দাদুর চিকিৎসা সোজা নয়

দাদুর চিকিৎসা সোজা নয়

টুসির দাদুকে ধরেছে এবার এক অদ্ভুত ব্যারামে–এক আধ দিন নয়, প্রায় মাসখানেক থেকে কিছুতেই ঘুম হচ্ছে না ওঁর; কত ডাক্তার, কবিরাজ, হাকিম, বৈদ্য, হোমিওপ্যাথ ও হাতুড়ে–নামজাদা আর বদনামজাদা, নানারকমের চিকিৎসা করে হদ্দ হয়ে গেল–কিন্তু অসুখ–সারার নামটি নেই আর। এই একমাসে এ ডিসপেনসারি ঔষুধই গিলে ফেললেন তিনি, কিন্তু অসুখ একেবারে অটল–যেমনকে তেমন।

ঘুম তার হয় না আর। রাত্রে তো নয়ই, দিনের বেলায়, দুপুর কিংবা বিকেলের দিকে–তাও না! ভোরবেলায়, কি সকালে ঘুম ভাঙবার পর, কিংবা রাত্রে খাবারের ডাক আসবার আগে–যেসব অধোদয়যোগে টুসির এবং সব স্বাভাবিক মানুষেরই স্বভাবতই ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে, প্রগাঢ় নিদ্রা আপনা থেকেই এসে জমে, তিনি আপাদমস্তক চেষ্টা করে দেখেছেন, কিন্তু না, সে-সব মাহেন্দ্রক্ষণেও ঘুম তার পায় না, এমন কি, টুসির পড়ার টেবিলে বসেও দেখেছেন, টুসির পরামর্শ মতই, কিন্তু সব প্রাণপণ প্রয়াসই ব্যর্থ হয়েছে তার। অবশেষে তিনি সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়েছেন–

যখন হাকিমি দাবাই-ই দাবাতে পারলো না, তখন এ রোগ আর–

বাক্যটার তিনি আর উপসংহার করেননি, নিজেকে দিয়েই তা করতে হবে হয়তো, এইরকমই তার আশঙ্কা।

ডাক্তারিতেই বা কি হবে? বলে, পুরো একটা ডিসপেনসারিই সরিয়ে ফেললাম–হ্যাঁ!

কোথায় সরালে দাদু? কই আমি জানি না, তো! বিস্মিত হয়ে জিগগেস করে টুসি–দাদুর এবং বিধ কার্য্যকলাপের সে তো ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি কখনো।

কোথায় আবার! আমার এই পেটেই–পেটের মধ্যেই!

ও তাই বলো। পেটের খবর সে টের পাবে কি করে?

তবুও সারলো না অসুখ।

দাদুর খেদোক্তিতে টুসির মন কেমন করে। তাই এবার সে নিজেই দাদুর চিকিৎসার ভার নেবে, এইরকমই সে স্থির করেছে। তখন থেকেই দস্তুরমতো মাথা ঘামাতে লেগেছে। স্কুলের টাস্ক, মার্বেল খেলা, ঘুড়ি ওড়ানো, এমন কি সুযোগ পেলেই একটু ঘুমিয়ে নেওয়া ইত্যাদি সব জরুরি কাজ ছেড়ে দিয়ে কেবল ওর দাদুকে ভাল করার কথাই সে ভাবছে এখন। কতকগুলো উপায় মনেও যে আসেনি তার, তা নয়। কোন সম্রাট অসুস্থ ছেলের বিছানার চারদিকে ঘুরপাক খেয়ে ছেলেকে আরাম করে এনেছিলেন–সেই ঐতিহাসিক চিকিৎসা পদ্ধতি পরীক্ষা করে দেখলে কেমন হয়? অসুখ সারাবার এইটেই তো সবচেয়ে সহজ ও শ্রেষ্ঠ উপায়, তার মনে হতে থাকে। এক্ষুনি– আজ রাত্রেই বা যে কোনো সময়ে দাদু খানিকক্ষণের জন্যে একটু চোখ বুজোলেই এই চিকিৎসা শুরু করে দিতে পারে–

কিন্তু দাদু যে চোখই বোজয় না ছাই। এক মিনিটের জন্যেও না।

তখন মরীয়া হয়ে আর কোনো উপায় না দেখে সে সজাগ দাদামশায়ের চারদিকেই প্রদক্ষিণ লাগিয়ে দেয়, কিন্তু দাদুর চোখও ঘুরতে থাকে তার সাথে সাথে।

এই। এই। ওকি হচ্ছে? ঘুরণি লেগে পড়ে যাবি যে-আমার ঘাড়েই পড়বি ঘুরে থাম থাম।

বাধা পেয়ে সে বসে পড়ে লজ্জিত হয়ে–থামের মতই বসে যায়। ঘুরপাকের রহস্য দাদুকে জানাবার তার আর উৎসাহ হয় না। কে জানে, কি ভাববে দাদু?

আচ্ছা, সেই রেলিং চিকিৎসাটা কেমন? হঠাৎ তার মনে পড়ে এখন। এক গভীর রাত্রে দাদুর জন্যে ডাক্তার ডাকতে বেরিয়ে বেরসিক এক কুকুরের পাল্লায় পড়ে হন্তদন্ত হয়ে পার্ক ভেদ করে যাবার মুখে রেলিংয়ের ফাঁকে আটকে গেছল সে-না পারে রেলিংকে বাড়াতে, না পারে নিজেকে ছাড়াতে। কিন্তু সেই অবস্থায় সটান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েই কি তোফা ঘুমটাই না দিয়েছিলো সে। তেমন ঘুম তার আর কোনদিনই হয়নি। কখন কোন ফাঁকে যে ভোর হয়েছে, টেরই পায়নি টুসি, কিন্তু–

হতাশভাবে যে ঘাড় নাড়ে। নাঃ, এ-চিকিৎসায় রাজি করানো যাবে না দাদুকে। দাঁড়াবার জন্যে ততটা নয়, কেন না, বলতে গেলে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েই আমরা ঘুমুই, যদিও সে হচ্ছে পৃথিবীর সঙ্গে সমান্তরালভাবে দাঁড়ানো, কিন্তু টুসি ভেবে দেখে, রেলিং-এর কবলে ঐভাবে আটকে থাকাটা একবারেই পছন্দ করবেন না দাদামশাই। ওর নিজেরই তো পছন্দ হয়নি প্রথমটায়।

তবে? আর কি কোন উপায় নেই? ভয়ানকভাবে ভাবতে থাকে টুসি। ডাক্তারেরা হাল ছেড়ে দিয়েছে, কিন্তু সে তো ছাড়তে পারে না যেহেতু দাদুর যা হাল, তাতে হাল ছেড়ে দেওয়া মানে– দাদুকেই ছেড়ে দেওয়া। দাদুকে ছাড়ার কথা মনে হলেই দেদার কান্না পরতে থাকে।

আচ্ছা দাদু, এক কাজ করলে হয় না–?

কি কাজ?

আমতা আমতা করে কোনরকমে বলে ফেলে টুসি–নতুন একটা বুদ্ধি খেলেছে ওর মাথায়–সেই যে এক রাত্তিরে তোমার কলিকের জন্যে ডাক্তার ডাকতে বেরিয়েছিলাম, রাস্তায় দেখেছিলাম কি, বড়ো রাস্তাতেই দেখেছিলাম, ফুটপাথের ওপর সারা ফুটপাথ জুড়ে কত লোক যে শুয়ে আছে, একফুট পথও বাদ রাখেনি। আর তারা শুয়ে আছে দিব্যি আরামে, বালিশের বদলে মাথায় কেবল একখানা করে ইঁট দিয়ে। অক্লেশে ঘুম দিচ্ছে–খাসা ঘুমোচ্ছে তারা–কুকুর-ফুকুর কারু কোনো তোরাক্কা না করেই–

ফুটপাথে গিয়ে আমি শুতে পারবো না বাপু। তা তুমি যাই বলো। তা ছাই আমার ঘুম হোক, আর নাই হোক–

না-না ফুটপাথে কেন, আমার মনে হয় কি জানো দাদু ফুটপাথ নয়, ঐ হাঁটের সাথেই ঘুমের কোন যোগাযোগ আছে। একটা শক্ত জিনিসে মাথা রাখলে ঘুম না হয়েই পারে না-জানো দাদু, ইস্কুলের ডেক্সওয়ালা বেঞ্চে বসে বইয়ের গাদায় মাথা রেখে ছেলেরা কেমন তোফা ঘুমোয় মাস্টার ক্লাসে এলেও টের পায় না। তখনো তাদের নাক ডাকতে থাকে, মাস্টারের হাঁক-ডাকেও ঘুম ভাঙে না। জানো?

দাদু ভুরু কুঁচকে ব্যবস্থাপত্রটা ভেবে দেখেন।

টুসি উৎসাহ পায় বুঝেছ–দাদু, ঐ বালিশের জন্যেই ঘুম হচ্ছে না তোমার। যা নরম। যখন আমার মাথায় তলায় বালিশ থাকে না, চৌকির তলায় চলে যায়, তখনই আমি দেখছি–আমার ঘুম সবেচেয়ে ঘন হয়ে ওঠে–বুঝেছো দাদু।

যা তবে, নিয়ায় ইঁট! ঢালাও হুকুম দিয়ে দেন ওর দাদু। রাস্তার থেকেই আনবি তো? ভাল দেখে আনিসি কিন্তু। দেখে-শুনে ভাল করে বাজিয়ে–বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দেখে–বুঝলি? হাঃ, রাস্তার ইঁট আবার ভাল হবে! কিন্তু কি আর করা, উপায় তো নেই!

মনোহারি দোকানে তো কিনতে পাওয়া যায় না ইঁট। টুসির অনুযোগ।

তবে যা, তাই নিয়ে আয়গে–সাবান দিয়ে সাফ করে নিলেই হবে। যা।

বলতে না বলতেই দৌড়ান টুসি। একখানা আঠারো ইঞ্চি, একটুকরো কার্বলিক–সোপ আর তিনখানা চন্দন-সাবান আর পামোলিভ নিয়ে আসে সেই সঙ্গে। প্রথমে কার্বলিকটা দিয়ে হঁটের যত জীবাণু-ছাড়ানো, তারপরে পামোলিভ ঘসে ঘসে কার্বলিকের গন্ধ–তাড়ানো! সবশেষে চন্দন সুরভিত করা। তার সৌরভ বাড়ানো।

দেখছো দাদু! সাবান-টাবান মাখিয়ে কিরকম করে ফেলেছি ইঁটখানাকে?

দাদু শুঁকে দেখেন একবার–হুম! বেশ উপাদেয় হয়েছে বটে।

রাজভোগ্য ইঁট-মাথায় সারারাত কেটে যায় দাদুর–কিন্তু ঘুমোবার ভাগ্য আর হয় না। একপলের জন্যেও চোখের পলক পড়ে না তার।

সকালে উঠেই তার গজগজানি শুনতে হয় টুসিকে–হ্যাঃ ইঁট না ছাই! ইঁট মাথায় দিয়ে শুয়ে আছে সবাই! দিব্যি আরামে ঘুমোচ্ছে তারা! কি দেখতে কি দেখছেন, তার নেই ঠিক। মাঝখানে থেকে আমার–উঃ! সেই তখন থেকেই মাথাটা টাটিয়ে আছে! বলে মাথার বদলে ঘাড়েই হাত বুলোতে থাকেন তিনি।

উঃ কী মাথাটাই না ধরেছে!…ক্যাফিয়াস্পিরিন? ক্যাফিয়াস্পিরিনে কি হবে আমার? ক্যাফিয়াস্পিরিন কে কিনে আনতে বললো তোকে? একি তোের সেই আধকপালে? বলছেন মাথা ধরেছে? সমস্ত মাখাটাই এই ঘাড়ের এখান থেকে ও-ঘাড় পর্যন্ত। ক্যাফিয়াস্পিরিনে কি করবে এর? ঘাড় ধরা কি সারে ওতে? অ্যাস্পিরিন-ট্যাস্পিরিনের কম্মো নয় বাপু!

ঘাড়ের দুধারই ধরে গেছে তোমার, বলছো কি দাদু? ।

ধরবে না? ইঁটখানা কি একটুখানি? দাদু ঘাড় নাড়েন।

আমূল-মস্তকের সর্বত্রই ধরেছে, কিন্তু যার ধরবার ছিল–নিদ্রাদেবী, যদি-বা তিনি আসতেন, কিন্তু ইটের বহর দেখে ত্রিসীমানার মধ্যেও আর ঘেঁস দ্যাননি তিনি–ইত্যাকার নিজের মতামত প্রবলভাবে ব্যক্ত করতে থাকেন ওর দাদু!

টুসি? টুসি আর কি করবে? চুপ করে শুনতে থাকে। এঁটের আপরাধ অম্লানবদনে নিজের ঘাড় পেতেই নেয় সে।

কয়েকদিন পরে একরাত্রে দাদু অনিদ্রার আতিশয্যে ছটফট করছেন, পাশের বিছানায় শুয়ে ওর নিজের চোখেও ঘুম নেই–ভয়ে-ভয়ে একটা কথা বলে ফেলে টুসি–

আচ্ছা দাদু তুমি উপক্রমণিকা পড়ে দেখেছো কখনো? সত্যি-সমসকৃত পড়তে বসলেই এমন ঘুম পায়, অ্যাতো ঘুম পায় আমার, যে কী বলবো!

কথাটা মনে ধরে ওর দাদুর। টুসির দিদিমা বই হাতে নিয়ে দিবানিদ্রা শুরু করতেন, স্মরণ হয় ওঁর। প্রত্যহই প্রথম থেকে হরিদাসের গুপ্তকথা তাঁর আরম্ভ হতো, কিন্তু কোনোদিনই আড়াই পাতার বেশি এগুতে পারতে না; বলতেন–আঃ কী ঘুমটাই না আছে ঐ বইটাতে! অবশেসে গুপ্তকথা অজ্ঞাত রেখেই একদা ওঁকেই ভবলীলা সাঙ্গ করতে হয়েছে, কোন এক গুপ্ততর জগতে চলে যেতে হয়েছে, ভেবে অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে দাদুর চোখ। একদিন বইখানা খুঁজে পাওয়া যায়নি, সেদিন দুপুরে, কী আশ্চয্যি, ঘুম তো হলোই না বৌয়ের, উপরন্তু তার বদলে তার সঙ্গে বকাবকি করে অম্বল হয়ে গেল।

যা, নিয়ায় তো! উপক্রমণিকাকেই দেখব আজ।

টুসি কখন ঘুমিয়ে পড়েছে, কিন্তু ওর দাদু মাথার কাছে আলো জ্বেলে উল্টে যাচ্ছেন পাতার পর পাতা–উপক্রমণিকাও শেষ আর রাতও কাবার! বাস্তবিক, কী চমৎকার বই এই উপক্রমণিকা, ঘুম না হোক, দুঃখ নেই কিন্তু কী ভালই লেগেছে যে দাদুর! সন্ধি বিধি ও যত্ন-ণত্তের অনুক্রম থেকে শুরু করে দ্বন্দ্ব ও মধ্যপদলোপী আর যাবতীয় সমাসকে অবহেলায় অতিক্রম করে, নরঃ-নরৌ-নরাঃ এবং লট-লোট-লঙ-বিধিলিঙের বৃহভেদ করে বীরবিক্রমে এগিয়েছেন তিনি, তুদাদি ধাতু থেকে, তদ্ধিত প্রত্যয় পর্যন্ত পার হয়ে গেছে তার, সহজেই হয়ে গেছে; ণিজন্ত প্রকরণ ও পরস্মৈপদীয় ব্যাপারটাও বেশ হাড়ে-হাড়েই বুঝেছেন, অবশেষে কর্মবাচ্য ও কর্তৃবাচ্য থেকে ভাববাচ্যে এসে ঠেকেছেন এন। আগাগোড়া সবই তিনি পড়েছেন সাগ্রহে। পড়েছেন আর ভেবেছেন। ভেবেছেন আর অবাক হয়েছেন। কত সত্য, কত তত্ত্ব, কত রহস্য, কী গভীরত্বের পরিচয়ই না নিহিত আছে ওর পাতায় পাতায়? ওর বিধি-বিধানে জীবনের কত জটিল সমস্যা সমাধানই না খুঁজে পেলেন। বাস্তবিক, ওকে ব্যাকরণ না বলে ব্যাকরণদর্শনই বলা চলে, এর জন্যে যদি ষড়দর্শনের তালিকায় আরেকটা সংখ্যা বাড়াতে হয়–বাড়িয়ে সপ্তম দ্রষ্টব্যেরও আমদানি করতে হয়–তবুও। আহা! অবহেলা না করে ছেলেবেলায় এই সদগ্রন্থ মন দিয়ে পড়তেন যদি!–

তাহলে কী যে হতো আজ, তা অবিশ্যি তিনি আন্দাজ করতে পারেন না। সকালে উঠে টুসি, দাদুকে নিদ্রিত না দেখুক, কিন্তু খুশি দেখেছে। পুলকিত না দেখতে পাক, অন্তত তিতবিরক্ত দেখতে হয়নি।

উপক্রমণিকা মুখস্থ করেও যখন বিনিদ্রার ব্যতিক্রম দেখা গেল না, তখন অন্য প্রস্তাব পাড়ে টুসি। খেলাধুলো করলে কেমন হয়? ফুটবল কি টেনিস বা ঐরকমের একটা কিছু? ফুটবল খেলে ফিরলে কেমন গা ঝিম ঝিম করে। আপনার থেকেই চোখের পাতা জড়িয়ে আসে টুসির। সেইজন্যেই তো সন্ধ্যায় পড়ার টেবিলে বসেই যে সে চেতনা হারায়, রাত্রে খাবার সময় অমন ষাড়ের ডাকাডাকিতেও সহজে তার সাড়া মেলে না।

মাঠে গিয়ে তোমার মতো বল পিটতে পারব না বাপু! ওসব গোঁয়ারদের খ্যালা। যতো সব গুণ্ডারাই খ্যালে! তারপর ল্যাং মেরে ফেলে দিক আমায়! ফেলে আমার ঠ্যাং ভেঙে দিক আর কি! দাদু মুখ বেঁকান।

মাঠে কেন, ছাদে? আমাদের বাড়ির ছাদেই তো। টুসি তাঁকে আশ্বস্ত করে। আর কেউ না, কেবল তুমি আর আমি।

হ্যাঁ, তাহলে হয় বটে! কিন্তু দয়াখো বাপু, কেয়ারি করতে পাবে না, ফাউল টাউল করা চলবে না তা বলে। আর দাদু শেষ পর্যন্ত খোলসা করেই কন–আর আমাকেও কিন্তু বল মারতে দিতে হবে–মাঝে-মাঝেই।

বাঃ, তুমিই তো মারবে তোমারই তো দরকার একসারসাইজের! টুসি বিশদ করে দেয়–ভয় সেই, আমি একলা-একলা খেলবো না।

আমি গোল দেবো কিন্তু! আমাকেও গোল মারতে দিতে হবে! হা!

বেশ তো, তুমিই খালি গোল দিয়ে। আমি একটাও গোল দেব না তোমায়। গোড়াতেই অভয় দিয়ে টুসি গোলযোগ থামাল।

তারপরে পাড়ার এক টেনিসক্লাব থেকে বহু ব্যবহৃত ও বহিস্কৃত একটা ডিউস বল যোগাড় করে হাজির হয় টুসি।

অ্যাঁ! এত ছোট?; দাদু অবাক হন–ফুটবল এত ছোট কেনরে?

ফুটবল না তো। টুসি জানায়, ছাদে কি অত বড়ো ফুটবল চলে কখনো? আমার এক শটে তাহলে তো কোথায় উড়ে যাবে, তার ঠিক নেই। তাই টেনিসের বল নিয়ে এলাম। টেনিসই বা মন্দ কি দাদু?

তা মন্দ কি! তিনিও সায় দেন–তবে টেনিসই হোক,ক্ষতি কি তাতে? ফুটবল সম্পর্কে ব্যাটবল, ব্যাটবল আর টেনিস, টেনিস আর ক্রিকেট, ক্রিকেট আর হকি–তাদের তারতম্য বিশেষত্ব কেবল নামমাত্র নয়, ভালোভাবেই দাদুর জানা; ওদের ভেদাভেদের সব খবর তাবৎ রহস্য কিছুই তার অবিদিত নেই আর।

তারপর থেকে দুপদাপ, ধুপধাপ–পাড়ার লোক সচকিত হতে থাকে প্রত্যহ। বাড়িওয়ালা এসে বলেন–ছাদ ভেঙে ফেলবেন দেখছি। কি হয় আপনাদের ফুটবল খেলা?

ফুটবল? না তো। দাদুর চোখ কপালে ওঠে–ফুটবল! রামমাঃ! ফুটবল আবার খ্যালে মানুষে? ওতো গোঁয়ারদের খ্যালা মশাই! আমরা, টেনিস খেলি। আসবেন, আপনিও আসবেন–তিনজনেই খালা যাবে না হয়।

বাড়িওয়ালাকে আমন্ত্রণ করে তো বসেন, কিন্তু সন্দিগ্ধভাবে একটা থেকেই যায় তাঁর। আপনমনেই বলেন তিনি আসবেন তো খেলতে, তবে টুসির সঙ্গে পেরে উঠলে হয়! আমি যে আমি–-আমাকেই গলদঘর্ম করে দিচ্ছে!

বাড়িওয়ালা আসেন বিকেলে, ঈষৎ আপ্যায়িত হাসিমুখ নিয়েই–হ্যাঁ! বাড়রি ছাদ আমার বেশ বড়োই, টেনিস খ্যালা যায় বটে। তবে আপনারাই খেলুন, আমি দেখি। এই স্কুলদেহ নিয়ে এ-বয়সে আর ঐসব খ্যালাধুলোর হুলস্থুল আমার পোর না মশাই!

টেনিসের বল পড়ে ছাদে। বলটাকে রাখা হয় সেন্টারে নাতি আর দাদু দুজনেই মুখোমুখি হন–নাতি বৃহৎ কুরুক্ষেত্রের সম্মুখে।

নেট? নেট আবার কি? নেট কে? নেটে কি হবে? কিসের নেট? দাদুও কম বিস্মিত নন।

কেন টেনিস নেট? বাড়িওয়ালা বলেন। বলই তো দেখছি কেবল–তাও তো কুল্লে একটাই। র‍্যাকেটই বা কোথায়?

ততক্ষণে খেলা শুরু হয়ে যায় ওঁদের। খেলতে-খেলতেই বলেন দাদু-বলের সঙ্গে ই তার গলা চলেও, ব্যাটের কথা বলছেন? আমাদের তো এ ব্যাটবল-খেলা নয় মশাই! ভুল করছেন আপনি–খ্যালার কোনো খবর তো রাখেন না! আর কি করেই বা রাখবেন–এসব খ্যালাধুলো তো আর ছিল না আমাদের কালে! তাই এসব খ্যালার নাম-ধাম জানার কথাও নয় আপনার। আরে মশাই–আমরা টেনিস খেলছি যে। ওই যাঃ! দেখুন তো গোল দিয়ে দিলে বকতে বকতে সামলাই বা কখন ছাই!

আর বৃথা বাক্যব্যয় না করে গোলের মুখে গিয়ে তটস্থ হয়ে দাঁড়া তিনি। দুড়দাড় করে বল পিটিয়ে আনছে টুসি, কোন ফাঁকে যে গোল দিয়ে বসে কিসের ফাঁকতালে যে ফের আবার গোলযোগ ঘটায়, ঠিক নেই কিছু। তর্ক মাথায় রেখে এখন রেখে এখন সতর্ক হয়ে থাকতে হয় তাঁকে।

বাড়িওয়ালা চটেই যান, তাঁর নিজের বাড়ির ওপর একটা বাড়াবাড়ি তার বরদাস্ত হয় না। বাড়ির মায়ার জন্যে ততটা নয়; যেরকম খেলার দাপট, তাতে এর ইহকাল, পরকাল-সমস্তই ঝরঝরে! এবাড়ির ভবিষয়তের আশা তিনি ছেড়েই দিয়েছেন–খেলোয়াড়দের স-বলতার জন্যই ছাড়তে হয়েছে; কিন্তু তাহলেও টেনিস-বলের প্রতি ফুটবলের ন্যায় এই দুর্ব্যবহার তার সহ্য হয় না– এইটেই সবচেয়ে তাঁর প্রাণে লাগে। বিশেষ রকম ব্যথা দেয়।

ঘুম না হোক, খেলার ফল অবিশ্যি একটা দেখা যায়–সেটাকে হয়তো সুফলই বলা যেতে পারে।

টুসির দাদু আর অভিযোগ করেন না, নিদ্রাহানির জন্যে কোন ক্ষোভের বাণী তার মুখে শোনা যায় না আর।–নাই হোকগে–ঘুম না হয় নাই হোলো, না হোলো তো বয়েই গ্যালো আমার! ঘুমের দরকারটাই বা কি? ঘুমিয়ে কে কবে বড়লোক হয়েছে? দুরদুর–ঘুমোয় আবার মানুষ! যতো গরু, ভ্যাড়া, ছাগল, গাধারই খালি ঘুমিয়ে সময় বাজে নষ্ট করে। এবংবিধ সব বাক্যই বরং তাঁর মুখে এখন।

আজকাল সকাল থেকেই শুরু হয় তাঁর উপক্রমণিকা-পাঠ, এরকম নিত্যক্রিয়ার মধ্যে; আর বিকেলে টুসি ইস্কুল থেকে ফিরলে পরে টেনিস-পর্ব– সেটাকে নৃত্য ক্রীড়া বলা যেতে পারে। আর রাত্রে? সারারাত তার চোখে ঘুম ত নেইই, টুসিরও ঘুমের দফা রফা।

কোন গোলটা তাঁকে নিতান্ত অন্যায় করে দেওয়া হয়েছে, কোনটাকে আর একটু হলেই নির্ঘাৎ বাঁচানো গিয়েছিল, কোন গোলটার পায়ের ফাঁকের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়ার অপরাধ কিছুতেই তিনি মার্জনা করতে পারেন না, এমনি না জানিয়ে সুড়ুৎ করে চলে গেল যে হঠাৎ! কোন অবশ্যম্ভাবী গোলকে তিনি অকস্মাৎ দুপা জুড়ে দিয়ে গলে যেতে দেননি, সোজাসুজি গোল দেবার কি-কি নতুন কায়দা তিনি আবিষ্কার করেছেন, কোনটাকে তিনি কৃপা করে ছেড়ে দিয়েছেন বলের প্রতি নয়, টুসির প্রতি কৃপাবশেই, কোন গোলটা তিনি নিজেই, হ্যাঁ, তিনি নিজেই ত-আর একটু হলেই প্রায় দিয়ে ফেলেছিলেন আর কি বিছানায় শুয়ে-শুয়ে সেইসব কূটকচালে আলোচনায় টুসিকে যোগ দিতে হয় তাঁর সঙ্গে।

আচ্ছা ফুটবলেও ত গোল দ্যায় বলে শোনা যায়? দ্যায় না? টেনিসেও দ্যায়। স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। ফুটবলের গোলে আর টেনিসবলের গোলে তাহলে প্রভেদ কোথায়? দুটোর আকারে আর ওজনে তফাত আছে অবশ্যি, তা ঠিক! যদিও দুটোই গোলাকার তাহলেও ভারি গোলমাল ঠেকে ওর দাদুর। দুটো খেলাতেই যখন গোল দেবার প্রথা এক, কোন প্রকারভেদ নেই, তখন আলাদা নামকরণ কেন? বলের আকারভেদের জন্যেই কি তাহলে?

দাদুর জিজ্ঞাসুতার কি জবাব দেবে টুসি? শুনতে শুনতে নাজেহাল হয়ে পড়ে সে।

প্রহরের পর প্রহর চলে যায়–অফুরন্ত বাক্যলাপ আর ফুরোয় না। হঠাৎ ওর দাদু মোড় ঘোরেন তদ্ধিত-প্রত্যয় জানিস? জানিস কি? জানিস। আচ্ছা, বল ত তাহলে লকারার্থ নির্ণয় কাকে বলে?

খেলার ঠেলা তবুও ভাল উপক্রমণিকার উপক্রমেই গলা শুকিয়ে আসে টুসির। ক্ষীণস্বরে সে জানায়–উঁহু! এ বিষয়ে তার নিজের প্রতি একটুও প্রত্যয় আছে বলে মনে হয় না।

বটবৃক্ষ সন্ধিবিচ্ছেদ করত। করতে পারিস? খেলার থেকে ব্যাকরণে নেমেছেন ওর দাদু! দেখেছিস করে?

ভাল করেই দেখে টুসি। বটবৃক্ষের শাখা-প্রশাখাগুড়ির থেকে শুরু করে মায় গাছের ডগা অব্দি, পাতার থেকে মাথা পর্যন্ত কোথাও বাদ রাখে না, কিন্তু কোথাও কোন বিচ্ছেদের আভাসমাত্রও তার নজরে পড়ে না।

পারলিনে ত? বট ছিল বৃক্ষ, হলো গিয়ে বটবৃক্ষ–দেখলি?

ওর দাদু জোর দিয়েই জানতে চান যে, এটা হলো গিয়ে স্বরসন্ধি এবং নিশ্চয়ই এর কোন ভুল নেই কিন্তু মানতে কিছুতেই রাজি হয় না টুসি। অদৃশ্য সন্ধিতে সে ঘোরতর অবিশ্বাসী। ওর মতে যদি হতেই হয়, তবে নিছক এটা দাদুর একটা অভিসন্ধি কেবল।

সেও পাল্টা প্রশ্ন করে বসে দাদুকে–আচ্ছা, Buchanan সন্ধিবিচ্ছেদ কর ত তুমি!

বুচানন? এ আর এমন শক্তটা কি? বুচা ছিল আনন, হলো গিয়ে বুচানন–যেমন পঞ্চানন আর কি! আবার সমাসও হয় বুচা আনন যাহার, সেই বুচানন; কিন্তু কি সমাস, কে জানে! দ্বন্দ্ব না বহুব্রীহি? ওঁর নিজেরই কেমন খটকা লাগে। মধ্যপদলোপী কর্মধারায়ও হতে পারে বা। সমাস-প্রকরণটায় এখন উনি তেমন পাকা হতে পারেননি, অকালপক্ক এখন টুসির মতই! ভাল করে পোক্ত হতে কমাস লাগে, কে জানে!

হঠাৎ ওঁর প্রাণে সন্দেহ জাগে–আমাদের পাড়ার সেই ফিরিঙ্গিটা নয়ত রে? বুচানন সাহেব? সাবধান, ওর সঙ্গে যেন কোন সন্ধি বাধাতে যাস না। মারখুনে মানুষ—কাণ্ডজ্ঞানহীন–কখন কি করে বসে তার ঠিক নেই তো!

নাতিকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপ তিনি সাবধান করে দেন।

আচ্ছা উপসর্গ কয় প্রকার বল ত দেখি?

পর-পর তিনবার একটা বেজে গেছে ঘড়িতে–সাড়ে বারোটার, একটার এবং দেড়টা ঘণ্টা–সেও হয়ে গেল কতোক্ষণ! ঘুমে সারাদেহ জড়িয়ে আসছে টুসির–এখন উপসর্গে কেন–সোজা স্বর্গে যেতে বললেও সে রাজি নয়, শক্তিও নেই তার।

আচ্ছা আমি বলে যাচ্ছি, তুই গুণে যা। প্র, পরা অপ, সং–

ঘুমের ঘোরেই শুনতে থাকে টুসি। কটা হলো উপসর্গ সবশুদ্? দশটা না না দুশোটা? ওর নিজেকে নিয়ে? দাদুকে ধরে, না বাদ দিয়ে? আর বুচানন? সেও তো দেখতে অনেকটা সঙের মতোই! সঙও তো একটা উপসর্গ? বুচানন তাহলে উপসর্গ। আর বটবৃক্ষ? বটগাছের তদ্ধিত হয়? বুচাননের?–

–উৎ পরি, প্রতি, অভি, অতি, উপ, আ! কিরে? গুণলি? কটা হলো? আরে মোলো যা, এ যে নাক ডাকতে লেগেছে!

দেখতে না দেখতে আরেক উপসর্গ দেখা দিয়েছে টুসির। নাঃ ভারী ঘুম কাতুরে হয়েছে ছেলেটা! এই কথা বলছে–বলতে-বলতে–এই ঘুম? দিনরাতই ঘুমুচ্ছে! আশ্চয্যি! ঘুমিয়ে কি সুখ পায় এরা? ঘুমিয়ে হয়টা কি, অ্যাঁ? নাক-ডাকানো নাহক সময়ের অপব্যয়! নাঃ ঘুমিয়েই ফতুর– মানুষ আর হলো না ছোঁড়াটা। কড়িকাঠের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়তে থাকে দাদুর।

সকালে টেবিলে বসে মলিনমুখে দৈনিক কাগজের পাতা ওলটায় টুসি। এত বড়ো আনন্দবাজার সামনে, তবু সে নিরানন্দ। দাদুর অসুখ সারাতে গিয়ে নিজের সুখও তার গেছে। হঠাৎ বিজ্ঞাপনের এক জায়গায় তার চোখ গিয়ে আটকায়–স্বামীজির অদ্ভুত যোগবল! পড়ে উৎপুল্ল হয়ে দাদুকে লুকিয়ে সেই ঠিকানায় একটা চিঠি লিখে ছেড়ে দেয় তক্ষুনি।

পরদিন প্রাতঃকালেই নধর-দর্শন স্বামীজির প্রাদুর্ভাব হয় তাদের বাড়িতে। কি চাই আপনার?

জয়োস্তু! আপনার দৌহিত্রের আত্নানেই আসা। তার পত্রে আনুপূর্বিক সমসস্তই প্রণিধান করেছি। অত না লিখলেও হতো–যোগবলেই সব।

কি? হয়েছে কি? দাদু একটু ভীতই হন।

আপনার দুঃসাধ্য ব্যাধি–তবে আমি সারিয়ে দেবো। যোগবলে সবই সম্ভব। শুরু যোগবলেই সম্ভব।

কিছু তো বুঝতে পারছি না মশাই! থমমত খান উনি।

সন্ত্রস্ত হবে না। তখন স্বামীজিই সমস্ত বুঝিয়ে দেন সাবলীল ব্যাখ্যায়–এই যে নিদ্রাহীনতা, এ সামান্য ব্যাধি নয়, আশু না সারালে এতেই গতাসু হবার ধাক্কা! যোগের দ্বারাও নিদ্রা আনানো যায়, যাকে বলে যোগনিদ্রা, নিদ্রাযোগের সঙ্গে অবশ্যই তার অগাধ পার্থক্য; যোগবলে মানুষকে এমন কি, চিরনিদ্রায় পর্যন্ত অভিভূত করে দেওয়া যায়, যদিও বলযোগেও সেটা সম্ভব, কিন্তু দুইয়ের ফারাক বহুৎ। উনি ইচ্ছা করলে টুসির দাদুকে এই মুহূর্তেই নিদ্রালু করে দিতে পারেন।

কিন্তু সন্ত্রস্ত হতেই হলো এঁকে–কি আলু? আলুত্বে পরিণতির ভয়াবহ আমঙ্কায় তাঁর চোখ-মুখ তখন বেগুনের মত নীল হয়ে গেছে।

নিদ্রালু। এক্ষুণি হঠযোগের সাহায্যে আপনার ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারি আমি। সহজ করে বলেন স্বামীজি।

কি যোগ বললেন?

হঠযোগ।

ওতে কিসসু হবে না। হতাশভাবে ঘাড় নাড়ের টুসির দাদু। ইঁটযোগ করে দেখা হয়েছে মশাই, কিসসু হয়নি।

ইটযোগ বলতে স্বামীজি কি প্রণিধান করলেন, স্বমীজিই জানেন, কিন্তু তারপরই তিনি ইঁটযোগ আর হঠযোগের পার্থক্য, প্রথমোক্তের চেয়ে শেষোক্তের শ্রেষ্ঠতা, যোগের পরম্পরা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মরূপে বোঝাতে অগ্রসর হন। টুসির দাদুর প্রথমে সংশয়, তারপরে সন্দেহ, তারপরে বিজাতীয় রাগ হতে থাকে। অবশেষে স্বামীজি যখন টাকাকড়ির প্রস্তাবে আসেন, যোগ থেকে একবারে বিয়োগের ব্যাপারে-হঠযোগের ক্রিয়াকলাপে কি কি এবং কত কত খরচ তখন আত্মসংবরণ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় না।

কী? জোচ্চুরির আর জায়গা পাওনি? বোকা পেয়ে ঠকাতে এসেছ আমায়? বটে? বোমার মতন ফাটেন তিনি–নিয়ায় তো টুসি, সেই হঁটখানা। ইঁটযোগ কাকে বলে, একবার বুঝিয়ে দিই লোকটাকে।

আপমান-সূচক কথা বলবেন না বলছি। স্বামীজিও চটে যান।–তাহলে আমি রাগান্বিত হয়ে এই মুহূর্তেই হয়তো আপনাকে ভস–ভস্মীভূত করার আগেই ফস করে তাঁকে থামতে হয় হঠাৎ। সেই মুহূর্তে ইঁট হস্তে টুসির প্রবেশ ঘটে।

আহা ক্রোধ-পরবশ হচ্ছেন কেন। ক্রোধ-পরবশ–বলতে বলতে কয়েক–পা পিছিয়ে যান স্বামীজি এবং পরমুহূর্তেই সুপরিকল্পিত এক পশ্চাৎ লাফে অদৃশ্য হন, বোধকরি যোগবলেই।

টুসির দাদু শুধু বলেন–ছ্যাঃ!

ঐ অব্যায়–শব্দে টুসির কি প্রণিধান হয় কে জানে; সে লজ্জায় ঘাড় হেঁট করে থাকে।

ওর বিষণ্ণ-মুখ দেখে মায়া হয় দাদুর!–যাক, তাতে আর কি হয়েছে? তুই তো ভালই চেয়েছিলি–যাকগে, ভালই হয়েছে। পরশু আছে শিবরাত্রি। ছোটবেলা থেকে ভেবে আসছি যে, শিবরাত্রি করবে; কিন্তু করা আর হয় না! হয় খেয়ে ফেলি, নয় ঘুমিয়ে পড়ি। এবার তো আর ঘুমোনোর ভয় নেই, কেবল খাওয়াটা বাদ দিতে পারলেই হয়। তাহলে হলো। পুণ্যটা করে ফেলা যাক এই ফাঁকে। কি বলিস?

টুসি এতক্ষণে খুশি হয়–আমিও দাদু করবো তাহলে!

তখন দুজনে মিলে প্ল্যান আঁটেন–না-খাওয়ার, না-ঘুমোনোর প্ল্যান। দীর্ঘ এক ফিরিস্তি বেরোয়–কখন কি কি না করতে হবে তার। টুসি কি না খেয়ে থাকতে পারবে, বিশেষ করে না ঘুমিয়ে? যা ঘুম পায় ওর। আর যেমন বিটকেল খিদে। দিনরাত খালি খাই-খাই। আর সারাদিন না হয় টেনিস খেলেই গেল, কিন্তু রাত্রে? রাত্রে টেনিস খেলা তো সম্ভব নয়, আর রাত্রে তো ঘুম পাবেই টুসির। এ বিষয়ে টুসির দাদুর বিশ্বাস সুদৃঢ়; টুসির নিজেরও যে একেবারে সন্দেহ নেই, তা নয়।

টুসি প্রস্তাব করে–সরারাত সিনেমা দেখা যাক না কেন? তাহলে কিছুতেই ওর ঘুম পাবে না, শিবের দিব্যি গেলে সে বলতে পারে। কত ভাল-ভাল বাংলা বই আর বিলিতি সিরিয়াল হোলনাইট শো রয়েছে সব হাউসেই।

বায়স্কোপে দাদুকে রাজি করাতে বেশী বেগ পায় না সে। আর তখন থেকেই লাফানো শুরু হয়ে যায় তার।

শিবরাত্রির সকাল থেকেই উপবাস শুরু হয় টুসির। প্রথমে রাস্তায় বেরিয়েই এক বন্ধুর আমন্ত্রণে রেস্তোরাঁয় বসে অন্যমনস্কতার বশে এককাপ চা একখানা মামলেট; তারপরে ঘন্টা-দুয়েক বাদ আর এক বন্ধুর পাল্লায় পড়ে মনের ভুলে ফের চিনেবাদাম আর ডালমুটের সদ্ব্যবহার; তারপরে আরেজনার খপ্পরে পড়ে আবার শোন পাপড়ি আর চন্দ্রপুলি, সেও অবিশ্যি ভুলক্রমেই; তারপরে বিকেলে যোগেশদার আহ্বানে অনিচ্ছাসত্ত্বেই একপ্লেট মটনকারি আর খানকয়েক টোস্ট তারপর সন্ধ্যের মুখে ওদের ক্লাসের সেকেন্ড বয় সমীরের বাড়ি হানা দিয়ে এবং সে না সাধতেই–তাকে সতর্কতার অবকাশ না দিয়েই তার পাত থেকে পাঁচখানা পরোটা আর গোটা-আলুর দম–এইভাবে সারাদিন দারুন উপবাস চালিয়ে শ্রান্ত, ক্লান্ত ও বিপর্যস্ত টুসি রাত নটার দাদুর সঙ্গে যায় নামজাদা এক সিনেমায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *