কল্কেকাশির অবাক কাণ্ড

কল্কেকাশির অবাক কাণ্ড

আপনার একটু অবিমৃষ্যকারিতা হয়েছে, বললাম অমি হর্ষবর্ধনকে : মানে ঐভাবে কথা বলাটা ঠিক হয়নি। ঐ লোকটা আসলে এক ডিটেকভিট। আপনার টাকাকড়ির খোঁজ খবর নিতেই এসেছিলো।

তাতে ওর লাভ? ওকে কি আমার টাকাকড়ির ভাগ দিতে হবে নাকি?

গভর্নমেন্ট থেকে ওকে লাগিয়ে থাকবে হয়তো। ইনকমট্যাকস-এর তরফ থেকেও হতে পারে! মুনাফাবাজদের পাকড়াবার চেষ্টা হচ্ছে না আজকাল? আপনি আবার ফলাও করে নিজের মুনাফার কথা জাহির করলেন ওর কাছে, এক কথায়, Moon offer করলেন, চাঁদ তুলে দিলেন ওর হাতে।

কিন্তু আপনি এটাকে দাদার অবিমিশকারিতা বলছেন কেন বলুন তো? তস্য ভ্রাতা গোবর্ধন বসে ছিল পাশেই, খট করে বলে বসলো।

ও-কথা তো বলিনি! বলেছি অবিমৃষ্যকারিতা। আমি ওকে শুধরে দিতে চাই।

একই কথা। কিন্তু ওর মানেটা কি, তাই আমি জানতে চাইছি।

মানেটা যে কি, তা আমিও ঠিক জানিনে ভাই! অভিধানে আছে। তবে মনে হচ্ছে তোমার কথাটাতেও ওর মানে পাওয়া যায়। কি মেশাতে গিয়ে কি মেশানো-এ কথার সঙ্গে সে-কথা মিশিয়ে গুলিয়ে গিয়ে কি বলতে গিয়ে কি বলে ফেলা আর কি!

গোয়েন্দা যে লোকটা তা আপনি জানলেন কি করে? জিজ্ঞেস করলেন হর্ষবর্ধন।

চিনি যে ওকে। কল্কেকাশি ওঁর নাম, নামজাদা গোয়েন্দা উনি। অনেকদিন আগে ওঁল সঙ্গে একবার আলাপ হয়েছিল আমার কোন এক সূত্রে। উনি আমাকে চিনতে পারেননি। আমি কিন্তু ঠিক চিনেছি।

ডিটেকটিভ কল্কেকাশি? গোবরা জিজ্ঞেস করে। হুঁকোকাশি তো জানি, মনোরঞ্জন ভট্টচার্যের ডিটেকটিভ বইয়ে পড়েছিলাম! ডিটেকটিভ হুঁকোকাশি।

তস্য ভ্রাতা হবেন হয়তো বা! জানিনে ঠিক। হুঁকোকাশির ভাই কল্কেকাশি হওয়া বিচিত্র নয়। আমি জানাই।

আমাদের কাছে ওঁকে কন্ধে পেতে হবে না। বললেন হর্ষবর্ধন।

আমাদের ল্যাজে পা দিতে এলে ওঁর কাশী-প্রীপ্তি ঘটিয়ে দেবো আমরা! এখানে আর কল্কে পেতে হবে না।

গোবর্ধন সায় দেয় দাদার কথায়।

হয়েছিল কি, ডিটেকটিভ কল্কেকাশি নিরীহ ভদ্রলোকের মতই এসেছিলেন হর্ষবর্ধনের কাছে এমনি আলাপ করতে। কথায় কথায় তিনি বললেন–আপনাদের ব্যবসায় আর এমন কি লাভ হয় মশাই! সামান্য কাঠের কারবার তো আপনার।

হর্ষবর্ধনের পেটের খবর টেনে বের করার জন্যেই যে কথাটা পাড়া ওঁর, পাড়তেই আমি তা টের পাই।

সামান্য! কথাটায় ওঁর অহমিকায় লাগল। গর্বে তিনি ফেটে পড়লেন তক্ষুনি, বড়াই করে বললেন–বলেন কি মশাই! আমাদের কারবারে পারসেন্ট মুনাফা, আঁচ করতে পারেন তার? চার টাকার কাঠের থেকে আমরা চারশো টাকা লাভ করি তা জানেন? হিসেব করে বলুন তো কত পারসেন্ট লাভ দাঁড়ায় তাহলে?

শুনে তো আমি থ হয়ে যাই, মানসাঙ্ক করেও ওর পারসেন্টেজের কোনো থই পাইনে।

কিরকম, কিরকম? নির্দোষ কৌতূহল দেখা যায় কষ্কেকাশির। হর্ষবর্ধনের হাঁড়ির খবর জানার মতলব তাঁর, আমি বুঝতে পারি বেশ।

কিন্তু আমি ওঁকে সামলাবার আগেই উনি নিজের হাঁড়ি নিজেই হাটে ভেঙে বসেছেন!

কি রকম শুনবেন? শুনুন তাহলে। ছোটনাগপুরের জঙ্গল আমরা ইজারা নিই। জঙ্গলকে জঙ্গল। ওইসব জঙ্গল বরাবর চলে গেছে মধ্যপ্রদেশের সেই দণ্ডকারণ্য অব্দি। অফুরন্ত জঙ্গল সীমা পরিসীমা নেই। এনতার গাছ। সেই সব গাছ কেটে তার ডালপালা হেঁটে কলকাতায় আমদানি করি আমরা। এখানে আমাদের কারখানায় সেইসব ইলাহি কাঠ করাত দিয়ে চিরে তক্তা বানানো হয়–সেই তক্তা আমরা বেচি। বেচি লাভ হয় আমাদের।

কেমনধারা লাভ? কল্কেকাশির ঔৎসুক্য।

তার কি ইয়ত্তা আছে নাকি? জঙ্গলকে জঙ্গল ইজারা নিই, বলো না? নীলাম ডেকে ইজারা নেয়া হয়। গাছ প্রতি আমাদের পরতা পড়ে চার টাকা মতন, সেই চার টাকার গাছের তক্তা বেচে পাই

অন্তত চার শো টাকা। তারপর… বলে তিনি একটু থামেন, দম নিতেই বোধ করি।

তারপর? কল্কেকাশি উসকে দেন ওঁকে নতুন উদ্যম দেবার জন্যেই বোধ হয়।

দম পেয়ে তিনি শুরু করেন আবার–তারপর ঐ সব তক্তার থেকে যদি আমরা আলনা, আলমারি, দেরাজ, ডেসক, টেবিল, চেয়ার, খাট, পালঙ্ক ইত্যাদি নানান আসবাব পত্তর বানিয়ে বেচি, তাহলে গোড়াকার সেই চার টাকার মুনাফাই হয়ে দাঁড়াবে চার হাজার টাকা। বুঝলেন এবার?

না না, এর মধ্যে শ্রমের প্রশ্নও রয়েছে যে! লেবারটাও ধরতে হবে। এই সব বানাতে কারিগরদের মজুরি দিতে হয় না? তাদের চারজও তো চারগুণ এখন। মুনাফার সবটাই আপনার সেবায় নয় মশাই! দেবার দিকটাও রয়েছে আবার। ওঁর কথায় বিপক্ষে বলে ওঁর পক্ষ সমর্থনের প্রয়াস আমার।

তা আছে। মেনে নেন হর্ষবর্ধন ও তা আছে বইকি। সেটাও ধর্তব্য ঐ সঙ্গে। তবে তা ধরেও..।

বিস্তর মুনাফা হয়, তাই না? কল্কেকাশি ওঁকে দম দেন আবার।

তা তো হয়ই। না হয়ে কি আর যায় মশাই? যাবার যো কী!

অ্যাতো টাকা আপনি রাখেন কোথায়! আনাড়ির মতই জিজ্ঞাসা কষ্কেকাশির। একটু যেন বিস্ময়ের সুরেই।

টাকা কি আবার রাখা যায় নাকি? রাখতে পারে কখনো কেউ? আপনার থেকেই তো উড়ে যায় টাকা। টাকার যা দস্তুর।

কেমন করে যায় কে জানে! গোবরার সায় দেওয়া। আসতে না আসতে চলে যায়।

কি করেন অ্যাতো টাকা দিয়ে? তবুও শুধান উনি-ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ওঁর সেই এক কথাই।

বিলিয়ে দিই। কি আবার করবো? হর্ষবর্ধনের সরল জবাব–টাকা নিয়ে কি করে মানুষ?

বিলিয়ে দেন! অবাক হন কল্কেকাশি। তার বিশ্বাস হয় না বলাই বাহুল্য।

বিল মেটাতেই চলে যায় টাকা। বেতনের বিল, বোনাসের বিল। বলেন হর্ষবর্ধন ও আমার কারখানার মজুর-করিগরকে মাইনে দিতেই কী কম টাকাটা যায় মশাই? বেতন মিটিয়ে, বোনাস দিয়ে কী আর থাকে বলুন।

কতো আর দেন বোনাস! বড়জোর তিনমাসের?

তাতে দিই-ই সব কোম্পানিই তা দেয়। তবে তারা দেয় বছরে তিনমাসের, আর আমি দিই প্রতি মাসে।

তার মানে?

মানে, মাস মাস তিন মাসের বেতন বাড়তি দিয়ে যাই। না দিলে চলবে কেন ওদের? জিনিসপত্রের দাম কি তিনগুণ করে বেড়ে যায়নি বলুন।

বলেন কি মশাই অ্যাঁ? এবার কল্কেকাশি সত্যিসত্যিই হতবাক হন।

বলে, দাদার ঐ বোনাস পেয়ে পেয়ে আমাদের কারিগররা বোনাই পেয়ে গেল সবাই। গোবর্ধন জানায়।

বোনাই পেয়ে গেলো? সে আবার কি? কল্কেকাশি কথাটার কোনো মানে খুঁজে পান বা–বোনাস থেকে বোনাই!

পাবে না? ব্যাসিলাস-এর বেলা যেমন ব্যাসিলাই। ইংরিজি কি জানিনে নাকি একদম? বোনাস এর বহুবচনে কী হয়? জিনিয়াসের পুরালে যেমন জিনিয়াই, তেমনি বোনাস-এর পুরালে বোনাই-ই তো হবে। হবে?

গোবর্ধন আমার দিকে তাকায়।

ব্যাকরণ মতে তাই হওয়াই তো উচিত। বলি আমি।

বোনাস-এর ওপর বোনাস পেতে ওদের আইবুড়ো বোনদের বিয়ে হয়ে গেলো সব। আপনিই বর-রা এসে জুটে গেলো যতো না! বিনাপণেই বলতে কি! বউয়ের হাত দিয়ে সেই বোনাস-এর ভাগ বসাতেই বোনাইরা জুটে গেলো সব আপনার থেকেই।

এই কথা! কথাটা পরিষ্কার হওয়ায় কল্কেকাশি হাঁফ ছাড়লেন? তাহলেও বাড়ি টাকার অনেকখানিই মজুদ থেকে যায় সে সব টাকা রাখেন? ব্যাঙ্কে না বাড়তি?…তিল তিল করে জমলেও তো তাতাল হয়ে ওঠে একদিন আপনাদের সেই বিপুল ঐশ্বর্য…।

অরণ্যেই ওঁদের ঐশ্বর্য! কথাটা আমি ঘুরিয়ে দিতে চাই : ঐশ্বর্য কি আর ওঁদের বাড়িতে আছে? না,বাড়িতে থাকে? জমিয়ে রাখবার দরকারটাই বা কী? গোটা অরণ্যভূমিই তো ঐশ্বর্য ওঁদের। বনস্পতিরূপে জমানো। কাটা গাছই টাকার গাছ। বলে উদাহরণ দিয়ে কথাটা আরো পরিষ্কার করি–যেমন মড়া মড়া জপতে জপতেই রাম হয়ে দাঁড়ায়, তেমনি কাটা উলটোলেই টাকা হয়ে যায় মশাই! মানে, কাটা গাছই উলটে টাকা দেয় কিনা! টাকার গাছ তখন।

বুঝেছি। বলে ঘাড় নেড়ে কল্কেকাশি চাড় দেখান-আবার আপনাদের বাড়ি সেই গৌহাটি না কোথায় যেন বললেন না? আসাম থেকেই তো আসা আপনাদের এখানে–তাই নয়? তা আসামের বেশির ভাগই তো অরুণ্য। তাই নয় কি? তাহলে বোধহয় সেই অরণ্যের কাছাকাছি কোথাও…মানে, আপনাদের বাড়ির কাছেই হয়তো কোনো গভীর জঙ্গলেই জমানো আছে, তাই না।

কল্কেকাশির কথায় হর্যবর্ধনের কোনো সাড়া পাওয়া যায় না আর। তিনি শুধু বলেন–হুম। বলেই কেমনধারা গুম হয়ে যান। কল্কেকাশির উদ্যম সত্বেও তার গম্ভীর্যের বাঁধ ভেঙে কথার স্রোত আর গড়াতে পারে না।

আচ্ছা, নমস্কার, আজ আমি আসি তাহলে। বলে উঠে পড়ে আপনার নাম শুনেছিলাম, আপনার সঙ্গে আলাপ করে খুব আনন্দ হলো। নমস্কার।

লোকটার কথাবার্তা কেমনধারা যেন। কল্কেকাশি গেলে পর মুখ খুললেন হর্ষবর্ধন–আমাদের টাকাকড়ির খোঁজ খবর পেতে চায় লোকটা!

হ্যাঁ দাদা, কেমন যেন রহস্যময়। গোবরা বলে।

তখন আমি ভদ্রলোকের রহস্য ফাঁস করে দিই। জানাই যে, ঐ কল্কেকাশি কোনো কেউকেটা লোক নন, ধুরন্ধর এক গোয়েন্দা। সরকার এখন কালোবাজার এর টাকার সন্ধানে আছে কি না, কোথায় কে কতো কালো টাকা, কালো সেনা জমিয়ে রেখেছে….।

কালো সোনা তো আফিঙকেই বলে মশাই! সোনার দাম এখন আফিঙের সমান। দাদার টীকা আমার কথার ওপর। আমার কি আফিঙের চাষ নাকি?

আবার কেষ্টঠাকুরকেও কালোসোনা বলে থাকে কেউ কেউ! তস্য ভ্রাতার টিপপনি দাদার ওপরে। কালোমানিকও বলে আবার।

এখনকার দিনে কালো টাকা তো কেউ আর বার করে না বাজারে, সোনার বার বানিয়ে লুকিয়ে কোনো খানে মজুদ করে রাখে, বুঝেছেন? আমি বিশদ ব্যাখ্য করি তখন আপনারা কালো বাজারে, মানে, কাঠের কালো বাজার করে প্রচুর টাকা জমিয়েছেন, সরকার বাহাদুরের সন্দেহ। তাই তার আঁচ পাবার জন্যেই এই গোয়েন্দা প্রভুটিকে লাগিয়েছেন আপনার পেছনে।

তাহলে তো বেশ গনগনে আঁচ মশাই মানুষটার। গোবর্ধন বলে, না আঁচলে তো বিশ্বাস নেই…বাচন নেই আমাদের।

সর্বনাশ করেছেন দাদা। হর্ষবর্ধনের প্রায় কাঁদার উপক্রম, আপনি ওই লোকটাকে আসামের অরণ্য দেখিয়ে দিয়েছেন আবার।

এমন সময় টেবিলের ফোন ক্রিং ক্রিং করে উঠলো ওঁর। ফোন ধরলেন হর্ষবর্ধন হ্যালো। কে?…কে একজন ডাকছেন আপনাকে। রিসিভারটা উনি এগিয়ে দিলেন আমায়।

আমাকে? আমাকে কে ডাকতে যাবে এখানে? অবাক হয়ে আমি কর্ণপাত করলাম হ্যালো, আমি শিব্রাম….আপনি কে?

আমি কল্কেরাশি। কাছাকাছি এক ডাক্তারখানা থেকে ফোন করছি আপনাকে। ওখানে বসে থাকতে দেখেই আপনাকে আমি চিনতে পেরেছি। আপনি বোধহয় চিনতে পারেননি আমার…শুনুন, অনেক কথা আছে আপনার সঙ্গে। অনেকদিন পরে দেখা পেলুম আপনার। আজ রাত্রের ট্রেনে গৌহাটি যাচ্ছি, আসুন না আমার সঙ্গে। প্রকৃতির লীলাভূমি আসাম, আপনি লেখক মানুষ বেশ ভালো লাগবে আপনার। দু-পাঁচ দিন অরণ্যবিহার করে আসবেন এখন। চেঞ্জের কাজও হবে। কেমন, আসছেন তো?

অরণ্যবিহার? আমার সাড়া দিই :–আজ্ঞে না। আমাদের বাড়ি ঘাটশিলায়, তার চারধারেই জঙ্গল পাহাড়। প্রায়ই সেখানে যাই আমি সঠিক বললে, বিহারের বেশির ভাগই অরণ্য। খোদ বিহার-অরণ্যে বাস করি। আমাকে আবার গৌহাটি গিয়ে অরণ্য-বিহার করতে হবে কেন? অরণ্য দেখে দেখে অরুচি ধরে গেছে আমার। আর সত্যি বলতে, এক আধটু লিখিটিখি বটে, তবে কোনো প্রকৃতিরসিক আমি আদপেই নই।

ফোন রেখে দিয়ে হর্ষবর্ধনকে বললাম–ঐ ভদ্রলোক, মনে কল্কেকাশিই ফোন করেছিলেন এখন। আর রাত্রের ট্রেনেই উনি গৌহাটি যাচ্ছেন কিনা…

অ্যাঁ? গৌহাটি যাচ্ছেন। কী বললেন? অ্যাঁ? আতঙ্কিত হন হর্ষবর্ধন, সেরেছে তাহলে। এবার আমাদের সর্বনাশ রে গোবরা।

সর্বনাশ কিসের। বাঁচিয়ে দিয়েছি তো আপনাকে। এখানে আপনাদের বাড়িতে তল্লাশী করলে বিস্তর সোনা দানা পেয়ে যেতো, এখান থেকে কায়দা করে হটিয়ে দিলাম কেমন। এখন মরুক না গিয়ে আসামের জঙ্গলে। অরণ্যে অরণ্যে রোদন করে বেড়াক।

এখানে আমাদের বাড়ি তল্লাশী করে কিছুই পেতো না সে। বড়ো জোর লাখ খানেক কি দেড়েক আমাদের দৈনন্দিন দরকার মিটিয়ে মাস খরচার জন্য লাগে যেটা। আমরা কি এখানে জমাই নাকি মশাই? চোর-ডাকাতের ভয় নেইকো? সেদিনের কারখানার সেই চুরিটা হয়ে যাবার পর থেকে আমরা সাবধান হয়েছি। আমাদের কারবারের লাভের টাকা আর বাড়তি যা কিছু, সব আমরা সোনার বাট বানিয়ে গৌহাটি নিয়ে যাই-বাড়ির কাছাকাছি একটা জঙ্গলে গিয়ে এক চেনা গাছের তলায় পুঁতে রেখে আসি।

চেনা গাছ। অবাক লাগে আমার গাছ কি আবার কখনো চেনা যায় নাকি? একটা গাছের থেকে আরেকটাকে, এক গোরর থেকে অন্য গোরু, এক চীনেম্যানের থেকে আরেক চীনেম্যান কি আলাদা করে চিনতে পারে কেউ? গাছ যদি হারিয়ে যায়?

ঐ একটা বস্তু যা কখনো হারায় না, টাকাকড়ি নিয়ে পালিয়ে যায় না কদাচ। হাত-পা নেই তো, একজায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে ঠায়…

এই জন্যেই তো শুদ্ধভাষায় ওদের পাদপ বলেছে, তাই না দাদা? গোবরার সঠিক ভাষ্য বনে আগুন লাগলে দপ করে জ্বলে ওঠে বটে কিন্তু সেখান থেকে মোটেই পালাতে পারে না।

আমি তো মশাই চিনতে পারিনে, শাখা-প্রশাখা ডাল-পালা নিয়ে সব গাছই তো আমার চোখে এক চেহারা মনে হয়। ফুল ধরলে কি ফল ফললে তখন যা একটু টের পাই তাদের জ্ঞাতগোত্রের কোনটা আম, কোনটা জাম-কিন্তু কোন গাছটা যে কে, কোনজনা, তা আমি চিনে রাখতে পারিনে।

আমরা পারি। একবার যাকে যে গাছটাকে দেখি তাকে আর এ জীবনে ভুলিনে….

যাক গে সে কথা…এখন আপনাদের গোয়েন্দা যদি আমাদের বাড়ি গিয়ে কাছাকাছি জঙ্গলের যতো গাছের গোড়ায় না খোঁড়াখুড়ি লাগিয়ে দেয় তাহলেই তো হয়েছে।

গোড়ার গলদ বেরিয়ে পড়বে আমাদের। গোবরা বলে।

একটা না একটার তলায় পেয়ে যাবে আমাদের ঐশ্বর্যের হদিস। অরণ্যেই আমাদের ঐশ্বর্য, যতই গালভরা হোক, কথাটা বলে আপনি ভাল করেননি। এভাবে হদিসটা দেওয়া ঠিক হয়নি আপনার।

তার চেয়ে আপনি কষে আমাদের গাল দিতে পারতেন বরং। কিছু আসতো যেতো না। গালে চড় মারতেও পারতেন। গাল বাড়িয়ে দেয় গোবরাকিন্তু আমাদের ভাঁড়ারের নাগাল দেওয়াটা উচিত হয়নি।

কী করা যায় এখন। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েন হর্ষবর্ধন। বসে তো ছিলেনই, মনে হয়, আরো যেন তিনি একটু বসে গেলেন।

চলো দাদা, আমরা গৌহাটি চলে যাই। গোবরা একটা পথ বাতলায়, ওই ট্রেনেই চলে যাই আজ। গোয়েন্দার উপর গোয়েন্দাগিরি করা যাক বরং। ডিটেকটিভ বই তো নেহাত কম পড়িনি ওদের হাড়-হদ্দ জানি সব। কিছুই আমার অজানা নয়।

ওর পড়াশোনার পরিধি কদুর জানার আমার কৌতূহল হয়। সে অকাতরে বলে–কম বই পড়েছি নাকি? লাইব্রেরি থেকে আনিয়ে আনিয়ে পড়তে কিছু আর বাকি রাখিনি। সেই সেকেলে দারোগার দপ্তর থেকে শুরু করে পাঁচকড়ি দে-আহা সেই মায়াবী মনোরমা বিষম বৈসূচন…কোনোটাই বাদ নেই আমার। আর সেই নীলবসনা সুন্দরী।

দাদার সমর্থন আসে–আহা, মরি মরি।

থেকে আরম্ভ করে সেদিনের নীহার গুপ্ত, গৌরাঙ্গ বোস অব্দি সব আমার পড়া। ব্লেক সিরিজ, মোহন সিরিজ বিলকুল। জয়কুমার থেকে ব্যোমকেশ পর্যন্ত কারো কীর্তিকলাপ আমার অজানা নয়। এতো পড়ে পড়ে আমি নিজেই এখন আস্ত একটা ডিটকিটিভ, তা জানেন?

বলো কি হে?

সেবারকার আমাদের কারখানার চুরিটা ধরলো কে শুনি? কেন গোয়েন্দা? এই-এই শর্মা তো। তেজপাতার টোপ ফেলে তৈজসপত্রের লোভ দেখিয়ে আমিই তো ধরলাম চোরটাকে। দাদার বেবাক টাকা উদ্ধার করে দিলাম। তাই না দাদা?

তোর ওই সব বই টই এক-আধটু আমিও যে পড়িনি তা নয়। ওর আনা বই-টই অবসরমতন আমিও ঘেঁটে দেখেছি বইকি। তবে পড়ে-উড়ে যা টের পেয়েছি তার মোদ্দা কথাটা হচ্ছে এই যে গোয়েন্দাদের মৃত্যু নেই। তারা আপনার ঐ আত্মার মতই অজর অমর অবিনশ্বর অকাট্য অবিধ্য…

অকাট্য? অবিধ্য?

হ্যাঁ, তরোয়াল কেটে ফেলা যায় না, গুলি দিয়ে বিদ্ধ করা যায় না মেরে ফেলা তো অসম্ভব। কানের পাশ দিয়ে চলে যাবে যতো গুলিগোলা। এই পরিচ্ছেদে দেখলেন আপনি সে হতভাগা খতম হলো, আবার পরের পরিচ্ছদই দেখুন ফের বেঁচে উঠেছে আবার। অকাট্য অবিধ্য অখাদ্য।

তাহলে চলো দাদা। আমরাও ওকে টের পেতে না দিয়ে ওই ট্রেনেই চলে যাই আজকে। গুলি করেও গুলিয়ে দেওয়া যাক ওকে আসল জায়গার থেকে ভুলিয়ে অন্য জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিয়ে আসবো দেখো তুমি।

এতক্ষণে দাদা যেন একটু আশ্বস্ত হলেন মনে হলো। হাসিমুখে বললেন–যাব তো, কিন্তু যাচ্ছি যে, ও যেন তা টের না পায়!…

গৌহাটি স্টেশনে নামতেই তাঁর নজরে পড়ে গেলেন কল্কেকাশির। কষ্কেকাশি তাদের দেখতে পেয়েছে সেটা তারা লক্ষ্য করলেন বটে, কিন্তু তারা যে লক্ষীভূত হয়েছেন সেটা তাকে টের পেতে দিলেন না একেবারেই। নজরই দিলেন না একদম তার দিকে। আপন মনে হেলে দুলে বাইরে গিয়ে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করলেন তাঁরা।

কল্কেকাশিও অলক্ষে পিছু পিছু আরেকটা ট্যাক্সিতে গিয়ে উঠলেন তারপর। ছুটলেন তাঁদের পিছনে পিছনে।

হর্ষবর্ধনের গাড়ি কিন্তু কোন জঙ্গলের ত্রিসীমানায় গেল না, তাঁদের বাড়ির চৌহদ্দির ধারে তো নয়ই। অনেক দূর এগিয়ে ছোটখাটো পাহাড়ের তলায় গিয়ে খাড়া হল গাড়িটা।

ভাইকে নিয়ে নামলেন হর্ষবর্ধন। ভাড়া মিটিয়ে মোটা বখশিস দিয়ে ছেড়ে দিলেন ট্যাক্সিটা। কল্কেকাশিও নেমে পড়ে পাহাড়ের পথ ধরে দূর থেকে অনুসরণ করতে লাগলেন ওঁদের।

আড়চোখে পিছনে তাকিয়ে দাদা বললেন ভাইকে ছায়ার মতন আসছে লোকটা। খবরদার ফিরে তাকাস নে যেন।

পাগল হয়েছে দাদা? তাকাই আর তাক পেয়ে যাক? দাদার মতন গোবরারও যেন আজ নয়া চেহারাঃ দু-ভায়ে এখেনেই ওকে আজ নিকেশ করে যাব। কাক চিল কেউ টের পাবে না, সাক্ষী সাবুদ থাকবে না কেউ। শকুনি গৃধিনীতে খেয়ে শেষ করে দেবে কালকে।

কাজটা খুবই খারাপ ভাই, সত্যি বলছি। দাদার অনুযোগ; কিন্তু কি করা যায় বল? ও বেঁচে থাকতে আমাদের বাঁচান নেই, আর আমাদের বেঁচে থাকাটাই যখন বেশি দরকার, অন্তত আমাদের কাছে…তখন ওকে নিয়ে কি করা যায় আর? তবে ওকে আদৌ মারা যাবে কিনা সন্দেহ আছে। এখনো পর্যন্ত কোনো বইয়ে একটা গোয়েন্দাও মরেনি কখনো।

কিন্তু বাবার যেমন বাবা আছে তেমনি গোয়েন্দার উপরে গোয়েন্দা থাকে… জানায় গোবরা আর তিনি হচ্ছেন খোদ এই গোবর্ধন। খোদার ওপর খোদকারি হবে আজ আমার। ব্লেক আর স্মিথের মতই গোবরা দাদাকে নিজের সাকরেদ বানাতে চাইলেও হর্ষবর্ধন অন্যরূপে প্রকট হন, গোঁফ মুচড়ে বলেন–তুই যদি গোবর্ধন, তাহলে আমি সাক্ষাৎ শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং গোবর্ধনকে ধারণ করে রয়েছি।

বলে ভাইয়ের হাত ধরে বলেন–আয়, আমরা এই উচ টিবিটার আড়ালে গিয়ে দাঁড়াই। একটুখানি গা ঢাকা দিই। লোকটা এখানে এসে আমাদের দেখতে না পেয়ে কী করে দেখা যাক…

কষ্কেকাশি বরাবর চলে এসে কাউকে না দেখে সোজা পাহাড়ের খাড়া দিকটার কিনারায় গিয়ে পৌঁছান। দেখেন যে তার ওধারে আর পথ নেই, অতল খাদ, তার খাদ্যরা বিলকুল গায়েব। তাকিয়ে দেখেন চার দিকে দুই ভাই কারোরই কোন পাত্তা নেই গেলো কোথায় তারা?

এমন সময় যেন মাটি খুঁড়েই তারা দেখা দিলে হঠাৎ। কল্কেকাশি সাড়া পেলেন পেছন থেকে হাত তুলে দাঁড়ান।

ফিরে তাকিয়ে দেখেন দুই মূর্তিমান দাঁড়িয়ে যুগপৎ শ্রীহর্ষ এবং শ্রীমান গোবর-বধর্ন ভ্রাতৃদ্বয়। দুজনের হাতেই দোনলা পিস্তল।

এবারে আপনি আমাদের কবজায়, কল্কেকাশিবাবু। হাতের মুঠোয় পেয়েছি আপনাকে। আর আপনার ছাড়ান নেই, বিস্তুর জ্বালিয়েছেন কিন্তু আর আপনি আমাদের জ্বালাতে পারবেন না। দেখছেন তো আমাদের হাতে এটা কী। হর্ষবর্ধন হস্তগত বস্তুটি প্রদর্শন করেন–সব জ্বালাযন্ত্রণা খতম হবে এবার আমাদের, আপনারও।

একটু ভুল করছেন হর্ষবর্ধনবাবু। জানেন নাকি, আমাদের গোয়েন্দাদের কখনো মৃত্যু হয় না? আমরা অদাহয় অভেদ্য অমর।

জানি বইকি, পড়েওছি বইয়ে। আপনারা অসাধ্য, অকাট্য, অখাদ্য ইত্যাদি ইত্যাদি; কিন্তু তাই বলে আপনারা কিছু অপত্য নন। দু-পা আগ বাড়িয়ে তাকিয়ে দেখুন একবার আপনার সামনে অতল খাদ মুহূর্ত বাদেই ওই খাদে পড়ে ছাতু হতে হবে আপনাকে। পালাবার কোনো পথ নেই। ওই পতন অপ্রতিরোধ্য কিছুতেই আপনি তা রোধ করতে পারবেন না। সব হতে পারেন কিন্তু আপনি তো অপত্য, মানে, অপতনীয় নন।

আপনাকে প্রজাপুঞ্জের মতন অপত্যনির্বিশেষে আমরা পালন করবো। গোবর্ধন জানায়, বেশির ভাগ বাবাই যেমন ছেলের অধঃপতনের মূল, মানুষ করার ছলনায় তাকে অপমৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয় ঠিক তেমনি ধারাই প্রায় আপনাকে পুঞ্জীভূত করে রাখবো পাহাড়ের তলায়। হাড়মাস সব এক জায়গায়।

পায়ে পায়ে এগিয়ে যান এইবার। হর্ষবর্ধনের হুকুম, খাদের ঠিক কিনারায় গিয়ে খাড়া হন। নিজে ঝাঁপিয়ে পড়বার সাহস আপনার হবে না আমি জানি। আপনাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেবো আমরা। এখোন এগোন….নইলেই এই দুড়ম!

অগত্যা কষ্কেকাশি কয়েক পা এগিয়ে কিনারাতেই গিয়ে দাঁড়ান। হাতঘড়িটা কেবল দেখে নেন একবার।

ঘড়ি দেখে আর কী হবে সার! অন্তিম মুহূর্ত আসন্ন আপনার। দাদা বলেন–গোবরা, চারধারে একবার ভালো করে তাকিয়ে দ্যাখ তো, পুলিস- টুলিস কারু টিকি দেখা যাচ্ছে নাকি কোথাও?

উঁচু পাহাড়ের ওপরে দাঁড়িয়ে গোবরা নজর চালায় চারধারে, না দাদা, কেউ কোথাও নেই। পুলিস দূরে থাক, চার মাইলের মধ্যে জনমনিষ্যির চিহ্ন না। একটা পোকা মাকড়ও নজরে পড়ছে না আমার।

খাদটা কতো নিচু হবে রে? দাদা শুধায়, ধারে গিয়ে দেখে আয় তো।

তা, পাঁচশো ফুট তো বটেই। আঁচ পায় গোবরা।

কোথাও কোনো ঝোঁপ-ঝাড়, গাছের শাখা-প্রশাখা, লতা-গুল্ম কিছু বেরিয়ে-টেরিয়ে নেই তো! পতন বোধ রোধ হতে পারে এমন কিছু কোথাও কোন ফ্যাকড়ায় লোকটা আটকে যেতে পারে শেষটায়–এমনতরো কোনো ইতর বিশেষ আছে কিনা ভালো করে দ্যাখ।

বিলকুল ন্যাড়া এই খাড়াইটা। আটকারার মতন কোথাও কিছু নেইকো।

বেশ। আমি রিভলভার তাক করে আছি। তুই লোকটার পকেট-টকেট তল্লাশী করে দ্যাখ এইবার। কোনো প্যরাসুট কি বেলুন-ফেলুন লুকিয়ে রাখেনি তো কোথাও?

এক পকেটে একট রিভলভার আছে দাদা!

বার করে নে এক্ষুনি, আর অন্য পকেটটায়? একখানা রুমাল।

নিয়ে নে ওটাও। কে জানে, ওটাকেই হয়তো ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্যারাসুটের মতো বানিয়ে নিয়ে দুর্গা বলে ঝুলে পড়বে শেষটায় কিছুই বলা যায় না। ওদের অসাধ্য কিছু নেই।

গোবর্ধন হাসে–রুমালকে আর প্যারাসুট বানাতে হয় না। তুমি হাসালে দাদা! বলে রুমালটাও সে হাতিয়ে নেয়।

এখন কোনো ভূমিকম্পটম্প হবে না তো রে? সে রকম কোনো সম্ভাবনা নেই, কী বলিস?

একদম না। এ ধারটায় অনেকদিন ও-সব হয়নি আমি শুনেছি।

তাহলে তুই এবার রিভলভার বাগিয়ে দাঁড়া, আমি লোকটাকে ছুটে গিয়ে জোরসে এক ধাক্কা লাগাই।

ওই কমমোটি কোরো না দাদা! দোহাই! তাহলে ও তোমায় জড়িয়ে নিয়ে পড়বে, আর পড়তে পড়তেই, কায়দা করে আকাশে উলটে গিয়ে তোমাকে তলায় ফেলে তোমার ওপরে গিয়ে পড়বে তারপর। তোমার দেহখানি দেখহ তো! ওই নরম গদির ওপরে পড়লে ওর কিছুই হবে না। লাগবে

একটুও। তুমিই ছাতু হয়ে যাবে দাদা মাঝ থেকে। গৌহাটি এসে আমাকে এমন ভাবে দাদৃহারা কোরো না তুমি রক্ষে করো দাদা!

ঠিক বলেছিস! আমার চেয়ে বেশি পড়াশুনা তোর তো। আমি আর ক-খানা গোয়েন্দাকাহিনী পড়েছি বল! পড়বার সয়ম কই আমার। ভাইয়ের বুদ্ধির তারিফ করেন হর্ষবর্ধন–দাঁড়া, তাহলে একটা গাছের ডাল ভেঙে নিয়ে আসি। তাই দিয়ে দূর থেকে গোত্তা মেরে ফেলে দিই লোকটাকে কী বলিস?

তারপর হর্ষবর্ধনের গোঁত্তা খেয়ে কল্কেকাশি পাহাড়ের মাথা থেকে বেপাত্তা! কল্কেকাশির কল্কেপ্রাপ্তি ঘটে গেলো দাদা! তোমার কৃপায়।

একটা পাপ কমলো পৃথিবীর। একটা বদমাইশকে দুনিয়া থেকে দূর করে দিলাম। আরামের হাঁফ ছাড়লেন হর্ষবর্ধন।

একেবারে গোটুহেল করে দিয়েছে লোকটাকে। এতক্ষণ নরকের পথ ধরেছে সটান। গোবর্ধন বলেঃ খাদের তলায় দেখবো নাকি তাকিয়ে একবার? কিরকম ছরকুটে পড়েছে দেখবো দাদা?

দরকার নেই। পাহাড়ের থেকে পড়ে পায়ের হাড় পর্যন্ত হয়ে গেছে। বিলকুল ছাতু! সে-চোহারা কি আছে নাকি আর? তাকিয়ে দেখবার কিছু নেই। দাদা বলেন, এবার আস্তে আস্তে ফিরে চলি আমরা। ইস্টিশনের দিকে এগুনো যাক। বড়ো রাস্তার থেকে একটা বাস ধরলেই হবে।

পাহাড়তলীর পথ ধরে এগিয়ে চলেন দু-ভাই।

যেতে যেতে হঠাৎ পেছন থেকে সাড়া পান যেন কার–হাত তুলে দাঁড়ান। দুজনেই।

পিছন ফিরে দেখেন স্বয়ং সাক্ষাৎ কঙ্কোকাশি। হাতে পিস্তল নিয়ে খাড়া।

আপনারা টের পাননি প্যান্টের পকেটে আরেকটা পিস্তল ছিল আমার। কৈফিয়তের মতই বলতে যান কল্কেকাশি।

তা তো ছিলো। কিন্তু আপনি ছিলেন কোথায়? হতভম্ব হর্ষবর্ধনের মুখ থেকে বেরোয়।

আকাশে। আবার কোথায়! হেলির নাম শুনেছেন কখনো? বাতলাম কল্কেকাশিঃ তার দৌলতেই বেঁচে গেলাম এ-যাত্রা।

হেলিই আপনাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে, বলছেন আপনি? মানে, জাহান্নামের পথ থেকেই ফিরে আসছেন সটান?

না। অদুর যেতে হয়নি অবশ্যি। হেলি–মানে হেলির ধূমকেতুর নাম শোনেননি নাকি কখনো? নিরানব্বই বছর অন্তর অন্তর একবার করে পৃথিবীর পাশ কাটিয়ে যায় সেটা। সেই সময়টায় তার বিকর্ষণে কয়েক মুহূর্তের জন্যেই, মাধ্যকর্ষণ শক্তি লোপ পায় পৃথিবীর। তাই অমি তখন ঘড়ি দেখছিলাম বার বার–হেলির ধূমকেতু কখন যায় এ ধার দিয়ে। আজ তার ফিরে আসার নিরানব্বইতম বছর তো! আর ঠিক সেই সময়েই ফেলেছিলেন আপনার আমায়। আমাকে আর মাটিতে পড়তে হয়নি আছড়ে। আকাশের গায় ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম ঠায়। আর আপনারা পেছন ফিরতেই, পাখির মতন বাতাস কেটে সাতরে এসে উঠেছি ওই পাহাড়ে। তারপর থেকেই এই পিছু নিয়েছি. আপনাদের। রিভলভার দুটো লক্ষ্মী ছেলে মতন ফেলে দিন তো এইবার। ব্যস, এখন হাত তুলে চলুন দুজনে গুটিগুটি। সোজা থানার দিকেই সটাং!

নিরানব্বই বছর অন্তর হেলির ধূমকেতু পাশ দিয়ে যায় পৃথিবীর? জানতাম না তো! কখনো শুনিওনি এমন আজগুবি কথা।

অবাক লাগে হর্ষবর্ধনের।

এখন তো জানলেন! পাক্কা নিরানব্বই বছর বাদ ধূমকেতুর আসার ধুমধাড়াক্কার মুখেই আপনার ধাক্কাটা এলো কিনা, তাই দুই ধাকায় কাটাকাটি হয়ে কেটে গেলো। বুঝলেন এখন?

এর নামই নিরানব্বইয়ের ধাক্কা, বুঝলে দাদা? বললো গোবরা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *