুলোতেও কোনো বিরূপ প্রভাব পড়ে না। জীবনের গতিও মন্থর হলো না, ভালো বন্ধুর সংস্পর্শও থাকলো।

ফেইসবুককে আপনি আপনার পাশের বাড়ির সেই ভালো বন্ধুটার মতোই নিতে পারেন। প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আপনি এখানে আসবেন। যাদের লেখাজোকা-আর্টিকেল-ভিডিও দেখা জরুরি মনে হবে সেগুলো পড়ে-দেখে নিয়ে দ্রুত ত্যাগ করবেন এখান থেকে। কোনো ভালো লেখা, ভালো আর্টিকেল, ভালো ভিডিও দেরিতে পড়লে বা দেখলে কোনো সমস্যা নেই। শুরুতে দেখলেও তা যেমন ভালো থাকে, দু-দিন পরে দেখলেও সেটা ভালো-ই থাকবে, পচে যাবে না।

দশ.

ধরা যাক, আপনি দিনে চার ঘণ্টা ফেইসবুক ব্যবহার করেন সব মিলিয়ে। যদি তা-ই হয়, তাহলে একবছরে আপনার ফেইসবুক ব্যবহারের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৪৬০ ঘণ্টা। বাংলাদেশে একজন মানুষের গড় আয়ু ৬০ বছরের কাছাকাছি। যদি ধরে নেওয়া হয় যে, আপনি ৬০ বছর বাঁচবেন, তাহলে ৬০ বছরে আপনি মোট ৮৭,৬০০ ঘণ্টা ফেইসবুকে কাটান!

তবে জন্মের পর থেকেই তো কেউ ফেইসবুক চালায় না। যদি ধরা হয় যে, পনেরো বছর বয়সে আপনার হাতে স্মার্টফোন এলো এবং পঞ্চাশ বছর বয়স অবধি আপনি ফেইসবুকে সক্রিয় থাকলেন, তাহলে বাকি থাকে পঁয়ত্রিশ বছর। বছরে যদি আপনি ১৪৬০ ঘণ্টা ফেইসবুক চালান, পঁয়ত্রিশ বছরে এই ব্যবহারের পরিমাণ দাঁড়াবে ৫১,১০০ ঘণ্টা!

৮৭৬০ ঘণ্টায় যদি ১ বছর হয়, ৫১,১০০ ঘণ্টা মানে প্রায় ৬ বছরের কাছাকাছি। অর্থাৎ, ৩৫ বছরের স্মার্টফোন ব্যবহারের সময়কালে জীবন থেকে ছয়টা বছর আপনি হারিয়ে ফেলবেন শুধু ফেইসবুক স্ক্রল করতে করতে! ভাবা যায় কী এক ভয়াবহ ব্যাপার এটা?

এটা কেবল যারা দিনে চার ঘণ্টা ফেইসবুক ব্যবহার করে তাদের হিশেব, ব্যক্তিগতভাবে আমি এমন বহু মানুষকে চিনি, যারা প্রতিদিন গড়ে ১০-১২ ঘণ্টা ফেইসবুক ব্যবহার করে। আমি এমন লোকও পেয়েছি, যারা দিনে ১৫-১৮ ঘণ্টা ফেইসবুকে কাটায় এবং তা কোনো কারণ ছাড়াই। এদের ক্ষেত্রে হিশেবটা তাহলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?

এগারো.

অস্বীকার করবো না যে, প্রযুক্তি আমাদের জীবনটাকে অনেক সহজ করে দিয়েছে, কিন্তু প্রযুক্তির অপব্যবহার, সোশ্যাল মিডিয়াগুলোর মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার কি আমাদের জীবন থেকে প্রকৃত আনন্দটুকু কেড়ে নিচ্ছে না? শেষ কবে আমরা নিজেদের জন্য একটু সময় বের করেছি মনে পড়ে? শিশিরভেজা ঘাসে একটু হাঁটবার জন্য, বিমুগ্ধ বিস্ময়ে পাখ-পাখালির গান শোনবার জন্য, নদীর কলতান আর সমুদ্রের গর্জনে নিজেকে একাকার করবার জন্য শেষ কবে আমরা সময় করতে পেরেছি?

শারীরিক ক্ষতি তো আছেই, আত্মিক দিক থেকেও সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তি কি আমাদের কুরে কুরে খাচ্ছে না? সালাতে দাঁড়ালেই আমাদের কি অনলাইন জগতের নানান কথাবার্তা, নানান ঘটনা মনে পড়ে না? অনলাইনে কী লিখছি, কী পড়ছি, কী দেখছি–তা নিয়ে সারাক্ষণ ব্যতিব্যস্ত থাকতে গিয়ে, আমাদের ঈমান-আমলের যে বেহাল দশা হয়ে আছে, তা ভেবে দেখবার সময় হয়েছে কখনো? টেক-জায়ান্টেরা তাদের ব্যবসার নিমিত্তে এখানে পেতে রেখেছে একটা মোহনীয় খেলাঘর, আর সেই খেলাঘরে আমরা দিব্যি খরচা করে যাচ্ছি আমাদের জীবন।

জীবনটা বড় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এই জীবনের বড় একটা অংশ যদি অযথা, অহেতুক কোনো আসক্তির পেছনে খরচ হয়ে যায়, কতটাই বা তবে বিকশিত হতে পারে মানবজীবন?

——–
[1] সুরা নাবা, আয়াত : ৯-১১

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *