০৭. বন্দিশিবির থেকে

০৭. বন্দিশিবির থেকে

এক.

মানুষ বন্দি হয়ে বাঁচতে চায় না। সে স্বাধীন পাখির মতো ডানা মেলে আকাশপানে উড়তে চায়। সে উড়ে বেড়াবে সবুজ অরণ্যে, বৃক্ষের ডালে-ডালে। সে কথা বলবে ফুলের সাথে। মুক্তবিহঙ্গ হয়ে সে উপভোগ করবে জীবন আর জীবনের ছন্দ। সে তন্ময় হয়ে দেখবে আদিগন্ত নীল আকাশ! দখিনা বাতাসে সে এলিয়ে দেবে গা। ঝুম বৃষ্টির ঐকতানে সে কান পেতে শুনবে প্রকৃতির নির্মল সংগীত। নদীর কলতান, ঝরনার গান আর দৃষ্টি ছাড়িয়ে যাওয়া দূর পাহাড়ের ছায়া–প্রকৃতির শোভা দু-চোখে নিয়ে বাঁচতে চায় সে।

কিন্তু মানুষ তা পারে না। দিনশেষে তাকে বন্দি হতে হয়। সমাজের শৃঙ্খলে, অনিয়মের অন্ধকারে। কখনো-বা নিরন্তর সংগ্রামের বাঁধনে। সে দেখতে চায় নীল আকাশ, কিন্তু জীবন তাকে উপহার দেয় বেদনার নীল। পাহাড় তার পছন্দ, কিন্তু যাপিত জীবনে দুঃখ আর বেদনা হয়তো তার জীবনে হিমালয় হয়ে বর্তমান। মানুষ কোনো না কোনোভাবে জীবনে বন্দি হয়ে পড়ে। সে ছটফটায়। সে মুক্তি চায়। সে চায় শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে যেতে। বেদনার যে নীল সমুদ্রে তলিয়ে যাচ্ছে সে, সেখান থেকে বেঁচে উঠবার তার আকুল ইচ্ছে। দুঃখের যে হিমালয় চেপে আছে তার ওপর, তা সরিয়ে মুক্তির সুবাস পেতে তার অনন্ত অভিপ্রায়। তবে, এই বন্দিদশা থেকে মানুষের মুক্তি কীসে?

দুই.

বন্দিত্বের কথা মনে আসলে আমার মনে পড়ে যায় বনু ইসরাইলের সেই তিনজন মানুষের কথা, যারা একদিন আটকা পড়েছিলো একটা অন্ধকার গুহার মধ্যে। চমৎকার সেই ঘটনাটা আমাদের প্রায় সবারই জানা। ঘুরতে বের হয়ে পথিমধ্যে রাত হয়ে গেলে তারা রাত্রি যাপনের জন্য একটা গুহার মধ্যে ঢুকে পড়েন। উদ্দেশ্য ছিলো রাতটা এই গুহার মধ্যে কাটিয়ে ভোর হলেই নিজ নিজ গন্তব্যে ফিরে যাবেন। রাত তাদের কাটলো বটে, কিন্তু ভোরে উঠে তাদের সকলের তো মাথায় হাত! গুহার যে প্রবেশদ্বার দিয়ে তারা প্রবেশ করেছিলেন এখানে, সেই উন্মুক্ত দ্বার যেন কোথায় হাওয়া হয়ে গেলো! দৃষ্টিসীমার মধ্যে তার কোনো অস্তিত্বই নেই।

ঘটনার আকস্মিকতায় শুরুতে ঘাবড়ে গেলেও, খানিক বাদে তারা আবিষ্কার করলেন। যে–পাহাড়ের ওপর থেকে কোনো কারণে বেশ বড়োসড়ো একটা পাথর ঠিক গুহাটার মুখে এসে পড়েছে। পাথরের আকৃতি এতই বিশাল ছিলো, পুরো গুহাটার মুখ তাতে বন্ধ হয়ে গেলো।

ভাবুন তো–কোনো এক দূরের জায়গা থেকে গন্তব্যে ফিরছেন আপনি। পথিমধ্যে রাত নেমে যায়। এমতাবস্থায় বনজঙ্গল পেরিয়ে এগিয়ে যাওয়াটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ আপনার জন্য। যেকোনো সময় সামনে চলে আসতে পারে বাঘ-ভাল্লুক কিংবা হিংস্র। কোনো প্রাণী। বিপদ মাথায় নিয়ে ঘরে ফেরার চাইতে পাহাড়ের কোলে থাকা একটা নির্জন গুহার মধ্যে আশ্রয় নেওয়াটাই আপনার জন্য অধিক উত্তম এবং আপনি তা-ই করলেন। একটা গুহার মধ্যে ঢুকে পড়লেন যাতে নির্বিঘ্নে রাতটা কাটানো যায়।

কিন্তু সকালে ঘুম ভাঙার পরে যদি সেই গুহার প্রবেশমুখ খুঁজে না পান? যে দ্বার দিয়ে সেখানে পা রেখেছিলেন, তা যদি ভোর বেলাতে ভোজবাজির মতো হাওয়া হয়ে যায়–ব্যাপারটা কেমন দাঁড়াবে? ঘন বনজঙ্গল পরিবেষ্টিত একটা পাহাড়। তার কোলে থাকা নির্জন একটা গুহা।

সেই গুহায় আপনি এখন বন্দি! গুহা থেকে বেরোনোর কোনো রাস্তাই আপনার সামনে খোলা নেই। সারাদিন চিৎকার-চেঁচামেচি করলেও আপনার আওয়াজ বাইরে বেরোবে না। কেউ জানতেও পারবে না যে, এই গুহায় কোনো এক মানুষ আটকা পড়ে আছে। হিংস্র জন্তুর থাবা থেকে বাঁচতে আপনি আশ্রয় নিয়েছিলেন গুহার মধ্যে, কিন্তু সেই গুহার মধ্যেই এখন আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছে ক্ষুধা আর তৃষ্ণার যন্ত্রণা এবং সেই যন্ত্রণার শেষ পরিণতি–মৃত্যু! কেমন হবে এই দৃশ্যপট?

এমন পরিস্থিতির সামনে দাঁড়িয়ে আপনার যে অনুভূতি হবে, গুহার মধ্যে বন্দি হয়ে পড়া বনি ইসরাইলের সেই তিনজন মানুষের অনুভূতিও একই ছিলো–সম্মুখে নিশ্চিত মৃত্যুর হাতছানি! তবে বন্দি হয়ে পড়া সেই আল্লাহর বান্দাদের ঝুলিতে কিছুটা সম্বল ছিলো, যা দিয়ে তারা এই নিশ্চিত মৃত্যু-কূপ থেকে মুক্তির আশা করতে পারেন।

কী সেই সম্বল জানেন? সেই সম্বল ছিলো তাদের সৎকর্ম। কেবল আল্লাহকে খুশি করবার জন্য তারা যে কাজগুলো করেছিলো, যেগুলোর ব্যাপারে তারা ছাড়া দুনিয়ার কেউ জানে না, সেগুলোকে অসিলা করে তারা আল্লাহর কাছে সেই বন্দিদশা থেকে মুক্তি চাইলেন।

তাদের প্রথমজন গাভীর দুধ দোহন করে সবার আগে বাবা-মাকে পান করাতেন। বাবা-মা পান করার আগে পরিবারের কাউকেই দুধ পান করানো হতো না। এমনকি নিজেও খেতেন না। কোনো এক কাজে একবার বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে যায় এবং দুধের পেয়ালা হাতে বাবা-মায়ের ঘরে ঢুকে তিনি দেখতে পেলেন– তারা দুজনেই ঘুমে বিভোর। একদিকে বাবা-মা দুধ পান করলে পরিবারের অন্য কেউ দুধ পান করতে পারবে না, আবার অন্যদিকে ঘুমের ব্যাঘাত হবে ভেবে বাবা-মার ঘুম ভাঙিয়ে তাদের দুধ পান করানোও পছন্দ হচ্ছে না। ফলে দুধের পেয়ালা হাতে তিনি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলেন তাদের মাথার কিনারে। সকালবেলা বাবা-মার ঘুম ভাঙলে তারা দেখতে পান–তাদের সন্তান বিছানার কাছে দুধের পেয়ালা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলের এই কাজে বাবা-মা সন্তুষ্ট হলেন এবং তৃপ্তিভরে দুধ পান করলেন।

গুহায় বন্দি হয়ে পড়া সেই প্রথম ব্যক্তি আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে বললেন, ‘ইয়া আল্লাহ, আমি যদি এই কাজ কেবল আপনাকে সন্তুষ্ট করবার উদ্দেশ্যে করে থাকি, তাহলে আপনি আমাকে আজকের এই বিপদ থেকে উদ্ধার করুন।

মুহূর্তেই তার দুআ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা কবুল করলেন। তারা দেখতে পেলেন–গুহার মুখ থেকে পাথর খানিকটা সরে গেছে। তবে বের হওয়ার মতো অবস্থা তখনো তৈরি হয়নি।

দলের দ্বিতীয়জন একবার অনৈতিক সম্পর্কে জড়াবার সুযোগ পেয়েছিলেন। চাচাতো বোনের সাথে শারীরিক সম্পর্কে জড়াবার তার ছিলো অদম্য নেশা এবং তাকে নানাভাবে প্রলোভনও দেখাতেন তিনি, কিন্তু বরাবরই মেয়েটা তাকে এড়িয়ে যেতো। একদিন বেশ বিপাকে পড়ে মেয়েটা তার কাছে উপস্থিত হয় এবং নিরুপায় হয়ে তার কাছে কিছু অর্থকড়ি চায়। এমন সুযোগ হাতে পেয়ে তার ভেতরে এতদিনের পুষে রাখা সুপ্ত অনৈতিক ইচ্ছেটা জেগে ওঠে এবং শারীরিক সম্পর্কের বিনিময়ে মেয়েটাকে অর্থ দিতে রাজি হন তিনি। নিরুপায় মেয়েটা তাতে রাজি হয় শেষ পর্যন্ত।

কামনা চরিতার্থ করবার লক্ষ্যে যখন তিনি মেয়েটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যাবেন, এমন সময় মেয়েটা বললো, আল্লাহকে ভয় করো। আমার পবিত্রতা তুমি নষ্ট করো না।

মেয়েটার প্রতি তার ছিলো দুর্নিবার আকর্ষণ, তথাপি তার এমন আকুতি শুনে তিনি ছিটকে দূরে সরে গেলেন আর তাকেও চলে যেতে বললেন। মেয়েটাকে যে

গুহার সেই দ্বিতীয় ব্যক্তি আল্লাহর কাছে করজোড়ে ফরিয়াদ করে বললেন, ‘মাবুদ, সেদিন যদি কেবল আপনাকে ভয় করে আমি ওই অসৎ কাজ থেকে বিরত থেকে থাকি, তার অসিলায় আজকের বিপদ থেকে আপনি আমাকে রক্ষা করুন।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তার দুআও কবুল করলেন এবং গুহার মুখে থাকা পাথর আরো খানিকটা সরে গেলো তাতে, কিন্তু বেরোনোর জন্য তখনো তা যথেষ্ট নয়।

তাদের তৃতীয়জনের অধীনে কিছু লোক কাজ করতো। কাজ সম্পন্ন হলে সবাইকে সবার মজুরি পরিশোধ করে দেন তিনি; তবে মজুরদের মধ্যে একজন তার মজুরি নিয়েই অন্যত্র চলে যায়।

সেই মজুরের টাকাটা তিনি একটা ব্যবসাতে বিনিয়োগ করে দেন। আস্তে আস্তে দেখা গেলো–সেই ব্যবসাতে প্রচুর লাভ ও অর্থকড়ি হতে লাগলো।

অনেক আগের সেই মজুর একদিন তার কাছে ফেরত আসে এবং তার না নিয়ে যাওয়া মজুরি দাবি করে। তখন লোকটা বললেন, এই যে দেখছো উট, গাভী, বকরি আর ছাগলের খামার, এ সমস্তকিছুই তোমার। তুমি সব নিয়ে যেতে পারো।

লোকটার কথায় বেশ বিভ্রান্ত হয় সেই মজুর। সে বললো, একদিন আপনার এখানে কাজ করে মজুরি না নিয়ে চলে গিয়েছিলাম আমি। সেই মজুরি চাইতে এসেছি আজ। আপনার সহায়-সম্পত্তি দাবি করতে আসিনি। দয়া করে আমার সাথে উপহাস করবেন না।

লোকটা বললেন, আল্লাহর বান্দা, আমি তোমার সাথে উপহাস করছি না। তুমি মজুরির যে টাকা নিয়ে যাওনি, তা আমি ব্যবসাতে বিনিয়োগ করেছিলাম। এই যে উট, গাভী, বকরির খামার দেখতে পাচ্ছো, এ সবকিছুই সেই ব্যবসার লাভ থেকে করা। সুতরাং, এসবকিছুর প্রকৃত মালিক তুমি। এগুলো তুমি নিয়ে যেতে পারো। মজুর লোকটা সবকিছু বুঝে নিয়ে প্রস্থান করলো।

গুহার সেই তৃতীয় ব্যক্তিটা বললেন, ‘মালিক, সেদিনের সেই কাজটা যদি আমি কেবল আপনার সন্তুষ্টির জন্যই করে থাকি, তাহলে আজকের এই বিপদের ঘনঘটা। থেকে আপনি আমাদের মুক্ত করুন।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাঁর এই বান্দার আকুতিটাও কবুল করলেন এবং তারপর গুহার মুখ থেকে বিশালকায় সেই পাথর পুরোপুরিভাবে সরে যায় আর তারা বাইরে বেরিয়ে আসেন।[১]

বন্দিত্বের এমন চরম পর্যায়ে দাঁড়িয়ে, শিয়রে মৃত্যুর এত সুনিশ্চিত হাতছানি থাকা সত্ত্বেও তাদের হাতে মুক্তি লাভের একটা উপায়, একটা অবলম্বন ছিলো। তারা তাদের সৎ আমলগুলোকে তুলে ধরতে পেরেছিলেন, যা কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই করা।

তিন.

কুরআনও কয়েকটা গা ছমছমে বন্দি অবস্থার কথা আমাদের শোনায়। আমরা স্মরণ করতে পারি মুসা আলাইহিস সালামের ঘটনা। ফিরআউনের বিশাল বাহিনী যখন তাড়া করেছিলো মুসা আলাইহিস সালামকে, তখন অনুসারীদের নিয়ে তিনি লোহিত সাগরের দিকে চলে যান। একপর্যায়ে অবস্থা এমন দাঁড়ালো–

সামনে কূল-কিনারাবিহীন সমুদ্র আর পশ্চাতে শত্রুর নিশ্চিত উপস্থিতি। সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়লে মৃত্যু সুনিশ্চিত। আর ফিরআউন বাহিনীর হাতে ধরা পড়লেও আছে প্রাণনাশের শঙ্কা। বনু ইসরাইল সম্প্রদায়ের সামনে এ যেন জলে কুমির আর ডাঙায় বাঘের মতো অবস্থা! এমন ঘনঘোর বিপদের মুখে মুসা আলাইহিস সালামের অনুসারীরা ভয়ে বিহ্বল হয়ে বলতে লাগলো, আমরা তো নিশ্চিত ধরা পড়ে গেলাম।[২]

অনুসারীরা যতই ব্যাকুল আর বিহ্বল হোক, উপনীত বিপদে তারা যতই ঘাবড়ে যাক, নবি মুসা আলাইহিস সালাম তা নিয়ে বিন্দুমাত্রও বিচলিত নন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলাকে তিনি যেভাবে চেনেন, আর কেউ তো সেভাবে চেনে না। মহাপরাক্রমশালী রবের ক্ষমতার ব্যাপারে তার হৃদয়ে আছে অপরিসীম ভরসা। তার অন্তর তাওয়াক্কুলে টইটম্বুর। তাই, অন্য সবাই যেখানে ভয়ে কাবু, সেখানে মুসা আলাইহিস সালাম শোনালেন ভরসার সেই অমিয় বাণী। তিনি বললেন, ‘কখনোই নয়। আমার পালনকর্তা আমার সাথে আছেন। অতিসত্বর তিনি আমাকে পথ দেখাবেন।[৩]

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা মুসা আলাইহিস সালামকে ঠিক ঠিক পথ দেখালেন। সমুদ্রের বিশাল জলরাশিকে তিনি নবি মুসার জন্য পরিণত করলেন প্রশস্ত রাস্তায়, যে রাস্তা ধরে মহাসমুদ্র পার হবে তার অনুসারীরা। সেদিন মুসা আলাইহিস সালামকে পথ দেখিয়েই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা থেমে যাননি, ওই একই পথকে ফেরাউনের জন্য তিনি পরিণত করেছিলেন মৃত্যুফাঁদে।

এই যে অনুসারীদের নিয়ে এমন কঠিন বন্দিদশায় পড়েছিলেন মুসা আলাইহিস সালাম, সেই বিপদ কাটাতে কোন জিনিসটা তাকে সহায়তা করেছে জানেন? সেটা হলো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার ওপর তার টইটম্বুর তাওয়াক্কুল। অনুসারীরা যেখানে নিশ্চিত মৃত্যু ব্যতীত আর কিছুই দেখছিলো না, নবি মুসা আলাইহিস সালাম সেখানে দেখছিলেন বেঁচে ওঠার আলোকরশ্মি! কেউ যেখানে মর্মান্তিক পরাজয় ব্যতীত কোনো পথ দেখছে না, সেখানে মুসা আলাইহিস সালাম দেখছিলেন বিজয়ের রক্তিম সূর্যোদয়! তিনি জানেন, পথ তৈরির মালিককে ডাকতে জানলে, তাঁর ওপরে ভরসা করতে জানলে পথ তৈরি হতে সময় লাগবে না। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার ওপরে যারা ভরসা করে, তাদেরকে তিনি অবিশ্বাস্যভাবে পথ প্রদর্শন করেন।

হিজরতের দিন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুকে নিয়ে যাত্রা করলে মক্কার মুশরিকরা সেদিন তাদের পিছু নিয়েছিলো। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো যেকোনো প্রকারে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বন্দি করে হত্যা করা। নবিজিকে হত্যা করবার উদ্দেশ্যে তারা শুরুতে হামলা করেছিলো তার ঘরে। সেখানে নবিজিকে না পেয়ে, হত্যার নেশায় উন্মত্ত আর পাগলপারা হয়ে তারা পিছু নেয় নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুর।

পেছনে শত্রুবাহিনী আর সম্মুখে যেন এক অনন্ত মরুভূমি! বিপদের এমন ঘনঘোর সময়ে ক্লান্ত-শ্রান্ত দেহ নিয়ে তারা আশ্রয় নিলেন একটা গুহার মধ্যে।

কিন্তু, বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ গুহার মুখে টের পাওয়া গেলো শত্রুর উপস্থিতি! শত্রু যদি ভুল করে একবার নিজের পায়ের দিকে তাকায়, তাহলে গুহার ভেতরে থাকা আবু বকর এবং নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ধরা পড়ার সম্ভাবনা শতভাগ। বন্দিত্বের এমন করুণ মুহূর্তে ঘাবড়ে গেলেন আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু৷ কী হবে যদি ধরা পড়তে হয়? নিজের চাইতেও নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিরাপত্তা নিয়েই তিনি সবিশেষ আতঙ্কিত! তাকে যে নিজের প্রাণের চাইতেও বেশি ভালোবাসেন তিনি!

আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুর এমন বিচলিত অবস্থা, বিমর্ষ চেহারা দেখে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেদিন অভয়বাণী হিশেবে যে কথাটা বলেছিলেন, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সেটাকে কুরআনে স্থান দিয়েছেন। তিনি বলেছেন

‘চিন্তিত হয়ো না। আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন।[৪]

নাকের ডগায় শত্রুর উপস্থিতি টের পেয়ে দুজনের একজন ঘাবড়ে যাচ্ছেন আর অন্যজন নির্ভার-চিত্তে বলছেন, ‘চিন্তিত হয়ো না। আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন!

এই যে অন্তরের গভীরে প্রোথিত থাকা এই নির্ভরতা, এই নির্ভরতার নাম তাওয়াক্কুল। এই তাওয়াক্কুলের কারণেই সেদিনকার সেই বন্দিদশা থেকে মুক্ত হতে পেরেছিলেন আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু আর নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।

আমরা আরো স্মরণ করতে পারি নবি ইউনুস আলাইহিস সালামকে। গভীর সমুদ্রতলে মাছের পেটে আটকে পড়তে হয় তাকে। জগতে এরচেয়ে করুণ, ভয়ংকর, বিভীষিকাময় বন্দিদশা আর কার হয়েছে! একে তো সমুদ্রের অতল অন্ধকার, তারওপর মাছের পেটের ভেতরের সংকীর্ণতা এবং সেখানেও অন্ধকারের আরেক স্তর–সে কী এক মহাবিপদই না ছিলো আল্লাহর নবি ইউনুস আলাইহিস সালামের জন্য!

কিন্তু এমন ঘোরতর বিপদের মুখে পড়লে যেখানে দুনিয়ার কঠিনপ্রাণ মানুষও বিহ্বল হয়ে যাবে, সেখানে আল্লাহর নবি ইউনুস আলাইহিস সালাম হৃদয়ের গভীর থেকে আল্লাহর স্মরণে মত্ত হয়ে গেলেন। যেন মাছের পেট থেকে উদ্ধার হওয়া নয়, নিজের কৃতকর্মের জন্য আল্লাহর কাছে লজ্জিত, অনুতপ্ত হওয়াটাই তার ধ্যান-জ্ঞান। সেই শোচনীয় অবস্থার মধ্য থেকে তিনি আল্লাহর কাছে হাত তুলে ফরিয়াদ করলেন–

‘আপনি ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই। আপনি মহা-পবিত্র, আর নিশ্চয় আমি ছিলাম জালিম।[৫]

গভীর সমুদ্রতলে এক মহাবিপদের মাঝে নিপতিত হয়েও নবি ইউনুস আলাইহিস সালাম যা ভুলে যাননি, সেটা হলো–তাকওয়া। ওই মহাবিপদ থেকে বাঁচবার কী পথ, তা নিয়ে তিনি চিন্তিত নন। প্রাণবায়ু আর কতক্ষণ তার শরীরে অবশিষ্ট থাকবে–তা নিয়েও তার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। তার সমস্ত চিন্তা কেবল আল্লাহকে ঘিরে–যে পদস্খলন তার থেকে হয়েছে, তা কি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ক্ষমা করবেন? নিজের কৃতকর্মের জন্য একটা অনুতপ্ত হৃদয় নিয়ে তিনি তাই আল্লাহর কাছে ফরিয়াদে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তার সেই ব্যস্ততার কাছে মাছের পেটের সংকীর্ণতা, সমুদ্রতলের গভীর অন্ধকার আর বাঁচবার তীব্র আকুলতা কোনোকিছুই মুখ্য হয়ে উঠতে পারেনি।

কিন্তু ইউনুস আলাইহিস সালামের শেষ পরিণতি সম্পর্কে আমরা জানি। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কাছে নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে যে দুআ তিনি করেছিলেন, তা তো কবুল হলো-ই, সাথে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ইউনুস আলাইহিস সালামকে বাঁচিয়ে নিলেন সেই মহা সংকট থেকে। মাছের পেটের দুর্ভেদ্য সংকীর্ণতা, সমুদ্রতলের অন্ধকার–সবকিছুকে ডিঙিয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাকে মুক্ত করে নিয়ে আসলেন। ইউনুস আলাইহিস সালামের অন্তরে তাকওয়ার যে বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিলো, অনুতপ্ত অন্তরের যে স্বাক্ষর তিনি বিপদের মাঝে দাঁড়িয়ে দেখিয়েছিলেন, তা ছিলো অনন্য-অসাধারণ!

সে এক সু-কঠিন বন্দিদশা থেকে ইউনুস আলাইহিস সালাম মুক্তি পেলেন আর তার সেই মুক্তির পেছনে নিয়ামক হিশেবে যা কাজ করেছে, তা হলো–তাকওয়া।

চার.

হয়তো গুহা-মুখের পাথর এসে দাঁড়ায় না আমাদের যাপিত জীবনের পথে। হয়তো মুসা আলাইহিস সালামের জীবনের মতো সমুদ্র আর শত্রু বাহিনীর দ্বৈত দ্যোতনার বিপদ নেমে আসে না আমাদের সম্মুখে। মক্কার মুশরিকদের মতো ধাওয়া করবার মতো শত্র হয়তো উপস্থিত নেই আমাদের জীবনে। সমুদ্রের অতল অন্ধকার আর মাছের পেটের সংকীর্ণতাও হতে পারে আক্ষরিক অর্থে আমাদের জীবনে বিপদ হয়ে আসে না, কিন্তু মাঝে মাঝে আমাদের জীবনেও বন্দিত্ব আসে। কখনো কখনো আমাদের জীবন আটকে যায় তীব্র সংকীর্ণতায়। আমাদের দুআ কবুল হয় না, সুখ হারিয়ে যায় আমাদের জীবন থেকে, কাজকর্মে, ব্যবসা-বাণিজ্যে, পড়াশোনা কিংবা সাংসারিক জীবনে–কোথাও আমরা পাই না এতটুকু বারাকাহ। দুনিয়াটাকে তখন খুবই সংকীর্ণ মনে হয়। মনে হয়, পৃথিবী তার সকল ভারত্ব নিয়ে ভেঙে পড়বে আমাদের মাথার ওপরে। হতাশা, অশান্তি আর অপূর্ণতা তখন আমাদের কুরে কুরে খায়। আমরা চিন্তার বন্দিত্বে ভুগি আর ভুগি স্বাধীনতার সংকীর্ণতায়। তখন ইচ্ছে করে–ইশ! আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা যদি আমার অমুক দুআটা কবুল করতেন! যদি তিনি আমাকে উদ্ধার করতেন অমুক বিপদ থেকে! যদি কেটে যেতো আমার বন্দিত্বটা! যদি খুলে যেতো আমার মুক্তির পথ!

জীবনের এমন বন্দি শিবিরে শিকলবন্দি হয়ে যখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার অপার অনুগ্রহ লাভের আশায় অস্থির হয়ে ওঠে আমাদের মন, যখন সকল প্রতিকূলতা, বিপদ আর বন্দিত্ব থেকে মুক্তির জন্য আশায় কাতর হয় আমাদের হৃদয়, তখন গুহায় আটকে যাওয়া আমাদের সেই পূর্বসূরিদের মতো করে, নিজেদের আমলনামাতে আমরা একটু চোখ বুলাতে পারি। যদি তাতে পাওয়া যায় কোনো গোপন আমল, যার সাক্ষী কেবল আমি এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা, যদি তা আমি লোকের প্রশংসা লাভের আশায় না করে থাকি, যদি তাতে না থাকে মানুষের বাহবা লাভের কোনো আকাঙ্ক্ষা, আল্লাহর সন্তুষ্টি সাধনই যদি তার একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে থাকে–তাহলে গভীর অন্ধকার রাতে, জায়নামাযে দাঁড়িয়ে আমরা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কাছে বলতে পারি–’মালিক, আমার সেদিনকার সেই কাজটা আমি একান্তই আপনার সন্তুষ্টি লাভের জন্যই করেছিলাম। মানুষের চোখে বড় আর মহান হতে, তাদের বাহবা কুড়াতে আমি সেই কাজটা করিনি। মাবুদ, অন্তরের খবর আপনার চাইতে ভালো আর কে জানে! আপনি আমার অন্তরের সেদিনকার অবস্থাও জানতেন, আর আজকের অবস্থাও জানেন। আজ যে বিপদ, যে দুর্যোগ আর দুর্ভোগে আমি নিপতিত, জীবনের যে সংকীর্ণতা আজ আমার শ্বাসরোধের দ্বারপ্রান্তে, সেদিনকার সেই কাজটার অসিলায় আপনি আমার জীবনের সমস্ত প্রতিকূলতা, সমস্ত বিপদ আর দুর্যোগ দুর করে দিন। নিশ্চয়। বান্দার ডাকে আপনি সাড়া দেন আর বান্দার বিপদে আপনার আশ্রয়ের চাইতে উত্তম আশ্রয়স্থল আর কোথায় আছে?’

দুর্যোগ জীবনের এক অনিবার্য বাস্তবতা। সেই বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার আগে আমরা মেরামত করতে পারি আমাদের তাওয়াক্কুল আর তাকওয়ার স্তরকে। যদি তাতে মরচে ধরে থাকে, যদি তা হয়ে থাকে ভীষণ দুর্বল আর নড়বড়ে, যত্ন নিয়ে। সেটাকে আমরা সেই স্তরে উন্নীত করতে পারি, যে স্তরে গেলে গভীর সংকটেও পথিক পথ হারায় না। তাওয়াক্কুল বুকে থাকলে সম্মুখের পথহীন অবস্থাতেও পথ তৈরি হয়ে যায়, যেভাবে দরিয়া ফুড়ে পথ তৈরি হয়েছিলো মুসা আলাইহিস সালামের জন্য। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার প্রতি আকাশ-সমান ভরসার প্রাচুর্য বুকে ছিলো বলেই হিজরতের দিন নিশ্চিত মৃত্যুর সামনেও নির্ভার থাকতে পেরেছিলেন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। আর অন্তরে তাকওয়ার অথৈ জোয়ার ছিলো। বলেই মাছের পেটের সংকীর্ণতার মাঝেও বাঁচবার কথা ভুলে আল্লাহর ক্রোধ থেকে বাঁচতে নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হতে পেরেছিলেন নবি ইউনুস আলাইহিস সালাম। তাকওয়া তার জন্য সেই বিপদ থেকে, সেই সংকীর্ণতা থেকে, সেই অতল অন্ধকার থেকে মুক্তির মাধ্যমে পরিণত হয়ে গেলো।

জীবনের বন্দিশিবির থেকে মুক্তির স্বাদ আস্বাদন করতে চলুন আমরা আমাদের আমল, আমাদের তাওয়াক্কুল আর তাকওয়ার যত্ন নিই। আমলনামায় যোগ করি এমন গোপন আমল, যা বিপদের দিনে আমাদের জন্য বর্ম হয়ে দাঁড়াবে। অন্তরে চাষ করি তাওয়াক্কুল আর তাকওয়ার বীজ, যা মহীরুহ হয়ে একদিন রুখে দেবে জীবনের প্রতিকূলতা, বিপদের তপ্ত-কঠিন সময়ে, যা আমাদের ছায়া দেবে আর দেবে নিরাপত্তা।

————
[1] সহিহুল বুখারি : ২২৭২; সহিহ মুসলিম : ২৭৪৩; শুআবুল ঈমান : ৬৭০৪; আত-তারগিব ওয়াত তারহিব :১; মুস্তাখরাজু আবি আওয়ানা : ৫৯৯৮

[2] সুরা শুআরা, আয়াত : ৬১

[3] সুরা শুআরা, আয়াত : ৬২

[4] সুরা তাওবা, আয়াত : ৪০

[5] সুরা আম্বিয়া, আয়াত : ৮৭

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *