প্রবীর পতন

প্রবীর পতন

নেহাত অমূলক নয়। বরং বলতে গেলে বলতে হয় মূলোই এই কাহিনীর মূলে।

কথায় বলে শত্রুর শেষ রাখতে নেই। সমূলে তাকে সংহার করাই উচিত।

আমার সংহার পর্বটা প্রায় তার কাছাকাছিই যায়। সমূলে তাকে আমি শেষ করেছি।

সেদিন রবিবার হলেও সবাই আমরা গেছি ইস্কুলে। আমার, মানে, আমাদের সেকেন্ড ক্লাসের ছেলেরাই কেবল; আমাদের কেলাসে গিয়ে জমেছি সক্কলে।

ইস্কুলের বার্ষিক উৎসবের দিনে একটা নাটক অভিনয়ের কথা হচ্ছিল। সেদিন সেই নাটকের মহড়া শুরু হবার কথা।

কী নাটক আমরা জানিনে। আমাদের বাংলার স্যার লিখেছিলেন পালাটা। আর, তার বিভিন্ন ভূমিকায় অভিনয় করবার পালা ছিল আমাদের। সেদিনকে সেই সব পার্ট বিলি হবার কথা।

ক্লাসের আমরা বসতে না বসতেই স্যার এসে দাঁড়ালেন। হাতে-খেড়ড়া বাঁধা মোটা একটা খাতা। সেইটেই তাঁর স্বরচিত নাটকের কপি বলে মনে হলো আমাদের।

জনা-কে কেউ জানো তোমরা? ক্লাসে বসেই তিনি শুধোলেন আমাদের। কারো মুখে কোন জবাব নেই। কোন জনার কথা উনি বলছেন কে জানে। কত জনাকেই তো জানি।

প্রবীরের মা জনা। তিনিই জানালেন।

আমরা সবাই একদৃষ্টে প্রবীরের দিকে তাকালাম।

প্রবীর ত তার মার নাম কোনদিন আমাদের জানায়নি স্যার। আমি বললাম–জানব কি করে?

কেউ কি তার মার নাম কখনো মুখে আনে? আপত্তি করে প্রবীর : আনতে আছে কি? মা গুরুজন না?

মহাগুরু। সায় দিলেন মাস্টারমশায়। কিন্তু আমাদের প্রবীরের মার কথা এখানে হচ্ছে না। পৌরাণিক প্রবীরের কাহিনী নিয়েই আমার নাটকটা। মহাভারতের প্রবীর–যেমন বীর তেমনি যোদ্ধা। তাকে নিয়েই আমাদের এই পালা। আর সেই প্রবীরের মার নামই হচ্ছে জনা।

তাই বলুন স্যার। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

আমার নাটিকাটির নাম হচ্ছে জনা, ওরফে প্রবীন পতন। বললেন বাংলার স্যার। মহাকবি গিরিশচন্দ্র বিখ্যাত বই জনা-কে কেটে হেঁটে তোমাদের উপযোগী করে বানিয়েছি আমি।

তারপর তাঁর কথার সারাংশ প্রকাশিত হলো–প্রবীরই হলো এই বইয়ের হীরো। নাটকের যেন পার্ট। এখন তোমাদের মধ্যে কে এই পার্ট নিতে চাও জানাও আমায়।

ক্লাসশুদ্ধ সব ছেলেই আমি আমি করে উঠল। আমি স্যার…আমি স্যার.. আমি স্যার। এবং আমিও।

হীরো হতে চায় না কে? আমার আমিত্বও কারো চাইতে কিছু কম নয়। হারবার পাত্র নয় কারও কাছে।

কিন্তু প্রবীর বলল–না স্যার, আমাকেই এই পার্ট দেওয়া উচিত আপনার। আমি এর জন্য আগের থেকেই বিধিনির্দিষ্ট।

বিধিনির্দিষ্ট? বাংলার স্যার বিস্মিত।

নইলে স্যার আমার নাম প্রবীর হতে গেল কেন? এই স্কুলে আমি পড়তে এলাম কেন? এখানে ভর্তি হতে গেলাম কেন? এই কেলাসে প্রোমোশনই বা পেলাম কেন?

এত কেন-র জবাবে আমার ছোট্ট একটি প্রতিবাদ–তোর নাম প্রবীর হতে পারে, কিন্তু তোর মার নাম তো আর জনা নয়। বইটার নাম শুনেছিস? জনা ওরফে প্রবীর পতন।

মার নাম জনা না হতে পারে কিন্তু জনাই আমাদের দেশ। জানায় প্রবীর।

জনাই? যেখানকার মনোহরা বিখ্যাত? মাস্টারমশাই জিজ্ঞেস করেন–মনোহরা নামক মেঠাই প্রসিদ্ধ যেখানকার?

হ্যাঁ স্যার, সেখানেই আমার জন্ম। সেই জনাই আমার মাতৃভূমি। আর মা আর মাতৃ মা তো এক; তাই নয় কি স্যার?

তা বটে। ঘাড় নাড়েন বাংলার স্যার–সে কথা ঠিক। জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী।

তাহলে পার্টটা আমার পাওয়া উচিত কিনা আপনি বলুন স্যার?

কিন্তু শুনেছ তো, বইটার নাম প্রবীর পতন। প্রবীর খুব বীর হলেও যুদ্ধ করতে করতে পড়বে শেষটায়। শেষ পর্যন্ত মারা পড়তে রাজি আছ তো তুমি?

কেন মরব না স্যার? সত্যি সত্যি তো আর মরতে হবে না। তবে যতক্ষণ আমি পারব বীরের মত লড়াই করে যাবো। সহজে মরব না স্যার–তা কিন্তু আমি বলে দিচ্ছি।

তোমাকে পাঁচ মিনিট লড়াই করতে হবে, তার বেশি নয়। তারপর যেই আমি উইং এর পাশে থেকে ইশারা করব–এইবার, তক্ষুনি তোমাকে ধপাস করে পড়তে হবে কিন্তু গায়ে একটু লাগতে পারে; কিন্তু তা গ্রাহ্য করলে চলবে না। এর নাম হচ্ছে পতন ও মৃত্যু। ভেবে দয়াখো কথাটা…রাজি আছ?

এক কথায় সে রাজি। তার নামের টু-থার্ড বীর তো-সেই কথাটাই, আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে সে বললে যে বীরের মৃত্যু তার শিরোধার্য। (আহা, নামমাত্র মরে নাম করতে কে চায় না যেন।)

প্রবীরের পার্টটা সে-ই পেল। আর সব পার্টও বিলি হলো। সবাই পেল এক একটা পার্ট আমিও পেলাম একটা।

আমারটা কাটা সৈনিকের পার্ট। তাতে কোন বক্তৃতা নেই, লম্ফ ঝম্ফ কিছু না। স্টেজের এক কোণে চুপটি করে মড়ার মতন শুয়ে থাকা কেবল। নাকে মাছি বসলেও নড়া চলবে না, মশা কামড়ালেও নয়। প্রবীর যখন বীরদর্পে তার তরোয়াল ঘুরিয়ে স্টেজময় দাপাদাপি করে লড়াই কররে, আমি তখন লাশের মতোই পড়ে থাকব এক পাশে। একটি কথাও কইতে পারবো না। ও যদি আমার পায়ের কাছেও এসে লাফায়, আমায় ডিঙিয়ে যায়, বারংবার আমার এধার থেকে ওধারে টপকাতে থাকে, এমন কি আমার ওপরে দাঁড়িয়েই লড়াই জমায় তবু আমি মোটেই ওকে ল্যাং মারতে পারব না। আমার মুখে যেমন কথাটি নেই, পায়ের বেলাও ও-কথা নয়।

সেরকম কথা থাকলে স্টেজের ওপরে শুয়েই এইসা একটা ল্যাং মারতাম ওকে যে বাছাধনের আর পাঁচ মিনিট ধরে লড়াই চালাতে হত না, সেই একটি ল্যাংয়েই পতন। আর পতনের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু।

কিন্তু মাস্টারমশাই বললেন, প্রবীর যাই করুক না, আমার পক্ষে কোন ল্যাং বা ল্যাংগুয়েজ নাস্তি।

বইয়ের সব পাটেরই ব্যবস্থা হলো, কিন্তু জনা সাজতে রাজি হলো না ছেলেদের কেউই। পার্টটা ডিফিকালট বলে নয়, মেয়ের পার্ট বলেই। বরং নেপথ্যে কোলাহল হতে রাজি হলো কিন্তু জনা হতে একজনাও না।

তখন মাস্টারমশাই নিজেই জনার পার্ট নিলেন।

জোর মহলা চলল তারপর কদিন ধরে। তেঁড়ে কুঁড়ে হাত পা নেড়ে যা শুরু করল প্রবীরটা…

দাও মাগো সন্তানে বিদায়।
চলে যাই লোকালয় ত্যজি।
ক্ষত্রিয়-সন্তান,
অপমান–কত সবো আর?…

তাকিয়ে দেখবার মতোই ব্যাপার। তার অঙ্গভঙ্গী রকমসকম হাবভাব দেখে, এমন কি, প্রবীর-প্রসবিনী জননী জনা (ওরফে আমাদের বাংলার মাস্টারেরও) তাক লেগে যায়।

আর এমন রাগ ধরে আমার। হাত পা খেলানো অ্যায়সা চমৎকার পার্টটা আমার হলে কী মজারই না হত। অবিশ্যি, শেষ পর্যন্ত, ‘পতন ও মৃত্যু’ অবধারিত হলেও আমার কোন আপত্তি ছিল না। তার বদলে আমাকে হতে হলো কিনা কাটা সৈনিক । চিরকাল ধরে দেখে আসছি আমার কপালটাই এমনি ফাটা।

তাহলেও, নিজের পার্টটা তৈরি করতে কোন কসুর ছিল না আমার। সুবিধের এইটুকু যে, এর রিহার্সাল স্টেজে না দিলেও চলে, নিজের ঘরে বিছানায় শুয়ে শুয়েই আরামে রপ্ত করা যায় বেশ খানিকক্ষণ নিঃস্পন্দ হয়ে পড়ে থাকা–এই বইতো নয়।

বিছানায় শুয়ে শুয়েই মতলব খেলতে থাকে আমার মাথায়। দাঁড়াও বৎস, তোমার ঐ হাত পা নেড়ে বক্তৃতা দেওয়া বার করছি আমি-এর ল্যাং মারতে না পারি, কিন্তু তোমার ঐ ল্যাংগুয়েজই মারব তোমায়। ল্যাং-ল্যাংগুয়েজ নাই মারলাম, ল্যাংগুয়েজের ল্যাং মেরেই কেড়ে ফেলব তোমাকে–দাঁড়াও না।

উৎসবের দিন সকার বেলায় এক কোচর মুড়ি আর আস্ত একটা মূলো নিয়ে প্রবীরের পাড়া দিয়ে যাচ্ছি–দেখি যে তখনো সে তার পার্ট নিয়ে দারুণ সোরগোল তুলেছে। সারা বাড়ি ফাটিয়ে পার্ট দিয়ে তার বাড়াবাড়ি।

সামনে দিয়ে আমায় যেতে দেখে সে বলল–কি খাচ্ছিস রে?

মুড়ি আর মূলো।

দিবি আমায় দুটি?

তা খা না, কত খাবি। বজার থেকে আজ এক ঝুড়ি মূলো নিয়ে এসেছে আমাদের বাড়ি। তুই খা ততক্ষণ, আমি পোস্টাফিস থেকে বাবার জন্যে ডাকটিকিট কিনে আনি।

বলে মূলো আর মুড়ি তার জিম্মায় রেখে আমি চলে গেলাম। বেশ খানিকক্ষণ বাদ ফিরে এসে দেখি, মুড়ির স্বাদ আর আমায় পেতে হবে না–মুড়ির সঙ্গে আস্ত মূলোটিও খতম। আমূল সে শেষ করেছে সবটা।

যাকগে-খাকগে। কথায় বলে বীরভোগ্যা বসুন্ধরা। সেই বসুন্ধরার সামান্য একটা মূলোর গোটাটাই সে হজম করবে সে আর বেশি কি। আজকের দিনটির বীর তো ঐ প্রবীরই।

উৎসবের ক্ষণটি এলো অবশেষে। ঠিক দুপুরবেলায় স্কুলের প্রাঙ্গণে খাটানো সামিয়ানার তলায় প্রথম সারিতে বসে হেড স্যার, জেলার ম্যাজিস্ট্রেট, আর পুলিস সাহেব এবং আমাদের ছোট্ট শহরের আরো সব বড় বড় লোক।

দৃশ্যপট উঠল স্টেজের।

আলুলায়িতকুন্তলা জনা। (ছদ্মবেশে আমাদের বাংলার স্যার) স্টেজের মাঝখানে দাঁড়িয়ে, আর প্রবীর তার সামনে খাড়া। কাটা সৈনিকের ন্যায় আমি রণক্ষেত্রের এক পাশে ধরাশায়ী।

হাত পা নাড়া দিয়ে শুরু হলো প্রবীরের

দা-দাও মা-মা গো স-স-স-সন্তানে বিদায়-হিক-হিক-হিক-….দা-দাও মা-মা গগা…হিক…হিক…

হেঁচকিরা এসে ওর বক্তৃতার তোড়ে বাধা দিতে লাগল।

দাদা আর মামা পাচ্ছ কোথায়? ফিস ফিস করলেন জনা।-তোমার তো তোতলামি ছিল না, এ ব্যরাম আবার কবে থেকে?

প্রবীর। চ-চ-চ-চ-চ-চ-চ-চ-….

জনা (জনান্তিকে) এই সেরেছে।

প্রবীর। চলে যাই হিক হিক…লো-লোলো-লো লোকালয় ত্যজি-হি-হিক

কী হচ্ছে কি। জনা এগিয়ে গেলেন প্রবীরের কাছে–ওমা, দারুণ মূলোর গন্ধ বেরুচ্ছে যে মুখ দিয়ে। মুলো খেয়েছিল না কি আজ? প্রবীবের কানে প্রশ্ন তার।

আ-আমি মূ-মূ-মূ-মূলো হিক হিক হিক খা-খাইনি স্যার। ও-ও-ও আমায় খা-খাইয়ে দিয়েছে বলে সে ধরাশায়ী আমায় একটা তরোয়ালের খোঁচা লাগায়।

খাইয়ে দিয়েছে। জনা-মশাই তো অবাক।

হ্যাঁ স্যার। ও বলললে যে খা। তখন কি জা জানি মূ-মূ-মূ-মূ-মূলো খেলে এমন হেঁ হেঁ হেঁ হেঁচকি ওঠে। হিক হিক।

জনার মুখে কথাটি নেই। আড়চোখে দেখি দেখি তিনি রোষ-কষায়িত নেত্রে তাকিয়ে রয়েছেন আমাদের দুজনার দিকেই।

আবার শুরু করে প্রবীব ও লোকালয় ত্যজি।

ক্ষ-ক্ষ-ক্ষ-ক্ষ-ক্ষ-ক্ষ-হিক হিক।

প্রবীরের ক্ষয় আর শেষ হয় না। কিন্তু ওকে ক্ষয়িষ্ণু হতে দেখে মাস্টারমশাই আর সহিষ্ণু থাকতে পারলেন না। খুব হয়েছে। বেশ চড়া গলাতেই বলে ফেললেন এবার।

কিন্তু প্রবীরের হেঁচকি উঠতেই লাগল। জনার ধিক্কারে তার হিক্কার বাধা পেল না একটুও।

জা-জানি সার। ও আমার শত্রুর। চি-চি-চিরদিন জানি। কি-কিন্তু এত বড় শত্রুর তা-তা আমি জা-জা জানতুম না।

বলে সে আমাকে আবার এক তরোয়ালের খোঁচা লাগাল।

পড়ে পড়ে মার খেতে হয় আমায়। কিন্তু মড়ার উপর খাড়ার ঘা কত আর সওয়া যায় বল?

আমি লাফিয়ে উঠি। উঠে দৌড় মারি স্টেজ থেকে। আর প্রবীর এদিকে প্রাণ ভরে হেঁচকাতে থাকে।

হেঁচকি সমেত প্রবীরকে এক হ্যাঁচকায় টেনে নিয়ে জনাও স্টেজে তেকে অদৃশ্য হন।

যবনিকা পড়ে যায়–অট্টহাস্যে সামিয়ানা ফেটে পড়ে। আমি ততক্ষণে তার ত্রিসীমানা থেকে কেটে পড়েছি।

সংস্কৃতের স্যার তার ব্যাকরণের সূত্রে নিপাতনে সিদ্ধ কতবার করে বুঝিয়েছিলেন ক্লাসে, কিন্তু আমাদের মাথায় ঢোকেনি। আজ প্রবীবের নিপাতনে আমার সিদ্ধিলাভ হওয়ায় তার মানে হাড়ে হাড়ে টের পেলাম আমি। তারোয়ালের খোঁচাগুলোই টের পাইয়েছিল আমায়।

আর এর মূলে ছিল সেই মূলো–মূলতঃ আমি হলেও, মূলোকেই আসলে আসামী করা উচিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *