ছারপোকার মার

ছারপোকার মার

ছারপোকা আমি মারি নে। মারতে পারি নে। মারতে মারতে হাত ব্যথা হয়ে যায় কিন্তু মেরে ওদের শেষ করা যায় না।

তাছাড়া, মারলে এমন গন্ধ ছাড়ে। বিচ্ছিরি। শহীদ হয়ে ওরা কীর্তির সৌরভ ছড়ায় এমন আমার কীর্তি আর ওদের সৌরভ যাতে আমাদের উভয় পক্ষকেই ঘায়েল হতে হয়।

প্রাণ দিয়ে ওরা আমাদের নাক মলে দিয়ে যায়। যা নাকি কানমলার চেয়েও খারাপ। এই কারণেই আমি ছারপোকা কখনো মারি নে।

আমার হচ্ছে সহাবস্থান। ছারপোকাদের নিয়ে আমি ঘর করি। আত্মীয়-স্বজনের মতোই একসঙ্গে বাস করি তাদের নিয়ে।

আমার বিছানায় হাজার-হাজার ছারপোকা। লাখ-লাখও হতে পারে। এমন কি কোটি কোটি হলেও আমি কিছু অবাক হব না।

কিন্তু তারা আমায় কিছু বলে না।

আমিও তাদের মারি নে, তারাও আমায় কামড়ায় না। অহিংসানীতির, গান্ধীবাদের উজ্জ্বল আবাদ আমার বিছানায়।

আমি করেছি কি, একটা কম্বল বিছিয়ে দিয়েছি বিছানায়। কম্বলের ঝুল চৌকির আধখানা পায়া অবধি গড়িয়েছে।

চৌকির ফাঁকে-ফোকরে তো ওদের অবস্থান। আমার গায়ে এসে পড়তে হলে তাদের কম্বলের একড়োখেবড়ো পথ ভেঙে আসতে হবে। আসতে হবে পশমের জঙ্গল ভেদ করে।

কিন্তু সেই উপশমের উপর নির্ভর করেও আমি আর একটা কৌশল করেছি। চৌকির চারদিকে কম্বলের ঝুল বরাবর ফিনাইলের এক পোচ লাগিয়ে দিয়েছি। রোজ রাত্রেই শোবার আগে নিপুণ তুলির দক্ষতায় একবার করে লাগাই। তাই দিয়ে কম্বলের তলায় দিকটা কেমন চটচটে হয়ে গেছে। হোকগে, তাতে আমার চটবার কোন কারণ নেই। ফিনাইলের গন্ধ, আমার ধারণা, মানুষের গায়ের চেয়ে জোরালো। সেই গন্ধের আড়ালে আমি গায়েব। আমার গন্ধথ তারা পায় না। চৌকির উপরেই যে আমি তা তারা টের পায় না।

তাদের মধ্যে যারা ভাস্কো-ডি গামা কি কলম্বাস গোছের, তারা হয়তো চৌকির তলায় থেকে বেরোয়–আমার আবিষ্কার উদ্দেশে। কিন্তু ফিনাইলের বেড়া অবধি এসে ঠেকে যায় নির্ঘাত, এগুতে পারে না আর। তাদের নাকে লাগে, তারপর আরও এগুলে পায়ে লাগে, ফিনাইলের কাদায় তাদের পা এঁটে বসে যায়, চলৎশক্তিহীন হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত চটচটে কম্বলের সঙ্গে তাদের চটাচটি হয়ে যায় নিশ্চয়। বিশ্বসংসারের উপর বীতশ্রদ্ধ তিতবিরক্ত হয়ে তারা ঐখানেই জবড়জং হয়ে পড়ে থাকে।

বছরের পর বছর আমার রক্ত না খেয়ে কী করে যে তারা বেঁচে আছে তাই আমার কাছে এক বিস্ময়। সেই রহস্যের আমি কিনারা পাইনি এখনও। যাকে উপোসী ছারপোক বলে, আমার মনে হয়, সেই রকম কিছু একটা হয়ে রয়েছে তারা।

তা থাক, তারা সুখে থাক, বেঁচে থাক। তাদের আমি ভালোবাসি। তারাই আমাকে একবার যা বাঁচিয়ে দিয়েছিল–

সকালে সবে ক্ষুর নিয়ে বসেছি, আমার বন্ধু বদ্যিনাথ হন্তদন্ত হয়ে হাজির।

পালাও পালাও, করছ কী। বলতে বলতে আসে।

পালাব কেন? দাড়ি কামাচ্ছি যে।

আরে হরেকেষ্টদা আসছে। এসে উঠবে এখানে–তোমার বাসায়। সে জানায়, এইখানে আস্তানা গাড়বে।

সস্তা না। দাড়ি কামাতে কামাতে বলি, সস্তা নয় অত।

গতবারে যখন কলকাতায় এসেছিল, উঠেছিল আমার ওখানে। যাবার সময় বলে গেছে আবার এলে তোর বাসাতেই উঠব, আর তোকে যদি বাসায় না পাই তো উঠব গিয়ে শিবুর কাছে….! বলে সে একটু দম নেয়। তারপরে ইঞ্জিনের মতো হাঁফ ছাড়ে একখানা।

আজ সকালে আমার এক টি-টি আই বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গেছলাম শেয়ালদায়। ইস্টিশানের প্লার্টফর্মে, দেখি কিনা, হরেকেষ্টদা ব্যাগ হাতে নামছে ট্রেন থেকে।

বটে?

দেখেই আমি পালিয়ে এসেছি….

যাতে হরেকেষ্টদা বাসায় গিয়ে তোমায় না পায়?

হ্যাঁ। চলে এলাম তোমার কাছেই। দিতে এলাম খরবটা। আমাকে যদি না পায় তো সটান তোমার এখানেই সে….।

আরে আমার এখানে উঠবে কেন সে? আমি তাকে আশ্বস্ত করি, একখানা মাত্র ছোট্ট চৌকি আমার দেখছ তো, এর মধ্যে আমার সঙ্গে তোণ্ঠতি করতে যাবে কেন? তার কিসের অভাব? দুশো বিঘে তার ধানের জমি, দশটা আমবাগান, কাড়ি কাড়ি টাকা–সে কলকাতার যে-কোনো নামকরা ভালো হোটেলে উঠতে পারে।

এক নম্বরের কঞ্জুস। গতবারে আমার মেসে উঠেছিল, গেস্ট চার্জ দিয়ে ফতুর হয়ে গেছি। তিনটি মাস নড়বার নামটি ছিল না। যাবার সময় সর্বস্বান্ত করে গেল আমায়।

কি রকম?

আমার শখের জিনিসগুলি নিয়ে গেল সব। ড্রেসিং টেবিলটা নিল, ডেক চেয়ারটাও, ব্রাকেট, তার ওপরে অ্যালার্ম টাইমপিসটা অবধি। বললে খাসা হবে, এসব জিনিস পাড়াগাঁয়ের লোক চোখে দেখেনি এখনো! শেষটায় আমার টুথব্রাশটা ধরে টানাটানি।

সে কী! একজনের বুরুশ কি আরেকজন ব্যাভার করে নাকি?

বললে, জুতোয় কালি দেওয়া যাবে এই দিয়ে। এমন কি, আলমারিটা ধরেও টানছিল বইপত্র-সমেত! কিন্তু বড্ড ভারী বলে পেরে উঠল না। বলেছে পরের খেপে এসে মুটের সাহায্যে নিয়ে যাবে….

মোটের ওপর আলমারিটা তোমার বেঁচে গেছে। মুটের ওপরে চাপেনি।

আমি পালাই। এখুনি হরেকেষ্টদা ব্যাগ হাতে এসে পড়বে হয়তো। সে ব্যগ্র হয়ে ওঠে।

বাড়ি যাবে এক্ষুনি? বোসো, চা খাও।

বাড়ি? আজ সারাদিন নয়। খুব গভীর রাত্রে ফিরব বাসায়। আমি ভাই এখন যাই।

হরেকেষ্টদার ভয়ে বাসাতেই ফিরবে না আজ? সারাদিন থাকবে কোথায় শুনি? আমি জিজ্ঞেস করি।

হরেকেষ্ট হরেকেষ্ট কেষ্ট কেষ্ট হরে হরে–করে ঘুরে বেড়াব রাস্তায় বাস্তায়। বলে সে আর দাঁড়ায় না।

দাড়ি কামিয়ে মুখ না–ধুতে হরেকেষ্টদা হাজির।

আসুন আসুন হরেকেষ্টদা! আস্তাজ্ঞে হোক! আমি অভ্যর্থনা করি, আমার কী ভাগ্যি যে আজ আপনার পায়ের ধুলো পড়ল।

বদ্যিনাথকে বাসায় পেলাম না, তাই তোর কাছেই চলে এলাম। ব্যাগ নামিয়ে তিনি বললেন।

আসবেন বইকি! হাজারবার আসবেন। আপনি হলেন হরেকেষ্টদা। আমাদের গায়ের মাথা। আমরা কি আপনার পর?

তা নয়। তবে বদ্যিনাথ ছেলেটি ভালো। তার ওখানেই উঠি। আমাকে পেলে সে ভারী খুশি হয়।

আমিই কি অখুশি? বসুন, চা খান। চা আনাই, জিলিপি শিঙারা কচুরি–কি খাবেন বলুন?

যা হচ্ছে আন। চা-টা খেয়ে চান করে দুটি ভাত খেয়ে বেরুব একটু। কলকাতায় এসেছি, এবার তোর এখানেই থাকব ভাবছি। বদ্যিনাথকে পেলুম না যখন….

তা, থাকুন না যদ্দিন খুশি। দাঁড়ান,–আনাই, পোর্টম্যানটো খুলে পয়সা যার করি। ওমা, কী, বাকসর চাবি কোথায়? খুঁজে পাচ্ছি না তো। চাবিটা কোথায়! ভাঙতে হবে দেখছি বাকসটা! চাবিওয়ালা কোথায় পাই এখন? ভাবতে হবে দেখছি।

না, না, ভাঙবি কেন বাকসটা? দুবেলা চাবিওয়ালা হেঁকে যায় রাস্তায়। চাবি করিয়ে নিলেই হবে। বে পোর্টম্যানটোটি! ভাঙবি কেন? আমায় দিয়ে দিস বরং। দেশে নিয়ে যাব! শুনে আমি হাঁ হয়ে যাই নিজের চাবি নিজেই চাবি নিজেই সারিয়ে ভাল করলাম কিনা খতিয়ে দেখি।

এখন টাকার দরকার তোর বল না? দিচ্ছি না-হয়!

গোটা পাঁচেক দাও তাহলে।

পাঁচ টাকা! ব্যাগ খুলে তিনি বলেন, পার্ট টাকা তো নেই রে দশ টাকার নোট আছে।

তাই দাও তাহলে। পরে বাক্স খুলে দেব ধন তোমায়।

হরেকেষ্টদার পয়সায় চা কচুরি শিঙাড়া জিলিপি জিবেগজা রাজভোগ দরবেশ বসানো যায় বেশ মজা করে।

দুপুরের আহার সেরে হরেকেষ্টদা বললেন, যাই, এবার একটু বদ্যিনাথের বাসা থেকে ঘুরে আসি। সে আমাকে একটা আলমারি দেবে বলেছিল। আধুনিক ডিজাইনের আলামারিটা! দেখতে খাসা। তার ওপরে রবিঠাকুরের বই ঠাসা। আমাকে উপহার দিতে চেয়েছিল বদ্যিনাথ। মুটের মাথায় চাপিয়ে নিয়ে আসি গে।

সেই যে বেরিয়ে গেলেন হরেকেষ্টদা, ফিরবেন সেই রাত দশটায়।

হায় হায় করতে করতে এলেন কোথায় গেছে বদ্যিনাথটা সরাদিন দেখা নেই। বাসায় লোক বলল সকালে বেরিয়েছে, কিন্তু এই রাত সাড়ে দশটা অপেক্ষা করে…করে….করে…

এতক্ষণ বদ্যিনাথের বাসাতেই ছিলেন তাহলে?

না, বাসায় থাকব কোথায়? ওর ঘরে তো চাবি বন্ধ। কার ঘরে থাকতে দেবে? বাসার সামনের একটা চায়ের দোকানে বসে বসে এতক্ষণ কাটালাম।

সেই দুপুরবেলার থেকে এতক্ষণ!

শুধু শুধু কি বসতে দেয়? বসে বসে চা খেতে হল। তিনশো কাপ চা খেয়েছি। এনতার খেলাম। খান পঞ্চাশেক টোস্ট। আড়াই ডজন আমলেট। সব বদ্যিনাথের অ্যাকাউন্টে। খেয়েছি আর নজর রেখেছি বাসার দরজার, কখন সে ফেরে। কিন্তু নাঃ, এতক্ষণেও ফিরল না।…

তাহলে আর কী করবেন। খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ুন এবার।

না কিছু খাব না। যা খেয়েছি তাতেই অম্বল হয়ে গেছে। তিনশো কাপ চা বাপ জীবনে কখনো খাইনি।….না, কিছু আর খাব না। শুয়ে পড়ব সটান। মেজেয় আমার বিছানা করে দে। আছে তোর বাড়তি বিছানা? আমি তো বেডিং-ফেডিং কিছু আনিনি। বদ্যিনাথের বাসায় উঠব ঠিক ছিল। এই মেজেয়…এইভেনেয়…মাদুর-টাদুর যা হোক কিছু পেতে দে না হয়।

তুমি মেজেয় শোবে? তুমি বলছ কী হরেকেষ্টদা? অমন কথা মুখে এনো না, পাপ হবে আমার। তুমি আমার চৌকিতেই শোবে। আমি ঐ কম্বলটা বিছিয়ে সোবখন মেজেয়….

বলে আমি ফিলাইল-লাঞ্ছিত কম্বলট বিছানার থেকে তুলে নিয়ে মাটিতে বিছোই। আর চৌকিতে তোশকের ওপর ধবধবে চারদ পেড়ে হরেকেষ্টদার জন্যে পরিপাটি বিছানা করে দিই।

হরেকেষ্টদা শুয়ে পড়েন। আমিও আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ি। শুতে না–শুতে হরেকেষ্টদা নাক ডাকতে থাকে। রাত বোধ হয় বারোটা হবে তখন, দারুণ একটা চটপটে আওয়াজে আমার ঘুমস ভেঙে যায়।

কী ব্যাপার? হরেকেষ্টদা নাক আর ডাকছে না! খালি মাঝে মাঝে চটাস টচ চটাচট চটাপট চটাপট চটাপট….শুনতে পাচ্ছি কেবল।

ওরে, ওরে শিবু! আলোটা জ্বাল তো!

আলো জ্বালা যাবে না হরেকেষ্টদা। এগারটার পর মেন পর সুইচ অফ করে দেয়।

কি কামড়াচ্ছে রে? ভয়ঙ্কর কামড়াচ্ছে। দেশলাই আছে তোর?

দেশলাই কোথায় পাব দাদা? আমি কি সিগ্রেট খাই?

তাহলে মোমবাতি?

বাজারে।

কী সর্বনাশ! টর্চ আছে? টর্চ?

রাতে দুপুরে কেন এই টর্চার করছেন হরেকেষ্টদা? চুপচাপ ঘুমোন!

ঘুমোব কী রে? জ্বালিয়ে যাচ্ছে যে! বাঁ পাশটা যে জ্বলে গেল রে-বাঁ–পাশে ছুঁয়েছিলাম…পা থেকে ঘাড় পর্যন্ত জ্বলছে।

পাশ ফিরে শোন।

পাশ ফিরে শোব কী রে? শুতে কী দিচ্ছে? উঠে বসেছি। বসতেও দিচ্ছে না। ভীষণ কামড়াছে রে?

কে জানে! আমি নিস্পৃহ কণ্ঠে বলি? কি আবার কামড়াবে?

এ তো দেখছি খুন করে ফেলবে আমায়। একদম তিষ্ঠোতে দিচ্ছে না। কী পুষেছিস তুই জানিস। ছারপোকা নয় তো রে?।

ছারপোকা? অসম্ভব। আমি অ্যাদ্দিন ধরে শুচ্ছি, আমি কি তাহলে আর টের পেতুম না

তুই একটা কুম্ভকর্ণ। নাঃ, বিছানায় কাজ নেই আমার। আমি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই।

তিনি বিছানা ছেড়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন। সারা রাত দাঁড়িয়ে থাকলেন ঠায়।

সকালে আমরা উঠে দেখি আমি উঠে দেখলাম, তিনি তো আগের থেকেই উঠেছিল। তিনি শুধু দেখলেন কেবল চৌকির ওপর হাজার হাজার মৃতদেহ। ছারপোকার হয়ে যাব চাপে আর চটাপট চাপড়ে ছারপোকাদের ধ্বংসাবশেষ।

ইস, তুই এখানে থাকিস কি করে রে? এই বিছানায় ঘুমোস কি করে তুই একটা রাসকেল। রাবিশ–কুম্ভকর্ণ। নাঃ, আর আমি এখানে নেই। মা কালির দিব্বি আর কখনো এখানে আসছি না বাবা! আমার নাকে খত। বদ্যিনাথের বাসাতেই আমি থাকব। সেখানেই চললাম। সকাল সকাল গিয়ে পাকড়াই তাকে। বলেই তিনি আর দাঁড়ালেন না। ব্যাগহাতে বেরিয়ে পড়লেন, তার ধার দেওয়া দশ টাকার উদ্ধারের বেমালুম ভুলে গিয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *