৩০. রামকিঙ্কর বেইজের বাড়িতে

৩০.

বেলার সঙ্গে রামকিঙ্কর বেইজের খুব জানাশোনা ছিল। ও একদিন ওঁর বাড়িতে ধরে নিয়ে গিয়েছিল আমাকে। ভাঙাচোরা মাটির ঘর। আমাদের শকুন্তলা মাসিমার ভাই শিল্পী শঙ্খ চৌধুরী ঘরটি করেছিলেন নিজের জায়গায়। নিজের থাকা হয়নি, রামকিঙ্করদাকে থাকতে দিয়েছিলেন। শুনতাম খুব সাপখোপ আছে। রামকিঙ্করদা থাকতেন নির্বিকার। এদিকে-ওদিকে এটা-ওটা গড়তে গড়তে অর্ধেক করে ফেলে রাখতেন।

লাইব্রেরির বারান্দার অনুষ্ঠান দেখতে গেলে ওঁকে দেখতাম পেছন দিকে দাঁড়িয়ে আছেন। কখনো গিয়ে আলাপ করিনি। ভাস্কর্যের কিছু কি বুঝি যে আলাপ করব! বেলা পরিচয় করিয়ে দেবার পর আমাকে দেখে উনি মিটমিট করে হাসতেন। আমাকে কি গুণেই বা মনে রাখবেন? ভেবে, গিয়ে কথা বলতাম না।

অনিল চন্দ-রানী চন্দ থাকতেন শ্যামবাটিতে। আমার স্কলার্স ব্লকের ঘরের বাইরের রাস্তা দিয়ে অনিলদা বাড়ি যেতেন। বেশির ভাগ দেখা হতে পোস্টাপিসে। চিঠি সংগ্রহ করতে গিয়ে। দিল্লির চাকরি শেষ করে শান্তিনিকেতনে ফিরেছিলেন, বেশ কিছু চিঠি ডাকে দিতেন। চাইতেন আমি তার সেক্রেটারির মতন এসব কাজ করে-টরে দিই। আমার তো অত সময় ছিল না! একদিন খুলে বললাম, নিজের লেখার কাজ করে হাতে সময় থাকে না তো! তায় হাঁটাহাঁটি করতে বেশ কষ্ট হতো আমার।

ওঁদের বাড়িতে গেলে খুব ‘ফললাভ’ হতো। বাড়ির হাতায় পেয়ারা, আতা, আম, পেঁপে ফলত প্রচুর। রানীদির হাত তত খোলা ছিল না। অনিলদা বলতেন, ‘ওকে আরও দাও! বাড়িতে খাবে কে?’ একবার আমার সঙ্গে রণেন ঘোষ চৌধুরী গিয়েছিলেন। অনেক আতা পেয়েছিলাম, তার বেশির ভাগ তাকেই দিলাম। বাড়িতে ওঁর স্ত্রী আর দুই ছেলে ছিল তো।

শ্যামলীর বাড়ির কাছেই থাকতেন সুরেশদা। ওঁর স্ত্রী ঢাকাতে বড়দির সঙ্গে পড়তেন ইডেন স্কুলে। খনা নাম। উনি অরুন্ধতী গুহঠাকুরতার দিদি। একবার অরুন্ধতী ও বাড়িতে এসেছিলেন। আমাকে ধরলেন, আমাকে একদিন রানী চন্দের কাছে নিয়ে চলো।

রিকশা করে ওঁকে নিয়ে গেলাম শ্যামবাটিতে। দেখা হয়ে দুজনের সে যে কী উচ্ছ্বাস! মনে হলো একটা পুণ্যকর্ম করেছি। রানী চন্দ গাছের পেয়ারা খাওয়ালেন বান্ধবীকে। ওঁদের একটা কথা মনে লেগেছিল। বলাবলি করছিলেন, ‘দ্যাখো না মনটা যে কিছুতেই মরে না। ওর যেন বয়সই বাড়ে না!’ বয়স বেড়ে গেলে মন নিয়ে সত্যিই এক জ্বালা হয় বটে। শরীর আর মনের বয়স একভাবে বাড়ে না তো!

রণেন ঘোষ চৌধুরী ছিলেন এক আশ্চর্য মানুষ। খাটো পাজামা পরা, খালি পা, বয়স্ক, খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা এক ভদ্রলোক একদিন এসে উপস্থিত হলেন আমার ঘরে, ‘কিছু লাগবে?’ আমি তো অবাক–এ আবার কী! বললেন, ‘না, বিদেশে লেখাপড়া করতে এসেছেন, এখানে তো অনেক অসুবিধা হতে পারে!’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি?’ বললেন, বাংলায় অনার্স পাস করে এখন এমএ পড়ছেন। অবাক লাগল এ রকম বয়স্ক মানুষ এখনো ছাত্র!

ক্রমে জেনেছিলাম গ্ল্যাক্সো কোম্পানিতে ভালো চাকরি করতেন, আগাম অবসর নিয়ে এখন লেখাপড়াটা শেষ করছেন। বিয়েও করেছেন দেরিতে। কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে স্কুল শিক্ষয়িত্রী পাত্রী বিয়ে করেছিলেন। দুই ছেলে এখন পাঠভবনে পড়ছে।

আমার যা কিছু লাগত, তা এনে দেবার চেষ্টা করতেন। বাড়িতে পড়ে থাকা একটা ইকমিক কুকার এনে দিলেন আমাকে। বন্ধু প্রসেনজিৎ দিল এক হটপ্লেট। কুকারের বাটিতে বাটিতে চাল-ডাল সবজি দিয়ে হটপ্লেটে বসিয়ে সেদ্ধ করে নিতাম। কড়াইতে তেল গরম করে তরকারিতে ফোড়ন দিয়ে নিলেই হয়ে গেল।

রণেনবাবুর বাড়ি দেখতে গিয়েছিলাম একদিন। ছোটখাটো, যতটুকু না হলেই নয়। গৃহিণী অপ্রসন্ন মুখের এক মধ্যবয়সী। ছেলেরা নাকি ছিল ব্রিলিয়ান্ট। ওদের জন্যে ঢাকার বাংলা একাডেমির বই নিয়ে যেতে বলতেন আমাকে। বিজ্ঞানের বই। উনি তার বদলে আমাকে আমার প্রয়োজনীয় রবীন্দ্র-রচনাবলী কিনে দিতেন। রণেনবাবুর মতন নিরহং বিনয়ী মানুষ পৃথিবীতে দুটি দেখা যাবে না। যেখানে যত বক্তৃতা হতো, সবই একাগ্র মনোযোগে শুনতেন উনি। আমার মনে তার জন্যে চিরন্তন শ্রদ্ধার আসন থাকবে।

.

৩১.

শান্তিনিকেতনে আমার অতি প্রিয় মানুষ ছিলেন অধ্যাপক সত্যেন রায়। ইনি ঠাট্টা করে আমাকে বলতেন, ‘আমি তো আপনার ছাত্র। তার কারণ, দর্শনে এমএ পাস করে উনি আবার বাংলায় এমএ করেন। তখন সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ওপরে লেখা আমার বইটি এমএর সিলেবাসে (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়) সহায়ক গ্রন্থ হিসেবে নির্দিষ্ট ছিল। উনি মজা করতেন, আমিও খুব হাসতাম। ওঁর স্ত্রী ভালো গান গাইতেন, কিন্তু সে জন্যে আমার সঙ্গে তাঁদের ভাব হলো এমন নয়। স্ত্রীর রান্নাও ছিল অতি চমৎকার, আগেই একবার বলেছি। ওঁদের বাড়িতে অনেক খেয়েছি। কিন্তু গল্প করেছি তার চেয়ে অনেক বেশি। বাকপটু ছিলেন বটে ভদ্রলোক। স্ত্রী হার মেনে ঘরের কাজে চলে যেতেন। হ্যাঁ, গীতাদি। নামটা এতক্ষণে মনে পড়ল। সুস্বাদু কফিও তৈরি করতেন কী একটা কলে।

সত্যেন রায় গল্প থামাতে পারতেন না। শেষ যেবার দেখা, অনেক বেলা হয়ে গেছে। হঠাৎ একটা খালি রিকশা পেয়ে ছুটে গিয়ে তাতে উঠলাম। উনি বেরিয়ে এসে রিকশার হ্যাঁন্ডেল ধরে রিকশাওয়ালাকে মিনতি করলেন, আর একটু থামো না, আরেকটু গল্প করে নিই!

একবার কাজ করতে গিয়েছিলাম রবীন্দ্রসংগীত স্বরলিপির ইতিহাস নিয়ে। পত্রিকা ঘেঁটে ঘেঁটে তথ্য বার করব। উনি বললেন, ‘উঁহু, এটা আপনার যোগ্য কাজ নয়। ও ইতিহাস তো যে কেউ লিখতে পারে!’ অনেক মান দিতেন আমাকে সত্যি। আর তর্ক করতে এত দড় ছিলেন যে একটা আলোচনার বহু মাত্রা খুলে যেত। এমন মানুষ জীবনে আর পাইনি। প্রবোধ সেন কাকাবাবুও তর্কের বহু মাত্রা দেখতে পেতেন। কিন্তু ওঁর সঙ্গে তো তর্কে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না, অমন পণ্ডিত মানুষ! সত্যেন রায় মশাই তর্ক করতে করতে নানা খুনসুটি করতেন। হাউমাউ করে তর্ক করতাম তখন।

দোলের সময় মেয়েদের খামোখাই জাপটে ধরে আবির মাখাতেন সে-সব গল্প করতেন রসিয়ে। বউদি ওসব শুনে রান্নাঘরে পালাতেন।

শান্তিনিকেতনে বুদ্ধদেব বসুর একটি বাড়ি ছিল, স্বাগতবিদায়। প্রতিভা বসু ওখানে গিয়ে থাকতেন অনেক সময়। আমি আর কেতকী কুশারী ডাইসন পূর্বপল্লী গেস্টহাউসের ৯ আর ৬ নম্বর ঘরে থাকতে একবার ওঁর বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। কেতকীর বাবাকে তিনি ভালো চিনতেন। আমার বাবার যোগেই তো ঢাকায় কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে ওঁর ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। কাজেই আমাদের পরিচয়। পেয়ে ওঁর উচ্ছ্বাসের আর অন্য রইল না। দুজনকে খেতে বললেন এক সন্ধ্যায়। গেলাম। পূর্বপল্লী গেস্টহাউসের দুটো গলি উত্তরেই ওঁর ‘স্বাগতবিদায়’। কেতকীর কাছে মাইনারদের (খনিশ্রমিক) ব্যবহারের বড় চারকোনা একটা টর্চ ছিল। খুব আলো হতো।

খাবার টেবিলে বসে খাবার আগে গল্পসল্প হচ্ছিল। শান্তিনিকেতনে তখন যেমন হতো, দপ করে লোডশেডিং হয়ে গেল। একটু ঘাবড়েই গেলাম, কারণ, পূর্বপল্লীতে খুব ছিনতাই হতো পথে। প্রতিভা বসু কেতকীর টর্চটা জ্বেলে ছাদের দিকে ফোকাস করে বললেন, ‘বাঃ, কেমন চাঁদের আলোর মতো দেখাচ্ছে, এসো এই আলোতে খেয়ে নিই। খাওয়াদাওয়া হলো পরিপাটি। গেস্টহাউসে ফিরব বলে দুজনে পথে বেরোলাম। লোডশেডিং চলছে তখনো। মোড়ে পৌঁছুনোর সঙ্গে সঙ্গে টর্চটা নিভে গেল। চার্জ শেষ। কেতকী ঘাবড়ে গিয়ে প্রতিভাদি! প্রতিভাদি!’ বলে ডাকতে লাগল। ওঁর দরজায় ফিরে গিয়ে অনেক ডাকাডাকি করলাম দুজনে। সাড়া মিলল না। ওঁর দরজা খুলল না।

আমি বললাম, কাছেই তো, চলো সাবধানে পথ ঠাহর করে চলে যাই গেস্টহাউসে। যাহোক, ওই পথে কোনো বিভ্রাট হলো না। এর পরে আমি আর প্রতিভা বসুর বাড়িতে সহজে যাইনি।

কলকাতার কবি মণীন্দ্র রায়ের প্রাক্তন স্ত্রী তপতী রায় একদিন ফোন করলেন, ‘আমি প্রতিভা বসুর বাড়িতে উঠেছি, এসো তুমি এক সন্ধ্যায় এসে আমাকে গান শোনাও।’ এর মধ্যে আরও কিছু ঘটনা ঘটে গেছে। এক. নরেশ গুহ ও বাসায় বসে আলোচনা করেছেন যে আমি কেজিবির এজেন্ট। আরও শোনা গেল, বিবিসির নিমাই চট্টোপাধ্যায় শান্তিনিকেতনে এসেছেন, আমি খনাদির স্বামী সুরেশবাবুকে ‘ওহে জীবনবল্লভ’ শুনিয়েছি শুনে নিমাই মন্তব্য করেছেন, সন্‌জীদা ওটা গাইবেন কি? ও গায় ওঁর বোন ফাহ্‌মিদা।’ ফাহমিদা রেকর্ডে চমৎকার গেয়েছিল ওই গানটি সত্যিই। তা বলে আমি ও গান আর গাইতে পারব না! কথাটা খুব গায়ে লাগল। শ্যামলী খুব পীড়াপীড়ি করছিল, ‘তপতীদির ক্যানসার। এমন করে গান শুনতে চেয়েছেন, চলো গিয়ে গান শোনাবে।’ এক সন্ধ্যায় জাহানারা নিশি এল আমার কাছে। ওর আবার নামকরা লোকদের কাছে ঘেঁষবার আগ্রহ খুব। বললাম, ‘শোনো, প্রতিভা বসুর বাড়ি যাবে?’ ও সঙ্গে সঙ্গে রাজি। তো গেলাম।

সেখানে গিয়ে দেখি নিমাই বসে আছেন বৈঠকখানায়। সোনায় সোহাগা! আছেন নরেশ গুহও। এখানেই তো গান গাইতে হবে। আমাকে!

প্রথমে তপতীদির ফরমাশের গানগুলো গাইলাম। সবাই বেশ ‘আহা! বাহা!’ করতে লাগল। তারপর বললাম, এবার নিজের পছন্দের গান গাইব।’ বলে ধরলাম, ‘ওহে জীবনবল্লভ’। ওরে সেকি মুগ্ধ বিমূঢ় ভাব সকলের! এবার নিশি লালনের গান শোনাবার ইচ্ছা প্রকাশ করলে সবাই হইহই করে উঠল। আমি সেই ফাঁকে উঠে পড়লাম। তপতীদি আমাকে এগিয়ে দিতে এসে বললেন, ‘মনের জোর বটে তোমার! তুমি এ বাড়িতে আসবে আমি ভাবতেই পারিনি। কেন আসতে চাওনি, সবই জেনেছি আমি!’ যাহোক, বিজয়ীর মতো ফিরে এলাম।

আমার ‘রবীন্দ্রসংগীতের ভাবসম্পদ’ নিয়ে কাজ করবার সময় থেকেই সত্যেনদা গুরুপল্লীতে সেজদির বাসায় ছিলেন। সে আমার আনন্দ! মনে হলেই সেজদির বাড়ি চলে যেতাম। এক প্রিয়জন সত্যেনদা, আর হলেন সেজদি। এমন সব সুন্দর মনের মানুষ আর কোথায় পাব! পরস্পর কথাবার্তার তো দরকার নেই কোনো। স্মিতহাস্য বিনিময়ের পরেই চলত গান। টুলু মামাও এগান-ওগান ফরমাশ করতেন। আর এক বিনোদন ছিল টুলু মামার বাবার চিৎকার-চেঁচামেচি-গালাগাল। প্রোস্টেটগ্ল্যান্ড অপারেশনের পর প্লাস্টিকের নল দিয়ে পেচ্ছাপ গড়িয়ে থলিতে জমা হবার ব্যবস্থা ছিল। থেকে থেকেই নলের মুখ থেকে ইনফেকশন হয়ে সারা গায়ে চুলকানির যন্ত্রণা হতো তাঁর। কষ্টে ঝালাপালা হয়ে চুলকাতে চুলকাতে তিনি সেজদিকে যা-তা বলে গালিগালাজ শুরু করতেন। সেজদি পট করে মাঝের ঘরে আমার আর সত্যেনদার কাছে চলে এসে হাসতে থাকতেন! গালি খাবার মতো এমন আমোদ বুঝি আর কিছুতেই হয় না। আমি আর সত্যেনদাও হাসতাম। নিঃশব্দ হাসি। গৃহকর্তা কিছুই টের পেতেন না। বাড়িসুদ্ধ সবাই অসুস্থ। সেজদির নিজের পিঠটা গেছে বেঁকে। কিন্তু সারা বাড়ির তিনিই একমাত্র ত্রাতা। ওপাশের ঘর থেকে টুলু মামা ডাকেন, ‘মা!’, মাঝের ঘর থেকে সত্যেনদা, ‘সেজদি!’, আর এক ঘর থেকে অসুস্থ গৃহকর্তা ‘শুনছ!

বাড়িতে খানিকটা গানের হাওয়া বইয়ে দিয়ে ঘরের পথে রওনা হতাম। পেছন থেকে ছোট্ট একটা জানালা ধরে সেজদি তাকিয়ে থাকতেন, যত দূর দেখা যায়।

সত্যেনদার ধারণা ছিল রক্তের সম্পর্ক-টম্পর্ক সব বাজে কথা। (না হলে আমি ওঁদের কে?)। কিন্তু অন্য সম্পর্ক পাতিয়ে কম ছ্যাকাও খেতেন না। টাকা গেছে কত! একবার হরিনাভিতে পাতানো সম্পর্কের এক বাড়িতে গিয়েছিলেন থাকতে। বিশাল চকমিলানো জমিদারবাড়ির একটা ধার পেয়েছিলেন গৃহস্বামী।

কোণের ঘরে স্বামী-স্ত্রীর বসবাস। পাশেই হল কামরায় সার সার সিঙ্গল বেড তথা চৌকি পাতা। সে-ঘরে থাকেন সত্যেনদা। অন্যধারের এক বেডে থাকেন কর্তা গিন্নির এক পুত্র। কখন আসেন যান কেউ জানে না। খাওয়াও নেই বাড়িতে। সত্যেনদা শান্তিনিকেতনে পোস্টকার্ডে খবর দিলেন, ‘মিনু, চলে এসো। একটা মজার জিনিস শোনাব। থাকবার অসুবিধে নেই, এখানেই থাকবে।’

শিবনাথ শাস্ত্রীর হরিনাভিতে ঘুরে আসব, বেশ তো! ছুটলাম।

সত্যেনদার পাশের চৌকিতে আমার স্থান। হল কামরার পরে একটা খাবার ঘর। দুপুরে খেতে বসে এক বিশ্রী অভিজ্ঞতা হলো। গৃহিণী খাবার বেড়ে দিচ্ছেন। আমার জন্যে দই দিলেন পাত্রে করে। সত্যেনদা আমার পাশে বসে খাচ্ছেন। বললাম, ‘সত্যেনদার দই? বললেন, ‘দেখতে পায় না তো!’ অর্থাৎ দেখতে পাচ্ছেন না বলে ওঁকে দই দেবার দরকার নেই। হতভম্ব হয়ে গেলাম। তবে দইয়ের পাত্র সত্যেনদার পাত্রের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম, ‘সত্যেনদা, দই।’ মহিলা বিরক্ত হলেও কিছু বললেন না।

প্রথম রাত্রে যাত্রাক্লান্ত বলে এক ঘুমে রাত্রি কাবার হলো। ঘোর ঘোর অন্ধকার থাকতে সত্যেনদা ডাকলেন, ‘মিনু, ওঠো।’ বারান্দায় নিয়ে গিয়ে আমাকে একটা চেয়ারে বসতে বললেন। মুখে আঙুল দিয়ে চুপ করে থাকতে ইশারা করলেন। বসে আছি। বেশ খানিকটা সময় পার হলে হঠাৎ সামনের গাছের সব পাখি একসঙ্গে কলকল করে ডেকে উঠল। যেন বলল, ‘ভোর হয়েছে।’ তারপরেই চুপ। আমি তো অবাক। এই মজার ব্যাপার শোনাতেই আমাকে হরিনাভিতে ডেকেছেন সত্যেনদা। এবার আমাকে একখানা গান গাইতে বললেন। গাইলাম ‘তোমার সুর শুনায়ে যে ঘুম ভাঙাও’।

সন্ধ্যাবেলা হলঘরের শেষপ্রান্তে একটা চৌকিতে বসে আমি আর সত্যেনদা গল্প করছিলাম। কাগিন্নি এসে প্রবেশ করলেন। কর্তা বললেন, রোজ ভোর না হতে খখস্ স্যান্ডেলের আওয়াজে ঘুমানো যায় না। আর আজ, আহা! কী মধুর গান শুনলেন ভোরসকালে, ভাবাই যায় না। গৃহিণীও উচ্ছ্বসিত। বিশেষ রসাবেশ আছে বলে মনে হওয়াতে আমি কেবলই সরে সরে বসছিলাম।

ওদিকে আমি সত্যেনদাকে দধি-সমাচার খুলে বলে জানতে পেরেছি সত্যেনদাই বাড়িতে রোজ দুধ কেনেন। তবে দুধ বা দই চোখে দেখেন না। খুব রাগ হলো, ‘থাকো কেন এখানে? চলো, কালই আমার সঙ্গে যাবে কলকাতায়।’ ভেতরে ভেতরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন বোধ হয়। আমার সঙ্গে কলকাতায় যেতে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন। নানা জায়গায় ঠকতে ঠকতে শেষ পর্যন্ত সেজদির কাছেই শেষ দিনগুলো কাটিয়েছিলেন সত্যেনদা। শেষ দিকে হাঁপানিটা এত বেড়েছিল যে শুতে পারতেন না। ঘুম তো দূরের কথা। মুখের হাসি নিভে গিয়েছিল। গান শুনতেও আর ইচ্ছে হতো না। একদিন বললেন, ‘আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না। ডিসেম্বরে বলেছিলেন, জানুয়ারিতে সত্যি সত্যি চলে গেলেন।

সেজদির প্রয়াণের কথাও এখানে লিখে যাই। ঢাকাতে আমার এক ছাত্র একদিন বলল সে যাচ্ছে শান্তিনিকেতনে, আমি কাউকে চিঠি দেব নাকি? টুলু মামা চলে গেছেন, সত্যেনদা তো গেছেন আগেই। বললাম, ‘হ্যাঁ, সত্যেনদার সেজদিকে চিঠি দেব, দিতে পারবে গিয়ে?’ সে বাসায় এসে পরমোৎসাহে চিঠি নিয়ে গেল। তারপর অনেক দিন আর খবরাখবর নেই। একে-ওকে জিজ্ঞেস করবার পর সে ছেলে একদিন এল। আমার চোখের দিকে আর তাকায় না। শেষে ক্রমে ক্রমে শুনলাম, শান্তিনিকেতনে পৌঁছে সে সোজা সেজদির বাসাতেই গিয়েছিল। দেখতে পেল বাইরের ঘরটায় একটা শব শোয়ানো। তার মুখে স্মিতহাসি। কাউকে কিছু না জিজ্ঞেস করে সে সেখান থেকে ফিরে এসেছে। এইভাবে সেজদির চলে যাবার খবরটি আমি জানতে পেরেছিলাম।

.

৩২.

২০০১ সালে রবীন্দ্রসংগীতের স্বরলিপির তথ্য নিয়ে কাজ করব বলে শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলাম। রবীন্দ্রভবনে বসেই এসব কাজ করবার সুবিধে হয়। প্রথম কিছুদিন পূর্বপল্লী গেস্টহাউসে থেকে আমার ধ্বনি থেকে কবিতা বইয়ের দ্বিতীয় মুদ্রণের কাজ করলাম। তারপরে রবীন্দ্রভবন পাঠাগারে বসে কাজ শুরু করা গেল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক স্বপন মজুমদার তখন রবীন্দ্রভবনের অধ্যক্ষ। ভদ্রলোক কেন জানি না আমাকে তাঁর অধস্তন কর্মচারী ভেবে বসলেন। কথায় কথায় আমাকে ডেকে পাঠাতেন। কথাবার্তায় আক্রমণাত্মক ভাব থাকত। সেসব কথা ছেড়ে, তাঁর কথায় রবীন্দ্রভবনে যে বক্তৃতা করেছিলাম, সেই বিষয়ে লিখি।

অল্প দিনেই রবীন্দ্রগানের স্বরলিপি বিষয়ে অনেক খবর পেয়ে গিয়েছিলাম। ‘সখী, ওই বুঝি বাঁশি বাজে’ গানটিতে রবীন্দ্রনাথের সায় পেয়েই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ থিয়েটারি ঢঙের চড়া সুর বসিয়েছিলেন। এ সুর নিজেই গেয়ে শোনাব ঠিক করলাম। দিলীপ রায় রবীন্দ্রনাথের ‘তোমার বীণা আমার মনোমাঝে’ গানে নিজে আরেকটি সুর দিয়ে তাঁর গীতিমঞ্জরী বইতে ছাপিয়েছিলেন, সেই সুরটি বললাম স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়কে গাইতে। সরলা দেবী ‘এমন দিনে তারে বলা যায়’ গানটিতে কোথাও জোরে, কোথাও মৃদুকণ্ঠে গাইবার নির্দেশ দিয়ে যে স্বরলিপি করেছিলেন, সেখানাও সেইভাবে গেয়ে শোনাতে বললাম স্বস্তিকাকে। ইন্দিরা দেবী কাঙালিচরণ সেনের করা ‘মোরে বারে বারে ফিরালে’ গানটির স্বরলিপি বদল করে অন্তরা আর আভোগের পরে মুখ গাইবার সময়ে ‘মোরে’ উচ্চারণের ছন্দে গানটিকে রাগভঙ্গি করে তুলেছিলেন। আলপনা রায় চৌধুরীকে বলেছিলাম এই দুই স্বরলিপির ভেদ গেয়ে শোনাতে। প্রসঙ্গ ছিল আরও নানা, যাতে বক্তৃতা হলো দুঘণ্টাব্যাপী।

রবীন্দ্রনাথ কবিতার ছন্দের নয় মাত্রা রক্ষা করে গানও গাওয়া যাবে না কেন প্রশ্ন তুলেছিলেন। কবিতা বলবার সময়ে আমরা পঙক্তি শেষে কয়েক মাত্রা নীরব থেকে পাদপূরণ করে নিয়ে থাকি। যেমন, ‘যে কাঁ দ নে হি য়া কাঁ দি ছে।।।’ গানটির স্বরলিপি করবার সময়ে দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর গানেও ‘কাঁদিছে’র পরে ৩ মাত্রা সুর টেনে রেখেছেন। অর্থাৎ ৯ নয়, ১২ মাত্রায় এক ছত্র বাঁধা হয়েছে। আমি একবার ৯ মাত্রায়, একবার ১২ মাত্রায় গেয়ে কোন ছন্দ স্বাভাবিক তার আলোচনা করেছিলাম।

বক্তৃতা করবার দিনই আমার ছেলে আর ছেলের বউ পঞ্চবটীতে আমার কাছে এসেছিল। তাদের বললাম আমার কাপড়চোপড় গুছিয়ে নিতে, এক দিন পরই আমি শান্তিনিকেতন ছেড়ে যাব। রবীন্দ্রভবনের পরিবেশ এত দুঃসহ হয়েছিল যে গবেষণার ইচ্ছা বিসর্জন দিয়ে ওখান থেকে চলে এলাম কলকাতায়।

.

৩৩.

বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বিশ্বভারতীর দেশিকোত্তম উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এই সম্মান লাভ করেছেন। ২০১২ সালে বিশ্বভারতীর তৎকালীন উপাচার্য টেলিফোনে আমাকে জানালেন যে কেন্দ্রীয় সরকার ২০০৮ সালের দেশিকোত্তম উপাধি আমাকে দিতে চেয়েছিলেন। ২০০৭ সাল থেকে পাঁচ বছর বিশ্বভারতীর কোননা সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়নি বলে ২০০৮ সালে আমিও ওই সম্মাননা পাইনি। দেশিকোত্তম হলো সম্মানসূচক ডি-লিট উপাধি। এত বড় অর্জনের কোনো আশাই আমার ছিল না। বিস্ময় আর আনন্দে আপ্লুত হলাম। বাংলাদেশের মানুষ যেমন, তেমনি শান্তিনিকেতনের সকলেই আনন্দে উচ্ছ্বসিত হলো। ঢাকা থেকে অনেকেই, বিশেষত ছায়ানটের সকলে সম্মাননা অনুষ্ঠানে যাবে বলে আমার সঙ্গ ধরল।

বিশ্বভারতীর উপাচার্য বাংলাদেশের উচ্ছ্বাস দেখে খুব খুশি হয়ে বললেন, আমার সঙ্গীদের প্লেন ভাড়া আর শান্তিনিকেতনের ব্যয় তারা বহন করবেন। আমাদের পক্ষ থেকে জানানো হলো থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হলেই যথেষ্ট হবে, যাতায়াত ভাড়া আমরাই দেব। ঢাকা থেকে তিরিশজন মানুষ শান্তিনিকেতনে গিয়েছিল। শান্তিনিকেতন আর ঢাকার শখের ঝগড়া আমি শান্তিনিকেতনের না ঢাকার, তাই নিয়ে! আমার আহ্লাদের সীমা থাকল না। কলকাতা আর জামসেদপুর থেকেও কিছু বন্ধু হাওড়া স্টেশন থেকে চললেন আমার সঙ্গে। শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকলেও মনের আনন্দে সব কষ্ট পুষিয়ে গেল। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল সম্মাননা প্রদান করলেন। আর দ্বিপ্রহরিক আহারের জন্যে আমন্ত্রণ জানালেন। চলচ্চিত্রের জননন্দিত নায়ক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সমাবর্তনের আমন্ত্রিত বক্তা ছিলেন। আহারের সময়ে দেখা হলো। আমাকে রাখা হয়েছিল রতনকুঠিতে। সৌমিত্রও সেখানে ছিলেন বটে, তবে আলাপের অবকাশ হয়নি। হাওড়া থেকে বোলপুর পর্যন্ত ট্রেনে গান, রতনকুঠি পৌঁছে গান, আর সর্বদা শান্তিনিকেতনের প্রিয়জনদের আসা-যাওয়া। অবকাশ কোথায়?

রাজ্যপাল উপাচার্যকে দিয়ে অনুরোধ পাঠালেন, আমি যেন একখানা গান গেয়ে শোনাই। শুনে তো আমার আক্কেলগুড়ুম! গানের সঙ্গে বহুদিন কোনো যোগ নেই, এখন কী করব! সংগীতভবনের অধ্যক্ষ আর এক অধ্যাপিকা বসেছিলেন আমার টেবিলে, অনুরোধ করলাম, আমার স্কেলটা তো খুব নেমে গেছে, যদি ওঁরাও আমার সঙ্গে কণ্ঠ মেলান! ভেতরে কাঁপতে কাঁপতে প্রিয় গান ‘পথে যেতে ডেকেছিলে মোরে’ ধরলাম। অবসর নেওয়া শিল্পীদের মনেও বোধ হয় একটা জেদ থাকে, গাইতে পারতে হবেই! ভোলা গলার আওয়াজে ডাইনিং হল ভরে গেল। গান শেষে রাজ্যপালের টেবিল থেকে হর্ষধ্বনি উঠল। সৌমিত্র উঠে এসে বলে গেলেন, ‘এই বয়সেও আপনি এমন গান গাইতে পারেন!’ মান রক্ষা হলো যা হোক।

শান্তিনিকেতনে ‘লিপিকা’ নামে একটা প্রেক্ষাগৃহ হয়েছে, দেখিনি আগে। সেখানে বাংলাদেশের শিল্পীদের গানের এক আয়োজন হলো। ইফফাত, মিতা, লিসা (ইফফাত আরা দেওয়ান, মিতা হক, লাইসা আহমদ লিসা) অনেকেই গিয়েছিল। আমার স্মৃতিচারণার সঙ্গে সঙ্গে সবাই কখনো একক কণ্ঠে, কখনো সম্মেলক কণ্ঠে গান গাইল। বেশ লম্বা হয়ে গেল অনুষ্ঠান। দর্শক সারিতে শেষ পর্যন্ত মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায় আর আলপনা রায়কে দেখা গেল। উপাচার্য তো ছিলেনই, উচ্ছ্বসিত বক্তৃতা করলেন। বাংলাদেশের শিল্পীরা শান্তিনিকেতনে গিয়ে রবীন্দ্রসংগীত গাইতে পেরে তৃপ্ত হলো।

শান্তিনিকেতনে যেখানেই আমার প্রবন্ধ পাঠ থাকত, তাতে নিত্য শ্ৰোতা থাকত মানস বন্দ্যোপাধ্যায়। বোলপুরের বাসিন্দা। স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে আমাকে ব্যক্তিগত নানা কাজে সাহায্য করত। মানস তার ‘চতুর্দশী’ প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে আমার সঙ্গীদের সংবর্ধনা দিয়েছিল। সুসজ্জিত পরিবেশে সুন্দর-পরিচ্ছন্ন আয়োজন। স্বর্ণচাঁপা ফুল সাজিয়ে নিজের হাতে বিশেষ পুস্পার্ঘ্য তৈরি করেছিল সে।

জীবনে আমরা যা চাই, তা সব সময়ে পাই না। মনের কোণে এক গোপন আক্ষেপ থেকেই যায়। কিন্তু এমন কিছু জিনিস আছে, যার আকস্মিক প্রাপ্তি জীবনের সমস্ত ক্ষোভকে শান্ত করে দিতে পারে। দেশিকোত্তম অর্জন আমার জীবনের সেই পরম প্রাপ্তি। ধন্য আমার জীবন, ধন্য এই জন্ম। আমার চেয়ে বেশি সুখী কি এ পৃথিবীতে আর কেউ হতে পেরেছে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *