নিখরচায় জলযোগ

নিখরচায় জলযোগ

সেই থেকে নকুড় মামার মাথায় টাক। ফাঁস করছি সেকথা অ্যান্দিনে….

চালবাজি করতে গিয়ে চালের ফাঁকিতে বানচাল হয়ে–মাথার আটচালায় ঐ ফাঁক! সেদিন যে হাল হয়েছিল যা নাজেহাল হতে হয়েছিল আমাদের….কী আর বলব!

সাড়ে-এগারোটা থেকে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে, ভিড় ঠেলে, ঘোড়ার ধাক্কা সয়ে কতো তপস্যার পর তো ঢুকলাম খেলার গ্রাউন্ডে! ভিড়ের ঠেলায় পকেট ছিঁড়ে যা ছিল সব গড়িয়ে গেছে গড়ের মাঠে। মানে, মামার পকেটের যা কিছু ছিল। আমার পকেট তো এমনিতেই গড়ের মাঠ!

ছিন্ন হয়ে ক্যালকাটা গ্রাউন্ডে ঢুকেছিলাম, ভিন্ন হয়ে বেরুলাম খেলার শেষে। ঐ ভিড়ের ঠেলাতেই।

ভাগ্যিস মামা ছিলেন হুশিয়ার! খাড়া ছিলেন গেটের গোড়ায়, তাই একটু না আগাতেই দেখা মিলল, নইলে এই গোলের মধ্যে (মোহনবাগানের এত গোলের পর) আবার যদি মামাকে ফের খুঁজতে হতো তা হলেই আমার হয়েছিল! আমার হাঁকডাকে কতো জনার সাড়া মিলতো, কতো জনার কতো মামাই যে অযাচিত এসে দেখা দিতেন কে জানে! এই জন-সমুদ্রে আমি নিজেই হারিয়ে যেতাম কিনা তাই কে বলবে! আমার নিজেই খেই হারিয়ে গেলেই তো হয়েছিল।

মামা বললেন, একটু চা না হলে তো বাঁচিনে রে, যা তেষ্টা পেয়েছে, বাপস! গলা শুকিয়ে যেন কাঠ মেরে গেছে জিভ-টিভ সব সুখতলা।

আমারো তেষ্টা লেগেছে মামা–আমি বলি ও তবে চা যদি নেহাত নাই মেলে, শরবত হলেও আমার হয়।

হ্যাঁ, শরবত! বলে চায়েরই পয়সা জুটছে না, তো শরবত! নকুড় মামা চাচান : দু-আনা পয়সা হলে এক কাপ চা কিনে দুভাগ করে খাওয়া যায়। গলাটা একটু ভিজিয়ে বাঁচি–দুজনেই বাঁচি। আছে কি তোর কাছে দু-আনা?

না মামা।

একটা দুয়ানিও নেই? একদম না? দেখেছিস ভাল করে? তা দুয়ানি না থাক– দুটো আনি? দুটো আনি হলেও তো হয়।

অ্যাঁ! তাও না? একটা আনি আর দুটো ডবল পয়সা? নেইকো? যাকগে, তবে চারটে ডবল পয়সা–তাই দে? তাও পারবিনে? তাহলে ডবল আর বে- ডবলে মিলিয়ে বার কর। মোটের ওপর যে করেই আটটা পয়সা হলেই হয়ে যায়। তবুও ঘাড় নাড়ছিস? তাও নেই? তাহলে ফুটো পয়সাই সই–তাই বার কর দেখি আটটা–তাহলেই চালিয়ে নেব কোন রকমে।

না মামা। আমার পুনঃপুনরুক্তি।

আহা, প্রাণে যেন আমার চিমটে কেটে দিলেন? কেতাখ হলুম। মামা আমায়–ন্যা ম্যা ম্যা।

কার্জন পার্কের কোণ অবদি মামা চুপচাপ আসেন, আধমড়ার মতন। তারপর চৌরঙ্গীর মোড়ে পৌঁছাতেই যেন চমকে আবার।চ তোদের পাড়ায় যাই, সেখানকার চায়ের দোকানে নিশ্চয় তোকে ধার দেবে। তোর চেনাশোনা লোক সব-ভাবসাব আছেই! তাই চল্ ।….চা না পেলে আজ আমি বাঁচবো না। পঞ্চত্ব লাভ করবো। দেখিস তুই।

আমার পাড়ার চা-ওয়ালারা? তুমি তাদের চেনো না মামা! এমন খুঁতখুঁতে তোক আর হয় না। এত কেপপণ তুমি সাতজন্মে দ্যাখেনি। আর, এমনি হুঁশিয়ার যে, তুমি যদি সিগ্রেট ধরাতে যাও আর দেশলায়ের বাকস চাও, না?–তারা বাকসর বদলে শুধু একটা কাঠি দেবে তোমাকে, আর খোলটা শক্ত করে ধরে রাখবে হাতের মুঠোয়। বাকসটা হাতছাড়া-ই করবে না, এক মিনিটের জন্যেও নয়, ধার দেয়া দূরে থাক। কেবল তার ধারে কাঠিটা ঘষে তোমার সিগ্রেট ধরিয়ে নাও, ব্যাস। দেশলায়ের গায়ে ঘষতে দেবে কেবল, কিন্তু দেশলায়ের কাছে ঘেঁষতে দেবে না তোমায়। এমনি মারাত্মক লোক সব।

বলিস কিরে, অ্যাঁ? এই বয়সেই সিগ্রেট খাওয়ার বিদ্যে হয়েছে? গোঁফ না গজাতেই বিড়ি ধরাতে শিখেছো? বটে? মামা ভারি খাপপা হয়ে ওঠেন।

বা রে, তা আমি কখন বলুম? এতো আমার চোখে দেখার কথাই বলচি –চোখ দেখার কথা বলেচি কি? আমি আপত্তি করি।

খাসনি? খাসনি তো? খাসনে তো? তাহলেই হলো! না খেলেই ভাল। তুই আমার একমাত্র ভাগনে নোস তা জানি, কিন্তু অদ্বিতীয় তোঃ তোর মতন মার্কামারা আরেকটা তো আমার নেই। তুইও যদি সিগ্রেট ফুকে অকালে যাদবপুর হয়ে কেটে পড়িস, অবশ্যি দুঃখে আমি যাব না, তা ঠিক কিন্তু তাই বলে টি-বি হওয়াটা কি ভাল? তুইও যদি টিবিয়ে কেঁসে যাস–সান্ত্বনা দেবার আরো ভাগনে আমার থাকবে বটে–

কিন্তু, ভাগে যে একটা কম পড়বে তাও বটে! ভয় নেই মামা, আমি তোমার ভাগবো না। জানাতে হয় আমায়।

আমার ভাগ্যি!…এখন আয়, এখানে বসে নিখরচায় চা খাবার একটা বুদ্ধি বার করি…নকুড় মামা বলেন। দুজনে মিলে তখন মাথা খাটাই আমরা। ভিখিরি হলে যেমন ভেক এসে পড়ে, ফকির হলেই তেমনি যতো ফিকির দেখা যায়।

শোন, এক কাজ করা যাক মামা বালান তুই যেন অজ্ঞান হয়ে পড়েছিস এই রকম ভাব দেখাবি। অ্যাকটিং করবি আর কি! আমি তোকে ধরে ধরে নিয়ে যাবো একটা চায়ের দোকানে, কিংবা ঢুকবো কোন একটা রেস্তোরাঁয়–

কী রকমের অ্যাকটিং? প্রথম অঙ্কের আগেই আমার প্রস্তাবনা : ভালো করে বুঝিয়ে দাও আগে।

ডালুদির হস্টিরিয়া হতে দেখেছিস তো? আমার ডালুদি, তোর ডালু মাসি রে? তুই সেই ডালুদির মত সেইরকম গা নাড়তে থাকবি হাত পা কাঁপাবি। যদি কাছে পিঠে কেউ না থাকে তো হাত-পা ছুঁড়তে শুরু করতে–

নকুড় মামা, ন কুরু, আমি সংস্কৃত করে বলি–তারপর ফের ব্যাখ্যা করে দিই সোজা বাংলায়–অমন কার্য্যটি কোরো না। কদাপি না। হিস্টিরিয়া হচ্ছে মেয়েলী ব্যাপার। ছেলেদের ওসব রোগ কি কখনো হয়? কক্ষনো না।

না, হয় না! তোকে বলেছে! ছেলেমাত্ৰই তো এক-একটি রোগ। আর ও জি উই ই। মামা সাদা বাংলায় বলে সিধে ইংরেজিতে বুঝিয়ে দ্যান ফের : শোন, ওসব আদিখ্যেতা রাখ, এখন যা বলছি তাই কর। আমি তোকে ধরাধরি করে নিয়ে যাবো চা-খানায়! এইতো গেল প্রথম দৃশ্য। তারপর আমি যা যা বলি যা যা করি দেখতেই পাবি। তুই ভান করবি আর আমি ভনিতা করবো, কিন্তু আড়চোখে দেখে রাখবি সব ভাল করে কেন না।

হিস্টিরিয়া বানিয়ে আমার লাভ? সমস্ত দৃশ্যটা মনশ্চক্ষে দেখেই এমন আমার বিসদৃশ লাগে। ঘিয়ের মত লাগতে থাকে আমার।

দেখতেই পাবি। হাতেনাতেই দেখবি, হিস্টিরিয়ার দাবাই হলো গরম দুধ, চা, টোসট, কেক, কারি, চপ, কাটলেট, পুডিং, পোচ, ডবল মামালেট, ফিস-ফ্রাই ইত্যাদি! ইত্যাদি!

আর বোলো না, বোলো না! বলতে না বলতেই আমি চলকে উঠি, রাজি হয়ে যাই তৎক্ষণাত।–-কিন্তু মামা, সে তো হলো আমার খাওয়া। তারপর? তোমার দশা কি হবে তারপর?

আরে, সেই কথাই তো বলছি রে। আমি যা-যা করি বলি দেখেশুনে মনের মধ্যে টুকে রাখবি ভাল করে। বলছি কি তবে? আরে, তার পরের দোকানটাতেই তো আমার পালা। তখন হবে হিস্টিরিয়া, আর তোকে করতে হবে আমার তদারক। বুঝেছিস রে হাঁদা?

জলের মতন। বলেই আমি একগাল হাসি। হেসেই হাঁটা বুজিয়ে ফেলি তক্ষুণি। অমন হাঁ, করে মামার ব্যাখ্যানা শুনছিলাম বলেই-ই ঐ হাঁদা–অপবাদ শুনতে হলো আমায়।–ধন্য মামা, ধন্য! এমন না হলে মাথা! মুক্তকণ্ঠে মামার প্রশংসাপত্র বিলাই–অ্যাতো বুদ্ধি ধরে তোমার ধড়ে, অ্যাঁ?

আরে, এ আর তুই কি দেখলি আমার মাথার? মাথা নাড়ে মামা, তো নয়, যেন সার জন মাথাই। বুদ্ধির একটি আটচালা এটি! আট রকমের চাল খেলছে এখানে! সব সময়েই বুঝেছিস?

তারপর আমাদের মামা-ভাগনের অভিযান শুরু হলো। অভিনয়ের দায় পড়লো আমার। প্রাথমিক শুশ্রষার ভার নিলেন মামা। বেন্টিক স্ট্রীট ধরে প্যারাডাইজ সিনেমার ধার দিয়ে আরম্ভ হলো আমাদের অভিযান।

আমার হাত পা কাঁপতে থাকলো, ডালু-মাসির মতই যতো ডালপালা নড়তে লাগলো আমার। দাঁতে দাঁতে লেগে গেল, চোখ বুজে এলো দেখতে না দেখতেই।

নকুড় মামা, আমাকে সযত্নে ধরাধরি করে এক চায়ের দোকানে এনে বসালেন।

চেয়ারটায় বসতেই আমি এলিয়ে পড়লাম।

নকুড় মামা, যাতে আমি গড়িয়ে মাটিতে না পড়ি, লক্ষ্য রাখবেন সেদিকে। আর জামার গলার দিকে বোতামগুলো খুলে দিলেন আমার। দোকানের টেবিলে সেদিনের সে খবরকাগজ পড়েছিলো, কাউকে একটিও কথা না বলে নকুড় মামা তাই দিয়ে সজোরে হাওয়া করতে লাগলেন আমায়। আমিও উঃ! আঃ! ইঃ! ঈঃ! এঃ! ওঃ! ঐঃ! ঔঃ! স্বরবর্ণের থেকে এইরকম এক একটা বিচ্ছিরি আওয়াজ বার করতে লাগলাম যে বলবার নয়।

ও মা, মা গো! ও মামা গো!–তারস্বর বেরুতে থাকে আমার। তাড়িতে বার্তার মতই চাপা যায় না কিছুতেই।

দেখেশুনে ব্যস্ত হয়ে উঠলো দোকানদার। সেই সঙ্গে, দোকানে বসে যারা চা খাচ্ছিল তারাও–কি হয়েছে, কি হয়েছে এর?

হিস্টিরিয়া আছে ছেলেটার। জানালেন মামা।

হিস্টিরিয়া! কী সর্বনাশ!

না, ও এমন কিছু না। ভাবনার কিছু নেই। খানিক একটু হাত-পা চালবে চাঁচাবে, এই রকম। তারপর দুয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সেরে যাবে আপনা থেকেই।

দু-এক-ঘন্টা! শুনেই তো আর্তনাদ করে উঠেলো দোকানদার–দু-এক ঘণ্টা কি গো?

না না, ভয়ের কিছু নেই। অজ্ঞাত হয়ে পড়বে এক্ষুণিই। তারপর ওর শিরদাঁড়া বেঁকে যাবে। ধনুষ্টঙ্কার হতে পারে, হয়তো, তবে ভাববেন না আপনারা। ঘাবড়াবেন না কিছু সাধারণতঃ ওর ধনুষ্টঙ্কার বড় একটা হয় না।

কিন্তু ছোট একটাও তো হতে পারে? কাটলেট হাতে করে একজন এগিয়ে এলো : সেও তো খুব ভাল নয়। অন্তত দেখতে শুনতে ভাল নয় নিশ্চয়ই।

দেখতে? না, দেখতে ভাল না, সেকথা ঠিক। সায় দিলেন মামা শিরদাঁড়া বেঁকে যাওয়া কি দেখতে কখনো ভাল হয়? সে ভারি বিশ্রী। সত্যিই!

চায়ের দোকানের ইতর-ভদ্র সবাই এসে ঘিরে দাঁড়ালো। মামা আরো জোরে জোরে হাওয়া করতে লাগলেন আমায়।

কি করলে সারে? ওষুধ-টষুধ কিছু নেই এর? জিগ্যেস করলেন এক ভদ্রলোক।

এর আর ওষুধ কি? এমনিতেই সারবে একটু সময় নেবে খালি, এই যা। ধাক্কাটা কেটে গেলে সামলে উঠবে আপনিই। তবে বলকর কিছু একটা ওর পেটে পড়লে তার আগেই হয়তো সামলানো যায়। দুধ-টুধ আছে? দিতে পারেন একটা গরম করে? নিদেন এক কাপ গরম চা হলেও চলে।

এক গেলাস গরম দুধ এলো চিনি মেশানো! এক পেয়ালা চাও পেলাম, চা-টা আর আমি খেলাম না, অকারণ নষ্ট হয়ে যায় কেন, তাই কষ্ট করে মামাই সেটা মারলেন। সহানুভুতিরপরবশ একজন বললেন–আহা, শুধু দুধে কি হবে? একটু পাউরুটি ফেলে দাও ওতে। কিংবা একটা মামলেট করে দাও না ছেলেটাকে! পেটে কিছু শক্ত খাবার না পড়লে কি শক্তি আসে? মামলেট পড়লেই সামলে উঠবে মনে হয়। আচ্ছা, আমি দিচ্ছি দাম, দাও ওকে একটা মামলেট।

ডবল ডিমের মামলেট। বলতে মামা লেট খেলো না একটুও। মনে মনে মামার ধন্যবাদ জানালাম। এমন না হলে মামা?

মামলেট খেয়ে সামলালাম সত্যিই। কিন্তু একটুখানি, ওতে কি এই প্রচণ্ড ক্ষিদে মেটে? ফের আমার উপসর্গগুলি ফিরে আসতে লাগলো। আবার আমি অজ্ঞান হবার মত হলাম, এলিয়ে পড়লাম চেয়ারে। হাত-পা খিচুনি শুরু হলো আবার।

একটু ঘোলের শরবত করে দিতে পারনে? এ-ব্যারামে ঘোলটা খুব উপকারী।

মামার বললেন যেন একটু নিরুপায় হয়েই–অবশ্যি, অভাবে মাংসের জুস কি মুর্গির সুরুয়া হলেও হয়।

চায়ের দোকানে আর ঘোল-টোল কোথায়? অভাবে, মাংসের ঝোলই এলো কয়েক টুকরো মাংসও এলো সেই সঙ্গে। দু-তিন পীস রুটিও এসে গেল তার সাথে। এলোচা। খেয়ে-টেয়ে সত্যিই এবার আমি চাঙ্গা হলাম। পায়ে জোর এলো, গায়ে জোয়ার। এতক্ষণে আমার হিস্টিরিয়া ছাড়লো। উঠে দাঁড়ালাম আমি, ছাড়লাম সেই দোকান। পাড়ি দিলাম আমরা আরেকটায়।

পরেরটা একটা রেস্তোরাঁ। এবার ছিলো মামার অসুখের পালা। আমার সমস্ত দুর্লক্ষণ তখন দেখা দিলো মামার। আর আমি তার হেফাজতে রইলাম।

রেস্তারার এক কোণে মামাকে বসিয়ে গলার বোতামগুলো খুলে দিলাম পটাপট। খবরের কাগজের অভাবে নিজের শার্ট খুলেই হাওয়া করতে লাগলাম। নার্সিং-এর আমার মেডইজি–এই শার্ট-কাট।

অনে লোক ছিলো দোকানটায়, কিন্তু কেউ আমাদের দিকে লক্ষ্যটাই করল না। মামা, তোমার উঃ আঃ গুলো তেমন জোরে হচ্ছে না, শুনতেই পাচ্ছে না কেউ। ফিসফিস করলাম মামার কানে কানে।

 তুই কি লাগিয়েছিস বলতো? শার্ট দিয়ে পিটোচ্ছিস খালি আমায়? এই কি তোর হাওয়া করা নাকি? ফিসফিসিয়েই জবাব দিলেন মামা, যা মার লাগিয়েছিস বাপু তোর জামার! আমি তো মারা গেলাম। বলে ওরই এক ফাঁকে চট করে নিজের নাকে একটু হাত বুলিয়ে নিলেন।

হাত-পা খেচুনির আগেই মামার দাঁত-মুখের খিচুনি দেখা গেল। দেখতে হলে আমাকেই।

বা রে! আমারো রাগ হয়ে যায়, সত্যিই! হাওয়া করতে গিয়ে তার চোটে যে জামার এতগুলো বোম উড়ে গেল আমার, তার কোনো কথাই নাই! আমার এই স্বার্থত্যাগটা যেন কিছুই না! মামার

এই সেলফিশনেস আমার ভারি খারাপ লাগে।

চেয়ারে তুমি কাত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তোমার কাতরানি বাপু মোটেই ঠিকমতো হচ্ছে না একেবারেই। দোকানের মালিকের কানে না গেলে কি করে হবে?

তারপর মামা সত্যিই সত্যিই ছাড়লেন একটা যা! রাতবিরেতে ছাতের ওপর বেড়ালছানা যেমন ছাড়ে সেইরকম একখানা আওয়াজ। পটাপট আরো গোটাকতক বোম ছিঁড়ে গেল। আমার ছিড়লো আমার হাওয়ার ঠেলাতেই। কিন্তু আমি গ্রাহ্যই করলাম না! ( কারো অসুখ-বিসুখে নিজের লাভ-ক্ষতির দিকে থাকালে চলে না। তাই আমি জামার দিকে তাকালাম না, মামার দিকেও নয়। মামা নাক মুখ সিটকালেন, কিন্তু কি করবো? শক্ত রোগীকে কি কখনো জামাই-আদর করা যায়?

চিঁ চি গলায় শুরু কর মামা হাউ মাউ করে উঠলেন শেষটা—

মিঁ-মিঁ-মিঁ- মিঁয়াও!…

অমন করে ডাকলে স্বয়ং মা জগদম্বাই এসে দেখা দেন, আর, মিঞা না এসে পারে? এগিয়ে এল দোকানদার–

এ কি? এসব কি হচ্ছে এখানে? এটা কি তোমার ওস্তাদির আখড়া পেয়েছে নাকি? গলা ভাঁজবার আর জায়গা পাওনি? গানের কসরতের জায়গা এ নয়। বললেন লেকটা।

অসুখ করেছে মামার। আমি জানালাম।

অসুখ করেছে তো এখানে কি? এখানে কি? ডাক্তারখানায় নিয়ে যাও! সোজা পথ দেখলো সেঃ ঐ যে, সামনেই তো ডাক্তারখানা। চোখের সামনেই দেখচো না?

ওষুধে সারবার অসুখ নয় এ। আমি বলে–এ হোলোগে হিস্টিরিয়া। ভালোমন্দ কিছু পেটে পড়লেই সারে। দেখছেন না, হাঁ করছে কি রকম?

হাঁ করছে? কুইনিনই হচ্ছে এর একমাত্র দাবাই, আছে আমার কাছে, এক্ষুণি আমি আনছি, দাঁড়াও।

আমি তো দাঁড়িয়েই ছিলাম, কিন্তু মামা আর দাঁড়ালেন না!

কুইনিনের নাম শুনেছি তার হ বুজে এসেছিল! হাঁ-হাঁ করে তিনি উঠে পড়লেন। সেরে উঠলেন চটপট। সরে আসতেও তার দেরি হলো না। এক মিনিটও আর তিনি দাঁড়ালেন না সেখানে। তারপর আর একটু রেস্ট না নিয়ে রেস্তেরা থেকে দৌড়ে আমরা বেরিয়ে এলাম।

একটা দোকান অমনি-অমনি চলে গেল আমাদের। যাক গে, গোটা বেন্টিক ইসটিই পড়ে আছে এখনো। বহরে খাটো, দেখতে বেঁটে হলে কি হবে, চায়ের দোকানের কিছু কমতি নেই রাস্তায়! আর এই শহরেই বা কম কি? আর, সব চা-ওয়ালাই এমনি ডাক্তার নয় সবার কাছেই কিছু কুইনিন মজুত নেই।!

পরের দোকানটাতেই মামার পেটে চা-মামলেট প্রভৃতিরা এসে পড়ে।

আর পড়তে থাকে পরের পর। তারপর থেকে চলতে থাকে এমনি ধারা। একবার আমি পড়ি, মামা ওঠেন। তারপর মামা পড়েন, আমি তাঁর শুষা করি। মামার আর আমার সেবায় উঠে পড়ে লাগি–পরম্পরায়। চললো এই রকম দোকানের পর দোকান।

চৌহদ্দিটার চারধারে চক্কর মেরে চা-র চক্রান্ত চলতে থাকে আমাদের। খেয়ে খেয়ে পেট ফুলে ঢোল হয়ে উঠলো দুজনেরই। আমাদের জয়ঢাকও বলা যায়।

বেন্টিক স্ট্রিটের মোড় ঘুরে কফি-হাউসের পাশ কাটিয়ে যাই, সেখানে ঢুকতে সাহস হয় না আমাদের। কফি-হাউসের মতন অত বড় স্টেজে অভিনয় করা কি চাট্টিখানি? অগত্যা স্যান্ডউইচ, পটেটো-চিপ আর কাজুবাদামের মায়া কাটিয়ে, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ দিয়ে ফের আসি ধর্মতলার মোড়টায়। বেন্টিক স্ট্রিটের গোড়াতেই ঘুরে আসি আবার।

চা খেয়ে-খেয়ে মানুষ চাতাল হয় কি না জানি না, কিন্তু যেতে-যেতে আর খেতে-খেতে পথঘাট আর দোকানপাট কখন যে গুলিয়ে গেছল আমাদের! আবার যে আমরা ঘুরপাক খেয়ে আগের দোকানে সবরের আগেকারটায় ফিরে এসেছি তো খেয়ালই হয়নি একদম।

চমক ভাঙল যকন টনক নড়ল দোকানদারের–আরে, এরা যে আবার ফিরে এসেছে রে! ঘুরে এসেছে আবার! দ্যাখ দ্যাখ, ফের সেই সেই হিস্টিরিওয়ালারা!

খালি দোকানদারই নয়, আগের চাপায়ীদের যারা তখন সেই দোকানে ছিল, তারাও বেশ অবাক হলো আমাদের আবিভার্বে।

বেয়ারিং চিঠির মতন ফের আমাদের ফেরত আসতে দেখে চাওয়ালাকে মোটেই খুশি দেখা গেল না। বেয়ারিং ডাক মানেই তো বেয়াড়া এক ডাকাতি। গাঁটের পয়সা খসিয়ে তাকে খালাস কর? আমাদের মতো অখদ্যে যত অখদ্দেরকে খাইয়ে খাইয়ে লাস কর! তাতে কার লালসা হয়?

কিন্তু ভেবে দেখলে, এতে এমন অবাক হবার কি ছিল? হিস্টিরি যখন রিপিট করে, তখন হিস্টিরিয়া কি রিপিট করতে পারে না? অবশ্যি, একটা খুঁত হয়েছিল বটে, সামান্যই সেই একটুই যা গলদ এক জায়গায়! মামার পালা পড়েছিল এবার! আমার হিস্টিরিয়া মামার জিওগ্রাফিতে রিপিট করেছিল এইটুকুই যা! হিস্টিরি আর জিওগ্রাফিতে গোল বেধেছিল শুধু এইখানেই ইতিহাস আর ভূগোল পালটে ছিল এই একটুখানিই। এমন কিছু ইতরবিশেষ নয়।

আমাদের অজ্ঞাতসারে, আমার হিস্টিরিয়া, মামার মানচিত্রে কম্পমান হয়ে দেখা দিয়েছিলো।

একটুকুই যা খুঁত। নামমাত্রই। এছাড়া, আর সবই আমরা ঠিক করেছি। জামার বোম খোলা, খবরের কাগজের হাওয়া লাগান বিলকুল! আমার দিক থেকে কোন ত্রুটি হয়নি। মামার অভিনয়ও যদ্দুর নিখুঁত হয়। কিন্তু হলে কি হবে, দোকানদাররা তবুও কেমন খুঁতখুঁত করে।

অ্যাঁ? এরকমটা হোলে যে? এ-রকম কেন? সেবারে দেখলাম বাচ্চাটার, এবারে দেখছি ধাড়ীটাকে ধরেছে। অ্যাঁ, এ কিরকমের ব্যায়রাম? খালি আওড়ান।

ভারী শক্ত ব্যায়রাম। আমি বললাম–ছোঁয়াচে ব্যায়রাম কি না! এপি ডেমিক তো একেই বলে। আমার থেকে মামার হয়েছে। মড়ক হলে যেমন হয়ে থাকে। যাই হোক, এ হচ্ছে হিস্টিরিয়া, এর ওষুধ হচ্ছে মামলেট। ডবল মামলেট। নিদেন একখানা মোগলাই পরোটা হলেও হয়।

কুছ পরোয়া নেই। সারাচ্ছি আমি এই ছোঁয়াচে। এই দণ্ডেই। এই! নিয়ায় তো গরম জলের কেটলিটা। হাঁকলো সেই চা-ওয়ালা।চায়ের দরকার নেই। পারেটারও পরোয়া করে না। সুষ্ঠু গরম জলেই সারবে এই রোগ।

টগবগে ফুটন্ত জলের কেটলিটা এসে পড়লো। চায়ের জল গরম হচ্ছিল যেটায়।

উপুর কর। দে উপুর করে পুরো কেটলিটা এই লোকটার উপর। হ্যাঁ তার আগে এই ছোঁড়াটার মাথাতেও ছটাকখানেক ছাড়।

শুনতে না–শুনতেই আমি ছটকে আসি–-বারে। আমি কেন? আমাকে কেন? আমার মাথায় কিসের জন্যে? আমার তো হিস্টিরিয়া হয়নি?

হয়নি, কিন্তু হতে কতক্ষণ? প্রিভেনসন ইজ বেটার দ্যান কিওর, পড়োনি বইয়ে? ব্যায়রাম হবার আগেই তো সারাতে হয়। কে জানে, তোমার হয়তো ফের জিওগ্রাফিয়া হতে পারে, সে আরো শক্ত অসুখ! আরো বেশি ছোঁয়াচে। তার আগেই আরাম করা যাক তোমায়।

আরামের কথা পাড়তেই আমি লাফ মারি। এক রাম লাফ। রামরাজ্যসুলভ লাভ! আর সেই এক লাফেহ সারা ধড়ামতলা পেরিয়ে আসি।

আর মামা? মামাও বেরিয়ে আসেন–তবে কিনা, একটু দেরি করে, আর মেডিক্যাল কলেজ হয়ে। মাসতিনেক বাদে।

আর, তার পরেই–সেই মাথার ফাঁড়ায়– সব চুল উঠে গেল মামার, টাক পড়ে গেল তাঁর। হবেই, জানা কথা। গরম জল চুলের বেজায় ক্ষতিকর। তাতে চুল উঠে যায়; পড়েছিলাম হাইজিনে। কথাটা মিথ্যে নয়। ট্যাকসো না দিয়ে চা খেতে গেলে যা হয়, বিনে পয়সায় ঐ টাক–Show!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *