একটি স্বর্ণঘটিত দুর্ঘটনা

একটি স্বর্ণঘটিত দুর্ঘটনা

বিশ্বেশ্বরবাবু সবেমাত্র সকালের কাগজ খুলে বিশ্বের ব্যাপারে মনযোগ দেবার চেষ্টা পাচ্ছেন, এমন সময়ে বিশ্বেশ্বর–গৃহিণী হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসেন। ওগো সর্বনাশ হয়েছে–!

বিশ্বজগৎ থেকে তার বিনীত দৃষ্টিকে অপসারিত করেন বিশ্বেশ্বরবাবু। চোখ তুলে তাকান গৃহিণীর দিকে।

ওগো আমার কি সর্বনাশ হলো গো। আমি কি করবো গো!

বিশ্বেশ্বরবাবুকে বিচলিত হতে হয়। কি–হয়েছে কি?

চুরি গেছে। আমার সমস্ত গয়না। একখানাও রাখেনি গো–

বিশ্বেশ্বরবাবুর বিশ্বাস হয় না প্রথমে। ব্যাপারটা বোঝবার চেষ্টা করেন তিনি। অবশেষে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেন–ও! গয়না চুরি! তাই বলো! আমি ভেবেছি না জানি কি! বিশ্বেশ্বরবাবু যোগ করেন। তার য়্যানাটমিতে ব্যস্ততার চিহ্নমাত্র দেখা যায় না।

আমার অত গয়না! একখানাও রাখেনি গো!

একখানাও রাখেনি নাকি? বিশ্বেশ্বরবাবু বাঁকা ঠোঁটে ঈষৎ হাসির আভাস যেন উঁকি মারে।– তা হলে ভাবনার কথা তো।

বিশ্বেশ্বরবাবুর ভাবভঙ্গি গৃহিণীকে অবাক করে, কিন্তু অবাক হয়ে থাকলে শোক প্রকাশের এমন সুযোগ হারাতে হয়। এহেন মাহেন্দ্র যোগ জীবনে কটা আসে?

ভাবনার কথা কি গো! আমার যে ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কে আমাদের এমন সর্বনাশ করে গেল গো–তারস্বর ছাড়তে উদ্যত হন তিনি।

 যাক, যেতে দাও। যা গেছে তার জন্য আর দুঃখ করে কি হবে?–হাসি মুখেই বলেন বিশ্বেশ্বরবাবু–গতস্য শোচনা নাস্তি বুদ্ধিমানের কার্য্য।

এহেন বিপর্যয়ের মধ্যেও হাসতে পারছেন বিশ্বেশ্বরবাবু? সর্বস্তান্ত হয়ে দুঃখের ধাক্কায় তার মাথা খারাপ হয়ে গেল না তো? না, গিন্নীকে সান্ত্বনা দিতেই তার এই হাসিখুশির ভান? কিছুই বুঝে উঠতে পারেন না, না পেরে আরো তিনি বিগড়ে যান–তুমি বলছ কি গো! হায় হায় আমার কি সর্বনাশ হল গো! বাজখাই গলা বার করেন গৃহিণী।

আরে থামো থামো, করছ কি। এবার বিশ্বেশ্বরবাবু সত্যিই বিচলিত হন–চেপে যাও, পাড়াব লোক জানতে পারবে যে!

বয়েই গেল আমার!–গিন্নী খাপ্পা হয়ে ওঠেন–আমার এত টাকার গয়না গেল আর পাড়ার লোক জানতে পারবে না। কোনদিন গা সাজিয়ে পরতে পেলুম না, দেখাতেও পেলুম না হিংসুটেদের। জানুক না মুখপোড়ারা–মুখপুড়িরা।

উঁহুহু, তুমি বুঝছ না গিন্নী! বিশ্বেশ্বরবাবু মুখখানা প্যাচার মতো করে আনেন–চুরির খবর পেলে পুলিস এসে পড়বে যে!

পুলিস? পুলিসের কথায় গিন্নীর ভয় হয়।

আর পুলিস এলই বাড়িঘর সব খানাতল্লাসী হবে! আষাঢ়ের ঘন মেঘে বিশ্বেশ্বরবাবুর হাঁড়িপানা-মুখে ভারী হয়ে আসে। সে এক হাঙ্গামা।

এবার ভড়কে যান গিনী।–কেন, চুরি গেলেই পুলিস খবর দেয় এই তো জানি। চোরেই তো পুলিসের কিনারা করে। পরমুহূর্তেই ভুল শুধরে নেন–উঁহু! পুলিসেই তো চুরির কিনারা করে, চোরকেও পাকড়ায়!

সে হাতেনাতে ধরতে পারলেই পাকড়ায়–বিশ্বেশ্বর গোঁফে মোচড় দেয়, তা না হলে আর পাকড়াতে হয় না।

হ্যাঁ হয় না;–গিন্নী মাতা নাড়েন, তুমি বললেই আর কি?

তা তেমন পীড়াপীড়ি করলে নিয়ে যায় পাকড়ে। একটাকে নিয়ে গেলেই হলো! এখানে চোরকে হাতে না পেয়ে আমাকেই ধরে কিনা কে জানে!

তোমাকে কেন ধরতে যাবে? গিন্নীর বিস্ময় হয়।

সব পারে ওরা। হাঁস আর পুলিস, ওদের পারতে কতক্ষণ? বিশ্বেশ্বরবাবু বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করেন, তবে তফাত এই, হাঁস পাড়ে হাঁসের ডিম। আর ওরা পাড়ে ঘোড়ার ডিম। ঘোড়ার ডিমের আবার মাললেটও হয় না, একেবারে অখাদ্য। তাঁর মুখ বিকৃত হয়।

তোমাকে কক্ষনো ধরবে না।–গিন্নী সজোরে বলেন।

না ধরবে না আবার। আমাকেই তো ধরবে। বিশ্বেশ্বরবাবুর দৃঢ় বিশ্বাসের বিন্দুমাত্র ব্যত্যয় হয় । আর ধরলেই আমি স্বীকার করে ফেলব। তা বলে রাখছি কিন্তু। করাবেই ওরা আমাকে স্বীকার। স্বীকার করানোই হলো কাজ, তাহলেই ওদের চুরির কিনারা হয়ে গেল কিনা।

চুরি না করেও তুমি স্বীকার করবে চুরি করেছ?

করবই তো! পড়ে পড়ে মার খেতে যাব নাকি? সকলেই স্বীকার করে। করাটাই দস্তুর। আর নাও যদি মারে, হাজত বলে এমন একটা বিশ্রী জায়গায় আটকে রাখে শুনেছি সেখানে ভারী আরশোলা, আর নেংটি ইঁদর। আরশোলা আমার দুচক্ষের বিষ, আর নেংটি ইঁদুর? বাবাঃ, সে বাঘের চেয়েও ভয়ানক! অমন অবস্থায় পড়লে সকলকেই স্বীকার করতে হয়।

যদি তেমন তেমন দেখ না হয় স্বীকার করেই ফেল। তাহলেই ছেড়ে দেবে তো?

হ্যাঁ, দেবে। একেবারে জেলের মধ্যে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেবে।

তবে কাজ নেই তোমার স্বীকার করে।–গিন্নী এবার শান্ত হন, গয়না আমি চাই না।

হ্যাঁ, সেই কথাই বল! আমি বেঁচে থাকতে তোমার ভাবনা কি? আবার গয়না গড়িয়ে দেব না হয়।

হ্যাঁ, দিয়েছ! সেবার বালিগঞ্জের জমিটা বিক্রী করেই তো হলো!

এবার না হয় টালিগঞ্জের বাড়িটাই বেচে ফেলব।

এতক্ষণে গিন্নীর মুখে হাসি দেখা দেয়–জমিটা বেচে পাঁচ হাজার টাকার গয়না হয়েছিল। পুরানো বাড়ির আর কত দাম হবে?

যতই কম হোক, বিশ হাজারের কম তো না। আমি ব্যঙ্কে টাকা জমানোর চেয়ে গয়না গড়িয়ে রাখতেই বেশি ভালবাসি। তুমি তো জানো! মাটিতে পুঁতে রাখার চেয়েও ভাল।–একটু দম নেন–হ্যাঁ নিশ্চয়ই। জলে ফেলে দেওয়ার চেয়েও।

কিন্তু এত টাকার গয়না! পুলিসে খবর না দাও, নিজে থেকেও একটু খোঁজ করলে হতো না! হয়তো পাওয়া যেত একটু চেষ্টা করলে।

হ্যাঁ, ও আবার পাওয়া যায়। তা আর ফেরে না। ও আমি অনেকবার দেখেছি। কেবল খোঁজাখুঁজিই সার হবে! বিশ্বেশরবাবু বুড়ো আঙুল নাড়েন।

তবু–গিন্নীর তথাপি খুঁত-থুতুনি যায় না।

খুঁজব কি, কে নিতে পারে তা তো আমি ভেবেই পাচ্ছি না। বিশ্বেশ্বরবাবু কপাল কোচকান, কার যে এই কাজ?

কার আবার! কার্তিকের! তা বুঝতেও তোমার এত দেরি হচ্ছে। যে চাকর টেরি কাটে, সে চোর হয়ে যায় না।

কার্তিক? এতদিন থেকে আছে, অমন বিশ্বাসী? সে চুরি করবে তা কি হয় কখন?

সে করবে না তো কি আমি করেছি? গিন্নী এবার ক্ষেপে যান।

তুমি?–বিশ্বেশরবাবু সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকান–তোমার নিজের জিনিস নিজে চুরি করবে? আমার বিশ্বাস হয় না।–

তাহলে কি তুমি করেছ?

আমি? অসম্ভব। বিশ্বেশ্বরবাবু প্রবলভাবে ঘাড় নাড়েন।

তুমি করোনি, আমিও করিনি, কার্তিকও করেনি–তাহলে কে করতে গেল? বাড়িতে তো এই তিনটি প্রাণী! গৃহিণী অন্তরের বিরক্তি প্রকাশ করেই ফেলেন।

তাই তো ভাবনায় বিষয়। বিশ্বেশ্বরবাবু মাথা ঘামাবার প্রয়াস পান,এইখানেই গুরুতর রহস্য! গোয়েন্দার মতো গোলমেলে হয়ে ওঠে তার মুখ।

তোমার রহস্য নিয়ে তুমি থাকো, আমি চললুম। গয়না গেছে বলে পেট তো মানবে না, চলে যেতে যেতে বলে যান গিন্নী, তুমি টালিগঞ্জের বাড়িটার বিহিত কর এদিকে, তাছাড়া আর কি হবে তোমাকে দিয়ে! গয়নার কি গতি করতে পারি, আমি নিজেই দেখছি।

কার্তিককে কিছু বোল না যেন। প্রমান নেই, বৃথা সন্দেহ করলে বেচারা আঘাত পাবে মনে।–কর্তা উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

কি করতে হয় না হয় সে আমি বুঝব।

আর পাড়ায় কেউ যেন ঘুণাক্ষরেও টের না পায়। বিশ্বেশ্বরবাবু ঈষৎ ব্যস্তই হন–চুরি যাওয়া একটা কেলেঙ্কারীই তো?

অত টাকার গয়না, একদিন গা সাজিয়ে পরতেও পেলুম না। তোমার জন্যেই তো। কেবলই বলেছ, গয়না কি পরবার জন্যে। ও-সব বাক্সে তুলে রাখবার জন্যে! এখন হল তো, সব নিয়ে গেল চোরে? গিন্নীর কেবল কাঁদতে বাকী থাকে।

সে তো তোমার ভালই জন্যেই বলেছি। পাড়ার লোকের চোখ টাটাবে। তোমার হিংসে করবে–সেটা কি ভাল?

বেশ, তবে এবার ওদের কান টাটাক। আমি গলা ফাটিয়ে ডাক ছেড়ে বলব যে, আমায় অ্যাতো টাকার গয়না ছিল। বলবই তো!

উঁহুহু। তাহলেই পুলিসে জানবে। চুরির কিনারা হবে, ভারী হাঙ্গামা। ও নিয়ে উচ্চবাচ্যও কোরো না। আমি আজ বিকেলেই বরং টালিগঞ্জে যাচ্ছি।

গিন্নী চলে গেলে আবার খবরের কাগজ নিয়ে পড়েন বিশ্বেশ্বরবাবু। নিজের গৃহের সমস্যা থেকে একেবারে স্পেনের গৃহ সমস্যায়। বিশ্ব ব্যাপারে ওতঃপ্রোত হয়ে কতক্ষণ কাটে বলা যায় না, হটাৎ সদর দরজায় কড়া নাড়া ওঁকে সচকিত করে। নিচে নেমে যেতেই পাড়ার সবাই ওঁকে হেঁকে ধরে।

কোথায় গেল সেই বদমাইশটা? তাকেই জিজ্ঞাসা করে সবাই।

কে গেল কোথায়? বিশ্বেশ্ববাবু বিচলিতই হন।

সেই গুণধর আপনার চাকর? কার্তিক? চুরি করে পালিয়েছে বুঝি?

পালিয়েছে? কই তা জানি না! কার চুরি করল আবার?

আপনাকেই তো পথে বসিয়ে গেছে আর অপনিই জানেন না? আশ্চর্য!

আমাকে? পথে বসিয়ে? বিশ্বেশ্বরবাবু আরো আশ্চর্য হন, আমি তো এতক্ষণ ওপরেই বসেছিলাম।

দেখুন বিশ্বেশ্বরবাবু, শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে যাবেন না। আপনার ও চারটি কম নয়। আমরা তখন থেকেই জানি। যে চাকর টেরি কাটে, সে চোর ছাড়া আর কি হবে? আমরা সবাই জানতে পেরেছি, আপনার গিন্নীর থেকে আমাদের গিন্নী, আমাদের গিন্নীদের থেকে আমরা।

হ্যাঁ, কিছুই জানতে বাকি নেই। জনতার ভেতর থেকে একজন বেশি উৎসাহ দেখায় এখন কোথায় গেল সেই হতভাগা! পিটিয়ে লাশ করব তাকে। সেই জন্যই আমরা এসেছি।

দেখুন, সমস্তই যখন জেনেছেন তখন আর লুকোতে চাই না।–বিশ্বেশ্বরবাবু বলেন–কিন্তু একটা কথা। মেরে কি লাভ হবে? মারলে অন্য অনেক কিছু বেরুতে পারে, কিন্তু গয়না কি বেরুবে?

আলবৎ বেরুবে।–তাদের মধ্যে দারুণ মতের ঐক্য দেখা যায়, বার করে তবে ছাড়বো। বেরুতেই হবে।

বিশ্বেশ্বরবাবু দেখেন, এরা সব বাল্যকাল থেকে এখন পর্যন্ত এ যাবকাল বাবার কাছে, মাস্টারের কাছে, স্কুলে আর পাঠশালায়, খেলার মাঠে আর সিনেমা দেখতে গিয়ে সার্জেন্টের আর গুণ্ডার হাতে যেসব ঠেঙান, ঠোক্কর আর তো খেয়ে এসেছে আজ সুদে আসলে নিতান্তই ধরা পড়ে যাওয়া কার্তিককেই তার সমস্ত শোধ দেবার জন্য বদ্ধপরিকর। বেওয়ারিশ মাথায় চাদা করে চাটাবার এমন অধোদয়যোগে সহজে এরা হাতছাড়া করবে না। তবু তিনি একবার শেষ চেষ্টা করেন একটা কথা ভাবার আছে। শাস্ত্রে বলে ক্ষমা হি পরমো ধর্মঃ। মার্জনা করে দেওয়াই কি ভাল নয় ওকে?

আপনার চুরি গেছে আপনি ক্ষমা করতে পারেন। আপনার চাকর আপনি তো মার্জনা করবেনই। কিন্তু আমরা পাড়ার পাঁচজন তা করতে পারি না।

কি মুশকিল, কি মুশকিল! তাহলে এক কাজ করুণ আপনারা। অর্ধেক লোক যান হাওড়ায়, অর্ধের শেয়ালদায়। এই দুটো পথের একট পথেই সে উধা হয়েছে এতক্ষণ।

পাড়ার লোকেরা হতাশ হয়ে চলে যায়। পলায়মান চোরের পশ্চাদ্ধাবনের উৎসাহ প্রায় কারোরই হয় না। বিশেশ্বরবাবুর আবার কাগজের মধ্যে ফিরে আসেন। এমনই সময়ে টেরি সমন্বিত কার্তিকের আবির্ভাব।

কি রে, কোথায় ছিলি এতক্ষণ? বিশ্বেশ্বরবাবু খবরের কাগজ থেকে চোখ তোলেন। সকাল থেকে তো দেখতে পাইছি। ওঁর কণ্ঠে সহানুভূতির সুর।

আত্মীয়র বাড়ি গেছলাম–আমতা আমতা করে কার্তিক। কিন্তু একটু পরেই ফোঁস করে ওঠে–গেছলাম এক স্যাকরার দোকানে।

বিশ্বেশ্বরবাবু যেন ঘাবড়ে যান–আহা, কোথায় গেছলি আমি জানতে চেয়েছি কি! যাবি বই কি, একটু বেড়াতে টেড়াতে না গেলে হয়। বয়স হয়েছে আর পেরে উঠি না তাই, নইলে আমিও এককালে প্রাতঃভ্রমণ করতাম! রেগুলারলি।

গিন্নীমা আমার নামে যা–নয়–তাই বদনাম দিয়েছেন। পাড়ায় কান পাতা যাচ্ছে না–চাপা রাগে ফেটে পড়তে চায় কার্তিক।

বাধা দেন বিশ্বশ্বরবাবু–ওর কথা আবার ধরে নাকি! মাথার ঠিক নেই ওর। তুই কিছু মনে করিসনে বাপু।

আমি কিনা–আমি কিনা–কার্তিক ফুলে ফুলে ওঠে। অকথ্য উচ্চারণ ওর মুখ দিয়ে বেরুতে চায় না।

আহা কে বলছে! বিশ্বেশ্বরবাবু সান্ত্বনা দেন, আমি কি বলেছি সে কথা? বলিনি তো? তা হলেই হল।

পাড়ার পাঁচজনের নাকি আমায় পুলিশে দেবে। দিক না–দিয়েই দেখুক না মজাটা

হ্যাঁ, পুলিশে দেবে! দিলেই হল!–বিশ্বেশ্বরবাবু সাহস দেন–হ্যাঁ, দিলেই হল পুলিশে। কেন মিছে ভয় খাস বলতো। ওরা পুলিশে দেবার কে? আমি আছি কি জন্যে?

ভয় যার খাবার সেই খাবে। আমি কেন ভয় খেতে যাবো? কোনো দোষে দুষী নই আ আমারই যত বদনাম। আসুক না একবার পুলিশ। আমি নিজেই না হয় যাচ্ছি থানায়।

বিশ্বেশ্বরবাবু বেজায় দমে যান এবার–আরে, তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? কোথায় পুলিশ, কে কাকে দিচ্ছে তার ঠিক নেই, হাওয়ার সঙ্গে লড়াই। একটু থেকে ট্যাক থেকে একটা টাকা বের করেন–বদনাম দিয়েছে তার হয়েছে কি! গায়ে কি লেগে রয়েছে? এই নে, বকশিস নে–কিছু খা গিয়ে।

ঝনাৎ হতেই তৎক্ষণাৎ তুলে নেয় কার্তিক। একটু ঠাণ্ডা হয় এতক্ষণে।

কিন্তু একটা কথা বলি বাপু। যদি কিছু নিয়েই থাকিস, এখান থেকে সরিয়ে ফেল। একখানাও রাখিস নি যেন এখানে। পাড়ার লোক যখন খবর দেয়, পুলিশ যদি এসেই পড়ে, খানাতল্লাসী হতে কতক্ষণ? সদুপদেশ দিতে যান বিশ্বেশ্বরবাবু!

কী নিয়েছি, নিয়েছি কি? কার্তিক ক্ষেপে ওঠে।

আমি কি বলেছি কিছু নিয়েছিস? কিছু নিসনি। তবু যদি কিছু নিয়ে থাকিস বলে তোর সন্দেহ হয়।…আচ্ছা, এক কাজ কর না কেন কার্তিক? আমি তোকে গাড়ি ভাড়া এবং আরো কিছু টাকা দিচ্ছি, এখান থেকে পালিয়ে যা না কেন?

কেন পালাবো? আমি কি চুরি করেছি? তবে পালাব কেন? কার্তিক দপদপ করে জ্বলতে থাকে।

আহা, আমি কি পালাতে বলেছি? বলছি, দিনকতক কোথাও বেড়াতে যা না? এই হাওয়া খেতে, কি চেঞ্জে কোথাও শিলঙ কি দার্জিলিং, পুরী কিম্বা ওয়ালটোয়ারে? লোকে কি যায় না? চুরি না করলে কি যেতে নেই? দেশেও তো যাসনি অনেকদিন! আমি বলি কি–

কিন্তু তাঁর বলাবলির মধ্যে বাধা পড়ে। বিশ্বেশ্বরবাবু বাড়ি আছেন? বলতে বলতে কতকগুলি ভারী পায়ের শব্দ ক্রমশ উপরে উঠতে থাকে, সটান তাঁর ঘরের মধ্যে এসে থামে। জনকতক পাহারাওলা নিয়ে স্বয়ং দারোগাবাবুকে দেখা যায়।

আপনার নামে গুরুতর অভিযোগ। আপনি নাকি বাড়িতে চোর পুষেছেন?

বিশ্বেশ্বরবাবু আকাশ থেকে পড়েন, এসব মিথ্যে কথা কে লাগাচ্ছে বলুন তো? কার খেয়েদেয়ে কাজ নেই? ঘর-বাড়ি কি চোর পুষবার জন্যে হয়েছে? কেউ শুনেছে কখনো এমন কথা?

আপনার কি গয়নার বাকস চুরি যায়নি আজ? দারোগা জিজ্ঞাসা করেন।

বিশ্বেশ্বরবাবু ভারি মুশড়ে যান। চুপ করে থাকেন। কি আর বলবেন তিনি?

চুরির খবর থানায় রিপোর্ট করেন নি কেন তবে?- দারোগাবাবু হুমকি দেন।

গিন্নী বলছিলেন বটে চুরি গেছে। কিন্তু আমার বিশ্বাস হয়নি। কার্তিকের দিকে ফেরেন এবার–এই, তুই এখানে কি করছিস? দাঁড়িয়ে কেন? বাড়ির ভেতরে যা। কাজ কর্ম নেই?

এই বুঝি আপনার সেই চাকর? কিরে ব্যাটা, তুই কিছু জানিস চুরির?

জানি বইকি হুজুর, সবই জানি। চুরি গেছে তাও জানি কি চুরি গেছে তাও জানি–কার্তিক বলতে থাকে।

বিশ্বেশ্বরবাবু বাধা দেন–দারোগাবাবু, অ্যাকে ছেলেমানুষ তার ওপর ওর মাথা খারাপ। চারক হয়ে টেড়ি কাটে, দেখছেন না? কি বলতে কি বলে ফেলবে, ওর কথায় কান দেবেন না। বহুদিন থেকে আছে, ভারী বিশ্বাসী, ওর ওপর সন্দেহ হয় না আমার।

বহুদিনের বিশ্বস্ততা একদিনেই উবে যায, লোভ এমনই জিনিস মশাই!–দারোগাবাবু, বলেন, আকচারই দেখছি এরকম। কার্তিকের প্রতি জেরা চলে–এ চুরি-কার কাজ বলে তোর মনে হয়?

আর কারো কাজ নয় হুজুর, আমারি কাজ।

কেন করতে গেলি এ কাজ?

ঐ তো আপনিই বলে দিয়েছেন হুজুর। লোভের বশে! কার্তিক প্রকাশ করে, তা শিক্ষাও আমার হয়েছে তেমনি। সবই বলব আমি, কিছুই লুকবো না হুজুরের কাছে।

যা যাঃ! আর তোকে সব বলতে হবে না! বিশ্বেশ্বরবাবু দুজনের মাঝে পড়েন, ভারি বক্তা হয়েছেন আমার! অমন করলে খালাস করাই শক্ত হবে তোকে। দারোগাবাবু, ওর কথায় কান দেবেন না আপনি।

দারোগাবাবু বিশ্বেশ্বরের কথায় কান দেন না–কোথায় সে সব গয়না? কার্তিককেই জিজ্ঞাসা করেন।

কোথায় আবার? আমারই বিছানার তলায়! বিরক্তির সঙ্গে বিস্তারিত করে কার্তিক।

ছেঁড়া কাঁথার মধ্যে নাড়াচাড়া শুরু করতেই কার্তিকের লাখটাকার স্বপ্ন বেরিয়ে পড়ে। নেকলেস, ব্রেসলেট, টায়রা, হার, বালা, তাগা, চুড়ি, অনন্ত–সব কিছুরই অন্ত মেলে। দড়ি দিয়ে বাধা হয় কার্তিককে। সে কিন্তু বেপরোয়া। এবার বিশ্বেশ্বরবাবু নিজেই ওকালতি শুরু করেন ওর তরফে–-দেখুন দারোগাবাবু! নেহাত ছেলেমানুষ, লোভের বশে একটা অন্যায় করেই ফেলেছে। ছেলেবেলা থেকে আছে, প্রায় ছেলের মতই, আমার কোন রাগ হয় না ওর ওপর। এই ওর প্রথম অপরাধ, প্রথম যৌবনে এবারটা ওকে রেহাই দিন আপনি। সুযোগ পেলে শুধরে যাবে, সকলেই অমন শুধরে যায়। যে অভিজ্ঞতা আজ ওর লাভ হলো তাই ওর পক্ষে যথেষ্ট। অভিজ্ঞতা থেকেই মানুষ বড় হয় জীবনে। এই থেকে ও কর্পোরেশনের কাউন্সিলার, কলকাতার মেয়রও হতে পারে একদিন–হবে না যে তা কে বলবে? আর যদি নিতান্তই রেহাই না দেবেন, তবে দিন ওকে গুরুতর শাস্তি। আমি তাই চাই আপনার কাছে। চুরির চেয়েও গুরুতর। ও কি চোর? ও চোরের অধম। ও একটা গুণ্ডা! দেখছেন না কি রকম টেরি? ওকে আপনাদের গুণ্ডায়্যাক্টে একসটার্ন করে দিন–ঘাড় ধরে বার করে দিন এ দেশ থেকে। যাবজ্জীবন নির্বাসন। আমি ওকে এক বছরের বেতন আর গাড়িভাড়া আগাম গুণে দিচ্ছি, ও এক্ষুণি কেটে পড়ক, ছাপরা কি আরা জিলায়–যেখানে খুশি চলে যাক। গয়না তো সব পাওয়া গেছে, কেবল সাধু হবার, নতুন করে জীবন আরম্ভ করবার একটা সুযোগ দিন ওকে আপনি।

বিশ্বেশ্বরবাবুর বক্তৃতায় দারোগার মন টলে! কেবল বক্তৃতাই নয়, সেইসঙ্গে বক্তার দুই নয়নের দর বিগলিত ধারায় দারোগাবাবু বিমুগ্ধ, ব্যথিত, ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠেন। তিনি শিকার ফেলে চিত্তবিকার নিয়ে চলে যান।

পুলিশের কবল থেকে অব্যাহতি পেয়েও একটুও কাহিল হয় না কার্তিক। তার সঙ্গে যেন ভয়ানক অদ্ৰতা করা হয়েছে, ভয়ানক রকম ঠকানো হয়েছে তাকে, এহেন ধারণার বশে একটা জিঘাংসার ভাব তার প্রত্যেকটি আচরণ- বিচরণ থেকে প্রকাশ পেতে থাকে।

অবশেষে চিরবিদায়ের আগের মুহূর্ত ঘনিয়ে আসে। কর্তা অনেক আদর আপ্যায়নে, অযথা বাক্য বিস্তারে, অযাচিত বখশিসের প্রাচুর্য দিয়ে ওর যাবজ্জীবন নির্বাসনের দুঃখ ভুলিয়ে দেবার চেষ্টা করেন কিন্তু ও কি ভোলে? ওর ব্যথা কি ভোলবার? ওই জানে!

তোমার আদরেই তো সর্বনাশ হয়েছে ওর! মানুষ এমন নেমকহারাম হয়! গিন্নী নিজের অসন্তোষ চাপতে পারেন না–যথেষ্ট মাথা খেয়েছে, আর কেন? বরং, দড়ি-কলসী কিনে ডুবে মরতে বলল ওকে!

নিতে যাবার আগে শেষবারের মতন উসকে ওঠে কার্তিক। দড়ির ভাবনা নেই, কর্তার পুজোয় দেওয়া ছেঁড়া সিল্কের জামাটা পাকিয়েই দড়ি বানিয়ে নেব, কিন্তু কলসী আর হলো কোথায়? বড় দেখেই কলসী গড়াতেই চেয়েছিলাম মাঠাকরুণ, কিন্তু গড়তে আর দিলেন কই? হ্যাঁ, বেশ ভাল একটা পেতলের কলসী হত– বলে একটু থেকে সে উপসংহার করে আপনার গয়নাগুলি গালিয়েই!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *