২০. ধ্বনি থেকে কবিতা

২০.

‘ধ্বনি থেকে কবিতা’ লিখবার সময়ে কতজনের কত সহায়তা যে পেয়েছি, কী বলব! দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বমান্য অধ্যাপক শিবতোষ মুখোপাধ্যায় (আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের বংশধর) এসেছিলেন রতনকুঠিতে। বিশ্বভারতীর কাজে। উনি একদিন আমার ঘরে চলে এলেন। নিরহংকার সুজন আমাকে বললেন, ‘কী লিখছ, শুনি?’ ‘নিরুদ্দেশ যাত্রার ধ্বনি’ প্রবন্ধটি লেখা হয়েছে তখন। শোনালাম। খুব মন দিয়ে শুনলেন। বললেন, কী ধ্বনি কতবার ব্যবহার হয়েছে তা যদি গ্রাফ এঁকে দেখিয়ে দেওয়া যায়, তো বক্তব্য অনেকখানি প্রত্যক্ষ হয়ে উঠবে। কিছু কঠিন নয় গ্রাফ করা। ঢাকার শিল্পীবন্ধু ইমদাদ হোসেনের ছেলেকে দিয়ে গ্রাফ করিয়ে নিলাম। ছাপাবার সময়ের টেকনোপ্রিন্টের অরিজিৎ কুমার নানা সমস্যা দেখাতে থাকলে কলকাতার শমীন্দ্র ভৌমিককে দিয়ে আবার কী সব আঁকাজোকা করানো হয়েছিল। অরিজিৎ কুমার কিছুতেই গ্রাফ ছাপবেন না, কেবলই আপত্তি। অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল

তাই।

শান্তা-অসিতের কন্যা এত্তটুকুন ‘সোনাই’-ও কেমন করে আমার কাজে সাহায্য করেছে, বলি। সবার সাথে চলতেছিল অজানা এই পথের অন্ধকারে’ গানটির কথার কাব্যসৌন্দর্য গানে যথাযথ প্রকাশ পেয়েছে কি না পরীক্ষা করে দেখছিলাম। অজানা গানটি স্বরলিপি দেখে তুললাম। সুরটা আয়ত্ত হতে চায় না। গাইতে না পারলে সুরের যথাযযাগ্যতা বিচার করব কী করে! দিনভর চেষ্টার পরে রাত ৯টা নাগাদ মোটামুটি গাওয়া যাচ্ছে মনে হলো। অমনি ছুটলাম শান্তার বাড়ির দিকে। ঢুকেই ঘোষণা দিলাম একটা গান গাইব, শুনুন। বসবার ঘরে সোনাইও দাঁড়িয়ে ছিল তখন। আমার জিজ্ঞাস্য ছিল গানের বাণীর বেদনা সুরে সেভাবে প্রকাশ পেয়েছে কি না। সে কথা বলিনি ওঁদের। গান শেষ হতেই হু হু করে কান্নায় উচ্চকিত হলো সোনাই! অবাক হয়ে চেয়ে থেকে শান্তাকে আমার প্রশ্নের বিষয়ে বললাম। স্মিতমুখে শান্তা বলল, ‘উত্তর তো পেয়ে গেছেন, তাই না?’

.

২১.

কানাই সামন্ত মশাই বলতেন, বিশ্বভারতাঁকে বলে তাদের কোনো মুদ্রণপ্রমাদ সংশোধন করানো যায় না। শততম বার একই ভুল ছেপে যাবে। আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতাতেও ভুল সংশোধনের অসম্ভব দেখেছি আমি। রবীন্দ্রভবনের সনবাবুর টেবিলে বসে একটি চিঠি দেখছিলাম আমি। চিঠিটি এক ভদ্রলোক লিখেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রনাথের শব্দতত্ত্ব বইতে চিঠিটি ছাপা হয়েছিল। বাংলা ভাষায় মুসলিম সমাজে ব্যবহৃত আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার বিষয়ে চিঠিতে অভিমত জানানো হয়েছিল। ভদ্রলোকের নাম ছাপা হয়েছে ‘এম এ আজান’। ‘আজান’ নাম কখনো শুনিনি বলে অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল। হঠাৎ খামের গায়ে হাতের লেখায় পত্রপ্রেরকের নামটি চোখে পড়ল। ‘এম এ আজম’। অমনি মনে পড়ে গেল, আমার মায়ের এক কুটুম্বের (ছোট বোনের স্বামী) ওই নাম ছিল। হোমরাচোমরা ধরনের ভদ্রলোককে তেমন ভালো লাগত না আমার। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্স নিয়ে লেখাপড়া করছি শুনে উনি আমাকে কটকট করে রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে কিছু বিরূপ কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, বাংলা ভাষায় মুসলমানি শব্দ ব্যবহার নিয়ে রবীন্দ্রনাথকে একটি চিঠি লিখেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ কোনো জবাব দিতে পারেননি। দুইয়ে দুইয়ে চার হিসাব করে নামের রহস্যটি আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। সনৎবাবুর দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম সঙ্গে সঙ্গে। প্রবাসী পত্রিকাতে এই চিঠি ছাপা হয়েছিল। পত্রিকা-সংশ্লিষ্টরাই ‘আজম’কে ‘আজান’ বানিয়ে ফেলেছেন বুঝতে পারা গেল। তারপর থেকে ওই ভুল ছাপা হয়ে এসেছে নির্বিচারে।

কানাই সামন্ত মশাই বললেন, ‘বাংলা শব্দতত্ত্ব’ নামে শব্দতত্ত্ব বইয়ের নতুন সংস্করণ বার হচ্ছে, এই সময়ে তুমি অন্যতম সম্পাদক শুভেন্দুশেখরকে চিঠি লেখো, ওরা ভুলটা শুধরে নেবে। লিখলাম। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল না। কিন্তু রবীন্দ্রভবনে গবেষণার কাজ করি বলে উনি আমার নামটি জানতেন।

চিঠির কোনো জবাব এল না।

বহুদিন বাদে পূর্বপল্লীতে সত্যেন রায় মশাইয়ের বাসায় গিয়ে এক বিকেলে শুভেন্দুশেখরবাবুর দেখা পেলাম। ওঁদের কথার মাঝখানে কথা না বলে ধৈর্য ধরে বসে রইলাম। সুযোগ হলে বললাম, ‘আমি আপনাকে একটা চিঠি লিখেছিলাম…।’ উনি মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, কিন্তু তখন বইটা ছাপা হয়ে গেছে বলে আর কিছু করা গেল না।’ ফুরিয়ে গেল।

আরও পরে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের রবীন্দ্র-রচনাবলী ছাপা হয়। অনেক আশা নিয়ে বই খুলে দেখলাম যথাপূর্বং…, যেমনকার ‘আজান’ তেমনি আছে।

গানের স্বরলিপির ব্যাপারেও কোনো ভুল নিয়ে প্রশ্ন করে কোনো জবাব পাইনি। ভুলের কোনো সুরাহা পাওয়ার আশা সত্যিই বৃথা।

.

২২.

আমি যখন এমএ পড়ছি, তখন ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী পাঠভবনের শিক্ষক বুবুদির বাসায় থাকতেন। বুবুদি তাঁর পুত্রবধূ। সুপ্রিয়-সুপূর্ণা বুবুদির পুত্রকন্যা। আগে লিখেছি, সুপূর্ণাকে ইন্দিরা দেবী ট্রেনিং দিয়ে দক্ষ গাইয়ে করে তুলেছিলেন। আমি একবার প্রথম পর্ব এমএর বান্ধবীদের সঙ্গে ওঁকে দেখতে গিয়েছিলাম। উনি জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘গান জানো?’ গান শোনাতে বললে বোকার মতো ধরেছিলাম অনেক চড়া সুরের গান ‘মেঘ বলেছে যাব যাব। খালি গলায় গাইতে গিয়ে গলা সুরে পৌঁছুল না। উনি বেশ বিরক্ত হয়েছিলেন মনে হয়েছিল। ভয়ে আর কখনো তার ধারেপাশে যাইনি।

‘ধ্বনি থেকে কবিতা’ লিখবার সময়ে কানাই সামন্ত মশাই কত যে সহায়তা দিয়েছেন আমাকে, তা আগে বলেছি। তবে সব কি আর বলে শেষ করা যায়! রবীন্দ্রনাথ কখনো কখনো এক কবিতাকে বারবার বদল করে দেখতেন কোনটি সবচেয়ে ভালো হয়। সেসব পাঠান্তর নিয়ে নানা ভাবনাচিন্তা করা যেতে পারে, বলেছিলেন কানাইবাবু। ওঁর কথামতো পাণ্ডুলিপি নিয়ে কাজ করে নানা রকম বিবেচনা শেষে মত প্রকাশ করা সম্ভব হয়েছিল।

একটি গানের পাঠ নিয়ে একবার বিভ্রাট হয়েছিল। গানটি দেবব্রত বিশ্বাস গেয়েছিলেন রেকর্ডে। পাঠ নিয়ে বাদানুবাদের কথাও সেই শিল্পীর কাছেই শুনেছিলাম। পুরোনো সংস্করণের গীতবিতান-এ ‘তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম’ গানের যে পাঠ ছিল, পরের সংস্করণে তা বদলে গিয়েছিল। ‘মম জীবন যৌবন মম সকল স্বপন/ তুমি ভরিবে সৌরভে নিশীথিনী-সম’ পাঠ ছিল আগের সংস্করণে; সেই পাঠ অনুযায়ী দেবব্রত গান রেকর্ড করেছিলেন। বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ড’ পরের সংস্করণের বই দেখে বলল, না, সকল স্বপন’ হবে না, হবে ‘সফল স্বপন’। কর্তৃপক্ষ হিসেবে মিউজিক বোর্ডের কথাই ওপরে থাকল। কানাই সামন্ত মশাইকে বলে পাণ্ডুলিপি বার করে দেখলাম একাধিক পাণ্ডুলিপিতে সকল’-এর ‘ক’-এর ওপরে ওভাররাইটিং রয়েছে। সব ‘সকল’ ‘সফল হয়ে গেছে। মন খুশি হলো না। কানাইবাবু বললেন, ‘ও তুমি যা-ই বলো ওটা ‘সফল’ বলেই চলে। গেছে। মন বেজার করে বসে রইলাম। তখন বললেন, তুমি শোভনলালকে জিজ্ঞেস করতে পারো গানটির ইংরেজি অনুবাদে কী আছে।’ গেলাম শোভনদার কাছে। উনি বিড়বিড় করে পাণ্ডুলিপির নম্বর উল্লেখ করে বললেন, ‘ওতে দ্যাখো তো!’ খুলে দেখি, ওতে আছে ‘all my dreams’। তবে তো ‘সকল স্বপনই হলো! কানাইবাবু মিটিমিটি হেসে বললেন, ‘ও তুমি যা-ই বলো, ওটা ‘সফল স্বপন’ই চালু হয়ে গেছে!’ আমি ক্ষমাদির গীতবিতান-এ ‘সফল’ কেটে ‘সকল’ লিখে রাখা আছে দেখেছি। ইন্দিরা দেবী নাকি নিজ হাতে বইতে ভুল সংশোধন করে দিয়েছিলেন। ওটা যে সকলই হবে, তা নিয়ে আমার কিছুমাত্র সংশয় নেই।

কবিতার ধ্বনির হাত ধরে ব্যঞ্জনার উপলব্ধিতে পৌঁছানোর সুবিধার জন্যে কবিতাগুলো মুখস্থ করে নিয়ে সারাক্ষণ মনে মনে আবৃত্তি করে চলতাম। নিরুদ্দেশ যাত্রা’ তো আগে থেকেই প্রায় মুখস্থ ছিল। সত্যেন দত্তের ‘চম্পা’র প্রথম দিকটা প্রায় মুখস্থ ছিল। বাকি অংশের ছন্দান্তর করতে গিয়ে মোটামুটি আয়ত্ত হয়ে গেল। মোটে পাঁচখানি কবিতা বিশ্লেষণ করার জন্যে নির্বাচন করেছিলাম। বাকি তিনটির একটি নজরুলের ‘সর্বহারা। বালিকা বয়স থেকেই সঞ্চিতা খুলে এ কবিতা কতবার যে পড়েছি তার ঠিক নেই। চতুর্থ কবিতা নিয়েছিলাম জীবনানন্দ দাশের ‘আমাকে একটি কথা দাও’। তত পরিচিত কবিতা নয়, কিন্তু উপসংহারে ‘পাখির প্রেমে, পাখিনীর ‘অন্তিম শরীরিনী মোমের মতন’ গলে যাবার কথায় নিঃশেষে সর্ব সমর্পণের ছবিতে মুগ্ধ হয়ে কবিতাটি বেছেছিলাম। এ কবিতা রীতিমতো মুখস্থ করতে হয়েছিল। ক্ষুদ্র অবয়ব বলে যাহোক করে মুখস্থ করে ফেলি। শেষ কবিতা শঙ্খ ঘোষের ‘ভিখিরির আবার পছন্দ’ পেয়েছিলাম প্রতিক্ষণ পত্রিকায়। উপর্যুপরি উষ্মধ্বনির ব্যবহার নিহিত ব্যঞ্জনাকে যেন অসহিষ্ণুতার ঝঙ্কারে উচ্ছ্বসিত করছিল। কবিতাটির ছত্রে ছত্রে অন্ত্যমিল না থাকলেও অন্যবিধ ধ্বনি সুষমা আর সাম্য সহজেই সেটিকে আয়ত্তে এনে দিল।

আশ্চর্যের বিষয়, কবিতাগুলো যখনই আবৃত্তি করা যায়, একের পর এক দল মেলে নতুন নতুন তাৎপর্য বিকশিত করে ওরা। মনে হতো কবিতাগুলোকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে অনুভব করতে করতে ভেতরে প্রবেশ করছি। এ কথা থেকে ধরা যাবে, ওই দিনগুলো আনন্দের ঘোরে কেটেছিল।

.

২৩.

শান্তিনিকেতনের সংগীতভবনে একটি লাল খাতা চেয়ে হাঁকডাক শোনা যেত প্রায়ই। সংগীতশিক্ষকেরা ক্লাসে গান শেখাতে গিয়ে স্বরলিপির কোনো সমস্যায় পড়লে বেয়ারাকে হাঁক দিতেন, ‘ওরে, লাল খাতাটা নিয়ে আয় তো!’ সে কী রকম খাতা জানতে খুব কৌতূহল হতো। একবার সময় পেয়ে লাইব্রেরিতে গিয়ে বসে লাল খাতা চেয়ে নিলাম কালীপদদার কাছ থেকে। কিসের লাল! ব্যবহারে জীর্ণ মলাটের লাল রং কবেই মাটি মাটি হয়ে গেছে!

ভেতরে দেখি গোটা গোটা হাতের লেখায় পরিষ্কার করে স্বরলিপি টুকে রাখা হয়েছে। সেই সঙ্গে কোন পত্রিকায় কত সালের কোন মাসে স্বরলিপিটি ছাপা হয়েছিল, তা-ও লেখা। খাতার শেষে নোট রয়েছে, স্বরলিপিগুলো টুকে রেখেছেন বীরেন পালিত মাস্টার মশাই। শান্তিনিকেতনে ইনিই কেবল নিজের ক্লাসঘরে একটি হারমোনিয়াম রাখতেন। আর সব ক্লাসে তানপুরা বেঁধে গান শেখানো চলত। বীরেনদা কঠিন কঠিন ধ্রুপদাঙ্গের রবীন্দ্রসংগীতগুলো শেখাতেন ছেলেমেয়েদের।

লাল খাতাতে আমাদের জাতীয় সংগীতের স্বরলিপি পেলাম। স্বরবিতানে ইন্দিরা দেবীর যে স্বরলিপি আছে, বীরেনদা পত্রিকা থেকে সেই স্বরলিপিই টুকেছেন। খেয়াল করে দেখি সেই স্বরলিপির মাথায় পেনসিল দিয়ে আর এক স্বরলিপি লেখা রয়েছে। বীরেনদা নোট লিখেছেন, পেনসিলের ওই লেখা ইন্দিরা দেবীর হাতের। সুচিত্রাদির রেকর্ডের যে সুরে আমরা আমার সোনার বাংলা গাই, এটা সেই সুর! মনে পড়ল, সুচিত্রাদির এক সাক্ষাৎকারে পড়েছিলাম রেকর্ড করার সময়ে তিনি ইন্দিরা দেবীর কাছ থেকে সুরের অনুমোদন নিয়ে নিয়েছিলেন। স্বরবিতানের সুরলিপি দেখে আমরা বিভ্রান্ত হতাম, কোনটা তবে আসল সুর! ওই সুরটি এল কোথা থেকে, সেটা আমাদের কাছে রহস্যই থেকে গেল। লাল খাতায় ইন্দিরা দেবীর পেনসিলে লিখে রাখা স্বরলিপি দেখে শান্তি হলো যে সুচিত্রাদির রেকর্ডের সুরে গানটি গেয়ে আমরা কোনো ভুল করিনি। নতুন সংস্করণ স্বরবিতানের পরিশিষ্টে এখন সুচিত্রাদির গাওয়া সুরের লিপি মুদ্রিত হয়েছে। লেখা আছে রেকর্ডের সুর শুনে শান্তিদেব ঘোষ এই স্বরলিপি তৈরি করেছেন।

পরবর্তীকালে শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার কাছে শুনেছি, আগুনে লাল খাতাটি নাকি পুড়ে গেছে। আমাদের জাতীয় সংগীতের সুর-বিষয়ে লাল খাতার তথ্যটুকু লিখে রাখা দরকার মনে হলো। লাল খাতায় স্বরলিপি নকল করে রেখে বীরেনদা একটা বিরাট কাজ করেছিলেন বলতে হবে।

.

২৪.

পরিমল চন্দ কলকাতাতে তিন-চার দিনব্যাপী রবীন্দ্রসংগীতের অনুষ্ঠান আয়োজন করতেন। একবার আমারও গান গাইবার আমন্ত্রণ ছিল। লেখাপড়ার ফাঁকে শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতা গিয়ে সারা দিন ধরে নানা জনের নানা স্বাদের গান শোনা। বেশ সুন্দর বিনোদন হয়েছিল। একদিন গীতবিতান-এর শিক্ষক গীতা সেনের এক গান শুনে চমকে গেলাম। গাইলেন ‘মনে যে আশা লয়ে এসেছি হল না হে’। প্রথম। অন্তরার ‘বেদনা রহিল মনে মনে’র শেষ দুটি ‘মনের সঙ্গে প্রথম ছত্রের ‘মনে’ মিলে বাণীতে-সুরেতে, মনে কী দ্বিধা রেখে গেলে চলের সঙ্গে গানটির মিল চমকে দিল। পরের অংশের ‘নিয়ে কম্পিত হৃদয়খানি’ পদ ‘মনে কী দ্বিধা’ গানটিকে আরও বেশি মনে করিয়ে দেয়।

গীতা সেনের সঙ্গে কথা বললাম। উনি তো দ্যাশের মাইয়া’ বলে আমাকে কাছে টেনে কী সব খাবার-টাবার কিনে খাওয়ালেন!

শান্তিনিকেতনে ফিরে স্বরবিতান অষ্টম খণ্ড খুলে ‘মনে যে আশা লয়ে’ গানখানি তুলতে শুরু করলাম। গানের মাথায় রাগ নাম নির্দেশ করা রয়েছে ‘মেঘাবলী’। সংগীতভবনের ওয়াজেলওয়ার ওস্তাদজির বাড়ির কাছ দিয়েই রোজ রবীন্দ্রভবনে পড়তে যাই। আগেই কবে আলাপ হয়েছিল। একদিন ওঁর কাছে গেলাম। মেঘাবলী’ রাগ নিয়ে জানতে চাইলাম। ওই নাম শুনে উনি তো অবাক। ‘এ রাগের নাম তো শুনিনি।’ ভাতখণ্ডে ঘাঁটলেন। আরও কী কী মারাঠি গানের বই খুলে খুলে খুঁজলেন। ‘না!’

শেষে বললেন, ‘গান তো গানখানি, শুনে দেখি!’। যা পারি গেয়ে শোনালাম। উনি বললেন, ‘এ তো ইম্‌নি বিলাবল। একে বেলাবলীও বলে।’

রবীন্দ্রভবনে রবীন্দ্রনাথের গানের সংকলন গানের বহি ও বাল্মীকি প্রতিভা নাড়াচাড়া করতে গিয়ে দেখি ওমা, এতে তো ‘মনে যে আশা লয়ে’ গানটি রয়েছে! মাথার ওপরে লেখা রয়েছে ‘বেলাবলী’। তবে তো ওয়াজেওয়ার ওস্তাদজি যা বলেছেন, তা-ই ঠিক! এর রাগ ‘বেলাবলী’ বা ‘ইম্‌নি বিলাবল।

স্বরবিতান অষ্টম খণ্ডে ‘মেঘাবলী’ নিশ্চয়ই ভুলবশত ছাপা হয়েছে। অর্থাৎ মুদ্রণপ্রমাদ ঘটেছে! এ ভুল নিয়ে লেখালেখি করলেও বিশ্বভারতী সংশোধনের কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি, যথারীতি।

সংগীতভবনের উচ্চাঙ্গসংগীতের ধ্রুবতারা যোশীজি তখন অবসর নিয়েছিলেন। ইনিও ছিলেন সুজন। পূর্বপল্লীতে থাকতেন। তাঁর কাছেও গিয়ে এটা-ওটা প্রশ্ন করতাম। উনি কফি খাওয়াতেন। মোহরদির মামা সুজিত মুখোপাধ্যায়ের কন্যা রুচিরা যোশীজিকে দেখাশোনা করতেন। রুচিরাই সবাইকে কফি বানিয়ে খাওয়াতেন। যোশীজি বারীণ মজুমদারের কথা খুব জিজ্ঞেস করতেন। আগ্রা থেকে ওঁদের পরিচয় ছিল। এই স্নেহশীল ওস্তাদজি পরে বর্ধমানে গিয়ে বসবাস করতেন। একবার ঢাকায় এসে আমার খোঁজ করেছিলেন। আমি গিয়ে দেখা করেছিলাম।

.

২৫.

প্রথম শান্তিনিকেতনে যাবার পর জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে বিদেশি ছাত্রছাত্রীদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল একবার। নেহরু উদয়নের একতলার ঘরে বসে আমাদের সঙ্গে আলাপ করেছিলেন। হাতে-পায়ে চঞ্চল নেহরু বসবার তাকিয়া দুমড়াতে দুমড়াতে আমরা। কে কোন দেশ থেকে এসেছি জেনে নিচ্ছিলেন। শারীরিক চাঞ্চল্য সত্ত্বেও কী মনোযোগের সঙ্গে যে তিনি পরিচয় নিয়েছিলেন, বোঝা গেল তার ভাষণের সময়ে। প্রত্যেক দেশ নিয়ে বলবার সময়ে উনি। সেই দেশের শিক্ষার্থীর দিকে তাকিয়ে বললেন। কোনো ভুল হলো না! সে দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক নিয়ে বলতে বলতে বারবার মূল এক কথায় ফিরে গেলেন–সে হচ্ছে Asia is one। বললেন, রবীন্দ্রনাথও ওই মতে বিশ্বাসী ছিলেন। বক্তব্য ছিল চমৎকার গোছানো।

উদয়ন ভবনের বাইরের প্রাঙ্গণে আমাদের সঙ্গে ছবিও তুলেছিলেন নেহরু। শান্তিনিকেতনে শম্ভুবাবু নামে একজন সব ছবি তুলতেন। তিন-চার কপি ছবি পেয়েছিলাম। এ নিয়ে মজার ব্যাপার হলো। পাকিস্তান আমলে আমাদের বাড়িতে যারা আসতেন, সকলেই যে বন্ধুভাবে আসতেন তা মনে করা যায় না। তাই একসময়ে দেখা গেল, ভারত আর নেহরুর সঙ্গে আমার অন্তরঙ্গতার প্রমাণ হিসেবে সম্ভবত, নেহরুর সঙ্গে তোলা সেই ছবিগুলো বাসা থেকে উধাও হয়েছে। গুপ্তচর বিভাগের দপ্তরে ওগুলোর খুব কদর হয়েছিল নিশ্চয়ই!

আমাকে কোনো না কোনো দেশের গুপ্তচর ভাবতে কারোরই কোনো কসুর হতো না। একবার শান্তিনিকেতনে রটে গেল, আমি নাকি কেজিবির এজেন্ট! বিষয়টা কী তা আমার জানা ছিল না। বান্ধবী সুতপা ভট্টাচার্য জানালেন, প্রতিভা বসুর বাড়িতে আলাপ শুনেছেন। নরেশ গুহ গৃহকত্রীকে জানাচ্ছিলেন যে আমি বস্তুত কেজিবির এজেন্ট। অর্থাৎ রাশিয়ার গুপ্তচর! বোকা বনে গেলাম, এ আবার কী কথা! কলকাতায় গৌরী আইয়ুবকে দুঃখ জানিয়েছিলাম। দেশে বাঙালি সংস্কৃতির উন্নয়ন আর প্রসারের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে অবশেষে এই নাম জুটল আমার!

বহুদিন পরে নিজেই ওর কারণ বুঝতে পারলাম। ভালো স্যুটকেসের অভাব ছিল আমার। কন্যা রুচিরা মস্কোতে লেখাপড়া করছিল। সেবার ঢাকায় এল ‘সিসিসিপি’ লেখা একটা বেশ বড় ব্যাগ নিয়ে। আমিও খুশিমনে ব্যাগখানি বগলদাবা করে কাপড়চোপড় ভরে শান্তিনিকেতনে নিয়ে গেলাম। এখন বোলপুর স্টেশন থেকে আমার আবাস পর্যন্ত রিকশায় মস্কোর নাম লেখা ওই ব্যাগ নিয়ে যাবার সময়ে আমাকে ও দেশের গুপ্তচর হিসেবে চিনে ফেলতে কোনো অসুবিধা হয়নি সংশ্লিষ্টদের! পাকা ছাপমারা ব্যাপার যে! দুইয়ে দুইয়ে চার হয় তো!

.

২৬.

একাত্তর সালে ঢাকা থেকে পালিয়ে কলকাতায় গিয়ে প্রবোধ সেন কাকাবাবুর কাছে উঠেছিলাম, তার মেয়ের বাসায়। কাকাবাবু তাঁর বন্ধু খড়গপুর ইনস্টিটিউটের ইংরেজির অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক বিনয়েন্দ্রমোহন কাকাবাবুর কাছে প্রথমে, তারপরে জাস্টিস মাসুদ আলীর বাসায় আমার সপরিবারে থাকবার ব্যবস্থা করলেন। মাসুদ সাহেব আমার মায়ের বোনজামাই। সেদিক থেকে তিনি আত্মীয় বটে। বিশ্বভারতী বোর্ডের ট্রেজারারও ছিলেন তিনি। বিশ্বভারতীর প্রাক্তন ছাত্রী হিসেবে আমার জন্যে কোনো ব্যবস্থা করতে পারবেন জাস্টিস মাসুদ, এই ভরসা ছিল কাকাবাবুর। বোর্ডের সভায় সাংবাদিক অমিতাভ চৌধুরী, আমাদের অমিতদাও বিশ্বভারতীতে আমার একটা ফেলোশিপের ব্যবস্থা করলে আমার হিল্লে হলো।

সঙ্গে সঙ্গেই যে শান্তিনিকেতনে যেতে পারলাম, তা তো নয়! তবে গ্রীষ্মের ছুটির মধ্যেই একাত্তরের জুনে ইন্টারন্যাশনাল গেস্টহাউসে পরিবার নিয়ে গিয়ে উঠলাম। বাচ্চুদির স্বামী অমিয়দা তখন ওখানে রেজিস্ট্রার। অল্প কদিন পরেই পূর্বপল্লীর এক বাড়ির আউটহাউস ভাড়া নিয়ে সেখানে চলে গেলাম। ছোট্ট ছোট্ট তিনটি ঘর, রান্নাঘর আর বারান্দা। ভাড়া মাসিক আশি টাকা। তার সঙ্গে বিদ্যুৎ-বিল যখন যেমন হয়। বিশ্বভারতীর গোটা তিনেক চৌকি পাওয়া গেল। বাচ্চুদি ঘরসংসারের এটা-ওটা দিলেন। ভুলুদা তত দিনে মারা গেছেন। সুপ্রিয়াদি ওঁদের ব্যবহারের জন্যে রাশিয়া থেকে আনা ভাঁজ করা একটা টেবিল আর চারটা চেয়ার আমাকে দিলেন। খাবার টেবিল, চেয়ার হয়ে গেল।

প্রথম দিকে অনেক দিন বড় দুটো টিফিন ক্যারিয়ারে করে কিচেন থেকে খাবার আনাবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বাড়ির কোণে এক গর্তে কিচেনের ভাতের অনেকখানিই প্রায় ফেলে দিতে হতো, খাওয়া হতো না। বাড়িওয়ালা কাকাবাবু একদিন বাগান থেকে কী একরকম শাক তুলে আমাকে দিয়ে গেলেন। সকালের ডিম ভাজার জন্যে ঘরে তেল ছিল। তাই দিয়ে শাক ভাজি করে টেবিলে বেড়ে দিলাম। আশ্চর্য! সেদিন ছেলেমেয়েদের ভাত কম পড়ে গেল শাক ভাজির গুণে! তাই দেখে কাকাবাবু ওঁর বাগানের একটা-দুটো করলা বা পোকাধরা একটা ফুলকপি কাপড়ের আড়ালে লুকিয়ে আমাকে দিয়ে যেতেন। অবস্থা বুঝে এটা-ওটা রান্না করে ছেলেমেয়েদের ক্ষুন্নিবৃত্তি করতে শুরু করা গেল। শেষ পর্যন্ত ভাত-মাছ সবই রাধা আরম্ভ করলাম। কিছুদিন আগে থেকেই রাতে রুটি বানিয়ে সেঁকে ন্যাকড়া জড়িয়ে রেখে দিতাম সকালের খাবারের জন্যে। বড় মেয়ে অপালা ডিম ভেজে নিয়ে তিন ভাইবোনে খেয়ে পাঠভবনে পড়তে যেত। আমাদের একটা বাড়ির পরে উত্তর দিকের দোতলা থেকে উপাচার্য প্রতুল গুপ্ত মশাই ওদের স্কুলে যাওয়া দেখতেন, কেমন চুল ছেড়ে স্কুলের দিকে ছুটত, দেখতে ভালো লাগত তার।

প্রতুল গুপ্ত মশাই আমার সঙ্গে খুব সৌজন্য করতেন। বিকেলে আমি প্রবোধ কাকাবাবুর কাছে যেতাম। প্রতুলবাবুও গিয়ে নানা বিষয়ে আলাপ করতেন আমার সঙ্গে। রবীন্দ্রভবনের একটি ফেলোশিপ আমাকে দিয়েছিলেন উনি। তা নিয়ে সরকারের প্রতি বিরূপ ব্যক্তিরা নানা মন্তব্য করতেন। বলতেন, ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের ওদের চাকরি দিতে চান, ভালো কথা, চাকরি তৈরি করুন! আমাদের জন্যে যেসব চাকরি, তা ওদের দেওয়া হবে কেন? প্রতুল গুপ্ত মশাই আমাকে বলেছিলেন, প্রথম দিকে যা-ই হোক আমার জন্যে ভিন্ন ব্যবস্থা করেছেন তিনি।

দেশ স্বাধীন হয়ে গেলে যখন ফিরে আসব, তখন বড় একটা থালায় করে মিষ্টি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ছেলেমেয়েদের জন্যে। অপালা তো ছিল মিষ্টির পোকা! সারাক্ষণ ঘুরে ঘুরে মিষ্টি খেয়েছিল।

.

২৭.

দ্বৈতগানে গীতা ঘটকের সঙ্গে বাচ্চুদির গলা কী চমৎকার মিলত, কী বলব! ১৯৫৪ সালে শান্তিনিকেতনের সাহিত্য মেলা ৫৩-র বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে শুনেছিলাম। মন্দিরের কাছের যে বাড়িটিকে অনেকে। শান্তিনিকেতন বাড়ি বলে ’৫৪ সালে, সেটি ছিল বিদ্যাভবনের আপিস। ওই বাড়ির ছাদ সে রাতে বসন্ত পূর্ণিমার আলোতে ধুয়ে যাচ্ছিল। প্রবোধ কাকাবাবু বাচ্চুদিকে গান গাইতে বললে, তিনি গীতাদিকে সঙ্গে নিয়ে গাইলেন ‘নিবিড় অমা-তিমির হতে বাহির হল জোয়ার-স্রোতে/ শুক্লরাতে চাঁদের তরণী।’ দুটি ঐশ্বর্যমণ্ডিত কণ্ঠস্বরে ওই যুগল পরিবেশনা যে সেই রাতে কী মায়া বিস্তার করেছিল, সে কথা বলে বোঝানো যাবে না।

গীতাদির তখন অনীশ ঘটকের সঙ্গে সদ্য বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পরপরই এসেছেন শান্তিনিকেতনে। সিঁদুর দিয়ে সিঁথি লাল করে সুখী সুখী মুখে শ্রীসদনের প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে খোলা গলায় গান গাইছেন বিভোর হয়ে। মঞ্চ পরিবেশনা কোথায় লাগে! সেই সময়কার গানের সৌন্দর্যই আলাদা।

চাঁদের আলোয় ধোয়া বিদ্যাভবনের ছাদে সেদিন আমি এমন ফেল করেছিলাম, সে কথাও বলতে হয়। সাহিত্যমেলার বর্ষপূরণ বলে প্রবোধ কাকাবাবু হঠাৎ আমাকে বাংলাদেশের তখনকার সাহিত্য নিয়ে বলতে বললেন। এমন বোকা হয়ে গেলাম যে তো তো করে মুখ দিয়ে কোনো কথাই বার করতে পারলাম না। এমন আচরণ জীবনে আর কখনো করেছি বলে মনে পড়ে না।

বাচ্চদির স্বভাবটা এমন ছিল যে তাকে ভালো না বেসে পারা যায়। না। আমি তো প্রায় সর্বক্ষণ বাচ্চুদির মুখের দিকেই চেয়ে থাকতাম। সংসারের কাজ করতেন, সে-ও দেখতে ভালো লাগত। আমাকে, আমার পরিবারকে কতবার নিজে-হাতে রান্না করে খাইয়েছেন। কম মসলার সুস্বাদু রান্না। শেষ পাতে একটু চাটনির ছোঁয়াও দারুণ আকর্ষণীয় ছিল।

শৈলজাদা একবার বেশ কিছুদিন ঢাকায় থেকে আমাদের গানটান শিখিয়ে অনুষ্ঠানের মহড়া দিয়ে শেষে অমিয়দা আর বাচ্চুদিকে ডেকে পাঠালেন। অমিয়দা গান নিয়ে বলবেন আর বাচ্ছদি গানের দলে নেতৃত্ব দেবেন। কী সুন্দর অনুষ্ঠানই যে হয়েছিল! শৈলজাদা আমাদের বলতেন বাচ্চুর মতো ঢেলে গাইতে পারে না কেউ। ‘আমি জ্বালব না। মোর বাতায়নে প্রদীপ আনি’–এই ‘না’টা আর কেউ এমন করে গাইতে পারে না।

বাচ্চুদিকে আমরা পরেও নিয়ে এসে গান শিখেছি। যে শিল্পীই গান শিখতে আগ্রহী, তাকেই আমরা বসিয়েছি সেই শিখবার আসরে। এর ফলেই বাচ্চুদির কিডনির সমস্যা হয়েছে শুনে আমরা ঢাকার সব রবীন্দ্রসংগীতশিল্পীকে একত্র করে শ্রবণগাথা গীতিনাট্য মঞ্চস্থ করতে পেরেছিলাম। নাট্যশিল্পী আলী যাকের, আবুল হায়াত, আসাদুজ্জামান নূর, যুবরাজ (খালেদ খান)–এরা এসে নাট্যাভিনয় অংশটিতে যোগ দিয়েছিল। বেশ ভালো অঙ্কের অর্থ বাচ্চুদির চিকিৎসার জন্যে তুলতে পেরেছিলাম আমরা।

শেষ যেবার ওঁর বাড়িতে খেলাম, সেদিন উনি আমার জন্যে একটা সুন্দর শাড়ি নিয়ে রতনকুঠিতে এসে আমাকে দিয়ে গিয়েছিলেন, ‘তুমি পরো’।

তাঁর শেষযাত্রাকে কিছুতেই ‘শেষ’ মনে হয়নি আমাদের। কলকাতার ক্লিনিকে দেখতে গিয়েছিলাম। আমাকে দেখে প্রসন্নমুখে তাকালেন। বললেন, ‘আবার বাংলাদেশে যাব’। বলেই পাশ ফিরে ঘুমিয়ে গেলেন। পরদিন আমার ঢাকায় ফিরবার কথা। ছিলাম সল্টলেকে বান্ধবী সন্ধ্যা মৈত্রের বাসায়। গ্রন্থন বিভাগের প্রধান অশোক মুখোপাধ্যায় ফোনে জানালেন, তিনি চলে গেছেন। তাঁর দেহ সকালবেলাতে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে রাখা ছিল, সবাই গিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছিল। দুপুরের পরেই আমার এয়ারপোর্টে পৌঁছুতে হবে। আমি আর জোড়াসাঁকোতে যেতে পারলাম না। সন্ধ্যার সঙ্গে চুপ করে বসে রইলাম কিছু সময়।

সন্ধ্যা মৈত্রের কথা আগেও বলেছি। বিনয় ভবনে স্কুল-কলেজের শিক্ষকেরা এসে পড়েন টিচার্স ট্রেনিং বিষয়ে। অর্থাৎ বয়স্ক ছাত্রছাত্রীরাই পড়তেন সেখানে। বান্ধবী সন্ধ্যার অভিজ্ঞতার কথা বলি। লেখাপড়া শেষ করে চলে যাবার আগে কুমারী সন্ধ্যার বয়স্ক ছাত্র ভবেশ মৈত্র এসে শিক্ষয়িত্রী সন্ধ্যাকে জানালেন, ‘আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই।’ সন্ধ্যাও দাপটের সঙ্গে প্রশ্ন করলেন, ‘বয়স কত?’ তা, বয়স শুনে বুঝলেন ব্যাপারটা বেমানান হবে না। ব্যস, হলো বিয়ে। সন্ধ্যার কিছু শারীরিক সমস্যা-সন্তান না হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। চোখেও কী যেন অসুখ ছিল। তবে ‘মিয়া-বিবি রাজি, তো কেয়া করেগা কাজি’!

বিনয় ভবনের কোয়ার্টার্সে ভবেশবাবুর বিশেষ থাকা হতো না। চাকরিস্থলেই থাকতে হতো, মাঝেমধ্যে সুযোগমতো চলে আসতেন। উনি আবার রাজনীতি করা লোক। মহাবতাপ্রবণ! টেরিয়ে টেরিয়ে দেখতাম, খুব একটা পছন্দ হতো না। অত ‘নীতি’র বক্তিমে কে শোনে! আমাকে দেখলেই বাংলাদেশের চাল, ডাল, চিনি, তেল ও আটার দাম ইত্যাদি জিজ্ঞেস করতেন। ফাঁপরে পড়তাম। আমি ওখানে লেখাপড়া করতে গেছি, ঢাকার বাজারদর নিয়ে অত কথা জানব কী করে?

কলকাতায় সন্ধ্যার অসুস্থ মা থাকতেন। বাড়িটা তৈরি করেছিলেন ভবেশবাবুই, অনেক যত্ন নিয়ে। সন্ধ্যা কলকাতা গিয়ে গিয়ে মায়ের সেবা করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। আগাম অবসর নিয়ে কলকাতাবাসী হয়ে গেল শেষ পর্যন্ত। সেই সুবাদে ঢাকা থেকে শান্তিনিকেতন যেতে কলকাতায় একটু পা ঠেকিয়ে যাবার সুযোগ হলো আমার। আর গান! ভোরে উঠে দোতলার ঘরে বসে প্রাণভরে গান গাও–তাতে সন্ধ্যার যদি প্রাণ ভরে। কোনো কোনো দিন বলবে, ‘ওমা, কই, এখুনি শেষ হয়ে গেল!’

ভবেশবাবু সরকারি শিক্ষা বিভাগে কাজ করতেন আর সিপিএমের রাজনীতি করতেন। রাজনৈতিক বন্ধুরা মর্নিংওয়াকে বের হয়ে, কই ভবেশবাবু!’ হাঁক দিয়ে জড়ো হতেন এসে, আর চলত ওঁদের রাজা উজির মারা গপ্পো। সন্ধ্যাও যে ওসবে যোগ দিত না, তা নয়। দুজনের একই রাজনীতি তো! দুজনের ভাবও তেমনি। খেতে বসে ইনি ওঁকে তুলে দিচ্ছেন, উনি এঁকে। ডায়াবেটিস আছে তো কী? মিষ্টি খেতে তুমি এত ভালোবাসো, তা খাবে না? সে অসুখও দুজনেরই। ভালোবেসে পরস্পর পরস্পরকে প্রিয় মিষ্টান্ন খাওয়াচ্ছেন! ওই প্রেম দেখতে ভালোই লাগত।

এখন সন্ধ্যা চলে গেছে। ভবেশবাবুর দশা দেখে সহ্য করা যায় না। কেবলই প্রলাপ বকেন, ‘তোমরা ডাকো, তবে যদি আসে! আমার ডাকে তো এল না!’

মোহরদিকেও কয়েকবার ঢাকায় এনে গান শিখেছি আমরা। সপ্রেমে শিখিয়েছিলেন ‘ডুবি অমৃত পাথারে’। গোরা হারমোনিয়াম ধরত আর উনি গেয়ে গেয়ে শেখাতেন। গোরাসুদ্ধ মোহরদিকে নিয়ে যশোর, খুলনা, চট্টগ্রামেও ঘুরেছি। সর্বত্র গান শেখার আসর হয়েছে। মোহরদির আলসেমি ধরলে গোরা একাও শিখিয়েছে গান। যশোরের নড়াইলে সেবার ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর বাসায় মোহরদির সে কী ভালো-লাগা! খুশিতে নিজের পরা কিছু শাড়ি আমাকে আর প্রিয়ভাষিণীকে দান করলেন।

চট্টগ্রামের এক বাড়িতে কেবল ইলিশ মাছ দিয়ে রাতের খাবার দিয়েছিল বলে মোহরদির সে কী রাগ! সন্‌জীদা তো ইলিশ মাছ খেতে পারে না, কী বলে ওরা শুধু ইলিশ মাছ দিয়ে খেতে দিল! মোহরদি খাটে শুয়েছিলেন। আমি আর মালেকা আজিম খান মাটিতে। শুয়ে শুয়ে আমাদের জন্যে মোহরদির কী মন খারাপ! এই আদরগুলোই জমার খাতায় জ্বলজ্বল করে জ্বলবে। মনে পড়ছে কারা যেন মোহরদিকে বাসায় নিয়ে যাবার জন্যে ব্যাকুল ছিল, আমাদের কাউকে নেবে না। রাগে মোহরদি গেলেনই না ওদের বাড়ি।

একাত্তর সালে শান্তিনিকেতনেও মোহরদির অনেক আদর পেয়েছিলাম। ধোপায় ধোয়ানো চারখানা শাড়ি দিয়েছিলেন আমাকে পরবার জন্যে। শীতের সময় দরকারি বিছানাপত্র সবই আমার পরিবারের জন্যে দেবেন বলেছিলেন। আমারও যেমন! বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক জামিল চৌধুরীকে খুশি করবার জন্যে উনি তাঁর ভাইঝি মিলিয়াকে এ গ্রেডের শিল্পী করেছিলেন। আর আসল ভালো গাইয়ে ফ্লোরা আহমেদকে বি গ্রেডে দিয়েছিলেন। আমি এই বিচারের সমালোচনা করেছিলাম কট কট করে। কলকাতার রেডিওর কোনো বড় কর্তা সে কথা মোহরদিকে জানানোতে উনি বিগড়ে গেলেন আমার ওপর। শীতবস্ত্র দেবেন বললেও পরে বললেন, ‘তুমি কেন আগে থেকে বলোনি, এখন দিতে পারব না।’ বাড়ি ফিরবার পথে খুব কেঁদেছিলাম সেদিন। দীন শরণার্থী হলে এমন পরিস্থিতির শিকার হতে হয়! আমারই মুখের দোষে মোহরদির আদর হারিয়েছিলাম বলতে হবে।

দেশে ফিরে ওঁকে কৃতজ্ঞতার চিঠি লিখলে পরে উনি চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি। দেখা হলে সব খুলে বলেছিলেন আমাকে।

.

২৮

শান্তিনিকেতনের অ্যাগ্রো-ইকোনমিকসের ডাইরেক্টর ছিলেন গোবিন্দচন্দ্র মণ্ডল। ওখানকার গবেষক সুনীলদা আমাকে একদিন বললেন, চলো ওঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। খুব চমৎকার মানুষ, তোমার ভালো লাগবে। দেখি গানেরই লোক! বললেন, বিষ্ণুপুরের সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিষ্য তিনি। তাঁর কাছ থেকে ‘অসীম ধন তো আছে তোমার’ শিখেছিলেন। গেয়ে শোনালেন, ‘কণায় কণায় বেঁটে’র শেষের তানটি উনি কেমন গমক দিয়ে গাইতে শিখিয়েছেন। সরল-সহজ মানুষটিকে ভালো লাগল। ওঁর স্ত্রী আবার আমাদের মিষ্টি খাওয়ালেন।

বাসায় গেলেই আমার গান শুনতে চাইতেন। আমিও গাইতাম। ওঁর ভালো লাগত কি না জানি না। গানের ভাব নিয়ে সুন্দর আলোচনাও করতেন, আমার খুব উপকার হতো। বীরেনদার পত্রিকায় গান বিশ্লেষণ করে বেশ বড় লেখাও লিখেছিলেন। তাঁর প্রিয় গান নিয়ে একটি বইও ছাপিয়েছিলেন। ওঁর বাড়িতে গান গাইবার সময়ে একদিন অলকানন্দা প্যাটেল আর আইজি প্যাটেল এসেছিলেন সেখানে। ওঁরাও কিছু গান শুনেছিলেন। পরে শুনেছি অলকানন্দা রীতিমতো রাগসংগীতের চর্চা করেছিলেন।

অলকানন্দার বাবা অমিয়রঞ্জন দাশগুপ্ত তখন পূর্বপল্লীতে একটি বাসা নিয়ে ছিলেন। উনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বাবার সহকর্মী ছিলেন শুনে আমি গিয়ে দেখা করেছিলাম। কিন্তু অলকানন্দার সঙ্গে আমার আর যোগাযোগ হয়নি। ওঁদের নাম শান্তিনিকেতনে খুব শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হতো।

গোবিন্দ মণ্ডল মশাই আমাকে এত স্নেহ করতেন যে কিছুদিন না গেলে অস্থির হয়ে খোঁজ করতেন। শেষ জীবনটাতে রোগে বড় কষ্ট পেয়ে গত হয়েছেন উনি। খুব যন্ত্রণা ছিল। মনে হয়েছিল ক্যানসারে ভুগেছিলেন। ওঁর একটিমাত্র সন্তানও চিররুগ্ণ ছিল। বউদি তার সেবায় তৎপর থাকতেন। ছেলেটি বাবার আগেই মারা যায়।

গোবিন্দবাবুর মৃত্যুর সময়ে আমি পঞ্চবটীর বাসিন্দা ছিলাম। খবর পেয়ে ছুটে গেলাম। দেখলাম, বউদি একাই দক্ষভাবে সবকিছু সামাল দিচ্ছিলেন। স্মরণসভায় আমি ‘পথের শেষ কোথায়’ গানটি গেয়েছিলাম।

.

২৯.

শান্তিনিকেতনে থাকতে বিরাট এক সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। সামতাবেড় গ্রামটিতে শরৎচন্দ্রের জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠান হচ্ছিল। শুনলাম ওই সামবেড়েই পল্লী সমাজ উপন্যাসের সেই রমেশ আর রমার বাস ছিল। শ্রীনিকেতনবাসী অজয়দা (অজয় মিত্র) একদিন বললেন, ‘শরৎচন্দ্রের জন্মশতবার্ষিকীতে যাবেন নাকি সামতাবেড়, ওঁর প্রিয় কটা রবীন্দ্রসংগীত গাইবেন।’ কোন কোন গান প্রিয়? কী কী বলেছিলেন সব মনে নেই। ‘ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা’, ‘দুঃখ আমার অসীম পাথার পার হল’, আর ‘ওহে জীবনবল্লভ’ গানের কথা মনে পড়ছে।

অজয়দার গ্রাম হাওড়ার মুগকল্যাণ গ্রামে। বললেন, ‘আমাদের মাটির দোতলায় এক রাত্রি কাটাবেন, দেখবেন খারাপ লাগবে না।’ রাজি হয়ে গেলাম। মাটির দোতলা বাড়ির দিকে ঝোঁক ছিল একটা।

রাতে তো ঘুমিয়ে কাদা। ভোরে জেগে দেখি মাটির জানালা দিয়ে ফুরফুর করে বাতাস আসছে! দারুণ লাগল। গ্রাম থেকে বেরিয়ে পাকা রাস্তায় উঠে, না রিকশা না আর কোনো যানবাহন! অজয়দা বললেন, ‘সাইকেলের পেছনে উঠবেন?’ চেষ্টা করা যাক! সাইকেল চালাতে গিয়ে অজয়দা তো জেরবার। বেশ ওজন আছে তো আপনার। খানিক টেনে ক্ষান্ত দিলেন। পরে হেঁটে হেঁটেই বুঝি চলাফেরা করা গিয়েছিল।

মাঠে প্যান্ডেল টাঙানো ছিল। লোকজন বিশেষ নেই। গ্রামের হাফপ্যান্ট পরা ছেলেপুলেরা হল্লা করছে। সে যে কী পরিবেশ। ওখানে গান গায় কেউ? ভাবলাম দুঃখ আমার অসীম পাথার’ দিয়ে শুরু করে ‘ধায় যেন মোর’ চেষ্টা করি, শেষে ‘ওহে জীবনবল্লভ’ হবে। তিতিবিরক্ত হয়ে কোনোমতে গান শেষ করে উদ্ধার পেলাম। ‘ওহে জীবনবল্লভ’টাই যা একটু শুনেছিল ছেলেপিলেরা। যাহোক শরৎচন্দ্রকে আমার শ্রদ্ধা জানানো তো হলো!

হাওড়া স্টেশনের লাইনে উলুবেড়িয়াতে নামতে চাইলাম। অজয়দা বললেন, ‘তথাস্তু’। স্বপ্ন নামে ওখানকার কলেজের বাংলার অধ্যাপিকাকে চিনতাম। গেলাম ওদের বাসায়। স্বপ্ন তখন কলেজে। ওর মা ব্যস্ত ছিলেন রান্না নিয়ে। বারান্দায় মাদুর পেতে বসে বেশ কতগুলো গান গাইলাম। আসতে-যেতে গান শুনে বললেন, ‘বেশ মন দিয়ে গান গাও তো তুমি!’ স্বপ্ন ভালো গান গায় বলে শোনা ছিল, নিজের কানে শুনবার সুযোগ হয়নি। স্বপ্নার গল্প ছিল ভারি মজাদার। ও পিএইচডি থিসিস করেছিল অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের তত্ত্বাবধানে। তাঁকে নিয়ে অনেক গল্প বলত। হাঁটতে হাঁটতে গাইডের গল্প শুনে একবার কী দশা হয়েছিল তাই বলল। বেচারি দেশে থাকতে পারেন না, জার্মানিতে থাকতে হয়, কী করবেন! দেশের ‘মৃদু উপার্জনে বিদেশি স্ত্রীকে নিয়ে চলবেন কী করে? ‘উপার্জন’-এর ‘মৃদু’ বিশেষণ শুনে স্বপ্নার নাকি হোঁচট খাবার অবস্থা!

সুরজিৎ সিংহ দম্পতির প্রাণপণ লিচু খাবার গল্প ছিল আর এক মজাদার কিস্সা! লিচু কিনেছেন। মেয়েটি গেছে স্কুলে। বাইরের ঘরে স্বপ্নর সঙ্গে কথা বলতে বলতে সুযোগ পেলেই দুজনের একজন উঠে ঘরের ভেতরে চলে যাচ্ছেন। মানে, মেয়েটা স্কুল থেকে ফিরবার আগেই নিজেদের ভাগের লিচু শেষ করা দরকার তো! তাই একজন উঠে ভেতরে গেলে অন্যজন উসখুস করতে করতে উঠে ভেতরে চলে যাচ্ছেন। ভেতরের জনকে তখন ফিরতে হচ্ছে। দুজনকেই তো লিচু খাবার চান্স নিতে হবে ঠিকমতো! এই সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নাকি দুজনে বড্ড ব্যস্ত থাকতেন।

উলুবেড়িয়া স্টেশনে নেমে স্বপ্নার বাসায় যাওয়ার কথা থেকে স্বপ্নর গল্পে ঢুকে গেছি, অজয়দার সঙ্গে ‘আনন্দনিকেতনে যাওয়ার কথা আর বলা হয়নি। ওই গ্রামটার নাম মনে রাখতে পারিনি। কেবল মনে আছে, ম্যাককাচ্চিওন যেসব এলাকায় থেকে ঘুরে ঘুরে বাংলার মন্দির স্থাপত্য নিয়ে কাজ করেছিলেন–এটি সেই এলাকা। আনন্দনিকেতন মেয়েদের একটি প্রতিষ্ঠান। আনন্দের মধ্যে দিয়েই এখানে লেখাপড়া আর হাতের কাজ শেখানো হয়। আমি ওদের একখানা গান। শিখিয়েছিলাম। পাকা রাস্তার উল্টো দিকে দেখা যায় ঘোড়াঘাট স্টেশন। কবি তারাপদ রায় ওই স্টেশন থেকেই ট্রেন ধরে কলকাতা যেতেন শুনেছিলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *