নববর্ষের সাদর সম্ভাষণ

নববর্ষের সাদর সম্ভাষণ

সেদিন পয়লা বোশেখ! কমল নিয়ে বসে কি লিখি কি লিখি করছিলাম। কিছুই আসছিল না কলমে।

অবশেষে বিরক্ত হয়ে কলম ফেলে টেলিফোনের রিসিভারটা তুলে নিলাম। সামনেই পড়েছিল রিসিভারটা, আমার টেবিলের এক কোণে।

কিন্তু এখন কাকে ফোন করি? টেলিফোনের রিসিভারটা হাতে নিয়ে ভাবছিলাম। আজ সম্বচ্ছরের প্রথম দিন–কাউকে ডেকে নতুন বছরের সাদর সম্ভাষণ জানালে কেমন হয়?

কিন্তু কাকে জানাই? কাকে আবার! যাকে তাকে, যাকে খুশি তাকেই। আজকের দিনে কে আপনার, কে-ই বা পর? একধার থেকে ডেকে ডেকে সবাইকে আমার শুভেচ্ছা জানিয়ে দিই। ধরে পাকড়ে তাই করাটাই কি ঠিক হবে না?

টেলিফোন ডিরেকটরী নিয়ে নাড়াচাড়া করি। অসংখ্য নাম। নম্বরও বহুৎ। কোন ধার থেকে শুরু করা যায়?

চক্রবর্তীদের নিয়েই আরম্ভ করা যাক না। চ্যারিটি বিগন্স অ্যাট হোম। তাছাড়া বঙ্কিমবাবুও বলে গেছেন–। কী বলে গেছেন? না, চক্রবর্তীদের নিয়ে বিশেষ করে কিছু বলেন নি, তবে চক্রবর্তীদের নিয়েও সেকথা বলা যায়। একটু ঘুরিয়েই বলতে হয় বলতে গেলে। হ্যাঁ চক্রবর্তীকে চক্রবর্তী না ডাকিলে কে ডাকিবে? অতএব একে একে চক্রবর্তীদের ধরে ধরে ডেকে যাই। এবং মিষ্টি করে নববর্ষের সাদর সম্ভাষণ জ্ঞাপন করি। আমার দ্বারা, তাদের চক্রবর্তীসুলভ যৎকিঞ্চিৎ জীবনে কিছু কিছু আরামের আমদানি হোক। ক্ষতি কি?

কিন্তু চক্রবর্তীও খুব কম নেই! তারাই দেড় গজ জুড়ে আছে ডিরেকটরীর। কলকাতার ফুটপাথ হতে পারে, কিন্তু টেলিফোনের পাতারও যে এমন চক্রবর্তী সঙ্কুল এ ধারণা আমার ছিল না। যাই হোক, প্রথম একটা চক্রবর্তীকে পছন্দ করলাম, এবং টেলিফোনটা কাছে এনে রিসিভারটা তুলে ধরলাম যথারীতি নম্বর বলা হলো। অনেকক্ষণ ধারে কোন সাড়া-শব্দ নেই। হালখাতায় বেরিয়ে গেছেন নাকি ভদ্রলোক? এতো বেলা পড়ে থাকতেই? বিচিত্র নয়, চক্রবর্তীরা যেরূপ মিষ্টান্নলোলুপ আর উদরহৃদয়, অবাক হবার কিছু নেই।

বহুক্ষণ বাদে একটা আওয়াজ এল। মাছের মুড়ো মুখে করে কে একজন কথা বলেছ বোধ হল আমার। রং নম্বার। রং নম্বার। রং নম। বলতে বলতেই নিরুদ্দেশে মিলিয়ে গেল সেই আওয়াজ।

ভারী বিরক্তি লাগে। নববর্ষের সাদর সম্ভাষণ জানাতে বসে মন্দ না। ভাব জমাবার গোড়াতেই আড়ি। দূর দূর!

রিং করতে শুরু করি ফের।

আওয়াজটা আবার ঘুরে আসে এসে জানায় : নাম্বার এনগেজট।

এবং এই বলেই আবার সেটা উধাও হবার চেষ্টা করে, কিন্তু আমিও নাছোড়বান্দা। শুনুন মশাই, শুনুন। উপরচড়াও হয়ে আওয়াজটাকে পাকড়ে ফেলি।

বলুন! বলুন তাহলে! আওয়াজটাকে হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে মনে হয়।

আপনিই শ্ৰীযুত চক্রবর্তী? আমি বলি।

না। মেগাফোন বিনিন্দিত কণ্ঠে উনি জবাব দিলেন।

আপনি-আপনি কে তবে?

এই! এই ঠাকুর! ইলিশমাছের বোসট কই আমার? রোসট? ইলিশের গোসত কাবাব? যাও, নিয়ে এস জলদি! তাঁ, কি বলছেন? আমি? আপনি কে? বলেছি তো আমি রং নাম্বার। তার ওপরে এখন আবার রীতি মতন এনগেজড।

তারপর আর কোন উচ্চবাচ্যই নেই। কিন্তু আমিও সহজে পরাস্ত হবার পাত্র না। আমার আরেক ডাকাতি শুরু হয়।ও-বেচারী এখন নাচার-রোসটলেস বলেই হয়তো রেস্টলেস এবং চক্রবর্তীও হয়তো নয়। দেখে শুনে দ্বিতীয় এক চক্রবর্তীকে ডাক দিই।

আপনিই কি মিস্টার চক্রবর্তী?

হ্যাঁ আপনি কে? নিজের নাম বললাম।

টেলিফোনের অপর-প্রান্তবর্তী সশব্দে ফেটে পড়লেন–

বাধিত হলাম। কিন্তু আপনাকে তো আমি চিনি না মশাই! নামও শুনি নি কক্ষনো! আমার কাছে কি দরকার আপনার? .

আজ্ঞে, দরকার এমন কিছু নয়। এই, কেবল আপনাকে আমার নমস্কার–অর্থাৎ–এই নববর্ষের–

কে হে বদ ছোকরা? ইয়ার্কি দেবার আর জায়গা পাও নি? আধঘণ্টা ধরে রিং করে অনর্থক বাথরুম থেকে টেনে আনলে আমায়? এখন ঠাণ্ডা লেগে আমার সর্দি হবে, সর্দি বসে গিয়ে ব্রংকাইটিস হবে। তারপরে নিউমোনিয়া দাঁড়িয়ে নিমতলা হয় কিনা কে জানে! হায় হায়, তোমার মতন গুণ্ডার পাল্লায় পড়ে অবশেষে আমি বেঘোরে মারা পড়লাম।

এবং সঙ্গে সঙ্গে তিনি কানেকশন কেটে দিলেন। নববর্ষ অবধি হয়ে থাকল, সাদর সম্ভাষণটা ভাল করে জানাবার ফুরসন্টুকুও পাওয়া গেল না। সে অবকাশ তিনি দিলেন না আমায়।

আবার ডাক দিতে হলো ভদ্রলোককে। দুঃখের সহিত, সেই বাথরুম থেকেই টেনে আনতে হল আবার। কি করব? কোন কাজ অসমাপ্ত কি অর্ধসমাপ্ত রাখা ঠিক নয়। সেটা চক্রবর্তীদের কাজ না। বিশেষ করে আজকের দিনে কারো সঙ্গে নতুন বছরের প্রথম খাতির জমাতে গিয়ে অখ্যাতি লাভটা যেন কেমন–!

আপনি মিষ্টার চক্রবর্তী?

আলবাৎ! আমি সেই! তুমি কোন বেয়াক্কেলে?

আজ্ঞে, আমি-আমি–আমতা আমতায় দ্বিধাভরে বলতে যাই।

একটু আগেই তো আমার জবাব দিয়েছি, আবার কেন? আচ্ছা তাঁদোড় তো!–

এই বলে সশব্দে তাঁর রিসিভার ত্যাগ করলেন, স্বকর্ণেই শুনতে পেলাম। আমাকে পরিত্যাগ করে আবার তাঁর বাথরুমেই প্রস্থান করলেন বোধহয়। নাঃ, উনি ওঁর জীবনকে সমুজ্জ্বল করতে উৎসুক নন। অন্তত আপাতত এই মুহূর্তে যে নন, তা বেশ বোঝাই যাচ্ছে।

তালিকার তৃতীয় ব্যক্তিকে ধরে টানি এবার।

শ্ৰীযুত চক্রবর্তী আপনি?

ঠিক ধরেছেন? আপনি কে?

আজ্ঞে, আমিও আরেক শ্ৰীযুত–আজ্ঞে হ্যাঁ,চক্রবর্তীই। যুতসই হয়ে জানিয়ে দিই।

ও, তাই নাকি? চোখা গলায় বলতে শুরু করেন তৃতীয় ব্যাক্তি?

দু হপ্তা ধরে আমি গরু খোঁজা খুঁজছি আপনাকে। সেই যে আপনি কেটে পড়লেন দালালির টাকাটা মেরে দিয়ে তারপরে আপনার আর কোন পাত্তাই নেই। আচ্ছা লোক আপনি যাহোক! আপনার আক্কেলকে বলিহারি।

আমি একটু বিব্রত বোধ করি। সাদর সম্ভাষণের পূর্বেই একজন অপরিচিতের কাছ থেকে এতটা মোলায়েম অভ্যর্থনা–এমন সাগ্রহ হাপিত্যেশ আমি প্রত্যাশা করি না। বিশেষ করে একটু আগেই, দুদুটো সংঘর্ষ সামলাবার ঠিক পরেই। আমি তো কেবল সম্ভাষণ করেই সারতে চাই, এবং সরতে চাই। তারপরে আর কিছুই চাই না। কিন্তু ইনি তো দেখছি তারও বেশি অগ্রসর হতে উদগ্রীব। যেভাবে যেরূপ ঘোরতরভাবে আমাকে খোঁজাখুঁজি করেছেন বললেন, তাতে হয়তো এব পরেও রীতিমত ঘনিষ্ঠতা জমাবার পক্ষপাতী বলেই তাকে মনে হয়। এখন, ধরে বেঁধে কোরবানি না করলেই বাঁচি।

আমার তরফে বাক্যস্ফুর্তি হতে বিলম্ব হয়, স্বভাবতই একটু সময় লাগে। একি! চেপে গেলেন যে একেবারে? অন্য তরফে সম্ভাষণের দ্বিতীয় পালা শুরু হয়েছে ততক্ষণে : বেশ ভদ্রলোক আপনি! দালালির টাকাটা তো অক্লেশে মেরে দিয়ে যেতে পারলেন, কিন্তু এই পচা বাড়িতে কোনো মানুষ বাস করে? এঁদো, ড্যাম্পো, মশার আড্ডায়, কাঁকড়া বিছের সঙ্গে থাকতে পারে কেউ? এরকম বাড়ি আমাদের ভাড়া গছিয়ে এভাবে ঠকিয়ে কি লাভ হল আপনার শুনি? তিনি জবাবদিহি চান।

কী জবাব দেব? এবার আমাকেই কানেকশন কাট আপ করতে হলো, সম্ভব বজায় রাখা আর সম্ভব হলো না। দফায় দফায় করো রাহাজানি চললে তার সঙ্গে রফা করে নিজের দফা রফা করা আমার মত সুরাহাবাদীর রপ্ত নয়। কাজেই বিদায় সম্ভাষণ না করেই সাদর সম্ভাষণ স্থগিত রাখতে হল বাধ্য হয়েই–কী করব?

এবার চতুর্থ ব্যক্তির উদ্দেশে ডাক ছাড়লাম। এবং তাকে কাছাকাছি পাবা মাত্রই আর অন্য কথা পাড়তে দিই না, সর্বপ্রথমেই আমার কাজ সেরে নিই ।

শ্ৰীযুত চক্রবর্তী! আপনাকে আমার সাদর সম্ভাষন জানাই। নববর্ষের সাদর সম্ভাষণ!…

কাঁদো কাঁদো গলায় জবাব আসে; তা জানাবে বৈকি! তা না হলে বন্ধু? তা না জানাবে কেন? আজ তো তোমাদেরই সুখের দিন হে, তোমাদেরই স্ফুর্তি। এতদিনে আমার সর্বনাশ হয়েছে, পরশু মামলায় হেরেছি, শুশুরমশাই আত্মহত্যা করেছেন, আর আজ সকাল থেকে যত কাবলেওয়ায় ছেকে ধরেছে, আগামীকার আমায় দেউলে খাতায় নাম লেখাতে হবে, আজই তো তোমাদের মত হিতৈষীদের দহরমের সময় গোয় আনন্দ উথলে ওঠবার দিন তো। আমার সর্বনাশ না হলে আর তোমাদের পৌষমাস ফলাও হবে কি করে?

টেলিফোনের অপর প্রান্তে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে আর্তনাদ উচ্ছাসিত হতে থাকে।

এই ব্যক্তিকেও, এই চক্রবর্তীটিকেও, বরখাস্ত করে দিই তৎক্ষণাত। যে রকম বুঝছি, সব দিক থেকেই আমার সাদর সম্ভাষণের একদম অযোগ্য বলেই একে বোধ হচ্ছে। নববর্ষের জন্য একেবারেই ইনি প্রস্তুত নন। অতএব, পঞ্চম চক্রবর্তীকে বেশ একটু ভয়ে ভয়েই ডাকতে হয়।

সাড়া দিতে না দিতেই সদ্যলদ্ধ চক্রবর্তীমশাই আরম্ভ করেন–বুঝেছি আর বলতে হবে না গলা পেতেই চিনেছি। তা, সুদটা দিচ্ছেন কবে শুনি? আসল দেবার তো নামই নেই। কত জমে গেল খেয়াল আছে? অ্যাঁ? একেবারেই উচ্চবাচ্চই নেই যে! ঢের ঢের লোক দেখেছি বাবা, কিন্তু তোমার মতন এক নম্বরের এমন জোচ্চোর আর একটাও চোখে পড়ল না। একবার যদি সামনে পেতাম মেরে পসতা ওড়াতাম তোমার। পসতালেন তিনি।

আর বেশি শোনবার আমার সাহস হল না। পস্তায়মান এই ধারদাতার ধাক্কায় আমি আঁধার দেখলাম। তা ছাড়া সামান্য সাধারণ একজন, এক নামমাত্র চক্রবর্তী কেই আমি ডাকতে চেয়েছিলাম, এহেন কোন রাজচক্রবর্তীকে না!

রিসিভার নামিয়ে অনেকক্ষণ কাহিল হয়ে থাকি।

তারপর বিস্তর ইতস্তত করে যষ্ঠ ব্যক্তির জন্য রিসিভার তুলি। কথায় বলে, বার বার তিনবার। আবার তিনে শত্রুতাও হয়, বলে থাকে। এতএব, কার্য্যত, তিনবারের ডবল করে, নয় ছয় করে তবেই ছাড়া উচিত।

হ্যালো, আপনি কি শ্ৰীযুত চক্রবর্তী? ও, আপনি? নমস্কার! আমি? আমিও একজন চক্রবর্তী আপনারই সগোত্র নগণ্য এক নরাধম। হ্যাঁ, নমস্কার! আজ নববর্ষের প্রথম দিনটিতেই আপনাকে আমার সাদর সম্ভাষণ জানাচ্ছি। সাদর সম্ভাষণ–আজ্ঞে হ্যাঁ!

অন্য তরফ থেকে অন্যতর চক্রবর্তীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল বেশ গদগদ স্বরে। মোলায়েম তার মিহি হয়ে। এ চক্রবর্তীটিকে অন্যান্য চক্রবর্তীর থেকে একটু স্বতন্ত্র বলেই মনে হয়! বঙ্কিমবাবুর কথাটা রকমফের, হয়ে এঁরও যেন জানা আছে মনে হচ্ছে।

তিনি বলতে থাকেন–ধন্যবাদ! হ্যাঁ, কি বললেন? নামটা তো বললেন, কিন্তু আপনার ঠিকানাটা, একশো চৌত্রিশ নম্বর, বেশ বেশ! রাস্তার নাম? বাঃ। নাম ঠিকানায় কবিতা মিলিয়ে হরিহরাত্ম হয়ে আছেন দেখছি, বাঃ বাঃ! এই তো চাই। ছেলেপিলে কটি? একটি। আপনিই একমাত্র? তার মানে? ও, এখনো বিয়েই হয় নি? হবার আর আশঙ্কাও নেই? তা না থাক! মানুষ আশাতেই, এমন কি, আমঙ্কা নিয়েও বেঁচে থাকে। বয়েসটা কত বললেন? আন্দাজ করা একটু কঠিন? আটাশ থেকে আটাশীর মধ্যে? তাহলেই চলবে। এত কথা জিজ্ঞেস করছি কেন? এক্ষুনি জানতে পারবেন, আমি যাচ্ছি আপনার কাছে। না না, কোন ঘটকালি নয়। তবে আপনি যেমন আমাকে সাদর সম্ভাষণ দ্বারা আপ্যায়িত করলেন, তেমনি আজ নববর্ষের প্রথম দিনে একটা ভাল কাজ আপনার জন্যও আমি করতে চাই। আপনার জীবনবীমাটা আজই করে ফেলুন। শুভস্য শীঘ্রম। জীবন-বীমার দ্বারাই জীবনের সীমা বাড়ানো যায়। এতএব শুভকাজ দিয়েই বছরের প্রথম শুভদিনটা আরম্ভ হোক। কেমন?… দাঁড়ান, এই দণ্ডেই আমি যাচ্ছি।

এই প্রত্যুত্তর লাভের পর বলা বাহুল্য আমি আর দাঁড়াইনি। সেই দণ্ডেই বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *