০৫. বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর

০৫. বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর

এক.

বনশ্রীর যে বাসায় আমি থাকতাম, ও বাসার নিচে আমার স্ত্রী এক হাফিযা মহিলার কাছে প্রতিদিন সকালে হিফয করতে যেতেন। তাদের সাথে, এক থুরথুরে বৃদ্ধ মহিলা, বয়স কম করে হলেও সত্তর-পঁচাত্তরের কোঠায়, দেখতাম তিনিও রোজ কুঁজো হয়ে যাওয়া শরীর নিয়ে চলে আসতেন আরবি পড়তে। আরবি পড়া মানে একেবারে আলিফ, বা দিয়ে শুরু করা। এমন বয়সে একজন অতি-বৃদ্ধা মহিলা রোজ নিয়ম করে শিশুদের মতন কায়দা পড়ছে–তা দেখে শুরুর দিকে আমি খানিকটা বিস্মিত হয়েছিলাম বৈকি! কিন্তু পরে বৃদ্ধা মহিলার কুরআন দেখে দেখে পড়তে পারার যে অদম্য স্পৃহা, তা দেখে ভেতরটা সম্মান আর শ্রদ্ধায় কানায় কানায় ভরে উঠলো।

আমাদের একটা বাতিক আছে। বয়স কম থাকলে আমরা বলি, এই বয়সেই তোমাকে কেন ওসব শিখতে হবে বাপু? জীবন তো এখনো অ-নে-ক পড়ে আছে। বয়স বাড়ুক, আস্তে আস্তে না হয় শিখবে।

আবার যাদের বয়স বেড়ে গেছে, তারা ভাবে, জীবনের আর কটা দিনই তো বাকি! এই জীবন-সায়াহ্নে বসে আমি আর কী এমন শিখতে পারবো? সময় যে ভারি অল্প।

আমার ধারণা, ওপরের এই দুই ভাবনাই শয়তানের প্ররোচনা। শয়তান ভালো মানুষের মতন, দেখতে ভালো এবং যৌক্তিক ধারণা দুটো মানুষের মস্তিষ্কে এমনভাবে গেঁথে দেয়, যেন সে জ্ঞান অর্জনে নিজেকে ডুবিয়ে না রাখে। মানুষকে জ্ঞান আহরণের রাস্তা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে শয়তান ‘এখনো বয়স হয়নি কিংবা আর কি সময় আছে?’–ধরনের প্ররোচনাগুলোকে আমাদের সামনে রঙচঙ মাখিয়ে উপস্থাপন করে, যাতে আমরা বিভ্রান্ত হই এবং জ্ঞানের সাগরে ডুব না দিতে পারি।

আমি এমন অনেককে চিনি, যারা শয়তানের এই প্ররোচনায় প্ররোচিত হয়ে জ্ঞান আহরণের চেষ্টায় নিবিড়ভাবে নিজেদের নিয়োজিত করেছেন। আমার বাবার বয়সী অনেক মানুষকে চিনি, যারা সারাদিনের কাজকর্ম সেরে, সন্ধ্যার অবসরে আরবি ভাষা শেখার জন্য হয়তো-বা অনলাইন কোর্স কিংবা অফলাইন ক্লাশে গিয়ে খাতা-কলম নিয়ে বসে পড়েন। আমি এমন অনেক জুনিয়র ভাই-বন্ধুকে চিনি, যারা জ্ঞান অর্জনের প্রতিযোগিতায়, শেখার প্রতিযোগিতায়, নিজেকে সমৃদ্ধ করার দৌড়ে আমার চাইতে আলোকবর্ষ এগিয়ে। তাফসির, হাদিস, ফিকহ, ইতিহাস, সাহিত্যে তারা আমার চেয়ে ঢের অগ্রগামী। এই দুই ভিন্ন বয়সী, যারা শেষে এসেও হতোদ্যম হয়নি, আর যারা আগেভাগেই নিজেদেরকে নিয়ে এসেছে সঠিক স্রোতে, তাদের উভয়ের জন্যই আমার অফুরান ভালোবাসা।

দুই.

নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যু নিঃসন্দেহে এই উম্মাহর জন্য সবচেয়ে বড় বিপর্যয়। মানবজাতি এমন বিপর্যয়ের মুখোমুখি না আগে কখনো হয়েছে, না পরে আর হবে। আসমান থেকে প্লাবিত হয়েছে রহমতের যে ফল্গুধারা, যাকে বিশ্বমানবতার জন্য মুক্তি-দূত বানিয়ে পাঠানো হয়েছে, তার মৃত্যু অতি অবশ্যই আমাদের জন্য এক বিশাল ধাক্কা! আসমানি এই রহমত কখনো ফুরিয়ে যেতে পারে, কখনো তা মৃত্যুর হাত ধরে অলক্ষ্যে চলে যেতে পারে, এই ভাবনাটুকুও অনেক সাহাবি ভাবতে পারতেন না। তাই তো আমরা দেখি, নবিজির প্রয়াণ-দিবসে, নবিজিকে মৃত্যুর বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখে হতবিহ্বল চিত্তে উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেছিলেন, ‘কখনোই নয়। নবিজি তো মৃত্যুবরণ করতেই পারেন না। যে বলবে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যু হয়েছে, তাকেই আমি হত্যা করবো।

প্রিয়মুখ, প্রিয়জন গত হলে আমরা যেভাবে ভেঙে পড়ি, শোকের সাগরে হাবুডুবু খাই, সাহাবিদের জন্য নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যু-দিনটাও ছিলো এমনই এক ঘোরতর শোকের সময়; কিন্তু সেদিন শোক আর বিষণ্ণতার মাঝেও, দুঃখ আর দুঃসহ যন্ত্রণার দিনে এমন এক সাহাবি ছিলেন, যিনি সবকিছু সত্ত্বেও, সবকিছুকে ছাপিয়ে একটি অনন্য দিকেও নিবদ্ধ রেখেছিলেন নিজের সবটুকু মনোযোগ। তার নাম আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু।নবিজির চাচা আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুর সন্তান। নবিজির মৃত্যুকালে আবদুল্লাহর বয়স ছিলো মাত্র তেরো বছর। শৈশবের পাঠ চুকিয়ে কৈশোরে পা রাখা এক দুরন্ত বালক আবদুল্লাহ। তিনি ছিলেন নবিজির বিশেষ স্নেহধন্যদের একজন। শিশুদের সাথে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মিষ্টি-মধুর সম্পর্কের কথা তো সর্বজনবিদিত। তার ওপর নিজের পরিবারের একজন হওয়ায় আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস নবিজিকে কাছে পেয়েছিলেন অন্যদের চাইতে অনেক বেশি। খুব কাছ থেকে নবিজিকে দেখা, তার কথা শোনা, তার কাছ থেকে জ্ঞান আহরণের এক অনুপম ও অনন্য সুযোগ ছিলো ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুর সামনে এবং তা তিনি হেলায় নষ্ট করেননি মোটেও।

নবিজির মৃত্যুর দিন সবাই যখন শোকাহত, বিষণ্ণতার ভীষণ ভারে যখন নুইয়ে আছে উম্মাহর তনু-মন, সেদিন ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু ভাবলেন একেবারে ভিন্ন কিছু। যা হয়তো-বা ঘুণাক্ষরেও কারো মনে আসতো না, তেমন একটা কাজ তিনি করেছিলেন সেদিন।

নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সময়েই ইসলামি সাম্রাজ্য বিস্তার লাভ শুরু করে। আরব-ভূমির বাইরেও মুসলিমরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়তে থাকে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে। যেহেতু দ্বীনের মশাল পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে, তাই নতুন করে যারাই ইসলামকে আপন করে নিচ্ছিলো আপন আলয় হিশেবে, তাদের মাঝে দ্বীনের বার্তাটুকু এবং আসমানি আলোর প্রভাটুকু বিলিয়ে দিতে, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার অনেক সাহাবিকে দীক্ষা দিয়ে ওই-সমস্ত অঞ্চলগুলোতে পাঠিয়েছিলেন। তারা কুরআনের সুমহান বার্তা, রিসালাতের অমিয় বাণী মানুষের দ্বারে দ্বারে, যেভাবে নবিজির কাছ থেকে তারা রপ্ত করেছিলেন, সেভাবেই তাদের কাছে পৌঁছে দিতেন।

কিন্তু যখন প্রিয় নবিজির মৃত্যুসংবাদ তাদের কাছে পৌঁছালো, তারা কি আর সেখানে থাকতে পারেন? সবচেয়ে প্রিয় এবং সবচাইতে আপন মানুষটার বিদায়-বেলায় যদি হাজির না থাকা যায়, যদি চর্মচক্ষু দিয়ে প্রিয় মুখখানা শেষবারের মতন নাই-বা দেখা গেলো, তাহলে যে বন্ধুত্ব, যে ভ্রাতৃত্ব, যে প্রেম আর প্রণয়ের সম্মেলন হয়েছিলো হৃদয়ে, তা কি অপূর্ণতার গ্লানিতে ভরে উঠবে না?

তাই নবিজিকে শেষবারের মতন বিদায় জানাতে, শেষ দেখাটুকু দেখতে এসেছিলেন সাহাবিরা। যারা দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছিলেন, তারা দলে দলে আসতে লাগলেন প্রিয় নবিকে ‘আল-বিদা’ জানাতে।

নবিজির প্রয়াণ-দিনে শোকে একেবারে আবিষ্ট হয়েও আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু ভাবলেন–দূর দূরান্তে ছড়িয়ে পড়া সাহাবিরা যখন নবিজিকে শেষ দেখা দেখতে মদিনায় ফিরছে, তাহলে জীবিত সব সাহাবিকে একত্রে, একসাথে পাওয়ার এই তো সুযোগ! এমন সুযোগ আর পাওয়া যাবে, এমনটা বলা যায় না কোনোভাবে। আজ এমনসব সাহাবিরা মদিনায় ফিরছেন, যারা নবিজিকে কাছ থেকে দেখেছেন, নবিজির কাছ থেকে শিখেছেন। কুড়িয়ে নিয়েছেন রত্নের আকর। যেহেতু সবাই আজ দলে দলে মদিনায় ফিরে আসছেন, তাই নবিজির কাছ থেকে তারা যা পেয়েছেন, তা কুড়িয়ে নেওয়ার, সংগ্রহ করে ফেলার এই তো সুবর্ণ সুযোগ!

জ্ঞান অর্জনের প্রতি কতটা প্রবল আগ্রহ, অনির্বাণ ইচ্ছে, অদম্য প্রেরণা থাকলে এমন বেদনাহত দিনেও এমনকিছু কেউ ভাবতে পারে? অন্য কোনো সাহাবির মানসপটে যে ভাবনার বিন্দুবিসর্গ পর্যন্ত ছিলো না, তা-ই কিনা ভেবে বসলেন মাত্র তেরো বছরের এক কিশোর!

তবে এ কথা ভাববার অবকাশ নেই যে–আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রয়াণে কাতর ছিলেন না। অন্য সবার মতন তিনিও শোকাহত ছিলেন। নবিজির বিদায়ে তারও হৃদয় ভেঙে চৌচির। এই বিপর্যয়ে তার মনেও কালবোশেখির ঝড়, কিন্তু সেই শোকের আবহ থেকে, সেই কালবোশেখির অন্ধকারেও তিনি জ্ঞান অর্জনের চিন্তা থেকে নিবৃত হননি৷ বিপদের মাঝেও তিনি আশা খুঁজে নিতে চেয়েছেন। শোকের মাঝেও খুঁজে নিতে চেয়েছেন সান্ত্বনার বস্তু।

তিনি ভেবেছিলেন–মদিনার বাইরে ছড়িয়ে পড়া সাহাবিরা, তাদের মাঝে এমন জ্ঞানের সন্ধান মিলতে পারে, যা হয়তো-বা আমার জানা নেই। হতে পারে–নবিজির কাছ থেকে তারা এমনসব জ্ঞান আহরণ করেছিলেন, যা আর অন্য কেউ জানে না। এই সুযোগে আমি যদি তাদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে তাদের কাছ থেকে সেই দুর্লভ মণিহার আহরণ করে নিতে পারি, তাহলে আমার জানার জগৎ আরো সমৃদ্ধ, আরো পোক্ত হবে।

তিনি তা-ই করলেন। নবিজির মৃত্যু উপলক্ষে মদিনার বাইরে থেকে আগত অসংখ্য সাহাবির দরোজায় দরোজায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস। তাদের বলতেন, ‘আমি ইবনু আব্বাস। আমি জানি আপনি নবিজির প্রিয় একজন সাহাবি। আপনি তো দিন কয়েক বাদেই মদিনা ছেড়ে চলে যাবেন, তাই আমি আপনার কাছ থেকে এই ফাঁকে কিছু শিখতে এসেছি। আপনি আমাকে এমনকিছু শেখান, যা নবিজি আপনাকে শিখিয়েছেন। হতে পারে, আপনার আহরিত জ্ঞানে এমন অসংখ্য মণি-মুক্তো আছে, যা আমার জানা নেই। আমি শিখতে চাই।’[10]

তেরো বছরের এক কিশোর, যার স্বভাব-স্নিগ্ধ কোমল চেহারা থেকে এখনো মোছেনি কৈশোরের দ্যুতি, সেই বালক জ্ঞানের তৃয়া নিবারণের তাগিদে কী অদম্য প্রয়াসেই না মানুষের দ্বারে দ্বারে ধরনা দিতে এলো!

ইনিই সেই আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু, যিনি কুরআনের তাফসির করার জন্য ইসলামের ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন। তাকে বলা হয় তাফসিরকারকদের শিরোমণি। তাফসিরশাস্ত্রে তার মতন প্রজ্ঞা আর পাণ্ডিত্য আর কারো মাঝেই ছিলো না। পৃথিবীর যেখানেই, যে-কেউই কুরআনের তাফসির করতে গেলে, তাকে অবশ্যই অবশ্যই আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুকে সামনে রাখতে হবে। তার মত ডিঙিয়ে তাফসির করা একপ্রকার অসম্ভব। জ্ঞান অর্জনে তার যে ব্রত ছিলো, যে অনির্বাণ, অনিঃশেষ স্পৃহা নিজের মাঝে তিনি ধারণ করেছিলেন, তা-ই তাকে এই মর্যাদায় আসীন করেছে নিঃসন্দেহে।

‘বয়স কম, এখনো তো জীবনের অনেক সময় বাকি’ এই অজুহাত আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুর জ্ঞানার্জনের অদম্য স্পৃহাকে দমাতে পারেনি। যে বয়সটা হেসেখেলে পার করবার, সেই বয়সে তিনি হয়ে উঠেছিলেন জ্ঞানের এক অনন্য বাতিঘর! একদিনের চমৎকার এক ঘটনা থেকে আমরা যার প্রমাণ পাই।

উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু তখন মুসলিম জাহানের খলিফা। রাষ্ট্রের যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে তিনি শুরা বৈঠক ডাকতেন এবং অভিজ্ঞ, প্রবীণ কিন্তু দূরদর্শী–এমন সব সাহাবিদের সাথে শলা-পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিতেন। এমন এক বৈঠকে, যখন প্রবীণ ও প্রসিদ্ধ সাহাবিরা বসে আছেন, তখন সেখানে একদিন আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু এসে উপস্থিত। সাধারণত এমন বৈঠকে তার উপস্থিত হওয়ার কথা নয়। একে তো আবদুল্লাহ বয়সে অনেক ছোটো, সবে কৈশোর যায় যায় করছে, তার-ওপর, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এমন এক বৈঠকে। হঠাৎ করে তার আগমনে সবাই বেশ বিস্মিত! কেউ কেউ প্রশ্নও উত্থাপন করে বসলেন উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুর কাছে। বললেন, আমিরুল মুমিনিন! মার্জনা করবেন। আমাদের শুরা মজলিসে বালক আবদুল্লাহর উপস্থিতির কারণ আমাদের কারো বোধগম্য হয়নি। আপনি কি আমাদের জানাবেন, কেন এমন একটা বৈঠকে আবদুল্লাহকে ডাকা হলো?

উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘আবদুল্লাহ বয়সে ছোটো, কিন্তু জ্ঞানের দিক থেকে সে আপনাদের অনেকের চেয়ে এগিয়ে।

উত্তরটা উপস্থিত অনেকের মনপূত হলো না। আবদুল্লাহর বয়েসী অনেক ছেলেপিলে তাদেরও আছে। তাদের কাউকে তো এখানে ডাকা হয় না। তাহলে আবদুল্লাহকেই। বা কেন ডাকা হবে?

অন্য আরেকদিন আবারও শুরা মজলিসের ডাক পড়লো। মজলিসের প্রবীণ ও প্রাজ্ঞ সকল সাহাবি উপস্থিত। উপস্থিত আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুও। উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু উপস্থিত সকল সাহাবির দিকে তাকিয়ে সুরা আন-নাসর তিলাওয়াত করে বললেন, ‘আচ্ছা, আপনাদের কাছে আমি একটা বিষয় জানতে চাই। আপনাদের কেউ কি বলতে পারবেন, এই সুরা নাযিলের মাধ্যমে আল্লাহ আমাদের কীসের ইঙ্গিত দিয়েছেন?

মজলিসে শুরার প্রবীণ ও প্রাজ্ঞ সাহাবিদের অনেকে বললেন, আমি জানি না; আর অনেকে চুপ করেই থাকলেন। এরপর উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুর দিকে ফিরে বললেন, ‘আবদুল্লাহ, তুমি কি কিছু বলতে পারো এই ব্যাপারে?

আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা এই সুরার মাধ্যমে আমাদের খুব সূক্ষ্ম একটা ইঙ্গিত প্রদান করেছেন। যখন বিজয় আসবে এবং মানুষেরা দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করবে’–এই কথাগুলোর মাধ্যমে তিনি আমাদের জানিয়েছেন যে, ইসলামের বিজয় যখন অত্যাসন্ন হবে, ঠিক তখন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামেরও দুনিয়ার জীবনের সময়কাল ফুরিয়ে আসবে। এই সুরা থেকে ইসলামের বিজয়ের সাথে সাথে আমরা নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যুরও একটা পূর্বাভাস পাই।

আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুর উত্তর শুনে উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘আবদুল্লাহ, এই ব্যাপারে আমি যা জানতাম, তুমিও ঠিক তা-ই জানো।[11]

খেয়াল করা যাক–মজলিসে শুরায় কত প্রবীণ, অভিজ্ঞ সাহাবিরা ছিলেন, তথাপি সুরা আন-নাসরের মাঝে থাকা এই সূক্ষ্ম বিষয়, এই সুপ্ত জ্ঞান তাদের কেউই কিন্তু জানতেন না; অথচ তারা সকলে যা জানতেন না, তা জানতেন আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু। অতোটুকুন বয়সে, জ্ঞানের শাখায় কীরকম বুৎপত্তি লাভ হলে তিনি এই সূক্ষ্ম বিষয়টা জানতে পারেন, তা কি অনুমান করা যায়? এই হচ্ছে আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাসের কুরআনকেন্দ্রিক অর্জিত জ্ঞান ও চিন্তা। আর এই কারণেই, বয়সে সর্বকনিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও, মজলিসে শুরার অন্যতম সদস্য হওয়ার সৌভাগ্য তিনি লাভ করেছিলেন।

‘বয়স কম’–এই অজুহাতে আমরা যারা নিজেদের জ্ঞানার্জন থেকে নিবৃত করতে চাই কিংবা আমাদের পরিবার-সমাজ, যারা আমাদের দমিয়ে রাখতে চায় ‘বয়স হয়নি’ বলে, সবার জন্যই একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ আছে আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুর এই ঘটনায়। কম বয়স যে শেখার পথে কোনো বাধা নয় বরং উৎসাহ–সেটা আমরা উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুর মজলিসে শুরার ঘটনায় আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুর অনন্য-সাধারণ মেধার পরিচয় থেকে অনুধাবন করতে পারি।

তিন.

বয়স বেশি হয়ে গেছে বলেও আমাদের অনেকসময় মনোকষ্টে, অসহায়ত্বে ভুগতে দেখা যায়। যদি ভেবে থাকেন যে, জ্ঞান অর্জনের বয়স আপনি পার করে এসেছেন, এই বয়সে আপনি আর কতই-বা জানতে পারবেন, শিখতে পারবেন, যদি মনে করেন জ্ঞানার্জনে আপনি অন্যদের চাইতে পিছিয়ে পড়েছেন, আর কোনোভাবেই আপনি জ্ঞানার্জনের ধারায় অগ্রগামীদের কাছাকাছি আসতে পারবেন না, তাহলে আপনাকে জাগিয়ে তুলতে, ফিরিয়ে আনতে আপনার হারানো আত্মবিশ্বাস–আমার কাছে একটা চমৎকার উপায় আছে।

সাহাবি আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহুর নাম শুনেছেন নিশ্চয়? হাদিসের গ্রন্থগুলোর পাতা উল্টালে কিংবা অন্য অনেক জায়গায়, যখনই আপনি হাদিস পড়তে গেছেন, অসংখ্য অসংখ্যবার আপনি এই নামখানা দেখেছেন অবশ্যই। আপনি পড়েছেন, ‘আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন…।

আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু হলেন সেই সাহাবি, যিনি সবচেয়ে বেশিসংখ্যক হাদিস বর্ণনা করেছিলেন। সাহাবিদের মধ্যে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিস সবচেয়ে বেশি মুখস্থ করেছিলেন তিনিই। পরবর্তী সময়ে তা ছড়িয়ে দিয়েছেন উম্মাহর মাঝে। এমনকি হাদিস বর্ণনার ক্ষেত্রে তিনি এগিয়ে আছেন নবিজির স্ত্রী, উম্মুল মুমিনিন আয়িশা রাযিয়াল্লাহু আনহার চাইতেও। এ এক অনন্য, অসাধারণ কীর্তি!

কিন্তু জানলে অবাক হতে হয়, আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গ পেয়েছিলেন মাত্র তিনবছর। নবিজির গোটা তেষট্টি বছরের জীবন থেকে কেবল তিনটে বছর তার সংস্পর্শে থাকার সৌভাগ্য হয় আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহুর। তার ইসলাম গ্রহণের তিন বছর পরেই নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃত্যুবরণ করেন।

মাত্র তিনটি বছর কাছে পেয়েছিলেন নবিজিকে। নবিজির সাথি হওয়ার সময়কালটা তার জন্য বড়োই সংক্ষিপ্ত; অথচ এই তিন বছরেই তিনি কিনা হয়ে উঠলেন জ্ঞানের এক অনন্য উদাহরণ! এই তিন বছরেই তিনি নিজেকে নিয়ে গেলেন এমন এক উচ্চতায়, যেখান থেকে আজ গোটা মুসলিম উম্মাহ নিত্যদিন, নিত্য-নিয়ম করে তাকে পড়ে, তার নাম উচ্চারণ করে। হোক হাদিসের ছাত্র কিংবা সাধারণ তালিবুল ইলম, আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহুকে চেনে না, তার নাম শোনেনি কোনোদিন–এমন ঘটনা ঘটা একেবারে অসম্ভব।

‘অন্যেরা অনেকদূর এগিয়ে গেছে, আমি পিছিয়ে পড়েছি, কিংবা জীবনের সূর্যটা অস্তগামীপ্রায়, আর কি সময় হবে নতুন করে শেখার’-ভাবনার এমন দোলাচলে আমরা যারা দোদুল্যমান আছি, আমাদের জন্য অনুপ্রেরণার এক অনন্য বাতিঘর হলেন সাহাবি আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু। কত কম সময়ে কতকিছু যে শিখে ফেলা যায়, তা আমরা এখান থেকে শিখতে পারি।

তাই, শেখার শুরুটা আপনি কবে করছেন তা বিবেচ্য নয়। করছেন কি না, আর করলেও তাতে কতখানি আন্তরিকতা বিদ্যমান, তা-ই হচ্ছে ব্যাপার।

বয়সের ভার যদি জ্ঞানার্জনের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়, একবার মনে করুন সাহাবি আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহুর কথা। মাত্র তিনটে বছর-ই তো! এর পরেরটুকু ইতিহাস!

চার.

সময় ফুরিয়ে যায়নি। দরকার একটা ইস্পাত-কঠিন সংকল্প আর অদম্য ইচ্ছের। আপনার বয়স কম, সেটা কোনো বড় ব্যাপার নয়। ব্যাপার হচ্ছে, আপনার ভেতরে সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুর মতন সবুজ-সতেজ চেতনা আছে কি না, যেই চেতনা গভীর শোকের মাঝেও খুঁজে নেবে শেখার উপকরণ। যে চেতনা আপনাকে আন্দোলিত করবে নতুন করে শিখতে। নতুন কিছু শিখতে।

বয়সের ভারে ন্যুজ হয়ে গেলেও ঘাবড়াবেন না, চিন্তিত হবেন না। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমাদের জন্য বরাদ্দ আছে অবারিত সুযোগ। আরবি পড়তে পারেন

কিংবা এককালে পারলেও এখন ভুলে গেছেন, তা কোনো সমস্যা না। সমস্যা তখনই যখন শেখার জন্য আপনার মাঝে কোনো তাড়না না থাকে। বনশ্রীর সেই বৃদ্ধ, যাকে আমি দেখতাম কুঁজো হয়ে যাওয়া শরীর নিয়ে রোজ আরবি পড়তে আসতেন, তার দৃঢ়তা আর ধৈর্যকে আমার কাছে কখনোই নুইয়ে পড়া কিংবা ম্লান হয়ে আসা কোনোকিছু মনে হতো না; বরং মনে হতো–থুরথুরে শরীরের আড়ালে একটা অদম্য যৌবনশক্তি কোথায় যেন লুকিয়ে আছে, যা তাকে জীবনের শেষলগ্নে এসেও কাবু হতে দেয়নি। বয়সের ভার কিংবা সময়ের স্বল্পতা কখনোই শেখার পথে বাধা নয়। সাহাবি আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহুর মতন যাদের অন্তরে আছে শেখার অদম্য তৃষা, তাদের জন্য জীবনের শেষ দিন, এমনকি শেষ মুহূর্তটাও সুবর্ণ সুযোগ। কবি বলেছিলেন, বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর, সবার আমি ছাত্র ছাত্র হওয়ার একটা দারুণ মজা আছে! শিখতে পারার মজা!

———-
[1] মিহনাতুল ইমাম আহমাদ, আব্দুল গনি আল-মাকদিসি, পৃষ্ঠা : ৩৩-৩৪; আল-জামি লি উলুমিল ইমাম আহমাদ, খণ্ড : ৩; পৃষ্ঠা : ৪২৪

[2] বর্তমানে এটি তুরস্কের একটি শহর।

[3] সিয়ারু আলামিন নুবালা, খণ্ড : ৮; পৃষ্ঠা : ৪০৮-৪০৯

[4] সুরা আলি-ইমরান, আয়াত : ৩৭

[5] সুরা নাসর, আয়াত : ১-৩

[6] সিয়ারু আলামিন নুবালা, খণ্ড : ১৫; পৃষ্ঠা : ৩৯৫

[7] মুআত্তা মালিক : ১২৮; আল-ইস্তিযকার, ইবনু আব্দিল বার, খণ্ড : ৪; পৃষ্ঠা : ২২৪; জামিউল উসুল, খণ্ড : ৩; পৃষ্ঠা : ২১৮

[8] জামি তিরমিযি : ২১৪০; সুনানু ইবনি মাজাহ : ৩৮৩৪–হাদিসটির সনদ সহিহ

[9] শারহুল আকিদাতিল মুমিত, ইবনু উসাইমিন, খণ্ড : ৫; পৃষ্ঠা : ৩৮৮

[10] আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খণ্ড : ৮; পৃষ্ঠা : ৩২৮

[11] আল আকিদা ফি আহলিল বাইত বাইনাল ইফরাত ওয়াত তাফরিত, পৃষ্ঠা : ৩২৪-৩২৫; সহিহুল বুখারি : ৪২৯৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *