১০. হোস্টেলে কার ঘরে যেন রেডিও

১০.

হোস্টেলে কার ঘরে যেন রেডিও বাজত। বসন্তের শুরুতে রাগসংগীতের সুরে মনকে বড় ব্যাকুল করত। কখনো হয়তো রবীন্দ্রসংগীতই শোনা যেত ‘মন যে বলে, চিনি চিনি যে-গন্ধ বয় এই সমীরে/ কে ওরে কয় বিদেশিনী চৈত্ররাতের চামেলিরে’। গানটা জানা না থাকলে একেবারে পাগল পাগল দশা হতো। হীরেন্দ্রনাথ দত্ত মশাইয়ের মেয়ে পূরবীদিকে পাকড়াও করে গানটা শিখে নিস্তার মিলত। পূরবীদির গান ভালোবাসতাম, জানতেন বলে আমাকে গান শোনাতেন-শেখাতেন খুশি হয়ে। বিয়ের পরে কলকাতায় বাস করতে গিয়ে পূরবীদির গান ক্রমে ক্রমে মিলিয়ে গেল। শরীরটাও কেমন ভেঙে পড়ল। হীরেন দত্ত মশাইয়ের থ্রি কমরেডস-এর অনুবাদ তিন সঙ্গী আমাদের খুব প্রিয় বই ছিল সে সময়ে।

‘আমি তারেই খুঁজে বেড়াই যে রয় মনে/ আমার মনে’ গানটি আমি পূরবীদির গলায় কতবার যে শুনেছি, তার হিসাব নেই। বাউল সুরের গানখানিতে শ্রুতির ব্যবহার যে তিনি কী দক্ষতার সঙ্গে করতেন, কী বলব! ও গান আয়ত্ত করবার চেষ্টাও আমি করিনি। বারবার শুনে শুনে আঁজলা ভরে বুকের ভেতর ভরে নিয়েছি। এমএ পড়বার দিনগুলোতে পূরবীদি ছিলেন আমার আদর্শ গায়িকা।

‘ধ্বনি থেকে কবিতা নিয়ে কাজ করবার সময়ে অনেক দিন আমি শ্যামলীর দোতলাতে ছিলাম। লেখা নিয়ে আলোচনাতে ওর দারুণ আগ্রহ ছিল। শিবনারায়ণ রায় ওর বাড়ির কাছাকাছি একটা বাসাতে থাকতেন। একদিন ঢাকার শিখা গোষ্ঠীর লেখার কথা বলতে গিয়ে উনি নাস্তিকের ধর্ম’ নামের এক প্রবন্ধ নিয়ে খুব উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন। বললেন, এ লেখার লেখকের কথা কেউ আলোচনা করে না। ইনি নাকি তাঁরই আবিষ্কার। লেখকের নাম জিজ্ঞেস করে শুনেই শ্যামলী আমার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করল। আমি তো প্রবন্ধের নাম শুনেই বুঝে গেছি উনি কার লেখার কথা বলছেন। উঠে যাবার সময়ে শ্যামলী তাকে বলল, আপনি যার কথা বলছেন তিনি মিনুদির বাবা। উনি থতমত খেয়ে গেলেন। তাঁর ‘আবিষ্কার’ অন্যদের পরিচিত এমনকি স্বয়ং ‘পিতা’ শুনে ওই দশা হলো।

শ্যামলীর স্বভাব ছিল শান্তিনিকেতনে কাজ করতে আসা বিদেশিদের দিকে নজর রাখা–কার কী অসুবিধা হচ্ছে। জার্মান গবেষক মার্টিন ক্যাম্পশেনের দিকে ওর নজর ছিল। এই ভদ্রলোককে আমার একটু কড়া মেজাজের বলে মনে হতো। একদিন কে যেন আমাকে গান গাইতে অনুরোধ করেছিল। মনে পড়ছে না। লিখবার কাজে ব্যস্ত থাকলে আমি অন্যদিকে মন দিতে পারি না। কথাটা শুনে মার্টিন ক্যাম্পশেন বাঁকাভাবে কিছু বললেন। আমি বিরক্ত হয়ে ‘তোমরা যা বলো তাই বলল, আমার লাগে না মনে’ গানখানি ধরলাম। এ গানের সুর আমাকে সবকিছু ভুলিয়ে দেয়। বাউল সুরের শ্রুতির কাজভরা গানটিতে আমি ভেসে গেলাম। তখন মার্টিন ক্যাম্পশেন মাথা নেড়ে নেড়ে অ্যাপ্রিশিয়েট করতে লাগলেন। গান শেষ করে কারও দিকে না চেয়ে আমি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। বিরূপ ভাবটি সুরের ধারা দিয়ে ধুয়ে দিয়েছি বলে মনটা ভালো লাগল।

এমএ পড়বার সময়ে শান্তিনিকেতনে আমার লোকাল গার্জিয়ান হয়েছিলেন অন্নদাশঙ্কর রায়। বাবার বন্ধু। আমাকে হোস্টেলে তুলে দিয়ে মা অন্নদাশঙ্করের বাড়িতে রাত্রি যাপন করলেন। প্রত্যেক বিকেলে অন্নদাশঙ্কর-লীলা রায়ের বাসায় আমার চায়ের দাওয়াত ছিল। কিন্তু বিদেশি ছাত্ররা আসত আর ইংরেজিতে বাতচিত হতো বলে কিছুদিনের ভেতরেই চম্পট দিলাম। ওঁরা ভাবতেন আমার খবরাখবর জানবার জন্যে বিকেলের সমাবেশটা ভালো ছিল। কিন্তু সহজ হতে পারলাম না কিছুতেই। ওঁদের মেয়ে জয়াকে খুব ভালো লাগত। ব্যবহার ছিল ভারি সহজ।

আমি শান্তিনিকেতনে যাবার বছরখানেকের মধ্যেই নাজিক নামে এক ইজিপশিয়ান এসে উঠল আমারই ব্লকে। এইবার ইংরেজি বলা থেকে পালানো গেল না আর। আর দেখলাম, ইংরেজিতে কথা-বলা তেমন অসুবিধাজনক নয়। নাজিককে নিয়ে সারা শান্তিনিকেতনে চোখ টেপাটিপি! ও দাড়ি শেভ করে নিয়মিত। প্রশ্ন করে জানলাম, ওদের দেশে মেয়েদের দাড়ি গজানোটা বিশেষ সৌন্দর্যের পরিচায়ক। আমাদের ধারণা আর সংস্কার কি ও-কথা মানে? হাসি তো পাবেই।

ওর স্বভাবটা কিন্তু ভারি নম্র ছিল। চাহনিটাও কোমল। মুসলমান বলে আমার ওপরে ওর একটা বিশেষ অধিকার বোধ ছিল। একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কলেমা জানো? হ্যাঁ, বলে গড়গড়িয়ে বলতে শুরু করলাম। ও আমার হাত চেপে ধরে বলল, তুমি তো আরবি উচ্চারণ করতেই জানো না! আমার সঙ্গে সঙ্গে কলেমা বলল। বাপরে! একেবারে অন্য রকম উচ্চারণে কলেমা পড়ে গেল। তাই নকল করে করে বলে ওর হাত থেকে ছাড়া পেলাম। বলে, এত দিন তো মুসলমানই হওনি তুমি!

পরে শুনেছি আরবির প্রাদেশিক উচ্চারণ সর্বত্র এক রকম নয়। তাই একেক এলাকায় একেক উচ্চারণে কলেমা পড়া হয়। কেমন করে অন্য এলাকার কাউকে তুষ্ট করব।

আরেক বিপদ হয়েছিল, একদিন নাজিক ওর ঘরে আমাকে খেতে বলল। আমাদের মতন সে কিচেনে খেত না। রান্নার খুব ঘটাপটা দেখলাম। খেতে বসে আমার দফারফা! টক খেতে পারি না। সে টমেটোর ভেতরে চাল পুরে সেদ্ধ করে কী এক টকটক ডেলিকেসি তৈরি করেছে। পাকা টমেটোর লালটু চেহারা দেখতে অবশ্য অতি চমৎকার ছিল। মাছ খাই না। মাছেরও বিচিত্র সব ডেলিকেসি! সেদ্ধ না কাঁচা মাছ কে জানে, তাতে গন্ধরাজ লেবুর প্রচুর নির্যাস। কিছু খেতে না পেরে বমি ঠেকিয়ে কোনোমতে ওর ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। কঠিন সব রান্না করে আমাকে চমক দিতে চেয়েছিল সে। ভীষণ রেগে গেল আমার কাণ্ড দেখে। আমার খাদ্যরুচি তাকে পুরোদস্তুর হতাশ করেছিল।

.

১১.

শ্যামলী খাস্তগীরের রান্নাতেও টকের প্রাধান্য দেখেছি। ভারতবর্ষের সকল প্রান্তের খাদ্যই তার কাছে আদরণীয় ছিল। দক্ষিণ ভারতীয় বহু রান্নাও সে করত, যাতে টকের প্রাধান্য। আমি সে-সব খাবারের রসিক ছিলাম না বলে ওর বাড়িতে সাহেবদের দাওয়াতের ডাক থাকলে নানা ছুতোতে পালাতে হতো আমাকে। সাহেবরা দেখেছি। ঢের নির্বিকার। আসলে বোধ হয় বেজায় ভদ্র, না হয় টকটক রান্নার দিকে তাদেরও আকর্ষণ ছিল। শ্যামলী ইডলি রাধত, রাজমা-ও।

মানুষের অভ্যাস তার রুচিকে যে কী রকম বদলে দিতে পারে, দেখেছি অশোকবিজয় রাহার মধ্যে। উনি ছিলেন বেজায় আবেগপ্রবণ মানুষ, বলেছি আগে। আমার কবিতার ভাব আর আঙ্গিকের পরস্পর সম্বন্ধ’ নিয়ে উচ্ছ্বাসবশে কত কী যে বলেছিলেন। সেই অশোকদাই কিনা বিসর্জন কাব্যনাট্যটি নিয়ে বলেছিলেন, ‘ওতে কী রকম একটা পাঁঠা পাঁঠা গন্ধ’! জয়সিংহের আত্মদানের ঘটনাটি যে কতটা ভাববিহ্বল–সে কথা মোটে মানলেন না! বলিপ্রথা ওঁর কাছে এত স্বাভাবিক আর পাঁঠা খাওয়ার ব্যাপারটি এত সহজ যে আমাদের কথা মানলেন না কিছুতেই।

অথচ এই কবিটিই কী আন্তরিকভাবে লিখেছিলেন, ‘চমকে উঠি–আরে! আধখানা চাঁদ আটকে আছে টেলিগ্রাফের তারে! যা নিয়ে ছেলেরা ওঁর পেছনে লাগত। শৈলেশ্বর বাগ নামের এক শিক্ষার্থী তাঁর কাছে গিয়ে বলেছিল, অশোকদা, আমি একটা কবিতা লিখেছি—’অশোকবিজয় রাহা/আ-হা!’ বাস্তবিক ওই কবিতার লক্ষ ছিল তার আসল স্বভাব! অশোকদাও অবশ্য তাকে ছেড়ে দেননি। একদিন পথের মধ্যে ডেকে বললেন, ‘শোনো হে, আমিও একখান কবিতা লিখেছি। সেটা হলো—’শৈলেশ্বর বাগ/ভাগ’।

গুরু-শিষ্যের মধ্যে এমন অনেক কাণ্ড চলত শান্তিনিকেতনে। যেমন বালক প্রমথনাথ বিশী একদিন মাস্টার মশাইকে সতর্ক করে বলতে গেলেন–আশ্রমে কিন্তু মারধর করবার নিয়ম নেই। মাস্টার মশাই তখন তাঁকে কান ধরে আশ্রমের মাটি থেকে উঠিয়ে আর একবার শাসন করে আশ্রমের মাটিতে নামিয়ে দিলেন। আর একটা গল্প শুনেছি, শিল্পী মুকুল দের কন্যা মঞ্জরী একদিন ক্লাসে গিয়ে দেখে চিরকুমারী খিটখিটে স্বভাবের নলিনীদি মেয়েদের একে একে দাঁড় করিয়ে প্রতিজ্ঞা করাচ্ছেন, ‘আমি জীবনে কখনো বিবাহ করিব না।’ মঞ্জরীর পালা এলে ও উঠে দাঁড়িয়ে গড়গড় করে বলল, ‘আমি জীবনে সুযোগ পাওয়ামাত্র বিবাহ করিব’।

.

১২.

বাংলাদেশে সবাই আমাকে রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী আর ছায়ানটের শিক্ষক-সংগঠক বলে খুব জানলেও শান্তিনিকেতনে অদ্ভুত সব পরিস্থিতিতে পড়তে হতো আমাকে। গবেষণা করতে গিয়েছি রবীন্দ্রসংগীতের ভাবসম্পদ নিয়ে। শুনে সুরজিৎ সিংহ বললেন, ‘আপনি কি গান জানেন?’ শুনে হতবাক হয়ে থাকলাম। সামলে নিয়ে বললাম, তা জানি। ততক্ষণে উপাচার্যের বাড়ির ভেতর থেকে তাঁর স্ত্রী পূর্ণিমা সিংহ বেরিয়ে এসে আমার নাম শুনেই বললেন, ‘ও, আপনি তো গান করেন’! তখন মনে একটু বল-ভরসা এল!

আর একবার উপাচার্য অম্লান দত্তের বাসায় গিয়ে পরিচয় হলো লন্ডনপ্রবাসী এক দম্পতির সঙ্গে। ওঁরা উচ্ছ্বসিত হয়ে আমার ছাত্র ইকবালের গানের কথা বলছেন। ইকবালের স্ত্রী সাকীর নজরুলগীতির কথাও বলছেন। আমি মহা খুশি হয়ে বললাম ইকবাল আমার প্রিয় ছাত্র। অমনি তাদের উচ্ছ্বাস থেমে গেল। সন্দেহের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন দুজনে। বললাম ওরা তো দুজনেই ছায়ানটের ছাত্রছাত্রী। হ্যাঁ, ছায়ানটেই তো গান শিখেছে ওরা। অর্থাৎ তাতে কি বোঝায় যে আমি ছায়ানটের শিক্ষক হতে পারি! বললাম, আমি ছায়ানটের অধ্যক্ষ। তাতে সন্দেহ বেড়ে গেল আরও। আসলে দোষ তো আমার পোশাক-আশাকের! যে রকম সাদাসিধে হয়ে চলি তাতে কে ভাববে যে আমি নামী শিক্ষক হতে পারি! মানুষকে ইমপ্রেস করতে হলে তেমন শাড়ি-জামা পরতে হবে না? একে তো চেহারাটাই আনইমপ্রেসিভ। তো এই ছিল আমার দশা!

.

১৩.

শান্তিনিকেতনের প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের পরিবারের প্রতি আমার মা খুব অনুকূল ছিলেন। জীবনে কত জায়গাতেই তো মুসলমান বলে হেনস্তার পাত্র হয়েছেন! তাই ওঁদের বাসায় আমাকে পরিচয় করিয়ে। দিয়ে বলেছিলেন–এই বাড়িতে মুসলমান বলে কোনো মানুষকে ছোট করা হয় না। সত্যি সত্যি ওঁদের বাড়িতে কারও কাছে কোনো অবহেলা পাইনি।

ভুবনডাঙার সুনুদা সুন্দর গান গাইতেন। এ বাড়ির ছেলেমেয়েদের মাসতুতো ভাই বলে শুনেছিলাম। গানের এমন পাগল যে ওঁদের বাড়ির কাছেই ছোট্ট একটা বাড়িতে তাঁকে গান শোনাতে যেতে হতো আমাকে। মাঝেমধ্যে ভুবনডাঙা থেকে বেশ দূরে আমার স্কলার্স ব্লকের ঘরেও চলে আসতেন উনি রিকশা নিয়ে। এত ক্ষীণদৃষ্টি ছিলেন যে সকালের দিকে ছাড়া ঘরের বাইরে ঘুরে বেড়ানো তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। স্বাস্থ্যও ছিল খুব খারাপ।

আর প্রভাতবাবুদের বাড়িতে যেকোনো উপলক্ষে আমার গান হতেই হতো। প্রায়ই, কারও-না-কারও জন্মদিন থাকলেই আমার নিমন্ত্রণ ছিল বাঁধা। শেষ পর্যন্ত প্রভাতবাবুর মৃত্যুর পরেও পারিবারিক সমাবেশে ওঁর প্রিয়গান ‘সকরুণ বেণু বাজায়ে কে যায়, গাইতে হয়েছিল।

প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী সুধাদির মৃত্যুর পরে বাড়ির ভেতরেই প্রার্থনার আয়োজন হয়েছিল। ‘এখন আমার সময় হলো’ গেয়েছিলাম। সেখানে ওঁদের এক বয়স্ক আত্মীয়া সেদিন বায়না জানিয়ে গেলেন, তাঁর মৃত্যুতেও যেন আমি ওই গানখানি গাই। এর বাড়ির সকলে আমাকে জানত না। মৃত্যুর খবর পেয়ে আমি গান গাইতে গেলে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি হয়েছিল। আমিও যেমন বোকাসোকা!

এর অনেক দিন পরে প্রসেনজিৎ সিংহের এক দিদি আরতিদি আমাকে বলেছিলেন, আমার মৃত্যুর পরে তুমি অবশ্যই এখন আমার সময় হলো’ গাইবে। তখন তাঁর আশি বছর পেরিয়ে গেছে। বললাম। আমি তখন কোথায় থাকব তার কি ঠিক আছে? বললেন, খবর শুনলে যেখানে থাকো, সেখান থেকেই এদিকে (শান্তিনিকেতনের দিকে) মুখ করে গাইবে। বড় মন খারাপ হয়েছিল শুনে। এত দিনে উনি নিশ্চয়ই বেঁচে নেই আর, কে জানে!

.

১৪.

আমার প্রথম পর্ব এমএর দুই বান্ধবীর সঙ্গে প্রথম প্রথম এদিক-ওদিক বেড়াতে যেতাম বিকেল বেলায়। উষা আর মণিকা। ফ্যাকাশে ফরসা মণিকা চুপচাপ সঙ্গ দিত-মুখে রা করত না। আর উষার মুখে ফুটত খই। মনে হতো শান্তিনিকেতনে আসবার আগে কিছু বিষয়ে বইপত্র ঘেঁটে কিছু তথ্য সংগ্রহ করে এসেছিল। ক্ষিতিমোহন সেন দাদুর মন্দিরে উপাসনা পরিচালনার কথা বলত। কথায় কথায় উনি কেমন রস করতেন, বলত সেসব। চুয়ান্ন-পঞ্চান্ন সালে আমরা যখন শান্তিনিকেতনে গেছি, তখন ক্ষিতিমোহন সেন শয্যাশায়ী। তাঁকে দেখতে চললাম একদিন। শেষ বিকেলে প্রায়-অন্ধকার বাইরের ঘরে বিছানায় শুয়ে আছেন। বাবার শিক্ষা ছিল, বয়স্ক মানুষ দেখলেই পায়ে হাত দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবে। আমি প্রণাম করতে যেতেই উষা আমাকে ধরে ফেলল। শুয়ে থাকা মানুষকে প্রণাম করতে হয় না। মৃত্যুর পরেই নাকি শয়ান অবস্থার মানুষকে প্রণাম করা চলে। থতমত খেয়ে নিজেকে সামলে নিলাম। ওদের নিয়ম-টিয়মগুলো তো আমরা কিছু জানি না!

আমি মানুষের কানে ফুঁ দিয়ে মজা করতাম। একবার কে যেন আমাকে হাত চেপে ধরে শাসন করেছিল–খবরদার কানে ফুঁ দেবে না। আমাদের মন্ত্রগুরুরাই শুধু কানে ফুঁ দেবার অধিকারী। পরে অন্যরা আমার ঘাবড়ে-যাওয়া দেখে বলেছিল–ধ্যাৎ, সব কথা বিশ্বাস করো কেন? মজা করেছে।

ক্ষিতিমোহন সেন বাস্তবিকই খুব অসুস্থ ছিলেন। প্রায় কথা বলেননি আমাদের সঙ্গে। উষা-মণিকা একদিন নন্দলাল বসুর বাড়িতেও নিয়ে গিয়েছিল আমাকে। সকাল দশটার মতন বাজে তখন। বাইরের ঘরে বসে ছবি আঁকছিলেন তিনি। আমাদের দু-চার কথা জিজ্ঞেস করে পাশের বসবার ঘরে আলতামিরা গুহার ছবিসুদ্ধ বই দিয়ে বসিয়ে ছবি আঁকতে চলে গেলেন। উষা গেছে কথা বলবে আর শুনবে বলে–ওর কি এতে পোয়! খুব হতাশ হলো।

উষা সরদার একদিন আমাদের নিয়ে চলল শ্যামবাটির দিকে। পোস্টাপিসের পরে খানিকটা ফাঁকা জায়গা আছে। সেখানে দুটো কাঠগোলাপের গাছ ডালপালা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। একটি পাতাও অবশিষ্ট নেই গাছে। আর মাথার ওপরে দু-এক গোছ ফুল ফুটে আছে। উষা বলে কী–দ্যাখো দ্যাখো, গাছ দুটো কেমন ন্যাড়া মাথায় রিবন বেঁধেছে। এমন তুলনা শুনে হাসতে হাসতে মরি–উষা নির্বিকার!

অনেক পরে মুর্শিদাবাদে উষা-মণিকার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ওদের বাসায় গিয়েছিলাম। দুই বন্ধু মিলে বাড়ি করেছে। উষার বোনের সঙ্গে (যদ্দুর মনে হয়) মণিকার ভাইয়ের বিয়ে হয়েছে। কুটুম্বিতা পাতানোও হয়েছে এইভাবে। তখন চাকরি থেকে অবসর নেবার সময় হয়ে এসেছে ওদের।

.

১৫.

অনেককাল আগের কথা, শিশির ঘোষ মশাই শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন ছবি আঁকা শিখতে। কলাভবনে পড়া শেষ হলো। তখন তো চলে যেতে হয় তবে! মন তো মানে না। রবীন্দ্রনাথ বললেন, তুমি তো বাঁশি বাজাও, ও নিয়ে থাকো না! যা-ই হোক, এটা-ওটা শিখতে শিখতে করতে করতে শেষ পর্যন্ত থেকেই যাওয়া হলো শান্তিনিকেতনে। আর শুধু বাঁশি বাজানো কেন, গানও তো গাইতেন উনি।

চাকরি করতেন শ্রীনিকেতনে, কলাভবনের বিদ্যা সম্বল করেই। বিনয় ভবনের সঙ্গেও, গানের সূত্রে যুক্ত ছিলেন। আমি তাঁকে পাই তাঁর প্রবীণ বয়সে। বিনয় ভবনের ছাত্রী সান্ত্বনা সেনগুপ্ত তাঁর অনুগত ভক্ত ছিল। আমাকে সে তার কাছে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দিল। আমার গানের কথা শুনে উনি এসরাজ বার করে সুর মেলালেন। শুরু হলো তার বাজনার সঙ্গে আমার গান গাওয়া। ওঁর বাড়িটি দূরে (শ্রীনিকেতনের মুখে) বলে বেশি যেতে পারতাম না। উনিও আমার স্কলার্স ব্লকে আসেননি কখনো। কিন্তু আমার জন্যে খুব অপেক্ষা করে থাকতেন শিশিরদা। গান ছাড়া নানা গল্পও চলত।

শৈলজাদা নাকি রবীন্দ্রনাথের গানের সুর নিয়ে কখনো কখনো আপত্তি করতেন। নাকি বলেছেন–এ জায়গাটা আমি অন্য রকম করে নিয়েছি। এ নিয়ে শিশিরদা ক্ষুব্ধ ছিলেন। শান্তিদেব ঘোষও নাকি রবীন্দ্রনাথের ডাক পেয়েও সহজে কাছে যেতেন না। এ কথা আর কারও মুখেও শুনেছি আমি। শিশিরদার কাছে এই অবাধ্যতাগুলো খুবই খারাপ লাগত।

শিশিরদার বাইরের ঘরটা একেক দিন গানে ভেসে যেত। আসর হতো জমজমাট। একবার গানের পরদিন রেজিস্ট্রার্স অফিসে ঢুকছি—’শুনি কেউ আবৃত্তি করছেন আর কি কখনো কবে/ এমন সন্ধ্যা হবে’। চমকে উঠে দেখি একটা বেঞ্চে বসে আগের দিন গাওয়া ‘গোধূলিলগনে মেঘে ঢেকেছিল তারা’ গানের কথা বলছেন শিশিরদা। সত্যি সত্যি ও রকম সন্ধ্যা হয়নি আর কখনো। প্রথম দিকে এসরাজে শিশিরদার হাত বেশ চলত, সুরও বাঁধতেন যত্ন করে। বয়স বেড়ে নব্বই পার হলে সেই দক্ষতা হারিয়ে গেল ক্রমে।

সান্ত্বনা সেনগুপ্তের কথা বলি আর একটু। কানাই সামন্ত মশাইয়ের মাধ্যমে ওদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল আমার। সান্ত্বনা আর প্রীতি। মুর্শিদাবাদের বেলডাঙার স্কুলের শিক্ষক ছিল ওরা। সান্ত্বনা খুব চিঠি লিখতে পারত। ওর সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন কানাইবাবু। ওরা দুই বন্ধু খুব বেড়িয়ে বেড়াত। কোনো জায়গায় যাবার আগে টুরিস্ট গাইডজাতীয় বইটই পড়ে সেখানকার দর্শনীয় জায়গা আর ইতিহাস জেনে নিত ওরা।

শান্তিনিকেতনে প্রথম যেদিন ওদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো, সেদিন ওরা বেরিয়েছে শিউড়ি হয়ে দেওঘরের নন্দন পাহাড়, মধুপুর, গিরিডি-ওসব দিকে যাবে। শুনে আমি সুর করে বললাম, আমাকে কেউ নিয়ে যায় না রে! আমাকে সঙ্গে নিতে তক্ষুনি রাজি ওরা। সেই শুরু। পরে জম্মু-কাশ্মীরও ঘুরে এসেছি ওদের সঙ্গে। গেছি কুলু মানালিতে। ভারতে বেড়াবার সুবিধা এই যে পথেঘাটে খাবারের দোকান পাওয়া যায়। পরে তুলনা করে দেখেছি–যশোর থেকে ঢাকা আসবার পথে ওই সুবিধা খুব একটা ছিল না। আর টয়লেটের অভাব তো আর এক দুঃসহ ব্যাপার।

বাংলাদেশে ওদের নিয়ে ঘুরতে পেরেছি নানাজনের সঙ্গে চেনাজানার সূত্রে। একবার কুষ্টিয়ার লালনের আখড়া হয়ে শিলাইদহ কুঠিবাড়ির পাশের সরকারি রেস্টহাউসে রাত্রিযাপন করে চমৎকার ঘুরেছি। কুষ্টিয়ার শিল্পী অশোক সাহা যাবতীয় ব্যবস্থা করে দিয়েছে। ঢাকা থেকে মাইক্রোবাস নিয়ে বগুড়া-জয়পুরহাট হয়ে ঘুরেছি পতিসর, দিনাজপুরের কান্তজির মন্দির। সাহায্য করেছিল জয়পুরহাটের আমিনুল হক বাবুল। থাকা-খাওয়ার কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে নীরবে। শান্তিনিকেতনে আলাপ বলেই এই বন্ধুদের সঙ্গে ভ্রমণের কথা লিখলাম এখানে।

শান্তিনিকেতনের মোহরদি, বাচ্চুদি, শৈলজাদা বাংলাদেশে এলেও কিন্তু মনে হয়, শান্তিনিকেতনই যেন এসেছে বাইরে!

সুতপা ভট্টাচার্যের নাম এসেছে নানা প্রসঙ্গে, কিন্তু তাঁর কথা লেখা হয়নি। স্কলার্স ব্লকের ঘরের দরজায় একদিন চিঠি পেলাম, দেখা করতে এসে আমাকে পাননি সুতপা ভট্টাচার্য। সেই দিনই সত্যেন রায় মশাইয়ের বাসায় গিয়ে সুতপা ভট্টাচার্যের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শুনলাম। তার লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়েছেন সত্যেন রায়। আমাকেও লেখাটি পড়তে দিলেন। সেবার ওই নাম শোনা পর্যন্ত।

কলকাতায় কী একটা সমাবেশে গিয়ে দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের (কালান্তর) সঙ্গে দেখা হলে তিনি আমাকে আর একজনের সঙ্গে আলাপ করাচ্ছিলেন, এমন সময়ে এক মহিলা এসে বললেন, আর আমার সঙ্গে পরিচয় করাবেন না? চেনাজানা হলো–ইনিই সেই সুতপা ভট্টাচার্য। তিনি ছায়ানটের মুক্ত করো হে বন্ধ’ প্রবন্ধ সংকলনের ভূমিকায় আমার লেখা পড়ে আমাকে পছন্দ করেছিলেন, শুনলাম। সেই থেকে ঘনিষ্ঠতা।

সেই সময়ে সুতপা কলকাতাতেই থাকতেন। কিছুকাল পরে পাঠভবনের শিক্ষক হয়ে তিনি বিশ্বভারতীতে যোগ দিলেন। স্কলার্স ব্লকে আমার পাশের একটি কামরাই তাঁর আবাসস্থল হলো। ফলে নিত্য দেখাশোনা। তা ছাড়া আমি রবীন্দ্রভবনে পড়তাম, উনিও রবীন্দ্রভবনে পড়াশোনা শুরু করলেন। ‘কবির চোখে কবি’ নামে রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে অমিয় চক্রবর্তী আর আরও তিনজন কবির অভিমত সংকলন করে বিশ্লেষণ করছিলেন সুতপা। ফলে বিশেষ স্বভাববশত নিজের কামরায় চশমাটি রেখে পড়তে চলে গেলে, আমাকেই চশমার বাহক হয়ে রবীন্দ্রভবনে ছুটতে হতো। এভাবে আমার ওপরে তার নির্ভরশীলতা বেড়ে চলেছিল। উঁচু-নিচু অসমান পথে চলতে গিয়ে ঠ্যাং ভাঙলে তাকে প্লাস্টার করা পা নিয়ে কলকাতার ট্রেন ধরিয়ে দেওয়া ইত্যাদি অনেক কিছুই করতে হতো। তার স্বামী প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্য স্ত্রীকে কলকাতা থেকে সারিয়ে শান্তিনিকেতনে পৌঁছিয়ে দিতে এসে বলতেন ‘এত দিন প্র-যত্নে ছিল, এবারে সযত্নে রেখে গেলাম’। কাজেই সম্পর্কটি বোঝাই যাচ্ছে।

আমার শান্তিনিকেতনে দীর্ঘ অবস্থান এই সম্পর্কের ওপরে কালিমাও ফেলেছিল একসময়ে। যোগাযোগ যতটা ছিল, বন্ধুত্ব ততখানিই ছিল বলা দুষ্কর। যাহোক, সুতপা ভট্টাচার্য আমার শান্তিনিকেতন বাসকালের দীর্ঘদিনের সহচর বটে। ওর কলকাতার বাসায় কতবার যে নেমন্তন্ন খেয়েছি! রান্নার দিকটা সুতপারই তত্ত্বাবধানে ছিল, কিন্তু খাওয়ার পরের মিষ্টান্নর যে কত রকম বৈচিত্র্য দেখিয়েছেন প্রদ্যুম্ন! আর ছিল মিষ্টি পান। বিশেষ দোকান থেকে কিনে আনা হতো দুপুরের রোদ অগ্রাহ্য করে। কলকাতায় আমি ওদের দুজনের সেবায় পরিতৃপ্ত হতাম।

.

১৬.

আমি ‘ধ্বনি থেকে কবিতা’ নিয়ে কাজ করতে শান্তিনিকেতনে গেলে কাকাবাবু খুশি হননি। তিনি তখন তাঁর সেজ কন্যা নোটনের (সঙ্ঘমিত্রা) থিসিসের তত্ত্বাবধান নিয়ে দারুণ ব্যস্ত। আমার কাজ নিয়ে তার দুটি আপত্তি ছিল। প্রথমত, বিষয়টি সাধারণ মানুষের জন্যে নয়। ওসব বুঝবে কে? কী উপকার হবে ও থেকে! এ ছাড়াও পঞ্চাশ বছর। বয়স পার করে এ রকম কাজ করতে গেছি। কিছু যদি ফল দেখা না দেয় তো সে বেইজ্জতি সইব কী করে।

যে কাকাবাবু এত ভালোবাসতেন, চিঠির পাঠ লিখতেন ‘তনয়া প্রতিমাসু’, সেই কাকাবাবু এমন সরাসরি দোষ ধরলেন–কোনো উৎসাহ দিলেন না একেবারে। ফিরতি পথে চোখের জল তো ঝরলই, স্কলার্স ব্লকে ফিরে দরজায় খিল দিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললাম। বেশ কিছু সময় চুপচাপ বসে থেকে মনের মধ্যে জেদ হলো–না, এ কাজ পারতেই হবে।

কিছুদিনের ভেতরেই সকাল আটটায় লাইব্রেরিতে গিয়ে বসলাম। আহমেদাবাদের স্বল্প পরিচিত এক স্কলার ভোলাভাই প্যাটেল বললেন, আপনি যে বিষয়ের কথা বলছেন, তা নিয়ে কাজ করতে হলে Stanley Burnshaw-র The Poem Itself বইটি পড়তে হবে। পড়া শুরু করলাম। যে-যা বলে সব করি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক স্কলার ছিলেন তখন ওখানে। তাঁকে ধরে লিঙ্গুইস্টিকসের কত বই পড়লাম, কী বলব। নোট করে করে পড়া। একটার আগে উঠে কাউন্টারে বই জমা রেখে বেরোতাম। ঘরে ফিরে খাওয়া সেরে পাঁচ মিনিটের জন্যে বালিশে মাথা রাখতাম। সময় দেখে তড়াক করে উঠে আবার ছুট লাইব্রেরিতে। তত দিনে প্রসেনজিৎ-রত্নার আহ্বানে ওদের বাসায় থাকতে শুরু করেছি। পুঁচকিদি নামে একজন খাবার সরবরাহ করবার ব্যবসা করতেন। তার বাড়ি থেকে খাবার আসত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে মুহম্মদ আবদুল হাই স্যার আমাদের ফোনেটিকস পড়াতেন। লন্ডনের JR Firth ছিলেন স্যারের গুরু। Firth-এর লেখা Papers on Linguistics পড়তে শুরু করলাম। Firth বলছেন, ভাষাধ্বনি ব্যক্তি আর সমাজের সকল ধারণার বাহন হয়ে বয়ে চলে। সমাজভুক্ত মানুষের জীবনে সামাজিক সাহিত্যিক বিনিময় সূত্রে ওই ধারণাগুলো দিনে দিনে হয়ে ওঠে সেই সমাজের জাতীয় ধারণা। ব্যাপারটি ভাষাবিজ্ঞানের Phonaesthetic অর্থাৎ ধ্বনি সৌন্দর্যমূলক বিবরণ হিসেবে ব্যক্তির ক্ষেত্রেও যেমন, তেমন ভাষাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও মূল্যবান। এই মত আমাকে ধ্বনিব্যঞ্জনা আলোচনার ভাষাবিজ্ঞানসম্মত ভিত্তি সরবরাহ করল।

গবেষণাপত্রের তত্ত্বের মতো ভারী বিষয়ে স্মৃতিকথায় এর বেশি কিছু লেখা সমীচীন হয় না।

.

১৭.

প্রথমবার শান্তিনিকেতনে যাওয়ার পর পাঠভবনের যে মেয়েরা আমার জানালায় এসে গল্পে মত্ত হতো, তাদের কনিষ্ঠতম ছিল শ্যামলী খাস্তগীর। ক্লাস শেষ হলে সে এর-ওর বাড়ি ঘুরতে বেরোত। কখনো রবীন্দ্রনাথের সেজ মেয়ে মীরা দেবীর মালঞ্চ, কখনো নটীর পূজার ‘শ্রীমতী’ ভূমিকার বিখ্যাত গৌরী ভঞ্জ চৌধুরীর বাড়ি। শিল্পী নন্দলাল বসুর জ্যেষ্ঠ কন্যা তিনি। আশ্রমকন্যা হিসেবে শান্তিনিকেতনের সব বাড়িতেই শ্যামলীর যাতায়াত ছিল। গৌরীদি তার আমলের শান্তিনিকেতনের উৎসব-অনুষ্ঠানের সাজসজ্জা নিয়ে কথা বলতেন। শ্যামলী সেসব মনে ধরে রাখত। নন্দলাল বসুর আরেক মেয়ে যমুনাদির কাছেও পুরোনো কথা শুনতে যেত শ্যামলী। আরও ছিলেন শিল্পাচার্য পুত্র বিশ্বরূপ বসু আর নিবেদিতা বউদি। ওই পাড়াতেই পথের ধারে আরও ছিল লাবুদির বাসা। শ্যামলীর স্বভাব ছিল পথের ধারে কিংবা কারও প্রাঙ্গণে ফোঁটা ফুল তুলে খোঁপায় গোঁজা। ভালো লাগত ওরই খোঁপায় আশ্রমে প্রথম ফোঁটা পলাশ কিংবা অগ্নিশিখা ফুল দেখতে পেলে। অগ্নিশিখা ফুলের ক্রমিক রং বদল-করা একটা দেখবার মতো ব্যাপার ছিল। ফুটত সবুজ রং নিয়ে। সবুজের ডগায় এরপর দেখা যেত হলুদ শিখা। সে রংও বদলে লাল আগুনের রং ধরত। এরপর কালচে লাল হয়ে খসে পড়বার প্রস্তুতি। স্মৃতি এত দিনে ঝাপসা হয়ে আসছে, এ ফুলটা যেন যমুনাদির উঠোন থেকেই পেত শ্যামলী। ঘোরাঘুরির পরে সারা দিনে চুলের পারিপাট্য বলতে কিছুই থাকত না। ওকে দেখে একটা বনবালা বলে মনে হতো। কপালে সিঁদুরের টিপও যেত ধেবড়ে। চোখের কাজলেরও ওই দশা। বুধবার ছুটির দিনের বিকেলে শ্যামলীর চেহারা দাঁড়াত ওই রকম।

সন্ধ্যাবেলা নার্স শান্তিদির সিকরুমে জড়ো হতাম আমরা কজন। শ্যামলীর মা ছিলেন না। ও শান্তিদিকে মায়ের মতোন জানত। আমি, শিউলি, কখনো কখনো রীতা (রীতা গাঙ্গুলি, পরে কোঠারি) রোগীর জন্যে পাতা বিছানাতে জটলা করে বসতাম। পাঠভবনের তখন স্টাডি আওয়ার, তবুও ছুটে চলে আসত আরও কেউ কেউ। গান হতো। শান্তিদির মুখটা প্রসন্ন হয়ে উঠত। শিউলির যা হারিয়ে যায় তা আগলে বসে রইব কত আর খুব ভালোবাসতাম শুনতে। অনেক পরে অর্থনীতির অনুপমবাবুর স্ত্রীর গলায় এই গানটা শুনেছিলাম। উনি মোহরদির ভালো নকল করতেন। অনেক কাজ দিয়ে গাইতেন গানখানি। ওঁর দুই মেয়েও চমৎকার গান গাইত। সিকরুমের আসরে আমার গান ছিল, অশ্রুনদীর সুদূর পারে। প্রায় প্রতিদিন গাইতে হতো। রীতার পছন্দের গান ছিল খুব। তবে সেসব কথা তার এখন আর মনে নেই। এখন বেগম আখতারের কাছে শেখার কথা বলে বেশি। এই আসরে গীতাঞ্জলি নামে আর একটি মেয়ে যোগ দিয়েছিল পরের বছর। ওর গলায় তোমার সুর শুনায়ে যে ঘুম ভাঙাও শুনতাম খুব। একবার মিষ্টি করে গেয়েছিল শিউলি-ফোঁটা ফুরোল যেই ফুরোল।

শ্যামলীটা ছিল পাগলি! না হলে স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখের সংসার করতে করতে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে বলে আমেরিকার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে আন্দোলন জুড়ে দিল! রাস্তায় অবস্থান নিয়ে হাজতবাস পর্যন্ত করেছে! ভ্যাঙ্কুভারে থাকত তখন। শেষ পর্যন্ত শান্তিনিকেতনেই ফেরত এল ছেলেকে নিয়ে। বাবা বাড়ি রেখে গেছেন, আর আছে। ওড্রদেশীয় বংশী’ চাকর। একে-তাকে ধরে এনে এনে খাওয়ায়। একা খেতে ভালো লাগে না তো! আর এক আছে ‘মন্টু’ রিকশাওয়ালা। খুচখাচ সাহায্য-সহযোগিতা পায় আর শ্যামলীকে নিয়ে এবাড়ি-ওবাড়ি যায়। যতবার শান্তিনিকেতন গিয়ে পূর্বপল্লী গেস্টহাউসে উঠি ঠিক খবর হয়ে যায়। মন্টু রিকশাওয়ালার গাড়ি খড়খড় করে এসে দাঁড়ায়। হাঁক আসে ‘মিনুদি!’। আমার জন্যে শ্যামলীর হৃদয়ের দুয়ার সব সময়ের জন্যে ভোলা। ঢাকার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের খবর নিয়ে উত্তেজিত হয়ে থাকত। সংস্কৃতি নিয়ে ওদিকের মানুষের ভাবনাচিন্তা নেই বলে মন খারাপ থাকত। আমাকে বড় ভালোবাসত সে।

শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে এসে দেখে গেছে এখানকার কাজকর্ম। আমার বাড়ির সাদামাটা রান্নাবান্না তার খুব পছন্দ হয়েছিল। চাল, ডাল, আলু, পটোল, বরবটি এটা-ওটা একসঙ্গে চুলোয় চাপিয়ে ফুটিয়ে খিচুড়ি করে ওপর থেকে খানিকটা ঘি ছেড়ে দিয়ে যে দ্রব্যটি প্রস্তুত হয়েছিল, তার নাম বৈরাগীভাত। মহা পছন্দ তার। সঙ্গে পাঁচফোড়ন দিয়ে সম্বরা দেওয়া জলপাই বা তেঁতুলের টক-মিষ্টি আচার থাকলে আর কথা কী! এমন খাবারের পরেও লোকে কেন মাংস-মাংস। করে কে জানে! মাংস খাওয়া দুচক্ষে দেখতে পারত না–এই এক বাতিক ছিল ওর।

আণবিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে প্রচারণা ছিল বুঝি আর এক বাতিক। সেই বক্তব্য নিয়ে প্রায় একই ধরনের বহু ছবি এঁকেই চলত। একবার ওই সব ছবির এক এক্সিবিশনে আমাকে এক বিকেলে গান গাইতে বলল। গেলাম ওর সঙ্গে কলকাতায়। উদ্বোধনের দিনই হবে গান। উদ্বোধক লেডি রানু মুখার্জি। বর্ষার দিন। সারা বিকেল একের পর এক প্রিয় বর্ষার গান গাওয়া চলল, আমার দিন ফুরালো ব্যাকুল বাদলসাঁঝে’, ‘উতল ধারা বাদল ঝরে’, ‘পুব হাওয়াতে দেয় দোলা, মম মন-উপবনে চলে অভিসারে’–একের পর এক। রানু মুখার্জি বসে ছিলেন প্রথম থেকেই। আর কোনো প্রদর্শনী উদ্বোধনে যেতে হবে বলে আমাকে গান গেয়ে যেতে বললেন। চট করে ফিরে এসে আরও গান শুনবেন ইচ্ছে করেছিলেন। কিন্তু ঘণ্টা দুই গাইবার পরে থামতেই হলো। রানু মুখার্জি ফিরে এসে মন খারাপ করেছিলেন।

জাদুগোড়াতে ইউরেনিয়ামের খনি থেকে পুরো এলাকায় কী রকম বিকিরণ হয়েছিল তার দৃশ্য শ্রমিকদের বসতিতে বিকলাঙ্গ শিশুদের দেখে শ্যামলী সরাসরি জেনেছিল। সে নিয়ে সচিত্র বই লিখে ছাপিয়েছিল শ্যামলী। ভোপালে কীটনাশক কারখানার গ্যাস ট্যাংক লিকেজের ভয়াবহ দুর্ঘটনার খবর শুনে শ্যামলীকে ছুটে যেতে দেখেছি সেখানে। দুর্গত মানুষের সেবা ছিল তার ব্রত। নিজের নিরাপত্তার পরোয়া করতে দেখিনি কখনো। সমাজকর্মী পান্নালাল দাশগুপ্তকে তাঁর শেষ জীবনে শ্যামলীর যত্নেই জীবনযাপন করতে দেখেছি। ‘পলাশ’ বাড়িতে থেকেই বীরভূমের গ্রামের সংস্কৃতি আর উন্নয়ন নিয়ে কাজ করতেন তিনি।

মন্টু রিকশাওয়ালার কথা লিখছিলাম। মন্টু মাঝেমধ্যে দরকারে পাঁচ-দশ টাকা ধার নিত। রিকশায় কোথাও যাওয়ার থাকলে ওকে ডাকতাম। কখনো কখনো টাকা ফেরত দিতে দেরি করলে বলতাম, কী মন্টু, আজকে তাহলে আর রিকশা ভাড়াটা দিই না। সজোরে মাথা নেড়ে বলত, না দিদি না, আজ থাক। আর এক রিকশাওয়ালা মহাদেব’ ছিল কবি। একটু বড় বড় চুল রাখত। ওর রিকশায় উঠলে ওর কথাবার্তা চলত বেশ গুরুগম্ভীর, কবিতা শুনতে হতো কখনো কখনো। সে-ও ধার নিত। একবার গোটা বিশেক টাকা নিয়ে আর তো দেয় না! তাগাদা করাতে ওর মানে লাগল। দিন কয় পরে টাকাটা ফেরত দিয়ে গেল। সত্যেন রায় মশাই সে কথা শুনে হেসে আর কূল পান না। বললেন, এই ব্যাপার! বুদ্ধি রাখে তো! সেই দিনই ব্যস্তসমস্ত হয়ে তার কাছ থেকে বিশটা টাকা ধার নিয়েছে। অর্থাৎ সেই ধার করা। টাকায় আমার টাকা শোধ করেছে। কইয়ের তেলে কই ভাজা!

কয়েক বছর আগে সুতপা ভট্টাচার্যের ফোন পেলাম কলকাতা থেকে। শ্যামলীর অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে, মারাত্মক অবস্থা। হাসপাতালে রয়েছে। কয়েক দিন গেল ছটফট করে। তারপর শ্যামলীর মোবাইলে কল দিলাম। অনুমান করছিলাম তত দিনে ওর ছেলে আনন্দ এসে গেছে খবর পেয়ে। আনন্দ ফোন ধরল। বলল, জ্ঞান ফিরেছে। ভুরু কুঁচকে ইশারা করে দেখাচ্ছে আনন্দকে নাকে নল আর স্যালাইনের তার-টার এসব কেন। কোনো কৃত্রিম আয়োজন তো পছন্দ নয় তার! দু-চার দিন পরে আর ফোন ধরল না কেউ। হয়তো সে চলে গেছে। আর আনন্দও ফিরে গেছে ভ্যাঙ্কুভারে। শ্যামলীকে এখানে আর কে চেনে! একা একা শোক যাপন করেছিলাম। তবে দেখা গেল শ্যামলী মাসিকে পার্থ-রুচিরা ‘পলাশ’ বাড়িটাসমেতই চেনে ভালোভাবে। ‘মনফকিরা’ থেকে ওর একটা বই ছেপে বার করেছে সন্দীপনরা, তার মলাটে ‘পলাশ’ বাড়ির ছবি সামনের পেছনের প্রচ্ছদ মিলিয়ে। ওরা দেখেই বলল, শ্যামলী মাসির বাড়ি।

.

১৮.

রবীন্দ্রসংগীতের ভাবসম্পদ বিশ্লেষণ করবার সময় উপাচার্য ছিলেন। অম্লান দত্ত। আমার সঙ্গে যোগ ছিল গানের সূত্রে। দারুণ মনোযোগী শ্রোতা ছিলেন। মনে হলে যখন-তখন বাসায় চলে যেতাম, বলতাম, গান শোনাব। উনিও প্রস্তুত। সাহসও ছিল বলতে হবে। বই খুলে গুন গুন করে দেখলাম, ‘চোখের জলের লাগল জোয়ার’ গানটা তো পারি। মনে হচ্ছে! লীনুর (ফাহমিদা) গানের সঙ্গে হারমোনিয়াম বাজাতে বাজাতে ওসব গান বেশ আয়ত্ত হয়ে যেত। চলে গেলাম অম্লানবাবুর বাসায়। আমার গলায় খুব শ্লেষ্ম জমে বলে ঘন ঘন গলা ঝাড়তে হয়। আর একজন অতিথি বসেছিলেন কেউ, আমার গলা ঝাড়া শুনছিলেন। আর ‘গান শোনাব’ বলে দাপুটে উচ্চারণ লক্ষ করছিলেন। সুযোগমতো গান গেয়ে উঠলাম। গান গাইবার সময়ে শ্লেষ্মটেষ্ম বোঝা যায় না কিছুই। অতিথি বলে উঠলেন, ‘যা ভেবেছিলাম তা নয় তো!’ তাঁর কথায় কর্ণপাত না করে অম্লানবাবুকে বললাম, ‘হল কানায় কানায় কানাকানি’ এই অনুপ্রাস আমার দুঃসহ লাগে। উনি কথাটা পছন্দ করলেন না। পুলিনবিহারী সেন বা কানাই সামন্তের মতোই খানিক অসহিষ্ণু হয়ে বললেন, ‘ও ঠিক আছে।’ বিসর্জর্ননাটকের ঘটনাবিন্যাসের ত্রুটি নিয়ে আমার মন্তব্য শুনে ওঁরা ঠিক ওই বাক্যই উচ্চারণ করেছিলেন। আর কানায় কানায় কানাকানি নিয়ে আমার অভিমত এখনো বদলায়নি। কেন যে আমাকে রবীন্দ্রনাথের অন্ধভক্ত মনে করে লোকে, কে বলবে!

মানসী দাশগুপ্তা ছিলেন অম্লানবাবুর অনেক দিনের বান্ধবী। ইনি পূর্বপল্লী গেস্টহাউসের পশ্চিম প্রান্তে থাকতেন। নিজের খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল আলাদা। সেই সময়টাতে আমি আর কেতকীকুশারী ডাইসন তখন পূর্বপল্লী গেস্টহাউসের ৯ নম্বর আর ৬ নম্বর ঘরে ছিলাম। খাবার ঘরে আমরা একসঙ্গে খেতে বসতাম। অম্লানবাবু মজা করে বলতেন, ‘ও আপনারা তবে নয়-ছয়ে আছেন!’ শব্দ নিয়ে খেলতে ভালোবাসতেন বেশ।

আমি পরে পঞ্চবটীতে থাকতে সেখানেও অম্লানবাবু যেতেন কখনো কখনো। আমি কী খাচ্ছি, কত দূর লেখা হলো–খোঁজখবর নিতেন।

আইসিএস রণজিৎ রায় আর শকুন্তলা মাসিমা পঞ্চবটীর কাছেই থাকতেন। মাসিমা আমাকে এতটাই স্নেহ করতেন যে নিত্যি এক পোয়া দুধ কিনে জ্বাল দিয়ে দই পেতে রাখতেন আমার জন্যে। ঘরে ফিরবার সময় আমি তারের বেড়ার এপাশ থেকে ডাক দিলে মাসিমা দইয়ের গ্লাসটা আমাকে এনে দিতেন।

একাত্তরে ওঁর কাছ থেকে কত যে সাহায্য পেয়েছি, কী বলব। পরিবারসুদ্ধ সবাই তাকে ভালোবাসতাম আমরা।

একাত্তর সালে নকশাল আন্দোলন শেষ হয়ে আসবার দিকে এক ঘটনা এখনো আমার মনে সমুজ্জ্বল। তখনো পূর্বপল্লীর সেই বাড়িতে থাকতেন ওঁরা। বাড়ির পশ্চিম দিকের বেড়ার পরে ছিল একটা মাঠ। এই মাঠেই পরে পঞ্চবটীর ঘরগুলো তৈরি হয়েছিল। বেলা এগারোটার মতো বাজে বোধ করি তখন।

আমি ছিলাম মাঠের উত্তর দিকে প্রবোধচন্দ্র কাকাবাবুর বাড়িতে। গুরুর কাছে কিছু বুঝে নিচ্ছিলাম। হঠাৎ একটু হইচই চিৎকার আর গুলির শব্দ শুনলাম। দেখি, মাঠে বেরিয়ে এসে রণজিৎ কাকাবাবু আকাশের দিকে পিস্তল উঁচিয়ে কী যেন চিৎকার করছেন।

ঘটনা জানা গেল পরে। রণজিৎ কাকাবাবু টেবিলে কী কাজ করছিলেন। হঠাৎ দুটো ছেলে এসে ঘরে ঢুকে ওঁর পিস্তলটা চাইল। কাকাবাবু মাসিকে বললেন, ‘ওটা তো মনে হচ্ছে তোমার কাছে। দ্যাখো তো আলমারিতে আছে কি না!’ মাসিমা জানেন সেটা তাঁর কাছে নেই, তবু কাকাবাবুর দিকে তাকিয়ে চাবির গোছা নিয়ে আলমারি খুলে হাঁটকাতে লাগলেন। একটি ছেলে ছুরি ধরে মাসিমার পাশে দাঁড়িয়ে। অন্য ছেলেটি কাকাবাবুর সামনে পিস্তল তাক করে দাঁড়িয়ে আছে। কাকাবাবু বললেন, ‘তোমাদের তো গুলিও লাগে, তাই না?’ ড্রয়ার খুলে কিছু গুলি মাটিতে ছড়িয়ে দিলেন। ছেলেটি দ্রুত গুলি কুড়াতে কুড়াতে একটা শব্দ পেয়ে মুখ তুলে তাকাতেই কাকাবাবু গুলি করলেন। ভিতরের ঘরের ছেলেটি গুলির শব্দ শুনে ছুটে পালাল। অন্যজনও ছুটল মাঠের দিকে, পেছনে কাকাবাবু। ছেলেটির গুলি লেগেছিল, তবু সে মাঠের পুব দিক দিয়ে ছুটে পরের রাস্তার এক বাড়ির বাগানে ঢুকে পড়ল। কাকাবাবু অবশ্য তার পেছনে আর যাননি।

সেদিনকার খবর ওই পর্যন্ত। পরদিন শুনি, ছেলেটি বাগানে ঢুকে একটা ঝোঁপের আড়ালে গিয়ে প্যান্ট বদল করছিল, সেখানেই মরে পড়ে রয়েছিল! আইসিএস কাকাবাবুর হাতের টিপ ছিল অব্যর্থ। ছেলেটির বাঁচবার উপায় থাকেনি।

‘ধ্বনি থেকে কবিতা’ নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে language পত্রিকার একটি সংখ্যায় ‘The Phonemes of Bengali’ নামের এক প্রবন্ধ পেলাম। লেখক দুজন। একজন আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুনীর চৌধুরী, অন্যজন ভাষাবিজ্ঞানী চার্লস এ ফাগুসন। বাংলা স্বরধ্বনি বিষয়ে অনেক নতুন তথ্য সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের কিছু ইংরেজি বই থেকে পাচ্ছিলাম, এ প্রবন্ধে আরও স্পষ্টভাবে পেলাম। দিনটা ছিল মঙ্গলবার। বুধবার ওখানকার সাপ্তাহিক ছুটি। বইটি হাতছাড়া করতে প্রাণ চাইছিল না। ছুটি হয়ে গেছে। আমি আর লাইব্রেরি থেকে বেরোতে পারি না! ডেপুটি লাইব্রেরিয়ান ছিলেন বীরেন বন্দ্যোপাধ্যায়। উনি আমার ও রকম ন যযৌ ন তস্থৌ দশা দেখে কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী, বইটা ওভার নাইট ইস্যু করে দিয়ে দেব? নিয়ে যাবে?’ হাতে স্বর্গ এল! বীরেনদা আমাদের মোহরদির (কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়) বর। আমার জন্যে কেন যে ওঁর এত মায়া ছিল!

একবার গরমের ছুটিতে মোহরদি কোথাও বেড়াতে গেছেন। নটা কি দশটার দিকে রতন কুঠির ফোনে বীরেনদা আমাকে ডাকলেন। ‘কী হে কী করছ? চলে এসো, দুপুরে খাবে। গাছের আম পেকেছে, ওদিকে কেউ নেই যে খাবে।’ ওঁর বাড়ির রান্না এত ঠান্ডা আর। সুস্বাদু–সে তো ভালো কথা! আমটাই যা মুশকিল। কিচেনের গণরান্না খেতে খেতে সারাক্ষণই পেটটা নরম। যা হোক, বীরেনদার আদরের ডাক, যাব তো নিশ্চয়ই! ঠান্ডা ঝোলকে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত নাকি বলতেন স্নিগ্ধ ঝোল। চমৎকার সেই বিবরণ!

ঝোল ভাত খাওয়া হতেই এল আমের থালা। কোনো রকম একটা আম খাওয়া শেষ করে উঠতে যাব আর বাজ পড়ল ঘরে—’এই আম খাওয়া!’ কষ্ট করে ডেকে এনেছেন আমাকে, আর আমি কিনা আম ফেলে উঠে পড়ছি! ম্যাও ম্যাও করে পেটের অসুবিধার কথা বললাম। বললেন, আমার সঙ্গে উপরে চলো। ইজিচেয়ারে এলিয়ে বসবে, আর আমি পাঁচ মিনিটের জন্যে বালিশে মাথা রেখেই উঠে পড়ব, গল্প হবে। কাঠের পাটাতন পাতা সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলার ঘরে ঘুমাতেন বীরেনদা। গেলাম পিছু পিছু। ওমা! বালিশে মাথা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই শুনি নাকডাকা শুরু হয়ে গেল। হেসে বাঁচি না। তা মিনিট দশেক বাদে নাকডাকা থামিয়ে উঠে পড়লেন বীরেনদা। শুয়ে শুয়ে টুকটাক কথাবার্তা চালাতে লাগলেন। মোহরদির গল্পই বেশি। কিছু ভক্ত গোরার কথা। দেখতাম গোরার জন্যে দুজনেরই খুব টান ছিল। ‘আনন্দধারা’ বাড়িটা গোরা আর মোহরদির দুজনেরই। সেটা বোঝাবার জন্যে বিছানা ছেড়ে উঠে দেখালেন বাড়ির মাঝখান। দিয়ে কেমন একটা ফাঁক রাখা হয়েছে।

মোহরদিকে তো সারাক্ষণ ‘গোরা, গোরা’ করতেই দেখতাম। আবার বীরেনদার জন্যেও তাঁর কাতরতা দেখেছি। একবার ঢাকাতে বীরেনদা গেছেন নিউমার্কেটে, আর সবাই হইহই গপ্পো করছে। হঠাৎ ঝপঝপিয়ে বৃষ্টি নেমে গেল। মোহরদি সবাইকে তিরস্কার করে বললেন, ‘খুব তো সব গপ্পো আর মজা করছ! ওদিকে তোমাদের বীরেনদা যে ভিজে যাচ্ছে!’ কণ্ঠস্বরে বেজায় উৎকণ্ঠা! আমার বড় অবাক লেগেছিল। বীরেনদার জন্যে ও রকম উদ্বেগও আছে আবার!

এক বিস্ময়কর রূপমুগ্ধতা মোহরদির মনকে আচ্ছন্ন করে রাখত। গোরার মুখের দিকে, মমিত্ নামের আর এক ছেলের মুখের দিকে বিভোর হয়ে চেয়ে থাকতে দেখেছি তাঁকে। গোরার গান ভালো লাগত না আমাদের। চেহারাতেও ‘আহামরি! কিছু খুঁজে পেতাম না। মোহরদি গান দিয়ে কারও বিচার করতেন না, দেখতেন চেহারা। মেয়েদেরও কারও কারও স্কিন কত ভালো এসব বলাবলি করতেন। শুনেছি। আর এক মোহ ছিল বিদ্যার। বীরেনদা যখন তাকে বিয়ে করবেন, তখন উনি বিএ পাশ, শুনেই মোহরদি প্রায় মূৰ্ছা যান! হবে না? গল্প শুনেছি, রবীন্দ্রনাথ মোহরদিদের ক্লাস নিচ্ছিলেন, সবাইকে লিখতে দিলেন। পরদিন ক্লাসে খাতা খুলে খুলে দেখে সবাইকে কার কেমন হয়েছে বলতে গিয়ে এক খাতা পেলেন–আগাগোড়া সাদা, কোথাও কালির আঁচড়টিও নেই। সে এক মোহরদির খাতাই হতে পারে, সে তো ক্লাসের সবাই জানে!

মোহরদির ছোট ভাই পানু খুব ভালো টিভি সারাইয়ের কাজ বুঝত। কিন্তু ওর স্বভাবটাতে দোষ ছিল। মোহরদি তাঁর বাড়িতে পানুর আসা-যাওয়া পছন্দ করতেন না। একদিন সংগীত ভবনের ক্লাস সেরে বাসায় ফিরে দেখেন পানু বেরিয়ে যাচ্ছে! বীরেনদা তাকে বিদায় দিচ্ছেন। ঘরে ঢুকে মোহরদি তো ‘খাব খাব করে বীরেনদাকে ধরেছেন। কেন ওকে আমার বাড়িতে ডেকেছ?’ বীরেনদা এড়িয়ে দোতলায় উঠতে যাচ্ছেন, মোহরদি তো ছাড়বেন না! শেষে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে বীরেনদা বলছেন, তুমি তো আমার বউ’। মোহরদি চেঁচাচ্ছেন, না বউ না। তখন বীরেনদা সিঁড়িতে পা দাপিয়ে বলছেন, হ্যাঁ, আমার বউ’। মোহরদি, না, বউ না’! সে এক মজার দৃশ্য। হাসতে হাসতে বাঁচি না!

নৃপেন বন্দ্যোপাধ্যায়-বেলা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যা ফিজিকসে অনার্স পড়ছিল শান্তিনিকেতনে। শ্রীভবনে এক বিকেলে ওকে দেখতে গিয়ে শুনি জ্বর হয়েছে। বায়না ধরল ‘মাসি, আমি তোমার সঙ্গে যাব। সুধাদি বললেন, ‘তুমি নিয়ে যাবে তার অসুবিধা কী! তবে ওদের ছাত্র উপদেষ্টাকে একটু বলে নাও। যে করেই হোক, শান্তিনিকেতনে তখন আমার ওপরে আস্থা রয়েছে সবার। অনুমতি নিয়ে স্কলার্স ব্লকে নিয়ে এলাম ওকে। দিন দুই দেখে বড় ডাক্তরবাবুকে খবর দিলাম। উনি এসে পরীক্ষা করে বললেন, ব্লাড টেস্ট করতে দিন, টাইফয়েড হলো কি না দেখা দরকার। টাইফয়েডই হয়েছে জেনে ভয় পেলাম। ওর বাবা-মাকে খবর দেওয়া জরুরি। কী করি!

শেষে বীরেনদাকে ফোন করলাম, ‘কেমন করে খবর দিই কলকাতায়?’ বললেন, ‘গেস্টহাউসের লোকদের ফোন ধরতে বলো, আমি দেখছি। দিলাম, ওদের বলে দিলেন আমি রতনকুঠি থেকে কলকাতায় ফোন করব, বিল হবে বীরেনদার নামে। কে জানে এত সহজে সমাধান হতে পারে! বেলাদের ফোন করলাম। দেবরকে নিয়ে বেলা চলে এল শান্তিনিকেতনে। মেয়ের তখন অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। তাকে কলকাতায় নিয়ে যায় কী করে? ঠিক হলো, প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা চলছে, সেগুলো শেষ হলে বেলা ওকে কলকাতা নিয়ে যাবে ব্যবস্থা করে। পরীক্ষার সময় আমি সঙ্গে যাব, সিক বেডের পরীক্ষার্থীকে কমলা ছিলে, হরলিকস গুলিয়ে খাওয়াব দরকার মতো। এই প্ল্যানে যথাকৰ্তব্য শেষ করে মায়ের সঙ্গে মেয়েকে কলকাতা পাঠিয়ে মুক্তি পেলাম।

.

১৯.

বেলার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল বহুদিনের। একাত্তরে শান্তিনিকেতনে দেখা হলে বেলা জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি কি সেই সন্‌জীদা যে আমাকে চিঠি লিখেছিল ঢাকা থেকে? মনে পড়ল, ওপারের ছাত্রী সংঘের সাধারণ সম্পাদক বেলা বন্দ্যোপাধ্যায় একবার আমাকে চিঠি দিয়েছিলেন। ঢাকাতে ‘ছাত্রী সংসদ’ নামে একটি সংগঠনের সম্পাদক ছিলাম আমি। বেলা লিখেছিলেন, আমাদের সংগঠনকে ওঁদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করতে হবে। আমি একমত হইনি। ভিন্ন রাষ্ট্রের সংগঠনের সঙ্গে আমাদের যুক্ত হতে হবে কেন? তখন তো আমরা পাকিস্তানের অধিবাসী। সেই পত্রোত্তরের কোনো জবাব দেয়নি বেলা। বলবেই বা কী! তো সেই চিঠির কথাই সে বলছিল।

শান্তিনিকেতনে সুনীলদা, নৃপেন, শচীনদের সঙ্গে আগে একবার দেখা হয়েছিল। এবারে নৃপেন-বেলারা বাড়িতে ডেকে খাওয়াল। ভাব জমে গেল আরও। নৃপেন শান্তিনিকেতনের কাজ ছেড়ে কলকাতায় চলে গেলেও বন্ধুত্ব বজায় ছিল। কলকাতায় ওদের বাসাতেই উঠতাম আমি শান্তিনিকেতন যাওয়ার পথে। বেলাও শান্তিনিকেতনে কোনো কাজে গেলে আমার ঘরেই উঠত। মহাভাব হয়ে গেছিল আমাদের। একবার অনেক দিন শান্তিনিকেতন যাওয়া হয়নি বলে জানতেই পারিনি বেলা কবে মরে গেছে! নৃপেন ঢাকায় এসে এক রাতে আমার বাসায় খেতে এল। ‘বেলা কেমন আছে’ জিজ্ঞেস করতে নৃপেন বলল,

‘ও তো চলে গেছে’!

নৃপেন বেঁচে আছে এখনো। ওপারে গেলে বারকয় দেখা হয়েছে। তবে ইদানীং প্রয়োজন ছাড়া কলকাতায় যাওয়া বা কারও সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করা চলে না তো আর!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *