২. চাণক্য সূত্র – দ্বিতীয় অধ্যায়

চাণক্য সূত্রদ্বিতীয় অধ্যায়

কাৰ্যান্তরে দীর্ঘসূত্রতা ন কর্তব্যা ॥ ১ ॥
ন চলিত চিত্রস্য কাৰ্য্যাবাপ্তি ॥ ২॥
হস্তাগতাবমানাৎ কাৰ্যব্যক্তি ক্রমো ভবতি ॥ ৩ ॥
দোষবর্জিতানি কাৰ্য্যাণি দুর্লভানি ॥ ৪ ॥
দুরনুবন্ধং কাৰ্য্যং নারভেত ॥ ৫ ॥

অনুবাদ : কার্য আরম্ভ করে তার মধ্যে বৃথা কালক্ষেপন করা উচিত নয়। ১।

মর্মার্থ : পূর্বে উক্ত হয়েছে যে, কার্যারম্ভের পূর্বে তার শুভাশুভ চিন্তা করা উচিত নয়। সম্প্রতি আরদ্ধ কার্যে বৃথা কালক্ষেপন করার প্রতিষেধ এই সূত্র দ্বারা কথিত হয়েছে। আরদ্ধ কার্যে যে বৃথা সময় নষ্ট করা হয়, তার নাম দীর্ঘসূত্রতা; এই দীর্ঘসূত্রতা দ্বারা বর্তমান কার্য ও ভাবী কার্য এই উভয়ের অনিষ্ট হয়। ১।

অনুবাদ : অস্থিরচিত্ত পুরুষের কার্য ও তার ফললাভ হয় না। ২।

মর্মার্থ : সকল কার্যে চিত্তের ধৈর্য ও স্থৈর্যের একান্ত আবশ্যক। মন স্থির হলে ইন্দ্রিয়গণ স্থির হয়, ইন্দ্রিয় স্থির হলে বিষয়ের প্রকৃতভাবে অবধারণ করা যায়, কার্যে কোনোরুপ ভ্রম জুটি হয় না। সকল ইন্দ্রিয়ের ব্যাপার বা বৃত্তি মনের বৃত্তিপূর্বক হয়; সুতরাং মনের যখন যেরূপ ব্যাপার ঘটবে ইন্দ্রিয়গণের বৃত্তিও সেরূপ ভাবে হবে। ২।

অনুবাদ : কোনো বিষয় হস্তগত হলে তার প্রতি অবজ্ঞা করা অনুচিত্ত, অবজ্ঞা দ্বারা কার্যে ব্যতিক্রম ঘটে। ৩।

মর্মার্থ : যা হস্তগত হয়, তার প্রতি যত্ন করা উচিত। হস্তগত বস্তু কিংবা কার্য অবজ্ঞাত হলে তার ফল ভিন্নরূপ দাঁড়ায়, অর্থাৎ যথাযথ ফল না হয়ে বিপরীত ফল হয়। উপস্থিত বিষয়কে তুচ্ছজ্ঞান করলে তা অবহেলায় নষ্ট হয়। পরে প্রয়োজনে তা শত অনুসন্ধানেও পাওয়া যায় না। ৩।

অনুবাদ : দোষশূন্য কার্য জগতে প্রায় দুর্লভ। ৪।

মর্মার্থ : যাতে কার্যকালে কোনো দোষ উপস্থিত হয়ে কার্যে বিঘ্ন উপস্থিত না হয়, সেজন্য কার্যারম্ভের পূর্বে তাতে অবহিত হতে হবে। জগতে দোষশূন্য কার্য দুর্লভ বলে কার্যে পরাসুখ হওয়া উচিত না, নির্দোষ কার্য করতে সচেষ্ট হতে হয় এবং দোষ ভয়ে কার্য পরিহার করাও উচিত না। ৪।

অনুবাদ : দোষবহুলকার্য আরম্ভ করবে না। ৫।

মর্মার্থ : দোষযুক্ত কার্য কিংবা অনিষ্টসূচক কার্য আরম্ভ করা উচিত নয়, সেরূপ কার্যারম্ভে কোনো সুফলের আশা করা যায় না। যে কার্য নিজের ও অপরের হিতকর, এমন কার্য আরম্ভ করা উচিত নয়। ৫।

দেশকালবিৎ কাৰ্য্যং সাধয়তি ॥ ৬ ॥
কালাতিক্রমাৎ কালএব তফলং পিবতি ॥ ৭ ॥
ক্ষণং প্রতিকালবিক্ষেপং ন কুৰ্য্যাৎ সৰ্ব্বকৃত্যেষু ॥ ৮ ॥
দেশে কালে চ কৃত ফলবৎ।। ৯।।
দেশকাল বিহীনং কাৰ্য্যং সুসাধমপি দুঃসাধম্ ॥ ১০ ॥

অনুবাদ : দেশ কালাভিজ্ঞ ব্যক্তি স্বীয় কার্য সাধন করেন। ৬।

মর্মার্থ : দৈপিক ও কালিক অবস্থায় প্রাজ্ঞ ব্যক্তি আক্লোশ কার্য সাধনে সমর্থ হয়। নিয়মের পরিবর্তন না হলেও দেশ, সমাজ, কাল, বস্তুর পরিবর্তন ঘটে থাকে। অতএব সকল সময়ে সকল দেশে সর্ব সমাজে সকল অবস্থায় এক নিয়মে চলা কঠিন, তার ব্যক্তিক্রমও হতে পারে–এই সকল বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তি কার্য সাধনে বিশেষ দক্ষ হয়। ইহা নৈতিক সম্বন্ধেই খাটে, ধর্ম ও ঈশ্বর বিষয়ে নয়। ৬।

অনুবাদ : কার্যে কালক্ষেপণ করলে সে কালই কার্যফল হরণ করে। ৭।

মর্মার্থ : কার্য আরম্ভের পূর্বে ও পরে বৃথা সময়ক্ষেপণ করা উচিত নয়, তাহলে কার্যের অধিকরণ কালই তার ফল অপহরণ করতে থাকে, অর্থাৎ সেই কার্যের ফল পাওয়া যায় না। যে কার্যের যা যোগ্য কাল, সে কালেই সে কার্য আরম্ভ করে ক্ষিপ্রতা সহকারে তা সম্পন্ন করতে হয়। অকালে কার্যারম্ভ করা, আরম্ভ করে সময়ক্ষেপণ করা–এই উভয়ই অবিধেয়। ৭

অনুবাদ : সকল কার্যে একটি মুহূর্তও কাল বিক্ষেপ করা উচিত নয়। ৮।

মর্মার্থ : আরম্ভ করে কোনো কার্যে অথবা কার্য আরম্ভের পূর্বে উপযুক্ত কাল উপস্থিত হলে, তার এক মুহূর্তও বৃথা বিক্ষেপ করা উচিত নয়, সেরূপ কালক্ষেপণ করলে কালই কার্যফল বিনষ্ট করে ইহা পূর্বসূত্রেও ব্যক্ত হয়েছে। এই সূত্র তার বিশেষ উক্তি মাত্র। ৮।

অনুবাদ : উপযুক্ত দেশে ও কালে কার্য অনুষ্ঠিত হলে তা সফল হয়। ৯।

মর্মার্থ : যেই কার্যের যেটি যোগ্য দেশ বা স্থান এবং যেই কার্যের যেটি প্রশস্তকাল, সেরূপ উপযুক্ত স্থানে ও যথাযোগ্য কালে কার্যের অনুষ্ঠান করলে সেই কার্য আশু-ফলজনক হয়, অন্যথা অনুষ্ঠিত কার্য নিষ্ফল হয়। ৯।

অনুবাদ : অযোগ্য দেশে, কালে অনুষ্ঠিত কার্য সুসাধ্য হলেও তা দুঃসাধ্য হয়। ১০।

মর্মার্থ : দেশ, কাল বর্জিত, অর্থাৎ যে কার্যের প্রতি যে দেশ ও কাল উপযুক্ত নয় তাদৃশ দেশ, কালে অনুষ্ঠিত কার্য অতি সুখকর হলেও তা কষ্টসাধ্য হয়ে উঠে। অতএব উপযুক্ত দেশ কালে-কার্যসাধন করা উচিত। ১০।

পরীক্ষাকারিণিশ্রীশ্চরং তিষ্ঠতি ॥ ১১ ॥
নীতিজ্ঞো দেশেকালৌ পরীক্ষেত ॥ ১২ ॥
সৰ্বোশ্চ সম্পদ উপতিষ্ঠন্তি ॥ ১৩ ॥
ভাগ্যবন্তমপ্যপরীক্ষাকারিণং শ্ৰীঃ পরিত্যজতি ॥ ১৪ ॥
জ্ঞানানুমানৈশ্য পরীক্ষাকর্তব্যা ॥ ১৫ ॥

অনুবাদ : যে ব্যক্তি পরীক্ষাপূর্বক সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে কার্য করে, তার শ্রী চিরকাল স্থির থাকে। ১১।

মর্মার্থ : ভালো, মন্দ, হিত, অহিত চিন্তাপুর্বক কার্যের অনুষ্ঠান করলে, তার শ্রী অর্থাৎ সম্পত্তি দীর্ঘকাল অবস্থান করে। মানবের সম্পদ নাশের কারণ, অবিবেকিতা, অদূরদর্শিতা, বিলাসিতা, সত্যহীনতা, মূর্খতা প্রভৃতি। শিক্ষিত ও ধীমান ব্যক্তি জ্ঞানপূর্বক কার্য করে বলে তার সম্পদ বিনষ্ট হয় না, তার গৃহে সতত লক্ষ্মী বিরাজ করে। ১১।

অনুবাদ : নীতিজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি দেশ ও কালের পরীক্ষা করবে। ১২।

মর্মার্থ : নীতি পারদর্শী ব্যক্তি কার্যের প্রধান সহায় দেশ ও কালের পরীক্ষা করবে। দেশ এবং কালের লক্ষণ পূর্বে উক্ত হয়েছে। অস্থানে বা অনুপযুক্ত কালে কার্য করলে, তা নিষ্ফল হয়। ১২।

অনুবাদ : প্রেক্ষাবান (মহামতি) পুরুষের সকল সম্পদ উপস্থিতি থাকে। ১৩।

মর্মার্থ : পূর্ব সূত্রে উক্ত হয়েছে, যে নীতিজ্ঞ ব্যক্তি দেশই কাল, পাত্র পরীক্ষাপূর্বক কার্য করবে, এই সূত্রে বলা হয়েছে তাদৃশ নিপুণ ব্যক্তির অভিজ্ঞতাহেতু সকল সম্পদ তাকে আশ্রয় করে থাকে। ১৩।

অনুবাদ : পরীক্ষা না করে কার্যকারী অবিমৃশ্যাকারী ব্যক্তি সৌভাগ্যবান হলেও তাকে শ্রী পরিত্যাগ করে। ১৪।

মর্মার্থ : ভাগ্যবান হলেও অবিবেকপূর্বক, অর্থাৎ দণ্ড দৰ্পের সহিত কোনো কার্য করবে না, সেরূপ অবিচালিত কার্য কর্তাকে শ্ৰী পরিত্যাগ করে থাকে। অবিচার, দর্প, দম্ভ প্রভৃতি ক্রমে মানবের অবনতি ও সম্পদ বিনাশের হেতু। ১৪।

অনুবাদ : প্রত্যক্ষ জ্ঞান ও অনুমান দ্বারা বিষয় পরীক্ষা করা উচিত। ১৫।

মর্মার্থ : শ্ৰম (একবস্তুতে অন্য বস্তুজ্ঞান), প্রমাদ (মনের অনবধানতা), বিপ্রলিপ্সা (প্রতারণার ইচ্ছা), ইন্দ্রিয়াপাটব ইন্দ্রিয়ের অপটুতা), এই সকল দোষশূন্য জ্ঞানই; যথার্থ জ্ঞান ঈদৃশ যথার্থ ও অনুমান প্রভৃতি দ্বারা (অর্থাৎ বস্তুর এক দেশ প্রত্যক্ষ ও অপর দেশ স্মরণ দ্বারা) বিষয়সমূহের পরীক্ষা করা উচিত। অনুমান শব্দোত্তর যে বহুবচন প্রযুক্ত হয়েছে, তার দ্বারা উপমান, আগম প্রমাণজনিত জ্ঞান বুঝতে হবে। ১৫।

অনুবাদ : যে ব্যক্তি যে কার্যে অভিজ্ঞ, তাকে সে কার্যে নিযুক্ত করা উচিত। ১৬।

যো যস্মিন, কর্মণিকুশলস্তং তস্মিন্নেবনিয়োজয়েৎ ॥ ১৬ ॥
দুঃসাধ্যমপি সুকরংকরোতি ॥ ১৭ ॥
অজ্ঞানিনা কৃতমপি নবহুমন্তব্যম ॥ ১৮ ॥
যাদৃচ্ছিকত্বাত, কৃমিরপিরুপান্তরাণিকিংনকরোতিঃ ॥ ১৯ ॥

মর্মার্থ : মতিমান্ চাণক্য তদীয় রাজনীতি শাস্ত্রে বলেছেন–উত্তম, মধ্যম, অধম অনুসারে যার যতটুকু গুণ ও যে কার্যে যার যোগ্যতা এরূপ বিবেচনাপূর্বক, প্রথমত রাজা তাদের স্ব স্ব কর্মে নিয়োগ করবে। প্রাজ্ঞ ব্যক্তিকে নিযুক্ত করলে রাজার তিনটি গুণ প্রকাশিত হয়, যশ:স্বর্গ, বিপুল ধনাগণ। যোগ্য স্থানেই যোগ্য ভূষণ ও ভূত্যগণকে নিযুক্ত করবে। অযোগ্য স্থানে যোগ্যকে এবং অযোগ্যকে যোগ্য স্থানে নয়। যেমন মস্তকের চূড়ান্থানীয় চূড়ামণি পাদদেশে নিবেশিত হয় না। ১৬।

অনুবাদ : নিপুণ ব্যক্তি দুঃসাধ্য কার্য ও অনায়াসে সাধন করতে পারে। ১৭।

মর্মার্থ : পূর্ব সূত্রে বলা হয়েছে কার্যে উপযুক্ত ব্যক্তিকে নিযুক্ত করবে, এই সূত্রে তার ফল কথিত হয়েছে। কার্যে শক্তিমান, প্রাজ্ঞ ব্যক্তিকে নিযুক্ত করলে সে অতিকষ্টা সাধ্য কার্যও অক্লেশে সাধন করতে সমর্থ হয়; অযোগ্য ব্যক্তির নিয়োগে সহজসাধ্য কার্যও দুঃসাধ্য হয়, অতএব কঠিন ও বৃহৎ কার্যে অযোগ্যদের নিয়োগ করা উচিত নয়। ১৭।

অনুবাদ : অজ্ঞ লোকের দ্বারা সাধিত কার্ষকেও অত্যধিক আদর করা উচিত নয়। ১৮।

মর্মার্থ : অজ্ঞতার মানব বৃদ্ধিহীন ও অদূরদর্শী হয়, অতএব তাদৃশ লোক দ্বারা অনুষ্ঠিত কার্য প্রচুর ফলদায়ক বলে মনে করা উচিত নয়। অনুষ্ঠিত কার্যে ত্রুটি থাকলে তাতে সুফলের আশা বৃথা। কোনো অযোগ্য দ্বারা কোনো কার্য সিদ্ধ হয়, তথাপি পরিণাম সুখকর নয় ভেবে নিগ্হ থাকাই বিধেয়। ১৮।

অনুবাদ : স্বেচ্ছা আরচরণহেতু কৃমিও কি কোনো বিষয়ে রূপান্তর করে না। ১৯।

মর্মার্থ : পূর্ব সূত্রে বলা হয়েছে, অজ্ঞ লোকের সাফল্যকে যথেষ্ট মনে করবে, কেননা অজ্ঞ ব্যক্তির কার্য যথেচ্ছাচারপূর্ণ হয়ে থাকে। সেরূপ কৃমিও যাদৃচ্ছিক কার্য কি করে না, অর্থাৎ কীট, পতঙ্গ প্রভৃতিও উত্তম কার্য করতে সমর্থ না হলেও দৈবক্রমে অজ্ঞাতেই কিছু করে থাকে। অজ্ঞ লোকের কার্যও সেরূপ দৈব্যক্রমে কৃমির কার্যের ন্যায় অন্যথাভাবে প্রকাশ পায়। ১৯।

সর্বোশ্চ সম্পদ সৰ্ব্বোপায়েন পরিশ্রহেৎ ॥ ২০ ॥
সিদ্ধস্য কাৰ্য্যস্য প্রকাশনং কর্তব্যম্ ॥ ২১ ॥
জ্ঞানবতামপি দৈবমানুষদোষাৎ কাৰ্য্যাণিদুষ্যন্তি ॥ ২২ ॥
দৈবং শান্তিকৰ্ম্মণা প্রতিষেদ্ধব্যম্ ॥ ২৩ ॥

অনুবাদ : সকল উপায় দ্বারা অশেষ সম্পদ অর্জন (গ্রহণ) করবে। ২০।

মর্মার্থ : সাম, দান, দণ্ড, ভেদ এই চতুর্বিধ উপায় এবং কৌশল দ্বারা অশেষ সম্পদ পরিগ্রহ করবে, ক্রয়োদশ সূত্রে এই সূত্রের আভাস উক্ত হয়েছে। পরন্তু এই সূত্রটি তার অনুক্ত অংশের উক্তি ও ব্যাখ্যারূপে কথিত হয়েছে। সকল আদর্শ পুস্তকে এই সূত্রটি এই সংখ্যায় নেই, ত্রয়োদশ সংখ্যায় উক্ত হয়েছে। ২০।

অনুবাদ : কোনো কার্য সম্পন্ন হওয়ার পূর্বে যদি তা প্রকাশ পায়, তবে কার্যকর্তার অপটুতা, ক্লেশ এবং শত্রুর সন্ধান লাভ হয়। সেই কার্যে ফল হতেও বঞ্চিত হতে হয়। অতএব কার্যসিদ্ধ হওয়ার পূর্বে তার সন্ধান দেওয়া বা রহস্য প্রকাশ করা উচিত নয়। ২১।

অনুবাদ : সুধীজনগণের কার্যসমূহও দৈবদোষ ও মনুষ্যকৃত দোষে দুষ্ট হয়। ২২।

মর্মার্থ : প্রাজ্ঞ ব্যক্তিও যদি কোনো কার্য করে তা দৈব অর্থাৎ নিয়তির দোষে অথবা মানুষের (শত্রু প্রভৃতির) দোষে নিন্দিত কিংবা নিষ্ফল হয়। প্রাজ্ঞেরও প্রমাদ, শ্রম, ইন্দ্রিয়ের পটুতার অভাব, প্রতারণা প্রভৃতি থাকা সম্ভব। দৈবদোষ অনিবার্য, মনুষ্যকৃত দোষ, মনীষা, প্রযত্নকার্য দক্ষতার দ্বারা বিদূরিত করা যায়। ২২।

অনুবাদ : দৈব বিঘ্নের শান্তি ও স্বস্ত্যয়ন বর্ম দ্বারা প্রতিষেধ করণীয়। ২৩।

মর্মার্থ : মানুষের যখন অচিন্তিতভাবে বিঘ্ন উপস্থিত হয়, অর্থাৎ ভূকম্প, অশনিপাত, ঝঞ্ঝাবায়ু, গ্রহনক্ষত্র বৈগুণ্য ধুমকেতু-দর্শন, দুভিক্ষ, মহামরি প্রভৃতি উপস্থিত হয়, সে সময়ে আর্থবোক্ত শান্তি, স্বস্ত্যয়ন মন্ত্রশাস্ত্রোক্ত; গ্রহশান্তি প্রভৃতির অনুষ্ঠান করা উচিত। তৈল, শলতা, অগ্নি সত্ত্বেও প্রদীপ নির্বাপিত হয়, নতুন সুদৃঢ় ও বৃহৎ জলযান ও প্রবল বায়ু দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ডুবে যায়, অতএব দৈব-বিঘ্ন অবশ্য স্বীকার্য এবং তার প্রতিকারার্থে দৈব্যকর্মই সমাশ্রয়নীয়। ২৩।

মানুষীং কাৰ্য্য বিপত্তিং কৌশলেন বারয়েত ॥ ২৪ ॥
কার্যাবিপত্তৌ দোষান, বর্ণয়ন্তি বালিশাঃ ॥ ২৫ ॥
কাৰ্য্যার্থিনা দাক্ষিণ্য ন কর্তব্যম্ ॥ ২৬ ॥
ক্ষীরার্থী বৎসোমাতুরূধঃ প্রতিহস্তি ॥ ২৭ ॥

অনুবাদ : মনুষ্যকৃত নানারূপ বিপদকে বুদ্ধিকৌশল দ্বারা নিবারণ করতে হয়। ২৪।

মর্মার্থ : মানুষের যদি অনুষ্ঠিত কার্যে ভ্রম, প্রমাদ, অজ্ঞতাহেতু কিংবা অন্য দ্বারা কোনো বিঘ্ন উপস্থিত হয়, তা বুদ্ধির নিপুণতা দ্বারা নিবারণ করতে হয়। রোগ, শোক, দৈন্য প্রভৃতি কৌশলে ও ঔষধাদি দ্বারা নিবৃত্ত করবে। শত্রু দ্বারা অগ্নিদান, বিষ প্রয়োগ চৌর্য, দস্যুতা প্রভৃতিও বুদ্ধি বা কৌশল দ্বারা প্রতিহত করতে হয়। ২৪।

অনুবাদ : কার্যে কোনো বাধ্যবিপত্তি উপস্থিত হলে অজ্ঞ শিশু বা মূর্খগণ, কার্যকর্তার দোষ বর্ণনা করে। ২৫।

মর্মার্থ : কোনো কোনো সময় লোক কোনো কার্যানুষ্ঠান করেও স্বীয় ভ্রম, প্রমাদ, অনভিজ্ঞতাহেতু কার্যে ফল পায় না, তাতে শিশু ও অজ্ঞ ব্যক্তিগণ কর্মকর্তার দোষ কীর্তন করে, কিন্তু সুধীজনেরই দোষগুণ বিচারের অধিকার, অজ্ঞের তা নেই ইহাই দণ্ডাচার্য বলেছেন, অশাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তি কীরূপ দোষগুণ বিচার করবে? যেমন অন্ধ ব্যক্তি শ্বেত, পীত, রক্তগুণের দর্শন ও সে সমুদয়ের তারতম্য বুঝতে পারে না, তদ্রুপ অজ্ঞ ব্যক্তি এবং শিশু গুণ দোষের বিচার করতে সমর্থ হয় না। সুতরাং অজ্ঞদের সমালোচনা গ্রাহ্য নয়। ২৫।

অনুবাদ : কার্য তৎপর ব্যক্তি সরলতা প্রকাশ করবে না। ২৬।

মর্মার্থ : কানো কার্য করলে কার্যসিদ্ধির পূর্বে উদারতাপূর্বক সকল কথা প্রকাশ করবে না, সকল বিষয় প্রকাশ করে দিলে পরে সে কার্যে ব্যাঘাত ঘটার সম্ভাবনা অতএব; বিচারপুর্বক কোনো কথা ব্যক্ত করবে, কোনো বিষয় গোপন রাখবে। যাতে কার্যহানি না হয়, অপর কেউ বিরক্ত না হয়, এমনকি কার্যের সন্ধানও না পায়–এই সকল কর্মকর্তার একান্তভাবে বিচার করা আবশ্যক। ২৬।

অনুবাদ : দুগ্ধপানাভিলাষী গো-বস দুগ্ধের জন্য বারংবার মায়ের স্তনদেশে আঘাত করে। ২৭।

মর্মার্থ : গোদোহনকারী দুগ্ধার্থী গোপ, গোবসকে বারংবার ধেনুর স্তনদেশে মুখের দ্বারা আঘাত করায়। কিংবা ক্ষীরার্থী বসকে ধেনুর জঙ্ঘদেশে দৃঢ়বন্ধন করে গো-দোহন করে, বাস্তবিক তা বন্ধনের যোগ্য নয়, সেরূপ কার্যের বিশেষ অনুরোধে অসারল্যাদি করতে হয়। অথবা দুগ্ধার্থী বৎস, নিজ মুখের দ্বারা মায়ের স্তনে বহুবার আঘাত করে। (কোনো আদর্শ পুস্তকে ‘উধ’ স্থানে অধঃ’ এরূপ পাঠও আছে সেখানে অধঃশব্দের অর্থ জঙ্দেশ বলা হয়েছে)। ২৭।

নাস্তিদৈবাৎ কাৰ্যবিপত্তিঃ ॥ ২৮ ॥
ন দৈব প্রমাণানাং কাৰ্য্যারম্ভঃ ॥ ২৯ ॥
কার্যবাহ্যো নপোষয়ত্যাশ্রিতা ॥ ৩০ ॥
যাঃ কাৰ্য্যং ন পশ্যতি সোহন্ধঃ ॥ ৩১ ॥

অনুবাদ : দৈন হতে কোনো কার্যে বিপদ হয় না। ২৮।

মর্মার্থ : দৈব শুভা দৃষ্টি ও অশুভদৃষ্ট যাই হোক, তা হতে কখনো কার্যে বিপদ হয় না। পুরুষকার প্রবল থাকলে কার্যে দৈবদ্বারা কোনো বিঘ্ন হতে পারে না। অথবা দেবতা প্রসন্ন থাকলে কোনো কার্যে বিঘ্ন উপস্থিত হয় না। নীতিশাস্ত্রে উক্ত আছে প্রবল পুরুষকার দ্বারা দুর্বল দৈবকেও ব্যাহত করা যায়। দৈবই সকল কার্যে ফল প্রদান করে, ইহা কাপুরুষগণ বলে। পৌরাণিকগণ বলেন, দৈব হতে আর কোনো শ্রেষ্ঠবল নাই। ২৮।

অনুবাদ : যাদের দৈবই প্রমাণ (আশ্রয়) তাদের কার্যারম্ভ করা অনুচিত। ২৯।

মর্মার্থ : যাদের পুরুষকার নেই, দৈবমাত্রই আশ্রয়, তাদের কার্যারম্ভ করা ঠিক নয়। দৈব-অদৃষ্ট প্রত্যক্ষ হয় না, তার তত্ত্ব কঠিন: পুরুষকার না থাকলে কার্যের সম্পাদক যোগ্যসামগ্রী না হলে কার্যারম্ভ করা বৃথা। কার্যারম্ভের প্রতি বস্তু, কাল, যোগ্যতা নীতিজ্ঞান একান্ত আবশ্যক। ২৯।

অনুবাদ : কার্যশূন্য মানব নিজ অনুগত ব্যক্তিদিগকে পোষণ করে না। ৩০।

মর্মার্থ : কার্যে অসমর্থ, অকর্মণ্য পুরুষ অনুগতজনকেও পালন করতে সমর্থ হয় না। রাজ্যশাসন সৌকার্য, শিল্প, বাণিজ্য প্রভৃতি কার্য পরিচালন শক্তি থাকলে, বহু লোককে পরিপালন করা যায়, সে সমুদয় কার্যে শক্তির অভাব থাকে, কিংবা কোনো সুযোগ থাকে না, সেই সকল কার্যে অনুগত লোককেও পোষণ করা যায় না। ৩০।

অনুবাদ : যে ব্যক্তি কর্তব্য, কার্য দেখতে পায় না, সে অন্ধ। ৩১।

মর্মার্থ : যে নৃপতি স্বয়ং কিংবা মন্ত্রী, দূত প্রভৃতি দ্বারা কাজকর্ম দেখে না, সে অন্ধ বলে অভিহিত। অথবা যে নিজের কর্তব্যকার্য চক্ষু থাকতেও দেখতে পায় না, তাকে অন্ধ বলা হয়েছে। অন্ধ যেমন দৃষ্টিশক্তির অভাবে কোনো বস্তু দেখে না, সেরূপ অকর্মণ্য ব্যক্তি চক্ষু থাকতেও বস্তু দেখতে পায় না, অতএব সে অন্ধতুল্য। ৩১।

প্রত্যক্ষ-পরোক্ষানুমানৈঃ কাৰ্য্যাণিপরীক্ষেত ॥ ৩২ ॥
ন পরীক্ষাকারিণাং কাৰ্যবিপত্তি ॥ ৩৩ ॥
পরীক্ষা তাৰ্য্যা বিপত্তিঃ ॥ ৩৪ ॥
স্বশক্তিংজ্ঞাত্বা কাৰ্য্যামারভেত ॥ ৩৫ ॥

অনুবাদ : প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ ও অনুমান ও প্রমাণ দ্বারা কার্য সকল পরীক্ষা করতে হয়। ৩২।

মর্মার্থ : প্রত্যক্ষ চাক্ষুষ, শ্রাবণ, রাসন, স্পর্শন, ঘ্রাণেন্দ্রিয় জন্য এই পাঁচ প্রকার। পরোক্ষ-অতীন্দ্রিয় বা অপ্রত্যক্ষ, উক্ত পাঁচ প্রকার। অনুমান-পূর্ব প্রত্যক্ষ বস্তুর একদেশদর্শনে অপর দেশ জ্ঞান, তাকে অনুমিত্যাত্মক জ্ঞান বলে; যেমন কোনো শিল্পশালাতে প্রস্তুত দ্রব্য ও তার সংযুক্ত কারণ পূর্বে দেখে পরে স্থানান্তরে সেরূপ দ্রব্য দেখে তার কারণের অনুমান। সুতরাং সব সময় এই সকল উপায় দ্বারা সকল কার্য সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করলে তার ক্ষতি হয় না। ৩২।

অনুবাদ : যারা পরীক্ষাপূর্বক কার্য করে, তাদের কার্যে বিপত্তি হয় না। ৩৩।

মর্মার্থ : প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ ও অনুমান প্রমাণ দ্বারা পরীক্ষা (সুচিন্তা, আলোচনা, পরিদর্শন) করে কার্য সম্পাদন করলে সে কার্যে কোনো বিপদ হয় না, অবিমৃশ্য কারিতাপূর্বক কার্য করলে কার্যে বিঘ্ন হয়। পরীক্ষাপূর্বক কার্যকারীদের মধ্যে বিক্রমাদিত্য, ভোজরাজ, অশোক প্রভৃতি নাম উল্লেখযোগ্য। অবিবেশকপূর্বক কার্যকারী রাবণ, বেণরাজা, দুর্যোধন, শিশুপাল প্রভৃতি। ৩৩।

অনুবাদ : পরীক্ষাকার্য দ্বারা বিপদ থেকে উত্তীর্ণ হওয়া যায়। ৩৪।

মর্মার্থ : পরীক্ষা ভিন্ন বিপদ থেকে উদ্ধার হওয়া যায় না। যখন কোনো কার্যে বিপদ উপস্থিত হবে, স্বীয় বুদ্ধি, বিক্রমপূর্বক উপস্থিত হয়ে তখন পরীক্ষা প্রত্যক্ষাদি প্রমাণ দ্বারা করলে বিপদ হতে উদ্ধার পাওয়া যাবে। যেমন যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধার্থ উপস্থিতিরই জয় বা পরাজয় সম্ভাবনা, যে ঘরে বসে কেবল যুদ্ধের চিন্তা করে; তার নয়। বিপদেই বুদ্ধি ও শক্তির পরীক্ষা হয়, সুখের সময় নয়। (এই সূত্রটি কোনো কোনো আদর্শ গ্রন্থে দেখা যায় না, পূর্বসূত্র দ্বারা এই সুত্রাৰ্থ উক্ত হয়েছে)। ৩৪।

অনুবাদ : নিজের সামর্থ্য জেনে তারপর কার্যারম্ভ করবে। ৩৫।

মর্মার্থ : নিজ শক্তি জ্ঞানপূর্বক কার্য আরম্ভ করা উচিত। নীতিপক্ষে শক্তি তিন প্রকার ১. প্রভাব শক্তি, ২. উৎসাহ শক্তি ৩. মন্ত্রজাত শক্তি। কোষ, দণ্ড, বল (সৈন্যাদি) প্রভুশক্তি। পরাক্রম বা বিক্রমবল উৎসাহ শক্তি। পঞ্চাঙ্গ মন্ত্রই মন্ত্রশক্তি। সন্ধ্যাদি ষড়গুণ, সামাদি উপায় চতুষ্টয়ের যথানিয়মে অবস্থানই পঞ্চাঙ্গ মন্ত্রশক্তি। অন্য বিষয়ে শক্তি উৎসাহ, বল, সামর্থ্য, পরাক্রমাদি। সকল কার্যই শক্তনুসারে হওয়া উচিত। ৩৫।

ষঃ স্বজনংতর্পয়িত্ব শেষংভুঙক্তেমোসোহমৃতভোজী ॥ ৩৬ ॥
কাৰ্যানুষ্ঠানাদায়-মুখানি বর্ধন্তে ॥ ৩৭ ॥
নাতিভীরো কাৰ্যচিন্তা ॥ ৩৮ ॥
স্বামিনঃ শীলং বিজ্ঞায় কাৰ্য্যার্থী কাৰ্য্যং সাধয়েৎ ॥ ৩৯ ॥

অনুবাদ : যে ব্যক্তি স্বজন পরিজনের তৃপ্তিসাধনপূর্বক অবশিষ্ট ভক্ষ্যদ্রব্য ভোজন করে, সে অমৃত ভক্ষণ করে। ৩৬।

মর্মার্থ : জীবগণের মধ্যে নিজের যেরূপ হর্ষজনক বিষয়ে সুখ, ক্লেশজনক বিষয়ে দুঃখ হয়; তদ্রুপ আত্মগত অবিশেষহেতু সকলেই সমান সুধ দুঃখভাগী হয়। অতএব ভোজনাদির দ্বারা অপরের তৃপ্তিসাধনপূর্বক স্বয়ং তৃপ্ত হওয়া উচিত। সেরূপ আহারকে শাস্ত্রে অমৃত ভোজন বলেছে। কেবল নিজের তৃপ্তির জন্য যে আহার, তাকে পাপভোজন বলা হয়েছে। এরূপ পাপভোজন পশু প্রভৃতির মধ্যে আছে, সেহেতু সাধু, বন্ধু, অতিথি, দীন, অন্ধদিগকে ভোজন করিয়ে নিজের ভোজন করা উচিত। ৩৬।

অনুবাদ : কার্যারম্ভ দ্বারা ধনাদির আয় প্রধানভাবে বৃদ্ধি পায়। ৩৭।

মর্মার্থ : কার্যানুষ্ঠান ভিন্ন সকল দিক হতে ধনরত্নাদির বিশেষভাবে আয় বৃদ্ধি হয় না, আলস্যবশত উদ্যমহীন হয়ে থাকলে তার আয় বৃদ্ধির কথা দূরে থাকুক, সঞ্চিত ধনও চারদিকে শীঘ্র ব্যয় হয়ে যায়। অথএব সকল সময়ে আলস্য ত্যাগ ও উদ্যম, উৎসাহের সঙ্গে কার্যানুষ্ঠান দ্বারা ধন বৃদ্ধি করবে। ৩৭।

অনুবাদ : অতিশয় ভয়শীল ব্যক্তির কার্য চিন্তা হয় না। ৩৮।

মর্মার্থ : কোনো কার্যের মানসিক আলোচনা করতে হলে ধৈর্য ও ভয়শূন্য হতে হয়, ভয়শীল ও অধীর জনের কোনো বিষয়ের চিন্তা করার অধিকার নেই, তাদের সকল বিষয়েই ভ্রম, প্রমাদ, বুদ্ধিমন্দতা উপস্থিত হয়। অতএব নির্ভীক হয়ে কার্যালোচনা করবে। ৩৮।

অনুবাদ : প্রভুর অভিপ্রায় জ্ঞাত হয়ে কার্যার্থী ব্যক্তি কার্যসাধন করবে। ৩৯।

মর্মার্থ : যে যে বিষয়ের অধিপতি তার মনোগত ভাব ও আচরণ বুঝে কার্য করলে, সে অশেষ কার্য সাধনে সক্ষম হয়। প্রভুর স্বভাব না জেনে কার্য সাধনে ব্যয় হলে তাতে কার্যে ত্রুটি ও তার বিরক্তি হতে পারে, যেহেতু কার্যে অনিষ্ট ও ইষ্টের ফলভাগী প্রভু, কার্যার্থী কেবল তাতে নিমিত্ত মাত্র। ৩৯।

ধেনোঃ ক্ষীরং শীলজ্ঞোভুঙক্তে ॥ ৪০ ॥
ক্ষুদ্রোগুহ্য প্রকাশনমাত্মবতানক্রিয়েত ॥ ৪১ ॥
আশ্রিতৈরপ্যবমন্যতে মৃদুস্বভাবঃ ॥ ৪২ ॥
তীক্ষ্ণদণ্ড সৰ্বেরুদ্বেজনীয়ো ভবতি ॥ ৪৩ ॥

অনুবাদ : ধেনুর দগ্ধ তার স্বভাবজ্ঞ ব্যক্তিই পান করতে সমর্থ। ৪০।

মমার্থ : যে ব্যক্তি ধেনুর স্বভাব জানে, অর্থাৎ কীরূপ জল, তৃণ, কাঁচা ঘাস, সার্যপ মল প্রভৃতি দিলে তার পুষ্টি ও তৃপ্তি সেরূপ জল, তৃণাদি প্রদান করে ধেনুর তৃপ্তি-পুষ্টিসাধনপূর্বক দুগ্ধ দোহন করে সেই পান করতে পারে, অন্যে তা পারে না। সেরূপ প্রভুর স্বভাব জেনে তার কার্য দ্বারা সন্তোষ উৎপাদনপূর্বক কর্ম দ্বারা সুখভোগে প্রভুর চরিত্রজ্ঞ ব্যক্তিই সক্ষম হয়, এটি পূর্বসূত্রের উদাহরণরূপে ব্যক্ত হয়েছে। ৪০।

অনুবাদ : আত্মবান ব্যক্তি ক্ষুদ্র লোকের নিকট গুহ্য কথা প্রকাশ করবে না। ৪১।

মমার্থ : প্রশস্তমনা ব্যক্তি কখনো ক্ষুদ্র বা নীচ প্রকৃতির লোকের নিকট গোপনীয় কথা প্রকাশ করবে না, প্রকাশ করলে তদ্দ্বারা কার্যের ও নিজের বিশেষ হানি হয়। যেমন ছিদ্রযুক্ত পাত্রে জল রাখলে তা অলক্ষ্যেভাবে চলে যায়, সেরূপ খল লোকের নিকট রহস্য প্রকাশ করলে তা গুপ্ত না থেকে, যেখানে সেখানে প্রকাশিত হয়ে অনিষ্ট করে। ৪১।

অনুবাদ : রাজা কিংবা কোনো অধিপতি অতি মৃদু স্বভাব হলে, তাকে আশ্রিত জনগণও অবজ্ঞা করে। ৪২।

মর্মার্থ : সংসারে নিজের শক্তির অনুরূপ প্রভাব বা তেজ প্রকাশ করতে হয়। নীতিশাস্ত্রে উক্ত হয়েছে যে, নিজের শক্তির অনুরূপ কোপ প্রকাশ করবে। আত্মশক্তিসমং কোপং যোজানাতি স পন্ডিত। অন্যথা অনুগত ও ক্ষুদ্র লোকেরাও তার প্রতি অবজ্ঞা করে। অতএব রাজা স্বীয় প্রজাবর্গের নিকট যাতে ন্যূনতা। প্রকাশ না পায়, সেরূপ করবেন। ৪২।

অনুবাদ : অতি তীক্ষ্ণদন্ড প্রয়োগকারী রাজ্য, সকল লোকের নিকট উদ্বেগের পাত্র হয়। ৪৩।

মর্মার্থ : রাজা যদি অতি কঠোর দণ্ড প্রদান করে, তবে লোকসাধারণ তাকে সমাজে হিতের কারণ না বলে উদ্বেগ বা অশান্তির কারণ মনে করে; অতএব লঘু অপরাধে লঘুদণ্ড কঠোর অপরাধে গুরুদন্ড প্রয়োগ করা উচিত। বিবেকপূর্বক দণ্ড প্রযুক্ত হলে তা প্রজাস্থিতির নিমিত্ত হয়। দণ্ড আর্থিক, মানসিক, শারীরিক প্রাণগতভেদে নানা প্রকার। ৪৩

ততো যথার্হ-দণ্ডঃ স্যাৎ ॥ ৪৪ ॥
সারং মহাজনঃ সংগ্রহঃ পীড়য়তি ॥ ৪৫ ॥
অতিভারঃ পুরুষমবসাদয়তি ॥ ৪৬ ॥
যঃ সংসদি পরদোষংবক্তি স স্বদোষবহুত্বং প্রখ্যাপয়তি ॥ ৪৭ ॥

অনুবাদ : যার যেরূপ অপরাধ তার তদনুসারে দণ্ডবিধান করবে। ৪৪।

মমার্থ : অযোগ্য দন্ডের বিষয় পূর্বে নিষিদ্ধ হয়েছে। সম্প্রতি যার যেরূপ অপরাধ নিশ্চিত ও প্রমাণিত হবে, তার তদনুসারে শাস্তিবিধান হওয়া উচিত ইহা এই সূত্র দ্বারা সূচিত হলো। অপরাধ বিষয়ে ও বিচারপূর্বক দণ্ডবিধান বিষয়ে বিভ্রাট সংঘটিত হওয়া উচিত নয়। রাজা যদি অদন্ড্যকে দণ্ড দেন, দণ্ডনীয়কে দন্ড প্রদান না করেন, তার ঐহ্যিক ভীষণ দুর্নাম, রাজ্যহানি পারত্রিক নরক ভোগ হবে। ৪৪।

অনুবাদ : দরিদ্রের পক্ষে কিংবা ক্ষুদ্র বিষয়ে মহা জনসমাগম হলে তা ক্লেশকর হয়। ৪৫।

মর্মার্থ : দীনজনের পক্ষে ক্ষুদ্রকার্যে মহাজনের সংগ্রহ করা বিশেষ কষ্টদায়ক, যেহেতু তা ক্ষুদ্র কার্যে দরিদ্রের বিশেষ হানিকর হয়। অথবা সূত্রের পাঠান্তর অনুসারে অল্পসার অর্থাৎ অল্পজ্ঞ লোক, সে যদি সাধারণ বিদ্বানও হয়, তাকে কেহ প্রবীন বলে জানে না, অর্থাৎ মানে না, অতএব অল্পসত্ব লোকের সমাজে আদর হয় না। ৪৫।

অনুবাদ : কার্যের গুরুত্ব অধিক হলে তদদ্বারা পুরুষকে অবসন্ন করে। ৪৬।

মমার্থ : মানবের শক্তির কার্য হলে তার সম্পাদনে অবসন্ন হতে হয়, অথবা বহনযোগ্য বস্তু যদি শক্তির অধিক পরিমাণ হয়, তা দ্বারাও অবসাদগ্রস্ত হয়। অতএব অধিক গুরুভার বহনে ও শক্তির অতীত কার্যানুষ্ঠান পুরুষ অবসন্ন হয়, ভারবহন ও কার্য গ্রহণের পূর্বে তার গুরুত্ব জ্ঞান ও একান্ত আবশ্যক। ৪৬।

অনুবাদ : যে ব্যক্তি প্রকাশ্য সভায় পরের দোষ বলে, সে নিজের দোষ নানা প্রকারে খ্যাপন করে। ৪৭।

মর্মার্থ : প্রকাশ্য সভায় কারও দোষ প্রকাশ করলে নানা লোকের শ্রুতিগোচর, হওয়াতে সেই দোষগ্রস্ত ব্যক্তিও তা শুনতে পারে এবং যার দোষ বলা হলো, সেও দোষবক্তার দোষ অন্বেষণ করে সাধারণ প্রকাশ করতে পারে, অতএব পরের দোষ কীর্তন করতে গেলে নিজের দোষ প্রকাশেরই অবসর দেওয়া হয়, এই সম্বন্ধে কবি বলেছেন,-যদি একটি উপায় দ্বারা এই জগৎকে বশীভূত করতে ইচ্ছা কর, তবে অন্যের অপবাদরূপ শস্যক্ষেত্র হতে বিচরণশীল গো (বাক্য) কে নিবারণ কর। সূত্রে সভার উল্লাস থাকতে গোপনে কোনো বন্ধুকে বললে বিশেষ দোষ হয় না। ৪৭।

আত্মানমেবপীড়য়ত্যনাত্মবতাংকোপঃ ॥ ৪৮ ॥
নাস্তাপ্রাপ্যং সত্ত্ববতাম্ ॥ ৪৯
সাহসে খলু শ্রীর্বসতি ॥ ৫০ ॥
ব্যসনার্তোবিস্মরত্য প্রবেশন ॥ ৫১ ॥

অনুবাদ: ক্ষুদ্র ব্যক্তির ক্রোধ দ্বারা মহামতি পুরুষের মনে ব্যথা জন্মে। (১) অথবা অনীতিজ্ঞ পুরুষ স্বীয় ক্রোধ দ্বারা আত্মাকেও বিনাশ করে (২)। ৪৮।

মর্মার্থ : ক্ৰোথ মানবের শত্রু ক্ষুদ্রচিত্র লোকের ক্রোধ দ্বারা স্বীয় ধৈর্য না থাকাতে নিজের আত্মনাশ ঘটে। কিংবা বিবেক জ্ঞানহীন পুরুষেরা ক্রোধের দ্বারা মহামতি জনের মনে ব্যথা পায়। মতিমান ব্যক্তি ধৈর্যশীল বলে স্বীয় ক্রোধ (চিত্তেজ্বলন বা উদ্দীপনভাবকে ক্রোধ বলে) দ্বারা বিশেষ ক্ষতি হয় না ও অন্যের বিপদ ঘটাতে পারে। ৪৮।

অনুবাদ : প্রশস্তমনা ব্যক্তির কিছুই অপ্রাপ্য নেই, তার মনীষা বলে সকলই সুলভ। ৪৯।

মর্মার্থ : মহামতি ব্যক্তির স্বীয় প্রতিভাবলে যা দুর্লভ, তাও অতি সুলভ হয়। অথবা, সত্যশীল পুরুষের জগতে কিছুই অপ্রাপ্য নেই, যা অন্যের পক্ষে অপ্রাপ্য তাও সত্যশীলের সত্য বলে সুপ্রাপ্য। যার যত্ন উদ্যম, অধ্যবসায়, প্রতিপূর্ণভাবে বিদ্যমান, তার পক্ষে সকল সুলভ, শক্তিহীনের পক্ষেই জগতে বহু বিষয় দুর্লভ বা অপ্রাপ্য। যে বিষয়ে একবার যত্ন করলে কার্যসিদ্ধ হয় না, সে বিষয়ে নানা কৌশল বহুবার যত্ন করবে। ৪৯।

অনুবাদ : সাহসেই শ্রী নিবাস করে থাকেন, সাহসযুক্ত পুরুষকে সম্পদ, নিত্যই আশ্রয় করে। ৫০।

মর্মার্থ : পুরুষের কর্মক্ষেত্রে গুণাবলির মধ্যে সাহসই প্রধান, সাহস না থাকলে সকল কার্যেই ভীতির সঞ্চার হয়। প্রবাদ আছে, সাহসযুক্ত লোককে লক্ষ্মী আশ্রয় করে। তাই সূত্রকার ব্যক্ত করেছেন সাহসেই শ্ৰী বাস করেন। ‘সাহস’ উদ্যম, শৌষ, কৃতজ্ঞতা, ক্রিয়ানিপুণতা, ব্যসন বর্জন প্রভৃতি গুণসম্পন্ন পুরুষকে লক্ষ্মী স্বয়ং আশ্রয় করেন। অতএব উক্ত গুণাবলি অর্জন করতে পারলে নিশ্চয় লক্ষ্মীর কৃপাপাত্র হওয়া যায়। ৫০।

অনুবাদ : বাসন-পীড়িত ব্যক্তি কার্য মধ্যে প্রবেশ করতে না পারাতে কার্যবিস্মৃত হয় (১) অথবা ব্যসনে অতি আসক্ত ব্যক্তি উৎসাহ প্রভৃতি গুণশূন্যহেতু পূর্বোক্ত শ্রীকেও বিস্মৃত হয়। (২)। ৫১।

মর্মার্থ : ব্যসমৃগয়া, অক্ষক্রীড়া দিবান্দ্রিা, ঈষ, পরনিন্দা, কম বিষয়ে চর্চা, বাদ্য, নৃত্য, গীতে আসক্তি, বৃথা ভ্রমণ, এই দশটি কামজাত ব্যসন। পিশুনতা, অতিসাহস, পরদ্রোহ, ঈর্ষা, অসূয়া, অর্থদূষণ, বাক্যদণ্ডজ, পুরুষতা, এই আটটি ক্রোধজাত ব্যসন। ব্যসনে আসক্ত ব্যক্তি কোনো কার্যে মনোনিবেশ করতে অক্ষম হয়ে তা ভুলে যায়। কিংবা পূর্বসূক্ৰাক্ত সম্পদমার্গে প্রবেশ করতে না পেরে শ্রীকেই বিস্তৃত হয়।৫১।

নাস্ত্যনন্তরায়ঃ কালক্ষেপ ॥ ৫২।
অসংশয়বিনাশাৎ সংশয়-বিনাশঃ শ্রেয়া ॥ ৫৩।
অপর ধনানপেক্ষং কেবলমর্থদানং শ্রেয়ঃ । ৫৪।

অনুবাদ : বিঘ্নশূন্য পুরুষের সময় নষ্ট হয় না। (১)। (সূত্রের পাঠান্তরহেতু) কার্যে কালক্ষেপণ হলে অন্তরায় ঘটে (২)।৫২।

মর্মার্থ : যার কোনো বিষয়ে কালক্ষেপ হয় না, তার কার্য অতি শীঘ্র সম্পন্ন হয়, কার্যফলও শীঘ্র লাভ হয়, অথবা বৃথা কালক্ষেপণ করলে তাতে অস্থায় বা বিঘ্ন উপস্থিত হয়। কার্যে বিঘ্নহীন পুরুষের সময় নষ্ট হয় না, সময় বৃথা নষ্ট করলেও কার্যে বিঘ্ন উপস্থিত হয়, সূত্রের পাঠাস্থর থাকতে এই দুইরকম অর্থ প্রকাশ পায়। পাঠান্তরিত সূত্র যথা নাস্ত্যনন্তরায়: কালবিক্ষেপে কালক্ষেপণ করলে কার্যে অন্তরায় আছে। ৫২।

অনুবাদ : অসংশয় বিনাশ হতে সংশয় বিনাশ হওয়া বাঞ্ছনীয়। ৫৩।

মমার্থ : সংশয় নষ্ট করে কার্য করতে হয়, সন্দেহ থাকলে কার্যে প্রবৃত্ত হতে নেই, হয় কি না হয়? এরূপ দুই পক্ষকে যে জ্ঞান আশ্রয় করে, তাকে সংশয় বা সন্দেহ বলে। সংশয় বর্তমান থাকলে, কোনো বিষয়ে বিশ্বাস করতে দেয় না। তাতে কবি বলেছেন, যদি সন্দেহ দ্বারা সকল বিষয় আক্রান্ত হয়, তবে কোথায়বা প্রবৃত্তি হবে, কোথায় বা নিবৃত্তি জন্মাব। সংসারে কীরূপেই বা জীবনধারণ করা যাবে? সংশয় বা সন্দেহ হিতজনক কার্যেও প্রবৃত্ত হতে দেয় না। ৫৩।

অনুবাদ : অন্যের ধনের অপেক্ষা না করে কেবল অর্থদান করাই উত্তম কার্য। ৫৪।

মর্মার্থ : প্রত্যুপকার ও স্বার্থ বুদ্ধিশূন্যভাবে শুদ্ধ দান করা প্রশস্ত, প্রত্যুপকার ও যশ স্বার্থ বুদ্ধিতে যে দান তা নিকৃষ্ট দান বা হীন দান, এরূপ দান দ্বারা ধর্ম ও হিতসাধন কম হয়। কলিতে একমাত্র দানই প্রশস্ত উদ্ধৃত্ত ধনের দান ভিন্ন আর উত্তম গতি নেই। ধরেনর তিনটা গতিদান, ভোগ ও সঞ্চয়। বেদে উক্ত আছে–দান দ্বারা শুত্রু মিত্র হয়, দানেই সকল প্রতিষ্ঠিত হয়, সেহেতু দানকে পরম শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে। ৫৪।

ন্যায়াগতোহৰ্থঃ ॥ ৫৫ ॥
তদ্বিপরীতেহর্থাভাসঃ ॥ ৫৬ ॥
যোধৰ্ম্মার্থেনপয়তি সকামঃ ॥ ৫৭ ॥
তদ্বিপরীতঃ কামাভাসঃ ॥ ৫৮ ॥

অনুবাদ : সদুপায়ে লব্ধ অর্থই প্রকৃত অর্থ ॥ ৫৫ ॥

মর্মার্থ : অর্থ নানা প্রকারে লাভ হয়। জগতে অর্থ লাভের বহু উপায় আছে, সে সমস্ত উপায়ের মধ্যে অন্যের পীড়া সৃষ্টি না করে সদুপায়ে যে অর্জিত অর্থ, তাই প্রকৃত অর্থ। অসদুপায়ে অর্জিত অর্থ অনেক সময় অনর্থের হেতু হয় এবং অর্থার্জন কর্তাকেও সুখ না দিয়ে বিপদগ্রস্ত করে, লব্ধ অর্থ ও সঞ্চিত অর্থ দ্বারা স্বীয় ও পরের হিত হওয়া একান্ত উচিত। উদ্বৃত্ত অর্থের সদব্যয় বাঞ্ছনীয়। ৫৫।

অনুবাদ : ন্যায়পথ ভিন্ন অন্যায় পথে উপার্জিত যে অর্থ, তা অৰ্থতুল্য প্রকৃত অর্থ নয়। ৫৬।

মর্মার্থ : সৎপথে যে ধনাগম হয় না, সে ধন প্রকৃত ধন নয়, তা ধনের তুল্য, ত দ্বারা উপকার অপেক্ষা অপকার অধিক পরিমাণে হয়, অন্যের সহিত বা পড়িন না করে অন্যায় পথে অর্থোপার্জন করা যায় না–তাতেই সোমদেব সুরির মতে তাদৃশ অর্থ সঞ্চয়ীকে কদর্য বলা হয়েছে। যে আশ্রিতের ও অন্যের অনিষ্ট সাধন করে, অর্জন করে সে দকর্য। যে উপায় হতে অধিক ব্যয় ও অসদ ব্যয় করে পরে ধনাভাবে বিপন্ন হয়, সে তাদাত্বিক। ৫৬।

অনুবাদ : যে ধর্ম ও অর্থের ব্যাঘাতকারী নয়, তা কাম (বিষয়ের ইচ্ছা)। ৫৭।

মর্মার্থ : পুরুষার্থের মধ্যে ধর্ম, অর্থ, কাম এই তিনটা নীতিশাস্ত্রের অভিপ্রেত, মোক্ষের প্রয়োজন নীতিশাস্ত্রে নেই বলে তা উল্লিখিত হয়নি। ধর্ম ও অর্থের আবরুদ্ধ অর্থাৎ ধর্ম ও অর্ধের পীড়াদায়ক নয়, এমন কামই অভিপ্রেত। ধৰ্মার্ত বিরোধী কাম দ্বারা ইন্দ্রিয়গণ ভোগের নিমিত্ত তীব্র তাড়নায় বিষয়াভিমুখে ধাবিত হয়, তাতে লোকের অচিরকাল মধ্যে আপদের সম্ভাবনা থাকে। তীব্র লালসায় মানব ধর্মাথ বিরোধী কামের বশবর্তী হয় অতএব এই দুইয়ের প্রতিকূল কামনা বর্জনীয়। ৫৭।

অনুবাদ : ধর্ম ও অর্থের পীড়াকর যে কাম, সে কাম কামের আভাস মাত্র। ৫৮।

মর্মার্থ : কামনা শূন্য কোনো কার্য দেখা যায় না, সকল কার্যই কামনামূলক হয়, কিন্তু ধর্ম ও অর্থের বিরোধী যে কাম, তা কামের আভাস মাত্র, প্রকৃত কাম নয়, তাকে অসাধু কামও বলা যেতে পারে। সূত্রকার তাকে কামাভাব বলেছেন, কামাভাস দুষ্ট কাম এই দুই, এই স্থলে একই অর্থে বুঝতে হবে। তাৎপর্য এই যে, ধর্ম ও অর্থের প্রতিকুল কাম অহিতজন, ইহা পূর্বে ব্যক্ত হয়েছে। ৫৮।

ঋজু-স্বভাবঃ পরিজননাদুর্লভঃ ॥ ৫৯ ॥
অবমানগত মৈশ্বৰ্য্য মবমন্যতে সাধুঃ ॥ ৬০ ॥
বহুনপি-গুণানেকোদোষো ঘসতে ॥ ৬১ ॥
মহতা সাহসং নপরেণ কৰ্তব্যম ॥ ৬২ ॥

অনুবাদ : সরল-স্বভাব আত্মীয়বর্গ ও আশ্রিত লোক দুর্লভ। ৫৯।

মর্মার্থ : মানব সুশিক্ষায়, সৎসঙ্গ ও সম্ভাবে অবস্থিত হলে সরল হয়, জন্মমাত্রে সরল হওয়া খুব সম্ভব নয়। সরল প্রকৃতি পরিজন বা পোষ্যবর্গ সংসারে পাওয়া দুর্লভ। শঠতা, কপটতা, ক্রুরতা, মিথ্যাচরণই ব্যবহার ক্ষেত্রে এই কলিকালে সুলভ, ইহা সূত্রকারই ব্যক্ত করেছেন। অতএব চেষ্টা, শিক্ষা প্রভৃতি দ্বারা স্বজনগণকে সরল স্বভাব করতে যত্ন পাবে। ৫৯।

অনুবাদ : সাধু ব্যক্তি অবজ্ঞা দ্বারা প্রাপ্ত ঐশ্বর্ষকে তুচ্ছ বোধ করেন। ৬০।

মর্মার্থ : সম্ভাবে যে অর্থ প্রাপ্ত হওয়া যায়, তা দ্বারা হিত হয়, অসাধু উপায়ে যা অর্জিত বা লাভ হয়, সে অর্থ দ্বারা অহিত ও দুনার্ম হয়। অপমান হতে আগত ঐশ্চর্যকে সাধু স্বীয়সতাতা হানি ভয়ে অবজ্ঞা করেন। সাধুতা রক্ষা করতে হলে অসৎ উপায়ে অর্থালাভ বাঞ্ছনীয় নয়, তদদ্বারা লোক সমাজে অবজ্ঞাত ও অবিশ্বস্ত হতে হয়। ৬০।

অনুবাদ : এক প্রবল দোষ, বহু গুণকেও গ্রাস করতে সমর্থ। ৬১।

মমার্থ : অনেক গুণকে একটি দোষ গ্রাস করতে পারে, গুণ মানবের উৎকর্ষের জনক, দোষ তার মালিন্যকারক। অতএব উন্নতি বিধায়ক গুণ, দোষ অধঃপতনের হেতু। ‘মানবের এক দারিদ্র্য দোষ গুণরাশিকে নাশ করে’ ইহা কবি বলেছেন। ধনুর বংশদণ্ড অতি বিশুদ্ধ হয়েও গুণ বর্জিত হলে কার্যক্ষম হয় না ‘প্রতাপ বংশধর হয়েও গৃহহীন হলে প্রসিদ্ধ লাভ করতে পারে না’। অতএব গুণ অপেক্ষা দোষ, মানবের পতনের হেতু বলে অল্প হলেও তা পরিহার্য। ৬১।

অনুবাদ : শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি অপর সমশক্তির সহিত সাহস করবে না। ৬২।

মর্মার্থ : শক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি নিজের সমান অপর শক্তি মানের সহিত সাহস প্রকাশ করবে না, তাতে নিজের হানি ও পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। অথবা মহান ব্যক্তি সাহস প্রকাশ করবে না, কেবল কার্যই করবে। কার্যশূন্য সাহস দ্বারা কোনো ফলোদয় হয় না, অতএব স্বীয় শক্তি ও পরের শক্তি জেনে সাহস প্রকাশ করবে। ৬২।

কদাচিদপিচারিত্রং নলয়েৎ ॥ ৬৩ ৷
ন ক্ষুধার্তোহপি সিংহণঞ্চতি ॥ ৬৪।
প্রাণাদপি প্রত্যয়োরক্ষিতব্যঃ ॥ ৬৫
পিশুনঃশ্রোতা পুত্রদারৈরপিত্যজ্যতে ॥ ৬৬ ।
বালাদপ্যর্থজাতং শুণুয়াত্ ॥ ৬৭।

অনুবাদ : কখনো স্বীয় চরিত্র লঙ্ঘন করবে না। ৬৩।

মর্মার্থ : ব্যবহার ক্ষেত্রে মানবের চরিত্র বিশুদ্ধি একান্ত আবশ্যক, অপর গুণ প্রকাশের পূর্বে স্বভাব বা চরিত্র অগ্রে প্রকাশ পায়। নীতিবিদগণ বলেছেন, অতীত্যহি গুণাহ সবান্ স্বভাববামুদ্ধি বৰ্ততে। সকল গুণকে অতিক্রম করে নিজ স্বভাব বা চরিত্র গুণাবলির মস্তকে অবস্থান করে। সুশীলতা দ্বারা অনেককে বশীভূত করে অনায়াসে বহু কার্য সাধন করা যায়। সচ্চরিত্রতা প্রদর্শন করতে পারলে শিক্ষিত জনগণের বিশ্বাসভাজন হওয়া যায়। ৬৩।

অনুবাদ : ক্ষুধায় পীড়িত হয়ে সিংহ কখনো ঘাস খায় না। ৬৪।

মর্মার্থ : মনস্বী শক্তিমান পুরুষ বিপদ জালে জড়িত হলেও স্বীয় পথচ্যুত হয় না। দুঃখ, শোক, বিপদ ক্ষণস্থায়ী, সত্য অবিনশ্বর, সত্যই জগতের স্থিতির হেতু, অতএব মহাশক্তি পুরুষ সম্পদ, বিপদ অর্থাৎ সকল অবস্থায় নিজ মহত্ত্ব হারায় না, যেমন সিংহ অতিশয় ক্ষুধার্ত হয়েও তৃণ ভোজন করে না। ৬৪।

অনুবাদ : প্রাণ হতেও শ্রেষ্ঠ জ্ঞানে প্রত্যয়কে রক্ষা করবে। ৬৫।

মর্মার্থ : প্রত্যয় অর্থাৎ সংসারে বিশ্বাসমূলক সকল ব্যবহার করা হয়, সেই প্রত্যয়ের ব্যতিক্রম ঘটলে, সকল বিষয়ে (বিশ্বাসের অভাব হেতু) ব্যবহারে ব্যতিক্রম ঘটে। কার্য ক্ষেত্রে পরস্পর বিশ্বাস না থাকলে কার্য সম্পাদন অসম্ভব, বিশ্বাসহীন সমাজ সকল বিষয়ে বিপন্ন ও অনুন্নত; অতএব প্রাণের অনুরূপ বিশ্বাসকে যত্নপূর্বক পালন করবে। ৬৫।

অনুবাদ: খল প্রকৃতি শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তিকে পুত্র ও স্ত্রী পরিত্যাগ করে। ৬৬।

মর্মার্থ : খল স্বভাব ব্যক্তি শায়েস্তা হলেও তাকে স্বীয় পুত্র, পত্নী পর্যন্ত ত্যাগ করতে বাধ্য, যেহেতু তাদৃশ্য লোকের দ্বারা নিজের এবং অন্যের বিশেষ ক্ষতির সম্ভাবনা। কবি বলেছেন, মন্ত্র ও ঔষধ দ্বারা সম্পর্কেও বশীভূত করতে পারা যায়, কিন্তু পিশুন ব্যক্তিকে কোনো উপায়ে সৎপথে আনা যায় না। মন্ত্রৌষধি বশঃসপোন খল কদাচন। সূত্রে পরিত্যাগ শব্দের অর্থ সঙ্গ ত্যাগ, গুরুত্বরভাবে অনিষ্ট সাধন করা নয়। ৬৬।

অনুবাদ : শিশুর নিকট হতেও সৎ বিষয়সমূহ শ্রবণ করবে। ৬৭।

মর্মার্থ : সদ্‌গুণ সকলের নিকট হতে অর্জন করা যায়, সৎ অর্থ সকলও শ্রবণ করা উচিত, শিশু বা বালকের কোনো গুরুত্ব না থাকলেও বিষয়ের গুরুত্ব থাকতে পারে। যেমন পশুপক্ষীর নিকট হতে গুণ শিক্ষা করার উপদেশ লঘু চাণক্যে আছে, তদ্রপ বালক হতেও সৎ বিষয়সমূহ শ্রবণ করা যেতে পারে। কেবল বালক নয়, বুদ্ধিমান অজ্ঞ হতেও সৎ কথা শ্রবণ করবে। ৬৭।

সত্যমপাশ্রদ্ধেয়ং ন বদেত ॥ ৬৮ ॥
নাগ্নিমিচ্ছতা ধূমস্ত্যজ্যতে ॥ ৬৯ ॥
বিপশ্চিৎস্বপি সুলভা দোষাঃ ॥ ৭০ ॥
নাস্তি রত্নমখণ্ডিতস্‌ ॥ ৭১ ॥

অনুবাদ : অনাদরণীয় বিষয় সত্য হলেও বলবে না। ৬৮।

মর্মার্থ : সত্য কথা বলাই নিয়ম, কিন্তু সে সত্য বিষয় যদি অশ্রদ্ধেয় হয়, তবে তা বলা অনুচিত। জগতে সত্যের মর্যাদা অতুলনীয় হলেও নৈতিক বা ব্যবহারিক বিষয়ে তা চাতুর্ষ ও কাপট্যের আবরণে আবৃত করে ব্যবহার করতে হয়, কিন্তু ধর্ম বিষয়ে দ্রপ করতে হয় না। সংসার নিত্য পরিবর্তনশীল, অতএব পরিবর্তিত সাংসারিক বিষয়ে অপ্রীতিকর সত্য আদরণীয় নয়। ৬৮।

অনুবাদ : যে অগ্নি ইচ্ছা করে, তার ধর্ম ত্যাগ করা সম্ভব নয়। ৬৯।

মর্মার্থ : যার সঙ্গে যার নিরত সম্বন্ধ থাকে, এই দুইয়ের মধ্যে একের গ্রহণে অন্যের পরিহার করা দুষ্কর, তাই সূত্রকার বলেছেন অগ্নিপ্রার্থী কখনো ধূম পরিহার করতে পারে না, বৈষয়িক কার্য প্রায় সত্য ও অসত্যযুক্ত। কোনো কার্যেসত্য ব্যবহার করতে হয়, অপর কোনো কার্যে অসত্যাবৃত সত্য গ্রহণ করতে হয়, অন্যকার্যে কেবল অসত্যই করতে হয়, অতএব বিষয় যেমন সত্যাসত্যযুক্ত, সেরূপ বিষয় ব্যবহারে একের ইচ্ছায় অন্য অসত্য ত্যাগ করা দুরূহ। ৬৯।

অনুবাদ : বিদ্বানগণের মধ্যেও দোষ সুলভ দেখা যায়। ৭০।

মর্মার্থ : সাংসারিক কার্যে বিদ্বাগণের মধ্যেও দোষ প্রকাশ পায়। অজ্ঞ লোকের মধ্যে দোষ প্রকাশ পাওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু ব্যবহারিক ক্ষেত্রে দোষের হাত পণ্ডিতগণও পরিহার করেতে পারেন কিনা সন্দেহ। যেহেতু নানা বিষয়ে নানা প্রকৃতির লোকের সঙ্গে বহুবিধ কার্যে সকল সময়ে অনেক ক্ষেত্রে সুখী ব্যক্তিও দোষদৃষ্ট থাকে। ৭০।

অনুবাদ : যেমন অখণ্ডিত রত্ন প্রায়শ দেখা যায় না, সেরূপ বিদ্বানও প্রায় দোষশূন্য হয় না। ৭১।

মমার্থ : রত্ন সকল যেমন প্রায়শই বক্তৃতা, মালিন্য প্রভৃতি দোষযুক্ত হয়, দ্রপ পণ্ডিতের মধ্যেও প্রায়ই ব্যবহার সময়ে দোষ প্রকাশ পায়। নির্দোষ বস্তু জগতে দুর্লভ। ভোজরাজ কৃত যুক্তিকল্পতরু, গরুড়পুরাণ, বৃহসংহিতা প্রভৃতি গ্রন্থে রত্নের দোষ, গুণ, মূল্য নির্ধারণ প্রভৃতি বর্ণিত আছে। যুক্তি কল্পতরুতে বিশেষ বিবরণ পাওয়া যায়। ৭১।

মর্ম্যাদাভেদকং ন কদাচিদপি বিশ্বসেৎ ॥ ৭২ ॥
অপ্রিয়েণ কৃতং প্রিয়মপি দ্বেষ্যং ভবতি ॥ ৭৩ ॥
নমত্যপি তুলা কোটিঃ কূপস্যোদক-ক্ষয়ং করোতি ॥ ৭৪ ॥
সতাং মতিং নাতিক্রমেৎ ॥ ৭৫ ॥

অনুবাদ : কোনো বিষয়ে মর্যাদা লঙ্ঘনকারীকে কখনো বিশ্বাস করবে না। ৭২।

মর্মার্থ : সকল কর্তব্য কার্যেরই রীতি, নিয়ম ও সীমা আছে, কার্য সম্পাদনে যদি তা লঙ্ঘন করে, তাকে কর্তব্য বিষয়ে অযোগ্য বা বিশ্বাসহীন বলে জানতে হবে, অর্থাৎ তদৃশ ব্যক্তিকে কখনো বিশ্বাসপূর্বক কার্যভার দেওয়া উচিত হয় না, অথবা একবার কার্য পদ্ধতি লঙ্ন কলে পুনঃ তাকে কোনো বিষয়ে বিশ্বাস করা যায় না। অবিশ্বস্তকে বিশ্বাস করলে পরিণামে গুরুতর অনিষ্টের সম্ভাবনা। ৭২।

অনুবাদ : অপ্রিয় ব্যক্তির দ্বারা অনুষ্ঠিত কার্য প্রিয় হলেও তা অহিতজনক হয় (১) পাঠান্তর হেতু সূত্রের অন্যরূপ অর্থ মূর্খ বা শত্ৰু প্রিয় কার্য করলেও তা মন্দ হয় (২)। ৭৩।

মর্মার্থ : যে ব্যক্তি অপ্রিয় বা অবিশ্বস্ত তা দ্বারা কৃত কার্য প্রিয় হলেও অপ্রিয় জানবে। কারণ যার প্রতি বিশ্বাস নেই, তার কার্যে আর বিশ্বাস কী থাকবে? অথবা সূত্রের ভিন্নরূপ পাঠ থাকতে অপর একরূপ অর্থ দৃষ্ট হয়, শত্রু বা অপ্রিয় ব্যক্তি ভালো কার্য করলেও সে তার বুদ্ধিদোষে মন্দ মনে করে। উপকথাতেও তা ব্যক্ত আছে মূর্খ লোকে সদা ভয়, ভালো করলে মন্দ হয়। অতএব লোকের চরিত্র জেনে তার সঙ্গে ব্যবহার করবে। ৭৩।

অনুবাদ : তুলাদণ্ড অবনত হয়েও কূপের জল শোষণ করতে পারে না। ১. তুলাদন্ড নত হলে কূপোদক শোষণ করে। ২. সূত্রে পাঠান্তর থাকাতে দ্বিবিধ অর্থ হয়) ৭৪।

মর্মার্থ : যেরূপ তুলাদণ্ড নত হলেও তার জলক্ষয় করা স্বভাব যায় না, তদ্রুপ শত্রু বশীভূত হয়েও তার অনুষ্ঠিত কার্য অনিষ্টজনকে ভিন্ন শুভজনক হয় না–তা পূর্ব সূত্রের সম্বন্ধনুসারে জানা যায়। অথবা তুলাদণ্ড নত হলে জলক্ষয় করে, নত না হলে তা করতে পারে না। মন্দ লোক অবনত হয়েও ক্ষতি করতে পারে।

অনুবাদ : সজ্জনের মতো লঙ্ঘন করা চলে না। ১. অথবা সাধুদেব অভিমত, আদেশ অতিক্রম করা উচিত না। ৭৫।

মর্মার্থ : প্রাজ্ঞ, মহাজন এবং দূরদর্শীগণের মতো লঙ্ঘন করে চললে মানুষকে প্রতিপদে বিপন্ন হতে হয়, যেহেতু তারা স্বীয় প্রজ্ঞানুসারে যা পরীক্ষিত মনে করেন, সেরকম আদেশ, অভিমত প্রদান করে থাকেন, অতএব মানুষের তদানুসারে চলা উচিত, তাতে বিপদের সম্ভাবনা অনেক কম। মহাজনের উপদেশ লঙ্ঘন করে চললে প্রতি ক্ষণে বিপন্ন হতে হয়। ৭৫।

গুণবন্তমাশ্রিতা নির্গুণোহপিগুণী ভবতি ॥ ৭৬ ॥
ক্ষীরাশ্রিত মুদকং ক্ষীরমেব ভবতি ॥ ৭৭ ॥
মৃৎপিণ্ডোহপি পাটলি-গন্ধমূৎপাদয়তি ॥ ৭৮ ॥
রজতমপি কনকসম্পর্কাত্ কনকমেব ভবতি ॥ ৭৯ ॥
উপকৰ্ত্তৰ্য্যপকর্ত্তূচ্ছিত্য বূধঃ ॥ ৮০ ॥

অনুবাদ : গুণবানকে আশ্রয় করে গুণহীনও গুণী হয়। ৭৬।

মর্মার্থ : যার যে বিষয়ে অভাব থাকে তা পূরণের জন্য চেষ্টিত হলে, তার সে অভাব থাকে না। অতএব গুণবানের আশ্রয়ে নিন ব্যক্তির গুণী হতে পারা সম্ভব। যেমন অশিক্ষিত ব্যক্তিকে শিক্ষিত সুধীজনের আশ্রয়ে শিক্ষা লাভ করে শিক্ষিত হতে দেখা যায়। মানুষের কথা দূরে থাকুক, জ্ঞানী লোকের আশ্রয় পেয়ে পশুপক্ষীও গুণযুক্ত এবং শিক্ষিত হয়-এমনও শোনা যায়। ৭৬।

অনুবাদ : ক্ষীর মিশ্রিত জল, ক্ষীররূপে নিত্য সম্মিলনে শক্তিহীন নির্ণও শক্তিযুক্ত গুণবান হয়, যেমন দুগ্ধের সঙ্গে জল মিলিত হলে দুগ্ধরূপে পরিণত হয়, তার স্বতন্ত্র সত্তা থাকে না। অতএব পূর্বসূত্রের সঙ্গে এই সূত্রের সঙ্গতি হবে যে, গুণবানের আশ্রয়ে নিগুণও গুণী হয়। ৭৭।

অনুবাদ : মাটির ঢিল ও পাটলিপুষ্প মর্দিত হলে পাটলিপুষ্প গন্ধ উৎপন্ন হয়। ৭৮।

মর্মার্থ : এক বস্তু অপর প্রসিন্ধ গুণযুক্ত বস্তুর গুণে স্বয়ং গুণী হয়, অর্থাৎ সেই দ্রব্যের গুণ বা ধর্ম অপরে (সংযুক্ত দ্রব্যে) সংক্রমিত হয়, যেমন মাটির ঢিল পাটলিপুষ্পের মধ্যে থাকলে পাটলিপুষ্পের সৌরভ আমোদিত হয়, অথবা বন্ত্রবদ্ধ গোলাপপুষ্প স্বীয় সুগন্ধিতে বস্তুকেও সুগন্ধিময় করে। সেরূপ আজ্ঞের সঙ্গে মিলনে অজ্ঞও প্রাজ্ঞতা লাভ করতে পারে। ৭৮।

অনুবাদ : রজতও সুবর্ণের সঙ্গে মিলিত হলে সুবর্ণে পরিণত হয়। ৭৯।

মর্মার্থ : পূর্বসূত্রের উদাহরণ ও সূত্রার্থের দৃঢ়তার জন্য এই সূত্রেও কন্তু অন্য বস্তুর সহিত মিলিত হয়ে, শক্তির তারতম্যে তার লঘু গুরুত্ব এবং বর ভাবাপন্ন হওয়ার কথা ব্যক্ত হয়েছে। রজত সুবর্ণের সহিত মিলিত হয়ে সুবর্ণত্ব প্রাপ্ত হয়, তদ্রুপ মন্দ ব্যক্তি প্রাজ্ঞের সঙ্গে মিলনে প্রাজ্ঞ হতে পারে। অয়স্কা মণির স্পর্শে লৌহও সুবর্ণত্ব প্রাপ্ত হয়। ৭৯। অর্থাৎ হিতাকারীরও অপকার করে, নিয়ম এই যে, উপকারের প্রত্যুপকার করতে হয়ঃ কিন্তু অজ্ঞতা হেতু তার বিপরীত করে থাকে। এমন কি? অজ্ঞ ও দুষ্টমতি, সময়ে স্বীয় অনিষ্ট সাধন করতেও কুণ্ঠিত হয় না। অতএব সুশিক্ষা, সসঙ্গ দ্বারা সকলের অজ্ঞতা দূর করতে হবে। ৮০।

তদ্বিপরীতে বুধঃ ॥ ৮১।
নপাপ কৰ্ম্মৰ্ণাং সংক্রোশ ভয়ম্ ॥ ৮২
উত্সাহবতাং শক্রবোহপি বশীভবন্তি ॥ ৮৩ ॥
বিক্রমধনা রাজানঃ ॥ ৮৪।
নাস্তালসস্যৈহিকামুষ্মিকম্‌ ॥ ৮৫।

অনুবাদ : জ্ঞানী ব্যক্তি, অসৎ লোকের (সহিত) বিপরীত। ৮১।

মর্মার্থ : প্রাজ্ঞ, সজ্জন, অসতেন বিপরীত কার্য করে থাকে, অসৎ ব্যক্তি উপকারীজনেরও অপকার করে, কিন্তু সুধী ব্যক্তি কখনো তা করে না, বরং সৎ ও অসতেন উপকারই করে। কখনো কারও অপকার করে না। অতএব সুধীজন, অসৎ ব্যক্তি হতে সর্বদা ভিন্ন। যে পণ্ডিত হয়েও অসতের কার্য করে সে যথার্থ পণ্ডিত নয়। ৮১।

অনুবাদ : পাপ কর্মকারীগণের নিন্দা বা দণ্ডভয় থাকে না। ৮২।

মর্মার্থ : যারা পাপ কর্ম করে, তাদের লোক নিন্দা ও নরক ভয় থাকে না, কিন্তু রাজদণ্ডের ভয় থাকে। দীর্ঘকাল দুষ্কর্মে লিপ্ত থাকলে তার পক্ষে প্রায় দুস্কাৰ্যই সম্ভব, অতএব সমাজে এতাদৃশ লোকের সুশাসন হওয়া ও সংখ্যা কমে যাওয়া বাঞ্ছনীয়। একের অন্যায় কর্ম অপরের পক্ষে সহজে শিক্ষা হয়। ৮২।

অনুবাদ : উৎসাহযুক্ত ব্যক্তিদিগের শত্রুগুণও বশীভূত হয়। ৮৩।

মমার্থ : পুরুষের গুণাবলির মধ্যে উৎসাহ, যা অধ্যবসায় শক্তি প্রধান গুণ, এই গুণের দ্বারা শত্রুগণও বশীভূত হয়। নীতিবিদগণের মতে, বিক্রমের বলই উৎসাহ শক্তি। শক্ৰবশ করার কথা তা দূরে থাক, চেষ্টা উদ্যম, উৎসাহহীনের কোনো কার্যই সিদ্ধ হয় না। ৮৩।

অনুবাদ : বিক্রমই নূপতিগণের ধন। ৮৪।

মর্মার্থ : বিক্রমই (পরাক্রম শক্তি) রাজাদিগের ধন, অর্থাৎ বিক্রম না থাকলে শুধু ধন দ্বারা কার্য সিদ্ধ হয় না। বিক্রম থাকলে ধন না থাকলেও তা দ্বারা ধন সঞ্চয় করতে পারা যায়। বিক্রমহীন রাজার সময়ে সঞ্চিত ধনও নাশপ্রাপ্ত হয়, বিক্রম দ্বারা উৎসাহ ও সাহস বৃদ্ধি পায়। ৮৪।

অনুবাদ : অলস ব্যক্তির ঐহিক ও পারত্রিক কোনো কার্য সিদ্ধ হয় না। ৮৫।

মর্মার্থ : আলস্য মন, ইন্দ্রিয়, শরীরে অবসাদ বা মন্দ–এই আলস্য যুক্ত ব্যক্তির ঐহিককার্য সাধন করা কঠিন, আলস্যই তাকে কার্যে পরাসুখ করে রাখে। ঐহিককার্যে অক্ষম হলে তার পারত্রিক কোনো কার্য ফলের আশা করা বৃথা। আলস্য মানবের শরীরস্থিত শত্রু তা দ্বারা কর্মশক্তি নাশ হয়, উৎসাহ, উদ্যম, শ্রম, পটুতা থাকে না। ৮৫।

নিরুৎসাহে দৈবং পরিশপতি ॥ ৮৬ ॥
মৎস্যবজ জলমূপযুজ্যার্থং গৃহীয়াৎ ॥ ৮৭
অবিশ্বস্তেযু বিশ্বাসো ন কর্তব্যঃ ॥ ৮৮ ॥
বিষং বিষমেব সৰ্বকালম্ ॥ ৮৯ ৷

অনুবাদ : উৎসাহহীন ব্যক্তি, দৈবের প্রতি অভিসম্পাত করে। ৬৬।

মর্মার্থ : আলস্যবশতঃ উৎসাহ থাকে না, উৎসাহহীন মানব দৈবকেও অভিসম্পাত করে, সকল কার্যের প্রতি উৎসাহ, উদ্যম, অধ্যবসায় একান্ত প্রয়োজন। উক্ত গুণাবলি না থাকলে ঐহিককার্য সাধন হয় না, আর পারত্রিক কার্য ফলের আশা কোথায়? অতএব আলস্য পরিহারপূর্বক পূর্ণোদ্যমে কার্যে প্রবৃত্ত হবে। সূত্রের পাঠান্তর হেতু অর্থ উৎসাহের অভাবে দৈবও বিনষ্ট হয়ে যায়। ৮৬।

অনুবাদ : মৎস্য জালে আবদ্ধ হয়েও স্বীয় অর্থ ভক্ষ্যদ্রব্য গ্রহণ করে, ১. সূত্রের পাঠান্তর হেতু–মৎস্যার্থী ব্যক্তি জলে ডুব দিয়েও অর্থ গ্রহণ করবে, ২. অথবা জলের তলদেশ হতে অর্থ সংগ্রহ করবে। ৮৭।

মর্মার্থ : যার কার্য সাধন করাই মূখ্য, সে অতি কঠিন বন্ধনে পড়েও কার্য সাধনে পরাজুখ হয় না, যেমন মত্স্য জালে আবদ্ধ হয়েও নিজ আহার্য দ্রব্য সংগ্রহ করে, ১. অথবা মস্যার্থী যেমন জলের মধ্যে ডুবে মত্স্যগ্রহণ করে, সেরূপ লোক জলের তলদেশ হতে কঠোর পরিশ্রমে অর্থ গ্রহণ করবে। ২. কঠোর বন্ধনে পড়েও অর্থ গ্রহণ কিংবা স্বকার্য সাধনে পশ্চাৎপদ হবে না। ৮৭।

অনুবাদ : অবিশ্বস্ত ব্যক্তিকে কখনো বিশ্বাস করবে না। ৮৮।

মর্মার্থ : যার প্রতি বিশ্বাস নেই, তাকে বিশ্বাস করলে সে বিশ্বাস দ্বারা কার্যহানি ক্ষতিগ্রস্ত ও বিপদে পড়তে হয়। চরিত্রবানকে বিশ্বাস করবে তা দ্বারা কঠোর কার্য সহজে সাধিত হয়। অতএব সূত্রকার উপদেশ প্রদান করেছেন যে, অবিশ্বাসীকে বিশ্বাস করবে না। এরূপ উপদেশ প্রাচীন আচার্যগণও দিয়েছেন ‘অবিশ্ববাসীকে বিশ্বাস করবে না, বিশ্বাসীকে অতি বিশ্বাস করবে না। ৮৮।

অনুবাদ : বিষ সকল সময়ে বিষই হয়। ৮৯।

মর্মার্থ : পূর্বের সূত্রে উক্ত হয়েছে যে, অবিশ্বাসী ব্যক্তিকে বিশ্বাস করবে না। তারই উদাহরণরূপে এই সূত্রে বলা হয়েছে যে, বস্তুর স্বরূপ থাকতে তার স্বভাবের কখনও বিচ্যুতি হয় না, অতএব বিষ সকল সময়ে বিষ থাকে আর অমৃত হয় না, তদ্রুপ খল প্রকৃতির অবিশ্বস্ত ব্যক্তি কখনো বিশ্বাসভাজন হয় না। তাকে বিশ্বাস। করলেও বিপন্ন হতে হয়। ৮৯।

অর্থ সামন্যৈবৈরিণা সংসর্গো ন কর্তব্যঃ ॥ ৯০ ॥
আৰ্য্যাৰ্থমের নীচস্য সবম্বঃ ॥ ৯১ ॥
অর্থ সিদ্ধৌ বৈরিণং ন বিশ্বসেৎ ॥ ৯২ ॥
অর্থাধীন এব নিয়ত সম্বন্ধঃ ॥ ৯৩ ॥

অনুবাদ : সাধারণ আর্থিক বিষয়ে শত্রুর সহিত মিলিত হওয়া উচিত নয়, ১. অথবা অর্থ গ্রহণ সময়ে শত্রুর সঙ্গ করা ঠিক নয়, ২. সূত্রে পাঠান্তর থাকাতে দুরূপ অর্থ হয়। ৯০।

মর্মার্থ : বিশ্বস্ত ও মিত্ৰজনের সঙ্গে সকল প্রকার আর্থিক ব্যবহার নিঃসং কোচে করা যেতে পারে, কিন্তু শত্রুর সঙ্গে সেরূপ ব্যবহার করা উচিত নয়। তাদৃশ ব্যবহারে পরে প্রবঞ্চিত হতে হয়, অনেকে ব্যবহারের পরে অনুতপ্ত ও বিপন্ন হয়, অতএব সাধারণ আর্থিক ব্যবহার (শত্রুর সঙ্গে) চিন্তাপূর্বক করা উচিত। ৯০।

অনুবাদ : নীচ বা ক্ষুদ্র লোকের সঙ্গে মিলিত হওয়া উচিত (১) প্রভুত্ব লাভের নিমিত্ত নিচ লোকের সঙ্গও করতে হয়। (২) ১।

মর্মার্থ : বৈশ্যপদ লাভের জন্য নিচ সঙ্গ করা উচিত, বাণিজ্য ব্যপদেশ স্বদেশ, বিদেশে যে দ্রব্যাদি ক্রয়-বিক্রয় করা-বৈশ্যকার্য। কৃষি, গোপালন, বাণিজ্য, কৌসীদ্য প্রভৃতিও বৈশ্যকার্য। এই সকল বৃত্তি ভিন্ন বৈশ্য পদ লাভ করা সম্ভব নয়। প্রভুর কার্যের নিমিত্ত অথবা ব্যবসা বাণিজ্য দ্বারা অর্থ লাভ করতে হলে শ্রেষ্ঠ, নিকৃষ্ট, ক্ষুদ্র মহৎ প্রভৃতি সকল প্রকার লোকের সহিত সম্বন্ধ রাখতে হয়। ৯১।

অনুবাদ : অর্থ সিদ্ধি বিষয়ে শত্রুকে কখনো বিশ্বাস করবে না। ৯২।

মর্মার্থ : যে সকল কার্যের সঙ্গে অর্থ সম্বন্ধ থাকবে অর্থাৎ অর্থের আদান প্রদান, কার্যের পূর্বে অর্থ সমর্পণ প্রভৃতি, সে সমুদয় কার্যে শত্রুকে বিশ্বাস করবে না, তাদৃশ ব্যক্তিকে বিশ্বাস করলে কার্যহানি, মনোবেদনা, অর্থাপহরণ ঘটার সম্ভাবনা যথেষ্ট। বিশ্বাসমূলক লিপি ও সাক্ষী প্রমাণ দ্বারা প্রত্যয় করলে বিশেষ হানি ঘটার সম্ভাবনা বিরল। ৯২।

অনুবাদ : সংসারে বিষয় সম্বন্ধ প্রায় অর্থের অধীন হয়। ৯৩।

মর্মার্থ : যা হতে অনায়াসে সকল কার্য সম্পন্ন হয় তাই অর্থ। কার্যের সহিত সম্বন্ধ শূন্য অর্থ দ্বারা কোনো হিত সাধন হয় না, অর্থের অধীন সকল কার্যেই লোকের পরস্পর সম্বন্ধ। অর্থানুবন্ধ পথে অর্থ ব্যবহার করবে, অর্থানুবন্ধ তিন প্রকার, অলদ্ধের লাভ, লব্দার্থের উত্তমরূপ রক্ষা, রক্ষিত অর্থের বুদ্ধি। অর্থহীন কার্য সম্বন্ধ প্রায় দুর্লভ। ৯৩।

শত্রোরপি সখা সুতো রক্ষিতব্যঃ ॥ ৯৪ ॥
যাবচ্ছেত্রোশিছদ্রং পশ্যতি তাবদ্ধস্তেন স্কন্ধেন বা বাহ্যঃ ॥ ৯৫ ॥
আত্মচ্ছিদ্র ন প্রকাশয়েৎ ॥ ৯৬ ॥
শত্ৰুং ছিদ্রে পরিহরেৎ ॥ ৯৭ ॥
ছিদ্র-প্রহরিণো হি শত্রুবঃ ॥ ৯৮ ॥

অনুবাদ : শত্রু হতে পুত্র ও বন্ধুকে রক্ষা করবে। ৯৪।

মর্মার্থ : আত্মা রক্ষায় ন্যায়, বিপদকালে পুত্র ও মিত্রকে রক্ষা করলে, সময়ে নিজে আবার তাদের দ্বারা বিপদ থেকে রক্ষা পায়। স্বতঃই সংসারে পুত্র, মিত্রকে এবং আশ্রিতজনকে রক্ষা করার নিয়ম আছে, যেহেতু তারা রক্ষিত হলে স্বয়ং রক্ষিত হয়, এটি সামাজিক রীতি। ৯৪।

অনুবাদ : যে সময়ে শত্রুর ছিদ্রান্বেষণ করবে, তখন হস্ত কিংবা কাঁধের দ্বারা শত্রুকে বহন করা যুক্তিযুক্ত। ৯৫।

মর্মার্থ : শত্রুর সঙ্গে পূর্বে বিবাদ করে তার দুর্বলতার পথ বা দোযানুসন্ধান করা কঠিন। কারণ সে আশঙ্কিত হয়ে জাগরূক থাকে। অতএব শত্রুর সঙ্গে সৌহার্দ্য প্রকাশপূর্বক তার দোষানুসন্ধান করে পরে তাকে নির্যাতিত করতে হয়। যে পর্যন্ত ছিদ্রানুসন্ধান না হয়, সে পর্যন্ত সম্ভাব রাখা কর্তব্য। ৯৫।

অনুবাদ :স্বীয় ছিদ্র কখনো প্রকাশ করবে না। ৯৬।

মর্মার্থ : যার শত্রু ভয় থাকে, তাকে সকল সময়ে অত্যন্ত সাবধানে থাকতে হয়। শত্রু নিয়ত ছিদ্রান্বেষণ করে, স্বয়ং কখনো নিজ দোষ পথ প্রকাশ করে শত্রুকে দেবে না, তার দ্বারা স্বীয় অনিষ্ট সহজে সাধিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, এই বিষয়ে মহষি মনু বলেছেন, নিজের ছিদ্র পরে জানবে না, পরের ছিদ্র স্বয়ং জানবে। কুর্মের ন্যায় শীয় ভাব গোপন করবে, সকল সময়ে আত্ম দোষ (ছিদ্র) ঢেকে চলবে। ৯৬।

অনুবাদ : শত্রুকে বিপদে কিংবা তার দোষ-ছিদ্রপথে পরিত্যাগ করবে। ৯৭।

মর্মার্থ : পূর্বসূত্রে উক্ত হয়েছে যে, শত্রুকে হস্ত ও স্কন্ধ দ্বারা বহন করবে, কিন্তু তা সকল সময় নয়। যে সময় শত্রুর বিপদ উপস্থিত হবে, সে সময় তাকে বিপথপথে ত্যাগ করবে, অর্থাৎ এই সুযোগে শত্রুকে পরাভূত করবে। সাক্ষাৎ বিবাদ অপেক্ষা ছিদ্রপথে বিবাদেই নীতি কৌশলে সাধিত হয়। ৯৭।

অনুবাদ : শত্রুগণ, ছিদ্র পেয়ে প্রহার করে থাকে, এটি শত্রুর স্বভাব। ৯৮।

মর্মার্থ : পূর্বে বলা হয়েছে, বহুব্যাপারযুক্ত ব্যক্তি কর্মের ন্যায় স্বীয় দোষকে আবৃত করে রাখবে। কুর্ম যেমন নিজের হস্তপদাদি স্বীয় দেহ মধ্যে সম্বরণ করে রাখে, দ্রপ কার্যে ব্যাপৃত ব্যক্তি আত্নদোষ পথ গোপন করে চলবে। শত্রুর স্বভাব এই যে, ছিদ্র পেলেই নির্যাতন করে থাকে। ৯৮।

স্বহস্তগতমতি শত্ৰুং ন বিশ্বসেৎ ॥ ৯৯
স্বজনস্য দুর্বৃত্তং নিবারয়েৎ ॥ ১০০ ॥
স্বজনাবমানোহি মনস্বিনাং দুঃখমাবহতি ॥১০১ ॥
শত্ৰুং জয়তি সুবৃত্তঃ ॥১০৩ ॥

অনুবাদ :শত্রু হস্তগত হলেও তাকে বিশ্বাস করবে না। ৯৯।

মমার্থ : যে পর্যন্ত শত্রু বৈরতা বা বিদ্বেষ পরিহার না করে, সে অবধি তাকে বিশ্বাস করা উচিত নয়। শত্রু নিজের অধীন হলেও সময়ে সুযোগ পেয়ে শত্রুতা সাধন করতে পারে। পূর্ব স্বভাব ও কার্য পরিবর্তন করলে তবে অনুগত শত্রুকে বিশ্বাস করা যায়, কিংবা পরীক্ষাপূর্বক বিশ্বাসভাজন হতে পারে। ৯৯।

অনুবাদ : স্বজনগণের দুবৃত্ততা নিবারণ করবে। ১. আত্মীয়গণের প্রতি যে কেউ দুর্দান্তভাব প্রকাশ করলে তার নিবৃত্তি করবে। (২) ১০০।

মর্মার্থ : নিজ আশ্রিত জনগণের অসদাচরণ নিবারণ করা উচিত, সেরূপ আচরণ দ্বারা নিজের এবং আশ্রিত লোকের বিশেষ অহিতের সম্ভাবনা। অথবা আত্মীয়গণের প্রতি যদি কেউ দুর্দান্তভাব প্রকাশ করে, তার নিবৃত্তি করা শিষ্টজনের একান্ত কর্তব্য। অসদাচরণের প্রশ্রয় দেওয়া অবিধেয়।

অনুবাদ : আত্মীয়জনের অপমান, মহামতি পুরুষের দুঃখজনক হয়। ১০১।

মর্মার্থ : মহৎ ব্যক্তির মানই ধন, অপমান অতিশয় দুঃখজনক, ড্রপ আত্মীয়গণের অপমানও সুধীজনের দুঃখজনক। সম্মানমাত্রই গৌরব ও হর্যজনক, সম্মানে লোক উষ্ণুমনা হয়, অপমানে নিজের ও স্বজনের মুখ মলিন হয়, অতএব অপমান জনক কার্যের অবসর দেওয়া উচিত নয়। ১০১।

অনুবাদ : অঙ্গে একটি দোষ থাকলেও সে দোষ পুরুষকে অবসন্ন করে। ১০২।

মর্মার্থ : দোষ সকল সময়ে পরিহার্য, দোষ দ্বারা পুরুষ পরাভূত হয়। বহু গুণের মধ্যে একটি দোষও গুণাবলির হানিকর হয়। সর্বাঙ্গ সুন্দর হলেও দেহের এক স্থানে দোষ (রোগ, চিহ্ন, অঙ্গ বিকলাদি) থাকলে পুরুষের সৌন্দর্য হানি ও গৌরব নাশ হয়, এইরুপ কার্যক্ষেত্রে ও জ্ঞাতব্য। ১০২।

অনুবাদ : সভৃত্তিসম্পন্ন ব্যক্তি শত্রুকে জয় করে। ১. যার সভৃত্তি আছে, সে তার শত্রুকে প্রাজিত করে। (২) ১০৩।

মর্মার্থ : সদবৃত্তি ও সুনীতিসম্পন্ন ব্যক্তি শত্রুকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়, সেরূপ সদ্গুণ সুশিক্ষা, দৃঢ়হৃদয়তাও চাই। কেবল সুবৃত্ততা দ্বারা শত্ৰু পরাজয় করা কঠিন। এই স্থলে সূত্রকারের সুবৃত্ত কথাতে সদ্গুণ রাজিও বুঝতে হবে। অন্যত্র শেীষ ধৈর্য, নৈপুণ্যের কথা উক্ত হয়েছে। ১০৩।

নিকৃতি প্রিয়া নীচাঃ ॥১০৪
নীচস্য মতির্নদাতব্যা ॥১০৫
নীচেষু বিশ্বাসসোনকর্তব্য ॥ ১০৬ ॥
সম্পূজিতোহপি বাধতে দুর্জনং ॥ ১০৭ ॥

অনুবাদ :নীচ প্রকৃতি লোক শঠতা ও কপটতাদি প্রিয় হয়। ১০৪।

মর্মার্থ : সজন, দুর্জন হতে সাবধানে থাকবে, এই নিমিত্ত সূত্রকার নীচ প্রকৃতি লোকের স্বভাব বর্ণনা করেছেন, শঠ, ধূর্ত, কপট, কুর, ইহা শাঠ্য, কাপট্য, তস্কর পরানিষ্ঠ প্রভৃতিকে ভালোবাসে, এমনকি তার দ্বারা তারা জীবনযাত্রাও নির্বাহ করে। কখনো গর্হিত কার্য হতে বিরত হয় না, নীচ প্রকৃতির সংসর্গে সজ্জজনকেও বিপন্ন হতে হয়। ১০৪।

অনুবাদ : নীচ ব্যক্তিকে জ্ঞান বা সদৃবুদ্ধি প্রদান করবে না। ১০৪।

মর্মার্থ : পাত্র বিশেষে বা যোগ্য পাত্রে জ্ঞানের উপদেশ দেওয়া উচিত, অপাত্রে কিংবা অযোগ্য পাত্রে অর্থাৎ নীচ, হীন, নষ্টবুদ্ধি প্রভৃতিকে জ্ঞানোদেশ প্রদান করলে, তা নিষ্ফল ও বিপরীত ফল প্রদান করে, সেজন্য সূত্রকার অপাত্রে জ্ঞানোপদেশ নিষেধ করেছেন। ১০৪।

অনুবাদ :নীচ প্রকৃতি লোককে বিশ্বাস করবে না। ১০৫।

মমার্থ : পামর, শঠ, মূৰ্থহীন লোকদিগকে বিশেষ পরীক্ষা না করে বিশ্বাস করা যেতে পারে না। সাধারণ বিশ্বাসে বিশেষ অনিষ্টের সম্ভাবনা। নীচ বা হীনলোকের স্বভাব এই যে, তারা গহিত আচরণে সংকোচ বোধ করে না। ১০৫।

অনুবাদ : দুর্জন ব্যক্তি, অর্থাদি দ্বারা সম্মানিত হয়েও সজ্জনের অহিত সাধন করে। ১০৬।

মর্মার্থ : খল লোককে অর্থ ও সম্মানে আপ্যায়িত করলেও সে তার স্বভাবানুরুপ আচরণ করতে ছাড়ে না। দুর্জনকে সততাই শঙ্কার চক্ষে দেখতে হয়। এই জন্য বিষ্ণু শর্মা বলেছেন, দুর্জন প্রিয়বাদী হলেও বিশ্বাসের কারণ নয়, যেহেতু গুণবান জনের, নৃশংসের নিকটে সতত ভয় বর্তমান থাকে। যেমন, সর্প দুগ্ধ পান করেও বিষ উদ্গীরণ করে। ১০৬।

অনুবাদ : অগ্নিকে বিশেষ যত্নপূর্বক মস্তকে ধারণ করলেও দাহ করতে ছাড়ে । ১০৭।

মর্মার্থ : এই সূত্রটি পূর্বসূত্রের উদাহরণস্বরুপ, যেমন অগ্নিকে বিশেষ যত্নসহকারে মস্তকে ধারণ করলে সে দাহ করতে কুটি করে না, তদ্রুপ দুর্জন ও সম্মান দানাদি দ্বারা পরিতোষ লাভ করেও দুর্ব্যবহার করতে ছাড়ে না। যার যা স্বভাব, সে তা পরিহার করতে সহজে পারে না। ১০৭।

অনুবাদ : কোনো পুরুষকে অপমানিত করা উচিত নয়। ১০৮।

মর্মার্থ : বৃথা অবহেলা এবং ক্রোধভরে কারও অপমান করতে নেই, অবজ্ঞাত ব্যক্তি সুযোগ পেলে প্রতিশোধ বাসনায় অপমানকারীকে পুনঃ অবজ্ঞা করতে ছাড়বে না। সকলের প্রতি সুশীলতা ও মধুর ভাব প্রদর্শন করা উচিত। কবি বলেছেন, সুশীলতার দ্বারা সকলকে বশীভূত করবে। ১০৯।

অনুবাদ : সকলকে ক্ষমা করা সম্ভব হলে ক্ষমা করা উচিত। কাকেও পীড়া দেওয়া কর্তব্য নয়। ১১০।

মর্মার্থ : শক্ত জনের ক্ষমাই ভূষণ, অশক্তের ক্ষমা দৌর্বল্যের পরিচালক। সকলকে ক্ষমা করতে না পারলে, কাকেও পীড়িত করবে না। ক্ষমা, কৌশল, প্রতিভা, দয়া দ্বারা সকলকে বশীভূত করবে, তাতে শত্রু কর্তৃক অনিষ্ট সম্ভাবনা বিরল হয়। ১১০।

অনুবাদ : সুশীতল চন্দন হতে উৎপন্ন বহ্নিও দাহ করে। ১১১।

মর্মার্থ : পূর্বসূত্রে বলা হয়েছে যে, দুর্জন ব্যক্তি উপকৃত হয়েও উপকারির অহিত সাধন করে, যেরূপ শীতল চন্দন হতে উৎপন্ন অগ্নি দাহ করে। অথবা সকল স্থানে কার্য, কারণের গুণ লাভ করে না, যেখানে কার্যকারণের উপাদান উপাদেয় ভাব বিদ্যমান থাকে, সে স্থলে কারণ, গুণ কার্যে সংক্রমিত হয়, যথা গুড় হতে উৎপন্ন শর্করা। অন্যত্র বিপরীত পটোল লতা জাত ফল ও পত্র, ফল ত্রিগুণ যুক্ত, পত্র অতিরিক্ত। ১১১।

অনুবাদ : প্রভু কর্তৃক অতি গোপনীয় উক্ত বিষয়, বুদ্ধিহীন ব্যক্তি সাধারণে প্রকাশ করতে ইচ্ছা করে। ১১২।

মর্মার্থ : স্বামী প্রভু বা অভিভাবক কোনো বিষয় গোপনে বললে, তা বুদ্ধিহীন ব্যক্তি সাধারণের নিকট প্রকাশ করতে ইচ্ছা করে। কোনো বিষয় গোপন করলে যে কুটিল হয় তা নহে, যে বিষয় প্রকাশ করলে বক্তাও শ্রোতার কোনো উপকার সাধিত হয় না, তা প্রকাশ করা বৃথা তাতে উভয়ের বা একের অনিষ্টও হতে পারে। এমন বিষয় প্রকাশ করা উচিত নয়। অনধিকারী, শিশু, অজ্ঞ, দুর্জন, খলের নিকট গুপ্ত বিষয় প্রকাশ করবে না। ঢাকের শব্দের ন্যায় প্রভুর গুপ্ত উপদিষ্ট অর্থ বুদ্ধিহীন ব্যক্তি প্রকাশ করতে ইচ্ছা করে, সূত্রের পাঠাস্তর হেতু এরূপ অর্থও হয়। ১১২।

অনুরাগস্তু ফলেন সূচ্যত ॥ ১১৩
আজ্ঞাফল মৈশ্বৰ্য্যম ॥ ১১৪ ॥
দাতব্যমিতি বালিশঃ পরিক্লেশেন দাস্যতি ॥ ১১৫ ॥
মহদপৈশ্বৰ্য্য মবাপ্যাধূতিমান্ বিনশ্যতি ॥ ১১৬ ॥

অনুবাদ : মানবের অনুরাগ কার্য ফলের দ্বারা সূচিত হয়। ১১৩।

মর্মার্থ : কার্যে অনুরাগ আছে কিনা তা কার্য ফলের দ্বারা সূচিত হয়, কেবল মুখের কথা দ্বারা নয়। অনুরাগ, আসক্তি প্রীতি, একার্থবোধক। যার সতত কার্যে অনুরাগ আছে, হিতোপদেশকার তার লক্ষণ এরূপ উল্লেখ করেছেন মুখ প্রসন্ন দৃষ্টি সুন্দর, কথায় অনুরাগ, মধুর বাক্য, অধিক স্নেহ, সসমদর্শন, এই সকল কার্যসমূহ অনুরাগী পুরুষের লক্ষণ। ১১৩।

অনুবাদ : প্রভুর আদেশানুসারে কার্য করলে তার ফল ঐশ্বর্য হয়ে থাকে। ১১৪।

মর্মার্থ : স্বামীর আদেশ কিংবা শাস্ত্ৰদেশে কার্য সাধন করলে, সে কার্যের ফল ঐশ্বর্যতুল্য হয়। প্রভু বাক্য বা শাস্ত্ৰদেশ লঙ্ঘন করে কার্য করলে সে কার্যের ফল বিপরীত হয়, অর্থাৎ তাতে অনিষ্ট সাধিত হয়, সম্পদ লাভ হয় না। ১১৪।

অনুবাদ : মূর্খ ব্যক্তি দান করা উচিত জেনেও অতিক্ৰেশে কিছু দান করে। ১১৫।

মর্মার্থ : অজ্ঞ লোক দান করবে বলে ও মনে করে, পরে কিছু সন্ধিগ্ধ দান করে। অজ্ঞতা ও কৃপণতাহেতু সরলভাবে দান করতে পারে না, অর্থ থাকলেও নানা প্রকার মানসিক সন্দেহে দান কার্যে পশ্চাৎপদ হয়, দাতা, নিয়ত পরোপকারেও যশ লাভে সমর্থ হয়। ১১৫।

অনুবাদ : অতি বিপুল ঐশ্বর্য লাভ করেও ধৈর্যহীন ব্যক্তি বিনাশপ্রাপ্ত হয়। ১১৬।

মর্মার্থ : পুরুষের ধৈর্য স্থৈর্য, সংযম, সুশিক্ষা প্রভৃতি থাকলে সে অতি সামান্য ধন হতেও ধনী হতে পারে। উক্ত গুণাবলির অভাব হলে বিপুল রাজ্য লাভ করেও সুখী হতে পারে না, বস্তুত সে সমুদয় হারিয়ে পরে আপনাকেও বিপন্ন করে। সূত্রকার ঐশ্বর্যের উল্লেখ করেছেন মাত্র, তবে স্থৈর্য চরিত্র বুদ্ধিমত্তারও একান্ত প্রয়োজন। ১১৬।

ইতি দ্বিতীয় অধ্যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *