ঋণং কৃত্বা

ঋণং কৃত্বা

কারো ধার ধারি না, এমন কথা আর যেই বলুক আমি কখনই বলতে পারি না। আমার ধারণা, এক কাবুলিওয়ালা ছাড়া এ জগতে এ-কথা কেউই বলতে পারে না। অমৃতের পথ ক্ষুরস্য ধারা নিশ্চিতা; অকালে মৃত না হতে বলে ধার করতেই হবে।

ধার হলেও কথা ছিল বরং, কিন্তু তাও নয়। বাড়ি ভাড়া বাকি। তাও বেশি না পাঁচশো টাকা মাত্তর! কিন্তু তার জন্যেই বাড়িওয়ালা করাল মূর্তিটি ধরে দেখা দিলেন একদিন আপনাকে অনেক সময় দিয়েছি কোন অজুহাত শুনছি না আর

ভেবে দেখুন একবার। আমি তাকে বলতে যাই : এই সামান্য পাঁচশো টাকার জন্যে আপনি এমন করছেন! অথছ এক যুগ পরে একদিন–আমি মারা যাবার পরেই অবিশ্যি–আপনার এই বাড়ির দিকে লোকে আঙুল দেখিয়ে বলবে, একদা এখানে বিখ্যাত লেখক শ্রীঅমুকচন্দ্র বাস করতেন।

বাস করতেন! বাস করে আমার মাথা কিনতেন জবাবে তার দিক থেকে যেমন ঝাঁপটা এলো–শুনুন মশাই, আপনাকে সাফ কথা কথা বলি যদি আজ রাত্রি বারোটার ভেতর আমার টাকা না পাই তাহলে এক যুগ পরে নয়, কালকেই লোকে এই কথা বলবে।

বাড়িওয়ালা তো বলে গেলন, চলেও গেলেন। কিন্তু এক বেলার মধ্যে এতো টাকা আমি পাই কোথায়? পাছে ধার দিতে হয় ভয়ে সহজে কেউ আমার মতো লেখকের ধার ঘেঁষে না। লেখক মাত্রই ধারাল, আমি আবার তার ওপর এক কাঠিজানে সবাই।

হর্ষবর্ধনের কাছে যাবো? তাদের কাছে এই ক-টা টাকা কিছুই নয়। কীর্তি-কাহিনী লিখে অনেক টাকা তাদের পিটেছি, এখন তাদের পিঠেই যদি চাপি গিয়ে? তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় যদি এই দায় থেকে উদ্ধার পাই।

গিয়ে কথাটা পাড়তেই হর্ষবর্ধন বলে উঠলেন–নিশ্চয় নিশ্চয়! আপনাকে দেবো না তো কাকে দেববা!

চমকে গেলাম আমি। কথাটা যেন কেমনতরো শোনাল।

আপনি এমন কিছু আমাদের বন্ধু নন? তিনি বলতে থাকেন।

বন্ধুত্বের কথাই যদি বলেন- আমি বাধা দিয়ে বলতে যাই।

হ্যাঁ, বন্ধুত্বের কথাই বলছি। আপনি তো আমাদের বন্ধু নন। বন্ধুকেই টাকা ধার দিতে নেই, মানা আছে। কেননা, তাতে টাকাও যায় বন্ধুও যায়। তিনি জানান তবে হ্যাঁ, এমন যদি সে বন্ধু হয় সে বিদেয় হলে বাঁচি তার হাত থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হচ্ছে তাকে ঐ ধার দেওয়া। তাহলেই চিরকালের মতন নিস্তার!

আহা! আমি যদি ওঁর সেই দ্বিতীয় বন্ধু হতাম মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।

কিন্তু আপনি তো বন্ধু নন, লেখক মানুষ। লেখকরা তো কখনো কারো বন্ধু হয় না।

লেখকদেরও বোধহয় কেউ বন্ধু হয় না। সখেদে বলি।

বিলকুল নির্ঝঞ্ঝাট! এর চেয়ে ভাল আর কি হতে পারে, বলুন? তিনি বলেন, আপনি যখন আমাদের আত্মীয় বন্ধু কেউ নন, নিতান্তই একজন লেখক তখন আপনাকে টাকা দিতে আর বাধা কি? কতো টাকা দিতে হবে বলুন?

বেশি নয় শ-পাঁচেক। আর একেবারে দিয়ে দিতেও আমি বলছি না। আমি বলি :–আজ তো বুধবার, শনিবার দিনই টাকাটী আমি আপনাকে ফিরিয়ে দেবো।

কথা দিলাম। এছাড়া আজ বাড়িওয়ালার হাত থেকে ত্রাণ পাবার আর কি উপায়, কিন্তু কথা তো দিলাম। না ভেবেই দিয়েছিলাম কথাটা–শনিবারের সকাল হতেই ওটা ভাবনার কথা হয়ে দাঁড়াল।

ভাবতে ভাবতে চলেছি, এমন সময় গোবর্ধনের সঙ্গে মোলাকাত অকুলপাথারে, চৌরাস্তার মোড়ে।

গোবর্ধন ভায়া একটা কথা রাখবে? রাখো তো বলি।

কি কথা বলুন?

যদি কথা দাও যে, তোমার দাদাকে বলবে না তাহলেই বলি।

দাদাকে কেন বলতে যাবো, দাদাকে কি আমি সব কথা বলি?

অন্য কিছু কথা নয়, কথাটা হচ্ছে এই, আমাকে শপাঁচেক টাকা ধার দিতে পারো দিন কয়েকের জন্যে? আজ তো শনিবার? এই বুধবার সন্ধ্যের মধ্যেই টাকাটা আমি তোমাকে ফিরিয়ে দেবো।

এই কথা? এই বলে আর দ্বিরুক্তি না করে শ্রীমান গোবরা তার পকেট থেকে পাঁচখানা একশো টাকার নোট বার করে দিল।

টাকাটা নিয়ে আমি সটান শ্রীহর্ষবর্ধনের কাছে।

দেখুন আমার কথা রেখেছি কিনা। দরিদ্র লেখক হতে পারি, কথা নিয়ে খেলা করতে পারি কিন্তু কথার খেলাপ কখনো করি না।

হর্ষবর্ধন নীরবে টাকাটা নিলেন।

আপনি তো ভেবেছিলেন যে টাকাটা বুঝি আপনার মারাই গেল, আমি আর এ-জন্মেও এ-মুখো হবো না। ভাবছিলেন যে–

না না। আমি সে-সব কথা একেবারেও ভাবিনি। টাকার কথা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম।

তিনি বললেন, বিশ্বাস করুন, টাকাটা আপনাকে দিয়ে আমি কিছুই ভাবিনি কিন্তু ফেরত পেয়ে এখন বেশ ভাবিত হচ্ছি।

ভাবছেন এই যে, এই পাঁচশো টাকা ফিরিয়ে দিয়ে নিজের ক্রেডিট খাঁটিয়ে এর পরে আমি ফের হাজার টাকা ধার নেবো। তারপর সেটা ফেরত দিয়ে আবার দু-হাজার চাইবো। আর এমনি করে ধারটা দশ-হাজারে দাঁড় করিয়ে তারপরে আর এ-ধারই মাড়াবো না? এই তো ভাবছেন আপনি? এই ভেবেই তো ভাবিত হয়েছেন, তাই না?

আমি তার মনোবিকলন করি। তার সঙ্গে বোধহয় আমার নিজেরও।

তিনি বিকল হয়ে বলেন–না না, সে-সব কথা আমি আদৌ ভাবিনি। ভাবছি যে এত তাড়াতাড়ি আপনি টাকাটা ফিরিয়ে দিলেন! আর এতো তাড়াতাড়ি আপনার প্রয়োজন কি করে মিটতে পারে? বেশ, ফের আবার দরকার পড়লে চাইতে যেন কোন কুণ্ঠা করবেন না।

বলাই বাহুল্য! মনে মনে আমি ঘাড় নাড়লাম। লেখকরা বৈকুণ্ঠের লোক, কোন কিছুতেই তাদের কুণ্ঠা হয় না।

বুধবার দিনই দরকারটা পড়ল আবার। হর্ষবর্ধনের কাছ থেকে টাকটা নিয়ে গোবর্ধনকে গিয়ে দিতে হলো।

কেমন গোবর্ধন ভায়া! দেখলে তো কথা রেখেছি কিনা। এই নাও তোমার টাকা প্রচুর ধন্যবাদের সহিত প্রত্যর্পিত।

বুধবার আবার গোবরায় কাছে যেতে হলো। পাড়তে হলো কথা–

গোবর্ধন ভায়া বুধবারে টাকাটা ফেরত দেবো বলেছিলাম বুধবারেই দিয়েছি, দিই–নি কি? একদিনের জন্যেও কি আমার কথার কোন নড়চড় হয়েছে?

এমন কথা কেন বলছেন? গোবর্ধন আমার ভণিতা ঠিক করতে পারে না।

টাকটার আমার দরকার পড়েছে আবার। ওই পাঁচশো টাকাই–সেই জন্যেই তোমার কাছে এলাম ভাই। এই বধুবারই তোমায় আবার ফিরিয়ে দেবো টাকাটা। নির্ঘাত।

এইভাবে হর্ষবর্ধন আর গোবর্ধন, গোবর্ধন আর হর্ষবর্ধন শনিবার আর বুধবারের দু-ধারের টানা পোড়েনে আমার ধারিওয়াল কম্বল বুনে চলেছি এমন সময়ে পথে একদিন দু-জনের সঙ্গে দেখা।

দুই ভাই পাশাপাশি আসছিল। আমাকে দেখে দাঁড়াল। দু-জনের চোখেই কেমন যেন একটা সপ্রশ্ন দৃষ্টি।

হয়তো দৃষ্টিটা কুশল জিজ্ঞাসার হতে পারে, কোথায় যাচ্ছি, কেমন আছি–এই ধরনের সাধারণ কোন কৌতূহলই হয়তো বা, কিন্তু আমার তো পাপ মনে, মনে হলো দু-জনের চোখেই যেন এক তাগাদা!

হর্ষবর্ধনবাবু, ভাই গোবর্ধন, একটা আমি বলবো, কিছু মনে করো না–বলে আমি শুরু করি: ভাই গোবর্ধন, তুমি প্রত্যেক বুধবার হর্ষবর্ধনবাবুকে পাঁচশো টাকা দেবে। আর হর্ষবর্ধনবাবু, আপনি প্রত্যেক শনিবার পাঁচশো টাকা আপনার ভাই গোবর্ধনকে দেবেন। হর্ষবর্ধনবাবু, আপনি বুধবার, আর গোবর্ধন, তুমি শনিবার মনে থাকবে তো?

ব্যাপার কি! হর্ষবর্ধন তো হতভম্ব: কিছুই বুঝতে পারছি না।

ব্যাপার এই যে, ব্যাপারটা আমি একেবারে মিটিয়ে ফেলতে চাই। আপনাদের দুজনের মধ্যে আমি আর থাকতে চাই না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *