৫. চাণক্য সূত্র – পঞ্চম অধ্যায়

চাণক্য সূত্র – পঞ্চম অধ্যায়

পুত্ৰার্থা হি স্ত্রিয়ঃ ॥১॥
স্ব দাসী পরিগ্রহোহি স্ব দাসভাবঃ ॥ ২॥
উপস্থিত-বিনাশঃ পথ্য-বাক্যং ন শৃণোতি ॥ ৩॥
নাস্তি দেহিনাং সুখদুঃখাভাবঃ ॥৪॥

অনুবাদ : পুত্রোৎপদনের নিমিত্ত স্ত্রী গ্রহণ করবে। ১।

মর্মার্থ : পুত্রকামী ব্যক্তি ভার‍্যা গ্রহণ করবে, পুত্র দ্বারা ঐহিক সুখ ও পারলৌকিক পিতৃপুরুষগণের কার্য রক্ষা হয়। স্বীয় বংশের ধারা অব্যাহত থাকে। পুত্রহীন গৃহ অন্ধকারময়। ভার্যাসত্ত্বেও যার পুত্র জন্মে না, তার জীবন এক প্রকার শাপগ্রস্ত বলা যায়। কারণ আত্মজেয় মাধ্যমেই মানুষ জীবিত থাকে। সেই আত্মজ লাভ না ঘটলে নিজের বিনাশের সঙ্গেই সমস্ত শেষ হয়ে যায়। ১।

অনুবাদ : নিজের পরিচারিকাকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করলে স্বীয় দাসত্ব প্রকাশ পায়।

মর্মার্থ : হীন সমাগমে উচ্চ ব্যক্তিরও হীনতার উপচয় হয়। কুৎসিত কার্যে রত হলে উচ্চপদস্থকে যেমন হীন হতে হয়, তদ্রুপ নিজ দাসীতে আসক্ত হলে কিংবা তার পাণিগ্রহণ করলে, তাকেও দাসভাব গ্রহণ করতে হয়। কারণ দাসীর পতি দাসই হয়। ২।

অনুবাদ : যার বিনাশ উপস্থিত, সে হিতবাক্য শুনতে চায় না। ৩।

মর্মার্থ : মানব, বিপদ রোগ, শোক প্রভৃতিতে অধীর হলে হিতবাক্য শ্রবণে পরাখে হয়। যার পতন অবশ্যম্ভাবী, সে সুহৃদজনের হিতোপদেশ শুনতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু মানুষের কর্তব্য হলো, যেকোনো দুরবস্থা হোক না কেন, হিতোপদেশ শুনতে ইচ্ছা করে, সে সময় অসীম ধৈর্যসহকারে কৌশল ও উপায় দ্বারা বিপদ হতে ত্রাণ পাওয়ার চেষ্টা করবে। দৈব দুর্বিপাকে পতিত হলে, তখন সুহৃদজনের হিতোপদেশই উদ্ধারের একমাত্র পথকেই কবি বলেছেন, যে হিতজনের বাক্য শোনে না, সে কুৎসিত প্রভু। ৩।

অনুবাদ : দেহি জীব মাত্রই সুখ-দুঃখভাগী হয়। ৪।

মমার্থ : জীব মাত্রই সুখ-দুঃখ ভোগ করে থাকে। সেই ধারণ করে কেহই নিরবচ্ছিন্ন সুখী অথবা দুঃখি হতে পারে না। তার সুখের সঙ্গে দুঃখভোগও নিশ্চিত। নানা উপায়ে সাময়িক দুঃখের হাত হতে অব্যাহতি পেলেও পুনঃদুখান্তরভাগ করতে হবে। দুঃখ নিয়ত বিদ্যমান, তার পরিহারে উদ্যোগই পুরুষার্থ। এই নিমিত্ত ন্যায় দর্শনে সুখ ছেড়ে দুঃখের উল্লেখ ও তার উচ্ছেদের কথা বলেছেন। ৪।

মাতরমিব বৎস্যাঃ সুখদুঃখানি কর্তারমেবানুগচ্ছন্তি ॥ ৫ ॥
তিলমাত্রমপ্যুপকারং শৈলমাত্রমিবন্যন্তে সাধবঃ ॥ ৬ ॥
উপকারোহনাৰ্য্যে স্বকর্তব্যঃ ॥৭॥

অনুবাদ : যেরূপ বৎসগণ স্ব-স্ব জননীর অনুগমন করে, সেরূপ সুখ ও দুঃখ তৎকর্তার অনুসরণ করে। ৫।

মর্মার্থ : জগতে সুখ-দুঃখ ভিন্ন জীবনধারণ করতে কেউ পারে না। স্তন্যপায়ী শিশুগণ যেরূপ আশ্রয় লাভের জন্য নিজ নিজ জননীর অনুধাবন করে, সেরূপ সুখ ও দুঃখও যেন আশ্রয় লাভের জন্যই প্রতিনিয়ত মানুষের দিকে ছুটে যাচ্ছে। তাই কোনো মানুষই কোনো অবস্থায় সুখ বা দুঃখের হাত থেকে অব্যাহতি পেতে পারে না। তবে সুখ পাবে কি দুঃখ পাবে, তা মানুষের কার্যের উপর নির্ভর করে। তাই সূত্রকার বলেছেন, কর্তারমনুধাবন্তি। অর্থাৎ যেমন কার্য করবে, সেই অনুসারে সুখ বা দুঃখ ভোগ করতে হবে। সকার্য করলে সুখ আসবে, আর বিপরীত কর্মে তার বিপরীত দুঃখ আসবে জীবকেও বিপর্যস্ত করতে। ৫।

অনুবাদ : সাধুগণ তিলমাত্র উপকারকে পর্বত পরিমাণ মনে করেন। ৬।

মর্মার্থ : উপকার ও প্রত্যুপকার করা সকলের পক্ষে ঘটে না। অনেকে উপকার লাভ করে প্রত্যুপকার করতে পারে না, কিন্তু উপকার সকলেই প্রার্থনা করে। জগতে প্রত্যুপকার বড়ই দুলভ, সজ্জনগণ বিন্দুমাত্র উপকার পেয়ে তাকে মহোপকার বলে মনে করেন। দুর্জন ব্যক্তি উপকার লাভ করেও স্বীকার করতে সমর্থ হয় না। ৬।

অনুবাদ : অনার্যের (নীচাশয় বা অধম ব্যক্তির উপকার করবে না। ৭।

মর্মার্থ : যারা উপকার প্রার্থী ও উপকারের তত্ত্ব বুঝে এবং প্রত্যুপকার করতে সমর্থ, এইরূপ লোকের উপকার করা বিধেয়। নীচ, কর, গহিত প্রকৃতি লোকের উপকার বা হিতসাধন করলে তাতে কোনো ফলোদয় হয় না, প্রত্যুত বিপরীত ফল হয়। (অনার্য) কুটিলমতি পুলিন্দ, কিরাত, শবর, পামর প্রভৃতি) কিন্তু পরস্পরের মধ্যে উপকার করা অভ্যাস না থাকলে, সমাজ অবনত হয়ে পড়ে। তথাপি নীচ প্রকৃতির ব্যক্তিদের সম্পর্কে উপকার করা সম্পর্কে সাবধান হতে হয়। কারণ তারা উপকারে কদৰ্থ-করে অপকারই করে থাকে। ৭।

প্রত্যুপকারভয়াদনাৰ্যঃ শত্ৰুৰ্ভবতি ॥ ৮ ॥
স্বল্পমপ্যুপকারকৃতে প্রত্যুপকারষ্কৰ্তমাৰ্য্যেনস্বপিতি ॥ ৯ ॥
নকদাপি দেবতা অবমন্তব্যা ॥ ১০
নচক্ষুঃ সমং জ্যোতিরত্তি ॥ ১১ ॥

অনুবাদ : প্রত্যুপকার করার ভয়ে নীচে প্রকৃতি ব্যক্তি শত্রু হয়। ৮।

মর্মার্থ : উপকারকের প্রত্যুকার করা লোকের স্বাভাবিক কার্য। কিন্তু যারা। নীচাশয়, কুটিল প্রকৃতির লোক, তারা প্রত্যুপকারের পরিবর্তে শত্রুতা করে থাকে। তাদৃশ প্রপঞ্চকের উপকার করে কোনো ফললাভ হয় না। উপকার করার ক্ষেত্রে লোক বুঝে করতে হয়। বিশেষত যারা নীচাশয় তারা সাধারণত কৃতঘ্ন হয় এবং তাদের কৃতজ্ঞতাবোধ থাকে না। তাই তারা উপকারীর বিনাশ করতেই যত্নশীল হয়। সে কারণে নীচ শয়দের শান্ত করার জন্য উপকারের পরিবর্তে অপকার করাই বিধেয়। ৮।

অনুবাদ : আর্য ব্যক্তি উপকারীর প্রত্যুপকার অল্পমাত্রায় ও বিস্মৃত হয় না (১) আর্যজনের অল্পমাত্র উপকার করলেও সে প্রত্যুপকার না করে নিদ্রা যায় না (২)।

মর্মার্থ : উপকার অল্পই হউক, বহুই হইক, তার প্রত্যুপকার করতে বিস্মৃত হওয়া উচিত নয়। উপকার ও প্রত্যুপকার দ্বারা সমাজের কল্যাণ হয়। প্রত্যুপকার না করলে কৃতঘ্ন ও প্রতারক হয়। উপকার দ্বারা পরহিত এবং সুকীতি ও দানশক্তি বৃদ্ধি পায়, তা মহতের একটি লক্ষণ । ৯।

অনুবাদ : কখনো দেবতা প্রভৃতির অবমাননা করা উচিত নয়। ১০।

মর্মার্থ : যা আদর্শ ও মান্যস্থল, তার প্রতি অবজ্ঞা করলে সুশিক্ষা ও সদ্যচারলাভে বঞ্চিত হতে হয়। দেবতা, রাজা, গুরু মহাজন এদের আদেশ এবং কার্যের প্রতি কখনো অবজ্ঞা করা উচিত নয়। সেরূপ কার্যে প্রবৃত্ত হলে নিজের ও সমাজের প্রভূত ক্ষতি হয়। দেবতা, গুরুজন ও শ্রদ্ধেয়দের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা সুশিক্ষা ও মানবিকতার পরিচয়। ১০।

অনুবাদ : চক্ষুর তুল্য জ্যোতি নেই। ১১।

মমার্থ : মানুষের চক্ষু দ্বারা সকল বস্তু দর্শন হয়, চক্ষুহীন ব্যক্তি মণি, মুক্তা, কাঞ্চনাদি দ্বারা বিভূষিত হলেও শোভিত হয় না। অন্ধ ব্যক্তি বাইরের অনন্তলোক কখনো দেখতে পায় না। তার মানসিক শক্তি দ্বিগুণ হয় বলে অন্ধের স্মৃতি ও মেধা বিশেষ প্রবল হয়। কখনো অতি প্রবল স্পর্শ শক্তি দেখা যায়। অধিক উত্তাপ, পারদসেবন, শুক্রবিকার, কুষ্ঠাদি রোগে দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়ে যায়। অপরিমিত ইন্দ্রিয়-ব্যভিচার দর্শন শক্তিনাশের প্রধান হেতু। ১১।

চক্ষুশিরীরিণাং নেতা ॥ ১২ ॥
অপচক্ষুষ: কিং শরীরেণ ॥ ১৩ ॥
নাপ্ত মূত্রং কুৰ্য্যাৎ ॥ ১৪ ॥
ন নগ্নঃ প্রবিশেজ্জলমা ১৫।
যথা শরীরং তথা জ্ঞানম্ ॥ ১৬ ॥

অনুবাদ : শরীরধারী জীবগণের চক্ষুই নেতা। ১২।

মর্মার্থ : বস্তুর রূপদর্শনের চক্ষুই মানবের একমাত্র কারণ, যার দুটি চক্ষু নাই, সে অন্ধ, যার এক চক্ষু নেই, সে কাণ’ বলে প্রসিদ্ধ। নায়ক যেরূপ শুভকর কার্যে লোকসমূহকে পরিচালনা করে থাকে, দ্রপ চক্ষুও রূপাদি গ্রহণপূর্বক বিষয়সমূহে লোককে প্রেরণ করে। প্রগাঢ় অন্ধকারে চক্ষু থাকা সত্ত্বেও বস্তুগত মহত্ত্ব আলোকঃ সাহায্য, অদূরতা প্রভৃতি দ্রব্য প্রত্যক্ষের অপেক্ষা করে। ১২।

অনুবাদ : দৃষ্টিশক্তিহীন ব্যক্তির শরীরভার বহন করা বৃথা। ১৩।

মর্মার্থ : যার চক্ষু দৃষ্টিশক্তিহীন, সে ব্যক্তি জগতে নিজ শরীর দ্বারা ইচ্ছানুরূপ কোনো কাজ করতে পারে না। তার শরীর, চালকশূন্য যানের ন্যায় বৃথা হয়। নানা কারণে চক্ষুঃ দৃষ্টিশূন্য হয়। জন্মান্ধের কোনো চিকিৎসা নেই। সাময়িক নেত্ররোগের চিকিৎসা আছে। আয়ুর্বেদে চক্ষু চিকিৎসা বিশেষভাবে উক্ত আছে। ১৩।

অনুবাদ : জলে মূত্র ত্যাগ করবে না। ১৪।

মর্মার্থ : মানবমূত্র বিষাক্ত, মানবের ভুক্ত ও পীতদ্রব্যের অপকৃষ্টাংশ মূত্ররূপে নির্গত হয়। তা পবিত্র জলে ও পরিষ্কৃত বাসস্থানাদিতে ত্যাগ করলে নানা রোগেৎপত্তি ও স্বাস্থ্যহানি ঘটে। মূত্র অতিশয় দুর্গন্ধ, সে দুগন্ধ অসহনীয়। অতএব জীবের জীবনসদৃশ জলে মূত্রত্যাগ নিষিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু গোমূত্র দ্বারা কোনো কোনো দুষ্টস্থান নির্দোষ হয়। ১৪।

অনুবাদ : নগ্নাবস্থায় জলে প্রবেশ করবে না। ১৫।

মর্মার্থ : বিবস্ত্র হয়ে শয়ন, শ্রীদর্শন, জলে নিমজ্জন, ভোজন প্রভৃতি অনুচিত। জলে বিবসন হয়ে প্রবেশ করলে, জলজতু আক্রমণ করতে পারে। জলের স্বচ্ছতাও নষ্ট হয়। জলে মলমূত্র ত্যাগের সম্ভাবনাও থাকে। নগ্নাবস্থায় দেহের সৌষ্ঠব হানিকর এবং কুৎসিত দৃশ্য ইন্দ্রিয় বিশেষের চাঞ্চল্য বর্ধক ও রোগের হেতু। ১৫।

অনুবাদ : যার যেরূপ শারীর-শক্তি তার জ্ঞানও তদ্রুপ। ১৬।

মর্মার্থ : শরীরের শক্তির তারতম্যানুসারে সাধারণ জ্ঞানের পার্থক্য হয়। শরীর নীরোগ ও পুষ্ট হলে জ্ঞানক্রমে বর্ধিত হয়। শরীর রুগ্ন জীর্ণ হলে জ্ঞান বা বুদ্ধিবৃত্তি বিপর্যস্ত ও হ্রাস পায়। জ্ঞান নানা প্রকার বিষয়জ্ঞান, বিজ্ঞান (পদার্থ তত্ত্বের সূক্ষ্মভাবে পরীক্ষণ দ্বারা তার সংযোগ ও বিয়োগ সংঘটনে যে অভিনব বস্তু প্রকাশ হয়, তার নাম বিজ্ঞান।)। পরমেশ্বর বিষয়ে যে জ্ঞান, তা তত্ত্বজ্ঞান। এক বস্তুতে অন্য বস্তুজ্ঞান মিথ্যাজ্ঞান। যথাযথ জ্ঞানের তুল্য পবিত্র কিছুই নেই। ১৬।

যথাবুদ্ধি স্তথা বিভবঃ ॥ ১৭ ॥
অগ্নাবগ্নিং ন নিক্ষিপেৎ ॥ ১৮ ॥
পরদারান মনসাপি নগচ্ছেৎ ॥ ১৯ ॥
তপস্বিনঃ পৃজনীয়াঃ ॥ ২০ ॥
অন্নদাং ভ্রুণহত্যামপি মাৰ্টি ॥ ২১ ॥

অনুবাদ : যার যেরূপ বুদ্ধি, তার সেরূপ সম্পত্তি হয়। ১৭।

মর্মার্থ : বুদ্ধিমান ব্যক্তি অতি দরিদ্র হলেও সে বুদ্ধিবলে প্রচুর ধনার্জন করতে সমর্থ হয়। বুদ্ধিহীন ব্যক্তি সঞ্চিত প্রচুর অর্থ অর্জন করে কীর্তিমান হয়। তার কার্যক্ষেত্রে পরাভবও বিরল। অতএব বুদ্ধ্যনুসারেই সম্পত্তি থাকে। ১৭।

অনুবাদ : অগ্নিতে পুনঃ অগ্নি নিক্ষেপ করবে না। ১৮।

মর্মার্থ : প্রজ্বলিত অগ্নিতে পুনঃ অগ্নি সৃষ্টিকারী বস্তু প্রদান করলে, তা দ্বিগুণ হয়ে অদাহ্যকেও দাহ করতে পারে। সেরূপ রাগান্ধ ও নেশাসক্তকে ক্রোধ এবং মদ্যপানাদিতে উৎসাহিত করবে না। বিবাদে শান্তি কামনা করবে, তা জটিল করে তুলবে না। অধর্ম ও পাপ বুদ্ধির চেষ্টা করা ও ঠিক নয়। ১৮।

অনুবাদ : পরস্ত্রীতে মনের দ্বারাও গমনের ইচ্ছা করবে না। ১৯।

মর্মার্থ : পরস্ত্রী গমনের বাসনা করাও পাপজনক, যে কোনো বিষয়ে প্রবৃত্তি হয়, তা মনের ব্যাপারপূর্বক দেখা যায়। মনের অগোচরে হয় না। পরদারোভিমৰ্ষণ কার্যত নীতিবিরুদ্ধ এবং পাপজনক এইরুপ নয়, মানসিক যে প্রবৃত্তি হওয়াও অন্যায়। তদ্ দ্বারা দুর্নাম, সামাজিক ক্ষতি, রাজদণ্ড, অবনতি অনিবার্য। একবার চরিত্র কলুষিত হলে পুনঃ তার সংস্কার করা কঠিন। ১৯।

অনুবাদ : তাপসগণ নিয়ত পুজনীয়। ২০।

মর্মার্থ : যার দর্শনেই মন পবিত্র হয়, শান্তির উদয় হয়, সে শুভপ্রদ ব্যক্তি অবশ্যই পূজনীয়। তাপস, ভিক্ষুক দণ্ডী ইহা সেবনীয় ও পূজনীয়, এদের তপঃ প্রভাবে সমাজের প্রভূত কল্যাণ সাধিত হয়। এদের কার্য ও স্থান লোকের পরম হিতও মঙ্গলজনক। দর্শন শ্রবণে কোনোরূপ হিংসা দ্বেষের উদ্রেক হয় না। ২০।

অনুবাদ : অন্নদান দ্বারা ক্রুণহত্যার পাপ বিনষ্ট হয়। ২১।

মর্মার্থ : দান দ্বারা পরোপকার এবং ধর্ম হয়, সেই দান নানা বিষয়ে বহুবিধ। সকল দানের মধ্যে বর্তমান যুগে অন্নদানই শ্রেষ্ঠ। অন্নদান দ্বারা নিরন্নের জীবন রক্ষা ও ভূণহত্যাজনিত পাপ হতে অব্যাহতি পাওয়া যায়। অন্ন দ্বারা জগতের সকল প্রাণী জীবন ধারণ করতে সমর্থ হয়। দারূপ ধর্ম দ্বারা পাপ মুক্ত হওয়া অবশ্যই সম্ভব। ২১।

নবেদ-বাহ্যোধর্মঃ ॥ ২২ ॥
ন কদাচিদপি ধর্মংনিষেধয়েৎ ॥ ২৩ ॥
স্বর্গৎ নয়তি সুনৃতম্ ॥ ২৪ ॥
নাস্তি সত্যাৎ পরন্তপঃ ॥ ২৫ ॥
সত্যং স্বর্গস্য সাধনম্‌ ॥ ২৬ ॥

অনুবাদ : যা বেদ বহির্ভূত, তা ধর্ম নয়। ২২।

মর্মার্থ : যাতে মানবের ঐহিক সুখ-শান্তি, পরকালে শ্রীভগবৎ প্রাপ্তি ঘটে, তাই ধর্ম। ধর্মানুষ্ঠানে মানব চরিত্রবান, উন্নত ও মাননীয় হয়। ধর্মহীন মানবহৃদয় নানা দোষের আকর। সে ধর্ম দেববিহিত। যা বেদ বিরোধী, তা অধর্ম নামে প্রসিদ্ধ। ধর্ম দ্বারা লোক ও সমাজ অবিরোধ সত্য, শান্তিলোভে সমর্থ হয়। ২২।

অনুবাদ : কখনো ধর্মাচরণে নিষেধ করবে না। ২৩।

মর্মার্থ : ধর্ম হতে মানবের সুখ-শান্তি লাভ হয়, কখনো ধর্মের প্রতিষেধ উচিত নয়। অধর্মে বিবাদ, হিংসা, প্রতারণা লোভ, মিথ্যা বৃদ্ধি পায়। ধর্ম দ্বারা সে সমুদয়ের নিবৃত্তি হয়ে সুশৃঙ্খলায় সমাজ পরিচালিত হয়, অতএব ধর্মের প্রতিষেধ করা উচিত নয়। ধর্মহীনের পতন নিশ্চিত। ২৩।

অনুবাদ : সুনৃত (সত্য) লোককে স্বর্গে নিয়ে যায় (১) সৃকৃত (পুণ্য) কর্ম দ্বারা স্বর্গলাভ হয়। (২) ২৪।

মর্মার্থ : সত্যের ফল স্বর্গপ্রাপ্তি, সত্যপরায়ণ ব্যক্তি ধার্মিক বলে প্রসিদ্ধ লাভ করে। ধর্ম পরায়ণের স্বর্গলাভ অনিবার্য। অধর্ম ও অসত্যপরায়ণ ব্যক্তি নরকে গমন করে থাকে। অথবা সুকৃত পুণ্য–পুণ্যকর্ম দ্বারাও স্বর্গীয় নিত্য সুখলাভ অবধারিত, সত্যপরায়ণ ব্যক্তি বিশ্বাসভাজন হয়ে সকল কার্যে সাফল্য লাভ করে। ২৪।

অনুবাদ : সত্য হতে শ্রেষ্ঠ তপ নেই (সত্য পালনই পরম তপস্যা) ২৫।

মর্মার্থ : লোকসমাজে সত্য প্রচারিত ও ব্যবহৃত হলে, সেরূপ সমাজে কার্যসমূহেঁ কোনো বাধাবিঘ্ন হয় না, পরস্পর বিশ্বাস দ্বারা অনায়াসে বহু কঠোর কার্য সাধন করা যায়। সত্যে হিংসা, দ্বেষ, বিবাদে নেই, তাই সত্য সকল তপের শ্রেষ্ঠ বলে বিশ্ববিখ্যাত। ২৫।

অনুবাদ : সত্য, স্বর্গের সাধনস্বরূপ। ২৬।

মমার্থ : সত্য পালন, স্বর্গলাভের একটি শ্রেষ্ঠ উপায় সত্যাচরণশীল তার বলে অক্লেশে স্বর্গে গমন করতে সমর্থ। বেদান্তিগণ সত্যকে পরমব্রহ্মের স্বরূপ বলেছেন। লোকসমাজে সত্যশীল ব্যক্তি বিশ্বস্ত ও শ্রদ্ধেয়। ২৬।

সত্যেন ধাৰ্যতে লোকঃ ॥ ২৭ ॥
সত্যাদ্দেবোবৰ্ষতি ॥ ২৮ ॥
নানৃতাৎ পরং পাপম্ ॥ ২৯ ॥
ন মীমাংসা গুরবঃ ॥ ৩০ ॥

অনুবাদ : সত্য দ্বারা সকল লোক বিধৃত আছে। ২৭।

মর্মার্থ : লোক ব্যবহার সত্যমূলক হলে অনায়াসে মানব সংসার যাত্রা নির্বাহ করতে সমর্থ হয়। সত্যশূন্য সকল ব্যবহার, বিবাদ ও দুঃখের আকর। সত্যহীন কার্যে প্রতারণাঃ প্রবঞ্চনা, চৌর্য প্রভৃতি প্রকটিত হয়। অতএব সত্যই লোকসমূহের বিধারক হতে সমর্থ। ২৭।

অনুবাদ : সত্য প্রভাবে দেবতা বারি বর্ষণ করে। ২৮।

মর্মার্থ : দেশ, সমাজ উদ্বেগহীন ও সত্য পালন তৎপর হলে শান্তি বিরাজ করে। শান্ত জনমণ্ডলী ধর্মপরায়ণ হয়, তাতে যথাকালে বৃষ্টি দ্বারা প্রচুর শস্য উৎপন্ন হয়। দেবারাধন ভিন্ন দেবতা যথাকালে বর্ষণ করে না। বর্ষাভাবে শস্যাভাব ও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ২৮।

অনুবাদ : অসত্য ভাষণ অপেক্ষা পাপ নেই। ২৯।

মর্মার্থ : মিথ্যাভাষণ, মিথ্যাভিনিবেশ করতে অভ্যস্ত হলে সে ব্যক্তি ক্রমে অভ্যাসবশত সকল প্রকার গর্হিত কার্য করতে অভ্যস্ত হয়। মিথ্যাচরণ সমাজে প্রাবল্য লাভ করলে শাঠ্য, কাপট্য, প্রবঞ্চন, প্রতারণায় সমাজ পূর্ণ হয়ে অধঃপতনের দিকে ধাবিত হয়। অতএব অনৃত ভাষণ ও তাদৃশ কার্য অপেক্ষা বড় পাপ নেই। তবে বিবাহের জন্য গুরুর নিমিত্ত, রতিসংপ্রয়োগে অবৈধ প্রাণনাশ কালে, সর্বস্ব অপহরণে, ব্রাহ্মণ রক্ষার নিমিত্ত, গোরক্ষার্থ, অন্যের প্রাণার্থে মিথ্যা বলা যায়–ইহা শাস্ত্রকারগণের অভিমত। ২৯।

অনুবাদ : গুরুজনগণের বাক্য ও কার্যের মীমাংসা করতে যাবে না। (গুরু জ্ঞান, ধর্ম, চরিত্রোপদেষ্টা, রাজা, সাধু, বিদ্যায়, বয়সে ও গুণেজ্যেষ্ঠ, মহাজন প্রভৃতি)। ৩০।

মর্মার্থ : বিদ্যা, বয়স, গুণ দ্বারা যে প্রবীণ, সে বৃদ্ধ নামে প্রসিদ্ধ। তাদৃশ প্রাজ্ঞ ব্যক্তির বাক্যে ও কার্যে অজ্ঞের দোষ প্রদর্শন ও সেরূপ ব্যক্তির সঙ্গে তর্ক করতে যাওয়া অনুচিত। নিপুণ ব্যক্তি সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে যা যা করবে, দোষ প্রদর্শনের কথা দূরে থাকুক, অজ্ঞের পক্ষে তা বুঝে ওঠাও অতি কঠিন। অতএব অজ্ঞের পক্ষে প্রাজ্ঞের কার্য ও কথা অনুসরণ করাই বিধেয় বা সমীচীন। ৩০।

খলত্বং নোপেয়াং ॥ ৩১ ॥
নাস্তি খলসা মিত্রম্ ॥ ৩২ ॥
লোক যাত্রা দরিদ্রান বাধতে ॥ ৩৩ ॥
অতিশূরো দানশূরঃ ॥ ৩৪ ॥
ভূষণং গুরু-দেব ব্রাহ্মণেষু ভক্তিঃ ॥ ৩৫ ॥

অনুবাদ : খলতা অবলম্বন করবে না। ৩১।

মর্মার্থ : খলতা বা দুর্জনতার আশ্রয় গ্রহণ করলে, তাকে লোকে বিশ্বাস করে না। তাই নীতিবিদগণ বলেছেন, দুর্জন ব্যক্তি প্রীতিপূর্ণ বাক্য বললেও সে বিশ্বাসের পাত্র হয় না। খল প্রকৃতির লোক সকল কার্যেই বিবাদের সূচনা করে, তাতে কার্যহীন, পারস্পরিক অসম্প্রীতি ও বিচ্ছেদ জন্মায়। ৩১।

অনুবাদ : খল লোকের মিত্র থাকে না। ৩২।

মমার্থ : খল প্রকৃতিসম্পন্ন ব্যক্তি সকল সময়ে বিবাদের অনুসন্ধানে থাকে বলে কেউ মিত্র হয় না। সদ্বব্যবহারে মিত্র হয়, দুর্ব্যবহারে শত্রুতা জন্মে। বিবাদে ও হিংসায় বন্ধুর নাশ হয়, দুর্জন বহু কার্যে বিশ্বাসভাজন হয় না, তার সঙ্গে কোনো লোক বন্ধুতা ও প্রীতিসূচক ব্যবহার করতে চায় না। সুতরাং মানুষের শঠতা কপটতা প্রভৃতি দোষগুলো পরিহার করা উচিত। ৩২।

অনুবাদ : নিত্য লোকসমাগম দরিদ্র লোকের ক্লেশ দায়ক। ৩৩।

মর্মার্থ : লোকযাত্রা, বহুগোষ্ঠী, মহোত্সব, বিবাহ, দেবসেবা প্রভৃতি দিনের পক্ষে অর্থাভাব নিবন্ধন ও কার্য সম্পাদনে অশক্তি হেতু বিশেষ ক্রেশদায়ক। ধনীর পক্ষে সে সমুদয় বিশেষ সুখকর। দরিদ্র ক্ষুদ্র কার্যেই প্রীতি অনুভব করে। ৩৩।

অনুবাদ : দানকার্যে বীর ব্যক্তিই অতি শুর নামে খ্যাত। ৩৪।

মর্মার্থ : বীরজনোচিত দানকার্যে যার বিপুল খ্যাতি, সে ব্যক্তিই জগতে অতিশুর। কেবল দৈহিক বলে অধিক বলবান হলে শুর হয় না। যে যে বিষয়ে সকলের শ্রেষ্ঠ স্থান লাভ করে থাকে, সে, সে বিষয়ে শুর নামে খ্যাত হয়। বিশেষ করে দানকার্যে সাফল্য মানুষের পক্ষে বিশেষ শ্লাঘা। ৩৪।

অনুবাদ : গুরু দেবতা, ব্রাহ্মণের প্রতি ভক্তিই ভূষণ। ৩৫।

মর্মার্থ : ভক্তিতত্ত্ব সত্ত্বগণের উদ্রেকে প্রাদূর্ভূত হয়, শান্ত, স্থিরচিত্ত ভিন্ন ভক্তির উন্মেষ হয় না, দেবাদিতে বিশেষ অনুরক্তিতে হৃদয়ের উদ্বেগ, ত্রাস, অশান্তি প্রশমিত হয়। গুরু দেবতা, নূপ, গুণালঙ্কৃত বয়ঃবিদ্যাঃ বৃদ্ধের প্রতি স্বতঃই মানসিক ভক্তি প্রকাশ পায়। একই চিত্তের বৃত্তি সত্ত্বরজঃ তমঃগুণরূপ উপাদান তারতম্যে বিভিন্ন আকারে প্রকাশ পায়। ৩৫।

সৰ্ব্বস্য ভূষণং বিনয়ঃ ॥ ৩৬ ॥
আচারবান্ বিনীতকূলীনোহপি আৰ্য্যঃ ॥ ৩৭ ॥
আচারান্দায়ুৰ্ব্বদ্ধতে কীৰ্ত্তিশ্চ ॥ ৩৮ ॥
প্রিয়মপ্যহিতং ন বক্তব্যম ॥ ৩৯ ॥
বহুজন বিরুদ্ধমেকং নানুবৰ্ত্তেত ॥ ৪০ ॥

অনুবাদ : বিনয় সকলের অলঙ্কারস্বরূপ। ৩৬।

মর্মার্থ : বিনয়তুল্য গুণ দুর্লভ, বিনয়ী ব্যক্তির শত্রু, অল্পসংখ্যক। যেমন বিনয়ের দ্বারা সকলকে বশীভূত করা যায়, সেরূপ নানা বিপদ হতে ত্রাণ পাওয়া যায়। অবিনয়ও দ্বেষই বিবাদের হেতু। ৩৬।

অনুবাদ : সদাচারযুক্ত, বিনীত ব্যক্তি অকুলীন হলেও আর্যতুল্য। ৩৭।

মর্মার্থ : যার আচরণ নির্দোষ ও কার্যক্ষেত্রে বিনয় প্রকাশ পায়, এরূপ ব্যক্তি প্রশস্ত কুলজাত না হলেও কুলীদের সমান। কার্যক্ষেত্রে বিনয়, সৌজন্য, শিষ্টাচার দ্বারা কৌলীন্যের প্রকাশ ঘটে। আচার বিনয়, বিদ্যা, প্রতিষ্ঠা, তীর্থদর্শন, নিষ্ঠাবৃত্তি, তপ, দান এই নয়টি কুলীনের লক্ষণ। অকুলীন এই সকলের বিপরীত ভাবধারণ করে। ৩৭।

অনুবাদ : সদাচরণে আয়ু, কীর্তি বর্ধিত হয়। ৩৮।

মর্মার্থ : আচার, অনুষ্ঠানের দ্বারা মানবের কীর্তি ও আয়ু বৃদ্ধি পায়। নীতিশাস্ত্রোক্ত আচার ব্যবহার। পূর্বলিখিত বিষয়ে অবসন্ন হয়ে যদি পুনঃ লেখা সম্পাদন করে, পূর্বে সে অভিধেয় জিত হয়। তাকে প্রাগ ন্যায় বলে এটি বৃহস্পতির অভিমত। শাস্ত্রোক্ত আচার দ্বারা স্বাস্থ্য বর্ধিত হয়। তদদ্বারা ইন্দ্রিয় নির্মল ও বৃদ্ধি প্রখর হয়। স্বাস্থ্য ও বৃদ্ধির প্রখরতায় আয়ু অক্ষুণ্ণ থাকে। ৩৮।

অনুবাদ : প্রিয় হলেও যদি অহিতজনক হয়, তা বলবে না। ৩৯।

মর্মার্থ : বিষয়, লঘু গুরু জেনে এবং প্রিয় বা অপ্রিয় চিন্তা করে ব্যক্ত করা উচিত। অপ্রিয় সত্য, লোকের উদ্বেগ ও ক্রোধ বর্ধিত করে। প্রিয়বাক্য মিথ্যা হলে সমাজের অনিষ্টকর, কিন্তু এই প্রিয় ও মিথ্যা দুটি সমাজের প্রভূত কল্যাণ সাধন হলে সাময়িক ব্যবহার করা যেতে পারে, এটি রাজনীতিতে কোনো কোনো নীতিবিদের অভিমত। ৩৯।

অনুবাদ : বহু লোকের বিরুদ্ধ এক বিষয় বা মতের অনুবর্তন করবে না। ৪০।

মর্মার্থ : যা বহু লোকের বিরুদ্ধ, অর্থাৎ জনভিপ্রেত, তার অনুসরণ করবে । অর্থাৎ সেরূপ বিষয়ে মনোনিবেশ করা বা সেরূপ কার্য করা উচিত নয়। যাতে বহু লোকের ঐকমত্য হয়, সেরূপ বিষয়ের প্রতিকুলাচরণ করাও অনুচিত। তবে যা আপাতত বহু লোকের অনভিপ্রেত কিন্তু ভবিষ্যতে প্রভূত কল্যাণকর তার অনুসরণ করবে। ৪০।

ন দুর্জনেষু ভাগধেয়ং কর্তব্যম্‌ ॥ ৪১ ॥
ন কৃতার্থেষু নীচেষু সম্বন্ধঃ ॥ ৪২ ॥
ঋণাগ্নি-শত্ৰু-ব্যাধিশেষঃ ॥ ৪৩ ॥
ভূত্যনূবর্তনং পুরুষস্য রসায়ন ॥ ৪৪ ॥
নার্থিষু অবজ্ঞা কাৰ্য্যা ॥ ৪৫ ॥

অনুবাদ : দুষ্ট লোকের উপর নিজের ভাগ্য নির্ভর করা উচিত নয়। ৪১।

মর্মার্থ : ক্রুর ও দুষ্ট লোকের উপর নিজ ভাগ্যোন্নতির আশা করা অনুচিত। কারণ সে নিজের প্রিয়জনেরও হানি করতে পশ্চাৎপদ হয় না। গুণী হলেও দুর্জনকে ত্যাগ করবে’ এটি বৃদ্ধ চাণক্যে উক্ত আছে। দুষ্ট লোকের সহযোগে উন্নতি অপেক্ষা অবনতির প্রমাণই বিশেষভাবে আছে, যেমন অম্নের সংস্পর্শে থাকলে দুগ্ধও ছানা হয়ে যায়। ৪১।

অনুবাদ : সম্পাদিতার্থ নীচলোকের সহিত সম্বন্ধ রাখা অনুচিত। ৪২।

মর্মার্থ : যে ব্যক্তি কৃতকার্য হয়েছে, এরূপ হীনস্বভাব লোকের সঙ্গে সম্বন্ধ : করলে কার্যহানি ও ভাবী অনিষ্টের প্রচুর সম্ভাবনা থাকে। হীন প্রকৃতি ব্যক্তি স্বকার্য। সাধন করে, পরকার্যে কিংবা অন্যের উপকার সাধনে পরামুখ হয়। নীচ প্রকৃতির লোককে বিশ্বাস করাও অনুচিত। ৪২।

অনুবাদ : ঋণ (ধার), অগ্নি, শত্রু ও ব্যাধির শেষকে নিঃশেষ করা উচিত। ৪৩।

মর্মার্থ : ঋণ (যা পরে পরিশোধ করবে বলে গ্রহণ করা হয় তা), অগ্নিশ, অনিষ্টকারী, ব্যাধি, ধাতু বৈষম্যহেতু জাতপীড়া। এই সমুদয়ের শেষ রাখবে না, এদের পরিশেষকে নিঃশেষ করবে। অবশেষ থাকলে তা ক্রমে বর্ধিত হয়ে অনিষ্ট সাধন করে। ৪৩।

অনুবাদ : ঐশ্বর্যের অনুবর্তনে মানব রসায়ন ফললাভ করে। ৪৪।

মর্মার্থ : ধন দ্বারা লোক দৈহিক, মানসিক, ঐন্দ্রয়িক সুখ লাভ করে অতি মাত্রায় গর্বিত ও প্রফুল্ল হয়। তদ্রুপ বৈদ্যকোক্ত রসায়ন সেবনে শরীর মনের প্রফুল্লতাও নৈরুজ্য লাভে স্ফীত হয়। সুতরাং ঐশ্বর্য ও রসায়ন উভয়ই মানবের বৃহণজনক। তাদের সাম্যও নিশ্চত চরক, ভাব প্রকাশ প্রভৃতি গ্রন্থে রসায়ন প্রক্রিয়া বর্ণিত আছে। ৪৪।

অনুবাদ : যাচকগণের প্রতি অবজ্ঞা করা উচিত নয়। ৪৫।

মর্মার্থ : দরিদ্রের দুঃখ, সৈন্য প্রতীকারের উপায় ধনীর দান। দরিদ্রের অর্থ প্রার্থনা দেখে ধনীদের তার প্রতি অবজ্ঞা করা উচিত নয়। ধনবান অর্থ দ্বারা দীনের সাহায্য করলে দরিদ্র ও ধনবানের শারীরিক শ্ৰমাদি দ্বারা বিশেষ সহায়তাপূর্বক সমাজকে উন্নত করতে পারে। ধনীর সাহায্য ভিন্ন কোনো দীন সমাজ উন্নত হতে পারে না। ধনের উত্তম পরিণতি দান। ৪৫।

সুদুষ্করং কৰ্ম্ম কারয়িত্বা কৰ্ত্তারং নাবমন্যেত ॥ ৪৬ ॥
ন কৃতঘৃস্য নরকান্নিবর্তনম্ ॥ ৪৭ ॥
জিহ্বায়ত্তেী বৃদ্ধি বিনাশৌ ॥ ৪৮ ॥
বিষামৃতয়োরাকরোজিহ্বা ॥ ৪৯ ॥
প্রিয়বাদিনো ন শত্রুঃ ॥ ৫০ ॥

অনুবাদ : অতি কঠিন কার্য করার পর কর্মকর্তার অবমাননা করতে নেই। ৪৬।

মর্মার্থ : কার্য বিরল হলে, যা দ্বারা তা সম্পন্ন হয়েছে, তার প্রতি অবজ্ঞা করা উচিত নয়। সেরূপ অবজ্ঞা করলে পরের দ্বারা কার্য সম্পাদন করা অতি দুষ্কর। কোনো দোষে কার্য নিষ্ফল হয়, তারই অনুসন্ধান করা উচিত। কর্মকর্তার দোষানুসন্ধান করা ঠিক নয়। কোনোরূপ কার্যহানি ঘটলে সে কার্যের পুনঃ অনুষ্ঠান করা কর্তব্য। পাঠন্তরার্থ’দুষ্ট লোক কঠিন কার্য করার পর কার্যফল না হলে তকর্তাকে অবজ্ঞা করে। ৪৬।

অনুবাদ : অকৃতজ্ঞের নরকবাসের নিবৃত্তি হয় না। ৪৭।

মর্মার্থ : পরকৃত উপকারের প্রত্যুপকার করা স্বাভাবিক নিয়ম। যে ব্যক্তি প্রত্যুপকার না করে উপকার বিস্মৃত হয়, অথবা অনিষ্টাচারণ করতে উদ্যত, তাদৃশ কৃতঘ্নজনের দ্বারা সমাজে প্রচুর অনিষ্ট হয় বলে তার সুদীর্ঘকাল নরকবাস নিশ্চিত। ব্রহ্মহন্তা, সুরাপায়ী, চোর, ভগ্নব্রত, শঠ এদের শাস্ত্রে নিষ্কৃতির বিধান আছে, কৃতম্নের নিষ্কৃতি নেই। ৪৭।

অনুবাদ : কার্য ও বিষয়ের বৃদ্ধি, উচ্ছেদ জিহ্বার অধীন। ৪৮।

মর্মার্থ : জিহ্বার লালসা, চাঞ্চল্য কার্যও বিষয় উচ্ছেদের হেতু। জিহ্বা সংযত হলে মধুর বাক্য দ্বারা অনায়াসে কার্য সাধন করা যায়। জিহ্বার লালসা অধিক হলে, অসংযত জিহ্বা দুর্বাক্য প্রয়োগের কারণ, তাতে বিবাদ ঘটে। অতএব বহু বিষয়ের বৃদ্ধি ও বিনাশ রসুনেন্দ্রিয়ের অধান। সেরূপ অপর ইন্দ্রিয়গণের সংযত অসংযত ভাব জ্ঞাত হওয়া যায়। ৪৮।

অনুবাদ : বিষ ও অমৃত–এই দুটিরই উৎপত্তি স্থান জিহ্বা। ৪৯।

মর্মার্থ : বাগিন্দ্রিয়ের সাহায্যে জিহ্বা মধুর ভাষণ দ্বারা অমৃত প্রকাশ করে, যে জিহ্বা পুনঃ সে ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে দুর্বাক্যবান বর্ষণপূর্বক বিষভাব ব্যক্ত করে বিপদ আনয়ন করা, অতএব জিহ্বা অমৃত ও বিষের খনিস্বরুপ। ৪৯।

অনুবাদ : প্রিয়বাদী ব্যক্তির কেউ শত্রু হয় না। ৫০।

মর্মার্থ : মধুর বাক্য দ্বারা সকল লোক প্রীত ও বাধ্য হয়। দুর্বাক্য শ্রবণে লোক রুষ্ট ও অপমানিত হয়ে শত্রুতাচরণ করে। সুতরাং সকল সময় প্রিয় বাক্য বলতে চেষ্টা করা উচিত। ৫০।

স্তুতাদেবা অপি চিরন্তুষ্যন্তি ॥ ৫১ ॥
অনুতাদপি দুৰ্ব্বচশ্চিন্তিষ্ঠতি ॥ ৫২ ॥
রাজ-দ্বিষ্টং নচ বক্তব্যম্ ॥ ৫৩ ॥
শ্রুতিসুখাঃ কোকিলাপাঃ ॥ ৫৩ ॥
তপ্যতে দুষ্ককরকারী যত্নবান নাম ॥ ৫৫ ॥
স্বধৰ্ম্ম-হেতু সৎপুরুষঃ ॥ ৫৬ ॥

অনুবাদ : স্তুতিবাক্য দ্বারা দেবগণও নিত্য তুষ্ট হয়ে থাকে। ৫১।

মর্মার্থ : প্রিয়ভাষণ, প্রশংসা বাক্য, স্তব দ্বারা প্রীত হওয়া মানবের স্বভাব। স্তুতিবাক্য দ্বারা দেবতা যখন প্রসন্ন হয়, তাতে মানবের প্রীত হওয়া আর বিচিত্র কী? সকলের প্রতি প্রশংসাসূচক ও হিতবাক্য প্রয়োগ করা বিধেয়। ৫১।

অনুবাদ : মিথ্যা বাক্য হতেও দুর্বাক্য দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়। ৫২।

মর্মার্থ : মিথ্যা বাক্য সত্য বাক্য দ্বারা বিলোপ পায়, কিন্তু দুর্বাক্য হৃদয় বিদারক ও অপমানজনক বলে চিরকাল থাকে। রাগ ও বিদ্বেষ বৃদ্ধিতে দুষ্টবাক্য উচ্চারিত হলে তাতে শ্রোতারও তদ্রুপ ভাব জন্মে, অতএব দুর্বাক্য পরিহরণীয়। ৫২।

অনুবাদ : রাজার বিদ্বেষসূচক কোনো বিষয় বলা উচিত নয়। ৫৩।

মর্মার্থ : রাজাদেশ বা বিধান প্রজাগণের সকল সময় পালনীয়। রাজশাসন ভিন্ন লোক সমাজে কার্য শৃঙ্খলা ও সমুন্নতি হয় না। সমাজের মধ্যে ঘোর বিবাদ, অশান্তি, উপদ্রব, অবিচার উত্থিত হয়ে সমাজকে ধ্বংসের পথে চালিত করে। রাজার বিরুদ্ধাচরণে অর্থহানি ও দণ্ডভোগ করতে হয়। তদ্রুপ দেবতা, গুরু, সাধু, সাধ্বীরমণী, মহাজনেরও বিরুদ্ধচরণ করবে না, তাতে ন্যায় ও সত্যের হানি হয়।

অনুবাদ : বিশেষ উদ্যোগসম্পন্ন পুরুষও দুষ্কর্ম করে শেষে অনুতপ্ত হয়। ৫৫।

মর্মার্থ : অতি কঠোর কর্মা ও সদাচারী ব্যক্তি বিশেষ যত্নপূর্ব কার্য করেও পরে সন্তাপ ভোগ করে। অসাধু কর্মের ফলও দুঃখজনক হয়। কার্যের প্রথমেই তার সুফল কুফল চিন্তা করে পরে কার্যানুষ্ঠান করা উচিত, যেমন শৈশবে বালক অসাধু কার্যে রত হলে, যৌবনে তাকে বিদ্যা ও শিল্প শিক্ষার অভাব-নিমিত্ত অনুতাপ ভোগ করতে হয়। ৫৫।

অনুবাদ : উত্তম ব্যক্তি স্বধর্মের কারণ হয়, (১) যে স্বধর্মের হেতু হয়, সেই শ্রেষ্ঠ মানব (২) ৫৬।

মর্মার্থ : যার স্বধর্মে শ্রদ্ধা ও ঈশ্বরে বিশ্বাস আছে, সে সমাজে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। ধার্মিক ও ঈশ্বর বিশ্বাসসম্পন্ন ব্যক্তি চরিত্রবান এবং সকর্মপরায়ণ হয়ে অপরকেও সেরূপ সুশিক্ষা দ্বারা উন্নত করে তুলতে সমর্থ। শিক্ষিত ব্যক্তি তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও ধার্মিক হলে তার শ্রেষ্ঠতা স্বতঃই এসে উপস্থিত হয়। ৫৬।

নাস্তি অর্থিনো গৌরবম্ ॥ ৫৭ ॥
স্ত্রিণাং ভূষণং সৌভাগ্য ৫৮ ॥
শত্রোরপিন পতনীয়া বৃত্তিঃ ॥ ৫৯ ॥
অপ্রযত্নোদকং ক্ষেত্রম্ ॥ ৬০ ॥

অনুবাদ : অর্থী ব্যক্তির গৌরব নেই, (১) যাচক, বাদী, ধনবান, কৃপণ এরা গৌরবান্বিত হয় না। (২) ৫৭।

মর্মার্থ : ধনাদি প্রার্থনাকারী স্বীয় দৈন্য প্রকাশে এবং ধনবানের প্রীতি উৎপাদনের স্বীয় গৌরব পায় না। বিবাদে জয় প্রত্যাশী, যেকোনো উপায় দ্বারা জয়লাভ করতে গিয়ে স্ব-গৌরব হারায়। ধনবান সঞ্চিত ধনব্যয়ে ভীত হয়ে দীন প্রভৃতি লোকের নিকট স্বীয় গৌরব নষ্ট করে থাকে। বাস্তবিক, বহুঁকার্যে সাফল্য লাভাকাক্ষার গৌরবের প্রতি লক্ষ করা অনুচিত। ৫৭

অনুবাদ : নারীগণের সৌভাগ্যই অলঙ্কার। ৫৮।

মমার্থ : মহিলাগণের সৌভাগ্যই (পতি-পুত্ৰ বত্ত্বা) ভূষণ, এই বিষয়ে নীতিবিৎ ও ধর্মশাস্ত্রকারগণের মতভেদ বিদ্যমান। কিন্তু পাব্ৰিতা সকলের ঐকমত্য দেখা যায়। বিনয়, ক্ষমা, পান্ত্ৰিত্য, গৃহকর্ম দক্ষতা, অপত্যের আদর্শ ক্ষেত্ৰতা প্রভৃতি গুণও নারীদিগের সৌভাগ্যের নিদান। মতান্তরে শিল্প, বিনয়, ধৈর্য, সাধারণ বিদ্যা, পরিচর্যা, ধর্ম, গীতানুশীলনাদিও তাদের উপাদেয় গুণ। ৫৮।

অনুবাদ : শত্রু হলেও তার জীবিকা উচ্ছেদ করা উচিত নয়। ৫৯।

মর্মার্থ : যার যা বৃত্তি অর্থাৎ জীবনধারনের উপায়, তা উচ্ছেদ করা উচিত নয়। এমনকি শত্রুরও বৃত্তিনাশ করা অনুচিত। বৃত্তির উচ্ছেদ সাধন করলে, তার জীবনেরও ক্ষতি করা হয়। সুতরাং এ ভিন্ন অন্য উপায়ে শত্রুতা সাধন করা বিধেয়। ৫৯।

অনুবাদ : যে স্থলে অনায়াসে জল পাওয়া যায়, তাই ক্ষেত্র। ৬০।

মর্মার্থ : যে স্থানে জল নির্মল ও সুলভ, সাগর সন্নিহিত, সেরূপ ভূমিই শস্য এবং নিবাসের উপযুক্ত। কেবল ধালুকাময় স্থান শস্য এবং নিবাসের যোগ্য নয়। অতি ক্লেশে যেখানে জল পাওয়া যায়, সে স্থানও বাসের পক্ষে অনুপযুক্ত। ৬০।

এবন্ডমরলম্ব্য কুঞ্জরং ন কোপয়েং ॥ ৬১ ॥
অতিপ্রবৃদ্ধা শালমলির্নবারণস্তবঃ ॥ ৬২ ॥
অতিদীর্যোহিপিকর্ণিকারো ন মূসলী ॥ ৬৩ ॥
অতিদীপ্তোপি খদ্যোতো ন পাবকঃ ॥ ৬৪ ॥
ন প্রবৃদ্ধত্বং গুণহেতুঃ ॥ ৬৫ ॥

অনুবাদ : এর বৃক্ষ দ্বারা মহাকায় হস্তীকে তাড়না করবে না। ৬১।

মর্মার্থ : অসার, অতিলঘু এর বৃক্ষ গ্রহণ করে মহাকায় হস্তীকে তাড়ন করা উচিত নয়। কারণ তাতে হস্তী বিতাড়িত হয় না, বরং হস্তীর কোপের উদ্রেক হয় এবং তার ফলে হস্তী অধিকতর ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। বিপদ যেরূপ তার প্রতীকার সামগ্রীও তদ্রুপ হওয়া যুক্তিসংগত, যেমন সশস্ত্র প্রবল নৃপতির, দুর্বল নিরাশ্রয় ঐক্যহীন লোকগণ, কোপ নিজেরই বিশেষ ক্ষতি হয়। অতি লঘু উপায় দ্বারা বিশেষ গুরুকোষ সাধন করতে উদ্যত হওয়া বুদ্ধিমানের কর্তব্য নয়। ৬১।

অনুবাদ : অতি বৃদ্ধ শাল্মলিতরু, হস্তীবন্ধনের স্তব্ধ হয় না। ৬২।

মর্মার্থ : শাল্মলি বৃক্ষ অতি পুরাতন, বৃহৎ হলেও অসারহেতু হস্তীবন্ধন স্তবের অযোগ্য। পূর্বসূত্রের উদাহরণরূপে এই সূত্র উক্ত হয়েছে। যে যার প্রতি কার্য সাধনে অযোগ্য, কেবল কায়গত গুরুত্ব দ্বারা তার সাধক হয় না। ৬২।

অনুবাদ : কর্ণিকার বৃক্ষ বা তার ফল অতি দীর্ঘ হলেও সে মূসলী হতে পারে । ৬৩।

মর্মার্থ : আকারগত সাদৃশ্য দ্বারা এক দ্রব্য অন্য দ্রব্যে পরিণত হয় না। কর্ণিকার বৃক্ষ কিংবা তার ফল দীর্ঘতা নিবন্ধন সাদৃশ্য থাকলেও তালমূলিকা হতে পারে না। ইহাও যেন পূর্বসূত্রের উদাহরণস্বরূপ প্রদর্শিত হয়েছে। কর্ণিকার, পরিব্যাধ শোদালবৃক্ষ, সে কখনো মূসল অথবা তালমূলী হয় না। ৬৩।

অনুবাদ : খদ্যোত অতিশয় দীপ্ত হলেও অগ্নি হতে পারে না। ৬৪।

মমার্থ : বস্তুদ্বয়ের পরস্পর সাদৃশ্য থাকলে এক হতে পারে না, যেমন ডুভুভ ও বিষধর সর্প। তাতে একের দ্বারা অপরের কার্য সম্পূর্ণরূপে সাধিত হতে পারে ন। আলোকবত্তা খদ্যোত ও অগ্নিতে আছে, কিন্তু দাহকত্ব পাঁচকত্ব খদ্যোতে নেই। ৬৪।

অনুবাদ : কেবল বৃদ্ধতা গুণের হেতু নয়, (১) গুণহেতু শ্রেষ্ঠবৃদ্ধ হয় না (২)

মর্মার্থ : কেবল বৃদ্ধ হলে যে গুণবান হয়ে শ্রেষ্ঠপদ লাভ করে, তা নয়। গুণবত্তা, পাণ্ডিত্য, বয়োবৃদ্ধতা, প্রাচীনত্বের হেতু। গুণজ্ঞানসম্পন্ন যুবাও বৃদ্ধের স্থানীয়। গুণহীন অশিক্ষিত অতি বৃদ্ধও নিমস্থান অধিকার করে। ধর্মশাস্ত্রকারের মতে, বিদ্যাবত্তাই মূলতঃ আভিজাত্য ও শ্রেষ্ঠত্বের হেতু হয়। ৬৫।

সৃজীর্ণোহপি পিচুমর্দ্দো ন শর্করায়তে ॥ ৬৬ ॥
যথা বীজং তথা নিষ্পত্তিঃ ॥ ৬৭ ॥
যথাক্রতং তথাবুদ্ধিঃ ॥ ৬৮ ॥
যথাকুলং তথাচারঃ ॥ ৬৯ ॥
সুসংস্কৃতোহপি পিচুমর্দ্দোন সহকারঃ ॥ ৭০ ॥

অনুবাদ : পিচুমদ (নিম্ব) বৃক্ষ অতিসারবান হলেও তা শর্করা হয় না। ৬৬।

মর্মার্থ : নিম্ব স্বাভাবিক তিক্ত সে অতি পুরাতন হলে, কিংবা সূক্ষ্ম চূর্ণিত হয়ে দুগ্ধমিশ্রিত হলেও তিক্ততা পরিহার করে না। যার যা স্বভাব, তা অবস্থান্তরেও পরিত্যক্ত হয় না। এরূপ অপরাপর দ্রব্যের বিষয়েও জানতে হবে। পিচুম স্থানে দক্ষিণাত্যের পাঠ পিচুমন’ এরূপ আছে। ৬৬।

অনুবাদ: যেরুপ বীজ, তার ফলের উৎপত্তি সেরূপ হয়। ৬৭।

মর্মার্থ : বীজের অনুসারে ফল হয়, বীজ যদি নির্দোষ হয়, তার ফল অবিকল দোষশুন্য হয়। বীজগত দোষ তার ফলে সংক্রমিত হয়। শস্যাদির বীজ যেমন নির্দোষ হওয়া উচিত, সেরূপ প্রজা উৎপাদনের বীজ, নির্দোষ ও পবিত্র হওয়া একান্ত প্রয়োজন, তা না হলে শক্তিমান ও মহাপুরুষের প্রাদুর্ভাব হয় না। কারণগত দোষ কার্যে সংক্রমিত হওয়া সুনিশ্চিত। ৬৭।

অনুবাদ : যে বিষয় যখন যেভাবে শুনবে, তার জ্ঞানও সেভাবে হবে। ৬৮।

মর্মার্থ : যে বিষয়ে সময় যার শ্রবণ, দর্শন, স্পর্শনাদি হয়, তার সে সময়ে সে বিষয়ের জ্ঞানও সেরূপ জন্মে। সৎ, হিতকর, প্রীতিজনক বাক্য শ্রবণে হর্ষ ও দুর্বাক্য প্রকাশে দুঃখের উৎপত্তি সহকারে বুদ্ধির সংস্কার স্ট্রপ হয়। ৬৮।

অনুবাদ : যেরূপ কুল তার আচরণও সেরূপ। ৬৯।

মর্মার্থ : যার যেরূপ বংশগত বৈশিষ্ট্য শক্তি, তার ব্যবহার ও কার্য ক্ষেত্রে সেরূপ দেখা যায়। পুত্র পিতার গুণ লাভ করে, কন্যা মাতার গুণ পায় অর্থাৎ পুত্র কন্যাতে যথাক্রমে পিতা ও মাতার গুণ সংক্রমিত হয় এই নিমিত্ত আভিজাত্যশক্তির সম্মান সমাজে দেখা যায়। অপর নীতিবিৎ পণ্ডিতগণ বলেন, সুশিক্ষাজনিত গুণাবলিরই সম্মান, বংশ গৌরবের মূল্য নেই। গুণহীন ব্যক্তির বংশ মর্যাদা দ্বারা কী হয়? তবে গুণসৃষ্টিতে বংশগতি যে অসীম প্রভাব আছে, তা অনস্বীকার্য। ৬৯।

অনুবাদ : যত্নপূর্বক পরিশোধিত নিম্ববৃক্ষ আম্র বৃক্ষ হয় না। ৭০।

মর্মার্থ : বিশেষভাবে মধু, শর্করা প্রভৃতি দ্বারা পরিভাবিত নিম্ববৃক্ষ কখনো সৌরভযুক্ত আবক্ষ হয় না। যার যে স্বভাব সে তা স্বরূপ থাকতে পরিত্যাগ করতে পারে না। যেমন সূৰ্য্যালোকে উত্তাপ, চন্দ্রালোকে স্নিগ্ধতা। এই সূত্রপূর্ব সূত্রে ব্যাখ্যারুপে পরিস্ফুট হয়েছে। ৭০।

নবাগতং সুখ পরিত্যজেৎ ॥ ৭১ ॥
স্বয়মেব দুঃখমধিগচ্ছতি রাজচৰ্য্যাৎ ॥ ৭২ ॥
নরাত্রি চারণং কুৰ্য্যাৎ ॥ ৭৩ ॥
নচার্ধরাত্ৰং স্বপেৎ ॥ ৭৪ ॥
তদ্বিদ্বম্ভি পরীক্ষেত ॥ ৭৫ ॥

অনুবাদ : উপস্থিত সুখ পরিত্যাগ করা উচিত নয়। ৭১।

মর্মার্থ : বর্তমান সুখকে পরিহার করে ভবিষ্যৎ সুখের আশা করা বৃথা। দুঃখ, অগ্রে ও পশ্চাতে নিয়ত থাকে। সুখ কখনো কখনো প্রগাঢ় অন্ধকারে ক্ষীণালোকের ন্যায় প্রকাশ পায়। সুখ ত্যাগ করলে দুঃখ ভোগ অনিবার্য। এমন কার্যও করবে না, যার দ্বারা অদ্য পরিণামে সুখ, দুঃখ অনন্ত হয়। ৭১।

অনুবাদ : নিঃস্ব ব্যক্তি রাজার ন্যায় আচরণ করলে দুঃখপ্রাপ্ত হয় (১) রাজার প্রতিকুলাচরণ করে স্বয়ং ভোগ করে। (২) ৭২।

মমার্থ : দরিদ্র লোক রাজার ন্যায় আচরণ করে দুঃখ পায়। অথবা রাজার প্রতিকূলাচরণ করলে তার দুঃখ অবশ্যম্ভাবী। রাজার মতো সমাজসেবা করেও লোকের দুঃখ যায় না। বরং রাজসেবায় রত থাকলে আপাতত দুঃখ হয় না। ৭২।

অনুবাদ : রাত্রিতে অধিক বিচরণ করা উচিত নয়। ৭৩।

মর্মার্থ : প্রাতঃকালে ও অপরাহে ভ্রমণ স্বাস্থ্যকর, প্রত্যহ দীর্ঘপথ ভ্রমণ করলে শারীরিক বিশেষ হানি হয়। কঠিন পীড়াক্রান্ত ব্যক্তিরও দীর্ঘ ভ্রমণ নিষেধ। মধ্য রাত্রে ও শেষ রাত্রে দীর্ঘ পথ ভ্রমণ নিষিদ্ধ। অবস্থানুসারে পূর্ব রাত্র ভ্রমণ বিধেয়। দিবসে যথাযোগ্য ভ্রমণ ও রাত্রিতে শয়ন চিকিৎসা শাস্ত্রের অভিপ্রেত। সর্বদা ভ্রমণে ব্যক্তির মূত্র রোগ ও মেদ রোগের সম্ভাবনা থাকে। ৭৩।

অনুবাদ : অন্ধ রাত্রিতে শয়ন করা উচিত নয়। ৭৪।

মর্মার্থ : রাত্রির প্রথম ভাগের পর শয়ন করা ও শেষ ভাগের পর শয্যা ত্যাগ করা উচিত। দিবান্দ্রিা শারীরিক হানিকর। যারা রাত্রি জেগে থাকে, তাদের দিবান্দ্রিা হিতকর। অজীর্ণ রোগে পূর্বাহ্নে নিদ্রা রোগনাশক। অৰ্দ্ধ রাত্রিতে ও তার পরে শয়ন করলে স্বাস্থ্য হানি ঘটে। মধ্য রাত্রির পরে আহারও বর্জনীয়। আয়ুর্বেদে এই বিষয় বিশেষ বর্ণিত আছে। ৭৪।

অনুবাদ : পণ্ডিতগণ উক্ত বিষয়ে পরীক্ষা করবে। ৭৫।

মর্মার্থ : পূর্বে শয়ন, ভ্রমণ, আহারাদি বিষয়ে যা বলা আছে সে সমুদয় শাস্ত্র, যুক্তি এবং অনুষ্ঠান দ্বারা দেখবে, কেবল শাস্ত্র দ্বারা বা তর্কের দ্বারা নয়। মানবের সাধারণত যথাকালে শয়ন, স্থান, ভ্রমণ, আহার প্রভৃতি স্বাস্থ্যরক্ষার হেতু। স্বেচ্ছায় অবজ্ঞাবশতঃ বিপরীত করলে শারীরিক সুস্থতাহানি অনিবার্য। ৭৫।

পরগৃহকারণভোন প্রবিশেৎ ॥ ৭৬ ॥
জাত্বাপি দোষমেব করোতি লোকঃ ॥ ৭৭ ॥
শাস্ত্রপ্রধানা লোকবৃত্তিঃ ॥ ৭৮ ॥
শাস্ত্রাভাবে শিষ্টাচার মনুগচ্ছেৎ ॥ ৭৯ ॥
নাচিরতাচ্ছাং গরীয়ঃ ॥ ৮০ ॥

অনুবাদ : কোনো প্রয়োজন না থাকলে, পরের গৃহে প্রবেশ করা অনুচিত। ৭৬।

মর্মার্থ : বিনা প্রয়োজনে ও অনুমতি ভিন্ন পরের গৃহে, শস্যাদি ক্ষেত্রে, উদ্যানে, অথবা পরশ্বামিক দ্রব্য সংগ্রহ করা উচিত নয়। তাতে অপরাধ ও দুষ্প্রবৃত্তি বর্ধিত হয়। স্বামিক স্থানে নিজের প্রবেশে কোনো আপত্তির হেতু থাকে না। পর দ্রব্যে লোভ করাও নিষিদ্ধ। ৭৬।

অনুবাদ : মানুষ পরগৃহাদিতে প্রবেশ করা অন্যায় জেনেও প্রবেশ করে অপরাধ করে। ৭৭।

মর্মার্থ : পূর্বোক্ত পরগৃহ ও শস্য ক্ষেত্রাদিতে প্রবেশ করা অন্যায়, তা জেনেও বহু লোক লোভ এবং প্রমাদবশতঃ প্রবেশ করে অপরাধী হয়। পরদ্রব্যাদি অধিপতির বিনা আদেশে গ্রহণ করলে বলপূর্বক হরণ হয়। অতএব জেনে যারা গ্রহণহরণাদি করে, তারা ঘোরতর অপরাধী। ৭৭।

অনুবাদ : লোক বৃত্তি শাস্ত্রমূলক হবে। ৭৮।

মর্মার্থ : নীতিশাস্ত্র প্রভৃতির যেরূপ অনুশাসন, তদনুসারে লোকের আচরণ করা উচিত। যথেচ্ছ আচরণ হলে লোক ঐ মতে কোনো কার্য করতে পারে না। শাস্ত্রানুসারে লোক চলবে। লোকবৃত্তির অনুযায়ী শাস্ত্র হওয়া উচিত নয়। লোকের বাহুল্যে প্রবৃত্তি বাহুল্য ঘটে থাকে। ৭৮।

অনুবাদ : শাস্ত্র বাক্যের অভাবে শিষ্ট মহাপুরুষের আচরণের অনুকরণ করবে। ৭৯।

মর্মার্থ : শাস্ত্রোপদেশ প্রথম পালনীয়, তার অভাব ঘটলে অর্থাৎ শাস্ত্র অধ্যয়নের সামর্থ্য বা সময় না থাকলে, শিষ্ট মহাজনের যেরূপ আচরণ প্রসিদ্ধ আছে, তার অনুসরণ করতে হয়। যথেচ্ছভাবে কোনো কার্য করবে না। নীতিশাস্ত্রোক্ত শিষ্ট মহাজন-ব্যাস, বৃহস্পতি, পরাশর, বিশালাক্ষ, বাতব্যাধি, পিশুন, বিদুর, কৌটিল্য, ভোজরাজ প্রভৃতি; এদের আচরণও অনুকরণীয়। ৭৯।

অনুবাদ : লোকাঁচার অপেক্ষা শাস্ত্র প্রবল নয়। ৮০।

মর্মার্থ : যে স্থলে লোকচারও শাস্ত্রের বিরোধ ঘটে, যে স্থলে প্রত্যক্ষ লোকাঁচারই প্রবল হবে। কারণ শাস্ত্র বাক্যের পরস্পর বিরোধ দৃষ্ট থাকাতে এবং তার প্রণেতার পরোক্ষতাহেতু অজ্ঞ লোকের ও নীতিপরায়ণের পক্ষে তাদৃশ বিরোধস্থলে শিষ্টাচার আশ্রয়ণীয়। শাস্ত্রীর বহুগ্রন্থ কালে লোপ হয়েছে ও তাতে মতভেদ আছে। কিন্তু লোকাঁচার পরম্পরাক্রমে একভাবে চলে আসে। তাই তাকে অনুসরণ করাও সহজ। ৮০।

দূরস্থমপি চারচক্ষুঃ পশ্যতি রাজা ॥ ৮১ ॥
গতানুগতিকোলোকঃ ॥ ৮২ ॥
জীবিভিস্তস্মিন্নাজীবেৎ ॥ ৮৩ ॥
যমনুজীবেত্তং নাপবদেৎ ॥ ৮৪ ॥

অনুবাদ : রাজা চার-রূপ চক্ষু দ্বারা দুরন্থিত বিষয়ও দেখতে পায়। ৮১।

মর্মার্থ : কোনো ভূপতিই বিশাল রাজ্যে সমস্ত বিষয় সমীপন্থ দ্রব্যের ন্যায় প্রত্যক্ষ করতে পারে না, দূত দ্বারা যথাযথ বিষয় উত্তমরূপে জ্ঞাত হয়। এই ভিন্ন আর উপায়ন্তর নেই। বৃদ্ধগণ বলেছেন, রাজা শ্রবণশক্তির দ্বারাই দেখেন, ধীশক্তির বলে পণ্ডিতগণ, পশুগণ ঘ্রাণশক্তি দ্বারা অজ্ঞ লোক বিষয় ঘটনা অতীত হয়ে গেলে প্রকৃতভাবে দেখে। দুরস্থ ব্যবহিত সূক্ষ্ম বিষয় শাস্ত্র ও শ্রবণেন্দ্রিয় দ্বারা সম্যক জ্ঞাত হওয়া যায়। ৮১।

অনুবাদ : মানুষ সাধারণত গতানুগতিক হয়ে থাকে। ৮২॥

মর্মার্থ : সাধারণত মানুষ কার্য প্রবাহে গতানুগতিক হয়ে চলে। বিবেকপূর্বক কার্য করার শক্তি সকলের থাকে না; সময়, সকল বিষয়ে পাওয়া যায় না। কিন্তু পুরাতন বিষয় মাত্রই যে আদরণীয়, এমন নয়, হিতকর নতুন বহু বিষয়ও উপাদেয়। সুধীগণ পূর্বাপর বিচারপূর্বক কার্য করে থাকে, অজ্ঞ লোক প্রবাহণশ্রয়ে কার্য করে। ৮২।

অনুবাদ : মানুষের সেই গতানুগতিক পথ অনুসরণ করে জীবিকা নির্বাহ করা উচিত। ৮৩।

মর্মার্থ : যে ব্যক্তি, যে সমাজ ও সম্প্রদায়ের লোক, সে সে সম্প্রদায় ও সমাজের গতানুগতিক প্রথানুসারে সংসার যাত্রা নির্বাহ করে। পূর্ব সংস্কার তাকে সেভাবে পরিচালিত হয়। মহাজন যে পথে গেছেন, পরবর্তী সামাজিকেরাও সে পথে যাবে’। ধর্মশাস্ত্রকার বলেছেন যে পথে পিতা, পিতামহ প্রভৃতি গিয়েছেন, তাই সজনগণের পথ, সে পথে চললে কোনো দোষ নেই। ৮৩।

অনুবাদ : লোক যার আশ্রয়ে জীবিকা অর্জন করবে, তার অপবাদ করা উচিত নয়। ৮৪।

মর্মার্থ : যার দ্বারা জীবিকা নির্বাহ হবে এবং যে হিতকারী ব্যক্তি, তাদের নিন্দা করা উচিত নয়। রাজভৃত্যগণ ও প্রজাগণের পক্ষে রাজার অপবাদ করা অপরাধ জনক। মহাপুরুষ গুরু, দেবতা ভূপতিগণের নিন্দা ও অপমান করবে না, তাতে নীতি লঙ্ঘন রূপ পাপ হয়। ৮৪।

তপঃসার ইন্দ্রিয়নিগ্রহঃ ॥ ৮৫ ॥
দুর্লভ খ্রীবন্ধনানন্মাক্ষ ॥ ৮৬ ॥
স্ত্রী নাম সৰ্বাশুভানাং ক্ষেত্রঃ ॥ ৮৭ ॥
ন চ স্ত্রীণাং পুরুষ পরীক্ষা ॥ ৮৮ ॥
স্ত্রীণাং হি মনঃ ক্ষণিকমেকস্মিন্নতিষ্ঠতি ॥ ৮৯ ॥

অনুবাদ : তপস্যার সার ইন্দ্রিয় সংযম। ৮৫।

মর্মার্থ : ইন্দ্রিয় সংযম না হলে মনঃস্থির হয় না, মনের স্থৈর্য না হলে, তপ ও আরাধনা হতে পারে না, অতএব তপশ্চর্যার প্রধান উপায় মন ও জ্ঞানেন্দ্রিয়ের নিগ্রহ। সকল কার্যেই মনের ধৈর্য এবং ইন্দ্রিয়ের দৃঢ়তা ও সংযম একান্ত আবশ্যক। ৮৫।

অনুবাদ : স্ত্রী বন্ধন হতে মুক্তিলাভ করা মানুষের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন। ৮৬।

মর্মার্থ : সংসার কারাগৃহে স্ত্রীরজু দ্বারা পুরুষগণ আবদ্ধ হয়, যেমন ঊর্ণনাভ স্বরচিত জালে আবদ্ধ হয়ে পরে বন্ধন ক্লেশ অনুভব করে। যার এই দৃশ্য সংসারকে মোহকর পতিত মায়াজালের ন্যায় মনে করে, বিরক্তিতে, পরিহার করে, তারা স্ত্রী বন্ধনের হাত হতে অব্যাহতি পায়। বিষয় বিষ, ভোগ-ত্যাগ না করলে সংসার ক্ষেত্রে এই বন্ধন হতে মুক্ত হওয়া কঠিন। ৮৬।

অনুবাদ : স্ত্রীলোক, সকল অশুভ কর্মের উৎপত্তি স্থান। ৮৭।

মর্মার্থ : কাম, ক্রোধ, বিবাদ, লোভ প্রভৃতি নানা প্রকার বিয়ের স্ত্রী লোক উৎপত্তি ক্ষেত্র। প্রাজ্ঞ অপেক্ষা অজ্ঞ লোক সে অশুভসমূহ ভোগ করে। সুশিক্ষা ও সততা দ্বারা সে অশুভ হতে আত্মাকে স্বতন্ত্র রাখা উচিত। সত্য, দয়া, স্নেহ, ধৈর্যের পথে থেকে নারীগণ অশুভ ক্ষেত্রকে শুভস্থলে পরিণত করতে সমর্থ। ৮৭।

অনুবাদ : স্ত্রীগণের পুরুষ পরীক্ষণীয় নয়। ৮৮।

মর্মার্থ : নারীগণের পক্ষে পুরুষের পরীক্ষা করা উচিত নয়। পুরুষের পক্ষেই নারী পরীক্ষণীয়া। নারী দ্বারা বংশের ধারা ও গৃহস্থিতি হয়। বিবাহের পূর্বে বিশেষভাবে সামুদ্রিক ও বৈদ্যকশাস্ত্র দ্বারা কন্যার লক্ষণ জ্ঞাত হওয়া আবশ্যক। সাংসারিক নানা প্রকার সুকঠিন কার্যে নারী পরীক্ষণীয়া। নারী কর্তৃক পুরুষ পরীক্ষার যোগ্য নয়। ৮৮।

অনুবাদ : নারীগণের চিত্ত ঋণকালের জন্য এক বিষয়েও স্থির থাকে না। ৮৯।

মর্মার্থ : পুরুষ অপেক্ষা নারীগণের মন সরল ও কোমল, সেহেতু কোনো বিষয়ে ক্ষণকালের জন্য তারা চিত্ত স্থির রাখতে পারে না। এক বিষয়ে বহুক্ষণ চিত্তের ধৈর্য ধারণ করতে না পারলে ও বিশেষ চিন্তাপূর্বক কোনো কার্য করতে সক্ষম নয়, নারীর উপর কঠিন কার্যের গুরুভার ন্যাস্ত করা যায় না। ৮৯।

অশুভদ্বেষিণঃ ঘ্রাণ ন প্রসক্তাঃ ॥ ৯০ ॥
যজ্ঞফলজ্ঞাস্ত্রিবেদবিদঃ ॥ ৯১ ॥
স্বর্গস্থানং ন শাশ্বতম্ ॥ ৯২ ॥
যাবৎ পুণ্যফলং তাবদেব স্বর্গ ফলম্ ॥ ৯৩ ॥
নচ স্বর্গপতনাপরং দুঃখম্‌ ॥ ৯৪ ॥

অনুবাদ : যারা অশুভ দ্বেষী, তারা খ্রীতে আসক্ত হয় না। ৯০।

মর্মার্থ : গৃহীত বিষয়ে যারা হেয়জ্ঞান করে, তারা স্ত্রীলোকের প্রতি বিশেষ আসক্ত হয় না, স্ত্রৈণ ব্যক্তি বিশেষ আসক্তি নিবন্ধন, মেধা, স্মৃতি, বুদ্ধি হারিয়ে রুগ্ন এবং অল্পকাল মধ্যে নষ্ট স্বাস্থ্য হয়ে অকর্মণ্য হয়। অতএব অল্প পরিমাণে নারী প্রসক্তি হিতকর। ৯০।

অনুবাদ : যারা ঋগবেদাদিতে অভিজ্ঞ, তারা যজ্ঞ কর্মের ফল জ্ঞাত আছেন। ৯১।

মর্মার্থ : ঋক, যজু, সাম–এই তিন বেদে, শ্রৌতসূত্রে এবং বেদের ব্রাহ্মণ ভাগে অভিজ্ঞ ঋত্বিগণ যজ্ঞকর্মের ফলবেত্তা। বেদের ব্রাহ্মণভাগও শ্রৌতসূত্রাদিতে যজ্ঞপদ্ধতি বর্ণিত আছে। যথাযথ যজ্ঞকর্ম অনুষ্ঠিত হলে তার ফলও নিশ্চিত, সে বিষয়ে সন্দেহ করার কিছুই নেই। ভ্রম, প্রমাদ, প্রতারণা ইন্দ্রিয়ের অপটুতা প্রভৃতি দোষ পুরুষগত অপৌরুষের বেদে তা নেই। ৯১।

অনুবাদ : (কর্মফল জন্য হেতু) স্বৰ্গস্থান অনিতা। ৯২।

মর্মার্থ : কর্মজনিত ফল দ্বারা লোক স্বর্গে গমন করে, যারা যেরূপ কর্মের ফল তদনুরূপ ভোগ করে, অনন্তর মত লোকে আসতে হয় এটি স্থির সিদ্ধান্ত। যজ্ঞাদি কর্মফলে স্বর্গলাভ হয়, যা কর্মজনিত তা অনিত্য যেমন গৃহাদি’। শ্রীপরমেশ্বরস্বরূপ নিত্য, তত্ত্বজ্ঞানের দ্বারা তা লাভ হলে পুনরাবৃত্তি হয় না। ৯২।

অনুবাদ : যার পুণ্য কর্মের ফল যে পরিমিত, তার স্বর্গবাস ও সে পরিমাণ কাল হয়। ৯৩।

মর্মার্থ : কর্ম, ক্ষুদ্র, বৃহৎ হয় বলে তার ফল ভোগকাল ড্রপ হয়। অনন্ত অপরিমিত কাল স্বর্গ ভোগ হয় না। পরমাত্মা নিত্য সত্য বিভু, সেহেতু তার স্বরূপ তত্ত্বজ্ঞান ও অপার অনন্ত, তাতে তারতম্য নেই। এই সূত্রটি পূর্বসূত্রের সমর্থকরূপে পতীত হয়। ৯৩।

অনুবাদ : স্বর্গ হতে চ্যুত হওয়া থেকে আর অধিক দুঃখ নেই। ৯৪।

মর্মার্থ : পূজা, পাঠ, যজ্ঞাদি কর্মের অনুষ্ঠান করে স্বর্গ লাভ হয়, সেই স্বর্গ হতে মর্ত্যলোকে পুনঃ পতিত হওয়া বিশেষ দুঃখের। স্বর্গভ্রষ্ট ব্যক্তির সংসারে বারবার জন্ম-মরণজনিত অশেষ ক্লেশ সহ্য করতে হয়। শ্রীপরমেশ্বরের আরাধনায় সিদ্ধিলাভ করতে সমর্থ হলে জন্ম, মৃত্যু হতে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়, অসীম, নিত্য সুখই স্বর্গ। ৯৪।

দেহী দেহন্তক্তা ঐন্দ্রপদংবাঞ্চতি ॥ ৯৫ ॥
দুঃখানা মৌষধং নিৰ্বাণম্ ॥ ৯৬ ॥
অনাৰ্য্য-সৰ্ব্বন্ধাদ্বরমাৰ্য্য-শত্রুতা ॥ ৯৭ ॥
নিহন্তি দুর্বলচং কুলম্ ॥ ৯৮ ॥
ন পুত্র সংস্পর্শাৎ পরং সুখম্‌ ॥ ৯৯ ॥

অনুবাদ : জীবগণ নিজ শরীর ত্যাগ করে ইন্দ্র পদের আকাক্ষা করে। ৯৫।

মর্মার্থ : যারা সংসারে অনন্ত দুঃখ ভোগ করে, তারা, নিদাঘ সন্তপ্ত প্রান্তরগামী লোক যেরূপ সুশীতল ছায়া ইচ্ছা করে, সেরূপ অমর ধামস্থ দেবরাজের পদ অভিলাষ করে। দুঃখ যন্ত্রণাগ্রস্ত লোকের সুখ, শান্তি কামনা স্বাভাবিক। ৯৫।

অনুবাদ : দুঃখ ভোগের একমাত্র মহৌষধ নির্বাণ। ৯৬।

মর্মার্থ : সাংসারিক জীবের দুঃখ ভোগ অপরিহার্য, কিন্তু তার একমাত্র নিবৃত্তির ঔষধ তত্ত্বজ্ঞান বা নির্বাণ। এই নির্বাণ সম্বন্ধে বিভিন্ন দার্শনিক ঋষিগণের নানামত নানাগ্রন্থে দৃষ্ট হয়। ধন, ঔষধ, কৌশল দ্বারা সাংসারিক দুঃখের সম্যকরূপে প্রতিকার হয় না। একমাত্র তত্ত্ব সাক্ষাৎকারেই হয়ে থাকে। ৯৬।

অনুবাদ : নীচ লোকের সহিত সম্বন্ধে অপেক্ষা শ্রেষ্ঠজনের সঙ্গে বিরোধও ভালো। ৯৭।

মর্মার্থ : সংসর্গবশত ক্ষুদ্র ব্যক্তিও শ্রেষ্ঠ হয়, নীচ সম্বন্ধে মহৎ ব্যক্তি হীন হয়ে থাকে। সংসর্গে দোষ ও গুণ অপরে সংক্রমিত হয়। অতএব নীচের সহিত উত্তম ব্যক্তির সম্মিলন উচিত নয়। দুগ্ধ অম্নের সহযোগে স্বীয় শ্রেষ্ঠত্ব হারায়, শর্করাযোগে তা বর্ধিত হয়। ৯৭।

অনুবাদ : কুৎসিত ও পরুষ বাক্য দ্বারা স্বীয় কুলের গৌরব বিনাশ হয়। ৯৮।

মমার্থ : লোকসমাজে মধুর বাক্য দ্বারা স্বীয় সৌজন্য ও কুলগৌরব বর্ধিত হয়। পরনিন্দা ও কুবাক্য দ্বারা কার্যহানি এবং কুলগৌরব নষ্ট হয়। প্রায়ই মধুর ভাষণের বিশেষ উপকারিতা দেখা যায়। ৯৮।

অনুবাদ : পুত্র সংস্পর্শ ও তার মুখ দর্শনের তুল্য আর অধিক সুখ নেই। ৯৯।

মর্মার্থ : প্রীতি ও সুখকর বস্তু দর্শন মাত্রেই হৃদয়ে হর্ষের উদ্রেক হয়। কিন্তু সুখজনক বস্তুর মধ্যে অভিনব পুত্র মুখ দর্শন ও তার সংস্পর্শে অতিশয় সুখকর। এটি সাংসারিক সুখের চরম দৃষ্টান্ত। ৯৯।

বিবাদে ধর্মনুস্মরেৎ ॥ ১০০ ॥
নিশান্তে কাৰ্য্য চিন্তয়েৎ ॥ ১০১ ॥
প্রদোষে ন সংযোগঃকর্তব্যঃ ॥ ১০২।
উপস্থিত-বিনাশো দুর্নয়ংমন্যাতে ॥ ১০৩।
ক্ষীরার্থিনঃ কিং করিণ্যা ॥ ১০৪ ॥

অনুবাদ : বিবাদে অন্য উপায় অপেক্ষা ধর্মানুসরণ করবে। ১০০।

মর্মার্থ : বিবাদ উপস্থিত হলে নানারূপ কৌশল ও ধনের দ্বারা তার মীমাংসা করা হয়, কিন্তু উপায় সমূহের মধ্যে প্রধান উপায় ধর্মানুসরণ করা। অনুসরণ এইরূপ সূত্র পাঠও সংগত। ধর্ম অনুসরণ ধর্মের বিশেষভাবে স্মরণ করা। অনুসরণ করা। অনুসরণ অপেক্ষা ধর্মের অনুষ্ঠান ও আশ্রয় শ্রেয়। ১০০।

অনুবাদ : রাত্রি শেষে কার্য সম্পর্কে চিন্তা করতে হয়। ১০১।

মর্মার্থ : রাত্রির শেষভাবে নিদ্রার অবসান ঘটলে সে সময় শরীর, ইন্দ্রিয়, মন স্থির ও শান্ত হয়। বুদ্ধির উত্তমরূপ বিকাশ হয়। গুরুতর কার্যের অথবা ঈশ্বর ও ধর্ম বিষয়ের চিন্তা করবে সে চিন্তা স্বয়ং বিশ্বস্ত সুহৃদজনের সহিত হবে। দিবসে কার্য বাহুল্য মনের স্থিরতা হয় না, চারদিকে নানা কথা শোনার ও সন্দেহ করার অবসর থাকে। চিন্তা শব্দের দ্বারা চিন্তা ও আলোচনা উভয় বুঝতে হবে। ১০১।

অনুবাদ : প্রদোষকালে কোনোও কার্যে সংযুক্ত হতে নেই। ১০২।

মর্মার্থ : সায়ংকাল দিন ও রাত্রির সন্ধিক্ষণ, এই সময় সূর্যালোক হ্রাস পায়। ক্রমে জগৎ অন্ধকারে ঢাকতে থাকে। বিশ্রাম ও ঈশ্বর চিন্তার উপযুক্ত সময়। তা কার্যলিপ্ত হওয়ার উপযুক্ত সময় নয়। নীতিবিদগণ বলেছেন, সন্ধ্যাসময়ে আহার, মৈথুন, নিদ্রা, শান্ত্রপাঠ, এ চারটি কার্য ত্যাগ করবে। দিনের প্রারম্ভ সময়ই কার্যের মুখ্য কাল, সে সময় মনের বিশেষ স্থৈর্য থাকে। ১০২।

অনুবাদ : উপস্থিত বস্তুনাশকে দুর্নীতি বলে মনে করা হয়। ১০৩।

মর্মার্থ : উপস্থিত প্রাপ্তদ্রব্যের যথেচ্ছভাবে নাশ করা অথবা রক্ষা করতে অসমর্থভাবে ত্যাগ করা এবং অনিশ্চিত লাভের আশায় লব্ধ বস্তু পরিহার করা প্রভৃতিকে প্রাজ্ঞগণ দুর্নীতি বলে অভিহিত করেছেন। নীতিজ্ঞ ব্যক্তি সুনীতির পথেই বিচরণ করে লাভবান ও জয়ী হয়। মন্দমতি সকল বিষয়ে দুর্নামের আশ্রয় গ্রহণ করা। ১০৩।

অনুবাদ : যার দুগ্ধের প্রয়োজন, সে হস্তিনীয় অনুসন্ধান করবে না। ১০৪।

মর্মার্থ : যার যে দ্রব্যের বিশেষ প্রয়োজন হবে, সে প্রয়োজনীয় দ্রব্যের উপাদানই সংগ্রহ করবে, যেমন দুন্ধার্থী ধেনু, তন্ডুলার্থী ধান্য; তৈলের আবশ্যক হলে তিল বা সর্ষপ সংগ্রহ করবে, ধূলিমুষ্টি নয়। প্রয়োজন সাধনের অযোগ্য বস্তু সংগ্রহ করা বৃথা ও অনিষ্টের হেতু। ১০৪।

ন দানসমং বশ্যম ॥ ১০৫ ॥
পরায়ত্তেষুৎকণ্ঠাং নকুৰ্য্যাৎ ॥ ১০৬ ॥
অসৎ সমৃদ্ধিরসদ্ভিরেব ভুজ্যতে ॥ ১০৭ ॥
নিম্বফলং কাকৈৰ্ভুজ্যতে ॥১০৮ ॥
নাম্ভোধি স্তৃষ্ণামপোহতি ॥ ১০৯ ॥

অনুবাদ : দানের তুল্য বশীভূত করার আর উপায় নেই। ১০৫।

মর্মার্থ : ধনীর দান দ্বারা অনায়াসে বিশেষ উপকৃত হয়, ধনী তদ্দ্বারা ধার্মিক, দয়ালু যশস্বী হন। দান দ্বারা শত্রুও বশে আসে, বহু কার্য অনায়াসে সাধিত হয়। কলিতে দানই প্রশস্তকার্য দানপূর্বক ভোগ ধনের শ্রেষ্ঠ পরিণতি। অসৎপথে ব্যয় ধনের অধোগতি। উদ্বৃত্ত অর্থের সন্ধ্যয় একান্ত প্রয়োজন। ১০৫।

অনুবাদ : পরের অধীন বিষয়ে উত্তষ্ঠা করবে না। ১০৬।

মর্মার্থ : কোনো বিষয় অর্থাৎ টাকা ভূসম্পত্তি প্রভৃতি অন্যের হস্তগত হলে, তার নিমিত্ত উল্কণ্ঠা করবে না। যা পরের সম্পূর্ণ আয়ত্ত পুনঃ উদ্ধারের সম্ভাবনা নেই, সেরূপ বিষয়ে, অথবা পরের ঐশ্বর্য দেখে উদ্বেগ, ত্রাস, অনুতাপ করা বৃথা, ধনার্জন, স্বধনের রক্ষণ ও বন্ধনে যত্নবান হতে হয়। ১০৬।

অনুবাদ : অসাধু উপায়ে অর্জিত অর্থের অসৎপথে গমনও অসৎ লোকের উপভোগ্য হয়। ১০৭।

মর্মার্থ : ন্যায়ার্জিত অর্থ দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়, তার গতিও সৎপথে হয়ে থাকে। অসৎ উপায়ে অর্জিত ধন চোরাদির উপভোগের সামগ্রী হয় এবং বিবাদ ও গর্হিত কার্যে ব্যয়িত হয়ে থাকে। তাদৃশ ধনের দ্বারা মানুষ ধনপতি ও সুখী হয় না। ১০৭।

অনুবাদ : কাক পক্ষীরা নিম্ব ফল খেয়ে থাকে। ১০৮।

মর্মার্থ : যার বা যোগ্য ও প্রিয় সে তা ভক্ষণ করে। নিমের ফল অতি তিক্ত, তা কাকগণ খায়, পিক তা খায় না। সেরূপ অন্যায়ার্জিত অর্থ চোর, দস্যুগণ ভোগ করেও বিবাদে কুপথে যায়। ন্যায়র্জিত ধন ন্যায় পথেই গমন করে। ১০৮।

অনুবাদ : সমুদ্রও লোক তৃষ্ণা দূর করতে পারে না। ১০৯।

মর্মার্থ : মানুষ জীবনে কখনো আশার অবধি প্রাপ্ত হতে পারে না। ধনাদির, আশা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। সমুদ্র স্বীয় রত্নরাজি সমর্পণ করলেও ধনের আশায় নিবৃত্তি হবে না। সমুদ্রবারি দ্বারাও পিপাসার শাস্তি হয় না। একদিন পিপাসার শাস্তি হলেও পরদিন পুনঃ পানেচ্ছার উদ্রেক হয়। পারমার্থিক চিত্তাভিন্ন সাংসারিক আশার নিবৃত্তি হয় না। তাই কবি বলেছেন-তৃষ্ণার অবধি কেউ প্রাপ্ত হয় না। ১০৯।

বালুকা অপি স্বগুণমাশ্রয়ন্তে ॥ ১১০ ॥
সন্তোহসসুন রমন্তে ॥ ১১১ ॥
ন হংস প্রেতবনে রমন্তে ॥ ১১২ ॥
অর্থার্থং প্রবর্ততে লোকঃ ॥ ১১৩ ॥

অনুবাদ : বালুকাও নিজ গুণকে আশ্রয় করে। ১১০।

মর্মার্থ : বালুকা স্বতঃ বিশুষ্ক স্বভাব ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাগে বিভক্ত হয়েও স্বীয় স্বীয় গুণকে আশ্রয় করে। অর্থাৎ যে সকল বস্তু পরস্পর পৃথক স্বভাবাপন্ন অসম্মিলিত তারা ক্ষুদ্র হয়েও সম্মিলিত হয়। বালুকা, প্রস্তুকণা প্রভৃতি। পরস্পর সংহত স্বভাব জল, তৈল, ঘৃত প্রভৃতির মিলনের কথা বিচিত্র নয়। সিন্ধ ও অকঠিন বস্তু অতি সহজে মিলিত হয়। ১১০।

অনুবাদ : বিদ্বানগণ, অসৎলোকের সঙ্গ করে না। ১১১।

মর্মার্থ : সংসর্গে দোষ ও গুণের বিপর্যয় ঘটে থাকে। অসসঙ্গে পতিত হলে সৎ ও অসৎ হয়। সতের সঙ্গে সদ্ভাবে মিলিত হলে অসও সৎ হতে পারে। কিন্তু সত্যের অসৎ হওয়া সহজ, অসতের সৎ হওয়া বড়ই কঠিন। অতএব সাধু নিপুণ ব্যক্তি অসতের সঙ্গে মিলিত হবে না, নির্মল জল ধুলার সঙ্গে মিলিত হলে কর্ম হয়। ১১১।

অনুবাদ : হংস কখনো মৃতবনে ক্রীড়া করে না। ১১২।

মর্মার্থ : হংস পদ্মবনে বিচরণ করে। পদ্মবন নষ্ট হয়ে গেল, সেখানে হংসগণ আর যায় না। যার যেটি যোগ্য স্থান, সে তাদৃশ স্থানে গমন ও অবস্থান করে। বিঘ্নসঙ্কুল কিংবা অযোগ্য স্থানে কেউ বাস করতে ইচ্ছা করে না। তাদৃশ স্থান নিবাসে স্বীয় অবনতি ঘটে। ১১২।

অনুবাদ : মানব অর্থের নিমত্তিই কার্যে প্রবৃত্ত হয়। ১১৩।

মর্মার্থ : স্বার্থ ও করুণাপ্রেরণায় লোকের প্রবৃত্তি হয়। কোথাও স্বার্থ, কোথাও করুণা। এই উভয় যেখানে নাই, সে স্থলে লোকের প্রবৃত্তিও নেই। প্রয়োজনহীন প্রবৃত্তি অজ্ঞ লোকের হয়। পদচ্যুত, অর্থহীন ব্যক্তির সময়ে বন্ধুও শত্রুরূপে দাঁড়ায়। যেখানে কোনো প্রয়োজন থাকে না, সেখানে প্রাজ্ঞ ব্যক্তি উদাসীন হয় ॥ ১১৩ ॥

ইতি চাণক্যসূত্রানুবাদে পঞ্চম অথ্যায় ॥ ৫॥

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *