০২. যে সুতোয় বাঁধা জীবন

০২. যে সুতোয় বাঁধা জীবন

এক,

খুব কাছের এক ভাইয়ের সম্প্রতি ডিভোর্স হয়ে যায়। বেচারা জান-প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করেছে সম্পর্কটা টেকানোর, কিন্তু কোনোভাবেই তা পারা গেল না। মেয়ের মায়ের একটাই কথা–তার সাথে নিজের মেয়েকে সংসার তিনি করতে দেবেন না। শেষমেশ মেয়ের মা’র জেদই জিতলো। তাদের সংসার নামক ফুলটা প্রস্ফুটিত হবার আগে কলিতেই ঝরে পড়লো। ভীষণ মন খারাপ নিয়ে ভাইটা যখন আমার কাছে এলো, কী বলে যে তাকে সান্ত্বনা দেবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ভাঙা হৃদয় নিয়ে একপর্যায়ে ভাইটা আমাকে বললো, সে আর কোনোদিন বিয়ে করবে না। বিয়ের ওপর, আরো নির্দিষ্ট করে বললে মেয়েদের ওপর থেকে তার আস্থা উঠে গেছে!

গভীর দুঃখবোধ যে তাকে গ্রাস করেছে, তা আঁচ করতে পারলাম। তাকে বোঝালাম যে–এটা যতখানি না মেয়ে-ঘটিত ব্যাপার, তারচেয়েও বেশি তাকদির-সংশ্লিষ্ট। তাকদিরের ফয়সালা তো এমন-ই। তাকদিরের সকল ফয়সালা সর্বদাই যে আমাদের পছন্দনীয় হবে, অন্তত সাথে সাথে–তা কিন্তু নয়। মাঝে মাঝে আমাদের মনে হতে পারে, ‘হায়! আমার সাথেই কেন এমনটা হলো?’

মন খারাপের দিনে, যখন বিচ্ছেদ আর বিরহে কাতর হয়ে ওঠে মন, তখন সকল মর্মযাতনার মহৌষধ একটাই–তাকদিরকে সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেওয়া। এর অপর নাম তাওয়াক্কুল। আল্লাহর ওপর ভরসা করে যাওয়া।

আমার বন্ধু, যে বিরহ বেদনায় কাতর, তাকে তাকদিরের ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললাম। যদিও ব্যাপারগুলো আমার চাইতে তার বেশি ভালো জানা থাকার কথা, তথাপি। দুঃখের দিনে জানা বিষয়টাও কাছের মানুষের কাছে শুনতে মন্দ লাগে না। মন। ভাঙার দিনে কেউ যখন পাশে এসে একটু কোমল গলায় কথা বলে, যখন সান্ত্বনার সুরে মনে একটু সাহস যোগায়–মানুষের তখন খড়কুটো আঁকড়ে ধরে হলেও বাঁচতে ইচ্ছে করে।

যদি আল্লাহ চান, এই সংসারের চাইতেও ভালো সংসার, এই জীবনসঙ্গীর চাইতেও ভালো জীবনসঙ্গী তাকে মিলিয়ে দেবেন। এই সংসারের কোথাও হয়তো তার জন্য অকল্যাণ লুকিয়ে ছিলো। কোথাও হয়তো-বা এমন অনিষ্ট লেপ্টে ছিলো, যা সে আজকের সময়ে বসে দেখতে পারছে না কিংবা বুঝতে পারছে না; কিন্তু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কাছে তা কোনোভাবেই অজানা আর অজ্ঞাত নয়। তিনি সময়ের স্রষ্টা আর তিনি জানেন, বান্দার জন্য ভবিষ্যতে কী অপেক্ষা করছে। যেহেতু তিনি তা জানেন, তাই অনুগ্রহ করে বান্দাকে বাঁচানোর জন্য তিনি যদি বান্দার জীবনের গল্পটাকে অন্যভাবে পাল্টে দেন, যদি আপাতদৃষ্টিতে ‘ঠিকঠাক বয়ে চলা জীবনের স্রোতকে তিনি অন্য খাতে, অন্যদিকে বইয়ে দেন, তাহলে হতাশ হয়ে পড়ার কোনো কারণ নেই। সম্মুখে থাকা সম্ভাব্য সকল ক্ষতি আর অকল্যাণ আল্লাহ-ই দেখতে পান শুধু, আমরা পাই না। তাই সেই অকল্যাণের হাত থেকে আমাদের উদ্ধারের নিমিত্তে যখনই তিনি আমাদের জীবনে বিচ্ছেদ ঘটাবেন, বিরহ যন্ত্রণায় আমাদের নিপতিত করবেন, যখন প্রিয় সাথির সাথে আমাদের সম্পর্কচ্ছেদ হবে, যখন প্রিয় মানুষ আমাদের জীবন থেকে চলে যাবে, তখন ভেঙে পড়া চলবে না। আমাদের জীবনের অপূর্ণ গল্পটাকে পুরা করবার ভার আল্লাহর ওপরই ন্যস্ত করতে হবে। আর আল্লাহ কখনোই তার অনুগত বান্দার জন্য অকল্যাণ চান না।

দুই.

সুরা কাহফে আমরা খিযির আলাইহিস সালামের সাথে মুসা আলাইহিস সালামের সাক্ষাতের যে বিবরণ দেখতে পাই, তাতে বিস্ময়কর একটা ঘটনা আছে। মুসা আলাইহিস সালাম এই মর্মে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন যে, খিযির আলাইহিস সালামের সমস্ত কর্মকাণ্ড তিনি ধৈর্য ধরে অবলোকন করবেন ও শিখবেন।

খিযির আলাইহিস সালাম মুসা আলাইহিস সালামকে নিয়ে একটা নৌকায় চড়লেন। নৌকা থেকে নামার আগে ওই নৌকায় তিনি একটা ফুটো করে দেন। এটা দেখে বিস্মিত হয়ে পড়েন মুসা আলাইহিস সালাম। বললেন, ‘আপনি এই কাজ কেন করলেন? এটা তো ঠিক করলেন না।’

খিযির আলাইহিস সালাম বললেন, ‘কথা ছিলো আপনি আমার সমস্ত কাজ ধৈর্য ধরে দেখবেন। আমি না বলা পর্যন্ত কিছু বলতে পারবেন না।’

নিজের প্রতিজ্ঞার কথা ভেবে লজ্জিত হন মুসা আলাইহিস সালাম এবং তিনি খিযির আলাইহিস সালামের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করেন।

এরপর লোকালয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা বালক তাদের সামনে এসে পড়ে। খিযির আলাইহিস সালাম এবার করে বসেন আরো আশ্চর্যজনক কাজ! মুসা আলাইহিস সালামের সামনেই তিনি বালকটিকে হত্যা করে ফেলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় ঘাবড়ে যান মুসা আলাইহিস সালাম! তিনি অধৈর্য হয়ে বলেন, ‘হায়! হায়! এটা আপনি কী করলেন? এই নিরীহ শিশুটাকে আপনি মেরে ফেললেন? এটা কি আপনি ঠিক কাজ করলেন?

খিযির আলাইহিস সালাম বললেন, ‘আপনি কিন্তু আবারও ধৈর্যহারা হয়ে পড়েছেন।’

পুনরায় লজ্জিত ও অনুতপ্ত হলেন মুসা আলাইহিস সালাম।

এরপর চলতে চলতে তারা একটা বাড়ির কাছে এসে ওই বাড়ির লোকেদের কাছে কিছু খাবার চাইলেন; কিন্তু বাড়ির লোকেরা তাদেরকে কিছু খেতে দিলো না। ওই বাড়ির পাশে একটা ভগ্নপ্রায় দেওয়াল ছিলো, যা অতি-দ্রুতই ভেঙে পড়বে। খিযির আলাইহিস সালাম ওই দেওয়াল নিজ হাতে মেরামত করে দিয়ে রওনা করলেন নিজের পথে। এবারও অবাক হলেন মুসা আলাইহিস সালাম! ভাবলেন, ‘আরে! এরা তো আমাদের কিছু খেতেও দিলো না, তথাপি ইনি তাদের দেওয়ালটা মেরামত করে দিলেন কেন? আচ্ছা, তা নাহয় দিলেন, কিন্তু এর বিনিময়ে তো কিছু পারিশ্রমিক তিনি চাইতে পারতেন তাদের কাছে, যা দিয়ে আমরা কিছু কিনে খেতে পারতাম?’

মুসা আলাইহিস সালাম বললেন, আপনি তো চাইলে এই কাজের বিনিময়ে পারিশ্রমিক নিতে পারতেন।

এবার খিযির আলাইহিস সালাম বললেন, আপনার সাথে আমার যাত্রা এখানেই সমাপ্ত। ধৈর্য ধরে রাখার শর্তারোপ থাকা সত্ত্বেও আপনি বারে বারে ধৈর্যহারা হয়ে পড়েছেন; তবে যে তিনটি ঘটনা আপনি দেখেছেন, তার ব্যাখ্যা আমি আপনাকে বলবো।

আপনি দেখেছেন, একটা নৌকায় আমি ফুটো করে দিয়েছিলাম। তা এজন্যই যে সমুদ্রে, কিছুটা দূরেই এক রাজা জেলেদের যা নৌকা পাচ্ছে, সব অন্যায়ভাবে জব্দ করে নিচ্ছে। আমরা যে গরিব মাঝির নৌকায় চড়েছি, ফুটো করে দেওয়ার ফলে তা বেশিদূর এগোতে পারবে না। যেভাবেই হোক–সে নৌকাটাকে কূলে ভিড়াবে। ফলে ওই লোভী রাজার হাতে জব্দ হওয়া থেকে বেঁচে যাবে দরিদ্র মাঝির নৌকাটা।

দ্বিতীয়বার আপনি দেখেছেন, আমি একটা বালককে হত্যা করেছি। তা এজন্যই যে–ওই বালক বড় হলে আল্লাহর অবাধ্য ও সীমালঙ্ঘনকারী হয়ে যেতো, কিন্তু তার বাবা-মা আল্লাহর খুবই একনিষ্ঠ বান্দা। ওই সন্তানের কারণে তার পিতা-মাতাকে ভবিষ্যতে অনেক যন্ত্রণা ভোগ করতে হতো। ফলে আমি ওই বালককে হত্যা করি এবং আমি এ-ও আশা করি, তার বিনিময়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাদের নেককার সন্তানাদি দান করবেন।

তৃতীয় এবং সর্বশেষ যে ঘটনাটা আপনি দেখেছেন, তা হচ্ছে–আমি কিছু অকৃতজ্ঞ মানুষদের ভগ্নপ্রায় দেওয়াল বিনা পারিশ্রমিকে মেরামত করে দিয়েছি। তা এজন্যই–ওই দেওয়ালটা ছিলো শহরের দুই ইয়াতিম শিশুর। দেওয়ালের নিচে তাদের বাবার রেখে যাওয়া কিছু লুকানো সম্পদ আছে। দেওয়ালটা যদি এখনই সম্পূর্ণরূপে ভেঙে যায়, তাহলে গুপ্ত সম্পদগুলো প্রকাশ্যে চলে আসবে এবং ওই

অন্য লোকেরা তা আত্মসাৎ করে ছাড়বে। ছোটো শিশু দুটোর তাতে কিছুই করার থাকবে না তখন। যেহেতু আমি দেওয়ালটা মেরামত করে দিয়েছি, শিশুগুলো বড় হওয়ার আগে সেটা ভেঙে পড়ার কোনো সম্ভাবনা অবশিষ্ট নেই। আর তারা বড় হওয়ার পরে যখন সেটা ভাঙবে, তত দিনে নিজেদের সম্পদ বুঝে নেওয়ার বয়স। তাদের হয়ে যাবে।[1]

এই ঘটনা তিনটাতে আমরা দেখতে পাই–খিযির আলাইহিস সালামের সাথে ধৈর্য ধরে রাখার শর্তে আবদ্ধ থাকার পরও মুসা আলাইহিস সালাম বারংবার নিজের ওয়াদা থেকে বিচ্যুত হচ্ছিলেন। এর কারণ হলো–মুসা আলাইহিস সালাম তাকদির সম্পর্কে জ্ঞাত নন। আল্লাহ তাকে সেই জ্ঞান প্রদান করেননি, যা তিনি খিযির আলাইহিস সালামকে দিয়েছিলেন। ফলে একই বিষয়ে মুসা আলাইহিস সালাম বিচলিত, বিমূঢ় ও বিভ্রান্ত হলেও খিযির আলাইহিস সালাম ছিলেন শান্ত ও স্থির।

খিযির আলাইহিস সালাম আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানে জানতে পেরেছিলেন এক অসাধু রাজার ব্যাপারে, যে দরিদ্র মাঝিদের নৌকা জব্দ করছে। এক মাঝিকে সেই অসাধু রাজার অন্যায় কাজ থেকে বাঁচাতে তিনি মাঝির নৌকায় ফুটো করে দেন যাতে নৌকাটা আর বেশিদূর না এগোতে পারে। নৌকার মাঝির কাছে এবং মুসা। আলাইহিস সালামের চোখে খিযির আলাইহিস সালামের এই কাজ ভারি অন্যায়ের। এই কাজের ভবিষ্যৎ ফলাফল জানতেন না বলেই তারা এমনভাবে বিচলিত হয়ে পড়েছেন, কিন্তু তাকদির তথা আল্লাহর কৌশল ভিন্ন। তিনি আপাত ক্ষুদ্র ক্ষতি দিয়ে ওই দরিদ্র মাঝিটাকে বৃহৎ ক্ষতির রাস্তা থেকে বাঁচিয়ে দিলেন।

একইভাবে ওই বালক হত্যার মাধ্যমে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তার বাবা-মাকে ভবিষ্যৎ বিপদ থেকে বাঁচিয়েছেন। খাবার চেয়ে তিরস্কৃত হওয়ার পরেও ভগ্নপ্রায় দেওয়াল বিনা পারিশ্রমিকে মেরামত করিয়ে দিয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা দুই ইয়াতিম শিশুর সম্পদকে সুরক্ষিত করে রাখলেন।

এসব-ই আল্লাহর পরিকল্পনার অংশ। ভূত ও ভবিষ্যৎ কেবল আল্লাহই জানেন, আমরা জানি না। আর জানি না বলেই আমরা খুব সহজেই বিচলিত হয়ে পড়ি। আপাত ক্ষতিতে, আপাত বিচ্ছেদে, আপাত বিরহে আমরা ভেঙে খান খান হয়ে যাই।

যদি আমি আল্লাহর কাছে সৎ থাকি, যদি আমি এই ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী হতে পারি যে, কোনো অন্যায় আমি করিনি; তাহলে আমার কোনোভাবেই উচিত নয় তাকদিরের ফয়সালার ওপর অসন্তুষ্ট হওয়া। কোনোভাবেই আল্লাহর পরিকল্পনাকে। দোষারোপ করা আমার কাজ হতে পারে না।

ডিভোর্সের বেলায়, যদি আপনি সৎ থাকেন আপনার সঙ্গীর ব্যাপারে, তার অধিকারের ব্যাপারে যদি আপনার দিক থেকে কোনো অন্যায় না হয়ে থাকে, আপনার সততা, ভালোবাসা, মায়া এবং যাবতীয় আত্মিক সম্পর্কের নিয়ামকগুলো বহাল থাকা সত্ত্বেও যদি আপনার সংসার ভেঙে যায়, যদি আপনার জীবনসঙ্গী আপনাকে অপছন্দ করে ছেড়ে চলে যেতে চায়–তাহলে তাকে যেতে দিন। আল্লাহ হয়তো-বা আপনার জন্য ভিন্ন কোনো পরিকল্পনা এঁকেছেন, যা আপনি এই মুহূর্তে বসে দেখতে পাচ্ছেন না। হয়তো আরো যোগ্য কেউ, আরো ভালো, আরো চক্ষু শীতলকারী কোনো জীবনসাথি আপনার জন্য তিনি নির্ধারণ করেছেন, যার কাছে যেতে হলে আপনাকে এই সম্পর্ক থেকে বেরোতে হবে। তিনি আপনাকে একটা জঞ্জাল থেকে মুক্ত করে, একটা নির্মল পরিবেশ দিতে চান। সেই নির্মল, নির্ঞ্ঝাট পরিবেশে যেতে আপনাকে একটা দুঃখের নদী পার হতে হবে। এই বিচ্ছেদ-ব্যথা হলো সেই দুঃখের নদী। সেটা পার হন, তবে আল্লাহর ওপর সম্পূর্ণ কৃতজ্ঞচিত্তে।

সেই মাঝি জানতো না, তার জন্য কী অপেক্ষা করে ছিলো সমুদ্রে; সেই বালকের বাবা-মা জানতো না, ভবিষ্যতে কোন দুর্ভোগ তাদের জন্য ওত পেতে আছে; সেই ইয়াতিম শিশুগুলো জানতো না, তাদের জন্য কী সম্পদ লুকায়িত আছে দেয়ালের নিচে। কেউ-ই কিছু জানতো না। না জানার কারণে বিচলিত হয়ে পড়াটা মানুষের বৈশিষ্ট্য; তবে এমন দুঃখের দিনে, এমন দুর্ভোগ আর দুর্দিনে যদি আল্লাহর পরিকল্পনাকে ভালোবেসে ফেলা যায়, নিজেকে সেই পরিকল্পনার অংশ মনে করা যায়, তাহলে অন্তর থেকে বিদেয় দেওয়া যায় যাবতীয় দুঃশ্চিন্তা আর দুর্ভাবনাগুলোকে।

তিন.

জীবনে যা কিছু ঘটে, তার পেছনে আল্লাহর একটা পরিকল্পনা থাকে। কোনো মুমিন বান্দার জীবনে যখন কোনো দুর্যোগ নেমে আসে, যখন কোনো বিপদ এসে লন্ডভন্ড করে দিয়ে যায় তার জীবনের সাজানো উঠোন, তখন হতবিহ্বল না হয়ে সেই

পরিকল্পনায় নিজেকে সঁপে দেওয়ার মাঝেই প্রভূত কল্যাণ নিহিত।

ইবরাহিম আলাইহিস সালাম যখন শিশু ইসমাইল আলাইহিস সালামসহ হাজেরা আলাইহাস সালামকে জনমানবহীন মক্কার রুক্ষ এক উপত্যকায় রেখে যান, সেই দৃশ্যের কথা ভাবলে মনে হয়, একজন নারীর জীবনে এর চাইতে বেদনাবিধুর মুহূর্ত আর থাকতেই পারে না। এমন নির্জন সে প্রান্তরদৃষ্টিসীমার মধ্যে কোনো মানবকুলের আভাস পর্যন্ত পাওয়া যায় না। খাবারের বন্দোবস্ত নেই, পানির বন্দোবস্ত নেই। এমনকি একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই পর্যন্ত ছিলো না সেখানে। হাজেরা আলাইহাস সালামের জন্য তার ওপর আরো কঠিন বিয়োগ-ব্যথা ছিলো–ইবরাহিম আলাইহিস সালামের কাছ থেকে দূরে থাকা। এই যে এত আসন্ন বিরহ ও বিপদ, সম্মুখে এত রুক্ষ-কঠিন দিনের চোখ রাঙানি–সমস্তকিছু জেনেও সেদিন হাজেরা আলাইহাস সালাম কান্নায়, দুঃখে, রাগে ফেটে পড়েননি। ভীষণ হতাশায় আর্ত-চিৎকার করে তিনি জানতে চাননি, ‘কেন আমার সাথেই এমন হচ্ছে? কী দোষ আমি করেছি? বরং তিনি ইবরাহিম আলাইহিস সালামের কাছে জানতে চাইলেন, আপনি যা করতে যাচ্ছেন, তা কি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার নির্দেশ?’

ইবরাহিম আলাইহিস সালাম বললেন, হ্যাঁ।

হাজেরা আলাইহাস সালাম তখন বলে উঠলেন, ‘নিশ্চয় আমার রব আমাকে তার দয়া থেকে বঞ্চিত করবেন না।’[2]

কোলের শিশুকে নিয়ে হাজেরা আলাইহাস সালাম সেই একাকী রুক্ষ নির্জন প্রান্তরে থাকতে রাজি হয়ে গেলেন শুধু এইটুকু আশ্বাস পেয়ে, এই কাজের নির্দেশ ইবরাহিম আলাইহিস সালাম আল্লাহর কাছ থেকেই পেয়েছেন। এমন ভাগ্যকে বরণ করে। নিতে আর কোনো আশ্বাসবাণী, আর কোনো সান্ত্বনাবাক্য হাজেরা আলাইহাস সালামের দরকার পড়েনি। কারণ তিনি জানতেন, আল্লাহর কোনো এক পরিকল্পনার মধ্যে তিনি যুক্ত হতে চলেছেন এবং সেই পরিকল্পনায় তার জন্য এমনকিছু অপেক্ষা করে আছে, যা কল্পনার চেয়েও সুন্দর, স্বপ্নের চাইতেও অবিশ্বাস্য! যেহেতু এই পরিকল্পনাকারী স্বয়ং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা-ই, তাই এই পরিকল্পনায়। অখুশি হওয়ার, অতৃপ্তি মনে পুষে রাখার এবং এই পরিকল্পনায় অসম্মতি জ্ঞাপনের কোনো প্রশ্নই থাকতে পারে না।

হাজেরা আলাইহাস সালামের বিশ্বাস অমূলক ছিলো না। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার এক মহা-পরিকল্পনার মধ্যে তিনি যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন সেদিন। হাজেরা আলাইহাস সালামের সেদিনকার সেই কষ্টের দিনগুলোর বিনিময়ে, সেই রুক্ষ-কঠিন একাকী নির্জন প্রান্তরের নিঃসঙ্গ মুহূর্তগুলোর বদৌলতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাকে মুসলিম উম্মাহর মাঝে এমনভাবে স্মরণীয় করে রাখলেন যে, কিয়ামত অবধি যতজন মুসলিম হজ আর উমরা সম্পন্ন করবে, তাদেরকে অতি-অবশ্যই হাজেরা আলাইহাস সালামের স্মৃতিকে স্মরণ করতে হবে। তার স্মৃতি স্মরণ করে সাফা-মারওয়ায় দোঁড়াতে হবে। আর ইসমাইল আলাইহিস সালামের স্মৃতিবিজড়িত যমযম কূপ তো ইতিহাস-ই হয়ে থাকলো!

এটাই হলো সেই প্রাপ্তি, যা আল্লাহর পরিকল্পনায় ভরসা রাখলে পাওয়া যায়। তিনি হয়তো মাঝে মাঝে আমাদের কষ্টে রাখেন, হয়তো-বা মাঝে মাঝে আমাদেরকে তিনি কোনো বিয়োগ-ব্যথা, কোনো বিচ্ছেদ-যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে নিয়ে যান। কোনো আর্থিক-শারীরিক ক্ষতি হয়তো-বা আমাদের হয়ে থাকে, কিন্তু যখনই আমাদের ভরসার পারদ হাজেরা আলাইহাস সালামের স্তরে উন্নীত হবে, যখনই মন থেকে এই বিশ্বাসের সুর প্রতিধ্বনিত হবে যে, নিশ্চয় আমার রব আমাকে তার দয়া থেকে বঞ্চিত করবেন না, তখনই আমাদের জন্য খুলে যাবে আসমানের দরোজা। আমাদের ধৈর্যের, আমাদের ত্যাগের, আমাদের সকল দুঃখ আর কষ্টের বিনিময়ে তখন এমন প্রাপ্তির বন্দোবস্ত করা হবে, যা স্বপ্নেরও অতীত!

শিশু মুসা আলাইহিস সালামকে হত্যার জন্য যখন ফিরআউন বাহিনী পাগলপারা, তখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাকে বাকসো-বন্দি করে নদীতে নিক্ষেপ করার জন্য তার মাকে নির্দেশ দিলেন। একজন মায়ের কাছে কোলের শিশুকে নদীতে নিক্ষেপ করবার মতন কঠিন কাজ দুনিয়ায় আর কী হতে পারে? ভয়, শঙ্কা আর বিহ্বলতায় অস্থির হয়ে যাওয়া মুসা আলাইহিস সালামের মা যখন আল্লাহর আশ্বাসবাণী পেলেন, যখন শুনলেন, তার কোলের মানিককে তার-ই কাছে পুনরায় ফিরিয়ে দেওয়া হবে, তখনই তার হৃদয়ের সমস্ত ভয়, সমস্ত দ্বিধা কেটে যায়। আল্লাহর কোনো এক পরিকল্পনার অংশ যে তার শিশুপুত্র হতে যাচ্ছে–তা তিনি বুঝে যান সাথে সাথেই। ফলে সেই পরিকল্পনা থেকে ছিটকে না গিয়ে বরং বিপুল আগ্রহে তিনি তাতে জড়িয়ে গেলেন।

তার পরের ঘটনাও আমাদের জানা। মুসা আলাইহিস সালাম বিপুল-বিক্রমে তার মায়ের কাছে ফিরেছিলেন। তার কাছে পদানত হয়েছিলো দোর্দণ্ড প্রতাপের ফিরআউন বাহিনী। সেদিন মায়ের কাছে শুধু সন্তানকেই ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি; বরং তাকে একজন প্রসিদ্ধ নবির মর্যাদা দান করা হয়েছে।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আমাদের জীবনকে নিয়ে যে ছক আঁকেন, তাতে পরিপূর্ণ বিশ্বাস এনে, তা থেকে কল্যাণ এবং দয়া কামনা করে নিজের চেষ্টাটুকু যদি করে যাওয়া যায়–যেভাবে হাজেরা আলাইহাস সালাম করে গিয়েছিলেন মক্কার একাকী নির্জন প্রান্তরে শিশু ইসমাইল আলাইহিস সালামকে নিয়ে, যেভাবে মুসা আলাইহিস সালামের মাতা করেছিলেন ফিরআউন বাহিনীর বিপরীতে–তাহলে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, জীবনের কোনো এক পর্যায়ে সেই চেষ্টার, সেই ত্যাগের, সেই ধৈর্যের ফল আমরা অবশ্যই পাব। দুনিয়াতে অথবা অনন্ত আখিরাতে।

চার.

নবি ইউসুফ আলাইহিস সালামকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা মিশরের মন্ত্রীর পদে আসীন করেছেন; কিন্তু দেখুন–মর্যাদার এই স্তরে উন্নীত করতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ইউসুফ আলাইহিস সালামকে কত তীব্র পরীক্ষার মুখোমুখি করেছিলেন। ছোটোবেলায় ভাইদের দ্বারা অন্ধকারকূপে নিক্ষিপ্ত হওয়া, বণিকদলের দ্বারা অন্যত্র ক্রীতদাস হিশেবে বিক্রি হয়ে যাওয়া, বাদশাহর স্ত্রীর অশালীন প্রলোভন এবং সর্বোপরি জেল! কী এক তীব্র সংকট আর সংগ্রামের মধ্য দিয়েই না কেটেছে নবি ইউসুফ আলাইহিস সালামের সেই দিনগুলো!

কিন্তু দৃশ্যপটের শেষটা কেমন ছিলো?

আমরা জানি–ইউসুফ আলাইহিস সালাম জীবনের একটা পর্যায়ে এসে সেই সবকিছু পুনরায় ফিরে পেয়েছেন, যা তিনি একদিন হারিয়েছিলেন–তার দয়াময় বাবা, ভাই ও পরিবার। মিশরে একদিন অসহায় ক্রীতদাস হিশেবে যে বালক প্রবেশ করেছিলো, নির্দিষ্ট সময়ের পর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাকে আসীন করে দিলেন সেখানকার অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ পদে! তাকে নবুওয়াত দান করলেন এবং পৃথিবীতে অধিষ্ঠিত করলেন একজন সম্মানিত নবি হিশেবে! কী অসাধারণ প্রাপ্তি ছিলো সেগুলো!

মুসা আলাইহিস সালামের জন্য যিনি দরিয়ায় পথ তৈরি করে দিয়েছিলেন, একদিন তিনিই কিন্তু আদেশ করেছিলেন তাকে দরিয়ায় নিক্ষেপ করার।

নবি ইউনুস আলাইহিস সালামের মাছের পেটের ভেতর থেকে বেঁচে আসাটা আমাদের পুলকিত করে, কিন্তু সেই পুলকের পেছনের কার্যকারণ কতখানি ভীতি-জাগানিয়া তা কি ভেবেছি কখনো?

গভীর সমুদ্রতলে, সেই বিশালকায় মাছের পেটে, যেখানে দুনিয়ার কোনো শব্দ, কোনো আওয়াজ পৌঁছে না, যেখানে বিস্তৃত জায়গাজুড়ে কেবল অন্ধকার আর অন্ধকার–এমন পরিস্থিতিতে আরশের অধিপতি নবি ইউনুস আলাইহিস সালামের জন্য যথেষ্ট হয়ে গেলেন।

তিনি যথেষ্ট হলেন ঠিকই, তবে নবি ইউনুস আলাইহিস সালামকে কঠিন একটা পরীক্ষার মুখোমুখি করার পরে।

আপনি হয়তো কোনো একটা সংগ্রামের ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন। হতে পারে সেই সংগ্রাম ভীষণ দুঃসহ! আপনি হয়তো প্রিয় কোনো মানুষকে জীবন থেকে হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণায় দন্ধ। কোনো অপ্রিয় বিচ্ছেদ-ব্যথায় হয়তো আপনি ভীষণ নাজেহাল। অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো সমস্যা হয়তো আপনাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। হতে পারে জীবন আপনার ছক অনুযায়ী চলছেই না।

জীবনের এইসব সংগ্রামে আপনি ক্লান্ত হতে পারেন মাঝে মাঝে, তবে হতোদ্যম হবেন না। বিচ্ছেদ-ব্যথায় আপনি কাঁদতেও পারেন, যেভাবে ইউসুফ আলাইহিস সালামকে হারিয়ে কাঁদতে কাঁদতে চোখের জ্যোতি হারিয়েছিলেন ইয়াকুব আলাইহিস সালাম। কাঁদুন, অশ্রু ঝরান, ব্যাকুল হোন; কিন্তু কখনোই আল্লাহকে অভিযুক্ত করবেন না। ধৈর্য রাখুন। আপনার জীবনের যে অংশটা এখনো বাকি, যে অংশে আপনার জন্য কী অপেক্ষা করে আছে, তা আপনি জানেন না–তার জন্য আল্লাহকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন না।

মাছের পেটে বিলীন হয়ে ইউনুস আলাইহিস সালাম আল্লাহকে অভিযুক্ত করেননি। শিশু মুসা আলাইহিস সালামকে দরিয়ায় নিক্ষেপ করে তার মা অভিযোগের তির ছুঁড়ে দেননি আল্লাহর দিকে। প্রিয়তম পুত্র ইউসুফকে হারিয়ে ভীষণ বিচ্ছেদে কাতর হয়ে পড়ার পরেও একটিবারের জন্য আল্লাহর ওপর থেকে ভরসা হারাননি নবি ইয়াকুব আলাইহিস সালাম। তিনি এত কেঁদেছিলেন যে, তার চোখের জ্যোতি পর্যন্ত চলে গিয়েছিলো; কিন্তু অন্তরের গভীরে তার ছিলো আল্লাহর ওপর টইটম্বুর তাওয়াক্কুল। তিনি জানতেন–আল্লাহ নিশ্চয় একটা সুন্দর পরিণতির দিকে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন।

জীবনের সাময়িক চিত্রনাট্যে বিলীন হয়ে যাবেন না। যে সুতোয় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আপনার জীবনকে বাঁধতে চান, তাকে ধৈর্যের সাথে আলিঙ্গন করুন। বিশ্বাস করুন, রাত পোহালে একটা সুন্দর সকাল আপনার জীবনটাকেও রাঙিয়ে যাবে।

———-
[1] সুরা কাহফ, আয়াত : ৭০-৮২

[2] সহিহুল বুখারি : ৩৩৬৪; তাফসিরুত তাবারি, খণ্ড : ১৭; পৃষ্ঠা : ১৯; আস-সুনানুল কুবরা, বাইহাকি, খণ্ড : ১০; পৃষ্ঠা :১৬; তাফসিরুল বাগাভি, খণ্ড : ৪; পৃষ্ঠা : ৩৫৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *